রাজা গার্ডেন

রাজা গার্ডেন – মতি নন্দী – উপন্যাস

এক

অঘ্রানের শেষাশেষি ভাত খেয়ে উঠে দুপুরে রোদ্দুরে বসে থাকার আরামের মতো সুখের কিছু হয় না। নগেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী ছিয়াত্তরে পড়েছেন গত ফাল্গুনে, তার মনে হয় এটা তার জীবনের অন্যতম সেরা বিলাসিতা, এই বারান্দাটায় দুপুরে ঘণ্টাখানেক চেয়ারে বসে খবরের কাগজ অথবা সাপ্তাহিক পত্রিকা পড়া। পড়ার ব্যাপারে তার বাছ-বিচার নেই, বিজ্ঞান স্বাস্থ্য ধর্ম সিনেমা পুস্তক সমালোচনা রাজনীতি ভ্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে লেখাটি আকর্ষণীয় বোধ করলেই তিনি পড়ে ফেলেন। পড়ার পরই সদ্য আহরিত তথ্যটি কাউকে জানিয়ে দেবার জন্য তিনি ব্যাকুলতা বোধ করেন। কাছাকাছি পুত্রবধূ রেবা অথবা পরিচারিকা শোভা যদি থাকে তা হলে তাদের জানিয়ে দিয়ে স্বস্তি লাভ করেন। এই দুটি স্ত্রীলোক ছাড়া দুপুরে আর কেউ এই পরিবারে লভ্য নয় তাঁর কথা শোনার জন্য। পুত্র অতীন্দ্রনারায়ণ খুবই ব্যস্ত ডাক্তার, আক্ষরিক অর্থেই তার নাওয়া খাওয়ার সময় নেই, নাতি কীর্তিনারায়ণ বারো ক্লাসের ছাত্র, এবারই উচ্চচ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বালিগঞ্জে যে কলেজে কীর্তি পড়ে সেখানে লেখাপড়ায় কমজোরি ছেলেরা বারো ক্লাসে পৌঁছতে পারে না সুতরাং ধরে নেওয়া যায় সে ছাত্র হিসাবে গড়-পড়তার ঊর্ধ্বে।

বিপত্নীক নগেন্দ্র নাতিস্থূল, গৌরবর্ণ, মাথার চুল ও ভুরু সাদা, দীর্ঘদেহী। যৌবনে ইচ্ছা ছিল ব্যায়ামবীর হওয়ার। তাঁর আদর্শ ছিল ভীমভবানী। বাল্যেই তিনি বাবা প্রতাপনারায়ণের সঙ্গে বরিশাল থেকে কলকাতায় চলে এসে ভরতি হন স্কটিশচার্চ স্কুলে। দেশে জমিদারির দায়ভার জ্যাঠা ও কাকার হাতে ছেড়ে দিয়ে কলকাতার সিমুলিয়ায় অর্থাৎ সিমলায়, একটা পুরোনো স্টিমার ও গাদাবোট কিনে তিনি পণ্য পরিবহণ ও পূর্ববঙ্গ থেকে চাল ও পাট আমদানির ব্যাবসা শুরু করেন। ব্যাবসা লাভজনক হয়ে উঠতেই তিনি কলকাতার দক্ষিণ প্রান্তে অনুন্নত পল্লি অঞ্চলে গাছপালা পুকুর সমেত প্রায় পঞ্চাশ বিঘা জমি কিনে একটি দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। এই সময়ে তাঁর স্ত্রী অর্থাৎ নগেন্দ্রর মা মারা যাওয়ায় তিনি দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন। তাঁর দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী কুসুমকুমারীর সন্তানাদি এখন সিমলার বাড়িতে থাকে।

নগেন্দ্রর ব্যায়ামবীর হওয়ার স্বপ্ন বিনষ্ট হয়ে যায় বাবার দ্বিতীয় বিবাহে। বিমাতা বাড়িতে পদার্পণ করেই সাংসারিক ব্যয়সংকোচে মনোযোগী হয়ে পড়েন কেননা তখন প্রতাপনারায়ণের ব্যাবসা একটা গুরুতর ধাক্কা খেয়েছে। আড়িয়াল খাঁ-য় প্রবল ঝড়ে মালপত্র সমেত স্টিমারটি ডুবে যাওয়ায় প্রতাপ বিধ্বস্ত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। জাপান সিঙ্গাপুর দখল করে রেঙ্গুনের দিকে এগোচ্ছে। বাজার থেকে চাল-পাট উধাও। প্রতাপ বুঝলেন এবার তিনি মধ্যবিত্ত হতে চলেছেন। যেখানে যা সঞ্চিত অর্থ ছিল তা সংগ্রহ করে এবং কুসুমকুমারীর কিছু গহনা বিক্রি করে তিনি তাই দিয়ে স্ত্রীর নামে স্থাবর সম্পত্তি কিনতে থাকেন। কলকাতায় তখন জাপানি আক্রমণের ভয়ে জলের দামে বাড়ি বিক্রি করে বহুলোক গ্রামে চলে যাচ্ছিল। প্রতাপনারায়ণ এক লাখ টাকায় কিনে ফেলেন তিনটি বাড়ি।

প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী কুসুমকুমারী ব্যয়সংক্ষেপ করতে গিয়ে প্রথমেই অর্ধেক করে দেন নগেন্দ্রর ভোজন তালিকাটি। বাদাম-পেস্তার শরবত, ডিম, দুধ, মাংস কমে গেল তো বটেই ব্যায়ামের জন্য চার ঘণ্টা সময়ও ছাঁটাই করে দু-ঘণ্টায় নামিয়ে দেন। নগেন্দ্রকে তিনি জানিয়ে দেন, ‘ব্যায়াম করার থেকেও ভালো কাজ লেখাপড়া করা, ভবিষ্যতে তোমার ভালো হবে, বাড়িরও ভালো হবে। আমাদের এখন এত টাকা নেই যে রোজ রোজ তোমাকে হাতির খোরাক জোগাতে পারব, সবাই যা খাচ্ছে তাই খাবে। ম্যাট্রিক পরীক্ষা তো এসে গেল, দু-জন মাস্টার আছে আরও একজন রাখব, ব্যায়ামের সময় কমিয়ে এখন থেকে সেই সময়টায় পড়ো।’

নগেন্দ্রর মাথায় হাত বুলিয়ে কথাগুলো বলেছিলেন কুসুমকুমারী। তিনি অত্যন্ত সজাগ ছিলেন সৎপুত্রের প্রতি সৎমায়ের মনোভাব ও আচরণ সম্পর্কে যেসব অপবাদ দেওয়া হয় সেটা যেন তার ভাগ্যে না জোটে এবং তাই করতে গিয়ে আদিখ্যেতার বাড়াবাড়িও যাতে না ঘটে সেদিকেও তার দৃষ্টি ছিল। ব্যায়ামবীর হওয়ার পথে পাঁচিল তুলে দেওয়ায় নগেন্দ্র খুবই রুষ্ট হন। বাবার কাছে এই নিয়ে নালিশও জানান। প্রতাপনারায়ণ জবাব দিয়েছিলেন, ‘মুগুর ভেঁজে আর ডন-বৈঠক দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা পালোয়ান হবি তাতে লাভটা কী? এখন থেকে রোজগারের কথা ভাব, আমাদের আর আগের অবস্থা নেই।’

নগেন্দ্রনারায়ণ ম্যাট্রিকে প্রথমবার ফেল করে দ্বিতীয়বারে তৃতীয় ডিভিশনে পাশ করেন। কুসুমকুমারীর পরামর্শে প্রতাপনারায়ণ তাকে ডেকে বলে দেন, ‘পড়াশুনো তোর দ্বারা হবে না, এই বিদ্যে নিয়ে চাকরিও কোথায় পাবি না তার থেকে বরং এখনই কোনো ব্যাবসা শুরু করার চেষ্টা কর।’

ভীষণ ফাঁপরে পড়ে যান নগেন্দ্র বাবার কথা শুনে, কী ব্যাবসা করবেন? তা ছাড়া কীভাবে ব্যাবসা করতে হয় সেটাই তো জানেন না। স্কুলের বন্ধু অমল ক্ষেত্রিদের মিষ্টির দোকান ‘ক্ষেত্রি ব্রাদার্সের’ তখন বিশাল নাম, কলকাতায় চারটে ব্রাঞ্চ। নগেন্দ্র ধরে পড়লেন অমলকে। সে নিয়ে গেল তাদের ব্যাবসার প্রধান কর্তা জ্যাঠামশাই হরিচরণ ক্ষেত্রির কাছে। ভাইপোর বন্ধু আর বয়সটাও কাঁচা এবং কিছুক্ষণ কথা বলেই বুঝে গেলেন ছেলেটার ব্যাবসা বুদ্ধি একদমই শূন্য। উৎসাহ দিলেন না, নিরুৎসাহিতও করলেন না, শুধু বললেন, ‘কিছুদিন দোকানে এসে আমার কাছে বসো, চোখ কান খুলে বুঝে নাও কীভাবে ব্যাবসা চালাই, কীভাবে হিসেবপত্তর রাখি, কাঁচামাল কিনি, তৈরি জিনিস বেচি। তারপর ঠিক করো কী ব্যাবসা তুমি করবে।’

নগেন্দ্র একমাস হরিচরণের পাশে বসে চোখ কান খুলে দেখলেন ও শুনলেন এবং ঠিক করলেন দুধের ব্যবসায় নামবেন। ক্ষেত্রি ব্রাদার্সদের চারটে দোকানের জন্য প্রতিদিন কম করে চার মণ দুধ লাগে, ছানা, দই, ক্ষীর ও রাবড়ির জন্য তো বটেই ওরা ঘি-ও তৈরি করে খুচরো বিক্রি করে। ওদের নিজেদের গোশালা আছে বারুইপুরে, সেখান থেকে রোজ দুধ আসে ভ্যান লরিতে জোড়াসাঁকোর কারখানায়। নগেন্দ্র বারুইপুর, জোড়াসাঁকো ঘুরে সবকিছু খতিয়ে দেখে নেয়।

হরিচরণ নগেন্দ্রর দুধের ব্যবসায় নামার ইচ্ছার কথা শুনে বলে, ‘ভালোই তো, তোমাদের তো কোথায় যেন অনেক জমি আছে সেখানেই ডেয়ারি করো, আমি তোমার কাছ থেকে দুধ নেব। সাউথ ক্যালকাটায় লোক বাড়ছে, বালিগঞ্জের দিকে নতুন নতুন রাস্তা হচ্ছে, নতুন নতুন বাড়ি উঠছে, আমরা রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে গড়িয়াহাট মোড়ের কাছাকাছি দোকান খোলার জন্য ঘর খুঁজছি, তখন দুধের দরকার হবে। নর্থ আর সেন্ট্রাল ক্যালকাটা তো ঘিঞ্জি, সচ্ছল কালচার্ড লোকেরা এখন সাউথের ডেভেলপড জায়গায় বাড়ি করছে। তুমি দেখে নিয়ো কুড়ি-পঁচিশ বছরের মধ্যে ওদিকটায় লোক কত বেড়ে যাবে।’

কথাগুলো হরিচরণ বলে ছিল দেশভাগের দু-বছর আগে। পঁচাত্তর বছর বয়সে নগেন্দ্রনারায়ণ বারান্দায় চেয়ারে বসে অঘ্রানের রোদ পোয়াতে পোয়াতে পাশে টুলে বসা পুত্রবধূকে তার প্রথম যৌবনের কথা শোনাচ্ছিলেন। রেবা তার ছেলে কীর্তিনারায়ণের জন্য সোয়েটার বুনছে, যন্ত্রের মতো তার হাতের কাঁটা চলেছে।

‘লোকটার দূরদৃষ্টি ছিল স্বীকার করতে হবে। তখন ওই গড়িয়াহাটা মোড় কী ছিল আর আজ কী হয়েছে! বহু বছর ওদিকটায় যাই না। তুমি তো যাও, কী দাঁড়িয়েছে বলো তো?’

‘ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা যায় না বাবা, গিজগিজে ভিড় আর ফুটপাথে ছড়ানো মালপত্তর নিয়ে দোকান। আপনার ছেলে কাল বলল, গোলপার্ক থেকে গড়িয়াহাট মোড় ওইটুকু রাস্তা যেতেই গাড়িতে দশ মিনিট লেগে গেল।’

‘লোকটার দূরদৃষ্টি ছিল, এটা না থাকলে ব্যাবসা করে বড়ো হওয়া যায় না। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছর আগেই বুঝে গেছল ঝোপ-জঙ্গল ডোবা বাঁশবন ভরা শেয়ালডাকা জায়গাটা একদিন ব্যাবসাবাণিজ্যের বিশাল সেন্টার হয়ে উঠবে। একটা দুটো নয়, ক্ষেত্রিরা চার চারটে দোকান করে। তার মধ্যে একটা শাড়ির আর একটা ওষুধের, অতীন তো সেদিন বলল, নানান রকমের অসুখ পরীক্ষার একটা সেন্টারও খুলছে, রমরমিয়ে চলছে। দারুণ সব যন্ত্রপাতি নাকি আনিয়েছে।’

‘উনি বলেন, আগে যেসব রোগ আন্দাজে বা অভিজ্ঞতা দিয়ে ডাক্তাররা ধরতেন, এখন যন্ত্রেই নিখুঁতভাবে ধরা পড়ছে, ডাক্তারদেরও সুবিধে হচ্ছে চিকিৎসা করতে। দেখবেন লোক মরছে খুব কম, আমাদের আয়ু নাকি বেড়ে গেছে।’

‘আমাদের মানে কাদের আয়ু বাড়ার কথা বলছ বউমা?’ নগেন্দ্র চোখটা সরু করে রেবার দিকে তাকালেন। রেবা মুখের মধ্যে গালের একধারে পান রেখে কথা বলছিল। এবার সে চিবোতে শুরু করল। নগেন্দ্র ঠোঁট ও চোয়ালের নড়াচড়া দেখতে লাগলেন। অতীনের বিয়ের জন্য সাত-আটটি মেয়ে দেখার পর তিনি খবরের কাগজে ‘গ্র্যাজুয়েট প্রকৃত সুন্দরী’ পাত্রী চেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। ফোটোসহ আঠাশটি চিঠি পান, তাতে ডাক্তার, কলেজ শিক্ষিকা, কবি এবং সরকারি অফিসারও ছিল। অবশেষে তিনি মনোনীত করেন খদ্দরপরা এক স্কুল শিক্ষকের সাধারণ গ্র্যাজুয়েট কনিষ্ঠ কন্যা রেবাকে, যাকে দেখে মনে হয়েছিল ব্যক্তিত্বসম্পন্না, গেরস্থ এবং অবশ্যই রূপবতী।

রেবা উলবোনা থেকে চোখ নামিয়ে বলল, ‘যারা ভালো ডাক্তার দেখায়, ঠিকমতো টেস্ট করে, ওষুধপত্তর খায় তারাই বেশিদিন বাঁচে।’

‘তুমি যা বললে সেগুলো কি একটা চাষি বা মেছুনির পক্ষে পাওয়া সম্ভব? সম্ভব নয়। অথচ আমাদের দেশে গরিব লোকেরাই সংখ্যায় বেশি। এমনকী তেমন কোনো রোগ হলে আমার পক্ষেও চিকিৎসা করা কঠিন হবে।’

রেবা মুখ তুলে জিজ্ঞাসু চোখে শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, ‘এই বয়সে আপনার যা স্বাস্থ্য অসুখবিসুখ ধারেকাছে আসবে না।’

একটা লেপ নিয়ে শোভা এল বারন্দার গ্রিলের উপর মেলে দেবার জন্য। বছর দশেক সে এই পরিবারে দিনরাতের কাজের লোক। সুন্দরবনের একটি দ্বীপে তার বাড়ি, স্বামী-স্ত্রী নদীতে নেমে বাগদার মীন ধরছিল, স্বামীকে কুমিরে টেনে নিয়ে যায়। শোভার গা ঘেঁষেই কুমির এগিয়ে এসে স্বামীকে ধরে, কেন যে তাকে ধরল না সেটা এখনও ভাবলে সে শিউরে ওঠে। ‘আমারে বলল জালটা নিয়ে আস্তে আস্তে আমার দিকে আয়। আমি তখন একমনে মীন খুঁজতেছি তখন একটা কাঠের মতো কী যেন ভেসে আইসা আমার কোমরের কাছে লাগল, বর্ষাকালে নদীতে তখন খুব জল, আমি তো জালের দিকে তাকাইয়া হঠাৎ শুনি ও চেঁচাইল ‘শোভারে আমাকে ধরছে’, মুখ তুলে দেখি ওর হাতদুটো ডুবতেছে, তারপর দেখি জলের মধ্যে ঝাপটাঝাপটি চলছে। কী করব ভেবে পাইলাম না, তাড়াতাড়ি ডাঙায় উঠে দৌড় দিলাম।’

শোভার কথা শুনে নগেন্দ্র বলে, ‘কুমিরে তো প্রথমে তোকেই ধরার কথা, তা যখন ধরেনি তুই অনেকদিন বাঁচবি।’

রেবার সঙ্গে আয়ু নিয়ে কথা হচ্ছে। শোভাকে দেখে এখন নগেন্দ্রর মনে পড়ল, ‘অনেকদিন বাঁচবি’ বলেছিলেন। এ বাড়িতে আসার পর শোভার একবারও জ্বরজারি হয়েছে বলে কেউ মনে করতে পারে না এমনকী সর্দিকাশিও নয়। রোগা, লম্বা কাঠামো, রং নদীর মাটির মতো, কষ আছে শরীরে, বয়স বোঝা যায় না। রেবার অনুমান পঞ্চাশ তো অবশ্যই পেরিয়েছে।

‘বউমা আমার স্বাস্থ্য দেখে মনে কোরো না আমি খুব সুস্থ।’ বলেই নগেন্দ্র শোভাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘লেপটা অত বাইরের দিকে ঝুলিয়ে দিসনি, বেশ হাওয়া রয়েছে নীচে পড়ে যেতে পারে।’ এবার রেবার দিকে মুখ ফিরিয়ে, ‘দেহের মধ্যে কোথায় কী রোগ কুমিরের মতো ঘাপটি মেরে আছে তা কেউ বলতে পারে না আমিও পারি না। অমন যে ভীমের মতো শক্তিমান ভবানী যাকে শ্মশানে নিয়ে যেতে আটটা লোককে কাঁধ দিতে হয়েছিল, এমন দশাসই চেহারা। সে কী জানত মাথায় হঠাৎ ব্যথা হবে, সামান্য জ্বরও, তার দু-দিন পরই মারা যাবে? এটা আমার জন্মের তিনবছর আগের ঘটনা, বাবার মুখে শুনেছি, মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপ্যাল ডাক্তার বার্নাডো স্টেথিস্কোপ ভবানীর বুকে লাগিয়ে হার্টবিট শুনতে পাননি, বুকে চার ইঞ্চি পুরু চর্বি! ব্যাপারটা বুঝেছ? রাক্ষসের মতো গাদা গাদা খেয়েছে আর চর্বি জমিয়েছে তারই ফল ফলল।’

হাত নেড়ে লেপের উপর বসা শালিখটাকে তাড়িয়ে রেবা বলল, ‘তখনকার বেশিরভাগ পালোয়ান খুব একটা শিক্ষিত ছিল না, ভাবত এন্তার খেলেই বুঝি গায়ের জোর বাড়বে। আমি কিন্তু মেপে খাই, উনি বলে দিয়েছিলেন যেমন যেমন পরিশ্রম করবে তেমন তেমন খাবে, ভাজাভুজি ছোঁবে না। অক্ষরে অক্ষরে আমি তা মেনে চলেছি। আচ্ছা মারা যাবার সময় ভীম ভবানীর বয়স কত ছিল?’

‘চৌত্রিশের কাছাকাছি। এখন আমি বুঝতে পারছি আমার রাক্ষুসে খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে মা আমার কী উপকারটাই না করেছেন। তোমাকে তো বলেছি ভীম ভবানী হবার জন্য কীরকম খেতুম। বাবার তখন পয়সা ছিল, ষোলোবছর বয়সে আটটা কাঁচা মুরগির ডিম, ছ-টা মর্তমান কলা। দু-সের দুধ, আধসের মাংস, ইয়াবড়ো গেলাসে চার গেলাস পেস্তাবাদামের শরবত, পনেরোটা রুটি। ভাবতে পারো বউমা? এখনকার বডি বিল্ডার ছেলেরা শুনলে তো হেসে গড়িয়ে পড়বে। মা যদি বন্ধ করে না দিত তা হলে ওটাই তো চালিয়ে যেতাম, না থেমে তখন পাঁচশো বৈঠক, দুশো ডন দিতাম, মনে রাখবে, না থেমে!’ নগেন্দ্রর চোখে ষাট বছর আগের ডন-বৈঠক দেওয়ার বিস্ময় ফুটে উঠল। ‘কী করে পারতুম বলো তো!’

রেবা হাসি টানল ঠোঁটে। শ্বশুর এখন গল্প করতে করতে প্রায়ই বলে ওঠেন, ‘কী করে পারতুম বলো তো!’ প্রশ্ন নয় অবাক হন। দরজার দিকে মুখ করে রেবা চেঁচিয়ে বলল, ‘শোভা আচারের শিশি আর বোয়েম রোদে দিয়ে যাও।’ তারপর টুল থেকে উঠে গ্রিলের ধারে গিয়ে মুখ থেকে পানের ছিবড়ে নীচের রাস্তায় ফেলল।

‘দেখে ফেলো বউমা।’

‘দেখেছি রাস্তায় লোক নেই।’

টুলে ফিরে এসে রেবা বলল, ‘আজ হাওয়াটা একটু বেশি মনে হচ্ছে, কাল ছিল তেইশ ডিগ্রি, আপনি বেশিক্ষণ আর বাইরে থাকবেন না।’

নগেন্দ্র ফতুয়ার উপর আলোয়ানটা আর একটু ভালো করে জড়িয়ে নিতে যেতেই হাত থেকে ম্যাগাজিনটা পড়ে গেল। রেবা ঝুঁকে কুড়িয়ে তুলে শ্বশুরের হাতে দিয়ে বলল, ‘কী পড়ছিলেন?’

‘আজকাল সব পত্রপত্রিকাতেই শরীর স্বাস্থ্য নিয়ে লেখা বেরোচ্ছে। লোকে এখন বাঁচার কথা খুব ভাবছে, এটা একদিক দিয়ে ভালোই, বেঁচে থাকার জন্য এই ভাবনাটা।’ নগেন্দ্র দেখলেন শালিখটা আবার উড়ে এসে বসল গ্রিলের উপর । তিনি হাসলেন। ‘পড়ছিলুম কিডনি নিয়ে এক ডাক্তারের লেখা। কিডনির রোগ কেন হয়, কী করে রোগ এড়ানো যায়, রোগ হলে কী চিকিৎসা করতে হবে এইসব। কিন্তু মুশকিল কী জানো রোগ আমরা ফেলে রাখি আর সেটাই সর্বনাশ ঘটায়। রোগ বাড়তে বাড়তে কিডনি যখন আর কোনোমতে কাজ করতে পারে না তখন তো মরা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।’

‘কেন নেই?’ রেবা বোনা থামিয়ে ভ্রূ তুলল। ‘ডায়ালিসিস করে বাঁচবে।’

ডাক্তার পুত্রের বউ কিছু ডাক্তারি জ্ঞান যে কুড়ি বছরে সংগ্রহ করেছে নগেন্দ্র তা বুঝতে পারছেন। আরও বোঝার জন্য কৌতূহলী হয়ে এগোলেন, ‘ডায়ালিসিসের খরচ কত সেটা জান কি?’

জবাব না দিয়ে রেবা শুধু মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। নগেন্দ্র বুঝলেন খরচ কত জানে না। বললেন, ‘হপ্তায় অন্তত দু থেকে তিনবার করতে হয়, মাসে খরচ মোটামুটি পনেরো হাজার টাকা। ভাবতে পারো!’

রেবা মনে মনে দ্রুত হিসেব করে নিয়ে বলল, ‘বছরে একলাখ আশি হাজার টাকা! সে তো অনেক টাকা।’

‘হ্যাঁ। যদি আমার এমন রোগ হয় তা হলে আমি কী করব বলতে পারো? একবছর, দু-বছর, তিনবছর পর্যন্ত চালাতে পারব বাড়ি জমিজমা যা আছে বিক্রি করে, ব্যাঙ্কের টাকা তুলে কিন্তু সেও তো একদিন ফুরিয়ে যাবে। ডায়ালিসিস ব্যাপারটা কষ্টকর, অতীন দু-বেলায় তিনটে জায়গায় বসে, পেসেন্টের বাড়ি ভিজিটেও যায় বোধ হয়, মাসে হাজার পঞ্চাশ রোজগার করে, ঠিক বলছি?’

রেবা অস্ফুটে বলল, ‘কাছাকাছি। ফি এখনও পঞ্চাশ টাকাই রেখেছেন রুগিদের অবস্থার কথা ভেবে নয়তো দু-বছর আগেই একশো টাকা করতে পারতেন। ওর বন্ধু ডাক্তার বিশ্বাস নিউরোলজিস্ট, তিনি তো ফি দুশো টাকা করে দিয়েছেন।’

হঠাৎই একদিন দেখে ফেলেছিলেন রেবার মুঠোয় নোটের গোছা, আলমারির লকারে মুঠো ঢুকিয়ে গোছাটা ভিতরে রাখছে। তিনি জানেন অতীন ব্যাঙ্কে টাকা রাখেন খুবই কম, বেশিরভাগটাই খাটে নানান মিউচুয়াল ফান্ডে আর ডাকঘর স্বল্প সঞ্চয়ে। অতীনের রোজগারের কথাটা তিনি তুললেন। শুধু রেবাকে একটা কথাই বলার জন্য, মাসে আধ লাখ টাকা রোজগার করা ছেলে বুড়ো বাবার ডায়ালিসিস কতদিন কর্তব্য বোধের চাপে চালাবে? তা ছাড়া তিনি ছেলের কাছ থেকে সাহায্য নেবেনই বা কেন?

রেবার মুখে হঠাৎই একটা ছায়া যেন পড়তে দেখলেন। ওকে আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, ডায়ালিসিসের জন্য কারোর কাছ থেকে আমি টাকা চাইব না।’

‘তা হলে?’

রেবার মুখ থেকে ছায়াটা সরল না দেখে তিনি মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার ওপারের চারতলা বাড়িটার দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় বললেন, ‘তা হলে আর কী, পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যাব।’

‘তার মানে?’

নগেন্দ্রনারায়ণ জবাব দিলেন না।

‘আপনি কি তা হলে সুইসাইড করবেন!’ রেবার স্বরে আতঙ্ক।

নগেন্দ্র তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেন পুত্রবধূর মুখের ভাবটা। ভয়ে শুকিয়ে গেছে। ঢোঁক গিলল। শিরদাঁড়া আলগা হয়ে কুঁজো হয়ে যাচ্ছে। হাতের কাঁটা চলছে না।

হেসে উঠে নগেন্দ্র বললেন, ‘আরে দূর, একেই বলে গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল! আগে কিডনিটা অকর্মণ্য হোক তারপর তো ডায়ালিসিসের প্রশ্ন আসবে। তা ছাড়া কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টও তো করা যেতে পারে। তোমাদের কারোর একটা কিডনি পেলে আর সেটা বসাবার জন্য লাখ দুই টাকা খরচ করলেই তো বেঁচে যাবে। এখানে যা জমি আছে তা বেচে ও টাকা আমার জোগাড় হয়ে যাবে। আর বসব না, শীত করছে।’

নগেন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন। হাওয়াই চটিতে পা গলিয়ে বললেন, ‘একতলায় ভাড়াটে আসছে কবে?’

‘আসার কথা তো পয়লা তারিখে, ভদ্রলোক তো তাই বলে গেলেন।’

‘কে জানে কেমন লোক হবে!’

একতলাটা বড়োছেলে যতীন্দ্রনারায়ণের। সে পাটনায় থেকে ওকালতি করে। রোজগারের দিক থেকে অতীন যতটা সফল তার দাদা ততটা নয়। পাটনা থেকে যতীন বছরে একবার সপরিবারে কলকাতায় আসে, ওঠে গোয়াবাগানে শ্বশুরবাড়িতে। একদিন এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে যায়। নগেন্দ্র বাড়িটি দুই ছেলেকে ভাগ করে দিয়েছেন জীবদ্দশাতেই। তিনি চান না তাঁর মৃত্যুর পর বাড়ির অংশ নিয়ে ছেলেদের মধ্যে সম্পর্ক নষ্ট হোক।

প্রতাপনারায়ণ পঞ্চাশ বিঘা জমি কিনেছিলেন মুর্শিদাবাদের এক জমিদারের কাছ থেকে, যাকে স্থানীয় লোকেরা রাজাবাবু বলত। আর জায়গাটাকে বলত রাজার বাগান। বাবার দেওয়া বাড়ি সমেত এই বাগানেই নগেন্দ্র তার ডেয়ারি করেছিলেন পঞ্চাশ বছর আগে।

শালের খুঁটির উপর কাঠ আর বাঁশের কাঠামো তার উপর টিনের চালা, চার ফুট উঁচু দেয়ালে ঘিরে তৈরি হয় গোয়ালঘর, শানবাঁধানো মেঝে। শুরু করেছিলেন সাতটি গোরু দিয়ে। তার মধ্যে দুটি ছিল মুলতানি। পরে তৈরি করেছিলেন জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি করার ঘর, কিনেছিলেন দুটি মোষ এবং আরও দুটি মুলতানি গোরু। গাওয়া আর ভয়সা দু-রকম ঘি তৈরি করে সবটাই নিয়ে আসতেন হরিচরণ ক্ষেত্রির জোড়াসাঁকোর প্যাকিং ঘরে। সেখানে আধসেরি আর একসেরি ‘রাজা ঘি’ ছাপমারা টিনে ভরে বিক্রির জন্য দোকানে দোকানে পাঠাত ‘ক্ষেত্রি ব্রাদার্স।’

নগেন্দ্র ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে শোবার ঘরে এসে খাটে বসলেন। দরজা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বারান্দায় রেবা উলের কাঁটা হাতে নিয়ে বসে। হাত চলছে না, চোখ কুঁচকে রয়েছে। নগেন্দ্র ম্যাগাজিনটা ছুড়ে রাখলেন টেবিলে। বালিশটা গুছিয়ে নিয়ে কাত হয়ে গড়িয়ে আলোয়ানটা পায়ের উপর ছড়িয়ে দিলেন।

‘বাবা!’

চোখ বুজে আসছিল, খুলে তাকালেন নগেন্দ্র।

‘বাবা হঠাৎ ওকথা বললেন কেন ডায়ালিসিসের জন্য কারোর কাছে টাকা চাইব না? ছেলে কি আপনার পর? ও আপনার জন্য কয়েক লাখ টাকা খরচ করবে না, এটা ভাবলেন কী করে?’ রেবার গলায় স্পষ্ট অভিমান।

নগেন্দ্র মনের গভীরে সুখবোধ করলেন। নির্বাচনে ভুল করেননি, প্রতিদিন মুঠোভরে টাকা পায় কিন্তু মুঠোটাকে বন্ধ করে তালা দিয়ে ফেলেনি, আলগা করে রেখেছে। খরচটা আসলে অতীন তো করবে না, করবে রেবাই। তিনি জানেন তার নরম ঠান্ডা প্রকৃতির ছেলেটি নিজের বিশ্বাসে দৃঢ় থাকলেও বউয়ের ভ্রূকুটিতে বা ছোট্ট একটা ধমকেই কাতর হয়ে পড়ে। অতীনের মা সুধারানি কখনো স্বামীর সঙ্গে গলা তুলে কথা বলেনি বরং ধমক খেয়েছে। অতীন অনেকটা ওর মায়ের মতো।

‘আমি কিছু ভেবে বলিনি বউমা।’ নগেন্দ্র ইচ্ছা করেছিল বউমা না বলে রেবা বলতে। পুত্রবধূকে নিজের মেয়ের মতো নাম ধরে ডাকবে শ্বশুর-শাশুড়ি, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের পরিবারে বউমা বলে ডাকাটাই রীতি। তিনি রীতি ভাঙতে পারেননি বা চাননি।

‘অতীন অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে। দেখি তো, সকালে কিছু খেয়েই বেরিয়ে পড়ে, ফেরে একটা-দেড়টায়, ঘণ্টাতিনেক বাড়িতে থেকে আবার বেরোয়। তারপর ফেরার আর ঠিক নেই। রাত দশটাও হয়, এগারোটাও হয়। দেখে আমার কষ্ট হয়। জীবনটা যে কত বিচিত্র আর মজার সেটাই ও আর জানার চেষ্টা করছে না। অথচ একসময় ও রোজ রেডিয়োয় গান শুনত, টেপরেকর্ডার কিনল গান শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়বে বলে, সিনেমায় যেত, মোহনবাগান হারলে রাতে খেত না। নিয়মিত ফ্রিহ্যান্ড ব্যায়াম করত, কোমরের মাপ বাড়লে খাওয়াদাওয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ত। এখনকার কীর্তিকে দেখলে তুমি বুঝতে পারবে তখন অতীন কীরকম ছিল। ভালো কথা, তোমায় বলা হয়নি, আজ কীর্তিকে ফোন করেছিল একটি মেয়ে নাম বলল ক্ষণপ্রভা, তুমি তখন কলঘরে ছিলে, কীর্তি বাড়ি ছিল না, বলল বাড়ি এলেই যেন ওকে ফোন করে। কীর্তিকে এটা বলে দিয়ো। মেয়েটিকে চেনো নাকি?’

নগেন্দ্রর পায়ের কাছে খাটে হেলান দিয়ে চোখ নামিয়ে রেবা শ্বশুরের কথাগুলো শুনছিল, বলল, ‘আগেও ফোন করেছে, আমি ধরে কীতুকে ডেকে দিয়েছি। ওরা একই ক্লাসে পড়ে। কিন্তু বলেছে ওকে একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়াবে।’

রেবা ইতস্তত করছে, বলতে চায় কিছু। নগেন্দ্র মৃদুস্বরে বললেন, ‘তুমি বোধ হয় কিছু বলবে।’

‘হ্যাঁ, আপনি যা বললেন সেটা আমিও ভেবেছি। উনি কেমন যেন একটা গোলকধাঁধায় পড়ে গেছেন, সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছেন, বেরোবার চেষ্টাও করছেন না। একদিন ওকে বললাম সেই কোন যুগে ‘টিনের তলোয়ার’ দেখিয়েছিলে তারপর আর থিয়েটার দেখিনি, চলো একটা দেখে আসি। শুনেই বললেন, ‘কীতুকে বলো ও দেখিয়ে আনবে, আমি সময় করে উঠতে পারব না।’

‘আর কী বলল, একবেলা রুগি না দেখলে রুগিরা সব মরে যাবে?’ নগেন্দ্রর স্বর বিদ্রূপ ঘেঁষা।

‘না তা বলেননি। তবে যেটা বুঝলুম জীবনটাকে উনি ওর মতো করে তৈরি করে নিয়েছেন, রুগি দেখার ব্যাপারটা ওর বেশ ভালোই লাগে, টাকা না পেলেও উনি রুগি দেখে যাবেন। ব্যাপারটা প্রায় ড্রাগের নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখে খালি বিধান রায়ের গপ্পো, রুগির মুখ দেখেই তিনি নাকি রোগটা কী বলে দিতেন। তাই উনিও চেষ্টা করেন বিধান রায় হতে।’

‘কতকগুলো টেস্ট প্রথমেই করিয়ে নিলে তো রোগ ধরা পড়ে যাবে, তাই করলেই তো পারে!’ দরকার কী বিধান রায় হবার! নগেন্দ্র সহজ গলায় পরামর্শটা যেন অতীনকেই দিলেন।

‘আমিও ঠিক তাই বললুম। তাইতে বললেন, শুধুমাত্র রুগিকে খরচ করাব কেন, প্রথমে চেষ্টা করে দেখি না।’

‘আরে বোকা, চেষ্টা করতে করতে তো অমূল্য সময় চলে যাবে, টেস্ট করলে রোগটা সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়বে আর সেটাই তো দরকার। বুঝি না যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই ডাক্তারি করব এমন গুমোর করার মানে কী! এই যে এক্স-রে মেশিন, ই.সি.জি মেশিন তারপর আরও কত রকমের যে মেশিন মাথা খাটিয়ে মানুষ তৈরি করেছে, সবই কি মিছিমিছি? ওকে কোবরেজি কী হোমিয়োপ্যাথি করতে বলো বউমা, এম.বি.বি.এস অক্ষরগুলো নেমপ্লেট আর প্যাড থেকে তুলে ফেলুক। বুঝি না এমন ডাক্তারের কাছে লাইন দিয়ে রুগিরা বসে থাকে কেন!’

ক্ষুব্ধ হয়েছেন যেন এমন একটা ভাব দেখিয়ে তিনি পাশ ফিরলেন। তারপরই মনে হল বোধ হয় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল, রেবা হয়তো মনে আঘাত পেল। পতিনিন্দা কোনো বউ-ই ভালো মনে নেবে না।

‘কাল মিসেস মুখার্জির সঙ্গে দেখা হল, গেটের কাছে নাতিকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। বললেন ওর কর্তার পেটের কষ্টটা অনেক কমে গেছে অতীনের ওষুধ খেয়ে। এখন তিনি সকালে আগের মতো বেড়াতে বেরোচ্ছেন। অতীনকে বললেন ধন্বন্তরী। গত সাত বছর ধরে কষ্ট পাচ্ছিলেন, হেন চিকিৎসা নেই যে করাননি।’ নগেন্দ্র মুখ ঘুরিয়ে রেবাকে দেখার চেষ্টা করলেন, বুঝতে পারলেন না, মুখে ভাবান্তর নেই। এরপর যোগ করলেন, ‘শুনে আমার খুব ভালো লাগল। মুখার্জিরা সহজে তো কারও গুণ গায় না।’

‘উনি বললেন, অ্যালকোহলে মোসোমশাইয়ের লিভারটা নষ্ট হয়ে গেছে, সাবধান না হলে বেশিদিন বাঁচবেন না।’

‘সেটা কি মুখার্জিকে বলেছে?’

‘বলেননি। শুধু বলেছেন মদ খাওয়াটা এবার বন্ধ করুন, সময়মতো খাওয়াদাওয়া আর নিয়মিত ওষুধগুলো খেয়ে যান।’

‘মুখার্জি এখন বোধ হয় খাওয়া বন্ধ রেখেছে, একটু ভালো থাকলেই আবার শুরু করবে। মরবে তো বটেই আর তখন অতীনের বদনাম হবে ওকে বারণ করে দিয়ো বউমা মুখার্জির চিকিৎসা যেন আর না করে। ওরা ফি দেয় কি?’

‘দেয়, তবে উনি অর্ধেক নেন।’

‘সামান্য টাকা। ছেড়ে দিক মাতালটাকে।’

বাড়ির সামনে মোটরগাড়ির হর্নের শব্দ হল। গাড়ি থেকে নেমে এসে অতীন নিজেই গেট খুলবে। সিমেন্ট বাঁধানো চওড়া চাতালে গাড়ি রেখে এবার উপরে উঠে আসবে।

বহু বছর আগে নগেন্দ্রর ছিল অস্টিন গাড়ি, সেটা বিক্রি করে কেনেন অ্যাম্বাসাডার। তখন অতীন সবে ডাক্তার হয়েছে। গাড়িটা তিনি ছেলেকে ব্যবহার করতে দেন। পনেরো বছর সেই গাড়িতে চড়ার পর অতীন বলল, এবার এটাকে বানপ্রস্থে পাঠানো যেতে পারে, ইঞ্জিনটা গোলমাল করছে।

গাড়িটা বহু বছর নগেন্দ্রকে বহন করে তাকে মায়ার বাঁধনে বেঁধে ফেলেছিল। প্রথমে বিক্রি করতে রাজি হননি। বলেছিলেন, ‘দেখ না, সারিয়ে-সুরিয়ে যদি আরও কিছুদিন চলে।’ গ্যারাজে পাঠানো হয়। কিন্তু তারপর একদিন অতীনকে পথে বসিয়ে ট্যাক্সিতে রুগির বাড়ি যেতে বাধ্য করায় অবশেষে। নগেন্দ্র বলেন, ‘তা হলে ওটা বিক্রি করে তুই নতুন একটা কেন, কাগজে কত নতুন নতুন বিদেশি গাড়ির বিজ্ঞাপন দেখি, দেখতেও বেশ।’

শুনেই লাফিয়ে উঠেছিল কীর্তি। ‘বাপি, ওপেল অ্যাস্ট্রা, জার্মান গাড়ি, দ্যাখোনি স্টেফির শার্টে ওপেলের লোগো থাকে?’

অতীন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল ছেলের দিকে।

‘স্টেফি গ্রাফ। টেনিস প্লেয়ার।’ কীর্তিও সমান অবাক হয়ে তাকায় তার বাপির দিকে। অতীন লজ্জা পেয়ে শুধু বলে ‘ওহ’।

কীর্তির ইচ্ছা মেনেই কেনা হয় অ্যাস্ট্রা। রবিবার অতীন ডাক্তারিতে বেরোয় না, সারাদিনই প্রায় বাড়িতে থাকে। সেদিন অ্যাস্ট্রাকে ধুয়েমুছে রাখার কাজটা করে কীর্তি। গাড়িটাকে সে হাত বুলিয়ে আদর করে, দু-হাতে জড়িয়ে ধরে। একটু জোরে কেউ দরজা বন্ধ করলে যেন ব্যথা পেয়েছে এমনভাবে সে ‘উহহ’ করে কাতরে ওঠে। নগেন্দ্র ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘বউমা একটা বালিশ দাও কীর্তিকে, রাতে গাড়ির মধ্যে গিয়ে শুয়ে থাকুক।’

গেট খোলা আর বন্ধের জন্য একজন লোক রাখার কথা তুলেছিল অতীন। খারিজ করে দিয়ে রেবা বলেছিল, ‘শোভাই তো কাজটা করে আসছে এতকাল। এমন কিছু শক্ত ব্যাপার নয় যে পুরুষমানুষ দরকার হবে।’

নগেন্দ্র তাকে সমর্থন করে বলেছিলেন, ‘শোভা তো একটা পুরুষের সমানই, আবার দারোয়ানের কী দরকার?’

‘অতীনের আজ যেন একটু দেরি হল।’ নগেন্দ্র টেবল ক্লকটার দিকে তাকিয়ে বললেন।

রেবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মুখ নীচু করে বারান্দায় বসে শোভা চুল শুকোচ্ছে। নগেন্দ্র পাশ ফিরলেন এবং তিন মিনিটের মধ্যেই ঘুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

দুই

বিকালে নগেন্দ্র বেড়াতে বেরোন। বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেট বন্ধ করে স্থির করেন কোন দিকে যাবেন। উত্তরে, আর পশ্চিমে তিনদিকে রাস্তা গেছে। উত্তরে মিনিট সাতেক হাঁটলেই আর একটি বসত এলাকা ‘হীরকনগর’। গুটি ত্রিশ একতলা-দোতলা বাড়ি নিয়ে সাজানো সুরুচিকর একটি কলোনি, অবস্থাপন্ন লোকেরা এখানে থাকে। বছর পনেরো আগে এখানে বাড়ি তৈরি হতে শুরু করে। নগেন্দ্র এই দিকটায় বেড়াতে ভালোবাসেন। পুবদিকে তিন মিনিট হাঁটলে বিপ্লবী পূর্ণ সরকার রোড। সেটি বেঁকে পুবদিকে গেছে, পাঁচ মিনিট হাঁটলেই ডায়মন্ডহারবার রোড। এই ডায়মন্ড থেকেই হীরকনগর নামটির উৎপত্তি। নগেন্দ্র পুবদিকে কদাচিৎ যান। পূর্ণ সরকার রোড ভাঙাচোরা, অটো রিকশা ও সাইকেল রিকশা অধ্যুষিত, রাস্তার ধারে খোলা ড্রেন ও কাঁচা বাজার বসে, প্রচুর দোকান ইত্যাদি থাকায় বেড়াবার পক্ষে একদমই স্বাচ্ছন্দ্যকর নয়। পারতপক্ষে এই দিকটা তিনি এড়িয়ে চলেন।

তাঁর ভালো লাগে পশ্চিমদিকে যেতে। সাত-আট মিনিট হাঁটলেই বেরিয়ে আসে গ্রাম। পুকুর-ডোবা, খোলা জমি, ফুটবল মাঠ, খেজুর-নারকেল গাছ, ছোটো ছোটো সবজি খেত, টালির চালের মাটির ঘর। রাস্তার খানিকটা ইটবিছানো তারপরই মাটির। প্রাচীন একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছের গুঁড়ির ধারে বিসর্জিত রং চটা, বৃষ্টিতে গলে যাওয়া শীতলা প্রতিমা পর্যন্ত তিনি হেঁটে আসেন। এখানেই ছোটো বরহাট গ্রামের সীমানা শেষ হয়ে শুরু হচ্ছে মঙ্গলতলি গ্রাম। নগেন্দ্র এখান থেকেই প্রতিবার ফিরে আসেন। দূর থেকে মঙ্গলতলিকে দেখে তার রাজার বাগানকে মনে পড়ে। হুবহু একরকম দেখতে। ওইসব গাছপালা মাটি আর খড়ের ঘর আর ক-বছর পর থাকবে না। টাকার থলি নিয়ে একদল লোক নিশ্চয়ই ঘুরে বেড়াচ্ছে গ্রামের লোকেদের লোভ দেখিয়ে জমি কেনার জন্য।

নগেন্দ্র তার রাজার বাগানের জমি বিক্রি করেছিলেন আগুনে তার ডেয়ারি ভস্মীভূত হয়ে যেতে। আগুন লেগেছিল মাঝরাতে, লাগার কারণটা আজও তিনি জানেন না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু-হাতে সদ্য মা-মরা এগারো বছরের যতীন আর আট বছরের অতীনের হাত চেপে ধরে দূর থেকে তিনি দেখে যান কাঠ আর বাঁশের তৈরি গোয়াল দ্রুত ছাই হয়ে গেল আশেপাশের অনেকেই ছুটে গেছিল, তিনি যাননি। যে দু-জন কর্মচারী রাতে গোয়ালের পাশের ঘরে থাকত তারা প্রথমেই গোরুমোষগুলোকে চালার নীচ থেকে বার করে আনে, প্রাণীগুলো অক্ষত ছিল। গ্রামের লোকেরা পুকুর থেকে কলসি বালতি করে জল এনে ঢালে বটে কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে।

হরিচরণ বলেন, ‘এটা আর কী এমন লোকসান? তোমার আসল অ্যাসেট গোরুমোষগুলো তো রয়ে গেছে, আবার শুরু করো।’

নগেন্দ্র শুরু করেননি। হঠাৎই মনে হয় তার উপর শনির দৃষ্টি পড়েছে। এর মাত্র দু-মাস আগে পরপর মারা যায় সুধারানী আর সূয্যি। সুধারানীর লাশ পাওয়া যায় বরানগরের গঙ্গার ঘাটে। আহিরিটোলায় বাপের বাড়িতে গেছল জলবসন্তে আক্রান্ত বাবাকে দেখতে। বহুদিন গঙ্গাস্নান না করার খেদ মিটিয়ে নিতে পাড়ার দু-তিন জনের সঙ্গে সে যায় গঙ্গায়। বুকজলে দাঁড়িয়ে যখন দুই কানে আঙুল দিয়ে ডুব দিচ্ছিল তখনই আচমকা বান আসে। ঘাটের থেকে চিৎকার করে দু-তিনজন সুধারানীকে উঠে আসতে বলে। শুনল সে কিন্তু একটু দেরি করে। আঁকুপাকু করে উঠে আসার সময় সিঁড়ির ধাপে জমা শ্যাওলায় সে পিছলে পড়ে তখন শাড়ি খুলে শরীর থেকে নেমে যায়। সুধারানী হাঁটুজলে বসে পড়েন লজ্জা নিবারণের জন্য। সেই সময়ই প্রচণ্ড ঢেউ ধেয়ে এসে তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এসবই নগেন্দ্র শুনেছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছ থেকে। পরের দিন কুঠিঘাটে লাশটা পাওয়া যায়।

এরই একসপ্তাহ পরে নগেন্দ্র মেজো সতাতোভাই সূর্যশেখর তিনতলার ছাদের পাঁচিলে ঝুঁকে ঘুগনিওয়ালাটাকে খুঁজছিল। পাঁচিলের ওই জায়গাটাতেই আলগা হয়েছিল সুরকির গাঁথনি। বুকের চাপে ভেঙে পড়ে পাঁচিল। কয়েকটা ইট নিয়ে সূর্যশেখর আছড়ে পড়ে রাস্তায়। খবরটা পেয়েই নগেন্দ্র ছুটে যান সিমলায়। ভাইয়েদের মধ্যে ‘সূয্যি’ ছিল অত্যন্ত প্রিয়। বিয়ে করেনি, ভবঘুরে ধরনের। সাইকেলে প্রায় সারা ভারত ঘুরে বেড়িয়েছে। প্রায়ই রাজার বাগানে এসে কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেত বড়দার কাছে।

‘বড়দা তোমার ওই গোয়ালটার পাশে আমি একটা ঘর করে থাকব। বড়ো শান্ত তোমার গোরুগুলো। ওদের গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে কেন জানি ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে যায়, কেন বলো তো?’

সূয্যি অবাক হয়ে তাকিয়ে প্রশ্নটা করেছিল। পরে নগেন্দ্রর বহুবার মনে পড়েছে ওই তাকানো চোখ দুটো আর অবুঝ বালকের মতো প্রশ্নটা-কেন বলো তো? সেদিন নগেন্দ্র জবাবে বলেছিলেন, ‘তোর ছোটোবেলায় বাড়িতে জীবনটা খুব শান্ত ছিল, সদ্ভাব ছিল, আমারও ছোটোবেলা মনে পড়ে তবে গোরুর গায়ে হাত বুলিয়ে নয়।’

পরে নিজের কাছে তিনি এর একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে স্বস্তি পান। সব মানুষের অনুভূতি সমান হয় না। সূয্যিটা একটু পাগলাটে, পাগলদের বোধশক্তি স্বাভাবিক মানুষদের থেকে অন্যরকম হয়।

ছোটোবেলায় ফিরে যাবার জন্য সূয্যি গোরুদের কাছে থাকতে চেয়েছিল, হেসে নগেন্দ্র বলেছিলেন, ‘ঠিক আছে থাকবি, ওদের সঙ্গেই জাবনাটাবনা খাবি।’

‘খাবি কী মানে? একদিন একগলা খেয়েও দেখেছি, নট ব্যাড!’

নগেন্দ্র হতভম্ব হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে যান। সুধারানী আর দুই ছেলে খুব মজা পেয়েছিল কথাটা শুনে। অতীন অনেকদিন পর্যন্ত বলত, ‘মেজো কাকা আগের জন্মে নিশ্চয় গোরু ছিল পরের জন্মেও গোরু হয়ে জন্মাবে।’ সূর্যশেখর মারা যাওয়ার পর অতীন আর কখনো এই রসিকতাটা মুখে আনেনি।

পরপর দুটো অপমৃত্যু বিমূঢ় করে তার উত্তুঙ্গ মনের জোরকে শূন্যে নামিয়ে দেয় এবং তিনি ভয় পেতে শুরু করেন, শুধুই মনে হতে থাকে আরও অনিষ্ট আরও ক্ষতি তার হবে। তখন ছোটোখাটো ব্যাপারেও তিনি সিঁটিয়ে উঠতেন। যতীন ইলেকট্রিক সুইচ টিপে আলো জ্বালতে গিয়ে শক খেল বা অতীন পা হড়কে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে পাঁজরে চোট পেল, নগেন্দ্র তাতেই এর মধ্যে অমঙ্গলের ছায়া দেখতে পেতেন। শনির দৃষ্টির ধারণাটা পাকাপোক্ত হয়ে তাঁর মনে ভিত গেঁথে দিল যখন তারাতলায় ব্যাক থেকে সাত হাজার টাকা তুলে বাসে ফেরার সময় তার পাঞ্জাবির পকেট থেকে টাকাটা উধাও হয়ে গেল। বাস থেকে নেমে পকেটে হাত দিয়েই যখন বুঝলেন নোটের তাড়াটা নেই তখন একটা কথাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। শনি ভর করেছে নয়তো গাড়ির ফ্যানবেল্ট কি না আজই ছিঁড়ে গেল!

এর কয়েকদিন পর গোয়ালে আগুন লাগে। হরিচরণ বলেছিলেন বটে আবার শুরু কর, সূয্যি বেঁচে থাকলে হয়তো শুরু করতেন সুধারানী জীবিত থাকলে অবশ্যই গোয়ালঘর আবার খাড়া করতেন। তা না করে তিনি পরিচিত এক পাঞ্জাবি দুধব্যবসায়ীকে ডেকে এনে গোরুমোষগুলো দিলেন প্রায় অর্ধেক দামে। প্রাণীগুলোকে হাঁটিয়ে তার বাড়ির সামনে দিয়ে নিয়ে যাবার সময় তিনি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। মন্থর চালে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ওদের হেঁটে যাওয়া দেখে তার বুকে মোচড় দিয়েছিল। তার মা ভারী নিতম্বের জন্য অনেকটা এইভাবেই ধীর গতিতে হাঁটতেন মাথাটা একদিকে হেলিয়ে। পলকের জন্য ছোটোবেলা তার চোখে ঝলসে ওঠে।

তার গোরুমোষগুলো বিক্রি করে দেওয়া এবং কর্মচারীদের বিদায় করা দেখে আশপাশের লোকেরা বুঝে যায় রাজা ডেয়ারি বন্ধ হয়ে গেল। কয়েকদিন পর বিকেলে নগেন্দ্রর কাছে একটি লোক এসে হাজির হল। লোকটিকে তিনি আগে কখনো দেখেননি। লোকটি মাঝবয়সি, উচ্চচতা পাঁচ ফুটের বেশি নয়, হৃষ্টপুষ্ট ঘাড়ে গর্দানে, টাকটি চকচকে, পরনে ধুতি ও হাফহাতা পাঞ্জাবি, পায়ে গোড়ালি ক্ষয়ে-যাওয়া পাম্প শু। নমস্কার জানিয়ে বলল, ‘আমার নাম দেবেন নস্কর, থাকি ওই পাশেই মঙ্গলতলিতে।’

দেবেনের কণ্ঠস্বর মেয়েদের মতো। নগেন্দ্রর প্রথমেই মনে হল লোকটি বোধ হয় যাত্রায় মেয়ের পার্ট করে। তবে দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ যেরকম তাতে কোনো স্ত্রী ভূমিকাতে ওকে কল্পনা করে নেওয়া কঠিন।

‘এসেছি কৌতূহল নিয়ে নিজের স্বার্থেই।’ দেবেন বাচ্চচার মতো হাসল। দোতলায় বড়ো বসার ঘরে সোফা এবং চেয়ার দুই-ই রয়েছে। দেবেন বসার জন্য বেছে নিয়েছে চেয়ার। ‘আপনি বোধ হয় আর ঘিয়ের ব্যাবসা করবেন না।’

নগেন্দ্রর ভ্রূ কুঁচকে উঠল। করব কী করব না তাই নিয়ে তোমার কৌতূহল কেন? মনে মনে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘আপনি করেন কী?’

‘সামান্য চাষবাস আছে আর জমি কেনাবেচা করি।’ দেবেনের গলা থেকে বিনীতভাবে কথাগুলো বেরিয়ে এল।

‘জমির দালালি করেন? তা আমার কাছে কেন?’

‘আপনার এতখানি জমি, প্রায় পঞ্চাশ বিঘের মতো, মিছিমিছি ফেলে রেখে দেবেন!’ দেবেনের চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল।

‘আমি তো বলিনি ফেলে রেখে দেব!’

‘তা হলে কিছু একটা করবেন।’ দেবেন এবার সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘যদি কিছু না মনে করেন স্যার তা হলে একটা কথা বলব?’

‘বলুন।’

‘আপনি যে দুধ-ঘিয়ের ব্যাবসা আর করবেন না সেটা তো গোরুমোষ বেচে দেওয়া থেকেই বোঝা গেছে। তা হলে আর কী কাজে লাগাবেন অতখানি জমি? পোলট্রি করবেন? সূর্যমুখীর বা সর্ষের চাষ করবেন? বোধ হয় নয়,আপনি চাষবাসের কিছুই জানেন না। ধরে নিচ্ছি আপনি ওই লাইনে যাবেন না। তা হলে বড়ো রাস্তা থেকে এত ভেতরে জমি নিয়ে কী করবেন? বলবেন, ফেলে রেখে দোব, আমার যা খুশি তাই করব, কেমন?’ দেবেন চুপ করে নিরীহ মুখে তাকিয়ে রইল কথার প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য।

‘হ্যাঁ ফেলে রেখে দোব।’ নগেন্দ্র গোঁয়ারের মতো প্রায় ধমকে উঠলেন। অনুক্ত রইল-তাতে আপনার কী?

দেবেনের মুখে ভাবান্তর ঘটল না। ঠান্ডা নরম গলায় সে বলল, ‘আপনি বোধ হয় অনেকদিন রাজার বাগানের দিকে যাননি । গেলে দেখতে পাবেন আপনার জমির এলাকার পুব সীমানা বরাবর গোটা তিনেক দরমার ঘর উঠে গেছে। মাসখানেকের মধ্যেই বিঘে দুয়েক জমি আপনার হাতছাড়া হয়ে যাবে। সেই জমি উদ্ধার করার মতো সাধ্যি আপনার নেই, মানে জবরদখল হলে যা যা কর্ম জমির মালিককে করতে হয় তা আপনার দ্বারা সম্ভব নয়।’

শুনেই নগেন্দ্রর মুখ শুকিয়ে গেল। তিনি শুনেছেন এই অঞ্চলে কিছু কিছু অরক্ষিত জমি জবরদখল হয়ে গেছে। আইন-পুলিশ লাগিয়েও তাদের উচ্ছেদ করা যায়নি।

নগেন্দ্র বললেন, ‘আপনি কি ইদানীং রাজার বাগানে গিয়ে দেখে এসেছেন?’

দেবেন বলল, ‘আজ্ঞে হ্যাঁ, আজ সকালেও গিয়েছিলুম। আপনি নিজে বরং একবার গিয়ে দেখে আসুন।’

‘ঠিক আছে দেখে আসব।’

‘যদি দেখেন আমি যা বললুম সব সত্যি, তা হলে কী করবেন?’

‘সেটা পরে ভেবে দেখব।’

‘তা হলে আজ আসি স্যার, পরশু এমন সময়ে আবার আসব!’

নমস্কার জানিয়ে দেবেন দোতলা থেকে নেমে যেতেই নগেন্দ্র বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

পশ্চিমের কাঁচা রাস্তা ধরে দেবেনকে চলে যেতে দেখে ঘরে এলেন। দুটি নাবালক ছেলে, ঠিকে ঝি, এক বিধবা দু-বেলা রান্না করে দিয়ে যায়, এই নিয়ে তার এখনকার সংসার। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকে বাড়িতেই বেশিরভাগ সময় থাকেন, রাজার বাগানে কী ঘটছে তার খবর তিনি রাখেন না যদিও বাড়ি থেকে দুশো গজ হাঁটলেই জমির পুব সীমানা আর তারপরই ছোট্ট গ্রামের মতন দরিদ্র লোকেদের বসত।

ছেলেরা এই সময় খেলতে যায় বরহাটের ফুটবল মাঠে, রাঁধুনি আসবে সন্ধ্যা নাগাদ, নগেন্দ্র একতলার সিঁড়ির দরজায় তালা দিয়ে বেরোলেন। ফটক বন্ধ করে রাস্তায় নেমে এগোলেন রাজার বাগানের দিকে। পোড়া গোয়াল পর্যন্ত চোখ যায় বিনা বাধায় কারণ ঘি-এর টিন বহনকারী টেম্পো চালাবার জন্য রাস্তাটা পরিষ্কার রাখতে হয়েছে। গোয়ালের পিছনে একটা ছোটো পুকুর তারপর খেজুর, বাবলা, কৃষ্ণচূড়া, বট, তেঁতুল ইত্যাদি গাছের অগোছালো সমাবেশ এবং গাছগুলিকে ঘিরে আছে ঝোপঝাড়, ফলে দূর থেকে পুকুরের ওপারটা দশ গজের পর আর দেখা যায় না।

পুকুর ধারে দাঁড়িয়ে নগেন্দ্র চেষ্টা করলেন পুবদিকে তার জমির প্রান্ত দেখার। দেখায় ব্যর্থ হয়ে পুকুরের কিনার ধরে এগোলেন, ঝরা পাতায় ঢাকা নরম মাটি মাড়িয়ে, আসশ্যাওড়া আর ফণীমনসার কাঁটা বাঁচিয়ে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন প্রায় চল্লিশ গজ দূরে তার জমির সীমানা হিসাবে চিহ্নিত বেল গাছটাকে। বেল গাছের ধারে পাশাপাশি টালির চালের দুটো দরমার ঘর। টালি আর দরমার রং দেখে বুঝলেন ঘর দুটোর বয়স খুব অল্পই। দেবেন বলেছিল ‘গোটা তিনেক’, তৃতীয় ঘরটা তিনি দেখতে পেলেন না এমনকী ঘরে বা কাছাকাছি একটা লোকও দেখতে পাচ্ছেন না। বুঝলেন ঘরে বসবাস এখনও শুরু হয়নি।

নগেন্দ্র আর এগোলেন না, ছেলেরা আর রাঁধুনি এসে দেখবে সিঁড়ির দরজায় তালা দেওয়া, ফিরে এলেন। তিনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, দেবেন তো ঠিকই বলেছে, জবরদখলের প্রথম ধাপ তো দেখেই এলেন। কিন্তু লোকটা এসব জানল কী করে! থাকে তো প্রায় আধ মাইল দূরের মঙ্গলতলিতে। রাজার বাগানে যেতে হলে তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া ছাড়া তো আর পথ নেই। নগেন্দ্রর মনে পড়ল না দেবেনকে কোনোদিন বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে দেখেছেন।

বাড়ির গেটের ভিতর দাঁড়িয়ে রাঁধুনি অপর্ণা। নগেন্দ্রকে বাড়ির বাইরে দেখে সে একটু অবাক স্বরে বলল, ‘বেড়াতে বেরিয়েছিলেন মেসোমশাই?’

‘হ্যাঁ রাজার বাগানের দিকে গেছলুম।’

সিঁড়ির দরজার তালা খুলে দোতলায় উঠতে উঠতে নগেন্দ্র বললেন, ‘অপর্ণা তুমি তো বরহাটে থাকো, পাশেই মঙ্গলতলি। ওখানে দেবেন নস্কর নামে একটা লোক থাকে, নামটা শুনেছ?’

‘না। তবে নস্করপাড়া আছে।’

‘লোকটা সম্পর্কে একটু খোঁজ নেওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে।’

দোতলায় উঠে নগেন্দ্র বললেন, ‘আগে একটু চা খাওয়াও।’ তারপর ঘরের আলো জ্বালিয়ে ট্রানজিস্টার নিয়ে বারান্দায় বসলেন। কলকাতা কেন্দ্রে পুরুষকণ্ঠে খেয়াল গান হচ্ছে। স্বর কমিয়ে তিনি শুনতে লাগলেন। ধুঁপদি গানের ব্যাকরণ তিনি জানেন না, কোনটে কী রাগ তাও বলতে পারবেন না। কণ্ঠস্বর যদি মিষ্টি হয়, সুর যদি তাঁর অনুভূতি আর স্নায়ুতে স্নিগ্ধ প্রলেপ মাখিয়ে দেয় তা হলে তিনি শোনেন।

একসময় চা নিয়ে এল অপর্ণা। পরিচ্ছন্ন কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পরনে। পৃথুলা, শ্যামবর্ণ, এক সন্তানের জননী, পরিষ্কার কথাবার্তা। গৃহস্থ পরিবারের বিধবা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, নগেন্দ্ররই বয়সি।

নগেন্দ্র চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললেন, ‘তোমার দেওরদের কাউকে দিয়ে একটু খোঁজ নেওয়াতে পারো লোকটা কেমন, কী করে?’

‘বলব খোঁজ নিতে, কী নাম বললেন, দেবেন নস্কর?’

‘আচ্ছা, তুমি কখনো রাজার বাগানের দিকে গেছ?’

‘না, তবে হীরকনগরের পাশেই তো, ওখানে যাওয়া-আসার সময় যতটকু চোখে পড়ত।’

‘এই ভেতরের রাস্তা দিয়ে গেলে রাজার বাগানে যাওয়া যায়। কাল তুমি একবার যাবে?’

‘কেন বলুন তো!’

‘ওই বাগানটা আমার তুমি বোধ হয় জানো। আজ দেবেন নস্কর নামের লোকটা আমায় এসে বলল বাগানে ঘর তুলে জমি দখল হয়েছে। আমি গিয়ে দূর থেকে দেখলুম সত্যিই ঘর উঠেছে তবে কোনো লোক দেখতে না পেয়ে আমি আর এগোলুম না। তুমি একবার গিয়ে খোঁজ নেবে কারা ঘর তুলেছে? আমি গিয়ে কথা বলতে পারতুম কিন্তু জমির মালিকের কাছে ওরা খোলসা করে মুখ খুলবে না। বরং একজন মেয়েছেলের কাছে নরম হয়ে অনেক কিছু বলে দেবে। ভেবে পাচ্ছি না এইরকম বেআইনি কাজ করার সাহস পেল কোথা থেকে, আমার মনে হয় এর পেছনে কেউ আছে।’

‘কিন্তু আমি অচেনা লোক, যারা জোরজার করে জমি দখল করে তারা মোটেই নরম প্রকৃতির হয় না, আমাকে তো ওরা গোড়াতেই খেদিয়ে দেবে।’

নগেন্দ্র চিন্তায় পড়ে গেলেন। পুলিশেই যান বা আদালতেই যান জবরদখলকারীদের পরিচয় তো প্রথমেই তাকে জানাতে হবে। এরা থাকবে এককাট্টা হয়ে। তাঁকে হয়তো মারধোর করে তাড়িয়ে দেবে।

‘মেসোমশাই একটা কাজ করতে পারি। হীরকনগরে যে বাড়িতে রান্না করতুম, সেই বাড়ির ঝি জোছনা ওখানকারই বউ, ওর কাছে গিয়ে খবর নিতে পারি।’

‘বাহ, তা হলে তো ভালোই হয়।’

পরদিন সকালে রান্নার কাজ সেরে অপর্ণা গেল হীরকনগরে। নগেন্দ্র উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকেন বিকেলে ওর না আসা পর্যন্ত।

‘মেসোমশাই, জোছনা খুব বেশি কিছু বলতে পারল না। শুধু বলল, একটা লোক ওদের বলেছে, ওই তো জমি পড়ে আছে, বনজঙ্গল হয়ে সাপখোপের বাসা তৈরি হচ্ছে, ওখানে গিয়ে ঘর তুলে থাক না। ওরা প্রথমে রাজি হয়নি, পরের জমিতে মালিকের হুকুম ছাড়া বাস করতে গেলে যদি পুলিশ কোর্ট-কাছারি করতে হয়। এরপর নাকি লোকটা বলে কোর্ট-কাছারি হলে আমি দেখব। দু-তিনজনকে টাকাপয়সা দিয়ে হাতও করে, ঘর তোলার জন্য টাকাও দেয়। এইটুকু শুধু বলল।’

নগেন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, ‘একটা লোক? আচ্ছা লোকটাকে দেখতে কেমন বলেছে?’

‘আমি অত আর জিজ্ঞাসা করিনি, সিঁড়ি মুছতে মুছতে কথা বলছিল, মনে হল না ও লোকটাকে দেখেছে তবে একটা কথা বলল, বাইরে থেকে লোক এসে জায়গাটা দেখে যাচ্ছে।’

নগেন্দ্র চুপ করে রইলেন। মনের মধ্যে উদবেগ তৈরি হচ্ছে। একটা লোক এসে উসকেছে, টাকাও দিয়েছে, দেবেন নয় তো?

‘আচ্ছা দেবেন নস্কর সম্পর্কে খোঁজ নিতে বলেছিলুম, নিয়েছ?’

‘মেজো দেওরকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম, বলল, ও লোকটা তো এ তল্লাটের নামকরা জমির দালাল। বউ ডুবে মরেছে, গ্রামের লোক বলে গলা টিপে মেরে বউকে পুকুরে ফেলে দিয়েছিল। ওর ছেলের নাম অরুণ, বছর কুড়ি বয়স, মার্ডার কেসে পুলিশ ধরেছিল,পরে খালাস পেয়ে যায়। ওই দেবেনের সঙ্গে পুলিশের খুব ভাব, আক্রার দিকে ওর অনেক জমিজমা আছে।’

অপর্ণার কথাগুলো শুনে নগেন্দ্রর মনের মধ্যে শীতল হাওয়া বইতে শুরু করে, একটা কাঁপুনি বুকের মধ্যে ওঠানামা করতে থাকে। বার বার মনে হয় আর একটা ক্ষতি এগিয়ে আসছে। একে রোধ করার ক্ষমতা তার নেই। ক্ষতিটাকে কমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছু তিনি করতে অপারগ।

পরদিন বিকেলে তিনি খালি চেয়ারটার মুখোমুখি সোফায় বসে অপেক্ষা করেন। দেবেন আসবে, আসবেই। সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাবার সময় ওর পায়ের শব্দ হয়নি, ওঠার সময়ও হবে না। নগেন্দ্র দরজার দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে যেন চমকে দিতে না পারে। অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত চোখ সিঁড়ির দিক থেকে সরিয়ে বারান্দার দিকে ফেরান আর তখনই দরজার কাছ থেকে দেবেনের গলা শোনেন, ‘স্যার আসতে পারি?’

পারলেন না, দেবেন ঠিকই চমকে দিল। নগেন্দ্র ত্রস্ত হয়ে বললেন, ‘আসুন দেবেনবাবু।’

দেবেন চেয়ারে বসে জুতো থেকে পায়ের পাতা মুক্ত করল। থ্যাবড়া, আঙুলগুলোয় অসমান নখ, গোড়ালিতে কাটা দাগ। পরনে একই জামাকাপড়।

‘গেছলেন নাকি দেখতে?’

‘একজনকে পাঠিয়েছিলুম, সে দূর থেকে দেখে এসেছে, দুটো ঘর।’ নগেন্দ্র সাবধানী হলেন।

‘আপনার নিজের যাওয়া উচিত ছিল । পরের উপর নির্ভর করে বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করা যায় না।’ দেবেনের গলায় এই প্রথম মাতব্বরি ভাব ফুটে উঠল। ‘অবশ্য জমিজমা আপনি তো কখনো হ্যান্ডেল করেননি তাই জানেনও না। এই অঞ্চলে বসত জমির এখন খুব ডিমান্ড। দেখছেন তো হীরকনগরে কীরকম চরচর করে বাড়ি উঠে গেল, কত ফ্ল্যাটবাড়ি হয়েছে, আট-দশটা মোটরগাড়ি, কত জানলায় এয়ারকুলার লাগানো। জায়গাটা দেখলে কে বলবে ওখানে ধানখেত ছিল! এ সবই কিন্তু আমার হাড়ভাঙা চেষ্টায় হয়েছে।’

‘কীরকম?’ এবার নগেন্দ্র কৌতূহলী হলেন।

‘ঠাকুরপুকুরে ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের নাম শুনেছেন?’

‘না’। নগেন্দ্র দেখলেন দেবেনের মুখে পলকের জন্য বিরক্তি ফুটেই মিলিয়ে গেল।

‘না শোনারই কথা। ওরা জমি কিনে মাটি ফেলে লেভেল করে পাকা ড্রেন তৈরি করে, জলের আর ইলেকট্রিক লাইন আনিয়ে, ধানখেতকে বসতজমি বানিয়ে প্লট করে বিক্রি করে। কোটি কোটি টাকার ব্যাবসা, শুধু কী এখানেই নাকি? বারাসাতে, দমদমে দু-দুটো ছোটোখাটো শহর বানিয়েছে। কলকাতার লোকেরা হু হু করে জমি কিনছে।’

‘আপনার হাড়ভাঙা চেষ্টাটা কীরকম?’

‘হীরকনগরের জমি তো আমিই জোগাড় করে দিলুম। ছোটো ছোটো চাষের জমি, এক-একটা জমির চার-পাঁচজন করে মালিক। ঘুরে ঘুরে বাড়ি গিয়ে সবাইকে রাজি করানো সে কী সহজ কম্মো! এক ভাগিদার এখানে থাকে তো আর একজন থাকে বিষ্টুপুরে। এ রাজি হয়তো ও বেঁকে বসে বেশি দাম চেয়ে। শেষমেশ একে টর্চ কিনে দিয়ে ওর ছেলের জন্য জুতো কিনে দিয়ে, তার বউয়ের ছেলে হবে হাসপাতালে ভরতির ব্যবস্থা করে দিয়ে রাজি করিয়েছি। একটা মোক্ষম দশ শতক মাঝের জমি শুধু একজনের জন্য আটকে গেছিল তাকে সাইকেল কিনে দিতে হয়েছে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই আছে। ছাব্বিশজনকে রেজিস্টিরি অফিসে নিয়ে যেতে হয়েছে। এসব করা কী কোম্পানির ম্যানেজার শর্মাজির পক্ষে সম্ভব ছিল?’ দেবেনের মুখে আত্মতৃপ্তির হাসি ফুটল।

‘আপনি রাজার বাগান কিনতে চান?’ নগেন্দ্র সোজাসুজি দুম করে প্রশ্নটা করলেন।

দেবেন একটুও অপ্রতিভ না হয়ে বলল, ‘হ্যাঁ।’

‘আপনি লোক দিয়ে ঘর দুটো তুলিয়েছেন আমাকে বিপদে ফেলার জন্য, ঠিক কিনা?’

‘হ্যাঁ’। দেবেনের মুখ পাথরের মতো শুধু ঠোঁটের কোণ দুটো সামান্য মোচড়ানো।

‘যদি আমি না বেচি!’

‘জমি আপনার থাকবে না। নগেনবাবু আপনি বোকা লোক নন, বিক্রি করলে কিছু টাকা পাবেন, বিক্রি না করলে একটা নয়া পয়সাও পাবেন না। ভেবে দেখুন।’

দেবেন নীচু গলায় যতটা সম্ভব সুপরামর্শ দেবার ভঙ্গিতে বললেও নগেন্দ্র অনুভব করলেন কঠিন একটা রুক্ষ পরতে কথাগুলো মোড়া। ওর কথা বলা বা চেয়ারে বসার মধ্যে ঔদ্ধত্য নেই কিন্তু প্রত্যয় ফুটে রয়েছে। নগেন্দ্র বুঝে গেলেন জমি দেবেন নেবেই।

নগেন্দ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে দেবেন বুঝে গেল জমি তার হাতে আসবে। সে আরও ঘনিষ্ঠ স্বরে বলল, ‘এই বাড়ি আর লাগোয়া কাঠা দশেক রেখে বাকিটা বিক্রি করে দিন। দুটি মাত্র তো ছেলে, আর তো কেউ নেই । ছেলে দুটি পড়াশুনোয় ভালো বলেই শুনেছি। ওরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। আপনি টাকাটা নিয়ে গরমেন্টের ঘরে রাখুন, মাসে মাসে সুদ নিন। বাকি জীবনটা নির্ঝঞ্ঝাটে কেটে যাবে। জমিটা তো বাবার কাছ থেকে পাওয়া, নিজের পরিশ্রমের টাকায় তো কেনেননি, তা হলে বরং মায়া -মমতার কথা উঠত।’

নগেন্দ্র বুঝলেন তার সম্পর্কে বেশ ভালোমতোই খোঁজখবর নিয়ে তাকে জরিপ করে দেবেন এখানে এসেছে। সে জেনে গেছে বিশাল শরীরের এই নগেন্দ্র রায়চৌধুরী নামের লোকটা আসলে তার থেকেও খাটো, কান মুলে এর কাছ থেকে জমি হাতিয়ে নেওয়া কঠিন ব্যাপার নয়। চোখ বন্ধ করলেন নগেন্দ্র অপমানটা চেপে রাখতে।

দেবেন লক্ষ করছিল নগেন্দ্রর চোখের হাবভাব। বলল, ‘আপনাকে স্যার একটুও কষ্ট করতে হবে না, শুধু জমির দলিলের একটা কপি দেবেন পরে আসলটা মাত্র একদিনের জন্য নোব, কয়েকটা স্ট্যাম্প পেপারে সই করে দেবেন, শেষ ট্যাক্সের রসিদ আছে তো? সেটাও চাই। আর একবার শুধু রেজিস্টারের অফিসে যাবেন অবশ্য যাবার আগে এখানে জমির দর এখন যা চলছে সেই মতো হিসেব করে আপনাকে টাকাটা পুরো মিটিয়ে দোব।’ যেন জমি হস্তান্তর সম্পর্কিত বোঝাপড়া হয়ে গেছে এমন নিশ্চিন্তি নিয়ে দেবেন কথাগুলো বলে গেল।

জমির দাম স্থির হয় আড়াই হাজার টাকা প্রতি বিঘা। এই দরের কথাই দেবেন বলে এবং নগেন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান। দেবেন সত্যি না মিথ্যা বলল সেটা যাচাই করতে কোনো খোঁজখবর নেওয়ার উৎসাহও বোধ করেননি। রাজার বাগানটা তার কাছে তখন অবাঞ্ছিত অপ্রয়োজনীয় পোষ্য বলে মনে হচ্ছিল, ঘাড় থেকে নামাতে পারলে বাঁচেন। জমিটা আছে বলেই দেবেনের মতো লোক বাড়ি বয়ে এসে তাকে চাপা শাসানি দিতে পারল। পরিষ্কার ব্ল্যাকমেইলিং আর এটা করতে পারল তার ভিতু ভালোমানুষি গাছাড়া স্বভাবের জন্য। নগেন্দ্র নিজের উপর ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতে থাকেন একে একে নিজের চরিত্রের ত্রুটিগুলো আবিষ্কার করে।

নগেন্দ্রর ক্রোধ আরও বেড়ে যায় যখন গাছ কাটতে আসা এক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জানতে পারেন এখানে সাড়ে তিন হাজার টাকা বিঘা পনেরো দিন আগে বিক্রি হওয়া জমিতে সে গাছ কেটেছে। নগেন্দ্রর এবারের রাগটায় প্রচণ্ড ঘৃণা মিশে গেল এবং সেটা পুষে রাখলেন দেবেন নস্করের জন্য।

টাকা দেবার জন্য দেবেনের সঙ্গে এসেছিল এক উকিল, মিহির ঘোষ। ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্টের আইন বিভাগে কাজ করে। জমিটা আসলে বেনামিতে কিনছে এরা দু-জন, ইউনাইটেড নয়। দেবেন হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘মাড়োয়ারির অনেক সেবা করেছি, অনেক টাকা লাভ করিয়ে দিয়েছি। আমি আর মিহিরবাবু তাই ঠিক করলুম এবার নিজেরাই ব্যবসায় নামব মেড়োকে কাঁচকলা দেখিয়ে।’ দেবেন গলা খুলে হেসে উঠেছিল। নগেন্দ্র চমকে ওঠেন, গলাটা ভীষণভাবে পুরুষের মতো।

তিন

নগেন্দ্র গেট খুলে বেরিয়ে এসে গেট বন্ধ করলেন। রোজ বিকেলে তিনি ঘণ্টাখানেক হাঁটেন। চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হলে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলেন। আজ দুপুর থেকে ঠান্ডা হাওয়া বইছে। গেঞ্জির ওপর সোয়েটার তার উপর পাঞ্জাবি তার উপর জড়িয়েছেন আলোয়ান। রেবা বলেছিল মাথায় উলের টুপিটা পরতে। ওটা পরলে বুড়ো-বুড়ো দেখায়। পঁচাত্তর পেরিয়ে ছিয়াত্তর হল এখনও চান ছোকরা থাকতে। নগেন্দ্র নিজের এই দুর্বলতাটা বোঝেন, মাঝে মাঝে ভাবেন এটা কাটিয়ে ওঠা দরকার। একদা ব্যায়াম করা শরীরটাকে একটু কুঁজো করে, পদক্ষেপ ছোটো করে কয়েকদিন হাঁটেন, তার পর ভুলে যান। আবার মেরুদণ্ড খাড়া হয়ে যায়, বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ছাতিটা সামনে ঠেলে ওঠে, পদক্ষেপের মাপ বেড়ে যায়।

রাস্তাটা চওড়া তিরিশ ফুট। মাঝের ষোলো ফুট পিচের। তার দু-ধারে মাটির তারপর খোলা ড্রেন। প্রত্যেক বাড়ির গেটের সামনে ড্রেনের উপর কংক্রিটের চৌকো খণ্ড বসানো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রাস্তার ওপরে রমেনের দোকানের দিকে তাকালেন নগেন্দ্র। একতলা পাকাঘর। সামনে ছোটো একটা চৌকিতে বসে পান সেজে বিক্রি করে রমেন, সবাই ডাকে রমু কিন্তু নগেন্দ্র বলেন রমেন। পানের নানান মশলা, জর্দার কৌটো, সুপুরি খয়েরগোলা, চুনের বাটি ইত্যাদি সাজানো। চৌকিতে একটা কাচের বাক্স তার দুটো তলা। একতলায় থাকে ভিজে কাপড়ে ঢাকা গোটা পান। দোতলায় দেশলাই, মোমবাতি, সিগারেটের প্যাকেট, অ্যাসপিরিন, জেলুসিল ইত্যাদি। বাক্সের উপর বসানো তিনটি বড়ো স্বচ্ছ প্লাস্টিকের বোয়েমে চকোলেট, টফি, চিউইংগাম, লজেন্স আর কাগজে মোড়া কেক। চৌকির পাশে থাক দিয়ে বসানো তিনটে সফট ড্রিঙ্কসের ক্রেট। দড়িতে চাঁদমালার মতো ঝুলছে পানপরাগের পাউচ, একটা নাইলনের ঝুড়ি তার মধ্যে নুডলসের পাউচ। চৌকির ধার দিয়ে সরু একটা ফাঁকা জায়গা পথের মতো তার পরে একটা কয়লার উনুন। ওই ফাঁকা জায়গাটা দিয়ে ভিতরে যেতে হয়, সেখানে তিনটি কাঠের টেবল। সিমেন্টের একটা রকের একধারে উনুনটা তৈরি করা। রকের উপর তারের ঝুড়িতে ডিম, ডেকচিতে ঘুগনি, পাউরুটি, কাপ, গেলাস, মাটির ভাঁড়।

দোকানের সামনে একটা বেঞ্চ, বাইরে যারা চা খেতে চায় তারা বেঞ্চে বসে খায়। শীতের দুপুরে রমেন লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বেঞ্চে চিৎ হয়ে শুয়ে খবরের কাগজ পড়ে। নগেন্দ্র বারান্দা থেকে দেখে একদিন রেবাকে বলেছিলেন, ‘ছেলেটার স্বাস্থ্যটা ভালো, গেঞ্জিটা পরলে ওকে মানায়, আমিও একসময় স্যান্ডো গেঞ্জি পরতাম।’

রেবা উঠে গিয়ে বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে রমেনকে দেখে এসে বলল, ‘ওই বগলকাটা গেঞ্জিকে স্যান্ডো গেঞ্জি বলে?’

‘হ্যাঁ, স্যান্ডো সাহেব খুব নামকরা বডি বিল্ডার ছিলেন, বোধ হয় হাঙ্গেরিয়ান, ওইরকম গেঞ্জি পরতেন বলে ওর নামেই এটা চলেছে। ছেলেটার মাসল দেখে মনে হয় একসারসাইজ করত।’

‘শুনেছি গুন্ডামি ছিনতাই করত, কেষ্ট না বিষ্টু কার দলে যেন ছিল। তারপর ওই অরুণ নস্কর ওকে এনে দোকানে বসায়। আসলে ও নাকি নস্করের বডি গার্ড, বাড়ির দরজায় দোকানদার সেজে নজর রাখে।

নগেন্দ্র অবাক হয়ে বলেন, ‘কার বডিগার্ড, অরুণের?’

‘হ্যাঁ। অরুণ শুনেছি একসময় খুনটুন করেছে, এখন নাকি একটা তোলাবাজ গুন্ডাদের দল চালায়, লোকটা যেকোনো সময় খুন হতে পারে। আপনি দেখেননি রমুর চায়ের দোকানে মাঝে মাঝে কারা ঢোকে? চেহারা দেখলেই বোঝা যায় অ্যান্টিসোশ্যাল। আচ্ছা আপনার কি একবারও মনে হয়নি এখানে এত সুন্দর সুন্দর বাড়ির আর সাজানো ঝকঝকে দোকানের মাঝে অমন কুচ্ছিত একটা চা-ওমলেট আর পান বিড়ির দোকান হল কেন?’

‘কিন্তু দোকানটা তো বেশ চলে। অনেক দরকারি জিনিস তো পাওয়া যায়। এই তো সেদিন হঠাৎ লোডশেডিং হতেই বাড়িতে মোমবাতি মোমবাতি করে খোঁজাখুজি শুরু হল, পাওয়া গেল না, শেষে রমেনের দোকান থেকে কিনে আনা হল। পান ফুরিয়ে গেলে তুমিই তো ওর দোকান থেকে পান কিনে আনিয়েছ। আমি তো ঘড়ির ব্যাটারি কিনলুম ওর কাছ থেকেই। দেখলুম সুজির বিস্কুট রয়েছে দুটো কিনে খেয়ে নিলুম। কুচ্ছিত ঠিকই তবে দরকারিও। আচ্ছা বউমা এসব কথা তুমি শুনলে কার কাছে?’

রেবা সামনের চারতলা বাড়ির দিকে আঙুল দেখিয়ে গলা নামিয়ে বলে, ‘তিনতলার সামনের ফ্ল্যাটের কল্যাণী আমাকে বলেছে। অরুণ নস্কর সোনা স্মাগেল করে, ওর ফ্ল্যাটে কিলো কিলো সোনা আর লাখ লাখ টাকার নোটের বান্ডিল লুকোনো আছে। সিঁড়িতে কোলাপসিবল গেট চব্বিশ ঘণ্টা তালা দেওয়া থাকে, একটা ডোবারম্যান কুকুর সিঁড়িতে বাঁধা থাকে। দেখেছেন তো চারতলার বারান্দা গ্রিল দিয়ে ঘেরা। ফ্ল্যাটটা একেবারে দুর্গ বানিয়ে রেখেছে, কেন?’

রেবা রহস্যে ঘিরে ফেলল ঠোঁট দুটো, দশ সেকেন্ড পর নিজেই ‘কেন’র জবাব দিল, ‘খুন হওয়ার ভয়ে। অরুণের পার্টনার ছিল শামিম নামে আর একজন স্মাগলার। তাকে খুন করিয়ে ও একাই কারবারটা দখল করে। শামিমের লোকেরা কী ওকে ছেড়ে দেবে ভেবেছেন? চার মাস আগে বউবাজারে ওকে খুনের অ্যাটেম্পট করেছিল। ফুটপাথের ধারে গাড়িতে বসেছিল তখন দুটো ছেলে হঠাৎ এসে জানালা দিয়ে তিনটে গুলি চালায়, দুটো লাগে গাড়ির সিটে আর একটা কাঁধে, খুব বেঁচে যায়। লোকটা এখন বাড়ি থেকে বেরোয়ই না।’

নগেন্দ্রর মনে হল রোজ খবরের কাগজে যা তিনি পড়েন রেবা যেন তাই পড়ে যাচ্ছে। ‘এত কাণ্ড হয়ে গেল সামনের বাড়ির লোকের অথচ কিছুই আমি জানি না!’

‘জানবেন কী করে। ওরা তো পুলিশকে জানায়নি, খবরের কাগজেও বেরোয়নি। ড্রাইভার সোজা নিয়ে যায় ওদের চেনা নার্সিংহোমে, সেটার অর্ধেক মালিক ওই অরুণ নস্কর। অপারেশন করিয়েই বাড়ি চলে আসে। কাকপক্ষীতেও জানে না এতবড়ো একটা ব্যাপার ঘটে গেল।’

‘আর জানল শুধু তোমার ওই কল্যাণী!’ নগেন্দ্রর গলায় ছিল পরিহাসের সুর।

‘আমিও প্রথমে এইরকমই ভেবেছিলুম, যা এমন করে গোপনে রাখা হল তা ও জানল কী করে? কল্যাণীকে সেটা বললুমও, তখন ও বলল পার্ক সার্কাসে নার্সিংহোমটার বাকি অর্ধেকের মালিক ওর স্বামী। বুঝলুম, এ লোকটাও সুবিধের নয়, নস্করের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্যাবসা করে তার মানে দু-নম্বরী। এক রাত্তিরে ঘরে মদ খেতে খেতে বউয়ের কাছে গলগল করে সব বলে ফেলে।’

নগেন্দ্র এই সময় বলে ওঠেন, ‘অতীন ঘরে বসে ওসব খায়টায় না তো?’

রেবা ভ্রূ কুঁচকে কঠিন চোখে তাকায় শ্বশুরের দিকে। ঠোঁট মুচড়ে বলে, ‘আমি বেঁচে থাকতে।’

আশ্বস্ত হয়ে নগেন্দ্র বললেন, ‘সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনি, রিল্যাক্স করার জন্য খেতে তো পারেই। কল্যাণী মেয়েটি কেমন?’

‘খুব সাদাসিধে সরল, বি এসসি পাশ। ছেলেপুলে নেই, কথা বলার লোক নেই। ওপরের এরাও কারোর সঙ্গে মেশে না। মেয়েটা বোরড হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে আলাপ হল পূর্ণ সরকার রোডে ব্লাউজ পিস কেনার সময়। যেচে আলাপ করল, বলল রোজ বারান্দা থেকে আমাদের দেখে।’

বারান্দা থেকে নগেন্দ্রও দেখেন তবে তিনতলা নয়, চারতলা। বাড়ির নাম ‘অরুণোদয়’। প্রতি তলায় দুটি করে তিনতলা পর্যন্ত ছ-টি ফ্ল্যাট। চারতলার পুরোটাই নস্করদের। দু-হাতে গ্রিল আঁকড়ে বিরাশি বছরের দেবেন নস্কর মাঝে মাঝে বিকেলে দাঁড়িয়ে থাকে বারান্দায়। হাঁপানি আর বাত ওর চলৎশক্তির ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। নগেন্দ্র ওকে দেখলেই মনে মনে বলেন, ঠিক হয়েছে, দীর্ঘজীবী হোক। যতই বাঁচবে বদমাইশটা ততই এই যন্ত্রণা ভোগ করবে।

দেবেন তাকে দেখে হাত নেড়ে প্রথম দিন চেঁচিয়ে কী যেন বলেছিল, বোধ হয়, ‘কেমন আছেন?’ নগেন্দ্র মুখ ফিরিয়ে রাস্তায় দুটো কুকুরের ঝগড়া করা দেখায় মন দেন। দেবেনের উপর রাগ আর ঘৃণাটা শরীর থেকে আজও তিনি বার করে দিতে পারেননি। দেবেন তার দিকে আর কখনো হাত নাড়েনি।

‘কল্যাণী কি আমাদের বাড়ি কখনো এসেছে?’

‘অনেকবার। দেখবেন কী করে! বিকেলে তো আপনি তখন বেড়াতে বেরিয়েছেন আর ওর স্বামীও তখন বেরোয় নার্সিং হোমে। ওর স্বামী পছন্দ করে না বউ বাইরে বেরোক।’

‘কেন, বউ বুঝি খুব সুন্দরী?’

‘সুন্দরী তেমন নয় তবে সুশ্রী, ফিগারটা ভালো, ছেলেপুলে হয়নি তো।’

বন্ধ গেট পিছনে রেখে নগেন্দ্র রাস্তা পার হয়ে রমেনের দোকানে এলেন। অরুণোদয়ের সীমানা ও পাঁচিল ঘেঁষে দোকানটা নস্করদের জমিতেই। দোকানের অন্য পাশে দোতলা বাড়ি উকিল মিহির ঘোষের। লোকটি মারা গেছে। তার ছেলে টিভি সেট, ওয়াশিং মেশিন ইত্যাদির দোকান দিয়েছে তারাতলায় ডায়মন্ডহারবার রোডে। দুটি সুদৃশ্য বাড়ির মাঝখানে এমন একটা দোকান সত্যিই বেমানান, নগেন্দ্র তা এখন মনে মনে স্বীকার করলেন। কয়েকটা তিন কাঠার প্লটে এখনও বাড়ি ওঠেনি। শুনেছেন জমির দর এখন নাকি কাঠাপিছু দেড় লাখ টাকা। আরও নাকি বাড়বে। পঞ্চাশ বিঘা বিক্রি করে যা পেয়েছেন তাতে তিনি এখন ‘রাজা গার্ডেনে’ এক কাঠা জমিও কিনতে পারবেন না। নামটা কে দিয়েছে, দেবেন না মিহির? যেই দিক নামটা রাজা নামের উপযুক্তই হয়ে উঠেছে।

দোকানের ভিতরে টেবলে বসে একটি লোক ঘুগনি খাচ্ছে। বাচ্চচা ছেলেটা চা ভরতি কেটলি আর হাতের আঙুলে কাপ ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল কাছেই মোজাইক টালি তৈরির কারখানার উদ্দেশ্যে। রমেন চা খাচ্ছিল গেলাসে, লম্বা একটা চুমুক দিয়ে তলানিটা রাস্তায় ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘আসুন মেসোমশাই এই একটু আগেই সুজির বিস্কুট দিয়ে গেল, আজকের তৈরি, টাটকা।’

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই রমেন প্লাস্টিকের জারটা নামিয়ে ঢাকনা খুলল, ‘ক-টা দোব?’

‘আগে একটা খেয়ে দেখি।’

রমেন একটু পুরু অমসৃণ সাবানের আকারের একটা বিস্কুট নগেন্দ্রর হাতে দিল। তিনি কামড় দিয়েই বুঝলেন রমেনের কথাই ঠিক। শক্ত মচমচে, জিভে জড়াচ্ছে না।

উৎকট শব্দ তুলে একটা মোটর বাইক দোকানের সামনে দিয়ে পূর্ণ সরকার রোডের দিকে চলে গেল। নগেন্দ্র বিরক্ত চোখে মুখ ঘুরিয়ে একবার দেখলেন। বাইক চালকের লাল-কালো ডোরাকাটা জামার পিঠ আর মাথায় কাপড়ের হলুদ ক্যাপটা দেখে বললেন, ‘কী বিশ্রী আওয়াজ করে যে যায়!’

রমেন গলা লম্বা করে তুলে তীক্ষ্ন চোখে বাইকটার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে অস্ফুটে বলল, ‘নতুন দেখছি!’

‘রমেন ঠিকই বলেছ, টাটকা।’ আঙুল থেকে সুজির গুঁড়ো ঝাড়তে ঝাড়তে নগেন্দ্র বললেন।

‘আর একটা দি?’

‘দাও। আর ঠোঙায় গোটা দশেক দাও বাড়িতে খাওয়াব, ছোটোবেলায় রোজ খেতুম, বাড়ির সামনেই একটা দোকান ছিল, সন্তাোষ বিস্কুট কোম্পানির সাইকেল ভ্যান এসে দিয়ে যেত। তবে তখনকার বিস্কুটের দু-ধারে পলকাটা নকশা থাকত।’

রমেনের হাত থেকে দ্বিতীয় বিস্কুটটা নিয়ে তিনি মুখ ফিরিয়ে দোতলার বারান্দাটা দেখে নিলেন। বউমা বা শোভা কাউকে দেখতে পেলেন না। রাস্তার ধারে পাতা বেঞ্চটায় বসলেন। রমেন বিস্কুটের ঠোঙা নিয়ে এল।

‘কত হল, বারো টাকা?’

‘হ্যাঁ, জল খাবেন?’

পূর্ণ সরকার রোডের দিক থেকে একটা অটো রিকশা আসছে। রাজা গার্ডেনের এই দিকটায় বাইরের যানবাহন বেশি আসে না, যখন আসে স্থানীয় লোক কৌতূহলে একবার তাকায়। নগেন্দ্র বিস্কুটের ঠোঙাটা পাঞ্জাবির পকেটে ভরতে ভরতে তাকালেন অটোর দিকে। রমেনও তাকিয়ে দেখে দোকানের মধ্যে ঢুকে গেল। খাবার জলের ড্রাম থেকে রমেন মগে জল তুলতেই যে লোকটি টেবলে বসে ঘুগনি খাচ্ছিল বলে উঠল, ‘আমাকেও একগ্লাস দেবেন।’

অটোরিকশাটা দোকানের সামনে গতি মন্থর করল। নগেন্দ্র তখন অন্য পকেটে হাত ঢুকিয়ে টাকা বার করছেন। তখন অটো থেকে একটা মুখ ঝুঁকে বেরোতেই নগেন্দ্র-র সঙ্গে চোখাচোখি হল। এরপরই তার কানের দু-হাত দূর দিয়ে নারকেলের মাপের গোলাকার একটা বস্তু দোকানের মধ্যে উড়ে গেল। একটা বিস্ফোরণের বিকট শব্দ হল কমলা রঙের ঝলক দিয়ে। ঝাঁকুনি দিয়ে গতি বাড়িয়ে অটোরিকশাটি হীরকনগরের দিকে ঊর্ধ্বশ্বাসে চলে গেল। দোকানের ভিতরটা ধোঁয়ায় অন্ধকার, গন্ধকের কটু গন্ধে ভরপুর চারদিক। দোকানের মধ্য থেকে চিৎকার করতে করতে বেরিয়ে এল রমেন দু-হাত বাড়িয়ে। তার হাওয়াই শার্ট পুড়ে গেছে, কালো ছোপ ধরা তার একটা টুকরো কাঁধ থেকে ঝুলছে, দুই হাঁটু থেকে প্যান্টের নীচের অংশ নেই। মাথা নাক আর মুখ থেকে রক্ত ঝরে পড়েছে। হাতে পায়ে ঝলসানোর চিহ্ন। সারা মুখে কালি মাখা। দোকানের বাইরে ছুটে এসেই লুটিয়ে পড়ল নগেন্দ্রর পায়ের কাছে। মুখ তুলে ঘড়ঘড়ে স্বরে বলল, ‘মেসোমশাই।’ এরপরই কপালটা মাটিতে ঠুকে পড়ে যায়।

নগেন্দ্র পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে। চেতনা বলে তার এখন কিছু নেই। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না, শুনতেও না। থরথরিয়ে কাঁপছে দুটো পা। বুকের মধ্য থেকে ক্ষীণ একটা আওয়াজ বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু আটকে যাচ্ছে গলার কাছে। মাথা নামিয়ে তাকিয়ে রইলেন। একটা মানুষ শুয়ে আছে দেখে চেনার চেষ্টা করে অবশেষে চিনতে পেরে ধীরে ধীরে বেঞ্চে বসে পড়লেন।

বিস্ফোরণের পনেরো সেকেন্ড পর আশেপাশের বারান্দা ও জানলায় লোক জমতে শুরু করে। রাস্তায় যারা ছিল তারা প্রথমে ভয়ে ছুটে পালাতে যায়। যখন দেখল এক বৃদ্ধ একা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তখন কৌতূহল চাপতে না পেরে এগিয়ে এল, ততক্ষণে অটো রিকশাটা অদৃশ্য হয়ে গেছে।

রেবা আর শোভা বারান্দা থেকে দোকানের দিকে তাকিয়ে আলোয়ান গায়ে জড়ানো নগেন্দ্র এবং তার সামনে উপুড় হয়ে থাকা রমেনকে দেখেই দু-জনে চিৎকার করে উঠে একসঙ্গেই সিঁড়ির দিকে ছুটল। গেট থেকে দু-জনে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে দু-পাশ থেকে নগেন্দ্রকে ধরে বেঞ্চ থেকে তুলল।

‘বাবা লাগেনি তো?’ রেবার দৃষ্টি শ্বশুরের পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওঠানামা করল। আশ্বস্ত হয়ে বলল, ‘আর এখানে নয় বাড়ি চলুন। শোভা ওই হাতটা ধরো বাবা কাঁপছেন।’

তারা দুই বাহু ধরে তাকে ধীরে ধীরে দোতলায় তুলে এনে বিছানায় শুইয়ে প্রথমেই বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে বাইরের ঘটনা থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে নিল। শীতকাল কিন্তু নগেন্দ্র ঘামছেন।

‘বাবা পাখা চালাব?’

‘হুঁ’। নগেন্দ্র চোখ বুজে বললেন।

পাখা চালিয়ে দিয়ে শোভা বলল, ‘মেসোমশাইকে দুধ গরম করে দোব বউদি?’

নগেন্দ্র পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে ঠোঙাটা বার করলেন। সেটা রেবার হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমাদের সবার জন্য কিনেছিলুম, কীর্তি বলেছিল সে কখনো খায়নি।’

ঠোঙার মুখ খুলে ভিতরটা দেখে রেবা বলল, ‘অনেকগুলো ভেঙে গেছে। গরম দুধ খেলে শরীরে জোর পাবেন, খাবেন?’

‘বলছ? দাও। খুব বাঁচান বেঁচে গেলুম। আলোটা জ্বালো ঘরটা অন্ধকার লাগছে।’

শোভা আলো জ্বেলে বেরিয়ে গেল দুধ গরম করে আনতে। রেবা লক্ষ করল নগেন্দ্রর হাতের আঙুল এখনও কাঁপছে। আলোয়ানটা গা থেকে সরিয়ে দিয়ে সে শ্বশুরের বুকে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

‘বাইরে নিশ্চয় খুব হইহই হচ্ছে।’

‘হবেই তো। বাইশ বছর হল এখানে আছি এমন ব্যাপার আগে কখনো দেখিনি। বোমাটা যদি আপনার গায়ে লাগত!’

‘তাই ভাবছি, ছেলেটা বেশ এক্সপার্ট, হাতের টিপটাও ভালো।’ নগেন্দ্রর গলায় প্রাণরক্ষা পাওয়ার জন্য ছেলেটির প্রতি কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠল। ‘যদি হাতটা কেঁপে একটু এধার-ওধার হয়ে যেত, ভাবো তো! ঠিক টিপ করে আমার কানের পাশ দিয়ে ছুড়ে দিল, টার্গেট ছিল রমেন। ভালো কথা রমেনটা বেঁচে আছে কি না একটু দেখো তো। যেভাবে বেরিয়ে এল, দেখে তো ভয় লেগে গেছল।’

রেবা বারান্দায় গিয়ে দেখে এসে বলল, ‘রমেনকে তো দেখতে পেলুম না, বোধ হয় হাসপাতালে নিয়ে গেছে। খুব ভিড় জমেছে।’

‘ভেতরে তখন একটা লোক খাচ্ছিল। তার কী হল কে জানে। পুলিশ দেখলে?’

‘না। এরমধ্যেই কী আসবে! আর এখন এসে করবেই বা কী? একে তাকে বাঁধা গতে জিজ্ঞাসা করবে, কেউ তো দেখেইনি এক আপনি ছাড়া।’

‘আমাকে জিজ্ঞাসা করবে!’ নগেন্দ্র অবাক হয়ে রেবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কী জিজ্ঞাসা করবে?’

নিরুৎসুক স্বরে রেবা বলল, ‘কী আবার করবে, তখন আপনি কোথায় ছিলেন, রমেন কী করছিল, বোমা যে ছুড়ল তাকে দেখেছেন কি না-।’

‘হ্যাঁ একটুখানি অবশ্য মুখটা দেখেছি।’

‘অ্যাঁ দেখেছেন! চেনেন তাকে?’ রেবার স্বর সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল।

‘চিনব কী করে, আগে তো কখনো দেখিইনি।’

‘আবার দেখলে কি চিনতে পারবেন?’ একটু ঝুঁকে রেবা বলল।

‘বোধ হয় পারব, মুখটায় অনেকটা কীর্তির আদল আছে।’

রেবার মুখ দপ করে অপ্রতিভ হয়েই গম্ভীর হয়ে গেল। ‘এসব কথা পুলিশকে কখনো বলতে যাবেন না। বলবেন, কে ছুড়ল জানি না, তাকে চোখেও দেখিনি। চিনতে পারব বললেই আপনাকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবে পুলিশ আর গুন্ডারাও তখন আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না।’

নগেন্দ্র লক্ষ করলেন নীচু গলায় বলতে বলতে রেবার স্বর ধমকের মতো কর্কশ হয়ে উঠল। বুঝতে পারলেন কীর্তি শব্দটা তার উচ্চচারণ করা উচিত হয়নি। কিন্তু মুখটা ছিল অল্পবয়সি ছেলের আর সব অল্পবয়সিদের মুখেই কীরকম একটা যেন বেপরোয়া ভাবের ছাপ থাকে, কীর্তিরও আছে তাই ওর নামটাই মুখ থেকে বেরিয়ে এল। লজ্জিত হয়ে পড়লেন নগেন্দ্র, অন্য কারোর নাম মুখে এল না কেন?

‘অনেকটা আদল আছে বললে কী আর সত্যিসত্যিই মুখটা হুবহু হয়ে যায়? দেখেছি তো মোটে তিন কী চার সেকেন্ড।’ নগেন্দ্র আশ্বস্ত করার চেষ্টায় রেবাকে বললেন। রেবার মুখের অন্ধকার তাইতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল না।

কাচের গ্লাসে গরম দুধ নিয়ে এল শোভা। উঠে বসে হাত বাড়ালেন নগেন্দ্র, দেখলেন তার আঙুলগুলো কাঁপছে। ‘বড্ড গরম, জলের বাটিতে বসিয়ে ঠান্ডা করে আন। বউমা প্রেশারটা বোধ হয় বেড়েছে।’

গ্লাস এগিয়ে দিতেই রেবা সেটা নগেন্দ্রর হাত থেকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বলল, ‘ওকে একটা ফোন করে তাড়াতাড়ি আসতে বলি।’

‘শোভা বারান্দায় গিয়ে দ্যাখ তো পুলিশ-টুলিশ এল কিনা।’

শোভা বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ পর ঘরে ফিরে এসে বলল, ‘মেলা লোক মেসোমশাই, পুলিশের জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে। দারোগা মতন একটা লোক কথা বলছে সামনের বাড়ির চারতলার নস্করবাবুর সঙ্গে। এখনও কী গন্ধ রয়েছে। সারা পাড়া ঝেঁটিয়ে লোক জড়ো হয়েছে। আচ্ছা মেসোমশাই বোমাটা মারল কেন বলুন তো?’

‘তা আমি কী করে বলব! নিশ্চয় কোনো কারণ আছে, শুধু শুধু কী আর এমন কাজ করে কেউ? দ্যাখ দুধটা ঠান্ডা হল কি না।’

শোভা বেরিয়ে যেতেই নগেন্দ্র বারান্দার দরজার কাছে এসে বাইরে উঁকি দিয়ে তাকালেন। একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়াল। স্ট্রেচার নিয়ে দুটো লোক দোকানের ভিতর ঢুকল। উর্দি পরা কোমরে পিস্তল এক ছোকরা অফিসার দোকানের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল অরুণ নস্করকে সঙ্গে নিয়ে। রাইফেল হাতে দু-জন পুলিশ জিপের পিছনে বসে, ওদের কিছু করার নেই। স্ট্রেচারে একটা নিথর মানুষকে বহন করে এনে তাকে অ্যাম্বুলেন্সের গাড়িতে তুলে দিল। নগেন্দ্রর মুখচেনা পাড়ার একটি কিশোর অফিসারকে কিছু একটা বলল, অফিসার মুখ তুলে বারান্দার দিকে তাকাল।

‘বাবা আপনাকে এখন শুয়ে থাকতে বলল আপনার ছেলে।’ হাতে দুধের গ্লাস নিয়ে রেবা তখনই ঘরে ঢুকে বলল।

‘বউমা পুলিশ বোধ হয় জিজ্ঞেস করতে আসছে।’ গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললেন নগেন্দ্র।

শীতকালের বিকেল তাড়াতাড়ি শেষ হয়। বাইরে আবছা একটা ভাব জানিয়ে দিচ্ছে সন্ধ্যা এবার নামতে আসছে। রমেনের দোকানের সামনে কঅন্তত জনা ত্রিশেক নানা বয়সি লোকের ভিড়, তার মধ্যে কিছু স্ত্রীলোক। পথচলতি লোকেরা কৌতূহলে দাঁড়িয়ে গিয়ে ব্যাপার কী জানার চেষ্টা করছে। প্রত্যেকেরই মুখে বিস্ময়: ‘রমেনকে বোমা মারল কেন! এতদিন দোকান চালাচ্ছে, কারোর সঙ্গে সামান্য একটা কথা কাটাকাটি হয়েছে বলেও কেউ জানে না। পয়সা কম পড়ে গেলে বলত, ঠিক আছে পরে দিয়ে যাবেন। আর এমন লোককে কি না-!’

দগ্ধ রমেনকে যাঁরা দেখেছে তাঁদেরই ঘিরে আগ্রহটা বেশি। বিশেষ করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যে বর্ণনা দিচ্ছে তার কাছেই শ্রোতার সংখ্যা বেশি। কীভাবে চোখ দুটো ঠেলে বেরিয়ে এসেছে, মুখের মাংস গলে হাড় বেরিয়ে পড়েছে, হাতের দুটো কবজি থেকে তালু নিশ্চিহ্ন, মাথার চুল পুড়ে গিয়ে খামচা খামচা টাক, পিঠে দগদগে ফোস্কা ইত্যাদির ছবি শ্রোতাদের স্মৃতিপটে নানান রংয়ের শব্দে আঁকা হয়ে গেল। এতসবের পরেও একটা প্রশ্নের উত্তর তারা পেল না-এমন নির্বিরোধী লোককে মারার জন্য কারা এবং কেন বোমা ছুড়ল?’

উত্তরটা কল্যাণী মারফত রেবা এবং তার কাছ থেকে নগেন্দ্র কিছুদিন আগে আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। এরপর রমেন সম্পর্কে তিনি কৌতূহলবোধ করতে থাকেন। রোজই বেড়াতে যাবার আগে কিছু একটা কেনার ছলে রমেনের সঙ্গে গল্প ফাঁদার চেষ্টা করেছেন।

পরশুদিনই তিনি বলেছিলেন, ‘রমেন পানপরাগ খুব খারাপ জিনিস, খেলে মুখের ক্যানসার হয়, বিক্রি করো কেন?’

‘লোকে খেতে চায় তাই বেচি। তারা যদি ক্যানসার চায় আমি কী করব!’

রমেন হাসতে হাসতে বলেছিল। ‘সিগারেট খেলেও তো ক্যানসার হয়, আজ সকাল থেকে এগারো প্যাকেট বেচেছি। আমাকেও তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে। মেসোমশাই, মরুক মরুক, দেশে এত লোক বেড়ে গেছে যে হাঁপ ধরে যায়, দম ফেলতে কষ্ট হয়, এবার লোক একটু কমুক।’

‘লোক কমলে তো তোমারও রোজগার কমবে। এখন দিনে যা হাতে থাকে সেটা কত?’

রমেন ইতস্তত না করেই বলেছিল, ‘সব মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশেক টাকা তো আমার থাকে।’

‘বিয়ে করেছ?’

‘নাঃ।’

‘করে ফ্যালো।’

‘মেসোমশাই, এত কম টাকায় দুটো লোকের চলে না, দুটো থেকে তো তিনটে-চারটে হবে, খাওয়াব কী? একটু ভদ্রভাবে বাঁচতে হলে এই রোজগারে বিয়ে করা চলবে না।’

একদিন নগেন্দ্র দেখলেন রমেনকে একটা বোতল থেকে জল খেতে। বোতলের গায়ে সাঁটা লেবেলটা দেখে বললেন, ‘রমেন এটা তো মদের বোতল, তুমি খাও নাকি?’

‘বিশ্বাস করুন মেসোমশাই আমি খাই না। বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসে, এখানে বসে খায়। আমি সোডা আর গেলাস দিই। আমার কোনো কিছুর নেশা নেই, মাঝেমধ্যে এক-আধটা পান খাই, ব্যস।’

অল্প গরম দুধ নগেন্দ্র এক চুমুকে শেষ করলেন আর তখনই দরজায় বেজে উঠল সুরেলা হারমোনিকা। শ্বশুরের মুখের দিকে তাকিয়ে রেবা দরজা খুলতে গেল। নগেন্দ্র আলতোভাবে খাটে গড়িয়ে আলোয়ানটা গায়ে বিছিয়ে নিলেন। বাইরে কথা বলার শব্দ হচ্ছে। ঘরে এল রেবা, তার পিছনে উর্দি পরা পুলিশ অফিসারটি, তাকে দেখে নগেন্দ্রর মনে হল অল্পদিনই থানায় এসেছে। মনে হওয়ার কারণ, ছেলেটির ভুঁড়ি নেই। সঙ্গে রয়েছে পোড়খাওয়া মুখের সাধারণ পোশাকের একজন পুলিশ।

‘বাবা ইনি আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান। আমি বলেছি আপনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, প্রেশার বেড়ে গেছে।’

‘বাড়াটা স্বাভাবিক।’ তরুণ অফিসার সহৃদয় নম্র গলায় বলল, ‘দু-মিনিট আপনাকে বিরক্ত করব। ঘটনার সময় আপনিই একমাত্র স্পটে ছিলেন। ঠিক কী কী ঘটল সেটা বলুন। দোকানে কখন আসেন?’

‘বোমাটা ফাটার মিনিট পাঁচ-ছয় আগে। একটা বিস্কুট খেলুম। রমেন আর একটা দিল সেটা খাচ্ছি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে, তখন রমেন বলল জল খাবেন? বললুম দাও। ও দোকানের ভেতর ঢুকল জল আনতে। ঠিক তখনই একটা অটোরিকশা এল।’

‘কোনদিক থেকে এল?’

‘পূর্ণ সরকার রোডের দিক থেকে। ওরকম কতই তো অটো যায় আসে, আমি আর তাকাইনি। রমেন জল আনতে ভেতরে গেছে, ওই দিকেই তাকিয়ে রয়েছি, আর তখনই আমার কানের পাশ দিয়ে কী যেন একটা উড়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে গেল, তারপরই প্রচণ্ড শব্দ।’

‘অটোয় ক-জন ছিল বলে মনে হয় আপনার?’

‘বলতে পারব না।’

‘কারোর মুখ কি দেখতে পেয়েছেন?’

নগেন্দ্রর চোখ রেবার মুখের দিকে সরে গেল। একদৃষ্টে তাকিয়ে নিথর হয়ে আছে মুখ, শুধু ওঠানামা করল গলার নলিটা।

‘দেখা সম্ভব ছিল না, আমি তাকিয়ে ছিলুম দোকানের দিকে, অটোটা ছিল আমার পিছনে।’

‘অটোটা তারপর ফুলস্পিডে পালাল, কেমন?’

‘হ্যাঁ’, হীরকনগরের দিকে।’

‘আর কিছু দেখেছেন কি অটো আসার আগে? কোনো অপরিচিত লোকজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছেন দোকানের সামনে?’

‘না, কাউকে ঘোরাঘুরি করতে দেখিনি।’

সাধারণ পোশাকের পুলিশটি জিজ্ঞাসা করল, ‘অটোর নাম্বারটা দেখেছেন কি, মানে প্রথম দিকের অন্তত গোটা দুয়েক নাম্বার চোখে পড়ে মনে থেকে যেতে পারে তো।’

‘তখন কিছু দেখার মতো অবস্থা আমার ছিল না।’ নগেন্দ্রর স্বরে ক্লান্তি ফুটে উঠল। ‘আচ্ছা তখন একটা লোক ভেতরে বসে খাচ্ছিল, সে কি বেঁচে আছে?’

‘স্পট ডেড। রমেনও দেখে মনে হল বাঁচবে কি না বলতে পারছি না।’

পুলিশ দু-জন চলে যেতেই নগেন্দ্র পুত্রবধূর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। রেবা চোখের পাতা নামিয়ে আবার তুলল, উজ্জ্বল চোখের মণি।

‘কী বুঝলে? প্রশ্নের ধরন দেখে মনে তো হল না ওরা খুব গুরুত্ব দিচ্ছে ঘটনাটায়, হামেশাই তো এসব ঘটছে।’

‘ভয় করছিল, এই বুঝি বলে বসেন কীতুর সঙ্গে মিল আছে মুখের আদলের।’

‘বললে কী হত? ওরা কি বিশ্বাস করত অটোয় কীর্তি ছিল?’

‘পুলিশকে বিশ্বাস নেই। ধরে নিয়ে গিয়ে হাজতে তো আগে পুরে দিত, তারপর তদন্তটদন্ত, মারধোর করে সাতঘাটের জল খাইয়ে ছাড়ত।’

‘তুমি কী করে ভাবলে আমার বুদ্ধিটা মোটা, নিজের নাতিকে বিপদে ফেলে দিতে পারি!’

রেবা বলল, ‘বুদ্ধি মোটার কথা উঠছে কেন, দরকারের থেকে বেশি কথা তো আপনি বলেনই।’

নগেন্দ্র গম্ভীর হয়ে গেলেন। এর আগেও তিনি রেবাকে বলতে শুনেছেন, বুড়ো হলে মানুষ একটু বেশি বকে। ইদানীং তার মনে হয় সংসারের এক নম্বর জায়গাটা থেকে রেবা একটু-একটু করে তাকে হটিয়ে দিচ্ছে। অনেক কিছুই রেবা এখন আর তাকে জানায় না যেমন, সামনের বাড়ির কল্যাণীর সঙ্গে আলাপ হওয়া, তার কাছ থেকে অরুণ নস্কর সম্পর্কে যেসব কথা শুনেছে প্রথমে তা জানায়নি, পরে কথায় কথায় একদিন বলে ফেলে। নগেন্দ্র তখন বলেন, ‘এগুলো আমাকে তুমি আগে জানাওনি?’ রেবা বলেছিল, ‘আগে জেনে আপনার কী লাভ হত?’ ওর গলার স্বরে হালকা তাচ্ছিল্য আর উপেক্ষা মিশে এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে যাতে নগেন্দ্রর নিজেকে গুরুত্বহীন মনে হয়, পরে ভেবে দেখেন রেবা ঠিকই তো বলেছে, জেনে আমি কী করতুম? একটা লোক কাঁধে গুলি খেয়ে যদি পুলিশকে তা না জানায় সেটা তার ব্যাপার, আমার তাই নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ কী?

মিনিট পনেরোর মধ্যেই অতীন বাড়িতে এসে গেল। এসেই বাবার ঘরে ঢুকল, হাতে একটা অ্যাটাচি কেস। সেটা বিছানায় রেখে স্থির চোখে দশ-বারো সেকেন্ড নগেন্দ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘শরীর কেমন লাগছে?’

নগেন্দ্র মনে মনে বললেন, বিধান রায় হতে চাস তো তুই-ই বলে দে কেমন আছি, অতক্ষণ তো মুখটা দেখলি। অতীন অ্যাটাচি থেকে ব্লাডপ্রেশার মাপার যন্ত্রটা বার করে বলল, ‘শুয়ে পড়ো।’

পাঞ্জাবির ডান হাতটা গুটোতে গুটোতে নগেন্দ্র তাকালেন অ্যাটাচি কেসটার দিকে। একবার অতীনকে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁরে তুই আপিস যাচ্ছিস না রুগি দেখতে যাচ্ছিস? আমাদের ছোটোবেলায় ডাক্তার চিনতুম হাতের ব্যাগ দেখে।’ শুনে অতীন হেসেছিল, জবাব দেয়নি।

যন্ত্রের দিকে ভ্রূকুটি করে অতীন প্রেশার মাপছে আর নগেন্দ্র তখন ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে চাইছিলেন সে কতটা উদবিগ্ন বাবার সুস্থতা সম্পর্কে। অতীনের চোখের ভাব দেখে বুঝলেন গুরুতর নয়। প্রফুল্ল কণ্ঠে জানতে চাইলেন, ‘নীচেরটা কত?’

‘বেশি। একশোর কাছাকাছি।’ যন্ত্রটা গুছিয়ে রাখতে রাখতে অতীন বলল।

পাশে দাঁড়ানো রেবা বলল, ‘নর্ম্যালের অনেক উপরে!’

নগেন্দ্র আবার জানতে চাইলেন, ‘ওপরেরটা?’

‘ওটাও বেশি। এখন শুয়ে থাকো। কাল সকালে আবার দেখব।’

অ্যাটাচি কেসটা তুলে নিয়ে অতীন ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সঙ্গে রেবা। এখন অতীন যা কিছু ঘটেছে খুঁটে খুঁটে সবিস্তারে শুনবে বউয়ের কাছ থেকে। আজ ওর অর্ধেক রোজগার নষ্ট হল। কীর্তিটা এখনও কিছুই জানে না। কলেজ থেকে বেরিয়ে সোজা চলে যায় প্রাইভেট টিউটরের বাড়ি। কেমিস্ট্রিতে ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া এক প্রাক্তন অধ্যাপকের কাছে ও পড়ে এবং ওর মতো আরও আটজন, সপ্তাহে দু-দিন। পড়ার পর কীর্তি নিউ আলিপুরে একটা ক্লাবে যায় টেবল টেনিস খেলতে। এই বছরই তিনটে টুর্নামেন্টের দুটোয় সে সেমিফাইনালে উঠে হেরেছে বাংলার তিন ও চার নম্বরের কাছে। নগেন্দ্রর ধারণা প্রতিভা বিচারে পড়াশুনো আর টেবিল টেনিস দুটোতেই তার নাতি সমান সমান।

একটু পরেই কীর্তি বাড়ি ফিরল। পিঠে একটা কালো বস্তার মতো স্যাচেল। তাতে বইখাতাপত্তর, টেবল টেনিস ব্যাট, জলের বোতল আর খাবারের বাক্স। দরজা থেকে ভিতরে পা দিয়েই চেঁচিয়ে উঠল, ‘দাদু নাকি মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে এসেছে, টেরিফিক! কোথায় দাদু?’

বলতে বলতে ঘরে ঢুকল কীর্তি। পৌনে ছ-ফুট লম্বা, চওড়া কপালের উপর নেমে এসেছে ঝুরো চুল। আয়ত চোখ, কোমরের থেকে কাঁধ চওড়া, গায়ের রং তো বটেই মুখের আদলটিও মায়ের মতো, গায়ে ফুলহাতা নীল সোয়েটার। কীর্তির উত্তেজিত মুখের দিকে তাকিয়ে নগেন্দ্রর মনে হল, আমি তো বলতে পারতুম, বউমা অটোয় যে মুখটা দেখেছিলুম তার আদল অনেকটা তোমার মতো।

‘রাস্তায় কান্তু বলল, তোর দাদু আজ মরে যেত, সত্যি? দেখলুম রমেনদার দোকানের ভেতরটা চুরমার, বোমাটা খুব পাওয়ারফুল ছিল। আজই চিউইংগাম কিনলুম কলেজ যাওয়ার সময়, আমার দরকার ছিল বাস ভাড়ার জন্য খুচরোর তাই দশ টাকার নোট দিলুম। চারটে টাকা ফেরত দিয়ে রমেনদা বলল, বাকিটা পরে নিয়ো।’ পিঠ থেকে স্যাচেলটা নামিয়ে সে টেবলের উপর রেখে বলল, ‘আর নেওয়া, কোনোদিনই বাকিটা আর পাব না।’

নগেন্দ্রর এতক্ষণে মনে পড়ল বিস্কুটের জন্য বারোটা টাকা রমেনকে দেওয়া হয়নি। ‘জানিস কীর্তি বারোটা বিস্কুট কিনেছি রমেনের কাছ থেকে, দাম দোবো বলে পকেটে হাত ঢুকিয়েছি টাকা বার করছি আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড শব্দটা হল। টাকাটা আর রমেনকে দেওয়া হল না। আর কোনোদিনই দেওয়া হবে না। একে তুই কী বলবি?’

আঠারো বছরের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র কীর্তিনারায়ণ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী বলব মানে? সিম্পল ব্যাপার, শোধবোধ হয়ে গেল! দু-টাকার চিউংগাম কিনেছি আমি ফেরত পেতুম আট টাকা দিয়েছে চার টাকা তার মানে এখনও আমি পাব চার টাকা আর তোমার কাছ থেকে রমেনদা পাবে বারো টাকা। ওহ দাদু, এখনও রমেনদার কাছে আট টাকা ধার রয়ে গেল আমাদের।’

নগেন্দ্র লক্ষ করলেন তার টিনএজার নাতির মুখে দেনার দায়টা লজ্জার ছাপ এঁকে দিয়েছে। এই ছাপটা তার বা তার ছেলের বউয়ের মুখে পড়বে কি? তিনি নিশ্চিত নন। আটটা টাকা কেনো ব্যাপারই নয় কিন্তু দেনাটা?

নগেন্দ্র বললেন, ‘দাদু ভাগ্য মানিস?’

ইতস্তত করে কীর্তি বলল, ‘একটু একটু।’

‘আমি কিন্তু মানি। জীবনে এমন সব ঘটনা ঘটে যা তোর ধারণা বা বিশ্বাসকে টলিয়ে দিয়ে যাবে। এইসব ঘটনার ওপর তোর কোনো হাত নেই, কন্ট্রোল নেই। তোর ঠাকুমার মৃত্যু, আমার ভাইয়ের মৃত্যু, গোশালায় আগুন লাগা পরপর এইসব ঘটনা আমাকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আজকের এই ব্যাপারটাকে যদি ভাগ্যের জোরে বেঁচে যাওয়া মনে করি তা হলে তো ভাগ্যকেই আমি আঁকড়ে ধরব, ঠিক ভেবেছি?’

‘অফকোর্স! তোমার তো মরে যাওয়ারই কথা অথচ স্টিল বেঁচে আছ! আই অ্যাম রিয়্যালি ফরচুনেট।’

নগেন্দ্র অবাক হয়ে বললেন, ‘ফরচুনেট বললি কেন?’

ঘরে ঢুকল রেবা। শেষের কথাটা সে শুনেছে,বলল, ‘ফরচুনেটই তো, বাবা আপনার তো বেঁচে যাওয়ার কথাই নয়।’

কীর্তি মায়ের ভুল ধরাতে বলল, ‘দাদু ফরচুনেট বলিনি, বললুম আমি ফরচুনেট।’

‘কেন তুই ফরচুনেট!’ রেবা ধাঁধায় পড়ে যাওয়ার মতো করে তাকাল।

‘সকালে চিউইংগাম কেনার সময় যদি বোমাটা মারত! আমি আর রমেনদা তো মুখোমুখি তখন।’ কীর্তি হঠাৎ তেঁতুল খেয়ে ফেলার মতো শিউরে উঠল, ‘উ উ উ উ ভাবা যায় না।’

ধমকে উঠে রেবা বলল,’এটা ঠাট্টা করার মতো ব্যাপার নয় কীতু। যা নিজের ঘরে জামাপ্যান্ট বদলা।’

তক্ষুনি কীর্তি সোয়েটার খুলে জামাটাও খুলল। ভিতরে গোল গলা সাদা গেঞ্জি। তারপর গায়ের স্নিকার খুলে প্যান্টটা খুলল,ভিতরে কালো শর্টস। এটা তার টেবল টেনিস খেলার পোশাক। এইসব খোলাখুলির সঙ্গে সঙ্গে সে কথা বলে যাচ্ছিল, ‘রোববারে দাদুর পুনর্জন্মটা সেলিব্রেট করতে হবে না, একটা দারুণ খাওয়ার ব্যবস্থা করো। আমি বাজার যাব।’

নগেন্দ্রর মনে পড়ে গেল কীর্তি ক্লাসের একটা মেয়েকে বাড়িতে খাওয়াতে চায় এবং সেই মেয়েটি সকালে ফোন করেছিল কীর্তি কলেজে বেরিয়ে যাবার একটু পরেই।

‘কীর্তি, তোর মা বলল, একটি মেয়েকে তুই বাড়িতে নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে চেয়েছিস? বোধ হয় সেই মেয়েটিই সকালে তোকে ফোন করেছিল, নামটা কী বউমা?’

‘ক্ষণপ্রভা।’

‘নামটার মানে জানিস?’ নগেন্দ্র বললেন।

‘বিদ্যুৎ।’ ব্যস্তভাবে বলেই সে জানতে চাইল ‘ক্ষণা কি কিছু বলেছে? তিনদিন কলেজে আসেনি।’

ছেলের মুখ লক্ষ করে রেবা বলল, ‘তোকে ফোন করতে বলেছে।’

নগেন্দ্র বললেন, ‘তোর মা যদি রোববারে আমাদের খাওয়ায় তা হলে ওকেও বলে দিস।’

কীর্তি জুতো জামাপ্যান্ট আর স্যাচেল নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘বলব।’

তিনতলার ছাদে যাবার সিঁড়ির মাঝামাঝি এগারো ধাপ উঠলে কীর্তির নিজস্ব ঘর। খাট টেবল চেয়ার আলনা, পাখা আর বই রাখার ছোট্ট একটা র‌্যাক। এই আসবাবগুলি ছাড়া ঘরে আর আছে রেডিয়ো-কাম-ক্যাসেট প্লেয়ার। ঘরে দুটি ছোটো জানলা।

কীর্তি ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার পর নগেন্দ্র বললেন, ‘রমেনের খবরটা নিলে ভালো হয়, বাঁচবে কি না কে জানে? কোন হাসপাতালে নিয়ে গেল তাও তো জানি না।’

‘জেনে আর এখন কী হবে, যে অবস্থায় নিয়ে গেল তাতে তো বাঁচার কথা নয়। আপনি কিন্তু দু-দিন বাড়ি থেকে বেরোবেন না। আপনার ছেলে বলল বাবাকে ওষুধ খেতে হবে আর ব্লাডসুগারটাও টেস্ট করাতে হবে।’

‘সুগার? আমি তো দিব্যিই আছি!’

‘মনে হয় দিব্যি আছেন, টেস্ট করলে দেখা যাবে দিব্যি নেই। কালকেই করিয়ে ফেলুন। উনি এক্ষুনি ফোন করে দিচ্ছেন কাল লোক এসে ব্লাড নিয়ে যাবে।’

রেবা নিজের ঘরে ফিরে এসে দেখল অতীন বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে। ট্রানজিস্টারে পুরুষকণ্ঠে বাউল গান হচ্ছে নীচু স্বরে।

‘বাবার সুগার টেস্ট কালই করিয়ে দাও। তুমি বোস প্যাথোলজিতে এক্ষুনি ফোন করে বলে দাও কাল সকাল ন-টায় ব্লাড নিতে যেন লোক পাঠায়।’ রেবা খাটে বসল অতীনের গা ঘেঁষে। দরজার দিকে তাকিয়ে উঠে গিয়ে পর্দাটা ভালো করে টেনে দিয়ে ফিরে এসে আগের মতো বসল। ‘আজ দুপুরে বাবা অদ্ভুত একটা কথা বললেন।’

অতীন পাশ ফিরে ডান হাত রেবার ঊরুর উপর রেখে বলল, ‘কী কথা?’

‘এই কিডনির অসুখের কথা। ম্যাগাজিনে পড়ছিলেন। বললেন, কিডনি যখন আর কোনোমতে কাজ করে না তখন মরা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। আমি কেন ডায়ালিসিস করে বাঁচব। তাতে উনি যা হিসেব দিলেন খরচ হবে বছরে প্রায় দু লাখ টাকা। বললেন আমার ওই রোগ হলে বড়োজোর তিন বছর পর্যন্ত ডায়ালিসিস চালাতে পারব জমি বাড়ি বিক্রি করে ব্যাঙ্কের টাকা তুলে। এজন্য কারোর কাছ থেকে উনি টাকা চাইবেন না।’

রেবা কথা থামাল। নীরবতাটা যখন অর্থবহ হয়ে উঠল তখন বলল, ‘শুনে আমার খুব খারাপ লাগল। বললুম তা হলে কী করবেন? বললেন, তা হলে পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যাব।’

‘সে কী!’ অতীন ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

‘বললুম আপনি কি সুইসাইড করবেন? তাইতে হেসে বললেন, আগে কিডনিটা অকর্মণ্য হোক তারপর তো ডায়ালিসিসের প্রশ্ন আসবে। কেমন যেন ভয় ভয় করল বাবার কথা শুনে। তুমি বাপু কালই ওঁর সুগার টেস্ট করাও। ব্লাড প্রেশার হাই, এরপর যদি সুগারও হাই ধরা পড়ে? কিডনি অকর্মণ্য হবার জন্য বসে থাকলে চলবে না। কারোর কাছ থেকে টাকা চাইবেন না মানে তোমার কাছ থেকে নেবেন না। এটা কি আত্মসম্মানবোধ? কোনো মানে হয় এইরকম কথা বলার! বাবার জন্য ছেলে বছরে দু-লাখ টাকা কি খরচ করতে পারে না, বললুম ওঁকে সে কথা, তাইতে বললেন অতীন অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করে টাকা রোজগার করে সেজন্যই কষ্টের টাকা উনি নেবেন না।’

‘অদ্ভুত কথা তো!’ অতীন আহত চোখে বউয়ের দিকে তাকাল। ‘কারোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে বাঁচতে চান না, ছেলের টাকাও নেবেন না। পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে চান! দ্যাখো রেবা, ওর মুখ দেখে আমার মনে হল যেন কিডনির গোলযোগ শুরু হতে পারে, কেন মনে হল জানি না তবে হাই প্রেশারটা খুবই মারাত্মক কিডনির পক্ষে। তখন বাবাকে বললুম বটে ডায়াস্টোলিক একশোর কাছাকাছি, আসলে ছিল একশো পনেরো, থাকা উচিত আশি। সিস্টোলিক দেখলুম একশো ষাট, থাকা উচিত একশো কুড়ি।’

অতীন বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে এগোল, পর্দা সরিয়ে বসার ঘরে তাকিয়ে পর্দা নামিয়ে ফিরে এল।

‘কী হল?’ রেবা বলল।

‘কীতু ফোন করছে। সকাল ন-টায় তা হলে আসতে বলব, বাবাকে বারো ঘণ্টা কিছু না খেয়ে থাকতে হবে, রাত ন-টায় যেন খেয়ে নেয়। তারপর পি.পি.-টার জন্যও ব্লাড দেবে ভাত খাওয়ার দু-ঘণ্টা পর।’ অতীন আবার পর্দা সরিয়ে দেখে বিরক্ত স্বরে বলল, ‘কাকে এতক্ষণ ধরে ফোন করছে বলো তো?’

রেবা কথার উত্তর না দিয়ে ঘর থেকে বেরোল। কীর্তি ফোনে কথা বলছে দেখে দ্রুত পায়ে তার কাছে গিয়ে বলল, ‘অনেকক্ষণ ফোন আটকে রেখেছিস, বাবা জরুরি কথা বলবে এবার ছাড়।’

কীর্তি রিসিভার রাখার আগে বলল, ‘রাখছি ক্ষণা বাকিটা পরে বলব, বাবা এখন জরুরি একটা কল করবে, গুডনাইট বাই-ই।’

দাদুর ঘরে ঢুকে কীর্তি দেখল নগেন্দ্র বারান্দায় দাঁড়িয়ে। দাদুর পিছনে গিয়ে সে দাঁড়াল। অন্ধকার দোকানের সামনে জটলা। পথচলতি মানুষ জটলা দেখে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, প্রশ্ন করছে তারপর দোকানের কাছে এগিয়ে উঁকিঝুঁকি দিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করে চলে যাচ্ছে। নগেন্দ্র অনুমান করতে চেষ্টা করছেন ওরা কতটা ভয় পেয়েছে, বাঁচা-মরার ব্যাপারটা দৈবের হাতে তুলে দেবার কথা ভাবছে কতটা? শান্ত পুকুরের মতো রাজা গার্ডেনের স্থির জলে একটা থান ইট পড়ল, একটা আলোড়ন তো উঠবেই। কয়েকদিন জলটা কাঁপবে তারপর স্থির হয়ে যাবে। নিত্য কত লোককে তো পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে, ক-জন মৃতদের কথা মনে রেখে দিয়েছে, যারা পিটিয়ে ছিল তারা তো সেই হাত দিয়েই ভাত খাচ্ছে, খাবার সময় হাতটার দিকে তাকিয়ে কি মনে পড়ে কাঁচা রক্তে আর স্যাঁতলানো মাংস হাতটা মাখামাখি হয়েছিল? কুড়ি তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে একটা মানুষের শরীর তৈরি হয়ে বেড়ে উঠল, হতে পারে সে ডাকাত খুনি গুন্ডা কিন্তু তারও তো একটা প্রাণ আছে, আর পাঁচটা মানুষের মতো তারও তো জীবন ভোগ করার বাসনা আছে! সেই প্রাণটাকে তার বাসনাগুলোকে খুঁচিয়ে পিটিয়ে থেঁতলে শেষ করে দিচ্ছে যারা তাদেরও তো একই রকমের প্রাণ আর বাসনা আছে! মানুষ পারে কী করে? এইরকম বোধহীন কাজ তো জানোয়ারে করে, তবে কি জানোয়ার দেখলুম আজ অটোরিকশায়? ছেলেটার মুখের আদল ছিল কীর্তির মতো।

নগেন্দ্রর বুকের মধ্যেটা হিম হয়ে গেল। মনে মনে বললেন, না কখনোই কীর্তির মতো আদলের মুখটা ছিল না। আমি ভুল দেখেছি একশো ভাগ ভুল দেখেছি। অস্থির হয়ে তিনি ঘরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়েই দেখলেন কীর্তিকে। ভয় পাওয়া চোখে কীর্তির মুখটা দেখতে দেখতে অস্ফুটে বললেন, ‘দাদু, তুই মানুষ মারতে পারবি?’

প্রশ্নটা অদ্ভুত লাগল কীর্তির কাছে, বলল, ‘হঠাৎ এমন কথা। ডেফিনিটলি মারতে পারব। রমেনদাকে যখন মারতে এল তখন যদি আমি ওখানে থাকতুম আর আমার কাছে যদি রিভলভার থাকত তা হলে কী ছেড়ে কথা বলতুম? যে প্রাণ নিতে আসবে তার প্রাণও আমি নোব। যুদ্ধে সোলজাররা যা করে তাই করব।’

নাতির মুখ উত্তেজিত হয়ে রং বদলে গেছে। প্রসঙ্গটা বদলাবার জন্য বললেন, ‘মেয়েটিকে ফোন করলি?’

‘ওকে বলে দিলুম রোববার দুপুরে আমাদের বাড়িতে খাবে আর খাওয়ার উপলক্ষ্যটাও বললুম।’

‘তোর মাকে জানিয়ে রাখ, একটা মেয়ে, কী নাম? ক্ষণা, রোববারে খাবে। আমি ওকে নেমন্তন্ন করতে বলেছি, তোর মা কিন্তু বলেনি।’

‘না বললেই বা! তুমি তো বলেছ।’

নগেন্দ্র মনের গভীরে সুখবোধ করলেন। ছেলের মেয়ে বন্ধু থাকাটা রেবার পছন্দ নাও হতে পারে।

‘আমাদের সময়ে ভাবাই যেত না কোনো মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে। আমি তো কোনোদিন কলেজেই পড়লুম না। তখন আমাদের ওদিকে শুধু স্কটিশচার্চ কলেজেই ছেলেমেয়ে একসঙ্গে পড়ত। এখন তো প্রায় সব কলেজেই কো-এডুকেশন।’

‘তোমার মন খারাপ হচ্ছে?’

‘তা একটু একটু তো হচ্ছে।’ নগেন্দ্র জোরে হেসে উঠতে গিয়ে চুপ করে গেলেন, ঘরে রেবা ঢুকেছে।

‘বাবা আপনার কিন্তু শুয়ে থাকার কথা। কাল সকাল ন-টায় ব্লাড নিতে আসবে, রাত ন-টার মধ্যে আপনাকে খেয়ে নিতে হবে।’

‘বউমা কীর্তি ওর বন্ধুকে রোববারে খেতে বলেছে, এমন রান্না করো যাতে মেয়েটা সারা কলেজে রটিয়ে বেড়ায়, খেলুম বটে কীর্তিনারায়ণের মায়ের হাতের রান্না, দ্রৌপদীও শিখে আসতে পারে!’

রেবা ঠোঁট টিপে হাসল। শ্বশুর ভালোমন্দ খেতে ভালোবাসেন এটা সে জানে। যত বয়স বাড়ছে ততই ওনার খাওয়ার ইচ্ছেটা বাড়ছে। একটা-না-একটা ছুতো তৈরি করেই শোভাকে নিয়ে বাজারে মাছ মাংস কিনতে ছুটবেন। টুর্নামেন্টের সেমি ফাইনালে উঠল নাতি অমনি সাড়ে তিনশো টাকা দিয়ে একটা এক বিঘৎ চওড়া পেটির ইলিশ এনে বললেন, ‘এই গাঁটটা পেরোলেই ফাইনাল আর ফাইনালে পাশ করলেই খাওয়াব আমার পুরোনো পাড়ার শর্মার রাবড়ি।’ কীর্তির আর গাঁট পেরোনো হয়নি, রাবড়িও আসেনি। নগেন্দ্র খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছিলেন, রেবার ধারণা সেটা নাতির হেরে যাওয়ার জন্য নয়।

এবারের ছুতোটা দাদুর বেঁচে যাওয়া সেলিব্রেট করার জন্য কীর্তির আবিষ্কার। রেবা এটাকে অবশ্য ছুতো বলে মনে করে না। এটা তো উৎসব করার মতোই একটা ঘটনা। এভাবে অবধারিত মরণের হাত থেকে ক-জন বাঁচে? বাড়িতে সত্যনারায়ণ বা কালীঘাটে গিয়ে পুজোও দেওয়া যায়।

‘দ্রৌপদীকে আর আমার কাছে শেখার জন্য পাঠাবেন না বাবা, ঝোলভাত যা পারব রেঁধে দোব।’

‘না মা না।’ কীর্তি নাকিসুরে আদুরে গলায় বলে উঠল, ‘ঝোলভাত নয়। তা হলে আমি ক্ষণাকে আসতে বারণ করে দোব।’

নগেন্দ্র বুঝে গেছেন রেবার ‘ঝোলভাত’ মানে জমকালো কিছু। বললেন, ‘অতীনকে বলে রেখো তো বউমা রোববার খুব সকালে আমাকে যেন গড়িয়াহাট বাজারে নিয়ে যায়, একটু বেলা হলেই গলদা কী ভেটকির আর দেখা পাওয়া যাবে না।’

নগেন্দ্র রাতের খাওয়া, তিনটি রুটি ডাল ও তরকারি, শেষ করলেন যখন ঘড়িতে তখন ন-টা বাজতে পাঁচ। কীর্তি তার নিজের ঘরে, অতীন টিভি দেখছে। রেবা খাওয়ার টেবলে শ্বশুরকে সঙ্গ দিচ্ছে এবং সোয়েটার বুনছে। এই পরিবারে দশটার আগে রাতের খাওয়ার চল নেই, এগারোটার পর কেউ জেগে থাকে না শুধু কীর্তি ছাড়া। নিজের ঘরে সে বেশি রাত পর্যন্ত পড়াশুনো করে।

‘কাল থেকে আপনাকে ব্লাড প্রেশারের ওষুধ খেতে হবে। আপনার ছেলে লিখে দিয়েছে, দুটো করে বড়ি।’

নগেন্দ্র হাত ধুয়ে তোয়ালেতে মুখ মুছছিলেন। একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘প্রেশার খুব বেশি কি?’

‘একটু বেশি। পাতে কাঁচা নুন একদম বন্ধ, মুড়ি খাওয়াও। এবার থেকে রান্নাতেও নুন কম দেওয়া হবে।’

‘সেটা কি আমার জন্যই?’

হাতের বোনা থামিয়ে রেবা শ্বশুরের দিকে তাকাল। মাথা নেড়ে বলল, ‘সকলের জন্যই। ভবিষ্যতের কথা ভেবে এখন থেকেই সাবধান হওয়া উচিত। ওনারও প্রেশারটা মাঝে মাঝে বেড়ে যায়। এটা বোধ হয় আপনাদের বংশের ধাত।’

নগেন্দ্র বাবাকে দেখেছেন, বংশ বলতে যদি ঠাকুরদা, জ্যাঠা, কাকা বোঝায় তাহলে কাউকেই দেখেননি। তার কাছে বংশটা বাবাতেই শুরু, বংশধর বলতে তিনি নিজে এবং সতাতো ভাইয়েরা। বাবার রক্তচাপের সমস্যা ছিল কি না সেটা জানেন না, তাকে কখনো ওষুধ খেতে দেখেননি। তবে শেষ জীবনে মোটা হয়ে পড়েছিলেন। মারা যান হঠাৎ হার্টফেল করে। নগেন্দ্র মোটা হননি। অতীনেরও রক্তচাপ বেড়ে যায় শুনে তিনি উচাটন হলেন।

‘তা হলে কাল থেকেই রান্নাবান্নায় নুন কম দিতে বোলো শোভাকে।’

আজ তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়লেন নগেন্দ্র কিন্তু ঘুম আসছে না। অন্ধকার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। বাতাস নেই তাই শীত করছে না। একটা জমাট ঠান্ডা চেপে বসল শরীরে। এটা তার ভালোই লাগল। রাস্তার দু-দিকে তাকালেন ঘুটঘুটে কালো। বহুদূরে রাস্তার ইলেকট্রিক পোস্টে একটা নিওন আলো জ্বলছে। এ পাড়ায় সবকটা রাস্তার আলো কখনো তিনি একসঙ্গে জ্বলতে দেখেননি। অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধ এলাকাটা। কিছুক্ষণ আগেও টিভি চলার শব্দ পেয়েছেন।

নগেন্দ্র বারান্দায় ঝুঁকে রমেনের দোকানের দিকে তাকালেন। ঠিক কোনখানটায় বেঞ্চে বসেছিলেন সেই জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করে ঠাওর করতে পারলেন না। সবাই বলছে খুব বেঁচে গেছি,কীর্তি দাদুর পুনর্জন্ম সেলিব্রেট করতে চাইল। ভাগ্য মানতে এখন আর আপত্তি করার প্রশ্ন ওঠে না। বাইরে সদ্য মৃত্যু ঘটেছে একজনের আর একজন মরোমরো ঠিক তখনই তার ব্লাডপ্রেশার মাপছে ছেলে। তিনি মরেননি কিন্তু মরণ কতটা এগিয়ে এসেছে সেটা মাপা হল। আপাতত তার মৃত্যু হচ্ছে না। দুপুরেই ম্যাগাজিনে এক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের লেখায় পড়েছেন-অহেতুক উদাসীনতায় প্রেশার আর সুগারের রোগীরা যেচেই নিজেদের জীবনে বিপদ ডেকে আনেন। আজ যারা ডায়ালিসিস বা ট্রান্সপ্লান্টের জোরে বেঁচে আছেন তাদের বেশিরভাগই হয় সুগারের নয়তো হাই প্রেশারের রোগী ছিলেন।

ম্যাগাজিনে এই জায়গাটা পড়েই তার খটকা লেগেছিল, অহেতুক উদাসীনতা বলতে কী বোঝায়? অনুভূতি তখন থেকে কাজ করতে শুরু করে দেয়, বোধ হয় তার রক্তে কোনো সমস্যা তৈরি হয়েছে নয়তো অতীন ঘরে ঢুকেই কীরকম চাউনি নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলবে কেন, শরীর কেমন লাগছে। যখন জানা গেল প্রেশার রয়েছে স্বাভাবিকের অনেক উপরে তখন ভয় পেয়ে মুহূর্তে সবাই ভুলে গেল একটু আগে বাড়ির সামনেই অস্বাভাবিক একটা ঘটনায় মানুষ মারা গেছে। বাড়ির সবাই প্রতিদিন দেখত যে রমেনকে তারা সঙ্গে সঙ্গে মন থেকে তাকে খারিজ করে দিল। রেবার কাছে বড়ো হয়ে উঠল শ্বশুর যেন কীর্তির সঙ্গে মুখের আদলের মিলের কথাটা না বলে ফেলে।

কীর্তি এসেই জানাল সে ফরচুনেট আর পুনর্জন্ম হয়েছে, দুটো শব্দকে আঁকড়ে ধরে তারা পেল তৃতীয় শব্দ সেলিব্রেট। তখনই চোখ থেকে সরে গেল রমেনের দু-হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে ছুটে এসে তার পায়ের কাছে পড়ে যাওয়ার দৃশ্যটা। নগেন্দ্রনারায়ণ চোখ বন্ধ করে মাথা নীচু করলেন, কানের পিছন গরম হয়ে উঠল।

স্যান্ডো গেঞ্জিপরা রমেনের বুক কাঁধ বাহুর তারিফ করতেন মনে মনে, প্রতিদিনই কিছু একটা কিনতেন আর কিছুক্ষণ কথা বলতেন। ওর স্পষ্টাস্পষ্টি কথাগুলো তার ভালো লাগত,ছেলেটার মধ্যে ভান ছিল না। ওর মধ্যে তার পুরোনো পাড়ার হাবভাব চলনবলন দেখতে পেতেন। রমেন এখনও বারোটা টাকা তার কাছ থেকে পাবে। ওকে মন থেকে সরিয়ে তিনি কী করে গলদা আর ভেটকি পাবেন কি না বেলা করে বাজারে গেলে এই ভাবনাটা মাথায় আনতে পারলেন! পাষাণ ভারের মতো একটা প্রবল চাপ তার বুকের মধ্যে চেপে বসল। এটা না নামাতে পারলে দমবন্ধ হয়ে বোধ হয় মরে যাবেন বলে তার মনে হতে লাগল।

অন্ধকার ঘুটঘুটে কিন্তু ঘরে বাইরে চলাফেরার পথ তার মুখস্থ। সন্তর্পণে ছিটকিনি খুলে খালি পায়ে নগেন্দ্র সিঁড়িতে বেরিয়ে এলেন। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলেন কীর্তির ঘরের দরজা ইঞ্চি ছয়েক ফাঁক। দরজা ভেজিয়ে রাখলে একটা পাল্লা খানিকটা খুলে যায়। ঘরে আলো জ্বলছে, দেওয়ালে সিলিং ফ্যানের ছায়া। কীর্তি পড়ছে এখনও। দেওয়ালে হাত দিয়ে নগেন্দ্র এক-পা এক-পা করে একতলায় নেমে দরজার খিল ও ছিটকিনি খুলে বেরোলেন। ডানদিকে গ্যারেজ বাঁদিকে গেট। গেটের মাথায় পরানো হুক আর পেটের কাছে আটকানো বোল্ট খুলে অন্ধকার রাস্তা পার হয়ে দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন। এখন তার শীত করছে।

দোকানের ভিতরের দিকে বোমাটা ফেটেছিল। সামনের দিকের মালপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। বিমূঢ় অবস্থাতেও নগেন্দ্র দেখেছিলেন পানপরাগের ঝুলন্ত মালা তখনও ঝুলছে, কাচের বাক্সটা উলটে পড়ে গেছে মাটিতে। স্থির চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে অন্ধকারের সঙ্গে চোখ সইয়ে তিনি বুঝলেন বাক্সটা নেই, সামনের কাঠের পাটাতনগুলো লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। দোকানের আসল মালিক অরুণ নস্কর বোধ হয় কাউকে দিয়ে চুরি বন্ধের জন্য এটা করিয়েছে।

নগেন্দ্র অনুমান করতে চেষ্টা করলেন তখন তিনি কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, রমেন কোনখানে এসে উপুড় হয়ে মুখ তুলে ‘মেসোমশাই’ বলেছিল। একটা জায়গা আন্দাজ করে ধীরে ধীরে উবু হয়ে বসে মাটিতে হাত রেখে দু-ধারে তাকালেন। মনে হল অটোরিকশার ইঞ্জিনের শব্দ যেন শুনতে পেলেন। পূর্ণ সরকার রোডের দিকে তীক্ষ্ন চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘ওঠো রমেন পালাও ওরা আবার আসছে।’ চোখ বন্ধ করে তিনি সিঁটিয়ে অপেক্ষায় রইলেন বিস্ফোরণের শব্দের জন্য। অনেকক্ষণ পর চোখ খুললেন। কপালে ঘাম ফুটে উঠেছে। ডায়মন্ডহারবার রোড দিয়ে ভারী ট্রাক যাবার ক্ষীণ শব্দ ভেসে এল তা ছাড়া রাজাগার্ডেন আগের মতোই নিস্তব্ধ। নগেন্দ্র মুখ নীচু করে বললেন, ‘বারো টাকা তুমি পাবে কিন্তু কোনোদিনই শোধ করতে পারব না, এ কী ঝঞ্ঝাটে আমাকে ফেলে গেলে রমেন। এই দেনা আজীবন টেনে যেতে হবে, আমাকে কোথায় রেখে গেলে রমেন।’ নগেন্দ্র ফুঁপিয়ে উঠলেন।

অরুণোদয়ের বন্ধ গ্যারেজে আলো জ্বলে উঠল। দরজার পাল্লার তলা দিয়ে আলো বেরিয়ে এসেছে। নগেন্দ্র অবাক হয়ে গেলেন, এত রাতে কার দরকার হল গাড়ি চড়ার? ভিতর থেকে গ্যারেজে ঢোকার দরজা আছে, কেউ ঢুকে আলো জ্বেলেছে। নগেন্দ্র অপেক্ষায় রইলেন। ভিতর থেকেই দরজাটা হাট করে খুলল অরুণ নস্করের ড্রাইভার। বাইরে বার করে এনে গ্যারেজের দরজা বন্ধ করতে নামল। নগেন্দ্রর মনে হল পিছনের সিটে বসে একটা লোক।

হেডলাইট জ্বেলে গাড়িটা হীরকনগরের দিকে এগিয়ে গেল। নগেন্দ্র দু-ধারের বাড়িগুলোকে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেই অন্ধকারে ফিরে যেতে দেখলেন। রাস্তা পার হয়ে তিনি ফিরে এলেন বাড়ির গেটে।

‘দাদু।’

নগেন্দ্র চমকে গেলেন। গেটের পিছনে কীর্তি ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে। নিশ্চয় তার পিছু নিয়ে নেমে এসে অপেক্ষা করছিল।

‘তোর নামার কী দরকার ছিল?’

‘তুমিই বা এত রাতে এই ঠান্ডায় বেরিয়েছ কেন?’

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে নগেন্দ্র নাতির পিঠে হাত রেখে বললেন ‘ওপরে চল।’

কথা না বলে তারা দোতলায় উঠে এল। নগেন্দ্রর ঘরে এসে কীর্তি আলো জ্বালল। খাটে বসে তিনি নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রশ্নের অপেক্ষায়। প্রশ্ন না করে কীর্তিও তাকিয়ে রইল। নগেন্দ্র এই প্রথম লক্ষ করলেন ওর ঠোঁটের উপর হালকা গোঁফের রেখা, থুতনির লোমগুলো বড়ো হয়ে গেছে।

‘কীর্তি আমরা দু-জনেই কিন্তু রমেনকে মনে রেখে দোব, আমার দেনা আর তোর পাওনার জন্য।’

‘তোমার মনে থাকবে কিন্তু আমার থাকবে না।’

‘থাকবে না কেন?’

‘মনে রাখার মতো অনেক ভালো জিনিস আমার আছে, এইভাবে মরাটা খুব গৌরবের মৃত্যু নয়।’

‘আমি যদি রোগে ভুগে মরি সেটা তো গৌরবের মৃত্যু হবে না, তুই তা হলে আমাকে মনে রাখবি না?’ নগেন্দ্র উদবিগ্ন চোখে তাকালেন।

‘রোগটা জীবনের একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আচ্ছা দাদু তোমার বাবা তো শুনেছি হার্টের ডিজিজে মারা যান, স্বাভাবিক মৃত্যু, তাকে কতটা মনে রেখেছ?’

চট করে উত্তর দিতে পারলেন না নগেন্দ্র। তার ক্ষীণ বিশ্বাস, কিডনির অসুখে তিনি আক্রান্ত হবেন তার পর ডায়ালিসিস করে বাঁচার চেষ্টা, যে জন্য বছরে খরচ হবে প্রায় দু-লাখ টাকা। টাকাটা অবশ্য অতীন দিতে পারবে তবে যতীন দেবে না, দিলেও কিছু একটা ছুতোয় সামান্য কিছু ঠেকাবে। দিতে পারলেও অতীন ক-বছর এতগুলো টাকা দেবে?

উত্তরের জন্য কীর্তি তাকিয়ে আছে দেখে তিনি হেসে ফেললেন, ‘খুব জবরদস্ত একটা প্রশ্ন করলি বটে, সত্যি কথা বলতে বাবাকে এখন একদমই মনে পড়ে না, এটাও কিন্তু স্বাভাবিক ব্যাপার। আসলে মনে পড়ার মতো কিছু বাবা করেনি বরং আমার সৎ মা করেছে, আমার পালোয়ান হওয়াটা বন্ধ করে দিয়েছিল। যাক অনেক রাত হল এবার শুতে যা।’

চার

দু-বার নগেন্দ্রর রক্ত নিয়ে গেল বোস প্যাথলজির লোক, খালি পেটে আর ভাত খাবার দু-ঘণ্টা পর। রাত্রে অতীন রিপোর্ট নিয়ে বাড়ি ফিরবে। সন্ধ্যাবেলায় যখন তিনি টিভি-তে খবর শুনছিলেন তখন ফোন বেজে উঠল। রেবা ফোন ধরল। নগেন্দ্র রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টিপে টিভি-র গলা নামিয়ে দিলেন।

‘বাবা, ভাসুরঠাকুর ফোন করছেন, আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।’ রেবার গলায় বিস্ময়।

নগেন্দ্রও বিস্মিত। হঠাৎ যতীন পাটনা থেকে ফোন করছে, ব্যাপার কী?

‘কে যতীন, বাবা বলছি, কী ব্যাপার?’

‘বাবা আমি গোয়াবাগান থেকে কথা বলছি। একটু মুশকিলে পড়ে গেছি। তোমার সঙ্গে তাই কথা বলতে চাই।’

যতীনের স্বর চাপা এবং অস্থিরতা মেশানো। সেটা লক্ষ করে নগেন্দ্র বুঝলেন উকিল যখন কথা বলতে চায় তখন মুশকিলটা হালকা ধরনের নয়।

‘তুই কলকাতায় কবে এলি?’

‘দুপুরে এসেছি।’

‘বউমা, ছেলেমেয়েরা।’

‘ওরা পাটনাতেই রয়েছে শুধু টুনি আমাদের সঙ্গে এসেছে।’

টুনি যতীনের বড়ো মেয়ে, বছর কুড়ি বয়স। এই বছরে পাটনা কলেজে বি এ ফার্স্ট ইয়ারের ইতিহাস অনার্স নিয়ে ভরতি হয়েছে। নগেন্দ্র দু-বছর আগে ওকে দেখেছেন যখন যতীন সপরিবারে পিতৃদর্শনে এসেছিল। নাতনিটিকে তার খুব ভালো লেগেছিল। ছিপছিপে শ্যামলা লম্বাটে মুখ, কথা বলে ধীর এবং অল্পবাক, সুরেলা মিষ্টি গলা, দুটি অতুলপ্রসাদের গান গেয়ে শুনিয়েছিল। প্রথম গানটি গাওয়া শেষ হতেই কীর্তি ছুটে গিয়ে তার টেপ রেকর্ডটারটা নিয়ে আসে। ওর কাছে নতুন টেপ ছিল না, একটা ইংরিজি রক গান টেপ থেকে মুছে দিয়ে কীর্তি তার উপর তুলে নেয় তার টুনিদিদির গাওয়া ‘পাগলা মনটাকে তুই বাঁধ।’

‘শুধু টুনি! আর সবাই আসেনি?’

একটু ইতস্তত করে যতীন বলল, ‘না আসেনি, কাল সকালে গিয়ে সব বলব।’

‘তোর ভাড়াটে পয়লা আসছে তো?’

‘না আসবে না। ভদ্রলাকের কলকাতায় বদলি হওয়াটা ক্যানসেল হয়ে গেছে তার বদলে যাচ্ছেন কটকে।’

‘আর একটা কথা। টুনিকে এখন কিছুদিন তোমার ওখানে রাখতে চাই। অসুবিধে হবে না তো?’

‘অসুবিধে আর কী হবে।’ নগেন্দ্র একটু অবাক হলেন, শ্বশুরবাড়ি থাকতে যতীন টুনিকে এখানে রাখতে চায় কেন, ওর যত ঘনিষ্ঠতা তো গোয়াবাগানের সঙ্গে।

‘বউমা আর অতীনের যদি অসুবিধে হয় তাই বললুম।’

নগেন্দ্র এবার স্বর গম্ভীর করে বললেন, ‘আমি বলছি তুই টুনিকে আমার কাছে রেখে যা।’

‘তা হলে কাল যাচ্ছি।’

রেবা কাছেই দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনছিল। নগেন্দ্রর শেষ কথাটির খেই ধরে বলল, ‘ভাসুরঠাকুর টুনিকে এখানে রাখতে চাইছেন, কেন?’

নগেন্দ্র পুত্রবধূর ভ্রূ ও গলার স্বরের কুঁচকে যাওয়া লক্ষ করে অপ্রসন্ন হলেন। তিনি জানেন রেবা পছন্দ করে না নমিতাকে এবং এটাও জানেন যতীনের মতো তার স্ত্রীও স্বার্থপর, কৃপণ ও পরশ্রীকাতর। কিন্তু ওদের ছেলেমেয়েরা কেউই বাবা-মার মতো হয়নি। টুনির এখানে এসে থাকাটা রেবা মন থেকে চাইবে না এটা অনুমান করতে নগেন্দ্রর অসুবিধা হল না।

‘কেন এখানে রাখতে চাইছে সেটা কাল যতীন এলে জানা যাবে। তোমার কি খুব অসুবিধে হবে? বলল কিছুদিন রাখতে চায়।’

‘টুনি তো ওর মামার বাড়িতেই থাকতে পারে।’

‘ঠাকুরদার বাড়ি থাকতে মামার বাড়িতে থাকবে কেন?’ নগেন্দ্রর স্বরে বিরক্তি স্পষ্ট হল।

তর্কের সুরে রেবা বলল, ‘এতকাল তো ওরা মামার বাড়িতেই এসে উঠেছে থেকেছে। এখন কী এমন দরকার পড়ল এখানে এসে থাকার? তা ছাড়া টুনি বড়ো হয়েছে, থাকার জন্য ওর তো আলাদা একটা ঘর চাই।’

নগেন্দ্র টুনির থাকার জন্য এই সমস্যাটা খেয়াল রাখেননি। রেবার যদি টুনির বয়সি মেয়ে থাকত তা হলে কোথায় রাত্রে শুত? বড়ো ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ঘর চাই। দোতলায় দুটি শোবার ও একটি বসার ঘর। আড়াই তলার ছোটো ঘরটা কীর্তির। একসময় কীর্তির বিয়ে হবে তখন বউ নিয়ে ওই ছোটো ঘরটায় থাকা ওদের পক্ষে সম্ভব হবে না। অবশ্য বিয়ে অন্তত বছর দশেকের আগে হচ্ছে না আর ততদিনে তিনি মারা গিয়ে ঘরটা খালি করে দেবেন। এই নিয়ে তিনি ভেবেছেন এবং ঠিক করে রেখেছেন বাড়ির লাগোয়া খালি জমি থেকে অতীনকে চার কাঠা দেবেন। এখানে বাড়ি করার ইচ্ছা ওর আছে কি না সেটা এখনও তিনি জানেন না।

‘দোতলায় শোবার আর ঘর নেই তো কী হয়েছে! যতীনকে বলব নীচে ওর একটা ঘর খুলে দিক আমি গিয়ে থাকব।’ নগেন্দ্র চোখ দুটো কড়া করে তাকিয়ে রইলেন নিজের অনমনীয় মনোভাব জানাতে।

রেবা গলা নরম করে বলল, ‘টুনি আপনার নাতনি ওকে যেভাবে রাখতে চান রাখবেন তাতে আমি বলার কে?’ মুখ ভার করে রেবা শোবার ঘরে চলে গেল।

রাত্রে অতীন ফিরল ব্লাড রিপোর্ট সঙ্গে নিয়ে।

‘ওষুধ একেবারে কিনেই এনেছি।’ রিপোর্টের খামটা বাবার হাতে দিয়ে অতীন বলল, ‘কাল থেকে খেতে শুরু করো। পিপি নর্মালের থেকে একশো বেশি, ফাস্টিংও নর্মালের ডাবল। তুমি কি জানতে সুগার বেশ ভালোমতোই তোমার হয়েছে?’ অতীনের কথা বলার ধরনে যথেষ্ট উদবেগ।

নগেন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, ‘কিচ্ছু জানতুম না।’

‘আর নেগলেক্ট করা নয়, কাল থেকেই রেস্ট্রিক্টেড। খাওয়াদাওয়া, নিয়মিত সকালে একঘণ্টা হাঁটা, চিনির জিনিস একদম বন্ধ। মনে রেখো এই সুগার থেকেই হার্ট ব্রেইন কিডনি, লিভার, প্রেশার সবরকমের খানদানি রোগের সূত্রপাত হয়। ডায়বিটিস কখনো সারে না, একে শুধু কন্ট্রোলে রাখতে হয়।’ অতীন আর কিছু বলল না। তার ধারণা বললে কিছু বুঝবেও না। বাবা এখন যে বয়সে তাতে বেশি বুঝতে গেলে সব গুলিয়ে ফেলবে। আসলে কে ওঁকে চালনা করবে, ওঁকে প্রতিদিনের নিয়ম পালনে বাধ্য করবে তাকে অর্থাৎ রেবাকেই বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। ‘আমি রেবাকে বলে দিচ্ছি, কী কী খাবে না, বেড়ানো ঘুমোনো সব দিকে যাতে নজর রাখে। একটা কথা, যদি ভালোভাবে বাঁচতে চাও তো এখন থেকে যা বলব তাই করবে।’

কথা বলার ধরনটা ঠিক ডাক্তারের মতো নয়, নগেন্দ্রর মনে হল বাবাকে বাঁচাবার জন্য ছেলের উৎকণ্ঠাই যেন বেরিয়ে এল অতীনের গলা দিয়ে। নিজেকে তার ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে। তবে রেবা এবার থেকে তার উপর কর্তৃত্ব করবে এটা ভেবেই তিনি অস্বস্তি বোধ করলেন।

‘নুন খাওয়া বন্ধ করলি এবার চিনিও, তা হলে খাবটা কী?’

‘দেদার ভালোমন্দ খেয়ে এসেছ ছোটোবেলায়, এখন ঠ্যালা সামলাতে কষ্ট তো করতে হবেই।’

রেবা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল, বলল, ‘এ বাড়িতে মিষ্টির কোনো জিনিস আর ঢুকবে না।’

‘তার মানে এবার থেকে তোমরা বাইরে মিষ্টি খাবে। ভালো কথা অতীন, কাল যতীন আসবে ওর বড়োমেয়ে টুনিকে সঙ্গে করে। কিছুদিন টুনি আমাদের এখানে থাকবে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝলুম না, মেয়েটাকে হঠাৎ এখানে রাখতে চাইল কেন। বলল এখানে এসে বলবে।’

পরদিন সকালে অতীন যখন গাড়ি বের করার জন্য গ্যারেজের দরজার পাল্লা খুলেছিল তখন অটোরিকশা থেকে যতীন ও টুনি নামল। টুনির পরনে খয়েরি রঙের ফুল ছাপ দেওয়া হলুদ সালোয়ার-কামিজ, খয়েরি ওড়না, হাতে একটা ছোটো সুটকেস। যতীনের মাথায় টাক, কানের উপরের চুল আধপাকা, পুরু গোঁফ, চকচকে কামানো গাল, বাবার মতো লম্বা এবং চওড়া বেল্ট দিয়ে প্যান্টটি ভুঁড়িতে আটকে রাখা। সুটকেসটি সে টুনির হাত থেকে নিয়ে গেট দিয়ে ঢুকল। টুনি হাঁটতেই বোঝা গেল সে খোঁড়া।

অতীন শুনেছিল দু-বছর আগে বাসের ধাক্কা লাগায় টুনি আর নমিতা সাইকেল রিকশা থেকে ছিটকে পড়ে, তারপর টুনিকে হাসপাতালে থাকতে হয় দশদিন। এর বেশি পটনা থেকে আর কিছু জানানো হয়নি, রাজা গার্ডেনও জানার জন্য ব্যস্ততা দেখায়নি শুধু নগেন্দ্র একবার বলেছিলেন, ‘বউমা মেয়েটার একবার খবর নিয়ো, দশদিন হাসপাতালে ছিল!’ রেবা বলেছিল ‘গুরুতর তেমন কিছু হলে নিশ্চয় ওরা জানাত, তা যখন জানায়নি তখন বুঝতে হবে ভালোই আছে।’

অবাক হয়ে অতীন ভাইঝির দিকে তাকিয়ে রইল। দু-বছর আগেও যাকে স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে দেখেছে তার হাঁটা যে এমন করুণা জাগানো বিস্ময়ের কারণ হবে এটা তার কাছে অপ্রত্যাশিত। বাঁ পা ফেলার সময় টুনির শরীর এমনভাবে বাঁদিকে ঝুঁকল যে পড়ে যাবে কিন্তু পড়ল না। ডান পা বাড়াতেই শরীর সিধে হল। বাঁদিক ডানদিক করে দুলে দুলে টুনি এগিয়ে এসে কাকাকে প্রণাম করল।

ফ্যাল ফ্যাল চোখে অতীন তাকিয়ে রইল দাদার দিকে। স্বাভাবিক মুখ করে যতীন বলল, ‘বাসের চাকায় গোড়ালিটা গুঁড়িয়ে গেছল। পটনার টপ সার্জন ডাক্তার শিবেন পাণ্ডে অপারেশন করে পা-টা বাঁচিয়েছেন, বাদ দিতে হয়নি।’

বাদ না যাওয়ার কৃতিত্বটা যেন তারই এমন মুখ করে যতীন বলল, ‘তুই ফিরবি কখন, দুপুরে? আয়, তখন কথা বলব।’

সুটকেস হাতে নিয়ে যতীন সিঁড়ির দিকে এগোল, তার পিছনে টুনি। অতীন ব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি তার দুটো কাঁধ ধরল।

‘কাকাবাবু আমি নিজেই যেতে পারব।’ নরম লাজুক স্বরে টুনি বলল।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ও নিজেই দোতলায় উঠতে পারবে।’ যতীন মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কলেজ টলেজ তো একাই যায়। হাঁটাচলায় এখন আর কোনো অসুবিধে হয় না।’

‘না হোক অসুবিধে, চলো দোতলা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসি।’

দোতলায় সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে ছিল রেবা। সে কয়েকধাপ নেমে এসে টুনির হাত ধরল, ‘আয়।’

নগেন্দ্র কীর্তি এমনকী শোভাও কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে টুনির পা নিয়ে একটি কথাও বলল না, সহানুভূতি জানাবার চেষ্টা তো নয়ই। সবাই কথাবার্তায় এমন ভাব দেখাতে লাগল যেন দু-বছর আগের স্বচ্ছন্দে হাঁটাচলা করা টুনির সঙ্গেই তারা কথা বলছে। একসময় নগেন্দ্র বড়ো ছেলেকে বললেন, ‘মুশকিলে পড়েছিস বললি কাল টেলিফোনে, কী ব্যাপার?’

বসার ঘরে তারা কথাবার্তা বলছিল। যতীন ইতস্তত করে বলল, ‘চলো বারান্দায় যাই।’

দু-জনে বারান্দায় এল। নগেন্দ্রর দৃষ্টি গিয়ে পড়ল রমেনের দোকানে। একইভাবে রয়েছে কাঠের পাল্লা বোধ হয় কোনোদিন আর খুলবে না। অরুণ নস্কর বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, বাতে পঙ্গু দেবেন একা বাড়িতে। রোজই একবার চাকরের হাত ধরে বারান্দায় এসে গ্রিল ধরে চেয়ারে বসে বাইরের পৃথিবী দেখে। নগেন্দ্রকে দেখে হাতটা একবার তোলে।

দোকান থেকে দেবেনের বারান্দা, সেখান থেকে চোখ সরিয়ে তিনি ছেলের মুখের উপর রাখলেন ‘বল।’

‘টুনির একটা বিয়ে ঠিক করেছিলুম, তখন ওর পায়ের এই ব্যাপারটা ঘটেনি। রাইটস অ্যান্ড করবেট ওষুধ কোম্পানিতে ছেলেটি অ্যাসিন্ট্যান্ট মার্কেটিং ম্যানেজার, বেশ ভালো দেখতে শুনতে আঠাশ বছর বয়স, বাড়ি দমদমে, পটনাতে ঘর ভাড়া নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে। মাইনে পায় সাত হাজারের মতো, দমদমে নাগেরবাজারে নিজেদের বাড়ি, বাবা নেই, মা আর এক ভাই এক বোন। টুনির গান শুনতে অনেকবার আমাদের বাড়িতে এসেছে,ওর মা-ও এসেছে। টুনিও গেছে মাঝে মাঝে ওদের বাড়িতে। বিয়ের প্রস্তাবটা প্রথমে দেয় ওর মা। আমরা রাজি হই। শুধু একটা জায়গায় একটু খচখচানি ছিল আমরা দক্ষিণ রাঢ়ি ওরা বঙ্গজ। যাকগে ওসব, ছেলেটা তো ভালো, পাকা চাকরি, উন্নতির পথও খোলা, অনেকদূর উঠতে পারবে, সংসারটাও ছোটো। এইসব দেখেই তোমার বউমা বলল, হ্যাঁ বলে দাও। ওদের মেলামেশায় আমরা আর আপত্তি করিনি। ওদের দাবিদাওয়া কিছুই ছিল না কিন্তু আমার বড়োমেয়েকে আমি তো কিছু দোব!’ টানা কথাগুলো বলে যতীন দম ছাড়ল।

‘হ্যাঁ তাতো দিবিই। বলে সবাই দাবিদাওয়া নেই কিন্তু মনে মনে অনেক কিছুই আশা করে, না পেলে বউকে গঞ্জনা দেয়। তুই কত খরচ করবি ঠিক করেছিলি।’

‘বিয়ের খরচ-খরচা বাদে এক লাখ টাকা। যাই হোক, তারপরই টুনির অ্যাক্সিডেন্টটা ঘটে গেল। ব্যস তারপর ওদের মত বদলে গেল। খোঁড়া মেয়েকে ছেলের বউ করবে না, ছেলেও মায়ের কথায় সায় দিল। সব শুনেটুনে টুনিও বলল, এখানে বিয়ে করবে না, পড়াশুনো চালিয়ে যাবে। আমরাও ভেবে দেখলুম এখন ওকে বিয়ের কথা না বলাই ভালো। কিন্তু যে মুশকিলের কথা তোমায় বলেছিলুম ফোনে সেটা হল এখন একটি ছেলে ওকে বিয়ে করতে চাইছে।’

‘ভালোই তো, ছেলেটা করে কী?’

‘করে বলতে,’ যতীন আর একটু সরে এল বাবার কাছে, গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘একটা চিনে খাবারের রেস্টুরেন্ট আছে আর টুনি যে বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে গান শেখে সেখানে তবলা বাজায়, হাতটা খুব ভালো। কিন্তু মুশকিলটা হল, ওর মা বাইজি ছিল আর ছেলেটা বিহারি, স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি।’

নগেন্দ্র বিস্ফারিত চোখে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘না না না, এখানে বিয়ে হতে পারে না। তুই বলছিস কী, বাইজির ছেলে!’

‘ছেলেটা কিন্তু খুব ভালো, দেখতে ফিল্মের হিরোর মতো, খুব নম্র ভদ্র, কথাবার্তা মার্জিত, সুন্দর বাংলা বলে, যেকোনো বাবা-মায়ের জামাই করতে ইচ্ছে হবে। পটনা আর গয়ায় দুটো বাড়ি আছে, ভাড়া পায়। রেস্টুরেন্টও খুব চালু, একটা টু হুইলার আছে টুনিকে পিছনে বসিয়ে নিয়ে যায় পৌঁছে দেয়।’

‘তাতো বুঝলুম কিন্তু বাইজির ছেলেকে জামাই করলে লোকের সামনে মুখ দেখাবি কী করে, টুনি এটা জানে?’

‘জানে নিশ্চয় তবে আমাদের কিছু বলেনি আর আমরাও ওকে বলিনি যে জেনেছি। হাইকোর্টের এক উকিল প্রথম আমায় জানায়, বার লাইব্রেরিতে আলাদা ডেকে নিয়ে বলল, চৌধুরী সাব আপনার মেয়েকে দু-দিন দেখলাম মোটরবাইকে কদমকুঁয়া দিয়ে যাচ্ছে। যে ছেলেটি চালাচ্ছিল তাকে আমি জানি আমার মহল্লাতেই থাকে, কিশোরী বাইজির ছেলে প্রেমপ্রকাশ। বাবা বলে একজনকে পরিচয় দেয় বটে কিন্তু লোকটা ওর আসল বাবা নয়। আপনার মেয়েকে মানা করে দেবেন বেশি মেলামেশা না করে। শুনে তো আমি থ।’

‘আমিও তো অবাক হচ্ছি। টুনি দেখতে শুনতে খুবই ভালো কিন্তু ছেলেটা অমন একটা পঙ্গু মেয়েকে কেন বিয়ে করতে চায় জিজ্ঞেস করেছিস?’

‘করেছি। বলল হ্যান্ডিক্যাপড বলেই বিয়ে করতে চায়।’

‘তার মানে দয়া দেখাতে চায়।’

‘তাতো বটেই।’

‘টুনি কী বলছে?’

‘ওকে এখনও বলিনি তবে প্রেম নিশ্চয় ওকে না জানিয়ে আমাকে বিয়ের কথা বলেনি। টুনি কিন্তু হাবেভাবে আগের মতোই রয়েছে, এমনিতেই খুব চাপা মেয়ে এখন আরও চাপা হয়ে গেছে।’

‘ওকে এখানে আনলি কেন?’

‘আমরা বোঝাতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে। তুমি এবার একটু ওকে বুঝিয়ে বলো।’ মিনতি ভরা স্বরে বলে যতীন অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

নগেন্দ্র বিব্রত বোধ করলেন। এমন সমস্যায় জীবনে পড়েননি। নিজের নাতনি বংশের মুখে চুনকালি মাখাতে যাচ্ছে সেটা ঠেকাতে হবে। মেয়েটিকে তিনি প্রায় জানেনই না, তিন-চারবার এই বাড়িতে এসে কাটিয়েছে একবেলা। চুপচাপ থেকেছে গান শুনিয়েছে। দু-বছরের ছোটো কীর্তির সঙ্গেই যা কিছু কথা বলেছে।

‘টুনিকে কী বলে এখানে এনেছিস?’

‘প্রায়ই বলে পায়ে একটা ব্যথা করে। তাই বলেছি কলকাতায় চল বড়ো ডাক্তার দেখাব যদি অপারেশন করে ঠিক করে দিতে পারে, তোর কাকার চেনাশোনা অনেক স্পেশালিস্ট আছে। একটা কথা বাবা, তুমি কিন্তু অতীন বা বউমাকে এই ব্যাপারটা সম্পর্কে একদম কিছু বলবে না।’

নগেন্দ্র শুকনো হেসে মাথাটা সামান্য ঝোঁকালেন। ‘অনেকক্ষণ বাইরে আছি, ভেতরে চল।’

বসার ঘরে টুনি আর কীর্তি কথা বলছে, রেবা রান্নাঘরে। সেখান থেকেই সে চেঁচিয়ে বলল, ‘টুনি আলুভাজা খাবি।’

টুনি জবাব দেবার আগেই কীর্তি বলে উঠল, ‘মা আমিও খাব।’

সোফায় বসে নগেন্দ্র বললেন, ‘যতীন তোর সঙ্গে নীচের ঘরের চাবি আছে?’

‘আছে।’

‘তা হলে খুলে দে। একটা তক্তাপোশ তো রাখা আছে রাতে আমি গিয়ে শোব, টুনি শোবে আমার ঘরে। তুই কোথায় থাকবি? এখানে না গোয়াবাগানে?’

‘আমি ওখানেই থাকব।’

‘তুমি নীচে শোবে কেন! আমি গিয়ে শোব।’ কীর্তি বলল।

‘না।’ নগেন্দ্র প্রায় ধমকে উঠলেন। ‘রাতে তোকে পড়তে হয়, পরীক্ষা এসে গেছে, বইপত্তর হাতের কাছে না থাকলে অসুবিধে হয়। আমি তো শুধু রাতটুকু থাকব।’

প্লেটে আলুভাজা নিয়ে রেবা এল।

‘কাকিমা আমি কিন্তু খাব না।’ ক্ষীণ গলায় টুনি বলল।

‘খাবি না কেন! মোটা হয়ে যাবার ভয়ে?’ রেবা ঠাট্টার সুরে বলল, ‘টিভি-তে মডেলদের যা চেহারা দেখি মনে হয় যেন দুর্ভিক্ষের দেশের মেয়ে, তুই যেন অমন চেহারা করিসনি। গায়ে একটু চর্বি না থাকলে মেয়েদের লাবণ্য হয় না, নে খা।’ রেবা প্লেটটা টুনির সামনে ধরল। হাত বাড়িয়ে কীর্তি দুটো টুকরো তুলে মুখে দিয়ে বলল, ‘টুনিদি যদি না খায় তা হলে আমিই সবটা খেয়ে নোব।’

‘কী হল, খাবি না?’ রেবা হালকা ধমকের সুরে বলল। টুনি একটা টুকরো তুলে নিয়ে বলল, ‘আলু আমার ভালো লাগে না।’

যতীন নীচে নেমে গেল। নগেন্দ্র রেবাকে বললেন, ‘রাতে টুনি আমার ঘরে শোবে, আমি শোব নীচের ঘরে।’

রেবা শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে শুধু ভ্রূ কোঁচকাল, কিছু বলল না।

‘শোভাকে বলো ঘরটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দিতে। কীর্তি সুটকেসটা আমার ঘরে রেখে আয়।’

কীর্তি সুটকেস হাতে নিয়ে টুনিকে বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে, একটা জিনিস দেখাব।’

টুনি উঠে নগেন্দ্রর ঘরে দিকে যাচ্ছে, রেবা তাকিয়ে দেখছে। ‘কষ্ট হয় দেখলে, দু- বছর আগে দেখেছি কী সুন্দর হাঁটত।’ আপন মনে রেবা বলল।

নগেন্দ্র মুখ ঘুরিয়ে তার ঘরের মধ্য দিয়ে বারান্দা দেখতে পেলেন। কীর্তি আঙুল দিয়ে কিছু একটা টুনিকে দেখাচ্ছে। তিনি বুঝলেন রমেনের দোকান আর সেদিনের ঘটনাকীর্তির কথা বলার বিষয়।

‘যতীন ওকে এনেছে ডাক্তার দেখাতে, মাঝে মাঝে ব্যথা হয়, অতীন যাতে ব্যবস্থা করে দেয় সেজন্যই এখানে আসা।’

টুনির এখানে আসার আসল উদ্দেশ্য সবার কাছে আড়াল করে রাখতে পারলেও টুনি তো একসময় জেনে যাবেই। জানিয়ে দেওয়াটা অর্থাৎ প্রেমপ্রকাশের সঙ্গে তার বিয়ে কোনোভাবেই হতে পারে না এই কথাটা টুনিকে কীভাবে বলবেন? নগেন্দ্র চিন্তায় পড়ে গেলেন।

দুপুরে খাওয়ার টেবলে অতীন জানাল, ‘আজই ডাক্তার দস্তিদারকে ফোন করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাইব, বেলভিউতে নয়তো ওর বাড়িতে গিয়ে দেখিয়ে আসব।’

বিকেলে অতীন ফোন করল। ডাক্তার দস্তিদারের সঙ্গে কথা বলে সে জানাল, ‘কাল সকালে ওর সাদার্ন অ্যাভেন্যুর বাড়িতে সকাল সাড়ে সাতটায় যেতে বললেন, টুনি তুমি রেডি থেকো।’

অতীন বেরিয়ে যেতেই নগেন্দ্র রেবাকে বললেন, ‘আজ আমি কিন্তু একটু বেরোব। অনেকদিন হাঁটাচলা করা হয়নি।’

‘দাদু আমি যদি যাই আপনার সঙ্গে অসুবিধে হবে?’ টুনি বলল।

‘অসুবিধে?’ নগেন্দ্র যেন ফাঁপড়ে পড়লেন।’ ‘অসুবিধে আর কী, ভালোই তো। নতুন জায়গা দেখতে তোমার ভালোই লাগবে। বউমা আমার সঙ্গে তা হলে ও চলুক।’

‘পূর্ণ সরকার রোডের দিকে যাবেন না। ওদিকে মানুষের ভিড় আর গাড়ি, রাস্তাও ভাঙাচোরা বরং হীরকনগরের দিকে যান।’ রেবা বেড়াবার রাস্তা বাতলে দিল টুনির কথা ভেবে। এটা নগেন্দ্র ও টুনির বুঝতে অসুবিধা হল না।

‘কাকিমা এর থেকেও ভিড় আর গাড়ির রাস্তা দিয়ে আমি রোজ হাঁটি।’

সালোয়ার-কামিজ বদলে টুনি শাড়ি পরে নিল। রাস্তায় বেরিয়ে তারা উত্তরে হীরকনগরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। নগেন্দ্র লক্ষ করলেন রাস্তার লোকেরা টুনির দিকে কীরকম করুণামিশ্রিত চোখে তাকাচ্ছে। স্বাভাবিকই। একটা সুশ্রী মেয়েকে এত অল্পবয়সেই দুমড়ে মুচড়ে যেতে দেখলে, তার নষ্ট হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি পলকের জন্য চোখে ভেসে উঠলে কার না মনে করুণা জেগে উঠবে!

‘টুনি এই যে জায়গাটা দেখছ এর নাম রাজা গার্ডেন। এখানকার সব জমি একসময় আমার ছিল।’

‘আপনার ছিল!’ অবাক হয়ে যাওয়া টুনি থমকে দাঁড়াল, তার সঙ্গে নগেন্দ্রও। টুনি এধার-ওধার তাকিয়ে তার বিস্ময়কে আরও বাড়িতে তুলল।

‘হ্যাঁ আমার ছিল, আমার মানে তোমার ঠাকুরদার ছিল। বাবার কাছে শোননি রাজা গার্ডেনের কথা? যতীন তো জন্ম থেকে এখানেই আঠাশ বছর কাটিয়েছে। তোমার দাদামশাই পটনার বড়ো উকিল ছিলেন তিনিই জামাইকে ওখানে নিয়ে যান। ওঁর দুটি ছেলের একটি অল্পবয়সেই কলেরায় মারা যায়, অন্যটি, তোমার বড়োমামা কলকাতায় গোয়াবাগানের বাড়িতে থেকে কলেজে পড়ে শেষে রামকৃষ্ণ মিশনে এখন স্বামীজি।’

নগেন্দ্র এই পর্যন্ত বলে হাঁটার জন্য পা বাড়ালেন। সিরসির করা ঠান্ডা একটা বাতাস বইছে। লক্ষ করলেন, টুনির গায়ে ফুলহাতা পাতলা কার্ডিগান। নিজের আলোয়ানটা গা থেকে খুলে টুনির গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘শীতটা এখন আমার দরকার। বউমার জন্যই এটা গায়ে জড়াতে হয় নইলে কথা শুনতে হবে। আচ্ছা পঁচাত্তরটা কি একটা খুব বেশি বয়স? তুমি কী বলো?’

টুনি ইতস্তত করছে দেখে বললেন, ‘কাগজে দেখি পঁয়তাল্লিশ বছরের এক প্রৌঢ়া গাড়ি চাপা পড়েছে, পঞ্চান্ন বছরের এক বৃদ্ধ গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে, পড়ে রাগ হয়। পঞ্চাশ-পঞ্চান্ন বছরকে প্রৌঢ়া-বৃদ্ধ বলা হয়, এসব কী? যারা এসব লেখে তারা কি ভালো করে মানুষজন দেখে না? একসময় বলতুম রাস্তাঘাট, গাড়ি-ঘোড়া, আরে ঘাট বলে এখন কিছু আছে? ঘোড়া তো তুমি চোখে দেখতে পাবে না, তবুও আমরা বলি, লিখিও।’

‘দাদু পুরোনো অভ্যাস চট করে যায় না, সময় লাগে।’

নগেন্দ্র দেখলেন টুনি হাসল, সারাদিনে এই প্রথম, বললেন, ‘কতদিনে পুরোনো অভ্যাস যায়?’

‘অনেকদিন লাগে, একপুরুষ, দু-পুরুষ।’

‘বরাবর চিৎপুর বলেছি এখনও বলি, অতীন বলে রবীন্দ্র সরণি। এটা অবশ্য এক পুরুষেই ধাতস্থ হবার মতো ব্যাপার কিন্তু সামাজিক মানসিক অনেক ধারণা, প্রথা যা বদ্ধমূল হয়ে মনে গেঁথে আছে, তাকে দু-এক পুরুষে উপড়ে ফেলা যায় না।

‘কেন যাবে না?’

নগেন্দ্র আড়চোখে তাকালেন নাতনির মুখের দিকে। চ্যালেঞ্জ জানানোর কোনো ইচ্ছা মুখে দেখতে পেলেন না। শান্ত প্রত্যয় মুখে লেগে রয়েছে।

‘আমাদের বংশে নাকি বঙ্গজদের সঙ্গে বিয়ে হয় না। একটা লোক আমাকে বিয়ে করতে চাইল, সে বঙ্গজ। বাবা-মা কিন্তু রাজি হয়ে গেল, কেন? কারণ লোকটির পরিবার, চাকরি, মাইনে, ডিগ্রি, চেহারা এইসব বিবেচনা করে তারা স্থির করলেন, লোকটি সুপাত্র, অতএব বংশের প্রথা ভেঙে ফেলা যায়।’

টুনির কথা শুনে নগেন্দ্রর মনে পড়ে গেল আজই যতীন বারান্দায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘যাকগে ওসব, ছেলেটা তো ভালো, পাকা চাকরি, অনেকদূর উঠতে পারবে, সংসারটাও ছোটো।’ তখন কিন্তু তিনিও আপত্তি জানিয়ে যতীনকে কিছু বলতে পারেননি।

‘এটা এমন কোনো গুরুতর প্রথা নয় যা ভাঙলে বংশে কলঙ্ক লাগবে। পাত্রের বংশটা তো সৎ, তা হলে জাত গোত্র নিয়ে মাথা ঘামাবার কী আছে?’

নগেন্দ্র ইচ্ছে করেই ‘কলঙ্ক’ ‘সৎ’ শব্দ দুটো ব্যবহার করলেন। প্রেমপ্রকাশ নিয়ে কথা বলার জন্য একটা ভূমিকা দরকার ছিল। তার মনে হচ্ছে সেটা বোধ হয় তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এবার আসল সমস্যার দিকে এগিয়ে যাওয়া-তবে মেয়েটি বুদ্ধিমতী, কথার প্যাঁচে ওকে জড়ানো সহজ হবে না।

‘তোমার বিয়ের জন্য যতীন চেষ্টা করেছিল নাকি?’ নগেন্দ্র না জানার ভান করে মনে করলেন এইভাবেই এগোতে হবে।

‘হ্যাঁ, অ্যাকসিডেন্টের আগে।’ এইটুকু বলে টুনি চুপ করে থেকে বুঝিয়ে দিল এই প্রসঙ্গে তার আর কিছু বলার নেই।

ওরা দু-জনে মুখার্জিদের বাড়ির সামনে পৌঁছেছে। গেটের কাছে কয়েক বর্গ গজ জমিতে বাগান করার একটা ক্ষীণ চেষ্টায় কয়েকটা গোলাপ আর একটা বাচ্চচা দেবদারু গাছ। নগেন্দ্র যতবারই আসেন প্রশংসা করেন গৌরী মুখার্জির এই প্রকৃতি প্রেমকে। আট মাসের নাতিকে দু-হাত ধরে হাঁটাবার চেষ্টা করছিলেন, গৌরী, গেটের সামনে নগেন্দ্র এবং একটি মেয়েকে দেখে বলে উঠলেন, ‘ওমমা আপনি!’

‘হ্যাঁ, আমি, মরে গিয়ে ভূত হয়ে এসেছি।’

‘কী আজেবাজে কথা বলেন, শুনে যে কী ভয় করেছিল। একজন বলল বোমায় নাকি আপনার একটা হাত উড়ে গেছে, আর একজন বলল স্ট্রোক হয়ে হাসপাতালে গেছেন।’

‘গুজব কী জিনিস এবার বুঝতে পারছেন, এই দেখুন।’ নগেন্দ্র দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন, ‘দুটোই আস্ত রয়েছে।’

‘এই মেয়েটিকে তো চিনলুম না।’

‘আমার বড়ো নাতনি, পটনায় থাকে। নাম টুনি, শমিতা। ওর পায়ে চোট তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছে। মুখুজ্যেমশাই এখন কেমন আছেন?’

‘ভালোই আছেন। যাচ্ছেন কোথায়?’

‘নাতনিকে জায়গাটা একটু ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি। আচ্ছা আসি।’

দু-জনে আবার হাঁটতে শুরু করল। নগেন্দ্র ভেবেছিলেন টুনির নিশ্চয় কষ্ট হচ্ছে এতটা হেঁটে আসার জন্য তাই মুখার্জিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে কথা বলেন যাতে টুনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিতে পারে পা দুটোকে।

‘দাদু কীরকম লেগেছিল তখন?’

প্রশ্নটা খাপছাড়া। নগেন্দ্র জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

‘মানে?’

‘মানে যখন বুঝতে পারলেন আপনি বেঁচে আছেন, সেই সময় আপনার মনে কোন জিনিসটা প্রথমেই এল?’ টুনি মাথা নামিয়ে রাস্তা দেখে চলতে চলতে বলল, মুখের ভাবটা বয়স্কদের মতো।

মুশকিলে পড়ে গেলেন তিনি। প্রথমে তো তার মনে কিছুই ছিল না। একেবারে সাদা কাগজের মতো। তারপর ধীরে ধীরে একটা অনুভূতি, শরীর কাঁপছে আর কঁকানির মতো একটা আওয়াজ বিনা চেষ্টাতেই গলা দিয়ে উঠে আসতে চাইছে। তখনও তাঁর চেতনায় সাড় ফিরে আসেনি, সেটা এল যখন মাথা নীচু করে দেখলেন পায়ের কাছে একটা মানুষের মতো কী যেন শুয়ে রয়েছে। মানুষটকে যখন চিনতে পারলেন তখন প্রথমেই-‘টুনি আমি ভয় পেয়ে গেছলুম আর মনে হয়েছিল, আমি মরিনি আমার আশপাশ সব আমি দেখতে পাচ্ছি, শব্দটাও শুনতে পাচ্ছি দু-মিনিট আগেও যেমন ছিলুম তেমনিই রয়েছি, একটা দারুণ ফিলিং আমি পেয়েছিলুম, বুঝলুম আমি বেঁচে গেছি।’

বাঁচাটা বোঝাতে নগেন্দ্র অবাক চোখে তাকিয়ে রইলেন টুনির দিকে। তারপর চোখ তুলে আকাশ, গাছপালা, বাড়িগুলোর উপর দিয়ে দৃষ্টি বুলিয়ে আবার চোখ রাখলেন টুনির মুখে। ‘আচ্ছা টুনি তোমার যখন অ্যাকসিডেন্ট হল, মানে যখন বাসের চাকাটা যে মুহূর্তে পায়ের উপর উঠেছে সেই মুহূর্তে কীরকম মনে হয়েছিল?’

দাঁড়িয়ে পড়ল টুনি। সরল হেসে বলল, ‘আমি জানিই না তখন আমার কী হয়েছে। বাসটা রিকশায় ধাক্কা মারতে ছিটকে রাস্তায় পড়েই অজ্ঞান হয়ে যাই, জ্ঞান ফেরে হাসপাতালে। তখন খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল, ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। পরে শুনেছিলাম, চাকাটা এক ইঞ্চি বাঁদিকে থাকলে আমার পায়ের পাতাটা নাকি কেটে বাদ দিতে হত। এটা শুনে অবশ্য স্বস্তি পেয়েছিলাম। তখনও অবশ্য জানতাম না আমি খোঁড়া হয়ে যাব, জানলে নিশ্চয়ই কাঁদতাম। এভাবে বেঁচে থাকাটা দাদু খুব কষ্টের।’

নগেন্দ্র হাঁটার জন্য পা বাড়ালেন। টুনির মুখের দিকে আর তিনি তাকালেন না। দু-জনে কথা না বলে মিনিট দুয়েক হাঁটার পর নগেন্দ্র ডানদিকের রাস্তা নেবার সময় বললেন, ‘এই জায়গাটায় আমার একটা গোয়াল ছিল।’

‘গোয়াল!’ টুনি ভ্রূ তুলল অবাক হয়ে। ‘গোয়াল কেন? দুধের ব্যাবসা করতেন?’

‘হ্যাঁ। আর ঘি তৈরি করতুম, ব্যাবসাটা ভালোই চলছিল। ওই যে একতলা সাদা বাড়িটা দেখছ ওখানেই ছিল। একরাত্রে আগুন লাগল, কী করে যে লাগল আজও তা জানি না। বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যতীন আর অতীনকে নিয়ে দেখলুম গোয়ালটা পুড়ে গেল। ওরা তখন খুব ছোটো। গোরুমোষগুলো অবশ্য বেঁচে যায়।’ নগেন্দ্র পিছন ফিরে দূরে বাড়ির বারান্দার দিকে তাকালেন।’

‘তারপর আর ব্যাবসা শুরু করেননি?’

‘নাহ। আর উৎসাহ পাইনি।’

নগেন্দ্র নিঃশব্দে কিছুটা চলার পর বললেন, ‘তখন এই জায়গাটা ছিল গ্রামের মতো, সন্ধ্যার পর রাস্তা দিয়ে চলতে গা ছমছম করত, শেয়াল ডাকত। খুব মন খারাপ লাগত, ভাবতুম কলকাতায় ফিরে যাই। মনে হয়েছিল জায়গাটা অপয়া।’

‘আপনি এসব মানেন? পয়া-অপয়া!’

‘মানি।’ আড়চোখে টুনির মুখ দেখে বুঝলেন উত্তরটা তার পছন্দ হয়নি। ‘তুমি বোধ হয় মানো না।’

টুনি উত্তর দিল না। হঠাৎই আনমনা হয়ে চলার গতি মন্থর করে কী যেন ভাবতে শুরু করেছে।

‘কী করবে ঠিক করেছ?’

‘কী করব মানে?’

‘মানে ভবিষ্যতে কী করবে?’

‘ওহহ, ভবিষ্যৎ?’ টুনি হাসল। ‘দেখা যাক।’

‘ভালো করে পড়াশুনো করো, এখন নানারকমের চাকরির রাস্তা খোলা আছে।’

‘এই খোঁড়া পায়ে রাস্তা দিয়ে চলা খুব শক্ত। দেখছেন তো লোকেরা কীরকমভাবে আমার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছে।’

নগেন্দ্র দেখেছেন ফলে মাথাটা গরম হয়ে উঠেছে, লজ্জাও বোধ করেছেন। প্রসঙ্গটা বদলাতে বললেন, ‘গানও তো একটা রাস্তা হতে পারে।’

‘তা পারে। একজন বলেছেন, ভালো করে শিখে নিয়ে গানের স্কুল করো, সাহায্য করবেন।’

‘বাহ খুব ভালো কথা, লোকটি কে?’

‘যেখানে গান শিখি সেখানে উনি তবলা বাজান।’

নগেন্দ্রর মুখ দিয়ে প্রায় বেরিয়ে আসছিল, প্রেমপ্রকাশ? সামলে নিয়ে বললেন, ‘তা হলে তো খুবই ভালো, তবলচি খুবই দরকারি লোক। গানবাজনার ব্যাপারটা এরা খুব ভালো বোঝে।’

‘উনি ছোটোবেলা থেকে গানবাজনার মধ্যে বড়ো হয়েছেন।’

নগেন্দ্র আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘তাই নাকি! বাড়িতে নিশ্চয় গানবাজনার চল আছে।’

টুনির মুখে হাসি ফুটল, বলল, ‘ওনার মা পটনার একজন নামকরা বাইজি, বলেছেন আমাকে গান শেখাবেন।’

নগেন্দ্র থমকে দাঁড়ালেন, এই তথ্যটাতো যতীন তাকে দেয়নি। কিশোরী বাইজি বলেছে ওকে গান শেখাবে তার মানে টুনির সঙ্গে কথা হয়েছে। ‘বাইজির সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওর বাড়িতে গেছলে?’

‘হ্যাঁ।’ টুনি উৎসাহ নিয়ে কথা বলছিল, এবার নগেন্দ্রর গলা কর্কশ হয়ে উঠতেই তার চোখে সন্দেহের ছায়া পড়ল। ‘কেন দোষের কিছু হয়েছে নাকি?’

‘আমাদের বংশের মেয়ে বাইজি বাড়ির চৌকাঠ মাড়িয়েছে, ভাবতে পারছি না!’

‘ভাবতেই পারছেন না!’ টুনির কপাল কুঁচকে গেল। ‘আমি ওঁকে প্রণামও করেছি, মা বলেছি, গানও শুনিয়েছি। তাই শুনে রাজি হয়েছেন তালিম দিতে।’

উপেক্ষা ঔদ্ধত্য স্পষ্ট টের পেলেন নগেন্দ্র টুনির বলার ভঙ্গিতে। তিনি আহত বোধ করলেন, একটু রাগও হল।

‘তুমি জান না বোধ হয় কত মানী নামি লোক আমাদের রায়চৌধুরী বংশে জন্মেছে। বারোভুঁইয়াদের এক ভুঁইয়া ছিল আমাদের পূর্বপুরুষ। আইসিএস, স্যার রায়বাহাদুর থেকে শুরু করে এমএলএ, বড়ো বড়ো কোম্পানির ডিরেক্টর, কলেজ প্রিন্সিপাল, হাইকোর্ট জজ, সমাজের বড়ো বড়ো মাথাওলা লোক প্রচুর পাবে আমাদের বংশে।’

নগেন্দ্র তালিকা বাড়াবার জন্য কৃতীদের সন্ধানে কয়েক সেকেন্ড থামতেই সেই ফাঁকে টুনি বলল, ‘দাদু আমাদের বংশে কলেজে পড়া অবিবাহিত খোঁড়া মেয়ে ক-জন ছিল?’

থতমত হলেন নগেন্দ্র। আঁচ করতে পারেননি এমন একটা প্রশ্ন আতে পারে।

নিশ্চিত গলায় টুনি বলল, ‘যতদূর জানি একজনও ছিল না। আমার সমস্যাটা শুধু আমারই ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে, এটা আমার বাঁচারও সমস্যা। বুঝি না এর সঙ্গে বংশমর্যাদা বা কলঙ্কের কী সম্পর্ক? তা হলে বলি ওই বাইজির ছেলে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছেন।’

‘তুমি তাতে রাজি হবে?’ চোখ বিস্ফারিত করে নগেন্দ্র তাকালেন।

‘কেন হব না! আমারও তো আশ্রয় চাই। ভবিষ্যতের সিকিউরিটি চাই। এই চাওয়ার অন্যায় কোথায়? মানুষটাকে আমি অনেকদিন ধরে দেখেছি। সৎ ভদ্র আর সবথেকে বড়ো কথা বিশ্বাস করা যায়। সেই সুপাত্রটি তো আমার হাঁটা দেখেই সটকান দিলেন।’

টুনির মুখের ক্ষীণ হাসিটি নগেন্দ্রকে জানিয়ে দিল এই মেয়ের সঙ্গে তর্ক করা বৃথা। বংশের কথা তুলে ওকে ঘায়েল করা যাবে না, আত্মীয় সমাজে মুখ দেখানো যাবে না বলেও ওকে থামানো যাবে না, আবেদন-নিবেদনেও টলবে না।

‘আচ্ছা দাদু আপনি বোধ হয় এই রাজা গার্ডেনের বাইরে বিশেষ যাননি।’

নগেন্দ্র বুঝলেন টুনি কী বলতে চাইছে। বললেন, ‘লেখাপড়া আমার বিশেষ হয়নি, কোনোক্রমে ম্যাট্রিক পাশ, তোমার থেকে কম শিক্ষিত।’

অপ্রতিভ হয়ে টুনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না না আমি ওভাবে বলিনি, আমি বলছি কলকাতার বাইরে কখনো গেছেন কি না।’

‘গেছি খুব ছোটোবেলায় বাবা-মার সঙ্গে পুরী আর কাশী। এখন কিছুই মনে নেই। স্কুলে পড়ার সময় গেছি দার্জিলিং। ব্যস।’

‘চলুন না আমার সঙ্গে পাটনা। দিনকতক থেকে আসবেন।’

নগেন্দ্র অনুভব করলেন টুনির স্বরের আন্তরিকতা। একটু বিচলিত হলেন। এত বছর হয়ে গেল যতীন বা নমিতা কখনো তাকে নিজেদের কাছে নিয়ে যাবার কথা বলেনি।

‘গিয়ে থাকব যতীনের বাড়িতে? যেকোনোদিন আমাকে যেতে বলেনি! না দিদি তা পারব না।’

‘আপনি প্রেমের বাড়িতে থাকবেন, ওহো বলতে ভুলে গেছি, প্রেম হচ্ছে প্রেমপ্রকাশ শর্মা, যে আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। ওদের বাড়িতে চমৎকার গেস্টরুম আছে, একেবারে আলাদা।’

‘এটাও পারব না। কারণটা নিশ্চয় বুঝতেই পারছ। শ্মশানের দিকে একপা বাড়িয়েই আছি। এখন আর সংস্কার ধ্যানধারণা বদলাতে পারব না। তুমিও বোধহয় সিদ্ধান্ত বদলাবে না।’

টুনি জবাব না দিয়ে শুধু হাসল।

পাঁচ

বাড়ি ফিরে টুনি দোতলায় উঠে গেল। একতলা ঘরের দরজা খোলা দেখে নগেন্দ্র ঢুকলেন। তক্তাপোশে তোষক পেতে বিছানা করা। শোভা ঝাঁট দিয়ে মুছে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেছে। বাইরে অন্ধকার নামছে, আলো জ্বলছে ঘরে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে যতীন খবরের কাগজ পড়ছিল। বাবাকে দেখে সে কাগজ রেখে উঠে বসল।

‘দু-তিনটে জরুরি মামলা ফেলে রেখে এসেছি। পরশু একটার হিয়ারিং আছে। কালকে সকালেই পূর্বা এক্সপ্রেসে ফিরব। ডাক্তার কী বললেন সেটা আর জানা হবে না। টেলিফোন করে জেনে নোব। যদি বলেন অপারেশন করলে পা ইমপ্রুভ করবে তা হলে ও থেকে যাবে। তুমি ইতিমধ্যে ওই ব্যাপারটা নিয়ে ওকে বুঝিয়ে বলো।’

‘বলেছি।’

‘অ্যাঁ! কখন বললে?’

‘একটু আগে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে।’

‘কী বলল টুনি?’

নগেন্দ্র খোলা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন, দেখলেন রমেনের দোকানটা একই অবস্থায় রয়েছে। উদগ্রীব যতীনের চোখ মুখের ওপর। বিছানায় বসে শুকনো হেসে তিনি মাথা নাড়লেন, ‘ওকে বোঝানো যাবে না। ও ভবিষ্যতের জন্য আশ্রয় চায় সিকিউরিটি চায়। এবার কী বোঝাবে?’

‘কেন আমার আশ্রয়টা কি আশ্রয় নয়? আমি কি সিকিউরিটি দিতে পারি না? আমার বাড়িতে ওর অংশ থাকবে। আজীবন বসবাসের উইল করে দোব এই মাসেই। বিয়ের জন্য যে টাকা খরচ হত তার দ্বিগুণ টাকার কিষাণ বিকাশপত্র ওর নামে কিনে দোব। আশ্রয় আর সিকিউরিটি এর থেকে বেশি আর কী চাই?’

‘থাকার জায়গা আর টাকার ব্যবস্থা থাকলেই কি মেয়েদের আর কোনো সমস্যা থাকবে না?’ নগেন্দ্র আরও বলতেন তাদের আবেগের সমস্যা, জননী হবার ইচ্ছা, স্বাধীনভাবে ঘর বাঁধার বাসনা, কিন্তু এসব কথা ছেলের কাছে তুললেন না। যতীনের কথা শুনে তার মনে হচ্ছে এগুলো ওর মাথায় ঢুকবে না। সাক্ষ্য প্রমাণ আর আইন দিয়ে ঘেরা জীবনে কোনো ছিদ্র রাখেনি যার মধ্য দিয়ে মানবিক যুক্তিগুলো ঢুকতে পারে।

বিছানায় বাবার পাশে বসে দু-হাতে মুখ ঢেকে যতীন বসে রইল। নগেন্দ্র বিষণ্ণ চোখে দেওয়াল দেখতে লাগলেন। উই ধরেছে, বাসাটা প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা। খবরের কাগজটা নিয়ে তিনি উঠে গেলেন বাসাটা ভাঙতে।

‘তোমাদের আর কী, দাঁত বার করে লোকের হাসি তো তোমাদের দেখতে হবে না। রাস্তায় দোকানে বাজারে কোর্টে, ছেলেমেয়েদের স্কুলে, ঝি-চাকররা পর্যন্ত আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে ফিসফাস করবে। এতগুলো লোকের মুখে চুনকালি মাখাবে শুধু নিজের সুখের জন্য?’

নগেন্দ্র খবরের কাগজে উইয়ের ভাঙা বাসা সংগ্রহ করে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলতে যাবার সময় যতীনের মুখটা দেখলেন। লাল হয়ে ওঠা দুটো চোখ কোটর থেকে যেন বেরিয়ে আসতে চাইছে। সারা মুখ ফুলে উঠেছে। ঘাম গড়াচ্ছে গাল বেয়ে। নগেন্দ্রের মনে হল যতীন উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে, মুখের চামড়া ফেটে রক্ত ছিটকে বেরোবে।

‘যতীন তুই শুয়ে পড়।’ নগেন্দ্র ভীতস্বরে ফিসফিসিয়ে বললেন, ‘তুই উত্তেজিত হোসনি, শান্ত হ।’

‘কীসের শান্ত হওয়া। মেয়ে তোমার নয়, আমার। ওর হাড়মাস আলাদা করব।’ বলতে বলতে যতীন ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল, হতভম্ব নগেন্দ্র সিঁড়িতে যতীনের পায়ের আওয়াজ থেকে বুঝলেন সে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠেছে।

বসার ঘরে সোফায় বসে টিভি দেখছিল টুনি, বাংলা সিরিয়াল হচ্ছে।

দেওয়ালের ধারে খাবার টেবিলে বিছানার চাদর পেতে রেবা কীর্তির প্যান্ট ইস্ত্রি করছিল। শোভা টিভি সেটের সামনে মেঝেয় বসে আটা মাখছিল। যতীন ক্ষ্যাপার মতো ছুটে এসে ঘরে ঢুকল, টুনির সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত চেপে বলল, ‘কী বলেছিস দাদুকে, আশ্রয় চাই, সিকিউরিটি চাই? কেন, ওগুলো কি তোকে দিইনি না দিতে পারব না?’

হাতের কাজ থামিয়ে রেবা আর শোভা মূর্তির মতো জড়ো হয়ে গেল। টুনি যেন চোখের সামনে বাজ পড়তে দেখল এমনভাবে তাকাল বাবার দিকে।

‘বল! চুপ করে আছিস কেন, বল?’

‘বাবা!’ টুনির গলা দিয়ে কোনোক্রমে বেরিয়ে এল শব্দটা।

‘তোকে আঁতুড়েই মুখে নুন দিয়ে মেরে ফেলা উচিত ছিল।’

সাড় ফিরেছে রেবার। সে যন্ত্রের মতো বলল, ‘কী হয়েছে বটঠাকুর, আপনি অমন করে বলছেন কেন?’

‘সাধে কী আর বলছি। বাইজির তবলচি ছেলের সঙ্গে প্রেম করেছে,এখন তাকে বিয়ে করার জন্য নেচে উঠেছে। নাচা বার করছি। দেখি পা-টা দেখি।’

টুনির সামনে এসে দাঁড়াল যতীন, মেয়ের বাঁপায়ে ফুটবলে শট নেওয়ার মতো একটা লাথি মারল। কাতরে উঠল টুনি।

‘বাবা।’ কইমাছের মতো লাফিয়ে উঠল সে যন্ত্রণায়।

‘বাবা বলা বার করছি।’ যতীন আর একবার পায়ে লাথি মারল।

‘বটঠাকুর এ কী করছেন।’ গরম ইস্ত্রিটা প্যান্টের উপর রেখে রেবা এগিয়ে এসে যতীনের হাত ধরে টানল। প্রতিরোধ পেয়ে যতীন আরও খেপে উঠল। ঝটকা দিয়ে হাতটা ছাড়িয়ে টুনির চুল মুঠোয় ধরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে সোফা থেকে তাকে মেঝেয় ফেলে দিল।

বসার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে নগেন্দ্র। গম্ভীর স্বরে হাঁক দিলেন, ‘যতীন, যথেষ্ট হয়েছে।’

‘না যথেষ্ট হয়নি।’ কথাটা বলে যতীন তার ভারী শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল টুনির ডান পায়ের গোছের উপর।

যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে টুনি আর্তনাদ শুরু করল। শোভা হাতের গামলাটা ছুড়ে ফেলে যতীনের পা জড়িয়ে ধরল। পা ছুড়ে নিজেকে শোভার কবল থেকে মুক্ত করে সে গোড়ালি দিয়ে দুরমুস করার মতো আঘাত করে চলল টুনির পায়ের পাতার উপর।

শোভা যতীনের প্যান্ট হাঁটুর কাছে আঁকড়ে ধরে টানাটানি করতে করতে চেঁচিয়ে উঠল, ‘একটা আস্ত কুমির। ও মেসোমশাই দাঁড়িয়ে কেন, মেয়েটাকে বাঁচান।’

নগেন্দ্রর সংবিৎ ফিরে এল। দ্রুত টেবলের কাছে গিয়ে গরম ইস্ত্রিটা তুলে নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন যতীন সামনে ঝুঁকে দু-পায়ে মাড়াচ্ছে টুনির দুটো পায়ের পাতা। মুখ দিয়ে কাঠচেরাইয়ের মতো শব্দ বেরোচ্ছে। জ্ঞান হারিয়ে টুনি মেঝেয় দলা পাকিয়ে পড়ে।

‘হারামজাদা।’ চিৎকার করে নগেন্দ্র ছুটে গিয়ে ইস্ত্রিটা দিয়ে যতীনের মাথার পিছনে আঘাত করলেন একবার, দু-বার। যতীন ‘বাবা’ বলেই মুখ থুবড়ে পড়ে গেল টুনির দেহের পাশে।

সারা ঘর নিস্তব্ধ। কীর্তির প্যান্ট পুড়ে গেছে। পোড়া গন্ধে রেবারই প্রথম হুঁশ ফিরল। নগেন্দ্রর হাত থেকে ইস্ত্রিটা তুলে নিয়ে টেবলে রেখে দিল।

‘বাবা বটঠাকুরকে দেখুন।’

নগেন্দ্রর আগে শোভা ঝুঁকে পড়ল। যতীনের কাঁধটা ধরে নাড়া দিয়ে বলল, ‘ও বউদি আমার যেন কেমন লাগছে, তুমি দ্যাখো তো।’

রেবা ভয়ে ভয়ে কাছে এসে যতীনের ঘাড়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের ক্ষীণ ধারাটি দেখে কেঁপে উঠল।

‘বাবা ভয়ে ভয়ে কাছে এসে যতীনের ঘাড়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের ক্ষীণ ধারাটি দেখে কেঁপে উঠল।

‘বাবা আপনি দেখুন তো, আমি বুঝতে পারছি না।’

নগেন্দ্র মুখ নীচু করে তাকালেন। ঝাপসা ভাবে দেখলেন একটা মানুষ উপুড় হয়ে পড়ে। কে ওটা? চোখ সরু করে চেনার চেষ্টা করলেন। রমেন? না, এ তো রমেন নয়, তা হলে হাতে পায়ে ঝলসানো মাংস দেখা যেত, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসত, মুখে কালি মাখা থাকত। এর তো পরিষ্কার জামাপ্যান্ট। নগেন্দ্রর মাথার মধ্যেটা গুলিয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে তিনি সোফায় বসে পড়লেন।

জল এনে শোভা ছিটোচ্ছে টুনির মুখে। রেবা টেলিফোনের বোতাম টিপে বিরক্ত হয়ে রিসিভার রেখে বলল, ‘এনগেজড!’ একটু পরে আবার রিসিভার তুলে বোতাম টিপে পেয়ে গেল অতীনকে।

‘শিগ্গিরি বাড়িতে এসো। ভয়ংকর একটা ঘটনা ঘটে গেছে। ডিটেলে এখন বলতে পারব না, সব কাজ ফেলে চলে এসো। বটঠাকুর বোধ হয় মারা গেছেন।’

ক্যাসেটে ফিতে জড়িয়ে যাওয়া ভিডিও ফিল্মের মতো তিনজন স্থির অনড় হয়ে বসে। কেউ মুখ দিয়ে শব্দ বার করছে না। শুধু টুনি জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে যন্ত্রণায় চাপা গোঙানির মতো আওয়াজ মাঝে মাঝে করে যাচ্ছে।

মিনিট কুড়ি পর গেটের সামনে মোটর থামার শব্দ পেয়ে শোভা চাপা গলায় বলল, ‘দাদা এলেন।’

ঘরে পা দিয়েই অতীন প্রথম তাকাল মেঝেয় পড়ে থাকা যতীন তারপর রেবার দিকে। দ্রুত এগিয়ে এসে যতীনের হাত তুলে নিয়ে নাড়ি দেখল, কণ্ঠনালি দু-আঙুলে ধরে আবার হৃৎস্পন্দন পরীক্ষা করল, চোখের মণি দেখল। তারপর রেবাকে বলল, ‘কী করে হল?’

রেবা যতীনের ঘাড়ের দিকে আঙুল তুলল। তারপর আঙুলটা ঘুরিয়ে দিল টেবলে রাখা ইস্ত্রিটার দিকে, শেষবার আঙুল ঘুরে এল নগেন্দ্রকে লক্ষ করে।

‘কেন?’

‘বটঠাকুর অকথ্যভাবে মারছিলেন টুনিকে, কারণটা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। টুনি মরেই যেত। ওকে বাঁচাতে গিয়ে বাবা ইস্ত্রিটা দিয়ে মারেন। টুনিকে হসপিটালে এখুনি নিয়ে যেতে হবে। ওর পা গুঁড়িয়ে দিয়েছে বটঠাকুর।’

অতীন আঙুল দিয়ে টুনির পায়ের পাতায় আলতো চাপ দিতেই সে তীক্ষ্ন স্বরে কাতরে উঠল। ‘ওকে পরে দেখছি, হসপিটালে নয় ডক্টর দস্তিদারের কাছে আগে নিয়ে যাব তারপর নার্সিংহোমে। তার আগে পুলিশকে খবর দিতে হবে।’

নগেন্দ্র কথা না বলে অতীনের গতিবিধি আর কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। এবার বললেন, ‘পুলিশকে কেন! যতীন কি মরে গেছে?’

অতীন বলল, ‘হ্যাঁ।’

নগেন্দ্র বললেন, ‘পুলিশ কি আমায় ধরে নিয়ে যাবে?’

জবাব না দিয়ে অতীন ফোনের কাছে গেল। নগেন্দ্র এবার জিজ্ঞাসা করলেন রেবাকে ‘বউমা তুমি দেখেছ শোভা দেখেছে আমি ওকে মেরে ফেলার জন্য মারিনি, মেয়েটাকে শুধু বাঁচাতে চেয়েছিলুম।’

রেবা বলল, ‘হ্যাঁ।’

নগেন্দ্রর মুখে স্বস্তি ফুটে উঠল। তখনই কীর্তির গলা শোনা গেল সিঁড়ি থেকে। ‘এ কী সব দরজা হাট করে খোলা, চোর-ছ্যাঁচোড় ঢুকে-।’ ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সে হতবাক হল।

রেবা বলল, ‘এখন কোনো প্রশ্ন কোরো না। জেঠু মারা গেছেন, টুনিদিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে, তোমার সাহায্য দরকার।’

নগেন্দ্র বললেন, ‘বউমা আমি একটু বারান্দায় যাব, বড্ড গরম লাগছে।’

‘বেশিক্ষণ থাকবেন না, বাইরে বেশ ঠান্ডা।’

ঘর ছেড়ে নগেন্দ্র বারান্দায় এলেন। সত্যিই বাইরে ঠান্ডা। তিনি আরামবোধ করলেন। রাস্তায় লোকজন চলছে, রাত বেশি হয়নি। রেলিং-এ হাত রেখে অরুণোদয়ের চারতলায় তাকালেন, বারান্দাটা অন্ধকার। দেবেন এখন কী করছে? ওর পরিবার এখন কেউ নেই। ছেলেটা পালিয়ে গেছে, দেবেন একা বসে বোধহয় টিভি দেখছে।

ডানদিকে তাকালেন। রাস্তার কাছাকাছি বাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে, দূরটা অন্ধকার। কয়েক ঘণ্টা আগে টুনিকে নিয়ে ওদিকে গেছলেন, ওকে দেখিয়েছেন গোশালা কোথায় ছিল। এই বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক হাতে যতীনের অন্য হাতে অতীনের হাত ধরে তিনি দাউ দাউ পুড়ে যেতে দেখেছেন গোশালা। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঝাপসা হয়ে এল তার চোখ।

তার হঠাৎ মনে হল দূরে যেন অটো রিকশার ইঞ্জিনের শব্দ হল। তিনি বাঁদিকে পূর্ণ সরকার রোডের দিকে দৃষ্টি রাখলেন। শব্দটা এগিয়ে আসছে। একটা অটো রিকশা দেখতে পেলেন। থরথর করে উঠল তার বুক। একটা প্রচণ্ড শব্দের জন্য তিনি তৈরি হলেন, চোখ বন্ধ করে। তখন দেখলেন রমেন চিৎকার করতে করতে দোকান থেকে ছুটে বেরিয়ে আসছে। তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে পড়ল, ‘মেসোমশাই’। ওর কাছে ধার হয়ে গেল বারোটা টাকা। যাত্রীভরা অটো রিকশাটা বারান্দার সামনে দিয়ে হীরকনগরের দিকে চলে গেল।

পিঠে আঙুলের ছোঁয়া পেয়ে নগেন্দ্র মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন। কীর্তি!

‘পুনর্জন্মটা আমার আর সেলিব্রেট করা হল না রে। ভেবেছিলুম তোর বান্ধবীকে দেখব, কী কপাল দেখ। ভেবেছিলুম দেবেন নস্করকে দেখতে পাব। এসে দেখি ওর বারান্দাটা-‘

নগেন্দ্র মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়েই বলে উঠলেন, ‘আরে আলো জ্বলছে!’ বারান্দায় কোনো লোক নেই। তিনি একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন, দেবেন আসবেই, গ্রিল ধরে তাকিয়ে থাকবে, হয়তো তাকে দেখে হাতটা তুলবে। আজ তিনিও হাত তুলবেন। কিন্তু অন্ধকারে দেবেন কি তাকে দেখতে পাবে?

‘কীর্তি বারান্দার আলোটা জ্বেলে দে তো।’

তখনই পুলিশের জিপ এসে গেটের সামনে থামল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *