১৪. সাধারণ আলোচনা ও বাইবেল পুরাতন নিয়ম

সাধারণ আলোচনা : বাইবেল পুরাতন নিয়ম

কে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের লেখক? কোনো সন্দেহ নেই এর উত্তরে বলা হবে যে, বাইবেলের এই পুরাতন নিয়ম মানুষের রচনা, তাহলেও এ রচনার প্রেরণা এসেছে ‘হোলি-ঘোস্ট’ বা ‘পবিত্র-আত্মা’ থেকে, সুতরাং এ পুস্তকের রচয়িতা বিধাতাই।

বাইবেলের পরিচিতি লেখার সময় পাঠকবর্গের খেদমতে এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্য পেশ করেই লেখকেরা ক্ষান্ত থাকেন বলে পরবর্তীকালে আর কোনো প্রশ্ন উত্থাপনের অবকাশ থাকে না। কখনো কখনো পরিচিতি-পর্বে এই মর্মেও পাঠকদের সতর্ক করা হয়, কোনো ব্যক্তি সম্ভবত পরবর্তী পর্যায়ে আদি-পুস্তকের সঙ্গে বিশদ কোনো বিবরণী সংযুক্ত করেছেন; কিন্তু সেই সংযুক্তিতে সংশ্লিষ্ট বক্তব্যে সন্নিবেশিত সত্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই পর্যায়ে উল্লিখিত এই ‘সত্যে’র উপরেই বেশি গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বলা আবশ্যক, বাইবেলের এই পরিচিতি রচনার ব্যাপারে চার্চ-অথরিটি নিজেদের একমাত্র হকদার বলে মনে করেন। কেননা, সাধারণ্যে এ ধারণা দিয়ে আসা হয়েছে যে, চার্চ-অথরিটিই একমাত্র সংস্থা–যাঁরা পবিত্র আত্মার সহযোগিতায় এসব বিষয়ে বিশ্বাসীদের প্রয়োজনীয় আলোকদানের ক্ষমতা রাখেন। স্মর্তব্য যে, চার্চ-কাউন্সিল বা গির্জা পরিষদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল চতুর্থ শতাব্দীতে। সেই থেকে এই গির্জা সংস্থাই একের-পর-এক ‘পবিত্র বাইবেল’ প্রকাশ করে এসেছে। পরবর্তীকালে কাউন্সিল অব ফ্লোরেন্স (১৪৪১), ট্রেন্ট ১৫৪৬ এবং ফাস্ট ভ্যাটিক্যান কাউন্সিলও (১৮৭০) এইসব প্রকাশিত বাইবেল অনুমোদন দিয়ে গেছেন। এভাবেই অধুনা কানুন’ বা ‘প্রামাণ্য হিসেবে পরিচিত বাইবেল পাওয়া যাচ্ছে। অনুমোদিত এই বাইবেল প্রচুরভাবে সম্প্রচারিত হওয়ার পর অতিসম্প্রতি দ্বিতীয় ভাটিক্যান কাউন্সিল সম্পূর্ণ নতুনভাবে একখানি বাইবেল সংকলনও প্রকাশ করেছেন। এটি প্রকৃতপক্ষেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উল্লেখ্য যে, এই সংকলনটি প্রকাশ করতে দীর্ঘ তিনটি বছর ধরে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। বাইবেলের এই আধুনিক সংস্করণের গোড়াতে স্পষ্ট ভাষায় বলে দেয়া হয়েছে যে, বিগত শতাব্দীগুলোতে বাইবেলের নির্ভুলতা সম্পর্কে যে গ্যারান্টি দেয়া হয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণভাবে সন্তোষজনক। আধুনিক সংস্করণে সন্নিবেশিত এই বক্তব্যের পর বাইবেলের বাণীর নির্ভুলতা নিয়ে আর কোনো বিতর্ক উত্থাপনের অবকাশ যে থাকে না, তা বলাই বাহুল্য।

তবুও কথা থেকে যায়। কেননা, ইতিমধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক পুরোহিত পণ্ডিত বাইবেল সম্পর্কে বেশকিছু রচনা প্রকাশ করেছেন। এসব রচনা যদিও সর্বসাধারণের জন্য নয়, তবুও সে-সবের প্রতি যদি কেউ দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, দেখতে পাবেন, বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন পুস্তকের যে নির্ভুলতাকে এতকাল উপাসনালয়ের মতোই নির্মল ও পবিত্র বলে মনে করা হত, সেই নির্ভুলতার প্রশ্নে জড়িয়ে রয়েছে নানান ঘোর-প্যাঁচ।

উদাহরণস্বরূপ, জেরুজালেমের বাইবেল স্কুলের তত্ত্বাবধানে অনূদিত ফরাসী ভাষার বাইবেলের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। কয়েকটি খণ্ডে প্রকাশিত এই আধুনিক ফরাসী বাইবেল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বাইবেলের নির্ভুলতা সম্পর্কে এর বক্তব্য সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু তাই নয়, বাইবেলের নতুন নিয়মের মতো পুরাতন নিয়মেরও বেশিরভাগক্ষেত্রে যেসব বিতর্কমূলক বিষয় নানাসমস্যার সৃষ্টি করে রেখেছে, সে সম্পর্কে এই বাইবেলের অনুবাদকেরা কোনো রাখ-ঢাকের বালাই রাখেননি। অধ্যাপক এডমন্ড জ্যাকোব রচিত আর একটি গবেষণামূলক পুস্তকের নাম : দি ওল্ড টেস্টামেন্ট। সংক্ষিপ্ত হলেও এই পুস্তকটি অনেক বেশি নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচিত। এই পুস্তক পাঠে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের বহু ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে জানা যায়। বস্তুত, এই পুস্তকে বাইবেলের ক্রটি-বিচ্যুতির বিভিন্ন চিত্র চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে।

অনেকের অজানা, কিন্তু এডমন্ড জ্যাকোব দেখিয়েছেন যে, আদিতে বাইবেলের পুরাতন নিয়মের একটি নয়, বরং একাধিক পাঠ বা টেক্সট বা পাঠ অংশত হলেও গ্রীক অনুবাদের জন্য ব্যবহৃত হত এবং তৃতীয় পাঠটি পরিচিত ছিল সামারিটান পেন্টাটেক’ নামে। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে বাইবেলের (পুরাতন নিয়ম) একটিমাত্র পাঠ প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে, সেই একমাত্র পাঠ সুনির্দিষ্টভাবে প্রতিষ্ঠা পায় খ্রিস্টের জন্মের শতাব্দীকাল পরে।

যদি বাইবেলের পুরাতন নিয়মের উপযুক্ত তিনটি পাঠই এখন পাওয়া যেত, তাহলে তাদেরমধ্যে তুলনামূলক বিচার-পর্যালোচনা সম্ভব হত। শুধু তাই নয়, আদি বা মূল পাঠ কোনটি, সে সম্পর্কেও একটি অভিমতে পৌঁছানো যেত। দুর্ভাগ্যের বিষয়, এ ব্যাপারে এখন কারোপক্ষে সামান্যতম ধারণাও গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে না। এখন আদিযুগের প্রাচীনতম বাইবেল বলতে যা পাওয়া যাচ্ছে, তা সেই মরুসাগরের প্রাপ্ত জড়ানো কাগজের একখানি পুস্তক (ডেড সী স্ক্রল–কেভ অব কামরান)। এরও সময়কাল বর্তমান খ্রিস্টধর্মের আবির্ভাবের আগে হলেও যীশুখ্রিস্টের সমসাময়িক।

আর পাওয়া যাচ্ছে খ্রিস্ট-পরবর্তী দ্বিতীয় শতকে প্রাপ্ত টেন-কম্যান্ডমেন্টস সম্বলিত একখানি প্যাপিরাস পুস্তক। এতেও দেখা যায় যে, প্রচলিত বাইবেলের স্বীকৃত পাঠের সঙ্গে এর গরমিল প্রচুর। তাছাড়া, তৃতীয় আর যা পাচ্ছি, তাহলে খ্রিস্টপরবর্তী পাঁচ-শতকের বাইবেলের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন পুস্তক (জেনিজা অব কায়রো)। পক্ষান্তরে, বাইবেলের নতুন নিয়মের (ইঞ্জিল) প্রাচীনতম হিব্রু পাঠ হিসেবে যা পাওয়া যাচ্ছে, তার সময়কাল হলো খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দী।

‘সেপ্টোজিন্ট’ নামে পরিচিত বাইবেলটি (পুরাতন নিয়ম) খুব সম্ভব গ্রীক ভাষায় অনূদিত প্রথম বাইবেল। এর সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী। এটি আলেকজান্দ্রিয়ার ইহুদীদের দ্বারা রচিত হয়েছে। এর পাঠের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হয়েছে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্ট বা নতুন নিয়ম। সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই বাইবেল প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ হিসেবে চালু ছিল। সাধারণ্যে ব্যবহারের জন্য খ্রিস্টান জগতে বাইবেলের যে গ্রীক পাঠটি চালু আছে, তার মূল খসড়াটি Codex Vaticanus নামে তালিকাভুক্ত হয়ে ভাটিক্যান নগরীতে সংরক্ষিত রয়েছে। এরই আরেকটি খসড়া লন্ডনের ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত হচ্ছে Codex Sinaiticus নামে। এই উভয় পাণ্ডুলিপি প্রণয়নের সময়কাল হচ্ছে খ্রিস্টপরবর্তী চতুর্থ শতাব্দী।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর শুরুতে সেন্ট জেরোমে হিব্রু দলিল-প্রমাণ সহযোগে ল্যাটিন ভাষায় আর একটি বাইবেল প্রকাশ করতে সমর্থ হন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর পর এই বাইবেলের ব্যাপক প্রচার ঘটে। এটি সাধারণ্যে ‘বালগেট’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

এ প্রসঙ্গে বাইবেলের আরামীয় এবং সিরিয়াক (পেশিত্তা) অনুবাদের কথাও উল্লেখ করতে হয়। কিন্তু এই উভয় অনুবাদই অসম্পূর্ণ।

বাইবেলের এতোগুলো পাঠ চাল থাকার ফলেই পরবর্তীকালে সবকয়টিকে একসঙ্গে যোগাড় করে নিয়ে তথাকথিত মাঝামাঝি ধরনের একটি টেকসট বা পাঠ দাঁড় করা বিশেষজ্ঞদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। বলা অনাবশ্যক যে, এই পদক্ষেপ ছিল বিভিন্ন পাঠের মধ্যে একটি সামঞ্জস্য বিধানের প্রয়াস মাত্র। এদিকে, একইসঙ্গে একাধিক ভাষায়ও বেশকিছু বাইবেল সংকলিত ও প্রকাশিত হয়। এতে একই বাইবেলের মধ্যে পাশাপাশি স্থান পেয়েছিল হিব্রু, গ্রীক, ল্যাটিন, সিরিয়াক, আরামীয় এবং এমনকি আরবি ভাষার পাঠ। বিখ্যাত ওয়াল্টন বাইবেল (লন্ডন, ১৬৫৭) এমনিধারার একখানি গ্রন্থ।

বক্তব্য সম্পূর্ণ করার প্রয়োজনে আরেকটি কথা বলে নিতে হয়। বাইবেলের এতোসব ভিন্ন ভিন্ন পাঠের কারণ আর কিছুই নয় : খ্রিস্টানদের গির্জার যেমন বিভিন্নতা রয়েছে, তেমনি গির্জাভিত্তিক বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা বাইবেল। কেননা, বাইবেল সম্পর্কে একেক গির্জার ধারণা একেকরকম। আর পারম্পরিক এই ভিন্ন ধারণার কারণেই অন্যভাষায় বাইবেল তরজমা করতে গিয়েও তাদের পক্ষে একমতে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতি এখনও অব্যাহত রয়েছে।

উল্লেখ্য যে, The Ecumencial Translation Of The old Testament নামে একটি সংকলন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এই সংকলনটি বেশ কিছুসংখ্যক ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট বিশেষজ্ঞের সম্মিলিত অনুবাদ। এতে বাইবেলের সবধরনের সবভাষ্যের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধনের প্রয়াস পরিলক্ষিত হয়।

পূর্বোক্ত বিবরণী থেকে এটা স্পষ্ট হয় বাইবেলের পুরাতন নিয়ম রচনার ক্ষেত্রে মানুষের হাত কমবেশি সক্রিয় ছিল আগাগোড়া। এ থেকে এ কথা বুঝতেও বেগ পেতে হয় না যে, এক পাঠের সঙ্গে আরেক পাঠের, এক অনুবাদের সঙ্গে আরেক অনুবাদের এই যে পার্থক্য, তা সংশ্লিষ্ট বাইবেলগুলোর সংশোধনজনিত কর্মকাণ্ডের অনিবার্য পরিণতি। এভাবে বিগত দু’হাজার বছর ধরে ক্রমাগতভাবে সংশোধনী চালিয়ে যাওয়ার ফলেই বাইবেলের মূলবাণীর পাঠ সাত নকলে আসল খাস্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *