০৪. কবি কিংকর চৌধুরী

কবি কিংকর চৌধুরী

টেলিফোনের শব্দে সকালবেলা ঘুম ভাঙল। বাংলাদেশে ঘুমের ব্যাপারে আমার চাইতে বড় এক্সপার্ট কেউ আছে বলে আমার মনে হয় না। যদি ঘুমের ওপর কোনো অলিম্পিক প্রতিযোগিতা থাকত সোনা না হলেও নির্ঘাত একটা রুপা কিংবা ব্রোঞ্জ পদক আনতে পারতাম। এরকম একটা এক্সপার্ট হিসেবে আমি জানি সকালের ঘুমটা হচ্ছে ঘুমের রাজা এইসময় কেউ যদি ঘুমের ডিস্টার্ব করে তার দশ বছরের জেল হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু দেশে এখনো সেই আইন হয় নি। কাজেই আমাকে বিছানা থেকে উঠতে হল। উঠতে গিয়ে আমি আউক বলে নিজের অজান্তেই একটা শব্দ করে ফেললাম। বেকায়দায় ঘুমাতে গিয়ে ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা।

কোনোমতে ব্যথা সহ্য করে গিয়ে টেলিফোন ধরে বললাম, হ্যালো।

ভাইয়া! এতক্ষণ থেকে ফোন বাজছে, ধরছ না, ব্যাপারটা কী?

গলা শুনে বুঝতে পারলাম ছোট বোন শিউলি, আমাদের পরিরারের সবচেয়ে বিপজ্জনক সদস্য। সবকিছু নিয়ে তার কৌতূহল এবং সবকিছু নিয়ে তার এক্সপেরিমেন্ট করার একটা বাতিক আছে। বিশেষ করে নতুন নতুন যে রান্নাগুলি সে আবিষ্কার করে, সেগুলিকে আমি সবচেয়ে ভয় পাই। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কী হয়েছে? এত সকালে ফোন করছিস?

সকাল? কয়টা বাজে তুমি জান?

কয়টা?

সাড়ে দশটা।

সাড়ে দশটা অবশ্যই সকাল। আমি হাই তুলে বললাম, কী হয়েছে তাড়াতাড়ি বল। বাকি ঘুমটা শেষ করতে হবে।

তাড়াতাড়ি-তাড়াতাড়ি সব সময় তোমার শুধু তাড়াতাড়ি। ছোট বোন শিউলি বলল, কোনো কিছু যে ধীরে ধীরে সুন্দর করে করার একটা ব্যাপার আছে সেটা তুমি জান?

আমার ঘুম চটকে গেল, সে যে কথাগুলি বলেছে সেগুলি মোটেও তার কথা না। শিউলি সব সময়েই ছটফট করে হইচই করে চিৎকার করে ছোটাছুটি করে! আমাকে উপদেশ দিচ্ছে ধীরে-সুস্থে কাজ করতে, সুন্দর করে কাজ করতে—ব্যাপারটা কী? আমি বললাম, তোর হয়েছে কী? এভাবে কথা বলছিস কেন?

কীভাবে কথা বলছি?

বুড়ো মানুষের মতো। ধীরে ধীরে কাজ করা সুন্দর করে কাজ করা, এগুলো আবার কী রকম কথা?

শিউলি বলল, মানুষের জীবন ক্ষণিকের হতে পারে কিন্তু সেটা খুব মূল্যবান। সেটা তাড়াহুড়ো করে অপচয় করা ঠিক না। সেটা সুন্দর হতে হবে, পবিত্র হতে হবে, কোমল পেলব হতে হবে

আমার ঘুম পুরোপুরি ছুটে গেল, উত্তেজনায় ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে আবার প্রচণ্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠে বললাম, আউক!

আউক? শিউলি প্রায় আর্তনাদ করে বলল, ভাইয়া, তুমি এসব কী অশালীন অসুন্দর কথা বলছ? ছি ছি ছি —

আমি এবারে পুরোপুরি রেগে আগুন হয়ে উঠে বললাম, আমার ইচ্ছে হলে আউক বলব, ইচ্ছে হলে ঘাউক বলব, তোর তাতে এত মাথাব্যথা কিসের?

অন্যপাশে শিউলি বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে একটা স্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে তুমি রাগাতে পারবে না ভাইয়া। আমি ঠিক করেছি জীবনের যত অসুন্দর জিনিস তার থেকে দূরে থাকব। তোমাকে যে জন্য ফোন করেছিলাম-

কী জন্য এই সকালে ঘুম ভাঙিয়েছিস?

আজ সন্ধেবেলা আমার বাসায় আস।

কী ব্যাপার? খাওয়াদাওয়া—

ইস ভাইয়া! শিউলি কেমন যেন নেকু নেকু গলায় বলল, তুমি খাওয়া ছাড়া আর কিছু বোঝ না। খাওয়া হচ্ছে একটা স্কুল ব্যাপার। পৃথিবীতে খাওয়া ছাড়া আরো সুন্দর বিষয় থাকতে পারে।

সেটা কী?

আজকে বাসায় কবি কিংকর চৌধুরী আসবেন–

কী চৌধুরী?

শিউলি স্পষ্ট করে বলার চেষ্টা করল, কিংকর চৌধুরী।

কিংকং চৌধুরীঃ কিংকং গরিলার নাম, মানুষকে কিংকং ডাকছিস কেন? আমি অবাক হয়ে বললাম, বেশি মোটা আর কালো নাকি?

কিংকং না, শিউলি শীতল গলায় বলল, কিংকর। কিংকর চৌধুরী।

কিংকর? কী অদ্ভুত নাম!

মোটেও অদ্ভুত না। কিংকর খুব সুন্দর নাম। তুমি বইপত্র পড় না বলে জান। কিংকর চৌধুরী বাংলাদেশের একজন প্রধান কবি। তার একটা করে কবিতার বই বের হয় সেগুলো হটকেকের মতো বিক্রি হয়। দেশের তরুণ-তরুণীরা তার জন্য পাগল–

চেহারা কেমন?

শিউলি থতমত খেয়ে বলল, চেহারা?

হ্যাঁ। কালো আর মোটা নাকি?

মানুষের চেহারার সাথে তার সৃজনশীলতার কোনো সম্পর্ক নাই।

তার মানে কালো আর মোটা। আমি সবকিছু বুঝে ফেলেছি এরকম গলায় বললাম, স্মাথায় টাক?

মোটেও টাক নাই। শিউলি ঠাণ্ডা গলায় বলল, কপালের ওপর থেকে হুঁবহুঁ রবীন্দ্রনাথ। চোখ দুটো একেবারে জীবনানন্দ দাশের। নাকের নিচের অংশ কাজী নজরুল ইসলাম। আর তোমার হিংসুটে মনকে শান্ত করার জন্য বলছি, কবি কিংকর চৌধুরী মোটেও কালো আর মোটা নন। ফরসা এবং ছিপছিপে! দেবদূতের মতো—

বুঝেছি। আমি চিন্তিত গলায় বললাম, এই কবিই তোর মাথা খেয়েছে। শরীফ কী বলে?

শরীফ হচ্ছে শিউলির স্বামী, সেও শিউলির মতো আধপাগল। কোনো কোনো দিক দিয়ে মনে হয় পুরো পাগল। শিউলি বলল, শরীফ তোমার মতো কাঠখোট্টা না, তোমার মতো হিংসুটেও না। শরীফই কবি কিংকর চৌধুরীকে বাসায় এনেছে–

বাসায় এনেছে মানে? আমি আঁতকে উঠে বললাম, এখন তোদের বাসায় পাকাপাকি উঠে এসেছে নাকি?

না ভাইয়া। শিউলি শান্ত গলায় বলল, তার নিজের বাসা আছে, ফ্যামিলি আছে, সেখানে থাকেন। মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন।

হ্যাঁ, খুব সাবধান। আমি গম্ভীর হয়ে বললাম, কবি-সাহিত্যিকরা ছ্যাবলা টাইপের হয়। একটু লাই দিলেই কিন্তু মাথায় চড়ে বসবে তার বাসায় পাকাপাকিভাবে ট্রান্সফার হয়ে যাবে।

উঁহ! ভাইয়া–শিউলি কান্না কান্না গলায় বলল, তুমি একজন সম্মানী মানুষ নিয়ে এত বা কৃষ্ণা বলতে পার, ছি!

মোটেও বাজে কথা বলছি না। তুই কী জানিস?

অন্তত এইটুকু জানি কবি কিংকর চৌধুরী বাংলাদেশের একজন শ্রেষ্ঠ মানুষ। বিখ্যাত মানুষ। সম্মানী মানুষ। তার সাথে কথা বলে আমরাও চেষ্টা করছি তার মতো হতে–

সর্বনাশ! আচমকা ঘাড় ঘোরাতে গিয়ে আবার রগে টান পড়ল, আমি আবার বললাম, আউক।

শিউলি না শোনার ভান করে বলল, যদি একজন সত্যিকারের মানুষের সাথে দেখা করতে চাও, কথা বলতে চাও তা হলে সন্ধেবেলা এসো। কবি কিংকর চৌধুরী থাকবেন।

খাবারের মেনটা কী জিজ্ঞেস করার আগেই শিউলি টেলিফোন রেখে দিল। মনে হয় আমার ওপর রাগ করেছে। টেলিফোন রেখে দেবার পর আমার মনে হল, কবি কিংকর চৌধুরীকে দেখে বিলু আর মিলি কী বলছে সেটা জিজ্ঞেস করা হল না। বিলু আর মিলি হচ্ছে আমার ভাগ্নে-ভাগ্নি, একজনের বয়স আট অন্যজনের দশ, ঐ বাসায় এই দুইজন এখনো স্বাভাবিক মানুষ—বড় হলে কী হবে কে জানে! শিউলি-শরীফের পাল্লায় পড়ে কবিসাহিত্যিকের পেছনে যে ঘোরাঘুরি শুরু করবে না কেউ তার গারান্টি দিতে পারবে না। পাগলা-আধপাগলা মানুষ নিয়ে যে কী মুশকিল!

শিউলি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে, তাই আর বিছানায় ফেরত গিয়ে লাভ নেই। ঘাড়ের ব্যথাটাও মনে হয় ভালোভাবেই ধরেছে। সঁত ব্রাশ করা, শেভ করা, এই কাজগুলো করতে গিয়েও মাঝে মাঝে আউক শব্দ করতে হল। বেলা বারোটার দিকে ঘর থেকে বের হয়েছি। বাসার বাইরে একজন দারোয়ান থাকে, আমাকে দেখেই দাঁত বের করে হি হি করে হেসে বলল, স্যার, ঘাড়ে ব্যথা?

আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাতে গিয়ে উক করে শব্দ করলাম। পুরো শরীর ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাতে হল, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে আমার ঘাড়ে ব্যথা?

দশ মাইল দূর থেকে আপনাকে দেখে বোঝা যায় স্যার। দুইটা জিনিস মানুষের কাছে লুকানো যায় না। একটা হচ্ছে ঘাড়ে ব্যথা আরেকটা–

আরেকটা কী?

সেটা শরমের ব্যাপার, আপনাকে বলা যাবে না।

ও। শরমের ব্যাপারটা আমি আর জানার চেষ্টা করলাম না। আমি হেঁটে যাচ্ছিলাম, দারোয়ান আমাকে থামাল, বলল, স্যার। ঘাড়ের ব্যথার জন্য কী ওষুধ খাচ্ছেন?

এখনো কোনো ওষুধ খাচ্ছি না।

ওষুধে কোনো কাজ হয় না স্যার, যেটা দরকার সেটা হচ্ছে মালিশ।

মালিশ?

জে স্যার। সরিষার তেল গরম করে দুই কোয়া রশুন ছেড়ে দিবেন স্যার। সকালে এক মালিশ বিকালে আরেক মালিশ। দেখবেন ঘাড়ের ব্যথা কই যায়।

ঠিক আছে। আমি ঘাড়ের ব্যথার ওষুধ জেনে বের হলাম। মোড়ের রাস্তায় যাবার সময় শুনলাম পানের দোকান থেকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, ঘাড়ে ব্যথা?

ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে গিয়ে যন্ত্রণায় আউক শব্দ করলাম। পুরো শরীর ঘুরিয়ে তাকাতে হল, পানের দোকানের ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একজনের ঘাড়ে কথা হলে অন্যকে কেন হাসতে হবে? আমি বললাম, । ঘাড়ে ব্যথা।

কমলার রস খাবেন। দিনে তিনবার। দেখবেন বাধা বাপ বাপ করে পালাবে।

আচ্ছা। ঠিক আছে।

আমি দশ পাও সামনে যাই নি, একজন আমাকে থামাল, জাফর ইকবাল সাহেব না?

জি।

ঘাড়ে ব্যথা?

মানুষটা কে চেনার চেষ্টা করতে করতে বললাম, জি। সকাল থেকে উঠেই ঘাড়ে বাধা।

ঘাড়ে ব্যথার একটাই চিকিৎসা, ঠাণ্ডা-গরম চিকিৎসা।

ঠাণ্ডা-গরম?

জি। আইসব্যাগ আর হট ওয়াটার ব্যাগ নিবেন। দুই মিনিট আইসব্যাগ দুই মিনিট হট ওয়াটার ব্যাগ। ব্লাড সারকুলেশান বাড়বে আর ব্লাড সারকুলেশান হচ্ছে সব সমস্যার সমাধান। দুই দিনে সেরে যাবে।

ও আচ্ছা। আমি মানুষটার দিকে তাকিয়ে তার পরিচয় জানতে চাচ্ছিলাম, তার আগেই সে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। আমাদের দেশের মানুষের মনে হয় রোগের চিকিৎসা নিয়ে উপদেশ দেওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুর জন্য সময় নেই।

সারা দিন অন্তত শ খানেক পরিচিত এবং অপরিচিত মানুষ আমার ঘাড়ের ব্যথা কেমনভাবে সারানো যায় সেটা নিয়ে উপদেশ দিল। সবচেয়ে সহজটি ছিল তিনবার কুলহুঁ আল্লাহ পড়ে কুঁ দেওয়া। সবচেয়ে কঠিনটি হচ্ছে জ্যান্ত দাঁড়াশ সাপ ধরে এনে শক্ত করে তার লেজ এবং মাথা টিপে ধরে শরীরটা ঘাড়ে ভালো করে ডলে নেওয়া। আশ্চর্যের ব্যাপার, এই শখানেক মানুষের মাঝে একজনও আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে বলল না। বিকালবেলা আমি তাই ঠিক করলাম ডাক্তারের কাছেই যাব।

কোন ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় সেটা নিয়ে একটু সমস্যার মাঝে ছিলাম, তখন সুব্রতের কথা মনে পড়ল। আমি কাছাকাছি একটা ফোন-ফ্যাক্সের দোকান থেকে সুব্রতকে ফোন করতেই সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কৈ, জাফর ইকবাল?

হ্যাঁ।

কী হয়েছে তোর? এইরকম সময়ে ফোন করেছিস? কোনো সমস্যা?

না-না, কোনো সমস্যা না। আমি তাকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম, একটা ডাক্তারের খাজ করছিলাম।

ডাক্তার? সুব্রত প্রায় চিৎকার করে বলল, কেন? কার জন্য ডাক্তার? কী হয়েছে? সর্বনাশ!

সেরকম কিছু হয় নাই। আমার নিজের জন্য।

তোর নিজের জন্য? কেন? কী হয়েছে তোর?

ঘাড়ে ব্যথা।

ঘাড়ে ব্যথা? সুব্রত হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেল, আমার মনে হল আমি যেন ঘাড়ে ব্যথা না বলে ভুল করে লিভার ক্যান্সার বলে ফেলেছি। সুব্রত থমথমে গলায় বলল, কোন ঘাড়ে?

দুই ঘাড়েই। বামদিকে একটু বেশি।

সুব্রত আর্তনাদ করে বলল, বামদিকে একটু বেশি? সর্বনাশ!

এর মাঝে সর্বনাশের কী আছে?

হার্ট অ্যাটাকের আগে এভাবে ব্যাখা হয়। ঘাড়ে হাতে ছড়িয়ে পড়ে। আমার আপন ভায়রার ছোট শালার এরকম হয়েছিল। হাসপাতালে নেবার আগে শেষ।

এবারে আমি বললাম, সর্বনাশ!

তুই কোনো চিন্তা করিস না। আমি আসছি।

আয় তা হলে।

কোথায় আছিস তুই?

আমি রাস্তার ঠিকানাটা দিলাম। সুব্রত টেলিফোন রাখার আগে জিজ্ঞেস করল, তোর কি শরীর ঘামছে?

না।

বুকের মাঝে কি চিনচিনে ব্যথা আছে? মনে হয় কিছু একটা চেপে বসে আছে?

আমি দুর্বল গলায় বললাম, না, সেরকম কিছু নেই।

ঠিক আছে। তুই বস, আমি আসছি। কোনো চিন্তা করবি না।

আমি ফোন-ফ্যাক্সের দোকানে বসে রইলাম। দোকানের মালিক খুব বিরক্ত চোখে আমার দিকে তাকাতে লাগল, আমি বেশি গা করলাম না। সত্যি যদি হার্ট অ্যাটাক হতেই হয় এখানে হোক, সুব্রত তা হলে খুঁজে পাবে। রাস্তাঘাটে হার্ট অ্যাটাক হলে উপায় আছে!

বসে থাকতে থাকতে আমার মনে হতে লাগল, ঘাড়ের ব্যথাটা আস্তে আস্তে ঘাড় থেকে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে। একটু পরে মনে হল, বুকে ব্যাথা করতে শুরু করেছে। মনে হতে লাগল হাত ঘামতে শুরু করেছে, খানিকক্ষণ পর মনে হল শুধু হাত না শরীরও ঘামছে। আমার শরীর দুর্বল লাগতে থাকে, মাথা ঘুরতে থাকে এবং হাত-পা কেমন জানি অবশ হয়ে আসতে থাকে। জীবনের আশা যখন প্রায় ছেড়েই দিয়েছি তখন সুব্রত এসে হাজির। আমাকে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, বেশি ভালো না!

তুই কোনো চিন্তা করিস না। ডাক্তারকে ফোন করে দিয়েছি। আয়।

ডাক্তার নাম কী?

সুব্রত আমাকে ধমক দিয়ে বলল, তুই ডাক্তারের নাম দিয়ে কী করবি?

কোথায় বসে?

সেটা জেনে তোর কী লাভ? আয় আমার সাথে।

আমাকে একটা সিএনজিতে তুলে সুব্রত ধানমণ্ডিতে এক জায়গায় নিয়ে এল। ডাক্তারের চেম্বারের বাইরে অনেক মানুষজন কিন্তু সুব্রত কীভাবে কীভাবে জানি সব মানুষকে পাশ কাটিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল।

ডাক্তারের বয়স হয়েছে, চুল পাকা। চশমার ফাঁক দিয়ে আমাকে একবার মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে জিজ্ঞেস করলেন, কী সমস্যা?

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, ঘাড়ে ব্যথা।

ঘাড় থাকলেই ঘাড় ব্যথা হবে। যাদের ঘাড় নেই, তাদের ঘাড়ের ব্যথাও নেই।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, কাদের ঘাড় নেই?

ব্যাঙদের। তাদের গলা-ঘাড় কিছু নেই। মাথার পরেই ধড়।

সুব্রত আমার পাশে বসে ছিল, আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তোর ব্যাঙ হয়েই জন্ম নেওয়া উচিত ছিল।

ডাক্তার সাহেব অবাক হয়ে বললেন, কেন?

সুব্রত বলল, দেখছেন না ব্যাঙের মতন মোটা হয়েছে। এ শুধু খায় আর ঘুমায়।

ডাক্তার সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সত্যি নাকি?

আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিতে গিয়ে যন্ত্রণার কারণে বললাম, আউক।

সুব্রত বলল, আউক মানে হচ্ছে ইয়েস।

ডাক্তার সাহেব কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আসেন, কাছে আসেন।

আমি ভয়ে ভয়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। ডাক্তার আমার ঘাড় ধরে খানিকক্ষণ টেপাটেপি করলেন, ব্লাড প্রেসার মাপলেন, স্টেথিস্কোপ কানে লাগিয়ে কিছুক্ষণ বুকের ভেতরে কিছু একটা শুনলেন তারপর মুখ সুচালো করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?

কী হয় নাই?

মা-মানে?

ডাক্তার সাহেব রাগ রাগ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আপনার আমার কাছে না এসে যাওয়া উচিত ছিল দশতলা একটা বিল্ডিয়ের ছাদে।

কেন?

নিচে লাফিয়ে পড়ার জন্য।

আমি থতমত খেয়ে বললাম, নিচে লাফিয়ে পড়ার জন্য? নিচে লাফিয়ে পড়ব কেন?

সুইসাইড করার জন্য। ডাক্তার সাহেব আমার দিকে রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে থেকে বললেন, তাই তো করছেন। শুধু খান আর ঘুমান। কোনোরকম এক্সারসাইজ নেই শারীরিক পরিশ্রম নেই। আস্তে আস্তে ব্লাড প্রেসার হবে, ডায়াবেটিস হবে। কোলেস্টেরল হবে। আর্টারি ব্লক হবে। হার্ট অ্যাটাক হবে। গ্লুকোমা হবে। কিডনি ফেল করবে। স্ট্রোক হয়ে শরীর প্যারালাইজড় হয়ে যাবে। বিছানায় পড়ে থাকবেন। বিছানায় খাওয়া, বিছানায় পাইখানা-পিসাব।

শেষ কথাটা শুনে আমি চমকে উঠলাম, বলে কী ডাক্তার সাহেব? আমি জিজ্ঞেস করলাম, বি-বিছানায় খাওয়া। বিছানায় পা পা–

কথা শেষ করার আগে ডাক্তার সাহেব হুঙ্কার দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। তারপর টেবিলে কিল মেরে বললেন, বিয়ে করেছেন?

আমি চিঁ চিঁ করে বললাম, এখনো করি নাই। তাড়াতাড়ি করে ফেলেন। বোকাসোকা টাইপের একটা মেয়েকে বিয়ে করবেন।

সুব্রত বললেন, সেটা নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না ডাক্তার সাহেব। যার মাথায় ছিটেফোটা বুদ্ধি আছে, সে একে বিয়ে করবে ভেবেছেন?

সুব্রত কথাটা মিথ্যে বলে নি। কিন্তু সত্যি কথা কি সব সময় শুনতে ভালো লাগে? আমি শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করলাম, বোকাসোকা মেয়েকে কেন বিয়ে করতে হবে।

যখন স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে থাকবেন তখন নাকের ভেতর নল দিয়ে খাওয়াতে হবে না পাইখানা-পিসাব পরিষ্কার করতে হবে না? চালাক-চতুর একটা মেয়ে হলে সেটা করবে ভেবেছেন? করবে না। সেইজন্য খুঁজে খুঁজে বোকাসোকা মেয়ে বের করবেন। বুঝেছিলা

আমি পুরো ব্যাপারটা কল্পনা করে আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। কঁদো কাঁদো গলায় বললাম, তা এলে কী হবে আমার ডাক্তার সাহেব?

কী আর হবে? মরে যাবেন।

মর যাব?

হ্যাঁ। আস্তে আস্তে সুইসাইড করে কী হবে? দশতলা বিল্ডিঙের ওপর থেকে একটা লাফ দেন। এবারে কাজ কমপ্লিট।

আমি শুকনো গলায় বললাম, কিন্তু কিন্তু–

আর যদি সুইসাইড না করতে চান, যদি বেঁচে থাকতে চান তা হলে আপনাকে এক্সারসাইজ করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। প্রতিদিন এক ঘণ্টা এক্সারসাইজ করবেন।

এ-এক ঘণ্টা?

হ। এক ঘণ্টা। হাটবেন। হাঁটা হচ্ছে সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম। আর যদি না হঁটেন, যদি না ব্যায়াম করেন তা হলে আজকে ঘাড় ব্যথা, কালকে কোমর ব্যথা, পরশু বুকে ব্যথা, তারপরের দিন—–ডাক্তার সাহেব মুখে কথা না বলে হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার জুঙ্গি করে আমার কী হবে বুঝিয়ে দিলেন।

আমি ফোঁস করে একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। ডাক্তার সাহেব তার প্যাডটা টেনে নিয়ে সেখানে খসখস করে কী একটা লিখে দিয়ে বললেন, ঘাড়ে ব্যথার জন্য একটু ওষুধ লিখে দিলাম, ব্যথা অসহ্য মনে হলে খাবেন। কিন্তু মনে রাখবেন, ঘাড় ব্যথাটা কিন্তু কিছু! নিয়মিত ব্যায়াম করে শরীরকে যদি ফিট না করেন, তা হলে আপনি শেষ। আপনার পেছনে পেছনে কিন্তু গুপ্তঘাতক ঘুরছে, আপনি টের পাচ্ছেন না, কিছু বোঝার আগেই আপনার জীবন শেষ করে দেবে। খুব মজ্জার একটা কথা বলেছেন এরকম ভান করে ডাজ্ঞার সাহেব আনন্দে হা হা করে হেসে উঠলেন।

সুব্রত বলল, আপনি চিন্তা করবেন না ডাক্তার সাহেব, জাফর ইকবাল যেন প্রতিদিন এক ঘণ্টা করে এঁটে আমি নিজেই দায়িত্ব নিচ্ছি।

ভেরি গুড। ডাক্তার সাহেব তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকর একটা হাসি দিয়ে বললেন, গুড লাক!

 

ডাক্তার সাহেবের চেম্বার থেকে বের হবার পর সুব্রত বেশ কিছুক্ষণ আমাকে যাচ্ছেতাইভাবে গালাগাল করল, আমি মুখ বুজে সেগুলি সহ্য করে নিলাম। আমি যদি প্রতিদিন এক ঘণ্টা না ইটি তা হলে সে আমাকে কীভাবে শাস্তি দেবে সেরকম ভয়ংকর ভয়ংকর পরিকল্পনার কথা বলতে লাগল। আমি তাকে কথা দিলাম যে, এখন থেকে আমি নিয়মিতভাবে দিনে এক ঘণ্টা করে হাঁটব।

অনেক কষ্ট করে সুব্রতের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে প্রথমেই এক ফাস্টফুডের দোকানে ঢুকে একটা ডোবল হ্যামবার্গার খেয়ে নিলাম। মন খারাপ হলেই আমার কেন জানি খিদে পায়। প্যারালাইসিস হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি এবং আমার বোকাসোকা একটি বউ নাকের ভেতর নল ঢুকিয়ে সেদিক দিয়ে খাওয়াচ্ছে, সেটা চিন্তা করেই আমার ড়ুকরে কেঁদে ওঠার ইচ্ছে করছে। আরো একটা হ্যামবার্গার অর্ডার দেবার কথা ভাবছিলাম, তখন আমার বিজ্ঞানী

অনিক লুম্বার কথা মনে পড়ল, তার সাথে বিষয়টা আলোচনা করে দেখলে হয়।

অনিক বাসাতেই ছিল, আমাকে দেখে খুশি হয়ে গেল, বলল, আরে! জাফর ইকবাল, কী খবর তোমার?

আমি উত্তর দিতে গিয়ে মাথা নাড়াতেই বেকায়দায় ঘাড়ে টান পড়ল, যন্ত্রণায় কাতর শব্দ করে বললাম, আউক?

অনিক ভুরু কুঁচকে বলল, ঘাড়ে ব্যথা?

আমি মাথা নাড়াতে গিয়ে দ্বিতীয়বার বললাম, আউক!

অনিক বলল, ইন্টারেস্টিং?

আমি বললাম, কোন জিনিসটা ইন্টারেস্টিং?

এই যে তুমি প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ আউক শব্দ করে। কোনোটা আস্তে কোনোটা জোরে। একটাই শব্দ ভিন্ন ভিন্নভাবে উচ্চারণ করছ, উচ্চারণ করার ভঙ্গি দিয়ে অর্থ বুঝিয়ে দিচ্ছি। আমার মনে হয় একটা ভাষা এভাবে গড়ে উঠতে পারে। শব্দ হবে মাত্র একটা কিন্তু সেই শব্দটা দিয়েই সবরকম কথাবার্তা চলতে থাকবে। কী মনে হয় তোমার?

আমি চোখ কটমট কবে অনিকের দিকে তাকিয়ে বললাম, আমি মারা যাচ্ছি ঘাড়ের যন্ত্রণায় আর তুমি আমার সাথে মশকরা করছ?

অনিক বলল, আমি আসলে মশকরা করছিলাম না, সিরিয়াসলি বলছিলাম। তা যাই হোক-ডাল্ডারের কাছে গিয়েছিলে?

হ্যাঁ।

কী বলেছে ডাক্তার?

ঘাড়ের ব্যথা নিয়ে বেশি কিছু বলে নাই কিন্তু প্রতিদিন এক ঘণ্টা ব্যায়াম করতে বলেছে। যদি না করি তা হলে নাকি মারা পড়ব। ব্লাড প্রেসার হবে, ডায়াবেটিস হবে, হার্ট অ্যাটাক হবে, কিডনি ফেল করবে, গ্লুকোমা হবে তারপর একসময় স্ট্রোক হয়ে বিছানায় পড়ে থাকব। নাকের ভেতর নল দিয়ে খাওয়াতে হবে।

কে খাওয়াবে?

ডাক্তার সাহেব একটা বোকাসোকা টাইপের মেয়ে বিয়ে করতে বলেছেন। সে খাওয়াবে।

আমার কথা শুনে অনিক হা হা করে হাসতে লাগল। আমি বললাম, তুমি হাসছ? এটা হাসির ব্যাপার হল?

অনিক বলল, ডাক্তার সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ। তোমাকে দেখেই বুঝেছেন। এমনি বললে কাজ হবে না, তাই তোমাকে ভয় দেখিয়ে দিয়েছেন। আর কিছু না–

সত্যি?

হ্যাঁ। তোমার এত ঘাবড়ানোর কিছু নেই।

ঠিক বলছ?

হ্যাঁ। তবে ডাক্তার সাহেবের কথা তোমার শুনতে হবে। তুমি যেভাবে খাও আর ঘুমাও সেটা ঠিক না। তুমি একেবারেই ফিট না। কেমন যেন ঢিলেঢালা টাইপের মোটা। তোমার কোনো এক ধরনের ব্যায়াম করা উচিত।

আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, শরীরে তেল মেখে একটা নেংটি পরে আমি হুঁম হাম করে বুকডন দিচ্ছি দৃশ্যটা কল্পনা করতেই আমার কষ্ট হল। অনিক মনে হয় আমার মনের ভাবটা বুঝতে পারল, বলল, হাঁটাহাঁটি দিয়ে শুরু করতে পার। আগে যেসব জায়গায় রিকশা করে যেতে, সিএনজি করে যেতে, এখন সেসব জায়গায় হেঁটে যাবে।

অমি মাথা নাড়লাম, বললাম, আইডিয়াটা খারাপ না। অং রাতে আমার বোনের বাসায় যাবার কথা। এখান থেকে হেঁটে চলে যাব, কী বলো? আজ থেকেই শুরু করে দেওয়া যাক।

অনিক বলল, হাঁ। আজ থেকেই শুরু কর। দেখবে তোমার নিজেরই ভালো লাগবে।

আমি আর অনিক ব্যায়াম নিয়ে, শরীর আর স্বাস্থ্য নিয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বললাম। অনিক নতু। অক্ষর কী কী করেছে তার খোঁজখবর নিলাম, তারপর কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীগায়ক-সাংবাদিক খেলোয়াড় সবাইকে নিয়ে খানিকক্ষণ হাসি-তামাশা করলাম। অনিক কয়েকটা চিপসের প্যাকেট খুলল। সেগুলো খেয়ে দুই গ্লাস পেপসি খেয়ে রাত আটটার দিকে আমি শিউলির বাসায় রওয়ানা দিলাম। অনা দিন হলে নির্ঘাত একটা রিকশায় চেপে বসতাম, আজ হেঁটে যাবার ইচ্ছা।

শুরুটা খুব খারাপ হল না, কিন্তু পাঁচ মিনিট পরেই আমি দরদর করে ঘামতে শুরু করলাম, দশ মিনিট পর আমি রীতিমতো ইসাস করতে থাকি, মনে হতে থাকে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। আরো পাঁচ মিনিট পর আমার পা আর চলতে চায় না, পায়ের গোড়ালি থেকে নাকের ডগা পর্যন্ত ব্যথায় টনটন করতে থাকে। এমনিতেই ঘাড়ে ব্যথা, সেই ব্যথাটা মনে হয় এক শ গুণ বেড়ে গিয়ে শরীরের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ল। প্রত্যেকবার পা ফেলতেই বাথাটা ঘাড় থেকে একসাথে ওপরে এবং নিচে নেমে আসে এবং আমি ককিয়ে উঠি, আউক!

শেষ পর্যন্ত যখন শিউলির বাসায় পৌঁছলাম তখন মনে হল বাসার দরজাতেই হার্টফেল করে মরে যাব। জোরে জোরে কয়েকবার বেল বাজালাম, দরজা খুলে দিল মিলি, আমি তাকে ঠেলে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে সোফার মাঝে দড়াম করে হাত-পা ছড়িয়ে প্রায় শুয়ে পড়লাম। আমার মুখ দিয়ে বিকট এক ধরনের শব্দ বের হতে লাগল। জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলাম এবং দরদর করে ঘামতে লাগলাম। এইভাবে মিনিট পাঁচেক কেটে গেল, বুকের হাঁসফাস ভাবটা একটু যখন কমেছে তখন আমি চোখ খুলে তাকালাম এবং আবিষ্কার করলাম পাঁচচজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। মিলি এবং বিলুর দুই জোড়া চোখে বিস্ময় এবং মনে হল একটু আনন্দ। শিউলির এক জোড়া চোখে দুঃখ এবং হতাশা। শরীফের চোখে অবিশ্বাস এবং কৌতুক। পঞ্চম চোখ জোড়া একজন অপরিচিত মানুষের, তার লম্বা চুল এবং টুলুঢুলু চোখ। সেই চোখে ভয়, আতঙ্ক এবং ঘৃণা। আমি একটু ধাতস্থ হয়ে সোজা হয়ে বসতে গেলাম, সাথে সাথে ঘাড়ে বেকায়দায় টান পড়ল, আমি যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে বললাম, আউক।

শিউলি আমার দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া, তোমার এ কী অবস্থা?

আমি ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, ঘাড়ে ব্যথা।

ঘাড়ে ব্যথা হলে বের হয়েছ কেন?

তুই না আসতে বললি।

আমি তোমাকে এইভাবে আসতে বলেছি? ছি ছি ছি।

আমি রেগে বললাম, ছি ছি করছিস কেন?

এবারে মনে হল শিউলি রেগে উঠল, বলল, আয়নায় নিজের চেহারাটা একটু দেখেছ? এভাবে কেউ ঘামে? এভাবে সোফায় বসে? কেউ এরকম হাঁসফাস করে? ভাইয়া, তোমার পুরো আচার-আচরণে এক ধরনের বর্বর ভাব আছে।

ঢং করিস না। আমি শার্টের বোতাম খুলে তার তুলা দিয়ে পেট এবং বগল মোছার চেষ্টা করতে করতে বললাম, এরকম চং করে কথা বলা কোন দিন থেকে শিখেছিস? সোজা বাংলায় কথা বলবি আমার সাথে, তা না হলে কিন্তু তোকে কিলিয়ে ভর্তা করে দেব।

শিউলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাইয়া! তুমি এরকম অসভ্যের মতন কথা বলছ কেন? দেখছ না এখানে বাইরের মানুষ আছেন? তিনি কী ভাবছেন বলো দেখি!

লম্বা চুল এবং ঢুলুঢুলু চোখের মানুষটা নাকি গলায় বলল, নাঁ নাঁ শিঁউলি তুঁমি আঁমার জঁন্যে এঁকটুও চিঁন্তা কঁরো নাঁ। আঁমি পুঁরো ব্যাঁপারটা উঁপভোগ কঁরছি।

শিউলি বলল, কোন জিনিসটা উপভোগ করছেন কিংকর ভাই?

এই তা হলে সেই কবি কিংকর চৌধুরী? যার কপালের ওপরের অংশ রবীন্দ্রনাথের মতো, চোখ জীবনানন্দ দাশের মতো এবং থুতনির নিচের অংশ কাজী নজরুল ইসলামের মতো? যে শিউলি এবং শরীফের মাথাটা খেয়ে বসে আছে। আমি ভালো করে মানুষটার দিকে তাকালাম, আমার মনে হল মাথাটা শেয়ালের মতো, চোখগুলো পেঁচার মতো, নাকটা শকুনের মতো এবং মুখটা খাটাশের মতো। মানুষটা যত বড় কবিই হোক না কেন, আমি দেখামাত্র তাকে অপছন্দ করে ফেললাম। মানুষ যেভাবে মরা টিকটিকির দিকে তাকায় আমি সেভাবে তার দিকে তাকালাম।

কবি কিংকর চৌধুরী আমার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে ইঁদুরের মতো চিকন দাঁত বের করে একটু হেলে নাকিসুরে বলল, আঁমি কোন জিনিসটা উপভোগ করছি আনতে চাও?

শিউলি বলল, জানতে চাই কিংকর ভাই।

কবি কিংকর চৌধুরী খুব একটা ভাব করে বলল, আঁমি তো সুঁন্দরের পূঁজারী। সাঁরা জীঁবন সুঁন্দর জিঁনিস, শোঁভন জিঁনিস আঁর কোঁমল জিঁনিস দেঁখে এঁসেছি। তাঁই যঁখন কোঁনো অঁসুন্দর জিঁনিস অঁশালীন জিঁনিস দেঁখি ভাঁরি অঁবাক লাঁগে, চোঁখ ফেঁরাতে পাঁরি নাঁ–

আমার ইচ্ছে হল এই কবির টুঁটি চেপে ধরি। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করলাম। কবি কিংকর চৌধুরী বলল, সঁত্যি কঁথা বঁলতে কিঁ, এঁই বিঁচিত্র মাঁনুষটাকে দেঁখে চঁমৎকার এঁকটা কঁবিতার লাঁইন মাঁথায় চঁলে এঁসেছে। লাইনটা ইচ্ছে— কবি মুখটা ছুচোর মতো সুচালো করে বলল, আঁউক শঁব্দ কঁরে জেঁগে ওঁঠে পিঁচ্ছিল প্রাঁণী—

আমি এবার লাফিয়ে উঠে মানুষটার গলা চেপে ধরেই ফেলছিলাম। শরীফ আমাকে থামাল, খপ করে হাত ধরে বলল, ভাই, হেঁটে টায়ার্ড হয়ে এসেছেন, হাত-মুখ ধুয়ে একটু ঠাণ্ডা হয়ে আসেন।

বিলু আর মিলি আমার দুই হাত ধরে টানতে টানতে বলল, চলো মামা চলো, ভেতরে চলো।

আমি অনেক কষ্ট করে কয়েকবার আউক আউক করে সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে কবির দিকে তাকিয়ে বললাম, কবি সাহেব, আপনার কি সর্দি লেগেছে?

কৰি কিং–চৌধুরী চমকে উঠে বলল, কেঁন সঁর্দি লাঁগবে কেঁন?

আমি বললাম, ফ্যাঁত করে নাকটা ঝেড়ে সর্দি ক্লিয়ার করে ফেলুন, তা হলে আর নাঁকি সুঁরে কঁথা বঁলতে হঁবে নাঁ।

আমি কথা শুনে কবি কিংকর চৌধুরী কেমন জানি শিউরে উঠল, মনে হল ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবে! তার আগেই মিলু আর বিলু হি হি করে হাসতে হাসতে প্রায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করে। শিউলি ধমক দিয়ে বলল, ভেতরে যাও মিলু-বিলু। অভদ্রের মতো হাসছ কেন?

আমি এসকে দুই হাতে ধরে নিয়ে গেলাম। বিলু আর মিলুর সাথে আমিও তখন হা হ কা হাতে আ: করেছি। হাসির মতো ছোঁয়াচে আর কিছু নেই।

মিলু-বিলুর ঘরে আমি ঘামে ভেজা শার্ট খুলে আরাম করে বসলাম। বিলু ফুল স্পিডে ফ্যান ছেড়ে দিয়েছে, মিলু তারপরেও একটা পাখা দিয়ে বাতাস করতে লাগল। আমি পেট চুলকাতে চুলকাতে এলাম, তারপর বল তোদের কী খবর?

মিলু মুখ কালো করে বলল, খবর ভালো না মামা।

কেন? কী হয়েছে?

দেখলে না নিজের চোখে? কবি কাকু এসে আমাদের জীবন নষ্ট করে দিয়েছে!

আমি সোজা হয়ে বসে বললাম, কেন? কী হয়েছে?

আমরা জোরে কথা বলতে পারি না। হাসতে পারি না। টেলিভিশন দেখতে পারি না। আম্মু এই লম্বা লম্বা কবিতা মুখস্থ করতে দিয়েছে।

আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম, এত বড় সাহস শিউলির?

বিলু বলল, শুধু আম্মু না মামা–আব্বুও সাথে তাল দিচ্ছে।

বিলু বলল, তাল দিচ্ছে বলছিস কী? আব্বুই তো প্রথমে কবি কাকুকে বাসায় আনল।

আমি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নাড়াতে গিয়ে যন্ত্রণায় আউক করে শব্দ করলাম। সাথে সাথে মিলু আর বিলু হি হি করে হাসতে শুরু করল। আমি চোখ পাকিয়ে বললাম, হাসছিস কেন গাধা?

মিলু হাসতে হাসতে বলল, তুমি যখন আউক শব্দ কর সেটা শুনলেই হাসিতে পেট ফেটে যায়।

আমি বললাম, আমি মরি যন্ত্রণায় আর তোরা সেটা নিয়ে হাসিস? মায়া-দয়া বলে তোদের কিছু নেই?

সেটা শুনে দুজনে আরো জোরে হাসতে শুরু করে। কিন্তু একটু পরেই তাদের হাসি থেমে গেল। মিলু মুখ কাচুমাচু করে বলল, এই কবি কাকু আসার পর থেকে বাসায় কোনো আনন্দ নেই, খাওয়াদাওয়া পর্যন্ত নষ্ট হয়ে গেছে।

আমি প্রায় আর্তনাদ করে বললাম, খাওয়াদাওয়া নষ্ট হয়েছে মানে?

কবি কাকু খালি শাকসবজি খায় তো, তাই বাসায় আজকাল মাছ-মাংস কিছু রান্না হয় না।

আমি বললাম, বলিস কী তোরা?

সত্যি মামা। বিশ্বাস কর।

এই কবি মাছ-মাংস খায় না?

উঁহ। শুধু শাকসবজি। আর খাবার স্যালাইন।

খাবার স্যালাইন! আমি অবাক হয়ে বললাম, খাবার স্যালাইন একটা খাবার জিনিস হল নাকি? আমি না শুনেছি মানুষের ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খায়!

বিলু মাথা নাড়ল, উঁহুঁ মামা। কবি কাকু সব সময় চুকচুক করে খাবার স্যালাইন খেতে থাকে। আম্মু আপুকে বুঝিয়েছে এটা খাওয়া নাকি ভালো, এখন আন্ধু-আম্মু সব সময় আমাদেরকে স্যালাইন খাওয়ানোর চেষ্টা করে।

এত বড় সাহস শিউলির আর শরীফের?

মিলু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল, আম্মু-আব্দুর দোষ নাই মামা। সব ঝামেলা হচ্ছে কৰি কাকুর জন্য—-

আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম, খুন করে ফেলব এই কবির বাচ্চা কবিকে—

করতে চাইলে কর, কিন্তু দেরি কোরো না। দেরি হলে কিন্তু আমাদের জীবন শেষ।

আর না করতে চাইলে এখনি বলে দাও। বিলু মুখ শুকনো করে বলল, আমাদের মিছিমিছি আশা দিও না।

আমি বিলু আর মিলুর হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললাম, বিলু, মিলু তোরা চিন্তা করিস না। আমি কোনো একটা হেস্তনেস্ত করে দেব। আমার ওপর বিশ্বাস রাখ। আমি সবকিছু স্যু করতে পারি কিন্তু খাওয়ার ওপরে হস্তক্ষেপ কোনোভাবে সহ্য করব না। উত্তেজনায় বেশি জোরে ঝাকুনি দিয়ে ফেলেছিলাম বলে যন্ত্রণায় আবার শব্দ করতে হল, আউক।

আর সেই শব্দ শুনে বিলু আর মিলু আবার হি হি করে হাসতে লাগল।

কিছুক্ষণ পর শিউলি এসে বলল, ভাইয়া খেতে অস। আর তোমার দোহাই লাগে, খাবার টেবিলে বসে তুমি কোনো উল্টাপাল্টা কথা বলবে না।

আমি গম্ভীর গলায় বললাম, আমি কখনো উল্টাপাল্টা কথা বলি না। কিন্তু আমার সাথে কেউ উল্টাপাল্টা কথা বললে আমিও তাকে ছেড়ে দিই না।

শিউলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, প্লিজ, ভাইয়া, প্লিজ! কবি কিংকর চৌধুরী খুব বিখ্যাত মানুষ, খুব সম্মানী মানুষ। তাকে যা ইচ্ছে তা বলে ফেললা না।

সে যদি বলে আমি তাকে ছেড়ে দেব ভেবেছিস? আর পেতনির মতো নাকি সুরে কথা স্বলে কেন? শুনলেই মেজাজ খাট্টা হয়ে যায়।

শিউলি বলল, ওনার কথা বলার স্টাইলই ওরকম।

স্টাইলের খেতা পুড়ি। এরপর থেকে বলবি নাক ঝেড়ে আসতে।

শিউলি কঁদো কাঁদো গলায় বলল, প্লিজ, ভাইয়া প্লিজ!

খাবার টেবিলে গিয়ে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। মিলু আর বিলু ঠিকই বলেছে, টেবিলে শাকভর্তা ডাল এরকম কিছু জিনিস। মাছ-মাংস-ডিম জাতীয় কিছু নেই। কবি কিংকর চৌধুরী ঢুলুঢুলু চোখে বলল, শিউলি তোমার হাতেঁর পটল ভর্তাটা যা চমৎকার, একেবারে বিষ্ণু দের একটা কবিতার অঁতো।

শিউলি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, আমি বাধা দিয়ে বললাম, কী রে শিউলি! শুধু দেখি ঘাস লতা পাতা বেঁধে রেখেছিস। আমাদেরকে কি ছাগল পেয়েছিস নাকি?

শিউলি বলল, আজকে নিরামিষ মেনু।

মানুষকে দাওয়াত দিয়ে নিরামিষ খাওয়াচ্ছিস, ব্যাপারটা কী?

কবি কিংকর চৌধুরী বলল, মাঁছ মাঁংস খাওয়া বর্বরতা! ওঁসব খেঁলে পঁশু রিঁপু জেঁগে ওঁঠে।

কে বলেছে? আমি টেবিলে কিল দিয়ে বললাম, পৃথিবীর সব মানুষ মাছ-মাংস খাচ্ছে। তাদের কি পশু রিপু জেগেছে? লেজ গজিয়েছে?

কবি কিংকর চৌধুরী চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, পৃথিবীর সব মানুষ মাছ-মাংস খায় না। দক্ষিণ ভারতের মানুষেরা নিরামিশাষী। তাদের কাছ থেকে খাদ্যাভ্যাসটি আঁমাদের শেখার আছে।

আমি বললাম, আমাদের নিজেদের খাদ্যাভ্যাস কি খারাপ নাকি যে অন্যদের থেকে শিখতে হবে। আর অন্যদের থেকে যদি শিখতেই চান তা হলে কোরিয়ানরা দোষ করল কী? তাদের মতো কুকুরের মাংস খাওয়া শুরু করেন না কেন? খাবেন নাকি?

শিউলি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাইয়া।

আমি না শোনার ভান করে বললাম, কিংবা চায়নিজদের মতো? তারা নাকি তেলাপোকা খায়। খাবেন আপনি তেলাপোকা? ড়ুবোতেলে মুচমুচে করে আনব ভেজে কয়টা তেলাপোকা? মুখে পুরে কচমচ করে খাবেন?

শিউলি প্রায় আর্তনাদ কবে কী একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই মিলু আর বিলু হি হি করে হাসতে শুরু করল, হাঁসি আর থামতেই চায় না। শিউলি চোখ গরম করে বলল, মিলু বিন্দু অসভ্যের মতো হাসছিস কেন? হাসি বন্ধ কর এই মুহূর্তে।

দুজনে হাসি বন্ধ করলেও একটু পরে পরে হাসির দমকে তাদের শরীর কেঁপে উঠতে লাগল। কবি কিং টৌধুরীও একটা কথা না বলে বিষ্ণু দের কবিতার মতো পটল ভর্তা খেতে লাগল। আমিও জোর করে ঘাস-লতাপাতা খেয়ে কোনো মতে পেট ভরালাম। খাবার টেবিলে আমাদের দেখলে যে কেউ বলবে নিশ্চয়ই খুব বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে—কারো মুখে একটা কথা নাই!

 

সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে খালি এপাশ-ওপাশ করলাম, একটু পরে পরে মিলু-বিলুর শুকনো মুখের কথা মনে পড়ছিল, সেটা একটা কারণ আর হঠাৎ করে হাঁটার চেষ্টা করে পুরো শরীরে ব্যথা—সেটা দ্বিতীয় কারণ।

পরদিন বিকালবেলাতেই আমি বিজ্ঞানী অনিক লুম্বার বাসায় হাজির হলাম। আমাকে দেখে অনিক খুশি হয়ে বলল, তুমি এসেছ। ভেরি গুড। আমার একটা এক্সপেরিমেন্ট কারো ওপর পরীক্ষা করতে হবে। তুমিই হবে সেই গিনিপিগ।

আমি বললাম, আমি গিনিপিগ, ইঁদুর, আরোলা সবকিছু হতে রাজি আছি কিন্তু তার বদলে তোমার একটা কাজ করে দিতে হবে।

কী কাজ?

একজন কবি, তার নাম কিংকর চৌধুরী, সে আমাদের খুব উৎপাত করছে। তাকে আচ্ছামতো সাইজ করে দিতে হবে।

অনিক অবাক হয়ে বলল, কবি আবার কীভাবে উৎপাত করে?

আমি তখন তাকে কবি কিংকর চৌধুরীর পুরো ঘটনাটা খুলে বললাম। শুনে অনিক মাথা নেড়ে বলল, ঠিকই বলেছ, এ তো মহাঝামেলার ব্যাপার।

এখন তা হলে বলো তাকে কীভাবে শায়েস্তা করা যায়।

অনিক মাথা চুলকে বলল, কীভাবে তুমি শায়েস্তা করতে চাও?

সেটা আমি কেমন করে বলব? তুমি হচ্ছ বিজ্ঞানী, তুমিই বলো কী করা যায়।

অনিক তবুও মাথা চুলকায়, বলে, ইয়ে—কিন্তু–

আমি বললাম, এক কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

এমন একটা ওষুধ বের কর যেটা খেলে তার সাইজ ছোট হয়ে যাবে।

অনিক অবাক হয়ে বলল, সাইজ ছোট হয়ে যাবে? কত ছোট?

এই মনে কর ছয় ইঞ্চি।

ছয় ইঞ্চি?

হাঁ, তা হলে তাকে আমি একটা বোতলে ভরে দশজনকে দেখাতে পারি, চাই কি সার্কাসে বিক্রি করে দিতে পারি।

অনিক মাথা নাড়ল, বলল, উঁহুঁ। এটা সম্ভব নয়। একটা আস্ত মানুষকে কেমন করে তুমি ছয় ইঞ্চি সাইজ করবে!

তা হলে কি কোনো মতে তার মাথায় এক জোড়া শিং গজিয়ে দেওয়া যাবে? গরুর মতো শিং। সেটা যদি একান্তই না পারা যায় তা হলে অন্তত ছাগলের মতো এক জোড়া শিং?

অনিক চিন্তিত মুখে কী একটা ভাবে, তারপর আমতা-আমতা করে বলে, ইয়ে সেটা যে খুব অসম্ভব তা না। জিনেটিক্সের ব্যাপার। কোন জিনটা দিয়ে শিং গজায় মোটামুটিভাবে আলাদা করা আছে। সেটাকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে একটা রেট্রো ভাইরাসে ট্রান্সপ্লান্ট করে তখন যদি–

আমি বিজ্ঞানের কচকচি কিছুই বুঝতে পারলাম না, চেষ্টাও করলাম না, অন্য একটা আইডিয়া দেওয়ার চেষ্টা করলাম, ত্তা হলে কি তুমি একটা লেজ গজিয়ে দিতে পারবে? ছোটখাটো লেজ না–মোটাসোটা লম্বা একটা লেজ, যেটা লুকিয়ে রাখতে পারবে না?

অনিক আবার চিন্তিত মুখে মাখা চুলকাতে থাকে, বলে, একেবারে অসম্ভব তা না, কিন্তু অনেক রিসার্চ দরকার। মানুষের ওপর এইরকম গবেষণা করার অনেক ঝামেলা!

আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, তা হলে আমাকে কিছু একটা ব্যবস্থা করে দাও যেন কবি ব্যাটাকে সাইজ করতে পারি!

অনিক বলল, আমাকে একটু সময় দাও জাফর ইকবাল। আমি একটু চিন্তা করি। তোমার এত তাড়াহুড়ো কিসের? অনিক সুর পাল্টে বলল, তোমার ব্যায়ামের কী খবর?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, নাহ! ব্যায়ামের খবর বেশি ভালো না। মাথা নাড়ার পরও আউক করে শব্দ করতে হল না, সেটা একটা ভালো লক্ষণ। ঘাড়ের ব্যথাটা একটু কমেছে।

কেন? খবর ভালো না কেন?

আমি হেঁটে শিউলির বাসায় যাবার পর আমার কী অবস্থা হয়েছিল, সারা শরীরে এখনো কেমন টনটনে ব্যথা সেটা অনিককে সবিস্তারে ব্যাখ্যা করলাম। ভেবেছিলাম শুনে আমার জন্য তার মায়া হবে। কিন্তু হল না, উল্টো মুখ শক্ত করে বলল, তুমি তো মহা ফাঁকিবাজ দেখি। একদিন দশ মিনিট হেঁটেই এক শ রকম কৈফিয়ত দেওয়া শুরু করেছ?

আমি বললাম, ফাঁকিবাজ বলো আর যাই বলো আমি প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটতে পারব না। মুখ শক্ত করে বললাম, আমার পক্ষে অসম্ভব।

তা হলে?

দরকার হলে বোকাসোকা দেখে একটা বউ বিয়ে করে নেব। স্ট্রোক হবার পর যখন বিছানায় পড়ে থাকব, তখন নাকের মাঝে একটা নল ঢুকিয়ে সে খাওয়াবে।

অনিক আমার দিকে তাকিয়ে কেমন জানি হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। আমি বললাম, তুমি এত বড় বিজ্ঞানী, তুমি এরকম কিছু আবিষ্কার করতে পার না–একটা ছোট ট্যাবলেট—সেটা খেলেই শরীর নিজে থেকে ব্যায়াম করতে থাকবে!

অনিক কেমন যেন চমকে উঠে বলল, কী বললে?

আমি বললাম, বলেছি যে তুমি একটা ট্যাবলেট আবিষ্কার করবে সেটার নাম দেবে ব্যায়াম বটিকা। সেটা খেয়ে আমি শুয়ে থাকব। আমার হাত-পা নিজে থেকে নড়তে থাকবে, ব্যায়াম করতে থাকবে, আমার কিছুই করতে হবে না!

অনিক কেমন যেন চকচকে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি শুয়ে থাকবে। আর তোমার শরীর ব্যয়াম করতে থাকবে? হাত-পা-ঘাড়-মাখা সবকিছু?

হ্যাঁ। তা হলে আমাদের মতো মানুষের খুব সুবিধে হয়। মনে কর–

অশি হতে কিল দিয়ে বলল, ব্রিলিয়ান্ট আইডিয়া।

আমি উৎসাহ পেয়ে বললাম, এরকম অনেক আইডিয়া আছে আমার মাথায়। যেমন মনে কর গভীর রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যায়, খুব বাথরুম পেয়েছে। বিছানা ছেড়ে উঠতেও ইচ্ছা করে না আবার না গেলেও না। তাই যদি বিছানার সাথে একটা বাথরুম ফিটিং লাগিয়ে দেওয়া যায় যেন শুয়ে শুয়েই কাজ শেষ করে ফেলা যায়।

আমি আরেকটু বিস্তারিত বলতে যাচ্ছিলাম অনিক বাধা দিয়ে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও আগেই অন্য কিছু খেলো না। আগে শুয়ে শুয়ে ব্যায়াম করার ব্যাপারটা শেষ করি। তুমি চাই তোমার হাত, পা-ঘাড়-মাথা এগুলোর ওপর তোমার নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এগুলো নিজে নিজে ব্যায়াম করবে, নড়তে থাকবে, ছুটতে থাকবে?

হ্যাঁ।

হার্ট পাম্প করবে? ফুসফুসের ব্যায়াম হবে?

হ্যাঁ।

সারা শরীরে রক্ত সঞ্চালন হবে?

অনিক কঠিন কঠিন কী বলছে আমি পুরোপুরি না বুঝলেও মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ। অনিক চকচকে চোখে আমার দিকে মাথা এগিয়ে এনে বলল, তুমি একটা জিনিস জান?

কী?

তুমি যার কথা বলছ সেটা আমার কাছে আছে।

তোমার কাছে আছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি এর মাঝে ব্যায়াম বটিকা আবিষ্কার করে ফেলেছ?

ঠিক ব্যায়াম বটিকা না, কারণ জিনিসটা তরল, বোতলে রাখতে হয়। এক চামচ খেলে মস্তিষ্ক নার্ভের ওপর থেকে তার নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে নেয়। আমাদের হাত-পা এসব নাড়ানোর জন্য যে ইম্পালস আসে সেটা ইলেক্ট্রনিক সিগন্যাল। এই তরলটা স্থানীয়ভাবে সেই ইম্পালস তৈরি করে। শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালেন্সটা খুব জরুরি। অনিক উৎসাহে টগবগ করতে করতে একটা কাগজ টেনে এনে বলল, তোমাকে বুঝিয়ে দেই কীভাবে কাজ করে?

আমি মাথা নেড়ে বললাম, না, না, খামকা সময় নষ্ট করে লাভ নেই, আমি বিজ্ঞানের কিছু বুঝি না। কীভাবে কতটুকু খেতে হবে বলে দাও।

অনিক অবাক হয়ে বলল, কতটুকু খেতে হবে মানৈ? কে খাবে?

আমি।

তুমি খাবে মানে? এখনো ঠিক করে পরীক্ষা করা হয় নাই। আগে জন্তু-জানোয়ারের ওপর টেস্ট করতে হবে, তারপর অল্প ডোজে মানুষের ওপরে।

আমি দাঁত বের করে হেসে বললাম, জন্তু-জানোয়ার দরকার নেই, সরাসরি মানুষের ওপরে টেস্ট করতে পারবে! একটু আগেই না তুমি বললে আমাকে তোমার গিনিপিগ বানাবে? আমি গিনিপিগ হবার জন্য রেডি।

অনিক মাথা নাড়ল, বলল, না না তোমাকে গিনিপিগ হতে বলেছিলাম অন্য একটা আবিষ্কারের জন্য—দ্বিমাত্রিক একটা ছবিকে ত্রিমাত্রিক দেখা যায় কিনা সেটা টেস্ট করব ভেবেছিলাম।

দ্বিমাত্রিক ত্রিমাত্রিক এসব কঠিন কঠিন জিনিস পরে হবে। আগে আমাকে ব্যায়াম বটিকা দাও! ও আচ্ছা এটা তো ট্যাবলেট না। এটাকে ব্যায়াম বটিকা বলা যাবে না। ব্যায়াম। মিক্সচার বলতে হবে। ঠিক আছে তা হলে ব্যায়াম মিক্সচারই দাও। খেতে কী রকম? বেশি তেতো না তো? আমি আবার তেতো জিনিস খেতে পারি না।

অনিক বলল, খেতে কী রকম সেটা তো জানি না। মনে হয় একটু নোনতা ধরনের মিষ্টি হবে। অনেকটা খাবার স্যালাইনের মতো।

গুড়! আমি সন্তুষ্ট হয়ে মাথা নাড়লাম, দেখতে কী রকম? টকটকে লাল হলে সবচেয়ে ভালো হয়। কিংবা গোলাপি!

অনিক একটু অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! তোমার কৌতূহল তো দেখি উল্টাপাল্টা জায়গায়। দেখতে কী রকম খেতে কী রকম এটা নিয়ে কে মাথা ঘামায়!

আমি মাথা নেড়ে বললাম, তোমরা বিজ্ঞানীরা এসব জিনিস নিয়ে মাথা না ঘামাতে পার, আমরা সাধারণ মানুষেরা এসব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাই! বলো কী রঙ?

কোনো রঙ নেই। একেবারে পানির মতো স্বচ্ছ।

কোনো রঙ নেই? আমি রীতিমতো হতাশ হলাম। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা জিনিসের কোনো রঙ থাকবে না কেমন করে হয়? এটাতে একটা রঙ দিতেই হবে। আমার ফেবারিট হচ্ছে লাল। টকটকে লাল।

অনিক হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে, সেটা পরে দেখা যাবে। এক ফোটা খাবারের রঙ দিয়ে লাল করে দেওয়া যাবে।

এখন তা হলে বলো কখন খাব? কীভাবে খাব?

অনিক কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি সত্যিই এটা খেতে চাও?

হ্যাঁ। খেয়ে যদি মরেটরে যাই তা হলে খেতে চাই না–

না। মরবে কেন? এটার মাঝে বিষাক্ত কিছু নেই। আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ভেতর শরীর পুরোটা মেটাবলাইজ করে নেবে।

আমি উৎসাহে সোজা হয়ে বসে বললাম, দাও তা হলে এখনি দাও। খেয়ে দেখি।

না। এখন না। অনিক মাথা নেড়ে বলল, যদি সত্যিই খেতে চাও বাসায় গিয়ে শোয়ার ঠিক আগে খাবে। ঠিক এক চামচ–বেশি না।

বেশি খেলে কী হবে?

বেশি খাওয়ার দরকার কী? নতুন একটা জিনিস পরীক্ষা করছি, রয়ে-সয়ে করা ভালো না?

ঠিক আছে। বলো তা হলে–

অনিক বলল, খেয়ে সাথে সাথে বিছানায় শুয়ে পড়বে। মিনিট দশেক পরে দেখবে তোমার হাত-পা তুমি নাড়াতে পারছ না, কেমন যেন অবশ হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ দেখবে সেগুলো নিজে থেকে নড়তে শুরু করেছে। কখনো জানে কখনো বামে কখনো সামনে পিছে। দেখতে দেখতে হার্টবিট বেড়ে যাবে, শরীরের ব্যায়াম হতে থাকবে।

সত্যি? দৃশ্যটা কল্পনা করেই আনন্দে আমার হার্টবিট বেড়ে যায়।

হ্যাঁ। তোমার ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আধঘণ্টা থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাঝে আশা সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

ভেরি গুড। আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, এখনি দাও আমার ব্যায়াম মিক্সচার?

অনিক ভেতরে ঢুকে গেল, খানিকক্ষণ কিছু জিনিস ঘাটাঘাটি করে একটা খাবার পানির শাষ্টিকের বোতলে করে সেই বিখ্যাত আবিষ্কার নিয়ে এল। আমি বললাম, কী হল? তুমি না বলেছিলে এটাকে লাল রঙ করে দেবে?

অনিক হাত নেড়ে পুরো বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে বলল, তুমি একজন বয়স্ক মানুষ, লাল রঙ গোলাপি রঙ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছ কেন? রঙটা তো ইম্পরট্যান্ট না।

আমার মনটা একটু খুঁতখুঁত করতে লাগল কিন্তু এখন আর তাকে চাপ দিলাম না। বোতলটা হাতে নিয়ে ছিপি খুলে ওঁকে দেখলাম, ভেবেছিলাম তীব্র একটা ঋজ্জালো গন্ধ হবে কিন্তু সেরকম কিছু নয়। আমার আরো একটু আশাভঙ্গ হল, এরকম সাংঘাতিক একটা জিনিস যদি টকটকে লাল না হয়, ভয়ংকর ঝুঁজালো গন্ধ না থাকে, মুখে দিলে টক-টক মিষ্টি একটা স্বাদ না হয় তা হলে কেমন করে হয়? বিজ্ঞানীরা মনে হয় কখনোই একটা জিনিসের সত্যিকারের গুরুত্বটা ধরতে পারে না।

আমি প্লাস্টিকের বোতলটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, বললাম, যাই।

কোথায় যাচ্ছ?

বাসায়। গিয়ে আজকেই টেস্ট করতে চাই।

কী হল আমাকে জানিও।

জানাব।

অনিকের বাসা থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে মাত্র অল্প কিছু দূর গিয়েছি তখন দেখি রাস্তার পাশে একটা ফাস্টফুডের দোকান। দোকানের সাইনবোর্ডে বিশাল একটা হ্যামবার্গারের ছবি, টলটলে রসালো একটা হ্যামবার্গার, নিশ্চয়ই মাত্র তৈরি করা হয়েছে, গরম একটা ভাপ বের হচ্ছে। ছবি দেখেই আমার খিদে পেয়ে গেল। আমি রিকশা থামিয়ে ফাস্টফুডের দোকানে নেমে গেলাম।

হ্যামবার্গারটা খেতে ভালো, প্রথমটা খাবার পর মনে হল খিদেটা আরো চাগিয়ে উঠল, একটা খাবার দোকানে এসে তো আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় উঠে যেতে পারি না তাই দ্বিতীয় হ্যামবার্গাবটা অর্ডার দিতে হল। যখন সেটা আধাআধি খেয়েছি তখন হঠাৎ আমার বিলু-মিলুর কথা মনে পড়ল। কবি কিংকর চৌধুরীর উৎপাতে এখন তাদের মাছ-মাংস-ডিম খাওয়া বন্ধ, ঘাস-লতাপাতা খেয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে। তাদেরকে নিয়ে এলে এখানে আমার সাথে হ্যামবার্গার খেতে পারত! নিয়ে যখন আসি নি তখন আর দুঃখ করে কী হবে ভেবে চিন্তাটা মাথা থেকে প্রায় দূর করে দিচ্ছিলাম তখন মনে হল এখান থেকে তাদের জন্য দুটি হ্যামবার্গার কিনে নিয়ে গেলে কেমন হয়? সাথে কিছু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই? আমি আর দেরি করলাম না, কাউন্টারে গিয়ে বললাম, আরো দুটি হ্যামবার্গার।

কাউন্টারে কমবয়সী একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, চোখ কপালে তুলে বলল, আরো দুটি হামবার্গার খাবেন?

আমি বললাম, আমি খাব না। সাথে নিয়ে যাব।

মেয়েটা খুব সাবধানে একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে আমার জন্য হ্যামবার্গার আনতে গেল।

শিউলির বাসায় গিয়ে দরজার বেল টিপতেই মিলু দরজা খুলে দিল। তার মুখ শুকনো, আমাকে দেখেও খুব উজ্জ্বল হল না। আমি বললাম, কী রে মিলু, কী খবর?

মিলু একটা নিশ্বাস ফেলে চাপা গলায় বলল, খবর ভালো না।

কেন? কী হয়েছে?

কবি কাকু এখানে চলে এসেছে।

এখানে চলে এসেছে মানে?

এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে।

আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, বলিস কী তুই?

মিলু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, শিউলিকে দেখে থেমে গেল। শিউলি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাইয়া। কখন এসেছ? তোমার হাতে কিসের প্যাকেট?

হ্যামবার্গার। মিলু-বিলুর জন্য এনেছি।

শিউলি বলল, আমাদের বাসায় মাছ-মাংস বন্ধ রাখার চেষ্টা করছি।

আমি গলা উঁচিয়ে বললাম, তোর ইচ্ছে হলে মাছ-মাংস কেন লবণ-পানি এসবও বন্ধ রাখ। দরকার হলে নিশ্বাস নেওয়াও বন্ধ রাখ। কিন্তু এই ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দিতে পারবি না।

কষ্ট কেন হবে? অভ্যাস হয়ে গেলে–

তোদের ইচ্ছে হলে যা কিছু অভ্যাস করে নে। লোহার শিক গরম করে তালুতে ছ্যাকা দেওয়া শুরু কর। দেখবি কয়দিন পরে অভ্যাস হয়ে যাবে।

আমার কথা শুনে বিলুপ্ত বের হয়ে আসছে, তার মুখও শুকনো। আমি হ্যামবার্গারের প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, নে খা।

মিলু আর বিলু হামবার্গারের প্যাকেটটা নিয়ে ছুটে নিজেদের ঘরে চলে গেল। আহা বেচারারা! কতদিন না জানি ভালোমন্দ কিছু খায় নি। আমি শিউলিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোর কবি নাকি এই বাসায় উঠে এসেছে? মনে আছে আমি তোকে কী বলেছিলাম? কবিসাহিত্যিক থেকে এক শ হাত দূরে থাকবি। সুযোগ পেলেই এরা বাড়িতে উঠে আসে! আর একবার উঠলে তখন কিছুতেই সরানো যায় না!

শিউলি ঠোটে আঙুল দিয়ে বলল, শ-স-স-স আস্তে ভাইয়া, কিংকর ভাই শুনবেন।

শুনুক না! আমি তো শোনার জনাই বলছি। কোথায় তোর কিংকর ভাই? বলে আমি শিউলির জন্য অপেক্ষা না করে নিজেই তাকে খুঁজতে লাগলাম। বেশিক্ষণ খুঁজতে হল না, তাকে ড্রয়িংরুমে পেয়ে গেলাম, ধবধবে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে সোফায় পা তুলে বসে আছে। এক হাতে একটা কাগজ আরেক হাতে একটা কলম, চোখে-মুখে গভীর এক ধরনের ভাব। আমাকে দেখে মনে হল একটু চমকে উঠল। আমি তার পাশে বসলাম, হাতে অনিকের আবিষ্কারের বোতলটা ছিল, সেটা টেবিলে রাখলাম। কবি কিংকর চৌধুরী বলল, আঁ-আঁ–আঁপনি?

হ্যাঁ। আমি।

এঁত রাঁতে এঁখানে কীঁ মঁনে কঁরে?

শিউলি আমার বোন। নিজের বোনের বাসায় আমি যখন খুশি আসতে পারি! আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আপনি এখানে এত রাতে কী মনে করে?

কবি কিংকর চৌধুরী আমার কথা শুনে একটু রেগে গেল মনে হল। কিছুক্ষণ আমার দিকে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, শিঁউলি আঁর শঁরীফ অঁনেক দিঁন থেঁকে আঁমাকে থাঁকতে বঁলছে।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, মনে হয় না। শিউলি আর শরীফ দুজনই একটু হাবা টাইপের, কিন্তু এত হাবা না–

আমি কথা শেষ করার আগেই শিউলি এসে ঢুকল। বলল, যাও ভাইয়া ভেতরে যাও। হাত-মুখ ধুয়ে আস। টেবিলে খাবার দিয়েছি।

আমি বললাম, আমাকে বোকা পেয়েছিস নাকি যে তোর বাসায় ঘাস-লতা-পাতা খাব? আমি খেয়ে এসেছি।

কী খেয়ে এসেছ?

দুটি হ্যামবার্গার। শুধু খেয়ে আসি নি মিলু-বিলুর জন্যও নিয়ে এসেছি।

তাই তো দেখছি! শিউলি মুখ শক্ত করে বলল, ঠিক আছে হাত-মুখ ধুয়ে আমাদের সাথে বস।

বুঝতে পারলাম আমাকে কবি কিংকর চৌধুরী থেকে দূরে সরাতে চায়। আমি আর ঝামেলা করলাম না, ভেতরে গেলাম বিলু-মিলুর সাথে কথা বলতে।

দুজনে খুব শখ করে হামবার্গার খাচ্ছে। সস একেবারে কানের লতিতে লেগে গিয়েছে। আমাকে দেখে খেতে খেতে বিলু বলল, গাবী গাবা গাবা।

আমি ধমক দিয়ে বললাম, মুখে খাবার নিয়ে কথা বলিস না গাধা, খাওয়া শেষ করে কথা বল।

বিলু মুখের খাবার শেষ করে বলল, তুমি বলেছিলে কবি কাকুকে খুন করবে।

মিলু বলল, উল্টো কবি কাকু এখন আমাদের খুন করে ফেলবে।

কেন, কী হয়েছে?

কী হয় নাই বলো? আমাদের কথা শুনলে নাকি কবি কাকুর ডিস্টার্ব হয়। তাই আমাদের ফিসফিস করে কথা বলতে হয়।

বিলু বলল, টেলিভিশন পুরো বন্ধ।

মিলু বলল, আমার প্রিয় কমিকগুলো পুরোনো কাগজের সাথে বেচে দিয়েছে।

আমি রাগ চেপে বললাম, আর শিউলি এগুলো সহ্য করছে?

সহ্য না করে কী করবে? কবি কাকুর মেজাজ খারাপ হলে যা-তা বলে দেয়।

মিলু একটা নিশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে বলল, এখন বাসায় সবাই কবি কাকুকে ভয় পায়।

ভয় পায়? আমি রেগেমেগে বললাম, এখন এই মানুষটাকে ধরে ছুড়ে ফেলে দেওয়া দরকার।

মিলু বলল, মামা যেটা পারবে না সেটা বলে লাভ নেই। তোমার সেই সাহস নাই, তোমার গায়ে সেই জোরও নাই।

আমার জোর নাই? শুধু অপেক্ষা করে দেখ কয়দিন, আমার শরীর হবে লোহার মতো শক্ত।*

কীভাবে?

এমন বায়াম করার ওষুধ পেয়েছি— কথাটা বলতে গিয়ে আমার মনে পড়ল অনিকের দেওয়া ব্যায়াম মিক্সচারটা ড্রয়িংরুমে কবি কিংকর চৌধুরীর কাছে রেখেছি। আমি কথা শেষ না করে প্রায় দৌড়ে ড্রয়িংরুমে গেলাম, গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তাতে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। কবি কিংকর চৌধুরী আমার বোতলটা খুলে চকচক করে ব্যায়াম মিক্সচার খাচ্ছে। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখলাম পুরো বোতলটা শেষ করে সে খালি বোতলটা টেবিলে রেখে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ মুছল। আমি তার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বললাম, আ-আ-আপনি এটা কী খেলেন?

খাঁবার স্যাঁলাইন।

খাবার স্যালাইন?

হ্যাঁ। শিঁউলিকে বঁলেছি দিঁতে। আঁমাকে তৈঁরি কঁরে দিঁয়েছে। খেঁলে শঁরীর ঝঁরঝরে থাঁকে। বলে সে আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসল। সেটা দেখে প্রামার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার অবস্থা। অনিক আমাকে বলেছে এক চামচ খেতে আর এই লোক পুরো বোতল শেষ করে ফেলেছে। এখন কী হবে?

আমি ঠিক করে চিন্তা করতে পারছিলাম না, এর মাঝে শিউলি এসে বলল, খেতে আসেন কিংকর ভাই। টেবিলে খাবার দেওয়া হয়েছে।

কবি কিংকর চৌধুরী বলল, চলো। বলে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কেমন যেন টুলে ওঠে, কোনোভাবে সোফার হাতল ধরে নিজেকে সামলে নেয়।

শিউলি ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হল?

নাঁ কিছু নাঁ। কবি কিংকর চৌধুরী মাথা নেড়ে বলল, হঁঠাৎ মাথাটা একটু ঘুরে উঠল।

শিউলি বলল, একটু বসে নেবেন কিংকর ভাই?

নাঁ নাঁ। কোনো প্রয়োজন নেই। বলে কিংকর চৌধুরী হেঁটে হেঁটে খাবার টেবিলে গেল। তার জন্য আলাদা চেয়ার রাখা হয়েছে, সেখানে গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। আমি চোখ বড় বড় করে তাকে লক্ষ করি। অনিক বলেছিল তার ব্যায়াম মিক্সচার কাজ করতে পনের মিনিট সময় নেবে—কিন্তু কেউ যদি চামচের বদলে পুরো বোতল খেয়ে ফেলে তখন কী হবে?

কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। আমি এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করলাম যে, কবি কিংকর চৌধুরীর মুখে বিচিত্র প্রায় অপার্থিব এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। সে জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে শুরু করেছে এবং হঠাৎ করে তার মাথাটা ঘুরতে শুরু করল। টেবিল ফ্যানের বাতাস দেওয়ার জন্য সেটা যেভাবে ঘুরে ঘুরে বাতাস দেয় অনেকটা সেভাবে তার মাথা চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে তার মুখের হাসি বিতরণ করতে শুরু করেছে। দেখে মনে হয় এটা বুঝি তার নিজের মাথা না, কেউ যেন। আলাদাভাবে স্প্রিং দিয়ে লাগিয়ে দিয়েছে।

পুরো ব্যাপারটা এত অস্বাভাবিক যে শিউলি এবং শরীফ হাঁ করে কবি কিংকর চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইল। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম শুধু যে তার মাথাটা ঘুরছে তা না, তার কান, নাক, ঠোঁট, গাল, ভুরু সেগুলোও নড়তে শুরু করল। আমি এর আগে কোনো মানুষকে তার কান কিংবা নাককে নাড়াতে দেখি নি—গরু-ছাগল কান নাড়ায় সেটাকে দেখতে এমন কিছু অস্বাভাবিক মনে হয় না। কিন্তু একজন মানুষ যখন সেগুলো নাড়ায় তখন চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবার অবস্থা। শিউলি কিংবা শরীফ বুঝতে পারছে না—ব্যাপারটা কী ঘটছে, শুধু আমি জানি কী হচ্ছে। কবি কিংকর চৌধুরীর শরীরের ওপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই। সব এখন নিজে নিজে নড়তে শুরু করেছে। এখন নাক কান চোখ ঠোঁট ভুরু মায় মাথা নড়ছে সেটা বিপজ্জনক কিছু নয় কিন্তু যখন হাত-পা আর শরীর নড়তে থাকবে তখন কী হবে?

শিউলি ভয়ে একটু এগিয়ে গিয়ে ডাকল, কিংকর ভাই। এই যে কিংকর ভাই–আপনার কী হয়েছে?

আমি ভাবছিলাম শিউলিকে একটু সাবধান করে দেব কিন্তু তার সুযোগ হল না। হঠাৎ করে কবি কিঙ্কর চৌধুরী দুই হাত লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল, কিছু বোঝার আগেই হাত দুটো ধপাস করে টেবিলের ওপর পড়ল। টেবিলে কাচের গ্লাস এবং ডালের বাটি ছিটকে পড়ে পুরো টেবিল পানি এবং ডালে মাখামাখি হয়ে গেল।

শিউলি ভয়ে চিৎকার করে পেছনে সরে এল। ভাগ্যিস সূরেছিল তা না হলে কী হত বলা মুশকিল। হঠাৎ মনে হল কবি কিংক চৌধুরী দুই হাতে তার চারপাশে অদৃশ্য মানুষদের ঘুসি মারতে শুরু করেছেন। তার হাত চলতে থাকে ও ঘুরতে থাকে এবং হাতের আঘাত খেয়ে ডাইনিং টেবিলের খাবার শুন্যে উড়তে থাকে। ডালের বাটি উল্টে পড়ে কবি কিংকর চৌধুরীর সারা শরীর, হাত-মুখ এবং জামাকাপড় মাখামাখি হয়ে গেল কিন্তু কবি কিংকর চৌধুরীর কোনো ভ্রূক্ষেপ নাই। তার মুখে সারাক্ষণই সেই অপার্থিব মৃদু হাসি।

খাবার টেবিলে হইচই শুনে বিলু আর মিলু ছুটে এসেছে। তারা দৃশ্য দেখে একেবারে হতবাক হয়ে গেল। আমার দুই হাত ধরে বলল, কী হয়েছে মামা? কবি কাকু এরকম করছেন কেন?

আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বললাম, কবিতার ভাব এসেছে মনে হয়!

লু জানতে চাইল, এভাবে কবিতার ভাব আসে?

সাংঘাতিক কোনো কবিতা হলে মনে হয় এভাবে আসে।

মিলু বলল, একটু কাছে গিয়ে দেখি?

আমি বললাম, না না। সর্বনাশ!

কেন? সর্বনাশ কেন?

এখন পর্যন্ত খালি মুখ আর হাত চলছে। যখন পা চলতে শুরু করবে তখন কেউ রক্ষা পাবে না!

আমার কথা শেষ হবার আগেই আমি পা চলার নিশানা দেখতে পেলাম। হঠাৎ করে তার ডান পা-টা শূন্যে উঠে ডাইনিং টেবিলকে একটা লাথি মারল। কিছু বোঝার আগে এরপর বাম পা-টা, তারপর দুই পা নাচানাচি করতে লাগল। আমি চিৎকার করে বললাম, সাবধান, সবাই সরে যাও।

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, হঠাৎ করে কবি কিংকর চৌধুরী তিড়িং করে লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল, তারপর তিড়িংবিড়িং করে হাত-পা ছুড়ে নাচতে শুরু করল। তার পায়ের লাথি খেয়ে শরীফ একপাশে ছিটকে পড়ল এবং উঠে বসার আগেই কবি কিংকর চৌধুরী হাত-পা ছুড়ে বিচিত্র একটা ভঙ্গিতে নাচানাচি করে শরীফের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে গেল। তার হাতের আঘাতে প্লেট-থালা-বাসন নিচে পড়ে গেল আর পায়ের লাথি খেয়ে টেবিল ল্যাম্প, শেলফ, শোকেসের ওপরে সাজানো জিনিসপত্র ছিটকে ছিটকে পড়তে লাগল। কবি কিংকর চৌধুরী ডাইনিং রুম থেকে তিড়িংবিড়িং করে নাচতে নাচতে ড্রয়িংরুমে এল, লাথি মেরে বইয়ের শেলফ থেকে বইগুলো ফেলে দিয়ে মাটিতে একটা ডিগবাজি দিল। কিছুক্ষণ শুয়ে হাত-পা ছুড়ে হঠাৎ আবার লাফিয়ে উঠে, দেয়াল খামচে খামচে টিকটিকি মতো ওপরে ওঠার চেষ্টা করল। সেখান থেকে দড়াম করে নিচে পড়ে গিয়ে হাত দুটো হেলিকপ্টারের পাখার মতো ঘুরাতে ঘুরাতে ড্রয়িংরুম থেকে লাফাতে লাফাতে বেডরুমে টুকে গেল। আলনার কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ করে টর্নেডোর মতো ঘুরপাক খেতে লাগল, ঘুরতে ঘুরতে আলনার জামাকাপড়, শাড়ি চারদিকে ছুড়ে ছুড়ে ফেলতে লাগল। আমি হতবুদ্ধি হয়ে দেখলাম ড্রেসিং টেবিলের ওপরে সাজানো শিউলির পাউডার ক্রিম পারফিউম ছিটকে ছিটকে পড়তে থাকে, সেগুলো ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়।

কবি কিংকর চৌধুরী বিশাল একটা পোকার মতো তিড়িং করে লাফাতে লাফাতে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ছোটাছুটি করতে লাগল। কখন কোন দিকে যাবে কী করবে তার কোনো ঠিক নেই, সবাই নিজের জান বাঁচিয়ে ছোটাছুটি করতে লাগলাম। দেখতে দেখতে পুরো বাসা একেবারে তছনছ হয়ে গেল।

একজন বয়স্ক সম্মানী মানুষ এভাবে হাত-পা ছুড়ে নেচে কুঁদে লাফিয়ে সারা বাসা ঘুরে বেড়াতে পারে সেটা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব না। আমরা সবাই অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। তাকে থামানো অসম্ভব একটা ব্যাপার, কেউ সে চেষ্টাও করল না। মিনিট দশেক এইভাবে তিড়িংবিড়িং করে শেষ পর্যন্ত কিংকর চৌধুরী নিজে থেকেই থেমে গেল। ধপাস করে সোফায় বসে সে তখন লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিতে শুরু করে। একেবারে পুরোপুরি থেমে গেল সেটাও বলা যায় না কারণ কথা নাই বার্তা নাই মাঝে মাঝে হঠাৎ করে তার একটা হাত বা পা লাফ দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

আমরা ভয়ে ভয়ে কবি কিংকর চৌধুরীকে ঘিরে দাঁড়ালাম। শরীফ ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে কিংকর তাই?

বুঝবার পারলাম না। কবি কিংকর চৌধুরীর কথায় সেই নাকি ভাবটা চলে গেছে। শুধু যে নাকি ভাবটা চলে গেছে তা নয়, ভাষাটাও কেমন জানি চাঁছাছোলা অশালীন। কিংকর চৌধুরী এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, শরীলের উপর কুনো কন্ট্রোল নাই। ঠ্যাং হাত মাথা নিজের মতন লাফায়, হালার বাই হালা দেখি তাজ্জবের ব্যাপার।

কবি কিংকর চৌধুরীর নর্তন-কুর্দন দেখে যত অবাক হয়েছিলাম তার মুখের ভাষা শুনে আমরা তার থেকে বেশি অবাক হলাম। বিলু আমার হাত ধরে বলল, মামা! কবি কাকু এইভাবে কথা বলেন কেন?

এইটাই তার অরিজিনাল ভাষা? আমি ফিসফিস করে বললাম, আসল ভাষাটা এখন বের হচ্ছে। অন্য সময় স্টাইল করে নাকি নাকি কথা বলত।

কবি কিংকর চৌধুরী ঘ্যাস ঘ্যান করে বগল চুলকাতে চুলকাতে বলল, বুঝলা শিউলি, এমুন আচানক জিনিস আমি বাপের জন্মে দেখি নাই। একেবার ছাড়াবাড়া অবস্থা। তুমার ঘরবাড়িতে একটু ডিস্টার্ব দিছি মনে লয়।

শিউলি মুখ শক্ত করে বলল, একটু নয়, আমার পুরো বাসা সর্বনাশ হয়ে গেছে।

কবি কিংকর চৌধুরী লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তয় জব্বর পরিশ্রম হইছে। খিদা লাগছে ভালো মতন। টেবিলে খাবার লাগাও দেখি। বাসায় আণ্ডা আছে?

শিউলি বলল, না কিংকর ভাই। আমাদের বাসায় এখন যে অবস্থা খাবার ব্যবস্থা করার কোনো উপায় নেই। আপনি নিজেই তো করেছেন, নিজেই দেখেছেন?

তা কথা ভুল বলো নাই। শরীরের মধ্যেই মনে হয় শয়তান বাসা বানছে।

শিউলি বলল, আপনি বরং বাসায় চলে যান।

বাবাসায় যাব?

হ্যাঁ।

কবি কিংকর চৌধুরী ধীরে ধীরে একটু ধাতস্থ হয়েছে, বাসায় যাবার কথা শুনে মনে হয় আরো ধাতস্থ হয়ে গেল। এমনকি আবার শুদ্ধ ভাষায় কথা বলা আরম্ভ করল, কিন্তু আজ রাতের কবিতা পাঠের আসর?

শরীফ বলল, আপাতত বন্ধ।

বন্ধ?

হ্যাঁ।

তা হলে কি কাল রাতে?

না-মা-না শিউলি দুই হাত নেড়ে বলল, কবিতা আপাতত থাকুক। মিলু-বিলুর পেছনে সময় দেওয়া হচ্ছে না। আমি ওদের সময় দিতে চাই।

কবি কিংকর চৌধুরী কিছুক্ষণ শিউলির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল। আমরা সবাই তখন শুয়ে এক লাফে পেছনে সরে গেলাম। শিউলি ঠাণ্ডা গলায় বলল, বিলু, তোর কবি কাকুর ব্যাগটা নিয়ে আয় তো।

বিলু দৌঁড়ে তার ব্যাগটা নিয়ে এল এবং কবি কিংকর চৌধুরী ব্যাগ হাতে নিঃশব্দে বের হয়ে গেল। মনে হয় জনের মতোই।

দরজা বন্ধ করে শিউলি কিছুক্ষণ সারা বাসার দিকে তাকিয়ে থেকে ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ভাইয়া, তুমি ঠিকই বলেছ। কবি-সাহিত্যিকদের বইপত্র পড়া ঠিক আছে, কিন্তু তাদের বেশি কাছে যাওয়া ঠিক না।

আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, একেবারেই না।

শরীফ চারদিকে তাকিয়ে বলল, বাসার যে অবস্থা এটা ঠিক করতে মনে হয় এক মাস লাগবে।

বিলু-মিলু মাথা নাড়ল, বলল,  হ্যা আব্বু।

চলো সবাই মিলে বাইরে থেকে খেয়ে আসি।

আমি বললাম, ভ আইডিয়া। এয়ারপোর্ট রোডে একটা রেস্টুরেন্ট খুলেছে, একেবারে ফাটাফাটি খাবার।

মাংস-মুরগি আছে তো? শরীফ বলল, পাগলা কবির পাল্লায় পড়ে ভালো খাওয়া বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। এত সুন্দর কবিতা লিখে কিংকর চৌধুরী অথচ।

শিউলি ঠাণ্ডা গলায় বলল, এই বাসায় যদি ভবিষ্যতে কখনো কেউ কবি কিংকর চৌধুরীর নাম নেয় তা হলে কিন্তু তার খবর আছে।

বিলু বলল, কেন আম্মু কী করবে তা হলে?

কিলিয়ে ভর্তা করে দেব।

 

রাতে দুটো হামবার্গার খাবার পরেও আমার পেটে খাসির রেজালা আর চিকেন টিকিয়া খাওয়ার যথেষ্ট জায়গা ছিল। বিলু-মিলুর সাথে খেতে খেতে আমি নিচু গলায় তাদের বললাম, কেমন দেখলি?

বিলু আর মিলু অবাক হয়ে বলল, কী দেখলাম?

আমি চোখ মটকে বললাম, তোদের কী কথা দিয়েছিলাম? কবি কিংকর চৌধুরী—

বিলু আর মিলু চোখ বড় বড় করে বলল, তুমি? তুমি এটা করেছ?

তোরা কি ভাবছিস এমনি এমনি হয়েছে?