১১. ফেরাউনের মৃত্যু : ধৰ্মীয়-গ্রন্থের আলোকে

ফেরাউনের মৃত্যু : ধৰ্মীয়-গ্রন্থের আলোকে

ফেরাউনের মৃত্যু বাইবেল ও কোরআনের বর্ণনায় একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। উভয় ধর্মগ্রন্থের বাণীতে এই মৃত্যুর ঘটনাটি সুস্পষ্ট ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। বাইবেলের পোটেক বা তাওরাত অধ্যায়ে শুধু নয়, গীত-সংহিতা অধ্যায়েও এ ঘটনার উল্লেখ রয়েছে : ইতিপূর্বে সেসব বর্ণনা উদ্ধৃত করাও হয়েছে।

বিস্ময়ের ব্যাপার, খ্রিস্টান লেখকবৃন্দ এই বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গেছেন। যেমন, ফাদার ডি ভক্স শুধু এই অভিমত প্রকাশ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন যে, ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনাটি ঘটেছিল দ্বিতীয় রামেসিসের রাজত্বের প্রথমার্ধে অথবা মাঝামাঝি সময়। কিন্তু ইহুদীদের মিসরত্যাগের সময় ফেরাউন যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলেন, ঘুণাক্ষরেও তিনি সে কথার উল্লেখ কোথাও করেননি। ফেরাউনের মৃত্যু যে তাঁর রাজত্বের অবসানেরও সূচক, তা মেনে নিলে এ বিষয়ে জল্পনা-কল্পনার তেমন কোনো অবকাশ আর থাকে না। অথচ জেরুজালেম বাইবেল শিক্ষায়তনের এই বিজ্ঞ বিভাগীয় প্রধান একবারও ভেবে দেখার গরজ অনুভব করেননি যে, তার থিওরি খোদ বাইবেলের তাওরাত ও গীত-সংহিতা অধ্যায়ের বর্ণনার বিরোধী হয়ে পড়েছে।

পি. মতেঁও তাঁর ‘ইজিপ্ট অ্যান্ড দি বাইবেল’ পুস্তকে মারনেপতাহহর রাজত্বকালে ইহুদীদের মিসর ত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল, শুধু একথার উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবনকারী সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে ওই ফেরাউনও যে তখন ডুবে মরেছিলেন, সে সম্পর্কে তিনি একটা কথাও বলেননি।

ইহুদীদের মনোভাব কিন্তু খ্রিস্টানদের এই বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলাদা। গীত-সংহিতার ১৩৬নং গীতের ১৫নং বাণীতে ফেরাউন ও তাঁর লোকলশকরদের নলখাগড়ার সাগরে ডুবিয়ে মারার জন্য বিধাতার প্রশংসা-গীত রয়েছে। ইহুদীরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে সেই গীতটি মাঝেমধ্যে আবৃত্তি করে থাকে। ইহুদীরা জানে, এই গীতটির সাথে যাত্রাপুস্তকের বাণীর মিল রয়েছে, (১৪, ২৮-২৯)। সেখানে বলা হয়েছে :

“জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল, তাহাতে ফেরাউনের যে সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিল তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না।”

সুতরাং, সেদিন ফেরাউনও যে ডুবে মারা গিয়েছিলেন, সে বিষয়ে ইহুদীরা বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করে না। খ্রিস্টানদের বাইবেলের যাত্রাপুস্তকেও কিন্তু এই বাণীটি বিদ্যমান।

এতসব প্রমাণ-দলিলের বিরোধিতা করে, খ্রিস্টান লেখকেরা ইচ্ছাকৃতভাবেই যেন ফেরাউনের মৃত্যুর ঘটনাটাকে এড়িয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ভাষ্যকার তাঁদের রচনায় কোরআনে বর্ণিত ফেরাউনের মৃত্যু-কাহিনীকে তুলনামূলকভঙ্গিতে এমন এক কারসাজির মাধ্যমে প্রকাশ করে গেছেন যে, তার ফলে সাধারণ পাঠকের মনে কোরআন সম্পর্কে আজগুবি ধারণা গড়ে না ওঠে পারে না। জেরুজালেম বাইবেল স্কুলের তত্ত্বাবধানে অনূদিত বাইবেলের (প্যারিস, ১৯৬৮, পৃষ্ঠা ৭৩) যাত্রাপুস্তক অধ্যায়ে ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কে বলতে গিয়ে ফুটনোটে ফাদার কুরিয়ার মন্তব্য করেছেন।

“কোরআন (ফেরাউনের মৃত্যুর কথা) উল্লেখ করেছে (সূরা ১০, আয়াত ৯০-৯২) এবং বহুলপ্রচলিত কাহিনী এই যে, ফেরাউন তাঁর লোকলশকরসহ সমুদ্রে ডুবে যান। (এ ঘটনার উল্লেখ কিন্তু বাইবেলে নেই) এবং সেখানে সমুদ্রের তলদেশে জীবিত থেকে সমুদ্রের মানুষ অর্থাৎ সীল মাছদের উপরে রাজত্ব করতে থাকেন।”

কোরআন সম্পর্কে যারা কম জানেন, সে ধরনের কোনো পাঠকের পক্ষে এই বক্তব্য থেকে কোরআনের বাণী আর জনপ্রিয় লোককাহিনীর মধ্যে একটা যোগসূত্র না টেনে উপায় থাকে না। কেননা, ভাষ্যকার এখানে বাইবেলের বাণীর বিরোধিতায় তথাকথিত জনপ্রিয় লোককাহিনীটি কোরআনের বাণীর উল্লেখের পর পরেই এমনভাবে গেঁথে দিয়েছেন যে, কোরআনের বাণী আর লোককাহিনীর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন সে ধরনের পাঠকের পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক।

অথচ, ভাষ্যকার এখানে কায়দা-কসরতের মাধ্যমে পাঠকদের মনে যে ধারণা ঢুকিয়ে দেয়ার কারসাজি করেছেন, কোরআনের বক্তব্য সে ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোরআনের ১০ নং সূরার ৯০-৯২ নং আয়াতে বলা হয়েছে : ফেরাউন ও তার লোকলশকর বনী ইসরাইলকে ধাওয়া করেছিল; বনী ইসরাইল সমুদ্র পার হয়ে গেল আর ফেরাউন সুমদ্রে ডুবে যাওয়ার কালে চিৎকার করে বলে উঠেছিলঃ “আমি ঈমান আনিলাম কোনো মাবুদ নাই সেই আল্লাহ ছাড়া যে আল্লাহর উপরে বনী ইসরাইল বিশ্বাসী।” আল্লাহ জওয়াব দিলেন : “কি? এখন! তুমি বিদ্রোহ ঘোষণা করিয়াছিলে, নীতিভ্রষ্টতার কারণ হইয়াছিলে। এখন আমরা শুধু তোমার মৃতদেহকেই রক্ষা করিব; যাহাতে তুমি হইতে পার। নিদর্শন–যাহারা তোমার পরে আসিবে, তাহাদের জন্য।”

ফেরাউনের মৃত্যু সম্পর্কে উক্ত সূরায় যা কিছু বলা হয়েছে এটাই তার সবটা। বাইবেলের ভাষ্যকার যে আজগুবি কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছেন, সে ধরনের কোনো বর্ণনা এখানে কিংবা কোরআনের অন্যত্র থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কোরআনের বর্ণনায় সুষ্ঠুভাবে বলা হয়েছে, ফেরাউনের মরদেহ বা লাশকে রক্ষা করা হবে। বলা অনাবশ্যক যে, এই তথ্যটিই এক্ষেত্রে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

মোহাম্মদ (দঃ) কোরআনের বাণী জনসমক্ষে প্রচার করে গেছেন চৌদ্দশ’ বছর আগে। এখন আমরা যেসব ফেরাউনকে ইহুদীদের মিসরত্যাগের সাথে জড়িত বলে মনে করছি (ভুল-শুদ্ধ যাই হোক), তখন তাদের মৃত্যুদেহগুলো ছিল থেবেসের নেক্রোপলিস কবরখানায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। স্থানটি মিসরের লাকসর এলাকা থেকে নীলনদের সরাসরি ওপারে। তখন ওইসব মৃতদেহ সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কেউ কিছু জানত না। ওইসব মৃতদেহ তথা ‘মমি’ আবিস্কৃত হয়, উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে এসে। কোরআনে যেভাবে বর্ণিত আছে, বস্তুত ঠিক সেভাবেই ফেরাউনের মৃতদেহটি উদ্ধার পেয়েছিল : থেবেসের কবরখানায় সংরক্ষিত মৃতদেহের কোনো-না-কোনো একটি সেই আসল ফেরাউনের–যে ফেরাউন মারা পড়েছিলেন নীলনদে ডুবে গিয়ে।

অধুনা, যে-কেউ কায়রো গিয়ে সেখানকার মিসরীয় যাদুঘরে রাজকীয় মমির কামরায় সংরক্ষিত ফেরাউনের সেই মৃতদেহ বা মমিটি স্বচক্ষে দর্শন করে আসতে পারেন। সুতরাং, ফাদার কুরিয়ার কোরআনের বাণীর সাথে কারসাজিমূলকভাবে আজগুবি যে উপকথা দিয়েছেন, আসল সত্য তা থেকে সম্পূর্ণ দূরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *