নীল পাখির পালক

নীল পাখির পালক

ঝকঝকে পিচঢালা পথ আর দু-পাশে ঘন শালবন। সাইকেল রিকশা চেপে যেতে যেতে অবাক চোখে তাকিয়েছিল সুজন। কবে কোন একটা মাসিক পত্রিকায় শালবনের ছবি দেখে খুব ভালো লেগেছিল ওর, মনে গেঁথে গিয়েছিল। ঠিক সেই ছবিটাই যেন সত্যি হয়ে দেখা দিয়েছে। ছবিতে দু-ধারে শালবনের মাঝ দিয়ে এমন একটা পথও ছিল। ছবির সঙ্গে সত্যিকারের জিনিসের এমন মিলও হয়? আশ্চর্য!

স্টেশন থেকে অনেকটা দূর জ্যাঠামণির বাড়ি। বাবার মুখেই শুনেছে সুজন, জ্যাঠামণির বাড়ির আশেপাশে মাত্র দু-তিনটে বাড়ি। তারপর খানিকটা এগিয়ে সাঁওতাল পাড়া। খুব নির্জন নাকি জায়গাটা, চারদিকে গাছপালা। সন্ধের পর শেয়াল ডাকে। মুরগির লোভে বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করে।

হঠাৎ রিকশাওয়ালা সাইকেল থেকে নেমে রিকশাটা টানতে টানতে এগিয়ে নিতে শুরু করতেই চমক ভাঙল সুজনের। ও যেন এতক্ষণ অন্য জগতে চলে গিয়েছিল। মাঝে মাঝেই এমন হয় ওর। কিছু খেয়াল থাকে না, কে যেন ওর মনকে কোথায় উড়িয়ে নিয়ে যায়। রিংকু ঠাট্টা করে ওকে বলে ভাবুক। রিংকুর বয়স বারো, ওর চাইতে তিন বছরের ছোটো, কিন্তু কথায় ভীষণ পাকা।

‘লোকটা সাইকেল না চালিয়ে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে কেন?’ মাকে জিজ্ঞেস করল সুজন।

‘রাস্তাটা এখানে কেমন উঁচু হয়ে গেছে, দেখছ না?’ মা বললেন। ‘সাইকেল চালাতে কষ্ট হচ্ছে ওর, তাই টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এটাকে বলে চড়াই।’

‘ও’, সুজন মাথা দোলায়। চড়াই আর উতরাই। কোন গল্পের বইয়ে ও যেন পড়েছিল। এটা যদি চড়াই হয় তবে যে রাস্তা নীচু তাকে নিশ্চয়ই উতরাই বলে।

পেছনের রিকশায় রিংকু আসছিল বাবার সঙ্গে। ও চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘দাদা তোদের রিকশা খারাপ হয়ে গেছে।’

সুজন মনে মনে হাসল। এখুনি ওদের রিকশাওয়ালা নেমে পড়বে আর নিজের ভুল বুঝতে পারবে রিংকু।

কলাবনির মোড়ে পৌঁছোল ওরা। রিকশা এবার পাকা রাস্তা ছেড়ে ডান দিকে লালমাটির রাস্তা ধরল। একটু এগোতেই ডান দিকে একটা পুকুর চোখে পড়ল সুজনের। এতক্ষণে এই প্রথম একটা পুকুর দেখল। পুকুরের জল কিন্তু পরিষ্কার টলটলে নয়, একটু ঘোলাটে।

পেছন থেকে বাবা বললেন, ‘সুজু, এই পুকুরে গত বছর একটা বাঘ সন্ধেবেলা জল খেতে আসত।’

‘বাঘ!’ সুজনের যেন আর বিস্ময়ের অন্ত থাকে না। ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, বাবা?’ ঘাড় ফিরিয়ে ও প্রশ্ন করে।

‘না’, বাবা হেসে জবাব দেন। ‘রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার সুন্দরবনে থাকে। ওটা ছিল একটা কেঁদো বাঘ।’ কেঁদো বাঘ কি সেটা সুজন ঠিক বুঝতে পারে না, কিন্তু বাবাকে জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা হয়। তবে কেঁদো বাঘ যে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের মতো ভয়ানক নয় তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না ওর।

‘এখানে আবার বাঘ-টাগ আছে নাকি?’ ঘাড় আদ্ধেক ফিরিয়ে মা জিজ্ঞেস করলেন। তাঁর গলায় একটা শঙ্কার ভাব চাপা থাকে না।

‘শুধু বাঘ কেন, বুনো হাতিও মাঝে মাঝে দর্শন দেন’, সুজনের বাবা হাসতে হাসতে জবাব দিলেন। ‘ময়ূরভঞ্জের জঙ্গল এখান থেকে খুব বেশি দূর নয়। বুনো হাতি ওখান থেকেই আসে। পাকা ধান খেয়ে লণ্ডভণ্ড করে চলে যায়।’

‘তবে বাপু ছেলে-মেয়ে নিয়ে এখানে আমি থাকতে পারব না’, মা যেন বেশ ভয় পেয়েছেন। ‘আগে জানলে কখনো আসতাম না আমি।’

‘আরে এত ভয়ের কি আছে!’ বাবা মাকে সাহস দিয়ে বললেন, ‘লোকজন কি বাস করে না এখানে! তা ছাড়া গত ক-বছর বুনো হাতির উপদ্রব হয়নি।’

‘হয়নি, কিন্তু হতে কতক্ষণ!’ বাবার কথায় মা যেন আশ্বস্ত হতে পারেন না।

‘আসুক না হাতি’, বাবা এবার জোর দিয়ে বললেন, ‘আমাদের বন্দুক আছে না?’

‘বন্দুকটা ছুড়বে কে?’

‘কেন আমি!’

‘তুমি!’ মা এবার হেসে ফেললেন, ‘শুনলি তো সুজু, তোর বাবা কত বড়ো শিকারি, মুখে মুখে বাঘ হাতি মারেন।’

বাবাকে এমন হেনস্তা করায় সুজনের খারাপ লাগল। ও বলল ‘হাতি তো প্রকাণ্ড, তাকে টিপ করে গুলি করা এমন কিছু কঠিন নয়।’

মা এবার গলা ছেড়ে হেসে ওঠেন।

‘টিপ করার আগেই ভিরমি না খেলে ভালো’, হাসি থামিয়ে টিপ্পনী কাটলেন তিনি।

রিকশা চলেছে। মাঝে মাঝে দু-পাশে বুনো ঝোপের সারি, তারপর শুধু বাঁ-পাশ ঘেঁষে ঝোপ আর ডান দিকে মাঠ। কিংবা দু-পাশে মাঠ, মাঝখান দিয়ে কাঁচা রাস্তা। ঝোপে একরকম বুনো ফুল থোকা থোকা। ফুটে আছে, হলুদ আর কমলা রঙের ছোটো ছোটো ফুলের থোকা। একটা কেমন বুনো গন্ধ সুজনের নাকে এসে লাগছে, খারাপ লাগছে না গন্ধটা। চারদিক কী শান্ত। মনটা আবার উড়ু উড়ু হতে চায় সুজনের। ‘এগুলো হচ্ছে সাঁইবনি গাছের ঝোপ’, বাবা বললেন পেছন থেকে। ‘কুরচি আর বনতুলসীর ঝোপও পথে পড়বে।’

‘ওটা কী গাছ বাবা?’ মাঠের ধারে একটা বড়ো গাছ দেখিয়ে ও জিজ্ঞেস করে। গাছের পাতাগুলো বেশ বড়ো বড়ো আর লালচে, দূর থেকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে।

‘কুসুম’ বাবা বললেন।

‘কুসুম!’ —সুজন মনে মনে অবাক হয়। কুসুম মানে তো ফুল, ও নামে আবার গাছ হয় নাকি! এখানে আসতে না আসতেই একটা নতুন গাছের নাম জানা হয়ে গেল, কী মজা! গাছটার পাশ দিয়ে যাবার সময় ওপর দিকে তাকাল সুজন। পাতাগুলো কেমন যেন চিকন আর একটা স্নিগ্ধ লাল আভা ফুটে বেরুচ্ছে পাতা থেকে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল মাটিতে পড়ে থাকা একটা পাতা কুড়িয়ে নেয়, কিন্তু শুধু সে জন্য রিকশা থামাতে বলতে ওর বাধল। ছোটোবেলা থেকেই ও একটু লাজুক আর মুখচোরা। রিংকু ঠিক উলটো।

যতই দেখছিল চারদিক, ততই জায়গাটাকে ভালো লাগছিল সুজনের। এখানকার সব কিছুই যেন ছবির মতো সুন্দর। আগে কখনো এখানে আসেনি ও। জ্যাঠামণিই এখানে এসেছেন মোটে দু-বছর। তিনি ছিলেন ফরেন সার্ভিসে। বাবাই ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়েছেন সুজনকে। বিদেশে নিজ নিজ দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য আর অন্যান্য স্বার্থের ব্যাপারে যে আপিস থাকে সেগুলোকে বলা হয় অ্যামব্যাসি বা দূতাবাস, আর যাঁরা সেখানে কাজ করেন তাঁরা হলেন ফরেন সার্ভিসের লোক, সবচেয়ে যিনি বড়ো তিনি হলেন রাষ্ট্রদূত। জ্যাঠামণির নাকি রাষ্ট্রদূত হবার ষোলো আনা সম্ভাবনাই ছিল, কিন্তু একটা দুর্ঘটনা তাঁর জীবনের সব কিছু ওলটপালট করে দিয়েছে।

জ্যাঠামণি তখন তিব্বতে ভারতের প্রথম কনসাল জেনারেল। একটা জরুরি ব্যাপারে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু জ্যাঠামণিকে দিল্লি ডেকে পাঠিয়েছিলেন। বলে দিয়েছিলেন আসার আগে তিনি যেন ওখানকার ধর্মগুরু দালাই লামার সঙ্গে আলোচনা করে আসেন। তাই আসছিলেন জ্যাঠামণি।

তখন শীতকাল, দুর্গম পাহাড়ি পথ, বরফে ঢাকা। অনেকটা রাস্তা। টাট্টু ঘোড়ার পিঠে আসতে হয়। শীতের ও সময়টা নাকি ও পথে মানুষ চলাচল করে না, কিন্তু দিল্লি থেকে জরুরি তলব এসেছে, তাই যেতেই হবে জ্যাঠামণিকে।

মাঝপথে গিয়ানৎসিতে গভীর রাতে জ্যাঠামণির ঘুম ভেঙে গেল। বাঁ-দিকটা অসাড় হয়ে গেছে। প্রথমে ভাবলেন প্রচণ্ড ঠান্ডায় ওই অবস্থা হয়েছে। সঙ্গের লোকজনদের তিনি ডাকলেন। সারারাত ধরে তারা গরম সেঁক দিল শরীরে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। পরে ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে বললেন স্ট্রোক হয়েছে, বাঁ-দিকটা জখম করে দিয়ে গেছে সারাজীবনের মতো।

খবর পেয়ে দিল্লি থেকে ডাক্তার এলেন, আর এল এয়ার ফোর্সের একটা বিমান। ওই বিমানে তাঁকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হল। মিলিটারি হাসপাতালে কয়েক মাস ছিলেন জ্যাঠামণি। ডান হাতে লাঠিতে ভর দিয়ে বাঁ-পা টেনে টেনে হাঁটা অভ্যেস করেছিলেন; বাঁ-হাত দিয়ে কিছু করতে কষ্ট হয়, হাত কাঁপে। কবিরাজি চিকিৎসার জন্য সুদূর কেরালা পর্যন্ত গিয়েছিলেন জ্যাঠামণি। ওখানে নাকি এসব রোগের ভালো চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। কয়েক মাস এক কবিরাজের বাড়ি থেকে চিকিৎসা করিয়েছিলেন, কিন্তু তেমন কিছু উন্নতি হয়নি। ওখান থেকে কলকাতায় এসেছিলেন। বিরাট চেহারার মানুষটি নিজের অসহায় অবস্থায় ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁর অবস্থা বিবেচনা করে দিল্লি থেকে আলাদা ছুটির ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হয়তো ঠিক সময়ের অনেক আগেই তিনি চাকরি থেকে অবসর নিতেন, কিন্তু ডাক্তারদের পরামর্শে তিনি মনে জোর ফিরে পেলেন, দিল্লিতে ফিরে আবার কাজে যোগ দিলেন। ওপর মহল তাঁর সঙ্গে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করেছিল। হালকা কাজ দিয়ে একটা নতুন পদই সৃষ্টি করা হয়েছিল তাঁর জন্য। এসবই সুজন শুনেছে বাবা-কাকাদের মুখে।

১৯৬২ সালে যখন চীন ভারত আক্রমণ করে তখন তিনি দিল্লিতে। তারপর আরও ক-বছর চাকরি করেছিলেন। রিটায়ার করার পর দিল্লিতেই ছিলেন, ভেবেছিলেন বাকি জীবনটা ওখানেই কাটিয়ে দেবেন। বিয়ে-থা করেননি। একা মানুষ, কোনো ঝঞ্ঝাট নেই। কিন্তু হঠাৎ কেন জানি বাংলা মুলুকে ফিরে আসার ইচ্ছে হল তাঁর। ভবানীপুরে প্রিয়নাথ মল্লিক রোডের বাড়িটা মস্ত বড়ো হলে কী হবে, অনেক লোক। দাদুরা সাত ভাই ছিলেন, তাঁদের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিতে পা ফেলবার জায়গা নেই বাড়িতে। পিসিদের অবশ্য বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাই বোনদের নিয়ে ছোটোখাটো একটা বাহিনী গড়া যায়।

জায়গার অভাব ছাড়াও কলকাতার কোলাহলময় জীবনে ফিরে আসতে চাননি জ্যাঠামণি! অনেক বছর আগে তিনি নাকি এখানে একবার এসেছিলেন, খুব মনে ধরেছিল জায়গাটা। দিল্লির পাট চুকিয়ে তাই এখানে চলে এসেছেন। আগে থেকেই অবশ্য জমি কেনা, বাড়ি তৈরি করা, এইসব ব্যবস্থা করে ফেলেছিলেন। সুজনের বাবাকে এ ব্যাপারে সে সময় প্রায়ই এখানে আসতে হত। এখনও একমাস দু-মাস অন্তর একবার করে আসেন; তবে ওদের নিয়ে এই প্রথম এখানে আসা।

জ্যাঠামণিকে সুজন আগে দেখেনি। দিল্লিতে যখন জ্যাঠামণি আবার ফিরে গিয়েছিলেন তখন ওর জন্মই হয়নি। আর তো কলকাতায় আসেননি তিনি। তবে জ্যাঠামণির ফটো দেখেছে সুজন। খুব রাশভারী চেহারা। শুনেছে আগে যখন তিনি দেশে ফিরতেন, ছুটিছাটায় কলকাতায় আসতেন, বাড়িসুদ্ধু লোক তটস্থ হয়ে থাকত। এমনকী, মেজো দাদু, সেজো দাদু, ন-দাদু তাঁরাও নাকি জ্যাঠামণিকে সমীহ করে চলতেন। এ হেন মানুষটির সম্বন্ধে সুজনের মনে যে একটা ভয় আর কৌতূহলের সৃষ্টি হবে তাতে আর বিচিত্র কি!

এতদিন তাদের এখানে না নিয়ে আসার একটা কারণও ছিল বাবার। ভবানীপুরের বাড়িতে নানা অশান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। দাদুরা যদ্দিন বেঁচেছিলেন, সবাই মিলেমিশে ছিলেন। বাবার মুখে সুজন শুনেছে রাত্তিরে যখন সবাই খেতে বসতেন তা একটা দেখার মতো জিনিস ছিল। ভেতরের লম্বা বারান্দায় পর পর পিঁড়ি পড়ত, গোটা কুড়ি তো হবেই। ছোটোরা আগে খেয়ে নিত। মেয়েদের খাবার ঘর ছিল আলাদা। সারির প্রথম পিঁড়িতে বসতেন দাদুদের মধ্যে বয়সে যিনি সবার বড়ো, তারপর পরের জন। দাদুদের পর পালা আসত বাবাদের— খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাইদের— বড়ো থেকে ছোটো এই নিয়মে। যে ছোটো, সে তার চাইতে বড়োকে ডিঙিয়ে বসতে পারত না। পাত পড়লেই সুন্দর দাদু, বাবা-কাকা-জেঠাদের নাম ধরে হাঁক দিতেন, আর যে যেখানে থাকত সবাই সুবোধ বালকের মতো সুড়সুড় করে খাবার জায়গায় এসে হাজির হত। খাবার সময় কেউ কথা বলত না, অবশ্য দাদুরা বাদে।

কিন্তু দাদুরা মারা যাবার পর থেকেই একান্নবর্তী পরিবারের ভিত নড়ে উঠল। একটা উনুনের জায়গায় অনেকগুলো উনুন হল, সেইসঙ্গে শুরু হল সামান্য ব্যাপার নিয়ে খিটিমিটি। এ ভাবেই চলছিল এত বছর। শেষপর্যন্ত বাড়ি বিক্রির প্রস্তাব উঠল। অনেক টালবাহানার পর সবাই সই দিল দলিলে। চার মাস হল বাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে, কিনেছে একটা নামকরা গানের স্কুল। বাড়ি বিক্রির পর যে যার ভাগের টাকা নিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে, ছড়িয়ে পড়েছে নানান জায়গায়। সুজনদের ভাগ্য ভালো, পুরোনো বাড়ির কাছাকাছি একটা বাড়ির দোতলায় একটা ফ্ল্যাট ভাড়া পেয়ে গেছে। কিন্তু পুরোনো বাড়ির পাশ দিয়ে যাবার সময় সুজনের বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। ওই বাড়ির প্রত্যেকটি ঘর, প্রতিটি আনাচকানাচ ওর স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

গত দু-বছর নানান অশান্তি আর ঝামেলায় বাবা বড়োই বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন। মাঝে মাঝে এখানে আসতেন, কিন্তু একা। এখন সব গোলমাল চুকে গেছে, অনেকটা নিশ্চিন্তি, তাই এবার পুজোর ছুটিতে ওদের নিয়ে এসেছেন। দিন সাতেক ওরা এখানে থাকবে।

রিকশা একটা বাড়ির গেটের সামনে এসে থামল।

আবার অবাক হবার পালা সুজনের। কলাবনির মোড় থেকেই বাড়িঘর কমতে শুরু করেছিল। এই মাইল দেড়েক পথের মধ্যে শুধু ফাঁকা মাঠ, বুনো ঝোপঝাড়, একটা একতলা ছোট্ট পাকা বাড়ি আর দুটো টিনের চালার ঘর ওর চোখে পড়েছিল, কিন্তু এ বাড়িটা ঠিক যেন ছবির মতন। অনেকটা জমির মাঝখানে বাড়িটা। চারপাশে কাঁটা তারের বেড়া। বাড়ির সামনে দু-পাশে গোলাপের বাগান। বাড়িটা দেখতে ভারি সুন্দর, রেলিং দেওয়া ঢালা বারান্দা সামনের ঘরগুলোকে যেন ঘিরে রেখেছে। কত গাছ বাড়িতে! ফলের গাছ, ফুলের গাছ, পাতাবাহার গাছ। গেটের দু-পাশে দুটো বোগেনভেলিয়া— একটা ভরে আছে রক্তের মতো টকটকে লাল ফুলে আর অন্যটা হালকা গোলাপি রঙের ফুলে। এত ফুল যে পাতাই দেখা যায় না।

গেট থেকে পাথরকুচি বিছানো রাস্তার দু-পাশে ঝাউ গাছের সারি। রাস্তার যে পাশটা বাড়ির সামনের দিকে মুখ করা, তার উলটো দিকে ছোটো ছোটো ক্ষেতে নানারকমের শাকসবজি ফলে আছে।

‘কী হল, নামছিস না কেন?’ ফিসফিস করে বলা মার কথা শুনে চমকে ফিরে তাকাল ও, আর আরও অবাক হল। মা মাথার ঘোমটা একটু যেন বেশিই টেনে দিয়েছেন। সঙ্গেসঙ্গে ওর দৃষ্টিটা আবার চলে গেল বারান্দার দিকে। একপাশে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটিকে এতক্ষণ ও লক্ষ করেনি। মাথার চুল সব সাদা, কিন্তু বেশ ভারী চেহারা। একটা পাজামা পরে আছেন, গায়ে বুকখোলা শার্ট, ডোরাকাটা। পায়ে লাল ক্যাম্বিস জুতো। এই তবে জ্যাঠামণি! কিন্তু ওঁর যে অসুখের কথা শুনেছিল সুজন, তা বোঝার উপায় নেই। ঠিক যেন একজন স্বাস্থ্যবান, বয়স্ক মানুষ চেয়ারে বসে ওদের লক্ষ করছেন, আর মুখে ফুটে উঠেছে একটা মৃদু হাসির ঝিলিক। এত দূর থেকেও হাসিটা দেখতে পাচ্ছে সুজন। জ্যাঠামণি তবে রাগী মানুষ নন, ওঁর মুখেও হাসির ঝিলিক খেলে।

পাথরের নুড়ির ওপর দিয়ে হেঁটে ওরা সিঁড়ির মুখে এল। বারান্দায় উঠে মা ঢিপ করে একটা প্রণাম করলেন জ্যাঠামণিকে। মাকে এখন কেমন শান্ত, কিচ্ছুটি জানে না মনে হচ্ছে, অথচ কথায় মার সঙ্গে এঁটে ওঠা রীতিমতো কঠিন; বাবাকে তো প্রায়ই ঘোল খাইয়ে ছাড়েন। সুজনের ভীষণ হাসি পাচ্ছিল মার হাবভাবে।

ও আর রিংকুও প্রণাম করল জ্যাঠামণিকে।

‘তুমিই বুঝি জ্যাঠামণি, তোমার কথা কত শুনেছি, আমার নাম রিংকু, ও আমার দাদা, নাম সুজন, মা-বাবা সুজু বলে ডাকে।’

এক নিশ্বাসে বলে গেল রিংকু। সুজন মনে মনে লজ্জা পেল, কী অসভ্য রিংকুটা, গুরুজনদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, এখনও শিখল না!

‘ও’ জ্যাঠামণি বললেন। ‘তোমার দাদার নামটাও তুমি বললে কেন, ও বলতে পারত না?’ জ্যাঠামণির চোখ যেন হাসছে।

‘ও ভীষণ লাজুক তো, লোকের সঙ্গে কথা বলতে পারে না’, রিংকু জবাব দিল, ‘কত বকুনি খায় ও মার কাছে এজন্য। ছেলেদের অমন মুখচোরা হলে চলে? বল তুমি।

ভীষণ রাগ হল সুজনের, ইচ্ছে করছে একটা চড় কষিয়ে দেয় রিংকুর গালে।

জ্যাঠামণি তাকালেন ওর দিকে। বোধ হয় ওর মনের কথা বুঝলেন। একটু হেসে বললেন, ‘কোন ক্লাসে পড়?’

‘ক্লাস নাইনে’, সুজন মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল।

‘কোন স্কুল?’

‘সেন্ট লরেন্স।’

‘ও। খুব ভালো স্কুল।’

‘আমি ইউনাইটেড মিশনারিতে পড়ি, ক্লাস সিক্সে’, রিংকু প্রশ্নের প্রত্যাশায় না থেকে বলল।

‘হ্যাঁ, ওটাও ভালো স্কুল’, জ্যাঠামণি বললেন। ‘কত বয়স তোমার?’ সুজনের দিকে তাকিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

‘পনেরো’।

‘আমার বারো’, রিংকু বলে উঠল।

জ্যাঠামণি এবার তাকাল রিংকুর দিকে। একটু হেসে বললেন, ‘তোমাকে যখন জিজ্ঞেস করব, তখন তুমি জবাব দেবে। নইলে মন্দ বলবে লোকে।’

রিংকু যেন চুপসে গেল। সুজন মনে মনে ভাবল, ঠিক হয়েছে, যেমন বেশি কথা বলা!

‘যাও জামাকাপড় ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফেল। খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?’ জ্যাঠামণির চোখ দুটো আবার যেন হেসে উঠল।

হাত-মুখ ধোবার জন্য কুয়োর পাড়ে গেল ওরা দু-জন। অবশ্য মা ওদের একা একা যেতে দিলেন না। বাড়িতে যে লোকটা কাজ করে তাকে ওদের সঙ্গে থাকতে বললেন। সুজন লক্ষ করছিল, আরও লোক কাজ করছে এখানে-সেখানে। এক জন পুরুষ আর দু-জন মেয়ে বাগানের কাজে ব্যস্ত। মাটি উসকে দিচ্ছে, আগাছা পরিষ্কার করছে, গাছে জল দিচ্ছে। আরেকজন মেয়ে বড়ো বড়ো গাছের তলা ঝাঁট দিচ্ছে, শুকনো ডাল ভেঙে ঝুড়ি ভরছে। বড়ো বড়ো দুটো গোরুও চোখে পড়ল সুজনের। পরে ও জেনেছিল ও দুটো বলদ, জমিতে লাঙ্গল দেয়া, গাড়িতে মাল টানা, এসবের জন্য ওদের রাখা হয়েছে। জ্যাঠামণির নাকি আশেপাশে আরও জমি আছে, সেখানে ধান, গম চাষ হয়। সারাবছরের চাল, ডাল জমি থেকেই আসে, বাড়তি যা থাকে হাটে-বাজারে বিক্রি হয়। তা নাকি অনেক, চাষের খরচা উঠে আসে। শাকসবজিও প্রচুর হয়, তা বিক্রি করেও বেশ দু-পয়সা লাভ হয় জ্যাঠামণির। মাচায় মস্ত মস্ত কুমড়ো ঝুলছে, মাটিতেও রয়েছে বেশ কয়েকটা। একটা ঘরে তাকের ওপর অনেকগুলো পাকা কুমড়ো চোখে পড়ল সুজনের। ওর কেমন যেন অবাক লাগে। ফলন্ত শাকসবজি, গাছের ফল, এসব আগে কোনোদিন দেখেনি ও। এ যেন একটা স্বপ্নপুরীতে এসে পড়েছে ওরা। ট্রাম নেই, বাস নেই, ভিড় নেই, কোলাহল নেই, আছে একটা শান্ত নির্জনতা, আর নিরুদবিগ্ন কর্মব্যস্ততা। মুখ বুজে যে-যার কাজ করে যাচ্ছে, আলস্য নেই, কাজে ফাঁকি দেবার চেষ্টা নেই, সুন্দর নিয়মে সবাই কাজ করছে। জমি কোথাও একটু ফাঁকা পড়ে নেই। হয় ফুলের গাছ, কিংবা শাকসবজির ক্ষেত ছড়িয়ে আছে চারদিকে— ঠিক ছড়ানো নয় যেন সুন্দর একটা ছক কেটে সব কিছু করা হয়েছে এখানে। একেই বোধ হয় বলে পরিকল্পনামতো কাজ, সুজন ভাবল।

কুয়োর পাড়টা বাঁধানো। সুজন উঁকি মেরে দেখল জল অনেকটা নীচে।

‘এই দাদা, বেশি ঝুঁকিস না, পড়ে যাবি’, রিংকু শাসনের সুরে বলে ওঠে। ওর পুরোনো স্বভাবটা আবার ফিরে এসেছে।

‘তুমি দাঁড়াও খুকাবাবু, আমি জল তুল্যা দিব’, ওদের সঙ্গের লোকটা বলল। যে লোকটা রান্না করে সে ছাড়া আর সবাই সাঁওতাল। সাঁওতাল পাড়াটা নাকি আর একটু এগিয়ে, ওখান থেকেই কাজ করতে আসে সবাই।

‘তুমি কি সাঁওতাল?’ একটু দোনামনা করে জিজ্ঞেস করেই ফেলল সুজন।

‘হঁ, আমি সাঁওতাল আছি বটে’, কুচকুচে কালো মুখে সাদা বকের পালকের মতো ঝকঝক করে উঠল ওর দু-পাটি দাঁত।

‘তোমাদের নিজেদের ভাষা নেই?’ সুজন বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ‘বাংলা ভাষাতেই তোমরা কথা বল নাকি?’

‘ইটা তুমি কি বুলছ খুকাবাবু!’ লোকটি হেসে ফেলল।

‘আমাদের নিজের ভাষা আছে বটে, বাবুদের সঙ্গে কথা বুলবার সময় বাবুদের ভাষায় কথা বলি, আমাদের ভাষা বাবুরা বুঝবে না বটে।’

সুজন লক্ষ করল ওদের কথার মধ্যে বেশ একটা টান আছে, আর ‘বটে’ কথাটা খুব ব্যবহার করে ওরা। পরে অবশ্য ও জ্যাঠামণির কাছে জেনেছিল ওদের নিজেদের ভাষার মধ্যে ওখানকার স্থানীয় ভাষার যথেষ্ট প্রভাব এসে পড়েছে।

লোকটির নাম সূত্রা। দড়ি বাঁধা একটা বালতি নামিয়ে চটপট জল তুলে ফেলল ও। ওদের হাত-মুখ ধোয়া হয়ে গেলে বালতি ভরতি জল চানঘরের ড্রামে ভরবে মার জন্য।

যারা কাজ করছিল, তারা সবাই উৎসুক হয়ে ওদের দেখছিল, আগে কখনো দেখেনি— তাই বোধ হয়। মেয়েগুলোকে দেখে সুজন যেন অবাক হয়ে গিয়েছে। চকচকে কালো গায়ের রং, পরিষ্কার কাপড়, একটু উঁচু করে পড়েছে, চুল টান টান করে আঁচড়ানো, আঁটো করে খোঁপা বেঁধেছে। খোঁপার মধ্যে আবার একটা করে লাল ফুল গুঁজেছে। সুন্দর স্বাস্থ্য ওদের, চড়া রোদে নির্বিকার ভাবে কাজ করছে।

সুজনের হঠাৎ কেন জানি ওদের সঙ্গে কথা বলার খুব ইচ্ছে হল। এক-পা, দু-পা করে ওদের দিকে এগিয়ে গেল ও; রিংকু ঠিক পিছন পিছন এসেছে।

সুজনকে ওরা লক্ষ করছিল। ও কাছে আসতেই ওরা খিলখিল করে হেসে উঠল। সুজন তো অবাক, হাসছে কেন ওরা!

‘এই তোমরা দাদার দিকে তাকিয়ে অমন অসভ্যের মতো হাসছ কেন?’ ধমক দিয়ে বলে উঠল রিংকু।

ওদের একজন এবার সুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তু এত কালো আছিস ক্যানে খুকাবাবু, তুর বুনটাতো বেশ ধবো।’

সুজনের মুখটা কেমন হয়ে যায়। ওর গায়ের রং সত্যিই বেশ কালো, তা নিয়ে ওর মনে বেশ ক্ষোভ আছে, কিন্তু এমন করে কেউ তা বলে তাকে কখনো ঠাট্টা করেনি। মনে মনে ও চটে যায় ওদের ওপর। রিংকুই কিন্তু ওর পক্ষ নিয়ে তেড়ে ওঠে। ঝংকার তুলে ও বলে, ‘আমার দাদা কালো তো তোমাদের কি? তোমাদের রং বুঝি খুব ফর্সা, আলকাতরার মতো…।’

ওরা গা ঠেলাঠেলি করে হেসে ওঠে। রাগের মধ্যেও সুজন লক্ষ করে, এতটুকু জড়তা নেই ওদের মধ্যে।

‘আমরা কালো আছি বটে’, ওদের একজন বলল, ‘কিন্তুক বাবুদের ছেইলা হবে রাঙ্গাপানা, আমাদের মতোন কালো হবে ক্যানে?’ আবার হেসে ওঠে ওরা। সুজনেরও হঠাৎ হাসি পায়। ওদের কথাবার্তায় রাগের চাইতে যেন হাসিই পায় বেশি, তা যতই ঠাট্টা হোক না কেন।

রিংকুর মতো মেয়েও কিন্তু ওদের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে থতমত খেল; তারপর বলল, ‘কারু ইচ্ছেমতো হয় নাকি গায়ের রং? তোমরা কেন এমন কথা বলছ, আমার দাদা দুঃখ পাবে না?’

মুহূর্তে মেয়েগুলোর মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন আসে, হাসির বদলে যেন একটা সমবেদনার চিহ্ন ফুটে ওঠে মুখে।

‘ঘাট মানছি খুকাবাবু’, বলল প্রথম জন, ‘তুকে দুঃখ দিব বল্যা ও কুথা বলি নাই বটে।’

‘জানিস খুকাবাবু’, দ্বিতীয় জন সায় দিয়ে বলে ওঠে, ‘কৈলা পাওয়া যায় যিখানে, সিখানেই হিরা লুককাই থাকে। তু কালো মাণিক আছিস।’

তৃতীয় মেয়েটি বলে উঠল, ‘কালো গোরুর দুধ ভালো, কালো মুরগির মাংস ভালো, কালো ময়নার গান ভালো, আর কালো মেয়্যা বউ ভালো।’

ভীষণ লজ্জা পেল সুজন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে লুটিয়ে পড়ল মেয়েগুলো।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই একটু গড়িয়ে নিল। কিন্তু সুজনের চোখে ঘুম নেই। ও ঘুরে ঘুরে দেখছে সব। আমগাছ আছে মোট দশটা, ও গুণে দেখল। গাছগুলো কিন্তু বেশি বড়ো নয়, অনেকটা যেন বেঁটে তবে বেশ ঝাঁকড়া। তলাটা পরিষ্কার তকতকে। সাঁওতাল মেয়েরা কাজে ফাঁকি দেয় না কিন্তু। লিচু গাছ দুটো, আতা গাছ অনেক, প্রত্যেক গাছে আতা ঝুলছে। সুজনের মনে হল অনেক আতা পেকে এসেছে। ওপরের দানাগুলো ফেটে ফেটে সাদা হয়ে গেছে। বাবা যখন বাজার থেকে পাকা আতা আনেন তখন দেখতে অমন হয়, তবে নরম, এগুলো এখনও একটু শক্ত আছে। চালের ভেতর ঢুকিয়ে রাখলে আতা পেকে যায়, সুজন জানে। ওর খুব ইচ্ছে করছিল আতা পাড়তে, কিন্তু জ্যাঠামণি যদি রাগ করেন এই ভেবে ইচ্ছেটাকে দমন করল ও।

কলাগাছ দেখে তো ও অবাক। খুব ছোটো ছোটো গাছে কাঁদি পড়েছে। এখানে সব কিছুই কী অদ্ভুত! যে লোকটা রান্নার কাজ করে তার নাম রজনী। তাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল ওগুলো সিঙ্গাপুরি কলাগাছ, বেশি বড়ো হয় না। কুয়োর ধারে দুটো বেঁটে মোটা পেঁপেগাছে অগুনতি পেঁপে ঝুলছে। সুজন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জ্যাঠামণির যে চাষবাসের দিকে খুব নজর সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। খারাপ কিছু নেই বাগানে, সব ভালো জিনিস ভালো জাতের।

খানিকটা জমিতে শুধু লঙ্কা গাছ, লঙ্কায় ভরে আছে। দু-রকম লঙ্কা চোখে পড়ল সুজনের। কয়েক সারি গাছের লঙ্কা সবুজ, বাকি সারিগুলোতে কালো লঙ্কা হয়েছে— কুচকুচে কালো।

যারা বাগানে কাজ করছিল তারা দুপুরে যে যার বাসায় খেতে চলে গিয়েছিল। এখন আবার ফিরে এসেছে। ওকে দেখে যে মেয়েটি কালো বলেছিল, সে এগিয়ে এল। কালো লঙ্কার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘কালো লঙ্কার সাদার চেয়্যা তেজ বেশি খুকাবাবু, উয়ার কদর বেশি।’

হাসতে হাসতে ও আবার কাজে ফিরে গেল।

জ্যাঠামণিও উঠে পড়েছেন। বারান্দায় বসে আছেন। ওকে দেখে বললেন, ‘সব দেখা হল?’

ঘাড়টা ছোট্ট কাত করে সুজন জানাল, হ্যাঁ। তারপর বারান্দায় উঠে এসে জ্যাঠামণির মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসল।

‘কেমন লাগছে এখানে?’ জ্যাঠামণি জিজ্ঞেস করলেন।

‘খু-উ-ব ভালো’, সুজন মৃদু হেসে জবাব দেয়। ‘আচ্ছা জ্যাঠামণি’, ও জিজ্ঞেস করে, ‘আমগাছগুলো অত বেঁটে কেন?’

‘ওগুলো যে কলমের গাছ, বড়ো হবে না তো’, জ্যাঠামণি বললেন।

‘কলমের গাছ!’ সুজন ঠিক বুঝতে পারে না।

‘ও, কলম কাকে বলে তা তুমি জান না, জানবেই বা কী করে!’

অনেকটা যেন আপন মনেই বললেন জ্যাঠামণি। ‘দু-রকমের গাছ হয়’, বলতে থাকেন তিনি, ‘একটা হয় বিচি বা আঁটি থেকে আর অন্যটা কলম থেকে। কলম তৈরি করতে জানা চাই। একটা ফলন্ত গাছের ডাল কেটে খাগের কলমের মতো চাঁছতে হয়। গাছের আরেকটা ডালের আগার দিকটাও খানিকটা চেঁছে ওই কলমের মতো ডালটা জুড়তে হয় ওটার সঙ্গে, গোবর আর এঁটেল মাটি দিয়ে। তারপর খড় পেঁচিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলেই হল। বর্ষাকালেই কলম করবার সময়, কারণ তখন বৃষ্টির জল পায় গাছ। তারপর একসময় মাটির যে ড্যালাটা দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ডাল দুটো, সেটা ফুঁড়ে শেকড় বেরোয়। মাটির ড্যালার ঠিক নীচ থেকে কেটে ড্যালাসুদ্ধু ডালটা এবার মাটিতে পুঁতে দিলেই গাছ হবে, ওটাকেই বলে কলমের চারা আর বড়ো হলে বলে কলমের গাছ। সব ভালো জাতের গাছই কলম থেকে তৈরি, গাছও বড়ো হয় না আবার ফলও দেয় ভালো। এবার বুঝেছ?’

‘হ্যাঁ’, ঘাড় কাত করে সুজন জবাব দেয়। ‘এই বাগানের সব আমগাছের কলম কি তুমিই করেছ, জ্যাঠামণি?’

‘না’, জ্যাঠামণি একটু হেসে বলেন, ‘সব রকম ফল আর ফুল গাছের কলমের চারা কিনতে পাওয়া যায়। আমিও কিনেছি।’

‘কিন্তু যদি ঠকিয়ে দেয়?’ সুজন জিজ্ঞেস করে।

‘এসব ব্যবসায় যাদের নাম আছে তাদের কাছ থেকে কিনলে ঠকবার ভয় নেই’, জ্যাঠামণি ঘাড়টা অন্যদিকে ফিরিয়ে জবাব দিলেন তোমার বোনটি দেখছি ওদের সঙ্গে বেশ জমিয়ে ফেলেছে।’

সুজন জ্যাঠামণির দৃষ্টি অনুসরণ করে দেখল রিংকু হাত-পা নেড়ে মেয়ে তিনটিকে কী যেন বলছে আর ওরা হেসে কুটি কুটি হচ্ছে।

‘জান জ্যাঠামণি, ওরা না…’ মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যেতেই চুপ করে গেল সুজন।

‘কী? থামলে কেন?’

‘না, মানে…’ মাথা চুলকোয় সুজন।

‘আরম্ভ যখন করেছ, বলেই ফেল’, জ্যাঠামণির দু-চোখে কৌতুকের আভাষ।

‘ওরা আমাকে কালো বলে খেপাচ্ছিল’, ঢোঁক গিলে বলে ফেলল সুজন।

‘ওরা মানে ওই সাঁওতাল মেয়েরা?’

‘হ্যাঁ।’

‘ওদের কোন জন কে, জান না, তাই না?’

সুজন ঘাড় নেড়ে জানায়, ‘না’।

‘ওই যে লাল পাড় শাড়ি পরেছে, ওর নাম গুরু।’ সুজনকে ও-ই কালো বলেছিল। ‘ওর পাশের মেয়েটা হল ঠাকুর, আর যে মেয়েটা ঝুড়ি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম খাঁদি। ক-দিন এখানে থাকলেই বুঝতে পারবে ওরা খুব ভালো। খুব গরিব ওরা, কিন্তু কক্ষনো চুরি করে না। বাইরেটাও যেমন পরিষ্কার, ভেতরটাও তেমন তকতকে। সহজসরল জীবন ওদের, নীচতা একেবারেই নেই। হয়তো সভ্যতার ছোঁয়াচ তেমন লাগেনি বলেই ওরা এখনও স্বার্থপর আর কুটিল হয়ে ওঠেনি।’

জ্যাঠামণি একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, ‘তোমাকে কালো বলে ওরা খেপাচ্ছিল, কিন্তু ওদের ঠাট্টার মধ্যে কোনো হুল ছিল না, একথা তুমি বিশ্বাস করতে পার। খুব আমুদে ওরা, মজা করতে ভালোবাসে। আর একটা কথা তোমার জানা উচিত, গায়ের রং দিয়ে মানুষকে বিচার করা যায় না। ওটা তো একটা খোলস। মানুষের আসল বিচার হল তার গুণে। ছোটোবেলা থেকেই তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, তুমি বড়ো হবে। শুধু লেখাপড়া শিখে বড়ো চাকরি করলেই কেউ বড়ো হয় না। তোমাকে হতে হবে বিনয়ী, স্বভাবে-আচরণে সবার ভালোবাসা কুড়োতে হবে, শুধু নিজের কথা না ভেবে পরের কথাও ভাবতে হবে তোমাকে। তখন দেখবে তোমার গায়ের রং নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবে না। তোমার গুণটাই বড়ো করে দেখবে সবাই।’ তারপর একটু হেসে লঘু কণ্ঠে বললেন, ‘কালো— জগতের আলো, শোনোনি কথাটা?’

সুজন এবার হাসল। যে গ্লানির মেঘটা ওর মনে জড়ো হয়েছিল, তা যেন একটা দমকা হাওয়া এসে উড়িয়ে নিয়ে গেল।

পরদিন খুব ভোরে মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল সুজনের। একটু শীত করছে। এবার পুজো পড়েছে দেরিতে কার্তিকের গোড়ার দিকে, তাই রাত্তিরে একটু একটু হিম পড়ছে। সুজন গায়ে একটা জামা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সিঁড়ির দু-পাশে কয়েক সারি গোলাপ গাছ, কালই দেখেছিল ও। আজ এই ভোরে অপূর্ব দেখাচ্ছে, যেমন রং, তেমন বাহার ফুলের। একটা মিষ্টি টাটকা গন্ধ ওর নাকে লাগছে, শিশির ভেজা গোলাপের তাজা গন্ধ। বুক ভরে নিশ্বাস নিল সুজন, ভেতরটাও যেন মিষ্টি হয়ে গেল ওর।

একটা কীসের আকর্ষণে ও নেমে পড়ল গোলাপ বাগানে, ঘুরে-ফিরে দেখতে লাগল।

গোলাপের মখমলের মতো পাপড়িগুলো হাত দিয়ে স্পর্শ করতে ভীষণ ইচ্ছে হল ওর। এক একটা গোলাপের কী ঠাসা পাপড়ি। কম পাপড়ির গোলাপও আছে, সেগুলোর রং আবার অপূর্ব। ওর এতকাল ধারণা ছিল গোলাপের রং বুঝি শুধু গাঢ় লাল আর গোলাপিই হয়। কিন্তু রঙের বাহার থাকতে পারে তা চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করত না ও। রক্তের মতো লাল, কালচে লাল, ইটের মতো রং, গাঢ় হলদে, ধবধবে সাদা, গোলাপি, দু-রঙা— চোখ যেন ধাঁধিয়ে দেয়।

ওখান থেকে বেরিয়ে ও ঘাসের ওপর এসে দাঁড়াল। আরে, মুক্তোর মতো শিশিরবিন্দু টলটল করছে ঘাসের ওপর! কলকাতায় পিচের রাস্তা আর সিমেন্ট বাঁধানো ফুটপাতে ঘাসের দেখা মেলে না, তাই ঘাসের ডগায় ভোরের শিশিরের দেখাও পায়নি সুজন কোনোদিন। ও ঘাসের ওপর খুব সন্তর্পণে একটা পা ফেলল। শিশির মিলিয়ে পায়ের পাতা ভিজে গেল ওর।

‘খালি পায়ে ঠান্ডা লেগে যাবে।’

জ্যাঠামণির গলায় ও চমকে ফিরে তাকাল। এত ভোরেও জ্যাঠামণি উঠে বারান্দায় চেয়ারে বসে আছেন, হয়তো প্রথম থেকেই ওকে লক্ষ করেছেন।

‘জ্যাঠামণি’, একটু উত্তেজিতভাবে সুজন বলে উঠল, ‘ঘাসে শিশিরবিন্দু জমেছে।’

জ্যাঠামণির মুখে হাসির আভা ছড়িয়ে পড়েছে, এত সুন্দর হাসি আগে কখনো দেখেনি সুজন।

‘বাড়ির নামটা দেখনি কাল?’ জ্যাঠামণি বললেন।

সুজন দু-পাশে মাথা নাড়ল।

‘গেটের বাইরে যাও, দেখতে পাবে।’

গেট থেকে বেরিয়ে সুজন তাকাল। ডান দিকের থাম্বায় শ্বেতপাথরের ফলকে লেখা বাড়িটার নাম চোখে পড়ল ওর। আস্তে আস্তে ওর মুখেও হাসি ছড়িয়ে পড়ল। ওখান থেকেই জ্যাঠামণির দিকে ও তাকাল। তিনি হাসছেন, স্নিগ্ধ, কৌতুক হাসি।

‘কী নাম?’ ওখান থেকেই হেঁকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘শিশিরবিন্দু’, সুজনও চেঁচিয়ে জবাব দিল।

সুজন আবার ভেতরে এল। গেট দিয়ে ঢুকে ডান দিকে খানিকটা দূরে একটা শিউলি গাছ। গাছটা খুব বড়ো নয়, কিন্তু বেশ ঝাঁকড়া, তলায় মেলাই শিউলি ফুল পড়ে আছে, পা ফেলবার জায়গা নেই। এখানকার মাটি কেমন লাল আর যেন হালকা। পা ঝাড়লেই সব ধুলো ঝরে যায়। নিশ্চয়ই এই লালমাটির আলাদা গুণ আছে তাই এত ফুল আর ফল হয় এখানে। সুজন দু-হাত ভরে শিউলি ফুল কুড়োল। কী সুন্দর ফুল! সাদা ধবধবে পাপড়ি আর কমলা রঙের বোঁটা। কী মিষ্টি আর নরম নরম গন্ধ, নাকে চেপে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে।

ও বারান্দায় উঠে এল।

‘কলকাতায় শিউলি ফুল দেখেছ?’ জ্যাঠামণি জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ’, সুজন ঘাড় কাত করে জবাব দিল। ‘বড়ো বাড়িতে একটা গাছ ছিল।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’, জ্যাঠামণিরও মনে পড়ে যায়। ‘ভারতবর্ষের কোনো কোনো জায়গায় এ ফুলের নাম পারিজাত। রামায়ণ পড়েছ?’

সুজন সলজ্জভাবে দু-পাশে ঘাড় নাড়ে, মুখে বলে, ‘না’।

‘সে কি!’ জ্যাঠামণি যেন অবাক হন। ‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ আর কাশীরামদাসের মহাভারত পড়বে। প্রত্যেকের পড়া উচিত। মহাভারত শুধু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের কাহিনিই নয়, আমাদের এই মস্তদেশের ইতিহাস। আর রামায়ণে তখনকার দিনের সমাজের কথা, মানুষের কথা সব জানতে পারবে। খুব ভালো লাগবে পড়তে। আমি তো তোমার বয়সে রামায়ণ-মহাভারত কয়েক বার শেষ করে ফেলেছিলাম।’ তারপর একটু হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, যা বলতে যাচ্ছিলাম, রামায়ণে ইন্দ্রের নন্দনকাননের কথা আছে, আর আছে পারিজাত ফুলের কথা।’

‘এই ফুলের কথা!’ সুজন অবাক হয়ে যায়।

‘হ্যাঁ’, মুচকি হাসেন জ্যাঠামণি। ‘নন্দনকানন শোভা করে ছিল এই ফুল!’

‘স্বর্গ থেকে কে নিয়ে এল এই গাছ?’ সুজন প্রশ্ন না করে পারে না।

‘ফাঁপরে ফেলে দিলে দেখছি’, জ্যাঠামণি হাসি হাসি মুখে বললেন, ‘ও প্রশ্নের জবাব তো আমার জানা নেই, নিশ্চয়ই কেউ এনেছিল।’

সুজন একটা চেয়ারে বসে বলল, ‘আচ্ছা জ্যাঠামণি, ওই গাছটার তলায় অমন গোল করে বাঁধানো হয়েছে কেন?’ আঙুল দিয়ে একটা গাছ দেখিয়ে দেয় ও।

‘গরমকালে দুপুর বেলা বেশ ঠান্ডা হয় গাছের তলা, তাই বাঁধানো হয়েছে।’ গাছটার দিকে একপলক তাকিয়ে জবাব দিলেন জ্যাঠামণি।

‘ও’, সুজন বোঝদারের মতো ঘাড় দোলায়, ‘মস্ত বড়ো গাছ, কী গাছ ওটা?’

‘মহুয়া।’

‘মহুয়া!’ সুজন ভুরু কুঁচকে মনে করতে চেষ্টা করে। আগে কখনো শুনেছে নাকি ওই নাম। মহুয়া নামটা কিন্তু ভারি সুন্দর। হ্যাঁ, ওর এক বন্ধুর বোনের নামও মহুয়া।

‘সাদা সাদা ছোটো ফুল হয় মহুয়া গাছে, খুব মিষ্টি গন্ধ’, জ্যাঠামণি আবার বললেন। ‘ফাল্গুন মাসে গাছের তলা ভরে থাকে ফুলে।’

‘পেছন দিকে তারের বেড়া ঘেঁষে চার-পাঁচটা গাছ আছে’, সুজন আবার জিজ্ঞেস করে, ‘বেশি বড়ো নয়, পাতাগুলো একটু গোল, কাঁঠাল পাতার মতো, ওগুলো কী গাছ?’

‘ক্যাসু নাট ট্রি’, জ্যাঠামণি একটু রহস্যের হাসি হাসলেন।

সুজন মাথা চুলকাল। ক্যাসু নাট আবার কী জিনিস!

‘বাংলায় যাকে বলে কাজু বাদাম’, জ্যাঠামণি রহস্য ভাঙলেন। ‘সেন্ট লরেন্স স্কুলে পড় তাই ভেবেছিলাম ইংরেজি নামটা জানা আছে তোমার।’

সুজন লজ্জা পেল।

‘তোমাদের সব সাবজেক্ট তো ইংরেজিতে পড়ানো হয়, তাই না?’

‘হ্যাঁ’, সুজন জবাব দেয়।

‘ইংরেজি ভালো জানার একটা আলাদা দাম আছে’, জ্যাঠামণি যেন আপন মনেই বলতে থাকেন। ‘যতই ইংরেজি হটাও আন্দোলন হোক না কেন, যেকোনো অবস্থায়, যেকোনো জায়গায়, কেউ যদি চটপট ইংরেজিতে কথা বলতে পারে, তবে সে উতরে যাবেই। তা ছাড়া ইংরেজি সাহিত্য সমুদ্রের মতো গভীর, মণি-মুক্তোয় ভরা। ভালো ভালো ইংরেজি বই পড়বে বুঝেছ। শুধু আনন্দই পাবে না, ভাষাটাও রপ্ত হয়ে যাবে সেইসঙ্গে।’

‘আমি পড়ি’, সুজন হঠাৎ সোৎসাহে বলতে থাকে, ‘রবিনহুড, রবিনসন ক্রুশো, ডেভিড কপারফিল্ড, অলিভার টুইস্ট, আঙ্কল টমস কেবিন, গালিভারস ট্র্যাভেলস, ট্রেজার আইল্যান্ড এসব বই পড়েছি আমি।’

‘আচ্ছা! কোথায় পাও?’

‘আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতে অনেক ইংরেজি বই আছে।’

‘হ্যাঁ, থাকা উচিত। আমি তোমাকে একটা বইয়ের লিস্ট করে দেব, সেগুলো যদি তোমাদের লাইব্রেরিতে থাকে, পড়ো।’

সুজন খুশি হয়ে মাথা নাড়ে।

জ্যাঠামণি একটা চুরুট ধরান, খুব চুরুট খান উনি।

‘শরীরের দিকে নজর দেবে’, কয়েক বার চুরুটে টান দিয়ে তিনি বললেন, ‘বড্ড রোগা তুমি।’ একটু থেমে তিনি আবার বললেন, ‘আমার শরীর খুব ভালো ছিল, অনেক ডন বৈঠক দিতাম…।’

‘জানি আমি’, হাসিমুখে বলল সুজন, ‘বেস্ট ফিজিকের জন্য ইউনিভার্সিটি থেকে সোনার মেডেল পেয়েছিলে তুমি।’

‘অনেক খবর রাখো দেখছি তুমি আমার সম্বন্ধে’, জ্যাঠামণির মুখে আলগা হাসি।

‘জানো জ্যাঠামণি’, কী বলতে গিয়ে সুজন থেমে যায়। জ্যাঠামণি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে একটু দ্বিধাভরে ও বলে, ‘বড়ো বাড়িতে যখন ছিলাম, তোমার সম্বন্ধে সবাই এমন সব কথা বলত, মনে হত তুমি খুব গম্ভীর আর রাগী।’

‘আর এখন কী মনে হচ্ছে?’ জ্যাঠামণির হাসিতে যেন একটু কৌতুকের ছোঁয়া লেগেছে।

‘তুমি খুব ভালো’, সুজন চটপট বলে ফেলল।

হা হা করে হেসে উঠলেন জ্যাঠামণি, শক্তিমান মানুষের বুকখোলা হাসি। সুজনের বাবা একটু ব্যস্ত হয়েই ওখানে এলেন, তাঁর পেছনে রিংকু, ওর ঘুমের ভাবটা এখনও কাটেনি, হাত দিয়ে দু-চোখ কচলাচ্ছে।

‘সুজু কিছু করেছে নাকি?’ উদবিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন সুজনের বাবা। জ্যাঠামণি তাকালেন সুজনের দিকে, ওর দৃষ্টিতে বোধ হয় একটা কিছু ইঙ্গিত পেলেন। বললেন, ‘না, আমরা একটা হাসির কথা বলছিলাম।’

নিশ্চিন্ত হয়ে চলে গেলেন সুজনের বাবা। রিংকু ওর দাদার পাশে একটা চেয়ারে বসল।

‘কি এতক্ষণে মহারানির ঘুম ভাঙল!’ জ্যাঠামণি ওর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কত সুন্দর সুন্দর পাখি এসেছিল, দেখতে পেলে না।’

‘আমাকে ডাকলে না কেন?’ রিংকু একটু অভিমানের সুরে বলল।

‘আচ্ছা কাল সকালে ডাকব, আমার সঙ্গে বেড়াতে যাবে।’

রিংকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

‘সত্যি?’ ও বলল।

‘হ্যাঁ, সত্যি।’

‘কী মজা’, হাততালি দিয়ে উঠল রিংকু, ‘ঠিক ডাকবে কিন্তু।’

জ্যাঠামণি হেসে ঘাড় দোলালেন।

‘তোমার দাদা তো ঘুরে-ফিরে সব গাছ দেখছে, নতুন নতুন গাছ, তুমি দেখছ না?’

‘গাছ আমার ভালো লাগে না। আমি সূত্রাকে একটা দোলনা টানিয়ে দিতে বলেছি! কলকাতায় আমাদের স্কুলে দোলনা আছে, সবাই এত কাড়াকাড়ি করে, ভালো করে দোলনা খেতে পারি না। এখানে মজা করে একা একা দোল খাব।’

‘দাদাকে একটু দোলনা চাপতে দেবে না?’

‘ও তো ছেলে, দোলনা চাপবে কি?’

‘ওঃ! ছেলেরা বুঝি দোলনা চাপে না?’

‘না, খুব ছোট্ট ছেলেরা চাপে, ও তো আর ছোট্ট নয়।’

সুজন বোনের কথা শুনে ভুরু কুঁচকাচ্ছিল। বোনটা এমন আবোল-তাবোল কথা বলে, জ্যাঠামণি কী ভাববেন!

গেটের বাঁ-পাশে তারের বেড়া ঘেঁষে চারটা গাছ, সব কটাই বেশ লম্বা আর সরু, বাতাসে এমন দোলে, মনে হয় এই বুঝি ভেঙে পড়বে। ডালপালা তেমন অনেক নয়, তাও সব মাথার দিকে। পাতাগুলো বেশ কচি কচি, বাকলটা দুধের মতো সাদা। একটু বাতাস হলেই পাতাগুলো ঝিরঝির শব্দ করে ওঠে আর কেমন যেন একটা গন্ধ ছাড়ে, একটু ঝাঁঝালো গন্ধ। এই গাছগুলির কথা জ্যাঠামণিকে জিজ্ঞেস করা হয়নি, সুজনের মনে পড়ে গেল।

‘ওগুলো ইউক্যালিপটাস গাছ’, সুজনের প্রশ্নের জবাবে বললেন জ্যাঠামণি। ‘ওর পাতা থেকে ইউক্যালিপটাস ওয়েল হয়, সর্দি-কাশি নানারকম সংক্রামক রোগের ভালো ওষুধ।’

‘অনেক নতুন গাছ দেখলাম’, সুজন বলল, ‘ইউক্যালিপটাস, কাজু বাদাম, মহুয়া, কুসুম, লিচু…।’

‘লিচু গাছ আগে দেখনি, না?’

‘না।’

‘নিজেই চিনতে পারলে, না কেউ বলে দিয়েছে?’

‘পাতা দেখে চিনেছি।’

‘পাতা দেখেই চিনে ফেললে?’ জ্যাঠামণি যেন একটু অবাক।

‘গরমকালে বাবা পাতাসুদ্ধু লিচু কিনে আনে, তাই চিনতে পেরেছি’, সুজন সলজ্জভাবে জবাব দেয়।

একটা কালো কুকুর লাফিয়ে সিঁড়ি টপকে একেবারে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। রিংকু তাড়াতাড়ি ঝোলানো পা দুটো চেয়ারে তুলে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে উঠল, ‘জ্যাঠামণি, কুকরটাকে বকো, আমাকে কামড়ে দেবে।’

‘কামড়াবে না’, জ্যাঠামণি ওকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘ও খুব ভালো, বাড়ির লোকজনদের ঠিক চিনতে পারে।’

কুকুরটা লেজ নাড়ছিল।

‘কাল তো ওকে দেখিনি!’ সুজন জ্যাঠামণির দিকে তাকায়।

‘ওর আবার বেশ মজা আছে’ তিনি অল্প হেসে বললেন, ‘মাঝে মাঝে দু-একদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, তারপর আবার ফিরে আসে।’

‘ভারি মজার তো!’ সুজন খুব অবাক হয়ে যায়। মানুষের মতো কুকুরও নিরুদ্দেশ হয় একথা এই প্রথম শুনল ও।

‘কোথায় যায়?’ ও জিজ্ঞেস করল।

‘সাঁওতাল পাড়ায়, ওর আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করতে যায় বোধ হয়’, জ্যাঠামণি জবাব দিলেন।

‘ওর মা-বাবা ওখানে থাকে বুঝি?’ চেয়ারে পা গোটানো অবস্থায় বলে ওঠে রিংকু, পা নামাতে এখনও ভরসা হচ্ছে না ওর।

‘ঠিক ধরেছ, খুব বুদ্ধি আছে তো তোমার’, জ্যাঠামণি ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেন মিষ্টি মিষ্টি। রিংকুর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

কুকুরটা ওদের মাঝখানে চোখ বুজে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়েছে। ‘ওমা, এখন ওর ঘুমোবার সময় হল!’ রিংকু বলে উঠল।

‘একটা মজা দেখবে’, জ্যাঠামণি রিংকুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি চেয়ার থেকে নেমে গেটের দিকে যাও।’

রিংকু কিছু বুঝতে না পেরে একটু বোকা বোকা মতো তাকাল, তারপর ভয়ে ভয়ে চেয়ার থেকে পা টিপে টিপে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে গেল। যেই ও মাটিতে পা দিয়েছে, কুকুরটা মুখ তুলে তাকাল, তারপর এক লাফে উঠে পড়ে বারান্দা দিয়ে তিরবেগে নেমে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

‘আমাকে কামড়ে দেবে, কামড়ে দেবে’, প্রায় কেঁদে ফেলল রিংকু।

‘কেলো’, গম্ভীর কণ্ঠে জ্যাঠামণি ডাকলেন, ‘এদিকে আয়।’

বাধ্য ছেলের মতো ফিরে এল কুকুরটা, কয়েক বার লেজ নাড়ল, তারপর শুয়ে পড়ল আবার।

‘রিংকুর দিকে অমন করে তেড়ে গেল কেন ও?’ সুজন জিজ্ঞেস করল।

‘তেড়ে যায়নি’, জ্যাঠামণি জবাব দিলেন, ‘বাড়ির কেউ বাইরে যাচ্ছে বুঝতে পারলেই ও পেছন পেছন যায়, বোধ হয় প্রোটেকশন দেবার জন্যই যায়, মজা হচ্ছে, নতুন কেউ এলে, ওর এই দায়িত্ববোধ বেড়ে যায় যেন।’

‘আশ্চর্য তো!’ কুকুরটার ওপর সুজনের কেমন যেন শ্রদ্ধা জন্মায়। এত বুদ্ধি ওর।

কুকুরটা মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল। সুজনের মনে হল চোখ দুটো যেন মিটিমিটি হাসছে। তারপরই আবার কুণ্ডলীটা ভালোভাবে পাকিয়ে মুখ গুঁজে ও চোখ বুজল।

জল খাবার খেয়ে ওরা ভাই-বোন ঘুরে বেড়াচ্ছিল।

‘দ্যাখ, দ্যাখ, দাদা’, একটা আমগাছের দিকে আঙুল দেখায় রিংকু। সুজন তাকিয়ে দেখল। দুটো কাঠবেড়ালি ডালের ওপর ছুটোছুটি করছে। একটা আরেকটাকে তেড়ে যাচ্ছে, অন্যটা সুড়ুৎ করে ডালপাতার ফাঁকে লুকিয়ে পড়ছে। আবার বেরুচ্ছে, আবার লুকোচ্ছে, খেলায় মত্ত হয়ে উঠেছে ওরা।

ওরা ভাই-বোন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের খেলা দেখল।

‘আয় দাদা, আমরাও লুকোচুরি খেলি’, বলে উঠল রিংকু।

‘ধ্যাৎ’, বলল সুজন। ‘লুকোচুরি খেলার বয়স আছে নাকি আমার!’

‘না, তুই বুড়ো হয়ে গেছিস’, ঠোঁট ওলটায় রিংকু, ‘বেশি বেশি!’

ছিটকে দাদার কাছ থেকে সরে গেল রিংকু, ভীষণ রেগেছে ও। মেয়েরা কাজ করতে এসে গেছে, তাদের দিকে ও এগিয়ে যায়।

সুজন কিছুক্ষণ একা একা ঘুরে বেড়ায়। ফুলকপির চারাগুলো বেশ বেড়ে উঠেছে, ফুলও এসে গেছে কয়েকটাতে, তবে এখনও ছোটো। বাঁধাকপির পাতাগুলো কচি, সবে জোট বাঁধতে শুরু করেছে। দু-চারটে ইতিমধ্যেই কিন্তু বেশ বড়ো হয়েছে। যে লোকটা বাগানে কাজ করছিল সে বেড়ে ওঠা বাঁধাকপির পাতাগুলোকে গোল করে বাঁধছিল।

‘অমন করে বাঁধছ কেন?’ সুজন জিজ্ঞেস করল।

‘লয়তো পাতাগুলান ছড়্যায়ে যাবে, ঠাস বুননটি হবে নাই’, একগাল হেসে জবাব দিল লোকটি।

সুজন এবার বুঝতে পারল। বাবা মাঝে মাঝে যে বলেন, খুব টাইট বাঁধাকপি এনেছি, সেটা এজন্যই এমন ঠাসা হয়। বেঁধে দিলে পাতাগুলো ছড়িয়ে পড়তে পারে না আর তাই খুব ঘন হয়ে বেড়ে ওঠে। তাই বোধ হয় নাম বাঁধাকপি, সুজন ভাবল।

জ্যাঠামণি মোটা বেতের লাঠিটায় ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে এদিকেই আসছিলেন। রোজ একবার বাগানের কাজ ঘুরে ঘুরে তিনি দেখেন। বাগানে ক-টা কপি হয়েছে, প্রত্যেকটা গাছে কতগুলো বেগুন ঝুলছে, লাউ, কুমড়ো, আতা সব কিছুর হিসেব একটা খাতায় তিনি লিখে রাখেন, একটাও এদিক-ওদিক হবার জো নেই।

সব কিছুতেই একটা নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলেন জ্যাঠামণি।

সুজনের পাশে দাঁড়িয়ে তিনি যে লোকটি কাজ করছিল, তাকে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, চামটা, বেগুন গাছে ডি. ডি. টি স্প্রে করেছিস?’

‘হ বাবু’, লোকটি কাজ করতে করতে জবাব দিল।

‘ডি. ডি. টি স্প্রে কেন করে জ্যাঠামণি?’ সুজন জিজ্ঞেস করল।

‘বড্ড পোকা ধরে বেগুন গাছে, পাতা খেয়ে নেয়, বেগুনেরও ক্ষতি করে, তাই ওষুধ স্প্রে করতে হয়।’

একটু এদিক-ওদিক ঘুরে তিনি লোকটিকে আবার বললেন, ‘সার কম হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। খাঁদিকে বল কয়েক ঝুড়ি সার মাটি এনে দিক, কপি গাছগুলোর গোড়া উসকে সার মিশিয়ে দে।

‘হ বাবু’, লোকটি সেই একই জবাব দিল।

‘চল, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই’, সুজনের দিকে ফিরে তিনি বললেন। সুজন জ্যাঠামণির পাশে পাশে হাঁটতে লাগল, রিংকু ছুটে এসে জ্যঠামণির বাঁ-হাতটা ধরে বলল, ‘আমাকে ডাকা হয়নি যে?’

‘ও, তাই তো, বড্ড ভুল হয়ে গেছে’, জ্যাঠামণি যেন মহা অপরাধ করেছেন, এমনভাবে বললেন।

আস্তে আস্তে ওরা এগিয়ে চলল। সুজনের হঠাৎ মনে হল এখন যদি ভগবান ওকে বলেন, একটা মাত্র বর তোমাকে দেব। ও তক্ষুনি বলবে, জ্যাঠামণিকে একদম ভালো করে দাও।

একটা মস্ত গর্তের কাছে এসে জ্যাঠামণি থামলেন। সুজন লক্ষ করে দেখল, গর্তটা মোটেই গোল নয়, লম্বায় প্রায় তেরো-চোদ্দো পা আর চওড়ায় সাত-আট। গর্তটার মধ্যে রাজ্যের পাতা জড়ো করা হয়েছে। সুজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই জ্যাঠামণি বললেন, ‘এই গর্তের মধ্যে পাতা জড়ো করে পচানো হয়, মাটির সঙ্গে মিশে ওগুলো সার হয়ে যায়, এটাকে বলে পাতা সার। তবে আমরা শুধু পাতাই ফেলি না এখানে— গোবর, মাছের ফুসফুস, কাঁটা, মাংসের হাড় আরও নানারকম জিনিস এই গর্তে ফেলি। আরও কিছু মেশানো হয়। গর্তটাকে ঢেকে রাখলে তাড়াতাড়ি পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায় সব।’

‘সার কী?’ রিংকু বলে উঠল।

‘ও, সেটা তো তোমাকে বলা হয়নি’, জ্যাঠামণি ওর দিকে ফিরে বললেন। ‘আমাদের শরীর ভালো করবার জন্য যেমন ভালো ভালো পুষ্টিকর খাবার দরকার, তেমন গাছের জন্য সারের দরকার। সার হল গাছের টনিক।’

ওরা ওখান থেকে ফিরে চলল।

একটা খড়ের চালা, মেটে ঘরের পাশ দিয়ে ওরা ফিরছিল। ‘কী বিচ্ছিরি গন্ধ!’ নাক চাপা দিয়ে রিংকু বলে ওঠে।

‘মুরগির ঘর তো, নোংরা করে ওরা ঘরটা, সেই গন্ধ’, জ্যাঠামণি বললেন। ঘরটা রোজ ঝাঁট দিয়ে সব নোংরা তুলে ওই গর্তে ফেলা হয়, ওটাও সারের কাজ করে।

‘মাটির দেয়ালে এত ছোটো ছোটো গর্ত কেন?’ সুজন জিজ্ঞেস করল।

‘আলো বাতাস যাতে ঘরে ঢোকে, তাই’, জ্যাঠামণি বোঝালেন।

সুজন আর রিংকু দুটো গর্ত দিয়ে উঁকি দিল।

‘অনেক মুরগি, জ্যাঠামণি’, সুজন বলে উঠল।

‘কী বড়ো বড়ো’, রিংকু বলল।

‘এগুলো সব আলাদা জাতের মুরগি’, জ্যাঠামণি বললেন, ‘তাই এত বড়ো বড়ো।’

‘ডিম পাড়ে?’ রিংকু জিজ্ঞেস করে।

‘পাড়ে বই কী’, জ্যাঠামণি মৃদু হাসলেন, ‘তাইতো ওদের পোষা হচ্ছে, মাংস খাবার জন্য নয়।’

‘অতগুলো মুরগির অনেক ডিম হবে’, সুজন এবার বলল, ‘কী কর অত ডিম দিয়ে?’

‘নিজেদের খাবার জন্যে কিছু রেখে দিয়ে বাকি সব বিক্রি করে দিই। রজনীকে বলো, তোমাদের যেন ওমলেট করে দেয়।’

আবার হাঁটতে শুরু করে ওরা।

‘জানো জ্যাঠামণি’, রিংকু হঠাৎ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘দুটো কাঠবেড়াল দেখেছি, কেমন লুকোচুরি খেলছিল!’

‘তাই বুঝি’, জ্যাঠামণি ওর দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকালেন, ‘অনেক কাঠবেড়াল আছে এখানে। মাঝে মাঝে খরগোসও আসে।’

‘খরগোস!’ রিংকু হাততালি দিয়ে ওঠে।

‘কাঠবেড়ালির গা কেমন সুন্দর, তাই না জ্যাঠামণি’, সুজন বলে, ‘মনে হয় কেউ যেন ওর গায়ে তুলির আঁচড় টেনেছে।’

‘কাঠবেড়ালির গল্পটা জান না বুঝি?’ লাঠি দিয়ে সামনে পড়ে থাকা একটা ইটের টুকরোকে সরিয়ে দিতে দিতে বললেন জ্যাঠামণি।

‘না তো, বলো জ্যাঠামণি’, সুজন সাগ্রহে বলে উঠল।

‘গল্পটা বলতে গেলে সেই রামায়ণের কাহিনিতে ফিরে যেতে হবে। তুমি তো রামায়ণ পড়নি। সংক্ষেপে তাই বলছি অনেক বছর আগে ভারতবর্ষে অযোধ্যা বলে এক রাজ্যের রাজা ছিলেন দশরথ। তাঁর তিন রানি আর চার ছেলে, সবার বড়ো হলেন রাম। দশরথ বুড়ো হয়েছেন, বড়ো ছেলে রাম সিংহাসনে বসবেন সব ঠিকঠাক এমন সময় মেজো রানি কৈকেয়ী সব ভেঙে দিলেন। একবার যুদ্ধে দশরথ খুব আহত হয়েছিলেন, কৈকেয়ী সেবা করে তাঁকে ভালো করে তুলেছিলেন। তাই দশরথ তাঁকে কথা দিয়েছিলেন তাঁর দুটো ইচ্ছে পূর্ণ করবেন। কৈকেয়ী এতদিনে তাঁর ইচ্ছের কথা জানালেন— রামকে চোদ্দো বছরের জন্য বনবাসে পাঠাতে হবে, আর তাঁর ছেলে ভরতকে রাজা করতে হবে। দশরথ অনেক বোঝালেন, কিন্তু কৈকেয়ীর মন গলল না। সব শুনে বাবার সত্যরক্ষার জন্য রাম বনবাসে চললেন। তাঁর বউ সীতা আর দশরথের ছোটোরানি সুমিত্রার ছেলে লক্ষ্মণও তাঁর সঙ্গ নিলেন। লক্ষ্মণ রামের খুব বাধ্য ছিলেন তাই বড়ো ভাইয়ের সঙ্গ ছাড়লেন না। বনবাসে থাকার সময় একদিন লঙ্কার রাক্ষসরাজা রাবণ সীতাকে চুরি করে পালিয়ে গেল। রামচন্দ্র তখন সীতাকে উদ্ধার করবার জন্য বনের রাজা সুগ্রীবের সঙ্গে মিতালি করলেন। সুগ্রীব ছিল বানর, তার সৈন্যরাও সব বানর, কিন্তু তাদের মধ্যে অনেক বড়ো বড়ো যোদ্ধা ছিল। হনুমান হল তেমন একজন বীর। এদিকে লঙ্কায় যেতে হলে সমুদ্র পার হতে হবে। এই বানরবাহিনি নিয়ে সমুদ্র পার হওয়া সোজা কথা নয়। রামচন্দ্র তখন ঠিক করলেন বড়ো বড়ো পাথর ফেলে একটা সেতু বানাবেন। সেই সেতুর ওপর দিয়ে সবাইকে নিয়ে সমুদ্র পার হবেন তিনি। হনুমান আর অন্য সব বীর বানর পাহাড় থেকে বড়ো বড়ো পাথরের চাঁই আর গাছ এনে সমুদ্রের ওপর ফেলতে লাগল। নল বলে এক বানর ছিল। সে হাত ছোঁয়ালে পাথর জলে ভাসে। এমনি করে সবাই সেতু বানাচ্ছে। কাঠবেড়ালি ছোটো প্রাণী। সে কী করে! তারও খুব ইচ্ছে রামচন্দ্রকে সাহায্য করে। অনেক জায়গায় পাথরের মাঝে মাঝে ফাঁক রয়েছে। কাঠবেড়ালি করল কী, সমুদ্রের তীরের বালিতে লুটোপুটি খেয়ে গা ভরতি বালি নিয়ে আসে, তারপর সেই ফাটলের কাছে এসে গা ঝাড়া দিতেই বালি পড়ে ফাটল ভরাট হয়ে যেতে থাকে। এদিকে হনুমান ওই ছোট্ট প্রাণীটা তার যাওয়া-আসার পথে বাধা সৃষ্টি করছে ভেবে তাকে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। কাঠবেড়ালি তখন রামচন্দ্রের পায়ে কেঁদে লুটিয়ে পড়ল। সব শুনে রামচন্দ্র হনুমানকে ডেকে বললেন, ‘তুমি মহাবীর, তাই তোমার সাধ্যমতো বড়ো বড়ো পাথর মাথায় করে আনছ। ও ছোট্টো, কিন্তু ওর সাধমতো সাহায্য করছে। ওর সঙ্গে এমন ব্যবহার তোমার করা উচিত হয়নি।’ হনুমান নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জা পেল। রামচন্দ্র আদর করে কাঠবেড়ালির গায়ে হাত বুলিয়ে দিলেন। রামচন্দ্র আসলে ভগবান, মানুষের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছিলেন। তাই তিনি হাত বুলোতেই কাঠবেড়ালির গায়ে তাঁর আঙুলের ছাপ ফুটে উঠল।’

‘ভারি সুন্দর গল্প তো!’ সুজন বলল, ‘কলকাতায় ফিরে গিয়ে আমি রামায়ণ পড়ব।’

‘মহাভারতও পড়বে, মহান ভারতের মহান ইতিহাস ওটা।’

‘সত্যি!’ সুজন কেমন যেন অভিভূত হয়ে যায়।

জ্যাঠামণির সঙ্গে সঙ্গে সুজন আবার বারান্দায় উঠে এল। রিংকু গেছে ওর মায়ের কাছে। সুজন বুঝতে পারছে এই নির্জন জায়গা বোনের ভালো লাগছে না। পুজোয় নতুন জামা পরে বন্ধুদের সঙ্গে টকাস টকাস করে প্যান্ডেলে ঘোরা হচ্ছে না, তাই মন খুব খারাপ হয়ে গেছে ওর। সুজনের কিন্তু খুব ভালো লাগছে। স্কুলে বাংলার মাস্টারমশাই একদিন বলেছিলেন, শহরে বাস করে নিজের দেশ সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। দেশকে চিনতে হলে, জানতে হলে গ্রামে যেতে হবে। সত্যি, এ যেন একটা নতুন জগৎ। এখানকার মানুষ গরিব তা ওদের দেখেই বোঝা যায়, কিন্তু শহরের মানুষের মতো অতটা লোভী নয় ওরা। কী সহজসরল ওদের জীবন। ওদের কুঁড়েঘর, চালার ওপর লাউ-কুমড়ো গাছ, সেটাই যেন ওদের ঐশ্বর্য। চারদিকে ধানের ক্ষেত আর সবুজের ছড়াছড়ি— এখানকার শান্ত জীবনের সঙ্গে কেমন সুন্দর মিশে গেছে।

চেয়ারে বসতে বসতে জ্যাঠামণি বললেন, ‘গাছে উঠতে পার?’ একটু আমতা আমতা করল সুজন, কলকাতায় গাছে ওঠার সুযোগ সুবিধে কোনোটাই নেই। জ্যাঠামণি ওর জবাবের অপেক্ষায় না থেকে বললেন, ‘ওই দেখতে পাচ্ছ, একটা ডাঁসা পেয়ারা, পেড়ে আনো দেখি ওটা।’

লাঠিটা উঁচু করে তিনি সুজনকে দেখালেন। গাছটা বারান্দার রেলিংয়ের কয়েক হাত দূরে। পেয়ারাটা খুব উঁচু ডালে নয়, মাঝামাঝি জায়গায়। সুজনের পৌরুষ ভাবটা জেগে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে নেমে গাছটার দিকে ও এগিয়ে গেল। গাছের গোড়ার দিকটা বেশ মসৃণ। বেয়ে উঠতে গেলে পিছলে যাবার সম্ভাবনা, তা ছাড়া গাছ বাইবার অভ্যেস নেই ওর। একটা ডাল ধরে, সেটাতে ভর দিয়ে শরীরটাকে একটু টেনে তুলতে পারলেই একটা ফোকরে পা রাখা যাবে। প্রথম ডালটাই ওর নাগালের বাইরে, একটু লাফিয়ে ধরতে হবে।

সুজন লাফ দিল। ডালটা ও ধরেছে, কিন্তু মুঠোর মধ্যে রাখতে পারল না ওটাকে, আর সঙ্গেসঙ্গে ধপাস করে পড়ে গেল মাটিতে, একেবারে চিৎপটাং। ভাগ্যিস মাটিটা নরম তাই তেমন ব্যথা লাগল না।

একটা হাসির শব্দে সুজন মুখ ঘোরালো। ওরই বয়সি একটি ছেলে একটু দূরে দাঁড়িয়ে হেসে কুটি কুটি হচ্ছে। ছেলেটার পরনে ছোট্ট একফালি কাপড়, সেটা আবার মালকোঁচা মেরে পড়েছে; নেংটির মতো দেখাচ্ছে। খালি গা। কুচকুচে কালো গায়ের রং। সুজন মনে মনে চটল। ও পড়ে গেছে তাই ছেলেটা হাসছে এত। ভারি ইয়ে…।

ও উঠে দাঁড়িয়ে জ্যাঠামণির দিকে তাকাল। তাঁর মুখটা কেমন যেন গম্ভীর মনে হল সুজনের। সে পারেনি বলেই কি জ্যাঠামণি বিরক্ত হয়েছেন!

‘আবার চেষ্টা করব?’ যেন মুখ ফসকেই কথাটা বেরিয়ে গেল সুজনের।

‘নিশ্চয়ই’, জ্যাঠামণি জবাব দিলেন।

সুজন ছেলেটার দিকে তাকাল। সে-ও তাকিয়ে আছে ওর দিকে, বোধ হয় মজা দেখবার অপেক্ষায় আছে। সুজনের মন শক্ত হয়ে উঠল। নিশ্বাস বন্ধ করে আবার লাফ দিল ও। হ্যাঁ, ডালটা এবার মুঠোর ভেতর পেয়েছে। শক্ত করে ডালটা ধরে ও ঝুলে পড়ল, তারপর বাঁ-পা-টা বাড়িয়ে দিল ফোকরের দিকে। পা রাখবার একটা আশ্রয় পাওয়া গেছে। এবার ডান-পা-টা আর একটা ডালে রেখে ও নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়াল। বাঁ-হাত দিয়ে আর একটা ডাল ধরল। এবার আর উঠতে অসুবিধে হচ্ছে না একটার-পর-একটা ডাল, ছোটো ছোটো পা ফেলে উঠে গেলেই হল। পেয়ারাটা ও দেখে নিল। একটা সরু ডালের মাঝামাঝি জায়গায় ঝুলছে ওটা। একটা শক্ত ডালে দু-পা রেখে, বাঁ-হাত দিয়ে অন্য একটা ডাল চেপে ধরল ও তারপর যে ডালে পেয়ারাটা ঝুলছিল, ডান হাত দিয়ে সেটাকে আস্তে আস্তে নীচের দিকে টেনে আনল, কিন্তু পেয়ারাটা কী করে ধরবে? ওটা প্রায় ওর নাকের কাছে ঝুলছে, কিন্তু দুটো হাতই তো আটকানো! শেষে কি এত করেও হার মানতে হবে ওকে! জ্যাঠামণি ওকে অপদার্থ ভাববেন, আর ওই জংলি ছেলেটা হাসবে। না, তা কিছুতেই ও হতে দেবে না। আবার নিশ্বাস বন্ধ করে বাঁ-হাতটা ও ছাড়িয়ে আনল অন্য ডালটা থেকে, ধরল সরু ডালটা বেশ সন্তর্পণে। ডান হাতটা আস্তে আস্তে ছেড়ে দিয়ে বাড়িয়ে দিল পেয়ারাটার দিকে। খপ করে মুঠোয় পুরল ওটা, তারপর টান দিতেই পেয়ারাটা চলে এল ওর হাতের মুঠোয়। একটা জয়ের আনন্দে খুশি হয়ে উঠল ওর মন। পেয়ারাটাকে প্যান্টের পকেটে পুরে ও নামতে শুরু করল। ফোকরটায় দু-পা রেখে একটু দ্বিধায় পড়তে হল ওকে। এবার কী করবে! ও ভেবে দেখল লাফ মারা ছাড়া আর উপায় নেই। মাটি থেকে ওটা এমন কিছু উঁচু নয়, তবু বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করে উঠল সুজনের। পারব তো ঠিকমতো লাফাতে! দু-চোখ বুজে ও লাফ দিল। ভয়ের জন্যই হোক কিংবা অভ্যেস না থাকার জন্যই হোক, ও হুমড়ি খেয়ে পড়ল আর আবার হেসে উঠল ছেলেটা।

সুজন উঠে দাঁড়িয়ে জামা-প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে ফেলল। ছেলেটার দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে ও বারান্দায় উঠে জ্যাঠামণির সামনে দাঁড়াল।

‘পেরেছ তাহলে’ জ্যাঠামণির ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি।

সুজনও হাসল, পেয়ারাটা পকেট থেকে বার করে সামনে বেতের টেবিলের ওপর রাখল।

‘ওটা খেয়ে ফেল তুমি, বোনকে আদ্ধেকটা দিয়ো।’ তারপরই বললেন, ‘চেষ্টা করলে সব কিছু পারা যায়, শুধু ধৈর্য আর মনের জোরের দরকার।’

‘ওই ছেলেটা কে?’ অর্ধ উলঙ্গ ছেলেটাকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল সুজন।

‘ওর নাম জগো। সাঁওতাল পাড়ায় থাকে, আমাদের ফাইফরমাশ খাটে। তোমারই বয়সি, কিন্তু এখন থেকেই ওঁকে রোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে পড়তে হয়েছে।’ তারপরই তিনি ছেলেটার দিকে ফিরে হাঁক দিলেন, ‘জগো।’

‘এজ্ঞে’। ছেলেটা এগিয়ে এল।

জ্যাঠামণি পেয়ারা গাছটার একটা মগডাল লাঠি দেখিয়ে বললেন, ‘দুটো পেয়ারা দেখতে পাচ্ছিস?’

ছেলেটার সাদা দাঁতগুলো যেন ঝিলিক খেয়ে গেল।

‘হিঁ বাবু।’

‘পাড়।’

জ্যাঠামণির মুখের কথা শেষ হয়েছে কি না হয়েছে, ছেলেটা তরতর করে গাছ বেয়ে উঠতে লাগল। সুজন অবাক হয়ে দেখল চোখের নিমেষে ও পৌঁছে গেল মগডালটার কাছে, তারপর কী অদ্ভুত ভাবে হালকা পায়ে পট পট করে ছিঁড়ে ফেলল পেয়ারা দুটো। যেমন উঠেছিল, তেমন চটপট নেমে এল ছেলেটা, শেষের ডালটা ধরে ঝুলে আস্তে মাটিতে পা ঠেকাল।

‘দেখলে তো ওর কাছে কাজটা কত সহজ, অভ্যেস করলে তুমিও পারবে। কোনো কাজ প্রথম চেষ্টায় না পারলে ছেড়ে দেবে না। রবার্ট ব্র&সের কাহিনি পড়েছ তো, সাতবারের চেষ্টায় তবে তিনি সফল হয়েছিলেন।’

‘হ্যাঁ’, সুজন ঘাড় দোলাল।

জগো পেয়ারা দুটো নিয়ে বারান্দায় উঠে এল। জ্যাঠামণি একটা ওকে দিলেন আর অন্যটা সুজনের হাতে দিয়ে বললেন, ‘তোমার মাকে দিয়ো।’

জ্যাঠামণির জিপটা শহরের বাজারে যাচ্ছে, বাবাও সঙ্গে যাচ্ছেন। সুজন শুনেছে আগে জ্যাঠামণির একটা মোটরগাড়ি ছিল কিন্তু কলাবনি থেকে রাস্তা ভালো নয় বলে ওটা বেচে দিয়ে জিপ গাড়ি কিনেছেন। খুব শক্ত নাকি এই গাড়ি, যুদ্ধের সময় সৈন্যদের এ গাড়ি ছাড়া চলে না।

রিংকুও শহরে যাবে বলে সেজেগুজে তৈরি।

‘তুমিও ঘুরে এসো, দেখে এসো শহরটা’, জ্যাঠামণি সুজনকে বললেন।

‘না, আমি তোমার কাছে থাকি’, সুজন একটু ভয়ে ভয়ে বলল।

‘আমাকে দেখছি তোমার ভালো লেগে গেছে’, জ্যাঠামণি হাসলেন, সুজন একটু লজ্জা পেল।

গাড়িটা চলে যাবার পর সুজন বলল, ‘জ্যাঠামণি, তুমি তো অনেক জায়গায় ঘুরেছ, দেশ-বিদেশের কথা আমার খুব ভালো লাগে। আমাকে বলবে?’

জ্যাঠামণি একটা চুরুট ধরালেন। কয়েক মিনিট চুপ করে কী ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘একটা মজার ঘটনা বলি, শোনো। আমি সে সময় চীনের নানকিংয়ে যাচ্ছি, ওখানকার ভারতীয় দূতাবাসে ফার্স্ট সেক্রেটারি হয়ে। ফার্স্ট সেক্রেটারি মানে হল অ্যামবাসাডারের ঠিক পরেই প্রধান অফিসার। ওটা ছিল ১৯৪৯ সালের মে মাস। সাংহাইয়ের ভেতর দিয়ে যাবার সময় আমি ভীষণ একটা অবরোধের ভেতর পড়ে গেলাম। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে না বললে তুমি বুঝতে পারবে না। চীনে তখন গৃহযুদ্ধ চলছে। একদিকে চিয়াং কাইশেক— তিনি ছিলেন সমস্ত চীনের ডিক্টেটর, সোজা বাংলায় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা; আর অন্যদিকে কমিউনিস্ট সৈন্যরা, তাদের নাম ছিল জনগণের মুক্তি ফৌজ (পিপলস লিবারেশন আর্মি)। শহরের মাঝখানে আমি এবং বিদেশি আরও অনেকে আটকা পড়ে গেলাম। প্রায় গৃহবন্দি বলতে পার, কারণ বাইরে বেরোনো বিপজ্জনক। শহরের দু-প্রান্ত থেকে দু-পক্ষই আক্রমণ করছে পরস্পরকে, মরণপণ যুদ্ধ চলছে। এমনকী বড়ো বড়ো বাড়িতে দু-পক্ষের সৈন্যরা ঢুকে পড়ে লড়াই করছে। আমরা জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি খানিক দূরে মুখোমুখি দুটো বাড়ি থেকে গুলি বিনিময় হচ্ছে। সে যুদ্ধের ইতিহাস তুমি বড়ো হয়ে পড়বে, আমি যে ঘটনার কথা বলছিলাম সেটায় এবার আসি।

ওই সময় চীনে ভয়ানক মুদ্রাস্ফীতি চলছিল— মানে টাকার দাম একেবারে পড়ে গেছিল। একদিন দেখলাম, একজন চীনা বস্তা ভরতি কী যেন রাস্তা দিয়ে লাথি মারতে মারতে নিয়ে চলেছে। পরে দেখলাম ওই লোকটিই এক জোড়া জুতো নিয়ে ফিরছে, কিন্তু বস্তাটা তার সঙ্গে নেই। আমার কৌতূহল হল। খোঁজ নিয়ে জানলাম লোকটা এক বস্তা চীনা-ডলার দিয়ে ওই জুতো জোড়া কিনেছে। আমাদের যেমন টাকা ওদের তেমন ডলার— ব্যাপারটা বুঝতে পারছ তো? কী ভয়ানক অবস্থা, এক বস্তা টাকার বদলে এক জোড়া জুতো। তার মানে টাকার কিছুই মূল্য নেই। তাও আবার সকালে টাকার মূল্য একরকম বিকেলে অন্যরকম।’

‘নানকিংয়ে তুমি যেতে পারলে?’ সুজন প্রায় রুদ্ধনিশ্বাসে প্রশ্ন করে।

‘হ্যাঁ, যেতে পেরেছিলাম। কমিউনিস্ট বাহিনীই শেষপর্যন্ত জিতল, বিদেশি দূতাবাসের লোকজনদের তারা সুযোগসুবিধে দিয়েছিল।’

একটু থেমে জ্যাঠামণি বললেন, ‘যদিও আমার পদটা ছিল ফার্স্ট সেক্রেটারি, কিন্তু অমন গণ্ডগোলের মধ্যে ভারতের রাষ্ট্রদূত তখনও গিয়ে পৌঁছুতে পারেননি, ফলে ভারত সরকার আমার ওপরই সব ভার ছেড়ে দিলেন। আমার নতুন পদবি হল চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স। কমিউনিস্ট দেশগুলি বাদ দিলে আমিই প্রথম অ-কমিউনিস্ট একটা দেশের হয়ে নতুন সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার ব্যাপারে উদ্যোগী হয়েছিলাম।’

‘কূটনৈতিক সম্পর্ক মানে তো— দু-দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পর্ক?’ সুজন জিজ্ঞেস করে।

‘শুধু তাই নয়’, জ্যাঠামণি বললেন, ‘সব রকম রাজনৈতিক ব্যাপারে একটা বোঝাপড়া কূটনৈতিক সম্পর্কের মধ্যে পড়ে।’

‘তোমাকে চীনে আরশুলা খেতে দিত?’

‘আরে না না’, জ্যাঠামণি হেসে উঠলেন, ‘চীনারা খুব ভালো রাঁধুয়ে, সারা পৃথিবীতে ওদের রান্নার কদর। কতরকম রান্না খেয়েছি ওখানে, এখনও জিভে লেগে আছে।’ একটু থেমে আবার তিনি বললেন, ‘শিল্পকলায় খুব উন্নত ওরা। ওখান থেকে আসার সময় অনেক ছবি নিয়ে এসেছিলাম আমি। শিল্পীদের আঁকা ছবি। প্রায় দেড় হাত চওড়া আর সাত হাত লম্বা দামি কাগজে ওরা ছবি আঁকে। ওপর আর নীচটা বেলুনির মতো গোল কাঠে আটকানো থাকে, ইচ্ছেমতো গুটিয়ে ফেলা যায়। দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখে ওই ছবি। গোটা কয়েক এখনও আমার কাছে আছে, তুলে রেখেছি, কাল মনে করিয়ে দিয়ো, বার করে দেখাব।’

সপ্তমী আর অষ্টমী কেটে গেল, ওরা টেরই পেল না।

‘এখানে কি কোনো পুজো হয় না?’ সুজন জিজ্ঞেস করল জ্যাঠামণিকে।

‘শহরের দিকে হয়। এখানে দেখছ তো, কয়েক ঘর সাঁওতাল আর আমরা দু-তিন ঘর বাবু ছাড়া একেবারে ফাঁকা। পুজো করবার লোক কোথায়? দুগ্গা পুজোয় খরচ তো কম নয়।’

‘সাঁওতালরা বাঙালি নয়, তাই না?’ সুজন একটু কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

‘না, বাঙালি নয়। ওদের ভাষা, ধর্ম, আচার-ব্যবহার সব আলাদা। সারা ভারতে ওদের মতো আরও অনেক জাতি আছে, যেমন— কোল, ভীল, মুণ্ডা।’

নবমীর দিন ভোরে ওদের কথা হচ্ছিল।

‘এবার বোনটিকে ডাক’, জ্যাঠামণি বললেন, ‘ওকে পাখি দেখাতে হবে তারপর আমরা সামনে থেকে একটু বেড়িয়ে আসব।’

সুজন রিংকুকে ডেকে তুলল।

ও বারান্দায় আসতেই জ্যাঠামণি বললেন, ‘পাখি দেখবে না?’

‘কই পাখি?’ রিংকু ঘুম জড়ানো গলায় জিজ্ঞেস করল।

‘ওই তো সামনের বড়ো গাছটায় কত পাখি, কী হট্টগোল করছে, শুনতে পাচ্ছ না?’

‘দেখ, দেখ, জ্যাঠামণি, কী সুন্দর পাখিটা’, রিংকু আনন্দে বলে ওঠে, ‘ওটা কী পাখি?’

‘কোনটার কথা বলছ?’

‘ওই যে হলদে পাখিটা, গলা আর মাথা কুচকুচে কালো, ঠোঁটটা কমলা… কী সুন্দর! কেউ রং মাখিয়ে দিয়েছে নাকি পাখিটাকে, জ্যাঠামণি?’

‘ওটা হচ্ছে ইষ্টিকুটুম, ওর ডাকটাও খুব মিষ্টি’, জ্যাঠামণি বললেন।

‘আরেকটা পাখি দেখেছি আমি’, রিংকু হাততালি দিয়ে উঠল, ‘ওই যে কুচকুচে কালো, মাথায় আবার ঝুঁটি, বুকের কাছটা কেমন টকটকে লাল।’

‘ওটা হল বুলবুলি’, জ্যাঠামণির ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসি, ‘ওটা পুরুষ পাখি, মেয়ে বুলবুলির মাথায় ঝুঁটি থাকে না।’

‘দুটো শালিক দেখেছি আমি, কী মজা!’ রিংকুর আনন্দ যেন আর ধরে না। ‘ওটা কী পাখি জ্যাঠামণি? শালিকের মতো দেখতে কিন্তু পালকগুলো সাদা আর কালো মেশানো…।’

‘ওটাও শালিক, অন্য জাতের।’

‘আচ্ছা টিয়া পাখি নেই এখানে?’

‘যখন আম পাকে, তখন টিয়া আসে, একটা দুটো নয়, অনেক।’

রেলিংয়ের ধারে একটা কাঁঠালি চাঁপা গাছে হঠাৎ একটা ছোট্ট পাখি উড়ে এসে বসল। গায়ের রংটা শ্যাওলা, ঠোঁটটা ঝাঁটার কাঠির মতো ছুঁচলো । একবার এ ডাল ও ডাল করল তারপর পাখিটা ডেকে উঠল। সে কী ডাক! রিংকু চমকেই উঠেছিল। অতটুকুন পাখি অত জোরে ডাকতে পারে!

‘দেখেছ জ্যাঠামণি কাণ্ডটা’ রিংকু পাকা গিন্নির মতো বলে উঠল ‘এক আঙুলে পাখিটা কেমন বড়ো পাখির মতো ডাকছে!’

‘হ্যাঁ, তুমি যেমন ছোট্ট মেয়ে, টকটক করে কথা বল, ওরও তেমনি— ওটা হল টুনটুনি।’

ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে দলে দলে লোক সেই ভোর থেকেই কলাবনির দিকে যাচ্ছে— পুরুষ, মেয়ে, বড়ো-ছোটো, সবাই। কারও মাথায় ঝুড়ি ভরতি তরিতরকারি, কারো কাঁধের বাঁকে চাল বা তরকারি, কারো কারো সঙ্গে বড়ো আতা, কেউ কেউ আবার মুরগিও নিয়ে যাচ্ছে। কচি লাউ, কুমড়ো, ঝিঙে, অনেক কিছুই নিয়ে যাচ্ছে ওরা।

সুজন ওদের লক্ষ করছে দেখে জ্যাঠামণি বললেন, ‘আজ হাট বার, হাটে বেচতে যাচ্ছে সবাই।’

‘হাট আবার কী?’ রিংকু জিজ্ঞেস করল।

‘তোমাদের কলকাতায় দু-পা গেলেই বাজার-দোকান, সেখানে সব কিছু পাওয়া যায়। শহরেও রোজ বাজার বসে। কিন্তু পাড়াগাঁয়ে দোকানপাট, বাজার কিছু নেই। তাই সপ্তাহে দু-দিন করে একটা জায়গায় আশেপাশের চাষিরা তাদের ফসল বেচতে নিয়ে আসে। আশেপাশে গাঁয়ের মানুষরাও যার যা দরকার, কিনতে আসে সেখানে। তাকেই বলে হাট। চাষিরাও তরিতরকারি, চাল, এসব বেচে দু-পয়সা পায় আর যাদের ঘরে খাবার ফুরিয়ে গেছে তারাও জিনিসপত্তর কিনে বাড়ি ফিরে যায়। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত চলে হাট।’

‘দু-জন লোককে মুরগি নিয়ে যেতে দেখলাম, তারাও কি হাটে যাচ্ছে।’

‘হ্যাঁ। হাটে দাম বেশি পাবে। এবার চলো আমরা একটু বেড়িয়ে আসি।’

ওরা ভাই-বোন চট করে তৈরি হয়ে নিল। ওরা বেরুতেই কেলো ছুটে এল, তাদের সঙ্গ নিল। সুজন লক্ষ করল, জ্যাঠামণিকে সবাই চেনে। পাশ দিয়ে যাবার সময় নমস্কার জানাচ্ছে, জ্যাঠামণিও ওদের সঙ্গে দুটো কথা বলছেন। ভারি ভালো লাগল সুজনের, এখানে সবার কেমন যেন একটা আপনজন আপনজন ভাব, কলকাতায় পাশের বাড়ির লোকও ডেকে কথা বলে না।

একটা ছোটো ছেলে একপাল গোরু নিয়ে রাস্তা দিয়ে ওদের দিকেই আসছিল।

‘গোরু গুঁতিয়ে দেবে।’ রিংকু জ্যাঠামণির গায়ে যেন লেপটে যেতে চাইছে। সুজনও ভয় পেয়েছে, কিন্তু মুখে প্রকাশ করছে না। ও জ্যাঠামণির ঠিক পেছনে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে।

‘ভয় নেই, কিচ্ছু করবে না’, জ্যাঠামণি ওদের অভয় দিলেন।

সত্যিই গোরুগুলো ওদের পাশ দিয়ে চলে গেল, একবারও মাথা নাড়ল না, কিংবা ওদের দিকে তেড়ে এল না। সুজন অবাক হয়ে দেখল, যে ছোটো ছেলেটা গোরুগুলো নিয়ে যাচ্ছে সে আর কেউ নয়, জগো। তার হাতে একটা সরু লাঠি। এতগুলো গোরুকে ওই বাচ্চা ছেলেটা সামলাবে— ভাবতেই অবাক লাগছে সুজনের। জগোও ওদের পাশ দিয়ে যাবার সময় ওকে আর রিংকুকে দেখছিল। সুজনের চোখাচোখি হতেই ওর ঝকঝকে দাঁতগুলো ঝলসে উঠল। সুজনেরও কেমন যেন হাসি পেল।

‘তোমার সঙ্গে ও বন্ধুত্ব করতে চায়’ জ্যাঠামণি মুচকি হেসে বললেন। জ্যাঠামণির চোখ কিছুই এড়ায় না, মনে মনে ভাবল সুজন।

‘এখানকার গোরুগুলো কেমন ছোটো ছোটো, তাই না জ্যাঠামণি?’ ও বলল।

‘দেশি গোরু তো, তেমন খাবার-দাবারও জোটে না, তাই বোধ হয় বাড়তে পারে না।’

‘গোরুগুলোর গলায় ওগুলো কী, জ্যাঠামণি?’ রিংকু এবার জিজ্ঞেস করল। ওর ভয় এতক্ষণে কেটেছে। ‘কাঠের কী একটা পরিয়ে দিয়েছে, কেমন একটা খট খট শব্দ হচ্ছে!’

‘কোনো গোরু যাতে হারিয়ে না যায় তাই গলায় পরিয়ে দিয়েছে ওই কাঠের ঠুকঠুকিটা’, জ্যাঠামণি জবাব দিলেন। ‘দলছাড়া হয়ে কোনোটা যদি দূরে চলে যায় তবে ওই শব্দ শুনে খুঁজে বার করতে অসুবিধে হয় না।’

ওরা একটা ছোটো সাঁকোর কাছে এসে পড়েছে। তলা দিয়ে একটা নালা চলে গেছে, সেটা গিয়ে দু-পাশের ধানের ক্ষেতে মিশেছে। এক জন লোক খালি গায়ে লম্বা চুবড়ির মতো কী একটা দিয়ে জল ছেঁচে মাছ ধরছিল।

‘কিরে, মাছ পেলি?’ জ্যাঠামণি তাকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ বাবু’, লোকটা মুখ না তুলেই জবাব দিল, ‘পুঁটি মাছ পেলম কতগুনা।’

ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর মাছধরা দেখল। ছোট্ট ছোট্ট পুঁটি মাছ। সুজন শুধু মাছ ধরাই দেখছিল না, মুগ্ধ দৃষ্টিতে চারপাশে তাকাচ্ছিল। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু ধানের ক্ষেত। সবুজ ধান গাছগুলো শিষের ভারে নুয়ে পড়েছে। সবুজ ধান— অনেক ধানের শিষে আবার হলুদ রং ধরেছে। বাতাসে দোলা খাচ্ছে ধানের শিষ, মনে হচ্ছে যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। এই ধান থেকে হয় চাল, ক্ষুধার্ত মানুষের জোগায় অন্ন। একটা কেমন যেন অনুভূতি হচ্ছিল সুজনের। বাংলা মাস্টারমশাই বলেছিলেন, গ্রামগুলো হচ্ছে দেশের প্রাণকেন্দ্র। তখন সে কথাটার মানে বোঝেনি ও। এখন বোধ হয় বুঝতে পারছে। সারা দেশের খাবার হয় এই গ্রামেই, শহরের মানুষ বাঁচে গাঁয়ের এই গরিব মানুষদের পরিশ্রমে— তাদের ফলানো সোনার ফসলে। কিন্তু কী দুঃখী এই মানুষগুলো! সুজন তো দেখছে, ওদের গায়ে দেবার জামা পর্যন্ত নেই, কিন্তু তবু কত সৎ আর পরিশ্রমী ওরা।

ওদের ভালো না হলে দেশের ভালো হতে পারে না, পনেরো বছরের সুজন হঠাৎ উপলব্ধি করল এ সত্যটা।

দেখতে দেখতে দশমীও কেটে গেল, সুজনদের এবার ফেরার পালা, ওর মা কলকাতার বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো করবেন।

সুজন এক ফাঁকে জ্যাঠামণিকে ধরে বসল, ও আরও কয়েকটা দিন থাকতে চায়। স্কুল খুলবে সেই কালীপুজোর পর, এখনও দেরি আছে।

‘কিন্তু তোমার পড়াশোনা?’ জ্যাঠামণি জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কুল খোলার মাস খানেকের মধ্যেই তো অ্যানুয়াল পরীক্ষা।’

‘কয়েকটা বইখাতা আমি নিয়েই এসেছি’, সুজন জবাব দিল, ‘এখানে আসার আগে ভেবেছিলাম সময় কাটবে না, তাই এনেছিলাম।’

‘এখন বুঝি ধারণা বদলে গেছে?’ জ্যাঠামণি বললেন, ‘সময় কেটে যাচ্ছে?’

সুজন হেসে ঘাড় দোলাল, বলল, ‘ভাবতেই পারিনি, এমন সুন্দর জায়গা থাকতে পারে। বারান্দায় বসে বসে শুধু গাছপালা দেখে দেখেই আমার সময় কেটে যাচ্ছে।’

‘হু!’ জ্যাঠামণি বললেন, ‘কিন্তু তোমার বাবা কী বলবেন! লেখাপড়ার ক্ষতি হোক এ আমি চাইনে, অবশ্য তোমার প্রস্তাবে আমার পুরো সমর্থন আছে। আর এ জায়গা তোমার ভালো লেগেছে একথা শুনে আমিও খুশি হয়েছি। দেশের আসল রূপ তো এখানেই পাবে, শহরের কৃত্রিম পরিবেশে নিশ্চয়ই নয়। দেখি তোমার বাবাকে বলে।’

সুজনের বাবা কিন্তু এক কথাতেই রাজি হয়ে গেলেন। এখানে আর কিছুদিন থাকলে ছেলের শরীর ভালো হতে পারে, একথা ভেবে ওর মা-ও আপত্তি করলেন না। লেখাপড়ার ব্যাপারে সুজনের মা-বাবা কেউই চিন্তিত নন। জ্যাঠামণি জানতেন না, ও বরাবরই ক্লাসে ফার্স্ট হয়। বাড়িতে দিনরাত বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে বলে সুজনের মা-বাবা বরং ওর স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে চাইতেন যে, ও একটু কম পড়াশোনা করুক— খেলাধুলার দিকে মন দিক। তাই, সুজন নিজে থেকে থাকতে চাইছে জানতে পেরে ওঁরা মনে মনে খুশিই হলেন। তা ছাড়া জ্যাঠামণির কাছে ও যে নিরাপদে থাকবে সে বিষয়ে ওঁদের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। ঠিক হল ওর বাবা দিন পনেরো পরে এসে ওকে নিয়ে যাবেন।

যাবার আগে মা ওকে বার বার সাবধানে থাকতে বলে গেলেন, জ্যাঠামণিকে যেন বেশি বিরক্ত না করে, তাও বললেন। রিংকু বলল, ‘দাদা, মন খারাপ করলেই চিঠি লিখিস, বাবা এসে নিয়ে যাবে।’

পাকা বুড়ির মতো কথা, সুজন মনে মনে হাসল।

যেদিন সবাই চলে গেল, বিকেলে জ্যাঠামণি বললেন, ‘তোমার একটু হাঁটাহাঁটি করা দরকার। এক কাজ কর, বেরিয়ে পড়ো, মাইল দুই হেঁটে এসো। রোজ সকালে দু-মাইল আর বিকেলে দু-মাইল, দেখবে খিদেও বাড়বে আর শরীরও সারবে। পনেরো দিন বাদে তোমার বাবা এসে অবাক হয়ে যাবেন তোমার চেহারা দেখে।’

‘একা একা যাব!’ সুজন একটু ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করে।

‘কেন, একা ভয় কীসের?’ জ্যাঠামণি যেন একটু অবাক হলেন।

‘যদি রাস্তা হারিয়ে ফেলি?’

‘এটা তো কলকাতা নয় যে অলিতেগলিতে হারিয়ে যাবে! একটাই তো রাস্তা আর দু-পাশে মাঠ। আর হারিয়েই যদি যাও, সেটাও তো একটা অ্যাডভেঞ্চার হবে।’

সুজনের তবু একটু দ্বিধা দেখে তিনি বললেন, ‘দেখ সুজন, যাঁরা জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন, তাঁদের জীবনী পড়লে জানতে পারবে, ছোটোবেলা থেকেই তাঁরা অনেক বাধাবিপত্তির ভেতর দিয়ে সংগ্রাম করেছেন। আমরা বাঙালিরা বড্ড আয়েসী, ঘরমুখো, তাই অন্য মানুষের সঙ্গে প্রতিযোগীতায় ক্রমেই হঠে যাচ্ছি। এ ব্যাপারে আমরা অন্যদের দোষ দিই, কিন্তু নিজেদের দোষটা দেখি না। আমাদের গুরুজনরাও ছেলে-মেয়েদের পায়ে শেকল পরিয়ে বেঁধে রাখতে চান, গণ্ডি পেরিয়ে বেরুতে চাইলেই হাঁ হাঁ করে ওঠেন। এভাবে সর্বনাশ হচ্ছে আমাদের ছেলে-মেয়েদের। রবিঠাকুর শুধু মস্ত কবিই ছিলেন না, তাঁর দূরদৃষ্টিও ছিল অসাধারণ। তাই তিনি বলেছিলেন, ”শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে, দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া করে।” —পড়েছ কবিতাটা?’

‘হ্যাঁ’, সুজন বলল, ‘সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধা জননী, রেখেছ বাঙালি করে, মানুষ করোনি।’

‘অনেক দুঃখেই তিনি ওকথা বলেছিলেন’, জ্যাঠামণি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘ছোটোবেলা থেকেই আদর আর শাসনে বাঙালির মেরুদণ্ড বেঁকে যাচ্ছে। তুমি যদি বড়ো হতে চাও তবে শুধু লেখাপড়ায় ভালো হলেই হবে না— অত সহজ নয় জীবনটা, তার সঙ্গে চাই সাহসবিস্তৃত বক্ষপট।’

কথাটা খুব ভালো লাগল সুজনের— সাহসবিস্তৃত বক্ষপট। ও বলল, ‘তুমি ঠিকই বলেছ জ্যাঠামণি, সাহস ছাড়া কোনো মানুষ কোনো জাতি বড়ো হতে পারে না, আমি পড়েছি কোন একটা বইয়ে। বিপদের মুখেই মানুষের আসল পরীক্ষা। আমি তবে ঘুরে আসছি।’

ও বেরিয়ে পড়ল।

খানিকটা যাবার পরই ও দেখল কেলো ওর পেছন পেছন আসছে। অনেকটা ভরসা পেল সুজন। কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে যেতে কী খেয়াল হল, ডান দিকের ধান খেতে ও নেমে পড়ল। ধান খেতগুলির মাঝ দিয়ে একটা পায়ে চলা পথ চলে গেছে। ও সেই পথ ধরে এগিয়ে চলল। পথটা এঁকেবেঁকে একজায়গায় শেষ হয়েছে। আবার শুরু হয়েছে নতুন পথ। দূরে এক জায়গায় অনেক মানুষ দেখা যাচ্ছে। কৌতূহলের বশেই তাদের লক্ষ করে হাঁটা দিল ও।

ওদের কাছে পৌঁছে সুজন অবাক। প্রায় শ-খানেক লোক কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে খাল কাটছে, দু-পাশে যেন পাহাড়ের মতো মাটির ঢিবি— অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছে। মাথায় টুপি পরা কয়েক জন লোক কাজকর্ম তদারক করছেন, ফিতে দিয়ে এখানে-ওখানে মাপছেন। এলাহি কাণ্ড! সুজনের খুব ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করে কী হবে খাল কেটে, কিন্তু লজ্জায় বাধল। মাটির উঁচু ঢিবিতে ও খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়াল, কেউ ওকে মানা করল না। টুপি পরা এক ভদ্রলোক ওর নাম আর ও কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করলেন। ‘শিশিরবিন্দুর’ নাম শুনে বললেন, ‘ও, মি. সেনের বাড়ি! কেমন আছেন উনি?’

সুজন বলল, ‘ভালো।’

‘তুমি একা একা এতদূর এসেছ, ফিরতে পারবে তো?’ ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যাঁ’, সুজন একটু মুরুব্বিয়ানা চালে জবাব দিল।

ও আবার ফিরে চলল। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, অন্ধকার নামতে আর বেশি দেরি নেই।

বেশ খুশি মনেই ও ফিরছিল, অনেকটা হেঁটেছে, নতুন একটা জিনিস দেখেছে, জ্যাঠামণিকে গিয়ে গল্প করতে পারবে। কিছুটা হাঁটার পর ওর হঠাৎ খেয়াল হল, একী! ও কোথায় এসে পড়েছে! পায়ে হাঁটা পথটা কোথাও দেখতে পাচ্ছে না, শুধু ধানের খেত আর ধানের খেত। বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল সুজন। এখন ও কী করবে! ধারে-কাছে জনমনিষ্যি নেই, এদিকে অন্ধকার নেমে আসছে একটু একটু করে। ওর কান্না পেয়ে গেল আর তখুনি মনে পড়ে গেল জ্যাঠামণির কথা, ‘চাই সাহসবিস্তৃত বক্ষপট।’ সঙ্গেসঙ্গে মনকে শক্ত করে ফেলল সুজন। না, ভয় পেলে চলবে না, বিপদের মুখে সাহসের পরিচয় দিতে হবে ওকে।

ও দাঁড়িয়ে পড়ায় কেলোও দাঁড়িয়ে পড়েছিল, তাকিয়েছিল ওর মুখের দিকে। সুজন এপাশ-ওপাশ তাকাল, না তেমন কোনো পথ ওর চোখে পড়ছে না। হঠাৎ একটা চিন্তা মাথায় এল ওর। কুকুর খুব বুদ্ধিমান, গন্ধ শুঁকে হারানো জিনিস খুঁজে বার করতে পারে। তা ছাড়া কেলো এখানকার প্রাণী, ও কি আর বাড়ির পথ জানে না!

‘এই কেলো।’ নাম ধরে ডাকতেই কেলো লেজ নাড়তে লাগল। ‘আমি রাস্তা খুঁজে পাচ্ছি না, আমাকে বাড়ি নিয়ে চল’, সুজন ওর দিকে তাকিয়ে বলল। কেলো কিন্তু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মহা মুশকিল, সুজন ভাবল, কী করে বোঝাই ওকে।

‘বাড়ি চল’, একটু ধমকেই বলল সুজন।

এবার কিন্তু কাজ হল। কেলো চলতে শুরু করল। কেলো আগে আগে যাচ্ছে আর তার পেছন পেছন সুজন। সত্যিই অবাক কাণ্ড। কোনখান দিয়ে কোনখান দিয়ে কেলো আবার সেই পায়ে হাঁটা পথে এসে পড়ল। আর ভয় নেই, এবার ঠিক পথে চলেছে ওরা। কাঁচা রাস্তাটায় যখন ওরা এসে উঠল তখন চারদিকে অন্ধকার নেমে এসেছে। কেলো সঙ্গে না থাকলে ওই অন্ধকারে ওকে যে ধানের খেতের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে হত সেকথা ভেবে শিউরে উঠল সুজন।

ওর দেরি দেখে জ্যাঠামণি একটু চিন্তিতই হয়ে পড়েছেন, গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছেন।

‘এত দেরি হল কেন, কোন দিকে গিয়েছিলে?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘ওই যে অনেক লোক খাল কাটছে, সেখানে গিয়েছিলাম।’

‘তবে তো অনেক দূর গিয়েছিলে। ভেরি গুড। প্রথম দিনেই তুমি রেসে জিতে গেছ।’

‘অত লোক খাল কাটছে কেন?’ সুজন জিজ্ঞেস করল।

‘ওটা হচ্ছে কংসাবতী প্রোজেক্ট। কংসাবতী বলে একটা নদী আছে, খাল কেটে সেই নদী থেকে জল আনা হবে। চাষের সময় বৃষ্টির জলের অপেক্ষায় না থেকে চাষিরা যাতে ওই খালের জল কাজে লাগাতে পারে, তারজন্য এই ব্যবস্থা।’

‘খালটা কি খুব বড়ো হবে?’

‘নিশ্চয়ই! অনেক টাকা খরচ করে এই খাল কাটা হচ্ছে, অনেক অনেক চাষির উপকারের জন্য। আমাদের বাড়ির কাছ দিয়েই যাবে খালটা।’

পথ হারিয়ে ফেলার কথাটা জ্যাঠামণিকে আর বলল না সুজন, কেন জানি বাধল ওর।

১০

পরদিন সকালে জ্যাঠামণি ওর সঙ্গে বেরুলেন। কিছুটা গিয়ে, তিনি ফিরে এলেন, সুজনকে বললেন সে যেন জোরে জোরে পা ফেলে হেঁটে আসে।

সাঁওতাল পাড়ার পাশ দিয়ে যাবার সময় সুজন দেখল ওদের প্রত্যেকের কুড়ে ঘরের সামনে ছোট্ট একটু শাকসবজির বাগান, চালায় লতিয়ে উঠেছে লাউ-কুমড়োর গাছ। কুঁড়ে ঘরের মাটির দেওয়ালগুলো যেন ঝকঝক করছে। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নাকি সাঁওতালেরা। কয়েকটা মুরগি বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক, মাটি থেকে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে ওরা। ওকে দেখে অবাক চোখে তাকায় ছোটো ছোটো ছেলে-মেয়েরা, বেশিরভাগই আদুড় গা। সুজন মনে মনে ভাবে, আহা, কী গরিব ওরা! বাচ্চাদের পরনের ইজের পর্যন্ত নেই।

সাঁওতাল পাড়া ছাড়িয়ে আরও কিছুটা যাবার পর আবার বাড়িঘর চোখে পড়ল ওর। টিনের চালারও ঘর আছে কিছু। কথাবার্তা শুনে ও বুঝল, এরা সাঁওতাল নয়— বাঙালি, কিন্তু কথাবার্তায় কেমন যেন একটা টান। সাঁওতালদের চাইতে এদের অবস্থা ভালো বলে মনে হল সুজনের। কয়েকটা বাড়ি বেশ বড়ো বড়ো। দু-পাশে কিন্তু যতদূর চোখ যায় শুধু ধানের খেত, লোকজন সব কাজ করছে খেতে। আরও কিছুটা যাবার পর ও লক্ষ করল ঘর বাড়ি কমে আসছে। সুজন আর এগুলো না।

ফেরার পথে সেই সাঁকোর কাছাকাছি এসে ও অবাক। একটা গোরুর গাড়ি আসছে, আর সেই গাড়িটা চালাচ্ছে জগো। যতই জগোকে দেখছে, অবাক হয়ে যাচ্ছে সুজন। ছেলেটা সব কিছুতেই ওস্তাদ। জগো একটা কঞ্চি তুলেছিল, বোধ হয় গোরুর পিঠে বসাবে একটা ঘা, ওকে দেখতে পেয়ে ওর হাতটা ওপরেই ওঠা রইল। গোরু দুটোর গলায় বাঁধা দড়ির যে অংশটা ওর বাঁ-হাতের মুঠোয় ছিল সেটা টেনে ধরে ও অস্বাভাবিক মোটা গলা করে বলে উঠল, ‘অ…অ…অ।’

আশ্চর্য! গোরু দুটো থেমে গেল। জগো তাকাল ওর দিকে, তারপর মিষ্টি করে একটু হেসে বলল, ‘চড়বা?’

সুজনের খুব ইচ্ছে করছিল গোরুর গাড়ি চড়ে, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে ভেবে ও ঘাড় নেড়ে বলল, ‘না।’ তারপর নিজেই জানে না কেন বলে ফেলল, ‘আমাদের বাড়ি আসবে তুমি?’

জগোর মুখ দেখে মনে হল ও যেন আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেছে। হাসিমুখে ও ঘাড় হেলিয়ে সায় দিল।

‘কতদূর গিয়েছিলে?’ বাড়ি ফেরার পর জিজ্ঞেস করলেন জ্যাঠামণি।

সুজন বলল, ‘জানো জ্যাঠামণি’, ও একটু উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘জগোকে দেখলাম গোরুর গাড়ি চালাচ্ছে…।’

জ্যাঠামণি হাসলেন। ‘হ্যাঁ, শুধু ও কেন, ওর মতো আরও অনেকে গোরুর গাড়ি চালাতে পারে, আরও অনেক কিছু করতে পারে। ছোটোবেলা থেকেই ওদের যে শিখতে হয় সব কাজ।’

‘ও’, সুজন বলল। ‘কার গাড়ি ওটা?’

‘তুমি আজ যেখানে গিয়েছিলে সেটা হল মাহাতো পাড়া, ওটা একটা পদবি। মাহাতোরা চাষবাস করে তবে ওদের অবস্থা অনেক ভালো, প্রচুর জায়গা জমি আছে, লোকও খাটায়। সাঁওতালদের জমিজমা বলতে তেমন কিছু নেই, মাহাতোদের জমি ভাগচাষ করে কিংবা মজুর হিসেবে খাটে। জগো রোজ তো কাজ পায় না, যেদিন যেখানে পায় কাজ করে। মাহাতোদের কারো গোরুর গাড়ি নিয়ে বোধ হয় কাজে গিয়েছিল।’

‘আচ্ছা, আমাদের এ জায়গাটার নাম কী?’

‘লাউখাপরা।’

‘কী অদ্ভুত নাম!’ সুজন বলল, ‘এটা কি সাঁওতালি নাম?’

‘তা হতে পারে, আমি ঠিক জানি না।’ একটু হেসে জ্যাঠামণি বললেন, ‘ভালো প্রশ্ন করেছ তো তুমি। খোঁজ নিতে হবে এ নাম হল কেন জায়গাটার।’

দুপুর বেলা জগো এল। ও যেন সুজনকে চমক লাগাবে বলে প্রতিজ্ঞা করেছে। এবার ওর হাতে একটা ধনুক আর তির।

‘তুমি তির ছুড়তে পার?’ সুজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘হ, পারি আমি’, জগো ঝকঝকে হাসি হাসল, ‘বাঁশি বাজাতে পারি, মাদল বাজাতে পারি।’

সুজন ধনুকটা হাতে নিল। ছিলাটা সরু কিন্তু খুব মজবুত, টেনে ছাড়লেই টং টং আওয়াজ করে। তারের ফলাটা লোহার পাতে মোড়ানো আর তীক্ষ্ন। তিরটা কিন্তু নল খাগড়ার কাঠি দিয়ে তৈরি, গোড়ায় একটু খাঁজ কাটা। বোধ হয় ছিলায় ঠিকমতো যাতে চেপে বসে তাই ওই খাঁজটা, কয়েকটা পাখির পালক সুন্দরভাবে আটকানো রয়েছে গোড়ার দিকে।

‘কাল আমি একটা খরগোশ মারলম। ওর মাস খেলম, খুব সোন্দর আর নরম মাস। দাঁড়া তুকে দিখাই।’

ওকে ‘তুই’ করে বলাতে সুজনের একটু রাগ হল, কিন্তু সঙ্গেসঙ্গে ও বুঝতে পারল ওদের কথা বলার ধরনটাই অমন।

তির-ধনুকটা হাতে নিয়ে জগো তিরটা ছিলায় আটকে অনেকটা টানল। তারপর আকাশের দিকে তুলে ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী আলগা করে দিল। সাঁ করে তিরটা শূন্যে উঠে গেল, অনেক উঁচুতে, তারপর বোঁ করে নেমে এসে মাটিতে গেঁথে গেল। ফলাটা প্রায় পুরোটা মাটিতে গেঁথে গেছে আর তিরের বাকি অংশটা থরথর করে কাঁপছে।

সুজন যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না— অত উঁচুতে তিরটা পাঠিয়ে দিল জগো! কী ভীষণ হাতের জোর ওর!

জ্যাঠামণি তখনও ওঠেননি। ও জগোকে বলল, ‘চল আমরা পেয়ারা বাগানে যাই।’

ওদের বাড়ি ছাড়িয়ে রাস্তার উলটোদিকে মস্ত এক পেয়ারা বাগান আছে, জ্যাঠামণিরই বাগান। সস্তায় এখানে জমি পেয়েছিলেন বলে ধানের জমি ছাড়াও উঁচু জমিও কিনেছিলেন বেশ কয়েক বিঘে। একটাতে পেয়ারা বাগান করেছেন, একটাতে গম চাষ হয়— সব বিক্রি হয় শহরের বাজারে। জ্যাঠামণির সব কিছুই যেন পরিকল্পনা মতো।

পেয়ারা বাগানে সব ভালো জাতের পেয়ারা গাছ, কাশীর পেয়ারাই বেশি। এসব গাছে উঠতে সুজনের মোটেই কষ্ট হয় না। খুব নীচু থেকেই দু-দিকে ডাল বেরিয়েছে তাই পা রাখার অসুবিধে নেই। জ্যাঠামণি বলে দিয়েছিলেন, যখন খুশি বাগানে ঢুকে ও যেন পেয়ারা পাড়ে। ভারি মিষ্টি পেয়ারা।

ওখানে বড়ো বড়ো ঘাসের একটু জঙ্গল মতো আছে, যদি খরগোশ মিলে যায় এই আশায় জগোকে বলল ও কথা।

পেয়ারা বাগানে দু-জনে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়াল, কিন্তু খরগোশ কেন, একটা কাঠবেড়ালির দেখাও পাওয়া গেল না। অগত্যা পেয়ারা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে সুজনকে।

একটা গাছে এক জোড়া বড়ো বড়ো ডাঁসা পেয়ারা দেখে ও উঠে পড়ল সেই গাছে, জগোকে বলল নীচে দাঁড়াতে। বেশ ফুর্তিতেই ও উঠছিল। পেয়ারা গাছে উঠতে আর তেমন কষ্ট হয় না ওর, গাছে ওঠা শিখে গেছে। পেয়ারা দুটোর কাছাকাছি গিয়ে হাত বাড়াতে গিয়েই চমকে উঠল সুজন, হাতটা থেমে গেল।

যে ডালে পেয়ারা দুটো ঝুলছে, সে ডালেই এক হাত লম্বা, সরু একটা সাপ লেপটে আছে ডালের সঙ্গে, কিন্তু ওটার ছোটো ছোটো কালো চোখ দুটো সুজনের দিকে মুখ করা— কী বিষাক্ত দৃষ্টি! সাপটা নড়ে উঠল, মাথাটা তুলল একটু। সুজনের হাত-পা অবশ হয়ে এল, এবার ওটা ওকে কামড়াতে আসবে। ভয়ে কেঁপে উঠল ওর শরীর, হাতের মুঠি আলগা হয়ে গেল, আর তাইতেই সে যাত্রা রক্ষা পেয়ে গেল সুজন। হাত ছেড়ে যাওয়ায় সামলাতে না পেরে ধপ করে ও পড়ে গেল মাটিতে।

‘পড়্যা গেলি তু আবার!’ জগোর গলায় যেন একটু ভর্ৎসনার সুর।

‘সাপ!’ কাঁপা কাঁপা গলায় বলল সুজন।

‘সাপ! কুথা?’ জগো ওপর দিকে তাকাল।

সুজন আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। সাপটা মাথা তুলে ওদের লক্ষ করছে।

‘ইঃ, ভারি বেপদ গেল তুর। দাঁড়া, দেখাই দিচ্ছি মজা।’

ধনুকে তির লাগিয়ে তাক করে ছুড়ল জগো। সুজন স্তম্ভিত। তিরের ফলাটা সাপের মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় করে ডালে গিয়ে বিঁধেছে। ছটফট করছে সাপটা, কিন্তু পরিত্রাণের কোনো উপায় নেই আর। তারপর একসময় স্থির হয়ে গেল ওর শরীর। জগো বোধ হয় এজন্যই অপেক্ষা করছিল। তিরতির করে ও গাছে উঠে গেল। তারপর খুব সাবধানে তিরটা টেনে ছাড়িয়ে আনল ডাল থেকে। সাপের মাথাটা কিন্তু তখনও ফলায় আটকে আছে। তিরটা নিয়ে নেমে এল জগো।

‘বেষাক্ত সাপ, তুর কপাল ভালো, তুকে কাটে লাই।’

সুজনের মনে হল সমস্ত ঘটনা শুনে আর সাপটা দেখে জ্যাঠামণির মুখ যেন একটু কেমন হয়ে গেল। ‘বনে-জঙ্গলে সবসময় সাবধান, চোখ খুলে চলবে’, বললেন তিনি। জগোকে তিনি দুটো টাকা দিলেন। আনন্দে লাফাতে লাফাতে চলে গেল জগো।

১১

বিকেলে জ্যাঠামণি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন দিকে যাবে?’

জগো এসে দাঁড়িয়েছিল গেটের কাছে। ‘জগো বলছিল ঝরনা দেখাতে নিয়ে যাবে’, সুজন একটু ইতস্তত করে বলল।

‘ঝরনা!’ জ্যাঠামণি ভুরু কোঁচকালেন। ‘এই জগো, এদিকে আয়।’

পায়ে পায়ে এগিয়ে এল জগো।

‘এখানে আবার ঝরনা কোথায় রে?’ জ্যাঠমণি জিজ্ঞেস করলেন।

‘উ—ই দিকে’, হাত দিয়ে দেখাল জগো। এমন টান দিয়ে ও বলল কথাটা যে মনে হয় অনেকটা পথ যেতে হবে।

‘ওদিকে সকালে আজ আমি গিয়েছিলাম’, সুজন বলল।

‘তুমি মাহাতোদের পাড়া পর্যন্ত গিয়েছিলে, ও তা ছাড়িয়ে আরও অনেকটা যেতে হবে বলছে বোধ হয়।’

‘হ’, জগো বলল, ‘আরও কোশটাক বটে, আমি কয়েক বার গেলম ওখানে।’

‘ঠিক আছে, যা তোরা, সন্ধের আগে ফিরে আসবি, বুঝলি?’

‘হ, বাবু।’

ওরা বেরিয়ে পড়ল। কেলো ঠিক পেছন নিল ওদের। জ্যাঠামণিকে যা বলতে পারেনি তাই বলে ফেলল সুজন তার নতুন বন্ধুকে— গতকাল সন্ধের ঘটনাটা।

‘তু লোধা পাড়ার দিকে চলে যেছিলি’, জগো সব শুনে বলল, ‘কেলো তুকে বাঁচাইছে।’

‘কেন?’ সুজন অবাক না হয়ে পারে না।

‘উয়ারা ডাকু, তুকে ধরি লিত।’

‘ডাকু!’ সুজন সভয়ে বলে ওঠে।

‘হ। ইখানে যত্য চুরি হয়, ডাকাতি হয়— সব উয়াদের লোক করে। উদের আমরা ডরাই।’

সুজনের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে ও। কেলোর দিকে ও তাকাল। পরম বিশ্বস্তের মতো অবোধ জীবটা চলেছে ওদের সঙ্গে।

কথা বলতে বলতে সাঁওতাল পাড়ার কাছে ওরা এসে পড়েছিল। ছোটো ছোটো কয়েকটা ছেলে-মেয়ে ওদের পিছু নিল, জগো সঙ্গে রয়েছে তাই বোধ হয় ওদের কৌতূহলটা বেশি। জগো কিন্তু ওদের প্রচন্ড ধমক দিল, তেড়ে গেল ওদের দিকে, ছুটে পালাল ওরা।

একজন বুড়োমতো লোক জিজ্ঞেস করল, ‘বাবুদের ছেইলাকে কুথা লিয়া যাচ্ছিসরে, জগো?’

‘ঝন্না দেখাতে লিয়ে যাচ্ছি গো, বাবুদের ছেইলা ঝন্না দেখে লাই যে।’

‘অ। বাবুদের ছেইলা অতটা পথ হাঁটি যাবে!’

সুজনের আত্মসম্মানে ঘা লাগল। ও বলল, ‘হ্যাঁ হেঁটেই যাব।’

বুড়ো লোকটার মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠল।

‘তা যাও খুকাবাবু, ঝন্না দেখ্যা আসো।’

ওরা এগিয়ে চলল।

মাহাতোদের পাড়া ছাড়িয়ে সেই নির্জন পথ ধরে ওরা হাঁটছে। দু-পাশে ধানের খেত। প্রায় প্রত্যেক খেতেই একধারে চারটে খুঁটির ওপর একটা ছোটো খড়ের কিংবা পাতা বিছানো চালা।

‘এই চালা কেন?’ সুজন কৌতূহলী হয়ে ওঠে।

‘আত্তিরে পাহারা দিতে হবে না!’ জগো জবাব দিল।

‘পাহার কেন?’ সুজন ঠিক বুঝতে পারে না।

‘অ্যাঁই দ্যাখো, ধান চুরি কর‌্যা লি যাবে না চোরে!’

‘ধানও চুরি হয়!’ সুজন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘হ। পাকা ধান কাটি লি যায়।’

‘শীতকালেও তবে পাহারা দিতে হয়?’

‘হ, দিতে হয় বটে।’

এই শান্ত নির্জন পরিবেশে চুরি ব্যাপারটা কেমন যেন বেমানান।

‘কারা চুরি করে?’ সুজন জিজ্ঞেস করল।

‘লোধারা করে, গরিব মানুষেরাও করে…।’

‘তোমাদের লোক করে না?’ সুজন হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসল।

‘আমরা চোর লয়। খেটে খাই আমরা’, জগোর গলায় একটু যেন ভর্ৎসনার সুর। সুজন বুঝল প্রশ্নটা করা ঠিক হয়নি। জগোর মুখ যেন অপ্রসন্ন হয়ে উঠেছে। ও তাড়াতাড়ি অন্য কথা পাড়ল। ক্রমে মেঘের ভাবটা কেটে গেল জগোর মুখ থেকে।

অনেকটা পথ যাবার পর জগো হাঁটা পথ ছেড়ে একটা মাঠে নেমে পড়ল। উঁচু এবড়োখেবড়ো একটা জায়গা লক্ষ করে ও এবার এগুচ্ছে। অবশেষে জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছোল ওরা।

‘ওই দ্যাখ ঝন্না’, সগর্বে আঙুল দিয়ে দেখাল জগো।

সুজন তাকাল।

বড়ো বড়ো কিছু পাথর পড়ে আছে এক জায়গায়। অনেক রকম পাথর। গোল, লম্বাটে চৌকো। মাঝারি আকারের আর ছোটো ছোটো পাথরও ছড়িয়ে আছে অনেক। আর আছে অসংখ্য পাথরের নুড়ি— সাদা, লাল, নানা রঙের। স্তূপীকৃত হয়ে আছে পাথর, আর সেই পাথর ফুঁড়ে ওপর দিকে উঠছে জলের ফোয়ারা, বেশি উঁচুতে অবশ্য নয়।

সুজন কিন্তু একটু হতাশই হল। ও ভেবেছিল আরও বিরাট কিছু একটা দেখবে। জগো আঁজলা ভরে পান করল ঝরনার জল।

‘তু খাবি না?’ ও জিজ্ঞেস করল সুজনকে। ‘খুব মিঠা জল, খেয়্যা দ্যাখ।’

সুজন একটু কিন্তু কিন্তু করে দু-হাত পেতে মুখে দিল জল। সত্যিই তো, কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি।

ওরা ঝরনা থেকে একটু দূরে একটা শুকনো পাথরের ওপর বসল। সবসময় জল পড়ার জন্য অনেক পাথরের গায়ে শ্যাওলা ধরে গেছে।

হঠাৎ তির ধনুকটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল জগো। সুজন ওর দৃষ্টি লক্ষ করে দেখল কাছেই একটা গাছে একটা পাখি এসে বসেছে। গাঢ় বাদামি আর নীল রঙে মেশানো ওটার সারা গা, মাথাটাও নীল, আর লেজটা বেশ বড়ো। ঠোঁটটাও একটু বড়ো আর বাঁকানো, গোলাপি লাল।

‘কী পাখি ওটা?’ সুজনও উঠে দাঁড়িয়েছে।

‘মাছআঙ্গা’, ধনুকে তির লাগাতে লাগাতে জবাব দিল জগো।

ওর দু-চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ন হয়ে উঠেছে।

সুজনের খুব খারাপ লাগল। অত সুন্দর পাখিটাকে মেরে ফেলবে জগো। ও জগোর কাঁধে হাত রাখল। চমকে ফিরে তাকাল জগো।

‘মারিস না ওটাকে’, সুজন নরম গলায় বলল।

অবাক হল জগো, ওর দু-চোখে ফুটে উঠল বিস্মিত দৃষ্টি।

‘ক্যানে, তুর মায়া লাগছে?’ জগো বলল। ও যেন এখন এক ব্যাধ, কঠিন আর নির্দয়।

‘হ্যাঁ, সুজন জবাব দিল, ‘কী হবে ওটাকে মেরে!’

জগো ধনুকটা নামাল।

‘তু যখন বলছিস ত্যাখন আর মারলাম না, তু ওর পেরাণ বাঁচায়ে দিলি’, একটু হাসল জগো।

‘তুর শরীরে খুব মায়া’, জগো আবার বলল, ‘তুকে একটা পাখি ধর‌্যা দিব আমি।’

‘সত্যি দিবি!’ সুজন খুশি হয়ে ওঠে।

‘হ, দিব’, জগো আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলল, ‘একটা সোন্দর পাখি তুকে দিব আমি।’

আবার বসল ওরা। চ্যাপটা মতো দুটো শুকনো পাথর কুড়িয়ে নিল জগো, বলল, ‘তুকে একটা মজা দিখাই।’ পাথর দুটো ও জোরে ঘষা দিতেই আগুন ঝিলিক দিয়ে উঠল।

‘আগুন জ্বলছে যে!’ সুজন যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

‘হ’, জগো বিজ্ঞের মতো বলল, ইগুলো চকমকি পাথর।’

সুজনের এবার মনে পড়ল। একটা বইয়ে চকমকি পাথরের কথা পড়েছে ও। হাজার হাজার বছর আগে মানুষ যখন অসভ্য ছিল, এখনকার মতো আগুন জ্বালাতে শেখেনি, তখন চকমকি পাথর ঘষে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালাত তারা।

কয়েকটা পাথর কুড়িয়ে ও পকেটে পুরলো, ছোটো ছোটো পাথর, কোনোটা গোল, কোনোটা চ্যাপটা, কোনোটা আবার সরু লম্বাটে, রং-ও আলাদা ওদের।

১২

কোজাগরী পূর্ণিমার সন্ধেবেলা প্রকাণ্ড থালার মতো চাঁদ উঠেছে আকাশে, আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। খোলামেলা জায়গা, তাই জ্যোৎস্নায় যেন নাইয়ে দিচ্ছে মাঠ আর প্রান্তর। চাঁদের সুধা ঝরে পড়ছে পৃথিবীর বুকে, উজ্জ্বল রুপোলি আলোয় হাসছে বসুন্ধরা। এমনকী বড়ো বড়ো গাছের মাথায়ও রুপোলি আলোর বন্যা।

‘চাঁদের এত আলো!’ সুজন মুগ্ধ বিস্ময়ে বলে উঠল।

জ্যাঠামণির সঙ্গে ও বারান্দায় বসে ছিল।

‘আজ যে লক্ষ্মীপুজো, পূর্ণিমা।’ জ্যাঠামণি বললেন।

‘কী ফুটফুটে জ্যোৎস্না, তাই না জ্যাঠামণি! সুজন আবার বলল।

‘হ্যাঁ, একেই বলে কাক জ্যোৎস্না।’

‘কাক-জ্যোৎস্না কী জ্যাঠামণি?’

‘চাঁদের আলোয় যখন পৃথিবী ভরে যায়, দিনের মতো মনে হয়, তখন সকাল হয়ে গেছে মনে করে কাক ডাকতে শুরু করে, তাকেই বলে কাক-জ্যোৎস্না।’

বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, কী মিষ্টি গন্ধ! কেমন একটা মাদকতা আছে জ্যোৎস্নায় ফোটা শিউলি ফুলে। নিশ্বাসের সঙ্গে মিষ্টি গন্ধটা নাকের ভেতর দিয়ে বুকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। সুজন কয়েক বার জোরে জোরে নিশ্বাস টানল।

আরও একটা গন্ধ নাকে এসে লাগছে, ফুলের নিশ্চয়ই, তবে একটু উগ্র। কয়েক বার গন্ধটাকে অনুভব করবার চেষ্টা করে সুজন বলল

‘একটা গন্ধ পাচ্ছ জ্যাঠামণি? গরম মশলার মতো গন্ধ…।’

‘ওটা হল ছাতিমফুলের গন্ধ, চারদিক গন্ধে মাতিয়ে দেয় ওই ফুল, দূর থেকেও পাওয়া যায়।’

সাঁওতাল পাড়া থেকে ভেসে আসছে বাঁশির সুর আর মাদলের বাজনা। বাঁশির সুরে কেমন যেন মায়া আছে। মাদলের বাজনাটাও কেমন যেন অদ্ভুত।

‘ধিতাং তাং’, ‘ধিতাং তাং।’

সুজনের খুব ইচ্ছে করছিল সাঁওতাল পাড়ায় গিয়ে ওদের গান-বাজনা শোনে।

‘কী সুন্দর বাঁশি আর মাদল বাজাচ্ছে, তাই না জ্যাঠামণি!’ সুজন না বলে পারল না।

‘ওদের নাচ হচ্ছে’, জ্যাঠামণি বললেন ‘বোধ হয় কোনো উৎসব আছে।’

সত্যিই তো একটা গানের সুর ভেসে আসছে, সুজন শুনতে পেল এবার, ছেলে-মেয়ে সবাই একসঙ্গে গলা মিলিয়েছে।

ঝলমলে চাঁদের আলো, শিউলি আর ছাতিম ফুলের গন্ধ, বাঁশির সুর, মাদলের বাজনা, সাঁওতালদের গান— সব মিলিয়ে যেন একটা মায়াপুরীর সৃষ্টি করেছে। সুজনের মনে হল ও যেন রূপকথার এক রাজ্যে এসে পড়েছে।

‘সাঁওতালদের নাচ দেখবে নাকি?’ জ্যাঠামশাই হঠাৎ বলে উঠলেন।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ’, লাফিয়ে উঠল সুজন।

‘সূত্রা’, জ্যাঠামণি হাঁক দিলেন।

‘সূত্রা কাছে এসে দাঁড়াতেই তিনি বললেন, ‘খোকাবাবুকে একটু নিয়ে যা, তোদের নাচ দেখিয়ে নিয়ে আয়।’

বত্রিশ পাটি দাঁত বার করে হাসল সূত্রা।

‘চল খুকাবাবু। তুমার ভালো লাগবে আমাদিগের লাচ।’

‘তুমি যাবে না জ্যাঠামণি?’ সুজন যেন একটু হতাশ হল।

‘না, অতটা হাঁটতে কষ্ট হয় আমার’, জ্যাঠামণির কণ্ঠে যেন একটু বিষাদের সুর। সুজনের খুব রাগ হয় নিজের ওপর। ছিঃ! ওর বোঝা উচিত ছিল।

সূত্রার সঙ্গে ও বেরিয়ে পড়ল।

‘বেশি রাত করো না’, জ্যাঠামণি পেছন থেকে বললেন।

বেশ তাড়াতাড়ি হেঁটে ওরা পৌঁছে গেল সাঁওতাল পাড়ায়। সূত্রা খুব খুশি। খোকাবাবু এল বলেই ওর আসা হল, নাচ-গানে যোগ দিতে পারবে। নয়তো বাবুদের বাড়িতেই এখন ফাইফরমায়েস খাটতে হত।

খোলা আকাশের তলায়, জড়ো হয়েছে সবাই, বুড়ো-বুড়ি থেকে শুরু করে বাচ্চা পর্যন্ত। যারা নাচছে আর গাইছে তারা ছোটো ছোটো পা ফেলে গান করছে। গানের তালে তালে পা মেলাচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে হাততালিও দিচ্ছে। মুখোমুখি দু-সারিতে ওরা নাচছে, গাইছে; মেয়েরা রয়েছে এক সারিতে আর ছেলেরা অন্য সারিতে। মাঝখানে দু-জন লোক নেচে নেচে মাদল বাজাচ্ছে, আর একজন ফুঁ দিচ্ছে বাঁশিতে।

চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে ওদের মুখ। মেয়েরা কোমরে আঁচল জড়িয়েছে আর বেশ খাটো করে পরেছে শাড়ি। ছেলেরা মালকোঁচা মেরে কাপড় পড়েছে, হাঁটুর ওপর। উদলা গা। ছাতিম ফুলের গন্ধটা বেশ উগ্র হয়ে উঠেছে, বোধ হয় কাছেই আছে গাছ।

গান কিন্তু ছেলে আর মেয়েরা একসঙ্গে করছে না। একবার মেয়েরা একসঙ্গে করছে, তারপরই গান ধরছে ছেলেরা। যেন মেয়েরা একটা কথা বলছে আর তার জবাব দিচ্ছে ছেলেরা। সুজন ওদের ভাষা বুঝতে পারছিল না, কিন্তু সুরটা খুব ভালো লাগছিল ওর।

সবাই তন্ময় হয়ে গিয়েছিল, সুজনের উপস্থিতি লক্ষ করেনি। হঠাৎ কে একজন ওকে দেখল, সঙ্গেসঙ্গে বলাবলি শুরু হয়ে গেল। ‘আরে, বাবুদের ছেইলা লাচ দেখতে আইছেরে।’

ওকে নিয়ে হইচই পড়ে গেল। আদরের কী ঘটা, যেন সম্মানিত অতিথি এসেছে। এক জন ব্যস্তভাবে কাঠের বাক্সের মতো কী একটা এনে ওর সামনে রাখল, বলল, ‘বসি যা খুকাবাবু, দাঁড়ায়ে দাঁড়ায়ে তুর কষ্ট হবে।’

সুজনের ওজর আপত্তি না শুনে ওকে জোর করেই বসিয়ে দিল বুড়ো মতন এক জন লোক। যারা নাচ-গান করছিল তাদের লক্ষ করে চেঁচিয়ে সে বলল, ‘বাবুদের ছেইলা তুদের লাচ দেখতে এইসেছে ভালো কর‌্যা লাচ দেখা।’

সুজনের মনে হল সত্যিই যেন ওদের নাচ-গানের ধারা একেবারে বদলে গেল। যেন খুব উৎসাহিত হয়ে উঠেছে ওরা। দ্রুত হয়ে উঠেছে ওদের পায়ের কাজ, মাদলের ওপর চাঁটি পড়ছে খুব ঘন ঘন। ঝাঁকড়া চুলের লোকটা বাঁশি বাজাচ্ছিল, সে খুব জোরে ফুঁ দিচ্ছে বাঁশিতে, আর সেইসঙ্গে তার সমস্ত শরীরটা নাচের তালে তালে দুলছে। একটা যেন প্রাণের জোয়ার এসেছে ওদের মধ্যে।

গানের কথাগুলো সুজন যেন বুঝতে পারছে, যদিও মানে বুঝতে পারছে না।

বীর কিতা মসমোতা ভুরকো ইপিল

আর হড়তে তাড়াম কুড়ি জামাই সভা—

মদনমোহন মোড়লি বাজায়

চ’ বিজুর বন গুপি কদমতলে

মৈসিনিচরে চ’ বিজুর বন গুপি কদমতলে।

মুগ্ধ হয়ে বসেছিল সুজন। এই পরিবেশে কেমন যেন অদ্ভুত একটা অনুভূতির সৃষ্টি হচ্ছিল ওর মনে। ও যেন ওদেরই একজন হয়ে গেছে। কলকাতার ভবানীপুরের বাসিন্দা, সেন্ট লরেন্স স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র, এস সেন নয়।

তারপর একসময় নাচ-গান থামল। মেয়েদের যারা নাচছিল তাদের মধ্যে থেকে হঠাৎ তিন জন ছুটে এল। সুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাদের খুকাবাবু!’ ওদের গলায় আনন্দের সুর।

সুজনও কম অবাক হয়নি। গুরু, ঠাকুর আর খাঁদিও নাচছিল! গান করছিল! ওদের জ্যাঠামণির বাগানে কাজ করতেও ও দেখেছে, ওদের সেই রূপটাই ওর চেনা, কিন্তু ওদের যে আর একটা রূপ থাকতে পারে, এমন সুন্দর নাচতে-গাইতে পারে ওরা, তা কি একবারও ভাবতে পেরেছিল ও!

যেন অবাক হয়েই ওদের মুখের দিকে তাকাল সুজন।

ততক্ষণে গুরু ওর একটা হাত আর ঠাকুর আর একটা হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে ওকে।

‘আমাদের সঙ্গে তুকে লাচতে হবে’, ওদের এক জন বলল।

সুজন যেন দু-চোখে অন্ধকার দেখল। সর্বনাশ! বলে কি ওরা! ও কি নাচ জানে যে ওদের সঙ্গে নাচবে! অসহায়ভাবে ও সূত্রাকে খুঁজল, কিন্তু সে তখন ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছে।

‘আ…মি, আ…মি, নাচতে জা…নি…না’, আমতা আমতা করে বলল সুজন।

‘আমাদের লাচ তু পারবি খুকাবাবু, বুলছি দ্যাখ’, ঠাকুরই বোধ হয় বলল।

ওকে দেখাতে লাগল ওরা। তেমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। তবে অন্যদের সঙ্গে তাল রাখতে হবে, বেতাল হলেই কেটে যাবে সুর। আর এ নাচে তালে তালে হাততালি দেবার দরকার নেই।

সবাই গোল হয়ে একে অপরের বাহু গলিয়ে পায়ে পা মেলাবে আর গান করবে।

সুজনকে জোর করেই ওরা টেনে নিল নাচে, কোনো ওজর আপত্তিই শুনল না, শুরু হল নাচ। প্রথম প্রথম একটু বাধো বাধো ঠেকছিল সুজনের, তালে তাল রাখতে পারছিল না, কিন্তু ওরা সবাই মিলে উৎসাহ দিতে লাগল ওকে, সাহায্য করতে লাগল, যাতে ছন্দপতন না হয়।

একটা যেন পৌরুষভাব চাড়া দিয়ে উঠল পনেরো বছরের কিশোরের মনে। কেন সে পারবে না এই সহজ নাচ নাচতে। জড়তা কাটিয়ে উঠল সুজন, বুঝতেও পারল না ওদের মতোই কখন উদ্দাম হয়ে উঠেছে ও। ওর রক্তেও ধরে গেছে খেপামি— নাচের নেশা। গানে অবশ্য ও গলা মেলাতে পারল না, কিন্তু পা দুটো পড়তে লাগল নিখুঁত তালে— ডান-বাঁ, ডান-বাঁ; ছোটো ছোটো তালে চার বার, তারপরই ডান-পা বাড়িয়ে দিতে হবে একটু বেশি, পরে বাঁ-পা। ডান দিক দিয়ে ঘুরে ঘুরে নাচছে ওরা। ধিতাং তাং, ধিতাং তাং— মাদল বাজছে চড়া সুরে। সুজনের সমস্ত শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠেছে।

বোধ হয় ওর সম্মানেই বাংলা গান ধরেছে ওরা সুজন মনে মনে এদের সঙ্গে গলা মেলাবার চেষ্টা করে :

ফুল ফুটিল জল মরিল

সে ফুলের দাম টাকা টাকা।

চাঁদ উঠিল সুর্যু ডুবিল

জোড়তলে কীসের অ্যালো (আলো) ভাই জোড়তলে!

চাঁদ উঠিল সুর্যু ডুবিল

সুর্যুর আলো বাই জোড়তলে!

নাচ শেষ হল। সবাই ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দারুণ নাকি ও নেচেছে। হঠাৎ ভীষণ লজ্জা হল সুজনের। কী কাণ্ডটা ও করল! মা জানতে পারলে গালে হাত দেবেন, জ্যাঠামণি হাসবেন, আর রিংকুটা বলবে, ‘ওমা, তুই ওদের সঙ্গে নাচলি!’

পরমুহূর্তে ওই চিন্তাটাকে দূরে সরিয়ে দিল ও। নেচেছে, বেশ করেছে; এটাও তো একটা অভিজ্ঞতা। তা ছাড়া এতগুলো মানুষকে ও আনন্দ দিতে পেরেছে সেটা কি কম কথা! ওরা গরিব-দুঃখী, কিন্তু জীবনকে ভালোবাসতে জানে।

হঠাৎ বাহুতে কার মৃদু স্পর্শে ফিরে তাকাল সুজন। জগো ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।

‘তুর কাছে আমি হার মানলম’, ও বলল, ‘সোন্দর নাচলি তুই, কেমন সোন্দর!’ ওর গলায় আন্তরিকতার পরশ।

কেমন যেন অভিভূত হয়ে গেল সুজন, জগোর ডান হাতটা চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে সব কিছু ব্যবধান অতিক্রম করে এক হয়ে গেল দুটি কিশোর মন।

১৩

সেদিন সন্ধের পর জ্যাঠামণির ঘরে বসে লেখাপড়া করছিল সুজন। আলোর অসুবিধে নেই, জ্যাঠামণি ডায়নামো বসিয়েছেন বাড়ির জন্য, ডিজেলে চলে। একদিন ওকে ভালো করে দেখিয়েছিলেন জ্যাঠামণি, কীভাবে বন্ধ করতে হয়— সব। তবে যখন বাড়িতে লোকজন আসে তখনই ওটা চালানো হয়, অন্য সময় লন্ঠন জ্বলে।

আজ ওর মন খুব ভালো, দুটো নতুন জিনিসও দেখেছে। সকালে দেখেছে একটা বাদামি রঙের পাখি, মাথায় আবার ঝুঁটি আছে। রাস্তার ধারে একটা মহুয়া গাছ ধারালো ঠোঁট দিয়ে অনবরত ঠুকেই যাচ্ছিল পাখিটা। সুজন অবাক হয়ে ওর কাণ্ড দেখছিল। জ্যাঠামণিই বললেন, ওটার নাম কাঠঠোকরা। ঠুকে ঠুকে গাছে গর্ত করাই নাকি ওর স্বভাব।

দুপুর বেলা বাড়ির পেছন দিকে যেখানে একটু জঙ্গলের মতো হয়েছে সেখানে নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করেছে ও। ছোটো ছোটো লতা, পাতাগুলো কচি কচি তেঁতুল পাতার মতো। হঠাৎই সুজনের পা লেগে গিয়েছিল একটা কচি পাতায়, আর সঙ্গেসঙ্গে দু-পাশের পাতাগুলো যেন কুঁকড়ে বুজে গেল। দাঁড়িয়ে পড়েছিল সুজন। তারপর উবু হয়ে বসে সাবধানে আঙুল ছুঁয়েছিল পাশের অমন একটা পাতায়। আশ্চর্য! ওটার পাতাগুলোও আগেরটার মতোই বুজে গেল। ছুটে এসেছিল ও জ্যাঠামণির কাছে, উত্তেজিত ভাবে বলেছিল ওর আবিষ্কারের কথা। জ্যাঠামণির মুখেই শুনল ওগুলো নাকি লজ্জাবতী লতা।

এদিকে আবার ছুটিও ফুরিয়ে এসেছে, এখানকার মেয়াদও ফুরিয়ে এল। আর ক-দিন বাদেই বাবা আসবেন। সত্যিই ওর চেহারায় এ ক-দিনেই একটা তাজা ভাব এসেছে, গালে মাংস লেগেছে। লাজুক, মুখচোরা ছেলেটি চটপটে হয়ে উঠতে শুরু করেছে, জেগে উঠেছে একটা আত্মবিশ্বাস। পরীক্ষায় ও ফার্স্ট হয় ঠিকই, কিন্তু লেখাপড়া ছাড়া আর কিছুতে মনোবলের পরিচয় এতদিন ও দিতে পারেনি, এখন বোধ হয় পারবে।

মাঝরাত্তিরে একটা গোলমালে ওর ঘুম ভেঙে গেল। সারা বাড়ি আলোময়, সবাই উঠেছে, একটা চাপা উত্তেজনা। কী ব্যাপার!

ধড়মড় করে উঠে পড়ল সুজন। জ্যাঠামণির ডান হাতে একটা বন্দুক— পরে ও জেনেছিল ওটা বন্দুক নয়, রিভলবার— সূত্রার হাতে তির-ধনুক, রজনীর হাতে একটা লাঠি, আর যে লোকটা রাত্তিরে বারান্দায় শোয়, তার হাতে বল্লমের মতো একটা অস্ত্র। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে কেলো, বারে বারে ছুটে যাচ্ছে বাড়ির পেছনে তারের বেড়ার দিকে।

‘কী হয়েছে জ্যাঠামণি?’ রুদ্ধনিশ্বাসে জিজ্ঞেস করল সুজন।

‘চোর ডাকাত এসেছে মনে হচ্ছে’, জ্যাঠামণির গলার স্বরটা কেমন যেন গম্ভীর।

‘আমি একটা লাঠি নেব?’ ব্যগ্রভাবে জিজ্ঞেস করল সুজন।

জ্যাঠামণি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘তুমি এক কাজ কর, আমার টেবিলের ওপর একটা বড়ো টর্চ আছে, সেটা নিয়ে এসো।’

সুজন ছুটে টর্চটা নিয়ে এল। মস্ত বড়ো টর্চটা, পাঁচ ব্যাটারির।

সবাই বেরিয়ে এসেছে। কালীপুজো আর মাত্তর ক-দিন বাকি, কৃষ্ণপক্ষ চলছে, চারদিক অন্ধকার।

‘টর্চটা জ্বালিয়ে আলো ছড়াও তো চারদিকে’, জ্যাঠামণি বললেন। সুজন আলো ছড়াতে লাগল। জোরালো আলো বাড়ির পেছন দিকে, সীমানার বাইরে, অনেক ঝোপঝাড়; বড়ো বড়ো গাছও ছড়িয়ে আছে এদিক-ওদিক। কেলো ভীষণ ভাবে ঘেউ ঘেউ করছে, তারের বেড়ার কাছে ছুটে যাচ্ছে আবার ফিরে আসছে।

হঠাৎ একটা ঝোপের ওপর আলো পড়তেই কী যেন নড়ে উঠল। দারুণ উত্তেজনায় আবার সেখানে আলো ফেলল সুজন। পরক্ষণেই লাফিয়ে উঠল একজন মানুষ, খালি গা। ছুটে অন্ধকারে দৌড় মারল লোকটা আর সঙ্গেসঙ্গে গর্জে উঠল জ্যাঠামণির হাতের রিভলবার।

সবাই এগিয়ে গেল তারের বেড়ার দিকে। চারদিকে আলো ছড়াতে লাগল সুজন, কিন্তু আর কিছু দেখা গেল না। আরও কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর ফিরে এল সবাই।

‘একটু সজাগ থাকিস তোরা’, ঘরে ফিরে এসে সবাইকে বললেন জ্যাঠামণি।

সজাগ ছিল সবাই, কিন্তু ভোররাতের দিকে বিপদ কেটে গেছে ভেবে ঘুমিয়ে পড়ল। একটু বেলা করে ঘুম ভাঙল সকলের। মুখ ধুয়ে সুজন বারান্দায় জ্যাঠামণির পাশে সবে এসে বসেছে এমন সময় গুরু আর ঠাকুর ছুটে এল ওখানে। ভীষণ উত্তেজিত ওরা। ওদের কথা শুনে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন জ্যাঠামণি, সুজনেরও সেই অবস্থা।

মুরগির ঘরের দরজাটা নাকি ভাঙা, ভেতরে একটাও মুরগি নেই। জ্যাঠামণি বারান্দা থেকে নেমে মুরগির ঘরের দিকে এগুতে লাগলেন, সুজনও তাঁর পাশে হাঁটছে। সবাই এসে জড়ো হল ঘরটার সামনে।

দরজাটা হাঁ করে খোলা। ভেতরে ঢুকল সবাই। খাঁ খাঁ করছে ঘরটা, মুরগির পালক আর রক্তে ছড়াছড়ি। চল্লিশ-পঞ্চাশটা মুরগির একটাও নেই। স্তম্ভিত সবাই। ওপরে খড়ের চালার মাঝখানে একটা বড়ো গর্ত, মাটিতে একটা লম্বা পাকানো দড়ি পড়ে আছে।

‘কী আশ্চর্য!’ অনেকটা যেন আপন মনেই বললেন জ্যাঠামণি, ‘এতগুলো মুরগির একটাও শব্দ করল না!’

সুজনও তাই ভাবছিল! ভয় পেয়ে ওরা যদি ডেকে উঠত, তবে একটা ভীষণ চ্যাঁচামেচির সৃষ্টি হত, কিন্তু ওরা চুপ করে ছিল কেন?

অতগুলো মুরগি চুরি হয়েছে, কেমন যেন একটা কষ্টের ভাব ফুটে উঠেছে জ্যাঠামণির মুখে। সুজনের খুব দুঃখ হল।

যে লোকটা বাগানে কাজ করে সে হঠাৎ দড়িটা হাতে নিয়ে বলে উঠল, ‘ইটা দেখ্যা ভয় পেল মুরগিগুলা, রা-টি করলেক লাই।’

‘কী বলছিস তুই।’ জ্যাঠামণি ধমক দিয়ে উঠলেন। সুজনের মনে হল খুব রেগেছেন তিনি।

‘আমি মিছা কথা বুলি নাই বাবু’, লোকটা বলল, ‘ইটাকে উপর থিক্যা ফেলায়েছে।’ ওপরে চালার গর্তটা সে আঙুল দিয়ে দেখাল। ‘দড়িটা নাড়ল আর আঁন্ধারে মুরগিগুলা ভাবল সাপ, ভয়ে উরা ডাকল না, খুব ডর উদের সাপকে। ত্যাখন অন্য জনা দরজা ভাঙি ঢুকল। মুরগিগুলাকে মারি নিয়ে গেল।’

সুজন দেখল জ্যাঠামণি আস্তে আস্তে মাথা দোলাচ্ছেন। একজন নয়, দু-তিন জন লোক ছিল। নিশ্চয়ই ভোররাতে ওরা আবার এসেছিল। কী সাহস ওদের! কেলোটাও টের পেল না, কী আশ্চর্য!

জ্যাঠামণির কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে। আস্তে আস্তে তিনি ঘরে ফিরে চললেন, সুজন পেছন পেছন চলল। ওর কেমন যেন এখন ভয় করছে জ্যাঠামণিকে।

বারান্দায় এসে জ্যাঠামণি দাঁড়ালেন কয়েক মিনিট, তারপরই গম্ভীরকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ড্রাইভারবাবু!’

‘আজ্ঞে’, ড্রাইভারবাবু ছুটে এলেন।

‘গাড়ি বার করুন।’

ড্রাইভারবাবুর বেশ বয়স হয়েছে, মাথার সব চুল পাকা। তিনি শহরের দিকে থাকেন। সকালে একটা সাইকেলে চলে আসেন আর সন্ধের পর চলে যান। তখন আর গাড়ি দরকার হয় না জ্যাঠামণির।

জ্যাঠামণি খাকি পোশাক পরলেন, কোমরে একটা চওড়া চামড়ার বেল্ট আঁটলেন, বেল্টের সঙ্গে একটা রিভলবারের কেস লাগানো। রিভলবারটা কেসের ভেতর ঢুকিয়ে চামড়ার মুখটা বন্ধ করলেন। বাঁ-পাশে বেল্টের সঙ্গে আটকানো ছোটো একটা চামড়ার বাক্স, তাতে কয়েকটা গুলি রাখলেন। ঠিক যেন মিলিটারির মতো দেখাচ্ছে জ্যাঠামণিকে।

‘কোথায় যাচ্ছ জ্যাঠামণি?’ সুজন সংকোচ কাটিয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘লোধাপাড়া।’

‘আমি তোমার সঙ্গে যাব, জ্যাঠামণি।’

‘ওখানে গোলমাল হতে পারে’, জ্যাঠামণি জবাব দিলেন।

‘তুমিই তো আমাকে বলেছ বিপদের মুখে ভয় না পেয়ে এগিয়ে যেতে’, সুজন বেশ সাহস করেই বলে ফেলল।

জ্যাঠামণি ওর মুখের দিকে তাকালেন। তাঁর নিজের মুখটাও একটু যেন প্রসন্ন হয়ে উঠেছে। কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন তিনি, তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, চল।’

আর কাউকে সঙ্গে নিলেন না জ্যাঠামণি। সুজন ভাবল, কী সাহস জ্যাঠামণির!

জ্যাঠামণির কথামতো ড্রাইভারবাবু কলাবনির দিকে চালাতে লাগলেন। অতটা অবশ্য যেতে হল না, মাঝপথ পর্যন্ত গিয়ে ড্রাইভারবাবু বাঁ-দিকে ঘোরালেন গাড়িটা। এবড়োখেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে কিছুটা গিয়ে আবার একটা কাঁচা রাস্তায় পড়ল জিপটা। গাড়ির রাস্তা নয়, জিপ বলেই যেতে পারছে। বেশ কিছুটা গিয়ে আবার ডাইনে ঘুরল গাড়ি। আরও কিছুটা যেতেই কয়েকটা খড়ের চালা চোখে পড়ল সুজনের। জ্যাঠামণির নির্দেশে গাড়ি থামালেন ড্রাইভারবাবু। জ্যাঠামণি আস্তে আস্তে নামলেন, সুজনও লাফিয়ে নেমে পড়ল।

জনা কয়েক জোয়ান পুরুষ আর ছেলে-মেয়ে ভিড় করেছে, একটু যেন অবাক হয়ে দেখছে ওদের। সাঁওতালদের মতোই ওদের চেহারা, তবে চেহারায় একটু যেন রুক্ষতা বেশি।

‘তোদের সর্দার কোথায়?’ জ্যাঠামণি গম্ভীরকণ্ঠে বললেন এক জনকে লক্ষ করে। কিন্তু কেউ জবাব দিল না।

‘আমার কথা কানে যাচ্ছে না তোদের’, হঠাৎ যেন রাগে ফেটে পড়লেন জ্যাঠামণি। জ্যাঠামণির এমন রাগ আগে কখনো দেখেনি সুজন, সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে, ডান হাতটা চলে গেছে রিভলবারের খাপের ওপর, লাঠিটা দিয়ে দিয়েছেন সুজনের হাতে।

জ্যাঠামণির চোখ-মুখ দেখে বোধ হয় একটু ভয়ই পেল ওরা। এক জন ছুটে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরে এক জন বুড়োকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল লোকটি।

‘তুই ওদের সর্দার?’ জ্যাঠামণির গলা যেন বজ্রের মতো কঠিন।

বুড়োটা মাথা দোলাল।

‘কাল রাত্তিরে আমার বাড়ি থেকে যারা মুরগি চুরি করেছে তাদের ডাক এখানে।’

বুড়ো লোকটা হতভম্বের মতো তাকাল।

‘কি বুলছিস তু বাবু, তুর মাথাটা কি খারাপ হয়্যা গেল!’ কোনোমতে সে বলল।

এক ঝটকায় রিভলবারটা টেনে বার করলেন জ্যাঠামণি, সোজা তাক করলেন বুড়ো লোকটার বুক লক্ষ করে। সারা মুখ থম থম করছে, এই বুঝি গুলি করেন।

‘সেই লোকদের যদি না ডাকিস, আমি তোকে গুলি করে মারব’, ভীষণ ঠান্ডা শোনাচ্ছে জ্যাঠামণির গলা। সুজনের বুকের ভেতরেও একটা ঠান্ডা কী যেন শিরশির করে উঠল। সত্যি যদি জ্যাঠামণি গুলি করে বসেন আর লোকগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের ওপর!

বুড়ো লোকটা থরথর করে কাঁপছে, ওর দু-চোখ বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে, সেখানে ভয়ের ছায়া।

জ্যাঠামণি এক পা এগুলেন, বাঁ-হাত আর বাঁ-পা কাঁপছে।

হঠাৎ ভেঙে পড়ল বুড়ো সর্দার।

হাতজোড় করে কঁকিয়ে উঠল, ‘বাবু ইবারটি মাপ করি দে, আর এমনটি হবেক নাই। আমি তুকে কথা দিলম, আমার লোক কুনোদিন তুর সঙ্গে বেইমানি করবে নাই। আমি ধম্ম মানলম, মিছা হবে না আমার কথা।’

সুজন দেখল জ্যাঠামণির মুখের থমথমে ভাবটা একটু একটু করে আবার আগের মতো হয়ে আসছে।

‘ঠিক বলছিস!’ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

‘হ বাবু, আমার কথা মিছা হবে নাই।’

যারা ওখানে জড়ো হয়েছিল তাদের সবার মুখের ওপর নিঃশব্দে চোখ বুলালেন জ্যাঠামণি, তারপর আস্তে আস্তে গাড়িতে এসে বসলেন। সুজন পেছনের আসনে বসল। গাড়ি চলতে শুরু করতেই বুড়ো সর্দার দু-হাত তুলে আবার নমস্কার করল।

গাড়ি ছুটে চলল।

জ্যাঠামণি ফিরে তাকালেন সুজনের দিকে, তাঁর মুখে মৃদু হাসি। সুজনও হাসল। যেন যুদ্ধজয় করে ফিরছে এমন একটা আনন্দের হাসি।

১৪

সুজনের জ্যাঠামণি গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। আজ হাট বার, দলে দলে মানুষ চলেছে হাটে বেচা-কেনা করতে। বাড়ির জমিতে তরিতরকারি হলেও কিছু কিছু জিনিস বাইরে থেকে কিনতে হয়। হাট বার সকালে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে পছন্দমতো জিনিস কেনা সুবিধে।

কামিনরা তখনও কাজে আসেনি। হঠাৎ জ্যাঠামণি দেখলেন গুরু আর ঠাকুর ছুটতে ছুটতে আসছে, আলুথালু ওদের পোশাক। কী ব্যাপার! ওরা অমন করে ছুটে আসছে কেন?

কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে ওরা বলল, ‘সব্বনাশ হয়্যা গেল বাবু?’

‘কী সর্বনাশ?’ বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল জ্যাঠামণির।

গুরুই বলল এবার, ‘একটা খেপা হাতি বেরোইছে বাবু। ধানগাছ ভাঙি শেষ করি দিল। খুকাবাবুকে দেখলাম জগোর সঙ্গে উদিকেই গেল।’

‘এ্যাঁ!’ জ্যাঠামণির মুখের সমস্ত রক্ত কেউ যেন নিংড়ে নিল।

‘তোরা ওকে ডাকলি না কেন?’ সংবিৎ ফিরে পেয়ে বললেন তিনি, ‘দেখলি তোরা, ডাকলি না!’

‘ই মাত্র শুনলম আমরা’, ঠাকুর বলল। ‘ছেইলাটা জগোর সঙ্গে উদিকে গেল, দেখলম আমরা, ত্যাখন হাতির কথা জানতম না। এখন শুনলম তাই ছুট্যা এলম।’

জ্যাঠামণির মনে হল তিনি বোধ হয় পড়ে যাবেন, সর্বাঙ্গ থরথর করে কাঁপছে।

‘তোদের মানুষদের বল গিয়ে যে যা পারে হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ুক… ছেলেটাকে ফিরিয়ে এনে দে… বলিস ওদের অনেক টাকা দেব… যা যা ছুটে যা, দেরি করিস না…’ এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে হাঁপাতে লাগলেন তিনি।

‘উরা গেইছে বাবু, সি কথা ভাবিস না। তির-ধনুক লিয়ে গেইছে, টিন বাজাইছে খুব।’

এটাই একমাত্র উপায়। টিন, ক্যানেস্তারা বাজিয়ে পাগলা হাতির পেছনে তাড়া করে অনেক লোক, খেদিয়ে দেয় নিজেদের এলাকা থেকে। আসলে দলছুট হয়ে এক-একটা বুনো হাতি এসে পড়ে এসব অঞ্চলে, লণ্ডভণ্ড করে দেয় ধানখেত। ওগুলো শয়তান হয়ে ওঠে বলেই সর্দার হাতি ওদের তাড়িয়ে দেয় দল থেকে, আর বসতি অঞ্চলে এসে উপদ্রব শুরু করে ওই গুন্ডা হাতিগুলো। প্রায়ই মারা পড়ে ওরা, আবার মানুষ আর ফসলের প্রচণ্ড ক্ষতি করে পালিয়েও যায় বনে পাহাড়ে।

গুরু আর ঠাকুরের কথা শুনে একটু ভরসা পেলেন জ্যাঠামণি। লোকজন যখন গিয়ে পড়েছে তখন হয়তো হাতিটাকে অন্যদিকে তাড়িয়ে দেবে। ভগবানের কাছে মনে মনে তিনি প্রার্থনা করতে লাগলেন,যেন তাড়া খাওয়া হাতির মুখে না পড়ে ছেলে দুটো!

ওরা দু-জন বেশ নিশ্চিন্তমনেই ধানখেতের আলের ওপর দিয়ে হাঁটছিল। জগো ওকে নিয়ে চলেছে একটা পুরোনো মন্দির দেখাবে বলে। এখন আর তেমন লোকজন নেই, ধানগাছগুলো বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে, আর কিছুদিন পরেই ধান পাকবে আর তখন শুরু হবে ধান কাটার পালা, লোকজনে ভরে যাবে খেতগুলো।

দূর থেকে একটা শব্দ ভেসে আসছিল, ওরা তেমন কান দেয়নি সেই শব্দে। কথা বলতে বলতে বেশ অনেকটা চলে এসেছে। হঠাৎ থমকে দাঁড়াল জগো। শব্দটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনেক লোকের হইহই আর সেইসঙ্গে টিন, ক্যানেস্তারা পেটানোর শব্দ। এদিকপানেই যেন আসছে।

জগো দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে সুজনও দাঁড়িয়ে পড়েছিল। জগোর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল ওর চোখ দুটো ছোটো ছোটো হয়ে গেছে, কুঁচকে গেছে ভুরু। যেন গভীরভাবে কিছু একটা ভাবছে।

‘কী হল?’ জিজ্ঞেস করল সুজন।

‘ইটা ভালো লাগছে না বটে’, জগো বিড় বিড় করে বলে উঠল, ‘টিন পিটাইছে, চেঁচাইতেছে, গতিক ভালো লয় মনে লিচ্ছে।’

‘কেন?’ সুজন বুঝতে পারে না কিছু।

‘হল্লা হইছে, টিন পিটাইছে, মনে লিচ্ছে পাগলা হাতি!’

‘পাগলা হাতি!’ সঙ্গেসঙ্গে সুজনের মনে পড়ে গেল এখানে আসার সময় রিকশায় বাবা বুনো হাতির কথা বলেছিলেন। সঙ্গেসঙ্গে ওর সমস্ত শরীরে যেন একটা শিহরন বয়ে গেল। হাতিটা এদিকেই আসছে না তো? সামনে পড়লে আর রক্ষে নেই!

ভাবতে কতটুকু সময়! হঠাৎ সামনে কিছুটা দূরে, দু-পাশে ধান ক্ষেতের মাঝখানে সামান্য যে ফাঁক থাকে সেই আলের পথে হাতিটাকে দেখতে পেল ওরা। ওটার শুঁড় ওপর দিকে গোটানো, কুলোর মতো বড়ো বড়ো কান দুটো ঘন ঘন নড়ছে, আর ওদের দিকেই ওটা এগিয়ে আসছে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো। হাতি নাকি ভীষণ জোরে ছুটতে পারে। ওটা সত্যিই জোরে ছুটছে, মনে হচ্ছে যেন লাফিয়ে লাফিয়ে আসছে। বিরাট হাতি, ওর গায়ের ধাক্কায় দু-পাশের ধানগাছগুলো ভেঙে পড়ছে, কত ধান গাছ যে পায়ের চাপে মাটিতে মিশে যাচ্ছে তার হিসেব নেই।

সুজন স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, ওর হাত-পা অসাড় হয়ে গেছে, বোধশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে ও। হাতিটা কাছে এসে পড়েছে, আর কিছুক্ষণ, তারপরই ওদের পিষে ফেলে চলে যাবে হাতিটা।

হঠাৎ চাবুক খাওয়ার মতো চমকে উঠল সুজন। জগো এক ধাক্কায় ওকে ডান পাশের খেতটায় ঠেলে দিয়ে বলল, ‘তু ভিতরে লুকাই পড়, আমি উটাকে উদিকে লিয়ে যেছি।’

সুজন ছুটল, কিন্তু একটু যেতে না যেতেই একটা ধান গাছের গোড়ায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। পেছন ফিরে তাকাল ও। জগো কী করছে!

জগোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ও। লাফাচ্ছে, হাততালি দিচ্ছে আর মুখ দিয়ে শব্দ করছে, ‘অ…অ…অ’। কী ভীষণ সাহস ওর!

ওই অবস্থাতেও উপলব্ধি করল সুজন। ওকে বাঁচাবার জন্য জগো নিজে হাতির সামনে দাঁড়িয়েছে একথা ভাবতেই কেমন যেন একটা লজ্জা আর অপরাধবোধ ওকে যেন পঙ্গু করে ফেলল। মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে ও দেখতে লাগল জগোর কাণ্ড!

হাতিটা প্রায় যখন দশ পনেরো হাত দূরে, জগো দৌড়ে বাঁ-পাশের খেতটায় ঢুকে পড়ল। প্রায় পরমুহূর্তে হাতিটা এসে পড়ল ওখানে। বিরাট দেহটাকে ঘুরিয়ে জগো যেদিকে গেছে সেদিকে ফিরতে একটু সময় লাগল ওটার। ওটুকু সময়ই জগোর কাছে যথেষ্ট। চাবুকের মতো ওর শরীর। ধান খেতের মাটি মেখেই বড়ো হচ্ছে ও। ও জানে হাতি সোজা ছুটতে ওস্তাদ। কিন্তু এদিক-ওদিক ফিরতে হলেই একটু বেকায়দায় পড়তে হয় তাকে।

তিরবেগে ছুটে চলল জগো, এঁকেবেঁকে, বারে বারে মোড় ঘুরে দিশেহারা করে ফেলল গুন্ডা হাতিটাকে।

তারপর একসময় পাশে ধপ করে কে যেন বসে পড়তেই প্রায় লাফিয়ে উঠল সুজন। মুক্তোর মতো দাঁত বার করে হাসছে জগো। হাঁপাচ্ছে ভীষণ।

‘খেদাই দিলম’, হাঁপাতে হাঁপাতে ও বলল, ‘উদিকে লিয়ে গিয়ে আমি চরকির মতো ঘুর‌্যা এলম, উটা উদিকে চল্যা গেছে, খুব ঠকালম উটাকে’, হি হি করে হাসে জগো।

সুজন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। নিজের জীবন বিপন্ন করে এই জংলি ছেলেটা তাকে বাঁচিয়েছে, কিন্তু এতটুকু তার জন্য অহংকার নেই, যেন সাধারণ একটা ঘটনা ঘটেছে।

টিন, ক্যানেস্তারা পেটাতে পেটাতে লোকজন পৌঁছে গেল ওখানে। জগোর মুখে হাতিটা কোন দিকে গেছে শুনে আবার হইহই করতে করতে ছুটে গেল তারা।

ধান খেতের জল-কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছিল সুজনের জামা প্যান্ট, মুখেও কাদা লেগেছিল। জগো হঠাৎ ওর মুখের দিকে আঙুল দেখিয়ে হাসতে লাগল, হি-হি-হি। হাসি যেন আর থামে না। সুজনও এবার হাসল, ওর মনে যে দারুণ একটা চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, হালকা মেঘের মতো উড়ে গেল সেটা। হাত ধরাধরি করে ধান খেতের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল ওরা।

জ্যাঠামণি গেটের কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে দৌড়ল সুজন। কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘জানো জ্যাঠামণি, একটা পাগলা হাতি তেড়ে এসেছিল আমাদের, মস্ত বড়ো হাতি! লাফাতে লাফাতে আসছিল। জগো কি করল জানো! আমাকে ধান ক্ষেতের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে হাতিটার সামনে দাঁড়াল, তারপর অন্য দিকে নিয়ে গেল ওটাকে। আমাকে ও বাঁচিয়েছে।’

সুজন অবাক হয়ে দেখল জ্যাঠামণি কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর দু-চোখের কোল বেয়ে জল পড়ছে। ও কেমন যেন থতমত খেল।

জগোও ততক্ষণে এসে পড়েছে।

‘যাও তুমি জামা প্যান্ট ছেড়ে পরিষ্কার হয়ে এসো, তারপর সব শুনব। জগোকেও নিয়ে যাও’, আস্তে আস্তে বললেন জ্যাঠামণি।

মিনিট পনেরো বাদে বারান্দায় বসে সুজনের মুখে সব শুনলেন জ্যাঠামণি। ওর কথা শেষ হলে তিনি বললেন, ‘সত্যিই জগো আজ তোমার প্রাণ বাঁচিয়েছে। ও না থেকে অন্য কেউ তোমার সঙ্গে থাকলে কি হত জানি না। ভগবান রক্ষা করেছেন— তোমাকে, আমাকেও।’ তারপর জগোর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জগো।’

‘আইজ্ঞা।’

‘তু একটা মানুষ আছিস বটে, তুর মতো মরদ দিখা যায় না রে’, ওদের মতো ভাষার অনুকরণ করে জ্যাঠামণি বললেন, মুখে তাঁর সস্নেহ হাসি।

জগো একটু হাসল, মাথা চুলকাল। একটু যেন অপ্রস্তুত অপ্রস্তুত ভাব।

‘কী লিবি বল, কী ইচ্ছা তুর মনে’, জ্যাঠামণি আবার বললেন।

‘লিব কেনে?’ এবার যেন জগো একটু অবাক হল। ও যা করেছে তার জন্য কোনো পুরস্কার দাবি করা যায় তার মাথায় আসেইনি ওর।

জ্যাঠামণি তাকালেন সুজনের দিকে। তাঁর চোখ দুটো যেন বলে দিল, ‘দেখলে, কিছুই চায় না ছেলেটা!’

মুখে তিনি বললেন, ‘তোমার নতুন একটা জামা আর প্যান্ট ওকে দাও।’

সুজন ছুটে সবচেয়ে ভালো জামাটা আর প্যান্টটা নিয়ে এল। জগোর হাতে দিতেই ও ভ্যাবাচ্যাকার মতো তাকাল সুজনের মুখের দিকে।

‘তোকে দিলাম’, সুজন বলল, ‘পরবি তুই।’

‘এগুন!’ অস্পষ্ট কণ্ঠে বলল জগো।

‘হ্যাঁ, কাল সকালে পরে আসবি, তোর সঙ্গে বেড়াতে যাব।’

আস্তে আস্তে হাসি ছড়িয়ে পড়ল জগোর সারা মুখে, একটা নির্মল সুন্দর হাসি।

‘জগোর সম্মানে আজ ভোজ দেব আমরা’, জ্যাঠামণি সুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কি বল?’

‘হ্যাঁ, সে-ই ভালো’, উৎসাহিত হয়ে উঠল সুজন। ও তাকাল জগোর মুখের দিকে। জগো ঠিক বুঝল না ওদের কথাবার্তা, কিন্তু ওকে নিয়েই যে কিছু বলা হচ্ছে তা বুঝে হাসল।

সূত্রাকে ডাকলেন জ্যাঠামণি, বললেন, ‘যা, ছুটে যা, চারটে বড়ো বড়ো মুরগি কিনে নিয়ে আয়।’ ওর হাতে টাকা দিলেন তিনি।

ড্রাইভারবাবুকে গাড়ি বার করতে বললেন। তিনি আজ নিজে বাজারে যাবেন, ভালো মাছ আনবেন, আর আনবেন মিষ্টি। রজনীকে বললেন পোলাও হবে আজ।

জগো তখনও কিছু বুঝতে পারেনি। সুজন বলল, আজ তার নেমন্তন্ন— এখানে খাবে সে। আহ্লাদে আটখানা হয়ে উঠল জগো, ঝলমল করে উঠল ওর মুখ। কী অল্পতেই সন্তুষ্ট ওরা, ভাবল সুজন।

গুরু, ঠাকুর ওরাও এসে পড়েছে খবর পেয়ে। সুজনের দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি হাসল ওরা, যেন সুজন সুস্থ দেহে ফিরেছে বলে খুব খুশি।

‘তুর লেগ্যা খু-উ-ব ডর ধরল আমাদের’, গুরু বলল, ‘ছুট্যা এলম বাবুর কাছে।’

সুজন ওদের কাছে আবার সব বলল। জগোর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ‘জানিস ও না থাকলে হাতিটা আমাকে মেরেই ফেলত।’

‘উ তুরে লিয়ে গেল, উর ধম্ম তুকে বাঁচানো, নিজের পেরান দিয়ে’, ঠাকুর একটু ভুরু কুঁচকে বলল। জগো যা করেছে তা যেন ওর কর্তব্য, না করলেই বরং অন্যায় হত ওর।

‘খুকাবাবুর জামা লিছিস, প্যান্ট লিছিস’ খাঁদি এবার বলল, ‘ক্যান জগো?’

‘আমি ওকে দিয়েছি’, সুজন তাড়াতাড়ি বলল।

‘ওঃ!’ খাঁদি ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে উঠল, ‘উ পরবে ওগুনা! বাবুদের ছেইলা হবে!’

জগোর মুখ যেন শুকিয়ে গেল একটু।

‘এই তোরা আজ খাবি এখানে’, কথার মোড়টা অন্য দিকে নিয়ে যাবার জন্য বলল সুজন। ‘সূত্রা মুরগি আনতে গেছে, বাবু বাজারে গেছেন গাড়ি নিয়ে, মাছ আনবেন, মিষ্টি আনবেন, ভোজ হবে আজ।’ সঙ্গেসঙ্গে ঝলমল করে উঠল ওরা।

‘জয় হোক খুকাবাবুর, রাজা হ তু’, বলে উঠল ওরা।

১৫

কালীপুজোর ঠিক দু-দিন আগে সুজনের বাবা ওকে নিয়ে যেতে এলেন। ওর চেহারা বেশ ভালো হয়েছে, একটা চিকন ভাব দেখা দিয়েছে, এটা লক্ষ করে খুব খুশি হলেন তিনি।

‘সুজনের খুব ভালো লেগে গেছে এ জায়গাটা’, জ্যাঠামণি ওর বাবাকে বললেন। সুজনের ওপর তাঁর মায়া পড়ে গেছে, বুকের ভেতর একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করছিলেন তিনি।

‘ডিসেম্বরে পরীক্ষা হয়ে গেলে ওকে আবার পাঠিয়ে দিস’, সুজনের বাবাকে তিনি বললেন, ‘শীতকালে শরীর আরও ভালো হবে।’

বাবার কাছে সুজন মুরগি চুরি, জ্যাঠামণির সঙ্গে লোধাপাড়ায় যাওয়া, হাতির তাড়া করা, সব ঘটনাই বলল। সব শুনে ওর বাবার তো চোখ কপালে ওঠার জোগাড়।

তাঁর মনের ভাব বুঝতে পেরে জ্যাঠামণি বললেন, ‘হ্যাঁ পাগলা হাতিটা যেদিন বেরিয়েছিল সেদিন ওর মস্ত একটা ফাঁড়া গেছে, কিন্তু ওর পক্ষেও সারাজীবনের মতো একটা দারুণ অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে ব্যাপারটা। ওর মন শক্ত হয়েছে। সাহাস বেড়েছে, সেটাও কম কথা নয়। তা ছাড়া কলকাতায় কি দুর্ঘটনা হয় না!’

যাবার দিন সকালে গুরু, ঠাকুর ওরা সব এসে দাঁড়াল বারান্দার সামনে।

‘আবার আসিস, খুকাবাবু’, গুরু বলল, ‘তু চল্যা যেছিস, মনটা দুখাইছে বড়ো।’

‘তোমাকে ওদের খুব ভালো লেগেছে’, জ্যাঠামণি বললেন, ‘মানুষের ভালোবাসার দাম অনেক।’

‘হ তু আসবি আবার’, ঠাকুর বলল, ‘তুকে লতুন লতুন লাচ শিখাই দিব।’

‘নাচ!’ সুজনের বাবা এবার অবাক হলেন।

‘হ, তুর ছেইলা আমাদের সঙ্গে লাচ করল, কেমন সোন্দর লাচল খুকাবাবু’, খাঁদি বলল এবার।

সুজনের বাবা অবাক হলেন। কলকাতায় যে ছেলে বাড়ি থেকে বেরোয় না, মুখচোরা— সে সাঁওতাল মেয়েদের সঙ্গে নেচেছে, একথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। শামুকের খোল থেকে বেরিয়ে এসেছে ছেলে, একথা ভেবে মনে মনে খুশিই হলেন তিনি।

ওদের যাবার সময় হল। জ্যাঠামণিকে প্রণাম করল সুজন; তিনি ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, বললেন, ‘আবার এসো।’

ছলছল করে উঠল সুজনের চোখ, সত্যিই মায়া পড়ে গেছে এখানকার ওপর, এখানকার মানুষের ওপর, গাছপালার ওপর, ধানখেতের ওপর— সব কিছুর ওপর।

সবার সঙ্গে দেখা হল শুধু জগো ছাড়া। ওকে সুজন বলেছিল, আজ চলে যাবে, তবু ও এল না! একটা অভিমানে গলা বুজে এল সুজনের।

জিপ গাড়িতে সুজন উঠতে যাচ্ছে এমন সময়— ‘খু…কা…বা…বু…, খু…কা…বা…বু…’, একটা চিৎকারে ফিরে তাকাল সুজন। জগো আসছে, প্রাণপণে দৌড়ুচ্ছে ও। যাক শেষপর্যন্ত ও এল!

জগো এসে পড়ল। ও হাঁপাচ্ছে ভীষণ।

‘তুকে একটা পাখি দিব বলেছিলম। ধর‌্যা ছিলম একটা, খুব সোন্দর পাখি, নীলকণ্ঠ বলে উটাকে। তা উটা পালাই গেল’, খুব যেন অপরাধ করে ফেলেছে এমনভাবে কথাগুলো বলল জগো। ‘তুর জন্য একটা পালক আনলম, লিবি তু?’

ডান হাতটা ও বাড়িয়ে দিল, হাতে রয়েছে গাঢ় নীল রঙের একটা পালক, আর দু-চোখে রয়েছে একটা গভীর প্রত্যাশা।

সুজন হাত বাড়িয়ে পালকটা নিল। জগোর মুখ ভরে গেল খুশির হাসিতে, সুজনও হাসল। এই মুক্ত পরিবেশ থেকে একটা পাখিকে খাঁচাবন্দি করে নিয়ে গেলে ওর হয়তো পরে খারাপই লাগত। এই ভালো হয়েছে। নীল রঙের সুন্দর পালকটাই এখানকার উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকবে। মনে করিয়ে দেবে সবার কথা, সাহসী ছেলে জগোর কথা। ওর সরল মনের ভালোবাসার দান এই পালকটা, যত্ন করে রেখে দেবে সুজন।

গাড়ি ছেড়ে দিল। যতক্ষণ না বাঁকের মুখে মিলিয়ে গেল ওদের গাড়ি, জগো হাত নাড়তে লাগল। সুজনও হাত নাড়ছে, কিন্তু ওর চোখে জল আসছে কেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *