তামাহাটের কড়চা – বুদ্ধদেব গুহ
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা, জানুয়ারি ২০২০
সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
ও
সৌম্যকান্তি দত্ত—কে
.
তামাহাট— অনেকে বলতেন তামারহাট। নামনী অসমের একটি অখ্যাত জায়গা। পাশ দিয়ে গঙ্গাধর নদী বয়ে গেছে। কোথা থেকে এসেছিল সে নদী আমার জানা ছিল না। কেউ কেউ বলতেন তিস্তা থেকে এসেছিল। তিস্তা তো নাব্য নয়। তাই তিস্তা দিয়ে নৌকো চলাচল ছিল না। তবে গঙ্গাধরের অন্য মুখ এসেছিল ধুবুড়ি শহরের কাছে। সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদে এসে পড়েছিল—ঠিক জানা নেই।
দেশভাগের আগে ওই নদী দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিরাট বিরাট মহাজনি নৌকো করে পাট আসত পুববাংলা থেকে এবং এই গঙ্গাধর নদীর তীর বরাবর অনেকগুলি জনপদ ছিল। সেইসব জনপদে ছিল পাটের ব্যবসাদারদের বাস। দেশভাগের আগে থেকেই বহু মাড়োয়ারি ব্যবসাদার যারা অনর্গল বাংলা বলতে পারতেন এবং কিছু বাঙালি ব্যবসাদারও সেইসব জায়গায় থিতু হয়েছিলেন। পাট কেনাবেচা তো হতই এমনকী ফরওয়ার্ড ট্রেনিং—ও হত। যেমন শেয়ার বাজারে হয়। সে ছিল একধরনের জুয়া খেলা।
তামাহাট আসতে হত নামনী অসমের ধুবুড়ি শহর হয়ে। ধুবুড়িতে মস্ত বড় স্টিমারঘাট ছিল ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে এবং এখানেই ছিল সেই বিখ্যাত নেতি ধোপানির ঘাট। ধুবুড়ি শহর থেকে ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে যাওয়া যেত ফুলবাড়ি বন্দরে। সে বন্দর থেকে বাঁদিকে রাস্তা চলে গেছিল গুয়াহাটি আর সে রাস্তার ডানদিকে চলে গেছিল গারো পাহাড়ের রাজধানী তুরার দিকে। এই গারো পাহাড় ছিল হাতি এবং বাঁশের জঙ্গলের জন্য বিখ্যাত। ভারতের সংসদের এককালীন স্পিকার পূর্ণ সাংমা ছিলেন তুরার মানুষ। উনি শুধু ভাল বাংলা বলতে পারতেন তাই নয়, বাংলা সাহিত্যেরও অনুরাগী ছিলেন। একসময়ে তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয় এবং পরবর্তীকালে দিল্লিতে, বম্বেতে লোকমুখে শুনেছি তিনি নাকি পূর্ণ সাংমারই ছেলে। আমার ঠিক জানা নেই। খাসি, জয়ন্তী এবং গারো পাহাড় সবই মেঘালয়ের অন্তর্গত। সেইসূত্রেই মেঘালয়ের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী সাংমা নির্বাচিত।
এই সমস্ত জায়গাতে একাধিকবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল কিন্তু ধুবুড়িতে আমি কখনও ট্রেনে যাইনি। ধুবুড়ি শহরের কাছেই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় আমেরিকানদের বানানো একটি এয়ার স্ট্রিপ ছিল, যার নাম ছিল— ‘রূপসী’। রূপসী ছিল কয়েক বর্গমাইল বিস্তৃত ল্যানটানা ঝোপের মধ্যে, ল্যানটানা ভারতের প্রায় সর্বত্রই বনে জঙ্গলে দেখা যায় এবং সেই ঝোপে খরগোশ, শেয়াল এবং চিতাবাঘের দৌরাত্ম্যও দেখা যায়। যুদ্ধের পরে এক ভদ্রলোক, সে আমেরিকান কি ব্রিটিশ আমি বলতে পারব না, জ্যামেয়ার এয়ার বলে একটি প্রাইভেট এয়ার ওয়েজের পত্তন করেন, যুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকানদের কয়েকটি ডাকোটা প্লেন নিয়ে। সেই প্লেনগুলি ছিল ফ্রেটার। সেসব প্লেনে করে মুখ্যত নানা পণ্যই বাহিত হত উত্তরবঙ্গের নানান চা—বাগান আর অসমের নানান চা—বাগানে। গারো পাহাড়ের ময়না পাখি এবং ওইসব অঞ্চলে উৎপাদিত জিসিপত্র বাণ্ডিল করে তার সামনে মোটা কাছি বেঁধে দেওয়া হত। সামান্য ক’জন যাত্রীর জন্য জায়গা থাকত। যাত্রীদের মধ্যে অধিকাংশই থাকতেন স্থূলকায়া মাড়োয়ারি মহিলারা এবং কিছু ক্ষীণকায় বাঙালি এবং অন্য জাতির যাত্রীরা। সেই নন এয়ার কন্ডিশনড, নন প্রেসারাইজড ছোট প্লেনে ওড়বার পরেই তামাক পাতার তীব্র গন্ধ এবং খাঁচাবন্দি শয়ে শয়ে ময়না পাখিদের চিৎকারে যাত্রীদের অবস্থা সঙ্গিন হত এবং তাঁদের মধ্যে অনেকেই বমি করতেন। সেই বমির দুর্গন্ধ তামাক পাতার গন্ধের সঙ্গে মিলে গিয়ে বিশেষ করে গরমের দিনে যাত্রীদের প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠত। জ্যামেয়ার কোম্পানির এই প্লেনেই আমি কলকাতা থেকে রূপসী যেতাম এবং সেখান থেকে কোম্পানির বাহনে করে ধুবুড়িতে গিয়ে উপস্থিত হতাম। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ধুবুড়ি ছিল অতি চমৎকার ছিমছাম একটি শহর। যেখানে ব্রহ্মপুত্রের বিখ্যাত চিতল মাছ এবং নদীতীরে অবস্থিত ম্যাচ ফ্যাক্টরি, দেশলাই প্রস্তুতকারক ‘উইমকো’ কোম্পানির কারখানা। পূর্ববঙ্গের ঢাকা, গোয়ালন্দ ইত্যাদি থেকে প্যাডল স্টিমার করে যাত্রী ও পণ্য আসত ধুবুড়িতে এবং ধুবুড়ি থেকে সেসব জায়গায় আবার চলে যেত। ধুবুড়ি শহর থেকে একটি রাস্তা চলে গিয়েছিল গৌরীপুর নামে একটি শহরে। ছবির মতো ছোট একটি শহর। যেখানে বাড়ি ছিল কলকাতা নিউ থিয়েটার্স কোম্পানির নানা ফিল্মের পরিচালক অসমবাসী প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়ার। তাঁর কনিষ্ঠতম ভ্রাতার নাম ছিল প্রকৃতিশচন্দ্র বড়ুয়া, যিনি লালজি বা রাজা নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। লালজি ছিলেন পৃথিবীর মধ্যে একজন বিখ্যাত হাতি বিশেষজ্ঞ। শোনপুরের হাটে যেখানে সবরকম গবাদি পশু এবং হাতির বাৎসরিক বিকিকিনি হয়। কথিত আছে, সেখানে লালজিকে না দেখিয়ে কোনও সার্কাস কোম্পানি বা রাজা মহারাজা হাতি কিনতেন না। হাতির পায়ের নখ, কান, দাঁত; এইসব দেখে এক হাতির অথবা গণেশের গুণাগুণ বিচার করে লালজি সে হাতি সুলক্ষণযুক্ত কি না বলে দিতে পারতেন। লালজি কিন্তু হাতি শিকার করতেন না। প্রতিবছর খেদা করে অথবা অন্যভাবে হাতি ধরে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তিনি বিভিন্ন ক্রেতাদের বিক্রি করতেন। শেষজীবনে লালজি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের উপদেষ্টা ছিলেন। এবং যেখানে যেখানে হাতির অত্যাচার হত সেখানে তাঁর দুটি হাতি নিয়ে তিনি উপস্থিত হতেন এবং তাদের তাড়িয়ে জঙ্গলে পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করতেন। সেই কাজে সহায়তা করতেন তাঁর কন্যা পার্বতী বড়ুয়া। লালজির অবর্তমানে পার্বতী একাই সে কাজে লিপ্ত থাকতেন এবং তিনি উত্তরবঙ্গের জলদাপাড়ার কাছে একটি ছোট্ট বাড়ি করে থিতু হয়েছেন।
এই গৌরীপুরে বড়ুয়াদের রাজবাড়িটির নাম ছিল মাটিয়াবাগ প্যালেস। সেটি ছিল একটি দোতলা বাড়ি। একটি টিলার উপর অবস্থিত সেই বাড়িটির উঠোনেই কবরস্থ হয়েছিল প্রমথেশ বড়ুয়া পরিচালিত এবং কানন দেবী ও অমর মল্লিক ইত্যাদি নানা বিখ্যাত বাঙালি অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনীত ‘মুক্তি’ ছবিতে ব্যবহৃত অতিকায় হাতিটি, যার নাম ছিল প্রতাপ সিং। সেই ছবিতে পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া— ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি সংযোজিত ছিল। ওঁদের পরিবারের রাজকুমারী ছিলেন প্রতিমা বড়ুয়া, যিনি অসমের হস্তীকন্যার গান গেয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। তবে লালজিদের পরিবারের সকলেই ভাল শিকারি ছিলেন এবং বোনদের মধ্যে যিনি বড়, সেই বড় রাজকুমারী চোদ্দো বছর বয়সে বাঘ শিকার করেছিলেন।
এই গৌরীপুর থেকে কাঁচা রাস্তা চলে গেছিল কুমারগঞ্জ হয়ে তামাহাটের দিকে এবং তামাহাট ছাড়িয়ে ডিঙডিঙা চা—বাগান পেরিয়ে চলে গেছিল বরবাধা জঙ্গলের দিকে এবং পথটি সেখানে একটি সমকৌণিক বাঁক নিয়ে ডানদিকে যেখানে ঘুরে গেছিল সেই ফরেস্ট রেঞ্জের নাম ছিল ‘গুমা রেঞ্জ’। সেই পথ দিয়েই যেতে হত অসমের বিখ্যাত আর ভয়াবহ যমদুয়ারের দিকে। যমদুয়ার নামটির মধ্যেই সেই বনের ভয়াবহতার হদিশ আছে।
যে পথটির কথা বললাম, সেই পথের ধুলোর একটি বিশেষ গুণ ছিল। আমি বলছি চল্লিশের দশক আর পঞ্চাশের দশকের গোড়ার কথা। সেই ধুলো ছিল পাউডারের মতন মসৃণ এবং ধবধবে সাদা।
কুমারগঞ্জের সামনেই ছিল একটি জঙ্গলাবৃত্ত ছোট পাহাড়। যার নাম ছিল লালমাটি। আমরা তামাহাট থেকে সাইকেল করে কুমারগঞ্জ এসে ধানখেতের পাশে ল্যানটানার ঝোপে সাইকেল লুকিয়ে রেখে সেখান থেকে পায়ে হেঁটে লালমাটি পাহাড়ে যেতাম। সেখানে ছিল টুঙ বাগান। শুনতাম সেই টুঙ ফল দিয়ে এয়ারক্র্যাফটের গায়ের উজ্জ্বল রুপোলি রং তৈরি হত। সেই বাগান দেখাশুনো করার জন্য যে দুজন চৌকিদার ছিল, তাদের থাকার জন্য একটা ছোট্ট কুঁড়েঘর ছিল। এছাড়া টুঙ বাগানের মধ্যে কোনও জনবসতি ছিল না।
লালমাটি পাহাড় পেরিয়ে আলোকঝারি পাহাড়ের দিকে একটা রাস্তা চলে গেছিল পর্বতজোয়ার পাহাড়ের দিকে। সেই পাহাড়ে অসমের আদিবাসী সম্প্রদায় মেচ উপজাতিদের বাস ছিল। পুরো বসতি নয়, কয়েকঘর মেচ সেখানে থাকতেন। আলোকঝারি আর পর্বতজোয়ারের মধ্যে একটা ছোট্ট মালভূমি ছিল। তাতে প্রতিবছর ৭ই বৈশাখ একটি মেলা বসত। সেখানে ঠাকুরানির ঠাঁই ছিল। সেখানে মুরগি, পায়রা ইত্যাদি বলি দিয়ে স্থানীয় মানুষ পুজো দিত। বৈশাখ মাসের পত্রহীন গাছে লাল, কালো, সাদা, সোনালি বনমুরগিরা ফুলের মতো ফুটে থাকত।
বহু দূর—দূরান্ত থেকে ছইওয়ালা মোষের গাড়ি, গরুর গাড়ি করে নারী—পুরুষরা আসতেন সেই মেলায়। পেছন পেছন লেজ নাড়িয়ে আসত লাল—কালো কুকুর। বনের মধ্যে থেকে ‘ক্যেঁয়া ক্যেঁয়া রবে ময়ূর ডেকে উঠত। ডাকত আরও নানান রকমের পাখি। তারপরে খিচুড়ি ভোগ খেয়ে বেলাবেলি গরু ও মোষের গাড়িগুলি একে একে লালমাটির পাহাড় ছেড়ে নেমে যেত যার যার গন্তব্যের দিকে। আবার বনস্থলী নির্জন হয়ে যেত। শুধু ময়ূরের কেকা ধ্বনি শোনা যেত এবং চাঁদ উঠলে ‘পিউ কাঁহা, পিউ কাঁহা’ করে ব্রেন ফিভার পাখিরা পাগলের মতো ডেকে ফিরত।
.
বেলীর বয়স তখন ছিল পনেরো—ষোলো। সে আমার পিসেমশাইয়ের এক দাদার নাতনি ছিল। তার বাবা ছিলেন অত্যন্ত দীর্ঘাঙ্গ ছিপছিপে পুরুষ। তার গায়ের রং ছিল কালো। মা ছিলেন পরমা সুন্দরী, দীর্ঘাঙ্গী এবং গৌরবর্ণা। বেলী তখন কোচবিহারে হস্টেলে থেকে স্কুলে পড়ত। গরমের আর পুজোর ছুটিতে সে আসত তামাহাটে। সেখানেই আমার সঙ্গে ওর প্রথম দেখা। অত্যন্ত সপ্রতিভ মেয়ে ছিল সে এবং কোচবিহারে শান্তিনিকেতনের এক প্রাক্তনীর কাছে সে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখত। গলাটা ছিল খুব মিষ্টি এবং গলার ভাবও ছিল খুব। রবীন্দ্রনাথের গান অনেকেই গান কিন্তু গানের মানে বুঝে প্রতিটি শব্দকে যথার্থ মর্যাদা দিয়ে গান গাইতে কম মানুষকেই দেখেছি। আর ওর ছুটির সময়েই তামাহাটে যেতাম এবং বেলীর সঙ্গে আমার এক ভারি সুন্দর সখ্য গড়ে উঠেছিল। তামাহাটের উদাত্ত প্রকৃতি, নদী, উন্মুক্ত প্রান্তর, গাছগাছালি ইত্যাদির মধ্যে আমরা দুজনে ঘুরে বেড়াতাম। প্রেম যাকে বলে তা তখনও হয়নি তার সঙ্গে আমার। কিন্তু প্রেমের উন্মেষের আগে যে এক মধুর অশরীরী সম্পর্ক ছেলেমেয়েদের মধ্যে গড়ে ওঠে, তাই উঠেছিল আমাদের মধ্যে।
আমার পিসেমশাই পাটের ব্যবসায়ী ছিলেন এবং অনেকখানি জায়গা নিয়ে তার বাড়ি ছিল। তখনকার দিনে পাটের ব্যবসায়ীদের সকলেরই বাড়ির বাইরের ঘরটির নাম ছিল গদিঘর। মস্ত বড় ঘরের একপাশটায় বিরাট চৌকির ওপর খুব মোটা গদি পাতা থাকত এবং তার ওপর থাকত দুগ্ধফেননিভ সাদা চাদর। সেটিই ছিল গদি। তার একপাশে থাকত মস্ত বড় লোহার সিন্দুক, তার মধ্যে থাকত নানান কাগজপত্র, টাকাপয়সা, দলিল দস্তাবেজ। এই গদির ওপরেই অনেকসময় অতিথি অভ্যাগতরা রাত কাটাতেন। গদিঘরের লাগোয়া থাকত পাটের গুদাম। সেখানেই নদীরঘাট থেকে মোষের গাড়ি করে মিষ্টি গন্ধের পাট এসে ঢুকত সেইসব গুদামে। খুব উঁচু ছিল সেইসব পাটগুদাম। তা সিল্কের মতো এবং মুখ্যত দু’রকমের। মেমসাহেবদের যেমন দুই রকম চুল হয় ব্লন্ড এবং ব্রুনেট। ব্লন্ড হত সোনালি আর ব্রুনেট হত রুপোলি। এইসব পাটের মধ্যেও দুরকমের রূপ দেখা যেত এবং যতদিন পাট বিক্রি না হয় এবং না চলে যায়, ততদিন পুরো এলাকাটি সুগন্ধে ম—ম করত। সেই গুদাম সংলগ্ন প্রান্তরে নানা রকমের ঝোপঝাড় ছিল। তারমধ্যে রঙ্গন, কাঞ্চন, কামিনী ইত্যাদি ঝোপ ছিল এবং তাতে সারাদিন বুলবুলি আর সুনটুনি মুনটুনি ছোট ছোট বিচিত্র রকমের মৌটুস্কি পাখিরা ঘুরে ঘুরে উড়ে উড়ে বসত। তাদের মিষ্টি গলার স্বরে সেই প্রান্তর মুখরিত হয়ে থাকত। সেই প্রান্তর পেরিয়ে অন্দরমহলে পৌঁছতে হত। সেইখানে গৃহস্বামীর পরিবারের থাকার জন্য ঘর, রান্নাঘর, চানঘর ইত্যাদি থাকত। চতুর্দিক ঘিরে থাকত নানান গাছগাছালি। অধিকাংশই ফুল আর ফলের গাছ। কত পাখিই যে আসত সেসব গাছে তা শহুরে আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতাম। অনেকসময় ওই গুদাম সংলগ্ন প্রান্তরের মধ্যে ইজিচেয়ারে বসে বই কোলে নিয়ে সারা দুপুর কাটিয়ে দিতাম। পাখির কূজনে কান ভরে যেত আর মনে হত আমি যেন এক ঘোরের মধ্যে আছি।
তামাহাটের হাট সপ্তাহে একদিন বসত। সে এক গন্ধ ও রঙের তুমুল ঘনঘটা। নানা জায়গা থেকে মোষের গাড়ি, বয়েল গাড়ি নানা পণ্য নিয়ে হাটে আসত। আর আসত গ্রামীণ মেয়েপুরুষরা। সর্ষের খোলের গন্ধ, কেরোসিন তেলের গন্ধ, ছাগল, পাঁঠা, মুরগি, হাঁসের গায়ের গন্ধ এবং গ্রামীণ মানুষদের ঘামের গন্ধে হাট এবং হাটের পরিবেশ এক মিশ্র গন্ধের আতরদানি হয়ে উঠত। ভিতরের দিকে ছিল মিষ্টির দোকান, পেঁয়াজি আর ফুলুরির দোকান এবং আরও নানান দোকান। হাটে আসতেন কিছু অহমিয়া মানুষ, কিছু আদিবাসী, কিছু মুসলমান ও হিন্দু চাষি। অদূরের বাগডোরা গ্রাম থেকে সাদা টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে মাথায় ফেজ টুপি চড়িয়ে আসতেন জোতদার মুনশের মিঞা। তিনি এসে তাদের গ্রামে চিতাবাঘের দৌরাত্ম্যের কথা বর্ণনা করতেন। আমি একাগ্র হয়ে তার কাছে বসে সেসব কথা শুনতাম এবং চিতাবাঘ মারার বাসনা প্রকাশ করতাম।
তখন আমার বন্দুকের লাইসেন্স ছিল না কারণ আঠারো বছর বয়স হয়নি। পিসেমশাইয়ের এক দাদা থাকতেন ধুবুড়ি শহরে, তার নাম ছিল পূর্ণচন্দ্র মিত্র। পিসেমশাইয়ের অনুরোধে তাঁর দো’নলা বন্দুক আমাকে ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। বাবা কলকাতা থেকে কাঠের বাক্স করে বারো বোর বন্দুকের নানা রঙা গুলি ডাকে পাঠিয়ে দিতেন আমাকে। ধুবুড়ির সেই বন্দুক আর কলকাতার গুলি নিয়ে আমার নানা অ্যাডভেঞ্চার চলত তামাহাটের চারপাশে। গঙ্গাধর নদীতে নৌকো করে সারাদিন ঘুরে ঘুরে নানা পাখি, উদবেড়াল শিকার করে বেড়াতাম। তখনও শিকারের ন্যায় অন্যায় এবং আইনকানুন সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম এবং তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। আইন কানুন থাকলেও তা আইনের বইতেই সীমাবদ্ধ ছিল। আইন মান্য করার মতো ব্যবস্থা তখনও চালু হয়নি। চালু থাকলেও অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনও পুরুষ অন্য মানুষের বন্দুক এবং বাবার পাঠানো গুলি নিয়ে এইভাবে বনজঙ্গল চষে বেড়াতে পারত না।
সব জিনিসই বহু যত্ন করে ধীরে ধীরে শিখতে হয়। শিকার মানে যারা বোঝেন বন্দুকের ট্রিগার টানা তারা কিছুমাত্রই বোঝেন না। শিকারের ভাল মন্দ বুঝতে জীবন কেটে যায়। তারপরেও সে জানা সম্পূর্ণ হয়, এমন নয়।
সারাদিন হাটের কোলাহলের শেষে যখন সন্ধ্যা নেমে আসত তখন এক এক করে মোষের গাড়ি, বয়েল গাড়ি ফিরে যেত যে যার জায়গায়। মস্ত বড় বড় চিতল মাছ আর মহাশোল মাছ বিভিন্ন গো—যানে করে আসত দূরবর্তী নদী থেকে। মহাশোল মাছের আঁশগুলি ছিল খুব বড় বড় এবং লাল রঙা। মাছগুলি আকারে এত বড় হত যে পাথালি করে গো—যানে রাখলে তার মাথা ও ল্যাজ গো—যানের বাইরে বেরিয়ে থাকত। মাছগুলির স্বাদও হত অতি উত্তম আর তেলে ভরা থাকত সেসব মাছ। চিতল মাছেরও কোনও তুলনা ছিল না। ওই অঞ্চলে বড় মাছই বেশি পাওয়া যেত, সেই তুলনায় ছোট মাছ কম।
দিনের আলো নিভে এলে একটি একটি করে কেরোসিনের লন্ঠন, কুপি এবং দু—একটি হ্যাজাক জ্বলে উঠত ভাঙা হাটের মধ্যে থেকে। দোকানিরা হিসেবপত্র চুকিয়ে দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে যেত অনেক। পুরো সপ্তাহের বাজার ওই একদিনেই করতেন তামাহাটের মানুষরা। তামাহাটের হাট যেহেতু খুব বড় ছিল, তাই ডিঙডিঙা চা—বাগান, বরবাঁধার মানুষজন আর অন্যদিকে কুমারগঞ্জের মানুষজনও হাট করতে আসতেন তামাহাটে সাইকেল বা হেঁটে বা ঝরঝরে বাসে করে।
বেলী সর্ষের তেল মেখে চান করে ডুরে শাড়ি পরে চটি পায়ে পাউডারের মতো ধুলোর পথ মাড়িয়ে আসত পিসেমশাইয়ের বাড়িতে। তার উড়াল চুল থেকে সুগন্ধী তেলের গন্ধ উড়ত। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে সদ্যস্নাতা বেলীর মুখে চেয়ে থাকতাম।
দুপুরের রোদে আমরা বেশি বেরোতাম না, বাড়িতেই গাছের ছায়ায় বসে গল্প করতাম। বেলী গান শোনাত। কখনও আমার গানও শুনত। আর তার কোচবিহারের হস্টেলের নানা গল্প বলত আমাকে। আমি জীবনে কোনওদিনও হস্টেলে থাকিনি। সেটি আমার এক বিশেষ দুঃখ ছিল। হস্টেলের জীবন যে কেমন হয় তা ছেলে ও মেয়ে বন্ধুদের কাছ থেকে শুনতাম সাগ্রহে আর আফশোস করতাম যে আমি কেন এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম।
আমরা বেড়াতে বেরোতাম প্রধানত সকালবেলায় বা বিকেলে বেলা পড়লে। সকালবেলার বনগন্ধময় পথে আমরা দুজনে হেঁটে বেড়াতাম। কখনও নদীর দিকে যেতাম। নদীর গন্ধ নাকে আসত দূর থেকে। বনের মধ্যে দিয়ে যখন হাঁটতাম, তখন প্রতি গাছের গায়ে আলাদা গন্ধ পেতাম। আর এই গন্ধসমষ্টির মধ্যেই বনের প্রাণ নিহিত থাকত। নদীর কাছে পৌঁছলে উচ্চচকিত চখাচখির স্বর কানে আসত। মাথার ওপরে খয়েরি ডানা মেলে চিল উড়ত চক্রাকারে। শহুরে কবিরা কলঘরে চিলের কান্না নিয়ে কবিতা লিখেছেন। যেমন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কিন্তু আমরা ভাগ্যবান, চিলের কান্না আমরা খোলা আকাশের নীচে নদীর আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে শুনতে পেতাম।
চোত—বোশেখ মাসে যখন শিমুল গাছের বীজ ফুটে তুলো উড়ত মৃদু বাতাসে এবং তা ধীরে ধীরে বাতাসে বাহিত হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত তখন ভারি ভাল লাগত।
”বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া আসে মৃদু মন্দ,
আনে আমার মনের কোণে সেই চরণের ছন্দ।”
বেলী একদিন বলল, তুমি যমদুয়ারে গেছ?
আমি হেসে বললাম, তুমি এত তাড়াতাড়ি আমাকে যমের দুয়ারে পাঠাতে চাইছ?
ও বলল, তুমি একটি বোকারাম! এ যমদুয়ার সে যমদুয়ার নয়। যমদুয়ার জঙ্গলের নাম শোননি? সে এক ভীষণ বন। এবং এমনই ভীষণ বন, সেখানে যাওয়া আর যমের দুয়ারে যাওয়ার মধ্যে বিশেষ তফাত নেই।
সে বন কোথায়? সেখানে কী করে যেতে হয়?
বেলী বলল, দাদুকে জিজ্ঞেসা করো। দাদু জানেন। তবে সেখানে গেলে তোমাকে একা একা যেতে দেবেন না। তাছাড়া তুমি গেলে তো আমিও যাব সঙ্গে।
সে বন কোনদিকে?
সে বনে যেতে হলে গুমা রেঞ্জের বরবাধা হয়ে যেতে হবে আরও বহুদূরে। সেখানে এত বড় বড় শালগাছ আছে যে তোমার আমার মতো চেহারার পনেরো কুড়িজন মানুষের বাহুবেষ্টনীতেও ঘিরতে পারব না। আর গাছ কি শুধু এক রকমের!
আর সে বনে কী কী জানোয়ার আছে?
কী নেই তাই বলো। বাঘ আছে, চিতা আছে, হাতির দল আছে, বুনো মোষ আছে, শম্বর আর হরিণ আছে অনেক রকমের। হায়না আছে, শেয়াল আছে, বনবিড়াল আছে। আর সেই বনের মধ্যে দিয়ে সঙ্কোশ নদী বইছে ভুটান পাহাড়ের পায়ের তলা দিয়ে। সেই নদীর স্বচ্ছ জলে মহাশোল মাছেদের ঝাঁক সাঁতরে বেড়ায় আর জলের ওপরে বসে থাকে নানান পরিযায়ী হাঁস। কত না দেশ বিদেশ থেকে উড়ে আসে শীতের দিনে।
”শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে বলে, শিউলিগুলি ভয়ে মলিন।”— আমি গেয়ে উঠলাম।
বেলী বলল, এই গানটি তো কোনওদিন শোনাওনি।
আমি বললাম, কটি গানই বা আমি জানি। আর আমার গলায় কটি গানই বা তুমি শুনেছ! তুমি আমার চেয়ে অনেক ভাল গাও। এসব গান তুমি গাইলে অনেক ভাল লাগত।
তারপরে বললাম, তাহলে যমদুয়ার যাওয়ার একটা ব্যবস্থা করো। তুমিও যখন যাবে বলছ আমার মতো বীর শিকারির সঙ্গে, তখন তোমার প্রাণটি কার কাছে গচ্ছিত রেখে যাব তার অগ্রিম বন্দোবস্ত কোরো।
বেলী হেসে বলল, আমার প্রাণ, সে তো কই মাছের জান। অত সহজে তা যাওয়ার নয়।
না বেলী ঠাট্টা নয়। তোমার কাছে যমদুয়ারের যা বর্ণনা শুনলাম তা সেখানে একবার না গেলেই নয়।
বেলী বলল, সেখানে যেতে হলে যোগ্য জনের সঙ্গে যেতে হবে।
যোগ্য জন মানে?
যোগ্য জন মানে সাত্তার মিঞার মতো কেউ।
সাত্তার কে?
সাত্তার মিঞার নাম শোনোনি? আবু সাত্তার। বাঘ আর চিতার চামড়া বিক্রি করে যার সংসার চলে। বাঘেদের যম সে। অবশ্য দু—দুবার বাঘের মুখে পড়ে হাসপাতালে বহুদিন থেকে সে ফিরে এসেছে। কিন্তু বনের নেশা বা বাঘের নেশা তাকে ছাড়েনি। সাত্তার মিঞার সঙ্গে না গেলে, যমদুয়ারে যাওয়ার সাহস কখনই কোরো না।
তা যাবে কীসে করে? পায়ে হেঁটে?
পায়ে হেঁটে অতদূর যাব কী করে? যেতে হলে রতু জেঠুকে বলতে হবে। রতু জেঠুর T8 মডেলের ফোর্ড গাড়িতে চড়ে যেতে হবে। একবার তোমার বাবা এসেছিলেন এবং রতু জেঠুর বেবি অস্টিন গাড়িতে করে ওরা যমদুয়ার গেছিলেন। সে এক কাণ্ড! হাতির দলের মধ্যে সেই বেবি অস্টিন ঢুকে পড়েছিল। তারপর প্রায় একঘণ্টা সেই হাতির দল বেবি অস্টিনকে ঘিরে নানা পরীক্ষা—নিরীক্ষা চালিয়েছিল।
আমি বললাম, বলো কী? যদি কোনও হাতি মোড়া ভেবে বেবি অস্টিনের ওপর বসে পড়ত!
বসতেই পারত। কিন্তু হাতিরা চলে যাওয়ার পরে আবার নতুন বিপদ ঘটেছিল। একটা বাচ্চচা হাতি হেলতে দুলতে একা একা হাতির দলের পেছন পেছন চলছিল। সে যাত্রায় হাতির দলের হাত থেকে বেঁচে প্রবল উৎসাহে রতু জেঠু বেবি অস্টিন দিয়ে হাতির বাচ্চচার পেছনে এক ঠোক্কর মেরেছিলেন। আর তাতেই বাচ্চচা ‘প্যাঁ’ করে চিৎকার করতেই পুরো হাতির দল ফিরে এসেছিল এবং তাদের প্রায় আরও দুঘণ্টা ঘেরাও করে রেখেছিল।
আমি বললাম, আশ্চর্য! এইজন্যই কথায় বলে হস্তিমূর্খ। মূর্খ না হলে বারবার মানুষের এই স্পর্ধা তারা সহ্য করবে কেন!
বেলীদের বাড়িতে সেদিন এঁচোড়ের চপ হয়েছিল। তার আগে আমি কখনও এঁচোড়ের চপ খাইনি। এঁচোড়ের যে চপ হয়, তাও জানতাম না। বেলীর মা চমৎকার রান্না করতেন এবং তিনি নিজে সে চপ বানিয়েছিলেন।
ওদের মস্ত উঠোনওয়ালা বাড়িতে চারটি মস্ত বড় বড় ঘর ছিল। প্রতিটি ঘরের সঙ্গে লাগোয়া ছিল সিমেন্টের তিনদিক খোলা চওড়া বারান্দা। বসার ঘর বলে কোনও আলাদা ঘর ছিল না। সেসব বারান্দাতেই আড্ডা, গুলতানি হত এবং রান্নাঘরের বারান্দাতে কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি পেতে ঝকঝকে কাঁসার থালাতে খাওয়াদাওয়া হত। তবে, এঁচোড়ের চপ অবশ্য থালাতে করে পরিবেশিত হয়নি। ছোট কানাওয়ালা পেতলের রেকাবিতে করে পরিবেশিত হয়েছিল। সঙ্গে ছিল পুদিনার চাটনি। সে যে কী স্বাদু সে কী বলব! তখনও গ্রামাঞ্চলে চায়ের প্রচলন ছিল না। তবু প্রায় সব বাড়িতেই ডিঙডিঙা চা—বাগান থেকে চা আসত এবং সকালে বিকালে চা পানের সময় চা খাওয়া হত। তবে সেসময়ে চায়ের বদলে শরবত দেওয়া হত। সেইসময় গরম পড়া সবে শুরু হয়েছে। তাই কাগজি লেবুর পাতা দিয়ে কাঁচা তেঁতুলের নুন চিনি দেওয়া শরবত কাঁসার গ্লাসে করে পরিবেশিত হত। সেই শরবতের স্বাদ ছিল অপূর্ব এবং শহুরে আমার কাছে অনাস্বাদিতপূর্ব।
বেলীর ছোটকাকা বাচ্চচুদা কালো এবং ছোটখাটো মানুষ ছিলেন। কিন্তু তার মুখটি ছিল ভারি মিষ্টি, চোখদুটি এমনই ছিল যে মনে হত কাজল লাগিয়েছেন। আর তার মুখে ঝুলে থাকত একাদশীর চাঁদের মতন একফালি মিষ্টি হাসি। বেলীর এক তরুণী মাসিমা তখন তামাহাটে বেড়াতে এসে ওদের বাড়িতেই ছিলেন। বেলীর মা যেহেতু পরমা সুন্দরী ছিলেন তাই তার মাসিও সুন্দরী ছিলেন কিন্তু অত লম্বা ছিলেন না। কালো ব্লাউজ এবং লালকালো ডুরে শাড়িতে তাকে ভারি মিষ্টি দেখাত। তিনি খুব ভাল গানও গাইতেন। একটি গান আজও কানে লেগে আছে। সেই গানটির প্রথম কলি ছিল ”যেন কার অভিশাপ লেগেছে মোর জীবনে…” কীসের অভিশাপ, কেন অভিশাপ সেসব জানার উপায় ছিল না। কিন্তু অভিশাপ শব্দটি মনের মধ্যে এক আশ্চর্য প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত এবং বৈশাখের বিকেলের উদাসী হাওয়ার মধ্যে বারান্দায় বসে সেই গান শুনতে শুনতে মন অজানা কারণে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত।
বেলীর ছোট মাসির ডাকনাম ছিল পাগু। বেলীর ছোট মাসি এবং আমাদের পিসি পাগুর সেই গান বৈশাখের শেষ বিকেলে চারদিকের গাছগাছালির মধ্যে এক ধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে দিত।
ওদের বাড়িতে মানিক কাকাও থাকতেন। মানিক কাকা ছিলেন অবিবাহিত। মানিক কাকার মতো সদাহাস্যময় মজার মানুষ খুব বেশি দেখিনি। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এয়ার ফোর্সে কাজ করতেন। পাইলট ছিলেন না এবং ঠিক কী কাজ করতেন, আমার জানা ছিল না। যুদ্ধ তখন শেষ হয়েছে বেশ কিছুদিন। সেইসঙ্গে তার চাকরিও শেষ হয়েছিল। তিনি কিছু একটা করার জন্য তামাহাটে এসে বাস করছিলেন। তাঁর চাকরির স্মৃতি হিসেবে কয়েকটি খাকি কাপড়ের ওভারঅল সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। সেই ওভারঅলের অনেকগুলি পকেট ছিল ওপরে আর নীচে। মাঝে মাঝে দীর্ঘদেহী মানিক কাকা ওভারঅল পরেও ঘুরে বেড়াতেন। মানিক কাকাদের এক বন্ধু তামাহাটে একটি ছোট মণিহারি দোকান খুলেছিলেন তা চালু থাকত শুধুমাত্র হাটের দিনে। সেই দোকান যেদিন প্রথম চালু হয় সেদিন মানিক কাকাও বন্ধুর দোকানে বসেছিলেন। এবং উদ্বোধনের দিন তাদের বন্ধু তাদের মিষ্টিমুখ না করাতে বিরক্ত হয়ে মানিক কাকা দুকৌটো পেতল পালিশ করা ব্রাসো খেয়ে ফেলেছিলেন!
মানিক কাকা খুব মজার মজার গল্প করতেন। আর ওঁর কথা বলার সরস ভঙ্গিটি এমনই ছিল যে তিনি যে কথাই বলতেন তাতেই হাসি পেত এবং যুদ্ধের নানা গল্প তিনি এত রসিয়ে বলতে পারতেন যে তা শুনে হাসতে হাসতে পেটে খিল পড়ত আমাদের।
.
তামাহাট পেরিয়ে গৌরীপুরের দিকে যেতে পড়ত কুমারগঞ্জ। সেটিও গঙ্গাধর নদীর ওপরেই। তবে তামাহাটের মতো বন্দর তা ছিল না। নানা পেশার সামান্য কিছু মানুষ সেখানে বাস করতেন এবং এই কুমারগঞ্জের উল্টোদিকে লালমাটির পাহাড়ের মধ্যে জঙ্গলের পথ চলে গিয়েছিল লালমাটি, আলোকঝারি আর পর্বতজোয়ারের দিকে। সেসব জায়গার কথা আগেও উল্লেখ করেছি। এইখানে বেলীর আরেক জ্যাঠামশাইয়ের বাড়ি ছিল। সেই বাড়িতে একটা লটকা গাছ ছিল এবং সেখানে রাস্তার পাশে একটা বিরাট গাছের গুঁড়িতে এক দেবতার অধিষ্ঠান ছিল। সেই দেবতার নাম ছিল ঢিল খাওয়া ঠাকুর। সেই দেবতা অন্য কোনও পূজা গ্রহণ করতেন না। সেই ধুলোধূসরিত পথ দিয়ে যে পথিক বা সাইকেল আরোহী যেতেন তিনি পথ থেকে একটা নুড়ি তুলে সজোরে ছুড়ে মারতেন সে গাছের গুঁড়িতে এবং সেই ঠাকুরের থানের চারপাশে নুড়ির পাহাড়ের সৃষ্টি হয়েছিল। সাইকেল থেকে নেমে সেই ঢিল খাওয়া ঠাকুরের থানে সজোরে নুড়ি ছুড়ে আমরা খুব মজা পেতাম। সেই জ্যাঠামশাইয়ের একমাত্র ছেলের নাম ছিল তিনকড়ি। তার জন্মের আগে তার মায়ের তিন—চারটে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েই মারা যান। তাই আমার বড় পিসিমা সেই সন্তানকে তিনটি কড়ি দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন বেলীর জেঠিমার কাছ থেকে। তাই তার নাম ছিল তিনকড়ি। উনি আমাদের চেয়ে বছর দুয়েকের বড় ছিলেন এবং কোচবিহারের স্কুলে পড়তেন এবং সেখানে বেলীর মতন হস্টেলে থাকতেন। এরকম সদাহাস্যময় অনুযোগ ও অভিমানহীন মানুষ আমি জীবনে কমই দেখেছি। পরবর্তী জীবনে কড়িদা কলকাতাতে এসে থিতু হন এবং ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে অকালে দেহ রাখেন।
বেলীকে সাইকেলে ডবল ক্যারি করে নিয়ে একদিন গেছিলাম কাননের বাড়ির দিকে। কানন একটি মেচ মেয়ে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে মালভূমির ওপরে দু—তিনটে ঘর ছিল যেখানে মেচরা থাকতেন। ঘরগুলির চারপাশে নানা ফলের গাছ ছিল। তার মধ্যে আম, জাম, আমলকী, কাঁঠাল, বেল, লিচু, ফলসা ইত্যাদি ছিল। এইসব গাছের বেষ্টনীর মধ্যেই মাচার মতো বাঁশের ধারা ঘেরা ঘর ছিল। মাথার ওপরে ছিল লাল টিনের ছাদ। সারা দুপুরে নানা বর্ণের কাঁঠাল পাতা ঝরে ঝরে পড়ত গোবর লেপা উঠোনে। দমকা হাওয়ায় ঝরে পড়ত আমের মুকুল। আর সেইসব গাছের ছায়ায় উঠোনে বসে কাঠ এবং বাঁশ দিয়ে বানানো বড় তাঁত সামনে নিয়ে খটাখট শব্দ করে বহুবর্ণ দোহর ও মোটা কাপড়ের মেখলা বুনতেন কাননের মা। আদিবাসীদের নাম সাধারণত কানন হয় না। কিন্তু সেইসময় প্রমথেশ বড়ুয়ার ছবিতে কাননবালা নায়িকা হতেন এবং তার মুখে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যেত। যেমন— ”ঐ মালতীলতা দোলে, কি আলো তরুর কোলে” সম্ভবত মেচ সর্দার ধুবুড়ি শহরে গিয়ে প্রমথেশ বড়ুয়ার কোনও ছবি দেখে থাকবেন, যে ছবিতে কাননবালা নায়িকা ছিলেন এবং সেই সুবাদেই হয়তো মেয়ের নাম রেখেছিলেন কানন। মেচ উপজাতিদের গড়ন অনেকটা নাগাদের মতন। গায়ের রং তামাটে এবং অত্যন্ত সুগঠিত শরীর তাদের পুরুষ এবং নারীদের। কোমর ছাপানো খয়েরি রঙা চুল তাদের সৌন্দর্যকে অন্য এক দীপ্তি দেয়। আমরা যখন পৌঁছলাম তখন কানন তার মায়ের পাশে মাদুরে বসে মায়ের তাঁত বোনা দেখছিল। কাননের বয়স তখন বেলীর মতোই ছিল। বেলীর সঙ্গে কাননের বন্ধুত্ব কী করে হয়েছিল তা আমি জানতাম না। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কটি ছিল অত্যন্ত মধুর। অধিকাংশ আদিবাসী আর উপজাতিদের মধ্যে একধরনের আশ্চর্য সারল্য দেখা যায়। কাননও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সেও তার মায়ের মতো হাতে বোনা বহু রঙা তাঁতের মেখলা পরেছিল। গায়ে একটি হাফহাতা ব্লাউজ। নাভির ওপরে ইঞ্চিখানেক অনাবৃত ছিল এবং তামারঙা দীপ্তি পেট থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছিল। বেলী আমার সঙ্গে কাননের আলাপ করিয়ে দিল। কানন হাসিমুখে আমায় দুহাত ধরে ডেকে বেতের মোড়াতে বসাল। বিকেলের আলো পড়ে আসা পর্যন্ত আমরা সেখানে বসে নানা গল্প করছিলাম এবং কাননের অনুরোধে বেলী একটা গানও গেয়েছিল। সে গানটির কথা আজ প্রায় সত্তর বছর পরেও স্পষ্ট মনে আছে। বেলী গেয়েছিল,
”আমার বেলা যে যায় সাঁঝবেলাতে
তোমার সুরে সুরে, সুর মেলাতে…”
.
আমরা চলে আসবার আগে কাননের দাদা হুকুম এসে হাজির হল। তার কাঁধে এক’নলা গাদা বন্দুক আর হাতে দুটি শিকার করা ধাড়ি খরগোশ, মেটে রঙ। আমাদের বাঁশের রেকাবিতে ভেলি গুড় আর ঝরনার জল পেতলের গ্লাসে খেতে দেওয়া হয়েছিল। অনেক দূরে জঙ্গলের পথে ফিরে যেতে হবে তাই আমরা আর বসিনি। ফেরার পথে ত্রয়োদশীর চাঁদ উঠেছিল আকাশে। বেলী আর আমি দুজনে ”সেদিন দুজনে দুলেছিল বনে, ফুল ডোরে বাঁধা ঝুলনা…” একসঙ্গে গাইতে গাইতে পর্বতজোয়ার থেকে নেমে আলোকঝারি হয়ে লালমাটি পাহাড়—বন পেরিয়ে কুমারগঞ্জের সামনের মাঠে যেখানে ল্যানটানার ঝোপে আমার সাইকেলটি রাখা ছিল, সেটি তুলে নিয়ে তামাহাটের দিকে চাঁদের আলোয় ভাসতে ভাসতে চলছিলাম বেলীকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে।
এক একটি সন্ধে, এক একটি দুপুর, এক একটি সকাল মনের গভীরে চিরদিনের মতো গেঁথে যায় এবং যুগ যুগ ধরে গাঁথা থাকে। কোনও কিছুতেই সেই মধুর এবং বিধুর স্মৃতি মলিন হয় না, এ বড় আশ্চর্যের কথা।
.
তখন ভরা শ্রাবণ। ধুবুড়ি শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপরে নেতি ধোপানির ঘাট থেকে ছোট ছইওয়ালা নৌকোয় করে আমরা চলেছি জিঞ্জিরাম নদীর উদ্দেশে। তিনজন মাঝি ছাড়া আমাদের সঙ্গে আছে আবু সাত্তার আর আছেন ধুবুড়ির বিখ্যাত ব্যবসায়ী শচীন রায় মশাই। তিনি ধুবুড়ির টাউন হোটেল আর টাউন স্টোর্সের মালিক এবং বাবাও সঙ্গে ছিলেন।
তখন ঝকঝকে রোদ্দুর আর বেশ উত্তাল হাওয়া। তাই মাঝিরা বাদামি রঙা পাল তুলে দিয়েছে। এখানে ব্রহ্মপুত্র বিরাট চওড়া আর অত্যন্ত গভীর। খুব বড় বড় স্টিমার বাংলাদেশ হয়ে এখানকার স্টিমারঘাটে এসে নোঙর করত। তখনকার দিনে স্টিমার তো আর ডিজেলে চলত না, সবই চলে প্যাডেলে। স্টিম ইঞ্জিনে সেই অতিকায় কাঠের প্যাডেলগুলি আবর্তিত হত এবং কয়লার কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে সেই স্টিমার জলে প্রচুর আলোড়ন তুলে এগিয়ে চলত। সৈয়দ মুজতবা আলি সাহেব তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘দেশে বিদেশে’তে লিখেছিলেন তাঁর নিজস্ব সাঁতার পটুত্ব সম্বন্ধে যে, গোয়ালন্দি স্টিমারের মতো যে পরিমাণ জল ছড়াতাম, সেই পরিমাণ এগিয়ে যেতে পারতাম না। একথা ঠিক যে কয়লায় চলা স্টিম ইঞ্জিন যে পরিমাণ আলোড়ন তুলত জলে সেই পরিমাণ এগোতে পারত না। তবে সেইসব স্টিমারের বাবুর্চিদের রান্নাকরা ইলিশ মাছের বিভিন্ন পদ আর মুরগির মাংসের কোনও তুলনা ছিল না। আমি পৃথিবীর নানা দেশের নানা বাবুর্চির রান্না খেয়েছি। কিন্তু ওরকম স্বাদু রান্না বেশি খাইনি।
আমি আর বেলী নৌকোর ছইয়ের ওপরে বসে আছি, ছইটিকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আর নৌকো চলছে পালের হাওয়ায় ভর করে তরতর করে। একজন মাঝি হাল ধরে বসে আছে আর দুজন দাঁড় বাইবার জন্য। যেহেতু তখন পাল তুলে দেওয়া হয়েছিল, দাঁড় বাইবার প্রয়োজন ছিল না। আমরা কোনাকুনি ব্রহ্মপুত্র নদ পেরোচ্ছিলাম। ব্রহ্মপুত্র পেরিয়ে একটি খালে ঢুকে আমরা যাব গারো পাহাড়ের পাদদেশে জিঞ্জিরাম নদীতে। জিঞ্জিরাম একটি ছিপছিপে নদী কিন্তু সে নদী ছিল প্রচণ্ড গভীর, গিরিখাতের নদীরা যেমন হয়। এবং বর্ষাকালে জিঞ্জিরামের দহতে কুমিরদের মেলা বসত। আমরা চলেছিলাম কুমির শিকারের উদ্দেশ্যে। লম্বা মুখওয়ালা মেছো কুমির বা ঘড়িয়াল যার ইংরেজি নাম অ্যালিগেটর এবং থ্যাবড়া মুখের মানুষখেকো কুমির ছিল অতিকায় মাপের, এদের ইংরেজি নাম ক্রোকোডাইল। কিছু কুমিরকে স্থানীয় মানুষরা বলত ঘটওয়ালা কুমির। বয়স বেশি হওয়াতে তাদের মাথার পেছন দিকের চামড়া কুঁচকে ঘটের মতো হয়ে যেত। তাই তাদের এরকম নাম ছিল।
.
ভরা বর্ষায় ছোট নৌকো করে ব্রহ্মপুত্র পেরোনো এক দুঃসাহসিক কাজ ছিল। দুঃসাহসেই ভর করে আমরা চলছিলাম কুমির শিকারের অদম্য বাসনায়। অনেকক্ষণের চেষ্টায় ব্রহ্মপুত্র কোনাকুনি পেরিয়ে আমরা একটি বড় খালে ঢুকলাম এবং আধ— ঘণ্টাখানেক চলার পর শালমাড়া বন্দরে পৌঁছলাম। তখন পাল নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দু’জন দাঁড় বাইছিল। শালমাড়ার নানারঙা টিনের ছাদের বাড়িগুলি এবং তার ওপরে উজ্জ্বল রোদে চক্রাকারে ওড়া বিভিন্ন রঙা পায়রার ঝাঁক এখনও চোখের সামনে ভাসে। সেই বন্দরে ছোট বড় নানান নৌকো নোঙর করা ছিল। ধুবুড়ি থেকে বেরোতেই আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছিল তাই যখন শালমাড়া পৌঁছলাম, তখন দুপুর শেষ হয়ে প্রায় বিকেল। ছিপ নৌকোতে ছেলেরা কাছেই কোথাও অন্য নদীতে অথবা ব্রহ্মপুত্রে, ঠিক মনে নেই এতদিন পরে, বাইচ খেলে ফিরে আসছিল। অতি দীর্ঘ ছিপছিপে ছিপ নৌকোয় খালি গায়ে সুগঠিত ছেলেরা দ্রুত দাঁড় বেয়ে জলে সপাসপ শব্দ করে চলে যাচ্ছিল। কলকাতার ছেলে আমার কাছে সে দৃশ্য ছিল অচেনা এবং রোমহর্ষক। বেলীর পাশে ছইয়ের ওপর বসে আমার বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত কবিতা এবং তার নায়িকা ছোকানুর কবিতাগুলি মনে পড়ছিল। বেলীকে ছোকানুর কথা বলতে বেলী খুব উত্তেজিত হচ্ছিল।
সন্ধের মুখেমুখে আমরা ব্রহ্মপুত্রর ব্যাকওয়াটারে পৌঁছলাম। সেই বিস্তীর্ণ জলাভূমি দেখবার মতন। দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছিল। জলের গন্ধ বয়ে আসা হাওয়াতে আমাদের গা শিরশির করছিল। একটি ছোট ডিঙি নৌকোয় মাছ ধরে ফিরছিল জেলেরা। সেই নৌকো থেকে সাত্তার ভাঙনি মাছ কিনল। ভাঙনি মাছ বড় নয়, পাবদা মাছের মতোও নয়। কিন্তু পাবদা মাছের চেয়ে অনেক পুরুষ্টু এবং স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। রাতে মাঝিরা সেই মাছের ঝোল রেঁধেছিল; হলুদ, কালো জিরে, কাঁচালঙ্কা দিয়ে। ভাত দিয়ে সে মাছের ঝোল আমরা খেয়েছিলাম রাতের খাবার হিসেবে। সে মাছের ঝোলের গন্ধ এখনও নাকে লেগে আছে। সন্ধে হয়ে যাওয়ার পর অন্ধকারে আমরা আর না এগিয়ে ওই অগভীর জলের ওপরেই নোঙর করে রাতটা কাটালাম।
রাত বাড়ার পর একটি নৌকো ধীরে ধীরে আমাদের নৌকোর কাছে এগিয়ে এল এবং সে নৌকোর মাঝিরা আমাদের বলল, বাবু, আগুন হবে কি?
আমাকে আর বেলীকে অবাক করে সাত্তার বলল, আগুন আছে বটে। কিন্তু সেই আগুন দুই নলের মধ্যে দিয়ে বেরোয়। ভাল চাও তো এখান থেকে সরে যাও।
আমরা সাত্তারের সেই অদ্ভুত ব্যবহারে আশ্চর্য হলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম, সে নৌকো ডাকাত বা জলদস্যুদের নৌকো। তারা এইভাবে অন্য নৌকোর যাত্রীদের দাঁড় করিয়ে সর্বস্ব লুটপাট করে। তবে তাদের কাছে বন্দুক থাকে না। সাত্তারের দুই নলের আগুন যে বন্দুক তা তারা বুঝেই চুপচাপ আমাদের পেরিয়ে শালমাড়ার দিকে চলে গিয়েছিল।
নৌকোতে পুবের আলো এসে পড়ল আমাদের চোখে। আমরা ঘুম থেকে ওঠার পর আবার নৌকো ছাড়া হল। রাতের রান্না কেরোসিন স্টোভেই হয়েছিল এবং ঘুম ভাঙার পর সকলের জন্য আদা তেজপাতা দিয়ে চা বানাল সাত্তার। বিস্কিটের সঙ্গে আমরা সেই চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম, সঙ্গে অবশ্য মুড়িমুড়কি ছিল। আমরা খাইনি। বেলা দশটা নাগাদ আমরা জিঞ্জিরাম নদীতে গিয়ে পৌঁছলাম। আগেই বলেছি সে নদী খুব ছিপছিপে কিন্তু প্রচণ্ড তার গভীরতা এবং বর্ষাকালে সেই নদীর জল নানা রকমের মাছে ভরে যায়। সেইজন্য নানা ধরনের কুমিরদের জমায়েত হয় এই জিঞ্জিরামে। নদীর একপাশে গারো পাহাড়ের পাদদেশ। খাল দিয়ে ভেতরে চলে গেলে ফুলবাড়ি বন্দরে পৌঁছানো যায়। গারো পাহাড়ের থেকে নেমে এলে ওই বন্দর একটি উল্লেখযোগ্য বন্দর। রাতের বেলা হ্যাজাক লন্ঠন এইসবের আলোতে ঝিকমিক করত। কখনও মাঝি খালি গলায় গান ধরে উচ্চচস্বরে। বড় নৌকোর সঙ্গে বাঁধা ছোট্ট ডিঙি নৌকোয় মশলা বাটার গাবুক—গুবুক শব্দ শোনা যায়।
নদীর বাঁ পাশে ছোট কিছু গ্রাম আছে। এইসব গ্রামে অসমের উপজাতি রাভাদের বাস। প্রতিবছর এই গ্রামগুলি থেকে বহু মেয়ে—বউ মানুষখেকো কুমিরের পেটে যায়। জিঞ্জিরামের পাশের গ্রাম— গুলিরঘাটে সচরাচর কেউ নামে না বা চান করে না কুমিরের ভয়ে। ঘাট থেকে কাঠের পাটাতন পাতা থাকে শক্ত খুঁটির ওপরে এবং সেই পাটাতনে বসেই বালতি করে জল তুলে মেয়েরা চান, কাপড়কাচা, বাসন মাজা ইত্যাদি সারে। খাবার জলও সংগ্রহ করে দড়িতে বাঁধা বালতি করে। এখানে কিছু কিছু জায়গা আছে তার ওপরে বড় বড় গাছেরা চন্দ্রাতপের সৃষ্টি করেছে। আমাদের নৌকো যখন সেসব জায়গা দিয়ে যেত, তখন মনে হত যেন অদেখা আফ্রিকার কোনও নদীর ওপর দিয়ে আমরা চলেছি। সেইসব জায়গায় সূর্যের আলোও পৌঁছত না, এমনই ঘন চন্দ্রাতপ ছিল। বৃষ্টির গন্ধ, নদীর জলের গন্ধ এবং অন্যান্য গাছগাছালির গায়ের গন্ধ, ফুলের গন্ধ মনকে আমোদিত করে তুলত। মনে হয় সে এক গা ছমছম স্বর্গরাজ্যে গিয়ে আমরা পৌঁছেছি। সেই সৌন্দর্যে মানুষখেকো কুমিরদের হত্যালীলার কথা মনেই থাকে না।
একটি গ্রামে আমরা নেমেছিলাম, গ্রামটির নাম ছিল রাভাতলা। সেই গ্রাম থেকেই আগের বছর চারজন বউকে কুমিরে নিয়েছে। সেইসব কুমির শিকার করার পরেও তাদের পেট থেকে সেই বউদের গয়না, নাকছাবি, পায়ের মল ইত্যাদি উদ্ধার হয়েছিল। জিঞ্জিরাম নদী যে কোথায় গেছে তা আমাদের জানা ছিল না। পথেরই মতো কোন নদী যে কোথায় যায় তার খবর সে পথের পথিক অথবা নৌকোর যাত্রীরা রাখে না।
আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্টের বিখ্যাত কবিতা আছে, নাম ‘The road not taken’। সেইরকম প্রতি নৌকোতেই নদীর মোহানায় এবং পথের চৌরাস্তায় পৌঁছে সেই কবিতাটির কথা মনে পড়ে আমার।
ডিঙডিঙা চা—বাগানের আগে একটি মস্ত বড় প্রান্তর ছিল। তাতে অনেকগুলি বড়বড় শিমুলগাছ ছিল। বৈশাখ মাসে প্রতিটি শিমুলগাছের বীজ ফেটে হালকা রেশমি নরম তুলো উড়ত বৈশাখী বাতাসে। তারা উড়ে উড়ে কোথায় কোথায় যে চলে যেত, তা তারাই জানে।
সন্ধের আগে পশ্চিমাকাশ যখন শেষ সূর্যের লালিমায় ভরে যেত তখন পশ্চিমাকাশে সবচেয়ে আগে উঠত সন্ধ্যাতারা। শুক্লপক্ষে চাঁদ—ও উঠত, সূর্য পশ্চিমে হেলার পর। সন্ধ্যাতারার স্নিগ্ধ নীলাভ সবুজ দ্যুতি জ্বলজ্বল করত মেঘহীন জ্যোৎস্নামাখা নীল আকাশে।
তামাহাটে শেষ গিয়েছিলাম বিংশ শতাব্দীর শেষে অথবা একবিংশ শতকের গোড়াতে, সময়টা ঠিক মনে নেই। ধুবুড়ি বইমেলার উদ্বোধন করতে। সেবারে বাগডোগরা এয়ারপোর্টে উদ্যোক্তারা গাড়ি পাঠিয়েছিলেন। আমি তাদের বলেছিলাম আমি প্রথমে তামাহাট যাব এবং সেখানে এক রাত থেকে বহুবছর আগের বহুতর স্মৃতি মন্থন করে পরদিন শেষ বিকেলে গাড়ি পাঠালে সেই গাড়ি করে ধুবুড়ি শহরে এসে সার্কিট হাউসে থাকব। ধুবুড়ি, গুয়াহাটি এইসব শহরের সার্কিট হাউসগুলি অতি চমৎকার, একেবারে ব্রহ্মপুত্রের ওপরে।
সেবার যখন গিয়েছিলাম তখন পরিচিতরা তামাহাটে প্রায় কেউই ছিলেন না। তখন গঙ্গাধর নদী দিয়ে পুব বাংলা থেকে পাটবাহী নৌকো আর আসত না। তামাহাটের হাটটিরও আর তেমন রমরমা ছিল না। অধিকাংশ মানুষই গত হয়েছিলেন। আর বাকিরা জীবিকার সন্ধানে ধুবুড়ি, কোচবিহার, বঙ্গাইগাঁও, গুয়াহাটি অথবা কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। অধিকাংশ বাড়ি তালাবন্ধ। বেলীর মা বাবা দুজনেই গত। আমার পিসেমশাইও অনেকদিন আগে ধুবুড়িতে কাজে গিয়ে সেখানেই হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। পিসিমা তখনও ভিটেমাটি আঁকড়ে একা পড়েছিলেন পরিচারক, পরিচারিকাদের সঙ্গে। পিসতুতো ভাইবোনেরা আর কড়িদাও কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়ে অথবা জীবিকার সন্ধানে। রাতটা পিসিমার কাছে কাটিয়ে পরদিন একা একা তামাহাটের শূন্য পথে এবং গঙ্গাধর নদীর তীরে ঘুরে বেড়ালাম। অধিকাংশ বাড়ি বন্ধ। বেলী পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে হওয়ার পর কোচবিহারেই এক অধ্যাপকের স্ত্রী হয়ে বসবাস করত শুনেছি। যদিও বাগডোগরা থেকে কোচবিহার হয়েই আমাকে তামাহাটে আসতে হয়েছিল। কিন্তু ওর ঠিকানা না জানায় খুব ইচ্ছে থাকলেও ওর সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠেনি। সময়াভাব তো ছিলই।
দুপুরবেলায় গঙ্গাধর নদীর ঘাটে অশ্বত্থগাছ তলায় সারি সারি নৌকো বাঁধা ছিল। গাছের ছায়ায় একটি নৌকো পাটাতনে একা বসে ছিলাম। আর পঞ্চাশ ষাট বছর আগের তামাহাটের স্মৃতিরোমন্থন করছিলাম। ঝুরু ঝুরু করে হাওয়া বইছিল। গাছতলায় নদীর পাটাতনে বসে ভারী স্নিগ্ধ লাগছিল সেই বাতাস। সেই ঘাটে বসে আমার প্রিয় গানটির কথা মনে হচ্ছিল,
”বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে
শূন্য ঘাটে বসে আছি
পার করে লও
পার করে লও
পার করে লও
খেয়ার নেয়ে
ভেঙে এলেম খেলার বাঁশি
চুকিয়ে এলেম কান্না হাসি
পার করে লও
পার করে লও
পার করে লও
খেয়ার নেয়ে
ও পারেতে ঘরে ঘরে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বলিল রে
আরতি ঘণ্টাধ্বনি উঠিল সুদূর মন্দির পরে
এসো এসো শ্রান্তিহরা
এসো সুপ্তি শান্তি ভরা
পার করে লও
পার করে লও
পার করে লও
খেয়ার নেয়ে…”
গঙ্গাধর নদীর বিস্তীর্ণ চরে মুসলমান চরুয়ারা অস্থায়ী ঘর বানিয়ে থাকত। সেখানে বালির মধ্যে তরমুজ, ফুটি, শসার চাষ করত। তাদের গরু, ছাগল তখন চরেই থাকত। আর সেই গরু, ছাগল ধরবার জন্য চিতাবাঘেরা ইতিউতি ঘুরে বেড়াত এবং প্রায়ই তাদের ধরে খেত।
.
আবু সাত্তারের সঙ্গে সেই প্রথম যৌবনে আমি মড়ির কাছে বালির মধ্যে গর্ত করে বন্দুক হাতে বসে থাকতাম চিতাবাঘ মারার আশায়। নদীপাড়ে বসে বসে সেইসব নানান স্মৃতি মনে আসছিল। নদীর ওপরের উঁচু ডাঙায় একজোড়া অসময়ের চখাচখি কঁক কঁক ডাক ডেকে আমার স্বপ্নভঙ্গ করল। নদী ঠিক আগের মতোই আছে। দুপাশের গাছগাছালিও আগের মতোই আছে। শুধু নেই আমার পরিচিত মানুষগুলি। পথের গাছ, ঘরের ভাঙা মোড়া, খাট পালঙ্ক সবই থেকে যায় বহুদিন। এইসব অনুষঙ্গের মধ্যে মানুষই সবচেয়ে কমদিন থাকে। তাদের ডাক পড়ে সবচেয়ে আগে। কেউ ঠাঁইনাড়া হয়ে অন্যত্র চলে যায় আর কেউ চলে যায় এই পৃথিবী থেকে পরপারে। কতদূরে, কোন দেশে তা কেউ জানে না। ধ্রুবতারা যেমন ওঠে সেই স্থির এবং অমোঘ ঘটনারই মতো মানুষের এই চলে যাওয়াও তেমনই অমোঘ এক ঘটনা।
তামাহাটের মানুষদের জীবিকা আর পাটনির্ভর নয়। এখন যারা তামাহাটে থাকেন তারা অন্য কোনও জীবিকায় ভর করে জীবন অতিবাহিত করেন।
এই একদিনের জন্য এসে বেলীর কথা খুব মনে পড়ছিল। সে তার মেধাবী স্বামীর সঙ্গে কোচবিহারে সুখে ঘর করছে। সে নিজেও নাকি একটি স্কুলের শিক্ষিকা। সুখ দুঃখ বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তা বুঝতে হলে মানুষের ভেতরে ঢুকতে হয়। সেই সুযোগ ও সময় সকলের হয়ে ওঠে না। মানুষের বহিরঙ্গের রূপটাই দৃশ্যমান হয়। অন্তরঙ্গ রূপ অন্তরেই চাপা থাকে।
.
কাশেম মিঞা থাকতেন ধুবুড়িতে। কিন্তু ব্যবসার কারণে মাঝেমধ্যেই তামাহাটে আসতেন। ওঁর একটি ট্রাক ছিল। গোলগাল ফর্সা মাঝারি উচ্চচতার মানুষ। সদাহাস্যময়, মুখভর্তি পান—জর্দা, পরনে চেক চেক লুঙ্গি আর হাফহাতা শার্ট, শীতকালে গলাতে চেক চেক মাফলার। খুব আমুদে মানুষ ছিলেন। যমদুয়ারে একবার যাওয়া হয়েছিল ওরই ট্রাকে করে। ট্রাক যখন যাচ্ছেই তখন তামাহাটের বহু মানুষ ‘আম্মো যাব, আম্মো যাব’ বলে আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন। ছল ছিল শিকার কিন্তু আসলে সে ছিল এক যাত্রা পার্টি। বড় বড় হোল্ডঅলে বিছানাপত্র, বালিশ—কোলবালিশ বড় বড় হাঁড়ি—কুড়ি, পান এবং দুর্গন্ধময় মজা সুপুরির হাঁড়ি। সেসব হাঁড়ি মাটির নীচে সুপুরিসুদ্ধু পোঁতা থাকত এবং সে মজা সুপুরির এক টুকরো খেলেই শীতের রাতেও সমস্ত শরীর গরম হয়ে যেত। গরিব মানুষদের কাছে এইই মজা। সুপুরিই ছিল শীতবস্ত্র। এই সুপুরির নাম ছিল —’গুয়া’। ‘গুয়াহাটি’ শব্দটিও এসেছে এই ‘গুয়া’ থেকে। একসময় গুয়াহাটিতে অনেক সুপুরি গাছ ছিল।
অত লোকের রান্নার জন্য বড় বড় হাঁড়ি, ওখানে বলত— ড্যাগ আর যারা ভাল রান্না করত তাদের বলত— ড্যাগমাস্টার।
নানারকম তরি—তরকারি, প্রচুর পরিমাণে মোরগ মুরগি, বেশ কয়েকটি পাঁঠা এবং যাত্রা পার্টির নানা ধরনের নানা অবস্থার মানুষদের নিয়ে যমদুয়ারে রওনা হয়েছিলাম আমরা কাশেম মিঞার ট্রাকে করে।
শীতকালে এই অঞ্চলে ভুটান পাহাড় থেকে অজস্র কমলালেবু আসত বড় বড় এবং মিষ্টি। বিকেল বিকেল যখন আমরা যমদুয়ার ঢুকব তখন এক বিরাট চিতাবাঘ রাস্তার ডানদিক দিয়ে বাঁদিকে যাচ্ছিল লাল ধূলিধূসরিত রাস্তা পার করে। কিন্তু সকলেরই এক’নলা, দো’নলা বন্দুক বাক্সবন্দি অবস্থায় মালপত্রের নীচে রাখা ছিল। বাঘ দেখেই সবাই বাঘ বাঘ করার মুহূর্তে বন্দুকের খোঁজ পড়ল। কিন্তু মালপত্রের নীচ থেকে বন্দুকগুলি নিষ্ক্রান্ত হওয়ার আগেই সে বাঘ হেলেদুলে ডানদিকের জঙ্গল থেকে বাঁদিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল।
.
বেলী আমাদের সঙ্গে গেছিল। তখনও বেলী কিশোরী, মহিলা হয়ে ওঠেনি। আমি ও বেলী দুজন দুজনের সান্নিধ্যে বুঁদ হয়েছিলাম। কাশেম মিঞার যাত্রাপার্টির সঙ্গে আমাদের বিশেষ যোগ ছিল না। ট্রাকের ওপরের মোটা হোল্ডঅলের গদির ওপর আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম এবং বেলীর আনা ঝাল লেড়ো বিস্কুট আর আমসত্ত্ব খাচ্ছিলাম।
.
যমদুয়ারে দোতলা বাংলোয় আমরা যখন পৌঁছলাম তখন রাত হয়ে গেছে অনেক। ড্যাগমাস্টাররা মুগের ডালের খিচুড়ি বসিয়ে মুরগির কষা মাংস এবং আলু ভাজার বন্দোবস্ত করেছিল। মুগের ডাল ভাজার সুগন্ধ সমস্ত বাংলোকে সুরভিত করে তুলেছিল। এখানে নদী থেকে জল আনতে যাওয়া দুজন যাত্রাদলের সঙ্গী ‘হাতি! হাতি!’ চিৎকার করে জলের বালতি নদীপাড়ে প্রাণভয়ে ফেলে রেখে বাংলোতে দৌড়ে ফিরে এল। তখন হাতির দল নেমেছিল জল খেতে নদীতে। হাতিরা সরে গেলে পরে অন্য দুজন সাহসী সঙ্গী নতুন করে বালতি ভর্তি করে জল নিয়ে এসেছিল। ওই অঞ্চলে প্রচুর বুনো মোষও ছিল। অতিকায় তাদের চেহারা আর প্রকাণ্ড বাঁকানো শিং। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আরণ্যকে’ সেই বুনো মোষেদের দেবতার কথা উল্লেখ আছে। সেই দেবতার নাম ‘টাঁড়বারো’। এই দেবতা, শিকারিদের থেকে সাবধান করে দিতেন বন্য মহিষদের।
ভারতের বিভিন্ন জঙ্গলে পরে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, আফ্রিকার জঙ্গলেও যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। যেখানেই বুনো মোষ আছে সেখানেই স্থানীয় মানুষদের কাছে আমি এই টাঁড়বারোর খোঁজ করেছিলাম।
কিন্তু বিভূতিভূষণের টাঁড়বারোর কথা কারোকেই জানতে বা শুনতে দেখিনি। জানি না, ক্ষমতাবান সাহিত্যিক তাঁর কল্পনাতেই টাঁড়বারোর সৃষ্টি করেছিল কিনা! তবে সত্যি হওয়াটাও আশ্চর্য নয়।
যমদুয়ার থেকে প্রায় তিরিশ মাইল ভেতরে ভুটান পাহাড়ের সীমান্তে বিরাট চওড়া একটা নদী ছিল। তার নাম রাঙা। গ্রীষ্মে সেই নদীতে জল থাকত না। তার বদলে নল বা ঢাড্ডার জঙ্গলে ভরা থাকত এবং সেই বিস্তীর্ণ চরের শেষে ছিল ভুটান পাহাড়। সেই চরে হাতি, গন্ডার, বড় বাঘ, বাইসন, বুনো মোষ এবং আরও নানারকম বিরাট ও ভয়াবহ জানোয়ারের বাস ছিল। এখানেই আরেকবার এসেছিলাম আশির দশকে। আমার শিকারি বন্ধু কেনেথ এডওয়ার্ড জনসন এবং তার স্কটসম্যান বন্ধু কলকাতার ব্রিটিশ হাই কমিশনের জিম ক্যালানকে নিয়ে এখানেই বাঘ শিকারে। তখন আবু সাত্তার সঙ্গে ছিল। আরও একজন ছিলেন ভুটানি। তিনি ইনকাম ট্যাক্স অ্যাপলেট ট্রাইবুন্যাল মেম্বার ছিলেন আর জনসন সাহেব ছিলেন সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডায়রেক্ট ট্যাক্সেস মেম্বার। রাঙা নদীর একপ্রান্তে একটি ওয়াটার হোল ছিল। গ্রীষ্মে তখন সেই ওয়াটার হোলের জল বিশেষ ছিল না। কিন্তু জল যখন ছিল তখন বিভিন্ন জানোয়ার জল খেতে আসত বলে ওয়াটার হোলের চারপাশে বিভিন্ন বড় বড় গাছের মসৃণ কাণ্ডে কাদার সঙ্গে মেশা লোম লেগে থাকতে দেখেছিলাম। যেমন বুনো মোষেদের লোম, বাইসনের লোম, শম্বরের লোম। হাতিরাও তখন জল খেতে আসত বলে নরম কাদায় হাতির পায়ের চিহ্নগুলি শুকনো কাদায় হামানদিস্তার মতো অদ্ভুত দেখাত। সেখানে হাঁটা অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। কারণ তাদের ওপরে লতা এবং নানারকম উদ্ভিদ গজিয়েছিল তাই গোড়ালি ভেঙে যাওয়ার বিপদ ছিল। কিন্তু কর্দমাক্ত ঘোলা জলীয় পদার্থ জলের বিকল্প হিসেবে জমা ছিল। যেহেতু চতুর্দিকে কোথাও তার জল ছিল না তাই বাঘ—ও আসত জল খেতে। সেই রুখু নদীর বুকে ওপরের বালিময় মাটিতে বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্তু দুঁদে শিকারি আবু সাত্তার তারই মধ্যে বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজে বের করে সেই বাঘ যেদিক থেকে এসে জলে পৌঁছত সেই দিকটি আবিষ্কার করে বাঘের চলাচলের পথে ঝোপঝাড়ের আড়ালে মাটির ওপরেই বসে বাঘ মারার পরিকল্পনা করেছিল।
আবু সাত্তার একইদিনে তাঁর এগারোজন আত্মীয়কে ধুবুড়িতে গুলি করে মেরে দেন। রাত্রিবেলা ওঁকে ঠকিয়ে ওঁর জমি—জমা সব নিয়ে নেয়। সেই দুঃখে এবং রাগে সে অমন কাণ্ড ঘটায়। ফলে তাঁর ফাঁসি হয়ে যায় এবং গুয়াহাটির হাইকোর্টে আপিল করেও কোনও ফল হয় না। ওঁর অনুরোধে ওঁকে টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করেছিলাম কিন্তু বাঁচাতে পারিনি।
সাত্তার বন—জঙ্গলের নিয়মকানুন বুঝত। বন— জঙ্গলকে ভালবাসত। কিন্তু মনুষ্য সমাজের কুটিল এবং ঠকবাজ মানুষদের সঙ্গে ও পরিচিত ছিল না। অনেক বছরের জঙ্গলের সঙ্গী সাত্তারের ফাঁসি হয়ে যাওয়াতে মাঝে মাঝেই বড় শূন্যতা বোধ করি।
সেইসব অনেক পরের ঘটনা আর এখানে তা অবান্তর। সেবারই দেখেছিলাম রাঙা নদীর পাড়ে মস্ত বড় পিপ্পল গাছের উঁচু ডালের ওপরে মস্ত বড় মাচা করে, চোরাশিকারিরা সেই মাচায় বসে অত্যন্ত শক্তিশালী টেলিস্কোপিক লেন্স লাগানো রাইফেল দিয়ে ওই ওয়াটার হোলে জল খেতে আসা প্রাণীদের শিকার করত। সেই মাচার ওপরেই ছিল চোরাশিকারিদের খাওয়া—দাওয়া এবং শোয়ার বন্দোবস্ত। তাদের সঙ্গে অবশ্য আমাদের মোলাকাত হয়নি, হলে দুপক্ষেরই কিছু হতাহত অবশ্যই হত। সেই সময়ে বহুদূর থেকে আসা চোরাশিকারিরা তাদের আস্তানা গুটিয়ে চলে গেছিল। রাঙা নদীর বিস্তীর্ণ শুকনো বুকের ওপরে ভুটান পাহাড়ের ঘনজঙ্গলাবৃত শরীর নানা রহস্যের আভাস দিত। বেলীকে সঙ্গে নিয়ে এই নদীর বুকে চরে বেড়ানো বুনো মোষেদের এবং বাইসনদের দল দেখেছিলাম। কাশেম মিঞার যাত্রাপার্টির কোনও সঙ্গীই হাতি বাইসন বুনো মোষ বা বাঘ শিকারে আদৌ উৎসাহী ছিলেন না। তারা ছিলেন হরিণ ও ময়ূর শিকারি। একবার পর্বতজোয়ার পাহাড়ের মেচ শিকারি কাননের দাদা হুকুম একটি ময়ূর মেরে আমাদের উপহার দিয়েছিল। ময়ূর অনেকদিনই হল ভারতের জাতীয় পাখি হিসেবে ভূষিত হয়েছে এবং ময়ূর শিকার গর্হিত অপরাধ। কিন্তু তখন সেইসব বিষয়ে কোনও জ্ঞান ছিল না, আইনকানুনও জানা ছিল না। কিন্তু ময়ূরের মাংস খেয়ে এটুকু বুঝেছিলাম যে পৃথিবীর পক্ষীকুলের মধ্যে ময়ূরের মাংস অত্যুৎকৃষ্ট হোয়াইট মিট। ভাবতেও খারাপ লাগে ময়ূরের মতো সুন্দর পাখিকে শিকার করা যায় এবং তার মাংসও খাওয়া যায়। কিন্তু সব দেশের শিকারিরাই সর্বভুক হন।
.
আমি আর বেলী চোরাশিকারিদের ছেড়ে যাওয়া মাচায় উঠে পাশাপাশি বসে ভুটান পাহাড়ের দিকে চেয়ে থাকতাম এবং নানা গল্প করতাম। গ্রীষ্মের উবু হাওয়া নদীচরের বালি উড়িয়ে এদিক ওদিক দাপাদাপি করে বেড়াত। আর ধুলোর মেঘ উড়ে যেত ভুটান পাহাড়ের দিকে। বেলীর সঙ্গে আমার এক অতি মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। প্রেম কাকে বলে তখনও দুজনের কারোরই জানা ছিল না। কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের দুই কিশোর কিশোরীর মধ্যে এক গভীর ভাললাগার বন্ধন দৃঢ় হয়েছিল। সব ভাললাগাই একসময় ভালবাসায় গড়িয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম,
”বারে বারে চেয়ো নাকো কারো পানে
প্রতিটি চাহনি জেনো, অজানিতে আসক্তি আনে…”
ঈশ্বর মেয়েদের শরীর ও মন বড় যত্নে গড়েছেন। ঈশ্বর মেয়েদের মন পাখির মতন, প্রজাপতির মতন, ফুলের মতন, ফুলের শরীরের মতন বড় যত্নে গড়েছেন। তাই তাদের প্রতি প্রত্যেক পুরুষেরই দুর্বার আকর্ষণ। পুরুষদের প্রতি মেয়েদের কী মনোভাব তা অবশ্য মেয়েরাই বলতে পারেন। তবে ভাললাগা অনেক ক্ষেত্রেই উভয়ত হতে দেখা যায় এবং আগেই বলেছি সেই ভাললাগাই একসময় প্রেমে গড়িয়ে যায়।
কাশেম মিঞার যাত্রাপার্টির অন্যরা যখন তুমুল কলরবে নদীর চরে চড়ুইভাতির বন্দোবস্তে ব্যস্ত সেসময় আমি আর বেলী মাচার ওপরে পা ঝুলিয়ে বসে কত না গল্প করেছি। আজ এত যুগ পরে ভাবলে ভারি অবাক মানতে হয়।
.
তামাহাটের আরেকজন মানুষের কথা না বললে এই কড়চা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, তিনি হলেন রতু বিশ্বাস। অত্যন্ত দীর্ঘদেহী সটান মেরুদণ্ডের এক মানুষ ছিলেন তিনি। পরনে লুঙ্গি আর ফুলহাতা শার্ট। পান জর্দা খেতেন। তাঁর বাড়িতে একটি ছোট্ট কারখানা ছিল। তাতে তিনি নানান জিনিস গড়তেন আর ভাঙতেন। উনি ছিলেন অরুন্ধতী রায়ের লেখা ‘God of small things’। উনি ভাল শিকারিও ছিলেন। তখনকার দিনে তামাহাটে চিতাবাঘের এমনই উপদ্রব ছিল যে অনেকেরই বাড়ির বেড়া ডিঙিয়ে চিতাবাঘ বাড়িতে ঢুকে ছাগল কি বাছুর মুখে করে আবার বেড়া টপকে লাফিয়ে বাইরে চলে যেত।
.
আমার পিসেমশাই ডায়াবেটিক ছিলেন। ডায়াবেটিসে তাঁর চোখ দুটি প্রায় নষ্ট হয়ে গেছিল। ঘষা কাচের চশমা পরতেন। একদিন শেষ বিকেলে পাট গুদামের পাশে মুরগির দোতলা কাঠের ঘরে হুটোপাটির শব্দ শুনতে পান। তখন বেলা পড়ে এসেছে। অন্ধকার প্রায় হয়েছে। তার খিদমতগার নেপালি ছেলেটিকে টর্চ ধরতে বলে তিনি তার বন্দুক দিয়ে আন্দাজে খাঁচার মধ্যে একটি গুলি করে দিয়ে কাঞ্চাকে বললেন, কাল সকালে খাঁচা খুলে দেখবি মুরগিগুলো কেন হুটোপাটা করছিল। সম্ভবত কোনও ভাম বা খাটাশ মুরগি ধরবার জন্য খাঁচায় ঢুকেছিল। পরদিন কাঞ্চা মুরগির খাঁচার দরজা খুলে দেখল একটি মাঝারি সাইজের চিতাবাঘ খাঁচার মধ্যে মরে পড়ে আছে। তাকে লেজ ধরে টেনে বের করার পর বাড়িসুদ্ধু সকলে মিলে তাকে নিয়ে নানান ভঙ্গিমায় ফোটোসেশন হল। তামাহাটের কিছু শিকারিকে দেখেছি মাথার ওপরে কাঁসার জামবাটি উল্টো করে রেখে তাকে গামছা দিয়ে বেঁধে গাছে উঠে বসা চিতাবাঘকে গুলি করতে। গুলিতে মরে অথবা না মরে চিতা যদি গাছ থেকে নীচে লাফিয়ে পড়ত তখন তার চাঁটিতে শিকারির মুন্ডুপাত হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা থাকত। সেই দুর্যোগ থেকে বাঁচার জন্য এই দিশি প্রক্রিয়া।
রতু জেঠুর একটি বেবি অস্টিন গাড়ি ছিল বহুদিন আগে। পরে তিনি T8 মডেলের তিরিশ দশকীয় ফোর্ড গাড়ি কিনেছিলেন। সেই গাড়ির সিডান ছিল না। হুড খোলা ছিল এবং তার চাকা ছিল সলিড রবারের টায়ারের। সে গাড়ি মাঠ—ঘাট, খেতের আল এবং ঝোপঝাড় মাড়িয়ে স্বচ্ছন্দে চলতে পারত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আমেরিকান জিপগাড়ির প্রবর্তন হয়েছিল। এই T8 মডেলের ফোর্ড যদিও আমেরিকান, কিন্তু সেই গাড়ি বোধহয় জিপের পূর্বসূরি।
রতু জেঠুর এই T8 মডেল ফোর্ডে করেই তাঁরই সঙ্গে আমরা বাগডোরা গ্রামে একবার বাঘ মারতে যাই। সেই গ্রামের সর্দার যার কথা আগেই বলেছি, মুনশের সর্দার। যে তার টাট্টু ঘোড়ায় চড়ে হাটের দিন তামাহাটে আসত। সেই সর্দার আমগাছে মাচা বেঁধে রেখেছিলেন এবং তার নীচে একটি পুরুষ্টু কালো পাঁঠা বেঁধে রেখে দিয়েছিলেন বাঘের টোপ হিসেবে। বাগডোরা গ্রামে পৌঁছে মুড়ি আর পাটালি গুড় খেয়ে আমি রতু জেঠুর সঙ্গে বন্দুক বাগিয়ে মাচায় উঠে বসেছিলাম। এবং ভদ্রলোকের মতো বাঘবাবাজি গাছের নীচে এসেওছিলেন। কিন্তু রতু জেঠু তখন আম গাছের ডালে শুয়ে নিদ্রা গিয়েছিলেন এবং আমাকে বলেছিলেন পাঁঠার কাছে কোনও জানোয়ার দেখলে আমার পায়ে একটা চিমটি কাটবি। অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পরে আবছা চাঁদের আলোয় আমি দেখলাম গুটিসুটি মেরে একটি চিতাবাঘ পাঁঠার কাছে এগিয়ে আসছে। আর তাকে দেখে পাঁঠা তার দড়ি ছিঁড়ে পালানোর চেষ্টায় দড়ির শেষ প্রান্ত অবধি গিয়ে ভয়ে নিথর হয়ে গিয়েছিল। আমি রতু জেঠুর পায়ে চিমটি কাটতেই রতু জেঠু ঘুম ভেঙে মোটা ডালে উঠে বসে হাততালি দিয়ে বলে উঠলেন, ‘দূর শালা, দূর শালা’।
রতু জেঠুর হঠাৎ শালা সম্বোধনে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বাঘ এক লাফে অন্ধকারের মধ্যে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। আমি জেঠুকে বললাম, এটা কী হল?
রতু জেঠু বললেন, শালা শেয়াল।
কিন্তু আমি নিজের চোখে দেখলাম শালা শেয়াল নয়, সেটি একটি বাঘ।
জেঠুকে সেকথা বলাতে উনি বললেন, তুই ছেলেমানুষ। তুই বাঘের সঙ্গে শেয়ালের তফাত কী জানিস?
আমার কপাল মন্দ! বাঘ শিকার সেই সন্ধেতে আমার হল না।
.
শাখ—বোশেখির মেলা, জিঞ্জিরাম নদী এবং যম— দুয়ারের বন এসব যখন ঘুরেছিলাম বেলীর সঙ্গে, তখন থেকে আজ প্রায় সত্তর বছরের ব্যবধান হয়ে গেছে। লালমাটির টুঙবাগান যেখানে এরোপ্লেনের রং তৈরির ফলের অরণ্য ছিল। আলোকঝারিপাহাড়ে শাখ—বোশেখির মেলার বহুবর্ণ টুকরো টুকরো স্মৃতি মনের চোখে যখন ভাসে তখন মনে হয় যেন সেদিনের ঘটনা বা দৃশ্য।
আমার বয়স এখন পঁচাশি হতে চলল, বেলীর বয়সও এখন হবে প্রায় আশি। বেলীর সঙ্গে দেখা হয়নি পঁচাত্তর বছর। অথচ সেই কিশোর বয়সে তার সঙ্গে এমন একটি নিষ্পাপ, সুন্দর এবং তীব্র অনুভূতির সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আজকে এতদিন পরে এসে বুঝি তাকেই বোধহয় প্রেম বলে। মানুষের শরীরের বয়স বাড়ে একদিন। এই শরীর রেখে আনন্দধামে যাত্রা করতে হয় সব পুরুষ এবং নারীকেই। কিন্তু প্রেমের বয়স বাড়ে না। প্রকৃত প্রেম অমলিন, সুরভিত থাকে স্বর্গের পারিজাত ফুলের মতো তা সত্তাকে স্নিগ্ধ এবং আবিষ্ট করে রাখে। জানি না আজও যদি বেলী বেঁচে থাকে তবে হয়তো তার মনে রাজলক্ষ্মীদেবীর ‘হাব—ভাব—কদমের ফুল’ বইয়ের কবিতার মতো সেই কবিতাটি মনে পড়ে তার।
আয়নার সামনে বসে চুল উঠে যাওয়া, দাঁত পড়ে যাওয়া একসময় সুন্দরী কুঞ্চিত চামড়ার মুখে রমণী আয়নাকে সম্বোধন করে হয়তো বিড়বিড় করে ওঠে। আজ যৌবনও নেই, রূপলাবণ্য নেই, দাঁত পড়ে গেছে, চুল উঠে গেছে— এই মুখের ছায়া পড়েছে আয়নাতে। আয়নাকে বলবে, ‘আমার ছিল সে এক আশ্চর্য ভালবাসা, তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবি সে পাওয়াকে।’
আমাদের প্রত্যেকের জীবন ঘিরেই হয়তো এই শাখ—বোশেখির মেলা, আলোকঝারির পাহাড়, লালমাটির টুঙবাগান, পর্বতজোয়ার পাহাড়ের মেচ পরিবারের কাননবালা অথবা জিঞ্জিরাম নদীর পাশে কুমির ভরা রাভাতলা গ্রাম, গারো পাহাড়ের পাদদেশের পালতোলা ছইদেওয়া নৌকায় বর্ষার দামাল ব্রহ্মপুত্র পেরোনোর অভিজ্ঞতা, যমদুয়ারের দুর্ভেদ্য বনাঞ্চলের স্মৃতি ঘুরে ফিরে আসে শয়নে— স্বপনে—জাগরণে। এইসব স্মৃতিরোমন্থনই কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব এমনকী বার্ধক্যও পার করে মানুষ— মানুষী মৃত্যুর দরজায় এসে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে কবে যে দেবতা ডেকে নেবেন, তার অপেক্ষায় দিন গোনা।
তখন মানুষ—মানুষী নিরুচ্চচারে গান গাইবে,
‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে
শূন্য ঘাটে বসে আছি একা
পার করে লও
পার করে লও
পার করে লও
খেয়ার নেয়ে।’
Leave a Reply