৩৭. ত্রাস [ওসিআর ভার্সন – প্রুফ সংশোধন করা হয়নি]
কুয়াশা ৩৭
প্রথম প্রকাশ : জুন, ১৯৭৩ এক কালো ঘন ভারি মেঘে ঢেকে রেখেছে গোটা আকাশটাকে।
থমথম করছে চারদিক। | গ্রামের পূর্ব প্রান্তে চিনিকলের পেটাঘণ্টায় ঢং ঢং করে দুটো বাজল।
মেঘ ডাকছে। মাঝে মাঝে মেঘের সাথে মেঘের সংঘর্ষে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মুহূর্তের জন্যে চোখ-ধাঁধানো আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছে। পরমুহূর্তে নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে ইহাপুর গ্রামটা।
| ভারি দুর্যোগপূর্ণ রাত। ঘুম আসার কথা নয় ইছাপুর বা আশপাশের গ্রামগুলোর মানুষের। সদা সর্বদা তাদের আশঙ্কা–এই বুঝি হৈ-চৈ শুরু হলো, এই বুঝি আবার কোথাও ডাকাত পড়ল।
গত মাসখানেক হলো ইছাপুর এবং আশপাশের গ্রামের মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সুস্থসবল একটি লোকও ভাল করে ঘুমায়নি গত একমাস ধরে।
সশস্ত্র ডাকাতরা বাংলাদেশের সর্বত্র ত্রাসের সঞ্চার করেছে সত্য। কিন্তু ইছাপুর থানাধীন প্রায় পাঁচটা বড় বড় গ্রামে, একদল সুসংগঠিত ডাকাত যা করছে তার বুঝি তুলনা নেই।, প্রতি রাতেই ডাকাতি হচ্ছে। মুখোশ পরে আসে তারা। আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা করে। বাধা পেলে নির্দিধায় গুলি চালায়। দশ-বিশটা লাশ ফেলে দিয়ে সর্বস্ব নিয়ে চম্পট দেয়।
ডাকাতরা নিশ্চয়ই গ্রামের লোক। তা না হলে মুখোশ পরে আসে কেন? এ প্রশ্নে প্রতিটি লোকই একমত। কিন্তু আজ অবধি একটি লোককেও গ্রামবাসীরা সন্দেহ করতে পারেনি। ধরা তো দূরের কথা।
ইছাপুর থানার জাদরেল ইন্সপেক্টর হায়দার সাহেব যেমন রাগী তেমনি করিৎকর্মা মানুষ। ডাকাত দলকে রার জন্যে আদাজল খেয়ে নেমেছেন তিনি। রাত নেই দিন নেই ডাকাতদের খোঁজে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। দিনের পর রাত আসছে। রাতে ঠিকই ডাকাতি করছে ওরা। নগদ টাকা
এবং স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে নিরাপদে।
এলাকার ধনীলোকেরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। কোন একটি উপায় করার জন্যে রোজই তাঁরা থানায় ধরনা দিচ্ছেন। হায়দার সাহেবের সাথে নানা পরামর্শ
কুয়াশা, ৩৭
করছেন তারা। হায়দার সাহেব ধৈর্য ধরার উপদেশ দেন, আশ্বাস দেন। সব কথার শেষে তিনি বলেন, জনসাধারণের সক্রিয় সাহায্য ছাড়া পুলিশবাহিনী একা পারবে
এই ডাকাত দলকে কাবু করতে। আপনারা ভয় পেলে চলবে না। সাহসে বুক বেঁধে বাধা দেবেন।’
| হায়দার সাহেবের কথা শুনে সকলের মুখ শুকিয়ে যায়। কার এত বুকের পাটা যে এমন ভয়ঙ্কর একদল ডাকাতকে বাধা দিতে যাবে?
প্রথম প্রথম বাধা দেয়া হয়েছিল বৈকি। ফল হয়েছিল মর্মান্তিক। বিশটা পঁচিশটা করে লাশ পড়েছিল।
অথচ ইছাপুর থানাধীন পাঁচটা গ্রামে ডাকাতদের সুযোগ সুবিধে কম। গ্রাম আসলে নামেই, এলাকাটা প্রায় শহর বলা যায়। ইলেকট্রিসিটি তো আছেই, গ্রামের লোকজন অধিকাংশ ধনীলোক বলে বহু বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্রও আছে। বাড়ি-ঘরগুলো ছাড়া ছাড়া ভাবে নয়। ইছাপুর, চন্দ্রগ্রাম, এবং ভাটপাড়া ঘনবসতি গ্রাম। কৌশলে বাধা দিলে ডাকাতদের পালাবার রাস্তা বন্ধ করে দেয়া যায়। কিন্তু ঝুঁকি নিতে রাজি নয় কেউ!
| ভয় শুধু ডাকাতকেও নয়। আরও একটি অলৌকিক ভয় আছে। যার কোন ব্যাখ্যা নেই। অথচ ভয়টা অমূলকও নয়।– ঢং করে শব্দ হলো আবার একটা । পেটঘড়িতে আড়াইটা বাজল।
চিনিকল কোম্পানীর নিজস্ব রেলপথের উপর একদল খাকি পোশাক পরা পুলিস এসে দাঁড়াল।
রেললাইনের এপারে ইছাপুর। ওপারে চন্দ্রগ্রাম। দল বেঁধে চন্দ্রগ্রামে গিয়েছিল ‘ পুলিশবাহিনী। পাঁচজনকে রেখে ফিরে আসছে ওরা ইছাপুরে।
খ্রী-নট-থ্র রাইফেল কাঁধে নিয়ে রেললাইনের উপর থেকে ধান খেতে নামল ওরা। বাতাস বইতে শুরু করেছে এতক্ষণে।
কনস্টেবল রাখাল বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছে দেখে জব্বার জিজ্ঞেস করল, “কি দেখহু পিছনে?’
না-না! কিছু না।
কথাটা বলেই জোরে পা চালাল রাখাল। জমাদার সাকীর বলল, এবার লাইট অফ হয়ে যাবে। ঝড় আসবে, মনে হচ্ছে।’
ছোট ধান খেত। খেতের পর উঁচু জমি। লম্বা লম্বা ঘাস সেখানে। তারপর অপ্রশস্ত পাকা রাস্তা। এদিকের রাস্তার দুপাশে ঘরবাড়ি নেই বলে লাইট পোস্টও নেই। প্রায় শ দুয়েক গজ পর পাশাপাশি অনেকগুলো বাড়ি। ওদিকে লাইটপোস্ট আছে। বাতি জ্বলছে। দেখা যাচ্ছে দূর থেকে।
| শালারা বোধহয় আজ ভাটপাড়া বা শিমূলপুরে হামলা করবে। এদিকে পরপর দুদিন ডাকাতি করেছে… ]
ভলিউম ১৩
,
,
জমাদার সাকীরের কথায় বাধা দিয়ে রাখাল বলে উঠল, ওদিকে চেষ্টা করলে ব্যাটারা নির্ঘাৎ ব্রা পড়বে আজকে। ইন্সপেক্টর সাহেব দলবল নিয়ে ওদিকেই আজ গেছেন না?
‘সাব ইন্সপেক্টর সাহেবও তত গেছেন মধুগ্রামে। শিমূলপুরেও যাবেন। কিন্তু••! জমাদার কথা শেষ না করে হতাশাব্যঞ্জক একটি অর্থহীন শব্দ করল নাক দিয়ে।
পাকা রাস্তায় উঠে হঠাৎ বেসামাল হয়ে পড়ল পুলিশবাহিনীর পাঁচজন লোক। প্রচণ্ড বাতাসে সোজা হয়ে পথ চলা যাচ্ছে না।
| বৃষ্টি আসবে!’ কথাটা বের হলো হাশেমের গলা দিয়ে। জোরে পা চালাল ওরা।
তিনটে প্রায় বাজে, না?’ জিজ্ঞেস করল জব্বার। দূর, এই তো আড়াইটা বাজার ঘন্টা হলো•••!’
কথা না বলে চুপ করে থাকতে পারছে না ওরা। অপ্রয়োজনেও কথা বলতে হচ্ছে। ওদের পাঁচজনেরই মনে একটি ভয় ঢুকে আছে। সেটাকে তাড়াতে পারছে
মন থেকে। সেই ভয় থেকে বাঁচবার জন্যেই কথা বলছে। | আলোর কাছাকাছি এসে বুকে সাহস ফিরে পেল ওরা। সাকী বলল, ভিজতে আজ হবেই।’
• যেরকম বাতাস দিচ্ছে তাতে মেঘ কেটে যেতেও পারে।’
রাখালের কথা শেষ হলো না, পাঁচজন রাইফেলধারী পুলিস পাথরের মূর্তি হয়ে গেল।
ঠিক তখুনি প্রচণ্ড শব্দে গর্জন করে উঠল মেঘ। তারপরই কেঁপে উঠল পায়ের নিচের মাটি। অত্যুজ্জ্বল আলোয় ধাধিয়ে গেছে ওদের চোখ।
রাস্তার দুই পাশে পাশাপাশি বাড়ি। প্রায় চল্লিশ গজ দূরে একটি গলি। গলিটা, ডান দিক থেকে এসে মিশেছে পাকা রাস্তায়। রাস্তা এবং গলির মাথায় একটি লাইটপোস্ট।
| গলির ভিতর থেকে একটি লোক ধীর পদক্ষেপে লাইটপোস্টের নিচে এসে সঁড়াল।
লোকটিকে দেখামাত্র সাকীর, জব্বার, রাখাল, হাশেম এবং সুলতানের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। নিঃশব্দে মর্মরমূর্তির মত দাঁড়িয়ে পড়ল ওরা।
পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। লাইটপোস্টের আলো তার সর্বশরীরে। কালো রঙের প্যান্ট লোকটার পরনে। গায়ে কালো চাদর। প্রকাও পাখির ডানার মত কালো চাদরটা উড়ছে বাতাসে লোকটার দুই পাশে।
দম বন্ধ করে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচজন।
কে ওখানে! সাকীরের অদ্ভুত কণ্ঠস্বর শোনা গেল। চিৎকার করে, জোর দিয়েই প্রশ্নটা কুয়াশা ৩৭
করতে চেয়েছিল সে। কিন্তু গলা শুকিয়ে যাওয়ায় কাঁপা কাঁপা দুর্বল কণ্ঠস্বর বাতাসের শব্দের সাথে মিশে গেল। কথাটা লোকটার কানে পৌঁছুল কিনা বোঝা গেল না।
লোকটা কিন্তু পিছন ফিরে তাকাল না । সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে দূরে কি যেন দেখছে লোকটা।
গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল ওদের। এক সময় ধীরে ধীরে ঘাড় ফেরাতে শুরু করল লোকটা। আবার গর্জে উঠল মেঘ।
ঘাড় ফিরিয়ে লোকটা তাকাল।
সাদা ধবধব করছে মুখের হাড়গুলো। সারাটা মুখে একতিল মাংস নেই। নাকের গর্ত দুটো বড় বড়। সাদা দেখাচ্ছে নাকের হাড়টুকুও। দাঁতগুলো অস্বাভাবিক। বড় বড়। চোখ দুটোর জায়গায় গর্ত, সেখানে অন্ধকার। ভিতরে মণি আছে কিনা বোঝা যায় না। কপালের হাড়টা চকচক করছে ইলেকট্রিক আলোতে। বড় বড় দাঁত
কে করে নিঃশব্দে হাসছে জিনিসটা।
| হুবহু একটি নরকঙ্কালের মুখ ।
কয়েকমুহূর্ত পর ঘাড় ফিরিয়ে নিয়ে আবার সামনের দিকে তাকাল সে। পঁড়িয়ে রইল একইভাবে কয়েক মুহূর্ত। তারপর পা বাড়াল।
ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে ‘জিনিসটা। বহুদূর অবধি দেখা গেল তাকে। ক্রমশ অস্পষ্ট হয়ে এল আকৃতিটা। এক সময় আর দেখা গেল না। শোনের পথে। বড় মাঠের দিকে চলে গেল সেটা।
গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। প্রথমে নড়ে উঠল রাখাল। ভগবান! ভগবান! কাঁপতে কাঁপতে কার উদ্দেশ্যে যেন নমস্কার করল সে।
পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে সাকীর বলল, দেখো দেখো, কেমন কাঁপছে দেখো আমার হাতটা।’
জব্বার হাশেমের কাঁধে হাত রেখে বলল, ভয় নেই। চলে গেছে।’
হাশেমকে আশ্বাস দেবার কারণ আছে। খুব বেশি ভীতু সে। এদের পাঁচজনই. এর আগে এই আশ্চর্য কঙ্কালকে দেখেছে। ভয় প্রায় সবাই পেয়েছে। কিন্তু হাশেম : প্রথম দিন দেখেই জ্ঞান হারিয়ে প্যান্ট খারাপ করে ফেলেছিল।
‘চলো, চন্দ্রগ্রামেই ফিরে যাই। ওখানে।’
হ্যাঁ। তাই চলো।’ সাকীরের সমর্থনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই। আজ রাতে ইছাপুরে আর থাকা নয়। আল্লার ভরসায় ইহাপুরকে রেখে চন্দ্রগ্রামের দিকে দ্রুত পা চালাল ওরা।
ভলিউম ১৩
দুই
থানায় বসে কথা হচ্ছিল।
পাটের ব্যবসায়ী তালুকদার সাহেব চোখ বড় বড় করে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন ইন্সপেক্টর হায়দারের দিকে। তারপর সিগারেটের প্যাকেটটা চিনিকলের সাপ্লাইয়ার আশরাফ সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, বলেন কি, সাহেব। নগদ পঁচাত্তর হাজার টাকা! অত টাকা কাশেম ব্যাপারী বাড়িতে রাখল কোন্ সাহসে?’
লঞ্চ মালিক গোলাম মাওলা সাহেব গালের এক ধারের চিবানো পান জিভ দিয়ে অন্যধারে নিয়ে যেতে যেতে বিকৃত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘গহনা-টহনা কি পরিমাণ ছিল?
সাব ইন্সপেক্টর মাথা নিচু করে বসেছিল। মুষড়ে পড়েছে সে। মাথা না তুলেই উত্তর দিল, পঁচিশ ভরির মত!
| সব নিয়ে গেল?’
ইন্সপেক্টর হায়দার সাহেব আনমনে বড় বড় গোঁফে আঙুল বুলাচ্ছিলেন। মোটা একটা চুরুট টেবিলের উপর থেকে তুলে নিয়ে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে বড় বড় লাল চোখ জোড়া তুলে ঘন ঘন মাথা নাড়লেন। বললেন, এ দুঃখ রাখব কোথায়! কাশেম সাহেবদের বাড়ি থেকে বড় জোর সিকি মাইল দূরে ছিলাম আমরা-অথচ কিছু টেরই পেলাম না! আরে সাহের, সেকি যেমন তেমন বৃষ্টি! আর শুধু কি বৃষ্টি, মেঘের সে কি ডাক! ব্যাটারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে ডাকাতি করে গেলেও শুনতে পাবার কথা নয়।’
গতরাতে ভোরের দিকে ডাকাতি হয়েছে মধুগ্রামের কাশেম ব্যাপারীর বাড়িতে। কাশেম ব্যাপারীর এক ছেলেকে এবং একজন বৃদ্ধকে খুন করে গেছে ডাকাতরা । ‘ সাব ইন্সপেক্টর শরীফউদ্দীন ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল মুখ তুলে। বলল, তিনটে বাজার পর থেকেই কেন যেন মন খুঁত খুঁত করছিল। বারবার যেতে ইচ্ছে করছিল মধুগ্রামের দিকে। কিন্তু আপনি এখানে আছেন বলে মনকে আশ্বাস দিয়ে রাখছিলাম।’
একটু থেমে আবার সে বলল, কিন্তু আমরা গেলেও কি আর করতে পারতাম! কে আর জানত কাশেম ব্যাপারীর বাড়িতে ওরা হামলা করবে। আপনাদের মতই হত হয়তো, কাছাকাছি থেকেও জানতে পারতাম না…!
| তালুকদার সাহেব হাতঘড়ির সোনার চেনের দিকে তাকিয়ে বললেন, নগদ টাকা বাড়িতে রাখি না। কিন্তু মেয়ে-বউদের গহনা তো আর সরিয়ে রাখা যায় না। কুয়াশা ৩৭
ডাকাতের ভয়ে কি বউ-ঝিরা গহনাও পরবে না? ইন্সপেক্টর সাহেব, উপায় একটা
বের করুন। এভাবে রাতের ঘুম হারাম করে ক’দিন কাটবে?
টাইয়ের নট ঠিক করতে করতে চিনিকলের ম্যানেজার মি, আব্বাস বললেন, ‘টাকা-পয়সাই বলুন আর গহনাই বলুন-প্রাণের চেয়ে বড় আর কি? আমার বাড়িতে তো ওসব কিছুই পাবে না। আর না পেলেই খেপে গিয়ে সবাইকে খুন করে যাবে। দরকার নেই, আমি ফ্যামিলি পাঠিয়ে দেব ঢাকায়। | গোলাম মাওলা বললেন, আপনি না হয় ঢাকায় পাঠিয়ে দিলেন, সেখানে বাড়ি আছে আপনার। আমাদের মত লোকের, যাদের জমিজমা আছে, গ্রামে নানা দায় দায়িত্ব আছে তাদের কি উপায়?’
ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালেন মাওলা সাহেব। তারপর বললেন, ‘মোটকথা এখন একমাত্র ভরসা হায়দার সাহেব। আমরা সবাই আহি পিছনে। টাকা পয়সা লাগে, ব্যবস্থা করব। কিন্তু এ বিপদ থেকে উদ্ধার হবার একটা উপায় করতেই হবে।’
জঁদরেল পুলিস ইন্সপেক্টর হায়দার সাহেব গাম্ভীর্য ভেঙে হেসে ফেললেন । এক মুখ নীলচে ধোয়া ছেড়ে তিনি বললেন, টাকার কথা তুলছেন কেন? টাকা আমার নেই, কিন্তু যা মাইনে পাই সেটুকুও দিতে রাজি আছি আমি-উপায় বের করুন আপনারা। নাহয় দু’মাসের বেতন যাবে আমার। কিন্তু চাকরিটা তো থাকবে। এখন যা অবস্থা দেখছি, এরকম যদি আরও কিছুদিন চলে তাহলে নির্ঘাৎ চাকরি যাবে।’
. সাব ইন্সপেক্টর হঠাৎ মুখ তুলে বলল, “ডাকাত ধরার জন্যে রাতে আমরা যে শক্তি ব্যয় করছি তা না করে দিনের বেলা আমরা যদি কুয়াশার আস্তানা খুঁজে বের করার চেষ্টা করি…!’
তাই করো না কেন! তুমি সে চেষ্টাই করো। আমি রাতে ব্যাটাদেরকে ধরার চেষ্টা করি। কিংবা তুমি রাতে ঘুরে বেড়াও দলবল নিয়ে, আমি দিনের বেলা…।’
আশরাফ সাহেব বললেন, কিন্তু কুয়াশা এই এলাকায় আস্তানা গেড়েছে বলে মনে হয় না। তাই যদি হত তাহলে এতদিনেও কি তার আস্তানা কারও চোখে পড়ত
?’ ‘ সাব ইন্সপেক্টর কলল, কিন্তু পচাগড়ের জঙ্গলে কেউ ঢোকে আজকাল? ঢুকলে হয়তো এতদিনে নিশ্চয়ই কারও না কারও চোখে পড়ত কুয়াশার আস্তানা। ওই জঙ্গলেই আছে…।’
হায়দার সাহেব বললেন, ‘ভাল কথা বলেছ। আজই, বুঝলে, জঙ্গলটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা যাক। তুমি চন্দ্রগ্রাম থেকে খাল পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকো। আমি
এদিক থেকে ঢুকি।’
‘কিন্তু সবাই তো সারারাত জেগে, বৃষ্টিতে ভিজে কাহিল হয়ে পড়েছে। সবাইকে ডেকে পাঠাতে হয়। আজ বরং থাক, আগামীকাল ভোর থেকে শুরু করা যাবে। আজ রাতে আর খামোকা টহল দিতে বের হবার দরকার নেই।
ভলিউম ১৩
এমন সময় বাইরে শোরগোল শোনা গেল। সবাই চুপ করে গেল তখুনি। বাইরে থেকে অধৈর্য কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে কার যেন, ‘টোমরা আমাকে চিনিটে পারিটেছ না-ইডিয়েট কহিকে। ইংরেজের ব্লাড বহিটেছে হামার ঢমনীটে। ওয়া আপন এ টাইম টোমরা যাডের গোলাম ছিলে। এই, এই, খবরডার, গায়ে হাট ডিয়ো না, ভাল হবে না বলে ডিচ্ছি..চলো, হামি যাচ্ছি, ডেখে লিবো টোমাডের বসকে। হামার বসের, থুড়ি, হামার ফ্রেণ্ডের নাম শুনলে টোমাডের বস্ সেন্সলেস হয়ে যাবে!
অফিসের দোরগোড়ায় দেখা গেল স্যানন ডি কস্টাকে। তার পিছনে দুজন লোক। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে তাদের।
| ডি. কস্টার ঢোলা প্যান্টের দু’এক জায়গায় কাদা লেগে রয়েছে। পায়ে। গামবুট। কাদায় লেপা । মাথার হ্যাটটা কপাল অবধি নামানো।
ইন্সপেক্টর হায়দার সাহেব কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন ডি কস্টার দিকে। ডি. কস্টাও নিজের চোখ দুটো কখনও কুঁচকে, কখনও বড় বড় করে আবার কখনও বাঁকা করে দেখছে ইন্সপেক্টরকে।
.কোত্থেকে নিয়ে এলে এই জানোয়ারকে তোমরা, নঈম?’
গর্জন করে উঠলেন ইন্সপেক্টর । ডি, কস্টার কোন ভাবান্তর লক্ষ করা গেল না।
নঈম হচ্ছে অপর লোক দুজনার একজন। আরেক জনের নাম সোবহান। সিভিল ড্রেসে রয়েছে ওরা। আসলে এই থানারই কনস্টেবল দুজন।
‘পচাগড়ের আশপাশে ঘুরঘুর করছিল, স্যার। আমাদেরকে দেখে কাছে ডেকে বলে কিনা সিগারেট খাও আর পাঁচ দুই সাত হায়ে যাও!
হোয়াট!’ গর্জে উঠলেন আবার ইন্সপেক্টর, ‘পাঁচ দুই সাত হয়ে যাও মানে?
রোগা লিকলিকে হাড়সর্বস্ব ডি. কস্টার শরীরটা নড়ে উঠল! সোজা টেবিলের দিকে এগিয়ে আসছে সে। জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ইন্সপেক্টর হায়দার। কিন্তু সেদিকে ক্ষেপমাত্র না করে একটি খালি চেয়ারে ইন্সপেক্টরের মুখোমুখি বসল সে। বসেই উঠে দাঁড়াল। পকেটে হাত ঢুকিয়ে বের করল এক প্যাকেট ‘সোনার বাংলা। সিগারেট।
* সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করে সিলিংয়ের দিকে একমুখ কটুগন্ধী ধোয়া ছেড়ে আবার সে আসন গ্রহণ করল। তারপর গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, হু আর ইউ? কঠা বলিবার আগে আপনার পরিচয় হামার জানা ডরকার। হোয়াটস্ ইওর নেম?’
সাব ইন্সপেক্টর শরীফ ডি, কস্টার পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘বেয়াদপি করার জায়গা পাওনি, না? ওর পরিচয় বলে দিতে হবে? ইন্সপেক্টর হায়দার চৌধুরী:.: 1 যাকগে, তুমি কে? কোথায় থাকো? জঙ্গলের ওদিকে কি করছিলে। ওদেরকে। আজেবাজে কথা বলেহ কেন?’ কুয়াশা ৩৭
ডি, কস্টা সিগারেটে টান দিয়ে বলল, “হাপনার কোশ্চেনের আনসার ডেয়া ইমপসিপল। বুঝিটে পারিটেছেন, মিস্টার? হামি একজন সিটিজেন অব বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারকে হেলপ করার জন্যে এই এরিয়ায় কাজ করিটেছি। সুটরাং•••!’ |
ব্যাটা বিদেশী গুপ্তচর।’ ফিসফিস করে বললেন তালুকদার সাহেব আশরাফ সাহেবের কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে গিয়ে। সারাদেশে এই যে লুটপাট, হাইজ্যাক, ডাকাতি, গুম-খুন হচ্ছে তা বড় বড় বিদেশী রাষ্ট্রের চালেই তো হচ্ছে। হাজার হাজার গুপ্তচর আছে বাংলাদেশে•••!’।
শরীফ!’ কঠিন কষ্ঠ ইন্সপেক্টরের, লোকটাকে সেলে নিয়ে গিয়ে বন্ধ করে রাখো।’
তড়াক করে উঠে পঁড়াল ডি, কস্টা। চিৎকার করে উঠল সে, ‘বি কেয়ারফুল। খবরডার, মিস্টেক করিবেন না। আমি চাই না হামার বসকে ডেকে পাঠাতে, বাট, আপনি যদি আমাকে বাঢ্য করেন…।
কিন্তু নঈম ও সোবহান ডি, কস্টাকে পিছন থেকে ধরে ফেলল শক্ত করে।
জোর করে টেনে নিয়ে গেল ওরা ডি. কস্টাকে। ডি. কস্টা ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে ঝড়ের মত উর্দু, বাংলা এবং ইংরেজিতে গালিগালাজ চালাতে লাগল। কিন্তু কাজ হলো না কোন। সেলে ঢুকিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো গেট।
দশ মিনিট পর ইন্সপেক্টরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল স্বয়ং কুয়াশাকে।
| তখনও ডি. কস্টাকে নিয়েই আলাপ করছিল সবাই। তালুকদার সাহেব থেকে শুরু করে গোলাম মাওলা অবধি সবাই অনুমান করলেন যে ডাকাতির সাথে এই অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান লোকটি নিঃসন্দেহে জড়িত। আলোচনা চলছিল, এমন সময় অফিল্মমের দোরগোড়ায় প্রকাণ্ড এক পুরুষকে দেখা গেল।
মুহূর্তের জন্যে দাঁড়িয়ে রইল সে। প্রত্যেকের দিকে তাকাল একবার। আগন্তুকের সাথে চোখাচোখি হবার সাথে সাথে সবাই কেমন যেন মুগ্ধ, সম্মোহিত হয়ে পড়ল। অদ্ভুত সুন্দর চোখ । সে চোখ জোড়ার দৃষ্টি আরও অদ্ভুত। যেন বুকের ভিতর, হৃদয়ের অন্তস্তল অবধি দেখতে পায় সে তার দৃষ্টি দিয়ে। আগন্তুক যেমন লম্বা তেমনি,চওড়া । এমন সুগঠিত পেশিবহুল লম্বা চওড়া বাঙালী আজকাল দেখাই যায় না ।
| আগন্তুক পা বাড়াল। ইন্সপেক্টরের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল সে।
বসুন।’
হাসি মুখে মুগ্ধ চোখে বিনয়ের সাথে বললেন ইন্সপেক্টর, ‘বলুন আপনার জন্যে আমি কি করতে পারি।’
কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালেন ইন্সপেক্টর। আগের কাজ পিছিয়ে গেছে। শুধরে
১২
ভলিউম ১৩
নেবার প্রয়োজনে করমর্দনের জন্যে হাতটা বাড়িয়ে দিলেন তিনি আগন্তুকের দিকে।
কুয়াশা ইন্সপেক্টরের বাড়িয়ে দেয়া হাতের দিকে তাকাল না। অদ্ভুত ভারি গলায় সে জানতে চাইল, আমার লোক স্যানন ডি কস্টাকে আপনারা আটকে রেখেছেন কেন?
থতমত খেয়ে ইন্সপেক্টর নিচু গলায় উচ্চারণ করলেন, আপনার লোক! স্যানন ডি. কস্টা!’
স্যানন ডি কস্টার নাম শুনেছিলেন বহুদিন আগে ইন্সপেক্টর। ধীরে ধীরে তাঁর দুই চোখে বিস্ময় ফুটে উঠল। কুয়াশার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কিন্তু নিজেকে সামলে নেবার অদ্ভুত শক্তি ইন্সপেক্টরের। ধীরে ধীরে বদলে যেতে লাগল
তার মুখের চেহারা।
. তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল উঁদরেল পুলিস ইন্সপেক্টর হায়দার চৌধুরীর চোখের দৃষ্টি। ঠোঁট জোড়া বেঁকে গেল সামান্য। ব্যঙ্গাত্মক একটু হাসি ফুটল সেই ঠোঁটে। দ্রুত কি যেন চিন্তা করছেন তিনি। কিন্তু কেউ যেন তা টের না পায় সে ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন তিনি।
‘আপনিই! আপনিই তাহলে কুয়াশা! ব্যাঙ্গাত্মক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর। ধীরে ধীরে তার একটি হাত এগিয়ে যাচ্ছে টেবিলের ড্রয়ারের দিকে।
কুয়াশা ইন্সপেক্টরের হাতের দিকে একবারও না তাকিয়ে বলে উঠল, ভয় নেই, বের করুন আপনি রিভলভার, বাধা দেব না। কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর দিন। ‘‘
ড্রয়ার থেকে রিভলভার বের করে ঝট করে সেটা কুয়াশার কপালের দিকে তাক করে ইন্সপেক্টর কঠোর কণ্ঠে বলে উঠলেন, চালাকির জায়গা নয় এটা, মি. কুয়াশা। আমার নাম হায়দার চৌধুরী। অনেক দিনের আশা আমার আপনাকে। গ্রেফতার করার। আজ কপাল খুলে গেছে…।’
প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল আচমকা কুয়াশা টেবিলের উপর।
সেক্রেটারিয়েট টেবিলের উপর বিহানো সম-আকৃতির কাঁচটা ভেঙে আট টুকরো হয়ে গেল। অ্যাশট্রেটা শূন্যে উঠল। শূন্যেই ডিগবাজি খেল একবার। উপুড় হয়ে পড়ল আবার টেবিলে। টুকরো সিগারেট, চুরুট, হাই এবং নোংরা খানিকটা পানি ছড়িয়ে পড়ল কাগজ পত্রের উপর। কিন্তু সেদিকে ভ্রূক্ষেপমাত্র না করে কুয়াশা তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল, আমার প্রশ্নের উত্তর চাই!
ইন্সপেক্টর হায়দার ততধিক তীব্র কণ্ঠে বলে উঠলেন, উত্তর দিয়েছি আমি। আপনাকে এবং আপনার লোককে আমি গ্রেফতার করছি।’
কারণ?”বজ্রকণ্ঠে প্রশ্ন করুল কুয়াশা।
হেসে ফেললেন ইন্সপেক্টর। হাসি থামিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘কারণের উল্লেখ দরকার? আপনি একজন ক্রিমিন্যাল। ডাকাতি করেছেন, খুন করেছেন…।’
‘প্রমাণ?’ কুয়াশা ৩৭
‘প্রমাণ?’
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, প্রমাণ। ডাকাতি করেছি, খুন করেছি-প্রমাণ করতে পারবেন?
ইন্সপেক্টর কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কুয়াশা ধমকে উঠল, বাঁচালতা পছন্দ করি না আমি। বেশি কথা বলার সময় আমার নেই। আমাকে গ্রেফতার করার অধিকার বা ক্ষমতা নেই আপনাদের । কথাটা বিশ্বাস না হলে আপনার ওপরআলার ওপরআলা সি.আই.ডি, অফিসার মি. সিম্পসনকে টেলিফোন করে জেনে নিন। মি. সিম্পসন নাকানিচোবানি খেয়েছিলেন একবার আমাকে গ্রেফতার করে ফোন
করুন তাকে।’
ইন্সপেক্টর একটু থমকে গেছে।
কুয়াশা বলল, না জেনে না বুঝে কিছু.করলে তার ফল ভাল হবে না। দেরি করবেন না, ফোন করুন।’
কি মনে করে ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে নিয়ে ডায়াল করতে শুরু করলেন ইন্সপেক্টর হায়দার।
মি. সিম্পসনের সাথে কয়েক মিনিট আলাপ করার পর ইন্সপেক্টর কুয়াশার দিকে রিসিভারটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘মি. সিম্পসন কথা বলতে চান, আপনার সাথে। | কুয়াশা রিসিভার নিয়ে কানে ঠেকিয়ে মি. সিম্পসনের উদ্দেশ্যে বলল, কুয়াশা বলছি। অকারণে আমাকে এভাবে বিরক্ত করার পরিণাম সম্পর্কে আপনাদের অধঃস্তন কর্মচারীদেরকে সাবধান করে দেয়া আপনার উচিত ছিল, মি. সিম্পসন । আপনারা কোনদিন আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ খাড়া করতে পারবেন না। তা সত্ত্বেও কেন যে…।’
মি, সিম্পসন অপর প্রান্ত থেকে বললেন, তোমার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহ করা কঠিন, তা স্বীকার করি। কিন্তু অসম্ভব নয়, কুয়াশা। যাক, ইছাপুরে কি উদ্দেশ্যে গেহ তুমি।’
আচমকা হো হো করে দরাজ গলায় হেসে উঠল কুয়াশা। হাসি থামতে বলল, ‘এসেছি বিশেষ এক উদ্দেশ্য নিয়েই। কিন্তু সেকথা তো আপনাকে বলা যাবে না । যাকগে, আপনার ইন্সপেক্টরকে কি নির্দেশ দিলেন? আমাকে গ্রেফতার করার সপক্ষে?’
ভাবছি।’ অপরপ্রান্ত থেকে বললেন মি. সিম্পসন, ভাবছি তোমাকে সন্দেহজনক গতিবিধির অজুহাতে গ্রেফতার করে আটকে রেখে প্রমাণ সংগ্রহের চেষ্টা করলে কেমন হয়।’
‘ক্ষমতা যখন আছে তখন তার অপব্যবহার হবেই । আপনিও জানেন যে আমার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণের অস্তিত্ব আমি রাখি না। এর আগেও তো একবার
ভলিউম ১৩
চেষ্টা করেছিলেন, মনে পড়ে? কি হয়েছিল সেবার? মানহানির কেস করলাম, হেরেছিলেন তো? এক কাজ করুন না, আপনি বরং আপনার বসকে ফোন করে এ ব্যাপারে পরামর্শ নিন। গতবারের ঘটনা সম্পর্কে ভাল ধারণা আছে আপনার বসের।
“, সে কথা আমিও ভাবছি। ঠিক আছে, খানিকপর ফোনে জানাব সিদ্ধান্ত। ইতিমধ্যে বসকে ফোন করে জেনে নিই আমি।’
: মি. সিম্পসন ফোন ছেড়ে দিলেন।
কুয়াশা রিসিভারটা রাখল ক্রেডরে উপর। ইন্সপেক্টর হায়দারের হাতে তখনও রিভলভার। কুয়াশার কপালের দিকে ধরা সেটা। কুয়াশার পিছনেও তিনজন কনস্টেবল কখন এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাতে রাইফেল। কুয়াশার দিকে রাইফেল তুলে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে তারা। সাব ইন্সপেক্টর শরীফও দাঁড়িয়ে আহে অফিমের দরজার বাইরে। তার হাতেও রিভলভার।’
অফিসরূরে কোথাও বিশিষ্ট গ্রামবাসীদের এখন আর দেখা যাচ্ছে না। তারা কখন নিঃশব্দে পা টিপে টিপে, দম বন্ধ করে থানা থেকে পালিয়ে গেছেন। কুয়াশার পরিচয় জানার পর তাঁরা, আর সাহস পাননি বসে থাকতে।
কি বললেন মি. সিম্পসন?’ গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর। অপেক্ষা করুন। সে তার বসের পরামর্শ নিচ্ছে।’
কুয়াশা কথাটা বলে ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল কনস্টেবল তিনজনের দিকে। তার জানতে চাইল, মি. ডি, কস্টাকে কে এনেছে থানায়?’
আমি আর সোহরাব। নঈম উত্তর দিল পিছন থেকে। ‘কেন গিয়েছিলে তোমরা জঙ্গলের ভি? ভারি গলায় প্রশ্ন করল কুয়াশা।
নঈম দ্রুত একবার তাকাল ইন্সপেক্টর হায়দারের দিকে। তারপর কি বলবে ভেবে না পেয়ে চুপ করেই রইল ।
মুচকি একটু হাসল কুয়াশা। তারপর ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে সে বলল, ডাকাতগুলো বড় জ্বালাচ্ছে, না? ধরতে চান?
| ‘ধরতে চাই মানে? আপনিই তো ডাকাতদের সর্দার। আপনাকে যখন হাতের মুঠোয় পেয়েছি তখন আপনার চেলাদেরকে ধরতে বেশি সময় লাগবে না। মি. সিম্পসন নিশ্চয়ই আপনাকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেবেন।’
আবার বেশি কথা বলছেন আপনি, কুয়াশা ভারি গলায় বলল। ‘ডাকাতগুলোকে আমি ধরে দিতে পারি দুদিনের মধ্যে, যদি আপনারা আমাকে সাহায্য করেন লোকজন দিয়ে। আমি অবশ্য একাই পারব, কিন্তু সময় লাগবে
বেশি। | ‘মি. সিম্পসনের ফোনই সব সমাধান করবে,’ বললেন ইন্সপেক্টর। তার কথা
কুয়াশা ৩৭
১৫;
শেষ হওয়া মাত্র বেজে উঠল ফোনের লে।
রিসিভার কানে ঠেকালেন ইন্সপেক্টর। আধমিনিট নিঃশব্দে শুনলেন তিনি। তারপর রিসিভারটা বাড়িয়ে দিলেন কুয়াশার দিকে।
কুয়াশা বলছি,’ কুয়াশা রিসিভার কানে ঠেকিয়ে বলল।
অপরপ্রান্ত থেকে সিম্পসনের গলা ভেসে এল, তোমারই জয় হলো, কুয়াশা। বস্ বললেন, প্রমাণ থাকলে কুয়াশাকে গ্রেফতার করো, না থাকলে ওকে-ঘাঁটিয়ে
। সুতরাং••• |’।
‘আবার কথা হবে। বিদায় নিই।’
কথাগুলো বলেই রিসিভার নামিয়ে রাখল কুয়াশা। ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, আমার প্রস্তাব কি গ্রহণ করবেন এবার?’
না। আপনাকে মি. সিম্পসনের নির্দেশে ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি ঠিক, কিন্তু আমরা নিঃসন্দেহে জানি যে আপনি এবং আপনার দলবলই এই এলাকায় প্রতি রাতে ডাকাতি করে বেড়াচ্ছেন, আপনিই প্রায় শ’ দেড়েক মানুষকে গত এক মাসে
খুন করেছেন।’
‘পাগল আর কাকে বলে। আমার লোককে নিয়ে আসুন।
নিরুক্ত হয়ে কথাটা বলল কুয়াশা। সাব ইন্সপেক্টর চলে গেল ভিতর দিকে। খানিকপরই দেখা গেল ডি. কস্টাকে। অফিসরূমে ঢুকেই ডি কস্টা বলে উঠল, বস্, ইন্সপেক্টরকে হাইজ্যাক করব নাকি?
| আজকের মত ছেড়ে দিন বেচারীকে! চলুন।
কথাটা বলে হো হো করে হাসতে হাসতে অফিসরূম থেকে বেরিয়ে গেল কুয়াশা ।ড়ি, কস্টা বুক টান করে চলল তার পিছন পিছন। ‘ সাব ইন্সপেক্টর শরীফ আপন মনেই বলে উঠল, কিন্তু কুয়াশা খবর পেল কিভারে।
উত্তর দিল একজন কনস্টেবল। সে ডি কস্টার পিছু পিছু অফিসরুমের দরজা অবধি এসে দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, “স্যার, লোকটা একটা সিগারেটের প্যাকেট চোখের সামনে ধরে বিড়বিড় করে কি যেন বলছিল। আমি ভাবলাম ব্যাটা পাগল। আসলে ওটা সিগারেট প্যাকেট ছিল না । ওটা নিশ্চয়ই ওয়্যারলেস। মিনি সাইজের, তাই না, স্যার?’ |
রীফ শুধু বলল, “। ইন্সপেক্টর ওদের কথায় কান দিচ্ছেন না। উত্তেজিতভাবে পায়চারি করছেন তিনি হাত দুটো পিছনে বেঁধে। তিন। পরবর্তী রাতেও আকাশে মেঘ করল । ১৬
ভলিউম ১৩
ঢং করে চিনিকলের পেটাঘড়িতে রাত, একটা বাজার পরই গর্জে উঠল কয়েকটা থ্রী-নট থ্রী রাইফেল।
| গুলির শব্দ হলো কিন্তু কোথাও কোন শোরগোলের শব্দ শোনা গেল না। সাব ইন্সপেক্টর শরীফ উদ্দীন আজ টহল দিতে রে হয়নি। অধিকাংশ কনস্টেবলই আজ বিশ্রাম নিচ্ছে। আগামীকাল ভোরে পচাগড়ের জঙ্গলে প্রবেশ করবে তারা কুয়াশার
আস্তানা খুঁজে বের করার জন্যে।
| ইন্সপেক্টর হায়দারের মন কিন্তু মানেনি। তার বিশ্বাস কুয়াশা আজ রাতেই ইছাপুরে ডাকাতি করার চেষ্টা করবে। সুতরাং তাকে হাতে নাতে ধরার চেষ্টা না করলেই নয়।
দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছেন ইন্সপেক্টর। ফাঁকা গুলি করছে তার সঙ্গের কনস্টেবলরাই। ডাকাতদলকে সাবধান করে দেয়াই ফাঁকা গুলি করার উদ্দেশ্য।
প্রায় ভাটপাড়ার কাছাকাছি গিয়ে ইন্সপেক্টর হায়দার তাঁর কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বললেন, চলো, এবার ফেরা যাক।
এদিকে চন্দ্রগ্রামের দিক থেকে একটি ছায়ামূর্তি লম্বা লম্বা পা ফেলে ইছাপুরে । প্রবেশ করল রাত দেড়টার দিকে। রেল লাইনের উপর দাঁড়িয়ে লম্বা ছায়ামূর্তি চারদিক ভাল করে দেখে নিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। কালো পোশাকে ঢাকা ছায়ামূর্তির দেহ। ছোট ধান খেতের উপর দিয়ে পাকা রাস্তার দিকে দ্রুত হেঁটে চলল সে।
পাকা রাস্তার উপর উঠে হায়ামূর্তি আবার একবার দাঁড়াল। গভীর মনোযোগের সাথে কি যেন শোনার চেষ্টা করল সে। তারপর আকাশের দিকে চোখ তুলে কি যেন দেখল। বৃষ্টি না-ও আসতে পারে। জোর বাতাস বইছে। এমন সময় ডানা ঝাঁপটাবার শব্দ শোনা গেল ছায়ামূর্তির মাথার উপর। একটি প্রকাণ্ড বাদুড় উড়ে গেল চন্দ্রগ্রামের দিকে। ..
দূরে দেখা যাচ্ছে লাইটপোস্টগুলো:। ওদিকে রাস্তার দু’ধারে পাকা বাড়ি। দোতলা, তিনতলা।
প্রতিটি বাড়ির গেট বন্ধ। জানালা দরজা, ভিতর থেকে আটকানো। প্রতিটি বাড়ি নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। কোন বাড়ির কোথাও কোন শব্দ নেই। প্রাণহীন নিঃসাড় । প্রতিটি বাড়িই যেন এক একটি পোড়োবাড়ি। ভূতের আড্ডা।
| পাকা রাস্তাটা সোজা চলে গেছে বহুদূর অবধি। বড় একটি মাঠে গিয়ে মিশেছে রাস্তাটা। মাঠের বাঁ দিকে, পচাগড় জঙ্গল। সোজাসুজি গেলে পড়বে শ্মশান। শ্মশানের পাশ দিয়ে পায়ে চলা পথ। পথের শেষে হাট। তারপর আবার বাড়িঘর। ওদিকেই হাইস্কুল, খেলার মাঠ, পোেস্ট অফিস, ডাক্তারখানা ইত্যাদি।
দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তি লম্বা লম্বা পা ফেলে দ্রুত এগিয়ে আসছে। লাইটপোস্টের আলোয় তালগাছের মত লম্বা ছায়া পড়ছে তার। আশপাশের কোন বাড়ি থেকে ২-কুয়াশা ৩৭
১৭’
অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর শোনা যায় কি যায় না। ছায়ামূর্তি নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে যেতে যেতে অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘাড় ফিরিয়ে একতলা একটি বাড়ির দিকে তাকাল সে। সজাগ হয়ে উঠল তার শ্রবণেন্দ্রিয়। পাকা রাস্তা ছেড়ে ঘাস ভর্তি মাটিতে পা রাখল সে। তারপর নিচু বারান্দার উপর উঠে পড়ল। বারান্দার দুই দিকে দুটি দরজা। দরজা দুটি ভিতর থেকে বন্ধ। কপাটের কাঠখণ্ডগুলো যেখানে সংযুক্ত হয়েছে সেখানে অতি সরু সরু ফাঁক দেখা যাচ্ছে। সেই ফাঁক দিয়ে কোন আলোর আভাস বাইরে আসেনি।
নিঃশব্দ পায়ে একটি দরজার ভিতর থেকে একটি নারী কণ্ঠ ভেসে এল, আমার কি মনে হয়, জানো?’
৷ কি?’
দ্বিতীয় কন্ঠটি একজন পুরুষের। বলব? কিন্তু ভয় করছে যে!’ । নারী কণ্ঠ ফিসফিস করে বলে উঠল।
পুরুষ কণ্ঠও ততধিক ফিসফিস করে বলল, ভয় কি আমি তো রয়েছি।’
আমার মনে হয় মানুষ মরে গেলে ভূত হয়, আর ভূতরা নানা জায়গা থেকে আসে একই জায়গায়। যেখানে তারা•• |
মেরে গর্জনে নারী কন্ঠ চুপ করে গেল ।
সেখানে তারা কি করে?’.. সেখানে তারা ভগবানকে ডাকে সবাই মিলে। কিন্তু মানুষ মরে গেলে ভূত হয় একথা কে বলল তোমাকে?’
ভাল মানুষরা হয় না, খারাপ মানুব্র হয়। আমি শুনেছি। আচ্ছা, সে যাক। কি বলতে চাইছিলে তাই বলো। “আমরা যে কঙ্কালটাকে দেখছি প্রতিদিন সে-ও ওই উদ্দেশ্যে শ্মশানে যায়।’ ‘কিন্তু এত শশ্মান থাকতে ইছাপুরের শ্মশানে•• |
“কেন, ইছাপুরের শ্মশানই তো এই এলাকার সবচেয়ে বড় শ্মশান। পঁচিশ মাইলের মধ্যে আর কোন শ্মশানই তো নেই।’
তুমি বলতে চাও পঁচিশ মাইল দূর থেকে ভূতটা বোজ আসে আমাদের গ্রামের শ্মশানে।’
‘ওদের পক্ষে সবই সম্ভব। কিন্তু আসে-এ তো আর মিথ্যে নয়! বোজই তো দেখো। আজও তো দেখলে।’ ‘.
দরজার সামনে থেকে সরে এল এবার হায়ামূর্তি। পাকা রাস্তায় নেমে আবার সে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল।
খানিক পরই দু’পাশে বাড়িঘরকে পিছনে ফেলে পাকা রাস্তা শেষ করে মাঠে
ভলিউম ১৩
নামল ছায়ামূর্তি। ক্রমশ অন্ধকার তাকে গ্রাস করল।
অন্ধকারের মধ্যেই দ্রুত এগিয়ে চলল হায়ামূর্তি। মাঠের মাঝামাঝি পৌঁছুল। এমন সময় শোনা গেল বাঁচাও! বাঁচাও?
একসঙ্গে বহু লোক বহু শিশু, কহু নারী আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল দূরে। | মুহূর্তের জন্যে থমকে দাঁড়াল ছায়ামূর্তি। কি যেন ভাবল সে। তারপরই শোরগোল লক্ষ্য করে হুটতে শুরু করল সে ঝত্রে বেগে।
| মাঠটা বিরাট। মাঠের জমি সমানও নয়। ছুটতে ছুটতে মাঠ অতিক্রম করে ছায়ামূর্তি পায়ে-হাঁটা সরু পথের উপরে চলে এল।
সময় বয়ে চলেছে হু-হুঁ করে। চিৎকার শোনা যাচ্ছে না এখন আর। তার বদলে শোনা যাচ্ছে স্টেনগানের শব্দ।
আরও খানিক পর শ্মশানের কাছে পৌঁছুল ছায়ামূর্তি। চারদিক নীরব হয়ে গেছে আবার। কোথাও কোন সাড়া শব্দ নেই। হঠাৎ কি মনে করে শ্মশানের পাশেই দাঁড়িয়ে পড়ল ছায়ামূর্তি।
সামনে, পিছনে, ডানে-বাঁয়ে, চারদিকে অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকারেও ছায়ামূর্তি তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। কান দুটো সদা সতর্ক তার। কি যেন শোনার চেষ্টা করছে সে। কয়েক মুহূর্ত পরই ছায়ামূর্তির মুখ উজ্জ্বল হয়ে। উঠল অন্ধকারে। শুনতে পেয়েছে সে যা আশা করছিল। একজন লোক হুটে আসছে সামনের দিক থেকে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে তার হুটন্ত পদশব্দ।
ধীরে ধীরে হায়ামূর্তি সরু পথ ছেড়ে সরে গেল এক পাশে।
চারদিকে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। দু’হাত দূরের জিনিসও দেখা যাচ্ছে না। একটি গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়াল ছায়ামূর্তি। তারপর কি মনে করে গাছের আড়ালে আত্মগোপন করল সে।
ছুটন্ত পদশব্দ কাছে এসে পড়েছে। নিঃশব্দে পঁড়িয়ে আছে গাছের আড়ালে ছায়ামূর্তি।
ছুটতে ছুটতে লোকটা ছায়ামূর্তিকে পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
খানিক পর ছায়ামূর্তি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে ছুটন্ত লোকটাকে অনুসরণ করল। | দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে আবার প্রকাণ্ড মাঠের মাঝখানে এসে পড়ল ছায়ামূর্তি। মাঠের পর পাকা রাস্তা। সেখানকার লাইটপোস্টের আলোয় দেখতে পেল পাকা রাস্তার উপর উঠে গেছে লোকটা।
লোকটার পরনে কালো প্যান্ট। কালো চাদর জড়ানো তার গায়ে। বাতাসে। কালো চাদরটা উড়ছে প্রকাও পাখির ডানার মত দুইপাশে। লোকটা এখন আর দৌড়াচ্ছে না। দ্রুত পায়ে হাঁটছে সে। হঠাৎ একটি লাইটপোস্টের নিচে পৌঁছে লোকটি পিছন দিকে ফিরে তাকাল। কুয়াশা ৩৭
ছায়ামূর্তি দেখল লোকটার মুখে এক তিল মাংস নেই। চোখ দুটোর জায়গায় বড় বড় গর্ত, মণি আছে কিনা বোঝা যায় না।
পিছন দিকে তাকিয়ে হায়ামূর্তিকে দেখতে পেল না জিনিসটা। আবার সে ঘাড় ফিরিয়ে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে শুরু করল।
ছায়ামূর্তি সতর্ক, সন্তর্পণে অনুসরণ করে চলল অদ্ভুত জিনিসটাকে’।
পরদিন সকাল বারোটায় দেখা গেল ইছাপুর থানায় মি, সিম্পসনকে।
‘ স্যার, কাজটা কিন্তু আমাদের উচিত হয়নি। কুয়াশার মত একজন কুখ্যাত ডাকাতকে গ্রেফতার করার জন্যে প্রমাণের অভাব যদি হয়।’
ইন্সপেক্টর হায়দার কথাটা শেষ করলেন না।
মি. সিম্পসন গার্য নিয়েই এসেছেন ঢাকা থেকে। কথা বলার সময়ও সে গার্য তিনি ভাঙলেন না, কুয়াশা যদি সাধারণ একজন ডাকাত হত তাহলে কথা ছিল না, ইন্সপেক্টর। কুয়াশা বুদ্ধিমান। আপনার চেয়ে, আমাদের সবার চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান সে। আইনের মারপ্যাঁচ আমাদের চেয়ে সে অনেক বেশি বোঝে। বিনা প্রমাণে তার বিরুদ্ধে আমরা যদি কিছু করি তাহলে এমন প্রতিশোধ সে নেবে যে তখন আর বাইরে মুখ দেখানো দায় হয়ে পড়বে। সুতরাং বুঝেশুনেই কাজ করা দরকার আমাদের।
একটু থেমে মি. সিম্পসন চুরুট ধরালেন। তারপর আবার বললেন, আপনি ঝলছেন প্রমাণ সংগ্রহ করা সহজ?.বেশ, করুন প্রমাণ সংগ্রহ। একটার পর একটা ডাকাতি করে যাচ্ছে সে-ধরুন তাঁকে হাতে নাতে।
ইন্সপেক্টর জোর দিয়ে বললেন, কুয়াশাকে আমি গ্রেফতার করবই, স্যার। ছাড়বার পাত্র আমি নই। জান যায় যাবে কিন্তু ওকে আমি দেখে নেব।’
মি. সিম্পসন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন ইন্সপেক্টরের দিকে। হঠাৎ তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘এদিকে প্রতিটি ডাকাতি কুয়াশা করছে এই আপনার ধারণা, ইন্সপেক্টর?
‘অফকোর্স, স্যার।– আপনার এ ধারণার কারণ?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠ মি. সিম্পসনের।
থতমত খেয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর। কিন্তু নিজেকে সামলে নিলেন তিনি, অপূর্ব মানসিক ক্ষমতাবলে। বললেন, কুয়াশাকে যেদিন থেকে দেখা গেছে এই এলাকায় সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে ডাকাতি। তাছাড়া কুয়াশা ছাড়া আর কে এমন ভয়ঙ্করভাবে ডাকাতি করতে পারে, স্যার? কুয়াশী ছাড়া আর কার এত সাহস আছে?’
গতকাল যে ডাকাতি হয়েছে সেটাও কুয়াশী করেছে বলে আপনার ধারণা?’ ‘অফকোর্স, স্যার।, মি. সিম্পসন বলে উঠলেন, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। প্রতিটি
ভলিউম ১৩
ডাকাতি করার সময় ডাকাতরা বাঘের মুখোশ পরে এসেছে। কুয়াশা তো এর আগে এমন ছেলেমানুষি কাণ্ড করেনি। অতু সে নয়, আত্মপরিচয় গোপন রে কোন কাজ কৰা তার স্বভাব নয়। কুয়াশার ব্যাপারে আমি একজন বিশেষজ্ঞ, ইন্সপেক্টর। আজ কত বছর ধরে তাকে গ্রেফতার করার চেষ্টা করছি তা জানেন?
ইন্সপেক্টর বললেন, কুয়াশার হয়তো এটা একটা নতুন কৌশল, স্যার । অন্তত আমার বিশ্বাস তাই। মুখোশ সে ব্যবহার করত না বলেই আজকাল করছে-যাতে। তার ওপর কারও সন্দেহ না হয়।’
মি. সিম্পসন প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বললেন, কাল যে ডাকাতি হয়ে গেছে তালুকদার সাহেবদের বাড়িতে তাতে নিহত হয়েছে কজন?’
‘পাঁচজন, স্যার। তালুকদার সাহেব, তার দুই ছেলে এবং দুজন চাকর।’ ‘অসম্ব!’ মি. সিম্পসন প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।
কি অস, স্যার?’ ইন্সপেক্টর অবাক হয়ে জানতে চাইলেন।
মি. সিম্পসন রিক্ত হয়ে বলে উঠলেন, ‘আপনার সন্দেহ মিথ্যে, ইন্সপেক্টর। কুয়াশা অকারণে, অপ্রয়োজনে মানুষ খুন করে না।’ |
ইন্সপেক্টর হায়দার অসহায়ভাবে বললেন, কেন যে স্যার আপনারা একজন নিকৃষ্ট শ্রেণীর ক্রিমিন্যাল সম্পর্কে এত বেশি উঁচু ধারণা পোষন করেন তা আমি
জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা করব তার নিকৃষ্ট, হীন স্বরূপ উদঘাটন করার। সত। তখনই কেবল আপনাদের ভুল ধারণা ভাঙবে কুয়াশা সম্পর্কে।
মি. সিম্পসন মনে মনে হাসলেন শুধু। ইন্সপেক্টরের কথার উত্তরে কোন মন্তব্য করলেন না। প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, নরকঙ্কাল সম্পর্কে যে গুজব রটেছে সে সম্পর্কে তদন্তের রিপোর্ট কি আপনার? নিশ্চয়ই ভূত আছে’ একথা লিখে রাখেননি রিপোর্টে?
শুকিয়ে গেল ইন্সপেক্টরের মুখ। ধীরে ধীরে তার চোখে-মুখে ফুটে উঠল ।
মি. সিম্পসন তাকালেন সাব-ইন্সপেক্টরের দিকে। শরীফেরও চোখ-মুখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক।
সকৌতুকে তাকালেন মি. সিম্পসন এবার দণ্ডায়মান কয়েকজন কনস্টেবলের দিকে। তারাও ঢোক গিলছে ঘন ঘন।
ইন্সপেক্টরের দিকে তাকালেন মি. সিম্পসন। বললেন, চুপ করে থাকার অর্থ,
কি?
: আপনি দেখতে চান?’ গম্ভীর গলায় পাল্টা প্রশ্ন করলেন ইন্সপেক্টর।
আমার প্রশ্নের উত্তর হলো না ওটা, স্পষ্ট ভাষায় বিরক্তি প্রকাশ করলেন মি. সিম্পসন।
আপনি যেটাকে গুজব বলছেন সেটা গুজব নয়। এর বেশি কলবার আপাতত নেই আমার কিছু, ইন্সপেক্টর খানিকটা আহত কণ্ঠেই বললেন। কুয়াশা ৩৭,
‘গুজব নয় কেন?’ নাছোড়বান্দার মত প্রশ্ন করেন মি. সিম্পসন। ‘নিজেদের চোখে যা দেখেছি।’ মি. সিম্পসন বাধা দিয়ে বলে উঠলেন, “কি দেখেছেন নিজের চোখে? নরকঙ্কালকে হাঁটতে দেখেছি। নরকঙ্কালকে হাঁটতে দেখেছেন? কঙ্কাল হাঁটতে পারে বলে মনে করেন?
মনে করার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই, স্যার। যা দেখেছি তাই বলছি। শুধু দেখিনি, গুলিও করেছি। সে গুলি “তার গায়েও লেগেছে। কিন্তু আহত বা নিহত কিছুই হয়নি “সে”। দিব্যি হেঁটে চলে গেছে।’
‘গুলি লেগেছিল? স্থির বিশ্বাস আপনার?
‘আমি একা গুলি করিনি, স্যার। সোহরাবও রাইফেল চালিয়েছিল। জিজ্ঞেস করে দেখুন ওকে।
মি. সিম্পসন তাকালেন সোহরাবের দিকে। সোহরাব সাথে সাথে বলে উঠল, “জ্বী, স্যার। গুলি লেগেছিল। কিন্তু কিছুই হয়নি তার।
ননসেন্স!’
সশব্দে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন মি. সিম্পসন। বললেন, ঠিক আছে। আমি দেখতে চাই একবার তোমাদের চলমান কঙ্কালকে।
*
চার। সেদিন বিকেল থেকেই বৃষ্টি শুরু হলো। সন্ধ্যার পর বেগ একটু কমল বটে। কিন্তু রাত দশটার পর প্রবল ভাবে শুরু হলো আবার। এরকম ভারী বৃষ্টি বড় একটা হয়
। ঝরছে তো ঝরছেই। বৃষ্টির শব্দে কান পাতা দায়। ঝিরি ঝিরি হলেও কথা ছিল। এ একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি। বড় বড় ফোঁটা সবেগে নেমে আসছে মাটির দিকে। বিরতি নেই, বিশ্রাম নেই, থামবার কোন লক্ষণ নেই।
রাত বারোটা বাজার ঘণ্টা ঠিকই পড়ল চিনিকলে। ঘণ্টার শব্দ কারও কানে গেল না। কিন্তু একজন লোক ঠিকই শুনতে পেল।
ঠিক বারোটার সময় চিনিকল কোম্পানীর নিজস্ব রেলপথের উপর উঠে এল একজন লোক। লঞ্চঘাট থেকে চন্দ্রগ্রাম পেরিয়ে আসতে তার সময় লাগল প্রায় দেড় ঘণ্টা। বারোটার ঘণ্টা পড়ার শব্দ শুনে রীতিমত শিউরে উঠল জাফর নানা বিপদের কথা ভেবে।
‘গ্রামে বড় একটা আসে না জাফর। ঢাকার একটি চটকলের শ্রমিক সে। ছুটিছাটা এমনিতেই কম। ছুটির সময়ও সে বড় একটা গ্রামে ফেরে না। ছুটির দিনগুলোয় বরং বেশি পরিশ্রম করে সে। খেটেখুটে কিছু পয়সা না জমালেই নয়। পৃথিবীতে একমাত্র মা ছাড়া তার কেউ নেই। বিয়ের বয়স হয়েছে তার, মা বউ না ২২
ভলিউম ১৩
দেখে মরবে না। জাফর তার একমাত্র ছেলে। কিছুতেই সে কালো মেয়েকে বউ করে আনবে না। সুন্দরী মেয়ে পেতে হলে টাকা চাই। তাই খাটতে হয়। জাফরকে। ছুটির দিনে সে বিড়ি-সিগারেটের দোকানটা খুলে বসে। তাতে বেশ দু’পয়সা আয় হয়।
| আজ শনিবার। শনিবারে মিলের কাজ কামাই করা মানে রবিবারের ছুটি হাত ছাড়া হয়ে যাওয়া। তাই মায়ের গুরুতর অসুখের খবর পেয়েও জাফর আজ সারা দিন মিলে কাজ করেছে। মিল থেকে ছুটি পেয়েছে সে বিকেল পাঁচটায়। ছুটি পেয়েই ছুটে চলে এসেছে সে সদরঘাটে। লঞ্চে চেপে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল সে। চন্দ্রগ্রামের মাথায় লঞ্চ ভিড়বার কথা রাত ন’টায়। কিন্তু বৃষ্টির দরুন দেরি হয়ে
গেল। লঞ্চ চন্দ্রগ্রামে ভিড়ল রাত সাড়ে দশটায়।
লঞ্চ থেকে নেমেই নানা দুর্ভাবনায় পড়ল জাফর। গ্রামের যে ছেলেটি তাকে খবর দিয়েছিল সে হাজারবার বলে দিয়েছে দিনের আলো থাকতে থাকতে গ্রামে, ঢুকতে। তা না হলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। একে ডাকাত তার উপর নরকঙ্কালের ভয়।
চন্দ্রগ্রামে জাফরদের কোন চেনাজানা লোক নেই। থাকলে এত বড় ঝুঁকি নিত জাফর। কিন্তু লঞ্চ থেকে নেমেই ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে চন্দ্রগ্রামেই কোন বাড়ির বারান্দায় বসে রাতটা কাটিয়ে দেবে।’ | কিন্তু খানিক পরই জাফরের মনে পড়ে যায় নরকঙ্কালের কথাটা। নরকঙ্কাল তো শুধু ইছাপুর গ্রামেই দেখা যায় না, দেখা যায় আশপাশের সব কটি গ্রামেই। সেক্ষেত্রে বাইরে একা রাত কাটানো যায় কিভাবে এই তুমুল বৃষ্টির রাতে?
| শেষ অবধি চন্দ্রগ্রামের একটি অপরিচিত বাড়ির দরজার কড়া নেড়ে বসল জাফর। দরজা খুলবে না বাড়ির লোক তেমন আশঙ্কা তার মনে উঁকি মারেনি একবারও। কিন্তু ঝাড়া দশমিনিট চেষ্টা করার পরও যখন বাড়ির ভিতর থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেল না তখন জাফর মনে মনে ঘাবড়ে গেল ভীষণ। ‘
আশ্রয় দেবার মত কেউ নেই একথা মর্মে মর্মে টের পেল জাফর। এদিকে রাত বাড়ছে। বৃষ্টির তেজও যেন বাড়ছে সেই সাথে । হঠাৎ কার উপর কে জানে প্রচণ্ড অভিমানে কান্না পেল জাফরের। চোখের জল ধুয়ে গেল বৃষ্টির পানিতে। জাফর পা ফেলল জোরে জোরে। যা আছে কপালে, বাড়ির দিকেই রওনা হবে সে।
চিনিকল কোম্পানীর রেল পথের উপর দাঁড়িয়ে ইছাপুর গ্রামটা দেখল জাফর। কোথাও কোন মানুষ নেই। প্রচণ্ড বৃষ্টির শব্দ চারদিকে। ছোট ধান খেতটা দ্রুত অতিক্রম করতে করতে জাফরের গা ছমছম করতে লাগল কেন যেন। বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে সে। কিন্তু পিছন দিকে তাকাতে ভয় হচ্ছে। থেকে থেকেই মনে হচ্ছে কে যেন আসছে তার পিছন পিছন।
বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে জাফরের শার্ট আর লুঙ্গি। লুঙ্গিটা সে তুলে
কুয়াশা ৩৭
নিয়েছে হাঁটুর উপর। বৃষ্টির দাপটে চোখ মেলে রাখা দায়। তবু থামছে না জাফর। মনের ভয় জোর করে ঠেলে দুরে সরিয়ে দিয়ে ছুটছে সে।
খেত পেরিয়ে পাকা রাস্তায় উঠতেই জাফরের মনে পড়ে গেল পাকা রাস্তাটা শেষ হলেই পড়বে অন্ধকার মাঠ। তারপর শ্মশান।
শোনের পাশ দিয়েই যেতে হবে মনে পড়ে যাওয়ায় ভয়ে হাত-পা অবশ হয়ে এল জাফরের। চলার বেগ একটু কমল তার। ইচ্ছা হলো গলা ছেড়ে চিৎকার করে সে। কিন্তু চিৎকার করে কোন লাভ নেই জেনে জাফর নিজেকে সাহস দেবার চেষ্টা করতে লাগল।
. পাকা রাস্তাটার দু’পাশে দোতলা তিনতলা বাড়িগুলোর দিকে তাকাতে হাঁটার গতি আরও যেন কমে এল জাফরের। থেকে থেকে দুর্দান্ত হয়ে উঠছে একটা ইচ্ছা। একটা বাড়ির দরজায় ঘা মেরে দেখলে কেমন হয়?
সামনে একটা সরু গলি। গলিটা পাকা রাস্তায় এসে মিলেছে। গলি এবং রাস্তার মাথায় একটি লাইটপোস্ট। জাফর ঠিক করল গলির পাশের বাড়ির পরের বাড়িটার দরজায় ঘা মারবে সে। বাড়িটা চৌধুরী সাহেবদের । জাফরের বাবা বেঁচে থাকতে চৌধুরী সাহেবদের ফাইফরমাশ খাটত।
কিন্তু জাফর গলির কাছাকাছি পৌঁছুবার আগেই গলির ভিতর থেকে লম্বা একটা লোক আচমকা বেরিয়ে এল।
জাফরকে দেখতে পায়নি লোকটা। গলি থেকে বেরিয়েই লোকটি লাইটপোস্টের নিচে দাঁড়াল। কিন্তু সে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্যে। পিছন দিকে একবারও না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল সে।
মুষলধারে বৃষ্টিতে ভিজে জবজবে হয়ে উঠলে কি হবে, আতঙ্কে সারা শরীরের লোম খাড়া হয়ে উঠল জাফরের। দাঁড়িয়ে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল সে। কিন্তু পারল না।
হঠাৎ জাফর অনুভব করল তার নিজের ইচ্ছা শক্তি সম্পূর্ণ লোপ পেয়েছে। দাঁড়াতে চাইলেও সে দাঁড়াতে পারছে না। কাঁদতে চাইলেও সে কাঁদতে পারছে
। চিৎকার করে উঠতে চাইলেও তার গলা দিয়ে এতটুকু শব্দ বের হচ্ছে না।
সম্মুখবর্তী লম্বা লোকটির পরনে কালো একটি রেনকোট। মাথায় একটি জাট। লোকটার কোন তাড়াহুড়ো নেই। এমন তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও স্বাভাবিক পদক্ষেপে
এগিয়ে যাচ্ছে সে।
রেনকোট পরিহিত যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে জাফরকে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। শত চেষ্টা করেও লোকটার আকর্ষণ থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না সে।
পাকা রাস্তার প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে রেনকোট পরিহিত লোকটা। তার, সামনেই একটি লাইটপোস্ট। শেষ লাইটপোস্ট ওটাই। জাফর লোকটার পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে পরিষ্কার। মাত্র পাঁচ ছয় গজ পিছনে সে লোকটার। অথচ মনে
ভলিউম ১৩
–
একবারও কথাটা খেলল না যে তার মত লোকটাও জাফরের পদশব্দ শুনতে পাচ্ছে।
লাইট পোস্টের ঠিক নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল লোকটা। পরমুহূর্তে ঘাড় ফিরিয়ে দ্রুত পিছন দিকে তাকাল সে।
দাঁত বের করে হাসছে প্রকাণ্ড একটি নরকঙ্কালের মুখ। সারাটা মুখে মাংস নেই একবিন্দু। ধীরে ধীরে নরকঙ্কালের একটি হাত উপর পানে উঠছে। রেনকোটে ঢাকা তার’হাত। হাত নেড়ে ডাকছে ‘সে’ জাফরকে।
হাঁ করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠক ঠক করে কাঁপছে জাফর। গলা দিয়ে অদ্ভুত এক ধরনের শব্দ বেরিয়ে আসছে তার। নরকঙ্কালকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল।
পাগলের মত মাথা নাড়ছে জাফর ঘন ঘন। দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে রক্ষা– করার চেষ্টা করছে সে নিজেকে। কিন্তু বড় দুর্বল, সে হাত দুটো। শিশুর হাতের মতই শক্তিহীন। আতঙ্কে বিকৃত দেখাচ্ছে জাফরের মুখটা। দু’পায়ে দাঁড়িয়ে আছে সে, কিন্তু একে ঠিক দাঁড়িয়ে থাকাও বলে না। হাঁটু দুটো বেশ খানিকটা ভাজ হয়ে গেছে। কাঁপতে কাঁপতে বোধহয় বসেই পড়ত, জাফর কিন্তু সে সময় ও পেল না। নরকঙ্কাল সামনে এসে দাঁড়াল। দুই হাত দিয়ে সে ধরল জাফরের গলাটা।
না•••!’ বিকৃত উচ্চারণের ফলে সঠিক বোঝা গেল না জাফবু কি কলল। সম্বত না। শব্দটা উচ্চারণ করতে চাইল সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার গলা দিয়ে শব্দ বের হবার সম্ভাবনা আর রইল না। নরকঙ্কাল তার গলা চেপে ধরেছে প্রচণ্ড শক্তি দিয়ে।
চারদিকে তুমুল বর্ষণের শব্দ। কোথাও আর কোন শব্দ নেই। এমন সময় ঝড়ের মত এগিয়ে এল কি যেন। সবেগে ঝড়টা এসে পড়ল নরকঙ্কালের উপর।
ছিটকে পড়ে গেল জাফর দূরে। পড়িমরি করে উঠে দাঁড়িয়েই সে দেখল দীর্ঘকায় এক লোকের সাথে প্রচণ্ড মারামারি বেধে গেছে নরকঙ্কালের।
দীর্ঘকায় লোকটা কোথা থেকে আশীর্বাদ স্বরূপ এল তা বুঝতে পারল না জাফর। বুঝতে পারত যদি ভুল করেও একবার পিছন ফিরে তাকাত।
দীর্ঘকায় লোকটি নরকঙ্কালকে অনুসরণ করেই আসছিল। গলি থেকে নরকঙ্কাল পাকা রাস্তায় ওঠার সময় দীর্ঘকায় লোকটি বেশ একটু পিছনে ছিল। কঙ্কাল পাকা
• রাস্তা ধরে সামনের দিকে এগোতে জাফর তার পিছু নিল। দীর্ঘকায় লোকটি এর খানিক পরই গলি থেকে বেরিয়ে পাকা রাস্তায় ওঠে। ফলে জাফরের পিছনে পড়ে যায়।
নরকঙ্কাল এবং দীর্ঘকায় লোকটি পরস্পরকে পরাজিত করার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। ওদের মারামারি দেখতে দেখতে জাফর প্রাণপণে ছুট দিল।
দেখতে দেখতে অন্ধকার মাঠের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল জাফর। * নরকঙ্কাল দীর্ঘকায় লোকটির বুকের ওপর বসে পড়েছে ইতিমধ্যে। দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তির গলা টিপে ধরেছে সে। কুয়াশা ৩৭
২৫.
ছায়ামূর্তি হঠাৎ দুই পা তুলে পেঁচিয়ে ধরল নরকঙ্কালের গলা। তারপর প্রচণ্ড এক ঘুসি মারল নরকঙ্কালের মাথায়।
ছিটকে পড়ে গেল নরকঙ্কাল ছায়ামূর্তির বুক থেকে। কিন্তু পরমুহূর্তে উঠে দাঁড়াল সে। | এদিকে উঠে দাঁড়িয়েছে ছায়ামূর্তিও। দুজন দুজনের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। এমন সময়, কোথাও কিছু নেই, গুলির শব্দ শোনা গেল। * বিকট একটা আতাঁর বের হলো দুজনের একজনের গলা চিরে। দুই হাত উপর পানে তুলে দিয়ে হোঁচট খেয়ে দু’পা সামনে বাড়াল সে। তারপর শিকড়হীন গাছের মত সবেগে মুখ থুবড়ে পড়ল অপর জনের পায়ের কাছে। পড়েই নিঃসাড় হয়ে গেল তার দেহটা।
| অপরজন তখন তাকিয়ে আছে বাঁ দিকে, দূরে। সেদিক থেকেই রাইফেলের গুলিটা এসেছে। পাঁচ পরদিন সকালে শুভ সংবাদ রটে গেল ইছাপুর গ্রামে-গত রাতে কোথাও ডাকাতি হয়নি। কিন্তু এই শুভ সংবাদকে অর্থহীন প্রমাণ করল একটি অশুভ সংবাদ ।
পাকা রাস্তার উপর শেষ লাইটপোস্টের নিচে পাওয়া গেল লঞ্চমালিক গোলাম মাওলার লম্বা-চওড়া যুবক ছেলে সালামের লাশ।
সালামকে কে বা কারা গুলি করে খুন করেছে। তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করে বেরিয়ে গেছে গুলি।
সালামের লাশকে ঘিরে করুণ এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। সালামের মা, বোন, ভাই খবর পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল। ভীড় জমাল গ্রামের সব লোক। সকলের মুখেই এক কথা-এ কাজ সেই কঙ্কালের!
কেলা দশটার সময় মি. সিম্পসনও এলেন অকুস্থলে। ইন্সপেক্টর হায়দার আগেই পৌঁছেছিলেন। মি. সিম্পসন লাশ পোস্ট মর্টেমের জন্যে ঢাকায় পাঠিয়ে দেবার হুকুম দিয়ে গোলাম মাওলার বাড়িতে গিয়ে বৈঠকখানায় বসলেন। গোলাম মাওলা সাহেব ভয়ানক আঘাত পেয়েছেন। দুটি মাত্র ছেলে তাঁর। সালামই ছিল বড়। কালাম এখনও হোট। সালামই ছিল তার ভবিষ্যতের স্বপ্ন, আশা। মি, সিম্পসন সান্ত্বনা দেবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। কিন্তু মাওলা সাহেব কোন প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। উত্তর দেবার মত মানসিক অবস্থা তার নেই।
সালাম রাতে বাইরে বেরিয়েছিল কেন এ প্রশ্নের উত্তর বাড়ির কেউই দিতে পারল না।
| আধঘণ্টা পর থানায় ফিরে ইন্সপেক্টরকে বললেন মি. সিম্পসন,, লাশের আশেপাশে দু’জন লোকের পায়ের দাগ ছিল বলে মনে হয়। সালামের ছাড়াও আর
২৬
ভলিউম ১৩
একজনের পায়ের দাগ ছিল ওখানে। কিন্তু বৃষ্টির পানিতে দাগ মুছে গেছে।
গভীর দুশ্চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে ইন্সপেক্টরের চোখে মুখে। মি. সিম্পসনের দিকে তাকিয়ে রইলেন শুধু তিনি। মি, সিম্পসন বললেন, ‘ঢাকায় আমার কাজ আছে। কবে আবার আসতে পারব জানি না। তবে প্রতিদিন এখানে যা যা ঘটে টেলিফোনে আমাকে জানাবেন, ইন্সপেক্টর।’
| “ঠিক আছে, স্যার।
সংক্ষেপে উত্তর দিলেন ইন্সপেক্টর হায়দার।
মি. সিম্পসন বিদায় নিয়ে চলে যাবার পর ইছাপুরের কয়েকজন লোককে সঙ্গে নিয়ে থানায় ঢুকল জাফর।
গতরাতে যা যা ঘটেছে সব খুলে বলল জাফর ইন্সপেক্টরকে। ইন্সপেক্টর যেন কূল দেখতে পেলেন জাফরকে পেয়ে। তাঁর থমথমে মুখ, গভীর কণ্ঠস্বর, সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টি দেখে ভয় পেয়ে গেল জাফর। একটার পর একটা আক্রমণাত্মক প্রশ্ন করে গেলেন ইন্সপেক্টর । সবশেষে তিনি কঠিন কণ্ঠে জানতে চাইলেন, “নিশ্চয়ই সালামের সাথে তোমার শত্রুতা ছিল। তা না হলে কেন তুমি তাকে খুন করলে?
| জাফর ভীত চোখে তাকিয়ে রইল। ইন্সপেক্টরের কথা যেন সে শুনতে পায়নি। জিজ্ঞেস করল, জ্বী, হুজুর!
কেন খুন করে সালামকে?’ ধমকে উঠলেন ইন্সপেক্টর বজ্রকণ্ঠে। ‘আমি…আমি না, হুজুর! আমি কেন খুন করব-হায় আল্লা…! রাখাল! ইন্সপেক্টর হাঁক ছাড়লেন। “জ্বী স্যার।
ব্যাটাকে সেলে ভরে রাখো। হাতের কাজ শেষ হোক তখন দেখব পেটের কথা কিভাবে বের করতে হয়। মারের চোটে ভূত সিধে হয় আর এ ব্যাটা তো মানুষ!
কেঁদে ফেলল জাফর। কিন্তু তাতে কোন ফল হলো না। সেলে নিয়ে গিয়ে। রাখা হলো তাকে। জাফরের সাথে যারা এসেছিল তারা ভয়ে ভয়ে পালিয়ে গেল।
যে-যার বাড়ির দিকে।
সেদিন রাতে আকাশে মেঘ করল না। প্রকাণ্ড একটা চাঁদ উঠল রাত দশটার দিকে। চাঁদের আলোয় ছবির মত ফুটে উঠল ইছাপুর গ্রামটা। | সালাম যেখানে খুন হয়েছে সেখানে পাহারায় রইল সাব ইন্সপেক্টর শরীফ এবং তিনজন কনস্টেবল। ইন্সপেক্টর হায়দার থানাতেই থাকবেন রাত বারোটা অবধি। বারোটার পর দলবল নিয়ে বের হবেন তিনি।
রাত সাড়ে বারোটার সময় দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে হাজির হলেন ইন্সপেক্টর। শরীফের সাথে কথাবার্তা হলো কিছু । শরীফ জানাল, ‘এখনও তো কিছু দেখিনি। তবে গোটা রাতই পড়ে রয়েছে সামনে। কি হয় বলা যায় না। কুয়াশা ৩৭
ইন্সপেক্টর বললেন, ‘ভাটপাড়ার ওদিকে জমাদার, সাকীর আছে। ওদিকে না গিয়ে আমি বরং চন্দ্রগ্রামে যাই একবার। যা আছে কপালে, তুমি কিন্তু ভয় কোরো নীভূতই হোক, কঙ্কালই হোক, অশরীরী আত্মাই হোক, দেখা মাত্র গুলি করবে।
শরীফ চুপ করে রইল। চলে গেলেন দু’জন কনস্টেবলকে নিয়ে ইন্সপেক্টর। রাত বাড়তে লাগল।
সালাম যেখানে খুন হয়েছে গত রাতে তার পাশেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে শরীফ। কনস্টেবল তিনজন পাকা রাস্তার শেষ মাথায় যাচ্ছে একবার করে তারপর আবার ফিরে আসছে।
| রাত আড়াইটার সময় শরীফ হাত ইশারায় ডাকল ওদেরকে।
| ফিরেই আসছিল ওরা। সাব ইন্সপেক্টরের ডাকে দ্রুত পা চালিয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। ওরা কাছে এসে দাঁড়াতে শরীফ মাঠের দিকে তাকিয়ে বলল,
দেখতে পাচ্ছ?’
দেখতে না পাবার কথা নয়। চাঁদের আলোয় গোটা মাঠটা দেখা যাচ্ছে। শ্মশানের দিক থেকে একজন লোক দ্রুত লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে কোনাকুনি।
ভাবে।
* লোক নয়, কঙ্কাল। কঙ্কালের মুখটা পরিষ্কার এতদূর থেকে দেখা না গেলেও মুখের ধবধবে হাড়ে চাঁদের আলো পড়ায় চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না।
পচাগড়ের জঙ্গলের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে লোকটা। কালো একটা চাদর কঙ্কালের গায়ে। বাতাসে উড়ছে সেটা।
নির্বাক নিঃসাড় দাঁড়িয়ে রইল ওরা চারজন। কারও মুখে কথা নেই। কারও চোখে পলক নেই।
মাঠ পেরিয়ে জঙ্গলের ধারে গিয়ে পঁড়িয়ে পড়ল অদ্ভুত জিনিসটা। আবার পা বাড়াল. সে। ডানদিকে গেল কয়েক গজ। আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে আগের জায়গায় ফিরে এল।
কিছু যেন খুঁজছে!’ কয়েকবার ঢোক গিলে বলল শরীফ।
আর কেউ কোন মন্তব্য করল না। রাখাল বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ভগবানকে ডাকছে সম্বত।
হাশেম কিন্তু কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। জিনিসটা যখন মাঠের মধ্যে ছিল তখন সে দেখেছে বটে কিন্তু তারপর সেই যে চোখ বন্ধ করে রেখেছে আর খোলেনি।
রাইফেল নামাল জব্বার কাঁধ থেকে । | ‘গুলি করবে?’
শরীফ জিজ্ঞেস করল। সে-ও রিভলভারের জন্যে পকেটে হাত ঢুকিয়ে
ভলিউম ১৩
দিয়েছে।
রাখাল চোখ বন্ধ করেই কাঁদ কাঁদ গলায় বলে উঠল, না! না! ভগবানের দোহাই…!’
শরীফ বলল, মনে হয় রাইফেলের গুলিও ঠিকমত যাবে না। অনেক দূর•••।’
জব্বার রাইফেলটা পাকা রাস্তার উপর নামিয়ে রেখে বলে উঠল ফিসফিস করে, আমাকে মাফ করুন, স্যার । আমি পারব না।’
শরীফ জোর করে হাসার চেষ্টা করুল। তুলে নিল সে রাইফেলটা। রাইফেল তাক করে ট্রিগার টেপার পূর্ব মুহূর্তে “জিনিসটা নড়ে উঠল আবার।
এবার সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। জঙ্গলে ঢুকবে বলে মনে হচ্ছে। পালাচ্ছে নাকি? বুঝতে পেরেছে গুলি করা হবে? কিন্তু বুঝল কিভাবে? পিছন ফিরে তো একবারও তাকায়নি। তবে ‘ওদের কথাই আলাদা। ওদের জানতে বাকি থাকে
কিছু। ওরা সব দেখতে পায়, সারা গায়েই ওদের শত শত চোখ আছে। |
গর্জে উঠল শরীফের হাতের রাইফেল।
কিন্তু ‘জিনিসটা’ সাবলীল গতিতে জঙ্গলে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাকালও না একবার।
সে-রাতেও ডাকাতি হলো। ডাকাতি হলো ভোরের দিকে। সাব ইন্সপেক্টর শরীফ এবং তিনজন কনস্টেকল যেখানে ছিল দিনের আলো ফোঁটা অবধি সেখান থেকে মাত্র একশো গজের মধ্যে ডাকাতি হলো অথচ ওরা কিছু জানতেই পারল না।
| এবার ডাকাতরা অন্য এক কৌশলে ডাকাতি করেহে। ডাকাতরা যে কী ভয়ঙ্কর প্রকৃতির, মায়ামমতা বলে যে কিছুই নেই তাদের, তা প্রমাণ হয়ে গেল সে রাতের ঘটনায়।
সালাম গত রাতে খুন হয়েছে। স্বভাবতই গোলাম মাওলা সাহেবের বাড়িতে নেমে এসেছে শোকের কালো হয়। ডাকাতরা চুপিচুপি গোলাম মাওলাদের বাড়িতেই ঢুকল। গোলাম মাওলার নাম ধরে ডাকাডাকি করে দরজা খোলায় তারা। গোলাম মাওলা একাই তখন জেগেছিলেন বিছানায়। ঘুমুতে পারছিলেন না তিনি। ‘ দরজা খুলতেই ডাকাতরা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গলা টিপে খুন করে তাকে ডাকাতরা। শুধু গোলাম মাওলাকেই নয়, একে একে তারা গোলাম মাওলার স্ত্রী, ছোট ছেলে এবং মেয়েকে খুন করে ঘুমন্ত অবস্থায়।
সালামের মৃত্যুর খবর শুনে ঘনিষ্ঠ কিছু আত্মীয় এসেছিল দূর-গ্রাম থেকে। তাদের মধ্যে একজনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সম্বত। ডাকাতরা সেই বৃদ্ধকেও খুন করে গেছে। গহনা আর টাকা, কিছুই রেখে যায়নি।
সকালে পাঁচটা লাশ পাওয়া গেল। চারটে বিছানাতেই। গোলাম মাওলার লাশটা পাওয়া গেল দোর গোড়ায়।
।
কুয়াশা ৩৭,
সারাটা দিন গ্রামের মানুষের খাওয়া দাওয়া হলো না। মি. সিম্পসন না এলেও উচ্চ পদস্থ কয়েকজন পুলিস অফিসার চাক্ষুষ করে গেলেন লোমহর্ষক দৃশ্যটা। ইন্সপেক্টর হায়দারের সাথে রূদ্ধদ্বার কক্ষে আলাপ করলেন তারা। তারপর চলে গেলেন। রিপোর্ট নিয়ে।
মি. সিম্পসনকেও রিপোর্ট পাঠালেন ইন্সপেক্টর।
দিন গড়িয়ে রাত এল। গোটা এলাকায় নেমে এল আতঙ্ক। জানালা দরজা বন্ধ করে গ্রামবাসীর সজাগ হয়ে বসে রইল। ক্রমশ গম্ভীর হলো রাত। গোটা ইছাপুরে ছড়িয়ে পড়ল পঁচিশ তিরিশ জন কনস্টেবল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। পাশ্ববর্তী থানা থেকে সাহায্য হিসেবে এসেছে বেশ কয়েকজন কনস্টেবল।
সে-রাতেও দেখা গেল সেই জিনিসকে। শম্মানের দিক থেকে এসে জঙ্গলের ভিতর প্রবেশ করল সে। দূর থেকে দেখল তাকে একদল কনস্টেবল। পাঁচ রাউন্ড গুলিও প্রল তারা। কিন্তু একটি বুলেটও তার গায়ে লাগল না। বেশ দূর থেকেই গুলি করেছিল পুলিসবাহিনীর লোকেরা।
সে-রাতে ডাকাতি হলো না।
ডাকাতি হলো না পরের রাতেও। কিন্তু সেই জিনিসকে ঘুর ঘুর করতে দেখা গেল ঠিকই পচাগড় জঙ্গলের ধারে। ঘুর ঘুর করতে করতে শেষ পর্যন্ত প্রত্যেকবার। সে প্রবেশ করে জলে।
| দিন চারেক বেশ ভালই কাটল। কোথাও কোন ডাকাতি হলো না এই কদিন। ইন্সপেক্টর হায়দার আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন আবার। রোজ সন্ধ্যায় রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন তিনি মি. সিম্পসনের কাছে টেলিফোনে। ডাকাতি হয়নি এখবর শুনে মি. সিম্পসন খুশি। কিন্তু নরকঙ্কালের কথা শুনে রীতিমত খেপে ওঠেন তিনি।
পঞ্চম দিন সন্ধ্যায় মি, সিম্পসনকে ফোন করে গত রাতের রিপোর্ট দিলেন ইন্সপেক্টর। কথায় কথায় ইন্সপেক্টর জিজ্ঞেস কলেন, আপনি আমাদের এলাকায় আবার একবার আসুন না, স্যার।
কোন বিশেষ কারণ আছে?’ জানতে চাইলেন মি. সিম্পসন।
একটু রিতি নিয়ে ইন্সপেক্টর বললেন, আপনি এলে সাহস বাড়ে, স্যার। তাই বলছিলাম।’
‘আই সি। ঠিক আছে, যাব। তবে কবে যাব বলতে পারছি না। তাছাড়া ফোনে সে-কথা না বলাই ভাল, কি বলেন?’
| তা তো নিশ্চয়ই, স্যার।’
কাল রিপোর্ট পাঠাবেন। ছাড়ছি।’
সন্ধ্যার সময় ফোনে আলাপ করলেম, মি, সিম্পসন ইন্সপেক্টর হায়দারের সাথে আর রাত ন’টার সময় তাঁকে দেখা গেল চন্দ্রগ্রামে।
ভলিউম ১৩
৩০।
স্পীড বোটে চড়ে চন্দ্রগ্রামে পৌঁছুতে খুব বেশি সময় লাগেনি মি. সিম্পসনের। কৃতিত্বটুকু অবশ্যি তার সঙ্গে সুদর্শন যুবকটির। সে-ই চালিয়ে নিয়ে এসেছে স্পীড বোট।
রাত নটাতেই চন্দ্রগ্রাম জনশুন্য, খা খা করছে। লঞ্চ ঘাটে স্পীড বোট রেখে নৌকা নিলেন মি. সিম্পসন। সঙ্গীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, কোন শব্দ করা চলবে না, রাসেল। খুব সাবধানে যেতে হবে আমাদেরকে। বিশেষ করে খালে. ঢুকে।
| ভারী গলায় মৃদু হাসি শোনা গেল মাত্র। রাসেল কথা না বলে ছেড়ে দিল নৌকো।
নৌকো এসে থামল পচাগড় জঙ্গলের ভিতর। নৌকো থেকে নেমে ওরা দুজন প্রবেশ করুল জ্বলে। | পালটা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে চলে গেছে। খাল থেকে ইছাপুরের শ্মশান বা মাঠ খুব বেশি দূরে নয়। ওরা যেখানে নৌকো থেকে নামল সেখান থেকে পঞ্চাশ কি ষাট গজ গেলেই জঙ্গল শেষ। জঙ্গলের যেখানে শেষ সেখানেই ইছাপুরের প্রকাণ্ড মাঠের
রু। মাঠের উপর দিয়ে কোনাকুনি গেলে পড়ে শ্মশান।
জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে চলল ওরা। মি. সিম্পসনের হাতে রিভলভার। রাসেলের হাতেও রয়েছে একটা। আগে আগে হাঁটছেন মি. সিম্পসন। পিছনে দীর্ঘকায় রাসেল।
| জঙ্গল শেষ হয়ে এসেছে। মি. সিম্পসন দাঁড়িয়ে পড়লেন। ভাল করে দেখতে শুরু করলেন তিনি উঁকি মেরে সামনের দৃশ্যটা।
চাঁদের আলোয় সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। সামনেই প্রকাণ্ড মাঠ। বহুদূরে পাকা রাস্তা। লাইটপোস্ট।
‘এখানেই আসে, বুঝলে রাসেল, মি. সিম্পসন ফিসফিস করে জানালেন। ‘রোজ আসে? একদিনও বাদ যায় না?’ প্রশ্ন করল রালে।
অন্যমনস্কভাবে মি. সিম্পসন বললেন, ইন্সপেক্টর হায়দারের রিপোর্ট তো সে কথাই বলে।’
‘আসুন। | মি. সিম্পসন ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন রাসেলের দিকে। জানতে চাইলেন, কোথায়?’
‘ওই বট গাছের আড়ালে বসি চলুন। আপনার কঙ্কাল গভীর রাত ছাড়া তো আসে না। খামকা পঁড়িয়ে থেকে দুই পা বেচারীকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।
এগিয়ে চলল রাসেল। প্রকাণ্ড বট গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসল ওরা।
রেডিয়াম লাগানো ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় রাসেল বলল, ‘মাত্র নটা কুয়াশা ৩৭
চল্লিশ হয়েছে। অন্তত চার ঘন্টা সময় পাচ্ছেন। ইচ্ছা করলে লম্বা হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে নিতে পারেন। চিন্তা নেই, আমি জেগে থাকব।
‘শোব? ঘুমিয়ে নেব? এখানে? এই মাটিতে?’ মি. সিম্পসন অবাক হয়ে বললেন।
হেসে ফেলল মৃদু স্বরে রাসেল। বলল, “পুলিস অফিসারের দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় দু’যুগ ধরে। অথচ এখনও. পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে শেখেননি দেখছি। | তা নয় ।’
মি, সিম্পসন কি বলবেন ভেবে পেলেন না। রাসেল প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে জিজ্ঞেস করল, কুয়াশা তাহলে এদিকেই আছেন?
‘আপনি কি সন্দেহ করেন সে ডাকাতির সাথে জড়িত?
মনে হয় না।’
• সেক্ষেত্রে এখানে কেন সে?
সেটা তো আমারও প্রশ্ন। রাসেল একমনে খানিকক্ষণ চিন্তা করল। তারপর বলল, “নিশ্চয়ই কোন উদ্দেশ্য আছে কুয়াশার। উদ্দেশ্যটা সবত এই, ডাকাতদের সঞ্চিত সম্পদের মালিক হতে চায় সে। তারমানে চোরের ওপর বাটপারি করার উদ্দেশ্য নিয়েই কুয়াশা এদিকে এসেছে।’
মি. সিম্পসন লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘এজ্যাক্টলি সো! থ্যাঙ্ক ইউ, মাই বয়। সত্যি, তোমার বুদ্ধির প্রসংশা না করে পারছি না। কথাটা একবারও আমার মাথায় খেলেনি•• || | বাধা দিয়ে রাসেল বলল, “আস্তে কথা বলুন, মি. সিম্পসন। তা না হলে আমাদের এখানে আসার উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে।’
বড় বড় মশার কামড় নীরবে সহ্য করতে করতে অপেক্ষা করছে ওরা।
| রাত হয়েছে অনেক। চিনিকলের পেটা ঘড়িতে দুটো বেজেছে অনেক আগেই। আড়াইটা প্রায় বাজে। অধৈর্য হয়ে উঠছেন মি. সিম্পসন। বারবার রিক্তি প্রকাশ করছেন তিনি। বলছেন, এমন জানলে আসতামই না।’
কোন রকমে হাসি চেপে অপেক্ষা করছে রাসেল। হঠাৎ একসময় মাঠের দিকে তাকিয়ে ও বলে উঠল, ‘ওই যে, মি. সিম্পসন। তিনি আসছেন। | রাসেলের গলায় ব্যঙ্গ ফুটে উঠলেও মি. সিম্পসন উত্তেজিত ভাবে সিধে হয়ে বসলেন। মাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন, কই!
ভাল করে দেখুন–আসছে।’
ভলিউম ১৩
খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ঠিকই একটি ছায়ামূর্তিকে দেখতে পেলেন মি. সিম্পসন।
মেঘে ঢাকা পড়ে গেছে চদি। তবু পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছায়ামূর্তিকে। যদিও ছায়ামূর্তির চোখ-মুখ-নাক গাল বা তার পোশাক আশাক কিরকম তা বোঝা যাচ্ছে
। কিন্তু কেউ যে একজন এইদিকেই দ্রুত, প্রায় ছুটতে ছুটতে এগিয়ে আসছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
মাঠের উপর দিয়ে হন হন করে এগিয়ে আসছে ছায়ামূর্তি। মাঝেমধ্যে পিছন ফিরেও তাকাচ্ছে সে। পরনে সম্ভবত একটি আলখাল্লা, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। তবে কালো চাদরও হতে পারে ওটা, গায়ে জড়ানো।
. দেখতে দেখতে একেবারে কাছে এসে পড়ল ছায়ামূর্তি। জঙ্গলের ধারে এসে এদিক ওদিক তাকাল সে ল ভাবে। পা বাড়াল হঠাৎ, যেন জঙ্গলে ঢুকতে চায়। কিন্তু কি মনে করে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছন ফিরে তাকাল আবার। তারপর
আবার চারদিকে তাকাল চঞ্চল ভাবে। |
মি. সিম্পসন উঠে দাঁড়িয়েছেন। তার পাশেই রয়েছে রাসেল। দুজনের হাতেই রিভলভার। দুজনেই মোটা বট গাছের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে উঁকি মেরে দেখছে ছায়ামূর্তিকে।
ছায়ামূর্তি ওদের কাছ থেকে মাত্র হাত দশেক দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চঞ্চল ভাবে চারদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ সে পা বাড়াল।– আর দেরি করা উচিত নয়। মি. সিম্পসনের গায়ে একটা খোঁচা দিয়ে রাসেল, লাফিয়ে পড়ল হায়ামূর্তিকে লক্ষ্য করে।
চোখের পলক পড়তে না পড়তে দেখা গেল ছায়ামূর্তিকে দুই হাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলেছে রাসেল।
ছায়ামূর্তি চিৎকার করছে আর্ত স্বরে, ও মাই গড! ও মাই গড হেল্প, মি. কুয়াশা হেলপ মি-ফর গডস সেক••!’
ডি. কস্টাকে ছেড়ে দিয়ে চারদিক সচকিত করে দিয়ে হেসে উঠল রাসেল হাঃ হাঃ করে।
মি. সিম্পসন রাগে, দুঃখে পারলে নিজের চুল হেঁড়েন। কোথায় নরকঙ্কাল। জলজ্যান্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে ডি. কস্টা। অবিরাম চেঁচাচ্ছে সে। সাহায্য চাইছে। কুয়াশার।
প্রচণ্ড এক ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন, মি. সিম্পসন ডি. কস্টাকে। ডি কস্টা, এতক্ষণে চিনতে পারল ওদেরকে। চিনতে পেরেই সে সামলে নিল নিজেকে। গায়ের কালো চাদরটা ঠিকঠাক করে নিয়ে সে ভারিক্কি চালে বলল, তা আপনারা এডিকে কি উচ্চাশা নিয়ে উপস্তি হইয়াছেন জানিটে পারি কি, মাই ফ্রেণ্ডস্?
মি. সিম্পসন ধমকে উঠলেন, এত রাতে আপনি কেন এদিকে এসেছেন? ৩-কুয়াশা ৩৭
৩৩
হঠাৎ ডি. কস্টা চট করে বলে উঠল, ‘বী কেয়ারফুল, ওরা আসিটেছে। ‘ওরা কারা? জানতে চাইল রাসেল। ‘ওরা? তা জানি না। বাট, আসিটেছে।’
কেন আসছে?’ আবার জিজ্ঞেস করল রাসেল।
মার্ডার করিটে আসিটেছে। হামাকে ওরা মার্ডার করিটে চেষ্টা করিবে, মাই ফ্রেণ্ড। আমার ফ্রেণ্ডই আমাকে কেয়ারফুল ঠাকটে বলিয়া ডিয়াছেন।’
কুয়াশা কোথায়, জানেন? জানতে চাইলেন মি. সিম্পসন। জানি, অফকোর্স জানি। কি বলিব না।’ আচমকা চারদিক কাঁপিয়ে মাথার উপর থেকে গর্জে উঠল’একটি রাইফেল। | চমকে উঠে উপর দিকে তাকাল ওরা। প্রকাণ্ড বট গাছের মগডালে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তিকে।
ছায়ামূর্তির দিকে রিভলভার তুলে ধরল রাসেল এবং মি. সিম্পসন।
মি. সিম্পসন কঠোর কণ্ঠে বলে উঠলেন, যে-ই হও তুমি নেমে এসো ভালোয় ভালোয়।
কিন্তু হায়ামূর্তি তার আগেই নামতে শুরু করেছে গাছ থেকে। বড় অদ্ভুতভাবে গাছ থেকে নামছে সে।
বট গাছটা যেমন উঁচু তেমনি চওড়া। এক একটি প্রধান শাখায় একজন করে লোক শুয়ে থাকতে পারে। ছায়ামূর্তি গাছের মাথা থেকে বাদুড়ের মত দুই হাত বিস্তার করে শূন্যে লাফিয়ে পড়ছে। নামছে চওড়া একটি শাখায়। তারপর সেখান থেকে আবার লাফিয়ে পড়ছে নিচের একটি মোটা শাখার উপর। এমনি করে পাঁচ ছয়টা লাফ দিয়ে প্রকাণ্ড কালো বাদুড়ের মত মাটিতে এসে নামল ছায়ামূর্তি।
‘. সব গোলমাল করে দিয়েছেন আপনারা, কলল কুয়াশা।
তার মানে? ঝাঁঝাল গলায় বলে উঠলেন মি. সিম্পসন, কি বলতে চাও তুমি?
কুয়াশা গভীর স্বরে বলল, ‘বলতে চাই আপনারা চেঁচামেচি করে সব নষ্ট করে ফেলেছেন। নির্ঘাৎ ধরতাম আজ ওদেরকে। কিন্তু…।’
কাদেরকে ধরার কথা বলছ তুমি?’ কৌতূহল দমন করতে না পেরে প্রশ্ন করলেন মি. সিম্পসন।
কিন্তু, অন্য এক প্রশ্ন করে প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে বাধ্য করল রাসেল, ‘গুলি করলেন কাকে, মি. কুয়াশা?’
কুয়াশা জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে ঢুকতে বলল, “চলো, দেখি। গুলি লেগেছে, তবে লাশটা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
‘কার লাশ? কাকে গুলি করেছেন আপনি? বেশ একটু কঠোর স্বরেই প্রশ্ন দুটো করল রাসেল।
ভলিউম ১৩
৩৪
কুয়াশা আগে আগে হাঁটতে হাঁটতে মুচকি হাসল। তারপর বলল, চলো, সব, নিজের চোখেই দেখতে পাবে। নীরবে কুয়াশাকে অনুসরণ করল ওরা।
খালের ধারে পৌঁছে কুয়াশা বলল, নৌকোটা কাজে লাগল। ওপারে যেতে হবে আমাদেরকে।
রাসেলরা যে নৌকোয় এসেছিল সেই নৌকোয় চড়ে বসল ওরা চারজন।
খালের অপর পাড়ে নেমে কিনারা ধরে হাঁটতে লাগল কুয়াশা। পকেট থেকে একটা, পেন্সিল টর্চ বের করেছে সে। টর্চের আলোয় পথ দেখতে দেখতে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে খালের পাড় ধরে।
এক সময় দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা। তার দুই পাশে এসে পঁড়াল রাসেল ও মি,
সিম্পসন।
রক্ত!’ মি. সিম্পসন অস্ফুটে উচ্চারণ করলেন।
কুয়াশা চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে উঠল, “এখানেই গুলি খেয়েছে লোকটা। কিন্তু গেল কোথায়?
রক্তের দাগ অনুসরণ করে খালের পাড় থেকে সরে ওরা জঙ্গলে প্রবেশ করল। আর মাত্র দশ গজ এগোবার পর আবার পঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশ।
বাই দেখল লাশটাকে। লাশের মুখে কুয়াশার পেন্সিল টর্চ পড়ল। সুদর্শন এক যুবকের লাশ।
কুয়াশা নিচু গলায় শুধু বলল, “জহুর ব্যাপারীর ছেলে কাদির।’ ‘জঙ্গলে কি ছিল?’ মি, সিম্পসন প্রশ্ন করলেন।
রাসেল তীব্র কণ্ঠে বলে উঠল সাথে সাথে, জঙ্গলে সে যে কারণেই আসুক, আপনি একে গুলি করে খুন করলেন কেন, মি. কুয়াশা!
. কুয়াশা সরাসরি তাকাল রাসেলের দিকে। কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকার পর সে একটু হাসল। তারপর বলল, গুলি করার অবশ্যই কারণ ছিল। সে কারণ এখন বলব না। তবে একদিন বলব। কিন্তু আমার গুলিতে কাদির মরেছে একথা প্রমাণ করতে পারবে তুমি, রাসেল?’
কুয়াশার কথা শুনে লাশটার দিকে ভাল করে তাকাল রাসেল।
কুয়াশা ঝলল, “আমি যখন ওকে লক্ষ করে বট গাছের ওপর থেকে গুলি করি তখন ওর পরনে সাদা রঙের প্যান্ট ছিল না। প্রমাণ করতে পারি আমি।
কুয়াশাকে প্রমাণ কতে হলো না। রাসেলের চোখেই ধরা পড়ল ব্যাপারটা।
আশ্চর্য ব্যাপার সন্দেহ নেই। রাসেল দেখল কাদিরের ডান পায়ের উরুতে গুলি লেগেছে। অথচ সাদা প্যান্টের কোথাও ছিদ্র নেই এতটুকু। প্যান্ট ছিদ্র না করে বুলেট ঢুকল কি করে উরুতে? “ এ রহস্যের একটিই সমাধান। গুলি লাগার পর প্যান্ট বদল করেছে কাদির। বদল করেছে বা বদল করতে বাধ্য হয়েছে, কারও নির্দেশে। কুয়াশা ৩৭ ।
৩৫
আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করো। উরুতে গুলি খেয়ে কেউ এত তাড়াতাড়ি মারা যায় না। কাদিরও মারা যায়নি। ওকে হত্যা করা হয়েছে অন্য উপায়ে। ওর গলার দিকে ভাল করে তাকাও। আঙুলের দাগ দেখতে পাবে।
| কুয়াশার এ কথাও সত্য প্রমাণিত হলো।
মি. সিম্পসন বিমূঢ় হয়ে বলে উঠলেন, তারমানে কাদিরের সাথে আরও লোক ছিল। তারাই কাদিরকে খুন করে রেখে গেছে। কারণ কি? কাদির আহত হয়েছে বলে? ধরা পড়ে যাবে বলে? তবে কি কাদিররাই ডাকাতি করে বেড়াচ্ছে একটার পর একটা?’,
কুয়াশা হেসে ফেলল। বলল, ‘এত প্রশ্ন?
তুমি জানো এসব প্রশ্নের উত্তর?’
কুয়াশা গম্ভীর হয়ে উঠল। বলল, ‘সব জানি না। তবে জানতে আমাকে হবেই।
• সময় আসুক, আপনাদেরকে জানাব। কথা দিচ্ছি।’
• বিদায় নিয়ে চলে যাবার আগে একটি সিগারেট কেস উপহার দিল, কুয়াশা রাসেলকে। বলল, “এটা সবসময় সঙ্গে সঙ্গে রেখো। মিনি ওয়্যারলেস। দরকার। হলে তোমাকে ডাকব। চললাম।’
কুয়াশার দীর্ঘ শরীরটা দেখতে দেখতে অদৃশ্য হয়ে গেল জঙ্গলের ভিতর।
ছয় সে রাতে ডাকাতি হলো না। কিন্তু চন্দ্রগ্রামের মাতবরের ছেলে ইয়াসিনকে পাওয়া গেল না কোথাও।
ইয়াসিন পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের যুবক। লেখাপড়া মোটামুটি শিখেছিল। কিন্তু আচার ব্যবহারে তার কোন ছাপ ছিল না। জুয়া খেলত, মদ খেত । মাঝেমধ্যে ঠিকাদারীর কাজ করে ভাল পয়সাই পেত।
সেদিন রাতে যথারীতি খাওয়াদাওয়া সেরে নিজের ঘরে ঘুমুতে যায় সে। পরদিন সকালে উঠে দেখা যায় তার ঘরের দরজা খোলা। ভিতরে সে নেই।
‘ নেই তো নেই-ই। সারাদিন খুঁজেও তার কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। ‘
রাত নামল। কিন্তু ইয়াসিন ফিরল না বাড়িতে।
মাতবরের স্ত্রী সারা দিন ধৈর্য ধরে হিল। কিন্তু রাত নামার সাথে সাথে গলা ছেড়ে কাঁদতে শুরু করল। মাতব্ব শুকনো মুখে পায়চারী করতে লাগল শুধু। | রাত, বারোটার দিকে ক্লান্ত হয়ে মাতবরের প্রৌঢ়া স্ত্রী কান্না থামিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
বাঘের মুখোশ মুখে লাগিয়ে একদল লোক মাতবরের বাড়ির পিছন দিকের * দেয়ালের উপর চড়ে বসেছে তখন।
এমন সময় কালো আলখাল্লা পরিহিত এক দীর্ঘকায় ছায়ামূর্তিকে দেখা গেল
ভলিউম ১৩
–
মাতবরের বাড়ির দোতলার ছাদে।
: ছায়ামূর্তি ছাদের কিনারায় শুয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। তার হাতে একটি রাইফেল। পাশে একটি স্টেনগান।
: পাঁচিলের উপর উঠে বসেছে লোকগুলো। দোতলার ছাদ থেকে ছায়ামূর্তি গুলি করল পাচিলের উপর দাঁড়ানো একটি লোককে লক্ষ্য করে।
. রাইফেলের গর্জনে চারদিকের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল ।
গুলিবিদ্ধ লোকটি পড়ে গেল পাঁচিলের নিচে, বাড়ির বাইরে। অপর লোকগুলো : সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বাগিয়ে ধরে ব্রাশ ফায়ার করতে শুরু করল এদিক সেদিক।
দোতলার ছাদে শোয়া অবস্থায় ছায়ামূর্তি এবার তুলে নিল স্টেনগানটা। ‘
স্টেনগানের ফাঁকা শব্দ করল এবার সে। চোখের পলকে পাঁচিলের উপর থেকে। লাফিয়ে পড়ল বাঘের মুখোশ পরা লোকগুলো। নেমেই তারা প্রাণপণে ছুটল।
‘দোতলার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামল ছায়ামূর্তি নিচে। তারপর দৌড়ে গেল পাচিলের কাছে। |
বুলেটবিদ্ধ লোকটির পাশে গিয়ে দাঁড়াল সে। এক মুহূর্ত কি যেন ভাবল। মুখোশ পরিহিত লোকটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। ছায়ামূর্তি আচমকা লোকটার কপালের ডান পাশে সজোরে একটি লাথি মারল।
. স্থির হয়ে গেল লোকটার দেহ। জ্ঞান হারিয়েছে সে ছায়ামূর্তির লাথি খেয়ে। জ্ঞান ফিরতে অন্তত একঘণ্টা লাগবে লোকটার।
মুখোশ পরা লোকগুলো যে পথ ধরে পালিয়েছে সেই পথ ধরে ছুটতে লাগল ছায়ামূর্তি।
মুখোশ পরা লোকগুলো দ্রুত হাঁটছে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। নিচু গলায় উত্তেজিতভাবে কথা বলছে তারা। সংখ্যায় তারা মোট ছয় জন। সবচেয়ে মোটা এবং ভারী লোকটা কর্কশ গলায় বারবার বলছে, ওস্তাদ গেল কোথায়! ওস্তাদকে
তো পাচিলের ওপর দেখিনি।’
অন্য একজন বলল, ওস্তাদ বড় চালাক লোক। টের পেয়েছিল সে আগে। কেটে পড়েছে বিপদ দেখেই।’
| আমরা এখন করবটা কি?’ জানতে চাইল অপর একজন।
সবচেয়ে বেঁটে লোকটি বলল, কি আর করব। আস্তানায় অপেক্ষা করি চলো। ওস্তাদ আসুক।
মোটা লোকটা দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, কিন্তু ওস্তাদ যদি না ফেরে? গুলিটা করল কে বলো দেখি। আচ্ছা, ওস্তাদের লাগেনি তো গুলি?’
কয়েকজন একযোগে বলে উঠল, দূর দূরা : কুয়াশা ৩৭,
অন্য একজন বলল, ওস্তাদ খাবে গুলি? উঁহু, ওস্তাদের মরণ এত তাড়াতাড়ি হতেই পারে না।’
দ্রুত পায়ে, সশব্দে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ওরা কথা বলতে কলতে। কেউ যে ওদেরকে অনুসরণ করতে পারে সে কথা ভুলেও ভাবছে না ওরা।
কিন্তু দীর্ঘাকৃতি সেই ছায়ামূর্তি ঠিকই অনুসরণ করে চলেছে ওদের ছয়জনকে।
খালের ধারে এসে দাঁড়াল ওরা। নৌকো ছিল, আগে থেকেই। নৌকো করে খাল অতিক্রম করল ওরা। ছায়ামূর্তি নিঃশব্দে নামল খালে। দ্রুত সাঁতার কেটে অপর পাড়ে পৌঁছুল সে। ছয়জন লোক তখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকে পড়েছে। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই, ছায়ামূর্তি তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে। | মুখোশ পরা লোকগুলো আরও দশ মিনিট একনাগাড়ে হাঁটার পর প্রকাণ্ড একটি বট গাছের সামনে এসে দাঁড়াল। এদিক ওদিক না তাকিয়ে ছয়জনের একজন বটগাছের মোটা কাণ্ডের গায়ে হাত দিয়ে একটি বোতাম খুঁজতে লাগল।
| বোতামটা পাওয়া গেল নির্দিষ্ট জায়গাতেই। বোতামে চাপ দিল লোকটি। বট গাছের মোটা কাণ্ডের গায়ে দেখা গেল ছোট একটি দরজা।
দরজা গলে একে একে ছয়জন প্রবেশ করল বট গাছের ভিতর।
ছায়ামূর্তি মাত্র তিন হাত দূর থেকে ছয়জন মুখোশ পরা লোকের কীর্তিকলাপ সবই দেখল।
| বট গাছের গায়ের দরজা আবার বন্ধ হয়ে গেল আপনা আপনি। ছায়ামূর্তি সেখানে আর দাঁড়াল না।
একটা ঝড় যেন জঙ্গল ভেদ করে খানিকপর বেরিয়ে এল চন্দ্রগ্রামে। ঝড় নয়, একজন দীর্ঘাকৃতি মানুষ, সেই ছায়ামূর্তি। |
| মাতবরের বাড়ির ভিতর তখন মহা শোরগোল শুরু হয়ে গেছে। গুলির শব্দে : ছুটে এসেছেন মি. সিম্পসন, রাসেল, শরীফ এবং কয়েকজন কনস্টেবল। ইন্সপেক্টর হায়দার কাছে পিঠে নেই। তাকে মি. সিম্পসন সন্ধ্যার পরই পাঠিয়েছেন মধুগ্রামে।
* মাতবরের বাড়ি পুলিসের বুট জুতোর শব্দে মুখর হয়ে উঠেছে।
এদিকে প্রায় ঘন্টাখানেক পর ছায়ামূর্তি বাড়ির পিছন দিককার পাঁচিলের কাছে, এসে দাঁড়াল।..
মুখোশ পরা জ্ঞানহীন লোকটি সেই আগের জায়গাতেই নিঃসাড় পড়ে আছে।
ছায়ামূর্তি দ্রুত লোকটার পোশাক খুলে পরে নিল নিজে। নিজের পোশাক পরিয়ে দিল লোকটাকে। ছায়ামূর্তি মুখোশটা পরতেও ভুলল না।
জ্ঞানহীন লোকটিকে ছায়ামূর্তি অবলীলাক্রমে তুলে নিল নিজের কাঁধে। তারপর আবার সে দ্রুত পা বাড়াল জঙ্গলের দিকে।
না।
কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারল না মাতবর। তবে একটা কথা বাড়ির সবাই স্বীকার
৩৮.
ভলিউম ১৩
করল-দু’দলে গুলি বিনিময় হয়েছে। | রাসেল বলল, “মি. সিম্পসন এভাবে সময় নষ্ট করার কোন মানেই হয় না। চলুন বাড়ির চারপাশটা ভাল করে একবার দেখি। প্রথম থেকেই কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে আমার।’.
‘কি সন্দেহ হচ্ছে তোমার?
রাসেল বলল, মাতবর সাহেব বলছেন, তার বাড়ির ছাদ থেকে কেউ গুলি চালিয়েছে। এর অর্থ কি? নিশ্চয়ই কাউকে লক্ষ্য করে চালানো হয়েছে গুলি। গুলি যখন বাড়ির পিছন দিকে চালানো হয়েছে ছাদ থেকে ওদিকে নিশ্চয়ই এমন কিছু পাওয়া যাবে।’ | রাসেলের কথা শেষ হলো না, তার আগেই ওর পকেট থেকে যান্ত্রিক শব্দ বের হলো, কিরিং কিরিং!
মি. সিম্পসন খানিকটা উত্তেজিত হয়েই বলে উঠলেন, কুয়াশা কথা বলতে চাইছে!’
পকেট থেকে সিগারেট কেস সদৃশ ওয়্যারলেসটা বের করে রাসেল। ক্ষুদ্র একটি বোতাম টিপে মুখের সামনে তুলে ধরে বলল, রাসেল বলছি।’
ইথারে ভেসে এল কুয়াশার কণ্ঠস্বর, তোরা মাতবরের বাড়িতে রয়েহু, তাই? তা যেখানেই থাকো, পচাগড়ের জঙ্গলে ঢোকো, যদি ধরতে চাও ডাকাত দলকে। আমি পথের হদিস দিচ্ছি। খাল পেরিয়ে প্রথমে খুঁজে বের করবে পাশাপাশি একজোড়া পেয়ারা গাছ। ডান পাশের গাছটায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াবার র সোজা নাক বরাবর যেদিক মনে হয় সেদিক পানে হাঁটবে। পঞ্চাশ গজ হাঁটলেই আমার দেখা পাবে। খুব সাবধানে, এসো মি, সিম্পসনকেও নিয়ে এসো। এবং তাঁর ক্ষুদ্র বাহিনীকেও নিয়ে আসতে ভুলো না।’
| ঠিক আছে।’
কানেকশন অফ করে দিল কুয়াশা।
দেরি হচ্ছে দেখে খানিকটা আগে বেড়ে গিয়েছিল কুয়াশা। আচমকা একটি গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল এক ছায়ামূর্তি।
হ্যাণ্ডস্ আপ!’ গর্জে উঠল ছায়ামূর্তি। কুয়াশা থমকে সঁড়াল। কিন্তু হাত মাথার উপর না তুলে মৃদু স্বরে হেসে উঠে সে বলল, আমাকে চিনবার কথা নয়, কিন্তু তবু আমি কুয়াশা।’
মি. সিম্পসন রিভলভার নামিয়ে নিয়ে অবাক গলায় বললেন, তোমার এ ছদ্মবেশ কেন?”
পিছন থেকে মৃদু শব্দে হেসে উঠল রাসেল। ঘুরে পিছন দিকে তাকাল কুয়াশা। বলল, ‘ও তুমি পিছনে ছিলে? ভাল ফাঁদ, বলতে হয়।’
• কুয়াশা বাঘের মুখোশ খুলে ফেলে বলল, ‘এসো তোমরা আমার সাথে। কুয়াশা ৩৭ ।
কুয়াশার পিছন পিছন সেই প্রকাণ্ড বট গাছের নিচে এসে দাঁড়াল ওরা। কুয়াশা প্রশ্ন করল, আপনার দলবল কই? আসছে ওরা। নৌকোয় জায়গা হয়নি তাই।
খানিকপরই দশ-বারোজন কনস্টেবলকে নিয়ে সাব-ইন্সপেক্টর শরীফ উদ্দীন হাজির হলো।
কুয়াশা বট গাছের মোটা কাণ্ডের গায়ে লাগানো বোতামটা দেখিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা টিপলেই ছোট একটি গুপ্ত দরজা দেখা যাবে। দরজার কাছ থেকে একটী. সিঁড়ি নেমে গেছে। সিঁড়ির পর ছোট একটি প্যাসেজ। প্যাসেজের শেষ মাথায় একটি কামরা। সেই কামরাতেই আছে ডাকাতরা। মোট ছয়জন ওরা। কিন্তু ওদের সর্দার, নেতা বা ওস্তাদকে ওখানে পাবেন না।’
সে কি পালিয়েছে?’ জানতে চাইলেন মি. সিম্পসন।
। সে আছে কাছে পিঠেই। ইঞ্জেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে রেখেছি তাকে। এখুনি দেখতে চান, না, দলের অন্যদেরকে গ্রেফতার করার পর দেখতে চান?
রাসেল জিজ্ঞেস করল, বট গাছের নিচের কামরায় যারা আছে তারা কি সশস্ত্র?’
কুয়াশা বলল, না।’
রাসেল বলল, তাহলে শরীফ সাহেবই দলবল নিয়ে ওদেরকে গ্রেফতার করতে পারবেন। আমরা বরং দলের ওস্তাদকেই দেখে আসি।”
. তাই হোক।’ বলল কুয়াশা।
কুয়াশা শরীফকে আর একবার বট গাছের নিচে যাবার কায়দা কানুন শিখিয়ে দিয়ে বলল, ‘শব্দ না করেই যাবার চেষ্টা করবেন। এরা একমাত্র ওদের ওস্তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে। খানিক আগে আমি গিয়ে কথা বলে এসেছি, ওদের ওস্তাদের ছদ্মবেশ ধরে। সুতরাং হাঙ্গামা এড়াতে হলে শব্দ করবেন না। অবশ্য ভয়ের কিছু নেই। ওরা সবাই নিরস্ত্র এবং পালাবার পথ একটাই। চলুন মি, সিম্পসন।’
কুয়াশা পা বাড়াল। পিছন পিছন চলল রাসেল এবং মি. সিম্পসন।
বেশ খানিকটা দূর যাবার পর কুয়াশা জিজ্ঞেস করল, ইন্সপেক্টর সাহেবকে যে দেখলাম না?’
মি. সিম্পসন বললেন, তাকে মধুগ্রামে পাঠিয়েছি।’
কেন? ‘ওদিকেও তো ডাকাতরা হামলা করতে পারে। সেকথা ভেবেই…।’ মৃদু হাসল কুয়াশা।
হাসলে কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন মি. সিম্পসন। উত্তর দিল না কুয়াশা। খানিক, পর মি. সিম্পসন বিরক্তির সাথে বললেন, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তুমি? লোকটাকে এত দূরে রাখার কারণ কি?
৪০
ভলিউম ১৩
দেখলাম
সন বলতে
‘এই তো, এসে গেছি।’ কথাটা বলেই দাঁড়িয়ে পড়ল কুয়াশা।
সামনেই একটি ঝোঁপ। ঝোঁপের ভিতর থেকে একটি পা ধরে টেনে বের করে আনল কুয়াশা নিঃসাড় একটি লোককে।
কে বলুন তো এ লোক? ‘অন্ধকারে কিছুই তো দেখছি না?”
কুয়াশা হাতের পেন্সিল টর্চ জ্বালল। পেন্সিল টর্চের আলোয় জ্ঞানহীন ডাকাত সর্দারের মুখ দেখতে পেল ওরা।
. চমকে উঠল রাসেল।
চমকে উঠলেন মি. সিম্পসন। অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রইলেন তিনি। কয়েক মুহূর্ত পর তিনি বলে উঠলেন, কিন্তু এ যে অস! ইন্সপেক্টর হায়দার ডাকাতদের সর্দার!
| না, এ লোক ইন্সপেক্টর হায়দার নয়, কলল কুয়াশা।
‘এ তোমার কিরকম ঠাট্টা, কুয়াশা! পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি।’
কুয়াশা বলল, ভুল দেখছেন।
কথাটা বলেই নিঃসাড় লোকটার গোঁফ ধরে টান মারল কুয়াশা। উঠে এল নকল গোফ।
‘এ কি!’ সবিস্ময়ে বলে উঠলেন মি. সিম্পসন।
কুয়াশা বলল, হ্যাঁ, এই গোঁফ ব্যবহার করেই প্রতিটি লোককে ফাঁকি দিচ্ছে এই লোক। প্রকৃত ইন্সপেক্টর হায়দারের সাথে এর চেহারার মিল আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃত ইন্সপেক্টর হায়দারের গোঁফ ছিল বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এই লোক সেই গোঁফ নকল করে বাজিমাত করে। গোঁফেই ঢাকা পড়ে যায় প্রকৃত ইন্সপেক্টর হায়দারের সাথে এর চেহারার অমিল।’
‘প্রকৃত ইন্সপেক্টর হায়দার তাহলে কোথায়?
তিনি নিহত হয়েছেন আজ একমাস আগে এই ডাকাতদলেরই একজনের হাতে। লাশ গুম করে ফেলে এই লোক ইন্সপেক্টর হায়দার হয়ে বসে সাধারণ মানুষের চোখকে ফাঁকি দিয়ে।
‘এ লোক তাহলে এতদিন…।’
মি. সিম্পসনকে বাধা দিয়ে কুয়াশা বলে, “হ্যাঁ। এতদিন বোকা বানিয়ে রেখেছিল এ আপনাদেরকে।
মি. সিম্পসন জানতে চাইলেন, তুমি এসব জানলে কিভাবে?
কুয়াশা হাসল। বলল, কিভাবে জানলাম সে কথা বলতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। আমার সময় খুব কম। যেতে হবে অন্যত্র। ছোটখাট কোন প্রশ্ন থাকলে জিজ্ঞেস করুন :
নরকঙ্কালের রহস্যটা কি?’ কুয়াশা ৩৭
কুয়াশা বলল, এই ডাকাতদলে শুধু নকল হায়দারই নয়, এই থানা এলাকার অনেক যুবক ছেলেও আছে। আছে দু’জন পুলিস কনস্টেবল। নঈম এবং সোহরাব। একটা জিনিস লক্ষ করেছেন কোনদিন? নকল ইন্সপেক্টর যখনই রাতে বাইরে ব্বে হত তখনই দুজন কনস্টেবলকে নিয়ে বের হত। এবং সে দু’জন সবসময়ই নঈম এবং সোহব হত। ওদের দুজনকে নিয়ে নকল ইন্সপেক্টর সুযোগ মত চলে আসত ওই বটগাছের নিচে নিজেদের আস্তানায়। সেখানে একে একে মিলিত হত আরও অনেকে। তারা আসত মুখোশ পরে। নরকঙ্কালের মুখোশ দেখেছেন কখনও? প্লাস্টিকের হয় ওগুলো। সেই মুখোশ পরে বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতিদিন গুপ্ত আস্তানায় আসত ওরা।’
কেন?’
যাতে লোকে ওদেরকে প্রশ্ন না করে, ধারে কাছে না ঘেঁষে, যাতে কেউ চিনতে না পারে, যাতে ভয় পায়-বুঝেছেন এবার? আস্তানার সবাই একত্রিত হয়ে বাঘের মুখোশ পরত ওরা। নকল ইন্সপেক্টর এবং তার দুই কনস্টেবল পুলিসের ইউনিফর্ম খুলে ফেলত। তারপর বের হত ডাকাতি করতে। ডাকাতি শেষ করে আবার ওরা ফিরে আসতু এখানে। তারপর নকল ইপেক্টর ও তার দুজন কর্মচারী খাকী পোশাক পরে নিত । কঙ্কালের মুখোশ পরে নিত অন্যান্যরা। তারপর বেরিয়ে পড়ত যে যার গন্তব্যস্থানের দিকে।
: গোলাম মাওলা সাহেবের ছেলেকে কে হত্যা করে? জাফর?’
কুয়াশা বলল, না। জাফরকে সালাম আক্রমণ করেছিল। সালামের মুখে ছিল কঙ্কালের মুখোশ। সালামকে আমি অনেক আগে থেকেই অনুসরণ করেছিলাম। জাফরকে সে যখন আক্রমণ করে তখন আমি তাকে বাধা দিই। ফলে জাফর মুক্ত হয়ে পালিয়ে যাবার সুযোগ পায়। মারামারি শুরু হয় আমার সাথে নরকঙ্কালের মানে সালামের। এমন সময় হঠাৎ একটি গুলি কোথা থেকে যেন এসে লীগে সালামের বুকে। এ কাজটাও এই নকল হায়দারের।
: তারমানে সালামও ছিল ডাকাতের দলে। কিন্তু সেক্ষেত্রে পরের রাত্রে সালামের বাড়িতে ডাকাতি হলো কেন? কেন সালামের বাবাকে খুন করা হলো? _ নকল হায়দারের ভয় ছিল সালামের বাবা গোলাম মাওলা সব কথা জানেন।
তাই তাকে খুন করার জন্যেই ডাকাতি করতে যায় সে।’ .:: সেদিন বট গাছের ওপর থেকে যাকে তুমি গুলি করলে, মানে কাদিরের কথা বলছি, সেও তাহলে ডাকাতদের দলে ছিল।
ছিল। এবং কাদিরকেও নকল ইন্সপেক্টর খুন করে। ইয়াসিনকে গ্রামে পাওয়া যাচ্ছে না কেন জানো?
কুয়াশা বলল, সঠিক জানি না। তবে অনুমান করে বলতে পারি। আমার বিশ্বাস ইয়াসিনও ছিল এদের সঙ্গে। সালাম এবং কাদির খুন হতে নকল ইন্সপেক্টরের
৪২ |
ভলিউম ১৩
ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে সে। তাই পালিয়ে যায়। পালানো ছাড়া নকল ইন্সপেক্টরে হাত থেকে বাঁচা যাবে না মনে করেই… ।
মাতবরের বাড়ির ছাদ থেকে গুলি করে কে?’ ‘আমি। ডাকাতরা গিয়েছিল ওখানে।–
জানলে কি করে ওরা যাবে?
ইয়াসিন পালিয়ে গেছে অনুমান করেই আমি বুঝতে পারি নকল ইন্সপেক্টর আজ হামলা চালাবে মাতবরের বাড়িতে।
এতক্ষণ পর হেসে উঠল কুয়াশা। তারপর বলল, ‘আরও প্রশ্ন করবেন? ‘আর মাত্র একটি। সেদিন বটগাছের মাথায় চড়েছিলে কেন তুমি?’
‘ক’দিন থেকেই আমি ডাকাতদের আস্তানা খোঁজার জন্যে নুরকঙ্কালের মুখোশ পরে ওদিকে রাতের দিকে যেতাম। মুখোশটা আমি পেয়েছিলাম সালামের কাছ থেকে। আমি ওদিকে যাওয়া আসা করায় ডাকাতদের বেশ অসুবিধে হয়। ওদের আসা যাওয়ার সহজ পথ ছিল ওটাই। তিন চারদিন ডাকাতি করতে পারেনি ওরা। ব্যাপারটা আমি টের পাই। ফলে সেদিন আগে থাকতেই বট গাছের মাথায় গিয়ে। চড়ি। অনুমান করেছিলাম ডাকাতরা পথের কাটা সরাবার জন্যে আমাকে খুন করবার চেষ্টা করবে। সে চেষ্টা তারা করেছিল। কিন্তু আপনাদের গলা শুনে পিছিয়ে যায় তার। আমি বটগাছের উপর থেকে সবাইকে দেখতে না পেলেও কাদিরকে দেখতে পেয়েছিলাম।
কুয়াশার কথা শেষ হতেই রাসেল বলল, ‘ডাকাতরা ডাকাতি করে টাকা, সোনা রাখত কোথায়? নিশ্চয়ই সেগুলো, ওদের গোপন আস্তানায় আছে?’
কুয়াশা, বলল, আমার মনে হয় ওদের গোপন আস্তানার কোথাও গোপন কুঠুরী আছে। সেখানেই আছে টাকা-পয়সা, সোনাদানা। আচ্ছা, মি, সিম্পসন, এবার। আমাকে বিদায় নিতে হয়। আবার দেখা হবে।’
কথাগুলো বলে আর কোন প্রশ্নের অবকাশ না দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল কুয়াশা।
পিছন থেকে মি. সিম্পসনকে কি যেন বললেন, উত্তরে কুয়াশা বলল, যারা ধরা : পড়েছে তাদেরকে জেরা করলেই সব পাবেন। চললাম।’
ভোর হয়ে আসছে।
দ্রুত ফিরে এল ওর বট গাছের কাছে।
ইন্সপেক্টর শরীফকে পাঠিয়ে দিলেন মি. সিম্পসন নকল ইন্সপেক্টরের দেহটাকে নিয়ে আসার জন্যে। | রাসেল একজন ডাকাতকে জিজ্ঞেস করল, টাকা পয়সা, সোমা কোথায় রেখেছ |
তোমরা?’ কুয়াশা:৩৭
• ৪৩
চুপ করে রইল সবাই। কেউ কোন কথা বলতে চায় না।
রাসেল বলল, ‘চুপ করে থাকলে পিঠের ছাল তুলে নেব। ভেবো না চুপ করে থাকলে…’
একজন বলে উঠল, খোদার কসম’ বলছি হুজুর, আমরা জানি না।’
প্রচণ্ড এক চড় মারল রাসেল লোকটার গালে। ‘ | অপর একজন লোক বলে উঠল, এখন আর না বলে লাভই বা কি! ধরা তো পড়েই গেছি। শোনেন, হুজুর। আমরা ধরা পড়ার আগে আমাদের ওস্তাদ মানে ইন্সপেক্টর হায়দার সাহেব টাকার দুটো ট্রাঙ্ক আর সোনা ভর্তি একটি ট্রাঙ্ক আস্তানা থেকে বের করার নির্দেশ দেন। আমরা সেগুলো বের করে দিই। তারপর তার। দেখাও পাইনি, আর…।’
| আর কোন কথা শোনার দরকার ছিল না। মি, সিম্পসন এবং রাসেল দুজনই সেই মুহূর্তে বুঝতে পারল যে এ কাজ কুয়াশা ছাড়া আর কারও না।
রাসেল বলল, কুয়াশা পালাবে, মি. সিম্পসন! তাকে পালাতে দেয়া উচিত হবে না!’
“কিন্তু তাকে ধরবে কিভাবে তুমি?’
রাসেল একমুহূর্ত চিন্তা করেই লাফিয়ে উঠল। বলল, চলুন? নিশ্চয়ই সে আমাদের স্পীড বোটে করে পালাবার চেষ্টা করবে। চলুন, এখুনি চলুন।
ছুটল ওরা।
কিন্তু ওরা পৌঁছুবার এক মিনিট আগেই স্পীড বোটের শব্দ শোনা গেল। স্টার্ট । নিচ্ছে বোট।. ‘
ছুটতে ছুটতে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল ওরা।
স্পীড বোট তখন মাঝ দরিয়ায় চলে গেছে। বোটের উপর তিনটি ট্রাঙ্ক দেখা যাচ্ছে। একটি ট্রাঙ্কের উপর বসে রয়েছে হট পরিহিত একজন লোক। নিঃসন্দেহে লোকটি স্যানন ডি কস্টা।
কুয়াশা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে বোটের ড্রাইভিং হুইল ধরে রয়েছে। পানি কেটে সবেগে দূরে সরে যাচ্ছে স্পীড বোটটা। ‘
| ঘাড় ফিরিয়ে পিছন দিকে একবার তাকাল কুয়াশা। বোধহয় হাসল। ঠিক বোঝা গেল না। | ডি, কস্টা ন্যাট কিং কোল-এর একটি বিখ্যাত গানের কলি আওড়াচ্ছিল মনের সুখে মাথা দোলাতে দৌলাতে। হঠাৎ সে নদীর জুরে দেখতে পেল মি. সিম্পসন এবং রাসেলকে।
মাথার হ্যাটটা খুলে ওদের দিকে সেটা নাড়তে লাগল-বাই বাই..টা টা••••
মি. সিম্পসন যেন নিজের উপরই রাগে দুঃখে ক্ষোভে বলে উঠলেন, কী সাংঘাতিক! আবার বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পালিয়ে গেল কুয়াশা!
Leave a Reply