বাংলাদেশে রাষ্ট্র কিংবা সরকারপ্রধানদের কাছ থেকে আত্মজীবনী অথবা তাঁদের শাসনামলের ওপর বিস্তারিত কিছু লেখা অথবা তাঁদের অভিজ্ঞতা পুস্তক আকারে প্রকাশ করা একটি বিরল ঘটনা। এর কারণ দুটি। প্রথমত, এই দেশের ইতিহাস স্বাধীনতা অর্জনের পর এমন একটি খাতে প্রবাহিত হয়েছে, যার কারণে কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানের পক্ষে সম্ভব হয়নি তাঁদের নিজের কথা লিপিবদ্ধ করা। কেউ আততায়ীর হাতে নিহত হয়েছেন, আবার কেউ এমনভাবে ক্ষমতা গ্রহণ বা দখল করেছেন যে তাঁরা যে বই লিখবেন সেটা কেউ কখনো আশা করেননি। লিখলেও হয়তো কেউ এ বই পাঠ করতে চাইতেন না। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জনগণ বরাবরই লক্ষ করেছেন যে তাঁদের নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা যদিও বছরের পর বছর রাজনৈতিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে সক্ষম, লেখক হিসেবে তাঁদের শক্তি অতি সীমিত। কথাটা রূঢ় শোনায় কিন্তু আমরা এই সত্যটি এড়াতেও পারি না।
কিন্তু এতগুলো কথা সত্ত্বেও কিছুটা অবাক, কিছুটা পুলকিত হতে হয় এই ভেবে যে বিগত একুশে বইমেলায় অন্তত একজন প্রাক্তন সরকারপ্রধান তাঁর সরকার পরিচালনার বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং সেটা আবার সহজ-সাবলীল ভাষায়। আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মোট নব্বই দিন অর্থাৎ তিন মাস দেশ পরিচালনা করেন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল ব্যক্তিত্ব অথবা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। অবশ্য বিচারপতি লতিফুর রহমানও তাঁর সময়ের কথা লিখেছেন। কিন্তু মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান যেভাবে তাঁর সরকারের কথা তুলে ধরেছেন, সেটা বোধকরি একটু ভিন্ন ধরনের এই কারণে যে তাঁকে অনেক প্রতিকূলতার মাঝে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। এবং সে দায়িত্ব কাঁধে না নিয়ে উপায়ও ছিল না। ১৯৯৬-এর জুন মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনের আগে তিনিই ছিলেন অবসরে যাওয়া সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি। এই বইয়ে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর সেই দায়িত্বভার গ্রহণ করা।
এই বইয়ের একটি বিশেষ দিক হচ্ছে, তাঁর সরকারে তাঁর সঙ্গে সরকার পরিচালনা করার লক্ষ্যে অন্যান্য উপদেষ্টা নিয়োগ করা। সৈয়দ আলী কবির, যিনি তাঁর বন্ধু ছিলেন, তাঁকে তিনি অনুরোধ করেছিলেন উপদেষ্টা হতে। কবির তাঁর অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে তিনি হাবিবুর রহমানকে এও বলেছেন যে, ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ একজন ভালো উপদেষ্টা হতে পারেন। এবং সেভাবেই মাহমুদ তাঁর তত্ত্বাবধায়ক সরকারে প্রবেশ করলেন। বিচারপতি হাবিবুর রহমান আশা করেছিলেন যে তাঁর বন্ধু আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল মোমেনের ছোট ভাই পরমাণু বিজ্ঞানী ড. আবদুল মতিনকে উপদেষ্টা পরিষদে তিনি আনতে পারবেন। ড. মতিন রাজি হলেন না এ কারণে যে তিনি সেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে এলে খোদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যাবে।
তাঁর তিন মাস মেয়াদি সরকার বেশ কিছু কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে বাধ্য হয়েছে। ১৯৯৬-এর মে মাসে রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কর্তৃক দুজন উচ্চপদস্থ সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাতে অবশেষে সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমকে অপসারিত করা হয়। সময়টি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর। ঢাকার রাস্তায় ট্যাংক নেমে আসে এবং এমনও ধারণা জন্মায় জনমনে এবং তা স্বাভাবিক কারণেই যে সেনাপ্রধান অথবা স্বয়ং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বানচাল করার কাজে লিপ্ত রয়েছেন। দেশের প্রতিরক্ষা বিষয় দেখার দায়িত্ব সাংবিধানিকভাবে ন্যস্ত ছিল রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের ওপর। অতএব বিচারপতি হাবিবুর রহমানের এই ক্ষেত্রে কিছু করার ছিল না। অথচ তাঁকেই বিভিন্ন দেশি এবং বিদেশি পত্রিকা ও টেলিভিশনের সামনে সেনাবাহিনী ও নির্বাচন—সব ব্যাপারেই বক্তব্য পেশ করতে হয়েছে।
বইটির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সহজ ভাষায় এবং অত্যন্ত খোলামেলাভাবে বিচারপতি রহমান তাঁর চিন্তা ও চেতনার কথা পাঠকের সামনে পেশ করেছেন। তিনি লক্ষ করেন যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর কাছ থেকে আসা বার্তায় ফ্লুইড দিয়ে মুছে ফেলা একটি শব্দের ওপর তাঁকে প্রধান উপদেষ্টা সম্বোধন করা হয়েছে। তাহলে কি বেনজির ভুট্টো তাঁকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন এবং সেই ভুল কি কোনো পাকিস্তানি সরকারি কর্মকর্তা বা কেরানি সংশোধন করে দিয়েছিলেন ওই ফ্লুইড ব্যবহার করে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পরিচালনার সময়ে একপর্যায়ে আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি তাঁকে জানিয়ে দেন যে আওয়ামী লীগের ৫০ হাজার কর্মী তাঁকে নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে পথে নামতে প্রস্তুত। হাবিবুর রহমান বিনয়ের সঙ্গে সেই প্রস্তাবে রাজি হননি। ১৯৯৬-এর ১২ জুন নির্বাচনের পর রাষ্ট্রপতি বিশ্বাস একদিন প্রধান উপদেষ্টাকে জিজ্ঞাসা করেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে প্যারোলে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া সম্ভব কি না; যেহেতু তিনি জাতীয় সংসদের পাঁচটি আসনে জয়ী হয়েছেন। এর কিছুক্ষণ পর বেগম খালেদা জিয়া বিচারপতি হাবিবুর রহমানকে ফোন করেন এবং তাঁকে পরিষ্কারভাবে বলে দেন, ‘আপনি রাষ্ট্রপতির কথা শোনেন না।’ যখন প্রধান উপদেষ্টা তাঁকে জবাবে বলেন যে তিনি রাষ্ট্রপতির কথা সব সময় শোনেন, তখন বেগম জিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে বলেন, ‘আপনি যদি এমন করেন, তাহলে পরে আপনাকে আমরা ঘরে থাকতে দেব না, দেশেও থাকতে দেব না।’
এ বইটি পাঠককে আকৃষ্ট করবে। ভাষার দিক দিয়ে, বিভিন্ন বিষয়ের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের জাতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কী রকম বিচিত্র ঘটনা আমাদের বিচলিত করে—এ সবই হচ্ছে এই বইয়ের মূল উপাদান। যে বই পড়া ভালোবাসে, সে-ই বিচারপতি হাবিবুর রহমানের বইটি হাতছাড়া করতে চাইবে না।
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, এপ্রিল ১৬, ২০১০
Leave a Reply