প্রেত
প্রথম অংশ–অন্ধকার জগৎ
এক
রুমী বরাবরই একেবারে সাধারণ ছেলে। সাধারণ ছেলেদের মতো তাকে কেমন দেখাচ্ছে সে নিয়ে তার মাথাব্যথার শেষ ছিল না। ক্লাসের ফিটফাট ছেলেদের দেখে তাই তার ভিতরে হীনমন্যতা জেগে উঠতো। ঘুরেফিরে দুটি প্যান্ট পরেই তাকে ক্লাসে আসতে হয়, ব্যাপারটা অন্যেরা লক্ষ করছে কি না সে নিয়ে তার দুশ্চিন্তার সীমা নেই। টিউশনির টাকা পেয়ে সে যখন হাল ফ্যাশনের চওড়া কলারওয়ালা নতুন একটা শার্ট তৈরি করল তার ভিতরে তখন আনন্দের একটা জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। সে সেই শার্ট পরে দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটার সময় সাবধানে দোকানের আয়নায় নিজেকে লক্ষ করতো। তার চেহারা মোটামুটি ভালো এ নিয়ে সে খুব সচেতন, গায়ের রংটা আরেকটু ফর্সা হলে তার আর কোনো দুঃখ থাকতো না। অন্যদের দেখাদেখি সে তার চুলকে কান ঢেকে ঝুলে পড়তে দিয়েছে, তাই সেগুলিকে আগের থেকে বেশি যত্ন করতে হয়। কাছে-পিঠে কেউ না থাকলে আজকাল সে তার পকেট থেকে ছোট একটা চিরুনি বের করে অনেক যত্ন করে চুল ঠিক করে নেয়। তার বয়সী অন্য যে কোনো ছেলেদের মতো রুমীরও মেয়েদের নিয়ে খুব আগ্রহ। রাস্তাঘাটে কোথাও কোনো মেয়ে তাকে আলাদা করে লক্ষ করে কি না সেটা জানার তার খুব কৌতূহল। কখনো কোনো কারণে কোনো মেয়ে ঘুরে দ্বিতীয়বার তার দিকে তাকালে সে সারাদিন ঘটনাটি ভুলতে পারে না। এমনিতে সে খুব মুখচোরা, কোনোদিন যেচে কোনো মেয়ের সাথে কথা বলবে এরকম সাহস নেই; অথচ প্রায়ই সে কল্পনা করে একটা আধুনিকা। মেয়ে তার জন্যে পাগল হয়ে আছে। প্রতিবার নতুন টিউশনি নেবার আগে সে মনে মনে আশা করে একটি সুন্দরী মেয়েকে পড়াবে, কিন্তু কখনোই তা হয়ে ওঠেনি। কে জানে, সুন্দরী মেয়েদের বাবারা হয়তো উঠতি বয়সের কলেজের একটা ছেলের হাতে মেয়েকে অঙ্ক কষতে দেওয়ার সাহস পান না!
রুমীর সবচেয়ে বড় সমস্যা তার নিজেকে নিয়ে। সে প্রাণপণ চেষ্টা করে কেউ যেন বুঝতে না পারে সে মফস্বলের ছেলে। ক্লাসের ফিটফাট ইংরেজি কথা বলা ছেলেদের সে মুগ্ধ বিস্ময়ে লক্ষ করে। শুদ্ধ ইংরেজিতে সে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে যেতে পারে কিন্তু মুখে মুখে সে ইংরেজিতে একটা কথা পর্যন্ত বলতে পারে না। চেষ্টা করে দেখেছে, তার গ্রাম্য ক্লাস-টিচারের সুর এসে পড়ে। বৃদ্ধ ক্লাস-টিচারের তাকে নিয়ে যত গর্বই থাকুক না কেন,রুমীর নিজেকে নিয়ে লজ্জার সীমা নেই। একসময় ফিটফাট ছেলেদের সাথে সে মেশার চেষ্টা করে দেখেছে, কিন্তু তাদের প্রচ্ছন্ন অবহেলা বুঝতে পেরে সে নিজের মাঝে গুটিয়ে গেছে। মাঝে মাঝে রুমী কল্পনা করে সে বিদেশ থেকে অনেক বিখ্যাত হয়ে ফিরে এসেছে, আর এইসব ফিটফাট ছেলেরা তার সাথে দেখা করতে এসেছে। সে। যেন বিশুদ্ধ সাহেবি ইংরেজিতে বলছে : তোমাদের দেখেছি দেখেছি মনে হচ্ছে, কিন্তু ঠিক চিনতে পারলাম না তো।
রুমীর এই ধরনের অনেক কল্পনা, সাধারণ ছেলেদের মতো তার কল্পনাগুলিও সাধারণ। মোহ আর উচ্চাশা তাকে বাঁচিয়ে রাখে। যা কিছু বিদেশি তাতেই আজকাল তার প্রচণ্ড বিশ্বাস। নিজের দেশের রাজনীতি পর্যন্ত সে বিদেশি সাংবাদিকদের আলোচনা পড়ে শিখতে চেষ্টা করে। দেশকে নিয়ে সে আজকাল সত্যি সত্যি হতাশাগ্রস্ত, বিদেশিরা কীভাবে উন্নতি করে ফেলছে আর এ দেশের লোকেরা কীভাবে নিজেদের সর্বনাশ করছে এ ব্যাপারে আজকাল সে বুদ্ধিজীবীদের সাথে একমত। একবার দেশের বাইরে যেতে পারলে সে আর কোনোদিন ফিরে আসবে
-এরকম একটা ধারণা আস্তে আস্তে তার ভিতরে গড়ে উঠছে। সার্থক জীবনের অর্থ বিদেশে প্রতিষ্ঠা, এ ব্যাপারে তার আজকাল আর কোনো সন্দেহ নেই। এই আশা নিয়েই সে আস্তে আস্তে বড় হয়ে উঠছিল, কিন্তু একদিন সেটাতে একটা চোট খেয়ে গেল।
তখন পরীক্ষার মাস দুয়েক বাকি, পড়াশোনার খুব চাপ। বিকেলে একটা টিউশনি করে রুমী খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ছাত্রটার আলাদা পড়ার ঘর নেই, কাজেই মধ্যবিত্তের সংসারের ঠিক মাঝখানে বসে থেকে তাকে পড়াতে হয়। দৈনন্দিন তিক্ত ঘটনাবলির মাঝে বসে থেকে প্রায়-নির্বোধ একটি ছেলেকে এক জিনিস দশবার করে বোঝাতে তার দুই ঘণ্টা সময়কে দশ ঘণ্টার মতো দীর্ঘ মনে হয়। তার ওপর কোনোদিনই তাকে কিছু খেতে দেয় না, প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে সে উঠে আসে।
চা খেয়ে খিদে নষ্ট করার জন্যে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার কাছাকাছি একটা চায়ের দোকানে যেতো। আজকাল সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এসে আড্ডা জমায়। তাদের দেখা একটা মজার কাজ। একজন-দুজন রুমীর মনের মতো বের হয়ে পড়ে, তাদের সে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে লক্ষ করে সময় কাটিয়ে দেয়। নিজের অগোচরে সে তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করে-কথাবার্তায়, হাসিতে, পোশাকে, হাঁটার ভঙ্গিতে।
সেদিন বৃষ্টি বলে চায়ের দোকানে ভিড় কম। রুমী জানালার পাশে একটা চা, একটা শিঙ্গাড়া নিয়ে আরাম করে বসেছে। তার ঠিক পাশেই একজন গভীর মনোযোগ দিয়ে গাঁজাভরা একটা সিগারেট নির্বিকারভাবে টেনে যাচ্ছে। সামনের টেবিলে বসে দুজন তর্ক করছে-বিষয়বস্তু রুমীর জ্ঞানের বাইরে, কোনো একজন আমেরিকান অর্থনীতিবিদের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের যৌক্তিকতা। তর্ক উত্তপ্ত হতেই কথাবার্তায় ইংরেজি বের হয়ে আসতে থাকে। কি সুন্দর, উচ্চারণ, কি সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি, কি চমৎকার শব্দ চয়ন! রুমী মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে।
দাদা কি করে আপনাদের?
রুমী গলার স্বর শুনে চমকে তাকায়। গাঁজা খাওয়া লোকটি লাল চোখে কিন্তু মুখে একটা হাসি নিয়ে তর্করত ছেলে দুটিকে জিজ্ঞেস করছে। ছেলে দুটি থতমত খেয়ে থেমে গিয়ে একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল। প্রশ্নটি ঠিক বুঝতে পারেনি ভেবে লোকটি গলা উঁচিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল, আপনাদের দাদারা কি করতেন?
এক্সকিউজ মি?
আপনার দাদা, মানে আপনার বাবার বাবার বাবা কি করতেন?
কেন?
গরিব ছিলেন কি না? চাষা, কি গোয়ালা, কি মাঝি?
হোয়াট? একজনের ফর্সা মুখ টকটকে লাল হয়ে ওঠে, হোয়াট ডু ইউ মিন?
আহা-হা-হা রাগ করেন কেন? আমি শুধু জানতে চাইছি আপনাদের দাদারা কি করতেন?
কেন? ইটস নান অব ইওর বিজনেস। আমার দাদা যা খুশি করুক তাতে আপনার কি?
লোকটার মুখে তখনো হাসি। পান খাওয়া দাঁত বের করে বলল, বলতে না চাইলে বলবেন না। লজ্জা করলে বলবেন কেন?
একটা বড় ঝগড়া লেগে যাবার উপক্রম, অন্য ছেলেটা কোনোমতে থামিয়ে দিয়ে তাকে টেনে নিয়ে বের হয়ে গেল। গাঁজা খাওয়া লোকের সাথে ঝগড়া করে কখনো, কি বলতে গিয়ে কি বলেছে!
রুমী আড়চোখে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করে, এমন অভদ্র লোকও আছে! লোকটা তখনো খিক খিক করে হাসছে যেন একটা ভারি মজার ব্যাপার হয়েছে। রুমীর চোখে চোখ পড়তেই বলল, দশ টাকা বাজি।
রুমী থতমত খেয়ে বলল, বাজি?
হ্যাঁ। ওই দুইটার ভিতরে অন্তত একটার দাদা গয়লা না হয় ধোপা ছিল!
কেন? রুমী একটু উত্তপ্ত হয়ে যোগ না করে পারল না, ধোপা কিংবা গয়লা হওয়া দোষ নাকি?
দোষ কেন হবে? লোকটা সাগ্রহে মাথা এগিয়ে আনে, দাদা ধোপা ছিল তাই বাপ খুব কষ্ট করে বড় হয়েছে। এখন ছেলেদের তাই সাহেব বানাচ্ছে। ভুলতে পারে না তো নিজে ধোপার পোলা! এমন সাহেবের সাহেব যে বাড়িতেও ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না।
রুমী যুক্তিটার মাথামুণ্ড কিছু না বুঝে চুপ করে রইল। লোকটার তাতে নিরুৎসাহিত হবার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, নিজের মনে সে মা-বাপ তুলে গালিগালাজ দেওয়া শুরু করে।
অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে রুমী তাড়াতাড়ি নিজের চা শেষ করার চেষ্টা করতে থাকে। উঠে পড়া ভালো, কে জানে আবার কখন তাকে ধরে বসবে।
ইংরেজি! ইংরেজি বলেন! লোকটা আবার শুরু করে, জার্মান বলে না কেন? স্প্যানিশ বলে না কেন? ফ্রেঞ্চ বলে না কেন?
প্রশ্নগুলি রুমীকে নয়, তাই রুমী চুপ করে থাকে। তাড়াতাড়ি চা খেতে গিয়ে তার জিব গেছে পুড়ে, রাগটা উঠছে এই লোকটার ওপর। লোকটা হঠাৎ দুই হাত মাথার ওপরে তুলে নাচার ভঙ্গি করল, ইংরেজি বলে কারণ তাদের ব্রিটিশ বাবারা ইংরেজিতে কথা বলেন। তারা তিনশো বছর তাদের পাছায় লাথি মেরে গেছেন, এখন তাদের ভাষায় কথা না বললে চলে কেমন করে? কর্তায় কইছে শালার ভাই, আনন্দের আর সীমা নাই!
লোকটা হঠাৎ তার দিকে ঘুরে বলল, ওই ব্রিটিশ বাবারা কি তাদের মানুষ বলে জানতো? জালিয়ানওয়ালাবাগে ডায়ার যখন চারশো লোককে কুত্তার মতো গুলি করে মেরে নিজের দেশে ফিরে গেছে তখন তার দেশের লোক কি করেছিল?
রুমীর চা শেষ। সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কি করেছিল?
ব্রিটিশেরা চাদা তুলে ডায়ারকে ছাব্বিশ হাজার পাউন্ড উপহার দিয়েছিল। আর আমরা এখনো সেই ব্রিটিশের ইয়ে ধরে লাফাই! লোকটা অশ্লীল একটা কথা বলে মাটিতে একদলা থুতু ফেলল।
রুমী আর দাঁড়াল না, পয়সা দিয়ে দ্রুত বের হয়ে এলো। লোকটার পুরোপুরি মাথা খারাপ।
পরের কয়দিন কিন্তু ঘুরেফিরে লোকটার কথাগুলি মনে হতে থাকে রুমীর। বিশেষ করে সেই ইংরেজটার কথা, এ দেশের মানুষকে খুন করেছিল বলে যাকে নিজের দেশের লোকেরা খুশি হয়ে চাদা তুলে টাকা উপহার দিয়েছে। কথাটি কতটুকু সত্যি জানার জন্যে ওর ভিতরটা উশখুশ করতে থাকে। কাউকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, ক্লাসের বন্ধু-বান্ধবেরা তার মতোই ইতিহাস বইয়ে শুধু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গুণপনা আর বীরত্বের কথা পড়ে এসেছে। সত্যি কথাগুলো কোথাও লেখা নেই। রুমী কথা প্রসঙ্গে ফিটফাট ছেলেগুলিকে জিজ্ঞেস করে একদিন, তারাও কিছু জানে না। একজন শুধু বলল টাগোর নাকি ওই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদস্বরূপ নিজের স্যার উপাধি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। রুমী স্কুলে শিখেছিল প্রপার নাউনের নাকি ইংরেজি হয় না, কিন্তু ঠাকুরের ইংরেজি কেমন করে টাগোর হলো? রুমী অবাক হলো আগে কখনো ওর এই প্রশ্নটি মনে হয় নি কেন ভেবে।
কয়দিন পর এক বিকেলে কোনো কাজ খুঁজে না পেয়ে সে পাবলিক লাইব্রেরিতে ‘পাক ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ’ নামে একটা বই বের করে পড়তে বসে যায়। রাতে পরীক্ষার পড়া আছে তাই বেশিক্ষণ পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। এমনিতেও তার পাঠ্যবই এবং পত্রপত্রিকা ছাড়া আর কিছু পড়ার অভ্যাস নেই, একটা কথা তিন-চারবার পড়ে বুঝতে হয়। সন-তারিখ দিয়ে কণ্টকিত ইতিহাস পড়ে কিছু বুঝে ওঠাও মুশকিল। রুমী ঘণ্টা দুয়েক চেষ্টা করে খানিকটা বিরক্ত হয়েই উঠে এলো। প্রথম যে ইংরেজ মোগল বাদশাহদের সুনজরে পড়ার চেষ্টা করেছিল সে ব্যাটা পরিষ্কার জোচ্চোর ছিল, দুই ঘণ্টা পড়ে এইটুকু মাত্র জ্ঞান লাভ হয়েছে। ফিরে যাবার সময় রুমী ঠিক করে এই শেষ, আর সে বাজে সময় নষ্ট করবে না। কবে কখন কোন ইংরেজ কার কি ক্ষতি করেছে তাতে তার কি?
পরদিন বিকেলে কিন্তু রুমী আবার পাবলিক লাইব্রেরিতে ফিরে এসে ঠিক ওই বইটা খুঁজে বের করে।
সেদিন রুমী লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে আসে অনেক রাতে, লাইব্রেরি বন্ধ হয়ে যাবার পর। পরীক্ষার পড়া আর হলো না, কিন্তু তাতে এমন কিছু ক্ষতি হবে না। সে মাঝে মাঝেই এরকম ছুটি নেয়, বিশেষ করে পরীক্ষার আগে। পড়ার চাপটা মাঝে মাঝে অন্য কিছু করে বের করে দিতে হয়। আজ অবিশ্যি অন্য ব্যাপার। সিপাহি বিদ্রোহের পুরোটা শেষ না করে সে কিছুতেই উঠে আসতে পারছিল ও জানতো না ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রভুত্ব দূর করার শেষ চেষ্টাকে ইংরেজরা কি নির্মমভাবে দমন করেছিল। বিদ্রোহী সিপাহিদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করেই সন্তুষ্ট হয় নি, তাদের মৃতদেহ কানপুর থেকে এলাহাবাদ পর্যন্ত পুরো রাস্তার দুপাশের গাছ থেকে ঝুলিয়ে রেখেছিল। নীলক্ষেতের অন্ধকার রাস্তায় বড় গাছগুলির নিচ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রুমীর মনে হয় সে বুঝি কানপুরের রাস্তা ধরে হাঁটছে, আর দুপাশের গাছ থেকে বিদ্রোহী সিপাহিদের মৃতদেহ ঝুলছে–প্রচণ্ড রাগে রুমীর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
রুমীর পরিবর্তন হয় খুব তাড়াতাড়ি। শুধু পাক-ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস পড়েই ওর কাছে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। ইংরেজদের দুইশো বছরের শাসন এ দেশের মানুষের মনোভাবকে কি রকমভাবে নষ্ট করেছে সে প্রথমবার বুঝতে পারে। এখনো কেউ ইংরেজি লিখতে গিয়ে ভুল করলে তার লজ্জায় মাথা কাটা যায়, কিন্তু বাংলা লিখতে ভুল করলে ভিতরে এতটুকু অপরাধবোধ পর্যন্ত জন্মায় না। যে ছেলেদের দেখলে একসময় রুমী মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতো আজকাল তাদের দেখলে তার ঘেন্নায় বমি আসতে চায়। আরও অনেক ব্যাপারেই রুমীর ধারণা আজকাল স্পষ্ট হয়ে আসছে। আগে রাজনীতি নিয়ে কখনো মাথা ঘামায় নি, ক্লাসের যে কয়টা ছেলে রাজনীতি করতো তাদের জন্যে ওর অনুকম্পা হতো, আজকাল তাদের সে রীতিমতো শ্রদ্ধা করা শুরু করেছে। ভুল হোক আর শুদ্ধ হোক, তারা দেশের জন্যে নিজেদের সময়, শক্তি, সামর্থ্য এমনকি ভবিষ্যৎ পর্যন্ত নষ্ট করতে প্রস্তুত। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বয়সী ছেলেরা কীভাবে দেশের জন্যে যুদ্ধ করেছে সে খানিকটা বুঝতে পারে। নিজের দেশকে নিয়ে তার ভিতরে গর্ব হতে থাকে, গোপন প্রেমের মতো সেটা ওকে আশ্চর্যভাবে আনন্দ দেয়।
আবার একদিন সেই অভদ্র মাথা খারাপ লোকটির সাথে দেখা হলো রুমীর। দেখা হলো সেই একই জায়গায়, একইভাবে, লোকটা গম্ভীর মুখে নির্বিকারভাবে গাঁজা ভরা সিগারেট টানছে। আজকে কেন জানি রুমীর লোকটাকে এতটা খারাপ লাগল না, সামনে বসে বলল, ভালো আছেন?
মাথা নেড়ে হাসল লোকটি, যেন কতকালের চেনা। রুমী বুঝতে পারে লোকটি তাকে চেনে নি, চেনার কথা না। চায়ে চুমুক দিয়ে রুমী জিজ্ঞেস করল, মনে আছে একদিন দুজনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন তাদের দাদারা কি করে?
মনে পড়ার সাথে সাথে কৌতুকে লোকটার চোখ নেচে ওঠে, দশ টাকা বাজি। অন্তত একটার বাবা গয়লা না হয় ধোপা…
রুমী একটু হেসে প্রসঙ্গটা পাল্টানোর জন্যে বলে, আপনি ডায়ারের কথা বলেছিলেন মনে আছে? যে জালিয়ানওয়ালাবাগে…
বলেছিলাম নাকি?
হ্যাঁ। ডায়ারকে তো লন্ডনে গুলি করে মেরেছিল।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। উধম সিং, উধম সিং! অন্য ডায়ারকে মারতে পারে নি ওই ব্যাটা আগেই মরে গেছে। একই সময়ে একই জায়গায় দুই কুত্তার বাচ্চা দুইটার নামই এক। লোকটা হঠাৎ কথা বন্ধ করে ঘুরে ভালো করে রুমীকে দেখল, তোমার কি ইতিহাসে খুব উৎসাহ?
না, খুব নয়। আসলে সেদিন আপনার মুখে জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা শুনে একটু পড়ে দেখছিলাম।
লোকটার মুখ খুশিতে ছেলেমানুষের মতো হয়ে ওঠে, আমার কথা শুনে? সত্যি? তুমি আরও পড়তে চাও? কি পড়বে বলো?
এইভাবে কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে পরিচয় রুমীর। কিবরিয়া ভাইয়ের কোনো ভালো গুণ নেই, তিনি স্বার্থপর এবং হিংসুটে। পৃথিবীর কোনো লোককে তিনি পছন্দ করেন না। তিনি ভীষণ সাম্প্রদায়িক। বয়স্ক লোকদের মাঝে হিন্দুবিদ্বেষ বিচিত্র নয়, কিন্তু কিবরিয়া ভাইয়ের ভিতর এই বয়সে এত হিন্দুবিদ্বেষ কীভাবে গড়ে উঠেছে বোঝা মুশকিল। তিনি যে শুধু সাম্প্রদায়িক তাই নয় তার প্রখর আঞ্চলিকতাবোধ! কোনো কোনো জেলার লোকজনের সাথে তিনি কথা পর্যন্ত বলতে রাজি নন। দেশের প্রায় সব কজন বুদ্ধিজীবীকে তিনি উঠতে-বসতে মুখ খারাপ করে গালি দেন। কে কবে কখন কি ধরনের নোংরামি করেছিল সব তার নখদর্পণে। নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কাজেই মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স্ক শিক্ষকদের দুবেলা মুণ্ডুপাত করার অধিকার আছে তার। সব সময়েই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেন, তাই কেউ প্রতিবাদ পর্যন্ত করতে পারে না। এমনিতে খিটখিটে এবং বদমেজাজি, সাধারণ লোকজনের জন্যে কোনো সম্মানবোধ নেই। রুমী নিজে কিবরিয়া ভাইকে এক রিকশাওয়ালার সাথে কথা কাটাকাটি করে চড় মারতে দেখেছে। তারপর সমস্ত রিকশাওয়ালা একত্র হয়ে উল্টে কিবরিয়া ভাইকে সে কি মার! রুমী কোনোমতে সেবার প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। এরপর থেকে তিনি রিকশাওয়ালাদের দুই চোখে দেখতে পারেন না। কিবরিয়া ভাইয়ের বয়স খুব কম নয়, কিন্তু এখনো বিয়ে করেন নি, রুমীর ধারণা কোনো মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। জগৎ সংসারের ভালোমন্দ সবকিছুর ওপর এরকম খেপে থাকা লোক রুমী আগে কখনো দেখে নি।
কিবরিয়া ভাইয়ের একটি ব্যাপার অবিশ্যি প্রশংসা করার মতো, সেটি হচ্ছে তার পড়াশোনা। গল্প, কবিতা এবং উপন্যাস ছাড়া আর সব ধরনের বই পড়ায় তার সমান উৎসাহ। এমন কোনো বিষয় নেই যা সম্পর্কে তিনি পড়েন নি এবং তার বেশ ভালো ধারণা নেই। এতে অবিশ্যি লাভের চেয়ে ক্ষতি হয়েছে বেশি, তর্কবিতর্ক কথা কাটাকাটিতে তিনি প্রতিপক্ষকে চেপে ধরে তার সমস্ত জ্ঞানভাণ্ডার এত নির্দয়ভাবে ব্যবহার করেন যে প্রতিপক্ষ কখনো তাকে ক্ষমা করতে পারে না। রুমী এখন পর্যন্ত একটি লোকও খুঁজে পায় নি যে কিবরিয়া ভাইকে পছন্দ করে বা যাকে কিবরিয়া ভাই পছন্দ করেন। সে নিজে তার থেকে অনেক ছোট বলে কিবরিয়া ভাই কখনো তার সাথে লাগেন নি। রুমী যে কিবরিয়া ভাইকে খুব পছন্দ করে তা নয়, কিন্তু একজন মানুষকে ভালোভাবে বুঝে নিলে তখন তার খারাপ আর ভালো কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তাছাড়া কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে কথা বলায় একটা আনন্দ আছে, অনেকটা পরচর্চার আনন্দের মতো। কখন কি পড়তে হবে এবং কোন্ বইয়ে কি পাওয়া যাবে কিবরিয়া ভাই খুব ভালো বলে দিতে পারেন। তিনি নিজে রুমীকে অনেক বই জোগাড় করে দিয়েছেন যেগুলি তার পক্ষে পাওয়া অসম্ভব ছিল।
কিবরিয়া ভাইয়ের সাথে পরিচয় হওয়ার পর রুমী অনেক যত্ন করে পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়াশোনা শুরু করেছে। পৃথিবী সম্পর্কে ওর ধারণা আজকাল পাল্টে গেছে। আগে মনে করতো যা ছাপা হয় বিশেষ করে বিদেশি পত্রপত্রিকায় সব বুঝি সত্যি। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সংবাদপত্রগুলি যে খুব যত্ন করে পৃথিবীর খবর নিজেদের মনমতো করে পরিবেশন করে সাধারণ মানুষদের একটা ঘঁচের ভিতর ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করছে তা বোঝার পর সে তাদের অবিশ্বাস করা শুরু করল। বিদেশিরা ভালো বললে ভালো এবং বিদেশিরা খারাপ বললে খারাপ-এই ধরনের মতাবলম্বী লোকজনের সংখ্যা দেখে রুমী এই প্রথমবার বুঝতে পারে এ দেশের সত্যিকার সমস্যা কাদের মাঝে।
দুই
পরীক্ষার আর ঠিক দশ দিন বাকি। রুমী নিজের পড়াশোনাতে খুব সন্তুষ্ট। অন্যদের মতো সে নির্দিষ্ট কয়টা প্রশ্নের উত্তর না শিখে পুরো বই পড়ছে। যদিও আজকাল সে প্রচুর বাইরের জিনিস পড়াশোনা করে, সপ্তাহে চারদিন দুটি করে টিউশনি করে তবু তার সময়ের অভাব হয় নি। পড়াশোনা একেবারে নেশার মতো হয়ে। গিয়েছে। সবকিছু প্রথমবার পড়ে শেষ করতে অনেক সময় নেয়, দ্বিতীয়বার পড়তে আর তত সময় নেয় না। তৃতীয়বার পড়তে শুধু যেসময় আরও কম লাগে তাই নয় পড়ে প্রচণ্ড একটা আনন্দ হয়। রুমী ছোট একটা নোটবইয়ে বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্ন অংশের নাম লিখে তার পাশে তারকা চিহ্ন দিয়ে পড়াশোনার হিসাব রাখছে। তিন তারকা মানে ভালো পড়া হয়েছে, দুই তারকা মানে মাঝারি, এক তারকা মানে খারাপ। তার নোটবইয়ে তিন তারকা খুব বেশি, দুই তারকা খুব কম, এক তারকা নেই বললেই চলে। বাকি দশ দিনে সে তিন তারকাগুলিকে চার তারকা করে ফেলবে, না দুই এবং এক তারকাকে তিন তারকাতে নিয়ে আসবে ঠিক করতে পারছিল না। গত কয়েক বছরের প্রশ্ন যাচাই করলেই বোঝা যায় কোনো কোনো পরিচ্ছেদ না পড়লেও চলে, রুমীর নোটবইয়ে সেগুলিই দুই এবং এক তারকা হিসেবে রয়েছে–অন্যেরা সেগুলি মোটেও পড়ছে না। রুমীর নীতিবোধ আজকাল প্রখর হয়ে উঠছে, প্রশ্ন বেছে পড়ে ভালো করাকে সে জোচ্চুরি মনে করে। একটা ভালো স্কলারশিপ ছাড়া আর কিছুতে তার আকর্ষণ নেই, অন্তত সেটাই সে নিজেকে বোঝায়।
আজ তাই সে একেবারে নতুন একটা জিনিস পড়া শুরু করেছে। কিন্তু খানিকক্ষণ পড়েই সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে–গত কয়েক দিন পরিশ্রম একটু বেশি হয়ে গেছে। একটু বিশ্রাম নেবার জন্যে রুমী ঘর থেকে হাঁটতে বের হয়। সে নতুন সিগারেট খাওয়া শিখছে, এখনো সিগারেট ভালো লাগা শুরু হয় নি, খেতে বেশ কষ্টই হয়। সাধারণত ভাত খাবার পর সে সিগারেট খেতে চেষ্টা করে, আজ কি মনে করে এখনই একটা সিগারেট ধরিয়ে নিল। প্রথম দু-তিন টান ওর খারাপ লাগে না, কিন্তু তারপরই গা গুলিয়ে ওঠে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে শুরু করল। কারো বাসায় যাওয়া যায় কি না ভাবল, কিন্তু পরীক্ষার পড়া নিয়ে সবাই ব্যস্ত এখন, যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ঠিক তক্ষুনি তার বিখ্যাত জ্যোতিষী জোয়ারদারের কথা মনে পড়ল বেশ অনেকদিন থেকেই খবরের কাগজে প্রেম-ভালোবাসা, মামলা-মোকদ্দমা, শিক্ষা-সাফল্য, বিদেশ-ভ্রমণ সম্পর্কে জানার “ অপূর্ব সুযোগের” বিজ্ঞাপন দেখে আসছিল। সে কোনো দিন এসব ব্যাপারে উৎসাহী নয়, কিরোর হাত দেখার বই বারবার পড়েও কোনটা আয়ু রেখা কোনটা হৃদয় রেখা সে মনে রাখতে পারে না। কিন্তু এই জ্যোতিষীর কথা ভিন্ন, তার এক বন্ধু বলেছে মাত্র দশ টাকার বিনিময়ে জ্যোতিষী নাকি সবকিছু বলে দিতে পারে। রুমীর বিশ্বাস হয় নি, কিন্তু তার বন্ধুটি খোদার কসম খেয়ে বলেছে যে ছেলেবেলায় তার অ্যাপেনডিসায়টিস অপারেশনের কথাটিও নাকি জ্যোতিষী দিন-তারিখসহ বলে দিয়েছে। সেই থেকে ওর ইচ্ছে ব্যাপারটি নিজে গিয়ে দেখে, কিন্তু যাওয়া হয় নি। এখন, হঠাৎ করে, সেখানে যাওয়ার কথা মনে হলো। পকেটে কিছু টাকা আছে, পড়ায় মন বসছে না–এর থেকে ভালো সময় আর হবে না। বাসস্টপে এসে দাঁড়াল রুমী।
জোয়ারদারের নাম এবং বিজ্ঞাপনের ধরন দেখে রুমীর ধারণা হয়েছিল সাদাসিধে একজন বুড়োমানুষ নিজের বসার ঘরে লোকজনের হাত দেখে কিছু বাড়তি পয়সা রোজগারের চেষ্টা করে, তাই ঠিকানা খুঁজে বের করে জোয়ারদারের ঘর দেখে সে হতবাক হয়ে গেল। মতিঝিলের এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় চৌদ্দ তলা দালানের সাত তলায় চমৎকার একটা ঘর আর ছোট একটা বারান্দা নিয়ে জোয়ারদারের হাত দেখার জায়গা। বারান্দায় বসে জোয়ারদার হাত দেখে। একটা পর্দা দিয়ে সেটা ঘর থেকে আলাদা করে রাখা। ঘরটিতে একটা ছোট টেলিভিশন চলছে। এক কোনায় চায়ের সরঞ্জাম এবং কেতলিতে ফুটন্ত পানি; যারা চায় চা তৈরি করে নেবে। চমৎকার সোফা এবং টেবিলে দেশি-বিদেশি রংচঙে পত্রপত্রিকা। ঘরে হালকা আলো। টেলিভিশনের শব্দ কমে এলেই শোনা যায় কোথা থেকে যেন মিষ্টি সেতারের শব্দ ভেসে আসছে। দেখেশুনে রুমী মুগ্ধ হয়ে যায়। যে লোক হাতদেখা পয়সা দিয়ে এতসব আয়োজন করে ফেলতে পারে সে হয়তো সত্যিই হাত দেখতে পারে। এই প্রথম রুমীর লোকটার প্রতি একটু বিশ্বাস জন্মাল।
বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। ঘরের ভিতর এখন রুমী ছাড়া আরও দুজন। তারা ওর পরে এসেছে। রুমীর ঠিক আগে যে এসেছে সে এখন পর্দার ওপাশে হাত দেখাচ্ছে, এর পরেই রুমী। একজন কুড়ি থেকে পঁচিশ মিনিট করে সময় নেয়। রুমীর ঘণ্টাখানেক সময় এর মাঝে নষ্ট হয়ে গেছে, হাত দেখিয়ে ফিরে যেতে আরও দুই ঘণ্টা। ওর বাসা অনেকটা দূর, একবার বাস বদলাতে হয়। পরীক্ষার আগে এভাবে এতটা সময় নষ্ট করা ভালো হলো কি না রুমীর সন্দেহ হতে থাকে।
পাশের ঘর থেকে জ্যোতিষী জোয়ারদার এবং তার সাথে রুমীর আগের লোকটি বের হয়ে আসে। লোকটির মুখ একটু বিমর্ষ, কে জানে ভাগ্য গণনায় কি বের হয়েছে। জোয়ারদার রুমীর দিকে তাকিয়ে বলল, এরপর কে, তুমি?
রুমী মাথা নাড়ল। এসো, বলে জোয়ারদার পর্দা তুলে ওকে ভিতরে ডাকল।
কি হলো কে জানে হঠাৎ রুমী প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। ওর মনে হতে লাগল পর্দার ওপাশে একটা ভয়ানক অশুভ কিছু অপেক্ষা করে আছে। ওর ভিতর থেকে কে যেন ওকে বলছে, পালা পালা বাঁচতে হলে পালা…
রুমীর হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, হঠাৎ সে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। জোয়ারদার ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল, ঠাণ্ডা স্বরে বলল, এসো। রুমীর সারা শরীর আবার কাটা দিয়ে ওঠে, কি নিষ্করুণু তীব্র দৃষ্টি। শুকনো গলায় টোক গিলে বলল, আমি আজ বরং যাই, আরেক দিন আসব। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে, এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।
জোয়ারদার এগিয়ে এসে ওর হাতে ধরে। শক্ত লোহার মতো হাত, কিন্তু মরা মানুষের মতো ঠাণ্ডা। রুমীকে প্রায় টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে, সে কী চলে যাবে কেন? বেশিক্ষণ লাগবে না-এসো।
পর্দার এপাশে ছোট বারান্দা, মাঝখানে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের দুই পাশে দুটি চেয়ার টেবিলের ওপর একটা টেবিল ল্যাম্প, একটা টেলিফোন আর একটা বড় ম্যাগনিফাইং গ্লাস, আর কোথাও কিছু নেই। বারান্দায় রেলিঙের ওপর দিয়ে ঢাকা শহর দেখা যায়। নিওন লাইট জ্বলছে-নিভছে, মাঝে মাঝে গাড়ির শব্দ। মতিঝিলের এ এলাকাটা সন্ধ্যার পর এমনিতে খুব চুপচাপ হয়ে পড়ে।
জোয়ারদার একটা চেয়ারে বসে তাকে অন্যটাতে বসতে ইঙ্গিত করে। রুমী যন্ত্রের মতো চেয়ারে বসে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে। খামোখা আমি ভয় পাচ্ছি, রুমী নিজেকে বোঝাতে শুরু করে, এই লোক আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে বাইরে আরও দুজন লোক বসে আছে, আমার ভয় কিসের? লোকটার বিজনেস হাতদেখা, হাত না দেখে ছাড়তে চাইবে কেন? রুমী ঘামে ভেজা ডান হাতটা টেবিলের ওপর মেলে দেয়।
জোয়ারদার বলল, বাম হাতটাও দেখি। রুমী তার বাম হাতটা বাড়িয়ে দেয়।
রুমীর মেলে রাখা দুই হাত নিজের দিকে টেনে এনে এক পলক দেখে জোয়ারদার হাতে ম্যাগনিফাইং গ্লাসটা তুলে নেয়। রুমী জানতেও পারল না জোয়ারদার যে রেখাটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে দেখে নিঃসন্দেহ হয়ে নিল সেটি তার পুরো ভবিষ্যৎকে সেই মুহূর্তে কি ভয়ানকভাবে পাল্টে দিল।
অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হাত দুটি দেখল জোয়ারদার। তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ক্লান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করল, কি নাম তোমার?
রুমী নিজের নাম বলে।
হাত দেখাতে এসেছ কেন?
এটা আবার কোনো প্রশ্ন হয় নাকি? লোকজন হাত দেখাতে এলে ওর ব্যবসা চলবে কেমন করে? মুখে বলল, এমনি এসেছি, সবাই যেজন্যে আসে।
ও! জোয়ারদার আবার চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি ভয়ানক নিষ্করুণু দৃষ্টি। সারা মুখে খোঁচা খোঁচা লালচে দাড়ি, শুকনো টেনে থাকা মুখ ঝাঁকড়া লালচে চুল ঝকঝকে সাদা দাঁত আর সবকিছু ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করছে তার চোখ দুটি।
জোয়ারদার হঠাৎ টেলিফোনটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে রিসিভার তুলে সাবধানে আস্তে আস্তে ডায়াল করে রুমীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি এই টেলিফোনটা শেষ করেই শুরু করছি।
ওপাশ থেকে একটা মেয়ে টেলিফোন ধরল বলে মনে হলো। জোয়ারদার গলা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করে, রুমী চেষ্টা করেও কিছু শুনতে পায় না। কথা বলার ভঙ্গি শুনে মনে হয় কাউকে যেন কিছু একটা নির্দেশ দিচ্ছে। রুমীর খুব অস্বস্তি বোধ হতে থাকে, কেন জানি ওর মনে হয় ওকে নিয়েই কথা বলছে ওরা।
টেলিফোন শেষ করেও জোয়ারদারের শুরু করার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না, অন্যমনস্কভাবে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। রুমী একটু অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, কি দেখলেন হাতে?
ও, আচ্ছা। একটু নড়েচড়ে বসে জিজ্ঞেস করল, তোমার জন্ম-তারিখ কত?
ডিসেম্বরের কত তারিখ?
তেইশ।
বয়স কত?
রুমী নিজের বয়স বলে।
জোয়ারদার মাথা নেড়ে বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে শুরু করে। অদ্ভুত একটা গলার স্বর, একঘেয়ে ক্লান্ত আবেগহীন। কথা যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে, অনেকটা দৈববাণীর মতো, থেকে থেকে রুমী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে।
খুব ছেলেবেলায় তোমার বাবা মারা গেছেন। তাকে খুন করা হয়েছিল… হ্যাঁ, ওর বাবাকে খুন করা হয়েছিল। সবাই জানে ওর বড় চাচা খুন করিয়েছিলেন লোক লাগিয়ে।
কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু সবাই জানে। জমি নিয়ে গোলমাল ছিল অনেকদিনের। হাজীপুরের আলিমুল্লা হাজার টাকা পেলে এক কোপে গলা নামিয়ে দেয়। বড় চাচা পাঁচশো দিয়ে বায়না করেছিলেন, কাজ শেষ হবার পর বাকি পাঁচশো। কাজ শেষ করে সেই রাতেই আলিমুল্লা বড় চাচাকে ডেকে তুলল। হাতে লম্বা দা, তখনো রক্ত লেগে আছে। বড় চাচা তাড়াতাড়ি বাকি টাকা দিয়ে দিলেন। আলিমুল্লা তিন মাসের জন্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তিন মাস পরে সবাই ভুলে গেলে সে আবার ফিরে এলো। শুকনো গিরগিটির মতো চেহারা, কালো কুচকুচে গায়ের রং, পান খেয়ে দাঁত লাল। সবাই জানে হাজার টাকা দিলে আলিমুল্লা গলা নামিয়ে দেয়। রাতের অন্ধকারে ওর বাবার গলা নামিয়ে দিয়েছিল আলিমুল্লা। কি নিখুঁত হাত, পাশে ওর মা শুয়ে ছিলেন, তার গায়ে আঁচড়টিও লাগে নি। সারা শরীর শুধু রক্তে ভিজে গিয়েছিল। মা চিৎকার করে উঠে বসেছিলেন, আর ঘুম ভেঙে উঠে রুমী দেখেছিল, ওর মায়ের সারা শরীর রক্তে লাল। ও ভেবেছিল ওর মাকে কেউ কেটে ফেলেছে, কিন্তু ওর মায়ের কিছু হয় নি। ওর বাবাকে কেটে ফেলেছিল। নিখুঁত নিশানা, ঠিক গলাটা এক কোপে দুই ফাঁক। রুমী অনেকদিন ভেবেছিল ওর হাজার টাকা হলে আলিমুল্লাকে দিয়ে বলবে বড় চাচার গলা নামিয়ে দিতে। ও ঠিক নামিয়ে দিত। কিন্তু বড় চাচা মরে গেলেন, এমনিতে ভুগে ভুগে মরে গেলেন। শরীরের মাংস পচে খসে খসে পড়তো আর সারা রাত যন্ত্রণায় কাটা মাছের মতো লাফাতেন। সবাই বলতো বদ দোয়া লেগেছে, এতিমের বদ দোয়া..
তোমার মায়ের সাথে তোমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে খুব ছেলেবেলায়।
… মায়ের চেহারা হয়ে গেল ডাইনির মতো। রুমী কাছে যেতে ভয় পেতো। দাঁতে দাঁত ঘষে ফিট হয়ে যেতেন, সবাই বলতো জিনে ধরেছে। এত এত তাবিজ দিল গলায়, মা টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলতেন। একদিন নানা নৌকো করে এসে তার মাকে নিয়ে গেলেন। শুধু মাকে, রুমীকেও না শানুকেও না। রুমীর কি কান্না, শানু তখন কিছু বোঝে না, কিন্তু রুমীর কান্না দেখে তারও চিৎকার করে কান্না। নৌকো করে নানা মাকে নিয়ে গেলেন, মা পাথরের মূর্তির মতো নৌকোয় বসে রইলেন, একবার ঘুরেও তাকালেন না। রুমী নৌকোর সাথে সাথে নদীর তীরে তীরে চিৎকার করে ছুটে যেতে লাগল। ওর ছোট চাচা ওকে ধরে নিয়ে এলেন, বললেন ওর মা আবার ফিরে আসবেন। রুমী কিন্তু জানতো আর আসবেন না। ওর মা আসলেও আর আসেন নি। অন্য জায়গায় বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ বলে নি, কিন্তু রুমী জানে..
তোমার কোনো আপনজন নেই?
…কে বলেছে নেই? নিশ্চয়ই আছে, শানু আছে! শানু-শানু-শানু গুটি গুটি হাঁটতো উঠানের নেড়ে দেওয়া ধানের মাঝে। মোরগগুলিকে তাড়া করতো, মোরগুলিও বুঝতো ও শানু, তাই ভয় পেতো না মোটেই। শানুর গা ঘেঁষে এসে ধান খেয়ে যেতো। শানু কিছু বুঝতো না, ওর মা ওদের ছেড়ে চলে গেছেন তাও বুঝতো না। থালা উল্টে ভাত ছড়িয়ে দিতো মাটিতে, তারপর খুঁটে খুঁটে খেতো মাটি থেকে তুলে। শুধু হাসততা ফোকলা দাঁত বের করে। কিছু বুঝতো না শানু, এত দুঃখ ওদের তাও বুঝতো না। তারপর একদিন শানুর বিয়ে হয়ে গেল। রুমী জানতেও পারে নি কখন শানু বড় হয়ে গেছে, শান্ত হয়ে গেছে, দরজার আড়ালে পঁড়িয়ে চুপচাপ ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। বিয়ের রাতে শানু ওকে সালাম করতে এলো। বড় ফুফু বললেন, ভাইরে শেষবার সালাম করে নে রে, শানু। শুনে হঠাৎ রুমীর বুকটা হা হা করে ওঠে। শানু ওকে জরিয়ে ধরে কি কান্না! বলতে চাইছিল, আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও দাদা, আমি বিয়ে করব না। রুমী জানে তাই বলতে চাইছিল, কিন্তু বলে নি। কেন বলবে? ভালো প্রস্তাব, ভালো বংশের ছেলে, দোকান আছে সদরে। কতদিন আর চাচাঁদের সংসারে থাকবে? শানু চলে গেল। কেমন আছে এখন শানু? কতদিন যোগাযোগ নেই-কতদিন! তিন বছর? চার বছর?…
অনেক কষ্টে মানুষ হয়েছো তুমি। কারো কোনো সাহায্য ছাড়া, একা একা।
একা একা? হবে হয়তো। বড় ফুফু বললেন, ঢাকা যাবি আমার সাথে? নাইট কলেজে পড়বি। আমার বাজারটা, ইলেকট্রিক বিলটা করে দিবি, তোর ফুপা পারলে প্রেসে একটা চাকরি খুঁজে দেবে। বিলু রীতার পড়াশোনাটা দেখবি। রুমী রাজি হলো। ফুফু এসে কাজের ছেলেটা ছাড়িয়ে দিলেন। রুমী চরকির মতো ঘুরতে থাকে, শখ ছিল পড়াশোনা করে বড় হবে কিন্তু ও কাজের ছেলে হয়ে গেল। বাজার করে, বাসন মাজে, কাপড় ধোয়। ময়লা কাপড় পরে, উচ্ছিষ্ট তরকারি দিয়ে একগাদা ভাত খায়, রাতে রান্নাঘরে মাদুর পেতে ঘুমায়। তখন ওর পরীক্ষার ফল বের হলো। স্টার মার্ক পেয়েছে, চার বিষয়ে লেটার। ক্লাস টিচার সেই গ্রাম থেকে দেখা করতে এলেন একটা নতুন এ সি দেবের ডিকশনারি নিয়ে। ওর অবস্থা দেখে একেবারে চুপ মেরে গেলেন, এমন কি ডিকশনারিটা দেওয়ার কথা পর্যন্ত মনে থাকল না। বসার ঘরে সারাদিন বসে রইলেন কিছু না খেয়ে। সন্ধ্যায় ফুপা এলে তার সাথে কথা বললেন, কি বললেন কে জানে। ওর ক্লাস টিচার চলে যেতেই ফুপা চিৎকার করে গালি দিতে শুরু করলেন ফুফুকে, তোমার চোদ্দগুষ্ঠির কেউ প্রাইমারি পর্যন্ত পাস করে নাই, আর তুমি আমাকে বলো নি পর্যন্ত যে রুমী ম্যাট্রিক পাস করেছে, স্টার মার্ক, চার সাবজেক্ট লেটার। ওকে দিয়ে তুমি বাসন মাজাও, বাজার করাও। তোমার বাপের গোলাম নাকি? স্কলারশিপ পাবে মাসে দেড়শো টাকা, কয়দিন পরে তোমাকে বাঁদী রাখবে সেটা খেয়াল আছে? ফুপু প্রথমে একটা দুটো কথা বলে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করলেন তারপর ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগলেন। অবস্থা পাল্টে গেল রুমীর, নতুন কাপড় কিনে দিলেন ফুপা, বাইরের ঘরে ওর জন্যে বিছানা পাতা হলো, ঢাকা কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হলো তাকে। লোকজন এলে ফুপা পরিচয় করিয়ে দিতেন, আমার মেজোশালার ছেলে, চার সাবজেক্টে লেটার, স্টার মার্ক। রুমী অবিশ্যি তবু বাজার করে দিতো, বিলু রীতার অঙ্ক দেখে দিতো। স্কলারশিপের টাকা পেয়ে ফুপুকে একটা শাড়ি কিলে দিল, ফুপাকে প্যান্টের কাপড়। তাই পেয়ে কি খুশি! টিউশনি নিল রুমী…
কতক্ষণ ধরে জোয়ারদার কথা বলছিল রুমীর মনে নেই। অন্যমনস্কভাবে একঘেয়ে আবেগহীন গলার সুরে রুমীর ভাবনা-চিন্তা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুর্বলতা, আক্রোশ, গোপন কামনা-বাসনার কথা এত অনায়াসে বলে গেল যে রুমীর মনে হতে থাকল জোয়ারদার নয়, সে নিজেই যেন নিজের কথা বলছে। জোয়ারদার কথা বলে সুন্দর ভারি গলায়, নিশ্চিত আত্মবিশ্বাসে। রুমীর ভিতরটা যেন খোলা বইয়ের মতো পড়ে গেল। কখনো কখনো থেমে যাচ্ছিল ঠিক জুতসই শব্দটা না পেয়ে। তখন ধৈর্য ধরে একটার পর একটা শব্দ ব্যবহার করতে থাকে যতক্ষণ না ঠিক শব্দটা খুঁজে পায়।
আস্তে আস্তে রুমী যেন সম্মোহিতের মতো হয়ে গেল। জোয়ারদারের গলার স্বর যেন ভেসে আসছে অনেক দূর থেকে। সাগরের ঢেউয়ের মেতো অর্থহীন কিছু শব্দ ওকে স্পর্শ করে যাচ্ছে। জোয়ারদারের চেহারা অস্পষ্ট হয়ে গেল ওর সামনে, কি বলছে কিছু সে বুঝে উঠতে পারছে না। একটি একটি শব্দ সে শুনছে, কিন্তু সব মিলিয়ে তার যেন কোনো অর্থ নেই। যুগ যুগ যেন সে বসে আছে এখানে, এর যেন শুরু নেই, শেষ নেই।
রুমীর চমক ভাঙলো তীব্র একটা আলোর ঝলকানিতে। পর্দা সরিয়ে একটি মেয়ে এসে ঢুকে ছবি তুলেছে, ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে গেছে রুমীর। কিসের ছবি তুলেছে মেয়েটি? রুমী ঠিক বুঝতে পারল না। মেয়েটি ভিতরে এলো না, জোয়ারদারের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বাইরে আছি। তোমার কাজ শেষ হলে ডেকো।
আমার কাজ শেষ।
রুমী উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে মানিবাগ বের করে একটা দশ টাকার নোট কীভাবে দেবে বুঝতে না পেরে টেবিলের ওপরে রাখলো। কাউকে টাকা দিতে বা কারো কাছ থেকে টাকা নিতে সব সময়েই কেমন যেন অস্বস্তি লাগে। প্রত্যেক মাসে টিউশনির টাকা নেওয়ার সময় ওর এই রকম হয়।
জোয়ারদার কিন্তু বেশ সপ্রতিভভাবে নোটটা নিয়ে পকেটে রাখল। তারপর ড্রয়ার খুলে একটা কাগজ বের করে রুমীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার নাম-ঠিকানাটা লিখে দেবে? আমি সবার নাম-ঠিকানা রাখছি রেফারেন্সের জন্যে। তোমার যদি কোনো আপত্তি থাকে তাহলে দরকার নেই।
রুমীর আপত্তি ঠিকই ছিল কিন্তু কেউ এভাবে বললে না করা মুশকিল। একবার ইচ্ছা হলো একটা ভুল ঠিকানা দিয়ে দেয়, কিন্তু জেনেশুনে এত বড় মিথ্যা কাজ কীভাবে করে। নাম-ঠিকানা লিখে সে উঠে দাঁড়ায়, জোয়ারদার খুব আন্তরিকভাবে তার সাথে হাত মিলিয়ে বলে, তুমি বলছিলে তোমার দেরি হয়ে গেছে। তুমি যদি চাও ইভা তোমাকে পৌঁছে দিতে পারে।
না, না-রুমী ব্যস্ত হয়ে বলল, আমি একাই যেতে পারব। মেয়েটি, যার নাম নিশ্চয়ই ইভা রুমীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কোথায় বাসা তোমার?
মালিবাগ।
ওঃ কি সুন্দর করে হেসে উঠল মেয়েটি, আমি এমনিতে রাজারবাগ যাচ্ছিলাম, চলো তোমাকে পৌঁছে দিই।
চমৎকার চেহারা ইভার, চমৎকার শরীরে আরও চমৎকার একটা শাড়ি পরে আছে। কেমন একটা আকর্ষণ আছে মেয়েটার শরীরে। একবার চোখ পড়লে আর চোখ সরানো যায় না। চোখের দৃষ্টি কেমন যেন ধারালো, মোটেই মেয়েদের চোখের মতো নয়, সোজাসুজি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারে।
চলো যাই, ইভা রুমীকে নিচে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে সে রুমীর জন্যে দরজা খুলে দেয়। রুমী তার জীবনে গাড়ি চড়েছে খুব কম, হাতে গুনে বলা যায় কয়বার। বড় হয়ে ছাদ খুলে ফেলা যায় এরকম একটা গাড়ি কিনবে-কালো রঙের-এরকম একটা স্বপ্ন ওর বহুদিনের।
ফাঁকা রাস্তায় গাড়িটা ঘুরিয়ে ইভা রুমীকে নিয়ে রওনা দেয়। গাড়িতে মিষ্টি একটা গন্ধ, সুন্দরী মেয়েদের গায়ে বুঝি সুন্দর একটা গন্ধ থাকার নিয়ম! রুমী আড়চোখে ইভাকে দেখার চেষ্টা করে।
কি পড় তুমি? তুমি বলে বলছি বলে কিছু মনে করছো না তো? ইভা একটু হেসে বলে, বয়সে তুমি আমাদের থেকে অনেক ছোট হবে।
না, না মনে করার কি আছে-ভদ্রতার খাতিরে রুমীকে বলতেই হলো। এমনিতে কেউ সোজাসুজি তাকে তুমি বলে সম্বোধন করলে তার মোটেই পছন্দ হয় না। চেহারায় এখনো বয়সের ছাপ পড়ে নি, গোঁফটা একটু ঘন হলে সে রাখার চেষ্টা করে দেখতো।
কি পড়ছো বললে না?
রুমী বলল সে কি পড়ছে। পরীক্ষা দেবে তাও বলল।
কবে পরীক্ষা তোমার?
এই মাসের আঠারো তারিখ।
তাই? পরীক্ষা তো এসে গেল।
হুঁ।
ইভা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে ওঠে, রুমী অবাক হয়ে তাকায় ইভার দিকে। পড়াশোনা করো নি বুঝি, তাই হাত দেখাতে গিয়েছিলে?
রুমীও হেসে ফেলে, বলে, না তা নয়। পড়া আমার ঠিকই হয়েছে, এমনি খেয়াল হলো তাই গেলাম।
গাড়ি চালাতে চালাতে ইভা ঘুরে রুমীকে দেখল, কিছু বলল না। বেশ অনেকক্ষণ পর আস্তে আস্তে অনেকটা আপনমনে বলল, খেয়াল হলো তাই গেলে। আশ্চর্য!
এর মাঝে আশ্চর্য কোন ব্যাপারটা রুমী বুঝতে পারে না।
রুমীকে ইভা ওর বাসার কাছে নামিয়ে দেয়। রুমী একটু আগেই নেমে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ইভা ওকে ঠিক বাসার সামনে না নামিয়ে ছাড়বে না। শুধু তাই নয় ইভা গাড়িতে বসে রইল যতক্ষণ পর্যন্ত রুমী তার বাসায় গিয়ে না ঢুকছে। এত রাতে এরকম একটা সুন্দরী মেয়ের গাড়ি থেকে নামছে, ব্যাপারটা কেউ দেখে ফেলছে কি না এ নিয়ে শঙ্কিত ছিল বলে ও তাড়াতাড়ি বাসায় ঢুকে পড়েছে, তা নইলে ও নিশ্চয়ই লক্ষ করতো যে ইভা কাগজ বের করে ওর বাসার নম্বরটা টুকে নিয়েছে।
কেউই খেয়াল করল না গত ছয় মাস থেকে জ্যোতিষী জোয়ারদারের ভাগ্য গণনার যে বিজ্ঞাপনটি দৈনিক পত্রিকাগুলিতে ছাপা হচ্ছিল সেটি পরদিন থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।
পাবলিক লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে রুমী হেঁটে হেঁটে নীলক্ষেতের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। ওর এক বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথা, নিউমার্কেট থেকে বাস ধরবে। ওর গাঘেঁষে একটা হালকা নীল রঙের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে ও লক্ষও করে নি। গাড়ি থেকে মাথা বের করে একটা মেয়ে উচ্চকণ্ঠে ডাকল, রুমী-রুমী!
রুমী ঘুরে তাকিয়ে দেখে ইভা। অবাক হয়ে কাছে এগিয়ে যায়।
কি খবর তোমার? ইভা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, কোথায় চলেছ?
রুমী একটু থতমত খেয়ে বলল, এই এসেছিলাম একটু লাইব্রেরিতে।
এখন কোথায় যাচ্ছ? কলেজ গেটের দিকে এক বন্ধুর বাসায়।
চলো পৌঁছে দিই রুমী কিছু বলার আগেই দরজা খুলে দেয় ইভা। বাসে যেতে ওর আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগতো, ইভা সেখানে ওকে দশ মিনিটে পৌঁছে দিল। অল্প সময়ে বেশি কথাবার্তা হওয়ার সুযোগ নেই। এর মাঝেই ইভা তার পড়াশোনোর খবর নিয়েছে। কবে কোথায় পরীক্ষা তাও জেনে নিয়েছে। রুমী মেয়েদের সাথে কথা বলে অভ্যস্ত নয়, তাই পুরো সময়টুকু একটু আড়ষ্ট হয়েই বসেছিল, কথা যা বলার ইভাই বলেছে। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মোড়ে ওকে নামিয়ে দেওয়ার পর ও যেন স্বস্তি ফিরে পেয়েছে।
সে-রাতে ঘুরেফিরে ওর অনেকবার ইভার কথা মনে পড়ল।
.
পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে রুমী ওর ক্লাসের কজন ছেলের সাথে রাস্তা ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। ও খেয়াল করে নি, করলে দেখতে পেতো একটু দূরে গাড়ি নিয়ে বসে আছে ইভা। রুমীকে অন্যদের সাথে বাসের জন্যে অপেক্ষা করতে দেখে ইভা গাড়ি ঘুরিয়ে উলটোদিকে চলে গেল। একা থাকলে হয়তো আবার রুমীকে গাড়িতে তুলে নিত।
.
নিউমার্কেটে বইয়ের দোকানে উবু হয়ে বসে রুমী বই দেখছিল, কে যেন ওর খুব কাছে মাথা এনে ডাকল, রুমী!
রুমী ঘুরে দেখে ইভা। কি খবর-ইভা হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, ভালো?
হ্যাঁ, এই আর কি।
পরীক্ষা কেমন হলো তোমার?
ভালো।
কি করছো এখানে? যাবে নাকি কোথাও?
নাহ। সাতটার সময় ওর একটা টিউশনি আছে, এখনো খানিকক্ষণ বাকি সাতটা বাজতে, তাই সময় কাটাচ্ছিল। ইভাকে টিউশনির কথা বলতে ওর লজ্জা করল, বলল,অন্য কাজ আছে। শুনে ইভা আর অপেক্ষা করল না। মিষ্টি করে হেসে বলল, আসি তাহলে, আবার দেখা হবে।
দেখা হোক কি না হোক বিদায় নেওয়ার সময় অনেকেই বলে, আবার দেখা হবে, ওটা একটা কথার কথা।
কিন্তু ইভার কথাটা কথা ছিল না। ও সত্যিই জানতো আবার দেখা হবে। শুধু ইভা নয় আরও অনেকে জানতো আবার দেখা হবে। বহুদিন থেকে ওকে ওরা চোখে চোখে রাখছে। অনেক খুঁজে ওরা রুমীকে পেয়েছে, এখন ওকে কিছুতেই হাতছাড়া করা চলবে না।
রুমী যখন সেটা জানতে পারল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তিন
রুমী বহুদিন হলো শানুকে দেখে নি। সেই কবে শানুর বিয়ে হয়ে গেছে তারপর মাত্র একবার দেখা হয়েছে। কদিন আগে শানুর স্বামী ঢাকা এসেছিলেন গুড়ের একটা চালান নিয়ে। ছোটখাটো মানুষ, মুখে সব সময়ই ভালো মানুষের মতো একটা হাসি। সদরঘাটের কাছে কি একটা ঘিঞ্জি হোটেলে ছিলেন সপ্তাহখানেক। রুমীকে খুব যত্ন করে হোটেলে নিয়ে শিককাবাব খাইয়েছিলেন। যাবার সময় খুব করে বলেছেন যেতে। রুমী কথা দিয়েছিল পরীক্ষা শেষ হলে যাবে। তখন ভদ্রলোককে শান্ত করার জন্যেই বলেছিল, কিন্তু পরীক্ষা শেষ হবার পর ও সত্যিই ঠিক করল যাবে। হকার্স মার্কেট ঘুরে ঘুরে সে শানুর জন্যে একটা শাড়ি কিনল, শানুর বাচ্চার জন্যে একটা খেলনা গাড়ি। শানুর স্বামীর জন্যে একটা দামি সিগারেট লাইটার, ভদ্রলোক শৌখিন মানুষ কিন্তু প্রাণে ধরে বিলাসিতার জিনিস পয়সা খরচ করে কিনতে পারেন না।
রাত আটটায় ট্রেন। রুমী ছটার মধ্যে রওনা দিল। সকাল সকাল গেলে ট্রেনে একটু ভালো জায়গা পাওয়া যাবে। সাথে ছোট একটা ব্যাগ, খামোখা রিকশা করে না গিয়ে সে বাসেই চলে যাবে ভাবছিল, তাতে অনেক পয়সা বাঁচে। বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটও অপেক্ষা করে নি, ওর পাশে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে ইভা বলল, কি খবর রুমী, কোথায় যাচ্ছ?
রুমী একটু অবাক হয়ে এগিয়ে যায়, কমলাপুর স্টেশন।
তাই নাকি? চলো তোমাকে পৌঁছে দিই।
বাসে করে যাবার বদলে গাড়িতে করে যেতে আজ ওর কোনো আপত্তিই ছিল না, কিন্তু ও দেখল গাড়ির ভিতরে আরও দুজন লোক বসে আছে। একজন সামনে ইভার পাশে, আরেকজন পেছনে। অপরিচিত লোকজনের সাথে প্রায়-অপরিচিত আরেকজন মেয়ের গাড়িতে ওঠা কোনো সুখকর ব্যাপার নয়। কিন্তু ততক্ষণে পেছনের লোকটা পিছনের দরজা খুলে দিয়ে সরে বসে তাকে জায়গা করে দিয়েছে। রুমী একটু ইতস্তত করে উঠে বসে, ইভা সাথে সাথে গাড়ি ছেড়ে দেয়। হঠাৎ করে কেন জানি রুমীর ইচ্ছে হলো নেমে পড়ে, গাড়ির ভিতরে যেন কি একটা অশুভ জিনিস অপেক্ষা করে আছে। ওর শিরদাঁড়া বেয়ে বেয়ে ঠাণ্ডা কি যেন একটা নেমে যায়।
কোথাও যাচ্ছ নাকি? ইভা জিজ্ঞেস করে।
হুঁ।
কটায় ট্রেন তোমার? ভারী গলার স্বর শুনে সে পাশে তাকায়, লোকটিকে সে আগে দেখেছে, জোয়ারদার… সেই জ্যোতিষী।
রুমী শুষ্ক গলায় বলল, আটটায়।
ও। বলে জোয়ারদার কোথা থেকে যেন একটা পকেট ঘড়ি বের করল। লম্বা চেন লাগানো সাথে। সোনালি রঙের চমৎকার একটা ঘড়ি। ওপরে কারুকাজ করা ঢাকনা। ঢাকনা খুলে সময় দেখে বলল, এখনো অনেক সময় আছে।
ঢাকনাটা বন্ধ করে চেনটা ধরে রেখে জোয়ারদার আস্তে আস্তে ঘড়িটাকে ঝুলে পড়তে দিল। গাড়ির অল্প কাঁপুনির সাথে ঘড়িটা চেনের মাথা থেকে দুলছে, এত চমৎকার কাজ, রুমী চোখ ফেরাতে পারে না ঘড়ি থেকে।
ঘড়িটা আস্তে আস্তে দুলছে জোয়ারদারের হাতে, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। তাকিয়ে থেকে থেকে রুমীর কেমন যেন মাথা গুলিয়ে আসে, চোখ সরাতে পারে না সে ঘড়ি থেকে। ভয় পেয়ে যায় হঠাৎ। লাফিয়ে উঠে বসতে চায় সে, কিন্তু আবিষ্কার করে ওর কোনো শক্তি নেই, ওর চোখ ভেঙে ঘুম নেমে আসছে।
ঘুমাও তুমি, ঘুমাও–কে যেন ওকে বলছে অনেক দূর থেকে।
না, না, না, রুমী প্রাণপণ চেষ্টা করে জেগে থাকতে, ভয়ের একটা শীতল স্রোত ওর চেতনাকে জাগিয়ে রাখতে চায়, কিন্তু পারে
ঘুমাও, ঘুমাও তুমি, ঘুমাও!
রুমীর চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে আসে। গাড়ির সিটে মাথা রেখে শিশুর মতো ঘুমিয়ে পড়ে একসময়।
গাড়ি মতিঝিল কলোনির সামনে এসে ঘুরে গেল তারপর ছুটে চলল উলটোদিকে।
.
রুমীর ঘুম মাঝে মাঝে হালকা হয়ে এসেছে, কিন্তু একবারও ভাঙে নি। স্বপ্নে দেখছিল উত্তপ্ত মরুভূমির ওপর দিয়ে সে প্রাণপণে ছুটে যাচ্ছে আর ওর পিছু পিছু ছুটে আসছে বুনো কুকুরের দল, একটি দুটি নয় হাজার হাজার, অন্ধকারেও তাদের সাদা দাঁত আর হিংস্র চোখ স্পষ্ট দেখা যায়। তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে রুমীর, কিন্তু তবু ও থামতে পারছে না, থামলেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে বুনো কুকুরের দল, মুহূর্তে ওকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে ধারালো দাঁত দিয়ে। কিন্তু আর পারছে না রুমী, হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল বালিতে, কোনোমতে উঠে দাঁড়াল সে, কিন্তু পা যেন গেঁথে গেছে, কিছুতেই নড়তে পারছে না।
লক্ষ লক্ষ বুনো কুকুর ছুটে আসছে-আরও কাছে আরও কাছে-তাদের হিংস্র চিৎকারে কানে তালা লেগে যায়, ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর।
প্রচণ্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে রুমী, সাথে সাথে ঘুম ভেঙে যায় ওর। অনেকক্ষণ লাগল ওর বুঝতে ব্যাপারটা কি। ধ ধ করে তখনো ওর বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ড শব্দ করছে, প্রচণ্ড তৃষ্ণায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে, সে শুয়ে আছে একটা অন্ধকার ঘরে আর ঘরের বাইরে সত্যি সত্যি অসংখ্য কুকুর তখনো গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। মনে করার চেষ্টা করল রুমী। কি হয়েছে ওর! আবছা, মনে পড়ল শানুর কাছে যাবার কথা ছিল, কমলাপুর স্টেশনে যাচ্ছিল সে, হঠাৎ-ইভা!
এক মুহূর্তে সবকিছু মনে পড়ে যায় রুমীর, সাথে সাথে লাফিয়ে উঠে বসে বিছানায়। কোথায় নিয়ে এসেছে ওকে? অন্ধকার ঘর, ভালো করে কিছু দেখা যায় না। ঘরে আর কেউ আছে কি? কান পেতে শোনার চেষ্টা করল রুমী, কিছু বুঝতে পারল না। ছোট ঘর, দরজা-জানালা সব বন্ধ, ঘরের একপাশে কি সব জিনিস রাখা। সাবধানে বিছানা থেকে নামে রুমী, হাতড়ে হাতড়ে দেয়াল স্পর্শ করে দরজা খুঁজতে থাকে সে। ঘরটা নোংরা এবং মাঝে মাঝেই ভিজে, ওর পায়ের নিচে কাঠকুটো পাথর-চাপা পড়ছে। খুঁজে খুঁজে দরজা পেল শেষ পর্যন্ত, কিন্তু বাইরে থেকে তালা মারা, ও ফাঁক করে দেখতে পায় দরজার কড়ায় মাঝারি গোছের একটা তালা ঝুলছে।
প্রচণ্ড ভয় পেল রুমী, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল ওর, মনে হলো মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তাকে একটা অন্ধকার ঘরে তালা মেরে আটকে রেখেছে। কি করবে তাকে? মেরে ফেলবে? নিশ্চয়ই মেরে ফেলবে! কিন্তু কেন মেরে ফেলবে? ইভার কথা মনে পড়ে ওর, জোয়ারদারের কথা। গাড়িতে নিশ্চয়ই তাকে সম্মোহিত করেছিল জোয়ারদার। কি আশ্চর্য ব্যাপার, সে ওই ঘড়িটা থেকে চোখ সরাতে পারছে না আর জোয়ারদার তাকে বলে চলছে ঘুমিয়ে পড়তে, কিছুতেই সে জেগে থাকতে পারছে না। কত চেষ্টা করল জেগে থাকতে অথচ সে ঘুমিয়েই পড়ল শেষ পর্যন্ত। রুমীর সারা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, ভুরু বেয়ে ঘাম গালের ওপর দিয়ে গলার দিকে নেমে যায় স্রোতের মতো।
একটুক্ষণ বসে থাকে সে, তারপর আবার উঠে দাঁড়ায়, হাতড়ে হাতড়ে ঘরটা দেখতে থাকে। কোনো আসবাবপত্র নেই, কোনো জানালা নেই, একটা মাত্র দরজা, তাও বাইরে থেকে তালা মারা। ঘরময় নানা আবর্জনা, ইট, গাছের ডাল, মাটি, ভেজা মতন কি সব জিনিস। এক কোনায় ওর পায়ে গোল মতো কি একটা লাগল। হাত দিয়ে দেখে বেশ মসৃণ, সাবধানে হাতে তুলে নিল সে। ভিতরটা ফাপা, জিনিসটা যত বড় ওজন তার তুলনায় বেশ কম। সে চোখের কাছে নিয়ে দেখার চেষ্টা করল, কিছু দেখা যায় না। সাদা মতন একটা কিছু হবে, বোটকা গন্ধ রয়েছে মনে হয়। দরজার ফাঁক দিয়ে নক্ষত্রের একটু আলো এসে ঢুকছে, রুমী জিনিসটা সেখানে নিয়ে গেল। সে আলোতেও ভালো দেখা যায় না। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ জিনিসটা চিনে ফেলল। সারা শরীর শিউরে উঠল ওর। হাতে একটা মরা মানুষের করোটি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। যেটুকু আলো আসছে তাতে স্পষ্ট দেখা যায়, ও চিনতে পারছিল না কারণ ও কল্পনাও করে নি এটা একটা করোটি হতে পারে।
জন্তুর মতো গোঙানোর আওয়াজ করে সে ছুঁড়ে ফেলে দিল করোটিটা, সশব্দে পড়ে
সেটা গড়িয়ে গেল কোনার দিকে। সারা শরীর কাঁপছে রুমীর, ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে পৃথিবীকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়, দরজা ভেঙে ছুটে পালিয়ে যায় এই অশুভ ঘর থেকে।
কিন্তু ওর কিছু করার নেই, টলতে টলতে বিছানার ওপর উঠে বসে, করোটির স্পর্শ মুছে ফেলার জন্যে বিকারগ্রস্তের মতো বারবার হাত দুটি বিছানার চাদরে ঘষতে থাকে।
খুব ধীরে ধীরে ভোর হলো। দরজার ফাঁক দিয়ে আলো এসে ঘরের ভিতরকার
অন্ধকার তরল করে দিল, আস্তে আস্তে আর একটি একটি করে ঘরের সবকটা জিনিস
স্পষ্ট হয়ে উঠল। রুমী অবাক হয়ে গেল এতক্ষণে কেন পাগল হয়ে যায় নি ভেবে। ঘরের মেঝেতে রয়েছে কাপড়ে জড়ানো একটা শিশুর মৃতদেহ, এমন অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে পড়ে রয়েছে যে দেখেই বোঝা যায় শিশুটি মৃত। রাতে রুমী কীভাবে শিশুটির মৃতদেহে পা দেয় নি সেটাই আশ্চর্য। ঘরের চারদিকে অসংখ্য বাদুড়, সব কয়টির গলা দুভাগ করে কাটা, কুঁকড়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে বাদুড়গুলি। এক কোণে মাটিমাখা মৃত মানুষের হাড়গোড়। দেখে মনে হয় কেউ গোর খুঁড়ে তুলে এনেছে, রাতের সেই করোটিটাও এক কোনায় পড়ে আছে। ঘরে মাঝামাঝি রয়েছে কিছু বড় বড় পাত্র, নানা ধরনের তরল পদার্থ সেখানে, বোটকা গন্ধ বের হচ্ছে সেখান থেকে। এসব বীভৎস জিনিসের মাঝে খুব বেমানান লাগছে একগোছা ফুল-এত সুন্দর জবা ফুল সে জীবনে দেখে নি।
সবকিছু দেখে রুমী খুব আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে যায়। কাপড়ে জড়ানো শিশুর
মৃতদেহটিও তাকে আর বিচলিত করছে না, মৃত মানুষের হাড়গোড় তার মনে হতে থাকে খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। ঘরভরা এসব বীভৎস জিনিসের ভিতর বসে থেকে তার খিদে পেতে থাকে। সে হাঁটুতে মুখ রেখে অপেক্ষা করতে থাকে কি হয় দেখার জন্যে।
অনেক বেলা করে একজন লোক তালা খুলে এসে ঢোকে। মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, হাসি-খুশি চেহারা। চোখ দুটির দিকে না তাকালে মনে হয় বুঝি খুব আমুদে মানুষ, চোখ দুটি স্থির, মনে হয় মৃত মানুষের। লোকটা গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাসনপত্র টানাটানি করতে থাকে। ঘরে যে রুমী বসে আছে সেটা যেন ওর চোখেও পড়ছে না। রুমী আস্তে আস্তে বলল, আমি একটু পানি খাব।
লোকটা কথা শুনেছে কি না বোঝা গেল না, একমনে নিজের কাজ করতে থাকে।
কয়টা বাসন নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সময় রুমী আরেকবার একটু জোরে বলল, আমি একটু পানি খাব।
লোকটা না শোনার ভান করে ঘরে তালা মেরে চলে গেল। একটু পরে কিন্তু সত্যি এক গ্লাস পানি নিয়ে ফিরে আসে। গ্লাসটা পরিষ্কার, রুমী এক নিঃশ্বাসে ঢক্ করে পুরো পানিটুকু খেয়ে নিল। গ্লাসটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, আমি এখান থেকে যাবো।
লোকটার মুখ দেখে মনে হলো সে যেন ভারি মজার একটা কথা শুনেছে।
খিকখিক করে হাসতে হাসতে বলল, তাই নাকি? চেষ্টা করে দেখ না, ভুড়ি কীভাবে ফাঁসিয়ে দিই দেখবে না? লোকটা রুমীর দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকে। কি নিষ্করুণু দৃষ্টি। রুমীর সারা গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। সে আর কোনো কথা না বলে বিছানায় বসে থাকে, প্রচণ্ড খিদে পেয়েছিল, এখন সেটাও কেমন ভোতা হয়ে বমি বমি লাগছে।
ঘর থেকে সবকিছু বাইরে নিয়ে সামনের ফাঁকা মতো জায়গাটাতে বেশ কয়েকজন লোক মিলে কি কি করতে শুরু করে। দু’একজন বিভিন্ন বয়সী মেয়েও আছে। একে একে সবাই এসে রুমীকে উঁকি মেরে দেখে গেছে, কেউ কিন্তু একটা কথাও বলে নি। রুমীর নিজেকে মনে হতে লাগল খাঁচায় আটকে রাখা একটা অদ্ভুত জন্তু। সে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে বাইরে কি হচ্ছে। একটা বড় আগুন জ্বালানো হয়েছে, চারপাশে ইট সাজিয়ে একটা চুলার মতন তৈরি করে সেখানে একটা বড় ডেকচি বসানো হয়েছে। একজন খালি গায়ে ঘর্মাক্ত শরীরে মস্ত বড় একটা হাতা দিয়ে প্রাণপণে ডেকচির ভিতরের ফুটন্ত তরল জিনিসটা নেড়ে যাচ্ছে। এদিকে-সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লোকজন নানা কাজে ব্যস্ত। কথাবার্তা শুনে মনে হয় একটা বড় উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। রুমীর দিকে পেছন দিয়ে ক’টা লোক কি যেন কাটাকাটি করছে, একজন একটু সরতেই রুমী দেখতে পেল শিশুর মৃতদেহটি। গা গুলিয়ে বমি এসে গেল ওর, চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কোনোমতে সরে আসে সে। কি ভয়ানক ব্যাপার! এ কাদের পাল্লায় পড়েছে সে? রুমী চোখ বুজে বসে থাকে, কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই–কথাবার্তা ভেসে আসে তখন। সব সে বুঝতে পারে না কিন্তু একটি-দুটি যা শুনতে পায় তাতে তার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে।
উলটাপাল্টা কোপ দিয়ে নষ্ট করিস না।
সবার কি আর তোর মতো মরা কাটার ডিগ্রি আছে!
ডিগ্রি লাগে না, একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকলেই হয়। কোথায় রাখব?
এইখানে এইখানে। এইটুকু মাত্র চর্বি?
দুই বছরের একটা বাচ্চার কতটুকু চর্বি থাকবে? আধমণ?
ভালো বলেছিস… হি হি হি…
দেখো তো রংটা কেউ, পানসে লাগছে না?
ঠিক হয়ে যাবে, বাদুড়ের রক্তটুকু দিলেই ঠিক রং চলে আসবে।
মনে আছে, গতবার কিছুতেই বাদুড় পাওয়া গেল না, শেষে কয়টা চামচিকে ধরে এনে-হি হি হি…
চামচিকে আর বাদুড়ের মাঝে তফাত কি? একটা ছোট আরেকটা বড়, এ ছাড়া
আর কি তফাত?
আরে দুর–দুটো একেবারে ভিন্ন জিনিস!
সে কি রক্ত জমে গেছে যে?
ও কিছু হবে না। ঢেলে দাও।
বোতলটা কার কাছে?
কখন শেষ হয়ে গেছে! তুমি আছ কোন দুনিয়ায়?
আরেকটা বের করো না কেউ!
বেশি খেয়ো না, তোমার তো লেমনেড খেলেই নেশা হয়ে যায়।
হি হি হি…
একটু পরে বাইরে কথাবার্তা কমে আসে। একজন শুধু বসে বসে বড় ডেকচিতে একটা হাতা দিয়ে নাড়ছে। ঝাঁজালো কটু গন্ধে জায়গাটা ভরে গেছে। রুমীর কেমন অস্বস্তি হতে থাকে। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে তার, কিন্তু কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। এমন সময় হঠাৎ সে ইভার গলার স্বর শুনতে পায়। এই সর্বনাশী মেয়েটার ওপরে তার যত আক্রোশই থাকুক না কেন এখন সে-ই হচ্ছে একমাত্র পরিচিত। রুমী দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকল, ইভা এই ইভা!
ইভা একজনের সাথে কথা বলছিল, ঘুরে ওর দিকে তাকাল, কিন্তু তাকে চিনতে পেরেছে সেরকম ভাব দেখাল না। রুমী রাগে প্রায় অন্ধ হয়ে আবার ডাকে, এবারে কাছে এগিয়ে আসে ইভা, কি হয়েছে?
রাগ দুঃখ হতাশা সব মিলিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হলো রুমীর। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে ওর, কোনোমতে বলল, আমাকে জিজ্ঞেস করছ কি হয়েছে?
ইভা নিস্পৃহাভাবে হাত উল্টিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম করে, রুমী ওকে থামানোর চেষ্টা করে, আমাকে এখানে এনেছ কেন?
কাজ আছে।
কি কাজ?
সময় হলেই দেখবে।
আমাকে কেন?
তোমার মতই একজন দরকার, ভালো মিডিয়াম।
মানে?
ইভা কঁধ ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে যায়, তুমি বুঝবে না।
রুমী আর কি বলবে বুঝতে না পেরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ইভা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার চলে যাচ্ছিল, রুমী আবার তাকে থামায়, আমার খুব খিদে পেয়েছে কিছু খেতে দেবে?
সে কি! তোমাকে কেউ খেতে দেয় নি? ইভা হঠাৎ খুব ব্যস্ত হয়ে ডাকাডাকি শুরু করে দেয়। এইটুকু সমবেদনাতেই হঠাৎ করে কেন জানি রুমীর চোখে পানি এসে পড়ে।
ইভা কিছুক্ষণের মাঝেই এক প্লেটবোঝাই খাবার এনে দরজার ফাঁক দিয়ে সাবধানে ঘরের ভিতর গলিয়ে দেয়। রুটি, মাখন,ডিম, মাংসের তরকারি, সবজি এমন কি একটা পেট মোটা বোতলে আধ বোতল মদ। রুমী বুভুক্ষের মতো খাওয়া শুরু করে। ভীষণ খিদে পেয়েছিল ওর, কিন্তু বেশি খেতে পারল না। হঠাৎ করে ওর পেট ভরে বমি বমি লাগতে থাকে। পান খেতে পারলে হতো একটা, মিষ্টি সুপারি দিয়ে সুগন্ধি একটা পান!
রুমী বাড়তি খাবারটুকু বিছানার নিচে রেখে দিল। আবার কখন ওরা খেতে দেবে কে জানে। মদের বোতলটা ফিরিয়ে দিতে দরজার কাছে এসে দেখে ইভা অন্যমনস্কভাবে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, মুখের ভাব দেখে মনে হয় যেন একটু বিচলিত। যত আক্রোশই থাকুক, এই সর্বনাশী মেয়েটার অস্বাভাবিক সৌন্দর্যকে অস্বীকার করা যায় না। রুমী ওকে ডেকে বোতলটা ফিরিয়ে দেয়।
খাও না বুঝি তুমি?
রুমী মাথা নাড়ল। ইভা ছিপি খুলে বোতলে মুখ লাগিয়ে এক ঢোক খেয়ে হাতের উলটো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়। রুমী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, সে আগে কখনো কাউকে মদ খেতে দেখে নি।
তোমরা কারা?
রুমীর প্রশ্ন শুনে ইভা কেমন যেন একটু চমকে ওঠে। উত্তর দেবে, রুমী আশা করে নি। কিন্তু ইভা বোতলটা হাতে নিয়ে বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসে ওর প্রশ্নের উত্তর দেয়, আমরা ডেভিল বা শয়তানের উপাসক। ইংরেজিতে আমাদের বলে উইচ। বাংলায় ডাইনি। কিন্তু ডাইনি কথাটা আমার একেবারে পছন্দ হয় না, আমাকে কি ডাইনির মতো দেখায়?
রুমীকে স্বীকার করতেই হয় ইভাকে ডাইনির মতো দেখায় না।
কখনো ব্ল্যাক আর্টের নাম শুনেছ?
রুমী মাথা নাড়ে, না।
ব্ল্যাক আর্ট হচ্ছে…
ইভার কাছে পরের এক ঘণ্টা রুমী আশ্চর্য এক জগতের খবর শুনল।
.
মানুষ একই সাথে ঈশ্বর এবং শয়তানের অস্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়েছিল। বেশিরভাগ মানুষ ঈশ্বরের প্রভুত্ব স্বীকার করে নিয়েছে, কিন্তু এর উল্টোটাও হতে পারতো, সৌভাগ্যবশত হয় নি, হয়তো সেটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। কিন্তু ঈশ্বরের প্রভুত্বকে অস্বীকার করে শয়তানের প্রভুত্ব মেনে নিয়েছে সেরকম মানুষ একেবারে নেই। তা সত্যি নয়। ষোড়শ শতাব্দীর দিকে সারা ইউরোপ এ ধরনের মানুষে ছেয়ে গিয়েছিল। তাদের এই শয়তান বা ডেভিলের কাছে বশ্যতা স্বীকার করার এবং তার উপাসনা করার বিভিন্ন পদ্ধতিতে বলে ব্ল্যাক আর্ট বা ব্ল্যাক ম্যাজিক। সাধারণ সমাজ কখনো এদের ভালো চোখে দেখে নি, দেখার কথাও নয়। যুগ যুগ ধরে মানুষ যেসব নীতি এবং বিশ্বাস নিয়ে গড়ে উঠেছে সেসব কিছুকে অস্বীকার করে এরা অদ্ভুত একটা বিকৃত ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকে। শুধু ধর্ম নয়, সত্য-ন্যায় এবং যে কোনো ভালো জিনিসের সাথে এদের যুদ্ধ। শয়তানের প্রভুত্ব স্বীকার করে নেওয়ার পর শয়তান এদের অনেক আশ্চর্য ক্ষমতা দিতে পারে বলে এরা বিশ্বাস করে। এর জন্যে এরা এমন কোনো বিকৃত কাজ নেই যা করতে পারে না। এদের নানা ধরনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে, বিশেষ করে ধর্মের বিরুদ্ধে লেগে থাকার জন্যে ধর্মযাজকরা খুব খেপে ওঠে এদের ধরে পুড়িয়ে মারা শুরু করে। সেই সময়ে সারা ইউরোপে বিশেষ করে ইংল্যান্ডের হাজার হাজার শয়তান উপাসক নর-নারীকে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে মারা হয়। অনেক নির্দোষ মানুষ যে মারা যায় নি তা নয়, কিন্তু এদের সংখ্যা সত্যিই কমে গিয়েছিল।
বহুকাল পরে বিংশ শতাব্দীতে মানুষ যখন অনেক কিছু সহ্য করতে শিখেছে এরা আবার তখন আস্তে আস্তে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। খানিকটা নিষিদ্ধ কৌতূহল, খানিকটা বিশ্বাস, খানিকটা লোভ নিয়ে অনেকে আবার সেই পুরাতন শয়তান উপাসনায় ফিরে গিয়েছে। পাশ্চাত্য দেশে জাতি-দ্বেষ, নাৎসিবাদ, সমকাম কোনো কিছুই আর বেআইনি নয়, তাই শয়তান উপাসনাতে আপত্তি কিসের? আগের মতো এটা আর ছড়িয়ে পড়বে না কারণ পাশ্চাত্যের লোকজন এখন পুরোপুরি পার্থিব জগতের বাইরে যেতে চায় না। এ দেশের খেটে খাওয়া একজন চাষির যে পরিমাণ আধ্যাত্মিক জগৎ রয়েছে পাশ্চাত্যের সবচেয়ে শিক্ষিত লোকটিও তা কল্পনা পর্যন্ত করতে পারে না।
ইভা এবং তাদের দলের কিছু লোকজন আমেরিকা এবং ইউরোপ থেকে শয়তানের উপাসনা শিখে এসেছে। পাশ্চাত্যের শয়তান বা ডেভিলের উপাসক আর এ দেশের প্রেতসাধক কাঁপালিকেরা মিলে এরা নতুন ধরনের ব্ল্যাক আর্ট শুরু করার চেষ্টা করছে। বছর দুয়েক হলো ওরা এখানে-সেখানে শয়তান উপাসনার অনুষ্ঠান শুরু করেছে। চেষ্টা করলে শয়তান বা ডেভিলকেও অনুষ্ঠানে হাজির করা যায়, কিন্তু তার জন্যে বিশেষ গুণসম্পন্ন একটা মানুষ দরকার, সেই ধরনের মানুষকে ওরা মিডিয়াম বলে। গত ছয় মাস থেকে জোয়ারদার হাত দেখার ভান করে মিডিয়াম খুঁজে যাচ্ছিল। একটা মোটামুটি ভালো মিডিয়াম পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু রুমী তার থেকে অনেক ভালো, ওর হাতে নাকি তার স্পষ্ট চিহ্ন আছে। সেজন্যেই রুমীকে এভাবে ধরে এনেছে, এমনিতে সে কখনোই রাজি হতো না।
ইভা রুমীকে বারবার বোঝালো, এতে কোনো ভয় নেই, রুমী কিছু জানতেও পারবে না, প্লানচেট করে আত্মা আনার ব্যাপার। রুমীর বিশ্বাস হয় নি, সব শুনে ওর আত্মা শুকিয়ে গেছে।
ইভা বলেছে সাধারণ লোকজন কখনো তাদের কাজকর্ম ভালো চোখে দেখে না বলে তারা মফস্বলের এই নির্জন জায়গায় চলে এসেছে। আজ রাতে অমাবস্যা, রাত বারোটার পর তাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। সব মিলিয়ে তেরোজন, রুমীকে নিয়ে চৌদ্দ। এক জোড়া স্বামী-স্ত্রী তাদের শিশুসন্তানকে নিয়ে আসবে শয়তানের কাছে উৎসর্গ করার জন্যে। তারা স্বামী-স্ত্রী এই ধরনের ধারণায় বিশ্বাস করে না, কিন্তু সমাজে থাকতে হয় বলে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়। সাধারণ মানুষজন সবাই জানে জোয়ারদার তার স্বামী, কিন্তু ইভার সাথে জোয়ারদারের কোনো সম্পর্ক নেই।
অনুষ্ঠান বেশ লম্বা। অনুষ্ঠানে যোগ দিতে হলে সবাইকে গায়ে বিশেষ এক ধরনের তেলজাতীয় জিনিস মাখতে হয়। আজ সারাদিন ধরে সেটা তৈরি হচ্ছে। খাওয়ার জন্যে রয়েছে বিশেষ এক ধরনের পানীয়, তাতে অ্যালকোহল ছাড়াও আরও অনেক কিছু মেশানো হয়। তাদের অনুষ্ঠানে গায়ে কোনো কাপড় না রেখে যোগ দেওয়ার কথা, কিন্তু যারা বিদেশে যায় নি তাদের লজ্জা একটু বেশি বলে অনেক সময়ে একটু কাপড় পরে থাকে। ইভার কাছে। কেন যেন এ ব্যাপারটা খুব কৌতুককর মনে হওয়াতে সে খিল খিল করে হাসতে শুরু করে। তার সুন্দর মুখে এই মিষ্টি হাসি দেখে কে তাকে কোনো কিছুতে সন্দেহ করবে? হাসি থামিয়ে ইভা রুমীকে অভয় দেয়, তাকে কাপড় ছাড়া থাকতে হবে না, সে তো আর তাদের দলের কেউ নয়–সে হচ্ছে মিডিয়াম। আর গায়ে অবিশ্যি সেই বিশেষ তেলটি মাখতে হবে আর সেই পানীয়টা তাকেও খেতে হবে। পানীয়টা নাকি খুব সুস্বাদু, খেতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। রুমী ওদের মাঝখানে বসে থাকবে, সময় হলে ডেভিল তার ওপরে ভর করে অনুষ্ঠানে যোগ দেবে। সারারাত ধরে অনুষ্ঠান চলার পর ভোর রাতে ওরা ঘুমাতে যাবে। তখন রুমীর কাজ শেষ, সে যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে।
ওর কাজ শেষ হলে ও যেখানে খুশি চলে যেতে পারবে কথাটা রুমী প্রায় বিশ্বাস করে ফেলেছিল, মানুষ সব সময়েই ভালো জিনিসটা বিশ্বাস করতে চায়, দৈনন্দিন জীবনে সেটা একটা আশীর্বাদের মতোই। কিন্তু অঘটনের আগে মানুষ যেসব খারাপ ব্যাপার ঘটতে পারে সেগুলি ইচ্ছা করে না দেখার ভান করে বলেই এতে অঘটন ঘটে। এ সত্যটা রুমী সব সময় মনে রেখেছে, এবারেও সে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে বুঝতে পারল আসলে এরা তাকে ছেড়ে দেবে না। অন্য কোনো কারণে না হোক, সে ঘরে একটা শিশুর মৃতদেহ দেখেছে, তার সামনে আজ রাতে আরেকটা শিশুকে উৎসর্গের নামে হত্যা করা হবে, এই দুই ঘটনার সাক্ষীকে ছেড়ে দিয়ে নিজেরা কিছুতেই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে না। এদের কোনো কোমল অনুভূতি নেই, কাজ শেষ হওয়ার পর তাকে ওরা অবলীলায় হত্যা করবে।
মৃত্যু-ভয়ের চেয়ে বড় ভয় কিছু নেই, রুমী পায়ে দাঁড়ানোর জোর পাচ্ছে না। বিছানায় বসে দরদর করে ঘামতে শুরু করে। কোনো কিছু চিন্তা করতে পারছে না সে। ছাড়াছাড়া ভাবে ছেলেবেলার ঘটনা, বন্ধুদের চেহারা, শানুর কথা, বহুকাল আগে শোনা মায়ের গলার স্বর এসব মনে হতে থাকে ওর। রুমী প্রাণপণ চেষ্টা করে নিজেকে শান্ত করতে। তাকে মেরে ফেলবেই, এটা কোনো অবধারিত সত্য নয়, কাজেই ওকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কত মানুষ আরও কত বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে, কাজেই ওর কোনো আশা নেই এটা ঠিক নয়। রুমী ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করতে বসে। ওর বারবার মনে হয় এটা বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন, এক্ষুণি ঘুম ভেঙে দেখবে ঘরে তার পরিচিত বিছানায় শুয়ে আছে।
কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন নয়, দুঃস্বপ্ন থেকে অনেক ভয়াবহ সেটা বুঝল অনেক পরে।
চার
রাত ঠিক বারোটা বেজেছে। রুমী উঁচু একটা জায়গায় কালো কাপড়ে ঢাকা একটা চেয়ারে বসে আছে। অদ্ভুত একটা কালো আলখাল্লা পরানো হয়েছে তাকে, মাথায় কালো লম্বা সুচালো একটা টুপি। টুপির দুপাশে শিঙের মতো খানিকটা বের হয়ে আছে। আলখাল্লার বুকে সাদা চাকার মতো কি যেন আঁকা, তাতে নানারকম উদ্ভট চিহ্ন। ইভা, আরও দুটি মেয়ে এবং একজন নির্লজ্জা বুড়ি তার সারা গায়ে খুব ভালো করে সেই বিশেষ লাল রঙের তেলটি মাখিয়েছে। ইভার কাছে শোনার পর থেকে রুমীর সন্দেহ হচ্ছিল যে এই তেলটিতে কোনো ধরনের ওষুধ থাকতে পারে যা তার লোমকূপের ভিতর দিয়ে শরীরে ঢুকে তাকে নেশাগ্রস্তের মতো করে ফেলবে। সেটা যতটুকু সম্ভব বন্ধ করার জন্যে সে তার বুকে-পিঠে আর মুখে ধুলোবালি আর দুপুরের অবশিষ্ট খাবারের মাখনটুকু মেখে নিয়েছে। তাতে কোনো লাভ হয়েছে কি না বলা কঠিন, কারণ তেলটুকু মাখানোর পর থেকে তার সারা শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে গিয়ে হঠাৎ মাথা ঘুরে উঠছে। শুধু তা-ই নয়, তার প্রচণ্ড ভয়টুকু কমে গিয়ে মাঝে মাঝে হঠাৎ করে একটু একটু খুশি খুশি লাগা শুরু হয়েছে। সারাক্ষণ গ্লাসে করে তাকে কি একটা খেতে দিচ্ছে, খেতে সেটা সত্যিই খুব ভালো। রুমী সেটা ঠোঁটে লাগিয়ে খাওয়ার ভান করে সাবধানে নিজের আলখাল্লায় ঢেলে ফেলছে। কালো আলখাল্লা ভিজে গেলেও বোঝা যায় না, তাছাড়া জায়গাটা বেশ অন্ধকার, আলো বলতে মশালের মতো বড় একটা মোমবাতি, একটি করোটির ওপর সেটা বসানো। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেছে বলে এই আলোতে বেশ দেখা যায়। রুমীর পায়ের কাছে তাকে পেছন দিয়ে একটা বৃদ্ধ লোক হাঁটু মুড়ে বসে আছে। তার সামনে একে একে এগারোজন নর-নারী এসে গায়ে গায়ে ঘেঁষে চুপ করে বসে আছে। একপাশে মাটিতে একটা শিশু ঘুমিয়ে আছে, সকাল থেকেই তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে রাখা হয়েছে। একে উৎসর্গ করার নামে হত্যা করা হবে ভেবে একটু পর পরই রুমীর সারা শরীর শিউরে উঠছে।
কোনো কথাবার্তা নেই, শুধু মোমবাতির শিখাঁটি একটু একটু শব্দ করে পুড়ছে। মোম গলে করোটির একটা চোখ প্রায় বুজে গিয়েছে। দূরে কোথাও প্রথমে একটা তারপর অনেক শেয়াল ডেকে উঠল, তাই শুনে হঠাৎ রুমীর বুকের ভিতরটা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।
বৃদ্ধ লেকাটি উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি পড়তে শুরু করে দিল, হঠাৎ শুনলে মনে হয় খিস্তি করছে। আসলেও তাই। ঈশ্বরকে, সকল ধর্মকে, সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাকে, পৃথিবীতে যা কিছু ভালো আছে সবকিছুকে অভিশাপ দিয়ে এই অনুষ্ঠান শুরু করতে হয়। বৃদ্ধের সাথে গলা মিলিয়ে অন্যেরাও বিড়বিড় করে কি সব বলতে শুরু করে। মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে মন্ত্র পড়ার মতো বেশ অনেকক্ষণ চলল এই রকম। একসময় সবাই থেমে পড়লে বৃদ্ধটি কেশে গলা পরিষ্কার করে অনেকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে কথা বলা শুরু করে। প্রথমে সে সবাইকে ধন্যবাদ দেয় এখানে আসার জন্যে, তারপর তারা যে কত ভাগ্যবান সে নিয়ে একটু বিস্ময় প্রকাশ করে। নতুন যারা এসেছে তারা যদিও সবারই পরিচিত তবু তাদের আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। তারা উঠে এসে বৃদ্ধটি যে জায়গায় মুখ লাগিয়ে চুমু খাওয়ার ভান করল সেটি না দেখলে রুমী কখনো বিশ্বাস করতো না। একজন একজন করে সবাই স্পষ্ট ভাষায় বলল তারা নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছে। তারা সজ্ঞানে এখন থেকে খোদার ওপর থেকে বিশ্বাস সরিয়ে শয়তান বা প্রেতকে নিজেদের ভবিষ্যতের প্রভু হিসেবে স্বীকার করে নিচ্ছে। এরপর প্রত্যেককেই দু-তিন মিনিট করে সময় দেওয়া হলো কিছু বলার জন্যে। তারা প্রথমে এখন পর্যন্ত কি কি অসামাজিক কাজ করেছে তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিয়ে ঈশ্বর, সমাজ এবং ধর্মকে এমন জঘন্য ভাষায় গালাগাল শুরু করে দিল যে তাদের থামানো মুশকিল হয়ে পড়ল। এরপর এদের প্রত্যেকের নাম পাল্টে নতুন নাম দেওয়া হলো। এখন থেকে নিজেদের মাঝে তারা এ নামেই পরিচিত হবে। একজনের নাম মড়াখাগী’, একজন রক্তচোষা’ অন্যগুলি এত অশ্লীল যে মুখে উচ্চারণ করা যায় না।
দলের নতুন সভ্যেরা বৃদ্ধটির সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। বৃদ্ধটি আবার বক্তৃতার মতো শুরু করে, আমাদের সাথে আজকে আরও পাঁচজন এসে যোগ দিতে পেরেছে এজন্যে আমরা সবাই আনন্দিত। আজকে এজন্যে অনেক রকম আনন্দের ব্যবস্থা আছে। অনুষ্ঠান শুরু করার আগে তোমাদের নতুন পাঁচজনের প্রভু শয়তানের কাছে সারা জীবনের জন্যে অঙ্গীকার লিখে দিতে হবে। প্রভু তাহলে তোমাদেরও নিজের কাছে টেনে নেবেন। তোমাদের ভাগ্য আমাদের ভাগ্য থেকে অনেক ভালো, অঙ্গীকারে আজকে স্বয়ং প্রভু শয়তান নিজে এসে স্বাক্ষর করবেন। এই সময় সবাই ঘুরে রুমীর দিকে তাকায়, রুমী অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বসে।
বৃদ্ধটি কোথা থেকে কাগজ বের করে পাঁচজনের হাতে দিয়ে ইংরেজিতে বলে দিতে থাকে কি লিখতে হবে। মোমবাতির কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে ওরা লিখতে শুরু করে। একজন ইংরেজি জানে না বলে তাকে বাংলায় অনুবাদ করে দেওয়া হলো। প্রভু শয়তানের স্পষ্টতই ভাষা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। সবাই লিখল যে ওরা প্রতিজ্ঞা করছে আজীবনের জন্যে সবাই প্রভু শয়তানের দাসত্ব স্বীকার করে নিচ্ছে। তার বিনিময়ে প্রভু শয়তান তাদের ঈশ্বরের কোপানল থেকে রক্ষা করবেন এবং নিজের কাছে টেনে নিয়ে তার প্রচণ্ড ক্ষমতার একটা ক্ষুদ্র অংশ তার মাঝে সঞ্চারিত করে দেবেন। সবাই স্পষ্ট করে লিখল যদি তারা কোনোভাবে তাদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করে প্রভু শয়তান তার এবং তার বংশধরের আত্মাকে ইহকাল ও পরকালে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে নিপীড়ন করতে পারেন।
অঙ্গীকার লেখা শেষ হবার পর ওরা উঁচ দিয়ে আঙুল ফুটিয়ে রক্ত বের করে সাবধানে কাগজের নিচে স্বাক্ষর করে। বৃদ্ধটি সবার হাত থেকে কাগজগুলি নিয়ে একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখে বলল, প্রভু শয়তান অঙ্গীকারপত্র স্বাক্ষর করে তাদের শরীরে একটা চিহ্ন দিয়ে দেবেন, এরপর থেকে তারা পুরোপুরি নিজেদের লোক হিসেবে গণ্য হবে।
বৃদ্ধ লোকটি কি বলতেই সবাই উঠে দাঁড়ায়। একজনকে, দেখে ঠিক চেনা যায় না কিন্তু রুমীর মনে হলো, জোয়ারদারই হবে, একটু সরে গিয়ে কি একটা যেন চালিয়ে দিয়ে গেল। একটু পরেই আস্তে আস্তে ঢাকের শব্দ ভেসে আসতে লাগল। গমগমে অদ্ভুত একটা শব্দ, কখনো সামনে কখনো পেছনে আবার কখনো ডান পাশ আর বাম পাশ থেকে শব্দ ভেসে আসছে। রুমী স্পিকারগুলি দেখার চেষ্টা করে কিন্তু অন্ধকারে দেখা যায় না। ঢাকের শব্দ এত জীবন্ত যে রুমীর মনে হতে থাকে ভালো করে তাকালে দেখবে ওকে ঘিরে আদিবাসীরা নাচের তালে তালে ঢাক বাজিয়ে চলছে। অদ্ভুত রহস্যময় ঢাকের শব্দ, বুকের ভিতরে যে আদিম অনুভূতি লুকিয়ে রয়েছে সেটা টেনে বের করে নিয়ে আসতে চায়। রুমীর মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে।
সবাই নিজেদের গ্লাসভর্তি করে নিয়ে সেই সুস্বাদু পানীয়টুকু খেতে শুরু করে। ঢাকের শব্দের তালে তালে সবাই মেঝেতে পা ঠুকছে, ওদের মাথা দুলছে, কেউ কেউ আবার তালে তালে হাত দোলাচ্ছে। আস্তে আস্তে সবাই একজন আরেকজনের পেছনে দাঁড়িয়ে লম্বা সারি করে রুমীকে ঘিরে ঘুরতে থাকে। ঢাকের শব্দের তালে তালে ওদের পা পড়ছে, হাত নড়ছে, মাথা দুলছে। বৃদ্ধ লোকটি হাত থেকে কি যেন ছুঁড়ে দিল আগুনে, দপ্ করে বড় একটা শিখা জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল, আর সাথে সাথে সারাঘর অদ্ভুত একটা গন্ধে ভরে গেল, মাতৃগর্ভে বুঝি এরকম গন্ধ থাকে।
রুমীর আশ্চর্য এক অনুভূতি হচ্ছে, সবকিছুকে মনে হচ্ছে অবাস্তব ঘোরের মতো। হাত-পা হঠাৎ করে ওর শিথিল হয়ে ওঠে, পর মুহূর্তে আবার টানটান হয়ে উঠতে চায়। মনে হতে থাকে ওর পা দুটি যেন পেছন দিকে ঘুরে যেতে চাইছে। মাথাটা কেন জানি বুকের ওপর ঝুঁকে পড়তে চায়, ও চেষ্টা করেও সোজা রাখতে পারে না। ঠোঁট, গলা শুকিয়ে ওর প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেতে থাকে, হাতের গ্লাসের পানীয়টুকু ঢক ঢক্ করে এক নিঃশ্বাসে শেষ করেও তৃষ্ণা কমে না, বুকটা শুকনো মরুভূমির মতো মনে হয়।
ঢাকের শব্দ দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে থাকে। ওকে ঘিরে সবাই তখন আরও দ্রুত ঘুরে চলেছে, নাচের ভঙ্গিতে হাত-পা নড়ছে, মাথা দুলছে, দেহ নড়ছে। সাপের মতো এঁকেবেঁকে সবাই আদিম উল্লাসে ঘুরে চলেছে। একে একে ওদের দেহ থেকে কাপড় খসে পড়ে। মোমবাতির ম্লান আলোতে ওদের ঘর্মাক্ত নগ্ন দেহ চকচক করতে থাকে। ঢাকের দ্রুত লয়ের শব্দের সাথে সাথে ওদের অঙ্গভঙ্গি অশ্লীল হতে শুরু করে, ওরা যেন মানুষ নয়, বোধশক্তিহীন হিংস্র পশু। নাচতে নাচতে ওরা আহত পশুর মতো দুর্বোধ্য শব্দ করতে তাকে, দেহ দুলিয়ে হাত নেড়ে ওরা রুমীকে আহ্বান করতে থাকে নিজেদের দিকে।
নিজের ভিতর অদ্ভুত একটা পরিবর্তন টের পায় রুমী। ওর হাত-পা যেন অনেক বড় বড় হয়ে গেছে, শরীর থেকে খুলে বেরিয়ে যেতে চায়। সমস্ত শরীরে যেন কাটা ফুটছে, সেই সাথে কুলকুল করে ঘামছে সে। প্রচণ্ড গরমে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়, জোরে জোরে শ্বাস নিতে থাকে রুমী, তবু কিছুতেই যেন ও বুক ভরে শ্বাস নিতে পারে না। মুখ খুলে গিয়ে দাঁত বের হয়ে পড়ে হাসির ভঙ্গিতে, চোখ বড় বড় করে তাকায়। মাথাটা ঘুরে যেতে থাকে অদ্ভুতভাবে কখনো ডান দিকে, কখনো বাম দিকে-চেষ্টা করেও সোজা রাখতে পারে না। ঢাকের শব্দ দ্রুত লয়ে বেজে চলেছে, ওকে ঘিরে সবাই পাগলের মতো নাচছে, মুখে চিৎকার করে বলছে, আয়-আয়-আয়রে! আয়-আয়-আয়রে!!
রুমীর ভিতরে বহুদূর থেকে কে যেন বলতে থাকে, আসছি! ওর চেতনা আস্তে আস্তে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। মোমবাতির আলোতে আদিম উল্লাসে নৃত্যরত উলঙ্গ নর-নারী ওর চোখের সামনে আবছা হয়ে মিলিয়ে যেতে থাকে। কুৎসিত একটা মুখ সে দেখতে পায়, বীভৎস তার চেহারা। সে মানুষ নয় কিন্তু মানুষের মতো, সে কোনো পশু নয় কিন্তু পশুর মতো। লাল সরু একটা জিব একবার বের হচ্ছে একবার বড় মুখের ভিতর ঢুকে যাচ্ছে। চোখ দুটি নির্বোধ ছাগলের চোখের মতো নিষ্প্রভ, একদৃষ্টে যে রুমীর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ভয় পেল রুমী, ভয়, প্রচণ্ড ভয়। এ ভয়ের কোনো সীমা নেই, শেষ নেই। জীবন শেষ হয়ে গেলেও এই ভয় রক্তের মাঝে রয়ে যায়, যুগ যুগ ধরে রক্তের ভেতর দিয়ে এই ভয় বংশধরের মাঝে সঞ্চারিত হয়ে যায়।
চিৎকার করে ওঠে রুমী, যত জোরে সম্ভব, ওর গলার শিরা বুঝি ছিঁড়ে যাবে, তবু থামতে পারে না সে।
কানের কাছে কে যেন বলল, লুসিফার! লুসিফার!!
আর কিছু মনে নেই রুমীর।
ভাগ্যিস মনে নেই। অন্য সবকিছু ছেড়ে দিলেও চৌদ্দ মাসের যে শিশুটিকে নিজের বাবা-মায়ের হাতে এক অন্ধকার জগতের উপাসনায় প্রাণ দিতে হলো সে ঘটনাটি নিজের চোখে দেখতে হলো রুমী কোনোদিন জানতেও পারবে না শিশুটির রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে সে যখন খনখনে গলায় অট্টহাসি দিয়ে উঠেছিল, শয়তানের উপাসক ওই বারোজন নর-নারী পর্যন্ত আতঙ্কে শিউরে উঠেছিল। কিন্তু রুমীর কিছু মনে নেই।
.
রুমীর খুব ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে এসেছে। ওর নিজেকে প্রচণ্ড জ্বরে বিকারগ্রস্তের মতো মনে হচ্ছিল। অনেকক্ষণ লাগল ওর সবকিছু মনে করতে। ওর ইচ্ছে করছিল আবার অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু বুকের ভিতর কে যেন তাকে জোর করে জাগিয়ে রাখল। বারবার কে যেন মনে করিয়ে দিতে থাকে : ওকে বাঁচতে হবে, আর বাঁচতে হলে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে। বারবার ওর বোধশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছিল, যা হয় হোক, এ ধরনের একটা অনুভূতি ওকে দখল করে নিতে চাইছিল, কিন্তু জোর করে সে নিজেকে জাগিয়ে রাখল। সাবধানে চোখ খুলে তাকিয়ে পরিবেশটা বুঝতে চেষ্টা করল সে।
একটা বিছানায় শুয়ে আছে রুমী। ও একা নয়, ওকে জড়িয়ে ধরে ওর পাশে আরও কেউ শুয়ে আছে, ওর বুকের ওপর তার একটা হাত। সাবধানে সে হাতটা সরিয়ে দিয়ে মানুষটাকে দেখতে চেষ্টা করে, অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু রুমী বুঝতে পারে: একটি মেয়ে। রুমী আস্তে আস্তে উঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রচণ্ড ব্যথায় ওর মাথাটা ছিঁড়ে পড়তে চাইল। শব্দ করবে না করবে না করেও গলা দিয়ে ব্যথার একটা আর্তধ্বনি বের হয়ে গেল। পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটি ঘুমের ঘোরে কি একটা বলে আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে, গলার স্বরে মেয়েটিকে চিনতে পারে রুমী, ইভা। কিন্তু এ নিয়ে রুমীর এখন বিস্মিত হওয়ার মতো অবস্থা নেই। সাবধানে সে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ায়, মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো অবস্থা তার, কোনোমতে একটু স্থির হয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়, অন্ধকারেও জায়গাটি বেশ বোঝা যাচ্ছে। শব্দ না করে ছিটকিনি খুলে সে বের হয়ে আসে, একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ওর সারা শরীর জুড়িয়ে দেয় সাথে সাথে। বাইরে অন্ধকার রাত, পরিষ্কার আকাশে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্র ঝক্ঝক্ করছে। সপ্তর্ষিমণ্ডল অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে। ও নক্ষত্র চেনে না, চিনলে বলতে পারতো এখন ভোর রাত চারটা। রুমী সাবধানে বারান্দা দিয়ে হেঁটে উঠানে নেমে পড়ে। ঘেউ ঘেউ করে একটা কুকুর ডেকে উঠল কোথাও, রুমী ভ্রূক্ষেপ না করে দৌড়ানোর চেষ্টা করে। একটা বিরাট মাঠের মতো ফাঁকা জায়গা, দূরে উঁচু সড়ক আবছা বোঝা যায়। রুমী সেদিকে ছুটতে থাকে। খালি পায়ে হাঁটার অভ্যাস নেই অনেকদিন, লম্বা আলখাল্লা পায়ে জড়িয়ে যায়, প্রতি পদক্ষেপে ওর মাথা প্রচণ্ড ব্যথায় শরীর থেকে ছিঁড়ে পড়তে চায়, কিন্তু রুমীর কিছু করার নেই। দাঁতে দাঁত চেপে হাঁটতে থাকে ও। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর এখান থেকে সরে পড়তে হবে। মাঠটা পার হয়ে উঁচু সড়কে উঠে ও পেছন ফিরে তাকায়, দূরে ওই ভুতুড়ে বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, লম্বা দুটি তালগাছ বাড়ির পেছনে, এখান থেকে আবছা আবছা দেখা যায়। জায়গাটা চিনে রাখতে পারলে হতো, কিন্তু রুমীর এখন থামার সাহস নেই। সে রাস্তা ধরে ছুটতে থাকে, চেষ্টা করে মনে রাখতে রাস্তায় কি পড়ছে। কোনো লোকালয় নেই, একটা গোরস্তান, বহুদূর ফাঁকা রাস্তা তারপর একটা বড় বটগাছ আবার ফাঁকা রাস্তা, রুমী প্রাণপণে ছুটতে থাকে। ওর গায়ে জোর নেই, পা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে, ঘামে সারা শরীর ভিজে গেছে, প্রচণ্ড ব্যথায় মাথা ছিঁড়ে পড়তে চাচ্ছে কিন্তু তবু সে থামে না, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালাতে পারলে বাঁচে।
স্থানীয় থানায় পৌঁছাল রুমী ঘণ্টাখানেক পরে। পথে ছোট একটা দোকান পেয়ে সে দোকানিকে ডেকে তুলেছে। দোকানি দরজার ফাঁক দিয়ে ওকে এই অদ্ভুত পোশাকে এরকম অবস্থায় দেখে প্রথমে কিছুতেই ঝাঁপ খুলতে চায় না। রুমী অনেক কষ্ট করে বুঝিয়েছে নিজের অবস্থা, তখন দোকানি পৌঁছে দিয়েছে ওকে থানায়। থানার বৃদ্ধ এসআই কিছুতেই রুমীর কথা বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না। চোখ লাল, কথাবার্তা অসংলগ্ন, শরীর থেকে পরিষ্কার মদের গন্ধ বের হচ্ছে, কম বয়সী নষ্ট হয়ে যাওয়া ছেলে তিনি আগেও অনেক দেখেছেন। এর কথা বিশ্বাস করে এখন কে যাবে ভূতের সাধনা দেখতে? গায়ের লাল রং আর অদ্ভুত আলখাল্লাটি দেখে অবিশ্যি কেমন যেন একটু সন্দেহ হচ্ছিল, কিন্তু তবুও তিনি ভোর পর্যন্ত অপেক্ষা করাই স্থির করলেন। রুমীকে রাতটা লক-আপে রাখতে বলে তিনি গেলেন অজু করতে, ফজরের আজান পড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।
রুমীর কথা পুলিশের বিশ্বাস না হওয়ায় তার খুব আশা ভঙ্গ হলো। এতক্ষণ যে শক্তিটি তাকে চালিয়ে এনেছে সেটি এখন ফুরিয়ে গেছে। বসে থাকার ক্ষমতা নেই। ওকে নিয়ে হাজতে রাখবে রাতটা, কিন্তু তাতে ওর কিছু আসে যায় না। ও লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল একটা বেঞ্চের ওপর। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে, শরীরটা কাঁপছে অল্প অল্প। চোখ ভেঙে ঘুম আসছিল ওর, অচেতন হয়ে পড়ছিল সে। হঠাৎ রুমীর চোখ বিস্ফারিত হয়ে খুলে যায়-ও স্পষ্ট দেখতে পায় সেই বীভৎস কুৎসতি মুখটি ওর মুখের ওপর ঝুঁকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে, লাল জিবটি বারবার লক লক করে বের হয়ে আসছে মুখ থেকে। ছাগলের চোখের মতো দুটি স্থির চোখ সোজা ওর দিকে তাকিয়ে রুমীর সারা শরীর কুঁকড়ে গেল ভয়ে, চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে উঠল সে, অমানুষিক সে চিৎকার। চিৎকার বন্ধ করতে পারে না রুমী, দম বন্ধ হয়ে আসতে চায় ওর, একসময় গলগল করে রক্ত বের হয়ে আসে ওর গলা দিয়ে। বেঞ্চ থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায় সে, প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকে বেঞ্চের তলায় অন্ধকারে ঢুকে পড়তে।
বৃদ্ধ এসআই অজু শেষ না করেই ছুটে এলেন ভিতরে, রুমীর ওপর ঝুঁকে পড়ে ভয় পাওয়া গলায় ডাকলেন তাকে, এই ছেলে, এই ছেলে কি হয়েছে তোমার? আস্তে আস্তে রুমীর সারা শরীর শিথিল হয়ে আসে, সে মেঝেতে লম্বা হয়ে পড়ে থাকে স্থির হয়ে। বৃদ্ধ এসআই ওকে টেনে বের করলেন বেঞ্চের তলা থেকে, মাথাটা ঘুরে গেছে অদ্ভুতভাবে, টেনে সোজা করার চেষ্টা করলেন তিনি। আস্তে আস্তে চোখ খুলে গেল রুমীর, আশ্চর্য স্থির একটা দৃষ্টি তার চোখে। সে দৃষ্টি বৃদ্ধ এসআইয়ের চোখের ভিতর দিয়ে ঢুকে তার হৃৎপিণ্ড যেন টেনে-হিঁড়ে বাইরে নিয়ে এলো। আতঙ্কে শিউরে উঠে লাফিয়ে পিছিয়ে গেলেন তিনি ইয়া আল্লাহ! কঁপা গলায় আয়তুল কুরসি পড়তে লাগলেন বুকে হাত দিয়ে খন্ খন গলায় অট্টহাসি হেসে ওঠে রুমী, ওর গলা দিয়ে রক্ত বের হয়ে আসে আবার। বৃদ্ধ এসআইয়ের মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের একটা শীতল স্রোত নেমে গেল, হাত বাড়িয়ে একটা টেবিল ধরে কোনোমতে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, ইদরিস মিয়া তাড়াতাড়ি দশজনকে বলো রাইফেল নিয়ে তৈরি হতে। ড্রাইভারকে ডেকে তোলো-জলদি!
থানার মেঝেতে শুয়ে অট্টহাসি হাসতে থাকে রুমী, কেউ কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। হাসপাতালে খবর দেওয়া হয়েছে, লোকজন ওকে নিতে আসছে। বৃদ্ধ এসআই দশজন সশস্ত্র পুলিশকে পুরোনো একটা জিপে গাদাগাদি করে তুলে সেই ভুতুড়ে বাড়িটি ঘিরে ফেললেন ভোর রাতেই। ফজরের নামাজ কাজা হয়ে গেল তার বহুদিন পর।
পাঁচ
কিবরিয়া ভাইয়ের অনেক বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা অভ্যাস, তাই সাতসকালে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে খুব বিরক্ত হলেন তিনি। নিশ্চয়ই খবরের কাগজের ছেলেটা টাকা নিতে এসেছে, খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন চলে যাবে ভেবে, কিন্তু চলে যাবার কোনো লক্ষণ নেই, কড়া নাড়া বন্ধ হয়ে বরং দরজায় লাথি মারার মতো শব্দ হতে থাকে। বাধ্য হয়ে বিছানা থেকে উঠে চোখ মুছতে মুছতে দরজা খুলতেই তার খাবি খাবার মতো অবস্থা! বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, আপনার নাম কিবরিয়া চৌধুরী? টোক গিলে কঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি, কি হয়েছে?
হুঁ। আমার সাথে যেতে হবে আপনাকে, চলুন। পুলিশটি পারলে তাঁকে সেভাবেই নিয়ে যায়।
কিবরিয়া ভাই মিনমিন করে বললেন, একটু বাথরুম থেকে… তাড়াতাড়ি… পুলিশটা প্রায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে।
বাথরুমের দরজা বন্ধ করে কিবরিয়া ভাই জানালা গলে পালিয়ে যাবেন কি না ভাবলেন। নিশ্চয়ই তাঁর ইদানীংকার রাজনীতি নিয়ে একটা কিছু হয়েছে। কেন মরতে ওই সব উগ্র বামপন্থি রাজনৈতিক নেতাদের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলেন, রাগে-দুঃখে তার হাত কামড়াতে ইচ্ছে করে।
এমনিতে তার কোষ্ঠকাঠিন্যের দোষ, প্রতিদিন বাথরুমে পাকা এক ঘণ্টা সময় লেগে যায়। ভয়ের চোটে আজ পাঁচ মিনিটেই সব সমাধান হয়ে গেল। যত্ন করে দাড়ি কামিয়ে একেবারে সুট-টাই পরে নিলেন। ভালো কাপড় পরা থাকলে লোকজন ভালো ব্যবহার করে, সমাজব্যবস্থার এই জঘন্য প্রচলিত নিয়ম মানতে আজ তাঁর। এতটুকু দ্বিধা হলো না।
তাঁর চকচকে পোশাক দেখে সত্যি সত্যি পুলিশটা পঁড়িয়ে পড়ে, ভদ্রভাবে বলে, চলুন স্যার, বাইরে জিপ আছে।
জিপে ওঠার সময় কিবরিয়া ভাই দেখলেন আশেপাশে লোকজন উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করেছে-বাড়িওয়ালা আবার একটা ঝামেলা না বাধিয়ে ছাড়বে না।
কিবরিয়া ভাইকে থানায় না নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের তিন তলা একটা কেবিনে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে পুলিশ পাহারা, ভিতরে বেশ কজন ডাক্তার, পুলিশের বড় বড় অফিসার। কিবরিয়া ভাইকে দেখে একজন এগিয়ে এলো, আপনি কিবরিয়া চৌধুরী?
জি।
একে চেনেন আপনি?
কিবরিয়া ভাই দেখলেন বিছানায় অচেতন হয়ে পড়ে আছে রুমী। মাথায় ব্যান্ডেজ, নাকে অক্সিজেন টিউব, হাতে স্যালাইন, বুকে-হাতে-কপালে নানা ধরনের মনিটর, দেখে বোঝা যায় না আদৌ বেঁচে আছে কি না।
চেনেন একে?
চেনেন বলে কি বিপদে পড়বেন কে জানে, মিথ্যা বললে বিপদ হয়তো আরও বেড়ে যাবে। দুর্বল গলায় আমতা আমতা করে বললেন, হ্যাঁ চিনি। কেন?
পুলিশ অফিসারটি সংক্ষেপে তাকে পুরো ব্যাপারটি খুলে বলতেই মুহূর্তে তিনি সাহস ফিরে পেলেন। সেই ভুতুড়ে বাড়িতে রুমীর ব্যাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির একটা বই পাওয়া গেছে, লাইব্রেরিতে খোঁজ করে দেখা গেছে এটি কিবরিয়া ভাই নিয়েছেন। সে রাতের পর রুমীর আর জ্ঞান ফেরে নি, তাই তার পরিচয় জানার জন্যে কিবরিয়া ভাইকে আনা হয়েছে। রুমীকে যখন ঢাকায় আনা হয় তখন তার মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, নিউরো সার্জনরা ছয় ঘণ্টা অপারেশন করেছেন, তারা বলেছেন এ যাত্রা সে বেঁচেও যেতে পারে। পাঁচ দিন হয়ে গেছে এখনো জ্ঞান ফেরে নি, আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে হবে। কিবরিয়া ভাই রুমীর আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়ার ভার নিলেন। পুলিশ অফিসারটি তাঁকে অনুরোধ করলেন ব্যাপারটি গোপন রাখতে, খবরের কাগজে পর্যন্ত ঘটনাটি ছাপতে দেওয়া হয় নি।
রুমীর জ্ঞান ফিরল কুড়ি দিন পর। এই কুড়ি দিন কিবরিয়া ভাই প্রেতচর্চা এবং ব্ল্যাক আর্ট সম্পর্কে দেশি-বিদেশি যতগুলি বই পেয়েছেন সব পড়ে ফেলেছেন। যত পড়েছেন তত তিনি অবাক হয়েছেন এই বিংশ শতাব্দীতেও যে ধরনের ব্যাপারটা ঘটতে পারে তিনি নিজের চোখে রুমীর অবস্থা না দেখলে বিশ্বাস করতেন না। রুমীর জ্ঞান না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকদিন তিনি ওকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছেন, শেষের দিকে ডাক্তাররা সন্দেহ করছিলেন রুমীর জ্ঞান হয়তো আর নাও ফিরে আসতে পারে, এভাবেই অনির্দিষ্টকাল অচেতন হয়ে থাকবে। তাই যেদিন রুমীর জ্ঞান ফিরে এলো সেদিন কিবরিয়া ভাইয়ের আনন্দের সীমা ছিল না, পরিচিতদের ভিতর রুমীর জন্যেই তাঁর খানিকটা স্নেহ রয়েছে।
জ্ঞান ফিরে আসার পর রুমীর মুখে পুরো ঘটনা শুনে তিনি প্রেত উপাসকদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে উঠলেন। তিনি নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করেন কাজেই ঈশ্বর বা শয়তান যাকে খুশি প্রভু হিসেবে দাবি করায় তার কিছু আসে যায় না, কিন্তু উপাসনার নামে নিষ্পাপ শিশুদের হত্যা করা বা নিরীহ ছেলেদের মেরে ফেলার আয়োজন করাটা মেনে নেওয়া যায় না। ওদের প্রত্যেককে ফাঁসিতে ঝোলানো পর্যন্ত তিনি শান্তি পাবেন বলে মনে হয় না। তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে ওদের বিচারের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রেত উপাসকদের কোনো বিচার হলো না। রুমী হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার আগেই প্রেত উপাসকের দল ছাড়া পেয়ে গা ঢাকা দিল, কেন এমন হলো ঠিক জানা গেল না। কিবরিয়া ভাই অনেক চেষ্টা করে শুধু জানতে পারলেন, দেশের খুব একজন বড় হর্তাকর্তার ছেলে প্রেত উপাসকদের সাথে ধরা পড়েছিল, পুরো ব্যাপারটি তাই এত তাড়াহুড়া করে চাপা দেওয়া হয়েছে। ছেলেটিকে পরদিনই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, সে এখন ইংল্যান্ড না আমেরিকা কোথায় যেন আছে। দণ্ডমুণ্ডের মালিক একেবারে পাষণ্ড নন, রুমীর যেন ভালো চিকিৎসা হয়, এবং চিকিৎসার সব খরচ যেন সরকার বহন করে তার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এটুকু না করলেও চলতো, কারণ কিবরিয়া ভাই খোঁজ নিয়ে জেনেছেন প্রেত উপাসকের বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই, রুমীর একার বক্তব্য ধোপে টিকবে না। সাক্ষী-প্রমাণ বের করার দায়িত্ব পুলিশের কিন্তু পুলিশ এ ব্যাপারে আঙুলও নাড়াবে না, বলা যেতে পারে নাড়াতে পারবে না।
পরের কয়দিন কিবরিয়া ভাই আগুন খেয়ে অঙ্গার বাহ্যি করার যন্ত্রণা বয়ে বেড়ালেন।
***
রুমী অনেক পাল্টে গেছে। তার মস্তিষ্কের অপারেশনের পর অনেক কিছু সে একেবারে ভুলে গেছে, মাঝে মাঝে অনেক ছোটখাটো ব্যাপার চট করে মনে করতে পারে না। একটু বেশি রাত জাগলে কিংবা কোনো ব্যাপারে একটু বেশি চাপ পড়লেই তার মাথায় প্রচণ্ড যন্ত্রণা হতে থাকে, কোনো পেনকিলার দিয়ে সেটা বন্ধ করা যায় না। ডাক্তার বলেছেন আস্তে আস্তে নাকি সেরে যাবে। আজকাল সে একটু ভীতু হয়ে গেছে, একা ঘরে ঘুমোতে ভয় পায়।
সে আর কাউকে তার সে রাত্রির অভিজ্ঞতা খুলে বলে নি। পুরো ব্যাপারটি খুঁটিনাটিসহ ডাক্তার এবং পুলিশ ছাড়া শুধু কিবরিয়া ভাই শুনেছেন। ডাক্তার এবং কিবরিয়া ভাই দুজনেই তাকে বুঝিয়েছেন যে প্রেত বা শয়তান সবকিছু বাজে কথা, তার পুরো অভিজ্ঞতার মূলে রয়েছে কয়টি মারাত্মক ড্রাগ। তার রক্তে নাকি কোকেন পাওয়া গিয়েছিল। তাকে যে পরিমাণ ড্রাগ দেওয়া হয়েছিল তাতে তার মস্তিষ্ক পাকাপাকিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারতো। কেন হয় নি সেটা একটা বিস্ময়। হতে পারে সে বুকে পিঠে কপালে মাখন লাগিয়ে নিজেকে খানিকটা রক্ষা করেছে, মদের সাথে মিশিয়ে যা খেতে দিয়েছিল সেটাই সে কম খেয়েছে। ঠিক কি হয়েছে বলা মুশকিল, কিন্তু ডাক্তার বারবার বলেছেন তার ভাগ্য খুবই ভালো।
রুমীও নিজেকে তাই বোঝায়। মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছে সে। সে রাতের পর ওই কুৎসিত মুখটিকে লক্ লকে জিব বের করে এগিয়ে আসতে দেখে নি। অনেক কিছু ভুলে গেছে সে, কেন ওই মুখটিও ভুলে গেল না ভেবে ওর খুব দুঃখ হয়। কে জানে ওই মুখ হয়তো ভোলা যায় না, ওর স্মৃতি হয়তো রক্তে মিশে থাকে যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকার জন্যে।
.
ঠিক রুমীর গাঘেঁষে একটা গাড়ি এসে থামে। এ ধরনের ব্যাপার ওর আগে ঘটেছে, কিন্তু রুমী কিছুতেই মনে করতে পারে না কবে কোথায় কীভাবে। গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে একটা মেয়ে ওকে ডাকে, রুমী।
সাথে সাথে রুমীর সব মনে পড়ে যায়, ইভা! রুমীর বুক ধক্। করে ওঠে। পালিয়ে যাবে সে? কিন্তু কোথায় পালাবে?
রুমী।
রুমী ইভার দিকে তাকায়, হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। এই প্রকাশ্য দিনের বেলায় কি করবে ইভা? গাড়িতে আর কেউ নেই, রুমী একটু এগিয়ে যায়, কি?
কেমন আছ?
ন্যাড়া মাথায় গজানো অল্প অল্প চুল মস্তিষ্কের সেই অপারেশনের দাগ এখনো ঢাকতে পারে নি, আর তাকে কি না জিজ্ঞেস করছে সে কেমন আছো রুমীর ইচ্ছে হলো সে শব্দ করে হেসে ওঠে, কিন্তু ওর হাসি আসতে চায় না। অবাক হয়ে সে ইভার দিকে তাকিয়ে থাকে, এ কি মানবী?
আমি কাল চলে যাচ্ছি। নিউ ইয়র্কেরুমী চুপ করে তাকিয়ে থাকে, এত সুন্দর একটা মুখ, অথচ…
ভয় নেই, আমি আর আসব না। মিষ্টি করে হেসে খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলে ওঠে, জানো? আমার বাচ্চা হবে?
রুমীর কি আসে যায় তাতে? ওকে বলছে কেন?
বাচ্চার বাবা কে জানো?
চমকে ওঠে রুমী কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে কে?
লুসিফার! লুসিফার আর তুমি! খিলখিল করে হেসে ওঠে ইভা। হাসি আর থামতে চায় না কিছুতেই। হাসতে হাসতেই হাত নেড়ে গাড়ি ছেড়ে দেয় ইভা, রাজারবাগের মোড়ে ডান দিকে ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যায়।
রাস্তার ধারে অনেকক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে রইল রুমী, নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেছে মেয়েটা, নিশ্চিয়ই মিথ্যা বলেছে! রুমীর বিশ্বাস হয় না। ওটা মেয়ে নয় ওটা রাক্ষুসী, ও সব পারে। আবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করতে হবে কেন এরকম বলল।
কিন্তু রুমীর সাথে ইভার আর কোনোদিন দেখা হয় নি।
দ্বিতীয় অংশ–দুঃস্বপ্ন
ছয়
প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে রুমীর সাথে কাজ করে আরিফ, হালকা-পাতলা সুদর্শন একটা ছেলে। ভারি হাসি-খুশি ছেলে আরিফ, সব সময়েই একটা না একটা কিছু নিয়ে হৈচৈ করছে। পড়াশোনায় খুব মন নেই, সব সময়েই বলছে এ দেশে আর থাকবে, কি আছে এই পোড়া দেশে? আমেরিকান, ব্রিটিশ এবং আরও সব বিদেশি কাউন্সিলে ঘোরাঘুরি করে, বিভিন্ন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে চিঠি লিখে বেড়ায়। একবার বিদেশে পৌঁছতে পারলে নাকি বাসন মেজেই অবস্থার পরিবর্তন করে ফেলবে। খুব বড়লোকের ছেলে, “পোড়া দেশের কোনো দুঃখ-কষ্টই কখনো তাকে স্পর্শ করে না, তবু কেন বিদেশে গিয়ে বাসন মাজার এত আগ্রহ আজকাল রুমী খানিকটা বুঝতে পারে। জন্ম হবার পর থেকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন এমন কি এ দেশের পত্রপত্রিকাতেও শুধু বিদেশের প্রশংসাই শুনে এসেছে, ওর দোষ কি? ওদের শুধু এ দেশে জন্ম, কিন্তু ওরা এ দেশের মানুষ নয়।
এ সপ্তাহের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে রুমীদের হিলিয়াম গ্যাসের স্পেকট্রাম বের করার কথা। হিলিয়াম গ্যাস ভরা ডিসচার্জ টিউবের দুই মাথায় ইনডাকশন কয়েল দিয়ে কয়েক হাজার ভোল্ট দিতে হয়, একটু সাবধানে কাজ করার কথা, হঠাৎ ছুঁয়ে ফেললে প্রচণ্ড শ লাগে, কারেন্ট কম বলে আর কিছু হয় না। রুমী সুইচ অফ করে তার দুটি লাগাচ্ছিল, হঠাৎ তার স্পষ্ট মনে হলো আরিফ মনে মনে বলছে, দেই শালাকে একটা শ! এত স্পষ্ট মনে মনে কথাটি শুনল যে রুমী অবাক হয়ে ঘুরে আরিফের দিকে তাকায়, আর আরিফ সত্যি সত্যি সেই মুহূর্তে ইনডাকশন কয়েলটির সুইচ অন্ করেছে।
প্রচণ্ড একটা ইলেকট্রিক শক খেল রুমী। যদিও আরিফ বারবার বলল সে খুব দুঃখিত, ভুলে সুইচটা অন করে ফেলেছে, কিন্তু রুমী ঠিক জানে কাজটা সে ইচ্ছা করে করেছে। আরিফের ওপর ঘেন্না ধরে গেল তার।
কিন্তু কীভাবে শুনল সে আরিফের মনের কথাটা? রুমী এত অবাক হলো যে বলার নয়।
.
সন্ধ্যার পর রিকশা করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ফিরে আসছিল রুমী। অনেকদিন অপেক্ষা করে একটা আবাসিক জায়গা পেয়ে সে তার ফুফুর বাসা ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল ছুটিতে রোববার বেড়াতে যায়, ফুফু গাল ফুলিয়ে বলেন ভুলেই গেলি আমাদের? বিপদের সময় তো আমিই জায়গা দিয়েছিলাম ইত্যাদি ইত্যাদি। নির্বোধ মহিলা, রুমী কিছু মনে করে না।
বুড়ো রিকশাওয়ালার রিকশাটা টেনে নিতে জোর পরিশ্রম হচ্ছে। রিকশার বেল কাজ করছে না। তাই ছোট একটা লোহার শিক দিয়ে ঠুন ঠুন করে বেলটা ঠুকছে একটু পর পর। রুমীর একটু মায়া হলো বুড়ো রিকশাওয়ালার ওপর। কে যেন বলেছিল রিকশাওয়ালারা নাকি একজন কেরানির চেয়ে বেশি টাকা উপার্জন করে। যে কষ্টটুকু করতে হয় ওদের, তাতে প্রফেসরের থেকেও বেশি টাকা উপার্জন করা উচিত। পৃথিবীটা বড় একচোখা, কাউকে বেঁচে থাকার জন্যে এত কষ্ট করতে হয়, আবার কেউ..
রুমীর চিন্তার স্রোত হঠাৎ থেমে গেল পেছন থেকে একটা গাড়ি ক্রমাগত হর্ন দিয়ে যাচ্ছে, খুব তাড়া নিশ্চয়ই। রিকশাওয়ালা জায়গা দিতে পাশে সরতে পারছে না। পাশে কাদা জমে আছে, একবার চাকা আটকে গেলে টেনে নিতে জান বেরিয়ে যাবে।
বাস্টার্ড! রুমী হঠাৎ পরিষ্কার শুনল পেছনে গাড়ির লোকটি মনে মনে রিকশাওয়ালাকে গালি দিচ্ছে। ড্যাম রিকশাওয়ালা… এমন একটা কুৎসিত ইংরেজি শব্দ, বাংলায় এর ভালো প্রতিশব্দ পর্যন্ত নেই। রুমী অবাক হয়ে পেছনে তাকায়, হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে গেল ওর, কিছু দেখতে পেল না।
হারামজাদা–হাঠাৎ চমকে ওঠে রুমী, শালা তোমাকে দেখাচ্ছি মজা, এক ধাক্কায় যদি তোমার বাপের নাম না ভোলাই!
কিছু বোঝার আগে পাশ থেকে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে রুমী রিকশা থেকে ছিটকে পড়ল মাটিতে, রিকশাওয়ালাকে নিয়ে রিকশা আরও সামনে কাত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে অনেক লোক জমা হয়ে গেল ওদের ঘিরে। রিকশার বারোটা বেজে গিয়েছে, কিন্তু রিকশাওয়ালার বিশেষ কিছু হয়নি, হাঁটুর ওপর থেকে শুধু খানিকটা ছাল উঠে গেছে। রুমীর হাত-পায়ে সামান্য কাদা লেগেছে কিন্তু কোথাও ব্যথা পায় নি। বুকটা শুধু ধক ধক্ করছে অনেক্ষণ থেকে।
লোকজন গাড়িওয়ালাকে মুখ খারাপ করে গালি দিল, যদি কোনোভাবে ধরতে পারতো পিটিয়ে মেরে ফেলতো। যাদের গাড়ি আর পয়সা আছে আর যাদের গাড়ি বা পয়সা কিছুই নেই, দুই ভিন্ন দল। এক দলের সাথে আরেক দলের সম্পর্ক শুধু পথে-ঘাটে, কারো জন্যে কারো মমতা নেই।
রুমীর পকেটে বেশি টাকা ছিল না, যা ছিল তাই রিকশাওয়ালাকে দিয়ে পুলিশ আসার আগেই সরে এলো। সে থেকে আর কি করবে?
হেঁটে হেঁটে ফিরে এলো রুমী। কিন্তু কি আশ্চর্য! কি পরিষ্কার শুনল সে লোকটির কথা!
এলিফেন্ট রোড ধরে হাঁটছিল রুমী হঠাৎ ভারি অন্যমনস্ক হয়ে গেল সে, আবছা মনে হলো কে জানি বলছে ভাত খাওয়ার পয়সা নেই ওষুধ খাওয়ার শখ! কানে শোনা যায় না, কিন্তু এত
স্পষ্ট শোনার অনুভূতি যে রুমী ভীষণ চমকে ওঠে। একটা ওষুধের দোকানের সামনে দিয়ে হাঁটছে সে, হতে পারে এ দোকান থেকেই কেউ বলেছে। রুমী একটু এগিয়ে যায়। আধময়লা সবুজ শাড়ি পরা রোগা কমবয়সী একটি মেয়ে ওষুধ কিনছে। রুমী শুনতে পেল মেয়েটি বলল, খুব জ্বর পোলাডার। ডাক্তার সাব কইছেন চাইরডা বড়ি খাইলেই জ্বর নাইমা যাইবো।
হুঁ। ওষুধ তো জ্বর নামানোর জন্যেই। রুমী স্পষ্ট শুনল ওষুধের দোকানের লোকটা এ বলেই থেমে গেল না, মনে মনে বলল, লাটসাহেবের পোলা অ্যান্টিবায়োটিক খাবেন!
কি দিয়া খাওয়ামু? পানি দিয়া?
হুঁ। দুইটা বড়ি একবারে।
তয় ডাক্তার যে কইলো একটা কইরা?
মনে মনে অশ্লীল একটা গালি দিল লোকটা। মুখে বলল, একটা করে খাওয়াতে পারো একটু দেরি হবে জ্বর নামতে এই আর কি? দুইটা করে দিলে…
ডাক্তার সাব যে কইলো। ছেডু পোলা একটার বেশি যেন না দেই…
লোকটা আবার মনে মনে বিশ্রী অশ্লীল একটা গালি দেয়। মুখে বলল ডাক্তাররা ওই রকমই বলে। আমি ওষুধ বিক্রি করি আমি জানি না? এরপর মনে মনে যে কথাটি বলল তা শুনে রুমী থ হয়ে যায়, বলল, মাগি তোর এত চিন্তা কি? তোকে টেরামাইসিন কে দিচ্ছে? অ্যাসপিরিন দিচ্ছি, দুটো করেই খাওয়া, বাঁচার হলে এমনি বাঁচবে।
রুমী আরেকটু এগিয়ে যায়। মেয়েটি বলল, কত দাম?
চোদ্দ টাকা।
কিছু কম নেন। গরিব মানুষ, ঠিকা কাম করি।
থামো থামো! টেরামাইসিনের দাম জানো? ষোলটার দাম ষোল টাকা। তোমার কাছে এমনি দুই টাকা কম নিচ্ছি। মনে মনে বলল, নেট লাভ সাড়ে তেরো টাকা, যা মাগি দূর হ, সারাদিন বিক্রি নাই।
রুমী দোকানের ভিতর ঢোকে, মেয়েটি সরে ওকে জায়গা দিল। লোকটা উৎসুক চোখে ওর মুখের দিকে তাকায়, রুমী খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, টেরামাইসিনের বদলে অ্যাসপিরিন দিলেন
কেন?
দাড়িসহ লোকটার চোয়াল ঝুলে পড়ে অদ্ভুত একটা মাছের মতো দেখাতে লাগল, রুমী তার জীবনে কোনো মানুষকে এত অবাক হতে দেখে নি। লোকটা প্রাণপণ চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর জন্যে।
নেট লাভ সাড়ে তোরো টাকা, না?
আমি… আমি… আমি… লোকটা খাবি খেতে থাকে।
মেয়েটি হাতে শক্ত করে টাকাগুলি ধরে অবাক হয়ে রুমীর দিকে তাকিয়ে ছিল। রুমী বলল, তুমি এসো আমার সাথে, ওষুধ কিনে দিই। এ তোমাকে অন্য ওষুধ দিচ্ছিল।
লোকটার অবস্থা দেখে সন্দেহের অবকাশ নেই, এত হতভম্ব হয়ে গিয়েছে যে প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত নেই। রুমী প্রেসক্রিপশনটি নিয়ে মেয়েটির হাতে দেয়।
কি চোরা, কি সর্বনাইশা চোরা, আবার দাড়ি রাখছে হারামির বাচ্চায় মেয়েটি সরু গলায় চিৎকার করে লোকটিকে গালি দিতে শুরু করে, অসুস্থ সন্তানের কথা চিন্তা করে মেয়েটির রাগ কিছুতেই কমতে চায় না। রুমী অনেক কষ্টে মেয়েটিকে শান্ত করে, এখন সে লোকজনের ভিড় জমাতে চায় না। অন্য একটি দোকান থেকে সে ঠিক ওষুধ কিনে দিয়ে মেয়েটিকে বিদায় করল।
মেয়েটি যাবার সময় বারবার বলল, সে আল্লাহর কাছে তার জন্যে দোয়া করবে, তার ভালো হবে, গরিবের দোয়া নাকি বৃথা যায় না।
.
ছটফট্ করে ঘুরে বেড়ায় রুমী, হঠাৎ সে প্রায়ই আজকাল এর ওর মনের কথা শুনে ফেলছে। ভালো ভালো সব লোকজন কি ভয়ানক সব কথা বলে, মনে মনে সে অবাক হয়ে যায় শুনে। কাউকে সে বিশ্বাস করে না আজকাল, পৃথিবীতে ভালো লোক নেই একটিও, সব ভণ্ড। খ্যাপার মতো হয়ে যাচ্ছিল রুমী, কোনো কিছুতে শান্তি নেই ওর। লোকজনের মনের কথা শোনার ওপর তার নিজের কোনো হাত নেই, তাহলে সে কখনোই কিছু শোনার চেষ্টা করতো না। আজকাল সে একটু আগে থেকে বুঝতে পারে কিছু একটা শুনবে, সেজন্যে ভারি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সে, কোনোকিছু ঠিক করে ভাবতে পারে না, অনেকটা ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগের অবস্থা। তার মাঝে হঠাৎ করে সে শুনতে পায় কথাটা, যেন সে নিজেই বলে ওঠে মনে মনে। সে যেন আর রুমী থাকে না, অন্য একজন হয়ে যায়। তার মতো করে কথা বলে, তার মতো করে চিন্তা করে। একদিন কি ভয়ানক ইচ্ছা করছিল একজনকে ধাক্কা মেরে ট্রাকের সামনে ফেলে দিতে। শেষ পর্যন্ত দেয় নি, হয়তো ঠিক সুযোগটা পায় নি বলে। সে নিজে তখন একটা রেস্টুরেন্টে বসে চা খাচ্ছে বন্ধুদের সাথে। হঠাৎ করে আবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায় একটি বৃদ্ধ লোকের মুখ, অনাহারে দুঃখে কষ্টে শীর্ণ হয়ে আছে। দেখে ওর কোনো করুণা হয় না, উল্টে প্রচণ্ড রাগ ফুঁসে উঠতে থাকে, হারামির বাচ্চা দুনিয়াটা নোংরা করে ফেললি তোরা-দেই শালাকে ধাক্কা মেরে ট্রাকের নিচে ফেলে। রুমী হঠাৎ একটা ট্রাকের শব্দ শুনতে পায়। দেই শালাকে ফেলে, দেই ফেলে…দেই ফেলে…
হঠাৎ করে রুমী সম্বিৎ ফিরে পায়। বন্ধুটি তাকে ডাকছে, কি রুমী, কি হলো তোর?
দরদর করে ঘামছে সে, মুখ-চোখ কাগজের মতো ফ্যাকাশে। আস্তে আস্তে বলল, না, হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল কেমন!
ব্লাড প্রেশার। বন্ধুটির অভিমত দিতে এক মুহূর্ত দেরি হয় না, কান আর কপালে গরম লাগতে থাকে না?
হুঁ, অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ে রুমী।
মনে হয় না কেমন চেপে ধরে আছে?
হুঁ।
ব্লাড প্রেশার, পরিষ্কার ব্লাড প্রেশার। লবণ কম করে খাবি। বন্ধুটির বাবা ডাক্তার অথচ তার নিজের ডাক্তারির যন্ত্রণায় কারো দুই দণ্ড সুস্থ হয়ে থাকার উপায় নেই।
রুমী রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়েই বৃদ্ধটিকে দেখতে পায়, ভিক্ষে করছে। শেষ পর্যন্ত ধাক্কা মেরে ফেলেনি তাহলে। রুমী আস্ত এক টাকা লোকটিকে দিয়ে দিল। বৃদ্ধটি হাত তুলে দোয়া করল রুমীকে। রুমী গলা নামিয়ে বলল, রাস্তার এত কাছে দাঁড়াও কেন চাচা? গাড়ি একটা ধাক্কা মারে যদি? ওই পাশে সরে দাঁড়াতে পারো না?
বৃদ্ধটি অপ্রস্তুতভাবে একটু হেসে নির্জীবভাবে বিড়বিড় করে কি যেন বলে একটু সরে দাঁড়াল। ভাগ্যের কাছে কি পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ! হয়তো এর বাবাও ভিক্ষে করেছে, এর ছেলেও তাই করবে।
কথা শোনার সাথে সাথে দেখতে পাওয়াটা আজকাল নতুন শুরু হয়েছে। আগে শুধু আশেপাশের লোকজনের মনের কথা শুনতে পেত, আজকাল অনেক দূরের লোকজনের মনের কথাও শুনতে পায়, কার কথা শুনতে পাচ্ছে জানে না পর্যন্ত। শুধু যে শুনতে পায় তাই নয়, সে নিজে কিছুক্ষণের জন্যে ওই লোকটি হয়ে যায়, তার মতো করে কথা বলে, তার মতো করে ভাবে, এমন কি তার মতো করে দেখে। পরিষ্কার দেখতে পায় কখনো কখনো। হয়তো কারো ভয়ার্ত মুখ, কারো যন্ত্রণাক্লিষ্ট চেহারা, কিন্তু কি হচ্ছে বলতে পারে না। কখনো কখনো সে এমন অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখে যার অর্থ বুঝতে পারে না, মানুষের বা জন্তু-জানোয়ারের আশ্চর্য রূপ, অদ্ভুত সব রং, বিচিত্র রকমের গন্ধ, অর্থহীন নানা শব্দ। রুমীর চেহারা খারাপ হয়ে যেতে থাকে; রাতে ভালো ঘুম হয় না, খেতে পারে না, প্রায়ই হজমের গোলমাল হয়। মেজাজ সব সময় খিটখিটে হয়ে থাকে। সব সময়েই ভেতরে অশান্তি, একটা চাপা ভয়, কখন আবার তাকে কি দেখতে হয়, কি শুনতে হয় যা সে দেখতে চায় না, শুনতেও চায় না। রুমী ঠিক করল, কাউকে এটা বলতে হবে, জিজ্ঞেস করতে হবে কি করা উচিত তার। কে জানে, হয়তো সে পাগলই হয়ে যাচ্ছে।
কিবরিয়া ভাইয়ের বাসায় গিয়ে তাকে পেল না। দরজায় একটা চিঠি লিখে দিয়ে এলো, বিশেষ প্রয়োজনে এসেছিলাম, আপনাকে পেলাম না। কাল আবার আসব, সম্ভব হলে বাসায় থাকবেন।
সময় কাটানোর জন্যে সে তার ফুফুর বাসায় গেল। রাতে খাবার জন্যে জোরাজুরি করায় সে খেয়েই নিল। অনেকক্ষণ থেকেই তার ভেতরে কেমন একটা চাপা অশান্তি এসে ভর করেছে। থেকে থেকে সে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, চোখের সামনে অদ্ভুত অদ্ভুত সব চেহারা ভেসে ওঠে, নারী-পুরুষ-শিশু, সবাই দুঃখে কষ্টে জীর্ণশীর্ণ। হঠাৎ হঠাৎ কে যেন কুৎসিত গালি দিয়ে ওঠে ওর ভেতরে, শুনে সে নিজেই চমকে ওঠে।
হলে ফিরে দরজা বন্ধ করে ঘরের বাতি নিভিয়ে বিছানায় বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল রুমী। পুকুরে আলোর প্রতিফলন পড়ে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। তিরতির করে কাঁপছে নারকেলগাছের পাতা আর কেমন চুপচাপ হয়ে আসছে চারদিক। রুমীর ঘুম ঘুম লাগতে থাকে। কিন্তু ঘুমোতে পারে না। ভেতরে কেমন জানি একটা চাপা উত্তেজনা। জেগে জেগে দুঃস্বপ্ন দেখার। মতো অবস্থা, কিছু একটা হবে এখন, ও বুঝতে পারে; রুমীর স্নায়ু অপেক্ষা করে আছে।
খুব আস্তে আস্তে হলো পুরো ব্যাপারটা। প্রথমে ছাড়াছাড়াভাবে স্বপ্ন দেখার মতো তারপর খুব স্পষ্টভাবে, এত স্পষ্ট যে রুমীর সারা শরীর শিউরে ওঠে।
সে হাঁটাছে, রাস্তার ধারঘেঁষে হাঁটছে অন্ধকারে। অদ্ভুতভাবে হাঁটে সে, ডান পা-টা একটু টেনে টেনে, প্রতি পদক্ষেপে কোমরের কাছাকাছি কোথায় যেন ব্যথা করে ওঠে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে দেখে এদিক-ওদিক। অন্ধকার বাড়ি, বন্ধ দোকানপাট। রাস্তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা পথের লোকজন দেখে বিতৃষ্ণায় ওর ভিতরটা বিষিয়ে ওঠে। অবাক হয়ে রুমী দেখল কি সহজে সে কুৎসিত একটা গালি দিল ওদের।
মন ভালো নেই ওর, প্রচণ্ড রাগ যেন কার ওপরে। ইচ্ছে করে কাউকে লাথি মেরে ফেলে দেয় কোথাও, কারো কুঁটি ছিঁড়ে নিয়ে আসে। তার ওপর কোমরের কাছে সেই ব্যথা, প্রতি পদক্ষেপে ওর সারা শরীর যন্ত্রণায় ককিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে, ভয়াবহ যুক্তিতর্কহীন অন্ধ রাগ। একজন বুড়ো এগিয়ে আসে কোথা থেকে, যেন অন্ধকার কুঁড়ে বের হয়ে এসেছে। ভয়ানক চমকে ওঠে সে, আর রাগটা বেড়ে যায় হাজার গুণ।
বাবা, একটা টাকা দিবেন, বাবা? সারাদিন খাতি পাই নি।
খাওয়াচ্ছি তোকে, দাঁতে দাঁত চিবিয়ে মনে মনে বলল, রুমী, খাওয়াচ্ছি, তোকে এমন খাওয়াব যে আর খেতে চাবি না।
বহুদূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যায়, একটা গাড়ি আসছে, কিসের গাড়ি? রুমীর হৃদস্পন্দন হঠাৎ বেড়ে যায় দশ গুণ।
বৃদ্ধটি আবার হাত পেতে দাঁড়াল। দিবেন, বাবা?
দাঁড়াও। গলার স্বর শুনে রুমী অবাক হয়ে ভাবে কি চমৎকার ভরাট গলার স্বর।
বৃদ্ধটি পঁড়িয়ে থাকে আশা নিয়ে। দূর থেকে গাড়িটা এগিয়ে আসছে আরও কাছে, ইঞ্চিনের শব্দ শোনা যাচ্ছে এখন, ওটা একটা ট্রাক।
বাবা…
এক মিনিট, পকেটে হাত ঢোকায় রুমী। রক্তের কল্লোল শুনতে পায় সে, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে।
ট্রাক আরও কাছে এগিয়ে আসে।
আরও কাছে…
আরও কাছে…
এইবার! প্রচণ্ড ধাক্কায় বৃদ্ধটি ছিটকে গিয়ে পড়ে ট্রাকের সামনে। প্রাণপণে ব্রেক কষার চেষ্টা করে ট্রাক ড্রাইভার, কিন্তু বৃদ্ধটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে প্রায় তিরিশ ফুট দূরে গিয়ে থামে অতিকায় ট্রাক।
ছুট, ছুট, ছুট, প্রাণ নিয়ে ছুট, ধরা পড়ার আগে ছুট। ডান পা-টা টেনে টেনে প্রাণপণে ছুটতে লাগল রুমী। ওই তো যাত্রাবাড়ীর মোড়, সাঁকোটা পার হলেই মিশে যাবে সে ছোট ছোট ঝোঁপঝাড় আর বাড়িঘরের মাঝে। ছুট ছুট ছুট প্রাণপণে ছুট। পেছন ফিরে তাকাল একবার, ট্রাকটা ছেড়ে দিয়েছে, পালিয়ে যাচ্ছে ট্রাক ড্রাইভার।
হা হা করে হেসে উঠল রুমী, পালিয়ে যাচ্ছে সে ভয় পেয়ে। প্রচণ্ড হাসির দমকে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। পা টন্ টন্ করছে ওর, হাঁটু চেপে বসে পড়লো মাটিতে। পেট চেপে হাসতে থাকল বসে বসে, হাসি আর থামানো যায় না-কিছুতেই থামানো যায় না।
প্রচণ্ড আঘাতে যেন ঘুম ভাঙল রুমীর, অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে সে পাগলের মতো হাসছে। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, বুক ধক ধক্ করছে, যেন এখনি ফেটে যাবে, উঠে বসতে গিয়ে ওর মনে হলে ওর মাথা ছিঁড়ে যাবে প্রচণ্ড ব্যথায়। আবার শুয়ে পড়ল রুমী বালিশের তলা থেকে ঘড়ি বের করে দেখল, রাত দেড়টা বাজে।
কি করবে সে? একটা মানুষকে ও খুন হতে দেখল, এখন সে কি করবে?
সি কি খুন করেছে? না, না, কিছুতেই না!
তাহলে ওরকম দেখল কেন? সব নিশ্চয়ই দুঃস্বপ্ন, ভোর হলে দেখবে সব স্বপ্ন।
প্রচণ্ড মাথাব্যথায় রুমী কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে তার বিছানায়।
.
সারারাত ছটফট করে ভোরের আলো ফোঁটার পর রুমী ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা দুপুর হয়ে গেছে। সকালে এর মাঝে দুটি ক্লাস হয়ে গেছে। এমনিতে সে এমন। কিছু নিয়মিত ক্লাসে যাওয়া ছাত্র নয়, তবু আজ ওর যাবার ইচ্ছা ছিল, একটা ভালো বিষয় পড়ানোর কথা। কিন্তু এ নিয়ে তার মাথা ঘামানোর অবসর নেই, প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে, কিন্তু এতক্ষণে কেন্টিনও বন্ধ হয়ে গেছে। রুমী উঠে হাত-মুখ ধুয়ে গতরাতের কথা ভাবল, রাতের অন্ধকারে যে ঘটনাটা এত ভয়াবহ মনে হচ্ছিল দিনের আলোতে সেটাকে অনেক অবাস্তব এমন কি খানিকটা ছেলেমানুষী মনে হতে থাকে। নিশ্চয়ই একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে সে, এ নিয়ে এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। যদিও সে প্রাণপণে ব্যাপারটি উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল, তবু ওর ভেতরে কোথায় জানি খুঁতখুঁত করতে থাকে।
রুমী পাশের একটা রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে রেস্টুরেন্টের খবরের কাগজটি নিয়ে এক কোনায় আরাম করে বসে। মধ্যপ্রাচ্যে আবার নতুন ঝামেলা বেধেছে, ব্যাংককে প্লেন হাউজ্যাক, আফ্রিকাতে খাদ্যাভাব এ ধরনের খবরগুলিতে চোখ বোলাতে বোলাতে রুমী নিজের অগোচরে যাত্রাবাড়ীতে ট্রাক দুর্ঘটনার খবরটি খুঁজতে থাকে। রুমী আগে কখনো লক্ষ করে দেখেনি যে প্রতিদিন অনেক করে মানুষ দুর্ঘটনায় মারা যায়, বেশির ভাগই ট্রাক দুর্ঘটনা। সারা খবরের কাগজ খুঁজেও যাত্রাবাড়ীর ঘটনাটা না পেয়ে রুমী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। রাতের ঘটনা পরদিন ভোরেই কাগজে পাওয়া যায় কি না এ নিয়ে সন্দেহটুকু সে জোর করে সরিয়ে রাখল।
নাস্তা শেষ করে সে চায়ে চুমুক দিয়ে একটা আরামের ভঙ্গি করে চেয়ারে হেলান দিয়ে পকেটে হাত দেয়। সিগারেট খাওয়া আজকাল বেশ রপ্ত হয়ে গেছে, চায়ে চুমুক দিলেই ওর আজকাল সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়ে যায়। খবরের কাগজটি ভাজ করে সরিয়ে রাখতে গিয়ে ওর চোখে পড়ে খবরের কাগজের নিচে ছোট ছোট করে লেখা শেষের খবর-গতরাতে যাত্রাবাড়ীতে এক ট্রাক দুর্ঘটনায় জনৈক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির শোচনীয় মৃত্যু ঘটেছে। শেষ খবর অনুযায়ী ট্রাক ড্রাইভার পলাতক।
রুমী স্তব্ধ হয়ে বসে রইল, হাতের সিগারেটের ছাই লম্বা হয়ে জমে একসময়ে টুক করে ভেঙে ওর কোলের ওপর পড়ে, তবু ওর সিগারেট টানার কথা মনে পড়ে না।
প্রচণ্ড রোদ, গরমের হলকা ছুটছে যেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে রুমী হেঁটে বেড়ায় রাস্তা ধরে। কেমন একটা চাপা অভিমান ওর বুকের ভিতর গুমরে উঠছে। ইচ্ছে করে কোথাও বসে হু হু করে খানিকক্ষণ কেঁদে নেয়। কেন সে এরকম হয়ে পেল, কি দোষ তার? কি করেছে সে? এতটুকু শান্তি নেই ওর ভিতরে। সেই ভয়াবহ রাতে তার ওপর যখন প্রেতের আবির্ভাব হয়েছিল তারপর থেকে সব ওলটপালট হয়ে গেছে। এতদিন সে কিছু বিশ্বাস করে নি, ভেবেছে ডাক্তারের কথাই ঠিক, মারাত্মক যত ওষুধ তাকে ভয়াবহ সব অনুভূতি দিয়েছে। এখন সে আর ডাক্তারের কথা বিশ্বাস করে না। হয়তো সত্যিই তার ওপরে প্রেতের আবির্ভাব হয়েছিল, সে-প্রেত কখনো ফিরে যায় নি, তার ভিতরে রয়ে গেছে। ধীরে ধীরে সে নিজেও এখন প্রেতের মতো হয়ে যাচ্ছে, সব অশুভ ব্যাপার সে দেখতে পায়, শুনতে পায়, বুঝতে পারে। কোনো ভালো জিনিসের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই, সে শেষ হয়ে গেছে।
হাঁটতে হাঁটতে কখন সে রমনা পার্কের কাছে চলে এসেছে। কিছুক্ষণ গাছের ছায়ায় দেয়ালের ওপরে পা ঝুলিয়ে বসে রইল। হঠাৎ হঠাৎ একটু বাতাস এসে ওর সারা শরীর জুড়িয়ে দিচ্ছিল। খানিকক্ষণ একটা সিগারেট খাওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু মুখে কটু স্বাদ, দুই টান দিয়েই সে ওটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ছোট অর্ধোলঙ্গ একটা বাচ্চা ছেলে সেটা তুলে নিয়ে গভীর পরিতৃপ্তির সাথে টানতে টানতে হেঁটে চলে গেল। কতইবা বয়স বাচ্চাটার অথচ এখনই তার কত দায়িত্ব। মাথায় একটা টুকরি, হয়তো পাতা কুড়ায়, হয়তো। কিছু ফেরি করে বেড়ায়। কি একচোখা পৃথিবী, এই বাচ্চাটির এখন মাথায় টুকরি নিয়ে রোদের মাঝে আরেকজনের ফেলে দেওয়া সিগারেট খেয়ে আনন্দ পাবার কথা নয়, স্কুলে বসে পড়ার কথা, দুরন্তপনা করার কথা, মায়ের সাথে মান-অভিমান করার কথা…
রুমী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, তবু তো বাচ্চাটি তার থেকে সুখী! সে তো সিগারেটটা পর্যন্ত খেতে পারল না।
আপনি কীভাবে জানেন?
আমি দে-দেখেছি।
কীভাবে দেখেছেন?
রুমী একটু ভেবে বলল, আমি ওখানে ছিলাম।
রাত কয়টা তখন?
একটা-দেড়টা হবে। এত রাতে ওখানে কি করছিলেন?
রুমী কুলকুল করে ঘামতে থাকে। থানার পাশ দিয়ে আসার সময় হঠাৎ কি ভেবে হুট করে থানার ভিতর ঢুকে পড়ে সে শুধু জানতে চেয়েছিল, যাত্রাবাড়ীর অ্যাকসিডেন্টে ড্রাইভার ধরা পড়েছে কি না। নিরপরাধ ড্রাইভার ধরা পড়লে সে হয়তো নিজে থেকেই বলতো ড্রাইভারের কোনো দোষ নেই। কিন্তু তাকে কিছু না বলে বসিয়ে রেখেছে অনেকক্ষণ, একটু উত্তেজনা লক্ষ করেছে। তারপর মধ্যবয়স্ক একজন তাকে জেরা করতে শুরু করেছেন। রুমী যা জানতো সব বলেছে, শুধু সে যে নিজের ঘরে বসে পুরো ব্যাপারটি ঘটতে দেখেছে সেটা বলে নি, বললে কেউ বিশ্বাস করবে না তাই। পুলিশ অফিসারের ঠিক সেখানেই আপত্তি, এত রাতে ওই রাস্তায় কি করতে গিয়েছিল সে, ঘুরেফিরে শুধু ওই কথাটিই জিজ্ঞেস করছেন। রুমী বলেছে এমনি ওখানে হাঁটছিল, পুলিশ অফিসার সেটা বিশ্বাস করতে চান না।
বলুন কেন গিয়েছিলেন ওখানে।
এমনি হাঁটতে।
এত রাতে?
হ্যাঁ। ঘুম আসছিল না তাই হাঁটতে বের হয়েছিলাম।
হেঁটে যাত্রাবাড়ী গিয়েছেন?
রুমী একটু থতমত খেয়ে বলল, হ্যাঁ।
হেঁটে?
হেঁটে। রুমী বুঝতে পারে আস্তে আস্তে সে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছে। একটি মিথ্যা কথা বললে সেটিকে বাঁচানোর জন্যে আরও দশটি মিথ্যা বলতে হয়। সে মিথ্যা ভালো বলতে পারে না, অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারের নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে বাকি নেই। রুমী কুলকুল করে ঘামতে থাকে।
কটার সময় হল থেকে বের হয়েছেন?
ঠিক জানি না। ঘড়ি দেখি নি।
তবু, আন্দাজ?
সাড়ে বারোটা হবে।
কেউ নিশ্চয়ই দেখেছে আপনাকে বের হতে?
জানি না। রুমী শুকনো গলায় বলল, এত রাতে সবাই শুয়ে পড়ে।
কেউ দেখে নি তাহলে, পুলিশ অফিসার হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে চলে এলেন, যে লোকটি বুড়োটিকে ধাক্কা মেরে ট্রাকের নিচে ফেলেছে তার গলার স্বর কি রকম?
ভরাট স্বর, বেশ ভালো।
তার কথা স্পষ্ট শুনেছেন?
হুঁ।
কি বলেছে সে?
বলেছে, একটু দাঁড়াও তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে পয়সা বের করার ভান করেছে।
কত কাছে থেকে ওর কথা শুনেছেন?
রুমী ঢোঁক গিলে বলল, এই দশ-বারো হাত।
এত দূর থেকে স্পষ্ট শুনেছেন ওর কথা?
তাহলে হয়তো আরও কাছে ছিলাম।
কত কাছে? দেখিয়ে বলুন।
রুমী অনিশ্চিতের মতো একটা দূরত্ব দেখাল, যেটুকু দূর থেকে কথা শোনা সম্ভব।
এত কাছে?
রুমী মাথা নাড়ল।
সে আপনাকে দেখে নি?
পুলিশ অফিসার অনেকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। আস্তে আস্তে একটা সিগারেট ধরিয়ে অন্যমনস্কভাবে টানতে থাকেন। একসময় সিগারেট নামিয়ে ঘুরে ওর দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, কেন মিথ্যে কথা বলছেন?
.
রুমী ভীষণ চমকে ওঠে, কিন্তু কি বলবে বুঝতে পারে না। আমতা আমতা করে প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, কিন্তু পুলিশ অফিসার কঠোর স্বরে ওকে থামিয়ে দেন, ট্রাক ড্রাইভারকে আজ ভোরে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। সে বলেছে, কে একজন ধাক্কা মেরে বুড়োটিকে ট্রাকের নিচে ফেলে দিয়েছে।
রুমী উত্তেজিত হয়ে বলল, বললাম না, আমি বললাম না…
হাত তুলে থামিয়ে দিলেন ওকে পুলিশ অফিসার, ট্রাক ড্রাইভার বলেছে সে তার হেডলাইটে স্পষ্ট দেখেছে সেই লোকটিকে। একা ছিল সে, ধারে কাছে কেউ ছিল না।
রুমী ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে হঠাৎ বুঝতে পেরেছে পুলিশ অফিসার কি সন্দেহ করছেন। অসহায় ভয়ের একটা শীতল স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে মাথায় উঠে আসতে থাকে। সে শুনতে পায় পুলিশ অফিসার আস্তে আস্তে বলছেন বুড়োটিকে কেন খুন করেছেন?
পুরোপুরি ভেঙে পড়ল রুমী।
.
পরদিন কিবরিয়া ভাই হাজতে রুমীর সাথে দেখা করতে এলেন। এক রাতে তার বয়স দশ বছর বেড়ে গিয়েছে। সারারাত সে ঘুমোতে পারে নি। শক্ত মেঝেতে কুটকুটে কম্বলে গা ঘিনঘিন করা দুর্গন্ধ, ভ্যাপসা গরম, মশা আর ছারপোকার কামড়। হাজতবাসী অন্যদের হাসি-মশকারা সবই সহ্য করা যায়, কিন্তু খুনের অপরাধে তাকে ধরে রাখা হয়েছে এ চিন্তাটি তাকে একেবারে কাবু করে ফেলেছে। রুমী কিবরিয়া ভাইকে নিজের অবস্থাটা বোঝানোর চেষ্টা করল। কিবরিয়া ভাই গুম হয়ে শুনলেন, তবে কোনো কথা বিশ্বাস করলেন বলে মনে হলো না। রুমী খুন করেছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়, কিন্তু একেবারে বিনা কারণে পুলিশ তাকে অ্যারেস্ট করবে কেন? কিবরিয়া ভাই বেশিক্ষণ থাকলেন না, তার খাওয়ার ব্যবস্থা করে চলে গেলেন, জামিনের বন্দোবস্ত করে আবার ফিরে আসবেন বলে গম্ভীর মুখে বিদায় দিলেন। রুমী আবার দুর্গন্ধময় অন্ধকার হাজতে অনির্দিষ্টকালের জন্যে আটকা পড়ে গেল।
এক কোনায় বসে কয়জন তাস খেলছে। মনে হয় এরা ঘুরেফিরে প্রায়ই আসে এখানে। দু-একজনের পুলিশের সাথে ভালো খাতিরও আছে, পান-সিগারেট কিনিয়ে আনে ওদের দিয়েই। উচ্চস্বরে হাসে, কুৎসিত গালাগালি দিয়ে ওঠে একটু পর পর। আশ্চর্য এক জগতের লোক ওরা, রুমী ভয় পেয়ে যায় ওদের দেখে। ওর গাঘেঁষে এসে বসে বারবার, অশ্লীল রসিকতা করে ওকে নিয়ে। এখানে বেশিদিন থাকতে হলে রুমী পাগল হয়ে যাবে। বিভিন্ন ধরনের লোকজন আছে এখানে। কয়জন প্রচণ্ড মার খেয়েছে, রক্তাক্ত শরীর বীভৎসভাবে ফুলে আছে। একজনের মাথায় টুপি, হাজতের ভিতর নির্বিকারভাবে নামাজ পড়ল একবার। কয়েকজন বেশ অল্পবয়সী, তাদের ভিতর একজন ভেউ ভেউ করে কাঁদছে। একজন পাঞ্জাবি আর চশমা পরা ছেলে শান্তভাবে সিগারেট খেয়ে যাচ্ছে, রুমী কথা বলার চেষ্টা করে বেশি সুবিধা করতে পারল না।
রাত গম্ভীর হয়ে এলে একজন দুজন করে এখানে-সেখানে শুয়ে পড়ে। গুমোট গরম আর ভ্যাপসা গন্ধে হাজতের গিঞ্জি ঘরটা বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। রুমী দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপচাপ বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরের ওই সাধারণ পথঘাট, বাড়িঘর তার কাছে কত অচেনা বলে মনে হতে থাকে। কে জানে কিবরিয়া ভাই জামিনের ব্যবস্থা করতে পারলেন কি না। বসে থাকতে থাকতে একসময়ে তার চোখে ঘুম নেমে আসছিল, হঠাৎ কে জানি তার ভিতরে একটা কুৎসিত গালি দিয়ে ওঠে। রুমী ভয়ানক চমকে লাফিয়ে উঠে বসে। ওই লোকটা! কীভাবে সে বুঝতে পারে জানে না, কিন্তু তার কোনো সন্দেহ থাকে না।
ধরতে হবে লোকটাকে, যেভাবে হোক ধরতে হবে। কীভাবে ধরতে হবে জানে না সে, এর আগে কখনো চেষ্টা করে নি, কিন্তু আজ তাকে চেষ্টা করতেই হবে। মাথা ঢেকে সে শুয়ে পড়ে তারপর সমস্ত মনপ্রাণ ইন্দ্রিয় একত্র করে লোকটার কথা ভাবতে থাকে, তার মনের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করতে থাকে। হাজতঘরে চাপা গলার স্বর, অশ্লীল গালির শব্দ দূরে কোথাও ঘণ্টা বাজিয়ে একটা দমকল চলে গেল। ছাদে কোথাও কবুতর বাসা করেছে, বাকবাকুম বাকবাকুম শব্দে প্রেয়সীর মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করছে। বাইরে একটা সেপাই হাতের রাইফেল মেঝেতে ঠুকে ঠুকে একটানা একটা শব্দ করে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে রুমীর মনে হতে থাকে সে যেন ভেসে চলে যাচ্ছে সব শব্দ যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে ওর কাছে। সে দূরে আরও দূরে চলে গেল, সব শব্দ আস্তে আস্তে অস্পষ্ট থেকে অস্পষ্টতর হয়ে একসময় একেবারে মিলিয়ে গেল।
হাঁটছে রুমী। ফাঁকা অন্ধকার রাস্তা ধরে লাঠিতে ভর দিয়ে দিয়ে সে পা টেনে টেনে হাঁটছে। প্রতি পদক্ষেপে ওর সারা শরীর ব্যথায় শিউরে উঠছে, রাগ ফুঁসে উঠছে ভেতরে। এদিক-সেদিক ওর চোখ নড়ছে দ্রুত, মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে সে, দুর্বল নিরীহ মানুষ। ওর ভেতরকার রাগটা ঝাড়তে হবে কারো ওপর। ইচ্ছে করছে কাউকে ধরে পশুর মতো নির্যাতন করতে। কিন্তু কীভাবে করবে? ওর সে ক্ষমতা কই? শক্ত লাঠিটার স্পর্শ পেয়ে ওর হাত নিশপিশ করতে থাকে আহ্! কারো মাথার ওপর যদি বসিয়ে দিতে পারতো সজোরে, খুলিটা ফাটিয়ে দিতে পারতো এক আঘাতে…
মালিবাগ… মালিবাগ… মালিবাগ… একটা রিকশাওয়ালা ডাকছে। বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, কাউকে পেয়ে গেলে আর খালি রিকশা নিয়ে যেতে হয় না। রুমী রিকশাওয়ালার দিকে তাকায় না। খুব বেশি জোয়ান এই রিকশাওয়ালাটা। হাতে-পায়ে শক্ত পেশি, সাপের মতো কিলবিল করছে শক্তির প্রাচুর্যে। একে দিয়ে হবে না। লাঠিতে ভর দিয়ে রুমী আবার হাঁটতে থাকে।
.
রাস্তার পাশের গাছের নিচে ছোট একটা খুপরিতে চায়ের দোকান। ইটের ওপর বসে এক বুড়ো চা খাচ্ছে সেখানে, পাশে তার খালি রিকশা। দুর্বল বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে ওর ভেতরে লোভ জেগে ওঠে। একে একবার চেষ্টা করে দেখা যায়, পায়ে ওর ব্যথা কিন্তু হাত দুটি তো ঠিক আছে, দুহাত একত্র করে পেছন থেকে মাথায় মারতে পারলে এক ঘায়ে কাজ শেষ হয়ে যাবে। জিভে পানি এসে গেল ওর।
যাবে নাকি রিকশা?
না স্যার। বুড়ো চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে পরিতৃপ্তির শব্দ করে।
চলো না, এত রাতে রিকশা কোথায় পাব?
পাবেন স্যার, একটু হাঁটেন তাইলেই পাবেন।
হাঁটতে পারছি না বলেই তো বলছি, পায়ে ব্যথা আমার। চলো, তোমাকে দুই টাকা বেশি দেব।
কই যাবেন?
ইন্দিরা রোড।
লোকটার যাবার ইচ্ছে নেই, কিন্তু সে জোর করল। পায়ের ব্যথা এবং টাকার লোভ দেখিয়ে রাজি করাল।
কি উত্তেজনা। রুমীর ভেতরটা আনন্দে নেচে ওঠে, আর খানিকটা গেলেই অন্ধকার নির্জন অংশটুকু, তখন দুহাত শক্ত করে লাঠিটা ধরে মাথার পেছন থেকে দেবে এক ঘা। আনন্দে খিকখিক করে হেসে ওঠে সে।
ঠুন ঠুন করে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছে রিকশাওয়ালা, ঘুণাক্ষরেও কিছু সন্দেহ করে নি। অন্ধকার রাস্তায় তাড়াতাড়ি চালাচ্ছে সে, মাঝে মাঝে গুণ্ডারা নাকি এখানে হামলা করে পেছনের সিটে বসে রুমী দুই হাতে ধরে লাঠি ওপরে তুলল, তারপর প্রচণ্ড এক ঘা।
ছোট একটা আর্তচিৎকার করে রিকশার হ্যাঁন্ডেলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল রিকশাওয়ালা। রিকশা তাল সামলাতে না পেরে ঘুরে রাস্তার পাশে গড়িয়ে যাচ্ছিল, একটা লাইটপোস্টে ধাক্কা লেগে থেমে গেল। অদ্ভুতভাবে হ্যাঁন্ডেলে ঝুলে আছে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা, মাথা থেকে টন্ টন্ করে রক্ত পড়ছে গাল বেয়ে। রুমী লাফিয়ে নামল রিকশা থেকে পালিয়ে যেতে হবে এখন, কেউ দেখে ফেলার আগে…
হঠাৎ রুমী সম্বিৎ ফিরে পায়। এই লোকটাকে থামাতে হবে, কিছুতেই ওকে পালিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, কিছুতেই না, কিছুতেই না। কিন্তু রুমীর কিছু করার নেই। লোকটা পা টেনে টেনে হেঁটে চলে যাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। আর একটু গেলেই ওই গলির ভেতরে ঢুকে যাবে, ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে তখন।
রাস্তা ঘুরতেই একটা গাড়ি এসে পড়ে ওর সামনে, হেডলাইটে চোখ ধাঁধিয়ে যায় লোকটার। মুখ ঢেকে ফেলে লোকটা ভয়ে, তারপর উলটোদিকে ছুটতে শুরু করে। গাড়িটা থেমে গেছে রিকশাটার কাছে। গাড়ি থেকে দুজন লোক নেমে এলো, বৃদ্ধ রক্তাক্ত রিকশাওয়ালাকে ধরাধরি করে নামাল রিকশা থেকে। বিড়বিড় করে কি যেন বলল রিকশাওয়ালা, সাথে সাথে লোক দুটি চিৎকার করে উঠল, ধর শালা ল্যাংড়াকে…
ভয়-ভয়-ভয় জান্তব ভয় ওর ভেতরে। ছুটে যেতে চেষ্টা করছে। সে, পা টেনে টেনে ছোটা যায় না, ব্যথায় ককিয়ে উঠছে, তবু প্রাণপণে ছুটতে থাকে। কিন্তু পেছন পেছন ছুটে আসছে দুজন, লম্বা লম্বা পা ফেলে ধরে ফেলল প্রায়। প্রচণ্ড ভয় হলো ওর, ঘুরে দাঁড়াল হঠাৎ, দুই হাতে শক্ত করে ধরল লাঠি…
কিন্তু তার আগেই মুখে প্রচণ্ড ঘুষি। মাথা ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে, মার শালা শুয়োরের বাচ্চাকে-প্রচণ্ড লাথি পড়ল ওর পেটে। ফার্স্ট ডিভিশন ফুটবল লীগে হাফ ব্যাক খেলে নীলু, ওর এক লাথিতে বল মাঠ পার হয়ে যায়। লোকটা জ্ঞান হারাল প্রচণ্ড যন্ত্রণায়।
থরথর করে কাঁপছে রুমী, ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে হাজতের সব কজন লোক। চশমা পরা ছেলেটা ডাকছে ওকে, কি হয়েছে? এই ছেলে, কি হয়েছে তোমার?
রুমী উঠে বসে। তখনো ওর সারা শরীর কাঁপছে, কোনোমতে বলল, না, কিছু না।
কে একজন বলল, মৃগী ব্যারাম। উঠতে দেবেন না, চেপে ধরে নাকের কাছে জুতাটা ধরেন।
রুমী ওদের কথায় কান দিল না, দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকাডাকি করতে থাকে, এই যে, কে আছেন? শুনে যান…
একজন সেপাই ঘুম ভাঙা গলায় হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, কি হয়েছে?
ওসি সাহেবকে ডাকেন একবার, ভয়ানক জরুরি দরকার।
ঘুমা শালা শুয়োরের বাচ্চা! এখন আমি ওসি সাহেবকে ডাকি!
কে একজন হো হো করে হেসে ওঠে হাজতের ভেতর। রুমী তবু হাল ছাড়ল না, বলল, গিয়ে বলেন আসাদগেটের কাছে ধরা পড়েছে ওই পা খোঁড়া লোকটা।
সেপাইটি খানিকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার দিকে, তারপর খেঁকিয়ে ওঠে বিশ্রীভাবে।
বিশ্বাস করেন। একটা রিকশাওয়ালার মাথায় লাঠি মেরে…
চোপ শালা হারামজাদা, আর একটা কথা বলবি তো দাঁত ভেঙে দেব।
রুমী চুপ করে গেল। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কিন্তু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো না। রাত তিনটের সময় সেই পুলিশ অফিসার নিজে এসে রুমীকে ডেকে নিয়ে গেলেন। সেন্ট্রি সেপাইটা চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে নিজের কানে শুনেছে রুমী বলেছে আসাদগেটের কাছে। খোঁড়া লোকটা ধরা পড়েছে, রিকশাওয়ালাকে মেরে পালিয়ে যাচ্ছিল। কি করে বলল ও?
একটু আগে থানায় দুজন এসে ডায়েরি করিয়ে গেছে। রিকশাওয়ালা আর খোঁড়া লোকটাকে নিয়ে গেছে হাসপাতালে। সেপাইটা একটু এগিয়ে রুমীর কাছে গলা নামিয়ে বলল, আপনি কীভাবে জানলেন? হাজতেই তো ছিলেন সারাক্ষণ। কিছুক্ষণ আগেই সে তার দাঁত ভেঙে ফেলার ভয় দেখাচ্ছিল, কিন্তু তা আর মনে রাখে নি রুমী। একটু বিব্রতভাবে বলল, জানি না, কি করে যে জানলাম। আপনি রাগ করেন নি তো, স্যার? মুখটা খারাপ আমার।
না, না।
কীভাবে বুঝব, স্যার? এতগুলি চোর-ছ্যাচোড়ের মাঝে যে আপনি আছেন আমি কীভাবে জানব?
হুঁ। মাথা নাড়ে রুমী, তা তো বটেই।
কিছু মনে করবেন না স্যার। বাচ্চাকাচ্চার বাপ আমি-সেপাইটা ভয় পেয়ে যায়। না, না রাগ করব কেন?
পুলিশ অফিসার অনেকক্ষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে রুমীর দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর আস্তে আস্তে বললেন, কোনো শালা বিশ্বাস করবে না।
কিসের কথা বলছে বুঝতে পেরে একটু হাসার ভঙ্গি করল রুমী। কোর্টে কেস ওঠার সময় একেবারে চেপে যেতে হবে পুরো ব্যাপারটা। কোনো শালা বিশ্বাস করবে না, আর বেকসুর খালাস পেয়ে যাবে ল্যাংড়া!
চুপ করে থাকে রুমী।
আপনি কাউকে বলবেন না, খবরের কাগজ যেন খোঁজ না পায়, আপনার জীবন নষ্ট হয়ে যাবে! আমি এদিকটা সামলাবো।
রুমী ব্যস্ত হয়ে বলল, হ্যাঁ, প্লিজ, আমি চাই না কেউ জানুক।
জানবে না, নিশ্চিন্ত থাকুন। একটু হেসে পুলিশ অফিসার আন্তরিক গলায় বললেন,
এত রাতে আর কোথায় যাবেন? আমার বাসায় চলুন, এই কাছেই আমার বাসা।
না, না, থাক। আমি হলে ফিরে যাই বরং, ভালো করে গোসল করে ঘুমাব। আমার বাসায় চলুন, গোসলের ব্যবস্থা করে দেব। কিছু খেয়ে ঘুমোবেন, হাজতে থেকে কি চেহারা হয়েছে আপনার। কোনো কথা শুনলেন না তিনি, তাকে বাসায় নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক একটু স্ত্রী-পাগল, রুমীর ব্যাপারটা শুধু গল্প করে মন। ভরবে না বলে নিজের চোখে দেখাতে চাইছিলেন তার স্ত্রীকে। তার মতো আর কয়টা কেস আছে এই পৃথিবীতে?
সাত
নৃশংস : ঢাকা, ২১ জুন; গতরাত একটার সময় আশফাক হাসান (৩৫) নামে এক ব্যক্তিকে নির্মমভাবে জনৈক রিকশাওয়ালার মাথায় আঘাত করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয়। উক্ত আশফাক হাসানের স্বীকারোক্তিতে আরও জানা যায়, সে পূর্ব রাত্রিতে যাত্রাবাড়ীর নিকটে কদম আলী নামক এক পথচারীকে চলন্ত ট্রাকের সামনে ধাক্কা দিয়া ফেলিয়া নির্মমভাবে হত্যা করিয়াছে। পুলিশ সূত্রে জানানো হয় যে, এই অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের এখন পর্যন্ত কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় নাই। রিকশাচালক সৈয়দ ইমতিয়াজ আলীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হইয়াছে, তার অবস্থা সংকটজনক। আশফাক হাসান ঢাকার প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডা. আবিদ হাসানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। বৎসরাধিককাল পূর্বে জার্মানিতে সড়ক দুর্ঘটনায় এক পা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উক্ত আশফাক হাসান স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে। শেষ খবর পাওয়া অনুযায়ী জোর পুলিশি তদন্ত চলিতেছে।
.
শহরে রিকশা ধর্মঘট : ঢাকা, ২২ জুন, রাত এগারোটার সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আহত রিকশাচালক সৈয়দ ইমতিয়াজ আলী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। জনৈক আশফাক হাসান পূর্বরাত্রে রিকশার সিটে বসে লাঠি দিয়ে তার মাথায় প্রচণ্ড আঘাত করে। সৈয়দ ইমতিয়াজ আলীর মৃত্যুতে ঢাকা নগরী রিকশাচালক ইউনিয়নের আহ্বানে সারা শহরে রিকশা ধর্মঘট পালন করা হয়। জানাজার পর ক্ষুব্ধ রিকশাচালকেরা শোভাযাত্রা সহকারে সৈয়দ ইমতিয়াজ আলীর মৃতদেহ বহন করে সমস্ত শহর প্রদক্ষিণ করে। আজিমপুর গোরস্তানে দাফন সম্পন্ন করে ফিরে আসার পথে ক্ষুব্ধ রিকশাচালক এবং জনতা ওই আশফাক হাসানের পিতা ডা. আবিদ হাসানের বাসা ঘেরাও করে। পুলিশ অনেক কষ্টে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হয়। এ ব্যাপারে কাউকে গ্রেফতার করা হয় নাই।
.
সম্পাদকীয় : আমাদের সমাজে ভায়োলেন্স কম তাহা এখন জোর করিয়া বলা মুশকিল। দশ বৎসর আগের তুলনায় আজকাল সংবাদপত্রে অনেক বেশি হত্যাকাণ্ড বা অন্য ধরনের নৃশংসতার বিবরণ প্রকাশিত হয়। কিন্তু এইসব হত্যাকাণ্ড বা নির্মমতা কখনোই সম্পূর্ণ বিনা কারণে ঘটে নাই। সামাজিক বা রাজনৈতিক কারণ, পারিবারিক কলহ, অর্থলোভ কিংবা ক্রোধের বশবর্তী হইয়া এ হত্যাকাণ্ডগুলি সংঘটিত হইয়াছে। কিন্তু এ দেশে সম্পূর্ণ বিনা কারণে হত্যাকাণ্ড বোধ করি এই প্রথম ঘটিল। আশফাক হাসান নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত, বিদেশ হইতে তথাকথিত উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তি শুধু মনের খেয়াল মিটাইবার জন্যে দুই-দুইটি নির্মম হত্যাকাণ্ড করিয়াছে বলিয়া পুলিশ সূত্রে জানানো হইয়াছে। বিদেশে এ ধরনের নমুনার অভাব নাই। ব্রিটেনের জ্যাক দা রিপার, ইদানীংকার ইয়র্কশায়ার রিপার, আমেরিকার সান অফ স্যাম, হিলসাইড স্ট্র্যাংলার, ফ্রি ওয়ে কিলার বা আটলান্টার শিশু হত্যাকারী বিভিন্ন সময়ে সারা পৃথিবীতে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করিয়াছিল। বিদেশে শিক্ষা লইতে গিয়া যদি এই দেশের যুবকেরা এই প্রকার শিক্ষা গ্রহণ করিয়া আসিতে থাকে…
খুব সাবধানে পরের কদিন সব কটি খবরের কাগজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল রুমী। তার সম্পর্কে কোথাও একটি কথাও লেখা হয় নি। তার ব্যাপারটি কোনোভাবে প্রকাশ পেয়ে গেলে চমৎকার একটি খবর হলো, প্রথম পৃষ্ঠায় তার ছবি এবং নিচে তরুণের অলৌকিক রহস্যভেদ’ বা এই ধরনের একটা কিছু লিখে একটি ছোটখাটো আলোড়নের সৃষ্টি করা যেতো। কিন্তু পুলিশ অফিসার তার কথা রেখেছেন, তাই রুমীকে একটি আলোড়নের কেন্দ্রস্থল হওয়ার বিড়ম্বনা সহ্য করতে হলো না। এমনিতেই তার সমস্যার অন্ত নেই, তার ওপর আবার নতুন বিড়ম্বনার জায়গা কই?
.
প্রাথমিক উত্তেজনাটুকু কেটে যাবার পর কিবরিয়া ভাই রুমীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বড় বড় ডাক্তার এবং নিউরোলজিস্টের সাথে যোগাযোগ করে রুমীকে তাদের কাছে নিয়ে গেলেন। তারা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন। রক্ত, কফ, মলমূত্র কিছুই বাকি থাকল না। তার ইইজি ইসিজি করানো হলো, কিবরিয়া ভাই বিভিন্ন জায়গায় কথাবার্তা বলে প্রায় বিনা খরচে করিয়ে দিলেন সব। ডাক্তাররা অনেক কঠিন কঠিন অসুখের নাম বলে নিজেরা আলোচনা করলেন, তার বেশির ভাগই বুঝতে পারলো না রুমী। তার মস্তিষ্কের ছোট একটা অংশ পাকাপাকীভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। যার জন্যে কোনো কোনো ব্যাপার সে কিছুতেই মনে করতে পারে আবার তার মস্তিষ্কের সামনের অংশে কিছু একটা হয়েছে যা স্বাভাবিক নয়, সেখানকার বৈদ্যুতিক বিশ্লেষণ অন্য কারো সাথে মেলে না। এর পরেই ডাক্তাররা নিজেদের সাথে আর একমত হতে পারলেন না। কয়েকজন বললেন রুমীর দৈনন্দিন জীবনে এর জন্যে কোনো ধরনের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, অন্যরা বললেন যে তার চিন্তা করার ক্ষমতা অনেক পরিবর্তিত হয়ে যাবার কথা। অবিশ্যি সবাই এক বিষয়ে একমত হলেন যে মস্তিষ্ক সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান এত কম যে তারা কোনো কিছুই জোর দিয়ে বলতে পারেন না। ডাক্তাররা রুমীকে মনোবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলার উপদেশ দিলেন।
কিবরিয়া ভাই খুঁজে খুঁজে তাকে এক মনোবিজ্ঞানীর কাছে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। অবসর সময়ে মানসিক রোগীদের দেখেন। রুমীর নিজেকে মানসিক রোগী হিসেবে কল্পনা করতেও প্রচণ্ড আপত্তি, কিন্তু কিছু করার নেই। মনোবিজ্ঞানী ভদ্রলোক তাকে অদ্ভুত অদ্ভুত সব প্রশ্ন করলেন। কিছু কিছু এত অবান্তর নির্লজ্জ প্রশ্ন যে শুনে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে রুমী। পাকা দুই ঘণ্টা তাকে নানাভাবে জেরা করে ভদ্রলোক বললেন, তার সুপ্ত অপরাধবোধ নাকি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে তার ভেতরে দ্বিতীয় আরেকটা ব্যক্তিত্বের সৃষ্টি করেছে। এই দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব নিজেকে প্রেত হিসেবে কল্পনা করে। কাজেই তাকে সম্মোহিত করে প্রেত-ব্যক্তিত্বকে বের করে এনে সেটিকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে হবে। সব শুনে সেখানে দ্বিতীয়বার যাওয়ার সাহস হলো না রুমীর।
কে জানে, হয়তো ভুল করে তার নিজের ব্যক্তিত্বকেই টেনে বের করে ছিন্নভিন্ন করে দেবে, তারপর আজীবন তাকে প্রেতের ব্যক্তিত্ব নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে। তাছাড়া অনেক করে টাকা নেয়, শুধু গালগল্প শোনার জন্যে এত টাকা দেওয়ার কোনো মানে হয়
কিবরিয়া ভাই কিন্তু রুমীকে নানাভাবে জোর করে মনোবিজ্ঞানীর কাছে পাঠানোর চেষ্টা করতে থাকলেন। রুমীকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন মানুষের মন কি বিচিত্র, সাধারণ মানুষ যা ধরতে পারেন না মনোবিজ্ঞানীরা তা ধরে ঠিক সমস্যাটা খুঁজে বের করতে পারেন। টাকার কথা বলে লাভ নেই, কিবরিয়া ভাই তাহলে নিজের পকেট থেকে টাকা দিয়ে দেবেন। শেষ পর্যন্ত আর একবার চেষ্টা করতে রাজি হলো রুমী। কিন্তু এই শেষ, যদি তার কোনো উপকার না হয় সে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দেবে।
কিন্তু মনোবিজ্ঞানীর কাছে আর যেতে হলো না তাকে, তার আগেই একটা ছোট ঘটনা অনেক কিছু পাল্টে দিল।
.
বাসে করে আসছিল ও, প্রচণ্ড ভিড় কিন্তু বসার জায়গা পেয়েছে সে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল, আবছা আবছাভাবে সে বুঝতে পারে আবার একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে তার ভেতরে। প্রচণ্ড ভয় আর অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকে রুমী। তাড়াতাড়ি হলে পৌঁছে চারটে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়বে। আগে দুটো খেলেই ঘুমোতে পারতো, আজকাল চারটের কমে হয় না। যখনই তার মনে হয় কোনো ধরনের ভয়ানক অভিজ্ঞতা হতে পারে, তখনই ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, পরের দুদিন গা ম্যাজম্যাজ করে, মাথা ভার হয়ে থাকে তবুও সে বেশ কিছুদিন থেকে তাই করে আসছে।
ওর কাঁধে হাত দিল কে যেন। ঘুরে তাকিয়ে দেখে একজন বুড়োমতো লোক। মাথায় সাদা কিস্তি টুপি, পরনে আধময়লা শার্ট, ওর পাশে বসে আছে। গলা নামিয়ে জিজ্ঞেস করে ওকে, বাবা, তোমার কি হয়েছে?
অবাক হয়ে লোকটির দিকে তাকায় রুমী, চোখ দুটি কি আশ্চর্য স্বচ্ছ! হঠাৎ করে মনে হয় খুব আপনজন। মাথা নেড়ে বলল রুমী, কিছু হয় নি তো।
লোকটা গলা আরও নামিয়ে বলে, বলো আমাকে, কি হয়েছে?
রুমী আবার বলতে যাচ্ছিল কিছু হয় নি কিন্তু লোকটা বাধা দেয়, আমাকে বলো, আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারব।
অবাক হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে রুমী, আপনি কি করে বুঝলেন আমার কিছু হয়েছে?
বোঝা যায় বাবা, মানুষের মুখ দেখলে সব বোঝা যায়। বলো বাবা আমাকে, তোমার কিসের ভয় এত?
কি বলবে বুঝতে পারছিল না রুমী। খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি ঠিকই ধরেছেন, আমার কিছু একটা হয়েছে তাই এত অশান্তিতে আছি, কাউকে বললে বিশ্বাস করবে না।
আমি বিশ্বাস করব, বাবা।
রুমী লোকটার চোখের দিকে তাকায়, এত আশ্চর্য স্বচ্ছ কোমল চোখ সে জীবনে কখনো দেখে নি। লোকটা দেখতে এত সাধারণ, আধময়লা কাপড়, মাথায় একটা টুপি, কিন্তু চোখ দুটির দিকে তাকালে সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। এ সাধারণ মানুষ নয়, রুমীর হঠাৎ তাকে বিশ্বাস হয়, একে সব খুলে বলা যায়। সে গলা নামিয়ে তার কথা বলতে শুরু করে। লোকটা গম্ভীর হয়ে শোনে, একটি-দুটি প্রশ্ন করে, তারপর চুপ হয়ে যায় অনেকক্ষণের জন্যে।
বাস ততক্ষণে কার্জন হলের কাছে চলে এসেছে, ওরা দুজনে নেমে পড়ে সেখানে, হেঁটে হেঁটে পুরোনো হাইকোর্টের সামনে একটা গাছের নিচে বসে।
রুমী তার সব কথা শেষ করে বলল, বিশ্বাস হয় আপনার?
লোকটা একটু হেসে আস্তে আস্তে বলল, আল্লাহ্র দুনিয়ায় কত কি আছে, বিশ্বাস না করলে চলে না বাবা। আমি নিজে কত কি দেখেছি, বললে লোকে পাগল ভাববে। তোমার কোনো ভয় নেই বাবা, সব ঠিক হয়ে যাবে।
কীভাবে?
এমনি ঠিক হয়ে যাবে বাবা। তোমার ভেতরে একটা ক্ষমতা হয়েছে যেটা অন্য লোকের নাই। কেন হলো আমি জানি না। আশ্চর্য মানুষের মন, কীভাবে কাজ করে কেউ জানে না। হয়তো ওইসব লোক তোমার মাথায় কিছু করেছে, হয়তো তোমার মাথায় অপারেশন করার সময় কিছু হয়েছে, কে জানে এমনিতেই হয়তো হয়েছে। তোমার এটা ভালো লাগে না, তুমি ভয় পাও সেটাই হয়েছে তোমার জন্যে মুশকিল। তুমি ভয় পেয়ো না, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমার মন তোমার কথায় ওঠে-বসে, যা তোমার ভালো লাগে না তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না।
কিন্তু…
হ্যাঁ বাবা। তুমি অশিক্ষিত লোক হলে তোমাকে একটা তাবিজ দিয়ে বলতাম, এটা গলায় ঝুলিয়ে রাখো তোমার আর অসুবিধা হবে না। তুমি সেটা বিশ্বাস করে ভাবতে তোমার কিছু হবে না, তখন সত্যিই তোমার কিছু হতো না। কিন্তু তুমি যে মূর্খ লোক নও, তোমাকে ঠকাই কেমন করে বলো?
একটু অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল রুমী, এত সহজ ব্যাপারটা?
হ্যাঁ বাবা। এত সহজ। যদি তুমি চাও। আর যদি না চাও অনেক কঠিন। তুমি যদি মনে করো, বিশ্বাস করো তোমার আর কোনোদিন এরকম হবে না তাহলে সত্যিই কোনোদিন হবে না। তোমাকে বিশ্বাস করতে হবে। তোমার মন তোমার কথায় ওঠে বসে, সেটা তোমার বিশ্বাস করতে হবে। নিজের ওপরে বিশ্বাস। পারবে?
উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে রুমী। লোকটা আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলে, এর মানে পারবে না! বিশ্বাস নেই নিজের ওপর।
না, বিশ্বাস থাকবে না কেন। কিন্তু…
ওই কিন্তুটাই হচ্ছে বিশ্বাসের অভাব। তুমি জানো না বাবা, মানুষের ভেতরে কি শক্তি আছে। পৃথিবীতে কিছু নেই যা মানুষের সাথে পারে, মানুষ জানে না বলে ভয় পায়। যখন ভয় পায় তখন সেই শক্তি চলে যায়। তুমি তোমার ক্ষমতাটা পছন্দ করো না, যদি করতে তাহলে কি বলতাম জানো?
কি?
বলতাম ওইসব লোকের ওপর তুমি জোর খাটাও, ওদের সব শক্তি কেড়ে নাও, ওদের জন্মের মতো শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দাও। কিন্তু তুমি তোমার ক্ষমতাটা পছন্দ করো না, তোমার কাছে খারাপ মনে হয়। তাই তোমাকে আমি কখনো বলব না সেটা করতে। কিন্তু তুমি নিজেকে কষ্ট দিও না। যেটা পছন্দ করো না সেটা কেন ঘটতে দাও? এটা তো অসুখের বীজাণু নয় যে রক্তের মাঝে আছে। এটা তোমার নিজের মন, ধমক দিয়ে থামিয়ে দাও। যদি না পারো নিজেকে ব্যস্ত রাখো, বন্ধুর সাথে গল্প করো, কিছু তৈরি করো, কিছু ভেঙে ফেলো, রাজনীতি করো, তর্ক করো, ঝগড়া করো, মারামারি করো, কিছু একটা করো। বসে থেকে তোমার মাঝে ওটা ঘটতে দিও না।
লোকটা একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল বলে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। গলা নামিয়ে বলল, বাবা, কিছু মনে করো নি তো?
না, না, মনে করব কি? আপনি তো ঠিকই বলেছেন, আমি আসলেই কিছু করি না। একা একা থাকি, আমার ভালো কোনো বন্ধু নেই। সব সময়ই ভয় ভয় করে, মনে হয় এই বুঝি আবার কিছু হলো।
হ্যাঁ বাবা। নিজের কাছে নিজে হেরে যেও না। এখন নিজের ওপর বিশ্বাস নেই তাতে ক্ষতি কি? আস্তে আস্তে হবে। যখন নিজেকে বুঝতে পারবে তখন খুব তাড়াতাড়ি বিশ্বাস ফিরে আসবে। আজ রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমোবে বলছিলে না?
হ্যাঁ। ভুলেই গিয়েছিল রুমী। আবার সব একসাথে মনে পড়ে যায়। সাথে সাথে চাপা অস্বস্তি, ভয় সব একসাথে ফিরে আসে। রুমীর মুখে তার স্পষ্ট ছাপ পড়ে।
এই যে, এই যে, বাবা, তুমি আবার ভয় পাচ্ছ। লোকটা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আজ রাতে যদি তোমার কিছু না হয় তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে?
আপনার কথা আমি কখনো অবিশ্বাস করি নি।
আমি বলছিলাম তোমার কথা, নিজের ওপর বিশ্বাসের কথা। করবে?
করব।
তার জন্যে তুমি কতটুকু কষ্ট করতে পারবে, বাবা?
যতটুকু দরকার।
পুরো রাত?
হ্যাঁ।
ঠিক আছে। লোকটা শার্টের পকেট থেকে একটা ওষুধের শিশি বের করে বলে, এটা খুব একটা দরকারি ওষুধ, বাজারে পাওয়া যায় না। টাঙ্গাইলে একজনের এটা খুব দরকার। আজ রাতের মধ্যে এটা যদি তাকে খাওয়ানো যায় তাহলে সে বেঁচে যেতে পারে। আমি এটা নিয়ে টাঙ্গাইল যাচ্ছিলাম। এখন আমি আর যাব না। তুমি এটা পৌঁছে দিয়ে এসো বাবা।
শুনে একটু হকচকিয়ে যায় রুমী, সে এ ধরনের কিছু আশা করে নি। লোকটার সদিচ্ছায় ওর কোনো সন্দেহ নেই, যদি সত্যি ওষুধটা টাঙ্গাইলে পৌঁছে দিয়ে এলে সে ভালো হয়ে যায়, তাহলে কেন যাবে না? কিন্তু ওর ভয় ভয় করতে থাকে, এখন ওর ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে থাকার কথা।
লোকটা পকেট থেকে কটা দুমড়ানো-মোচড়ানো নোট বের করে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ভাড়াটা..
সে কি, আপনি ভাড়া দেবেন কেন, আমি দিয়ে দেব।
না বাবা, কাজটা আমার। তাছাড়া আমি চাই তুমি এখান থেকে সোজা রওনা দিয়ে দাও।
কেন? হল থেকে কয়টা দরকারি জিনিস ব্যাগে…
না বাবা, তুমি সোজা এখান থেকে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওষুধটা পৌঁছানো দরকার; কিন্তু আমি সেজন্যে বলছি না, আমি তোমার নিজের জন্যেই বলছি। নাও বাবা, টাকাগুলি ধরো।
রুমী একটু ইতস্তত করে বলে, আমার পকেটে কিছু টাকা আছে, টিউশনি বাবদ গত মাসের টাকাটা সে আজকেই পেয়েছে। যাওয়া-আসার ভাড়া উঠে যাবে।
তবু এটা রাখো বাবা। ভাড়া যদি নিজে দিতে চাও, দিও। এই টাকাটা তাহলে ওই লোকটাকে দিয়ে দিও। লোকটা পকেট হাতড়ে একটা চিরকুটের মতো কাগজ বের করে ওর হাতে দেয়, ওপরে লেখা কোথায় যেতে হবে।
ঠিক আছে বাবা, তুমি তাহলে যাও। মনে রেখো, আজ রাতে এ ওষুধটা খেলে লোকটা হয়তো বেঁচে যাবে। আল্লাহ্ যদি চান তাহলে তার জীবনটা এখন তোমার হাতে। লোকটা তার শক্ত হাতে রুমীর হাত স্পর্শ করে বিদায় নেয়, আল্লাহ্ তোমার ভালো করবেন, তুমি এখন যাও বাবা। রুমীর উৎসুক চোখের দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলে, বাবা তুমি আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করো না, মিথ্যে বলতে আমার খুব কষ্ট হয়…
রুমী আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। কি আশ্চর্য লোক! ও তাকিয়ে তাকিয়ে লোকটাকে চলে যেতে দেখে। দ্রুত হেঁটে রাস্তার লোকজনের মাঝে মিশে গেল লোকটা, কে জানে আর কখনো দেখা হবে কি না।
সে রাতের অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। রুমী রাতের অন্ধকারে বাসের পেছনে বসে আছে। প্রচণ্ড ঝড় বাইরে, আকাশ চিরে বিজলি নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। বাস যাচ্ছে আহত জন্তুর মতো শব্দ করতে করতে। মাঝে মাঝে চাপা দুঃস্বপ্নের মতো কি একটা ওর ওপর ভর করতে চায়, কিন্তু সে প্রাণপণে তার সাথে যুদ্ধ করে, ওর ওপর এখন একজন অসুস্থ মানুষের জীবন-মরণ নির্ভর করছে, এখন সে অন্য কিছুকে প্রশ্রয় দিতে পারে না। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে ও, মন থেকে সব চিন্তা দূরে সরিয়ে দেয়, তারপর বাইরে ঝড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রথম একবার দুবার ওর মনে হতে থাকে সে বুঝি পারবে না, প্রায় হাল ছেড়ে দিতে গিয়ে অনুভব করে, ভেতরে কে যেন ক্রমাগত বলতে থাকে-না, না, না কিছুতেই না, কিছু-তে-ই-না! আর সত্যি সত্যি কিছুক্ষণ পর ও বিস্মৃতির অন্ধকার থেকে আবার বের হয়ে আসে। আস্তে আস্তে ও সাহস ফিরে পায়। বুঝতে পারে সত্যি সত্যি সে যদি চায়, তাহলে আর চেতনা হারিয়ে অন্ধকার জগতের দাসত্ব করতে হবে না। ওই অনুভূতিটা কি আনন্দের, কি পরিতৃপ্তির, ওর বহুকাল এরকম অনুভূতি হয় নি।
মাঝরাতে বাস যখন টাঙ্গাইল পৌঁছেছে তখন বাসের সবাই আধো ঘুমে, সে নিজেও খুব ক্লান্ত, কিন্তু ওর চোখে ঘুমের রেশ নেই, মনে ফুরফুরে একটা আনন্দ। বাসস্টেশনের কাছে একটা রেস্টুরেন্টে গরম এক কাপ চা খেয়ে সে চাঙ্গা হয়ে নিল। রেস্টুরেন্টের লোকজনকে ঠিকানাটা দেখিয়ে সে জায়গাটা কোথায় সে-সম্পর্কে একটা ধারণা করে নেয়। ভাগ্য ভালো থাকলে এত রাতে রিকশা পেতেও পারে, কিন্তু পুরো রাস্তা রিকশা করে যাওয়া সম্ভব না, অন্তত মাইলখানেক ওকে হাঁটতে হবে। সে নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা নেই রুমীর, হালকা মনে শিস দিতে দিতে বের হয়ে পড়ে।
বাসাটা সে বেশ তাড়াতাড়িই খুঁজে বের করে ফেলে। জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা, বাঁশের ঘরের ওপর নড়বড়ে টিনের ছাদ। ভেতরে কোথায় জানি একটা মিটমিটে বাতি জ্বলছে। রুমী দরজায় কড়া নাড়ে, বেশ অনেকক্ষণ পর জানালা খুলে একজন মেয়ে ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করে, কে?
আমি, ঢাকা থেকে ওষুধ নিয়ে এসেছি।
ওষুধ। মেয়েটা আনন্দে চিৎকার করে ওঠে, ওষুধ এনেছে মা, ওষুধ!
দরজা খুলে হারিকেন হাতে একজন মহিলা পাগলের মতো বের হয়ে এলেন। রুমীর হাত জড়িয়ে ধরে সাগ্রহে ওষুধটা হাতে নিলেন। উদ্ভান্তের মতো চেহারা, ঝড়ে দিকভ্রষ্ট নাবিকের চেহারাও বুঝি এত ব্যাকুল নয়। রুমীকে বাইরের ঘরে বসিয়ে রেখে তারা ভেতরে চলে গেল। ভেতর থেকে অস্ফুট কথাবার্তা শোনা যেতে থাকে, চামচের টুংটাং শব্দ, একটু চাপা কান্না, দীর্ঘশ্বাস। রুমী চুপচাপ বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে একজন মানুষ মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে, ও কখনো দেখে নি মানুষটাকে, কিছু জানে না তার সম্পর্কে, কিন্তু তবু কি আশ্চর্য, বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করছে সে, মনপ্রাণে কামনা করছে লোকটা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসুক।
দুদিন পর ফিরে এলো রুমী। অসুস্থ লোকটা উঠে পথ্য করার পর। দুদিনের পরিশ্রমেই সে বেশ শুকিয়ে গেছে, পরিবর্তনটা সবাই লক্ষ করে। ও এখন অনেক হাসি-খুশি, অনেক চঞ্চল। একেবারে অন্য মানুষ হয়ে ফিরে এসেছে সে। ও জানে, ও ভালো হয়ে গেছে।
সাদাসিধে সেই লোকটাকে রুমী অনেক খুঁজেছে, আর পায় নি। নিজের অজান্তে লোকজনের ভিড়ে সেই মুখটা খুঁজতে থাকে, বড় ইচ্ছা করে আরেকবার কথা বলতে, অন্তত কৃতজ্ঞতাটুকু জানাতে। কিন্তু তাকে আর কখনো দেখে নি সে।
তৃতীয় অংশ–আরেক বিধাতা
আট
তিন বছর পর।
তিন বছর অনেক সময়, অনেক কিছু ঘটতে পারে এর মধ্যে, কিন্তু রুমীর খুব একটা পরিবর্তন হয় নি। স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে কিছুটা, তার ওপরে গোঁফ রেখেছে, তাই দেখতে একটু ভারিক্কি লাগে আজকাল। চিন্তাভাবনা অনেক স্পষ্ট হয়েছে, দেশ-বিদেশের সত্যি খবর রাখে তাই আপাতদৃষ্টিতে তাকে উচ্চাশাহীন সাদামাঠা ছেলে বলে ভুল হতে পারে। বই পড়ার অভ্যাস দিনে দিনে আরও বেড়েছে। চোখ খারাপ হয়ে থাকতে পারে, ক্লাসে পেছনে বসলে সে বোর্ডের লেখা ভালো দেখতে পায় না, তবুও কখনো চোখের ডাক্তারের কাছে যায় নি। ওর ভয় হয় ডাক্তার জোর করে ওকে চশমা দিয়ে দেবেন। চোখে চশমা ও দুচোখে দেখতে পারে না। আলগা বুদ্ধিজীবীর একটা ভাব ফুটে ওঠে যেটা ওর ভারি অপছন্দ।
তিন বছরে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটেছে রুমীর জীবনে। সে প্রেমে পড়েছিল আবার আঘাত পেয়ে ফিরেও এসেছে, এখনো সে ভুলতে পারে না, প্রায় প্রতিদিনই তার বুকের ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যায়। চমৎকার মেয়েটি ছিল, ওদের ক্লাসের অনেকেই ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়েছিল মেয়েটির জন্যে। সুন্দরী হিসেবে মেয়েটিকে ওরও ভালো লাগতো, মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো কিন্তু কখনো সে চেষ্টা করে নি। ওর ধারণা ছিল যেচে কোনো মেয়ের সাথে গল্প করা হ্যাংলামোর পর্যায়ে পড়ে। ওদের একজন শিক্ষক তখন নতুন পিএইচডি করে এ দেশে ফিরে এসেছেন। সুদর্শন অল্পবয়সী ভদ্রলোক, করিডোরে দাঁড়িয়ে ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সাথে গল্প করতে ভালোবাসেন। ফাজিল ছেলেরা বলে বিয়ে করেন নি তাই মেয়ে পছন্দ করার চেষ্টা করছেন। রুমীও দু-একদিন তার গল্প শুনেছে, এমনিতে মানুষটা খারাপ নন, নিজের বিষয়ে জানেন খুব ভালো, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে সাধারণ। রুমী বাজি রেখে বলতে পারে ভদ্রলোক রিডার্স ডাইজেস্ট পড়েন এবং বিশ্বাসও করেন। রুমীর এমনিতে কোনো আপত্তি ছিল না, কিন্তু ভদ্রলোক যখন রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন সে চুপ থাকতে পারল না। তার প্রথম কথাটি শুনেই সে বলে উঠল, না, স্যার, আপনি ভুল বলছেন।
ভুল? ভদ্রলোকের ফর্সা চেহারা একটু লাল হয়ে ওঠে। এ সপ্তাহের নিজউ উইকে–না স্যার, ওটা ভুল। নিউজ উইকের খবরটা পড়তে পারেন কিন্তু তার অ্যানালিসিস পড়বেন না। ওটা ওয়েস্টার্ন দৃষ্টিভঙ্গি। আমি আপনাকে চারটি ভিন্ন ভিন্ন কাগজের নাম বলতে পারি যারা ওরকম করে দেখবে না। রুমী কাগজগুলির নাম বলল, কে কি লিখেছে তাও বলল। কিবরিয়া ভাইয়ের কাছে সে তর্ক করা শিখেছে, উদাহরণ না দিয়ে সে কখনো কথা বলে না।
তাই বলে তুমি নিউজ উইককে অবিশ্বাস করবে? জানো ওদের সার্কুলেশন কত?
রুমী সঠিক সংখ্যাটি বলতেই ভদ্রলোক একটু হকচকিয়ে গেলেন। রুমী ঠাণ্ডা গলায় ভদ্রলোককে বোঝাতে শুরু করে, নিউজ উইক টাইম ওরা তো কাগজের ব্যবসা করে। ওরা খবরগুলি এমনভাবে ছাপায় যেন মানুষের পড়তে ভালো লাগে, না হলে লোকে ওদের কাগজ কিনবে কেন। থার্ড ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে ওরা কি ভাবে আপনি কখনো খেয়াল করে দেখেছেন?
ভদ্রলোককে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই সে উদাহরণ দিতে শুরু করে কবে বাংলাদেশকে নিয়ে কি লিখেছে যা লেখার কোনো মানে হয় না, কবে কোন্ সত্যকে বিকৃত করেছে, কবে কোন্ সত্যকে গোপন করেছে, কবে কোন্ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে অবহেলা করেছে। এটা রুমীর প্রিয় বিষয়, সে এত জানে এ সম্পর্কে যে আজকাল কিবরিয়া ভাইও তার সাথে সাবধানে কথা বলেন। ভদ্রলোক একেবারে চুপসে গেলেন। এরপর আর কোনো গল্পই জমল না, ভদ্রলোক একটা ক্লাসের অজুহাত দিয়ে চলে গেলেন। তিনি চোখের আড়াল হতেই সেই মেয়েটি খুব অবাক হয়ে বলল, তুমি তো খুব জোর দিয়ে কথা বলো, আমি সব সময়ে ভাবতাম তুমি বুঝি খুব চুপচাপ।
রুমী মেয়েটার চোখের দিকে তাকায়, সুন্দর বিস্ময়াভিভূত চোখ দুটি দেখে ওর ভেতরে কি যেন নড়েচড়ে যায়। একটু হাসার ভঙ্গি করে বলে, আমি এমনিতেই চুপচাপই। কেউ বিদেশিদের মতো কথা বললে কেন জানি চুপ করে থাকতে পারি না। মাথা চুলকে বলে, বেশি বলে ফেললাম কি-না কে জানে, স্যারের পরীক্ষা সামনে।
মেয়েটি খিলখিল্ করে হেসে ওঠে খুব মিষ্টি স্বরে। বলে, না-না খুব ভালো করেছ! এখন যদি স্যারের গল্প করা কিছুটা কমে।
ক্লাসের ফাজিল মেয়েটা বলল, কবে যে স্যারের বিয়ে হবে আর আমরা রেহাই পাব! সবাই হো হো করে হেসে ওঠে। এ নিয়ে খানিকক্ষণ হাসাহাসি চলে, মেয়েটি একটু পরে আবার আগের ব্যাপার টেনে আনে, তুমি বুঝি এসব নিয়ে খুব ভাব?
রুমীর বুকের ভেতর কি যেন ঘটে যায়, কথা বলতে কষ্ট হয়। ওর। কোনোমতে বলে, বেশি আর কোথায়!
কিন্তু তুমি তো স্যারকে বলেছ খুব ভালো, এতগুলো রেফারেন্স দিয়েছ যে বেচারা স্যার কিছুই বলতে পারলেন না। আমেরিকা থেকে এসেছেন মোটে তিন মাস।
মেয়েটিকে রুমীর এত ভালো লেগে যায় যে বলার নয়। ইচ্ছে করে কাছে টেনে এনে ওর চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। নিজেকে ওর অনেক বড় মনে হয়, প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস অনুভব করে নিজের ভেতর। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে, কি হলো মেয়েটির কে জানে, হঠাৎ লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নেয়।
ফাজিল মেয়েটি বলল, ওই যা!
এরপর রুমীকে প্রায়ই ওই মেয়েটির সাথে দেখা যেতে লাগল–করিডোরে কথা বলছে, কেন্টিনে চা খাচ্ছে, লনে বসে চীনাবাদাম চিবুচ্ছে। এক ছুটির দিনে দুজন লুকিয়ে সিনেমাও দেখতে গেল।
রুমীর জীবনে সবচেয়ে আনন্দের সময় ছিল সেই কটা মাস। মেয়েটির জন্যে কি করবে সে ভেবে পেত না। ইচ্ছে করতো মেয়েটিকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতে, সমুদ্রের ধারে নারকেলগাছের ছায়ায়, নীল আকাশের নিচে নীল সমুদ্রের তীরে যেখানে তরঙ্গ পায়ের কাছে আছড়ে পড়ে। রাতে পড়তে বসে আনমনা হয়ে যেতো সে।
ঠিক বুঝতে পারে নি রুমী মেয়েটি আস্তে আস্তে কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গুটিয়ে যেতে থাকে নিজের ভেতর। প্রায়ই মনে হতো মেয়েটি ওকে কি যেন বলতে চায় কিন্তু পারে না। কি বলতে চায় ও যখন বুঝল তখন মেয়েটির বিয়ের কার্ড ছাপা হয়ে গেছে। প্রচণ্ড একটা আঘাত পেল রুমী, কেউ যেন ধারালো একটা ছুরি দিয়ে নিপুণভাবে ওর ভেতরটা চিরে দিয়ে গেছে। জীবন অর্থহীন হয়ে ওঠে ওর কাছে, প্রচণ্ড শূন্যতা নিয়ে দিনের পর দিন কাটে, কি করবে সে বুঝতে পারে না। আস্তে আস্তে সামলে নিয়েছে নিজেকে, শুধু বুকের ভেতর কোথায় জানি খানিকটা শূন্যতা রয়ে গেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকালে এখনো মেয়েটির কথা মনে হয় ওর। কোথায় আছে সে?
বিয়ের পর পরই মেয়েটি তার স্বামীর সাথে আমেরিকা চলে গিয়েছিল। অনেক চিন্তা করে সে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সে যদি না চাইতো ওখানে বিয়ে হতো না। ইচ্ছে করলে সে রুমীকে বিয়ে করতে পারতো। কিন্তু সে অনেক ভেবে দেখেছে রুমীর সাথে তার খাপ খাবে না। খুব ভালো লাগত ওর রুমীকে, ইচ্ছে করত রুমীর মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে রাখে, কিন্তু ও জানে বিয়ে হলে সব অন্যরকম হয়ে যাবে। ওর নিজের বোনকে দেখে শিখেছে, কত ভালোবাসা ছিল ওর বোনের। বিয়ের এক বছরের ভেতর দুজন দুরকম হয়ে গেল, ছোটখাটো জিনিস নিয়ে কি ভয়ানক ঝগড়া করে দুজন। ওর নিজের অনেক শখ, বিদেশে যাবে, চমৎকার একটা বাসা হবে দেশে ফিরে এলে, ওর ফুটফুটে ছেলেমেয়েরা বাসার লনে গুটি গুটি হেঁটে বেড়াবে। লাল একটা গাড়ি হবে ওদের, ছুটিতে ওরা ব্যাংকক বেড়াতে যাবে। কিন্তু রুমী অন্যরকম। ভবিষ্যতের কথা বললেই ওর চোখ স্বপ্নালু হয়ে যায়, টিনের ছাদে ঝমঝম্ করে বৃষ্টি পড়ছে, পালতোলা নৌকায় বসে হাওরের কালো পানির দিকে তাকিয়ে আছে, এর বেশি সে কল্পনা করতে পারে না। ওরা দুজন দুরকম, ওদের বিয়ে হলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে। অনেক ভেবেছে সে, অনেক ভেবে সে এখানে বিয়ে করেছে। রুমীর কথা মনে হয় এখনো, বড় ভালো ছেলে, তাকে নিশ্চই খুব ভুল বুঝেছে, কিন্তু কি করবে সে? রুমীর জন্যে সে তো ঠিক মেয়ে নয়, জীবন অনেক দীর্ঘ সময়, সেটা তো নষ্ট করতে পারে না, তার নিজেরটাও নয়, রুমীরটাও নয়।
ভদ্রলোকের নাম ড. আজহার আলী, বাঙালি, কিন্তু বিদেশেই থাকেন। দেশে এসেছিলেন, বেশিদিন থাকতে পারেননি, মোহভঙ্গ হয়ে ফিরে গেছেন। প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী দূর গ্যালাক্সির আলো বিশ্লেষণ করে কীভাবে জানি মুক্ত কোয়ার্কের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। সারা পৃথিবীতে খুব এ নিয়ে, রুমী নিজে নিউজ উইকে ভদ্রলোকের ছবি দেখেছে। কদিন আগে দেশে এসেছিলেন, সেমিনারে লোক আর ধরে না। হলের কমন রুমের টেলিভিশনে দেখেছে রুমী, বেশি বয়স না, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে হয়তো। বাংলা বলেন একটু অদ্ভুতভাবে, দীর্ঘদিন বিদেশে থেকে বোধ করি এমন হয়েছে।
আদিল রহমান, মধ্যবয়স্ক কিন্তু এখনো প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। প্রযোজকরা কেউ তাকে ছবি তৈরি করার টাকা দিতে চায় না। নিজের সবকিছু বিক্রি করে ধারদেনা করে ছবি তৈরি করলেন, ‘ হাতছানি’। কোনো সিনেমা হল প্রথমে দেখাতে রাজি হলো না। একটিতে কোনোরকমে এক সপ্তাহ টিকে থাকল, লোকজন দেখতে পর্যন্ত গেল না। কাগজে কিন্তু খুব ভালো সমালোচনা বের হলো, বিজ্ঞ লোকেরা যথেষ্ট প্রশংসা করলেন, তবু সেই ছবি বাজার পেল লোকজন ভুলেই গিয়েছিল ‘হাতছানির’ কথা, বার্লিনের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে সেটা সর্বশ্রেষ্ঠ ছায়াছবি হিসেবে সে-বছর প্রথম পুরস্কার পেয়ে গেল। শুধু তাই নয়, এ ছবিরই পরিচালক ও চরিত্রাভিনেতা শ্রেষ্ঠ হিসেবে সম্মান পেলেন। দেশে হৈচৈ পড়ে গেল, সব জায়গায় শুধু হাতছান’র গল্প। লোক ভেঙে পড়ল ছবি দেখতে। আদিল রহমান মাথা উঁচু করে দেশে ফিরে এলেন। তাঁকে নিয়ে কি মাতামাতি।
হৈচৈ কমে এলে আবার ছবি করতে চাইলেন ভদ্রলোক, প্রচণ্ড বাধা পেলেন আবার। স্টুডিওর লোকেরা সহযোগিতা করল না, নায়ককে গুম করে ফেলার ভয় দেখানো হলো। ভদ্রলোকের বাড়িতে গ্রেনেড ফাটল একদিন। আদিল রহমান সেই সপ্তাহেই স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে ইতালি চলে গেলেন। আর ফিরে আসেন নি। সেখানকার কি একটা ফিল্মের স্কুলে নাকি পড়ান এখন।
.
শাজাহান সুজা, বয়স মাত্র ত্রিশ, তার আঁকা তেল রঙের ছবি ‘প্রিন্স’ ওয়াশিংটন ডিসির মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছে। টাকাটা অবিশ্যি শাজাহান সুজা পান নি, পেয়েছে অন্য লোক যার কাছে ছবিটা বিক্রি করেছিলেন তিনি, খুব প্রিয় ছবি ছিল তার, নেহাত বিদেশে অর্থকষ্টে পড়েছিলেন বলে বিক্রি করেছিলেন ওটা। টাকা না পেলেও সম্মান ঠিকই পেয়েছিলেন। পৃথিবীর সব বড় বড় শিল্প সমালোচক প্রিন্সকে অসাধারণ কালজয়ী ছবি হিসেবে প্রশংসা করেছে। প্রিন্স ছবিটি কিন্তু খুব সাধারণ, কোনো নতুন টেকনিক বা স্টাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নেই। বিমূর্ত ছবি নয়, ছবিতে সত্যি সত্যি প্রিন্স বা রাজপুত্রকে চেনা যাচ্ছে, ক্ষুধার্ত উলঙ্গ একটি শিশু উবু হয়ে বসে তাকিয়ে আছে, জ্বলজ্বলে চোখে। অতি সাধারণ ছবি ভালো একটা ক্যামেরা দিয়ে অনায়াসে এরকম একটা ছবি তোলা যায় এ দেশের পথেঘাটে। কিন্তু তবু ছবিটিতে কি যেন একটা রয়েছে, অত্যন্ত স্পষ্ট, অত্যন্ত নির্মম, অত্যন্ত নিষ্করুণু, যা শুধু একজন শিল্পীই সৃষ্টি করতে পারে, ক্যামেরা পারে না। তাই সাধারণ ছবি হয়েও প্রিন্স অসাধারণ ছবি। যে-ই দেখেছে সে-ই স্বীকার করেছে এটা শুধু ছবি নয়, এটা গোটা পৃথিবীর দুঃখ-কষ্টের। ইতিহাস।
শাজাহান সুজা তার সম্মান নিয়ে দেশে ফিরে এলেন। রুমী অপেক্ষা করছিল কবে নাগাদ চলে যান দেখার জন্যে। এ দেশে কেউ থাকে না, কোনো কিছুতে একটু ভালো হলেই লোকজন এ দেশ ছেড়ে চলে যায়। শাজাহান সুজা বড় শিল্পী, তাঁর থাকার তো কোনো কারণই নেই। তবু তিনি থেকে গেলেন। চুপচাপ লোক, এখনো বিয়ে করেন নি। অনেক মেয়ের গোপন দীর্ঘশ্বাস দীর্ঘতর করে শাজাহান সুজা ক্যামেরা নিয়ে তার লাল রঙের গাড়ি করে ঢাকা শহর ঘুরে বেড়ান। রুমী খুব পছন্দ করে তাকে, সুযোগ পেলে একবার কথা বলে দেখবে, এত বিখ্যাত লোক সুযোগ পাবে কি না সেটাই সন্দেহ। দেশের জন্যে রুমীর খুব মমতা, দেশের বড় বড় লোকজন যদি ফিরে আসে তাহলে দেশের লোককে আশা দেওয়া যায়। না হলে তারা কাকে দেখে মুগ্ধ হবে, আশা পাবে? যোগ্য মানুষ এ দেশে অনেক আছে, কিন্তু তারা স্বীকৃতি পায় না যতদিন না পাশ্চাত্য দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়। এ নিয়ে রুমীর দুঃখটা আন্তরিক।
জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাপারটা অনেকের চোখে পড়ল। গত কয়েক মাসে অন্তত চারটি শিশু অস্বাভাবিকভাবে মারা গেছে। প্রথমে সবাই ভেবেছিল বুঝি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, কিন্তু তিন মাসের মাথায় দেখা গেল এগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ব্যাপারটা বুঝতে তিন মাস সময় লাগার আরও একটা কারণ আছে। যে সমস্ত শিশু এ সময়ে মারা গেছে বা নিখোঁজ হয়েছে তারা সবাই গরিবের সন্তান, রাস্তাঘাট… বড়জোর বস্তিতে থাকে। তাদের বেঁচে থাকাটাই বিস্ময়, তাই হঠাৎ করে মারা গেলে কেউ অবাক হয় না, মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ সভ্য লোকজনের কান পর্যন্ত পৌঁছোয় কিন্তু ঢাকা শহরে তিন মাসে অন্তত চারটি শিশুর অস্বাভাবিক মৃত্যু, দুজন নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ একটু বাড়াবাড়ি, তা সে যত গরিবের সন্তানই হোক। প্রথম প্রথম শিশুগুলির মৃতদেহ পোস্টমর্টেম পর্যন্ত করা হয় নি। তৃতীয় শিশুটির বেলায় একটু হৈচৈ হলে তাকে পোস্টমর্টেম করে দেখা গেল তাকে বিষ প্রয়োগে মারা হয়েছে। চতুর্থ শিশুটিকে মারা হয়েছে গলা টিপে। শহরে এবার কিছুটা হৈচৈ পড়ে গেল, খবরের কাগজে লেখালেখি হলো, সমাজব্যবস্থাকে একচোখা বলে গালি দেওয়া হলো, কিন্তু সুরাহা হলো না ব্যাপারটার। নওয়াবপুর রোডে আধপাগল গোছের একজন লোক একটা বাচ্চাকে আদর করতে গিয়ে খামোখা প্রচণ্ড মার খেলো একদিন। শহরের মা-বাবারা সতর্ক হয়ে গেলেন, ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে আর চোখের আড়াল করতে চান না। কিন্তু যে ধরনের ছেলেমেয়েরা মারা যাচ্ছিল সেই সব পথের শিশু ঠিকই পথে পথে ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাদের বেঁচে থাকতে হলে ঘুরে বেড়াতে হয়, এখানে-সেখানে ছোটখাটো কাজ, ভিক্ষা ও চুরিচামারি করে বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে হয়। তাদের ঘর নেই, বন্ধ হয়ে থাকবেই বা কোথায়?
ব্যাপারটা নিয়ে হৈচৈ হওয়ার পর প্রায় মাসখানেক কিছু ঘটল না। একজন-দুজন নিখোঁজ হয়েছে হয়তো, কিন্তু পথের ছেলেমেয়েরা কখন সত্যিই নিখোঁজ হয়েছে, আর কখন নিজেই কোথায় চলে গিয়েছে ঠিক করে বলা মুশকিল।
ফেব্রুয়ারি মাসে আবার সবার টনক নড়ল, চার বছরের একটা শিশুকে প্রকাশ্য রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেল। নির্মমভাবে তাকে ধারালো কিছু দিয়ে আঘাত করে মারা হয়েছে। যখন তাকে পাওয়া গেছে তখনো তার মৃতদেহ শীতল হয়ে যায় নি। মুখের যন্ত্রণার অভিব্যক্তি থেকে যেটা বড় সেটা হচ্ছে ভীতি। কি ভয়ানক ভীতি, মৃত্যুর মুখোমুখি হলেই বুঝি এরকম ভীতি সম্ভব।
সারা শহরে এবার হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। অনেকে এবার সত্যিসত্যি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাজনৈতিক দলগুলি মাইক নিয়ে বস্তিতে বস্তিতে সবাইকে সচেতন করার জন্যে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াল। ছোট ছোট ছেলেমেকে শিখিয়ে দেওয়া হলো কখনো যেন তারা অপরিচিত কারো কাছে না যায়, অপরিচিত লোকদের দেওয়া কিছু না খায়, কখনো যেন একা হাঁটাহাঁটি না করে, রাতে কখনো পথেঘাটে ঘোরাঘুরি না করে, সন্দেহজনক কিছু দেখলেই যেন বয়স্ক কাউকে বা পুলিশকে জানায়। রাস্তার মোড়ে মোড়ে বয়স্কাউট আর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীরা তাদের অফিস খুলে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করল।
কিন্তু তবু ব্যাপারটি বন্ধ হলো না, প্রায় নিয়মিতভাবে দুই থেকে তিন সপ্তাহের ভেতর একটা করে শিশু নিখোঁজ হতে লাগল। সব সময়েই যে শিশুগুলির মৃতদেহ পাওয়া যেতো তা নয়, কিন্তু যে একবার নিখোঁজ হয়েছে সে আর কখনো ঘুরে আসততা না, তা থেকে সবাই প্রায় নিঃসন্দেহ হতো যে তাদেরও মেরে ফেলা হয়েছে। আরও নিঃসন্দেহ হওয়া গেল কারণ কদিন পরেই সাভারের কাছে একটা ডোবায় একজন চারটে মৃতদেহ আবিষ্কার করল। সবই বাচ্চাদের দেহ, দীর্ঘদিনে সেগুলি বিকৃত হয়ে এমন অবস্থা হয়েছে যে কাউকে চেনার উপায় নেই। পুলিশ অনেকদিন খবরটা চেপে রেখে সেখানে চব্বিশ ঘণ্টা গোপন পাহারার ব্যবস্থা করেছিল, কিন্তু কোন লাভ হয় নি, হত্যাকারী সেখানে আর কখনো ফিরে আসে নি।
চেষ্টার অবিশ্যি কোনো ত্রুটি ছিল না। দিনরাত অসংখ্য পুলিশ সাদা পোশাকে সারা শহরে ছড়িয়ে থাকতো। শিশুর মৃতদেহে হাতের ছাপ বা অন্যান্য চিহ্ন খুঁজে বের করার জন্যে মূল্যবান যন্ত্রপাতি কিনে আনা হলো। ফরেনসিক এক্সপার্ট একজনের ট্রেনিং বাতিল করিয়ে দিয়ে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হলো। একদিন কারফিউ দিয়ে মিলিটারি আর পুলিশ সারা শহর তন্নতন্ন করে খোঁজাখুঁজি করল। কেউ হত্যাকারী সম্পর্কে কোনো খোঁজ দিতে পারলে তাকে দশ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করা হলো। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সে-টাকা কদিনের ভেতর বাড়িয়ে এক লাখ করে দিল, কিন্তু তবু কোনো লাভ হলো না। টাকার লোভে আজকাল লোকজন অনেক ঘন ঘন খবর নিয়ে আসে, কিন্তু সব খবরই ভিত্তিহীন। দেখতে দেখতে পাঁচ মাস হয়ে গেল, তবু ঘটনার কোনো কিনারা হলো না।
দুস্থ শিশুদের পথেঘাটে ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করার জন্যে অনেক বড় বড় পরিকল্পনা নেওয়া হলো। শহরের বড় বড় বস্তিতে ছোট শিশুদের জন্যে লঙ্গরখানা খোলার ব্যবস্থা করা হলো। প্রচুর টাকার প্রয়োজন, সবাই নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা করল। সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা তাদের একদিনের বেতন দান করল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তাঘাটে দাঁড়িয়ে লোকজনের কাছ থেকে টাকা তুলতে লাগল। বড় শিল্পীরা গানের আসর করলেন, অনেক মোটা টাকায় টিকিট বিক্রি করে পুরো টাকাটা শিশুদের জন্যে দান করা হলো। শাজাহান সুজা তার ছবির প্রদর্শনী করলেন, প্রদর্শনী শেষে ছবিগুলো নিলামে বিক্রি করা হলো। স্থানীয় বিদেশিরা অবিশ্বাস্য দাম দিয়ে ছবিগুলি কিনে নিল, শাজাহান সুজার ছবি কিনলে নাকি টাকা খরচ করা হয় না, টাকা খাটানো হয়, কদিন পরে ছবিগুলি হয়তো লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে। ছবি প্রদর্শনী থেকে অনেক টাকা উঠল, পুরো টাকাটাই শাজাহান সুজা শিশুদের জন্যে দিয়ে দিলেন।
.
দরজায় টোকা শুনে উঠে দরজা খুলে দেয় রুমী, বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ ওর ভেতরটা চমকে ওঠে। হলে আশেপাশের দরজা থেকে অনেক ছেলে উঁকি দিয়ে দেখছে, পুলিশ এ সমাজে খুব ভয়াবহ জীব। পুলিশ অফিসার হাত বাড়ালেন, চিনতে পারছেন?
চিনতে পারল রুমী, এক রাত হাজতবাসের সময় এই পুলিশ অফিসার তাকে জেরা করেছিলেন, তাকে অবিশ্বাস করে হাজতে পুরেছিলেন আবার তার কথা সত্যি হওয়ার পর নিজে গিয়ে লকআপ খুলে বের করে এনেছিলেন। রুমী হাত বাড়িয়ে বলল, চিনতে পারব না! এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাব! আমার জীবনের প্রথম হাজতবাস!
ভদ্রলোক জোরে জোরে হাসলেন, তাই শুনে আশেপাশের সবাই বুঝল ভয়ের কিছু নেই, যে যার নিজের কাজে ফিরে গেল। ভদ্রলোক রুমীর সাথে তার ঘরে ঢুকে এদিক-সেদিক তাকালেন। চমৎকার ঘর, চমৎকার দৃশ্য ইত্যাদি বলে রুমীকে একটা সিগারেট দিয়ে নিজে আরেকটা ধরিয়ে কাজের কথায় চলে এলেন। রুমী বুঝতে পেরেছে কি জন্যে এসেছেন, তবু নিজের কানে শোনার জন্যে অপেক্ষা করে রইল।
মনে আছে আপনি হাজতে বসে আশফাক হাসানের কেসটা কীভাবে বলে দিয়েছিলেন?
মাথা নাড়ে রুমী।
আমি নিজে না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। অবিশ্বাস্য!
চুপ করে থাকে রুমী। ভদ্রলোক একটু নিচু গলায় বললেন, আপনাকে আবার সাহায্য করতে হবে।
রুমী নড়েচড়ে বসে বলে, কি সাহায্য?
পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কিছুতেই বাচ্চাদের মার্ডারকে ধরতে পারছে না। কোনোদিকে এতটুকু চিহ্ন নেই। এত চেষ্টা করা হচ্ছে আপনি কল্পনা করতে পারবেন না, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। আপনি যদি আগের মতো বলে দেওয়ার চেষ্টা করেন, জাস্ট একটু ধরিয়ে দেবেন, কোনো ধরনের ব্লু, জাস্ট ছোট একটা ক্ল…
রুমী আস্তে আস্তে বলে, আমি পারলে সত্যি বলতাম। আপনি না এলেও আমি চেষ্টা করতাম। ঠাট্টা করে বলে, অন্তত টাকাটার লোভে চেষ্টা করতাম! কিন্তু বিশ্বাস করুন, আজ তিন বছর ধরে
আমি আর পারি না। একেবারেই পারি না।
ভদ্রলোকের খুব আশাভঙ্গ হলো। মরিয়া হয়ে লুকিয়ে রুমীর কাছে এসেছিলেন তিনি। শিশু হত্যাকারীকে ধরার জন্যে সম্ভাব্য সবকিছু চেষ্টা করা হচ্ছে। পুলিশের ডিআইজি নিজে নাকি সব কজন পীরের কাছে গিয়ে ধর্না দিয়েছেন, কোনো লাভ হয় নি।
ভদ্রলোক যাবার সময় রুমীকে নিজের নাম আর ফোন নম্বর দিয়ে গেলেন। যদি কোনোভাবে কোনোরকম হদিস পায় তাকে জানাতে যেন দ্বিধা না করে।
রুমী সে রাতে অনেকক্ষণ ভাবল ব্যাপারটা। তার যে কথাটা আগে মনে হয় নি তা নয়, এমনকি কিবরিয়া ভাইও একবার তাকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। পুরস্কারের টাকাটা এক লাখ হয়ে যাবার পর তার নিজেরও প্রচণ্ড লোভ হয়েছিল। তবু কিছুতেই সেই অন্ধকার জগতে ফিরে যেতে চায় না রুমী। যাদের অভিজ্ঞতা হয় নি তারা কোনোদিন ওর ব্যাপারটা বুঝতে পারবে না। এটা অনেকটা চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো, ড্রাইভার ট্রেনের ব্রেক কষে থামাতে পারবে কি না জানা নেই। যতবার ওই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে, ততবারই সে তার ভেতর থেকে ফিরে আসতে পারবে বলে ভাবতে পারে নি। ব্যাপারটা এখন অতীত, তবু ওর বুকের ভেতর ভয়টুকু রয়ে গেছে, প্রচণ্ড অশরীরী ভয়, সে ভয়ের রাজ্যে আর ফিরে যেতে চায় না রুমী।
ঘুরেফিরে একসময়ের সর্বনাশা ক্ষমতার কথা মনে হতে থাকে ওর। শিশু হত্যাকারীদের ওপর সবার মতো সে নিজেও এমন বিরক্ত হয়ে উঠেছে যে বলার নয়, আরও কিছুদিন এরকম চললে ও সত্যিই চেষ্টা করে দেখবে হত্যাকারীর মনের ভেতর প্রবেশ করা যায় কি না। এখন সে তা পারে না, ক্ষমতাটা শেষ হয়ে গেছে, তবু চেষ্টা করাটা ওর কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কে জানে হয়তো তার ভেতরে কোথাও এখনো ক্ষমতাটা লুকিয়ে আছে, চেষ্টা করলেই বের হয়ে আসবে। তাই যদি হয়, তবে শিশুগুলির মৃত্যুর জন্যে সে-ও খানিকটা দায়ী হবে।
.
চিৎকার করে উঠে বসে রুমী। স্বপ্নে দেখেছে ছোট একটা শিশু প্রচণ্ড ভয় পেয়ে আর্তনাদ করছে। যন্ত্রণায় ওর সারা মুখ বিকৃত হয়ে উঠেছে, চোখ দুটি যেন ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দেখতে দেখতে ছোপ ছোপ রক্তে ওর মুখ ভরে উঠছে। শিশুটি তখনো চিৎকার করে যাচ্ছে, অসহায় ব্যাকুল চিৎকার, দেখে বুক ফেটে যেতে চায়।
ঘুম ভেঙে বিছানায় উঠে বসে রুমী, দরদর করে ঘামছে সে, বুকের ভেতর ধক ধক করছে। কি ভয়ানক! ইশ! কি ভয়ানক স্বপ্ন!
রুমীর বুকের ভেতর বহু পুরোনো চাপা একটা ভয় বাসা বাঁধতে থাকে, ও জানে এটা শুধু স্বপ্ন নয়-স্বপ্নের থেকে অনেক বেশি।
পরদিন ভোরে খবরের কাগজে বড় বড় করে লেখা হলো, আরও একটি হতভাগ্য শিশু। পাশেই শিশুটির রক্তাক্ত ছবি। রুমী চিনতে পারল একেই সে দেখেছে গতরাতে।
নয়
সারাদিন ধরে প্রস্তুতি নিল রুমী, আজ রাতে সে শিশু হত্যাকারীকে খোঁজার চেষ্টা করবে। আগে কখনো এ ধরনের চেষ্টা করে নি ও, পারবে কি না তাও জানে না, কিন্তু আগের রাতে সেই হতভাগ্য শিশুটিকে দেখার পর ওর মনে হয় ব্যাপারটা সম্ভব হতেও। পারে। ওর প্রস্তুতির বেশির ভাগই মানসিক। শানুকে একটা লম্বা চিঠি লিখল, অনেকদিন দেখা হয় না, সময় পেলেই বেড়াতে যাবে, ভাগনেরা সব কেমন আছে–এ ধরনের কথাবার্তা। দুপুরে অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে পরিষ্কার কাপড় পরল সে। খাওয়ার পর ভালো এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনল দোকান থেকে। লাইব্রেরির কটা বই ছিল তার কাছে, সব সময় পাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে পেয়েছে সে, তবু সেগুলি কি ভেবে ফেরত দিয়ে এলো। একটা ছেলের কাছ থেকে দশ টাকা ধার করেছিল সেদিন, টাকাটা ফিরিয়ে দিয়ে এলো। পুলিশ অফিসারকে জানাবে কি না ভেবে না পেয়ে, না জানানোই ঠিক করল। রাতে যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায় সেটা ওর পাশের রুমের ছেলেটি জানতে পারবে। আজকাল ভোরে নাস্তা করতে যাওয়ার সময় রোজ তাকে ডেকে নিয়ে যায়। সন্ধ্যে হয়ে এলে বুকের ভেতর যেন কেমন করতে থাকে। রুমীর। কে জানে শেষ পর্যন্ত কিছু হবে কি না! সে একটু পর পর নিজের মনের ভেতর খুঁজে দেখে অশুভ কোনো অনুভূতি জেগে উঠছে কি না। আজ সারাদিনই ওর বুকে একটা চাপা ভয়, সবকিছুকেই ওর অশুভ মনে হয়।
একটু সকাল সকাল খেয়ে নেয় রুমী। কারো সাথে কথা না বলে নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাতি নেভানোর আগে একটা সিগারেট ধরায়, অন্ধকারে সিগারেট খেয়ে সে মজা পায় না। কোনোরকমে সিগারেট শেষ করে বাতি নিভিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বিছানায় বসে। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শিশুগুলির কথা ভাবতে থাকে সে। যে মানুষ এরকম অবোধ শিশুদের মারতে পারে সে না জানি কি রকম! কে জানে হয়তো এটাও কোনো ধরনের প্রেত-সাধনা–রুমীর বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে ওঠে। সাথে সাথেই তার টুপি মাথায় সেই বৃদ্ধিটির কথা মনে। পড়ে, সে তাকে বুঝিয়েছিল মানুষের ভেতর কত ক্ষমতা আছে তা সে জানে না, জানলে প্রথিবী অন্যরকম হয়ে যেতো। সে নিজেকে সাহস দেয় অতীতে যা ঘটেছে তা অতীতেই থাকবে, ভবিষ্যতে আর ঘটতে দেবে না।
…লুসি ইন দা স্কাই…ডায়ম…হঠাৎ করে রুমীর ভেতরে একটা ইংরেজি গানের সুর ভেসে ওঠে। মুহূর্তে সোজা হয়ে বসে রুমী। কেউ একজন গান গাইছে! কে লোকটা? হঠাৎ গান বন্ধ হয়ে তীব্র গালাগালি শুরু হয়ে যায়, সে ভাষা বুঝতে পারে না রুমী কিন্তু অনুভূতিটা বুঝতে পারে। প্রচণ্ড ঘৃণা কারো ওপর, প্রচণ্ড ঘৃণা! চোখ বন্ধ করে দেখার চেষ্টা করে রুমী, কিচ্ছু দেখতে পায় না। সমস্ত মনপ্রাণ একত্র করে সে চেষ্টা করতে থাকে। হঠাৎ হঠাৎ একটা দুটো ছবি ভেসে ওঠে, কিন্তু তেমন পরিষ্কার হয় না। মনে হচ্ছে সে দ্রুত ভেসে যাচ্ছে, যেন হাওয়ায় ভর করে-একটা দোকান, একটা লাইট পোস্ট, ঠেলাগাড়িতে শুয়ে আছে একজন…আবার অন্ধকার।
আর একটা হলেই হয়। শালারা এত সাবধান হয়ে গেছে! আবার অশ্রাব্য গালি, এবারে বাংলায়। রুমী বুঝতে পারে লোকটা ছোট বাচ্চার কথা বলছে। সে ঠিক লোকটাকেই পেয়েছে। এতক্ষণ ভাবছিল বিদেশি, কিন্তু না বিদেশি নয়। সারা মনপ্রাণ একত্র করে মানুষটার ভেতরে মিশে যাবার চেষ্টা করে রুমী, পারে না, বারবার লোকটা ওর কাছ থেকে যেন ফস্কে বেরিয়ে যায়। কিন্তু সে হাল ছাড়ে না, প্রচণ্ড একাগ্রতা নিয়ে পেছনে লেগে থাকে।
আস্তে আস্তে লোকটাকে অনুভব করতে পারে সে, দেখতে পায় লোকটার চোখ দিয়ে, ভাবনাগুলি জানতে পারে। গাড়ি চালাচ্ছে রুমী, চোখ দুটি ঘুরছে রাস্তার দুপাশে, ছোট শিশু খুঁজছে সে। আপন মনে গান গাইছে, লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ড, ঘুরেফিরে একটা লাইনই গাইছে সে অনেকক্ষণ ধরে। কি গান এটা? লোকটাকে দেখতে পায় না ও, তার চোখ দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখে, কিন্তু তাতে লাভ কি? লোকটাকে ওর দেখা দরকার।
পারল না রুমী, হঠাৎ করে সে লোকটার অনুভূতি হারিয়ে ফেলল। কিছুক্ষণ লাগল ওর বুঝতে ও কোথায় আছে। নিজের বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। ভীষণ ক্লান্তি অনুভব করে, আগে কখনো সে এত ক্লান্তি অনুভব করেনি। কে জানে, জোর করে চেষ্টা করছে বলেই হয়তো এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তবু ওর বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে যায়। লোকটাকে পেয়েছে সে, এবারে তার পরিচয় বের করতে হবে। লোকটার গাড়ি আছে, অন্ধকারে বোঝা যায় না কি রং। বিদেশি ভাষায় কথা বলতে পারে সে, ইংরেজি গান গায় লুসি ইন দ্য স্কাইন না কি যেন। কি গান এটা? বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না রুমী, মড়ার মতো ঘুমিয়ে পড়ে সে।
পরদিন ফোন করে পুলিশ অফিসারকে পেল না রুমী, কি কাজে জানি রাজশাহী গেছেন, দুদিন পর ফিরে আসবেন। একটু আশাভঙ্গ হলো তার, ভদ্রলোক শুনলে খুশি হতেন। অবিশ্যি এখন পর্যন্ত সে বিশেষ কিছু জানতে পারে নি, লোকটা কোথায় থাকে বের করতে হবে, কি রকম চেহারা, কি নাম সব জানতে হবে।
রাত গম্ভীর হয়েছে। লোকটা আবার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। লাল রঙের গাড়ি, রুমী দেখতে পেয়েছে আজ। লোকটা গাড়ি চালায় খুব বেপরোয়াভাবে। প্রতিবার একটা রিকশা পার হয় আর কুৎসিত গালি দেয় রিকশাওয়ালাকে। লোকটা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে একটা বাচ্চার জন্যে, অপেক্ষা করতে পারছে না আর। গান গাইতেও মনে নেই, চোখ দুটো শুধু নড়ছে দুই পাশে।
কি একটা কাজ আটকে আছে ওর, রুমী অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না। একটা বাচ্চা না পেলে সে কাজটা শেষ করতে পারছে না। অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিচ্ছে বাচ্চাদের, মানুষ বলেই ভাবে না, কুকুর-বেড়ালের মতো দেখে সে ওদের। জীবন সার্থক করে দিচ্ছে সে শিশুগুলির, সেজন্যে ওদের খুশি হওয়া উচিত। মরে তো এমনিতেই শেষ হবে, একটা কাজে লাগলে ক্ষতি কি?
তৃতীয় রাত। ঘরের বাইরে গেল না রুমী, অন্ধকার ঘরে বসে মদ খেলো সারাক্ষণ। মন-মেজাজ খুব খারাপ, মদ খেয়ে আরও খারাপ হয়ে গেল। বসার ঘরে টেলিফোন বেজেই চলল, সে গিয়ে ধরল না পর্যন্ত।
চতুর্থ রাত। কি আনন্দ! কি আনন্দ! বাচ্চা পেয়েছে সে একটা, ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে এখন। কাল ভোর থেকেই কাজ শুরু করে দেবে। অনেক দূর যেতে হয়েছে আজ, শহরের সবাই এত সাবধান হয়ে গেছে যে বলার নয়। তার এতগুলি কায়দা ছিল বাচ্চা ধরে আনার তবু কোনোটাই কাজে লাগছে না আজকাল। দূরে গ্রামের দিকে শিশুগুলি এখনো সাবধান হয় নি, সেখান থেকেই ধরে এনেছে সে। সবার এটা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার দরকার কি সে বুঝতে পারে না। সে তো খারাপ কিছু করছে।, বাচ্চাগুলি তো এমনিতেই মরে ভূত হয়ে যেতো, এখন তবু একটা কাজে লাগছে। লোকটা হালকা সুরে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বাথরুমে গেল, রুমী প্রস্তুত হয়ে নিল সাথে সাথে, বাথরুমে আয়নায় চেহারা ভালো করে দেখে নিয়ে মনে রাখতে হবে। চেহারার থেকে বেশি দরকার লোকটার পরিচয়, বাসার ঠিকানা।
বাথরুমে বাতি জ্বালিয়ে লোকটা আয়নার দিকে তাকাল, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিজেকে দেখছে।
লোকটাকে আগে দেখেছে রুমী, কিন্তু মনে করতে পারছে না কোথায় দেখেছে। কে? কে লোকটা? কে?
হঠাৎ চিনতে পারে রুমী, হতবাক হয়ে যায়, শাজাহান সুজা!
.
পুলিশ অফিসার গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন, আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়ে যাবে এখন।
রুমী জোর দিয়ে বলল, আমি স্পষ্ট দেখেছি শাজাহান সুজাকে। আমি ওকে ভালো করে চিনি, ওর একটা লাল গাড়িও আছে।
কিন্তু ওর বাসায় আমি কিছু পাই নি, বললেন পুলিশ অফিসার। সবকিছু তন্নতন্ন করে দেখেছি। ভীষণ খেপেছে শাজাহান সুজা, ডিআইজিকে ফোন করেছে, এখন আমার চাকরি যাবার দশা।
রুমী মাথা নেড়ে বলল, আমি স্পষ্ট দেখেছি, বিশ্বাস করুন আমাকে।
কিন্তু কি করবে ও বাচ্চাকে মেরে?
জানি না। কি একটা খুব নাকি জরুরি দরকার। কি কাজ কিছুতেই বুঝতে পারলাম না।
পুলিশ অফিসার মুখ গম্ভীর করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। একটু পড়ে বললেন, হয়তো এতদিন পরে আপনার ক্ষমতাটা কমে আসছে, ঠিক করে বলতে পারছেন না আজকাল…
উত্তেজিত হয়ে বাধা দেয় রুমী, কক্ষণো না। আমি ঠিক বুঝতে পারি কখন কি হচ্ছে।
কিন্তু আমাদের হাত-পা বাঁধা। শাজাহান সুজাকে হাতেনাতে ধরতে না পারলে কিছুতেই প্রমাণ করা যাবে না। আপনার কথার ওপর ভরসা করে ওকে তো অ্যারেস্ট করতে পারি না।
রুমী এবারে রেগে ওঠে। চেষ্টা করে রাগটা চেপে রাখতে, তবু ওর গলার স্বরে সেটা প্রকাশ হয়ে যায়, আপনিই নিজে গিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন একটা কিছু আভাস দিতে। এখন আমি বলে দিচ্ছি লোকটা কে তবু আমার কথা বিশ্বাস করছেন না।
বিশ্বাস করছি না কে বলল? ভদ্রলোক বাধা দিলেন, আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে শাজাহান সুজাকে চোখে চোখে রাখলেই সে ধরা পড়বে।
কতদিন চোখে চোখে রাখবেন?
যতদিন সে আবার একটা কিছু না করছে।
মানে? আর সে যে আরেকটা বাচ্চা ধরে এনেছে। তাকে যদি…
আমি ওর বাসা দেখেছি, কোনো বাচ্চা নেই।
আমি বলছি আছে, আমাকে নিয়ে চলুন।
তা হয় না। ভদ্রলোক নরম গলায় বললেন, শাজাহান সুজা খুব ক্ষমতাশালী লোক। আপনি বুঝবেন না, ওকে হাতেনাতে ধরলেও ওর নামে কেস করা খুব মুশকিল হবে।
আস্তে আস্তে বলল রুমী, তার মানে আপনি ওই বাচ্চাটাকে শাজাহান সুজার হাতে মরতে দেবেন?
ভদ্রলোক দুর্বল গলায় বললেন, ওর বাসায় কোনো বাচ্চা নেই।
রুমী টেবিলে কিল মেরে বলল, একশোবার আছে। কাল-পরশু যখন বাচ্চাটাকে রাস্তায় মরে পড়ে থাকতে দেখবেন তখন বিশ্বাস করবেন।
আমাদের ওই একটা চান্স! আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে শাজাহান সুজাকে কোথাও না কোথাও মৃতদেহটা ফেলতে হবে। তখন হাতেনাতে ধরে…
রুমী লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, চিৎকার করে বলে, তার মানে ওই ছেলেটাকে জান দিতে হবে ওকে ধরার জন্যে, আপনারা জেনেশুনে শিশুটিকে মরতে দিচ্ছেন?
ব্যস্ত হবেন না, আমার কথা শুনুন। ভদ্রলোক রুমীকে হাত ধরে বসিয়ে দিলেন।
ব্যাপারটা এইভাবে দেখুন, ছেলেটা হয়তো মারা যাবে, তবু আমরা ওকে ধরতে পারব, এ ছাড়া তাকে ধরার আর কোনো উপায় নেই। আপনার কথা শুধু আমিই বিশ্বাস করছি, অন্য কেউ বিশ্বাস করবে না। শুধু তাই নয়, আপনি যদি অন্য কাউকে এটা বলতে যান, আপনি নিজে সমস্যায় পড়ে যাবেন। শাজাহান সুজা ছলিমদ্দি, কলিমদ্দি না, শাজাহান সুজা হচ্ছে শাজাহান সুজা, দেশের সম্পদ। ওই বাচ্চাটা মারা গিয়ে হয়তো আরও দশটা বাচ্চার জান বাঁচাবে।
মাথা নাড়ে রুমী, আমি কিছুতেই আপনার কথা মানতে পারব না। এক হাজার পুলিশ দিয়ে ওর বাড়ি ঘেরাও করুন, হারামজাদাকে ধরে গরুর মতো পিটিয়ে ওর মুখ থেকে কথা বের করুন…
আপনি এখনো অনেক ছেলেমানুষ। দুনিয়া বড় কঠিন। জায়গা। পকেটমারকে ধরে পেটানো যায়, যদিও সে পকেট মারছে ছেলেমেয়েদের খাওয়ানোর জন্যে। শাজাহান সুজারাও ছাড়া পেয়ে যায়, যদিও খুন করছে নিছক আনন্দের জন্যে।
ঠিক তক্ষুনি একটা টেলিফোন এলো। রুমী পুলিশ অফিসারের কথা শুনে বুঝতে পারে শাজাহান সুজার বাসায় গিয়েছিলেন বলে কৈফিয়ত তলব করা হচ্ছে। খবরের কাগজে খবর চলে গিয়েছে, কাল ভোরে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের মুখ দেখানোর উপায় থাকবে না। ভদ্রলোক মুখ কালো করে শুনে গেলেন। কোন খবরের ওপর ভরসা করে শাজাহান সুজার বাসায় গিয়েছিলেন বলার উপায় নেই। আমতা আমতা করে বললেন, সাভারের রাস্তায় একটা লাল গাড়ি দেখা গিয়েছিল, শাজাহান সুজার গাড়িও লাল…।
ফোনের অন্য পাশ থেকে একটা অট্টহাসির মতো শব্দ ভেসে এলো। রুমী প্রায় দুহাত দূরে বসে স্পষ্ট শুনল ওপাশ থেকে বলছে, তাহলে ফায়ার ব্রিগেডের লোকজনকে অ্যারেস্ট করো না কেন? ওদের গাড়িও তো লাল!
ভদ্রলোক ফোন রেখে বললেন, আজকালের ভেতর এটার কোনো কিনারা না হলে আমার গারো পাহাড়ে পোস্টিং হয়ে যাবে!
ক্ষুব্ধ হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়াল রুমী, ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করে সেও খানিকটা বুঝতে পেরেছে কেন এখন শাজাহান সুজাকে ধরার উপায় নেই। ওর মনে পড়ে প্রেত উপাসকের দল হাতেনাতে ধরা পড়েও শেষ পর্যন্ত ছাড়া পেয়ে গিয়েছিল। তবুও চুপচাপ একটা শিশুকে মরতে দিতে কিছুতেই ওর মন সায় দিচ্ছে না।
রুমী খেয়াল করে নি কখন সে হাঁটতে হাঁটতে শাজাহান সুজার বাড়ির কাছে চলে এসেছে। সম্ভ্রান্ত এলাকা, ঝকঝকে বাসাগুলি আশ্চর্য রকম চুপচাপ। প্রায় বাসাতেই বড় বড় কুকুর, ঘেউ ঘেউ করে ঐশ্বর্যের কথা জানিয়ে দেয়।
শাজাহান সুজার বাড়িটি একতলা, ছিমছাম। বাইরে বড় লোহার গেট, সেখানে মস্ত তালা ঝুলছে। এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল রুমী। কে জানে হয়তো এর ভেতর এখন শাজাহান সুজা বাচ্চাটিকে হত্যা করছে। ভাবতে ভাবতে একটা শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকার শুনতে পেল রুমী। চমকে ঘুরে তাকায় সে, কেউ নেই। চিৎকারটি সে শুনতে পায়নি, অনুভব করেছে। কিন্তু এত স্পষ্ট আর
জীবন্ত অনুভূতি এর আগে কখনো হয় নি।
চলে যাচ্ছিল রুমী, হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। শাজাহান সুজার গলা শুনতে পেল সে, দেখি কত সহ্য করতে পারিস হারামজাদা। রুমীর মনে হলো ওর কানের কাছে চিৎকার করে বলছে শাজাহান সুজা। এত জীবন্ত গলার স্বর যে রুমীর গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আবার শাজাহান সুজার হিংস্র চিৎকার শুনতে পেল রুমী, আর সাথে সাথে একটা শিশুর প্রাণফাটা আর্তনাদ। রুমীর চোখের সামনে একটা শিশুর রক্তমাখা মুখ এক মুহূর্তের জন্যে ভেসে ওঠে। ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটতে থাকে সে, আর সহ্য করতে পারে না। কিন্তু ছুটে গিয়েও রেহাই পায় না সে, শিশুটার প্রাণফাটা আর্তনাদ তাকে তাড়া করতে থাকে।
পাগলের মতো ছুটতে থাকে রুমী, আর কি ভাগ্য তখনি খালি রিকশা পেয়ে যায়। কোনোমতে উঠে বলে, তাড়াতাড়ি চলো।
কোথায়?
যেখানে খুশি। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে প্রাণপণে রিকশা ছুটিয়ে চলে।
অনেকক্ষণ পর সম্বিৎ ফিরে পায় রুমী। অনেক ঘুরেফিরে সে হলের কাছে এসে পৌঁছেছে। বাচ্চাটার আর্তনাদ আর সে শুনতে পাচ্ছে না কিন্তু তাতে লাভ কি? সে ভুলবে কি করে?
দশ
সারা বিকেল সে চুপচাপ বসে ভেবেছে। ঘুরেফিরে বারবার ওর তিন বছর আগের সেই টুপি মাথায় শান্ত মতন বুড়ো লোকটার কথা মনে পড়েছে। তাকে বলেছিল, বাবা, তোমার সাহস থাকলে বলতাম তুমি ওই লোকদের শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দাও। তখন তার সাহস ছিল না, যে কোনোভাবে এই যন্ত্রণাদায়ক ক্ষমতার হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে সে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এখন অন্য ব্যাপার, সে নিজেই এখন তার ভেতর সেই পুরোনো ক্ষমতা জাগিয়ে তুলেছে। এবারে সে চেষ্টা করে দেখতে পারে না? শাজাহান সুজাকে একটা শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দিতে পারে না? এতে শিশুদের আত্মা যদি একটু শান্তি পায়, সেটুকুই লাভ।
কথাটা যতই ভাবে ততই তার স্নায়ু উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে। আস্তে আস্তে নিজের ভেতরে একটা অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের অস্তিত্ব অনুভব করে সে। সন্ধ্যায় খেতে বসে থেকে থেকে তার মুখের মাংসপেশি শক্ত হয়ে কেমন একটা কঠোর ভাব ফুটে ওঠে। সামনের চেয়ারে পরিচিত ছেলেটি রুমীকে দেখে অবাক হয়ে বলল, কি রে রুমী, কি হয়েছে তোর?
মুহূর্তে মুখের মাংসপেশি শিথিল করে হেসে বলল, না কিছু না।
মুখ এমন করে রেখেছিস যেন কাউকে মারবি!
একটু হাসল রুমী, কাকে মারবে? ও কি জানে মারলে তার কি শাস্তি হবে?
শান্ত হয়ে নিজের ঘরে বিছানায় বসে আছে রুমী। ঘরের বাতি বন্ধ, খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো বিছানার ওপর এসে পড়েছে। আজকাল তার আর ভয় হয় না, নিজের ক্ষমতার ওপর একটা বিশ্বাস জন্মে গেছে। অবিশ্যি আজ দুপুরে সে যখন শাজাহান সুজার বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তখন তার নিজের ইচ্ছার ওপর কোনো হাত ছিল না। সে শাজাহান সুজার হিংস্র চিৎকার আর বাচ্চাটির আর্তনাদ কিছুই শুনতে চাচ্ছিল না। তবু তাকে শুনতে হয়েছে। পুরো অনুভূতিটা এত তীব্র আর এত জীবন্ত ছিল যে তার সহ্য করা পর্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছিল। কে জানে খুব কাছাকাছি থাকলে হয়তো এরকম তীব্র অনুভূতিই হয়।
চোখ বন্ধ করে, মনপ্রাণ অনুভূতি একত্র করে শাজাহান সুজার ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করে রুমী।
শাজাহান সুজা ছবি আঁকছে–যন্ত্রণাকাতর ভীত একটা শিশু হাত-পা শক্ত করে চেয়ারের সাথে বাঁধা। একটু পর পরই সে একটা বড় ধারালো ছুরি দিয়ে ভয় দেখিয়ে শিশুটার এখানে-সেখানে খোঁচা মারছে। প্রাণপণে আর্তনাদ করে ওঠে শিশুটা, তীক্ষ্ণ চোখে সে তখন শিশুটাকে লক্ষ করে। তারপর তুলিতে রং লাগিয়ে ছবিতে মন দেয়। ছবিতে শিশুটির চেহারা এই শিশুটির মতো নয়। সে ইচ্ছা করেই কোনো নির্দিষ্ট শিশুর চেহারা নেয় নি, শুধু তাদের যন্ত্রণার অভিব্যক্তিটি ধরার চেষ্টা করেছে। আশ্চর্য রকম জীবন্ত এ ছবিটি, হঠাৎ দেখলে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন মুহূর্তের জন্যে থেমে যেতে চায়। শাজাহান সুজার ছবি আঁকা শেষ হয়ে গেছে। এখন সে খুব সূক্ষ্ম কটি জিনিস দেখে নিতে চায়। বাড়তি আলো লাগিয়েছে আজ, একটা ক্যামেরা রেখেছে বাচ্চাটির যন্ত্রণাকাতর মুখের ছবি তুলতে। যে অভিব্যক্তি তার আঁকা ছবিতে ফোঁটানোর চেষ্টা করেছে ক্যামেরার ফিল্মে তা ধরা পড়ে না, তবু শিশুগুলির ছবি তুলছে সে, কে বলতে পারে হয়তো পরে কাজে লাগবে।
ছবিটির এখানে-সেখানে তুলির একটি দুটি পোচ দিয়ে মাথা সরিয়ে দেখে শাজাহান সুজা। মুখে ওর পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। কিন্তু থেকে থেকে তার ভেতরে একটা দুশ্চিন্তা এসে উঁকি দিচ্ছে। পুলিশ অফিসার কি করে তাকে সন্দেহ করল? ভাগ্যিস জানালা দিয়ে সে পুলিশের জিপটা দেখেছিল, বাচ্চাটির মুখ শক্ত করে বেঁধে আলমারির পেছনে গোপন জায়গাটাতে লুকিয়ে রাখার মতো সময় পেয়েছিল সে! কিন্তু পুলিশ অফিসার বুঝল কি করে? সবচেয়ে অবাক লাগে যখন হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে হঠাৎ অন্য কেউ যেন কথা বলে ওঠে। কে জানে ওইসব মৃত শিশুর আত্মা মিছিল করে তাকে মারতে আসে কি না।
এসব ভেবে শাজাহান সুজার হাসি পেয়ে যায়, কিন্তু ছবিটির দিকে তাকিয়ে আবার সে গম্ভীর হয়ে পড়ে। ওর জীবনের শ্রেষ্ঠ ছবি। এটা শেষ করে মারা গেলেও তার দুঃখ নেই। কি আনন্দ! নিখুঁত একটা ছবি এঁকে এত আনন্দ সে জানতো না। নিখুঁত ছবি কটি আছে পৃথিবীতে? একেই বোধ হয় সৃষ্টি বলে সৃষ্টি! বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে ঈশ্বর বুঝি এরকম আনন্দ পেয়েছিলেন। সে যেটা করেছে সেটাই তো সৃষ্টি অসাধারণ সৃষ্টি। যুগ যুগ ধরে মানুষ জানবে যন্ত্রণা কাকে বলে, মৃত্যুভয় কাকে বলে। যারা যন্ত্রণাকে কোনোদিন অনুভব করেনি। তারা যন্ত্রণাকে অনুভব করবে। জীবন্ত মানুষ মৃত্যুর আগেই পারবে মৃত্যুকে অনুভব করতে।
শাজাহান সুজার চোখে পানি এসে যায়। এরকম মহান একটা সৃষ্টির জন্যে না হয় কটা প্রাণ গেলই। আর সে তো খুঁজে গরিব, দুঃখী, ভাগ্যহীন শিশুদেরই বেছে নিয়েছে। এরা বড় হলে তো অনুভূতিহীন নির্বোধ মানুষ হয়েই বড় হতো, ক্ষুধার অনুভূতি ছাড়া আর কি অনুভূতি আছে এদের? সুন্দর কিছু দেখার, অনুভব করার ক্ষমতা এদের কখনো হতো না। পৃথিবীটা তো এদের জন্যে তৈরি হয় নি, এরা কীটপতঙ্গের মতো জন্মায়, কীটপতঙ্গের মতো মারা যায়। অল্প কজন মানুষ শুধু প্রতিভা নিয়ে জন্মায়, ওদের দেখার চোখ থাকে, বোঝার ক্ষমতা থাকে, অনুভব করার শক্তি থাকে, পৃথিবীটা তো তাদের জন্যেই। অন্যেরা শুধু পেটের ক্ষুধা, বড়জোর দেহের ক্ষুধা নিয়ে বেঁচে থাকে। ওদের বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়ার মাঝে পার্থক্য কি?
অপলক দৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকে শাজাহান সুজা, ওর মুখ কোমল হয়ে আসে। চোখ থেকে মমতা যেন বৃষ্টির ফোঁটার মতো গড়িয়ে পড়ে। এরকম পরিতৃপ্তি ওর জীবনে আর কখনো আসে নি। ছবিটির দিকে তাকালে মনে হয় যন্ত্রণাকাতর একটি শিশুর মুখ, ভালো করে দেখলে চোখে পড়ে শুধু যন্ত্রণা নয় আরও কিছু আছে এতে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ছোট একটা শিশু যখন তার যন্ত্রণাকে ভুলে গিয়ে ভাগ্যের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত হয় তখন তার চোখে মুহূর্তের জন্যে যে বিচিত্র দৃষ্টি ফুটে ওঠে, এটি সেই মুহূর্তের ছবি। যন্ত্রণা যখন ভীতির রূপ নেয়, আশা যখন ভাগ্যের কাছে আত্মসমর্পণ করে, সুখ-দুঃখ যখন অর্থহীন হয়ে যায় এটি ঠিক সেই পরিবর্তনের মুহূর্ত।
ছবি আঁকা শেষ হয়েছে। তুলিটা রেখে দিয়ে সে একটু পিছিয়ে এসে দাঁড়ায়। আহা! কি ছবি! ঘরের আলোগুলি একটু সরিয়ে দেয়, অন্যদিক থেকে আলো এসে পড়ায় ছবিটা একটু অন্যরকম লাগতে থাকে। জিব দিয়ে একটা আনন্দের শব্দ করল শাজাহান সুজা।
অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল বাচ্চাটা, এবারে হঠাৎ যন্ত্রণার অস্ফুট একটা শব্দ করল। শাজাহান সুজা ভুরু কুঁচকে বাচ্চাটার দিকে তাকায়। সে ভুলেই গিয়েছিল বাচ্চাটার কথা। এর প্রয়োজন শেষ, পারলে সে ছেড়েই দিত বাচ্চাটাকে। তেলাপোকা মারতেও তো খারাপ লাগে, আর এ তো মানুষের বাচ্চা! কিন্তু ছাড়তে পারবে না সে, জানাজানি হয়ে যাবে তাহলে। মরার আগে একেকটার গায়ে কি ভয়ানক শক্তি এসে যায়, শাজাহান সুজার মনের আনন্দটা বিরক্তিতে ম্লান হয়ে আসে। কম ঝামেলায় কীভাবে বাচ্চাটাকে মারা যায় ভাবতে বসল সে। মারার পর এটাকে আবার বাইরে নিয়ে ফেলে আসতে হবে, কে জানে ওই মাথা খারাপ পুলিশ অফিসার আবার তার ওপর পাহারা বসিয়ে রেখেছে কি না। তাহলে সে এটাকে এখন বাইরে নিয়ে ফেলতেও পারবে না। হয়তো কেটে টুকরো টুকরো করে ছোট ছোট প্যাকেটে ভরে..ভাবতেই শাজাহান সুজার মন বিরক্তিতে বিষিয়ে ওঠে।
মনের এত পরিতৃপ্তির ভাবটা এই বাচ্চাটার জন্যে নষ্ট হয়ে গেল। শাজাহান সুজা এগিয়ে গিয়ে প্রচণ্ড একটা লাথি মারে বাচ্চাটাকে। এক লাথিতে মরে গেলেও চুকে যেতো, মরেও না শালার বাচ্চা! বাচ্চাটা প্রচণ্ড লাথি খেয়েও কেন জানি এবারে ডুকরে কেঁদে উঠল না, হয়তো বুঝতে পেরেছে এখন ওকে কি করা হবে। অদ্ভুত বোবা একটা দৃষ্টিতে শাজাহান সুজার দিকে তাকিয়ে রইল সে, দেখে আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেল তার।
ফ্রিজ খুলে একটা বিয়ারের বোতল বের করে আনতে হলো তাকে। সোফায় বসে বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে সে ভাবতে থাকে কি করা যায়।
এদিকে মনপ্রাণ এক করে শাজাহান সুজার ওপর নিজের প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করছে রুমী, ও জানে না কি করতে হয়, কি করবে কোনো ধারণা নেই। প্রথমে চেষ্টা করছে শাজাহান সুজার অস্তিত্ব থেকে নিজের অস্তিত্ব আলাদা করে রাখতে। প্রথম প্রথম পারছিল না, বারবার মনে হচ্ছিল সে নিজেই শাজাহান সুজা। আস্তে আস্তে সেটা সম্ভব হয়েছে, এখন শাজাহান সুজার অস্তিত্বের মাঝে থেকেও সে আলাদা হয়ে আছে। শাজাহান সুজার অস্তিত্বে বসে থেকে নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে সে। কোনো লাভ হচ্ছে না, শাজাহান একমনে বিয়ার খেয়েই চলছে। সমস্ত শক্তি একত্র করে সে ডাকার চেষ্টা করল শাজাহান সুজাকে, কোনো লাভ হলো না। রুমী জানে একবার যদি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে তবে নিজের ওপর বিশ্বাস বেড়ে যাবে হাজার গুণ, সঙ্গে সঙ্গে শক্তিও বেড়ে যাবে অনেকখানি। তাই সে হাল ছাড়ল না, আবার ডাকল শাজাহান সুজাকে আবার ডাকল-কিন্তু কোনো লাভ হলো শাজাহান সুজা সোফায় বসে চুক চুক করে বিয়ার খেয়েই চলেছে।
খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বিশ্বাস সঞ্চয় করার চেষ্টা করে রুমী। নিশ্চয়ই পারবে সে, নিশ্চয়ই পারবে। তাকে পারতেই হবে, ছোট একটা শিশুর জীবন নির্ভর করছে তার ওপর। আর কোনো বিকল্প নেই, তাকে পারতেই হবে-পারতেই হবে। রুমী মনপ্রাণ একত্র করে ডাকে শাজাহান সুজাকে, আর কি আশ্চর্য শাজাহান সুজা চমকে পেছনে তাকায়। কেউ নেই কোথাও অথচ কি আশ্চর্য। ও স্পষ্ট শুনল কে যেন ওকে ডাকল।
আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস আস্তে আস্তে বের করে দেয় রুমী। পেরেছে সে, শাজাহান সুজার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। এবার সে তাকে শিক্ষা দেবে, এমন শিক্ষা দেবে যে, তার আত্মা নরকে গিয়েও ভুলতে পারবে না।
শাজাহান সুজা!
শাজাহান সুজা আবার চমকে পেছনে তাকাল, আবার সে শুনেছে কেউ যেন তাকে ডাকল। কি আশ্চর্য, আধ বোতল বিয়ার খেয়েই তার নেশা হয়ে গেল নাকি? শাজাহান সুজা বিয়ারের বোতলটা রেখে দেয়। এখনো অনেক কাজ বাকি, নেশা করার সময় হয় নি। কিন্তু ভেতরটা জানি কেমন করতে থাকে। অনেকদিন পর ভয় পেয়েছে সে।
শাজাহান সুজা, ডান দিকে তাকাও!
শক খাওয়া লোকের মতো চমকে ডান দিকে তাকাল শাজাহান সুজা। কেউ নেই। বাম দিকে তাকাও শাজাহান সুজা!
টেবিল ধরে কোনোমতে বাম দিকে তাকায় শাজাহান সুজা। জানে কেউ নেই, তবু তাকিয়ে দেখল। কি হয়েছে ওর? বাথরুমে গেল মাথায় পানি দিতে।
রুমী আস্তে আস্তে বলল, রেজরটা দেখো শাজাহান সুজা!
শাজাহান সুজা ভয়ে ভয়ে রেজরটার দিকে তাকায়।
হাত বাড়িয়ে তুলে নাও দেখি!
নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে শাজাহান সুজা হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় ওটা।
এবারে গলায় একটা পোচ লাগাও দেখি চাঁদ!
শাজাহান সুজা চিৎকার করে হাত থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল রেজরটা। পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে।
দাঁতে দাঁত ঘষে রুমী, কোথায় যাবে তুমি বাছাধন?
শাজাহান সুজা ফ্রিজ খুলে ব্র্যান্ডির একটা বোতল বের করে ঢক ঢক্ করে দুই টোক খেয়ে নিল। মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে গেছে। বাচ্চাটাকে শেষ করে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হবে। অনেক ধকল গিয়েছে শরীরের ওপর দিয়ে। রান্নাঘর থেকে একটা বড় ছুরি নিয়ে স্টুডিওতে চলে এলো সে।
একটু চমকে ওঠে রুমী, শাজাহান সুজাকে থামাতে হবে। মনপ্রাণ একত্র করে সে ওকে আদেশ দিতে থাকে, এক এগোবে
তুমি, দাঁড়াও যেখানে আছ। ( হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শাজাহান সুজা। দরদর করে ঘামছে সে। সারা মুখ রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেছে ভয়ে।
তোমার আর কোনো শক্তি নেই, শাজাহান সুজা! প্রথমবার কথাটা এমনি বলল রুমী, দ্বিতীয়বার বলল অনেক জোর দিয়ে, তৃতীয়বার শুধু জোর দিয়ে নয়, বিশ্বাস নিয়ে।
শাজাহান সুজার মনে হলো সত্যিই তার কোনো শক্তি নেই। হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবার মতো অবস্থা এখন ওর। কোনোমতে পা টেনে টেনে টলতে টলতে সোফায় এসে বসে পড়ল। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে। ভয় পেয়েছে সে, প্রচণ্ড ভয়।
বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলছে রুমীও, প্রচণ্ড পরিশ্রম হচ্ছে ওর। একটি করে আদেশ দেয় শাজাহান সুজাকে আর সেটি কাজে খাটাতে গিয়ে সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় তার। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে ওর, কিন্তু উঠে পানির গ্লাসটা আনতেও ভয় পাচ্ছে সে যদি সেই সময়টাতে কিছু একটা করে ফেলে বাচ্চাটাকে, চোখ বন্ধ করে সে দেখে শাজাহান সুজাকে, মড়ার মতো পড়ে আছে সোফায়। হয়তো ওর শাজাহান সুজার বাসার কাছে চলে যাওয়া উচিত, ত হলে ওর এত পরিশ্রম হবে না। কাছাকাছি থাকলে অনুভূতিটা অনেক তীব্র হয় আজ বিকেলেই সে দেখেছে। কাছে থাকলে আরও শক্ত করে শাজাহান সুজাকে ধরতে পারবে, আরও ভালো করে শিক্ষা দিতে পারবে।
উঠে দাঁড়ায় রুমী, ঢক ঢক্ করে গ্লাসের পানিটা শেষ করে পায়ে জুতো পরে নেয়। এত রাতে রিকশা না পেলে তাকে হয়তো হেঁটেই যেতে হবে। জুতো পায়ে অনেক তাড়াতাড়ি হাঁটা যায়। শাজাহান সুজা এখন মড়ার মতো পড়ে আছে, কতক্ষণ পড়ে থাকবে কে জানে, এর মাঝে রুমীকে যতটুকু সম্ভব ওর কাছাকাছি চলে যেতে হবে। দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে প্রায় ছুটতে থাকে সে।
অন্ধকার রাত। ঢাকা শহরেই রাতে এত অন্ধকার নামতে পারে, গ্রামেগঞ্জে বনেবাদাড়ে না জানি এখন কত অন্ধকার! শহরে কেউ কখনো আকাশের দিকে তাকায় না। আকাশে চাঁদ ওঠে, আবার চাঁদ ডুবে যায়, কেউ খেয়াল পর্যন্ত করে না। রুমীর মনে আছে রাতে পড়াশোনা করে ঘুমানোর সময় একদিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে কত বড় একটা চাঁদ। দেখে সে কি অবাক, কতদিন পরে চাঁদ দেখল। সেই ছেলেবেলায়
মায়ের কোলে বসে চাঁদ দেখতো, ওর মা গুনগুন করে কি যেন গান গেয়ে ওকে আদর করতেন। তারপর কদিন হয়ে গেছে আর সে আকাশের দিকে তাকায় নি। আজ মাঝরাতে রিকশায় বসে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ওর মায়ের কথা মনে পড়ল, কোথায় আছেন ওর মা? ওর ভেতরে কেমন একটা দুঃখ বোধ জেগে ওঠে, কি মানে আছে এই জীবনের? সে কি করেছে এখন? কি প্রয়োজন তার এইসব করার?
.
ঠিক রাস্তার মোড়ে একজন লোক লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে-যে কেউ দেখে বলে দিতে পারবে এ পুলিশের লোক। পুলিশের সাদা পোশাকের লোকগুলিকে দেখতে সব সময় এরকম দেখায় কেন কে জানে। বোধহয় তারা একই ধরনের কাপড় পরে, একই ধরনের কাজকর্ম করে-হয়তো যেখানে তাদের কাজ শেখানো হয় সেখানে সবাইকে একই জিনিস শেখানো হয়। লোকটি সিগারেট টানতে টানতে খুব নিস্পৃহভাবে রুমীর দিকে তাকাল যেন রুমী কে তাতে তার কিছুই এসে যায় না।
কি ভেবে সেখানেই নেমে পড়ল রুমী, পুলিশের লোকটাকে কিছু একটা বলে গেলে হতো। রুমী একটু দ্বিধা করে, কে জানে হয়তো এ পুলিশের লোক নয়। রুমী চেষ্টা করল লোকটি কি ভাবছে বুঝতে, কিন্তু পারল না। আগেও দেখেছে স্বাভাবিক চিন্তাভাবনাগুলো সে বুঝতে পারে না, শুধু খারাপ, অশুভ কথাগুলিই শুনতে পায়।
একটু দ্বিধা করে জিজ্ঞেস করল রুমী, আপনি কি পুলিশের লোক?
লোকটা হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আপনি… আপনি কীভাবে জানলেন?
জানি না বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম। আমি আন্দাজ করেছিলাম আপনারা কেউ কাছাকাছি থাকবেন। লোকটিকে আরও ঘাবড়ে না দিয়ে ব্যাপারটা খুলে বলল সে। পুলিশ অফিসারের নাম করে বলল, সে তাকে খুব ভালো করে চেনে এবং তার খবরের ওপর ভিত্তি করেই শাজাহান সুজার বাসার ওপর পাহারা বসানো হয়েছে। শুনে লোকটি একটু সহজ হলে রুমী বলল, আপনাকে আমার একটা উপকার করতে হবে।
কি উপকার?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কিছু পুলিশ নিয়ে আসতে হবে। আপনাদের অফিসারকে আমার নাম বলে ফোন করলেই হবে।
লোকটি চোখ কপালে তুলে বলল, পুলিশ? সর্বনাশ! এটা খুব গোপন ব্যাপার, আমি এখানে আছি সেটা পর্যন্ত ডিপার্টমেন্ট জানে না।
জানি। রুমী ঠাণ্ডা গলায় বলল, গোপন ব্যাপার আর গোপন নেই। আমি শাজাহান সুজার বাসায় ঢুকছি ওকে হাতেনাতে ধরার জন্যে।
লোকটি অবাক হয়ে রুমীর দিকে তাকাল, এর মাথা খারাপ না আর কিছু! কি একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সে রুমীকে ভীষণ চমকে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেলতে দেখল। তীক্ষ্ণ একটা চিৎকার শুনেছে রুমী-চোখ বন্ধ করে দেখতে পায় শাজাহান সুজা ছুরি হাতে বাচ্চাটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বেঁচে থাকার আদিম প্রবৃত্তির বশে বাচ্চাটা প্রাণপণে চেষ্টা করে চেয়ারসহ মাটিতে পড়ে গেছে। ছুরি তার হাতের খানিকটা কেটে ফেলেছে কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেছে সে। প্রচণ্ড রেগে গেছে শাজাহান, সুজা, মুখ বিকৃত করে আবার এগিয়ে আসছে সে। না! প্রাণপণ চিৎকার করে ওঠে রুমী, থাম-থাম শুয়োরের বাচ্চা! শক খাওয়া লোকের মতো ঘুরে দাঁড়ায় শাজাহান সুজা। এক পা নড়েছিস কি তোর জান শেষ করে দেব-দাঁতে দাঁতে ঘষে রুমী বলতে থাকে, আর একটু নড়েছিস কি তোর জিব টেনে বের করে ফেলব। পুলিশের লোকটি বিস্ফারিত চোখে রুমীর দিকে তাকিয়ে থাকে, এক মুহূর্তের জন্যে সে ভেবেছিল রুমী বুঝি তাকে কিছু বলছে। কিন্তু রুমীর দৃষ্টি অন্য কোথাও, কথা বলছে অনেকটা নিজের মনে। দেখে ভয় হয়, মনে হয় সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। কি ভয়ানক চেহারা হয়ে গেছে এক মুহূর্তে, দাঁত বেরিয়ে পড়েছে, শক্ত চোয়াল, চোখ টকটকে লাল, কিন্তু পাতা নড়ছে না, মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলল রুমী, আমি আসছি। তোকে আজ দেখে নেব, শয়তানের বাচ্চা! পুলিশের লোকটা অবাক হয়ে দেখল, অদ্ভুত একটা ভঙ্গিতে শাজাহান সুজার বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রুমী, কেন জানি ভয়ে ওর সারা শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। আরও আধঘণ্টা পরে অন্য আরেকজন এসে তাকে ছুটি দেওয়ার কথা কিন্তু এতক্ষণ অপেক্ষা করার সাহস নেই। তার, তক্ষুনি সে ছুটল কাছাকাছি পুলিশ ফাড়ি থেকে ফোন করার জন্যে।
লোহার গেট বাসার সামনে, মস্ত তালা ঝুলছে। রুমী এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে গেট টপকে ভেতর ঢুকে পড়ে। ওপরে কাঁটাতার দেওয়া, ওর হাত ছড়ে গেছে কিন্তু এখন সে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই। কঁকর বিছানো পথ, দুধারে ফুলের গাছ, অযত্নে অবহেলায় একটা বুনো রূপ নিয়েছে। ঝিঁঝি ডাকছে কোথায়, মুহূর্তের জন্যে থামতেই বোঝা গেল চারদিক কি ভয়ানক নীরব হয়ে আছে।
দরজা খোলো!
না।
দরজা খোলো শাজাহন সুজা!
না-না…
প্রচণ্ড জোরে ধমকে ওঠে রুমী, দরজা খোল্ শুয়োরের বাচ্চা!
শাজাহান সুজা তবু দাঁড়িয়ে থাকে। রুমী বাইরে দাঁড়িয়ে শাজাহান সুজাকে দরজার কাছে টেনে আনে খুব সহজে। ওকে বাধ্য করে দরজা খুলতে। শাজাহান সুজা ছিটকিনি খুলে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে, লাথি মেরে দরজা খুলে ফেলল রুমী। ভয়ে ছিটকে সরে গেল শাজাহান সুজা-ড্রয়ার হাতড়াচ্ছে প্রাণপণে, পিস্তলটা খুঁজছে ওর। ততক্ষণে রুমী ঢুকে গেছে ভেতরে।
কি, কি চান আপনি?
রুমী হাসল। বিকারগ্রস্ত লোকের হাসি। কি চাই? দেখবে, এক্ষনি দেখবে।
শাজাহান সুজা তখনো ড্রয়ার হাতড়ে যাচ্ছে, রুমী জানে ও পিস্তলটা খুঁজছে কিন্তু বাধা দিল না সে। কি করবে ও পিস্তল দিয়ে? তাকে গুলি করবে। রুমী জানে সে ইচ্ছা করলে এখন শাজাহান সুজা একটা আঙুল পর্যন্ত নাড়াতে পারবে না। কি প্রচণ্ড শক্তি ওর ভেতরে! ইচ্ছা করলে শাজাহান সুজার জিব টেনে বের করতে পারে সে, হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে ফেলতে পারে! ও ইচ্ছা করলে খুলি ফেটে তার মস্তিষ্ক বের হয়ে যাবে এখন পিস্তল দিয়ে কি করবে?
খুঁজে পেয়েছে সে পিস্তলটা-তুলে ধরল রুমীর দিকে।
রুমী আবার হাসার ভঙ্গি করে, গুলি করতে চাও? তাহলে ঘুরিয়ে নিজের মাথার দিকে নাও।
শাজাহান সুজার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে ওর, নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হাত উঠে যাচ্ছে তার মাথার দিকে।
কি, গুলি করবে?
প্রাণপণ চেষ্টায় মাথা নাড়ল, না-না…
পিস্তলটা আমার দিকে ছুঁড়ে দাও! শাজাহান সুজা পিস্তলটা ছুঁড়ে দেয়। রুমী জীবনে পিস্তল ভালো করে দেখে নি পর্যন্ত, দেখার ইচ্ছাও নেই। লাথি মেরে পিস্তলটা সরিয়ে দিল দূরে।
কি, কি চান আপনি? শাজাহান সুজার কণ্ঠস্বর শুষ্ক, ভয়ে কাঁপছে।
অনেক কিছু চাই আমি। তোমাকে এমন শিক্ষা দিতে চাই…
কেন? কি করেছি আমি?
প্রচণ্ড রাগে রুমীর মুখ ভয়াবহ হয়ে ওঠে, কি করেছ তুমি? চিৎকার করে ওঠে রুমী, তুমি জানো না? রুমীর অদম্য ক্রোধ প্রচণ্ড একটা শক্তির মতো শাজাহান সুজাকে আঘাত করে, ছিটকে গিয়ে সে পড়ে এক কোনায়, প্রচণ্ড জোরে ওর মাথা ঠুকে যায় দেয়ালে। রুমীর রাগের দমকে দমকে ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে, মুখে ফেনা এসে যায় যন্ত্রণায়।
অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে রুমী, আস্তে আস্তে শাজাহান সুজার কাঁপুনিও থেমে যায়। কোনোমতে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ায়, প্রচণ্ড ভয়ে ওর মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেছে।
তুমি কি করেছ তুমি জানো না?
শাজাহান সুজা মাথা নিচু করে থাকে। আস্তে আস্তে মাথা তুলে কাতর ভঙ্গিতে বলে, কিন্তু আমি তো শুধু শুধু করি নি। এই দেখুন, এই ছবিটা আমি এঁকেছি, পৃথিবীর লোক এই ছবিটা পেতো না আমি যদি কিছু না করতাম…
কি ছবি এটা?
শাজাহান সুজা একটু আশায় ভর করে এগিয়ে আসে, ভালো করে তাকিয়ে দেখুন, আপনিও বুঝতে পারবেন।
তাকিয়ে দেখল রুমী।
শাজাহান সুজা দুর্বলভাবে একটু হাসল, আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ এটা
প্রিন্সে’র থেকে হাজার গুণ ভালো। এরকম আর হবে না কখনো হবে না। রঙের কাজ আর টেকনিক ছেড়ে দিয়ে শুধু অভিব্যক্তিটা দেখুন।
খুব যত্নের ছবি তোমার?
হ্যাঁ। এটা শেষ করে আমার মরতেও দ্বিধা নেই। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে শাজাহান সুজা আস্তে আস্তে বলে, মরতেও দ্বিধা নেই!
সিগারেট খাও তুমি?
হ্যাঁ, খুব ব্যস্ত হয়ে শাজাহান সুজা পকেট হাতড়াতে থাকে। সিগারেট বের করে এগিয়ে দেয় রুমীর দিকে।
ম্যাচটা বের করো।
শাজাহান সুজা একটা দামি সিগারেট লাইটার বের করে।
সাবধানে ছবিটার নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরো।
প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠল শাজাহান সুজা, কি বলছে সে? এক মুহূর্তের জন্যে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না ও।
নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরো!
হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল শাজাহান সুজা, আপনি বুঝতে পারছেন না এই ছবির মূল্য।
আমাকে মেরে ফেলুন, যা খুশি করুন, কিন্তু এই ছবিটাকে বেঁচে থাকতে দিন।
ছবির নিচে লাইটারটা জ্বালিয়ে ধরো!
কাতর অনুনয়ে শাজাহান সুজার গলার স্বর ভেঙে পড়ে, আপনি একটু বুঝতে চেষ্টা করুন। তাজমহলকে কেউ যদি বোমা মেরে উড়িয়ে দেয় আপনার কেমন লাগবে? দা ভিঞ্চির মোনালিসাকে কেউ যদি পুড়িয়ে দেয় আপনার কেমন লাগবে? মাইকেল এঞ্জেলোর পিয়েতাকে কেউ যদি ভেঙে ফেলে কেমন লাগবে আপনার? আপনি বিশ্বাস করুন এটা ঠিক সেরকম একটা সৃষ্টি। এটা নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। আমি অপরাধ করেছি, আমাকে যা ইচ্ছা শাস্তি দিন, আমার ছবির ওপর প্রতিশোধ নেবেন না।
একটিবার পৃথিবীর লোককে এই ছবি দেখতে দিন।
লাইটারটা জ্বালিয়ে ছবির নিচে ধরো।
দোহাই আপনার-এটা আমার সন্তানের মতো। আমার যদি একটা সন্তান থাকতো তাকে কি আপনি মারতেন? আমি যত দোষই করি আমার সন্তানের তো কোনো দোষ নেই। তাকে আপনি বাঁচতে দিন…
হঠাৎ প্রচণ্ড রাগে ফুঁসে ওঠে রুমী, তোমার সন্তানের মতো! যাদের তুমি মেরেছ তারা কারো সন্তান ছিল না?
রুমীর কথা শেষ হবার আগেই প্রচণ্ড একটা আঘাতে শাজাহান সুজা ছিটকে মাটিতে পড়ে। রুমীর রাগ কমে না আসা পর্যন্ত সে যন্ত্রণায় কাটা মুরগির মতো ছটফট করতে থাকে। তারপর আস্তে আপ্তে আবার উঠে দাঁড়ায়। কপালের কাছে কেটে গেছে ওর, ফুলে উঠছে ধীরে ধীরে। একটা চোখ প্রায় বুজে গেছে। কাতর অনুনয়ের দৃষ্টিতে শাজাহান সুজা রুমীর দিকে তাকিয়ে থাকে।
রুমী ওকে আবার আদেশ দেয় ছবিটাতে আগুন ধরানোর জন্যে। শাজাহান সুজা দুই হাত জোর করে ক্ষমা ভিক্ষা চায়। রুমী পাথরের মতো নিজের শক্তি ব্যবহার করে। শাজাহান সুজা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটারটা জ্বালিয়ে, আস্তে আস্তে আগুনটা ছবির নিচে ধরে। ওর মুখ প্রচণ্ড হতাশায় বিকৃত হয়ে আছে, চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে আসছে। আস্তে আগুন ধরে গেল একপাশে। শাজাহান সুজা প্রাণপণ চেষ্টা করল হাত দিয়ে আগুন নিভিয়ে দিতে, কিন্তু ওর কোনো ক্ষমতা নেই। রুমীর ইচ্ছার দাস হয়ে ও দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে। আস্তে আস্তে আগুনটা ছড়িয়ে পড়ছে, দ্রুত এগিয়ে এসে গ্রাস করে নিচ্ছে ছবিটাকে।
আর্তনাদ করে উঠল শাজাহান সুজা, দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাটিতে মাথা কুটতে থাকে প্রচণ্ড দুঃখে। ওর সারাজীবনের স্বপ্ন ওর চোখের সামনে শেষ হয়ে যাচ্ছে, ও একটা ফটো পর্যন্ত তুলে রাখে নি ওটার। আর দেখতে পারল না, চোখ বন্ধ করে ফেলল, শাজাহান সুজা!
চোখ খোলো শাজাহান সুজা!
শাজাহান সুজার চোখ খুলে গেল ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ওর চোখের সামনে পুরো ছবিটা ঢেকে গেল জ্বলন্ত আগুনের শিখায়। অনেক ওপরে উঠে গেল আগুনের শিখা, ধোঁয়ায় ভরে গেছে সারা ঘর, খক্ খক্ করে কাশতে থাকে রুমী।
শাজাহান সুজাকে ডাকল রুমী। তার উত্তর দেয়ার ক্ষমতা নেই, অর্থহীন বোবা দৃষ্টিতে রুমীর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
খুব একটা সৃষ্টি করেছিলে, বাচ্চাদের খুন করে সৃষ্টি কর তুমি। বাচ্চারা সৃষ্টি না, সৃষ্টি তোমার ওই আর্ট। প্রচণ্ড ঘৃণায় রুমীর মুখ বিকৃত হয়ে উঠতেই আবার শাজাহান সুজা ছিটকে পড়ে মাটিতে। রুমীর তীব্র দৃষ্টিতে মাটিতে পড়ে ছটফট করতে থাকে যন্ত্রণায়। ভীষণ দুর্বল লাগতে থাকে রুমীর। ও আস্তে আস্তে সোফায় গিয়ে বসে, পুলিশ এসে যাবে যে কোনো মুহূর্তে, তখন ওর কাজ শেষ। হঠাৎ ওর চোখ পড়ে বাচ্চাটার ওপর, রুমী ওর কথা ভুলেই গিয়েছিল। শক্ত করে বাঁধা চেয়ারে, রক্তাক্ত শরীর, বাম হাত থেকে তখনো রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। রুমী চোখের দৃষ্টি কোমল করে ওর দিকে এগিয়ে যায়, বাচ্চাটা ভীত চোখে ওকে লক্ষ করে, ওর ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে। ভয় কি তোমার? ভয় নেই, তোমাকে আর কেউ কিছু করতে পারবে না। রুমী ওর দড়ির বাঁধন খুলে দিতে লাগল।
বিড়বিড় করে কথা বলছে শাজাহান সুজা। কান পেতে শোনার চেষ্টা করে রুমী, প্রথমে মনে হচ্ছিল অসংলগ্ন কথা, কিন্তু আসলে তা নয়। প্রচণ্ড দুঃখে ওর বুক ভেঙে গেছে তাই নিজেকে সান্তনা দিচ্ছে নিজেই। বলছে, এটা পুড়ে গিয়েছে তো কি হয়েছে।
আবার আঁকব আমি, আবার আঁকব। আরও ভালো করে আঁকব আমি, আরও অনেক যত্ন করে। আমি শিল্পী, আমার চোখ আছে, আমার দেখার ক্ষমতা আছে, আমার সৃষ্টির ক্ষমতা আছে! কজনের আছে আমার মতো ক্ষমতা? আমি আবার সৃষ্টি করব। দরকার হলে আবার ধরে আনব নোংরা জানোয়ারগুলোকে, গলা টিপে মেরে…
প্রচণ্ড রাগ রুমীর শিরদাঁড়া বেয়ে উঠতে থাকে-প্রচণ্ড রাগ! দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, আবার ছবি আঁকবে তুমি? আবার সৃষ্টি করবে? তোমার ওই চোখ দিয়ে তুমি দেখবে আর সৃষ্টি করবে?
রুমী ওর দিকে এগিয়ে যায়, তোমার চোখ আমি ছিঁড়ে নেব, ছিঁড়ে উপড়ে নেব। চোখ উপড়ে নেবার ভঙ্গি করে রুমী, আর হঠাৎ ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে এলো শাজাহান সুজার চোখ থেকে। প্রচণ্ড আর্তনাদ করে দুই চোখ ঢেকে ফেলল শাজাহান সুজা, হাতের ফাঁক দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে।
রুমীর মনে হয় তার মাথাটা হালকা হয়ে গেছে। সমস্ত ঘরটা যেন ওর চোখের সামনে ঘুরে ওঠে। সাবধানে সে সোফার হাতল ধরে বসার চেষ্টা করল, ঘরটা আরও জোরে ঘুরছে, আলোগুলি যেন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে, ও তাকিয়ে থেকেও আর দেখতে পাচ্ছে কোলাহলের মতো শব্দ ভেসে আসতে থাকে, ঢেউয়ের মতো সে শব্দ এগিয়ে আসছে, আস্তে আস্তে তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে। রুমী সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে খুব ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল।
বাইরে তখন পুলিশের জিপ এসে থেমেছে।
পরিশিষ্ট
এগারো
শাজাহান সুজাকে অন্ধ অবস্থায় তার বাসায় গ্রেফতার করা হয়। কি এক অজ্ঞাত কারণে তার দুই চোখেরই নার্ভ ছিঁড়ে গিয়ে সে অন্ধ হয়ে গেছে। বহুদিন চিকিৎসাধীন থাকল সে। প্রচণ্ড শকে সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে বলে তার বিচার অনেক দিন বন্ধ রাখা হয়েছিল। বিচারের বিশেষ কিছু ছিলও না, নিজেই সব কটি শিশুহত্যার অপরাধ স্বীকার করেছে। এ নিয়ে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তার কোনো অনুতাপ ছিল না। বিচারে ওর মৃত্যুদণ্ডই হতো কিন্তু রায় বের হওয়ার আগেই সে জেলখানায় মারা গেল। অনেকে বলে আত্মহত্যা করেছে, অনেকে বলে জেলখানায় অন্যরা তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। কোনটি সত্যি এখনো সেটা ভালো করে জানা যায় নি। কীভাবে মারা গেছে সেটা নিয়ে বিশেষ কারো মাথাব্যথা নেই, শাজাহান সুজা যে মারা গেছে সেটাই অনেকের কাছে একমাত্র স্বস্তির কথা।
যে রাতে শাজাহান সুজাকে গ্রেফতার করা হয়, সে রাতে রুমীকেও তার বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়। রুমীর বাইশ বছরের জীবনে মস্তিষ্কে দ্বিতীয়বার অস্ত্রোপচার করে তাকে বাঁচাতে হয়েছে। তার মস্তিষ্কের বড় একটা অংশ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, ডাক্তাররা সন্দেহ করেছিলেন সে হয়তো জ্ঞান বুদ্ধিহীন অথর্ব একটা মানুষে পরিণত হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল রুমী খুব ভালোভাবেই সামলে উঠেছে। তার দৈহিক কোনো সমস্যাই হয় নি, বুদ্ধিমত্তাও পুরোপুরি স্বাভাবিক রয়েছে, কিন্তু স্মৃতি একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে তার অতীতের একটি কথাও মনে করতে পারে ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করলেন। শাজাহান সুজাকে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে সে এক লাখ টাকা পুরোটাই পেয়েছিল। তার থেকে অনেকখানি ওর চিকিৎসার জন্যে ব্যয় করা হলো, কিন্তু কোনো লাভ হলো না। অন্যরা যদিও রুমীর স্মৃতি নষ্ট হয়ে যাওয়াটা খুব গুরুত্ব নিয়ে দেখছিল তবু সে নিজে এ ব্যাপারে বেশি বিচলিত হয় নি। তার স্মৃতির কিছুই অবশিষ্ট নেই, তাই সে জানতোও না কি নিয়ে তার বিচলিত হওয়া উচিত।
রুমী একটু সুস্থ হওয়ার পর ওর বোন শানু ওকে নিজের কাছে নিয়ে গেল। প্রথম প্রথম সে শানুকে দেখে একটু লজ্জা পেতো, এই সুন্দরী মেয়েটি তার বোন তার বিশ্বাস হতে চাইতো না। বোনের ছোট ছেলেটির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা হলো খুব সহজে, বড়দের সাথেই তার কথাবার্তা বলতে অসুবিধে অসুবিধে হতো। কখন কীভাবে কি বলতে হয় সে তখনো শিখে উঠতে পারে নি। তার নাকি এমএসসি. পরীক্ষা দেবার কথা ছিল, কিন্তু এ বছরটা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই, যদিও সবাই চায় যে সে আবার ঢাকা গিয়ে পড়াশোনা শুরু করুক, কিন্তু তার নিজের সেরকম কোনো ইচ্ছা নেই। সে কেন গ্রামে থাকতে পারে না, এই সহজ ব্যাপারটা এখনো কেউ তাকে বুঝিয়ে দিতে পারে নি। সে তার বোনের স্বামীর মতো দোকান দেবে বলায় একদিন সবাই এমনভাবে তার মুখের ওপর হেসে উঠেছিল যেন সে ভারি মজার কথা বলেছে। রুমী আজকাল তাই কাউকে কিছু বলে না, সে কি করবে সেটা সে নিজেই ঠিক করবে। তার নাকি অনেক টাকা জমা আছে ব্যাংকে, সেটা কীভাবে তুলতে পারবে এখনো জানে না। জেনে। নিতে পারবে সে কদিনের ভেতরেই। তখন টাকাটা তুলে এনে কংশ নদীর চরটা কিনে নেবে ও, ওখানে নাকি খুব ভালো ধান হয়। কিছু টাকা দিয়ে সে গ্রামের স্কুলটা ঠিক করিয়ে দেবে। হেডমাস্টারের সাথে কথা বলেছে গোপনে, সে চাইলেই তিনি তাকে একটা মাস্টারি দিয়ে দেবেন। স্কুলে অঙ্ক আর বিজ্ঞান পড়ানোর কেউ নেই, সে বিএসসিতে অনার্স, তবুও একটু ভয়ে ভয়ে ছিল হয়তো অঙ্ক, বিজ্ঞান সব ভুলে গেছে এই ভেবে, কিন্তু স্কুলের অঙ্ক বই খুলে দেখেছে খুব সহজ। কিছুই ভুলে যায় নি।
কদিন আগে ঢাকা থেকে কিবরিয়া চৌধুরী নামে একজন তার সাথে দেখা করতে এসেছিলেন, একসময়ে নাকি তার সাথে খুব বন্ধুত্ব ছিল। কেমন রাগী রাগী আর অসুখী মানুষের মতো চেহারা। তাকে অনেক বুঝিয়ে গেছেন যেন সে ঢাকা চলে আসে, যাওয়ার আগে তাকে চিঠি লিখলেই তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। ঠিকানা রেখে গেছেন তার কাছে। তাকে সে কিছু বলে নি, বললে ভদ্রলোক হয়তো রেগে যেতেন। কেউ গ্রামে থাকতে পারে সেটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। রুমী কিন্তু গ্রামেই থাকবে, যে যাই বলুক তাকে।
অনেক ঘুরে দেখেছে সে। সড়ক ধরে অনেক দূর হেঁটে গেছে, কি সুন্দর ধানের ক্ষেত দুপাশে, বাতাস যেন ঢেউ খেলে যাচ্ছে। আকাশে সাদা মেঘ এপাশ থেকে ওপাশে ভেসে ভেসে যায়। একদিন কালো মেঘে আকাশ ঢেকে গেল, রুমীর দেখে আশা মেটে না, বিজলি চমকাতে থাকে, তারপর কি গুড়গুড় মেঘের ডাক! রাখাল ছেলেরা গরু ছুটিয়ে নিয়ে আসছে গোয়ালে, উঠনে শুকাতে দেওয়া ধান হৈচৈ করে তুলে নিচ্ছে মেয়েরা, মোরগগুলি কঁক্ কঁক করে ঘরে ঢুকছে সন্ধ্যা হয়ে গেছে ভেবে। দেখতে দেখতে ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এলো, ভেসে গেল যেন পৃথিবী। ভেজা শাড়ি পরে মেয়েরা ছুটোছুটি করতে থাকে, সংসারের খুঁটিনাটি জিনিস তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নিতে চায়। এসব দেখে আনমান হয়ে যায় রুমী।
নৌকা করে গিয়েছিল একবার, নদীর দুতীরে তাকিয়ে সে স্তব্ধ হয়ে যায়, দূরে কাশবন, ঝোঁপঝাড়, বনজঙ্গল। আকাশে মেঘ, তার মাঝে সারি সারি বক উড়ে যায় দক্ষিণে। নদীর কালো পানি দেখে অবাক হয়ে যায় রুমী, কে জানে কত রহস্য লুকানো আছে ওখানে। জেলেরা মাছ ধরছে তার মাঝে হঠাৎ একটা শুশুক লাফিয়ে উঠে আবার ডুবে যায় পানিতে। সন্ধ্যার পড়ন্ত আলোতে নিচু গলায় কথা বলে মাঝিরা, নৌকোর গলুইয়ে চুলো জ্বালিয়ে রান্না চাপায়। রাতে কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে খেতে বসে সবাই। লাল চালের ভাত, মুগের ডাল আর মাগুর মাছের ঝোল, খেতে অমৃতের মতো লাগে ওর।
ভোরে কুয়াশায় মাঠ ঢেকে থাকে, হুঁকো খেতে খেতে গল্প করে চাষিরা, তামাকের মিষ্টি গন্ধে বাতাস ভারি হয়ে আসে। লাঙল-গরু নিয়ে মাঠে চলে যায় সবাই ভোরের আলো ফোঁটার আগে। রুমী চুপচাপ ওদের দেখে মনে হতে থাকে সে ওদেরই একজন। শহরে ও যাবে না, এখানেই থাকবে, এদের সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে থাকবে, যে যাই বলুক না কেন।
একটা মোটে জীবন, সেটা সে নষ্ট করবে না এবার।
Leave a Reply