বয়োজ্যেষ্ঠ এক কবির কাছে এখনকার কবিদের কবিতা সম্পর্কে তাঁর অনুভূতির কথা জানতে চেয়েছিলাম। উত্তরে একটা টাটকা সাম্প্রতিক ছবি তিনি উপহার দিয়েছিলেন। স্বনামে কোথাও এ কথাগুলো উদ্ধৃত করতে নিষেধ করেছিলেন তিনি। তাই তাঁর নামটা উহ্যই রাখতে হচ্ছে। তাঁর মতে, ‘এখনকার তরুণ কবিদের অনেকেই খুব প্রতিভাবান। কিন্তু এঁদের অধিকাংশই নিজেদের তৈরি একটা মেনিফেস্টো অনুসরণ করে চলেন। আঞ্চলিক-প্রমিত এই দুয়ের জগাখিচুড়ি ভাষাকে এঁরা নিজেদের কাব্য ভাষা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কবিতাকে কবিতা করে তোলার চেয়ে তাঁরা ভাষাভঙ্গি ও আঙ্গিক নিয়ে বেশি চিন্তিত। এঁদের কাছে পৃথিবীটা ঢাকা শহরের একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ। বাদ-বাকি পৃথিবীর সঙ্গে এঁদের যোগাযোগ ঘটেনি খুব একটা। কমবয়েসি পাড়ার তরুণদের হালকা চটুল রসিকতাও তাই অনায়াসেই এঁদের কবিতার ভেতর ঢুকে পড়তে পারছে।’
এই মূল্যায়নের সঙ্গে আমি পুরোপুরি একমত হইনি। তবে বাস্তবচিত্র যদি এর কাছাকাছিও হয়ে থাকে, তবুও একটাকে নৈরাশ্যজনক বলে চিহ্নিত করার খুব অবকাশ রয়েছে কি? হয়ত এঁদের হাতেই তৈরি হবে আগামী দিনের কবিতা। খেলারছলে যে কাজ এখন চলছে, তার একটা শুভ ফল যে মিলবে না, তা কে বলতে পারে। কেউ কেউ তেমন আশাও জাগাচ্ছেন। ফিরোজ এহতেশাম তাঁদেরই একজন। এখনকার তরুণ কবিদের অনেক প্রবণতা তাঁর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তিনি স্বতন্ত্র। তাঁর সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ অস্ত্রে মাখিয়ে রাখো মধু থেকে কয়েকটা লাইন উদ্ধৃত করলেই তা স্পষ্ট হয়। একজন প্রকৃত কবিকে চিনতে এমন কয়েকটি লাইনই যথেষ্ট, ‘অনেক হেমন্ত শেষে পাশাপাশি/কেমন আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি বর্তমানে, আমরা সবাই/আগুনকে ঘিরে ফেলি। আমাদের কোনো নাম নাই।/আমাদের কাব্যগুলো কোন অর্থ পাবার আগেই/পরিণত হচ্ছে কুয়াশায়।’ (‘কুয়াশা’) কাব্যগ্রন্থটিতে ৪০টি কবিতা। সব কয়টি কবিতায় কিছু না কিছু হলেও ফিরোজের নিজস্ব ভাষাভঙ্গির স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি ছন্দ ভালোই জানেন কিন্ত ছন্দ নিয়ে খুব একটা নিরীক্ষার দিকে যাননি। অন্ত্যমিলের প্রতি নিদারুণ আসক্তি তাঁর। চারণকবিদের মতো প্রতি বাক্যেই অন্ত্যমিল রাখার চেষ্টা করেছেন। প্রবাদ-প্রবচনের কাছাকাছি একটা ভঙ্গি খুঁজে নিয়েছেন তিনি। মনে হবে কোনো কিছু বয়ান করতে চাইছেন। রসিকতা কৌতুকপ্রবণতা বেশ ভালোভাবেই উপস্থিত তাঁর মধ্যে। ‘ওরে, উন্নয়নের জোয়ারে ভাইস্যা গেলাম খোঁয়াড়ে/সেথায় যায়া দেখি আমি ছেলের হাতে মোয়ারে।’ (‘উন্নয়নমূলক গান’)
ফিরোজের কবিতায় স্ফটিক স্বচ্ছতা নেই। বরং ধাঁধার মধ্যে পড়ে কেন্দ্র থেকে সরে গিয়ে অনেক সময় পাঠক পথ হারিয়ে ফেলে। তাৎক্ষণিকতার একটা রেশ রয়েছে তাঁর পঙিক্তগুলোতে। স্বতঃস্ফূর্ত শব্দগুলো মাঝেমধ্যে একটা সামগ্রিক চেহারা ধারণ করে না। পাঠকের কাছে তাই দুর্বোধ্য মনে হতে পারে তাঁকে। কিন্তু একটু মনোনিবেশ করলে তাঁকে বোঝা অসম্ভব নয়। আবিষ্কার করা যাবে এক নতুন কাব্যভূমি, ‘যেসব ফুলেরা আজও অসম্মত ঘ্রাণ সম্প্রচারে/নাকি এই ইন্দ্রিয়কে গোপনে অগ্রাহ্য করে ভেসে যায়/আমাদের কাঙ্ক্ষিত সুবাস?/সতত নিকটে এসে, মাধুর্য হারিয়ে ফেলেছ তুমি, মধু/গর্ভকেশরের মধ্যে তবু, ক্ষীণ-বিন্দু প্রাণ নিয়ে আমি নড়ে উঠি।/সুতরাং, ক্ষুধা টের পাই।’ (‘আমা দ্বারা দুলে ওঠো’)
উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার এঁরা এখনকার তরুণ কবিদের বেশি মাত্রায় প্রভাবিত করেছেন। সে প্রভাব নিয়ে অনেকেই সার্থক কবিতা লিখতে পারেননি। কিন্তু ফিরোজের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। এঁদের প্রভাব থাকা সত্ত্বেও ফিরোজের নিজস্ব ভাষাভঙ্গি এর ভেতরেই স্পষ্ট। ইঙ্গিত রয়েছে আরও বদলের, আরও নিজস্ব হয়ে ওঠার। ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থে নজরুল-মোহিতলালের প্রভাব এড়িয়ে যেমন ভবিষ্যতের জীবনানন্দকে চোখে পড়ে, তেমনি ফিরোজও তাঁর কাব্য স্বতন্ত্রকে এখানে স্পষ্ট করতে পেরেছেন। নিচের কয়েকটি লাইন সেই স্বাক্ষরই বহন করে, ‘কত শব্দ খোলেনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বন্ধ দরজাটা/আর তাতে পিঠ ঠেকিয়ে ভিতরে ভিতরে কত শব্দ নিঃশব্দে কেঁদেছিল।/কত শব্দ হদিসও রাখে নি তার, দ্যাখো/পচে যাচ্ছে ব্যবহূত হতে হতে কত শব্দ/রিকশা পাচ্ছে না শেষ রাতে।/আলোতে মুখটা তোলে না কত শব্দ ব্রিজের নিচে/বাচ্চাটাকে রেখে পালিয়েছে।’ (‘কত শব্দ’)
সাধু ও চলিত ভাষার মিশ্রণ ঘটিয়েছেন তিনি অনায়াসে। আঞ্চলিক শব্দ ঢুকে গেছে প্রমিত বাক্যের রীতির ভাঁজে ভাঁজে। এই মিশেল সব সময় ভালো লেগেছে এমন নয়। তবে বেশ কিছু পঙিক্ততে আছে বুদ্ধির ঝলক। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকপ্রবণতা। যেমন, ‘‘কী জানি কী হইছে আমার/সুইচবোর্ডে সুইচ টিপি তবুও আন্ধার।/…/এই ফাঁকে এক সাধু ভায়া/বলে আমারে একলা পায়া/চলো একটু দূরে যায়া/দুই জনাতে বুদ্ধি করি ঐ ঘরে সান্ধার।’ (‘দুইজনাতে বুদ্ধি করি’)
প্রেম, যৌনতা আর নগরজীবন প্রধানত ফিরোজের কবিতার বিষয়। তাঁর কবিতায় প্রেম আছে, প্রেমের গল্পও আছে। ‘পঞ্চগড়’ তেমনই একটি কবিতা, ‘চতুর্দিকে পঞ্চগড়/তুমিই আপন আমিই পর/তবু,/সেবা আর শুশ্রূষার/চূড়ান্ত বেদনার ভার/আমি/তোমাকে দিলাম,/পরিচর্যা করো ধীরে ধীরে।’
এই কাব্যগ্রন্থের ফ্ল্যাপে লেখক পরিচিতির শেষে উল্লেখ আছে লেখকের নতুন প্রকাশিত্য গ্রন্থ বাউল কথার সংবাদ। এই বইটি পড়ে তাঁর সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হলো। অপেক্ষায় রইলাম নতুন গ্রন্থের জন্য। পাঠককে বরাবরই এভাবে অপেক্ষা করিয়ে রাখতে পারবেন ফিরোজ। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা এতটুকুই।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৪, ২০১০
Leave a Reply