৩. হিন্দুস্থান প্রসঙ্গে

হিন্দুস্থান প্রসঙ্গে

[বার্নিয়েরের সময় চতুদর্শ লুই ফ্রান্সের সম্রাট ছিলেন এবং মঁশিয়ে কলবার্ট ছিলেন ফ্রান্সের অর্থসচিব। স্বদেশে ফিরে গিয়ে বার্নিয়ের হিন্দুস্থানের অর্থনৈতিক অবস্থা ও সম্পদ, আচার—ব্যবহার, সেনাবাহিনী, সমাজব্যবস্থা ইত্যাদি সম্বন্ধে মঁশিয়ে কলবার্টের কাছে একখানি দীর্ঘ পত্র লেখেন। বার্নিয়েরের ভ্রমণবৃত্তান্তের অন্যান্য অংশের মধ্যে এই পত্রখানির ঐতিহাসিক মূল্য ও গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বললেও বোধ হয় অত্যুক্তি করা হয় না। মোগলযুগের ভারতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার এই জাতীয় নিখুঁত চিত্র ও বিশ্লেষণ সমসাময়িক অন্য কোনো সাহিত্যে বাস্তবিকই দুর্লভ।

—অনুবাদক।]

মঁশিয়ে কলবার্টের কাছে লেখা বার্নিয়েরের পত্র

এশিয়ার কোনো বিখ্যাত ব্যক্তির কাছে শূন্য হাতে যাওয়া যায় না। মোগল বাদশাহ ঔরঙ্গজীবের পোশাক স্পর্শ করার প্রথম সুযোগ ও সৌভাগ্য যখন আমার হয় তখন তাঁর সম্মানের জন্য আমাকে নগদ আটটি টাকা প্রণামী দিতে হয়েছিল। তাছাড়া একটি ছোরার খাপ, একটি কাঁটা এবং ভালো চামড়ায় বাঁধানো একখানি ছুরি আমাকে দিতে হয়েছিল ফজল খাঁকে। ফজল খাঁ একজন মন্ত্রী এবং সাধারন মন্ত্রী নন, অত্যন্ত ক্ষমতাশালী মন্ত্রী। পারিবারিক চিকিৎসক হিসাবে আমার বেতন কি হওয়া উচিত তাও তাঁর ওপর নির্ভর করে। মোটকথা, তিনি অনেক গুরুতর দায়িত্ব পালন করতেন। সেইজন্য তাঁকেও প্রথম সাক্ষাতের সময় ভেট দিতে হয়েছিল। যদিও এই ধরনের কোনো রীতি আমি আমার দেশে ফ্রান্সে চালু করতে চাই না, তবু হিন্দুস্থান থেকে ফিরে আসার পর এত তাড়াতাড়ি আমি সেখানকার রীতিনীতি ভুলে যেতেও পারি না। তাই আপনাকে চিঠিতেই সমস্ত কথা লিখে জানাচ্ছি। সম্রাটের সামনে উপস্থিত হতে আমি বাস্তবিকই সংকোচবোধ করছি এবং সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আমাদের দেশের সম্রাটের সঙ্গে হিন্দুস্থানের বাদশাহ ঔরঙ্গজীবের নানাদিক দিয়ে পার্থক্য আছে। দুজনের সামনে গেলে দু—রকমের বিভিন্ন মনোভাব হয়। আর আপনার সামনেও বা আমি শূন্য হাতে কি করে যাই? ফজল খাঁর চেয়ে আপনাকে যে আমি কত বেশি শ্রদ্ধা করি, তা তো আপনি জানেনই! তাই এই ধরনের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আপনাদের জানানো বিশেষ দরকার মনে করি।

হিন্দুস্থানে আমি দীর্ঘ বারো বছর কাটিয়েছি। সেই সময় বুঝেছি আমার দেশ ফ্রান্সের সঙ্গে হিন্দুস্থানের পার্থক্য কোথায় ও কতখানি। হিন্দুস্থানে থাকার সময় আমি আপনার মতন মন্ত্রীর দক্ষতা সম্বন্ধেও সচেতন হয়েছি। সে কথা এখানে আলোচনা করার আপাতত কোনো প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে হিন্দুস্থান সম্বন্ধে আমি যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান সঞ্চয় করেছি, সেই সম্বন্ধেই এই পত্র মারফত আপনাকে কিছু জানাতে চাই।

এশিয়ার মানচিত্রের দিকে চেয়ে দেখলে মোগল বাদশাহের রাজত্বের বিশালতা সহজেই কল্পনা করা যায়। এই বিশাল রাজ্যই ‘হিন্দুস্থান’ নামে পরিচিত। এই বিশাল রাজ্য আমি মেপে দেখিনি, দেখা সম্ভবও নয়। তবে আমার ভ্রমণ থেকে আমার যে ধারণা হয়েছে তাতে মনে হয় যে, গোলকুণ্ডার সীমানা থেকে গজনি বা কান্দাহারের কাছাকাছি পর্যন্ত, অর্থাৎ পারস্যের প্রথম শহর পর্যন্ত, তিন মাসের ভ্রমণ—পথ এবং দুরত্বও প্রায় পাঁচশত ফরাসি লিগ বা প্যারিস থেকে লিয়ঁ যতটা দূর তার প্রায় পাঁচগুণ বেশি দূর। আশ্চর্য হল, এতবড়ো বিশাল রাজ্যের অধিকাংশই অত্যন্ত উর্বরা। তার মধ্যে বাংলাদেশ হল অন্যতম। এরকম উর্বর দেশ পৃথিবীতে খুব অল্পই দেখা যায়। বাংলাদেশের সম্পদ ও ঐশ্বর্য অতুলনীয়। মিশরের সঙ্গে তুলনা করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু বাংলার উর্বরতা মিশরের তুলনায় অনেক বেশি। মিশরে যে পরিমাণ শস্যাদি উৎপন্ন হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি হয় বাংলাদেশে, যেমন ধান, গম ইত্যাদি। এছাড়া আরও নানারকমের ফসল ও পণ্যদ্রব্যাদি যা বাংলাদেশে প্রচুর পরিমাণে হয়, মিশরে তা হয় না—যেমন তুলো, রেশম, নীল ইত্যাদি। হিন্দুস্থানের বহু প্রদেশে লোকসংখ্যা খুব বেশি এবং চাষ—আবাদও বেশ ভালোভাবে করা হয়। শিল্পী ও কারিগররা সাধারণত আয়েসি হলেও প্রয়োজনের তাগিদে তারা মেহনত করতে বাধ্য হয় এবং নানারকমের কার্পেট, ব্রকেড, সোনারূপোর কারুকাজ—করা দামি কাপড় ও সূক্ষ্ম জিনিসপত্তর তৈরি করে বিক্রি করে এবং বিদেশে চালান দেয়।

হিন্দুস্থান প্রসঙ্গে একটি ব্যাপার লক্ষণীয় বলে মনে হয়। সোনা—রূপো পৃথিবীর অন্যান্য সব জায়গা ঘুরে শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্থানে এসে পৌঁছয় এবং হিন্দুস্থানের গুপ্ত গহ্বরে অন্তর্ধান হয়ে যায়! আমেরিকা থেকে যে সোনা বাইরে বেরিয়ে এসে ইউরোপের নানা রাষ্ট্রের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তারই একটা অংশ নানা পথ ঘুরে শেষে তুরস্কে এসে জমা হয়, তুরস্কের পণ্যের বিনিময়ে। আরও একটা অংশ স্মির্না ঘুরে পারস্যে যায়, সেখানকার রেশমের বিনিময়ে। তুরস্ক কফি চালান দিতে পারে না, কারণ ইয়েমেনের কাছ থেকে সে নিজেই কফি আমদানি করে। হিন্দুস্থানের পণদ্রব্য তুরস্ক, ইয়েমেন ও পারস্য প্রত্যেকেরই দরকার। সুতরাং এই সব দেশ থেকে বেশ খানিকটা পরিমাণ সোনা—রূপো লোহিত সাগরের বন্দরে, পারস্য সাগরের শীর্ষে বসরায় এবং বন্দর আব্বাসিতে গিয়ে জমা হয়, হিন্দুস্থানাভিমুখে যাত্রা করার জন্য। প্রত্যেক বছর যথাকালে এই তিনটি বিখ্যাত বন্দরে হিন্দুস্থানের জাহাজ এসে ভিড় করে নানারকমের বাণিজ্যের পণ্য নিয়ে এবং সেইসব সোনা বোঝাই করে নিয়ে আবার হিন্দুস্থানে ফিরে যায়। একথাও মনে রাখা দরকার যে ভারতীয় জাহাজ, তা সে যারই হোক, হিন্দুস্থানের নিজের বা ডাচ, ইংরেজ ও পর্তুগিজদের—প্রত্যেক বছর যখন নানারকম পণ্য বোঝাই করে নিয়ে হিন্দুস্থান থেকে পেগু, তেনাসেরিম, শ্যাম, সিংহল, আচেম (বলখ?), মালদ্বীপ প্রভৃতি দেশে যায়, তখন সেই সব দেশ থেকে ফেরবার সময় সোনা—রূপো বোঝাই করে নিয়ে আসে। মক্কা, বসরা ও বন্দর আব্বাসির সোনা—রূপোর মতন এই সব সোনারূপোরও একই পরিণতি হয়। ডাচ ব্যবসায়ীরা জাপানিদের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করে যে সোনা পেত তা শেষ পর্যন্ত হিন্দুস্থানে এসে জমা হত। যা কিছু পর্তুগাল বা ফ্রান্স থেকে আসত, তাও আর ফিরে যেত না। তার বদলে হিন্দুস্থানের পণ্যদ্রব্য চালান যেত। এইভাবে সারা দুনিয়ার সোনা—রূপোর একটা মোটা অংশ বাণিজ্যের দৌলতে হিন্দুস্থানে এসে জমা হত এবং একবার জমা হলে আর ফিরে যেত না কোথাও, একেবারে মজুতদারের গুহায় আত্মগোপন করত।

আমি যতদূর জানি, হিন্দুস্থানের প্রয়োজন তামা লবঙ্গ জায়ফল দারুচিনি ইত্যাদি এবং এসব জিনিস ডাচ ব্যবসায়ীরা জাপান, মালাক্কা, সিংহল ও ইউরোপ থেকে সরবরাহ করে। বনাত আমদানি হয় ফ্রান্স থেকে। ভালো ভালো বিদেশি ঘোড়ারও খুব প্রয়োজন হিন্দুস্থানের। বছরে প্রায় পঁচিশ হাজার ঘোড়া শুধু উজবেকিস্থান থেকে আমদানি হয়। কান্দাহার হয়ে পারস্য থেকে এবং মক্কা, বসরা ও বন্দর আব্বাসি থেকে সমুদ্রপথে আরবি ও হাবসি ঘোড়াও অনেক আমদানি হয়। সমরকন্দ, বলখ, বোখারা ও পারস্য থেকে টাটকা ফলও প্রচুর পরিমাণে হিন্দুস্থানে আসে। দিল্লিতে আপেল, নাসপাতি, আঙুর ইত্যাদি ফল খুব বেশি দামে সারা শীতকাল ধরে বিক্রি হয়। শুকনো ফলেরও—যেমন বাদাম, পেস্তা ইত্যাদি—চাহিদা খুব বেশি। এসব ফল বাইরে থেকে হিন্দুস্থানে আমদানি হয়ে থাকে। মালদ্বীপ থেকে সমুদ্রের কড়ি প্রচুর আমদানি হয়, এবং এই কড়ি দিয়ে বাজারে কেনাবেচা চলে, বিশেষ করে বাংলাদেশে কড়ির চলন খুব বেশি। অম্বরীও মালদ্বীপ থেকে আসে (যা তামাক ইত্যাদির সঙ্গে মেশানো হয়)। গণ্ডারের শিঙ, হাতির দাঁত ও ক্রীতদাস আমদানি হয় প্রধানত হাবসিদের দেশ ইথিওপিয়া থেকে। মৃগনাভি ও পোর্সিলিন আসে চিনদেশ থেকে। মুক্তা আসে বহারীন থেকে (পারস্য সাগরের দ্বীপ—অল বহারীন) এবং টিউটিকোরিন (মাদ্রাজের তিন্নেভেলি জেলার বন্দর) ও সিংহল থেকে আরও অন্যান্য স্থান থেকে নানারকমের জিনিস আমদানি হয় হিন্দুস্থানে।

কিন্তু এত রকমের পণ্যদ্রব্যের আমদানি হলেও হিন্দুস্থানের প্রয়োজন হয় সোনা রূপো চালান দেওয়ার। কারণ হিন্দুস্থানের বণিকরা সোনা দিয়ে দাম না শোধ করে, পণ্যের বিনিময়ে পণ্য দিতেই অভ্যস্ত বেশি। হিন্দুস্থানের এই বাণিজ্যিক বিশেষত্ব বাস্তবিকই উল্লেখযোগ্য। হিন্দুস্থানের বণিকরা পণ্যের পসরা নিয়ে জাহাজ থেকে দেশে—বিদেশে সমুদ্রযাত্রা করেন এবং সেই জাহাজে তাল—তাল সোনা বোঝাই করে দেশে ফিরে আসেন। পণ্যের বদলে পণ্য দিয়ে তাঁরা বাণিজ্যের ঋণ পরিশোধ করেন। সাধারণত সোনা দিতে চান না। তাই হিন্দুস্থানে সব দেশের সোনা—রূপো এসে জমা হয়।

আরও একটা কথা এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য বলে আমি মনে করি। হিন্দুস্থানের মোগল সম্রাট দেশের সমস্ত সম্পদের একমাত্র মালিক। দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির মালিকানা দেশীয় প্রথা বা বিধানসম্মত নয়। আমির—ওমরাহ অথবা মনসবদার, যাঁরা বাদশাহের অধীনে নিযুক্ত, তাঁদের যাবতীয় সম্পত্তি ও সম্পদের উত্তরাধিকারী হলেন বাদশাহ নিজে। হিন্দুস্থানের প্রতিবিঘা জমির মালিক বাদশাহ, চাষি বা জমিদার নয়। বসতবাড়ি, উদ্যান, দীঘি ইত্যাদি কয়েকটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি মধ্যে মধ্যে বাদশাহ নিজের খেয়াল ও মর্জি অনুযায়ী কোনো কোনো প্রিয়জনকে ভোগ করার জন্য দান করেন। এছাড়া ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তি’ বলে হিন্দুস্থানের রাষ্ট্রীয় বিধানে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই।

মোটকথা, হিন্দুস্থানে সোনা—রূপো প্রচুর পরিমাণে জমা আছে, যদিও সোনার খনি তেমন নেই। হিন্দুস্থানের সম্রাটই সমস্ত সম্পদ ও সম্পত্তির মালিক। উপঢৌকন তিনি অনেক পান এবং ধনদৌলত তাঁর অফুরন্ত। কিন্তু তাহলেও, হিন্দুস্থান সম্পর্কে আরও কয়েকটি জ্ঞাতব্য বিষয় আছে যা আমি আপনাকে জানানো প্রয়োজন বোধ করি।

হিন্দুস্থানের দেশীয় রাজাদের কথা

প্রথমত হিন্দুস্থান একটি বিশাল সাম্রাজ্যের মতন একথা আগেই বলেছি। এই বিশাল সাম্রাজ্যের অনেকটা অংশ হয় মরুভূমি, না হয় অনুর্বর পার্বত্য অঞ্চল। এসব অঞ্চলে জমিজমার আবাদ তেমন ভালো হয় না এবং লোকজনের বসবাসও তেমন নেই। ভালো আবাদি জমি আছে, তারও বেশ খানিকটা অংশ লোকাভাবে পতিত থাকে, চাষ হয় না। আবাদ করে যারা ফসল ফলায় সেই সব চাষির অবস্থা হিন্দুস্থানে খুব শোচনীয়। সুবাদার ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের কাছ থেকে তারা মানুষের মতন ব্যবহার পায় না। ওপরের কর্তারা সকলেই তাদের ওপর নির্মম অত্যাচার করে এবং এই অত্যাচারের জ্বালায় অনেক সময় চাষিরা গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র পালিয়ে যায়। সাধারণত নগরের দিকে তারা পালাবার চেষ্টা করে এবং সেখানে গিয়ে বোঝা বয়, ভিস্তির বা ঘোড়ার সহিসের কাজ করে। মধ্যে মধ্যে কোনো রাজার (বার্নিয়ের বোধ হয় এখানে দেশীয় হিন্দু সামন্ত রাজাদের কথা বলতে চেয়েছেন) রাজ্যে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে, কারণ তাদের ধারণা, বাদশাহের রাজত্ব ছেড়ে কোনো দেশীয় রাজার রাজ্যে গেলে অনেক বেশি সুখেস্বচ্ছন্দে থাকা যায়। দেশীয় রাজারা নাকি প্রজাদের ওপর এরকম অমানুষিক অত্যাচার করেন না।

দ্বিতীয়ত—মোগল সাম্রাজ্যের মধ্যে একাধিক জাতির বসবাস আছে এবং সমস্ত জাতির সর্বময় কর্তা হলেন মোগল বাদশাহ। এসব জাতির অনেকেরই নিজেদের ‘প্রধান’ ‘নায়ক’ বা ‘রাজা’ আছে। প্রধানরা ও রাজারা মোগল বাদশাহকে ‘কর’ দেন নামমাত্র। তাও আবার সকলে দেন না। কেউ দেন, কেউ দেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘পেশ কস’ বা ‘কর’ দেওয়াটা অতি নগণ্য ব্যাপার। বাদশাহের কাছে বশ্যতা স্বীকারের সঙ্গে এর বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই। আবার এমনও দু—চারজন রাজা আছেন যাঁরা ‘কর’ দেন না, বরং উলটে আদায় করেন। তাঁদের কথাও বলব।

যেমন—পারস্যের সীমান্তে যে সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য আছে তারা কাউকেই কিছু দেয় না, পারস্যের রাজাকেও না, হিন্দুস্থানের বাদশাহকেও না। বেলুচি ও আফগানরা তো বাদশাহকে কিছুই দেয় না এবং নিজেদের সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে মনে করে। মোগল বাদশাহ যখন কান্দাহার অবরোধ করার জন্য সিন্ধু থেকে কাবুল অভিযান করেছিলেন তখন এইসব বেলুচি ও আফগানদের উদ্ধত ও গর্বিত আচরণ থেকেই তা পরিষ্কার বোঝা গিয়েছিল। পাহাড় থেকে জল সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে তারা সেনাবাহিনীর অভিযান একরকম বন্ধ করে দিয়েছিল এবং শেষে পুরস্কার আদায় করে তবে ছেড়েছিল।

পাঠানরাও খুব দুর্ধর্ষ জাতি। একসময় তারাও হিন্দুস্থানে রাজত্ব করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে তাদের বেশ প্রতিপত্তি ছিল। মোগলরা ভারতে অভিযান করার আগে পাঠানরা হিন্দুস্থানের অনেক জায়গায় বেশ ঘাঁটি তৈরি করে বসেছিল। প্রধানত তাদের শাসনকেন্দ্র ছিল দিল্লি এবং আশপাশের প্রতিবেশি রাজারা (হিন্দু রাজা) পাঠানদের ‘কর’ও দিতেন। হিন্দুস্থান মোগলদের অধিকারে আসার পরেও পাঠানরা সহজে আত্মসমর্পণ করেনি। বিভিন্ন স্থানে তারা রীতিমতো শক্তিশালী রাজ্য স্থাপন করেছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে মোগলদের নানাভাবে নাজেহাল করে তাদের অভিযান প্রতিরোধ করেছিল। মোগল আমলে তাই পাঠানরা তাদের সেই স্বাধীন রাজ্য—পরিচালনার কথা বিস্মৃত হতে পারেনি সহজে। জাত হিসাবেও তাই তারা অত্যন্ত দুর্ধর্ষ ও স্বাধীনতাপ্রিয়, এমন কি পাঠান ভিস্তিরা ও অন্যান্য দাসানুদাসরাও আচার—ব্যবহারে রীতিমতো উদ্ধত।* পাঠানরা প্রায় কথার কথায় বলে যে একদিন দিল্লির সিংহাসন, আবার তারা দখল করতে পারে। হিন্দুস্থানের প্রত্যেক লোককে, সে হিন্দুই হোক, আর মোগলই হোক, তারা মনেপ্রাণে ঘৃণা করে। তারা সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে মোগলদের, কারণ মোগলরাই তাদের দিল্লির সিংহাসনচ্যুত করে দেশ থেকে দূরে পাহাড়ের কোলে তাড়িয়ে দিয়েছিল। এসব পাহাড় অঞ্চলে পাঠানরা এখনও স্বাধীনভাবে বসবাস করে, তাদের নিজেদের প্রধান ও অন্যান্য রাজাদের অধীনে। কারও কোনো হুকুম তারা মানতে চায় না, কারও বশ্যতাও স্বীকার করতে চায় না। অবশ্য স্বাধীন রাজ্য হিসাবে তারা যে খুব ক্ষমতাশালী তা নয়।

রাজপুতদের শৌর্যবীর্য

গোলকুণ্ডার রাজাও খুব শক্তিশালী, বিজাপুররাজের মিত্র। বিজাপুরের রাজাকে তিনি অর্থ ও সৈন্যসামন্ত দিয়ে সাহায্য করেন গোপনে। এইরকম আরও শত শত রাজা রাজড়া ও জমিদার আছেন যাঁরা সম্রাটকে কোনোরকম কর দেন না এবং প্রায় স্বাধীনভাবে তাঁদের নিজস্ব রাজ্যে ও এলাকায় প্রভুত্ব করেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বেশ শক্তিশালী, নিজেদের সৈন্যসামন্তও তাঁদের আছে এবং স্থানীয় প্রভাব—প্রতিপত্তিও তাঁদের যথেষ্ট। আগ্রা ও দিল্লি থেকে কেউ কাছে, কেউ দূরে থাকেন। এঁদের মধ্যে পনেরো ষোলোজন রাজার ধনৈশ্চর্য ও সামরিক শক্তি খুব বেশি, বিশেষ করে চিতোরের রাণার, রাজা জয়সিংহের ও রাজা যশোবন্ত সিংহের। এই তিনজন রাজা যদি একবার হাত মিলিয়ে একত্রে কোনো অভিযান করার সংকল্প করেন তাহলে মোগল সম্রাটের সিংহাসন তাঁরা টলিয়ে দিতে পারেন। এরকম দুর্ধর্ষ তাঁদের শক্তি! প্রত্যেক রাজা ইচ্ছা করলে প্রায় বিশ হাজার অশ্বারোহী রাজপুত সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্রে মোতায়েন করতে পারেন এবং সারা হিন্দুস্থানে তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বী খুঁজে পাওয়া যাবে না কোথাও। রাজপুত অশ্বারোহীদের শৌর্যবীর্যের কথা হিন্দুস্থানের কারও অজানা নেই। এই রাজপুত সৈন্যদের কথা পরে আরও বিশদভাবে বলব। রাজপুতরা পুরুষানুক্রমে যোদ্ধার জীবন যাপন করে। রাজার কাছ থেকে জমি—জমা জায়গির পায় এবং বংশানুক্রমে রাজার অধীনে সৈনিকের কাজের বিনিময়ে সেই জায়গির ভোগ করে। যুদ্ধ ও বীরত্ব তাদের রক্তের মধ্যে আছে। এরকম কষ্টসহিষ্ণু ও নির্ভীক জাত হিন্দুস্থানে খুব অল্পই দেখা যায়। সৈন্য হিসাবে, যোদ্ধা হিসাবে তাদের সমকক্ষ আর বিশেষ কেউ নেই।

‘মোগল’ কাদের বলা হয়?

তৃতীয়ত—মোগল সম্রাট মুসলমান হলেও ‘সুন্নি’ সম্প্রদায়ভুক্ত। তুরকিদের মতন তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে ওসমান হলেন মহম্মদের উত্তরাধিকারী। সম্রাটের পার্ষদ ও সভাসদরা, আমির ও ওমরাহরা হলেন অধিকাংশই ‘সিয়া’ সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁরা আলির উত্তরাধিকারে বিশ্বাসী, পারসিদের মতন। তাছাড়া মোগল সম্রাট হিন্দুস্থানে অনেকটা বিদেশির মতন বলা চলে। তাঁরা তৈমুরের বংশধর এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ায় তাঁরা ভারতবর্ষ জয় করেন। সুতরাং মুঘলেরা হিন্দুস্থানে চারিদিকেই শত্রু—পরিবেষ্টিত। হিন্দুস্থানের একশোজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন ‘মোগল’ আছে কিনা সন্দেহ। শতকরা একজন মুসলমান আছে কিনা সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সুতরাং হিন্দুস্থানে নিরাপদে রাজত্ব করা ও বসবাস করা মোগলদের কাছে একটা সমস্যার ব্যাপার। ঘরে শত্রু, বাইরের শত্রু। ঘরে দেশীয় রাজারা প্রবল শত্রু, বাইরে পারস্য থেকে আক্রমণের আশঙ্কাও আছে। ঘরে—বাইরে এইভাবে শত্রু—পরিবেষ্টিত হয়ে থাকার জন্য মোগল সম্রাটরা সর্বদা নিরাপত্তার ও আত্মরক্ষার দুশ্চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকেন। এজন্য তাঁদের বিশাল সেনাবাহিনী সব সময় প্রস্তুত রাখতে হয়। সংকটের সময় তো হয়ই, শান্তির সময়ও হয়। এদেশের লোকদের নিয়েই সেনাবাহিনী গঠন করা ছাড়া উপায় নেই। তার মধ্যে অধিকাংশই রাজপুত ও পাঠান, এবং বাকি মোগল সৈন্য। এখানে ‘মোগল’ কথাটা অবশ্য একটা বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। যে কোনো শ্বেতাঙ্গ বিদেশি ব্যক্তি মুসলমানধর্মী হলেই ‘মোগল’ বলে পরিচিত হন। আসল ‘মোগল’ কিন্তু ‘মোগল’ বলে যাঁরা পরিচিত তাঁদের মধ্যে খুব অল্পই আছে। রাজদরবারেও বিশেষ নেই। উজবেক, পারসি, আরবি, তুরকি সকলেরই বংশধররা এখন ‘মোগল’ নামে অভিহিত হন। এই প্রসঙ্গে একথাও জেনে রাখা দরকার যে, এসব তথাকথিত ‘মোগল’রা এদেশে কিছুদিন বসবাস করার পর আর তেমনি মর্যাদা পান না। তাঁদের বংশধররা অনেকটা এদেশি হয়ে যান, সম্রাটের কাছে তাঁদের মোগলাই মর্যাদার জৌলুষও অনেকটা ম্লান হয়ে যায় এবং নবাগত বিদেশি মুসলমানরা মোগলাই আভিজাত্যের তকমা এঁটে ঘুরে বেড়ান। দু—তিন পুরুষের মধ্যে তথাকথিত ‘মোগল’দের বংশধররা এমন এক সাধারণের স্তরে নেমে আসেন যে তখন মোগল সেনাবাহিনীতে সামান্য পদাতিক বা অশ্বারোহী হতে পারলেই তাঁরা কৃতার্থ বোধ করেন। এই হল মোগলদের পরিচয়।

মোগল সেনাবাহিনীর কথা

এইবার মোগল সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আপনাকে দু—চার কথা বলব। কি পরিমাণ অর্থব্যয় যে সৈন্যদের জন্য করা হয় তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। প্রথমে হিন্দুস্থানের সৈন্যদের কথা বলি।

হিন্দুস্থানের সৈন্যদের মধ্যে সর্বপ্রথম উল্লেখযোগ্য, জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহের রাজপুত সৈন্যরা। এই দুজন এবং অন্যান্য আরও রাজাদের মোগল সম্রাট যথেষ্ট টাকা দেন। টাকা দিয়ে তাঁদের সৈন্যদের মধ্যে নির্দিষ্ট একটা সংখ্যক নিজের কাজের জন্য নিযুক্ত রাখেন। অর্থাৎ রাজারা মোগল সম্রাটের অর্থের বিনিময়ে রাজপুত সৈন্য দিয়ে যুদ্ধ—বিগ্রহের সময় তাঁকে সাহায্য করেন। অর্থ অনুপাতে সৈন্যসংখ্যা নির্দিষ্ট থাকে। বিদেশি ও মুসলমান ওমরাহদের সমান মর্যাদা রাজারা পান। ওমরাহদের অধীনেও নির্দিষ্ট সংখ্যক সৈন্য থাকে এবং সেই সৈন্যসংখ্যা অনুযায়ী তাঁরা জায়গির ও তনখা পান। একাধিক কারণে এই দেশীয় রাজাদের এইভাবে হাতে রাখার দরকার হয়।

প্রথম কারণ হল, রাজপুত সৈন্য হিসাবে চমৎকার, তাদের বীরত্বের তুলনা হয় না। আগেই বলেছি, এই রাজারা ইচ্ছা করলে একদিনে প্রত্যেকে বিশ হাজারের বেশি সৈন্য মোতায়েন করতে পারেন।

দ্বিতীয় কারণ হল, এই রাজারা প্রায় স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজ্যে রাজত্ব করেন। তাঁরা কেউ মোগল সম্রাটের বেতনভুক নন, কোনো হুকুমের ধার ধারেন না। ‘কর’ দিতে বললে তাঁরা যুদ্ধের জন্য অস্ত্র ধারণ করেন এবং যুদ্ধে যোগ দিতে বললে আদেশ অগ্রাহ্য করেন। এ—হেন রাজাদের যদি ফিকির—ফন্দি করে কিছুটা তাঁবে রাখা যায়, তাহলে মোগল সম্রাটের তাতে সুবিধা ছাড়া অসুবিধা হবার কথা নয়।

তৃতীয় কারণ হল, এই রাজাদের মধ্যে বিবাদ ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি করতে পারলে মোগল সম্রাটের পক্ষে সবচেয়ে সুবিধা। তাঁর রাষ্ট্রনীতির প্রধান লক্ষ্যও তাই। তিনি সব সময় চেষ্টা করেন দেশীয় রাজাদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে। একজন রাজাকে বেশিমাত্রায় তোষণ করে উপঢৌকন দিয়ে অন্যান্য রাজাদের বিদ্বেষভাব জাগিয়ে তোলেন। রাজায় রাজায় যুদ্ধ বাধে এই বিদ্বেষ থেকে, তাঁদের সৈন্যক্ষয় ও ধনক্ষয় হয় এবং তাঁরা দুর্বল হয়ে যান। তাতে মোগল সম্রাটের শক্তি ও নিরাপত্তা বাড়ে। এই কারণেও অনেক সময় মোগল সম্রাট দেশীয় নৃপতিদের দলভুক্ত করার চেষ্টা করেন।

চতুর্থ কারণ হল, এই দেশীয় রাজারা দলে থাকলে পাঠানদের জব্দ করার সুবিধা হয় এবং বিদ্রোহী ওমরাহদের সায়েস্তা করা যায়।

পঞ্চম কারণ হল, গোলকুণ্ডার রাজা যখন কর দিতে চান না অথবা বিজাপুর বা অন্যান্য প্রতিবেশী রাজাদের মোগল সম্রাটের বিরুদ্ধে চক্রান্তে সাহায্য করতে চান, তখন এই দেশীয় রাজাদের পাঠানো হয় তাঁকে জব্দ করার জন্য। সিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ওমরাহদের পাঠাতে সম্রাট ভরসা পান না।

ষষ্ঠ কারণ হল, পারসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বিগ্রহের সময় এই দেশীয় রাজাদের ওপর মোগল সম্রাট সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেন। তার কারণ তাঁর ওমরাহরা অধিকাংশই পারসি এবং তাঁরা নিজেদের দেশের রাজার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে রাজি হন না। তাঁদের ইমাম বা খলিফার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাকে তাঁরা কাফেরের হীন কাজ বলে মনে করেন। সুতরাং পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে মোগল সম্রাটের পক্ষে এই দেশীয় রাজাদের শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই কারণেও রাজাদের স্বপক্ষে রাখার দরকার হয়।

যে কারণে মোগল সম্রাট রাজপুতদের স্বপক্ষে রাখতে বাধ্য হন, অনেকটা সেই একই কারণে পাঠানদেরও তিনি নিজের দলে রাখতে চান। এছাড়া, বিশাল মোগল সেনাবাহিনীও তাঁকে নিযুক্ত রাখতে হয় এবং তার জন্য প্রচুর অর্থব্যয় করতেও তিনি বাধ্য হন। এই সেনাবাহিনীরও কিছুটা বিস্তারিত পরিচয় দিচ্ছি।

প্রধানত পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে এই সেনাবাহিনী গঠিত। একদল সৈন্য সব সময় সম্রাটের নিজের প্রয়োজনের জন্য তাঁর কাছেই রাখা হয়, আর বাকি সৈন্যরা বিভিন্ন প্রদেশে সুবাদারদের অধীনে ছড়িয়ে থাকে। অশ্বারোহী সৈন্যের মধ্যে সম্রাটের নিজস্ব প্রয়োজনের জন্য যারা তৈরি থাকে তাদের কথা প্রথমে বলছি। এই অশ্বারোহীরা ওমরাহ, মনসবদার, রৌশিনদার প্রভৃতির অধীনে বহাল থাকে। অশ্বারোহী সৈন্য ছাড়াও পদাতিক সৈন্য আছে এবং গোলন্দাজবাহিনীর মধ্যে পদাতিক গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী গোলন্দাজ আছে। তাদের কথাও একে—একে বলব।

একথা ভাববেন না যে রাজদরবারের ওমরাহরা বনেদি পরিবারের বংশধর, ফ্রান্সের অভিজাতশ্রেণির মতন। আদৌ তা নয়। হিন্দুস্থানের সম্রাটই যেহেতু, সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র মালিক, সেইজন্য সেখানে ইউরোপের মতন ‘লর্ড’ বা ‘ডিউক’রা গজিয়ে ওঠার সুযোগ পাননি। বিরাট কোনো সম্পত্তির মালিকানাস্বত্ব বংশপরম্পরায় ভোগ করে কোনো পরিবার হিন্দুস্থানে প্রচুর পরিমাণে ধনসঞ্চয় করবার সুযোগ পান না, সম্রাটের সভাসদরা সকলে ওমরাহদের বংশধরও নন। সম্রাট সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকারী বলে কোনো ওমরাহদের মৃত্যু হলে তাঁর সম্পত্তির মালিক হন সম্রাট। আমির পরিবারের আভিজাত্য একপুরুষ, কি দুইপুরুষের মধ্যেই শেষ হয়ে যায় এবং তাঁর পুত্র বা পৌত্ররা প্রায় ভিক্ষান্নজীবীর স্তরে নেমে আসতে বাধ্য হন। তখন তাঁরা সম্রাটের সেনাবাহিনীতে সাধারণ অশ্বারোহী সেনাদলে নাম লেখান। সম্রাট অবশ্য সাধারণত মৃত আমিরের পত্নী ও সাবালকদের একটা ভাতার বন্দোবস্ত করে দেন, কিন্তু সেটা আমীর আভিজাত্য অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষে যথেষ্ট নয়। আর যদি কোনো আমির সৌভাগ্যক্রমে দীর্ঘায়ু হন তাহলে তাঁর জীবদ্দশায় তিনি চেষ্টা করে হয়ত তাঁর পুত্রদের একটা ভালো ব্যবস্থা করে দিয়ে যেতে পারেন। সেটা আর কিছু নয়, কোনোরকমে সম্রাটের সুনজরে এনে আমিরনন্দনদের কোনো যোগ্য পদে বহাল করে যেতে পারেন। কিন্তু সেরকম ব্যবস্থা করে যাওয়া সকলের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাও আবার তার জন্য আমিরনন্দনের সুদর্শন শ্রী থাকা দরকার, যাতে তাকে দেখলে বনেদি মোগলবংশজাত বলে মনে হয়। তা না হলে সম্রাটের নেকনজরে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সাধারণত অবশ্য সম্রাট হঠাৎ কাউকে কোনো উচ্চপদের মর্যাদা দিতে চান না। সাধারণ স্তর থেকে ক্রমে উচ্চস্তরে ধীরে ধীরে উঠতে হয় সকলকে। এইজন্য দেখা যায়, মোগল দরবারের ওমরাহরা সকলে বনেদি বংশের সন্তান নন, কারণ বংশানুক্রমে আমিরি মর্যাদা ভোগ করা হিন্দুস্থানের খুব কম ভাগ্যবানের পক্ষেই সম্ভব হয়। সাধারণত ওমরাহরা বিদেশি ভাগ্যান্বেষীর দল এবং অধিকাংশই অনভিজাতবংশজ। প্রায়ই দেখা যায় যে, তাঁরা ক্রীতদাসপুত্র এবং শিক্ষাদীক্ষার কোনো বালাই নেই তাঁদের। সেইজন্যই সম্রাট নিজেই মর্জিমাফিক তাঁদের পদমর্যাদায় ভূষিত করতে পারেন এবং টেনে নিম্নপদে নামিয়েও দিতে পারেন। মান—অপমান বোধ তাঁদের বিশেষ নেই।

ওমরাহদের কথা

ওমরাহরা কেউ ‘হাজারি’, কেউ ‘দু—হাজারি’, কেউ ‘পাঁচ—হাজারি’, কেউ ‘সাত—হাজারি’ কেউ ‘দশ—হাজারি’ ইত্যাদি পদমর্যাদা বিশিষ্ট। হাজার ঘোড়ার অধিনায়ক যিনি তিনি ‘হাজারি’, দু—হাজার ঘোড়ার যিনি তিনি ‘দু—হাজারি’ ইত্যাদি। হাজারি, দু—হাজারি, পাঁচ—হাজারি ইত্যাদি শব্দ এই অর্থে ব্যবহৃত হয়। দ্বাদশ হাজারিও কেউ কেউ আছেন, যেমন সম্রাটের জ্যেষ্ঠপুত্র। সৈন্যসংখ্যার অনুপাতে ওমরাহরা তনখা পান না, ঘোড়ার সংখ্যা অনুপাতে পান। যিনি যতগুলি ঘোড়ার মালিক, তাঁর তনখাও সেইরকম। সাধারণত একজন সৈন্যের জন্য দুটি করে ঘোড়া বরাদ্দ থাকে। কথায় বলে, যার একটি মাত্র ঘোড়া, তার এক পা নাকি মাটিতেই থাকে। কিন্তু ওমরাহরা যে তাঁদের পদমর্যাদা অনুযায়ী ঘোড়া পোষেন তা ভাববার কোনো কারণ নেই। যিনি যত হাজারি, সম্রাট তাঁকে সেই অনুপাতে তনখা দেন। সৈন্যদের বেতন বাবদও তিনি বরাদ্দ টাকা পান। এই বেতন থেকে তিনি অধিকাংশ নিজে আত্মসাৎ করেন। তাছাড়া যতগুলি ঘোড়া তাঁর পদমর্যাদা অনুযায়ী রাখার কথা তা তিনি কোনোকালেই রাখেন না। ঘোড়ার ‘রেজিস্টার’ বা হিসাবের খাতাটিতে অবশ্য নির্দিষ্ট সংখ্যার উল্লেখ ঠিকই থাকে এবং সেই ঘোড়ার খরচ বাবদ তাঁর যা প্রাপ্য তা তিনি আদায়ও করে নেন। ঘোড়ার বদলে বরাদ্দ টাকা তিনি নিজেই ভোগ করেন। কেউ কেউ নগদ টাকার বদলে জায়গীরও ভোগ করেন। অবশ্য বাইরে থেকে ‘হাজারি’ খিলাতের হাঁকডাক যতটা, আসলে তার অনেকটাই ফাঁকা ছাড়া কিছু নয়। দু—হাজারি যিনি, তাঁর হয়তো আসলে দুশ ঘোড়া রাখার অধিকার আছে। সেই দুশ ঘোড়ার ভরণপোষণের খরচ তিনি পান। তাই থেকে যথেষ্ট উদ্বৃত্ত টাকা নিজে আত্মসাৎ করেন। আমি নিজে যে আমিরের অধীনে কাজ করতাম, তিনি একজন ‘পাঁচ—হাজারী’, কিন্তু তাঁর পাঁচশো ঘোড়া পোষার হুকুম ছিল। এই পাঁচশো ঘোড়ার বরাদ্দ টাকা থেকেও তিনি মাসে পাঁচ হাজার ক্রাউন আত্মসাৎ করতেন। তবু তো তিনি জায়গিরভোজী ছিলেন না, নগদি ছিলেন, অর্থাৎ নগদ টাকায় তাঁর বেতন দেওয়া হত। জায়গিরভোগীদের উপরি আয়ের যথেষ্ট সুযোগ থাকে, প্রচুর আয় তাঁরা করেনও। কিন্তু নগদীদের সে—সুযোগ খুব কম থাকে। তবু তাই থেকেও তাঁরা অল্প ঘোড়া পুষে, খাতাপত্রে ঘোড়ার হিসেব ঠিক দেখিয়ে, উদ্বৃত্ত টাকা নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। এত আয়ের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও ওমরাহদের মধ্যে ধনী ব্যক্তি খুব অল্পই আমার নজরে পড়েছে। আমি যাঁদের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই দেনার দায়ে জড়িত, অন্যান্য দেশের লর্ড বা ডিউকদের মতন তাঁরা যে নিজেদের ভোগবিলাসের জন্য এরকম দুরবস্থার মধ্যে পড়েন তা নয়। অধিকাংশ ওমরাহের শোচনীয় দুর্দশার কারণ হল, বছরে একাধিক উৎসব—পার্বণে তাঁদের ভেট দিতে হয় সম্রাটকে এবং তার জন্য বেশ মোটা টাকা ব্যয় হয়ে যায়। তাছাড়া অধিকাংশ ওমরাহকে অত্যাধিক স্ত্রী চাকরবাকর, উট, ঘোড়া ইত্যাদি প্রতিপালন করতে হয়। প্রধানত এই দুই কারণে তাঁরা সর্বস্বান্ত হয়ে যান।

বিভিন্ন প্রদেশে, সেনাবাহিনীতে ও রাজদরবারে যথেষ্ট ওমরাহ আছেন। তাঁদের সংখ্যা ঠিক কত, তা আমি বলতে পারব না, তবে সংখ্যা সাধারণত নির্দিষ্ট কিছু নেই। রাজসভার ওমরাহের সংখ্যা পঁচিশ থেকে ত্রিশজনের মধ্যে, তার বেশি নয়। সকলেই প্রায় মোটা টাকা আয় করেন এবং আয়ের মাত্রা তাঁদের ঘোড়ার সংখ্যার ওপর অনেকখানি নির্ভর করে। ঘোড়ার সংখ্যা এক থেকে বারো হাজার পর্যন্ত হতে পারে। এই ওমরাহরাই হলেন রাষ্ট্রের সবচেয়ে উচ্চপদস্থ ব্যক্তি। বড়ো বড়ো রাজকার্যের দায়িত্ব ও রাজকীয় মর্যাদা তাঁরাই পান। রাজসভায়, প্রদেশে ও সেনাবাহিনীতে সর্বত্র তাঁরাই সবচেয়ে বেশি সম্মানিত। ওমরাহদের মোগল—সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ বলা যায়। তাঁরা রাজদরবারের জাঁকজমক বজায় রেখে চলেন, কখনো তাঁদের পথেঘাটে সাধারণের মধ্যে চলাফেরা করতে দেখা যায় না।

বাইরে যখন তাঁরা যান তখন রাজকীয় পোশাকপরিচ্ছদে সুসজ্জিত হয়ে যান। জমকালো পোশাক দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। কখনো যান হাতির পিঠে চড়ে, কখনো বা ঘোড়ার পিঠে। মধ্যে মধ্যে পালকিতে চড়েও যেতে দেখা যায়। যখনই যেভাবে যান না কেন, বাইরে যাবার সময় তাঁদের সঙ্গে একদল অশ্বারোহী সৈন্য থাকে। তাছাড়া একদল চাকর তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। আগে যায় একদল, পথের লোকজন সরাতে সরাতে, ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে মশা—মাছি ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে। দুই পাশে যায় দুই দল চাকর, কেউ পিকদানি, কেউ পানীয় জল, কেউ হিসেবের খাতা ইত্যাদি নিয়ে। এইভাবে ওমরাহরা বাইরে পথ চলেন। প্রত্যেক আমিরকে প্রত্যেহ রাজদরবারে দুবার করে হাজরে দিতে হয়। একবার বেলা দশটা—এগারোটার সময়, সম্রাট যখন বিচার করতে বসেন, আর একবার সন্ধ্যা ছ—টায়। প্রত্যেক আমিরকে সপ্তাহে অন্তত পুরো একদিন (২৪ ঘণ্টা) পালাক্রমে দুর্গ পাহারা দিতে হয়। যাঁর যখন পাহারা দেবার পালা পড়ে তিনি তখন নিজের যাবতীয় আসবাবপত্র শয্যাদ্রব্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে যান। সম্রাট শুধু তাঁদের আহারের ব্যবস্থা করেন। নিচে মাটিতে হাত ঠেকিয়ে, ধীরে ধীরে সেই হাত ওপরে তুলে ‘তছলিম’ করে তিনি সম্রাটের সেই প্রেরিত খাদ্য গ্রহণ করেন।

সম্রাটের বিলাসভ্রমণ

মধ্যে মধ্যে সম্রাটও বিলাসভ্রমণে যান, পালকি করে হাতির পিঠে বা ‘তখৎরওয়ানে’ চড়ে। তখৎ—রওয়ান ভ্রাম্যমাণ সিংহাসন, সম্রাটের ভ্রমণের জন্যই তৈরি করা। আটজন বেহারা তখৎ কাঁধে করে ছুটে চলে, আরও আটজন সঙ্গে থাকে মধ্যে মধ্যে কাঁধ বদলাবার জন্য। সম্রাট যখন ভ্রমণে যাবেন, তখন ওমরাহরা তাঁর সঙ্গে যাবেন, এই হল প্রথা। অসুস্থতা, বার্ধক্য বা অন্য কোনো বিশেষ গুরুতর কারণ ছাড়া কেউ অনুপস্থিত থাকতে পারবেন না। সম্রাট পালকিতে, হাতির পিঠে বা তখৎ—রওয়ানে চড়ে যাবেন, ওমরাহরা অশ্বপৃষ্ঠে তাঁর অনুগমন করবেন। ঝড়—বাদল—ধুলো উপেক্ষা করেই তাঁদের যেতে হবে। সব সময় সম্রাট চারিদিকে প্রহরীবেষ্টিত হয়ে বাইরে চলবেন, যখনই হোক—শিকারের সময়ই হোক, যুদ্ধযাত্রার সময় হোক বা নগর থেকে নগরান্তরে যাত্রাকালেই হোক। যখন সম্রাট রাজধানীর কাছাকাছি কোথাও শিকারে যান, বাগানবাড়ি বা প্রমোদভবনে যান, অথবা মসজিদে যান, তখন খুব বেশি আমির ওমরাহ, সাঙ্গোপাঙ্গ দাসদাসি নিয়ে যান না। সেদিনে যে ওমরাহদের পাহারা দেবার পালা পড়ে, কেবল তাঁদেরই তখন সঙ্গে নিয়ে যেতে হয়।

মনসবদারের মর্যাদা

মনসবদাররাও* ঘোড়া রাখতে পারেন এবং তাঁরাও তনখা পান। পদমর্যাদা তাঁদেরও আছে, তনখাও তাঁদের অল্প নয়। ওমরাহদের সমান তনখা না হলেও, সাধারণ কর্মচারীদের চেয়ে তাঁরা অনেক বেশি তনখা পান। সেইজন্য মনসবদারদের ক্ষুদে ওমরাহ বলা হয়। সম্রাট ছাড়া তাঁরা আর কারও অধীন নন এবং ওমরাহদের মতন তাঁদেরও কয়েকটি নির্দিষ্ট রাজকর্তব্য পালন করতে হয়। ঘোড়া রাখার অধিকার থাকলে তাঁরা স্বচ্ছন্দে ওমরাহদের সমকক্ষ হতে পারতেন। আগে এ অধিকার তাঁদের ছিল, এখন তাঁদের দুটি, চারটি বা ছ—টি ঘোড়া রাজকীয় মর্যাদায় প্রতীকরূপে রাখার অধিকার আছে। মনসবদারদের বেতন মাসিক দেড়শত টাকা থেকে সাতশত টাকা পর্যন্ত। তাঁদের সংখ্যাও নির্দিষ্ট নয়, তবে ওমরাহদের চেয়ে অনেক বেশি। বিভিন্ন প্রদেশে ও সেনাবাহিনীতে মনসবদার অনেক আছেন, রাজদরবারেও তাঁদের সংখ্যা দু—তিন শ—র কম নয়।

রৌজিনদার বা পদাতিক

রৌজিনদার’রাও পদাতিক বাহিনীর অন্তর্গত। যারা রোজ বেতন পায় তাদেরই ‘রৌজিনদার’ বলে। রোজ বেতন পেলেও, তাদের বেতন অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ‘মনসবদার’দের চেয়ে বেশি। বেতন ও পদমর্যাদা অবশ্য অন্যরকমের, সম্মান বা মর্যাদার দিক দিয়ে মনসবদারদের সঙ্গে তুলনীয় নয়। রাজপ্রাসাদের ব্যবহৃত কার্পেট বা অন্যান্য আসবাবপত্র বা মনসবদাররা নিজেদের জন্য ব্যবহারের সুযোগ পান, রৌজিনদাররা তা পায় না। এসব আসবাবপত্রের সম্মানমূল্য অনেক সময় যথেষ্ট বেশি ধার্য করা হয়। রৌজিনদাররা সংখ্যায় অনেক বেশি। সম্রাটের দফতরখানায় তারা নানারকমের ছোটোখাটো কাজকর্মে নিযুক্ত থাকে। কেরানির কাজও অনেকে করে। অনেকে সম্রাটপ্রদত্ত বরাতের ওপর দস্তখতের ছাপ দেবার কাজ করে। বরাত হল টাকা দেবার আদেশপত্র। এই সব ‘বরাত’ দেবার সময় তারা উৎকোচ গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করে না। সাধারণ অশ্বারোহীরা ওমরাহদের অধীন থাকে। দুই শ্রেণির অশ্বারোহী আছে। প্রথম শ্রেণির অশ্বারোহীরা দুটি করে ঘোড়া রাখে এবং ঘোড়ার পায়ে ওমরাহদের মোহরাঙ্কিত থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণির অশ্বারোহীরা একটি মাত্র ঘোড়া রাখে। প্রথম শ্রেণির অশ্বারোহীদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণির চেয়ে বেশি তাদের তনখাও বেশি। ওমরাহদের ব্যক্তিগত মর্জি ও উদারতার উপর সৈন্যেদের বেতন অনেকটা নির্ভর করে। অবশ্য বাদশাহের হুকুমে প্রত্যেক অশ্বারোহীর (একটি অশ্বের রক্ষক) অন্ততঃ পঁচিশ টাকা মাসিক বেতন পাওয়া উচিত। এই বেতনের হারেই ওমরাহদের সঙ্গে হিসাবনিকাশ করা হয়।

পদাতিক ও বন্দুকচি

পদাতিক সৈন্যেরা সবচেয়ে অল্প বেতন পায়। শোচনীয় অবস্থা হল গাদা—বন্দুকধারীদের। মাটিতে শুয়ে পড়ে যখন তারা তাম্বে বন্দুক ব্যবহার করে তখন তাদের অবস্থা দেখলে করুণা হয় মনে। তারাও ভয় পেয়ে যায়। চোখ দুটো তাদের বিস্ফারিত হয়ে থাকে। যাদের লম্বা দাড়ি আছে, তারা দাড়িতে আগুন লাগার ভয়ে ঘাবড়ে যায়। তাছাড়া, জিনপরীদের ভয় তো আছেই। বন্দুকচিদের ধারণা যে জিনদৈত্যদের চক্রান্তে গাদাবন্দুক ফেটে গিয়ে আগুন ধরে যেতে পারে। তাই বন্দুকচিরা বন্দুকের চেয়ে বেশি দাড়ি ও চোখ সামলাতেই ব্যস্ত থাকত যুদ্ধক্ষেত্রে। বেতন তাদের কারও মাসিক কুড়ি টাকা, কারও পনেরো টাকা, কারও বা দশ টাকা মাত্র।

গোলন্দাজবাহিনী

কিন্তু গোলন্দাজবাহিনীর সৈন্যরা অনেক বেশি বেতন পেয়ে থাকে, বিশেষ করে বিদেশি পর্তুগিজ, ইংরেজ, ডাচ, জামলান ও ফরাসি যারা তারা তো নিশ্চয়ই। গোয়া ও অন্যান্য ডাচ ও ইংরেজ কুঠির পলাতক কর্মচারীরা বাদশাহের গোলন্দাজবাহিনীতে অনেকে যোগদান করত। এইসব ফিরিঙ্গি বা খ্রিস্টান গোলন্দাজরা অনেক বেশি বেতনও পেত। গোড়ার দিকে যখন গোলন্দাজসেনা সম্বন্ধে মোগল বাদশাহের বিশেষ ধারণা ছিল না, তখন তিনি রীতিমতো উচ্চবেতন দিয়ে ফিরিঙ্গিদের নিয়োগ করতেন। সেই সময় ফিরিঙ্গি গোলন্দাজরা সাধারণত মাসিক দুই শত টাকা পর্যন্ত বেতন পেত! পরে যখন এদেশি লোক বেশ শিক্ষা পেয়ে গেল এবং গোলন্দাজবাহিনী গড়ে উঠল, তখন বাদশাহ আর ফিরিঙ্গিদের এত টাকা বেতন দিতেন না। মাসিক ত্রিশ—বত্রিশ টাকা করে তারা বেতন পেত।*

কামান দু’রকমের আছে—ভারী ও হালকা কামান। ভারী কামান সম্বন্ধে এইটুকু বলতে পারি যে আমি একবার স্বচক্ষে সম্রাটের সসৈন্যে রাজধানী থেকে লাহোরের পথে কাশ্মীরযাত্রা করতে দেখেছি এবং সেই সৈন্যদের সঙ্গে গোলন্দাজরাও ছিল মনে আছে। ভারী কামান প্রায় ৭০টি ছিল এবং দু’শ থেকে তিনশ উটের পিঠে সরঞ্জামসহ সেগুলি বহন করা হয়েছিল। কামানগুলি সব পিতলের তৈরি। যাত্রাপথে বাদশাহ কিভাবে শিকার করতেন নিছক আমোদের জন্য তা বাস্তবিকই বলবার মতন। প্রতিদিন কিছু না কিছু একটা শিকার তাঁর করা চাই—ই চাই—সে যাই হোক। হয় কোনোদিন তিনি তাঁর নিজের শিকারের পক্ষীগুলি ছেড়ে দিতেন এবং তারা কিছু শিকার করে নিয়ে আসত। কোনোদিন তিনি নীল গাই শিকার করতেন নিজে, কোনোদিন বা সখ করে হরিণ শিকার করতেন নিজের পোষা নেকড়ের দল লেলিয়ে দিয়ে। আবার কখনও বাদশাহী মেজাজ হলে সিংহ শিকারও করতেন।

বাদশাহের কাশ্মীর যাত্রার সময় হালকা কামানধারীদেরও বেশ সুসজ্জিত দেখেছি। প্রায় পঞ্চাশ—ষাটটি হালকা কামান ছিল, সব পিতলের তৈরি। হালকা কামান প্রত্যেকটি সুন্দর একটি শকটের উপর বসানো এবং তার সঙ্গে গুলিগোলার বাক্স সাজানো। একটির পর একটি সারবন্দীভাবে সাজানো ছিল এবং তার উপর নানারকমের লাল পতাকা ঝুলছিল। দুটি করে বলিষ্ঠ ঘোড়া প্রত্যেক কামানের শকটের সঙ্গে জোতা ছিল টানার জন্য এবং পাশে আরও একটি করে ঘোড়া ছিল তার সঙ্গে। ভারী কামানধারী যারা তারা রাজপথ বা সোজা সড়ক দিয়েই চলছিল, সব সময় যে বাদশাহের অনুগমন করছিল তা নয়। কারণ বাদশাহ সব সময় বাঁধা সড়ক দিয়ে যাচ্ছিলেন না, মধ্যে মধ্যে আশপাশের সরু পথে ঢুকে পড়ছিলেন শিকারের সন্ধানে। সুতরাং ভারী কামানধারীদের পক্ষে সব সময় তাঁকে অনুগমন করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু হালকা কামানধারীদের তাঁকে পদে পদে অনুসরণ করার কথা এবং তারা করছিলও তাই।

প্রাদেশিক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্রাটের নিজস্ব সেনাবাহিনীর অন্যদিক থেকে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই, কেবল সংখ্যার দিক থেকে ছাড়া। প্রত্যেক জেলায় জেলায় ওমরাহ, মনসবদার, রৌজিনদার, সাধারণ সেনাদল, পদাতিক ও গোলন্দাজবাহিনী আছে। শুধু দাক্ষিণাত্যেই আছে প্রায় বিশ—পঁচিশ থেকে ত্রিশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য। গোলকুণ্ডা, বিজাপুর ও অন্যান্য রাজাদের সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করবার পক্ষে খুব বেশি সৈন্য নয়! কাবুলে বাদশাহ যে সৈন্য রাখেন তার সংখ্যাও প্রায় বারো হাজার থেকে পনেরো হাজার পর্যন্ত এবং পারসি, বেলুচি ও সীমান্তের অন্যান্য জাতির অভিযান ও উপদ্রব প্রতিরোধ করার জন্য এইরকম সৈন্য থাকে। বাংলাদেশের সৈন্যসংখ্যা আরও অনেক বেশি, কারণ বাংলাদেশে বিদ্রোহ ও যুদ্ধবিগ্রহ প্রায় লেগেই থাকে। এইরকম প্রত্যেক প্রদেশে ও প্রত্যেক অঞ্চলে বাদশাহী সৈন্য থাকে এবং স্থানের গুরুত্ব হিসেবে সৈন্যসংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়। এই কারণে সারা হিন্দুস্থানে মোট জনসংখ্যা এত বেশি যে, বাইরে থেকে তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। পদাতিক সৈন্যের কথা আপাতত বাদ দিয়ে বলা যায় যে, শুধু সম্রাটের অধীনে অশ্বারোহী সৈন্য আছে প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার। এর সঙ্গে প্রত্যেক প্রদেশের সৈন্য সংখ্যা যোগ করলে অশ্বারোহী সৈন্যের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দু লক্ষ।

পদাতিক সৈন্যের বিশেষ গুরুত্ব নেই বলেছি। সম্রাটের অধীনে প্রায় পনেরো হাজার পদাতিক সৈন্য আছে, বন্দুকচি ও গোলন্দাজদের নিয়ে। এই সংখ্যা থেকে প্রদেশের পদাতিক—সংখ্যা সম্বন্ধেও একটা ধারণা করা যায়। কিন্তু অনেক সময় সৈনিক, চাকরবাকর, খিদমতগার, খানসামা, দাসদাসি, ব্যবসায়ী প্রভৃতি সকল শ্রেণির লোক যারা সম্রাটের অনুগমন করে, তাদের সকলকেই পদাতিক নামে অভিহিত করা হয়। এর অর্থ কি, আমি ঠিক বুঝি না।  যদি এইভাবে পদাতিকের সংখ্যা গণনা করা হয়, তাহলে সম্রাট যখন তাঁর রাজধানী ছেড়ে কোথাও যাত্রা করেন, তখন তাঁর সঙ্গে দু লক্ষ থেকে তিন লক্ষ পদাতিক সৈন্য থাকে। সংখ্যার কথা শুনলে হয়তো আশ্চর্য হয়ে যাবেন। হবারই কথা। কিন্তু বাদশাহ যখন কোনো জায়গায় যান তখন তাঁর সঙ্গে কতরকমের জিনিস ও কতরকমের লোকলস্কর থাকে সে—সম্বন্ধে যদি কোনো ধারণা থাকত আপনার তাহলে আপনি একেবারেই আশ্চর্য হতেন না। সম্রাট যান, তাঁর সঙ্গে যায় তাঁবু, আসবাবপত্র, নানারকমের জিনিসপত্র, চাকরবাকর, দাসদাসি, সৈন্যদের জন্য প্রচুর জেনানা ইত্যাদি। এইসব লোকজন ও লটবহর বহন করার জন্য যায় অসংখ্য হাতি, ঘোড়া, উট, গরু, পালকি, চৌপালা ইত্যাদি। সব মিলিয়ে একটা বিচিত্র চালচিত্র বলে মনে হয়। সম্রাট যেদেশে সর্বশক্তিমান মহাপুরুষ ও সর্বময় কর্তা, সম্রাট যেখানে দেশের সমস্ত ধনসম্পদের একমাত্র আইনসঙ্গত মালিক, সেখানে এরকম ঘটনা ঘটা কিন্তু মোটেই আশ্চর্যের ব্যাপার নয়। সেখানে রাজধানী প্রধানত রাজাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এবং রাজা না থাকলে রাজধানী হতশ্রী হয়ে যায়। দিল্লি ও আগ্রা এইরকম রাজসর্বস্ব রাজধানী। রাজা থাকেন বলে তার শ্রী থাকে, রাজা না থাকলে শ্রীহীন হয়ে যায়। রাজধানী ছেড়ে রাজা যখন কোনো জায়গায় যান, তখন মনে হয় যেন গোটা রাজধানীটাই তাঁর সঙ্গে সঙ্গে চলেছে। এ দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। আমির—ওমরাহ, আমলা—অমাত্য, সেনাবাহিনী, সাঙ্গপাঙ্গ, দাসদাসি, কারিগর—কারখানার সঙ্গে উষ্ট্রশালা, হাতিশালা, অশ্বশালা, সব সম্রাটের সঙ্গে সঙ্গে চলতে থাকে। মনে হয় যেন রাজার সঙ্গে রাজধানীও চলেছে। রাজধানী একেবারে শূন্য হয়ে যায়। দিল্লি বা আগ্রা ঠিক প্যারিসের মতো শহর নয়। যুদ্ধক্ষেত্রের শিবির বলতে যা বোঝায়, দিল্লি আগ্রাকে অনেকটা তাই বলা চলে। শিবির গুটিয়ে সেনাপতি যেমন স্থান থেকে স্থানান্তরে যাত্রা করেন, তেমনি হিন্দুস্থানের সম্রাটও তাঁর রাজধানী গুটিয়ে নিয়ে অন্য স্থানে যান। এরকম রাজধানীকে যুদ্ধক্ষেত্রের শিবির ছাড়া কি বলা চলে?

সৈন্য ও আমলাদের বেতনের কথাও এখানে উল্লেখ করতে হয়। আমির—ওমরাহ থেকে সাধারণ সৈনিক পর্যন্ত সকলকে দু মাস অন্তর বেতন দিতে হয়, না দিলে চলে না। কারণ সম্রাটের এই তনখার উপর জীবনধারণের জন্য তাদের সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হয়। ফ্রান্সে যেমন কোনো জরুরি অবস্থায় বা জাতীয় সঙ্কটের সময় সম্রাট যদি তাঁর ঋণ দু—এক মাসের জন্য পরিশোধ করতে না পারেন, তাহলে যেমন যে—কোনো কর্মচারী বা সাধারণ সৈনিক পর্যন্ত নিজেদের সামান্য মজুত অর্থেও কোনোরকমে জীবনধারণ করতে পারে, হিন্দুস্থানে তা কেউ পারে না, সাধারণ সৈনিক বা কর্মচারীরা তো নয়ই, আমির—ওমরাহরাও না। সম্রাটের কর্মচারীদের ব্যক্তিগত আয়ের কোনো উপায় নেই হিন্দুস্থানে। সম্পূর্ণ সম্রাটের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকা ছাড়া তাদের গত্যন্তর নেই। সুতরাং নিয়মিত মাসিক তনখার গুরুত্ব হিন্দুস্থানে তার ফলাফল ভয়াবহ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। প্রথমে তারা নিজেদের সামান্য পুঁজিপাটা যা—কিছু সব বেচে ফেলে বাঁচার চেষ্টা করে। তারপর যখন সব নিঃশেষ হয়ে যায়, তখন সেনাদল ছেড়ে পলায়ন করে, বিদ্রোহ করে অথবা অনাহারে দলে—দলে মৃত্যু বরণ করে। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য, দেখা যায় না এবং না দেখলে বিশ্বাসও করা যায় না। সিংহাসন নিয়ে হিন্দুস্থানের ঘরোয়া যুদ্ধের শেষ দিকে লক্ষ্য করেছি, অর্থাভাবে সৈন্যরা তাদের নিজেদের ঘোড়া পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে চেয়েছে। বিক্রি তারা করতে আরম্ভ করত, যদি আরও কিছুদিন ঘরোয়া লড়াই চলত। তাতে অবশ্য আশ্চর্য হবার একেবারেই কিছু নেই। কারণ, আপনি হয়ত জানেন না যে মোগল সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সৈন্য ও সেপাই বিবাহিত। তাদের পুত্রকন্যা আছে, পরিবার আছে, ঘরবাড়ি, দাসদাসি সবকিছু আছে। সকলেই তাদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে জীবিকার জন্য, অর্থাৎ তাদের মাসিক তনখার দিকে। হিসেব করলে দেখা যায়, এইভাবে কয়েক লক্ষ লোক, স্ত্রীপুরুষ ছেলেমেয়ে সকলে সরকারি কর্মচারীদের মাসিক বেতনের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করে জীবন যাপন করে। জানি না, কোনো রাজার রাজকোষ থেকে এত লোকের ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব কি না?

মোগল বাদশাহের অন্যান্য খরচের কথা আমি এখনও উল্লেখ করিনি। দিল্লি ও আগ্রাতে বাদশাহ সব সময়ের জন্য প্রায় দু—তিন হাজার সুন্দর বাছা—বাছা ঘোড়া আস্তাবলে রেখে দেন। তাছাড়া প্রায় আট—ন শ’ হাতি এবং কয়েক হাজার টাট্টু, কাহার, বেহারা ইত্যাদিও থাকে সম্রাটের বড় বড় তাঁবু ও তার সরঞ্জামাদি বহন করার জন্য। বেগমসাহেবারা ও জেনানারাও বাদশাহের সঙ্গে যান। তার সঙ্গে যায় গঙ্গার জল ও হরেকরকমের জিনিসপত্র। এত জিনিস, এত সাজসরঞ্জাম, এত বিলাসসামগ্রী কোনো সম্রাটের দরকার হয় না কখনও। এর সঙ্গে যদি আবার হারেম বা বেগমখানার খরচের কথা বলি তাহলে আপনার কাছে রূপকথার কাহিনি বলে মনে হবে। দামী দামী সোনা—রুপোর কাজ করা কাপড়—চোপড়, রেশম, মণিমুক্তা, মৃগনাভি, সুগন্ধি আতর ইত্যাদি হারেমখানার জন্য অজস্র আমদানি করা হত।

মোগলদের ধনদৌলত

সুতরাং যদিও বাদশাহের রাজস্ব প্রচুর এবং ঐশ্বর্যও প্রচুর, তাঁর এই অপরিমিত ব্যয়ের জন্য উদবৃত্ত কিছু থাকে না বিশেষ। যেমন আয় তেমনি তাঁর ব্যয়। অনেক রাজার রাজস্বের আয় থেকে হিন্দুস্থানের বাদশাহের আয় অনেক বেশি, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁকে আমি ধনী সম্রাট বলতে রাজি নই। মোগল বাদশাহকে ধনী বলাও যা, কোনো কোষাধ্যক্ষকে ধনী বলাও তাই। কোষাধ্যক্ষ প্রচুর টাকা নাড়াচাড়া করেন, এক হাতে জমা নেন, অন্য হাতে দিয়ে দেন। সেই টাকার মালিক তিনি নন। তেমনি ঠিক হিন্দুস্থানের বাদশাহও। ধনী ও ঐশ্বর্যবান সম্রাট আমি তাঁকেই বলতে পারি যিনি নিজের রাজ্যের প্রজাদের পীড়ন বা শোষণ না করে এমন রাজস্ব আদায় করতে পারেন যা দিয়ে তিনি স্বচ্ছন্দে তাঁর বিরাট রাজদরবারের ব্যয়ভার বহন করতে পারেন, বড় বড় প্রাসাদ ও অট্টালিকা তৈরি করতে পারেন, রাজ্যের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সৈন্যসামন্ত যথেষ্ট পরিমাণে বহাল করতে পারেন—এবং এত সব করা সত্ত্বেও, যিনি বিপদ আপদ ও সঙ্কটের জন্য প্রচুর পরিমাণে উদবৃত্ত টাকা মজুত রাখতে পারেন। এসব অধিকাংশ গুণই বাদশাহের আছে বটে, কিন্তু যতটা পরিমাণে থাকলে ভাল হয়, তা নেই। আমি যা বলতে চাচ্ছি, আশা করি তা আপনি বুঝতে পেরেছেন। আপনিও নিশ্চয় হিন্দুস্থানের বাদশাহকে এই কারণে খুব ধনী সম্রাট বলতে চাইবেন না। এইবার আপনাকে আমি আরও দুইটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ করছি, যা থেকে আপনি আমার বক্তব্য সমর্থন করার মতো যথেষ্ট যুক্তি খুঁজে পাবেন মনে হয়। এই ঘটনা থেকেই বুঝতে পারবেন মোগল বাদশাহের ঐশ্বর্য সম্বন্ধে বাইরের লোকের যে ধারণা আছে তা ঠিক নয়।

প্রথম ঘটনা : বিগত গৃহযুদ্ধের শেষদিকে সম্রাট ঔরঙ্গজীব সৈন্যদের বেতন সম্পর্কে রীতিমতো চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ভেবেই কূল পাচ্ছিলেন না, কি করে তাদের বেতন ও ভাতা দেবেন। এই প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, গৃহযুদ্ধ পাঁচ বছর মাত্র স্থায়ী হয়েছিল এবং সৈন্যদের বেতন স্বাভাবিক অবস্থায় যে রকম থাকত, তার চেয়ে কম ছিল। তাছাড়া কেবল বাংলাদেশ ছাড়া, যেখানে সুলতান সুজা তখনও লড়াই করছিলেন—হিন্দুস্থানের আর কোথাও বিশেষ যুদ্ধবিগ্রহ হচ্ছিল না। সর্বত্র শান্তি বজায় ছিল বললেও ভুল হয় না। এও মনে রাখা দরকার যে সম্রাট ঔরঙ্গজীব যেভাবেই হোক, সেইসময় তাঁর পিতা সাজাহানের অগাধ ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন।

দ্বিতীয় ঘটনা : সম্রাট সাজাহান যথেষ্ট বিচক্ষণ সম্রাট ছিলেন এবং প্রায় চল্লিশ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। এই সুদীর্ঘ রাজত্বকালে খুব বড় রকমের কোনো যুদ্ধবিগ্রহের মধ্যে তিনি লিপ্ত হননি। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ছয় কোটির বেশি টাকা জমাতে পারেননি। অবশ্যই টাকার সঙ্গে আমি সোনা—রুপোর অসংখ্য মূল্যবান জিনিস, দামী দামী পাথর মণিমুক্ত হীরা জহরত ইত্যাদির মূল্য যোগ করছি না। এদিক দিয়ে বরং সম্রাট সাজাহানের মতো দৌলত অন্য কোনো সম্রাটের ছিল না বলা চলে। কিন্তু এইসব মূল্যবান মণিমুক্তা হীরা জহরত ইত্যাদি দীর্ঘকাল ধরে সঞ্চিত ও সংগৃহীত, অধিকাংশই হিন্দুরাজা ও পাঠানদের। ওমরাহদের কাছ থেকে উপহার পাওয়াও কম নয়। এ সবই সম্রাটের পবিত্র সম্পত্তি এবং স্পর্শ করা নিষেধ। দেশের দুর্দিনেও সম্রাট তাঁর এই সম্পদের কোনো সাহায্য পান না।

হিন্দুস্থানের দারিদ্র্যের কারণ

অবশেষে আমি এই কথা বলতে চাই যে যদিও মোগল সাম্রাজ্যের সোনা—রুপোর ও সম্পদের আদি—অন্ত নেই, তাহলেও সোনা যে অন্য দেশের তুলনায় মোগলদের খুব বেশি আছে তা মনে হয় না। বরং হিন্দুস্থানের লোকদের দেখলে মনে হয়, তারা অন্যান্য অনেক দেশের লোকের তুলনায় বেশি দরিদ্র। মনে হবার কারণ আছে।

প্রথম কারণ হল : সোনা অনেক পরিমাণে গলিয়ে নষ্ট করে ফেলা হয়, অর্থাৎ সোনা গলিয়ে মেয়েদের নানারকমের অলঙ্কার তৈরি করা হয় এবং হাত, পা, মাথা, গলা, নাক, কান সর্বত্র অলংকৃত করার জন্য সোনা অপচয় করা হয়। সোনা থেকে নানারকমের জরি—জালিদাও তৈরি করা হয়। সেইসব সোনার জরি দেওয়া পাগড়ি, পোশাক ইত্যাদি দেহের শোভাবর্ধন করে। এইভাবে কতটা পরিমাণ সোনা যে হিন্দুস্থানে অপব্যবহার করা হয় তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। আমির—ওমরাহ থেকে আরম্ভ করে সাধারণ কর্মচারী পর্যন্ত সকলে গিল্টি—করা অলংকার ব্যবহার করেন। সাধারণ পদাতিকরা পর্যন্ত স্ত্রী—পুত্রকে স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করর জন্য উদগ্রীব। অনাহারে ও অর্ধাহারে থেকেও ভারতবর্ষে সোনার গহনা পরার লোভ ও অভ্যাস খুব প্রবল।

দ্বিতীয় কারণ হল : সম্রাট দেশের সমস্ত সম্পদের মালিক, বিশেষ করে ভূসম্পত্তির। সামরিক কর্মচারীদের বেতন হিসাবে তিনি ভূসম্পত্তির ভোগাধিকার দান করেন। তাকে ‘জায়গীর’ বলে, যেমন তুর্কিতে বলে ‘তিমর’। এই জায়গির থেকে তাঁরা তাঁদের ন্যায্য বেতন আয় করেন। প্রাদেশিক সুবাদারদেরও জায়গির দেওয়া হয়, শুধু বেতনের জন্য নয়, সৈন্যসামন্তদের জন্যও। একমাত্র শর্ত হল এই যে বাৎসরিক বাড়তি রাজস্ব যা আয় হবে সেটা সম্রাটকে দিতে হবে। যে সব ভূসম্পত্তি জায়গির দেওয়া হয় না, সেগুলি সম্রাটের নিজস্ব আয়ত্তে থাকে এবং তিনি রাজস্ব—আদায়কারী (জমিদার ও চৌধুরী) নিয়োগ করে তার রাজস্ব আদায় করেন।

এইভাবে ভূসম্পত্তির অধিকারী যাঁরা হন—সুবাদার, জায়গিরদার ও জমিদার—তাঁরা প্রজাদের একমাত্র হর্তাকর্তাবিধাতা হয়ে যান, চাষিদের উপর তাঁদের পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় থাকে, এমন কি নগর ও গ্রামের বণিকশ্রেণি ও কারিগরদের উপরেও। এই কর্তৃত্ব ও আধিপত্য তাঁরা যে কি নির্মমভাবে প্রয়োগ করেন নিষ্ঠুর অত্যাচারীর মতো, তা কল্পনা করা যায় না। এই অত্যাচার ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ করারও কোনো উপায় নেই। কারণ যিনি রক্ষক, তিনিই ভক্ষক। এমন কোনো নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ কেউ নেই, যাঁর কাছে তার অভিযোগ পেশ করতে পারে। আমাদের দেশের (ফ্রান্স) মতোন হিন্দুস্থানে পার্লামেন্ট নেই, আইনসভা নেই, আদালতের বিচারক নেই—অর্থাৎ এমন কিছু নেই যার সাহায্যে এই নিষ্ঠুর অত্যাচারীদের বর্বরতার প্রতিকার করা যেতে পারে। কিছু নেই, কেউ নেই। আছেন শুধু কাজি সাহেব, কিন্তু কাজির বিচারও তেমনি, কারণ কাজির কাছে জনসাধারণের সুবিচারের কোনো আশা নেই। রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ও দায়িত্বের এই চরম লজ্জাকর অপব্যবহার কেবল রাজধানীতে (দিল্লি ও আগ্রা) বা রাজধানীর কাছাকাছি নগরে ও বন্দরে একটু অল্প দেখা যায়, কারণ নিদারুণ কোনো অন্যায় বা অত্যাচার এইসব স্থানে ঘটলে, সম্রাটের কর্ণগোচর হতে দেরি হয় না। এই অবস্থাকে আমরা ‘দাসত্ব’ ছাড়া আর কি বলতে পারি?

এই দাসত্বই হল হিন্দুস্থানের প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। ব্যবসা—বাণিজ্য, আর্থিক অবস্থা, ব্যক্তিগত জীবনধারা, আচার—ব্যবহার, সব কিছু এই কারণে এত অনুন্নত বলে মনে হয়। ব্যবসা—বাণিজ্যেও বণিকশ্রেণি বিশেষ কোনো উৎসাহ পান না, কারণ বাণিজ্যে লক্ষ্মীলাভ ঘটলে আশার চেয়ে আতঙ্কের সম্ভাবনা থাকে। প্রতিবেশী স্বেচ্ছাচারী তাঁর ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যের দম্ভে সার্থক ব্যবসায়ীর সর্বনাশ করার চেষ্টা করেন সব দিক দিয়ে এবং কিছুতেই অন্য আর—একজনের ঐশ্বর্যের প্রতিপত্তি সহ্য করেন না। সুতরাং হিন্দুস্থানের বণিকশ্রেণি ও বাণিজ্যেরও কোনো ক্রমোন্নতি নেই, কোনো প্রসার ও প্রগতি নেই। তাছাড়া, হিন্দুস্থানের আরও একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যদি কেউ ধনোপার্জন করেন, তাহলে তিনি তখনও ব্যক্তিগত ভোগবিলাসের জন্য এক কপর্দকও খরচ করেন না। তাঁর ঘরবাড়ি, পোশাক—পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র সব একরকম থাকে, কখনও বদলায় না এবং তা দেখে বোঝবার উপায় নেই যে তাঁর ধনদৌলত কত আছে। কৃপণতাই হিন্দুস্থানের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। এদিকে ক্রমে তাঁর সোনারুপো মজুত হতে থাকে এবং মাটির গভীর তলদেশে স্তূপাকারে সমাধিস্থ হয়ে আত্মগোপন করে থাকে। ধনী কৃষক, ধনী কারিগর, ধনী বণিক—সকলের ঠিক একইরকম মনোবৃত্তি—মুসলমান বা হিন্দু যে সম্প্রদায়েরই লোক হন না কেন তিনি। সাধারণত হিন্দুস্থানের বণিকশ্রেণি বলতে হিন্দুদেরই বুঝায়, কারণ হিন্দুরাই ব্যবসা—বাণিজ্যাদি নানা উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করেছেন। তাঁদের ধারণা বা বিশ্বাস যে উপার্জিত অর্থ এইভাবে সঞ্চয় করে রাখলে পরলোকে পরমাত্মার সদগতি হয়, অর্থাৎ অর্থ ও পরমার্থ তাঁদের কাছে এক পদার্থ। মুষ্টিমেয় একদল লোক যাঁরা সম্রাট বা আমির—ওমরাহের আওতায় থাকেন, তাঁরাই কেবল ভোগ—বিলাসের জন্য ব্যয় করেন এবং বাইরে দীনদরিদ্র সেজে থাকেন না।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সোনারুপো এইভাবে মজুত করে রাখার অভ্যাস যুক্তিহীন মিতব্যয়িতা এবং খরচ না করে টাকা জমিয়ে রাখার প্রবৃত্তির জন্যই হিন্দুস্থানের দারিদ্র্য এত বেশি। উপার্জিত অর্থ দিয়ে লেনদেন না করে যদি তা ঘরে সঞ্চয় করে রাখা হয়, তাহলে পর্যাপ্ত ধনসম্পদ থাকা সত্ত্বেও কোনো দেশের দারিদ্র্য দূর হতে পারে না।

যে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হল তাতে সকলের মনে একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগবে। প্রশ্নটি হল :

সম্রাট যদি সমস্ত ভূসম্পত্তির মালিক না হতেন এবং সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার যদি স্বীকৃত হত, তাহলে কি হিন্দুস্থানের আরও অনেক বেশি উন্নতি হত।

আর্থিক অবনতির কারণ কি?

এই প্রশ্ন নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি। ইউরোপের যে সব রাষ্ট্রে সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার আছে এবং যেসব রাষ্ট্রে নেই, তাদের অবস্থা তুলনা করে দেখে আমার দৃঢ়বিশ্বাস হয়েছে যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার না করলে রাষ্ট্রের মারাত্মক ক্ষতি হয়। পূর্বালোচনা থেকে আমরা বুঝেছি, হিন্দুস্থানের সোনা—রুপো কিভাবে জায়গিরদার, সুবাদার ও জমিদার গোপন সিন্ধুকে মজুত করে ফেলেন এবং বহির্জগতে লেনদেনের ক্ষেত্র থেকে সরিয়ে ফেলে আত্মসাৎ করেন। তাঁদের এই নিষ্ঠুরতার কোনো যুক্তি নেই, জায়গিরদার, জমিদারের এই নিষ্ঠুরতা সংযত করার ক্ষমতা সম্রাটের পর্যন্ত নেই, একমাত্র রাজধানীর কাছাকাছি অঞ্চলে ছাড়া। সাধারণত রাজধানী থেকে দূরে এক একটি অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিয়ে এরা যথেচ্ছাচার করতে থাকেন এবং তার অধিকাংশই সম্রাটের কর্ণগোচর হয় না। সুতরাং যথেচ্ছাচারিতার সীমাও থাকে না। এই যথেচ্ছচার মধ্যে মধ্যে এমন কদর্যভাবে সীমা ছাড়িয়ে যায় যে চাষি ও কারিগররা দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিরও সংস্থান করতে পারে না এবং না—পারার জন্য অনাহারে, নিদারুণ কষ্টের মধ্যে নীরবে মৃত্যু বরণ করে। এই যথেচ্ছাচারিতার জন্য দরিদ্র চাষিদের বংশবৃদ্ধিও হয় না এবং হলেও ভবিষ্যৎ বংশধরদের তারা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে যায়। অনেক সময় তারা গ্রাম ছেড়ে গ্রামান্তরে চলে যায় উদার ব্যবহারের প্রত্যাশায়, অথবা সেনাবাহিনীতেও যোগদান করে। চাষবাস সম্বন্ধে বিশেষ কোনো উৎসাহ বা আগ্রহ থাকে না চাষিদের, নেহাত বাধ্য হয়ে করতে হয় তাই করে। সাধারণ চাষিদের পক্ষে জলসেচনের জন্য খাল নালা ইত্যাদি খনন করা সম্ভব নয়, তাদের সামর্থ্যে কুলায় না। সুতরাং জলসেচন—ব্যবস্থার অভাবের জন্য চাষবাসের প্রচণ্ড ক্ষতি হয় এবং যথেষ্ট আবাদি জমি পতিত থাকে। দেশের বসতবাড়ির অবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়, সবই জরাজীর্ণ এবং নতুন করে তৈরি করার সঙ্গতিও খুব অল্প লোকের আছে। মনে হয় হিন্দুস্থানের চাষি ও সাধারণ লোকের মনে এই প্রশ্নই জাগে : ‘কেন আমি একজন স্বেচ্ছাচারী জায়গিরদার বা জমিদারের জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি খাটব? খাটুনির সার্থকতা কি? যে কোনোদিন আমার সমস্ত সম্পত্তি ও অর্জিত ধন যদি খেয়ালখুশির বশে স্বেচ্ছাচারী প্রভুর কবলিত হতে পারে, তাহলে মেহনতের মূল্য কি? জীবনের সামান্যতম নিরাপত্তা নেই যেখানে, সেখানে মেহনতের সার্থকতা নেই। সুতরাং যেভাবে হোক, জীবনের কটা দিন কাটিয়ে দিতে পারলেই হল। ফসল ফলিয়ে, সম্পদ বাড়িয়ে লাভ কি?

ঠিক এই ধরনের প্রশ্ন রাজস্ব—আদায়কারী জমিদারদের মনেও জাগে। তাঁরা ভাবেন : ‘দেশের অবস্থা, জমিজমা চাষবাসের অবস্থা কি হচ্ছে না হচ্ছে, তা নিয়ে চিন্তা করে লাভ কি? তার জন্য আমাদের অর্থ ব্যয় করাও অর্থহীন। কেনই বা আমরা জমির উন্নতির জন্য, ফসল ও সম্পদবৃদ্ধির জন্য অর্থ ব্যয় করব? যে—কোনো দিন সম্রাটের মর্জি অনুযায়ী আমাদের সমস্ত অধিকার অপহৃত হতে পারে, আমরা সাধারণ প্রজা বলে গণ্য হতে পারি। তাই যদি হয়, তাহলে আমাদের সুকাজের সুফল যে আমাদের বংশধররা উত্তরাধিকার—সূত্রে ভোগ করবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সুতরাং ক্ষণিকের রাজা যখন আমরা, তখন প্রজাদের শোষণ করে যতদূর সম্ভব অর্থ রোজগার ভাল। তাতে যদি প্রজারা অনাহারে মরে বা ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যায়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। কারণ আমরাই বা কদিন আছি প্রভুত্ব করতে? আজ আছি, কাল নেই। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজার কল্যাণ ইত্যাদি গুরুগম্ভীর বিষয় চিন্তা করে আমাদের লাভ কি? যে কদিন পারা যায় আমরা লুটে নেব এবং যখন সব ছেড়ে চলে যাব তখন এমন ভয়াবহ রিক্ত অবস্থায় রেখে যাব জমিদারি যে ভবিষ্যতে সম্রাটের নিযুক্ত অন্য কোনো জমিদার সেখান থেকে আর কিছু শোষণ করতে পারবেন না।’

এই কারণেই শুধু হিন্দুস্থানের নয়, এশিয়ার প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের ক্রমিক অবনতি হয়েছে। যে—দেশের গভর্নমেন্টের এই অবস্থা, সেখানে অবনতি ছাড়া উন্নতি হবে কি ভাবে? এই অবনতির চিহ্ন হিন্দুস্থানের সর্বত্র দেখা যায়। হিন্দুস্থানের অধিকাংশ নগরের ঘরবাড়ির অবস্থা খুব শোচনীয়, মাটির তৈরি ঘরবাড়ি এবং এইরকম পরিত্যক্ত নগরের অভাব নেই সেখানে। জীর্ণ ঘরবাড়ির ভগ্নস্তূপে পরিণত নগরও অনেক আছে। যেগুলির অস্তিত্ব আজও আছে, তাদের চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে আর বেশি দেরি নেই।

হিন্দুস্থান অনেক দূরে। হিন্দুস্থানের কথা ছেড়ে দিলেও দেখা যায় যে আরও কাছাকাছি অন্যান্য দেশের অবস্থাও প্রায় একরকম। সেই স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্রীয় শক্তির ধ্বংসলীলার সুস্পষ্ট চিহ্ন সর্বত্র বিরাজমান—মেসোপোতামিয়ায়, আনাতোলিয়ায়, ফিলিস্তিনে, সর্বত্র। একসময় এই সব দেশ ছিল সোনার দেশ, মাটিতে সোনা ফলত বললেও ভুল হয় না। দিগন্তবিস্তৃত শস্যশ্যামল ফসলক্ষেত এইসব দেশের প্রাকৃতিক শোভাবর্ধন করত। এখন সেখানে মরুভূমির অবস্থা বিরাজ করছে, ক্ষেতের দিকে চাইলে কল্পনা করা যায় না যে এককালে সোনা ফলত এই সব দেশে। যেখানে আবাদ করলে সোনা ফলত, সেখানে এখন জলাজঙ্গল, কীটপতঙ্গের উপদ্রব হয়েছে এবং মানুষের বসবাসের অযোগ্য স্থান হয়ে উঠেছে। সোনার দেশ মিশরের ইতিহাসও ওই একই করুণ মর্মান্তিক ইতিহাস, অর্থাৎ দাসত্বের ও ক্রমিক অবনতির ইতিহাস। মিশরের দশভাগের একভাগ অঞ্চল বিগত আশি বছরের মধ্যে অনাবাদী পতিত জমিতে পরিণত হয়েছে, জলসেচনের প্রণালীগুলি সংস্কার করা হয়নি এবং করার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষই মাথা ঘামাননি। নীল নদের নিয়ন্ত্রণের সমস্যা নিয়েও কেউ মাথা ঘামানোর প্রয়োজনবোধ করেননি। তার ফলে ভাটি অঞ্চলে প্রতি বৎসর প্রবল বন্যায় ভেসে যায় এবং বালিতে ঢেকে যায়। এই বালির অবরণ পরিষ্কার করা রীতিমতো শ্রমসাধ্য ও ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। কে করবে?

শিল্পী ও শিল্পকলার অবস্থা

এই শোচনীয় অবস্থার মধ্যে কোনো দেশের শিল্পকলার সুস্থ বিকাশ হতে পারে কি? পারে না। কোনো শিল্পী শিল্পকলার উৎকর্ষের জন্য এই পরিবেশের মধ্যে আত্মোৎসর্গ করতে পারেন না। চারিদিকে যে দেশে দারিদ্র্যের বীভৎসতা প্রকট হয়ে থাকে, এবং ধনীরা যেখানে সরলতার ভান করে কৃপণতাকে জীবনের ধর্ম বলে গ্রহণ করেন, সুলভ মূল্যের দ্রব্যাদির জন্য যেখানে সকলে লালায়িত, সেখানে শিল্পকলার আসল উৎকৃষ্টতা বা সৌন্দর্য বিচার্যবস্তু নয়, তার কোনো মূল্য নেই। যে দেশের ধনীরা ফকিরের জীবন যাপন করাটা জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করেন, না খেয়ে না পরে কেবল মাটির তলায় টাকা পুঁতে রাখতে চান, খরচ করতে চান না এবং করতে জানেনও না, তাঁদের জীবন সম্বন্ধে কোনো উদার দৃষ্টিভঙ্গী থাকতে পারে না। আর যাই হন, তাঁরা কখনও শিল্পকলার সমঝদার বা পৃষ্ঠপোষক হতে পারেন না। এই অবস্থায় শিল্পকলা বা শিল্পীর বিকাশ বা সমৃদ্ধি কখনই সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, যেখানে শিল্পীদের তথাকথিত ‘অপরাধে’র জন্য কথায় কথায় বেত্রাঘাত পর্যন্ত করতে সঙ্কোচ হয় না, সেখানে শিল্পীরা তো মানুষ বলেই গ্রাহ্য নন? শিল্পীদের সেখানে কোনো মর্যাদা নেই, কোনো স্বাধীনতা বা স্বাতন্ত্র্যের অধিকার নেই। তাঁদের সৃষ্টির জন্য কোনো ব্যক্তিগত সম্মানও তাঁদের দেওয়া হয় না। তাঁরাও সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মতো দাসত্বই করেন। যেখানে শিল্পসৃষ্টির স্বাধীনতা নেই এবং তার কোনো স্বীকৃতিও নেই, সেখানে শিল্পকলার উন্নতির জন্য শিল্পীরা কোনো প্রেরণা পেতে পারেন না। শিল্পীদের আর্থিক অবস্থাও শোচনীয়। অর্থ উপার্জনের কোনো স্বাধীনতা শিল্পীর নেই। ধনসম্পত্তি সঞ্চয় করার ব্যক্তিগত অধিকারও নেই। বংশপরম্পরায় শিল্পীদের অস্তিত্ব বজায় রাখাই এইজন্য দায় হয়ে ওঠে। সামান্য অর্থও সঞ্চয় করার অধিকার তাঁদের নেই। একেবারে ঠিক ক্রীতদাসের মতো অবস্থা। একটু মূল্যবান পোশাক—পরিচ্ছদ পর্যন্ত তাঁরা ব্যবহার করতে পারেন না, কারণ পোশাক দেখে যদি আমির—ওমরাহ বা জায়গিরদার—জমিদারদের মনে সন্দেহ হয় যে তিনি বিত্তশালী, তাহলে তাঁর পরিত্রাণ নেই। আমার বিশ্বাস, হিন্দুস্থান থেকে শিল্পকলার অস্তিত্ব বহুদিন আগে বিলুপ্ত হয়ে যেত যদি বাদশাহ ও আমির—ওমরাহরা নিজের বেতনভুক শিল্পী নিয়োগ না করতেন, তাঁদের বংশধরদের শিল্পশিক্ষা দেবার ব্যবস্থা না করতেন, এবং সবার উপরে পুরস্কার ও তিরস্কার বা চাবুকের ভয় না দেখাতেন। ধনিক, বণিক ও ব্যবসায়ীশ্রেণি ও শিল্পীদের নিজেদের কাজকর্মের জন্য নিয়োগ করেন এবং তার জন্য শিল্প ও শিল্পীর অস্তিত্ব কিছুটা বজায় থাকে। অনেক সময় তাঁরা বেশি বেতনও দেন। কোনো মহানুভবতা বা উদারতার জন্য বেশি দেন না, সম্পূর্ণ নিজেদের স্বার্থের জন্য কাজের তাগিদে দিতে বাধ্য হন। চাবুকের ভয় দেখিয়ে ধনিক বণিকরাও কারিগর ও শিল্পীদের কাজ করাতে দ্বিধাবোধ করেন না। কারিগর ও শিল্পীদের কোনো উপায়েই ধনসঞ্চয় করার উপায় নেই। দুবেলা দুমুঠো খেয়ে, সামান্য মোটা কাপড়ে লজ্জানিবারণ করে তাঁরা বেঁচে থাকেন এবং তাতেই তাঁরা খুশি। তাঁদের তৈরি কারুশিল্পাদির ব্যবসা করে প্রচুর ধনসঞ্চয় করেন বণিকরা এবং বণিকদের একমাত্র লক্ষ্য হল, তাঁদের পৃষ্ঠপোষক যাঁরা তাঁদের সন্তুষ্ট করা, শিল্পীদের নয়।

শিক্ষা ও বাণিজ্যের অবস্থা

এই যে সমাজের পরিচয় দিলাম, এর ভবিষ্যৎ কি? এরকম সামাজিক পরিবেশের মধ্যে শিক্ষার প্রসার হতে পারে না। অশিক্ষাই এই সমাজব্যবস্থার অনিবার্য পরিণাম। হিন্দুস্থানে এই অবস্থার মধ্যে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলেজ বা আকাদেমি জাতীয় কিছু কি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভবপর? আমার তো মনে হয়, সম্ভব নয়। কারণ প্রতিষ্ঠাতা কোথায় পাওয়া যাবে, কে প্রতিষ্ঠা করবে? প্রতিষ্ঠা করলেও বা বিদ্বান ব্যক্তি কোথায় পাওয়া যাবে? সেরকম লোকই বা কোথায়, যাঁরা খরচ করবেন শিক্ষার জন্য? যদিও বা সেরকম লোক দু—চারজন থাকেন তাঁরা ভয়ে তা করবেন না, কারণ তাঁদের অর্থসামর্থ্য যে আছে একথা তাঁরা প্রকাশ্যে প্রচার করতে চান না। আর যদি এত অসুবিধা সত্ত্বেও শিক্ষা পায় কেউ, তাহলে সেই শিক্ষার উপযুক্ত মর্যাদাই বা দেবে কে? অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কাজকর্ম, চাকরি—বাকরি এমন কিছু নেই যার জন্য বিশেষ বিদ্যাবুদ্ধি, শিক্ষাদীক্ষা বা জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার প্রয়োজন। সুতরাং তরুণরা শিক্ষার প্রেরণাই বা পাবে কোথা থেকে?

এই অবস্থায় ব্যবসা—বাণিজ্যের উন্নতি সম্ভব নয়।১০ কারণ বাণিজ্যের অধিকার যদি বাধাবন্ধবহীন না হয়, তাহলে তার বিস্তারও হয় না। ইয়োরেপের মতো তাই হিন্দুস্থানে বাণিজ্যিক উন্নতি হয়নি। এমন লোক কে আছে, যে পরের স্বার্থের জন্য নিজে পরিশ্রম করবে, দুশ্চিন্তা করবে এবং বিপদ—আপদের সম্মুখীন হবে? প্রাদেশিক সুবাদার যদি বাণিজ্যের মুনাফার মোটা অংশ গ্রাস করে ফেলেন, তাহলে বণিকদের বাণিজ্য করার দরকার কি? যে বণিক যত মুনাফাই করুন না কেন, তাঁকে বাইরে সেই দীনদরিদ্রের বেশেই থাকতে হবে, এবং দৈনন্দিন জীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যভোগও তিনি নিশ্চিন্তে করতে পারবেন না। কারণ তাহলেই তিনি তাঁর প্রতিবেশী জমিদার বা সুবাদারের ঈর্ষার পাত্র হবেন এবং তাঁর ধনসম্পত্তি থেকে হয়তো বঞ্চিতও হবেন। সাধারণত বণিকরা অবশ্য উচ্চপদস্থ ফৌজদার বা আমিরের আশ্রয়ে থেকে ব্যাবসা করেন, তা না হলে তাঁদের পক্ষে ব্যাবসা করাই বিপজ্জনক। তাহলেও কিন্তু বণিকের কোনো স্বাধীনতা বা সম্মান নেই হিন্দুস্থানে। বণিকরা তাঁদের পৃষ্ঠপোষক, আশ্রয়দাতা প্রভুদের ক্রীতদাস বললেও অত্যুক্তি হয় না। তাঁদের আশ্রয় ও পোষকতার জন্য তাঁরা বণিকদের কাছে যে কোনো মূল্য দাবি করতে পারেন। সাধারণত মূল্য হল বাণিজ্যের মুনাফার অংশ এবং কোনো চুক্তিবদ্ধ নির্দিষ্ট অংশ নয়, আশ্রয়দাতার খেয়ালখুশি মতন অংশ।

মোগল বাদশাহ তাঁর নিজের রাষ্ট্রীয় কাজকর্মের জন্য কখনও রাজবংশ ও বনেদি সম্ভ্রান্তবংশের লোক নির্বাচন করেন না। এমন কি সাধারণত ভদ্র নাগরিক, বণিক বা ব্যবসায়ী কেউ কোনোদিন তাঁর নেকনজরে পড়েন না। শিক্ষিত লোক, সম্ভ্রান্ত সঙ্গতিপন্ন পরিবারের লোক, যাঁরা সাহস ও নিষ্ঠার সঙ্গে রাজকর্তব্য পালন করতে পারেন, বিপদে—আপদে নিজেদের সমার্থ্য নিয়ে সম্রাটের পাশে দাঁড়াতে পারেন, দেশের প্রতি অনুরাগ যাঁদের বেশি, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে যাঁরা সচেতন, তাঁরা কেউ সম্রাটের রাজকার্যের দায়িত্ব পালন করার জন্য আমন্ত্রিত হন না। তার বদলে সম্রাট তাঁর চারিদিকে নিরক্ষর ও বর্বর ক্রীতদাস পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে ভালোবাসেন। সমাজের জঘন্য আবর্জনাস্তূপ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া একদল পরানুগ্রহজীবী মোসাহেব তাঁকে ঘিরে থাকে। তারা দেশপ্রেম বা রাজভক্তি কাকে বলে জানে না। তার ধারও ধারে না। সম্রাটের নেকনজরে থেকে তারা মিথ্যা দম্ভের বড়াই করে শুধু, সৎসাহস, সম্মান বা শালীনতার তোয়াক্কা করে না। দরবারের শোভা তারাই বর্ধন করে।

এইভাবে হিন্দুস্থান ক্রমে অবনতির চরম সীমায় পৌঁছেছে। বিশাল এক সেনাবাহিনী ও বিরাট এক রাজদরবারের কৃত্রিম জাঁকজমকের ব্যয়ভার বহন করতেই হিন্দুস্থান সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। সেনাবাহিনী প্রয়োজন, কারণ তারই জোরে হিন্দুস্থানের জনসাধারণকে পদানত করে রাখতে হয়। সৈন্যসামন্ত না হলে হিন্দুস্থানে রাজার পক্ষে রাজত্ব করা একদিনও চলে না। হিন্দুস্থানের জনসাধারণের দুঃখদুর্দশারও যেন সীমা নেই মনে হয়। কেবল ডাণ্ডা আর চাবুকের জোরে তাদের ক্রীতদাস করে রাখা হয়েছে। অমানুষিক খাটুনিও তারা খাটে এবং চাবুক মেরেই তাদের খাটানো হয়। নানাভাবে নির্মম নির্যাতন করে জনসাধারণকে বিদ্রোহের প্রান্তে আনা হয়েছে হিন্দুস্থানে। গণবিদ্রোহ কেবল সামরিক শক্তির জোরে দাবিয়ে রাখা হয়েছে।

হতভাগ্য দেশ হিন্দুস্থান। হিন্দুস্থানের দুর্ভাগ্যের আরও একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, বড়ো যুদ্ধবিগ্রহের সময় বিভিন্ন প্রাদেশিক গভর্নমেন্ট প্রচুর অর্থের বিনিময়ে আত্মবিক্রয় করেন। প্রাদেশিক সুবাদাররা ক্রয়মূল্যের এই টাকা কড়ায়গণ্ডায় আদায় করে নেন। উচ্চাহারে সুদ দিয়ে টাকাটা তাঁরা কর্জ করেন। প্রদেশগুলি এইভাবে কেনা হোক বা না হোক, প্রত্যেক প্রদেশের সুবাদার, জায়গিরদার ও রাজস্বআদায়কারী জমিদারদের মূল্যবান জিনিসপত্র উপহার দিতে হয় প্রতিবৎসর উজির, খোজা বা বেগমখানার কোনো মহিলাকে—রাজদরবারে যাঁর প্রতিপত্তি আছে এবং বাদশাহের উপর যাঁর ব্যক্তিগত প্রভাব আছে যথেষ্ট। ভেট না দিয়ে কোনো কাজ হাসিল করার উপায় নেই। প্রাদেশিক সুবাদার সম্রাটের নিয়মিত কর—পেস্কসাদিও আদায় করে দেন। এইভাবে একজন অতি নিম্নস্তরের লোক, সাধারণত গোলামশ্রেণির লোক, ক্রমে প্রাদেশিক শাসনকর্তা হয়ে দেশের মধ্যে হোমরাচোমরা ব্যক্তি বলে গণ্য হন।

এইভাবে হিন্দুস্থান প্রতিদিন ধ্বংসের মুখে এগিয়ে যাচ্ছে। অগ্রগতির কোনো চিহ্ন নেই কোথাও হিন্দুস্থানে। আলোর কোনো আভাস নেই, চারিদিকে কারাগারের ভয়াবহ নিস্তব্ধতা ও গাঢ় অন্ধকার থমথম করছে মনে হয় হিন্দুস্থানে। প্রাদেশিক সুবাদাররা হঠাৎ নবাব হয়ে ধরাকে সরা জ্ঞান করেন এবং এই জাতীয় ক্ষুদে নবাবের উৎপীড়ন, অত্যাচার ও যথেচ্ছাচার করার ক্ষমতাও অপরিসীম। তাঁদের ঔদ্ধত্যের রশ্মি সংযত করার মতো কেউ নেই। এই সীমাহীন অত্যাচার দিনের পর দিন মাথা হেঁট করে হিন্দুস্থানের জনসাধারণ নীরবে সহ্য করে। প্রতিকারের কোনো পন্থা নেই, ন্যায়বিচারের কোনো আশা নেই। অভিযোগ ও আবেদন করার মতো কোনো নিরপেক্ষ বিচারক নেই কোথাও। রক্ষকরাই সেখানে ভক্ষক।

হিন্দুস্থান ও অন্যান্য দেশ

একথা অবশ্য ঠিক যে মোগল বাদশাহ প্রত্যেক প্রদেশে একজন করে ‘ওয়াকিবনবিশ’১১ পাঠান। তাঁদের একমাত্র কাজ হল যেখানে যা ঘটবে তা ঠিকভাবে বাদশাহকে জানানো কিন্তু বিভিন্ন প্রাদেশিক শাসনকর্তার সঙ্গে প্রায়ই দেখা যায় যে এই ওয়াকিবনবিশদের মধ্যে মতান্তর ও মনোমালিন্য হয় এবং তার ফলে তাঁদের মধ্যে বিরোধও দেখা দেয় কদর্যভাবে। সুতরাং প্রজাদের কোনোদিক থেকেই নিশ্চিন্ত হবার সুযোগ নেই, এবং প্রজার দুঃখ—দুর্দশা অভিযোগ ইত্যাদি সম্রাটের কর্ণগোচর হওয়াও সম্ভব নয়।

হিন্দুস্থানে ‘গভর্নমেন্ট’ বিক্রি হয় অবশ্য, কিন্তু তুরস্কের মতো অতটা প্রকাশ্যে হয় না এবং ঘন ঘন হয় না। ‘প্রকাশ্যে’ বিক্রির কথা বললাম এইজন্য যে প্রাদেশিক গভর্নর বা সুবাদাররা যেরকম মূল্যবান উপঢৌকন ও ভেট পাঠান নিয়মিতভাবে সম্রাটের কাছে, তাতে একটা প্রদেশের শাসনাধিকার সত্যই কেনা যেতে পারে। ভেটের মূল্য প্রায় প্রদেশের ক্রয়মূল্যের সমান হয়ে ওঠে। হিন্দুস্থানে একই লোক দীর্ঘকাল গভর্নর থাকেন, তুরস্কের মতো ঘন ঘন বদলি হন না এবং দীর্ঘকালের স্থায়ী সুবাদাররা প্রজাদের সুখসুবিধার দিকে তবু একটু নজর দেন, যা নতুন গভর্নররা লোভের বশবর্তী হয়ে একেবারেই দেন না। স্থায়ী সুবাদাররা কতকটা নিজেদের স্বার্থেও কিছুটা সংযত ব্যবহার করতে বাধ্য হন। কারণ তাঁরা জানেন যে যথেচ্ছাচার করলে প্রজারা উৎপীড়িত হয়ে অন্য রাজার রাজ্যে গিয়ে বসবাস করবে এবং তাতে তাঁরই ক্ষতি হবে। হিন্দুস্থানে এরকম প্রায়ই হয়ে থাকে।

পারস্যে এরকম প্রকাশ্যে বা ঘন ঘন গভর্নমেন্ট বেচাকেনা হয় না। বংশানুক্রমেও সেখানে অনেকে গভর্নর হন। তার ফলে পারস্যের সাধারণ লোকের অবস্থা অনেক বেশি উন্নত দেখা যায়। পারসিরা তুরকিদের চেয়ে অনেক বেশি অমায়িক এবং বিদ্যাচর্চার প্রতি তাদের অনুরাগও আছে।

কিন্তু তুরস্ক, পারস্য ও হিন্দুস্থান এই তিনটি দেশের সম্রাটদের ব্যক্তিগত ধনসম্পত্তি বা ভূসম্পত্তির প্রতি বিশেষ কোনো শ্রদ্ধা নেই দেখা যায়। এইদিক দিয়ে এই তিনটি দেশের সাদৃশ্য আছে মনে হয়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার না করার অর্থ সব রকমের সামাজিক অগ্রগতির পথ বন্ধ করা। এই মারাত্মক ভুলের জন্য এই দেশগুলিকে একদিন অনুতাপ করতে হবে এবং তখন তারা বুঝতে পারবে এই অস্বাভাবিক ব্যবস্থার ফলে তাদের কি অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার যে—দেশের শাসকরা স্বীকার করেন না, সে—দেশের অগ্রগতির কোনো আশা নেই—অত্যাচার, অবনতি ও চরম দুঃখদুর্দশার নরককুণ্ডে তার ধ্বংস অনিবার্য।

প্রায়ই মনে হয় আমার, এইসব দেশবাসীর তুলনায় আমরা কত সুখী। আমাদের দেশের সম্রাটরা সমস্ত ভূসম্পত্তির মালিক নন। তা যদি হত তাহলে আমরা এত সুন্দর দেশ, এত সব বড় বড় শহর নগর, এত সব সুখী পরিবার গড়ে তুলতে পারতাম না। এত লোকসংখ্যাও বাড়ত না, এত ফসল ফলত না আমাদের দেশে। সম্পত্তির অধিকার যদি আমাদের না থাকত, তাহলে ইয়োরোপের সম্রাটদেরও সঞ্চিত ধনরত্ন থাকত প্রচুর এবং তাঁদের প্রতি প্রজাসাধারণের এরকম আনুগত্যবোধও থাকত না। রাজারা প্রত্যেকে একাকী মরুভূমিতে রাজত্ব করতেন—বৈরাগী, সন্ন্যাসী ও বর্বরঅধ্যুষিত—মরুভূমিতে।

এশিয়ার সম্রাটরা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতের। তাঁদের ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এত বেশি উদ্ধত ও অন্ধ যে তাঁরা রাজকীয় শক্তিকে ঐশ্বরিক শক্তির চেয়েও স্বেচ্ছাচারী মনে করেন এবং সবকিছু ভোগ—দখল করতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত প্রকৃতির নিয়মে সর্বস্ব হারাতে বাধ্য হন। তাঁদের টাকাপয়সা সংগ্রহের সুযোগ যথেষ্ট থাকা সত্ত্বেও, আদায় করার সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা ব্যর্থ হন। আজ যদি আমাদের দেশেও ওইরকম সম্রাট থাকতেন এবং দেশের ধনসম্পত্তির উপর তাঁর একচেটে অধিকার থাকত তাহলে আমাদের দেশে ধনী ব্যক্তির সংখ্যা এরকম বৃদ্ধি পেত না এবং ব্যবসায়ী ও কারিগরদেরও এত উন্নতি হত না। প্যারিস, লিঅঁ, তুলু, রুয়েঁর মতো এমন সুন্দর সুন্দর শহরও গড়ে উঠত না আমাদের দেশে। এত নগর ও গ্রামের অস্তিত্বও থাকত না। এত সুন্দর সব ঘরবাড়ি তৈরি করা বা পাহাড় পর্বতে ও উপত্যকায় এত যত্ন ও মেহনত করে প্রচুর পরিমাণে ফসল ফলানো, এসব কিছুই সম্ভব হত না। তাছাড়া, আমাদের দেশে শিল্পবাণিজ্য ইত্যাদি থেকে যে রাজস্ব রাষ্ট্র উপার্জন করে, তাই বা কোথা থেকে করা সম্ভব হত? এই রাজস্ব থেকে রাজা ও প্রজা উভয়েই উপকৃত হন। সম্পত্তির অধিকার না থাকলে এই অগ্রগতির পথ বন্ধ হয়ে যেত। দেশের এই সমৃদ্ধ রূপ বদলে যেত তাহলে। এই বিচিত্র প্রাণৈশ্বর্য দেশ থেকে লোপ পেয়ে যেত। আমাদের বড়ো বড়ো নগরগুলি মানুষের বসবাসযোগ্য থাকত না, নরকের মতো কদর্য ও বিষাক্ত হয়ে উঠত। কোন কালে সেগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হত, তার পরিবেশ নিষ্ক্রিয় ও নিষ্পন্দ জীবনের জীবাণুতে কলুষিত হয়ে যেত, কোনো লোকালয়ের চিহ্ন কোথাও থাকত না। আজ যে পাহাড়ি জমিতে আবাদ করে আমরা সোনা ফলাচ্ছি তা আর সম্ভব হত না তখন। সোনার বদলে, ফসলের বদলে, কীটপতঙ্গ, বনজঙ্গল, কাঁটাগাছ ও বন্যজন্তুর জন্ম হত সেখানে। পর্যটকদের জন্য এরকম সুন্দর বন্দোবস্ত আমরা করতে পারতাম না। প্যারিস ও লিঅঁর মধ্যবর্তী পথে যেসব পান্থনিবাস আজ বিদেশি ও এদেশি পর্যটকদের কলরবে মুখর হয়ে উঠছে, সেসব কতকগুলি কুৎসিত ক্যারাভান—সরাইয়ে পরিণত হত হয়তো এবং পর্যটকরা স্থান থেকে স্থানান্তরে যাযাবরের মতো মালপত্তর নিয়ে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য হত। শত শত পথযাত্রী ও দেশযাত্রীরা তার মধ্যে তাদের ঘোড়া, উট ও ঘোটক—গর্দভসহ একত্রে বাস করে। সে এক বিচিত্র জীবন। মানুষ ও পশুর দল যে এইভাবে মিলেমিশে দিনযাপন করতে পারে তা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। গ্রীষ্মকালে নিদারুণ উত্তাপের জন্য ক্যারাভান—সরাইয়ে বাস করা যায় না, অতিষ্ঠ হয়ে উঠতে হয় গরমে। শীতকালেও কেবল জন্তুজানোয়ারের অবাঞ্ছিত সাহচর্যের উত্তাপেই যাত্রীদের কোনোরকমে আত্মরক্ষা করতে হয়।

কিন্তু হিন্দুস্থান ছাড়াও এমন দু—একটি দেশ আছে যেখানে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার স্বীকার না করা সত্ত্বেও দেশের শ্রীবৃদ্ধির কোনো বিশেষ ক্ষতি হয়নি। তার জন্য খুব বেশিদূর হিন্দুস্থান পর্যন্ত যাবার দরকার নেই, কাছেই ইতালির দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। ইতালিতেও সম্পত্তির ব্যক্তিগত অধিকার বিধিসম্মত নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইতালি ক্রমে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে। এতবড় সাম্রাজ্য ইতালির এবং এত সমৃদ্ধ সব দেশ সেই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত যে বিনা চাষবাসেও তাদের উর্বরতাশক্তি নষ্ট হবে না। এরকম যার সাম্রাজ্য তার অবশ্য উন্নতির পথে কোনো অন্তরায় না থাকাই উচিত। তার শক্তি ও ঐশ্বর্য তো থাকবেই। কিন্তু এইদিক দিয়ে বিচার করলে তুরস্কের সামর্থ্য ও সম্পদ যে কত অল্প তা বলা যায় না। অথচ তুরস্কের প্রাকৃতিক সম্পদ অতুলনীয়। তুরস্কের সম্পত্তির অধিকার যদি আজ থাকত, সেখানকার মাটিতে যদি প্রচুর ফসল ফলত এবং বহু লোকজনের বাস হত, তাহলেও সেখানে আগেকার মতো সেনাবাহিনী গঠন করা সম্ভব হত না। কনস্টানটিনোপলের মতো শহরে পাঁচ—ছ হাজারের মতো সৈন্যসংখ্যা নিয়ে একটা বাহিনী গড়তে এখন প্রায় তিন মাস লাগে। তার কারণ কি? দেশের লোকের শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে, লোকশূন্য হয়ে গেছে দেশ এই নীতির জন্য। তুরস্কের সাম্রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সর্বত্র আমি নিজে ভ্রমণ করে স্বচক্ষে দেখেছি তার চরম দুরবস্থা। কল্পনা করা যায় না তার ভয়াবহতা। যেখানে গেছি সেখানে দেখেছি ধ্বংসের চিহ্ন, ক্ষয়ের চিহ্ন, মৃত্যু, হতাশা ও নিষ্ক্রিয়তার চিহ্ন। কোনো প্রাণের সাড়া নেই কোথাও। লোকালয় প্রায় জনশূন্য। তুরস্কের একটা বড় সম্পদ হল, চতুর্দিক থেকে বন্দি করে আনা খ্রিস্টান ক্রীতদাসদের দল। কিন্তু কেবল ক্রীতদাসের মেহনতে কি হবে? যদি আরও কিছুকাল তুরস্কের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী রাজত্ব করেন, তাহলে তুরস্কের নিশ্চিত ধ্বংস সম্বন্ধে আমি জোর গলায় ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারি। কোনো সম্ভাবনা নেই তুরস্কের মতো দেশের উন্নতির ও অগ্রগতির। পুনরুজ্জীবনের কোনো আশা নেই তার। আভ্যন্তরিক দুর্বলতায় তুরস্কের পতন অবশ্যম্ভাবী, যদিও এখন মনে হয় যেন এই দুর্বলতাই তুরস্কের জীবনশক্তি যোগাচ্ছে। কারণ এখন আর এমন কোনো গভর্নর নেই তুরস্কে যিনি কোনো কিছু পরিকল্পনা কার্যকরী করার মতো অর্থের সংস্থান করতে পারেন, এবং করলেও তার জন্য যে লোকের প্রযোজন তা সংগ্রহ করতে পারেন। দেশকে বাঁচিয়ে রাখার, সাম্রাজ্য রক্ষা করার এ এক বিচিত্র পদ্ধতি। দেখা যায় না কোথাও। তুরস্ক তার নিজের মধ্যেই ধ্বংসের বীজ বহন করে চলেছে। লোকসাধারণের মধ্যে সমস্ত রকমের আন্দোলনের স্পন্দন বন্ধ করতে গিয়ে তুরস্ক কতকটা সেই পেগুর কুখ্যাত রাজার মতো আচরণ করছে বলা চলে।১২ পেগুর রাজা তাঁর রাজ্যরক্ষার জন্য রাজ্যের প্রায় অর্ধেক প্রজাকে দুর্ভিক্ষে ও অনহারে মেরে ফেলেছিলেন, সারা দেশটাকে জঙ্গলে পরিণত করেছিলেন এবং দীর্ঘকালের জন্য চাষবাসের কোনো সুযোগ পর্যন্ত দেননি প্রজাদের। তাতেও তিনি কৃতকার্য হননি। রাজ্যকে ভাগ করা হল শেষ পর্যন্ত। অবশ্য এমন কথা আমি বলছি না যে হঠাৎ কয়েকদিনের মধ্যেই তুরস্কের পতন হবে এবং তুরকি সাম্রাজ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। তা হয়তো যাবে না, কারণ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলিও এমন শক্তিশালী নয় যে তুরস্কের বিরুদ্ধে তারা সামরিক অভিযান করতে পারে। আত্মরক্ষা করারও শক্তি নেই তাদের, বিদেশির সাহায্য ভিন্ন। এইদিক দিয়ে তুরস্কের নিরাপত্তা ক্ষুণ্ণ হবার কোনো আশঙ্কা নেই। কারণ বিদেশি রাষ্ট্রগুলি তুরস্কের প্রতিবেশী শত্রুদের সন্দেহের চোখে দেখে এবং প্রয়োজনে বা বিপদে—আপদে কোনো সাহায্যই তারা করবে না। নিজের দুর্বলতায়, নিজের শক্তি অপচয়ের দোষে, নিজের অদূরদর্শিতা ও কুনীতির জন্য তুরকি সাম্রাজ্য ধ্বংস হবে।

বিচারের সুযোগ

আপনি হয়ত ভাবতে পারেন যে প্রাচ্যদেশে সাধারণ লোক সুবিচারের জন্য আইনের সাহায্য নিতে পারবে না কেন? কেন তারা উজির১৩ বা প্রধানমন্ত্রী ও সম্রাটের কাছে তাদের অভিযোগ, আবেদন নিবেদন করতে পারবে না? বাধা কোথায়? বিচারের কোনো বিধানই যে নেই সেখানে তা তো নয়! স্বীকার করি, আছে। আইনকানুন, বিধিবিধান কিছুই যে এশিয়াতে নেই তা নয়, আছে এবং এও স্কিকার করি যে সুষ্ঠুভাবে সেইসব বিধান মেনে চললে বা প্রয়োগ করলে এশিয়া পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চল থেকে কম উপভোগ্য হবে না, বসবাসের দিক থেকে। কিন্তু শুধু ভাল ভাল বিধান থাকলেই তো হয় না, এবং মনে মনে সদিচ্ছা থাকলেও কোনো লাভ নেই। কার্যক্ষেত্রে যথাসময়ে সেগুলি প্রয়োগ করা দরকার এবং তার সাহায্য নেওয়ার সুযোগ দেওয়াও প্রয়োজন। তা যদি না করা হয় বা না দেওয়া হয়, তাহলে হাজার বিধান থাকা সত্ত্বেও ন্যায়বিচারের কোনো আশা নেই।

প্রাদেশিক গভর্নর বা সুবাদাররা অন্যায় করেন, অত্যাচার করেন, ক্ষমতার অপব্যবহার করেন পদে পদে, কিন্তু সেই একই উজির বা একই সম্রাট কি তাঁদের প্রত্যেকবার ওই পদে নিয়োগ করেন না? সুবাদাররা কি তাঁদেরই মনোনীত ব্যক্তি নন? এই সম্রাট ও উজিরই হলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, ন্যায়—অন্যায়ের প্রধান বিচারক। অত্যাচারী শাসনকর্তা ছাড়া অন্য কোনো প্রকৃতির লোক নিয়োগ করার সাধ্যও নেই তাদের। তার কারণ, হয় সম্রাট, না হয় তাঁর উজির রাজ্যটিকে একরকম বিক্রি করে দেন বলা চলে। যিনি বেশি উপঢৌকন দেন, ভেট পাঠান, প্রাদেশিক শাসনকর্তা তাঁকেই তাঁরা নিয়োগ করেন। আর যদিও স্বীকার করা যায় যে তাঁরা অভিযোগ শুনতে রাজি আছেন, তাহলেও কোনো দরিদ্র চাষি বা অসহায় কারিগরের পক্ষে অত দূরে রাজধানীতে গিয়ে বিচারের জন্য হাজির হওয়া সম্ভব নয়। শত শত মাইল দূরে রাজধানীতে যাওয়ার খরচ যোগাবে কে তাদের? পায়ে হেঁটে যে তারা যাবে, তারও উপায় নেই, কারণ শেষ পর্যন্ত সশরীরে পৌঁছবে কি না তা বলা যায় না। পথে হয়তো খুনে চোরডাকাতের হাতেই তাদের প্রাণটা যাবে। পথেঘাটে প্রায় এরকম ঘটে থাকে হিন্দুস্থানে। যদিও বা কোনোরকমে গিয়ে রাজধানীতে পৌঁছায়, সেখানে গিয়ে দেখবে তার পৌঁছানোর আগেই, যাঁর বিরুদ্ধে তার অভিযোগ তিনি নিজে সম্রাটের কাছে সমস্ত ব্যাপারটা বিবৃত করেছেন এবং তাঁর বিবৃতির মধ্যে আসল সত্যকে যতদূর বিকৃত করা সম্ভবপর, তাও তিনি করতে কুণ্ঠিত হননি। তার পরে তার পক্ষে কোনো আবেদন বা অভিযোগ করাও যা, না করাও তাই। মোটকথা, সুবাদারই সর্বময় কর্তা। তিনি হর্তাকর্তা—বিধাতা। বিচারক, আদালত, আইন সভা, খাজনা আবওয়াব নির্ধারণ ইত্যাদি সর্বব্যাপারের তিনি সর্বময় অধীশ্বর। এই শ্রেণির শোষক ও অত্যাচারী প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের সম্বন্ধে একজন পারসি ভদ্রলোক বলেছিলেন যে, সুবাদাররা শুকনো বালি থেকে তেল নিঙড়ে বার করেন। কথাটা মিথ্যা নয়। স্ত্রীপুত্র ক্রীতদাস রক্ষিতা মোসাহেবি নিয়ে সুবাদারদের যে বিশাল পোষ্যসংখ্যা, তাতে তাঁদের নির্দিষ্ট উপার্জিত অর্থে কুলোয় না।

যদি কেউ বলেন যে আমাদের দেশের সম্রাটেরও তো জমিদারি আছে এবং সেই জমিদারিতে চাষবাস হয় ভালোভাবে, যথেষ্ট লোকজন বাস করে, তাহলে তার উত্তরে আমি বলব, যে—রাজ্যের রাজা অন্যান্য আরও অনেকের মতো জাতীয় ভূসম্পত্তির সামান্য একাংশের মালিক, তাঁর সঙ্গে, যিনি সমস্ত সম্পত্তির মালিক, এমন কোনো সম্রাটের তুলনা হতে পারে না। ফ্রান্সে এমন সুন্দর আইন প্রণয়ন করা হয়েছে যে সম্রাট নিজেই তা সর্বপ্রথম মান্য করে চলেন। তিনি যে ভূসম্পত্তির মালিক, সেখানেও তিনি সম্রাট বলে আইনকানুন অমান্য করে মালিকানা খাটাতে পারেন না। তাঁর জমিদারির প্রত্যেকটি লোকের আইন—আদালতের সাহায্য নেবার ন্যায্য অধিকার আছে এবং প্রত্যেক চাষি ও কারিগরের অন্যায়ের প্রতিকার করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু এশিয়ায় তা নেই। এশিয়ায় দুর্বল ও অসহায়ের কোনো আশ্রয় নেই। আদায় ও অবিচারের প্রতিকার করার কোনো পন্থা বা সুযোগ নেই তাদের। একজন অত্যাচারী শাসকের চাবুক ও মর্জিই সেখানে একমাত্র ন্যায়দণ্ড, তার উপরে আর কিছু নেই।

কেউ কেউ হয়তো বলবেন, এইরকম এশিয়ার মতো, একজন রাজার ও শাসনকর্তার একনায়কত্ব যেখানে প্রতিষ্ঠিত, সেখানে সুবিধাও আছে অনেক। সেখানে আইনজীবী উকিলের সংখ্যা অল্প, মামলা—মোকদ্দমার সংখ্যাও বেশি নয়। সামান্য যা হয়, তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়ে যায়। বিলম্বিত বিচারের চেয়ে দ্রুত বিচার অনেক ভাল। দীর্ঘস্থায়ী মামলা—মোকদ্দমা যে—কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে যে মারাত্মক ক্ষতিকর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং রাজার কর্তব্য এই ধরনের মামলা—মোকদ্দমার দ্রুত নিষ্পত্তির একটা ব্যবস্থা করা। একথা আমি স্বীকার করি। একথাও ঠিক যে ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার যদি কেড়ে নেওয়া যায়, তাহলে আইন—আদালত বা মামলা—মোকদ্দমার ঝঞ্ঝাটও অনেক কমে যায়। ‘আমার’ ‘তোমার’ এই অধিকার যদি হরণ করে নেওয়া যায় একবারে, তাহলে মামলার সমস্যাও সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়, বিশেষ করে দীর্ঘকালস্থায়ী মামালার কোনো চিহ্নই থাকে না। সম্রাট যেসব ম্যাজিস্ট্রেট বা হাকিম নিয়োগ করেন, তাঁদের অধিকাংশরই তাহলে আর কোনো কাজ থাকে না এবং অসংখ্য আইন ব্যবসায়ীরও আর কোনো প্রয়োজন হয় না। কিন্তু একথাও ঠিক যে, এইভাবে যদি মামলা—মোকদ্দমার ব্যাধির চিকিৎসা করতে হয়, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার কেড়ে নিয়ে যদি সমাজকে মামলামুক্ত করতে হয়, তাহলে ব্যাধির তুলনায় প্রতিষেধক অনেক বেশি ক্ষতিকর হবে। সে ক্ষতির কোনো খতিয়ান করা সম্ভব হবে না। হাকিমের বদলে আমাদের সম্রাট—নিযুক্ত প্রাদেশিক শাসকের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে এবং সেই নির্ভরতা যে কি ভয়াবহ তা আগে বলেছি। এশিয়ায় সুবিচার বলে যদি কোনো পদার্থ থাকে তাহলে তা একমাত্র দরিদ্র নিম্নশ্রেণির লোকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। কারণ সেক্ষেত্রে কোনো পক্ষই মিথ্যা সাক্ষীসাবুদ পয়সা দিয়ে কিনে হাকিমকে প্রভাবান্বিত করতে পারে না। দুইপক্ষই সমান দরিদ্র ও অসহায় বলে হাকিম অনেকটা নিরপেক্ষ বিচার করতে পারেন। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে কোনো সুবিচারের আশা নেই। মিথ্যা জাল সাক্ষী পয়সা দিয়ে ধনীর পক্ষে কেনা সম্ভবপর এবং এরকম সাক্ষী সেখানে যথেষ্ট পাওয়া যায় সস্তায়, দীর্ঘকালের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে আমি এসব কথা বলছি। নানাদিক থেকে খোঁজ করে, নানাজনকে জিজ্ঞাসা করে আমি এই সব তথ্য অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেছি। শুধু হিন্দুস্থানের লোক নয়, সেখানকার ইয়োরোপীয় ব্যবসায়ী, রাজদূত, কনসাল, দোভাষী, প্রভৃতি সকলের মতামত যাচাই করে গ্রহণ করেছি প্রত্যেকটি তথ্য। আমার এই বিবরণের সঙ্গে, আমি জানি, অন্যান্য অনেক পর্যটকদের বিবরণ মিলবে না। তাঁরা হয়ত কোনো শহরের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কাজির সামনে দুজন অপোগণ্ড লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। দেখেছেন হয়ত, হাকিম তাদের ‘মুসালিহ বাবা’ (শান্তিতে থাকো, বাবা) বলে বিদায় দিচ্ছেন। দুই পক্ষের কোনো একপক্ষেরও যদি ঘুষ দেবার ক্ষমতা না থাকে এবং দুইপক্ষই যদি সমান দরিদ্র হয়, তাহলে অনেক সময় কাজিরা এইরকম বিচারই করে থাকেন। ‘শান্তিতে থাকো, বাবা’ বলে তাদের জলদি বিদায় করে দেন। অন্যান্য পর্যটকরা এইরকম কাজির বিচার দেখে বাইরে থেকে হতবাক হয়ে গেছেন, ভেবেছেন এরকম সুন্দর বিচার আর হয় না। বিচার তো বিচার, কাজির বিচার! কিন্তু ভিতরে তাঁরা একেবারেই তলিয়ে দেখেননি। যদি দেখতেন, তাহলে দেখতে পেতেন কাজির বিচার সত্যই কি! দুইপক্ষের মধ্যে একপক্ষের যদি দুটো টাকা কাজির ট্যাঁকে গুঁজে দেবার সাধ্য থাকত, তাহলেই কাজির বিচার অন্যরকম হয়ে যেত। ‘শান্তিতে থাকো, বাবা’ বলে তখন তিনি আর দুইপক্ষকেই বিদায় করে দিতেন না। বেশ ধীরে—সুস্থে দীর্ঘকাল ধরে বিচার করতেন এবং যেপক্ষ ‘কিঞ্চিৎ’ দিয়েছে, মিথ্যা সাক্ষীসাবুদ যোগাড় করেছে, সেই পক্ষেরই সমর্থনে তিনি বিচক্ষণের মতন রায় দিতেন।

অবশেষে এই কথা বলে আমি এইপত্র শেষ করতে চাই : ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকার হরণ করার অর্থ হল—অন্যায়, অত্যাচার, দাসত্ব, অবিচার, ভিক্ষাবৃত্তি ও বর্বরতার পথ পরিষ্কার করা। মানুষ তাহলে জমিতে আবাদ করে ফসল ফলাবে না এবং পরিত্যক্ত মরুভূমিতে পরিণত হবে দেশ। সম্রাটের সর্বনাশের পথ, রাজ্যের ধ্বংসের পথ প্রশস্ত হবে। এই ব্যক্তিগত সম্পত্তিই হল মানুষের একমাত্র আশাভরসা প্রেরণা, যাতে মানুষ উদবুদ্ধ হয়ে ওঠে। মানুষ তার মেহনতের ফলভোগ করবে নিজে, এবং সেই ভোগের অধিকার দিয়ে যাবে তার বংশধরদের, এই হল মানুষের কামনা। এই কামনা চরিতার্থ হয় বলেই মানুষের হাতে পৃথিবীর রূপ বদলে যায়, সুন্দর হয়ে ওঠে পৃথিবী। যে—কোনো দেশের দিকে চেয়ে দেখলেই বোঝা যায়, যেখানে এই অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়নি সেখানে দেশের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে এবং যে—দেশে এই পবিত্র অধিকার থেকে মানুষ বঞ্চিত, সে—দেশ ক্রমে শ্রীহীন হয়ে ধ্বংস হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির জাদুস্পর্শেই পৃথিবীর পরিবর্তন হয়, নতুন রূপ ধারণ করে পুরনো পৃথিবী।

……………

* দিল্লির পাঠান সুলতানেরা ১১৯২ খ্রিঃ অঃ থেকে ১৫৫৪ খ্রিঃ অঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর রাজত্বকালের মধ্যে ছয়টি রাজবংশ ও চল্লিশজন রাজা রাজত্ব করেন। কখনো তাঁদের রাজ্যের সীমানা পূর্ববঙ্গের প্রান্ত থেকে কাবুল কান্দাহার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, কখনও বা তাঁরা কয়েকটি জেলার অধীশ্বর ছিলেন মাত্র দেখা যায়।—অনুবাদক

* আরবি ও ফারসি ভাষায় ‘মনসব’ কথার অর্থ ‘office’ বা ‘পদ’। ‘মনসবদার’ কথার অর্থ ‘অফিসার’ বা পদস্থ কর্মচারী। আকবর বাদশাহ মনসবদারের সংখ্যা ৬৬ জনের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন (ব্লকম্যান অনুদিত ‘আইন—ই—আকবরী’—প্রথম খণ্ড)।

১। ‘বরাত’ কতকটা আধুনিক কালের ‘pay order’-এর মতন। ঠিক একালের ব্যাঙ্কের চেকের মতন না হলেও, ‘বরাত’কে অনেকটা মোগলযুগের চেকও বলা যায়। কি কাজের জন্য কত টাকা দেওয়া হচ্ছে, বরাতে তাই লেখা থাকত এবং বাদশাহের স্বাক্ষরসহ মোহরাঙ্কিত থাকত প্রত্যেকটি ‘বরাত’। অনেক হাত ঘুরে অনেক কর্মচারীর স্বাক্ষর—চিহ্নিত হয়ে, তবে বরাতের বিনিময়ে নগদ টাকা পাওয়া যেত। ‘বরাত’ সম্বন্ধে ‘আইন—ই আকবরী’ গ্রন্থে বলা হয়েছে যে, রাজার কারখানার কারিগরদের এবং পিলখানা, অশ্বশালা, উষ্ট্রশালা ইত্যাদি বিভাগের কর্মচারীদের বরাতের মারফত বেতন দেওয়া হত। বরাতের হিসেব দেখে দেওয়ান তন্খার ব্যবস্থা করে দিতেন এবং পাশে লিখে দিতেন ‘বরাত—নবীসন্দ’। মুস্তফী মূলরেফ তাই দেখে একটি ‘কবচ’ তৈরি করে দিতেন; ‘কবচ’ কথাটি ফারসি, কথা, অর্থ হল কর বা হাতের তালু। কবচ থেকে কব্জা কথা এসেছে। কবচপত্র পেলে বোঝা গেল, উদ্দেশ্য হস্তগত হয়েছে। ‘কবচ’ কতকটা ‘প্রমিসারী নোট’ ও ‘রসিদে’র সংমিশ্রণ বলা চলে। এখন জমিদাররা ‘কবচ’ বা দাখিলা দিয়া থাকেন, কিন্তু বাদশাহী আমলে কবচ একালে গভর্নমেন্ট নোটের মতো ব্যবহৃত হত।

 যাই হোক, মুস্তফি কবচ করে দেয়, তাতে দেয় টাকার কথা লেখা থাকে। সেই টাকার এক চতুর্থাংশ কেটে নেওয়া হয়। পরে কবচ ও বরাত উভয়পত্রে তৌজীনবীশ, মুস্তফি, নাজির, দেওয়ান, উকিল প্রভৃতি সকলে দস্তখত করেন। তারপর বাদশাহের পাঞ্জা ও মোহরের ছাপ পড়ে। পাঞ্জামোহরের পাশে লেখা থাকে, কোন শ্রেণির মুদ্রার টাকা দেওয়া হবে। —অনুবাদক 

২। মোগল বাদশাহের আমলে যুদ্ধের অশ্ব চিহ্নিত করা হত এবং তাদের সাত ভাগে ভাগ করা হত সাধারণত। যেমন—আরবি, ইরাকি, মোজন্নস, তুরকি, ইয়াবু, তাজি ও জঙ্গলি। যারা আরবি অশ্বারোহী তাদের বেতন ছিল প্রায় ৮০০ দাম (৫৫ দামে এক টাকা)। যারা ইরাকি অশ্বারোহী, তাদের বেতন ছিল ৬০৮ দাম, মোজন্নস অশ্বারোহীদের ৫৬০ দাম (ইরাকি ও তুরকি অশ্বের সংমিশ্রণ জাতকে মোজন্নস বলা হত), তুরকি অশ্বারোহীদের ৪৮০ দাম, ইয়াবুদেরও ৪০০ দাম। তাজি ও জঙ্গলি ভারতবর্ষের অশ্ব। অশ্বারোহীদের বেতন ছিল ৩২০ দাম এবং জঙ্গলি অশ্বারোহীদের ২৪০ দাম। যারা টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে সংবাদবাহকের কাজ করত, তারা ১৪০ দাম বেতন পেত। (‘আইন—ই—আকবরী’ থেকে সংগৃহীত)।

* বিদেশি ইয়োরোপীয়দের সংস্রবে ভারতীয় গোলন্দাজবাহিনী গড়ে ওঠার এই ইতিহাস প্রণিধানযোগ্য।

৩। আকবর বাদশাহের রাজত্বকালে ডাকহরকরা, কুস্তিগীর, পালকি—বেহারা ভিস্তি প্রভৃতি সকলকেই পদাতিক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হত।

৪। তাঁবু অনেক রকমের ছিল বাদশাহী আমলে। ‘আইন—ই—আকবরীতে তার খানিকটা বিবরণ পাওয়া যায়। আকার ও রকমভেদে তাঁবুর নাম ছিল নানারকম, যেমন—বরগা, চৌবীনরৌতি, ডুরাসনা—মঞ্জেল, খটগা, সরাপর্দা, সামিয়ানা ইত্যাদি। ‘বরগা’ বিরাট তাঁবু, নিচে অন্তত দশ হাজার লোক দাঁড়াতে পারত। ‘বরগা’ তাঁবু এক হাজার লোক সাতদিনে খাটাতে পারত। ‘চৌবীনরৌতি’ দশটা খুঁটির উপর টাঙানো হত। তাঁবুর নিচে খসখসের চাল দেওয়া থাকত এবং সঙ্গে খসখস ও বেণা বোনা থাকত। খসখসের বেড়ার উপর ভাল কিংখাব ও মখমল আঁটা থাকত। উপরে চাঁদোয়ার মতো নাল সুলতানী বনাত দেওয়া হত। চৌবীনরৌতি তাঁবু টাঙাবার জন্য রেশমের ও তসরের দড়ি ব্যবহার করা হত। দোতলা তাঁবুর নাম ছিল ‘ডুরাসনামঞ্জেল’, আট—নটা খুঁটির উপর দাঁড় করানো। উপর তলায় বাদশাহ নমাজ পড়তেন, নিচের তলায় বেগমরা থাকতেন। (‘আইন—ই আকবরী’ থেকে সংকলিত)—অনুবাদক।

৫। মোগল বাদশাহরা পানি—বিশারদও ছিলেন। পানীয় জল, স্নানের জল ইত্যাদি সম্বন্ধে তাঁদের বিলাসিতার দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ‘আইন—ই—আকবরী’তে এ—সম্বন্ধে চমৎকার বিবরণ আছে। সরকারি দফতরখানায় একটি স্বতন্ত্র বিভাগই ছিল, যার কাজ ছিল পানীয় জল ঠাণ্ডা করা ও বরফ আমদানি করা ইত্যাদি সম্বন্ধে তদারক ও ব্যবস্থা করা। সেই বিভাগের নাম ছিল—’আবদারখানা’। সাধারণত সোরা দিয়ে বাদশাহের পানীয় জল ঠান্ডা করা হত। বালি ও মাটির তৈরি কুঁজোতে জল ভরে, তার মুখে ভিজে কাপড় বেঁধে একটা বড় গামলায় রাখা হত। সেই গামলায় জল থাকত এবং তাতে প্রচুর পরিমাণে সোরা মেশানো থাকত। কুঁজোর গলায় তিনপাক রেশমের দড়ি দিয়ে, ঠিক যেমন করে মন্থনদণ্ড ঘোরানো হয়, তেমনি করে কুঁজো ঘোরানো হত। খানিকক্ষণ ঘোরালেই কুঁজোর জল খুব ঠান্ডা হত। একে ‘গড়গড়ি’র জল বলত। ‘হর্ষচরিতে’ এর বিস্তৃত বিবরণ আছে। বাদশাহের পাকশালায় গঙ্গা ও যমুনার জল ব্যবহার করা হত। পাঞ্জাবের কাছে থাকলে হরিদ্বার থেকে জল আনা হত, আগ্রায় থাকলে জল আসত প্রয়াগ থেকে। হিমালয়ের কাছ থেকে বরফও আমদানি করা হত। (‘আইন—ই—আকবরী’ থেকে সংগৃহীত)—অনুবাদক।

৬। হারেম বা বেগমখানারও সুন্দর বিবরণ আছে ‘আইন—ই—আকবরী’তে। চারিদিকে উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হারেম, তার মধ্যে এক—এক দল বেগমের জন্য এক—একটা মহল তৈরি থাকে। দু তিনটি মহলের মধ্যে একটি করে বাগান, পুষ্করিণী ও ইঁদারা। আকবর বাদশাহের কিঞ্চিদধিক পাঁচ হাজার বেগম ও সেবিকা ছিল। এক—এক দল বেগমের উপর একজন স্ত্রী—দারোগা নিযুক্ত থাকত। দারোগাদের যে সর্দার, তাকে হারেমকর্ত্রী বলা হত। বেগমদের প্রত্যেকের মাসহারা ঠিক থাকত। বয়স ও রূপগুণানুসারে এক হাজার আটশ টাকা মাসহারা ছিল তাদের। সেবিকাদের পঞ্চাশ থেকে দুশ টাকা পর্যন্ত বেতন ছিল।—অনুবাদক।

৭। বার্নিয়েরের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ শক্তি দেখে বাস্তবিকই আশ্চর্য হতে হয়। মোগল বাদশাহের একটি ‘রত্নাভাণ্ডার’ ছিল। রত্নভাণ্ডারের কোষাধ্যক্ষের নাম ‘তেপকচী’। একজন জহুরি দারোগাও থাকতেন। চুনী, পান্না, হীরা, নীলা প্রভৃতি নানারকমের মণিমাণিক্য ভাণ্ডারে সঞ্চিত থাকত।—অনুবাদক

৮। আধুনিক কিনেসিয়ান অর্থনীতির (Keynesian Economics) ছাত্রদের কাছে বার্নিয়েরের এই মন্তব্য রীতিমতো বিস্ময়ের উদ্রেক করবে। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, অর্থাৎ প্রায় তিনশ বছর আগে, বার্নিয়ের ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে গিয়ে তার অর্থনৈতিক অবস্থার এই বিশ্লেষণ করেছিলেন। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গীতে যদি আজও কেউ মধ্যযুগের ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাস লেখেন, তাহলে বার্নিয়েরের এই বিশ্লেষণ থেকে তিনি যথেষ্ট মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত পেতে পারেন। আধুনিক অর্থনীতির ছাত্ররা জানেন ‘Saving’, ‘Spending’, ‘Consumption’ ও ‘National Income’-এর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক কি, এবং ‘Consumption curve’ কাকে বলে। তিনশ বছর আগে বার্নিয়ের এইসব বৈজ্ঞানিক পরিভাষার তাৎপর্য না জেনেও বিশ্লেষণের মধ্যে বিস্ময়কর বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিয়েছিলেন।—(অনুবাদক।)

৯। সামাজিক ক্রমবিকাশের ইতিহাসে ‘ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারে’র একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রত্যেক সমাজবিজ্ঞানী সেকথা স্বীকার করবেন। বার্নিয়ের এইখানে চমৎকারভাবে সেই ভূমিকার আভাস দিয়েছেন। তাঁর অসাধারণ পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণশক্তি দেখলে অবাক হতে হয়।

১০। প্রাচীন হিন্দুযুগ থেকে ব্রিটিশযুগের আগে পর্যন্ত ভারতীয় বণিকশ্রেণির বিকাশের ইতিহাস নিয়ে আজও অর্থনীতির বা ইতিহাসের কোনো ছাত্র গবেষণা করেননি। অথচ ভারতীয় বণিক শ্রেণির ক্রম—বিকাশের ধারা বিশেষভাবে অনুসন্ধানের বিষয়। ভারতীয় বণিকরা দেশে—বিদেশে বাণিজ্য করতেন এবং বাণিজ্যের দৌলতে যথেষ্ট অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হল না, কেন এদেশে শিল্প—বাণিজ্যের যুগের আবির্ভাব হল না, কেন বণিকরা যুগে—যুগে সমাজের উপেক্ষার পাত্রই হয়ে রইলেন, এ সব প্রশ্ন ইতিহাসের দিক দিয়ে জটিল প্রশ্ন। বার্নিয়ের এই জটিল প্রশ্নের উত্তর দেবার চেষ্টা করেছেন এখানে এবং বিস্ময়কর বিশ্লেষণশক্তির পরিচয় দিয়েছেন।

১১। ‘ওয়াকি’ কথার অর্থ ‘ঘটনা’ বা ‘সংবাদ’। ‘ওয়াকিবনবিশ’ অর্থে যিনি ঘটনার খোঁজ রাখেন, হিসাব রাখেন। উইলসনের অভিধানে ‘ওয়াকিবনবিশ’ সম্বন্ধে এই বিবরণ দেওয়া হয়েছে :

‘A remembrancer, a recorder of events : and officer on the royal establishment under the Moguls, who kept a record of the various orders issued by and transactions connected with, the sovereign, in the revenue department : an officer of this denomination was also attached to the Nazim or provincial governor, who reported to the principal remembrancer at the court the particular revenue transactions of the province : any communicator of official intelligence’– Wilson’s Glossary.

ওয়াকিবনবিশ বাদশাহের সমস্ত হুকুম লিখে নেন, বাদশাহের রোজনামচা লিখে থাকেন, বাদশাহের কাছে রোজ যেসব আবেদন অভিযোগ উপস্থিত হয় তার হিসাব রাখেন। এছাড়া বাদশাহের পানাহারের ব্যবস্থা, তাঁর হারেমে যাবার ব্যবস্থা, বরগাখাসে যাবার ব্যবস্থা, শিকারের উদযোগ ইত্যাদি করেন, এবং নজর, ফরমান, হুকুম ইত্যাদির হিসাব রাখেন। রাষ্ট্রের ভিতরের ও বাইরের বিবরণপত্র পাঠ করা, কোন দেশে কার সঙ্গে কিভাবে সন্ধি হল তার স্মারকলিপি লিখে রাখা, রাজ্যের মধ্যে কোথায় কি ঘটল তার বিবরণ রাখা, এইসব হল ওয়াকিবনবিশের কাজ। ওয়াকিবনবিশ প্রতিদিন একটি রোজনামা লিখে এনে বাদশাহকে পড়ে শোনান এবং বাদশাহ মঞ্জুর করলে তাতে মোহর দিয়ে দস্তখত করেন। এই দস্তখতী কাগজকে ‘ইয়াদদস্ত’ বা ‘স্মারকলিপি’ বা ‘মেমরেন্ডাম’ বলে। (‘আইন—ই—আকবরী’ থেকে সংগৃহীত)।

১২। বার্নিয়ের নিজের পাণ্ডুলিপিতে ‘Brama’ কথাটি আছে। ফার্ডিনান্ড মেন্ডেজ পিন্টো ১৫৪২—৪৫ সালে পেগু ভ্রমণ করেন এবং তদানীন্তন পেগুর রাজাকে তিনি ‘Brama’ বলে বর্ণনা করেছেন। পেগুর এই সম্রাট ১৫৩৯ সালে তার অনেক রাজভক্ত উচ্চপদস্থ কর্মচারীকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন, অকথ্য অত্যাচার করেন সাধারণ প্রজাদের উপর এবং তাঁর ভয়ে দেশের লোকজন দেশত্যাগ করে। বার্নিয়ের বোধ হয় এই ঘটনারই উল্লেখ করেছেন।—অনুবাদক।

১৩। ‘উজির’ হলেন মোগলযুগের ‘প্রধানমন্ত্রী’। এই পদমর্যাদার সঙ্গে অবশ্য বিশেষ কোনো নির্দিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের সম্পর্ক নেই। সাধারণত তিনি রাজস্ববিভাগের প্রধান বলে গণ্য হতেন এবং তখন তাঁকে ‘দেওয়ান’ বলা হত। দেওয়ান মাত্রই অবশ্য ‘উজির’ ছিলেন না, বিশেষ করে হিন্দু দেওয়ানদের ‘উজীর’ বলা হত না। আকবর বাদশাহের রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রীকে বলা হত ‘উকিল’ (Wakil) এবং অর্থমন্ত্রীকে বলা হত ‘উজির’ (Wazir)।

 পণ্ডিতরা ‘উজির’ কথার উৎপত্তি পহ্লবী শব্দ ‘বিচির’ (সংস্কৃত ‘বিচার’?) থেকে হয়েছে মনে করেন, মানে যিনি বিচারক। প্রথম যুগের খলিফাদের শাসনকালে ‘সেক্রেটারি অফ স্টেট’কে বলা হত ‘কাতিব’ বা লেখক। আব্বাসিদরা পারসিদের কাছে শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেক দিক থেকে ঋণী এবং তাঁরাই প্রথম ‘উজির’ কথাটি ব্যবহার করেন। ক্রমে উজির পত্রলেখক থেকে ট্রেজারির প্রধান হন এবং আবেদন—নিবেদনের বিচারক হয়ে ওঠেন। অটোমান তুরকিদের রাজত্বকালে প্রায় ‘সাতজন’ উজির ছিলেন। “As a rule , Wazir in later times was simply a title of the high officials” (Encyclopaedia of Islam, V. 1135)

 ‘উজির’ সম্বন্ধে আচার্য যদুনাথ সরকার বলেছেন : ‘Originally, the Wazir the highest officer of the revenue department, and in the natural course of events control over the other departments gradually passed into his hands. It was only when the king was incompetent, a pleasure-seeker or a minor, that the Wazir controlled the army also …. It was only under the degenerate descendants of Aurangzib that the Wazirs became virtual rulers of the state, like the Mayors of the Palace in mediaeval France.’ (Jadunath Sarkar : Mughal Administration : p. 20-21)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *