• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • নতুন সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • পুরানো সব ক্যাটাগরি
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

০৩. রিরা খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল

লাইব্রেরি » মুহম্মদ জাফর ইকবাল » সায়েন্স ফিকশন সমগ্র » অবনীল » ০৩. রিরা খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল

রিরা খুব ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। মহাকাশযানটিতে এক বিস্ময়কর নীরবতা। কিছুক্ষণ আগেই ভয়ংকর শব্দে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে কেঁপে উঠছিলএখন হঠাৎ করে এই নৈঃশব্দ্যকে অসহনীয় আতঙ্কের মতো মনে হতে থাকে। রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে চারদিকে তাকাল। পুরো মহাকাশযানটি একটি ধ্বংসস্তুপের মতো, দেয়ালে বড় বড় গর্ত, ধাতব বিম ভেঙে পড়েছে, এদিকে সেদিকে আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে, চারদিকে কালো। ধোয়া এবং পোড়া গন্ধ।

রিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে পুরো মহাকাশযানে কোথাও কোনো জীবিত প্রাণীর শব্দ নেই। কারো কথা, কাবো নিশ্বাস, এমনকি যন্ত্রণার একটু কাতরধ্বনিও নেই। নীলমানব আর এই মহাকাশযানের মহাকাশচারীরা কি তা হলে পরস্পর পরস্পরকে একেবারে পরিপূর্ণভাবে নিঃশেষ করে দিয়েছে? হঠাৎ করে রিয়ার ভেতরে এক অচিন্তনীয় আতঙ্ক এসে ভর করে—সে কি তা হলে এই মহাকাশযানে একমাত্র জীবিত প্রাণী? রিরা ফিসফিস করে নিজেকে বলল, না না—এটা হতে পারে না। কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। নিশ্চয়ই বেঁচে আছে।

রিরা খুব সতর্ক পায়ে হাঁটতে শুরু করে, তীক্ষ্ণ চোখে সে তাকায়—কোথাও কি কেউআছে?

করিডরের গোড়ায় সে ক্যাপ্টেন বর্কেনের মৃতদেহটি দেখতে পেল ভয়ংকর গোলাগুলির মাঝে থেকেও তার মৃতদেহটি আশ্চর্যরকম অক্ষত। মুখে এক ধরনের প্রশান্তির চিহ্ন, দেখে মনে হয় কোনো একটা কিছু দেখে কৌতুক বোধ করছেন।

রিরা কিছুক্ষণ মৃতদেহটির কাছে দাঁড়িয়ে রইল, তার ভেতরে দুঃখ, ক্রোধ বা হতাশা কোনো ধরনের অনুভূতিই নেই, সে ভেতরে এক ধরনের আশ্চর্য শূন্যতা অনুভব করে। রিরা অনেকটা যন্ত্রের মতো মৃতদেহটি ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

দুজন নীলমানবের মৃতদেহ পাওয়া গেল কন্ট্রোলরুমের দরজায়। শক্তিশালী কোনো বিস্ফোরকের আঘাতে একজনের মস্তিষ্কের বড় অংশ উড়ে গেছে। গুলির আঘাতে দ্বিতীয়জনের বুকের একটা অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে আছে। কালচে এক ধরনের রক্তে পুরো জায়গাটা ভিজে আছে। মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের মৃতদেহের বেশিরভাগ তাদের কেবিনের কাছাকাছি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। তাদের বেশিরভাগই ছিল নিরস্ত্র, প্রতিবোধ দূরে থাকুক নিজেদের রক্ষা করার সুযোগও কেউ পায় নি। ইঞ্জিনঘরের কাছাকাছি মনে হয় একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, সেখানে ইতস্তত অনেকগুলো মৃতদেহ পড়ে আছে। নীলমানবদের মৃতদেহের বেশিরভাগই কুরু ইঞ্জিনের আশপাশে মনে হয় তারা ইঞ্জিনটা ধ্বংস করতে চেষ্টা করেছিল। উপরে নিরাপত্তাকর্মীরা থাকায় শেষপর্যন্ত ধ্বংস করতে পারে নি। ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ারের মৃতদেহটি পাওয়া গেল কন্ট্রোল প্যানেলের উপর তার পায়ের কাছেই একজন নীলমানবের মৃতদেহ পড়ে আছে। আশপাশে চারদিকে ধস্তাধস্তির চিহ্ন একপর্যায়ে মনে হয় অস্ত্র হাতে এরা হাতাহাতি যুদ্ধ করেছে, কিন্তু শেষরক্ষা হয় নি, একটি মানুষ কিংবা নীলমানবও বেঁচে নেই। পুরো ইঞ্জিনঘরটির ভেতরে মনে হয় একটা প্রলয়কাণ্ড ঘটে গেছে তার ভেতরে ধক ধক শব্দ করে এখনো ইঞ্জিনটি চলছে, সেটাই একটি রহস্য।

রিরা ইঞ্জিনঘর থেকে বের হয়ে কমিউনিকেশনস ঘরে গেল, সেখান থেকে মূল প্রসেসর ঘরে। প্রসেসর ঘর থেকে শীতলঘর, সেখান থেকে কার্গোঘরে—কোথাও একজন জীবিত প্রাণী নেই। একজন মানুষ কিংবা একজন নীলমানব কেউ বেঁচে নেই। এই পুরো মহাকাশযানে সে একা অসংখ্য মানুষ এবং নীলমানবের মৃতদেহ নিয়ে মহাকাশ পাড়ি দেবে-রিরা হঠাৎ করে অসহনীয় আতঙ্কে থরথর করে কাপতে শুরু করে।

ঠিক তখন সে একটা শব্দ শুনতে পেল, কোনো একজনের পদশব্দ কিংবা কোনো কিছু সরে যাবার শব্দ। নিজের অজান্তেই সে চিৎকার করে উঠল, কে?

নিঃশব্দে মহাকাশযানে তার চিঙ্কার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে কিন্তু কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। রিরা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি হাতে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে চারদিকে তাকায়। কোনো মহাকাশচারী হলে নিশ্চয়ই তার প্রশ্নের উত্তর দিত—এটি হয়তো কোনো নীলমান। ভয়ংকর দুর্ধর্ষ নৃশংস একজন নীলমানব। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে তার অস্ত্রটি ধরে রাখে, কোনো একটা কিছুকে নড়তে দেখলেই সে গুলি করবে।

আবার কিছু একটা নড়ে যাবার শব্দ হল—মনের ভুল নয়, নিশ্চিত শব্দ, কোনো জীবন্ত প্রাণীর সরে যাবার শব্দ। রিরা শক্ত হাতে তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে এগুতে থাকে, করিডরের পাশেই একটা ছোট ঘর, তার ভেতর থেকে শব্দটা এসেছে। দরজার সামনে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎ করে লাথি দিয়ে দরজাটা খুলে অস্ত্র উদ্যত করে ভেতরে ঢুকে গেল সে—একমুহূর্ত সে নিশ্বাস নিতে পারে না আতঙ্কে। দেয়ালে হেলান দিয়ে স্থির চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে একজন নীলমানব। কী ভয়ংকর ক্রুর সে দৃষ্টি! রিরার সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল আতঙ্কে।

রিরা নীলমানবটির মাথার দিকে অস্ত্রটি উদ্যত করে রেখে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকে এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারল নীলমানবটি নিরস্ত্র ও আহত। পায়ের কাছাকাছি কোথাও গুলি লেগেছে। নীল রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ে পুরো জায়গাটা কালচে হয়ে আছে। নীলমানবটি ইচ্ছে করলেই তাকে হত্যা করতে পারবে না বুঝতে পেরে হঠাৎ সে তার শরীরে শক্তি ফিরে পায়, অস্ত্র হাতে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে সে অস্ত্রটি নীলমানবের মাথার দিকে তাক করে। হত্যা খুব ভয়ংকর ব্যাপার, তারপরেও আমাদের হত্যা করতে হয়। ক্যাপ্টেন বর্কেন বলেছিলেন, নিজেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনে অন্যকে হত্যা করতে হয়। রিরা এই মুহূর্তে নীলমানবটিকে হত্যা করবে। সে অস্ত্রটি নীলমানবের মাথার দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরল। কান ফাটানো বিস্ফোরণের শব্দে পুরো ঘর প্রকম্পিত হওয়ার কথা ছিল কিন্তু কোনো শব্দ হল না; খট করে একটা শব্দ করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি মৃদু ঝাকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল মাত্র। রিরা অস্ত্রটির দিকে তাকায় গুলি শেষ হয়ে গেছে। কোমর থেকে নতুন ম্যাগজিন বের করে অস্ত্রতে লোড করে আবার সেটি উদ্যত করল নীলমানবের মাথার দিকে। নীলমানবটি স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে কী ভয়ংকর ক্রুর তার দৃষ্টি, মুখমণ্ডলে কী ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা! একটু আগে কী নৃশংসভাবেই না তারা এই মহাকাশের সবাইকে হত্যা করেছে। রিরা ট্রিগারে চাপ দিতে গিয়ে থেমে গেল, দৃষ্টিতে কি শুধু অমানবিক নিষ্ঠুরতা? তার সাথে কি একটু ভয়, একটু আতঙ্ক এবং শূন্যতা নেই তাকে হত্যা না করার জন্য কাতর প্রার্থনা নেই? বেঁচে থাকার জন্য আকুলতা নেই?

রিরা অস্ত্রটি নামিয়ে রাখল, পায়ে গুলি লেগে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, নীলমানবটি এমনিতেই মারা যাবে তার মাথায় গুলি করে তাকে আলাদাভাবে হত্যা করার প্রয়োজন নেই। সে ঘরটির চারদিকে তাকাল, এখান থেকে বের হয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। বাইরে থেকে তালা দিয়ে রাখলে নীলমানবটি এই ঘর থেকে বের হতে পারবে না—আপাতত আটকে থাকুক এই ঘরে। রিরা ঘরটি বন্ধ করে বের হয়ে এল।

কন্ট্রোলরুমের দরজায় ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে থাকা নীলমানবটির মৃতদেহ ডিঙিয়ে রিরা কন্ট্রোলরুমের ভেতরে এসে ঢোকে। ক্যাপ্টেন বর্কেন যে চেয়ারটিতে বসতেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে সে সুইচ স্পর্শ করল। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন ছাড়া আর কেউ এই কন্ট্রোল প্যানেল ব্যবহার করার কথা নয়। কিন্তু এখন পুরোপুরি ভিন্ন একটা অবস্থা, জরুরি অবস্থায় যে-কেউ মূল প্রসেসরের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। শিক্ষানবিশ মহাকাশচারী হিসেবে তাদেরকে অনেকবার এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। রিরা তার রেটিনা স্ক্যান করিয়ে গোপন পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করাল। সাথে সাথেই উত্তর আসার কথা কিন্তু কোনো উত্তর না এসে মনিটরটি নিরুত্তর হয়ে রইল। রিরা এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে, সে দ্বিতীয়বার চেষ্টা করল। দুই চোখের রেটিনা স্ক্যান করিয়ে সে আবার গোপন পাসওয়ার্ডটি প্রবেশ করাল। কয়েক মুহূর্ত পরে মনিটরে কিছু আলোর বিচ্ছুরণ দেখা যায় এবং শুষ্ক কণ্ঠস্বরে মূল প্রসেসর যোগাযোগ করার চেষ্টা করল, জরুরি পর্যায় আট, আমি আবার বলছি মহাকাশযানে জরুরি পর্যায় আট।

রিরা এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করে। মহাকাশযান অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবার পূর্বমুহূর্তে জরুরি পর্যায় দশ ঘোষণা করা হয় এই মহাকাশযানটি সেই পর্যায় থেকে মাত্র দুই পর্যায় উপরে রয়েছে। নীলমানবেরা যখন মহাকাশযানে আক্রমণ করেছিল, তখন মহাকাশযানটিকে নিশ্চয়ই পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে। জরুরি পর্যায় পাঁচ পর্যন্ত মহাকাশযান সহ্য করতে পারে। জরুরি পর্যায় আট পৌঁছে গেলে সেটা পরিত্যাগ করে সরে যাবার কথা—যে কোনো মুহূর্তে সেটা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। রিরা কাপা গলায় বলল, আমি মহাকাশ্যানচারী রিরা। মহাকাশযানে একমাত্র জীবিত মানুষ আমার সাহায্যের প্রয়োজন।

শুষ্ক কণ্ঠস্বরে মহাকাশযানের প্রসেসর উত্তর করল, এই মহাকাশযান খুব শিগগিরই ধ্বংস হয়ে যাবে। মহাকাশযানের বায়ুর পরিশীলন সিস্টেম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, বাতাসের চাপ কমে আসছে। কুরু ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জ্বালানি টিউবে ফুটো হওয়ার কারণে জ্বালানি ছড়িয়ে পড়ছে।

রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, কেন্দ্রীয় মহাকাশ কেন্দ্রে খবর পাঠানো প্রয়োজন। জরুরি সাহায্য না পেলে–

বিস্ফোরণের কারণে যোগাযোগ কেন্দ্র নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের পক্ষে বাইরে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়।

রিরা আর্তচিৎকার করে বলল, বাইরে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়?

না।

এই মহাকাশযানটা কয়েকদিনের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে?

হ্যাঁ। মহাকাশযানে বাতাসের চাপ কমে আসছে। ইঞ্জিনঘরে যে জ্বালানি ছড়িয়ে পড়েছে, যে কোনো মুহর্তে সেটা দিয়ে বিস্ফোরণ হতে পারে।

এবং সাহায্য পাবার কোনো আশা নেই?

মহাকাশযানের মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে বলল, সাহায্য পাবার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য তিন।

চমৎকার! রিরা হঠাৎ আবিষ্কার করল পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তার যেরকম অস্থির হয়ে যাবার কথা ছিল, সে মোটেও সেরকম অস্থির হয়ে উঠছে না। বরং পুরো ব্যাপারটা সে বেশ সহজভাবেই মেনে নিয়েছে। একটা নিশ্বাস ফেলে সে বেশ শান্ত গলায় বলল, যদি তা-ই সত্যি হয় যে, এই মহাকাশযানে আগামী কয়েকদিনই আমার জীবনের শেষ কয়েকদিন, তা হলে সময়টা আমি ভালোভাবে কাটাতে চাই।

মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী করতে চাও রিরা?

প্রথমত মহাকাশযানে যে অসংখ্য মৃতদেহ পড়ে আছে, সেগুলো যথাযযাগ্য মর্যাদা দিয়ে সমাহিত করতে চাই। সেটা সম্ভব না হলে সেগুলোকে অন্তত হিমঘরে সংরক্ষণ করতে চাই।

কাজটা একটু কঠিন হবে। মহাকাশযানের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ অনেক জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কঠিন হলেও করতে হবে। রিরা একটু থেমে যোগ করল, আমি এতগুলো মৃতদেহের মাঝে একদিনও থাকতে পারব না।

রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে যদি দুএকটি নিচু শ্রেণীর রোবট অক্ষত অবস্থায় পাওয়া যায়, তা হলে তাদেরকে ব্যবহার করা যেতে পারে।

ঠিক আছে। মৃতদেহগুলো সরিয়ে নেবার পর মহাকাশযানটিকে পরিষ্কার করতে হবে। সব জায়গা রক্ত এবং ক্লেদে মাখামাখি হয়ে আছে।

ভ্যাকুয়াম সিস্টেম ব্যবহার করে সেটা সহজেই পরিষ্কার করা যাবে।

আমার থাকার জন্য খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে দিলেই আপাতত কাজ চলে। যাবে।

সেটি কোনো সমস্যা নয়, ক্যাপ্টেনের নিজস্ব অতিরিক্ত কেবিনটি তুমি ব্যবহার করতে পারবে। সেখানে আরামদায়ক বিছানা, ব্যক্তিগত আনন্দের জন্য বিনোদন কেন্দ্র, বিশেষ স্নায়ু-উত্তেজক পানীয় এই সবকিছু আছে।

তার কোনো প্রয়োজন নেই। এখন মৃতদেহ সংরক্ষণের কাজ শুরু করে দেওয়া যাক।

রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র থেকে চারটি নিচু শ্রেণীর রোবট পেয়ে যাবার পরও মহাকাশকেন্দ্রের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মৃতদেহগুলো শীতল ঘরে নিয়ে সংরক্ষণ করে মহাকাশযানটি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য করতে করতে প্রায় আট ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়ে গেল। কাজ শেষ করে রিরা যখন ক্যাপ্টেনের অতিরিক্ত কেবিনে শুতে এসেছে, তখন সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিল না। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথে তার চোখে ঘুম নেমে এল–শুনতে পেল তার মহাকাশযানের মূল প্রসেসর শুষ্ক কণ্ঠে বলছে, রিরা, অভুক্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তুমি আর কিছু না হলেও বলকারক একটু পানীয় মুখে দিয়ে নাও।

না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে শরীরের কী কী ক্ষতি হতে পারে আবছাভাবে শুনতে শুনতে রিরা গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল।

রিরার ঘুম ভাঙল ভয়ংকর খিদে নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে সে খানিকক্ষণ নরম বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে রইল। তার মনে পড়ল—সে একটি মহাকাশযানে একা এবং এই মহাকাশযানটি আগামী কয়েকদিনের মাঝেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে। ব্যাপারটি নিয়ে তার যেরকম বিচলিত হওয়ার কথা ছিল, সে সেরকম বিচলিত হল না। কোনো একটা অজ্ঞাত। কারণে তার ভাবনা-চিন্তা সবকিছুই কেমন যেন ভোতা হয়ে এসেছে। রিরা কিছুক্ষণ বিছানায় শুয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে রইল; মহাকাশযানের ইঞ্জিনের চাপা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে–গুঞ্জনটির মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন হয়েছে, যদিও সে পরিবর্তনটা ঠিক ধরতে পারল না। রিরা একসময় উঠে দাঁড়াল, শরীরের অবসাদ কেটে গেছে, ভালো করে কিছু খেয়ে নিতে পারলে সে দিনটি ভালোভাবে শুরু করতে পারবে। মহাকাশযানের সব মহাকাশচারী মারা গিয়েছে, বেঁচে আছে শুধু সে একা–জেনে প্রথমে তার ভেতরে এক ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম হয়েছিল। সে কী করবে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না। মহাকাশযানটি কয়েকদিনের মাঝে ধ্বংস হয়ে যাবে শুনে হঠাৎ করে তার আতঙ্ক এবং অস্থিরতা পুরোপুরি কেটে গেছে, সে আবিষ্কার করেছে তার আসলেই কিছু করার নেই। কাজেই জীবনের শেষ কয়টি দিনকে এখন যতটুকু সম্ভব অর্থবহ করাই হতে পারে একমাত্র অর্থপূর্ণ কাজ।

রিরা দীর্ঘ সময় নিয়ে শরীর পরিষ্কার করে সত্যিকার পানিতে স্নান সেরে নিয়ে পরিষ্কার একটি ওভারঅল পরে নেয়। ক্যাপ্টেনের সুদৃশ্য টেবিলে বসে সে যখন কী খাবে সেটা নিয়ে। মহাকাশযানের প্রসেসরের সাথে কথা বলছিল, ঠিক তখন তার নীলমানবটির কথা মনে পড়ল। কী আশ্চর্য! সে একটি আহত নীলমানবকে রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যাবার জন্য একটা ঘরে বন্ধ করে রেখে তার কথা পুরোপুরি ভুলে গেছে। রিরা তার বিছানায় বসে দ্রুত খেয়ে নেয়। এক টুকরো রুটি, সত্যিকারের মাখন, পনির এবং খানিকটা কৃত্রিম প্রোটিন। খাবার শেষে এক মগ গরম কফি। রিরা খাওয়া শেষ করে তার অস্ত্রটি খুঁজে বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে কার্গো বের করিডরের শেষ মাথায় বন্ধ ঘরটিতে হাজির হল। সাবধানে তালা খুলে সে দরজা টেনে ভেতরে উঁকি দেয়, মনে মনে আশা করেছিল নীলমানবটি এতক্ষণে মরে গিয়ে সব ঝামেলা চুকিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সে দেখতে পেল নীলমানবটি এখনো বেঁচে আছে। রিরা নিজের ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করে, সে তার অস্ত্রটি হাতবদল করে হিংস্র আক্রোশ নিয়ে নীলমানবটির দিকে তাকাল, দাঁতে দাঁত ঘষে চাপা গলায় বলল, এখনো বেঁচে আছ?

নীলমানবটি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর আশ্চর্য রকমের এক ধরনের ভরাট গলায় বলল, পানি।

পানি! রিরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, আহত নীলমানবটি তার কাছে পানি চাইতে পারে সেটি নিজের কানে না শুনলে সে বিশ্বাসই করত না। রিরা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমার মহাকাশযানের সব মানুষকে একজন একজন করে গুলি করে মেরে ফেলেছ, এখন তুমি আমার কাছে পানি চাইছ, তোমার সাহস তো কম না! পানি নয়, তোমার মাথার খুলিতে চতুর্থ মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে একটা বুলেট পাঠানো দরকার। বুঝেছ?

নীলমানবটি ধৈর্য ধরে রিয়ার কথা শেষ হবার জন্য অপেক্ষা করল, তারপর আবার ঠিক আগের মতো ভরাট গলায় বলল, পানি।

রিরা আবার ক্রুদ্ধ গলায় বলল, চুপ কর শয়তানের বাচ্চা। আমি আমার জীবনের শেষ সময়টা তোমার মতো দানবদের সেবা-যত্ন করে কাটাতে পারব না। তোমার গুলি খেয়ে মরার কথা ছিল—-তোমার চৌদ্দপুরুষের সৌভাগ্য যে গুলি খেয়ে মরতে হচ্ছে না। সভ্য মানুষের মতো রক্তক্ষরণে মারা যাচ্ছ। বুঝেছ?

নীলমানবটি আবার ধৈর্য ধরে রিরার কথা শুনে গেল। তার কথা শেষ হবার পর বলল, পানি। কিশিমারা।

কিশিমারা? রিরা ধমক দিয়ে বলল, কিশিমারা মানে কী? তিতির পাখির ঝলসানো কাবাব? নাকি আঙুরের রস? গ্যালাক্সির মহাসম্রাটের আর কী কী প্রয়োজন? ঘুমানোর জন্য নরম বিছানা? নিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রার সুগন্ধি বাতাস? স্নায়ু-উত্তেজক কিছু পানীয়?

নীলমানবটি মাথা নাড়ল, এবং রিরার প্রথমবার মনে হল তার মুখে খুব সূক্ষ্ম এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। নীলমানবেরা যে মানুষের একটি অপভ্রংশ এই প্রথমবার রিরার মাথায় উঁকি দিয়ে যায়। রিরা জিজ্ঞেস করল, তা হলে কিশিমারা মানে কী?

কিশিমারা। নীলমানবটি মুখে একটি কাতর ভঙ্গি করে হাত দুটি বুকের কাছে এনে অনুনয়ের ভঙ্গি করে।

ও! রিরার রাগ কমে আসে, তা হলে কিশিমারা মানে অনুগ্রহ করে?

নীলমানবটি মাথা নাড়ল, কিশিমারা অনুগ্রহ… কিশিমারা… অনুগ্রহ পানি পানি অনুগ্রহ।

ঠিক আছে। রিরা তার অস্ত্রটা হাতবদল করে বলল, তোমাকে এক বোতল পানি দিচ্ছি কিন্তু আর কিছু পাবে না। এই বোতল পানি খেয়ে ঝটপট তোমাকে মরে যেতে হবে। বুঝেছ? আমি তোমার সেবা করতে পারব না।

নীলমানবটি মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। বুকে হাত দিয়ে নিজেকে দেখিয়ে বলল, বুঝেছি।

রিরা পানির একটি বোতলের সাথে কী মনে করে দুই টুকরো রুটি, এক টুকরো কৃত্রিম প্রোটিন আর একটা শুকনো ফল নিয়ে এল। ট্রেটা নীলমানবের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, খাও। এবং মনে রেখ এটা হবে তোমার প্রথম এবং শেষ খাবার।

নীলমানবটির মুখের মাংসপেশি হঠাৎ শিথিল হয়ে সেখানে একটি হাসি ফুটে ওঠে। রিরা প্রথমবার লক্ষ করল, নীলমানবটির বয়স খুব বেশি নয় এবং গায়ের রঙ নীল না হলে এবং চোখ দুটোতে এত অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি না থাকলে তাকে সুদর্শন মানুষ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যেত। নীলমানবটি খাবার ট্রেটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল, কুগুরা।

কুগুরা? রিরা কঠিন মুখে বলল, কুগুরা মানে কী? আরো চাই?

নীলমানবটি খাবারটুকু দুই ভাগ করে এক ভাগ নিজের কাছে রেখে অন্য ভাগ রিরার দিকে এগিয়ে দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কুগুরা।

রিরার কয়েক মুহূর্ত লাগল বুঝতে যে নীলমানবটি তার খাবারের অর্ধেক তাকে খেতে দিয়েছে। যখন বুঝতে পারল তখন হঠাৎ সে শব্দ করে হেসে ফেলল, হাসতে হাসতে বলল, এমনিতে মহাকাশযানের সব মানুষকে গুলি করে মেরে ফেল, কিন্তু খাবার বেলায় সেটা ভাগাভাগি করে খাও! এটা তোমাদের কোন ধরনের ভদ্রতা?

নীলমানবটি কোনো কথা না বলে বোতলটি মুখে লাগিয়ে ঢকঢক করে অনেকখানি পানি খেয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কুগুরা। অনেক কুগুরা।

কুগুরা মানে কি ধন্যবাদ?

হ্যাঁ। নীলমানবের মুখে আবার একটু হাসির চিহ্ন দেখা গেল, মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, ধন্যবাদ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

রিরা অর্ধেক করে তার কাছে পাঠানো খাবারের ট্রেটা ধাক্কা দিয়ে নীলমানবের কাছে ফেরত পাঠিয়ে দিয়ে বলল, কুগুরা। ধন্যবাদ। আমি খেয়ে এসেছি—এটা তোমার জন্য।

তারপর দরজাটা টেনে বন্ধ করতে করতে বলল, আবার যখন আলব, তখন যেন ঝামেলা না থাকে। খাবারটা খেয়ে ঝটপট মরে যাও। মনে থাকবে?

নীলমানবটি দুই টুকরো রুটির মাঝে প্রোটিনের টুকরোটা রেখে সেটিতে একটা বড় কামড় দিয়ে বলল, ধন্যবাদ। তোমাকে ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ।

Category: অবনীল
পূর্ববর্তী:
« ০২. তীক্ষ্ণ একটা অ্যালার্মের শব্দ
পরবর্তী:
০৪. কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে »

Reader Interactions

Leave a Reply Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

বাংলা লাইব্রেরি : উল্লেখযোগ্য বিভাগসমূহ

লেখক ও রচনা

অনুবাদ সাহিত্য

সেবা প্রকাশনী

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

কোরআন

হাদিস

ত্রিপিটক

মহাভারত

রামায়ণ

পুরাণ

গীতা

বাইবেল

বিবিধ রচনা

বাংলা ওসিআর

Download Bangla PDF

হেলথ

লাইব্রেরি – ফেসবুক – PDF

top↑