০২. জলপাইগুড়ি শহরে সন্ধে নামতেই

জলপাইগুড়ি শহরে সন্ধে নামতেই সেটা রাত হয়ে যায়। নটা বেজে গেলে রাস্তাগুলো খাঁ-খাঁ হয়ে যায়। নির্জন রাস্তায় দ্রুত বাইক চালাতে-চালাতে অর্জুনের একবার মনে হল এটা অসময়, মহাদেববাবু ঘুমিয়ে পড়তে পারেন। এখন যাওয়া মানে বিরক্ত করা। কিন্তু, একটু মরিয়া হল সে।

বাবুপাড়ায় করলা নদীর ধারে একটা গেটওয়ালা বাড়ির সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে সে ভেতরে ঢুকল। বাইরেটা অন্ধকার কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে। বেল টিপতেই মহিলা কণ্ঠে প্রশ্ন এল, কে?

আমি অর্জুন।

মিনিটখানেকের মধ্যেই ওপরের বারান্দায় আলো জ্বলল। অর্জুন দেখল যোলো-সতেরো বছরের একটি স্কার্ট-পরা মেয়ে ওপর থেকে ঝুঁকে দেখার চেষ্টা করছে। সে জিজ্ঞেস করল, মহাদেববাবু কি জেগে আছেন? একটু দরকারে এসেছিলাম।

আপনি! মেয়েটি ওপর থেকে নেমে আসা আলোয় অর্জুনকে চিনতে পেরে হঠাৎই উচ্ছ্বসিত হল, ও আপনি! না না, দাদু ঘুমোয়নি এখনও। দাঁড়ান, একটু দাঁড়ান। মেয়েটি অন্তর্হিত হল। অর্জুন বেশ অবাক। মেয়েটিকে সে আগে কোনওদিন দ্যাখেনি। অমলদার কাজে মহাদেববাবুর কাছে তাকে কয়েকবার আসতে হয়েছে এখানে।

মেয়েটি দরজা খুলল, আমি তিস্তা। আপনার কথা খুব জানি।

ও।

আসুন।

তিস্তার পেছনে সে দোতলায় উঠে এসে যে-ঘরটিতে ঢুকল সেখানেই মহাদেববাবু পড়াশোনা করেন। চোখের গোলমাল বেড়ে যাওয়ার পর অবশ্য সেটা বন্ধ হয়েছে। ত ক অপেক্ষা করতে বলে তিস্তা খবর দিতে গেল। মহাদেববাবু এলেন খানিক বাদেই। লুঙ্গির ওপর গেঞ্জি পরা, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী খবর অর্জুনবাবু?

অর্জুন উঠে দাঁড়িয়েছিল চেয়ার ছেড়ে, একটু বিরক্ত করলাম।

নট অ্যাট অল। আয় দিদু, এই হল আমার নাতনি। খুব গোয়েন্দা গল্প ভালবাসে। শুরু করেছিল এনিড ব্লাইটন, ক্যারোলিন কিন দিয়ে। এখন কোনান ডয়েল শেষ করে আগাথা ক্রিস্টি ধরেছে। থাকে কলকাতায়। মহাদেববাবু নাতনির কাঁধে হাত রাখলেন।

তিস্তা বলে উঠল, সত্যি, আপনি লন্ডন, নিউ ইয়র্কে গোয়েন্দাগিরি করেছেন?

মহাদেববাবু বললেন, যা পড়েছ সব সত্যি। এখন যাও দিদু, আমরা একটু কথা বলি। বেশ অনিচ্ছার সঙ্গে তিস্তা চলে গেলে মহাদেববাবু বসলেন, তোমার দাদা তো আবার উধাও হয়েছেন। বেশ আছে সে। হিংসে হয়। ঈশ্বর আমার চোখ দুটো এমন না করলে কে থাকত এখানে পড়ে? যাকগে, এত রাত্রে এসেছ যখন তখন নিশ্চয়ই কোনও প্রয়োজন আছে?

হ্যাঁ আছে। কিন্তু তার আগে বলুন আপনি ঈশ্বর আছেন বলে বিশ্বাস করেন?

একটা কিছুর ওপর নির্ভর করলে মনে জোর পাওয়া যায়। এই পৃথিবীটার সবকিছু যে নিয়ম মেনে চলে তার পেছনে যদি কারও পরিকল্পনা না থাকত তা হলে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যেত। ঈশ্বর থাকার বিপক্ষে যত যুক্তি, থাকার পক্ষে অনেক বেশি যুক্তি দেওয়া যায়। আসলে তিনি আছেন ভাবতেই ভাল লাগে।

অর্জুন মহাদেববাবুর চোখের দিকে তাকাল। মোটা কাচের আড়ালে চোখ দুটো অদ্ভুত বড়। সে জিজ্ঞেস করল, আপনার চোখে কী হয়েছে? ছানি পড়লে…।

মহাদেববাবু হাত নাড়লেন, না ভাই। এটা ছানি নয়। গ্লুকোমা। আমার চোখের ভেতরের কিছু শিরা শুকিয়ে গেছে। চোখের ভেতরের প্রেশারও অ্যাবনমালি বেশি। এ-জীবনে সারবে না, বরং দিন-দিন আরও কম দেখতে পাব। এই সুন্দর পৃথিবীতে অন্ধ হয়ে বেঁচে থাকার কথা ভাবতে খুব কষ্ট হয়।

মহাদেববাবুর মুখটাকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, অপারেশন করলে হয় না?

হত। কিন্তু আমার যে আবার বেশিরকমের ব্লাড সুগার আছে। হত বলছিই বা কেন! আমার যে স্টেজ তাতে নিশ্চয় করে কিছুই বলা যায় না। থাকগে। আমার কথা থাক। কী উদ্দেশ্যে এখন এলে তাই শোনা যাক। মহাদেববাবু হাসার চেষ্টা করলেন।

অর্জুন বলল, আমি একটু বিপাকে পড়েছি। অমলদা থাকলেও উনি আমাকে আপনার কাছে পাঠাতেন। ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত। আমি অন্তত আগে শুনিনি।

মহাদেববাবু বললেন, কে যেন লিখেছেন পৃথিবীর সব রহস্য কোথাও-না-কোথাও কেউ-না-কেউ সমাধান করে গেছেন। যেহেতু আমরা সেই সমাধানের সূত্র জানি না তাই এখনও আমাদের কাছে রহস্যময় বলে মনে হয়। ব্যাপারটা শোনা যাক।

অর্জুন থানায় সন্ধেবেলায় রামচন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে সমস্ত ঘটনা পর-পর বলে গেল। কম দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন মানুষেরা কোনও কথা শোনার সময় অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করেন। মনে হয় নিজেদের শ্রবণেন্দ্রিয় ক্রমশ শক্তিশালী করাই তাঁদের চেষ্টা হয়ে থাকে। অর্জুন চুপ করলে মহাদেববাবু জিজ্ঞেস করলেন, কার্ভালো অসমে যাওয়ার সময় রামচন্দ্রবাবুকে কি কিছু বলে গিয়েছেন?

বোধ হয় না। বললে উনি আমাকে বলতেন।

বোধ হয় ব্যাপারটা ঠিক নয়। তোমার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল। কারণ যদি সুটকেসের বস্তুটা সম্পর্কে কিছু জানিয়ে গিয়ে থাকে, ধরো, কোথেকে তিনি ওটাকে পেলেন, তাঁর কিছু হয়েছে কি না, তা হলে একটা ধারণা স্পষ্ট হত।

আমি জিজ্ঞেস করিনি। তবে জানা থাকলে রামচন্দ্রবাবু নিশ্চয়ই বলতেন।

কার্ভালো ওঁর বাড়িতে এক রাত ছিল?

হ্যাঁ।

তখন কার্ভালোকে কেউ মিডিয়াম হিসেবে ব্যবহার করেনি?

এই প্রশ্নটাও আমি করিনি।

রামচন্দ্রবাবু সিগন্যাল না কি যেন শুনতে পাচ্ছিলেন, তুমি পাওনি?

না।

তোমার সঙ্গে যে-লোকটা তালা ভাঙতে গিয়েছিল সে পেয়েছে?

না। পেলে বলত।

যন্ত্রটাকে একবার না দেখলে কিছু বলা যাচ্ছে না। এমন হতে পারে, এসবই রামচন্দ্রবাবুর কল্পনা। আজ রাত্রে থানায় ওটা রেখে এসেছ। যদি এটা সক্রিয় থাকে তা হলে থানার কোনও চোর অথবা পুলিশের অবস্থা রামচন্দ্রবাবুর মতো হবে। অতএব আগামীকাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যাক। মহাদেববাবু বললেন।

আচ্ছা, যন্ত্র বলেই বলছি, মহাকাশের সঙ্গে জড়িত কিছু নয় তো?

মহাকাশে তো কোনও যন্ত্র এমনি ঘুরে বেড়ায় না যে খসে পড়লে পৃথিবীর কোনও মানুষ কুড়িয়ে পবেআর যদি বা পড়ে তা হলে পৃথিবীতে পড়তে যাবে কোন দুঃখে! যদি পৃথিবীতে পড়ে তো ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

অর্জুন উঠে দাঁড়াল, তা হলে কাল সকালে থানায় গিয়ে খোঁজ নেব।

দাঁড়াও। মহাদেবাবু হাত তুললেন, তুমি বললে রাত হলে রামচন্দ্রবাবু যে সিগন্যালটা শোনেন, তা ওই যন্ত্রের মধ্যে মিলিয়ে যায়। তখন তাঁর আর হুঁশ থাকে না। যা উনি করেন তা তাঁকে দিয়ে অন্য কেউ করায়?

হ্যাঁ। উনি তো তাই বলেছেন।

তোমার সঙ্গে তো বাইক আছে?

হ্যাঁ।

কিন্তু বাইকে বসার সাহস আমার নেই। নইলে তোমার সঙ্গে গিয়ে রামচন্দ্রবাবুকে এই রাত্রে দেখে আসতাম। বেশি রাত তো হয়নি!

আপনি যদি আমার পেছনে বসেন তা হলে আমি খুব সাবধানে চালাতে পারি।

না, তুমি রিকশা ডাকো।

মহাদেববাবু যে অত রাত্রে অর্জুনের হাত ধরে বের হচ্ছেন, তা ওঁর বাড়ির লোকদের পছন্দ ছিল না। অনেকেই মুখের ওপরেই আপত্তি জানালেন। তিস্তা বায়না ধরল সে সঙ্গে যাবে, কিন্তু মহাদেববাবু কারও কথা কানে তুললেন না।

তিনি যখন তৈরি হচ্ছিলেন, তখন অর্জুন জলপাইগুড়ির রাত্রের রাস্তায় রিকশা খুঁজছিল। যেহেতু নটা বেজে গেছে, একটাও রিকশা চোখে পড়ছিল না। সে খুব হতাশ হয়ে মহাদেববাবুর গেটের সামনে ফিরে আসতেই শুনল বৃদ্ধ বলছেন, কে।

আমি অর্জুন। ও, রিকশা পেলে না?

না।

রাজবাড়ি তো বেশি দূর নয়, চলো হেঁটেই যাই।

অন্তত দেড় কিলোমিটার পথ।

এমন কী বেশি? তোমার বাইকের চেয়ে হাঁটতে আরাম হবে। নিজন জলপাইগুড়ির রাস্তায় হাঁটতে ভাল লাগছিল অর্জুনের। নিজের বাইকটাকে সে মহাদেববাবুর বাড়ির গেটের ভেতরে ঢুকিয়ে রেখে এসেছিল। মহাদেববাবু হঠাৎ বললেন, জানো, আমাদের বাংলা ভাষায় মহাকাশ নিয়েও গল্প-উপন্যাস লেখা হচ্ছে। কিন্তু সেদিন একটা কাহিনী শুনলাম, যা আমাকে খুব চমকে দিয়েছে।

মহাদেববাবু যে আন্দাজে হাঁটছেন, তা বুঝতে পেরেই অর্জুন তাঁর হাত ধরল। দুপাশে বাড়ি-ঘর-দোকানের আলো নিভে গেছে। মাঝে-মাঝে দু-একটা বিকশা দেখা গেলেও তারা যাত্রী নিয়ে পাঁই-পাঁই করে ছুটছে। হাঁটতে হাঁটতে মহাদেববাবু গল্পটা শোনালেন। এক ভদ্রলোকের হার্ট ব্লক হয়েছিল। কিন্তু তাঁর শরীরের যা অবস্থা তাতে অপারেশন করা সম্ভব ছিল না। অনেক ভাবনাচিন্তার পব সার্জেন এবং তাঁর সহকারী নিজেদের শরীরে যে ইনজেকশন নিলেন তাতে তাঁদের শরীর ছোট হয়ে গেল। একটা ছোট্ট ক্যাপসুলেব মধ্যে ঢুকে পড়লেন তাঁরা। তারপর সেই ক্যাপসুলটাকে ইঞ্জেকশনের সাহায্যে ভদ্রলোকের ধমনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। ধরা যাক, চব্বিশ ঘণ্টাব মধ্যে যা করার করতে হবে সার্জেনকে। তারপরে ওই ক্যাপসুল গলে যাবে।

এই পর্যন্ত বলে মহাদেববাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী, আজগুবি বলে মনে হচ্ছে?

একটু।

লেখক সামান্য লাইসেন্স নিয়েছেন। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে লোকে চাঁদে হেঁটে বেড়ানোটাকে আজগুবি বলে মনে করত।

তারপর  হাটতে-হাঁটতে অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

ধমনী বেয়ে ক্যাপসুলে চেপে লোক দুটো পথ হারিয়ে ফেলল। ওরা প্রথমে গেল স্টম্যাকে। তারপর লিভারে। নানা জায়গায় ঘুরে ওরা যখন হার্টে পৌঁছল তখন অনেক নাটক হয়ে গেছে। কিন্তু হাতে সময় নেই। শিরা বেয়ে ওরা হৃদযন্ত্রে প্রবেশ করল। খুদে-খুদে যন্ত্রপাতির সাহায্যে ওরা অপারেশনের পুরো কাজটা শেষ করল। হাতে বেশি সময় নেই কিন্তু বেরিয়ে আসার পথ ওরা খুঁজে পাচ্ছিল না। কী করে ওরা বের হল বলতে পার? মহাদেববাবু প্রশ্ন করলেন।

অর্জুন ভেবে পেল না। ওরা তখন রাজবাড়ির গেট পেরিয়ে যাচ্ছে। মহাদেববাবু বললেন, পেশেন্টের চোখের জলের সঙ্গে ওদের ক্যাপসুল বেরিয়ে আসামাত্র গলে গেল। বেরোবার ওই একটিমাত্র পথ ছিল। দারুণ গল্প। পড়তে-পড়তে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে যায়।

অর্জুন বলল, এই বাড়ি।

রামচন্দ্র রায়ের বাড়ির সদর দরজা বন্ধ। জানলাগুলোও। কিন্তু ভেতরে আলো জ্বলছে। অর্জুন কড়া নাড়ল। ভেতর থেকে কোনও শব্দ ভেসে এল না। দ্বিতীয়বারের পর গলা পাওয়া গেল। অর্জুন নিজের পরিচয় দেওয়ার পর দরজাটা খুলল। খালি গায়ে লুঙ্গি পরে রামচন্দ্র রায় তাদের দিকে অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন। যেন তাঁর বুঝতে সময় লাগল। শেষমেশ বললেন, ও, আমি ভাবলাম, আসুন-আসুন। আমি শুয়ে পড়েছিলাম। কথাগুলো বেশ জড়ানো।

অর্জুন বলল, আমি খুবই দুঃখিত যে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে–।

হাত নাড়লেন রামচন্দ্রবাবু, ঘুমোইনি। কিছুতেই ঘুম আসছিল না। শুয়ে ছিলাম।

প্রতি রাত্রে যা হয় আজ সেসব–।

হয়নি। এমনকী সেই সিগন্যালিং সাউন্ডটাও কানের পরদা থেকে উধাও। প্রতি মুহুর্তে মনে হচ্ছিল কিছু একটা হবে, কিন্তু হচ্ছে না। টেনশন বাড়ছে কিন্তু ঘুম আসছে না।

আপনি তো তাই চেয়েছিলেন।

মোটেই নয়। ওরা আমাকে দিয়ে কোনও অপরাধ করাক এটা চাইনি। কিন্তু আমার কাছ থেকে চলে যাক, এটা কখনও ভাবিনি। সুটকেসটাকে

কোথায় রেখেছেন?

এবার মহাদেববাবু কথা বললেন, নমস্কার। আমার নাম মহাদেব সেন। চোখে দেখি না বলাই সঙ্গত। অর্জুনবাবুর সঙ্গে তবু এলাম। আপনার মনে হচ্ছে সুটকেসটা এখানে থাকলে সুবিধে হত?

রামচন্দ্র রায় বললেন, নিশ্চয়ই। কার্ভালো যে আমার এত বড় উপকার করেছে তা আগে বুঝিনি। ওর ওই সুটকেসটার জন্যেই রোজ রাত্রে ওরা এই বাড়িতে আসত।

কারা? মহাদেব সেনজিজ্ঞেস করলেন।

আমি জানি না। কিন্তু ওদের উপস্থিতি টের পেতাম। বেশ ভাল লাগত।

এবার অর্জুন বলল, ভাল লাগত? আপনি আগে একবারও বলেছেন এ কথা? থানায় গিয়েছিলেন এর বিরুদ্ধে ডায়েরি করতে, তা হলে কী করে ভাল লাগত?

আঃ, বোঝাতে পারছি না, ওদের উপস্থিতি আমার ভাল লাগত কিন্তু ওরা যদি আমাকে দিয়ে অন্যায় কিছু করিয়ে নেয় তাই ভয় করত। সুটকেসটা কোথায়? রামচন্দ্র রায় বেশ উদ্বিগ্ন।

ওটা ঠিক জায়গায় আছে। আমরা আপনার সঙ্গে ওই ব্যাপারেই কথা বলতে এসেছি। একটু বসতে পারি? উনি অনেকটা পথ হেঁটে এসেছেন।  অর্জুন বলল।

বোঝা গেল অনিচ্ছা প্রবল, তবু বসতে বললেন রামচন্দ্র রায়। বসাটা দরকার ছিল মহাদেববাবুর। তিনি একটু আরামসূচক শব্দ করে জিজ্ঞেস করলেন, সুটকেসটা যে এত জরুরি তা আপনি আগে জানতেন?

না। ওটা পড়ে থাকত ঘরের কোণে।

আপনার বন্ধু আপনাকে দিয়েছিল?

দেয়নি। রেখে গিয়েছিল। বলেছিল অসম থেকে ফেরার পথে নিয়ে যাবে।

যে রাত্রে তিনি এ বাড়িতে ছিলেন সেই রাত্রে কোনও ঘটনা ঘটেছিল? মানে, ওই সিগন্যালিং সাউন্ড? কারও আসার অনুভূতি। মহাদেববাবু প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন।

না। একদম হয়নি। কার্ভালো চলে যাওয়ার পরের রাত থেকে এটা শুরু হয়েছে।

যাওয়ার দিন উনি কি সুটকেস খুলেছিলেন?

রামচন্দ্রবাবু মনে করার চেষ্টা করলেন। তারপর মাথা দোলালেন, না। কেউ নিজের সুটকেস খুলছে তা মুখ বাড়িয়ে দেখা অভদ্রতা। আমি দেখিনি।

কার্ভালো আপনাকে যন্ত্রটা সম্পর্কে কিছু বলে গিয়েছেন?

না।

মিস্টার রায়, এখন কি মনে হচ্ছে আপনি রোজ রাত্রে একটা নেশার মধ্যে ছিলেন, কিন্তু আজ সেই নেশার বস্তুটি পাচ্ছেন না?

হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমার ঘুম আসছে না।

যারা আপনার কাছে আসে বলে মনে হয়, তাদের কোনও কথা আপনার মনে আছে?

তারা কোনও কথা বলে না।

মহাদেব সেন এবার উঠে দাঁড়ালেন, চলি, অনেকটা পথ ফিরতে হবে।

রামচন্দ্র রায় বললেন, কিন্তু সুটকেসটাকে আমার চাই, এখনই।

এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। অর্জুন উঠে দাঁড়াল।

কেন?

ওটাকে থানার সিন্দুকে রেখে এসেছি। কাল সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

সঙ্গে-সঙ্গে ভদ্রলোক ভেঙে পড়লেন, ওঃ, কী দুর্মতি হয়েছিল। থানায় গিয়ে আমার কাল হল। ওঃ।

মহাদেব সেনের হাত ধরে অর্জুন বেরিয়ে আসতেই লটারির মতো একটা রিকশা পেয়ে গেল। রোড স্টেশনে তার রিকশা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এত রাত পর্যন্ত আটকে পড়ে ছিল। মহাদেব সেন আর অর্জুন সেই রিকশায় বসে শহরের দিকে হু-হু করে চলে আসছিল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কিছু বুঝলেন?

এক বিন্দু নয়। বুঝবে তুমি। আমার কাজ প্রশ্ন করে যাওয়া। আমরা কি থানার রাস্তায় যাচ্ছি?

থানা? আপনি এখন বাড়িতে ফিরবেন না?

নিশ্চয়ই। তবে তার আগে একবার থানার ব্যাপারটা শুনে যেতে চাই।

বুঝলাম না।

রাত অনেক হয়েছে। থানার লোকজন সিগন্যালিং সাউন্ড শুনতে পাচ্ছে কি না অথবা ওদের কারও রামচন্দ্র রায়ের মতো অবস্থা হল কি না। এটা জানা দরকার।

অর্জুন রিকশাওয়ালাকে থানার দিকে যেতে বলল। লোকটা আপত্তি করল। ওর বাড়ি থানা থেকে অনেক দূরে। সে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে না।

থানায় পৌঁছে মহাদেব সেন নামতে চাইলেন না। তিনি রিকশায় বসে রইলেন। অর্জুন নামল। পাহারায় থাকা সেপাই জানাল অবনীবাবু ফিরেছেন। তিনি এখন নিজের কোয়ার্টার্সে আছেন। সেকেন্ড অফিসার শঙ্করবাবু এত রাত্রে অর্জুনকে দেখে অবাক, কী হল মশাই?

কিছুই হয়নি। আপনাদের নতুন কোনও খবর আছে?

পুলিশের আবার নতুন খবর! সবসময়ই খবর। কী ব্যাপার বলুন তো?

একবার ভল্টের সামনে নিয়ে যাবেন?

নিশ্চয়ই। কিন্তু রহস্য কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে!

অর্জুন আর কথা না বাড়িয়ে শঙ্করবাবুকে অনুসরণ করল। ভল্টের দরজায় তেমনই তালা ঝুলছে। সে জিজ্ঞেস করল, এখানে যারা আছে তাদের আচরণে কোনও পরিবর্তন এসেছে?

না। আর পরিবর্তন হবেই বা কেন?

একটা কারণ ছিল। কেউ কোনও শব্দ শুনতে পাচ্ছে? মেটালিক টোন?

আমি তো শুনিনি। কেউ শুনলে নিশ্চয়ই বলত। আপনি শুনছেন?

অর্জুন হেসে ফেলল, নাঃ। চলুন।

কী ব্যাপার! এসব প্রশ্ন করছেন কেন?

যে ভদ্রলোকের কাছে সুটকেসটা ল্লি তিনি শুনতে পেতেন।

লোকটা নিশ্চয়ই নেশাভাঙ করত! জলপাইগুড়িতে এরকম লোকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। আরে মশাই এক ভদ্রমহিলা রোজ রাতে ভূত দেখছেন। গিয়ে জানলাম একটা মাটির প্যাঁচা মেলা থেকে কেনার পর থেকেই নাকি ওই কাণ্ড শুরু হয়েছে। বললাম, ভেঙে ফেলুন কিন্তু তা করবে না। জোর করে সেটাকে করালাম, ফেলে দিতে ভূত দেখা বন্ধ হল। বুঝুন। কিসে এলেন, বাইক কোথায়?

রিকশায় এসেছি। সঙ্গে একজন বিশিষ্ট মানুষ আছেন।

কে?

মহাদেব সেন।

শঙ্করবাবু সম্ভবত মহাদেব সেন সম্পর্কে বেশি কিছু জানেন না। কিন্তু তিনি অর্জুনের সঙ্গে গেট পর্যন্ত এলেন। দূর থেকেই রাস্তার আলোয় অর্জুনের চোখে পড়ল রিকশার ওপরে মহাদেব সেন দু হাতে কান চেপে বসে আছেন। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে নাকি ভদ্রলোকের! নিজেকে অপরাধী বলে মনে হল। এত রাত্রে ওঁকে বিব্রত কবা ঠিক হয়নি। কাছে পৌঁছে সে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

অদ্ভুত চোখ কবলেন মহাদেব সেন, অর্জুন, আমি বুঝতে পারছি না, কিন্তু আমার কানের পরদায় একটানা একটা সাউন্ড বিপবিপ করে বেজে যাচ্ছে। কখনও রেডিয়ো খোলর আগের শব্দের মতো টানা। মাই গড। তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ?

হতভম্ব অর্জুন বলল, না।

এই রিকশাওয়ালাটাও পাচ্ছে না। আপনি পাচ্ছেন ভাই?

শঙ্করবাবু হাঁ হয়ে শুনছিলেন। মুখ বন্ধ করে দ্রুত মাথা নেড়ে না বললেন। সেটা ভাল করে দেখতে পেলেন না মহাদেব সেন। বুঝতে পেরে অর্জুন বলল, উনিও কিছু শুনতে পাচ্ছেন না।

মহাদেব সেনকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছিল। অর্জুন বলল, ঠিক আছে। চলুন, বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নেবেন।

মাথা নাড়লেন মহাদেব সেন, না ভাই। মিস্টার রায় যা বলেছিলেন অবিকল সেই আওয়াজ। খুব দূর থেকে আসছে, যেন ক্ষীণ কিন্তু কানে পৌঁছে যাচ্ছে। রিকশাটা এখানে দাঁড়ানো মাত্র ওটা কানে পৌঁছেছে। ব্যাপারটা আমার দেখা উচিত।

শঙ্করবাবু বললেন, সার, আপনি বোধ হয় ঠিক সুস্থ নন।

রাবিশ। চোখে দেখতে না পাওয়া ছাড়া আমার কোনও প্রব্লেম নেই। মহাদেব সেন রিকশা থেকে নামার চেষ্টা করছেন দেখে অর্জুন এগিয়ে গিয়ে তাঁকে ধরল। মহাদেব সেন মাটিতে দাঁড়িয়ে বললেন, আমাকে থানার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলো।

রিকশাওয়ালা এতক্ষণ এসব কাণ্ড দেখছিল। এবার লিল তাকে ছেড়ে দিতে। এমনিতেই প্রচুর রাত হয়ে গিয়েছে, তার ওপর ভুতুড়ে ব্যাপারে সে নেই। অর্জুনের আপত্তি ছিল, কিন্তু শঙ্করবাবু বললেন, এখানে এসে পড়েছেন যখন, তখন কোনও প্রব্লেম নেই। গাড়ি করে ওঁকে পৌঁছে দিয়ে আসব।

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে মহাদেব সেনের পাশে এসে দডিতেই তিনি বললেন, অর্জুনবাবু।

হ্যাঁ, বলুন।

মনে করে দ্যাখো তো, তোমার সঙ্গে কথা বলতে মিস্টার রায় এরকম শব্দ শুনতে পেয়েছেন কি না?

হ্যাঁ। উনি পাচ্ছিলেন।

গুড। এখনও আমার বোধবুদ্ধি ঠিক আছে। মিস্টব নয় তোমাকে বলেছেন একটা সময় তাঁর কোনও হুঁশ থাকত না। সেই অবস্থা যদি আমার হয় তা হলে একটু লক্ষ রেখো। আমি চেষ্টা করব আমার হুশ ঠিক রাখতে। সুটকেসটাকে কোথায় রেখেছ? মহাদেব সনের চোখ এখন একেবারেই বন্ধ। কিন্তু মুখ দেবোঝা যাচ্ছিল ওঁর ভেতরে কিছু ঘটে যাচ্ছে!

মাটির তলার ঘরে। অর্জন জবাব দিল। আমাকে সেখানে নিয়ে চলো।

আমি তো নিয়ে যেতে পারব না। জায়গাটায় বাইরের মানুষের যাওয়া নিষেধ যদি না এঁরা অনুমতি দেন। শঙ্করবাবু, উনি একবাব ভল্টের সামনে যেতে চান। নিয়ে যাবেন?

অর্জুন প্রশ্ন করতে শঙ্করবাবু তার দিকে মুখ ফেরালেন। বি চোখে-মুখে বিস্ময়। মহাদেব সেনের ওই পরিবর্তনের কাবণ তিনি বুঝতে পারছেন না। থানায় যারা পাহারা দিচ্ছিল সেই সেপাইরাও কাছাকাছি এসে যেন মজা দেখছে।

শঙ্করবাবু চাপা গলায় জিজ্ঞেস করবেন, কী ব্যাপার? ওতে ভর করছে নাকি?

কথাটা চাপাস্বরে হলেও মহাদেব সেনের কানে গেল! তাঁব গলা শোনা গেল, অর্জুন, ওর কথাগুলো শুনতে পেয়েছি। তার মানে আই অ্যাম ইন ফুল সেন্স। ভূতে ভর করলে এসব কথা বলতে পারতাম না মশাই। ঠিক কি না?

শঙ্করবাবু চটপট বলে উঠলেন, ঠিক কথা। অর্জুনবাবু, আমি একবার বড়সাহেবকে জিজ্ঞেস করে আসি। যদি কিছু হয়ে যায়, মানে, আমার একটু ঝুঁকি থাকছে তো!

অর্জুন বলল, এত রাত্রে ভদ্রলোককে ঘুম থেকে তুলবেন? আমরা তো কিছুই করছি না। শুধু দরজা পর্যন্ত যাচ্ছি আর ফিরে আসছি।

শঙ্করবাবু আর একটু ইতস্তত করে বললেন, ঠিক আছে, তবে অন্য কিছু হলে আপনি কিন্তু আমার কথা বড়সাহেবকে বলবেন। আমি অবশ্য এঁকে বলেছি যে, আপনি এসে একটা সুটকেস রেখে গেছেন। উনি জিজ্ঞেস করলেন, কীসের সুটকেস? আমি বললাম সম্ভবত দামি জিনিস আছে ভেতরে।

তা হলে তো ওঁকে জানানোই হয়ে গেছে। চলুন, আপনার কোনও অসুবিধে হবে না।

ওরা যত এগোচ্ছিল তত নিচুস্বরে মহাদেব সেন বলছিলেন, খুব জোরে বাজছে হে। রায় ঠিকই বলেছে। কোনও আজগুবি ভূতপ্রেত নয়। একেবারে মাথার ভেতরে হ্যামার করছে।

বন্ধ দরজার সামনে ওরা যখন এসে দাঁড়াল, তখন মহাদেব সেনের মুখ-চোখ বেশ উত্তেজিত। অর্জুন বলল, ওই ঘরের ভেতরে সুটকেসটা আছে।

মহাদেব সেন সজোরে দরজায় ঘুসি মারলেন।

শঙ্করবাবু বললেন উঠলেন, করছেন কী? তালা দেওয়া আছে। কাল সকালের আগে খোলা যাবে না। আরে, আপনার হাতে লাগবে! ও অর্জুনবাবু, সামলান ওঁকে।

অর্জুন মহাদেব সেনের হাত ধরল, আপনি আহত হবেন।

হই হব। আই মাস্ট সি দ্যাট সুটকেস। আঃ কী আরাম। কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছিল ওঁর। চোখ-মুখ পালটে যাচ্ছিল। শঙ্করবাবুর ইঙ্গিতে পাহারাদাররা ছুটে এসে মহাদেব সেনকে জড়িয়ে ধরল। একজন একটা দড়ি এনে ভাল করে বাঁধতে যাচ্ছিল, কিন্তু অর্জুন তাকে বাধা দিল। না। ওটা করবেন না। ধরাধরি করে ওঁকে বরং বাইরে নিয়ে চলুন।

ওরা যখন মহাদেব সেনকে জোর করে তুলে ওপরে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন শঙ্করবাবু ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সুটকেসটার ভেতরে ভূত আছে। নাকি? অ্যা। ভদ্রলোকের ওপর তো ভর করে ফেলেছে।

আপনি তো ওসবে বিশ্বাস করেন না।

করতাম না। কিন্তু এখন চোখের ওপর দেখছি।

ওপরে এসেও সেপাইরা মহাদেব সেনকে সামলাতে পারছিল না। তিনি যেন প্রচণ্ড শক্তির অধিকারী এখন। সেপাইরা কী করবে বুঝতে পারছে না। অর্জুন ওঁকে বোঝাতে গেল, আপনি শান্ত হোন, কী করছেন?

মহাদেব সেন এমন সব শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলেন, যা অর্জুন এই জীবনে শোনেনি। এমনিতে দৃষ্টিশক্তি প্রায় নেই, কিন্তু এখন তাঁকে দেখে ওসব মনেই আসছে না। চিৎকার চেঁচামেচিতে অবনীবাবুর ঘুমও ভেঙে গেল। তিনি নেমে এলে অর্জুন তাঁকে সব জানাল। ব্যাপারটা পরীক্ষা করার জন্যে অবনীবাবু নিজে একবার ভল্টের দরজা থেকে ঘুরে এলেন, তাঁর আচার-আচরণে কোনও পরিবর্তন হল না। ওপরে এসেই অবনীবাবু মহাদেব সেনের বাড়িতে একজন সেপাইকে পাঠালেন খবর দিতে, আর টেলিফোনে ডাক্তার দাসকে থানায় আসতে বললেন।

দুটো হাত পেছন দিকে শক্ত করে ধরে মহাদেব সেনকে একটা চেয়ারে জোর করে বসিয়ে রাখা হয়েছিল। অর্জুনের খুব কষ্ট হচ্ছিল। এই বৃদ্ধ অসুস্থ মানুষটিকে সে কোন্ সমস্যায় জড়িয়ে দিল!

মিনিট কুড়ির মধ্যে প্রায় একই সঙ্গে মহাদেব সেনের ছেলে এবং বউমা আর ডাক্তার দাস এসে গেলেন। মহাদেব সেনের ছেলে সুব্রত সেন এখানকার কলেজের অধ্যাপক। বাবার ওই অবস্থা দেখে তিনি অবাক!

কী করে এমন হল প্রশ্ন করাতে অর্জুন খুব দুঃখের সঙ্গে ব্যাপারটা জানাল। ভদ্রলোক বললেন, খুব অন্যায় করেছেন বাবাকে অত রাত্রে নিয়ে গিয়ে। এই বয়সে এ কী হয়ে গেল বলুন তো!

সুব্রত সেনের স্ত্রী অনেকটা বাস্তব কথা বললেন, বাবা না চাইলে কেউ কি ওঁকে নিয়ে যেতে পারে? তা ছাড়া উনি কী করে জানবেন যে, এমন হবে।

ডাক্তার দাসকে মংদেব সেন পরীক্ষা করতে দিলেনই না। যতবার তিনি কাছে যাচ্ছেন ততবার যেন তাঁর ওপরেই আক্রোশ পড়ছে। শেষপর্যন্ত ডাক্তার দাস বললেন, মনে হচ্ছে কোনও কারণে ওর নার্ভাস সিস্টেমে গোলমাল হয়েছে। এখনই কড়া ঘুমের ওষুধ দেওয়া উচিত। আপনারা জোর করে ধরুন, আমি একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিচ্ছি।

তাই করা হল। মহাদেব সেনের শরীরে প্রচণ্ড শক্তি, এখন তবু সবাই মিলে জোর করে তাঁকে এমনভাবে ধরা হল যাতে ডাক্তার দাস ইনজেকশন দিতে পারেন। কিন্তু আশ্চর্য, তাতেও কাজ হল না। ভদ্রলোক রীতিমতো অবাক। বললেন, কোনও মানুষ এই ইনজেকশনের পর মিনিট পাঁচেক জেগে থাকতে পারে না। এঁর কী হল?

রাতটা ওইভাবেই কাটল। ভোর যত এগিয়ে এল, তত নেতিয়ে পড়তে লাগলেন মহাদেব সেন। সূর্য ওঠার ঠিক আগে তিনি একদম শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়লেন। তাঁর মুখ-চোখ শান্ত হয়ে এল। অবনীবাবু বললেন, এখন ওঁকে বাড়িতে নিয়ে গেলে ঘুম ভেঙে যেতে পারে। এই ঘরেই আমি বিছানা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। শঙ্করবাবু, আপনি দেখবেন কেউ যেন এখানে না ঢোকে। মহাদেব সেনের মতো নামী বিজ্ঞানীর কোনও ক্ষতি হোক আমরা চাই না।

কয়েক মিনিটের মধ্যে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল। মহাদেব সেন এখন আরামে ঘুমোচ্ছেন। ডাক্তার দাস পরীক্ষা করে দেখলেন, ওঁর পাস এবং হার্ট নর্মাল। ভয়ের কোনও কারণ নেই। ঘুমের স্তর পরীক্ষা করে ভদ্রলোক শুধু বললেন, আশ্চর্য! মনে হচ্ছে আমি এইমাত্র ইজেকশন দিয়েছি। কী কাণ্ড!

মিসেস সেন চলে গেলেন। বললেন, কাউকে পাঠিয়ে দিলে তুমি যেয়ো।

সুব্রত সেন মাথা নাড়লেন। তাঁকে তখনও অর্জুনের ওপর সদয় মনে হচ্ছিল না।

অবনীবাবু বললেন, চলুন, দরজা ভেজিয়ে আমরা বাইরে যাই। অর্জুনবাবু, অনেক ঝড় গেল, আপনি বাড়িতে গিয়ে বিশ্রাম করুন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, অসম্ভব। আমার জন্যে ওঁর এই দশা, উনি যতক্ষণ না সুস্থ হয়ে কথা বলছেন ততক্ষণ আমার ঘুম আসবে না।

বেশ, তা হলে চলুন, আমরা একটু চা-পান করি।

ওরা দরজা ভেজিয়ে বাইরে এল। অবনীবাবু একজনকে ডেকে চায়ের কথা বললেন। সবে ভোর হচ্ছে। হঠাৎ অর্জুনের নজরে এল থানার গেট পেরিয়ে রামচন্দ্র রায় বেশ ইতস্তত ভাব নিয়ে ঢুকছেন। এই সময়ে ওঁকে এখানে দেখবে ভাবেনি সে। রামচন্দ্র বায় অর্জুনকে দেখতে পেয়ে ইশারায় ডাকলেন।

অবনীবাবু বললেন, আরে, এই ভদ্রলোকই তো গতকাল সন্ধেবেলায় আমার কাছে এসেছিলেন, তাই না অর্জুনবাবু?

হ্যাঁ, উনিই। দাঁড়ান, দেখি কেন ডাকছেন!

অর্জুন এগিয়ে গেল। রামচন্দ্র রায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। অর্জুন কাছে গিয়ে বলল, সুপ্রভাত!

ও, হ্যাঁ, সুপ্রভাত। ভদ্রলোককে আজ আরও বয়স্ক দেখাচ্ছিল।

কী ব্যাপার?

আপনার বাড়িতে গিয়েছিলাম। গিয়ে শুনলাম কাল রাত্রে নাকি ফেরেননি।

এখন মা বাড়িতে নেই। কদিনের জন্যে এক পিসির বাড়িতে গিয়েছিলেন। কাজের লোকটি নিশ্চয়ই চিন্তা করবে না। অর্জুন গতরাত্রে বাড়িতে খবর দেয়নি সেই কারণেই।

হঠাৎ কোনও প্রয়োজন হয়েছিল?

হ্যাঁ। আমার সুটকেসটা ফেরত দিন।

আপনি বলেছেন ওটা কার্ভালোর।

কার্ভালো আমার বন্ধু। সে ওটা আমার কাছে রেখে গিয়েছিল। অতএব ওর সম্বন্ধে যাবতীয় দায়িত্ব আমার। দয়া করে ফেরত দিন। প্রায় মিনতি করলেন রামচন্দ্র রায়।

দেখুন, ওটার অস্তিত্ব আছে তাই আমরা জানতাম না। আপনি নিজে এসে থানায় কথা না বললে এসব কিছুই হত না। কিন্তু নিজের অজান্তে আপনি একটা ভাল কাজ করেছেন। আপনার কাছে সুটকেসের ভেতরে যে যন্ত্রটি ছিল তার রি-অ্যাকশন সব মানুষের ওপর পড়ে না। আমি, ল্যাংড়া-পাঁচু, থানার অফিসার অথবা সেপাইরা ওর রি-অ্যাকশন থেকে মুক্ত, অথচ কাল যে-ভদ্রলোক আমার সঙ্গে আপনার বাড়িতে গিয়েছিলেন, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন। সারারাত ওঁর যে কষ্ট হয়েছে, তা আমি দেখেছি। মনে হয় আপনারও একই কষ্ট হত। এখন ওই যন্ত্র সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আপনাকে ফেরত দিতে পারি না, অর্জুন বলল।

অবনীবাবু ততক্ষণে কাছে এসে পড়েছিলেন, জিজ্ঞেস করলেন, আপনার বন্ধু ওই যন্ত্র কোথায় পেয়েছেন তা কি আপনাকে বলেছেন?

নীরবে মাথা নেড়ে না বললেন রামচন্দ্রবাবু।

একটা অদ্ভুত জিনিস বেআইনিভাবে আপনি রাখতে পারেন না!

রামচন্দ্রবাবুর কাছে এসব কথা যাচ্ছিল না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের কারও কিছু হয়নি আর সেই ভদ্রলোকের অবস্থা আমার মতো হয়ে গেল! একবার তাঁকে দেখতে পারি?

উনি এখন ঘুমোচ্ছেন! অবনীবাবু বললেন।

আচ্ছা, আমিও সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মড়ার মতো ঘুমোতাম। আপনারা আমার সনাশ করেছেন। এই কদিন বাতের ব্যথাটা ছিল না একটুও, আজ আবার ফিরে এসেছে। ওটা না পেলে আমি আজ আত্মহত্যা করব! রামচন্দ্র রায় চাপা গলায় বললেন।

অর্জুন বৃদ্ধকে বলল, ওই সিগন্যাল শোনা, ঘোরের মধ্যে থাকা আপনার নেশা হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। একটা রাত না পেয়ে আপনি এসব কথাও ভাবতে পারছেন। অথচ আপনি নাবিক ছিলেন, কত কষ্ট, পরিশ্রম করেছেন, জীবন দেখেছেন। একটা সাধারণ নেশাখোরের কথা আপনার মুখে কি মানায়?

ওঃ, কী করে বোঝাব ওটা কী ধরনের নেশা!

আপনি তো ওই নেশায় আক্রান্ত হয়ে কাউকে খুন করতে পারতেন!

হ্যাঁ, ঠিক, সব ঠিক। রামচন্দ্র রায় মাথা নাড়লেন, তবু–।

আর কোনও তবু নয়। আমরা পরীক্ষা করে দেখতে চাই যন্ত্রটাকে। দরকার হলে সরকারকে জানাতে হবে। এরকম হচ্ছে কেন! চিংড়িমাছ খেলে সবার ভাল লাগে, আবার কারও-কারও শরীরে এমন অ্যালার্জি বের হয় যে, সে দ্বিতীয়বার খায় না। তার শরীরের গঠনের সঙ্গে ওই মাছ মেলে না। মনে হচ্ছে আপনার বন্ধুর দেওয়া ওই যন্ত্রটি সব মানুষকে আক্রমণ করে না। কোনও-কোনও মানুষের মস্তিষ্কে এমন কিছু কোষ আছে, যা ওর পছন্দ। বোঝাই যাচ্ছে তাঁদের সংখ্যা খুব অল্প। আপাতত আপনি আর মহাদেববাবু একই গোত্রের। এখন আপনি বাড়ি ফিরে যান। মহাদেববাবুর ঘুম ভাঙলে মনে হয় কিছু জানা যেতে পারে। অর্জুন তার লাল বাইকটির কথা ভাবল। সেটা মহাদেব সেনের বাড়ির সামনেই পড়ে আছে গত রাত থেকে। সে অবনীবাবুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা শুরু করল। সমস্ত রাত অদ্ভুত টেনশনে কাটিয়ে এখন বেশ অবসন্ন মনে হচ্ছে নিজেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *