উপন্যাস
গল্প
নাটিকা

০৯. এ কার কণ্ঠস্বর?

০৯. এ কার কণ্ঠস্বর?

সেই নয়া পয়সার মতো চোখ দুটোর দিকে তাকিয়েই তো আমার হয়ে এসেছে। গল্পে শুনেছি, অজগর সাপ অমনিভাবে চোখের দৃষ্টি দিয়ে নাকি হিনটাইজ করে ফেলে, তারপর ধীরেসুস্থে এগিয়ে এসে পাকে পাকে জড়িয়ে একেবারে কপাৎ। অতএব হিনটাইজ করার আগেই ধড়মড়িয়ে উঠে আমি তো টেনে দৌড়। দৌড়ই আর তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি তাড়া করে আসছে কি না পেছন-পেছন!

না—এল না। এঁকেবেঁকে, সুড়সুড়িয়ে, আস্তে আস্তে নেমে গেল পাশের একটা শুকনো নালার ভেতর।

আধ মাইল দৌড়ে বাগানের মধ্যে এসে যখন থামলুম, তখন আমি আর আমি নেই! এ কোথায় এলুম রে বাবা! কথা নেই বার্তা নেই—কোত্থেকে গোদা বাঁদর এসে খপ করে কাঁধ চেপে ধরে রাত্তিরে জানালার কাছে এসে চিতাবাঘ দাঁত খিঁচিয়ে যায়, আমলকী গাছের তলায় ঘাপটি মেরে ময়াল সাপ বসে থাকে! আফ্রিকার মতো বিপজ্জনক জায়গায় বেড়াতে এলে এমনি দশাই হয়!

থুড়ি—আফ্রিকা নয়। এ নিতান্তই বাংলাদেশ। কিন্তু এমনভাবে রাতদিন প্যাঁচে পড়ে গেলে কারও কি আর কিছু খেয়াল থাকে—তোমরাই বলল। তখন মনে হয় আমার নাম প্যালারাম হতে পারে—গদাইচরণ হতে পারে, কেষ্টদাস হওয়াও অসম্ভব নয়। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটা গোবরডাঙা হতে পারে, জিব্রাল্টার হতে পারে জাঞ্জিবার হলেই বা ঠেকাচ্ছে কে?

দুত্তোর, কিচ্ছুটি ভালো লাগছে না। কেমন উদাস-উদাস হয়ে যাচ্ছি। আর বাঁচব না বলে মনে হচ্ছে। এই আফ্রিকার জঙ্গলে-না, আফ্রিকা নয়, এই ম্যাডাগাস্কারের মরুভূমি—দুত্তোর, ম্যাডাগাস্কারও নয়—মানে, এই খুব বিচ্ছিরি জায়গায় আমি নির্ঘাত মারা যাবে। বাঘেই খাক কি সাপেই ফলার করুক।

মারা যাব—এ-কথা মনে হলেই আমার খুব করুণ সুরে গান গাইতে ইচ্ছে করে। বাগেশ্রী-টাগেশ্রী ওই রকম কোনও একটা সুরে। আচ্ছা, বাগেশ্রী না বাঘেশ্রী? বেমক্কা বনের মধ্যে বাঘের ছিরি দেখলে গলা দিয়ে কুঁই কুঁই করে যে-গান বেলোয়তাকেই বাঘেশ্রী বলে নাকি? খুব সম্ভব। আর বাঘ যখন গম্ভীর সুরে বলে—হালুম, খাম্খাস্তখন সেই সুরটার নাম বোধহয় খাম্বাজ। তাহলে মল্লার গান কি মল্লরা—মানে পালোয়ানরা কুস্তি করবার সময় গেয়ে থাকে?

কিন্তু মল্লার-ফল্লার চুলোয় যাক। সাপ বাঘের ফলার হওয়ার আগে বরং মনের দুঃখে ঘরে যাওয়াই ভালো। টেনে দৌড় দেওয়ার ধুকপুকুনি একটু থামলে, আমি খুব মিহি গলায় গাইতে লাগলুম :

এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো
সে মরণ স্বরগ সমান—

বেশ আবেগ দিয়ে গাইছি, চোখে জল আসব-আসব করছে, এমন সময় কানের কাছে কে যেন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হেসে উঠল :

—আরে খেলে যা! এই ভরা রোদ্দুরে চাঁদের আলো পেলি কোথায়?

আর কে? বেয়াক্কেলে ক্যাবলাটা! খুব ভাব এসেছিল, একদম গুলিয়ে দিলে। সাধে কি টেনিদা যখন-তখন চাঁদিতে ওর চাঁটি হাঁকড়ে দেয়।

–গোলমাল করছিস কেন? আমি মারা যাব।

—যা না। কে বারণ করেছে তোকে? বেশ কায়দা করে—যা-ইবি-দায় বিদায় বলে মরে যা, আমরা তোর শোকসভা করব। কিন্তু খবরদার, ওরকম যাচ্ছেতাই সুরে গান গাইবি না!

আমি ব্যাজার হয়ে বললুম, দ্যাখ ক্যাবলা, বেশি ঠাট্টা করিসনি। জানিস—এক্ষুনি একটা অজগর সাপ আমাকে প্রায় ধরে খাচ্ছিল?

ক্যাবলা বললে, খাচ্ছিল নাকি? তা খেলে না কেন? তোকে খেয়ে পাছে পালাজ্বর হয় এই ভয়েই ছেড়ে দিলে বুঝি?

–সত্যি বলছি, ইয়া পেল্লায় এক অজগর সাপ—

ক্যাবলা বাধা দিয়ে বললে, বটেই তো। ত্রিশ হাত লম্বা আর সাড়ে চার হাত চওড়া। জানিস আমাকেও এক্ষুনি একটা তিমি মাছ—তা প্রায় পঞ্চাশ হাত হবে—একটা ইঁদুরের গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে কপাৎ করে চেপে ধরে আর-কি! কোনও মতে পালিয়ে বেঁচেছি।

বলে মুখ-ভর্তি শাঁকালুর দোকান দেখিয়ে ক্যাবলার কী হাসি!

—বিশ্বাস হল না–না?

—কেন এলোমেলো বকছিস প্যালা? চালিয়াতি একটু বন্ধ কর এখন। কপালজোরে একটা বাঘ না-হয় দেখেই ফেলেছিস, তাই বলে অজগর-গণ্ডার-হিপোপটেমাস-উকু মাছ সব তুই একাই দেখবি? আমরা দুটো-একটাও দেখতে পাব না? গল্প মারতে হয় পটলডাঙায় চাটুজ্যেদের রোয়াকে গিয়ে যা-খুশি মারিস, এখানে ওসব ইয়ার্কি চলবে না। এখন চল—ওরা সবাই তোকে গোরু-খোঁজা করছে।

বেশ, বলব না। কাউকেই কোনও কথা বলব না আমি। এমনকি কুট্টিমামাকেও না। তারপর কালকে একটা মতলব করে সবাইকে ওই আমলকী গাছের দিকে পাঠিয়ে দেব। তখন বোঝা যাবে নালা থেকে অজগর বেরোয়, না ইঁদুরের গর্ত থেকে পঞ্চাশ হাত তিমি মাছই বেরিয়ে আসে।

 

সন্ধেবেলায় কুট্টিমামা বললেন, এক-আধটা চিতাবাঘ না মারলে নয়। ভারি উৎপাত শুরু করেছে। আজও বিকেল নাগাদ একটা এসেছিল কুলি লাইনের দিকে। অবিশ্যি কিছু করতে পারেনি। কিন্তু এখন রোজ হাঙ্গামা বাধাবে মনে হচ্ছে।

টেনিদা খুব উৎসাহ করে বললে, তাই করো মামা। গোটা কয়েক ধাঁ করে মেরে ফেলে দাও, আপদ চুকে যায়।

ক্যবলা বললে, তারপর আমরা সবাই মিলে একটা করে বাঘের চামড়া নেব।

হাবুল বললে, আর সেই চামড়া দিয়া জুতা বানাইয়া মচমচাইয়া হ্যাঁইট্যা যামু।

আমি চটেই ছিলুম। সেই অজগরকে নিয়ে ক্যাবলাটা ঠাট্টা করবার পর থেকে আমার মন-মেজাজ এমন খিঁচড়ে রয়েছে যে কী বলব। আমি বললুম, আর কলার খোসায় পা পড়ে ধপাস্ করে আছাড় খামু।

কুট্টিমামা হেসে বললেন, আচ্ছা—আচ্ছা, আগে বাঘ তো মারা যাক, পরের কথা পরে হবে। আজ কয়েকটা টোটা আনতে পাঠিয়েছি শহরে নিয়ে আসুক, তারপর কাল বিকেলে বেরুব।

–আমরাও যাব তো সঙ্গে?ফস করে জিজ্ঞেস করল ক্যাবলা।

শুনেই তো আমার পেটের মধ্যে গুরুগুরিয়ে উঠেছে। আগে যেটুকু বা সাহস ছিল, জানালার পাশে বাঘ এসে দাঁড়াবার পর থেকে সমানে ধুকপুক করছে বুকের ভেতরটা। তারপর ওই বিচ্ছিরি সাপটা। নাঃ, শিকারে গেলে আমাকে আর দেখতে হবে না! পটলডাঙার প্যালারামের কেবল বারোটা নয় সাড়ে দেড়টা বেজে যাবে। বাঁচালেন কুট্টিমামাই।

—সে হরিণ শিকার হলে নিয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু চিতাবাঘ বড্ড শয়তান। কিছু বিশ্বাস নেই ওদের।

টেনিদাও বোধহয় মওকা খুঁজছিল। বললেন, আমরা তো শিকার করবার জন্যেই এসেছিলুম। কিন্তু কুট্টিমামার অসুবিধে হলে কী আর করা যায়—মনে ব্যথা পেলেও বাংলোতেই বসে থাকব।

ক্যাবলা বললে, সমঝ গিয়া। তোমার ভয় ধরেছে, তাই না যেতে পারলে বাঁচো। ওরা থাকুক মামা—আমি সঙ্গে যাব।

হাবলা সঙ্গে সঙ্গেই পোঁ ধরলে : হঃ–ক্যাবলা সাহস কইরা যাইতে পারব—আর আমি পারুম না। আমারেও লইতে হইব।

আমার যে কী বিচ্ছিরি স্বভাব—ওদের উৎসাহ দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আমারও দারুণ তেজ। এসে যায়। তখন মনে হয় পালাজ্বর-ফালাজ্বর পিলে-টিলে কিচ্ছু না—আমি সাক্ষাৎ ভীম-ভবানী, এক্ষুনি গরিলার সঙ্গে দমাদম বসিং লড়তে পারি। মনে হয়, মনের দুঃখে মরে যাওয়ার কোনও মানে হয় না-মরি তো একটা কিছু করেই মরব।

একটু আগেই ভয় ধরে গিয়েছিল, হঠাৎ বুক চিতিয়ে বলে ফেললুম, আমিও যাব—নিশ্চয় যাব!

টেনিদা কেমন করুণ চোখে আমাদের দিকে তাকাল। তারপর ঘাড়-টাড় চুলকে নিয়ে বললে, সবাই যদি যায়—তবে আমিই আর বাদ থাকি কেন?

ক্যাবলা বললে, কিন্তু তুমহারা ডর লাগ গিয়া।

—ডর? হেঁঃ! আমি পটলডাঙার টেনি শর্মা—আমি ভয় করি দুনিয়ায় এমন কোন—

কথাটা শেষ হতেও পেল না। হঠাৎ বাইরে চ্যাঁ-চ্যাঁ করে এক বিটকেল আওয়াজ। টেনিদা তড়াং করে লাফিয়ে উঠল : ও কী—ও কী মামা?

কুট্টিমামা কী যেন বলতে গিয়েই হঠাৎ থমকে গেলেন। আমরা দেখলুম তাঁর মুখের চেহারা কেমন পাল্টে গেছে—দুচোখে অমানুষিক ভয়ের ছাপ।

কুট্টিমামা কেবল ফিসফিস করে বললেন, সর্বনাশ-কী সর্বনাশ! তারপর এক হাতে গলাটা চেপে ধরলেন।

বাইরে আবার চ্যাঁ-চ্যাঁ করে সেই বীভৎস ধ্বনি। আর কুট্টিমামার আতঙ্কে স্তব্ধ মুখের দিকে তাকিয়ে আমরাও একটা রহস্যময় ভয়ের অতলে ড়ুবে যেতে লাগলুম।

বাইরে ও কী ডাকল? কোন্ অদ্ভুত আতঙ্ক—কোন্ ভয়াল ভয়ঙ্কর?