টিলাগড় রহস্য

টিলাগড় রহস্য

ছোট্ট পাহাড়ের মতো একটি টিলা, তার উপর দুর্গের মতো সুন্দর একটা বাড়ি। ঠিক যেন পটে আঁকা একটি ছবি।

শানু বলল, ‘যাবি ওখানে?’

রাণু সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড় কাত করল, তারপর বলল, ‘যদি পড়ে যাই!’

‘ধ্যাত’। শানু জবাব দিল, ‘পড়ব কেন? আমরা কি কচি খোকা-খুকি?’

একটু দ্বিধাভরে ঘাড় দোলাল রাণু, তারপর বলল, ‘কেমন করে উঠব?’

‘বোকা!’ শানু যেন বিরক্ত হল, ‘ওই যে একটা রাস্তা দেখতে পাচ্ছিস না? এঁকেবেঁকে ওপরে চলে গেছে।’

‘ওমা, তাই তো!’ রাণু এবার খুশি হয়ে বলল, ‘বেশ মজা হবে দাদা, আমরা তবে পাহাড়ে উঠব।’

শানু আর রাণু ভাই-বোন। শানুর বয়স তেরো, রাণুর দশ। এই প্রথম ওরা মা-বাবার সঙ্গে কলকাতার বাইরে বেড়াতে এসেছে। ওদের মা-র খুব অসুখ করেছিল, সেরে ওঠার পর ডাক্তারবাবু বাবাকে বলেছিলেন মাকে কিছুদিনের জন্য বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে। বাইরের জল হাওয়ায় শরীর ভালো হবে।

বিহারের এ জায়গাটা শুকনো হলেও শরীর সারাবার পক্ষে নাকি খুব ভালো। পুজোর ভিড়ে টিকিট পাওয়া যায়নি, তাই দশমীর পরের দিন ওরা এখানে এসেছে, ভাই ফোঁটার দিন ফিরে যাবে। এ সময় স্কুলও বন্ধ থাকে আর সময়টাও ভালো, না গরম না খুব ঠান্ডা। তবে কলকাতার মতো নয়, হিম পড়তে শুরু করেছে, রাত্তিরে কাঁথা গায়ে দিতে বেশ আরাম লাগে। রোদটাও যেন মিঠে মিঠে।

কাল ওরা এখানে এসেছে, আর আজ সকালেই বেরিয়ে পড়েছে জায়গাটা কেমন দেখতে। এখানে হারিয়ে যাবার ভয় নেই, তবু মা বার বার বলে দিয়েছেন, ‘বেশি দূরে যেও না, হারিয়ে যাবে।’ মা-বাবারা যেন কেমন, তাঁদের ছেলে-মেয়েদের সবসময় ছোটোটি দেখেন!

টিলাটার গায়ে ছোটো ছোটো গাছ, কাঁটা গাছই বেশি, তবে বড়ো বড়ো গাছও যে নেই তা নয়। দূর থেকে মনে হয় ঘন জঙ্গল, কিন্তু কাছে এলে বোঝা যায় আসলে তা নয়, এখানে-ওখানে ঝোপঝাড়। টিলাটা প্রায় চার তলার মতো উঁচু, ওপরটা অনেকটা ছাদের মতো, সেখানেই বাড়িটা। দু-পাশে বড়ো বড়ো কয়েকটা পাম গাছ। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওই টিলায় ওটাই একমাত্র বাড়ি।

‘যদি জঙ্গলে বাঘ থাকে?’ রাণু ভয়ে ভয়ে বলল, ‘যদি খেয়ে ফেলে আমাদের?’

‘তুই বড়ো ভীতু!’ শানু ঠোঁট উলটাল, ‘বাঘ থাকলে কি ওখানে কেউ বাড়ি করত! বাঘ থাকে গভীর জঙ্গলে, সুন্দরবনে। সেখানে কত বড়ো বড়ো গাছ জানিস?’

শানু খুব শিকারের গল্পের ভক্ত। ওর সবচেয়ে প্রিয় শিকারের বই হচ্ছে সুন্দরবনে আর্জান সর্দার।

দাদার ওপর খুব ভক্তি রাণুর, ও বলল, ‘সত্যি?’

‘সত্যি নয়তো কি!’ শানু বিজ্ঞের মতো জবাব দিল, ‘সেখানে সুঁদরি গাছের বন, কাঠুরেরা দল বেঁধে গাছ কাটতে যায়, আর ঝোপের আড়াল থেকে যমদূতের মতো লাফিয়ে পড়ে বাঘ, রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। সামনে যে পড়ে তার রক্ষে নেই। হুঁ!’

‘আমার কিন্তু ভয় করছে দাদা।’

‘দুর বোকা মেয়ে’, শানু ধমকে উঠল, ‘এটা কি সুন্দরবন নাকি যে ভয় পাচ্ছিস! দেখছিস না, শুধু ছোটো ছোটো ঝোপ। তা ছাড়া অমন একটা বাড়ি যেখানে, সেখানে আবার ভয় কীসের!’

রাস্তাটা এঁকেবেঁকে ওঠাতে সুবিধে হয়েছে। খাড়া ওপরে উঠতে গেলে পা হড়কে পড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু এ পথে সে ভয় নেই। একটা চ্যাপটা মাথা মস্ত ঢিবির সঙ্গে তুলনা করা যায় টিলাটার। ওখানে কেন যে কেউ বাড়ি করল সেটাই আশ্চর্য!

ওরা ভাই-বোন হাত ধরাধরি করে উঠছিল। রাণুর ভয় এখন কেটে গেছে, দাদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ও দৌড়চ্ছিল আর খিলখিল করে হাসছিল। ঝোপে ঝোপে নানান রঙের ফুল ফুটে আছে, কোনো কোনো ঝোপে আবার ফল ধরেছে।

শানু বোনকে সাবধান করে দিল, ‘খবরদার খাসনি, হয়তো বিষ ফল।’

কয়েকটা রঙিন প্রজাপতি উড়ছিল। ‘ধরবি দাদা?’ রাণু সাগ্রহে বলল।

শানুরও লোভ হচ্ছিল, কিন্তু ওর মনে এখন অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়া লেগেছে, প্রজাপতির পেছনে ধাওয়া করার সময় নেই। শিকারের পরই ওর প্রিয় হচ্ছে ডিটেকটিভ গল্পের বই। ফেলুদা ওর আদর্শ। ওর ভীষণ ইচ্ছে বড়ো হয়ে ও একজন শিকারি আর গোয়েন্দা দুই-ই হবে।

ওই বাড়িটা দেখেই ওর মনে কেমন একটা খটকা জেগেছে। অমন জায়গায় কেউ অকারণে বাড়ি করেনি। নিশ্চয়ই একটা উদ্দেশ্য আছে, হয়তো কিছু রহস্যও জড়িয়ে আছে। সেই রহস্য ভেদ করার ইচ্ছাটাই এখন প্রবল হয়ে উঠেছে ওর। প্রজাপতির পেছনে সময় নষ্ট করার মানে হয় না।’

‘প্রজাপতি পরে হবে’, বোনকে ও ধমকে উঠল, ‘এখন চল দেখি, বাড়িটা দেখি আসি।’

আঁকাবাঁকা পথ ধরে ওদের উঠতে হচ্ছিল বলে পরিশ্রম একটু বেশিই হচ্ছিল, পথও ভাঙতে হচ্ছিল বেশি। তবে কম বয়স বলে ও সব ভ্রূক্ষেপের মধ্যে আনছিল না ওরা। রাস্তাটা দিয়ে যে মানুষ চলাচল করে তার প্রমাণ চোখে পড়ে।

‘দেখেছিস, এ রাস্তা দিয়ে গাড়িও চলে’, শানু হঠাৎ ঝানু গোয়েন্দার মতো বলে উঠল, ‘ওই দ্যাখ চাকার দাগ।’

‘ওমা, এ তো মাত্র একটা চাকা’, রাণু মৃদু প্রতিবাদ করল।

‘আমি কি মোটর গাড়ি বলেছি’, শানু গম্ভীর মুখে বলল, ‘নিশ্চয়ই মোটরসাইকেলের চাকার দাগ, কেমন মোটা দেখছিস না?’

‘ও!’ রাণু একটু চুপসে গেল।

বাড়িটার কাছে পৌঁছে গেল ওরা।

দূর থেকে বাড়িটাকে দুর্গের মতো দেখলেও এখন কিন্তু আর তা মনে হচ্ছে না। লাল টালির ছাদ। আসলে উঁচু টিলার মাথায় বলেই ওটাকে দুর্গ মনে হচ্ছিল। একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হয়, ওটা কিন্তু বাইরের দিকে। দোতলায় কাঠের রেলিং ঘেরা একটা বারান্দা, রেলিংয়ে বোধ হয় সদ্য রং করা হয়েছে, ঝকঝকে সবুজ। বাইরের দেওয়ালের ইটগুলো খাঁজ কাটা, লাল রং। ভেতরের দেয়ালের রং গাঢ় হলুদ।

‘লাল-হলুদ-সবুজ’, শানু যেন আপন মনেই বলল, ‘রঙের মধ্যেও একটা রহস্য আছে।’

‘কী বলছিস দাদা বিড়বিড় করে?’ রাণু ভুরু কুঁচকে তাকাল।

‘আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি’, শানু গলা নামিয়ে বলল, ‘তুই বুঝবি না।’

‘রহস্যের আবার গন্ধ থাকে নাকি?’ রাণু চোখ দুটো বড়ো বড়ো করল।

‘তোকে নিয়ে এখানে আসাটাই অন্যায় হয়েছে’, শানুর এবার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল, ‘আমি কি ফুলের গন্ধের কথা বলছি নাকি? এই গন্ধ কান আর চোখ দিয়ে টের পেতে হয়, তবেই না ডিটেকটিভ হওয়া যায়। হুঁ!’

বাড়িটার চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া, একটা কাঠের গেটও আছে। অল্প জমির ওপরেই সব কিছু। টিলার অসমতল, চ্যাপটা মাথাটাও অপ্রশস্তই বলা চলে। গেটের ভেতরেই ছোট্ট একটা শেডের তলায় কালো রঙের ছোটো মোটরসাইকেল চোখে পড়ল ওদের।

‘দেখেছিস!’ শানু যেন মস্ত বড়ো একটা রহস্যের সমাধান করেছে এমনভাবে বলল, ‘আমার কথা ঠিক—’

‘কে— কে ওখানে?’

শানুর কথা শেষ না হতেই হেঁড়ে গলায় বলে উঠল কে একজন, আর ভীষণ চমকে উঠল ওরা।

‘কে— কে তোমরা?’

দোতলার বারান্দার কাঠের রেলিংয়ে ভর দিয়ে একটু বাইরের দিকে ঝুঁকে প্রশ্নটা যে করল, তার গায়ের রং তামাটে, চওড়া, কাঁধ, পেশল চেহারা। পরনে শুধু একটা লুঙ্গি।

ওরা এমন হকচকিয়ে গিয়েছিল যে, মুখ দিয়ে কথা সরছিল না। রাণু তো ভয়ে কুঁকড়ে গেছে।

‘কী হল, জবাব দিচ্ছ না যে?’ লোকটা ভুরু কুঁচকে ওদের দিকে তাকাল, তারপর তর তর করে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। এত বড়ো শরীর নিয়ে কেউ যে অমন তাড়াতাড়ি নড়াচড়া করতে পারে তা যেন চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করা যায় না।

‘বোবা নাকি তোমরা?’ ওদের একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা।

‘মানে— আমরা বেড়াতে এসেছি’, এবার একটু আমতা-আমতা করে জবাব দিল শানু, ‘এই বাড়িটা দেখে ভালো লাগল, তাই এসে পড়েছি।’

‘ও’, গেট খুলে লোকটা বলল, ‘এসো, ভেতরে এসো।’

‘কোথায় থাকো তোমরা?’ প্রশ্ন করল লোকটা।

‘আমরা কলকাতা থেকে এখানে হাওয়া বদলাতে এসেছি’, এবারও বলল শানু। এতক্ষণে ওর অস্বস্তি ভাব অনেকটা কেটে গেছে। তা ছাড়া ছোটো বোনের দায়িত্ব ওর ওপর, এই বোধটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বড়োদের মতো মাঝে মাঝে ভারিক্কি চালে কথা বলা ওর অভ্যেস।

‘হাওয়া বদলাতে এসেছ?’ লোকটা প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ, আমাদের মা-র খুব অসুখ করেছিল, তাই ডাক্তারবাবু বলেছেন হাওয়া বদল করতে’, শানু জবাব দিল, ‘কালই আমরা এখানে এসেছি।’

রাণুর ভয় তখনও কাটেনি, দাদার গা ঘেঁষে বড়ো বড়ো চোখ মেলে লোকটাকে দেখেছিল, সেটা লক্ষ করে লোকটি কৌতুক করে বলল, ‘তোমার বোনটি একেবারে চুপসে গেছে কেন? মুখে রা-টি নেই।’

‘আমার ভয় করছে’, রাণু এতক্ষণে কথা বলল।

‘ভয় করছে! কেন?’ লোকটা যেন বেশ অবাকই হয়েছে।

‘তুমি যদি আমাকে মার!’

‘মারব কেন?’ এবার হেসে ফেলল লোকটি।

‘সত্যি মারবে না তো’, লোকটির হাসি দেখে বোধ হয় সাহস হল রাণুর, ‘তোমার মুখ দেখে আমার মনে হয়েছিল, তুমি খুব রাগ করেছ।’

‘রাগ করেছি?’

‘হ্যাঁ, না বলে-কয়ে তোমার বাড়ি এসেছি বলে তুমি রাগ করেছ। তোমার চোখ দেখে তাই মনে হচ্ছিল’, এক নিশ্বাসে বলল রাণু।

‘ন-ন না, রাগ করিনি।’ লোকটি যেন একটু সময় নিয়ে বলল, ‘তা হঠাৎ এখানে আসার ইচ্ছে হল কেন তোমাদের?’

‘বাড়িটা দূর থেকে ফোর্টের মতো দেখাচ্ছিল, তাই আমাদের আসতে ইচ্ছে হল’, শানু বলল।

‘আর দাদা বলল’, কথাটা শুরু করেই থেমে গেল রাণু।

‘কী বলল? প্রশ্ন করল লোকটি।

শানুর ইচ্ছে হল বোনকে একটা চিমটি কেটে চুপ করিয়ে দেয়, কিন্তু তার সুযোগ পেল না। তার আগেই রাণু বলে উঠল, ‘বলল, এখানে রহস্যের গন্ধ পাচ্ছে।’

‘রহস্যের গন্ধ!’ লোকটি ভুরু কোঁচকাল, দু-চোখেও যেন ফুটে উঠল একটা ধারালো দৃষ্টি।

‘আমার দাদা ডিকেটটিভ গল্প পড়ে যে, বড়ো হয়ে ও ফেলুদা হবে’, রাণুর ভয় আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।

‘তুমি তবে রহস্যের গন্ধ পেয়ে এখানে এসেছ, অ্যাঁ!’ লোকটির গলার স্বর বেশ গম্ভীর।

‘আমার বোনের কথায় কান দেবেন না’, শানু তাড়াতাড়ি বুদ্ধি করে বলল, ‘ওকে ভোলাবার জন্য ও কথা বলেছিলাম। ও এখানে আসতে ভয় পাচ্ছিল, যদি বাঘ বেরোয়, তাই ওকে ও কথা বলেছিলাম।’

‘বাঘ!’ লোকটির গলা একটু নরম হল, ‘তা বাঘ না হোক, মাঝে মাঝে ভালুক বেরোয় এখানে। মহুয়া ফুলের মধু খেতে আসে।’

‘আমি চিড়িয়াখানায় ভালুক দেখেছি’, রাণু সঙ্গেসঙ্গে বলে উঠল, ‘গায়ে বড়ো বড়ো কালো লোম আর খালি জ্বর হয় ওদের।’

‘চিড়িয়াখানায় খাঁচার মধ্যে দেখেছ, এখানে ওদের মূর্তি অন্যরকম, ভয় করে সবাই।’

‘তুমিও কর?’ রাণু বড়ো বড়ো চোখ করে জিজ্ঞাসা করল।

‘আমি!’ লোকটি হা হা করে হেসে উঠল, ‘ভালুকই আমাকে ভয় পায়, দেখছ না আমার কেমন জোয়ান চেহারা।’

লোকটির মজবুত চেহারা দেখে সে-কথা মনে মনে স্বীকার করল শানু।

‘তা বাড়িটা যখন তোমাদের পছন্দ হয়েছে, দেখেই যাও।’

ভেতরে অল্প জমিতে কেয়ারি করা ঝোপ; থরে থরে বুনো ফুল ফুটে আছে, তার রঙের বাহার আছে বটে, তবে গন্ধ নেই। ছোট্ট বাড়ি, নীচে তিনটে ঘর, ওপরে তিনটে। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে ওরা ওপরে উঠে এল। দোতলার ঘরের মেঝে কাঠের পাটাতনের। কাঠের মেঝে আগে ওরা কখনো দেখেনি। বারান্দাটা কিন্তু বেশ চওড়া আর অনেকটা গোল হয়ে সব কটা ঘরকেই ছুঁয়ে গেছে। মেঝেটা আবলুশ কাঠের, তাকে এত পালিশ যে, ওরা কয়েক বারই পা পিছলে পড়ে যাচ্ছিল।

‘সাবধানে চল’, লোকটি ওদের হুঁশিয়ার করে দিল। ‘এ বাড়িটা ছিল একজন ক্রিশ্চান পাদরির। অনেক বছর আগে শখ করে তিনি এটা বানিয়েছিলেন। টাকা দিয়েছিল বড়ো বড়ো সাহেবরা। তারপর এখানে একবার সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়, কিছু ক্রিশ্চান তাদের হাতে মারা পড়ে, বাকিরা পালিয়ে বাঁচে। বাড়িটা হাত বদল হতে হতে একজন শেঠজির হাতে এসেছে।’

‘তোমার বাড়ি নয় এটা?’ রাণু জিজ্ঞাসা করল।

‘না, খুকুমণি। এটা ভাড়া নিয়েছি আমি। এমন জায়গায় কেউ থাকতে চায় না, তাই ভাড়া কম’, মুচকি হাসল লোকটি।

‘কিন্তু আপনাকে তবে জিনিসপত্তরের জন্য বার বার নীচে নামতে হয়? কাছাকাছি তো দোকানও নেই’, শানু বলল এবার।

‘কেন, আমার বাহন দেখনি? ওই মোটরসাইকেলটা। ওটার আমি নাম দিয়েছি ‘হংসদূত’, ঠিক যেন হাঁসের মতো উড়ে চলে।’

‘তোমার নাম বললে না তো?’ রাণু ফস করে বলল।

‘ওঃ! ভীষণ ভুল হয়ে গেছে’, লোকটির দু-চোখে যেন ঝিলিক খেলে গেল, ‘আমার নাম হল গিয়ে শ্রীযুক্ত বাবু গোবর্ধন সাঁতরা। কিন্তু তোমাদের নামও তো বলনি।’

শানুর মনে হল নিজের নামটা বলার সময় একটু যেন টেনে টেনে কথা বলল গোবর্ধন, যেন একটু ভেবে নিল।

‘আমার ভালো নাম সোনালি চৌধুরী, ডাক নাম রাণু; আর আমার দাদার ভালো নাম শার্ণব চৌধুরী, ডাক নাম শানু।’

‘রাণু! বাঃ বেশ নাম।’ লোকটি যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে গেল।

ঘরগুলি খুব খোলামেলা। টিলার ওপর ফাঁকা জায়গায় আলো বাতাসের অভাব নেই। ভাঁড়ার ঘর নানান উপকরণে ঠাসা, বোধ হয় জিনিসপত্তরের জন্য যাতে হুটহাট করে ছুটতে না হয় তাই ঘর ভরতি জিনিস। গোবর্ধন ওদের দু-জনের হাতে দুটো কমলালেবু দিয়ে বলল, ‘তোমাদের কিন্তু মিষ্টি খাওয়াতে পারলাম না।’

দোতলার একটা ঘরে তালা বন্ধ, সব জানলাও বন্ধ। শানু জিজ্ঞেস করল, ‘এ ঘরটা বন্ধ কেন?’

গোবর্ধনের মুখে যেন চকিত একটা ছায়া পড়ল, তবে তা মুহূর্তের জন্য, তারপরই ও বলল, ‘ও ঘরে দরকারি জিনিসপত্তর আছে তাই বন্ধ করে রেখেছি। বলা যায় না তো, চোর-টোর আসতে পারে।’

‘তোমাকে চোর ভয় পায় না?’ কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে প্রশ্ন করল রাণু।

‘তা পায়’, গোবর্ধন সশব্দে হাসল, ‘কিন্তু আমি যখন আমার বাহনে চেপে শহরের দিকে যাই, তখন তো বাড়িটা খালি পড়ে থাকে, কোনো পাহারা থাকে না, তাই।’

‘একটা কুকুর রেখে দাও না কেন? ভালো অ্যালসেসিয়ান কুকুর!’ রাণু উপদেশ দিল, ‘আমার বন্ধু মিতালিদের বাড়িতে একটা আছে, একবার একটা চোরকে কামড়ে ধরেছিল।’

‘তা মন্দ বলনি’, গোবর্ধন ঘাড় দোলাল, সত্যি এ বুদ্ধিটা আমার মাথায় আসেনি তো। তোমার তো দেখছি খুব বুদ্ধি!’

‘বাঃ! আমি যে দাদার অ্যাসিস্ট্যান্ট’, রাণু গর্বের সঙ্গে বলল, ফেলুদার যেমন তোপসে, তেমন।’

‘তাই বুঝি!’ গোবর্ধন মুখে ভয়ের ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘তবে তো আমাকে সাবধান হতে হবে দেখছি, আমি যদি কোনো খারাপ কাজ করি তবে গোয়েন্দা শানু আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট রাণু আমাকে ধরে ফেলবে।’

‘যাঃ!’ রাণু জোর গলায় বলল, ‘তুমি খারাপ কাজ করবে কেন? তোমাকে তো এখন ভালো লোকই মনে হচ্ছে।’

গোবর্ধনের মুখে যেন একটা ম্লান ছায়া পড়ল, তারপরই নরম গলায় ও বলল, ‘বেলা হয়ে যাচ্ছে, তোমাদের মা-বাবা হয়তো ভাববেন।’

‘এই রাণু’, শানু এবার বলল, ‘চল, অনেকটা যেতে হবে।’

গোবর্ধন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আমার বাহনটা একটু বিগড়েছে, নইলে তোমাদের পৌঁছে দিতাম।’

গেট পেরিয়ে বেরিয়ে এল ওরা। কয়েক পা গিয়েই রাণু ফিরে তাকাল, গোবর্ধন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওর দু-ঠোঁটের ফাঁকে এক টুকরো হাসি।

ওঠা যেমন কঠিন, নামা তেমন সহজ। আঁকাবাঁকা ঢালু পথ বেয়ে গড়গড়িয়ে নামছিল ওরা।

‘তুই মুখটা অমন হাঁড়িপানা করে আছিস কেন রে দাদা?’ রাণু জিজ্ঞেস করল।

‘তোকে আমি কিছু বলব না’, শানু হঠাৎ রাগ রাগ গলায় বলে উঠল, ‘তুই ও কথা বলে দিলি কেন?’

‘কোন কথা?’ রাণু অবাক হয়ে তাকায়।

‘কেন! ওই যে আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। লোকটা কেমন সন্দেহ সন্দেহ চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছিল।’

‘ওমা।’ রাণু গালে হাত দিল ‘আমি কিছু মনে করে বলেছি নাকি!’

‘মনে করে বলেছি নাকি?’ ভেংচে উঠল শানু, ‘সব কথা ফাঁস করে দিলে গোয়েন্দার শাগরেদি করা যায় না, বুঝেছিস?’

‘আচ্ছা, আর বলব না’, রাণু ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে বলল।

‘তিন সত্যি কর’, শানু হুকুম করল। রাণু পালন করল দাদার হুকুম।

‘তাহলে শোন’, শানু বলল, ‘ব্যাপারটা খুব গোলমেলে, জটিল রহস্য আছে ওখানে।’

‘কী করে বুঝলি তুই?’ রাণু সাগ্রহে জিজ্ঞেস করল।

‘ও লোকটার নাম গোবর্ধন সাঁতরা নয়।’

‘বাঃ রে! ও নিজে বলল।’

‘ধুৎ! নিজে বললেই হল। আমি যদি বলি আমার নাম অশোক মজুমদার, তবে কি আমি অশোক মজুমদার হয়ে যাব?’

‘তুই কেন তোর নাম অশোক মজুমদার বলতে যাবি!’ রাণু প্রতিবাদ করে উঠল, ‘তোর নাম তো শার্ণব চৌধুরী।’

‘তবেই বুঝতে পারছিস’, শানু এবার বিজ্ঞের মতো হাসল, ‘বিশেষ কারণ না থাকলে কেউ নিজের নাম লুকোয় না।’

‘তবে ওর নাম কী?’

‘ওর নাম রজত হালদার।’

‘তুই কী করে জানলি?’

‘দোতলার বারান্দায় বেতের টেবিলে একটা খাম দেখেছি, তার ওপর ওই নামটাই লেখা ছিল।’

‘সেটা তো ওর নাও হতে পারে’, রাণু হার মানল না।

‘ও নিজের মুখেই বলেছে ওখানে থাকে, তবে অন্যের নামে চিঠি আসবে কেন? ঠিকানাটাও আমি পড়ে নিয়েছি, ‘দ্য রিট্রিট’। বাড়িটার গেটের দেওয়ালে ওই নামটাই লেখা আছে।’

‘কিন্তু ও নিজের নাম না বলে অন্য নাম বলল কেন?’ রাণু যেন দাদার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না।

‘নিশ্চয়ই এমন কিছু আছে যার জন্য নিজের নাম ও বলতে চায় না। আরও শুনবি?’

‘কী?’ রাণুর মন কেমন যেন খারাপ হয়ে যায়।

‘ওখানে আরও লোক থাকে’, শানু গোয়েন্দার মতো বলল, ‘জুতোর শেলফে দু-তিন রকম মাপের জুতো আমি দেখেছি।’

‘তারা কোথায় গেল তবে!’ রাণু অবাক।

‘গেছে কোথাও।’

‘তবে তো চিঠিটা তাদের কারও নামে হতে পারে’, রাণু ওর দাদাকে চেপে ধরল।

‘না, ওই লোকটার ডান হাতে ”আর”, ”এইচ” কথা দুটো উল্কি কাটা। রজতের ”আর”, হালদারের ”এইচ”, আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।’

‘তুই যে সত্যিই ডিটেকটিভ হয়ে গেছিস!’ হঠাৎ ভ্রাতৃগর্বে দু-হাতে তালি দিল রাণু, ‘বাবাকে গিয়ে বলব।’

‘খবরদার! এসব শুধু তোর আর আমার মধ্যে, কাউকে বলবি না।’

‘মাকেও বলব না?’

‘না। বললে আমাদের গোয়েন্দাগিরি বন্ধ হয়ে যাবে।’

‘কেন?’

‘বোকা মেয়ে।’ শানু বিরক্তির সঙ্গে বলল, ‘মা বাবাকে বলে দেবে, বাবা আমাদের ওখানে যেতে দেবে না।’

‘বেশ তবে বলব না।’

‘লোকটার সঙ্গে দেখা হলে আমরা ওকে বুঝতে দেব না যে, আমরা ওর আসল নাম জেনে ফেলেছি। ওকে আমরা গোবর্ধন বলেই যেন জানি, বুঝলি?’

রাণু মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল।

‘চোরের ভয়ে ওই ঘরটা তালাবন্ধ করে রাখা হয়েছে এ আমি বিশ্বাস করি না’, শানু গম্ভীর মুখে বলল, ‘এখন তো লোকটা বাড়ি রয়েছে, তবে আবার চোরের ভয় কীসের? তা ছাড়া ঘরের সব জানলাই বা বন্ধ কেন? ওর মোটরসাইকেলটা বিগড়েছে বলে আমাদের পৌঁছে দিতে পারল না, তার মানে ও এখন বাড়ি থেকে বেরুবে না। তাহলে দরজা জানলা অমন এঁটে রাখার দরকার কী?’

‘ওই ঘরে তবে কী আছে?’ রাণুর মনেও এবার রোমাঞ্চের ছোঁয়া লেগেছে।

‘সেটাই তো রহস্য’, শানু গম্ভীর মুখে বলল, ‘সেটাই জানতে হবে আমাদের।’

‘কিন্তু কী করে জানব?’ রাণু এবার ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল।

‘বাড়িতে যখন কেউ থাকবে না, তখন আমরা ওখানে গিয়ে সার্চ করব’, শানু চিন্তিত মুখে জবাব দিল, ওর কপালে কয়েকটা রেখা ফুটে উঠেছে।

বাড়ি ফিরতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় গিয়েছিলি, এত দেরি হল?

‘ওমা দেরি কোথায়!’ রাণু যেন আকাশ থেকে পড়ল, ‘মোটে তো সাড়ে দশটা।’

‘সেই কোন সকালে বেরিয়ে গেছিস’, মা এবার বললেন, ‘এতক্ষণ কী দেখবার আছে?’

‘বারে! আমরা যে পাহাড়ের চুড়োয় উঠেছিলাম’, রাণু আদুরে গলায় বলল।

‘পাহাড়ের চুড়ো!’ বাবা এবার ভুরু কুঁচকোলেন।

‘ওই যে পশ্চিম দিকে ছোট্ট একটা পাহাড়, ওটার মাথায় উঠেছিলাম আমরা’, শানু ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিল।

‘ওঃ! ওই টিলাটা!’ বাবা বললেন, ‘তা উঠতে পারলি তোরা?’

‘খুব বেশি উঁচু নয় বাবা’, শানু জবাব দিল, ‘পথটা ঘুরে ঘুরে গেছে তাই একটু বেশি হাঁটতে হয়েছে।’

‘কিন্তু ওখানে তো জঙ্গল থাকতে পারে’, মা-র গলায় আশঙ্কার সুর, ‘যদি জন্তুজানোয়ার তাড়া করত!’

‘জঙ্গল নয় মা’, শানু মাকে আশ্বস্ত করে বলল, ‘শুধু কাঁটা ঝোপ, আর বুনো ফুল।’

‘তা হোক’, মা তবু প্রবোধ মানেন না।

‘ভালুক বেরোয় নাকি মাঝে মাঝে’, রাণু এবার বলল, ‘গোবর্ধনদা বলছিল…’

শানুর পাকানো চোখে চোখ পড়তেই চুপ করে গেল ও।

‘গোবর্ধনদা!’ বাবা অবাক হয়ে বললেন।

‘মানে, ওই টিলার মাথায় একটা সুন্দর বাড়ি আছে। আমরা ওখানে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওই বাড়িতে গোবর্ধনবাবু বলে একজন থাকেন, আমাদের সব কিছু দেখালেন। তিনি বলছিলেন মাঝে মাঝে ভালুক নাকি মহুয়া ফুলের মধু খেতে আসে।’

‘তোমরা আর ওখানে যাবে না’, মা এবার রেগে উঠলেন, ‘ভালুক সামনে পড়লে তোমাদের আস্ত রাখবে নাকি! হয়তো খেয়েই ফেলবে।’

শানু এবার হেসে ফেলে বলল, ‘তুমি কিছু জানো না মা, ভালুক কি বাঘ নাকি যে মানুষ খাবে!’

‘খেলেই হল’, মা ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘তুমি সব জেনে বসে আছ।’

‘টিলার ওপর বাড়িটা আমারও চোখে পড়েছে’, বাবা চিবুকে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘অমন বেখাপ্পা জায়গায় বাড়ি করার কী মানে হয়?’

‘ওটা একটা ক্রিশ্চান পাদরির ছিল’, শানু বলে উঠল, ‘সে আজ অনেকদিন আগের কথা। তারপর সাঁওতালদের সঙ্গে সাহেবদের যুদ্ধ হয়েছিল, সাহেবরা এখান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। বাড়িটা এখন এক শেঠজির, তিনি ভাড়া দিয়েছেন।’

‘এত কথা তুমি জানলে কেমন করে?’ বাবা বেশ অবাকই হলেন।

‘ওই গোবর্ধনদাদাই তো বলেছে’, শানুর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল রাণু।

‘বাড়িটা অনেকটা দুর্গের মতো’, ওদের বাবা মন্তব্য করলেন। ‘ওখান থেকে নীচে কী হচ্ছে না হচ্ছে সব দেখা যায়। আগেকার দিনে এই কারণেই পাহাড়ের চুড়োয় দুর্গ বানানো হত। শত্রু আক্রমণ করলে তাদের প্রতিরোধ করার খুব সুবিধে ছিল দুর্গ থেকে। ওটার কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই দুর্গ রক্ষীদের পালটা আক্রমণে তাদের অনেকেই মারা পড়ত।’

ইতিহাসের অধ্যাপক শানু-রাণুর বাবা নিজের সাবজেক্ট পেয়ে উৎসাহিত হয়ে বললেন, ‘যখন আমাদের দেশে গোলা বারুদের অভাব ছিল, তখন দুর্গ থেকে শত্রু বাহিনীর ওপর পাথর ছুঁড়ে মারা হত, মেয়েরাও পুরুষদের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াই করত, ওপর থেকে ফুটন্ত জল ঢেলে দিত।’

‘কিন্তু আমাদের কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম তো গড়ের মাঠে’, শানু বলল।

‘ঠিকই বলেছ, গড় মানে দুর্গ, সেইজন্যই কলকাতার ময়দানকে বলা হয় গড়ের মাঠ’, শানুর বাবা বললেন, ‘তবে আমি যখনকার কথা বলছি তখন দুর্গম সব পাহাড়ের চুড়োয় দুর্গ গড়ে উঠেছিল।’ তিনি একটু থামলেন, তারপর শানুর মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, ‘তুমি যখন আর একটু বড়ো হবে, রাজপুতদের বীরত্বের কাহিনি পড়বে। মেবারের রাণাদের কথা, চিতোর গড়ের কথা, সব জানতে পারবে। মহারাষ্ট্রে শিবাজীও অনেক দুর্গ গড়েছিলেন, তাঁর অভিষেকও হয়েছিল রায়গড় দুর্গে। শুধু দাক্ষিণাত্যেই সে সময় দুর্গ ছিল প্রায় তিন-শো পঁয়ষট্টিটি। কোঙ্কনে একটি দুর্গ ছিল ‘রাজমাচি’। এখন যেটা বম্বে-পুণা রোড— সেই রাস্তার ওপর। দুর্গের প্রাচীর ছিল তিন মাইল জুড়ে, ষাট ফুট উঁচু পাথরের কেল্লা। ওটার দেওয়াল এমন খাড়া ছিল যে, বলা হত গিরগিটি পর্যন্ত পিছলে পড়ে যাবে।’

‘ওসব দুর্গ দখল করা তবে খুব কঠিন ছিল, না বাবা?’ গল্পের গন্ধ পেয়ে কৌতূহল চাড়া দিয়ে উঠল শানুর।

‘তা ছিল বই কী। তাই শত্রুবাহিনি এসে কেল্লার চারপাশে ঘাঁটি গেড়ে বসত। মাসের পর মাস, বছর গড়িয়ে যেত। তারপর একসময় কেল্লার খাবার-দাবার, রসদ সব ফুরিয়ে যেত, মনোবল ভেঙে পড়ত দুর্গ রক্ষীদের। তখন শত্রুবাহিনি আক্রমণ করত দুর্গ।’

‘থাক তোমাকে আর ইতিহাসের লেকচার দিতে হবে না’, ওদের মা এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কোথায় ওদের একা একা যেখানে-সেখানে যেতে মানা করবে, তা না যত সব বাজে কথা—’

‘আহা কলকাতায় ফিরে আবার তো সেই ভিড় আর গাড়ির জ্যাম, এখানে খোলামেলা জায়গায় একটু যদি না বেড়াবে তবে এসে লাভটা কী হল? যার জন্য আসা, তিনি তো বেড়াতেই চান না।’

‘বেশ’। ওদের মা রাগ করে মুখ ফেরালেন, ‘অত হাঁটতে আমি পারি না, ডাক্তারবাবু আমাকে বিশ্রাম করতে বলেছেন।’

‘এখানকার মুক্ত বাতাসে একটু হাঁটাচলা করলে শরীর তাড়াতাড়ি সেরে উঠবে’, বাবা বললেন, ‘এখানকার জল আর বাতাসেই সোনা।’

‘বাবা যে কি বলে!’ রাণু হেসে উঠল, ‘জলে আর বাতাসে বুঝি সোনা থাকে!’

‘থাকে রে থাকে’, বাবা আদর করে ওর ফর্সা গাল টিপে দিলেন, আর বললেন, ‘সেটা তুই টের পাবি ক-দিন পরে। এই জল আর বাতাসে তোর গাল দুটো যখন পাকা আপেলের মতো টসটসে হয়ে উঠবে তখন।’

ওদের বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে হাট বসে— সোমবার আর শুক্রবার। ওখানে অবশ্য হাটকে বলে বাজার। আশেপাশের গাঁ থেকে চাষিরা ঝাঁকা মাথায়, বাঁক কাঁধে সেই কাক ভোর থেকে আসতে শুরু করে, ব্যাপারিরা আসে শহর আর দূর গাঁ থেকে। সারা দিন চলে বেচা-কেনা। যে মেয়েটা ওদের বাড়িতে কাজে লেগেছে, সেই দিয়েছে খবরটা।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ভাই-বোন ফন্দি আঁটল, মা-বাবা ঘুমিয়ে পড়লেই বেরিয়ে পড়বে ওরা, বিকেল বিকেলই ফিরে আসবে।

ওরা একটু বেলা করেই বেরুল। একটা মাঠে হাট বসেছে। বেশিরভাগ চাষিই বিহারি, তবে জায়গাটা বাংলা-বিহার সীমান্ত থেকে বেশি দূর নয় তাই বেশ কয়েক ঘর বাঙালিও আছে, তারাও সওদা করতে এসেছে।

চাল-ডাল, তরিতরকারি, আনাজপাতি থেকে শুরু করে পাঁঠা, ছাগল, মুরগি সবই এসেছে হাটে। আর এসেছে একদল সাঁওতাল মেয়ে-পুরুষ। ঝাঁকা মাথায় ওরাও এসেছে বেচা-কেনা করতে। এনেছে লাউ-কুমড়ো, শাক, মুরগি আর ফলের মধ্যে আতা। এ অঞ্চলে আগে নাকি ওদেরই প্রাধান্য ছিল। পুরুষদের বেশিরভাগ খালি গা, হাঁটুর ওপর কাপড়। মেয়েদের আঁটো করে বাঁধা খোঁপা, পরনের কাপড়টা খাটো হলেও পরিষ্কার, কালো চুলে লাল ফুল। গায়ের রং কালো কিন্তু একটা আলগা শ্রী আছে।

শানুর গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু রাণু রীতিমতো ফর্সা। কোঁকড়া চুল, ডাগর ডাগর চোখ। ওকে দেখে সাঁওতাল মেয়েরা নিজেদের মধ্যে গা টেপাটেপি করে কী সব বলাবলি করছিল আর হাসছিল।

শানু এক জনকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমরা আমার বোনকে দেখে অমন হাসছ কেন?’

ওরা হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর ওদের এক জন জবাব দিল, ‘হাঁইসতে ইচ্ছ হইয়েছঞে যে গো, হাঁইসব নাই?’

‘হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে কেন?’ শানুর একটু রাগই হল, ‘আমরা কি সং নাকি যে দেখে ইচ্ছে হচ্ছে!’

‘নাই গ’, মেয়েটি জবাব দিল, ‘সং হবে ক্যানে! কথাটা তবে বল্যা ফেলি, তুর বুনটা খুউব সোন্দরপানা বটে।’

‘বা!’ শানু তো অবাক! ‘সুন্দর হলে হাসির কী আছে?’

ওরা আবার এক দমক হাসিতে ঢলে পড়ল।

‘তু বুঝতে পারলেক নাই’, আর একজন বলল, ‘সোন্দর জিনিস দেখ্যা মন খুশি হয়্যা যায়, মন খুশি হল্যে, হাসি আইসঞে, গান আইসঞে।’

‘কী বলছে ওরা?’ দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল রাণু। সাঁওতাল মেয়েদের কথার এক বর্ণও ওর মাথায় ঢোকেনি।

‘ওরা বলছে সুন্দর জিনিস দেখলে মন খুশি হয়, হাসি আসে।’

‘হঁ, ঠিক বুলছ গো খুকাবাবু।’ আর একজন বলল, ‘হামাদের কথা তুমহারা বুঝবে ক্যানে নাই, হামরা তো তুমহাদের ভাষায় কথা বুলছি, তুমহাদের ভাষা শিখেঞইছি, ক্যামন সুন্দর বুলছি দেখ ক্যানে!’ খিলখিল করে হেসে উঠল মেয়েটি, আর সেই হাসির ঢেউ লাগল অন্যদের মধ্যে।

হাসি থামিয়ে প্রথম মেয়েটি বলল, ‘তুমহাদের চিনি গো, যে বিটি তুমহাদের ঘরে কাম করে বটে, উঁ হামার বুন আছে, যেমন উটি তুমহার বুন!’

‘ওঃ!’ শানু যেন দারুণ একটা আবিষ্কার করেছে এমনভাবে বলল, ‘ও তোমার বোন?’

‘হঁ, মেয়েটি হাসল, বকের পালকের মতো সাদা এক সার দাঁত যেন ঝিলিক খেয়ে গেল।

‘তুমহারা ইখানে কার সাথে আইসেছ?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করল।

শানু একটু অস্বস্তি বোধ করল, ওরা যদি বাড়িতে বলে দেয়। মুখে ও বলল, ‘আমরা একাই এসেছি, এখানে তো আর হারিয়ে যাবার ভয় নেই।’

‘তা লয়গো খুকাবাবু’ মেয়েটি বলল, ‘ইখানে কত্য রকম মানুষ আছে বটে। তা আইসেছ যখন সব দেখ্যা যাও।’

রাণুর হাত ধরে শানু অন্য দিকে হাঁটা দিল।

ওরা ঘুরে ঘুরে সব দেখছিল, বেশ ভালো লাগছিল বেচা-কেনা দেখতে। বেলা যে গড়িয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। হঠাৎ শানু থমকে দাঁড়িয়ে রাণুর হাতটা চেপে ধরল।

‘কী হল রে দাদা?’ রাণু অবাক হয়ে প্রশ্ন করল। ‘চুপ’, শানু ওকে সাবধান করে একটা গাছের আড়ালে টেনে নিল, তারপর আঙুল দিয়ে দেখাল।

একটু দূরে তিন জন লোক দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা বলছে। তাদের মধ্যে একজন গোবর্ধন সাঁতরা। অন্য দু-জনের চেহারাও ষণ্ডামার্কা। কথা শেষ করে ওদের একজন পকেট থেকে এক তাড়া নোট বার করল, নিজেদের মধ্যে তা ভাগাভাগি করে এদিকেই এগিয়ে এল ওরা। ওদের চোখ এড়াবার আর উপায় নেই।

শানু কী করবে ভেবে ওঠার আগেই ওদের সামনে এসে পড়ল গোবর্ধন আর তার সঙ্গী দু-জন। রাণু একেবারে সিঁটিয়ে দাঁড়াল দাদার গায়ের সঙ্গে, ওর বুকের ভেতর ঢিপ টিপ করছে।

ওদের দু-জনকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল গোবর্ধন। ওর দু-চোখে রাজ্যের বিস্ময়!

‘একী! তোমরা এখানে—?’

‘আমরা হাট দেখতে এসেছে’,শানু ঢোঁক গিলে বলল। গোবর্ধনের সঙ্গী দুজনকে ওর ভালো ঠেকছে না।

‘তুমি এখানে কি করছ?’ দাদার দেখাদেখি রাণুও সাহস করে প্রশ্ন করল।

 হা হা করে হেসে উঠল গোবর্ধন, বলল, ‘ভালো প্রশ্ন করেছ। আমি এসেছি সওদা করতে। দেখেছ তো, আমি এমন জায়গায় থাকি যেখানে কিছু পাওয়া যায় না, তাই আমাকে হাটে এসে বাজার করতে হয়।’

‘কে ওরা?’ ওর সঙ্গীদের একজন জিজ্ঞেস করল। লোকটার গলার স্বর যেমন কর্কশ, চেহারাও তেমন কুৎসিত। গোবর্ধনের গায়ের রং ফর্সা না হলেও স্বাস্থ্যবান চেহারা, মুখেও একটা নরম নরম ভাব। কিন্তু এ লোকটার মিশমিশে গায়ের রং, বনমানুষের মতো লোমশ শরীর, বাবরি চুল, মুখে চাপ দাড়ি, দু-চোখে যেন বাজ পাখির দৃষ্টি। কপালে একটা বিচ্ছিরি কাটা দাগ।

‘আমার ছোট্ট বন্ধু’, গোবর্ধন হেসে জবাব দিল, ‘কলকাতা থেকে এখানে বেড়াতে এসেছে ওদের মা-র অসুখ করেছিল তাই ডাক্তার হাওয়া বদল করতে বলেছেন। সেদিন আমাদের ওখানে গিয়েছিল।’

‘আমাদের ওখানে!’ সেই সঙ্গী যেন ভীষণ চমকাল, ‘কই, আমাকে বলিসনি তো!’

‘তুমি হাসালে গুরু’, গোবর্ধন ব্যাপারটা হালকা করতে চাইল, ‘দুটো বাচ্চা এখানে মা-বাবার সঙ্গে হাওয়া বদলাতে এসেছে। বেড়াতে বেড়াতে আমাদের ওখানে চলে গিয়েছিল, তা আবার ঢাক পিটিয়ে বলার মতো ব্যাপার নাকি!’

গোবর্ধনের জবাবে লোকটি তেমন খুশি হল বলে মনে হল না, গম্ভীর গলায় বলল, ‘হুঁ!’

‘আসলে বাড়িটা দূর থেকে দেখে ওদের ভালো লেগেছিল, তাই দেখতে যাওয়া। আমার সঙ্গে খুব ভাব হয় গেছে।’ তারপরই ওদের দিকে ফিরে বলল, ‘মিঠাই খাবে? চলো, ওদিকে মিঠাইয়ের দোকান আছে।’

‘তোর কি মতিভ্রম হল নাকি!’ সেই লোকটি রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এইসব কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে ঝামেলা বাড়াচ্ছিস কেন?’

‘আহা, অত চটছ কেন?’ গোবর্ধন হেসে উঠল, ‘ছেলেমানুষ, এখানে বেড়াতে এসেছে, একটু মিঠাই খাওয়াব তাতে দোষটা কোথায়? তোমরা বরং মতির দোকানে অপেক্ষা কর, আমি পাঁচ দশ মিনিটের মধ্যেই আসছি।’

সঙ্গীদের কাউকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে শানু আর রাণুর দু-হাত দু-মুঠিতে চেপে ধরে ও তাদের নিয়ে হাঁটা শুরু করে দিল।

গোবর্ধন যদি তখন পেছন ফিরে তাকাত, তবে দেখতে পেত তার সেই সঙ্গীর চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে একটা হিংস্র ছাপ। শক্তিতে যদি কুলোত তবে হয়তো সে গোবর্ধনকে বাধা দিত, কিন্তু সেদিক দিয়ে বিচার করলে পাল্লাটা গোবর্ধনের দিকেই বেশি ভারী।

এখানকার মিষ্টির দোকানে রসগোল্লা পান্তুয়া পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় লাড্ডু আর ক্ষীরের মেঠাই। তাই কিনল গোবর্ধন। ওদের দু-জনের হাতে দুটো শালপাতার ঠোঙা তুলে দিল।

‘বাঃ রে! আমরা একাই খাব নাকি!’ রাণু প্রতিবাদ করে উঠল, ‘তোমারটা কোথায়?’ ও এখন অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে, গোবর্ধনকে প্রথম দর্শনে যে ভয়টা হয়েছিল তা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।

‘আমাকেও খেতে হবে বুঝি?’ গোবর্ধন হেসে ফেলল।

‘হবে না!’ রাণু বলল, ‘আমরা খাব আর তুমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে, আমাদের পেট খারাপ হবে না?’

‘তাই তো! সে-কথা মনে ছিল না’, গোবর্ধন জিভ কাটল, তারপর নিজের জন্য একটা ঠোঙা নিল।

খাওয়া শেষ হলে গোবর্ধন জিজ্ঞেস করল, ‘এবার কোথায় যাবে?’

‘এবার আমরা বাড়ি ফিরব’, শানু জবাব দিল, ‘দেরি হলে মা-বাবা ভাববেন।’

‘হ্যাঁ, সে-কথা ঠিক। আচ্ছা এসো তোমরা তবে।’ ওদের ছেড়ে দিয়ে উলটো মুখে হাঁটা দিল গোবর্ধন।

বাড়ির দিকে যেতে যেতে শানু বলল, ‘শুনলি তো? গোবর্ধনবাবু বন্ধুদের বলল, ‘আমাদের ওখানে গিয়েছিল। আমার ওখানে গিয়েছিল, বলেনি। তার মানে ওই বাড়িতে ওই দু-জন লোকও থাকে।’

‘তোর খালি সন্দেহ’, অপ্রসন্ন মুখে বলল রাণু। গোবর্ধন সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য ওর তেমন মনঃপূত হচ্ছে না। নিজের অজান্তেই ওই মানুষটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে ওর।

‘তোর দ্বারা গোয়েন্দার শাগরেদি করা হবে না’, শানু রায় দিল, ‘তোকে মিষ্টি খাইয়ে ভুলিয়ে দিয়েছে লোকটা।’

‘বেশ!’ অন্য দিকে মুখ ফেরাল রাণু, ওর চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে স্পষ্ট বিরক্তির চিহ্ন।

গোবর্ধন মুখ নীচু করে হাঁটছিল। ওর মনের মধ্যে কেমন যেন একটা ঝড় উঠেছে। ছেলে-মেয়ে দুটিকে সেদিন গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিরক্তই হয়েছিল ও, কিন্তু পরে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে সেই ভাবটা এখন আর নেই। যেমন মিষ্টি মেয়েটির চেহারা, তেমনই মিষ্টি কথা। ‘তোমাকে তো ভালো লোকই মনে হচ্ছে।’ রাণুর সেই কথাটা বার বার মনে পড়ছিল ওর, আর দু-ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠছিল এক চিলতে হাসি।

আরও একটা কথা মনে পড়ছিল গোবর্ধনের। সে আজ চোদ্দো পনেরো বছর আগের কথা, ওর বয়স তখন কত? তেরো চোদ্দো। ছোট্ট এক বোন ছিল ওর, এই মেয়েটির বয়সি। কী হাসিখুশিই না ছিল! দাদাকে ছাড়া এক মুহূর্তও চলত না। কী ভালোই না বাসত ওকে। তারপর একদিন ঘনিয়ে এল কালো মেঘ, একটা দমকা হাওয়া এসে তছনছ করে দিয়ে গেল ওদের সুখের সংসার। ও তখন নেহাতই ছেলেমানুষ, একটা অবলম্বন করে দাঁড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি। পায়ের তলার মাটি এক বার সরে গেলে আবার তার নাগাল পাওয়া সহজ নয়। শেষপর্যন্ত অন্ধকারে হারিয়ে গেল সেই ছেলেটি। এখন অন্ধকার জগৎটাই বাঁচিয়ে রেখেছে ওকে, কিন্তু তবু মাঝে মাঝে পুরোনো দিনের কথা মনে পড়লে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। এই মেয়েটি ওকে যেন নতুন করে পুরোনো দিনগুলিতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। ওর ডাগর ডাগর নিষ্পাপ দু-চোখের চাউনি বুকে যেন শেলের মতো বিঁধছে গোবর্ধনের।

একটা চায়ের দোকানে ওর সঙ্গী দু-জন অপেক্ষা করছিল। যে লোকটির চেহারা ভয় পাবার মতন, গোবর্ধনের সঙ্গে কথা বলছিল, তার নাম বিষ্টু, অন্যজনের ভিখু।

ওকে আসতে দেখে বিষ্টু ঠেস দিয়ে বলে উঠল, ‘এত তাড়াতাড়ি নতুন বন্ধুদের মিঠাই খাওয়ানো হয়ে গেল?’

গোবর্ধন কোনো জবাব দিল না, শুধু এক পলক স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। সে দৃষ্টি বিষ্টুর অচেনা নয়। আজ কয়েক বছর হল গোবর্ধন দলে আছে, ওর শক্তি আর সাহস দলের পক্ষে মস্ত এক সহায়। কিন্তু খেপে গেলে ওকে সামলানো দায় হয়ে ওঠে। খেপা বুনো মোষের মতোই তখন হিংস্র হয়ে ওঠে ও।

‘শেঠজি গোসা করিয়েছেন’, হিন্দি বাংলার খিচুড়ি ভাষায় ভিখন বলল, ‘বেওসা এ মাসে আচ্ছা নেহি হুয়া।’

‘আচ্ছা নেহি হুয়া’, গোবর্ধন ভেংচে উঠল, ‘উনি লাভের গুড় খাচ্ছেন বসে বসে, আর যত ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে আমাদের, কিন্তু পাচ্ছি ছিটেফোঁটা।’

‘শেঠজি টাকা ঢেলেছেন, বাড়িটা দিয়েছেন’, বিষ্টু বলল, ‘লাভের বেশি অংশটা উনি তো নেবেনই।’

‘তুমি তো তা বলবেই’, ঝাঁঝিয়ে উঠল গোবর্ধন। ‘তুমি ওর ডানহাত, বেশি পাও কিনা তাই—।’

‘অত মেজাজ ভালো নয়’, বিষ্টুর দু-চোখ এবার কুঁচকে গেল, ‘কিছুদিন ধরে লক্ষ করছি কিছুই তোর পছন্দ হচ্ছে না। শেঠজিও এ নিয়ে আমাকে বলেছেন।’

‘শেঠজি বলছেন না তুমি শেঠজিকে বলেছ সেটাই হল কথা’, গোবর্ধন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আমার ব্যাপারে তুমি যে শেঠজির কাছে ভাংচি কাটছ, সে খবর আমার কানে এসেছে।’

উঠে দাঁড়াল বিষ্টু, ওর মুখটা কালো হয়ে গেছে।

‘তোকে একদিন পস্তাতে হবে এ আমি বলে দিলাম’, ক্রুদ্ধ কণ্ঠে ও বলল, ‘আমি দলের সর্দার, কেউ আমার মুখের ওপর কথা বলতে সাহস করে না, আর তুই যা ইচ্ছে তাই বলছিস!’ হনহন করে ওখান থেকে চলে গেল বিষ্টু।

‘কাজটা ভালো হল না ওস্তাদ’, ফিসফিস করে বলল ভিখু ওরফে ভিখন। গোবর্ধনকে ও ওস্তাদের চোখেই দেখে। ‘তোমাকে ও পসন্দ করে না, ঝামেলায় ফেলনে সকতা।’

‘ছাড় তো’ গোবর্ধন বিরক্ত মুখে উঠে দাঁড়াল, ‘ওসব চামচেকে এ শর্মা ডরায় না।’

কয়েকটা দিন কেটে গেছে। ওদের মা-র শরীর সত্যিই সেরে উঠছে। জায়গা বদলে যে এত তাড়াতাড়ি কাজ হয় তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। আগের সেই ক্লান্তি ভাব নেই, খিদে হচ্ছে, আর সবচেয়ে যা চোখে পড়ার মতো তা হল, তাঁর দু-গালে লাল ছোপ পড়েছে।

এখানে খাবার-দাবারও সস্তা। মুরগির দাম তো কলকাতার তুলনায় খুবই কম, দশ-বারো টাকায় একটা বেশ বড়ো মুরগি পাওয়া যায়। সাঁওতালদের জন্যই মুরগির দাম কম। ওদের প্রত্যেকের ঘরে মুরগি আছে, তারা ডিম পাড়ে, তারপর একদিন ডিম ফুটে বেরোয় ছানা। মা মুরগির পেছন পেছন ছানাগুলো ঘুরে বেড়ায়, মাটি থেকে খুঁটে খুঁটে খাবার খায়, শানুর আর রাণুর ভারি মজা লাগে দেখতে।

সেদিন ওরা ভাই-বোন সাঁওতাল পাড়ার দিকেই যাচ্ছিল। রাস্তায় এক সাঁওতাল ছেলের সঙ্গে দেখা হল। ছেলেটি শানুরই বয়সি হবে। পরনে একটা নেংটির মতো কাপড়, উদলা গা।

ওদের সামনে পড়তেই ছেলেটা মুক্তোর মতো দাঁত বার করে হাসল। রাণু ভুরু কুঁচকে বলল, ‘এত বড়ো ছেলে কিছু পরেনি, আবার হাসছে দেখ।’

শানু একটু বিব্রত বোধ করল। চাপা গলায় বলল, ‘আঃ! ওরা গরিব, জামাকাপড় পাবে কোথায়?’

‘হুঁ’, ছেলেটি এবার বলল, ‘হামরা কি বাবুদের ছেইল্যা! হামাদের কি পইসা আছে? জামাকাপড় পাব কুথা থিকে?’

‘তুমি আমাদের বাড়ি এসো’, রাণু এবার বলল, ‘আমি মাকে বলে আমার দাদার একটা জামা তোমাকে দেব।’

‘দিবি তু!’ ছেলেটির মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, ‘তবে আমি তুকে একটা মুরগির ছানা দিব।’

‘সত্যি!’ আনন্দে দু-হাতে তালি দিল রাণু।

‘কিন্তু ওটা খাবে কী?’ শানু সংশয় প্রকাশ করল।

‘ক্যানে।’ ছেলেটি একটু অবাক হয়ে বলল, ‘এট্যু চাউল দিবা, ধান দিবা, আর কিছু না দিবা তো উটা ঠিক খাবার জুগাড় কর‌্যা লিবে। তুমহাদের ভাবতে হবেক লাই।’

ছেলেটির নাম বুধন। পরদিন সত্যিই ও একটা মুরগির ছানা নিয়ে এল। ওদের উৎসাহ দেখে মা-বাবা আর বাধা দিলেন না। বুধনই ছানাটার থাকার ঘর বানিয়ে দিল, কী করে খাওয়াতে হয় দেখিয়ে দিল। ছানাটা একটু বড়ো দেখেই এনেছিল বুধন, ও জানত, ছোটো হলে ওটা বাঁচবে না, বাবুদের ছেলে-মেয়েরা বাঁচাতে পারবে না ওটাকে।

ওটার নাম রাখা হল ‘ডাচেস’, ওটা মোরগ নয় মুরগি, তাই ওই নামটা পছন্দ করে দিলেন ওদের মা।

রাণু কিন্তু বুধনকে ওর দাদার একটা জামা দিতে ভুলল না। মাকে বলে পুরোনো জামা থেকে একটা বেছে দিল ওকে। পুরোনো হলেও শক্ত আর ডোরা কাটা।

জামা পেয়ে বুধনের সে কী আনন্দ! কিন্তু কিছুতেই সেটা গায়ে দিল না, যক্ষের ধনের মতো বুকে আঁকড়ে রইল।

বুধন সাঁওতালদের মোড়লের ছোটো ছেলে। ওর সঙ্গে শানু-রাণুর বেশ ভাব হয়ে গেল। প্রায়ই আতাটা, পেয়ারাটা ও নিয়ে আসে ওদের জন্য। রাণুর মাও ওকে এটা ওটা খেতে দেন। ও লাজুক মুখে তা হাত পেতে নেয়, কিন্তু ওদের সামনে লজ্জা পায় খেতে। ছেলেটা গরিব হলে কী হবে, আত্মসম্মান জ্ঞান ওর টনটনে। বলে, ‘হামরা ভিগ মাগি না, হঁ।’

ওদের পাড়ায় শানুদের বেড়াতে নিয়ে গেছে বুধন। খড়ের ছাউনি দেওয়া মাটির দেয়ালের সব ঘর, ভেতর দিকে খানিকটা উঠোন, তকতকে নিকানো। প্রায় সব বাড়ির চালা লাউ-কুমড়োর ডগায় ছেয়ে গেছে। সবুজ ডগা-পাতা আর হলুদ কিংবা সাদা ফুল। বাইরের দিকে ছোট্ট একফালি বাগান। লঙ্কা, বেগুন আর শিমের ফলনই চোখে পড়ে বেশি।

ওদের দেখে ছেলে-বুড়ো সবাই ভিড় করেছিল। পুরুষদের বেশির ভাগেরই গায়ে কিছু নেই, বড়োজোর কাপড়ের খুঁট। এখানে কিন্তু ঠান্ডা পড়তে শুরু করে দিয়েছে।

সদ্য গাছ থেকে নামানো টাটকা খেজুরের রস ওদের খেতে দিল বুধনের বাবা। বুড়ো মানুষ কিন্তু বুক সোজা করে হাঁটে।

টাটকা খেজুরের রসের স্বাদই আলাদা, আগে কখনো খেজুরের রস খায়নি ওরা, পাবে কোথায়! কী মিষ্টি, যেন অমৃত!

যে মেয়েদের সঙ্গে হাটে ওদের দেখা হয়েছিল, তারা সবাই কামিনের কাজ করে। ওরা কাজে বেরুচ্ছিল। শানুদের দেখে এগিয়ে এল। ওদের বাড়িতে যে মেয়েটি কাজ করে তার বোনের নাম কুসুম। সেই বলল, ‘অ্যাই দ্যাখ, বাবুদের ছেইল্যাটা আর মেইয়্যাটা হামদের ঘরে আইল, পাটিয়া পাতি দিলেক নাই বটে!’

এক জন তাড়াতাড়ি একটা চাটাই এনে দাওয়ায় বিছিয়ে দিল। শানুর খুব লজ্জা করছিল, রাণু যদি উলটোপালটা কথা বলে ফেলে!

‘আমরা এখন বসব না’, ও বলল, ‘আমরা বেড়াতে বেরিয়েছি, ঘুরে ঘুরে সব দেখব কিনা তাই।’

‘হঁ হঁ’, বুধনের বাবা বলল, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, ইখানে একটা ঝন্না আছে, দেখ্যা লিও।’

যাবার সময় কুসুম বলল, ‘ইখানে আইসছ, হামদের লাচ দেখ্যা য্যেও কিন্তুক। খুব সোন্দর নাচ করি হামরা।’

খিলখিল করে হেসে উঠল ও।

বুধন ওদের সঙ্গেই হাঁটছিল। আজকাল ও ওদের সঙ্গ ছাড়তে চায় না, অন্য সব সাঁওতাল ছেলে-মেয়েদের হাত থেকে সবসময় আগলে আগলে রাখে, ও যেন এখানে ওদের গার্জিয়ান।

শানু ওকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওই পাহাড়ে তুই উঠেছিস?’

‘হঁ’, বুধন হাসিমুখে জবাব দিল, ‘উখানে খরগোশ আছে, আমি মারলম।’

‘কী করে মারলি?’ শানুর কৌতূহল যেন ফেটে পড়ছে।

‘ক্যানে, তির মারলম’, বুধন সরল ভাবে জবাব দিল।

‘তির! তুই তির ছুঁড়তে পারিস?’ শানু যেন বিশ্বাস করতে পারে না।

‘হঁ, এবার গর্বের সঙ্গে জবাব দিল বুধন, ‘পারি বটে, হামরা শিকারি আছি, উ পাহাড়ে কেত্য শিকার কর‌্যাছি।’

এবার একটু শ্রদ্ধার সঙ্গে ওর দিকে তাকাল শানু।

‘পাহাড়ের মাথায় ওই বাড়িটায় গেছিস তুই?’ ও আবার প্রশ্ন করল।

‘উখানে!’ বুধনের দু-চোখ বিস্ফারিত হল, ‘উটা ভালো নয়।’

‘ভালো নয়! কেন?’ শানু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল।

‘তা হামি বুলতে লারব’, বুধন ঘাড় নাড়ল, ‘শুন্যেঞছি উখানে দানো আছে, ডান আছে।’

শেষপর্যন্ত বোঝা গেল অনেক রাতে ওই বাড়িতে নাকি আলো দেখা যায়। দপ দপ করে জ্বলে আর নিভে যায়।

আলোর সংকেত! খুদে ডিটেকটিভ শানুর মগজটা কাজ শুরু করে দিল। ওই টিলাটার নীচে মাঝে মাঝেই নাকি একটা কালো গাড়িকে আসতে দেখা যায়। নিশ্চয়ই ওই বাড়ির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে।

একটা কিছু রহস্য নিশ্চয়ই আছে বাড়িটাকে ঘিরে! শানু মনে মনে ফন্দি আঁটতে থাকে।

যে সাঁওতাল মেয়েটি শানুদের বাড়ি কাজে লেগেছিল, সে-ই একদিন সন্ধের পর নাচের দল নিয়ে এল। মেয়ে পুরুষ মিলে জনা পঁচিশেক, তা ছাড়া ছোটো ছেলে-মেয়েও আছে।

পুরুষেরা কাঁধে তুলে নিয়েছে মাদল, বোল উঠেছে ধিতাং তাং ধিতাং তাং। তার সঙ্গে তাল মিলিয়েছে বাঁশি। শিউলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। এ যেন অন্য এক জগৎ।

শানুর মা গায়ে একটা শাল জড়িয়ে বাইরের বারান্দায় চেয়ারে বসেছেন। তাঁর মুখে খুশি খুশি ভাব। ওদের বাবারও খুব উৎসাহ। এখানে এসে তিনি সাঁওতালদের সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য জোগাড় করতে উঠে-পড়ে লেগেছেন। ওদের মোড়লের সঙ্গে তাঁর খুব ভাব হয়ে গেছে। এই মোড়লের ঠাকুরদাই সেই সাঁওতাল বিদ্রোহের নেতা ছিল। মোড়লের বাড়িতে একটা পুঁথি পেয়েছেন শানুর বাবা, সাঁওতালি ভাষায় লেখা। তিনি এখন ওটার পাঠোদ্ধারের চেষ্টায় আছেন। সেই সূত্রে মোড়লের ওখানে মাঝে মাঝেই তিনি যান। একদিন তিনি গোটা সাঁওতাল পাড়াকেই পেট ভরে খাইয়েছিলেন। শুধু ভাত আর পাঁঠার মাংস। তাই যেন ওদের কাছে উৎসব। রান্না হয়েছিল মোড়লের উঠোনে। মস্ত বড়ো একটা উনুন বানাতে হয়েছিল, মোটা মোটা শাল কাঠ কেটে এনেছিল ওরা, গনগনে আগুন। ওরা সবাই মিলে জোগাড় দিয়েছিল। শানুর মাও গিয়েছিলেন, রান্নার তদারক তিনিই করেছিলেন, ওদের সঙ্গে একপাতে বসে খেয়েছিলেন তাতেই ওরা খুব খুশি। শানুর মা-র গায়ের রং খুব ফর্সা, তাই ওরা তাঁকে বলে আঙ্গা মা, রাণুকে বলে আঙ্গা খুকি, শানুকে শুধু খুকাবাবু। শানুর বাবা ওদের কাছে বড়োবাবু। আগে এ অঞ্চলে প্রচুর বাঙালি ছিল, তাই তাদের ভাষাটাও এদের মধ্যে মিশে গেছে।

নাচ শুরু হল। একপাশে মেয়েরা হাত ধরাধরি করে সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে, তাদের মুখোমুখি জোয়ান ছেলেরা। মাদলের তালে তালে পা ফেলে ওরা নাচছে। এক বার মেয়েরা সামনের দিকে কয়েক পা এগিয়ে আবার পিছিয়ে আসছে, তারপরই পালা আসছে ছেলেদের। মেয়েরা মিষ্টি গলায় গান ধরেছে, ছেলেদের লক্ষ করে কী যেন বলছে, পরে তার জবাব দিচ্ছে ছেলেরা। গান কিন্তু ওরা করছে নিজেদের ভাষায়।

মেয়েরা গান ধরল :

গাডা ঘাটরে হঁ বঞিঁ চালাঃ

কাদাম ব্যুটরে-হঁ বঞিঁ চালাঃ।

গাডা ঘাট দ লেঞ্জে আঃ

কাদাম ব্যুটরে হেন্দে আয়াং।

[নদীর ঘাটে যাব না গো

কদম তলায় যাব না বাপ—

নদীর ঘাট পিছল বড়ো

কদম তলায় কেউটে সাপ।]

ছেলেরা গানে গানে জবাব দিল :

গাডা পেরেঃ তে আমাঃ ওড়াঃ দাসাওয়েন

গাডা পেরেঃ তে ইঁঞে ওড়াঃ দাসাওয়েন।

নিত দ বানা হড়তে মিঃ টেইলাং ওড়াঃ গা,

ববুঃ কোয়া কলরে কালাং কïমি।

(ï-উচ্চারণ ‘আও’য়ের মতো)।

[নদীর বানে ভাসল তোমার ঘর

আমার ঘর ভাসল নদীর টানে—

এবার দু-জন বাঁধব মোরা ঘর

কাজ করব বাবুদের কারখানে।]

আরও অনেক গান করল ওরা।

সেইসঙ্গে নাচ, আর তার সঙ্গে সমানে পাল্লা দিয়ে বাজল বাঁশি আর মাদল। এ যেন এক অন্য জগৎ। সেখানে দুঃখ নেই, বিষাদ নেই, আছে শুধু হাসি, গান আর আনন্দ।

সব শেষে পুরুষ মেয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে গান ধরল, গানের ভাষাটাও বেশ সরস—

পস্তু বাটি ঘসর ঘসর

মুগ কলাইয়ের ডাল লো—

নাই আইলা বড়ো বহুর ভাই লো।

তারপর একসময় শেষ হল ওদের নাচ-গান, শানুর বাবা ওদের মোটা বখশিশ দিলেন। ওরা বলল চাঁদের আলোয় নাচ আরও জমে। কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে নাকি খুব উৎসব হয়েছিল ওদের। বুধন শানুকে বলল, ‘ইস, উ লাচ তুরা দেখতে পাল্যে নাই, খুব জম্যেঞছিল, কেত্য লাচ-গান হয়েঞছিল।’

বিদায় নেবার আগে শানুর মা-বাবার নামে ওরা জয়ধ্বনি দিল। শানুর মা যেন অভিভূত হয়ে গেলেন। এমন পরিবেশ, এমন অকুণ্ঠ ভালোবাসা, শহরের মানুষ চিন্তাও করতে পারে না।

তিনি কি তখন ছাই জানতেন, এই শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশেও কী ভীষণ বিপদ তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে!

সেই যে মুরগির ছানাটা, ডাচেস, ওটা তির তির করে বড়ো হচ্ছে। এখন বেশ ছুটতে পারে। রাণু ওর পেছনে ছুটে হিমসিম খেয়ে যায়। তবে ও কিন্তু রাণুর খুব ন্যাওটা। রাণু দূর থেকে ওর নাম ধরে ডাকলেই, ও যেখানেই থাকুক না কেন, ছুটে আসবে। রাণু ওকে খাওয়ায়, ওর সঙ্গে খেলা করে, খুব ভাব হয়ে গেছে ওদের। ওটার রং হয়েছে ধবধবে সাদা, ডাচেস নাম সার্থক।

শানু ঠাট্টা করে বলে, ‘মা লক্ষ্মীর বাহন হল পেঁচা, আর তোর বাহন হল মুরগির ছানা।’

‘বেশ!’ রাণু জবাব দেয়, তারপরই বলে ওঠে, ‘জানিস দাদা, কাল সেই কী যেন নামটা… হ্যাঁ, হংসদূত… ওই হংসদূতের বাহন আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিল। আমি চেঁচিয়ে ডাকতেই গাড়ি থামাল। আমার সঙ্গে কথা বলল।’ তারপরই গলা নামিয়ে বলল, ‘একটা কথা বলব, কাউকে বলবি না বল।’

‘বেশ বলব না’, জিজ্ঞাসা ভরা চোখে তাকাল শানু।

‘গোবর্ধনদা আমাকে মিষ্টি খাবার জন্য দশটা টাকা দিয়েছে।’

‘তুই হ্যাংলার মতো টাকা নিলি!’ শানু একটু রাগই করল, ‘অচেনা লোকের কাছ থেকে হাত পেতে কিছু নিতে নেই জানিস না?’

‘বারে!’ রাণু জবাব দিল, ‘গোবর্ধনদাকে তো আমি দাদা বলে ডেকেছি, অচেনা লোক হতে যাবে কেন?’

‘তুই একটা বোকা মেয়ে’, শানু বলল।

‘বেশ!’ রাণু ঠোঁট উলটাল, ‘বুঝেছি, তোকে টাকা দেয়নি তো, আমাকে দিয়েছে, তাই তোর রাগ হয়েছে।’

‘ধ্যাৎ’, শানু প্রতিবাদ করল, ‘আমাকে দিলে আমি নিতামই না।’

‘না, নিত না’, রাণু একটু ঠেস দিয়ে বলল, ‘তবে সেদিন মিঠাই খেলি কেন?’ তারপরই গলার স্বর বদলে বলল, ‘জানিস, গোবর্ধনদা কি বলেছে?’

‘কী?’ ভুরু কোঁচকাল শানু।

‘বলেছে ওর নাকি আমার মতো ছোট্ট এক বোন ছিল, ঠিক আমার মতো দেখতে। খুব ভালোবাসত গোবর্ধনদাদাকে, হঠাৎ অসুখ হয়ে মরে গেল। বেচারি!’

রাণুর গলার স্বর নরম হয়ে আসে।

শানু কিন্তু তখন অন্য কথা ভাবছে। এখান থেকে চলে যাবার আগেই একটা কাজ করতে হবে ওকে। যখন কেউ থাকবে না, তখন ওই টিলার বাড়িতে গিয়ে যেমন করেই হোক বন্ধ ঘরের দরজাটা খুলে ভেতরে কী আছে দেখতে হবে। গোয়েন্দাগিরির এমন সুযোগ হারালে চলবে না, হয়তো সারাজীবন আফশোস করতে হবে।

কিন্তু রাণুকে নিয়ে ওখানে যাওয়া ঠিক হবে না। যদি কোনো বিপদ হয়। বুধন? ও কি যেতে রাজি হবে, না ওকে এ ব্যাপারে সঙ্গে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

ও আজকাল প্রায়ই বুধনের সঙ্গে সাঁওতাল পাড়ায় যায়, দেরি হলেও মা-বাবা কিছু বলেন না। ওখানে যে ওরা নিরাপদ তা এতদিনে ওঁরা বুঝে গিয়েছেন।

একদিন বুধনকে ও বলল, ‘আচ্ছা, তুই যে বলেছিলি ওই পাহাড় চুড়োর বাড়িটা থেকে দপ দপ করে আলো জ্বলে, তা আমাকে দেখাতে পারবি?’

‘ক্যানে দেখাতে লারব’, বুধন জবাব দিল, ‘কিন্তুক সেটা তো আতে হয়গো, তুমহাকে দেখাব কী কর‌্যা?’

‘ও’। শানুর মনটা দমে গেল, রাত্তিরবেলা তো আর বাড়ি থেকে বেরুনো যাবে না।

বুধনের কাছে আসল প্রস্তাবটা পাড়বে কিনা সে বিষয়ে মনস্থির করতে পারে না ও।

এর মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটে গেল।

বুধন প্রায়ই গোরু চরাতে যায়। ওই টিলার চারপাশে সবুজ প্রান্তর আর বড়ো বড়ো গাছ। সেখানে গোরুগুলি ছেড়ে গিয়ে গাছের ছায়ায় বসে ওদের দেখাশোনা করে। একদিন বিকেলে শানু একাই বেরিয়েছিল। ইচ্ছে ছিল ওই বাড়িটায় হানা দেবে। পথেই বুধনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ও তখন ফিরবার উদ্যোগ করছে। শানুকে দেখে তখুনি আর ফিরল না ও। একটা গাছের তলায় বসে ওরা গল্প করছিল। হঠাৎ ওদের চোখে পড়ল একটা কালো গাড়ি লাল ধুলো উড়িয়ে এ দিকেই আসছে।

‘উ দ্যাখ!’ বুধন বলে উঠল, ‘উ গাড়িটা ইখানে আইসঞছে, উটার কথা বলঞ্যছিলম তুকে।’

গাড়িটা টিলায় ওঠার পথটা যেখানে শুরু হয়েছে ঠিক তার সামনেই এসে থামল। শানুরা যেখানে ছিল সেখান থেকে সব দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু ওরা গাছের গুঁড়ির আড়ালে থাকায় ওদের কেউ দেখতে পাচ্ছিল না।

গাড়ি থেকে কয়েক বার হর্ন বেজে উঠল। আগেই বলা হয়েছে, টিলাটা চারতলার মতো উঁচু, অমন উঁচু বাড়ি কলকাতায় মেলাই আছে। বাড়িটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল ওরা। ওখান থেকে তিন বার ভেঁপুর মতো আওয়াজ হল।

 শানুর মনে হল এই হর্নের জবাবে কেউ অমন শব্দ করল। তারপর ওদের নজরে পড়ল বাড়ি থেকে দু-জন লোক মাথায় ভারী কিছু একটা নিয়ে ঢালু পথ বেয়ে তর তর করে নেমে আসছে। নীচে নেমে আসতেই ওদের চিনতে পারল শানু। সেদিন হাটে গোবর্ধনের যে দু-জন সঙ্গীকে দেখেছিল, তারা। বিষ্টু আর ভিখু। গাড়ি থেকেও নামল দু-জন ঝাঁকড়া চুলওয়ালা লোক। পেছনের ক্যারিয়ারে প্যাকিং বাক্সের মতো জিনিস দুটো ঢুকিয়ে ঢাকনা ফেলে দেওয়া হল। দু-তিন মিনিট ওরা নিজেদের মধ্যে কী যেন কথা বলল। তারপর যেমন ঝড়ের বেগে এসেছিল, তেমনি ঝড়ের বেগে মিলিয়ে গেল গাড়িটা। বিষ্টু আর ভিখু আবার ওপরে উঠতে শুরু করল।

রুদ্ধ নিশ্বাসে ওদের ব্যাপার-স্যাপার লক্ষ করছিল শানু, এবার বলে উঠল, ‘কী নিয়ে গেল রে ওরা?’

‘উটা শেঠজির বেওসার কিছু হবেক বটে’, বুধন বলল, ‘উ বাড়িটা তো শেঠজির আছে।’

‘হ্যাঁ, তাই তো শুনেছিলাম’, শানু বলল।

‘উ গাড়িটাও শেঠজির আছে, মস্ত মকান শেঠজির, অন্যেক পইসা।’

ওই বাড়িটা তবে শেঠজিরই, মনে মনে ভাবল শানু, আর গোবর্ধনরা শেঠজিরই লোক, ভাড়াটে নয়। তা যদি হত, তবে শেঠজির গাড়ি এসে হর্ন দিলে ওরা বাক্স মাথায় করে হুটোপাটি করে নেমে আসবে কেন? নিশ্চয়ই ও বাড়িতে এমন কিছু আছে যা পাহারা দেবার জন্য গোবর্ধনদের রেখে দিয়েছে শেঠজি। রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠছে।

মুখে ও বলল, ‘শেঠজির বুঝি বড়ো ব্যবসা?’

‘হঁ’, বুধন ঘাড় দোলাল, ‘বাজারে বড়ো দুকান আছে, একটা গুদাম আছে নদীর পাড়ে। উখানে এক মিলিটিরি আছে বটে।’

‘মিলিটারি?’

‘হঁ’, বড়ো বড়ো চোখ করে বলল বুধন, ‘বন্দুক লিয়্যে দাড়্যে থাকে, গুল্যি কর‌্যা দিবে বটে।’

শানু এবার বুঝতে পারল। গুদামের গেটে বন্দুক নিয়ে এক জন পাহারা দেয়। বুধন বোঝাতে চাইছে কাউকে কাছে ঘেঁষতে দেয় না।

শেঠজির কীসের ব্যবসা? গোবর্ধন সত্যি কথা বলেনি কেন? দিনের বেলা কেউ কি ঘরের দরজা জানলা সব এঁটে রাখে! ওই কালো গাড়িটা ওখানে কেন আসে?

ওই টিলায় নাকি ভোর বেলা পাখির মেলা বসে, বুধনই বলেছিল ওদের। ও কথা দিয়েছিল, একদিন সকালে ওদের নিয়ে যাবে, পাখি দেখাবে। তবে খুব সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে। বুধন এসে ডাকবে ওদের।

খুব ভোরেই ওরা বেরিয়ে পড়েছিল। মা-বাবাকে বলাই ছিল, ওদের আগ্রহ দেখে তাঁরা আর বাদ সাধেননি। তা ছাড়া বুধন সঙ্গে থাকবে, ভয়ের কিছু নেই।

বুধন কিন্তু বলে দিয়েছিল টিলার মাথায় যে বাড়িটা, সেখানে ও যাবে না। বুধনের বাবার মুখে সাঁওতালদের সেই বিদ্রোহের গল্প শুনেছিল শানু। সে প্রায় দেড়-শো দু-শো বছর আগেকার কথা। দেশে তখন সাহেবদের রাজত্ব। একদিকে রাজ্য শাসন অন্যদিকে ধর্ম প্রচার, এই ছিল তাদের নীতি। ধর্মের ব্যাপারে সাঁওতালদের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। তাদের কয়েক জনকে জোর করে ক্রিশ্চান করেছিল সেই পাদরি সাহেব। তাঁর নাকি তখন এ অঞ্চলে খুব প্রতিপত্তি। বড়ো বড়ো সাহেবরা তাঁর কাছে আসত। ওই বাড়িটা তাঁর বিশ্রামের জন্য বানিয়ে দিয়েছিল এক বিলিতি কোম্পানির বড়ো সাহেব। গরমের দু-মাস পাদরি সাহেব ওখানে বিশ্রাম করতেন।

পাদরি সাহেবকে নিয়েই বিদ্রোহের সূচনা। তিনি তখন টিলার বাড়িতেই ছিলেন। এক অমাবস্যার রাতে সাঁওতালরা আক্রমণ করল সেই টিলা-গড়। পাদরি সাহেব একা ছিলেন না, তাঁর কিছু অনুচরও ছিল সেখানে। তাদের কাছে বন্দুক ছিল। গুলিতে কিছু সাঁওতাল মারা পড়ল, তারপরই খেপে গেল ওরা। গুলি না চললে হয়তো শেষ পর্যন্ত ঘটনা অতদূর গড়াত না। কিন্তু নিজেদের লোকদের চোখের সামনে মরতে দেখে ওদের রক্তে আগুন ধরে গেল। ওটা তখন সত্যিই দুর্গ হয়ে উঠেছে। গড়ে যারা ছিল কেউই রেহাই পেল না সাঁওতালদের হাত থেকে।

ওই অঞ্চলে আর যেসব সাহেব ছিল তাদের অনেকেই মারা পড়ল, কেউ কেউ পালিয়ে বাঁচল। এরপর এসেছিল লালমুখো পল্টন। তাদের সঙ্গেও যুদ্ধ হয়েছিল সাঁওতালদের। শেষপর্যন্ত বন্দুকের কাছে হার মানতে হয়েছিল তাদের।

ওই ঘটনার পর থেকেই নাকি ওই টিলাগড়ে মাঝ রাত্তিরে আলো দেখা যায়। সাঁওতালদের দৃঢ় বিশ্বাস সেই ক্রিশ্চান পাদরির প্রেতাত্মা এখনও ওখানে আছে। তাই তারাও বাড়িটা এড়িয়ে চলে, ধারে কাছেও ঘেঁষতে চায় না। বড়োজোর টিলার মাঝামাঝি, তার বেশি অনেক লোভ দেখিয়েও তাদের ওঠানো যাবে না।

শানুর খুব ইচ্ছে হয়েছিল গোবর্ধনকে জিজ্ঞাসা করে রাত্তিরে সেই পাদরিকে কখনো দেখেছে কিনা, কিন্তু সুযোগ হয়নি।

বুধন কিন্তু টিলায় ওঠার পথটা ছেড়ে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে পথ করে এগোচ্ছিল। অবাক কাণ্ড। এক জায়গায় ওপর থেকে টিলার গা বেয়ে জলের ধারা নেমেছে। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার খানিকটা দূরে ছোটো ছোটো নুড়ি থেকে বড়ো বড়ো পাথর স্তূপাকার হয়ে আছে।

জলের ধারা সেখানে বাধা পেয়ে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু কিছু জল সবসময় জমে আছে ওখানে। তার চারপাশে জমা হয়েছে কত রকমের পাখি।

রংচঙে একটা পাখি দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল রাণু, বলল, ‘দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর পাখিটা।’

‘ওটা মাছআঙা’, রাণুর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল বুধন। বাদামি আর নীল রঙে মেশানো ওটার সারা গা, মাথাটাও গাঢ় নীল, ঠোঁট গোলাপি লাল।

একটা পাখির মস্ত লেজ দেখে রাণু ছড়ার সুরে বলে উঠল—

আয়রে পাখি লেজ ঝোলা

খোকন নিয়ে কর খেলা।

খাবি দাবি কলকলাবি

খোকাকে মোর ঘুম পাড়াবি।

আরও কত পাখি। বুধন ওদের চিনিয়ে দিতে লাগল। বুলবুলি, দোয়েল, শালিক, ফিঙে, বাবুই, ইষ্টিকুটুম। নাম না জানা পাখিও আছে অনেক। যেন ওদের সভা বসেছে ওখানে। ফেরার পথে বুধন রাণুকে কথা দিল, ওকে একটা সুন্দর পাখি ধরে দেবে।

খুশি মনে ওরা হাঁটছিল, কিন্তু পথের কাছে এসেই থমকে দাঁড়াল। তখনও বেশ সকাল। ঠান্ডা হাওয়া বইছে। বেড়ালের মতো আকারের দুটো কুচকুচে কালো প্রাণী মনের আনন্দে পথের মাঝখানে খেলা করছে। ডিগবাজি খাচ্ছে, হুটোপুটি করছে; মাঝে মাঝে দুটিতে আবার পেছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে সামনের দু-পা হাতের মতো নাড়াচ্ছে, যেন লড়াই করছে। বড়ো বড়ো লোমে ঢাকা ওদের শরীর।

‘কী ও দুটো?’ শানু জিজ্ঞাসা করল।

‘ভাল্লুর ছানা আছে বটে’, বুধন যেন বেশ চিন্তিত, ‘ধ্যেইড়েটা ইদিক-উদিক হবেক, হাকোপাকো পাল্যে যাই চল বটে।’

ওরা ছানা দুটোর কাছাকাছি এসে পড়তেই কাণ্ড ঘটে গেল একটা। ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করে ছুটে এল একটা ভালুক। যেমন মিশমিশে কালো, তেমন প্রকান্ড চেহারা, চোখ দুটো যেন জ্বলছে। আসলে ওটা ছানা দুটোর মা। বাচ্চাদের নিয়ে বোধ হয় খাবারের সন্ধানে বেরিয়েছিল। খেলা করতে করতে ছানা দুটো পথের ওপর এসে পড়েছে। মা অবশ্য ওদের ওপর নজর রেখেছিল, যেন কোনো বিপদ আপদ না হয়। শানুদের আসতে দেখে ভেবেছে ওরা ওর ছানাদের ক্ষতি করতে আসছে, তাই ছুটে এসেছে।

হিংস্র ভাবেই ওটা এগিয়ে আসছিল। রাণু তো ভয়ে কেঁদেই ফেলল, শানুর অবস্থাও তথৈবচ।

শুধু সাহস হারাল না বুধন। এর সঙ্গে ছিল কয়েকটা বাসি রুটি আর গুড়। টিলা থেকে নেমে ওকে আবার গোরু চরাতে হবে। তাই খাবারটা ও সঙ্গে রেখেছিল। বুদ্ধি করে ওগুলো ও ভালুকটার দিকে ছুড়ে দিল। ধপ করে ওগুলো সামনে পড়তেই থমকে দাঁড়াল ভালুকটা, নীচু হয়ে গন্ধ শুঁকল, তারপর একটু সন্দেহের দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে খানিকটা রুটি আর গুড় মুখে পুরল। লেখাপড়া না জানা, সরল গ্রাম্য ছেলেটা জানত ভালুক মধু খেতে ভালোবাসে, গুড়ও মিষ্টি, তাই উপস্থিত বুদ্ধিতে ওটাই ছুড়ে দিয়েছিল।

ঠিক তখুনি মোটরসাইকেলের শব্দটা কানে এল ওদের, ভালুকটাও যেন কান খাড়া করে পথের দিকে তাকিয়ে আছে। পর মুহূর্তে ওখানে এসে হাজির হল গোবর্ধন। এক নজরেই অবস্থার গুরুত্ব অনুভব করল ও, আর সঙ্গেসঙ্গেই ভট ভট শব্দ তুলে জোরে জোরে হর্ন বাজাতে লাগল। ভালুকটা আর ওখানে থাকা নিরাপদ মনে করল না, বাচ্চা দুটোকে প্রায় বগলদাবা করে ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড় লাগাল।

গোবর্ধন মোটর সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে এল। সঙ্গেসঙ্গে রাণু ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর কোলে, এতক্ষণে একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় পেয়ে গেছে ও। গোবর্ধনের বুকে মুখ গুঁজে ওর ফোঁপানির যেন আর শেষ নেই।

ওর মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে গোবর্ধন তাকাল শানুর দিকে, বলল, ‘কী করছ তোমরা এখানে?’

‘আমরা পাখি দেখতে এসেছিলাম’, ঢোঁক গিলে বলল শানু, ‘বুধন বলছিল সকালে এখানে অনেক পাখি আসে। আমরা পাখি দেখে ফিরছিলাম, ভালুকটা আমাদের তেড়ে এল।’

‘কেন ওদের এখানে নিয়ে এসেছিস?’ গোবর্ধন বুধনের দিকে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল, ‘ভোর বেলা এখানে মাঝে মাঝে ভালুক বেরোয় জানিস না?’

বুধন মাথা চুলকাল। এমন বিপদের কথা ওর মনেই আসেনি।

গোবর্ধন ওদের টিলার শেষ ধাপ পর্যন্ত পৌঁছে রাণুকে মাটিতে নামিয়ে বলল, ‘আর ভয় নেই দিদি, ভালুকটা পালিয়ে গেছে। আমি বলেছিলাম না, ভালুকও আমাকে দেখে ভয় পায়।’ সশব্দে হেসে উঠল ও। এতক্ষণে রাণুর মুখেও ফুটল এক টুকরো স্বচ্ছ হাসি।

গোবর্ধন ফিরে গেল ওর মোটরসাইকেলের কাছে, ওরা ফিরে চলল বাড়ি।

একটা মস্ত ফাঁড়া কেটেছে আজ।

রাণুকে সাবধান করে দিল শানু, বাড়িতে যেন আজকের ঘটনার কথা ভুলেও না বলে, মা তবে বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দেবেন।

কালী পুজো এসে গেছে, ওদের ফেরার দিনও এগিয়ে এসেছে। শানু মনস্থির করে ফেলল, এবার যাহোক একটা কিছু করতে হবে।

একটা কথা আগে বলা হয়নি, শানুরা যে বাড়িতে ছিল সেটা ঠিক শহরের মধ্যে নয় বরং লোকালয়ের বাইরেই বলা চলে। শুধু সাঁওতাল পল্লিটা ওখান থেকে কাছে। তিরিশ চল্লিশ ঘর নিয়ে ওই সাঁওতাল পল্লি, মেয়ে পুরুষ সব মিলিয়ে প্রায় শ-দুয়েকের মতো মানুষের বাস। যেমন পরিশ্রমী ওরা তেমন সৎ, আর আত্মসম্মান জ্ঞান ওদের খুব। মোড়লের হুকুমে যেকোনো মুহূর্তে ওরা তির-ধনুক হাতে রুখে দাঁড়াতে পারে, ওদের শিরায় শিরায় যেন বিদ্রোহের রক্ত। কিন্তু এমনিতে ওরা খুব শান্ত আর ভদ্র। আর ওদের মেয়েদের মুখে হাসি লেগেই আছে। কথায় কথায় ওরা হেসে লুটিয়ে পড়ে, কৃত্রিম শহুরে লজ্জার ছোঁয়া স্পর্শ করেনি ওদের।

শহরটা কিন্তু ছোট্ট। জল-হাওয়া বদলের পক্ষে সুন্দর জায়গা, তাই আগে অনেক বাঙালি ছুটি কাটাতে আসত এখানে। বাঙালিদের বেশ কিছু বাড়িও আছে, তবে বেশির ভাগই এখন বন্ধ থাকে। মাঝে মাঝে শানুদের মতো কেউ হয়তো বেড়াতে আসে।

কালী পুজোর রাত্রে সাঁওতাল পল্লিতে নাচ-গানের আসর বসবে, মোড়ল নিজে এসে শানুর মা-বাবাকে নেমন্তন্ন করে গেল।

আর সুযোগটা শানুর এসে গেল কালী পুজোর দিনই। গত কয়েক দিন ধরেই ও তক্কে তক্কে ছিল। রোজ সকালে আর বিকেলে একা একা ও বেরিয়ে পড়ত, ওর লক্ষ ছিল ওই টিলা। আসলে ও নজর রাখছিল, বাড়িটায় কেউ নেই বুঝতে পারলেই হানা দেবে।

কালী পুজোর দিন বেলা দশটা নাগাদ ও টিলার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল। হঠাৎ মোটরসাইকেলের শব্দে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। মোটরসাইকেলের আরোহী গোবর্ধন, আর তার পেছনে বসে আছে ভিখু।

দেখতে দেখতে ওরা দূরে মিলিয়ে গেল, শানু অনুমান করল শহরের দিকেই গেল ওরা। এখন একমাত্র বিষ্টু। সে যদি না থাকে তবে তো কথাই নেই। আর যদি সে থাকে তবে শানু বলবে যে, ওরা এখান থেকে চলে যাচ্ছে, তাই যাবার আগে বাড়িটা শেষ বারের মতো দেখতে এসেছে। সেটা তো আর কোনো অপরাধ নয়। পকেটে কিন্তু ওর এক গোছা চাবি। সময় অসময় ওটা যে গোয়েন্দাদের খুব দরকার পড়ে তা ও বইয়ে পড়েছে, তাই অনেকদিন ধরে একটা একটা করে এই চাবির গোছাটা তৈরি করেছে।

বাড়িটার কাছে এসে কেউ আছে বলে কিন্তু মনে হল না, চারদিক নিস্তব্ধ। গেট খুলে ও ভেতরে ঢুকল। ঘরগুলো সব বন্ধ। এক বার ওর মনে হল একটা পর্দা যেন একটু নড়ে উঠল, কিন্তু জানলার দিকে ভালো করে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না। নিশ্চয়ই বাতাসে পর্দাটা নড়েছে। তবু ও চেঁচিয়ে বলল, ‘বাড়িতে কেউ আছেন? আমার বড্ড জল তেষ্টা পেয়েছে।’

কেউ সাড়া দিল না। নিশ্চিন্ত মনে ও এগিয়ে গেল!

নির্দিষ্ট ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে চাবির গোছাটা বার করে ও তালা খুলতে চেষ্টা করতে লাগল। হঠাৎ একটা চাবি লেগে গেল। আনন্দে নেচে উঠল ওর মন। দরজার পাল্লা দুটো ঠেলে ও ভেতরে ঢুকল। জানলাগুলো বন্ধ থাকায় ঘরটা অন্ধকার। খোলা দরজা দিয়ে যে আলো ঢুকছিল তাতেই ওর চোখে পড়ল ঘরের একপাশে সাজানো রয়েছে থরে থরে প্যাকিং বাক্স, মাঝখানে একটা ছোটোখাটো মেশিন। একটা ডেস্ক, তার উপর নানারকম কালির বোতল, রং, তুলি, আরও কত কী! মেশিনটা ছাপাখানার মেশিনের মতো।

পায়ে পায়ে ও এগিয়ে গেল। একটা বাক্সের মুখ ভালো করে বন্ধ করা হয়নি, সেটার ঢাকনা খুলেই চমকে উঠল ও। গোছা গোছা নোট। দু-টাকা, পাঁচ টাকা আর দশ টাকার। কিছুদিন আগে টিভিতে একটা হিন্দি সিনেমা দেখেছিল শানু। দুঃসাহসী নায়ক অনেক কাণ্ডের পর জাল নোট তৈরি করে এমন এক গুন্ডার দলকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিল, তার ছবি। গোয়েন্দা বইয়ের পোকা শানুর বুঝতে বাকি রইল না, এটা একটা জাল নোট তৈরির কারখানা। এখানে তৈরি হয়, তারপর চালান হয় শেঠজির গাড়িতে। টিলার ওপর বাড়িটা হওয়ায় খুব সুবিধেই হয়েছে।

হঠাৎ কীসের একটা অনুভূতিতে ও ফিরে তাকাল, তারপরই ভীষণ চমকে উঠল।

ওর ঠিক পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে বিষ্টু। ওর চোখে মুখে ফুটে উঠেছে একটা নিষ্ঠুরতার ছাপ।

বিচ্ছিরি একটা গাল দিল বিষ্টু, তারপরই সজোরে আঘাত করল শানুর মুখে। ঘুরে পড়ে গেল শানু আর সঙ্গেসঙ্গে জ্ঞান হারাল।

ঘরের এক কোণায় একটা টেলিফোন ছিল। সেটা তুলে একটা নম্বর ডায়াল করল বিষ্টু। ওপাশ থেকে সাড়া পেয়ে ও বলল, ‘আমি বিষ্টু বলছি। যে ছেলে-মেয়ে-দুটোর কথা আমি আপনাকে বলেছিলাম, সেই ছেলেটা এখানে এসেছে… হ্যাঁ হ্যাঁ… একা। ভেবেছিল কেউ নেই… চাবি দিয়ে তালা খুলে ঘরে ঢুকেছে… হ্যাঁ আমি ওকে আটকেছি… হ্যাঁ, এখানে রাখা ঠিক হবে না… মুশকিল হচ্ছে ওই রাজাকে নিয়ে… ছেলে আর মেয়েটার ওপর মনে হয় টান পড়ে গেছে… হ্যাঁ, হ্যাঁ… সেই ভালো, আপনি ওকে ছুতো করে আটকে রাখুন, আমি এদিকটা সামলাচ্ছি… ঠিক আছে… আপনি তবে গাড়ি পাঠাচ্ছেন? সব সরিয়ে ফেলব?… সেই ভালো… ছেলেটা সব জেনে ফেলেছে। ওকে সরিয়ে ফেলাই ভালো… ঠিক আছে, আপনি গাড়ি, ভ্যান দুটোই পাঠান… আচ্ছা, ছাড়ছি।’

১০

বেলা একটা বেজে গেল তবু শানু ফিরল না। ওর মা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শানুর বাবা বললেন, ‘তোমার সব কিছুতেই একটু বাড়াবাড়ি। এখানে তো আর কখনো আসা হবে না, ছেলেরা এমন স্বাধীনতার সুযোগও পাবে না। একটু আনন্দ করে বেড়াচ্ছে, তাতেও তোমার দুর্ভাবনা? সাঁওতাল পল্লিতে আজ রাত্তিরে নাচ-গান হবে, হয়তো ওখানেই আছে।’

মা আর কী করে; চুপ করে গেলেন।

কিন্তু যখন দুটো বাজল, তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। শানুর বাবাকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাকে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি ওর খোঁজে।’

এতক্ষণে ওদের বাবারও হুঁশ হল। এত দেরি তো শানু করে না! কোথায় গেল?

শানুর মাকে আশ্বস্ত করে তিনি বেরিয়ে পড়লেন। রাণুও তার সঙ্গ নিল, দাদার জন্য ওর ভীষণ চিন্তা হচ্ছে।

সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে খোঁজ করে কিন্তু কোনো ফল পাওয়া গেল না। শানুকে আজ কেউ দেখেনি। বুধনের সঙ্গেও কোথাও গিয়েছে বলে মনে হয় না, বুধন তো সকাল থেকে পাড়াতেই ছিল। আজ রাতে উৎসব হবে, তা নিয়েই মেতে ছিল। অনেক বকাঝকার পর এই তো খানিক আগে গোরুর পাল নিয়ে বেরিয়েছে।

শানুর বাবা এবার সত্যিই চিন্তিত হলেন। কোথায় গেল ছেলেটা? বিপদ-আপদ হল না তো?

ওখান থেকে বেরিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে তিনি হাঁটছিলেন। আসলে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। এদিকে রাণুর কান্না পাচ্ছে। ও হঠাৎ বলল, ‘বাবা চলো ওই পাহাড়ের ওপর বাড়িটা দেখে আসি।’

‘ওখানে!’ ওর বাবা একটু অবাক হয়ে তাকালেন।

‘হ্যাঁ, দাদা ওখানে রহস্যের গন্ধ পেয়েছিল, তোমাদের বলতে মানা করে দিয়েছিল।’

‘চল তবে।’ দ্বিধাগ্রস্তভাবে বললেন ওদের বাবা।

ওরা যখন টিলাটার কাছাকাছি পৌঁছেছে, ঠিক তখুনি ভট ভট শব্দ তুলে মোটরসাইকেলটা ওদের পেছনে এসে পড়ল। রাণু দু-হাত তুলে চেঁচাতে লাগল, ‘গোবর্ধন দাদা, গোবর্ধন দাদা।’

গোবর্ধন গাড়ি থামিয়ে কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেল। রাণুর মুখের ‘দাদা’ ডাক গিয়ে স্পর্শ করেছে ওর অন্তরের অন্তস্থলে। অনেকদিন আগের একটা মিষ্টি ডাক হঠাৎ যেন মনে পড়ে গেছে।

‘গোবর্ধন দাদা, গোবর্ধন দাদা’, হাঁপাতে হাঁপাতে রাণু ওর সামনে এসে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার দাদা হারিয়ে গেছে, তুমি ওকে তাড়াতাড়ি খুঁজে দাও।’

গোবর্ধন অবাক হয়ে তাকাল ওর মুখের দিকে। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না ও।

রাণুর বাবাই সব খুলে বললেন। শানুকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে রাণুর পরামর্শমতো টিলার বাড়িতে খুঁজতে যাচ্ছেন। শানু নাকি ওখানে রহস্যের গন্ধ পেয়েছিল।

গোবর্ধন ঠোঁট কামড়াল, তারপর রাণুর বাবাকে বলল, ‘আপনারা এখানে অপেক্ষা করুন, আমি দেখে আসছি।’

ভীষণ জোরে মোটরসাইকেল চালিয়ে ও ওপরে উঠতে লাগল, রাণুর বাবা ভয় পাচ্ছিলেন, এই বুঝি একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়।

গেটটা হাঁ করে খোলা, গোবর্ধন একটা যেন ধাক্কা খেল। সব ঘরের দরজায় তালা। কী ব্যাপার! দোতলার কোণের ঘরের তালা খুলে ও ভেতরে ঢুকল। ঘর ফাঁকা। প্যাকিং বাক্স, ডেস্ক, ছাপার মেশিন কিছুই নেই। যেন ঝেঁটিয়ে সব বিদেয় করা হয়েছে!

তবে কি শানু সত্যি সত্যিই এখানে এসেছিল? সব কিছু জেনে ফেলেছিল? সে জন্যই তড়িঘড়ি সব সরিয়ে ফেলা হয়েছে। সেইসঙ্গে ওকেও গুম করা হয়েছে?

শেঠজিকে হাড়ে হাড়ে চেনে গোবর্ধন। শেয়ালের মতো লোভী, হায়নার মতো হিংস্র। একটা অজানা আশঙ্কায় বুক কেঁপে উঠল ওর। ছেলেটাকে হয়তো মেরেই ফেলবে। ব্যবসার ক্ষতি সহ্য করবে না শেঠজি। ও ব্যাপারে যে সে কত নিষ্ঠুর হতে পারে তার প্রমাণ আগেও পেয়েছে গোবর্ধন। পুলিশের ওপরেও শেঠজির খুব প্রভাব। টাকায় কে না বশ হয়!

চিন্তিত মুখে মোটরসাইকেলে আবার স্টার্ট দিল ও।

রাণুর বাবা ব্যাকুল হয় ওর জন্য অপেক্ষা করছিলেন। গোবর্ধন কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘নেই ওখানে?’

‘না’, গোবর্ধন জবাব দিল, ‘আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে… আপনাকে আমি এখন সব খুলে বলতে পারছি না। আমি ওর খোঁজেই চললাম। যদি তিন চার ঘণ্টার মধ্যে না ফিরি আপনি পুলিশে খবর দেবেন।’

‘গোবর্ধন দাদা’, রাণু এবার কেঁদে ফেলল, ‘আমার দাদাকে তুমি খুঁজে এনে দাও।’

‘তুমি কিচ্ছু ভেব না বোন’, গোবর্ধন মন শক্ত করে বলল, ‘আমি বেঁচে থাকতে ওর কোনো অনিষ্ট হতে দেব না।’

দেখতে দেখতে মিলিয়ে গেল ওর মোটরসাইকেলটা।

১১

প্রথমেই শেঠজির বাড়ি গেল গোবর্ধন, কিন্তু গিয়ে শুনল তিনি বাড়ি নেই, জামশেদপুর গেছেন, ফিরতে দু-তিন দিন দেরি হবে। এক ঘণ্টা আগেও তিনি বাড়ি ছিলেন, গোবর্ধনের সঙ্গে একটা বিষয় নিয়ে অনেক আলোচনাও করেছেন। এর মধ্যে এমন কী দরকার পড়ল যে, জামশেদপুর ছুটতে হল? তা ছাড়া জামশেদপুর যাবার ট্রেন এখন কোথায়? আর গাড়িটাও তো গ্যারেজে রয়েছে। একটা ক্ষীণ সন্দেহ উঁকি দিতে থাকল গোবর্ধনের মনে।

কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে ও চিন্তা করল। শানুকে এখানে নিজের বাড়িতে কখনো তুলবেন না শেঠজি, অত বোকা তিনি নন। মাত্র একটা জায়গাতেই ওকে রাখা হতে পারে, সেটা হল নদীর পাড়ে নির্জন গুদামে। নির্জন হলেও ওখানে একজন বন্দুকধারী নেপালি দারোয়ান আর তিন চার জন জোয়ান হিন্দুস্থানি সব সময় পাহারা থাকে।

গুদাম লক্ষ করেই ছুটে চলল মোটরসাইকেল।

গুদামের লোহার ফটক বন্ধ, ও পাশে দারোয়ান বন্দুক হাতে একটা টুলে বসে আছে। অন্য দিন গোবর্ধনকে দেখে সে উঠে দাঁড়ায়, সেলাম করে। আজ কিন্তু সেসব কিছু করল না। দারোয়ানকে ও গেট খুলে দিতে বলল।

‘হুকুম নেহি’, জবাব দিল দারোয়ান।

‘হুকুম নেহি?’ গোবর্ধন যেন কথাটা বিশ্বাসই করতে চাইল না। অত বেলা পর্যন্ত শেঠজি ওর সঙ্গে শলাপরামর্শ করলেন কেন? সেটা কি তবে একটা চাল? এ সবই বিষ্টুর কাজ, ওই শেঠজির কান ভাঙিয়েছে। একটা ক্রুদ্ধ আক্রোশে মাথার রক্ত ছলাৎ করে উঠল ওর।

‘গেট খুলে দাও।’ প্রায় গর্জন করে উঠল ও।

‘হামলা মত কিজিয়ে’, নেপালি দারোয়ান রুক্ষস্বরে জবাব দিল, ‘আপকা হিঁয়া ঢুঁড়নেসে মানা হ্যায়, মনিবকা হুকুম।’

মনিবের হুকুম! দাঁতে দাঁত চাপল গোবর্ধন। ঠিক আছে, দেখা যাবে।

দারোয়ানের দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ও গাড়ি ঘোরাল। কিছুটা গিয়ে একটা দোকানে মোটরসাইকেলটা ও রাখল, তারপর হাঁটা দিল গুদাম লক্ষ করে। তবে এবার সামনে দিয়ে নয়, পেছন দিয়ে। গুদামটার চারপাশ উঁচু দেয়ালে ঘেরা। ইতস্তত বড়ো বড়ো গাছ আর ঝোপঝাড়। খুব সাবধানে ও এগুচ্ছিল, যেন কেউ ওকে দেখে না ফেলে।

এদিকে সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে। কার্তিকের দ্বিতীয় সপ্তাহ, তাড়াতাড়ি অন্ধকার নেমে আসছে। গোবর্ধন সেই সুযোগই নিতে চাইল। তাড়াহুড়ো না করে অন্ধকারের অপেক্ষায় রইল।

অন্ধকার নেমে আসতেই ও জিমন্যাস্টিকস-এর কায়দায় দু-হাতে ভর দিয়ে পাঁচিলের মাথায় উঠে পড়ল, তারপর ঝুপ করে এক লাফে মাটিতে। গুদামটা অনেকটা জায়গা নিয়ে, টিনের চালা। ওটার গায়েই পাশাপাশি দুটো ঘর। একটা ঘরে চার জন তাস খেলছিল, বিষ্টু তাদের একজন। নেপালি দারোয়ান সতর্ক প্রহরীর মতো দৃষ্টি রেখেছে সামনের দিকে।

দ্বিতীয় ঘরে হাত-পা-বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে শানু। বেচারা কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে গেছে— করুণ অবস্থা।

গোবর্ধন পা টিপে টিপে প্রথম ঘরটা পেরিয়ে দ্বিতীয় ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজায় একটা তালা ঝুলছে। তালাটা ভাঙতে হবে। একটা লোহার শিক পাওয়া গেলে হত, তালার ফাঁকে গলিয়ে চাড় দিলেই খুলে যাবে ওটা। গুদামে ইলেকট্রিক আলো নেই, ইচ্ছে করেই নেননি শেঠজি। বোধ হয় অন্ধকার জগতের কাজকর্ম অন্ধকারে রাখাই সমীচীন মনে করেছিলেন তিনি।

গোবর্ধন একটা উপায় চিন্তা করছিল, আর ঠিক তখুনি পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে এল বিষ্টু। গোবর্ধনকে দেখে ভীষণ চমকে উঠল ও। গোবর্ধন যাতে ওখানে ঢুকতে না পারে তার সবরকম ব্যবস্থাই ও করে ফেলেছিল; শেঠজির সম্পূর্ণ মত ছিল এ ব্যাপারে, তাই গোবর্ধনকে ওখানে দেখে নিজের চোখকেই যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না বিষ্টু, মুখ দিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত বেরুল না। সেই সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা নয় গোবর্ধন। এক লাফে এগিয়ে গেল, তারপর ডান হাতের তালুর ধার দিয়ে খাঁড়ার কোপের মতো তেরছা ভাবে আঘাত করল বিষ্টুর গলায়। ক্যারাটের একটা নিপুণ মার। মিছেই ওকে সবাই সমীহ করে চলে না, মুখোমুখি লড়াইয়ে ও যে কত দক্ষ তার প্রমাণ অনেক বারই পেয়েছে দলের সবাই।

কাটা কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল বিষ্টু, কোনোরকম প্রতিরোধের ক্ষমতাই নেই ওর। কিন্তু ওর পড়ে যাবার শব্দটাই বাধাল গণ্ডগোল।

‘ক্যা হুয়া? ক্যা হুয়া?’

বাকি তিন জন ছুটে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। শুরু হয়ে গেল প্রচণ্ড লড়াই। একসঙ্গে তিন জন আক্রমণ করলে ও পেরে উঠবে না এটা বুঝতে পেরে গোবর্ধন চেষ্টা করছিল একসঙ্গে সবার মুখোমুখি না হবার। এক লাফে এক জনের সামনে গিয়ে তাকে আঘাত করেই চট করে সরে যাচ্ছিল, প্রস্তুত হচ্ছিল দ্বিতীয় জনের জন্য, তৃতীয় জনকে একটু তফাতে রেখে। প্রায় কাবু করে এনেছিল তিন জনকে। ওদের এক জনের নাক দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়ছে, লাথির ঘায়ে এক জনের কোমর ভেঙে যাবার মতো অবস্থা। তৃতীয় জন পেট চেপে গোঙাচ্ছে। ঠিক তখুনি পেছন থেকে মাথায় বন্দুকের বাঁটের প্রচণ্ড আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল গোবর্ধন, দু-চোখে নেমে এল ঘোর অন্ধকার।

১২

বুধনের আজ সকাল থেকেই ফূর্তি। রাত্তিরে নাচ-গান হবে, তা ছাড়া আঙ্গা-মা ওকে আজ রাতে খেতে বলেছেন। শানুর মুখে ও শুনেছে, মাছ মাংস দুই-ই হবে, আঙ্গা-মা নিজের হাতে মিঠাই বানিয়েছেন।

বেলা করেই গোরুর পাল নিয়ে ও চরাতে বেরুল। রোজকার মতো একটা গাছের তলায় বসে ছেড়ে দিল গোরুদের। ধু-ধু প্রান্তর। চারদিক দেখা যায়। সূর্য যখন মাথার ওপর থেকে সরে পশ্চিমে কিছুটা হেলেছে, তখন আপন মনে একটা গানের কলি ভাজছিল ও।

হেন্দা রুপো দারি,

সোনা বাহা ঞমতোদো আলম

 বুলïঞয়ে;

আম দারে গোঁড়ারে মায়াম ইঁঞ

 দুলাম,

আম দে সোনাকে জঃ মে।।

[রুপোর গাছ ওগো

ভুলিও না শুধু সোনার ফুল দিয়ে;

রক্তের সেচ দেব গোড়ায় তোমার

সোনার ফল দিও তুমি তা নিয়ে।]

হঠাৎ একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল ওর। শুধু কালো গাড়িটাই নয়, তার পেছন পেছন চারদিক ঢাকা একটা বড়ো গাড়িও এসে দাঁড়িয়েছে পাহাড়ে ওঠার পথের মুখে। কালো গাড়িটা থেকে তিন বার হর্ন বেজে উঠল, ওপর থেকে তার সাড়া এল। তারপর গাড়ি দুটো থেকে নেমে পড়ল বেশ কয়েক জন লোক। তারা খুব তাড়াতাড়ি ওপরে উঠতে লাগল।

ব্যাপার কী! এত লোকজন আগে এখানে কখনো দেখেনি বুধন। গাছের মোটা গুঁড়ির আড়াল থেকে কৌতূহলভরা দৃষ্টি নিয়ে সব কিছু লক্ষ করতে লাগল ও।

খানিক বাদেই লোকগুলো মাথায় করে কী সব যেন বয়ে এনে ঢাকা গাড়িতে তুলে ফেলল। এসব করতে কয়েক বারই ওঠা নামা করতে হল ওদের।

সব শেষে ওদের এক জন কাঁধে করে যাকে নিয়ে এল, তার দিকে চোখ পড়া মাত্র লাফিয়ে উঠল বুধন। অত দূর থেকেও ওর চিনতে ভুল হয়নি, ওই গাঢ় নীল রঙের জামাটা তো নয়ই। শানুকে কালো গাড়িটার পেছন দিকে বোধ হয় শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, আর দেখা যাচ্ছে না।

তবে কি শানুর অসুখ করেছে? কিন্তু ওখানে কি করছিল ও? গাড়ি দুটো চলতে শুরু করল। শহরের দিকে কিন্তু নয়, গাড়ি দুটো নদীর ধারের রাস্তা ধরে এগুচ্ছে। এই প্রান্তরে দাঁড়িয়ে অনেকদূর পর্যন্ত দেখা যায়। দূরে একটা পাঁচিল ঘেরা টিনের ছাউনি। বুধন জানে ওটা শেঠজির গুদাম। সে দিকেই যাচ্ছে গাড়ি দুটো। হঠাৎ কিছু না ভেবেই দৌড়তে লাগল বুধন।

ও যখন গুদামটার কাছাকাছি পৌঁছুল, ততক্ষণে গাড়ি দুটো ফটক দিয়ে ভেতরে অদৃশ্য হয়েছে। তবে সারাক্ষণ গাড়ি দুটো ওর চোখে চোখে ছিল, ফাঁকা রাস্তা বলেই তা সম্ভব হয়েছে। ওর ভাগ্য ভালো, ভেতরে সবাই ব্যস্ত থাকায় কেউ লক্ষ করেনি ওকে।

হঠাৎ ফটকটা খুলে যেতেই একটা আদিম অনুভূতিতে চট করে ও একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর তখুনি কালো গাড়িটা বেরিয়ে এল। গাছটা ছিল ঠিক পথের ধারেই। গাড়িতে আরও লোক ছিল, কিন্তু যাকে বুধনের চোখ দুটো খুঁজছিল, সে ছিল না। শানু তবে এখানেই আছে। ছেলেটার যদি অসুখ করত তবে তাকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যেত, মা-বাবাকে খবর দেওয়া হত। সেসব কিছুই করল না ওরা। পাহাড়ের ওই বাড়ি সম্বন্ধে নানারকম গুজব চালু আছে সাঁওতালদের মধ্যে। দিনের বেলা ওখানে নাকি দুষ্টু লোকের আড্ডা, আর রাত্তিরে ভূতের। ওই কালো গাড়িটা কেন ওখানে আসে? রাত্তিরে দপ দপ করে আলো জ্বলে কেন? শানু একা একা কেন গেল ওখানে? অসংখ্য প্রশ্ন এসে ভিড় করছিল বুধনের মাথায়।

গাড়িটা চলে যেতেই ফটক বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বুধন আর ওখানে থাকেনি, জায়গাটা নিরাপদ নয় বলেই মনে হয়েছিল ওর। একটা ঝোপের আড়াল থেকে লক্ষ রাখছিল গুদামটার ওপর। গোবর্ধনের ওখানে আসা, দারোয়ানের সঙ্গে হাত পা নেড়ে কথা বলা, তারপর ফিরে যাওয়া, কোনো কিছুই দৃষ্টি এড়ায়নি ওর।

এমন একটা সুবিধেমতো জায়গা ও বেছে নিয়েছিল যেখান থেকে দেখতে ওর অসুবিধে হচ্ছিল না। পড়ন্ত বেলায় পেছন দিক থেকে গোবর্ধনকে চুপি চুপি ও এগিয়ে আসতে দেখল। অন্ধকার নেমে আসতেই তার পাঁচিল টপকানো দেখে একটা বিপদের আশঙ্কায় ধুক ধুক করে উঠল ওর বুক। অন্ধকারে এগিয়ে গেল বুধন। ওর পক্ষে অত উঁচু পাঁচিলের মাথায় ওঠা সম্ভব নয়। গেটের খানিকটা বাঁ-পাশে একটা মহুয়া গাছ পাঁচিলের গা ঘেঁষে উঠে গেছে। সাবধানে সেই গাছ বেয়ে ও উঠে পড়ল, একটু দূরেই বন্দুক হাতে দাঁড়িয়ে আছে নেপালি দারোয়ান, ওকে দেখে ফেললে আর রক্ষে নেই, গুলি করে বসবে। প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে ডাল-পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখল ও।

গেটের কাছে একটা বড়ো পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে, তার আলো ঠিকরে গিয়ে পড়ছে গুদাম ঘরের দিকে। সেই আলোয় সব কিছু দেখতে পাচ্ছিল বুধন। গোবর্ধনের তালা ভাঙার চেষ্টা থেকে শুরু করে মারামারি এবং শেষপর্যন্ত কাবু হওয়া, কিছুই এড়াল না ওর নজর। শানু যে ওখানে বন্দি এটা বুঝতেও আর কষ্ট হচ্ছে না ওর।

সেদিন টিলায় ভালুকের হাত থেকে গোবর্ধনই ওদের বাঁচিয়েছিল, রাণু ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ওর কোলে। ওদের নিশ্চয়ই আগে থেকে জানাশোনা ছিল। গোবর্ধন যে শানুকে উদ্ধার করার জন্যই চুপি চুপি পাঁচিল ডিঙিয়েছিল, সেটা এখন জলের মতো পরিষ্কার। কিন্তু গোবর্ধনও ওদের হাতে বন্দি তাই অবস্থাটা এখন বেশ ঘোরালো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক্ষুনি কিছু একটা না করলে হয়তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। লোকগুলোর মতিগতি ভালো ঠেকছে না।

বেড়ালের মতো লঘু পায়ে ও নেমে এল গাছ থেকে, তারপর ছুটতে লাগল অন্ধকারে।

দূরে আতসবাজি ফুটছে। আকাশে হাউই, ঝুর ঝুর করে ঝরে পড়ছে আলোর মালা। আলোর সাজে সেজেছে অন্ধকার রাত্রি।

সাঁওতাল পল্লি থেকে আসছে মাদলের বাজনা ধিতাং তাং ধিতাং তাং। সেই শব্দ লক্ষ করে ছুটল বুধন, অন্ধকারে ওর চোখ দুটো যেন জ্বলজ্বল করছে।

১৩

মোড়ল তার নিকানো দাওয়ায় বসে ছেলেমেয়েদের হুড়োহুড়ি দেখছিল আর হাসছিল মনে মনে। একদিন তারও ওই বয়স ছিল, রক্তে ছিল উদ্দাম।

মেয়েরা আজ সেজেছে। বাড়িতে কাচা পরিষ্কার কাপড় পড়েছে, তেলো চুল আঁটো করে বেঁধেছে, খোঁপায় গুঁজেছে লাল ফুল। ছেলেদের হাঁটুর ওপর কাপড়, কুচকুচে কালো শরীর যেন চকচক করছে। তির-ধনুক হাতে ওদের কেউ সেজেছে ব্যাধ, কেউ সেজেছে যোদ্ধা, কেউ আবার হাতে তুলে নিয়েছে বাঁশি, মাথায় পড়েছে পাখির পালকের মুকুট।

হঠাৎ ছুটতে ছুটতে সেখানে এল বুধন। সোজা মোড়লের কাছে গিয়ে বলল, ‘আপুং, আপুং (বাবা), বাবুদের ছেইল্যাটারে ধর‌্যা লিঞঁ গ্যাইছঞেঁ।’

তারপর নিজেদের ভাষায় ঝড়ের মতো বলে গেল সমস্ত ঘটনা।

বুড়ো মোড়ল উঠে দাঁড়াল। তার মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেছে, বুক টান টান, মুখে ফুটে উঠেছে এক দৃঢ় সংকল্পের রেখা। এক লহমায় একজনের হাত থেকে মাদল ছিনিয়ে সে চাঁটি মারল তাতে। গুড় গুড় করে একটা বোল উঠল, সে বোলের সুর অন্যরকম, গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে। মুহূর্তে বদলে গেল সাঁওতাল পল্লির চেহারা। এ বাজনা অনেকদিন তারা শোনেনি, এ বাজনায় রক্তে আগুন ধরে যায়। এ হল যুদ্ধে যাবার ডাক, ‘যে যেখানে আছ তৈরি হয়ে নাও, হাতে তুলে নাও অস্ত্র।’ এই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে পারে না কেউ।

মোড়লের উঠোনে ছুটে আসছে জোয়ান, বুড়ো সবাই। কারও হাতে তির-ধনুক, কারও হাতে টাঙ্গি, কারও হাতে বল্লম। একটা দারুণ উত্তেজনা থর থর করে কাঁপিয়ে তুলেছে আকাশ বাতাস।

মোড়লের উঠোনে আর তিল ধারণের ঠাঁই নেই।

‘শুন তুমাহারা’, বজ্রের মতো কণ্ঠে বলল মোড়ল, ‘আঙ্গা মায়ের ছেইলাটারে ধর‌্যা লিঞা গেইছে শেঠজির লুকে। উয়াকে হামরা ছাড়ায়ে লিঞা আসব।’

‘হঁ হঁ’, সমস্বরে বলল সবাই। এই কদিনেই শানুদের সঙ্গে ওদের নিবিড় একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। শানুর বাবা এখানে আসার পর সাঁওতালদের সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়েছেন, তাদের প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন, ওদের সঙ্গে আপনজনের মতো মিশেছেন। শানুর মা ওদের মেয়েদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে বসে ভাত খেয়েছেন, শানুর বন্ধু হয়েছে বুধন। এর পরেও যদি তাদের বিপদে ওরা পাশে না দাঁড়ায় তবে সেটা হবে চরম অকৃতজ্ঞতা। প্রাণ থাকতেও ওরা তা হতে দিতে পারে না।

একসঙ্গে বেজে উঠল অনেকগুলো মাদল, চড়া তাদের সুর। মশাল জ্বলল। বুড়ো মোড়লের পেছন পেছন সার বেঁধে তালে তালে পা ফেলে চলল জনা পঞ্চাশ জোয়ান, জনা তিরিশ কিশোর আর প্রবীণ মানুষ।

শানুর মা আর বাবা অস্থিরভাবে বাড়ির সামনে পায়চারি করছিলেন। গোবর্ধন এখনও এল না, এবার পুলিশে খবর দিতে হয়। রাণু কেঁদে কেঁদে চোখ লাল করে ফেলেছে।

হঠাৎ মশালের আলোয় অনেক মানুষকে এগিয়ে আসতে দেখে শানুর মা-বাবা হকচকিয়ে গেলেন। কী ব্যাপার! ওরা কাছে আসতেই চিনতে পারলেন, কেন জানি না ভরসা পেলেন।

বুড়ো মোড়ল এগিয়ে এল। শানুর বাবাকে সব খুলে বলল। ওরা অযাচিত ভাবে শানুকে উদ্ধারের জন্য চলেছে এটা শুনে তিনি অভিভূত হয়ে গেলেন। বুড়ো সর্দারের দু-হাত চেপে ধরলেন, তাঁর দু-চোখের কোল বেয়ে নামল জলের ধারা, মুখ দিয়ে কথা সরল না।

শানুর মা-ও জিদ ধরলেন সঙ্গে যাবেন। তাঁকে নিরস্ত করা গেল না। রাণুকে কুসুমের বোনের কাছে রেখে তিনিও বেরিয়ে পড়লেন।

গুদামের ফটকের সামনে এসে মোড়লের হুকুমে সবাই পাশাপাশি সার বেঁধে দাঁড়াল। অনেক মশাল আর অত লোকজন দেখে শেঠজির লোকেরা ভয় পেয়ে গেল। দারোয়ান ওদের লক্ষ করে বন্দুক তাক করে বলল, ‘হঠ যাইয়ে সব, ভাগো হিঁয়াসে জলদি, নহিঁ তো গোলি চালা দুঙ্গা।’

বন্দুক দেখে একটু থমকাল সাঁওতালরা। শানুর মা কিন্তু ভয় পেলেন না, তিনি এগিয়ে গেলেন, বললেন, ‘আমার ছেলেকে তোমরা আটকে রেখেছ কেন? শিগগির ছেড়ে দাও।’

‘হঠ যাইয়ে, হঠ যাইয়ে, ম্যায় ঝুটা নঁহি বলতা হুঁ, গোলি চালা দুঙ্গা’, দারোয়ান চিৎকার করে উঠল। ঘাবড়ে গেলে মানুষ যেমন দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, দারোয়ানের অবস্থা অনেকটা তেমন। নিজের ওপর আর আস্থা নেই, এলোপাথাড়ি গুলি করে দিলেই হল।

শানুর মা-র সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, তিনি এক-পা এক-পা করে ফটকের দিকে এগুচ্ছেন। দারোয়ান তাঁর বুক লক্ষ করে বন্দুকের নিশানা করল। সবাই যেন হতভম্ব, শানুর বাবা বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছেন। যে-কোনো মুহূর্তে ভয়ংকর একটা বিপদ ঘটে যেতে পারে।

তারপরই ঘটল একটা কান্ড। অব্যর্থ লক্ষে একটা তির এসে বিঁধল দারোয়ানের ডান হাতের কবজিতে, বন্দুক ছিটকে পড়ল হাত থেকে। বুধনের মুখে ফুটে উঠল হাসি, ওর নিশানা ব্যর্থ হয়নি।

তারপরই সমুদ্রের জোয়ারের মতো সাঁওতাল বাহিনী আছড়ে পড়ল ফটকে, ওটা ভেঙে ঢুকে পড়ল ভেতরে। তাদের বাধা দেবে এমন শক্তি তখন আর নেই।

দ্বিতীয় ঘরটায় হাত-পা-বাঁধা অবস্থায় শানুকে পাওয়া গেল, ওর পাশেই পড়ে ছিল গোবর্ধনের অচেতন দেহ। ওদের দু-জনকে নিয়ে জয়োল্লাসে ফিরে চলল সাঁওতাল বাহিনী, ওদের মাদলের সুর এখন বদলে গিয়েছে, ধিতাং তাং, ধিতাং তাং।

গোবর্ধনকে শানুদের বাড়িতেই আনা হয়েছে। শানুর মুখে সব শুনলেন ওর বাবা। কাউকে কিছু না জানিয়ে এমন সাংঘাতিক একটা ব্যাপারের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলার জন্য শানুর ওপর ভীষণ রাগ করলেন তিনি। সাঁওতালরা সহায় না হলে ওকে হয়তো আর ফিরে পাওয়া যেত না।

মোড়লের হুকুমে কয়েক জন ওখানে পাহারায় রইল। শেঠজিকে বিশ্বাস নেই, অত সহজে হার মানবার পাত্র সে নয়।

মোড়ল খুব বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছিল। একটু রাতের দিকে শানুদের বাড়ির কাছে কালো গাড়িটা এসে থামল। পাঁচ-ছ জন লোক নিঃশব্দে এগিয়ে আসতে লাগল বাড়ির দিকে। তাদের হাতে অস্ত্র, মুখে হিংসার রেখা। হঠাৎ তাদের চমকে দিয়ে আড়াল থেকে সাঁ সাঁ করে তির ছুটে আসতে লাগল, দু-জন জখম হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। কে এক জন জোরে মাদল বাজাল, তার জবাব ভেসে এল সাঁওতাল পাড়া থেকে। সাহায্যের জন্য তারা আসছে, ভয় নেই। বেগতিক দেখে শেঠজির ভাড়াটে গুন্ডারা আহত সঙ্গীদের নিয়ে চম্পট দিল।

১৪

মাঝ রাতে জ্ঞান ফিরল গোবর্ধনের। ওর মাথার ক্ষতটা পরিষ্কার করে মলম লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন শানুর মা। ওর জ্ঞান হয়েছে দেখে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে দিলেন, শানুর বাবার কথামতো এক চামচ ব্র্যান্ডি মিশিয়ে দিলেন দুধে। ওটাই টনিকের কাজ করল। বেশ সুস্থ বোধ করতে লাগল গোবর্ধন। শানুর বাবা মাথার যন্ত্রণার জন্য ট্যাবলেটও দিলেন।

শানু আর রাণু পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। ওদের মা-বাবা গোবর্ধনের পাশেই বসেছিলেন। গোবর্ধন উঠে বসবার চেষ্টা করতেই শানুর বাবা হাঁ হাঁ করে উঠলেন, জোর করে শুইয়ে দিলেন। গোবর্ধন জানতে চাইল কী হয়েছিল। শানুর বাবা সাঁওতালদের সাহায্যে কেমন করে ওদের উদ্ধার করা হয়েছে তা সবিস্তারে বললেন।

গোবর্ধন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর বলল, ‘আমারও কিছু বলার আছে আপনাদের কাছে।’

‘সে হবেখন’, শানুর বাবা বললেন, ‘কাল অনেক সময় পাওয়া যাবে।’

‘না, কাল সময় হবে না’, দৃঢ় কণ্ঠে বলল গোবর্ধন, ‘কাল সকালেই আপনারা এখান থেকে চলে যাবেন, নয়তো বিপদ হতে পারে। শেঠজি সহজে ছাড়বে না, তার আসল ব্যবসার কথা আপনারা জেনে ফেলেছেন, তার চোখে আপনারা এখন বিপদজনক।’

এই রূঢ় সত্যিটা অস্বীকার করতে পারলেন না শানুর বাবা।

‘আমার বাবা এক সরকারি অফিসে কাজ করতেন’, গোবর্ধন আবার বলতে শুরু করল, ‘আমরা ছিলাম দুই ভাই-বোন। আমার চাইতে বোন চার বছরের ছোটো ছিল, ওর নামও ছিল রাণু, ফুটফুটে চেহারা, আপনার মেয়ের সঙ্গে আশ্চর্য মিল, আর মুখে যেন কথার ফুলঝুরি।’ গোবর্ধনের ঠোঁটের ফাঁকে একটুকরো হাসি, বোধ হয় বোনের স্মৃতি ভেসে উঠল ওর মনের পটে। ‘আমাকে খুব ভালোবাসত, দাদা দাদা করে অস্থির করে তুলত। তারপর হঠাৎ যে কী হল! আমার যখন তেরো-চোদ্দো বছর বয়স, দু-দিনের জ্বরে আমাদের সবার মায়া কাটিয়ে চলে গেল ও। মা শোকে অজ্ঞান হয়ে গেলেন, সেই যে বিছানা নিলেন আর উঠলেন না। বোন মারা যাবার এক বছরের মধ্যেই মাকেও হারালাম। বাবা যেন কেমন হয়ে গেলেন। প্রথমে কেউ বুঝতে পারেনি, পরে ধরা পড়ল, তাঁর মাথায় গোলমাল দেখা দিয়েছে। লেখাপড়ায় বরাবরই আমি কিন্তু ভালো ছিলাম, স্ট্যান্ড করতাম। তারপর হঠাৎ একদিন বাবা হারিয়ে গেলেন, কোথায় যে গেলেন আর ফিরলেন না, খোঁজ পাওয়া গেল না। কিছুদিন আমি আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ছিলাম, ক্রমে বুঝতে পারলাম আমি একজন অবাঞ্ছিত উপরি বোঝা। আমার সামনেই আমার সম্বন্ধে এমন সব কথা তাঁরা বলতেন যা শুনে আমার খুব খারাপ লাগত। শেষে একদিন আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম। পেটের তাগিদে কত রকম কাজই না করেছি! তারপর একদিন অন্ধকার জগতে হারিয়ে গেলাম। ভাসতে ভাসতে এখন এখানে এসে ঠেকেছি। শেঠজি আমাকে আশ্রয় দিলেন, তাঁর দু-নম্বর ব্যবসার দলে নিয়ে নিলেন আমাকে। আড়তের ব্যবসাটা আসলে একটা আড়াল, জাল নোটের ব্যবসাই হচ্ছে আসল।’

গোবর্ধন দম নেবার জন্য একটু থামল, তারপর বলল, ‘আপনার মেয়েকে প্রথম দিন দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম, মনে হয়েছিল আমার ছোটো বোনটিই বুঝি আবার ফিরে এসেছে। ও আমাকে মনে করিয়ে দিল আমি কী ছিলাম আর কী হয়েছি। এই হচ্ছে আমার ইতিহাস, আপনারা ইচ্ছে করলে আমাকে পুলিশে দিতে পারেন।’

কয়েক মুহূর্ত কারও মুখে কথা নেই, তারপরই শানুর বাবা বলে উঠলেন, ‘পাগলের কথা শোনো, আমাদের মেয়ে যাকে দাদা বলে ডেকেছে, তাকে আমরা পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারি? তা ছাড়া শানুকে বাঁচাবার জন্য তুমি নিজের জীবনের মায়া করনি, এ কথা তো মিথ্যে নয়।

গোবর্ধনের দু-চোখ ছলছল করে উঠল, ও বলল, ‘কিন্তু কাল সকালেই আপনারা এখান থেকে চলে যাবেন, এখানে প্রতি মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে আপনাদের।’

‘তা যাব’, এতক্ষণে শানুর মা মুখ খুললেন, ‘কিন্তু আপনাকেও যেতে হবে আমাদের সঙ্গে।’

‘আমি!’ গোবর্ধন অবাক চোখে তাকালেন।

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ’, শানুর বাবা সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘তোমাকে এই অবস্থায় এখানে ফেলে যেতে আমরা পারি না, বিপদ তোমারও কম নয়। তুমি আমাদের সঙ্গে চল, আমি তোমার একটা কাজের ব্যবস্থা করে দেব। এ জীবন তোমার মতো মানুষের জন্য নয়।’

গোবর্ধনের মুখে মৃদু হাসি ফুটল, ও বলল, ‘বেশ, আমি যাব। আপনি যদি আমার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন তবে তো আমি বেঁচে যাই। কিন্তু তার আগে শেঠজির সঙ্গে আমার বোঝাপড়া আছে, তা না করে আমি যেতে পারব না।’ শেষের দিকে ওর গলার স্বর কঠিন হয়ে উঠল।

‘সে কি?’ শানুর বাবা বললেন, ‘তুমি নিজেই বলেছ শেঠজি লোকটা সাংঘাতিক, তার সঙ্গে তোমার কি বোঝাপড়া থাকতে পারে! না, না, আমি তোমাকে অনুরোধ করিছ…’

‘আপনি কিছু ভাববেন না’, গোবর্ধন হাসল, ‘আমি সাবধান হব, আমারও কিছু সাঙ্গপাঙ্গ আছে, শেঠজি তা জানে। চট করে আমাকে কিছু করতে সাহস করবে না।’

‘কিন্তু করেছিল তো?’ শানুর বাবা প্রতিবাদ করলেন।

‘সে আমি ওখানে গিয়ে পড়েছিলাম তাই।’

‘তা হোক’, শানুর মা বললেন, ‘আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন।’

‘আপনি আমাকে অমন করে বলবেন না’, গোবর্ধন মিনতিভরা কণ্ঠে বলল, ‘আপনাদের ঠিকানাটা আমাকে দিয়ে যান, আমি কয়েক দিনের মধ্যেই গিয়ে হাজির হব, তখন কিন্তু আমাকে ফেলতে পারবেন না।’

‘ছিঃ!’ শানুর মা ভর্ৎসনার সুরে বললেন, ‘অমন কথা ভাবলেও আমাদের পাপ হবে।’

সকালের যে ট্রেনটা কলকাতায় যায়, সেই ট্রেন ধরার জন্য পরদিন রওনা হলেন ওঁরা। বুধনের বাবা একটা গোরুর গাড়ি জোগাড় করে এনেছিল। গোবর্ধন ওদের সঙ্গে চলল স্টেশন পর্যন্ত, আর ওদের অনুসরণ করল একদল সাঁওতাল, তাদের হাতে টাঙ্গি আর তির-ধনুক। বুধনও আছে সেই দলে।

স্টেশনে হঠাৎ রাণু বলে উঠল, ‘ওমা! আমার ডাচেস! ওর কী হবে?’

তাই তো! তাড়াহুড়োয় মুরগির ছানাটার কথা সবাই ভুলে বসে আছে। ওদের মা বুধনকে ডেকে বললেন, ‘তুই ছানাটাকে নিয়ে যাস, ওটা তো তোরই জিনিস।’

‘কিন্তুক হামিতো উটা দিয়্যা দেইঞছি, ফিরে লিবে ক্যানে?’ ফোঁস করে উঠল বুধন।

শানুর মা ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে শেষপর্যন্ত রাজি করালেন।

শানুর বাবা সাঁওতালদের মিঠাই খাবার জন্য এক-শো টাকা দিতে গিয়ে অপ্রস্তুত হলেন। ওদের একজন বলল, ‘ইটা কি বখশিশ বটে? সেটা তো পাইঞছি, ভাত খেলম, মাংস খেলম, আবার বখশিস ক্যানে?’

ভীষণ লজ্জা পেলেন শানুর বাবা।

ট্রেন ছাড়বার মুহূর্তে শানু গোবর্ধনকে বলল, ‘একটা কথা জিজ্ঞেস করব?’

‘কী কথা?’ হাসিমুখে বলল গোবর্ধন।

‘আপনার আসল নাম কি রজত হালদার?’

‘তুমি কী করে জানলে!’ ভীষণ অবাক হল গোবর্ধন।

‘তোমাকে বলছি না আমি’, ওর অজ্ঞতায় রাণু যেন বিরক্ত হল, ‘দাদা রহস্যের গন্ধ পায়, বড়ো হয়ে ও ফেলুদা হবে।’

গাড়ি ছাড়াবার ঘণ্টা বাজল। রাণুর কচি নরম হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে মৃদু চাপ দিল গোবর্ধন, ওর চোখ দুটো ছলছল করছে।

ট্রেন ছেড়ে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *