১৩ নভেম্বর ছিল কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ৬১তম জন্মবার্ষিকী। তাঁর উপন্যাস বের হলেই অভিভূত হয়ে পড়তাম। এখন অবশ্য সে সময়টা পার হয়ে এসেছি। কিন্তু এখনো মনে করি, অতিসহজে মানুষের মনের গভীরের কথা জানানোর ভাষা তাঁর মতো সমসাময়িককালে অন্য কোনো কথাসাহিত্যিকের দখলে দেখিনি।
১৩ তারিখ ছিল শুক্রবার। অনুপম প্রকাশনীর মালিক মিলন নাথ আমার বন্ধু মানুষ। তিনি একবার বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ ধানমন্ডিতে ‘দখিন হাওয়া’ নামের একটা বাড়িতে থাকেন। আমিও ধানমন্ডি থাকি। হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। কিন্তু ১৩ তারিখ সকালবেলায় নাস্তা সারার পর একবার ভেবেছি, হুমায়ূন আহমেদের বাসায় গিয়ে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে কেমন হয়! পরে ভাবলাম ব্যাপারটা একটু নাটকীয় হয়ে যাবে। জোর করে আমাকে একটা পরিচয় দিতে হবে, অথবা ভ্যাবলাকান্তের মতো হয়তো অন্য অনেক ভক্তের মতো বসার ঘরে দেয়ালের চিত্রপট দেখে ঝিমাতে হবে। অপরিচিয়ের কারণে এই ঝুঁকিটা না নিয়ে বরঞ্চ যে দাওয়াতটা হাতে আছে, সেটাতেই যাব ঠিক করলাম।
ভারতবর্ষের ওপর লেখা দ্য হোয়াইট মোগলস-এর লেখক উইলিয়াম ডালরিম্পলের নাম বহুদিন থেকে শুনে আসছি। তাঁকে নিমন্ত্রণ করে আবাসিক লেখকের মর্যাদা দিয়ে নিয়ে এসেছেন ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১৩ তারিখ সকালে ছিল ডালরিম্পলের সদ্য প্রকাশিত বই নাইন লাইভস-এর বিক্রির ব্যবস্থা—লেখকের উপস্থিতিতে স্বাক্ষরসহ এবং তাঁর বক্তৃতা।
ঠিক সময়ের আগেই পৌঁছলাম। বড় একটি মিলনায়তন। নতুন তৈরি। কিন্তু সবগুলো সারি এরই মধ্যে ভরে উঠেছে। ঢাকার ইংরেজি-ঘরানার উচ্চসাংস্কৃতিক কাতারের এমন কাউকে দেখলাম না, যিনি সেখানে যাননি। ইংরেজ, ভারতীয় তথা বাংলাদেশি সমীকরণটা আমার মনে তখনই খেলতে শুরু করল। হয়তো এর আগে হুমায়ূন আহমেদকে শুভেচ্ছা জানাতে যাব ভেবেও যে যাইনি, সে জন্য তুলনাটা বেমক্কা আমার অবচেতন মন দখল করে নিল।
ডালরিম্পল মঞ্চে উঠলেন। অত্যন্ত সুদর্শন একজন ইংরেজ-স্কট সন্তান। ছয় ফুটের কাছাকাছি, তরতাজা স্বাস্থ্যের প্রবীণ যুবক। চেহারায় ক্রিকেটার জিওফ বয়কটের আদল। পরেছেন কালো একটি ঝুল নামানো পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা এবং পায়ে বাদামি রঙের স্যান্ডেল সু। পাঞ্জাবির আস্তিন কনুই পর্যন্ত গোটানো। অর্থাত্, ডালরিম্পল আপাদমস্তকই অরিয়েন্টালিস্ট—যাঁদের নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদের খোঁচাটা নিশ্চিত মনে এল। প্রাচ্যবাদী বলে সাঈদ পশ্চিমের সেসব তাত্ত্বিক এবং লেখকদের ঠাট্টা করেছেন, যাঁরা নিজেদের কল্পনাপ্রসূত ধারণা থেকে প্রাচ্যের বিশ্ব ও সভ্যতাকে ব্যাখ্যা করার একটা রীতিকে অধ্যয়নিকভাবে প্রতিষ্ঠা দেন।
কিন্তু ডালরিম্পল নিজেই যেন আমাদের অনেকের মনের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সূচনাপর্বে বললেন, সাত প্রজন্ম আগে তাঁর এক পিতৃপুরুষ এক বাঙালি রমণীকে বিয়ে করেছিলেন। তথ্যটা পেয়ে আমরা সবাই খুশি হয়ে হলাম। ডালরিম্পল তাহলে আমাদের লোক! তিনি বললেন, তিনি ইনসাইডার এবং আউটসাইডার দুটোই। ডালরিম্পল জানালেন, তিনি ২৫ বছর ধরে দিল্লিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। বহুবার গিয়েছেন পাকিস্তানে, যদিও বাংলাদেশে এটা তাঁর প্রথম আসা।
টাইম সাময়িকীর সাম্প্রতিক এক সংখ্যায় বইয়ের আলোচনায় পিকো আয়ার নাইন লাইভস সম্পর্কে বলছেন, খুবই অভ্রান্তভাবে ডালরিম্পল এ বইয়ে ভারতীয় ভক্তিবাদের চরিত্র অঙ্কন করেছেন। তাঁর বইয়ের বিষয় হলো, ভারত ও ভক্তির মেলবন্ধন বুঝতে চাওয়া। ডালরিম্পল নিজেই বললেন, তিনি তান্ত্রিক, বাউল, সন্ন্যাসী, পীর, মিস্টিক ও হিমালয়ের সাধুদের সঙ্গে দিনরাত করে মিশেছেন তাঁদের বিশ্বাসটা বোঝার জন্য। তাই তিনি নাইন লাইভস গ্রন্থে সাধারণ নয়জন মানুষের নিজের কথা তাঁদের নিজেদের ভাষায় তুলে ধরেছেন, যাঁরা নিজেরা কোনো না কোনোভাবে জীবনের আধ্যাত্মিকতার খোঁজে ব্রতী। এ বর্ণনাগুলো লেখার সময় তিনি নিজের মন্তব্য যথাসম্ভব পরিহার করেছেন। বললেন, যেহেতু বাংলাদেশে এসেছেন, তাঁর বইয়ে খানিকটা যে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ আছে, সেটি পড়ে শোনাবেন উপস্থিত শ্রোতাদের।
তিনি মোট তিনটি অধ্যায় থেকে পড়ে শুনিয়েছিলেন। বইয়ের যে অংশটি বাংলাদেশের, সেটি ছিল, ‘লাল পেড়ে শাড়ি’ পরা একজন নারীর নিজের বয়ানে নিজের জীবনকাহিনী। এই নারীর আদিনিবাস বিহারে। তাঁর বাবা মোহাজের হিসেবে দেশ বিভাগের সময় তত্কালীন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন। একপর্যায়ে অর্থাভাবে তিনি মেয়েকে, তখন তাঁর চৌদ্দ বছর বয়স, দালালদের হাতে বিক্রি করে দেন। নানা ভূগোল ঘুরে মেয়েটি শেষ পর্যন্ত স্থান পায় করাচির শাহবাজকা লন্দরের মাজারে, যেখানে সে স্থায়ীভাবে থাকে। ক্রমে তাঁর বয়স বাড়ে। বৃদ্ধ বয়সে তিনি মাজারের একজন প্রধান পরিচারিকা হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি সবসময় লাল কাপড় পরে থাকে। এ কারণে তাঁকে মুম্বাইসহ শাহবাজকা লন্দর মাজারের দূর-দূরান্তের ভক্তরা লাল পেড়ে নারী বলে জানে।
ডালরিম্পল ঘণ্টাখানেক পাঠ শেষ করার পর প্রশ্ন নিতে শুরু করলেন। একজন জিজ্ঞেস করলেন, ভারতীয় অধ্যাত্মবাদ যে অপস্রিয়মাণ, সে জন্য পশ্চিমারা দায়ী কি না। স্বভাব রসিক ডালরিম্পল বললেন, দিল্লিতে তাঁর এক পাঞ্জাবি প্রতিবেশী আছেন। তাঁর মতো আগ্রাসী বৈষয়িক লোক তিনি ভূ-ভারতে দেখেননি। একজন জিজ্ঞেস করলেন, বাহাদুর শাহ জাফরের পতন কেন হলো? তিনি বললেন, বাহাদুর শাহ হয়ে গেলেন পরিস্থিতির শিকার, কারণ সিপাহী বিপ্লবের (১৮৫৭-৫৮) নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁর বয়স, মানসিক গঠন বা সামরিক প্রস্তুতি কিছুই সহায়ক ছিল না। বস্তুত মেজর উইলিয়াম হাডসন খুব অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে তাঁকে হুমায়ুনের সমাধিস্থল থেকে গ্রেপ্তার করেন (২০ সেপ্টেম্বর, ১৮৫৭)। তার পরের দিন সকালে বাদশার দুই ছেলে যথাক্রমে মির্জা মুগল, মির্জা খিজির সুলতান ও পৌত্র মির্জা আবু বকরকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে খুনি দরোজায় মেজর হাডসনের নির্দেশে খুন করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল একটি তেলচিত্রের কথা। চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলার একটি চিত্রপ্রদর্শনীতে দেখেছিলাম। মহিশুরের বীর ব্যাঘ্র টিপু সুলতানের ইংরেজদের হাতে ৪ মে ১৭৯৯ সালে শ্রীরঙ্গনমপট্টম দুর্গে পতন হলে তাঁর ১৬ জন ছেলের দুজনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে মারার ছবি। লর্ড ক্লাইভের হাতে নবাব সিরাজদ্দৌলার পরাজয়ের কথাও মনে পড়ল (১৭৫৭)।
ইংরেজদের হাতে ভারতীয়দের পরাজয়ের যে রক্তাক্ত ইতিহাস, সে ইতিহাস-জারিত যন্ত্রণার কথা তো ডালরিম্পলের জানা থাকার কথা নয়। কোনো যন্ত্রণায়ই তো তাঁর ভোগার কথা নয়। একজন যুবক জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাউ ফার আর ইউ ডিফরেন্ট ফ্রম দ্য হোয়াইট মোগল অব দ্য এইটিন্থ সেঞ্চুরি?’ ডালরিম্পল সহাস্যে জানালেন, এ প্রশ্নটির উত্তর তিনি দেবেন না।
আমার আবার হুমায়ূন আহমেদের কথা মনে পড়ল। ডালরিম্পল বললেন, তাঁর এ বইটি এর মধ্যেই ৩৫ হাজার কপি বিক্রি হয়ে গেছে। প্রকাশক-বন্ধু মিলন নাথ বলেছিলেন, হুমায়ূন আহমেদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই ৫০ হাজার কপি বিক্রি হয়। কিন্তু কথা সেটা নয়। ডালরিম্পল দিল্লিতে থাকা সত্ত্বেও যিনি আগে কখনো বাংলাদেশে আসেননি, এসেছেন তাঁর নতুন বই ফেরি করতে এবং এসেই সর্বোচ্চ আতিথ্য পাচ্ছেন। আমাদের একজন লেখক লন্ডনে গিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অটোগ্রাফসহ বই বিক্রি ও সেমিনার করছেন, সেটা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। আমার মনে হলো, মিলনায়তন-ভর্তি আমরা সবাই একজন লেখকের কথা যে শুনতে এসেছি তা নয়, আসলে এসেছি তাঁর বই বিক্রিতে সহায়তা করতে।
অথচ, ভারতীয়রা যে অর্থে পরাধীন ছিল, সে অর্থে কখনো পরাধীন ছিল না আমেরিকা। সে আমেরিকার নাগরিক র্যালফ ওয়াল্ডো এমারসন উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় ব্রিটিশ সাহিত্য ও সাহিত্যিকের প্রভাব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ‘দ্য অ্যামেরিকান স্কলার’ বা অন্যান্য রচনায় চিত্কার করে বলেছিলেন, ‘ব্রিটিশ সাহিত্যিকেরা যতই উঁচুদরের হোক না কেন, তাঁরা আমাদের (আমেরিকার) প্রয়োজনের কথা বুঝতে পারবেন না। আমাদের কথা আমাদেরই বলতে হবে।’
তাই, একজন যুবকের যে প্রশ্নের উত্তর ডালরিম্পল দেবেন না বলেছেন, সে প্রশ্নটির উত্তর আমরা খুঁজে দেখি। তাঁর বইটির নাম: নাইন লাইভস। ইংরেজি প্রবাদে আছে: ‘দ্য ক্যাট হ্যাজ নাইন লাইভস’ অর্থাত্, বিড়ালের নয় প্রাণ। এখন বিড়াল যদি ভারতবর্ষের ম্যাটাফর বা চিত্রকল্প হয়ে থাকে, তাহলে অবিনশ্বর ভারতীয় আত্মার প্রতীকই এটি। কিন্তু ডালরিম্পল এই অবিনশ্বর শাশ্বত আত্মাটির খোঁজ করতে চান ভারতের মিস্টিক বা ভাববাদীদের যে একটি জীবনমাত্রা আছে, সেটার ভেতর। সাঈদ প্রাচ্যবাদীদের সমালোচনা করেছিলেন, কারণ তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী রাজনৈতিক এজেন্ডার কারণে ভারত বলতে তিন হাজার বছর আগের উপনিষদের এবং শকুন্তলার ভারতের জয়গান গেয়েছেন; তাঁরা আধুনিক রক্ত-মাংসের ভারতকে উপেক্ষা করেছেন বা আধুনিক ইরাক বলতে তাঁরা ব্যবিলনীয় সভ্যতাকে মহিমান্বিত করেছেন। সেই একই বৃত্তে ঘোরাফেরা করতে করতে ডালরিম্পল খেদ জানাচ্ছেন, তাঁকে নাকি এক তান্ত্রিক সাধু দুঃখ করে বলেছেন, তাঁর ছেলেটি বাপের পথে না গিয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক আগে সেই ১৯০৫ সালে লেখা ‘নূতন ও পুরাতন’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা যে কল্পনা করি আমাদের কেবল আধ্যাত্মিক সভ্যতা ছিল—আমাদের উপবাসক্ষীণ পূর্বপুরুষেরা প্রত্যেকে একলা একলা বসে আপন আপন জীবাত্মাটি হাতে নিয়ে কেবলই শান দিতেন—তাকে একেবারে কর্মাতীত অতিসূক্ষ্ম জ্যোতির রেখাটুকু করে তোলবার চেষ্টা—সেটা নিতান্ত কল্পনা।’
এ ‘নিতান্ত কল্পনা’টিই শিক্ষিত ভারতবর্ষীর মনে ডালরিম্পলের পূর্বপুরুষেরা, সে হোয়াইট মোগলেরা ঢুকিয়ে গেছে। এখনো আমরা সেই নিতান্ত কল্পনা নিয়েই আছি।
মোহীত উল আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২০, ২০০৯
apner lekha ti chinter khorak jogalo… dhonnobad