০৭. ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা : আধুনিক তথ্যজ্ঞান

ধর্মগ্রন্থের বর্ণনা : আধুনিক তথ্যজ্ঞান

বাইবেল এবং কোরআনে ইহুদীরা মিসরে যেভাবে দিন গুজরান করত এবং যে পথে তারা মিসর ত্যাগ করেছিল সে বিষয়ে যে তথ্যাবলী পাওয়া যাচ্ছে, তার সাথে আধুনিক যুগে প্রাপ্ত তথ্যজ্ঞানের তুলনামূলক বিচার-বিশ্লেষণ হতে পারে। তবে, একদিকের এই বিচার-বিশ্লেষণ বড় বেশি সমস্যার কারণ হিসেবে দেখা দেয়; আবার কোনো কোনো তথ্য এত গুরুত্বহীন যে, সে সম্পর্কে কোনো আলোচনা নিপ্রয়োজন।

বিষয়ের বিশ্লেষণ

মিসরে ইহুদীরা ও প্রকৃতপক্ষে, ভুলের তেমন কোনো ঝুঁকি না নিয়েই বলা যেতে পারে যে, ইহুদীরা মিসরে বসবাস করেছিল মোটামুটিভাবে ৪০০ অথবা ৪৩০ বছর। এটাই বাইবেলের বর্ণনা (আদিপুস্তক ১৫, ১৩ এবং যাত্রাপুস্তক ১২. ৪০)। এ বিষয়ে আদিপুস্তক ও যাত্রাপুস্তকে সময়ের যে পার্থক্য তা তেমন ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। ইহুদীদের মিসরে বসবাসের সূচনা ঘটে হযরত ইবরাহীমের অনেক পরে, যখন হযরত ইয়াকুবের পুত্র হযরত ইউসুফ ভাইদের সাথে নিয়ে মিসর গিয়েছিলেন সেই সময় থেকে। কোরআনে ইহুদীদের মিসরে যাওয়ার কথাই শুধু উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানে তারা কত বছর বসবাস করেছিল, সে বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। বাইবেলে প্রদত্ত সময়ের উদ্ধৃত করা হয়েছে। তদুপরি, তেমন কোনো আর তথ্য-পরিসংখ্যান নেই যার মাধ্যমে এ বিষয়ে আরো কিছু আলোকপাত করা যেতে পারে।

গবেষকগণ মনে করেন, হযরত ইউসুফ ও তার ভাইদের মিসর যাওয়া এবং হাইকসস্ রাজবংশের মিসর অধিকারের ঘটনা খুব সম্ভব একই সময়ের। কেননা, খ্রিস্টপূর্ব সপ্তদশ শতকে একজন হাইকসস্ নরপতি সম্ভবত হযরত ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের নীল-বদ্বীপের আভারিস নামক স্থানে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

সন্দেহ নেই যে, উপযুক্ত ভাষ্যকারদের এই ধারণা বাইবেলের বর্ণনার বিপরীত। কেননা, বাইবেলে বলা হয়েছে (রাজাবলি : ১, ৬, ১) ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল হায়কলে সোলায়মান (খ্রিস্টপূর্ব ৯৭১ সালের দিকে) নির্মাণের ৪৮০ বছর আগে। এ হিসেব থেকে পাওয়া যায়, ইহুদীদের মিসরত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল মোটামুটিভাবে খ্রিস্টপূর্ব ১৪৫০ অব্দে। হিসেব অনুসারে ইহুদীদের মিসরে বসবাস শুরুর সময়টা দাঁড়ায় খ্রিস্টপূর্ব ১৮৮০ থেকে ১৮৫০ অব্দের দিকে। পক্ষান্তরে, ধারণা করে আসা হচ্ছে যে, তখন হযরত ইবরাহীম জীবিত ছিলেন।

বাইবেলের অন্য বর্ণনা থেকে অবশ্য জানা যাচ্ছে যে, হযরত ইউসুফ থেকে হযরত ইবরাহীমের সময়ের ব্যবধান ছিল ২৫০ বছর। এই পরবর্তী হিসেব যদি সত্য হয়, তাহলে সময়ানুক্রমের বিচারে বাইবেলেরই রাজাবলি-১ অধ্যায়ে বর্ণিত হিসেব অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে।

দেখা যায়, রাজাবলি–১-এর তথ্য কিভাবে বাইবেলের অন্যস্থানে বর্ণিত তথ্যকে নাকচ করে দিচ্ছে। সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, এই আলোচনার উদ্দেশ্য বাস্তবে বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যকিছু নয়, বরং বাইবেলে বর্ণিত এমনিধারার এলোমেলো ও অসঠিক সময়-গণনার হিসেব।

ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত বিবরণ ছাড়া ইহুদীদের মিসরে অবস্থানের আর তেমন কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। অবশ্য, সাংকেতিক চিত্রলিখন পদ্ধতিতে (হাইয়ারোগ্লিফিক) রচিত এমনকিছু দলিলপত্র পাওয়া যাচ্ছে যাতে দেখা যায়, এককালে মিসরে এমন একধরনের শ্রমিক ছিল যাদের বলা হত আপিরু, হাপিরু অথবা হাবিরু। এই শ্রমিক শ্রেণীকেই (ভুল অথবা শুদ্ধ যেভাবেই হোক) হিব্রু বা ইহুদী হিসেবে সনাক্ত করা হয়। সাধারণত, এই শ্রেণীর শ্রমিক রাজমিস্ত্রি, কৃষক-মজুর অথবা ফসল কাটার কামলা হিসেবে কাজ করত। কিন্তু, এরা এলো কোত্থেকে? এর জবাব পাওয়া খুবই মুশকিল। এ বিষয়ে ফাদার ডি ভক্স-এর বক্তব্য হচ্ছে : এরা স্থানীয় লোক ছিল না; এরা স্থানীয় সমাজের সাথে একীভূতও হয়নি। তাছাড়া, এরা সকলেই এক পেশার বা সমমর্যাদার লোকও ছিল না।

তৃতীয় টুথমোসিসের আমলের প্যাপিরাসে লিপিবদ্ধ এক রচনা অনুসারে, এরা ছিল ‘আস্তাবলের শ্রমিক’। এও জানা যাচ্ছে যে, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চদশ শতকে, মিসরের অধিপতি দ্বিতীয় এ্যামেনোফিস–কেনান থেকে এদের প্রায় ৩৬০০ জনকে বন্দী করে এনেছিলেন। ফাদার ডি বক্স-এর মতে, এদের বেশিরভাগই ছিল সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের অধিবাসী। খ্রিস্টপূর্ব ১৩০০ অব্দের দিকে অধিপতি প্রথম সেথোসের আমলে এই ‘আপিরু’ লোকেরা দারুণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। কেনানের বেথ-শিন এলাকায়। দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে এদের অনেককে ফেরাউনের কাজে যেমন, গ্রেট পাইলন অব রামেসিস মিয়ামনের পাথর খোদাই কিংবা পাথর টানা শ্রমে নিয়োগ করা হয়। বাইবেল থেকে আরো জানা যায়, দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী রামেসিস নগরী নির্মাণের কাজে কিভাবে ইহুদীদের লাগানো হয়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর মিসরীয় রচনাবলীতে পুনরায় ‘আপিরুদের’ উল্লেখ দেখা যায় এবং এদের সর্বশেষ উল্লেখ রয়েছে, তৃতীয় রামেসিসের কাহিনীতে।

যাহোক, ‘আপিরু’ শব্দটা যে কেবল মিসরেই ব্যবহৃত হত, তা নয়। সুতরাং, এই শব্দটার দ্বারা শুধু যে হিব্রু তথা ইহুদীদেরই বোঝাবে, সেটাই বা নিশ্চিত করে বলা চলে কিভাবে? বলে রাখা ভালো যে, এই আপিরু শব্দটা প্রথম দিকে “জবরদস্তিমূলকভাবে কাজে ব্যবহৃত সবধরনের শ্রমিক মজুরের বেলায় ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে, সে শ্রমিকেরা যেখান থেকেই আসুক-না কেন। এভাবে, পরবর্তীকালে এ শব্দটা এই ধরনের যে-কোনো শ্রমিকের বিশেষণ হিসেবেও প্রচলিত হয়ে থাকতে পারে। এখানে উদাহরণ হিসেবে সুইশে (সুইস) শব্দটার সাদৃশ্য টানতে পারি। ফরাসী ভাষায়, এই শব্দটার বেশ কয়েকটা অর্থ রয়েছে। এর দ্বারা যেমন সুইজারল্যান্ডের অধিবাসী বোঝায়, তেমনি এর দ্বারা বোঝানো হয় অতীতের ফরাসী রাজাদের সেইসব ভাড়াটে সৈনিককেও, যারা সুইস বংশোদ্ভুত। ভ্যাটিক্যানের পাহারাদার কিংবা খ্রিস্টীয় গির্জার কোনো কোনো চাকুরেকেও সুইসে’ বলা হয়ে থাকে।

যাহোক, হতে পারে যে, দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে এই যে হিব্রু (ইহুদী, বাইবেলের বর্ণনা অনুসারে) অথবা এই যে আপিরু (সাংকেতিক ভাষার রচনামতে), এদের ফেরাউনের নির্দেশ মোতাবেক বড় বড় কাজে লাগানো হয়ে থাকবে। তবে, সেই সাথে এটা বুঝতেও বেগ পেতে হয় না যে, এসব শ্রমিক বলতে গেলে সবাই ছিল ‘জবরদস্তির শিকার’। দ্বিতীয় রামেসিস ইহুদী-নিপীড়ক ছিলেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বাইবেলের যাত্রাপুস্তকে উল্লিখিত ‘রামেষিষ’ ও ‘পিথমনগরী’ নীল-বদ্বীপের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ছিল। অধুনা, তানিস ও কানতির বলে পরস্পর মাইল পনেরো ব্যবধানে যে দুটি নগরী মিসরে বিদ্যমান, উল্লিখিত দুটি প্রাচীন নগরী এই দুই স্থানেই অবস্থিত ছিল। আর এই স্থানেই দ্বিতীয় রামেসিস কর্তৃক স্থাপিত হয়েছিল উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী। সুতরাং, দ্বিতীয় রামেসিসই ছিলেন ইহুদী-নিপীড়ক সেই ফেরাউন।

আর এই পরিবেশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন হযরত মুসা। কিভাবে শিশুকালে তিনি নদীগর্ভ থেকে উদ্ধার পান, সে বর্ণনা অনেকেরই জানা রয়েছে। হযরত মুসার মিসরীয় একটা নামও ছিল। পি. মতেঁ তাঁর ‘ইজিপ্ট অ্যান্ড দি বাইবেল” পুস্তকে পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছেন, একাধিক ‘মেসও’ অথবা ‘মেসি’ নাম মিঃ র‍্যাক কর্তৃক সঙ্কলিত সাংকেতিক ভাষার নাম-অভিধানের তালিকায় রয়েছে। কোরআনে ব্যবহৃত মুসা’ নামটি এই প্রাচীন মিসরীয় নামেরই অক্ষরান্তর মাত্র।

মিসরে প্লেগ :

এই শিরোনামে বাইবেলে মিসরবাসীদের উপরে আল্লাহর দশটি গজব নাজিল হওয়ার কথা বিশদভাবে বর্ণিত রয়েছে। এ গজবের অনেকগুলো অলৌকিক ধরনের বা চরিত্রের। কোরআনে গজবের সংখ্যা উল্লিখিত হয়েছে মাত্র পাঁচটি এবং সেই পাঁচটি গজবের প্রত্যেকটিতে প্রাকৃতিক ঘটনাই যে বাড়তি বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিয়েছিল কোরআনের বর্ণনায় সেটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে। এই পাঁচটি গজব হচ্ছে : বানভাসি, পঙ্গপাল, উকুন, ব্যাঙ ও রক্ত।

পঙ্গপাল ও ব্যাঙ-এর দ্রুত সংখ্যাবৃদ্ধির কথা বাইবেলেও বর্ণিত রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে যে, মিসরের সব নদীর পানি রক্তে পরিণত হয়েছিল এবং সেই রক্ত প্লাবন আকারে সারা দেশ ভাসিয়ে দিয়েছিল (!) কোরআনে শুধু রক্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু সে সম্পর্কে আর কোনো বর্ণনা অনুপস্থিত। সুতরাং, রক্ত বলতে এখানে কি বোঝানো হয়েছে, সে সম্পর্কে যে কেউ যে-কোনো ধারণা করে নিতে পারেন।

বাইবেলে বাড়তি যেসব গজবের কথা বলা হয়েছে (যেমন—ডাঁশ, পতঙ্গ, মাছি, ফোঁড়া, শিলাবৃষ্টি, অন্ধকার, প্রথম সন্তানের মৃত্যু ও গবাদিপশুর মৃত্যু) সেসবের উৎস কিন্তু উপরোল্লিখিত রক্ত-বন্যার মতই বিস্ময়কর। মূলত, যে বিভিন্ন উৎস থেকে রচনা নিয়ে বাইবেল সংকলিত হয়েছিল এ ধরনের বিবরণ এসেছে সেইসব বিভিন্নমুখী রচনা থেকেই।

যে পথে মিসরত্যাগ

ইহুদীরা কোন পথে মিসর ত্যাগ করেছিল, কোরআনে তার কোনো উল্লেখ নেই। পক্ষান্তরে, বাইবেলে এ সম্পর্কে বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে। হালে, ফাদার ডি ভক্স এবং পি. মতেঁ নতুন করে এই বিষয়টার উপরে গবেষণা চালিয়েছেন। ইহুদীরা খুব সম্ভব মিসরের তানিস-কানতির এলাকা থেকে যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু বাইবেলে যা বলা হয়েছে–তার সমর্থনে কোনোরূপ চিহ্ন বা নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া, সমুদ্রের পানি ঠিক কোন স্থানটিতে দু’ভাগ হয়ে হযরত মুসা ও তাঁর সঙ্গীদের পথ করে দিয়েছিল, তাও নির্দিষ্ট করে বলা অসম্ভব।

সমুদ্রের পানির অলৌকিক বিভক্তি:

কোনো কোনো আধুনিক ভাষ্যকার ইহুদীদের মিসরত্যাগের প্রাক্কালে সমুদ্রের পানি অলৌকিকভাবে দু’ভাগ হওয়ার ঘটনাকে ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করে থাকেন। কারো ধারণা, ঘটনাটা জোয়ার-ভাটার সাথে জড়িত : ইহুদীরা ভাটার সময় সমুদ্র পার হয়েছিল। কেউ মনে করেন, সমুদ্রের পানি নক্ষত্রালোকের কোনো আকর্ষণ বিকর্ষণে দু’ভাগ হয়ে পড়েছিল। আবার কেউ কেউ মনে করেন, দূরবর্তী কোনো এলাকায় কোনো এক আগ্নেয়গিরির প্রচণ্ড বিস্ফোরণেও সমুদ্রের পানি দুই ভাগ হতে পারে; কারণ যাই হোক, সমুদ্রের পানি যখন হ্রাস পেয়েছিল, ইহুদীরা সেই সুযোগে সমুদ্র পার হয়; আর তাদের যারা পশ্চাদ্ধাবন করেছিল, সেই মিসরীয়রা উত্তেজনার মুহূর্তে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই সেই পথে অগ্রসর হয়েছিল আর ভেসে গিয়েছিল সমুদ্রের ফিরতি স্রোতের তোড়ে। বলা নিষ্প্রয়োজন যে, উল্লিখিত সব ক’টা কারণই অনুমানভিত্তিক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *