থাই চলচ্চিত্রকার অ্যাপিচাটপং ভিরাসেথাকুলের সাক্ষাৎকার
ভূত-প্রেত আর পুনর্জন্মে বিশ্বাসটা আছে আমাদের রক্তের মধ্যেই
অ্যাপিচাটপং ভিরাসেথাকুল এবারের কান চলচ্চিত্র উৎসবের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার স্বর্ণ পাম জিতে নিয়েছে অ্যাপিচাটপং ভিরাসেথাকুলের ছবি আংকল বুনমি হু ক্যান রিকল হিজ পাস্ট লাইভস। দ্য হলিউড রিপোর্টারের সাংবাদিক জোনাথন ল্যান্ড্রেথকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই থাই পরিচালক কথা বলেছেন তাঁর চলচ্চিত্রভাবনা, বেড়ে ওঠা, তাঁর দেশের মানুষের ভূত-প্রেত ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস, থাইল্যান্ডে সাম্প্রতিক সংঘাত এসব বিবিধ বিষয়-আশয় নিয়ে। অনুবাদ করেছেন ইকবাল হোসাইন চৌধুরী
জোনাথন ল্যান্ড্রেথ: আপনার ছবিটির বোধগম্যতা নিয়ে কিছু বলুন। থাইল্যান্ডের মানুষের বিশ্বাসের (সর্বপ্রাণবাদ) যে জগৎ, সেটা বোঝার জন্য কি দর্শকদের অনেক বেশি কল্পনাশক্তির দরকার হয়ে পড়ে না?
অ্যাপিচাটপং ভিরাসেথাকুল: আমি এই দিকটা নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। কারণ, এই বিশ্বাসের জায়গাটা সব জায়গায় কমবেশি প্রায় এক। এবং আমি সব সময়ই বিশ্বাস করি, সব ছবি সবার জন্য নয়। আর যদি দর্শক বুঝতে পারবে কি না এই নিয়ে খুব বেশি শঙ্কিত থাকেন, তবে আপনার ছবি বানানোই উচিত নয়।
জোনাথন: ‘আংকল বুনমি’ ছবিটির চিত্রধারণ হয়েছে উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডে। আপনার বেড়ে ওঠা সেখানেই। এ জায়গাটা আদতে কেমন?
ভিরাসেথাকুল: উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ড একটি শুষ্ক আর প্রায় বৃষ্টিপাতহীন এলাকা। যদি চাষবাসের কথা বলেন তাহলে এদিকটা থাইল্যান্ডের সবচেয়ে রুক্ষ এলাকা। এখানকার মানুষেরা এই কারণে অভাবী। সুযোগ পেলেই তারা ব্যাংককের মতো বড়সড় শহরগুলোয় গিয়ে থিতু হতে চায়। লাওস ও কম্বোডিয়ার সংস্কৃতির বেশ খানিকটা প্রভাব এই এলাকায় আছে। ফলে প্রচুর আধিভৌতিক বিশ্বাস আমি এই এলাকার মানুষজনের মধ্যে দেখেছি। এ ধরনের প্রচুর গল্পগাথাও আমি শুনেছি সেই ছোট্টবেলায়। আগে কখনো এই ব্যাপারগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করার সুযোগ হয়নি। এ ছবিতে আমি এই ভূখণ্ড আর সেই সব গল্পগাথার খানিকটা ছোঁয়া রেখেছি।
জোনাথন: সম্প্রতি থাইল্যান্ডের রাস্তাঘাটে প্রচুর রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। সেসবের সঙ্গে কি আপনার ছবির কাহিনির কোনো যোগসূত্র আছে?
ভিরাসেথাকুল: ঠিক সরাসরি কোনো সম্পর্ক নেই। ব্যাংককে যা ঘটছে, সেটি আসলে একধরনের শ্রেণীসংগ্রাম। থাইল্যান্ডে এ রকম বেশকিছু সামাজিক শ্রেণী আছে। মানুষজন সব সময়ই কোনো না কোনোভাবে নিপীড়িত-নির্যাতিত হচ্ছে। সেটা সামাজিকভাবেই বলুন কিংবা অর্থনৈতিকভাবেই বলুন।
জোনাথন: আপনার মা-বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন ছিল।
ভিরাসেথাকুল: আমার মা-বাবা মধ্যবিত্ত। তাঁরা মূলত ব্যাংককের মানুষ। পরে তাঁরা ব্যাংকক থেকে উত্তর-পূর্ব দিকের ওই এলাকায় চলে যান। মা-বাবা দুজনেই ছিলেন চিকিৎসক। আমাদের খোন খায়েন শহরের পয়লা হাসপাতালটি তৈরি হয়েছিল আমার মা-বাবার মতো গুটিকয় চিকিৎসকের উদ্যোগে।
জোনাথন: ‘আংকল বুনমি’র ঘরে রাখা বেশ কিছু চিকিৎসা সরঞ্জাম আপনার প্রয়াত বাবার মৃত্যুশয্যার কথা মনে করিয়ে দেয়। আর পুনর্জন্ম নিয়ে আপনি অনেক কথাবার্তা বলেছেন। এই ছবি তৈরির সময় আপনার বাবা কি আপনাকে কোনোভাবে পরিচালিত করেছিলেন?
ভিরাসেথাকুল: পুনর্জন্ম বিষয়টা নিয়ে আমি নিজেও বেশ সন্দিহান। তবে এটাও সত্যি, ছবির কাজের জন্য গবেষণা আর খোঁজখবর করতে গিয়ে পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পারে এমন মানুষের দেখা আমি পেয়েছি। তাই আমি পুনর্জন্মের বিষয়টা পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারি না। সত্যি বা মিথ্যে যা-ই হোক। পুনর্জন্ম ব্যাপারটা আমাকে মুগ্ধ করে। এটাই আসল কথা।
জোনাথন: লেখার সময় আপনি কি শুধু চিত্রনাট্যের ওপর মনোনিবেশ করেন?
ভিরাসেথাকুল: আমি শুধু লিখি আর ভিপাসনা (ধ্যান) করি। এটা নিঃশ্বাসকেন্দ্রিক ধ্যান। এটা আমাকে মনঃসংযোগে সহায়তা করে; আমাকে সুস্থ আর শান্ত রাখে।
জোনাথন: আপনার ছবির গল্পের কোনো বিশেষ মর্মার্থ কি আছে?
ভিরাসেথাকুল: আমি ঠিক নিশ্চিত নই, দর্শকেরা এই গল্পের কী ধরনের অর্থ করবে। তবে এমনিতে আমি ‘মেসেজ’ সম্পন্ন ছবি তৈরিতে আগ্রহী নই। আমার মনে হয়, চলচ্চিত্র আসলে এর চেয়েও অনেক বেশি কিছু। এটি বহুবিধ ব্যাখ্যা ও তরজমার জন্য উন্মুক্ত রাখা উচিত। কারণ, একটি ছবি প্রতিজন দর্শক তাদের নিজস্ব ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি আর দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। বিশেষ করে এই ছবির বেলায় এটি খুব সত্যি।
জোনাথন: আপনার ছবিতে অনেক আধিভৌতিক ব্যাপারস্যাপার আছে। আপনি কি এসব তুলে ধরার জন্য কোনো স্পেশাল ইফেক্টের সহায়তা নিয়েছেন?
ভিরাসেথাকুল: ছবি তৈরিতে কম্পিউটার ব্যবহার করেছি, এটা বললে আবার ভুল হবে। তবে মামুলি কিছু ভিডিও গ্রাফিকস এবং ধ্রুপদী ইফেক্টের মিশেলে কাজটা করার চেষ্টা করেছি। পুরোনো দিনের ছবিগুলোয় যে রকম থাকে। ধরুন, ডিজলভ বা এ জাতীয় ইফেক্ট আমরা বেশি ব্যবহার করেছি। আর ভূত বা এ রকম কিছু বোঝানোর জন্য ব্যবহার করেছি আয়না। সেদিক থেকে ছবিটি খুব পুরোনো ঘরানার।
জোনাথন: আপনার ছবি কি থাইল্যান্ডের মানুষের আদি বিশ্বাসকে আরও উসকে দেয় অথবা বিষয়গুলোকে একটা আধ্যাত্মিক মোড়কে পরিবেশন করে?
ভিরাসেথাকুল: এ ছবিটি পুরোনো দিনের থাই ছবির প্রতি একধরনের শ্রদ্ধা নিবেদন। কিছু বিশেষ ধরনের উপাদান, চরিত্র অথবা আলোক প্রক্ষেপণের ধরন ব্যবহার করা হয়েছে, এটা সত্যি। কিন্তু মোটা দাগে যদি বলতে চান, এই ভূত-প্রেত আর পুনর্জন্মে বিশ্বাসটা আছে আমাদের রক্তের মধ্যেই। আমি বলব, প্রায় ৯০ ভাগ থাই এসবে বিশ্বাস করে। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে থাইল্যান্ডে যে বিক্ষোভ আর সংঘর্ষ হয়েছে, সেখানেও আপনি এসব অ্যানিমিস্ট ঐতিহ্যের নমুনা দেখতে পাবেন।
জোনাথন: থাইল্যান্ডের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি কি আপনাকে বিস্মিত করে?
ভিরাসেথাকুল: আমি মনে করি, এটি একটি চক্রের অংশ। তবে মজার দিকটি হচ্ছে, এটি এবার বেশ বড়সড় ধরনের একটি শ্রেণীসংঘাতে রূপ নিয়েছে, যার পুরোভাগে আছে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরা। এর আগে এটি ছিল অনেক বেশি মাত্রায় মধ্যবিত্ত বনাম সামরিক বাহিনীর সংঘাত। এখন এটা হয়েছে দরিদ্রদের সংগ্রাম। একই সঙ্গে যুদ্ধের রকমসকমও গেছে পাল্টে। কারণ, এ খেলার সঙ্গে যোগ হয়েছে ইন্টারনেট নামের অনুষঙ্গ এবং আরও নিত্যনতুন কলাকৌশল।
জোনাথন: থাইল্যান্ডে স্বাধীন সংবাদপত্রের ওপর সরকারের যে আক্রমণ, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার কথা কি আপনি এবং আপনার সঙ্গী, শিল্পী, কলাকুশলীরা কেউ ভাবছেন?
ভিরাসেথাকুল: অবশ্যই। এই তো গতকাল আমি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলাম। ছবির জন্য সরকারের আর্থিক অনুদান দেওয়ার বিষয়টা যথেষ্ট স্বচ্ছ নয়, এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে। সামনে আমরা আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠতে চাই এবং পরিবর্তন বয়ে আনার ক্ষমতা আমাদের আছে। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, থাইল্যান্ড আদতেই খুব রক্ষণশীল দেশ। সে কারণেই এটা কঠিন এক যুদ্ধ।
জোনাথন: সরকার ছবি তৈরির জন্য কী ধরনের অনুদান দিচ্ছে?
ভিরাসেথাকুল: এ বছরের শুরুর দিকে সরকার ছবির জন্য ২০০ মিলিয়ন বাত (৬.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) অনুদান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু এই অর্থের অর্ধেকটাই যাচ্ছে এক থাই যুবরাজের ছবির পেছনে। তিনি একটি ঐতিহাসিক কাহিনিনির্ভর ছবি তৈরির কথা ভাবছেন।
জোনাথন: আপনার প্রতিষ্ঠানের নাম আপনি দিয়েছেন ‘কিক দ্য মেশিন’। এ নামটি কীভাবে এল?
ভিরাসেথাকুল: বছর দশেক আগে বন্ধুবান্ধবেরা মিলে একটা গ্যালারি করেছিলাম। আমাদের একটা চলচ্চিত্র প্রদর্শনীও ছিল। নামটি এসেছে ‘কিক দ্য প্রজেক্টর’ থেকে। মানে বুঝতেই পারছেন, প্রজেক্টর চালু করা বা ‘টার্ন অন দ্য প্রজেক্টর’ কথাটি থেকে এটা এসেছে। সেই সঙ্গে এ নামটির সঙ্গে একটা প্রতিষ্ঠানবিরোধী ব্যাপারও মিশে আছে, ব্যক্তিগত এবং গৃহজাত।
জোনাথন: আপনার শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটের দিনগুলো কীভাবে কাটত? কোন সময়ে আপনি ওখানে ছিলেন?
ভিরাসেথাকুল: ১৯৯৪-৯৭ সাল পর্যন্ত আমি ওখানে কাটিয়েছি। ওখানে গিয়েই আমার বিভিন্ন রকম ছবির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। বিশেষ করে নিরীক্ষাধর্মী ছবির সঙ্গে। আর্ট ইনস্টিটিউটে তাঁরা আমেরিকান নিরীক্ষাধর্মী ছবিগুলোর ওপর বেশি জোর দিত। আমেরিকা সম্পর্কে আমার যা ধারণা, তার বেশির ভাগই এসব ছবি দেখে। বাকি আমেরিকা সম্পর্কে বলতে গেলে কোনো ধারণাই নেই আমার।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুলাই ০২, ২০১০
Leave a Reply