২. চপল আর স্বাধীন

চপল আর স্বাধীন শরীর থেকে বড় কাগজের ঠোঙা দুটো খুলে ফেলে। অনেক বড় কাগজের ঠোঙা, মানুষের সমান সাইজ, উল্টো করে পরেছিল তারা। চোখের কাছে ফুটো ছিল দুটো করে, কাজেই এটা পরেও চলতে অসুবিধা হয়নি। এই ঠোঙা পরা অবস্থায় চপল দেখছিল স্বাধীনকে, স্বাধীন চপলকে, একে অন্যকে দেখে চমকেই উঠেছিল। সত্যি, দেখতে মুণ্ডুহীন মানুষের মতোই লাগছে।

এই ঠোঙার বুদ্ধি চপলের। সে-ই দুটো বড় ঠোঙা বানিয়ে এনে রেখেছিল গাড়ির পেছনে লুকিয়ে। জাহিন ছেলেটা গোবেচারা ধরনের, তাকে ভয় দেখানোর মাহাত্ম্যই আলাদা।

কিন্তু স্বাধীন তো নিজেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

একটা ঠোঙা নিজের গায়ে চাপিয়ে আরেকটা স্বাধীনের মাথায় চাপাতে চাপাতে চপল তাকে বলছিল, এই গাধা, তুই আবার ভয় পাচ্ছিস কেন?

স্বাধীন ভয় পাওয়া গলায় বলছিল, ওই লোকটা…

কোন লোকটা?

ওই লোকটা। কোট-প্যান্ট পরে যে কিনা ইংরেজিতে ভিক্ষা চায়।

একটা ফকিরকে দেখে ভয় পেয়ে গেলি?

ওটা ফকির। নাকি অন্য কিছু?

গাধা। পৃথিবীতে অন্য কিছু বলে কিছু নাই।

স্বাধীনও সে কথা বিশ্বাস করতে চায় বটে। কিন্তু এই নির্জন বনপ্রান্তে এই রকম সন্ধ্যাবেলা একটা কোট-প্যান্ট পরা লোক আসবেই বা কোত্থেকে, ভিক্ষাই বা চায় কেন? সে জিজ্ঞেস করেছিল, জাহিনের কী অবস্থা?

চপল বলেছিল, তুই সব জেনেশুনে ভয় পেয়ে যাচ্ছিস। আর ও তো আমাদের ষড়যন্ত্রের কিছুই জানে না। আর এমনিতেই জাহিন একটা ভিতুর ডিম। এখন কাদেরের যা যা অ্যাকটিং করার কথা যদি ঠিকভাবে করে থাকে, তাহলে জাহিন এতক্ষণে কাপড়চোপড় নষ্ট করে ফেলেছে।

চল, তাড়াতাড়ি চল। দেখি কী অবস্থা।

ততক্ষণে ওদের মুণ্ডুহীন প্রাণীর সাজ পরা হয়ে গেছে।

জাহিনকে তারা ভয় দেখায়। আর তাদের নির্দেশ ও পরিকল্পনামতো কাদের ঢিল ছুড়তে থাকে।

তাতেই জাহিন অজ্ঞান।

চপল আর স্বাধীন গাড়ির কাছে যায়।

গাড়ির দরজা খোলে। মাইক্রোবাসের মাঝখানে জাহিনের দেহখানা পড়ে আছে। নড়ছে না, চড়ছে না।

স্বাধীন বলে, সর্বনাশ, মরেটরে যায়নি তো।

চপল বলে, বুক তো ওঠা-নামা করছে। সে তার মোবাইল ফোন দিয়ে টর্চ জ্বালায়। জাহিনকে ধরে দেখে, না, মরেনি, মনে হয় ফিট হয়ে গেছে।

গাড়িতে পানির বোতল ছিল। তারা তার চোখে-মুখে পানির ছিটা দেয়। খানিক পরে জাহিনের জ্ঞান ফিরে আসে।

চপল আর স্বাধীন হাঁপ ছাড়ে। ব্যাটা যদি মরেটরে যেত, তাহলে কী কেলেঙ্কারিই না হতো!

জাহিনকে তারা অভয় দেয়। বলে, জাহিন, ভয় পাস না। ভয়ের কিছু ঘটে নাই। পরে বলব সব।

চপল হাঁক ছাড়ে, কাদের, গাড়ি স্টার্ট দাও। চলো। এখান থেকে গেস্টহাউসটা কত দূর?

কাদের বলে, আধা মাইল হইতে পারে।

সে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করে। স্টার্ট নেয় না।

সে বলে, আপনেরা হাঁইটা যান। আমি দেখি, গাড়ি কী করা যায়। নাইলে গেস্টহাউস থাইকা লোক পাঠান। গাড়ি ঠেইলা নিমু।

চপল বলে, কাদের, গাড়ি স্টার্ট দাও। চলো।

কাদের বলে, গাড়ি তো স্টার্ট নিতাছে না ভাইজান। আপনে দেখেন।

চপল বলে, চল, হেঁটেই যাই। জাহিন, হাঁটতে পারবি?

জাহিন বলে, একা একা থাকার চেয়ে হাঁটা সোজা। চল।

কাদের রয়ে যায় গাড়ির কাছে। গাড়ি পেছনে ফেলে রেখে সেই ঘুটঘুটে আঁধারের মধ্যে তারা পথ চলতে থাকে। জাহিনের অবস্থা এমনিতেই খারাপ। একটু আগেই সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল ভয়ে। এখনো তার শরীর ঠিক হয়নি। ভয়টা তাকে পেয়ে বসেছে। পথের ধারে জঙ্গল, অন্ধকার, বড় বড় গাছ, তাতে বাদুড়েরা পাখা ঝাপটাচ্ছে। মানবশিশুর গলায় কান্নার আওয়াজ আসছে। সে স্বাধীনের কাঁধে হাত রাখে। তার শরীরে ভর দিয়ে হাঁটে। স্বাধীনের শরীরের ওম তাকে কিছুটা সাহসও দেয় যেন।

রিসোর্টটা আসলে কাছেই। একটা মোড় ঘুরতেই গেস্টহাউসের গেটের আলো দেখা যায়।

তারা গেট খুলে ভেতরে ঢোকে। চিৎকার করে ওঠে চপল, এই কে আছ? ঢাকা থেকে ভিআইপি গেস্ট এসে গেছে।

তাদের স্বাগত জানান গেস্টহাউসের কেয়ারটেকার কাম দারোয়ান। কোমর বাঁকা একজন মানুষ। বয়স ৪০-ও হতে পারে, ৬০-ও হতে পারে। তিনি বলেন, আপনাদের আসতে দেরি হইল মুনে লয়।

চপল বলে, আমরা আসব আপনাকে তো আমরা বলি নাই।

দারোয়ান চপলের পিঠের ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে বলেন, খবর তো ঠিকই পাই।

স্বাধীন বলে, খবর তো পাবেনই। আচ্ছা আমাদের তিনজনকে তিনটা রুম দিচ্ছেন তো?

দারোয়ান বলেন, না। তিনজনরে একটা রুম দিতে হইব। আরেকটা রুমে আরও দুজন গেস্ট আইতাছে।

স্বাধীন বলে, তাহলেও তো আরেকটা রুম থাকবে।

জাহিন বলে, আমি আলাদা ঘরে থাকতে চাই না।

স্বাধীন বলে, আমি থাকতে চাই।

চপল বলে, ঠিক আছে। আমি আর জাহিন এক রুমেই থাকি।

জাহিন যেন ধড়ে জান ফিরে পায়—সে-ই ভালো। তবে আরও ভালো তিনজন এক রুমে থাকা।

চপল বলে, আচ্ছা দুটো রুম যখন পাওয়া যাচ্ছে নিয়ে নিই।

দারোয়ান রুম দেখিয়ে দেন। বাইরে থেকে গেস্টহাউসটাকে একটা পোড়াবাড়িই মনে হচ্ছিল। রুমগুলো খারাপ নয়। দুটো করে সেমি ডাবল বেড। সাদা চাদর, সাদা বালিশ। রঙিন কম্বল। তাতে কভার নেই, সেটাই একটু সমস্যা।

স্বাধীন বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। দেখতে পায়, হেডলাইট জ্বালিয়ে একটা গাড়ি ঢুকছে বাগানবাড়িটিতে।

কার গাড়ি?

গাড়ি পার্ক করে কাদের এগিয়ে আসে স্বাধীনের কাছে।

হাসিমুখে বলে, স্যার, আপনারা চইলা আইলেন। আর আমি চাবি ঘুরাইলাম। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি স্টার্ট নিল। কী তাজ্জব ব্যাপার। এইটা ভূতের বাড়ি তো। এইখানে কী কাণ্ডকারখানা যে ঘটব, কেউ এইটা আগে থাইকা কইতে পারে না।

স্বাধীন হাসে। সে জানে কাদের পুরোটাই অভিনয় করছে। তবু এই অন্ধকার বাগানবাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকটা যেন একটু কেঁপে ওঠে। ওই রহস্যময় ইংরেজি জানা ভিখারিটাকে তার সত্যি সত্যি অশরীরী কিছু বলেই মনে হয়!

কাদের দুই হাত কচলাতে কচলাতে বলে, স্যার, ৫০টা ট্যাকা দেন।

স্বাধীন বিরক্তিভরে বলে, কেন?

কাদেরের ওপরে বারান্দার হলুদ বাতির আলো পড়েছে, তার ছায়া মাটিতে, সে ছায়ার দিকে তাকিয়ে থাকে স্বাধীন। ছায়াটা নড়ে ওঠে, ছায়ার ঠোঁট নড়ে—স্যার। সব কাজের দাম আছে, খালি অভিনয়ের কি দাম থাকব না? কী রকম অভিনয় করতে হইতাছে। আপনাগো শিখায়া দেওয়া কথা কী রকমভাবে কইয়া যাইতাছি। আমার প্যাট ফাইটা হাসি আহে। হাসতে পারি না।

চপল যে আগে থেকে কাগজের ভূত বানিয়ে এনেছে, স্বাধীন তা জানত না। চপল তার পরিকল্পনাটা স্বাধীনকে জানায় রাস্তায়। পথের ধারে গাড়ি থামিয়ে তারা চা খায়। জাহিন একটু জঙ্গলের দিকে হাঁটতে যায় একা একা।

স্বাধীনকে একা পেয়ে জাহিন বলে, স্বাধীন। শোন। জাহিনটা তো বোকাসোকা আছে। আর ভিতু টাইপের। আমরা একটা কাজ করি। ওকে ভূতের ভয় দেখাই।

স্বাধীন বলে, আচ্ছা। খুব মজা হবে।

কাদের ছিল গাড়িতে, বলে, ভাইজান। ভালো মানুষরে ভয় দেখায়া মজা পাইয়া কী লাভ।

চপল বলে, মজা তো মজাই। শোনেন কাদের ভাই। আপনি আমাদের গেস্টহাউসটার কাছে গিয়ে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দেবেন। তারপর বলবেন, জায়গাটা ভালা না। নানা রকম ভূতপেতনির আসর আছে। আমরা যখন জিজ্ঞেস করব এখানে গাড়ির স্টার্ট কেন বন্ধ হলো, তারপর বলবেন, পাশেই একটা গেস্টহাউস আছে। যেইটা নাকি ভূতপ্রেতের আখড়া। আমরা দেখব জাহিনের রিঅ্যাকশনটা কী হয়। তারপর নানাভাবে ওকে ভূতের ভয় দেখাব। কী কাদের ভাই, পারবেন না?

কাদের বলে, চেষ্টা কইরা দেখি। জীবনটা অভিনয়ের ওপরেই রাখছি। সারাক্ষণ তো অভিনয়ই করতাছি।

স্বাধীন বলে, কী রকম?

কাদের বলে, এই ধরেন টাকার দরকার। মালিকরে কই গাড়ি গ্যারাজে নেওয়া লাগব। মালিক কয় তোমারে নিতে হইব না, আমি গ্যারাজে গিয়া বইয়া থাইকা কাম করামু। হে নিজেই বইয়া থাকল। বিল দিয়া গেল। আমি আবার মেকানিকের কাছে গিয়া হাজির হই। ওই মিয়া আমার ভাগ কই। ধরেন কাম মানে তো ফাঁকি। সে আমারে দিয়া দিল ফিফটি ফিফটি। বউরে গিয়া কই আজকা আইতে দেরি হইব। খ্যাপ লইয়া সিলেট যাই। আসলে তো ধরেন বইয়া বইয়া বন্ধুগো লগে তাস খেলতাছি। এই রকম কত অভিনয় যে করন লাগে।

চপল অভিভূত, বলে, আমি তো মুগ্ধ। কাদের ভাই। আপনার প্রতিভায় আমি মুগ্ধ। আপনাকেই আমরা খুঁজছি। আপনি ভূতের ভয় দেখাবেন। জাহিন হলো আমাদের টার্গেট। ওরে নাকানিচুবানি খাওয়াব।

কাদের বলে, আচ্ছা। আপনারা আমার ওপরে ভরসা রাখেন। দেখি কতটা পারি।

তা অভিনয় কাদের ভালোই করেছে।

এখন তো চোরের ওপরে বাটপারি করতে সচেষ্ট। এসে টাকা চাইছে—বুঝেন। আপনাগো কথামতো অভিনয় করতাছি। মাত্র পঞ্চাশটা টাকা চাইছি। এইটা কোনো টাকা?

স্বাধীন বলে, অবশ্যই টাকা। পঞ্চাশ তো অনেক টাকা। পঞ্চাশ টাকা মানে পঞ্চাশটা টাকা।

কাদের বলে, ভাইজান, অভিনয় করা খুব কষ্টের কাজ। এই জন্য দেখেন, যারা নায়ক-নায়িকা, তারা কত টাকা পায়। শাহরুখ খান, আমির খান, সালমান খান—এরা সবাই নাকি কুটি কুটি টাকা নেয়। আমি তো কুটি কুটি টাকা চাই নাই। মাত্র পঞ্চাশ টাকা চাইছি। দিয়া ফেলান ভাইজান। আর তা ছাড়া জায়গাটা আসলেই ভালো না। ধরেন, আপনে যে আমারে দেখতেছেন, আমি কাদের, আমি তো কাদের নাও হইতে পারি। এমনও তো হইতে পারে, আসল কাদের ওইখানে গাড়ি সারতেছে। আর আমি নকল কাদের। আপনের কাছ থেকে টাকা নিতে আইছি। মাত্র পঞ্চাশ টাকা দিলেই যদি আমি যাই, সেইটা কি ভালো না?

স্বাধীন একটু ভড়কে যায়। তবে কাদের না আবার নিজেকে তার চেয়ে স্মার্ট প্রমাণ করে বসে, সেটা যেন না হয়, এই চিন্তা থেকে সে বলে, তোমাকে পঞ্চাশ টাকা দিচ্ছি, এর এক নম্বর কারণ টাকাটা তোমার দরকার, দুই নম্বর কারণ তুমি গল্পটা ভালো বানিয়েছ বলে। নাও।

স্বাধীন মানিব্যাগ খুলে দুইটা বিশ টাকা আর একটা দশ টাকা বের করে কাদেরের হাতে দেয়।

কাদের হাসে, বলে, থ্যাংক ইউ।

কাদের চলে যায়। তখন এলাকাটায় একটা শূন্যতা এসে ভর করে। স্বাধীন ধাতস্থ হয় এবং ভাবে, কাদের তাকে এইভাবে আউটস্মার্ট করে দিতে পারল। আর সেও ভেবে বসল, এটা সত্যিকারের কাদের নয়। কেউ কাদের সেজে তার কাছে এসেছে। তার মতো একটা শিক্ষিত ছেলে ভূতে বিশ্বাস করে বসল। মুহূর্তের জন্য হলেও তাকে সংশয়ী করে তোলে।

নিজের কাছে নিজেও যেন ধরা খেয়েছে স্বাধীন। সে যে সাহসী, এটা তো প্রমাণ করাও দরকার। মন থেকে, মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলা দরকার যত অমূলক ভয়। ভূত বলে পৃথিবীতে কিছু নেই, তবে ভূতের ভয় বলে জিনিসটা একেবারেই বাস্তব।

স্বাধীন বারান্দা থেকে নামে। বাইরে হাঁটাহাঁটি করে।

রিসোর্টটার ভেতরেই সে হাঁটছে। পেছনের দিকে আর কোনো বাউন্ডারি নেই। একটু উঁচু-নিচু টিলা। পায়ে চলা পাহাড়ি পথও আছে একটা। এই দিক দিয়ে বোধ হয় লোকজন নিয়মিত যাতায়াত করে। ওই দূরে বসতবাড়ি দেখা যাচ্ছে। তাদের চলাচলের শর্টকাট পথ বোধ হয় এটিই।

হাঁটতে হাঁটতে স্বাধীন একটু বেশি দূরেই চলে এসেছে।

হঠাৎ তার কাঁধে কে যেন হাত দেয়।

সে চমকে উঠে ঘুরতেই দেখতে পায় সেই কোট-প্যান্ট পরা লোকটাকে, সে খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলে, ক্যান ইউ গিভ মি টাকা টুয়েন্টি অনলি? আই নিড টু বাই ফুড।

স্বাধীন তাকে ধাক্কা দিয়ে উল্টো দিকে দৌড়াতে থাকে।

সোজা চলে আসে রিসোর্টে।

ঢুকে যায় রুমে।

জাহিন তখন গোসল সেরে এসে কাপড় পাল্টাচ্ছে।

স্বাধীন গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।

জাহিন বলে, এই কী হয়েছে?

স্বাধীন বলে, না, কিছু না। কিছু না।

তুই হাঁপাচ্ছিস কেন?

একটু দৌড়ে এলাম তো, তাই।

দৌড়ালি কেন?

গাড়িতে বসে থাকতে থাকতে পায়ে ঝিঁঝি ধরে গেছল। তাই?

ভয়ের কিছু দেখেছিস?

না, তেমন কিছু না।

কী দেখেছিস? বল।

আরে না।

বল না।

তোকে বললে তুই বেশি ভয় পাবি।

আচ্ছা ঠিক আছে, বলার দরকার নাই।

রাতের খাওয়া তারা খায় ডাইনিং টেবিলে বসে। কেয়ারটেকার নিজের হাতে পরিবেশন করেন। গরম গরম খিচুড়ি আর ডিম অমলেট। বলেন, কাল সকাল থেকে খাওয়া ভালো হবে। আজকে দেরি করে আসায় তিনি বাজার করে রাখেননি।

জাহিন আর স্বাধীন একটা রুমে শোয়। আলাদা বিছানা। শরীরটা ক্লান্ত ছিল। জাহিন কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।

জাহিন ঘুম থেকে উঠে দেখে স্বাধীন আগেই উঠে গেছে। রোদে চারপাশ ঝকঝক করছে। সে আইপডে স্পিকার যুক্ত করে গান বাজাচ্ছে। রবীন্দ্রসংগীত বাজছে: ‘গ্রামছাড়া এই রাঙা মাটির পথ, আমার মন ভুলায় রে…’

জাহিনও বিছানা ছাড়ে।

বারান্দায় গিয়ে তার মনটা একেবারে তরতাজা হয়ে যায়। কত আলো চারদিকে। কত সবুজ। আকাশ কত নীল। দূরের পাহাড়গুলোকেও নীল দেখাচ্ছে। কাছের পাহাড়গুলোকে দেখাচ্ছে সবুজ।

নাশতার টেবিলে আসে গরম গরম পরোটা। আলুর দম। আর সবজি।

তারপর চা আসে। গরুর দুধের চা। চা নিয়ে ওরা চলে আসে বারান্দায়।

জাহিনের মনে পড়ে, গত রাতে সে কী রকম ভয় পেয়ে গিয়েছিল।

আর স্বাধীনের মনেও পড়ে না যে আগের রাতটায় কোনো ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল।

চপল তো এদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া। ভয়ভীতি জিনিসটা তার অভিধানে নেই।

চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে চপল বলে, চল, চারপাশটা দেখে আসি। রেকি করে নিয়ে রাখা ভালো।

চল।

পায়ে চপ্পল, পরনে কোয়ার্টার প্যান্ট, তারা চলে পায়চারি করতে।

জাহিন বলে, আসলে আমি না অন্ধকারকে ভয় পাই। দিনের আলোয় আমার সাহস ঠিক থাকে। দেখ, এখন কিন্তু ভয় লাগছে না।

চপল হাসে, ও আচ্ছা, তুই শুধু রাতে ভয় পাস। দিনে না। ঠিক আছে।

স্বাধীন বলে, আমি দিন হোক, রাত হোক, কখনোই ভয় পাই না।

চপল হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে, ‘সাপ সাপ।’

স্বাধীন ‘ওরে বাবা রে’ বলে তাকে জড়িয়ে ধরে।

চপল হাসে।

চপল বলে, ভয় নাকি পাস না?

স্বাধীন ধাতস্থ হয়ে বলে, সাপ-বাঘ তো ভয় পাবই। ভূতপ্রেত এসব আধিভৌতিক জিনিসে বিশ্বাস করি না। তাই ভয়ও পাই না।

চপল তার পিঠ চাপড়ে বলে, আচ্ছা আচ্ছা। বেশ বেশ।

হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা রাবার বাগানে ঢুকে পড়ে। বেশ ঘন বন।

তার ভেতর দিয়েই চলে গেছে পায়ে চলার পথ।

একটা জায়গায় গিয়ে জঙ্গলটা অন্ধকার হয়ে আসে। এতক্ষণ রোদে হেঁটে ছায়াপথটা বেশ আরামদায়ক বলেই মনে হয়।

বেশ সুনসান নীরবতা। শুধু পোকার কিটকিট শব্দ কানে আসে। পাখিও ডাকে।

এই নীরবতা ভেদ করে তাদের কানে আসে নারীকণ্ঠে হাসির শব্দ।

তিনজনেই সচকিত হয়, কান খাড়া করে।

চপলই প্রথম মুখ খোলে, কে হাসে? এই গভীর জঙ্গলের মধ্যে নারীকণ্ঠের হাসি? আমার তো ভালো মনে হচ্ছে না। কে এই রহস্যময়ী নারী? নাকি পরি-ফরি কিছু।

স্বাধীন চপলের পিঠে চাপড় দিয়ে বলে, যাহ। অশরীরী কিছু এই দুনিয়ায় নাই।

ওরা দুজনে আশা করেছিল, জাহিন ভয় পাবে। কিন্তু ওদের বিস্মিত করে দিয়ে জাহিন বলে, হাসিটা কিন্তু খুব সুন্দর। চল, হাসিটা কে হাসছে খুঁজে বের করি।

রাতের বেলা হলে জাহিন কক্ষনো এ কথা বলত না। কিন্তু দিনের বেলায় নারীকণ্ঠের খিলখিল হাসির শব্দ পেলে তরুণদের পক্ষে কৌতূহল দমন করা মুশকিল। ভয়ের চেয়েও তখন বড় হয়ে ওঠে কৌতূহলই।

স্বাধীন মজা দেখতে চায়, জাহিনকে সে ঠেলে দিতে চায় বনের গহিন নির্জন পথে। তারপর নিশ্চয়ই জাহিন ভয় পাবে। কাঁপতে কাঁপতে ফিরে আসবে তাদের কাছে।

স্বাধীন বলে, চল, তিনজন তিনদিকে যাই।

আসলেই সামনে পায়ে চলার সরু পথ তিন ভাগ হয়ে গেছে। এবং তিন দিকেই জঙ্গলের ভেতরে গাছের পাতা নড়াচড়া করছে। তাতে মনে হচ্ছে তিন দিকেই কেউ না কেউ আছে।

স্বাধীন বলে, আমি এই দিকটায় গেলাম।

চপল বলে, যাহ। আমি তাহলে এইটাতে যাই।

স্বাধীন আর চপলের পথ দুটো প্রায় পাশাপাশি।

উল্টো দিকে একলা পথে তারা ঠেলে দেয় জাহিনকে।

স্বাধীন এগিয়ে যায়। এদিকে গাছপালা বড় ঘন। তার এগোতে অসুবিধা হয়। আরেকটু এগিয়ে যেতেই একটা ছাগল ভ্যা ভ্যা বলে ডেকে ওঠে।

চপল তার পাশে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই ডাক শুনে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।

জাহিন এগোচ্ছে। নারীকণ্ঠের হাসিটা মনে হয় ওদিক থেকেই আসছে। তার বুকটা একটুখানি কেঁপেও ওঠে যেন। দূর থেকে সে দেখতে পায় একটা লাল রঙের চাদর। নীল রঙের জামা। তার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ সে নিজেই শুনতে পাচ্ছে।

সে এগোতে থাকলে দেখতে পায় এক তরুণীকে। বেণি করা চুল। নীল ফতুয়া, জিনস, একটা লাল র্যাপার জড়ানো। তার ধন্দ লাগে। সে মুগ্ধ হয়। সে ভয় পায়। তার মনে হয়, এ এক অশরীরী অস্তিত্ব।

আর চপল আরেক দিকে মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে সেদিকে যায়।

সে দেখতে পায়, হালকা নীল রঙের শাড়ি পরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে। সে তার মুখ দেখতে পায় না। সে তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলে নীল শাড়ি ঘুরে দাঁড়ান। চপল দেখতে পায়, একজন বয়স্বিনীকে, যার বয়স ষাটও হতে পারে, সত্তর হওয়াও বিচিত্র নয়।

ওরা তিনজনে ফিরে আসে।

চপল বলে, আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরী নারীর দেখা পেয়েছি এইমাত্র।

স্বাধীন বলে, আমি কিছু দেখি নাই।

চপল বলে, তুই কি দেখবি। তোর প্রতিবিম্ব দেখেছিস, ম্যা ম্যা করছিল…হা হা হা…

জাহিন কিছুই বলে না। বর্ণনার ভাষা সে হারিয়ে ফেলেছে।

কী রে কী দেখেছিস, বল…চপল জাহিনের পিঠ চাপড়ে বলে।

জাহিন বলে, হাসিটাই খালি সুন্দর না, মেয়েটাও খুব সুন্দর রে…

স্বাধীন গান ধরে: ‘বুকটা ফাইট্টা যায়, বন্ধু যখন বউ লইয়া আমার বাড়ির সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্টা যায়, ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়।’

জাহিনের সত্যি কষ্ট হচ্ছে। কেন হচ্ছে, কী ধরনের কষ্ট, সে বলতেও পারছে না।

তারা হাঁটে। গল্প করে। একটা ঝরনা খুঁজে পায়। দুই টিলার মধ্যখানের সরু উপত্যকা বেয়ে কুল কুল করে বয়ে যাচ্ছে জলধারা। বেশ গভীরে। তারা টিলার শানু বেয়ে নেমে যায়।

বড় বড় পাথরখণ্ডের ফাঁকফোকর দিয়ে জলধারা ছুটে যাচ্ছে। শেওলাধরা পাথর। সেই পাথরে পা রেখে তারা সাবধানে পানিতে হাত দেয়।

কী ঠান্ডা!

নামাটা যত সহজ ছিল, ওঠাটা তত সহজ হয় না। গাছ ধরে ধরে তারা ফিরে আসতে সক্ষম হয়।

ফেরার পথে জাহিন ঘাড় ঘুরিয়ে খুঁজতে থাকে নীল জামা লাল চাদরকে!

পায় না কোথাও।

বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, গেস্টহাউসের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তাদের চোখে পড়ে নীল জামা লাল চাদরকে। বারান্দায় বসে আছে।

বাকি দুজনকে অবাক করে দিয়ে জাহিন তরুণীর দিকে এগিয়ে যায়।

বলে, আমার নাম জাহিন। আমি ঢাকা থেকে এসেছি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। বোটানি। আপনার হাতে যে পাতাটা, এটা কি চেনেন? এটা হলো চা-গাছের পাতা। আপনি জঙ্গলে কুড়িয়ে পেয়েছেন। এর সায়েন্টিফিক নেম হলো ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস।

ওমা। এটাই ক্যামেলিয়া নাকি? রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে। নাম তার ক্যামেলিয়া, দেখেছিলাম খাতার ওপরে লেখা।

না। ওই ক্যামেলিয়া একটা ফুলের নাম। ক্যামেলিয়া সাসানকুয়া। খুব সুন্দর ফুল। আপনার নাম কী?

আমার নাম শিশির।

শিশি?

না না। শিশির। ডিউ।

ও আচ্ছা। রবীন্দ্রনাথের ‘হৈমন্তী’ গল্পে হৈমন্তীর নাম শিশির হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তাহার নাম দিলেম শিশির।

কিন্তু রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তীর নাম শিশি বোতল হতে পারে, কেউ ভাবতে পারে? আপনি এটা কী ভাবলেন?

সত্যি। বোকার মতো ভেবেছি। আসলে শুনতে ভুল শুনেছি।

এই সময় বাগানবাড়ির টিনের চালে ঢিল পড়তে থাকে।

জাহিন চমকে ওঠে।

শিশির বলে, ঢিল পড়ে কোত্থেকে?

কী জানি। রাতের বেলা তো নানা ভৌতিক কাণ্ড ঘটেছে। দিনের বেলায়ও ঘটবে নাকি?

রাতের বেলা ভৌতিক কাণ্ড ঘটেছে নাকি?

কাল ঘটেছিল। আজ কী ঘটবে, তা তো জানি না।

ঢিল পায়ের কাছে এসে পড়ছে।

জাহিন বলে, চলেন ভেতরে যাই।

শিশির বলে, সেই ভালো।

জাহিন বলে, কেমন ভয় ভয় লাগে না! কী সব ভুতুড়ে কাণ্ড।

শিশির বলে, ভয় লাগুক না লাগুক, গায়ে ঢিল পড়লে তো ব্যথা লাগবেই।

তারা ভেতরে ডাইনিং টেবিলে গিয়ে বসে। সেখানে সেই ভদ্রমহিলা আর চপল গল্প করছে।

শিশিরকে দেখেই তিনি বলে ওঠেন, শিশির আয় আয়। কী কাণ্ড শোন। আমাদের তো মনে হয় আজকেই বেলা থাকতে থাকতে এই বাগানবাড়ি ছেড়ে দেওয়া উচিত।

শিশির বলে, কী হয়েছে দাদি?

ভদ্রমহিলা, শিশিরের দাদি, বলেন, এই জায়গাটা নাকি ভালো না। নানা রকমের ভৌতিক কাণ্ড ঘটে থাকে। কাল রাতে ওরা নাকি ভূত দেখেছে।

শিশির বলে, ভূত না থাকতে পারে। মানুষ তো সব জায়গাতেই আছে। অনেক সময় মানুষও অনেক ভৌতিক কাজ করে। কী হয়েছে বলুন তো।

চপল বলে, আমরা কালকে নানা রকমের রহস্যময় ঘটনা ঘটতে দেখেছি। আমাদের গাড়ির স্টার্ট অকারণে বন্ধ হয়ে গেল। কেন বন্ধ হলো, কেউ জানি না। আবার নিজে থেকেই স্টার্ট নিল। কেন নিল, তাও জানি না।

তারপর একযোগে ঢিল। ঝোড়ো বাতাস। বাদুড়ের পাখা ঝাপটানি। কী সব ভৌতিক কাণ্ড।

সেই টেবিলে এসে যোগ দিল স্বাধীনও। সে বলে, আর সবচেয়ে রহস্যময় একজন মানুষ। কোট-প্যান্ট পরা। ইংরেজিতে কথা বলেন। ভিক্ষা চান। আউট অব দ্য ব্লু এসে হাজির হন। ভয়াবহ ব্যাপার।

জাহিনের আবারও ভয় ভয় লাগছে।

চপল বলে, আসলে এই বাগানবাড়িটার একটা ইতিহাস আছে।

এটা ছিল ব্রিটিশ সাহেবদের। সাহেবেরা এখানে এসে থাকত।

একবার এক সাহেব এখানে এসে মারা যায় তার ঘোড়ার ছুড়ে মারা গুলিতে।

ঘোড়ার ছুড়ে মারা গুলিতে? শিশির বিস্মিত। ঘোড়া কখনো গুলি ছুড়তে পারে?

পারে না। কিন্তু একবার পেরেছিল। আমাদের ধারণা, এটা একটা হঠাৎ ঘটে যাওয়া ঘটনা। কিন্তু মানুষ বিশ্বাস করে ওই ইংরেজ সাহেব, তার নাম ছিল অ্যান্টনি, ঘোড়াটাকে অকারণে চাবুক দিয়ে পিটিয়েছিল। তাই ঘোড়া তার প্রতিশোধ নিয়েছে। সাহেবের বন্দুকটা রোদে শুকাতে দেওয়া ছিল। সেটা সে মুখে করে আনে। দুই পায়ে সেটার ট্রিগার টেপার চেষ্টা করে। সাহেব তা দেখতে পেয়ে বন্দুকটা কেড়ে নিতে এগিয়ে যায়। এই সময় সাহেবের আঙুল লেগে নাকি ট্রিগারের সঙ্গে লতাপাতা পেঁচিয়ে ঘোড়ার খুরে লেগে কে জানে, গুলি বেরিয়ে যায়। সাহেবের গলা ভেদ করে সেই গুলি চলে যায়। সাহেবকে অপারেশন করেন আরেক ব্রিটিশ সার্জন জন।

যাহোক, পরে ঘোড়াটার বিচার হয়। এক ম্যাজিস্ট্রেট ঘোড়াটাকে গুলি করে মারার রায় ঘোষণা করেন।

এই বাগানবাড়িতেই ঘোড়াটাকে গোরা সৈন্যরা গুলি করে মারে।

এরপর ওই ম্যাজিস্ট্রেট এখানে বেড়াতে আসেন স্ত্রীসমেত।

তিনি ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই এই টিনের বর্গাগুলোর সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেন।

এর পরও একটা নবদম্পতি হানিমুন করতে এসে এখানে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়।

তার পর থেকেই…

কে কে? কে ওখানে? একটা ছায়ামূর্তি ডাইনিং রুমে জানালায়…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *