• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

২৯. শ্রীনাথ বাড়ির ফটক পেরিয়ে

লাইব্রেরি » শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » উপন্যাস (শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়) » মানবজমিন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় » ২৯. শ্রীনাথ বাড়ির ফটক পেরিয়ে

শ্রীনাথ বাড়ির ফটক পেরিয়ে রাস্তায় পা দিয়ে চারপাশে লক্ষ করল। দু-চারজন যাতায়াত করছে, কিন্তু চেনা মুখ নজরে পড়ল না। ধীরেসুস্থে স্টেশনের দিকে হাঁটতে থাকে সে।

সামনেই একটা তেমাথা মোড়। আর মোড় মানেই কিছু পানবিড়ি বা মুদির দোকান। কিছু লোক সমাগম। এখানে দু-চারটে চেনা মুখ নজরে পড়ল বটে, কিন্তু এদের সঙ্গে কথাবার্তার সম্পর্ক বড় একটা নেই শ্রীনাথের। রাস্তায় ঘাটে প্রায়ই দেখে, এই যা। তবে হরিশ কম্পাউন্ডার ধীরে ধীরে সাবধানে সাইকেল চালিয়ে মোড় পেরিয়ে বাজারের দিকে যাচ্ছিল। হরিশের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা নেই, তবে কথাবার্তা হয়। শ্রীনাথ হক মারল, হরিশবাবু যে!

হরিশ সাইকেলের ব্রেক চেপে ধরেও ঘষটাতে ঘষটাতে খানিক দূর চলে গিয়ে নামল। এ অঞ্চলে শ্রীনাথবাবু মানী লোক। তিনি ডাকলে থামতেই হয়, পথ-চলতি জবাব দিয়ে চলে যাওয়া যায় না।

হরিশ একগাল হেসে বলে, ভাল আছেন তো শ্রীনাথদা?

খারাপ কী? আপনাকে বহুকাল দেখি না।

দেখবেন কী করে, আপনারা কাজের লোক, ব্যস্ত থাকেন।

আমার আর কাজ কী? বসে বসে খাচ্ছি।–বলে শ্রীনাথ একটু শ্লেষের হাসি হাসে।

হরিশের সাইকেলের হ্যান্ডেলে একটা ন্যাকড়ার ব্যাগ ঝুলছে। বোধ হয় বাজার করে ফিরবে সেই রাত্রিবেলা। কম্পাউন্ডার হলেও বোধ হয় হরিশের সংসার বেশ সুখেরই। মুখে-চোখে সংসারী মানুষের স্বাভাবিক দুশ্চিন্তার ছাপ আছে, চেহারাটাও গরিবদের মতো নীরস। বোধ হয় দিন দুয়েক দাড়ি কামায়নি। অল্পে বুড়িয়ে যাওয়ার ভাব। নিতান্তই সস্তা হ্যান্ডলুমের ময়লা গেরুয়া পাঞ্জাবি আর মোটা ধুতির পোশাক। পায়ে হাওয়াইজোড়ার সোল কাগজের মতো পাতলা। তবু লোকটাকে অসুখী মনে হয় না শ্রীনাথের। একহাতে সাইকেলটা ধরে রেখে অন্য হাতে মাথা চুলকোতে চুলকোতে কৃতার্থ হয়ে যাওয়ার হাসি হেসে বলে, বসে বসে খেলেও কি আর বড়লোকদের কাজের অভাব হয়?

আমি বড়লোক কিসের? সবাই জানে, সম্পত্তি সজলের মায়ের।

ওই হল। আপনার যে কেমন সব কথা!

কথাটা শুনতে খারাপ বলেই কি আর মিথ্যে? আমি বড়লোক-টড়লোক নই বাপু!

হরিশ বোধ হয় এসব কথায় থাকতে চায় না। অন্য কথায় যাওয়ার জন্যই বলল, আজ যে বড় বেলাবেলি দেখছি। এত সকালে তো ফেরেন না।

আজ ফিরেছি। ভাবলাম, রোজ তো কলকাতায় ফুর্তি করিই, আজ এখানকার রসের হাটটা একটু দেখে আসি।

হরিশ একটু ঘাবড়ে গেল এ কথায়। বলল, তা বেশ তো। ভাল কথা।

শ্রীনাথ কূটচোখে হরিশকে নজর করছিল। একে দিয়ে কাজটা হলেও হতে পারে। তাই সে গলাটা একটু নামিয়ে বলল, রামলাখনের ঝোপড়ায় কেমন ব্যবস্থা জানেন?

হরিশ থতমত খেয়ে বলে, রামলাখন? মানে লাইনের ওপাশে?

হ্যাঁ। শুনেছি নাকি খুব জমে সেখানে।

হরিশ বিষণ্ণ মুখে বলল, জানি না।

বেশ গলা তুলে মোড়ের প্রায় সবাইকে শুনিয়ে বলল, আজ রামলাখনের ঘরেই ফুর্তি করতে যাচ্ছি।

হরিশ এ কথার জবাব না দিয়ে এবং কথাটা যেন শোনেনি এমন ভাবখানা করে তাড়াতাড়ি বলল, যাই তা হলে, দেরি হয়ে যাচ্ছে।

বলেই সাইকেলটা একটু ঠেলে গুপ্ করে লাফিয়ে উঠে বসল।

শ্রীনাথ একটু চেয়ে রইল চলন্ত সাইকেলটার দিকে। আশা করা যায়, আজ বা কালকের মধ্যেই সারা বাজারে কথাটা ছড়িয়ে পড়বে। ভেবে আপনমনে এক বিষাক্ত আনন্দের হাসি হাসল শ্রীনাথ। ছড়াক, অনেকদূর পর্যন্ত ছড়াক।

মোড় ছাড়াতেই যতীনবাবুর সঙ্গে দেখা। বছরখানেক আগে হাইস্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার হিসেবে রিটায়ার করেছেন। এখন দু’বেলা টিউশনি করেন আর অবসর সময় কাটে বছর তিনেকের নাতনিটিকে নিয়ে। আজও নাতনি নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। যতীনবাবুরও ভারী গাছপালার শখ। তবে পয়সার অভাবে বিরল জাতের দামি গাছ লাগাতে পারেন না। আজ দেখা হতেই বললেন, দেওঘর থেকে গোলাপ আনিয়েছেন শুনলাম। আমাকে একটা কলম দেবেন?

আর কদিন যাক। গাছ এখনও মাটির সঙ্গে কথা কইছে।

সে তো জানি। গাছ বড় হোক, আমার কথাটা যেন মনে থাকে।

থাকবে। আপনি নতুন কী লাগালেন?

এ সিজনে আর কী হবে! মল্লিকা লাগিয়েছিলাম, খুব ফুল হচ্ছে। আপনার কথামতো কেমিক্যাল সার একদম বাদ দিয়ে দিয়েছি।

ভাল করেছেন। বেশিদিন কেমিক্যাল সার দিলে মাটি জমে পাথর হয়ে যাবে। দুনিয়াটার যে কী সর্বনাশই করছে মানুষ কেমিক্যাল সার দিয়ে। বুঝবে একদিন। দরদি লোক পেয়ে কথাটা আবেগ দিয়ে বলল শ্রীনাথ।

যতীনবাবুর বাচ্চা নাতনিটা খুঁত খুঁত করছে। দাদুর এই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলাটা তার বিশেষ পছন্দ নয়। যতীনবাবু নাতনিকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, কদিন ধরেই যাবাব ভাবছিলাম। কিন্তু আপনাকে তো বাড়ি গিয়ে পাওয়া যায় না। আজ ভাগ্যে দেখা হয়ে গেল।

সকালের দিকটায় থাকি।

আজ ছুটি নাকি?

না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছি।

বলে একটু ইতস্তত করল শ্রীনাথ। যারা গাছ ভালবাসে তাদের দুঃখ দিতে তার প্রাণ চায় না। কিন্তু মনে এত বিষজ্বালা যে, সব সৎ ও অসতের বোধ একাকার হয়ে গেছে। তাই শ্রীনাথ দ্বিধা ঝেড়ে বেশ স্পষ্ট করে বলল, যাচ্ছি একটু রামলাখনের ঘরে ফুর্তি করতে।

যতীনবাবু কথাটা ঠিক বুঝতে পারেননি। বললেন, রামলাখন? সেটা আবার কী?

ওই লাইনের ওপাশে তার ঝোপড়ায় দেশি মদ বিক্রি হয়। আরও সব ব্যাপার আছে।

যতীনবাবু হা হয়ে গেলেন। এমনভাবে তাকালেন যেন শ্রীনাথের মাথা খারাপ হয়েছে কি না তা বুঝতে পারছেন না। দৃশ্যটা করুণ এবং শ্রীনাথের একটু কষ্টও হল। কিন্তু এরকমভাবে কথাটা না ছড়ালেও তার উপায় নেই। এ তার লড়াই।

যতীনবাবু ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেলেন। নাতনিকে আর-একটু বুকে চেপে ধরে–টা কুঁচকে বললেন, যান। বড়লোকদের সবই মানায়।

আমি বড়লোক নই, তবে ফুর্তিবাজ বটে। বড়লোক হচ্ছে সজলের মা। আমি কে?

যতীনবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। তারপর বললেন, ওসব ভদ্রলোকের জায়গা নয়।

বেশ রেলার সঙ্গেই শ্রীনাথ বলল, ভদ্রতার মুখে পেচ্ছাপ।

এই কথাটাই যতীনবাবুকে ধাক্কা দিয়ে সচল করে দিল। নাতনি নিয়ে বেশ পা চালিয়ে চলে গেলেন।

মোড়ে দাঁড়িয়ে একা একা হাসল শ্রীনাথ। কাজ হচ্ছে। কাজ হচ্ছে।

চোটে হেঁটে শ্রীনাথ স্টেশনের বিপরীত গঞ্জে পৌঁছে গেল সন্ধের ঘোর-ঘোর আঁধারে। রামাখনের ঝোপড়াটা সে কয়েকদিন হল চিনে রেখেছে দূর থেকে। কাজেই খুঁজতে হল না।

তবে রামলাখনের আড্ডাটা নিতান্তই ছোটলোকদের জন্য। উঠোনে গোটা চারেক ছাগল বাঁধা অবস্থায় মিহিন স্বরে ডাকছে মাঝে মাঝে। দড়ির জালে ঘেরা বারান্দার একধারে মুরগির পাল ডানা ঝাপটাচ্ছে। ছাগলের বোঁটকা গন্ধের সঙ্গে মুরগির চামসে গন্ধ মিশে বাতাস দূষিত।

উঠোনের দু’পাশে দুটো খোড়ো ঘর। মাটির ভিত। সর্বত্রই নোংরা ময়লা আর দীনদরিদ্র হাড়হাভাতে ভাব। কোনওকালেই এরকম কুৎসিত জায়গায় পা দেয়নি শ্রীনাথ। এখানে ফুর্তির প্রশ্ন ওঠে না। বরং বমি আসছে।

তবু এ তো তার লড়াই।

রামলাখনকে চাক্ষুষ চেনে কি না তা সে নিজেও জানে না। দেখলে হয়তো মুখটা চেনা বলেই জানতে পারবে। তবে সে না চিনলেও এ তল্লাটে তাকে সবাই চেনে। তাই বারান্দায় উঠে গম্ভীব গলায় হক মারল, রামলাখন!

ঘরের ভিতর থেকে সোঁদা টকচা বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে। সম্ভবত পচাই বা তাড়ি, বা দুটোই। এসব কখনও খায়নি শ্রীনাথ। খেতে পারবে বলেও মনে হয় না। গন্ধে গা গুলোচ্ছে।

খুব নিচু আধমানুষ সমান একটা দরজা সামনে। কুঁজো হয়ে সাজোয়ান একটা লোক উঁকি মেরে খুব দ্রুকুটি করে তার দিকে চাইল।

শ্রীনাথ উঁচু গলায় বলে, তুমি রামলাখন?

রামলাখন সন্ধের ঘোর-ঘোর অন্ধকারে বোধ হয় ভাল দেখতে পায় না। ফের ঘরে ঢুকে একটা হ্যারিকেন হাতে উঁকি দিয়ে দেখে নিল। তারপর পরিষ্কার বাংলায় বলল, কী চাই বাবু?

শ্রীনাথ হেসে বলল, দূর ব্যাটা। তোর এখানে লোকে আবার কী চাইবে? ফুর্তি করতে চাই।

লোকটা হাঁ করে আছে। হ্যারিকেনের আলোতেও তার চোখে আতঙ্ক দেখতে পায় শ্রীনাথ। বোধ হয় তার মতো বিশিষ্ট লোক এখানে আসায় ভড়কে গেছে।

শ্রীনাথ গলা মোলায়েম করে বলে, ভাল মালটাল রাখিস? না কি শুধু পচাই আর তাড়ি?

লোকটা জবাব দিচ্ছিল না। ঘরের ভিতরে বোধ হয় দু-চারজন গুন গুন করে কথা বলছিল, সেসব কথাবার্তা থেমে গেছে। লোকটার মুখের ভাব আর চারদিককার আবহাওয়ায় কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল শ্রীনাথের। সে রামলাখনকে নিশ্চিন্ত করার জন্য বলল, আরে ভয় নেই, পুলিশের লোক নই। আমাকে চিনিস না? আমি চাটুজ্জেবাড়ির বাবু।

এবার লোকটা চেরা গলায় এক কথায় বলল, চিনি।

তবে হাঁ করে আছিস কেন?

লোকটা একটু যেন বিরক্ত গলায় বলল, যা হবার তা তো হয়ে গেছে। আবার কী অন্যায়টা হল?

কথাটার কোনও মানেই বুঝল না শ্রীনাথ। বলল, দূর ব্যাটা, নিজেই এক পেট গিলে বসে আছিস নাকি? কী হয়েছে? কিসের কথা বলছিস?

লোকটা কথা কানে না তুলে বলল, সাচ বাত বলে দিই বাবু, নিতাই শালা বহুত হারামি। অনেকদিন আমার বেজিটা চুরি করার মতলবে ছিল। লাইনের এধারে শালাকে পেলে ছাড়ব না।

শ্রীনাথ বুঝল, নিতাই একটা কিছু করেছে। তা সে নিত্যই সবসময়েই করে। চুরি তার হাতের পাঁচ। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে শ্রীনাথ ভাবে, নিতাইকে তাড়িয়ে দেবে। আবার মনে হয়, সেই দাদার। আমল থেকে আছে, পাগলছাগল লোক। আছে থাক। কত সময়ে কাজেও লেগে যায়।

শ্রীনাথ জিজ্ঞেস করল, কেন? নিতাই কী করেছে?

আপনি জানেন না বাবু?

বললে তো জানব! আমি কি নিতাইয়ের খবর নিয়ে বেড়াই নাকি?

আপনার শালা সরিৎবাবু আমাকে বাজার থেকে মারতে মারতে সকলের সামনে দিয়ে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। বলল, বের কর তোর বেজি, নইলে জান নিয়ে নিব। বলুন, কাজটা জুলুম নয়? নিতাই বেজি চুরি করেছে সবাই জানে। আর চোরাই মাল ঘরে রাখার মতো বুরবক তত নিতাই নয়। ঝুটমুট আমার হয়রানি।

সরিৎ তোমাকে মেরেছে? কবে বলো তো?

আজ দুপুরবেলা।

শ্রীনাথ কী বলবে ভেবে পেল না। তবে রাগে তার গা জ্বলতে লাগল। সরিং যে ভদ্রলোকের মতো মানুষ হয়নি সেটা শ্ৰীনাথ জানে। কিন্তু এটা বড় বেশি বুক চিতিয়ে চলা। এটাকে বাড়তে দিলে অনেক দূর গড়াবে। একা তৃষাতেই রক্ষা নেই, তার ওপর আবার সরিৎ।

শ্রীনাথ একটা ধমক দিয়ে বলল, তা তোকে মারল আর তুইও মার খেলি! এত বড় গতরটা কি ভোর গতব নাকি? উলটে দু’ ঘা দিলি না কেন?

আই বাবা, বাবুলোকদের গায়ে হাত তুললে পুলিস জান কয়লা করে দেবে। আমরা তৃষা বউদির সঙ্গেও কাজিয়া করতে চাই না। কিন্তু নিতাই শালা কে বলুন! ওকে খাতির করব কেন?

কথা বারান্দায় দাঁড়িয়েই হচ্ছে। ভারী মশার উৎপাত। দাঁড়ানো অবস্থাতেই শ্রীনাথের ধুতি পরা পায়ের পিছনে গোটা পাঁচ-সাত কামড়াল। সে নিচু হয়ে পা চুলকোতে চুলকোতে বলল, ঠিক আছে, ব্যবস্থা হবে। এখন ঢুকতে দে বাবা। মালটাল বের কর কী আছে।

লোকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে, এই ঘরে সব বস্তির লোক বসে। ওইদিকের ঘরে চলুন, আলাদা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

দূর ব্যাটা!–শ্রীনাথ হাসে, আলাদা মাল খাওয়ায় সুখ কী রে! সকলের সঙ্গে বসে খেলে তবে না মৌজ। দরজা ছাড় তো বাবা বিভীষণ।

রামলাখন দরজা ছেড়ে ভিতরে ঢুকে যায়। পিছু পিছু শ্রীনাথ।

ঘরটা বেশ বড় মাপের। মেটে ভিটির ওপর দেয়াল ঘেঁষে কয়েকটা কাঠের বেঞ্চ, আর মাঝখানে চাটাই পাতা। খদ্দের বেশি এখনও জোটেনি। দু-চারজন রিকশাওয়ালা বা কুলিকাবারি গোছের লোক বসে আছে এদিক ওদিক। জানালা বেশি না থাকায় ঘরের মধ্যে যেমন গুমোট তেমনি গাগোলানো গন্ধ। অতি জঘন্য পরিবেশ। একটা কালো মোটাসোটা গেছে মেয়েছেলে সার্ভ করছে। তার হাতে মোটা রুপোর রুলি, পায়ে মল। মুখখানার কোনও শ্রী নেই। বরং ব্রণ বা ঘামাচি থাকায়। মুখের চামড়া অমসৃণ। তবে মেয়েটার একটা প্লাস পয়েন্ট যে, তার বয়স ত্রিশের নীচেই।

এই মেয়েটাই যদি এখানকার মক্ষীরাণী হয়ে থাকে তবে শ্রীনাথ এখানে মেয়েছেলের বাপারটা পেরে উঠবে না।

রামলাখন তাকে একটা কাঠের চেয়ারে বসতে দিয়েছিল। শ্রীনাথ সোজা চাটাইয়ে বসল। রামলাখন বোধ হয় গরম জলে ধুয়ে ভাল একটা গেলাসে তার স্টকের সবচেয়ে সেরা দিশি মদই এনে দিল। তবু খুবই ঘিন ঘিন করছিল শ্রীনাথের। কিন্তু সে জানে মুখে দেওয়ার আগটুকু পর্যন্তই যত ঘেন্না। তারপর আর ঘেন্নাপিত্তি থাকে না, সব অমৃত হয়ে যায়।

মাল খেতে খেতে শ্রীনাথ রামলাখনের সঙ্গে জমিয়ে নিল।

 

বহু বহুকাল বাদে তৃষা এই ঘরের কাছের কলকাতায় এল।

দুপুরবেলা হাওড়া স্টেশনে নেমেই বুঝেছিল সে অনেকটাই গেঁয়ো হয়ে গেছে। শহর দেখলে বুকে চমক লাগে। ভয় ভয় করে। দিশাহারা বোধ হয়।

সরিৎ বলল, ট্যাক্সি নেব তো?

ট্যাক্সি। ট্যাক্সি কেন?

তবে কিসে যাব? যা ভিড়।

আমার পয়সা সস্তা হয়নি। বাসে বা ট্রামে যাব।

এ কথার ওপর কথা নেই। তবে সরিৎ আশা করেছিল। বড়লোক দিদির সঙ্গে একটু আরামে ট্যাক্সিতে ঘুরবে। সেটা হল না।

তৃষার তেমন কেনাকাটার বাই নেই। তবে বড়বাজার থেকে কিছু জামাকাপড় না কিনলেই নয়। ত্রয়ীর জন্য পাইকারদের কাছেও যেতে হল। বড়বাজারের পাইকাররা মফস্সলের খুদে দোকানদারদের পাত্তাই দিতে চায় না। তৃষা এসেছে তাদের কারও কারও সঙ্গে পাকাপাকি ব্যবস্থা করতে। না হোক তৃষার হাতব্যাগে হাজার দশেক টাকা আছে আজ। বাসে যাওয়া কতটা নিরাপদ। তা বুঝতে পারছিল না সরিৎ। শত সতর্ক থাকলেও কলকাতার হস্তশিল্পীদের কাজ খুবই সূক্ষ। মেজদিও তো এখন আর কলকাতার হালচালে রপ্ত নয়। তাই সরিৎ প্রায় চোখের পাতা ফেলছিল না।

বড়বাজারের কাজ সারতে সারতেই বিকেল হয়ে গেল। অফিস টাইম।

সরিৎ বলল, ভবানীপুরে কি আজই যাবে?

যেতেই হবে। কেন?

বলছিলাম, অফিস ভাঙল তো, বাসে ওঠা যাবে না।

আমি যাবই!

সঙ্গে মালপত্র আছে যে!

পাইকারদের সঙ্গে বন্দোবস্তে যাওয়া গেছে বলে তৃষা একটু খুশি। মেয়েছেলে খদ্দের দেখেই হোক বা অন্য কারণেই হোক পাইকাররা তৃষার সঙ্গে অন্তত দুর্ব্যবহারটা করেনি। পাইকার বাছতে ঘোরাঘুরিও কিছু কম হয়নি। তাই সবদিক বিবেচনা করে তৃষা বলল, ট্যাক্সি ধরতে পারবি?

দেখি।

দেখ তা হলে।

সরিৎ অবশ্য সহজেই ট্যাক্সি পায়। তার কারণ সে সহজাতভাবেই উদ্যোগী লোক। ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে যদি অন্য কারও সঙ্গে বখেরা লাগে বা ট্যাক্সিওয়ালা বেগড়বাই করে, তবে সরিৎ টপ করে হাত চালাচালিতে নেমে যেতে পারে। তা ছাড়া নিপাট ভালমানুষের মতো ট্যাক্সিওয়ালা যেদিকে যেতে চায় সেদিককার নাম করেই উঠে বসে, তারপর নিজস্ব পথে ঘাড় ধরে নিয়ে যেতে পারে।

সুতরাং আধঘন্টার চেষ্টাতেই সরিৎ ট্যাক্সি পেয়ে গেল। ভবানীপুরে যখন পৌছোল তখনও বেলা আছে বেশ।

একটু বাধোবাধো লাগছিল তৃষার। বহুকাল প্রীতমবাবু বা বিলুর সঙ্গে দেখা হয়নি। এ বাড়িতে আসেওনি তিন-চার বছর। বিলুর মেয়ে হয়েছে খবর পেয়েছিল, সেই মেয়েটাকে দেখেনি পর্যন্ত।

দোতলায় উঠে কলিং বেল টিপতেই অল্পবয়সী একটি মেয়ে দরজা খুলে দিল। ঘরে ঢুকে স্বভাবসিদ্ধ তীক্ষ্ণ নজরে চারদিকটা দেখে নেয় তৃষা। প্রথমেই নজরে পড়ে, ঘরে অনেক দামি জিনিস, কোনও যত্ন নেই। বিলু কোনওকালেই সংসারী ছিল না। একটু উড়ু উড়ু উদাসীন মেয়ে। কুমারী অবস্থায় অনেক জল ঘোলা করেছে। তৃষা কানাঘুষো শোনে, এখনও নাকি একজন পুরুষবন্ধুর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখে।

তা সে রাখুক গে, কিন্তু সংসারটা গুছিয়ে তুলবে তো। বাইরের ঘরে সিলিং-এ ঘন কালো স্কুল জমেছে, চেয়ারে ধুলো, সোফার ঢাকনা নোংরা, টেবিলের ওপর ম্যাগাজিন অগোছালোভাবে উঁই করা, মেঝের জুট কার্পেটের ফেঁসে বেরিয়ে আছে, দরজার পরদায় হাজার রকমের হাতমোছার দাগ।

তৃষা প্রথমে মেয়েটিকেই জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

এ বাড়িতে বাচ্চা রাখি।

শুধু বাচ্চা রাখো?

হ্যাঁ।

তৃষার চেহারায় ব্যক্তিত্ব এবং কণ্ঠস্বরের বিরক্তিতে মেয়েটা একটু মিইয়ে গেছে। ঠিক বুঝতে পারছে না, ইনি কে বা কতখানি কর্তৃত্বের অধিকারী।

তৃষা নীরস গলায় বলল, ঘরদোরের দিকে একটু নজর দিতে পারো না? বিলু বাড়ি আছে?

না। অফিসে।

প্রীতমবাবু?

ভিতরের ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছেন।

তা হলে আমরা এ ঘরেই একটু বসি। তুমি ততক্ষণে একটু চা করে আনন! আর প্রীতমবাবুর ঘুম ভাঙলে বোলো, রতনপুরের বউদি এসেছে।

আচ্ছা।

বাচ্চাটা কোথায়?

বাচ্চাও ঘুমোচ্ছে।

তোমার নাম কী?

অচলা।

কতদিন কাজ করছ?

এই তো মাস তিনেক।

চা করতে পারবে তো?

এবার অচলা হেসে বলে, কেন পারব না?

না ভাবছিলাম তোমার চা করার কথা হয়তো নয়।

তাতে কী? একটু বসুন, করে আনছি।

বাড়িতে আর কাজের লোক নেই?

আছে।

বলে অচলা সরিৎকে অপাঙ্গে দেখে নিল। ঘরে ঢুকে অবধি ছেলেটা খুব মন দিয়ে তাকে দেখছে। ক্ষুধার্ত চোখ। যেন পেলেই ছিড়ে খায়। নজরটা অবশ্য অচলার খারাপ লাগে না। পুরুষের চোখে নিজের একটা যাচাই হয়। রতনপুরের বউদিকেও তার একনজরেই ভাল লেগে গেছে। আজকালকার ফালতু বউ নয়, ওজন আছে। ঘরের পাখা চালিয়ে দিয়ে অচলা স্মিতমুখে ভিতরে চলে গেল।

প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে তৃষার ব্লাউজ ভিজে গেছে। কিন্তু শরীরের কষ্টকে সে কোনওকালে কষ্ট বলে মানে না। মনের কষ্টও তার নেই, কারণ মন জিনিসটাকে সে মেরে ফেলতে শিখে গেছে।

তৃষা পাখার তলায় সোফায় বসল। সরিৎ একটু সমসূচক দূরত্ব রেখে বসল চেয়ারে। সরিৎ জেনে গেছে সে মেজদির যতটা ভাই তার চেয়ে অনেক বেশি কর্মচারী।

একটু বাদেই ট্রেতে চা সাজিয়ে নিয়ে এল অচলা। প্লেটে বিস্কুট আর চানাচুর। বলল, দাদাবাবু জেগেছেন।

আমার কথা বলেছ?

বলেছি। উনি আসছেন।

আসছেন!–বলে ভ্রু তোলে তৃষা, আসছেন মানে? শুনেছি, উনি নাকি বিছানা থেকে উঠতে পারেন না!

এখন তো ওঠেন দেখি।

তবু কী দরকার? চলো, আমরাই ভিতরে যাই।— বলে তৃষা উঠে পড়ে।

অচলা মৃদু হেসে বলে, চা খেয়ে নিন। আমি ততক্ষণে ভিতরের ঘরটা গুছিয়ে নিচ্ছি। নইলে তো আপনি আবার রাগ করবেন।

এ কথায় মেয়েটিকে ভাল লেগে গেল তৃষার। সে মুখ টিপে একটু হেসে বলল, হ্যাঁ। অগোছালো দেখলে আমার খুব রাগ হয়। ঘরদোরের সিজিল মিছিল থেকে সে ঘরের লোকেরা কেমন তা বোঝ যায়।

তা তো ঠিকই। তবে আমার কাজ শুধু বাচ্চা রাখা। ঘরের কাজের জন্য অন্য লোক আছে।

তা তো থাকবেই। তবে কাজের লোক রাখলেই তো হয় না। লোককে দিয়ে কাজ করিয়ে নিতেও জানা চাই। সেটা সবাই পারে না। তোমার দোষ দিচ্ছি না। তবে বাপু তোমাকেই বলি, এ বাড়িতে যখন কাজে ঢুকেছ তখন তুমিও এ বাড়ির লোক। আপন মনে করে একটু চারদিকে নজর রেখো। শুধু মাইনের কেনা লোক হয়ে থাকলে কোনওদিন কোথাও ভালবাসা পাবে না।

এসব কথা অন্যে বললে অচলা হয়তো চটে যেত। সে বহু বাড়িতে বাচ্চা রাখার কাজ করেছে, বহু গিন্নিকে চরিয়ে খেয়েছে। কিন্তু এই বউদির কথাগুলোর মধ্যে এমন একটা জোর আর ভালবাসা আছে যে অচলার রাগ তো হয়ই না, বরং ভক্তি এসে পড়ে। সে শুনেছে রতনপুরের বউদির অনেক সম্পত্তি, অনেক টাকা। কিন্তু দেখে তা মনে হয় না। সাদা খোলের সাধারণ শাড়ি পরা, মুখে রূপটান নেই। কালো হলেও চেহারাখানা কী! এত সুন্দর যেন অচলা জীবনে দেখেনি। কথা বলার ঢঙটাও এত ভাল যে, বকলেও শুনতে ইচ্ছে করে।

চা খেতে খেতে তৃষা অচলার মুগ্ধ ভাব লক্ষ করছিল। সারা জীবনে তৃষা এইসব মানুষের ভালবাসা অঢেল পেয়েছে। এখনও যেসব কাজের লোক তার বাড়িতে আছে তারা এক কথায় তার জন্য প্রাণ দিতে পারে। বৃন্দাকে ডবল মাইনে দিয়ে নিতে চেয়েছিল বাজারের পুরনো মহাজন পোদ্দাররা। বৃন্দা তো যায়ইনি, তার ওপর ক্যাট ক্যাট করে দু’ কথা শুনিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু এসব লোকের ভালবাসা পেলেও তার জীবনে কোথাও একটা ভালবাসার অভাবও কি নেই? তৃষা জানে, তার তিন মেয়ে আর ছেলে তাকে ততটা ভালবাসে না যতটা স্বাভাবিক নিয়মে ছেলেমেয়েদের মাকে ভালবাসা উচিত। এই অভাববোধটা এতকাল তাকে কষ্ট দেয়নি। আজকাল মাঝে মাঝে কথাটা মনে হয়। নিজের পরিবারের কারও ভালবাসাই বোধহয় তৃষা কোনওদিন পাবে না। তাকে একমাত্র সত্যিকারের ভালবেসেছিল একজন। সেই তার একমাত্র প্রেমিক, একমাত্র উপাস্য, যার কথা ভাবলে আজও মন স্নিগ্ধ হয়ে যায়। সে মল্লিনাথ।

বাইরের চেহারায় তৃষার কোনও ভাবপ্রবণতা নেই, আবেগ নেই, আদিখ্যেতা নেই। তার জীবনে। ভালবাসার চর্চাও তেমন কিছু নেই। কিন্তু ভিতরে ওই একটা জায়গায় সে আজও দুর্বল। রতনপুরের বাড়িতে প্রকাশ্য জায়গায় মল্লিনাথের কোনও ছবি নেই। বেশি ফটোগ্রাফ মল্লিনাথের ছিলও না। অনেক কুড়িয়ে বাড়িয়ে গোটা দশেক ছবি জোগাড় করতে পেরেছে তৃষা। আলাদা একটা অ্যালবামে সেঁটে সেগুলো নিজস্ব স্টিলের আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছে। এখনও মাঝে মাঝে গোপনে বের করে দেখে। যত দিন যাচ্ছে তত ধীরে ধীরে মল্লিনাথের ওপর শ্রদ্ধা বাড়ছে তার। মৃত ভাসুর মল্লিনাথকে ভালবাসা পাপ কি না কে জানে। তবে এই পাপটুকু তৃষা করে যাবে।

ভিতরের দরজার পরদা হঠাৎ সরে যেতেই তৃষা চায়ের কাপ রেখে উঠে গিয়ে প্রীতমের হাত ধরল, অনেকক্ষণ বাইরের মানুষের মতো বৈঠকখানায় বসে আছি। আর নয়, এবার অন্দরমহলটায় ঢুকতে দিন।

প্রীতম স্নিগ্ধ হাসিতে মুখ আলো করে বলল, আপনার কথা এত ভাবি কী বলব! আজকাল সকলের কথা ভাবি।

যাক, আর বানিয়ে বানিয়ে খোশামোদ করতে হবে না নন্দাইমশাই। চলুন কথা বলি।

প্রীতমকে তার বিছানায় বসিয়ে পাশে বসে তৃষা। বলে, কবে রতনপুর যাবেন বলুন তো? দিন ঠিক করুন, আমি নেওয়াবার ব্যবস্থা করব।

নিয়ে কী হবে? আমার যে চিকিৎসা চলছে। গিয়েও তো থাকতে পারব না, বিলু আবার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসবে।

আনবেই তো। অসুখ হয় কেন?

সে কি আমার দোষ?

সেসব জানি না। অসুখ শিগগির সারিয়ে ফেলুন।

সারাবার মালিকও কি আমি?

সব আপনি। মানুষ ইচ্ছে করলে সব পারে।

বউদির যে কেমন সব কথা!–বলে উজ্জ্বল মুখে একটু হাসে প্রীতম। এই একজন লোক, যে এ কথা বলল।

মেয়ে কোথায়?

পাশের ঘরে।

দাঁড়ান দেখে আসি।

বলে তৃষা উঠে গেল। ফিরে এসে বলল, অচলা ওকে ঘুম পাড়িয়েছে বুঝি। কপাল আমার, মটকা মেরে পড়ে চোখ পিট পিট করছে। আমাকে দেখেই চোখের পাতা টাইট করে বন্ধ করল।

প্রীতম হাসল। বলল, আপনি এলে কী যে ভাল লাগে! দাদাকে সঙ্গে আনলেন না?

বেশ বলেছেন ভাই। দাদাকে সঙ্গে আনব কী, বরং আপনার দাদার সঙ্গেই তো আমার আসার কথা।

ওই হল।

আমি তাঁর নাগালই পাই না। কলকাতায় চাকরি করতে আসেন কোন সকালে, ফেরেন রাত্রে।

একদিন আমাকে দেখতেও এলেন না।

মানুষটা একটু ওইরকম।

আপনি এতদিন বাদে দোষ কাটাতে এলেন?

তৃষা হেসে বলে, রতনপুরে চলুন, দেখবেন আমাকে সকাল থেকে সংসার কেমন নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়াচ্ছে। তখন উলটে বোধহয় আমার জন্য মায়া হবে।

প্রীতম খুশি হচ্ছিল। তৃষা বউদি একবারও তার শুকিয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে একটুও মন্তব্য করেননি। সে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আপনি ইচ্ছাশক্তিতে বিশ্বাস করেন বউদি?

ওমা! কেন করব না? আমি নিজেই তো ভাই ইচ্ছের শক্তিতে চলি। আমার তো আর কোনও ক্ষমতা নেই।

বিমর্ষ মুখে প্রীতম বলে, কিন্তু বিলু করে না। বিলুকে অরুণ বুঝিয়েছে, অসুখ-বিসুখের ক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তির কোনও দাম নেই।

অরুণ কে তা জিজ্ঞেস করল না তৃষা। অরুণের কথা সে জানে। শুধু বলল, শহুরে লোকরা যা-ই ভাবুক, আমরা গেঁয়ো লোক ওসব মানি। বিলু অফিস থেকে কখন ফিরবে বলুন তো!

আজ রাত হবে বলে গেছে। অফিসের এক কলিগের বিয়ে।

তা হলে আমি তো আজ আর বেশিক্ষণ বসতে পারব না। শ্বশুরমশাই আমাকে কিছুক্ষণ না দেখলেই অস্থির হয়ে পড়েন।

আর-একটু বসুন বউদি। আপনার সঙ্গে কথা বললেই ভাল লাগে।

বসল তৃষা। কয়েকবার চা খেল। খাবারও খেতে হল। লাবুর জন্য একটা সোনার হার এনেছিল। লাবু ওঠার পর সেটা তার গলায় পরিয়ে আদর করল একটু। সন্ধের বেশ কিছু পরে যখন উঠল, তখন প্রীতমকে খুবই উজ্জ্বল এবং আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। তৃষা বলল, তাড়াতাড়ি রোগটাকে মেরে তাড়িয়ে দিন।

আবার কবে আসছেন?

আসব। শিগগিরই আসব। গিন্নিটাকে তৈরি থাকতে বলবেন। এবার এসে একবেলা থেকে খেয়েদেয়ে যাব।

বিশ্বাস হয় না। তবে শুনতে ভাল লাগল।-বলে প্রীতম স্নিগ্ধ হাসে।

দেখবেন।-বলে তৃষা উঠে পড়ে।

রতনপুরে গাড়ি থেকে তৃষা আর সনিং যখন নামল তখন রাত সাড়ে ন’টা বেজে গেছে। রিকশা তৈরি ছিল। উঠে পড়ল দুজনে।

তেমাথা পেরিয়ে রিকশা যখন সাঁই সাঁই করে ছুটছে তখন বটতলায় একটা ভিড় দেখে তৃষা বলল, ওরে, রিকশা থামা! থামা!

বটতলার বাঁধানো চত্বর ঘিরে অন্তত জনা কুড়ি লোক বুঝকো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে। একটা লোক চত্বরের ওপর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে, ওই মাগিকে যতক্ষণ না দেশছাড়া করতে পারছ ভাইসব, ওর ভাইটাকে যতক্ষণ না চিতায় তুলছ ততক্ষণ তোমরা সব শুয়োরের বাচ্চা…

সরিৎ মৃদু স্বরে বলল, জামাইবাবু।

জানি। তুই নেমে যা।

কিছু করতে হবে?

না, শুধু কী বলছে শুনে আসবি। আমি চললাম।

রিকশা চলে গেল। সরিৎ চিতাবাঘের পায়ে গিয়ে বটতলার ভিড়ে মিশে গেল।

Category: মানবজমিন - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
পূর্ববর্তী:
« ২৮. আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছিল সজল
পরবর্তী:
৩০. বোসোহেবের মুখে খুব ছেলেমানুষি হাসি »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑