বনানীদের বাড়ি

বনানীদের বাড়ি – মতি নন্দী – উপন্যাস

নর্থ এন্ড কমার্শিয়াল কলেজের দোতলা থেকে বনানী আরও তিনটি মেয়ের সঙ্গে নেমে ফুটপাথে পা দিয়েই রাস্তার ওপারে তাকাল।

পাঞ্জাবির দোকানে রুটি আর কষামাংস খাওয়ার প্রস্তাব উঠেছে কিন্তু বনানী রাজি নয়। তাকে টিউশনিতে যেতে হবে। আসলে সে ভীষণ একটা কৌতূহলের মধ্যে নেমে পড়েছে। টাইপ করার সময় সে দেখতে পেয়েছিল হিরু একটা স্কুটার চালিয়ে দু-বার আসা-যাওয়া করল। ওর স্কুটার আছে এটা তার জানা নেই। তবে চালক যে হিরুই প্রথমবার পিছনটুকু দেখেই সে বুঝতে পারে। এমন লম্বা, রোগা এবং ঝাঁকড়া চুল সংবলিত ছেলে হিরুর সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে পর্যন্ত সে দেখেনি। মিনিট দুয়েক পরেই ও যখন ফিরে আসছে, বনানী ওর মুখ তিন-চার সেকেন্ডের জন্য দেখতে পায়। মনে হল হিরু আড়চোখে একবার দোতলার দিকে তাকাল। লম্বা সাইনবোর্ডটা দোতলার জানালাগুলোর নীচেই।

ওর যাওয়া এবং আসার মন্থর ধরনটা দেখে বনানীর মনে হয়েছিল নিছকই সময় কাটাবার জন্য এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আরও মনে হয়, আসা-যাওয়াটা কয়েকবারই হয়েছে। কিন্তু কেন?

‘মীরা খাওয়াবে বলেছে, জীবনে এমন ব্যাপার আর কিন্তু ঘটবে না বনা।’

শুধু কৌতূহল মেটাবার জন্যই সে ওদের সঙ্গে গেল না। রাস্তার ওপারে হিরু গভীর মনোযোগে স্কুটারটা পরীক্ষা করছে উবু হয়ে। বোঝাই যাচ্ছে কারোর জন্য অপেক্ষা করছে।

দু-বার মাত্র আলাপ। বনানীর মনে পড়ল, প্রথম দিনেই ওকে বলেছিল, কোথায় টাইপ-শর্টহ্যান্ড শেখে এবং কোন সময়ে তার ক্লাস। বনানীর হঠাৎ মনে হল, তার জন্যই হিরু অপেক্ষা করছে।

‘না রে কাল যাইনি, আজ ও কী ভাববে, শুরুতেই কামাই।’

‘মীরার পেটে অনেক গপপো জমে আছে। কাল দু-জনে ট্রেনে সারা দুপুর বেড়িয়েছি, আয় না শুনবি। খেতে তোকে হবে না।’

ওরা কিন্তু খুব চাপ দিল না। ওদের সঙ্গে বনানীর বন্ধুত্ব হয়েছে এখানেই, টাইপ শিখতে এসে। তুমি থেকে তুই সাতদিনেই, কিন্তু মাখামাখির পর্যায়ে সে যেতে পারেনি। সম্পর্কটা আলগা সখ্যের বেশি করেনি। হিরু স্টার্ট দিচ্ছে স্কুটারে-এক হাতে হ্যান্ডেল, অন্য হাতে সিটটা ধরে মুখ নীচু করে। একবার যদি এদিকে তাকায় তা হলে চোখাচোখি হবে। বনানী ঠিক করল সে হাসবে।

কিন্তু হিরু তাকাল না।

স্কুটারে উঠে উত্তরে হাতিবাগানের দিকে কুড়ি-পঁচিশ মিটার এগিয়ে, রাস্তার এপারে এসে ফুটপাথ ঘেঁষে থামল। ঝুঁকে এক চিরুনিওলাকে কিছু বলতেই লোকটা টুল থেকে উঠে দু-তিনটি চিরুনি ওর হাতে দিল।

বনানী হাতঘড়ি দেখল। ঘড়িটা ওর মায়ের। স্কুল ফাইনাল পাশ করার পর মা একদিন দেরাজ থেকে বার করে।

‘বিয়ের পর অনেক কিছুই তো একে একে গেছে, এটা তুই রেখে দে।’

বনানীর বাবা অপূর্ব দত্ত ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে বড়ো হয়েছে জ্যাঠার কাছে। ওকালতি পাশ করার পর জ্যাঠাই তার বিয়ে দিয়ে পাঁচিল তুলে বাড়ি ভাগ করে তাকে আলাদা করে দেন। তরুণ উকিল অপূর্বকে তখন কয়েকটা বছর কষ্টের মধ্যে কাটাতে হয়েছে। তিন ভাড়াটেদের মধ্যে রাস্তার উপর ওষুধের দোকানটা তার ভাগে পড়েছিল। প্রধানত ভাড়ার দুশো ষাট টাকাই সেদিন সম্বল ছিল আর অলকার গহনা।

সত্যিই তার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বনানী পাঁচমাথার মোড়ের দিকে তাকাল। একটা দোতলা বাস আসছে কিন্তু ট্রামের টিকি দেখতে পেল না। বাস বড়ো ঝাঁকায়, ধাক্কাধাক্কি বেশি, অসভ্য লোকেরা সুযোগ নেয়। পারতপক্ষে সে বাসে ওঠে না। কিন্তু ও কি চিরুনি কিনতেই সল্টলেক থেকে শ্যামবাজার এসেছে?

বনানী অলস ভঙ্গিতে এগোল। ফুটপাথে হরেকরকমের সামগ্রী সাজিয়ে চারদিকে দোকান, বাড়িগুলোর দেওয়ালে দোকান, মাঝে চলার পথটাকে সরু করে দিয়েছে। জলের পাইপ বা টেলিফোন কি ইলেকট্রিক তার পাতার জন্য ফুটপাথটা কবে খোঁড়া হয়েছিল। ইটের টুকরো, কাদা আর গর্তে পথটা বিরক্তিকর হয়ে আছে। বনানীর ভিড় ভালো লাগে না। এখুনি সিনেমা ভাঙবে। পিলপিল করে মানুষ সিনেমাহলগুলো থেকে বেরিয়ে আসবে। কিছু মুখে সুখ, কিছু মুখে বিষণ্ণতা। ট্রামে-বাসে-রিকশায় বা হেঁটে এই জনতা সরে যাবে, এসে পৌঁছবে আর একদল। একই বেশ, একই গন্ধ, একই সাজ।

হিরু খুব মন দিয়ে চিরুনি দেখছে চোখের কাছে এনে। যেন প্লাসটিকের এই জিনিসগুলো ছাড়া পৃথিবীতে আপাতত গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই। বনানী সামনে তাকিয়ে চিরুনিওয়ালার পাশ দিয়ে যাবার সময় একটু মন্থর হল। সে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না। ওর যদি কথা বলার ইচ্ছে থাকে তা হলে দেখতে পেয়ে নিশ্চয় ডাকবে।

‘আরে বনা! ছুটি হল বুঝি?’

‘হিরু! এখানে যে?’

‘এই একটা চিরুনি কিনতে। সরু-দাড়ার তেমন পাচ্ছি না, চুলে বড্ড ময়লা জমে, কোনটা নিই বলো তো?’

‘চিরুনিতে ও ময়লা উঠবে না, শ্যাম্পু করা দরকার।’

‘শ্যাম্পু? বলছ? তা হলে তাই-ই, কিন্তু কোন শ্যাম্পু কিনব?’

‘ক্লিনিক প্লাস।’

চিরুনিওলাকে পার হয়ে বনানী শাড়ির দোকানের সামনে এসে থামল। ছাপা-শাড়ি সার দিয়ে ঝুলছে ভিতরে এবং বাইরে। মাঝবয়সি দুই গিন্নি মুখ তুলে শাড়ি দেখছে। সে তাদের সঙ্গে যোগ দিল। ও ডাকেনি। হয়তো দেখতে পায়নি কিংবা চিনতে পারেনি।

না পারার কোনো কারণ আছে কী! দু-বার তারা কথা বলেছে। বনানী বাবা-মার সঙ্গে ওদের ফ্ল্যাটে গেছল দু-মাস আগের এক সন্ধ্যায়। কয়েক সপ্তাহ পর হিরু তার বাবা-মার সঙ্গে এসেছিল তাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণে। কতদিন হবে। বড়ো জোর কুড়ি দিন। এর মধ্যে ভুলে যাওয়া সম্ভব কি?

তাকে উপেক্ষা করার মতো ছেলে ও নয়। যতটুকু আলাপ হয়েছে, বনানী ওর মধ্যে দেমাক তো পায়ইনি বরং একটু বেশি সরল, উচ্ছ্বাসপ্রবণ মনে হয়েছে।

‘মা বলেছিল, তুমি আমারই বয়সি। কিন্তু তোমাকে তো অনেক ছোটো দেখাচ্ছে…আমার উনিশ। কিন্তু এমন ঢ্যাঙা হওয়ার জন্য কত বড়ো মনে হয় বলো তো!’

‘পুরুষমানুষ লম্বাই তো ভালো।’

‘কিন্তু তাই বলে এমন সিড়েঙ্গি-মার্কা বকের মতো!’

প্রথম আলাপে ও নিজেকে নিয়েই কথা বলে যায়। বাবা-মা বসবার ঘরে। হিরুর মা-ই ওদের দু-জনকে হিরুর ঘরে গিয়ে গল্প করতে বলেন।

‘বড়োদের সঙ্গে বসে থাকবে কেন, হিরু তোমার ঘরে বনানীকে নিয়ে যাও।’

শোনামাত্র বনানীর মায়ের চোখে একটা কালো ছায়া পড়ে।

‘না, এখানেই থাক না।’

‘ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প করুক, কী বড়োদের আজে-বাজে কথা শুনবে? যাও, তোমরা ও ঘরে।’

হিরুর মা মৃদু ধমকের সুরে বললেন। ধমকটা তার প্রাক্তন বান্ধবীকে। মা শুকনো হেসে মাথা হেলিয়ে বনানীকে অনুমতি দেন। বাবার ঠোঁটে পাতলা হাসি ফুটে উঠেছিল। কদাচিৎ কথা বলেন, কোনো কোনোদিন একটিও নয়।

‘আমার হাইট ছ-ফুট এক, আমার অন্তত পঁচাশি কেজি ওজন হলে তবেই মানাত। কিন্তু কত ওজন জান? বলো তো?’

বনানী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে।

‘তবু আন্দাজ করো।’

ভ্রূ কুঁচকে আন্দাজ করার ভান করতে করতে সে লক্ষ করে হিরুর চোখদুটো একটু কোটরে বসা, ভুরু ঘন, কপাল ছোটো, মাথার চুল ঘাড় ও কান ঢাকা, মুখের আকার চৌকো ধরনের, অসম্ভব ফর্সা রং এবং ঠোঁটজোড়া গোলাপি।

‘সত্তর কেজি।’

‘ধ্যাৎ, তোমার আন্দাজের কোনো ক্ষমতাই নেই। এই ডিগডিগে চেহারায় কী… স্রেফ ষাট কেজি। পরশু গ্লোবে আমরা সিনেমা দেখতে গেছলাম, তখন ওজন নিয়েছি। বাবার কত জান…বাহাত্তর, মায়ের আটান্ন! তোমার?’

উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই ও অন্য প্রসঙ্গে চলে গেছল। ঘর থেকে বেরিয়ে একসময় তারা বারান্দায় দাঁড়ায়। চারজনের কথার টুকরো ভেসে আসছিল। টেলিফোন বেজে ওঠায় হিরুর ঘরের দরজার পর্দাটা যতবার ফুলে ভেসে উঠেছিল বনানী মায়ের মুখ দেখতে পাচ্ছিল বিরক্ত, সন্দিগ্ধ এবং অসুস্থ ভাব, যা সারাদিন রুগণ মুখটায় বিরাজ করে, তা আরও স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। শৈশব থেকেই সে মায়ের এই মুখ দেখে আসছে।

‘দিদি ভেতরে এসে দেখুন না, আরও অনেক ডিজাইনের আছে।’ দোকানের কাউন্টার থেকে লোকটা ঝুঁকে রয়েছে। শাড়ি কেনার উদ্দেশ্যে পছন্দ করতে করতে যেসব ভাব মুখে ফুটে ওঠে নিশ্চয় সেইরকম হয়েছে। বনানী অপ্রতিভ হয়ে মাথা নাড়ল। মনের ভাব মুখে বুঝতে না দেওয়ার ব্যাপারে কখনো সে সফল হয়নি। এ ব্যাপারে তার মা কখনো ব্যর্থ হয় না।

‘নতুন টাঙ্গাইল এসেছে দিদি, ভেতরে আসুন।’

বনানী মুখ ফিরিয়ে নিল এবং চোখাচোখি হল। হিরু তার দিকেই তাকিয়ে। চোখমুখ কুঁচকে জিব বার করে ভ্যাংচাল। না হেসে উপায় রইল না বনানীর।

‘দেখেও যে দেখলে না।’

‘কই, দেখতে তো পাইনি, সত্যি বলছি।’

‘বারে, অত জোরে বনা বনা বলে দু-বার ডাকলাম। তুমি তাকালেও, তখন এই চিরুনিটা তুলে দেখালাম তোমায়।’

‘মোটেই দেখাওনি।’

‘দেখাইনি?’

‘না। চিরুনি চোখের সামনে তুলে ধরে নিজেই দেখছিলে, ওকে দেখানো বলে না।’

শুনতে শুনতে ওর চোখে দুষ্টুমির মজা ঝকমক করে উঠল। বনানী বিব্রত বোধ করল। বোকার মতো সে ধরা পড়ে গেছে।

‘হাঁ দেখেছিই তো তোমায় কিন্তু তুমি আগে আমায় দেখেছ, তবু সামনে দিয়ে স্কুটার চালিয়ে চলে গেলে।’

‘ডাকলে না কেন?’

‘কেন ডাকব?’

‘আমি তোমায় দেখেছি, জানলে কী করে?’

‘তা হলে স্কুটার নিয়ে ওপারে দাঁড়িয়েছিলে কেন?’

‘ক্লাচটা কেমন আটকে যাচ্ছিল, তাই-‘

একটা অমীমাংসিত ফুটবল ম্যাচের রিলে শুনে রেডিয়ো বন্ধ করে দেওয়ার মতো ও বলল, ‘এখন কোথায়, টিউশনিতে?’

‘হাঁ, কী করে জানলে?’

‘তোমাদের বাড়িতে, তোমার মা-ই বলেছেন।’

বনানী সতর্ক হল মা কী বলেছেন তার সম্পর্কে?

চিরুনিওলা নিস্পৃহ চোখে দু-জনকে দেখছিল। এবার মুখ ফিরিয়ে জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে রইল।

‘লক্ষ করেছ, অনেক লোক আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, কেন বলো তো?’

বনানীও তা লক্ষ করেছে। ফুটপাথ ঘেঁষে স্কুটারে বসে একটি ছেলে কথা বলছে দাঁড়িয়ে-থাকা একটি মেয়ের সঙ্গে, এতে তো তাকাবেই।

বনানীর মনে পড়ল ওদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হিরু এই কথাটা আবার তুলেছিল।

‘হাঁটলে আমাকে বকের মতো দেখায়।’

‘তুমি জানলে কী করে? নিজের হাঁটা কি কেউ দেখতে পায়?’

‘ক্লাসের ছেলেরা বলেছে, একজন তো আমায় লগা বলে ডাকে।’

‘তোমাকে মোটেই খারাপ দেখায় না।’

‘তুমি তো আমার হাঁটা দেখোনি, সুতরাং মিথ্যে কথা বললে।’

‘না দেখলেও বুঝে নিতে পারি।’

‘আচ্ছা, হেঁটে দেখাচ্ছি তোমায়।’

প্রায় আট হাত লম্বা বারান্দায় ও, এদিক থেকে ওদিকের রেলিং ছুঁয়ে, কখনো জোরে কখনো ধীরে পাঁচবার যাতায়াত করে থামল। ব্যাপারটায় বনানীর মজা লেগেছিল তাই হেসে ফেলে।

‘হাসলে। আমি অবশ্য জানতাম হাসবে। সবাই হাসে, আমার হাঁটা হাস্যকরই।’

ওর কণ্ঠস্বরে দুঃখ বা অভিমান নয়, এক ধরনের হতাশা, সেটা বনানীর কানে চাপা রাগের মতো ঠেকল। নিজের উচ্চচতা ও শীর্ণতাকে যেন সহ্য করতে পারছে না। ভারসাম্য বা সামঞ্জস্য শরীরে পেতে চায়। এটার অভাব সম্পর্কে ও খুবই সচেতন। হয়তো সারাক্ষণই ভাবে আর মনে করে সবাই তাকাচ্ছে আর হাসছে।

‘সব মানুষের হাঁটাতেই কিছু-না-কিছু হাস্যকর জিনিস আছে।’

‘বেশ তুমি হাঁটো তো, দেখি হাসি পায় কি না।’

ও হাত ধরে টেনে তাকে বারান্দার মাঝখানে দাঁড় করায়। তখন বনানীর মনে হয়, ঘর থেকে মা যেন এই দিকে তাকিয়ে, মুখে একই ব্যাজার ভাব। বাবা কিছু বলছে, যা হিরুর মা ও বাবা চোখে বিস্ময় নিয়ে শুনছে-হয়তো মামলার গল্প। সম্ভবত ডাকাতি বা খুনের।

বনানী হাঁটেনি।

‘চিরুনি পছন্দ হচ্ছে না।-আচ্ছা ওটাই দিন তো।’

চিরুনি পকেটে রেখে স্কুটারে স্টার্ট দিল।

‘ওঠো, পৌঁছে দিই।’

‘না না ট্রামেই যাব।’

‘ভয় হচ্ছে, উলটে পড়ব?’

জেদি ভঙ্গিতে বনানী পিছনের সিটে বসল। ভয় কিছুটা অবশ্যই আছে। কিন্তু কৌতূহলটা আরও বেশি। দোতলা বাসগুলো যখন গা ঘেঁসে যাবে বা সামনে থেকে মিনিবাস যখন আসবে তখন কেমন লাগবে!

‘তোমার স্কুটার আছে, জানতাম না তো?’

‘এটা কিনব ভাবছি। আমারই এক আত্মীয়ের, ট্রায়াল দিচ্ছি।’

‘চালানো শিখলে কোথায়, কবে?’

যেরকম ঝাঁকুনি দিয়ে স্কুটারটা চলতে শুরু করল এবং টলমল করে উঠল তাইতে বনানী অস্বস্তি পাচ্ছে। সামনে ট্রাম দাঁড়িয়ে, বাঁদিকে রাস্তার ওপর ভিড়। হিরু ডানদিকে ঝুঁকে দেখে নিয়ে ট্রামের গা ঘেঁসে এগোল। সামনে আর একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে। বনানী চোখ বুজে হিরুর পিঠে মুখ চেপে ধরল।

‘যা ভয় করছিল।’

দুটো ট্রামের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে যাবার অনেক পরে বনানী চোখ মেলে। হিরুর পিঠ ও ঘাড়ের পেশিগুলো তখনও শক্ত হয়ে আছে।

‘স্কুটার তুমি চড়ো না।’

‘কেন?’

‘সব জিনিস সকলের জন্য নয়। কলকাতার ট্রাফিক মারাত্মক রকমের রেকলেশ।’

‘তাতে কী হয়েছে, আমিও রেকলেশ হব।’

‘কী লাভ! সব গাড়িই বিরাট বিরাট, ধাক্কা লাগলে তুমি উড়ে যাবে।’

গলি থেকে আচমকা একটা রিকশা বেরিয়ে এসেছে। হিরু ব্রেক কষল। বনানীর মুখ ওর পিঠে ঠেকল।

‘সত্যিই তুমি কী লম্বা। সামনের দিকে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।’

‘এটা কিনছি কেন জান! হাঁটাচলার বদলে বসে বসে গেলে কেউ আর দেখবে না।’

‘এটা কিন্তু তোমার বাতিক। লম্বা লোক কি…’

রূপবাণী সিনেমা হলের সামনে, রাস্তা পার হবার জন্য তিনটি যুবক দাঁড়িয়ে। তাদের সামনে দিয়ে স্কুটারটা যখন যাচ্ছে, বনানীর চোখ পড়ে মাঝের জনের উপর। বাসু, তার এক বছরের বড়ো ভাই। পিঠোপিঠি হলেও সে অবশ্য ‘দাদা’ বলে।

দেখতে পেয়েছে কি? স্কুটারে একটা ছেলের পিছনে যদি মেয়ে থাকে, চোখ আপনা থেকেই পড়বে। বনানী মুখ ফিরিয়ে পিছনে তাকাল। মনে হল, বাসুর সঙ্গে তার চাহনি যেন মিলল। মনে হল, বাসুর চোখে বিস্ময় দেখল।

বাসু চেনে না হিরুকে।

‘দাদা, কাল মা-র বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আমাদের, যাবি তো?’

‘মা-র বন্ধু আছে নাকি! কোত্থেকে জুটল আবার?’

‘স্কুলের বন্ধু। দারুণ ভাব ছিল। স্কুল ছাড়ার পর দু-জনের প্রথম দেখা পঁচিশ বছর বাদে বড়োমাসির নাতির ভাতে।’

‘এতদিন পর!’

‘ওরা বাইরে বাইরেই কাটিয়েছে, ভদ্রলোক ইকনমিকসের প্রফেসর, কানাডায়ও দু-বছর ছিলেন ডক্টরেট করার জন্য। এখন যাদবপুরে পড়াচ্ছেন, একটিই ছেলে, বি এ ফার্স্ট ইয়ার। ওরা সল্টলেকে ফ্ল্যাট কিনেছে। মা-র বন্ধুও এম এ পাশ।’

‘মা-র বন্ধু!’

বাসু অবাক হয়নি, শুধু ব্যঙ্গভরে ভ্রূ তুলে রাখে।

‘তোরা যা।’

হিরুরা যেদিন সন্ধ্যায় পালটা নিমন্ত্রণে আসে সেদিন বাসু দুপুরে বেরিয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় ফিরেছিল। হিরুকে ও দেখেনি। বনানী বুঝতে পারে ভদ্র মার্জিত শিক্ষিত লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা, আলাপ বাসু এড়াতে চায়। ও যখন ক্লাস এইট থেকে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করল, বোমা পাইপগানে দক্ষতা অর্জন শুরু করল, রাতের পর রাত বাড়ির বাইরে কাটাতে লাগল তখন কোনো শাসন, কোনো নিষেধ সতেরো বছরের বাসুকে করা হয়নি। বাবা নির্বিকার ছিলেন এখনকার মতোই। মাকে তো কোনোদিনই গ্রাহ্যের মধ্যে আনেনি। ওকে নিয়ে বনানী ছাড়া আর কেউ মাথা ঘামায় না।

বাসু জেনে গেছে ও পিছিয়ে পড়েছে এবং যাচ্ছে। পরিচয় দেবার মতো কিছুই ওর নেই। এগিয়ে এসে আর সে সমান হতে পারবে না এটাও বোধহয় বুঝে গেছে। ওর পিছিয়ে যাওয়াটা বন্ধের জন্য কেউ কখনো চেষ্টা করেনি। কেন করেনি, হয়তো একদিন সে এই প্রশ্নটা তুলবে। রাগে একদিন ও ফেটে পড়বে কিংবা পড়ছে। কিরণবালার সঙ্গে ব্যাপারটা হয়তো সেটাই।

বাসু তাকে নিশ্চয় দেখেছে। মাকে কি বলে দেবে?

‘তোমার মেয়েকে তো দেখলুম এক ছোঁড়ার পিছনে বসে, গালে গাল ঠেকিয়ে।’

‘কে বনা!’

‘খুব তো বলো, মেয়ে কত ভালো, কত সংসারের জন্য চিন্তা করে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে টাইপ শিখছে…’

ওরা হেদুয়া ছাড়িয়েছে। সামনে বিবেকানন্দ রোড।

‘হিরু থামাও, নামব।’

‘এখানে নাকি!’

‘বাকিটা হেঁটেই যাব।’

বনানী স্কুটার থেকে নেমে পড়ল।

‘এই তো সামনের গলিটা। তুমি এখন তো বাড়িই যাবে।’

‘দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিলে কি অসুবিধা হবে?’

‘না তা কেন।’

বনানী ওর চোখ থেকে চাহনি সরাতে গিয়ে আবার ফিরিয়ে আনল। হিরুর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে, চোয়াল শক্ত, চোখে ঝোড়ো রং। ঠিক এইরকম বাসুরও হয় যখন রাগতে শুরু করে।

‘আচ্ছা পৌঁছে দাও।’

হিরু একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে। স্কুটারের ইঞ্জিন বন্ধ করেনি। চাহনিতে এবার ফুটে উঠল আহত অভিমান। মাথা নেড়ে সে ক্লাচ ছাড়ল। ঝাঁকুনি দিয়ে কয়েক গজ গিয়েই ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। হিরু মাথা নুইয়ে স্টার্ট করার জন্য লাথি ছুড়ছে। জ্যা-টানা ধনুকের মতো পিঠটা বেঁকে। কিছু একটা ওর মধ্যে থেকে থরথর করছে। সিটে হাত রাখল বনানী।

‘পৌঁছে দেবে না?’

স্টার্ট নিয়েছে। হিরু উঠে বসল এবং সামনে তাকিয়ে ঘাড় শক্ত করে স্কুটার চালিয়ে দিল। বনানী তাকিয়ে রয়েছে। হিরু বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে পৌঁছে একটুও গতি কমাল না। ডানদিক থেকে আসা একটা দোতলা বাসের রেডিয়েটর ছুঁয়েই প্রায় গোঁয়ারের মতো স্কুটারটা সোজা বেরিয়ে গেল। এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশ দেরি হলে… বনানী কয়েক সেকেন্ড ধরে বুকের মধ্যে কম্পনটা অনুভব করল। সেটা থিতিয়ে যাবার পর ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা ছেয়ে এল।

মন্থর পায়ে ছাত্রী-বাড়ির দিকে যেতে যেতে তার মনে হল, যদি আজ কামাই করতাম। ছাত্রীর মা পরদিনই নিশ্চয়ই জানিয়ে দেবে। আগের দিদিমণি ফাঁকিবাজ ছিল, বড্ড কামাই করত, আর সেজন্যই তাকে ছাড়াতে হয়েছে।

দূরে একটা স্কুটার দেখে বনানী থমকে দাঁড়াল। লোকটা বেঁটে, মাথায় হেলমেট। হিরুর সঙ্গে তৃতীয়বার মাত্র আলাপ হল। হয়তো আবার আসবে, টাইপ কলেজের সামনে। কিন্তু অদ্ভুত লাগছে এই বিষণ্ণতাটা, এতে সে অভ্যস্ত নয়।

টেবলে খাওয়ার ব্যবস্থাটা এই পরিবারে নতুন। হিরুদের ফ্ল্যাটে ওরা প্রথমে একসঙ্গে বসে খেয়েছিল।

‘আমাদেরও তো একটা টেবল পড়ে আছে তিনতলার ঘরটায়, ঠিকঠাক করে নিলে হয়।’

ফেরার সময় ট্যাক্সিতে বলেছিল বনানীর বাবা। অলকা আড়চোখে স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘টেবলে খাওয়া! কোথায় টেবলটা পাতবে?’

‘কেন দোতলার বারান্দায়। রান্নাঘরের সামনে অতটা খোলা জায়গা, তিনদিকে দেওয়াল, শুধু ওপরে অ্যাসবেসটাস দিয়ে নিলেই প্রায় একটা ঘর।’

বনানী লক্ষ করেছিল, তার মা-র চোখে তক্ষুনি সন্দিগ্ধ ছায়া ভেসে ওঠে। সব কিছুতেই তার সন্দেহ। এখুনি যেন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে এমন এক পৃথিবীতে তার মা বসবাস করে, এক ধরনের জানোয়ারের মতো, এক ধরনের শিকারি পাখির মতো, শীর্ণ গলা উঁচিয়ে চোখকান খুলে সর্বদা হুঁশিয়ার হয়ে।

রাত প্রায় সাড়ে দশটা। টেবলের দু-দিকে তারা চারজন। একদিকে বাবা এবং সে, অন্যদিকে মা এবং বাসু। কেউ কথা বলছে না। সাধারণত তাদের মধ্যে কথা হয় না, দরকার না পড়লে। অদৃশ্য এক দেওয়াল দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা খেয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে আর প্রত্যেকে আলাদাভাবে অ্যাসবেসটাসে বৃষ্টি পড়ার শব্দ শুনছে। হঠাৎ তারা চারজনই খাওয়া থামিয়ে পরস্পরের দিকে এক পলক তাকিয়েই আবার খেতে শুরু করল। বাবার ঘন ভ্রূদুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য জুড়ে গেল, মায়ের গলার পেশি শক্ত হয়ে উঠল, বাসু মুখ নামিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকাতে গিয়েও তাকাল না। বনানী তাকে লক্ষ করছে।

কিরণ রুটির থালা হাতে বাসুর পাশে দাঁড়িয়ে। পরিবারে বাসু ছাড়া কেউ রুটি খায় না।

‘দোব?’

‘হুঁ।’

‘তরকারি?’

বাসু মাথা হেলাল। কিরণ রান্নাঘরে ফিরে যাচ্ছে আর তাকে অনুসরণ করছে মায়ের চোখ। বনানী তাকিয়ে মায়ের চোখে। ছোট্ট ভ্রূ কুঞ্চনের পর থেকেই বাবার মুখে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

কিরণ আবার আসছে। বাসু মুখ তুলে তাকাল। বনানী নিশ্চিতভাবে বুঝে গেল একটা নীরব বার্তা কিরণের কাছে পৌঁছল। সে এটাও জানে, মাথা না ফিরিয়েই মা সেই বার্তাটি দেখতে পেয়েছে। মা সব কিছুই দেখে এবং শোনে, রা কাড়ে না কিন্তু মনে করে রাখে।

‘শরীর কেমন, মাথা ধরাটা ছেড়েছে?’

বাবা নিজেকে বাধ্য অনুভব করল কেন মা-র শরীরের খবর নিতে? মা বোকা নয়, এবং জানে কথার পিছনে কী প্রচ্ছন্ন থাকে। এত বছর ধরে এই কথাবার্তা হয়ে আসছে। বনানী ঠাওর করে উঠতে পারল না, দু-জনের মধ্যে কাকে সে বেশি করুণা করবে। মায়ের চুপ করে থাকার মধ্যে চাপা হিংস্রতা রয়েছে।

মোটমাট বাবা ও স্বামী আর এখন মাকে যেমন দেখতে এর থেকে ভালো কিছু বিয়ের সময় ছিল না। বনানী ওদের বিয়ের সময় তোলা ছবি দেখেছে। মায়ের কপাল তখনও এমনি উঁচু আর চওড়া ছিল, থুতনি যৎসামান্য। বড়ো হাঁ মুখ। বিয়ের আগে বাবা শুধু ছবি দেখেছিল মায়ের। হয়তো হাড়ের উপর চামড়াসর্বস্ব এখনকার দেহ মায়ের তখন ছিল না। বাসুর জন্মের পরই সুতিকায় আক্রান্ত হয়, এক বছর পরই বনানীর জন্ম। ভাঙা শরীর আর সারেনি, উপরন্তু হাঁপানি এবং মাথা ধরা কয়েক বছর ধরে তাকে অধিকাংশ সময় বিছানায় ফেলে রাখছে।

বনানীর এক এক সময় মনে হয়, বাবা কি ছবিতেও বুঝতে পারেনি ভাবী-স্ত্রীর রূপ কেমন! নাকি নিছকই এক সাব-জজের চতুর্থ জামাই হবার গর্বলাভেচ্ছু সদ্য-পাশ উকিলের তরল মানসিকতার শিকার হয়েছিল। বনানীর তিন মামা, চার মাসি। বোধ হয় বাবার ধারণা ছিল, শ্বশুর তাকে পসার জমাতে সাহায্য করবে। কিন্তু বছরখানেকের মধ্যেই তিনি হৃদরোগে মারা যান। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে সাব-জজ দাদামশাই কোনোক্রমে চতুর্থটিকে পার করেন। ছোটোমাসির আর বিয়ে হয়নি, বরং বলা ভালো, বিয়ে করেনি।

বাবার তরুণ বয়সের কথা বনানী কিছুই জানে না, জানবার আগ্রহও নেই। তার ধারণা, ওদের বিচার করার অধিকার তার নেই, যদিও অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে মাঝে মাঝে করে। এমন এক বাড়িতে তার বাস, সেখানে প্রত্যেকে পরস্পরকে লক্ষ করে যায় এবং আলাদা আলাদা জীবনযাপন করে।

একমাত্র ব্যতিক্রম কিরণ। হিরুদের নিমন্ত্রণ করার তিন সপ্তাহ আগে সে এই পরিবারে রান্না, ঘরমোছা, কাপড়কাচা ইত্যাদির কাজে লাগে। হাওড়া জেলার গ্রাম থেকে এসে আগে দুটি বাড়িতে কাজ করেছে। একমাত্র ওর আচরণ হাবভাব থেকে মনে হয় এখানে তার চারপাশের সবকিছুই স্বাভাবিক। বাসনমাজার ঝিয়ের সঙ্গে ও ঝগড়া করে, রান্নার সময় গুনগুন করে হিন্দি গানও গায়। বনানীর আন্দাজ, তার থেকে কিরণ বছর চারেকের বড়ো।

রাতের খাওয়া শেষে বাবা একটি কলা খাবে। বনানী ছোটোবেলা থেকে দেখে আসছে, একবারের জন্যও অন্যথা হয়নি। কোর্ট থেকে ফেরার সময় ব্রিফকেসে ভরে আনে, কখনো কখনো পুরো একটি ছড়াই।

কিরণ কলা রেখে গেল। বাবা অতি সাবধানে টেনে টেনে খোসা ছাড়াচ্ছিল। সবকিছুই এত মনোযোগ দিয়ে, যা বনানীর হাঁপ ধরায়। নিজেকে টেনে রাখার কেনই বা এত দরকার? ধীর, রাশভারী চালটার মধ্যে কি কিছু মেকি ব্যাপার আছে?

সবার আগে টেবলে বসার মতোই, সবার আগে বাবাই টেবল থেকে ওঠে। হঠাৎ বাসু আজ আগে উঠে পড়ল। তিনজনে মুখ তুলে তাকাতেই সে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে, থুতনিতে উদ্ধত ভঙ্গি তুলে হাত ধোবার জন্য কলঘরে ঢুকল। বাসু ইদানীং নানাভাবে বাবাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করছে, এটাও তাই।

‘নীচে যাচ্ছি, কাজ আছে।’

রাতের খাবার পর এ কথাটা বলেই বাবা নীচে নেমে যায়। সদর দরজার ডাইনে, রাস্তার দিকে একখানিই ঘর। সেটি বাবার সেরেস্তা। বাঁদিকে ওষুধের দোকান। দোকানটি তোলার জন্য বছর দশেক আগে মামলা করে বাবা হেরে গেছল। পঁচিশ বছরে ভাড়া সতেরো টাকা বেড়ে এখন দুশো সাতাত্তর। সদরে একটা কাঠের ফলক আছে। খুব কাছে চোখ এনে ইংরেজি অস্পষ্ট অক্ষরগুলো কোনোক্রমে পড়া যায়: অর্পূবচন্দ্র দত্ত, বি এ এল এল বি, এবং নীচে লেখা: প্লিডার।

একতলায় সেরেস্তা আর কলঘর ছাড়া কিছু নেই। দোতলায় খাবার টেবলে যে চেয়ারে মা বসে, তার পাশেই রেলিং। সেখান থেকে নীচের উঠোন আর সেরেস্তার দরজাটা দেখা যায়। জীর্ণ একটা চামড়ামোড়া ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতলে পা তুলে বাবা সত্যিই কিছু কাজ করে কিনা বনানীর তাতে সন্দেহ আছে। দোতলা থেকে দেখা যায় শুধু পা-দুটি।

কিরণ টেবল থেকে বাসন সরিয়ে নেবার পর মা আবার তার চেয়ারে এসে বসে, ট্রানজিস্টর রেডিয়ো এবং সেলাই নিয়ে। টিভি খুব একটা দেখে না। আজও বসেছে। সেলাই করার মতো কিছু-না-কিছু জিনিস তার থাকেই। চেয়ারগুলো প্রত্যেকের ব্যক্তিগত সম্পত্তি যেন, কঠোরভাবে সংরক্ষিত। ভুলেও কেউ অন্যের চেয়ারে বসে না। অন্তত বনানী কখনো বসেনি।

নিজের ঘরে উপুড় হয়ে বনানী গল্পের বইয়ে ডুবে গেছল।

‘তোর আজ ফিরতে অ্যাতো দেরি হল?’

মা ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। বনানীর প্রথমেই মনে হল, বাসু কি কিছু বলেছে? গত দু-দিন সে মা-র সঙ্গে বাসুকে কথা বলতে দেখেনি। তা হলে হঠাৎ কেন এই প্রশ্ন!

‘রোজই তো ওই সময়ের মধ্যে ফিরি।’

রাত এগারোটা বেজে গেছে। কিরণের কাজও শেষ। তিনতলায় ছাদের ঘরে সে উঠে না যাওয়া পর্যন্ত মা চেয়ার থেকে ওঠে না। সিঁড়ির আলো জ্বলছে অর্থাৎ বাবা এখনও নীচে। বাসু এখন নিশ্চয় তার ঘরে এবং সেটি বনানীর ঘরের পাশেই।

‘পরশু হিরুর সঙ্গে দেখা হল। স্কুটারে যাচ্ছিল, আমাকে লিফট দিল।’

‘হিরু!… ওহ সুধার ছেলে।’

বনানী ঠিক করে ফেলেছে, ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জানার চেষ্টা করার আগেই সে মা-র কৌতূহল মিটিয়ে দেবে। কখনো কখনো মায়ের জন্য তার দুঃখ হয়, সেইসঙ্গে নিজের উপরও রাগ হয় মাকে করুণা করার জন্য। কখনো কখনো বাবার জন্যও দুঃখ হয়। দু-জনের মধ্যে কে প্রথম দুঃখ পাওয়ার ব্যাপারটা শুরু করায়? একসময় আমরা দু-জনেই শিশু ছিলাম, আমি এবং দাদা, এখন ওর বাইশ আমার একুশ। বনানীর মনে পড়ল, হিরুকে সে এই ধারণা দিয়েছে যে তারা সমবয়সি অর্থাৎ তারও বয়স উনিশ। ধারণাটা ভেঙে দিতে হবে। তখন ওর আচরণ কি বদলে যাবে? হয়তো নয়।

কিন্তু অন্যান্য বাবা-মা যে আচরণ করে আমাদের বাবা-মাও কি তাই করেছে? আমাদের কোলে নিয়ে ওরা কি পরস্পরের দিকে তাকিয়ে কখনো হেসেছে, চুমু খেয়েছে?

কল্পনা করা যায় না। বনানীর যতদূর মনে পড়ে বাড়িটাকে সে হুবহু এইরকমই দেখে আসছে-নীরব, শান্ত, গোছানো। বাবা ধৈর্যপরায়ণ এবং সেটা যথেষ্ট কঠিন কাজ। অনেক রাত পর্যন্ত কেন যে নীচের ঘরে কাজের অছিলায় কাটায়, বনানী তা বোঝে। কিন্তু ধৈর্য ছাড়াও বাবার কাছ থেকে আরও বেশি মা নিশ্চয়ই আশা করতে পারে। এক এক সময় তার মনে হয়, ওরা দু-জনে চেঁচিয়ে বিশ্রী ঝগড়াঝাঁটি করে আবার যদি ভাব করে নেয় তাহলে কিছুটা সহনীয় হবে পরস্পরের কাছে। তারপরেই মনে হয়, বোঝাবুঝির ব্যাপারে সে ততটা পাকা নয়, দেখতেও সুশ্রী নয়। মায়ের মতোই সাদামাটা তবে আলগা একটা লাবণ্য আছে। হয়তো বয়সকালে আর থাকবে না।

‘ছেলেটা নাকি পড়াশুনোয় ভালো, একটু চঞ্চল মনে হল, তবে বদমাইশ নয়।’

মা খাটের একধারে বসেছে। বনানী ভাবল, কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে কি মা এসেছে? বন্ধুর ছেলের সম্পর্কেই শুধু ভাবছে না, অন্য কোনো বিষয় এখন ওর মনে?

‘ওর মা আর আমি খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। পাশাপাশি বাড়ি, কতদিন আমাদের বাড়িতে রাতে থেকেছে, একই বিছানায় শুতাম। বাবা হোমিয়োপ্যাথি ডাক্তার, টানাটানির সংসার। তবে লেখাপড়ায় সুধা, ওর তিনভাই খুব ভালো ছিল। ছোটোভাই বিলেতে না আমেরিকায় কোথায় যেন আছে বলল।’

বনানী অস্বস্তি বোধ করল। এইসব স্মৃতি নিয়ে নাড়াচাড়া কেন? যেসব জিনিস তার নিজের এলাকায় নয় বলে সে মনে করে, সেইগুলি চিন্তা করাতে বাধ্য করানোটা সে অপছন্দ করে। এইসবের মধ্যে মানসিক শান্তি নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে। নিজেকে নিয়ে মায়ের এই কথা বলার ইচ্ছাটা এক ধরনের দুর্বলতাই ফাঁস করে দিচ্ছে।

টাইপ কলেজের মেয়েরা যা নিয়ে বকবক করে তাতে কিছুই আসে যায় না। কেননা ওরা তাৎপর্যহীন ব্যক্তিগত কথাবার্তাই বলে। বাইরের পৃথিবীর ছিটেফোঁটা প্রতিবিম্ব যে ধরনের ছবি সকলে অজান্তে শুষে নেয় রাস্তা থেকে, অথবা খবরের কাগজের খবর থেকে, সেইগুলোই ওরা বয়ে নিয়ে আসে।

কিন্তু মা-র ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অন্যরকম। কেন, বনানী তা জানে না। মন থেকে ভার লাঘব করা নয়, কোনো গোপন কথা বলাও নয়। মা-র কথাগুলো অসংবদ্ধ মনে হলেও ওর মনের মধ্যে যে ভাবনা চলেছে তার পটভূমিকা কিছু কিছু কথার মধ্যে দিয়ে বনানীর কাছে ধরা পড়ল।

‘সুধার মা বিষ খেয়ে মারা যায়। নিজেই খেয়েছিল না কেউ খাইয়ে দিয়েছিল, নাকি ভুল করে খেয়ে ফেলেছিল-সেটা আর শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি। অনেকে অনেক রকম গল্প বলল। তবে সুধার দূর সম্পর্কের এক মাসির সঙ্গে ওর বাবাকে জড়িয়ে কিছু কথা কেউ কেউ বলেছিল, আমরা তখন ছোটো, ওসব কথা উঠলে আমাদের সরিয়ে দেওয়া হত।’

বনানী বুঝতে পারছে না, যেসব লোককে সে চেনে না, জানে না, তাদের নিয়ে কেন মা কথা বলতে শুরু করল। অতীত থেকে হঠাৎ অকারণে উঠে আসার মতো গল্প এটা নয়।

‘সংসারের সবকিছু ওই বয়সে সুধা ঘাড়ে নেয়। বাইরের কথাবার্তা ওর কানেও যেত, বাড়ি থেকে বিশেষ আর বেরোত না, স্কুলে যাওয়া ছাড়া। আমার সঙ্গেও কথা বলত কম। আত্মহত্যা করলে তো চিঠিমিটি লিখে রেখে যায়!’

চুপ করে থেকে মা দেওয়ালে তাকিয়ে রইল। বনানী তার মায়ের মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। হঠাৎ ঘরে এল কেন? এইসব কথাবার্তাই বা কেন! কে কবে আত্মহত্যা না খুন হয়েছে তা শুনে কী লাভ!

ঘরের ছাদে ভারী কিছু একটা সরানোর শব্দ হল। ঠিক ওপরেই কিরণের ঘর। পুরোনো ভাঙা আসবাব আছে। কিরণ এখনও তা হলে ঘুমোয়নি।

মা মুখ তুলে কড়িকাঠে তাকিয়ে।

‘তোকে বিরক্ত করছি বোধহয়।’

‘না না।’

‘সুধার মায়ের মুখের আদল পেয়েছে ছেলেটা।’

‘হিরু!’

‘হ্যাঁ।’

যেন কিছু গোপন তাৎপর্য আছে, বুকে ভার চাপানো এমন এক নীরবতা ঘরে বিরাজ করে উঠল।

‘ছেলেটাকে দেখে প্রথমেই ওর দিদিমার কথা মনে পড়েছিল। কেন যে মারা গেল! অথচ সুধার বাবা কী শান্ত, ভদ্র মানুষই না ছিলেন। বিয়ে করতে পারতেন, বোধ হয় ছেলেমেয়েদের মুখ চেয়েই করেননি। জীবনে অনেক কষ্ট করে সুধা এখন সুখী।’

মায়ের মুখে বিষাদের ছায়া। একঘেয়ে স্বরে কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়াল। এখন যা ভাবছে তার সঙ্গে কথার সম্পর্ক যেন বহু দূরের।

‘চলি।’

এ পাশের ঘরটা বাবা-মায়ের। বনানীর ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দার রেলিংয়ে ঝুঁকে, মা নীচের সেরেস্তার দিকে তাকাল একবার, তারপর নিজের ঘরে ঢুকল।

যতক্ষণ না মা শুচ্ছে ততক্ষণ সেইজন্যই কি বাবা নীচে অপেক্ষা করে থাকে? মুখে চুরুট দিয়ে, একটা বই চোখের সামনে রেখে বোধ হয় কাজের ভান করে যায়। অতক্ষণ সেরেস্তার কাজ করার মতো পসারওলা উকিল নয়। টেনেটুনে সংসার চালাবার মতো আয় করে। বাবার ব্যাঙ্কের পাসবইটা বনানী একদিন দেখে ফেলেছিল। ঠিক পাঁচশো টাকা জমা আছে। দু-জনের শোবার ঘরে যাওয়ার মধ্যে সাধারণত মিনিট পনেরোর তফাত থাকে, যেন ওরা সামান্যতম ঘনিষ্ঠতাও এড়াতে চায়, অথচ ওরা একই বিছানায় শোয়।

মিনিট দশেক পর সিঁড়ির আলো নিবিয়ে বাবা দোতলায় উঠে এল। একমাত্র বনানীর ঘরের খোলা দরজা দিয়ে একফালি আলো বারান্দায় এসে দোতলার অন্ধকারকে বিভক্ত করেছে। বাবা ঘরে ঢুকে গেলে সে অন্ধকার জুড়ে দেয়।

বনানী অপেক্ষা করছে।

‘টাইপ কেমন শেখা হচ্ছে?’

দরজায় বাবা দাঁড়িয়ে।

‘হচ্ছে।’

‘বাসু শুয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’

যথারীতি বাবার গলা মৃদু ভারী কিন্তু একটু চাপা।

‘এবার শুয়ে পড়ো।’

‘আর একটুখানি…’

বাবা পাশের ঘরে চলে গেল। সুইচের শব্দ হল কিন্তু কথাবার্তার নয়। এরকমই হয় প্রতি রাত্রে। বাঁদিকে বাসুর ঘরটা নিঃশব্দ। ঘরের সিলিংয়েও আর শব্দ নেই।

বই চোখের সামনে রেখে বনানীর বারবার হিরুর, তার মা এবং দিদিমা-র কথা মনে পড়ল। বই রেখে আলো নিবিয়ে সে শুয়ে পড়ল। ঘুম সহজে তার আসে না। জীবনের নানান সময়ের ভাবনা আর ছবি সার দিয়ে এইসময় তার মনের মধ্যে চলতে শুরু করে। একসময় ঘুম আসে, কিন্তু ঘণ্টা দুয়েক পরেই ভেঙে যায়। আবার ঘুমিয়ে পড়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

বনানীর ধারণা, মায়ের কাছ থেকেই সে তীক্ষ্ন শ্রবণক্ষমতাটা পেয়েছে। বাড়িটার বয়স নাকি নব্বুই। এখানে যাবতীয় শব্দ যেন ঢাকের মতো প্রতিধ্বনিত হয়। একতলার কল থেকে ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ার শব্দ সে শুনতে পায়, গঙ্গার ওপারে মালগাড়ি সান্টিংয়ের শব্দও। বড়ো রাস্তা থেকে দ্রুতগামী মোটরগাড়ির শব্দ পেয়ে এক এক সময় তার মনে হয়েছে, অন্যান্য মানুষই সত্যিকারের বাঁচা বাঁচছে, সে নয়। গাড়িগুলো কোথাও যাচ্ছে, কোথাও থেকে আসছে। রাতের এই সময়ও সিনেমা থেকে, বিয়েবাড়ি থেকে মানুষ ফেরে, গল্প করতে করতে, হাসতে হাসতে। এ বাড়িতে হাসে কিরণ, তার চারপাশের পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন। কিরণকে সে ঈর্ষা করে কি না, সেটা বনানী ঠিক বুঝে উঠতে এখনও পারেনি। ওর চোখা নাকচোখ, ছিপছিপে গড়নে শরীরের শক্ত বাঁধুনির থেকে চঞ্চল খলবলে স্বভাবটাই প্রথমে অস্বস্তিকর ঠেকে তারপর চুম্বকের মতো সুট করে টেনে নেয়। স্বাস্থ্য এবং জীবনীশক্তিতে ও ভরা এবং অচেতনভাবেই ওর শরীর থেকে তা উপচে পড়ে। আর কুড়িয়ে নেবার জন্য….। বনানী যা আসা করেছিল এখন তাই ঘটছে।

বাসুর ঘরে শব্দ হল সামান্য। খাট থেকে নেমে এসে বনানী দরজা সামান্য ফাঁক করল। বাবা, মা কি ঘুমিয়ে পড়েছে? বাসুর ঘর থেকে জমাট একটা অন্ধকার বেরিয়ে পা টিপে তিনতলার সিঁড়ির দিকে চলে গেল। কিরণ অপেক্ষা করছিল নিশ্চয়, কেননা সিঁড়িতেই ফিসফিস শোনা গেল।

ঘর থেকে বেরিয়ে বনানী সিঁড়ির কাছে এল। এই নিয়ে সাত-আটবার এমনটি ঘটল। গত কুড়ি দিন ধরে এটা চলছে। বাসু আর কিরণকে রেখে সকলের হিরুদের ফ্ল্যাটে নিমন্ত্রণ রাখতে যাওয়ার দিনই বোধ হয় শুরু হয়েছে ব্যাপারটা।

ওরা দু-জনে এখন সিঁড়িতে। সিঁড়িটা একটা পাক দিয়ে তিনতলায় উঠেছে। বনানী কিছুই দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু তার মনে হচ্ছে দু-জনে দু-জনকে জড়িয়ে আছে। চুম্বনের মতো শব্দও যেন শুনতে পেল।

কিরণের ঘরের মেঝেয় কিছু একটা চাপড়ানোর শব্দ উঠল। বোধ হয় বালিশ। মা ও কি শব্দটা শুনল? শুনে থাকলে কী মনে করছে? বাসুর বয়স বাইশ মাত্র। এই বয়সে এইরকম কিছু ঘটলে সেটা অস্বাভাবিক নয়।

তবু মা-র পক্ষে এমন ব্যাপার মেনে নেওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। তার নিজের বাড়িতে, নিজের এলাকায় এটা হচ্ছে, তাও আবার রাঁধুনির সঙ্গে। এই মানসিক যাতনা কতদিন সহ্য করবে? বাসুকে কেউ কিছু বলে না। বললেও এখন আর শুনবে না।

গত পনেরো দিন ধরে মা রূঢ় ব্যবহার করে যাচ্ছে কিরণের সঙ্গে। কিন্তু ও যেন তা গ্রাহ্যই করছে না। এ বাড়িতে চার-পাঁচ মাসের বেশি কাজের লোক টেঁকে না মা-র জন্যই। কিরণের আগে দু-মাস কোনো লোকই ছিল না, বনানীকেই সব কাজ করতে হয়েছে। সে চায় না কিরণ কাজ ছেড়ে চলে যাক। কিন্তু কিরণকে ধরে রাখার জন্য কি এইসবকে প্রশ্রয় দিয়ে চোখ বুজে থাকতে হবে?

বনানী নিঃসাড়ে নিজের ঘরে ফিরে এল। ওরা দু-জন নিশ্চয়ই এখন মেঝেয় কিরণের ছেঁড়া শতরঞ্চিতে শুয়ে। একটাই বালিশ। কে মাথায় দিয়েছে? আর ঠিক মাথার উপর, এই কথাটাও এখন ওদের মনে নেই। কিংবা আছে, তবে পরোয়া করে না। ওদের নড়াচড়ার শব্দ বড়ো জোরে নয়। বনানী একইসঙ্গে ছাদের শব্দ ও বাবা-মা-র ঘরের নৈঃশব্দ্য শুনতে লাগল।

জেগে থাকলে ওরাও নিশ্চয় শুনছে উপরের শব্দ।

হঠাৎ দরজা খোলার মৃদু শব্দ। পাশের ঘরের দরজা। আবার সেটা বন্ধ হল। বনানী দরজার ফাঁকে চোখ রাখল। খালি পায়ে কে সিঁড়ির দিকে গেল তার প্রায় মুখ ঘেঁষে। ভারী নিশ্বাস এবং চুরুটের গন্ধ থেকে বনানী বুঝে গেল লোকটি কে। অনেক সময় নিয়ে বাবা সিঁড়ির কাছে পৌঁছল। নিথর দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর তিনতলায় উঠতে লাগল।

কীজন্য উঠছে? আজ এই মুহূর্তেই কি বাবা আবিষ্কার করল ছেলে রাঁধুনির ঘরে গেছে, নাকি আগেই জেনে এখন হাতেনাতে ধরার জন্য উঠছে?

অপূর্বচন্দ্র দত্ত, বি এ এল এল বি, বয়স চুয়ান্ন, সর্বদাই যাকে দেখে মনে হয় দায়িত্বের বোঝা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সে এখন অন্ধকারে খালি-গায়ে, লুঙ্গি পরে শুনছে ছেলে এবং রাঁধুনির জড়ামড়ির শব্দ। বনানীর আগেই সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হত না-বাবা প্রেমে পড়েছে এবং কিরণেরই প্রেমে। তা না হলে এই সময় বিছানা থেকে উঠত না। ওই বিছানায় তার স্ত্রী হয়তো জেগে রয়েছে বা যেকোনো মুহূর্তে জাগতে পারে। নিঃসাড়ে বিছানা ছেড়ে কী দেখতে বেরিয়েছে? যা জানার তা তো এখন জানল, আর কোনো প্রমাণই দরকার হবে না।

এবার কী করবে? নিজেকে নীচুস্তরে নামিয়ে আনতে, হুট করে দরজা খুলে দিয়ে প্রেমিক যুগলকে কি চমকে দেবে?

বনানীর চোখের সামনে অন্ধকার। বাবা নিজেকে যন্ত্রণায় দগ্ধ করা ছাড়া এই মুহূর্তে আর কী করছে! ওর বুকে কোনো রাগ আছে কি না বনানী তা জানে না। তবে দেখেছে, কিছু একটা ঘটলেই অজান্তে ডান হাতটা বুকে রাখে। এখন কি বুকে হাত রেখেছে? এরকম পরিস্থিতিতে তার বাবার মনে কী হতে পারে, তা সে আগে কখনো কল্পনা করেনি। মায়ের চেহারাটা একবার তার মনে ভেসে উঠল। একটু পরেই বাবা নেমে এল। যাওয়ার মতোই নিঃসাড়ে। কলঘরের দিকে গেল। বোধ হয় ঘর থেকে বেরোনোর জন্য নিজেকেই একটা অজুহাত দিতে।

বনানী ভেবেছিল, এরপর বাবা-মার মধ্যে কথা হওয়ার শব্দ পাবে, কিন্তু ঘরটা আগের মতোই নীরব রয়ে গেল। নিশ্চয় হাতড়ে হাতড়ে বাবা খাটে উঠেছে আর যদি জেগে থাকে তা হলে মা নিশ্চয় ঘুমের ভান করে আছে।

ক-টা বাজে আন্দাজ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল বনানী। মাথার মধ্যে ঘূর্ণি চলেছে, মানসিক অবস্থা ঘোলাটে। ভোররাতে তার ঘুম এল।

সকালে তার পড়ানোর কাজ আছে। কিন্ডারগার্টেনের সাত বছরের ফুটফুটে ছেলেটি। বনানীর ওকে ভালো লাগে, তাই কোনোক্রমেই গরহাজির হয় না।

দেরি হয়েছে ঘুম থেকে উঠতে। তাড়াতাড়ি কলঘরের দিকে এগোল। নীচে ঝি বাসন মাজছে।

‘কোনো বাড়িতে রোজ রোজ পোড়া বেরোয় না। শুধু তোমাদের বাড়িতেই। আজ দু-হপ্তা ধরে…।’

কিরণকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না নাড়ুর মা। মা-র সঙ্গে মাঝে মাঝে এ বাড়ি-ও বাড়ির গল্প করে। বিনিময়ে চা এবং বাসি রুটি খায়। টুকটাক জিনিস নাড়ুর মাকে দিয়ে মা কিনিয়ে আনে।

কলঘরের দরজা বন্ধ।

‘বাসুদা গেছে।’

রান্নাঘর থেকে কিরণ বলল। বনানী দরজায় টোকা দিল।

‘কে?’

‘আমি বনা, তাড়াতাড়ি কর।’

‘এখুনি বেরোবে, অনেকক্ষণ গেছে।’

কিরণ চায়ের কাপ হাতে বেরিয়ে এল।

‘ততক্ষণ খেয়ে নাও।’

বনানীর মনে হল কিরণকে বেশ তাজা প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। বাবা নিজে বাজার করে। বাজার করা সেরে এখন সেরেস্তায়। মা এখনও শুয়ে। বাসু কি ওদের মুখোমুখি হয়েছে? হলে ওরা চোখ সরিয়ে স্বাভাবিক দেখাবার চেষ্টা করবে হয়তো, তিনজনেই।

‘মুখ ধুইনি, দাঁত মাজিনি, এখনই চা দিলে কেন? রোজ রোজ বলতে হবে নাকি?’

বনানী বিরক্তি লুকোল না, মুখের রুক্ষতাও।

‘রোজ রোজ আর কোথায়! দেরি করে উঠলে, এদিকে চা হয়ে জুড়িয়ে যাচ্ছে তাই…।’

কিরণ মার্জনা চাওয়ার ভঙ্গিতে চায়ের কাপটা তুলে নিয়ে গেল। ওর নিতম্বে হাঁটাচলার সময় ভাঁজ পড়ে। বোধহয় ইচ্ছে করে দোলানোর জন্যই। বাবাও কি এটা লক্ষ করে? মা নিশ্চয়ই করেছে। বনানীর নিজেকে বিস্বাদ লাগছে। গতরাত্রের ব্যাপারটা মনে পড়ছে বারবার।

কলঘর থেকে বেরিয়ে বাসু নিজের ঘরে যেতে যেতে থেমে রান্নাঘরের দিকে তাকাল। কিরণও তাকিয়ে।

‘চা দাও।’

‘দাদা, তোর সঙ্গে একটা কথা আছে।’

বাসু ভ্রূ তুলল।

‘বল।’

‘এখন নয়, টিউশনি থেকে আসি।’

বাসু বা রান্নাঘরে না তাকিয়ে বনানী কলঘরের দিকে এগোল। ‘জরুরি কিছু? এখন বল।’

‘না, পরে বললেও চলে।’

বাড়ি থেকে বেরোবার সময় বনানী দেখল সেরেস্তায় দুটি লোক বাবার সামনে বসে। ওদের একজনকে সে কয়েকবার দেখেছে তার ছাত্রের বাড়ির কাছে, বাড়িটার কাছে প্রায় সকালে দাঁড়িয়ে থাকে। বস্তিতে ঢোকার মুখে টালির চালের দোতলা বাড়ির বারান্দায় ও লোকটাকে সে দেখেছে। একতলায় গুদাম আর দোকান। দোতলায় বোধহয় ব্যবসার গদি। লোকটাই বস্তির মালিক, বোধহয় অবাঙালি। গলায় সোনার চেন, আঙুলে বড়ো বড়ো পাথর বসানো গোটা চারেক আংটি আর থলথলে শরীর সহজেই চোখে পড়ে। ভাড়াটে তোলার কী ভাড়াটেকে পিটিয়ে ফৌজদারি মামলা ফাঁদার জন্য প্রায়ই আসে। চোরাই মাল বিক্রির কারবার আছে। বাবাকে খুব খাতির করে। ওই বস্তিরই বাসিন্দা এক ঝি কিরণকে এই বাড়িতে দিয়েছে! কিরণের নাকি মাসি হয়। কিরণ মাঝে মাঝে দুপুরে মাসির বাড়ি যায়।

বনানীকে ফিরে আসতে হল ছাত্রের বাড়ি থেকে। ছেলেটির মামার বিয়ে, তাই আজ সকালেই বর্ধমান রওনা হয়েছে মায়ের সঙ্গে। সাতদিন পর ফিরবে।

হাতে যথেষ্ট সময়। বনানী ঠিক করল আর যেখানেই সে যাক, এখন বাড়িতে নয়। কিরণ এবং মা ছাড়া সারাদিনই কেউ থাকে না। মায়ের সঙ্গে কথা বলার মতো কথা তাকে উদ্ভাবন করতে হবে। সেটা ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর ব্যাপার। কিরণকে সে এড়াতেই চায়।

কোনো বন্ধুর বাড়ি এখন সে যেতে পারে। কিন্তু কার কাছে? স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ ক্ষীণ হয়ে গেছে। কলেজের কাউকেই সে বন্ধু করেনি। ফেল করার পর একরকম আত্মগোপনই করে ছিল কয়েক মাস। প্রায় চুপিসারে কম্পার্টমেন্টাল দিয়ে তার পাশ করার খবরটাও, বাড়ির তিনজন ছাড়া কেউ জানে না। বাসু জানে কী জানে না, সে বিষয়ে বনানী নিশ্চিত নয়।

এ-গলি সে-গলি দিয়ে বনানী কিছুক্ষণ হাঁটল। এইসময় তার হিরুকে মনে পড়ছিল। হয়তো ওর ভালো লাগত কলকাতার অলিগলি দিয়ে হাঁটতে। হিরু কলকাতার ভিতরের কিছুই দেখেনি।

‘খুব হাঁটতে, বাংলার গ্রাম দেখতে, খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু আমার চেহারাটার দিকে সবাই যেভাবে তাকায়!’

বনানী গ্রে স্ট্রিট ধরে হাতিবাগানে এসে শ্যামবাজারের দিকে যাবার জন্য মোড় ফিরিয়েই দেখল ঠিক তার সামনেই হেঁটে চলেছে তপন। অফিস যাবার জন্য বাসস্টপের দিকে যাচ্ছে। হাতে ভিআইপি ব্রিফকেস। চলার মধ্যে ভারিক্কিপনা রয়েছে।

‘তপুদা, এই তপুদা!’

তপন ঘুরে দাঁড়াল। বিস্মিত চোখে মৃদু হাসি ফুটল। বছর চারেক আগে স্কুলের বন্ধু প্রীতির বাড়ির ছাদে এই তপন তার হাত ধরে গাঢ়স্বরে দু-চার কথা বলেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। ব্যাপারটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় তপনের একটা চিঠি বাসুর হাতে পড়ার পর। বনানী ভয়ে সিঁটিয়ে ছিল প্রায় এক মাস। বাসু কিন্তু কিছুই বলেনি।

‘আরে বনা, খবর কী?’

‘তোমার খবর কী?’

‘দারুণ খবর আছে।’

‘বিয়ের?’

‘এগজ্যাক্টলি।’

‘কাকে?’

‘চিনবে না। হস্টেলে থাকে, বেথুনে পড়ে থার্ড ইয়ারে।’

‘আলাপ-টালাপ করে নাকি?’

‘অল্পদিন, মাস তিনেকের। প্রথম দর্শনেই প্রেম।’

তপন আমুদে প্রকৃতির, রসিকতা করার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করে না।

‘তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব’খন।’

‘আমার কথা তাকে বলেছ।’

‘পাগল! বলে কখনো! তোমার খবর কী? আমার ধারণা ছিল এতদিন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘নাহ, আপাতত আমার ওতে ইচ্ছে নেই।’

‘তা হলে করবে কী, বছর দশেকের মধ্যেই তো বুড়ি হয়ে যাবে।’ তপন আন্তরিক ও সরলভাবেই বলেছে। আঘাত দেবার বা বিদ্রূপের ইচ্ছা কণ্ঠস্বরে নেই। বনানী হালকা স্বরে বলল, ‘আমার এক মাসি বিয়ে না করে, একা দিব্যিই আছে। এখন বয়স প্রায় চল্লিশ। তা ছাড়া সন্ন্যাসিনী হয়েও তো কত মেয়ে জীবন কাটাচ্ছে।’

‘তা হলে একজন ঈশ্বরজাতীয় পুরুষ তোমার দরকার। এই বাসটা ধরতেই হবে, চলি।’

তপন ছুটল বাসের দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বনানীর মনে হল, কী যে অদ্ভুতভাবে জীবন চলেছে, তাদের বাড়ির নাটকীয় পরিবেশের বাইরে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ কতরকমভাবে যে জীবন কাটাচ্ছে। রাস্তায় যখনই কারোর সঙ্গে দেখা হয়, তখনই তার মনে হয় ওরা সবাই যে যার নিজের জগতের কেন্দ্রে রয়েছে। ওদের চারপাশে যাই ঘটে চলুক তার থেকেও বেশি ব্যস্ত নিজের ঘটনা নিয়ে।

বনানী নিজেকে অন্য পাঁচজনের মতোই হিসেব করে। বাবা, মা, বাসু এদের নিয়েই তার চিন্তা। কখনো কখনো সে নিজের কথাও ভাবে। ছোটোমাসির মতো একটা ঘরে, অফিসের সময়টুকু বাদ দিয়ে, সারাক্ষণ সকাল-সন্ধ্যা কাটাচ্ছে-এমন একটা ছবি কল্পনা করতে তার ভালোই লাগে। একাকিত্বটা বিশ্রী লাগবে, তা তার মনে হয় না, বরং স্বস্তিই পাবে।

রোদটা চড়া লাগছে। বনানী পথে ঘুরে বেড়াবার ইচ্ছা ত্যাগ করে বাড়িমুখো হল। এই মুহূর্তে বাড়িতে রয়েছে দুটিমাত্র মেয়েছেলে, যারা পরস্পরকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না। হয়তো হুবহু তা নয়, তবে সন্দেহ নেই মা অন্তর থেকে ঘৃণা করে কিরণবালাকে। ও একইসঙ্গে স্বামী এবং ছেলেকে তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কিন্তু কিরণ? সারাদিনই টিভি দেখছে, কখনো একতলায় নামছে কখনো তিনতলায় উঠছে তরতরিয়ে। মাঝে মাঝে গুনগুন করে যাত্রার অথবা হিন্দি ফিল্মের গান। ওর গলায় সুর আছে। কোনো মানুষের দিকে তাকালে সেই মানুষের মুখে আপনা থেকেই হাসি ফুটে ওঠে। অধিকাংশেরই এমন হয়। কিরণের ক্ষেত্রেও তাই আশা করা যায়। কিন্তু বনানী বহুবার জানান না দিয়ে, কিরণ টের পাবার আগেই মুখোমুখি হয়ে দেখেছে, সেই একই তৃপ্ত হাসি মুখে লেগে আছে।

দু-তিনদিন অন্তর মাসির কাছে যায়। হয়তো ওখানে ওর প্রেমিক আছে, বাসুর মতোই কেউ।

এইভাবে চিন্তা করায় বনানী অভ্যস্ত নয়, কিন্তু চিন্তাটা এসে পড়লে থামানোও যায় না। একটা মেয়ে একাধিক পুরুষের সঙ্গে প্রেম করতে পারে কী করে! তার নিজের কি এমন ইচ্ছে হয়? এ ব্যাপারে তার মাথাটা পরিষ্কার। নিজেকে দেখতে ভালো নয়, এটা সে জানে। তপনের সঙ্গে ব্যাপারটা এমনিতেই বেশিদূর গড়াত না। পুরুষকে টানতে পারি, নিজের কাছে এমন একটা প্রমাণ সব মেয়েই দাখিল করতে চায়। এটাও তাই। তপন পরিচ্ছন্ন ব্যবহার করে গেছে।

কিন্তু সে কুশ্রী কিনা, তাই নিয়ে এখন বনানী আর ভাবে না। সে যেমনই হোক না কেন, জানে সত্যিই সে কুশ্রী নয়, শরীরের দিক থেকেও সম্ভবত যথেষ্টই আকর্ষণীয়। মুখটা তার মিষ্টি নয়, সাজগোজটাও পরিপাটি হয় না কিন্তু শরীরের গড়ন ভালো, বিশেষ করে বুকের। রাস্তায় বেরোলে, পুরুষদের চোখ তার শরীরের কোথায় পড়ে এটা সে জানে। মাথায় সে খাটো সেজন্যই কমবয়সি দেখায়।

হিরু তাকে ওর থেকেই ছোটোই ভেবে নিয়েছে। দু-এক বছরের এধার-ওধার, এটা এমন কিছু নয়। ও নিশ্চয় আকর্ষণ বোধ করছে আর সেটাই অদ্ভুত লাগছে বনানীর। কিরণের প্রতি বাসুর যে টান, সেরকম নয়। মেয়ে না হয়ে ছেলে হলেও বোধ হয় হিরু একই ব্যবহার করত তার সঙ্গে। বোধ হয় ও সমব্যথী সহমর্মী কাউকে চায়, যে বাইরের জগতের কাছে কুঁকড়ে আছে কোনো একটা ঘাটতির জন্য। ওর দেহ-কাঠামোর স্বাভাবিকত্বের ঘাটতির পরিপূরক খুঁজে পেয়েছে বনানীর সৌন্দর্যের ঘাটতির মধ্যে। কিন্তু বিপরীত মেরু তো পরস্পরকে আকর্ষণ করে না!

হয়তো তা হলে অন্য কোনো অভাব আছে ওর মধ্যে। হয়তো স্নেহ, মনোযোগ, সহানুভূতি যথেষ্ট পায়নি। বাবা-মা যথেষ্ট ভদ্র-মার্জিত এবং শিক্ষিত তো বটেই কিন্তু দু-জনেই ব্যস্ত থেকেছে নিজেদের কাজে। হিরু হয়তো খেলার সঙ্গী পায়নি, অভিমান করার লোক পায়নি। তা হলে এখন কি সে বনানীর মধ্যে আকাঙ্ক্ষা পূরণের উপাদান পেয়েছে? নিজের এই দিকটা নিয়ে সে কখনো ভাবেনি। স্নেহপরায়ণা মায়ের মতো কোনো ব্যাপার কি তার মধ্যে থেকে উছলে পড়ে অজান্তেই?

স্নেহ-ভালোবাসা-মনোযোগ বনানী নিজেও তো পায়নি। জন্ম থেকেই অসুস্থ রুগণ মা আর উদাসীন বাবার সান্নিধ্যে রয়েছে এবং এখনও। বছর দশেক বয়স পর্যন্ত বাসুই তার সঙ্গী ছিল। কিন্তু বাসুরও তো নিজস্ব চাহিদা আছে, সে কারোর কাছ থেকেই তা মেটাতে পারেনি।

বাসুর সঙ্গে কিরণের ব্যাপার নিয়ে কথা বলার ব্যাপারটা তার মনে পড়ল। বনানী দ্রুত পা চালিয়ে যখন বাড়ি পৌঁছল তখন সে অনেক ভালোবাসা ও সহানুভূতিতে ভরে উঠেছে এবং বিশেষ কোনো লোকের উদ্দেশে নয়।

দুপুরে বনানী ছোট্ট একটা ঘুম দেয়। চোখ সদ্য জড়িয়ে এসেছে, তখন বাসু তাকে ধাক্কা দিয়ে তুলল।

‘কী বলবি বলছিলিস?’

‘বোস।’

খাটে ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে আধ-বসা বনানী অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল বাসুর মুখের দিকে। নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে কিরণকে নিয়েই কথা হবে, তাই ওকে অস্বাচ্ছন্দ্যে, আবছা কৌতূহলী দেখাচ্ছে। বনানীর মনে পড়ল, আজ সকালে কিরণ যখন চা দিল তখন বাসু যেরকম নরম মিষ্টি হেসেছিল তার দিকে তাকিয়ে বনানী সেটা আশা করেনি। বাবা-মা যখন থাকে না তখনই বাসু আসল অনুভবগুলো দেখাতে পারে।

এটা কয়েকদিনের ব্যাপার, নিছকই শরীরের খিদেমাত্র, বনানী এইরকম একটা কিছু ভেবেছিল। কিন্তু সকালের ওই চাহনিটা তাকে অন্য কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে।

‘কী ব্যাপার?’ বাসু অধৈর্য হয়ে বলল।

বনানী শব্দগুলোকে সাবধানে বেছে নিল। ওর ভয়, বাসু হয়তো রাগে চিৎকার শুরু করবে। কে জানে দরজার পাশে মা এসে দাঁড়িয়ে আছে কি না। নিঃশব্দে মা চলাফেরা করে।

‘তোর সাবধান হওয়া উচিত।’

লাল হয়ে উঠল বাসুর মুখ। বেপরোয়া স্বরে বলল, ‘কীসের জন্য সাবধান?’

‘কাল রাতে একটা ব্যাপার হয়েছে যখন তুই ওপরে…’

‘মা?’

‘না…বাবা…’

‘বাবা কী করেছে?’

‘তুই ওপরে ওঠার কিছু পরেই বাবা ঘর থেকে চুপি চুপি বেরিয়ে ওপরে গেছল।’

‘কীজন্য? আড়ি পেতে শুনতে? দরজা ফাঁক করে দেখতে?’

‘মনে হয় না দরজা পর্যন্ত গেছে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিল সিঁড়ির মাঝবরাবর। বোধ হয় মনে আঘাত পেয়েছে।’

‘তার মানে?’

বনানী সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। বাসু হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠল।

‘তুই কি বলতে চাস যে বাবাও… তা হলে বাবাও… তা হলে…।’

কথাটা শেষ করার ক্ষমতা পাচ্ছে না।

‘হাঁ।’

‘ওহ, আর এ বাড়িতে বাস করা যাবে না। একেই তো অসহ্য এক মা, তার ওপর…’

‘চুপ, আস্তে।’

খাঁচার বাঘের মতো বাসু পায়চারি শুরু করল। নিজেকে বশে রাখার চেষ্টা করছে।

‘কিরণের সঙ্গে যদি কিছু করিই, তাতে ওর কী? আমার বয়সে এই লোকটা কী করত? ঘোড়ার ঘাস কাটত? তা করে থাকলে অবশ্য আশ্চর্য হবার কিছু নেই…একটা হেক্কোড়বাজ…হেক্কোড়বাজ…’

মনে হল শব্দটা উচ্চচারণে অনিচ্ছা, কিন্তু তা সত্ত্বেও মুখ থেকে বেরিয়ে এল:

‘একটা হেক্কোড়বাজ হিজড়ে।’

‘দাদা চুপ কর।’

বাবার প্রকৃত ব্যক্তিত্বটা যে কী, সে সম্পর্কে ধারণা তৈরি করা বনানীর পক্ষে আজও সম্ভব হয়নি। কখনো কখনো বাবাকে তার মনে হয়েছে, বাজে লোকদের মতো নিজেকে খুব উঁচু পর্যায়ের লোক হিসাবে জাহির করার আপ্রাণ চেষ্টা ছাড়া আর কিছু নেই। মাঝে মাঝে দুঃখও বোধ করে কারোর জন্য। যদি প্রথম থেকেই মুখ বুজে মাথা নুইয়ে থাকার বদলে কড়া শাসনে বাসুকে রাখত, তা হলে আজ ও অন্যরকম হত না?

‘আমাকে এই বলার জন্যই ডেকেছিলি?’

‘সাবধান করার জন্য ডেকেছি।’

‘তোর কি মনে হয় না, বাবা একটা কেঁচো টাইপের লোক?’

বনানী চুপ রইল। বাবা সম্পর্কে অস্বস্তি আর অসুখী হওয়া ছাড়া আর কিছু সে বোধ করছে না। যথেষ্ট লম্বাচওড়া মানুষ কিন্তু কেমন যেন একটা ওজনের অভাব রয়ে গেছে।

তার বয়সি অন্য মেয়েরা এভাবে তাদের বাবা-মায়ের সমালোচনা করে কি? বনানী জানে, এ বাড়িতে তারা সবাই একে অপরের উপর নজর রাখে। কিছুই তাদের চোখ এড়ায় না, না কোনো ভঙ্গি, কোনো কথা, না কারোর চোখের পলায়মান ঝিলিক।

দরজার পাশে মায়ের শাড়ির পাড় দেখতে পেল বনানী পূর্ব অনুমান মতোই। ঠোঁটে আঙুল রেখে সে বাসুকে চুপ থাকতে ইশারা করল।

‘তাতে কী হয়েছে, যা বলার আমি সামনেই বলব। বেশ করেছি…আরও করব।’

বাসু ঘর থেকে বেরিয়ে এক পলক তাকাল ডানদিকে। ওখানেই মা দাঁড়িয়ে, তারপর বাঁদিকে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল অত্যন্ত শব্দে।

ঘরে মায়ের প্রবেশ অবশ্যম্ভাবীই এবং তাই ঘটল। বনানী অদ্ভুত রকমের একা বোধ করল এই মুহূর্তে মায়ের দিকে তাকিয়ে। করুণা ছাড়া আর কিছু মনের মধ্যে খুঁজে না পেয়ে নিজেকে ধিক্কার দিল।

রাতে বাবা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বহুক্ষণ তিনতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়েছিল তখন মা কি জেগে ছিল?

‘কী খাবে?’

‘তোমার কী ইচ্ছে?’

বনানী কয়েক সেকেন্ড ইতস্তত করল। লস্যি আর মালাই ছাড়া আর যা তার কাছে লোভনীয়, পাশের টেবলে এক অবাঙালি দম্পতি তাই খাচ্ছে-ফুচকা। সেইদিকে তাকিয়ে বনানী হাসল। এবং সে যা আশা করেছিল, হিরুর চোখে মজা পাওয়ার চকচকানিতে দেখতে পেল। অবশ্য, মিনিট পনেরো আগে যখন তাদের দেখা হয়, তখন থেকেই ঝকমক করে যাচ্ছে ওর চোখ। বনানীর মনে হচ্ছে, তার নিজের চোখেও ওইরকম কিছু একটা হচ্ছে।

বয় অর্থাৎ ঝাড়ন কাঁধে এক যুবক অধৈর্য ভঙ্গিতে টেবলের পাশে জিজ্ঞাসু চোখে দাঁড়িয়ে।

‘ফুচকা, দুটো।’

বয় যেন জানতই এমন ভাব দেখিয়ে চলে গেল।

‘তোমার ভালো লাগে?’

‘নিশ্চয়ই, টক আর ঝাল আমি দারুণ খাই।’

‘আমিও।’

আজেবাজে কথা, কিন্তু কোনোদিন হয়তো এগুলোই গুরুত্বপূর্ণ মনে হতে পারে। কে বলতে পারে। জীবনে এমন মুহূর্তও আসে যা মনে হয় খুবই সাধারণ, যাকে একদমই কেউ লক্ষ করে না, তারপর বহু বছর পর, হয়তো বুড়ো বয়সে, তখন টের পায় বাকি জীবনটা ওই মুহূর্ত থেকে ঘুরে গেছে।

জুক-বক্সে হিন্দি ফিল্মের গান বাজছে। বনানীর সামনের দেওয়ালে সাঁটা লম্বা আয়না। তাই দিয়ে সে ফুটপাথের চলমান মানুষদের দেখতে পাচ্ছে। রাস্তাটা বাঁদিকে গজ কুড়ি-পঁচিশ গিয়ে পড়েছে চৌরঙ্গিতে। রাস্তাটায় বনানী আগে কখনো আসেনি, নামও জানে না। জীবনে কয়েকবার মাত্র এই অঞ্চলে সে পা দিয়েছে। কিন্তু রাস্তার নাম নিয়ে কী আসে যায়! কিছুই যায় না, কিছুই আসে না, একমাত্র তাদের চোখের ঔজ্জ্বল্যটুকু ছাড়া, এই হালকা মনের মজার অভিব্যক্তি ছাড়া যেন তারা নিজেদের নিয়েই হাসাহাসি করছে অথবা যেন তারা আপনা থেকেই জেনে গেছে আসল সময়ের বাইরের মুহূর্তগুলোর মধ্যে ডুবে আছে।

পাশের টেবলে মালাই দিয়ে গেছে। তারা আড়চোখে দেখছে, চামচে ভেঙে বড়ো টুকরোটা মুখে দিয়েই বউটি, মুখ থেকে প্লেটে ফেলে মুখ বিকৃত করল।

‘বোধহয় দাঁতে গণ্ডগোল আছে।’

‘খুব যন্ত্রণা হয়। একবার আমার হয়েছিল। ঠান্ডা জল খেতে গেলে মনে হত সারা মুখ যেন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে কেউ।’

দু-প্লেট ফুচকা, প্রতি প্লেটে চারটি আর বাটিতে তেঁতুলের জল, ওদের সামনে রেখে গেল। সঙ্গে লঙ্কা গুঁড়ো, নুন আর গোলমরিচ।

আজ বিকেলে হিরু স্কুটার নিয়ে টাইপ স্কুলের সামনে অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখামাত্র আঙুল দিয়ে পিছনের সিটটা দেখিয়ে স্টার্ট দেওয়ায় ব্যস্ত হয়। ও যেন ধরেই রেখেছিল, বনানী না বলবে না।

সে বলেওনি। হিরুর জন্য সে অপেক্ষা করে গেছে। প্রতিদিনই স্কুল থেকে বেরিয়ে দু-ধারে তাকিয়ে খুঁজত এবং বিষণ্ণ হত।

‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? আমাকে কিন্তু পড়াতে যেতে হবে।’

‘আমাকেও পড়তে যেতে হবে, সামনেই পরীক্ষা। কিন্তু দুটো কাজই আজ বন্ধ থাকবে।’

কণ্ঠস্বরে হালকা গোঁয়ারতুমি ছিল। বনানীর মনে হয়, হিরু বয়স্ক পুরুষ সাজার চেষ্টা করছে।

‘আগে কখনো এখানে খেয়েছ?’

‘না। শুনেছি এদের মালাই নাকি ভালো।’

‘কেমন লাগছে?’

‘এই ফুচকা?’

‘না, ওই গানটা?’

রেকর্ডে পুরুষকণ্ঠে গান বাজছে। হিরু মাথা হেলিয়ে কিছুক্ষণ শুনে বলল, ‘কিশোরকুমার? না না, মান্না দে…ভালোমন্দ লাগাটা অনেক কিছুর উপর নির্ভর করে, আমার ভালো লাগে সেতার। তোমার?’

‘ওটাও নির্ভর করে।’

গরম বিকেল। ছুটির পর নারী-পুরুষ অফিস থেকে বেরিয়ে বাস ধরার জন্য তিক্ত ব্যস্ত মুখে অপেক্ষা করে যাচ্ছে। ফুটবল মাঠের ভিড় এইবার যুক্ত হবে ওদের সঙ্গে।

‘কী ভাবছ এখন?’

‘কিছু না। তুমি?’

‘কিছুই না।’

পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ওরা যেভাবে হাসল, এমনভাবে হাসতে দেখেছে বনানী নতুন প্রেমিকদের। এই হাসির মানে হয় না।

‘তুমি কি পড়াশুনো ছেড়েই দিলে? কলেজে ভরতি হও না।’

‘ভাবছি প্রাইভেটে পড়ব।’

বনানী এই মুহূর্তের আগে পর্যন্তও পড়া নিয়ে ভাবেনি। হঠাৎই বলে ফেলল।

‘ভাবছি কোচিংয়ে ভরতি হব, কলেজে পড়তে ভালো লাগে না। যারা কেরিয়ার তৈরি করতে চায়, তারা রেগুলার হয়ে পড়ুক।’

‘কী করবে ঠিক করেছ?’

‘কিছুই না। টাইপ শিখছি, যদি কোথাও চাকরি পাই। পড়াশুনো করে আমার কিছু হবে না, আমার থেকেও বিদ্যে নিয়ে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজের চলার মতো একটা কিছু পেলেই আমি খুশি।…না, বিয়েটিয়ের কথা ভাবছি না।’

‘মালাই খাবে?’

‘না।’

‘লস্যি খেতে আমার খুব ভালো লাগে।’

রাজি হবার জন্য ওর মুখে অনুনয়। বনানী মাথা হেলাল।

‘অ্যাই, দুটো লস্যি দাও।’

‘স্পেশ্যাল?’

‘হ্যাঁ।’

‘হিরু, তোমার কোনো বন্ধু নেই?’

‘ওই দু-একজন…’

‘তা বলছি না, এমন কেউ যার কাছে সব কথা বলতে পারো।’

‘না।’

‘বাবা-মা?’

‘সব কথা নয়। তোমার?’

‘না। টাইপ স্কুলের ওরা অনেক কথা গলগল করে বলে কিন্তু আমার তো তেমন কোনো কথা নেই।’

‘কী কথা বলে?’

বনানী অস্বস্তিতে পড়ল। হিরুকে ওসব কথা বলা যায় না, উচিতও নয়।

‘কে কাকে ভালোবাসল, কোথায় বেড়াতে গেল, কী বলল এইসব। প্রথম তুমি যেদিন স্কুটার নিয়ে গেছলে, সেদিনই একটি মেয়ে গল্প করল, সে আর তার বয়ফ্রেন্ড আগের দিন সারা দুপুর ট্রেনে গল্প করে কাটিয়েছে।’

‘দারুণ তো। ট্রেন আমার খুব ভালো লাগে। যাবে একদিন কোথাও? যেকোনো ট্রেনে, ঘণ্টাখানেক-দেড়েকের জার্নি, একটা স্টেশনে নেমে একটু ঘুরেই আবার ফিরে আসব। যাবে?’

‘বেশ।’

একটুও চিন্তা না করে সে রাজি হয়ে গেল। হিরুর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তার মনে পড়ল, এর দিদিমা আত্মহত্যা করেছিল…বা খুন হয়েছিল।

দু-গ্লাস লস্যি টেবলে রেখে গেছে। দইয়ের ফেনার মধ্যে স্ট্র।

‘চুমুক দিয়ে কেউ খায় না?’

‘অনেকেই খায়, তবে স্ট্র-এ আলাদা একটা মজা আছে।’

দু-জনেই একসঙ্গে মুখ নামিয়ে লস্যি টানতে টানতে চোখ তুলে তাকাল। একই সঙ্গে ওদের চোখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এইগুলোই কী মূহূর্ত!

‘বেশিক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকলে কেউ কিছু বলে না?’

‘মা বলে।’

বনানীর মনে হল সত্যি কথাটা বললেই হত, কেউই কিছু বলে না, কেউ কারোর খোঁজই রাখে না। শুধুই লক্ষ করে যায়।

‘আমাদের বাড়ি একটু গোঁড়া, সেকেলে ধরনের। তোমাকে কিছু বলে না?’

‘না মা-ও কিছু বলে না।’

‘তোমার মা আমাদের সম্পর্কে কিছু বলেন না?’

হিরুর চোখে বিব্রত ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। বনানী বুঝল, আলোচনা হয়েছে এবং সেটা তাদের অনুকূলে নয়।

‘দু-একবার হয়েছে, এমন কিছু নয়। জান বনা, একটা বুলওয়ার্কার কিনব ভাবছি। দিনে দশ মিনিট, তিন সপ্তাহেই মাসল তৈরি করে দেবে! আমার তো বিশ্বাস হয় না, সম্ভব কি?’

প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যাবার জন্যই হিরু হঠাৎ বুলওয়ার্কের কথা তুলল। ওর বাবা অথবা মা কী আলোচনা করতে পারে তাদের সম্পর্কে?

‘মেয়েটার নাম যেন কী?…বনা, বনানী, অনেকটা মায়ের চেহারাই পেয়েছে। ছোটোবেলায় অলকা ওর মতোই দেখতে ছিল।’

‘তোমাদের পাশের বাড়িতেই থাকত?’

‘হ্যাঁ, ওরা অনেকগুলো বোন। সবাই খুব ঝগড়ুটে তবে অলকা একটু অন্য ধরনের ছিল। পড়াশুনোয় তেমন মাথা ছিল না, কিন্তু খাটত। ওর মেয়েও তো খুব খাটে-দুটো টিউশনি, টাইপ শেখা।’

‘ওর মা কীরকম নির্জীব ধরনের, আমার তো মনে হয় না নতুন করে তুমি বন্ধুত্ব শুরু করতে চাও।’

‘এতে ওর বা আমার কারোরই দোষ নেই। এখন অলকা সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে বরং বলব আমার পক্ষে ও একটু বেশি জটিল, হাঁফ ধরানো মনে হয়। আমার দুঃখ হয় ওর স্বামীর জন্য।’

‘শুধুই স্বামীর জন্য?’

‘ওদের সকলের জন্য। বাড়িটাই যেন কেমন, গোরস্থানের মতো ঠান্ডা, স্যাঁতসেঁতে, চুপচাপ। ওদের রাঁধুনি মেয়েটাকেই যা জ্যান্ত মনে হল।’

‘বনাকে?’

‘ওর সঙ্গে তোর কি দেখা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, স্কুটারে একদিন ছোট্ট একটা লিফট দিয়েছিলাম। খুব ভিতু।’

‘মনে তো হয় না মেয়েটা জীবনে কিছু করতে পারবে। মায়ের মতোই হবে।’

মায়ের মতো! এই একটি জিনিসই তো বরাবর সে ভয় করে এসেছে ছোটোবেলা থেকে।

‘বনা, তুমি আমার কথা কিছু শুনছ না, কী ভাবছ?’

‘কই ভাবিনি তো। বুলওয়ার্কার কী জিনিস তাই জানি না, কী কথা বলব।’

‘আমি অন্য বিষয়ে কথা বলছিলাম, আচ্ছা ওঠা যাক এবার।’

‘তুমি রেগে গেছ হিরু। তুমি বড্ড রাগি।’

‘আমি রাগিনি।’

‘তোমার চোখ দেখেই বুঝতে পারি। আগের দিনও বুঝতে পেরেছিলাম। সত্যিই আমি অন্যমনস্ক হয়ে গেছলাম।’

হিরুর চোখ আবার শান্ত হয়ে এল। লাজুকভাব ফুটে উঠল মাথাটা হেলিয়ে রাখার মধ্যে।

‘সত্যিই রাগি আমি। মাঝে মাঝে ভীষণ ক্ষেপে যাই।’

‘কার ওপর?’

নিজের ওপর।’

‘প্রায়ই হয় নাকি এরকম?’

‘তুমি কি নিজের ওপর ক্ষ্যাপো না?’

‘কখনো-সখনো, বিশেষত যখন অন্যের মনে আঘাত দিই।’

বনানী বলতে যাচ্ছিল-যখন নিজের মনে আঘাত দিই, যেটা করা উচিত নয়, সেটাই তখন করে ফেলি। তারপর যখন দুঃখ পাই তখন রেগে উঠি।

‘এবার ওঠা যাক। কিন্তু কথা রইল, একদিন আমরা ট্রেনে কোথাও গিয়ে নামব।’

বিল এনে দিতেই বনানী তার ছোট্ট ব্যাগটা খুলতে যাচ্ছিল।

‘আমার চোখের দিকে তাকাও, কী দেখছ?’

হিরু মিটমিট হাসছে।

‘রাগের পূর্বাভাস।’

‘সুতরাং ব্যাগের থেকে হাত ওঠাও।’

বনানী প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে আরও হেসে ফেলল। বিলটার দিকে তাকিয়ে স্বস্তিবোধ করল। তার কাছে যা টাকা আছে প্রায় সবটাই দিতে হত।

‘আজ তো টিউশনি হবে না। চলো, গঙ্গার ধার থেকে এক চক্কর দিয়ে আসি।’

প্রতিবাদ জানাতে বনানীর ইচ্ছা হল না।

এসপ্ল্যানেডের মুখ থেকেই ভিড়, গাড়ি এবং মানুষের। রানি রাসমণি রোড ধরে রেড রোডের মোড়ে পৌঁছে স্কুটার থামিয়ে অপেক্ষা করতে হল ফুটবল খেলা ভাঙার ভিড়ের মধ্যে পড়ে। হাজারে হাজারে মানুষ রাস্তা পার হচ্ছে।

‘কার খেলা ছিল, মোহনবাগানের?’

‘জানি না, ওসব খবর রাখি না। ফুটবল বিশ্রী লাগে আমার। যারা খেলে, যারা খেলা নিয়ে মাতামাতি করে, এইসব লোক…কী কুৎসিত, কী নির্বোধ, দেখো মুখগুলো।’

‘তুমি খেলোনি কখনো?’

‘স্কুলে বহু বছর আগে, আমার হাইট দেখে গোলে নামিয়েছিল। গোটা ছয়েক গোল খাবার পর মাঠ থেকে বেরিয়ে আসি। আর কখনো যাইনি।’

বনানীর চোখে পড়ল, বহু লোক তাদের দিকে তাকিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয় হিরুও তা লক্ষ করছে। রাগছে হয়তো। সবাই ওর চেহারার দিকে তাকাবেই, এই একটা ধারণা ওকে পেয়ে বসেছে।

মোটরগুলো ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। কতগুলো ছেলে একটা মোটরের গায়ে চাপড়ে দিল। ড্রাম পেটানোর মতো শব্দ হল। হাঁটু পর্যন্ত প্যান্ট গোটানো, খালি গা, হাতে চটি, লিকলিকে একটি ছেলে মোটরের চালে উঠে কোমর দুলিয়ে নাচছে। কেউ দেখছে, কেউ দেখছে না। দশ-পনেরোটি ছেলে বাসের চালে, পিছনের বাম্পারে দাঁড়িয়ে, জনা পাঁচেক, দরজায় ঝুলছে। রোদে-পোড়া শুকনো মুখ, অবসন্ন শরীর, কিন্তু অধিকাংশেরই চোখ জ্বলজ্বলে। এমন চোখ, বনানী ভাবল, তাদের বাড়িতে কারোরই নেই, শুধু কিরণের ছাড়া।

‘ফুটবল ব্যাপারটাই বিশ্রী, মানুষগুলোকে কী করে দেয় দেখেছ? জানোয়ারের মতো বিহেভ করে।’

‘আমাদের পাড়াতেও হয়, তবে এভাবে নয়।’

থামতে থামতে স্কুটারটা এগিয়ে চলেছে। ক্রিকেট স্টেডিয়াম ছাড়িয়ে আউট্রাম ঘাটের দিকে যত এগোচ্ছে ভিড়টা তত পাতলা হয়ে আসছে। বাঁদিকে ঘুরে কিছুটা এগিয়ে হিরু স্কুটার থামাল। চমৎকার সময়। সূর্য স্তিমিত, ঘোর কমলাবর্ণ। সূর্যের দিকে এখন নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকা যায়। শান্ত মৃদু ধূসরতা গঙ্গার ওপর ছড়ানো। নদী-সম্পর্কিত পদ্যে যেমন বর্ণনা থাকে, প্রায় সেইরকমই। পাখিরা গাছে ফিরে এসে কিচিরমিচির করছে, নৌকো বাঁধা রয়েছে কূলে, তীরে ছলাৎ ছলাৎ জোয়ারের আঘাত। এমনকী বিশ্রামে ব্যস্ত জাহাজগুলো বা ওপারের চিমনির ধোঁয়াও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। ডাইনে হাওড়া সেতুটা না থাকলে পুরো ছবিটাই বাজে হয়ে যেত।

‘এখানে কি প্রায় আসো।’

‘খুব বেশি নয়, সল্টলেক থেকে বড্ড দূর। তবে কলেজ ছুটির পর তিন-চারবার এসেছি।’

‘আমাদের বাড়ির কাছে গঙ্গাকে এরকম সুন্দর লাগে না।’

বনানীর ভালো লাগে কলকাতার ভোরের রাস্তা, যখন চায়ের আর খাবারের দোকানগুলো খোলার তোড়জোড় চলে। স্কুলে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করেই সে সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ দিয়ে যেত, ঘুরপথ হলেও।

দু-জনে মন্থরগতিতে হাঁটছে। বেঞ্চগুলোর একটাতেও বসার জায়গা নেই। ঢালু পাড়ে জোড়া নারী ও পুরুষ বসে। অন্ধকার নামলে ওরা নিশ্চয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে আসবে।

‘বাবু, নৌকো?’

হাঁটুর কাছে তোলা কাপড়, গেঞ্জি-পরা মাঝি উঠে এসে দাঁড়িয়ে আছে।

‘ঘণ্টা বিশ টাকা।’

ওরা অগ্রাহ্য করে কয়েক পা এগিয়ে, পরস্পরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে ছুটির দিনের মানুষের মতো অলসভাবে আবার হাঁটতে লাগল। মাঝে যেন পূর্বনির্ধারিত শর্ত অনুযায়ীই ওরা দাঁড়িয়ে পড়েছিল গঙ্গার দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকাবার জন্য।

‘একা যখন এখানে দাঁড়াই, সময়ের কথা ভুলে যাই। জাহাজগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ লাগে।’

‘জাহাজে কেমন লাগে কে জানে। কীসের এগুলো?’

‘নিশ্চয় কার্গো, মালের জাহাজ। এক জাহাজ কোম্পানির মালিকের সঙ্গে বাবার আলাপ আছে। খুব বড়োলোক।’

‘বড়োলোক হতে ইচ্ছে করে তোমার?’

হিরু কিছুক্ষণ যেন ভাবল। ‘না। সত্যি বলতে কী, খুব বেশি টাকার কথা ভাবলে ভয় ভয় করে। তার মানে, আমি গরিবও হতে চাই না, যদিও…’

‘শুনি।’

‘বুঝিয়ে ঠিক বলা মুশকিল। মাঝে মাঝে আমার এমন একটা ইচ্ছে হয়, যেন আমার নিজের বলতে কিছুই নেই-না বাড়ি, টাকা, স্কুটার, বই এমনকী জুতোজামাও, না কোনো দায়দায়িত্ব, কোনো কিছুতেই চাহিদা নেই…।’

‘কীরকম যেন দার্শনিকের মতো কথা বলছ।’

‘হবে। তোমার বাবাকে কি ধনী বলবে?’

‘একদমই নয়। মধ্যবিত্ত, বরং নিম্নমধ্যবিত্তই বলা যায়।’

‘মোটামুটি স্বাচ্ছন্দ্যে আমি থাকতে চাই তবে আরামের চাকর হয়ে কিছুতেই নয়। আমার কাছে সবথেকে বড়ো কথা হল স্বাধীনতা। এই এখন যেমন আমার ইচ্ছেমতো এখানে দাঁড়িয়ে কিংবা আর একটু এগিয়েও দাঁড়াতে পারি, এজন্য কাউকেই জবাবদিহি করতে হবে না।’

‘স্বাধীনতা তোমার নেই?’

‘এক ছেলে হওয়ার অসুবিধাটা তুমি বুঝবে না। বড়ো বেশি করে সবকিছু পাই, স্নেহ-মমতা-আদর, নানান জিনিস, বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন, সাবধানতা। হাঁফিয়ে যাই, ইচ্ছে করে ফেটে বেরিয়ে পড়ি, লণ্ডভণ্ড করে দিই। জানো, আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ জোরে কথা বলে না, চললে শব্দ হয় না। জীবনে আমি কখনো মারামারি করিনি। ভাবতে পার? একটা ছেলে…’

হিরুর বিস্মিত চোখে অপূর্ণ বাল্যের এবং কৈশোরের বেদনা প্রতিবিম্বিত। কোমর-সমান উঁচু পাঁচিল ধরে ও গঙ্গার দিকে ঝুঁকে। মুঠোদুটোর উপরের হাড় খোঁচা হয়ে উঠেছে। পিছনে ওদের ঘেঁষে মানুষের যাতায়াত চলছে।

‘অদ্ভুত ছেলে তুমি।’

‘কীরকম?’

‘সব রকমে। কখনো কখনো মনে হয় তোমার বয়স তিরিশ, আবার অন্য সময় মনে হয় যেন ছোটো ভাই, অবশ্য ছোটোভাই আমার নেই। তোমার মতো কেউ থাকলে বেশ হত।’

‘খুব মজা পেতে?’

‘না, না। রেগে উঠো না আবার। কেউ থাকলে তাকে তা হলে বিশ্বাস করতে পারতাম।’

‘আমি কারোর ভাই হতে চাই না।’

‘আমি কারোর দিদি হতে চাই না।’

বহুক্ষণ পর যখন পরস্পরের দিকে তাকাল তখন ওদের চোখ মৃদু শান্ত।

‘আমি যা হতে চাই, আমি সেরকমই নই…তাগড়াই ধরনের একটা কিছু।’

‘বুলওয়ার্কার তো কিনেছ।’

হিরু হেসে ফেলল।

‘ঠাট্টা কোরো না, তিন সপ্তাহ পর আমায় দেখে চিনতেই পারবে না আর। ভেলপুরি খাবে? আমার ইচ্ছে করছে খেতে।’

বনানীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে বাহু ধরে তাকে টেনে নিয়ে চলল রাস্তার দিকে।

ফেরার সময় এসপ্ল্যানেডের ট্রাফিক এড়াবার জন্য হিরু আকাশবাণী বাড়ির পাশ দিয়ে ডালহৌসি স্কোয়ারের পথ নিল। রাস্তা নির্জন, বিরাট অফিস বাড়িগুলোর জানালা বন্ধ। চারপাশ থমথমে। কিছু খাবারের, পানের দোকান শুধু খোলা। স্কুটারটা ধীরে চলছে।

‘কী ভাবছ?’

‘তোমাকে বোঝার চেষ্টা করছি। নতুন নতুন আবিষ্কার করছি।’

‘যেমন?’

‘বলা বড়ো শক্ত। আর একটু তোমায় জানি, তখন বলব।’

হিরু চুপ করে রইল। গর্তে পড়ে স্কুটার লাফাচ্ছে।

আধা ঠাট্টা, আরও গম্ভীর স্বরে বনানী বলল, ‘বাড়ি ফিরে বলবে তো আজকের কথা, আমার কথা?’

‘বলতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। তুমি বলবে?’

না জিজ্ঞেস করলে বলি না, তবে আমাদের বাড়িতে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করে না।’

‘আবার কবে যাব তোমার টাইপ স্কুলে?’

‘যেকোনো দিন। তবে টিউশনি আছে মনে রেখো।’

‘তা হলে সেখানেই যাব। বুধবার, ক-টায়?’

‘সাড়ে ছ-টা, না সাতটায় বরং সেদিন যেখানে নেমে গেছলাম।’ বাড়ির দরজায় বনানী নামল। হিরু এঞ্জিন বন্ধ করেনি। স্কুটার ঘুরিয়ে রওনা হওয়ার আগে আর একবার বলল, ‘তা হলে বুধবার, কেমন?’

দোতলায় মা নিজের চেয়ারটিতে বসে। টেবলে ট্রানজিস্টার, হাতে সেলাই। কিরণ রান্নাঘরে চা তৈরি করছে। বনানী চেয়ারে বসল, অবশ্যই তার চেয়ারটিতে। মা একবার তাকাল।

‘বনাদি চা দোব?’

‘দাও। রাতে আমি খাব না, খেয়ে এসেছি।’

মা আর একবার তাকাল।

‘কোথায়?’

বনানীর মনে হল বলে, ছাত্রীর বাড়িতে। কিন্তু হঠাৎ একটা চাপা রাগ তাকে খুঁচিয়ে তুলল নিষ্ঠুর হবার জন্য।

‘হিরু খাইয়েছে। আমরা গঙ্গার ধারে গেছলাম।’

তীক্ষ্নচোখে সে তাকিয়ে রইল প্রতিক্রিয়াটা লক্ষ করার জন্য। কোনো ভাবান্তর পেল না।

‘সেদিন বাসু কী বলছিল?’

আলগা প্রশ্ন ধীর স্বরে। বনানী জানত একসময় প্রশ্নটা আসবেই।

‘কবে?’

‘গত মঙ্গলবার, দুপুরে।’

‘কিছু না, কয়েকটা টাকা চাইছিল।’

মা বুঝেছে, মিথ্যা বলল বনানী। কিন্তু সেটা গ্রাহ্যে না এনে, অসুখী, রুগণ চোখে তার দিকে মা তাকাল। সেইসময় তাজা স্ফূর্তি শরীরে মাখিয়ে কিরণ দু-কাপ চা হাতে মায়ের পাশে এসে দাঁড়াল। দুটি স্ত্রীলোকের মধ্যেকার বৈপরীত্যটা বিষণ্ণ করল বনানীকে।

আর এক কাপ চা নিয়ে কিরণ নীচে যাচ্ছে বাবাকে দেবার জন্য। বনানী তাকিয়ে রইল মায়ের চোখের দিকে।

ঠিক ওইখানে, ওই চেয়ারটায় মা কেন বসে তা সে জানে। ওইখান থেকে দোতলা-একতলার প্রত্যেকটি ঘরের দরজা এবং ভিতরের কিছু অংশও দেখা যায়। বারান্দার রেলিংয়ের মধ্য দিয়ে মায়ের চোখ সেরেস্তার দরজায় নিবদ্ধ। কিরণ চা দিতে গেছে।

‘তোর বাবা কি একা রয়েছে?’

একথা জিজ্ঞাসা করা কেন? মা যখন যাই বলুক, বিনা উদ্দেশ্যে কখনো কথা বলে না। উদ্দেশ্যটা কখনো কখনো এত ভালোভাবে লুকোনো থাকে যে আবিষ্কার করতে কিছু সময় লাগে। উপরে ওঠার আগে বনানী একবার তাকিয়েছিল সেরেস্তায়।

‘হ্যাঁ, একাই।’

একদৃষ্টে মা নীচের দিকে তাকিয়ে, চোখ থেকে বনানী বুঝল প্রত্যাশিত কিছু ঘটেনি।

‘বাইরে বেশি খেয়ো না।’

বনানী জবাব দিল না। রীতিমতো ভালো লেগেছে তার বাইরের মুখরোচক বস্তুগুলো। আবার সে যাবে। বাসুও মাঝে মাঝে রাতে খায় না, বন্ধুরা খাওয়ায়। একমাত্র বাবারই বাইরে খাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই। প্রতিদিন এই টেবলে আসতেই হয়। দু-বেলা তার ওই চেয়ারে বসে মায়ের মুখোমুখি হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, তবে কাজের ভান করে সেরেস্তায় নিজেকে আটকে রাখার মধ্যে দিয়ে কিছুটা উশুল করে নেয়।

প্রত্যেকেই চায় মাকে এড়িয়ে চলতে। প্রত্যেকেরই এই বাড়ির বাইরে কাটাবার জন্য অন্য এক জীবন আছে, আর এক আমোদ আছে, নানা কাজ আছে। মায়ের কিছুই নেই।

মায়ের ঘরে মাসিমা এবং তাদের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে দাদামশাই-দিদিমার একটা ছবি টাঙানো আছে। মাসিদের কেউ-না-কেউ মাঝে মাঝে বেড়াতে আসত। এখন আসে শুধু অবিবাহিত ছোটোমাসি। বনানী তার মাসতুতো ভাইবোনদের প্রায় চেনেই না। চোখেই দেখেনি কোচবিহারে যারা আছে।

চা খেতে খেতে সে একদৃষ্টে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবে যাচ্ছিল এবং কী বিষয়ে ভাবছে তা বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত অবস্থাতেই ভাবনাটা শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

‘কোথায় যাচ্ছিস?’

‘চান করব, কী ভ্যাপসা গরম।’

‘আর একটু বোস, চা খেয়েই ঠান্ডা লাগায় না।’

‘কিছু হবে না।’

‘কেন আমার কাছে কি খারাপ লাগে? আমি কি এতই কুচ্ছিত?’

‘কে বলল?’

বনানী অবাক হয়ে যাচ্ছে, মা-র এই ভাবপ্রবণ কথাবার্তায়। কখনো ওকে এমন ব্যথিত অভিমানী দেখেছে মনে পড়ে না।

‘মেয়েমানুষকে তার রূপযৌবন ধরে রাখতে হয় অনেকদিন। স্বামীর জন্য ততটা নয়, যতটা ছেলেমেয়ের জন্য। মাকে বুড়ি দেখার মতো কুচ্ছিত জিনিস আর হয় না। ছেলেমেয়েরা এড়িয়ে যায়, ঘেন্নাও করে।’

‘তুমি বুড়ি হওনি।’

‘কথাটা মনে রাখিস, সুখী হতে পারবি। বেশিরভাগ মেয়েই বিয়ের পর আর নিজের যত্ন নেয় না। বোকামি। তিরিশ হতে-না-হতেই মনে হয় পঞ্চাশে পৌঁছে গেছে। ছেলেমেয়েরা এইসব মা সম্পর্কে কী যে ভাবে!’

‘কিছুই ভাবে না। মা সম্পর্কে অন্য কিছু কি ভাবা সম্ভব?’

কথাটা যে বিশ্বাস করল না, বনানী মুখ দেখেই বুঝল। আর কী সে বলতে পারে! এত করুণ আর কখনো মা-কে মনে হয়নি বা হয়েছে, কিন্তু প্রতিবারই মনে হয় যেন আগের থেকে বেশি।

মনে পড়ল মায়েরই বান্ধবী হিরুর মা-কে। সমবয়সি কিন্তু স্থাস্থ্যে-লাবণ্যে, পারিপাট্যে বয়সোচিত। কমও না, বেশি বয়সিও দেখায় না। শুধু ভালো থাকা বা খাওয়াতেই এটা সম্ভব নয়। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কও নিশ্চয় স্বাভাবিক। অথচ পরিশ্রম কম করে না।

‘তোদের আর একদমই দেখাশোনা করতে পারি না। অথচ যখন তোরা বাচ্চচা, আমিই স্কুলে দিয়ে আসতাম, নিয়ে আসতাম। কাচাকাচি করতাম, রাঁধতাম, ঘর মুছতাম-কাজের লোক রাখার মতো অবস্থা তখন ছিল না। তোর বাবা কোর্টে যেত আর আসত, দিনে দশ-কুড়ি টাকার বেশি রোজগার ছিল না। আমার কোনো চিকিৎসাই হয়নি।’

বনানী চাইল, মা এবার কথা বন্ধ করুক। তার নিজের নয় এমন স্মৃতি কেউ তাকে দেবার চেষ্টা করলে সেটা অসহ্য লাগে।

‘আমার কোনোই দোষ নেই। মনে ইচ্ছে ছিল বিয়ের পর প্রাইভেটে স্কুল ফাইনাল দেব।’

মা কি বুঝতে পারছে না, এভাবে তার কথা বলা উচিত নয়?

‘বনা, অনেক জিনিস আছে যেগুলো পরে বুঝতে পারবি, যখন বিয়ে হবে, যখন সন্তানের মা হবি।’

মায়ের সঙ্গে কথা বলতে হাঁফ ধরে। প্রত্যেকটা কথার নিজস্ব মানে ছাড়াও আরও অনেক ইঙ্গিত তার মধ্যে থেকে যায়। যে দু-তিনটে স্তর আছে, একটা থেকে আরেকটায় এত সূক্ষ্মভাবে যাতায়াত করে যে মানে বোঝা শক্ত হয়ে পড়ে।

‘চান করতে যাচ্ছি।’

বনানী তার ঘরের দিকে এগোল গামছা আনার জন্য। শান্তিতে থাকার অধিকার সবার মতো তারও আছে। হিরু যেমন স্বাধীনতা চায়, অনেকটা সেরকম। অন্যে তাদের স্মৃতির বোঝা খুলে তার জীবনটাকে জটিল করে দেবে না এটা সে নিশ্চয় আশা করতে পারে।

‘চুল যেন ভেজাসনি।’

কথাটা যে শুনতে পেয়েছে, এমন কোনো ভঙ্গি বনানীর মধ্যে প্রকাশ হল না। সে নিঃশব্দে কলঘরের দরজা বন্ধ করল। চারপাশে যা কিছু ঘটে তার গুরুত্ব আমাদের জীবনে আছে। কিন্তু কদাচিৎ কেউ সত্যি কথাটা বলে। অন্ধকারে নিজেকে নগ্ন করতে করতে বনানী ভাবল, সবাই কেমন সব গল্প তৈরি করে, নয়তো খুঁজে বার করে, যেগুলো তাদের কোলেই ঝোল টানায় সাহায্য করে।

‘শোনো মা, তোমার ওইসব কথার কোনো মানে আমার কাছে নেই। কিছুক্ষণ আগেই আমি যে দুটো ঘণ্টা কাটিয়েছি হয়তো আমার জীবনে তা সেরা হিসাবে প্রমাণিত হতে পারে। এই মুহূর্তে তা নষ্ট করতে চাই না। যে সমস্যা আমার নয় সেগুলোর সামনে জোর করে আমায় দাঁড় করিয়ো না।’

বনানী পাগলের মতো জল ঢালতে শুরু করল মাথা ভিজিয়ে। রাতে খাওয়ার টেবলে বাসু অনুপস্থিত রইল। কিন্তু বনানীকে বিস্মিত করে বাবা নীচে সেরেস্তায় না গিয়ে রেডিয়ো খুলে শুনতে লাগল।

কিরণ এবার এঁটো কুড়োনো, রান্নাঘরে বসে খাওয়া, ধোয়া ইত্যাদি শুরু করবে, বাবা হয়তো তাই দেখার জন্য বসে আছে। মা স্থির চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে। একটু আগেই মা মাথার যন্ত্রণার কথা বলছিল।

কিছুক্ষণ পরেই বনানী বুঝল বাবা সম্পর্কে ভুল ধারণা করেছে। রেডিয়োয় ‘সিরাজদৌল্লা’ নাটক হচ্ছে। গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবা শুনছে। চুরুটটা নিবে রয়েছে আঙুলের ফাঁকে। অন্যমনস্কের মতো টান দিয়ে, হাতটা আবার টেবলে রাখল। দেশলাই পকেটেই আছে, কিন্তু ধরাতে গিয়ে পাছে একটা সংলাপও ফসকায় তাই হয়তো দেশলাইটা জ্বালল না। দেখে বনানীর মনে হল, বাবা যেন বহু বহু বছর পিছিয়ে গেছে-যৌবনে বা কৈশোরে। চোখদুটো চিকচিক করছে বাষ্পে, ঢোঁক গিলল কয়েকবার। একসময় বাবার নাকি অভিনয়ের শখ ছিল।

আজ বনানী তাড়াতাড়িই শুতে গেল এবং শোওয়ামাত্রই ঘুমিয়ে পড়ল। একসময় ঘুম ভাঙে পায়ের শব্দে। বাসু ফিরল। ওর ঘরের সামনে শব্দটা কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে থেকে তিনতলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেল।

ডানদিকের ঘরে ওরাও নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছে। বাবা-মায়ের ঘুম খুবই পাতলা, বনানী অপেক্ষা করে রইল, বাবা ঘর থেকে বেরোয় কি না বোঝার জন্য। উপরের ঘরে পায়ের শব্দ, মেঝেয় বসার শব্দ এবং বাসুর রাগতস্বর বনানী শুনতে পাচ্ছে। বাবা আজ ঘর থেকে বেরোল না।

মিনিট পনেরো কোনো শব্দ নেই, সারা বাড়ি নিঝুম। কে যেন কলঘরে গেল, মেঝেয় জল ঢালার শব্দ বনানী শুনতে পাচ্ছে। বাসুই কি? এটা কি ওর এক ধরনের চ্যালেঞ্জ-বিদ্রোহ ঘোষণা? রাখাঢাকার ব্যাপারটাকে পরোয়া করার দরকারই বোধ করছে না। কিন্তু ও তো বহু আগেই বিদ্রোহ করেছে, তা হলে এটা কি যুদ্ধঘোষণা?

পরদিন সকালে বাসু তার ঘরে এল।

‘কাল দুপুরে কিরণ ওর মাসির কাছে গেছল জানিস কি?’

বনানী মাথা নাড়ল। বাসুর চোখদুটো ফোলা, ঈষৎ লাল। মুখে ক্লান্তি এবং তিক্ত মনোভাবের প্রকাশ।

‘হাঁ গেছল। আমার বন্ধু সুভাষ, ও পাড়ারই ছেলে, দেখেছে। কাকে দেখেছে জানিস…’

‘বাবাকে?’

বাসু চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থেকে ঠোঁট মোচড়াল। হঠাৎ বাবার কথা কেন যে মনে এল বনানী তা জানে না।

‘যাক, তোর তা হলে বুদ্ধিসুদ্ধি এখনও টিকে আছে। বাবাকে কাল দুপুরে বস্তি থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছে সুভাষ। আমি অবশ্য ওকে বলেছি, একটা মামলার ব্যাপারে বাবা গেছল। কিন্তু শুয়োরের বাচ্চচাটা কেন গেছল আমি আন্দাজ করছি।’

‘কী আন্দাজ করছিস?’

‘পরে বলব।’

‘হয়তো সত্যিই মামলার কাজে গেছল, বস্তির মালিক তো বাবার মক্কেল।’

বাসু কটমটিয়ে তাকাল।

‘তুইও তা হলে ওইদিকে?’

‘আমি কোনোদিকেই নেই, তোর দিকেও নয়। তুই কি ভেবেছিস যা করে যাচ্ছিস সেটা খুব ভালো কাজ?’

‘এ বাড়িতে আবার ভালোমন্দ কী? আমি বাঁচতে চাই, বাঁচার জন্য যা করব সেটাই ভালো। তুই কি ভেবেছিস আমি বেঁচে আছি? আমরা যেভাবে ওরা যেভাবে এ বাড়িতে রয়েছে সেটাকে বাঁচা বলে?’

‘বলে কি না বলে তা অত জানি না, তবে জেনে রাখ, যা শুরু করেছিস সেটা ভালো নয়। তুই একটা ভদ্র বনেদি ঘরের ছেলে আর ও একটা ঝি, রাঁধুনি!’

‘কে ভদ্র, কে বনেদি? ওই কুত্তাটা? জিব বার করে রাঁধুনির পেছনে যে ছুটছে হ্যা হ্যা করে?’

বনানী বুঝতে পারছে না কেন তার বুকে একটা ব্যথা খোঁচা দিল, বাসুর কথাগুলো চেপে চেপে বসছে আর ঘৃণার বদলে বাবার জন্য করুণা উঠে আসছে।

তবু সে বুঝতে পারছে কেন বাসুর ক্ষিপ্ততা। বনানী নিজেও তো এই বাড়ির জীবনধারার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। কারণটা কী? গোলমালটা কোথায়? বাবা-মা কি কখনো পরস্পরকে ভালোবাসেনি, ওরা কি যথাযথ স্বামী-স্ত্রী কখনো হতে পারেনি, নাকি এসবই তাদের জন্মের পর শুরু হয়েছে?

‘আজ যদি বাবা মারা যায়, কী করবি? এই সংসার তোকেই তো চালাতে হবে, পারবি?’

‘বয়ে গেছে চালাতে। নিজের পথ নিজেকেই দেখতে হবে। হাজারখানেক টাকা জোগাড় করে ব্যবসায় নেমে পড়ব। বর্ডার থেকে ফরেন কাপড় আনব আর বেচব।’

বাসু সিগারেট বার করে ধরাল। নিজের ঘরে ও খায় সেটা বনানী বা মা জানে, কিন্তু এ বাড়িতে প্রকাশ্যে কখনো খায়নি। এই প্রথম। ধোঁয়া ছাড়ার মধ্যে তাচ্ছিল্য দেখাবার চেষ্টা রয়েছে। প্রেমে মগ্ন মানুষের হিংস্র চাহনি ওর চোখে, দুনিয়াকে পরোয়া না করার জন্য তৈরি।

‘এবার বাড়িতে মদের বোতল নিয়ে ঢুকব। দেখি কোন শালা কী বলে।’

বাসু বেরিয়ে গেল। বনানী দরজার কাছে এসে উঁকি দিল। মা দাঁড়িয়ে নেই, কিন্তু সে জানে, মা ঠিকই শুনেছে বাসুর কথাবার্তা। দেওয়াল ভেদ করে শোনার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে মায়ের। জলভরা বালতি নিয়ে কিরণ রান্নাঘরে যাচ্ছে, মুখ ফিরিয়ে তাকাল মাত্র। বাবা এবার স্নান করতে যাবে, এখন নীচে সেরেস্তায়। রান্নাঘর থেকে একটা-দুটো শব্দ ছাড়া সারাবাড়ি নিঝুম, এই সকালেই। অথচ বাইরে এখন প্রচণ্ড কোলাহল, আনাগোনা, ব্যস্ততা। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের ব্যক্তিগত পৃথিবীর জন্য ভাবছে এবং কিছু করছে। অথচ আমার কোনো পৃথিবী নেই, করারও কিছু নেই, বনানী ভাবল এবং ক্লান্তবোধ করল।

বিছানায় শোওয়ামাত্র তার ঘুম এসে গেল।

দুপুরে বনানী দমদমে তার কলেজের এক বন্ধুর বাড়ি গেল। বন্ধুর দিদি এই বছরই বি এ ফাইনাল দিয়েছে, তার বইগুলো যদি পাওয়া যায় নতুন করে পড়াশুনো শুরু করবে, এই চিন্তাটা ঘুম ভাঙার পর থেকেই তাকে ব্যস্ত করেছে। কোয়ালিফিকেশন বাড়ালে কাজ পাওয়ার হয়তো সুবিধা হবে।

বন্ধুকে সে পায়নি, তার দিদি অবশ্য ছিল। বনানীকে নিরাশ হতে হল। ইতিমধ্যেই নাকি অন্য একজন বই চেয়ে রেখেছে।

ফেরার সময় বাস থেকে শ্যামবাজারে নেমেই সে স্থির করল আজ টাইপ স্কুলে যাবে না, তবে টিউশনি কামাই করবে না। হাতিবাগানে ঘেঁষাঘেঁষি কয়েকটা সিনেমা হল। একটায় সে টিকিট পেয়ে গেল। ভালোবাসার গল্প। কাল্পনিক নানান বাধাবিপত্তি জয় করে, বলা বাহুল্য, অবশেষে নায়ক-নায়িকার মিলন ঘটল। হল থেকে বেরোবার সময় তার জানতে ইচ্ছে করল, এই জিনিসের জন্যই কি কয়েকশো লোক এতক্ষণ অন্ধকারে বসে ছিল?

টিউশনি থেকে ফেরার সময় বনানী প্রায় গজ পঞ্চাশেক দূর থেকে দেখল তাদের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে কিরণ কথা বলছে। বাবার হাতে ব্যাগ, কোর্ট থেকে ফিরছে।

তাকে দেখতে পেয়েছে কি না বনানী বুঝতে পারল না, তবে কিরণ দ্রুত বাড়ির মধ্যে চলে গেল। বাবা ইতস্তত করে, বোধ হয় সময় নেবার জন্যই, ওষুধের দোকানের কার সঙ্গে কথা বলা শুরু করল।

‘এত দেরি হল ফিরতে?’

কোনোদিন প্রশ্ন করে না। হয়তো মানসিক ভারসাম্য টাল খেয়েছে।

‘কলা কিনতে ভুলে গেছলাম, আবার গিয়ে বাজার থেকে কিনে আনলাম।’

বেচারা! ওজর দেওয়ার জন্য নিজেকে এই বয়সে ছেলেমানুষের পর্যায়ে নামিয়ে আনতে হচ্ছে! জবাব দিয়ে বনানী তার বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। দোতলায় উঠে দেখল মা তার নিজের চেয়ারটিতে বসে মাথা নীচু করে এক থালা চাল থেকে কাঁকর বাছছে। বনানী তার নিজের চেয়ারটিতে এসে বসল। কিরণ রান্নাঘরে।

‘চা হয়ে গেছে?’

‘না, কিরণ তো এইমাত্র ফিরল।’

‘মাসির বাড়ি? কখন বেরিয়েছিল?’

‘বিকেল নাগাদ।’

নিশ্চয় দু-জনে একসঙ্গে ছিল, বাবা আর কিরণ। বাসু যা বলেছে তা হয়তো ঠিক, বনানী নিজের ঘরে এসে একটা উপন্যাস চোখের সামনে ধরে কাত হয়ে শুয়ে রইল।

রাতে খাওয়ার টেবলে সে বাবার মুখের দিকে বারবার তাকাল। চোখে কেমন যেন বদমাইশিভরা মিটমিটানি, বনানী যা আগে কখনো ওর চোখে দেখেনি। মনে হচ্ছে, রাশভারীত্বটাও যেন কমে গেছে।

বাসু তাকাচ্ছে বাবার দিকে। চোখে তীব্রতা। নিজেকে সামলাবার চেষ্টাতেই হয়তো গোগ্রাসে খাচ্ছে।

‘বড্ড গরম পড়েছে, বৃষ্টি হবে বোধ হয়।’

বাবার কথাটায় কেউ সাড়া দিল না। কেউ প্রতিধ্বনিও তুলল না। মা বিশ্রী চাহনিতে বাবার দিকে তাকাল মাত্র। একমাত্র বাবাই তা লক্ষ করল না। ওর চোখদুটো চকচক করছে বোধ হয় ভেতরের স্ফূর্তিতেই। অন্যদিনের থেকে আজ বেশিই খাচ্ছে। কেউ কথা না বলায় চুপ করেই রইল কিন্তু চনমনে ভাবটা কমেনি।

মা চুপ করে আছে। বনানী বুঝতে পারছে, চুপ থাকলেও নিজের সঙ্গে মনে মনে কথা বলে চলেছে। কয়েকবার মুখে ফুটে উঠল বাঁকা হাসি।

জল খাওয়া শেষ করেই বাবা উঠে দাঁড়াল। অন্যদিনের মতো ‘কাজ আছে’ না বলেই নীচের সিঁড়ির দিকে এগোল।

বাসু চেয়ার ছেড়ে উঠছে বাবার পিছু নেবার জন্যই। বনানী চোখ দিয়ে যতটা সম্ভব, ওকে নিষেধ করল। সিঁড়ির মুখে পৌঁছে বাসু আর এগোল না। বনানী উঠতেই মা মুখ তুলে তাকাল।

‘দাদা, মাথা গরম করিসনি।’

বাসুর কাছে এসে গলা নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল।

‘শুয়োরের বাচ্চচাকে শেষ করে দেব।’

বনানী আহত হল না। বাসুর মতো একই সিদ্ধান্তে সেও পৌঁছেছে, অন্তত এই মুহূর্তের জন্য।

‘ঘরে এসে কথা বল।’

বনানী হাত ধোবার জন্য কলঘরে গেল। সেখান থেকে মাকে সে দেখতে পাচ্ছে। অনুমানের চেষ্টা করল তার ছোটোবেলায় মাকে কেমন দেখতে ছিল। প্রায়ই অসুখী, বিষণ্ণ, মনমরা দেখাত। একদিন বনানী জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘মা তুমি কাঁদছ?’ জবাবে মা বলেছিল, ‘তোকে অত কথা বলতে হবে না। বড়োরা অনেক ব্যাপারে কষ্ট পায় যা ছোটোরা বুঝবে না।’

এখন দেখে মনে হচ্ছে মা বোধ হয় কাঁদছে। অন্তত সেরকমই মনে হচ্ছে। বনানী ভাবল, এখনও কি বুঝতে পারবে না বড়োদের কষ্ট?

‘আজ কিরণকে ফলো করেছিলাম।’

বনানীর খাটে বাসু উপুড় হয়ে কপালের নীচে দু-হাত রেখে শুয়ে।

‘বস্তির মালিক, বাবার ওই মক্কেলটা, ওর যে মাটকোঠা বাড়ি তার দোতলার দুটো ঘরের একটায় কিরণ ঢুকল। অবাকই লাগল, বুড়ি মাসিটা তো বস্তির ভেতর দিকে একটা ঘরে থাকে, তা হলে এখানে ও এল কেন? বারান্দার পেছনেই ঘর। রাস্তার অনেক দূর থেকে ঘরের দরজাটা দেখা যায়। আমি একটা বাড়ির রকে বসে রইলাম। কিরণ ঢোকামাত্র একটা লোক বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাড়িওলারই লোক, বোধ হয় কর্মচারী। লোকটা নীচে নেমে গেল। তারপর ভেতর থেকে একজন দরজাটা বন্ধ করল। কে করল জানিস?’

বাসু ঝটকা দিয়ে উঠে বসল। চোখে আগুন। বনানী চুপ রইল। সে জানে, কে দরজা বন্ধ করল।

‘শুয়োরের বাচ্চচাটা।’

‘তোর বাবা হয়।’

‘রাখ তোর বাবা! সেইজন্যই কি ছেলের…’

বনানী নিজের কথার অর্থহীনতা হৃদয়ংগম করল বাসুর অসম্পূর্ণ উক্তির মধ্য দিয়ে।

‘এখনও কিরণ সম্পর্কে তোর মোহ আছে? এরপর ও কী ধরনের মেয়েমানুষ এবার বুঝতে পারছিস তো!’

‘যে ধরনেরই হোক, বাবা কেন হাত বাড়াবে?’

বাসুকে নির্মম মারমুখো দেখাচ্ছে। ঘরে পায়চারি শুরু করল দাপিয়ে দাপিয়ে। নীচের ঘরে বাবা নিশ্চয় শুনতে পাচ্ছে। মা তার চেয়ারে আবার চালের থালাটা নিয়ে বসেছে। বাসু গলা চড়িয়ে কথা বলছে, নিশ্চয় মা শুনতে পাচ্ছে। রান্নাঘরে ঝাঁটার শব্দ হচ্ছে। কিরণও শুনছে, কিন্তু তাতে ওর কিছু এসে যায় না। হয়তো মুখে এখন হাসিটা লেগে আছে, হয়তো আর একটু বেশি দুলছে ওর পাছা, মাকে দেখাবার জন্য।

‘মাকে এসব কিছু বলিসনি।’

‘কেন? ভেবেছিস কিছু বুঝি জানে না?’

‘না, জানে না।’

‘তুই কি ভেবেছিস বাবা যে রাত্রে চুপিচুপি ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সেটা মা লক্ষ করেনি? আজও কি বাবার মুখ দেখে বুঝতে পারেনি, সোজা কোর্ট থেকে আসছে না? কিছু না বলে মা শুধু দেখে যাচ্ছে। দেখবি একদিন কিছু একটা করে বসবে।’

‘কী করবে, আত্মহত্যা?’

‘তাও পারে। এ বাড়িতে সবকিছু হতে পারে।’

বনানীর মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করে উঠল।

‘ওকে তাড়ানো দরকার। মা না পারলে আমিই তাড়াব।’

বাসু মিটমিট করে তাকাল। ধীরে ধীরে ঠোঁটদুটো মুচড়ে গেল। মুখটা বিকৃত করে নিঃশব্দে হাসতে শুরু করল।

‘তা হলেই সব বুঝি মিটে যাবে। ও যেখানে যাবে আমিও সেখানে যাব, বাবাও যাবে।’

হাতে চাপড় মেরে বাসু চিৎকার করল। বনানী ওকে থামাবার জন্য হাত তুলে দেখাল দরজায় মা দাঁড়িয়ে, সহ্যের শেষপ্রান্তে পৌঁছানো মুখ।

‘বাসু, এবার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়।’

‘যখন ইচ্ছে হবে যাব।’

‘এখুনি যা।’

বাবা নীচ থেকে উঠে এসেছে। ঘরের সামনে না এসে বারান্দা থেকে বলল, ‘চেল্লাচেল্লি বন্ধ করো।’

‘কী এমন মানী লোক যে চেঁচাব না?’

‘কথাবার্তা ঠিক করে বল।’

‘যা বলছি ঠিকই বলছি।’

‘তা হলে বাইরে গিয়ে বল।’

‘এখনও আমি এই বাড়ির ছেলে, বাইরে যাব কেন?’

‘তা হলে ভদ্রভাবে আচরণ করতে হবে।’

‘কার করতে হবে, আমার না তোমার? তুমি কি ভদ্রলোকের মতো কাজ করেছ? বস্তিতে গিয়ে বাড়ির রাঁধুনির সঙ্গে শোওয়াটা কি ভদ্রলোকের কাজ?’

‘আমি তোকে বলছি…’

‘যা খুশি বলো, আমি কেয়ার করি না।’

বাবা মুখ ফিরিয়ে মাকে বলল, ‘ঘরে যাও তুমি।’

মা দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ঘরে যাওয়ার বদলে আবার তার চেয়ারে গিয়ে বসল। রেডিয়ো বন্ধ হয়ে গেছে। চালের থালাটা টেনে নিল।

‘ওখানে গিয়ে বসলেই কি কথা কানে যাবে না?’

‘তোর মাকে বাদ দিয়ে কথা বল।’

বাবা শক্ত হওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাসু অনেকদূরে চলে গেছে। বাবার শাসানি সেখানে পৌঁছল না।

‘তুমি আর কথা বোলো না। এমন ঘেন্নার ব্যাপার যে করে, অন্য লোক সম্পর্কে তার কথা বলার অধিকার থাকে না।’

‘তোকে সাবধান করছি…’

বাবা এক পা এগোল হাত মুঠো করে।

‘ওরে বাব্বাঃ, মারবে নাকি! ভুলে যাচ্ছ কেন গায়ের জোরটা আমারই বেশি।’

খাওয়ার জায়গা থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল। মা বলছে ‘ওর যা বলার আছে বলতে দাও। ঠিকই বলছে ও, তুমি-আমি দু-জনেই সমান ঘেন্নার পাত্র…’

বনানীর কাছে যাবতীয় কথাবার্তা অর্থহীন নির্বুদ্ধিতা মনে হচ্ছে।

‘এবার যে যার ঘরে যাও।’

নিজের ঘরে ঢোকার আগে, বাবা ভারিক্কি গলায় মেকি মর্যাদা এনে বলল, ‘কাল দেখব কী করা যায়।’

‘বেশ দেখা যাবে।’ কষ্ট হয় শুধু মায়ের জন্য, এমন একটা লোকের সঙ্গে এত বছর নরকবাস করলে শরীরে কী থাকবে? বাসুও তার ঘরে ঢুকে শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। বনানী মায়ের কাছে এসে দাঁড়াল। হাতটা অনড় হয়ে চালের ওপর। গাল বেয়ে টপটপ করে জল ঝরছে।

‘ওর কোনো দোষ নেই।’

বিড়বিড় করে মা বলল, অবশ্যই বাসু সম্পর্কে। মা ঠিক কী বোঝাতে চাইল? বাসু উচ্ছন্নে গেছে এটা ওর দোষ নয়? বাবাকে যদি মারত, তা হলে ওর দোষে সেটা ঘটত না? বাধুনির প্রেমে পড়েছে তাতেও ওর কোনো দোষ নেই?

শোবার ঘরটা অন্ধকার, বাবা আলো জ্বালেনি।

‘বনা এবার শুয়ে পড়।’

মুহূর্তের জন্য বনানীর মনে হল, মা একটা মানুষ। ঘরে এসে বনানী আলো নিবিয়ে শুয়ে রইল। সহজে ঘুম আসবে না। উপরের ঘরের মেঝেয় নড়াচড়ার শব্দ হল। নাটকীয় ব্যাপার যখন শুরু হয়, কিরণ চুপিসারে উপরে উঠে গেছে। এখন ও কী ভাবছে?

ট্রেন ছাড়ার কয়েক মুহূর্ত আগে ওরা ছুটে এসে কামরাটায় উঠল। হাঁপাতে হাঁপাতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে রইল সাফল্যের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে।

‘তোমার জন্যই।’

‘মোটেই না, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গাতেই আমি দাঁড়িয়েছিলাম। তোমাকে পাইনি।’

‘দু-মিনিটের জন্য শুধু চা খেতে গেছলাম।’

হিরু টলে পড়ছিল। ট্রেনটা বাঁক নিচ্ছে, চাকায় খটখট শব্দে বোঝা যাচ্ছে লাইন বদলাচ্ছে।

‘আমি তো ভাবলাম বোধ হয় ট্রেন ফেল করলাম।’

‘এক ঘণ্টা পরে আর একটা আছে। বোর্ডে সব পড়ে নিয়েছি, তারপর দুটো বাইশে।’

হিরু কামরার মধ্যে চোখ বোলাল। টকটকে লালরঙের গেঞ্জি পরেছে। বুকে ইংরেজিতে লেখা সুজুকি। কথাটা নিশ্চয় জাপানি, কিন্তু কী যে অর্থ বুঝল না। আঁটো জামাটায় হিরুকে আরও লম্বা, আরও শীর্ণ দেখাচ্ছে। কিন্তু সুন্দর ও আকর্ষণীয়। অনেকেই তাকাচ্ছে।

কামরায় বসার জায়গা ভরতি। দাঁড়াতেও হয়েছে ঠাসাঠাসি। দরজার পাশে মেঝেয় বসে আছে কয়েকটি স্ত্রীলোক। সঙ্গে খালি ঝুড়ি, বস্তা। হাত তুলে বনানী আন্দাজ করল, সে হাতল ধরতে পারবে না। ট্রেনটা দুলছে। বনানীকে মাঝে মাঝে হিরুর বাহু চেপে ধরতে হচ্ছে।

‘তুমি কি ভাত খেয়ে এসেছ?’

‘না, এইসময় খাওয়ার অভ্যেস নেই, তুমি?’

‘আমারও। শুধু একটা অমলেট…দ্যাখো দ্যাখো, আহ চলে গেল, জানলায় একটা চমৎকার বাচ্চচা।’

বনানী ঘাড় ফিরিয়ে তবু তাকায়। রেললাইনের ধার ঘেঁষে কয়েকটি বাড়ি। সরকারি হাউজিং এস্টেট হবে বোধ হয়। এ সবই কলকাতার অন্তর্গত। গ্রামট্রাম আসতে এখনও হয়তো আধঘণ্টা।

‘নেমে নিশ্চয় মিষ্টির দোকান পাব। আমার বন্ধু দিলীপ বলেছে, সব স্টেশনেই খাবার দোকান পাওয়া যাবে। ওদের বাড়ি এই দিকেই-বারুইপুরে।’

বনানী বাহুতে টান দিয়ে হিরুকে একটু ঝুঁকে মাথাটা কাছে আনতে ইশারা করল।

‘কী?’

‘কোথাকার টিকিট কেটেছ?’

বনানী ফিসফিস করে বলল। ওদের ঘেঁষে দাঁড়ানো মাঝবয়সি লোকটি আড়চোখে তাকিয়েই উদাসীন হয়ে গেল।

‘কাল টাইমটেবল দেখছিলাম, আচ্ছা চম্পাহাটি নামটা কেমন বলো তো? খুব মিষ্টি নয়? পিয়ালী? তালদি? আর একটা লাইনে খুব ফানি একটা নাম পেলাম-গোচরণ কিংবা গোচারণ। কোনটে ঠিক মনে হয়? আমার তো মনে হয় চরণটাই অ্যাপ্ট। চব্বিশ পরগনায় বেশ মজার মজার নামের স্টেশন ধপধপি। তারপর বহরু নামেও একটা জায়গা পেলাম। তারপরই…বলো তো কী?’

‘কী জানি। আমি এদিকের কিছুই জানি না। এই দ্বিতীয়বার ট্রেনে উঠলাম। ছোটোবেলায় একবার তারকেশ্বর গেছলাম, মাসতুতো দিদির বিয়েতে, আর এই। কী আছে তারপর?’

‘মোয়া।’

‘মানে?’

‘জয়নগর-মজিলপুর। যাবে?’

‘হ্যাঁ।’

ওরা আবোল-তাবোল কথা বলতে বলতে গড়িয়ায় পৌঁছল। কামরা থেকে কয়েকজন নেমে এল।

‘দাদা, একটু সরে বসুন।’

হিরু সিটে-বসা দুটি লোকের মাঝখানে আধ-হাত ফাঁক আছে দেখে বলল।

‘কোথায় বসবেন, জায়গা কই!’

‘আমার নয়, এক মহিলার জন্য বলছি। সবাই একটু সরে সরে বসুন, হয়ে যাবে।’

সিটের লোকেদের ব্যাজার মুখ দেখে বনানীর বসার ইচ্ছা লোপ পেল।

‘না না, আমি বেশ আছি।’

‘আরে বোসো।’

হিরু ওকে ঠেলে দিল। লোকদুটি নড়াচড়া করে ইঞ্চি কয়েক জায়গা বার করে দিল। বনানী বসল।

‘সোনারপুরে অনেকে নামবে, তখন বসার জায়গা পাবেন।’

বক্তার মুখের দিকে তাকিয়ে হিরু ভ্রূ কোঁচকাল। যেন খুবই জানা কথাটা আবার শুনল। ট্রেনের গতি কমছে। সিট থেকে দু-জন উঠে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। বনানীর পাশে সে বসল।

‘জানালার কাছে বসতে না পারলে কোনো লাভ নেই।’

বনানী মাথা নেড়ে সায় দিল।

‘কথা বলার সুবিধে হয়। ট্রেনে জানালা না পেলে একদমই ভালো লাগে না।’

একদিকের জানালায় মুখোমুখি বসে দুই বড়োবুড়ি। বুড়ির চুল রুপোর মতো সাদা, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুর। চওড়া কালো পাড় শাড়ির ঘোমটায় মাথার অর্ধেক ঢাকা।

‘কী সুন্দর দেখতে, না?’

‘হ্যাঁ। বয়স কত হল বলো তো?’

‘ষাট-পঁয়ষট্টি হবে।’

ট্রেন সোনারপুর স্টেশনে ঢুকেছে। বুড়ির পাশের লোকটি এবার উঠল। বনানী ইতস্তত করে উঠে খালি জায়গাটায় বসল। জানালার কাছাকাছি তো হল।

‘বিল্টু এটায় আয়, অনেক খালি রয়েছে।’

প্ল্যাটফর্ম থেকে জানলা দিয়ে কামরায় উঁকি দিল দুটি মুখ।

‘ডাক ডাক ওদের ডাক…অ্যাই বিপ্লব, অ্যাই অ্যাই, শালারা শুনতে পায় না নাকি…অ্যাই গৌতম এদিকে, এটায় আয় খালি আছে। ডেকে আন না।’

লম্বা চুল, কাঁধে ব্যাগ, গেঞ্জি-শার্ট পরা গাঁট্টাগোট্টা ছেলেটি হাত নেড়ে তার সঙ্গীদের ডাকতে লাগল। অন্য ছেলেটি, প্রায় একই পোশাক, তবে একটু লম্বা, কোমরের বেল্টটাও বেশি চওড়া, ব্যস্ত হয়ে ট্রেনের সামনের দিকে এগিয়ে গেল।

একটু পরেই চে�চিয়ে কথা বলতে বলতে জনাদশেক ছেলে এই কামরায় উঠল। ওদের বয়স ষোলো এবং বাইশের মধ্যে। চেহারার মধ্যে বিশেষ তারতম্য নেই। ছিপছিপে কষওলা শরীর। পেশিগুলো খুব বড়ো নয় কিন্তু শক্ত, হাতের শিরা ওঠা, অধিকাংশের গাল বসা, বুক চাপা। দেখে বোঝা যায়, খাটতে পারে। কথাবার্তা চেঁচিয়ে, ধৈর্য কম। প্রত্যেকের বগলেই ব্যাগ। বুঝতে অসুবিধা হল না কোথাও ফুটবল ম্যাচ খেলতে যাচ্ছে। বনানী তিনটে লোকের পর, কথা বলা যাচ্ছে না। হিরু রেগে উঠতে লাগল এই নিরুপায়তার জন্য।

‘কতদূর যাবে?’

বুড়ি কৌতূহলে প্রশ্ন করেছে। বনানী ফাঁপরে পড়ল। হিরু কতকগুলো স্টেশনের নাম করেছিল।

‘গোচরণ, আপনি?’

‘বারুইপুর, বড়ো নাতির পইতে। কী পড় তুমি?’

‘বি এ।’

বলে ফেলে বনানীর নিজেকে খারাপ লাগল। এত সুন্দর দেখতে, মিষ্টি কণ্ঠস্বরের মানুষকে মিথ্যা বলতে ভালো লাগে না। কিন্তু সত্যি কথা বললে আরও কৌতূহলী হবে। আসলে হিরুর সঙ্গে এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বেচারা মুখ বুজে বসে।

‘গোচরণে বাড়ি?’

‘না, বাগবাজারের দিকে। পিসিমার বাড়ি যাচ্ছি।’

‘সঙ্গে কে, দাদা?’

বনানীর হাসি পেল। হিরুকে দাদা বানিয়ে নিজেকে মজা দেবার লোভ সামলাতে পারল না।

‘হ্যাঁ।’

হিরুর দিকে তাকিয়ে সে হাসল। জিজ্ঞাসু চোখে হিরু পালটা তাকাল। ব্যাপারটা ওকে পরে বলা যাবে।

বুড়ি এবার উঠে দাঁড়াল। বারুইপুর আসছে।

‘ওরে ওরে, একটা সিট হয়েছে, সাধন বসে পড়।…আর একটা সিট, আমি বসব।’

তিন-চারটি ছেলে অপেক্ষা করে, বুড়োবুড়ি সিট থেকে উঠে বেরিয়ে আসছে, ওই সময়টুকুর মধ্যেই হিরু উঠে গিয়ে বুড়োর জায়গাটায় বসে পড়ল। বনানী সরে গেল জানলার পাশে।

‘যাঃ বাব্বা, ভাবলুম জানলায় বসব!’

‘কেন রে সাধন, তোর অত জানলার দরকার হল কেন? মুখোমুখি হবার যাদের দরকার তারাই বসেছে।’

বনানী লক্ষ করল হিরুর কানদুটো যেন লাল হয়ে উঠল। চোখে রাগের আভাস।

‘ফুটবলাররা…এত অসভ্য হয়!’

বনানী পা দিয়ে হিরুর পায়ে চাপ দিল।

‘কতদূর যাচ্ছি আমরা?’

‘জয়নগর পর্যন্ত।’

দু-জনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে।

‘ফিরতে কি সন্ধে হবে?’

‘তোমার তো আজ তাড়া নেই, পড়াতে যাচ্ছ না তো?’

‘না।’

হিরুর কনুই আর হাত জানলায় রাখা। বনানী ঝুঁকে জানালায় মুখ নিয়ে গেল। ওর আঙুলে চিবুক ঠেকল।

‘দেখেছ কী সবুজ!’

‘তাই বলে ধানগাছে তক্তাটক্তা হয় বোলো না যেন।’

‘ওরে বিল্টু, খাট করবি ধানগাছের তক্তায়? দারুণ মজবুত হবে।’

হিরুকে স্পষ্টতই আড়ষ্ট হয়ে যেতে দেখল বনানী। এরা জ্বালাতন করবে যতক্ষণ থাকবে। কতক্ষণ থাকবে কে জানে।

‘এবার খুব ধান হবে।’

‘মনে হয়।’

হিরু গম্ভীর হয়ে গেছে। হাওয়ায় চুলগুলো থরথর উড়ছে। কপালের উপরে কয়েকটা। বনানীর ইচ্ছে করছে কপাল থেকে সরিয়ে দিতে।

‘চালের দাম কমলে, অন্য জিনিসেরও দাম কমবে।’

বনানীর চিবুক আবার হিরুর আঙুলে ঠেকল। হিরু হাতটা সরিয়ে নিল।

‘অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠলে হত, যাবে পরের স্টেশনে?’

‘না।’

জেদি ছেলের মতো হিরু শক্ত হয়ে বসে। ট্রেন মন্থর হচ্ছে। বনানীর পাশের লোকটি উঠল।

‘পেয়েছি রে একটা, অ্যাই আমি আমি…গৌতম ভালো হবে না বলছি।’

দুটি ছেলের মধ্যে হাত ধরে টানাটানি চলল। একজন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বনানীর পাশে বসে দাঁত বের করে হাসল।

কে একজন মন্তব্য করল, ‘মুখোমুখি নয়, পাশাপাশি হল।’

‘রাগ হল বুঝি। আয়, আয়, বোস তা হলে।’

‘থাক উঠতে হবে না, জায়গা হয়ে যাবে। একটু সরে বসুন তো, সরুন সরুন…’

ছেলেটি তার সদ্য-বসা সঙ্গীর পাশের লোকটির হাঁটু ধরে টানল। লোকটি যতটা সম্ভব সরে সামান্য জায়গা করে দিল। কোনোক্রমে ছেলেটি তার পাছা রাখার সুযোগ পেল, এবং তার সঙ্গীর চাপ পড়ল বনানীর উপর। সে জড়োসড়ো হয়ে কুঁকড়ে বসল।

‘এ কী! আপনারা এভাবে বসছেন কেন? দেখছেন না কী অবস্থা হল।’

হিরুর তীক্ষ্নস্বরে, রাগ এবং বিরক্তি ঝাঁঝিয়ে উঠল। যাত্রীদের অনেকেই এদিকে মুখ ফিরিয়ে। ছেলেদুটি যেন মজা পেয়েছে, এমনভাবে দাঁড়িয়ে-থাকা সঙ্গীদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মুখ টিপে হেসে হিরুর মুখে দৃষ্টি দিল।

এরা সময় কাটাবার একটা ছুতো চায় এবং তা পেয়ে গিয়ে খুশি। বনানীর বুক ঢিপঢিপ করে উঠল। হিরু যেন বোকামি না করে, যেন না রাগে, যেন আর কথা না বাড়ায়। এরা তপ্ত শারীরিক ঝঞ্ঝাটের মধ্যে ঝাঁপাতে চায়, এটা ওদের খেলা। এরা বাদুড় জাতের। হিরু বাংলার বাইরে থেকে এসেছে, নিঃসঙ্গ জীবনের মধ্য দিয়ে বড়ো হয়েছে, ও এদের বুঝবে না। দুর্বল, শীর্ণ হিরু মস্তিষ্ক চায়।

‘হল কী দাদা, অত চটছেন কেন? আপনি নিজেও তো ঠেলেঠুলে জায়গা করে ওনাকে বসিয়েছিলেন, সেটা কি ভুলে গেছেন?’

কামরার অন্য প্রান্ত থেকে একজন বলল, ‘নিশ্চয় শেয়ালদা থেকে উঠেছে।’

‘কিন্তু এইভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো অন্যের অসুবিধা করে নয়।’ বনানী আবার চাপ দিলে হিরুর পায়ে। কিন্তু ও সেটা গ্রাহ্যে আনল না।

‘কাণ্ডজ্ঞানহীন ব্যাপারটা কী দাদা? এ লাইনে নতুন উঠেছেন বুঝি? এভাবেই বসা হয়।’

দাঁড়িয়ে থাকাদের একজন বলল। বাকিদের চোখেমুখে সায় আছে। ‘না বসা হয় না। অন্যের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর দিতে হয়, সেটাই সভ্যতা।’

‘মানে! আমরা অসভ্য, ট্রেনের এত লোক অসভ্য?’

‘আমি কাউকে অসভ্য বলিনি।’

‘আমাদের সভ্যতা শেখাতে এসেছেন? বাড়ি কোথায়?’

‘শুনলুম তো গোচরণে যাবেন। ওই মেয়েটিই একজনকে বলল। তা হলে এ লাইনে কোথায় যাচ্ছেন? এটা তো ডায়মন্ডহারবার লাইন নয়।’

আর একজন পুরোনো যাত্রী বলল। বনানী প্রত্যেক যাত্রীর মুখে মজা এবং কৌতূহলের ছায়া দেখতে পাচ্ছে। এরা সবাই এখন তাদের কোণঠাসা করে এক ধরনের নীরব উল্লাস ভোগ করবে।

‘আমরা কোথায় যাই বা না যাই সেটা আপনার দেখার কথা নয়। ভালোভাবে আচরণ করুন, এটাই শুধু চাই।’

‘দেখুন অনেকক্ষণ আপনার বাড়বেড়ানি শুনেছি। আর একটি কথা নয়, চুপ করে বসে থাকুন।’

বনানীর পাশের ছেলেটিও শান্ত কঠিন কথায় হুমকি দিল।

‘বেশি কথা বললে তুলে ফেলে দোব।’

দাঁড়ানোদের কেউ আবহাওয়া গরম করে তুলতে চায়।

‘আপনারা কি সভ্য মানুষের মতো কথা বলছেন?’

‘হিরু এবার চুপ করো।’

‘কেন টিকিট কেটে আমরা যাচ্ছি।’

‘আর আমরা টিকিট না কেটে যাচ্ছি?’

‘দেখান তো টিকিট?’

হিরু উঠে দাঁড়াল। শরীরের ভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জ। সারা কামরা কয়েক সেকেন্ড বিব্রতবোধ করে রাগে ফেটে পড়ল। ওর সামনের ছেলেটি আবার শান্ত গলায় বলল, ‘ট্রেন তোর বাপের নয় শালা… আর একটি কথাও নয়।’

বনানী দেখল হিরুর সারা শরীর কাঁপছে।

‘ওই তো চেহারা, তার রোয়াব!’

‘যেমন দ্যাবা তেমনি দেবী।’

‘শাট আপ ইউ সোয়াইন।’

হিরু অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসল, সামনের ছেলেটির গালে চড় বসিয়ে।

ছেলেটি মুহূর্তকয়েক অপলক তাকিয়ে রইল হিরুর মুখে। একটা বিষাক্ত হাসি খেলে গেল ঠোঁটে এবং তাচ্ছিল্যভরে ডান হাতের মুঠো হিরুর পাঁজরে বসিয়ে দিল যার শব্দে বনানী চমকে উঠল। বাঁ হাতের ঘুষিটা মুখে পড়ল। বনানী চিৎকার করে হিরুকে জড়িয়ে ধরল। তিন-চারটি ছেলে বসা মানুষদের হাঁটু ঠেলে এগিয়ে আসছে। হাঁটু গুটিয়ে লোকগুলি সন্ত্রস্ত হয়ে ওদের জায়গা করে দিল।

‘না, না, এ কী করছেন আপনারা…’

‘বার করে আন বার করে আন, লাশ বানিয়ে ছাড়ব।’

বনানীর মুঠোয়, একজন হাতের চেটো দিয়ে কুড়ুলের মতো আঘাত করতেই মুঠো আলগা হয়ে গেল। ওরা হিঁচড়ে টেনে নিল হিরুকে। আঙুল বেঁকিয়ে বেঁকিয়ে হিরু একজনের গাল খামচে ধরেছে। সম্ভবত এক মিনিটের জন্য বনানীর চোখের আড়াল হল হিরু। কামরার মুখোমুখি দরজার মাঝখানের জায়গাটুকুতে হিরু উবু হয়ে এবং তাকে ঘিরে ওরা। কয়েকজন ঝুঁকে। কয়েকটা মুঠো উপর থেকে হাতুড়ির মতো নামল। কয়েকজন লাথি কষাল। বালিশে চাপড় মারার মতো ভোঁতা, নিরীহ, অনুত্তেজক শব্দগুলোর সঙ্গে ‘ওক ওক’ আর একটা শব্দ। অনেকগুলো কণ্ঠ থেকে ক্রুদ্ধ গজরানির আওয়াজ।

ওদের ঠেলে, পাগলের মতো বনানী জড়িয়ে ধরল হিরুকে। ফর্সা মুখ এবং গলা বেয়ে রক্তের ধারা নেমে লাল গেঞ্জিটায় বুকের স্থানে স্থানে কালচে করে দিয়েছে।

‘বাস্টার্ড…বাস্টার্ড।’

একটা লাথি বনানীর ঊরুতে লাগল। সে ব্যথা পেল না। হিরুর চুল মুঠোয় ধরে একজন ঝাঁকাচ্ছে।

‘ছাড়ুন ছাড়ুন ওকে আর মারবেন না। আমি ক্ষমা চাইছি, আর মারবেন না, ক্ষমা করুন।’

‘মাগো কী দশা করেছে!’

মেঝের বসা বুড়িটির দিকে কাতর চোখে বনানী তাকাল, মুখ তুলে, আরও কোথাও নিরাপত্তা ও সহানুভূতি আছে কি না খুঁজল।

‘নামিয়ে দে দুটোকে।’

‘বাঞ্চোত সভ্যতা শেখাতে এসেছে! প্রাণে মারিনি ওর বাবার ভাগ্যি। বাস্টার্ড বলা ঘুচিয়ে দিতুম।

আধ মিনিটের মধ্যেই স্টেশন এল।

‘নাম শালা, নাম।’

হিরুকে হাত ধরে মেঝের উপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে প্ল্যাটফর্মে ফেলে দিল। বনানীকে পিঠে ধাক্কা দিয়ে নামাল। সে ফ্যালফ্যাল করে কামরাটার দিকে তাকিয়ে রইল।

‘এবার মুখোমুখি বসে থাক দু-জনে, কেমন!’

বনানীর চোখ জলে ভরে আসছে। আবছা দেখাচ্ছে মানুষগুলো। ট্রেনের দরজায় জানলায় নড়াচড়া করছে শুঁয়োপোকার মতো মুখ। ওরা কী বলছে সে বুঝতে পারছে না। হিরু পা ছড়িয়ে মুখ নীচু করে প্ল্যাটফর্মে বসে। বনানী শুধু শুনতে পাচ্ছে একটা কাতরানির শব্দ। হাঁটু মুড়ে সে ওর পাশে বসল।

‘বাস্টার্ড।’

হিরু শান্ত হও।’

ট্রেনটা নিঃশব্দে ছেড়ে চলে গেল ওদের রেখে দিয়ে।

এবার সে কী করবে?

কৌতূহলী তিন-চারজন এগিয়ে এল। তারা এই ট্রেন থেকেই নেমেছে।

‘অ্যাক্সিডেন্ট নাকি? ট্রেন থেকে পড়ে গেছে?’

বনানী মাথা নাড়ল।

‘কতকগুলো ছেলে ওকে মেরে নামিয়ে দিল। ডাক্তারখানা আছে এখানে?’

‘এই দুপুরে ডাক্তারবাবু কি আর বসে থাকে?’

‘ফেরার ট্রেন কি এখন আছে?’

‘ঘণ্টাখানেক পর পাবেন।’

বনানী ঝুঁকে ফিসফিস করে বলল, ‘উঠতে পারবে?’

ঝিম ধরে বসে আছে হিরু। জবাব না দিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়েই কাতরে উঠল। দুটি লোক এগিয়ে এসে বগলের নীচে হাত দিয়ে টেনে তুলতে যেতেই ও প্রায় চিৎকার করে উঠল যন্ত্রণায়। নীচের ঠোঁট ফেটে ঝুলে পড়েছে। ডান হাতটা কনুই থেকে নড়নড় করছে। নাকের নীচে রক্ত। মুখটা ফুলে উঠে চোখ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে।

স্টেশনের চায়ের স্টল থেকে একজন মগে জল আনল। বনানী রুমাল ভিজিয়ে মুখ থেকে রক্ত মুছিয়ে দিল।

‘হাড়টাড় ভেঙেছে বোধহয়। বেঞ্চে শুইয়ে দিচ্ছি। এরপরের ট্রেনেই আপনারা কলকাতায় চলে যান।’

লোকগুলি অযথা কোনো প্রশ্ন করল না বা সমবেদনা জানাল না। যেন এসব ঘটনায় খুবই অভ্যস্ত। পাঁজাকোলা করে হিরুকে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চে শুইয়ে দিয়ে তারা চলে গেল।

ঘড়ি দেখার জন্য হাতটা তুলে বনানী দেখল কাচ ভেঙে গেছে, একটা কাঁটা নেই, ঘড়িটা বন্ধ। হিরুর হাতে ঘড়ি নেই, যেহেতু পরে না।

‘ঘড়ি মানেই কাজ, ব্যস্ততা, রুটিনমাফিক চলা। এসব আমার ভালো লাগে না।’

এখন নিশ্চয়ই দুটো-আড়াইটে। কলকাতায় যেতে অন্তত পাঁচটা বেজে যাবে। কী করবে সে পৌঁছেই? বনানী দিশাহারা বোধ করতে লাগল। এখুনি চিকিৎসা দরকার। এক্স-রে করতেই হবে। হাসপাতালে নিয়ে যাবে কি? শেয়ালদা স্টেশনের কাছে নীলরতন হাসপাতাল। নাকি বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেবে।

চোখ বুজে হিরু শুয়ে। ওকে যেন আরও লম্বা দেখাচ্ছে। ডান হাতটা শরীরের পাশে রাখা। গভীর নিশ্বাস-প্রশ্বাসে ওঠানামা করা বুকের দিকে তাকিয়ে রইল। বড়ো রোগা। বনানী আলতোভাবে বুকে হাত রাখল।

চোখ খুলে হিরু তাকাল।

‘কষ্ট হচ্ছে? ব্যথা করছে?’

হাসার চেষ্টা করতেই বীভৎস হয়ে উঠল হিরুর মুখ। কিছু একটা বলতে চাইছে। বনানী ওর মুখের কাছে কান আনল।

‘বুল… ওয়ার্কারটা… এবার…’

‘কথা বোলো না। উঠতে পারবে?’

‘হ্যাঁ।’

বনানীর সাহায্যে ধীরে ধীরে উঠে বসল ও। ইশারায় জানাল জল খাবে। চায়ের স্টল থেকে গ্লাসে জল আনল বনানী। কোনোক্রমে হিরু ঠোঁট ফাঁক করল। সে জল ঢেলে দিল।

‘কোথায় ব্যথা?’

মাথা নাড়ল ও।

‘আমরা ফিরে যাব।’

‘এই প্রথম… মারামারি।’

হিরুর ফুলে ওঠা মুখ কয়েক সেকেন্ডের জন্য কঠিন হল।

‘মার খেলাম।… গায়ে জোর নেই।’

‘তোমার বড্ড রাগ, ওটা কমাও।’

‘আবার আসব, এক বছর দু-বছর যতদিন হোক।’

বনানীর বুকের মধ্যেটা ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে যেতে শুরু করল। হিরুও তা হলে অতি সাধারণভাবেই বাঁচার পন্থা চাইছে। সেই সাধারণ রাগ, মান অপমানবোধ, প্রতিশোধ-ইচ্ছা-বাসুর মতোই। হয়তো এই ঘটনাই ওর জীবনকে অন্য খাতে বইয়ে দেবে। বহু বছর পর ও কি এটা বুঝতে পারবে? একটা সুন্দর মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারত।

‘টিকিট কেটে আনছি।’

বনানী উঠে দাঁড়াল। অসহ্য একটা শান্ততা চারিদিক বিরাজ করছে। ঝাঁ-ঝাঁ রোদ, ফুরফুরে হাওয়া এবং বিস্তৃত মাঠ ও আকাশ অবসন্নতা এনে দিচ্ছে। চিবুকে ঘামের ফোঁটা। ট্রেনের লাইন ধরে সোজা তাকালে মন বড়ো নিঃসঙ্গ বোধ করে। ট্রেনের জন্য কিছু যাত্রী এসেছে।

‘কেমন দেখাচ্ছে? বিয়ের বরের মতো?’

‘রুমালটা মুখে চেপে রাখো।’

বনানী হেসে ফেলল। হিরু আবার ছেলেমানুষ হয়ে গেছে। এইরকমই ও থাকে না কেন! সবাই থাকে না কেন? কিরণের মতো খুশিয়াল মেজাজে, হালকা হাসিঠাট্টার মধ্যে। মা, বাবা, বাসু পারে না একসঙ্গে বসে গল্প করতে, যেমন হিরুদের ঘরে হয়। হিরুর বাবা-মা ওকে দেখেই কী কথা বলবে? কী করবে? ডাক্তার, হাসপাতাল বা নার্সিং হোম। তাকে কিছু বলবে কি? বনানী ক্রমশ এই চিন্তায় মুহ্যমান হয়ে পড়তে লাগল।

নিশ্চয় হিরু কাউকে বলে আসেনি, তারা দু-জন ট্রেনে বেড়াতে বেরোচ্ছে। ব্যাপারটা লুকিয়েই। অবশ্য বলে এলেও ওর মা আপত্তি করত না।

কিন্তু হিরুকে যদি ওরা মেরে ফেলত? যদি অন্ধ করে দিত বা শিরদাঁড়া ভেঙে দিত? এই অজানা জায়গায় সে তখন কী করত? কী করে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেত? ব্যাগে তো গোটা তিরিশ মাত্র টাকা। তা ছাড়া মৃত হিরুকে বয়ে নিয়ে যাওয়া! এখানকার লোকেরা নিশ্চয় সাহায্য করত, পুলিশও এসে পড়ত।

ব্যাপারটা চিন্তা করতে করতে বনানী ট্রেনে সারাক্ষণ নিস্পন্দের মতো বসে রইল- কিছু ভালো লোক অবশ্যই আছে, যেমন প্ল্যাটফর্মের ওরা। জল এনে দিল, হিরুকে তুলে বেঞ্চে শুইয়ে দিল। হয়তো ওদেরই কেউ সঙ্গে আসত। অথবা প্রথমে হাসপাতালে তারপর লাশটা কোনো মর্গে পুলিশ পাঠাত। সে বসে থাকত সেখানে। পুলিশই খবর পাঠাত ওদের বাড়িতে। বাবা-মা না আসা পর্যন্ত সে ওইভাবেই বসে থাকত।

বনানী সন্তর্পণে পাশে বসা হিরুর দিকে তাকাল। রুমালটা মুখে চেপে মুখ নীচু করে বসে। দেখে কষ্ট হয়।

এখনও বেঁচে, আর কিনা ওর মৃত্যুর কথা ভাবছি! অপ্রতিভ হয়ে বনানী হিরুর বাঁ হাতটা চেপে ধরল।

‘আর একদিন আমরা আসব, তবে শোধ নিতে নয়, বুঝেছ?’

হিরু ঝিমোচ্ছে কিন্তু হাতে স্পন্দনটা দ্রুত। সেটা অনুভব করতে করতে বনানীর মনে হল, সে নিজেও বোধ হয় বেঁচে আছে।

শেয়ালদা থেকে ট্যাক্সিতে দু-জনে সল্টলেক পৌঁছল। যতই বাড়ির কাছাকাছি হচ্ছে, ভয়ে বনানীর বুক শুকিয়ে আসছে। হিরুই চিনিয়ে দিল বাড়িটা।

‘বাবা কখন ফিরবে?’

‘বাড়িতেই আছে।’

কলিং বেল টেপা এবং দরজা খুলে দেওয়ার মধ্যে সময়টুকুতে বনানীর মনে হল, তার চুল সাদা হয়ে যাবে।

হিরুর মা দরজা খুলেছে। প্রথমেই বনানীকে দেখে মুখে হাসি ফুটল। হাসিটা বিস্ময় এবং আতঙ্কে দ্রুত রূপান্তরিত হওয়া, বনানীর অনুমানমতোই ঘটল এবং পরবর্তী চাপা চিৎকারও।

এ কী! কে করল? কোথায় ঘটল?’

এক ছেলে হওয়ার যন্ত্রণার কথা হিরু বলেছিল। কিন্তু বাবা-মারও যে যন্ত্রণা একটি ছেলে থাকার জন্য কতটা হয়, বনানী নীরবে তা লক্ষ করে গেল। কথা বলার কোনো সুযোগই সে পেল না, পেলেও বলার ইচ্ছে তার নেই।

ট্যাক্সি আনা হয়েছে। হিরুর বাবার বন্ধু, মেডিকেল কলেজের এক অধ্যাপকের নার্সিং হোমে হিরুকে নিয়ে যাওয়া হবে পার্ক সার্কাসে। বাড়িতে পৌঁছনো পর্যন্ত হিরুর হাঁটা বা কথা বলার মতো সমর্থ ছিল, কিন্তু এখন ওর কষ্ট শুরু হয়েছে। ডান হাতটা ওরা ভেঙে দিয়েছে, নীচের ঠোঁট সেলাই করতে হবে। এবার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে ডান পাঁজরে আর তলপেটে। মুখে কয়েক জায়গায় রক্ত জমে লাল ছোপ। চোখ প্রায় বন্ধ। কথাও বলতে পারছে না।

পাশের ফ্ল্যাটের একটি লোকের সাহায্যে হিরুকে ওর বাবা নীচে নামিয়ে এনে ট্যাক্সিতে তুলল। ওদের সঙ্গে যাবার জন্য বনানীও ট্যাক্সিতে উঠতে যাচ্ছিল। হিরুর মা, যিনি এতক্ষণ ওর সঙ্গে তিন-চারটির বেশি কথা বলেনি, বনানীকে হাত দিয়ে আটকাল।

‘এবার বাড়ি যাও।’

দরজাটা বন্ধ করে হিরুর মা পাশ ফিরে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। ‘পার্ক সার্কাস। জলদি।’

হিরুর বাবা গম্ভীর মুখে তাকিয়ে সামনে। ঘটনা সম্পর্কে যাবতীয় প্রশ্ন ছাড়া আর কোনো কথা বলেনি। ওরা দু-জনে ব্যাপারটা নিয়ে, স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ত, উদবিগ্ন থেকেছে।

তবু ট্যাক্সিটা চলে যাবার পর, বিরাট বাড়িটার গেটে একা দাঁড়িয়ে, নির্জন প্রায়ান্ধকার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বনানীর চোখে জল এল। কেন সে কাঁদছে তা সে জানে না। হিরুর নুয়ে পড়া বিধ্বস্ত শরীরের কথা সে ভাবছে না, এমনকী, ওর মায়ের কর্কশ ‘এবার বাড়ি যাও’ কণ্ঠস্বরও নয়। দুপুর থেকে যা কিছু হয়েছে, সবই তার কাছে অবাস্তব মনে হচ্ছে। নষ্ট, সবই নষ্ট, এমন এক বিশৃঙ্খল অনুভবে সে ভরে যাচ্ছে। বুঝে ওঠার চেষ্টা করল না, কেন এমন চিন্তা তার আসছে।

হঠাৎ তার চোখে ভেসে উঠল সকালে দেখা মাকে! খাবার টেবলে তার নিজের চেয়ারটিতে বসে, সামনে চায়ের কাপ। সকালে সে মাকে কখনো কিছু খেতে দেখেনি। দু-চোখের নীচে কালি, ফলে মনে হচ্ছিল চোখদুটি কোটরে ঢুকে আছে। মা অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছিল রান্নাঘরের চৌকাঠে।

মা অসুখী। বনানী বাস ধরার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভাবে, আমাদেরও অসুখী করে তুলেছে, কিন্তু তাই থেকে যন্ত্রণাভোগ মা-ই প্রথম করে। বাসু আর বাবাও করে। ওরা দু-জন এখন পরস্পরকে সহ্য করতে পারছে না। দু-জনের চোখেই জেদের চাহনি চেপে বসেছে। ছেলের থেকে বেশি কিছু কাণ্ডজ্ঞান বাবার ব্যবহারে ধরা পড়ছে না। যা করেছে সেজন্য বাবা লজ্জিত কিন্তু তাকে ধুলোয় লুটিয়ে দেওয়ার জন্য ছেলেকে কোনোদিনই ক্ষমা করবে না।

সম্ভব হবে তো? আমাদের পরিবারটা সত্যিকার পরিবারের মতো আচরণ করবে কি? একে অপরের মুখের দিকে খুশি চোখে, ভবিষ্যতের জন্য নির্ভরতা নিয়ে তাকাবে? বনানী চোখের জল মুছল। হিরুর জন্য নয়, মায়ের জন্যও নয়, সে বুঝতে পারছে নিজের প্রতি দয়া থেকে তার এই কান্না আসছে।

লোডশেডিং তাদের তল্লাটে।

বাস থেকে অন্ধকারেই নেমেছে। ফুটপাথে কোথায় গর্ত, কোথায় কুকুর শুয়ে থাকে বা কোথায় মাথা তুলে আছে পাথর, বনানীর তা মুখস্থ। বাড়ির দরজাতেই হঠাৎ ছমছম করে উঠল তার শরীর। সেরেস্তা-ঘর বন্ধ। কিছু কি ঘটেছে? উঠোন থেকে সে দেখতে পেল খাওয়ার টেবলে হ্যারিকেন জ্বলছে। দাঁড়িয়ে কোনো শব্দ হয় কি না শোনার চেষ্টা করল। কিরণ বাসন বা বালতি কিংবা হাঁটার শব্দ করবেই। কিছুই সে শুনতে পেল না। তা হলে মা-র কিছু…। বনানী গাঢ় অন্ধকারের মধ্যেই ছুটে উপরে উঠল। হাঁটতে শেখা থেকে সে এই সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে। এখন শ্বাসপ্রশ্বাসের মতোই সে ভুলে গেছে বা দরকার হয় না লক্ষ করার।

চেয়ারে মা নেই। অথচ এইসময় বসে থাকে। রান্নাঘরে উঁকি দিল। মা ভাতের হাঁড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, ক্লান্ত দেখাচ্ছে, তবে সকালের মতো অতটা নয়।

‘তুমি রাঁধছ যে, কিরণ কোথায়, মাসির ওখানে আবার গেছে?’

‘না।’

‘তবে তাড়িয়ে দিয়েছ।’

কথাটা আপনা থেকেই মুখ এসে গেল। বহুদিন ধরে এটাই সে প্রত্যাশা করে এসেছে।

‘না। ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। দুপুরে ভাত খেয়েই ছটফট করে এলিয়ে পড়ে। আমি একা বাড়িতে। কী আর করব, তাই ওষুধের দোকানের নন্দবাবুকে ডেকে আনি। উনিই ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স ডাকিয়ে হাসপাতালে পাঠান।’

‘কতক্ষণ আগে?’

‘দুপুরেই।’

‘বাসু কোথায়? বাবা ফিরেছে?’

‘হাসপাতালে গেছে, আর জি কর-এ।’

‘খুব সিরিয়াস কিছু?’

‘কী জানি।’

তাচ্ছিল্যও নয়, ঔদাসীন্যও নয়, এমন এক স্বরে মা কথাটা বলেই বনানীর দিকে তাকিয়ে রইল। মুহূর্তের জন্য তার মনে হল, মা জানে। কী যেন গোপন করতে চাইছে।

‘ফুড পয়জন?’

‘হবে। বমি করেছে, পায়খানা করেছে।’

‘কী বলছিল?’

‘বলল, বাঁচতে চাই না, বিষ খেয়েছি। বাঁচাবার চেষ্টা তোমরা কোরো না। অনেকবার বলেছে।’

‘তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু শুনলে?’

‘কী করব আমি, কী করতে পারি তখন? নন্দবাবুকে ডেকে আনলাম।’

ঠিক এইভাবে হিরুর বাবা ঘণ্টা দুয়েক আগে তাকেই প্রশ্ন করেছিল। মিলটা অদ্ভুত রকমের। কী ধরনের উদবেগ হয় এবার বনানী বুঝতে পারছে। কিন্তু মা এমন নিস্পৃহ কেন?

কিরণের আত্মহত্যা করার কোনো কারণ, কোনো যুক্তি আছে কি? সে তার স্বভাব ও চাহিদা মতো সুখেই আছে। আপন বলতে কেউ নেই, দায়দায়িত্ব পালনের দাবিও নেই। দুটি পুরুষকে নিয়ে সে দিব্যিই আছে। বিষণ্ণতায় বা আবেগের তোড়ে অথবা পাপপুণ্যের দ্বন্দ্বে মানসিক ভারসাম্য হারাবে এমন সূক্ষ্ম মনও ওর নয় তা হলে?

‘নন্দবাবু যখন এল, তার সামনে কি ও এইসব বলেছে?’

‘না।’

‘শিশি বা কাগজটাগজ কিছু পড়ে আছে কি না দেখেছ?’

হাঁড়ি থেকে হাতায় ভাত চোখের কাছে ধরে পরীক্ষা করছে। বনানীর মনে হল, সময় নেবার জন্যই মা এটা করল।

‘কিছুই তো পাইনি।… তবে একটা হলদে ছোটো দোমড়ানো কাগজ যেন কলঘরের মেঝেয় দেখেছিলাম। সে তো ধোয়াধুয়ির সময় বেরিয়ে গেছে।’

‘তুমি ঠিক বলছ, ও বলেছে নিজে বিষ খেয়েছে?’

‘মিথ্যে বলা আমার স্বভাব নয়।’

এটা সত্যি নয়। বনানী জানে, মা নিজের অজান্তেই মিথ্যে বলে। বা সত্যিটাকে এমন বিকৃত করে যে চেনা শক্ত হয়।

‘বিষ খাওয়ার কোনো কারণ বলেছিল? কারোর নাম করেছিল?’

‘না। সকাল থেকে হাঁফ ওঠার মতো হচ্ছিল, আমি শুনেছিলাম। তখন ওকে খুব মনমরা দেখেছি।’

‘তুমি ভাত খেয়েছ?’

‘হ্যাঁ, অল্প।’

‘সেই ভাতই ও খেয়েছে?’

‘আবার কোথায় ভাত পাবে?’

মা যেন খানিকটা জোর ফিরে পেয়েছে। কতটা মিথ্যা বলছে তা আঁচ করতে না পারলেও কথার মধ্যে সাজানো ব্যাপারটা বনানীর কানে লাগছে।

‘এভাবে তুই আমায় প্রশ্ন করছিস কেন? আমার শরীর বলতে কিছু নেই, বিছানাতেই পড়ে থাকি, তোর বাবা আর ভাই নিজেদের মধ্যে আকচাআকচি করছে সারাদিনই বাড়িতে। আমি একা, তার ওপর তুই এইভাবে জেরা করছিস যেন আমিই বিষ দিয়েছি। আর কত সহ্য করব?’

মা হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল। বনানী পায়ে পায়ে নিজের ঘরে এল। অন্ধকারটাও তার মুখস্থ। বিছানায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে অস্ফুটে ‘আহ’ বলল। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আজ এই প্রথম সে শোবার সুযোগ পেল। সারাটা দিন… কী বীভৎস ভয়ংকর একটা দিন। চোখ বুজে আসছে, এখন সে কী ভাবতে পারে? হিরুকে না কিরণকে? মা কী করছে এখন? রান্না শেষ করে চেয়ারে বসবে আবার?

কিছুক্ষণ পর নীচে তালা খোলার শব্দ পেল বনানী। বাবা সেরেস্তা খুলছে। কিরণের খবর জানতে সে নীচে নেমে এল।

মোমবাতি জ্বলছে। বাবা ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে। কোর্টের পোশাক ছেড়ে যাবার সময় পায়নি, শোনামাত্রই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছল।

‘বাবা খবর কী?’

চমকে সিধে হয়ে বসল।

‘রাতটা কাটে কি না সন্দেহ। কোনো আশা নেই।’

‘কীভাবে ঘটল?’ বনানী বলল, ‘কেন খেল?’ সে নিশ্চিত, কিরণ জীবন ভালোবাসে, ভোগ করতে চায়।

‘আমি জানি না, তোর মাকে জিজ্ঞেস কর।’

‘দাদা কী ওখানে?’

‘ছিল, তারপর কোথায় গেল।’

‘ও কিছু করেনি?’

বাবা জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্নটা বোঝার জন্য কয়েক সেকেন্ড সময় নিল। তারপর মাথা নাড়ল।

বনানী বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে। তার ঠোঁট কেঁপে উঠল। অপরিচিতের দিকে যেভাবে তাকায় সেইভাবেই সে বাবার দিকে তাকিয়ে। তার মনে হল বাবা কিছু যেন লুকোচ্ছে, মিথ্যে বলার জন্য তৈরি হচ্ছে।

‘দাদা কোনো গালমাল করেনি?’

‘না।’

‘থানা-পুলিশ হবে এইবার।’

‘না। সেসব ব্যবস্থা, মারা গেলে তখন করব। তোকে চিন্তা করতে হবে না। কাউকেই হবে না।’

কাউকেই বলতে, বাবা কাকে বোঝাল? মাকে?

‘তোমার সঙ্গে কি ওর সকালে কোনো কথা হয়েছিল?’

‘কে বলল?’

অপমানিত, অসুখী বাবা মর্যাদাকর একটা ভঙ্গি নেবার জন্য ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছে।

‘কেন ও মরছে, তা কি তুমি জান?’

বাবা স্থিরদৃষ্টিতে মোমবাতির দিকে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না। দোতলায় এইমাত্র ট্রানজিস্টর খোলা হল। নারীকণ্ঠে কীর্তন গাইছে কেউ।

‘কাল ওকে পোড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘না। আমরা ওর বডি ক্লেম করব না বলে এসেছি। মনে হয় না কেউ আর ক্লেম করবেও।’

‘মর্গে চলে যাবে?’

জবাব এল না। বনানী উপরে উঠে এল। মা চেয়ারে বসে ট্রানজিস্টারের দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে। তাকে দেখেও যেন দেখল না। বনানীর মনে হল, আলতো একটা নিশ্চিন্তি যেন মায়ের মুখে। একবার জানতেও চাইল না, বাবা কী খবর নিয়ে ফিরেছে।

‘আমি খাব না রাতে।’

মা শুনতে পেল কি না, তা দেখার জন্য বনানী দাঁড়াল না। এখন তার জরুরি দরকার বিরাট গভীর ঘুম, নয়তো শরীর থেকে প্রত্যেকটি স্নায়ু খুলে খুলে পড়বে। আশ্চর্য, শোওয়ামাত্রই সে ঘুমিয়ে পড়ল।

বাড়িতে না নার্সিং হোমে, হিরু কোথায় আছে বনানী তা জানে না। জানার জন্য সে সল্টলেকে গেছল। ফ্ল্যাটে বাচ্চচা চাকরটি ছাড়া কেউ নেই। সে বলতে পারল না কোথায় নার্সিং হোমটা। পার্ক সার্কাসে, এটুকু বনানীও জানে। কিন্তু একটা বিরাট এলাকায় খুঁজে বার করা সম্ভব নয়। নিশ্চয় ডজনখানেক নার্সিং হোম সেখানে আছে।

হিরুদের ফ্ল্যাটের ভিতরে ঢুকে বনানী কথা বলছিল চাকরটির সঙ্গে। তখন সে শোবার ঘরের দেওয়ালে একটি পরিবারিক ছবি দেখতে পায়। এক মহিলার কোলে বছর চার-পাঁচেকের একটি মেয়ে। মহিলাটি হিরুর মা নয়। বনানীর মনে হল, বোধ হয় হিরুর দিদিমা, যার মৃত্যুর কারণ হত্যা, না আত্মহত্যা, না দুর্ঘটনা, জানা যায়নি।

ফেরার সময় বনানী ভাবল কিরণের মৃত্যুটাও এইরকম হেঁয়ালি তৈরি করে রাখল। আত্মহত্যার পক্ষে সে বাস্তব কোনো যুক্তি খুঁজে পায়নি। তার বিশ্বাস দুর্ঘটনাও নয়। তা হলে বাকি থাকে যা সেটি নিয়ে ভাবতে তার ভয় করে। গত তিনদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে, এইবার হয়তো পুলিশ আসবে তদন্ত করতে। আসেনি। বাবা বলেছিল, না আসার ব্যবস্থা করবে।

কিরণের মরার ব্যাপারটা কেউ জানে না, শুধু তারা চারজন ছাড়া। অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়ার সময় পাড়ার লোকেরা কৌতূহলী হয়েছিল নিশ্চয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কেউ আর জানতে চায়নি, কেমন আছে। নন্দবাবু শুধু একবার তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল। বনানী সত্যি কথা বলতে গিয়েও বলেনি।

‘ভালো আছে।’

পরে শিউরে উঠেছিল। কোনো সূত্র থেকে নন্দবাবু যদি সত্যিটা জানে তা হলে কী ভাববে তার সম্পর্কে?

বনানী টাইপ স্কুল এবং টিউশনির পর সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে মাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখল। ঘরের আলোটা জ্বালতেই বিরক্তিতে মায়ের কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘কী চাই? আমার শরীর ভালো নয়, বিরক্ত করিসনি।’

‘কিছু চাই তোমার?’

‘কী চাইব, চাওয়ার কিছু আছে কী?’

চোখে কঠিন চাহনি, স্বরে তিক্ততা। বনানী বুঝতে পারে বহু বছরের হতাশা এখন মাকে এই অবস্থায় এনে ফেলেছে। আমরা কি খোলামনে মা-র সঙ্গে কখনো কথা বলেছি? কখনো কি ওকে আমাদের দুশ্চিন্তার কথা বলেছি? পরিবারের বাইরের লোকের মতো কি ওর সঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি? এসব কি মা লক্ষ করেনি?

কখনো কি মা সুখী হয়েছে? এমনকী ছোটোবেলাতেও মাসিরা তাচ্ছিল্য করত মাকে, তার কুশ্রীতার জন্য। যারা বলে সাব-জজের মেয়ে বলেই বাবা বিয়ে করেছে, তারা কি খুব ভুল বলে? শুরু থেকেই কি মা-র মনে এই ধারণাটা ছিল না, নাকি পরে চোখ খোলে?

জন্ম থেকেই মায়ের সঙ্গে, বনানীর মনে হল, অথচ হঠাৎ যেন সে আবিষ্কার করছে, কিছুই সে জানে না মায়ের সম্পর্কে। যখন মাকে বিচার করার মতো বোধ হল, বা যখন ওকে বিচার করে দেখতে চাইল, ততদিনে মা এখন যা তাই হয়ে গেছে। অতীতকে খুঁজে পাওয়ার কোনো রাস্তাই আর নেই।

‘কিছু খাবে?’

‘ব্যাপার কী, হঠাৎ এত দরদ?’

‘এমনিই, কেন জিজ্ঞাসা করতে নেই? বড়ো বেশি আজকাল তুমি একা থাকো।’

‘তা হলে এখন আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

রান্না সেরে বনানী তার ঘরে না এসে, মা যা করে, ট্রানজিস্টার খুলে চেয়ারে বসল। সেতার বাজাচ্ছে কেউ। হিরু বলেছিল, সেতার শুনতে তার ভালো লাগে।

হিরুর কথা ভাবতে ভাবতে বনানীর ঢুলুনি এল। স্বপ্নের মতো একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে সে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে। তার মনে হচ্ছে সে মায়ের ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে। ভীতচোখে মা তার দিকে তাকিয়ে। সে প্রশান্ত।

‘কী চাই তোর, কী বলতে এসেছিস?’

‘জানতে এসেছি।’

‘কিছুই জানার নেই।’

‘বিষটা? তুমি দিয়েছ, কীভাবে দিলে?’

‘মিথ্যে কথা। কী বলছিস তুই?’

আতঙ্কে চিৎকার করল মা, কেননা হাতমুঠো করে বনানী এগিয়ে এসেছে।

‘আমাকে মারবি?’

‘হ্যাঁ। কীসের সঙ্গে বিষ দিলে?’

দু-হাতে সে মায়ের কবজি চেপে ধরল। বাচ্চচাদের মতো সরু কবজি।

‘মারিস না।’

‘তা হলে বলো। আমি জানি তুমিই ওকে মেরেছ।’

উত্তর না দিয়ে উদভ্রান্ত চোখে মা তাকিয়ে রইল। ঠোঁটদুটো ফাঁক হয়ে রয়েছে চিৎকার করতে, কিন্তু করা হল না।

‘কেন মারলে?’

‘আমার সবকিছু ও নিয়েছে।’

‘কী নিয়েছে?’

‘আমার ছেলে, আমার স্বামী।’

‘ও রান্নাঘরে বসে ভাত খাচ্ছিল, তুমিও সেখানে ছিলে?’

‘হ্যাঁ।’

‘ও যখন বুঝতে পারল কিছু একটা শরীরে ঘটছে তখন তোমাকে বলেছিল।’

‘হ্যাঁ।’

‘ও কলঘরে গেছল। তখন তুমি দরজাটা বন্ধ করে দাও, যাতে বেরিয়ে এসে নীচে গিয়ে কারোর সাহায্য চাইতে না পারে।’

‘আমাকে কি ফাঁসি দেবে? তুই বলে দিবি না তো?’

ধড়মড়িয়ে বনানী উঠে দাঁড়াল। বাসু কর্কশ শব্দে চেয়ার টেনেছে। বাবাও এবার খেতে আসবে।

মুহূর্তের জন্য দিশাহারা হয়ে বনানী ভেবে পেল না, এখন সে কোথায়! কী ভয়ংকর স্বপ্নটা। বাসুর দিকে তাকিয়ে থেকে বনানী কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যেকার তফাতটা বোঝবার চেষ্টা করল। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। এখন সত্যিকারের মনে হচ্ছে। এত বাস্তবিক। কথাগুলোর মধ্যে কোনটা আসল আর কোনটা বানানো সে ঠাওর করতে পারছে না। এমনও ঘটে নাকি স্বপ্নে! সত্যিই কি…

‘হয়েছে কী তোর?’

‘একটা বাজে স্বপ্ন দেখলুম।’

যতক্ষণ স্বপ্নটা থাকে ততক্ষণ সেটাকে সত্যিকারের মতোই সত্যি লাগে। বনানী উঠে গিয়ে জল খেল।

বাবা আর বাসু মুখোমুখি বসে খেয়ে গেল। মাথা নামিয়ে, কথা না বলে। বনানী তাকিয়ে রইল। তার মনে হল সে যেন নিজের দিকেই তাকিয়ে, ওদের মধ্য দিয়ে নিজেকেই দেখছে। মিনিট কেটে যাচ্ছে, আরও মিনিট রয়েছে, তারপর আরও মিনিট আসবে।

ওরা দু-জন নিঃশব্দে খেয়ে উঠে গেল, একজন নীচে, অন্যজন তার ঘরে।

বনানী খাওয়া শুরু করেছে, তখন ঘর থেকে মা বেরিয়ে এল। ওকে দেখামাত্রই সে আড়ষ্ট হয়ে গেল। একটুআগে দেখা স্বপ্নটা রেকর্ডের মতো মাথার মধ্যে বেজে উঠল। মাকে সে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল যেন সবকিছু বুঝে নিতে চায়। ঝুলে-পরা স্তন, এলোমেলো শাড়ি, না আঁচড়ানো চুল, চওড়া উঁচু কপাল নিয়ে করুণাকর চেহারা। সন্ত্রস্ত জানোয়ারের মতো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। ভয়ে যেন কুঁকড়ে রয়েছে।

সব জানি, এ কথাটা ওকে বলে কিছু লাভ আছে কি? ওর চাহনি থেকে বনানীর মনে হচ্ছে, সে ওর বিচারক, ওর জীবনে যেন তার রায়ের উপর নির্ভর করছে।

ওকে নিয়ে কী করবে? ফাঁসি নয় তো জেল!

ট্রেনের সেই পরিস্থিতি থেকেও যেন দমচাপা, ভয় পাওয়ানো সময় বনানী এখন যাপন করছে। মনে হচ্ছে পৃথিবী যেন ঘুরছে না, কোনো অস্তিত্বই নেই, শুধু মুখোমুখি তারা দু-জন ছাড়া।

বনানী এইবার বুঝতে পারছে,তাকে এই বাড়িতেই থাকতে হবে, মাকে দেখাশুনার জন্য। নতুন কোনো ঘটনা ঘটতে না দেবার জন্য। একমাত্র সে জানে ভয়ংকর সত্যটা। স্বপ্নে যা শুনল, সেটা সত্যি কিনা যাচাই করতে মাকে প্রশ্ন করে লাভ কী।

‘তুমি কি কিছু খাবে, একটু লেবুর জল?’

‘আছে লেবু? তুই বোস, আমি দেখছি।’

এ বাড়িতে কিরণের নাম আর যাতে উচ্চচারিত না হয়, তা দেখার জন্য বনানীকে থাকতে হবে। কিরণের স্বাস্থ্য, সজীবতা, উচ্ছ্বাস, লোভ কি মায়ের প্রতি এক ধরনের অপমান নয়?

এখন সে রান্নাঘরে গ্লাসে লেবু নিংড়োচ্ছে, তার জন্য জীবনে আর কী অবশিষ্ট আছে? লজ্জায় সারাজীবনই তো কাটাল। কুশ্রী হওয়ার জন্য লজ্জা, ভাঙা স্বাস্থ্যের জন্য লজ্জা। সেদিন কিরণ আর মায়ের মধ্যে কী কথা হয়েছিল, কখন বিষ মিশিয়েছিল, কোথা থেকে জোগাড় করেছিল, এসব নিয়ে সে কখনো প্রশ্ন করবে না। মা অনুমান করেছে যে আমি জানি, বনানী ভাবল, কথা মারফত বলার মতো জিনিস এটা নয়।

‘তুই একটু খাবি?’

‘দাও।’

এবার থেকে সর্বদা এখানেই কাটাব। গ্লাস হাতে নেওয়ার সময় বনানী এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য মায়ের প্রতি তিক্ততা বোধ করলেও তাকে দায়ী করতে পারল না। সবাই অপরাধী, মাকে এই পর্যায়ে পৌঁছে দেবার জন্য।

মা লেবুজলের গ্লাসটা নিয়ে তার চেয়ারটিতে বসল। কী দুর্বল, রুগণ। বনানী ধারণা করতে পারছে না, সামনে চেয়ারে যে বসে সেই তার মা। চোখের সামনে ধীরে ধীরে একটার পর একটা বছর কাটবে আর মা বুড়ি হবে। সে নিজেও হবে। ছোটোমাসির মতো একা জীবন কাটাবে।

বনানীর দিকে তাকিয়ে মা গ্লাসে চুমুক দিল। এখনও তাকে লক্ষ করে যাচ্ছে, কিন্তু কৃতজ্ঞতার স্পর্শ চোখে লেগেছে।

বনানী জানে, মা আর সঙ্গীহীন, একা নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *