৪. মাগুরি বিলের ধারে

আমরা এসেছি মাগুরি বিলের ধারে৷ পুরোপুরি সন্ধে হয়নি এখনও৷ থকথকে অন্ধকার নেমে আসছে চারিধারে৷ তারই মাঝে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে এই বিস্তীর্ণ জলাশয়৷ চারিধারে উজনি আসামের ঘন জঙ্গল৷ হ্রদের বুকে উঁকি মেরে নিজের মুখ দেখছে ঘোর অন্ধকার মেঘলা আকাশ৷ আর একটু পরেই আমরা ঢুকে পড়ব জঙ্গলের ভেতর, কাউরীবুড়ির মন্দিরের দিকে৷

এখন আমি জানি যে কাউরীবুড়ির মন্দিরে আমার সঙ্গে দেখা হওয়া মহিলাই মাধুরীর দিভাই৷ বিধবা মহিলা তাঁর ভাইয়ের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত৷ যৌন ঈর্ষায় জর্জরিত হয়ে মাধুরীকে তিনিই একটু একটু করে ঠেলে দিচ্ছিলেন নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে৷ হয়তো বা তার পরিবারের বাকিদেরও৷

আমরা বলতে আমি, কাকা আর পরাগ৷ আমার আর পরাগের পরনে শার্ট-প্যান্ট, কাকার ধুতির রং গেরুয়া, ঊর্ধ্বাঙ্গে একটা উড়নি৷

কাকা আমাদের দুজনকে আদেশ দিলেন, ‘‘যাও স্নান করে এসো৷’’

মাগুরি বিলের কনকনে ঠান্ডা জলে পা দিতেই সারা শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল৷ সেই গভীর নির্মম শৈত্য আমার পা থেকে কোমর অবধি অসাড় করে দিল প্রথমে৷ কেঁপে উঠলাম খানিকটা৷ তারপর মন শক্ত করে ডুব দিলাম জলের মধ্যে৷

সকালে উঠতে দেরি হয়েছিল বেশ৷ কাল রাতের কথা সদানন্দকাকুদের বলা হয়নি, কাকার বারণ ছিল৷ শুধু একবার গতরাতের ঝড়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করাতে কাকু আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘‘কই, কোনো ঝড়বৃষ্টি হয়নি তো কাল!’’

আমার ওঠার আগেই দেখি কাকা আমার ঘরের বাইরে একটা চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন৷ আশ্চর্য মানুষ বটে! কাল অনেক অনুরোধ করা সত্ত্বেও তিনি থাকলেন না এই বাড়িতে! কাকুর সাইকেলটা নিয়ে ওই গভীর রাতেই চলে গেলেন নিজের ডেরায়৷ ভদ্রলোক আমার কাছে সারাজীবন এক রহস্যই রয়ে গেলেন৷

আমাকে বললেন, ‘‘ঝটপট রেডি হয়ে নাও ভবতারণ, আজই সেই দিন৷ অনেক কাজ আছে৷’’

বেরোতে বেরোতে প্রায় নটা৷ স্নান করে জামাটা গলিয়ে বেরিয়ে দেখি বাড়ির সামনে দুটো মোটরবাইক, একটায় মংকু, আরেকটায় পরাগ৷ আমাকে দেখে মংকু একগাল হাসল৷ পরাগের চোখে একটা বেখাপ্পা সাইজের রোদচশমা, তাতে তার মুখের ভাব বোঝা দায়৷

কাকা দেখলাম একটু পরে বেরোলেন৷ জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘কোথায় ছিলেন?’’

‘‘মাধুরীর কাছ থেকে একটা জিনিস নেওয়ার ছিল৷’’

‘‘তা এখন আমরা কোথাও যাচ্ছি নাকি কাকা?’’

‘‘হুঁ’’, সংক্ষিপ্ত উত্তর৷

‘‘কোথায়?’’

‘‘গেলেই দেখতে পাবে৷’’ বলে কাকা পরাগের বাইকে সওয়ারি হলেন৷ আমি মংকুর বাইকে চড়ে বসলাম৷

গেলাপুখুরি থেকে আসাম ট্রান্সপোর্ট রোড ধরে তিনসুকিয়ার টাউনে পৌঁছোতেই সময় লাগল প্রায় আধঘণ্টা, রাস্তায় এত জ্যাম৷ যেখানে পৌঁছোলাম সে জায়গাটার নাম মাকুম৷ সেখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে দক্ষিণের দিকে, ওই রাস্তা ধরে ডিগবয় যাওয়া যায়৷ আমরা সেই রাস্তাটা নিলাম না৷ আসাম ট্রান্সপোর্ট রোড ওখান থেকে উত্তরে বেঁকে সোজা চলে গেছে অরুণাচল প্রদেশের দিকে৷ আমরা ধরলাম সেই রাস্তাটা৷

খানাখন্দভরা রাস্তা ধরে মিনিট চল্লিশ চলার পর যে জায়গাটায় এসে নামলাম, সেটা একটা বাজার৷ অতক্ষণ বাইকে বসে কোমরটা টাটিয়ে গেছিল৷ বাইক থেকে নেমে কোমরটা ছাড়িয়ে নিতে নিতে ভাবছিলাম পরাগ বা কাকাকে জিজ্ঞাসা করব কোথায় এলাম৷ তার আগেই সামনের চায়ের দোকানের মাথায় সাইনবোর্ডে চোখ গেল, দেখলাম লেখা আছে, ‘‘ডুমডুমা বাজার৷’’

জায়গাটার নাম শুনে মনে হল আমি নামটা শুনেছি, কিন্তু কখন বা কোথায় সেটা ঠিক মনে পড়ল না৷ এদিকে পরাগ এগিয়ে গেছে চায়ের দোকানের দিকে, চারটে চায়ের অর্ডার দিয়েছে৷

চায়ে চুমুক দিতে দিতে কাকা পরাগকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আসবে তো?’’

‘‘একদম আসবে স্যার৷’’

‘‘পালটি খাবে না তো? তুমি শিওর?’’

‘‘হান্ড্রেড পার্সেন্ট আসবে স্যার৷ পরাগ বসুমাতারি কাঁচা কাজ করে না৷’’

‘‘কী বলে রাজি করালে শুনি?’’ কাকা চোখটা কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, ঠোঁটের কোনায় একটা হাসির আভাস৷

‘‘রাজি করাতে বেশি কষ্ট হয়নি স্যার৷ সে মক্কেল তো হাঁসফাঁস করছিল প্রায়৷ আপনার কথা খুলে বলতেই…তবে কষ্ট হয়েছে খুঁজে পেতে৷ বহুত হুজ্জোত গেছে স্যার৷’’

‘‘পেলে কোথায়? বাড়িতেই ছিল না অন্য কোথাও?’’

‘‘বাড়িতেই৷ এই চার-পাঁচ মাস প্রায় গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছিল৷’’

‘‘হুম, সেরকমই আন্দাজ করেছিলাম৷ তা খুঁজে পেলে কী করে?’’

‘‘হে হে হে…ওটা নাহয় সিক্রেটই থাক স্যার৷ এককালে তো এই এলাকাতেই বাস ছিল আমাদের, কিছু যোগাযোগ তো আছেই৷’’

এইবার মনে পড়ে গেল ডুমডুমা নামটা আগে কোথায় শুনেছি৷ পরাগ বসুমাতারির পূর্বপুরুষেরা আগে এই গ্রামেই থাকতেন বটে! কিন্তু এখন এখানে কেন আমরা?

বিষয়টা মাথায় ঢুকছিল না৷ সকাল সকাল এতটা রাস্তা উজিয়ে কেনই বা এখানে এলাম, আর কে-ই বা গৃহবন্দি ছিল, কার সঙ্গে দেখা করার কথা হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছিলাম না৷

চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালেন কাকা, পরাগকে বললেন, ‘‘একবার খোঁজ নাও পরাগ, দ্যাখো এসেছে কি না৷’’

এতক্ষণ খেয়াল করিনি, চায়ের দোকানের পাশেই একটা ফোন বুথ৷ পরাগ সেখানে ঢুকে কাকে একটা ফোন করল যেন৷ তারপর বাইরে বেরিয়ে চাপা উত্তেজনার সঙ্গে বলল, ‘‘এসে গেছে স্যার৷ চলুন৷’’

এবার মেন রোড ছেড়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরলাম৷ একটু এগোতেই দেখি একটা পাড়ার মধ্যে ঢুকছি৷ হুবহু পরাগদের পাড়াটার মতো, শুধু আরেকটু ভদ্র গোছের, এই যা৷

মিনিট পাঁচেকের বাইক রাইডের পর একটা বাড়ির সামনে বাইকটা স্ট্যান্ড করে উচ্চৈঃস্বরে কাকে একটা ডাকল পরাগ৷ একটু পরেই একটি অল্পবয়সি মেয়ে বেরিয়ে এল৷ দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায় পরাগের স্বজাতি৷ মেয়েটির মুখে একটা আলগা ভয়ের ভাব, পরাগকে দেখে হাসলেও সেটা লুকোনো গেল না৷

পরাগ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে মেয়েটি ভেতরের দিকে ইঙ্গিত করল৷ পরাগ আমাদের দিকে ঘুরে একটু চাপা গলায় বলল, ‘‘আসুন৷’’ মংকুকে বলল, ‘‘তুই এখানেই থাক, পাহারা দে৷’’

বাড়ির ভেতর ঢুকে বুঝলাম মোটামুটি পয়সাওয়ালা লোকের বাড়ি৷ টিভি ফ্রিজ টেলিফোন সবই আছে৷ বসার ঘর থেকে ভেতরের দিকে যেতে যেতে কাকা চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এ কাদের বাড়ি পরাগ?’’

পরাগ একটু লাজুকস্বরে উত্তর দিল, ‘‘আমার হবু শ্বশুরবাড়ি৷’’

ওরেশালা! ব্যাটা এইখানে বিয়ের কথা দিয়ে ওদিকে শিলিগুড়ির ডান্সগার্লের সঙ্গে আশনাই করে বেড়াচ্ছে? মহা খলিফা ছেলে তো!

ভাবতে ভাবতেই দেখি একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল পরাগ৷ দরজাটা ভেজানো৷ সেটা ঠেলে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘‘আসুন৷’’ তিনজনে ঢুকে পড়লাম ৷

ঘরের ভেতরটা বেশ অন্ধকার, চোখ সইতে একটু সময় নিল৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে বুঝলাম এটা বোধহয় বাড়ির এক্সট্রা ঘর, প্রয়োজনে ভাঁড়ারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়৷ সারা ঘরে একটাই জানলা, যেদিক দিয়ে ঢুকলাম তার ঠিক উলটোদিকে৷ এখন অবশ্য ঘরে জিনিসপত্র ডাঁই করা নেই৷ তার বদলে যেটা আছে সেটা হচ্ছে জানলার ঠিক সামনে রাখা একটা টেবিল, তার ওপাশে একটা চেয়ার আর চেয়ারে বসে থাকা একটা মানুষ!

আমাদের ঘরে ঢুকতে দেখে লোকটা একটু নড়ে উঠল, কাঁপা কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করল, ‘‘পরাগ, পরাগ…উনি এসেছেন?’’

পরাগ আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘‘হ্যাঁ দাদা, উনি এসেছেন, একদম চিন্তা করবেন না৷ এবার সব ঠিক হয়ে যাবে৷’’

সেই অল্পবয়সি মেয়েটি এসে তিনটি চেয়ার দিয়ে গেল ঘরের মধ্যে, দরজা বন্ধ করার আগে পরাগকে বলে গেল, ‘‘বেরোবার আগে আমাকে একবার ডেকে নেবেন কিন্তু৷’’

পরাগ গিয়ে জানলাটা খুলে দিল, আর বাইরে থেকে ঝাঁপিয়ে পড়া আলোয় টেবিলের ওপারে বসা লোকটাকে দেখে প্রচণ্ড চমকে উঠলাম আমি৷ পরশু এই ছোঁড়াকেই সদানন্দকাকুর বাড়ির সামনে উঁকিঝুঁকি দিতে দেখেছিলাম না?

তবে আমার অবাক হওয়ার আরও বাকি ছিল৷ কাকা একটা চেয়ার টেনে নিয়ে লোকটার সামনে বসে প্রশ্ন করলেন, ‘‘আপনার শরীর ভালো আছে তো অনির্বাণবাবু?’’

নামটা শুনে মনে হল কে যেন আমার বুকে একটা ঘুসি মারল৷ অনির্বাণবাবু? এই তাহলে অনির্বাণ চৌধুরী? মাধুরীর স্বামী?

একটা দুরন্ত ক্রোধ, একটা অবর্ণনীয় অক্ষম ঈর্ষা আমার শরীরের বাঁদিক থেকে জ্বলতে জ্বলতে মাথার ওপরের দিকে উঠতে লাগল৷ এই সেই হারামজাদা, যে নিজের দিদির সঙ্গে শুয়ে, যৌবনের সমস্ত মস্তি লুটেও একটা নিষ্পাপ মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে৷ এই সেই শুয়োরের বাচ্চা, যার পারিবারিক সম্পর্কের বোধ নেই, অন্য কারও জীবনের প্রতি মায়া নেই, বিছানায় মেয়ে তোলার ক্ষেত্রে বাছবিচার নেই৷ এই পারভার্ট জানোয়ারটাকে…

একটা থরথরে ভয়ার্ত স্বরে উত্তর ভেসে এল, ‘‘আ…আমি..আমি ভালো নেই…আমি ভালো নেই…আ…আমি..আমি বাঁচতে চাই…আমি পালাতে চাই এসব থেকে…’’

কাকা একটু সামনে ঝুঁকে লোকটার দুটো হাত ধরে ফেললেন, ‘‘আমি জানি অনির্বাণবাবু, কী ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আপনি যাচ্ছেন৷ না জানলেও অন্তত আন্দাজ করতে পারি৷ সেইজন্যই কাল পরাগকে বলেছিলাম যে করে হোক আপনার খোঁজ করতে৷ আমার আশঙ্কা ছিল যে আপনাকে হয়তো এই ক-মাস কড়া পাহারায় রাখা হয়েছে৷ এবার আপনার গল্পটা বলুন তো৷ তার ওপরেই অনেকগুলো জীবন নির্ভর করছে৷’’

টেবিলের ওপর এক গ্লাস জল রাখা ছিল৷ এক চুমুকে পুরো জলটা শেষ করল ছেলেটা৷ কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইল৷ তারপর নীচু স্বরে বলতে শুরু করল৷

‘‘আপনারা জানেন কি না জানি না, আমার বাবা কলকাতার বাঙালি হলেও, মা ছিলেন এখানকার লোক৷ বাবা সত্তরের দশকে একটা কাঠচেরাই কলের ম্যানেজারির দায়িত্ব নিয়ে চলে আসেন৷ মায়ের সঙ্গে আলাপ এখানেই, বিয়েও এখানেই৷ বাবা আর কোনোদিন কলকাতা ফিরে যাননি৷

আমার মা ছিলেন দাপুটে মহিলা৷ একবার বাবার এক কলিগ বাবার চরিত্র নিয়ে কিছু একটা মিথ্যে গুজব রটায়৷ কথাটা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মায়ের কানে আসে৷ মা জানতেন যে রটনাটা আদ্যন্ত মিথ্যে, তিনি ঘাস কাটার হেঁসো হাতে সেই কলিগের বাড়িতে চড়াও হন৷ সেযাত্রা মায়ের হাতে-পায়ে ধরে তারা রক্ষা পায়৷ রেগে গেলে মা সাক্ষাৎ রণচণ্ডী হয়ে যেতেন৷ একমাত্র বাবা ছাড়া আমার মা কাউকে খুব একটা রেয়াত করতেন না৷ বাবাকে ভালোওবাসতেন খুব৷ জন্মের পরে দেখেছি মা আমাদের সংসারটাকে দাঁড় করাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছেন৷ বাবার একটু খরুচে বাই ছিল৷ মা-ই যতটা পারতেন সামলাতেন৷

আমি যবে থেকে বড় হতে শুরু করলাম, লক্ষ করলাম যে আমাদের বাড়িতে এমন কিছু কিছু ঘটে যা অন্য কারও বাড়িতে হয় না৷ বিষয়গুলো দেখে খুব অদ্ভুত লাগত আমার৷ যেমন ধরুন, মা প্রতি মাসেই এক-দু’দিন সারাদিনের জন্য কোথায় যেন উধাও হয়ে যেতেন৷ মানে ভোরে বেরোতেন, ফিরতেন রাত করে৷ কোথায় যেতেন, কী করতেন কেউ জানত না, এমনকি বাবাও না৷ এই কথাটা আমাদের পরিবারের মধ্যেই কঠোরভাবে গুপ্ত ছিল, বাইরের কেউ আঁচ পেত না৷ মায়ের কড়া আদেশ ছিল, এ কথা যেন ঘুণাক্ষরেও বাইরে না যায়৷

আমার দ্বিতীয় খটকা লাগে যখন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি খেলতে গিয়ে লক্ষ করলাম যে, আমাদের বাড়িতে পুজো হওয়া মূর্তিগুলোর সঙ্গে অন্যান্য বাড়ির মূর্তিগুলোর কোনো মিলই নেই৷ আমাদের মূর্তিগুলো সাধারণ হিন্দু দেবদেবীর মূর্তির থেকে আলাদা তো বটেই, এবং শুধু তাই নয়, তাদের মধ্যে কিছু কিছু মূর্তি এমন অদ্ভুত আর ভয়ংকর যে হঠাৎ করে দেখে ফেললে বেশ ভয় লাগে৷ এ নিয়ে একদিন মাকে প্রশ্ন করতে গিয়ে প্রচণ্ড বকা খাই৷ মা শাসিয়ে রাখেন, এই কথা যদি ঘুণাক্ষরেও বাইরে যায়, তাহলে ফল ভালো হবে না৷ এখানে বলে রাখি, আমাদের বাড়ির ঠাকুরঘরে মা আর দিদি ছাড়া অন্য কারও ঢোকা নিষেধ ছিল৷

তৃতীয় খটকা লাগে, যেদিন থেকে আমার দিদিও মায়ের সঙ্গে অমাবস্যার দিন উধাও হয়ে যাওয়া শুরু করল৷

আপনারা জানেন নিশ্চয়ই, দিদি আমার থেকে বছর পাঁচেকের বড়৷ দিদি যেদিন প্রথম মায়ের সঙ্গে যায়, তখন আমার বয়েস ছয়৷ তার আগের রাতে বাড়িতে একটা অদ্ভুত রিচুয়ালের আয়োজন করা হয়৷ পুজো নয় কিন্তু, রিচুয়াল৷ বাবা সেদিন বাড়ি ছিলেন না৷

আমি ছোট বলে আমার থাকার পারমিশন ছিল৷

ঘটনাটা ঘটেছিল মধ্যরাতে৷ মা ভেবেছিল আমি ঘুমিয়ে পড়েছি৷ কিন্তু আমি ঘুমোইনি, লুকিয়ে লুকিয়ে দরজার ফুটো দিয়ে দেখেছিলাম সেই অদ্ভুত অনুষ্ঠান৷ সেদিন বেশ কিছু অচেনা মহিলা আমাদের বাড়িতে এসেছিল৷ তাদের আর কোনোদিন দেখিনি৷ তারা দিদিকে মধ্যিখানে রেখে গোল করে ঘিরে বসেছিল৷ সারা ঘরে মোমবাতি ছাড়া আর কিছু জ্বলছিল না৷ সেই ভূতুড়ে আলোয় তারা অজানা সুরে, অজানা ভাষায় দুলে দুলে কী একটা গাইছিল৷ সেদিন আমার খুব ভয় করেছিল, ভীষণ ভয়৷

এখন আমি জানি, ওটা ছিল দিদির প্রথম মেন্সট্রুয়েশনের দিন৷

আমার মনে প্রশ্ন উঠতে শুরু করল, কোথায় যায় দিদি? মা কোথায় নিয়ে যায় ওকে? আমাকে বলে না কেন? এমন কোন জায়গায় যায় ওরা যেটা আমাকে বলা মানা?

বড় হওয়ার ওঠার সাথে সাথে দিদির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বলুন, ঘনিষ্ঠতা বলুন, ভালোবাসা বলুন, সব বাড়তে থাকে৷ মায়ের আচরণ দিন দিন অদ্ভুত হয়ে আসছিল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল বাড়ির ওই অদ্ভুত মূর্তিগুলোর পুজো৷ মা মাঝে মাঝে উন্মাদ হয়ে যেতেন৷ তখন বাবাও সামলাতে পারতেন না৷ উন্মাদ হয়ে বিড়বিড় করতেন, ‘হেই রে বুড়িমা, আবার তুই ফিরে আসবি রে মাই, তোর দেওরি তোকে ফিরিয়ে আনবে রে বুড়িমাই…’

আস্তে আস্তে মা-বাবার মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে৷ এই পরিস্থিতি সামলাতে সামলাতে বাবার হার্টের রোগ ধরা পড়ে৷ ডাক্তার বলে যান বাবার ওপর যাতে বেশি স্ট্রেন না পড়ে, তাই মায়ের এই অবস্থায় বাবাকে মায়ের থেকে একটু দূরে রাখাই শ্রেয়৷ সেই থেকে মা আর বাবা আলাদা ঘরে শুতে শুরু করেন৷ এদিকে আমাদের বাড়িতে তিনটেই শোয়ার ঘর৷ আগে বাবা-মা এক ঘরে, দিদি অন্য ঘরে শুত৷ আমি দোতলার ঘরে একা শুতাম৷ বাবা আর মা আলাদা শোয়া শুরু করাতে বাধ্য হয়েই দিদিকে আমার ঘরে শুতে আসতে হয়৷

তখন দিদির বয়েস সতেরো, আমার বারো৷ আর এখান থেকেই সব সর্বনাশের শুরু৷

দুজনেরই তখন কাঁচা বয়েস৷ শরীর নিয়ে দুজনেরই অনেক কৌতূহল, অনেক জিজ্ঞাসা৷

ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল ঠাট্টা-ইয়ার্কির ছলে৷ আস্তে আস্তে গায়ে এখানে-ওখানে হাত দেওয়া, খুনসুটি করা, এইসব৷ আস্তে আস্তে শারীরিক ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে৷ আমরা জানতাম যা করছি তা ঠিক নয়৷ কিন্তু এই নিষিদ্ধ শরীরী খেলা আমাদের নেশার মতো পেয়ে বসেছিল৷ রোজ রাতের খাওয়া শেষ হলেই আমরা বিছানায় যাওয়ার জন্য উশখুশ করতাম৷

বাবার সঙ্গে মায়ের খিটিমিটি ক্রমেই বাড়তে থাকে৷ মায়ের উন্মাদদশা ক্রমে বেড়েই চলেছিল৷ মাঝে মাঝেই মা অজানা ভাষায় বিলাপ করতেন, কাঁদতেন৷ কাদের যেন অভিসম্পাত দিতেন৷ ছাদে উঠে বিড়বিড় করতে করতে কী সব আউড়ে যেতেন৷

এই করতে করতেই অঘটনটা ঘটে গেল একদিন৷

রাতের খাওয়ার টেবিলে মা সেদিন খুব বেশি পাগলামো করছিলেন৷ আমরা কেউ সামলাতে পারছিলাম না৷ বাবা শেষমেশ অতিষ্ঠ হয়ে সারাজীবন যা করেননি তাই করলেন, মাকে সজোরে একটা থাপ্পড় মারলেন৷

সেই মুহূর্তটা আমার সারাজীবন মনে থাকবে৷ সেকেন্ডের মধ্যে মায়ের মুখটা রাগে টকটকে লাল হয়ে গেল৷ ঠোঁটের কোনা দিয়ে ফেনা গড়াচ্ছে৷ চুলগুলো উড়ছে ডাইনির চুলের মতো৷ মা রাগে কাঁপতে কাঁপতে সাপের হিসহিসানির স্বরে বাবাকে বললেন, ‘আমার গায়ে হাত তুললি তুই? বড়দেওরির গায়ে হাত তুললি? এত সাহস হয়েছে তোর? খাব রে শয়তান, খাব৷ আজই তোকে খাব৷’

সেই রাতে প্রচণ্ড ঝড় আসে৷ মনে হচ্ছিল সারা পৃথিবী উথালপাতাল হয়ে যাবে৷ দিদি ভয়ে আমার কাছে ঘেঁষে আসে৷ আমি সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে দিদিকে জড়িয়ে ধরেছি, আমার হাত দিদির বুকে, এমন সময় একটা অদ্ভুত আওয়াজ কানে আসে আমাদের৷ মনে হল ছাদ থেকে কে যেন একতলায় নেমে যাচ্ছে৷ ঝড়ের ওই প্রবল মত্ততার মধ্যেও শুনতে পাই, আমাদের দরজার বাইরে মেঝে থেকে আওয়াজ উঠে আসছে, ক্রররর…ক্ররররর…

আমি আর দিদি উঠে দরজাটা অল্প ফাঁক করে উঁকি মারি৷

প্রথমে মনে হয় কোথাও কিছু নেই, সবই মনের ভুল৷ কিন্তু যে ক্ররররর আওয়াজটা সিঁড়ি ভেঙে নীচের দিকে নামছিল, সেটায় কোনো ভুল ছিল না৷

এমন সময় বিদ্যুতের আলো ঝলসে ওঠে৷ জানলার শার্সি থেকে ছিটকে আসা আলোয় দেখি এক ভয়াবহ মূর্তি বাবার ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকছে৷ লোকটার বলিষ্ঠ শরীর, মাথাটা ন্যাড়া, ঠোঁটটা অদ্ভুতরকমের লম্বা আর বাঁকানো৷ আর লোকটার সারা গায়ে চামড়া নেই, যেটা আছে সেটা পাখির পালক! কুচকুচে কালো রঙের পালক!

আমি আর দিদি প্রবল ভয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে শুয়ে পড়ি৷ দিদি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে৷ আমিও দিদিকে প্রবলভাবে জড়িয়ে ধরি৷

সেই রাতেই আমাদের প্রথম যৌন মিলন৷

আর পরের দিন সকালে উঠে আবিষ্কার করি বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন!

এরপর অনুশোচনা, হতাশা সব মিলিয়ে মা পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে যান৷ আমি আর দিদি কী করে সব সামলাব বুঝতে পারছিলাম না৷ এখানে আমাদের চেনা-পরিচিত আত্মীয়স্বজন বিশেষ নেই, খুব দূর সম্পর্কের এক মামা ছাড়া৷ তিনিই বেগতিক বুঝে তাড়াতাড়ি দিদির বিয়ে দিয়ে দেন৷ মায়ের জন্য একজন আয়া রাখা হয়৷

কিন্তু তাতে আমার সঙ্গে দিদির শারীরিক সম্পর্কে কোনো ছেদ পড়েনি৷ মাকে দেখতে আসার অছিলায় দিদি মাঝেমধ্যেই এ বাড়ি আসত৷ তখন আমরা মিলিত হতাম৷ দিদির বিয়ে হওয়ার পর মায়ের পাগলামি কিন্তু অনেকটা কমে যায়৷ মা বোধহয় শেষদিকে বুঝতে পেরেছিলেন আমার আর দিদির ব্যাপারটা৷ দিদি এ বাড়িতে এলে মুখ ঘুরিয়ে থাকতেন, কথা বলতেন না৷

যে বছর আমার মা মারা যান, সেই বছরই দিদিও বিধবা হয়—তারপর আর কী৷ আমাকে দেখাশোনার অছিলায় দিদি এ বাড়িতে পার্মানেন্টলি এসে থাকতে শুরু করে৷

এদিকে আমি হাঁপিয়ে উঠছিলাম, এই অস্বাভাবিক সম্পর্ক থেকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছিলাম৷ আমার আর এসব ভালো লাগছিল না৷ কিন্তু দিদি ছাড়তে চাইত না৷ এসব বন্ধ করার কথা বললেই হিংস্র হয়ে উঠত৷ উন্মাদের মতো আচরণ করত৷ মায়ের কথা ভেবে আমি ভয় পেয়ে যেতাম, কিছু বলতাম না৷

তবে শুধু রাগারাগি নয়৷ দিদি আরও একটা জিনিস করতে শুরু করল৷

আগেই বলেছি, দিদিও প্রতি মাসে কয়েকদিন মায়ের মতো হারিয়ে যেত৷ এবার দিদি সেখান থেকে ফিরে আসার পর চুপিচুপি কিছু একটা ওষুধ খাওয়ানো শুরু করল আমাকে, কোনো ভেষজ ওষুধ৷ তাতে আমার মাথাটা কেমন যেন ঘেঁটে যেত, স্বাভাবিক বোধ, অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে যেত৷ তার বদলে চাগাড় দিয়ে উঠত উদ্দাম, প্রবল যৌন প্রবৃত্তি, আদিম খিদে৷ আমি ওই দিনগুলোতে বুনো মোষের মতো বল পেতাম শরীরে৷ বিছানায় ওকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেতাম৷ আর তারপর থেকেই দিদির ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যেত৷ মনে হত আমাকে কোনো অদৃশ্য সুতোর টানে নাচাচ্ছে দিদি৷ প্রায় পাঁচ থেকে ছ’দিনের জন্য আমি কেমন যেন দিদির পুতুল মতো হয়ে থাকতাম৷

এইভাবেই চলে যেত, যদি না একদিন মাধুরীর সঙ্গে আমার আলাপ হত৷

বাকিটা তো আপনারা বোধহয় এখন জানেন৷ স্বাভাবিকভাবেই দিদি প্রথমে রাজি হয়নি এই বিয়েতে৷ তখন বাধ্য হয়েই আমাকে বলতে হয়েছিল যে এই বিয়ে করতে না দিলে আমি সুইসাইড করব৷ তখন ও নিমরাজি হয়৷ কিন্তু ঘুণাক্ষরেও ভাবিনি যে ও এই সর্বনাশা খেলায় মাতবে৷

আমার ভুল হয়েছে প্রথমেই মাধুরীকে সবটা খুলে না বলা৷ ভেবেছিলাম বিয়ের পর হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু ব্যাপার যে এতদূর এসে পৌঁছোবে, সেটা আমার ধারণার বাইরে ছিল৷

কাল যখন পরাগ এসে আপনার কথা বলল, মনে হল আপনিই পারবেন এই সংকট থেকে আমাকে উদ্ধার করতে৷ বিশ্বাস করুন, এই দুনিয়ায় আমি মাধুরীর থেকে বেশি ভালো আর কাউকে বাসি না৷ আমি এসব থেকে মুক্তি চাই দাদা, আমি বাঁচতে চাই৷ যে-কোনো মূল্যে আমি মাধুরীকে ফেরত পেতে চাই৷’’

জল থেকে মাথা তুললাম৷ অনির্বাণের ওই শেষ কথাগুলো এখনও আমার কানে বাজছে৷ একটা অক্ষম ঈর্ষার বিষ যেন বুকের মধ্যে ফণা তুলে দাঁড়াতে চাইছে৷

মাথাটা তুলে একবার মেঘে ঢাকা আকাশটা দেখে নিলাম আমি৷ অমাবস্যার রাত থেকে নেমে আসা কঠিন শৈত্য আমার সমস্ত শরীর অজগরের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেছে৷ এক ফলহীন আশাহীন কর্মের ভার পাথরের মতো চেপে বসছিল আমার বুকে৷ আমি জানি আজ এই অভিযানে আমার জয় হোক বা পরাজয়, মাধুরী আমার হবে না! হয়তো এই গোলকপুষ্পের লতা আমার জীবন গড়ে দেবে, কিন্তু সেই জীবনে মাধুরী থাকবে না৷

আজ স্পষ্ট করে বুঝতে পারছিলাম, আমি ওই সর্বনাশীর প্রেমে পড়েছি!

পাড়ে ওঠার পর একটা করে গামছা আর পরিষ্কার ধুতি আমাদের দিকে এগিয়ে দিলেন কাকা, আদেশ করলেন, ‘‘পরে নাও৷’’

কাপড় পরার পর মনে হল উত্তুরে হাওয়া যেন জমাট বেঁধে আছড়ে পড়ছে আমার বুকে৷ শিউরে উঠলাম আমি৷ কাকা বুঝতে পারলেন আমাদের অবস্থাটা৷ হাতে ছোটমতো কী একটা দিয়ে বললেন, ‘‘চিবিয়ে নাও, আরাম পাবে৷’’

অন্ধকারে বুঝতে পারছিলাম না কী দিলেন কাকা৷ মনে হল শেকড়জাতীয় কিছু৷ মুখে ফেলে চিবোনো শুরু করতেই বুঝলাম একটা ওম ধীরে ধীরে শিরা আর ধমনি বেয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সারা দেহে৷

তিনজনে এগোচ্ছিলাম আমার দেখিয়ে দেওয়া রাস্তা ধরে৷ সবার হাতে বড় পাঁচ সেলের টর্চ৷ পরাগের হাতে একটা বড় ব্যাগ৷ ঝিঁঝির শব্দে ডুবে আছে অন্ধ চরাচর৷ নাম-না-জানা কোনো জংলি ফুলের মৌতাতে পাগল হয়ে আছে বনভূমি৷ আকাশ থেকে গুরু গুরু ডাক ভেসে আসছে মাঝে মাঝে৷ জঙ্গলের পাতা বিছোনো মাটি থেকে একটা জলীয় ভাপ উঠে আসছিল কোমর অবধি৷

সবার সামনে আমি৷ কাকা আমার পেছনেই ছিলেন৷ শুনলাম বিড়বিড় করে মন্ত্রোচ্চারণ করছেন তিনি, ‘‘ওঁ নমঃ কালরাত্রি শূলহস্তে মহিষবাহিনি/ রুদ্রকালকৃত শেষয়ে আগচ্ছ আগচ্ছ ভগবতি/অতুলবীর্য্যে সর্বকর্মাণি মে বশং কুরু কুরু…’’

চলতে চলতে এবার সেই শুখানালাটা এল৷ আগের বারে যেখান দিয়ে নেমেছিলাম সেখান দিয়ে না নেমে ফিরে আসার রাস্তাটার দিকে এগোলাম৷ একটু পরেই পৌঁছোলাম সেই গাছের গুঁড়ি ফেলা সেতুর কাছে৷

‘‘ঠাকুরমশাই…’’ পরাগের ভয়ার্ত স্বর শুনে পেছনে ফিরলাম৷ আধা অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম ভয়ে সিঁটিয়ে গেছে ছেলেটা৷ আজন্মলালিত সংস্কার পা টেনে ধরেছে ওর৷

‘‘চিন্তা কোরো না পরাগ৷ আমি আশ্বাস দিচ্ছি, তোমার কিচ্ছু হবে না৷’’

তিনজনে ধীরে ধীরে সেতুটা পার করে ওদিকে পৌঁছোলাম৷

আগের বারের মতোই ফেলে আসা বনভূমি আর আমাদের মধ্যে গাঢ় স্তব্ধতা দিয়ে বোনা শীতল ভারী পর্দা নেমে আসছিল ধীরে ধীরে৷ চারিদিক অবিশ্বাস্য রকমের চুপচাপ৷ পাতা নড়ার, বাতাসের ফিসফিস, ঝিঁঝির ডাক, রাতচরা পাখিদের কর্কশ স্বর, কিছুই ভেসে আসছিল না৷ মনে হচ্ছিল প্রকৃতি যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে৷ সেই গভীর রাত্রির যেন কোনো সাড় নেই, স্পন্দন নেই, প্রাণ নেই৷ শুধু আছে এক পাষাণবৎ নিষ্ঠুর নীরবতা৷

কাকা চাপাস্বরে বললেন, ‘‘বায়ুস্তম্ভ৷ প্রকৃতিবন্ধন৷ এ বড় সহজ ঠাঁই নয় ভবতারণ, যা ভেবেছিলাম তার থেকেও অনেক জটিল৷ আমাদের চেনাজানা তন্ত্রপদ্ধতির থেকে বহু সহস্র গুণ শক্তিশালী কোনো মন্ত্রে এই সমগ্র স্থানটি বন্ধন করে রাখা আছে৷ অতি প্রাচীন, কয়েক সহস্র বছরের সঞ্চিত এই মন্ত্রজ্ঞান৷ আমাদের আরও সতর্ক হতে হবে, আরও সাবধান হতে হবে৷’’

এতক্ষণ ধরে বুকের মধ্যে চেপে রাখা দুরুদুরু ভাবটা এবার দ্রিমিদ্রিমি হয়ে বাজতে লাগল৷ কারণ আমি জানি এরপর কী হবে, অন্ধকার থেকে উঠে আসবে কাউরীবুড়ির অনুচরেরা, আর উড়ে এসে বসবে সামনের গাছের ডালে৷

অথচ আমাকে অবাক করে সেরকম কিছুই ঘটল না!

কথাটা কাকাকে বলতে কাকাও চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘‘কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে ভবতারণ, আমাদের কোনো একটা হিসেব মিলছে না৷ নইলে এরকম তো হওয়ার কথা নয়৷’’

একরাশ অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে পা বাড়ালাম আমরা৷

তিনটে মানুষ হেঁটে যাচ্ছিল সেই নিঝুম নিস্পন্দ জঙ্গলের মধ্য দিয়ে৷ টর্চের আলো নিভু নিভু হয়ে আসছিল অজানা কারণে৷ পেছনের অন্ধকার ক্রমেই আরও ভয়াল, আরও নিশ্ছিদ্র, আরও শ্বাসরোধী হয়ে উঠছিল৷

টর্চ ফেলে ফেলে আমরা সুঁড়িপথ ধরে এগোচ্ছিলাম৷ এইভাবে খানিকটা এগোনোর পর দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি৷ পেছন থেকে কাকা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘কী হল ভবতারণ?’’

সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম৷

আমাদের সামনে সেই ছোট চত্বর, আর তার ওপারেই মূর্তিমান অশনি সংকেতের মতো দাঁড়িয়ে আছে পাথুরে মন্দির৷ কাউরীবুড়ির মন্দির৷

দ্রুতপায়ে মন্দিরে পৌঁছেই কাকা বললেন, ‘‘টর্চ জ্বালো ভবতারণ, মায়ের মুখখানি দেখতে দাও৷’’

দু’জোড়া টর্চের আলো গিয়ে পড়ল দেওয়ালের উলটোদিকে৷

কাকা খানিকক্ষণ তন্ময় হয়ে চেয়ে রইলেন কাউরীবুড়ির মূর্তির দিকে৷ বিড়বিড় করে বললেন, ‘‘মা যেমন স্নেহ করেন, তেমন শাসনও করেন বই কি! তাই তো মায়ের দুই রূপ, তিনি যেমন ঘোরা, তিনি তেমনই দিব্যাও বটে৷ তিনি যেমন রুদ্রাণী, তেমন তিনি কল্যাণীও৷ ভয়ের আড়ালে তিনিই অভয়া, লয়ের মধ্যে তিনিই জয়, মরণের মধ্যে তিনিই অনন্তজীবন৷ তাঁকে ভয় কী ভবতারণ?’’

‘‘ইনি কে ঠাকুর?’’ প্রশ্ন করল পরাগ৷ তার প্রাথমিক কাঁপুনি কমেছে তখন৷

‘‘মা যে দেশে দেশে বিভিন্ন রূপে প্রকাশিত হয়েছেন পরাগ৷ সে সাগরপারের দেশই হোক, বা ঘরের পাশের ঘর৷ একদিকে কৃষ্ণবর্ণা মাতৃমূর্তি রূপে অন্যদিকে করালবদনী মৃত্যুদেবী—এই দুই রূপেই দেবী প্রকটিত হয়েছেন বারে বারে৷ ইনিও মায়ের আরেক রূপ পরাগ৷ ইনি মহাপরাক্রমশালী নাগজাতির আরাধ্যা দেবী৷’’

‘‘কিন্তু কাকা, নাগ বলতে তো সাপ…’’

‘‘না ভবতারণ৷ নাগ বলতে সাপের টোটেম বা চিহ্নধারী জাতি বোঝায়৷ মহাভারতে এঁদের উল্লেখ আছে৷ অর্জুন নাগরাজ কৌরব্যের কন্যা উলূপীর পাণিগ্রহণ করেছিলেন৷ তাঁদের ইরাবান নামে এক পুত্র ছিল৷’’

‘‘কিন্তু কাকা, তার সঙ্গে এই পাতরগোঁয়্যা বা দেওরিদের সম্পর্ক কী?’’

‘‘আছে ভবতারণ, গভীর সম্পর্ক আছে৷ নাগজাতি প্রাচীন ভারতের এক অতি বলশালী নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী৷ ভেষজবিদ্যা, বিশেষ করে বিষবিজ্ঞানে এঁদের সমকক্ষ আর কেউ ছিলেন না৷ এঁরা একসময় সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে ছিলেন৷ তক্ষক নাগের নাম থেকেই তক্ষশীলার নামকরণ৷ মহারাজ নলের সঙ্গে যে কর্কোটক নাগের সাক্ষাৎ হয় তিনি ছিলেন নিষধদেশীয়, বর্তমানে বিদর্ভের কাছাকাছি৷ ওদিকে মহাভারতে যে উলূপী অর্জুনের ঘরণী হন তিনি ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুরের৷

মহাভারতের বহু আগেই ভারত জুড়ে নাগজাতির প্রব্রজন শুরু হয়৷ আমার ধারণা এই নাগজাতিরা পরে বর্তমান ব্রহ্মদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী পার্বত্য অঞ্চলে বসবাস শুরু করে৷ আজ থেকে দেড়-দু’হাজার বছর আগে তাদেরই এক অংশ আসামে এসে দেওরি নামে পরিচিত হয়৷ খুব সম্ভবত তখন যে কটি ভেষজবিদ্যা ও ঔষধিলতা তাঁরা নিয়ে আসতে পেরেছিলেন, এই গোলকপুষ্প তার অন্যতম৷

আর নিয়ে আসেন তাঁদের আরাধ্যা এই দেবীকে৷ ইনি মহাতেজা, মহাঘোরা, মহামোহনাশিনী৷ ইনি মহাকালের মতো কর্কশ, মৃত্যুর মতো অমঙ্গলজনক, জগতের ভোগতৃষ্ণার সংহারক৷’’

‘‘কিন্তু কাকা, কে এই দেবী?’’

ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন কাকা৷ টর্চের আলোয় তাঁর চোখ দুখানি জ্বলজ্বল করছিল৷ গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘‘এখনও বোঝোনি ভবতারণ? মাধুরী সামনে এলে শ্মশানধূমের গন্ধ পাও কেন ভবতারণ, ভেবেছ কখনও? মাধুরীর স্বপ্নে এত কাক কেন? কাউরীবুড়ির মন্দিরে যাওয়ার পথে এত কাক কেন? পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির প্রথম সন্তান জন্মাবার পর বিধবা হতে হত কেন? এত মৃত্যু কেন? এত বৈধব্য কেন? এত অভিশাপ কেন? এত হাহাকার কেন? এখনও বোঝোনি?’’

যে সন্দেহটা আমার মনের কোণে জমে উঠেছিল, সেটা আর আটকে রাখা গেল না, ‘‘ইনি কি…ইনি কি…’’

‘‘হ্যাঁ ভবতারণ, ইনিই দেবী ধূমাবতী৷’’

কাকা চুপ করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের টর্চগুলোও নিভে গেল৷ চারিদিকে নিরেট পাথুরে অন্ধকার৷ তার ঊর্ধ্ব বা অধঃ নেই, সীমাও নেই, দিক নেই, মাত্রাও নেই৷

‘‘পরাগ’’, মন্দিরের মধ্যে গমগম করে উঠল কাকার কণ্ঠস্বর৷ ‘‘যজ্ঞস্থল প্রস্তুত করো৷’’

পরাগের সঙ্গে আমরা বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালাম মন্দিরের দরজার ঠিক সামনে, দেবীমূর্তির দিকে মুখ করে৷ পরাগ সঙ্গে আনা ব্যাগটা থেকে কতগুলো ছোট ছোট মশাল বার করে একটু দূরে দূরে মাটিতে গুঁজে জ্বালিয়ে দিল৷ তারপর সেখান থেকে কাকা বেশ কিছু জিনিস বার করে মাটিতে রাখতে শুরু করলেন৷ সব সাজানো হয়ে গেলে, একটি আধপোড়া কাঠ তুলে নিলেন প্রথমে৷

আমি প্রশ্ন করলাম, ‘‘এটা কী কাকা?’’

‘‘অর্ধদগ্ধ নিমকাঠ৷ চণ্ডালের চিতা থেকে তুলে আনা৷’’

পরাগ কিছুটা বালি ছড়িয়ে দিয়েছিল মাটিতে৷ কাকা সেখানে ওই আধপোড়া নিমকাঠ দিয়ে প্রথমে একটা বৃত্ত আঁকলেন৷ তারপর তার পরিধি বরাবর আটটা পাপড়ি৷ তার বাইরে আরও একটি বৃত্ত আঁকলেন, তার পরিধি বরাবর আঁকলেন ষোলোটি পাপড়ি৷ তারপর চারিদিকে একটি চতুর্ভুজ ক্ষেত্র এঁকে সেটিকে বদ্ধ করলেন৷

‘‘এটা কী আঁকলেন কাকা?’’

‘‘ধূমাবতী যন্ত্রম৷ আজ এই যন্ত্রে আমি দেবী ধূমাবতীকে আহ্বান জানাব, প্রার্থনা করব তাঁর আশীর্বাদ৷ দেবী ধূমাবতী সাধকের সাধনায় তুষ্ট হলে তার শত্রুক্ষয় করেন, অপশক্তির নাশ করেন৷ আজ মধ্যরাত্রে এইখানে মাধুরীর দিভাই নিজের ভাইকে নিয়ে যক্ষিণীসাধনে বসবেন৷ আর একবার যদি সেই যক্ষিণীচক্র সফল হয়, তাহলে জেনে রেখো ভবতারণ, শুধু মাধুরী নয়, তার পরিবার সবংশে নিহত হবে৷ বংশে বাতি দেওয়ার মতো কেউ থাকবে না৷’’

‘‘কিন্তু তার প্রতিবিধান কী কাকা?’’

‘‘এর একটাই প্রতিবিধান ভবতারণ, বিষস্য বিষৌষধম৷ এই নাগরমণী যে মহাবিষ মাধুরীর ওপর প্রয়োগ করেছে, তাকে নিষ্ক্রিয় করতে হবে৷ তাহলেই সেই মহাবিষ প্রত্যাখ্যাত হয়ে আছড়ে পড়বে প্রয়োগকারীর ওপরেই৷ তবেই মাধুরী বাঁচবে, বাঁচবে তার পরিবার, তার কাছের লোকজন৷’’

‘‘কী সেই বিষ কাকা? কী উপায়ে সে অসম্ভব সম্ভব হবে?’’

‘‘যে বিষ ওই ক্রুরকর্মা মহিলা মাধুরীর সিঁদুরে মিশিয়েছে৷ গোলকপুষ্প৷’’

মনে হল রাত্রি যেন আরও গাঢ় হয়ে নেমে এল আমার চারিপাশে৷ যে মহার্ঘ ঔষধি নিয়ে আমি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখছি, মাধুরীর সিঁদুরে মেশানো হয়েছে তারই বিষ? আমাকে ভবিষ্যতের স্বাচ্ছন্দ্য কিনতে হবে মাধুরীর সর্বনাশের বিনিময়ে?

মশালের আলোছায়া খেলে যাচ্ছিল আমার মুখে৷ কাকা আমার দিকে তাকিয়ে বোধহয় বুঝলেন আমি কী ভাবছি৷ তারপর বললেন, ‘‘ভুল করছ ভবতারণ৷ মনে মনে যা ভাবছ তা নয়৷’’

‘‘তাহলে?’’

স্নিগ্ধ হেসেই গম্ভীর হয়ে গেলেন কাকা৷ তারপর বললেন, ‘‘এ বড় জটিল খেলা বাবা, বড় সহজ নয়৷ ওই মহিলা অতি উচ্চস্তরের তান্ত্রিক৷ পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরিরা প্রত্যেকে উত্তরাধিকার সূত্রে তাই-ই ছিলেন, তন্ত্রসিদ্ধা যোগিনী৷ বৈধব্য তাঁদের অলংকার, গোলকপুষ্প তাঁদের আয়ুধ৷

শোনো ভবতারণ, যে ফুলের খোঁজে তুমি এখানে এসেছ তার নাম গোলকপুষ্প কেন ভেবে দেখেছ? শোনো, তার পেছনে একটি কারণ আছে, সে কারণ বড় গুহ্য, বড় গোপন৷ জেনে রাখো, তন্ত্রশাস্ত্র মতে প্রতিটি রমণীর রজঃ বা ঋতুরক্তের গুরুত্ব অসীম৷ এই রজঃ স্ত্রীবীজ হিসেবে কল্পিত, তন্ত্রের ভাষায় বলে খ-পুষ্প৷ এই খ-পুষ্প দেবীর কাছে অতি পবিত্র৷ সবচেয়ে পবিত্র হচ্ছে অক্ষতযোনি বালিকার প্রথম রজঃ৷

এই প্রতিটি রজঃরক্তের ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে৷ কুমারীর রজের নাম স্বয়ম্ভূকুসুম, চণ্ডালীর রজের নাম বজ্রপুষ্প, সধবার কুণ্ডোদ্ভব এবং বিধবার রজঃরক্তের নাম গোলোকপুষ্প!’’

আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম৷ আমার সমস্ত ধারণা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল৷ গোলকপুষ্প মানে বিধবার রজঃরক্ত? এই লতা বা ফুলের সঙ্গে মাধুরীর সঙ্গে মাধুরীর ওপর নেমে আসা অভিশাপের কোনো সম্পর্ক নেই? তার মানে ওই মহিলা তাঁর…

‘‘হ্যাঁ ভবতারণ, উনি তাঁর নিজের ক্রিয়ামন্ত্রঃপূত রজঃরক্ত মিশিয়ে দিয়েছিলেন মাধুরীর সিঁদুরে৷ আর সেই থেকেই এই অনর্থের শুরু৷’’

ইতিমধ্যে পরাগ ব্যাগ থেকে আরও কিছু জিনিসপত্র বার করে রাখল কাকার সামনে৷

কাকা তার মধ্য থেকে কিছু ছোট ছোট কাঠের টুকরো বিশেষ পদ্ধতিতে যন্ত্রের ঠিক মাঝখানে স্তূপাকৃতি করে রাখলেন৷ সঙ্গে সঙ্গে মৃদুস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ চলতে লাগল,

‘‘পাতর্যা স্যাৎ কুমারী কুসুমকলিকয়া জাপমালাং জপন্তী,

মধ্যাহ্নে প্রৌঢ়রূপা বিকসিতবদনা চারুনেত্রানিশায়াম্৷

সন্ধ্যায়াং বৃদ্ধরূপা গলিতকুচযুগা মুণ্ডমালাং বহন্তী

সা দেবী দেবদেবী ত্রিভুবনজননী কালিকা পাতু যুষ্মান্…’’

সমস্ত উপচার শেষ হলে যজ্ঞকাঠে অগ্নিসংযোগ করলেন কাকা৷ দপ করে জ্বলে উঠল যজ্ঞানল৷ তাতে একে একে আহুতি দিলেন চন্দনচর্চিত জবাফুল, মুঠিভরা আতপচাল, যজ্ঞডুমুরের কাঠ৷ সঙ্গে চলতে লাগল উচ্চৈঃস্বরে মন্ত্রপাঠ,

‘‘ভ্রূভঙ্গী ভীমবক্ত্রা জঠরহুতভুজং ভীষণং তর্পয়ন্তি, চণ্ডী স্ফেংকারাকারা টকটকিতহসা নাদসংঘট্টভীমা৷ লোলা মুণ্ডাগ্রমালাল ললহ লহা-লহা লোল লোলোগ্রবাচং, চামুণ্ডা চণ্ডমুণ্ডং মটমটমটিতং চর্বয়ন্তী পুনাতু…’’

যজ্ঞাগ্নি থেকে এবার আগুনের সঙ্গে সঙ্গে উঠে আসছিল ধোঁয়ার কুণ্ডলী৷ সেই ধোঁয়া আর মশালের আগুনে কাকার মুখখানি সিল্যুয়েটের মতো দেখাচ্ছিল৷

এরপর কাকা আগুনে আহুতি দেওয়ার জন্য হাতে তুলে নিলেন কালোমতো কী একটা৷ আগুনের কাছাকাছি আনতে সেই আলোয় চিনতে পারলাম জিনিসটা কী৷ কাকের পালক!

ধোঁয়ার গন্ধ ক্রমেই কটু থেকে কটুতর হয়ে উঠছিল৷ চোখ জ্বলছিল আমার, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল৷ কাকার অবশ্য তাতে কোনো বিকার ছিল না৷ মন্ত্রপাঠ করতে করতে ঘি, দুধ আর মধু আহুতি দিলেন যজ্ঞে৷ তারপর হাতে আরেকটা কিছু তুলে আনলেন৷ আমি প্রথমে বুঝতে পারলাম না সেটা কী জিনিস৷ কাকা জিনিসটা যজ্ঞকুণ্ডের কিছুটা কাছাকাছি আনতে আমিও একটু ঝুঁকে এগিয়ে এলাম৷ কী ওটা? একটুকরো কাপড় নাকি?

হ্যাঁ, তাই তো! কিন্তু সে কাপড়ে শুকনো রক্তের দাগ কেন?

মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা সরে গেল৷ আমি বুঝতে পারলাম ওটা কীসের রক্ত৷

ওটা রজঃরক্ত, মাধুরীর মেনস্ট্রুয়েশনের রক্ত৷

কাকা আজ সকালে সেটা সংগ্রহ করে এনেছেন ওর থেকে৷

হঠাৎ করেই যেন আশপাশের তাপমাত্রা কমে গেল খানিকটা৷ মাথা তুলে দেখি আকাশের বুকে জমে এসেছে ঘনঘোর মেঘপুঞ্জ৷ মন্দিরের ঠিক মাথার ওপর লালচে মেঘের দল ঘূর্ণির মতো জমাট বাঁধছে৷ ওদিকে মন্দিরের চারিপাশের বন আগের মতোই একেবারে স্তব্ধ৷ রন্ধ্রে রন্ধ্রে বুঝতে পারছিলাম যে মহাপ্রলয় আসন্ন৷

কাপড়ের টুকরোটা আহুতি দিতেই আগুনের দলা যেন লাফিয়ে উঠল আমাদের মাথার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে একটা সাপের হিসহিসানির শব্দ৷ ফট করে কিছু একটা ফাটার আওয়াজ ভেসে এল আগুনের ভেতর থেকে৷ আর তারপরেই একটু আগের কটুগন্ধটা সরে গিয়ে একটা অদ্ভুত গন্ধে ভরে গেল চারিপাশ৷

গন্ধটা আমার খুব চেনা৷ ভিজে কাঠ পোড়ার ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর একটা গন্ধ৷

এইবার কাকা যেটা করলেন সেটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না৷ একটা ছোট্ট জিনিস ব্যাগ থেকে বার করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, ‘‘এই শেষ আহুতি ভবতারণ, আর সেটা তোমার হাত দিয়েই দিতে হবে৷ চোখ বন্ধ করো, আর আমার সঙ্গে আবৃত্তি করো, ‘দিগবাসা কৌতুকেন গ্রসতি জগদিদং যা মহাধূম্রবাসা…’’’

হাতের তেলো খুললাম, দেখি মাধুরীর সেই দিদুনের দেওয়া মাদুলি!

‘‘এ কী কাকা? এ তো মাধুরীর দিদুনের দিয়ে যাওয়া…’’

‘‘হ্যাঁ ভবতারণ৷ ওকে আহুতি দাও ওই অগ্নিতে, সমর্পণ করো৷’’

‘‘কিন্তু কাকা, এ তো মাধুরীর রক্ষার জন্য…’’

‘‘ওর প্রয়োজন ফুরিয়েছে ভবতারণ৷ অপার ভালোবাসা আর অক্ষয় যোগবিভূতি দিয়ে তিনি যে রক্ষাকবচ বানিয়ে দিয়ে গেছিলেন, আজই তার অন্তিম এবং চূড়ান্ত প্রয়োগের দিন৷ আজকের জন্যই ওকে তৈরি করা হয়েছিল…’’

‘‘কিন্তু আমার হাত দিয়ে কেন?’’

প্রশ্নটা শুনে থমকালেন কাকা৷ যজ্ঞের লেলিহান শিখা তাঁর মুখের ওপর আলোছায়ার অজস্র কাটাকুটি খেলছিল৷ আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তিনি বললেন, ‘‘কারণ এই মুহূর্তে একমাত্র ভালোবাসা ছাড়া মাধুরীকে বাঁচাবার জন্য আমাদের হাতে আর কিছুই নেই ভবতারণ৷ জেনে রেখো, ভালোবাসাই হল সবচেয়ে বড় তন্ত্র, সবচেয়ে বড় জাদু৷’’

 * * * *

আমরা অপেক্ষা করছি মন্দির থেকে একটু দূরে, কয়েকটা গাছের আড়ালে৷ এখান থেকে মন্দিরের ভেতরের অনেকটা বেশ স্পষ্ট দেখা যায়৷ আমি বলতে আমি আর কাকা৷ পরাগ আছে একটু দূরে, মন্দিরের কাছাকাছি৷ কথা আছে যে আমাদের মিশন শেষ হলে আমি আর ও মিলে গোলকপুষ্পের লতাটা সযত্নে তুলে নিয়ে যাব৷ প্রফিটের বখরা হবে আধাআধি৷

যজ্ঞ শেষ হয়েছে কয়েক ঘণ্টা হল৷ তার ভস্ম ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মন্দিরের সামনের চাতাল জুড়ে৷ আমরা বসে আছি এই নাটকের শেষ দেখার জন্য, গোলকপুষ্প তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য তো বটেই৷

ঘড়ি বলছে এখন মধ্যরাত৷ রাতের জঙ্গল শুনেছিলাম আশ্চর্য রকমের সুন্দর হয়৷ কিন্তু এই বনভূমির অতিপ্রাকৃতিক স্তব্ধতা আমাদের বুকের মধ্যে গভীর অস্বস্তির মতো চেপে বসছিল৷ মনে হচ্ছিল চারপাশের সবকিছু যেন এক অজানা আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছে৷

আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সমস্ত আকাশ লাল৷ আমাদের ঠিক মাথার ওপর মেঘের ঘূর্ণিমুখ৷ যে-কোনো মুহূর্তে প্রলয় শুরু হতে পারে৷

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটু ঢুলছিলাম বোধহয়৷ কাকা হঠাৎ করে আমাকে খোঁচা দিতে সজাগ হয়ে উঠলাম৷ মন্দিরে আসার রাস্তাটার মুখে একটা আলোর ছায়া না?

আস্তে আস্তে আলোটা বেড়ে উঠতে লাগল৷ কে বা কারা যেন আসছে ওই রাস্তা ধরে৷ পায়ের চাপে কাঠকুটো ভাঙার অতি ক্ষীণ শব্দ কানে এল৷ সমস্ত স্নায়ু টানটান সজাগ হয়ে উঠল আমার৷ ওরা আসছে তাহলে?

কিছুক্ষণের মধ্যেই সুঁড়িপথ বেয়ে অনির্বাণ বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে, হাতে একটা বড় টর্চ৷ মন্দিরটা চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে৷ সামান্য দুলছে ওর অবয়ব৷ ছেলেটা নেশা করেছে নাকি?

ধীরে ধীরে তার পাশে অলঙ্ঘ্য নিয়তির মতো ফুটে উঠল কার যেন অবয়ব৷ খিলখিল হাসির সঙ্গে ভেসে এল একটা প্রশ্ন, ‘‘কী রে ভাই, থেমে গেলি কেন?’’

‘‘এ…এটা কোথায় এলাম দিদি?’’

‘‘তুই ছোটবেলায় বারবার জিজ্ঞেস করতি না’’, আবার সেই খুনখুনে খিলখিল স্বর, ‘‘আমি মাঝে মাঝে সারাদিনের জন্য কোথায় যাই?’’

‘‘এইখানে আসিস তুই? এই জঙ্গলের মধ্যে?’’ অনির্বাণের স্বরের মধ্যে স্খলিত ভাব স্পষ্ট৷ ও কি নেশা করেছে?

‘‘হ্যাঁ রে অনি, আমি এখানেই আসি যে৷ মাও এখানেই আসত৷ দিদিমাও৷ দিদিমার মা৷ তার মা৷ আমরা সব্বাই আসতাম এখানে৷ চুপিচুপি৷ কাউকে না জানিয়ে৷’’

‘‘ক্কে…কেন? এ…এখানে আসত কেন?’’

‘‘মায়ের পুজো দিতে ভাই৷ মায়ের আদেশ ছিল যে৷’’

‘‘কীসের আদেশ? কোন মায়ের পুজো?’’

‘‘ওই যে মন্দিরটা দেখছিস ভাই, ওটা কীসের মন্দির জানিস?’’

‘‘ন্না…ন্না তো৷’’

‘‘আমাদের মায়ের মন্দির৷ সবার মায়ের মন্দির৷ কাউরীবুড়ির মন্দির৷’’

‘‘কাউরীবুড়ির মন্দির? কাউরী মানে তো কাক…কাকেদের আবার মন্দির হয় নাকি?’’

কথা বলতে বলতে দুটো ছায়া হেঁটে যাচ্ছিল মন্দিরের দিকে৷ অনির্বাণের পরনে একটা ধুতি আর উড়নি৷ পাশের খর্বকায় দেহটি চিনতে আমার বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি৷ আজও মহিলার কোমরে একটি বেতের চুবড়ি৷ সেদিনের কথা মনে পড়তেই আমার সারা শরীরে একটা শিহরন খেলে গেল৷

দুজনে যখন চত্বরটার মাঝামাঝি, হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন মহিলা৷ দেখাদেখি দাঁড়িয়ে পড়ল অনির্বাণও৷ কিছু জিজ্ঞেস করল দিদিকে৷ ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন না৷ এদিক-ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজলেন৷ আকাশের দিকে মুখ তুলে কী একটা শোঁকার চেষ্টা করলেন৷ তারপর ওইখানে দাঁড়িয়েই চারিপাশটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে থাকলেন৷ যেখানে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠিক সেখানে এসে দৃষ্টিটা থেমে গেল৷

বুকটা ধড়াস ধড়াস করছিল আমার৷ মহিলা বুঝতে পেরে গেলেন নাকি? ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠল না?

নাহ, চারিদিকটা দেখে আবার মন্দিরের দিকে চলতে শুরু করলেন তিনি৷ সঙ্গে সঙ্গে অনির্বাণও৷ ওর অবিন্যস্ত হাঁটাচলা দেখে বোঝাই যাচ্ছিল ও নিজের বশে নেই৷ যেন পুতুলের মতো ওকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বধ্যভূমির দিকে৷

মন্দিরের মধ্যে দুজন অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আলো জ্বলে উঠল সেখানে৷ এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে দেবীমূর্তির পায়ের সামনে জ্বলে উঠেছে দুটি বিশাল মাটির প্রদীপ৷ আরও দুটি বড় প্রদীপ জ্বেলে দেওয়া হল মন্দিরের কোনায়৷ তাদের আলোয় দুটি দীর্ঘ ভূতুড়ে ছায়া খেলে যাচ্ছিল মন্দিরের দেওয়ালে৷

এবার পুজো শুরু হল৷ কিন্তু আজকের পুজো আগের দিনের পুজোর থেকে আলাদা৷

মূর্তির সামনে একে অন্যের দিকে মুখ করে বসল দুজন৷ প্রথমে মহিলা চুবড়ি থেকে একটা মাটির ভাঁড় তুলে নিলেন, একটা কাচের বোতল থেকে তাতে ঢেলে দিলেন কিছু তরল৷ তারপর সেটা খাইয়ে দিলেন অনির্বাণকে৷ অনির্বাণ পুরো ভাঁড়টা এক নিমেষে খালি করে পাশে ছুড়ে দিল৷ চোখ বুজে বসে রইল কিছুক্ষণ৷ তারপর দেখলাম ওর মাথাটা ঝুঁকে পড়ল বুকের কাছে৷

মহিলা এবার কিছু ফুল ইত্যাদি তুলে নিয়ে একবার মূর্তির পায়ে ছোঁয়ালেন, তারপর ছুড়ে দিলেন অনির্বাণের বুকের দিকে৷ তারপর তুলে নিলেন আরও কিছু, দেবীর পায়ে ছুঁইয়ে রাখলেন অনির্বাণের মাথায়৷ সঙ্গে ক্রমাগত চলছিল মন্ত্রোচ্চারণ৷

এইরকম চলল বেশ কিছুক্ষণ৷ তারপর মহিলা উঠে মন্দিরের বাইরে এলেন৷ এদিক-ওদিক দেখে বাঁদিকে একটু এগিয়ে কী একটা তুলে নিলেন মাটি থেকে৷ অন্ধকারে মনে হল কী যেন একটা ছটফট করছে মহিলার হাতে৷

কাকা আমার হাতে আলতো চাপ দিলেন, ‘‘তৈরি হও ভবতারণ৷ যা আশঙ্কা করেছিলাম তাই ঘটতে চলেছে৷’’

‘‘কী আশঙ্কা কাকা?’’

‘‘একটু আগেও দেখেছিলে ওখানে কিছু রাখা আছে বলে?’’

‘‘কই, না তো!’’

‘‘তাহলে ওটা ওখানে এল কী করে?’’

জবাব দেওয়ার আগে আমার চোখ চলে গেল মন্দিরের ভেতরে৷ হাতের ভেতরে ছটফট করতে থাকা প্রাণীটাকে দেবীর পায়ের কাছে রাখা হাড়িকাঠে চড়িয়েছেন মহিলা৷ আর তারপর আগের দিনের মতোই একটা ধারালো ছুরি দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কী একটা মন্ত্র পড়তে পড়তে তার মাথাটা কেটে ফেললেন৷

আগের দিনই দেখেছি এই জিনিস ঘটতে, আমার আঁতকে ওঠার কথা নয়, তবুও উঠলাম৷ কারণ এইবার যে প্রাণীটাকে উনি বলি দিলেন সেটা একটা কাক!

কাকা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘‘কাকভোগ!’’

বলির রক্তটা গড়িয়ে যাচ্ছিল গোলকপুষ্পের দিকে৷ মহিলা সেই রক্ত তুলে নিয়ে তিলকের মতো টেনে দিলেন অনির্বাণের কপালে৷ তারপর অনির্বাণের গায়ের উড়নিটা একটানে খুলে ফেললেন৷

কাকা অস্ফুটে বললেন, ‘‘যক্ষিণীচক্র শুরু হতে চলেছে ভবতারণ, চূড়ান্ত সময় আগতপ্রায়৷ সতর্ক হও, চোখকান খোলা রাখো৷ যাই ঘটুক না কেন, আমি যখন যেটা করতে বলব তখন সেটা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে৷ আমার আদেশের যেন অন্যথা না হয়৷’’

ততক্ষণে অনির্বাণকে উপুড় করে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে দেবীমূর্তির পায়ের কাছে৷ তার দুই হাত সামনে, হাড়িকাঠটিকে বেষ্টন করে প্রসারিত৷ এখান থেকেই বুঝতে পারছি সম্পূর্ণ নগ্ন সে৷ মহিলা ঝুঁকে পড়েছেন ওর ওপর, পিঠে কী যেন একটা এঁকে দিচ্ছেন রক্ত দিয়ে৷ দুই কাঁধের ওপর রাখলেন কিছু রক্তবর্ণ পুষ্পগুচ্ছ৷

তারপর মহিলা উঠে দাঁড়ালেন৷ খুলে ফেললেন নিজের পরনের কাপড়৷ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল৷ যক্ষিণীচক্রের শুরু৷

মহিলা অনির্বাণের পিঠের ওপর পদ্মাসনে বসলেন, মুখখানি দেবীর মূর্তির দিকে৷ এখান থেকে তাঁর অনাবৃত পিঠ, মুখের ডানদিকটা আর অবনত স্তনের খানিকটা অংশ দেখতে পাচ্ছিলাম৷ প্রদীপের আলোয় চকচক করছে অনির্বাণের নিস্পন্দ দেহ৷ ছেলেটা জড়বস্তুর মতো শুয়ে আছে মাটিতে৷ মনে হচ্ছে ও যেন আর বেঁচে নেই, ওখানে যেটা পড়ে আছে সেটা ওর মৃতদেহ৷

এতদূর থেকেও মন্দিরের ভেতরের ঘটনাগুলো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম৷ প্রদীপের আলো-আঁধারিতে সেই উলঙ্গিনী নারীমূর্তির ছায়া দেখে আমার চোখে যেন ধাঁধা লেগে গেল৷ মহিলার হাত-পাগুলো দেহের তুলনায় এত লম্বা হয়ে গেল কী করে? একটু আগে খোঁপা করে বাঁধা চুলগুলো ডাইনির মতো উড়ছে কেন? স্তন দুখানি এত শুষ্ক কেন?

জঙ্গলের মধ্যে এক প্রাচীন মন্দির, তার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত অদ্ভুতদর্শন দেবী, আর তার সামনে দুই নগ্ন মানুষ-মানুষীর আদিম উপাসনা, সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল আমার সামনে যেন একটা প্রাগৈতিহাসিক ছায়াছবি অনুষ্ঠিত হচ্ছে৷ এই বুঝি ঘটে যাবে একটা অঘটন, আকাশ থেকে নেমে আসবে অশরীরী কোনো…

একঝলক ঠান্ডা বাতাস আমার মুখে ঝাপটা মেরে যেতে আকাশের দিকে চাইলাম আমি৷ মাথার ওপর জমে আসা মেঘের দল এখন আরও গভীর, আরও ঘন৷ যে-কোনো মুহূর্তে ঝড় শুরু হবে৷

মহিলা প্রথমে দু’হাত তুলে প্রণাম করলেন কাউরীবুড়ির মূর্তিকে৷ তারপর সম্পূর্ণ অজানা কোনো ভাষায়, অতি উচ্চকণ্ঠে শুরু করলেন মন্ত্রোচ্চারণ৷

কাকা ফিসফিস করে বললেন, ‘‘শুনতে পাচ্ছ ভবতারণ?’’

‘‘পাচ্ছি কাকা৷ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি৷ কিন্তু ভাষাটা বুঝতে পারছি না৷’’

‘‘এ ভাষা আমাদের চেনা পৃথিবীর কোনো ভাষাই নয় ভবতারণ৷ পরাগের বুড়ো ঠাকুর্দা কী বলেছিল গোলকপুষ্পর ব্যাপারে? পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর পাতাল থেকে তুলে আনা অভিশাপ৷ পাতাল ভবতারণ, পাতাল৷ যে পাতালে এই নাগজাতির বাস৷ এ তাদেরই ভাষা, হাজার হাজার বছর ধরে এই ভাষায় তারা পুজো করে এসেছে তাদের আরাধ দেবীকে৷’’

‘‘কিন্তু…কিন্তু…এত দূর থেকে এত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি কী করে কাকা?’’

‘‘বায়ুস্তম্ভন ভবতারণ, এই প্রাচীন বিদ্যায়…’’

কাকার কথা শেষ হল না, কারণ ততক্ষণে একটা অশরীরী দৃশ্য স্তম্ভিত করে দিয়েছে আমাদের দুজনকে৷

অনির্বাণের দু’হাত পেঁচিয়ে ধরেছে কোনো এক গুল্মলতা৷ শুধু পেঁচিয়ে ধরেছে তাই নয়, মুহূর্তে মুহূর্তে বেড়ে চলেছে তার দৈর্ঘ্য৷ মনে হচ্ছে যেন মাটির গভীর থেকে উঠে এসেছে কোন অতিদীর্ঘ মহাসর্প, ক্রমশ তা গ্রাস করে চলেছে অনির্বাণের শরীরের ঊর্ধ্বভাগ৷ সে দৃশ্য এতই অবিশ্বাস্য, এতই হাড়হিম করে দেওয়া যে আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা শীতল বিদ্যুতের ঝলক নেমে গেল যেন৷

কাকা অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন, ‘‘গোলকপুষ্প৷’’

আমি দু’চোখে ঘোর অবিশ্বাস নিয়ে দেখছিলাম যে লতা তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমার এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা, সেই মায়াবী লতা এখন হাড়িকাঠের সামনের গহ্বর থেকে উঠে এসেছে ভয়াল নিয়তির মতো৷ ক্ষণে ক্ষণে বেড়ে চলেছে তার দৈর্ঘ্য৷ মোটা কাছির মতো আষ্টেপৃষ্ঠে সে বেঁধে ফেলছে অনির্বাণের শরীর৷

দু’হাত তুলে উন্মাদের মতো হেসে উঠলেন সেই নারী৷ জয়, জয় হয়েছে তাঁর৷ তাঁর আহ্বান শুনে ঘোর পাতাল থেকে উঠে আসছে সেই শয়তানি লতা৷ আজ তিনি সিদ্ধকাম৷ আজ তিনি জয়ী৷

অনির্বাণের পিঠ থেকে উঠে দ্রুতপায়ে মন্দিরের বাইরে এসে দাঁড়ালেন সেই উলঙ্গিনী যক্ষিণী৷ তারপর মন্দিরের সামনের চত্বরটি বৃত্তাকারে ঘুরতে শুরু করলেন তিনি, দু’হাত উপরে তুলে উচ্চৈঃস্বরে আউড়ে যেতে লাগলেন কোনো এক সুরেলা মন্ত্রগান৷ মানুষের স্মৃতির অনধিগম্য কোন এক অশরীরী গানের সুর ঘুরে বেড়াচ্ছিল সেই আদিম বনভূমি জুড়ে৷ তার ক্ষয় নেই, তার লয় নেই, তার আদি নেই, তার অন্ত নেই৷ সেই ভৌতিক অপেরা-সংগীত কান্নার সুরে মাতাল করে তুলছিল অন্ধকার রাত, আর সেই নিঃসাড় বনাঞ্চল৷

কাকা আমার হাত চেপে ধরলেন, ‘‘গাছের দিকে তাকাও ভবতারণ৷’’

দেখি মন্দিরের পিছনে গাছের ডালে উড়ে এসে বসেছে কাকেদের দল৷ তাদের দৃষ্টি এখন পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরির দিকে, যিনি বাতাসে মিশিয়ে দিচ্ছিলেন দুর্বোধ্য ভাষার আহ্বান৷ সেই আহ্বান ক্রমেই আরও উচ্চকিত হয়ে উঠছিল৷ হয়ে উঠছিল আরও তীব্র, আরও তীক্ষ্ণ৷

হঠাৎ করে দেখি তারা নেই, অকস্মাৎ উধাও হয়ে গেছে কোথাও! কাকার দিকে মুখ ফিরিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই তিনি আঙুলটা ঠোঁটের ওপর চেপে ধরলেন৷ ইশারা করলেন সামনের দিকে দেখতে৷

যেমন হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেছিল কাকেদের দল, ঠিক তেমনই হঠাৎ করে মন্দিরের পেছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এল একদল নারী৷ তাদের আহ্বানকারীর মতো তারাও নগ্ন, উলঙ্গ৷ সেই ঘোর কৃষ্ণবর্ণা রমণীর দল ঘিরে দাঁড়াল তাদের কর্ত্রীকে৷ তারপর মাটিতে বসে তারাও দু’হাত উপরে তুলে গাইতে লাগল সেই অলৌকিক প্রার্থনাসংগীত৷

এই দৃশ্য দেখে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছিল৷ কোনোমতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘এরা কারা কাকা?’’

‘‘এরা তারাই ভবতারণ, যারা দেবীর আদেশে এক রাত্রের মধ্যে ধ্বংস করেছিল পাতরগোঁয়্যাদের৷ এরা তারাই, যাদের তুমি প্রথম দিন দেখেছিলে এখানে আসার সময়৷ ওরা কাউরীবুড়ির অনুচর ভবতারণ, পাতাল থেকে উঠে আসা অন্ধকারের প্রহরী৷ আড়াইশো বছর ধরে ওরা পাহারা দিয়ে এসেছে তাদের আরাধ্যা দেবীর মন্দির৷ অপেক্ষা করে আছে কবে কোনো এক বড়দেওরি এসে মুক্তি দেবেন ওদের৷’’

আমার শিরদাঁড়া দিয়ে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল, ‘‘কিন্তু এরা এখন এখানে কেন কাকা? কেন ডেকে আনা হয়েছে ওদের?’’

‘‘ভয় পেও না ভবতারণ৷ যদি আমার কিছুমাত্র যোগবিভূতি থাকে, যদি নিষ্ঠাভরে দেবীর পূজার্চনা করে থাকি, তবে শুনে রাখো, আজ এই সাধনার ফল অতি ভয়ংকর হবে৷ যে মহান বিদ্যা হাজার বছর ধরে গুপ্ত ছিল, গুহ্য ছিল, প্রকটিত হত শুধুমাত্র সমষ্টির স্বার্থে, আজ তাকে প্রয়োগ করা হয়েছে অতি হীন উদ্দেশ্যে৷ ওই যক্ষিণী নারী কেবলমাত্র নিজের স্বার্থ পূর্ণ করার জন্য, নিজের অতৃপ্ত কামবাসনার আগুনে আহুতি দেওয়ার জন্য আয়োজন করেছে দেবী ধূমাবতীর গোপনতম চক্রসাধনার৷ এর ফল অতি ভয়াবহ ভবতারণ৷ জেনে রাখো, আজ এই উন্মুক্ত প্রান্তরে, আড়াইশো বছর পর আবার দেবীর ক্রোধ নেমে আসবে৷ আর এবার নেমে আসবে অন্য কারও ওপর নয়, নেমে আসবে পাতরগোঁয়্যাদের শেষ বড়দেওরির ওপরে৷’’

কাকার শেষের কথাগুলো আমার কানে ঢুকছিল না৷ কারণ ভ্রূকুটি-থমথম আকাশের নীচে, নির্জন বনভূমির মধ্যে এক উন্মুক্ত প্রান্তরে একদল নগ্ন ছায়ারমণীর নাচ ক্রমেই আরও উদ্দাম, আরও অপার্থিব হয়ে উঠছিল৷

চোখটা একবার বন্ধ করে আবার খুললাম৷ হা ঈশ্বর, এসব কী দেখছি আমি?

কাকার দিকে চাইতে দেখি চোখ বন্ধ করে কী যেন উচ্চারণ করছেন তিনি৷ কোনো মন্ত্র কি? হ্যাঁ, তাই তো মনে হচ্ছে৷ কিন্তু…কিন্তু ভাষাটা সংস্কৃত নয়৷

এমনকি আমার চেনাজানা কোনো ভাষাই নয়!

এ সেই ভাষা, যাতে একটু আগে মন্ত্রোচ্চারণ করছিলেন ওই নাগযক্ষিণী৷

আমার সবকিছু গুলিয়ে গেল৷ ইনি কী করে জানলেন এই ভাষা? এই মন্ত্র? আসলে কে ইনি?

আমার ভাবার মধ্যেই হঠাৎ এক আর্ত চিৎকারে খানখান হয়ে গেল চারিদিক৷ তাকিয়ে দেখি সমস্ত চত্বর জুড়ে দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছে আগুন৷ মুহূর্তের মধ্যে লেলিহান হয়ে উঠেছে তার শিখা৷ তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ নেই৷ সেই আগুনের রং লাল, টককে লাল, ঠিক যেমন আমাদের যজ্ঞের আগুনটি ছিল৷ আর ভিজে কাঠ পোড়ার একটা খুব চেনা ভ্যাপসা, শ্বাসরুদ্ধকর গন্ধ তীব্র হয়ে বেড়ে উঠে আমার চৈতন্য আচ্ছন্ন করে দিল৷

সামনে ছড়িয়ে থাকা ভূখণ্ডখানি জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছিল আর্তনাদ, আতঙ্কের লেলিহান শিখা৷ আমাদের যজ্ঞের ছাই যেখানে যেখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেই প্রতিটি ভস্মকণা থেকে উত্থিত হয়ে উঠেছিলেন মহাহুতাশনসর্প৷ সেই মহাপাবক লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল ওরা৷ তাদের আর্তনাদ আমাকে বধির করে দিচ্ছিল৷ আমি ছটফট করে উঠছিলাম৷ আজ এতগুলো মানুষের মৃত্যু দেখতে হবে আমাকে?

ভাবতে ভাবতেই কতগুলো ক্র্যাঁড়ও ক্র্যাঁও স্বরে আর্ত চিৎকার ভেসে এল আমার কানে৷ সে অমানুষিক আওয়াজ কীসের? কীসের আওয়াজ ওগুলো? এত পালক পোড়ার গন্ধই বা আসছে কোথা থেকে?

আস্তে আস্তে আমার চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠল একদল মানুষ প্রমাণ আকারের পাখির দল৷ আগুনের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু হয়ে উঠেছে তাদের কালো মাথা, তাদের বাঁকানো ক্ষুরধার চঞ্চু৷ আর জ্বলন্ত হলুদ চোখের মধ্যিখানে উন্মত্তের মতো ঘুরছে লাল টকটকে মণিগুলি৷ আজ বুঝতে পারলাম কোন মহাভয়ংকর নারকী পাখির দল সেদিন নেমে এসেছিল পাতরগোঁয়্যাদের গ্রামে!

কিন্তু আজ তাদের চোখে জিঘাংসার বদলে অন্য কিছু ছিল৷ ভয়৷ মহাভয়৷ মৃত্যুভয়৷

হঠাৎ করে থেমে গেল কাকার অদ্ভুত মন্ত্রোচ্চারণ, তারপর উত্তেজিতভাবে নির্দেশ করলেন মন্দিরের ভেতরের দিকে৷

এতক্ষণে মন্দিরের ভেতরে চোখ গেল আমার, আর হৃৎপিণ্ডটা প্রায় কণ্ঠার কাছে এসে আটকে গেল৷

গোলকপুষ্পের লতা তখন প্রায় ঢেকে ফেলেছে অনির্বাণের শরীর৷ মনে হচ্ছিল যেন একটা সবুজ মমি পড়ে আছে মন্দিরের মেঝেতে৷ তখনও তার ওপর দিয়ে সাপের মতো বেড়ে চলেছিল সেই শয়তানের লতা৷ তার ওপর ঝুঁকে পড়েছেন অনির্বাণের দিদি, জান্তব স্বরে আর্তনাদ করতে করতে পাগলের মতো ঝাঁকাচ্ছেন অনির্বাণের দেহ৷ দু’হাতে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছেন সেই দৃঢ়বদ্ধ লতাজাল৷ কিন্তু হায়, ব্যর্থ সাধনার অভিশাপ তখন আর ফেরাবার উপায় নেই৷

মন্দিরের ভেতরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্রের মতো ধেয়ে গেল একদলা অগ্নিপিণ্ড৷

ঠিক তখনই মাথার ওপর শোনা গেল শনশন শব্দ৷ মাথা উঁচু করে দেখলাম বিশাল কিছু একটার ছায়া আকাশের বুক ছেয়ে নেমে আসছে আমাদের দিকে৷

‘‘পালাও ভবতারণ, পালাও৷ ও আসছে তোমারই জন্যে৷ যেভাবে হোক পালাও এখান থেকে, নিজের প্রাণ বাঁচাও৷’’

প্রবল ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘ওটা কী কাকা? কী নেমে আসছে আকাশ থেকে?’’

‘‘কী নয়, বলো কে৷’’

আমার মুখ থেকে কথা বেরোল না৷ তার আগেই বলে উঠলেন কাকা, ‘‘পালাও ভবতারণ, এখনই পালাও, যেদিকে দু’চোখ যায়৷ আজ ও তোমাকে আর আমাকে এখানে টেনে এনেছে খুন করবে বলেই, সেটাই ওর আসল উদ্দেশ্য৷ ও এই ডাইনির দোসর, সমস্ত পাপের ভাগীদার৷ সেইজন্যই ও অত সহজে অনির্বাণকে আমাদের জন্য নিয়ে আসতে পেরেছিল৷ সেইজন্যই ও যখন আজ এখানে ঢোকে, কাউরীবুড়ির অনুচরেরা ওর ক্ষতি করেনি৷ ওই-ই আজ কাকভোগ তুলে দিয়েছিল ওই রাক্ষসীর হাতে…’’

‘‘কিন্তু কাকা…আপনি কী করে এত নিশ্চিত হচ্ছেন?’’

এই প্রথম উত্তেজিত হতে দেখলাম কাকাকে, তিনি চিৎকার করে বললেন, ‘‘মনে করে দ্যাখো ভবতারণ, মন্দিরে ঢুকে যখন আমি যখন বললাম, ‘টর্চ জ্বালো ভবতারণ, মায়ের মুখখানি দেখতে দাও’, তখন কিন্তু তোমার সঙ্গে সঙ্গে ওর টর্চের আলোও আছড়ে পড়েছিল মাতৃমূর্তির ওপরে৷ ও কী করে জানল দেবীমূর্তি মন্দিরের ঠিক কোথায়, যদি না ও এখানে আগে থেকেই এসে থাকে? যেদিন ও মংকুর মুখে শুনেছে তোমার এখানে আসার কথা, সেদিন থেকে ও তোমার পেছনে ঘুরছে মৃত্যু হয়ে, কাউরীবুড়ির ছায়া হয়ে৷ তোমাকে ও কাউরীবুড়ির কাছে বলি দিতে চায় ভবতারণ, পালাও৷ আমার কথা ভেবো না, এক্ষুনি পালাও এখান থেকে৷ যেদিকে দু’চোখ যায়…’’

ততক্ষণে মানুষপ্রমাণ বিহঙ্গমটির ছায়া সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত হয়ে নেমে আসছে আমার মাথার ওপর৷ তার হিংস্র নখের সারি বেরিয়ে এসেছে উদগ্র আয়ুধের মতো৷ তার দিকে তাকিয়ে মোহগ্রস্তের মতো বললাম, ‘‘এ কি…এ কি…তাহলে…’’

‘‘হ্যাঁ ভবতারণ, মগলহানজামা মারা যায়নি৷ চাংদেওমাই তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় সঙ্গীকে এই অদ্ভুত ক্ষমতা দিয়ে যান৷ আড়াইশো বছর ধরে মগলহানজামার মৃত্যুহীন আত্মা রক্ষা করে এসেছে তাঁর উত্তরাধিকারীদের, আদেশ পালন করে এসেছে পাতরগোঁয়্যাদের বড়দেওরিদের৷ এই-ই হত্যা করেছে অনির্বাণের বাবাকে, এই-ই ধর্মনাশ করতে উদ্যত হয়েছিল মাধুরীর৷ মগলহানজামা-ই আসলে পরাগ বসুমাতারি…’’

আমি আর শুনিনি৷ দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড় দিলাম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে৷ শুধু তার আগে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম, যেখানে দাঁড়িয়ে কাকা কথা বলছিলেন, সে জায়গাটা ফাঁকা! সেখানে কেউ নেই!

 * * * *

আমি প্রাণভয়ে দৌড়োতে থাকলাম জঙ্গলের আরও ভেতরে৷ গাছের ডাল সপাং সপাং করে আছড়ে পড়ছে আমার চোখেমুখে, পা আটকে যাচ্ছে লতায়, ঘাসে৷ কোনোমতে সেগুলো ছাড়িয়ে জঙ্গলের আরও গভীরে ঢুকে যেতে চাইছি আমি৷ আমি জানি, এখন এই জঙ্গলই আমার রক্ষাকর্তা৷ মাঝে মাঝে ওপরে তাকিয়ে দেখছি, গাছের মাথার ফাঁকে দেখা যাচ্ছে সেই বিশাল কালো ছায়া৷ মৃত্যুর ছায়া উড়ে আসছে আমার পালাবার পথ অনুসরণ করে৷ বিন্দুমাত্র ফাঁকা জায়গা পেলেই আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সে৷

ছুটতে ছুটতে একটা বড় গাছের আড়ালে দাঁড়ালাম কিছুক্ষণ৷ বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছিল৷ চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিলাম৷ সারা গা বেয়ে দরদর করে নামছে ঘামের স্রোত৷ হাত-পা কাঁপছে থরথর করে, ভয়ে, আতঙ্কে৷

চোখটা খুলে চারিদিক দেখে নিলাম একবার৷ আর তখনই একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম৷

ঝিঁঝিপোকার ডাক৷ আমি ঝিঁঝিপোকার ডাক শুনতে পাচ্ছি৷ শুনতে পাচ্ছি রাতচরা পাখিদের ক্ষীণ আওয়াজ৷

তাহলে কি আমি নিজের অজান্তেই পেরিয়ে এসেছি ওই অভিশপ্ত মন্দিরের চৌহদ্দি?

মাথার ওপরে তাকালাম, গাছের ফাঁক দিয়ে যতটা দৃষ্টি যায়৷ পুবের আকাশ খুব অল্প লাল৷

ডানদিকে তাকিয়ে দেখি জঙ্গল পাতলা হয়ে এসেছে অনেকটাই৷ ডালপালার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে জঙ্গলের গা ঘেঁষে এক বিশাল জলাশয়৷ মাগুরির বিল৷

কী করব আমি? জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকব দিনের আলো ফোটা অবধি? ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য এ ছাড়া আর উপায় আছে?

ফের একবার আকাশের দিকে তাকালাম৷ কোথায় ও?

মাথার ওপরে কেউ নেই৷ কিচ্ছু নেই৷

দুটো হাত হাঁটুতে ভর দিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম একবার৷ ঠিক তখনই শব্দটা কানে এল৷ মৃদু৷ সন্তর্পণ৷ কাছে৷ খুব কাছে৷

আস্তে আস্তে ঘাড়টা বাঁদিকে ঘোরালাম৷ ও দাঁড়িয়ে আছে৷ আমার থেকে খানিকটা দূরে৷

কে ও? কী নাম ওর?

নাহ, এখন আর ওর কোনো নাম নেই৷

দৈর্ঘ্যে আমার থেকে এক হাত উঁচু৷ কুচকুচে কালো গায়ের রং৷ অন্ধকারের মধ্যেও বুঝতে পারছিলাম সারা শরীরে ঢেউ খেলছে পেশি৷ কাঁধের পাশে দুটো ডানার আভাস, যদিও সে দুটো মিলিয়ে আসছিল দ্রুত৷ নাক আর মুখ মিলিয়ে যেটা আছে সেটা চঞ্চু বা ঠোঁট ছাড়া আর কিছু হতে পারে না৷ আর চোখ, উফ, সেই ভয়ানক চোখ৷ স্থির অচঞ্চল চোখে সেই দানব তাকিয়ে ছিল আমার দিকে৷

কী ছিল সেই দৃষ্টিতে? রাগ? ক্ষোভ? প্রতিশোধের বাসনা?

ডানদিকে ঘুরেই দৌড় দিলাম আমি৷ আমাকে পৌঁছোতে হবে ওই বিলে৷ যে করে হোক, যে-কোনো মূল্যে হোক৷

ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োচ্ছিলাম আমি৷ পেছন থেকে ভেসে আসছিল কাঠপাতা ভাঙার মড়মড় শব্দ৷ এত কাছে এসে শিকারকে হাতছাড়া হতে দেবে না সে৷ প্রতি মুহূর্তে তার সঙ্গে আমার ব্যবধান কমে আসছিল৷ প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাক্ষাৎ মৃত্যু! ও আসছে, ও আসছে…

দুটো শরীর একসঙ্গেই ঝাঁপ দিল বিলের জলে৷

প্রথমে বেশ খানিকটা তলিয়ে যাওয়ার পর জলের নীচে স্থির হলাম৷ এই অন্ধকারে কয়েক হাত জলের নীচে কিছুই দেখার সম্ভাবনা নেই৷ স্থির হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম কোথায় গেল ও!

হঠাৎ কে যেন বড় বড় নখ দিয়ে খামচে ধরল আমার পা দুটো, আর টেনে নিয়ে যেতে চাইল জলের নীচে৷ দ্রুত, খুব দ্রুত জলের মধ্যে ডুবে যেতে থাকলাম আমি৷ ছটফট করতে থাকলাম উঠে আসার জন্য, প্রাণপণে চেষ্টা করতে থাকলাম…

কিন্তু না! সব চেষ্টা ক্রমে ব্যর্থ হতে থাকল৷ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে৷ প্রবল বেগে ছটফট করছি, একটু একটু করে আমার চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে আসছে৷ আর বোধহয় শেষরক্ষা হল না৷ চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকারের পর্দা নেমে এসেছে, শিথিল হয়ে এসেছে শরীরের পেশিগুলো, আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি, এমন সময় আমার মনে হল ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালাম৷

বহু কষ্টে মাথাটা একটু তুললাম৷ দেখলাম যে মাথার ওপরের জলটা যেন আলো হয়ে আছে৷ আর সেখান থেকে দুটো হাত নেমে এল জলের মধ্যে৷ পুরুষ নয়, নারীর হাত৷ দুটি নিরাভরণ কৃশকায় হাত আমার কাঁধদুটো আঁকড়ে ধরল সজোরে, আর টেনে নিয়ে যেতে লাগল জলের ওপরে৷

শুরু হল প্রাণপণ লড়াই৷ ধারালো নখের আঁচড় কেটে বসছে আমার পায়ের মাংসে৷ ওপরের টানও ক্রমশ বেড়ে উঠেছে৷ একসময় বুঝতে পারলাম নীচের দিকের টান আলগা হয়ে আসছে ক্রমশ৷ যত ওপরে উঠছি, তত আমার হাতে সাড় ফিরে আসছে৷ বেঁচে যেতে পারি, এই বোধটুকু আমার মাথার মধ্যে গেঁথে যেতেই আমার শরীরে আর মনে দুনো বল এল৷ আমি সাঁতার কেটে উঠছি, উঠছি…আরও ওপরে উঠছি…জলের ওপর আলোটা এখন অনেক স্পষ্ট৷ শরীর আর মনের সবটুকু জোর একত্র করে সেদিকে সাঁতার কাটতে লাগলাম আমি৷ মনে হচ্ছে ওই জলের মধ্যেই আমার শরীর ঘিরে যেন আলোর বন্যা বইছে—সেই আলোয় জলের অতলে বহুদূর অবধি দেখা যাচ্ছে৷ প্রাণপণে ওপরে উঠতে উঠতেই নীচের দিকে তাকিয়ে একটা অপার্থিব অলৌকিক দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম৷

দেখি যে মহামৃত্যুবিহঙ্গ আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল অতল জলের গভীরে, তার সারা শরীর গ্রাস করেছে একঝাঁক জলজ লতা৷ সেই দ্রুত বেড়ে ওঠা লতার ঝাঁক হাত-পা বেঁধে ফেলছিল তার, আর প্রধান লতাটি কালসর্পের মতো নির্ভুল লক্ষ্যে পেঁচিয়ে ধরছিল ওর গলা৷

ছটফট করতে করতে তলিয়ে যাচ্ছিল ও, আড়াইশো বছর ধরে বেঁচে থাকা এক প্রেত৷ তার শ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল আমার খুব পরিচিত একটি গুল্ম৷ আর আর সেই গুল্মের মাথাটা ছোবল দিতে ওঠা সাপের ফণার মতো!

এতদিনে বুঝলাম ওসমানের এনে দেওয়া পুথিটার সেই অদ্ভুত শ্লোকের অর্থ, গোলকপুষ্পাৎ মহাভয়ং সঞ্জাতং যদ্ভবিষ্যতে৷ তদ্ভয়ং নিবারণার্থং গোলকপুষ্পং বিধীয়তে৷ গোলকপুষ্প থেকে যদি মহাভয় উৎপন্ন হয়, তাহলে গোলকপুষ্পই তোমাকে রক্ষা করবে!

কোনোমতে হাঁপাতে হাঁপাতে ডাঙায় উঠে কাদার মধ্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম৷ শরীরে আর একবিন্দু শক্তি অবশিষ্ট ছিল না৷

খানিকক্ষণ পর মাথা তুলে দেখি পুবের আকাশ খানিকটা লাল৷ তবুও অন্ধকার কাটেনি পুরোটা৷ চোখের পাতায় জলকাদা লেগে সামনেটা ঝাপসা দেখাচ্ছিল৷ সেই আলো-অন্ধকারের মধ্যে দেখলাম আমার থেকে কিছু দূরে এক বৃদ্ধা রমণী ধীরে ধীরে হেঁটে মিলিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গলের মধ্যে৷ সামান্য ন্যুব্জ হয়ে হাঁটছেন তিনি৷ পরনে বিধবার বেশ৷ বাতাসে উড়ছে তাঁর শ্বেতশুভ্র কেশরাজি৷ চলে যেতে যেতে একবার থামলেন তিনি, তারপর ঘাড় ঘোরালেন আমার দিকে৷

আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলাম৷’’

 * * * *

চাটুজ্জেমশাইয়ের গল্প শেষ৷ সবাই স্তব্ধ হয়ে বসে আছে৷ রাত হয়েছে অনেক৷ বাইরের বৃষ্টিটাও ধরেছে খানিকটা৷

প্রথম প্রশ্ন করল গদাই, ‘‘আপনার কাকার আর কোনো খবর পাননি পরে?’’

দীর্ঘশ্বাস ফেললেন চাটুজ্জেমশাই, ‘‘না হে৷ কোনো খবর নেই৷ শিলিগুড়িতে যে পাড়ায় থাকেন বলে জানিয়েছিলেন, সেখানে গেছিলাম খোঁজ করব বলে৷ পাড়ার লোক তো শুনে আকাশ থেকে পড়ল৷ বলে ওই নামের বা ওই চেহারার লোক কস্মিনকালেও ও পাড়ায় দেখেনি কেউ৷’’

‘‘কাজের জায়গায় খোঁজ নেননি?’’

‘‘নিয়েছিলাম৷ সেটাও ভুয়ো৷ শুধু একবার কথায় কথায় বলেছিলেন ওঁদের আদি বাড়ি নাকি নবদ্বীপে৷ সেখানে গিয়ে অবশ্য আর খোঁজ নেওয়া হয়নি৷ ও হ্যাঁ, বাজারে ওঁর লেখা একটা বইও নাকি আছে, তন্ত্রমন্ত্রের ওপরে৷ তার নামটাও ছাই খেয়াল নেই আর৷’’

কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে এল বিশু, ‘‘কাকার নামটা কী বললেন যেন?’’

‘‘বলেছি হে, গল্পের মধ্যেই বলেছি একবার৷ তোমরা বোধহয় খেয়াল করোনি৷ উনি নিজের নাম বলতেন কে. এন. ভট্টাচার্য৷ কৌলিক উপাধি অবশ্য মৈত্র৷ পুরো নাম কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য মৈত্র৷ একবার ঠাট্টা করতে করতে বলেছিলেন, আগমমতে তন্ত্রসাধনা করেন বলে লোকে নাকি ওঁকে উপাধিও দিয়েছে একটা, আগমবাগীশ৷’’

বিশু শুনে ভুরু কুঁচকে রইল৷

রঘুর খটকা কিন্তু তখনও যায়নি৷ প্রশ্ন করল সে, ‘‘আচ্ছা চাটুজ্জেমশাই, একটা কথার জবাব দিন তো৷ আপনার কাকার নাহয় তন্ত্রের বিশেষ ক্ষমতা ছিল বলে বিনা বাধায় ওই মন্দিরের ওখানে যেতে পেরেছিলেন৷ পরাগ ওরফে মগলহানজামার কথা ছেড়েই দিলাম৷ কিন্তু যেখানে আড়াইশো বছরে কেউ যেতে পারেনি, বা গেলেও বেঁচে ফিরে আসতে পারেনি, সেখানে আপনি প্রথমবার ঢুকে পড়লেন কী করে? তাও সম্পূর্ণ বিনা বাধায়?’’

চাটুজ্জেমশাই কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইলেন৷ তারপর বরাভয় দেওয়ার ভঙ্গিতে ডান হাতের চেটোটা তুলে ধরলেন সবার চোখের সামনে৷

সবাই ঘিরে ধরল চাটুজ্জেমশাইকে, কিন্তু বুঝল না কিছুই৷ একমাত্র বিশুই শুধু ওর ডানহাতের তর্জনীটা চাটুজ্জেমশাইয়ের হাতের তেলোর ওপর রেখে অস্ফুটে বলতে লাগল, ‘‘বৃহস্পতির স্থান উচ্চ, একটি রিং চিহ্নও দেখা যাচ্ছে বর্তমান সেখানে…সেইসঙ্গে শনির স্থানও অতি উচ্চ, উমমমখ সেখানে একটা ত্রিশূলের চিহ্ন—তার ওপর…কেতু থেকে বৃহস্পতি অবধি একটি রেখা প্রসারিত…’’

চাটুজ্জেমশাইয়ের নিজের বলা কথাটাই মনে পড়ে গেল সবার, এ অতি উঁচু দরের আধ্যাত্মিক হাত, লাখে একটা মেলে!

উঠে পড়ছিলেন চাটুজ্জেমশাই৷ এরপর ওঁকে গিয়ে রান্না চাপাতে হবে৷ বেরোবার আগে হঠাৎ করে প্রশ্ন করল বংশী, ‘‘আচ্ছা, মাধুরীর শেষমেশ কী হল সেটা বললেন না তো চাটুজ্জেমশাই?’’

বেরিয়ে যেতে যেতে থমকে গেলেন ভদ্রলোক, তারপর পিছনে না ফিরেই বললেন, ‘‘এরপর আবার বিয়ে করে সে৷ তারপর দীর্ঘ তিরিশ বছর সুখে-দুঃখে কাটিয়ে শ্রীমতী মাধুরী চট্টোপাধ্যায় মারা গেছেন, বছর দুয়েক হল৷’’

.

চাটুজ্জেমশাই বেরিয়ে গেলেন৷ বাকিরা স্তব্ধ!

সমাপ্ত

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *