• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • লেখক
  • My Account
  • লেখক
  • My Account
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা PDF ডাউনলোড

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

১৪. ডি. এফ. ও. যে আন্দাজ দিয়েছিলেন

লাইব্রেরি » সমরেশ মজুমদার » অর্জুন সমগ্র - সমরেশ মজুমদার » কালাপাহাড় (অর্জুন সিরিজ) (১৯৯২) » ১৪. ডি. এফ. ও. যে আন্দাজ দিয়েছিলেন

ডি. এফ. ও. যে আন্দাজ দিয়েছিলেন তাতে বৈকুণ্ঠপুর চা বাগানের গা-ঘেঁষা জঙ্গলের উলটো দিকের কাছাকাছি সরকারি রাস্তা অন্তত মাইল তিনেক দূরে। জঙ্গলের মাঝখানে সিঁথির মতো পিচের পথ চলে গিয়েছে। দিনে চারবার বাস যায় এই পথে।

ডি. এফ. ওর জিপে ওরা যে-জায়গায় নামল সেখানে শুধু ঝিঝির ডাক আর গাছের ঘন ছায়া। গাছগুলো যেন আকাশছোঁয়া গা জড়িয়ে অজস্র পরগাছা ঝুলে থেকে কেমন রহস্যময় করে তুলেছে। ডি. এফ. ওর সঙ্গে ওই অঞ্চলের রেঞ্জার ছিলেন। দুজন বিট অফিসার আর জনা আটেক সেপাই। জানা গিয়েছিল দুটো থানায় হাতের কাছে এখন পনেরোজনের বেশি সেপাই পাওয়া যায়নি। অথাৎ সশস্ত্র পনেরোজনের সঙ্গে লড়াই হবে এ-পক্ষের পনেরোজনের। অর্জুনের হাতে কোনও অস্ত্র নেই। ডি. এফ. ও. অথবা অমলদা সঙ্গে কিছু রেখেছেন কি না তা অর্জুনের জানা নেই।

গাড়ি থেকে নেমে ডি. এফ. ও. বললেন, ওই যে দেখুন, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে আমাদের জিপ অথবা কন্ট্রাক্টারদের লরি যাওয়ার কাঁচা পথ আছে। ইচ্ছে করলে ওই পথ ধরে আমরা আরও মাইল দুয়েক এগিয়ে যেতে পারি।

অমল সোম মাথা নাড়লেন, মাইলখানেক এগিয়ে গেলেই যথেষ্ট হবে। কারণ গাড়ির শব্দ বেশি দূরে না যাওয়াই ভাল।

অতএব জিপগুলো জঙ্গলে ঢুকল। এই দিনদুপুরেও কেমন গা-ছমছমকরা ভাব জঙ্গলের ভেতরে। দুপাশের ডালে বসে বানর আর পাখিরা সমানে চিৎকার করে যাচ্ছে। জিপ চলছিল ধীর গতিতে, কারণ এদিকের রাস্তা খুবই অসমান। মাঝে-মাঝেই বানরগুলো সাহস দেখিয়ে রাস্তার মাঝখানে বসে পড়ছিল। ডি. এফ. ও. হেসে বললেন, এদের সাহস দেখছি খুব বেড়ে গিয়েছে।

অমল সোম বললেন, রোজ আপনাদের জিপ দেখছে, সাহস তো বাড়বেই।

ডি. এফ. ও. বলল, আমাদের জিপ রোজ এদিকে আসে না।

ঠিক মাইলখানেক যাওয়ার পর ডি. এফ. ও. জিপ থামাতে বললেন। এদিকে জঙ্গল আরও ঘন। একটা মাঝারি কাগজ সামনে রেখে তাতে কয়েকটা রেখা এঁকে বললেন, এই জায়গাটা আমরা জানি। আর অর্জুনবাবুর কথা ঠিক হলে এধারে আমাদের পৌঁছতে হবে।মাইল দেড়েক পথ। অবশ্য পথ করে নিতে হবে।

অমল সোম ঘাড় নাড়লেন, ঠিক আছে। জিপগুলো এখানেই থাক। আমরা দুটো দলে এগোব। আমি আর অর্জুন পাঁচ মিনিট আগে রওনা হচ্ছি। আপনি বাকিদের নিয়ে আসুন। ওদের ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছে যদি আমাদের দেখা না পান তাহলে একটু অপেক্ষা করবেন। আমি তিনবার শিস দেব। শিস শুনলে আপনারা চার্জ করবেন।

ডি. এফ. ও. মন দিয়ে শুনছিলেন। বললেন, কিন্তু আমরা পৌঁছবার আগেই যদি এস. পি. ওপাশ থেকে অ্যাটাক শুরু করেন? অমল সোম ঘড়ি দেখলেন, না। ওঁকে আমি একটা সময় দিয়েছি। তার আগে উনি বাংলো ছেড়ে নদীর দিকে এগোবেন না। আমি চেষ্টা করব একই সময়ে দুদিক থেকে আক্রমণ করতে। আপনি বাকিদের নির্দেশ দিন যাতে নিঃশব্দে এগোতে পারে।

ডি. এফ. ওর সঙ্গে সশস্ত্র মানুষেরা রয়েছে কিন্তু অর্জুন জানে না অমল সোমের সঙ্গে কোনও অস্ত্রও আছে কি না। সে নিজে তো নিরস্ত্র। কিন্তু অমলদা ইঙ্গিত করামাত্র সে এগিয়ে চলল। লতানো ডালপাতা সরিয়ে অমল সোম ক্ষিপ্রগতিতে এগোচ্ছিলেন। অর্জুনের মনে হল বয়স অমলদাকে একটুও কাবু করতে পারেনি। শখানেক গজ যাওয়ার পর অমল সোম দাঁড়ালেন। কান পেতে কিছু শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে বললেন, নিশ্চয়ই পায়েচলা পথ আছে, একটু খোঁজো তো! এভাবে জঙ্গল কুঁড়ে এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। পেলে জোরে শিস দেবে।

কথাটা নিজেই বলবে বলে ভাবছিল অর্জুন। ওরা এখন বেশ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। অমল সোম এবার ডান দিকে হাঁটতে শুরু করলেন, সে বাঁ দিকে। প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্ক থাকতে হচ্ছে যাতে জোঁক না ধরে। একটু বাদে পেছন ফিরে তাকিয়ে অমল সোমকে দেখতে পেল না অর্জুন। এদিকটায় বোধহয় বানরেরা নেই, শুধু পাখির ডাকের সঙ্গে ঝিঝি পাল্লা দিচ্ছে। মিনিট দশেক জঙ্গল ভেঙে কাহিল হয়ে পড়ল সে। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে চারপাশে তাকাল। হঠাৎ মনে হল চারপাশের এই সহজ সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়া আর ঠাকুরঘরের পবিত্র আবহাওয়ায় ধুমপান করা একই ব্যাপার। শহরের দূষিত পরিবেশে যে চিন্তাটা মাথায় আসে না এখানে প্রায় আদিম পরিবেশে সেটা প্রকট হওয়ায় অর্জুন প্যাকেটটা পকেটেই রেখে দিল।

কয়েক পা এগিয়ে যেতে সরসর আওয়াজ হল। একটা সাদা খরগোশ জুলজুল করে তাকে দেখছে। অর্জুন একটু ঝুঁকতেই সেটা বিদ্যুতের মতো পাশের গর্তে ঢুকে পড়ল। এগিয়ে চলল সে। এই জঙ্গলে একসময় বাঘেরা সংখ্যায় বেশি ছিল। এখনও কিছু আছে, তবে সচরাচর তাদের দেখা যায় না। কিন্তু বাইসন, বুনো শুয়োর, চিতা আর হাতির সংখ্যা প্রচুর। সে যে এভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেটাতে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু জিপে আসার সময় ডি. এফ. ও. বলেছেন সাধারণত দিনের বেলায় এই অঞ্চলে হিংস্র জন্তুদের দেখা বড় একটা পাওয়া যায় না।

হঠাৎ চোখের সামনে আট ফুট চওড়া একটা পথ ভেসে উঠল। জঙ্গল কেটে এই পথ করা হয়েছে কিন্তু অযত্নের ছাপ রয়েছে সর্বত্র। পথটা চলে গিয়েছে জঙ্গলের আরও ভেতরে। অর্জুন পথটার ওপর এসে দাঁড়াল। এবং তখন তার নজরে এল গাড়ির চাকার দাগ। সে ঝুঁকে দেখল। এই পথে প্রায়ই গাড়ি চলে, একটা দাগ রীতিমতো টাটকা। এই পথ নিশ্চয়ই হাইওয়ে থেকে বেরিয়েছে। ওরা যে পথ দিয়ে জিপে করে জঙ্গলে ঢুকেছে তার সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনও সংযোগ নেই। সামনে এগিয়ে যাওয়ার আগে এই পথ ধরে একবার পিছিয়ে গিয়ে দেখে আসতে ইচ্ছে করছিল কোথায় প্রবেশ পথ। সে জোরে শিস দিল দুবার।

মিনিট তিনেকের মধ্যে আরও কয়েকবার শিস দেওয়ার পর অমল সোমের দেখা পাওয়া গেল। রাস্তায় পা দিয়ে তিনি বললেন, বাহ। সুন্দর। আমি ভেবেছিলাম লোকগুলো এত কষ্ট করে তো রোজ যাওয়া-আসা করতে পারে না। প্রয়োজনেই মানুষ পথ করে নেয়। ওরাও নিয়েছে। ভাল, খুব ভাল।

রাস্তাটা কোথেকে বেরিয়েছে দেখা কি দরকার?

পেছনে তাকিয়ে কোনও লাভ নেই। আমাদের সঙ্গীরা ততক্ষণে এগিয়ে যাবেন। কিন্তু কথা হল যারা সমস্ত চা বাগানে জাল বিছিয়ে রেখেছে তারা এমন একটা রাস্তা কি বিনা পাহারায় রাখবে?

সন্দেহ হচ্ছিল অর্জুনেরও। কিন্তু পাহারাদাররা কাছেপিঠে থাকলে ঘন জঙ্গলের আড়াল তাদের নিশ্চিন্তে রেখেছে। হাঁটা শুরু করে অমল সোম বললেন, আমাদের ডি. এফ. ও. সাহেব নিশ্চয়ই খুব রেগে যাবেন, বুঝেছ? তাঁর জঙ্গলে বাইরের লোক গাড়ি চড়ার রাস্তা বানায় অথচ তিনি কিছুই জানেন না।

অর্জুন অমল সোমকে একবার দেখল। আজকাল অমলদা এমন করে সাধারণ কথা বলেন যে, মনেই হয় না উনি অতবড় সত্যসন্ধানী। অমলদার কী বয়স বাড়ছে? নইলে সব জেনেশুনেও তিনি সুভাষিণী বাগান থেকে চলে যেতে চাইছিলেন কেন? কথাটা সে না বলে পারল না। অমল সোম হাসলেন, এখন তো তেমন কিছু কাজ নেই। ঘিরে ধরে আটক করা। তাই চলে যেতে চেয়েছিলাম। পরে মনে হল লোকটার সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য থাকা যেতে পারে। এত জায়গা থাকতে ঠিক এখানেই যে কালাপাহাড় তার সম্পদ লুকিয়েছে এই খবরটা পেল কী করে? নিশ্চয়ই ওর ইতিহাস ভাল জানা আছে। আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখে।

হঠাৎ একটা তীব্র বাঁশির শব্দ শোনা গেল। ফুটবল ম্যাচের শেষ বাঁশির চেয়েও দীর্ঘ। তারপরেই গুলির শব্দ। খুব কাছেই। সেইসঙ্গে মানুষের আর্তনাদ। অমলদা চাপা গলায় বললেন, চটপট কোনও গাছে উঠে পড়।

হাতের কাছে যে গাছ তার সারা গায়ে এত শ্যাওলা যে, হাত দিতেও ঘেন্না হয়। সে দ্রুত রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে পড়ল। ওপাশে গুলির শব্দ এবং সেইসঙ্গে মানুষের চিৎকার চলছে। দুপদাপ পায়ের আওয়াজ ভেসে আসছে। অর্জুন আর-একটু এগোতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল জঙ্গলের আড়ালে দাঁড়িয়ে। ডি. এফ. ও. সাহেব সমেত পুরো বাহিনী, যারা তাদের সঙ্গে এ-পথে এসেছিল, তারা করুণ মুখে দাঁড়িয়ে। ওদের ঘিরে রেখেছে জনা আটেক অস্ত্রধারী। একজন বন্দিদের হাত বাঁধার কাজে ব্যস্ত। ওদের নেতা বলে যাকে মনে হচ্ছিল সে ডি. এফ. ও-কে একটার-পর-একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। ডি. এফ. ও. মাঝে-মাঝে জবাব দিচ্ছেন।

একসময় বাঁধার কাজ শেষ হয়ে গেলে বন্দিদের লাইন করিয়ে নিয়ে যাওয়া হল। অর্জুন দেখল আরও দুজন লোক পাহারায় থেকে গেল। ডি. এফ. ও. কী করে ধরা পড়লেন। ওঁর সঙ্গীরা অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগই পেল না? অর্জুন ব্যাপারটা বুঝতে পারছিল না। কিন্তু আপাতত তাদের দলগত শক্তি কমে গেল। এবার এস. পি. ওপাশ থেকে আক্রমণ করলে ওরা স্বচ্ছন্দে এদিক দিয়ে পালাতে পারবে। হঠাৎ হাত কুড়ি দূরের জঙ্গলটাকে একটু নড়তে দেখল সে। পাহারাদারদের নজর সেদিকে নেই। অর্জুন অনুমান করল সোম ওই দিক দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন। এবং এভাবে এগোনোর মানে হল ওই লোক দুটোর মুখোমুখি হওয়া।

পাহারাদারদের একজন বিড়ি ধরাবার জন্য বন্দুক দুই পায়ের মাঝখানে রেখে ঝুঁকে দাঁড়াল। দ্বিতীয়জন মুখ তুলে গাছের ডাল দেখছিল। দেখতে-দেখতে বলল, আজ রাত্রের মধ্যে কাজ শেষ হয়ে যাবে। ওরা কী করে চলে এল বল তো?

প্রথমজন বিড়ি ধরিয়ে বলল, জানি না। কিন্তু এটা আমার ভাল লাগছে। ওরা যদি কাল এই সময়ে আসত তা হলে ভাল হত। আমাদের কাউকে পেত না।

সব কটাকেই তো ধরা হয়েছে। কাল অবধি থাক বন্দি হয়ে।

সব কটাই যে ধরা পড়েছে তা কে বলতে পারে।

যাবে কোথায়? এগোতেই নজরে পড়ে যাবে।

পিছিয়ে আবার থানায় খবর দিতেও তো পারে।

তুমি ভাই বড় বেশি ভয় পাও। রোজগার করতে গেলে অত ভয় পেলে চলে না। আজকের রাতটা কাটলেই সব চুকে যাবে যেখানে সেখানে। লোকটা কথা শেষ করল না। অর্জুন এগোচ্ছিল। এবং সে চকিতের জন্য অমল সোমকে দেখতে পেল।

প্রায় একই সময়ে দুজন আক্রমণ চালাল। লোক দুটো কিছু বোঝার আগেই মাটিতে পড়ে গেল। দুজনেই অসতর্ক ছিল। ওদের উপুড় করে শুইয়ে ঘাড়ের পাশে মৃদু আঘাত করতেই চেতনা হারাল। এর পর খুব দ্রুত ওদের পোশাক ছিড়ে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে বাকিটা দিয়ে হাত এবং পা বেঁধে ফেলা হল। অমলদাকে অনুসরণ করে অর্জুন তার শিকারকে টানতে-টানতে নিয়ে গেল ঝোপের মধ্যে।

কাজ শেষ করে অমলদা জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মনে হচ্ছে ওরা রাস্তা থেকে লোক ধরে এনে হাতে বন্দুক ধরিয়ে দিয়েছে?

কী জানি। এরা তো কোনও প্রতিরোধ তৈরি করতে পারল না।

তা হলে ডি. এফ. ওর বাহিনীকে ধরল কী করে? খোঁজ নিয়ে দ্যাখো এরা নিশ্চয়ই এক্স-পুলিশম্যান। এই রাজ্যের না হলে পাশের রাজ্যের। চল।

বোঝা যাচ্ছে এতবড় জঙ্গলের সর্বত্র ছড়িয়ে রাখার মত পাহারাদার এদের নেই। অমলদা ঘড়ি দেখছিলেন। এমনিতে বেশ দেরি হয়ে গিয়েছে। এস. পির আক্রমণের সময় থেকে তাঁরা বেশ পিছিয়ে পড়েছেন। তবু অর্জুনের একটু ভাল লাগছিল। এতক্ষণ ছিল খালি হাতে, এখন লোক দুটোর অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। সবসুদ্ধ চারটে গুলি বন্দুক পিছু বরাদ্দ হয়েছিল বোধহয়। এরা ডি. এফ. ওর বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করেনি বলে বাঁচোয়া।

যে পথে বন্দিদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই পথটাই ধরেছিলেন অমলদা। প্রায় কাছাকাছি আসার পর তিনি বললেন, তুমি ডান দিকে এগোও। ওই গাছটায় উঠে বসো। আমরা এস. পি. সাহেবের জন্য অপেক্ষা করি। আমি বাঁ দিকে আছি।

সময় চলে যাচ্ছিল। অর্জুন ঘড়ি দেখল। এস. পি. সাহেবের যে সময়ে আসার কথা তার থেকে প্রায় কুড়ি মিনিট ঘড়ির কাঁটা বেশি ঘুরে গেছে। ব্যাপারটা কী ঘটেছে সে বুঝতে পারছিল না। গাছের যে ডালটায় সে বসে ছিল, তার অনেকটাই পাতায় ছাওয়া। বসতেও আরাম লাগছে। কিন্তু গত রাত্রের পরিশ্রমের পর এইরকম আরামদায়ক জায়গায় বসে থাকা অত্যন্ত ঝুঁকি নেওয়া হবে। ঘুম এগিয়ে আসছে গুড়ি মেরে। সেটা টের পেতেই অর্জুন নিজেকে সবল করার জন্য আর-এক ধাপ ওপরে উঠল। বেকায়দায় শরীর রাখলে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। এবার তার দৃষ্টি গাছের মাথা ছাড়াতে পেরেছে অনেকটাই। প্রথমেই দূরে সরু ফিতের মত জল চোখে পড়ল। চা-বাগানের গা ঘেঁষে যে নদীটা চলে গিয়েছে, যেটা পার হয়ে এই জঙ্গলে সে এসেছিল সেটা অনেক নীচে বাঁক নিয়েছে। সে চোখ সরাল। অনেকটা ন্যাড়া জায়গা, কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। পাশে দুটো গাড়ি, একটা জিপ অন্যটা অ্যাম্বাসাডার। অর্জুন খুব উত্তেজিত হয়ে পড়ল। এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে জিপ আর অ্যাম্বাসাডার মানে ওটাই শত্রু শিবির। জায়গাটা মোটেই দূরে নয়। মানুষগুলোকে এখান থেকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে না। অমল সোম যেদিকে আছেন সেখান থেকে এই দৃশ্য দেখা সম্ভব নয়। অর্জুনের ইচ্ছে হল গাছ থেকে নেমে অমল সোমকে ডেকে এনে দৃশ্যটা দেখায়। সে আর-একটু নজর সরাতেই চোখ ছোট হয়ে এল। ওটা কী? মন্দির-মন্দির মনে হচ্ছে। গাছের আড়ালে কি মন্দিরের চূড়ো? আবছা হলেও খানিকক্ষণ লক্ষ করার পর আর সন্দেহ রইল না। শ্যাওলা পড়ে-পড়ে প্রায় কালচে হয়ে গিয়েছে মন্দিরের চুড়ো। না, আর সন্দেহের অবকাশ নেই। দুর্ভেদ্য জঙ্গল, বিশাল বিল, শিব মন্দির। তাজ্জব ব্যাপার হল আজ দেশের সবরকমের জঙ্গল বনবিভাগের নখদর্পণে। বনবিভাগ নিশ্চয়ই জানে কোথায় কী আছে। এই মন্দিরের অস্তিত্ব তাঁদের অবশ্যই জানা আছে। কিন্তু ডি. এফ. ওর সঙ্গে আলোচনার সময় বোঝা গিয়েছিল ব্যাপারটা তিনি জানেন না। হয়ত বেশিদিন এ-জেলায় আসেননি অথবা জঙ্গলের কোনও প্রান্তে একটা ইটের চুড়ো আছে কি নেই তা তাঁকে জানানোর প্রয়োজন অধস্তন কর্মচারীরা মনে করেনি। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল এই মন্দির খুঁজে বের করা। হরিপদ যে অনুমান করেছিলেন কালাপাহাড় তাঁর সম্পদ উত্তর বাংলায় লুকিয়ে রেখে গেছেন। কোচবিহারের রাজার সঙ্গে যুদ্ধের পর সেটা সম্ভব বলে মনেই হতে পারে। কিন্তু উত্তর বাংলা মানে কয়েকশো মাইল জুড়ে জঙ্গল আর মন্দিরের পর মন্দির। ধীরে-ধীরে অর্জুন নীচে নেমে এল। এবং তখনই পায়ের আওয়াজ কানে এল। কেউ পাতা মাড়িয়ে আসছে। যদিও এখন সে সশস্ত্র তবু মুখোমুখি হওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। যতটা সম্ভব নিজেকে গাছের আড়ালে রেখে সে শুনল শব্দটা খুব কাছ দিয়েই তাকে পেরিয়ে চলে যাচ্ছে। অর্থাৎ যে লোকটি চলেছে সে খুব নিশ্চিন্ত, কিছু খোঁজার তাগিদ তার নেই। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল অর্জুন। খানিকটা দূরত্ব রেখে সে অনুসরণ শুরু করল, শব্দটির সঙ্গে পা মিলিয়ে।

মিনিটখানেক হাঁটাব পরেই লোকটাকে দেখা গেল। কাঁধে একটা লাঠি নিয়ে খোশ মেজাজে হেঁটে চলেছে। একে পেছন থেকে যতটুকু বোঝা যাচ্ছে মোটই অন্য বন্দুকধারীদের মতো মনে হল না। বরং চেহারায় এ-দেশীয় মানুষের ছাপ স্পষ্ট।

লোকটা হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। এপাশ-ওপাশে তাকাল। তারপর নিচু হয়ে এগিয়ে চলল। ওর এগোবার ভঙ্গিতে যথেষ্ট সতর্ক ভাব ফুটে উঠেছে এবার। আর তখনই গুলির শব্দ শুরু হয়ে গেল। শব্দ ভেসে আসছে নদীর দিক থেকে। পোর্টেবল লাউড স্পিকারে এস. পির গলা অস্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। প্রতিপক্ষকে আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দিচ্ছেন তিনি। এদিক থেকে গুলি ছোঁড়া এখনও শুরু হয়নি।

 

অর্জুন দেখল গুড়ি মেরে এগিয়ে যেতে-যেতে এইসব শব্দ কানে যাওয়া মাত্র হকচকিয়ে গিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। দুপাশে আগাছার ঝোপ থাকায় তাকে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু সে যে আর নড়ছে না এটাও ঠিক। অর্জুনের মনে হল লোকটা এই দলের কেউ নয়। অথচ বাইরের লোক জঙ্গলের এত গভীরে স্বচ্ছন্দে হেঁটে আসেই বা কী করে? নিশ্চয়ই এটা ওর প্রথম আসা নয়। অন্যদিন যখন এসেছে তখন বাধা পায়নি কেন? গোলমাল লাগছে এখানেই।

হঠাৎ অর্জুন ভূত দেখল যেন। নাকি অর্জুনকে ভূত বলে মনে হল লোকটার। যে পথে এসেছিল সেই পথে ফিরে যাওয়ার জন্য এগিয়ে আসতেই সে দেখল একজন মানুষ বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে। এক মুহূর্ত দেরি না করে সে হাঁটু মুড়ে বসে কাকুতি-মিনতি শুরু করে দিল। তার গলায় দিশি ভাষা। সে কিছু জানে না। তাকে ছেড়ে দিলে সে সোজা নিজের ঘরে ফিরে যাবে।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

মাংরা।

এখানে কী করতে এসেছ? লোকটা চুপ করে রইল। এবার ওদিকে প্রত্যাঘাত শুরু হয়েছে। গুলিগোলার শব্দ খুব কাছেই এগিয়ে এসেছে। এই শব্দে লোকটা কুঁকড়ে যাচ্ছিল। অর্জুন হাতের বন্দুক ছেড়ে হুকুম করল, তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে চল।

নেহি নেহি। আমাকে ছেড়ে দাও। লোকটা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গিয়েছে।

তুমি যদি আমার কথা শোন তা হলে বেঁচে যাবে। নইলে–। চল।

লোকটা সম্ভবত তার মতে, করে পরিস্থিতিটা বুঝল। নিতান্ত অনিচ্ছায় সে হাঁটা শুরু করল গুড়ি মেরে। অর্জুন বুঝতে পারছিল না এতটা পথ সহজভাবে এসে ও এখান থেকে গুড়ি মারা শুরু করেছিল কেন? ও কি বুঝতে পেরেছিল কেউ অনুসরণ করছে। সঙ্গে সঙ্গে চলার ধরন বদলেছিল? এটা ঠিক হলে…।

অর্জুন দেখল একটা বড় পাথর দুহাতে সরাচ্ছে লোকটা। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর সেটা সরতেই বেশ বড় সুড়ঙ্গ স্পষ্ট নজরে এল।

Category: কালাপাহাড় (অর্জুন সিরিজ) (১৯৯২)
পূর্ববর্তী:
« ১৩. সুভাষিণী চা-বাগানে
পরবর্তী:
১৫. সুড়ঙ্গের সামনে দাঁড়িয়ে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑