১৩ নভেম্বর ভারতীয় নাট্যকার রতন থিয়াম ঢাকায় মঞ্চস্থ করলেন হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েইকেন। লিখেছেন তৈমুর রেজা
হেনরিক ইবসেনের খ্যাতি এ জন্য যে, তিনি আধুনিক থিয়েটারের পিতা। চিরকাল উনি প্রকৃতিবাদ আর বাস্তববাদের শরণাগত ছিলেন, কিন্তু হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েইকেন নাটকে তাঁর সাকিন গেল ঘুরে। এখানে বাস্তবের তলানিতে লুকানো ঘিনঘিনে সত্যের প্রতি তাঁর সেই ক্রুর চাহনি নেই, যে দোষে তিনি যুগপত্ থিয়েটারে মান্য ও ভিক্টোরিয়া সমাজে জঘন্য ব্যক্তি। ইবসেন তাঁর শেষ নাটকে কল্পনা আর সুরের প্রতিমার বশ হয়েছিলেন।
রতন থিয়াম নদীয়ার ছেলে। একদা স্বয়ং চৈতন্য যেখানে লীলা করেছেন, থিয়াম সেই মাটির পুত্র। নদীয়ার ভাবের সঙ্গে তাঁর শৈশবের পুরনো ওঠা-বসা। থিয়ামের শিল্পমহলে ইবসেন পরদেশি লোক। ইবসেনের বাড়ি নরওয়ে কেবল সেই ওজরে নয়, থিয়াম এই প্রথম কোনো বিদেশি নাট্যকারে মন দিলেন, সেই বরাতেও। পরদেশি ইবসেন মণিপুরি থিয়ামের চোখে কোন প্রতিমায় ধরা দিলেন, সেটা নিয়ে কৌতূহলের ফুরসত আছে। তবে তার আগে থিয়ামের ভাববিগ্রহের একটা ছবি আঁকতে পারলে ভালো। এ ভাবটা থিতু হয়েছে যে, থিয়াম বিশেষভাবে ঋণী প্রাচীন ভারতীয় নাটকের ধারার কাছে। সেই সঙ্গে তিনি আঞ্চলিক পারফর্মিং আর্টসের ওপর অনেক জোর দিয়েছেন। আর জাপানি নোহ থিয়েটারের কাছেও তাঁর দেনা আছে। সব মিলিয়ে থিয়াম গভীরভাবে ঐতিহ্যের অনুসারী। এখানে একটা বিপদ হয়—ঐতিহ্যের মোহে অনেকে জড়ভরত পুত্তুলি গড়েন। কিন্তু থিয়ামকে জাতশিল্পী বলে মানতে হচ্ছে। কারণ, ঐতিহ্যের মাটিতে পা রেখেও তিনি গলা বাড়িয়েছেন আকাশের দিকে। ফলে দেশকালের ভেদ ভেঙে তাঁর হাতেগড়া মণিপুরি থিয়েটার সারা পৃথিবীকে মুগ্ধ করেছে।
হোয়েন উই ডেড অ্যাওয়েইকেন নাটক দেখার একটা সুযোগ মিলল ‘সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার’-এর কল্যাণে। তাদের আয়োজনে ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার অ্যান্ড থিয়েটার ফেস্টিভ্যাল ২০০৯-এ ১৩ নভেম্বর ইবসেনের এই নাটক দেখতে পাওয়া গেল। এ নাটকের প্রোটাগনিস্ট ইবসেনের খুব প্রিয় মোটিফ—একজন ভাস্কর। নাটকের মর্মবাণী এই সৃষ্টিশীল ভাস্করের ডিজায়ার—যার কোনো সদ্গতি হয় না, তেমনি দমিত আকাঙ্ক্ষাভূত হয়ে শিল্পীকে যুগপত্ আশীর্বাদ আর অভিশাপে ঋদ্ধ করে।
থিয়াম এই নাটকের থিমটা নিয়েছেন। রিয়েলিস্টিক প্লট মানেননি, কয়েকটা অঙ্ক নিয়ে আপন মতো সাজিয়েছেন, তবে খুব সাবধানে—স্টোরিলাইন ঠিক রেখে। তাঁর মক্কা ছিল শিল্পীর সেই দুর্বোধ্য অধিবিদ্যক অন্তর্লোক, যেখানে সৃষ্টিশীলতা আর যন্ত্রণা উদয়াস্ত ঠোরাঠুরি করছে।
এ নাটকে ইবসেন এমন সব অধিবিদ্যক ইশারা গুঁজে দিয়েছেন, যা তাঁর বাদবাকি নাটকে গরহাজির। তিনি কলাবিদ্যার হূিপণ্ডে হাত দিতে চেয়েছিলেন, ক্ষ্যাপার মতো বাস্তব চরিত্র খোঁজেননি, পুনরুত্থানের একটা গোপন ইশারা দিয়ে তিনি চৈতন্যের গহন কুঠুরিতে ঢুকে পড়েছেন আলাপ সারতে। সেখানে রোজকার ভাষা অচল, তাই সূক্ষ্ম ইঙ্গিতময় ভাষা তৈরি করেছেন। এ নাটকের প্রাণপাখি তাই ডুব মেরেছিল অনেক পাতালে, সেখানে তার অধিষ্ঠান রেখে মণিপুরের মাটিতে এনে রোপণ করা সাধকের কাজ—চিকন সুতার ওপর দিয়ে হাঁটার মতোই জটিল।
নাটকের কাহিনীর একটা স্কেচ আঁকা যাক। রুবেক বিশ্বখ্যাত হয়ে গেল ‘দ্য ডে অব দ্য রিজারেকশন’ ভাস্কর্যটা গড়ে, আইরিন ছিল সে কাজের মডেল। একসময় আইরিন খুব গভীর থেকে তাকে চায়, কিন্তু রুবেক তাকে মডেল হিসেবে পেলেই খুশি। ক্ষোভ আর হতাশা নিয়ে আইরিন চলে গেল। রুবেক বিয়ে করে মায়াকে, কিন্তু বিয়েটা ক্রমে শীতল হয়ে আসে। রুবেক দেখতে পায়, আইরিন চলে যাওয়ায় তার সৃষ্টিও তাকে ছেড়ে গেছে, এখন আর সে শিল্প গড়তে পারে না।
মায়ার জগতে আসে উলফসহেইম আর রুবেকের স্মৃতির সিন্দুক ভেঙে উঠে আসে আইরিন। রুবেক এবার তাকে ফিরে চায়, যেন সে যুগপত্ ফিরে পায় শিল্পের হিমঘরের চাবি। বহুদিনের গড়া দেয়াল ভেঙে তারা কাছে আসে—ওই পাহাড়ের চূড়ায় উঠবে। শিখরে উঠে গেলে ঝড় আসে, তার মধ্যে দুজনে তুষারধসে মারা পড়ে।
পানির মধ্যে লাঠি নিলে যেমন বেঁকে যায়, ইবসেনকে তেমনি বাঁকিয়ে মনের মতো করে নিলেন থিয়াম। তিনি নিরিখ করলেন তেমন মুহূর্তগুলো, যেখানে নাড়ির মৌলিক স্পন্দনগুলো আছে। মঞ্চ যেন আলো দিয়ে কয়েকটা ভাগে ফাল হয়ে আছে—এমন নিক্তিমাপা আলো; আবহ সংগীতের চলনটাও খুব তাজা। মঞ্চের পুরোটা তিনি আন্দোলিত করেন, এক তিল শূন্যস্থান তিনি ফেলে রাখেন না কোথাও। থিয়ামের মঞ্চে নরম আলোর মধ্যে গ্রামোফোনে সুর ভেসে এল—রুবেক ঝুঁকে পড়ে শুনছে। পেছনে তিনটি দুধসাদা ভাস্কর্য। সামনে মায়া কিছু পুতুল নিয়ে সেলাই করছে।
প্রথম দৃশ্যপটেই থিয়াম একগাদা ইশারা ছড়িয়ে দেন। পেছনে ভাস্কর্য আর সামনে পুতুল রাখা বোধকরি দুজনের মনোজগতের নিশানা দেবার গরজে। মায়া তখন খরখরে গলায় বুঝিয়ে বলছে, তার জীবনটা কেমন এই পুতুলের দশা পেয়েছে। দূর থেকে তারা যেন বাক্য ছুড়ে মারছে। সাধারণ কথাবার্তা এত উচ্চগ্রামে চলে না—এমনকি থিয়েটারেও না।
এবার থিয়ামের কল্পনার একটু ঠাঁই মিলছে। দৃশ্য ভেঙে তিনি ভেতরের পাখিটা বের করে নিয়েছেন, সেটাই নিজের রঙে আর ভাষায় সাজিয়ে তুলে দিচ্ছেন দর্শকের ইন্দ্রিয়ের ভোগে। থিয়ামের এ কল্পনাশক্তির সামনে অবনত না হয়ে উপায় নেই। আরও দৃষ্টান্ত নেওয়া যাক। রুবেক আর মায়ার আলাপে একটা জাদু হয়ে গেল, রুবেকের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল আইরিন, আর মায়ার মধ্যে উলফসহেইম। এ জাদুর ভিস্যুয়াল আঁকতে থিয়াম ব্যবহার করলেন বুদ্বুদ বা বাবল্স।
ভাব মুচড়ে ছবি বানানোর এই এক আশ্চর্য প্রতিভা থিয়ামের। রুবেন আর আইরিন দুজনে নৌকায় বেড়াচ্ছে। পেছনে নীল একটি ছাতা—যেন পেখম মেলেছে। নৌকা চলছে। পেছনে পদ্মবন, সেখানে পদ্মের খুব সুসার। জলে নৃত্য করে মাছ, আর আকাশে পাখিরা ওড়ে। শেষের দিকে এসে দশদিকে শুধু সফেদ তুষারের বন। মণিপুরি রাসের আদলের কিছু পুতুল। অনেক পরে দর্শকের ভুল ভাঙে, পুতুল কোথাও নেই, তারা আসলে মানুষ—একসময় নাচতে শুরু করে তারা। খুব ধীর লয়ে, যেন পাষাণ অহল্যা ফেটে প্রাণের খুব ধীর সঞ্চরণ হচ্ছে।
এবার খুব মানতে হয়—মঞ্চটা আসলে একটা ম্যাজিক স্পেস। রুবেক আর আইরিন পেছনে নিশ্চল স্থির, আর সামনে খুব ভাঙা শরীরে চলে যাচ্ছে নিষাদ-শিকারি ও মায়া। উপত্যকায় মায়া গেয়ে যাচ্ছে নিঃসঙ্গতার গান। নাটক শেষ হলে দর্শকের মধ্যে মারহাবার একটা দীর্ঘ স্রোত বয়ে গেল। ‘দি কোরাস রিপারেটরি থিয়েটার’ এর সবাই মিলে প্রায় সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেন দর্শকদের। এরপর মঞ্চে এলেন স্বয়ং রতন থিয়াম। তিনিও আবার সবাইকে নিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন দর্শকদের। দর্শকের প্রতি এই যে ভক্তির অর্ঘ্য, এর মধ্যেই হয়তো শিল্পী রতন থিয়ামকে আলাদা করে চিনে নেওয়া যায়।
নাটকের আগাপাশতলা-জুড়ে কেবল প্রাচ্যের গন্ধ। ইবসেন এই ঘরে আটক হলেন কী করে? থিয়াম তার উত্তর দিচ্ছেন এই বলে যে, ইবসেনের উদ্বেগের মধ্যে হিন্দুভাবের অনুরণন আছে। পুনরুত্থান, পুনর্জন্ম এবং কর্ম—এসব চিরায়ত ভাবের চোঙা দিয়ে ইবসেনের নাগাল পাওয়া যাচ্ছে বেশ। পশ্চিম তাহলে এই নাটকে অনুপস্থিত? সেটা হবার জো নেই, হলেই বিপদ ঘটত। কারণ, প্রাচ্যের আছে ভাব, কিন্তু একালের থিয়েটার অনেক পদ্ধতির শাসন ও প্রযুক্তির হিসাব মেনে চলে, এখানে ভারতীয়দের পুঁজি কম। থিয়াম এসব অকাতরে আমদানি করেছেন পশ্চিম থেকে। এবার থিয়েটারের দুটি চাকাই সমান মাপের হতে পারে।
তৈমুর রেজা
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ২০, ২০০৯
Leave a Reply