দিগ্বলয়ের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় রাজধানী শহরে প্রায় পৌঁছে গেছে। যদিও বাসটি দ্রুতগামী, কিন্তু যানজটে পড়ে পঙ্গু হয়ে যায়। তবু আড়াই ঘণ্টার পথ সে সাড়ে চার ঘণ্টায় অতিক্রম করতে পারবে বলে মনে করে। সে যাচ্ছে তার প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড় ুয়া মেয়ের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে। মেয়ের মা সুখ-স্বপ্নের বদলে আজকাল বদখোয়াব দেখে মেয়েকে ঘিরে। তাই প্রায় রাতই থাকে নিদ্রাশূন্য। রাত চরা পাখির মতো রাত কাটে। নিশিপতঙ্গের ডাকে কৈশোরে হাঁটাহাঁটি করে। গ্রামের বাড়ি এলে মেয়ের মতিগতি এবং চারদিক থেকে সংগ্রহ করা খবরা-খবরে বাপের চেয়ে মা আতংকিত হয়ে পড়ে। পাবলিক ভার্সিটিতে অযোগ্য মেয়ে প্রাইভেটে পড়বে। মুরগির খামার কিংবা হাইব্রিড মাছ-সবজি চাষের আয়ে খরচার চাপ পড়লেও বেসামাল হবার কথা নয় পিতার।
প্রাইভেট ভার্সিটি। শিক্ষাবাণিজ্য। লেখাপড়ার দোকান। শিক্ষাশূন্য আনন্দনিকেতন। শিল্পপতিদের সেবাদাস তৈরির কারখানা। পিতা বিষয়টা বুঝেছে দেরি করে। হাতে হাতে ল্যাপটপ। ল্যাপটপ বাণিজ্যের বাজার। পিতার বিস্ময়, আহা শিক্ষার উপকরণ। বই নয়, ইন্টারনেট। মা তাজ্জব বটে। সালোয়ার-কামিজ নয়, জিন্সের প্যান্ট। গ্রাম্য পিতার শস্যভূমিতে আকাশ থেকে মার্কিনি-বৃটিশ উপগ্রহের অবতরণ বুঝিবা বিষয়টি। অলৌকিক শিক্ষা বটে!
‘সে তুমি বুঝবে না মা, এটা যে প্রাইভেট ভার্সিটি, অন্যরকম বিষয়, বোঝা সহজ নয়’, মেয়ে মাকে বোঝায়। মা বুঝেও বোঝে না। বাবা বোঝার চেষ্টা করে। এমনটাও ভাবে জন্মদাতা, গ্রামের ক’জনের ভাগ্যে জোটে ছেলে-মেয়েদের ব্যয়বহুল প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ানো? শিক্ষা তো মাগনা নয়।
গ্রামের সবুজ ফসলের উপর আকাশটায় তারা জ্বলে। অগুণতি তারা। স্বপ্নের মতো। শহরবাসীর জন্য খাদ্য আর প্রোটিন যোগানদার পিতা আজকাল আর রাতের কিংবা দিনের আকাশ দেখার সুযোগ পায় না। মৎস্য-সবজি-মুরগীর লালন-পালনে বেলা যায়, রাত কাটে। দৃষ্টি কেবল মাটিতে। সেখানে ছড়িয়ে আছে সাদা-লালচে-নীলাড রঙ টাকা আর টাকা। হাতের মোবাইলের দিকেও তাকায়। মোবাইলে ইন্টারন্টে, কৃষি প্রযুক্তি আর কৃষি তথ্য প্রবাহের কোলাহল শুনতে চায়। আক্ষেপ হয় মৃত কৃষক পূর্ব পুরুষদের জন্য। অর্ধশিক্ষতি গ্রাম্য পিতা মেয়ের ভার্সিটির ক্যাম্পাস খোঁজে। তার বিশ্বাস ভার্সিটি মানে বিশাল মাঠ, সারি সারি শিক্ষা ভবন, ছাত্রাবাস, শিক্ষক নিবাস আর লাইব্রেরী। কিন্তু একি। নীচতলায় মার্কেট, দোতলায় বাণিজ্যিক অফিস, তিনতলায় ভার্সিটি, চারতলায় আবাসন। চারপাশে প্রার্থনা গৃহ, দোকানপাট, হোটেল আরো কতো কি বিচিত্র জিনিসপত্রের কাঁচঘেরা ঘর। তা হলে শিক্ষাগৃহ কোথায়? হয়তো শিক্ষাটা ভেতরে সুড়ঙ্গের মতো ঘরে আবদ্ধ, চোখে দেখার বিষয় নয়, অনুমানের বিষয়। ওসব জ্ঞানচর্চার ঘরে কি সূর্যের আলো পৌঁছে? পিতা নিজের কাছেই জানতে চায়।
চাইবে না কেনো? গ্রামের প্রাইমারী আর হাইস্কুলের চারপাশ সূর্যের আলোয় ঝলমল করে, বাগানের ছায়া পড়ে। পাবলিক ভার্সিটিতেও সূর্যালোকের অভাব নেই। নেই কেবল মেয়ের শিক্ষা ভবনে? তা মেয়ের প্রতি ঈশ্বরের এই বৈরিতা কেনো? প্রকৃতি জগতের আলো নেই এক বিন্দু যেখানে, সেই ছায়াচ্ছন্ন গৃহ কি করে জ্ঞানের আলোর গৃহ হয়? হায় গ্রাম্য পিতা, তুমি কতটুকু বুঝবে বাণিজ্যেই লক্ষ্মী বাস করে, সেই বাণিজ্য শিক্ষাই হোক আর আলু-পটলেরই হোক। চাই কি শেয়ারবাজার হোক।
কোথায় থাকে মেয়েটা? এটা কি ছাত্রী নিবাস না কি বাড়িঅলার ভাড়া বাণিজ্য নিবাস? এই গৃহেই কি তার মেয়ে রাত জেগে ল্যাপটপ টিপে আর রাত শেষে ঘুমোতে যায়? যাক, তবু তো অফুরন্ত স্বাধীনতা। ওই যে পিতা শুনেছে মেয়েরা সব রাতই এসব নিবাসে যাপন করে না, কোনো কোনো রাত কোথায় যে কাটায় তা দেখার কেউ নেই। গ্রামের বাড়ি এলে সারারাত মোবাইলে অবিরাম কথাই কইতে থাকে, কি কথা ইশ্বর কি জানেন?
‘তোকে নিয়ে আমার একটা স্বপ্ন আছে, সবাইকে বলতে পারি আমার মেয়ে ভার্সিটিতে পড়ে,’ একদিন পিতা এমন করেই বলেছিল মেয়েকে।
‘তো? এতে এমন কি?’ মেয়ের এমনি ধারা জবাব পিতা আশা করেনি। প্রত্যাশা ছিল কৃতজ্ঞ হোক কন্যা পিতার কাছে।
পিতা নিশ্চুপ। ভাবে অন্যরকম কিছু। যেমনি মুরগীর ফার্ম করে, মাছ আর হইব্রিড মাছের চাষ করে পৃথিবীর অনেক দেশের নাম, মাছের নাম, খাদ্য, কৃত্রিম প্রজনন সম্পর্কে অশ্রুতপূর্ব জ্ঞানের খবর জেনেছে, যা তার পূর্বপুরুষ শোনেনি, তেমনি আজ মেয়েকে শহরে পড়াতে পাঠিয়ে ও অজানা দুনিয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। একজন প্রাচীন যুগের পিতার পক্ষে যা জানার কথা নয়, তেমনি জানার কথা নয় শিক্ষা বাণিজ্যের শিকার সন্তানের পিতার পক্ষেও।
গ্রাম্য অর্ধশিক্ষিত পিতা যে খানিকটা হলেও ইংরেজি জানে, সে শেষ অবধি মেয়ের আবাসটি খুঁজে পায়। পায়নি কেবল মেয়েকে। মেয়ের রুমমেট মেয়ে দুটোর কৌতূহলী চোখ পিতাকে ভাবিত করে। পিতা নীরব। একজন মেয়ে বলে বসে, আঙ্কেল, আপনার মেয়ের ভাগ্য কত ভাল, পিতা শহরে এসে খোঁজ-খবর নেয়, আসলে পিতাদের মেয়েদের হোস্টেলে না-আসাই ভাল।’
‘কোনো, কোনো? এটা কি হোস্টেল? ভাড়া বাড়ি না?’ অবাক পিতার বুকটা কেঁপে ওঠে। বলে কি ওরা!
মেয়ে দুটো হাসে। এবার পিতা জানতে চায়, ‘আমাদের কোনো আত্মীয় এই শহরে নাই যার ঘরে মেয়ে মানুষ রাতে ঘুমাতে পারে। থাকলেও ঘুমানো জায়েজ কি?’
এবার মেয়ে দুটো সমস্বরে এতই উচ্চ কণ্ঠে হেসে ওঠে, পিতা ভড়কে যান। তার মাথা আনত হয়। হাসি থামিয়ে একজন বলে, ‘বেয়াদবী হলে মাফ করবেন আঙ্কেল, আসলে ভার্সিটির মেয়েরা রাতে কোথায় ঘুমাতে গেল আর কার সঙ্গে গেল সে সব জানার জামানা কি আছে?
পিতা হঠাৎ যেনো আর্তনাদ করে ওঠে। অথচ অস্ফুট আর্তনাদ, ‘জান, তালেবানদের আমি ঘিন্না করতাম তারা মেয়েদের খাঁচায় আটকে রাখে শুনে, এখন আর ঘিন্না করব না।’
মেয়ে দুটো এবার থমকে যায়। ওরা পরস্পর মুখ দেখে। অথচ পিতা দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু পা তার চলে না। এ কারণেই চলে না, সে এখানে মেয়ের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে তার গ্রামে ফেরার লাস্ট বাসের সময় অবধি। কিন্তু সময় দীর্ঘ। সবে দুপুর গড়িয়েছে। অথচ তার মনে হয় দুনিয়ার সব প্রহরের সময় দ্রুত গড়ায় না, খুব ধীরে বয়ে চলে।
ক্লান্ত হবার কথা থকালেও শরীর সতেজ থাকে পিতার। পিতার মনে হয় কন্যার জন্য এই অপেক্ষা নিশ্চয়ই সুখের। একটি সুখ নিশ্চয়ই শেষ বাসের পূর্বেই তার সামনে এসে হাজির হবে। কি সেই সুখ? রাতের অজানা সেই ঘুমের ঘর ছেড়ে তার মেয়ে ফিরে এসেছে পিতার কাছে।
‘আব্বু, আব্বু, আমি এসেছি, তোমার কাছেই ফিরে এসেছি আব্বা।’
‘জিন না মানুষ তুই? এত লম্বা ঘুম মানুষের?
‘কোথায় দেখলে ঘুম? ঢাকা শহরের মানুষ কি কখনো রাতে ঘুমের বিছানায় যায়? কত যে কাজ মানুষের, কোথায় ঘুমের সময় আব্বু?’
‘অথচ দেখ মা, আমাদের গ্রামে জোনাক-পড়া রাতে যেমনি ঘুমায় মানুষ, অন্ধকার রাতেও সব কি ভুলে গেলি মা?
তারপর হয় তো মেয়ে উত্তর খুঁজে পাবে না। ফ্যাল ফ্যাল তাকিয়ে থাকবে পিতার মুখের দিকে। ভার্সিটিতে-পড়া মেয়ে যে গ্রামের কথা ভুলে গেছে। গ্রামের আকাশে ভাসমান জোনাক কিংবা স্রোতের মতো অন্ধকার রাতের কথাও স্মরণে নেই তার। জোনাক কিংবা আঁধার রাতের নিশ্চুপ নিদ্রার কথা তো লেখা নেই মেয়ের পাঠ্যপুস্তকে। সেসব পুস্তকের ভাষা ইংরেজি, ওদের জন্মস্থান লন্ডন কিংবা নিউইয়র্ক।
স্তব্ধ হয়ে পিতা দাঁড়িয়ে থাকে। কন্যার দেখা নেই। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে। তার মোবাইল বন্ধ। এক সময় পিতা বুঝতে পারে, একজন পিতার কাছে কনার ফেরার অপেক্ষায় সময়ের গতি থেমে থাকে না। তার লাস্ট বাসের সময় ঘনিয়ে এসেছে। পিতার আশ্রয় সেই গ্রাম। গ্রামে ফিরতে না-পারলে এই শহরে কোথায় তার ঘুমের ঘর?
দ্রুত পা ফেলছে পিতা। যদি বাস ফেল করে? আতংকে আরো দ্রুত পা ফেলে সে। তার হঠাৎ মনে হয় সে বাড়ি পৌঁছে গেছে। অন্ধকার গভীর রাতে মেয়ের হাত ধরে উঠোনে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে ডাকছে, ‘এত ঘুম মানুষের? এত ঘুম? দুয়ার খুলবে তবে কে?’
সূত্র: দৈনিক ইত্তেফাক, জানুয়ারী ০১, ২০১০
Leave a Reply