১. প্রথম গল্প

প্রথম গল্প
প্রথম পরিচ্ছেদ–সূচনা

ডমরুধর বলিলেন,—এই যে দুর্গোৎসবটি, এটি তোমরা সামান্য জ্ঞান করিও না। কিন্তু এখানকার বাবুদের সে বোধ নাই। বাবুরা এখন হাওয়াখোর হইয়াছেন। দেশে হাওয়া নাই, বিদেশে গমন করিয়া বাবুরা হাওয়া সেবন করেন, আর বাপপিতামহের পূজার দালান ছুঁচো-চামচিকাতে অপরিষ্কার করে।

লম্বোদর বলিলেন,—সত্য কথা! সেকালে পূজার সময় লোকে বিদেশ হইতে বাড়ী আসিত। বন্ধু-বান্ধবের সহিত মিলিত হইত। যাহার যেমন ক্ষমতা মায়ের পূজা করিত, গরীব-দুঃখীরা অন্ততঃ একরা খয়ে-মুড়কি ও দুইটি নারিকেল নাড়ু পাইত।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,—শুনিয়াছি যে, কলিকাতায় পূজা করা এক নূতন ব্যবসা হইয়াছে। একটি প্রতিমা খাড়া করিয়া বন্ধু-বান্ধবদিগকে লোক নিমন্ত্রণ করে, পরে তাহাদের কান মলিয়া প্রণামি আদায় করে। পূজা করিয়া অনেকে দুই পয়সা উপার্জন করে।

ডমরুধর বলিলেন,–তাহাতে আর দোষ কি? পূজার সময় আমি আমার প্রজাগণকে নিমন্ত্রণ করি। ভক্তিভাবে মায়ের পাদপদ্মে তাঁহারা যদি কিছু প্রণামি প্রদান করে, তাহাতে আর আপত্তি কি? যাহা, বিলক্ষণ ঠেকিয়া এই দুর্গোৎসব আরম্ভ করিয়াছি। আমি এখন বুঝিয়াছি যে, ভগবতীর আরাধনা করিলে ধনসম্পদ হয়।

পুরোহিত বলিলেন,–তে সম্মতা জনপদেষু ধনানি তেষাং, তেষাং যশাংসি ন চ সীদতি ধর্ম্মবর্গঃ। হে দেবী! তুমি যাহার প্রতি কৃপা কর, জনপদে সে পূজিত হয়; তাঁহার ধন ও যশ হয়, তাঁহার ধর্ম্ম অক্ষুণ্ণ থাকে।

কলিকাতার দক্ষিণে একখানি গ্রামে ডমরুধরের বাস। প্রথম বয়সে তিনি নিতান্ত দরিদ্র ছিলেন। অনেক কৌশল করিয়া সাধ্যমতে একটি পয়সাও খরচ না করিয়া তিনি প্রভুত ধনশালী হইয়াছেন। অন্যান্য সম্পত্তির মধ্যে সুন্দরবনের আবাদে তাঁহার এখন বিলক্ষণ লাভ হইয়াছে। ডমরুধর এখন পাকা ইমারতে বাস করেন। পূজার পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যার পর দালানে, যেস্থানে প্রতিমা হইয়াছে, সেই স্থানে গল্পগাছা প্রসঙ্গে এরূপ কথাবার্তা হইতেছিল।

ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,–হাঁ! মা, আমাকে ঘোরতর বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। সেই বিপদে পড়িয়া, একান্ত মনে মাকে ডাকিয়া আমি বলিয়াছিলাম, মা! তুমি আমাকে এ সঙ্কট হইতে পরিত্রাণ কর। তাহা করিলে প্রতি বৎসর আমি তোমার পূজা করিব।

লম্বোদর বলিলেন,–তুমি তো কেবল তিন বৎসরের ভিতর তোমাকে তো কোন বিপদে পড়িতে দেখি নাই। বরং তিন বৎসর পূর্ব্বে এই বৃদ্ধবয়সে তুমি নূতন পত্নী লাভ করিয়াছ।

ডমরুধর বলিলেন,—তিন বৎসর পূর্ব্বে আমি ঘোরতর বিধ্বদে পড়িয়াছিলাম। তৃতীয় পক্ষ বিবাহের সময় আমি সঙ্কটাপন্ন হইয়াছিলাম। গ্রামের লোক, প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব কেহই সে কথা জানে না। মুখ ফুটিয়া আজ পর্যন্ত কাহারও নিকট সে কথা আমি প্রকাশ করি নাই। মা জগদম্বা আমাকে সে বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছেন। দুর্গতিনাশিনী দুর্গার প্রতি লোকের ভক্তি ক্রমে তোপ হইতেছে। কলেরা ম্যালেরিয়া বসন্ত প্লেগ তো আছেই, মায়ের প্রতি ভক্তির অভাবে এখন আবার ফুলো রোগ দেখা দিয়াছে ঘুমন্ত রোগও আসিয়াছে। জগদম্বার প্রতি ভক্তি থাকিলে লোকের এসব বিপদ হয় না।

পুরোহিত অপরিস্ফুট স্বরে বলিলেন,–
দুর্গে! স্মৃতা হরসি ভীতিমশেষজন্তোঃ,
স্বস্থৈঃ স্মৃতা মতিমতীব শুভাং দদাসি।।
দারিদ্র্যদুঃখ ভয়হারিণি! কা ত্বদন্যা,
সর্বোপকারকরণায় সদার্দ্র চিন্তা।।

হে দুর্গে! বিপদে পড়িয়া তোমাকে স্মরণ করিলে জীবগণের ভয় তুমি দূর কর। সুস্থ অবস্থায় তোমাকে স্মরণ করিলে তুমি তাহাদের মঙ্গল কর। হে দারিদ্র্যদুঃখহারিণি! সর্ব্বপ্রকার উপকার করিবার নিমিত্ত তুমি ভিন্ন দয়াচিন্তা আর কে আছে?

লম্বোদর বলিলেন,—কিন্তু বিপদটা কি? কি বিপদে তুমি পড়িয়াছিলে? ডমরুধর বলিলেন,–এতদিন পরে সে বিপদের কথা আজ আমি প্রকাশ করিতেছি, শুন।

 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ঠিক কন্দর্প পুরুষ কি

ডমরুর বলিলেন,—আমার তৃতীয় বিবাহের সময় এ বিপদ ঘটিয়াছিল। আমার বয়স তখন পঁয়ষট্টি বৎসর। এত বয়সে তোক বিবাহ করে না। তবে আমার ছেলে-বেটা মানুষ হইল না। আমি তাঁহাকে ত্যাজ্যপুত্র করিলাম। কোথায় সে চলিয়া গেল। সে একটি স্বতন্ত্র গল্প।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–সে গল্প আর একদিন হইবে।

ডমরুর বলিলেন,–তাহার পর বিবাহ না করিলে গৃহ শূন্য হইয়া থাকে। কিন্তু বিবাহ করিলেও কি হয়, তা জান তো লম্বোদর?

লম্বোদর উত্তর করিলেন,—খ্যাচ খ্যাচ, রাত্রি দিন খ্যাচ খ্যাচ।

ডমরুধর বলিলেন,–হাঁ, তুমি ভুক্তভোগী। ঘটনাচক্রে আমার এই বিবাহের কথা স্থির হইয়াছিল। আমডাঙ্গার মাঠে আমার যে বৃহৎ বাগান আছে, সে বৎসর বৈশাখ মাসে সেই বাগানে গিয়া আমি বেড়াইতেছিলাম। দুই চারি দিন পূর্ব্বে আমার পুরাতন উড়ে মালী দেশে গিয়াছিল, ভাইপোকে তাঁহার স্থানে রাখিয়া গিয়াছিল। সে আমাকে কখন দেখে নাই, আমি তাঁহাকে কখন দেখি নাই। ঘোষের জামাতা সেই ছোঁড়ার সহিত সড় করিয়া চোর বলিয়া আমাকে বাঁধিয়া ফেলিল। তাহার পর মারিতে মারিতে কুতবপুরের মহকুমাতে আমাকে লইয়া গেল। কিন্তু সে আবার একটি স্বতন্ত্র গল্প।

শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন, এই বিপদ?

ডমরুধর উত্তর করিলেন,—রাম রাম! এ সামান্য কথা ইহা অপেক্ষা ঘোরতর সঙ্কটে আমি পড়িয়াছিলাম। সেই সঙ্কট হইতে মা দুর্গা আমাকে রক্ষা করিয়াছিলেন।

দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া ডমরুধর পুনরায় বলিলেন,–কুতবপুরে ঘটকীর সহিত আমার সাক্ষাৎ হইল, পুনরায় বিবাহ করিতে সে আমাকে প্রবলত্তি দিল। আমি বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। বিবাহের কথাবার্তা চলিতে লাগিল। টাকায় কি না হয়? বাঁশপুরে এক বয়স্কা কন্যার সহিত বিবাহ স্থির হইল। তিনিই আমার বর্তমান গৃহিণী।

লম্বোদর বলিলেন,—সে কথা আমরা জানি, আমরা বরযাত্ৰ গিয়াছিলাম।

ডমরুধর বলিলেন,–কন্যার মাতা-পিতা অর্থহীন বটে, কিন্তু আমার নিকট হইতে নগদ টাকা চাহিলেন না। তবে ঘটকী বলিল যে, বিবাহের সমুদয় খরচা আমাকে দিতে হইবে এবং কন্যার শরীরে যেখানে যা ধরে, সেইরূপ অলঙ্কার দিতে হইবে। তোমরা জান যে, আমি কখন একটি পয়সা বাজে খরচ করি না। তোক পাছে অলস হইয়া পড়ে সেই ভয়ে ভিখারীকে কখন মুষ্টিতিক্ষা প্রদান করি না। সেরার পেট ভরাইতে প্রথম আমি সম্মত হইলাম না। আমি বলিলাম যে, গহনার পরিবর্তে কন্যার আঁচলে নোট বাঁধিয়া দিব। কিন্তু কন্যার মাতা-পিতা সে প্রস্তাবে সম্মত হইলেন না। অবশেষে আমি ভাবিয়া দেখিলাম, যে, আমার বয়স পঁয়ষট্টি বৎসর, তাহার পর আমাকে দেখিয়া কেহ বলে না যে, ইনি সাক্ষাৎ কন্দর্প-পুরুষ। নিজের কথা নিজে বলিতে ক্ষতি নাই;–এই দেখ, আমার দেহের বর্ণটি ঠিক যেন দময়ন্তীর পোড়া শোউল মাছ। দাঁত একটিও নাই, মাথার মাঝখানে টাক, তাঁহার চারিদিকে চুল, তাহাতে একগাছিও কাঁচা চুল নাই, মুখে ঠোটের দুইপাশে সাদা সাদা সব কি হইয়াছে। এইসব কথা ভাবিয়া গহনা দিতে আমি সম্মত হইলাম! যতদূর সাধ্য সাদা মাটা পেটা সোনার গহনা গড়াইলাম; কিন্তু তাহাতেও আমার অনেক টাকা খরচ হইল। ফর্দ অনেক। একবাক্স গহনা হইল।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–তা বটে! কিন্তু বিপদটা কি?

ডমরুধর বলিলেন,–ব্যস্ত হইও না। শুন।

 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ – গাছে-ঝোলা সাধু

ডমরুধর বলিলেন,–গ্রামের প্রান্তভাগে বিন্দী গোয়ালিনীর যে ভিটা আছে, সে জমি আমার। কিছুদিন পূর্ব্বে বিন্দী মরিয়া গিয়াছিল। তাঁহার চালাঘরখানি তখনও ছিল। দুইজন চেলা সঙ্গে কোথা হইতে এক সাধু আসিয়া সেই চালাঘরে আশ্রয় লইল। সে সাধুকে তোমরা সকলেই দেখিয়াছ, তাঁহাকে সকলেই জান। সাধুর দুইটি চক্ষু অন্ধ। চেলারা বলিল যে, তাঁহার বয়স পাঁচশত তিপ্পান্ন বৎসর। চালাঘরের সম্মুখে যে আমগাছ আছে, চেলারা তাঁহার ডালে সাধুর দুই পা বাঁধিয়া দিত। প্রতিদিন প্রাতঃকালে এক ঘণ্টাকাল নীচের দিকে মুখ করিয়া সাধু ঝুলিয়া থাকিত। চারিদিকে হৈ-হৈ পড়িয়া গেল। যাহারা বি-এ, এম-এ পাস করিয়াছে, সেই ছোঁড়ারা আসিয়া সাধুর কেহ পা টিপিতে লাগিল, কেহ বাতাস করিতে লাগিল, সকলেই পাদোদক খাইতে লাগিল। একখানি হুজুগে ইংরেজী কাগজের লোক আসিয়া সাধুকে দর্শন করিল ও তাহাদের কাগজে সাধুর মহিমা গান করিয়া দীর্ঘ দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিতে লাগিল। ফল কথা, দেশের লোকের ভক্তি একেবারে উথলিয়া পড়িল। সাধুর মাথার নিম্নে চেলারা একটি ধামা রাখিল; সেই ধামায় পয়সা-বৃষ্টি হইতে লাগিল।

লম্বোদর বলিলেন,—তুমিও সেই হুজুগে দুপয়সা লাভ করিয়াছিলে!

ডমরুর বলিলেন,–সে জমি আমার, সে চালা আমার, সে আমগাছ আমার; কেন আমি লাভ করিব না? আমি সাধুকে গিয়া বলিলাম,—ঠাকুর! সন্ন্যাসী মোহান্তের প্রতি আমার যে ভক্তি নাই, তাহা নহে। তবে কি জান, আমি বিষয়ী লোক। তুমি আমার জমিতে আস্তানা গাড়িয়াছ। দুপয়সা বিলক্ষণ তোমার আমদানি হইতেছে। ভূস্বামীকে ট্যাক্স দিতে হইবে।।

সাধু উত্তর করিলেন,—আমরা উদাসীন। আমি নিজে বায়ু ভক্ষণ করি। চেলারা এখনও যৎকিঞ্চিৎ আহার করে। দীন দুঃখীকে আমরা কিছু দান করি। কোন পরিব্রাজক আসিলে তাঁহার সেবার কিঞ্চিৎ অর্থব্যয় করি। সেজন্য পুণ্যাত্মা ভক্তগণ যাহা প্রদান করে, আমার শিষ্যদ্বয় এ স্থানে খরচের জন্য তাঁহার অর্ধেক রাখিয়া, অবশিষ্ট ধন প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তোমাকে দিয়া আসিবে। বলা বাহুল্য যে, আহ্লাদ সহকারে আমি এ প্রস্তাবে সম্মত হইলাম। কোনদিন চারি টাকা কোনদিন পাঁচ টাকা আমার লাভ হইতে লাগিল। সন্ন্যাসীর প্রতি আমার প্রগাঢ় ভক্তি হইল। যাহাতে তাঁহার পসার-প্রতিপত্তি আরও বৃদ্ধি হয়, দেশের যত উজবুক যাহাতে তাঁহার গোঁড়া হয়, সেজন্য আমি চেষ্টা করিতে লাগিলাম। মনে মনে সঙ্কল্প করিলাম যে, দুগ্ধবতী গাভীর ন্যায় সন্ন্যাসীটিকে আমি পুষিয়া রাখিব। কিন্তু একটা হুজুগ লইয়া বাঙ্গালী অধিক দিন থাকিতে পারে না। হুজুগ একটু পুরাতন হইলেই বাঙ্গালী পুনরায় নতুন হুজুগের সৃষ্টি করে। অথবা এই বঙ্গভূমির মাটির গুণে আপনা হইতেই নূতন হুজুগের উৎপত্তি হয়। এই সময় এ স্থান হইতে চারি ক্রোশ দূরে পাঁচগেছে রসিক মণ্ডলের সপ্তমবর্ষীয়া কন্যার স্কন্ধে মাকালঠাকুর অধিষ্ঠান হইলেন। রসিম মণ্ডল জাতিতে পোদ। মাকালঠাকুরের ভরে সেই কন্যা লোককে ঔষধ দিতে লাগিল। দেবদত্ত ঔষধের গুণে অন্ধের চক্ষু, বধিরের কর্ণ, পঙ্গুর পা হইতে লাগিল। বোবার কথা ফুটিতে লাগিল। কতকগুলি সুস্থ লোককে কানা খোঁড়া, হাবা কালা, জোরে অম্বুলে সাজাইতে হয়, তা না করিলে এ কাজে পসার হয় না। তুলসীর মালা গলায় দিয়া সেই ইংরাজী কাগজের লেখকও সেই স্থানে গিয়া উপস্থিত হইল। ভক্তিতে গদগদ হইয়া কত কি তাহাদের কাগজে লিখিয়া বসিল। বি-এ, এম-এ পাস করা ছোঁড়ারা আবার সন্ন্যাসীকে ছাড়িয়া সেই পোদ ছুঁড়ীর পাদক-জল খাইতে গেল। কাতারে কাতারে সেই গ্রামে লোক ভাঙ্গিয়া পড়িল। রসিক মণ্ডলের ঘরে টাকা-পয়সা আর ধরে না। আমার সন্ন্যাসীর আস্তানা ভো ভো হইয়া গেল। রসিক মণ্ডলের মত আমার কেন বুদ্ধি যোগায় নাই, আমি কেন সেইরূপ ফন্দি করি নাই, আমি কেন একটা ছোট ছুঁড়ীকে বাহির করি নাই, সেই আপশোষে আমার বুক ফাটিয়া যাইতে লাগিল।

এইরূপ দুঃখে আছি, এমন সময় একজন চেলা সন্ন্যাসীর হাত ধরিয়া আমার বাড়ীতে আনিয়া উপস্থিত করিল। সন্ন্যাসী বলিল যে, নিভৃতে তোমার সহিত কোন কথা আছে। আমি, সন্ন্যাসী ও তাঁহার চেলা এক ঘরে যাইলাম। সন্ন্যাসী বলিল যে, ট্যাক্স বন্ধ হইয়া গিয়াছে, সে জন্য নিশ্চয় তোমার মনে সন্দ হইয়াছে, কিন্তু দুঃখ করিও না, অন্য উপায়ে তোমাকে আমি বিপুল ধনের অধিকারী করিব। একটি টাকা দাও দেখি!

সন্ন্যাসীর হাতে আমি একটি টাকা দিলাম। সেই টাকাটিকে তৎক্ষণাৎ দ্বিগুণ করিয়া দুইটি টাকা আমার হাতে দিল। তাহার পর সন্ন্যাসীর আদেশে ভিতর হইতে একটি মোহর আনিয়া দিলাম, তাহাও ডবল করিয়া দুইটি মোহর সন্ন্যাসী আমার হাতে দিল। শেষে একখানি দশ টাকার নোটও ডবল করিয়া আমার হাতে দিল।

তাহার পর সন্ন্যাসী আমাকে বলিল,–এ কাজ অধিক পরিমাণে করিতে গেলে পূজাপাঠের আবশ্যক। তোমার ঘরে যত টাকা, মোহর, নোট, সোনা-রূপা আছে, পূজা-পাঠ করিয়া সমুদয় আমি ডবল করিয়া দিব।

আমি উত্তর করিলাম,–সন্ন্যাসীঠাকুর! আমি নিতান্ত বোকা নই। এরূপ বুজরুকির কথা আমি অনেক শুনিয়াছি। গৃহস্থের বাড়ী গিয়া দুই-একটি টাকা অথবা নোট ডবল করিয়া তোমরা গৃহস্বামীর বিশ্বাস উৎপাদন কর। তোমাদের কুহকে পড়িয়া গৃহস্বামী ঘরের সমুদয় টাকা-কড়ি গহনা-পত্ৰ আনিয়া দেয়। হাড়ী অথবা বাক্সের ভিতর সেগুলি বন্ধ করিয়া তোমরা পূজা কর। পূজা সমাপ্ত করিয়া সাত দিন কি আট দিন পরে গৃহস্বামীকে খুলিয়া দেখিতে বল। সেই অবসরে তোমরা চম্পট দাও। সাত আট দিন পরে গৃহস্বামী খুলিয়া দেখে যে হাড়ী ঢন ঢ। বাজিকরের ও-চালাকি আমার কাছে খাটিবে না।

সন্ন্যাসী বলিল,–পূজা-পাঠ করিয়া আমি চলিয়া যাইব না। তোমার ঘরে তুমি আমাকে বন্ধ করিয়া রাখিও। আর দেখ আমি অন্ধ। কাহারও সহায়তা ভিন্ন দুই পা চলিতে পারি না। পলাইব কি করিয়া? পূজার দিন কোন শিষ্যকে আমি এ স্থানে আসিতে দিক না। সাত দিন পরে তোমাকে টাকাকড়ি খুলিয়া দেখিতে বলিব না; পূজা সমাপ্ত হইলেই তৎক্ষণাৎ তুমি খুলিয়া দেখিবে যে, সমুদয় সম্পত্তি দ্বিগুণ হইয়া গিয়াছে।

সন্ন্যাসীর এরূপ প্রস্তাবে আমি সম্মত হইলাম। সন্ন্যাসী শুভদিন ও শুভলগ্ন স্থির করিল। পূজা ও হোমের উপকরণের ফর্দ দিল। সে সমুদয় আমি সংগ্রহ করিলাম। বাড়ীর দোতলায় নিভৃত একটি ঘরে পূজার আয়োজন করিলাম। ঘরে টাকা, মোহর নোট যত ছিল ও বিবাহের নিমিত্ত যে গহনা গড়াইয়াছিলাম, সে সমুদয় বৃহৎ একটি বাক্সের মধ্যে বন্ধ করিয়া পূজার স্থানে লইয়া যাইলাম।

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ–চিত্রগুপ্তের গলায় দড়ি-মোটা দড়ি নয়

নির্ধারিত দিন সন্ধ্যার সময় কেবল সন্ন্যাসী ও আমি সেই ঘরে গিয়া উপবেশন করিলাম। সন্ন্যাসী পাছে কোনরূপে পলায়ন করে, সেজন্য ঘরের দ্বারে চাকরকে কুলুপ দিয়া বন্ধ করিতে বলািম এবং একটু দূরে তাঁহাকে সতর্কভাবে পাহারা দিতে আদেশ করিলাম। সন্ন্যাসী ঘট স্থাপন করিল। দধি, পিঠালি ও সিঁদুর দিয়া ঘটে কি সব অঙ্কন করিল। তার পর ফট বষট্‌ শ্রীং ঐং এইরূপ কত কিমন্ত্র উচ্চারণ করিল। অবশেষে হোম করিতে আরম্ভ করিল। কিছুক্ষণ পরে স্বাহা স্বাহা বলিয়া আগুনে ঘৃত দিয়া সন্ন্যাসী আপনার থলি হাতড়াইয়া একটি টিনের কৌটা বাহির করিল। সেই কৌটাতে এক প্রকার সবুজ রঙের গুড়া ছিল। হরিৎ বর্ণের সেই চূর্ণ সন্ন্যাসী আগুনে ফেলিয়া দিল।

ঘর সবুজ বর্ণের ধূমে পরিপূর্ণ হইল। আমার নিদ্রার আবেশ হইল। আমি ভাবিলাম যে, এইবার সন্ন্যাসী বেটা একটা কাণ্ড করিবে, আমাকে অজ্ঞান করিয়া আমার টাকাকড়ি লইয়া কোনরূপে পলায়ন করিবে। উঠিয়া, দ্বারে ধাক্কা মাবিয়া আমার চাকরকে ডাকিব এইরূপ মানস করিলাম। আমি উঠিতে পারিলাম না। আমার হাত-পা অবশ অষাড় হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু আমার জ্ঞান ছিল। হঠাৎ আমার মাথা হইতে আমি বাহির হইয়া পড়িলাম। আমার শরীরটি তৎক্ষণাৎ মাটীর উপর শুইয়া পড়িল। শরীর হইতে আমি বাহির হইয়াছি, তাঁহার দিকে তখন চাহিয়া দেখিলাম। দেখিলাম যে সে আমি অতি ক্ষুদ্র, ঠিক বুড়ো আঙ্গুলের মত, আর সে শরীর বায়ু দিয়া গঠিত। সেই ক্ষুদ্ৰশরীরে আমি উপর দিকে উঠিতে লাগিলাম। সূক্ষ্ম বা লিঙ্গশরীরের কথা পূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম। মনে করিলাম যে, ঔষধের ধূমে সন্ন্যাসী আমাকে হত্যা করিয়াছে, মৃত্যুর পর লোকের যে লিঙ্গশরীর থাকে, তাহাই এখন যমের বাড়ী যাইতেছে।

ছাদ ফুঁড়িয়া আমি উপরে উঠিয়া পড়িলাম! সোঁ সোঁ করিয়া আকাশপথে চলিলাম। দূর-দূর-দূর—কতদূর উপরে উঠিয়া পড়িলাম, তাহা বলিতে পারি না। মেঘ পার হইয়া যাইলাম, চন্দ্রলোক পার হইয়া যাইলাম, সূৰ্য্যালোকে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানে আশ্চর্য ঘটনা দর্শন করিলাম। দেখিলাম যে, আকাশ-বুড়ী এক কদমগাছতলায় বসিয়া, আঁশবটি দিয়া সূর্যটিকে কুটি কুটি করিয়া কাটিতেছে, আর ছোট ছোট সেই সূখণ্ডগুলি আকাশ-পটে জুড়িয়া দিতেছে। তখন আমি ভাবিলাম,—ওঃ! নক্ষত্র এই প্রকার হয় বটে! তবে এই যে নক্ষত্র সব, ইহারা সূর্যখণ্ড ব্যতীত আর কিছুই নহে! যে খণ্ডগুলি বুড়ী আকাশপটে ভাল করিয়া জুড়িয়া দিতে পারে না, আলগা হইয়া সেইগুলি খসিয়া পড়ে। তখন লোকে বলে,–নক্ষত্র পাত হইল। কিছুক্ষণ পরে আমার ভয় হইল যে,সূর্যটি তো গেল, পৃথিবীতে পুনরায় দিন হইবে কি করিয়া? আকাশ-বুড়ী আমার মনের ভাব বুঝিয়া হাসিয়া বলিল,–ভোরে ভোরে উঠিয়া আকাশ ঝাড়ু দিয়া সমুদয় নক্ষত্রগুলি আমি একত্র করিব। সেইগুলি জুড়িয়া পুনরায় আস্ত সূর্য করিয়া প্রাতঃকালে উদয় হইতে পাঠাইব। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা আঁশবটি দিয়া সূর্য কাটিয়া নক্ষত্র করি, সকালবেলা আবার জুড়িয়া আস্ত সূর্য প্রস্তুত করি। আমার এই কাজ।

আকাশ-বুড়ীর নিকট হইতে বিদায় হইয়া, আমি ভাবিলাম যে, নভোমণ্ডলের সমুদয় ব্যাপারটা ভাল করিয়া দেখিতে হইবে। এইরূপ ভাবিয়া পুনরায় আমি শূন্যপথে সোঁ সোঁ করিয়া ভ্রমণ করিতে লাগিলাম। কিন্তু সর্ব্বনাশ! কিছুদূর গিয়া দেখি যে, দুইটা বিকটাকার যমদূত আমার আর একটা সূক্ষ্ম শরীরকে লইয়া যাইতেছে। আমার বড় ভয় হইল। সে স্থানে মেঘ নাই যে, তাঁহার ভিতর লুকাইব। পলাইবার সময় পাইলাম না। খপ করিয়া তাঁহারা আমাকে ধরিয়া ফেলিল। একজন জিজ্ঞাসা করিল,—তুই বেটা কে রে? সত্য যুগের রাজা হরিশ্চন্দ্র ভিন্ন বেওয়ারিশ হইয়া আর কাহারও এখানে বেড়াইবার হুকুম নাই। নিশ্চয় তুমি বেটা কুম্ভিপাক অথবা রৌরব নরকের ফেরারি আসামী। এই বলিয়া তাঁহারা আমাকে বাঁধিয়া ফেলিল ও ধাক্কা মারিতে মারিতে লইয়া চলিল।

ক্রমে আমরা যমপুরীতে গিয়া উপস্থিত হইলাম। যম দরবার করিয়া সিংহাসনে বসিয়া আছেন। পাশে স্থূপাকার খাতাপত্রের সহিত চিত্রগুপ্ত, সম্মুখে ডাঙ্গস হাতে ভীষণমূর্তি যমদূতের পাল। আমাদের দুইজনকে যমদূতেরা সেই রাজসভায় হাজির করিল। প্রথমে অপর লোকটির বিচার আরম্ভ হইল।

চিত্রগুপ্ত তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন,–তোমার নাম?

সে উত্তর করিল,—আমার নাম বৃন্দাবন গুঁই।

তাহার পর কোথায়, কি জাতি প্রভৃতি জিজ্ঞাসা করিয়া খাতাপত্র দেখিয়া যমকে চিত্রগুপ্ত বলিলেন,–মহাশয়! এ লোকটি অতি ধার্মিক, অতি পুণ্যবান। পৃথিবীতে বসিয়া এ বার মাসে তের পার্বন করিত, দীন-দুঃখীর প্রতি সর্ব্বদা দয়া করিত, সত্য ও পরোপকার ইহার ব্রত ছিল।

এই কথা শুনিয়া যম চটিয়া গেলেন। তিনি বলিলেন,–চিত্রগুপ্ত! তোমাকে আমি বারবার বলিয়াছি যে, পৃথিবীতে গিয়া মানুষ কি কাজ করিয়াছে, কি কাজ না করিয়াছে, তাঁহার আমি বিচার করি না। মানুষ কি খাইয়াছে, কি না খাইয়াছে, তাঁহার আমি বিচার করি। ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা, স্ত্রী-হত্যা করিলে এখন মানুষের পাপ হয় না, অশাস্ত্রীয় খাদ্য খাইলে মানুষের পাপ হয়। তবে শিবোক্ত তন্ত্রশাস্ত্র মতে সংশোধন করিয়া খাইলে পাপ হয় না। তন্ত্রশাস্ত্রে শিব বলিয়াছেন,–

গো-মেষাশ্ব-মহিষন-গোখাজোষ্ট্র-মৃগোম্ভবম্‌।
মহামাংসাষ্টকং প্রোক্তং দেবতাপ্রীতিকার।।

গোমাংস, মেষমাংস, অশ্বমাংস, মহিষমাংস, গাধামাংস, ছাগমাংস, উষ্ট্রমাংস ও মৃগমাংস—এই অষ্টবিধ মাংসকে মহামাংস বলে। এই সকল মাংসই দেবতাদিগের তৃপ্তিদায়ক। ওঁ প্রতদ্বিষ্ণুস্তবতে অথবা ও ব্রহ্মর্পণমস্তু এই মন্ত্রে সংশোধন করিয়া লইলে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণও এই সমুদয় মাংস ভক্ষণ করিতে পারে। মৃগমাংসের ভিতর শূকরের মাংসও ধরিয়াও লইতে হইবে। তন্ত্রশাস্ত্রে যাহাকে কলামাংস বলে, শিব তাহা খাইতেও অনুমতি দিয়াছেন আর দেখ, চিত্রগুপ্ত! তুমি এ কেরাণীগিরি ছাড়িয়া দাও। পৃথিবীতে তোমার বংশধর কায়স্থগণ কি করিতেছে, একবার চাহিয়া দেখ। উড়ে গয়লার মত এক এক গাছা সূতা অনেকে গলায় পরিতেছে। ব্রাহ্মণকে তাঁহারা আর প্রণাম করে না। ইংরাজী পড়িয়া তাহাদের মেজাজ আগুন হইয়া গিয়াছে। তাই বলি হে, চিত্রগুপ্ত! তুমিও ইংরাজী পড়। ইংরাজী পড়িয়া তোমার হেডটি গরম কর। হেডটি গরম করিয়া তুমিও গলায় দড়ি দাও। মোটা দড়ি নয়। বুঝিয়াছ তো? গলায় দড়ি দিয়া চিত্ৰবৰ্মা নাম গ্রহণ কর।

এই কথা বলিয়া যম নিজে সেই লোকটিকে জেরা করিতে লাগিলেন,—কেমন হে বাপু! কখনও বিলাতি বিস্কুট খাইয়াছিলে?

সে উত্তর করিল,আজ্ঞে না।

যম জিজ্ঞাসা করিলেন,—বিলাতি পানি? যাহা খুলিতে ফট করিয়া শব্দ হয়? যাহার জল বিজবিজ করে?

সে উত্তর করিল,–আজ্ঞে না।

যম পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন,–সত্য করিয়া বল, কোনরূপ অশাস্ত্রীয় খাদ্য ভক্ষণ করিয়াছিলে কি না?

সে ভাবিয়া-চিন্তিয়া উত্তর করিল,–আজ্ঞা একবার ভ্রমক্রমে একাদশীর দিন পুঁইশাক খাইয়া ফেলিয়াছিলাম।

যমের সর্ব্বশরীর শিহরিয়া উঠিল। তিনি বলিলেন,—সর্ব্বনাশ! করিয়াছ কি! একাদশীর দিন পুঁইশাক! ওরে এই মুহূর্তে ইহাকে রৌরব নরকে নিক্ষেপ কর। ইহার পূর্ব্বপুরুষ, যাহারা স্বর্গে আছে, তাহাদিগেকেও সে নরকে নিক্ষেপ কর। পরে ইহার বংশধরগণের চৌদ্দ পুরুষ পর্যন্তও সেই নরকে যাইবে। চিত্রগুপ্ত! আমার এই আদেশ তোমার খাতায় লিখিয়া রাখ।

যমের এই বিচার দেখিয়া আমি তো অবাক। এইবার আমার বিচার। কিন্তু আমার বিচার আরম্ভ হইতে না হইতে আমি উচ্চৈঃস্বরে বলিলাম,–মহারাজ! আমি কখন একাদশীর দিন পুইশাক ভক্ষণ করি নাই।

আমার কথায় যম চমৎকৃত হইলেন। হর্ষোৎফুল্ল লোচনে তিনি বলিলেন,—সাধু সাধু! এই লোকটি একাদশীর দিন পুইশাক খায় নাই। সাধু সাধু! এই মহাত্মার শুভাগমনে আমার যমালয় পবিত্র হইল। যমনীকে শীঘ্র শঙ্খ বাজাইতে বল। যমকন্যাদিগকে পুষ্পবৃষ্টি করিতে বল। বিশ্বকর্মাকে ডাকিয়া আন-ভুঃ ভুবঃ স্বঃ মহঃ জনঃ তপঃ সত্যলোক পারে ধ্রুবলোকের উপরে এই মহাত্মার জন্য মন্দাকিনী কলকলিত, পারিজাত-পরিশোভিত কোকিল কুহরিত, অপ্পারাপদ-নূপুর-ঝুনঝুনিত হীরা-মাণিক খচিত নূতন একটি স্বর্গ নির্মাণ করিতে বল।

চিত্রগুপ্তের—ও থুড়ি! চিত্রকর্মার হিংসা হইল। তিনি বলিলেন,–মহাশয়! পৃথিবীতে লোকটির এখনও আয়ু শেষ হয় নাই স্থূল দেহের রক্তমাংসের আঁসটে গন্ধ এখনও ইহার সূক্ষ্ম শরীরে রহিয়াছে।

এই কথা শুনিয়া যম চটিয়া আগুন হইলেন। আমার আদর লোপ হইল। তিনি বলিলেন,—কি! সাদা সাদা গোল গোল হাঁসের ডিমের গন্ধ গায়ে। মার ইহার মাথায় দশ ঘা ডাঙ্গস মার্‌।

যম বলিবামাত্র তাঁহার একজন দূত আমার মাথায় এক ঘা ডাঙ্গস মারিল। বলিব কি হে, মাথায় আমার যেন ঠিক বজ্রাঘাত হইল। যাতনায় ত্রাহি মধুসূদন বলিয়া আমি চীৎকার করিতে লাগিলাম। সেই এক ঘা ডাঙ্গসে যমপুরী হইতে আকাশপথে অনেক নিয়ে আসিয়া পড়িলাম। দমাস করিয়া আর এক ডাঙ্গসের ঘা! শূন্যপথে আরও নীচে আসিয়া পড়িলাম। আর এক ঘা! আরও নিম্নে আসিয়া পড়িলাম। এইরূপ দশম আঘাতে পৃথিবীতে আসিয়া আমার বাড়ীর ছাদ ফুঁড়িয়া আমার সূক্ষ্ম শরীর পুনরায় সেই পূজার ঘরে আসিয়া পড়িল।

নিজের বাড়ীতে সেই পূজার ঘরে আসিয়া ক্ষুদ্র মাথায় ক্ষুদ্র হাত বুলাইতে লাগিলাম। প্রহারের চোটে চক্ষুতে সরিষা-ফুল দেখিতেছিলাম। অনেকক্ষণ কিছুই দেখিতে পাইলাম না। অনেকক্ষণ পরে চাহিয়া দেখি যে, আমি বসিয়া আছি। অর্থাৎ আমার সেই বড় শরীর আসনে বসিয়া আছে, আর সন্ন্যাসীব শরীর মাটীতে পড়িয়া আছে। কি হইয়াছে, তখন বুঝিতে পারিলাম। বুঝিলাম, যে সবুজ গুঁড়ার ধূম দিয়া আমার শরীর হইতে প্রাণময় কোষ, মনোময় কোষ, আর সকল কোষ বাহির করিয়া, সন্ন্যাসী আপনার সূক্ষ্ম শরীর দ্বারা আমার স্কুল অম্নময় কোষ অধিকার করিয়াছে। আমার শরীর বটে, কিন্তু ঐ যে আসনে বসিয়া আছে, ও আমি নই, ও সন্ন্যাসী সূক্ষ্ম শরীরে মুখ দিয়া আমি সন্ন্যাসীর সহিত কথোপকথন করিতে পারিলাম না। সেজন্য নিরুপায় হইয়া আমি সন্ন্যাসীর দেহে প্রবেশ করিলাম।

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ–ডমরুধরের তপস্যা

সন্ন্যাসীর দেহে প্রবিষ্ট হইয়া আমি উঠিয়া বসিলাম। তাহার পর ক্রোধে আমি সন্ন্যাসীকে বলিলাম,ভণ্ড! আমার শরীর ছাড়িয়া নিজের শরীরে পুনরায় প্রবেশ কর।

সন্ন্যাসী উত্তর করিল,—এ পৃথিবীতে অন্ধ হইয়া দুঃখে কালযাপন করিতেছিলাম। ভোগবাসনা এখনও আমার পরিতৃপ্ত হয় নাই। মানস করিয়াছিলাম যে কোন যুবা ধনবান লোকের শরীরে আশ্রয় করিব। সেরূপ লোকের যোগাড় করিতে পারি নাই। কাজেই তোমার জীর্ণ শরীরে প্রবেশ করিতে বাধ্য হইয়াছি। তোমার এই শরীর দ্বারা এখন সুখাদ্য ভক্ষণ করিব, নানারূপ আমোদ-প্রমোদ করিব। তোমার বিবাহসম্বন্ধ হইয়াছে। তোমার শরীরে আমি বিবাহ করিব, তোমার গৃহিণীকে লইয়া ঘরকন্না করিব। মিছামিছি তুমি গোল করিও না। লোকের নিজের যেরূপ অভ্যাস হয় অর্থাৎ শরীরকে আত্মা বলিয়া মনে হয়, অন্য লোকেরও সেইরূপ হয়। তোমার শরীর দেখিয়া সকলে বলিবে যে, এই সন্ন্যাসী। কেহই বিশ্বাস করিবে না যে, আমার আত্মা তোমার শরীরে প্রবেশ করিয়াছে। শঙ্করাচার্য্য ও হস্তামলকের গল্প শুনিয়া থাকিবে। আজ তাই হইয়াছে। বেশীরভাগ কেবল একটু হেরফের।–ক্রোধে অধীর হইয়া হাতড়াইতে হাতড়াইতে আমি সন্ন্যাসীর গলা টিপিয়া ধরিলাম। কিন্তু তখন আমি পাঁচ শত তিপ্পান্ন বৎসরের পুরাতন সন্ন্যাসীর শরীরে ছিলাম। তাঁহার উপর আবার দুই চক্ষু অন্ধ। সন্ন্যাসীর আমি কিছুই করিতে পারিলাম না। হাসিয়া সে দূরে আমাকে ফেলিয়া দিল।

আমার দেহধারী সন্ন্যাসী পুনরায় বলিল,–যদি গোলমাল কর, তাহা হইলে তোমার ঘোরতর অনিষ্ট হইবে। তোমার চাকরের দ্বারাই তোমাকে আমি এই বাড়ী হইতে দূর করিয়া দিব। ঐ অন্ধ ও বৃদ্ধ শরীর লইয়া তখন তুমি কি করিয়া দিনযাপন করিবে? আমার শিষ্যদ্বয় এ ব্যাপার অবগত আছে, তাহাদিগকে ডাকিতে পাঠাইয়াছি। তাহাদের সহিত আস্তে আস্তে আমার আস্তানায় গমন কর। প্রাতঃকালে একঘণ্টা কাল তাঁহারা তোমাকে নীচের দিকে মুখ করিয়া ঝুলাইবে। সমস্ত দিন তুমি বায়ু ভক্ষণ করিয়া থাকিবে। ঘোর রাত্রিতে চুপি চুপি আহার করিবে। যতদিন তোমার ঐ বর্তমান শরীর জীবিত থাকে, ততদিন তোমাকে আমি খাইতে দিব।

আর উপায় কি? আমি নীরব হইয়া বসিয়া রহিলাম। সন্ন্যাসীর দুই জন চেলা আসিয়া আমার দুই হাত ধরিয়া লইয়া চলিল। অন্ধ দুইটি চক্ষু দিয়া দরদর ধারায় অশ্রুপাত হইতে লাগিল। বিন্দু গোয়ালিনীর চালাঘরে আমাকে লইয়া গেল। সে রাত্রি মাটির উপর পড়িয়া কাঁদিয়া কাটাইলাম। পরদিন প্রত্যুষে চেলা দুইজন আমার দুই পায়ে দড়ি বাঁধিয়া আমগাছের ডালে ঝুলাইয়া দিল। এক ঘণ্টাকাল অধোমুখে আমি ঝুলিতে লাগিলাম। সে যে কি যাতনা, তাহা আর তোমাদিগকে কি বলিব। অন্ধ তা না হইলে চক্ষু দুইটি ঘোর রক্তবর্ণে রঞ্জিত হইত। সন্ন্যাসীর গায়ের বর্ণও কাল ছিল, তা না হইলে মুখ লাল হইয়া যাইত। ঘোর কষ্ট! ঘোর কষ্ট! কেন যে দম আটকাইয়া মরিয়া যাই নাই, তাহাই আশ্চর্য্য।

লম্বোদর প্রভৃতি একবাক্যে বলিয়া উঠিল,—ঈশ! তুমি ত সামান্য বিপদে পড় নাই।

ডমরুর বলিলেন,–হাঁ আমি ঘোর বিপদে পড়িয়াছিলাম। কেবল মা দুর্গার কৃপায় আমি সে বিপদ হইতে পরিত্রাণ পাইয়াছিলাম।

.ডমরুর বলিতে লাগিলেন,এক ঘণ্টা পরে তাঁহারা আমাকে গাছ হইতে নামাইয়া লইল। তাহার পর সমস্ত দিন তাঁহারা আমাকে জলটুকু পৰ্য্যন্ত খাইতে দিল না। তাঁহারা কিন্তু একে একে আমার বাড়ীতে গিয়া আহার করিয়া আসিল। আসিয়া বলিল যে–ডমরুবাবুর বাড়ীতে আজ খুব ঘটা। পাঁচ ছয়টা খাসি কাটা হইয়াছে। নানা দ্রব্য প্রস্তুত হইয়াছে। গ্রামশুদ্ধকে তিনি নিমন্ত্রণ করিয়াছেন। তিনি আরও বলিয়াছেন যে, তাঁহার বিবাহ পৰ্য্যন্ত প্রতিদিন মহাসমারোহের সহিত সকলকে ভোজন করাইবেন।

লম্বোদর বলিলেন,—হাঁ! সেই সময় দিনকত তোমার বাড়ীতে খুব ধূম হইয়াছিল। প্রতিদিন ষোড়শ উপাচারে তোমার বাড়ীতে আমরা ভোজন করিয়াছিলাম। তখন তোমার সেই শরীরটিকে তুমি বলিয়াই আমরা মনে করিয়াছিলাম। সহসা তোমার মতিগতির কিরূপে পরিবর্তন হইল, তাহা ভাবিয়া সকলে আমরা আশ্চর্যান্বিত হইয়াছিলাম। তোমার কোরাম চাকর ও চেলা দুইজন বলিল যে, সন্ন্যাসী ঠাকুর তোমার সমুদয় সম্পত্তি ডবল করিয়া দিয়াছেন, সেই আহ্লাদে তুমি মুক্ত হস্ত হইয়াছ। কেহ কেহ বলিল যে, নূতন বিবাহের আমোদে আটখানা হইয়া তুমি এত টাকা খরচ করিতেছ। কিন্তু এখন বুঝিলাম যে, সে তুমি নও, তোমার শরীরে অধিষ্ঠিত সন্ন্যাসী।

ডমরুর বলিলেন,—আমি বৃথা টাকা খরচ করিব? আমি সে পাত্র নই। আমি সাজিয়া সন্ন্যাসী বেটা আমার সম্পত্তি নষ্ট করিতেছে, তাহা ভাবিয়া বুক আমার ফাটিয়া যাইতে লাগিল। ঘোর রাত্রিতে একজন চেলা আমার জন্য খাবার লইয়া আসিল। পোলাও, কালিয়া, কুর্মা, কোপ্তা, কাটলেট, সন্দেশ, রসগোল্লা, খাজা, গজা, বেদানা, আঙ্গুর, সেব প্রভৃতি সামগ্রী! ঈষৎ হাসিয়া চেলা বলিল,–আপনার প্রতি ডমরুবাবুর বড় ভক্তি! উঠুন, আহার করুন। কিন্তু ছাই আমি আর খাইব কি। আমার সর্ব্বনাশ করিয়া সেই সমুদয় সুখাদ্য প্রস্তুত হইয়াছে তাহাই ভাবিয়া আমার প্রাণ আকুল হইয়া পড়িল।

পরদিন প্রাতঃকালে পুনরায় আমাকে তাঁহারা গাছে ঝুলাইয়া দিল। তাহার পর সমস্ত দিন অনশনে রাখিয়া গভীর রাত্রিতে আমাকে খাবার দিল। প্রতিদিন এই ভাবে চলিতে লাগিল। ওদিকে আমার নিজ বাটীতে ধূমধামের সীমা-পরিসীমা নাই। প্রতিদিন যজ্ঞ। দিনের বেলা সাধারণ লোকের ভোজন, রাত্রিতে বন্ধু-বান্ধবের ফিষ্টি। শুনিলাম, ঐ ফিষ্টিতে সন্ন্যাসী বন্ধুবান্ধবের সহিত কিছু উচ্চ রকমের স্ফুর্তি করিতেছিল। সেরি শ্যাম্পেন প্রভৃতি বহুমূল্য মদ চলিতেছিল। কেবল আমার টাকার শ্রাদ্ধ!

ক্রমে শ্রাবণ মাস আসিল। আমার বিবাহের জন্য যে শুভদিন স্থির হইয়াছিল, সেই দিন নিকটবৰ্ত্তি হইল। যে শরীরে আমি অবস্থান করিতেছিলাম, তাহা অন্ধ বটে, কিন্তু কান তো অন্ধ ছিল না; কয়দিন আগে থাকিতে রোশন চৌকির ব্যঞ্জনা আমার কানে প্রবেশ করিতেছিল। তাহার পর বিবাহের পূর্ব্ব দিনে ইংরাজি বাজনা, দেশী বাজনা, ঢাক ঢোল সানাইয়ের রোলে ও লোকের কোলাহলে আমার কান ছেদা হইয়া গেল। শুনিলাম যে ডমরুবাবু মহাসমারোহের সহিত বিবাহ করিতে যাইবেন।

পাছে কোন যমদূতের সহিত সাক্ষাৎ হয়, পাছে বেওয়ারিস আমাসী বলিয়া আমাকে ধরিয়া লইয়া যায়, পাছে পুনরায় আমার মাথায় ডাঙ্গস মারে, সেই ভয়ে এতদিন সন্ন্যাসীর শরীর হইতে আমার সূক্ষ্ম শরীর বাহির করিতে চেষ্টা করি নাই। কিন্তু একে আমার টাকার শ্রাদ্ধ তাঁহার উপর সন্ন্যাসী আমার শরীরে আমার জন্য মনোনীত কন্যাকে গিয়া বিবাহ করিবে এই দুঃখে মনের ভিতর দাবানল জ্বলিতে লাগিল। সে চেলা দুইজন যখন গাছ হইতে আমাকে নামাইয়া চলিয়া গেল, তখন আমি আর থাকিতে পারিলাম। সন্ন্যাসীর শরীর হইতে বাহির হইবার নিমিত্ত বার বার চেষ্টা করিতে লাগিলাম। অবশেষে কৃতকাৰ্য্য হইলাম, সন্ন্যাসীর শরীর অন্ধ, কিন্তু আমার লিঙ্গ শরীর অন্ধ নহে। অনেক দিন পরে পৃথিবীর বস্তুসমূহ দেখিয়া মনে আমার আনন্দ হইল। সন্ন্যাসীর দেহ বিন্দীর চালাঘরে ফেলিয়া সূক্ষ্ম শরীরে আমি আমার নিজের বাটীতে গমন করিলাম। সে স্থানের ঘোর ঘটা দেখিয়া আমার প্রাণ ফাটিয়া যাইতে লাগিল। বাড়ীটি সুসজ্জিত হইয়াছে, কোন স্থানে বাজনাওয়ালারা বসিয়া আছে, কোন স্থানে রোশনাইয়ের বন্দোবস্ত হইতেছে, বরযাত্রীদিগের নিমিত্ত কলিকাতা হইতে অনেকগুলি ফাষ্টোকেলাস গাড়ি আসিয়াছে। আমাদের গ্রাম হইতে কন্যার গ্রাম সাত ক্রোশ পথ ভাল নহে—মেটে রাস্তা কিন্তু শুনিলাম যে, অনেক টাকা খরচ করিয়া ডমরুবাবু সে রাস্তা মেরামত করিয়াছেন।

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ছাল-হাড়ান বাঘ

এইরূপে চারিদিকে আমি দেখিয়া বেড়াইলাম। বলা বাহুল্য যে, আমাকে কেহ দেখিতে পাইল না সূক্ষ্ম শরীর অতি ক্ষুদ্র, হাওয়া দিয়া গঠিত সূক্ষ্ম শরীর কেহ দেখিতে পায় না। একে যমদূতের ভয়, তাঁহার উপর আবার এই সমুদয় হৃদয়বিদারক দৃশ্য। সে স্থানে আমি অধিকক্ষণ তিষ্ঠিতে পারিলাম না। আমি ভাবিলাম,–দূর কর! বনে গিয়া বসিয়া থাকি। সুন্দরবনে মনুষ্যের অধিক বাস নাই, যমদূতদিগের সেদিকে বড় যাতায়াত নাই, সেই সুন্দরবনে গিয়া বসিয়া থাকি।

বায়ুবেগে সুন্দরবনের দিকে চলিলাম। প্রথম আমি আমার আবাদে গিয়া উপস্থিত হইলাম। সে স্থানে আমার কোন কর্মচারীকে দেখিতে পাইলাম না। কেহ মাছ, কেহ ঘৃত, কেহ মধু, কেহ পাঠা লইয়া তাঁহারা আমার, বিবাহে নিমন্ত্রণে গিয়াছিল। সে স্থান হইতে আমি গভীর বনে প্রবেশ করিলাম। দেখিলাম যে, এক গাঙের ধারে একখানি নৌকা লাগিয়া আছে, উপরে পাঁচ ছয়জন কাঠুরিয়া কাঠ কাটিতেছে। তাহাদের সঙ্গে মুগুর হাতে একজন ফকীর আছে। মন্ত্র পড়িয়া ফকীর বাঘদিগের মুখ বন্ধ করিয়া দিয়াছে। নির্ভয়ে কাঠুরিয়াগণ কাঠ কাটিতেছে। সেই স্থানে গিয়া আমি একটি শুষ্ক কাঠের উপর উপবেশন করিলাম বলা বাহুল্য যে, তাঁহারা আমাকে দেখিতে পাইল না।

এই স্থানে বসিয়া মনে বেদনায় আমি দিতে লাগিলাম। অশ্রুজলে আমার বক্ষস্থল ভাসিয়া গেল। না এদিক, না ওদিক, না মরা না বাঁচা, আমার অবস্থা ভাবিয়া আমি আকুল হইলাম। আজ আমি সাজিয়া সন্ন্যাসী আমার কন্যাকে বিবাহ করিবে, বাসরঘরে সন্ন্যাসী গান করিবে, তাহার পর ফুলশয্যা হইবে,—ওঃ! আমার প্রাণে সয় না। হায় হায়! আমার সব গেল। হঠাৎ এই সময় মা দুর্গাকে আমার স্মরণ হইল। প্রাণ ভরিয়া মাকে আমি ডাকিতে লাগিলাম। আমি বলিলাম,–মা! তুমি জগতের মা! তোমার এই অভাগা পুত্রের প্রতি তুমি কৃপা কর। মহিষাসুরের হাত হইতে দেবতাদিগকে তুমি পরিত্রাণ করিয়াছিলে, সন্ন্যাসীর হাত হইতে তুমি আমাকে নিস্তার কর। মনসা লক্ষ্মীর কখন পূজা করি নাই, ঘেঁটু পূজাও করি নাই, কোন দেবতার পূজা করি নাই। কিন্তু এখন হইতে, মা প্রতি বৎসর তোমার পূজা করিব। অকালে তোমার পূজা করিয়া রামচন্দ্র বিপদ হইতে উদ্ধার হইয়াছিলেন। আমিও মা! সেইরূপ অকালে তোমার পূজা করিব। তুমি আমাকে বিপদ হইতে উদ্ধার কর। ব্রজের নন্দ ঘোষের স্বজাতি কলিকাতার হরিভক্ত গোয়ালা মহাপ্রভুরা কসাইকে যখন নব প্রসূত গোবৎস বিক্রয় করুন, কসাই যখন শিশু বৎসে গলায় দড়ি দিয়া হিচড়াইয়া লইয়া যায় তখন সেই দুধের বাছুরটি নিদারুণ কাতরকণ্ঠে যেরূপ মা মা বলিয়া ডাকিতে থাকে, সেইরূপ কাতর স্বরে আমিও মা দুর্গাকে ডাকিতে লাগিলাম।

জগদম্বার মহিমা কে জানে! প্রাণ ভরিয়া তাঁহাকে ডাকিলে তিনি কৃপা করেন। জগদম্বা আমায় কৃপা করিলেন। বন হইতে হঠাৎ এক বাঘ আসিয়া কাঠুরিয়াদিগের মাঝখানে পড়িল।

সুন্দরবনের মানুষখেকো প্রকাণ্ড ব্যাঘ্র! শরীরটি হরিদ্রাবণের ললামে আচ্ছাদিত, তাঁহার উপর কাল কাল ভোরা। এ তোমার চিতে বাঘ নয়, গুল বাঘ নয়, এ বাবা, টাইগার ইংরাজিতে যাহাকে রয়াল টাইগার বলে, এ সেই আসল রয়াল টাইগার।

এক চাপড়ে একজন কাঠুরিয়াকে বাঘ ভূতলশায়ী করিল, ফকীরের মন্ত্রে তাঁহার মুখ বন্ধ ছিল, মুখে করিয়া তাঁহাকে সে ধরিতে পারিল না। সেই স্থানে শুইয়া থাপা দিয়া মানুষটাকে পিঠে তুলিতে চেষ্টা করিল। না মোটা না সরু নিকটে একটা গাছ ছিল। বাঘেরী দীর্ণ লাঙ্গুলটি সেই গাছের পাশে পড়িয়াছিল। একজন কাঠুরিয়ার একবার উপস্থিত বুদ্ধি দেখ! বাঘের লাঙ্গুলটি লইয়া সে সেই গাছে এক পাক দিয়া দিল তাহার পর লেজের আগাটি সে টানিয়া ধরিল।

বাঘের ভয় হইল। বাঘ মনে করিল,—মানুষ ধরিয়া মানুষ খাইয়া বুড়া হইলাম, আমার লেজ লইয়া কখন কেহ টানাটানি করে নাই। আজ বাপধন! তোমাদের একি নূতন কাণ্ড! পলায়ন করিতে বাঘ চেষ্টা করিল। একবার, দুইবার, তিনবার বিষম বল প্রকাশ করিয়া বাঘ পালাইতে চেষ্টা করিল। কিন্তু গাছে লেজের পাক, বাঘ পলাইতে পারিল না। অসুরের মত বাঘ যেরূপ বল প্রকাশ করিতেছিল, তাহাতে আমার মনে হইল যে, বাঃ? লেজটি বা ছিঁড়িয়া যায়। কিন্তু দৈবের ঘটনা ঘটিল। প্রাণের দায়ে ঘোরতর বলে বাঘ শেষকালে যেমন এক হ্যাচকা টান মারিল, আর চামড়া হইতে তাঁহার আর শরীরটা বাহির হইয়া পড়িল। অস্থি মাংসের দগদগে গোটা শরীর, কিন্তু উপরে চর্ম নাই! পাকা আমের নীচের দিকটা সবলে টিপিয়া ধরিলে যেরূপ অডিটা হড়াৎ করিয়া বাহির হইয়া পড়ে, বাঘের ছাল হইতে শরীরটি সেইরূপ বাহির হইয়া পড়িল, কলিকাতার হিন্দু কই মহাশয়েরা জীবন্ত পাঠার ছাল ছাড়াইলে চমবিহীন পাঁঠার শরীর যেরূপ হয়, বাঘের শরীরও সেইরূপ হইল। মাংস বাঘ রুদ্ধশ্বসে বনে পলায়ন করিল। ফকীর ও কাঠুরিয়াগণ ঘোরতর বিস্মৃত হইয়া এক দৃষ্টে হাঁ করিয়া সেই দিকে চাহিয়া রহিল। বাঘের লাঙ্গুল লইয়া গাছে যে পাক দিয়াছিল, লেজ ফেলিয়া দিয়া সেও সেই দিকে হাঁ করিয়া চাহিয়া রহিল। বাঘশূন্য ব্যাঘ্রচর্ম সেই স্থানে পড়িয়া রহিল। আমার কি মতি হইল, গরম গরম সেই বাঘ ছালের ভিতর আমি প্রবেশ করিলাম। ব্যাঘ্র চর্মের ভিতর আমার সূক্ষ্ম শরীর প্রবিষ্ট হইবামাত্র ছালটা সজীব হইল। গাঝাড়া দিয়া আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। গাছ হইতে লাঙ্গুলটি সরাইয়া লইলাম। পাছে ফের পা দেয়। তাহার পর দুই একবার আস্ফালন করিলাম। পূর্ব্বে তো অবাক হইয়াছিলাম, তাহা অপেক্ষা এখন দশগুণ অবাক হইয়া ফকীর ও কাঠুরিয়াগুণ দৌডিয়া নৌকায় গিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি নৌকা নদীর মাঝখানে লইয়া দ্রুতবেগে ভাটার স্রোতে তাঁহারা পলায়ন করিল।

এখন এই নূতন শরীরের প্রতি একবার আমি চাহিয়া দেখিলাম। এখন আমি সুন্দরবনের কেঁদো বাঘ হইয়াছি—সেই যারে বলে রয়াল টাইগার ভাবিলাম যে,—এ মন্দ নয়, এখন যাই, এই শরীরে বিবাহ-আসরে গিয়া উপস্থিত হই। এখন দেখি সন্ন্যাসী বেটা কেমন করিয়া আমার কন্যাকে বিবাহ করে। এইরূপ স্থির করিয়া আমি দৌড়িলাম। সাঁতার দিয়া অথবা লম্ফ দিয়া শত শত নদী-নালা পার হইলাম। যে গ্রামে কন্যার বাড়ী, সন্ধ্যার সময় তাঁহার এক ক্রোশ দূরে গিয়া পৌঁছিলাম। দূর হইতে আলো দেখিয়া ও বাজনা-বাদ্যের শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম যে, ঐ বর আসিতেছে। সেই দিকে দ্রুতবেগে ধাবিত হইলাম। আলুম করিয়া এক লাফ দিয়া প্রথম বাদ্যকরদিগের ভিতর পড়িলাম, কালো কালো বিলাতী সাহেবরা কোট-পেন্ট পিধে যাহারা বিলাতী বাজনা বাজাইতেছিল, তাঁহারা আমার সেই মেঘগর্জনের ন্যায় আলুম শব্দ শুনিয়া আর আমার সেই রুদ্রমূর্তি দেখিয়া আপন আপন যন্ত্র ফেলিয়া যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল। ঢাকী ঢুলীদের তো কথাই নাই। তাহাদের কেহ পলাইল, কেহ কেহ সেই স্থানে মূর্হিত হইয়া পড়িল। যাহারা আলো প্রভৃতি লইয়া চলিয়াছিল, তাঁহারাও পলায়ন করিল। তাহার পর পুনরায় আলম করিয়া আমি বরযাত্রদিগের গাড়ীর নিকট উপস্থিত হইলাম। টপ টপ করিয়া তাঁহারা গাড়ী হইতে লাফাইয়া পড়িল ও যে যেদিকে পারিল পলায়ন করিল।।

লম্বোদর বলিলেন,—আমিও বরযাত্র গিয়াছিলাম। আমি একটি গাছে গিয়া উঠিয়াছিলাম।

শঙ্কর ঘোষ বলিলেন,–গাড়ী হইতে লাফাইয়া পড়িতে আমার পা ভাঙ্গিয়া গিয়াছিল। শেষে কেলেহাড়ী মাথায় দিয়া সমস্ত রাত্রি একটা পুষ্করিণীতে গা ড়ুবাইয়া বসিয়া রহিলাম।

 

সপ্তম পরিচ্ছেদ – ডমরুধরের গলায় কফ

ডমরুর বলিলেন,–তাহার পর লম্ফ দিয়া একেবারে আমি বরের চারি ঘোড়ার গাড়ীতে গিয়া উঠিলাম। ঘোর ত্রাসে সন্ন্যাসীর হৃৎকম্প হইল। আমার শরীর হইতে ফট করিয়া সে সূক্ষ্মশরীর বাহির করিল। আপনার সুক্ষ্মশরীর লইয়া কোথায় যে পলায়ন করিল, তাহা বলিতে পারি না। সেই দিন হইতে তাঁহাকে অথবা তাঁহার চেলা দুইজনকে আর কখনও দেখিতে পাই নাই।

আমি দেখিলাম যে, গাড়ীর উপর আমার দেহটি পড়িয়া রহিয়াছে। বাঘছাল হইতে বাহির হইয়া তৎক্ষণাৎ আমি নিজদেহে প্রবেশ করিলাম। গাড়ীর গদিতে বাঘ-ছালখানি পাতিয়া তাঁহার উপর আমি গেট হইয়া বসিলাম। নিজের শরীর পুনরায় পাইয়া আনন্দে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিলাম। কন্যার জন্য যে সমুদয় গহনা প্রস্তুত করিয়াছিলাম, সম্মুখে দেখিলাম যে সেই গহনার বাক্সটি রহিয়াছে। পরে শুনিলাম যে ঘটকীর পরামর্শে সন্ন্যাসী এই গহনার বাক্স সঙ্গে আনিয়াছিল।

এখন বিবাহ-বাড়ীতে যাইতে হইবে। কিন্তু নিকটে জনপ্রাণী ছিল না। একেলা বিবাহ বাড়ীতে যাইতে পারি না। গাড়ী হইতে নামিলাম। পথ হইতে একটি ঢোল লইয়া নিজেই ঢ্যাং ঢ্যাংকরিয়া বাজাইতে লাগিলাম। যে তিন চার জন ঢাকী ঢুলী বাঘ দেখিয়া মূচ্ছিত হইয়া পড়িয়াছিল, ক্রমে তাহাদের চেতনা হইল। পিট পিট করিয়া আমার দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া তাঁহারা উঠিয়া বসিল। অন্য বাদ্যকর কেহ আসিল না। পরে শুনিলাম যে, তাঁহারা প্রাণপণে দৌড়িয়া একেবারে কলিকাতা গিয়া তবে নিঃশ্বাস ফেলিয়াছিল। ভালই হইয়াছিল। তাহাদিগকে টাকা দিতে হয় নাই। বিবাহের পরদিন, কন্যা লইয়া যখন নিজ গ্রামে আমি প্রত্যাগমন করি, তখন তাহাদের যন্ত্রগুলি আমি কুড়াইয়া আনিয়াছিলাম। কিছুদিন পরে যখন তাঁহারা আসিল, তখন অনেক কষ্টে আমার নিকট হইতে যন্ত্রগুলি বাহির করিল। টাকা আর চাহিবে কোন লজ্জায়?

আমার কেনারাম চাকর ও দুই চারিজন বরযাত্ৰ ক্ৰমে আসিয়া জুটিল। প্রথম তাঁহারা মনে করিয়াছিল যে, নিকটে মানুষ আনিবার নিমিত্ত বাঘ স্বয়ং ঢোল বাজাইতেছে। যাহা হউক, সেই দুই চারিজন বরযাত্র ও দুই চারিজন বাদ্যকর লইয়া আমি বিবাহ-বাড়ীতে উপস্থিত হইলাম। অধিক কথায় প্রয়োজন কি? প্রথম তো কন্যা সম্প্রদান হইল। তাহার পর আমাকে সকলে ছাদনাতলায় লইয়া গেল। এক পাল স্ত্রীলোক আসিয়া আমাকে ঘিরিয়া দাঁড়াইল। তাড়কা রাক্ষসীর মত এক মাগী প্রথম আমার এক কান মলিয়া দিল, আর বলিল,–বিবাহ তৃতীয় পক্ষে, সে কেবল পিত্তি রক্ষে। পুনরায় আর এক কান মলিয়া বলিল,–বিবাহ তৃতীয় পক্ষে; সে কেবল পিত্তি রক্ষে। এইরূপে একবার এ কান একবার সে কান মলিতে লাগিল এবং ঐ কথা বলিতে লাগিল। মাগীর হাত কি কড়া। আমি মনে করিলাম যে, সাঁড়াশি দিয়া বুঝি আমার কান ছিঁড়িয়া লইতেছে। তার দেখাদেখি, নয়-দশ বৎসরের একটা ফচকে হুঁড়ি ডিঙ্গি দিয়া আমার কান টানিতে লাগিল আর ঐ কথা বলিতে লাগিল। আমার আর সহ্য হইল না। আমি বলিলাম,–নে নে! তোর আর কচকুমিতে কাজ নাই, আমি তোর পিতেমোর বয়সি।

কিন্তু এই সময়ে আবার এক বিপত্তি ঘটিল। বরণডালা হস্তে আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী বরণ করিতে আসিলেন। আমার মুখপানে একবার কটাক্ষ করিয়াই তিনি অজ্ঞান। বরণ ডালা ফেলিয়া, কন্যার হাত ধরিয়া, প্রাঙ্গণের এক পার্শ্বে গিয়া মাটির উপর শুইয়া পড়িলেন। সেই স্থানে শুইয়া উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিলেন। কান্নার সুরে তিনি বলিলেন,–ও গো, মা গো, ও পোড়া বাঁদরের হাতে তোরে কি করিয়া দিব গো! ও গো মা গো! ও বুড়ো ডোর হাতে কি করিয়া তোকে দিব গোয় ঘরে যে কালীঘাটের কালীর পট আছে, যা এক পয়সা দিয়া কিনিয়াছিলাম, তার মত তোর যে মুখখানি গো! তুই আমার কেলেসোনা গো! ইত্যাদি। কালীঘাটের পটের মত মুখ বটে! কন্যাকে বাড়ী আনিয়া যখন ভাল করিয়া প্রথম তাঁহার মুখ দেখিলাম, তখন আমার মনে হইল যে, ইনি মানুষ নহেন, কালীঘাটের মা কালীর বাচ্চা।

হুড়তে পুড়তে এই সময় ঘটকী আসিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইল। ঘটকী বলিল,–শীঘ্র গহনার বাক্স লইয়া এস।

কেনা চাকরের নিকট গহনার বাক্স আমি রাখিয়াছিলাম। গহনার বাক্স সে লইয়া আসিল। আমার নিকট হইতে চাবি লইয়া বাক্স খুলিয়া ঘটকী কন্যার গায়ে গহনা পরাইতে বসিল। বাম হাতে তাগা, জসম, তাবিজ, বাজু চুড়ি ও বালা পরাইল। কন্যার কালো গায়ে সোনা ঝম করিতে লাগিল। শাশুড়ী ঠাকুরাণী চক্ষুর জলের ভিতর দিয়া আড়ে আড়ে চাহিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাঁহার কান্নার সুর ক্রমে ঢিলে হইয়া আসিল, আমার রূপবর্ণনাও কিঞ্চিৎ শিথিল হইল। এখন তিনি বলিলেন,–ওগো মা গো! কালীঘাটের কালী ঠাকুরের মত তোর যে মুখখানি গো! এবার এ পর্যন্ত হইল।

যখন অপর হস্তে সমুদয় গহনা পরানো হইল, তখন তিনি বলিলেন,–ওগো মা গো! কালীঘাটের কালী ঠাকুরের মত! এইবার এই পর্যন্ত হইল।

যখন গলার গহনা পরানো হইল, তখন চক্ষু মুছিয়া একবার ভাল করিয়া দেখিলেন। তাহার পর কান্নার সুরে বলিলেন,–ওগো মা গো! কালীঘাটের। এবার এই পর্যন্ত।

এইরূপে ক্রমেই কান্নার সুর মৃদু ও ছন্দ পাপড়িভাঙ্গা হইয়া আসিল। অবশেষে কন্যার যখন সমুদয় ভূষণে ভূষিত হইল, তখন তিনি উঠিয়া বসিলেন, দুইবার চক্ষু মুছিয়া বলিলেন,–তা হউক! আমার এলোকেশী সুখে থাকিবে।

শুভদিনে শুভক্ষণে আমার বিবাহ হইয়া গেল। পরদিন কন্যা লইয়া আমি গৃহে প্রত্যাবর্তন করিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা বলিব কি—সেই তাড়কা রাক্ষসীর-বোলে সকলে যেন লুফিয়া লইল। সেই দিন হইতে সকলে আমার স্ত্রীর নাম রাখিল পিত্তি রকে। কেবল শ্রী কেন? আমি একটু বুঝিয়া সুঝিয়া খরচপত্র করি বলিয়া কেহ আমার নাম করে না। আড়ালে সকলে আমাকেও পিত্তিরগে বলে। আমার গৃহিণী ঘোষেদের গলায় মান করিতে যাইতেন। ছোঁড়ারা তাঁহাকে পিত্তি রকে বলে পোইত। সে জন্য এখন ভোরে ভোরে তিনি বসুদের গঙ্গায় স্নান করেন। কিন্তু যাই বল আর যাই কও, আমাদের কাটা গঙ্গার যেমন মাহাত্ম্য, তেমন আর কোন গঙ্গার নয়; হরিদ্বার, এয়াগ, বৃন্দাবনের গঙ্গা কোথায় লাগে!

সন্ন্যাসী আমার কত টাকা নষ্ট করিয়াছিল? সে কথায় এখন আর প্রয়োজন কি? কিন্তু চিরকাল আমি কপালে পুরুষ, আমার সৌভাগ্যক্রমে এই সময় স্বদেশী হিড়িকটি পড়িল। আমি এক কোম্পানী খুলিলাম। পূর্ব্বদেশের এক ছোকরাকে চারিদিকে বক্তৃতা করিতে পাঠাইলাম। তাঁহার বক্তৃতার ধমকে শত শত গরীব কেরাণী স্ত্রীর গহনা বেচিয়া শেয়ার কিনিল; শত শত দীন দরিদ্র লোকও ঘটি বাটি বেচিয়া আমার নিকট টাকা পাঠাইল। তারপর— এঃ—এঃ—এঃ—এঁঃগলায় কিরূপ কফ বসিয়াছে। লম্বোদর বলিলেন,–কফ কাশীতে আবশ্যক কি? স্পষ্ট বল না কেন যে, সমুদয় টাকাগুলি তুমি হাত করিয়াছ। তাহার পর, দেশশুদ্ধ লোক এখন মাথায় হাত দিয়া কাঁদিতেছে।

ডমরুর বলিলেন,—ভাগ্যবান্ পুরুষদিগের টাকা একদিক দিয়া যায়, অন্যদিক দিয়া আসে। যাহা হউক, মা দুগা আমাকে সেই সন্ন্যাসী সঙ্কট হইতে উদ্ধার করিয়া ছিলেন। সেই অবধি প্রতি বৎসর আমি মা দশভুজার পূজা করি।

পুরোহিত বলিলেন,

যদি বাপি বরো দেয়োস্মাকং মহেশ্বরি।
সংঘৃতা সংস্মৃতা ত্বং নো হিংসেথায় পরমাপদঃ।।

দেবগণ বলিলেন,–হে মহেশ্বরি! যদি আমাদিগকে বর দিবে, তবে ঘোর বিপদে পড়িয়া তোমাকে স্মরণ করিলে, তুমি আমাদিগকে রক্ষা করিও।–সমাপ্ত

মন্তব্য। পিত্তিরক্ষে বলিয়াছেন যে—পাঠকদিগের যদি আমার গল্পের সত্যতা সম্বন্ধে সন্দেহ হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে আমার নিকট পাঠাইয়া দিবেন। সে বাঘছাল আমার ঘরে আছে। আমি তাহাদিগকে দেখাইব। তাহাদের সন্দেহ দূর হইবে।