লিও জনসন, হ্যান্স লুইজটেন এবং নিয়েনকে বেকারের সম্পাদনার থ্যামস অ্যান্ড হাডসন প্রকাশ করেছে ভিনসেন্ট ভ্যানগগের চিঠি ও ছবির সংগ্রহ ভিনসেন্ট ভ্যানগগ: দ্যা লেটার্স (ছয় খণ্ড)। এই সংকলনের এই সমালোচনাটি দ্য ইকনোমিস্ট-এর ২৯ নভেম্বর সংখ্যা থেকে অনূদিত হলো
কয়েক দশকব্যাপী মিথের যে বেড়াজাল ভ্যানগগকে আড়াল করে রেখেছে প্রকৃতপক্ষে তার চেয়েও অনেক বেশি চমকপ্রদ তাঁর জীবন। ছয় খণ্ডে প্রকাশিত ভিনসেন্ট ভ্যানগগ: দ্য লেটার্স এর প্রমাণ। তাঁর লেখা ও আঁকার সংকলন এটি। তাঁর লেখা ৮১৯টি এবং তাঁকে লেখা ৮৩টি চিঠি আছে এ সংকলনে। প্রথম চিঠিটা তাঁর ১৯ বছর বয়সে লেখা। লিখেছেন তাঁর চার বছরের ছোট ভাই থিত্তকে উদ্দেশ করে। বেশির ভাগ চিঠিই লিখেছেন এই ভাইকেই। থিও পরবর্তীকালে ছবির ডিলার হয়েছিলেন এবং তিনিই ছিলেন ভ্যানগগের আর্থিক ও আত্মিক সহযোগিতার প্রধান উত্স।
ভ্যানগগ ছিলেন একনিষ্ঠ, বুদ্ধিমান, স্পর্শকাতর, হূদয়বান, সুপাঠক, বিদ্রোহী ও একরোখা। তিনি যখন ভবঘুরেদের মতো পোশাক-আশাক পরতে শুরু করলেন, তিনি বলতেন, এটা ছিল তাঁর ন্যুব্জ ও ভণ্ড সমাজের অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ। তাঁর জীবন কখনো খুবই করুণ, কখনো ছিলেন প্রেমাহত, সব সময় কোনো না কোনো ক্ষেত্রে পাগলের মতো নিবিষ্ট, কখনো একেবারে উন্মাদ।
সাহিত্য ও শিল্পকলা ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক সহযোগী। প্রায়ই যা পড়তেন বা দেখতেন তাঁর সম্পর্কে কিছু লিখে রাখতেন। শিল্পকলার ইতিহাসে কোন ছবির অবস্থান কোথায় বা প্রচলিত মতে বইটি ভালো না মন্দ তিনি কখনো এসব বিবেচনায় নিতেন না। তাঁর একমাত্র বিবেচ্য বিষয় ছিল, সেটা পাঠক বা দর্শকের সঙ্গে কী যোগাযোগ তৈরি করতে পারছে এবং কীভাবে করছে?
১৬ বছর বয়সে একজন প্রথাগত যুবকের মতোই তিনি চিত্রশালার ডিলার হওয়ার জন্য ঘর ছাড়েন। প্রথমে যান হেগে, তারপর প্যারিস হয়ে লন্ডনে। কিন্তু সেখানে তাঁর শৈশবের অস্থিরতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, সম্ভবত তাঁর বাড়িওয়ালার মেয়ের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়াটা ছিল এর অন্যতম কারণ। তিনি চাকরি হারান। শিক্ষক বা যাজক হিসেবেও ব্যর্থ হন তিনি।
তার ভেতরে ধর্মীয় উন্মাদনা গড়ে ওঠে। তাঁর এই উন্মাদনার আন্তরিক প্রতিবেদন পাওয়া যায় তাঁর সেই সময়ের চিঠিগুলোতে। সে সময় এক কম বয়সী বিধবার প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন এবং নাছোড়বান্দার মতো তাঁর পেছনে লেগে থাকেন। সেই বিধবার বারবার বলা ‘না, কখনোই না’, প্রত্যাখ্যানের এই কথাগুলোকে তাঁর ভাষায় ‘বরফ পিণ্ডের মতো ঘষতাম আমার বুকে, হূদয়ের উষ্ণতায় সেগুলোকে গলিয়ে ফেলার জন্য।’
২৬ বছর বয়সে তাঁর নিবেদন শিল্পে রূপ নিতে শুরু করে। এ সময় তিনি ছিলেন কপর্দকহীন এক নিঃসঙ্গ ছন্নছাড়া। এ সময় এক বছর কোনো চিঠি নেই। তাঁর ভবিষ্যত্ নিয়ে আলোচনায় থিওর সঙ্গে ঝাগড়া হয়। আবার যখন তাঁর চিঠি পাওয়া যায় তিনি নিজেকে একজন বন্দী ও খাঁচায় আবদ্ধ পাখির সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার ভেতরে কিছু একটা আছে, কিন্তু আমি জানি না সেটা ঠিক কী।’ দুই মাস পর ছবি আঁকার পেছনে তিনি প্রচণ্ড শ্রম দিতে শুরু করেন। এ সময় তিনি নিজেকে একজন লাঙল চালানো কৃষকের সঙ্গে তুলনা করেন। ১৮৮৫, পাঁচ বছর পরে আসে এর সুফল ‘পটেটো ইটার্স’। ভ্যানগগ নিজেকে আবিষ্কার করেন অন্য উচ্চতায়।
প্যারিসে দুই বছর থিওর সঙ্গে থাকার পর ১৮৮৮ সালে তিনি আরলেসে যান। ক্যানভাসে যেন রঙের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল। এটিই সেই অফুরন্ত, স্বতঃস্ফূর্ত, বস্ফুিরিত সৃজনশীলতার কিংবদন্তীয় পর্যায়। হ্যাঁ, এ সময়ই তিনি তাঁর কান কাটেন। এ সময় ‘দ্যা নাইট ক্যাফে’, ‘ইয়োলো হার্ডস’সহ ২০০ ছবি আঁকা হয়।
১৯৮৯ সালে ভাইয়ের বিয়ে কিংবা অতিরিক্ত মাদকসেবনের কারণে ভাইয়ের সঙ্গে কয়েক দফা মনোমালিন্যের পর এক বছর তিনি নিরাময় কেন্দ্রে কাটান। কাজ চলছিল আগের গতিতেই। এই সময় আঁকা হয় ‘সানফ্লাওয়ার’, ‘স্টারি নাইট’-এর মতো ছবিসহ প্রায় ১৫০টি ছবি।
তাঁর শেষ চিঠিটি পাওয়া যায় অসমাপ্ত অবস্থায়। তাঁর ভাইয়ের কাছে লেখা এই চিঠিটির তারিখ ছিল ২৩ জুলাই ১৮৯০। নিজেকে গুলিবিদ্ধ করার পর তাঁর পকেটে চিরকুটটি পাওয়া যায়। ২৭ জুলাই, ৩৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
২৫ বছরের পরিশ্রমের পর এই সংকলনটি আলোর মুখ দেখল। ডাচ্, ইংরেজি ও ফ্রেঞ্চ—তিনটি ভাষায় এটি প্রকাশিত হয়েছে। তার পত্রসংগ্রহের এটাই প্রথম প্রকাশনা নয়, কিন্তু এটাই শ্রেষ্ঠ। চিঠির সঙ্গে আঁকা ভ্যানগগের নানা স্কেচ, ইলাস্ট্রেশন ইত্যাদির হুবহু মুদ্রণ এ বইটিকে অন্যান্য সংকলন থেকে আলাদা করেছে। তিনি চিঠির খামেও নানা ধরনের স্কেচের আঁচড় দিতেন, সেগুলোও এখানে অবিকল মুদ্রিত হয়েছে। এটির প্রকাশ উপলক্ষে ভ্যানগগ জাদুঘর, লন্ডনের রয়েল একাডেমি নানা ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
লেখা ও আঁকার এই অপূর্ব সন্নিবেশনই ভ্যানগগের এই অনন্যসাধারণ আত্মপ্রকৃতিটির বৈশিষ্ট্য। এটাই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত কোনো শিল্পীর শ্রেষ্ঠ আত্মজীবনী।
ভাষান্তর: তামিম-ইয়াসীন
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, ডিসেম্বর ১১, ২০০৯
Leave a Reply