ফরাসি কবি ইভ বনফোয়া কবিতার দিকে চেয়ে বাসনার কথা বলেছিলেন। অর্থাত্, কবিতায় কবি একটি বাসনাকে ব্যক্ত করেন আর পাঠক তার বাসনা দিয়ে যুক্ত করেন নিজেকে। এই দুই বাসনার সংঘাতে চিহ্নিত হয় সাহিত্যিক বাস্তবতা এবং নির্ণীত হয় বিদ্যমানতার দিব্যজ্ঞান থেকে তা কতদূর। আল মাহমুদের কবিতা পাঠে এই বাসনার অন্তর্বাস খুলে দেখাটা দরকার এই কারণে যে, একটা দীর্ঘ সময় বাঙালি মধ্যবিত্তের সেক্যুলার চিন্তাকে এনকাউন্টার করতে করতে তার কবিতা কোথায় গিয়ে পৌঁছাল, তার হদিস মিলবে তাতে। এই ক্ষেত্রে আমরা কেন কাব্যের আলঙ্কারিকের দিকে নজর দিতে আগ্রহী নই, আশা করি আলোচনার ক্রম-পরম্পরায় তা পরিষ্কার হয়ে উঠবে।
তোমার রক্তে তোমার গন্ধে বইটিতে কবিকে বেশ নির্ভার মনে হয়, বিশেষত স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত তাঁর সঙ্গী হওয়ায়। ‘আমি একলাই পথ ছেড়ে দিই মরণকে বলি জেতো’—এই বলে তিনি হার-জিতের বাইনারি বিচারের বাইরে নিজেকে নিয়ে যেতে চান, পার হয়ে যান সত্য-মিথ্যার ছলনাকে। একটি যাত্রাপথের কথা ঘুরেফিরে আসে তাঁর জবানে। উঠে আসে এই যাত্রাপথে থমকে যাওয়া, অসমাপ্ত, অপূর্ণ বাসনার কয়েকটি মুখ—মল্লিক, সিরাজুদ্দীন হোসেন, শিকদার প্রমুখ। ফলে নিজের একাকিত্বই প্রকটিত হয় শুধু—‘খাঁচার মধ্যে পাখির বড় ছটফটানি/ আমিই জানি, আমি কেবল একলা জানি’। যেন এই একাকিত্বই তাঁর ভাগ্যলিপি। যতই না তিনি প্রমাণ করেন পানির ফোঁটায় সিক্ত তার দেহ, তবু যেন কেউ সন্দেহ মুছে হয় না তার পথের সাথি। এখানে কবি একটু দিশেহারা—‘কেউ কি জানে কোথায় আদি কোথায় অন্ত’?
দিশেহারা-দশদিগন্তে পেছন-ফিরে তাকাতে হয় তাঁকে। একদিন যৌবনের পাগলা ঘোড়া দিগ্বিদিক ছুটেছে। নানা মত, নানা চিন্তা ছিল তার সওয়ারি। আজ কেউ নেই পিঠে, কিন্তু পৃষ্ঠদেশে লাগাম টানে অদৃশ্য কেউ। কবি টের পান, ‘কালের পিছে ধাওয়া করব এমন শক্তি নাই’। কিন্তু কালের অধিক কালান্তরে, ঋতুর অধিক বসন্তে পৌঁছুতে চান তিনি। পৌঁছুতে চান ‘নিজেকে ছুঁয়েই’, ইতিহাস-কানামাছি খেলা সাঙ্গ করে। কারণ দেহ-দুনিয়াতেই ঘটছে সব ঘটনা। ফলে ‘আমিই আমাকে ধাওয়া করি তবে/ আমাকেই চাই আমি’—এই আত্মমন্থন তাঁকে ঠেলে দেয় দুঃস্বপ্নের ভেতর, যেখানে সাক্ষাত্ মেলে এমন এক রাজার, যাঁর নাকি বাম-ঘরানার বন্ধু আছে। এই দুঃস্বপ্নে অস্ফুটস্বরে একটা কথা আমরা শুনি, সমাজতন্ত্র থেকে খোদার রাজত্বে আকাঙ্ক্ষার রূপান্তর ঘটে গেছে কবির। কিন্তু এই অনুধাবনের কোনো বয়ান কাব্যে অনুপস্থিত। একে উল্লম্ফন বলেই মনে হয়। ভাবনার ধস কিংবা ভূস্ফীতি। প্রকৃতপক্ষে, কাব্যের অন্তস্থলে একটা বিরাট আফসোসের হাঁসফাঁস শুধু টের পাওয়া যায়। একটি লাইনে বিধৃত করা যায় তাঁকে—‘কিন্তু হঠাত্ উল্টে গেল পাশার ঘুঁটি/ হাতভরা এই মুক্ত (মুক্তো?) হলো মটরশুঁটি।’
তবে এ কথা সত্য যে, কোনো পূর্ণ-বাসনার দেশে পৌঁছানোর দাবি করেননি কবি। বলেছেন ছলনায় ঘেরা উপবন, মায়াবনের কথা, বুকের ভেতর ভয়ের দুলুনির কথা। কাজেই ‘দিল দরিয়া ভাব এসেছে যাওয়ার সময়’ বললেও ভেতরকার সুরটি ভিন্ন। তবে অনুচ্চস্বরে আঁতের কথা বলতে গিয়ে ভাষায় ‘ছলনার ছলাকলা’, আভরণ, হেঁয়ালি ত্যাগ করতে চেয়েছেন তিনি, এটি সত্য। কবিতাই তাঁর সাক্ষী। সেই সঙ্গে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়, সিদ্ধান্ত ও নিরুক্তির দায় চেপে বসেনি কবির ওপর। একটা দোলাচল শেষ পর্যন্ত তাঁকে এক অনির্ণেয়, অনিশ্চিতের দিকে ঠেলে দিয়েছে। সেই অনির্দিষ্টের রক্তে গন্ধে নাচতে নাচতে বাধ্য হয়েই কবিকে বলতে হয়েছে, জয় হবে মানুষেরই। সে মানুষ একা কোনো পুরুষ নন। নরম মাটির কাদায় ডোবা বাংলাদেশের সে এক সামূহিক ব্যাপার, সামষ্টিক চেতনা।
খাস-দিলে স্বীকার করলে এই সমাধানের রাস্তাটিকে আনপ্রেডিক্টেবল কিছু মনে হয় না। এটা একটা রোমান্টিক স্বপ্নোচ্চারণও বটে। চল্লিশের দশকে হারিয়ে যাওয়া, সত্তরের দশকে জেগে ওঠা কোনো কবির মৃদু পদধ্বনি। বাংলাদেশে থেকে বাংলাদেশে পৌঁছুতে চাওয়ার মানে কী? মধুসূদনের মুখে এ কথার একটা সরল মানে হতো নিশ্চয়ই। কিন্তু আল মাহমুদের প্রার্থিত দেশ কোন অপ্রাপণীয়ের বেদনায় সুদূরবিচ্ছিন্ন, তা অনুমেয় হলেও কাব্যে তার সংকেত গরহাজির। বিষয়টা হয়ে দাঁড়িয়েছে নিষ্ক্রিয় মধ্যবিত্তের নিষ্ফল কামনা।
সাংস্কৃতিক নির্মাণের ক্ষেত্রে যে ভাষাভঙ্গি, শব্দরুচি বাংলাদেশের পরিচয় নিয়ে জেগে উঠছিল মাহমুদের কবিতায়, এই কাব্যে তার পরিচয় অনঙ্কিত রয়ে গেল। উল্টে, এ যেন এক আত্মগোপন ও আত্মসমর্পণের কাব্য, তারই কাব্যাদর্শের বিচারে। না-হলে, মায়াবনে পথ হারানোর কোনো কারণ ছিল না। প্রচল ও জর্জর ভাষা-ছন্দে গুম হয়ে থাকা এক কবির দীর্ঘশ্বাসের বেশি এ আর কী? অথচ বিশ্বরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে সব থেকে সচকিত-উচ্চকিত হয়ে উঠবার কথা ছিল তারই।
তবে আশার কথা, বার্ধক্য পেয়ে বসেনি কবিকে। যে বার্ধক্য দৈনন্দিনতার খুঁটিনাটি বিষয়গুলোকে, নিজের অসহায়ত্বকে কাব্য করে তুলতে চায়, যেমনটা আমরা দেখেছি শামসুর রাহমানের শেষদিকের রচনায়, তার আঁচড় থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলেছেন আল মাহমুদ। ‘অন্ধের ডালপালা’ সেই দুর্বলতার আভাস দিয়ে যায় বটে, কিন্তু বৈশাখী হাওয়া এসে এলোমেলো করে দেয় সব। উল্টোরথের প্রেরণায় কবিও তখন ফুলকে আবাহন করেন মৌমাছিদের ডাকে, প্রার্থনা করেন মাধুর্যের—‘তুমি ফুল হও আমি এক ফুলদানী।’ তোমার রক্তে তোমার গন্ধে কাব্য সেই অদেখা ফুলের সুবাস ছড়াচ্ছে মৃদু, যেন কারও স্বপ্নের ভেতর। কিন্তু সেই স্বপ্ন কি জাগরণের অধিক?
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, এপ্রিল ৩০, ২০১০
Leave a Reply