কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তুহিনকে। কোনো এক মঙ্গলবার অফিস শেষ করে সে দাঁড়িয়েছিল বাসের অপেক্ষায়। প্রতিদিনকার মতো তুহিনের পরিবার, মানে ভাই-ভাবি তুহিনের জন্য অপেক্ষা করে ঘুমিয়ে পড়েছে খাবার ঢেকে রেখে। কিন্তু পরদিনও তুহিন এল না। অফিস থেকে জানানো হলো তুহিন কাজে যায়নি। তুহিনের অন্তর্ধানের রহস্য ভেদ করতে পারে না কেউ। তাকে কেউ কি অপহরণ করেছে? অজ্ঞাত যুবকের লাশ হয়ে সে কি পড়ে আছে মর্গে? নাকি গত কয়েক দিনে যে মস্তকবিহীন লাশগুলো উদ্ধার হলো তার মধ্যে রয়েছে সে? বিরোধী দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিকে বানচালের উদ্দেশ্যে সরকার যে গণগ্রেপ্তার চালাচ্ছিল, তুহিন কি তার শিকার?
না, কোনো উত্তর মেলে না তুহিনের পরিবারের। ২৮ বছর বয়সী পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতার ফর্সা মায়াবী চেহারার এক যুবকের নিখোঁজ হওয়ার গল্প বলতে গিয়ে পাঠককে এসব পরিণতির সামনে দাঁড় করিয়ে দেন গল্পকার শাহনাজ মুন্নী। আসলে তুহিনকে নিয়ে গল্প বলার উছিলায় আমাদের প্রত্যেকের বিপন্নতার চিত্রই তিনি তুলে ধরেন। পরিবারের কোনো সদস্য নিখোঁজ হলে তার পরিণতি কী হতে পারে, এটা অনুধাবন করা কারও পক্ষেই শ্রমসাধ্য নয়। এ জন্য যে খানিকটা চিন্তাঝড় প্রয়োজন ছিল পাঠক তা গল্পের শুরুতে পেয়ে যান। তবে পাঠকের দুশ্চিন্তা লাঘব করতে ১২ দিনের মাথায় ফিরে আসে তুহিন। নিজের অন্তর্ধানের বিষয়ে সে অদ্ভুত দুটো গল্প বলে। প্রথমে বলে, তাকে বহুদূরের এক মাজারে নিয়ে গিয়েছিল একদল লোক। তার কথা অবিশ্বাস্য মনে হয় সবার কাছে। শেষে সে বলে অন্তর্ধান সম্পর্কিত আরও একটা কাহিনি। একটা কালো গাড়িতে কালো কাপড়চোপড় কালো চশমা-পরা লোকজন নিয়ে গিয়েছিল তাকে। তাদের সবকিছু কালো, এমনকি জিহ্বাটাও কালো। ওরা তাকে একটা কালো বাড়িতে নিয়ে যায়। তারপর টার্গেট প্র্যাকটিস করতে চায়। তাকে নিয়ে যায় অস্ত্র উদ্ধার করতে।
কালো লোকদের টার্গেট প্র্যাকটিস চলে। দৌড়াতে থাকে তুহিন। দৌড়াতে দৌড়াতে তার মনে পড়ে না আর। কখন সে বাসায় পৌঁছায়, তাও বলতে পারে না। তবে সে সত্যি ফিরে এসেছে কি না সে-বিষয়ে নিজেই সন্দিহান হয়ে ওঠে শেষে। কালো লোকদের টার্গেট প্র্যাকটিস থেকে তুহিন কি সত্যি ফিরে এসেছিল—পাঠকের সামনে এই প্রশ্ন রেখে গল্পকার থামিয়ে দেন গল্পের চাকা। কারণ, উত্তরটা পাঠকের অজানা নয়। তাদের চোখের সামনে একটা ছকবাঁধা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি ভেসে ওঠে আর সেখানে দৌড়াতে থাকে তুহিনের মতো নামের ভুলের ফেরে পড়ে যাওয়া বহু তরুণ। তাদের পরিণতি তাই লেখককে বলে দিতে হয় না।
শাহ্নাজ মুন্নী দেশের জনপ্রিয় সাংবাদিক, লেখক। দেশের প্রথম বেসরকারি টেলিভিশনটি যাত্রা শুরু করার পরপরই তুখোড় নারী প্রতিবেদক হিসেবে দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন তিনি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য সারা দেশ ঘুরতে হয়েছে তাঁকে। মিশতে হয়েছে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে। তাই শহর, মফস্বল কিংবা কোনো বিচ্ছিন্ন গ্রামের যেকোনো চরিত্রই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর গল্পে। সাংবাদিকতার ছাপ কিংবা নিছক বিবরণধর্মিতাকে ছাপিয়ে গল্পের পেছনের গল্পকে তুলে আনেন তিনি। ঘটমান বাস্তবতা সম্পর্কে লেখকের যে নিজস্ব মতামত আছে, তা আর চাপা থাকে না; সে ঢাকা হোক কিংবা হোক ভৈরব—সব রকম অসংগতি ধরা পড়ে তাঁর চোখে। বিচিত্র পেশা ও শ্রেণীর মানুষের মনোজগেক এতটা নিখুঁতভাবে খুব কম গল্পকারের পক্ষেই তুলে ধরা সম্ভব হয়েছে।
বাদুর ও ব্র্যান্ডি গল্পগ্রন্থের নাম হিসেবে অসামান্য। নামের অন্তানুপ্রাস পাঠকের মনে প্রথমেই আলাদা অনুভূতি তৈরি করে। বইটিতে মোট ১৪টি গল্প গ্রন্থিত হয়েছে। গল্পগুলো পড়তে পড়তে পাঠক বাস্তবতা আর ফ্যান্টাসির ব্যবধান ভুলে যেতে থাকে। মাঝেমধ্যে বাস্তবকে মনে হয় ফ্যান্টাসি, আবার কখনো ফ্যান্টাসিকে মনে হয় বাস্তব; কিন্তু প্রতিটি গল্প শেষ করার পর সত্যিকারের বাস্তবতার ভয়ংকর চাপটা এসে গ্রাস করে পাঠককে।
ব্যাংকার ওয়াহিদ অর্ডার দিয়ে বউ বানিয়ে আনে। বেছে বেছে সব অঙ্গের অর্ডার দিলেও হূিপণ্ডের অর্ডার দিতে ভুলে যায় সে। তাই তার বউ হয় হূিপণ্ডবিহীন। গল্পের ভেতরে এই গল্প বেড়ে ওঠে—সুনন্দার স্বামীর গল্পের সূত্র ধরে সুনন্দাই বানিয়ে তোলে এই গল্প, যেখানে সদ্যবিবাহিত সুনন্দা নিজেই প্রতিস্থাপিত হয় তারই বানানো গল্পের চরিত্রের দ্বারা। পুরুষের রুচি, দৃষ্টিভঙ্গি, নারীকে দেখার চোখ ইত্যাদি যে শ্রেণীনির্বিশেষে পাল্টায় না, তা মর্মান্তিকভাবে সুনন্দা আবিষ্কার করে। আবিষ্কার করে, এক হূদয়হীন সম্পর্কের মধ্যে শুরু হয়েছে তার পথ চলা। রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবারের এই হূদয়হীনতার কাহিনিই যেন বলতে চেয়েছেন শাহ্নাজ মুন্নী।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply