কাবুলি চপ্পল তৈরির জন্য মশহুর মুরাদ খানি বস্তির চিপা গলি থেকে আমরা গুল মোহাম্মদ ইয়ামার কালো রঙের ভলগা গাড়িতে চাপি। মোটরে ওঠার আগে তিনি বুট খানিক তুলে কেইলিনকে ভেতরের সামানাদি দেখান। গাড়ির পেছনভাগে স্টেগ করে রাখা শিরাজ কেবারনে গোত্রের রেডওয়াইনের বোতলের একাধিক ক্রেইট্। শিশিগুলো দেখামাত্র হাঁপানি রুগিরা যে রকম অ্যাজমার ওষুধ পেলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে সে রকম কেইলিনের চোখে মুখে ফুটে খুশির গোলাব। গুল মোহাম্মদ ইয়ামা উইন্ডশিল্ডে আটকানো ইমাম আলী রেজার মাজারের তসবির স্পর্শ করে গাড়ি স্টার্ট দেন, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাসেটে বেজে ওঠে দরবেশি তরিকার জিকির ‘হাসনা জাবনা লাহু/ ও নাজজাইনা হু।’ কেইলিনের ওপর ইয়ামার আছর হয়েছে মাস দেড়েকের ওপর। লেদার জ্যাকেট পরা এ সুদর্শন আফগান প্রথম যৌবনে তাঁর ক্যারিয়ারের সূত্রপাত করেন নূর মোহাম্মদ তারাকির সমাজতান্ত্রিক খালক্ পার্টির সিক্রেট ক্যাডার হিসেবে। গুপ্তচর হিসেবে অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে তিনি যান পেশওয়ারে। তারপর বিস্তর দেশ-মুলুক ঘুরে ইস্তাম্বুল বসফরাস পাড়ি দিয়ে জার্মানির জিন্দানখানায় মাস কয়েক কাটান। অতঃপর মেক্সিকোর বর্ডার দিয়ে চলে আসেন লাস ভেগাসে। পাক্কা তিন বছর কাটান তিনি ফ্রনটিয়ার ক্যাসিনোতে ব্ল্যাকজ্যাকের ডিলার হিসেবে। একদিন মার্কিন ইমিগ্রেশনের হাতে পাকড়াও হলে পর তারা তাঁকে বাকায়দা ডিপোর্ট ব্যাক করে আফগানিস্তানে।
তত দিনে কাবুল হেরাত আজাদ হয়েছে তালেবানি ফিৎনা ফ্যাসাদ থেকে। দলে দলে ফিরিঙ্গিরা এসেছে হয় এডুকেশন প্রজেক্ট করে আফগানদের শিক্ষা দিতে, নয় ওয়োম্যানস ডেভেলপমেন্টের মারফতে বুর্কাওয়ালি তাজিক পাশতুন জেনানাদের আজাদ করতে। তাদের বাদ মাগরেব খানিক শরাব সেবন না করলে চলে না। আফগানিস্তান তো দেশ হিসেবে মিল্লাতে-ইসলাম, খোলাবাজারে সরিষার তেল কিংবা দধি-মাঠার মতো শরাব বিক্রির কোনো রসুম এখানে নেই। সুতরাং ফিরিঙ্গ সব তিয়াসবাজদের হয়েছে মহা মুসিবত। কিন্তু তাদের খেদমতে এগিয়ে আসেন ইয়ামা। তিনি তার ভলগা গাড়িতে করে চাপলিসে সরবরাহ করে থাকেন সাহেব-মেমদের গেস্টহাউসগুলোতে রেড কিংবা হোয়াইট ওয়াইন। কাবুল শহরে কেইলিনের তিয়াসওয়ালি হিসেবে খানিক তারিফ আছে। ইয়ামা এ সংবাদ রাখেন, তাই চেকপয়েন্টে ওজারাতে মারিফাত বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাস দেখিয়ে তিনি দ্রুত বেগে কাবুল শহর ছাড়িয়ে যেতে যেতে কেইলিনের দিকে বাড়িয়ে দেন কোকাকোলার ক্যান। কেইলিন কোনো সওয়াল-জবাব না করেই তা পান করে। ভলগা গাড়ির ভেতরবাগ ভুরভুর করে ওঠে হুইস্কির তাজা গন্ধে। আমি যেহেতু তাজিকদের কায়দায় ঢোলাঢালা লেবাস পরে তসবি হাতে চুকুমবুদাইয়ের মতো চুপচাপ বসে আছি, তাই ইয়ামা হয়তো ভেবেছেন, এ বান্দা জিন্দেগিতে চিরতার জল ভিন্ন অন্য কোনো গুরুপাক পানীয় কখনো পান করেনি, তাই আমাকে তিনি কোনো তরল অফার করা থেকে বিরত থাকেন।
খানিক পর কী ভেবে ইয়ামা আমার দিকে বাড়িয়ে দেন প্যান্টহাউস বলে একটি মাইল্ড পর্নোগ্রাফিক ম্যাগাজিন। গ্লসি এ কাগজের মলাটে এক নগ্নিকার মসৃণ ঊরুদেশ ফণিমনসার কণ্টকময় সবুজ পত্র দিয়ে আব্রু করা। কেইলিন গলা থেকে তার সিল্কের স্কার্ফ খুলে তা দিয়ে ম্যাগাজিনের মলাট ঢেকে দেয়। সে আজ পরে আছে রেশমের চৌখুপ্পি নকশা করা তুর্কম্যানি পিরহান। আমার হাত স্পর্শ করে তালুতে আঙুল দিয়ে সে লেখে, ‘আফগান ব্যুরোক্রেটস্ ও অপিয়াম প্রডিউসারদের মধ্যে হালফিল প্যান্টহাউস ও প্লেবয় নামক ম্যাগাজিনের চাহিদা বাড়ছে।’ কেইলিন রিসার্চের কাজে আছে তো! মেয়েটি মাসাল্লা জানে বিস্তর! ইনফরমেশনটি গবেষণাজাত কি না, তা-ই বা কে জানে?
আমাদের গাড়ি চারিখার বাঁক পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের সমান্তরালে ছোটে। কালচে পাটকিলে গাঢ় খয়েরি মেশানো হিন্দুকুশ পর্বত এখানে পাষাণের স্থাপত্যরেখায় জমিনের জিন্দান অতিক্রম করে উড়ে যাচ্ছে আসমানের দিকে। একটি প্রান্তরে মৃত ঘাসের হরিতে মিলেঝুলে বাস করছে পাথরের রুপালি ধূসর সব চাঙড়; তাতে থেকে থেকে প্রতিফলিত হচ্ছে মেঘমালার ফিরোজা জেওরাত। কেইলিন ‘দিস্ ইজ্ গ্রোবি’ বলে এক্সাইটমেন্ট ছড়ালে আমি চলমান সিলভার লাইন স্পষ্ট দেখতে পাই। ফিফথ গিয়ারে ভলগা গাড়িটি দোররা খাওয়া ঘোড়ার মতো ছোটে। আমাদের পাশ দিয়ে বিরহদগ্ধ ঊষর দিনে সহসা দেখা দয়িতার চুলের রুপালি রিবনের মতো উড়ে যায় জলছলছল একহারা গড়নের এক নদী। গুল মোহাম্মদ ইয়ামা গিয়ার বদলাতে বদলাতে বলেন, ‘নদী এখানে অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন।’ স্রোতস্বিনীর দুপাড়ে বুঝি কারও নওল তারুণ্যের মতো ফলে আছে আঙুরের প্রাণবন্ত ঝাড়। আমরা থোকা থোকা সব সবুজ মেওয়ার দিকে তাকিয়ে কবুল করি—নদীটি বিলকুল লাভলি।
হাজার বছরের লাভাপ্রবাহে তৈরি কালো পাথরের রীতিমতো মহররমি তাঁবুদের আবডালে দুটি ইস্পাতের কনটেইনারে এক দাঁত পড়া আংরেজ ডাক্তার খুলে বসেছেন ক্লিনিক। সাহেবটি চোগা চাপকান পরে খয়েরি দাড়িতে মেহেদি মাখিয়ে অনেক বছর হয় অনুসরণ করছেন আফগানদের লেহাজ তমিজ। মাঝে মাঝে তারও তিয়াস উসকে ওঠে, তখন তিনি মোবাইলে এত্তেলা দেন ইয়ামাকে। ইয়ামা আমাদের ভলগায় বসিয়ে রেখে বুট থেকে বের করে তার জন্য নিয়ে যান রেডওয়াইনের পাক্কা একটি ক্রেইট। ক্লিনিকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন হাতে ওষুধের চিট নিয়ে বেশ কজন কিজিলবাস কৌমের মুরব্বি। আমরা তাদের চোখেমুখে উমেদারির স্পষ্ট ছায়া দেখতে পাই। দন্তহীন ডাক্তারের সঙ্গে ইয়ামার কায়কারবার শেষ হলে পর তিনি বাজারি ছালা হাতে মুরব্বিদের সামনে এসে দাঁড়ান। মুরব্বিদের কেউ কেউ অত্যন্ত খোশ মেজাজে তাকে কুলচা-পীর বলে মুসাফা করেন। বিস্কুট বা মিঠাইকে দারী ভাষায় কুলচা বলে। কুলচা-পীর ছালা থেকে বের করে মুরব্বিয়ানদের সকলকে বিতরণ করেন মালবেরি তুতের সঙ্গে পেস্তা বাদামের মণ্ড মিশিয়ে তৈরি ‘তালখান’ বলে এক ধরনের কুলচা।
আমরা আরও মিনিট বিশেক পাথর কাটা সড়কে পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠি। পথের ঠিক মাঝখানে জেহাদ জঙ্গের স্মৃতি মিনার হয়ে পড়ে আছে অকেজো একটি ট্যাংক, তার পাশে ভলগা দাঁড় করালে আমরা বিশাল এক হাবেলির কাঁটাতারে মোড়া বারোফুটি চৌদেওয়ার দেখতে পাই। ইয়ামা তার অন্দরমহলে ফ্লাশ দিয়ে ছবি না তোলা ও মোবাইল ফোন ব্যবহার না করার জন্য অনুরোধ করেন। এককালে রয়েল ফ্যামিলির ব্যবহূত এ বাড়িতে আছে জহির শাহের আমলে করা পিওর ব্রিডের পাঁচ-পাঁচটি আফগান হাউন্ড। কোথাও ঝলকে উঠলে ফ্লাশের আলো বা বাজলে মোবাইলের রিং, হাউন্ড গোত্রের এ কুত্তাগুলো হয়ে ওঠে রীতিমতো খতরনাক। ইয়ামা বলেন, দলিলদস্তাবেজে ঐতিহাসিক এ বাড়িটির নাম ‘শের মঞ্জিল’ হলেও লোকজন একে ‘চেমনে দুখতারি’ বা ‘বালিকা উদ্যান’ বলে থাকে। দেউড়ি দিয়ে ঢোকার মুখে কেইলিন খুব করে ইয়ামাকে আমাদের সঙ্গে আসতে বলে। ইয়ামা দুকান মুচড়ে তৌবা তৌবা করে বলেন, ‘চেমনে দুখতারিতে কেবলমাত্র দুধরনের মরদদের প্রবেশের ইজাজত আছে। এক হচ্ছে যারা বালিকা খরিদ বিক্রির কাজে কোমরবন্ধে ডলারের ক্যাশ নিয়ে সফর করে, দুই হলো মূলত খোজা—কেবল তারাই পারে বালিকাদের নাজুক শরীরের কোনো প্রকার খতরা না করে তাদের হেফাজত করতে।’ ইয়ামা সুফি তরিকার দীক্ষা নিয়েছেন, আমাদের এখানে পৌঁছে দিয়ে তিনি যাবেন অল্প দূরে জনা কয়েক ‘জঙ্গে বেওয়া’ বা যুদ্ধ-বিধবাদের খান কতক কুলচা ছদকা দিতে। আমার হাতে তিনি পলিথিনের ব্যাগে বেশ কখানি তালখান দিয়ে অনুরোধ করেন চেমনে যদি কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তাহলে আমি যদি মেহেরবানি করে তাদের হাতে পৌঁছে দেই শিরনি হিসেবে তালখানি কুলচা। অতঃপর আমাদের দেউড়ির দারওয়ানের হাওলা করে দিয়ে ‘ব-আমানে খোদা’ বলে ইয়ামা বিদায় নেন।
দেউড়ির চৌকিদাররা বোধ করি আমাদের অপেক্ষায় ছিল। তারা দরোজা খুলে আমাদের নিয়ে আসে হাভেলির ভিতরবাগে। শ্বেতপাথরের চৌবাচ্চার পাশে ঘাসে কার্পেট বিছিয়ে তাকিয়া পাতা। আমরা ওখানে বসি। শুকনা চৌবাচ্চার শিথানে আধভাঙা একটি ফোয়ারা; তাতে এক সারি কালো জহর-মারা পাথর দিয়ে দুররানি রাজবংশের প্রতীক আঁকা। শাহি সিম্বলের মাঝবরাবর কেবল তিনটি হরিৎ বর্ণের সঙ্গে সিতারা পাথর ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে আমির শের আলী খানের সিলমোহর। পুষ্পহীন এ বাগিচার শেষ প্রান্তে ঝরোকা কাটা একটি বুরুজ; তাতে ফিরোজা, গোলাপি ও সোনালি গারেরা পরে বেশ কটি তুলতুলে পশমের বিড়ালছানা নিয়ে খেলা করে পাঁচটি অল্প বয়সী মেয়ে। লোমওয়ালা একটি বুড়ো আফগান হাউন্ড কুত্তা কোথা থেকে ছুটে এসে বাগানে নামাজ পড়ার জন্য তৈরি মর্মর পাথরে উঠে বসে। তার চোখমুখের অভিব্যক্তির দিকে তাকালে পিরামিডের সামনে হাজার বছর ধরে বসে থাকা স্ফিংসের কথা মনে পড়ে। বুুরুজের বালিকাগুলো এখন ঝরোকার জাফরিতে থুতনি রেখে চেয়ে আছে আমাদের দিকে। বেজায় রকমের বর্ণাঢ্য জামাকাপড়ের জন্য তাদের পিঞ্জিরাবদ্ধ মুনিয়া পাখিদের মতো দেখায়।
আমরা অনেকক্ষণ হলো চুপচাপ বসে আছি। কেইলিন তার গ্রীবা ঈষৎ হেলিয়ে পানশালায় তিয়াসতৃপ্ত মেয়েদের মতো মৃদু হেসে জানতে চায়, ‘এই ভিলাটি তুমি লকেট করতে পারবে? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া হোয়ার উই আর নাও?’ তার কথায় আমি বাগিচার অন্য প্রান্তে চোস্ত ইউরোপীয় ধাঁচের ইমারতটির দিকে তাকাই। অস্থিরতা কাটাতে সেও কাঁধ ঝাঁকায়; তার চুলে আটকানো তুর্কম্যানি ব্যান্ডে গাঁথা ফিরোজা বর্ণের কটি সলমা চুমকি ঝিকমিক করে ওঠে। স্পষ্ট বুঝতে পারি, সে আমাকে কিছুতে এনগেইজ রেখে পরিবেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। এ চান্সে আমি ইলিম জাহির করার অ্যাডভানটেজ নিয়ে বলি, ‘কাবুলের ইংরেজ রেসিডেন্ট আমির শের আলী খানের বাগানবাড়ি হিসেবে এ ভিলাটি তৈরি করেন ১৯০৯ সালে। আমরা কাপিসা থেকে মাত্র মাইল পনেরো দূরে আছি। যিশুখ্রিষ্টের জন্মেরও অনেক আগে এখানে ছিল কনিষ্কের সামার ক্যাপিলাট।’
‘হু ওয়াজ দ্যাট কনিষ্ক, ওয়াজ হি এ হিপি পোয়েট অর পেইন্টার? ইউ হ্যাভ এ নেক ফর আল দিস গাইজ।’ ‘আরে না, কনিষ্ক উসকো-খুসখো চুলের কোন হিপি কবি বা চিত্রকর না। হি ওয়াজ এ সম্রাট, কুষাণ ডাইনেস্টির সম্রাট।’ ‘শ্মশন ডাইনেস্টি, হোয়াট ওয়াজ দ্যাট্?’ ‘আরে শ্মশান না, হি ওয়াজ কুষাণ’, বলে আমি চুপ করে যাই। কেইলিনের এক্সপ্রেশন দেখে মনে হয় না সে এখন কুষাণের সঙ্গে শ্মশানের পার্থক্য ধরতে পেরেছে। আমি বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরাই। সে আমার হাত স্পর্শ করে তালুতে আঙুল দিয়ে লিখে, ‘উইল ইউ টেল মি আ লিটল মোর?’ আমি চোখেমুখে নির্লিপ্তি ধরে রেখে বলি, ‘১৯৩৯ সালে ফরাসি আর্কিওলজিস্টরা খোঁড়াখুঁড়ি করে চাপ চাপ মাটির নিচ থেকে বের করে আনে বৌদ্ধসম্রাট কনিষ্কের আমলের বিলুপ্ত এক নগরীর কাঠামো। ওখানে পাওয়া যায় হিন্দুস্থানি কেতায় কার্ভ করা কিছু আইভরি, চীনের সোনালি লকার এবং মিসরের আলেকজান্দ্রিয়ায় তৈরি কাচের পানপাত্রের নমুনা।’ ‘ওয়াজ হি এ বার্বার লাইক জেঙ্গিস খান?’ ‘সম্রাট কুষাণ বর্বর হতে যাবেন কেন? উনি যে এখান থেকে অল্প দূরে সরখ-কোতলে মন্দির তৈরি করেছিলেন যেখানে অগ্নি উপাসনার সঙ্গে পূজিত হতেন গৌতম বুদ্ধ—এই যে না বুঝে বর্বর বলে ডায়লগটা দিলা, ঢুকবে এসব তথ্য তোমার উর্বর মস্তিষ্কে?’ একটু কড়া মন্তব্য করে মনে মনে ভাবি, সাধে কি আর হিন্দুস্থানে অব্রাহ্মণে শাস্ত্রদান নিষিদ্ধ হয়েছিল?
নীল চাদরীতে চুল মুখ বেঁধে একটি সাত-আট বছরের মেয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসে তস্তরীতে করে পেস্তা-বাদাম-কিসমিস। আমরা পেস্তার খোল ভাঙতে ভাঙতে তিফিল এ বালিকাটির বয়সের কথা ভাবি। কেইলিন মোবাইলে ফ্ল্যাশ না দিয়ে মেয়েটির ছবি তুলে আবার নরমালি যেন কিছু হয়নি, এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে, ‘তথ্যগুলো তুমি কোথায় পেলে?’ বুঝি সে আপাতত কোনো দ্বন্দ্বে জড়াতে চাচ্ছে না। তাই নির্লিপ্ত একাডেমিকের মতো জবাব দিই, ‘২০০৩ সালে হেরাতের একটি পুরোনো বইয়ের দোকান থেকে দ্য রোড টু বলক বলে একটি বই কিনি। ১৯৬৭ সালে ছাপা। ন্যানসি ডুপরি বলে এক মহিলা ষাটের দশকের প্রথম দিকে এদিকের একটি উজবেক গ্রামে বাস করতেন। তখন তাঁর স্বামী কুষাণ যুগের পুরাতাত্ত্বিক সাইট খনন করছিলেন। ডুপরি তাঁর বইতে পুরাতাত্ত্বিক কিছু তথ্যের সঙ্গে এ ভিলারও একটি বর্ণনা রেখে গেছেন।’ কেইলিন এবার খপ করে আমার হাত চেপে ধরে জানতে চায়, ‘হোয়াই ডিড নট ইউ শেয়ার দিস উইথ মি?’
কেইলিন খানিকটা ডেসপারেট হয়ে পড়ছে তা বুঝতে পারি। হক কথা বলতে কি, অনেকক্ষণ হলো এ বাগিচায় বসে থেকে পানি পড়ে পড়ে জমে ওঠা কালচে শ্যাওলার মতো আমার মনে জমা হচ্ছিল অনিরাপত্তাবোধ। আফগানিস্তানে কম বয়সী মেয়েদের বিক্রি করা হচ্ছে, তাদের ট্রাফিকিংয়ের ওপর তথ্য সংগ্রহ করতে কেইলিন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ের সঙ্গে তার ক্যারিয়ারের যোগ আছে। কিন্তু তাই বলে ইয়ামার ওপর তার ভরসা করা সিকিউরিটির দৃষ্টিকোণ থেকে আমি ঠিক সাপোর্ট করতে পারি না। তাই তার হাত সরিয়ে দিয়ে বলি, ‘আই ফিল লাইক হুইপ ইয়োর ব্লাডি গুল মোহাম্মদ ইয়ামা। অজভূতটাকে কাছে পেলে নাকে পোড়া মরিচ দিয়ে ভূত ছাড়াতাম।’ কেইলিন এবার আমাকে ফেইস করে চোখে চোখ রেখে বলে, ‘হি ইজ এ প্রফেশনাল; আই অ্যাম শিওর, আমরা তার সোর্স থেকে অথেনটিক ইনফরমেশন পাব।’ ঠিক তখনই বালিকাগুলো হুড়মুড় করে বুরুজ থেকে নেমে আমাদের কাছাকাছি এসে চৌবাচ্চার পাশে দুধের বাটি রেখে বিড়ালের বাচ্চাগুলো ছেড়ে দেয়। মেকুরের ছানারা চুকচুক করে দুধ খায়। আর বালিকারা তাদের আওয়ারা ফেলে চলে যায় বাগিচার লতাপাতা পুষ্পবৃক্ষহীন এক ঊষর কর্নারে। ওখানে মাটিতে পোঁতা এক লাঠির ডগায় ঝুলে খিন্ন চেহারার এক পিঞ্জিরা। মেয়েগুলো পাখির খাঁচাকে বৃত্তাকারে ঘিরে মৃদু লয়ে নাচতে নাচতে তাজিক গোত্রের বিয়ের গান গেয়ে যায়, ‘পথ চলো অতি ধীরে’।
কোথায় যেন হালকা বাঁশির ধ্বনি বাজে। এর সন্ধানে ভিলার জানালার দিকে তাকাই। কপাটগুলো বন্ধ। একটি পিচ গাছের পুষ্পিত আড়াল থেকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে একটি দড়কচা মারা মানুষ বেরিয়ে আসে। তার পেছন পেছন হাঁটে বদখত চেহারার আরেকটি তাম্র বর্ণের আফগান হাউন্ড। ক্র্যাচওয়ালা পিঞ্জিরার দিকে এগিয়ে বাঁশি দিয়ে ইশারা করলে চিলের ছায়া দেখতে পাওয়া মুরগির বাচ্চাদের মতো বালিকারা দৌড়ে পালিয়ে যায় পিচ গাছের আড়ালে। ক্র্যাচ দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে মানুষটি মর্মর পাথরে বাঁধানো নামাজের মসল্লায় বসে। তার দুকানে ভারী রূপার আঙটা। বাঁশি দিয়ে বুড়ো কুকুরটির লোম চুলকায়। আমি ও কেইলিন তার সঙ্গে আই কনটাক্ট করতে চাই। কিন্তু সে উদাসীন হয়ে আসমানের দিকে তাকিয়ে যেন গায়েবি কোনো আওয়াজ শোনার প্রতীক্ষা করে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ১৬, ২০১০
মইনুস সুলতানের লেখাগুলো অতি চমৎকার। কেমন যেন অবসাদময় বিষন্নতা ছড়িয়ে থাকে
সুলতান সাহেবের লেখায় সৈয়দ মুজতবা আলীর একটা ছায়া পাওয়া যায়।