০২. তীক্ষ্ণ একটা অ্যালার্মের শব্দ

তীক্ষ্ণ একটা অ্যালার্মের শব্দ শুনে রিরা ঘুম থেকে জেগে উঠল। মহাকাশযানে এই অ্যালার্মটি একটি বিপদসংকেত। একাডেমিতে তাদের অনেকবার শোনানো হয়েছে। রিরা লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে তার কাপড় পরতে শুরু করে, জরুরি অবস্থার জন্য আলাদা করে রাখা ব্যাকপেকটা পেছনে ঝুলিয়ে সে দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে এল। মহাকাশযানের অন্যরাও ছুটতে ছুটতে যাচ্ছে, রিরা ভয় পাওয়া গলায় কমবয়সী একজনকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে জান?

উহ জানি না। মানুষটি হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দেবার একটা ভঙ্গি করে বলল, আমার মনে হয় ড্রিল।

ড্রিল?

হ্যাঁ। মহাকাশযানে রওনা দেবার পর প্রথম প্রথম ইচ্ছে করে এরকম ড্রিল করানো হয়।

রিরা ছুটতে ছুটতে মহাকাশযানের কন্ট্রোলরুমে হাজির হয়ে দেখতে পেল, সেখানে এর মাঝে অন্য সবাই পৌঁছে গেছে। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বড় মনিটরটির দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে আছেন। তিনি মনিটরটি বন্ধ করে মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি অ্যালার্ম বাজিয়ে সবাইকে ডেকে এনেছি—যদিও তোমাদের মনে হতে পারে ডেকে আনার প্রয়োজন ছিল না। তোমাদের মনে হতে পারে এটি মোটেও মহাকাশযানের একটি জরুরি ঘটনা নয়।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন চুপ করলেন এবং মধ্যবয়স্ক ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার লি জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে মহামান্য ক্যাপ্টেন?

তোমরা সবাই জান আমরা আমাদের এই মহাকাশযানে করে সতের জন নীলমানকে বিজ্ঞান একাডেমিতে নিয়ে যাচ্ছি। তোমরা নিশ্চয়ই এটাও জান যে নীলমানবেরা এই মহাজগতের সবচেয়ে দুর্ধর্ষ এবং সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণী। আমি যদি তাদেরকে ঘুম পাড়িয়ে শীতলঘরে করে নিতে পারতাম, তা হলে স্বস্তিবোধ করতাম। কিন্তু বিজ্ঞান একাডেমির বিশেষ নির্দেশে আমরা তাদেরকে একটা ঘরে বন্ধ করে মুক্ত অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছি। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমার একটি সন্দেই ছিল যে, এরা নিশ্চয়ই কোনোভাবে এখান থেকে নিজেদের মুক্ত করে মহাকাশযানটি দখল করার চেষ্টা করবে।

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার লি শঙ্কিত গলায় বললেন, তারা কি কিছু করেছে?

আমার ধারণা প্রক্রিয়াটি তারা শুরু করেছে।

উপস্থিত সবাই একসাথে চমকে উঠল। কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, তারা কী করছে?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, কিছুক্ষণ আগে একজন নীলমানব তার হাতের কবজির ধমনিটা কেটে ফেলেছে। তার শরীর থেকে নীল রক্ত বের হয়ে আসছে। কিছুক্ষণের মাঝেই এই নীলমানবটি মারা যাবে।

কমবয়সী মেয়েটা ছটফট করে বলল, কিন্তু এটা তো আত্মহত্যা। নীলমানবেরা নিজেরা আত্মহত্যা করে কেমন করে আমাদের মহাকাশযান দখল করবে?

ক্যাপ্টেন বর্কেন একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, নীলমানবেরা, যে ঘরটিতে আছে, সেটা বলা যেতে পারে একটা দুর্ভেদ্য ঘর, তার ভেতরে কারো যাবার কিংবা বের হবার ব্যবস্থা নেই। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দিয়ে তাদের খাবার দেওয়া হয়, তাদের বর্জ সরিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু এখন—

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু থামলেন—সবার দিকে একনজর দেখে বললেন, কিন্তু এখন এই দুর্ভেদ্য ঘরের দরজা আমাদের খুলতে হবে। নীলমানবের মানুষ নয়—তাই যে নীলমানরটি তার হাতের কবজি কেটে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে, তাকে বাঁচানোর আমাদের কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। কিন্তু বিজ্ঞান একাডেমি এদেরকে জীবন্ত পেতে চায়। আমাদের এখন একে বাচাতে চেষ্টা করতে হবে। এবং সেজন্য এখন আমাদের এই ঘরের দরজা খুলে ঢুকতে হবে।

মহাকাশযানের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ ভুরু কুঁচকে বললেন, মহামান্য ক্যাপ্টেন, আপনার ধারণা এই ঘরের দরজা খোলার জন্য নীলমানবটি আত্মহত্যা করেছে?

আমার তা-ই ধারণা।

তা হলে এর একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে। নীলমানবেরা সবাই মিলে এই পরিকল্পনাটি করেছে?

হ্যাঁ। নীলমানব বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। তারা সব সময় একসাথে কাজ করে। এরা এক ধরনের সমন্বিত প্রাণসত্তা।

নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ গম্ভীর মুখে বললেন, যদি তারা সত্যিই এটি পরিকল্পনা করে থাকে, তা হলে আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম সেটি জানবে। কারণ আমরা তাদের প্রত্যেকের প্রতিটি পদক্ষেপ মনিটর করছি। আমাদের সিকিউরিটি সিস্টেম কী বলছে?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, সেটাই হচ্ছে সমস্যা। আমাদের মহাকাশযানের মূল সিকিউরিটি প্রসেসর যে রিপোর্ট দিয়েছে, সেখানে কোথাও কোনো ধরনের পরিকল্পনার কথা নেই। কোনো ষড়যন্ত্র নেই। নীলমানবেরা হালকা কথাবার্তা বলেছে, দাবা জাতীয় একটা খেলা খেলে সময় কাটিয়েছে, গান করেছে এবং বেশিরভাগ সময়ে কিছু না করে চুপচাপ ছাদের দিকে তাকিয়ে শুয়ে থেকেছে।

নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ একটি নিশ্বাস ফেলে সহজ গলায় বললেন, মহামান্য বর্কেন, আমার মনে হয় আপনার সন্দেহটি অমূলক। নীলমানবের আত্মহত্যাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমাদের মহাকাশযান দখল করার প্রক্রিয়া এটা নয়।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন কিছুক্ষণ ক্রুশের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, আমি সত্যিই চাই যে, তোমার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হোক এবং আমি ভুল প্রমাণিত হই। কিন্তু–

কিন্তু?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হাত দিয়ে বড় মনিটরের সুইচটা স্পর্শ করে সেটা অন করে দিলেন। নীলমানবদের ঘরের দৃশ্যটি মুহূর্তের মাঝে ফুটে উঠল।

একজন নীলমান মেঝেতে নিথর হয়ে শুয়ে আছে। তার চোখ দুটো খোলা, ভান হাতটি অবসন্ন হয়ে পাশে পড়ে আছে। কবজির খানিকটা অংশ কাটা। সেখান থেকে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে বের হয়ে শরীরের নিচে জড়ো হয়েছে। রক্তের রঙ নীল, এখন কালচে হয়ে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। তার মাথার কাছে একজন নীলমানব স্থির হয়ে বসে আছে–তার মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন। দুজন মেঝেতে দুক কেটে রাখা ঘরের দু পাশে বসে খেলছে। তাদের পাশে আরো দুজন স্থির হয়ে বসে আছে। একজন করুণ বিষণ্ণ স্বরে গান। গাইছে। অন্যের দেয়ালে হেলান দিয়ে নিঃশব্দে বসে আছে।

সমস্ত দৃশ্যটি একটি পরাবাস্তব দৃশ্যের মতো।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, আমি নীলমানদের বিশেষজ্ঞ নই কিন্তু তারপরও আমি বলতে পারি, এই দৃশ্যটি স্বাভাবিক নয়। এটি স্বাভাবিক হতে পারে না। একজন মানুষের মৃত্যুর সময়ে অন্যেরা এত নিস্পৃহ হতে পারে না। নীলমানব হলেও না।

নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ বললেন, দৃশ্যটি অস্বাভাবিক হতে পারে মহামান্য ক্যাপ্টেন, কিন্তু এখানে তো কোনো ষড়যন্ত্রের আভাস নেই।

ক্যাপ্টেন বনে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে ক্রুশের দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, এই দৃশ্যটিতে ষড়যন্ত্রের কোনো আভাস নেই আমার ধারণা সেটাই হচ্ছে ষড়যন্ত্র।

ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার লি বললেন, এই নীলমানবটিকে বাঁচানোর জন্য কী করা হবে মহামান্য ক্যাপ্টেন?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মনিটরটির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন, প্রথমে ঘরটিতে নিথিলিয়াম গ্যাল দেওয়া হবে। গ্যাসের বিক্রিয়ায় সবাই অচেতন হয়ে যাবার পর নিরাপত্তাকর্মীরা ঘরটিতে ঢুকবে। কবজি কেটে যে নীলমানবটি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছে, তাকে বের করে আনা হবে চিকিৎসা করার জন্য।

তাকে কি বাঁচানো সম্ভব হবে?

জানি না। শুনেছি নীলমানদের প্রাণশক্তি আমাদের প্রাণশক্তি থেকে অনেক বেশি। হয়তো বেঁচে যেতেও পারে।

নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ বললেন, আমরা তা হলে কাজ শুরু করে দিই?

হ্যাঁ। শুরু করে দাও

ক্যাপ্টেন বৰ্কেনকে হঠাৎ কেন জানি ক্লান্ত দেখায়, তিনি ঘুরে অন্য সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, অ্যালার্মের শব্দ শুনে চলে আসার জন্য সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আমি সবাইকে সবকিছু জানিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম, যেন হঠাৎ করে আমরা আক্রান্ত হয়ে না পড়ি।

কমবয়সী মেয়েটি বলল, কিন্তু আমাদের তো এখন আক্রান্ত হবার কোনো আশঙ্কা নেই—তাই না?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন কোনো কথা না বলে অন্যমনস্কভাবে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রুশ মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, না, কোনো আশঙ্কা নেই। এখন আপনারা সবাই নিজেদের কেবিনে কিংবা নিজেদের স্টেশনে ফিরে যেতে পারেন। ক্রুশ মাথা ঘুরিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার কমান্ডে যারা আছ, তারা আমার সাথে এস। সবাই নিজেদের অস্ত্রগুলো লোড করে বেখ। ।

মহাকাশচারীরা একজন একজন করে কন্ট্রোলরুম থেকে বের হয়ে যেতে শুরু করার পর ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মনিটরের সামনে বড় চেয়ারটিতে বসলেন। হাত বাড়িয়ে সুইচ টিপে মনিটরটি চালু করে কার্গো বেতে দাঁড়িয়ে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে হাত দিয়ে টেবিলে শব্দ করতে লাগলেন।

মহামান্য ক্যাপ্টেন— গলার স্বর শুনে ক্যাপ্টেন বৰ্কেন মাথা ঘুরিয়ে দেখলেন রিরা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন হালকা গলায় বললেন, কী ব্যাপার রিরা?

আমি কি আপনার সাথে এখানে কিছুক্ষণ থাকতে পারি?

এখানে থাকতে চাও?

জি মহামান্য ক্যাপ্টেন।

কেন?

রিরা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নিচু গলায় বলল, আমাদের একাডেমিতে কয়েকটা কেস স্টাডি পড়ানো হয়েছিল, তার ভেতরে আপনার দুটো অভিযানের ঘটনা ছিল। আমি সেগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করেছি। আমার মনে হয়েছে, কিছু কিছু বিষয়ে আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে। গ্রিন গ্রহপুঞ্জে আপনি যেভাবে বিপদের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। সেটি রীতিমতো অলৌকিক।

কাপ্টেন বৰ্কেন কোনো কথা না বলে একটু হাসলেন। রিরা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমার ধারণা নীলমানবদের ব্যাপারে আপনি যে আশঙ্কাটুকুর কথা বলেছেন, সেটা সত্যি প্রমাণিত হবে।

তোমার তাই ধারণা?

আমার নিজের কোনো ধারণা নেই মহামান্য ক্যাপ্টেন, আমার এই বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাও নেই। কিন্তু আপনার সম্পর্কে আমি যেটুকু জানি, সেটা থেকে আমার ধারণা আপনার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হবে। নীলমানবেরা মহাকাশযান দখল করার চেষ্টা করবে। আমি আপনার কাছাকাছি থেকে পুরো ব্যাপারটি দেখতে চাই মহামান্য ক্যাপ্টেন। আপনি কীভাবে পুরো বিষয়টির অবসান ঘটান, আমি সেটা নিজের চোখে দেখতে চাই মহামান্য ক্যাপ্টেন।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, গ্রিন গ্রহপুঞ্জে আমার ভবিষ্যদ্বাণী যেভাবে কাজে লেগেছে, সেরকম অনেক জায়গায় আমার ভবিষ্যদ্বাণীর ভুল বের হয়েছে। আমি খুব আন্তরিকভাবে চাই, এবারে আমার আশঙ্কা ভুল প্রমাণিত হোক। তা না হলে—

তা না হলে?

এখানে যে ভয়ংকর রক্তারক্তি হবে, সেটি কোনো মহাকাশযানের ইতিহাসে আগে কখনো ঘটে নি। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন সোজা হয়ে তার চেয়ারে বসে মনিটরটি উজ্জ্বল করতে করতে বললেন, এবং সেই রক্তের রঙ হবে লাল ও নীল।

রিরা কোনো কথা বলল না, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে কেমন জানি শিউরে ওঠে।

 

নিথিলিয়াম গ্যাস সিলিন্ডারের ভাল্বটি খোলার সাথে সাথে নীলমানবদের একজন উপরের দিকে তাকাল। ক্যাপ্টেন দাতে দাঁত ঘষে বললেন, বুঝতে পেরেছে।

রিরা একটু অবাক হয়ে বললেন, কেমন করে বুঝতে পেরেছে? নিথিলিয়াম বর্ণহীন এবং গন্ধহীন গ্যাস।

নিথিলিয়াম আমাদের কাছে বর্ণহীন এবং গন্ধহীন গ্যাস। নীলমানরদের ইন্দ্রিয় আমাদের থেকে অনেক বেশি তীক্ষ। তাদের ইন্দ্রিয়ের সংখ্যাও আমাদের থেকে বেশি।

রিরা নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, এখন কী হবে মহামান্য ক্যাপ্টেন?

কিছুই হবে না। আগে হোক পরে হোক ওরা বুঝতে পারত, আমরা নিথিলিয়াম বা অন্য কোনো গ্যাস দিয়ে তাদের অচেতন করে ফেলব।

রিরা রুদ্ধশ্বাসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইল। যে নীলমানবটি উপরের দিকে তাকিয়েছিল সে উঠে দাঁড়াল এবং রিরা বুঝতে পারল সে একজন নারী। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, এই মেয়েটি সম্ভবত অন্তঃসত্ত্বা—অন্তঃসত্ত্বা মেয়েদের ঘ্রাণশক্তি খুব প্রবল হয়।

মেয়েটি অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দুই পা হেঁটে হঠাৎ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলল এবং তখন একসাথে সবাই উপরের দিকে তাকাল। তারা বুঝতে পারছে এই ঘরের ভেতর নিখিলিয়াম গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। তাদের মুখে কোনো ধরনের অনুভূতির চিহ্ন ফুটে উঠল না, স্থির হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন ফিসফিস করে বললেন, বাতাসে এক পিপিএম নিথিলিয়াম থাকলেই মানুষ অচেতন হয়ে যায়। এদের দেখ দশ পিপিএম দিয়েও কিছু হচ্ছে না।

ক্যাপ্টেন বকেনের কথা শেষ হবার আগেই দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকা একজন নীলমান কাত হয়ে পড়ে গেল। রিরা বলল, অচেতন হতে শুরু করেছে।

হ্যাঁ। কিছুক্ষণের মাঝেই আরো দু-একজন কাত হয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিও একসময় হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে গেল। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন নিচু গলায় বললেন,

চমৎকার। নিথিলিয়াম কাজ করতে রু করেছে। কিন্তু–

কিন্তু কী মহামান্য ক্যাপ্টেন?

কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে এখানে।

রিরা একটু অবাক হয়ে বলল, কী অস্বাভাবিক ব্যাপার?

আমি বুঝতে পারছি না—কিন্তু কিন্তু ক্যাপ্টেন বৰ্কেনের ভুরু কুঁচকে উঠল, তিনি অবাক হয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে থাকা নীলমানবদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই দৃশ্যে কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে, ব্যাপারটি তিনি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে পারছেন, কিছু বুঝতে পারছেন না।

কন্ট্রোলরুমের বড় মনিটরে হঠাৎ করে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ক্রশের ছবি ভেসে উঠল। ক্রুশ মাথা তুলে ক্যাপ্টেন বর্কেনের কাছে ভেতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। বললেন, আমার দলটি প্রস্তুত মহামান্য বর্কেন। আমরা কি ভেতরে যেতে পারি?

একটু দাঁড়াও ক্রুশ।

কেন মহামান্য ক্যাপ্টেন?

আমার কাছে কিছু একটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে।

সেটা কী মহামান্য বর্কেন?

আমি এখনো জানি না।

আমরা কি অপেক্ষা করব? আহত নীলমানবটির কিন্তু অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, তা ছাড়া নিথিলিয়াম খুব তাড়াতাড়ি অক্সিডাইজড হয়ে যায় আমাদের হাতে সময় বেশি নেই।

আমি জানি। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, তবুও একটু অপেক্ষা কর।

ক্রুশের মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, আপনি শুধু শুধু আশঙ্কা করছেন মহামান্য ক্যাপ্টেন। আপনি আমাদের ওপর ভরসা করতে পারেন। আমার দলটি অত্যন্ত সুগঠিত এবং দায়িত্বশীল। ভেতরে কোনো ধরনের অঘটন ঘটা সম্ভব নয়। তা ছাড়া নীলমানবেরা সবাই অচেতন হয়ে আছে। নিথিলিয়াম গ্যাসটি অত্যন্ত কার্যকর গ্যাস।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, বেশ। তোমরা ঢোকো।

রিরা ফিসফিস করে বলল, মহামান্য ক্যাপ্টেন, আপনি অনুমতি না দিলেই পারতেন। আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সাধারণত ভুল করে না।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন রিরার কথায় উত্তর না দিয়ে ভুরু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে রইলেন, ঘরের ভেতর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নীলমানবেরা পড়ে আছে দৃশ্যটি দেখে মনে হয় কোনো পরাবাস্তব জগতের দৃশ্য।

নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান শক্তিশালী আরগন লেজার দিয়ে বন্ধ ঘরের দরজা কেটে আলাদা করতে শুরু করতেই ক্যাপ্টেন বৰ্কেন লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, চিৎকার করে বললেন, সর্বনাশ!

রিরা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হয়েছে? কী হয়েছে মহামান্য ক্যাপ্টেন?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন চিৎকার করে বললেন, থামো। থামো তোমরা–

কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে, বিশাল দরজা হাট করে খুলে ভেতরে ঢুকে গিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন। ভেতরের নিথিলিয়াম থেকে রক্ষা পাবার জন্য তাদের শরীরে বায়ুরোধক পোশাক, সেই পোশাকে তাদেরকে দেখাচ্ছে অতিকায় পতঙ্গের মতো। তাদের হতের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো দেখাচ্ছে খেলনার মতো।

রিরা ভয় পাওয়া মুখে বলল, কী হয়েছে মহামান্য ক্যাপ্টেন? কী হয়েছে?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন খুব ধীরে ধীরে তার চেয়ারে বসে ফিসফিস করে বললেন, আমরা সবাই শেষ হয়ে গেলাম।

কী বললেন? আর্তচিৎকার করে রিরা বলল, কী বললেন আপনি?

আমরা শেষ হয়ে গেলাম। কেউ আর আমাদের রক্ষা করতে পারবে না।

কেন?

নীলমানবেরা নিথিলিয়াম গ্যাস দিয়ে আক্রান্ত হয় নি। তারা ভান করেছে আক্রান্ত হয়েছে।

আপনি কেমন করে জানেন?

সবাই অচেতন হয়েছে একইভাবে একই ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে উপুড় হয়ে কারো মুখ দেখা যাচ্ছে না—সবাই মুখ ঢেকে রেখেছে।

এখন কী হবে?

ওরা উঠে দাঁড়াবে।

ক্যাপ্টেন বর্কেনের কথা শেষ হবার আগেই ঘরের একেবারে অন্যপ্রান্তে পড়ে থাকা নীলমানবটি উঠে দাঁড়াল–হঠাৎ করে লাফিয়ে নয়, খুব সহজ ভঙ্গিতে। যেন কিছুই হয় নি কোনো একজন পুরাতন বন্ধুকে দেখে একজন মানুষ যেভাবে উঠে দাঁড়ায় সেভাবে। তারপর টলতে টলতে সে এগিয়ে আসতে থাকে নিরাপত্তা বাহিনীর দলটির দিকে। নিরাপত্তা বাহিনীর দলটি হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে—কী করবে বুঝতে পারে না।

রিরা চাপা গলায় বলল, এখন কী হবে?

গুলি করবে। গুলি করে মারবে নীলমানবটিকে।

কেন মারবে?

কথা শেষ হবার আগেই প্রচণ্ড শব্দে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র গর্জন করে উঠল—নীলমানবটির শরীর ঝরা হয়ে যায় মুহর্তে ঝনঝন করে কাচ ভেঙে পড়ল ঘরের ভেতর!

ঘরের ভেতর বিশুদ্ধ বাতাস আনার ব্যবস্থা করল আর ভয় নেই নীলমানদের। নিথিলিয়ামে অচেতন থাকবে না কেউ।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেনের কথা শেষ হবার আগেই ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা নীলমানবেরা উঠে দাঁড়ায়, টলতে টলতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষগুলোর ওপর। প্রচণ্ড গুলির শব্দে কানে তালা লেগে গেল, ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক।

তুমি কিছু বোঝার আগে নলিমানবেরা ছুটে আসবে—একজন একজন করে সবাইকে হত্যা করবে ওরা। ক্যাপ্টেন বর্কেনের গলার স্বর হঠাৎ আশ্চর্যরকম শান্ত হয়ে গেল, তিনি মাথা নেড়ে বললেন, কী আশ্চর্য! আমি এই সহজ জিনিসটা বুঝতে পারি নি।

রিরা রক্তশূন্য মুখে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে রইল। মনিটরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, নীলমানবেরা অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দলটির থেকে বায়ু নিরোধক পোশাক পরে থাকায় তারা ঠিকভাবে নড়তে পারছিল না, ক্ষীপ্র নীলমানবেরা অবলীলায় তাদের কাবু করেছে। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে বেশ কয়জন নীলমানবের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কিন্তু সেজন্য কারো ভেতর এতটুক ভয়ভীতি বা দুর্বলতা এসেছে বলে মনে হল না। নীলমানবেরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে বেপরোয়াভাবে গুলি করতে করতে ছুটে আসছে। তাদের ভাবলেশহীন মুখে এই প্রথমবার হিংস্র প্রতিহিংসার একটা চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুর্বোধ্য ভাষায় চিৎকার করতে করতে তারা মহাকাশযানের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। পুরো মহাকাশযানটাকে একটা ধ্বংসস্তুপে পরিণত না করে তারা থামবে না।

রিরা ক্যাপ্টেন বর্কেনের দিকে তাকিয়ে বলল, আমরা এখন কী করব মহামান্য ক্যাপ্টেন?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন অন্যমনস্কভাবে মাথা নেড়ে বললেন, আমাদের করার কিছু নেই। এই মহাকাশযানে যারা আছে, তারা সাধারণ মহাকাশচারী। এই নীলমানবেরা যোদ্ধা ওদের হাতে এখন অস্ত্র। আমাদের আর কিছু করার নেই।

কিন্তু–

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন এক ধরনের স্নেহ নিয়ে রিরার দিকে তাকিয়ে শোনা যায় না এরকম গলায় বললেন, আমরা যদি নীলমানবদের ভেতরে এই ভয়ানক প্রতিহিংসার জন্ম না দিতাম, তা হলে হয়তো এই অবস্থা হত না। নীলমানদের মানুষ হিসেবে বিবেচনা করা উচিত ছিল।

কিন্তু এখন কিছুই কি করতে পারব না?

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কিছু একটা চেষ্টা অবশ্যই করতে হবে। কার্গো বে থেকে মূল মহাকাশযানের করিডরটাতে যদি এদের কিছুক্ষণ আটকে রাখা যায়, তা হলে মহাকাশযানের অন্য ক্রুরা হয়তো খানিকটা সময় পাবে। তারা হয়তো কিছু ভারী অস্ত্র বের করে এনে সত্যিকারের একটা প্রতিরোধ দিতে পারে।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন দেয়ালের একটা সুইচ স্পর্শ করে বেশ বড় একটা অংশকে নামিয়ে আনলেন। ভেতরে বড় বড় কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র সাজানো। তিনি একটা বহুঁ ব্যবহৃত অস্ত্র টেনে নামিয়ে দক্ষ হাতে লোভ করে বললেন, কখনো ভাবি নি এটা আবার ব্যবহার করতে হবে। ভেবেছিলাম খুনোখুনির পর্যায় পার হয়ে এসেছি।

রিরা দেয়াল থেকে অন্য একটি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নামিয়ে নিল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তাকে বাধা দিলেন না। এই অস্ত্র কে কখন কীভাবে ব্যবহার করতে পারবে—সেটি নিয়ে নানারকম নিয়মকানুন আছে, কিন্তু সেসব এখন পুরোপুরি অর্থহীন। ক্যাপ্টেন বৰ্কেন বললেন, তুমি ডান দিক দিয়ে যাও, আমি বাম দিকে আছি, মিনিট পাচেক আটকে রাখতে পারলেই অনেক। মাথা ঠাণ্ডা রেখ–খুব কাছে না আসা পর্যন্ত গুলি করো না। নিশানা ঠিক রেখ–হত্যা খুব ভয়ংকর একটা ব্যাপার—কিন্তু তারপরেও আমাদের করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য ফুড চেইন নামে একটা প্রক্রিয়ায় একজন প্রাণী অন্য প্রাণীকে বহুদিন থেকে হত্যা করে আসছে। মনে রেখ যত বেশিজন নীলমানবকে হত্যা করতে পারবে, আমাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তত বেশি।

রিরা মাথা নাড়ল, ক্যাপ্টেন বৰ্কেন তার হাত স্পর্শ করে বললেন, আমি খুব দুঃখিত রিরা। খুব দুঃখিত।

আপনার সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়ে আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করছি।

ক্যাপ্টেন বৰ্কেন শব্দ করে হাসলেন, বললেন, যদিও সেই সুযোগটা হচ্ছে খুব অল্পবয়সে নীলমানবের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার সুযোগ।

কার্গো বে-র করিভরে বড় ধাতব দরজার নিচু অংশে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি বসিয়ে রিরা। অপেক্ষা করতে থাকে। দূরে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নীলমানবেরা গুলি করতে করতে ছুটে আসছে। নৃশংস নীলমান নিয়ে তার খুব কৌতূহল ছিল, একটু পরেই তাদেরকে সে দেখবে। প্রথমবার তাদেরকে সামনাসামনি দেখবে। হয়তো শেষবার।