মরমি তত্ত্বের আয়নামহল
আলতাফ শাহনেওয়াজ
রুমীর অলৌকিক বাগান—মুস্তাফা জামান আব্বাসী; ফেব্রুয়ারি ২০১০; মুক্তদেশ, ঢাকা; প্রচ্ছদ: মামুন হোসাইন; ৩৩৬ পৃষ্ঠা; ৩৫০টাকা
‘আমি পাথররূপে মারা যাই, এবং হয়ে উঠি একটি গাছ, একটি গাছরূপে মারা যাই আর হয়ে উঠি একটি জন্তু,…মানুষরূপে মারা গিয়ে একজন ফেরেশতার রূপে বেঁচে উঠবো আমি। এবং শেষ আমি আর কিছুই থাকবো না।’ রায়হান রাইন অনূদিত উদ্ধৃত কবিতাংশটির রচয়িতা জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমী। রুমীর কবিতা এবং ভাবনাবিশ্বে বিরাজ করছে আত্মা ও দেহপরম্পরা সর্বেশ্বরবাদের ধারণা, সুফিতত্ত্বের সেই অরূপরতনের খোঁজ রয়েছে তাঁর রচনার পরতে পরতে। আর এই বাংলাদেশে রুমীকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ারও কিছু নেই। তবে রুমীর অলৌকিক বাগান শীর্ষক গ্রন্থের মাধ্যমে রুমীর সমগ্র ভাবনাবিশ্ব যেন এখন এক মলাটে হাজির। পরিশ্রমলব্ধ কর্মটির কর্তা মুস্তাফা জামান আব্বাসী।
বইটি ছেচল্লিশ অধ্যায়ে বিভক্ত। এর মধ্যে যেমন রুমীর জন্ম, বেড়ে ওঠা, মরমি চিন্তার উন্মোচন লভ্য তেমনি মসনবীর দর্শন এবং রুমীর গল্প-কবিতা-উপাখ্যানগুলো সাজানো আছে থরেবিথরে। সেই যে ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানের বল্খ নগরে জন্ম নিল একটি শিশু, পরিণত বয়সে সারা বিশ্ব তাঁকেই জেনেছে মাওলানা রুমীর মহিমায়। তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন মসনবীর মধ্য দিয়ে। উল্লিখিত মসনবীর দর্শন সম্পর্কে মুস্তাফা জামান আব্বাসী আলোচ্য গ্রন্থে যেমন বলেন,— ‘নূরের প্রক্ষেপ সবার জন্য নয়। নূরের তালাশী যারা, তারা জানতে সক্ষম হবেন এর লুকোনো বস্তুগুণ। মানুষের জ্ঞান সীমিত, অসম্পূর্ণ ও সামান্য। …অসম্পূর্ণ জ্ঞানের অধিকার নিয়ে যখন কেউ পরলোক অস্বীকার করে, তখন তাদের একটি যুক্তি, তা হলো পরকালকে চোখে দেখা যায় না। পরমাত্মাকে চোখে দেখা যায় না। তাই তাদের মতে যাদেরকে দেখা যায় না, তারা দৃষ্টির বাইরে। স্থূল জ্ঞান সম্পন্ন মানুষদের রুমী বর্ণনা করেছেন ‘সংশয় ও দ্বিধাগ্রস্ত’ হিশাবে।’ এভাবে মসনবীর সারবস্তু সহজ ভাষায় দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে পুস্তকে। রুমীর অলৌকিক বাগানের খোঁজে আর কোথায় কোথায় হেঁটেছেন এই লেখক? হ্যাঁ, হাঁটাহাঁটি আছে বটে বিস্তর। মসনবীতে লিখিত মুসা ও ফেরাউন প্রসঙ্গ, হজরত সালেকের প্রসঙ্গ ছাড়াও রুমীর পিতা বাহাউদ্দিন রচিত মারিফ গ্রন্থটির নাম-সাকিনও এই গ্রন্থে দৃষ্ট। রুমীকে বোঝার এক অনবদ্য সুযোগ এনে দিয়েছে গ্রন্থটি। উপরন্তু, তাঁর কবিতার মর্মবস্তু সম্পর্কে লেখকের ভাষ্যও গ্রন্থমধ্যে প্রস্ফুটিত, ‘রুমীর কবিতায় ও কথনে শয়তান বহুবার দেখা দিয়েছে। যেমন কোরানে শয়তান বহুবার আলোচিত। শয়তানকে ভালোমত চিনতে পারলে পথচলা সহজ হয়।’
এ তো গেল রুমীর কবিতা সম্পর্কে লেখকের মনোভাবনা; কিন্তু আরও যে কারণে এই পুস্তকটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, তা হলো— গ্রন্থটিতে রুমী বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণ সাপেক্ষে লেখক মুস্তাফা জামান আব্বাসী তাঁর মতামত হাজির করেছেন। ফলে রথ দেখা ও কলা বেচার মতো রুমীর এই অলৌকিক বাগানে রুমীকে যেন বা পূর্ণাঙ্গভাবেই জানাশোনা সম্ভব হবে। এখানে লেখক রুমীর কিছু কবিতাও বাংলা অনুবাদে সন্নিবেশিত করেছেন। তা ছাড়া রুমী প্রসঙ্গে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে নতুন বিশ্লেষণও লক্ষ্যযোগ্য, যা নতুন ভাবনা উসকে দিতে পারে।
মোট কথা, যে জগৎ-মাজারে রুমী তার পরমের সন্ধানে ব্যাপিত, সেই জগতের অজস্র ঝিনুকে ভর্তি এই বই। একদিন মসনবীর শ্লোকে যেভাবে ভাষ্য পাঠিয়েছেন রুমী: ‘খোল তোমার হূদয়/ শুনতে পাবে ফেরেশতাদের/ অশ্রুত সঙ্গীত।…বিশ্বাসের অনুকূলে তোমার/ অনু পরিমাণ সুকর্ম/ কোনদিন হারিয়ে যাবে না’। সেই বিশ্বাসের আহ্বানে মানুষের কাছে বইটি বার্তা পাঠিয়েছে রুমীর জগতে প্রবেশের। রুমীর অলৌকিক বাগান বইয়ের কৃতিত্ব এখানেই। তবে যেহেতু রুমীর ভাবের জগৎ সুদীর্ঘ পরিসর এবং অনেকাংশে বিমূর্ত বাস্তবতায় আবৃত, ফলত বিষয়গুলো হয়তো বা আরও স্পষ্ট হতে পারত আলোচ্য গ্রন্থের সুপরিচ্ছন্ন অধ্যায় বিভাজনের মধ্য দিয়ে। তার পরও এখানে রুমীর মরমি তত্ত্বের আয়নামহল স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এ-ই বা কম কি!
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, আগস্ট ১৩, ২০১০
Fantastic!
haahaahahahahah…. vallagse