একটি অনমিত নাম : বনবিহারী মুখোপাধ্যায়
স্বর্গীয় লিখতে গিয়েই কলম থেমে গেল; এমনকি ক্ষণজন্মা, পুরুষসিংহ বনবিহারী মুখোপাধ্যায় পরলোক গমন করেছেন– এটা লিখতেও বাধো-বাধো ঠেকছে, কারণ বনবিহারী স্বর্গ, পরলোক, আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না।
বনবিহারীর পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা প্রায় অসম্ভব, কারণ চাকরিজীবনে তাকে বাধ্য হয়ে আজ পাকশী, কাল মৈমনসিং, পরশু বগুড়া করতে হয়েছে এবং অসময়ে বেকসুর বদলি হলেও তিনি হয়তো প্রতিবাদ জানাতেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনও মেহেরবানি চাইতেন না। বনবিহারী এ জীবনে কারও কাছ থেকে কোনও ফেবার চাননি, এবং ভগবানের কাছ থেকে অতি অবশ্য, নিশ্চয়ই না। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তিনি সর্বপ্রথম কোথায় যান জানিনে, কিন্তু তার পরই চলে যান দেরাদুনে। সেখানে বেশ কয়েক বৎসর একটানা হোটেলে বাস করার পর হঠাৎ চলে যান বিশ্বাস করুন আর না-ই করুন, আন্দামান। স্বেচ্ছায় এবং অতিশয় প্রসন্ন চিত্তে। বলা বাহুল্য, সেখানে রোমান্সের সন্ধানে যাননি। কাব্যে, সাহিত্যে তিনি কতখানি রোমান্টিসিজম বরদাস্ত করতেন বলা কঠিন, কিন্তু সংসার-জীবনে তিনি রোমান্টিসিজমের পিছনে দেখতে পেতেন, make belief, সত্য থেকে আত্মগোপন, একেপিজম এবং ভণ্ডামি এবং এর সবকটাকেই তিনি অত্যন্ত কুটিকুটিল নয়নে তিরস্কার জানাতেন। তার পর হঠাৎ একদিন তিনি আবার ভারতে ফিরে এলেন। বৃদ্ধ বয়সে তার বাসস্থান পরিবর্তন আমাকে বড় পীড়া দিত। তাই তাঁকে অনুরোধ জানালুম, তিনি যেন দয়া করে আমার সঙ্গে বসবাস করেন। উত্তম হোক মধ্যম হোক, আমি মোগলাই, বিলিতি কিছু কিছু রাধতে পারি; সে সময়ে আমার বাসস্থানটি ছিল প্রশস্ত ও নির্জনে– শুশানের কাছে অবস্থিত। আমার নিজস্ব বই তো ছিলই, তদুপরি তার পরিচিত একটি লাইব্রেরি কাছেই ছিল। অবশ্য সর্বপ্রধান প্রলোভন ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শ্ৰীযুত বিনোদবিহারী মুখুয্যে। তাঁর বাসাও নিকটে। এই ভাইটিকে বনবিহারী আপন হাতে মানুষ করেন এবং সে যেন ধর্ম, ঈশ্বর, পরকাল, উপাসনা ইত্যাদি সর্বপ্রকার সংস্কার থেকে মুক্ত থাকে সে জন্য কোনও ব্যবস্থার ত্রুটি করেননি। বিনোদবিহারীর ডাকনাম নন্তু। বনবিহারী তাকে ডাকতেন নাস্তিক বা নাস্তে। আমার বাড়িতে এসে বাস করলে তিনি যে তাঁর নাস্তেকে অক্লেশে দু বেলা দেখতে পাবেন সেইটেতে বিশেষ জোর দিয়ে আমি আমার চিঠিতে নিবেদন জানিয়েছিলুম। বিনোদবিহারী প্রায় দশ বত্সর পূর্বে তাঁর চোখের জ্যোতি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেন; তাই তাঁর পক্ষে অগ্রজ সন্নিধানে যাওয়া কঠিন ছিল।
আমি ক্ষীণ আশা নিয়েই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলুম, কারণ আমি তাঁর কৃতবিদ্য, বিত্তশালী, পিতৃভক্ত পুত্রকে উত্তমরূপেই চিনি। তাঁর শত কাতর অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি পুত্রের গৃহে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে রাজি হননি। আমার আশা ছিল, আমি তাঁর কেউ নই, তিনি জানতেন যে আমি ধর্মে, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসী একটি আস্ত জড়ভরত হওয়া সত্ত্বেও তাকে অবিচল ভক্তি করি, এবং দাসের মতো সেবা করব; বিশ্বসংসার নিয়ে তার যত রকমের সমালোচনা, ব্যঙ্গবিদ্রূপ আমি সহাস্য বদনে শুনেছি এবং শুনব এবং তর্কযুদ্ধ করার মতো লোকের অভাব হলে আমাকে দিয়েও কিছুটা কাজ চলবে– তিনি জানতেন, আমার জীবন কেটেছে তুলনাত্মক ধর্ম চর্চায়।
তিনি এলেন না সত্য, কিন্তু আমাকে একটি অতিশয় প্রীতিপূর্ণ (তিনি সেন্টিমেন্টের আতিশয্য এতই অপছন্দ করতেন যে, সেফসাইডে থাকার জন্য সেটা বাক্যে, পত্রে সর্বত্র বর্জন করতেন) পত্র লিখে জানালেন, তোমার নিমন্ত্রণ মনে রইল, সময় হলেই আসব।
আমার ক্ষোভ-শোকের অন্ত নেই যে তার সময় আর হল না। মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, আমি কে যে তিনি আমার সেবা গ্রহণ করে আমাকে ধন্য করতেন।
শেষদিন পর্যন্ত, এতসব ঘোরাঘুরির মাঝখানেও সর্বত্র তাকে সঙ্গ দিয়েছেন তাঁর ভ্রাতা শ্ৰীযুক্ত বন্ধুবিহারী। বনবিহারীর অধিকাংশ লেখাই ছাপাখানা পর্যন্ত পৌঁছত না। প্রকাশিত হলে ফাইলে রাখতেন না, নিতান্ত অন্তরঙ্গ বন্ধুকেও বলতেন না, অমুক কাগজে আমার লেখা বেরিয়েছে, পড়ে দেখ। তাঁর পরিপকু যৌবনে কিন্তু তিনি আমাদের মতো বালকদের প্রতি সদয় ছিলেন। সম্পূর্ণ, অসম্পূর্ণ বহু লেখা তিনি সোৎসাহে আমাদের পড়ে শুনিয়েছেন।
এখনও যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শ্রীযুত বন্ধুবিহারী প্রামাণিক নিবন্ধ লিখতে পারবেন। কোন লেখা কোন উপলক্ষে লেখা হয়েছিল, কোন ব্যঙ্গচিত্র আঁকবার সময় কাকে তিনি মনে মনে সামনে দাঁড় করিয়েছিলেন, কীভাবে সমাজের কোন গুপ্ত পাপাচার তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, এর বেশিরভাগই একমাত্র তাঁরই জানার কথা। এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের এত বড় পণ্ডিত, অধ্যাপক ওই বিষয়ে কখনও কিছু লেখেননি এটা কেমন জানি বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয়। আমি নিজে জানি, ছাত্রদের দুই ধরনের ব্যান্ডেজ শিখিয়ে তাদের নাম বলে, দোষগুণ আপন অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ দিয়ে যাচাই করার পর একটা তৃতীয় ব্যান্ডেজ হয়তো শেখালেন। কোনও বুদ্ধিমান ছেলে হয়তো লক্ষ করল এটার নাম তিনি বলেননি; শুধোলে পর বলতেন, ওহ! দ্যাট ওয়ান? ওটা ব্যান্ডেজ আ লা বনবিহারী (তিনি নিজের চেষ্টায় সুন্দর ফরাসি শিখেছিলেন ও উচ্চারণটিও তার চমৎকার ছিল। আমি ফরাসি শিখতে আরম্ভ করেছি জেনে তিনি আমাকে মপাস পড়ে শুনিয়েছিলেন; নতুবা নিতান্ত বাধ্য না হওয়া পর্যন্ত বনবিহারী আপন বৃহৎ-ক্ষুদ্র সর্বকৃতিত্বই লুকিয়ে রাখতেন)।
বনবিহারী সম্বন্ধে প্রামাণিক কিছু লেখা প্রায় অসম্ভব। কারণ প্রায় অসম্ভব শুধুমাত্র তার প্রকাশিত লেখা ও ব্যঙ্গচিত্র জোগাড় করা। বেনামে ছদ্মনামে তো লিখেছেনই, তদুপরি নিজের সৃষ্টির প্রতি তাঁর কোনওপ্রকারের মোহ ছিল না বলে সেগুলোকে তাদের ন্যায্য সম্মান দেবার জন্য তিনি কোনও চেষ্টা তো করতেনই না, উল্টো নিতান্ত অজানা অচেনা কাগজে প্রায়ই বাছাই বাছাই লেখা ছাপিয়ে দিতেন। এবং আমার জানতে সত্যই ইচ্ছে করে, তিনি তার লেখার জন্যে কখনও কোনও দক্ষিণা পেয়েছেন কি না।
উপস্থিত আমি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয়ের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ নিবেদন করছি; যদি কোনওদিন তাঁর প্রকাশিত রচনা ও ছবির দশমাংশের এক অংশও জোগাড় করতে পারি তবে তার জীবন-দর্শন সম্বন্ধেও কিছু পেশ করার ভরসা রাখি। অথবা হয়তো তখন দেখব, তাঁর জীবন-দর্শন ছিল যে, মানুষের পক্ষে কোনও প্রকারের শাশ্বত জীবনদর্শনে পৌঁছনো সম্পূর্ণ অসম্ভব, কারণ শাশ্বত বলে কোনও বস্তু, ধারণা বা আদর্শ এ-সংসারে আদপেই নেই।
ভ্যানিটি অব ভ্যানিটিজ অল ইজ ভ্যানিটি বাইবেলের এই আপ্তবাক্য তার মুখ দিয়ে বলাতে আমার বাধছে, কারণ নাটকীয় ভঙ্গিতে কোনও জিনিসই প্রকাশ করাতে তাঁর ঘোর আপত্তি। কারণ এসব ভঙ্গি, স্টাইল, পোজ থেকে উদ্ভূত হয় ধর্মগুরুর দঙ্গল এবং বনবিহারীর সুদৃঢ় ধারণা ছিল যে তাঁদের সম্বন্ধে আমরা যত কম শুনতে পাই ততই ভালো। বলার মতো বিশেষ কিছু তো নেই–হয়তো বলতেন বনবিহারী– তা হলে বলতে গিয়ে অত ধানাইপানাই কেন?
বৃষের মতো স্কন্ধ, আজানুলম্বিত বাহু– এসব শাস্ত্রসম্মত লক্ষণ দিয়ে বিচার করলে বনবিহারী নিশ্চয়ই সুপুরুষের পর্যায়ে পড়তেন না, তৎসত্ত্বেও বলি, বনবিহারীর মতো অসাধারণ বুদ্ধিদীপ্ত, তেজন সুপুরুষ আমি দেশ-বিদেশে অতি অল্পই দেখেছি। বাঙালি ফর্সা রঙ পছন্দ করে, কিন্তু বনবিহারীর গৌরবর্ণ আমি অন্য কোনও বাঙালির চর্মে দেখিনি। বলা বাহুল্য যে, সে বর্ণ ইংরেজের ধবলকুষ্ঠ শ্বেত নয়। গৌর হয়েও সে বর্ণে ছিল কৃষ্ণের স্নিগ্ধতা। তপ্তকাঞ্চন তো সে নয়ই, চাঁদের অমিয়াসনে চন্দন বাটিয়াও সে বর্ণ মাজা হয়নি। নদীয়ার গোসাঁইকে আমি দেখিনি, কিন্তু তাঁকে কল্পনায় দেখতে গেলে তার অঙ্গে আমি বনবিহারীর বর্ণ চাপাই। তার চুল ছিল কটা। আমি একদিন তাকে বলেছিলুম, ঋগ্বেদে না কোথায় যেন অগ্নির দাড়িকে রক্তবর্ণ বলা হয়েছে; আপনি দাড়ি রাখলে সেটা ক্রমে ক্রমে রক্তবর্ণ ধারণ করবে। আমার সত্যই মনে হত কেমন যেন এক অলৌকিক প্রক্রিয়ায় কী যেন এক অ্যাটাভিজমের ফলে তিন হাজার বৎসর পর আর্য ঋষি গৌড়দ্বিজের গৃহে আবির্ভাব হয়েছেন। বনবিহারী তার স্বভাবসিদ্ধ তর্কজাল বিস্তার করে পর্যায়ক্রমে, অপ্রমত্ত চিত্তে যে-সিদ্ধান্তটি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন তার অর্থ : যারা বলে বাঙালির গায়ে কিঞ্চিৎ আর্যরক্ত আছে এটা তাদের ভ্রম– যারা বলে বাঙালি পরিপূর্ণ আর্য তাদের ভ্রমের চেয়েও মারাত্মক দুষ্টবুদ্ধিজাত ভ্রম।
ওই সময়ে আমি রেনার খ্রিস্ট-জীবনী পড়ি অধ্যাপক হিড়জিভাই মরিসের কাছে। প্রথম অধ্যায়েই তিনি লিখেছেন যে তোক মানুষে মানুষে পার্থক্য ঘোচাবার জন্য সর্বাধিক প্রচেষ্টা দিয়েছেন (অর্থাৎ খ্রিস্ট) তাঁর ধমনীতে কোন্ জাতের রক্ত প্রবাহিত সে অনুসন্ধান করতে যাওয়া অনুচিত। বনবিহারী সমস্ত জীবন ধরে বিস্তর অক্লান্ত জিহাদ লড়েছেন, কিন্তু বর্ণবৈষম্য চোখে পড়লেই তিনি নিষ্কাশিত করতেন শাণিততম তরবারি। এস্থলে বলে রাখা ভালো, বনবিহারী তাঁর জিহাদ চালাতেন হৃদয়হীন যুযুধানের মতো। তাই সত্যের অপলাপ না করে অনায়াসে বলতে পারি, তার মতো মিলিটেন্ট নাস্তিক এদেশে তো কখনওই জন্মায়নি, বিদেশেও নিশ্চয়ই মুষ্টিমেয়। পিসফুল কো-এগৃজিস্টেন নীতিটি তিনি আদপেই বরদাস্ত করতে পারতেন না। তিনি ছিলেন হাসপাতালের ভিতরে-বাইরে সর্বত্রই, এবং টুয়েন্টি ফোর আওয়ার্স ডিউটির সার্জন। তাঁর বক্তব্য, তোমার পায়ে হয়েছে গ্যাঙরিন, সেটা আমি কেটে ফেলে দেব। গ্যারিনের সঙ্গে আবার পিসফুল কো-এগৃজিস্টেনস্ কী? কিন্তু পাঠক ভুলে ক্ষণতরেও ভাববেন না, বনবিহারী অসহিষ্ণু ছিলেন। এর চেয়ে বৃহত্তর, হীনতর মিথ্যা ভাষণ কিছুই হতে পারে না। তুমি আস্তিক। তোমার মস্তিষ্ক থেকে আমি সেই অংশ ছুরি দিয়ে কেটে ফেলব। কিন্তু তোমার প্রতি আমি অসহিষ্ণু হব কেন? বস্তুত চিকিত্সক বলে আমার সহিষ্ণুতা অনেক বেশি। তোমার পরিচিত কারও সিফিলিস হলে তুমি শুধু সিফিলিস না, সেই লোকটিকেও বর্জন কর। আমি সিফিলিস দূরীভূত করি, কিন্তু সে হতভাগ্যকে তো দূর দূর করে দূরীভূত করার চিন্তা আমার স্বপ্নেও ঠাই দিই না। প্লেগ এলে তুমি এ শহরের নাগরিকদের বিষবৎ বিবেচনা করে তাদের বর্জন কর; আমি তা করিনে। এবং আমি ব্যক্তিগতভাবে শপথ করতে রাজি আছি এটা তার বাগাস্কালন নয়। কাব্যে আমরা বাক্ ও অর্থের সমন্বয় অনুসন্ধান করি, জীবনে করি বাক ও কর্মের। এ দুটির সমন্বয় বনবিহারীতে প্রকৃতিগত ছিল। বলতে যাচ্ছিলুম বিধিদত্ত, কিন্তু তার আত্মাকে ক্ষুব্ধ করতে চাইনে। আবার ভুল করলুম, তিনি আত্মাকে বিশ্বাস করতেন না, কাজেই হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতোই তাঁর আত্মাকে নিপীড়িত করার সম্ভাবনা!
বনবিহারী তাঁর বাল্যবয়সের অধিকাংশটা কাটান তাঁর মাতামহের সঙ্গে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি তাঁর নাম ভুলে গিয়েছি কিন্তু সেটা বের করা কঠিন হবে না। এই মাতামহটি ছিলেন গত শতাব্দীর ধনুর্ধর, অপরাজিত দার্শনিক এবং নৈয়ায়িক। যে দ্বিজেন্দ্রনাথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্য উভয় দর্শনে ছিলেন সে যুগের চূড়ামণি, তিনি ছিলেন তাঁর নিত্যালাপী সখা। যে দ্বিজেন্দ্রনাথের গৃহে বঙ্কিমাদি মনীষীগণ আসতেন তত্ত্বালোচনার জন্য সেই দ্বিজেন্দ্রনাথ গিয়েছেন দিনের পর দিন এই নৈয়ায়িকের অপরিসর পথের ক্ষুদ্রতর গৃহে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ছিলেন এমনই আপন-ভোলা সাদা দিলের মানুষ যে তর্কে বিরক্তির সঞ্চার হলে তার কণ্ঠ তপ্ততর ও উচ্চতর হতে আরম্ভ করত– বনবিহারীর মাতামহ এ তত্ত্ব জানতেন বলে সেটা আদৌ গায়ে না মেখে পূর্বের চেয়ে ক্ষীণতর কণ্ঠে মোক্ষমতর যুক্তি পেশ করতেন। খাওয়ার বেলা গড়িয়ে যায়–দ্বিজেন্দ্রনাথ সে সম্বন্ধে বেহুঁশ। শেষটা বেলা প্রায় তিনটায় উত্তেজিত হয়ে আসন ত্যাগ করে বলতেন, ঝকমারি, ঝকমারি, এসব লোকের সঙ্গে তর্ক করা; আমি চললুম এবং এই আমার শেষ আসা। বনবিহারীর মাতামহ ক্ষীণকণ্ঠে বলতেন, গিন্নি পুঁইচচ্চড়ি বেঁধেছিল। অট্টহাস্য করে দ্বিজেন্দ্রনাথ টেনে টেনে বলতেন, সেটা আগে বললেই হত, আগে কইলেই হত। তার পর বারান্দায় প্রতীক্ষমাণ তাঁর গার্জেনকে বলতেন (মহর্ষিদেব এই আপন-ভোলা যুবরাজের জন্য একটি তদারকদার নিযুক্ত করে রেখেছিলেন), যাও, বাড়ি থেকে দাঁত নিয়ে এসোগে। শুধু খাবার সময়ই তিনি বাঁধানো দাঁত ব্যবহার করতেন। আমার ভাবতে বড় কৌতুক বোধ হয় যে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠতম দৌহিত্র বাড়ির কোর্মা-কালিয়া ছেড়ে অনাড়ম্বর নৈয়ায়িকের অপরিসর বারান্দায় পিঁড়িতে বসে পুইচচ্চড়ি চিবোতে চিবোতে উচ্চকণ্ঠে পাড়া সচকিত করে তার অকৃপণ প্রশস্তি গেয়ে চলেছেন।
পরদিন নাউ-চিঙড়ি! নাউ–লাউ না!
এ ধরনের একাধিক বিচিত্র বিষয় আমি ছেলেবেলা থেকেই শুনে আসছি প্রাগুক্ত বিনোদবিহারী মহাশয়ের কাছ থেকে।
দ্বিজেন্দ্রনাথ তাঁর সুচিন্তিত প্রবন্ধরাজিতে মাত্র দুজন দার্শনিক পণ্ডিতের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে সপ্রশংস চিত্তে উল্লেখ করেছেন যারা দার্শনিক ও তত্ত্ববিদের গুরুভার কর্তব্য আপন আপন স্বন্ধে অনায়াসে তুলে নিতে পারেন; এদের একজন পুইচচ্চড়ি-রসিক দার্শনিক বনবিহারীর মাতামহ। এবং তার সম্বন্ধে বলি, সে যুগে পিরিলি ঠাকুররা অন্যান্য ব্রাহ্মণদের কাছে অপাঙক্তেয় ছিলেন।
বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি, বনবিহারী বাল্য বয়সে অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিলেন। মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবস্থায়ও সূর্যোদয় থেকে প্রারম্ভ পূজা-অর্চনা শেষ করতে করতে কোনও কোনও দিন ক্লাসের সময় পেরিয়ে যেত। এটাতে আমার সামান্য বিস্ময় লাগে, কারণ আমি যে কয়টি প্রাচীনপন্থী নৈয়ায়িককে চিনি তাঁদের সকলেই পূজা-অর্চনা সম্বন্ধে ঈষৎ উদাসীন ছিলেন। আমার আপন গুরু পথে যেতে যেতে বারোয়ারি সরস্বতী প্রতিমা দেখে। নাসিকা কুঞ্চিত করে বলেছিলেন, ন দেবায়, ন ধর্মায়। অর্থাৎ হিন্দুশাস্ত্রে (অবশ্য তিনি স্মৃতি জানতেন অত্যল্পই এবং সে জন্য তার কণামাত্র ক্ষোভও ছিল না) এরকম পুজোর কোনও ব্যবস্থা নেই, বৌদ্ধধর্মে (ন ধর্মায়-এর ধর্ম এস্থলে ধর্মং শরণং গচ্ছামি থেকে নেওয়া) তো থাকার কথাই নয়। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সরস্বতীর যে কুখ্যাতি (হয়তো অমূলক) আছে সেটা তার স্মরণে আসত। তা সে যাক। কারণ আমার ধর্মের সুফিদের ও খ্রিস্টান মিস্টিকদের ভিতরও ক্রিয়াকর্মের প্রতি কিঞ্চিৎ অনাসক্তি লুক্কায়িত রয়েছে।
অকস্মাৎ একদিন বনবিহারী নাস্তিকরূপে সমাজে আত্মপ্রকাশ করলেন ও শুধু শাস্ত্রীয় ক্রিয়াকর্ম (রিচুয়েল) নয়, শঙ্করাচার্যের নিষ্ঠুণ ব্ৰহ্ম থেকে হাঁচি টিকটিকির বিরুদ্ধে তীব্র কর্কশ কণ্ঠে মারমুখো জিহাদ ঘোষণা করলেন। খ্রিস্টান মিশনারি পর্যন্ত তাঁর বিশ্বাসের দৃঢ়তা, উদ্দীপনা এবং যুদ্ধংদেহি মনোভাব দেখলে বিস্ময়ের সঙ্গে পরাজয় স্বীকার করত। এই যে সামান্য আমি, আমার বয়স তখন কত হবে? ষোলগোছ– আমাকে পর্যন্ত প্রথম দর্শনের পাঁচ মিনিটের ভিতর, কলার অভাবে কুর্তার গলার মুরি ধরে শুধোলেন, তুমি ঈশ্বর মানো?
আমি ভীত কণ্ঠে বললুম, আজ্ঞে আমার বিশ্বাস দৃঢ় নয়, অবিশ্বাসও দৃঢ় নয়। আমি তখন জানতুম না, এই উত্তরই চার দশক পরে কলকাতার মডার্ন মহিলাদের ভিতর ফ্যাশন হয়ে দাঁড়াবে।
তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিশ্বাস দৃঢ়ই হোক, আর শিথিলই হোক, সেইটে কিসের উপর স্থাপিত আমাকে বুঝিয়ে বল।
কী যুক্তি দেব আমি? যেটাই পেশ করি, সেটাই বুমেরাঙের মতো ফিরে আসে ফের আমারই গলায়। ইতোমধ্যে আমার জন্য উত্তম মমলেট, ঘোলের শরবত এসেছে–দুপুর অবধি তর্ক চালালে অবশ্যই পুঁইচচ্চড়ি আসত!
আমি রণেভঙ্গ দিতে চাইলেও তিনি ছাড়েন না। আমি যে ধর্মের অধর্ম পথে চলেছি সেইটে তিনি সপ্রমাণ করতে চান, সর্বদৃষ্টিকোণ থেকে, সর্বদৃষ্টিবিন্দু থেকে। এবং আমার সবচেয়ে বিস্ময় বোধ হল যে, আমি যে কজন ইউরোপীয় নাস্তিক দার্শনিকের নাম জানতুম– অবশ্য অত্যন্ত ভাসা-ভাসাভাবে তাঁদের কাছ থেকে বনবিহারী ঈশ্বরম্ন ধর্মগ্ন যুক্তি আহরণ করলেন না। বিস্তর তর্কজাল বিস্তৃত করার পর, মাঝে মাঝে তিনি সেগুলো সাম্-আপ করতেন, এ-দেশি পরিভাষায় সূত্ররূপে প্রকাশ করতেন সংস্কৃত শ্লোক উদ্ধৃত করে! এই প্রথম আমার গোচরে এল যে, আর্যাবর্তের মতো ধর্মাবর্তের দেশেও অসংখ্য নাস্তিক প্রচলিত ধর্মমতের বিরুদ্ধে বহুযুগ পূর্বেই বিদ্রোহ ঘোষণা করে গিয়েছেন।
সেদিন আমি বড়ই উপকৃত হয়েছিলুম। ঈশ্বরবিশ্বাসে যেসব বাতিল যুক্তি আছে সেগুলো থেকে মুক্ত হয়ে আমি ঈশ্বর সন্ধানে সত্য যুক্তি ও নিজস্ব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের কথা চিন্তা করলুম। কিন্তু আমার কথা থাক।
পাঠক, আপনি মোটেই ভাববেন না, বনবিহারীর প্রধান সংগ্রাম ছিল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে। তাঁর সংগ্রাম ছিল জড়তা, কুসংস্কার, ধর্মের নামে পাপাচার, সামাজিক অনাচার, তথাকথিত অপরাধীজনের প্রতি অসহিষ্ণুতা, যাজক সম্প্রদায়ের শোষণ, চিন্তা না করে বাঁধা পথে চলার বদঅভ্যাস, মহরমের তাজিয়ার সামনে কুমড়ো-গড়াগড়ি, যৌনসম্পর্কের ওপর তথাকথিত শালীনতার পর্দা টেনে আড়ালে আড়ালে কুমারী ও বিধবার সর্বনাশ, অশিক্ষিত ব্রাহ্মণের অকারণ দম্ভ, অব্রাহ্মণের অহেতুক দাস্যমনোবৃত্তি, তথাকথিত সত্যরক্ষার্থে সত্য গোপন, স্বার্থান্বেষণে বিদেশির পদলেহন ও অন্ধানুকরণ, কিন্তু যেখানে সে মহৎ সেটা প্রচলিত ধর্মের দোহাই দিয়ে বর্জন, বসরের পর বৎসর, প্রতি বৎসর রুগণা অর্ধমৃতা স্ত্রীকে গর্ভদান করে তার কাতর রোদন অনুনয়-বিনয় পদদলিত করে তাকে অবশ্যম্ভাবী অকালমৃত্যুর দিকে বিতাড়ন এবং সঙ্গে সঙ্গে সমাজে, ধর্মসভায় সচ্চরিত্র সজ্জন খ্যাতি অর্জন (বলা বাহুল্য চিকিৎসক হিসেবে ঠিক এই ট্র্যাজেডি তার সামনে এসেছে বহু, বহুবার), গণিকালয় থেকে একাধিকবার বিবিধ মারাত্মক ব্যাধি আহরণ করে নিরপরাধ অর্ধাঙ্গিনীর শিরায় শিরায় সেই বিষ সংক্রামণ, একবার একটিমাত্র ভুল করার জন্য অনুতপ্তা রমণীকে ব্ল্যাকমেল করে তাকে পুনঃপুন ব্যভিচার করাতে বাধ্যকরণ–
হে ভগবান! এ যে অফুরন্ত ফর্দ! কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, বনবিহারীর সিকি পরিমাণ প্রকাশিত– অপ্রকাশিতের হিসাব নিচ্ছিনে এবং অধিকাংশ লেখাই যে তিনি ছিঁড়ে ফেলতেন সে-ও বাদ দিচ্ছি– গদ্য পদ্য ব্যঙ্গচিত্র সগ্রহ করে কেউ যদি তার জিহাদের লক্ষ্য বিষয়গুলো সংকলন করেন তবে এ-স্থলে আমার প্রদত্ত নির্ঘণ্টের চেয়ে বহুগুণে বৃহত্তর ও কঠোরতর হবে।
কী নিদারুণ ব্যঙ্গ, বিতৃষ্ণা ও ঘৃণার সঙ্গে তিনি অন্যায় আচরণ, ভণ্ড কাপুরুষতাকে আক্রমণ করতেন সে তার গুণগ্রাহী পাঠকমাত্রই জানেন। ভাষার শাণিত তরবারি তার হাতে বিদ্যুত্বহ্নি বিচ্ছুরণ করত এবং এই মরমিয়া মোলায়েম আ মরি বাঙলা ভাষাও যে কতখানি বহ্নিগর্ভা সে তত্ত্ব উদঘাটিত হত বনবিহারীর অদম্য, নিঃশঙ্ক আঘাতের পর আঘাত থেকে। প্রত্যেক শব্দ প্রত্যেকটি বর্ণ বিশুদ্ধ যুক্তির ওপর দণ্ডায়মান। শাস্ত্র ভাঙতে যখন যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন তখন শাস্ত্রের দোহাইয়ের তো কথাই ওঠে না, তিনি বিজ্ঞানের দোহাইও দিতেন না। কোনওকিছুই অভ্রান্ত নয়, কোনও সত্যই শাশ্বত নয়; অতএব প্রত্যেকটি সমস্যা নতুন করে যাচাই করে দেখতে হবে, এবং এই সাধনা চলবে আমৃত্যু।
ঈশ্বর-বিশ্বাসকে যে তিনি গোড়াতেই আক্রমণ করেছিলেন তার অর্থ এই নয় যে, তিনি এই বিশ্বাস by itself, per se অন্যান্য সংস্কারের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। তার ধারণা জন্মেছিল এবং সেটা বিস্তর অনুসন্ধান ও গবেষণা করার পর, যে- এই বাঙলা দেশে যতপ্রকারের সামাজিক, অর্থনৈতিক অন্যায় অবিচার হচ্ছে, যা কিছু নারীর ন্যায্য অধিকার ও পরিপূর্ণ বিকাশের অন্তরায় হচ্ছে আর ধর্মের নামে অনাচার শোষণের তো কথাই নেই– এ সবকিছু হচ্ছে ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে।
যেসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে বনবিহারী লড়াই দিতেন তাদের বিরুদ্ধে কি অন্য বাঙালি লড়েনি? নিশ্চয়ই লড়েছে। বর্ণবৈষম্য, আহারে-বিহারে স্ব স্ব সংকীর্ণ গণ্ডি নির্মাণ, ধর্মের নামে অধর্মচর্চা শাস্ত্রাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করে তাদের কুসংস্কারে নিমজ্জিত রাখা, বিধবা, স্বামী-পরিত্যক্তাকে সুস্থ স্বাভাবিক জীবন থেকে বঞ্চিত করা, ধর্মত্যাগীকে পুনরায় স্বধর্মে প্রত্যাবর্তন করার পথ চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া ইত্যাকার বহু বহু সংস্কার আচার দূর করার জন্য চৈতন্য সংগ্রাম দেন ও সর্বজনীন বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করেন। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ এঁরা এবং আরও অনেকে মূঢ়তা, কুসংস্কার ও একাধিক পাপাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন। এঁদের তুলনায় বনবিহারীকে চেনে কে?
কারণ বনবিহারী অন্য পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।
প্রাগুক্ত সকলেই দেশ-দশকে পাপচিন্তা-পাপাচার থেকে মুক্ত করার জন্য শাস্ত্রের অর্থাৎ ধর্মের শরণ নিয়েছেন। বনবিহারী মানবিকতার শরণ নেন। প্রচলিত ধর্মও তাঁর শত্রু। একমাত্র ধর্মের moral, ethical যেটুকু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ধোপে টেকে সেইটুকু গ্রহণ করা যেতে পারে।
বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একখানা চিঠিতে যা লেখেন তার নির্যাস ছিল এই, শাস্ত্র মেনে হিন্দু তার সামাজিক জীবনযাপন করে না। সে মানে লোকাঁচার, দেশাচার। বিদ্যাসাগর যদি সর্বশাস্ত্র দিয়েও দ্ব্যর্থহীন নিরঙ্কুশ সপ্রমাণ করেন যে, বিধবা-বিবাহ শাস্ত্রসম্মত, শাস্ত্ৰসিদ্ধ তবু হিন্দু সে-মীমাংসা গ্রাহ্য না করে আপন লোকাঁচার দেশাচার আগেরই মতো মেনে নিয়ে বিধবার বিয়ে দেবে না। অতএব বিদ্যাসাগরের উচিত যুক্তি ন্যায় ও মানবিকতার (এই ধরনেরই কিছু, আমার সঠিক মনে নেই, তবে মোদ্দা– Reason-এর ওপর নির্ভর করা, শাস্ত্রের ওপর না করে) ওপর নির্ভর করা।
বিদ্যাসাগর উত্তরে কী লিখেছিলেন, আদৌ উত্তর দিয়েছিলেন কি না সেটা বহু অনুসন্ধান করেও আমি খুঁজে পাইনি। কিন্তু তিনি যে বঙ্কিমের উপদেশ গ্রহণ করেননি, সেকথা কারও অবিদিত নেই। হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, শাস্ত্রের সাহায্যে হয়তো-বা কিছু কার্যোদ্ধার হবে, যুক্তিতর্ক দিয়ে কিছুই হবে না। বিদ্যাসাগর আপন দেশবাসীকে বিলক্ষণ চিনতেন।
অতএব প্রাগুক্ত রামমোহনাদি সকলেই লুথার জাতীয় সমাজ ও ধর্মসংস্কারক। যে বাইবেল পোপ মানেন, খ্রিস্টান মাত্রই মানে সেই বাইবেল দিয়েই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত করলেন যে, প্রত্যেক মানুষেরই বিধিদত্ত অধিকার আছে– আপন বুদ্ধি অনুযায়ী বাইবেল থেকে বাণী গ্রহণ করে আপন জীবন চালনা করার; চিরন্তন, অভ্রান্ত কোনও পোপকে স্বীকার করার প্রয়োজন নেই। তলস্তয়, গাঁধী এই সম্প্রদায়ের।
ভলতেয়ার এ পথ স্বীকার করেননি। তিনি নির্ভর করেছিলেন যুক্তি (রিজন), শুভবুদ্ধি (মোটামুটি কমনসেন্স), মানবতা ও ইতিহাসের শিক্ষার ওপর। তাঁর কমনসেন্স ও ইতিহাসের ওপর বরাত মানার একটা উদাহরণ দিই। দক্ষিণ ভারতের হিন্দুরা ধর্মান্ধ হয়ে যে প্রথম খ্রিস্টান মিশনারি সিন টমাসকে আক্রমণ করে হত্যা করেছিল বা পশ্চাদ্ধাবিত হলে পর তিনি গুহাগহ্বরে বিলীন হয়ে যান, সেই কিংবদন্তি অস্বীকার করে আলোচনা করতে গিয়ে ব্যঙ্গের সুরে ভলতেয়ার বলছেন, যে হিন্দুর পরধর্মে সহিষ্ণুতা সম্বন্ধে আমরা বহুকাল ধরে বহু পর্যটকের কাছ থেকে শুনে আসছি, সেইটে হঠাৎ অবিশ্বাস করতে কাণ্ডজ্ঞানে (কমনসেনসে) বাধে। এদেশের বনবিহারী ভলতেয়ার কিন্তু তিনি ভলতেয়ারের শিষ্য নন।
তবে জনসাধারণ বনবিহারীকে চেনে না কেন? তার সর্বপ্রধান কারণ, বনবিহারী নিজেকে কখনও সংস্কারক, যুগান্তকারী মহাপুরুষরূপে দেখেননি। হয়তো তিনি ভাবতেন, উচ্চাসনে দণ্ডায়মান হয়ে অনলবর্ষী ভাষণের সাহায্যে জনসাধারণকে উত্তেজিত করে, কিংবা ভাবালুতার বন্যায় দেশকে ভাসিয়ে দিয়ে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সুদৃঢ় পরিবর্তন আনা যায় না। কিংবা হয়তো স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিক বিনয়বশত (সামান্য পরিচয়ের নসিকে লোক ভাবত, তাঁর মতো দম্ভী গর্বী ত্রিসংসারে বিরল– বিশেষত লোকটা যখন স্বয়ং ঈশ্বরকে তার যুগযুগাধিকৃত স্বর্গীয় সিংহাসন থেকে সরাতে চায়!) তিনি পেডেস্টেলে আরোহণ করতে চাইতেন না, কিংবা হয়তো তিনি নৈরাশ্যবাদী ছিলেন। তা সে যা-হোক, আমরা যে তার মতো কিংবা তার চেয়েও শক্তিশালী লোকের জন্য এখনও প্রস্তুত হইনি সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ।
কিন্তু কেন?
বনবিহারী তো এমন কিছু নতুন কথা বলেননি যা ভারতে কেউ কখনও বলেনি। স্থির হয়ে একটু ভাবলেই ধরা পড়বে ভারতবর্ষের চিন্তা-জগৎ (ধর্ম-শাস্ত্ৰ-নীতি-আচার-ঐতিহ্য-কলা জ্ঞানবিজ্ঞান) কী দিয়ে গড়া।
১। সনাতন হিন্দুধর্ম ২। বৌদ্ধধর্ম ৩। জৈনধর্ম ৪। দর্শনের মধ্যে নিরীশ্বর সাংখ্য ৫। চার্বাক প্রভৃতি লোকায়ত মতবাদ।
প্রথমটি বাদ দিলে বাকি চারটি চিন্তাধারাতেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বার বার সাবধান-বাণী প্রচারিত হয়েছে, তোমার সুখ-শান্তি, তোমার পরমাগতি সম্পূর্ণ তোমারই হাতে; দৃশ্য এবং অদৃশ্য কোনও লোকেই এমন কোনও অলৌকিক শক্তি নেই যে তোমাকে কোনওপ্রকারে কণামাত্র সাহায্য করতে পারে। এই চিন্তাধারা আদৌ অর্বাচীন নয়। বৈদিক যুগে দেবদেবীদের উদ্দেশে যখন যাগযজ্ঞহোমপশুবলি সর্বত্র স্বীকৃত, ঋষিকবিগণ যখন তাঁদের উদ্দেশে সবিস্ময়ে অপৌরুষেয় মন্ত্র উচ্চারণ করছেন, তখন তার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পাচ্ছি আরেকটি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠ, আরেক সত্যান্বেষী প্রশ্ন জিগ্যেস করছেন– ধন্য হোক সে প্রশ্ন, ধন্য হোক তার জন্মলগ্ন– তা হলে কোন দেবতাকে আমি স্বীকার করব? এই প্রশ্ন থেকেই আরম্ভ হল, চরম সত্যের আলটিমেট রিয়েলিটির অনুসন্ধান। এই প্রশ্নের দুটি উত্তর পাওয়া যাচ্ছে পরবর্তী আরণ্যক-উপনিষদের যুগে বেদান্তের মূল সূত্র সবকিছুই ব্ৰহ্ম, এই তিন ভুবন আনন্দময় ব্রহ্ম থেকে উদ্ভূত। দ্বিতীয় সম্পূর্ণ বিপরীত উত্তর জন্ম নেয় ওই সময়েই, হয়তো তার পূর্বেই, সবল কণ্ঠে ধ্বনিত হয় লোকায়ত মতবাদে এবং তারও পরে তীর্থঙ্করদের কণ্ঠে, বুদ্ধদেবের কণ্ঠে– দেবদেবীতে পরিপূর্ণ অনাস্থা প্রকাশ করে মানুষকে সৃষ্টির কেন্দ্ররূপে স্বীকার করা। এরই চরম বিকৃতরূপ– চার্বাকের মতবাদ, যে মতবাদ নৈতিক দায়িত্বে পর্যন্ত বিশ্বাস করে না।
বৌদ্ধধর্ম এ-দেশ থেকে লোপ পেয়েছে, কিন্তু সে মতবাদ সম্পূর্ণ বহিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। তর্কযুদ্ধে পরাজিত কোনও এক সাংখ্যতীর্থ বোধহয় বৌদ্ধবৈরী শঙ্করাচার্য সম্বন্ধে বক্রোক্তি করেছিলেন, বৌদ্ধদর্শনের সঙ্গে সে এতখানি সন্ধি করেছে যে, সে মতবাদ আত্মসাৎ করতে তার বাধেনি, তাকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলব না, তবে কী বলব?
আর নিরীশ্বর জৈনরা তো, এখনও ভারতবর্ষে বাস করেন।
নিরীশ্বর সাংখ্যের চর্চা করেন এখনও বহু পণ্ডিত : যাঁদের মতে ঈশ্বর প্রমাণাভাবে অসিদ্ধ।
নৈয়ায়িকরা কোন পন্থায়?
এবং এদেশের সহজিয়ারা সৃষ্টিকেন্দ্র করেছেন মানুষকে : সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
পূর্বেই বলেছি, বনবিহারী ভলতেয়ারের শিষ্য নন। তিনি ভলতেয়ারের শিষ্য এ-কথা তাঁর সামনে বললে তিনি নিশ্চয়ই তেড়ে আসতেন। অবশ্যই বলতেন, ভলতেয়ার যদি দেখেন যে তার মতবাদ আমার মতবাদের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে তবে তিনি গর্ব অনুভব করতে পারেন; আমার তাতে কী? আবার তাঁকে যদি বলা হত, তিনি ঐতিহ্যগত বৌদ্ধ-জৈন-সাংখ্য দর্শন প্রচার করছেন তবে তিনি নিশ্চয়ই আরও মারমুখো হতেন। নিশ্চয়ই বলতেন, চুলোয় যাক্ (জাহান্নমে যাক, নিশ্চয়ই বলতেন না, কারণ যে জায়গা নেই, সেখানে কোনও মতবাদকে পাঠিয়ে বনবিহারী অবশ্যই সন্তুষ্ট হতেন না!) তোমার সাংখ্য জৈন মতবাদ; পিছন পানে তাকাও কেন? নিজের বুদ্ধি, নিজের যুক্তি, নিজের রেশনালিটির ওপর নির্ভর করতে পার না? কপিল-জীনের ঠ্যাকনা ছাড়া বুঝি দাঁড়ানো যায় না? তুমি আছ, আমি আছি– ব্যস। আমরা বের করে নেব ন্যায় আচরণ কী? আর রাগ কোরও না, আমি আমারটা বহুপূর্বেই একাই বের করে নিয়েছি।
ডন কুইকসটের সঙ্গে বনবিহারীর মাত্র একটা বিষয়ে পার্থক্য। বিস্তর মধ্যযুগীয় রোমান্টিক কাহিনী পড়ে পড়ে ডনের মাথা গরম হয়ে যায়। তিনি ভাবলেন তিনি সে যুগের শিভালরাস্ নাইটদের একজন। ব্যস, আর যাবে কোথায়। দিগ্বিদিক-জ্ঞানশূন্য হয়ে একাকী, সম্পূর্ণ একা তিনি খোলা তলওয়ার হাতে আক্রমণ করলেন জলযন্ত্রকে (উইন্ডমিলকে)।
তারও বহু পরে যিনি এ-যুগের সর্বশেষ নাটক বলে নিজেকে প্রচার করেন তিনি ফিল্ড মার্শাল হেরমান গ্যেরি নর্নবের্গ মোকদ্দমায়। তাঁর কৃতিত্ব : জর্মনিতে তিনিই সর্বপ্রথম কনট্রেশন ক্যাম্প স্থাপনা করেন (অবশ্য তার বহু পূর্বে ইংরেজ করেছিল বোয়ার-যুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকায়) এবং আইষমানের ইহুদিহননে তার সম্মতি ছিল। নিহত ইহুদিদের ভিতর লক্ষাধিক কুমারী কন্যাও ছিল।
বনবিহারী কপিল-জীন-চার্বাক পড়ে পড়ে ডনের মতো মাথা গরম করেননি। ধীরস্থির মনে চিন্তা করে, মীমাংসায় পৌঁছে তিনি আক্রমণ করলেন বঙ্গদেশের জগদ্দল জাড্যকে। এখনও তার মাথা কতখানি ঠাণ্ডা সেটা বোঝা যায় এর থেকে যে, তখনও তার ঠোঁটে হাস্য-ব্যঙ্গ-রস– তাঁর নব-প্রকাশিত নাস্তিক্য প্রচারকামী পত্রিকা বেপরোয়ার (বাঙলা দেশে
এ ধরনের কাগজ বোধহয় এই প্রথম আর এই শেষ) প্রথম সংখ্যায় প্রথম war song-এ তিনি বললেন,
টুলবো না কো অনুস্বার আর বিসর্গের
ঐ ছররাতে
কিংবা দেখে টিকির খাড়া সঙ্গীন!
সে পত্রিকায় কী না থাকত? ধর্ম, দর্শন, নীতিশাস্ত্র থেকে আরম্ভ করে সাহিত্য, চিত্র– এস্তেক পদিপিসির মাদুলি, হচি-টিকটিকি। এর পূর্বে তিনি ভারতবর্ষে ব্যঙ্গচিত্রসহ বঙ্গজীবনবৈচিত্র্য তাবলো পদ্ধতিতে প্রকাশ করেছেন : তার একটি ছিল কেরানি– লোলচর্ম অস্থিসার জীর্ণবেশ রুক্ষ-কেশ কেরানির ছবির নিচে ছিল–
চাকরি গেল, চাকরি গেল, চাকরি রাখা
বিষম দায়
ঐ গো, বুঝি নটা বাজে, ওই গো বুঝি
চাকরি যায়।
বিজলি-বাতির ফানুস হেন ঠুনকো
মোদের চাকরি ভাই!
ফট করে সে ফাটে, কিন্তু ফাটার শব্দে
চমকে যাই।
সর্বশেষে কেরানি যেন বৈদ্যগুরু, কবিরাজ, ডাক্তার, মহামান্য শ্ৰীযুত বনবিহারী মুখোপাধ্যায়কেই ব্যঙ্গ করে বলছে (উইথ ও টুইস্টেড আইরিশ স্মাইল)–
ভরা পেটে ছুটতে মানা? চিবিয়ে খাওয়া স্বাস্থ্যকর?
চাকরি আগে বাচাই দাদা, প্রাণ বাঁচানো সে তার পর।
রবীন্দ্রসৃষ্টির সঙ্গে আমি ঈষৎ পরিচিত। রবীন্দ্ররসিকদের রচনা আমি পড়েছি। অধুনা রবীন্দ্ৰায়ণও (অত্যুকৃষ্ট প্রবন্ধ সংকলন, তদুপরি অতুলনীয় সম্পাদন) অধ্যয়ন করেছি। তার পরও বলব, মুক্তকণ্ঠে বলব, বনবিহারীর মতো রবীন্দ্রসৃষ্টির চৌকস সমঝদার আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। তাই আজ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের যেসব বিরুদ্ধ সমালোচনা বেরিয়েছে, তার মধ্যে বনবিহারীর সমালোচনাই সর্বোকৃষ্ট। পক্ষান্তরে রবীন্দ্রনাথের অন্য সমালোচকদের প্রতি তিনি ছিলেন হাড়ে হাড়ে চটা। বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলতেন, রসসৃষ্টির পথে যত সব অবান্তর বস্তু নিয়ে বর্বস্য শক্তিক্ষয়! রবীন্দ্রনাথ নাকি নগ্ন যৌনের অশ্লীল ছবি আঁকেন– তা তিনি আঁকেননি। আর যদি আঁকেনই বা, তাতেই-বা কী? এসব তো সম্পূর্ণ অবান্তর- রসসৃষ্টি হলেই হল! রবীন্দ্রনাথের রূপক নাকি অস্পষ্ট! তা হলে চশমা নাও– ওঁকে দোষ দিচ্ছ কেন?
তার পর বুঝিয়ে বলতেন, দে আর অল বার্কিং আপ দি রং ট্রি–অর্থাৎ বেড়ালটা উঠেছে একটা গাছে, আর কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে অন্য গাছের গোড়ায়।
সত্যেন দত্তকে আজকের দিনে তোক আর স্মরণে আনেন না; অথচ তিনি যখন সবে আসরে নেমেছেন, সেই সময় থেকেই বনবিহারী তার প্রশংসা গেয়েছেন। সেই সত্যেন দত্তই যখন এই শতাব্দীর দ্বিতীয় শতকে মাঝে মাঝে অনুপ্রাস ও ছন্দের ম্যাজিকের (জাগলারি) কেরদানি দেখাতেন, তখন বনবিহারী অতিষ্ঠ হয়ে বেপরোয়াতে অপ্রিয় সমালোচনা করেন। আমরা তখন তাকে বলি, এগুলো নিছক এক্সপেরিমেন্ট জাতীয় জিনিস; আপনি অত সিরিয়াসলি নিচ্ছেন কেন? আরেক টিপ নস্য নিয়ে– এইটাই ছিল তাঁর একমাত্র বদঅভ্যাস, আর ওই করে করে করেছিলেন তাঁর কণ্ঠস্বরের সর্বনাশ বললেন, তা হলে ছাপানো কেন? যে প্রচেষ্টা রসের পর্যায়ে ওঠেনি সেটা প্রকাশ করে বিড়ম্বিত হওয়ার কী প্রয়োজন?
দ্বিজেন্দ্রনাথের পৌত্র, রবীন্দ্রনাথের গানের ভাণ্ডারি দিনেন্দ্রনাথও বলতেন,
শতং বদ
মা লিখো
শতং লিখো
মা ছাপো।
***
আরও বহু স্মৃতি বার বার মনে উদয় হচ্ছে। একদা দুরারোগ্য রোগের অসহ্য যন্ত্রণা থেকে নিষ্কৃতি পাবার পথ তিনি আমাকে দেখিয়ে দেন। রিটায়ার করার বহু পরে তিনি একবার কলকাতায় এসে কী করে খবর পান আমি অসুস্থ। বিশ বছর ধরে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ নেই। তিনি খবর পাঠালেন। সব শুনে বললেন, এ রোগ সারে না– তবু তুমি পরেশ চক্রবর্তীর কাছে যাও। আমি বহু ছেলে পড়িয়েছি– সব ব্ল্যাঙ্কো। ওই একটি ছেলের আক্কেলবুদ্ধি ছিল। বিলেত থেকে ও নিয়ে এসেছে এ টু জেড বিস্তর ডিগ্রি। আমি তার কাছে গেলে সে ডাক্তার বলেন, শুরু এই প্রথম আমাকে একটি রোগী পাঠালেন। কী বলেছেন উনি? এ রোগ সারে না? না, সারে। তিনি আমাকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে দিয়েছিলেন। এক্সপেরিমেন্ট করে করে নয়। প্রথম ওষুধ দিয়েই। কিন্তু সে আরেক কাহিনী। এবং সবচেয়ে সন্তাপের কথা, এই কৃতবিদ্য চিকিৎসক অল্প বয়সে গত হন।
***
৫ জুলাই বনবিহারী পঞ্চভূতে লীন হন।
সাহিত্যিকশ্রেষ্ঠ বনফুল তার সম্বন্ধে দেশ পত্রিকার ১৫ই শ্রাবণ সংখ্যায় অতি অল্প কয়েকটি কথা বলেছেন, কিন্তু হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে, এবং তার প্রত্যেকটি শব্দ যেন আমার বুকের উপর হাতুড়ি পিটছে। আমি এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে যা প্রকাশ করতে সক্ষম হইনি, তিনি অল্প কথাতেই সেটি মূর্তমান করেছেন।
বঙ্গ সাহিত্য-ভাণ্ডারে তাঁর (বনবিহারীর) দান চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে। রাজনৈতিক সামাজিক কোনও অন্যায়ের সঙ্গে কখনও তিনি রফা করেননি। অনবদ্য তীক্ষ্ণ ভঙ্গিতে সে-সবের বিরুদ্ধে সাহিত্যিক প্রতিবাদ তিনি করে গেছেন। সেকালের ভারতবর্ষ, বঙ্গবাণী, শনিবারের চিঠি, বেপরোয়া প্রভৃতি সাময়িক পত্রিকাগুলির পৃষ্ঠায় তাঁর কীর্তি এখনও মণি-মুক্তার মতো ঝলমল করছে। মানুষ হিসেবে তিনি ছিলেন অনমনীয় দুর্বার প্রকৃতির লোক। কখনও কারও অন্যায় সহ্য করতে পারেননি। সুতরাং কারও সঙ্গে তিনি মানিয়ে চলতে পারেননি, কারও সঙ্গে তার বনেনি। এজন্যে শেষ জীবনে প্রায় একা একা নিঃসঙ্গ জীবনযাপন করতে হয়েছে তাঁকে। অতিশয় বিচক্ষণ চিকিৎসক ছিলেন। সিভিল সার্জন হয়ে বগুড়া থেকে রিটায়ার করেন।… পৃথিবীতে নিখুঁত মানুষ নেই, নিখুঁত মানুষের সন্ধানেই তাঁর সারা জীবন কেটেছে। কিন্তু কোথাও সে মানুষ পাননি। নিঃসঙ্গ জীবনই কাটাতে হয়েছে তাঁকে। তাঁর একটি ভাই তাঁকে ছাড়েননি। বন্ধুবিহারীই শেষ পর্যন্ত ছিলেন তার সঙ্গে। শেষে তিনি নিজের ঠিকানাও কাউকে জানাতেন না। গত ৫ জুলাই তিনি মারা গেছেন।
বনফুল তো চেনে বনবিহারীকে। আর এই বনবিহারী নাম সার্থক দিয়েছিলেন তার গুরুজন! জনসমাজে বাস করেও তিনি যেন সারাজীবন বনেই বিহার করলেন।
আমার আর মাত্র দুটি কথা বলার আছে।
বনবিহারী যে হিন্দু-সমাজ ও বাঙালির কঠোর সমালোচনা করে গিয়েছেন তার কারণ এই নয় যে, তিনি এই দুটিকেই পৃথিবীর নিকৃষ্টতম বলে মনে করতেন। তিনি নিজেকে প্রফেট বা রিফর্মার বলে মনে করতেন না। কাজেই বিশ্বভুবনের তাবৎ জাড্য দূর করার ভার আপন স্বন্ধে তিনি তুলে নেননি। এমনকি তার হাতের আলোটিও তিনি উঁচু করে তুলে ধরেননি। সে-আলো তাই পড়েছিল মাত্র তার আশপাশের সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, সাহিত্যের ওপর। তারই মলিনতাটুকু তিনি দেখিয়ে গিয়েছেন মাত্র। তবুও আমার মনে হয়েছে, তিনি রবীন্দ্রনাথের জ্যাঠামশাই ও রলাঁর জ্যাঁ ক্রিসতফ-এর সমন্বয় কোনও কোনও ক্ষেত্রে। জ্যাঁ ক্রিসতফ বনবিহারীর অন্যতম প্রিয় পুস্তক (ডাক্তার হয়েও সিরিয়াস ডাক্তাররা সাহিত্যচর্চার সময় পান কম– তিনি সম্পূর্ণ নিজের সাধনায় বিশ্বসাহিত্যের কতখানি আয়ত্ত করেছিলেন সেটা বোঝাবার চেষ্টা করব না)।
আজ তিনি জীবিত নেই, তাই বলবার সাহস পাচ্ছি, তিনি বাঙালিকে ভালোবাসতেন। তাঁর জীবিতাবস্থায় একথা বললে তিনি বোধহয় আর আমার মুখ দর্শন করতেন না। বাঙালি বলতে তিনি হিন্দু বিশেষ করে তথাকথিত নিম্নশ্রেণির হিন্দু-মুসলমান, ইলিয়ট রোড অঞ্চলের অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান, সকলকেই বুঝতেন।
এইবারে আমার শেষ বক্তব্যটি নিবেদন করি। এ কথাটি তার জীবিতাবস্থায় বললে তিনি সুনিশ্চিত রামদা নিয়ে আমার পশ্চাদ্দেশে ধাবমান হতেন।
ইংরেজিতে বলে– মিল্ক অব হিউমেন কাইনেস্।
অনিচ্ছায় বলছি, কিন্তু এস্থলে বলার প্রয়োজন, আমি বিস্তর দেশ-বিদেশ দেখেছি। বহু সমাজসেবী, হাসপাতাল চালক মিশনারি, রেডক্রসের একনিষ্ঠ সেবক কর্মী, সর্বত্যাগী মহাজন, স্তালিনগ্রাদের বিভীষিকাময় রক্তাক্ত রণাঙ্গন-প্রত্যাগত সার্জনকে আমি চিনি। বনবিহারীর হৃদয়ের অতিশয় গোপন কোণে যে ভুবন-জোড়া স্নেহমমতার ভাণ্ডার ছিল– সেরকম তো আর কোথাও দেখলুম না। সেই স্নেহমমতাই তাঁর আপন সুখশান্তি হরণ করেছিল। সেই বেদনাবোধই তাঁকে উত্তেজিত করত খড়গ ধারণ করে অন্যায়, অসত্য, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে।
এই স্নেহমমতা তিনি এমনই সঙ্গোপনে রেখেছিলেন যে, অধিকাংশ লোকই তাঁর কঠোর ভাষা, তীব্র কণ্ঠ, নির্মম ব্যঙ্গ শুনে বিভ্রান্ত হয়েছে। বনবিহারীর সে জন্য কণামাত্র ক্ষোভ ছিল না। তাঁর সহানুভূতি তিনি রাখতেন আরও গোপন করে।
আমরা বোধহয় অত্যন্ত সহিষ্ণু। কিংবা যথেষ্ট ইতিহাস পড়িনি। নইলে সোক্রাতে খ্রিস্টের জন্য একদা যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল বনবিহারীর জন্য সেটা করা হল না কেন?
কিন্তু এই অনুভূতিগত অভিজ্ঞতা গদ্যে প্রকাশ করা যায় না।
বনবিহারীর প্রয়াণ উপলক্ষে বনফুল যে সনেটটি লিখেছেন সেটি উদ্ধৃত করি :
‘বনবিহারী মুখোপাধ্যায়’
পাষাণে আঘাত হানি, অসি তীক্ষ্ণধার চূর্ণ-বিচূর্ণ হল? কঙ্কর কন্টক
জয়ী হল বিক্ষত করিয়া বার বার বলিষ্ঠ পথিক-পদ? ধূর্ত ও বঞ্চক সাধুরে লাঞ্ছিত করি বিজয়-কেতন আস্ফালন করিল আকাশে? অন্ধকার গ্রাসিল কি রবি? না– না– নতি-নিবেদন করি পদে উচ্চকণ্ঠে কহি বারংবার নহে ব্যর্থ, পরাজিত, হে বহ্নি-কমল তমোহন্ত্রী, হে প্রদীপ্ত মশাল-বর্তিকা, অগ্নি তব অনির্বাণ, চির-সমুজ্জ্বল, অনবদ্য অপরূপ ঊর্ধ্বমুখী শিখা। মহাপ্রস্থানের পথে বিগত অর্জুন অস্ত্রাগারে রেখে গেছে শরপূর্ণ তূণ।
.
Leave a Reply