মরুতীর্থ হিংলাজ – ২

গাছ। চোখ বুজে বিচিত্র ভঙ্গিমায় ধীরে সুস্থে সেই চর্বণ একটা দেখবার মতো ব্যাপার। জিভ কেটে রক্ত গড়াচ্ছে কষ বেয়ে। তা হোক, তবু এত বড় মুখরোচক খাদ্য চিবনো থামবে না।

আমরাও থামি না। দু-পায়ের তলায় অজস্র কাঁটা ফুটছে, এক-পা তুলে অন্য পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কাঁটাটা টেনে ফেলে দিয়ে আবার চলেছি। দু-একটা ভেঙে পায়ের তলায় থেকেও যাচ্ছে। থাকুক। যখন সেদিনের চলার পালা সাঙ্গ হবে তখন ওগুলোর ব্যবস্থা করা যাবে। আপাতত থামার উপায় নেই। দল এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ উট এগিয়ে চলেছে। একবার চোখের আড়াল হলে বুক চাপড়ে কাঁদলেও আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কি করেই বা যাবে! ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে ঝোঁপ-কাঁটাগাছের বংশাবলীর মধ্যে কেউ বাদ নেই। পাশাপাশি ঠাসাঠাসি সকলে বসে গেছে, শিরশিরিয়ে মাথা নাড়ছে, ফিসফিসিয়ে চলেছে কানাকানি পরামর্শ। বোধ হয়, হঠাৎ-আগন্তুক এই মানুষগুলির ভবিষ্যৎ নিয়েই জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে।

এদের কাউকে দক্ষিণে কাউকে বামে রেখে সসম্ভ্রমে পাশ কাটিয়ে ঘুরে ঘুরে আমরা চলেছি। পথ বলতে কোথাও কিছু নেই। হয়তো বা আছে কোথাও, কিন্তু সে পথ উটের মার পছন্দ নয়। দলসুদ্ধ সকলের খাদ্যদ্রব্য ঘাড়ে করে সে সংক্ষিপ্ততম পথে চলেছে সেখানে, যেখানে মিষ্টিজল মিলবে। আমাদেরও আজকের মতো এই দিকদারির হাত থেকে পরিত্রাণ মিলবে।

কিন্তু এর আর শেষ নেই-শেষ নেই অবিরাম মোড় ঘোরার। দশ পা সোজা চলার উপায় নেই। সামনের ঐ ঝোঁপগুলো পার হয়ে নিশ্চয়ই পরিষ্কার জমি দেখতে পাওয়া যাবে এই আশায় সেই ভোর রাত থেকে চোখের দৃষ্টি অনবরত বাধা পেতে পেতে মেজাজ পর্যন্ত বিগড়ে উঠেছে। একটা হাত-দুই উঁচু ঢিপি সামনে দেখে তার উপর উঠে ঘাড় উঁচু করে দেখবার চেষ্টা করলাম আর কতদূর গেলে খোলা মাঠ মিলবে। ‘ধুত্তোর ছাই’ বলে নেমে পুনরায় উটের পশ্চাৎ অনুসরণ। যতদূর দৃষ্টি পৌঁছল ঝোপেদের গুষ্টিগোত্রসুদ্ধ সবাই চতুর্দিকে ঘাপটি মেরে বসে আছে।

এর নাম যদি মরুভূমি হয় তবে আবাল্য যে সব মরুভূমির ছবি দেখলাম অথবা বই-এ পড়লাম ‘ধূ ধূ করছে দিগন্তবিস্তৃত বালু’-সবই স্রেফ ‘ইয়ে’।

পায়ের তলায় অবশ্য বালু, কিন্তু এই গোবেচারা বালুদের দিগন্ত দেখে প্রাণের সাধ মেটানো অনেক দূরের কথা, কতটুকু আকাশই বা দেখতে পায় এরা।

ভাগ্যে পায় না দেখতে আকাশ। যেখানে তা পায়, আর দু-দিন পরেই পৌঁছে গেলাম সেখানে। সেই অগ্নিকুণ্ডের মাঝে পড়ে বার বার স্মরণ হল-দু-দিন আগে ছেড়ে আসা কাঁটাঝোঁপগুলোকে। যাত্রার প্রথম দু-দিন যদি সেই কাঁটাগাছের ছায়ায় পায়ের তলার ধরিত্রী শীতল না থাকত তবে হয়তো আবার হাব নদী পার হয়ে করাচী পোঁছে সেইখানেই যাত্রার ইতি করতে হত।

বড়লোকদের বৈঠকখানায় মোসাহেবদের নির্লজ্জ হামবড়াপনার সঙ্গে তুলনা দিতে অনেক সময় বলা হয়-সূর্যের চেয়ে বালুর তাপ বেশি। এই নিরীহ তুলনাটা যে কী মারাত্মক ব্যাপার তার মর্মান্তিক পরিচয় পেয়ে বড়লোকের মোসাহেবদের কথা মনের কোণেও উদয় হল না। তার বদলে চোখের সামনে ভেসে উঠল গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুরগামী জাহাজের গর্ভে বয়লারের ভিতরটা। কয়লা দেবার সময় ওটার দরজা যখন খোলে তখন ভিতরের যে অংশটুকু দেখা যায়-রেলিং-এ ঝুঁকে দাঁড়িয়ে তা দেখে যাওয়া-আসার পথে অনেক সময় কাটিয়েছি। কালো কয়লার চাংড়াগুলো ভিতরে পৌঁছেই বাইরে পালিয়ে আসবার জন্যে ছটফট করে ওঠে, কিন্তু কোনো উপায় নেই। কয়েক মুহূর্ত পরেই লালে লাল, আর নড়তে হয় না।

সেখানে একটু একটু করে সূর্যদেব এগিয়ে এসে ঠিক মাথার উপর দাঁড়িয়ে পড়েন, আর নড়বার নামটি করেন না।

ধীরে ধীরে মা ধরণীর দেহের উত্তাপ বৃদ্ধি হতে থাকে। ক্রমে চারিদিকের জগৎ সঙ্কুচিত হয়ে আসে; যেন ঘন কুয়াশা করেছে। চার হাত দূরেও সব আবৃছা, আরও দূরে কিছুই দেখা যায় না।

প্রথমে মাথার তালু জ্বালা করতে থাকে, পায়ের তলায় শেষ পর্যন্ত কোনও সাড়াই থাকে না। নিঃশ্বাসের কষ্ট শুরু হয়। হাঁ-করা মুখ দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস চলতে থাকে, ফলে গলা থেকে পেটের ভিতর পর্যন্ত শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

তখন দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে কোথাও পালানো ভিন্ন অন্য কিছুই মাথায় আসে না। আর তখন সেই হিংস্র বালুর উপর তাড়াতাড়ি এগুতে গেলেই পায়ের গোছ পর্যন্ত বালুতে বসে গিয়ে ক্রমাগত পিছিয়ে পড়তে হয়। নেই অসহায়তার তুলনা কোথায়।

তার নাম মরুভূমি। তবে সেই মরুর মাঝে গিয়ে পৌঁছেছিলাম আমরা আর কয়েক দিন পরে।

মাথা নিচু করে একমনে কাঁটা এড়িয়ে কতক্ষণ চলেছিলাম খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মুখ তুলে দেখি- একি! এরা সব গেল বোথায়? লোকজন, উটেরা। মায় উটের ভৈরবী পর্যন্ত।

ঘাবড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তারপর বালুর উপর মানুষ আর উটের পায়ের ছাপ দেখে এগিয়ে চললাম।

পুনরায় আচম্বিতে-সামনে পরিষ্কার, ঝোঁপজঙ্গল সমস্ত সাফ। আধ মাইল চওড়া সাদা ধপধপে একখানি রুপোর পাত ঐ নীচে দক্ষিণ থেকে এসে বামে চলে গেছে। বামদিকে অতি সন্তর্পণে বোঁচকা-কুঁচকিসহ উট দুটি কোনাকুনি নেমে যাচ্ছে। গুলমহম্মদ বড় উটটার বুকের নীচে কাঁধ ঠেকিয়ে পিছনে ঠেলে রেখে ধীরে ধীরে তাকে নামাচ্ছে। যদি মালপত্র-বাঁধা অবস্থায় বালুর উপর উটের পা হড়কায় তবে গুরুভার মালের টানে সোজা একেবারে নদীগর্ভে গিয়ে পৌঁছে যাবে উট এবং আর কখনো উঠে দাঁড়াবে না।

ছোট উটটির গলার নীচে দু হাত দিয়ে পিছনে ঠেলে রেখে দিলমহম্মদ পিছু হেঁটে নামছে। এবং তখনও সেই উটের উপর খাঁটিয়ার মধ্যে ভৈরবী সমাসীন।

উপরে দাঁড়িয়ে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে সেই নেমে যাওয়া পর্ব দর্শন করলুম। যতক্ষণ না উট নামানো শেষ হল ততক্ষণ খাঁটিয়ার পায়ায় বাঁধা দড়ি ধরে কোনোক্রমে বাহনের উপর টিকে থাকবার জন্যে ভৈরবীর প্রাণান্তকর প্রয়াস দেখতে দেখতে আমার পিঠের শিরদাঁড়ার ভিতরটা জমে হিম হয়ে যেতে লাগল।

অবেশষে অবতরণের পালা শেষ হলে আমিও নেমে গেলাম সোজাসুজি তরতর করে ছুটে। একটা হাত-দুই হাত চওড়া জলের রেখা বয়ে যাচ্ছে। জল- ঠাণ্ডা, মিষ্টি ও পরিষ্কার জল।

সহযাত্রীরা জলের ধারে হাঁটু গেড়ে বসে অঞ্জলি ভরে সেই জল মাথায় মুখে দিচ্ছেন, পানও করছেন। আমি একেবারে সেই জলের ভিতর নেমে দাঁড়ালাম। অজস্র কাঁটার ঘায়ে বিঁধে পায়ের তলা কাঁটার ঘায়ে ছিঁড়ে হাঁটু পর্যন্ত জ্বালা করছিল।

জুড়াল। উটের প্রতি পায়ে দুটি করে হাঁটু। সেইজন্যে বসতে গেলে উট দুই স্থানে পা মুড়ে তবে বসে। প্রথমে সামনের পায়ের নীচের অংশটুকু মুড়ে দেহটা সামনের দিকে কিছুটা নামিয়ে নেয়, তারপর পিছনের পায়ের নীচের অংশটুক মুড়ে ফেলে। তখন সামনের পায়ের উপরে হাঁটু মুড়ে মুখটা মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে শেষে পিছনের পায়ের উপরের হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ে। কাজে কাজেই উটের টপ করে বসে পড়া হয়ে ওঠে না।

সেইভাবে উটকে বসিয়ে ভৈরবীকে নামানো হল। ভূমিষ্ঠ হয়ে তিনি আমাকে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সেখানেই এগিয়ে এলেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন লাগছে উটে চড়া?” অতি প্রশান্ত উত্তর হল, “কি যে মজা উপরে বসে দোল খেতে! আমার তো ঘুম আসছিল।”

মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম নাঃ, বানিয়ে বলছে না। কায়মনোবাক্যে মজাই উপভোগ করেছে। যাককথা বাড়াতে আর প্রবৃত্তি হল না।

দড়িদড়া খুলে বস্তাগুলো সেখানে ফেলে উটদের জলের ধারে নিয়ে আসা হল। সামনের পা দুটি মুড়ে লম্বা গলা বাড়িয়ে জলে মুখ দিয়ে সমানে আধ ঘণ্টা ধরে তারা জলপান করলে। শেষে উপরের ঝোঁপের ধারে নিয়ে গিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হল। দিলমহম্মদ সঙ্গে সঙ্গেই রইল। বিশ্বাস নেই-কাঁটা চিবুতে চিবুতে কত দূরে চলে যাবে কিছুই বলা যায় না।

এধারে তখন কাঁটাগাছের শুকনো ডাল জমা করতে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। রান্না চড়বে। রান্না কিন্তু চড়লও না নামলও না। ডালপালা জ্বেলে যে যেমন ভাবে পারলে, আটা মেখে চাবড়া চাবড়া বানিয়ে পুড়িয়ে নিলে। শেষে লঙ্কার গুঁড়ো ও লবণ সহযোগে তাই চর্বণ। ল্যাঠা চুকে গেল।

আমাদের দন্ধ অদৃষ্টে তখনও অনেক দন্ধানি বাকি ছিল। গুলমহম্মদের চাল খাওয়ার ভয়ানক শখ। সেজন্য বেচারা পরিশ্রমও অল্প করলে না। ডালপালা জোটানো, উনুনের জন্য পাথর খুঁজে আনা, হাওয়া বালির হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে খাঁটিয়াখানাকে খাড়া করে তাতে কম্বল টাঙিয়ে আড়াল করা, সমস্তই সে করলে। কিন্তু মাথা খোঁড়াখুড়িতেও চুলা থেকে অনর্গল কুণ্ডলী পাকিয়ে ধোঁয়া ছাড়া আগুন বেরুল না। লাভের মধ্যে ভৈরবী চোখের জলে নাকের জলে নাকাল হলেন। তখন শেষ উপায় করাচী থেকে আনা চীনাবাদামগুলিকে পোড়ানো। তাই করা গেল। আগুন বেরুল না। লাভের মধ্যে ভৈরবী চোখের জলে নাকের জলে নাকাল হলেন। তখন শেষ উপায় করাচী থেকে আনা চীনাবাদামগুলিকে পোড়ানো৷ তাই করা গেল।

সেই সময় স্মরণ হল একটি মুখঢাকা চ্যাপটা টিনের কথা। শেঠজীর স্ত্রী আমাদের বিদায় দেবার সময় ওটিকে নিজে নিয়ে আসেন। ভিতরে কি বস্তু আছে তখনও খুলে দেখা হয়নি। এখন সেটি খুলে তার মধ্যে পাওয়া গেল সযত্নে গুছিয়ে দেওয়া নানারকমের মিঠাই পেঁড়া লাড়ু, আরও কত কি। এমনকি ঝুরিভাজা চানাচুরভাজা আর নানারকমের আচার পর্যন্ত রয়েছে। গুলমহম্মদ তার ছেলে আর আমরা দুজন পোড়া চীনাবাদাম সহযোগে সেইগুলির সদ্বব্যবহার করে পেট ভরে জল পান করলাম।

এই যাত্রার প্রথা হচ্ছে-প্রত্যহ প্রত্যেক যাত্রী একখানি রুটি উটওয়ালাকে এবং আর একখানি রুটি জলওয়ালাকে দেবে। এই পথের যেখানে মিষ্টি জলের সন্ধান পেয়ে বালি খুঁড়ে জল বার করে কূপওয়ালা পাহারা দিচ্ছে সেই কুপওয়ালার প্রাপ্য মাত্র এই দগ্ধ রুটির একখানি প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে। এর অতিরিক্ত সে কিছু প্রত্যাশাও করে না, পায়ও না। কিন্তু দেখেছি যে, হয় রুটির ওজন নিয়ে নয় মাথাপিছু প্রত্যেক যাত্রীর একখানি করে হিসাবে কম পড়ার দরুন প্রতি কূপের ধার থেকে রওনা হবার সময় বিড়ম্বনার অন্ত থাকত না। আমরা অনেকেই চেষ্টা করতাম যাতে একখানি পাতলা রুটি বা না-পোড়া রুটি কুপওয়ালাকে দিয়ে তাড়াতাড়ি রওয়ানা হওয়া যায় সেখান থেকে।

কিন্তু এই জল, যার আশায় ঘণ্টা আট-দশ মরুভূমি পার হয়ে ছুটে আসছি, যা আমরা নিজ নিজ কুঁজোয় ভরে নিয়ে পুনরায় রওয়ানা হব-যথাস্থানে পৌঁছে যদি সেই জল না পাওয়া যেত? কিংবা যদি জলওয়ালা নির্বান্ধব একাকী মরুর মাঝে বাসা বেঁধে জল রক্ষা না করত-তা হলে?

তখন আমরা শুকনো কুঁজো ঘাড়ে করে কূপের ধারে পৌঁছে কূপের পাত্তাও পেতাম না। কারণ প্রতিদিন না খুঁড়লে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে উড়ন্ত বালিতে কূপ বোঝাই হয়ে চারিদিকের সঙ্গে সমান হয়ে যেত। চিনে নেবার উপায়ও থাকত না যে কোথায় জল ছিল।

ফলে যে তখন কি হতে পারত বা পারত না চিন্তা করতেও সাহস হয় না। সে। চিন্তা না করে জল পেয়ে আকণ্ঠ পান করে কুঁজোয় ভরে নিয়ে সর্বপ্রথম যে ফন্দিটি আমরা অনেকেই আঁটতাম তা হচ্ছে, কি উপায়ে রুটিখানি জলওয়ালাকে দিতে ভুলে যাওয়া যায়।

কূপগুলি সেখানকার মরুবাসীদের কাছে কত বড় সম্পদ তা স্বচক্ষে দেখেছি। দেখেছি ক্রোশের পর ক্রোশ ভেঙে দল বেঁধে স্ত্রী-পুরুষ আসছে একপাল ছাগল নিয়ে কূপের ধারে। ছাগল জল বয়ে নিয়ে যাবে। জল যাবেও ছাগলের মধ্যে ভরতি হয়ে। একটা ছাগলের গলা থেকে মাথাটা কেটে ফেলে কি এক অদ্ভুত উপায়ে চামড়ার ভিতর থেকে হাড় মাংস সমস্ত বের করে নেওয়া হয়। পায়ের খুর চারটে বাদ দিয়ে পায়ের শেষ প্রান্ত চারটি বেঁধে সেই চামড়ার মধ্যে গলা দিয়ে জল ভরতি করা হয়। তারপর গলাটি চমড়ার ফিতে দিয়ে বেঁধে ছাগলের পিঠে চাপিয়ে তারা স্বস্থানে নিয়ে হয়। এইভাবে মাসের পর মাস জল রক্ষা করা হয়। এতে জল ঠাণ্ডা থাকে, নষ্টও হয় না।

দশ-বিশ ক্রোশের মধ্যে একটিমাত্র মিষ্টি জলের কুয়া, সুতরাং প্রত্যহ ‘জলকে চল ব্যাপারটা সেখানে কোনোক্রমেই সম্ভব নয় বলেই এই ব্যবস্থা।

এই ব্যবস্থার অন্য একটা দিকও আছে। জল নিতে এসে উত্তরদিকের লোক দক্ষিণের লোকের জন্যে সংবাদ এই জলওয়ালার কানেই রেখে যায়। এখানেই বহু রকমের দেনা পাওনার হিসাব মেটানো হয়, এমনকি মন দেওয়া-নেওয়ার সাক্ষীও এই জলওয়ালা। অনেকের অনেক ঝামেলা তাকে পোহাতে হয়। বহু সমস্যার হরেক মীমাংসা তাকেই করে দিতে হয়। সে দেশের লোকের কাছে এই জলওয়ালার মর্যাদা সামান্য নয়।

তা হলে কি হবে, আমাদের কাছে সে মাত্র একখানি রুটির প্রত্যাশী-সুতরাং ভিক্ষুক ছাড়া আর কি?

কিন্তু প্রথম দিনে নদীর জলেই যখন আমাদের সমস্ত প্রয়োজন মিটে গেল তখন কুপওয়ালার রুটির কথা আর উঠল না। তার বদলে উটওয়ালার রুটির যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্যে আমাদের প্রথম অধিবেশন আরম্ভ হল।

বহুত বহুত সেলাম জানিয়ে গুলমহম্মদ অতি বিনীত ভাবে প্রস্তাব পেশ করলে যে উটওয়ালার প্রাপ্য একখানি রুটির বিনিময়ে তাকে জনা-প্রতি আধ পোয়া হিসাবে আটা দেওয়া হোক। তাদের রুটি বানাবার কষ্ট থেকে সে এই পুণ্যাত্মা যাত্রীদের রেহাই দিতে চায়

অতি নিরীহ জাতের প্রস্তাব। সকলেই প্রায় একবাক্যে সমর্থন করে ফেললেন।

শ্রীরূপলাল পণ্ডিত হচ্ছেন আমাদের জ্যেষ্ঠ ছড়িওয়ালা-অর্থাৎ আমাদের অভিভাবক। তাঁর মতামতের মূল্য আছে। তিনি তখন চুল আঁচড়াচ্ছিলেন। এই বিশেষ কর্মটি তিনি যখন তখন বহুবার সমাধা করতেন আর সেইজন্যে তার লাল ডোরাকাটা শার্টের বুকপকেটে একখানি চিরুনি সদাসর্বদাই গলা বাড়িয়ে বিরাজমান। চিরুনিখানি থেকে সযত্নে ছেঁড়া চুল ছাড়াতে ছাড়াতে তিনি তাঁর মূল্যবান অভিমত প্রকাশ করলেন।

তাঁর মতে, আটা যদি দিতেই হয় তবে এখনই হিসাব করে সম্পূর্ণ প্রাপ্য আটাটা ওদের দিয়ে দেওয়াই ভাল। বহুবার দেখা গেছে যে, ভোজ্য যা সঙ্গে চলেছে তার দ্বারা শেষ পর্যন্ত যাত্রীদেরই ক্ষুন্নিবৃত্তি হয় না, সেই জন্যেই বলা হয় যে হিংলাজের : পথে আছে ক্ষুধা ও ঝগড়া। এই ঝগড়া যাতে এড়ানো যায়, সেই জন্যেই তার এই সংশোধনী প্রস্তাব।

শুনলে মনে হবে যে এই প্রস্তাবটি আরও নিরীহ জাতের। আটাটা যখন দিতেই হবে তখন দিয়ে দিলেই হাঙ্গামা শেষ হয়। তা হয়তো হত। কিন্তু হিসাব কষে দেখা গেল যে ত্রিশজন লোকের মাথাপিছু আধ পোয়া করে আটা দিতে গেলে দৈনিক দিতে হয় পৌনে চার সের। বত্রিশ দিনে এই যাত্রা সমাপ্ত হবে এই আশায় জনা-প্রতি বত্রিশ সের হিসাবে আটা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বত্রিশ দিনের জন্য বত্রিশবার এই পৌনে চার সেরকে যোগ দিলে হয় তিন মণ। অর্থাৎ এখনই দু-বস্তা আটার মায়া ত্যাগ করতে হয়।

হিসাবটা যখন শেষ হল তখন ‘সভা হল নিস্তব্ধ’। তবে ঘাতক কেউ উপস্থিত না থাকায় সাঁড়াশি দগ্ধ করে ছেঁড়াছিড়িটা আর হল না।

তখন একটি পাল্টা প্রস্তাব আমি পেশ করে বসলাম। মণ দেড়েক চাল আমাদের উটের পিঠে যাচ্ছে। অক্লেশে আমরা আটার মায়া ত্যাগ করতে পারি। আটাই হোক আর চালই হোক, রান্না না করে গলাধঃকরণ করা সম্ভব হবে না। আজকের রান্নার দুরবস্থা দেখে ও সম্বন্ধে বেশি আশা না করাই শ্রেয়। অতএব সকলের দুশ্চিন্তা দূর করবার জন্যে আমাদের আটার বস্তাটা শেখ সাহেবদের অগ্রিম সঁপে দিতে চাইলাম।

দুশ্চিন্তা কিন্তু কালো বোরখা ঢাকা দিয়ে আমাদের পিছু নিল শ্রীমান পণ্ডিতজির শেষ কথাটিতে। শেষ পর্যন্ত খাদ্য সকলের ভাগ্যে ঢালাও জুটে যাবে এই অভয় দান করে। তিনি নির্বিকার ভাবে বললেন যে, পথে দু-চারজন ত কমবেই, সুতরাং ভাবনা কি?

কমবে অর্থাৎ আমরা সকলে সশরীরে হিংলাজ পর্যন্ত পৌঁছব না এবং এর কারণটি যে কি তা আন্দাজ করে নিয়ে আমরা প্রত্যেকে অন্য মুখগুলির উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম।

হায়, কে বলে দেবে সেই দু-চারজন আমাদের মধ্যে কে কে?

সভার কার্য শেষ হবার পূর্বেই দিলমহম্মদ উটসহ প্রত্যাবর্তন করলে। আর তৎক্ষণাৎ, বলা নেই কওয়া নেই, পিতাপুত্রে মালপত্র উটের পিঠে তুলে বাঁধতে শুরু করে দিলে।

শেষে যখন বুঝলাম যে সেখান থেকে পুনরায় উঠতে হচ্ছে তখন পশ্চিমের আকাশটায় কে যেন আগুন ধরিয়ে দিয়ে লালে লাল করে তুলেছে। ছেড়ে আসা নদীর পূর্বর্তীর ইতিমধ্যেই স্বচ্ছ আঁধারে রহস্যময় হয়ে উঠেছে।

সামনের পশ্চিমতীরে গায়ে গায়ে ঠাসাঠাসি করে বসে কারা যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সেই দিকে চেয়ে আসন্ন সন্ধ্যায় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

কিন্তু উপায় কি?

খাঁটিয়ার আড়ালে চাদর চাপা দিয়ে ভৈরবী ঘুমিয়ে ছিলেন। উটের পিঠে খাঁটিয়া বাঁধা হলে বালিসুদ্ধ চাদরটা তার উপর থেকে সাবধানে তুলে নিলাম। ইতিমধ্যে হাওয়ায় উড়ে একরাশ বালি তার চাদরের উপর জমেছিল। নিদ্রাভঙ্গ হলে অতিকষ্টে কনুই-এর উপর ভর দিয়ে ধীরে ধীরে কোমর সোজা করে উঠে বসলেন তিনি। উটের পিঠে মজায় দোল খাবার ফল হাড়ে হাড়ে মিলেছে। সর্বাঙ্গ টাটিয়ে টনটন করছে।

বললাম- “আবার চড়ে বসো।”

ভগ্নকণ্ঠে তিনি জিজ্ঞেস করলেন-”আজ আবার কেন?” বাহুল্য বোধে এই ‘কেন’র আর উত্তর দিলাম না।

বসুন্ধরা ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকা দিলেন। এই নদীটি তার সীমান্তের সিঁথি। ঘোমটার মধ্যেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

উট দুটিকে ঘিরে আমরা মানুষ কজন নিঃশব্দে অগ্রসর হলাম অজানা ঠিকানার উদ্দেশে, জল যেদিক থেকে আসছে সেইদিকে।

সেদিন সন্ধ্যার পরে চন্দ্রদেব বোধ হয় কোথাও গোপনীয় কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। অনেক রাতে অর্ধেকেরও বেশি মুখ ঢেকে শরমে জড়িত চরণ দুখানি টানতে টানতে নদীর পূর্ব তীরের ঘুটঘুঁটে আঁধারের ভিতর থেকে যখন তিনি দেখা দিলেন তখন হঠাৎ নদীগর্ভে আমাদের দেখে তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ-হেন অবস্থায় রাত্রিশেষে তাঁর চুপি চুপি বাড়ি ফেরার সাক্ষী থাকবার জন্যে সেই অস্থানে অতগুলি জীব জেগে রয়েছে, এ নিশ্চয়ই তাঁর কল্পনাও ছিল না- মহা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন!

আমাদের তবু একজন সঙ্গীবৃদ্ধি হল, একজন নয়-দু-জন। ভোরের তারাটাও একদৃষ্টে আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখছিল। তখন আমরা আমাদের নিজ নিজ কুঁজো উটের পিঠ থেকে নামিয়ে নিয়ে নদীর জল ভরে নিচ্ছি। জলভরতি কুঁজোগুলি এবার প্রত্যেকের কাঁধে কাঁধে চলবে। আমার কুঁজোটি অবশ্য ভৈরবীর কুঁজোর সঙ্গে উটের পিঠের খাঁটিয়ার মধ্যেই স্থান পেল। চাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আমরা নদীর পশ্চিমতীরে উঠলাম।

রসুলপুরের নদীর তীরে সহযাত্রীগণ কর্তৃক পরিত্যক্ত নবকুমার যখন আগুন দেখতে পেয়েছিলেন, তখন-, ওখানে নিশ্চয়ই মানুষ আছে নয়তো আগুন জ্বালাল কে,-এই চিন্তা করে আশ্রয়ের আশায় তাড়াতাড়ি সেই আগুনের কাছে গিয়ে কাঁপালিকের খপ্পরে পড়েন। আর সেই রাত্রি শেষ প্রহরে তীরে উঠেই, অদূরে আগুন দেখতে পেয়ে সহযাত্রীগণ পরিবৃত আমরা সকলেই একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়লাম। কার মনে কি উদয় হয়েছিল তা বলতে পারি না, তবে কাঁপালিকের কথাটা আমার স্মরণ হয়নি। হলে হয়তো বনদেবী কপালকুণ্ডলার চাক্ষুষ পরিচয় লাভের আশায় কি করে বসতাম তার ঠিক নেই। হলফ করে বলতে পারি বঙ্কিম-গ্রন্থাবলীর মলাটখানির ছবিও মনের কোণে ভেসে ওঠেনি। চরম অসহায়তার নিবিড় অনুভূতি কোনও কিছু চিন্তা বা বিচার করবার পূর্বেই পা দুটিকে একেবারে পাষাণে পরিণত করল, জ্বলন্ত আগুনটা যেন নিষ্ঠুর নিয়তি, রক্তচক্ষু নিয়ে ঐ আঁধারের বুকে নাচছে।

হুঁশ ফিরে পেলাম একটা বিচিত্র শব্দ-তরঙ্গে-বুড়ো গুলমহম্মদ তার দু-হাতের চেটো দিয়ে চোঙা বানিয়ে তাতে মুখ লাগিয়ে একটানা আওয়াজ করলেন-“ঊ ঊ ঊ হো।” সেই আওয়াজ তিনবার করার পর উত্তর ভেসে এল সেই আগুনের দিক থেকে-“ঊ ঊ ঊ হো।”

উত্তর পেয়ে পিতা পুত্রকে আপন ভাষায় কি খানিক গজ গজ করে বললে। তারপর উটের নাকের দড়িতে টান পড়ল, আমরা আগুনের দিকে এগিয়ে চললাম।

একটা ইঞ্চি দু-এক লম্বা কাঠিকে ধুনুরীদের হাতের তুলো ধুনবার মুগুরের মতন বানিয়ে সেই কাঠিটা উটের নাকে ছেদা করে পরিয়ে দেওয়া হয়। নাকের দুই গর্ত থেকে কাঠিটার দুই প্রান্ত বেরিয়ে থাকে। সেই দুই প্রান্তে বাঁধা হয় একগাছি রেশমের বা লোমের তৈরি সরু দড়ি। অপেক্ষাকৃত মোটা দড়ি একগাছি সেই সরু দড়িটার সঙ্গে বেঁধে তার প্রান্ত উটওয়ালার হাতে থাকে। এই হচ্ছে উটের লাগাম, নাকে টান পড়লেই উট জব্দ। এত বড় একটা প্রাণীকে সেই দড়ি টেনে যে-ধারে ইচ্ছা চালনো হয়। যাকে বলে প্রকৃত নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়ানো। কিন্তু এ পর্যন্ত আমাদের নাকেই দড়ি বেঁধে উট ঘোরাচ্ছিল। এইবার তাকে তার অনিচ্ছায় যেতে হল নাকের দড়ির টানে টানে উটওয়ালার পিছু পিছু সেই আগুনের দিকে।

রুদ্রাক্ষ-বাঘছাল-জটাজুটধারী কেউ তপস্যা করেছেন এ দৃশ্য আমাদের ভাগ্যে জুটল না। তার বদলে আমরা পেলাম আপাদমস্তক কাবুলীর সাজ-পোশাকপরা জনা তিনেক করাচী যাত্রী। হাড়গোড়, মড়ার মাথা, খাড়া-এ সমস্ত কিছুই নয়, আগুন জেলে তারা গরম জল চাপিয়েছেন চা বানাবার জন্যে। সাদরে তারা আমাদের চা পানের আহ্বান জানালেন।

স্মরণ হল যে আমাদের সঙ্গেও চা-চিনি-দুধ সবই আছে। কিন্তু তখন সে সমস্ত পাবার উপায় নেই। উটের পিঠ থেকে খাঁটিয়া খোলা হলে মালপত্র নামলে তখন তার নাগাল পাওয়া যাবে। উট এখানে থামবে না, অগত্যা তাদের আপ্যায়ন স্বীকার করা গেল। কাথীওয়াড়ী ভাইরা এ সবের তোয়াক্কা রাখেন না। সপুত্ৰ গুলমহম্মদ ও সভ্রাতা রূপলালকে নিয়ে আমি চা পান করতে বসলাম। আহা, কি তার স্বাদ, আর কি অপরূপ তার গন্ধ, যাকে ভাল কথায় বলা হয় ফ্লেভার। অন্নপ্রাশনের অন্ন উঠে আসবার জোগাড়। বৃহৎ পঞ্চতিকায় গরম গরম ভেল্লি গুড়ের প্রক্ষেপসহ পান। মুখে অবশ্য বললাম ‘ইয়াঃ’ এবং ‘তোফা’। শেষে বহুত পাঞ্জা-লড়ালড়ি ও মাথা নাড়ানাড়ির পর আমরা আমাদের পথ ধরলাম, তাঁরাও নদীতে নামবার জন্যে তৈরি হলেন।

পরদিন প্রথম চোখ মেলে যা দেখলাম তা হচ্ছে মাছি। ছোটখাটো গৃহস্থ মাছি নয়, আসল কাবুলি মাছি-এক একটি চীনাবাদামের মতো বড়। হাজারে হাজারে তাঁরা কোথা থেকে এসে হেঁকে ধরেছেন, তাঁদের সমবেত কণ্ঠের ঐকতানে নিদ্রাভঙ্গ হল!

শেষরাত্রে পৌঁছে দালানটার এক কোণে কম্বল বিছিয়ে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ি। তখন শরীর মনের যা অবস্থা তাতে সাপ বিছা বা কিসের উপর কম্বল পাতছি, তা দেখার ধৈর্য ছিল না। কিছুমাত্র চিন্তা না করে শয়ন এবং সঙ্গে সঙ্গে সকল দুঃখের অবসান-এই হচ্ছে গতরাত্রের কর্ম।

জেগে উঠে দেখি সকলেই পেটের ব্যবস্থা করতে ব্যস্ত। সেদিন থেকে আমাদের দলে রূপলাল পণ্ডিতের ছোট ভাই সুখলাল যোগদান করায় ভৈরবীর আর কোনো অসুবিধা নেই। তার মহা উৎসাহে সর্বকর্মে সাহায্যদান রান্নার দুঃখ দূর করেছে। ভাত রাঁধার পাত্রটা মাত্র দুজনের উপযুক্ত আনা হয়েছে, তাতেই পাঁচজনের ব্যবস্থা দুবারে হচ্ছে। তারপর ডালও হবে। শেষে হবে রুটি-রাতে পথের সম্বল।

দালানটার দক্ষিণে কুয়া, জল মুখে দেবার উপায় নেই, এতই বিস্বাদ। স্নান করা গেল। পানের জল তো নদী থেকেই বয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু খুব সাবধান, বার বার রূপলাল আর গুলমহম্মদ সকলকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, কুঁজোর জলে সারারাত আর পরদিন দুপুর পর্যন্ত চলা চাই। শোনবেণী না পৌঁছলে কোনো উপায় নেই আর জল পাবার।

সে রাজ্যের রাজধানীর নাম শোনবেণী, করাচী থেকে তিন দিনের পথ। পথে এই দালানটাই একমাত্র আশ্রয়স্থান, সে দেশের সরকারের নিজস্ব ব্যবস্থা। সেখান থেকে বেরিয়ে সারারাত হেঁটে পরদিন কোনও এক সময় আমরা শোনবেণী পৌঁছব, অবশ্য ইতিমধ্যে যদি আর কোনো বিভ্রাট না ঘটে বসে।

স্নানের পর পুরো এক গেলাস চা পান করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। হতে থাকুক রান্না ততক্ষণ। বসে থাকবার উপায় কি আছে? ঝাঁকে ঝাঁকে মাছি এসে মুখের উপর আছড়ে পড়ছে।

ডাকাডাকির ফলে আবার যখন উঠে বসলাম, তখন সমস্ত প্রস্তত। ভাত, ডাল, ডালের মধ্যে আলুসিদ্ধ, সঙ্গে খণ্ড খণ্ড কাঁচা পেঁয়াজ। পেঁয়াজ খেতেই হবে, নয়তো জলতেষ্টা কিছুতেই কমবে না। কাঁচা পেঁয়াজ কামড়ে খাওয়া এর পূর্বে আর কপালে ঘটে ওঠেনি। স্থানমাহাত্মে সত্যিই খারাপ লাগল না। বরং ঐ পেয়াজের দৌলতেই খাদ্য উদরস্থ হল বলা চলে।

সমস্ত ধুয়ে মেজে বাধা-ছাঁদা করে আবার শয়ন। দু-তিন ঘণ্টা পরে রোদ কমলে যখন বালি ঠান্ডা হবে তখন বেরুনো যাবে শুনে যে যার চাদরের তলায় ঢুকল।

ঘুম আর হল না। খাওয়ার আগ পর্যন্ত দু-বারে যা হয়েছে তা একেবারে মন্দ নয়। চাদর মুড়ি দিয়ে জেগে শুয়ে থাকাও আর এক অস্বস্তি। মাছিরা মনে করেছে যে আমরা বেঁচে নেই, মড়া ভেবে চাদরের উপর ছেয়ে ফেলেছে। চাদর ফেলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম।

বাইরে গুলমহম্মদ মালপত্রের বস্তাগুলোর উপর ঘুমিয়ে পড়েছে। দালানটার পূর্বদিকে হাত দু-এক ছায়া পড়েছে, সেইখানেই জিনিসপত্রগুলি পাকার পড়ে আছে। যতদূর দৃষ্টি যায় জ্বলন্ত রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছে। জনপ্রাণীহীন দগ্ধ মরুর বুকে একটা কাকপক্ষীরও ডাক শোনা যায় না। না জানি কোথায় কোনদিকে উট দুটিকে নিয়ে দিলমহম্মদ চরাচ্ছে। বিধাতা উট সৃজন করে তার আহারের ব্যবস্থা এই বালুর বুকে করতে ভালেননি। পেট ভরে খেয়ে ফিরে এসে তারা লম্বা গলা বোঝাই করে জল নিয়ে নেবে। তারপর নিশ্চিন্তে সারারাত পাড়ি দেবে যতক্ষণ না আবার জলের কাছে পৌঁছানো যায়। মনে পড়ল, দিল্লি মেল হাওড়া ছেড়ে ঘণ্টাখানেক দৌড়ে বর্ধমানে পৌঁছেই একপেট জল খায়, নয়তো আর নড়তে পারে না, সারারাত কত জল খায় কে জানে! উট সারারাত জলের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে চলে। পিঠে বিশ মণ বোঝা। সৃষ্টিকর্তার কারখানায় তার নিজের হাতে গড়া ইঞ্জিন, একেবারে নিখুঁত, কিছু বলবার উপায় নেই।

নির্বাসন-দণ্ড যে কত বড় সুকঠোর শাস্তি, মর্মে মর্মে তা অনুভব করলাম আমাদের আশ্রয়স্থল তিনদিক-বন্ধ একদিক-খোলা দালানটার দিকে চেয়ে। সারা দুনিয়ার তাবৎ শহরপল্লীর ছোট-বড় যত ঘরবাড়ি আছে, সকলে মিলে একদা না জানি কোন মহা অপরাধের দরুন এই দালানটাকে নির্বাসন দেয়, সেই থেকে বেচারা দিগন্তবিস্তৃত বালুরাশির মধ্যে একলা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ পুড়ে কালো হয়ে গেছে, কারণ যে কেউ কিছুক্ষণের জন্যেও আশ্রয় নেয় সে-ই পেটের দায়ে এর মধ্যে আগুন জ্বালায়। ফলে পশ্চিমের পাঁচটা ভোলা খিলান দিয়ে ধোয়া বেরিয়ে কালো দাগ পড়ে গেছে। এত বালি চারিদিকে তবু এর অঙ্গে কোথাও ছিটে ফোঁটাও চুন-বালির স্পর্শ নেই। এই মুখ-পোড়া হাড়-বার-করা বৃদ্ধ একলা দাঁড়িয়ে ধুকছে কত যুগ-যুগান্ত কে জানে!

নিযুতি রাতে সমুদ্র কিনারায় একলা বহুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলে ঢেউগুলোর আছড়ে পড়া দেখতে দেখতে মনে হয়, হাতের কাছে যদি এমন কোনো একটা উপায় থাকত যার দ্বারা কোনওক্রমে সমুদ্রটাকে কিছুক্ষণের জন্যে ঠাণ্ডা করে রাখা যেত তবে স্বস্তি পাওয়া যেত। একটার পর একটা ঢেউ অনবরত ঝপাং ঝপাং করে আছড়ে এসে পড়ছে তো পড়ছেই, কিছুতেই বিরাম নেই বিশ্রাম নেই। দেখতে দেখতে শরীরের মধ্যে একটা ভোলপাড় শুরু হয়। একবার যদি কিছু সময়ের জন্যেও চুপ করে তবেই শান্তি।

কিন্তু তা কখনোই হবার নয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডটা তালগোল পাকিয়ে বানিয়ে ব্রহ্ম তার দু হাতের কনুই পর্যন্ত মাখা কাদামাটি পরিষ্কার করবার জন্যেও জলের মধ্যে দু-হাত ডুবিয়ে বেশ করে ধুয়ে ফেলেন। সেই জলে যে দোলা লাগল আজ পর্যন্ত তা আর থামল না। তার আগে নিশ্চয়ই সমুদ্র শান্ত অচঞ্চল ছিল।

কিন্তু এখানে ধরণীর এই অংশটুকু একেবারে বিপরীত। কখনো কোনো কারণে এ নড়ে ওঠে না। সমুদ্রের মতো বালুরাশিও ঢেউ-এর পর ঢেউ তুলে চলে গিয়েছে, গিয়ে আকাশের সঙ্গে মিশেছে। দেখলে মনে হয় একদা এর প্রাণ ছিল সমুদ্রের মতো, তখন এও অশান্ত ছিল। হঠাৎ কোনো এক জাদুমন্ত্রে স্তব্ধ হয়ে গেছে। আজ আর এতে প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই। সমুদ্রের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে নিখিল বিশ্বের বিরাট প্রাণের স্পন্দন স্পষ্ট অনুভব করা যায়। আর সেদিন দুপুরে সেই নিষ্প্রাণ স্তব্ধতার মধ্যে দাঁড়িয়ে জগৎ-জোড়া মৃত্যুর শীতলতার মাঝে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে লাগলাম। জীবন ও মৃত্যু এই দুটির কোনটি যে বেশি শক্তিশালী তাই চিন্তা করতে লাগলাম।

কতক্ষণ একভাবে তাকিয়ে ছিলাম খেয়াল ছিল না। হঠাৎ মনে হল বহুদূরে আমার দৃষ্টির শেষ সীমায় কি যেন নড়ে উঠল। পশ্চিম দিক থেকে হাওয়া আর বালু পূর্বদিকে বয়ে যাচ্ছিল, তার উপর চোখ-ধাঁধানো রোদ। ভুল দেখছি মনে করে দু-চোখ বন্ধ করে রইলাম। কিছুক্ষণ পরে আবার যখন চেয়ে দেখলাম তখন আরও কাছে স্পষ্ট দেখা গেল কি যেন এধারেই এগিয়ে আসছে। একটা বালুর ঢেউ-এর উপর উঠে আবার যখন সামনের ঢেউটার পিছনে নামছে তখন আর দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আবার যখন আর একটা ঢেউ-এর মাথায় উঠে আসছে তখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। দু হাত দিয়ে চোখ রগড়ে নিয়ে এবার ভাল করে চেয়ে দেখি-না, কিছুতেই ভুল দেখছি না-নিশ্চয়ই কিছু একটা এগিয়ে আসছে এদিকে চেয়ে রইলাম মোহাবিষ্ট হয়ে।

ক্রমে সেই কালো বিন্দুটা বড় হয়ে একটা রূপ গ্রহণ করতে লাগল। মনে হল যেন একটা গুরুভার কিছু টেনে আনছে কোনো প্রাণী। আনতে তারও প্রাণান্ত হচ্ছে। রুদ্ধনিশ্বাসে প্রতীক্ষা করছি।

ঐ আবার একটা বালুর টিলার মাথায় উঠেছে! এবার সন্দেহ হল-মানুষ নয় তো? আবার নেমে অদৃশ্য হল। শেষে যখন আবার দেখতে পেলাম তখন আর ভুল হল না-হাঁ মানুষই বটে! কি একটা কাঁধে করে আনতে আনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

তাড়াতাড়ি গুলমহম্মদকে ধাক্কা দিয়ে জাগালাম। উঠে বসে দু-চোখ কচলে বুড়ো ক্ষণিকের জন্যে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। মরুবাসীর অভ্যস্ত চক্ষুকে ফাঁকি দেবার উপায় কি। পরমুহূর্তে লাফিয়ে উঠে একটা চিৎকার করে সেই দিকে দৌড় দিলে। কোনো কিছু চিন্তা করবার পূর্বেই আমিও তার পিছু পিছু ছুটলাম।

সেই তপ্ত বালুর মধ্যে বার দুই-তিন যখন আছাড় খেয়ে যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম তখন আর বাক্যব্যয়ের অবকাশ ছিল না। চোখের পলকে গুলমহম্মদ একটা দেহ কাঁধে তুলে নিল, আর একটাকে আমিও কাঁধে ফেললাম, তারপর সেই স্পন্দনহীন দেহ নিয়ে যতদূর শক্তিতে কুলোল-দৌড়!

দৌড়োবার উপায় কি? ভার কাঁধে বালুর মধ্যে পা বসে যেতে লাগল। সামনে যেতে যেতে গুলমহম্মদ হুঁশিয়ারি করে দিলে, পা যেন না হড়কায়। এখনও হয়তো এদের প্রাণ আছে, আছাড় খেলে জীবনের আর আশা থাকবে না।

পথ আর শেষ হয় না, দালানটা পিছিয়ে যাচ্ছে। শেষে যখন দালানটার কাছে পৌঁছলাম তখন সকলে জেগে উঠেছে। যাবার আগে গুলমহম্মদের চিৎকারে সকলের ঘুম ভেঙে যায়। কিন্তু আমাদের কেউ দেখতে পায়নি। কারণ দালানটার পিছনে পূর্বদিকে আমরা দৌড়েছিলাম।

সকলেই ঘিড়ে দাঁড়াল। কাঁধের বোঝ নামাতে দেখা গেল গুলমহম্মদ যাকে এনেছে সে একটা পুরুষ এবং আমার কাঁধে এসেছে একটি নারী।

আমার দম তখন শেষ হয়ে গেছে। ভার নামিয়ে তার পাশেই বসে পড়লাম।

ভৈরবী একটা কুঁজো নিয়ে ছুটে এলেন। আমি আমার পাশের দেহটাকে দেখিয়ে দিলাম! সঙ্গে সঙ্গে তিনি বসে পড়ে সেই মহামূল্য শীতল জল, যা কাল পর্যন্ত অতি সাবধানে খরচ করা একান্ত প্রয়োজন, তার সবটুকু অকৃপণ হস্তে মাথায় মুখে ঢালতে লাগলেন। যাত্রার পূর্বে হাব নদীর কিনারায় কাকেও এক ফোঁটা কুঁজোর জল না দেবার সেই প্রতিজ্ঞাটার এইভাবে চরম গতি লাভ হল।

মুখে মাথায় জল ঢেলে কি লাভ হবে? আগে দেখা দরকার এখনও শ্বাসটুকু বইছে কিনা।

ভৈরবী তার বুকের উপর মাথা রেখে কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করতে লাগলেন হৃৎপিণ্ডের আওয়াজ। আমি তার একটা হাত তুলে নিয়ে নাড়ী চলছে কি-না দেখবার চেষ্টা করলাম। প্রথমে একেবারেই কিছু বোঝা গেল না, তারপর মনে হল যেন ক্ষীণ, একটা গতি তখনও চলছে।

মেয়েটির বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশী হবে না। রোদে পোড়া ফর্সা রং, হাল্কা ছিপছিপে গড়ন। একটু লম্বা ছাঁদের মুখ, চ্যাপটা বা ভোঁতা নয়। চোখ দুটি সে বুজে আছে। মাত্র দু-আঙুল চওড়া কপালে ভ দুটি পরস্পর ছুঁয়ে আছে, কোঁকড়ানো কালো ঘন চুলে বহুদিন বোধহয় চিরুনি ছোঁয়ানো হয়নি। টিকোলো নাকের বামদিকে একটা সস্তা লাল রঙের পাথর বা কাঁচ বসানো নাক ছাবি। পাতলা ঠোঁট একটু ফাঁক হয়ে রয়েছে। দুই কষ বেয়ে গাঁজলা ভেঙ্গেছে, তার স্পষ্ট দাগ দেখা যাচ্ছে। ভৈরবী ঠোঁটের মধ্যে আঙুল দিয়ে বললেন, দাঁতে দাঁত লেগে আছে বোধ হয় অনেকক্ষণ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে।

ওধারে তখন পোপটভাই, রূপলাল–ওরা সবাই মিলে সেই লোকটাকে নিয়ে ব্যস্ত। তার দেহটা খাড়া করে বমিয়ে মাথায় মুখে জলের ঝাঁপটা দিচ্ছে, তারও জীবনের লক্ষণ নেই। ক্রমাগত ‘হা আল্লা হা আল্লা’ বলছে গুলমহম্মদ আর এধার ওধার ছুটোছুটি করছে।

আমি উঠে দাঁড়ালাম। দালানটার ওধারে হাওয়া একেবারে নেই। বললাম, চলো এদের সামনের দিকে নিয়ে, বাতাস পাওয়া যাবে।

পুরুষটিকে ওরা ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে গেল। ভৈরবী আর আমি মেয়েটাকে তুলতে গেলাম। তার পায়ের দিকে ধরতে গিয়ে ভৈরবী চমকে উঠে ইশারায় আমাকে দেখালেন। শুভ্র নিটোল পা হাঁটু থেকে শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে, পায়ের পাতার উপর রুপোর চওড়া একটা অলঙ্কার আর হাঁটুর উপর দিয়ে ঘাগরার নীচে পা বেয়ে রক্তের রেখা পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। সেই দিকে চেয়ে শিউরে উঠলাম!

ফিরোজা রঙের ঘাঘরা তার পরনে, তাতেও রক্ত লেগে শুকিয়ে শক্ত হয়ে রয়েছে। সরু কোমরে ঘাঘরাটা যেখানে কষে বাঁধা তার উপরে পেটের চামড়া অনেকটা দেখা যাচ্ছে। গায়ে একটা কমলা রঙের কাঁচুলি জাতীয় জামা, মাত্র বুকের উপরের মাংসপিণ্ড দুটিকে ঢেকে রেখেছে। উপরে আধখান বুক গলা পর্যন্ত খোলা। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত খুঁটিয়ে দেখে সন্দেহের অবকাশ রইল না যে হাড় মাংসে রক্তে গড়া এই নিখুঁত বস্তুটির উপর লালসা নখদন্ত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে একে নিংড়ে মুচড়ে দলে থেঁতলে এই অবস্থা করে দিয়ে গিয়েছে।

ভৈরবীর মুখের দিকে চেয়ে দেখলাম তিনি নির্বাক নিস্পন্দ। তাঁর কপালের উপরে একটা শিরা দাঁড়িয়ে উঠেছে। এক হাত ঘাড়ের নীচে আর এক হাত পায়ের নীচে দিয়ে মেয়েটাকে তুলে নিলাম, যেমন করে ঘুমন্ত ছেলে-মেয়েকে ভোলা হয়। ভৈরবী কুঁজোটাকে নিয়ে পিছনে পিছনে এলেন।

দালানের সামনে রকের একধারে তাকে নামিয়ে পোপটভাই আর গুলমহম্মদকে ডাকলাম। কাথীওয়াড়ী ভাইদের মধ্যে পোপটলাল প্যাটেল মুরুব্বী লোক। পাগড়িতে নীচে তার চওড়া কপালে পাঁচ-পাঁচটা সুগভীর রেখা এধার থেকে ওধার পর্যন্ত চলে গেছে। অবস্থাটা তাঁদের বুঝিয়ে দিয়ে আর সকলকে এধারে আসতে বারণ করতে বললাম। সমস্ত শুনে গুলমহম্মদ “হা আল্লা হা আল্লা” বলে কপাল চাপড়াতে লাগল।

আঠার উনিশ বছরের ছোকরা রূপলাল হঠাৎ একেবারে চল্লিশ পার হয়ে পঞ্চাশের কোঠায় গিয়ে পৌঁছল। সকলেই যখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তখন সে সমস্ত দলটার নেতৃত্ব গ্রহণ করলে। অভাবনীয় অসহায়তার মধ্যে দুটো জীবন বাঁচাতে গেলে যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় উপস্থিত বুদ্ধির, আর হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তার দ্বারা যতটা সম্ভব চেষ্টা করবার- তখন রূপলাল- আমাদের চেয়ে অর্ধেকের কম বয়সের ছড়িওয়ালা, সবাইকে সাহস দিয়ে হুকুম দিয়ে কাজ করাতে লাগল, যেন এ রকমের দু-চারটে কাণ্ড এই বয়সেই তার দেখা হয়ে গেছে।

এই যাত্রায় আগাগোড়া দেখেছি যে, এই ছোকরা সারাদিন হয় চুল আঁচড়াচ্ছে, শিস দিচ্ছে, মুহব্বতকী গীত চালাচ্ছে, নয়তো লম্বা কলকেয় কষে দম দিচ্ছে; কিন্তু ঠিক প্রয়োজনের মুহূর্তে এর মধ্যে থেকে আর একটি মানুষ আত্মপ্রকাশ করেছে, যে জন্মেছে এই মরুসমুদ্রের কাণ্ডারী হয়ে, যার বাপ-ঠাকুরদাদা একের পর এক এই কর্ম করতে করতে শেষে নিজেরা পার হয়ে চলে গেছে ওপারে।

ততক্ষণে লোকটার একটু একটু জ্ঞান ফিরে আসছে। তার গা থেকে ছেঁড়া শার্টটা খুলে ফেলে দিয়ে তাকে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রূপলাল তখনও মুখে জলের ছিটা দিচ্ছিল। সেখান থেকেই আমাকে বলল গরম চায়ের ব্যবস্থা করতে। এদের গরম চা খাওয়ানো জরুরি প্রয়োজন। তৎক্ষণাৎ ছোট ভাই সুখলাল, আরো কয়েকজন জল গরম করতে লেগে গেল।

কুয়ার জল তখনও রোদের জন্য গরম ছিল। আমাদের সঙ্গে বালতি একটি, অন্য সকলের লোটার গলায় দড়ি বাঁধা; সকলেই নিজ নিজ লোটায় জল এনে ভৈরবীর বালতি ভরতি করে দিলে। আমি সেই জল ঢালতে লাগলাম আর ভৈরবী মেয়েটার শরীর থেকে রক্ত ঘষে তুলে দিলেন।

অনেক চেষ্টায় পরিষ্কার করে,কাঁচুলি আর ঘাঘড়া ছাড়িয়ে ভৈরবীর একখানা শাড়ি জড়িয়ে যখন তাকে তুলে এনে কম্বলের উপর শোয়ানো হল তখন একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে সে পাশ ফিরলে। পোপটলাল ভাই তার নিজের কম্বলখানা এনে তার পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিলেন। এ সময় শরীর গরম থাকা একান্ত প্রয়োজন। রূপলাল একটা চামচ দিয়ে গরম চা তার মুখের মধ্যে দেবার চেষ্টা করে দেখলে তখনও দাঁত ছাড়েনি। পুরুষটি তখন খানিকটা চা খেয়ে কম্বল চাপা দিয়ে শুয়েছে। ভৈরবী পুনরায় স্নান করতে গেলেন। আমি মেয়েটির পাশে বসে রইলাম।

বেলা পড়ে আসছে, রোদের তাপ অনেকটা কমেছে। আমাদের বেরুবার সময় হয়েছে নিশ্চয়ই, কিন্তু কেউ একবার সে কথা মনেও করছে না। সকলেই এদের নিয়ে ব্যস্ত। ফাঁক পেয়ে ওধারে বড় কলকেয় আগুন দিয়ে সকলে গোল হয়ে বসেছে, সেখানে চাপা গলায় কি সমস্ত আলাপ হচ্ছে-হয়তো এদের সম্বন্ধেই। এরা কারা, কোথা থেকে আসছে, কি করে এদের এ দশা হল, এই রকম অনেক প্রশ্ন সকলেরই মনে তোলপাড় করছে। কিন্তু কে উত্তর দেবে যতক্ষণ না এদের জ্ঞান ফিরে আসে!

আমি বসে আছি। ডান পাশে মেয়েটি কম্বল-চাপা পড়ে আছে। ক্রমে তার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসছে। যেন সে ঘুমোচ্ছে। ভিজে কোঁকড়ানো চুলগুলির কয়েক গোছ মুখের উপর এসে পড়েছে। হঠাৎ মেয়েটি ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। কপালের উপরের চুলগুলি সরিয়ে দিয়ে তাকে জাগাবার চেষ্টা করলাম। কোনো ফল পাওয়া গেল না। তখনও বেঁহুশ অবস্থা, সেই অবস্থাতেই সে দু-হাতের মুঠোয় আমার হাতখানা চেপে ধরে আবার চুপ করল। যেন একটা আঁকড়ে ধরবার মতো অবলম্বন পেয়ে নিশ্চিন্ত হল।

ঠিক এমনই হয়। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের ফলে উলঙ্গ ভবিতব্যের হাঁ-করা মুখগহ্বরে ঝাঁপ দেওয়া ভিন্ন যখন আর কোনো উপায়ই থাকে না, তখন আর চেনা অচেনা, আত্ম-পর, জাত-বেজাতের প্রশ্নই ওঠে না। কণামাত্র সহানুভূতি, একবিন্দু সাহায্যে-যা কেবল মানুষের কাছ থেকেই পাওয়া সম্ভব-তার জন্যেই মানুষের কাছেই আমরা আছড়ে গিয়ে পড়ি। মানুষ পেলেই হল, তা সে যত দুর্বলই হোক না কেন। তাকেই আঁকড়ে ধরা তখন পরম সান্ত্বনা।

উট দুটিকে নিয়ে দিলমহম্মদ ফিরে এল। সঙ্গে নিয়ে এল একটা ছোট গলায় ঝুলাবার

হারমোনিয়াম, একটা কাঁধে ঝোলবার ঝুলি, আর একখানা পাতলা ফুলকাটা জরির ফিতে বসানো মেয়েদের চাদর, যাকে বলে ওড়না। নদীর মাঝে এক জায়গায় কুড়িয়ে পেয়েছে। কুলিটির মধ্যে পাওয়া গেল তিনটি হাড়ের চৌকা পাশা, দু-ছড়া পায়ে বেঁধে নাচবার ঘুঙুর, আরশি চিরুনি, ঠোঁটে গালে মাখবার এক শিশি রঙ, আরও এই রকমের কয়েকটি টুকিটাকি জিনিস। আর একখানা ছাপানো শাড়ি, একটা পায়জামা, নগদ এগারো টাকা কয়েক আনা পয়সা। এধারের অবস্থা দেখে শুনে দিলমহম্মদের সমস্ত শরীরে রক্ত মুখে এসে জমা হল। একেই সে কথা কম কয়, দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বার-দুই উচ্চারণ করলে, “হারামিকো বাচ্চা, শয়তানকো বাচ্চা লোগ!” তার মুখের অবস্থা দেখে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস হলো না কারও।

সেই রাত সেখানেই থাকা ঠিক হল। এদের এ অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়া যায় না, সঙ্গে নিয়ে যাওয়াও এখন সম্ভব নয়। এক প্রশ্ন পানীয় জলের। জল যা আছে তাতে সারারাতে অভাব হবে না বটে, কিন্তু তারপর? ঠিক হল, ভোররাতে দিলমহম্মদ যখন উটেদের নিয়ে নদীর ধারে চরাতে যাবে তখন এক-একজন দুটো করে খালি কুঁজো লাঠির দু-মাথায় বেঁধে তার সঙ্গে গিয়ে জল ভরে আনবে। নদী তো মাত্রই আড়াই ক্রোশ। সুতরাং পরোয়া নেই, আজ রাতটা আর কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এদের অবস্থা কি দাঁড়ায় দেখে তারপর যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে।

মেয়েটিকে নিয়ে ভৈরবী এক ধারে আর আমরা সকলে আর এক ধারে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। মালপত্র সহ উট দুটিকে দালানের সামনে রেখে দিলমহম্মদ ও গুলমহম্মদ সেখানেই আসন বিছাল, সদাজাগ্রত রূপলাল রোয়াকের উপর বসে একটা জুতসই মুহব্বতি গীত ধরলে।

শহর শোনবেণী হটতে হটতে একেবারে সমুদ্রের কিনারায় গিয়ে আস্তানা গেড়েছে। এমনই অশুভ লগ্নে লাসবেলা রিয়াসতের সুন্দরী রাজধানীর সঙ্গে আমাদের শুভদৃষ্টিটা হল যখন রস নামক পদার্থটি শরীরে মধ্যে থেকে বাষ্প হয়ে বেরিয়ে একেবারে উবে গিয়েছে। ফলে মোট দুই রাত দুই দিন ধরে সেখানকার ঘরকন্নার শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত আমাদের চক্ষু কর্ণ নাসিকা জিহ্বা ত্বক এর একটিরও তৃপ্ত হবার মতো কোন কিছুই জুটল না সেখানে।

বেলা বোধ হয় তখন বারোটার ঘরও ছাড়িয়ে গিয়েছে। উট দুটোর দুই কষ বেয়ে ফেনা দেখা দিয়েছে। আমাদের কুঁজোয় যেটুকু জল অবশিষ্ট আছে তাতে এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে চায়ের পাতা একমুঠো তার ভেতরে ফেলে দিলে সাভ্যালির গরম এক কাপ চা তৎক্ষণাৎ হাতে হাতে মেলে। সে সময় আমরা ঠিক হাঁটছিও না, হামাগুড়িও দিচ্ছি ও না, এই দুই-এর মাঝামাঝি একটা কসরত করে মোটের উপর দেহটাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি।

সর্বশেষ একটা বালির স্কুপের উপর উঠে চোখে পড়ল- চোখে পড়ল না বলে বলি আবির্ভূত হল-নীল-নীলে নীল একখানা ঢাকনা-নিরাবরণ কুশ্রী ধূসর ধরণীর সকল লজ্জা নিবারণ করে আকাশের গায়ে মিশে গিয়েছে। দৌড়ে নেমে গিয়ে ঐ নীলের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলবার একটা অদম্য বাসনা ভিতরে তোলপাড় করতে লাগল। বামদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলাম, দূরে সাগরের জল ছুঁয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে শহর শোনবেণী। নামতে শুরু করলাম।

সমাপ্তি সব কিছুরই আছে। সুতরাং হাড় মাংস অস্থি মজ্জার পিণ্ড দেহটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলারও সমাপ্তি হল। চারিদিকে গোল করে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো একটা ইঁদারার ধারে দেহটাকে আছড়ে ফেললাম। কুয়ার পিছনেই হাত ত্রিশেক দূরে ধর্মশালা। থাকুক-ত্রিশ হাত তখন তেত্রিশ ক্রোশের ধাক্কা। শরীর যখন উঠতে পারবে নিজে থেকে, তখন উঠবে গিয়ে ঐ ধর্মশালায়। আমার দ্বারা আর এক ইঞ্চিও একে বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানেই শুয়ে পড়লাম।

জায়গাটায় ছায়া ছিল, অনবরত জল পড়ার দরুন শীতলও ছিল। ডান পাশ ফিরে মাথার উপর মাথা রেখে চোখ বুজলাম।

আগের দিন ঠিক এমনি সময় যা ঘটছিল আর তখন আমাদের মনের মধ্যে যা হচ্ছিল, সেই সমস্ত আগাগোড়া স্মরণ হল। সকালের রান্না-খাওয়ার পাট চুকলে পর দলসুদ্ধ সবাই একেবারে অস্থির-কতক্ষণে বেরিয়ে পড়া যাবে। অনর্থক অনেক সময় নষ্ট হয়েছে, উড়ে এসে ঘাড়ে পড়া বাজে ঝাটের দরুন। নয়তো কাল ঠিক এমনি সময় এই শোনবেণীতে আমরা পৌঁছে যেতে পারতাম। কমবেশি সকলে সেই আপশোসেই কাল এমন সময় পস্তাচ্ছিলাম। কিন্তু যথাকালে শোনবেণী পৌঁছে একটি প্রাণীর মুখেও ‘রা নেই। শান্তি বা স্বস্তি বোধ করা অনেক দূরের কথা-আমি নামক চিড়িয়াটি শরীর নামক খাঁচাটির মধ্যে টিকে আছে না উড়ে গেছে তাও মোল আনা মালুম হচ্ছে না।

এরই নাম বোধ হয় ব্যাগার খাটা! ব্যাপার, তা সে ভূতেরই হোক আর ভবিষ্যতেরই হোক, মোটের উপর ব্যাপার হচ্ছে সব সময়েই বিড়ম্বনা। যে কাজে স্বাধীনতা নেই তাতে আনন্দের লেশমাত্র থাকতে পারে না। কি অপরিসীম উৎসাহ বুকে নিয়ে মহানন্দে কাল সন্ধ্যায় আমরা পথ চলা শুরু করি। শেষ রাতের দিকে সেই আনন্দ, উৎসাহ কোথায় কর্পূরের মতো উবে গেল যখন আস্তে আস্তে ভিতরে জন্মাতে লাগল একটা নিরীহ বাসনা-এবার থামলে হত। তার পর থেকে আরম্ভ হল গরজের তাগিদে হাঁটা। শরীর পারছে না, মন মুখ ফিরিয়ে জবাব দিয়ে বসেছে; কিন্তু চলতেই হবে, সামনে এগিয়ে যাওয়া ভিন্ন উপায়ান্তর নাস্তি। ঠিকানায় পৌঁছে থামা মানে চিরকালের মতন চলার চরম বিরতি। কাঁধের কুঁজোর মধ্যে আছে জীবন, সেইটুকু নিঃশেষ হবার পূর্বেই যেভাবে হোক পৌঁছতে হবে সেখানে যেখানে কুঁজো পুনর্বার পূর্ণ করা যাবে। তার পূর্বে মন বা শরীর কেঁদে মাথা খুঁড়ে মলেও তাদের আবদার রক্ষা করা সম্ভব নয়।

সকালে সূর্যদেব যথারীতি উদয় হলেন। কিন্তু মার্তণ্ড ভৈরবকে আমরা কেউ হাত জোড় করে স্বাগত জানালাম না। প্রণাম করার বদলে সভয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম উদিত আদিত্য রক্তচক্ষু নিয়ে তেড়ে আসছেন আমাদের পাকড়াও করবার জন্যে। তখন সকলের মনে একটিমাত্র প্রশ্ন –”আর কতদূর?” কোনোক্রমে ইনি মাথার উপরে এসে পৌঁছবার পূর্বেই একটা যে কোনো রকমের আশ্রয়ের তলায় আমরা নিজেরা মাথা গুঁজতে যদি পারি সেই আশায় মানুষ কজন আর উট দুটির কি আপ্রাণ চেষ্টা!

কিন্তু তা কি কখনো হয়? পথ কি কারো ব্যাকুল কামনায় কমে? বরং আরও দীর্ঘ হয়। নিজের মধ্যে আকুলি-বিকুলি যত বাড়তে থাকে, পথও সেই অনুপাতে ক্রমাগত লম্বা হয় আর ঠিকানা যায় পিছিয়ে। তখন আরম্ভ হয় প্রাণহীন পথ আর সজীব পথিকের মধ্যে রুদ্ধশ্বাস সগ্রাম, শেষ পর্যন্ত পথ বা পথিক যার জিত হয়, সেই থাকে টিকে। হয় পথ খতম হয়, নয় পথিক সেই পথের বুকেই অন্তিম শয্যায় লুটিয়ে পড়ে। তখন সেই হতভাগ্যে আর তার পথ চলা দু’এরই চিরতরে সমাধি রচিত হয় পথের উপর।

এই জীবনটা কি? সূতিকাগৃহ থেকে যাত্রা শুরু পরে শ্মশান পর্যন্ত পৌঁছবার সময়টুকুর নামই তো জীবন। সেই শ্মশান পর্যন্ত পৌঁছতে কেউ হয়তো দীর্ঘদিন ধরে নানা সড়ক ঘুরে বহু ঘাটের লোনামিঠা পানি গিলে টালবাহানা করে লম্বা দেরি করে ফেলে- কেউ বা সোজা-পথে সট করে গিয়ে পৌঁছয়। কিন্তু সূতিকাগৃহ থেকে শ্মশান পর্যন্ত পথটুকু চলতে যদি ব্যাগার খাটার দিকদারি না ভোগ করতে হয় তবেই না জীবনের সার্থকতা। স্বাধীনভাবে বুক ফুলিয়ে ভালোটা মন্দটা চাখতে চাখতে মর্জিমতো থেমে জিরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে খুশি মনে তবে আসি’ বলে পথের কাছে থেকে বিদায় নেওয়ার নামই জীবন্ত মৃত্যু অর্থাৎ সার্থক যবনিকা-পতন।

কিন্তু এই আকাশ-কুসুম কজনের ভাগ্যে জোটে। স্রোতের মুখে খড়কুটোর মতো ভাসতে ভাসতে ঠোক্কর খেতে খেতে উদ্দেশ্যহীন যাত্রার হঠাৎ যেখানে চরম ছেদ পড়ে তখন তাকে যেমন না বলা যায় মৃত্যু, তেমনি গুমরে কাঁদতে কাঁদতে অনিচ্ছায় পথ চলাটাকে কোনোরকমেই জীবন বলা চলে না। বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া-দুটোই এক বিরাট ফাঁকি হয়ে দাঁড়ায়। তাই বিদায়ের ক্ষণে সকরুণ হা-হুঁতাশ ছাড়া জমার ঘরে কিছুই পড়ে থাকে না। এরই নাম বেঁচে থাকার নির্মম পরিহাস।

তবে এবারের মতো যখন পথই খতম হয়েছে এবং আমি এখন পর্যন্ত তা হইনি তখন চোখও খুলতে হয়, উঠেও বসতে হল ছড়িওয়ালা রূপলালের তাড়নায়। ততক্ষণে মালপত্র নামানো হয়েছে, উটেরা আমার পায়ের কাছে এসে বসে পড়েছে, দিলমহম্মদও শিকল-বাঁধা বালতি দিয়ে কপিকলের সাহায্যে ইঁদারা থেকে জল তুলে বাঁধানো নালায় ঢালছে, দুটো উট আর নালায় মুখ জুড়ে চো চো করে সেই জল শুষছে। আমি মাথাটা বালতির নিচে এগিয়ে দিলাম। বালতি বালতি জল মাথা বেয়ে নালায় পড়ে উটের পেটে গিয়ে ঢুকল। ধড়ে প্রাণ ফিরে এল।

ধর্মশালাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং চুনবালি ধরানো। এমনকি জানালা দরজাগুলিতেও রং দেওয়া। মাড়োয়াড়ীর তৈরি বাড়িটিতে রামসীতার একটি ছোট মন্দিরও রয়েছে। কেবলমাত্র যে হিঙলাজ-যাত্রীদের জন্যই এই ধর্মশালার প্রয়োজনীয়তা তা নয়, শোনবেণীতে এবং এই রিয়াসতের আরও বহুস্থানে রাজস্থানবাসী কারবারি লোক অনেক আছেন, তাঁদের সকলের জন্যে রাজধানীতে এটা একটা মজবুত আশ্রয়স্থান। দূর-দূরান্তরে পাহাড়ে জঙ্গলে দ্বীপে মরুভূমিতে, একেবারে কল্পনায়ও আসে না যে সেখানেও হিন্দু-মারোয়াড়ী থাকতে পারেন, এমন স্থানেও গিয়ে দেখা যাবে, অপরিসীম ধৈর্যের অধিকারী এই বেনিয়ারা স্বচ্ছন্দে ব্যবসা বাণিজ্য চালাচ্ছেন এবং পয়সাকড়ি কামিয়ে একটা ধর্মশালা তুলেছেন এবং একটি মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করেছেন। এঁরাই সার্থক বলতে পারেন দেশে দেশে মোর ঘর আছে!

এখানকার বাড়িঘর সব পুবমুখী, সমুদ্রের দিকে পিছন ফিরে রয়েছে। ধর্মশালাটির দু-পাশে দু-খানি লম্বা ঘর। মাঝে চৌকো দালান, তার সামনে রোয়াক। রোয়াকের নীচে বাঁধানো উঠান। ছোট মন্দিরটি উঠানের এক কোনায়। মন্দির উঠান সমস্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার বাইরে প্রকাণ্ড ইঁদারা-সারা শহরের ইতর দ্ৰ হিন্দু মুসলমান সকলের পানীয় জল পাবার একমাত্র উপায়। দারা সরকারি সম্পত্তি, বাঁধানো হয়েছে সিমেন্ট পাথর দিয়ে ধর্মশালার প্রতিষ্ঠাতার অর্থে। পাঁচিলের গায়ে ধর্মশালায় প্রবেশের ফটক। মাথায় জল ঢালার পর ফটক পেরিয়ে ধর্মশালায় গিয়ে ঢুকলাম।

রোয়াকের উপর সকলে বসে পড়েছে। অনেকে দড়ি-বাঁধা লোটায় জল এনে মুখ হাত ধুচ্ছে। কে ভৈরবীকেও এক বালতি জল এনে দিয়েছে। বালতিটা সামনে নিয়ে তিনি থামে ঠেস দিয়ে বসে আছেন-একখানা ভিজে গামছায় তাঁর মুখ মাথা গলা পর্যন্ত ঢাকা। ভৈরবী বসে আছেন-হুঁশ আছে কি না বোঝা গেল না, আর তাঁর গা ঘেঁষে বসে রয়েছে সেই মেয়েটি। নাম তার কুন্তি বাই।

কুন্তিকে আনা হয়েছে ভৈরবীর সঙ্গে উটের খাঁটিয়ার মধ্যে শুইয়ে। কাল যাত্রাকালেও তার দাঁড়াবার সামথ্য হয়নি। উটের উপর ভৈরবী তাকে সারাটা পথ খেজুর আর বাদাম খাইয়ে এনেছেন। এই প্রথম তাকে খাড়া হয়ে বসতে দেখে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেল।

শ্রীমান থিরুমল কিন্তু আমাদের সঙ্গে পায়ে হেঁটেই এসেছে। তবে সমস্ত পথটা দুজন দু-পাশে থেকে তাকে একরকম টানতে টানতে এনেছে। বেদম প্রহারের চোটে বেচারার হাড়গোড় বোধহয় আস্ত নেই। পণ্ডিত রূপলালের বড় কলকের টানের গুণে সেও অনেকটা সামলে গেছে। এ পর্যন্ত কেউই তাদের কোনো কথা জিজ্ঞাসা করেনি। মাত্র নাম দুটো জেনে নেওয়া হয়েছে আর জানা গেছে তারা রাজপুতানার বিকানীরের কাছে একটা গ্রামের ছেলে মেয়ে-বর্তমানে যাযাবর বেদে।

ক্রমে ধাতস্থ হয়ে যে যার কম্বল বিছিয়ে ভিন্ন ভিন্ন সীমানা নির্দিষ্ট করে গুছিয়ে বসল। হাতে অঢেল সময়। এই মুল্লুকের রাজকর্মচারীরা যাত্রী পিছু এক টাকা চৌদ্দ আনা কর নিয়ে নিজেদের খাতাপত্রে আমাদের জমা করে ছাড়পত্র দিলে তবে আবার রওনা হয়ে যাবে। সুতরাং আপাতত নিশ্চিন্ত।

ধর্মশালায় শিলনোড়া রয়েছে, ইঁদারার আশেপাশে পুদিনার জঙ্গল। পুরানো তেঁতুল আমাদের ঝোলায়। শ্রীমান সুখলাল কালবিলম্ব না করে বাটতে বসে গেল পুদিনা আর তেতুল। আজ ভাগ্যে মহাভোজ।

হইচই করে ভোজ্য বানানো আরম্ভ হল। আমাদের মধ্যে এতেও যাঁদের উৎসাহে ভাটা পড়েনি, তারা ছুটলেন শহরের বাজারে কিছু পাওয়া যায় কি-না দেখতে। পাওয়া গেল ব্যাসম আর ছাগল দুধের দই। তাই নিয়ে তারা ফিরে এলেন। সেই ব্যাসম আর ছাগলের দুই পাতলা করে জলে গুলে নুন আর লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে এক কড়াই জ্বাল দিয়ে কাথিওয়াড়ী ভাইরা মহা আরামে রুটি ভিজিয়ে ভোজন করলেন। সেই মহা সুখাদ্য এক লোটা আমাদের জন্যেও এল, রূপ দেখে আর গন্ধ শুঁকে সে পদার্থ মুখে দিতে সাহস হল না। সুখলাল আর কুন্তী সবটুকু চেটেপুটে শেষ করলে।

খাওয়া-দাওয়ার পালা সাঙ্গ হলে আমি আর গুলমহম্মদ বাইরে কুয়োর পাড়ে গেলাম শুতে। ধর্মশালার ভেতরটা তেতে আগুন হয়ে উঠেছে, তার উপর মাছিরা সবংশে সমুপস্থিত ত রয়েছেই। বাইরেও সুবিধা হল না, নাগরিকারা জলকে এসেছেন, ‘গাগরি ভরণে’ নয়, ছাগলের চামড়ার খোল ভরণে।

তখন আর কি করা যাবে, নিদ্রার আশা ত্যাগ করে আমরা দুজনে শহর দেখতে বার হলাম।

দেখার মতো আশ্চর্য শহরই বটে। ধর্মশালার পশ্চিমে মিনিট পাঁচেক মাঠ আর কাঁটাঝোঁপ পার হয়ে শহরে গিয়ে ঢাকা গেল। প্রথমেই বাজার। পূর্ব পশ্চিমে লম্বা পাশাপাশি পাঁচ-ছটি চালা, এত নীচু যে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয়। আঁকাবাঁকা তেউড়ানো গাছের ডালের খোটা পুঁতে তার উপর ঘরের চাল। চাল ঢাকা হয়েছে যা হাতের কাছে মিলেছে তাই দিয়েই। কম্বলের টুকরো, ছেঁড়া চট, তার উপরে আলকাতরা মাখানো কাটা ত্রিপল, কোরোসিনের টিন চ্যাপটা করে আটকানো হয়েছে ঘরের চালে, বাজারে যে সমস্ত মালপত্র এসেছে তার বাক্সগুলোর কাঠও ব্যবহার করা হয়েছে। শুকনো ছাগলের চামড়াও বাদ পড়েনি। এক কথায় কিছুই বাদ পড়েনি বা ফেলা যায়নি। ফেলনা যা কিছু সব তুলে দেয়া হয়েছে ঘরের চালে। এই রকমের এক-একটা লম্বা চালার নীচে আট-দশটা দোকান। দোকানগুলিতে চব চুষ্য লেহ্য পেয় সব রকমের দাবি মেটাবার রসদ রয়েছে। তার সঙ্গে শয্যা বস্ত্র দাওয়াই কোনো কিছুরই অভাব নেই।

দুটো চালার মাঝখানে যে রাস্তা-যে রাস্তা দিয়ে খরিদ্দার-লক্ষ্মীরা শুভাগমন করেন। দোকানে-সেই হাত দশেক চওড়া রাস্তার দু-পাশে চার হাত করে বাদ দিলে মাঝখানে যে দু-হাত চওড়া স্থানটুকু থাকে, তার উপর কাঠ, চট-চামড়া, লোহার টুকরো, চাবড়া চাবড় পাথর ইত্যাদি দুনিয়ার সমস্ত প্রকার ফালতু জিনিস বিছিয়ে দিয়ে রাস্তার মাঝখানটা খানিক উঁচু করে জাগিয়ে রাখা হয়েছে, তার দু-ধারে একহাঁটু পচা পাক। দোকানগুলিতে প্রবেশ করার জন্য রাস্তার মাঝের সেই উঁচু আল থেকে দরজা পর্যন্ত লম্বা তক্তা বা লোহা ফেলে রাখা হয়েছে। মোটের উপর রূপে রসে গন্ধে সমগ্র বাজার এলাকাটি যাকে বলা চলে গুলজার করা একটি আদর্শ নরক।

তার মাঝে কাফিখানায় গ্রামোফান বাজছে। দেওয়ালে ঝুলছে সুন্দরী সিনেমা তারকাদের সদাহাস্যমুখ ফোটোগুলো। গোলমাল হাসিঠাট্টা আনন্দ-স্কৃর্তির কিছুমাত্র অভাব নেই। হাঁটু মুড়ে নিচু হয়ে দু-একখানা দোকানে ঢুকে দেখলাম-বস্তা বাক্স গামলা টিন সমস্ত খিচুড়ি পাকিয়ে টাল দেওয়া হয়েছে, মাছিতে সমস্ত কালো হয়ে গিয়েছে। তারই মাঝে কপালে চন্দন কুমকুম লাগিয়ে খুঁড়ি বার করে গেঞ্জির সামনেটা বুকের উপর তুলে, হৃষ্টপুষ্ট রাজস্থানী বেনিয়া মহাজন পরম নিশ্চিন্তে বাম হাতে শরীরের বিশেষ এক অংশ কয়ন করতে করতে ডান হাতে খেরো-বাধানো লম্বা খাতায় জমাখরচ লিখছেন।

গুলমহম্মদ অনেকের সঙ্গে ‘সালাম আলেকুম’ আর ‘আলেকুম সালাম সারতে লাগল। ভ্যাপসা দুর্গন্ধের হাত থেকে পরিত্রাণ পাবার আশায় আমি তাড়াতাড়ি পশ্চিম দিক দিয়ে বাজার থেকে বেরিয়ে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

বাজারের পশ্চিমপ্রান্ত থেকে একেবারে সমুদ্রের কিনারা পর্যন্ত বস্তি, তা প্রায় মাইল খানেক হবে। কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ি সমস্ত স্থানটি জুড়ে যার যেমন খুশি বসে আছে। কোনো শৃঙ্খলা নেই। কোনো পরিকল্পনার ধার ধারবার প্রয়োজন বোধ না করে শহর যাঁরা গড়েছেন তারা বাসস্থান বানিয়েছেন। রাস্তা বা গলি এ সমস্তর কোনো হাঙ্গামা নেই। সর্বত্রই পথ, অথবা কোথাও পথ বলতে কিছু নেই। যেখান দিয়ে ইচ্ছে যেমন ভাবে খুশি সব বাড়িতে যাওয়া-আসা যায়। দেখলে মনে হবে মহাশূন্য থেকে মুঠো মুঠো ঘরবাড়ি কে যেন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, সেগুলো সমুদ্রের জলে না পড়ে ছত্রাকার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আছে ডাঙ্গায়।

শহরের ঘরবাড়ির অবস্থা অধিকাংশই বাজারের চালাগুলির মতো; আবার বালি মাটি পাথর জমানো দেওয়ালের উপর স্লেট-পাথরের ছাদওয়ালা অট্টালিকাও রয়েছে। অনেক বাড়ির মেঝে সিমেন্ট করা, কিন্তু সমস্ত ইমারতই বেঁটে। এই খর্বকায় গৃহনির্মাণের হেতু পশ্চিম দিক থেকে আগত সমুদ্রঝড়। এ দেশে ঝড়ের মরশুম বলে কোনো কিছু নেই, যখন-তখন এলেই হল, দু-পাঁচ মিনিট বা বড়জোর আধ ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে তাড়াতাড়ি পূর্ব দিকে বেগে প্রস্থান, এই হচ্ছে এখানকার ঝড়-জলের রীতি।

বস্তি উত্তর-দক্ষিণ অনেকদূর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এই শহরের বাসিন্দার সংখ্যা কত তার হিসাব দেখবার কেউ নেই। তবে ঘরবাড়ি দেখে ধারণা হল, নেহাত কম ও হবে না। বাংলাদেশের বেশ বড় একটি পল্লীগ্রাম। শহরসুদ্ধ লোকের পেশা সমুদ্রে মাছ ধরা, সেই মাছকে শুঁটকিতে পরিণত করা এবং সেই শুঁটকি মাছ বস্তাবন্দি করে সমুদ্রপথে বা উটের পিঠে করাচী চালান দেওয়া। শহরময় যত্রতত্র ছোট বড় নানা আকারের মাছ-ধরা জাল দেখে এই ধারণাই হল।

শহর ভ্রমণ করতে করতে এ কথা বুঝতে কষ্ট হল না যে, এখানকার লোকে ঝটার ব্যবহার জানে না, এবং আস্তাকুঁড় বলতে কোনো কিছুর বালাই এখানে নেই। ছাই পাশ, পেঁয়াজ, ডিমের খোলা, পশুপাখির চামড়া পালক হাড়গোড়, মানুষ জীবজন্তুর বিষ্ঠা-এক কথায় যা কিছু ফেলে দেওয়া প্রয়োজন-সমস্তই সারা শহরের রাস্তাময় ছড়ানো রয়েছে। বিকারহীন শহরবাসী পরম সন্তোষে এরই মধ্যে বসবাস করছে, গৃহস্থালী করছে, বিয়ে-সাদী সন্তানপালন সমস্তই করছে। সাবাস না দিয়ে উপায় কি!

গুলমহম্মদের পরামর্শমতো, উত্তর দিকে যেখানে শহর শেষ হয়েছে সেই পর্যন্ত গিয়ে এখানকার সরকারি কাছারি পাওয়া গেল। পাকা দালান, উপরে টিন, অনেকটা আমাদের পুলিশ ফাঁড়ির মতো দেখতে। কেউ কোথাও নেই। একটি জোব্বা পরা স্ত্রীলোক এক কোনায় বসে মুরগির পালক ছড়াচ্ছিল। সে বললে যে সরকারি হুজুররা সকালে উপস্থিত থাকেন। শুনে ফিরলাম। কিন্তু আর শহরের ভিতর দিয়ে নয়, সমুদ্রের কিনারায় আরও উত্তরে খানিক এগিয়ে তারপর শহরের পাশ কাটিয়ে পূর্বদিকে মাইল দেড়েক হেঁটে প্রায় সন্ধ্যার সময় ধর্মশালায় এসে উঠলাম।

ধর্মশালার উঠানে রামসীতার মন্দিরের সিঁড়িতে তখন জমজমাট কাণ্ড। বিশ পঁচিশজন নানা বয়সের মারোয়াড়ী মহিলা লাল রঙের উপর কালোর বিচিত্র বরফি কাটা ওড়না জড়িয়ে সেই ওড়নায় মুখ ঢেকে অথচ সমস্ত উদর মায় নাভীর নীচে পর্যন্ত খোলা রেখে বিস্তর ঘেরওয়ালা নানা রঙের ঘাঘরা পরে উপস্থিত হয়েছেন। তারা সমস্ত স্থানটুকু জুড়ে ভৈরবীকে ঘিরে বসে গান আরম্ভ করে দিয়েছেন। প্রায় প্রত্যেকের সামনেই একখানি করে থালি। থালিতে রয়েছে সিঁদুরের দাগ দেওয়া ছোবড়াসুদ্ধ এক-একটি নারকেল, হলুদ ছোপানোসুতার গুচ্ছ-আর কিছু কিছু শুকনো মেওয়া মিছরি। বাংলাদেশের এক আওড়াৎ হিংলাজ-দর্শনে চলেছেন এই সংবাদ শুনে তীর্থযাত্রিনীর দর্শনলাভের জন্যে এই সমস্ত দ্রব্যসামগ্রী নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন এঁরা। এগুলি মাতা হিংলাজের পূজার উপাচার, আপাতত হিংলাজ মায়ীর একটি বন্দনা গীত চলেছে। হঠাৎ এ-হেন স্থানে এই অকল্পনীয় ব্যাপার দেখে থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।

মহিলারা চলে গেলেন। পণ্ডিত রূপলাল সযত্মে নারকেল এবং মেওয়া-মিছরিগুলি পোটলা বাঁধলে। লালপাড় একখানি কোরা কাপড় পরা একটি মেয়ে এসে আমার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে। এ আবার কে! চমকে উঠলাম। প্রণাম সেঁড়ে উঠে দাঁড়াতে দেখি-আমাদের কুন্তি।

মাথায় সাবান ঘষে স্নান করেছে। অপর্যাপ্ত রুক্ষ চুল ঘোমটার ভিতর থেকে বেরিয়ে মুখের দু-পাশ আবৃত করে নেমে এসে বুকের উপর ছাপিয়ে পড়েছে। ভাল করে স্নান করবার ফলে শরীরের গ্লানি সাফ হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে নূতন শাড়ি পরে আসা এই মেয়েটির সারা শরীরে যে স্নিগ্ধ শুচিতা আর শ্রী ফুটে উঠেছে তা দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। পরশুদিন যাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে এনেছিলাম এ যেন সে নয়, সে ছিল একটা জড়পদার্থ, আজ এতক্ষণে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।

ভৈরবী কুন্তিকে চায়ের জল চড়াতে বললেন। কুন্তি চলে গেল। এই অপূর্ব সৌষ্ঠববতী তৰঙ্গী মেয়েটির চলার দিকে চেয়ে রইলাম।

সেইখানেই মন্দিরের সিঁড়ির উপর বসলাম। মন্দিরে একটি প্রদীপ জ্বলছে। মাথার উপরে অনেক উঁচুতে অনেকগুলি দীপ একসঙ্গে মিটমিট করে জ্বলে উঠল। সমুদ্র থেকে গুরুগম্ভীর ধ্বনি মিষ্টি হাওয়ায় ভেসে আসছে। বাইরে আমাদের উট-দুটির গলার ঘণ্টার টিং টিং আওয়াজ হচ্ছে। সমস্ত কিছু মিল মিশে সন্ধ্যারতির সমস্ত আয়োজন যেন সম্পূর্ণ করে তুলেছে। স্থান কাল অবস্থা সব কিছু ভুলে গিয়ে ক্ষণিকের জন্যে একটি অপার্থিব তৃপ্তির আস্বাদ পাওয়া গেল। বুক ভরে একটা নিশ্বাস নিয়ে চুপ করে বসে রইলাম।

ভৈরবী বললেন, “কুন্তি আর আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না, আমাদের সঙ্গেই সে যাবে।”

জিজ্ঞাসা করলাম, “কোথায়?”

ভৈরবী উত্তর দিলেন, “এখন হিংলাজে, তারপর সেখান থেকে ফিরে আমরা যেখানে যাব সেইখানে।”

ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে গেলাম, “কিন্তু ওর ওই থিরুমল?”

যা কল্পনাতেও আসে না সেই উত্তর পেলাম।

“থিরুমলকে ও জন্মের শোধ ছেড়েছে। থিরুমল ওর কেউ নয়। তার যেখানে খুশি সে চুলোয় যাক না, কে তাকে ধরে রেখেছে। সে কোথায় যাবে, কি করবে, কুন্তি তার জানে কি। সে আমাদের ছেড়ে কোথাও যাবে না। ওই হতচ্ছাড়াই যত নষ্টের মূল, ও দূর হয়ে যাক।

এই পর্যন্ত বলে প্রসঙ্গটা একেবারে ইতি করে তিনি তাঁর কটকী জাতি দিয়ে কটাক করে কয়েক খণ্ড সুপারি কেটে মুখে ফেললেন। তারপর একটুখানি দোক্তাপাতা ছিঁড়ে নিয়ে তাতে উপযুক্ত পরিমাণ চুন প্রয়োগ করতে মনোনিবেশ করলেন।

তা তিনি করুন, কিন্তু আমি পড়লাম ভাবনার অকূল সমুদ্রে। কে এই মেয়ে, কার ঘর থেকে এসেছে-আর অবলীলাক্রমে এই যে সে ছোকারাকে ত্যাগ করে আমাদের সঙ্গ ধরতে চাইছে-সেই ছোকরার সঙ্গে ওর সম্বন্ধই বা কি? সম্বন্ধে যাই হোক, সেই ছোকরা ঐ মেয়ের জন্যে মার খেয়ে হাড় গুঁড়ো করেছে, নিজের চক্ষে দেখেছি-এই মেয়েকে ঘাড়ে করে বয়ে আনতে আনতে সামর্থ্যের চরম সীমায় পৌঁছে নিজে মুখ। ঔজড়ে পড়ে তবে সে ক্ষান্ত দিয়েছে। “থিরুমল ওর কেউ নয়” ভৈরবীর এই কথাটি গুম গুম করে আমার মাথার মধ্যে ঘা দিতে লাগল। কেউই যদি না হবে তবে এভাবে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে ওকে বাঁচাবার জন্য অন্তিম চেষ্টা সে করে কেন? সেই মরুর মাঝে ঐ মেয়েকে ফেলে রেখে নিজের প্রাণ নিয়ে পালালে আজ কুন্তী। থাকতই বা কোথায় আর আমাদের সঙ্গ পাকড়াতই বা কেমন করে? হয়তো সত্যিই থিরুমল ওর কেউ নয়। হতেও পারে মেয়েটার দুর্দশার কারণও এই থিরুমল ছোকরা। কিন্তু যমের গ্রাস থেকে টেনে আনতে সে নিজেই যমের মুখে ঢুকেছিল এও তো জলজ্যান্ত সত্য। “আমি তোমার কেউ নই” বা “তুমি আমার কে বটে”–এই দুটি বাক্য উচ্চারণ করা এমন কিছু কঠিন কার্য নয়, কিন্তু… এই কিন্তুটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে গেলাম। পরশুদিন সেই দুপুর রোদে সেই বালির টিলার উপর দিয়ে এই মেয়েকে ঘাড়ে করে আমি খানিক বয়ে এনেছি। কেন যে সে কাজ করতে গিয়েছিলাম তখন তা ভাববারও অবকাশ ছিল না। একজন পুরুষ থিরুমল যতক্ষণ নিজের পায়ের উপর খাড়া থাকতে পেরেছে ততক্ষণ একে বয়ে এনেছে, তারপর আর একজন পুরুষ, আমি, তার অসমাপ্ত কার্যটি শেষ করেছি। বিনা দ্বিধায় এই মেয়ে বলছে থিরুমলকে, “তুমি আমার কেউ নও!” এই নিরীহ বাক্যটি আর একজন পুরুষের প্রাণে কি সুরে বাজে, এই নারী কী তা চিন্তা করে দেখেছে?

ভৈরবীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এ কথা থিরুমলকে বলা হয়েছে?”

উত্তর হল, “ওকে আবার বলে কি হবে? ওর যেখানে খুশি চলে যাক না, কে ওকে আটকে রেখেছে?”

গরম চা ভরতি পিতলের গেলাসটা নূতন কাপড়ের আঁচল দিয়ে চেপে ধরে কুন্তী এসে দাঁড়াল। বিশেষ এক নূতন দৃষ্টিতে ওর আপাদমস্তক একবার দেখে নিলাম। এই যে ছন্দোময় গতিভঙ্গি, এই যে ঋজুতা আর তনিমা, এর অন্তরালবর্তিনী যে নারী, সেই নারীদেহের প্রতিটি রেখা আমার একান্ত পরিচিত। মাত্র কয়েক ঘন্টা পূর্বে এর নিরাবরণ অচেতন দেহ স্বচ্ছন্দে ধুইয়েছি, মুছিয়েছি, অর্ধচেতন অবস্থায় নিজের দুই হাতের মুঠায় আমার একটা হাত চেপে ধরে এই নারী পরম আশ্বাস লাভ করেছে। আজ নূতন করে মনে হল-একে চিনিও না জানিও না। এই নূতন শাড়ির মধ্যে যে দেহ, সেই দেহের মধ্যে সত্যিকারের যে নারী, তাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। বিতৃষ্ণায় মনটা তিক্ত হয়ে গেল। নারী চিরকাল পুরুষের নাগালের বাইরে, দূরে বহু দূরে যোজনান্তরে বাস করে। সেখানে পৌঁছানো পুরুষের অসাধ্য। তাকে ধরা বা ছোঁয়ার চেষ্টা করা আর মরীচিৎকার পিছনে দৌড়ানো একই কথা।

গেলাসটা কুন্তীর হাত থেকে নিয়ে বাইরে কুয়োর ধারে উঠে গেলাম। সেখানে সকলে গোল হয়ে বসেছে, বড় কলকেয় আগুন দেওয়া হয়েছে।

আমাকে দেখে ওদের মধ্যে যা আলোচনা চলছিল বন্ধ হয়ে গেল। নক্ষত্রের। আলোয় দেখে নিলাম কে কে আছে। ভাই পোপট আছেন, গুলমহম্মদ রয়েছে, সুখলাল থিরুমল এবং আরও জনাদশেক বসে রয়েছে। পিছনে কুয়োর পাড় ঠেস দিয়ে দিলমহম্মদ দাঁড়িয়ে আছে, বড় ছোট কোনো কলকের ধারই ও ধারে না। গেলাস হাতে পোপটলাল ভাই-এর পাশে গিয়ে বসে পড়লাম।

সবাই চুপচাপ, জ্বলন্ত কলকেটা একজনের হাত থেকে আর একজনের হাতে ফিরেছে। গেলাসের চা শেষ করে একবার কেশে গালটা সাফ করে নিয়ে ডাকলাম, “থিরুমল!”

সবাই একটু চমকে উঠল। থিরুমল উঠে দাঁড়াল, তারপর ঘাড় হেঁট করে উত্তর দিলে, “হাঁ জি মহারাজ!”

বললাম, “এসো এধারে, আমার কাছে বসবে।”

কুণ্ঠিত পদে এগিয়ে এল থিরুমল। হাত ধরে কাছে বসিয়ে তার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে জিজ্ঞাসা করলাম, “এখন কেমন মনে হচ্ছে, মানে শরীর বেশ বল পেয়েছ তো?” একথার উত্তর সে দিলে না, নিজের দুই হাঁটুর ভিতর মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কান্না আরম্ভ করলে। সে কান্নার অব্যক্ত ভাষা বেশ বুঝতে পারলাম কিন্তু কোনো সান্ত্বনার বাণী কারও মুখে জোগাল না।

কেবলমাত্র গুলমহম্মদ বার-দুই “হা আল্লা, হা আল্লা” বলে উঠল। অবশেষে পোপটলাল প্যাটেল মুখ খুললেন। বলতে লাগলেন তিনি দুর্ভাগার জীবনকাহিনী, যা তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেরা করে সারা বিকেল বেলাটা ধরে এর কাছ থেকে বার করেছেন। মুক্ত আকাশের তলায় পোপটলালের ধীর শান্ত গভীর চাপা স্বর সমুদ্র থেকে ভেসে আসা গুরু গুরু ধ্বনির সঙ্গে মিশে এমন ভাবেই স্থানটিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল যে, সবটুকু শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাতাসও যেন স্তব্ধ হয়ে রইল।

আরম্ভ করলেন পোপটলাল-খুব ছোটোবেলায় থিরুমলের বাপ-মা দু-জনেই হয় মারা যায়, নয় তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। যারা তাকে বড় করে তুললে তাদের জাত যে কি এবং পেশা যে কি নয় তা থিরুমল শেষ পর্যন্ত জানতে পারেনি। যে মায়ের। বুকের দুধ পান করে সে বেঁচেছে তার সেই মা রাস্তায় ঘাটে বাজারে নাচত আর গান গাইত; নাচ-গানের সঙ্গে যে লোকটি হারমোনিয়াম বাজাত, বড় হয়ে থিরুমল তাকে বাবা বলে ডাকতে আরম্ভ করে। বছর সাতেক বয়স পর্যন্ত থিরুমল তার গলায় হারমোনিয়াম-ঝোলানো বাপ আর নাচিয়ে মায়ের সঙ্গে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াল।

সেই সময়ে জন্মাল তার সেই মায়ের পেটে এক মেয়ে। এই মেয়ে জন্মেই তার ভাগ্যে চিড় খাওয়ালে। এই সময় তাকে প্রথম জানানো হল যে, তারা তাকে রেল স্টেশনে কুড়িয়ে পেয়ে মানুষ করেছে এবং এখন তার ভিক্ষা করে পেট চালাবার মতো বয়স হয়েছে সুতরাং তাকে বিদায় নিতে হবে। তার সেই মা অবশ্য চেষ্টার কসুর করলে না তাকে কাজে রাখবার জন্যে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থিরুমলকে পালাতেই হল ওই হারমোনিয়াম-বাজিয়ে বাপের অত্যাচারের তোয়।

পালিয়ে গেল সে আর একজন হারমোনিয়াম-বাজিয়ের সঙ্গে। সে লোকটা তাকে ঘাঘরা পরিয়ে মেয়ে সাজিয়ে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল। নাচটা তার মায়ের সঙ্গে সঙ্গে থাকতে থাকতে একরকম অভ্যাস হয়েই ছিল সুতরাং আটকাল না। এইভাবে বছর তিনেকের মধ্যে কলকাতা বোম্বাই সমস্ত ঘোরা শেষ করে লক্ষ্ণৌ গিয়ে পৌঁছোল। সেখানে থিরুমলের গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে দিয়ে সে লোকটা নাচ গানের মায়া জন্মের শোধ ত্যাগ করল, রোগে পড়ে সে ম’লো। তখন থিরুমলের বয়স তেরো পার হয়েছে। ঘাঘরা আর কাঁচুলি খুলে থিরুমল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তখন সে একরকম সাবালক হয়েই পড়েছে, নেশা বলতে সব কটাই শিখেছে, হারমোনিয়ামেও বেশ হাত চলে।

কিন্তু স্বাধীনভাবে নাচ-গানের কারবার চালাতে গেল আর এক জন চাই। তেরো চৌদ্দ বছরের ছেলের আর একজন জুটবে কেন? সুতরাং তাকে অন্য পেশা ধরতে হল। পেশাটি খুবই সহজ এবং সরল; অন্য কিছুই নয়-হাত সাফাই-এর খেল দেখানো। কিন্তু ঝুঁকিটা এ পেশায় অত্যধিক। কয়েকবার ধরা পড়বার পর তাকে তিন বছরের জন্য আটকা পড়তে হল। যে বিদ্যেগুলি তখনও তার শিক্ষা হয়নি এই তিন বছরে সেই সমস্ত বিদ্যেয় একেবারে ওস্তাদ হয়ে যখন ছাড়া পেল তখন সে পূর্ণ যুবক। এতকাল তার নাম ছিল ছুনু, এবার সে হল থিরুমল।

নাড়ির টান ছিল রাজস্থানের সঙ্গে। সেখানকার জাঁকজমক হাতি হাওদা আতর গোলাপ বাদি নাচওয়ালী-এ সমস্তর সঙ্গে ছিল তার রক্তের সম্বন্ধ। উপস্থিত হল থিরুমল রাজস্থানে নিজের ভাগ্যে পরীক্ষা করতে।

ভাগ্য মুখ তুলে চাইতে কসুর করলেন না। পড়ে গেল এক বড়দরের রানা সাহেবের নজরে। তিনি তাঁকে তাঁর খাস বাইজির কাছে বহাল করে দিলেন। ফলে এই দুনিয়ার যেটুকু দেখতে আর জানতে তার বাকি ছিল অল্প দিনেই সে সমস্ত রপ্ত হয়ে গেল। আদব-কায়দা চাল-চলন যেমন নজরও গেল তেমনি পালটে। ছোট কিছুতে আর মন ওঠে না। ঘরওয়ানা ঘরের আস্তাকুঁড়ের কুত্তাটারও মেজাজ আছে।

আমিরি চালে চলছিল দিন ভালই। কিন্তু বড় ঘরের বড় ব্যাপার ঘটে বসল। এক বাগানবাড়িতে বাইজি একদিন খুন হলেন। কে তাকে গুলি করলে। তিনি তো মরে রেহাই পেলেন কিন্তু চাকর-বাকররা অল্পে রেহাই পেল না। বছরখানেক হাজতবাসের পর ছাড়া পেয়ে আবার যখন সে পথের মাঝে এসে দাঁড়াল, তখন এই দুনিয়ার হালচালের উপর তার ধিক্কার জন্মে গেছে।

এইবার সব কিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে তিনটে হাড়ের তৈরি চৌকো পাশা আর একখানা হিজিবিজি-কাটা ছক সম্বল করে সে মানুষের ভাগ্যগণনার পেশা অবলম্বন করে ফকিরি নিয়ে বের হল। এর মতো স্বাধীন নিরুপদ্রব পেশা দুনিয়ার দুটি নেই। ঝক্কি নেই, ঝামেলা নেই; কোনো ফ্যাসাদ নেই। বিষম গরজের পুঁতোয় লোকে এসে স্বেচ্ছায় গলা বাড়িয়ে দেয়, তখন একমাত্র গুণের প্রয়োজন যিনি ভবিষ্যৎ বাতলাবেন তাঁর নিজে নির্লিপ্ত নির্বিকার ভাবটি বজায় রাখা, তারপর ধীরে-সুস্থে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে চাকু চালানো। জন্ম থেকে নানা রকমের অবস্থার ভেতর দিয়ে পার হয়ে এসে নানা ঘাটের লোনা মিঠা পানি গিলে ভিখারি আর আমির সব রকম লোকের সঙ্গে মিশে থিরুমলের একটা উচ্চশ্রেণীর নৈর্ব্যক্তিক ভাব এসেই গিয়েছিল। এখন সেটা চমৎকার কাজ দিলে এই ভাগ্য-গণনার পেশায়। ফলাও কারবার জমে গেল।

কিন্তু এবারে ফ্যাসাদ বাধল অন্য রকমের। থিরুমলের ভিতরের যে ভিতর সে এবার জেগে উঠল। শুধু জেগে উঠল না, একেবারে খেপে উঠল। খেপল ওই কুন্তীকে দেখে। ওই মেয়েকে ঘিরে সে নীড় রচনা করবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে। শেষ পর্যন্ত এই বদখেয়ালই যত অনর্থের মূল হয়ে দাঁড়াল।

কুন্তী নেহাত যা-তা ঘরের মেয়ে নয়। বাপ তার একজন ছোটোখাটো জায়গীরদার। আর পাঁচজনের মতো মেয়ের দশ বছর বয়সে তিনি বিয়ে দেন উপযুক্ত পাত্রের সঙ্গে। জামাই সরকারি ফৌজের চাকুরে। ফৌজিলোক বছরে দু-চারদিনের জন্য ছুটি পেয়ে বাড়িতে এসে থাকে, আবার চলে যায়। সেই ভাবেই চলছিল। এমন সময় লাগল লড়াই। কুন্তীর ফৌজি স্বামী লড়াই শুরু হবার পর সেই যে চলে গেল-সেই যাওয়াই তার শেষ যাওয়া। লোকটার পাত্তা পর্যন্ত পাওয়া গেল না।

মানুষের ভাগ্য আর ভবিষ্যৎ বাতলাবার বিরাট দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়ে যারা বেড়ায় তাদের কাছে যে স্ত্রীলোকদের দীর্ঘদিন স্বামীর খোঁজ মিলছে না সেই স্ত্রীলোকই সর্বগুণান্বিতা মক্কেল। কাঁধে ঝোলা ঝুলিয়ে থিরুমল যেদিন গিয়ে দাঁড়াল কুন্তীর বাপের দরজায় সেদিন সর্বপ্রথম তাকে ছক পেতে হাড়ের পাশা চেলে দেখতে হল কুন্তীর নিখোঁজ স্বামীর কোনো হদিশ মেলে কিনা। সামনে অন্য সকলের সঙ্গে বসে কুন্তীও রুদ্ধনিশ্বাসে গণকারের রায় শোনবার অপেক্ষায় রয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে মনের সুখে অনেকবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পাশা ফেলে অনেক রকমের শক্ত হিসাব কষে শেষে গণস্কার কুন্তীর হাত দেখতে চাইলে। তারপর তার হাতখানি নিজের হাতের মুঠোয় পেয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রেখাবিচার করতে লাগল।

কিন্তু সে বিচার কি সহজে শেষ হয়! গণকারের নিজের বুকের ভিতরে তখন ঢিপঢিপ শুরু হয়েছে, কপালে আর কানের পাশে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। যাক- শেষ পর্যন্ত টাকা পয়সা কিছুই না নিয়ে সেদিনের মতো গণৎকার বিদায় নিলে। বলে গেল, আবার সে আসবে, এসে বিচারের ফল জানাবে। তখন টাকাকড়ি যা নেবার নেবে।

এইভাবে যে কয়েকবার এল গেল, প্রতিবারই পাশার খুঁটি বহু চালাচালি করলে আর কুন্তীর হাত ধরে বসে দীর্ঘ সময় অনেক শক্ত বিচার করলে। কুন্তীর হারানো স্বামী অবশ্য শেষ পর্যন্ত হারানোই রয়ে গেল। তবে মাসখানেকের মধ্যে কুন্তীও গেল নিখোঁজ হয়ে। বোধহয় স্বামীর খোঁজেই পা বাড়ালে। গণৎকারকেও আর কখনো সে অঞ্চলে দেখা গেল না।

এই হল আরম্ভ-কুন্তী আর থিরুমলের একসঙ্গে পথচলার শুরু। এমনি করেই বছরখানেক পূর্বে শুরু হয় ওদের জীবনের দ্বৈত সঙ্গীত।

এই পর্যন্ত বলে পোটলাল ভাই একজনের হাত থেকে জ্বলন্ত কলকেটা গ্রহণ করলেন। তারপর সেটা দু-হাতের মুঠোয় বাগিয়ে ধরে তাতে ঠোঁট সংযোগ করলেন।

শোঁ শোঁ করে গোটাকতক টান দেবার পর শেষে একটি অতিদীর্ঘ মোক্ষম টানের সঙ্গে দপ করে কলকেটার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। তখন কলকেটা আর একজনের হাতে দিয়ে পোপটলাল দম বন্ধ করে বসে রইলেন-মহামূল্য ধূমের এক বিন্দুও না নাক-মুখ দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে অপচয় হয়।

সবাই নিস্তব্ধ, থিরুমল একভাবে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। কান্না তার অনেকক্ষণ থেমেছে। সেই বিকেল থেকে এদের সকলের জেরার মুখে নিজের সারা জীবনের সমস্ত খুঁটি-নাটি উজার করে নিয়ে বেচারা একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। নিজেকে কতদূর অসহায় বোধ করলে তবে মানুষ এভাবে বিগত জীবনটা অপরের সামনে নির্দয়ভাবে খুলে ধরে-সেই কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলাম।

অনেকক্ষণ পর জিজ্ঞাসা করলাম থিরুমলকেই, “একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে, শেষ পর্যন্ত কি আসায় তোমরা এই ভয়ানক মুলুকে মাথা গলালে! আর চলেছই বা কোথায় এই যমালয়ের মধ্যে? অন্য কোথাও পড়ে যদি মরতে অন্তত জলটুকুও তো পেতে, এখানে সে আশাও যে নেই। সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে ঢোকবার জন্যে এই দুঃসাহস কেন করতে গেলে তোমরা?”

থিরুমল সেইভাবেই বসে রইল, মুখও তুললে না। উত্তর দিলে রূপলাল। এতক্ষণের এত দীর্ঘ পাষাণের মতো ভারী কাহিনীটিকে হালকা তুলো করে উড়িয়ে দিলে দু কথায়। সে বললে-বাকিটুকু ভয়ানক সোজা-একেবারে জলবৎ তরলং। প্রথমে দুজনে পালিয়ে বেড়াতে লাগল ধরা পড়বার ভয়ে। ফুরিয়ে এল দুজনের কাছে যা কিছু ছিল রেস্ত। মেয়েটার গহনাগুলি পর্যন্ত যখন উদরের টানে উবে গেল তখন আমদানি না হলে চলে কি করে? আরম্ভ হল খিটিমিটি। শেষে জন্ম থেকে রুজি রোজগারের যে উপায় থিরুমলের জানা ছিল সেই সোজা পথে পা বাড়াল। কুন্তী লাগল নাচতে-আর তার পিছু পিছু ওই পিনপিনে বাদ্যযন্ত্রটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরতে লাগল থিরুমল। কিন্তু তাতেও শান্তি নেই। থিরুমলের এত সাধের সম্পত্তি ওই মেয়েই হাতছাড়া হবার ভয়। নাচ দেখে যারা পয়সা দেয় তাদের ভিতর আকার অনেক বেশি পয়সা খরচ করে নাচওয়ালীকে খানিক পেতে চায়। থিরুমল দেখলে দুনিয়াসুদ্ধ সবাই হাঁ করে তেড়ে আসছে-এক গ্রাস নেবেই তাঁর বুকের পাঁজরা থেকে। তখন পালাও, পালাও। ওই মেয়ে নিয়ে এমন স্থান খুঁজে বেড়াতে লাগল যেখানে কামড় দেবার ভয় নেই। এমন সময় করাচী শহরে উপস্থিত হয়ে ওরা শুনলে একদল যাত্রী চলেছে হিংলাজে। এদের সঙ্গ ধরতে পারলে অন্তত মাসখানেক নিশ্চিন্ত। সেই আশা নিয়ে ওরাও করাচী ত্যাগ করে এল, আমরা যেদিন করাচী থেকে রওয়ানা হই তার পরদিন সকালে। প্রাণপণে আসছিল যদি আমাদের নাগাল পায়। ওরা শুনেছিল যাত্রীদলে একজন মাইজিও আছেন। আমাদের ধরতে আর মাত্র কয়েকঘন্টা বাকী, এমন সময় সেদিন নদীর মাঝে পড়ল দুশমনের সামনে। চারদিক থেকে তাড়া খেয়ে এসে শেষ পর্যন্ত বাঘের মুখেই পড়তে হল।

এতক্ষণ পরে দাঁতে দাঁত ঘষে দিলমহম্মদ উচ্চারণ করলে, “আর একবার যদি সেই শয়তান তিনটের দেখা পেতাম!”

চমকে উঠলাম, “কে তারা, তাদের চেন তুমি দিলমহম্মদ?”

হাহাকারের মতো শোনাল জবাবটা। জবাব দিলে গুলমহম্মদ, “হুজুর, সেই রাত্রি শেষে আমরা হারামি বাচ্চাদের কাছেই চা খেয়েছিলাম। তারা পরদেশি, তারা পেশোয়ারের লোক। হয় ফৌজি আদমি নয়তো ডকাত, পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তাদের সামনেই এরা এসে পড়ে গিয়েছিল। উল্লুক পাঠারা…”

এই পর্যন্ত বলে বৃদ্ধ বার বার মাথা নাড়তে লাগল-আর তার গলা দিয়ে কিছু বার হল না।

হঠাৎ মনে হল কপালের দু-পাশের রগ দুটো টনটন করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। আর একটি কথাও না বলে উঠে গেলাম। দারার ওপাশে নেমে অন্ধকারে বালুর উপর এধার থেকে ওধার পায়চারি করতে লাগলাম। অসহ্য যন্ত্রণায় মাথাটা যেন ছিঁড়ে পড়তে চায়।

কতক্ষণ এমনি ভাবে পায়চারি করেছিলাম খেয়াল ছিল না। ধর্মশালার ভিতর ভৈরবী সুখলালকে পাঠালেন। সংবাদ-রুটি বানানো শেষ হয়েছে; গুড় সহযোগে জলপান সমাপ্ত করে আজ রাতের মতো শুয়ে পড়া প্রয়োজন।

এতক্ষণে স্মরণ হল-আমরা হিংলাজ-যাত্রী, এবং হিংলাজ তখনও বহুদূর। ভোর রাতে স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম এক উৎকট স্বপ্ন। আমাদের মনুকে তিনটে শেয়ালে তাড়া করেছে। জজান আশ্রমে দীঘির পাড়ে ঘটেছে ব্যাপারটা। মনু প্রাণপণে দৌড়ে আসতে আসতে হঠাৎ পিছন ফিরে পিঠের লোম খাড়া করে রুখে দাঁড়াল। শেয়াল তিনটে তিন দিকে ঘিরেছে কিন্তু ওর ওই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে আর এগুতে সাহস করছে না। একটা শেয়াল এক লাফে এল তেড়ে। চক্ষের নিমেষে মনু তার দিকে ফিরে থাবা উঁচিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আর একটা শেয়াল পিছন দিক থেকে দৌড়ে এসে মনুর ঘাড় কামড়ে ধরলে। কিন্তু রাখতে পারলে না। এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মনু মরীয়া হয়ে দৌড়ল আশ্রমের দিকে। তার সাদা লোমের উপর দিয়ে লাল রক্ত গড়িয়ে নামছে। ছুটে এসে ভৈরবীর কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওকে বুকে তুলে নিয়ে ভৈরবী হাউমাউ করে কাঁদছেন, রক্তে তাঁর বুক কাপড়চোপড় ভেসে যাচ্ছে। বিড়ালটা আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ল।

ঘুম ভেঙে গেল।

উঠে বসলাম। সকাল হতে আর বেশি দেরি নেই। উট দুটিকে নিয়ে দিলমহম্মদ রওয়ানা হচ্ছে। তার হাতের টাঙ্গির ছোট্ট ফলাখানির উপর নজর পড়ল। ওদের দুজনের হাতেই ওই রকম চকচকে ফলাওয়ালা দুখানা টাঙ্গি সদাসর্বদা রয়েছে। উট যদি ক্ষেপে যায় তখন ওই টাঙ্গির সাহায্যেই আত্মরক্ষা হবে। এতদিন এতবার ওই টাঙ্গি দু-খানি চোখে পড়েছে অথচ কেন যে ওই দুখানির উপর ভাল করে নজর দেবার অবকাশ পাইনি,আর আজই ওই চকচকে ফলাখানির উপর বিশেষ করে কেন যে বার বার দৃষ্টি গিয়ে পড়তে লাগল-এই কথা ভাবতে ভাবতে চোখে মুখে জল দেবার জন্যে বের হলাম। শোনবেণীতে প্রথম রাত কাটল।

আমরা মনুষ্যজাতি যখন এই পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীদের নাম উল্লেখ করি তখন পর পর এইভাবেই বলে যাই, যেমন-হাতি ঘোড়া উট বাঘ; কখনও বাঘকে আগে বসিয়ে বাঘ হাতি ঘোড়া উট বলি না অথবা উটকে আগে স্থান দিয়ে উট বাঘ ঘোড়া হাতি এরকমও উচ্চারণ করি না। সকল সময়ই সর্বাগ্রে হাতির স্থান, তারপর ঘোড়ার, তৃতীয় স্থান উটের এবং শেষ স্থান বাঘের। হাতির নাম প্রথমে বসায় কারো আপত্তি করার কিছুই থাকতে পারে না। কারণ হাতি হচ্ছে হাতি, এ দুনিয়ার নিয়ম হচ্ছে যা কিছু বিরাট আর দমেভারী তার কদর সবচেয়ে বেশি, চট করে চোখে ধরা যায় কিনা।

আমার বক্তব্য হচ্ছে, ঘোড়ার পরে উটকে না বসিয়ে উটের পরে ঘোড়ার স্থান দিলে কেমন হয়? হাতি উট ঘোড়া বাঘ-এইভাবে বললে যেমন ক্ৰমে বড় থেকে ছোটতে আসা হয়, শক্তিসামথ্যের দিক থেকে বিচার করতে গেলে তেমনি উটকে দ্বিতীয় স্থানটি দিয়ে ঘোড়াকে তৃতীয় স্থানে নামিয়ে আনলে ন্যায্য বিচারের মর্যাদা থাকে।

এক আপত্তি উঠবে যে, সৌন্দর্যের প্রতিযোগীতায় উটের স্থান কোথায় নিয়ে দাঁড়াবে তা একবার ভেবে দেখেছ কি বাপু?

উত্তরে আমি বলব, সৌন্দর্য বস্তুটা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর যতটা নির্ভর করে ততটা যার সৌন্দর্য বিচার হচ্ছে তার গুণের বা রূপের উপর করে না। গণ্ডারকে আসামের জঙ্গল থেকে ধরে এনে আলিপুরে রাখলে তাকে দেখে তোক নাক সিটকাবেই, কিন্তু আসামের সেই ঘন আঁধার জলা আর জঙ্গলের মধ্যে গণ্ডার ভিন্ন অন্য কিছুই মানাবে না। আমার কথা মানতেই হবে যদি কেউ উটতে তার নিজের ঘর-গৃহস্থালীর মাঝে, তার সেই রসকষশূন্য মরুভূমিতে কাঁটাগাছ আর বাবলাগাছগুলির মধ্যে লম্বা গলা উঁচিয়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে কাঁটা চিবুতে দেখে। কখনো কল্পনাও করা যায় না যে, উটের সেই নিজস্ব জগতে বিশালকায় হাতিকে বা চকচকে ঝকঝকে পালিশ করা রেসের ঘোড়াকে মানাবে। একেবারে বেখাপ্পা বেসুরো বেয়াড়া বলে মনে হবে সেখানে হাতি আর ঘোড়ার উপস্থিতি। সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা এর সঙ্গে ওদের চলেই না। উটেরও একটা বিশেষ সৌন্দর্য আছে, সে সৌন্দর্য শ্যামবাজারে বা ভবানীপুরে মানাবে না, যদিও হাতিবাগানে হাতিকে এবং বাগবাজারে বাঘকে মানালেও হয়তো মানাতে পারে। উটের জন্য বেকবাগানই প্রশস্ত স্থান। সেখানে গিয়ে সৌন্দর্য কেন, যে-কোনো জাতের প্রতিযোগীতায় তাকে পরাস্ত করা সম্পূর্ণ অসম্ভব, তা থাকুক না তার পিঠে আস্ত একটা কুঁজ।

কুঁজ সম্বন্ধেও আমার ঘোরতর আপত্তি আছে। উটের কোনো কুঁজই নেই। আজ পর্যন্ত কোথাও একদল বা অনন্ত চ্যাপটা-পিঠওয়ালা উট কি কেউ দেখেছে? কখনো নয়। উট মাত্রেরই পিঠটা ওই ধরনের, ওখানে কুঁজ গজাতে যাবে কোন দুঃখে? কোনো দেশের দেশসুদ্ধ লোকের দুটো পা যদি অস্বাভাবিক স্ফীত হয়, তবে কি বলতে হবে যে সে দেশের তামাম লোকের গোদ হয়েছে? তা হতে পারে না বরঞ্চ ওদের মধ্যে যদি দু-চারজনের পা সরু আর স্বাভাবিক থাকে তবে তাদেরই কোনো রোগ হয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। সুতরাং কুপৃষ্ঠ নজদেহ ইত্যাদি বদ বিশেষণগুলির জন্যে উটেদের তরফ থেকে আমি তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করছি।

যে উট-দুহিতার পিঠে চড়ে ভৈরবী তীর্থযাত্রা করেছেন, আদর করে তার নাম রেখেছেন উর্বশী। শুনেই হয়তো “নহ মাতা নহ কন্যা” পড়ার দল মুখ বাঁকিয়ে বলবেন “এঃ ছি ছি ছি।” বলুন তাঁরা একশ গণ্ডা ছি ছি, বললেও ভৈরবীর বাহনের নাম তিনি বদলাবেন না, কিছুতেই তিনি মানবেন না যে, উর্বশী নাম রাখাটা একটু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে।

আর খাঁটি কথা বলতে গেলে বলতেই হবে-কেই-বা চর্মচক্ষে দেখেছে উর্বশীকে? যার যতটা প্রাণে চেয়েছে ওই উর্বশী নামটি ঘিরে কল্পনায় রঙিন স্বপ্ন দেখার সাধ মিটিয়েছে। অপ্সরা শ্ৰেষ্ঠাকে কল্পনা করতে গিয়ে তাঁর বাহনের অপরূপ রূপটাই যদি ভৈরবীর মনে ভেসে ওঠে তাতে ওজর-আপত্তি করবার কি আছে! পেঁচার কথাটা ধরা যাক না। কুশ্রী কাকেও বোঝাতে গেলে বলা হয় ‘পেঁচার মতো দেখতে। অথচ এই পেঁচাই মা-লক্ষ্মীর বাহন। মা-লক্ষ্মী নিশ্চয়ই পেঁচাকে পেঁচার মতো দেখেন না।

যাক, কথা হচ্ছিল উর্বশীকে নিয়ে, ভৈরবী বললেন, “ওর জন্যে মোটা করে দুখানা রুটি বানানো হোক রোজ।”

গুলমহম্মদকে কথাটা বুঝিয়ে দিতে সে আকাশ থেকে পড়ল-উট খাবে রুটি-ক্যা তাজ্জব!

কিন্তু তাজ্জবের আরও বাকি ছিল। শুধু রুটিই আছে বাকি। ইতিমধ্যে শ্রীমতী উর্বশী খেজুর কিশমিশ আখরোট বাদাম গুড় সমস্তই চেখে দেখেছেন। দিলমহম্মদের কাছ থেকে এই সংবাদ শুনে বললাম, “তার চেয়ে ওকে সুপুরি দোক্তা চর্ণটা শেখাও। একেবারে মানুষ হয়ে যাক।”

কে কার কথায় কান দেয়, কুন্তীকে হুকুম হয়ে গেল ভালো করে দুখানা রুটি পোড়াবার জন্যে।

আজ দিনের বেলা আমাদের প্রধান কর্ম-সরকারি প্রভুরা কখন উপস্থিত থাকেন, শহরে তার খোঁজ নেওয়া। তারা মেহেরবানি করে আমাদের নামধাম লিখে নিয়ে কর আদায় করে কতক্ষণে ছেড়ে দেবেন এই চেষ্টা করাই আজকের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। বেলা আটটার পরই রূপলাল আর গুলমহম্মদ কাছারির উদ্দেশে বেরিয়ে গেল। ঘণ্টা দেড়েক পরে ফিরল এই সংবাদ নিয়ে যে দুপুরের দিকে আপিস খুলবে, সেই সময় লেখাপড়ার পালা সাঙ্গ হবে।

দুপুর ঠিক দুপুরের সময়ই উপস্থিত হল এবং রুটি চর্বণের কর্তব্য সমাপ্ত করে জনা দশ-বারো একসঙ্গে শহরে চলে গেল। ওরা ফিরে এলে বাকি আমরা সকলে যাব, যাতে সন্ধ্যার পূর্বেই জমা-খরচ শেষ হয় এবং সন্ধ্যার সময় আমরা বেরিয়ে পড়তে পারি।

দুপুর গড়িয়ে গেল, এল বিকেল। হা-পিত্যেশ করে আমরা শহরপানে চেয়ে রইলাম। কেউ আর ফেরে না। শেষে একলা গুলমহম্মদ ফিরে এসে ঘোষণা করলে যে, আজ আর কিছু হবার আশা নেই। হুজুররা আজও অনুপস্থিত। তবে কথা পাওয়া গেছে যে, কাল সকালে অতি অবশ্য তারা উপস্থিত থাকবেন এবং যথাবিহিত সরকারি কর্তব্য সম্পাদন করে আমাদের এ স্থান ত্যাগ করবার অনুমতি দেবেন। সেই সংবাদ শুনে যারা নাম লেখাতে গিয়েছে-তারা এখন শহর দেখে বেড়াচ্ছে।

তা বেশ করেছ। কিন্তু এ তো মহামুশকিলেই পড়া গেল দেখছি! এই অনর্থক আটকা পড়ে থাকার কোনো মানে হয় নাকি? কাল সকালেই যে কর্তাদের দয়া হবে আর আমরা রেহাই পাব তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? এধারে আমাদের দুজনের খাদ্যে আরও দুজন লোক বাড়ল-সুখলাল তো আছেই। মনে মনে ঠিক করলাম আরও কিছু আটা এখান থেকে জোটাতে হবে, তারপর আর একখানা নূতন শাড়িও চাই। হিংলাজ পৌঁছে নূতন কাপড় পরে তবে দেবীদর্শন করতে হয়, এজন্যে একখানা করে নূতন কাপড় সকলেই সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে। তা ভৈরবীর খানা তো কুন্তীকেই দিতে হল। আর একখানা না হলে সেখানে পৌঁছে করা যাবে কি?

গুলমহম্মদকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিছু আটা শহর থেকে কেনা যায় কিনা। করাচীতে তো র‍্যাশনের দৌরাত্মে এক ছটাক বেশি পাবার উপায় নেই। এখানে র‍্যাশন নেই, কিছু আটা হয়তো মিলতেও পারে।

বুড়ো উত্তর দিলে, “হুজুর, আটা হয়তো পাওয়া যাবে, কিন্তু তা খাওয়া চলে না। গম কিনে সকলে ঘরে ভেঙে নেয়। আটা এখানে বাজারে বিকায় না, যদিও বা কোথাও মেলে তা একেবারে অখাদ্য। তার চেয়ে যদি আপনি এখানকার বানিয়া মহাজনদের জানান, তবে অনেকটা আটা অমনিই মিলবে আর তা খাওয়াও যাবে।”

বললাম, “তা হয়তো মিলবে। কিন্তু করাচী থেকে আমরা যে র‍্যাশন নিয়ে আসছি। এ তো সকলেই জানে, আবার এখানে ভিক্ষা চাইলে লোকে বলবে কি?”

গুলমহম্মদ পাগড়ির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগল। তারপর বললে, “দেখি কাল সকালে কতদূর কি করতে পারি।”

কিছুই ভালো লাগছিল না। সন্ধ্যা হয়ে এল, সেই সঙ্গে এল শহুরে মশারা। রাতের আহারটা ওরা কাল রাতের মতো আজও ধর্মশালাতেই সারবে; ভিনদেশি মানুষের রক্তের ভিন্ন আস্বাদ-মশারাও মুখ বদলাচ্ছে।

ভৈরবীকে বললাম, “আজ রাতে কিছু খাব না, ছাতে উঠে শুয়ে পড়ব। তোমরা দুজনে কালকের মতো ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিও। কোনো চিন্তা নেই।”

তিনি ইশারায় জানালেন যে অতটা নিশ্চিন্ত না হওয়াই উচিত। এখন উপরে গেলে দোষ নেই কিন্তু খানিক পরে সকলে ঘুমোলে আমি যেন নীচে নেমে আসি। কালকের মতো দরজার বাইরে আমার জন্যে একখানা কম্বল তিনি বিছিয়ে রাখবেন।

ছাতের সিঁড়ি নেই। মন্দিরের সিঁড়ির উপর দাঁড়ালে পাঁচিলের মাথা কুত পর্যন্ত উঁচু। হাতে ভর দিয়ে পাঁচিলের উপর উঠলাম। মন্দিরের পূর্ব দিক দিয়ে ঘুরে দক্ষিণ দিকের পাঁচিলের উপর দিয়ে ছাতের আলসে ধরে একটু চেষ্টা করে উপরে উঠে পড়লাম। তারপর চাদর বিছিয়ে আরামে শয়ন। সিঁড়ি না থাকায় মশারা আর কষ্ট করে উপরে এল না, হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া আসছে, শরীর জুড়িয়ে গেল; চোখের পাতা জুড়ে এল।

ঘুম ভেঙে গেল একটা বুম বুম আওয়াজে। চোখ চেয়ে দেখলাম আকাশে কে যেন এক পোঁচ আলকাতরা লেপে দিয়ে গেছে, একটি তারাও দেখা যায় না। বুক কাঁপানো আওয়াজটা আসছে বহু দূর থেকে। আসছে সমুদ্র থেকে সমুদ্র গর্জাচ্ছে। কোমরে চাদরখানা জড়িয়ে নিয়ে ছুটলাম ছাতের কিনারায়-এখন যত শীঘ্র নেমে পড়া যায়।

আলসের কাছে পৌঁছে নিচু হয়ে পাঁচিলের মাথা ঠাওর পেলাম না, এত অন্ধকার। কি আপদ, এখন নামা যায় কেমন করে? একবার বিদ্যুৎ চমকাল-পাঁচিলের বাইরে ফটকের পাশে কে ওরা দুজন? আবার আকাশে ঝিলিক খেলে গেল। এবার আর চিনতে কষ্ট হল না-লালপাড় শাড়ি পরে একজন মেয়ের হাত ধরে একজন পুরুষ।

সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠল। কি বেহায়া, এত বড় ব্যাপারের পর দুটো রাতও সবুর সইলো না। ওই মেয়েটাই বা কতদূর বেইমান? পই পই করে ওকে বলে দেওয়া হয়েছিল যে, রাতে দরজা খুলে বেরুবার দরকার হলে যেন ভৈরবীকে জাগায়। ঠিক চুপি চুপি উঠে ভৈরবীকে না জাগিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে। এখন যদি কেউ ঘরে ঢুকে…।

আর এক মুহূর্ত দেরী না করে আলসে ধরে ঝুলে পড়লাম। পায়ে পাঁচিল ঠেকল। সাবধানে পা ঘষে ঘষে মন্দির পর্যন্ত এলাম, তারপর মন্দির ঘুরে পূর্বদিকের পাঁচিলের উপর দিয়ে মন্দিরের সিঁড়ির উপর পৌঁছতে আর কতটুকু সময় লাগে। এখন সিঁড়ির উপর নেমে পড়লেই হয়।

কড় কড় কড়াৎ-কোথায় একটা বাজ পড়ল। বিকট আওয়াজের ধাক্কা সামলাতে পাঁচিলের উপরেই বসে পড়তে হল। বজ্রাঘাতের তীব্র আলোতে চোখে পড়ল ফটকের পাশে ওরা দুজনে।

বসে রইলাম পাঁচিলের মাথায়। শুনি না ওরা কি বলাবলি করে! এমনও তো হতে পারে যে দুটোই আস্ত ধড়িবাজ, গলায় চাকু চালাবার মতলবে আছে।

কিছুই শোন গেল না। বসে বসে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে পাঁচিলের উপর শুয়ে পড়লাম। এইবার কিছু কিছু শোনা গেল। যা শুনলাম তা যে ভাষাতেই বলা হোক সেই অসহায় কাকুতি কানে যাওয়ায় বুকের ভেতরটা পর্যন্ত মোচড়াতে লাগল।

“ছুঁয়ো না আমায়।”

“কেন ছোঁব না, কি হয়েছে তোমার? তোমায় ছেড়ে কোথায় যাব আমি? বাঁচব কেমন করে?

“ছুঁয়ো না বলছি, খবরদার!”

“দয়া করো, কুন্তি-দয়া করো। যা হয়েছে সমস্ত ভুলে যাও। চলো এখান থেকে পালিয়ে। যেখানে তোক ঘর বাঁধব-কেন তুমি অবুঝ হচ্ছ?”

“বলছি আর এগিয়ো না-পথ ছাড়ো।”

“তুমি কি পাগল হলে কুন্তি? এরা তোমার কে? কাদের সঙ্গে তুমি যাচ্ছ? চলো কালই আমরা পালাই।”

“সরে দাঁড়াও বলছি বেইমান। মাইজি জাগলে আমার সর্বনাশ হবে। যে চুলোয় ইচ্ছা তুমি যাও, দূর হও।”

অসহায় আর্তনাদ করে উঠল ছোকরা। আবার বজ্রাঘাত হল। থিরুমলকে ঠেলে ফেলে দিয়ে ভিতরে দৌড় দিল কুন্তী।

প্রথমে একটা দমকা হাওয়া পশ্চিম দিক থেকে পূর্বদিকে চলে গেল। এমনই সাংঘাতিক এক ঝাঁপটা যে, পাঁচিলের উপর থেকে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার যোগাড়। প্রাণপণে পাঁচিলের মাথা আঁকড়ে পড়ে রইলাম। পরমুহূর্তেই আর একটা সেই রকমের ঝাঁপটা, তারপর একটার পর একটা। মুহূর্ত মাত্র অপেক্ষা না করে পাঁচিলের পূর্বদিকে দেহটা ঝুলিয়ে দিলাম। তারপর দিলাম হাত ছেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে পাঁচিলের বাইরে বালির উপর ধপ করে পড়লাম বসে। মাথার উপর প্রলয় কাণ্ড চলতে লাগল, পাঁচিলের আড়ালে বসে থেকে আমি খানিকটা রক্ষা পেলাম।

কিন্তু এরা গেল কোথায়? মেয়েটা তো ভিতরে চলে গেল, থিরুমলের হল কি? সেও ভিতরে গেল নাকি? আর একবার পর পর তিনটে ঝিলিক দিল আকাশে। সেই আলোয় দেখলাম-ঘাড় হেঁট করে সমানে ঝুঁকে ঝড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে থিরুমল প্রাণপণে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে সমুদ্রের দিকে।

উল্টোদিক থেকে প্রচণ্ড বিক্রমে হাওয়া ঘুরে এল। আরম্ভ হল মাতামাতি। পূর্বদিক থেকে হাওয়া যে মুহূর্তে ফিরল, পশ্চিমের থেকে পূর্বগামী ঝড়ের সঙ্গে হল তার সংঘর্ষ-একেবারে মহাপ্রলয় শুরু হয়ে গেল। হাওয়ায় হাওয়ায় বালুতে বালুতে ঝাঁপটাঝাঁপটি নিমেষে ঘূর্ণিতে পরিণত হল। একটার সঙ্গে সঙ্গে আর একটা, তারপরেই একটা, এইভাবে একটানা বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। চর্তুদিকে আলোয় আলো। রাশি রাশি বালু পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ঘুরতে ঘুরতে মহাশূন্যে উঠে পরস্পর লড়তে লাগল। ফলে যেন ঘন কুয়াশায় চারিদিক ঢেকে গেল। চোখ মেলে কিছু দেখা যায় না। তারই মাঝে আবার দেখলাম ধর্মশালার উত্তরদিকে ঘুরে ওধারে যাবার জন্যে চেষ্টা করছে থিরুমল।

যতদূর গলায় কুলোল চিৎকার করে ডাকলাম, “থিরুমল!” থিরুমল ধর্মশালার উত্তরদিকে অদৃশ্য হল।

চলল কোথায় মরতে হতভাগ্য এ সময়-এখন বাড়িটার পশ্চিমদিকে গিয়ে পড়া মানে সাক্ষাৎ আত্মহত্যা। হামাগুড়ি দিয়ে গেটের ওধারে এগিয়ে গেলাম। পূর্বদিকটা পার হয়ে ধর্মশালার উত্তরপূর্ব কোনায় এসে দেখলাম উন্মাদ মাঠের মাঝে নেমে পড়েছে–তার গতি সমুদ্রের দিকে।

ছুটলাম তার পিছু পিছু।

এইবার আরম্ভ হল লড়াই ঘূর্ণির সঙ্গে আর বালুর সঙ্গে। হাত ত্রিশ-চল্লিশ সামনে থিরুমল। সেও মরীয়া হয়ে সামনে ঝুঁকে সমানে এগিয়ে চলেছে। ঝড়ের চোটে মাটির উপর পা রাখাই দায়, এক পা এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা। সোজা হয়ে দাঁড়াবার উপায় আছে নাকি! ঝাঁপটায় উল্টে ফেলে দিতে চায়।

চড়বড় চড়বড় শব্দে বড় বড় ফোঁটা তিরের মতো গায়ে বিঁধতে লাগল। তারপর যা আরম্ভ হল তাকে বৃষ্টি বলা চলে না। বিরাট বিরাট বালতি করে রাশি রাশি জল কারা যেন ছুঁড়ে মারছে। জলের তোড়ে দম বন্ধ হবার উপক্রম।

সেই ঠেঙারে জলের ভয়ে বালুরা পুনারায় ধরার বুকে আশ্রয় নিল। হাওয়াও তখন আত্মরক্ষা করতে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালিয়ে গেল। কিন্তু পালাবে কোথা? সেই জ্যান্ত জলপ্রপাত হওয়ার পিছু পিছু ধাওয়া করল। চোখের উপর দেখলাম ঝড় আর তার পিছু পিছু জল দুই-ই পূর্বদিকে প্রাণপণে ছুটে বেরিয়ে গেল।…

হঠাৎ একেবারে সমস্ত ফাঁকা-এত বড় কাণ্ডটা যেন ভেল্কিবাজি। কেবলমাত্র মাথার উপর আকাশে এধার-ওধার বার বার তীব্র চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি খেলতে লাগল। তখনও সামনে আগে থিরুমল আর পিছনে আমি ছুটছি।

আবার চিৎকার করে উঠলাম : “থিরুমল থামো-দাঁড়াও বলছি- থিরুমল!”

কে কার কথা শোনে। পাখা গজিয়েছে ব্যাটার। এবার নির্ঘাত মরকে। পিছন ফিরেও তাকাল না।

ভয়ানক রাগ চড়ে গেল। শেষ চেষ্টা করলাম তাকে ধরবার। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছেছি এমন সময় সে বামদিকে ঘুরে দৌড়াতে লাগল।

মাথায় তখন খুন চেপে গিয়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে আরও কয়েক পা ছুটে এক লাফে তার পিঠের উপর গিয়ে পড়লাম। দুজনেই পড়লাম বালির উপর জড়ে। ঠেসে ধরে দমাদম গোটাকতেক কিল তার পিঠে বসিয়ে দিয়ে চুলের মুঠি ধরে তুলে দাঁড় করালাম।

হাঁপাতে হাঁপাতে মাথায় কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম-”কোথায় যাচ্ছিস মরতে হারামজাদা?”

সমুদ্রের উপর আলোর রোশনাই খেলে গেল। থিরুমল ‘হা-হা হা-হা করে একটানা বিকট হাসতে শুরু করলে। সভয়ে হাতের মুঠো থেকে তার চুল ছেড়ে দিলাম। তার মুখের উপর, তার জ্বলন্ত চোখের দিকে চেয়ে দেখি এ যে সম্পূর্ণ উন্মাদের দৃষ্টি!

‘হা-হা হা-হা করে থিরুমল হাসতেই লাগল। তারপর সে নিজের দু-হাতে মুখ ঢাকা দিল। কিন্তু সেই উচ্ছল হাসি থামল না।

হাসছে থিরুমল। সমানে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আছি। ওর পিছনে পাহাড়ের মতো ঢেউ তুলে সমুদ্র আমাদের দুজনকে গ্রাস করতে তেড়ে আসছে। আলকাতরার মতো কালো সেই ঢেউ-এর মাথায় সাদা ফেনা অন্ধকারের মাঝে জ্বলজ্বল করছে। যেন বিরাট আকতির দৈত্যেরা মাথায় রূপোর মুকুট পরে সদম্ভে এগিয়ে। এখুনি আমাদের দলে পিষে গুঁড়িয়ে ফেলবে।

সমুদ্রের জল তখনও অনেক দূর। কিন্তু সেই নিবিড় আঁধারের মাঝে সাগরবেলায় দাঁড়িয়ে পশ্চিমদিকে চোখ পড়তেই মনে হল-ওই যে বড় ঢেউটা ছুটে আসছে ওটা নিশ্চয়ই আমাদের উপর এসে ভেঙে পড়বে। আর চেয়ে দেখার সাহস হল না। থিরুমলের একটা কব্জি শক্ত করে ধরে তাকে টানতে টানতে ছুটলাম ধর্মশালার দিকে।

জোরে চলবার কি তখন সামর্থ্য আছে? কোনোরকমে তাকে টেনে নিয়ে চলেছি। আকাশ আবার তারায় তারায় ছেয়ে গিয়েছে। চতুর্দিক শান্ত স্তব্ধ। পিছনে গভীর গর্জনে একটার পর একটা ঢেউ ভেঙে পড়ছে। সেই এবড়ো-খেবড়ো প্রান্তরের বুকে মাত্র আমরা দুটি প্রাণী। চলেছি আন্দাজের উপর নির্ভর করে ধর্মশালার উদ্দেশে। থিরমলও আর হাসছে না। গা ছমছম করতে লাগল।

প্রবল উত্তেজনায় ঝড়ের মধ্যে থিরুমলের পিছু পিছু যখন ছুটছিলাম তখন খেয়ালই হয়নি কতদূর গিয়ে পড়ছি। ফেরবার সময় দেখি পথ ফুরোয় না। একবার মনে হল-ভুল করে অন্যদিকে যাচ্ছি না তো? ডানদিকে ঠাহর করে দেখলাম, দূরে শোনবেণীর ঘরবাড়ি। আরও খানিকটা এগিয়ে দেখতে পেলাম-গোটাতিনেক হ্যারিকেন লন্ঠন নিয়ে কারা যেন এদিকেই আসছে।

চিৎকার করে ডাকলাম-”রূপলাল! গুলমহম্মদ” ওধার থেকে একসঙ্গে বহু গলার স্বর ভেসে এল। আলো আর লোকজন আমাদের দিকেই আসতে লাগল। আরও কাছাকাছি পৌঁছে ওরা আমাদের দেখতে পেলে। দৌড়ে এসে গুলমহম্মদ আমাকে দু হাতে বুকে আঁকড়ে ধরলে।

তার আলিঙ্গন ছাড়তে ছাড়তে সকলে এসে ঘিরে ফেলল। ভৈরবী আমার একখানা হাত চেপে ধরলেন। তাঁর মুখ দেখা গেল না, কিন্তু বেশ বুঝলাম তিনি থরথর করে কাঁপছেন।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কুন্তী-কুন্তী কই?’ কুন্তী ভৈরবীর পিছনেই ছিল। সামনে এল। থিরুমলের হাতখানা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম-”শক্ত করে ধরে রাখো, ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে, একেবারে পাগল হয়ে গেছে।”

হঠাৎ থিরুমল আবার সেই অর্থহীন বিকট হাসি হেসে উঠল ‘হা-হা হা-হা’। সভয়ে তার হাত ছেড়ে দিয়ে কুন্তী পিছিয়ে গেল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পোপটভাই থিরুমলের কাঁধের উপর হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে নিয়ে চললেন।

পুবের আকাশে যখন ফিকে সাদা রং ধরতে শুরু করেছে। আমরা ফিরলাম। ন-দশ ঘণ্টা পরে জিনিসপত্র বাঁধাছাদা করে ‘জয় হিংলাজ মাই-কী’ ধ্বনি দিয়ে শোনবেণী ধর্মশালা থেকে আমাদের দুই দিন দুই রাতের গৃহস্থালির ইতি করা হল। কয়েকজন মারোয়াড়ী ভদ্রলোক অনেকটা পথ সঙ্গে এসে আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন। গুলমহম্মদ এঁদের কি বোঝাল সেই জানে। আটা আরও আধমণটাক বৃদ্ধি হল। আরও একটি জিনিস বৃদ্ধি হল, সেটি হচ্ছে-ডাকাতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার ভয়।

নাম লেখাতে গিয়ে যাঁর সঙ্গে দেখা হল তিনি এখানকার উঁচুদরের শাসনকর্তাদের একজন। সাধারণ মানুষের চেয়ে মাথায় তিনি হাতখানেক বেশি উঁচু। চেহারা অনেকটা তার তলোয়ারের মতো দেখতে। ছুঁচলো দাড়ির উপর নাকের নীচেটা কামানো অল্প গোঁফের লম্বা রেখা, তার উপর মানানসই তীক্ষ্ণ নাসিকা। নাকের উপর দিকে, দু-পাশে লম্বা, যাকে বলে পটলচেরা, এই রকম দুই চক্ষু। এই সমস্ত মিলিয়ে তাঁর মুখের, বিশেষ করে তার চোখের দৃষ্টির, একটা ধার আছে। দেখা মাত্রই মনে হবে যে, এই লোকটি আর ওঁর পাশে ঝোলানো দীর্ঘ বাঁকা তলোয়ারটি একই জাতের। কোনো কিছুকে বেমালুম দুআধখানাতে পরিণত করা এঁর আর এর অস্ত্রের কাছে একেবারে ছেলেখেলা।

খাঁ সাহেব বললেন কিছুদিন ধরে শহরের আশেপাশে গুণ্ডামি রাহাজানি চলেছে। আমরা যখন ত্রিশজনেরও বেশি একদলে চলেছি তখন তারা আমাদের কাছে ঘেঁষতে সাহস করবে না, কারণ যতদূর তাঁরা সংবাদ পেয়েছেন তাতে দু-চারজনের বেশি লোক এ কার্য করছে বলে মনে হয় না। লোকগুলো বিদেশি, মরুর বুকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে আর সুযোগ পেলে পথিকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

আমরা থিরুমলের কাহিনী চেপে গেলাম। কি জানি এঁদের জানালে যদি আটকা পড়তে হয়!

খাঁ সাহেব গুলমহম্মদ আর দিলমহম্মদকে উপযুক্ত উপদেশ দিলেন। অতি মোলায়েম উপদেশ, যদি দুশমনদের দেখা মেলে তবে যেন একেবারে তাদের নিকাশ করে দেওয়া হয়।

আভূমি সেলাম বুকে গুলমহম্মদ বললে, “তোবা তোবা, সে কথা কি আর বলতে! কুত্তারা আমাদের মুলুকের সুনাম নষ্ট করছ হুজুর।”

হুজুর প্রত্যেক কুপওয়ালাকে এই সংবাদ জানাতে আদেশ করলেন। কর জমা দিয়ে নাম, বাপের নাম, থানা জেলা ইত্যাদি লিখিয়ে আমরা শোনবেণী ছাড়বার হুকুম পেলাম।

তারপর কি আর সবুর সয়? রান্না-খাওয়ায় মাজা-ধোওয়ায় যেটুকু সময় লাগল। বেলা তিনটে নাগাদ ছড়ি উঠল।

শোনবেণী থেকে বেরিয়ে হিংলাজ ঘুরে পুনরায় শোনবেণী না পৌঁছানো পর্যন্ত আর আমাদের ছাতের তলায় মাথা দিতে হয়নি। এর পর প্রত্যহ বেলা পড়লে যাত্রা আরম্ভ করে প্রায় শেষ রাত্রি পর্যন্ত চলে কুয়োর ধারে পৌঁছে খোলা আকাশের তলায় পড়ে থাকতে হয়েছে, যতক্ষণ না উটেরা খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে জিরিয়ে আবার চলতে শুরু করেছে। আসল কথা, এ যাত্রায় উটের মর্জিই হচ্ছে একমাত্র জিনিস যার উপরে কোনো আপিল চলে না।

প্রকৃত হিংলাজের পথ এখান থেকেই আরম্ভ। গত বুধবার বৈকালে আমরা করাচী ত্যাগ করি আর আজ সোমবার শোনবেণী ছেড়ে চলেছি। লোকালয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ এইবার সত্যসত্যই ঘুচল। সামনে শোনবেণী নামে এক শহর আছে, সেখানে পৌঁছলে লোকের মুখ দেখতে পাওয়া যাবে, করাচী থেকে বিদায় নেবার সময় এটা একটা কত বড় আশার কথা ছিল। এবার সেটুকুর সম্ভাবনা সামনে কোথাও না থাকায় যাত্রাকালে মন বেশ ভারী হয়ে উঠল। একটা বালুর টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে সমস্ত দলটাই দেখতে পেলাম। সকলের পিছনে থাকায় টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে সমস্ত সকলকেই লম্বা সারি দিয়ে নেমে যেতে দেখলাম। দেখলাম-মুষড়ে পড়েছে, সকলেই বেম মুষড়ে পড়েছে।

মানুষ যেখানে নেই, দেবতার টোনে সেখানে অগ্রসর হওয়া ততটা সহজ নয়। মানুষের কাছে মানুষের না দেবতার কার আকর্ষণে শক্তি অধিক তাই চিন্তা করতে করতে দলের পিছু পিছু অগ্রসর হলাম। ফেলে-আসা পিছনের টান টানতেই লাগল পিছন থেকে। কিন্তু এখন কি আর ফেরবার উপায় আছে?

আমাদের এবারের লক্ষ্য-চন্দ্রকূপ। চন্দ্রকূপ-বাবার হুকুম মিললে তবে হিংলাজ। জয় বাবা চন্দ্রকুপ!

সমুদ্রকে বামে রেখে আমরা চলেছি। কিছুক্ষণ পর-পরই পিছন ফিরে শোনবেণীকে দেখে নিচ্ছি। ক্রমে ধর্মশালার ছাত অদৃশ্য হয়ে গেল। এখন শুধু দেখা যাচ্ছে। রামসীতার মন্দিরের ছোট্ট রক্তপতাকাটিকে। উচ্চ দণ্ডের মাথায় আরও কিছুক্ষণ সেই পতাকাটি দেখা গেল। ভৈরবীকে জিজ্ঞাসা করলাম-ধর্মশালা এখনও দেখা যায় কি না। উটের পিঠে অনেক ঊর্ধ্বে থাকায় আরও কিছুক্ষণ তিনি দেখতে পেলেন। তারপর শোনবেণীর সঙ্গে সম্বন্ধ ছেদ হল।

অনেক আগে থেকেই রূপলালের গীত ভেসে এল। দলের সর্বাগ্রে ছড়ি ঘাড়ে সে চলেছে। তার পিছনে পোপটলাল আছেন, তাঁর হেফাজতে কুন্তী আর থিরুমল। কুন্তী নিজের ছাপানো শাড়িখানি পরেছে আঁচল কোমরে জড়িয়ে। মাথায় তার ঘোমটা নেই। এ তার আর এক রূপ, যেন সে দলের সকলের ছোট বোনটি। কোনো জড়তা নেই, অনাবশ্যক কুণ্ঠার বা লজ্জার লেশমাত্র বালাই নেই। আনন্দের লাবণ্যের প্রাণচঞ্চল কল্যাণময়ী প্রতিমাখানি।

থিরুমলের হাত ধরে চলেছে কুন্তি। মাঝে মাঝে বিকট হাস্য করা ছাড়া আর কোনো বাতিক নেই থিরুমলের। কথাও বলে না, চোখও চায় না। যদি বা কখনো চোখ চায় তবে কি দেখছে তা বোঝ শক্ত। ফ্যালফ্যাল করে নিরর্থক বহুদূরে একভাবে চেয়ে থাকে। কুন্তী যে তার হাত ধরে নিয়ে চলেছে এও সে জানে না। কুন্তীর দৃঢ় বিশ্বাস একবার চন্দ্রকূপ-বাবার কাছে থিরুমলকে নিয়ে যেতে পারলে সব গোলমাল মিটে যাবে। যে জট পাকিয়েছে থিরুমলের জীবনসূত্রে তা খুলে যাবে। অন্তত কুন্তীকে চিনতে পারবে সে।

ওদের পিছনে সকলের খাদ্য পিঠে বাঁধা বড় উটটার দড়ি ধরে গুলমহম্মদ চলেছে, তারপর দলের অন্য সকলে ঘাড়ে-কুঁজো হাতে-লাঠি গল্প করতে করতে অগ্রসর হচ্ছে। সর্বশেষে দিলমহম্মদ আমাদের উর্বশীর নাকের দড়ি নিজের কাঁধে ফেলে যাচ্ছে-উপরে ভৈরবী হেলতে দুলতে সুপুরি দোক্তা চর্বণ করতে করতে টাল সামলাচ্ছেন। পিছনে সুখলালের কাঁধে হাত দিয়ে আমি হাঁটছি।

সমুদ্রের কিনারায় কিনারায় পথ, তা বলে হাত বাড়ালেই জল ছোঁয়া যাবে না। জল এক মাইলের বেশি দূরে এসে আছড়ে পড়ছে। ঘণ্টা দুই চলার পর জঙ্গল আরম্ভ হল। বেশ বড় বড় গাছ। এবার মাথার উপরে ছায়া পাওয়া গেল। বাবলা আর নোনা গাছই বেশি, আবার দু-চারটে তেতুলগাছও আছে। আর এরকম গাছ দেখলাম, অনেকটা ছাতিম গাছের মতো দেখতে। দিলমহম্মদ বললে, তারা এ গাছকে পিপড়ী বলে।

সেই গাছপালার ভিতর দিয়ে ক্রমে আমরা উঁচু দিকে উঠতে লাগলাম। বেশ চড়াই আরম্ভ হল। নানা জাতের পাখি মহা শোরগোল করে মাথার উপর গাছের ডালে ফিরে আসতে লাগল। পাখিদের আজকের মতো ঘুরে বেড়ানো শেষ হল।

জঙ্গলের জন্যে সমুদ্র আর দেখা যাচ্ছে না কিন্তু তার গর্জন শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উপর থেকে জল গড়িয়ে নেমে আসছে; উপরে কোথাও বোধ হয় জল জমেছে। এটা একটা ছোটখাট পাহাড় না কি ঠিক বুঝতে পারছি না। পাথর একখানাও চোখে পড়ছে না। সমানে চড়াই ভাঙছি। সন্ধ্যা পর্যন্ত সেই ভাবে উঁচুতে ওঠার শেষ হল না, তবে জঙ্গল ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে এল। আমরা উঠতেই লাগলাম।

অবশেষে সেই চড়াই-এর মাথায় উঠে খানিকটা ফাঁকা জায়গা পাওয়া গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে বামে অনেক দূরে অনেক নিচুতে দেখা গেল সমুদ্র। আর দেখা গেল সমুদ্র সেখানে আকাশের সঙ্গে মিশেছে সেখানটায় সমুদ্রের ভিতর থেকে প্রকাণ্ড গোল। রক্তবর্ণ ছটা আকাশের অনেক দূর পর্যন্ত রাঙিয়ে তুলেছে।

আপনা থেকে সকলের হাত জোড় হয়ে কপালে এনে ঠেকল। নেই অনির্বচনীয় ব্যাপারটা যার ইঙ্গিতে ঘটেছিল তাঁকেই বোধ হয় আমরা প্রণাম জানালাম।

শ্রীজয়াশঙ্কর মুরারজী পাণ্ডে মহাশয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি। কাথিওয়াড়ের জামনগর থেকে তিনি এসেছেন। এসেছেন তীর্থদর্শনের সবটুকু পুণ্য চেটেপুটে সঙ্গে নিয়ে ফিরবেন এই সৎ বাসনাটুকু সঙ্গোপনে বুকে পুরে নিয়ে। এক তোলা একরত্তি পুণ্য যদি কোনো ফাঁকে কোথাও পড়ে থাকে যা হয়তো তাঁর তীক্ষ্ণদৃষ্টিও এড়িয়ে যাবে এই আশঙ্কায় তিনি সদাসর্বদাই শশব্যস্ত।

এরও পরে আর এক বিপদ আছে, আর সে বিপদের ভয় পদে পদে। কথাটা হচ্ছে একমাত্র তিনিই ব্রাহ্মণ আর বাদবাকি দলসুদ্ধ আমরা কেউ ব্রাহ্মণ নই। কি করলে জাতি রক্ষা হয় এবং কি কি না করলে জাতি রক্ষা হয় না, এ সমস্ত শাস্ত্রীয় অনুশাসন শুধু তাঁর কণ্ঠস্থই নয় একেবারে জিহ্বাগ্রে বিরাজ করছে। এই দলের মধ্যেই জনা ছয়-সাত তাঁর শিষ্য সেবক চলেছেন। সশিষ্য দুর্বাসার মতো সশিষ্য পাণ্ডে মহারাজের শাস্ত্রজ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের আলোর তীব্র আঁচ মরুভূমির সূর্যের তেজ আর বালুর উত্তাপকেও সময় সময় ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

আমার উপরে তার ধারণা ভাল-মন্দ দুই স্তরই অতিক্রম করে এমন একটা স্থানে নেমে গেছে যে, আমার অতিবড় নিন্দুকও তাঁর সেই অভিমত শুনলে আমার জন্যে হায় হায় করে উঠবে। শ্রীপাণ্ডে মহারাজ শাস্ত্রবাক্য উদ্ধার করে সকলের কাছে সগৌরবে প্রমাণ করে ছেড়েছেন যে, ঘোর কলিকালে আমার মতো পাষণ্ড নাকি দু চারটে জন্মাবে। এ কথা বহুকাল পূর্বে পূজ্যপাদ শাস্ত্রকার মহোদয়গণ লিখে রেখে গেছেন। তাঁদের লিখন পাছে মিথ্যা হয় এই জন্যেই ভগবান আমার মতো মহাপাপীর সৃষ্টি করেছেন। এই যে গুলমহম্মদের হাত থেকে চা নিয়ে পান করছি, জলও প্রায় ওরাই তুলে এনে দিচ্ছে, কুঁজো তো ছুঁচ্ছেই-এ সমস্ত কর্মগুলি শুধু শ্রীভগবানের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্যই করে মরছি। শুনতে শুনতে মনমরা হয়ে আছি-এবং শ্রীভগবানের ইচ্ছা পূর্ণ হোক এই প্রার্থনা করছি।

সকলের ছোঁওয়া-ছুঁয়ির নাগালের বাইরে শ্রীপাণ্ডে নিজের জল নিজে আনেন-নিজের রুটি নিজেই পোড়ান। বাকি সময়টুকু চলতে ফিরতে উঠতে বসতে নিজের শিস্যসেবকদের শাস্ত্রীয় উপদেশ দান করেন। পাছে কোনো রকমে তাঁর সুপবিত্র গণ্ডীর মধ্যে পা দিয়ে ফেলি এই ভয়ে আমরা সদাই সশঙ্কিত। কিন্তু আমরা সাবধানে থাকলে হবে কি- আর এক আপদ সেই গণ্ডী ডিঙিয়ে পাণ্ডে মহারাজকে পাকড়াও করল। দেখি মাঝে মাঝেই আমাদের কিছুক্ষণ করে বিশ্রাম করতে হচ্ছে, মানে, এক-একবারে প্রায় অর্ধঘণ্টার মতো। ব্যাপার কি?

পাণ্ডে মহারাজ গত রাত থেকে বারংবার জঙ্গলে যাচ্ছেন। দূর থেকে দেখতে পেলাম তিনি ফিরে এলেন। যন্ত্রণার রেখা তাঁর মুখে ফুটে উঠেছে। ফিরে এসে পুনরায় কুঁজো ঘাড়ে করে হাঁটতে লাগলেন। আবার আমরা অগ্রসর হলাম।

যথোচিত গাম্ভীর্যের সঙ্গে শ্রীরূপলাল ছড়িওয়ালা ঘোষণা করলেন-আমাদের তীর্থযাত্রার প্রথম দর্শন, স্পর্শন এবং দান-দক্ষিণা করবার স্থান আগতপ্রায়। সামনের পাহাড়টার উপরে পৌঁছলেই আমরা শ্রীশ্রীগুরুশিষ্যের পবিত্র স্থানে উপস্থিত হব। এই যাত্রায় এই প্রথম পুণ্যকর্ম প্রায় নাগালের মধ্যে এসে গেছে একথা শুনে সকলেই একটু চাঙ্গা হয়ে উঠল।

কেবল পাণ্ডে মহারাজ ঘোরতর অসন্তোষ প্রকাশ করতে লাগলেন। তাঁর শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, স্নান করে অভুক্ত অবস্থায় দর্শনাদি পুণ্যকার্যগুলি করা বিধেয়। অথচ খেয়েদেয়ে রাতের প্রথম প্রহার পার করে আমরা গুরুশিষ্যের স্থানে পৌঁছচ্ছি। এটা মহা অন্যায় এবং অশাস্ত্রীয় কাণ্ডকারখানা হতে চলেছে। আমাদের উচিত ছিল-এমন সময় যাত্রা করা যাতে গুরুশিষ্যের দর্শনটা শাস্ত্রের নির্দেশনুযায়ী হয়। অর্বাচীন ছড়িওয়ালাটা যখন জানতই যে সামনে গুরুশিষ্যের দর্শন রয়েছে তখন তার উচিত ছিল-যজমানদের স্নান করিয়ে উপবাস করিয়ে নিয়ে এসে দর্শন করানো। দর্শন হলেও সবটুকু পুণ্যসঞ্চয় হবে না। এজন্য মহা বিরক্ত হয়ে তিনি গজগজ করতে লাগলেন।

তখন পশ্চিম আকাশের শেষ প্রান্তে সেই গেরুয়া রঙের ছটাটা সমুদ্রের মাঝে তলিয়ে যাচ্ছে।

যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা সূর্যাস্ত দেখলাম তার ডান দিকে আর একটি বড় পাহাড় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাহাড়ের উপর দিয়ে এক সোজা পথ চলে গিয়েছে পাহাড়ের ওপারে। যদি ওই পথে আরও খানিকটা কঠিন চড়াই ওঠা যায়, তখন পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে আরম্ভ হবে সোজা উত্রাই। ওই পথে গেলে পাহাড়টা ডিঙোতে লাগবে বড়জোর দু’ঘণ্টা। গুরুশিষ্যের স্থানে পৌঁছতে সেই পথ সোজা এবং সংক্ষিপ্ত।

কিন্তু লটবহরসুদ্ধ উট ওই পথে উঠতেও পারবে না, নামতেও পারবে না। উট যাবে বাম দিক দিয়ে নেমে সমুদ্রের কিনারায়। নেমে গিয়ে বড় পাহাড়টাকে ঘুরে ওপারে পৌঁছতে চার ঘণ্টার ধাক্কা। রূপলাল প্রস্তাব করলে- সে ডাউনের চড়াই-এর পথ ধরেই যাবে। তাতে ওপারে পৌঁছে ঘণ্টা দুই আরামসে আরাম করা যাবে। পথ ভুল হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। পায়ে চলা সরু পথ একেবারে সোজা পাহাড়ের মাথায় চলে গিয়ে ওপারে নেমে গিয়েছে। আর এ পথে সে কয়েকবার এসেছে-গেছেও। সুতরাং যারা তার সঙ্গে গিয়ে আরামসে আরাম করবার বাসনা রাখে তারা চলে আসতে পারে।

দেখা গেল বাসনা আছে সকলেরই, কিন্তু সবাই গেলে চলে কি করে উট ছেড়ে? ভৈরবী হাঁটতে পারেন না, তার উপর চড়াই ভেঙে ওঠা তাঁর পক্ষে সম্ভবই নয়, সুতরাং আমাকে থাকতে হল উটদের সঙ্গে। পোপটলাল আমাদের দল ছাড়লেন না, কারণ থিরুমলকে নিয়ে চড়াই ভাঙতে তার সাহস হল না-কখন তার কি খেয়াল হবে, কি করে বসবে তার ঠিক কি! গুলমহম্মদ আর দিলমহম্মদের সঙ্গে আমরা চারজন রইলাম-পোপটলাল, থিরুমল, কুন্তী আর আমি। উট দুটি আর তাদের উপর মালপত্র ও ভৈরৰী এগুলি সামলে নিয়ে আমরা ধীরে ধীরে বামে নেমে যেতে লাগলাম।

ওরা হই হই করে রূপলালের পিছন পিছন ডানদিকের সরু পথে অদৃশ্য হল। ঠিক রইল ওপারে পৌঁছে গুরুশিষ্যের স্থানে ওরা অপেক্ষা করবে যতক্ষণ না আমরা গিয়ে পৌঁছই। তারপর দর্শনাদি সমাপন করে আবার একসঙ্গে চলা হবে।

আরও কিছুদূর নামবার পর আমরা একটা গলির মতো সরু রাস্তায় গিয়ে ঢুকলাম। দু-দিকেই পাহাড়। একটি জলের ধারা তার ভিতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। মনে হয় জলধারাটির জন্যেই এই পথের সৃষ্টি হয়েছে। ঘোর অন্ধকারে সেই পথ দিয়ে অতি সাবধানে পা ফেলে আমরা চলতে লাগলাম, মানে নেমে যেতে লাগলাম।

গলিপথটা শেষ হতে বেশি দেরি হল না, অল্প কিছুদূর গিয়েই বামদিকটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আবার সমুদ্র দেখা গেল। আরও এক ঘণ্টার উপর সমানে উত্রাই পাওয়া গেল। অবশেষে সমতলভূমিতে সমুদ্রের চড়ায় আমরা নেমে এলাম। এইবার আমাদের ডানদিকে ঘুরে বড় পাহাড়টার ওধারে যেতে হবে।

ঠিক যেখানে আমাদের ডানদিকে ঘুরতে হবে সেই কোণটায় একখানা বড় পাথর পাহাড়ের গা থেকে বেরিয়ে অনেক উঁচুতে ঝুলে আছে। তার নীচে দিয়ে রাস্তা-অনেকটা গাড়িবারান্দা-ঢাকা ফুটপাতের মতো। গুলমহম্মদ বড় উটটাকে নিয়ে সামনে চলছিল-সে প্রথমে কোণটা ঘুরে গেল।

পরমুহূর্তেই চেঁচিয়ে উঠল-”কে, কারা ওখানে?” আমরা থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আবার শোনা গেল গুলমহম্মদের ওই এক প্রশ্ন?

ঊর্বশীর দড়িগাছা আমার গায়ে ফেলে দিয়ে দিলমহম্মদ ছুটে গেল কোণটা ঘুরে। তাড়াতাড়ি আমরা পা চালালাম।

কোণ ঘুরতেই দেখা গেল রাস্তার উপর বড় উটটার গলার নীচে দাঁড়িয়ে গুলমহম্মদ। আরও খানিকটা সামনে ডানদিকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে কারা যেন বসে রয়েছে। অন্ধকারে কতজন বোঝা গেল না, ওখান থেকে একটা স্পষ্ট গোঙানি কানে এল। কে যেন মরণ-যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে!

দিলমহম্মদ সেইদিকে এগিয়ে গিয়েছে। একটা ধমক দিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে “উত্তর দাও বলছি, তোমরা কে?”

কোনো উত্তর নেই-কেবল সেই অসহায় আর্তনাদ ছাড়া কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না।

বড় উটের পিছনে গিয়ে ছোট উট থামল। আমাদের আলো ভৈরবীর খাঁটিয়ার পায়ায় বাঁধা ছিল। দেশলাইটা তাকে দিয়ে ওটা জ্বালাতে বললাম। তিনি আলো জ্বেলে ঝুলিয়ে দিলেন-পোপটলাল সেটা ধরে নিয়ে এগিয়ে গেলেন। আমি উটের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছি।

বড় উটের পাশ দিয়ে পোপটলাল সামনে গিয়ে পড়তেই গুলমহম্মদ প্রচন্ড ধমক দিলে, “এগিও না, খবরদার!” সেই ধমকের সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের ভিতর থেকে একটা লোক ছিটকে ঊঠে দিলমহম্মদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল; নিমেষ মধ্যে লণ্ঠনের আলোয় গুলমহম্মদের টাঙ্গির ফলাখানা ঝলক দিয়ে উঠল। বুড়ো লাফিয়ে পড়ল সামনে। পরমুহূর্তেই একটা মর্মভেদী চিৎকার পাহাড়ের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।

আমার ঠিক পিছনেই কুন্তী চিৎকার করে উঠল। এক ঝটকায় তার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে থিরুমল তীরবেগে ছুটে গেল সেইদিকে। সভয়ে দেখলাম- একখানা প্রকাণ্ড ছোরা হাতে আর এক মূর্তি অন্ধকারের মধ্যে খাড়া দাঁড়িয়ে উঠেছে। সামনে ঝুঁকে সে একটু একটু করে এগুচ্ছে গুলমহম্মদের দিকে। গুলমহম্মদ স্থিরনিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অন্ধকারের ভিতর থেকে দিলমহম্মদের গলায় আওয়াজ উঠল, “হুশিয়ার!” এবং তার বাক্য শেষ হবার পূর্বেই হিংস্র পশুর মতো লোকটার পিঠের উপর প্রচণ্ড বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল থিরুমল।

আমায় এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল কুন্তী-পোপটলাল একটা অদ্ভুত চিৎকার করে উঠলেন।

রুদ্ধ নিশ্বাসে দেখছি-সেই প্রকাণ্ড জোয়ানটার পিঠের উপর আঁকড়ে ধরে ঝুলছে থিরুমল, আর লোকটা হাত ঘুরিয়ে তাকে ছোরা মারবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে।

কিন্তু তাদের কাছে কুন্তীর পৌঁছবার পূর্বেই লাফিয়ে উঠল দিলমহম্মদ। সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের টাঙ্গির ফলাখানার প্রায় সমস্তটাই সেই লোকটার বড় বড় চুলওয়ালা মাথাটায় বসে গেল।

আর একটা ভয়ঙ্কর আর্তনাদ-সেই আর্তনাদের সঙ্গে থিরুমলকে পিঠে নিয়ে লোকটা মুখ খুঁজড়ে পড়ল, তাদের উপর গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল কুন্তী।

চক্ষের নিমেষে সমস্ত ঘটে গেল। আমি আর পোপটভাই দাঁড়িয়ে কাঠ হয়ে রইলাম। উটের উপর ভৈরবী ডুকরে কেঁদে উঠলেন। “হা-হা হা-হা থিরুমলের বিকট হাসি শোনা যেতে লাগল।

সামনে এসে দাঁড়াল দিলমহম্মদ। মাথার পাগড়ি কোথায় চলে গিয়েছে, সর্বাঙ্গে জামা জোব্বা রক্তে রাঙা। তার হাতের টাঙ্গির ফলাখানাও টকটকে লাল। পোপটলালের হাত থেকে আলোটা নিয়ে এগিয়ে গেল সে, যেখান থেকে তখনও মৃত্যুযাত্রীর অন্তিম কাতরানি উঠছে, সেইদিকে।

ছুটে গেলেন পোপটলাল কুন্তী আর থিরুমলের দিকে। গুলমহম্মদ এসে আমার হাত থেকে উটের দড়িগাছা নিলে। ভৈরবীকে কাঁদতে বারণ করলে। আর ভয় নেই–সব মিটে গেছে। ভৈরবী নামতে চাইলেন। দড়ি ধরে দিলমহম্মদ উটকে বসাতে লাগল।

আমি এগিয়ে গেলাম দিলমহম্মদের কাছে।

পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা লোক উপুড় হয়ে বালুতে মুখ রগড়াচ্ছে, লোকটা একেবারে উলঙ্গ। জামা জোব্বা সমস্ত টুকরো টুকরো করে ছেঁড়া তার পাশে ছড়ানো রয়েছে। আলোটা আরও কাছে নিতে দেখা গেল একটা পা ফুলে নীল হয়ে গেছে।

আমার হাতে আলো দিয়ে দিলমহম্মদ লোকটাকে চিত করে দিল। তার নাক মুখ দিয়ে ফেনা বেরুচ্ছে। আরও দু-একবার কাতর আর্তনাদ করে লোকটা ধুনকের মতো

বেঁকে উঠল। তারপর তার কাতরানি বন্ধ হল, চিরকালের জন্যে সমস্ত যন্ত্রণার অবসান হয়ে গেল তার।

দিলমহম্মদ বললে, “সাপে কেটেছে।”

আলো নিয়ে আমরা উটের কাছে ফিরে এলাম। কুন্তী আর থিরুমলকে ধরে নিয়ে এলেন পোপটলাল।

গুলমহম্মদ তার ছেলের হাত থেকে আলোটা নিয়ে তার সর্বাঙ্গ ভালো করে দেখে নিলে। তারপর আলোটা নামিয়ে রেখে ছেলেকে দু-হাতে বুকে জাপটে ধরে চুমার পর চুমা খেতে লাগল।

কয়েকটা মুহূর্তের মধ্যে কাণ্ডটা ঘটে গেল। পাহাড়ের নীচে অন্ধকারে আত্মগোপন করে মৃত্যু আমাদের অপেক্ষায় হাঁ করে বসে ছিল। নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে আমরা আসছি-সোজা সেই হাঁ করা মুখের মধ্যে প্রবেশ করতে। সবই ঠিকমতো ঘটতে চলেছিল, কিন্তু বাদ সাধল এরা দুজন-এই বৃদ্ধ পিতা আর তার নির্ভীক যুবক পুত্র। বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে লাফিয়ে পড়ল সামনে, অকম্পিত কঠোর হস্তে আঘাত হেনে মৃত্যুকে নিরাশ করলে। নিরাশ করলে বলা উচিত নয়, বরং বলা চলে মৃত্যুকে মৃত্যু উপহার দিলে। তা যদি না হত, যদি এরা মনে করত আমরা বিধর্মী, বিদেশী, আমাদের কিছু হলে ওদের কি! বরং মালপত্র আমাদের সঙ্গে যা আছে তার ভাগ কিছু পেলে নিদারুণ অভাবের সামান্য কিছুটা ঘুচতে পারে। আরও কত কি বিবেচনা করতে পারত। ফলে এতক্ষণে আমরা তীর্থযাত্রার পথ থেকে ছিটকে অনেক দূরের অন্য এক পথে যাত্রা করতাম।

একটিমাত্র লণ্ঠনের আলোয় অন্ধকারকে আরও রহস্যময় করে তুলেছে। যেন অন্ধকারে আড়ালে আরও অনেকে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এইবার দল বেঁধে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। অদূরে তিনটে লোক মরে পড়ে আছে। জীবন্ত বিভীষিকার মাঝে সেই সামান্য আলোয় দেখছি আর এক দৃশ্য-এক বৃদ্ধ পিতা পিতৃহৃদয়ের শাশ্বত অমৃতধারায় এক ভাগ্যবান পুত্রকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে। কোথায় তলিয়ে গেল এত বড় মর্মান্তিক ঘটনাটা-কোথায় উবে গেল কয়েক মুহূর্ত পূর্বের নিদারুণ উত্তেজনা। একটি স্নিগ্ধ-মধুর অনুভূতিতে শরীরের প্রতি অণু পরমাণু থরথর করে কাঁপতে লাগল। বাৎসল্য রসটি কি জাতের রস, সন্তানের উপর মায়া কি ধরনের ব্যাপার, পিতার হৃদয়ের ব্যাকুলতা কি পদার্থ, তার চাক্ষুষ পরিচয় পেলাম। শুধু পেলাম নয়, আকণ্ঠ সেই রস পান করে নেশায় বুঁদ হয়ে গেলাম-সে নেশা আনন্দের না ব্যথার আজ তা ঠিক করে বলতে পারব না।

বাবা ছেড়ে দিলে পর দিলমহম্মদ কুন্তীর সামনে এসে দাঁড়াল। এই প্রথমবার সে কুন্তীর সঙ্গে কথা বললে। বললে, “বাই, তোমাকে যারা অপমান করেছিল, সেই জানোয়ারদের খুনে আমি গোসল করেছি। এবার তুমি ওই শয়তানদের কথা মন থেকে মুছে ফেলো, ওরা জাহান্নামে যাক।”

পোপটলাল একটা জলের কুঁজো নামিয়ে আনলেন। আমরা সকলে আকণ্ঠ জলপান করলাম, তৃষ্ণায় বুকের ছাতি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল।

বড় উটের উপর থেকে ওদের নিজেদের ঝোলা নামিয়ে আনল দিলমহম্মদ। ঘোয়া কাপড়-চোপড় বার করে রক্তমাখা জামা-জোব্বা বদলে ফেলল। থিরুমলকেও তার পাজামা শার্ট ছাড়ানো হল। কুন্তী তার শরীর থেকে সমস্ত রক্তের দাগ মুছে দিল; পোপটলালের একখানা ধুতি পরিয়ে কুন্তীর সঙ্গে তাকে উর্বশীর পিঠে তুলে দেওয়া হল। ভৈরবী হেঁটেই চললেন আমার চিমটেখানা বাগিয়ে ধরে।

যাত্রার পূর্বে গুলমহম্মদ আর পোপটলাল ওধারে গিয়ে মৃত লোক তিনটের কাছে জিনিসপত্র কি আছে দেখে এল। গোটাকতক টাকা আর তিনখানা ছোরা ভিন্ন বিশেষ কিছুই পাওয়া গেল না।

আমরা অগ্রসর হলাম। মাথার উপরের পাথরখানার নীচে থেকে খোলা আকাশের তলায় বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল। গুলমহম্মদ বললে, “রাত কাবার হবার আগেই জন্তু-জানোয়ার ওদের সাবাড় করে ফেলবে।”

“কি জানোয়ার?”

দিলমহম্মদ বললে, “নেকড়ে।”

গুলমহম্মদ সাবধান করে দিল, “ঘুণাক্ষরেও এসব কথা কোথাও যেন বলা যাবে না হয়।”

কুন্তীকে হুঁশিয়ার করলে দিলমহম্মদ-”বহিন, সাবধান, থিরুমল যেন পড়ে না। যায়।”

উপর থেকে কুন্তী জানালে-”ভয় নেই, সে ঘুমিয়ে পড়েছে।” পোপটলাল বিনীতভাবে একটা বিড়ি প্রার্থনা করলেন। অনেকক্ষণ ছিলিম না পাওয়ায় বেচারার কষ্ট হচ্ছিল।

আমরা পাহাড়ের ধার ছাড়লাম। সোজা উত্তর-পূর্ব কোণায় চলতে লাগলাম, ক্রমে আবার জঙ্গল আরম্ভ হল।

অনেকক্ষণ পরে পোপটলাল বললেন, “সেদিনই ওরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। অনেক লোকজন দেখে সাহস করেনি।”

দিলমহম্মদ বললে, “বাবা তখনই আমাকে বলেছিলেন। এরা ডাকাত।”

পোপটলাল দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, “পাপের শেষ ফল কি মারাত্মক!”

এ কথার কেউ জবাব দিলে না। পৌঁছলাম গুরুশিষ্যের স্থানে। দূর থেকে রূপলালের গলা শোনা গেল, “শ্রীহিংলাজ দেবী-রানী কি-”

আমি আর পোপটলাল উত্তর দিলাম, “জয়।”

গুলমহম্মদও এক বিচিত্র আওয়াজ করলে। এই গাছপালার মধ্যে তাদের সকলকে সটান শুয়ে থাকতে দেখলাম। দু-ঘণ্টা নয়-প্রায় তিন ঘণ্টার মতো সকলের আরামসে আরাম করা হয়েছে।

শ্রীশ্রীগুরুশিষ্যের স্থানে শ্রীশ্রীগুরুদেব আর শিষ্য মহাশয় দুজনে দুখানা কালো পাথরে পরিণত হয়ে পড়ে আছেন। প্রতি পাথরখানা তিন সাড়ে তিন হাত লম্বা আর দেড় কি দু হাত চওড়া। বালির ভিতর কতটা গাড়া আছে জানি না, বালির উপর অন্তত এক হাত করে জেগে আছে পাথর দু-খানা। ধারে-কাছে এই ধরনের পাথর আর একখানাও দেখা গেল না। কেউ কোথাও থেকে বয়ে এনে সেখানে পাথর দু খানা রেখে গেছে সে ধারণা না করে, বরং একদা গুরু আর এক শিষ্য হিংলাজ দর্শন করে ফেরবার সময় এখানে পড়ে কোনো কারণে পাথর হয়ে আছেন এবং যুগযুগান্তর পরে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র পুনরায় আবির্ভূত হয়ে যখন হিংলাজ দর্শনে গমন করবেন তখন তাঁর শ্রীচরণস্পর্শে এঁরা উদ্ধার হয়ে উঠে দাঁড়াবেন, একথা বিশ্বাস করা অনেক সহজ, অনেক আরামের। তাই মেনে নিয়ে আমাদের পাণ্ডা শ্রীমান রূপলালের নির্দেশমতো মন্ত্র আউড়ে পাথরের উপর কুঁজোর জল দিলাম, দক্ষিণা দিলাম। তা মন্দ হল না, প্রায় টাকা তিনেকের মতো দর্শনী পড়ল। এই আমাদের প্রথম দর্শন, জানি না পাণ্ডার তৃপ্তি হল কিনা।

তখন পাণ্ডাজি আমাদের শোনালেন এর উপাখ্যান। এই শিষ্য-গুরুর কীর্তিকলাপ। না শুনে উপায় নেই– দর্শন করা আর উপাখ্যান শোনা দুটোই হওয়া চাই। এ সমস্ত হচ্ছে তীর্থধর্মের অঙ্গ, সবটুকুই শেষ করা প্রয়োজন। নয়তো অঙ্গহানি হবে যে।

একদা এক গুরুদেব তাঁর এক শিষ্যকে সঙ্গে নিয়ে হিংলাজ দর্শন করে ফিরছিলেন। দু-জনার কাছেই দু-পাত্র জল ছিল। কি খেয়াল হল গুরুদেবের, তিনি বার বার শিষ্যের কাছ থেকে তার জলটুকু চেয়ে নিয়ে পান করতে আরম্ভ করলেন। গুরু জল চান- শিষ্য না দিয়ে করেন কি! শেষ পর্যন্ত গুরুদেব শিষ্যের পাত্রের শেষ জলটুকু নিঃশেষে পান করে নিশ্চিন্ত হলেন। শিষ্যের তখন তৃষ্ণায় প্রাণ যায়। গুরুদেব কিন্তু এক ফোঁটা জল তাঁর পাত্র থেকে শিষ্যকে দিলেন না। “হা জল হা জল” করতে করতে শিষ্য বালুর উপরে শুয়ে পড়ল। তাতেও না, অন্তিমকালেও শিষ্যের ঠোঁটে এক ফোঁটা জল ছোঁয়ালেন না গুরুদেব। চোখের উপর তিলে তিলে শিষ্যতে মরতে দেখলেন। যতই তিনি এই দৃশ্য দেখতে লাগলেন ততই তাঁর ভয় বাড়তে লাগল। ভয়-তাঁর নিজের জলটুকুর জন্যে। যদি ফুরোয় তবে তাঁরও শিষ্যের অবস্থা হবে। কিন্তু হল একেবারে সাংঘাতিক কাণ্ড। তাঁর পাত্রটি চৌচির হয়ে ফেটে গেল। সমস্ত জলটুকু পড়ল বালুর বুকে, সঙ্গে সঙ্গে চোঁ চোঁ করে সবটুকু শুষে নিল তপ্ত বালু। এইবার গুরুদেব যাবেন কোথা?। তাঁকেও শুয়ে পড়তে হল শিষ্যের পাশেই ৷

এই হল গুরু আর শিষ্যের উপাখ্যান। সহজ সরল অনাড়ম্বর এই ইতিহাস শুনে পুনরায় সকলে দক্ষিণা দিলাম। উপাখ্যান শোনার দক্ষিণা আলাদা করে দেওয়াই নিয়ম, নয়ত শ্রবণের ফল মিলবে না। তা যা দেবার দিলাম বটে, সঙ্গে সঙ্গে এইটুকুও বুঝলাম যে, এইবার সত্যসত্যই জলীয় ব্যাপারে একান্ত সাবধান হওয়া উচিত। এই নিষ্ঠুর কেচ্ছা শোনাবার আর যে কোনো উদ্দেশ্যেই থাকুক, এর দ্বারা আমাদের যে শেষবারের মতো সাবধান করে দেওয়া হল এটুকু বুঝতে বাকি রইল না। রূপলাল এই বলে তার বক্তব্য সমাপ্ত করল যে, এইজন্যেই এই যাত্রায় কেউ কাকেও জল দেবে না-এই ভীষণ প্রতিজ্ঞা করে তবে আসতে হয়।

জিজ্ঞাসা করলাম, “সামনের কুয়োর ধারে পৌঁছতে পৌঁছতে আর কত দেরি হবে মনে করো?”

উটওয়ালারা এবং রূপলাল তিনজনেই বললে, “দুই ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছাচ্ছি।”

কিন্তু জয়াশঙ্করের জন্য ঘনঘন থামতে হচ্ছে। এক-একবার আধঘণ্টার জন্য বিরতি। কাজে কাজেই গুরু-শিষ্যের স্থান ছেড়ে প্রায় তিন-ঘণ্টা পরে আমরা কুয়োর ধারে পৌঁছলাম। আকাশের পুবদিকের শেষপ্রান্তে তখন সরু একফালি চাঁদ মিনমিন করে চাইছে। আজ কৃষ্ণা ত্রয়োদশী বা চতুর্দশী হবে।

বিরাট এক তেতুঁলগাছের তলায় আমাদের আস্তানা পড়ল।

যে যেখানে পারলে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। ভৈরবী তাঁর কম্বলখানা কাঁধে ফেলে একটা জুতসই জায়গা খুঁজে বেড়াতে লাগলেন। কোথাও তাঁর পছন্দ হচ্ছে না। তেতুঁলগাছটার গুঁড়ি ঘেঁষে প্রথমে তিনি কম্বল বিছিয়েছিলেন; সেখানে উঁচুনিচু, কাজেই উঠিয়ে নিয়ে গেলেন কম্বলখানা। গিয়ে বসলেন যেখানে থিরুমল আর কুন্তী ছিল তার পাশে। সেখানেও কি অসুবিধা হল। গেলেন ঊর্বশীর কাছে ৷ ওরা মা মেয়ে মোটঘাট নামিয়ে পাশে বসে পড়ে মুখ নেড়ে জাবর কাটছিল। জাবর কাটা আর ঘুম দু কাজই ওরা এক সঙ্গে সারে। কাজেই গুলমহম্মদ ছেলের সঙ্গে শুয়েছে। ঊর্বশীকে খানিক আদর করে শেষ পর্যন্ত ভৈরবী এসে দাঁড়ালেন আমার কাছে।

দাঁড়িয়ে কি ভাবতে লাগলেন।

বললাম, “এক কাজ করো, আমার মাথার কাছে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ো। রাত আর বেশি বাকি নেই।”

আমি ঘুমোইনি এ তিনি আশা করেননি। কম্বল বিছিয়ে বসলেন সেখানে, শুলেন না।

বললুম, “শোও না, তবু যতটুকু ঘুম হয়।”

উত্তর দিলেন, “ঘুম কি আর চোখে আছে? খুনখারাপি হয়ে গেল! তিন-তিনটে লোক ম’লো। রক্ত দেখে ঘুম দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। চোখ বুজলেই আবার সেই সমস্ত দেখব!

ঘুম আমারও আসছিল না। আসবার কথাও নয়। লোকে সংসারের জ্বালায় অস্থির হয়ে শান্তির মুখ দেখবার আশায় তীর্থযাত্রায় পা বাড়ায়। আমরাও চলেছি হিংলাজ; উদ্দেশ্য ওই শান্তিলাভ। জানি না শান্তিটা কি বস্তু-তবে আজ এ কটা দিনে যে তার ছায়াও দেখতে পাইনি তাতে আর সন্দেহ নেই। শেষ পর্যন্ত পৌঁছে হিংলাজ দর্শনটা ভাগ্যে ঘটবে কি না কে বলতে পারে!

এই তীর্থের পথ যে বিপথ বা কুপথ এইটুকু জেনেই পথে নামা হয়েছে। সুতরাং পথের কষ্টটা কষ্টই নয়। হিংলাজ দর্শনে ও কষ্টটুকু পুষিয়ে যাবে এ বিশ্বাস আছে এবং সেই কারণে বুকে সাহস বেঁধে এগিয়ে চলেছি। কিন্তু হিসাবের মধ্যে ধরা ছিল না এমনই সমস্ত ব্যাপার আমদানি হচ্ছে যে। আর তাতে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আমরাই সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে পড়ছি।

এই যে ওরা, কুন্তী আর থিরুমল। একজন তো পাগলই হয়ে গেল। কে বলবে আবার কখনো ও হুঁশ ফিরে পাবে কি না। যদি এইভাবেই থাকে তাহলে উপায়? করাচী ফিরে আমরা তো আমাদের পথ দেখব, তখন ওরা যাবে কোথায়? কুন্তী তো সংকল্প করে রেখেছে যে, আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না। ভেবে হাসি পেল-ত্রিভুবনে মাথা গোঁজাবার যাদের ঠাঁই নেই, তাদের কাছেই আশ্রয় পেতে চায় ওরা! যে ডুবছে সে একগাছা খড়কুটো ভেসে যেতে দেখলেও তাই ধরে বাঁচতে চেষ্টা করে।

সে না হয় যা হবার হবে যখন করাচী ফিরে যাব। আপাতত সব চেয়ে বড় কথা ভালোয় ভালোয় হিংলাজ পর্যন্ত পৌঁছনো, তারপর আবার এই ভীষণ পথটুকু ফিরে আসা। এখানে বালুর উপরে মরে পড়ে থাকতে যেমন নিজেরাও চাই না, তেমনি যারা সঙ্গে চলেছে তাদের মধ্যে কেউ এখানে থেকে যাবে এও কল্পনা করা অসহ্য। বিশেষত ওরা দুজন। ওদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই এখন মস্ত গরজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাগল হয়ে থিরুমল ষোল দু-গুণে বত্রিশ আনা মুশকিলে ফেলেছে। এখানে নিজেদের প্রাণ বাঁচাতেই প্রাণান্ত, তার উপর দু-দুটো জীবনের দায়িত্ব বয়ে বেড়ানো। এ কর্ম সহজ নয়, আর এতে শান্তি বলতে বিন্দুমাত্র কিছু নেই। সংসারের জ্বালা আর কাকে বলে!

ভৈরবী বললেন, “কুন্তী বসে আছে। ও হতভাগীর চোখের ঘুম একেবারে ঘুচে গেছে। আজ ক’টা দিন ওকে নিমেষের তরেও চোখের পাতা এক করতে দেখিনি।”

মাথা তুলে দেখলাম কুন্তী বসে আছে গালে হাত দিয়ে থিরুমলের দিকে চেয়ে। থিরুমল তার পাশে নিশ্চিন্ত নিদ্রায় মগ্ন। ওকে খাওয়ানো ঘুমপাড়ানো এমনভাবে করছে কুন্তী যেন ও একটি শিশু। সর্বদা কুন্তীর ভয় পাচ্ছে থিরুমল এমন কিছু করে বসে যাতে আমরা কেউ বিরক্ত হই। আমাদের সকলের কাছে কুন্তীর অবনত, সকলের দয়ার উপর নির্ভর করে চলেছে থিরুমলকে নিয়ে। ওর সর্বদা ভয় আমরা যদি কোনো ছুঁতোয় ওদের ত্যাগ করি।

হায় রে–ও বেচারা জানে না এখানে এই মহা বিপত্তির মাঝে কেউ কাকেও তিলমাত্র সহায়তা করতে পারবে না, যদি সে রকমের কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। এখানে একে অপরের মুখ চাওয়া সম্ভবই নয়, সেটা উভয়ের পক্ষে চরম বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়াবে। এ বড় বিষম ঠাঁই….

কুন্তীকে ডাক দিলাম। উঠে এসে সে ভৈরবীর কাছে বসল। একটু গুছিয়ে নিয়ে আরম্ভ করলাম… দেখো–অত ভেবো না তুমি। অত ভাবনার কি আছে? আগে তো হিংলাজ দর্শন হোক। তারপর মায়ের দয়ায় আমাদের সকলেরই ভালো হবে। থিরুমল সেরে উঠবে। আর তোমরা তো যাচ্ছ আমাদের সঙ্গে কলকাতায়। সেখানে ওকে ভালো করে ডাক্তার দেখাতে পারা যাবে। আমাদের তো আপনার বলতে কেউ কোথাও নেই। তোমার মতো একটা মেয়ে পাওয়া গেল এ আমাদের ভাগ্য বলতে হবে। আমরা যখন মরব তখন অন্তত মুখে জল দেবার জন্যে তুমি আমাদের কাছে থাকবে। এটাও মায়ের দয়া।

আরও হয়তো খানিক লম্বা করে বক্তৃতাটা চালিয়ে যেতাম। কিন্তু কথা আর যোগাল না। ভৈরবীর কোলে মুখ গুঁজড়ে কুন্তী কান্নায় ভেঙে পড়ল। বেশ বুঝলাম, ওই দুটি নারী একে অন্যকে যে ভাবে বোঝে, তার সামান্য মাত্রও আমি বুঝি না। সর্বস্ব খুইয়ে কি আশায় কুন্তি থিরুমলকে সম্বল করে পথে নেমেছে তা পুরুষ হয়ে আমি কি জানব! ভৈরবী আমাকে আর না বকে ঘুমোতে বললেন। তাই করলাম। পাশ ফিরে শুলাম। ওরা বসে রইল।

একদিন সন্ধ্যার কিছু আগে বৌবাজারের এক গির্জার সামনে দাঁড়িয়ে এক বক্তৃতা শুনেছিলাম। একটা উঁচু টুলের উপর দাঁড়িয়ে বক্তা ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তা প্রমাণ করছিলেন শ্রোতাদের কাছে। তিনি বলছিলেন, “ঈশ্বর বললেন, অন্ধকার হইতে আলোক হউক।” সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বরের সেই আদেশ পালনার্থে আলো হল।

চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম –সেই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যদি দয়া করে আমাদের কাছে উপস্থিত হয়ে একটা উল্টো হুকুম জারি করতেন–”আলো না হইয়া আরো কিছুক্ষণ অন্ধকার থাকুক”, তাহলে অন্য কোথাও কারও কোনো অসুবিধা হত কিনা বলতে পারি না, তবে আমাদের এই যাত্রীদলটির বিশেষ উপকারই হত।

অনাবৃত আকাশের তলায় পড়ে ঘুমোতে বিশেষ কিছু অসুবিধা হয় না যদি সময়টা রাত্রিকাল হয়। কারণ রাত্রির আধারই তখন আচ্ছাদনের কাজ করে। দিনের বেলায় ঘর বাড়ি চালা গুহা এর যা হোক একটা কিছুর তলায় ঢুকে দিনের আলোটা একটু ঠেকাতে পারলে ঘুমোবার কিছু সম্ভাবনা তবু থাকে।

কিন্তু করা যাবে কি? চোখের পাতা বন্ধ করে চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে রইলাম। ওধারে যথাকালে সূর্যদেব দেখা দিলেন এবং এগিয়েও আসতে লাগলেন।

রূপলাল এসে ডেকে ওঠাল।

“একটু দাওয়াই দিন।”

“কিসের দাওয়াই? কার আবার কি হল?”

ধরেছে যে একজনকে! দেখছেন না পাণ্ডে বাবা বার বার লোটা হাতে ছুটছে!” ধড়মড় করে উঠে বসলাম-কি হয়েছে? বাড়াবাড়ি নাকি? চলো দেখে আসি আগে।”

“দেখবেন কি ছাই-ও আর পৌঁছবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত এইভাবে চলে। এই মুল্লুকে একবার ধরলে আর ছাড়ে না। বলেছিলাম তো- দু-একজন কমবেই আমাদের মধ্যে। এবার দেখুন না কি দাঁড়ায়।”

বললুম, “দাওয়াই দেব না দেখে? আগে দেখি গিয়ে রোগটা কি, তারপর তো দাওয়াই!” রূপলাল বললে, “তবেই হয়েছে। আপনার দেওয়া দাওয়াই জানতে পারলে ও খাবে নাকি? আপনার হাতের দাওয়াই খেলে যদি জাত যায়! তারচেয়ে যা দেবেন, আমার হাতে দিন। আমি পাণ্ডা মানুষ, আমার জাত সহজে যায় না। আপনার সমস্ত দাওয়াই তো ওই সাদা গুঁড়ো। খানিকটা নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিই। বলব, এ হচ্ছে হিংলাজের প্রসাদী-খেলে সব অসুখ সারে। বিশ্বাস করে খাবে, আর যদি পরমায়ুর জোর থাকে বেঁচে যাবে।”

বায়োকেমিক ওষুধের গোটাকতক শিশি ছিল আমাদের সঙ্গে রূপলাল তা জানত। এই সরলপ্রাণ ছোকরা যা হোক একটা কিছু করে দেখতে চায় যদি লোকটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। আর তর্কাতর্কি না করে উঠে গেলাম। আমাদের পোঁটলা পুঁটলির ভিতর থেকে ওষুধের শিশি কটা খুঁজে বার করে পেটের অসুখের ওষুধ একটু দিয়ে দিলাম। খুশি মনে রূপলাল খাওয়াতে চলে গেল।

আর শুয়ে থাকা হল না। কুয়োর ধারে গেলাম–জল চাই, মুখে চোখে দিতে হবে। হা হতোস্মি-এরই নাম কুয়া। বালুর মাঝে কোমর পর্যন্ত নিচু একটা গর্তের জলায় আধ হাত জল। সেই জলে না ভাসছে হেন দ্রব্য নেই, উটের বিষ্ঠা পর্যন্ত তার উপর, আর কি মুশকিল সেই জল তোলা। কিনারায় গিয়ে দাঁড়ালে পাড়ের বালি ধসে যাবে, দড়ি-বাঁধা বালতি বা লোটা ছুঁড়ে ফেললে বালি উঠে আসবে-এখন উপায়? দাঁড়িয়ে ভাবছি, পিছন থেকে কে বললে-”হুজুরের জলের প্রয়োজন নাকি?”

চমকে উঠে পিছনে ফিরে দেখি-হাঁ, দেখবার মতো চেহারাই বটে। সাদা, একেবারে আপাদমস্তক সমস্ত এত সাদা, যেন ধপধপে তুলোয় তৈরি একটি মূর্তি।

মাথায় একমাথা সাদা চুল, বুক ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত পৌঁছেছে সাদা দাড়ি। আর সে কি অল্প স্বল্প চুল দাড়ি! গোটা দশেক লোকের মাথায় মুখে ভাগ করিয়ে বসিয়ে দিলেও যথেষ্ট বাকি থেকে যাবে। সেই চুলদাড়ির মাঝখানে সামান্য যে স্থানটুকুতে কপাল চোখ দুটি আর নাকটি রয়েছে তাও সাদা। তবে চুলদাড়ির মতো অত সাদা নয়, সামান্য একটু লালচে আভা আছে। বিশেষ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে চোখের তারা দুটি যেন বহুদূর থেকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ফেলে দুনিয়ার সব কিছু এফোঁড়-ওফোঁড় দেখে নিচ্ছে।

মাথায় পাগড়ি নেই। জামা জোব্বা উট-ওয়ালাদের মতোই। তবে নিখুঁত পরিষ্কার। হাত দুটি পিছনে করে সেই অপরূপ মূর্তি সামান্য সামনে ঝুঁকে পুনরায় সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করল-”হুজুরের বোধ হয় জলের প্রয়োজন?”

হতভম্ব হয়ে তার আপাদমস্তক দেখছিলাম। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করায় সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললাম-”কিন্তু তুলব কি করে?”

সেই মূর্তি হাসল। হাসল মানে সাদা গোঁফদাড়ির ভিতর থেকে কয়েকটি সাদা দাঁত একবার বেরিয়েই আবার লুকাল।

“আসুন আমার সঙ্গে, জল তোলা আছে।”

চললাম। কুয়োর ধার থেকে উঠে পূর্বদিকের বালুর টিলাটার উপরে তাঁর পিছন পিছন উঠে দেখি, একটু দূরেই রাশীকৃত শুকনো কাঁটার ডালপালা স্তূপাকার করা রয়েছে।

“ওই গরিবের আস্তানা। হুজুর যদি দয়া করে একটু কষ্ট করেন, ওখানেই জল তোলা আছে”-বলে তিনি অগ্রসর হলেন।

তাঁকে অনুসরণ করে নামলাম গিয়ে সেই শুকনো কাঁটার ডালপালার পাহাড়ের কাছে।

হাঁ, ঘরই বটে।

গুহাবাসী মানব কবে কোন যুগে গুহার মায়া পরিত্যাগ করে নিজের হাতে নিজের বাসস্থান বানাতে শুরু করে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের মাথায় হাজার রকমের ফন্দি-ফিকির গজিয়েছে, ফলে কোথাও দু-শ তলা কংক্রিটের বাড়ি আকাশ ছুঁতে চলেছে, কোথাও বা গাছের ডালে মাচা বেঁধে লতাপাতা দিয়ে নীড় রচনা করে লোকে মনের সুখে সংসারধর্ম করছে। আবার এমন জায়গাও আছে যেখানে বরফের চাঁই এর উপর চাঁই সাজিয়ে বাসস্থান বানিয়ে মানবসন্তান তার মধ্যে ঢুকে আরাম করে কাঁচা সিলমাছ চিবুচ্ছে।

কিন্তু এই যে বাড়ি চোখের সামনে দেখছি এ একেবারে অবাক কাণ্ড, অভিনব ব্যবস্থা। বলা উচিত, গৃহনির্মাণ পরিকল্পনার অচিন্তনীয় আবাসন।

লম্বা লম্বা শুকনো কাঁটার ডাল রাশি রাশি জুটিয়ে এনে সেই ডালপালা বেশ করে গুছিয়ে উপরি উপরি সাজিয়ে দেওয়াল বানানো হয়েছে। চারিদিকের দেওয়ালের মাথা ঘরের ভিতর দিকে ক্রমে ঝুঁকিয়ে নিয়ে এসে পরস্পরের সঙ্গে ঠেকিয়ে উপরের হাতের কাজ সারা হয়েছে। তার ফলে উপরটায় মঠ-মন্দিরের ঢঙ এসে গেছে। যেন আমাদের বক্রেশ্বরের কোনো পুরোনো মন্দির।

তবে কাঁটা–আপাদমস্তক বিলকুল এর কাঁটায় তৈরি। একেবারে নিখুঁত কণ্টকগৃহ, কোনো ভেজাল নেই।

ভিতরে প্রবেশ করবার জন্যে পূর্বদিকে একটি গোলমতো দরজা রয়েছে। দরজার সামনেই গোটাকতেক মোরগ মুরগি কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উঁকি মেরে ভিতরটা একবার দেখতে বড়ই লোভ হল।

কিন্তু তার পূর্বেই একটি মহিলা হৃষ্টপুষ্ট ছেলে কোলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন সেই কাঁটার দূর্গ থেকে। পরনে তাঁর ছিটকাপড়ের সালোয়ার, সাদা কাপড়ের পাঞ্জাবি এবং তার উপর একখানি ছাতার কাপড় দিয়ে মুখ মাথা বুক আবৃত

আমাকে যিনি সঙ্গে করে নিয়ে এলেন, তিনি কি বললেন মহিলাকে নিজের ভাষায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি তাঁর কণ্টকের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন এবং পরমুহূর্তেই বেরিয়ে এলেন একটি ছোট মুণ্ডুহীন ছাগল হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে। সেটি আমার সামনে নামিয়ে দিয়ে ছেলে কোলে নিয়ে পুনরায় তাঁর সেই গৃহের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

“মেহেরবানি করে এই জল নিয়ে যান। আশা করি এতেই আপনার গোসল হয়ে যাবে। লোকজন সকলে উঠলে জল তোলার বন্দোবস্ত হবে।”

তাঁর কথায় হুঁশ ফিরে এল। এতক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে হাবা-গঙ্গারামের মতো হাঁ করে সব দেখছিলাম। দেখছিলাম একসঙ্গে অনেক কিছুই। এঁদের ঘর-গৃহস্থালি, ওই টকটকে লাল বেখাপ্পা জামা গায়ে দেওয়া ওই সুন্দর শিশুটিকে আর যাঁর কোলে ওই শিশু রয়েছে তাঁকে। স্বাস্থ্য এবং শ্রী, ঠিক এই পরিবারের সঙ্গে মানানসই শ্রী আর তদুপযুক্ত সাজ-পোশাক, এর একটির সঙ্গে আর একটির কি আশ্চর্যজনক মিল, কোথাও ছন্দপতন হয়নি।

মুখ তাঁর দেখাই গেল না। ছাতার কাপড়ে নাক থেকে গলা বুক সমস্ত ঢাকা। দেখা গেল দুটি চোখ এবং ভ্রূর উপর সামান্য একটু কপাল। আশ্চর্য রং, দুধে আলতায় গোলা বললে অত্যুক্তি হয় না। সেই আশ্চর্য চোখ দুটি যেন টলটল করে ভাসছে। এক লহমার জন্যে সেই চক্ষু দুটি আমার উপরে পড়েছিল। অদ্ভূত, সত্যই অদ্ভূত সে দৃষ্টি। বুঝলাম মরুভূমিরও প্রাণ আছে। সে দৃষ্টিতে মরুভূমির প্রাণের পরশ ছিল। আমার দেহের মধ্যে তড়িৎ খেলে গেল।

তাড়াতাড়ি নিচু হয়ে জলের থলিটা তুলে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেলাম।

সেই জলে মুখ ধোয়া থেকে সকল প্রয়োজনই মিটল। মাথা গা হাত সমস্ত মুছে নিলাম। রাত জেগে হাঁটার ক্লান্তি ও জড়তা দূর হল। তখনও সকালের ঠান্ডা হাওয়াটুকু বইছে, ধীরে-সুস্থে সকল কর্ম সমাধা করে ফিরে এলাম আড্ডায় সেই তেতুঁলগাছের তলায়।

তখন টানাটানি করে সকলে বয়ে নিয়ে চলেছে হাত-বিশেক লম্বা একখানা কাঠ। এখানা এতক্ষণ বালির নীচে চাপা পড়ে ছিল। কাঠখানা কুয়োর উপর আড়াআড়িভাবে ফেলে তার উপর দাঁড়িয়ে জল তোলা হবে।

গুলমহম্মদ আমাকে প্রভাতের সেলাম-আলেকুম জানিয়ে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল। সেই তুলোয় তৈরি মূর্তিটির নাম শেখ বসিরুদ্দিন, এখানকার কূপওয়ালা।

শেখ সাহেব সামান্য অবনত হয়ে এই আর্জি পেশ করলেন যে তাঁর স্ত্রীও এসেছেন আওরতদের সঙ্গে নিয়ে যেতে। এখানে খোলা জায়গায় ওঁদের তকলিফ আরও বেশি হবে। যদি আমার আপত্তি না থাকে তবে ভৈরবী আর কুন্তী তাঁর গরিবখানায় গিয়ে গোসল-আদি করে সুস্থ হয়ে সেখানেই বিশ্রাম করুন।

পিছন ফিরে দেখি সেই খোকার মা ভৈরবীর সঙ্গে আলাপ করছেন।

গুলমহম্মদের দিকে চাইলাম। সে বললে, “মাইজি ওখানেই যান। অনেক সুবিধা হবে।”

ভৈরবীকে বললাম, “ওর সঙ্গে যেতে পারো, ওই টিলার ওপরেই ওঁদের ঘরবাড়ি। তবে একটু সাবধান, কাঁটা ফুটে না মরো।”

গেলেন ভৈরবী শ্রীমতী বসিরুদ্দিনের পিছু পিছু আর সুখলাল গেল তাঁদের ঝোলা বয়ে নিয়ে। কুন্তী যেতে পারলে না, থিরুমল তখনও ঘুমোচ্ছে; সে উঠলে তাকে নাওয়ানো-খাওয়ানো করবে কে! কুন্তী মুহূর্তের জন্যে থিরুমলকে চোখের আড়াল করে না, আবার যদি কোনো দিকে লাগায় দৌড়-বিশ্বাস কি!

যথারীতি আরম্ভ হল সেদিনের ঘরকন্না করার ধুম। ধুমই বটে। কিছুক্ষণ পরে সারা গাছতলাটা ধোঁয়ায় ছেয়ে গেল। বিশটা চুলো ধরিয়ে বিশ জায়গায় রুটি পোড়ানো আরম্ভ হল।

আমাদের রান্নার জিনিসপত্র চলে যেতে লাগল শেখ বসিরুদ্দিনের আস্তানায়। ওখানে সুবিধামতো স্থান পেয়ে ভৈরবী রান্নার যোগাড় করছেন। তাঁর সুযোগ্য সহকারী শ্রীমান সুখলাল আসা-যাওয়া করছে, জিনিসপত্র বইছে– মহা ব্যস্ত।

এই ফাঁকে রূপলালকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম পাণ্ডে মহারাজের সংবাদটা। শুনলাম তিনি নিদ্রামগ্ন। রূপলালের তো খুবই আশা যে আমার ওষুধ কাজ করছে।

বসিরুদ্দিনের সঙ্গে তাঁদের দেশ-মুল্লুকের গল্প জুড়ে দিলাম। তিনি বললেন-সরকার থেকে তিনি এই কুয়োর ইজারা নিয়েছেন। জমা তাঁকে কিছুই দিতে হয়নি। তাঁর কাজ হচ্ছে কুয়ো পরিষ্কার রাখা এবং চারিদিকের হালচাল সম্বন্ধে মাঝে মাঝে সরকারকে ওয়াকিবহাল করা। অন্তত পঞ্চাশ-ষাটটি পরিবার এই কুয়োর উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। তারা ছাগল উট নিয়ে কাঁটার ঘর বানিয়ে এই কুয়োর চারিদিকে দশ-বিশ ক্রোশের মধ্যে বাস করছে। যেখানে ছাগল উটের পেট ভাবার মতো গাছপালা পায় সেখানেই ঘর তোলে, আবার গাছপালা ফুরোলে অন্যত্র চলে যায়। কিন্তু এই কুয়ো থেকে বেশি দূরে যায় না।

জিজ্ঞাসা করলাম, “এর পরের কুয়োটা কত দূর?”

শেখ সাহেব মাইল ক্রোশ এ সমস্তের ধার ধারেন না। বললেন, “উটের দশ-বারো ঘণ্টা লাগবে।” এ মুল্লুকে উটের চলার মাপই দূরত্বের পরিমাণ নির্দেশ করে, যেমন ইঞ্জিন মোটর ইত্যাদির শক্তি বোঝাতে ‘এতগুলো অশ্ব-শক্তির সমান’ বলা হয়।

আর একটি কথা জিজ্ঞাসা করা যায় কিনা ভাবছিলাম। হঠাৎ কথায় কথায় সুযোগ এসে গেল। আমার মনের মধ্যে খচ্‌খচ্ করছিল একটি প্রশ্ন, সেটি হল, এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর ওই ভার‍্যা লাভ কি করে সম্ভব হল।

শেখ সাহেব বলছিলেন তাঁদের দেশের দুঃখ-দারিদ্র্যের কথা। তাঁর সংসার চলা মুশকিল, সম্বলের মধ্যে একপাল বকরি আর মুরগিগুলো। হিংলাজযাত্রী বছরে আর ক’বার আসে! কিছূ কিছু যা আমদানি হয় ওই পঞ্চাশ-ষাটটি গৃহস্থের কাছে, যারা তাঁর কুয়োর জল খায়। তাদেরও অবস্থা তো সমান শোচনীয়। বিয়ে-সাদী করে ছেলেপিলে হওয়ায় আজকাল তাঁর কষ্টের অবধি নেই।

বললাম, “কিছু যদি মনে না করেন তবে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। আপনাদের দেশে দেখছি একটু বেশি বয়সেই বিবাহটা করে। মানে, আপনার বয়স এখন কত হবে?”

এবার হো হো করে প্রাণখোলা হাসি হেসে উঠলেন তিনি। বললেন, “হুজুরের কি ধারণা আমার বিবির বয়স আমার থেকে ঢের কম? সকলেই তাই মনে করে বটে। হুজুর আমার বয়স পয়তাল্লিশ, আমার বিবির বয়স চল্লিশ পার হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে ওর সাদী হয়েছে এই বছর পাঁচেক। এর আগে যিনি ওর স্বামী ছিলেন তিনি বেহেস্তে চলে গেছেন-আল্লা তাঁর আত্মার কল্যাণ করুন। আমার বিবির বিশ বছরের এক মেয়েই আছে। তারও ছেলেপিলে হয়েছে। আমার সঙ্গে সাদী হবার পর এই প্রথম ছেলে হল।”

একেবারে চুপ করে বসে থাকতে হল। ওই ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশ পার হয়ে গিয়েছে এবং তারপরেও ওঁর ওই অপরূপ সৌন্দর্য স্বাস্থ্য শ্রী বজায় রয়েছে, এ কি সহজে বিশ্বাস হয়! আর তা বিশ্বাস করতে গেলে আমার দেশের কুড়িতেই বুড়ি গৃহলক্ষ্মীদের ডাক দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে যে, তাঁদের উচিত এই মরুভূমির মাঝে চলে এসে এখানেই ঘর সংসার পাতা। আমার সুজলা সুফলা বঙ্গমাতার বুকভরা মধু বঙ্গবধূদের গাল-তোবড়ানো কোলকুঁজো হতশ্রী চেহারার ছবি চোখের উপর ভেসে উঠল। চলে আসুন তাঁরা এখানে, পুঁইশাক আর সজিনা ডাঁটা হয়তো মিলবে না, কিন্তু অম্বল আর সূতিকার সাক্ষাৎও যে পাওয়া যাবে না, এ আমি বুক ঠুকে বলতে পারি ৷

একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, “তা বহুত খুশি কি বাত। খোদা আপনার আর আপনার বিবির শরীর ভালো রাখুন। তবে আপনার চুলদাড়িটা একটু আগে আগেই ভয়ানক রকমের পেকে গিয়েছে।

এবার শেখ সাহেব মুচকি হেসে উত্তর দিলেন, “আজ্ঞে, মোটেই পাকেনি আমার চুলদাড়ি। চুলদাড়ির সাদা রং আমাদের বংশের বিশেষ গুণ বলতে পারেন। জন্মাবার সময়ই আমার সাদা চুল নিয়ে জন্মাই আর দাড়ি গজাবার সময়ই সাদা হয়ে গজায়। আমার বাচ্চার মাথাতেও সাদা চুল বেরিয়েছে, বোধ হয় অতটা লক্ষ করেননি। এই চুল-দাড়ির জন্যেই আমরা এ মুল্লুকে বিখ্যাত।”

একেবারে তাজ্জব বনে গেলাম।

এখন আমাকে যেতে হবে তপ্ত বালু ভেঙে পেটে কিছু দিতে। খাওয়া মাথায় থাকুক। কুন্তী থিরুমলকে নিয়ে চলেছে খাওয়াতে। তাকেই অনুরোধ করলাম, “যখন থিরুমলকে নিয়ে ফিরবে তখন এনো হাতে করে আমার খাবারটা। এই তপ্ত বালুর উপর দিয়ে আমি আর যাচ্ছি না, তোমরা খেয়ে নাও গিয়ে।

শেখ বসিরুদ্দিন আমার বিশ্রামের আয়োজন করলেন। চার খণ্ড গাছের ডাল জুটিয়ে এনে সেগুলো পুঁতে খাঁটিয়ার পায়া চারটে সেই ডাল চারটের মাথায় বেঁধে দিলেন। একখানা গালিচা এনে বিছিয়ে দিলেন খাঁটিয়ার উপর। ব্যাস, খাঁটিয়ার নীচে চমৎকার ঘর হয়ে গেল। উপর থেকে কাপড় কম্বল ঝুলিয়ে দিয়ে চারদিক বন্ধ করা হল।

একটানা ঘণ্টা দুয়েক ঘুমিয়ে উঠলাম। উঠে দেখি বাঁধা-ছাঁদা সমস্ত শেষ হয়ে গেছে। সুখলাল প্রস্তত এক গেলাস গরম চা হাতে নিয়ে। ভৈরবীও উপস্থিত, ছেলে কোলে করে তিনিও। কিছু আখরোট মিছরি বাদাম তাঁর খোকার জন্যে আলাদা করে রাখা হয়েছে। আমার চা খাওয়া আর উর্বশীর পিঠে খাঁটিয়া বাঁধা হলেই যাত্রা শুরু হবে!

ভৈরবী উঠলেন উটের উপর। “জয় হিংলাজ’ ধ্বনির সঙ্গে ছড়ি উঠল রূপলালের কাঁধে।

শেখ বসিরুদ্দিন আমার দু হাত চেপে ধরলেন। একটু দূরে তাঁর স্ত্রী দাঁড়িয়ে রইলেন ভৈরবীর দিকে চেয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *