প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৪.০৭ কসেত্তেদের বাসার ঠিকানা

সপ্তম পরিচ্ছেদ

১.

পাঠকদের হয়তো মনে আছে ম্যাগননের কাছ থেকে র‍্যু প্লামেতে কসেত্তেদের বাসার ঠিকানা পেয়ে সেটা খুঁজে বার করে তার চেনা দুবৃত্তদের সেখানে থেকে ঠেকিয়ে রাখে এপোনিনে। তার জন্য কেউ কিছু করতে পারেনি। পরে সে মেরিয়াসকে সেই বাড়িটা সঙ্গে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে দেয়। মেরিয়াস দিনকতক লক্ষ রাখার পর একদিন সন্ধের সময় সাহস করে কসেত্তে’র সঙ্গে দেখা করে বাগানে। তার পর থেকে রোজ সেখানে যেতে থাকে। রোমিও’র মতো জুলিয়েটের বাগানে যেতে থাকে প্রেমের টানে। তবে রোমিও’র মতো তাকে বাগানের পাঁচিল বেয়ে উঠতে হয়নি। শুধু সন্ধ্যার নির্জন অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে বাগানের মরচে পড়া গেটের ফাঁক দিয়ে গলে ঢুকে পড়েছে সে।

কসেত্তেও বাগানে এসে মিলিত হত মেরিয়াসের সঙ্গে। কিন্তু কসেত্তে যদি এই মিলনের ব্যাপারে বিশেষ বাড়াবাড়ি করত, যদি স্বাধিকার প্রমত্ত হয়ে উচ্ছলতার স্রোতে গা ভাসিয়ে দিত তা হলে সর্বনাশ হত তার। সাধারণত নারীরা এই সব ক্ষেত্রে কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়ে হৃদয়ের সঙ্গে তাদের দেহটাও বিলিয়ে দিয়ে থাকে। নারীদের হৃদয়দানের সুযোগ নিয়ে তাদের দেহটাকে ভোগ করে পুরুষরা। তাই যে প্রেম সৃষ্টি ও ধ্বংস, জীবন ও মৃত্যুর দ্বৈত লীলায় চঞ্চল, যে প্রেম একদিকে আশার উজ্জ্বল আলো বিকীরণ করার সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে আসে কৃষ্ণকুটিল হতাশার সঘন অন্ধকার সে প্রেম কোনও বিপত্তি নিয়ে আসেনি কসেত্তে’র জীবনে।

সেই জঙ্গলাকীর্ণ চেনা-অচেনা কত ফুলের সুবাসে আমোদিত নির্জন বাগানটায় যখন দুটি সরলহৃদয় নিষ্পাপ তরুণ-তরুণী বসে অবাধে প্রেমালাপ করে যেত তখন তাদের দেখে মনে হত তারা যেন মানুষ নয়–দেবমূর্তি, প্রথম দিনই তারা চুম্বন ও আলিঙ্গন করে পরস্পরকে। তার পর থেকে তারা শুধু বেঞ্চটায় পাশাপাশি বসে থাকত। কখনও কখনও একে অন্যের হাত ধরত। কিন্তু ওই পর্যন্ত। যাবার সময় মেরিয়াস শুধু কসেত্তে’র হাতটা অথবা তার শালের প্রান্তভাগ অথবা তার চুলের একটা গোছা চুম্বন করে চলে যেত।

মেরিয়াস ভাবত, কসেত্তে’র কুমারীজীবনের এই শুচিতা বা সতীত্ববোধ তাদের দেহ-মিলনের পথে একমাত্র বাধা আর কসেত্তে ভাবত মেরিয়াসের এই আত্মসংযমই তার রক্ষাকবচ। শুধু দুটি বিমুগ্ধ বিমোহিত আত্মার মিলনের মধ্যে সীমায়িত ছিল তাদের প্রেম।

সাধারণত প্রেমের এই প্রথম স্তরে দেহগত কামনাকে অবদমিত রেখে শুধু আত্মিক মিলনের আবেগকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। একবার কোনও একটা জিনিস মাটি থেকে কুড়োবার জন্য ঝুঁকে পড়লে কসেত্তে’র বুকের কাছটা অনেকটা অনাবৃত হয়ে পড়ে যখন। তখন মেরিয়াস তার চোখ দুটো সরিয়ে নেয়। তার শুধু মনে হত দেহভোগই যদি তার প্রেমের উদ্দেশ্য হয় তা হলে রাস্তা বা বাজারের ঘুরে বেড়ানো যে কোনও বারবণিতার কাছে যেতে পারে, কসেত্তে’র কাছে এসে তার স্কার্ট তোলার কোনও প্রয়োজন নেই। তারা পরস্পরকে ভালোবাসত। বাগানটাকে এক পবিত্র স্থান বলে মনে হত তাদের। যে সব ফোঁটা ফুল অকাতরে তাদের সুবাস বিলিয়ে দিত, তারা তাদের অন্তর উজাড় করে ঢেলে দিত সেই সব ফুলের ওপর। গাছে গাছে কচি পত্রোদ্যমের জৈবিক উত্তেজনার এক সবুজ সমারোহ তাদের ঘিরে থাকত। তার মাঝে তারা যে সব প্রেমের কথা বলত সে সব কথা যেন এক মৃদু কাঁপন ধরিয়ে দিত গাছগুলোকে। তাদের তরুণ প্রাণের বীণাতন্ত্রীতে যে সব কথাগুলো অনুরণিত হয়ে উঠত, যে কথাগুলো বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বাগানের বনপ্রকৃতিকে চঞ্চলিত করে তুলঁত, এক শিশুসুলভ নির্বুদ্ধিতাপ্রসূত সেই সব কথাগুলোর মধ্যে হয়তো কোনও গভীরতর তাৎপর্য ছিল না। তথাপি এমন গভীর তাৎপর্য ও মাধুর্য মণ্ডিত কথা আর হতে পারে না। এসব কথা জীবনে যারা কখনও বলেনি বা শুনেনি তারা মানুষের মতো মানুষই নয়।

কসেত্তে একদিন বলল, তুমি জান আমার আসল নাম হল ইউফ্রেসিয়া।

মেরিয়াস বলল, ইউফ্রেসিয়া? লোকে তো তোমায় বলে কসেত্তে।

ও নামটা বাজে নাম। আমার ছেলেবেলায় ও নামটা আমাকে ওরা দেয়। ও নামটা ভালো নয়, আমার আসল নাম হল ইউফ্রেসিয়া। তুমি এ নাম পছন্দ করো?

তা করি বটে… কিন্তু কসেত্তে নামটাও তো বাজে নয়।

তা হলে ওই নামেই আমাকে ডাকবে তুমি। হ্যাঁ, নামটা ভালোই। সুতরাং তুমি সব সময় ওই নামেই ডাকবে আমায়।

কসেত্তে’র এই কথাগুলোর সঙ্গে যে মধুর হাসি ঝরে পড়ছিল, তা যেন স্বর্গোদ্যানের উপযুক্ত।

আর একদিন কসেত্তে মেরিয়াসের চেহারাটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে বলতে লাগল, একটা কথা আমায় বলতে দাও তুমি, তুমি সুন্দর, সুদর্শন, বুদ্ধিমান, মোটেই বোকা নও, আমার থেকে অনেক বেশি বিদ্বান। কিন্তু একটা বিষয়ে আমি তোমার সমতুল্য, সমকক্ষ–সেটা হল এই যে আমি তোমাকে ভালোবাসি।

মেরিয়াসের মনে হল আকাশের সৌরমণ্ডল থেকে ঝড়ে পড়া ঐকতানের এক অক্ষত সুরলহরী কসেত্তে’র মুখ দিয়ে ধ্বনিত হচ্ছে।

আর একদিন মেরিয়াসকে কাশতে দেখে কসেত্তে বলল, তুমি আমার সামনে কাশবে না। কাশি হচ্ছে অসুস্থতার পরিচায়ক। তুমি কাশলে তোমার শরীরের কথা ভেবে দুঃখিত হব আমি।

আর একদিন মেরিয়াস বলল, জান, একদিন আমি ভাবতাম তোমার নাম আরসুলা?

এই কথাটা নিয়ে সেদিন সারা সন্ধেটা হাসাহাসি করতে থাকে তারা দু জনে।

আর একদিন মেরিয়াস বলে, জান, একদিন এক অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক তোমার-আমার মাঝখানে হঠাৎ এসে পড়ায় আমি তার ঘাড় ভাঙতে চেয়েছিলাম।

এইভাবে কসেত্তে’র জীবনের সঙ্গে নিজের জীবনকে জড়িয়ে ফেলে মেরিয়াস।

সে ভাবত এইভাবে রোজ সন্ধ্যায় এসে কসেত্তে’র পাশে বসা, তার মধুর স্পর্শ ও নিবিড় সান্নিধ্য লাভ করা, দু জনের কথা বলা–এক প্রেমঘন মিলনের কতগুলো মূহুর্ত দিয়ে গড়া এই দিনগুলোর যেন কখনও শেষ না হয়, অনন্তকাল ধরে চলতে থাকে যেন তাদের এই মিলন। ইতোমধ্যে তাদের অলক্ষে অগোচরে মেঘ জমতে থাকে আকাশে। এই মেঘের সঙ্গে সঙ্গে যে ঝড় পাগলের মতো ছুটে আসে তা যত সহজে মানুষের স্বপ্নকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তত সহজে ছিন্নভিন্ন করে উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে না আকাশের মেঘগুলোকে।

তার মানে এই নয় যে চুম্বন-আলিঙ্গন প্রভৃতি প্রেমের দেহগত অভিব্যক্তির ব্যাপারে তাদের কোনও সাহস ছিল না। তাদের প্রেমকে আরও গভীরতর তাৎপর্যমণ্ডিত করে তোলার জন্যই তারা সে প্রেমের দেহগত অভিব্যক্তির দিকে নজর দিত না। প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে মেরিয়াস যে সব কথা বলত, গদ্যে-পদ্যে মেশানো এক মেদুর ও মদির তোষামোদের সুরে বলা সে সব কথা ছিল শুধু প্রেমের সূক্ষ্ম নির্যাসে সমৃদ্ধ, সে কথা যেন শুধু দেবদূতদের সঙ্গে আকাশে উড়ে চলা পাখিরাই বুঝতে পারে, সে কথা যেন অন্য এক আত্মার উদ্দেশ্যে ধ্বনিত একটি আত্মার মৃদু মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কিছুই নয়।

মেরিয়াস একদিন বলল, তুমি কত সুন্দর! তোমার পানে তাকাতেই আমার সাহস হয় না, তাই দূর থেকে তোমার কথা ভাবি। তুমি হচ্ছ এক পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের মূর্ত প্রতিমা। তোমার স্কার্টের নিচে চটি জোড়াটা দেখলেই আমার মাথা ঘুরে যায়। তুমি যখন কিছু ভাব তখন তোমার মুখে-চোখে যে আলো ছড়িয়ে পড়ে, তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে যাই আমি। এক একসময় তোমাকে স্বপ্নে দেখা এক মূর্তি বলে মনে হয়। ও কসেত্তে, তুমি শুধু কথা বলে যাও আর আমি শুনে যাই। আমার মনে হয় আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। আমি যেন তোমার পা দুটো অণুবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে আর তোমার আত্মাটা দূরবীক্ষণ যন্ত্র নিয়ে দেখি।

এ কথার উত্তরে কসেত্তে বলল, প্রতিটি মুহূর্তে তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়ে যায়।

তাদের এলোমেলো সব কথাবার্তায় প্রেমই একমাত্র বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।

কসেত্তে’র সমগ্র সত্তা থেকে এক শুভ্র সরলতা আর স্বচ্ছতার আলো বিচ্ছুরিত হত। তাকে দেখে মনে হত সে যেন দিনের সকাল। প্রভাতের আলো মূর্ত হয়ে উঠেছে তার নারীমূর্তির মধ্যে।

এটা খুবই স্বাভাবিক যে মেরিয়াস সেত্তে’র মতো মেয়েকে ভালোবাসবে এবং তার গুণগান করবে। কিন্তু কনভেন্টের স্কুলে পড়া একটি মেয়ে কী করে এমন বিচক্ষণতার সঙ্গে কথা বলছে, তা ভেবে পেল না সে। তার প্রতিটি কথার মধ্যে উচ্ছ্বাস থাকলেও তার একটা অর্থ আছে। সে তার নারীহৃদয়ের সহজাত অন্তরবৃত্তির দ্বারা সবকিছু পরিষ্কারভাবে দেখতে পায় এবং কোনও বিষয়ে তাকে সহজে ভোলানো যায় না। তার প্রতিটি কথাই সহজ সরল মমতাময় অথচ গভীর ও অর্থপূর্ণ।

কথায় কথায় এবং ছোটখাটো নানা ঘটনায় চোখে জল আসে তাদের। কোনও এক পতঙ্গ কোনওভাবে নিষ্পেষিত হয়ে গেলে, অথবা পাখির বাসা থেকে কোনও পালক ঝরে পড়লে বা ফুলগাছ থেকে কোনও ডাল ভেঙে পড়লে চোখে জল এসে যেত তাদের। পরিপূর্ণ প্রেম থেকে এক করুণা জাগত তাদের মনে। মাঝে মাঝে তারা শিশুর মতো জোরে হেসে উঠত। কিন্তু তাদের প্রেমময় অন্তর যতই সৎ এবং নির্দোষ হোক না কেন, তাদের আত্মা যত পবিত্র হোক না কেন, তাদের উদ্দেশ্য যত মহান এবং নিষ্কাম হোক না কেন, তাদের সম্পর্কের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবার জন্য এক অদৃশ্যশক্তি গোপনে রহস্যময়ভাবে কাজ করে যাবেই।

তারা পরস্পরকে ভালোবাসত, হাত ধরাধরি করে হাসাহাসি করত, সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে বাগানের নির্জনে বসে ফুল আর পাখির গানের মধ্যে নিজেদের অন্তর বিনিময় করত; এক পরম আনন্দের জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠত তাদের চোখমুখ। কিন্তু সেই সঙ্গে সুদূর আকাশমণ্ডলের মহাশূন্যতায় নক্ষত্ররা আপন কক্ষপথে ঘুরতে ঘুরতে তাদের কাজ করে যেত।

.

২.

আপন আপন আকাঙ্ক্ষিত প্রেমাস্পদের সান্নিধ্যে ও সাহচর্যের নিবিড় সুখে তারা এমনভাবে ভুলে থাকত যে বাইরের জগতের কোনও ঘটনা তাদের মধ্যে প্রবেশ করতে বা কোনও বিকার জাগাতে পারত না। সেই সময় যে কলেরা মহামারীরূপে সমগ্র প্যারিস শহরটাকে বিধ্বস্ত করে দেয় সেদিকে কোনও খেয়াল ছিল না তাদের। তারা নিজেদের অনেক কথা বলাবলি করত নিজেদের মধ্যে। কিন্তু তার বাইরে কিছুর উল্লেখ করত না। মেরিয়াস তার জীবন সম্বন্ধে বলে, শৈশব থেকে সে ছিল পিতৃমাতৃহীন, তার মা’র বাবা তাকে মানুষ করে, তার মাতামহ ধনী। কিন্তু তার সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় সে তার বাড়ি থেকে চলে এসেছে, সে ওকালতি পাস করেছে, কিন্তু ওকালতি করে না; প্রকাশকদের কিছু লেখার কাজ করে সে জীবিকা অর্জন করে। তার বাবা একজন কর্নেল ছিলেন, পরে ব্যারন উপাধি লাভ করেন, সেই সূত্রে সে-ও ব্যারন। কিন্তু ব্যারন কাকে বলে তা জানত না কসেত্তে। কসেত্তে তার জীবন সম্বন্ধে শুধু বলে সে পিকপাসের কনভেন্টে পড়াশোনা করত। তার মা নেই, তার বাবা মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের কাছে সে থাকে। তার বাবার অবস্থা ভালো না হলেও তিনি গরিব-দুঃখীদের উদারহস্তে দান করেন। আবার সুখস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অনেক কিছুর ব্যবস্থা করলেও তিনি নিজে কিছু ভোগ করেন না।

প্রেমে মত্ত হয়ে অতীতের কোনও ঘটনার কথা তোলেনি মেরিয়াস। এমনকি থেনার্দিয়েরদের বাসায় ঘটে যাওয়া সেই অপ্রীতিকর ঘটনাটারও উল্লেখ করেনি কখনও কসেত্তে’র কাছে। তাছাড়া এসব কথা প্রেমের আবেগের জোয়ারে মনে স্থান পায়নি তার। সে সব ভুলে গিয়েছিল। শুধু সেই সব ঘটনার নয়, সে সকালে কী করেছে বা কাকে কী বলেছে তা-ও ভুলে যেত। যে যখন কসেত্তে’র কাছে থাকত না তখন তার মনে হত তার দেহে যেন প্রাণ নেই। অথচ কসেত্তেকে কাছে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেহে প্রাণ ফিরে পেত যেন সে। সে যেন স্বর্গসুখ উপভোেগ করত। সব প্রেমই এক জ্বলন্ত বিস্মৃতি, যা আর সবকিছুকে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। মেরিয়াসের কাছে কসেত্তে আর কসেত্তে’র কাছে মেরিয়াস ছাড়া আর কারও কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তাদের চারদিকে সমস্ত জগৎ মেঘের মতো অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল এক মহাশূন্যতায়। তারা শুধু ফুল, পাখি, সূর্যাস্ত আর চন্দ্রোদয়ের কথা বলাবলি করত। প্রেমিকদের কাছে যা যথাসর্বস্ব বাস্তব জগতে তার কোনও অর্থ নেই।

তারা যেন এক কল্পনার জগতে বাস করত। তারা যেন স্বর্গ আর মর্তের মাঝামাঝি এক জায়গায় বাস করত। তারা যেমন রক্ত-মাংসের মানুষের মতো পৃথিবীর মাটির উপর হাঁটতে পারত না, তেমনি তারা আত্মা আর আবেগসর্বস্ব হলেও দেবদূতদের মতো নীল আকাশে মিলিয়ে যেতে বা স্বর্গলোকে উঠে যেতে পারত না। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ সমন্বিত কালপ্রবাহ বা ভাগ্যের বিধান তাদের নাগাল পেত না বা তাদের স্পর্শ করতে পারত না। মর্ত্য জীবনের যে মুহূর্তগুলো তারা অন্যমনস্কভাবে যাপন করত সে মুহূর্তগুলো এমনই অবাস্তব ও হালকা ছিল যে তারা যে কোনও সময়ে অনন্তলোকের এক শূন্যতার মাঝে উড়ে গিয়ে মিলিয়ে যেতে পারত।

এক একসময় তারা কখনও চোখ বন্ধ করে, কখনও-বা চোখ দুটো বিস্ফারিত করে বসে বসে ঝিমোত। দেহটা তাদের বাস্তব জগতে থাকলেও তাদের মনগুলো এক আলস্যের ঐশ্বর্যে মণ্ডিত হয়ে এক আদর্শ জগতে মগ্ন হয়ে থাকত। তাদের সেই মুদ্রিত চোখের অন্ধকারে তাদের মগ্ন চৈতন্য শুধু আত্মা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেত না।

এইভাবে তাদের প্রেম কোথায় তাদের নিয়ে যাচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারত না। অথচ সব মানুষই চায় প্রেম কোথাও না কোথাও নিয়ে যাক।

.

৩.

জাঁ ভলজাঁ কিছুই সন্দেহ করেনি।

মেরিয়াসের থেকে কম স্বপ্নালু ছিল কসেত্তে’র মনটা। কসেত্তে’র মনের আনন্দ দেখে মেরিয়াস খুশি হত। কসেত্তে’র মনে সব সময় মেরিয়াসের চিন্তা আর ছবিটা বিরাজ করলেও তার মুখের সরল হাসিহাসি ভাবটা ঠিকই থাকত। কোনও দেবদূত যেমন হাতে করে পদ্মফুল বয়ে নিয়ে যায় তেমনি কসেত্তে তার পবিত্র প্রেমকে বয়ে নিয়ে বেড়াত তার অন্তরে। কসেত্তে’র মনে একটা সহজ স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের ভাব দেখে ভলজাঁ স্বস্তি অনুভব করত মনে। কসেত্তে তার ব্যাপারটা যথাসম্ভব গোপন করে চলত। মনের কোনও বিকার সে তার বাবার কাছে ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করত না। কসেত্তে ভলজাঁ’র কোনও ইচ্ছার বিরোধিতা করত না কখনও। সে বাইরে যেতে চাইলে যেত, আবার ঘরে থাকতে চাইলে থাকত। সন্ধ্যার সময় ভলজাঁ কোথাও না বেরোলে সে সারা সন্ধ্যাটা তার কাছেই বসে থাকত। তখন সন্ধ্যার সময় আসত না মেরিয়াস। এলেও রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করত বাগানের বাইরে। কসেত্তে দশটার সময় তার ঘরের দরজা খুলে বাগানে এলে তবে সে আসত। সে দিনের বেলায় কখনও না আসায় কোনও সন্দেহ করত না ভলজাঁ। মেরিয়াসের কথাটা একেবারে ভুলেই গিয়েছিল সে।

ভলজাঁ’র মতো বৃদ্ধা তুসও কিছু জানতে পারেনি। কারণ সে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ত এবং তার ঘুম ছিল গভীর।

বাড়ির ভেতরে কখনও ঢুকত না মেরিয়াস। তারা বাগানে অথবা একতলায় সিঁড়ির কাছে এমন এক জায়গায় বসে থাকত যেখান থেকে তাদের দেখতে পাওয়া যেত না অথবা তাদের কোনও কথা শুনতে পাওয়া যেত না। বাগানের বেঞ্চের উপর হাতধরাধরি করে বসে গাছের শাখাপ্রশাখাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকত তারা। সে সময় বজ্রপাত। হলেও তারা হয়তো কোনওরূপ বিচলিত হত না। পদ্মের পাপড়ির মতো এক পবিত্র প্রেমচেতনার মধ্যে মগ্ন হয়ে থাকত তারা।

মেরিয়াস বাগান থেকে বেরিয়ে যাবার সময় লোহার গেটটা এমনভাবে দিয়ে যেত যাতে কেউ বাগানে ঢুকেছিল বলে কিছু মনে হত না। সে বাগান থেকে রাতদুপুরে বেরিয়ে কুফেরাকের বাসায় শুতে যেত।

কুরফেরাক বাহোরেলকে বলত, বিশ্বাস করবে, মেরিয়াস আজকাল রাতদুপুরে বাসায় ফেরে।

বাহোরেল বলত, তাতে কী হয়েছে? স্থির শান্ত জল গভীরভাবে বয়ে যায়।

কুরফেরাক এক একসময় মেরিয়াসকে বলত, তুমি কিন্তু পথের বাইরে চলে যাচ্ছ ছোকরা।

সে খুবই বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন ছিল বলে মেরিয়াস মনে মনে যে স্বর্গসুখ অনুভব করত তার কথা কিছু বুঝতে পারত না। মেরিয়াসের গতিবিধি লক্ষ করে সে শুধু বিরক্ত বোধ করত। একদিন সে মেরিয়াসকে বলল, আমার মনে হচ্ছে আজকাল তুমি চাঁদ আর স্বপ্নের জগতে বাস করছ। এই চাঁদ আর স্বপ্ন হচ্ছে সাবানের ফেনার রাজ্যের রাজধানী। এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো মেয়েটির নামটা বলবে?

কিন্তু কিছুতেই তার প্রেমিকার নামটা বলত না মেরিয়াস। তার প্রেম সম্বন্ধে কোনও কথাই বলত না। কোনও পীড়নই তার ভেতর থেকে কসেত্তে এই নামটা বার করতে পারবে না। প্রেমিকাদের মুখ সাধারণত সকালের আলোর মতো উজ্জ্বল হলেও সমাধিস্তম্ভের মতো নীরব থাকে। তবু কুরফেরাকের মনে হত মেরিয়াসের মনের এক অন্ধকার গোপনতা উজ্জ্বলভাবে সোচ্চার হয়ে উঠছে।

মে মাসের মাঝামাঝি মেরিয়াস আর কসেত্তে’র প্রেমানুভূতির তৃপ্তি চরমে উঠল। তারা মাঝে মাঝে কথাবার্তা আর উচ্ছলতায় ফেটে পড়লেও পাশাপাশি ঘন হয়ে অন্ধকারে বসে আকাশে মুখ তুলে একই তারার দিকে তাকিয়ে থাকত অথবা মাটির দিকে তাকিয়ে একই জোনাকির উড়ে চলা দেখতে সবচেয়ে ভালো লাগত তাদের।

এই নীরবতার মাঝে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেত তারা।

এদিকে জটিলতার একটা মেঘ ঘনিয়ে উঠতে লাগল তাদের অলক্ষে।

একদিন রাত্রি প্রায় দশটার সময় মেরিয়াস বুলভার্দ দে ইনভালিদে হয়ে তাদের সঙ্কেতকুঞ্জের দিকে অভিসারে আসছিল। সে মুখ নিচু করে পথ হাঁটছিল। র‍্যু প্লামেতের দিকে মোড় ঘুরতেই কার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে।

শুভসন্ধ্যা, মঁসিয়ে মেরিয়াস।

মুখ তুলে তাকিয়ে সে দেখল এপোনিনে দাঁড়িয়ে আছে। অভিসারের পথে হঠাৎ একটা বাধা পেয়ে মনে মনে একটা জোর আঘাত পেল সে। যেদিন এপোনিনে তাকে র‍্যু প্লামেতের বাড়িটা দেখিয়ে দিয়ে যায় সেদিনের পর থেকে তার সঙ্গে আর দেখা হয়নি তার। তার কথা মুছে দিয়েছিল একেবারে। এপোনিনের প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়া তার উচিত ছিল। আজ যে প্রেমের সুখ উপভোগ করছে এর জন্য ঋণী সে তার কাছে। কিন্তু তাকে দেখে বিরক্তিবোধ করল সে।

প্রেম যতই নির্দোষ নিষ্পাপ বা সুখের হোক না কেন, সে প্রেম মানুষকে পূর্ণতা দান করে, এটা মনে করা ভুল। প্রেম শুধু মানুষকে ভুলিয়ে দেয় সবকিছু। প্রেমিক যেমন খারাপ হতে ভুলে যায়, তেমনি ভালো হতেও ভুলে যায়। সব কৃতজ্ঞতা বা বাধ্যবাধকতাবোধ, দৈনন্দিন জীবনের সব কর্তব্যবোধ দূরীভূত হয়ে যায় তার মন থেকে। অন্য সময় হলে হয়তো এপোনিনের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত, কিন্তু এখন তার মনটা কসেত্তে’র চিন্তায় মগ্ন থাকার জন্য তার নাম যে এপোনিনে এবং এক মাস আগে কসেত্তে’র ঠিকানা জোগাড় করে দিয়ে তার উপকার করেছে, সে একথা সে ভুলে গেল একেবারে। এমনকি তার প্রেমবোধের উজ্জ্বল আলোয় তার বাবার স্মৃতিটাও ম্লান হয়ে গেল অনেকখানি।

সে বিরক্তির সঙ্গে বলল, ও, তুমি এপোনিনে?

এপোনিনে বলল, এমন নীরসভাবে কথা বলছ কেন? আমি কি কোনও অন্যায় করেছি?

না।

আসলে এপোনিনের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই ছিল না তার। মোট কথা হল এই যে তার মনের সব নিবিড়তা, অন্তরের সবটুকু উত্তাপ কসেত্তে’র ওপর কেন্দ্রীভূত হওয়ার জন্য এপোনিনের জন্য তার কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।

চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল মেরিয়াস। এপোনিনে বলল, কিন্তু কেন–?

তবে এপোনিনে বুঝল, এমন অমনোযোগী লোকের সঙ্গে কথা বলে কোনও লাভ হবে না। তাই সে চুপ করে গেল। সে তার মুখের ওপর হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। সে শুধু বলল, ঠিক আছে। তার পর আবার চুপ করে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। তার পর বলল, বিদায়, শুভরাত্রি মঁসিয়ে মেরিয়াস।

এই বলে সে চলে গেল।

.

৪.

এর পরের দিনটি ছিল ১৮৩২ সালের ৩ জুন। এই দিনটি মনে রাখার মতো দিন, কারণ তখন প্যারিসের মাথার উপর বজ্রগর্ভ এক মেঘের মতো বড় রকমের কতকগুলি ঘটনা। ওত পেতে বসেছিল।

সেদিনও সন্ধ্যার সময় মেরিয়াস যথারীতি র‍্যু প্লামেতের দিকে হেঁটে চলেছিল। একই পথ দিয়ে। তার মনে তখন ছিল একই চিন্তা, অন্তরে ছিল একই তৃপ্তিবোধ। সে দেখল গাছের আড়াল থেকে এপোনিনে তার দিকে এগিয়ে আসছে। পর পর দু দিন এমন সময় তাকে দেখে বিরক্তি আরও বেড়ে গেল তার। সে কোনও কথা বলল না। সে সোজা তার পথে চলে গেল।

এপোনিনে আজ তাকে অনুসরণ করতে লাগল তার পিছু নিয়ে। এর আগে কখনও এ কাজ করেনি সে। এর আগে কিছুদিন সে তার পথের ধারে গাছের আড়াল থেকে লক্ষ করেছে মেরিয়াসকে। শুধু গতকালই প্রথম তার সামনে এসে কথা বলে।

এপোনিনে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে দেখল র‍্যু প্লামেতের সেই বাড়িসংলগ্ন বাগানের লোহার গেট ঠেলে বাগানের ভেতর ঢুকে গেল মেরিয়াস। এপোনিনে মনে মনে বলল, ও তা হলে বাড়ির ভেতরে যাচ্ছে।

গেটের পাশে পাহারাদারের মতো সিঁড়ির উপর বসে পড়ল এপোনিনে। জায়গাটা এক কোণে থাকায় তাকে দেখা যাচ্ছিল না। সে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বসে বসে ভাবতে। লাগল। দশটার সময় সহসা দেখল একজন একজন করে ছ জন লোক গেটের সামনে এসে জড়ো হল। তারা নিচু গলায় কথা বলতে লাগল নিজেদের মধ্যে।

একজন বলল, এই কি সেই বাড়িটা?

আর একজন বলল, কুকুর আছে বাড়িতে?

অন্য একজন বলল, জানি না, তবে কুকুরের জন্য খাবার এনেছি।

একজন বলল, জানালার কাঁচ ভাঙার জন্য গাম দেওয়া কাগজ এনেছ?

হ্যাঁ এনেছি।

লোহার গেটটা পুরনো।

ঠিক আছে, রেলিংগুলো ভেঙে ভেতরে ঢুকতে অসুবিধে হবে না কোনও।

একজন গেটটা পরীক্ষা করে দেখার জন্য এগিয়ে গেল। সে দেখল একটা রেলিং আলগা আছে আগে হতে। সেই রডটা সরিয়ে দিলে একজন ঢুকতে পারে। কিন্তু সেটা। সে সরাতে যেতেই একটা হাত পাশ থেকে এসে ধরে ফেলল। এক নারীকণ্ঠ বলল, হ্যাঁ, কুকুর আছে। পাহারাদার কুকুর!

এবার একটি মেয়ের মূর্তি তার সামনে এসে হাজির হল। অপ্রত্যাশিত বাধা পেয়ে থতমত খেয়ে গেল লোকটি। সে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বলল, কোন শয়তান তুমি?

তোমার মেয়ে।

লোকটি ছিল থেনার্দিয়ের। অন্য পাঁচজন ছিল, ক্লাকেসাস, গুয়েলবার, বাবেত, মঁতপার্নেসি আর ব্রুজোঁ। তারা থেনার্দিয়েরের চারপাশে এসে দাঁড়াল। তাদের হাতে নানারকমের অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি ছিল।

থেনার্দিয়ের এপোনিনেকে বলল, এখানে কী করছিস? কী চাস তুই? তুই কি পাগল হয়ে গেলি?

কথাগুলো সে যতদূর সম্ভব নিচু গলায় বলল। সে আরও বলল, তুমি কি আমার সব কাজ পণ্ড করতে এসেছ?

এপোনিনে হাসতে হাসতে তার বাবার ঘাড়টা জড়িয়ে ধরল। তার পর বলল, আমি এখানে আছি মানেই আছি। রাস্তার ধারে বসে থাকারও কি কোনও অধিকার নেই আমার? তোমারই এখানে আসা উচিত নয় একেবারে। আমি তো ম্যাগননকে আগেই বলে দিয়েছিলাম এখানে কিছু নেই। কত দিন তোমাকে দেখিনি। তুমি যখন আবার বাইরে এসেছ আমাকে অন্তত একটা চুম্বন করতে পার।

থেনার্দিয়ের বিরক্তির সঙ্গে এপোনিনোর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। বলতে লাগল, ঠিক আছে, তুমি তো আমায় চুম্বন করেছ, এবার যাও।

এপোনিনে বলল, কিন্তু কেমন করে বেরিয়ে এলে জেল থেকে? সত্যিই খুব চালাক তুমি। মা কোথায়? মা’র কথা বল।

থেনার্দিয়ের বলল, সে ঠিক আছে, কোথায় আছে এখন তা জানি না। এখন যাও দেখি।

এপোনিনে বলল, কিন্তু আমি যেতে চাই না। কতদিন পর দেখা আর তুমি আমাকে চলে যেতে বলছ?

সে আরও জোরে জড়িয়ে ধরল তার বাবাকে।

বাবেত বলল, এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।

থেনার্দিয়ের এপোনিনেকে বলল, তাড়াতাড়ি চলেও যাও, পুলিশ এসে পড়বে।

এপোনিনে অন্যদের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, কী মঁসিয়ে ব্রুজোঁ, মঁসিয়ে ক্লাকেসাস, শুভসন্ধ্যা! মঁসিয়ে গুয়েলমার, তোমরা আমাকে চিনতেই পারছ না? কেমন আছ মঁতপার্নেসি?

থেনার্দিয়ের বলল, ঠিক আছে, তোমাকে ওরা সবাই চেনে। এখন ঈশ্বরের নামে বলছি, চলে যাও। আমাদের শান্তিতে কাজ করতে দাও।

মঁতপার্নেসি বলল, এখন খেঁকশেয়ালের কাজ করার সময়, মুরগিদের নয়।

বাবেত বলল, দেখছ, আমাদের একটা কাজ করার আছে।

এপোনিন মঁতপার্নেসির একটা হাত ধরতেই সে বলে উঠল, সাবধান, ছুরিটা খোলা আছ।

এপোনিনে বলল, প্রিয়তম মঁতপার্নেসি, মঁসিয়ে বাবেত, গুয়েলমার, তোমাদের মনে নেই, এই জায়গাটার ওপর নজর রাখতে বলা হয়েছিল আমাকে? তোমরা জান, আমি বোকা নই। আমি বলছি আমি দেখেছি, এখানে কিছু নেই। শুধু শুধু বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কী লাভ?

গুয়েলমার বলল, এ বাড়িতে শুধু দু জন মহিলা থাকে।

না, কেউ থাকে না, সব চলে গেছে।

বাবেত বলল, কিন্তু বাতি জ্বলছে।

গুয়েলমার হাত বাড়িয়ে দেখাল, গাছপালার ফাঁক দিয়ে বাড়িতে একটা লণ্ঠন জ্বলছিল। কাঁচা পোশাক শুকোবার জন্য লণ্ঠনটা জ্বেলে রেখেছিল ঠুসা।

এপোনিনে বলল, যাই হোক, ওরা বড় গরিব। মূল্যবান কিছু নেই।

থেনার্দিয়ের বলল, জাহান্নামে যাও তুমি। বাড়িটা উপর থেকে নিচে পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখব আমরা কী আছে না-আছে।

থেনার্দিয়ের এপোনিনেকে সরিয়ে দিল।

এপোনিনে মঁতপার্নেসিকে বলল, তুমি আমার বন্ধু, তুমি ভালো ছেলে, তুমি ভেতরে যেও না।

মঁতপার্নেসি বলল, ছুরিতে হাত কেটে যাবে তোমার।

থেনার্দিয়ের গম্ভীরভাবে বলল, চলে যাও বলছি, আমাদের কাজ করতে দাও।

মঁতপার্নেসির হাতটা ছেড়ে দিয়ে এপোনিনে বলল, তোমরা তা হলে ভেতরে ঢুকবেই?

মঁতপার্নেসি বলল, ঠিক বলেছ।

এপোনিনে বলল, ঠিক আছে, আমিও তোমাদের কিছুতেই ঢুকতে দেব না।

এই বলে সে গেটের উপর পিঠটা দিয়ে ছয়জন সশস্ত্র লোকের সামনে দাঁড়াল। অন্ধকারে লোকগুলোকে দানবের মতো দেখাচ্ছিল। এপোনিনে দৃঢ় অথচ নিচু গলায় বলতে লাগল, আমার কথা শোন। যদি বাগানে ঢোকার চেষ্টা কর এবং এই গেটটায় হাত দাও তা হলে চিৎকার করে পাড়ার সব লোকদের জাগিয়ে দেব। তোমাদের সবাইকে ধরিয়ে দেব।

থেনার্দিয়ের ব্রুজোঁ ও মঁতপার্নেসিকে বলল, ও সত্যিই তা করবে।

এই বলে সে এপোনিনের দিকে এগিয়ে যেতেই সে বলল, খবরদার, আর এগোবে না।

থেনার্দিয়ের পিছিয়ে গেল, ওর মাথায় কী ঢুকেছে? কুকুরী কোথাকার।

এপোনিনে হাসতে লাগল বিদ্রুপের ভঙ্গিতে। হাসতে হাসতে সে বলল, যা খুশি বলতে পার, আমি হচ্ছি নেকড়ের মেয়ে, কুকুরের নয়। তোমরা ছয়জন আর আমি একা মেয়েছেলে। তোমরা বাড়িতে ঢুকবে না। আমি পাহারাদার কুকুর, যদি ঢোক তা হলে আমি ঘেউ ঘেউ করে ডাকব। যেখানে খুশি যেতে পার, কিন্তু এখানে নয়। আমি তোমাদের ঢুকতে দেব না।

তাদের দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে এপোনিনে বলল, আমার কথা ভাবতে হবে না তোমাদের। আমি গ্রীষ্মকালে অভুক্ত থাকি আর শীতকালে হিমে জমে যাই। আমার বাবা যদি আমাকে পিটিয়ে মেরে আমার দেহটাকে পথের ধারে ফেলে দেয় তাতেও আমি গ্রাহ্য করি না। সুতরাং আমাকে ভয় দেখিও না।

হঠাৎ কাশিতে তার কথা আটকে গেল। বুকের ভেতর থেকে আসছিল কাশিটা। কাশি সামলে সে বলল, আমাকে শুধু একবার চিৎকার করতে হবে। তা হলে লোক ছুটে আসবে। তোমরা ছয়জন আছ, কিন্তু আমার পেছনে আছে জনগণ।

থেনার্দিয়ের এপোনিনের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বলল, তুমি চলে যাও। ঠিক আছে, তুমি চেঁচিও না। আস্তে কথা বল। তুমি আমাকে কাজ করতে দেবে না? আমাকে জীবিকা অর্জন করতে হবে তো? তোমার বাবার ওপর একটু দয়া নেই? আমাদের খেতে হবে তো।

তোমরা খাও না-খাও আমার দেখার দরকার নেই।

এই কথা বলে সে আবার গেটের সামনে সিঁড়িতে বসে গান গাইতে লাগল আপন মনে।

একটা হাঁটুর উপর আর একটা হাঁটু দিয়ে, হাঁটুর উপর কনুই রেখে, আবার হাতের উপর তার চিবুক রেখে পা নাড়তে নাড়তে গান করছিল এপোনিনে। রাস্তার আলোর একটা ফালি এসে তার চেহারার উপর পড়েছিল। ছেঁড়া জামার ফাঁক দিয়ে তার কাঁধের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল।

এমন অদ্ভুত ছবি দেখাই যায় না।

ছয়জন দুবৃত্ত ছায়ার মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারা একটি তরুণীর কাছে হেরে গেল। তারা প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করতে লাগল। বাবেত বলল, নিশ্চয় এর পেছনে কোনও কারণ আছে। মেয়েটা হয়তো কুকুরটার প্রেমে পড়েছে। কিন্তু বাড়িটাতে তো আছে দু জন মহিলা আর একটা বুড়ো। তবে জানালা-দরজায় ভালো ভালো পর্দা আছে। একবার দেখলে হত।

মঁতপার্নেসি বলল, তোমরা অন্য দিক দিয়ে ভেতরে যাও। আমি মেয়েটাকে আটকে রাখব, তার সঙ্গে কথা বলব। যদি চেঁচামেচি করে তা হলে আমার ছুরি আছে।

থেনার্দিয়ের কোনও কথা বলল না। ওদের হাতেই সিদ্ধান্তের ভারটা ছেড়ে দিল। ব্রুজোঁর ওপর ওরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। কারণ তার বুদ্ধি, সাহস আর শক্তি বেশি এবং এর আগে অনেকবার তার পরিচয়ও দিয়েছে। ব্রুজোঁ কিন্তু এতক্ষণ কোনও কথা বলেনি। সে আবার মাঝে মাঝে কবিতা লিখত। সেইজন্য তারা সবাই তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত।

বাবেত ব্রুজোঁকে বলল, কথা বলছ না কেন?

ব্রুজোঁ বলল, আজ সকালে আমি দুটো চড়ুইপাখিকে ঝগড়া করতে দেখেছিলাম আর আজ বিকালে একটি মহিলার গাঁয়ে আমার ধাক্কা লাগে। এ দুটোই কুলক্ষণ। সুতরাং চল এখান থেকে।

তারা সেখান থেকে চলে গেল। মতপার্মেসি বিড়বিড় করে বলল, মেয়েটাকে দরকার হলে বেশ একটা শিক্ষা দিতে পারতাম।

বাবেত বলল, আমি মেয়েদের গাঁয়ে হাত দিই না।

এপোনিনে দেখল, ওরা কথা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে। সে ওদের অলক্ষে চুপিসারে কিছুক্ষণ অনুসরণ করতে লাগল। তার পর দেখল ওরা বুলভার্দ পর্যন্ত গিয়ে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়ে রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

৫.

র‍্যু প্লমেতের গেটের বাইরে ছয়জন দুবৃত্ত যখন এপোনিনের সঙ্গে ঝগড়া করছিল তখন মেরিয়াস কসেন্তের কাছে বাগানে বসেছিল। তারা এ সবের কিছুই জানতে পারেনি। এমন নক্ষত্রখচিত মনোরম রাত্রি তারা যেন আগে কখনও দেখেনি। সব গাছপালার মৃদু কম্পন পাখির এমন গান তারা যেন এর আগে কখনও শুনেনি। তারা গাছপালার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাদের প্রেমের অশ্রুত সঙ্গীতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্বের ঐকতানের সুরলহরী এমন মধুরভাবে কখনও বয়ে যায়নি। মেরিয়াস এতখানি মুগ্ধ আর কখনও হয়নি।

কিন্তু মেরিয়াস দেখল কসেত্তে’র মনটা ভালো নেই। সে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে লাল হয়ে উঠেছে তার চোখ দুটো। এই প্রথম মেঘ জমল তাদের স্বচ্ছ অন্তরের আকাশে।

মেরিয়াস একসময় বলল, কী হয়েছে তোমার?

কসেত্তে তার পাশে বসে বলল, আজ সকালে বাবা আমাকে তৈরি হয়ে নিতে বলল। বলল কাজ আছে তার। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে আমাদের।

মেরিয়াসের সর্বাঙ্গ কাঁপতে লাগল। জীবনের শেষে মৃত্যু স্বাভাবিকভাবেই এনে দেয় চিরবিচ্ছেদ, কিন্তু জীবন যখন শুরু সবেমাত্র, তখন বিচ্ছেদ মানেই মৃত্যু।

গত ছয় সপ্তার মধ্যে মেরিয়াস কসেত্তে’র মনটাকে ধীরে ধীরে জয় করে ফেলেছিল। এ জয় আত্মিক জয়, দেহের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু এ জয় গভীরভাবে তার আত্মাটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। প্রথম প্রেমের ক্ষেত্রে তাই হয়। প্রথমে প্রেমিক প্রেমাস্পদের আত্মাটাকে জয় করে, তারপরে তার দেহ। পরে দেহই আত্মার ওপর প্রাধান্য লাভ করে। তখন আত্মার কথা আর মনে থাকে না। মেরিয়াস সেত্তে’র গোটা আত্মাটাকে যখন শতপাকে বেঁধে তার দিকে দুর্বারবেগে টানছিল, তার মুখের হাসি, নীল চোখের সব আলো, তার নিশ্বাসের সুগন্ধ, ত্বকের মসৃণতা, তার গ্রীবাদেশের ঐন্দ্রজালিক সৌন্দর্য, তার সকল চিন্তা দিনে দিনে দখল করে ফেলেছিল সে। রাত্রিতেও মেরিয়াসের কথা একবার না ভেবে ঘুমোত না সে।

সুতরাং তার জীবনের স্বপ্নের ওপরেও অধিকার বিস্তার করে ফেলেছিল মেরিয়াস।

কসেত্তে’র ঘাড়ের উপর ছড়িয়ে থাকা সুন্দর চুলগুলোর ওপর সে তাকিয়ে থাকত যখন, যখন তার নিশ্বাসে সে চুলগুলো নড়ত তখন সে ভাবত কসেত্তে’র এমন কিছুই নেই যা তার অধিকারের মধ্যে আসেনি। কসেত্তে’র সাজ-পোশাকের প্রতিটি বস্তু ও উপকরণগুলো দেখতে দেখতে তার মনে হত তার গায়ে যা কিছু আছে সেই সব কিছুরই সে-ই হল একমাত্র স্বত্বাধিকারী। কসেত্তে’র পাশে বসে থাকতে থাকতে কসেত্তে’র জীবনের গোটা রাজ্যটাই তার দখলে। মনে হত তাদের দু জনের আত্মা এমনভাবে মিশে গেছে পরস্পরের মধ্যে যে যদি কোনওদিন সে আত্মা দুটি বিচ্ছিন্ন হতে চায় তা হলে তার অংশ কতখানি তা কেউ বলতে পারবে না। তখন একজন আর একজনকে বলবে, যেটা তুমি তোমার অংশ বলে দাবি করছ আসলে সেটা আমার। আসলে মেরিয়াস কসেত্তেরই একটা অংশ আর কসেত্তে মেরিয়াসেরই একটা অংশ। মেরিয়াস অনুভব করল কসেত্তে’র জীবন তার মধ্যেই মিশে আছে, সে একান্তভাবে আমার। কিন্তু এমন সময় কসেতে যখন বলল, আমাদের এখান থেকে চলে যেতে হবে, তখন মেরিয়াস সহসা বাস্তবের নিষ্ঠুর আঘাতে প্রথম সচেতন হয়ে বুঝল কসেত্তে তার নয়।

সহসা জেগে উঠল মেরিয়াস। ছয় সপ্তা ধরে সে যেন এই পৃথিবীতে থেকেও পৃথিবীর বাইরে গিয়ে এক অশরীরী অবাস্তব জীবন যাপন করছিল। আজ আবার বাস্তব জগৎ ও জীবনের মধ্যে ফিরে এল এক রূঢ় আঘাত খেয়ে।

কসেত্তে দেখল মেরিয়াসের হাতটা ভীষণভাবে ঠাণ্ডা হিম হয়ে গেছে। সে তাই বলল, কী হয়েছে তোমার?

মেরিয়াস ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ।

কসেত্তে বলল, আজ সকালেই বাবা আমাকে বলল, তার সঙ্গে আমাকে ইংল্যান্ড। যেতে হবে; আমি যেন মালপত্র গুছিয়ে রাখি। এক সপ্তার মধ্যে আমাদের রওনা হতে হবে।

মেরিয়াস বলল, কিন্তু এ যে ভয়ঙ্কর কথা।

তার মনে হল টাইবেরিয়াস থেকে অষ্টম হেনরি পর্যন্ত যত অত্যাচারী ও স্বৈরাচারী শাসক পৃথিবীতে এসেছে তারা কেউ মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের মতো নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে পারেনি। তার মেয়েকে মেরিয়াসের কাছ থেকে অকস্মাৎ ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া যেন মঁসিয়ে ফশেলেভেন্তের এক জঘন্য অপরাধ।

মেরিয়াস ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, ঠিক কবে যাচ্ছ তোমরা?

তা কিছু বলেনি।

মেরিয়াস উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কখন তোমরা ফিরে আসছ?

তা-ও বলেনি।

তুমি কি সত্যিই যাচ্ছ কসেত্তে?

কিন্তু–

তুমি কি ইংল্যান্ডে যাচ্ছ?

তুমি আমার ওপর এতখানি নিষ্ঠুর হচ্ছ?

তুমি যাচ্ছ কি না আমি শুধু তাই জিজ্ঞাসা করছি।

কিন্তু বাবা যদি যায় আমি কী করতে পারি?

কসেত্তে তার হাত দুটো মোচড়াতে লাগল।

মেরিয়াস বলল, ঠিক আছে, আমি চলে যাব।

কসেত্তে’র মুখখানা ভয়ে এতদূর সাদা হয়ে গেল যে অন্ধকারেও তা দেখা যাচ্ছিল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, কী বলতে চাইছ তুমি?

হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে মেরিয়াস দেখল কসেত্তে হাসছে। হঠাৎ হাসির ঝলকানিতে তার মুখটা চকচক করছে। সে বলল, আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে।

মেরিয়াস বলল, কী বুদ্ধি?

আমাকে যদি যেতেই হয়, তুমিও চল না ইংল্যান্ডে।

এবার পুরোমাত্রায় বাস্তব-সচেতন হয়ে উঠল মেরিয়াস। সে যেন হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠল। সে বলতে লাগল, তা কী করে সম্ভব? তুমি কি পাগল হয়ে গেছইংল্যান্ডে যেতে হলে টাকার দরকার। আমার একেবারেই টাকা নেই। কুরফেরাকের কাছে ইতোমধ্যেই দশ লুই ধার হয়ে গেছে। অবশ্য সে আমার বন্ধু। আমি যে টুপিটা পরে আছি তার দাম তিন ফ্রা-ও হবে না। আমার জামার অনেক বোম নেই। আমার জুতো ফুটো হয়ে গেছে। আজ ছয় সপ্তা ধরে কোনও দিকে তাকাতে পারিনি। তোমাকে এ সব কথা জানাইনি। কিন্তু আমি সত্যিই খুব গরিব কসেত্তে। তুমি শুধু রাত্রিতে আমাকে দেখ, আমাকে তোমার হাত দাও, কিন্তু দিনের বেলায় দেখা হলে তুমি আমায় ভিক্ষা দেবে। ইংল্যান্ড! আমি পাসপোর্ট জোগাড় করতেই পারব না।

মেরিয়াস এবার উঠে দাঁড়িয়ে একটা গাছের গুঁড়ির উপর মুখটা ঠেকিয়ে দাঁড়াল। হতাশায় এমনভাবে ভেঙে পড়ল সে যে মনে হল গাছে হেলান না দিয়ে থাকলে পড়ে যেত। এইভাবে অনেকক্ষণ রইল। পরে কিসের একটু মৃদু শব্দে পেছন ফিরে তাকাল। সে দেখল কসেত্তে কাঁদছে। মেরিয়াস তখন নতজানু হয়ে বসে কসেত্তে’র আঁচল ধরে পা দুটো চুম্বন করল। কসেত্তে কোনও কথা বলল না। সে দেবীর মতো বসে তার প্রেমিকের অঞ্জলি গ্রহণ করে যেতে লাগল নীরবে।

মেরিয়াস বলল, কেঁদো না।

কিন্তু আমাকে যদি যেতে হয় তা হলে তুমি তো যেতে পারবে না।

তুমি কি আমাকে ভালোবাস?

কসেত্তে চোখে জল নিয়ে অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলল, আমি তোমাকে দেবতার মতো পূজা করি।

মেরিয়াস তখন কম্পিত কণ্ঠে বলল, তা হলে কেঁদো না, আমার জন্য অন্তত এটুকু করো।

কসেত্তে বলল, তুমি আমাকে ভালোবাস?

কসেত্তে’র একটি হাত নিয়ে মেরিয়াস বলল, কসেত্তে, আমি কাউকে কোনও প্রতিশ্রুতি দিইনি। কিন্তু আজ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তা হলে আমি মরে যাব।

কথাটা এমন গম্ভীরভাবে বলল মেরিয়াস যাতে কসেত্তে’র মনের ওপর সেটা বেশ প্রভাব বিস্তার করল। সে কান্না থামিয়ে চুপ করে রইল।

মেরিয়াস বলল, আমার কথা শোন। আগামীকাল আমাকে এখানে আশা করো না। কাল আমি আসব না।

কিন্তু কেন? কাল কী করবে?

পরশু আসব। পরশু’র আগে নয়।

মেরিয়াস কসেত্তে’র একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে তার চোখের পানে তাকিয়ে তার মনের কথা বোঝার চেষ্টা করল।

মেরিয়াস বলল, আমার ঠিকানাটা দিচ্ছি, রেখে দেবে, যদি কোনও দরকার হয়। আমি ১৬ র‍্যু দ্য লা ভেরিয়েতে কুরফেরাক নামে আমার এক বন্ধুর কাছে থাকি।

পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বার করে মেরিয়াস পাঁচিলের গাঁয়ে তার ঠিকানাটা খোদাই করে দিল।

কসেত্তে তাকে লক্ষ করতে লাগল। তার পর বলল, কী ভাবছ তুমি মেরিয়াস? মনে হয় কী তুমি ভাবছ। আমাকে বল, তা না হলে রাত্রিতে আমার ঘুমই হবে না।

আমি শুধু এই কথাই ভাবছি যে ঈশ্বর কিছুতেই আমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাবেন না। আমি কাল বাদ পরশু সন্ধ্যার সময় আবার আসব।

কিন্তু কাল আমি কী করব? তুমি পুরুষমানুষ, তোমার অনেক কাজ আছে। তুমি বাইরে বেড়াবে। তোমাদের সুবিধা আছে। কিন্তু আমি একা একা কী করব? কী করে সময়টা কাটাব? কাল সন্ধ্যায় তুমি কী করবে?

কাল আমি এক জায়গায় কাজের চেষ্টায় যাব।

আমি তোমার সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করব। কাল সন্ধ্যায় আমি একটা গান গাইব যে প্রার্থনার গানটা তুমি একদিন বাড়ির বাইরে থেকে শুনেছিলে, যে গানটা তুমি ভালোবাস শুনতে। কিন্তু পরশু ঠিক ন টায় আসা চাই, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকব।

মেরিয়াস বলল, ঠিক আছে। ওই সময় আমি আসব এখানে।

এরপর তারা আবেগের সঙ্গে আলিঙ্গন করল পরস্পরকে। এক নিবিড় চুম্বনে ঠোঁটগুলো যুক্ত হল তাদের। কিন্তু তাদের চোখগুলো আকাশের তারার পানে উত্তোলিত ছিল।

মেরিয়াস যখন বাগান থেকে বেরিয়ে এল তখন রাস্তাটা জনমানবহীন হয়ে উঠেছে। এপোনিনে সেই দুবৃত্তদের অনুসরণ করতে করতে বুলভার্দ পর্যন্ত চলে গেছে।

মেরিয়াস যখন একসময় বাগানে একটা গাছের গুঁড়িতে মুখ দিয়ে ভাবছিল তখন সে একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়।

.

৬.

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের বয়স একানব্বই বছর পূর্ণ হয়েছে। তিনি তখনও তার মেয়ের সঙ্গেই সেই বাড়িতে বাস করছিলেন। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের দেহটা এমন এক প্রাচীন ধাঁচে গড়ে উঠেছিল যাতে তিনি জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মৃত্যুর জন্য নির্ভীক ও খাড়াখাড়িভাবে অপেক্ষা করতেন। বয়সের ভার, বার্ধক্যের ভার নত করতে পারেনি তাঁকে। সবচেয়ে তিক্ত হতাশাও তাঁর মন দমাতে পারেনি।

তবু ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ প্রায়ই বলত, আমার বাবার শরীরটা ভেঙে যাচ্ছে। আর তিনি আগের মতো চাকরদের বকাবকি করেন না, জুলাই বিপ্লব সম্বন্ধে মনিতিউর কাগজ পড়ে আর রাগারাগি করেন না আগের মতো। তিনি এক হতাশায় ভুগছেন। তাঁর দেহগত ও মনোগত প্রবৃত্তির অনমনীয়তার জন্য এই হতাশার কাছে আত্মসমর্পণ না করলেও তিনি বেশ বুঝতে পারতেন তাঁর অন্তরটা ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে। চার বছর ধরে তিনি আশা করে আসছেন মেরিয়াস একদিন না একদিন তার বাড়িতে ফিরে আসবে। কিন্তু সে না আসায় এক অপরিহার্য অপরিসীম বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। আসন্ন মৃত্যু তাঁর কাছে এমন কিছু দুর্বিষহ ব্যাপার নয়। তাঁর একমাত্র চিন্তা মৃত্যুর আগে তিনি মেরিয়াসকে আর দেখতে পাবেন না এই চিন্তাটাই দুর্বিষহ তার কাছে। এই চিন্তা আগে কখনও তার মনে আসেনি, কিন্তু আজকাল এ চিন্তাটা ঘুরে ফিরে প্রায়ই তার মনে আসে, তাকে সন্ত্রস্ত করে তোলে। এ চিন্তা মেরিয়াসের প্রতি তার স্নেহটাকে বাড়িয়ে দেয়। অথচ মেরিয়াসের সঙ্গে পুনর্মিলনের কোনও চেষ্টাই করেন না তিনি। মৃত্যুপথযাত্রী তাঁর বৃদ্ধ অন্তরটা এক নীরব হাহাকারে ফেটে পড়ে। মেরিয়াস নিজে থেকে তাঁকে ত্যাগ করে চলে গেছে, এ ব্যাপারে তার কোনও দোষ নেই, তবু তার প্রতি এক গভীর গোপন মমতায় হৃদয় পরিপূর্ণ ও আচ্ছন্ন হয়ে ওঠে। তাঁর কেবলি মনে হয় তিনি আর সহ্য করতে পারবেন না। তিনি এই দুঃখে মারা যাবেন। তার দাঁতগুলো একে একে পড়ে যায়। এতে তার অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়।

তবু তিনি এটা বাইরে প্রকাশ করতে পারেন না। তাঁর অন্তরের গভীর গোপনে অনুভূত এই দুঃখ আর হতাশার কথা বাইরে মুখ ফুটে বলতে পারেন না। এজন্য একটা প্রচণ্ড রাগ নিষ্ফল আক্রোশে ফুলে ফুলে উঠতে থাকে। তার শোবার ঘরে ছোট মেয়ের ফটোটার দিকে মাঝে মাঝে তাকিয়ে থাকেন তিনি। ফটোটা তার আঠারো বছর বয়সে তোলা। সে এখন নেই। একবার তিনি ফটোটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন আপন মনে, মেরিয়াস দেখতে তার মায়ের মতো।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ তা শুনে বলল, হ্যাঁ, ও দেখতে আমার বোনের মতো। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বলেন, ও ওর বাবার মতোও।

একদিন তিনি যখন হাঁটুর ভেতর মাথা গুঁজে বসে ছিলেন তখন তার মেয়ে বলে, বাবা, তুমি এখনও তার প্রতি রেগে আছ?

কার ওপর।

বেচারা মেরিয়াসের ওপর?

হ্যাঁ বেচারা মেরিয়াসই বটে। একটা অপদার্থ শয়তান ভদ্রলোক–যার মধ্যে কোনও মায়ামমতা বা কৃতজ্ঞতাবোধ নেই।

তিনি মুখটা সরিয়ে নিলেন যাতে তাঁর চোখের জল তাঁর মেয়ে দেখতে না পায়। তিনি বললেন, আমি আগেই বলেছি, ওর কথা যেন আর উল্লেখ করা না হয়।

অবশেষে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ এ বিষয়ে আর কোনও চেষ্টা করল না। ভাবল, তার বাবা তার ছোট মেয়ে তাঁর অমতে বিয়ে করায় তাকে ঘৃণা করতেন এবং মেরিয়াসকেও ঘৃণার চোখে দেখেন। মেরিয়াসের পরিবর্তে সে থিওদুলকে তাদের উত্তরাধিকারী হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা করে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তাকে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর অন্তরে মেরিয়াসের শূন্য আসনটা পূরণ করতে পারেনি সে। থিওদুল আনন্দোচ্ছল, কিন্তু বড় বাঁচাল আর চপল প্রকৃতির। তাকে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ভালো লাগেনি মোটেই। তিনি তার মেয়েকে স্পষ্ট বলে দেন, তোমার যা খুশি করতে পারো, কিন্তু থিওদুলের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।

সেদিন ছিল ৪ জুনের সন্ধ্যাবেলা। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার ঘরে জ্বলন্ত আগুনের কাছে একটা আর্মচেয়ারে বসে ছিলেন। একই সঙ্গে তিক্ততা আর মমতার সঙ্গে তিনি মেরিয়াসের কথাই ভাবছিলেন। তাঁর অন্তরে স্নেহমমতার প্রবণতা সব সময় প্রচণ্ড ক্রোধে পরিণত হত। মেরিয়াসের আসার কোনও সঙ্গত কারণ ছিল না, কারণ সে এলে আগেই আসত। আর কোনও আশা নেই। মৃত্যুর আগে তার সঙ্গে আর দেখা হবে না। তাই তিনি এ বিষয়ে চরম হতাশাটাকেই সহজভাবে বরণ করে নেবার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তবু তার অন্তরের সব বৃত্তিগুলো তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। তিনি আগুনের দিকে প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে তাকিয়ে ছিলেন।

এমন সময় তার ভৃত্য বাস্ক এসে বলল, মঁসিয়ে মেরিয়াস দেখা করতে চান।

কে?

বাস্ক ভয় পেয়ে বলল, আমি ঠিক জানি না, আমি তাকে আগে কখনও দেখিনি। তবে নিকোলেত্তে বলল, মঁসিয়ে মরিয়াস নামে এক যুবক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, নিয়ে এস তাকে।

এই বলে কম্পিত বুকে দরজার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন, অবশেষে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল মেরিয়াস। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আহ্বানের অপেক্ষায় রইল। ঘরের আঘো আলো-অন্ধকারের মাঝেও তার ছেঁড়া ময়লা পোশাকের দীনতা দেখা যাচ্ছিল। তবে তার শান্ত গম্ভীর মুখের বিষাদ-করুণ ভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সহসা ভূত দেখলে যেমন হয় তেমনি স্তম্ভিত ও অভিভূত হয়ে রইলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। তাঁর দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছিল। তাঁর কেবলি মনে হচ্ছিল ও কি সত্যিই মেরিয়াস? আবার নিজেই বুঝতে পারলেন, হ্যাঁ সত্যিই মেরিয়াস।

দীর্ঘ চার বছর পর তাকে দেখছেন তিনি। কিশোর থেকে আজ পূর্ণ যুবকে পরিণত হয়েছে সে। তার আচরণ এবং গতিভঙ্গি শান্ত, স্র এবং ভদ্র। চঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মন মেরিয়াসকে সঙ্গে সঙ্গে আলিঙ্গন করতে চাইল উঠে গিয়ে। তাঁর সমগ্র সত্তা এ কথাটা চিৎকার করে বলতে চাইল। কিন্তু তাঁর রূঢ় প্রকৃতির ভেতর থেকে একটা অদ্ভুত অনুভূতির ঢেউ এসে সব ওলটপালট করে দিল। তিনি বললেন, কী কারণে এসেছ তুমি?

বিব্রত বোধ করল মেরিয়াস। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, মঁসিয়ে–

ছুটে গিয়ে দু হাত বাড়িয়ে মেরিয়াসকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করছিল মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের। মেরিয়াস ও তাঁর নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল তাঁর। তাঁর মনে হল তিনি ভেতরে নরম এবং বিগলিত হয়ে উঠলেও বাইরে এত কঠোর কেন এবং মেরিয়াসই-বা এত হিমশীতল কেন।

তিনি আবার বলে উঠলেন, তুমি কী জন্য এখানে এসেছ?

তার মানে তিনি বলতে চাইছিলেন সে যখন এসেছে তখন কেন তাঁকে আলিঙ্গন করছে না আবেগের সঙ্গে। মেরিয়াস হতবুদ্ধি হয়ে তার মাতামহের মর্মরপ্রস্তরের মতো সাদা ফ্যাকাশে মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তুমি কি ক্ষমা চাইতে এসেছ? তুমি কি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ?

কথাগুলো মেরিয়াসের আত্মসমর্পণের পথ পরিষ্কার করে দিলেও সে বলল, না মঁসিয়ে।

কারণ সে বুঝল ক্ষমা চাওয়ার অর্থ হল তার পিতাকে অস্বীকার করা।

একই সঙ্গে ক্রোধ এবং বেদনায় ফেটে পড়লেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। ঠিক আছে, তা হলে কী চাও তুমি আমার কাছে?

হাত দুটো জড়ো করে মুখ নিচু করে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে মেরিয়াস বলল, মঁসিয়ে, আমি শুধু আপনার একটু দয়া চাই।

কথাটা মিঁয়ে গিলেনৰ্মাদের অন্তরটা স্পর্শ করল। এ কথাটা আগে বললে তিনি হয়তো বিগলিত হয়ে যেতেন একেবারে। কিন্তু বড় দেরি হয়ে গেছে।

লাঠি হাতে উঠে দাঁড়ালেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। তিনি মাথাটা নাড়াতে নাড়াতে বলতে লাগলেন, তা বটে! তোমার মতো এক যুবক আমার মতো এক একানব্বই বছরের বৃদ্ধের কাছ থেকে দয়া ভিক্ষা করছ। যে জীবন শুরু হয়েছে তোমার মধ্যে সে জীবন শেষ হতে চলেছে আমার মধ্যে। থিয়েটার ও নাচ দেখে, কাফে ও হোটেলে গিয়ে জীবনকে উপভোগ করছ তুমি। জীবনের সব ঐশ্বর্য তোমার হাতে, অথচ আমি বার্ধক্য, দুর্বলতা আর নিঃসঙ্গতার দারিদ্রে জর্জরিত হয়ে ঘরের কোণে বসে আছি। আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী তোমার পায়ের তলায় আর আমার চারদিকে অন্ধকার। তুমি প্রেমে পড়েছ, তোমার ভালোবাসার অনেকে আছে, কিন্তু আমাকে ভালোবাসার কেউ নেই। তবু তুমি আমার কাছে দয়া চেয়ে আমাকে উপহাস করতে এসেছ। কোনও হাস্যরসাত্মক নাটকে মলিয়ারও এটা কল্পনা করতে পারেননি।

এরপর সুরটা পাল্টে বললেন, ঠিক আছে, সত্যিই কী চাও তুমি?

মেরিয়াস বলল, মঁসিয়ে, আমি জানি এ বাড়িতে আমি সাদর অভ্যর্থনা পাব না। আমি শুধু একটা জিনিস চাইতে এসেছি। তার পরই আমি চলে যাব।

বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদ বললেন, বোকা ছোকরা কোথাকার! কে তোমাকে চলে যেতে বলল?

আসলে তিনি কিন্তু বলতে চেয়েছিলেন, আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে আমার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়। তিনি যখন দেখলেন মেরিয়াস তার মধ্যে কোনও আন্তরিকতা না দেখে চলে যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে তখন তিনি বুঝলেন মেরিয়াস তাঁর মনের আসল কথাটা ধরতে পারেনি। অথচ তিনি এটাই চেয়েছিলেন। এটা বুঝতে পারায় তার দুঃখ বেড়ে গেল এবং সেই দুঃখটা রাগে পরিণত হল।

তিনি রাগের সঙ্গে বলতে লাগলেন, তুমি তোমার মাতামহকে ছেড়ে তার বাড়ি থেকে কোথায় চলে গেছ, তা কেউ জানে না। আমাদের একটা কথাও জানাওনি কোথায় আছ। হয়তো নিঃসঙ্গ জীবনযাপন বেশি আনন্দদায়ক ভেবেই তা বেছে নিয়েছ, কারণ তার মধ্যে আছে অবাধ স্বাধীনতা আর অসংযমের প্রচুর অবকাশ। হয়তো ঋণ করেছ, কিন্তু আমাদের কাছে টাকা চাওনি। তোমার মাসির অন্তরকে ভেঙে দিয়েছ, আসলে তিনি পুনর্মিলনের উপযুক্ত একটা নরম নমনীয় ভাব জাগাতে চেয়েছিলেন মেরিয়াসের মনে। কিন্তু পদ্ধতিটা ভুল এবং রূঢ় হওয়ায় তাতে আরও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ল মেরিয়াস। সে চুপ করে রইল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, ঠিক আছে, আসল কথায় আসা যাক। তুমি বলছিলে, কিছু একটা চাইতে এসেছ তুমি। কী সে জিনিস?

একটা খাড়াই পাহাড় থেকে শূন্যে ঝাঁপ দেওয়ার মতো এক মরিয়া ভঙ্গিতে মেরিয়াস বলল, আমি আমার বিয়েতে আপনার অনুমতি চাইতে এসেছি।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ঘণ্টা বাজিয়ে বাস্ককে ডাকলেন। সে এলে তাকে বললেন, আমার মেয়েকে পাঠিয়ে দাও।

দরজা খুলে ম্যাদময়জেল গিয়েনৰ্মাদ ঘরে ঢুকল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ অশান্তভাবে সারা ঘরময় পায়চারি করে বেড়াচ্ছিলেন। মেরিয়াস অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। মেয়েকে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, ব্যাপারটা অতি তুচ্ছ। মঁসিয়ে মেরিয়াসকে দেখতে পাচ্ছ। উনি বিয়ে করতে চলেছেন। ওঁকে শুভেচ্ছা জানাও। তার পর চলে যাও।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ মেরিয়াসের দিকে এমনভাবে তাকাল যাতে মনে হল সে তাকে চেনেই না। এরপরই সে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আবার পায়চারি করতে শুরু করে দিয়ে বললেন, তা হলে তুমি বিয়ে করতে চাও–একুশ বছর বয়সে। আমার অনুমতি নেওয়ার মতো একটা তুচ্ছ ব্যাপার ছাড়া তুমি সবকিছুই ঠিক করে ফেলেছ। বস মঁসিয়ে। তুমি চলে যাওয়ার পর একটা বিপ্লব ঘটে গেছে এবং জ্যাকবিনরা তাতে জয়ী হয়েছে। তুমি হয়তো খুশি হয়ে প্রজাতন্ত্রী দলে যোগদান করেছ। তা হলে তুমি বিয়ে করতে চলেছ, কিন্তু কাকে তা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

মেরিয়াস কিছু বলার আগেই মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, আমার মনে হয় পদমর্যাদা এবং সম্পদ দুটোই লাভ করেছ। ওকালতি করে কী রকম রোজগার করো?

মেরিয়াস কড়াভাবে উত্তর দিল, কিছুই না।

কিছুই না? তা হলে তোমাকে দেবার বছরে যে বারোশো লিভার বরাদ্দ করেছি আমি, সেটাই তোমার একমাত্র আয়?

মেরিয়াস কোনও উত্তর দিল না। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আবার বললেন, তা হলে নিশ্চয় মেয়েটি ধনী।

আমার থেকে ধনী নয়।

তুমি কি বলতে চাও যৌতুক হিসেবে কিছু পাবে না?

না।

কিছু পাবার আশা থাকবে না?

আমার মনে হয় না।

মেয়েটির বাবা কী করে?

আমি জানি না।

মেয়েটির নাম কী?

ম্যাদময়জেল ফশেলেভেন্ত।

বাহ।

মঁসিয়ে!

মেরিয়াসকে কিছু বলতে না দিয়েই মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বলতে লাগলেন, তা হলে ব্যাপারটা হল এই। মাত্র একুশ বছর বয়স, কোনও প্রতিষ্ঠা নেই, বছরে মাত্র বাবোশো লিভার আয়। তা হলে তোমার স্ত্রী মাদাম লা ব্যারনী পঁতমার্সিকে তো বাজারে যাবার আগে পয়সা গুনে হিসাব করে যেতে হবে।

শেষবারের মতো বুকে আশা নিয়ে মেরিয়াস বলল, মঁসিয়ে, আমি নতজানু হয়ে দয়া ভিক্ষা করছি, আমার বিয়েতে অনুমতি দিন।

বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদ এক সকরুণ হাসি হেসে কাশতে কাশতে বললেন, তুমি বলতে চাইছিলে, তুমি মেয়ের বাপের কাছে গিয়ে বলবে আমার বয়স এখনও পঁচিশ হয়নি। আপনার মতামত গ্রাহ্য করি না। বলবে, আমার পায়ে একজোড়া জুতো নেই, মেয়েটির গায়ে শেমিজ নেই। কিন্তু তাতে কিছু যায়-আসে না। তোমার যা খুশি করতে পার, খুশি হয় বিয়ে করতে পার। কিন্তু আমার অনুমতির কথা যদি বল তা হলে বলব, কখনই আমি এ অনুমতি দেব না।

মাতামহ–

না, কখনই না।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ এমন কণ্ঠে কথাগুলো বললেন যা শুনে মেরিয়াসের আশা উবে গেল। সে তখন মাথা নিচু করে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তখন উঠে তার পিছু পিছু গিয়ে দরজার কাছ থেকে তার জামার কলার ধরে টেনে নিয়ে এসে একটা আর্মচেয়ারের উপর বসিয়ে দিলেন। তার পর বললেন, তোমার প্রেমের কথা সব বল।

‘মাতামহ’ এই কথাটা পরিবর্তন আনে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মধ্যে। তাঁর মুখের চেহারাটা পাল্টে যেতেই সেদিকে বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে মেরিয়াস। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আবার বললেন, তোমার প্রেমের কথা সব বল। ভয় কর না। তোমাদের মতো যুবকরা বড় বোকা। ভুলে যেও না, আমি তোমার মাতামহ।

টেবিলের ধারে একটা চেয়ারে বসেছিল মেরিয়াস। টেবিলের উপর একটা বাতি জ্বলছিল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কণ্ঠে এমন একটা মিষ্টি সুর ছিল যাতে হতাশার পরিবর্তে আশা জাগল তার মনে। এদিকে বাতির আলোয় তার ছেঁড়া পোশাকগুলো মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের চোখে পড়ল। তিনি বললেন, তুমি সত্যিই কপর্দকহীন, তাই নয় কি? তোমাকে দেখতে একজন ভবঘুরের মতো দেখাচ্ছে।

এই বলে তিনি ড্রয়ার খুলে তার থেকে কিছু টাকা বার করে টেবিলের উপর রেখে বললেন, এখানে একশো লুই রইল। তুমি কিছু জামাকাপড় কিনে নেবে।

মেরিয়াস বলল, দাদু, তুমি যদি জানতে আমি কত ভালোবাসি মেয়েটিকে। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি লুক্সেমবুর্গ বাগানে তখন সে সেখানে রোজ যেত। প্রথম প্রথম তাকে ভালো করে দেখিনি। কিন্তু ক্রমে কেমন করে জানি না, মেয়েটিকে ভালোবেসে ফেললাম তা বুঝতে পারছি না। তখন মনটা আমার অশান্ত হয়ে ওঠে। এখন অবশ্য রোজ আমাদের দেখা হয়। আমি তাদের বাড়িতে যাই। তাদের বাগানে আমি দেখা করি। তার বাবা আমাদের ভালোবাসাবাসির কথা কিছু জানে না। কিন্তু তারা এখন ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছে। আমি কথাটা শুনে ভাবলাম, আমি আমার দাদুর কাছে গিয়ে সব কথা জানাব। না হলে আমি পাগল হয়ে যাব, না হয় অসুখে পড়ব অথবা নদীতে ঝাঁপ দেব। এই হল আমার প্রেমের কথা। কোনও কথাই বাদ দিইনি। ওদের বাড়িটা হল র‍্যু প্লামেতে। ওদের বাড়িতে একটা বাগান আছে, বাড়িটা ইনভ্যালিদের কাছে।

র‍্যু প্লামেতের নামটা শুনে চমকে উঠলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। তিনি বললেন, র‍্যু প্লমেতে? থাম, এক মিনিট। কাছে একটা ব্যারাক আছে? তোমার আত্মীয় জ্ঞাতিভাই থিওদুল মেয়েটির কথা আমাকে বলেছিল। র‍্যু প্লমেতের মরচে পড়া লোহার গেটওয়ালা একটি বাগানবাড়িতে দেখা একটি মেয়ের কথা বলেছিল সে। যেন আর এক পামেলা। তোমার কিন্তু রুচি আছে। যতদূর মনে হয় মেয়েটি সুন্দরী। তার ওপর থিওদুলের নজর ছিল। কিন্তু তাদের ব্যাপারটা কতদূর গড়িয়েছিল তা জানি না। যাই হোক, তার কথা বিশ্বাস করো না। ও বড় বাজে কথা বলে। তোমার মতো এক যুবক যে প্রেমে পড়বে, সেটা খুবই স্বাভাবিক। তোমার বয়সে এটাই স্বাভাবিক। বিপ্লবে যোগদান করার থেকে সুন্দরী মেয়ের নাচ দেখা অনেক ভালো। একটি সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছ আর মেয়েটি তার বাবাকে না জানিয়েই তোমাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়–এই তো? এতে দোষের কী আছে। এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার আছে এবং আমিও এইভাবে একদিন অভিসারে গিয়েছি তোমার মতো। তবে আমার কথা হল, ব্যাপারটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ো না। বিয়ের কথা তুলে নাটক করতে যেয়ো না। শুধু প্রেম করে যাও। তোমার দাদুর ড্রয়ারে সব সময়ই কিছু লুই থাকে তা জান। টাকার কার হলে এসে নিয়ে যাবে। আমার কাছ থেকে যে টাকা নেবে পরবর্তীকালে তোমার নাতিকে তা দিয়ে শোধ করবে। বুঝলে ব্যাপারটা?

কথাটা শুনে এত দুঃখিত হল মেরিয়াস যে তার মুখ থেকে কথা বার হল না। সে শুধু মাথাটা নাড়ল, মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার হাঁটুতে একটা চাপ দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, মেয়েটিকে তোমার প্রেমিকাতে পরিণত করো না কেন?

মেরিয়াসের মুখখানা ম্লান হয়ে গেল একেবারে। সে তার দাদুর কথা কিছু বুঝতে পারল না। থিওদুলের প্রসঙ্গটাও বুঝতে পারল না। সে উঠে দাঁড়াল নীরবে। সে শান্ত অথচ দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে বলল, আজ হতে পাঁচ বছর আগে আপনি আমার বাবাকে অপমান করেছিলেন, আজ। আপনি আমার ভাবী স্ত্রীকে অপমান করলেন। আমি আপনার কাছ থেকে কিছুই চাই না মঁসিয়ে। বিদায়।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ হাঁ করে স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন সেই দিকে। তিনি চেয়ার ছেড়ে ওঠার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তিনি কিছু করার আগেই মেরিয়াস ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা পেছন থেকে বন্ধ করে চলে গেল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ এবার উঠে দরজার দিকে ছুটে গেলেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন, কে আছ ওকে ধর, যেতে দিয়ো না।

তার মেয়ে ও চাকররা ছুটে এল সবাই। তিনি বললেন, ওকে ধরে আন। যেতে দিয়ো না। কী আমি করেছি তার? ও কি পাগল হয়ে গেছে? ও চলে যাচ্ছে, ওকে ধর। এবার আর ও ফিরে আসবে না।

তিনি কথা থামিয়ে জানালার কাছে গিয়ে কম্পিত হাতে জানালা খুলে রাস্তার দিকে তাকালেন। তিনি কাঁপছিলেন, এমন সময় বাস্ক এসে পেছন থেকে তাকে ধরে ফেলল। তিনি তখনও মেরিয়াসের নাম ধরে ডেকে চলেছিলেন।

কিন্তু মেরিয়াস তখন র‍্যু সেন্ট লুই পার হয়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছিল।

এদিকে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার দু হাত দিয়ে মাথাটা ধরে টলতে টলতে জানালা থেকে সরে এসে আমচেয়ার বসে পড়লেন। তিনি হাঁপাচ্ছিলেন। তাঁর মাথা আর ঠোঁট দুটো নড়ছিল। তাঁর চোখে ও অন্তরে এক অন্তহীন শূন্যতা ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *