প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.১১ ব্যারিকেডের কথা

একাদশ পরিচ্ছেদ

১.

এর আগে কুরফেরাক যে ব্যারিকেডের কথা বলে সে ব্যারিকেড হল শাঁব্রেরির ব্যারিকেড। র‍্যু দ্য লা শভ্রেরি অঞ্চলে কোরিনথের হোটেলে ওরা মিলিত হত। গ্রান্তেয়ার প্রথমে জায়গাটা আবিষ্কার করে। কুরফেরাকের দল সেখানে খাওয়া-দাওয়া করত আর নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করত। মালিক পিয়ের হুশেলুপ খুব ভালো লোক ছিল। খাদ্য ও পানীয়ের জন্য ওরা কম টাকা দিত, অনেক সময় কিছুই দিত না। হোটেলমালিক হুশেলুপ কিছুই বলত না তার জন্য।

হুশেলুপের মুখে মোচ ছিল। তার উপরটা খুব কড়া আর কণ্ঠস্বরটা গম্ভীর ছিল। নবাগত খরিদ্দাররা তাকে দেখে প্রথমে ভয় পেয়ে যেত। আসলে পিস্তলের মতো দেখতে নস্যির ডিবের মতো তার গম্ভীর ছদ্মবেশের অন্তরালে পরিহাসরসিক একটা মন লুকিয়ে থাকত। তার স্ত্রী মেরে হুশেলুপ দেখতে খুব কুৎসিত ছিল। পিয়ের হুশেলুপের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী হোটেল চালায়। কিন্তু তখন খাদ্য ও পানীয়ের মান খারাপ হয়ে যায়। তবু কুরফেরাক আর তার বন্ধুর দল সে হোটেলে খেত। ১৮৫০ সালে পিয়ের হুশেলুপ মারা যাওয়ার পর মাতেলোত্তে আর গিবেলোত্তে নামে দু জন মেয়েকে নিয়ে তার স্ত্রী হোটেল চালাত

৫ জুন সকালে কোরিনথের হোটেলের বাসিন্দা ল্যাগলে দ্য মিউ আর জলি প্রাতরাশ করছিল। তারা ওই হোটেলেই দু জনে একসঙ্গে খাওয়া-থাকা করত। তারা তখন। প্রাতরাশ করছিল। তখন গ্রান্তেয়ার সেখানে হঠাৎ এসে পড়ে। গ্রান্তেয়ারকে দেখে আর এক বোতল মদ নিয়ে আসে গিবেলোত্তে। কিছু খাবার আগেই এক বোতল মদ শেষ করে ফেলল গ্রান্তেয়ার। তার পর বলল, হে আমার প্রিয় ল্যাগলে, তোমার জামাটা ময়লা আর ছেঁড়া।

ল্যাগলে বলল, আমার কুৎসিত চেহারাটার সঙ্গে এই জামাটা সঙ্গতিপূর্ণ। পুরনো পোশাক মানুষের পুরনো বন্ধুর মতো। যাই হোক, তুমি কি বুলভার্দে থেকে আসছ?

না, ওদিকে আমি যাইনি।

আমি আর জলি মিছিলটাকে ওদিকে যেতে দেখি। জলি বলল, দৃশ্যটা আশ্চর্যজনক। অথচ এ রাস্তাটা দেখ, কত নির্জন। এখান থেকে বোঝা যাবে না প্যারিস শহরে কী তুমুল। কাণ্ড চলছে। মনে হবে এইসব গোটা অঞ্চলটা একটা গির্জা আর এখানে যারা থাকে তারা সবাই সন্ন্যাসী যাজক।

গ্রান্তেয়ার বলল, ওদের কথা আর আমায় বল না। যাজকদের কথা শুনতে আমার গায়ে জ্বালা ধরে। আজ সকালে বাজে ঝিনুকের মাংস খেয়ে আর হোটেলের কুৎসিত মেয়ে দেখে আমার মাথা ধরে গেছে। সমগ্র মানবজাতিকে আমি ঘৃণা করি। র‍্যু রিচলু দিয়ে আসার পথে একটা বড় লাইব্রেরি দেখলাম। তার পর আমি আমার পরিচিত মেয়েটাকে দেখতে যাই। মেয়েটাকে দেখতে বসন্তকালের মতো সুন্দর। দেখলেই আনন্দ হয়। গিয়ে দেখি একটা সোনারুপোর দোকানের মালিক তার প্রেমে পড়েছে। মেয়েরা টাকার গন্ধকে ফুলের গন্ধের মতো মনে করে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়। মাস দুই আগে মেয়েটা পরিশ্রম করে জীবিকার্জন করত এবং সুখেই ছিল। এখন সে টাকাওয়ালা এক ধনী লোকের সঙ্গ পেয়ে খুব খুশি হয়ছে। তাকে আগের মতোই সুন্দর দেখাচ্ছে। পৃথিবীতে নীতি বলতে কিছু নেই। মার্টেল ফুল হচ্ছে প্রেমের প্রতীক, লরেল হচ্ছে যুদ্ধের প্রতীক, অলিভ হচ্ছে শান্তির প্রতীক। পৃথিবীতে ন্যায়বিচার বলে কোনও কিছু নেই। সারা জগৎ শিকারি পশুতে ভর্তি। যত সব ঈগলগুলো মাংসের লোভে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গ্রান্তেয়ার তার গ্লাসটা তুলে আর এক গ্লাস মদ চাইল। মদের গ্লাসটা পান করার পর আবার কথা বলতে শুরু করল। সে বলল, যে ব্রেনাস রোম জয় করেছিল সে যেমন ঈগল ছিল তেমনি সোনারুপোর দোকানের যে মালিকটা সুন্দরী মেয়েটাকে হাত করে সে-ও একটা ঈগল। দু জনেই সমান নির্লজ্জ। সুতরাং বিশ্বাস করার মতো কিছু নেই। শুধু মদ পান করে যাও। মদই একমাত্র সত্য। তোমার মতবাদ যাই হোক, তুমি যে দলের লোক হও না কেন, তাতে কিছু যায়-আসে না। তুমি শুধু মদ খেয়ে যাও। তুমি একটু আগে বুলভার্দ আর মিছিলের কথা বলছিলে, তাতে কী হয়েছে? আর একটা বিপ্লব হতে চলেছে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে ঈশ্বর এ বিপ্লব ঘটাতে চলেছেন সেটা বড় বাজে লাগছে। আমি যদি ঈশ্বর হতাম, তা হলে সব কিছুর সোজাসুজি খাড়াখাড়ি ব্যবস্থা করে ফেলতাম। সমগ্র মানবজাতিকে এমনভাবে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে রাখতাম যে মানবজগতের কোনও ঘটনার মধ্যে কোনও অসংগতি বা অযৌক্তিকতা থাকত না, তার মধ্যে কোনও যদি’ ‘কিন্তু’ বা ঐন্দ্রজালিক রহস্যময়তার অবকাশ থাকত না। তোমরা যেটাকে প্রগতি বল, সেই প্রগতির গাড়িটাকে চালায় দুটো জিনিস মানুষ আর ঘটনা। কিন্তু অনেক সময় দেখা যায় এই মানুষ আর ঘটনাই প্রগতিরূপ গাড়ি চালাবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। সে গাড়ি চালাবার জন্য সাধারণ মানুষের পরিবর্তে চাই প্রতিভাবান মানুষ আর ঘটনার পরিবর্তে চাই বিপ্লবের মতো বিশেষ ঘটনা। বিপ্লব দ্বারা কী প্রমাণ হয়? তার মানে ঈশ্বর হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছেন। ঈশ্বর যখন দেখেন বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যের ফাঁকটাকে কোনওমতে পূরণ করা যাচ্ছে না তখন রাষ্ট্রযন্ত্রে একটা বড় রকমের পরিবর্তন আনেন। এ ছাড়া তিনি আর কোনওভাবে প্রতিকার করতে পারেন না। যখন আমি দেখি স্বর্ণ ও মর্ত সব জায়গায় দুঃখের অগ্নিস্রোত বয়ে যাচ্ছে, তখন আমি রাজারাজড়াদের ও সমগ্র মানবজাতির দুর্ভাগ্য ও সকরুণ পরিণতির কথা ভাবি। যখন দেখি শীতকাল আসার সঙ্গে সঙ্গে আকাশটা ফুটো হয়ে বৃষ্টি পড়ছে, হিমেল বাতাস বয়ে যাচ্ছে, পাউডারের মতো তুষার ছড়িয়ে পড়ছে। যখন সূর্য আর চন্দ্রের কলঙ্কগুলো দেখি, মানবজগতে দেখি নানারকমের বিশৃঙ্খলা, যখন দেখি পরস্পরবিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর মধ্যে কোনও ঐক্য বা শৃঙ্খলা নেই তখন ভাবি ঈশ্বরকে পরম ঐশ্বর্যবান বলে মনে হলেও তিনি নিঃস্ব, আসলে তার কোনও ঐশ্বর্য নেই। কোনও দেউলে হয়ে পড়া ধনী ব্যবসায়ীর বলনাচের আসর বা ভোজসভার ব্যবস্থা করার মতো তখন তিনি বিপ্লবের ব্যবস্থা করেন। আজ ৫ জুন। আমি সকাল থেকে সূর্য ওঠার জন্য অপেক্ষা করে আছি। কিন্তু সারাদিন অন্ধকার হয়ে আছে। সূর্যের আলো নেই। জগতের সব কিছুই বিরক্তিকর, কোনও বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর, মানুষের সঙ্গে মানুষের মিল নেই। সব জায়গাতেই দেখবে বিশৃঙ্খলা। এই জন্যই আমি হয়ে উঠেছি তার বিরোধী, তাই বিপ্লবীদের দলে যোগ দিয়েছি। আমার মনে কিন্তু কোনও হিংসা নেই কারও প্রতি। প্রকৃত অর্থে জগত্তা যা আমি তাই বলছি। পৃথিবীটা পুরনো আর বন্ধ্যা। আমরা বৃথা পরস্পরের সঙ্গে মারামারি করে মরছি।

দীর্ঘ বক্তৃতার পর গ্রান্তেয়ার কাশতে লাগল।

জলি বলল, তুমি বিপ্লবের ওপর বক্তৃতা দিচ্ছ আর মেরিয়াস গলায় গলায় প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

ল্যাগলে বলল, কার প্রেমে কিছু জান?

না।

গ্রান্তেয়ার বলল, মেরিয়াস প্রেমে পড়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি তার চারদিকে কুয়াশা। সে হচ্ছে কবি জাতের মানুষ, তার মানে পাগল প্রকৃতির। মেয়েটার নাম মেরি বা মেরিয়া বা মেরিয়েত্তে যাই হোক না কেন, তারা প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। সব ভুলে আবেগভরে চুম্বন করতে করতে তারা স্বর্গে চলে যাবে। দুটি সংবেদনশীল আত্মা নক্ষত্রের রাজ্যে ঘুমোবে।

গ্রান্তেয়ার আরও এক বোতল মদ পান করতে যাচ্ছিল এমন সময় একটি নবাগত তাদের সামনে এসে হাজির হল। নবাগতের বয়স মাত্র দশ। পরনে ছেঁড়া-খোঁড়া পোশাক, অযত্নলালিত দেহ। ছেলেটি কোনও ইতস্তত না করেই ল্যাগলে দ্য মিউকে বলল, আপনি কি মঁসিয়ে বোসেত?

ল্যাগলে বলল, ওটা আমার অন্য নাম। কী চাও তুমি?

ছেলেটি বলল, তা হলে শুনুন। বুলভার্দে লম্বা চেহারার মাথায় সুন্দর চুলওয়ালা এক যুবক আমাকে বলল মেরে হুশেলুপকে আমি চিনি কি না। আমি তখন তাকে বললাম, আপনি কি র‍্যু শাঁব্রেরি হোটেলের ভূতপূর্ব মালিকের বিধবা পত্নীর কথা বলছেন? সে বলল, হ্যাঁ ঠিক বলেছ। তুমি সেখানে গিয়ে মঁসিয়ে বোসেতের খোঁজ করবে এবং তাকে ‘এ বি সি’ এই কথাটা বলবে। এর জন্য সে আমাকে দশ দ্যু দেয়।

ল্যাগলে বলল, জলি তুমি দশ স্যু আর গ্রান্তেয়ার, তুমিও দশ স্যু দাও।

এইভাবে ছেলেটি আরও কুড়ি স্যু পেল।

ল্যাগলে ছেলেটিকে বলল, তোমার নাম কী?

আমার নাম গাভ্রোশে।

তা হলে তুমি আমাদের কাছে থাক।

গ্রান্তেয়ার বলল, আমাদের সঙ্গে তুমি প্রাতরাশ খাও।

ছেলেটি বলল, তা আমি পারব না। কারণ আমি মিছিলে আছি। পলিতানাস্ক নিপাত যাক এই ধ্বনি দিচ্ছি আমি।

গাভ্রোশে এক পা পিছিয়ে সম্মানের সঙ্গে অভিবাদন জানিয়ে চলে গেল।

গ্রান্তেয়ার বলল, রাস্তার ভবঘুরে ছেলে হলেও সরল এবং সৎ।

ল্যাগলে ভাবতে ভাবতে বলল, এ, বি, সি–মানে ল্যামার্কের শবযাত্রা।

গ্রান্তেয়ার বলল, লম্বা চেহারা সুন্দর চুলওয়ালা যুবকটি হল এঁজোলরাস। সে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।

বোসেত তাকে বলল, তুমিও যাচ্ছ তো?

আমি আগুনের মধ্য দিয়ে যাব বলে কথা দিয়েছিলাম, জলের মধ্য দিয়ে নয়। আমার সর্দিটাকে বাড়াতে চাই না।

গ্রান্তেয়ার বলল, আমি এখানেই থেকে যাব। শবানুগমন থেকে প্রাতরাশ খাওয়া অনেক ভালো।

ল্যাগলে বলল, ভালো কথা। আমরা যেখানে আছি সেখানেই থেকে যাই। আরও কিছু মদপানে করা উচিত আমাদের। আমরা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এড়িয়ে যেতে পারি, কিন্তু বিদ্রোহকে এড়াতে পারি না।

জলি বলল, আমরা সবাই তাই চাই।

ল্যাগলে বলল, ১৮৩০ সালের অসমাপ্ত কাজ আমরা শুরু করতে চাই। জনগণ সব তৈরি।

গ্রান্তেয়ার বলল, আমি তোমাদের বিপ্লবের কিছু বুঝি না। তা নিয়ে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই। আমি রাজ সরকারকে ঘৃণা করি না। যে রাজা মাথায় সুতোর টুপি পরে এবং যার রাজদণ্ড ছাতায় পরিণত হয়েছে সে রাজার বিরুদ্ধে আমার কোনও অভিযোগ নেই। এই বৃষ্টির দিনে লুই ফিলিপ দুটো কাজ করতে পারে জনগণের মাথার উপর সে তার রাজদণ্ডটা ঘোরাতে পারে আর ঈশ্বরের দিকে তার ছাতাটা তুলে ধরতে পারে।

আকাশে ঘন মেঘ থাকায় ঘরখানা অন্ধকার দেখাচ্ছিল। হোটেলে বা রাস্তায় কোনও লোক ছিল না। সবাই মিছিল দেখতে গেছে।

বোসেত বলল, এখন মনে হয় রাতদুপুর। কিছু দেখা যাচ্ছে না। গিবোলেত্তে, একটা আলো এনে দাও।

গ্রান্তেয়ার মদ খেতে খেতে বলল, এঁজোলরাস আমাকে ঘৃণা করে। সে হয়তো ছেলেটাকে বোসেতের কাছে পাঠাবার কথা ভেবেছিল। জলি ভালো ছোকরা নয়, আর গ্রান্তেয়ার মহান। তাই বোসেতের কাছে ওকে পাঠাই। তবে এঁজোলরাস নিজে এলে তার সঙ্গে আমি শয়তানের কাছেও যেতে পারি।

এইভাবে ওরা তিনজনেই রয়ে গেল। জলি আর বোসেতকে মদের লোভ দিয়ে আটকে রাখে গ্রান্তেয়ার। সেদিন বিকালের দিকে দেখা যায় তাদের টেবিলের উপর অনেকগুলো মদের খালি বোতল পড়ে আছে। দুটো বাতি জ্বলছে।

গ্রান্তেয়ার মদ খাওয়া থামিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল। তার মুখে হাসিখুশির ভাবটা ঠিক ছিল। জলি আর বোসেত তার কাছে বসে তার সঙ্গে কথা বলে যাচ্ছিল সমানে। গ্রান্তেয়ার এক সময় বলল, সব দরজা খুলে দাও, সবাই আসুক ভেতরে, মাদাম হুশেপুলকে আলিঙ্গন করুক। মাদাম হুশেলুপ বয়োপ্রবীণা, তুমি আমার কাছে সরে এসে যাতে আমি ভালো করে দেখতে পারি তোমায়।

এরপর গ্রান্তেয়ার নেশার ঝেকে বলতে লাগল, কে আমার অনুমতি না নিয়েই আকাশ থেকে কয়েকটা তারা এনে টেবিলের উপর জ্বেলে দিয়েছে। সেগুলো বাতি হয়ে জ্বলছে।

জলি বলল, শোন মাতেলোত্তে আর গিবেলোত্তে, তোমরা আর গ্রান্তেয়ারকে মদ দেবে না। ঈশ্বরের নামে বলছি। ও আজ জলের মতো পয়সা খরচ করছে। সকাল থেকে ও ছ ফ্ৰাঁ নব্বই সেন্তিমে খরচ করেছে।

এই সময় বাইরে গোলমালের শব্দ শোনা গেল। অনেকে ছোটাছুটি করছিল। ‘অস্ত্র ধারণ কর’ বলে অনেকে চিৎকার করছে।

গ্রান্তেয়ার মুখ ঘুরিয়ে দেখল এঁজোলরাস, কুরফেরাক, গাভ্রোশে, কমবেফারে, ভেয়ারের নেতৃত্বে এক বিক্ষুব্ধ জনতা র‍্যু ডেনিস থেকে আসছে। তাদের প্রত্যেকের হাতে বন্দুক, পিস্তল, তরবারি, হাতবোমা প্রভৃতি অস্ত্র ছিল।

বোসেত হাতে তালি দিয়ে কুরফেরাককে ডাকল। কুরফেরাক বলল, কী বলছ?

বোসেত বলল, কোথায় যাচ্ছ তোমরা?

ব্যারিকেড করতে।

এখানে ব্যারিকেড করছ না কেন? এটা তো ভালো জায়গা।

ঠিক বলেছ ল্যাগলে।

এই বলে সে অন্যদের লা শাশোরিতেই ব্যারিকেড তৈরি করার জন্য বলল।

.

২.

রাস্তা থেকে একটা সরু গলিপথ বেরিয়ে আসার জায়গাটা ব্যারিকেডের পক্ষে সত্যিই ভালো। বোসেত মদ খেয়ে মাতাল হলেও তার হ্যাঁনিবলের মতোই দূরদৃষ্টি ছিল। চোখের নিমেষে হোটেলের জানালা-দরজা সব বন্ধ হয়ে গেল। কতকগুলি চুনের খালি পিপের ভেতর পাথরখণ্ড ভরে রাখা হল। জানালাগুলো থেকে লোহার রড ছাড়িয়ে নেওয়া হল। মাদাম হুশেলুপ কাতর কণ্ঠে প্রার্থনা করতে লাগল, ঈম্বর আমাদের রক্ষা করুন।

বোসেত বাইরে ছুটে কুফেরাককে অভ্যর্থনা জানাতে গেল। গ্রান্তেয়ার ঘরের ভেতর থেকে বলতে লাগল, তোমাদের মাথায় ছাতা নেই কেন? সর্দি হবে যে!

কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাইরে পথের পাথর, কাঠ প্রভৃতি দিয়ে মানুষের থেকে উঁচু একটা প্রাচীর খাড়া করা হল। তার উপর ভারী একটা বাসকে পথের উপর রাখা হল। ঘোড়ার গাড়িগুলো থেকে ঘোড়াগুলো খুলে দিয়ে গাড়িগুলোকেও ব্যারিকেডের সঙ্গে যোগ করে দেওয়া হল।

মাদাম হুশেলুপ হোটেলের দোতলার ঘরে বসে সব কিছু লক্ষ করে যাচ্ছিল আর বিড় বিড় করে আপন মনে কী বলে যাচ্ছিল। জলি এক সময় তার পেছন থেকে তার অনাবৃত ঘাড়ের উপর একটা চুম্বন করে গ্রান্তেয়ারকে বলল, মেয়েদের ঘাড়টাকে আমার সবচেয়ে সুন্দর বলে মনে হয়।

এদিকে গ্রান্তেয়ার তখন মাতেলোত্তে ঘরে ঢুকতেই তার কোমরটা জড়িয়ে ধরে হেসে বলল, মাতেলোত্তে কুৎসিত। মেয়েটা ভালো। আমি জোর করে বলতে পারি ও লড়াই ভালো করবে। মেরে হুশেলুপের বয়স হলেও চেহারাটা শক্ত। সে-ও ভালোই লড়াই করতে পারবে। ওরা দু জনে লড়াই করে গোটা অঞ্চলটাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলঁতে পারবে। বন্ধুগণ, আমরা সরকারের পতন ঘটাতে চাই। আমার অঙ্কে বুদ্ধি নেই বলে বাবা আমাকে দেখতে পারতেন না। আমি শুধু বুঝি প্রেম আর স্বাধীনতা। আমি হচ্ছি ভালো মানুষ গ্রান্তেয়ার। আমার টাকা নেই, টাকা রোজগারের কথা ভাবিওনি। আমি যদি ধনী হতাম তা হলে পৃথিবীতে কেউ গরিব থাকত না। উদার প্রকৃতির লোকরা ধনী হলে পৃথিবীর দুঃখ ঘুচে যেত। যিশুর যদি রথচাইল্ডের মতো ধনসম্পদ থাকত তা হলে তিনি কত লোকের উপকার করতেন, পৃথিবীর কত ভালো করতেন। মাতেলোত্তে, তুমি আমাকে চুম্বন কর। তোমার মধ্যে প্রেমের আবেগ আছে, তুমি লাজুক প্রকৃতির, তোমার গালদুটো সিস্টারের চুম্বনের জন্য আর তোমার আর তোমার ঠোঁটদুটো প্রেমিকের চুম্বনের জন্য তৈরি হয়েছে।

কুরফেরাক বলল, তোমার মাতলামি বন্ধ কর।

গ্রান্তেয়ার বলল, আমি হচ্ছি উঁচু দরের এক ম্যাজিস্ট্রেট আর আনন্দ উৎসবের রাজা।

এঁজোলরাস ব্যারিকেডের উপর দাঁড়িয়ে বন্দুক হাতে গ্রান্তেয়ারের পানে কড়া দৃষ্টিতে। তাকাল। সে ছিল যেমন স্পার্টানদের মতো বীর তেমনি পিউরিটানদের মতো গোড়া নীতিবাদী। সে বলল, গ্রান্তেয়ার, তুমি অন্য কোথাও গিয়ে ঘুমিয়ে তোমার মদের নেশাটা কাটাও গে। এখানে আবেগের মত্ততা আছে, কিন্তু মাতলামির কোনও অবকাশ নেই। ব্যারিকেডের অপমান করো না।

এঁজোলরাসের এই তিরস্কারে ফল হল। গ্রান্তেয়ার টেবিলের উপর কনুই রেখে গম্ভীরভাবে বসে রইল। তার পর বলল, এঁজোলরাস, তুমি জান, তোমার ওপর আমার বিশ্বাস আছে।

যাও, চলে যাও।

আমাকে এখানেই ঘুমোতে দাও।

এঁজোলরাস বলল, না, অন্য কোথাও গিয়ে ঘুমোও।

তবু গ্রান্তেয়ার বলল, আমাকে এখানেই ঘুমোতে দাও, দরকার হলে আমি এখানেই মরব।

এঁজোলারাস ঘৃণাভরে গ্রান্তেয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল, গ্রান্তেয়ার, তুমি কোনও কিছুই পারবে না। কোনও যোগ্যতাই নেই তোমার। তুমি কোনও কিছু বিশ্বাস করতে, চিন্তা করতে, ইচ্ছা বা সংকল্প করতে, বাঁচতে বা মরতে কোনও কিছুই পারবে না।

গ্রান্তেয়ার গম্ভীরভাবে বলল, তুমি দেখবে, দেখে নেবে।

সে আরও কী অস্পষ্টভাবে বলল। তার পর তার মাথাটা টেবিলের উপর গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। এটা হচ্ছে মদের নেশার দ্বিতীয় স্তরের প্রতিক্রিয়া।

.

৩.

বাহোরেল ব্যারিকেড দেখে আনন্দে চিৎকার করে বলে উঠল, এবার এ রাস্তাটা লড়াইয়ের উপযুক্ত জায়গা হয়ে উঠেছে, চমৎকার দেখাচ্ছে।

কুরফেরাক হোটেলের অনেক আসবাব, জিনিসপত্র ও জানালার রড ছাড়িয়ে ব্যারিকেড দেওয়ার পর মাদাম হুশেলুপকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। সে বলল মেরে হুশেলুপ, একদিন তুমি বলেছিলে গিবেলোত্তে জানালা দিয়ে একটা কম্বল ফেলেছিল বলে কে নাকি অভিযোগ করেছিল।

হুশেলুপ বলল, কথাটা ঠিক, মঁসিয়ে কুরফেরাক, ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন। তোমরা কি এই টেবিলটাকেও নিয়ে গিয়ে ব্যারিকেডের উপর চাপিয়ে দেবে? সেদিন গিবেলোত্তে একটা কম্বল আর ফুলদানি জানালা দিয়ে ফেলে দেওয়ায় সরকার একশো ঐ জরিমানা করেছে।

আমরা তা তোমাকে দিয়ে দেব মেরে হুশেলুপ।

কিন্তু সে টাকা কোনওদিন পাবে বলে বিশ্বাস হল না হুশেলুপের। উল্টে তার হোটেলের সব জিনিসপত্র নষ্ট হতে চলেছে।

তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। শ্রমিকরা অস্ত্র হাতে দলে দলে এসে যোগ দিচ্ছিল। এঁজোলরাস, কমবেফারে আর কুরফেরাক সব কিছু তদারক করছিল আর নির্দেশ দান করছিল। তখন আর একটা ব্যারিকেড তৈরি করা হচ্ছিল। র‍্যু মদেতুরে তৈরি দ্বিতীয় ব্যারিকেডটা করা হচ্ছিল শুধু খালি পিপে আর পাথর দিয়ে।

তিরিশজন শ্রমিক একটা বন্দুকের দোকান লুট করে তিরিশটা বন্দুক হাতে নিয়ে ব্যারিকেডের কাজে যোগ দিল। তারা সকলেই উদ্যমের সঙ্গে কাজ করতে লাগল। এক বিরাট জনতা ছিল তাদের সঙ্গে। বিচিত্র ধরনের মানুষ, বিভিন্ন বয়সের লোক–সকলেরই মনে এক উদ্দেশ্য, সকলের মুখেই এক কথা। কোনও এক উৎসব থেকে কতকগুলি মশাল হাতে করে নিয়ে এসেছিল তারা। তারা সবাই বলাবলি করছিল রাত দুটো-তিনটের সময় বিরাট এক জনতা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। তারা সবাই কেউ কারও নাম না জানলেও সবাইকে ভাই বলে মনে করছিল। এক জাতীয় বিপর্যয় তাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলেছিল এক মহান ভ্রাতৃত্ববোধ।

হোটেলের রান্নাঘরে আগুন জ্বালানো হল। তাতে যত সব কাঁটা-চামচ প্রভৃতি ধাতুর জিনিসগুলো গালিয়ে গুলি তৈরির কাজে লাগানো হল। গ্লাসে করে সবাইকে মদ বিতরণ করা হচ্ছিল। মাদাম হুশেলুপ, মাতেলোত্তে আর গিবেলোত্তে উপরতলার একটা ঘরে ভয়ে বসেছিল হতবুদ্ধি হয়ে। তাদের মধ্যে গিবেলোত্তে আর কয়েকজনের সঙ্গে কম্বল ছিঁড়ছিল। আহত লোকদের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করার জন্য ছেঁড়া কম্বলগুলোর দরকার। যে তিনজন বিপ্লবী গিবেলোত্তেকে সাহায্য করছিল এ কাজে তাদের মাথায় চুল আর মুখে দাড়ি ছিল। তাদের মুখের সেই কালো দাড়ি আর বলিষ্ঠ চেহারাগুলো দেখলে ভয় লাগছিল মেয়েদের।

র‍্যু দে বিলেত্তেতে কুরফেরাক, কমবেফারে আর এঁজোলরাস অচেনা যে একজন বয়স্ক বলিষ্ঠ চেহারার লোককে তাদের দলে যোগদান করতে দেখে সেই লোকটি বড় ব্যারিকেডটার কাজ দেখাশোনা করছিল। ছোট ব্যারিকেডটা দেখাশোনা করছিল গাভ্রোশে। কুরফেরাকের বাসায় মেরিয়াসের খোঁজ করতে এসেছিল যে যুবকটি সে কখন চলে গেছে কেউ দেখেনি। গাভ্রোশে হাসতে হাসতে এমন লাফালাফি করে মাতামাতি করে কাজ করছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল সবার মধ্যে উদ্যম জাগানোই ছিল তার কাজ। নিরাশ্রম দারিদ্রের সঙ্গে একটা অকারণ আনন্দ তাকে অনুপ্রাণিত করে তুলেছিল এ কাজে। এক প্রবল ঘূর্ণিবায়ুর মতো তার উত্তেজিত কণ্ঠস্বরের দ্বারা আকাশ-বাতাস পূর্ণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। তাকে সব জায়গায় দেখা যাচ্ছিল এবং তার কথা শোনা যাচ্ছিল। যারা অলস প্রকৃতির এবং যারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল গাভ্রোশে ঘুরে ঘুরে তাদের উত্তেজিত ও অনুপ্রাণিত করে তুলঁছিল। তার কথায় ও কাজে মজা পাচ্ছিল সবাই। আবার চিন্তাশীল প্রকৃতির যারা তারা বিরক্ত বোধ করছিল।

মাঝে মাঝে সে হাঁকাহাঁকি করে বলছিল, আরও পাথর চাই, আরও পিপে চাই। একটা ঝুড়ি চাই। ব্যারিকেডটাকে আরও উঁচু করতে হবে, এটা ঠিক হয়নি। দরকার হলে বাড়িটাকে ভেঙে দাও। ওই দেখ, কাঁচওয়ালা একটা দরজা রয়েছে।

একজন শ্রমিক বলল, কাঁচওয়ালা ওই দরজাটা নিয়ে কী করবে বালক লুমো?

গাভ্রোশে বলল, তুমি নিজে লুমো। কাঁচওয়ালা দরজা ব্যারিকেড়ে দিলে তাতে আক্রমণ করা সহজ হবে ব্যারিকেডটাকে, কিন্তু তার মধ্যে ঢোকা সহজ হবে না। তাতে সৈনিকদের হাত কেটে যাবে।

ঘোড়া ছাড়া পিস্তলটার জন্য বিরক্তিবোধ করছিল গাভ্রোশে। সে তাই একটা বন্দুকের জন্য চিৎকার করছিল, সে বলছিল, কেউ আমাকে একটা বন্দুক দেবে না?

কমবেফারে বলল, তোমার মতো ছেলে বন্দুক নিয়ে কী করবে?

কেন নেব না? ১৮৩০ সালে আমার হাতে একটা বন্দুক ছিল। তা দিয়ে দশম চার্লসকে তাড়াই।

এঁজোলরাস বলল, যখন সব প্রাপ্তবয়স্কর হাতে বন্দুক তুলে দিতে পারব তখন ছেলেদের হাতে বন্দুক দেওয়ার কথা ভাবব।

গাভ্রোশে গম্ভীরভাবে বলল, তুমি মরে গেলে তোমার বন্দুকটা নেব।

এঁজোলরাস বলল, এঁচোড়পাকা ছেলে।

সবুজ শিংওয়ালা যুবক।

রাস্তার ওপারে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সব কিছু লক্ষ করতে থাকা এক যুবকের দিকে ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। গাভ্রোশে চিৎকার করে তাকে বলল, চলে এস আমাদের দলে। তোমার গরিব দেশের জন্য কিছু করবে না?

তার কথা শুনে যুবকটি পালিয়ে গেল।

.

৪.

খবরের কাগজগুলোতে পরদিন খবর বেরোল র‍্যু দ্য লা শাঁব্রেরিতে বিপ্লবীরা যে ব্যারিকেড তৈরি করেছে তা দোতলার সমান উঁচু। কিন্তু কথাটা সত্যি নয়। বিপ্লবীদের তৈরি কোনও ব্যারিকেডই ছ-সাত ফুটের বেশি উঁচু নয়। ব্যারিকেডগুলো এমনভাবে তৈরি করা হত যাতে সামনের দিক থেকে কেউ তার উপর উঠতে না পারে। সামনের দিকে থাকত পিপে পাথর কাঠ আর ভাঙা গাড়ির লোহালক্কড়। পেছনের দিকে পাথরগুলো এমনভাবে সিঁড়ির মতো সাজানো থাকত যাতে কেউ সহজে উঠতে পারে তার উপর। র‍্যু মঁদেতুরের ব্যারিকেডটা ছোট ছিল। ব্যারিকেডের পেছনে যে সব বড় বড় পাকা বাড়ি ছিল সেগুলোতে লোক থাকলেও তাদের দরজা-জানালা সব বন্ধ ছিল।

এক ঘণ্টার মধ্যেই দুটো ব্যারিকেড তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেল। যে দু-একজন পথচারী সাহস করে রাস্তা দিয়ে র‍্যু ডেনিসের দিকে যাচ্ছিল তারা সে ব্যারিকেড দেখে ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে যায়। ব্যারিকেড তৈরির কাজ হয়ে গেলে তার উপর। একটা করে লাল পতাকা উড়িয়ে দেওয়া হল। কুরফেরাক হোটেল থেকে একটা টেবিল এনে এক জায়গায় রাখল। এঁজোরাস একটা বাক্স এনে তার উপর রেখে সেটা খুলে বন্দুকধারী লোকদের মধ্যে কার্তুজ বিতরণ করতে লাগল। অনেকের কাছে বারুদের পাউডার ছিল।

জয়ঢাকের যে ধ্বনি সরকারি সেনাবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য আহ্বান জানাচ্ছিল সে ধ্বনি শহরের বিভিন্ন জায়গায় ধ্বনিত হচ্ছিল। ধ্বনিটা ক্রমশই এগিয়ে আসছিল। বিপ্লবী জনতা সেদিকে কোনও কান দিচ্ছিল না। তাদের ঘাঁটির বাইরে তিন জায়গায় তিনজন প্রহরী মোতায়েন করে এঁজোলরাস। এরপর সবাইকে বন্দুকে গুলি ভরার হুকুম দিল সে। তখন গোধূলিবেলা। ঘনায়মান সান্ধ্য ছায়ার এক অটল নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল। সংকল্পে কঠিন, ব্যাপক অস্ত্রসজ্জার সমারোহে অশুভ সেই নিস্তব্ধতার মাঝে এক ভয়ঙ্কর ও বিষাদাত্মক ঘটনার প্রতীক্ষিত পদধ্বনি যেন অশ্রুত অথচ নির্মমভাবে ধ্বনিত হচ্ছিল।

.

৫.

এই প্রতীক্ষার সময় তারা কী করছিল? তারা যা করছিল সেটাও একটা মনে রাখার মতো ইতিহাস।

পুরুষ কর্মীরা যখন কার্তুজ তৈরি করছিল, মেয়েরা তখন ব্যান্ডেজ তৈরি করছিল, রান্নাঘরে একটা বড় কড়াই-এর উপর বন্দুকের গুলির জন্য সিসে গলানো হচ্ছিল, ব্যারিকেডের বাইরে প্রহরীরা যখন পাহারা দিচ্ছিল সজাগ দৃষ্টিতে আর এঁজোলরাস একমনে সবকিছু পরিদর্শন করে দেখছিল তখন কুরফেরাক, কমবেফারে, জাঁ প্রুভেয়ার আর কয়েকজন মিলে ব্যারিকেডের কাছে এক জায়গায় গুলিভরা বন্দুক নিয়ে বসে প্রেমের কবিতা আবৃত্তি আর গান করছিল। কবিতাটি ছিল এই :

প্রিয়া, আজও কি তোমার মনে পড়ে সেই কথা?
আশা ছিল যবে মনের মাঝারে, বুকভরা যৌবন
কোনও চিন্তা ছিল নাকো মনে, ছিল নাকো কোনও ব্যথা,
মনপ্রাণ জুড়ে ছিল বিরাজিত প্রেমের গুঞ্জরন।
শিহরে জাগাত স্পর্শ আমার তোমার ব্যাকুল মনে
কত ফুল আমি এনে যে দিতাম তোমার পদ্মহাতে,
কত পথিকদৃষ্টি হত যে ধাবিত তব যৌবনপানে
অলির মতো উড়তে চাইত তব পুষ্পিত আঁখিপাতে।
চুম্বন আমি করেছিনু যবে প্রথম প্রেমের দিনে
শান্ত মানুষ সয়ে যেত সবে সকল অত্যাচার
কোনও দ্বন্দ্ব কোনও বিক্ষোভ ছিল নাকো কোনওখানে
বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরপরে সব জীবনের সার।

অতীত যৌবনজীবনের প্রেমময় স্মৃতির সৌরভ, আকাশে প্রথম সন্ধ্যাতারা ফুটে ওঠার শান্ত মুহূর্ত, পরিত্যক্ত পথের সমাধিসুলভ নির্জনতা, এক অশুভ ঘটনার নির্মম আগমনের ভয়াবহ আভাস–সব মিলিয়ে ওদের কণ্ঠে আবৃত্ত কবিতাটিকে এক সকরুণ ভাবমাহাত্ম্য দান করেছিল। জাঁ প্রভেয়ার সত্যিই একজন কবি ছিল।

ছোট ব্যারিকেডটায় একটা ছোট আলো আর বড় ব্যারিকেডটায় একটা মোমের মশাল জ্বালানো হয়েছিল। হোটেলের নিচের তলার ঘরে গাভ্রোশে কার্তুজ তৈরি করছিল। সেখানে একটা বাতি জ্বলছিল। কিন্তু উপরতলার ঘরে কোনও আলো ছিল না। এছাড়া হোটেলের বাইরে পথেঘাটে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছিল। ব্যারিকেডের মাথার উপর উড়তে থাকা লাল পতাকার রংটা এক অশুভ লক্ষণে কালো দেখাচ্ছিল।

.

৬.

রাত্রি বাড়তে লাগল। কিন্তু কোনও ঘটনা ঘটল না। মঝে মাঝে এক একটা বন্দুকের গুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। সরকার পক্ষের এই দীর্ঘ নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার একটা অর্থ ছিল। তার অর্থ ছিল এই যে সরকার তখন সৈন্য সমাবেশে ব্যস্ত ছিল। এদিকে বিপ্লবীদের পঞ্চাশজন নেতা ষাট হাজার লোকের হত্যাকাণ্ডের অপেক্ষায় স্তব্ধ হয়ে ছিল।

বড় রকমের প্রতিকূল ঘটনার সম্মুখীন হয়ে দৃঢ়চেতা লোকরাও যেমন অধৈর্যে বিচলিত হয়ে পড়ে, এঁজোলরাসও তেমনি বিচলিত হয়ে পড়েছিল কিছুটা। সে গাভ্রোশের খোঁজ করছিল।

এদিকে গাভ্রোশে যখন নিচের তলার একটা ঘরের মধ্যে একা কার্তুজ তৈরি করছিল একটা বাতির আলোয় তখন যে লোকটি র‍্যু বিলেত্তেতে বিপ্লবীদের দলে এসে যোগ দেয়, যাকে তাদের কেউ চিনত না, সেই লোকটি একটি ঘরের মধ্যে এসে অন্ধকার একটা কেণে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। তাকে একটা বড় বন্দুক দেওয়া হয়েছিল। সেটা তখন তার দুটো হাঁটুর মধ্যে ছিল। যে লোক আসার পর বিরাট কর্মতৎপরতা দেখায় সে এখন শান্তভাবে কী ভাবতে লাগল। গাভ্রোশে আগে তাকে ভালো করে দেখেনি। কাজে মেতে ছিল সব সময়। এখন সে নিঃশব্দে পা ফেলে নবাগত অচেনা লোকটির কাছে গিয়ে ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। হঠাৎ সে আশ্চর্য হয়ে আপন মনে বলতে লাগল, না না, এ কখনও হতে পারে না এ অসম্ভব। সে বিস্মিত ও হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল। তার সমস্ত চেতনা ও বুদ্ধি সজাগ হয়ে উঠল।

এমন সময় এঁজোলরাস এসে ঘরে ঢুকে গাভ্রোশেকে বলল, তুমি ছোট আছ, কেউ দেখতে পাবে না। তুমি বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে রাস্তায় গিয়ে কী অবস্থা দেখে এস।

গাভ্রোশে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়াল। তার পর বলল, আমরা ছোট হলেও কাজে লাগতে পারি। ঠিক আছে, আমি তা করব। কিন্তু এবার বড়দের দিকে একবার তাকাও।

এই বলে ইশারা করে ঘরের কোণে বসে থাকা লোকটির দিকে হাত বাড়িয়ে তাকে দেখাল।

এঁজোলরাস বলল, কী হয়েছে?

ও পুলিশের গুপ্তচর। পুলিশের লোক।

তুমি ঠিক জান?

একপক্ষ কালও হয়নি, একদিন পঁত রয়ালে আমি যখন পথ হাঁটছিলাম ও আমাকে তুলে নিয়ে যায়।

এঁজোলরাস সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে একজন শ্রমিকের কানে কানে একটা কথা বলে। শ্রমিক তিন-চারজন লোককে ডেকে নিয়ে এসে ঘুরে ঢুকে কোণে বসে থাকা লোকটিকে ঘিরে দাঁড়ায়। এঁজোলারাস তখন সরাসরি লোকটির কাছে গিয়ে বলে, কে তুমি?

এই আকস্মিক অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে চমকে ওঠে লোকটি। সে উঠে দাঁড়িয়ে কড়াভাবে তাকাল এঁজোলরাসের মুখপানে। একটুখানি হাসি হেসে দৃঢ়ভাবে বলল, বুঝেছি… হ্যাঁ আমি।

তুমি একজন পুলিশের চর।

আমি হচ্ছি আইনের প্রতিনিধি।

তোমার নাম কী?

জেভাৰ্ত।

জেভার্ত কিছু করার আগেই এঁজোলরাস তার দলের সেই চারজন লোককে ইশারা করতেই তারা বেঁধে ফেলল লোকটিকে এবং তার পকেটগুলো হাতড়ে দেখতে লাগল। তার পকেটে একটা কার্ড আর কিছু স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেল। কার্ডটার একদিকে পুলিশের বড় কর্তার সই করা একটা নির্দেশনামা ছিল। তাতে একদিকে লেখা ছিল, ইন্সপেক্টর জেভাৰ্ত, বয়স ৫২, তার রাজনৈতিক কাজ শেষ হলে সেন নদীর দক্ষিণ তীরে দুবৃত্তরা গা ঢাকা দিয়ে থাকে, এই বিবরণের সত্যাসত্য নিজে পঁত দ্য অঞ্চলে গিয়ে দেখে আসবে।

জেতার্তকে বাঁধা হয়ে গেলে সে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে রইল অবিচলভাবে। সে একটা কথাও বলল না। তার হাত দুটো পেছন দিকে বাঁধা ছিল। গাভ্রোশে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে সব কিছু লক্ষ করে যাচ্ছিল নীরবে। সব কিছু দেখার পর সে জেভার্তের এই শাস্তি সমর্থন করল। তার পর সে জেভাৰ্তকে বলল, তা হলে সামান্য উঁদুরও বিড়ালকে ধরতে পারে।

জেভার্তকে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখা হল। খবর পেয়ে কুরফেরাক, কমবেফারে, ফুলি, বোসেত, জলি প্রভৃতি অনেকে ঘরে এসে দেখতে লাগল। এঁজোলরাস সবাইকে বলল, ইনি হচ্ছেন পুলিশের চর।

এবার জেভাৰ্তের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল সে, আমাদের ব্যারিকেডের দু মিনিট আগে তোমাকে গুলি করে মারা হবে।

জেতার্ত শান্ত ও নির্বিকারভাবে বলল, এই মুহূর্তে মারা হবে না কেন?

আমাদের একটা গুলি নষ্ট হবে।

আমাকে মারার জন্য একটা ছুরি ব্যবহার করতে পার।

এঁজোলরাস বলল, শোন, আমরা হচ্ছি সমাজের বিচারক, খুনি নই।

এরপর সে গাভ্রোশেকে বলল, তুমি চলে যাও, যা বলেছি করে এস।

গাভ্রোশে যেতে গিয়ে দরজার কাছে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওর বন্দুকটা আমাকে দাও। আমি বাদককে তোমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেলাম, কিন্তু তার ঢাকটা আমি চাই।

এই বলে সামরিক কায়দায় এঁজোলরাসকে অভিবাদন জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল গাভ্রোশে। ব্যারিকেডের পাশের সরু পথটা দিয়ে বড় রাস্তার দিকে চলে গেল।

.

৭.

গাভ্রোশে চলে যাবার কিছুক্ষণ পরেই যে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ না দিলে পাঠকরা গোটা ব্যাপারটা বুঝতে পারবেন না। বুঝতে পারবেন না, বিপ্লবের জন্মলগ্নে সমগ্র দেশ কিভাবে প্রসব-বেদনায় ছটফট করে, গণবিক্ষোভকালে এক চরম বিশৃঙ্খলার সঙ্গে কিভাবে এক মহান গণসংগ্রাম মিশে থাকে।

বিপ্লবী জনতার মধ্যে আর একজন শ্রমিকের ছেঁড়া পোশাকপরা অচেনা লোক যোগদান করেছিল। তার নাম ছিল লে কিউবাক। তার আচরণটা ছিল অসংযত মাতালের মতো। সে জনতার কিছু লোককে মদ খাবার জন্য উৎসাহ দিচ্ছিল। সেই সঙ্গে সে ব্যারিকেডের পেছনে যে একটা পাঁচতলা বড় বাড়ি ছিল সেটা খুঁটিয়ে দেখছিল। সহসা সে চিৎকার করে বলে উঠল, বন্ধুগণ, ওই বাড়িটা থেকে গুলি চালানো সহজ হবে। জানালা থেকে গুলি চালালে রাস্তার দিকে কোনও শত্রুসৈন্য কাছে ঘেঁষতে সাহস পাবে না।

একজন বলল, কিন্তু বাড়িটার সব দরজা-জানালা বন্ধ।

আমরা দরজায় ধাক্কা দিতে পারি।

ওরা দরজা খুলবে না।

আমরা তখন দরজা ভেঙে ফেলব।

বাড়িটার দরজা-জানালা একেবারে বন্ধ ছিল। বাড়ির সদর দরজাটা বেশ মজবুত। লে কিউবাক নিজেই দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। কিন্তু কোনও সাড়া না পেয়ে পর পর তিনবার সে জোর ধাক্কা দিল। কিন্তু তবু ভেতর থেকে কেউ সাড়া দিল না।

কিউবাক বলল, ভেতরে কে আছে?

কেউ সাড়া দিল না।

লে কিউবাক তখন তার বন্দুকের বাঁট দিয়ে ধাক্কা দিতে লাগল। দরজাটা পুরনো আমলের ওক কাঠ আর লোহা দিয়ে তৈরি। বন্দুকের বাঁটের ধাক্কায় বাড়িটা কেঁপে উঠল, কিন্তু দরজাটা ভাঙল না। তখন তিনতলায় একটা জানালা খুলে গেল। তাতে আলো দেখা দিল। আর সেই সঙ্গে পাকা চুলওয়ালা একটা লোকের মাথা দেখা গেল। হয়তো সে-ই ছিল বাড়ির দারোয়ান।

লোকটি বলল, আপনারা কী চান?

লে কিউবাক বলল, দরজা খোল।

দরজা খোলার হুকুম নেই।

তা হলেও ঢুকতে হবে।

দরজা খোলার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

লে কিউবাক তার বন্দুকটা তুলে লোকটার মাথা লক্ষ্য করল। তার পর বলল, তুমি দরজা খুলবে কি না?

না মঁসিয়ে।

তুমি খুলবে না?

না মঁসিয়ে।

লোকটি কিউবাকের বন্দুকটা দেখতে পায়নি। কারণ কিউবাক রাস্তার উপর যেখানে। দাঁড়িয়ে ছিল সেখানটা অন্ধকার ছিল।

লোকটার কথা শেষ হতে না হতেই সে কিউবাকের বন্দুকটা গর্জে উঠল। সে বন্দুকের গুলিটা লোকটার চিবুকে ঢুকে তার ঘাড় ফুটো করে বেরিয়ে গেল। তার নিস্পন্দ মাথাটা জানালার উপর ঢলে পড়ল। তার হাতে ধরা বাতিটা পড়ে গিয়ে নিবে গেল।

লে কিউবাক বন্দুকটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, এবার হল তো?

কিন্তু তার কথা শেষ হতেই হঠাৎ একটা হাত এসে তার ঘাড়টা শক্ত করে ধরে ফেলল। বারবার এক কণ্ঠস্বর বলে উঠল, নতজানু হয়ে বস।

লে কিউবাক মুখ ঘুরিয়ে দেখল এঁজোলরাস পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে আছে। গুলির শব্দ পেয়ে বেরিয়ে আসে সে।

এঁজোলরাস আবার বলল, নতজানু হও।

কুড়ি বছরের এক যুবক এক রাজকীয় প্রভুত্বের সঙ্গে পেশিবহুল চেহারার এক শ্রমিককে নলখাগড়া গাছের মতো নত হতে বাধ্য করল। লে কিউবাক বাধা দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু সে দেখল, এক অতিমানবিক শক্তির কবলে পড়ে গেছে সে। লম্বা অবিন্যস্ত চুলওয়ালা এঁজোলরাসের মেয়েদের মতো মুখখানা প্রাচীন গ্রিকদেবতার মতো মনে হচ্ছিল। তার চোখ দুটো এক ন্যায়সংগত পবিত্র ক্রোধের উত্তাপে জ্বলছিল। তার নাসারন্ধ্র দুটো কাঁপছিল। মনে হচ্ছিল সে যেন পৌরাণিক যুগের ন্যায়ের দেবতা।

যে সব লোক চারদিকে ছড়িয়ে ছিল তারা ঘটনাস্থলে এল। কিন্তু এঁজোলরাসের কাছে আসতে সাহস পেল না। তারা জানত এ ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবাদ করা চলবে না।

লে কিউবাক এবার নিজেকে মুক্ত করার কোনও চেষ্টা না করে নত হয়ে আত্মসমর্পণ করল। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। এঁজোলরাস তার ঘাড়টা ছেড়ে তার হাতঘড়িটার দিকে তাকাল। তার পর বলল, এবার তৈরি হও, মাত্র এক মিনিট সময় আছে। প্রার্থনা কর। অথবা চিন্তা কর।

লে কিউবাক বলল, ক্ষমা কর। তার পর মুখা নিচু করে অস্পষ্টভাবে বিড় বিড় করে কী বলতে লাগল।

এঁজোলরাস তার হাতঘড়ি থেকে একবারও চোখ ফেরাল না। এক মিনিট হয়ে গেলে সে রিভলবারটা হতে তুলে নিয়ে লে কিউবাকের মাথার চুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরল।

লে কিউবাক নতজানু বসতেই সে তার কানের কাছে পিস্তলের মুখটা ধরে গুলি করল। যে সব বিপ্লবী সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করার জন্য হঠকারিতার সঙ্গে ছুটে আসে তারা তাদের মুখ ঘুরিয়ে নিল।

লে কিউবাকের নিথর-নিস্পন্দ দেহটা রাস্তার উপরেই পড়ে গেল। এঁজোলরাস সেই মৃতদেহটার উপর একটা লাথি মেরে বলল, এটা সরিয়ে ফেল।

তিনজন লোক সঙ্গে সঙ্গে মৃতদেহটা নিয়ে ছোট ব্যারিকেডটার উপর ফেলে দিল। এঁজোলরাস গভীরভাবে কী ভাবতে লাগল। তার আপাতশান্ত চেহারাটার অন্তরালে আর কোনও ভয়াবহ এক মেঘচ্ছায়া ঘনিয়ে উঠছে কি না, তা কে বলতে পারে। চারদিক একেবারে চুপচাপ।

এঁজোলরাস সহসা বলতে লাগল, হে নাগরিকবৃন্দ, এই লোকটি যা করেছিল তা ঘূণ্য আর আমি যা করেছি তা ভয়ঙ্কর। সে কারণে হত্যা করেছে। কারণ বিপ্লব হবে নিয়ম-শৃঙ্খলার অধীন। অন্য ক্ষেত্রের থেকে বিপ্লবের ক্ষেত্রে অকারণ নরহত্যা অনেক বেশি অপরাধ। বিপ্লব ও প্রজাতন্ত্রের পুরোহিতগণ আমাদের সব কাজ বিচার করে দেখবেন। আমাদের কোনও কাজ যেন নিন্দনীয় না হয়। তাই এই লোকটিকে মৃত্যুদণ্ড দান করেছি আমি। তবু আমি যা করেছি তা ঘৃণ্য এবং অনিচ্ছার সঙ্গেই করেছি। আমি আমার এই কাজের জন্য আমার নিজের বিচার করেছি এবং সে বিচারের রায় একটু পরেই তোমরা জানতে পারবে।

উপস্থিত জনতার মধ্যে ভয়ের একটা শিহরণ খেলে গেল।

কমবেফারে বলল, আমরাও তোমার ভাগ্যের অংশীদার হব।

এঁজোলরাস বলল, তা হতে পার। কিন্তু আমার আরও কিছু বলার আছে। যে নির্মম প্রয়োজনীয়তার খাতিরে আমি এই লোকটিকে মৃত্যুদণ্ড দান করেছি, প্রাচীনকালের লোকেরা সেই প্রয়োজনীয়তাকেই নিয়তি বলত। অগ্রগতির নিয়ম অনুসারে এই নিয়তিই সেই ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসায় পরিণত হবে। এই ভালোবাসাই আমাদের ভবিষ্যৎ। ভবিষ্যতে কোনও মানুষকে কেউ হত্যা করবে না। জগতে কোথাও কোনও অন্ধকার বা বিদ্যুৎ থাকবে না, কোনও বর্বরতা ও গৃহযুদ্ধের কোনও অবকাশ থাকবে না। এমন দিন অবশ্যই আসবে যেদিন পৃথিবীজুড়ে বিরাজ করবে শান্তি, ঐক্য, আনন্দ আর প্রাণচঞ্চলতার আলো। সেদিনকে ত্বরান্বিত করার জন্যই মৃত্যুবরণ করতে হবে আমাদের।

এবার চুপ করে গেল এঁজোলরাস। যেখানে একটু আগে লে কিউবাককে হত্যা করেছে সে, সেইখানে পাথরের প্রতিমূর্তির মতো নীরবে দাঁড়িয়ে রইল সে। সে যেন একাধারে পুরোহিত এবং ঘাতক। তার ঠোঁট দুটো বন্ধ করে সে জনতার দিকে স্থির কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কমবেফারে আর জাঁ প্রুভেয়ার হাত ধরাধরি করে স্তব্ধ হয়ে ব্যারিকেডের পাশে একাধারে দাঁড়িয়ে রইল। এঁজোলরাসের কঠোর মুখখানার পানে একই সঙ্গে প্রশংসা আর করুণাঘন দৃষ্টিতে তাকাল। তার মুখখানা যেমন স্ফটিকের মতো উজ্জ্বল তেমনি পাহাড়ের মতোই কঠোর এবং অকম্পিত।

পরে পুলিশ রিপোর্ট থেকে জানা যায় আসলে লে কিউবাক ছিল ক্লাকেসাস। সে ছিল একজন দাগি অপরাধী। সে হঠাৎ কোথায় অদৃশ্য হয়ে যায়।

এই ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পরই কুরফেরাক দেখে যে যুবকটি আজ সকালে তার বাসায় মেরিয়াসের খোঁজ করতে এসেছিল, সে তাদের দলে যোগ দিতে এসেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *