• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

২১. ন্যায়রত্নের প্রচণ্ডতম আঘাত

লাইব্রেরি » তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় » পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪) » ২১. ন্যায়রত্নের প্রচণ্ডতম আঘাত

জীবনে এইটাই বোধহয় ন্যায়রত্নের প্রচণ্ডতম আঘাত।

প্রৌঢ়ত্বের প্রথম অধ্যায়ে পুত্রের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ার ফলে তিনি এক প্রচণ্ডতম আঘাত পাইয়াছিলেন। পুত্র শশিশেখর আত্মহত্যা করিয়াছিল। চলন্ত ট্রেনের সামনে সে ঝাঁপ দিয়া পড়িয়ছিল। অবশেষে মিলিয়াছিল শুধু একতাল মাংসপিণ্ড। ন্যায়রত্ন স্থির অকম্পিতভাবে দাঁড়াইয়া সেই দৃশ্য-পুত্রের সেই দেহাবশেষ মাংসপিণ্ড দেখিয়াছিলেন; সযত্নে ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত অস্থি-মাংস-মেদ-মজ্জা একত্রিত করিয়া, তাহার সৎকার করিয়াছিলেন। পৌত্র বিশ্বনাথ তখন শিশু। পুত্রবধূকে দিয়া তিনি শ্রাদ্ধক্রিয়া সম্পন্ন করিয়াছিলেন। বাহিরে তাহার একবিন্দু চাঞ্চল্য কেহ দেখে নাই। আজ কিন্তু ন্যায়রত্ন থরথর করিয়া কাঁপিয়া ময়ূরাক্ষীগর্ভের উত্তপ্ত বালির উপর বসিয়া পড়িলেন। বিশ্বনাথের অনেক বিদ্রোহ সহ্য করিয়াছেন। সে যে সম্পূর্ণরূপে তাহার জীবনাদর্শের এবং পুণ্যময় কুলধর্মের বিপরীত মত পোষণ করে এবং সে-সবকে সে অস্বীকার করে—তাহা তিনি পূর্ব হইতেন জানেন। বহুবার পৌত্রের সঙ্গে তাহার তর্ক হইয়াছে। তর্কের মধ্যে পৌত্রের মৌখিক বিদ্রোহকে তিনি সহ্য করিয়াছেন। মনে মনে নিজেকে নির্লিপ্ত দ্রষ্টার আসনে বসাইয়া, বিশ্বসংসারের সমস্ত কিছুকে মহাকালের দুৰ্জ্জেয় লীলা ভাবিয়া সমস্ত কিছু হইতে লীলা-দর্শনের আনন্দ-আস্বাদনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু আজ পৌত্রের মৌখিক মতবাদকে বাস্তবে প্রত্যক্ষ করিয়া তর্কের বিদ্ৰোহকে কর্মে পরিণত হইতে দেখিয়া, মুহূর্তে তাহার মনোজগতে একটা বিপর্যয় ঘটিয়া গেল। আজ ধর্মদ্রোহী, আচারভ্রষ্ট পৌত্রকে দেখিয়া, তীব্রতম করুণ ও রৌদ্র রসে বিচলিত অভিভূত হইয়া, আপনার অজ্ঞাতসারে কখন দৰ্শকের নির্লিপ্ততায় আসনচ্যুত হইয়া ন্যায়রত্ন অভিনয়ের রঙ্গমঞ্চে নামিয়া পড়িয়া নিজেই সেই মহাকালের লীলার ক্রীড়নক হইয়া পড়িলেন।

কয়েক দিন হইতে তিনি বিশ্বনাথকে প্রত্যাশা করিতেছিলেন। জয়াকে সে একটা পোস্টকার্ডে চিঠিতে লিখিয়াছিল—সে এবং আরও কয়েকজন ওদিকে যাইবে। ন্যায়রত্ন। লিখিয়াছিলেন—তোমরা কতজন আসিবে লিখিবে। কাহারও কোনো বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কিনা তাহাও জানাইবে। সে পত্রের উত্তর বিশ্বনাথ তাহাকে দেয় নাই। গতকাল সন্ধ্যার সময় দেবু তাঁহাকে সংবাদ পাঠাইয়াছিল যে রাত্রি দেড়টার গাড়িতে বিশু-ভাই কলিকাতার কয়েকজন কর্মী বন্ধুকে লইয়া জংশনে নামিবে। কিন্তু সে লিখিয়াছে, তাহারা জংশনের ডাকবাংলোতেই থাকিবার ব্যবস্থা করিবে।

ন্যায়রত্ন মনে মনে ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন। রাত্রিতে বাড়িতে আসিলে কি অসুবিধা হইত? বাড়িতে আজিও রাত্রে দুইজন অতিথির মত খাদ্য রাখিবার নিয়ম আছে। অতিথি না আসিলে, সকালে সে খাদ্য দরিদ্রকে ডাকিয়া দেওয়া হয়। প্রতিদিন সকালে দরিদ্ররা আসিয়া এ-বাড়ির দুয়ারে দাঁড়াইয়া থাকে। বাসি হইলেও উপাদেয় উপকরণময় খাদ্য উচ্ছিষ্ট নয়; এই খাদ্যটির জন্য এ গ্রামের সকলেই লোলুপ হইয়া থাকে। জয়া এখন পালা নির্দিষ্ট করিয়া দিয়াছে। সেই গৃহে বিশ্বনাথ রাত্রিতে অতিথি লইয়া আসিতে দ্বিধা করিল। বন্ধুরা হয়ত সম্ভ্ৰান্ত ব্যক্তি, বিশ্বনাথ হয়ত ভাবিয়াছে তাহাদের যথোপযুক্ত মর্যাদা এ গৃহের প্রাচীনধর্মী গৃহস্বামী দিতে পারিবেন না।

জয়া কিন্তু ব্যাপারটাকে অত্যন্ত সহজ সরল করিয়া দিয়াছিল। বিশ্বনাথের প্রতি তাহার কোনো সন্দেহ জন্মিবার কারণ আজও ঘটে নাই। পিতামহের সঙ্গে বিশ্বনাথ তর্ক করে, সে তর্কের বিশেষ কিছু সে বুঝিত না; তর্কের সময় সে শঙ্কিত হইত, আবার তর্কের অবসানে পিতামহ এবং পৌত্রের স্বাভাবিক ব্যবহার দেখিয়া স্বস্তির নিশ্বাস ফেলিয়া বাঁচিত। কখনও স্বামীকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করিলে বিশ্বনাথ হাসিয়া কথাটাকে উড়াইয়া দিত। বলিত ওসব হল। পণ্ডিতি কচকচি আমাদের! শাস্ত্রে বলেছে—অজা-যুদ্ধ আর ঋষি-শ্ৰাদ্ধ আড়ম্বরে ও গুরুত্বে এক রকমের ব্যাপার। প্রথমটা খুব হইহই তর্কাতর্কি—দেখেছ তো বিচার-সভা—এই মারে তো এই মারে কাণ্ড! তারপর সভা শেষ হল—বিদেয় নিয়ে সব হাসতে হাসতে যে যার বাড়ি চলে গেল। আমাদেরও তাই আর কি! সভা শেষ হল এইবার বিদেয় কর দিকি। তুমিই তো গৃহস্থামিনী! বলিয়া সে সাদরে স্ত্রীকে কাছে টানিয়া লইত। জয়া ব্ৰাহ্মণ পণ্ডিত-ঘরের মেয়ে, আক্ষরিক লেখাপড়া তেমন না করিলেও অজা-যুদ্ধ, ঋষি-শ্ৰাদ্ধ উপমা সমন্বিত বিশ্বনাথের যুক্তি রসসমেত উপভোগ করিত, এবং তর্কের মূল তত্ত্বের কিছু গন্ধও যেন পাইত।

জয়া কতবার জিজ্ঞাসা করিয়াছে—তুমি কি করতে চাও বল দেখি?

–মানে?

–মানে দাদুর সঙ্গে তর্ক করছ, বলছ–ঈশ্বর নাই—জাত মানি না! ছি, ওই আবার বলে নাকি এত বড় লোকের নাতি হয়ে?

–বলে না বুঝি?

–না। বলতে নাই।

স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া বিশ্বনাথ হাসিত। অল্প বয়সে তাহার বিবাহ দিয়াছিলেন ন্যায়রত্ব। বিশ্বনাথের মা—ন্যায়রত্বের পুত্রবধূ বহুদিন পূর্বেই মারা গিয়াছেন। ন্যায়রত্নের স্ত্রীবিশ্বনাথের পিতামহী মারা যাইতেই জয়া ঘরের গৃহিণী-পদ-গ্রহণ করিয়াছে। তখন তাহার বয়স ছিল সবে ষোল। বিশ্বনাথ সেবারেই ম্যাট্রিক পাস করিয়া কলেজে ভর্তি হইয়াছিল। তখন সে-ও ছিল পিতামহের প্রভাবে প্রভাবান্বিত। হোস্টেলে থাকিত; সন্ধ্যা-আহ্নিক করিত নিয়মিত। তখন তাহার নিকট কেহ নাস্তিকতার কথা বলিলে—সে শিশু কেউটের মত ফণা তুলিয়া তাহাকে আক্ৰমণ করিত। এমনও হইয়াছে যে, তর্কে হারিয়া সে সমস্ত রাত্রি কাঁদিয়াছে। তাহার পর কিন্তু ধীরে ধীরে বিরাট মহানগরীর রূপ-রসের মধ্যে এবং দেশ-দেশান্তরের রাজনৈতিক ইতিহাসের মধ্যে সে এক অভিনব উপলব্ধি লাভ করিতে আরম্ভ করিল। যখন তাহার এ পরিবর্তন সম্পূর্ণ হইল, তখন জয়ার দিকে চাহিয়া দেখিল—সে-ও জীবনে একটা পরিণতি লাভ করিয়াছে। তাহার কিশোর মন উত্তপ্ত তরল ধাতুর মত ন্যায়রত্নের ঘরের গৃহিণীর ছাচে পড়িয়া সেই রূপেই গড়িয়া উঠিয়াছে; শুধু তাই নয়—তাহার কৈশোরের উত্তাপও শীতল হইয়া আসিয়াছে। ছাঁচের মূর্তির উপাদান কঠিন হইয়া গিয়াছে; আর সে ছাঁচ হইতে গলাইয়া অন্য ছাচে ঢালিবার উপায় নাই। ভাঙিয়া গড়িতে গেলে এখন ছাঁচটা ভাঙিতে হইবে। ন্যায়রত্বের সঙ্গে জয় জড়াইয়া গিয়াছে। অবিচ্ছেদ্যভাবে। জয়াকে ভাঙিয়া গড়িতে গেলে তাহার দাদুকে আগে ভাঙিতে হইবে। তাই বিশ্বনাথ স্ত্রীর সঙ্গে ছলনা করিয়া দিনগুলি কাটাইয়া আসিয়াছে।

স্বামীর হাসি দেখিয়া জয়া তাহাকে তিরস্কার করিত। তাহাতেও বিশ্বনাথ হাসিত। এ হাসিতে জয়া পাইত আশ্বাস। এ হাসিকে স্বামীর আনুগত্য ভাবিয়া, সে পাকা গৃহিণীর মত আপন মনেই বকিয়া যাইত।

আজ জয়া দাদুকে বলিল—আপনি বড় উতলা মানুষ দাদু! রাত্রে নেমে জংশনে ডাকবাংলোয়। থাকবে শুনে অবধি আপনি পায়চারি করছেন। থাকবে তো হয়েছে কি?

ন্যায়রত্ন ম্লান হাসি হাসিয়া নীরবে জয়ার দিকে চাহিলেন। সে হাসির অর্থ পরিষ্কারভাবে না বুঝিলেও অ্যাঁচটা জয়া বুঝিল। সে-ও হাসিয়া বলিল—আপনি আমাকে যত বোকা ভাবেন দাদু, তত বোকা আমি নই। তারা সব জংশনে নামবে রাত্রে দেড়টা-দুটোয়। তারপর জংশন থেকে রেলের পুল দিয়ে নদী পার হয়ে—কঙ্কণা, কুসুমপুর, শিবকালীপুর—তিনখানা গ্রাম পেরিয়ে আসতে হবে। তার চেয়ে রাতটা ডাকবাংলোয় থাকবে, ঘুমিয়েটুমিয়ে সকালবেলা দিব্যি খেয়াঘাটে নদী পার হয়ে সোজা চলে আসছে বাড়ি।

ন্যায়রত্নকেও কথার যুক্তিটা মানিতে হইল। জয়া অযৌক্তিক কিছু বলে নাই। তা ছাড়া ন্যায়রত্বের আজ জয়ার বলটাই সকলের চেয়ে বড় বল। তাহার সঙ্গে প্রচণ্ড তর্ক করিয়া বিশ্বনাথ। যখন ন্যায়রত্ন-বংশের কুলধৰ্মপরায়ণা জয়ার আঁচল ধরিয়া হাসিমুখে বেড়াইত তখন তিনি মনে মনে হাসিতেন। মহাযোগী মহেশ্বর উন্মত্তের মত ছুটিয়াছিলেন মোহিনীর পশ্চাতে। বৈরাগীশ্ৰেষ্ঠ তপস্বী শিব উমার তপস্যায় ফিরিয়াছিলেন কৈলাসভবনে। তাঁহার জয়া যে একাধারে দুই, রূপে। সে মোহিনী, বিশ্বনাথের সেবায় তপস্যায় সে উমা। জয়াই তাহার ভরসা। জয়ার কথায় আবার তিনি তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিলেন—সেখানে এক বিন্দু উদ্বেগের চিহ্ন নাই। ন্যায়রত্ন এবার আশ্বাস পাইলেন। জয়ার যুক্তিটাকে বিচার করিয়া মানিয়া লইলেন–জয়া ঠিকই বলিয়াছে।

রাত্রিতে বিছানায় শুইয়া আবার তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। জয়ার যুক্তি সহজ সরল কোথাও এতটুকু অবিশ্বাসের অবকাশ নাই; কিন্তু বিশ্বনাথ সংবাদটা তাহাকে না দিয়া দেবুকে। দিল কেন? বিশ্বনাথ আজকাল জয়াকে পোস্টকার্ডে চিঠি লেখে কেন? তাহাদের দুইজনের সম্বন্ধের রঙ কি তাহার ওই চিঠির ভাষার মত ফিকে হইয়া আসিয়াছে? লৌকিক মূল্য ছাড়া অন্য মূল্যের দাবি হারাইয়াছে?মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠিল। তিনি বাহিরে আসিলেন।

–কে? দাদু?—জয়ার কণ্ঠস্বর শুনিয়া ন্যায়রত্ন চমকিয়া উঠিলেন। লক্ষ্য করিলেন–জয়ার ঘরের জানালার কপাটের ফাঁকে প্রদীপ্ত আলোর ছটা জাগিয়া রহিয়াছে। ন্যায়রত্ন বলিলেন, আমি। কিন্তু তুমি এখনও জেগে?

জয়া দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিল। হাসিয়া বলিল—আপনার বুঝি ঘুম আসছে না? এখনও সেই সব উদ্ভট ভাবনা ভাবছেন?

ন্যায়রত্ব আপনাকে সংযত করিয়া হাসিয়া বলিলেন—আসন্ন মিলনের পূর্বক্ষণে সকলেই অনিদ্রা রোগে ভোগে, রাজ্ঞি। শকুন্তলা যেদিন স্বামিগৃহে যাত্রা করেছিলেন, তার পূর্বরাত্রে তিনিও ঘুমোন নি

জয়া হাসিয়া বলিল-আমি গোবিন্দজীর জন্যে চাদর তৈরি করছিলাম।

গোবিন্দজীর জন্যে চাদর তৈরি করছিলে? আমার গোবিন্দজীকেও তুমি এবার কেড়ে নেবে। দেখছি। তোমার চারু মুখ আর সুচারু সেবায়—তোমার প্রেমে না পড়ে যান আমার গোবিন্দজী!

জয়া নীরবে শুধু হাসিল।

–চল, দেখি—কি চাদর তৈরি করছ?

চমৎকার একফালি গরদ। গরদের ফলিটির চারিপাশে সোনালি পাড় বসাইয়া চাদর তৈয়ারি হইতেছে। ন্যায়রত্ন বলিলেন—বাঃ, চমৎকার সুন্দর হয়েছে ভাই।

হাসিয়া জয়া বলিল—আপনার নাতি এনেছিল রুমাল তৈরি করবার জন্যে। আমি বললাম, রুমাল নয়—এতে গোবিন্দজীর চাদর হবে। জরি এনে দিয়ে। আর খানিকটা নীল রঙের খুব পাতলা ফিনফিনে বেনারসী সিল্কের টুকরো। রাধারানীর ওড়না করে দেব। গোবিন্দজীর চাদর হল—এইবার রাধারানীর ওড়না করব।

ন্যায়রত্নের সমস্ত অন্তর আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তাহার ভাগ্যে যাই থাক–জয়ার কখনও অকল্যাণ হইতে পারে না, কখনও না।

ভোরবেলায় উঠিয়াই কিন্তু ন্যায়রত্ন আবার চঞ্চল হইয়া উঠিলেন। প্রত্যাশা করিয়াছিলেন বিশ্বনাথের ডাকেই তাহার ঘুম ভাঙিবে। সে আসিয়া এখান হইতে তাহার বন্ধুদের জন্যে গাড়ি পাঠাইবে। প্রাতঃকৃত্য শেষ করিয়া তিনি আসিয়া সঁড়াইলেন-টোল-বাড়ির সীমানার শেষপ্রান্তে। ওখান হইতে গ্রাম্য পথটা অনেকখানি দূর অবধি দেখা যায়।

কাহার বাড়িতে কান্নার রোল উঠিতেছে। ন্যায়রত্ন একটা দীৰ্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। অকালমৃত্যুতে দেশ ছাইয়া গেল। আহা, আবার কে সন্তানহারা হইল বোঁ হয়।

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া ন্যায়রত্ন ফিরিয়া চাদরখানি টানিয়া লইয়া পথে নামিলেন। আসিয়া দাঁড়াইলেন গ্রামের প্রান্তে। পূর্বদিগন্তে জবাকুসুম-সঙ্কাশ স তার উদয় হইয়াছে। চারিদিক সোনার বর্ণ আলোয় ভরিয়া উঠিয়াছে। দিগদিগন্ত স্পষ্ট পরিার। পঞ্চগ্রামের বিস্তীর্ণ শস্যহীন মাঠখানার এখানে-ওখানে জমিয়া-থাকা-জলের বুকে আলোকচ্ছটায় প্রতিবিম্ব ফুটিয়াছে। ময়ূরাক্ষীর বাঁধের উপরে শরবন বাতাসে কাঁপিতেছে। ওই শিবকালীপুর। এদিকে দক্ষিণে বাঁধের প্রান্ত হইতে আলপথ। কেহ কোথাও নাই। বহুদূরে—সম্ভবত শিবকালীপুরের পশ্চিম প্রান্তে সবুজ খানিকটা মাঠের মধ্যে কালো কালো কয়েকটা কাঠির মত কি নড়িতেছে! চাষের ক্ষেতে চাষীরা বোধ হয় কাজ করিতেছে। ন্যায়রত্ন ধীরে ধীরে আল-পথ ধরিয়া অগ্রসর হইলেন। উদ্বেগের মধ্যে তিনি মনে মনে বার বার পৌত্রকে আশীর্বাদ করিলেন। মানুষের এই দারুণ দুঃসময় মুখের অন্ন বন্যায় ভাসিয়া গেল, মানুষ আজ গৃহহীন, ঘরে ঘরে ব্যাধি, আকাশেবাতাসে শোকের রোল—এই দারুণ দুঃসময়ে বিশ্বনাথ যাহা করিয়াছে করিতেছে, সে বোধ। করি মহাযজ্ঞের সমান পুণ্যকৰ্ম। পূর্বকালে ঋষিরা এমন বিপদে যজ্ঞ করিয়া দেবতার আশীর্বাদ আনিতেন মানুষের কল্যাণের জন্য। বিশ্বনাথও সেই কল্যাণ আনিবার সাধনা করিতেছে। মনে মনে তিনি বার বার পৌত্রকে আশীর্বাদ করিলেনধর্মে তোমার মতি হোক ধর্মকে তুমি জান, তুমি দীর্ঘায়ু হও–বংশ আমাদের উজ্জ্বল হোক!

মাথার উপর শনশন শব্দ শুনিয়া ন্যায়রত্ন ঈষৎ চকিত হইয়া আকাশের দিকে চাহিলেন। তাহার মন শিহরিয়া উঠিল। গোবিন্দ গোবিন্দ! মাথার উপর পাক দিয়া উড়িতেছে একঝাক শকুন। আকাশ হইতে নামিতেছে। ময়ূরাক্ষীর বাঁধের ওপাশে বালুচরের উপর শ্মশান, সেইখানে। ন্যায়রত্ন আবার শিহরিয়া উঠিলেন-মানুষ আর শব-সৎকার করিয়া কুলাইয়া উঠিতে পারিতেছে না। শ্মশানে গোটা দেহটা ফেলিয়া দিয়া গিয়াছে।

বাঁধের ওপারে বালুচরের উপর নামিয়া দেখিলেন শ্মশান নয়—ভাগাড়ে নামিতেছে। শকুনের দল। তিনটা গরুর মৃতদেহ পড়িয়া আছে। একটি তরুণ-বয়সী দুগ্ধবতী গাভী। পঞ্চগ্রামের গরিব গৃহস্থেরা সর্বস্বান্ত হইয়া গেল। সবাই হয়ত ধ্বংস হইয়া যাইবে। থাকিবে শুধু দালান-কোঠার অধিবাসীরা।…

–ঠাকুর মশায়, এত বিয়ান বেলায় কুথা যাবেন?

অন্যমনস্ক ন্যায়রত্ন মুখ তুলিয়া সম্মুখে চাহিয়া দেখেন খেয়া নৌকার পাটনি শশী ভল্লা হালির উপর মাথা ঠেকাইয়া সসম্ভ্ৰমে প্ৰণাম করিতেছে।

–কল্যাণ হোক। একবার ওপারে যাব।

শশী নৌকাখানাকে টানিয়া একেবারে কিনারায় ভিড়াইল।

ময়ূরাক্ষীর নিকটেই ডাকবাংলো।

ন্যায়রত্ন তীরে উঠিয়া মনে মনে বিশ্বনাথকে আশীর্বাদ করিলেন।

তাহার বন্ধুদের কল্পনা করিলেন। মনে তাঁহার জাগিয়া উঠিল শিবকালীপুরের তরুণ নজরবন্দিটির ছবি। প্রত্যাশা করিলেন-হয়ত সেই যতীন বাবুটিকেও দেখিতে পাইবেন।

ডাকবাংলোর ফটকে ঢুকিয়া তিনি শুনিলেন—উচ্ছ্বসিত হাসির কলরোল। হৃদয়ের উচ্ছ্বসিত হাসি। এ হাসি যাহারা হাসিতে না পারে তাহারা কি এই দেশব্যাপী শোকার্ত ধ্বনি মুছিতে পারে! হ্যাঁ—উপযুক্ত শক্তিশালী প্রাণের হাসি বটে।

ন্যায়রত্ন ডাকবাংলোর বারান্দায় উঠিলেন। সম্মুখের দরজা বন্ধ, কিন্তু জানালা দিয়া সব দেখা যাইতেছে। একখানা টেবিলের চারিধারে সঁচ-ছয়জন তরুণ বসিয়া আছে, মাঝখানে একখানা চীনামাটির রেকাবির উপর বিস্কুট-জাতীয় খাবার। একটি তরুণী চায়ের পাত্র হাতে দাঁড়াইয়া আছে; ভঙ্গি দেখিয়া বোঝা যায়—সে চলিয়া যাইতেছিল, কিন্তু কেহ একজন তাহার হাত ধরিয়া আটকাইয়া রাখিয়াছে। যে ধরিয়াছিল—সে পিছন ফিরিয়া বসিয়া থাকিলেও ন্যায়রত্ন চমকিয়া উঠিলেন। ও কে? বিশ্বনাথ?–হ্যাঁ বিশ্বনাথই তো।

মেয়েটি বলিল ছাড়ুন। দেখুন, বাইরে কে একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। তাহার হাত ছাড়িয়া দিয়া মুখ ফিরাইল বিশ্বনাথ।

–দাদু, এখানে আপনি বিশ্বনাথ উঠিয়া পড়িল—তাহার এক হাতে আধ-খাওয়া ন্যায়রত্নের অপরিচিত খাদ্যখণ্ড। পরমুহূর্তেই সে বন্ধুদের দিকে ফিরিয়া বলিল—আমার দাদু!… মেয়েটি পাশের ঘরে চলিয়া গেল।

তাহারা সকলেই সসম্ভ্ৰমে চেয়ার ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। ঘরের মধ্যে দেবুও কোনোখানে ছিল। সে দরজা খুলিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল—ঠাকুর মশায়, বিশু-ভাই চা খেয়েই আসছে। চলুন, আমরা ততক্ষণ রওনা হই।

ন্যায়রত্ন দেবুর মুখের দিকে একবার চাহিয়া, তাহাকে অতিক্ৰম করিয়া ঘরে ঢুকিলেন। সবিস্ময়ে চাহিয়া রহিলেন, বিশ্বনাথের বন্ধুদের দিকে। পাঁচজনের মধ্যে দুইজনের অঙ্গে বিজাতীয় পোশক। বিশ্বনাথের বন্ধুরা সকলেই তাহাকে নমস্কার করিল।

বিশ্বনাথ বলিল-আমার বন্ধু এঁরা। আমরা সব একসঙ্গে কাজ করে থাকি, দাদু!

ন্যায়রত্ন বলিলেন—তোমার বন্ধু ছাড়া ওঁদের একটা করে বিশেষ পরিচয় আছে আসল, ভাই! সেই পরিচয়টা দাও। কাকে কি বলে ডাকব?

বিশ্বনাথ পরিচয় দিল—ইনি প্রিয়ব্ৰত সেন, ইনি অমর বসু, ইনি পিটার পরিমল রায়–

–পিটার পরিমল!

–হ্যাঁ, উনি ক্রিশ্চান।

ন্যায়রত্ন স্তব্ধ হইয়া রহিলেন। শুধু একবার চকিতের দৃষ্টি তুলিয়া চাহিলেন পৌত্রের দিকে।

—আর ইনি–আবদুল হামিদ।

ন্যায়রত্বের দৃষ্টি ঈষৎ বিস্ফারিত হইয়া উঠিল।

–আর ইনি জীবন বীরবংশী।

বীরবংশী অর্থাৎ ডোম। ন্যায়রত্ন এবার চাহিলেন টেবিলের দিকে; একখানি মাত্র চীনামাটির প্লেটে খাবার সাজানো রহিয়াছে—এবং সে খাবার খরচও হইয়াছে। চায়ের কাপগুলি সবই টেবিলের উপর নামানো। সেই মুহূর্তেই সেই মেয়েটি ওঘর হইতে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহার হাতে ধোঁয়া জামা ও গেঞ্জি।

—আর ইনিও আমাদের সহকর্মী দাদু অরুণা সেন, প্রিয়ব্রতের বোন।

মেয়েটি হাসিয়া ন্যায়রত্নকে প্রণাম করিল, বলিল আপনি বিশ্বনাথবাবুর দাদু!

ন্যায়রত্ন শুধু বলিলেন থাক, হয়েছে! অস্ফুট মৃদু কণ্ঠস্বর যেন জড়াইয়া যাইতেছিল।

মেয়েটি জামা ও গেঞ্জি বিশ্বনাথকে দিয়া বুলিলনিন, জামা-গেঞ্জি পাল্টে ফেলুন দিকি! সকলের হয়ে গেছে। চলুন, বেরুতে হবে।

হামিদ একখানা চেয়ার আগাইয়া দিল, বলিল—আপনি বসুন।

ন্যায়রত্নের সংযম যেন ফুরাইয়া যাইতেছে। সুখ-দুঃখ, এমনকি দৈহিক কষ্ট সহ্য করিয়া, তাহার মধ্য হইতে যেন রসোপলব্ধি-শক্তি তাহার বোধহয় নিঃশেষিত হইয়া আসিতেছে। স্নায়ুশিরার মধ্য দিয়া একটা কম্পনের আবেগ বহিতে শুরু করিয়াছে; মস্তিষ্কমন আচ্ছন্ন হইয়া আসিতেছে সে আবেগে। তবু হামিদের মুখের দিকে চাহিয়া ক্ষীণ হাসি হাসিয়া তিনি বসিলেন।

বিশ্বনাথ জামা ও গেঞ্জি খুলিয়া ফেলিয়া, পরিষ্কার জামা-গেঞ্জি পরিতে লাগিল। ন্যায়রত্ন বিশ্বনাথের অনাবৃত দেহের দিকে চাহিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেলেন। বিশ্বনাথের দেহ যেন বালবিধবার নিরাভরণ হাত দুখানির মত দীপ্তি হারাইয়া ফেলিয়াছে। তাহার গৌর দেহবৰ্ণ পর্যন্ত অনুজ্জ্বল; শুধু অনুজ্জ্বল নয়, একটা দৃষ্টিকটু রূঢ়তায় লাবণ্যহীন। ওঃ তাই তো! উপবীত? বিশ্বনাথের গৌরবর্ণ দেহখানিকে তির্যক বেষ্টনে বেড়িয়া শুচি-শুভ্র উপবীতের যে মহিমা—যে শোভা ঝলমল করত, সেই শোভার অভাবে এমন মনে হইতেছে। ন্যায়রত্নের দেহের কম্পন এবার স্পষ্ট পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। তিনি আপনার হাতখানা বাড়াইয়া দিয়া ডাকিলেন পণ্ডিত। দেবু পণ্ডিত রয়েছ?

দেবু আশঙ্কায় স্তব্ধ হইয়া দূরে দাঁড়াইয়া ছিল। সে তাড়াতাড়ি অগ্রসর হইয়া আসিয়া বলিল-আজ্ঞে?

—আমার শরীরটা যেন অসুস্থ হয়েছে মনে হচ্ছে। আমায় তুমি বাড়ি পৌঁছে দিতে পার?

সকলেই ব্যস্ত হইয়া উঠিল। অরুণা মেয়েটি কাছে আসিয়া বলিল—বিছানা করে দেব, শোবেন একটু?

–না।

বিশ্বনাথ অগ্রসর হইয়া আসিল, ডাকিল–দাদু!

নিষ্ঠুর যন্ত্ৰণাকার স্থানে স্পর্শোদ্যত মানুষকে যে চকিত ভঙ্গিতে যন্ত্রণায় রুদ্ধবা রোগী হাত তুলিয়া ইঙ্গিতে নিষেধ করে, তেমনি চকিতভাবে ন্যায়রত্ন বিশ্বনাথের দিকে হাত তুলিলেন।

অরুণা ব্যস্ত উদ্বিগ্ন হইয়া প্রশ্ন করিল—কি হল?

অন্য সকলেও গভীর উদ্বেগের সহিত তাঁহার দিকে চাহিয়া রহিল।

ন্যায়রত্ন চোখ বুজিয়া বসিয়া ছিলেন। তাঁহার কপালে জ্বযুগলের মধ্যস্থলে কয়েকটি গভীর কুঞ্চন-রেখা জাগিয়া উঠিয়াছে। বিশ্বনাথ তাঁহার বেদনাতুর পাণ্ডুর মুখের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া ছিল। ন্যায়রত্নের অবস্থাটা সে উপলব্ধি করিতেছে।

কয়েক মিনিটের পর একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ন্যায়রত্ন চোখ খুলিলেন, ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—তোমাদের কল্যাণ হোক ভাই! আমি তা হলে উঠলাম।

—সে কি! এই অসুস্থ শরীরে এখন কোথায় যাবেন? বিশ্বনাথের বন্ধু পিটার পরিমল ব্যস্ত হইয়া উঠিল।

-নাঃ, আমি এইবার সুস্থ হয়েছি। বিশ্বনাথ বলিল আমি আপনার সঙ্গে যাই?

—না। বলিয়াই ন্যায়রত্ন দেবুর দিকে চাহিয়া বলিলেন—তুমি আমায় একটু সাহায্য কর। পণ্ডিত! আমায় একটু এগিয়ে দাও।

দেবু সসম্ভ্ৰমে ব্যস্ত হইয়া কাছে আসিয়া বলিল হাত ধরব?

—না, না। ন্যায়রত্ব জোর করিয়া একটু হাসিলেন—শুধু একটু সঙ্গে চল। ন্যায়রত্ন বাহির। হইয়া গেলেন; ঘরখানা অস্বাভাবিকরূপে স্তব্ধ, স্তম্ভিত হইয়া গেল। কেহই কোনো কথা বলিতে পারিল না। ন্যায়রত্ন প্রাণপণ চেষ্টায় যে কথা গোপন রাখিয়া গেলেন মনে করিলেন, সে কথা তাহার শেষের কয়েকটি কথায়, হাসিতে, পদক্ষেপের ভঙ্গিতে বলা হইয়া গিয়াছে।

বিশ্বনাথ নীরবে বাহির হইয়া আসিল। ডাকবাংলোর সামনের বাগানের শেষপ্রান্তে ন্যায়রত্ন দাঁড়াইয়া ছিলেন। বিশ্বনাথ কাছে আসিবামাত্র বলিলেন-হঁ, জয়াকে—জয়াকে কি পাঠিয়ে দেব। তোমার কাছে?

বিশ্বনাথ হাসিল, বলিল—সে আসবে না।

ন্যায়রত্ন বলিলেন–না, না। তাকে আসতে আমি বাধ্য করব।

–বাধ্য করলে অবশ্য সে আসবে। কিন্তু তাকে শুধু দুঃখ পেতেই পাঠাবেন।

–জয়াকেও তুমি দুঃখ দেবে?

–আমি দেব না, সে নিজেই পাবে, সাধ করে টেনে বুকে আঘাত নেবে; যেমন আপনি নিলেন। কষ্টের কারণ আপনার কাছে আমি স্বীকার করি। কিন্তু সেই কষ্ট স্বাভাবিকভাবে আপনাকে এতখানি কাতর করে নি। কষ্টটাকে নিয়ে আপনি আবার বুকের ওপর পাথরের আঘাতের মতন আঘাত করেছেন। জয়াও ঠিক এমনি আঘাত পাবে। কারণ, সে এতকাল আপনার পৌত্রবধূ হবারই চেষ্টা করেছে—জেনে রেখেছে, সেইটাই তার একমাত্র পরিচয়। আজকে সত্যকার আমার সঙ্গে নূতন করে পরিচয় করা তার পক্ষে অসম্ভব। আপনিও হয়ত চেষ্টা করলে পারেন, সে পারবে না।–

একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ন্যায়রত্ন বলিলেন, কুলধৰ্ম বংশপরিচয় পর্যন্ত তুমি পরিত্যাগ করেছ—উপবীত ত্যাগ করেছ তুমি! তোমার মুখে এ কথা অপ্রকাশিত নয়। অপরাধ আমারই। তুমি আমার কাছে আত্মগোপন কর নি, তোমার স্বরূপের আভাস তুমি আমাকে আগেই। দিয়েছিলে। তবু আমি জয়াকে আমার পৌত্রবধূর কর্তব্যের মধ্যে ড়ুবিয়ে রেখেছিলাম, তোমার আধ্যাত্মিক বিপ্লব লক্ষ্য করতে তাকে অবসর পর্যন্ত দিই নি। কিন্তু–

—বলুন!

–না। আর কিছু নাই আমার; আজ থেকে তুমি আমার কেউ নও। অপরাধ—এমনকি পাপও যদি হয় আমার হোক। জয়া আমার পৌত্রবধূই থাক। তোমাকে অনুরোধ আমার মৃত্যুর পর যেন আমার মুখাগ্নি কোরো না। সে অধিকার রইল জয়ার।

বিশ্বনাথ হাসিল। বলিল–বঞ্চনাকেও হাসিমুখে সইতে পারলে, সে বঞ্চনা তখন হয় মুক্তি। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন–আমি যেন এ হাসিমুখে সইতে পারি। সে প্রণাম করিবার জন্য মাথা নত করিল।

ন্যায়রত্ব পিছাইয়া গেলেন, বলিলেন—থাক্‌, আশীৰ্বাদ করি, এ বঞ্চনাও তুমি হাসিমুখে সহ্য কর। বলিয়াই তিনি পিছন ফিরিয়া পথে অগ্রসর হইলেন। দেবু নতমস্তকে নীরবে তাহার অনুগমন করিল।

বিশ্বনাথ তাহার দিকে চাহিয়া হাসিবার চেষ্টা করিল।…

ন্যায়রত্ন খেয়াঘাটের কাছে আসিয়া হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইলেন। পিছন ফিরিয়া হাতখানি প্রসারিত করিয়া দিয়া আৰ্ত কম্পিতকণ্ঠে বলিলেন–পণ্ডিত! পণ্ডিত!

আজ্ঞে? বলিয়া দেবু ছুটিয়া তাঁহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইতেই থরথর করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে ন্যায়রত্ব আশ্বিনের রৌদ্রতপ্ত নদীর বালির উপর বসিয়া পড়িলেন।

কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাঁচখানা গ্রামে কথাটা ছড়াইয়া পড়িল। অভাবে রোগে-শোকে। জর্জরিত মানুষেরাও সভয়ে শিহরিয়া উঠিল। সচ্ছল অবস্থার প্রতিষ্ঠাপন্ন কয়েকজন—এ অনাচারের প্রতিকারে হইয়া উঠিল বদ্ধপরিকর।

 

ইরসাদের সঙ্গে দেবুর পথেই দেখা হইয়া গেল।

দেবু গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় মাথা হেঁট করিয়া পথ চলিতেছে। ইরসাদের সঙ্গে মুখোমুখি। দেখা হইল; দেবু মুখ তুলিয়া ইরসাদের দিকে চাহিয়া ভাল করিয়া একবার চোখের পলক ফেলিয়া যেন নিজেকে সচেতন করিয়া লইল। তারপর মৃদুস্বরে বলিল-ইরসাদ-ভাই!

–হ্যাঁ। শুনলাম, তুমি মহাগ্রামে গিয়েছ! দুর্গা বললে।

গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া দেবু বলিল–হ্যাঁ। এই ফিরছি সেখান থেকে।

—তোমাদের ঠাকুর মশায় শুনলাম নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন নদীর ঘাটে। কেমন রইছেন তিনি?

একটু হাসিয়া দেবু বলিল—কেমন আছেন, তিনিই জানেন। বাইরে থেকে ভাল বুঝতে পারলাম না। নদীর ঘাটে কেঁপে বসে পড়লেন। আমি হাত ধরে তুলতে গেলাম। একটুখানি বসে থেকে নিজেই উঠলেন। ময়ূরাক্ষীর জলে মুখ-হাত ধুয়ে হেসে বললেন– মাথাটা ঘুরে উঠেছিল, এইবার সামলে নিয়েছি পণ্ডিত। বাড়ি এসে আমাকে জল খাওয়ালেন, স্নান করলেন, পুজো করলেন। আমি বসেই ছিলাম; দেখে বললেন–এইখানেই খেয়ে যাবে পণ্ডিত। আমি জোড়হাত করে বললাম-না না, বাড়ি যাই। কিন্তু কিছুতেই ছাড়লেন না। খেয়ে উঠলাম। আমাকে বললেন– আমার একটি কাজ করে দিতে হবে। বললেন–আমার জমিজেরাত বিষয়-আশয় যা কিছু আছে—তোমাকে ভার নিতে হবে। ভাগে—ঠিকে, যা বন্দোবস্ত করতে হয়, তুমি করবে। ফসল উঠলে আমাকে খাবার মত চাল পাঠিয়ে দেবে কাশীতে, আর উদ্বৃত্ত ধান বিক্রি করে টাকা।

ইরসাদ বলিল ন্যায়রত্ন মশায় তবে কাশী যাবেন ঠিক করলেন?

–হ্যাঁ, ঠাকুর নিয়ে, বিশু-ভাইয়ের স্ত্রীকে ছেলেকে নিয়ে কাশী যাবেন। হয় কালনয় পরশু।

–বিশুবাবু আসে নাই? একবার এসে বললে না কিছু?

–না।

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া দেবু আবার বলিল—সেই কথাই ভাবছিলাম, ইরসাদ-ভাই।

—কি কথা বল দেখি?

–বিশু-ভাইয়ের সঙ্গে আর সম্বন্ধ রাখব না। টাকাকড়ির হিসেবপত্র আজই আমি তাকে বুঝিয়ে দোব।

ইরসাদ চুপ করিয়া রহিল।

দেবু বলিল—তোমাদের জাতভাই একজন এসেছেন আবদুল হামিদ। তিনিও দেখলাম-ওই বিশু-ভাইয়ের মতন। নামেই মুসলমান, জাত-ধৰ্ম কিছু মানেন না।

Category: পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪)
পূর্ববর্তী:
« ২০. ম্যালেরিয়া এবার আসিয়াছে
পরবর্তী:
২২. মানুষ বন্যায় বিপর্যস্ত »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑