এ জীবন লইয়া কী করিব?

এ জীবন লইয়া কী করিব?

বৃষ্টি পড়ে ট্রাটোর ম্যাটোর সাবওয়েতে জল। মেট্রো বন্ধ গাড়ি কাৎ টেলিফোন বিকল। জানালার শার্সিকে খামচাচ্ছে হাওয়া। হাওয়ায় মেশানো জলরেণু। কাচের শরীরে নাচে জলের কত্থক।

লোকটা এসব কিছু দেখেনা। লোকটা বসে আছে বেশ আরাম চেয়ারে। আরাম চেয়ারে এখন বিরাম যদিও নেই, তবুও বসেছে। একটু আগে শুয়ে ছিল চিৎ। দেখছিল ফ্যানের ঘুর্ণন। আর.পি.এম. কত গুণছিল। এখন বসেছে। দেয়ালে অনেক সুইচ। আলো জুলে লাল সাদা নীল। সব আলো বন্ধ করে লোকটা বসেছে। এপাশে গদীর চেয়ার খালি। ও পাশে গদীর চেয়ারে গুঁড়ো গুঁড়ো বালি। বাথরুমে বালতিতে জলের ফোঁটারা পড়ে টুপ টুপ টুপ। এ ছাড়া এখন সবকিছু চুপ। লোকটা উঠে বসে। লাল আলো নীল আলো জ্বলে। বন্ধ করে ফের। একা একা জ্বালায় নেভায়। স্টিরিওতে ভরল ক্যাসেট। কী ক্যাসেট দেখেও দেখেনা। অবশেষে বাজল বেহালা। ভুল স্পীড টিপে দিয়ে বেহালাকে বেসুরো বানায়। বেসুরো বাজনার খেলা। নিজের সঙ্গে বেসুরো-বেসুরো এই বেশ খেলা। এইভাবে বেশ বেলা যায় তার। এইবার টি.ভি. চালায়। বিভিন্ন ছবি আসে বিভিন্ন চ্যানেলে। রিমোট কন্ট্রোলে সে অল্প অল্প দেখে। টমেটোর সস্ ও কিচাপ মেখে স্নান করে পাহাড়ি বালিকা। নাট, স্ক্রু ও বল্টুর মালা গায়ে জংলি যুবক গান গায় গ্লুম গ্লুম গ্লুম। রঙিন প্যাকেট ছিড়ে দু’হাতে ওড়াচ্ছে সাদা পপকর্ন। স্যানিটরি ন্যাপকিন আর দরকার নেই বিজ্ঞাপিত করে এক রোবট কিশোরী। সাজানো শ্মশানে মৃতদেহ ঢেকে দিচ্ছে ভিমলের শাড়ি। এই সব পুরোনো পুরোনো লাগে। একটাও ভাল নয়। লোকটা রিমোট কন্ট্রোলে বলে, তিন চার পাঁচ ছয়… অবশেষে আটের নম্বরে আসে সাদার মূর্ছনা। সাদার ভিতরে আসে কালো কালো ঢেউ। ঢেউ-এর ভিতরে আসে স্পট। বেশ লাগে। যন্ত্র শব্দ শোঁ-শোঁ-শোঁ…প্রট্‌ প্রট্‌ প্রট। তারপর উঠে যায় ফের। পায়ের পাতার নিচে মৃদু মোলায়েম ঘাস রঙ পিভিসি কার্পেট ঠিক যেন উইম্বলডন টেনিসের মাঠ। ধীরপায়ে লোকটা বেসিনের সামনে দাঁড়ায়। একটি বেসিন আছে তার, দুধ সাদা রং, প্রিয় স্থান। ওখানে দাঁড়ায় প্রিয় বেসিনের কাছে। একটি আরশোলা আছে। পোষা আরশোলা। বেসিনেই থাকে। কারণ বেসিন থেকে সে বেরুতে পারে না। বেসিনের মসৃণতা বেয়ে চেষ্টা করে উপরে ওঠার। চেষ্টা করে বেসিনের বাইরে যাবার। বারবার পড়ে যায় চামর চিক্কণে। লোকটা এর জীবন দেখে। কবে তার পূর্ব পুরুষ কলোসিয়ামে দেখেছিল খেলা। গ্লাডিয়েটার দেখেছিল। এখন আরশোলা দেখে। মাথার ভিতরে এক আনন্দ পিংপং। কী দেখে আনন্দ তার। বারবার ব্যর্থতা-রগড়। বারবার ফস্কাচ্ছে মাইরি, হি-হি, নাকি তার অবিরাম ওঠার প্রচেষ্টা। নাকি এসব কিছুই নয়। লোকটা রোজ রোজ দেখে ঐ প্রিয় আরশোলাটিকে। এখনো দেখছে।

কিছুক্ষণ আরশোলা দেখা হয়ে গেলে লোকটা আবার নতুন খোঁজে। ঘরের ভিতরে তার নতুনের সংখ্যা বড় কম। বড় তাড়াতাড়ি অ-নতুন হয়ে যায় যে কোন নতুন। ব্যবহৃত শুয়োরের মাংসের মতো পুরোনো নতুন। সুখের জন্য আনা যন্ত্রপাতিগুলি যার যার নিজস্ব দুঃখের কথাও জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং আবার বিষাদ। তখন প্রাঙ্গণ ভাবে। প্রাঙ্গণের সঙ্গে ভাবে শিশু। প্রাঙ্গণ মানে হল ডাইনিং-এর সামনে স্থান। এক্কাদোকা হতে পারে মোজাইক নকশায়। লেমম্যান কিংবা রাজা একটি বালিকা চাইল…। এখানেই খেলা হতে পারে। ক্যাবিনেট থেকে নামে খেলার শিশুরা। খেলা হয়, খেলা জমে। পুরো খেলা নয়, খেলাদের মিনি। শিশুরা খেলেনা, শিশুদের পুতুলেরা খেলে।

শিশুদের খেলা মানে সি.ডি. সেভেন সিক্স। বাক্সো যন্ত্র টিপে দিলে আলোর অক্ষর আসে জোছনা-বিষাদ সাদা স্ক্রিনে। চোর চোর… দাড়িয়াবান্ধা… ভলিবল… টেবিল টেনিস…। দাড়িয়াবান্ধা হয়নি বহুকাল। আজ হোক। ফোর ডি টিপে দিলে দাড়িয়াবান্ধা হয়। দাড়িয়া-বান্ধার হৈ হৈ হয়। হিপ হিপ হয়। একদিন ভালবাসা টিপে দেবে নাইন নাইন থ্রি। তৃপ্ত সঙ্গম ফোর লাইন টু। অভিমান, বিরহ, দুঃখ, কাছে পাওয়া, সমস্ত নম্বর আছে কোডে ফেলা। পুতুলেরা খেলে।

যে কোনো খেলার শুরু আছে বলে ভেঙে যাওয়া আছে। পুতুল রেফারি ইশারায় বলে খেলা ভেঙে গেল। পুতুলেরা নতুন নম্বর পাবে বলে বসে থাকে। এই পুতুলেরা আলাদা আলাদা। অস্তিত্ব ও ব্যক্তিত্বে পৃথক সবাই। এদের আলাদা নাম ছিল একদিন। এমন অনেক নাম জানা আছে, সেই নাম এখনো কোনো পুতুল পায়নি। সুতরাং বলা চলে এখনো অনেক নাম পুতুল প্রজাতির জন্য বাকি রয়ে গেছে। পৃথিবীতে আরও পুতুলের জন্ম হলে আরও আরও নাম দেয়া যেতে পারে। টেলিস্কোপ নাম দেয়া যেতে পারে, ডাকনাম টিলু। এন্টিমনি দেয়া যেতে পারে, ছোট করে মনি, এরকম পোর্সিলেন, আর্সেনিক, হিলিয়াম, কত নাম পড়ে আছে বাকি। কিন্তু অসুবিধে হ’ল ঐ সাদা রং বাক্সোমেশিন গ্রহণ করে না কোনো নাম। অক্ষর জানে না সে, শব্দমালা মানে না, ইলেকট্রনস্রোত ভালবেসে সংখ্যার বিদ্যুৎস্পর্শ শুধু জানে। পুতুলেরা তাই সব সংখ্যা হয়েছে। সংখ্যামালা নামী সেই প্রাচীনা পুতুল সংখ্যামালা। নাইন নাইন নাইন।

লোকটা এখন এঘর খোঁজে ওঘর খোঁজে। অন্যরকম কিছু পায় না। এ-দেয়াল দেখে, ও-দেয়াল দেখে। অন্যরকম কিচ্ছু দেখে না। এই কোনা দেখে, ঐ কোনা দেখে, তখন ঘরের কোনায় আটকে গেল চোখ। ঐখানে পড়ে আছে প্রজেক্টর মেশিন। একা একা আদুর গায়ে ধুলো মেখে চুপচাপ।

ইস্‌স্‌।

মানুষটার দুঃখ হ’ল।

মানুষটা মেশিনটাকে বললো :

ওঃ স্যাড ভেরী স্যাড ইউ লোনলি এলোন।

মেশিনটা মানুষটাকে বললো :

নট লোনলি, আই সি ইউ ওনলি অল ডে লং

মানুষটা মেশিনটাকে বললো :

হাউ ফানি নাহি জানি কি করিয়া হয়।

মেশিনটা মানুষটাকে বললো :

মাইলেন্স গুড পারফরমেন্স জানিও নিশ্চয়।

মানুষটা মেশিনটাকে বললো :

থ্যাংক ইউ মাই ফ্রেন্ড উই উইল সিং অ্যা সং।

মেশিনটা মানুষটাকে বললো :

উই উইল বি গুড ফ্রেন্ডস অল লাইফ লং।

লোকটা এবার প্রজেক্টারের চোখ মুছল। গা মুছল খুব যত্ন করে। তারপর টেবিলে বসাল। উল্টো দিকের দেয়ালের সাদার দিকে মুখ। প্লাগটা লাগাতেই দেয়ালের গায়ে লাগে আলোর চাদর। লেন্সের সামনে মানুষটার আঙুলগুলো নেচে উঠল। ওমনি নাচল ছায়ারা। ছায়া দেখতে বড় ভাল লাগছিল মানুষটার। এখন ছায়ারাও সেভাবে আসে না। টিউবলাইটের আলো ছায়াটায়া দেয় না তেমন। হ্যালোজেনের ছায়ায় কেমন মনমরা মনমরা ভাব। শার্সির ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে পড়া চাঁদ কখনো গা ছুঁলে যে করুণ ছায়া হয়, তার সাথে একদিন লোকটির কথা হয়েছিল। শুভেচ্ছা বিনিময় হয়েছিল। আবার আসব বলেছিল ছায়াটি। কিন্তু আর আসেনি এখনো।এদের দয়া হলে, পারমিশন পেলে চাঁদের চূর্ণক কিছু অ্যাডমিশন পায়।

লোকটা এবার প্রজেক্টারকে কী যেন বললো।সাস্তনা দেবার মতো ওর গায়ে বুলিয়ে দিল হাত। বললো,ওল্ডিজ ইজ গোল্ডিজ। তারপর একটা ড্রয়ার টানল।ড্রয়ারের ভিতরের লাল মখমল মোড়া একটি বাক্স।বাক্স খুললেই রঙিন ফিল্মের স্লাইডস।লোকটা প্রজেক্টারে একটা স্লাইড ভরে দিল।দেয়ালে রং ভরা মেঘ, সূর্য ডুবুডুবু। একটা একটা স্লাইড –

দেয়ালে সবুজ ঝিলে কতশত পদ্ম ফুটিয়েছে।

 দেয়ালে কদমতলে ময়ুর ময়ুরী নাচে।

দেয়ালে আম্রশাখে গাহিছে বুলবুলি

দেয়ালে যুবতী নারী পরনে কাঁচুলি।

এবার ঘটল এক মজার ব্যাপার।

দেয়ালের ছবির নারী,ঐ আলোর নারী মূর্তিমতী হল।রক্তবতী, মাংসবতী হল, মানুষের শরীর পেল। দেয়াল থেকে বেরিয়ে এল। আর ওমা! কী কাণ্ড, মেয়েটার চোখ থেকে ঝরে পড়ল দু’ফোঁটা জল। বললো, শাপমুক্ত হলাম। লোকটা ভাবল, এ কী ব্যাপার! মেড ইন হল্যান্ড, এত ভাল, এত দামি প্রজেক্টার, এমন বিগড়লো; লোকটা স্লাইডটা টেনে বার করল। দেখল সাদা।

মেয়েটা বললো আপনি বাঁচালেন আমায় প্রিয়, প্রণাম তোমায় ঘনশ্যাম। আমার ফিলিম জন্ম শেষ, মানুষ জন্ম পেলাম।খিদে পেয়েছে, খাব।

লোকটার চোখে মুখে কোনো ‘একী হল’ ভাব নেই। লোকটা মেয়েটার দিকে সোজা চোখে চায়। মেয়েটা আবার বলে, খাব। লোকটা বলে, আছেতো টিনড মাশরুম। বহুক্ষণ পরে, বহুদিন পরে লোকটা কোনো কোনো প্রকৃত প্রাকৃত কথা বলে। মেয়েটি বলে, মুড়ি-ফুলুরি নেই? লোকটা বলে, এসব হয় না এখন। বাড়ির তলার ম্যাক বারে হটডগ পেতে পার। খাবে? মেয়েটা অবাক হয়ে তাকালে লোকটা বলে, জানোনা, হটডগ! নামও শোননি! কী নাম তোমার? মেয়েটা বললে, বাবা নাম রেখেছিল সাবিত্রী। সিনেমায় যখন নামলাম, সবিতারাণী কিছুদিন পরে মিস স্যাবি।

তারপর?

তারপর নাচি। সেই নাচ সিনেমায় হয়। সতীবেহুলায় নাচি অমরায়, ইন্দ্রের সভায়, পদ্মাবতী নাচি পুরীর সভায়, জয়দেব সিনেমার নাম, মিস কিটির এক্সট্রা হয়ে নাচি রাতের কলকাতা বইয়ে, সিঁথির সিঁদুরে নাচি ধূপকাঠি হাতে নিয়ে মন্দির চাতালে।

তারপর?

তারপর ভুল হল। প্রেমে পড়লাম। ধুতির উপর হাফশার্ট। গান গাইত যমুনা কিনারে শাজাহানের স্বপ্নের শতদল। কাচি সিগারেট খেতো, মুড়ি-ফুলুরি ভালবাসত, রথের দিনে পাঁপর ভাজা খেত, হাতে থাকত উল্টোরথ বই। মেকাপম্যান। কিগো, শুনছো তো?

গো অ্যাহেড…

তখন এল যে বরষা সহসা মনে রিমঝিম রিমঝিম গান গেয়ে যাই। সতীনাথ। সতীনাথ গো। তখন নাচে ভুল হয়। ছন্দে ভুল হয়। ছেনালির ভিতরে ঢুকে যায় ফুলতোলা। একদিন ক্যাবারের নাচে ভুল করে আরতির ছন্দ চলে আসে।

হ্যাঁগো, শুনছো তো…

এ্যাহেড…

ঐ বইয়ের যে ডিরেক্টার ছিল, ভারী হিংসুটে। ভারী যাদুকর। আসলে সে একা চাইত আমায়। কিন্তু আমার জীবনে যে আরেকটা বই চলছে তখন; মেকাপম্যান গো…। একদিন ভীষণ রেগে গিয়ে বললো, প্রেম পাগলিনী তুই ফিল্ম হয়ে যা। সেই থেকে আমি ফিলিম।

ভারী অদ্ভুত তো, শরীরটা সেলুলয়েডে মিশে গেল? মিশে যেতে কতটা সময়? লোকটা বলে। মেয়েটা বললো, কতক্ষণ জানিনা। শুধু মনে আছে জোড়হাতে কী যেন বলতে চেয়েছি। তক্ষুণি শোনা গেল – একহাজার আটবার প্রজেক্শন হলে পরে মনুষ্যজন্ম পাবি ফের। তার মানে একহাজার সাতবার দেয়ালে পড়েছি। তুমিই বাঁচালে। কীগো…শুনছো না…।

গো…।

কি গো!

গো অ্যাহেড।

ক্ষিদে পেয়েছে। কতবছর খাইনি কিছুই। ক্ষিদে? দেখ, ফ্রীজে দেখ, কি রয়েছে দেখ…। মেয়েটা অল্প হাসে। বৌ নেই বুঝি আপনার! এবার এগুল। সামনেই আয়না রয়েছে। এইবার লজ্জা পেল। দু’হাতে ঢাকল দেহ। ছুটে গেল সামনের ঘরে। ওখানেও দর্পণ রয়েছে। দরজায় খিল দিয়ে দর্পণে নিজেকে দেখে। ব্রা ও প্যান্টিতে সেই কবেকার ক্যাবারে কালের। তাড়াতাড়ি বিছানার চাদরে নিজেকে জড়াল। চাদরে পুরুষ গন্ধ। মেয়েটি ঋতুমতী হল বহুকাল পরে। এই যে মেয়েটি, সাবি, মিস স্যাবি, যে কিনা এখন আবার সাবিত্রী হয়েছে, গান গায়…। সাত ভাই চম্পা জাগোরে জাগোরে। তুড়ি দেয়। খুশিতে ভরেছে মন। লোকটার কাছে যায়। বলে,মুড়ির টিন কই, মুড়ির টিন?

লোকটার কথা নেই কোনো। অপলক মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটির হাসি দেখে। হাসলে যেন মেয়েটির মুখ থেকে রেডিয়াম ঝরে। লোকটা নিয়ে আসে তিনটে প্যাকেট। বলে খাবে যদি খাও…। লাল প্যাকেট হাতে নিয়ে মেয়েটা বলে, কী আছে এতে?

স্পঞ্জ। স্পঞ্জের গুঁড়ো। ক্ষিদে মরে যায়। নীল প্যাকেটে হাত দিয়ে মেয়েটা বলে, কী এতে? চিনি ও চর্বি। হাই ক্যালোরি। শক্তি। হলুদ প্যাকেট মেয়েটি বলে, আর এই মুখপোড়া প্যাকেটে?

বিস্কুট! বিস্কুট! জিভে টেস্ট লাগে।

বিস্কুট, শুনেই হাত হল থাবা। চিরলো প্যাকেট। বিস্কুট খেয়ে বললে আঃ। ‘আঃ’ শব্দের বিসর্গ দুটি কাচের বল হয়ে ঝাড়লণ্ঠনে ঝুলতে লাগল সুখে। মেয়েটি বললো ইচেক দানা বিচেক দানা দানার উপর দানা। বললো ঝুমকা গিরা রে। বললো মন ডোলেরে… মেরা তন…।

লোকটাকে বললো হ্যাগা, মানুষ, কর কী?

কিছুই করি না।

মানে! বেকার নাকি? ঘরদোর দেখে তো মনে হয়না। আপিস নেই?

আছে।

আজ যাওনি?

ছুটি।

তবে আমার জন্য শাড়ি কিনে আনো গে যাও। সায়া, ব্লাউজ। ছত্তিরিশ সাইজ। এবেলা খেয়ে খাইয়ে ওবেলা চলে যাব। জ্বালাব না বেশি।

কোথায় যাবে?

বাড়ি। তেঘড়িয়া গ্রাম। এরোপ্লেন নামার শব্দ শোনা যায়। হাঁস আছে, আয় আয় আয় চৈ চৈ…। এখনো আছে তো? বুলুদির বাড়ি, পাকা ছাদ, বাড়িতে রেডিও। শুক্রবারে নাটকের ভিড় ওদের বারান্দার সামনে। আমাদের বাড়িতেও এল তারপর। জয়দেবে পদ্মাবতী নেচে রেডিও আনলাম মার্ফি কোম্পানির। এখনো আছে তো, নিয়ে যাবে? বিদ্যেধরী খালে নিয়ে যাবে, সোঁদর বনের ইস্টিমারের তো, খড়ের নৌকা, শিউলি তলায় যাব খুব ভোরে, একটিও ফুল মাড়াব না পায়ে… যাব। আমি আর প্লাস্টিকে নেই, রক্তের হয়েছি আমি, মাংসের হয়েছি।মেয়েছেলে। তোমরা যাকে বল নারী।

লোকটা হাসে। বলে, ঐ সব কবে চুকেবুকে গেছে। তেঘড়িয়া নাম আছে শুধু। ফ্ল্যাটের জঙ্গল। হাঁসটাস, পুকুরটুকুর এইসব চাও যদি দেয়ালে দেখ। প্রজেক্টার আলোকে দেখ, ইউম্যাটিক দেখ…। নারীটা বললো, তোমার ওসব অংবং মানেই বুঝি না। বলগো কী করি উপায়? কী আর করবে তুমি, থাকো।

রিল্যাক্সন পালঙ্কে থাক। রাতের বেলায় সোনার রড ছুঁইয়ে দেব, ঘুমবে। ওটা ভাইব্রেটার।সকালে রুপালি এলার্মে জেগে উঠবে ফের। তারপর?

বল তুমি বল তারপর?

নানা, তুমিই বল!

আমি আবার কী বলব?

তারপর ভাত রাঁধব।

সে তো মাইক্রোওয়েভ ওভেনে হয়।

বাটনা বাটবো।

মিক্‌সি আছে।

ফুল তুলব।

প্লাস্টিক পিভিসির ফুল।

তোমার জামা কাচব, গেঞ্জি কাচব।

ওয়াশিং মেশিন।

ঘর ঝাড়ু দেব।

ভ্যাকুয়াম ক্লিনার।

তোমায় ঘুম পাড়াব।

ভাইব্রেটার।

গান শোনাব। গানে ভুবন ভরিয়ে দেবে ভেবেছিল একটি পাখি।

স্টিরিও।

কানে কানে কথা কব।

হেডফোন।

মেয়েটা হঠাৎ দু’হাতে আঁকড়ে ধরল ওর মেঘবরণ চুল। ডুকরে উঠল। বললো, এ জীবন লইয়া তবে কী করিব, কী করিতে হয়?

লোকটা বললো, সফটওয়ার শেখো। কোবল, জিপসি, সিপিসি…।

মেয়েটা কাঁদতে লাগল। ভাল্লাগে না, ভাল্লাগে না। লোকটা ধীরে ধীরে বেসিনের কাছে গেল। সেই সাদা বেসিন। শ্বেত মসৃণ। মসৃণ দেয়ালে সেই প্রিয় আরশোলা। লোকটা ডাকে।বলে, দুঃখ কোরো না, এদিকে এসো, মজা দেখবে এসো।

এ মজা দেখব না আমি। আমি দেখব আকাশের মজা। বক দেখব, চিল দেখব। ছেলের হাতের লাটাই দেখব। আমি দেখব নারকোল কুঁচি দেয়া ঝালমুড়ি রূপ। চাল ধোবো। গা ভিজিয়ে স্নান করব শাপলাপুকুরে। নতুন বৃষ্টির গন্ধ নেব, পুরুষের ঘামগন্ধ বুকের ভিতরে। লোকটা তবু হাতছানি দেয়। ডাকে। সাবিত্রীর পা নড়ে। জল এগোয় না, তৃষ্ণা এগোয়। সাবিত্রী মানুষটার পাশেই দাঁড়ায়। লোকটা বলে, দেখ দেখ দেখ। সাবিত্রী দেখে দুধবরণ সাদা তেল চিকচিক বেসিন দেয়ালে বেচারা আরশোলা বারবার পড়ে যায়, তবু সে তার সরু সরু পায়ে মসৃণতা আঁকড়ে ধরে বেসিন রাজ্যের বাইরে যেতে চায়। সাবিত্রীর আরশোলাটাকে ভাল লেগে যায়। ওরা দুজনেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আরশোলা দেখে। মুক্তির প্রচেষ্টা দেখে। দেখতে দেখতে সাবিত্রী এক সময় ক্লান্ত হয়। লোকটার ধরে। বিছানার চাদর জড়ানো আদি মানবী লোকটার হাত ও বাহুমূল ধরে। হাওয়া বয় শন্‌শন্‌, তারারা কাঁপে। লোকটা হাত ছিটকে চলে যায়। ঝাঁপিয়ে পড়ে পালঙ্ক নরমে। পালঙ্কে ওঠে স্পঞ্জ ঢেউ। লোকটা সোনার কাঠি বের করে। সোনালি রড। বললো, ঘুমোবো। মেয়েটা ছুটে যায়। লোকটার হাত থেকে কেড়ে নেয় ঐ সোনার কাঠি। বলে এখন ঘুমিও না ওগো, আমার সঙ্গে জেগে থাকো। এখনো তারা আকাশে জ্বলে, মনে যে আমার কথাটি বলে। লোকটা কিন্তু রাগে না। সাবিত্রীকে বকে না, মারে না। স্টিরিওতে কী একটা মিউজিক চালিয়ে দিয়ে বেসিনটার কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।

সাবিত্রী পালঙ্কে বসে। দু’হাত হাওয়ায়। গা থেকে খসে যায় চাদর বল্কল। গান গেয়ে ওঠে, আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাব আমি তোমার কাছে… লোকটা ওদিকে চায় না, আরশোলার দিকে চায়…।

সাবিত্রী সে সময় আরশোলাটার দিকে ধেয়ে যায়। উথাল পাথাল পা। আরশোলাকে ছুইয়ে দেয় ঐ সোনার কাঠি। আরশোলাটা কিন্তু ঘুমোয় না। সাবিত্রী তখন লোকটাকে হঠাৎ আলিঙ্গন করে। লোকটা হ্যাঁ-ও করল না, নাও করল না। আস্তে আস্তে ওয়াশিং মেশিনটার কাছে গেল। সাবিত্রীর দিকে তাকিয়ে বললো, এটা নতুন কিনেছি, নতুন মডেল। মেশিনটাকে বললো, হ্যালো,ভালো? মেশিনটার বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। লোকটা মেশিনটাকে চুমো খেল একটা। তারপর শুয়ে পড়ল সানমাইকা লাগানো রঙিন পালঙ্কে। সাবিত্রীর চোখে তাকিয়ে মৃদু হাতছানি দিল হাতে। সাবিত্রীর মুখে টগর ফুটল, হাস্‌নুহানা ফুটল। সাবিত্রী পায়ে পায়ে এগুলো। লোকটা বললো, আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও। সাবিত্রী তখন পদ্মপাতা ডান হাতটা খুলেছে সবে, শুরু করেছে ঘুমপাড়ানি গান। লোকটা তখন ওর বাম হাত থেকে কেড়ে নেয় সোনার কাঠি। নিজেই নিজের মাথায় ছোঁয়ায়, আর লোকটা ঘুমিয়ে পড়ে।

সাবিত্রীর পদ্মপাতা হাত গুটিয়ে যায়। মুঠি হয়। সেই মুঠিটা শক্ত করে ধরে ঐ রড। ওটাকে মুষলের মতো ধরে। ভীষণ জোরে বাড়ি মারে ঐ ওয়াশিং মেশিনে। – ওলাউঠো। তক্ষুণি রডটা ভেঙে যায়। ছোট ছোট স্প্রিং ও ব্যাটারি, ট্রানজিস্টার, এইসব মাটিতে পড়ে থাকে। আপদ ভেঙেছে, এই ভেবে এইবার শ্বেতকমল বেসিনের কাছে যায়। ওখানে দুধ ধবল দেয়ালে ঐ আরশোলা একই কাজ করে যায়। বলে, আরশোলারে আরশোলা, তুই ওকে যাদু করেছিস। শঠের মায়া তালের ছায়া। বলে, তুই থাকিস জলে আর আমি থাকি ডালে, মোর সাথে দেখা হল মরণের কালে। সাবিত্রী তখন আরশোলাটাকে মুঠো করে ধরতে যায়। গা থমথম গা থমথম গা থমথম করে। আরশোলাটার পা ধরে দু’আঙুলে তীব্র টান দেয়।তখন আরশোলাটার গা থেকে স্প্রিং-এর পা, ধাতব পা খুলে আসে, প্লাষ্টিকের ডানা খুলে আসে, কাচের চোখ পড়ে যায়, আর সানমাইকার পালঙ্কে শুয়ে থাকা লোকটা। ছটফট করে ওঠে। স্পঞ্জ খাট কেঁপে ওঠে। আর আরশোলাটার, স্প্রিং-এর আরশোলাটার বুকের ভিতরে জল থলথল ছোট্ট একটা নরম মটর দানা। ঐ নরম মটর দানাটাও ওর গা থেকে পড়ে যায়। সাবিত্রীর মধ্যমা আর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের মধ্যে সোহাগে রয়েছে ছোট্ট মটর দানার মতে ছোট্ট নরম একটা প্রাণ পুঁটুলি। ওটা টিপে দিলেই লোকটা মরে যাবে। সাবিত্রী ওর আঙুল প্রসারিত করে পদ্মপাতা করে।তার ঠিক মধ্যিখানে শিশির ফোঁটার মতো টলটল করছে প্রাণবিন্দু। জীবন। মানুষটার জীবন।

এ জীবন লইয়া কী করিব, কী করিতে হয়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *