২. দ্বিতীয় গল্প

দ্বিতীয় গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ – পূর্ব্ব কাহিনী

ডমরুধর বলিলেন,—পূজার সময় সন্ন্যাসী সঙ্কটের গল্পে আমার সম্বন্ধে আরও দুইটি বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছিলাম। কিন্তু আমার একটু পূর্ব্ব কাহিনী না বলিলে তোমরা সমুদয় বিষয় বুঝিতে পারিবে না। আজ যদি কৃত্তিবাস, কাশীদাস না থাকিতেন তাহা হইলে আমার বুদ্ধি, আমার বীরত্ব, আমার কীর্তির বিষয়ে তাঁহারা ছড়া বাঁধিতেন। ঘরে ঘরে, লোকে তাহা পাঠ করিয়া কৃতার্থ হইত। আর, যাত্রায় যাহারা দূতী সাজে, হাত নাড়িয়া নাড়িয়া তাঁহারা আমার বিষয়ে গান করিত। এক দিন রেলগাড়ীতে যাইবার সময় শুনিয়াছিলাম যে, কে এক জন মাইকেল ছিলেন। কে এক জন আবার তাঁহার জীবন-চরিত লিখিয়াছিলেন। এ বৎসর আমার বাগানে অনেক কাঁচকলা হইয়াছে। খরিদদার নাই, যিনি মাইকেলের জীবনচরিত লিখিয়াছেন তিনি যদি আমার বিষয়ে সেইরূপ একখানি পুস্তক লেখেন, তাহা হইলে তাঁহাকে আমি তের পণ কাঁচকলা দিতে সম্মত আছি।

আমার পিতা জমিদারী কাছারিতে মুহুরিগিরি করিতেন। যৎসামান্য যাহা বেতন পাইতেন, অতি কষ্টে তাহাতে আমাদের দিনপাত হইত। মাতা-পিতা থাকিতে আমার প্রথম নম্বরের বিবাহ হইয়াছিল। তাহাদের পরলোক গমনে কলিকাতায় হর ঘোষের কাপড়ের দোকানে কাজ করিতাম। মাহিনা পাঁচ টাকা আর খাওয়া। যে বাড়ীতে বাবুর বাসা ছিল, তাঁহার নীচের এক সেতালে ঘরে আমি থাকিতাম। বাবুর এক চাকরাণী ব্যতীত অন্য চাকর ছিল না। তাঁহার গৃহিণী স্বয়ং রন্ধন করিতেন। রান্না হইত—অন্ততঃ আমার ও ঝিয়ের জন্য-মুসুর দাল ও বেগুন বা আলু বা কুমড়া ভাজা। মুসুর দালে কেবল একটু হলুদের রং দেখিতে পাইতাম, দালের সম্পর্ক তাহাতে থাকিত কি না সন্দেহ। তাহার পর বলিহারি যাই গৃহিণীর হাত! কি করিয়া যে তিনি সেরূপ ঝিঝির পাতের ন্যায় বেগুন কাটিতেন, তাহাই আশ্চৰ্য্য! অত্রের চেয়ে বোধ হয় পাতলা। বাজারে যে চিংড়ি মাছ বিক্রয় হইত না যাহার বর্ণ লাল হইয়া যাইত, বেলা একটার সময় কালেভদ্রে সেই চিংড়ি মাছ আসিত। তাঁহার গন্ধে পাড়ার লোককে নাকে কাপড় দিতে হইত। সেই চিংড়ি মাছের ধড়গুলি বাবু ও তাঁহার গৃহিণী খাইতেন! মাথাগুলি আমাদের জন্য ঝাল দিয়া রান্না হইত। যে দিন চিংড়ি মাছ হইত, সেদিন আমাদের আহ্বাদের সীমা থাকিত না। সেই পচা চিংড়ি অমৃত জ্ঞান করিয়া আমরা খাইতাম। দুইবার ভাত চাহিয়া লইতাম। অধিক ভাত খরচ হইত বলিয়া চিংড়ি কিছুদিন পরে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর একগাঁট তেঁতুল ট্যাকে কবিয়া আমি ভাত খাইতে বসিতাম। তাহা দিয়া কোনরূপে ভাত উদরস্থ করিতাম। যাহা হউক, এক স্থানে তাহা আমি শিক্ষা পাইয়াছিলাম, পরে তাহাতে আমার বিশেষ উপকার হইয়াছিল। আমি বুঝিয়াছিলাম যে টাকা উপার্জন করিলেই টাকা থাকে না; টাকা খরচ না করিলেই টাকা থাকে।

আমার বোধ হয় রাক্ষসগণ। আমার যখন পঁচিশ বৎসর বয়স, তখন আমার প্রথম গৃহিণীর কাল হইল। তাঁহার সন্তানাদি হয় নাই। তাহার পর দশ বৎসর পর্যন্ত আমার আর বিবাহ হইল না। আমার অবস্থা সেই; ললাকে বিবাহ দিবে কেন?

এই সময় পাশের বাড়ী আমাদের এক স্বজাতি ভাড়া লইলেন। তাঁহার নাম প্রহ্লাদ সেন। দোতালায় সপরিবারে তিনি বাস করিলেন। একজন আত্মীয়কে নীচের দুইটি ঘর ভাড়া দিলেন। তাঁহার নাম গোলক দে। প্রহাদ বাবু কোন বণিকের আফিসে কাজ করিতেন। অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না, তবে টাকাকড়ি কি গহণাপত্র কিছু ছিল না। গোলোক বাবু সরকারী অফিসে অল্প টাকা বেতনে কেরাণিগিরি করিতেন। তাঁহার পুত্র পশ্চিমে কোথায় কাজ করিতেন, কলিকাতায় তিনি ও তাঁহার গৃহিণী থাকিতেন।

প্রহ্লাদবাবুর গৃহিণী, তাঁহার মাতা, এক বিধবা ভগিনী, দুই শিশু-পুত্র ও এক কন্যা, তাহার পরিবার এই ছিল। এই সময়ে কন্যাটির বয়স দশ কি এগার ছিল। আমি তাঁহাকে যখন প্রথম দেখিলাম, তখন অকস্মাৎ আমার মনে উদয় হইল—কে যেন আমার কানে কানে বলিয়া দিল যে,—ওমরুধর। এই কন্যাটি তোমার দ্বিতীয় পক্ষ হইবে। তোমার জন্যই বিধাতা ইহাকে সৃষ্টি করিয়াছেন। কিন্তু কি করিয়া কন্যার পিতার নিকট কথা উত্থাপন করি? বয়স তখন আমার পঁয়ত্রিশ বৎসর, রূপ আমার এই অবস্থা আমার এই কথা উত্থাপন করিলে তিনি হয়ত হাসিয়া উড়াইয়া দিবেন। কিন্তু বিধাতার ভবিতব্য কে খাইতে পারে। এই সময় এক ঘটনা ঘটিল, কন্যাটি নিদারুণ রোগে দ্বারা আক্রান্ত হইল। এই সূত্রে পাশের বাড়ীতে আমি যাওয়া-আসা করিতে লাগিলাম। আপনার কন্যা আজ কেমন আছে? দুইবেলা প্রহ্লাদবাবুকে সেই কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলাম। ক্রমে তাহাদের জন্য কিছু কাজকর্মও করিতে লাগিলাম। প্রয়োজন হইলে ঔষধ আনিয়া দিতাম ও ডাক্তারের বাড়ী যাইতাম। নিজের পয়সা দিয়া বড়বাজার হইতে ছাড়ানো বেদানা আনিয়া দিতাম। ডাক্তারের সঙ্গে বাড়ীর ভিতর গিয়া দুই তিনবার কন্যাটিকেও দেখিলাম। কন্যাটির রূপ ছিল না, তথাপি তাঁহাকে দেখিয়া আমার মন আরও মোহিত হইয়া গেল। এইরূপ আত্মীয়তার গুণে প্রহ্লাদবাবুর সহিত আমার অনেকটা সৌহার্দ্য জন্মিল। শুনিলাম যে, কন্যাটির নাম মালতী। কেমন সুন্দর নাম দেখিয়াছ? নামটি শুনিলে কান জুড়ায়।

ভগবানের কৃপায় মালতী আরোগ্যলাভ করিল। আমাদের ঝিকে মাঝে মাঝে দুই একটি সন্দেশ, দুই একটি রসগোল্লা, দুই একখানি জিলেপি দিয়া বশ করিলাম, ক্রমে তাঁহার দ্বারা প্রহ্লাদবাবুর মাতা, স্ত্রী ও বিধবা ভগিনীর নিকট কথা উত্থাপন করিলাম। প্রহ্লাদবাবুর ভগিনী সংসারের কত্রী। যা বলিয়াছিলাম,—সে কথা তিনি হাসিয়া উড়াইয়া দিলেন। তিনি বলিলেন,–কি। ঐ জলার ভূতটার সঙ্গে মালতীর বিবাহ দিব? পোড়া কপাল!

কিন্তু কন্যার বিবাহের নিমিত্ত প্রহ্লাদবাবু বিব্রত ছিলেন? তাঁহার টাকা ছিল না। কি করিয়া কন্যাদায় হইতে তিনি উদ্ধার হইবেন, সর্ব্বদাই তাহা ভাবিতেছিলেন। সুতরাং ঝি যে প্রস্তাব করিয়াছিল, সম্পূর্ণরূপে তিনি তাহা অগ্রাহ্য করিলেন না। তিনি বলিলেন,–পুরুষমানুষের পক্ষে পঁয়ত্রিশ বৎসর বয়স কিছু অধিক নহে। তাহার পর রূপে কি করে, গুণ থাকিলেই হইল। মালতীৱ পীড়ার সময় সে আমাদের অনেক উপকার করিয়াছে। তাহাতে বোধ হয় যে, ডমরুধর মন্দ লোক নহে। কিন্তু কথা এই যে, সে সামান্য বেতনে কাপড়ের দোকানে কাজ করে। পরিবার প্রতিপালন সে কি করিয়া করিবে?

এ বিষয়ে পূর্ব্ব হইতেই আমি ঝিকে শিক্ষা দিয়াছিলাম। আমার অবস্থা সম্বন্ধে যখন কথা উঠিল, তখন ঝি বলিল যে, দেশে ডমরুবাবুর অনেক জমি আছে, তাহাতে অনেক ধান হয়। আম-কাঁঠাল-নারিকেলেরও অনেক বাগান আছে। বলা বাহুল্য যে, এ সব কথা সমুদয় মিথ্যা। এ সময়ে আমার কিছুই ছিল না। কন্যার মাতা, পিতা ও পিতামহী এক প্রকার সম্মত হইলেন। কিন্তু প্রহ্লাদবাবুর ভগিনী ক্রমাগত আপত্তি করিতে লাগিলেন। অবশেষে তিনি বলিলেন যে, হবু জামাতার যদি এত সম্পত্তি আছে, তাহা হইলে তাঁহাকে অন্ততঃ পাঁচশত টাকার গহনা দিতে হইবে। এ কথা শুনিয়া আমি হতাশ হইয়া পড়িলাম। পাঁচশত টাকা দূরে থাকুক, তখন আমার পাঁচশত কড়া কড়ি ছিল না।

কিন্তু মালতী পয়মন্ত কন্যা। এই সময় সহসা আমার ভাগ্য খুলিয়া গেল। অভাবনীয় ঘটনাক্রমে অকস্মাৎ আমি দেড় হাজারের অধিক টাকা পাইলাম। আমার আনন্দের পরিসীমা রহিল না। কিন্তু মুখ ফুটিয়া আমি আনন্দ প্রকাশ করিতে পারিলাম না। আমার সৌভাগ্যের কথা কাহারও নিকট প্রকাশ করিতে পারিলাম না। আমি আমার গ্রামে যাইলাম। তেরশত টাকা কোন স্থানে লুকায়িত রাখিলাম। দুইশত টাকা লইয়া ফিরিয়া আসিলাম।

কলিকাতায় আসিয়া প্রহ্লাদবাবুর কন্যাকে আমি পাঁচশত টাকার গহনা দিতে স্বীকৃত হইলাম। বিবাহের সমুদয় আয়োজন হইল। এ বিবাহে কোন বিড়ম্বনা ঘটে নাই। শুভদিনে আমার দ্বিতীয় বারের বিবাহ-কার্য সম্পন্ন হইয়া গেল। সেইদিন সন্ধ্যাবেলা কন্যার নিমিত্ত পাঁচশত টাকার গহনা আমি পাঠাইয়া দিয়াছিলাম। এই পাঁচশত টাকার গহনা আমি একশত টাকায় ক্রয় করিয়াছিলাম।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ–একশত মোহর

ইহার ছয় মাস পরম সুখে অতিবাহিত হইয়া গেল। পাশেই শ্বশুরবাড়ী। সে স্থানে সর্ব্বদাই আমার নিমন্ত্রণ হইত। আমার আদরের সীমা ছিল না। যখন আহার করিতে বসিতাম, তখন এটা খাই কি সেটা খাই, সর্ব্বদাই এই গোলে পড়িতাম। এত দ্রব্য তাঁহারা আমার সম্মুখে দিতেন।

কিন্তু চিরদিন সমান যায় না। একদিন বেলা নয়টার সময় আহার করিয়া দোকানে যাইবার উদ্যোগ করিতেছি, এমন সময় আমার শ্বশুরবাড়ীর নীচের তলায় ঠিক আমার ঘরের পাশের ঘরে একটা ভয়ানক কোলাহল পড়িয়া গেল। আমি পূর্ব্বেই বলিয়াছি যে, আমার শ্বশুরবাড়ীর নীচের তলায় গোলোকবাবু নামে আমাদের একজন স্বজাতি বাস করিতেন। এ বাড়ীতে আমার ঘর, সে বাড়ীতে তাঁহার ঘর, ঠিক গায়ে গায়ে ছিল। এ বাড়ীতে আমার ঘর যেরূপ স্যাৎসেঁতে কদর্য ছিল, গোলোকবাবুর সেইরূপ ছিল না। তাঁহার ঘরটি খটখটে শুষ্ক ফিটফাট ছিল। তিনি নিজে সরকারী অফিসে কাজ করিতেন, পশ্চিমে কোথায় তাঁহার পুত্র কাজ করিত। তাঁহার অবস্থা নিতান্ত মন্দ ছিল না। গোলোকবাবুর বয়স হইয়াছিল। কলিকাতায় কেবল তিনি নিজে ও তাঁহার বয়স্কা গৃহিণী থাকিতেন। গোলোকবাবুর ঘরেই এই কোলাহল হইয়াছিল।

গোল শুনিয়া আমি আমার শশুরবাড়ীতে দৌড়িয়া যাইলাম, মনে করিলাম, হয় তো কোন বিপদ ঘটিয়া থাকিবে। সে স্থানে গিয়া দেখিলাম যে, আমার শ্বশুরবাড়ীর সমুদয় লোক নীচে আসিয়াছেন। আমাকে দেখিয়া মালতী উপরে পলায়ন করিল। অন্যান্য স্ত্রীলোকেরা ঘোমটা দিলেন। আমার শ্বশুরমহাশয়ের নিকট শুনিলাম যে, গোলোকবাবুর পুত্র মাঝে মাঝে পিতার নিকট টাকা পাঠাইতেন। পিতা টাকার মোহর গাঁথাইয়া তাঁহার ঘরের প্রাচীরের গায়ে যে আলমারি আছে, একটি বগুলি অর্থাৎ থলি করিয়া তাঁহার ভিতর রাখিয়া দিতেন। ক্রমে ক্রমে তিনি একশত মোহর গাঁথাইয়া আলমারির ভিতর রাখিয়াছিলেন। ঘরের প্রাচীরের গায়ে আলমারি, তাহাতে চারিটি তক্তার খোপ ছিল, সম্মুখে কাঠের কপাট ছিল, কপাট সর্ব্বদা চাবি-বন্ধ থাকিত। গোলেকবাবুর এই একশত মোহর চুরি গিয়াছিল। তাঁহার জন্যই এ গোলমাল। গোলোকবাবু মনের দুঃখে নীরবে বসিয়া আছেন, তাঁহার স্ত্রী কাঁদিতেছেন। কবে চুরি গিয়াছে, তাহা তিনি বলিতে পারেন না। তিনি বলিলেন যে, এক বৎসর পূর্ব্বে ঐ মোহরগুলি তিনি আলমারির ভিতর রাখিয়াছিলেন। তাহার পর আর তিনি নূতন মোহর ক্রয় করিতে পারেন নাই। তিনি বলিলেন যে, এ ঘরে কেবল তিনি ও তাঁহার স্ত্রী থাকেন, অন্য কেহ এ ঘরে প্রবেশ করে না। সে জন্য কাহাকেও তিনি সন্দেহ করিতে পারেন না। আমার শ্বশুরমহাশয় পুলিশে খবর দিবার প্রস্তাব করিলেন। কিন্তু আমি তাহাতে আপত্তি করিলাম। আমি বলিলাম যে, কখন কবে চুরি গিয়াছে, তাঁহার কোন ঠিক নাই, কাহারও প্রতি গোলোকবাবুর সন্দেহ হয়, তখন মিছিমিছি পুলিশে আর সংবাদ দিয়া কি হইবে? পুলিশে আর সংবাদ দেওয়া হইল না।

সন্ধ্যার পর যখন আমি দোকান হইতে ফিরিয়া আসিলাম, তখন আমার শ্বশুর প্রহ্লাদবাবু আমাকে ডাকিয়া বলিলেন,—ডমরুধর। বড় বিপদের কথা। পাশের বাড়ীতে তুমি যে ঘরে বাস কর, আর এ বাড়ীতে গোলোকবাবু যে ঘরে বাস করেন, এই দুই ঘরের কেবল একটি প্রাচীর, দুই ঘরের কড়ি সেই এক দেওয়ালের উপর। গোলোকবাবুর ঘরে Sweet যে স্থানে সে আলমারি আছে, সে স্থানের দেওয়ালটি কাজেই অতিশয় পাতলা। আজ তিনি আলমারির ভিতর ভাল করিয়া অনুসন্ধান করিতেছিলেন, যে স্থানে তিনি মোহর রাখিয়াছিলেন, তাঁহার হাত লাগিতেই সেই স্থানের দেওয়ালটি ভাঙ্গিয়া গেল। তখন তিনি দেখিলেন যে, সে স্থানে দেওয়ালে ইট ছিল না, কেবল একটু বালি থাম ছিল। সেই বালি ভাঙ্গিয়া প্রাচীরের ফুটা হইয়া গেল। দুই ঘরের এক দেওয়াল, সুতরাং সেই ছিদ্র তোমার ঘরেও হইল। তোমার উপর এখন বিলক্ষণ সন্দেহ হইয়াছে। যদি মোহরগুলি তুমি বাপু লইয়া থাক, তাহা হইলে আস্তে আস্তে ফিরাইয়া দাও। তাহা হইলে সকল কথা মিটিয়া যাইবে। তা না হইলে বড় গোলমাল হইবে।

এই কথা শুনিয়া আমি যেন আকাশ হইতে পড়িলাম,–সে কি মহাশয়! আমি ভদ্র সম্ভান, আমি চোর নই। তাহার পর আপনি আমার শ্বশুর। আমাকে ওরূপ কথা বলিবেন না।–তাহার পর গোলোকবাবু নিজে এবং তাঁহার গৃহিণী আমাকে অনেক মিনতি করিয়া বলিলেন,—বাপু! ভুলভ্রান্তিক্রমে যদি মোহরগুলি তোমার হাতে পড়িয়া থাকে, তামাসা করিয়া যদি রাখিয়া থাক, তাহা হইলে ফিরাইয়া দাও, তোমার পায়ে পড়ি, মোহরগুলি ফিরাইয়া দাও।

তাঁহাদের উপর আমি রাগিয়া উঠিলাম যে,–আমাকে আপনারা চোর বলেন। আপনারা ভাল মানুষ নহে। ইত্যাদি।

ক্রমে এ কথা আমার মনিব হর ঘোষের কানে উঠিল। মোহর ফিরিয়া দিতে তিনিও আমাকে অনুরোধ করিলেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম,–মহাশয়! আজ কয়েক বৎসর আপনার দোকানে কাজ করিতেছি, আর কয় বৎসর আপনার বাটীতে বাস করিতেছি। এক পয়সা কখন কি আপনার লইয়াছি? আমার প্রতি সন্দেহ হয় এমন কাজ কখন কি আমি করিয়াছি?

দিনকয়েক বিলক্ষণ গোল চলিল, দেখ, লম্বোদর! মানুষ হাজার বুদ্ধিমান হউক, এরূপ কাজে একটা না একটা ভুল করে। আমিও তাহাই করিয়াছিলাম। এ অনেক দিনের কথা হইল, এখন আর প্রকাশ করিতে দোষ নাই। প্রকৃত ঘটনা এই হইয়াছিল,–মশার দৌরাত্মে রাত্রিতে আমার নিদ্রা হইত না। অনেক কষ্টে পাঁচসিকা দিয়া একটি মশারি কিনিয়াছিলাম। মশারিটি খাটাইবার নিমিত্ত দেওয়ালে একটি পেরেক মারিতেছিলাম। পেরেক মারিতে হঠাৎ দেওয়ালের কতকটা বালি ভাঙ্গিয়া পড়িল। সেই স্থানটিতে একটি ছিদ্র হইল। ছিদ্রের ভিতর আমি হাত দিলাম। হাতে কি এক ভারী দ্রব্য ঠেকিয়া গেল। বাহির করিয়া দেখিলাম যে, মোহরপূর্ণ এক বগলি। তৎক্ষণাৎ আমি আমার ঘরের দ্বার বন্ধ করিয়া দিলাম। তাহার পর পুনরায় গর্তের ভিতর হাত দিয়া দেখিলাম যে, তাঁহার অপর পার্শ্বে কাঠ। হাতে সেই কাঠ ঠেকিয়া গেল। তখন ইহার অর্থ কিছু বুঝিতে পারিলাম না। কিন্তু তাহার পর প্রকাশ হইলে যে, আমার ঘরের ও গোলোকবাবুর ঘবের এক প্রাচীর, প্রাচীবের অপর পার্শ্বে গোলোকবাবুর ঘবে আলমারি, আমার হাতে আলমারির কপাট ঠেকিয়াছিল।

বলা বাহুল্য যে মোহরগুলি পাইযা আমাব যেন স্বর্গলাভ হইল। চুপি চুপি সেইগুলি গণিতে লাগিলাম। পাছে শব্দ হয়, সেজন্য একটি একটি করিয়া গণিলাম একশত মোহর। চিরকাল পরিশ্রম করিলেও কখন আমি এত টাকা উপার্জন করিতে পারিতাম না। দেখিলাম যে, এ সেকালের মোহর নহে, বিলাতি মোহর, যাহাকে লোকে গিনি বলে। পরদিন একটু বালি ও চুণ আনিয়া দেওয়ালের চিত্রটি বুজাইয়া দিলাম। তাহার পর বাজারে গিয়া মোহরগুলি বিক্রয় করিলাম। পনর শত টাকার অধিক হইল। দেশে গিয়া তেরশত টাকা কোন এক নিভৃত স্থানে পুঁতিয়া রাখিলাম। বিবাহেব নিমিত্ত বাকী টাকা কাছে রাখিয়া দিলাম। মোহর যে গিযাছে, ভাগ্যে গোলোকবাবু ছয় মাস পর্যন্ত দেখেন নাই। যে সময় মোহর হস্তগত হইয়াছিল, সে সময় যদি তিনি খোঁজ করিতেন, তাহা হইলে আমার আর বিবাহ হইত না।

বলিতেছিলাম যে, এই মোহর সম্বন্ধে আমি একটি ভুল করিয়াছিলাম। বড়বাজারে আমাদের কাপড়ের দোকানের পার্শ্বে এক পোদ্দারের দোকান ছিল। সেই দোকানে আমি মোহরগুলি বিক্রয় করিয়াছিলাম। একটু দূরে গিয়া যদি এ কাজ করিতাম, তাহা হইলে আর বিশেষ কোন গণ্ডগোল হইত না। পাশেই দোকান, সেজন্য পোদ্দারের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে আমার মনিব হর ঘোষ মহাশয় আমি যে মোহর বেচিয়াছিলাম, তাহা জানিতে পারিলেন। প্রহ্লাদবাবুকে তিনি বলিয়া দিলেন। সকলে জটলা করিয়া আমাকে মোহর বিক্রয়ের টাকা গোলোকবাবুকে দিতে বলিলেন। আমি বলিলাম যে,–মোহর আমার মায়ের ছিল। মৃত্যুকালে আমাকে দিয়া গিয়াছিলেন। বিবাহে ও অন্যান্য বিষয়ে মোহর বিক্রয়ের টাকা আমি খরচ করিয়া ফেলিয়াছি। সে টাকা এখন আমি কোথায় পাইব, আর যদি থাকিত, তাহা হইলে কেনই বা দিব?

অবশ্য আমার এ কথা তাঁহারা বিশ্বাস করিলেন না। যখন নিতান্ত আমার নিকট হইতে তাঁহারা টাকা আদায় করিতে পারিলেন না, তখন আমাকে পুলিশে দিবার নিমিত্ত তাঁহারা স্থির করিলেন। আমি মনে মনে ভাবিলাম,—তাহাতে ক্ষতি কি? এক বৎসর কি দুই বৎসর যদি আমার জেল হয়, তাহা হইলে মেয়াদ খাটিয়া পরে সেই টাকা লইয়া কোনরূপ ব্যবসা করিব। আর এখন যদি টাকাগুলি দিয়া দিই, তাহা হইলে আমার দশা কি হইবে? ভগবান আমাকে মোহরগুলি দিয়াছেন। সে টাকা ফিরিয়া দিলে আমার মহাপাতক হইবে।

কিন্তু আমাকে পুলিশে দেওয়া হইল না। আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী কাঁদিয়া কাটিয়া কুরুক্ষেত্র করিলেন। অবশেষে সকলে মিলিয়া আমার নিকট হইতে গোলকবাবুর পুত্রের নামে এক হাজার টাকার হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লইলেন। আর আমি মালতীকে যে গহনাগুলি দিয়াছিলাম, প্রহ্লাদবাবু সেগুলি গোলকবাবুকে দিয়া দিলেন। তাঁহারা আরও অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে, আমার বিবাহের সময় যে জমি-জোরাত বাগান-বাগিচার কথা বলিয়াছিলাম, সে সমুদয় মিথ্যা।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ–সুন্দরবনের অদ্ভুত জীব

আমার নিকট হইতে ইঁহারা যখন হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লইলেন, তখন আমি মনে মনে ভাবিলাম,–যত পার হ্যাণ্ডনোট লিখিয়া লও। উপুড় হস্ত কখন আমি করিব না। নালিশ করিবে? ডিক্রি করিবে? ডিক্রী ধুইয়া খাইও। কি বেচিয়া লইবে বাপু?

বস্তুতঃ এ হ্যাণ্ডনোটর একটি পয়সাও আমাকে দিতে হয় নাই। ইহার কিছুদিন পরে গোলোকবাবু কর্মত্যাগ করিয়া কাশী চলিয়া গেলেন। সে স্থানে তাঁহার ও তাঁহার স্ত্রীর মৃত্যু হইল। টাকা সম্বন্ধে তাঁহার পুত্র আমাকে পত্র লিখিয়াছিলেন। তাঁহার উত্তর আমি দিই নাই, তাহা নহে। দুইটা দুড়ী! সে কথা পরে বলিব।

হর ঘোষ আমাকে দোকান হইতে ছাড়াইয়া দিলেন। সেজন্য আমি দুঃখিত হইলাম না। মনে জানি যে, আমার সেই তেরশত টাকা আছে। পূর্ব্বেই মনে মনে স্থির করিয়াছিলাম যে, সেই টাকা দিয়া হয় জামিদারী কিনিব আর না হয় ব্যবসা করিব, কিন্তু যতদিন ঐ হ্যাণ্ডনোটের ভয় থাকিবে, ততদিন কিছু করিব না।

আমার শ্বশুরমহাশয় বলিলেন,–তোমাকে আর আমার বাড়ীতে আসিতে দিব না। আজ হইতে জানিলাম যে, আমার কন্যা বিধবা হইয়াছে। তোমার মুখ দেখিলেও পাপ হয়, আর জন্মে অনেক পাপ করিয়াছিলাম, সেজন্য তোমা হেন ইতরের হাতে আমি কন্যা দিয়াছি। তোমার ঘরে আমি কন্যা পাঠাইব না।

আমি ভাবিলাম যে,–বটে, এখন আমার পুঁজি হইয়াছে, কি করিয়া অর্থ সঞ্চয় করিতে হয়, হর ঘোষের বাড়ীতে তাহা আমি শিখিয়াছি। যেমন করিয়া পারি আমি ধনবান হইব, টাকা হইলে কেহ জিজ্ঞাসা করে না যে, অমুক কি করিয়া সম্পক্তিশালী হইয়াছে। জাল করিয়া হউক, চুরি করিয়া হউক, যেমন করিয়া লোক বড় মানুষ হউক না কেন, অমুকের টাকা আছে, এই কথা শুনিলেই ইতর-ভদ্র সকলেই গিয়া তাঁহার পদলেহন করে, সকলেই তাঁহার পায়ে তৈল মর্দন করে, একবার আমার টাকা হউক, তখন দেখিব যে, তুমি বাছাধন আমার বাড়ীতে ফ্যান চাটিতে যাও কি না। অবশ্য এসব মনের চিন্তা প্রকাশ করিলাম না, কিন্তু যথাকালে আমার সে ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হইয়াছিল।

আমার শ্বশুরমহাশয়ের রাগের আর একটি কারণ ছিল, মালতীকে আমি যে পাঁচশত টাকার গহনা দিয়াছিলাম, তাহা একশত টাকায় ক্রয় করিয়াছিলাম।দুইখানি ব্যতীত সমুদয় অলঙ্কার কেমিক্যাল সোনার অর্থাৎ গিল্টির গহনা ছিল। সুতরাং গহনাগুলি পাইয়া গোলোবাবুর বিশেষ লাভ হয় নাই।

হর ঘোষের দোকান হইতে বাহির হইয়া কিছুদিন আমি সুন্দরবনের এক আবাদে চাকরী করিয়াছিলাম। সেই সময় আবাদ সম্বন্ধে আমার অভিজ্ঞতা জন্মিল। কিছুদিন পরে যখন হাশুনোটের ভয় যাইল, তখন নিজের জন্য আমি একটি আবাদ খুঁজিতে লাগিলাম। খুঁজিতে খুঁজিতে শুনিলাম যে, দূরে নিবিড় বনের নিকট এক আবাদ সুলভমূল্যে বিক্রয় হইবে। যাঁহার আবাদ, তাঁহার নিকট গিয়া সমুদয় তত্ত্ব আমি অবগত হইলাম। তিনি বলিলেন যে, এই আবাদ তিনি পাঁচ হাজার টাকায় ক্রয় করিয়াছিলেন। নোনাজল প্রবেশ নিবারণের নিমিত্ত ইহাতে তিনি ভেড়ী অর্থাৎ বাঁধ বাঁধিয়াছিলেন, পানীয় জলের নিমিত্ত পুষ্করিণী খনন করিয়াছিলেন, দুই চারি ঘর প্রজাও বসাইয়াছিলেন, কিন্তু সহসা তাঁহার বাঁধ কয়েক স্থানে ভাঙ্গিয়া গেল, আবাদের ভিতর নোজল প্রবেশ করিল, প্রজাগণ পলায়ন করিল, সে আবাদ পুনরায় বনে আবৃত হইয়া পড়িল। পুনরায় উঠিত করিবার টাকা তাঁহার নাই। সেজন্য তিনি আবাদ বিক্রয় করিয়া ফেলিবেন। এই সম্পত্তি তিনি পাঁচ হাজার টাকায় ক্রয় করিয়াছিলেন। এক্ষণে এক হাজার টাকা পাইলে ছাড়িয়া দিবেন। আমি একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া সে স্থান দেখিতে যাইলাম। কিন্তু বাঘের ভয়ে নৌকা হইতে নীচে নামিলাম না। এ অঞ্চলে তখন অধিক আবাদ হয় নাই, চারিদিক আবৃত ছিল, সেজন্য বিলক্ষণ বাঘের ভয় ছিল। নৌকার উপর হইতে স্থানটি দেখিয়া আমার মনোনীত হইল। মনে ভাবিলাম যে একটু বিপদের আশঙ্কা না থাকিলে এরূপ সম্পত্তি হাজার টাকায় পাওয়া যায় না। মোহর প্রদান করিয়া ভগবান আমার প্রতি কৃপা করিয়াছেন। আমার পড়তা খুলিয়া গিয়াছে। একটু যত্ন করিলেই এই আবাদে পরে সোনা ফলিবে। আরও ভাবিলাম যে, আমার কাছে পূর্ব্ব হইতেই তেরশত টাকা ছিল। তাহার পর আবাদে কাজ করিয়া আরও পাঁচশত টাকা সঞ্চয় করিয়াছি। এক হাজার টাকা দিয়া সম্পত্তি ক্রয় করিলে আমার কাছে আটশত টাকা থাকিবে। ভেড়ি বাঁধিতে, বন কাটিতে, প্রজা বসাইতে এই আটশত টাকা খরচ করিব। তাহার পরে মাছের তেলে মাছ ভাজিব, অর্থাৎ ইহার আয় হইতেই বাকি ভূমি উঠিত করিব। এইরূপ ভাবিয়া-চিন্তিয়া সে বিষয় আমি ক্রয় করিলাম। তাহার পর শুন বিপত্তির কথা।

আবাদে কাজ করিবার সময় একজন সাঁইয়ের সহিত আমার আলাপ হইয়াছিল। মন্ত্রবলে যাহারা বাঘ দূর করিতে পারে, এরূপ লোককে সাঁই বলে। বড়গোছের একখানি নৌকা ভাড়া করিলাম। তাহাতে ছয়জন মাঝি ছিল। আবাদে কোথায় কি করিতে হইবে, তাহা দেখিবার নিমিত্ত সই ও আমি যাত্রা করিলাম। আমাদের পাশেই এক গাঙ ছিল। এই নদী দিয়া পূর্ব্ব ও পশ্চিমবঙ্গের নৌকা যাতায়াত করিত। আমি, সাঁই ও তিনজন মাল্লা লাঠিসোটা লইয়া আবাদের এদিক-ওদিক কিয়ৎপরিমাণে ভ্রমণ করিলাম। অনেক ভূমি বনে আবৃত, সকল স্থান দেখিতে পারিলাম না। যে যে স্থানে বাঁধ ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল, তাহা দেখিলাম। পুষ্করিণীটি উচ্চ ভূমিতে ছিল, তবুও কতক পরিমাণে তাঁহার ভিতর জোয়ারের নোনাজল প্রবেশ করিয়াছিল। যে কয়জন কৃষক বাস করিয়াছিল, একখানি ব্যতীত আর সকলের ঘর ভূমিসাৎ হইয়া গিয়াছিল। সেই একখানি ঘরের ভিতর প্রবেশ করিতে আমার ইচ্ছা হইল। কিন্তু একটু আগে গিয়া দেখিলাম যে, একটি মৃত ব্যাঘ্র সেই স্থানে পড়িয়া রহিয়াছে। কিছুক্ষণ তাঁহার নিকট দাঁড়াইয়া আমরা দেখিতে লাগিলাম। আমার সাঁই বলিল যে, এ ব্যাঘ্ৰটিকে অন্য কোন সাঁই মন্ত্রবলে বধ করিয়া থাকিবে। কারণ, ইহার শরীরে গুলী অথবা অন্য কোন অস্ত্রচিহ্ন নাই।

তাহার পর কৃষকের ভগ্নগৃহ অভিমুখে আমরা গমন করিলাম। এ ঘরখানির চারিদিকে প্রাচীর ও উপরে চাল ছিল, কিন্তু ঘরের দ্বারে আগড় অথবা কপাট ছিল না, যেই আমরা দ্বারের নিকট দাঁড়াইয়াছি, আর ঘরের ভিতরে বন্ বন্ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। প্রথমে মনে করিলাম যে, লক্ষ লক্ষ মৌমাছির গুনগুন্ রব। ভিতরে হয় তো বৃহৎ একটি চাক হইয়াছে। পরক্ষণেই যাহা দেখিলাম, তাহাতে ঘোরতর আশ্চর্যান্বিত হইলাম। কালো কালো চড়াই পাখীর ন্যায় শত শত কি সব দেওয়ালের গায়ে বসিয়া আছে। তাহাদের সর্ব্বশরীর কালো, কিন্তু পেটগুলি রক্তবর্ণের, তাহাদের দুইটি করিয়া ডানা আছে, উড়িবার নিমিত্ত ডানাগুলি নাড়িতেছে। তাহাতেই এরূপ বন্ বন্ শব্দ হইতেছে, রক্তবর্ণের কোন দ্রব্য খাইয়া পেট পূর্ণ করিয়াছে, সেজন্য উড়িতে পারিতেছে না। এ কি জীব? কিছুই বুঝিতে পারিলাম না। যে জীব হউক, এই জীবই রক্তপান করিয়া ব্যাঘটিকে বধ করিয়া থাকিবে। সেই সময় সাঁই এক বড় নির্বোধের কাজ করিয়া বসিল, লাঠি দ্বারা মাটিতে আঘাত করিয়া শব্দ করিল। শুটিদশ জীব যাহারা সম্পূর্ণভাবে উদর পূর্ণ করিয়া রক্তপান করে নাই, প্রাচীরের গা হইতে উড্ডীয়মান হইল। সাঁই সকলের অগ্রে ছিল, জীব কয়টি তাঁহার গায়ে আসিয়া বসিল, প্রাণ গেল বলিয়া সাঁই ভূতলে পতিত হইয়া ছটফট করিতে লাগিল।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–মশার মাংস

ডমরুর বলিতে লাগিলেন,আমরা দেখিলাম যে, সাইয়ের গায়ে দশ-বারোটি কালো জীব বসিয়াছে। যাতনায় সাঁই ছটফট্‌ করিতেছে। লাঠি দিয়া আমি সেই জীবগুলিকে তাড়াইতে চেষ্টা করিলাম। আমার লাঠির আঘাতে সাঁইয়ের দেহ হইতে তিনটি জীব উড্ডীয়মান হইল। তাহাদের একটি আমার গায়ে বসিতে আসিল। সবলে তাঁহার উপর আমি লাঠি মারিলাম। লাঠির আঘাতে জীবটি মৃত হইয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। আমি তাঁহার মৃতদেহ তুলিয়া লইলাম। ইতিমধ্যে আর দুইটি জীব একজন মাঝির গায়ে গিয়া বসিল। মাঝি চীৎকার করিয়া উঠিল। দশ-বারো হাত দৌড়িয়া গিয়া সেও মাটিতে পড়িয়া ছটফট করিতে লাগিল। আমি বুঝিলাম যে, এ জীব কেবল যে রক্তপান করে, তাহা নহে, ইহার ভয়ানক বিষও আছে। তখন অবশিষ্ট দুইজন মাঝির সহিত আমি দৌড়িয়া নৌকায় গিয়া উঠিলাম ও তৎক্ষণাৎ নৌকা ছাড়িয়া দিয়া সে স্থান হইতে পলায়ন করিলাম।

নৌকায় বসিয়া আমি ভাবিতে লাগিলাম। মনে করিলাম যে, মোহর বিক্রয়ের টাকাগুলি বুঝি জলাঞ্জলি দিলাম, পাপের ধন বুঝি প্রয়শ্চিত্তে গেল। এখন বুঝিতে পারিলাম যে, পাঁচ হাজার টাকার সম্পত্তি কেন সে লোক এক হাজার টাকায় বিক্রয় করিয়াছে। যে জীবটিকে লাঠি দিয়া মারিয়াছিলাম, যাহার মৃতদেহ আমি তুলিয়া লইয়াছিলাম, তাহা এখন পর্যন্ত আমার হাতেই ছিল। নৌকার উপর রাখিয়া সেইটিকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিলাম। কিছুক্ষণ উল্টাইয়া পাল্টাইয়া আমি ঘোরতর আশ্চর্যান্বিত হইলাম। দেখিলাম যে, সে অন্য কোন জীব নহে, বৃহৎ মশা! চড়াই পাখীর ন্যায় বৃহৎ মশা! মশা যে এত বড় হয়, তাহা কখন শুনি নাই। শরীরটি চড়াই পাখীর ন্যায় বড়, শুড়টি বৃহৎ জোঁকের ন্যায়। ডাক্তারেরা যেরূপ ছুরি দিয়া ফোড়া কাটে শুড়ের আগায় সেইরূপ ধারালো পদার্থ আছে। জীব-জন্তু অথবা মানুষের গায়ে বসিয়া প্রথম সেই ছুরি দিয়া কতক চর্ম ও মাংস কাটিয়া লয়। তারপর সেইস্থানে শুঁড় বসাইয়া রক্তপান করে! কেবল যে রক্তপান করিয়া জীব-জন্তুর প্রাণ বিনষ্ট করে তাহা নহে, ইহাদের ভয়ানক বিষ আছে, সেই বিষে অপর প্রাণী ধড়ফড় করিয়া মরিয়া যায়।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি করিয়া জানিলে যে, যে জীব কোন নূতন পক্ষী নহে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,পক্ষীদের দুইটি পা থাকে, ইহার ছয়টি পা; পক্ষীদের ডানায় পালক ছিল না; পক্ষীদের ঠোট থাকে, ঠোটের স্থানে ইহার শুঁড় ছিল। পক্ষীদের শরীরে হাড় থাকে, ইহার শরীর কাদার ন্যায় নরম। সেইজন্য আমি স্থির করিলাম যে, ইহা পক্ষী নহে, মশা।

লম্বোদর বলিলেন,—মশা যে এত বড় হয়, তাহা আমার বিশ্বাস হয় না।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–কেন বিশ্বাস হইবে না? হস্তী বৃহৎ মশা ব্যতীত আর কিছুই নহে। মশার শুঁড় আছে, হস্তীরও শুঁড় আছে। তবে হস্তী যদি রক্তপান করিত তাহা হইলে পৃথিবীতে অপর কোন জীব থাকিত না। সেই জন্য হস্তী গাছপালা খাইয়া প্রাণধারণ করে।

ডমরুর বলিলেন,–তাহা ভিন্ন আমি এ কথায় প্রমাণ রাখিয়াছি। যেমন সেই বাঘের ছালখানি ঘরে রাখিয়াছি, সেইরূপ এই মশার প্রমাণস্বরূপ আমি জোক রাখিয়াছি। আমাদের গ্রামের নিকট যে বিল আছে, মশার ঔড়টি কাটিয়া আমি সেই বিলে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সেই শুঁড় হইতে এখন অনেক বড় বড় জোঁক হইয়াছে। আমার কথায় তোমাদের প্রত্যয় না হয়, জলায় একবার নামিয়া দেখ। প্রমাণ ছাড়া আমি কথা বলি না।

লম্বোদর বলিলেন,–মশার শুঁড় পচিয়া জোঁক হইতে পারে না।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–কেন হইবে না? স্বে হইতে স্বেদজ জীব হয়। বাদ বনের পাতা পচিয়া চিংড়ি মাছ হয়। কোন বি-এ অথবা এম-এ অথবা কি একটা পাশ করা লোক কৃষিকার্য সম্বন্ধে একখানা বাঙ্গালা স্কুলপাঠ্য পুস্তক লিখিয়াছিলেন। পুদিনা গাছ সম্বন্ধে তাহাতে তিনি এরূপ লিখিয়াছিলেন, একখণ্ড দড়িতে গুড় মাখাইয়া বাহিরে বাঁধিয়া দিবে। গুড়ের লোভে তাহাতে মাছি বসিয়া মলত্যাগ করিবে। মাছির মল-মুত্রে দড়িটি যখন পূর্ণ হইবে, তখন সেই দড়ি রোপণ করিবে। তাহা হইতে পুদিনা গাছ উৎপন্ন হইবে। মক্ষিকার বিষ্ঠায় যদি পুদিনা গাছ হইতে পারে, তাহা হইলে মশার শুঁড় হইতে জোঁক হইবে না কেন?

ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,–যাহা হউক, আমার বড়ই চিন্তা হইল। এত কষ্টের টাকা সব বৃথায় গেল, তাহা ভাবিয়া আমার মন আকুল হইল। কিন্তু আমি সহজে কোন কাজে হতাশ হই না। গ্রামে আসিয়া অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া বৃহৎ একটি মশারি প্রস্তুত করিলাম। কাপড়ের মশারি নহে, নেটের মশারি নহে, জেলেরা যে জাল দিয়া মাছ ধরে, সেই জালের মশারি। তাহার পর পাঁচজন সাঁওতালকে চাকর রাখিলাম। একখানি নৌকা ভাড়া করিয়া সেই পাঁচজন সাঁওতালের সঙ্গে পুনরায় আবাদে গমন করিলাম। ধীরে ধীরে আমরা নৌকা হইতে নামিলাম। চারি কোণে চারিটি বাঁশ দিয়া চারিজন মাঝি ভিতর হইতে মশারি উচ্চ করিয়া ধরিল। তীর-ধনু হাতে লইয়া চারিপার্শ্বে চারিজন সাঁওতাল দাঁড়াইল। একজন সাঁওতালের সহিত আমি মশারির মাঝখানে রহিলাম। মশারির ভিতর থাকিয়া আমরা দশজন আবাদের অভ্যন্তরে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। অধিক দূর যাইতে হয় নাই। বৃহৎ মশকগণ বোধ হয় অনেক দিন উপবাসী ছিল। মানুষের গন্ধ পাইয়া পালে পালে তাঁহারা মশারির গায়ে আসিয়া বসিল। কিন্তু মশারীর ভিতর প্রবেশ করিতে পারিল না। সাঁওতাল পাঁচজন ক্রমাগত তাহাদিগকে তীর দিয়া বধ করিতে লাগিল। সেদিন আমরা আড়াই হাজার মশা মারিয়াছিলাম। সন্ধ্যাবেলা কাজ বন্ধ করিয়া পুনরায় নৌকায় ফিরিয়া আসিলাম। সাঁওতালগণ এক ঝুড়ি মৃত মশা সঙ্গে আনিয়াছিল। শুড়, ডানা ও পা ফেলিয়া দিয়া সাঁওতালরা মশা পোড়াইয়া ভক্ষণ করিল। তাঁহারা বলিল যে, ইহার মাংস অতি উপাদেয়, ঠিক বাদুড়ের মাংসের মত। আমাকে একটু চাখিয়া দেখিতে বলিল, কিন্তু আমার রুচি হইল না।

পরদিন আমরা দুই হাজার মশা বধ করিলাম, তাহার পরদিন যোলশত, তাহার পরদিন বারশত, এইরূপ প্রতিদিন মশার সংখ্যা কম হইতে লাগিল। পঁয়ত্রিশ দিনে মশা একেবারে নিঃশেষ হইয়া গেল। হয় আমরা সমুদয় মশা মারিয়া ফেলিলাম, আর না হয় অবশিষ্ট মশা নিবিড় বনে পলায়ন করিল। সেই অবধি আমাদের আবাদে এ বৃহৎ জাতীয় মশার উপদ্রব হয় নাই। মশার হাত হইতে অর্থাৎ ড় হইতে পরিত্রাণ পাইয়া আমি আবাদের চারিদিকে পুনরায় ভেড়ি বাঁধাইলাম। বন কাটিয়া ও পুষ্করিণীর সংস্কার করিয়া কয়েক ঘর প্রজা বসাইলাম। এই সমুদয় কাজ করিতে আমার আটশত টাকা খরচ হইয়া গেল। তখন দেখিলাম যে, আরও হাজার টাকা খরচ না করিলে কিছুই হইবে না। সে হাজার টাকা কোথায় পাই।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–শূন্যপথে লোহার সিন্দুক

আমাদের গ্রাম হইতে সাত ক্রোশ দূরে কচপুরের স্বরূপ সরকেলের সহিত আমার আলাপ পরিচয় ছিল। কাপড়ের দোকানে যখন কাজ করিতাম, তখন তিনি আমাদের খরিদ্দার ছিলেন। কাপড়ের দাম লইয়া তিনি বড় হেঁচড়া-হিচড়ি কচলাকচলি করিতেন না। তিন সত্য করিয়া ধর্মের দোহাই দিয়া আমি তাঁহাকে বলিতাম যে, আপনার নিকট কখনও আমি এক আনার অধিক লাভ করিব না। কিন্তু ফলে তাঁহাকে বিলক্ষণ ঠকাইতাম। আমি ব্যবসাদারের চাকর ছিলাম। দোকানদারের রীতি এই। আলাপী লোকেরা আমাদিগকে বিশ্বাস করে, আলাপী লোককে ঠকাইতে দোকানদারের বিলক্ষণ সুবিধা হয়। বড়বাজারে বসিয়া প্রতিদিন হাজার হাজার মিথ্যা কথা বলিতাম; শত শত লোককে আমরা ঠকাইতাম।

ঠকাইলে আমাদের কাজ চলে না। এই সূত্রে সরকেল মহাশয়ের সহিত আলাপ-পরিচয় হইয়াছিল। সরকে মহাশয়ের একটা জমিদারী আছে, তাহা ব্যতীত তিনি তেজারতি করেন। আমি ভাবিলাম যে, তাঁহার নিকট হইতে এক হাজার টাকা ঋণ গ্রহণ করিয়া আমি আমার আবাদের পতিত ভূমি উঠিত করিব।

এইরূপ মনে করিয়া আমি সরলে মহাশয়ের ভবনে গমন করিলাম। আবাদ বাঁধা রাখিয়া তাঁহার নিকট এক হাজার টাকা ঋণ চাহিলাম। তিনি বলিলেন যে, আবাদ না দেখিয়া টাকা দিতে পারি না। একজন গোমস্তাকে আমার আবাদ দেখিতে পাঠাইলেন। সাতদিন পরে পুনরায় আমাকে যাইতে বলিলেন। এই সময় আমি দেখিলাম যে, সেই গ্রামে দুইজন সন্ন্যাসী আসিয়াছেন। সরকেল মহাশয়ের বাড়ীর বাহিরে তাঁহারা আড্ডা গাড়িয়াছেন। তাহাদের সহিত তিনটি ঘোড়া ও বৃহৎ এক প্রস্তরনির্ম্মিত কালীর প্রতিমা আছে। দিনের মধ্যে তিনবার শখ ও শিঙ্গা বাজাইয়া তাঁহারা দেবীর পূজা করেন। সমস্ত দিন অনেক লোক আসিয়া প্রতিমা দর্শন করে। খুব ধুম। যে পর্যন্ত সন্ন্যাসী মহাশয়েরা এই গ্রামে আসিয়াছেন, সেই পর্যন্ত সরকেল মহাশয় তাহাদের সমুদয় ব্যয় নির্বাহ করিতেছেন। ইহার অনেক বৎসর পরে আমি নিজে সন্ন্যাসী-মাহাত্ম্য সম্বন্ধে তখন যদি কিছু অভিজ্ঞতা থাকিত, তাহা হইলে সরকেল মহাশয়কে সাবধান করিতাম।

সাতদিন পরে পুনরায় আমি সরকেল মহাশয়ের বাটী গমন করিলাম। সন্ধ্যাবেলা পোছিলাম। সেজন্য টাকাকড়ি সম্বন্ধে সে রাত্রি কোন কথাবার্তা হইল না। সরকেল মহাশয়ের দুই মহল কোঠাবাড়ী। পূর্ব্বদিকে অন্তঃপুর, পশ্চিমদিকে সদরবাটী। সদরবাচীর উত্তর দিকে পূজা দালান। আহারাদি করিয়া আমি পূজার দালানে শয়ন করিলাম, পথশ্রমে ঘোর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িলাম। রাত্রি বোধ হয় তখন একটা এমন সময় ভিতরবাড়ীতে দুম দুম্ করিয়া শব্দ হইতে লাগিল। আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল। ডাকাত পড়িয়াছে মনে করিয়া আমি উঠিয়া বসিলাম। কিন্তু লোকের সাড়াশব্দ কিছুই পাইলাম না। শব্দটাও ডাকাতপড়া শব্দের ন্যায় নহে। আমার বোধ হইল, যেন একটা ভারী বস্তু এক সিঁড়ি হইতে অপর সিঁড়িতে সবলে লাফাইয়া উপরতালা হইতে নীচের তলায় নামিতেছে। প্রথম মনে করিলাম যে, সরকেল মহাশয় বুঝি কোন বস্তু এই প্রকারে উপর হইতে নীচে আনিতেছেন। রথের সময় পুরুষোত্তমে জগন্নাথের কোমরে দড়ি বাঁধিয়া উড়ে পাণ্ডারা যেরূপ মন্দিরের এক পৈঠা হইতে অপর পৈঠায় নামায়, সরকেল মহাশয় বুঝি সেইরূপ কোন ভারী বস্তু নামাইতেছেন।

কিছুক্ষণ পরে বাড়ীর ভিতর কোলাহল পড়িয়া গেল। সরকেল মহাশয় চীৎকার করিয়া বলিলেন যে, টাকাকড়ি পূর্ণ তাঁহার লোহার সিন্দুক কে লইয়া যাইতেছে। তাহার পর স্ত্রীলোকেরা চীৎকার করিয়া বলিল যে, ভূতে লোহার সিন্দুক লইয়া যাইতেছে। আমি স্বচক্ষে দেখি নাই, কিন্তু পরে শুনিলাম যে, সিন্দুক আপনা আপনি সিঁড়ির এক পৈঠা হইতে অপর পৈঠায় নামিতেছিল। লোহার সিন্দুক যখন উপর হইতে নীচে নামিতেছিল, তখন সরকেল মহাশয় একবার তাঁহার আংটা ধরিয়াছিলেন। পরমুহূর্তে পায়ের উপর লোহার সিন্দুক পড়িয়া তাঁহার পা ভেঁচিয়া গিয়াছিল। তখন সরকেল মহাশয় অজ্ঞান হইয়া মাটীতে পড়িয়া রহিলেন। সিন্দুক নীচে নামিয়া ভিতরবাড়ীর দরজায় সবলে দুম দুম শব্দে আঘাত করিল। ভিতরবাড়ীর দরজা ভাঙ্গিয়া গেল। সিন্দুক সদরবাড়ীর উঠানে আসিয়া উপস্থিত হইল। আমি দেখিলাম যে, মাটী হইতে চারি-পাঁচ হাত উপরে শূন্যপথে সিন্দুক আপনা আপনি সদরদ্বার অভিমুখে গমন করিতেছে। তাড়াতাড়ি দালান হইতে নামিয়া আমি একটা আংটা ধরিয়া টানিতে লাগিলাম। সেই সময়ে সরকেল মহাশয়ের দারোয়ান রামগোপাল সিংও আসিয়া সিন্দুকের অপর পার্শ্বের আংটা ধরিয়া ফেলিল। সিন্দুক তৎক্ষণাৎ ভূতলে পতিত হইয়া দারোয়ানের পা ছেচিয়া দিল। সে মাটীতে পড়িয়া, জান গিয়া জান গিয়া বলিয়া চীৎকার করিতে লাগিল। ভাগ্যে আমার পায়ে পড়ে নাই। আমার পায়ে পড়িলে আমি মারা যাইতাম। এ নিশ্চয়ই ভৌতিক ব্যাপার, এইরূপ বুঝিয়া আমি আর সিন্দুক ধরিয়া রাখিতে চেষ্টা করিলাম না।

সদর দরজায় উপস্থিত হইয়া সিন্দুক গুরুভাবে তাহাতে আঘাত করিতে লাগিল। তিন ঘায়ে সদর দরজা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। সদরদ্বার ভাঙ্গিয়া সিন্দুক শূন্যপথে গ্রাম পার হইয়া মাঠের দিকে যাইতে লাগিল। গভীর রাত্রিতে ভয়ানক শব্দ শুনিয়া গ্রামের লোক মনে করিল যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়ীতে ডাকাত পড়িয়াছে। লাঠিসোটা লইয়া প্রতিবেশিগণ দৌড়িয়া আসিল, কিন্তু তখন সিন্দুক গ্রামের প্রান্তভাগে গিয়া উপস্থিত হইয়াছিল। এই সময় আর একটি অদ্ভুত ঘটনা ঘটিল। সরকেল মহাশয়েরুগৃহে ও নিকটস্থ প্রতিবেশীদিগের গৃহে হাতা, বেড়ি, কড়া, দা, কুড়ুল, ছুরি, কাঁচি যাহা কিছু লোহার দ্রব্য ছিল, সমুদয় বাহির হইয়া সন্ সন্‌ শব্দে শূন্যপথে সিন্দুকের পশ্চাৎ ধাবিত হইল। তাহার পর যাহা হইল, তাহা বলিলে তোমরা হয় তো বিশ্বাস করিবে না, অতএব চুপ করিয়া থাকাই ভাল।

লম্বোদর বলিলেন,–বিশ্বাস করি না করি বলই না ছাই।

লম্বোধর বলিলেন,–বাঘের ছালের ভিতর প্রবেশ করিয়া যখন তোমাদের সম্মুখে লম্ফঝম্ফ করিয়াছিলাম, তখন তো বিশ্বাস করিয়াছিলে। তখন পুকুরে গিয়া কেলে হাঁড়ি মাথায় দিয়া সমস্ত রাত্রি বসিয়াছিলে।

লম্বোদর উত্তর করিলেন,—বাঘ দেখি নাই। বাঘ বাঘ বলিয়া একটা গোল পড়িয়াছিল, তাহা শুনিয়াই গাড়ী হইতে লাফাইয়া পলায়ন করিয়াছিলাম।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–না, না, বিশ্বাস করিব না কেন। তাহার পর কি হইল বল।

উপস্থিত অন্যান্য ব্যক্তিগণও অনেক সাধ্য-সাধনা করিলেন। তখন ডমরুধর পুনরায় বলিতে আরম্ভ করিলেন।

আমার কোমরে তখন বড় একথোলো চাবি থাকিত। কিন্তু তখন কেবল আমার দুইটি বাক্স ছিল। লোকে মনে করিবে যে, ইহার অনেক টাকা আছে, টাকা রাখিতে স্থান হয় না, তাই অনেক বাক্স করিতে হইয়াছে, ঐ চাবিগুলি সেই সব বাক্সের। দেখ লম্বোদর! সত্য সত্য লোকের টাকা না থাকুক, একটা জনরব উঠিলেই হইল যে, অমুকের অনেক টাকা আছে। কাহাকেও একটি পয়সা দিতে হয় না। মুখবন্ধ গুড়ের কলসীর কাছে কত মাছি থাকে। তাঁহারা একফোটাও গুড় খাইতে পায় না, তথাপি আশেপাশে ভ্যান ভ্যান করে? সেইরূণ যদি লোকে শুনিতে পায় যে, অমুকের অনেক টাকা আছে, তাহা হইলে দেশশুদ্ধ লোক তাঁহার পাশে পাইলাম, তাহা কি? পাশে আসিয়া ভ্যান ভ্যান করে, সেই হাই তুলিলে তুড়ি দেয়। বিশেষতঃ আমার হাই। আমার হাই তোলা দেখিলে মানুষের প্রাণ শীতল হয়। হাই তুলিয়া একবার সকলকে দেখাই।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ–সন্ন্যাসীর কালীঠাকুর

সকলে মনে করিবে যে, আমার অনেক টাকা আছে, সেইজন্য বৃহৎ চাবির থোলো সর্ব্বদা আমি কোমরে পরিতাম। চারি-পাঁচটি ঘুনসী একত্র পাকাইয়া মোটা দড়ির ন্যায় করিয়া, চাবির থোলো তাহাতে বাঁধিয়া আমি কোমরে পরিয়াছিলাম।

যখন লোকের হাতা, বেড়ি, খন্তা, কুড়ুল সন্ স শব্দে আইরণচেষ্টের সঙ্গে সঙ্গে চলিয়া গেল, তখন আমার চাবির গোলোতে টান ধরিল। সহজ অবস্থায় চাবির থোলো ঝুলিয়া থাকে, এখন সোজা সটান হইয়া লোহার সিন্দুকের পশ্চাতে যাইবার নিমিত্ত চেষ্টা করিতে লাগিল। আমার পশ্চাৎদিকের কোমরের মাংসে ঘুনসি বসিয়া গেল, আমার ঘোর যাতনা হইল, আমি ভাবিলাম যে কোমর পর্যন্ত কাটিয়া আমার শরীর বা দুইখানা হইয়া যায়। একটু আলগা করিবার নিমিত্ত আমি চাবির থোলোটি ধরিতে যাইলাম। যেই দুইয়াছি, আর আমার হাতে যেন হাজার সূচ ফুটিয়া গেল। চাবি হইতে আমি হাত ছাড়াইয়া লইতে চেষ্টা করিলাম, কিন্তু তাহা পারিলাম না। চাবি আমাকে মাঠের দিকে টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিল। আমার প্রাণ বাঁচাও, আমার প্রাণ বাঁচাও বলিয়া গ্রামের লোককে ডাকিতে লাগিলাম, কিন্তু এ ভূতের কাণ্ড এইরূপ মনে করিয়া সকলে পলায়ন করিল, আপন ঘরে গিয়া দ্বার বন্ধ করিয়া দিল।

চাবির থোলো আমাকে মাঠের দিকে লইয়া চলিল। মাঠে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম যে, আগে অনেক দূরে তিনটি ঘোড়া যাইতেছে। জ্যোত্সা রাত্রি, সেজন্য অনেকটা স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম। দুইটা ঘোড়ার উপর দুইজন সন্ন্যাসী চড়িয়াছে, তৃতীয় ঘোড়র উপর সেই প্রস্তরের কালীমূর্তি ও পূজার আসবাব বোঝাই আছে। তাঁহার পশ্চাতে প্রায় পাচশত হাত দূরে মাটী হইতে চারি-পাঁচ হাত উপরে শূন্যপথে লোহার সিন্দুক যাইতেছে। সিন্দুক হইতে প্রায় দুইশত হাত পশ্চাতে হাতা, বেড়ি, কড়া, খন্তা, দা, কুড়ুল লৌহনির্ম্মিত দ্রব্যসমূহ সেইরূপ শূন্যপথে যাইতেছে। তাঁহার প্রায় দুইশত হাত দূরে চাবির থোলো আমাকে টানিয়া লইয়া যাইতেছে। কাণ্ডখানা কি, তখন আমি কিছুই বুঝিতে পারি নাই। তখন আমার প্রাণ লইয়া টানাটানি, কোমর কাটিয়া শরীরটি দুইখানা হইবার উপক্রম হইয়াছিল। ভাবিবার চিন্তিবার তখন সময় ছিল না।

মাঠের উপর দিয়া প্রায় এক ক্রোশ পথ এইভাবে আমাকে টানিয়া লইয়া চলিল। তাহার পর সহসা দুম করিয়া শব্দ হইল। চাহিয়া দেখিলাম যে দূরে সিন্দুকটি মাটীতে পড়িয়াছে, তাঁহার শব্দ। আরও নিরীক্ষণ করিলাম যে, সিন্দুকের অগ্রে ঘোড়া তিনটি স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, সন্ন্যাসী দুইজন ঘোড়ার পিঠ হইতে নামিয়াছে, আর তৃতীয় ঘোড়া হইতে কালীর প্রতিমাটিও নামাইয়া নীচে মাটীর উপর সিংহাসনে রাখিয়াছে।

সিন্দুকটি যেই মাটীতে পড়িল, আর তাহার পরক্ষণেই হাতা, বেড়ি, খন্তা, কুড়ুল প্রভৃতি ঝুপঝাপ ঠসঠাস করিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল। তাহার পরক্ষণেই আমার চাবি পূর্ব্বের ন্যায় কোমরে ঝুলিয়া পড়িল। কোমরে ঘুনসির টান আর রহিল না। তখন আমার ধড়ে প্রাণ আসিল, তখন যথানিয়মে নিঃশ্বাস খেলিয়া আমি সুস্থির হইলাম। সেই স্থানে আমি প্রায় এক ঘণ্টা পড়িয়া রহিলাম। এক ঘণ্টা পরে যখন আমি পুনরায় চাহিয়া দেখিলাম, তখন দেখিলাম যে, দূরে সে ঘোড়াও নাই, সে সন্ন্যাসীও নাই; অনেকক্ষণ পরে অতি সাবধানে, অতি ধীরে ধীরে, অতি ভয়ে ভয়ে আমি সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইলাম; দেখিলাম যে, সন্ন্যাসী দুইজন লোহার সিন্দুকটি কোনরূপে ভাঙ্গিয়াছে অথবা খুলিয়াছে। তাঁহার ভিতর টাকাকড়ি, গহনা-পত্র যাহা কিছু ছিল সে সমুদয় লইয়া গিয়াছে। চারিদিকে কাগজ-পত্র ছড়াছড়ি হইয়া আছে। দুই চারিখানি কাগজে স্ট্যাম্প দেখিয়া বুঝিলাম যে, সে সব দলিলপত্র। তাহাতে আমি হাত দিলাম না। অন্য একতাড়া কাগজ তুলিয়া দেখিলাম যে, সে কোম্পানীর কাগজ, তাহা আমি ফেলিয়া দিলাম। আর একতাড়া কাগজ, লম্বোদর। সেদিন তোমাদিগকে আমি বলিয়াছিলাম যে, আমি ভাগ্যবান পুরুষ। আজ তাঁহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখা কাগজ তাড়াটি একটু খুলিয়া দেখিলাম যে, সেসব নোট! তাহার পর দৌড়িয়া বেলা নয়টার সময় বাড়ীতে পৌঁছিয়া, তবে হাঁপ ছাড়িলাম।

লম্বোদর বলিলেন,—এ সমুদয় তোমার আজগুবি গল্প। এ অনেক দিনের কথা, কিন্তু আমরা সেই সময় শুনিয়াছিলাম যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়িতে যথার্থই চুরি হইয়াছিল এবং সে চোরগণ তোমার অপরিচিত লোক ছিল না।

ডমরুর উত্তর করিলেন,—সমুদয় মিথ্যা কথা, হিংসায় লোক কি না বলে।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ–চুম্বকের সার

ডমরুধর বলিতে লাগিলেন,—বাড়ীতে আসিয়া নোটগুলি গণিয়া দেখিলাম যে, দুইশত দশ টাকার নোট, মোট দুই হাজার টাকা। আর ঋণের প্রয়োজন কি? সরকেল মহাশয়কে আমি এক পত্র লিখিলাম যে,সেদিন আপনার বাড়ীতে গিয়া ভূতের হাতে প্রাণ হারাইতে বসিয়াছিলাম। আপনার টাকার আমার প্রয়োজন নাই।

তাহার পর সেই টাকা দিয়া আমি সমুদয় আবাদটি উঠিত করিলাম। আমি ছাইমুঠা ধরিলে সোনা-মুঠা হইয়া যায়। সে অঞ্চলে এখন অনেক লোকের আবাদ হইয়াছে। বহুদূর পর্যন্ত এখন লোকের বাস হইয়াছে। নদীতে খ্যি বসিয়াছে, মাঝে মাঝে হাট বসিয়াছে। গ্রীষ্মকালে কোন কোন স্থানে বরফের কুলফি বিক্রয় হয়। শীতকালে হিন্দুস্থানীরা ফুলুরি ফেরি করিয়া বেড়ায়। যে সাঁওতালগণ মশা মারিতে আমার সহায়তা করিয়াছিল, তাহাদিগকে আমি জমি দিয়াছি, তাঁহারা আমার প্রজা হইয়াছে। তাহাদিগের দেখাদেখি আরও অনেক সাঁওতাল নিকটস্থ আবাদসমূহে বাস করিতেছে।

এখন আমার কিরূপ সম্পত্তি হইয়াছে, কিরূপ জনসাধারণের নিকট আমি গণ্যমান্য হইয়াছি তাহা তোমরা অবগত আছ। শ্বশুর প্রহ্লাদবাবু সম্বন্ধে আমি যে ভবিষ্যদ্বাণী বলিয়াছিলাম, তাহা পূর্ণ হইয়াছে। মালতীকে আপনা হইতে তিনি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাহার পর তিনি নিজে তাঁহার পুত্রগণ, তাঁহার ভগিনী কতবার যে আমার বাড়ীতে আসিয়াছিলেন, তাঁহার সংখ্যা নাই। মালতী জীবিত নাই। এখন অবশ্য তাঁহাদের সহিত আমার কোন সম্বন্ধ নাই। শুনিয়াছি যে, এখন সংসারে তাহাদের আর কেহ নাই। দেশে গিয়া ম্যালেরিয়া জ্বরে সে সংসার মরিয়া-হাজিয়া গিয়াছে।

লম্বোদর বলিলেন,—অনেক কথা তো শুনিলাম। তুমি বলিলে যে, সরকেল মহাশয়ের বাড়ী চুরি হয় নাই, আর সে চোরগণকে তুমি দ্বার খুলিয়া দাও নাই। তবে সন্ন্যাসী দুইজন কি করিয়াছিল যে, লোহার সিন্দুক ও অন্যান্য লোহালড়ে টান ধরিয়াছিল?

ডমরুধর উত্তর করিলেন যে, আমি যখন কাপড়ের দোকানে কাজ করিতাম, তখন কোন কোন দিন সন্ধ্যার পর সে স্থানে পুঁথি পড়া হইত। মহাভারত রামায়ণের পর সে একজন আরব্য উপন্যাস পাঠ করিয়াছিলেন। তাহাতে এক রাজপুত্রের গল্প শুনিয়াছিলাম। জাহাজে চড়িয়া সমুদ্রপথে তিনি দেশ-বিদেশ পরিদর্শন করিয়াছিলেন। অবশেষে ঝড়ে তাড়িত হইয়া তাঁহার জাহাজ এক কৃষ্ণবর্ণের পর্ব্বতের সমীপে উপস্থিত হইয়াছিল। জাহাজের যত পেরেক ছিল, সব খুলিয়া সেই পর্ব্বতে গিয়া লাগিল। জাহাজ জলমগ্ন হইল। আমার বোধ হয় সন্ন্যাসীদের যে বৃহৎ কালীমূর্তি ছিল, তাহা চুম্বক পাথরে গঠিত। কিন্তু সে সামান্য চুম্বক পাথর নহে। চোলাই করা চুম্বক পাথরের সার। সিংহাসনটি এরূপ পদার্থে গঠিত, যাহা ভেদ করিয়া চুম্বক প্রস্তরের আকর্ষণশক্তি দূরে যাইতে পারে না। প্রথম কয়দিন সন্ন্যাসী দুইজন দেবীকে সেই সিংহাসনে বসাইয়া পূজা করিয়াছিল। সে নিমিত্ত সে কয়দিন লৌহদ্রব্যে টান ধরে নাই। শেষদিন গভীর রাত্রিতে তাঁহারা দেবীকে সিংহাসন হইতে নিম্নে রাখিয়াছিল, আর সেই সময় নিকটস্থ লৌহনির্ম্মিত দ্রব্য আকৃষ্ট হইয়াছিল। সে রাত্রিতে প্রথম আমি দেখিয়াছিলাম যে, তৃতীয় ঘোড়ার উপর বলদের ছালার ন্যায় তাঁহারা দুইদিকে দুই প্রকার বোঝ রাখিয়াছিল। বোধ হয়, একদিকে প্রতিমা, অপরদিকে সিংহাসন ও পূজার সামগ্রী রাখিয়াছিল। সিংহাসন হইতে মূর্তি পৃথক ছিল সেজন্য তখনও লোহার দ্রব্য টান ছিল; তাহার পর মাঠে প্রতিমার আকর্ষণশক্তি লোপ হইয়াছিল। তাহার পর সিংহাসনের উপর মূর্তি রাখিয়া ঘোড়ার উপর সেইভাবে বোঝাই দিয়া তাঁহারা পলায়ন করিয়াছিল। আমার বোধ হয়, লৌহদ্রব্যসমূহ এই কারণে শূন্যপথে ভ্রমণ করিয়াছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–তুমি যে গল্পটি করিলে, উহার কোন প্রমাণ আছে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—প্রমাণ নাই? নিশ্চয় আছে। চাবির থোলো এখনও আমার ঘরে আছে। বল তো এখনি আনিয়া দেখাই।

 

অষ্টম পরিচ্ছেদ–কুম্ভীর-বিভ্রাট

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—শুনিয়াছি যে সুন্দরবনে নদী-নালায় অনেক কুমীর আছে। তোমার আবাদে কুমীর কিরূপ?

ডমরুর বলিলেন,–কুমীর! আমার আবাদের কাছে যে নদী আছে, কুমীরে তাহা পরিপূর্ণ। খেজুর গাছের মত নদীতে তাঁহারা ভাসিয়া বেড়ায়, অথবা কিনারায় উঠিয়া পালে পালে তাঁহারা রৌদ্র পোহায়। গরুটা, মানুষটা, ভেড়াটা, ছাগলটা, বাগে পাইলেই লইয়া যায়। কিন্তু এ সব কুমীরকে আমরা গ্রাহ্য করি না। এবার আমার আবাদের নিকট এক বিষম কুমীরের আবির্ভাব হইয়াছিল। গন্ধমাদন পর্ব্বতে কালনেমির পুকুরে যে কুম্ভীর হনুমানকে ধরিয়াছিল, ইহা তাহা অপেক্ষাও ভয়ানক, গঙ্গাদেবী যে মকরের পীঠে বসিয়া বায়ু সেবন করেন, সে মকরকে এ কুমীর একগালে খাইতে পারে! পর্ব্বত প্রমাণ যে গজ সেকালে বহুকাল ধরিয়া কচ্ছপের সহিত যুদ্ধ করিয়াছিল, সে-কচ্ছপকে এ কুমীর নস্য করিতে পারে। ইহার দেহ বৃহৎ, তালগাছের ন্যায় বড়, ইহার উদর এই দালানটির মত। অন্যান্য কুমীর জীবজন্তুকে ছিঁড়িয়া ভক্ষণ করে। কিন্তু এ কুমীরটা আস্ত গরু, আস্ত মহিষ গিলিয়া ফেলিত। রাত্রিতে সে লোকের ঘরে ও গোয়ালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু বাছুর লইয়া যাইত। লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেওয়াল ভিজাইয়া গর্ত করিত। ইহার জ্বালায় নিকটস্থ আবাদের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রজাগণ পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে, আমাদের সেই ভয় হইল, তাহার পর লাঙ্গলের আঘাতে নৌকা ড়ুবাইয়া আরোহীদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। সে নিমিত্ত এ পথ দিয়া নৌকার যাতায়াত অনেক পরিমাণে বন্ধ হইয়া গেল।

এই ভয়ানক কুম্ভীরের হাত হইতে কিরূপে নিষ্কৃতি পাই এইরূপ ভাবিতেছি, এমন সময় আমার আবাদের নিকট একখানি নৌকা ড়ুবাইয়া তাঁহার আরোহীদিগকে একে একে আমাদের সমক্ষে সেগিলিয়া ফেলিল। এই নৌকায় এক ভলোক কলিকাতা হইতে সপরিবারে পূর্ব্বদেশে যাইতেছিলেন। নদীর তীরে দাঁড়াইয়া আমরা দেখিলাম যে, তাঁহার গৃহিণী সর্বাঙ্গ বহুমূল্য অলঙ্কারে ভূষিত ছিল। তোমরা জান যে, কুমীরের পেটে মাংস হজম হয়, গহনা পরিপাক হয় না। কুমীর যখন সেই স্ত্রীলোককে গিলিয়া ফেলিল, তখন আমার মনে এই চিন্তা উদয় হইল,—চিরকাল আমি কপালে পুরুষ; যদি এই কুমীরটাকে আমি মারিতে পারি, তাহা হইলে ইহার পেট চিরিয়া এই গহনাগুলি বাহির করিব, অন্ততঃ পাঁচছয় হাজার টাকা আমার লাভ হইবে।

এইরূপ চিন্তা করিয়া আমি কলিকাতায় গমন করিলাম। বড় একটি জাহাজের নঙ্গর কিনিয়া উকো ঘষিয়া তাহাতে ধার করিলাম, তাহার পর যে কাছিতে মানোয়ারি জাহাজ বাঁধা থাকে সেইরূপ এক কাছি ক্রয় করিলাম। এইরূপ আয়োজন করিয়া আমি আবাদে ফিরিয়া আসিলাম। আবাদে আসিয়া শুনিলাম যে, কুমীর আর একটা মানুষ খাইয়াছে। চারিদিন পূর্ব্বে এক সাঁতালনী এককুড়ি বেগুন মাথায় লইয়া হাটে বেচিতে যাইতেছিল সে যেই নদীর ধারে গিয়াছে, আর কুমীর তাঁহাকে ধরিয়া বেগুনের ঝুড়ি সহিত আস্ত গিলিয়া ফেলিয়াছে, তাহাতে সাঁওতাল প্রজাগণ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে; বলিতেছে যে, আবাদ ছাড়িয়া তাঁহারা দেশে চলিয়া যাইবে।

আবাদে আসিয়া নঙ্গরটিকে আমি বঁড়শী করিলাম তাহাতে জাহাজের কাছি বাঁধিয়া দিলাম, মাছ ধরিবার জন্য লোকে যে হাতসূতা ব্যবহার করে, বৃহৎ পরিমাণে এও সেইরূপ হাত-সূতার ন্যায় হইল। নঙ্গরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগে এক মহিষের বাছুর গাঁথিয়া নদীর জলের নিকট বাঁধিয়া দিলাম। কাছির অন্যদিকে একগাছে পাক দিয়া রাখিলাম, তাহার পর পঞ্চাশ জন সবল লোককে নিকটে লুক্কায়িত রাখিলাম। বেলা তিনটার সময় আমাদের এই সমুদয় আয়োজন সমাপ্ত হইল।

বড়শীতে মহিষের বাছুরকে বিধিয়া দিয়াছিলাম সত্য, কিন্তু তাঁহার প্রাণ আমরা একেবারে বধ করি নাই। নদীর ধারে দাঁড়াইয়া সে গাঁ গাঁ শব্দে ডাকিতে লাগিল, তাঁহার ডাক শুনিয়া সন্ধ্যার ঠিক পূর্ব্বে সেই প্রকাণ্ড কুমীর আসিয়া উপস্থিত হইল। তাঁহার লেজের ঝাঁপটে পর্ব্বতপ্রমাণ এক ঢেউ উঠিল, সেই ঢেউয়ে বাছুরটি ড়ুবিয়া গেল তখন আর আমরা কিছুই দেখিতে পাইলাম না, পরক্ষণেই কাছিতে টান পড়িল। তখন আমরা বুঝিলাম যে, নঙ্গরবিদ্ধ বাছুরকে কুমীর গিলিয়াছে, বঁড়শীর ন্যায় নঙ্গর কুমীরের মুখে বিধিয়া গিয়াছে। তাড়াতাড়ি সেই পঞ্চাশ জন লোক আসিয়া দড়ি ধরিয়া টানিতে লাগিল। ভাগ্যে গাছে পাক দিয়া রাখিয়াছিলাম, তা না হইলে কুমীরের বলে এই পঞ্চাশ জন লোককে নদীতে গিয়া পড়িতে হইত। আমরা সেই রাক্ষস কুমীরকে বঁড়শীতে গাঁথিয়াছি ঐ কথা শুনিয়া চারিদিকের আবাদ হইতে অনেক লোক দৌড়িয়া আসিল। প্রায় পাঁচশত লোক সেই রশি ধরিয়া টানিতে লাগিল। দারুণ আসুরিক বলে কুমীর সেই পাঁচশত লোকের সহিত ঘোর সংগ্রাম করিতে লাগিল। কখন আমাদের ভয় হইল যে, তাঁহার বিপুল বলে নোঙ্গর ভাঙ্গি য়া যায়, কখন ভয় হইল যে, তাঁহার জাহাজের দড়া বা ছিঁড়িয়া যায়। কখন ভয় হইল, গাছ উৎপাটিত হইয়া নদীতে গিয়া পড়ে। নিশ্চয় একটা বিভ্রাট ঘটিত, যদি না সাঁওতালগণ কুমীরের মস্তকে ক্রমাগত তীরবর্ষণ করিত, যদি না নিকটস্থ দুইটি আবাদের লোক বন্দুক আনিয়া কুমীরের মাথায় গুলী মারিত। তীর ও গুলী খাইয়া কুমীর মাঝে মাঝে জলমগ্ন হইতে লাগিল। কিন্তু নিঃশ্বাস লইবার জন্য পুনরায় তাঁহাকে ভাসিয়া উঠিতে হইল। সেই সময় লোক তীর ও গুলীবর্ষণ করিতে লাগিল। কুমীরের রক্তে নদীর জল বহুদূর পর্যন্ত লোহিত বর্ণে রঞ্জিত হইয়া গেল। সমস্ত রাত্রি কুমীরের সহিত আমাদের এইরূপ যুদ্ধ চলিল। প্রাতঃকালে কুম্ভীর হীনবল হইয়া পড়িল। বেলা নয়টার সময় তাঁহার মৃতদেহ জলে ড়ুবিয়া গেল। তখন অতি কষ্টে তাঁহাকে আমরা টানিয়া উপরে তুলিলাম।

বড় বড় ছোরা বড় বড় কাস্তে আনিয়া তাঁহার পেট চিরিতে চেষ্টা করিলাম। কিন্তু সে রাক্ষস কুমীরের পেট অতি কঠিন ছিল। আমাদের সমুদয় অস্ত্র ভাঙ্গিয়া গেল। অবশেষে করাত আনাইয়া করাতের দ্বারা তাঁহার উদর কাটাইলাম। কিন্তু পেট চিরিয়া তাঁহার পেটের ভিতর যাহা দেখিলাম, তাহা দেখিয়াই আমার চক্ষুস্থির।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিল,–কি দেখিলে?

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি দেখিলে?

অন্যান্য শ্রোতৃগণ জিজ্ঞাসা করিলেন,—কি দেখিলে?

ডমরুর বলিলেন,–বলিব কি ভাই, আর দুঃখের কথা, কুমীরের পেটের ভিতর দেখি যে সেই সাঁওতাল মাগী, চারিদিন পূর্ব্বে কুমীর যাহাকে আস্ত ভক্ষণ করিয়াছিল, সেই মাগী পূর্ব্বদেশীয় সেই ভদ্রমহিলার সমুদয় গহনাগুলি আপনার সর্বাঙ্গে পরিয়াছে, তাহার পর নিজের বেগুনের ঝুড়িটি সে উপুড় করিয়াছে, সেই বেগুনগুলি সম্মুখে উঁই করিয়া রাখিয়াছে। ঝুড়ির উপর বসিয়া মাগী বেগুন বেচিতেছে?

শঙ্কর ঘোষ বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন,–কুমীরের পেটের ভিতর ঝুড়ির উপর বসিয়া সে বেগুন বেচিতেছিল?

ডমরুর বলিলেন,–হাঁ ভাই! কুমীরের পেটের ভিতর সেই ঝুড়ির উপর বসিয়া মাগী বেগুন বেচিতেছিল।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,–কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল? কুমীরের পেটের ভিতর সে খরিদ্দার পাইল কোথা?

বিরক্ত হইয়া ডমরুর বলিলেন,—তোমার এক কথা! কাহাকে সে বেগুন বেচিতেছিল, সে খোজ করিবার আমার সময় ছিল না। সমুদয় গহনাগুলি সে নিজের গায়ে পরিয়াছিল, তাহা দেখিয়াই আমার হাড় জ্বলিয়া গেল। আমি বলিলাম,–মাগী! ও গহনা আমার। অনেক টাকা খরচ করিয়া আমি কুমীর ধরিয়াছি, ও গহনা খুলিয়া দে। কেঁউ মেউ করিয়া মাগী আমার সহিত ঝগড়া করিতে লাগিল। তাহার পর তাঁহার পুত্রগণ ও তাঁহার জাতি ভাইগণ কাড়বাঁশ ও লাঠিসোটা লইয়া আমাকে মারিতে দৌড়িল। আমার প্রজাগণ কেহই আমার পক্ষ হইল না। সুতরাং আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে হইল। সাঁওতালগণ সে মাগীকে ঘরে লইয়া গেল। দিনকয়েক শূকর মারিয়া ও মদ খাইয়া তাঁহারা আমোদপ্রমোদ করিল। পূর্ব্বদেশীয় সে ভদ্রমহিলার একখানি গহনাও আমি পাইলাম না। মনে মনে ভাবিলাম যে, কপালে পুরুষের ভাগ্য সকল সময় প্রসন্ন হয় না?

লম্বোদর বলিলেন,—এত আজগুবি গল্প তুমি কোথায় পাও বল দেখি?

ডমরুর বলিলেন,–এতক্ষণ হাঁ করিয়া এক মনে এক ধ্যানে গল্পটি শুনিতেছিলে। যেই হইয়া গেল, তাই এখন বলিতেছ যে, আজগুবি গল্প। কলির ধর্ম্ম বটে!

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,–এ কুমীরের গল্প যে সত্য, তাঁহার প্রমাণ আছে?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—প্রমাণ? নিশ্চয় প্রমাণ আছে। কোমরের ব্যাথার জন্য এই দেখ সেই কুমীরের দাঁত আমি পরিয়া আছি।

লম্বোদর জিজ্ঞাসা করিলেন,—সে কুমীর যদি তালগাছ অপেক্ষা বৃহৎ ছিল, তবে তাঁহার দাঁত এত ছোট কেন? ঠিক অন্য কুমীরের দাঁতের মত কেন?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—অনেক মানুষ খাইয়া সে কুমীরের দাঁত ক্ষয় হইয়া গিয়াছিল।