প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৩.৬ এক সুদর্শন যুবক

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

১.

ইতোমধ্যে এক সুদর্শন যুবকে পরিণত হয়েছে মেরিয়াস। তার মাথায় ঘন কালো চুল, উঁচু চওড়া কপাল, তার মুখের ভাব দেখে বোঝা যায় সে বুদ্ধিমান, উচ্চমনা এবং কুশলী। তাকে দেখলেই মনে হয় সে জাতিতে ফরাসি, কিন্তু তার শান্ত স্বভাবটা জার্মানদের মতো। সে তখন তার যৌবন-জীবনের এমন একটা স্তরে এসে পড়েছিল যখন যুবকদের চিন্তার জগৎটা গভীরতা আর নির্দোষিতা এই দুই-এর মধ্যে বিভক্ত হয়ে থাকে। কোনও সংকটজনক অবস্থায় পড়লে অনেক সময় সে বোকার মতো আচরণ করত ঠিক, কিন্তু কোনও জরুরি অবস্থায় পড়লে সে যথেষ্ট মানসিক শক্তির পরিচয় দিতে পারত। তার আচরণ ছিল শান্তশীতল, সৌজন্যমূলক, ধীর স্থির এবং সব রকমের হঠকারিতা থেকে মুক্ত। কিন্তু তার মুখখানা সুন্দর এবং ঠোঁট দুটো লাল আর দাঁতগুলো ঝকঝকে হওয়ার জন্য সে যখন হাসত তখন তার অন্তরের শুচিতা আর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এক তপ্ত আবেগের একটা বৈপরীত্য প্রকট হয়ে উঠত।

তার চরম দারিদ্র্যের সময়ে তার পাশ দিয়ে কোনও মেয়েকে যেতে দেখলে সে তাকে এড়িয়ে যেত, তার কাছ থেকে দূরে সরে যেত। তার মনে হত মেয়েটা তার দীনহীন পোশাক দেখে তাকে উপহাস করছে। কিন্তু আসল কথা হল মেয়েটি তার সুন্দর মুখ দেখে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তার এই ভুল ধারণা তাকে আরও লাজুক করে তুলঁত। সে মেয়েদের কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যেত বলে কোনও মেয়ের সঙ্গে কোনওদিন ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি সে। ফলে সে একবোরে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করত।

কুরফেরাক তাকে প্রায়ই বলত, আমার একটা কথা শোন ছোকরা। শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে থেকো না। মেয়েদের একটা সুযোগ দাও। তাতে তোমার অনেক উপকার হবে। তুমি যেভাবে লজ্জায় লাল হয়ে তাদের কাছ থেকে দূরে সরে যাও তাতে তুমি ভবিষ্যতে একজন যাজক হয়ে উঠবে।

কুরফেরাক তাকে ঠাট্টা করে তাই ‘মঁসিয়ে আব্বে’ বলে ডাকত।

কুরফেরাকের কাছ থেকে এক কথা শোনার পর আগের থেকে আরও বেশি করে সব মেয়েদের এড়িয়ে চলত, এমনকি সে কুরফেরাককেও এড়িয়ে চলত।

মেয়েদের মধ্যে মাত্র দু জনকে এড়িয়ে যেত না মেরিয়াস। তারা হল একজন বৃদ্ধা যে তার ঘর পরিষ্কার করত, যাকে মেয়ে বলে ভাবতেই পারত না। আর একটি হল এক বালিকা যাকে সে প্রায়ই দেখত, কিন্তু ভালো করে তাকে কখনও দেখত না।

গত এক বছর হতে মেরিয়াস লুক্সেমবুর্গ বাগানের একধারে একজন বয়স্ক লোকের সঙ্গে একটি বালিকাকে প্রায়ই দেখত। তারা বাগানের নির্জন দিকটায় পাশাপাশি বসে থাকত। মেরিয়াস তখন ভাবতে ভাবতে প্রায়ই চলে যেত সেদিকটায়। সেদিকে গিয়ে পড়লেই সে তাদের দেখতে পেত। লোকটার বয়স ষাট বছর হলেও তার চেহারাটা বলিষ্ঠ, মুখখানা গম্ভীর। তাকে দেখে মনে হত সে একদিন সৈনিক ছিল। সে সব সময় একটা নীল পায়জামা আর নীল টেলকোট আর একটা চওড়া টুপি পরত। তার মাথার চুলগুলো ছিল একেবারে সাদা।

একটা বেঞ্চের উপর সেই লোকটির পাশে তেরো-চৌদ্দ বছরের একটি মেয়ে বসে থাকত। মেয়েটির চোখদুটো সুন্দর হলেও তার দেহটা ছিল রোগা এবং চর্মসার। তার পোশাকটা ছিল কনভেন্টের মেয়েদের মতো। তাদের দেখে মনে হত তারা হল বাপ আর মেয়ে। মেরিয়াস তাদের দেখত। বাপ খুব বেশি বৃদ্ধ হয়নি আর মেয়েটি তখনও যুবতী হয়ে ওঠেনি। তাই সে মেয়েটিকে এড়িয়ে চলার কোনও কারণ দেখতে পেত না। তারাও মেরিয়াসকে ভালো করে লক্ষ করত না। তারা দু জনের শান্তভাবে বসে থাকত। মেয়েটি আনন্দের সঙ্গে উচ্ছলভাবে কথা বলত আর তার বাবা পিতৃসুলভ স্নেহের সঙ্গে মেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে অল্প কথায় তার উত্তর দিত।

মেরিয়াস তাদের সামনে দিয়ে পায়চারি করতে করতে যাওয়া-আসা করত। কিন্তু কোনওদিন কোনও কথা বলেনি তাদের সঙ্গে। সেদিকে ছাত্ররাও মাঝে মাঝে গিয়ে পড়ত। কুরফেরাকও তাদের দেখেছিল। কিন্তু মেয়েটির মধ্যে কোনও সৌন্দর্য না দেখে আকৃষ্ট হয়নি তার প্রতি। কুরফেরাক তাদের একটা করে নাম বার করেছিল। সে মেয়েটিকে বলত ম্যাদময়জেল লানয়ের আর লোকটিকে বলত মঁসিয়ে লেবলাঁ। এই নাম দুটোই ছাত্রদের মধ্যে প্রচলিত হয়ে যায়।

মেরিয়াস রোজই একটা নির্দিষ্ট সময়ে সেই জায়গায় দেখত তাদের। লোকটির চোখের দৃষ্টিটা তার ভালো লাগত। কিন্তু মেয়েটির প্রতি কোনও আগ্রহ ছিল না তার।

.

২.

এক বছর এইভাবে কেটে যাবার পর দ্বিতীয় বছরে মেরিয়াস সেদিকে যাওয়া বন্ধ করেছিল। সে প্রায় ছ মাস আর বাগানের সেদিকে যায়নি। তার পর গ্রীষ্মের কোনও এক আলোকোজ্জ্বল সকালে বাগানের সেদিকটায় হঠাৎ গিয়ে পড়ল। তখন পাখি ডাকছিল বাগানে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে নীল উজ্জ্বল আকাশটাকে দেখা যাচ্ছিল।

বাগানের সেদিকটায় গিয়েই সে দেখতে পেল সেই বেঞ্চের উপর তারা বসে রয়েছে। দেখল বাপের চেহারাটা তেমনিই আছে। কিন্তু মেয়ের চেহারাটা একেবারে বদলে গেছে। মেয়েটি লম্বা এবং এক সুন্দরী যুবতীতে পরিণত হয়ে উঠেছে, কিন্তু তার মধ্যে সেই শিশুসুলভ সরলতাটা তখনও রয়ে গেছে। তার মাথায় বাদামি চুলের গুচ্ছ সোনার মতো চকচক করছিল, কপালটা মর্মরপ্রস্তরের মতো মসৃণ, গাল দুটো গোলাপের পাপড়ির মতো সুন্দর, মোলায়েম গায়ের ত্বক, তার সুন্দর মুখের হাসিটা সূর্যালোকের মতো ছিল উজ্জ্বল। তার মাথাটা রাফায়েলের নির্মিত ভার্জিনের মূর্তির উপর স্থাপন করতে পারতেন এবং গুজ তার ভেনাসের মূর্তির উপর স্থাপন করতে পারতেন। তার খাড়া নাকটা খুব একটা সুন্দর না হলেও সেটা ছিল সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল। তাতে চিত্রকরেরা কোনও শিল্পের উপাদান খুঁজে না পেলেও কবিদের কাছে সেটা ছিল আনন্দের বস্তু। মেয়েটির বয়স তখন পনেরো।

তার চোখের দিকে কখনও তাকায়নি মেরিয়াস। তার মনে হত চোখের ঘন পাতাগুলো দিয়ে তার চোখের তারাগুলো ঢাকা আছে। তার চোখের তারা না দেখলেও তার হাসিটা ছিল বড় সুন্দর। তার বাবার কথা শুনে সে যখন হাসত তখন তার সে হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত মেরিয়াস।

মেরিয়াসের প্রথমে মনে হয়েছিল এ মেয়ে আগের দেখা সেই মেয়েটি নয়, হয়তো তার বোন। এত তাড়াতাড়ি অর্থাৎ মাত্র ছ মাসের মধ্যে এতখানি বেড়ে উঠবে, তা সে ভাবতেই পারেনি। কিন্তু পরে খুঁটিয়ে দেখল, না, এ হল সেই মেয়েটি। সে শুধু মাথায় বেড়ে ওঠেনি, তার চেহারাটা একেবারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। যেন কোনও কুঁড়ি রাতারাতি পূর্ণ বিকশিত ফুলে পরিণত হয়েছে, যেন গতকালকার একটি বালিকা আজ হঠাৎ পূর্ণ যুবতীতে পরিণত হয়ে আমাদের মন ভুলিয়ে দিচ্ছে। এমনিই হয়। বসন্তের সামান্য দু-তিনটি দিন পাতাঝরা একটা শুকনো গাছকে কচি কিশলয়ে ভরে দিতে পারে, কেবল দুটি মাসের ব্যবধান মেয়েটির গোটা গা-টাকে ভরে দিয়েছে নবোদ্ভিন্ন যৌবনের সুষমায়। মেয়েটির যৌবন এসে গেছে।

তার পোশাক দেখে মেরিয়াস বুঝল সে এখন আর স্কুলে পড়ে না। তবে তার হাতের দস্তানা আর পায়ের চটি দেখে বোঝা যায় তার হাত আর পাগুলো ছোট ছোট। তার পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হয় নবযৌবনসমৃদ্ধ দেহ থেকে একটা সুগন্ধ বার হচ্ছে।

লোকটির অবশ্য কোনও পরিবর্তন হয়নি।

মেরিয়াস যখন সেদিন পর পর দু বার তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে গেল তখন চোখ তুলে তার দিকে তাকাল। মেরিয়াস এতক্ষণে দেখল তার চোখ দুটো যেমন নীল তেমনি তার দৃষ্টি ছিল গভীর। কিন্তু মেয়েটি এমন উদ্দাম দৃষ্টিতে তাকাল যাতে মনে হল সে একটা গাছের তলায় খেলতে থাকা এক শিশুকে দেখছে। মেরিয়াসও চিন্তান্বিতভাবে তাদের সামনে দিয়ে কয়েকবার যাওয়া-আসা করল। কিন্তু মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকাল না একবারও।

এরপর মেরিয়াস লুক্সেমবুর্গের সেই বাগানটায় যথারীতি যেত এবং সেই পিতা ও কন্যাকে বেঞ্চের উপর আগের মতোই বসে থাকতে দেখত। কিন্তু তাদের প্রতি কোনও মনোযোগ দিত না সে। আগে সে যখন দেখতে খারাপ ছিল তখন যেমন তার প্রতি তার কোনও আগ্রহ ছিল না তেমনি আজ তার যৌবনসৌন্দর্য বা দেহলাবণ্যের প্রতিও তার কোনও আগ্রহ নেই। অভ্যাসের বশেই সে রোজ একবার করে যেত সেদিকে।

.

৩.

সেদিনটা ছিল বেশ উজ্জ্বল আর তপ্ত। লুক্সেমবুর্গের বাগানে চলছিল আলোছায়ার খেলা। আকাশটা পরিষ্কার, যেন সকালে কোনও দেবদূত সেটাকে ঝকঝকে করে মেজে দিয়েছে। বাদামগাছে চড়ইপাখিগুলো কিচমিচ শব্দ করছিল। তখন কোনও বিশেষ চিন্তা ছিল না মেরিয়াসের মনে। মেরিয়াস তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সহসা মেয়েটি তার মুখপানে তাকাল। মেরিয়াসও তার মুখপানে তাকাল। দু জনের চোখের দৃষ্টি মিলিত হল।

তার সে দৃষ্টিতে কী কথা ছিল মেরিয়াস তা বলতে পারল না। হয়তো কোনও কথাই ছিল না অথবা অনেক কথা ছিল। তবে দু জনের দৃষ্টির মাধ্যমে একটা স্ফুলিঙ্গ খেলে গেল।

মেয়েটি একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল। মেরিয়াস তার পথে চলে গেল। সে বুঝল আজ তার চোখে যে দৃষ্টি দেখেছে তা কোনও বালিকাসুলভ নিরীহ নিষ্কাম দৃষ্টি নয়। সে দৃষ্টির মধ্য দিয়ে আজ যেন তার মনের গভীরের একটি রুদ্ধ দরজা খুলে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গে আবার তা বন্ধ হয়ে যায়। সব মেয়েরই চোখে একদিন না একদিন এই ধরনের এক দৃষ্টির ফুল ফুটে ওঠে।

এইভাবে যে মেয়ে প্রথম তাকায় এবং তার দৃষ্টির মধ্যে তার আত্মার এক অকথিত বাণী ফুটে ওঠে যার অর্থ সে নিজেই জানে না, তার সে দৃষ্টি এমনই এক নবোদিত সূর্যরশ্মির মতো, যা একই সঙ্গে আলোছায়ার এক জটিল দ্বন্দ্বে আকীর্ণ। সেই অপ্রত্যাশিত দৃষ্টির ভয়ঙ্কর সুন্দর আবেদনটিকে ভাষায় ঠিক প্রকাশ করা যায় না। সহসা নারীত্বে উপনীত এক তরুণী তার সেই দৃষ্টির মোহমেদুর আবেদনের মধ্য দিয়ে নিরীহ নির্দোষ হাতে যে ফাঁদ পাতে তাতে একটি হৃদয় ধরা পড়ে যায়, অথচ সে নিজেই জানে না, কেন সে এ ফাঁদ পাতল। কিন্তু যার জন্য এই দৃষ্টির ফাঁদ পাতা হয় সে কিন্তু কিন্তু খুব গভীরভাবে বিচলিত হয় না এ দৃষ্টির দ্বারা। কিন্তু এ দৃষ্টির মধ্যে একই সঙ্গে বর্তমানের এক নিরাবেগ নিস্পৃহতার সঙ্গে ভবিষ্যতের এক প্রেমাবেগ থাকে লুকিয়ে। এ দৃষ্টির মধ্যে এক পবিত্রতার সঙ্গে প্রাণাবেগ কেন্দ্রীভূত হয়ে তাকে এমনই করে তোলে, যা কোনও চটুল প্রেমাভিনয়পটীয়সী নায়িকার দৃষ্টির থেকে অনেক বেশি শক্তিশালিনী এবং যা অন্য একটি অন্তরে এমন এক ফলগাছের চারা রোপণ করে, যা একই সঙ্গে সুগন্ধ ও বিষের ভারে অবনত এবং যার নাম প্রেম।

সেদিন সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেই প্রথমে তার পোশাকের কথাটা চিন্তা করতে লাগল মেরিয়াস। জীবনে আজ এই প্রথম সচেতন হল সে তার পোশাকের প্রতি। সে একটা নির্বোধ বলেই তোবড়ানো টুপি, ময়লা পায়জামা আর ছেঁড়া জ্যাকেট পরে লুক্সেমবুর্গের বাগানে গিয়েছিল।

.

৪.

পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে মেরিয়াস সম্পূর্ণ নতুন একপ্রস্থ পোশাক পরে লুক্সেমবুর্গ বাগানের দিকে এগিয়ে গেল। নতুন জামা, নতুন পায়জামা, নতুন জুতো আর নতুন টুপি। সবশেষে হাতে তার দস্তানা ছিল, যা তার কখনও থাকে না। পথে কুরফেরাককে দেখতে পেল সে। কিন্তু সে দেখেও দেখল না।

কুরফেরাক পরে তার বন্ধুদের বলেছিল, মেরিয়াসকে নতুন পোশাক পরে কোথায় যেতে দেখলাম। মনে হল পরীক্ষা দিতে যাচ্ছে।

লুক্সেমবুর্গ বাগানে যাওয়ার পর প্রথমে বাগানের পুকুরটার চারদিকে একবার ঘুরল। পুকুরে চরতে থাকা হাঁসগুলোর পানে একবার তাকাল। তার পর একটা ভগ্ন প্রস্তরমূর্তিকে বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখল। সে দেখল একজন ভদ্রলোক পাঁচ বছরের একটি ছেলেকে হাত ধরে নিয়ে যেতে যেতে তাকে উপদেশ দিচ্ছে, কখনও চরম পন্থা অবলম্বন করবে না। স্বৈরাচার আর স্বেচ্ছাচার–দুটোকেই সব সময় এড়িয়ে চলবে।

পুকুরটার চারদিকে আর একবার ঘোরার পর ধীর পায়ে অনিচ্ছার সঙ্গে বাগানের সেই বেঞ্চটার পানে এগিয়ে যেতে লাগল মেরিয়াস। একই সঙ্গে সে যাবার একটা আকর্ষণ আর বিকর্ষণ অনুভব করছিল। একই সঙ্গে কে তাকে যেন টানছিল এবং কে যেন তাকে বাধা দিচ্ছিল। একই সঙ্গে সেখানে যেতে আসক্তি আর বিক্তি বোধ করছিল। সে ধীর পায়ে এমনভাবে যেতে লাগল যাতে মনে হচ্ছিল সে রোজ সেখানে যায় বলেই আজও যাচ্ছে।

সেই পক্ককেশ বৃদ্ধ তার মেয়েকে নিয়ে সেই বেঞ্চটায় আগের মতোই বসেছিল। আজ ভালো পোশাক পরে থাকার জন্য একটা গর্ববোধ করছিল মেরিয়াস। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল হ্যাঁনিবল যেন রোম জয় করতে চলেছে। এছাড়া মোটামুটি সে শান্ত এবং সরল ছিল। অন্যদিনকার মতোই সে অন্য সব চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা পাঠ্যবই-এর কথা ভাবছিল, সেই সঙ্গে সঙ্গে রেসিনের ট্র্যাজেডি আর মলিয়ারের কমেডির কথা ভাবছিল। এমন সময় একটা গানের শব্দ তার কানে গেল। সে তার পোশাকটা ঠিক করে নিয়ে এগিয়ে গেল বেঞ্চের দিকে। বেঞ্চের কিছুটা দূর থেকেই সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মেয়েটির দিকে। তার পরই হঠাৎ সে পেছন ফিরে উল্টোদিকে হাঁটতে লাগল। মেয়েটি তার দিকে তাকায়নি, তাকে নতুন পোশাকে কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে, তা সে দেখেনি। তবু একবার পেছন থেকে কেউ দেখছে কি না তা সে পেছনে ফিরে দেখল।

হাঁটতে হাঁটতে বাগানটার এক প্রান্তে চলে গেল মেরিয়াস। তার পর আবার সেই বেঞ্চটার কাছে এসে পড়ল। তার মনে হল মেয়েটি এবার তাকে দেখছে। কিন্তু সে জোর করে খাড়া হয়ে ডাইনে-বায়ে কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা হাঁটতে লাগল। বেঞ্চটার কাছ দিয়ে যাবার সময় তার অন্তরটা ভারী হয়ে উঠছিল। তার মুখটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল। মেয়েটির পরনে ছিল সেই সিল্কের পোশাক, মাথায় সেই টুপি। মেয়েটির মিষ্টি কথার সুরটা তার কানে আসছিল। সে তার বাবার সঙ্গে মিষ্টি সুরে কথা বলছিল শান্তভাবে। সে দেখতে সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী। মেরিয়াস সেটা বুঝতে পারল, কিন্তু সে ভালো করে তাকিয়ে দেখল না। সে ভাবতে লাগল, মেয়েটি যদি জানতে পারে মার্কো ওরেগন দ্য লা বোস্তার ওপর সে বইটা বেরিয়েছে এবং যেটা ফ্ৰাসোয়া দ্য লোফশ্যাতো নিজের লেখা বই হিসেবে চালাচ্ছে সে বই-এর সে-ই রচয়িতা, তা হলে হয়তো সে তাকে শ্রদ্ধা করবে।

মেরিয়াস আবার বেঞ্চের কাছে গেল। মেয়েটির কাছে এসে এবার সত্যিই বিচলিত হল। সে আবার বেঞ্চ আর মেয়েটির কাছ থেকে দূরে চলে গেল। যাবার সময় যখন সে ভাবল মেয়েটি তাকে পেছন থেকে দেখছে তখন সে শিউরে উঠল।

এবার সে এমন একটা কাজ করল যা সে আগে কখনও করেনি। সে আর মেয়েটির কাছে না গিয়ে কিছুটা দূরে অন্য একটা বেঞ্চে বসে মাঝে মাঝে তাদের পানে আড়চোখে তাকাতে লাগল। তার কেবলি মনে হতে লাগল সে ভদ্রলোক এমনিতেই ভালো পোশাক পরে এবং তার পোশাকের যে প্রশংসা করত সে কখনও তার এই নতুন পোশাকের জৌলুস দেখে মুগ্ধ হবে না।

এবার সে উঠে বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

এইভাবে পনেরো মাস কেটে যাবার পর হঠাৎ সেদিন মনে হল মেরিয়াসের, মেয়েটির সঙ্গে যে ভদ্রলোক আসে তার চোখে তার আচরণ হয়তো ভালো লাগেনি। তার আরও মনে হল ভদ্রলোককে মঁসিয়ে লেবলাঁ নামে অভিহিত করা তার প্রতি অশ্রদ্ধারই পরিচায়ক।

সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে রওনা হল সে। সেদিন রাত্রের খাওয়া খেতে ভুলে গেল। যখন তার খাওয়ার কথা মনে পড়ল তখন আর সময় নেই। র‍্যু সেন্ট জ্যাক রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে গেছে। সে রাতে একটুকরো রুটি চিবিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ল সে। বিছানায় শুতে যাবার আগে সে তার জামাটা ঝেড়ে এবং পায়জামাটা যত্নের সঙ্গে ভাঁজ করে রেখে দিল।

.

৫.

পরদিন গর্বোর সেই বাড়িতে মাদাম বুগনল নামে যে বৃদ্ধা মেরিয়াসের ঘর পরিষ্কার ও দেখাশোনা করত, সে দেখল মেরিয়াস আবার তার ভালো পোশাক পরে বেরিয়ে গেছে। দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল সে।

সেদিনও বিকালে লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল মেরিয়াস। মেয়েটি তার বাবার সঙ্গে যে বেঞ্চে বসত সেখানে গেল। সে আগের দিন একা যে বেঞ্চটায় বসেছিল সেই বেঞ্চটাতেই বসল। বাগানের গেট বন্ধ হবার সময় পর্যন্ত বসে রইল। তার পর বেরিয়ে গেল। যাবার সময় দেখে গেল ভদ্রলোক তার মেয়েকে নিয়ে তখনও বসে আছে। হয়তো র‍্যু লা কোয়েস্ট-এর দিকের গেটটা দিয়ে তারা বেরিয়ে যাবে।

সেদিনও সে তার রাতের খাওয়া খেয়েছিল কি না, তা তার মনে নেই।

পরদিন মাদাম বুগনল দেখল মেরিয়াস ভালো বেশভূষা করে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে।

মাদাম বুগনল আপন মনে বলে উঠল, এই নিয়ে তিন দিন এইরকম চলছে। সে মেরিয়াসের পিছু পিছু কিছুটা গেল। সে কোথায় যায়, তা সে দেখতে চায়। কিন্তু এত দ্রুত পা ফেলে চলে গেল মেরিয়াস যে তাকে অনুসরণ করা সম্ভব হল না তার পক্ষে। ফলে হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় ফিরে এল সে। সে আবার হাঁপানির রোগী, সে শুধু ভাবতে লাগল, এর মানে কী? এত তাড়াতাড়ি ছুটতে ছুটতে কোথায় যাচ্ছে সে?

মেরিয়াস আবার লুক্সেমবুর্গের বাগানেই গেল। সে দেখল, মেয়েটি তার বাবার সঙ্গে সেইখানেই বসে আছে। মেরিয়াস সেখানে না গিয়ে সে সেই বেঞ্চটাতে আগের মতো বসে রইল। সে একটা বই পড়ার ভান করতে লাগল। চড়ুইপাখির নাচ দেখতে লাগল। তার কেবলি মনে হতে লাগল মেয়েটি তাকে উপহাস করছে।

এইভাবে এক পক্ষকাল কেটে গেল। মেরিয়াস লুক্সেমবুর্গ বাগানে আর পায়চারি করত না। সে সেখানে গিয়ে সেই বেঞ্চটায় বসে থাকত। কিন্তু কেন বসে আছে সে প্রশ্ন সে নিজেকে করত না কখনও এবং প্রতিদিনই সে ভালো পোশাক পরে যেত।

মেয়েটি যে আশ্চর্যজনকভাবে সুন্দরী, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে তার সম্বন্ধে সমালোচনা করলে একটা কথাই মনে হত তার চোখের বিষাদগ্রস্ত দৃষ্টি আর হাসির উজ্জ্বলতার মধ্যে কেমন যেন একটা বৈপরীত্য আছে। এটা হতবুদ্ধি করে দিত মেরিয়াসকে। তার সুন্দর মুখখানা আনন্দদায়ক হলেও রহস্যজনক মনে হত তার।

.

৬.

দ্বিতীয় সপ্তার শেষের দিকে একদিন মেরিয়াস সেই বেঞ্চটায় তার হাঁটুর উপর একটা বই খুলে রেখে বসে ছিল। কিন্তু সে বই-এর একটা পাতাও পড়েনি। সহসা সামনে তাকিয়ে সে শিউরে উঠল। সে দেখল বাপ আর মেয়ে তাদের বেঞ্চ থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে এবং তার দিকেই আসছে। মেরিয়াস বইটা বন্ধ করে আবার খুলে পড়ার চেষ্টা করল। তার সর্বাঙ্গ কাঁপছিল। সে ভাবতে লাগল ওরা যদি কাছে এসে পড়ে তা হলে সে কী করবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েটি এসে পড়বে তার কাছে। তার মনে হল ভদ্রলোক তার দিকে রাগান্বিতভাবে তাকাচ্ছে। সে কি কথা বলবে তার সঙ্গে মেয়েটিও তার দিকে এক বিষাদমেদুর দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তা দেখে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। মনে হল মেয়েটির সে দৃষ্টি ভর্ৎসনা করছে তাকে। সে যেন বলছে, এতদিন তুমি আমার কাছে আসনি, আজ আমি তোমার কাছে এসেছি। তার চোখে আলোছায়ার খেলা দেখে হতবাক হয়ে গেল মেরিয়াস।

তার মনে হল তার মাথার মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে। সে অবশেষে তার কাছে এসেছে। এটা ভাবতেই আনন্দের আবেগে শিহরিত হয়ে উঠল সে। মেয়েটিকে আগের থেকে বেশি সুন্দর বলে মনে হল তার। সে সৌন্দর্যের মধ্যে একই সঙ্গে এক নারীতু আর দেবদূতের একটা ভাব ছিল। তার মধ্যে সেই পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ছিল যার আবেদন প্রেত্ৰার্ককে গীতিময় আর দান্তেকে নতজানু করে তোলে। সেই সঙ্গে তার জুতোজোড়াটা ময়লা এবং অপরিচ্ছন্ন ছিল বলে তার মনটা দমে গেল। তার মনে হল মেয়েটি তার জুতোটা দেখেছে।

মেরিয়াস মেয়েটির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এদিকে মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে তার দৃষ্টিপথ থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ধীরে ধীরে। এবার সে বাগানে পাগলের মতো পায়চারি করতে লাগল।

কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাগান ছেড়ে পথে বেরিয়ে গেল। তার মনে হল পথে সে মেয়েটির দেখা পাবে। কিন্তু পথে সে মেয়েটির দেখা না পেয়ে সোজা কুরফেরাকের কাছে চলে গেল। সে তাকে একসঙ্গে খাবার জন্য আহ্বান জানাল। তারা দু জনে এক সঙ্গে শেজ রুশোতে খেল। তাতে ছয় ফ্ৰাঁ লাগল আর ছয় স্যু পরিচারিকাকে উপহার হিসেবে দিল। মেরিয়াস ক্ষুধার্ত মানুষের মতো গোগ্রাসে খেল। তার মাথায় তখন অনেক কথা ভিড় করে আসছিল। সে কুরফেরাককে বলল, আজকের খবরের কাগজটা দেখেছ? অত্রে দ্য পুরাভো একটা ভালো বক্তৃতা দিয়েছে।… সে আকণ্ঠ প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিল।

খাওয়ার পর কুরফেরাককে নিয়ে থিয়েটার দেখতে গেল মেরিয়াস। থিয়েটারটার নাম পোর্তে সেন্ট মার্তিন। সে থিয়েটারে তখন রবার্ট ম্যাকেয়ারের আবেগপ্রধান নাটক লা অকার্দে দে আদ্ৰেস্ত অভিনীত হচ্ছিল। নাটক দেখে প্রচুর আনন্দ পেল মেরিয়াস। কিন্তু তার আচরণটা অদ্ভুত দেখাচ্ছিল। কুরফেরাক যখন একটি দোকানের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মেয়েটাকে পেলে মন্দ হত না, তখন মেরিয়াস তার দিকে তাকালও না।

কুরফেরাক তাকে পরদিন দুপুরে তার সঙ্গে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। কাফে ভলতেয়ারে তারা দুজনে একসঙ্গে খেল। গত সন্ধ্যার থেকে আরও বেশি খেল মেরিয়াস। একই সঙ্গে তাকে অন্যমনা, আরও আবেগে উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। কথায় কথায় সে জোর হাসিতে ফেটে পড়ছিল। কুরফেরাক এক গ্রামের যুবকের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিলে সে তাকে আবেগে জড়িয়ে ধরল। একদল ছাত্র এসে তাদের কাছে ভিড় করে দাঁড়াল। একথা-সেকথা আলোচনার পর তারা কুইশেরাতের অভিধান রচনায় ভুল ভ্রান্তির কথা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।

মেরিয়াস একসময় বলল, যাই বল, লিজিয়ন দ্য অনারের ক্রস পাওয়াটা সত্যিই ভাগ্যের কথা।

কুরফেরাক প্রফেয়ারকে বলল, তার পক্ষে এ পুরস্কারটা কিন্তু সত্যিই অদ্ভুত।

প্রুভেয়ার বলল, না, মোটেই অদ্ভুত নয়। এটা গুরুত্বপূর্ণ। মেরিয়াসের কাছে তখন সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ। সে তখন এক প্রবল প্রেমাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল।

কোনও নারীর চোখের দৃষ্টি আপাতত মনে হয় এক যান্ত্রিক ব্যাপার এবং নির্দোষ; কিন্তু আসলে তা ভয়ঙ্কর। আমরা প্রতিদিন সে দৃষ্টির সম্মুখীন হই এবং তাকে কোনও গুরুত্ব দিই না। তার অস্তিত্বের কথা মোটেই ভাবি না। আমরা সে দৃষ্টির ফাঁদে ধরা না পড়া পর্যন্ত মোটেই বিচলিত হই না। পরে দেখি এমন এক শক্তির কবলে আমরা পড়ে গিয়েছি, যার থেকে মুক্ত হবার জন্য বৃথাই সগ্রাম করি আমরা। একের পর এক দুঃখের পীড়নে যন্ত্রণায় জর্জরিত হই। আমরা বুঝতে পারি না সেই অজানা অচেনা শক্তি সৌভাগ্যের বা দুর্ভাগ্যের পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। বুঝতে পারি না কোনও হীন হিংস্র জন্তু বা কোনও শান্তশ্রী অন্তরের কবলে তা ফেলে দেবে আমাদের; ভেবে পাই না এক অপরিহার্য লজ্জার আঘাতে জর্জরিত ও ক্ষতবিক্ষত হবে অথবা প্রেমের অভিষেকে রূপান্তরিত হয়ে উঠবে আমাদের অন্তর।

.

২.

নিঃসঙ্গতা এবং অনাসক্তি, অভিমান, স্বাধীনতাস্পৃহা, প্রকৃতিপ্রেম, কর্মহীন আলস্য প্রবণতা, জীবনের খাতিরেই জীবনযাপনের ইচ্ছা, নিজের সত্তা বা স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্য এক গোপন অন্তঃসলিলা সংগ্রাম, সমস্ত সৃষ্ট জীবনের প্রতি শুভেচ্ছার এক আবেগ–এইসব কিছু মেরিয়াসের জীবনে প্রেমের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে আসন পেতে বসল। তার পিতার প্রতি অনুরাগ বা আসক্তির অনুভূতিটা ক্ৰমে এক ধর্মানুভূতিতে পরিণত হল এবং সকল ধর্মানুভূতির মতোই তা পশ্চাৎপটে সরে গেল। তার সামনের দিকের শূন্য ভূমিটা পূরণ করার জন্য কিছু একটার দরকার। সে শূন্যতা পূরণের জন্য তার জীবনে যা এল তা হল প্রেম।

একটা মাস কেটে গেল। এই এক মাসের মধ্যে রোজ একবার করে লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল মেরিয়াস। কোনও বাধা মানল না সে। মেয়েটি তাকে দেখছে–একথা মনে করতেই আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠল তার অন্তর।

ক্রমশ তার সাহস বেড়ে যাওয়ায় সে মেয়েটি যে বেঞ্চে বসত তার অনেকটা কাছাকাছি যেত, কিন্তু তাদের সামনে যেত না। কিছুটা লজ্জাবশত এবং কিছুটা প্রেমিকসুলভ সাধারণ সতর্কতাবশত সে মেয়েটির বাবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইত। সে তাই মেকিয়াভেলিসুলভ চাতুর্যের সঙ্গে যথাসম্ভব গাছপালা আর বাগানের মূর্তিগুলোর আড়ালে লুকিয়ে থাকত এমনভাবে যাতে মেয়েটি তাকে ভালোভাবে দেখতে পায় অথচ তার বাবা তাকে কম দেখতে পায়। এক একসময় সে লুনিদাস অথবা স্পার্টাকাসের মর্মরমূর্তির আড়ালে প্রায় পুরো আধঘণ্টা একটা বই খুলে দাঁড়িয়ে থাকত আর মাঝে মাঝে মেয়েটির দিকে তাকাত আর মেয়েটিও তার দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে ঠোঁটে ক্ষীণ একফালি হাসি নিয়ে তার পানে তাকাত মাঝে মাঝে। সে যখন শান্তভাবে তার বাবার সঙ্গে কথা বলত, সে তখন তার কুমারী হৃদয়ের এক তপ্ত আবেগের সঙ্গে মেরিয়াসের দিকে তাকাত আর তার কথা ভাবত। সৃষ্টির আদিকাল থেকে ইভ বা নারীদের অন্তরে যে কামনার কুঁড়িটি সুপ্ত হয়ে থাকে সে কুঁড়িটি ফুল হয়ে ফুটে উঠত তার দৃষ্টিতে। তার ঠোঁট দুটি যখন তার বাবার সঙ্গে কথা বলত, তার দু চোখের দৃষ্টি কথা বলত অন্য একজনের সঙ্গে।

কিন্তু মঁসিয়ে লেবলাঁ অর্থাৎ মেয়েটির বাবার মনে সন্দেহ জাগল। সে তাই মেরিয়াস বাগানে আসার সঙ্গে সঙ্গে বেঞ্চ থেকে উঠে পায়চারি করত। মেরিয়াস ও তার মেয়ের মধ্যে মাঝে মাঝে যে দৃষ্টি বিনিময় হত সে বিষয়ে কিছুটা সন্দেহ জেগেছিল তার। সে তাই মাঝে মাঝে বেঞ্চটা পাল্টে অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসত তার মেয়েকে নিয়ে। দেখত মেরিয়াস তাদের কাছে যায় কি না। মেরিয়াস কিন্তু এই সন্দেহের কথাটা বুঝতে পারেনি। এরপর মঁসিয়ে লেবলাঁ নিয়মিত আসা বন্ধ করল এবং যেদিন আসত তার মেয়েকে সঙ্গে আনত না।

মেরিয়াস কিন্তু এইসব ঘটনার কিছুই ভাবত না। প্রথম প্রথম সে সদাসতর্ক হয়ে থাকত, ক্রমে সে আবেগে অন্ধ হয়ে উঠল। তার প্রেমাবেগ ক্রমশই বেড়ে যেতে লাগল। সে রাত্রিতেও মেয়েটির স্বপ্ন দেখত। তার ওপর একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার প্রজ্বলিত প্রেমাবেগের আগুনে তেল ঢেলে যেন তাকে ইন্ধন জুগিয়ে দিল। তার সামনে কুয়াশা ঘেরা চিন্তার রাশ তাকে যেন আরও অন্ধ করে দিল। একদিন মেরিয়াস দেখল যে বেঞ্চটায় মেয়েটি তার বাবার সঙ্গে বসেছিল তারা উঠে চলে গেলে তার উপর একটা রুমাল পড়ে আছে। রুমালটা সাদা এবং তাতে কোনও সূচিশিল্পের কারুকার্য ছিল না; শুধু তার উপর ইউ আর এফ এই দুটো অক্ষর লেখা ছিল। রুমালটা থেকে একটা সুগন্ধ বার হচ্ছিল। তখনও পর্যন্ত মেরিয়াস মেয়েটির নাম-ধাম কিছুই জানত না। সে ‘ইউ’ অক্ষরটা দেখে ভাবল মেয়েটির নাম নিশ্চয় আরসুলা। কী সুন্দর নাম! সে রুমালটা চুম্বন করল, তার গন্ধ শুকল। রুমালটা সে তার বুকের কাছে রেখে দিত আর রাত্রিতে বালিশের তলায় রেখে দিত। সে যখন বাগানে যেত তখন রুমালটা সঙ্গে নিয়ে যেত।

আসলে কিন্তু রুমালটা ছিল মেয়েটির বাবার এবং সেটা তার পকেট থেকে একসময় পড়ে যায়।

কিন্তু মেরিয়াস তা জানতে না পারায় ভাবত সেটা মেয়েটির রুমাল এবং সে তাই বাগানে গিয়ে রুমালটা তার বুকের উপর জড়িয়ে ধরত। মেয়েটি কিন্তু এর কোনও মানে বুঝতে পারত না। ফলে তার মুখে-চোখে কোনও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করত না। মেরিয়াস আপন মনে বলত, কী সমবোধ!

.

৮.

মেয়েটির প্রতি তার শত প্রেমাবেগ থাকা সত্ত্বেও একদিন একটি ঘটনায় তার আরসুলার ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠে মেরিয়াস। একদিন মঁসিয়ে লেবলাঁ তার মেয়ের সঙ্গে বেঞ্চ থেকে উঠে পায়চারি করছিল বাগানের পথে। তখন জোর বাতাস বইতে থাকায় গাছের মাথাগুলো নুইয়ে পড়ছিল। বাবা আর মেয়ে হাতধরাধরি করে হাঁটতে হাঁটতে মেরিয়াসের বেঞ্চের কাছে এসে পড়ায় মেরিয়াস আবেগের বশে উঠে পড়ে তাদের দিকে তাকাতে থাকে।

সহসা একঝলক জোর দমকা বাতাস মেয়েটির পোশাকগুলোকে এলোমেলো করে দিল এবং মেয়েটি তখন ব্যস্ত হয়ে তার জামার উড়ন্ত আঁচলগুলোকে ঠিক করে নিতে লাগল। কেউ তখন তাকে না দেখলেও সে ভাবছিল কেউ তার অনাবৃত পাদুটোকে দেখেছে। তার অনাবৃত পায়ের লাবণ্য ঈর্ষার আগুন ধরিয়ে দিল যেন মেরিয়াসের মধ্যে। তার ওপর তার প্রতি মেয়েটির ঔদাসীন্য আর অনাগ্রহ দেখে রাগ হচ্ছিল তার। প্রথমে তারা মেরিয়াসের বেঞ্চটার সামনে দিয়ে পথটার অন্য প্রান্তে চলে গেল। তার পর সেই পথেই আবার ফিরতে লাগল। ফেরার সময় তারা আবার মেরিয়াসের সামনে এসে পড়ল। মেয়েটি কাছে আসতেই তার মুখপানে এমন ভ্রুকুটিকুটিল দৃষ্টিতে তাকাল যাতে কিছুটা চমকে উঠল মেয়েটি। তার চোখের পাতাগুলো এমনভাবে কাঁপতে লাগল তাতে মনে হল সে বলতে চাইছে, কী হল তার?

এই যেন তাদের চোখে-চোখে প্রথম ঝগড়া।

তাদের এই দৃষ্টি বিনিময়পর্ব শেষ হতে না হতেই সেখানে এক অবসরপ্রাপ্ত বৃদ্ধ সৈনিক পঞ্চদশ লুই-এর ধরনের পোশাক পরে বাগানের সেই পথটায় এসে হাজির হল। যুদ্ধে একটা পা তার গেছে এবং সে পা-টা কাঠের তৈরি। মাথার চুল সব পাকা। সেন্ট লুই ক্রস পুরস্কারের ব্যাজ আছে জামার উপর। লোকটাকে দেখে মেরিয়াসের মনে হচ্ছিল সে যেন নিজের অবস্থায় তৃপ্ত এবং গর্বিত। কিন্তু তার এই তৃপ্তি বা গর্বের কারণটা কী, তা বুঝতে পারল না মেরিয়াস। তার মনে হল লোকটা কি তবে তাদের দৃষ্টিবিনিময়ের ব্যাপারটা দেখে ফেলেছে! তার ঈর্ষাকাতর মনটা আরও বেশি ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠল।

কিন্তু কালক্রমে আরসুলার ওপর রাগ কমে গেল মেরিয়াসের। তাকে সে ক্ষমা করল মনে মনে। তবে এর জন্য তাকে চেষ্টা করতে হয়েছিল এবং তিন দিন ধরে সে এই দুঃখটা মনে মনে লালন করে রেখেছিল।

এ সব সত্ত্বেও আবার অনেকটা এইজন্যই মেয়েটির প্রতি তার আসক্তিটা বেড়ে গেল।

.

৯.

মেরিয়াসের মনে হল মেয়েটির নাম সে জানতে পেরে গেছে এবং সে নাম হল আরসুলা। কিন্তু নাম জানাটাই সব নয়, যথেষ্ট নয়। তার ভালোবাসার ক্ষুধাটা বেড়ে যেতে লাগল দিনে দিনে। এই নাম জানার তৃপ্তিটা কয়েক সপ্তার মধ্যে সব ক্ষয় হয়ে গেল এবং সে আরও কিছু জানতে চাইল। সে জানতে চাইল মেয়েটি কোথায় থাকে।

দুটো ভুল আগেই করেছিল মেরিয়াস। প্রথম ভুল হল এই যে মঁসিয়ে লেবলাঁ তার মেয়েকে নিয়ে আগের বেঞ্চ ছেড়ে অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসলেও সে তাদের কাছে সরে গেছে। এর দ্বারা তার মনোভাব বুঝতে পেরে গেছে মঁসিয়ে লেবলাঁ। মেরিয়াসের দ্বিতীয় ভুল হল এই যে মঁসিয়ে লেবলাঁ যেদিন একা আসত বাগানে অর্থাৎ তার মেয়েকে সঙ্গে আনত না সেদিন আসার সঙ্গে সঙ্গে বাগান থেকে চলে যেত মেরিয়াস। এরপর মেয়েটি কোথায় থাকে তা জানতে গিয়ে এক অসংযত কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে সে আর একটা ভুল করে বসেছে।

সে দেখল মেয়েটি থাকে র‍্যু দ্য লা কোয়েস্ট অঞ্চলে। বড় রাস্তার শেষ প্রান্তে এক শান্ত পরিবেশে অবস্থিত তাদের বাড়িটা দেখতে সত্যিই সুন্দর। সে ভাবল তাদের বাড়িটা আবিষ্কার করতে পারার ফলে তাকে দেখার আনন্দটা বেড়ে যাবে। বাগানে মেয়েটিকে দেখার পরেও সে তাদের বাড়ির কাছে গিয়ে তার পাশ থেকে তাকে দেখতে পারবে। তার নামের প্রথম পদটা সে জানতে পেরেছে। তার নামটা বড় সুন্দর। সে কোথায় থাকে তা-ও জানতে পেরেছে। এবার তাকে জানতে হবে সে কী করে, তার পরিচয় কী।

একদিন সন্ধ্যার সময় মেয়েটির পিছু পিছু গিয়ে মেরিয়াস দেখল তারা পোর্তে কশেরে নামে একটা হোটেলে গিয়ে উঠল। মেরিয়াসও হোটেলে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করল, যে ভদ্রলোক এইমাত্র ঢুকলেন তিনি কি দোতলায় থাকেন?

দারোয়ান বলল, না মঁসিয়ে। তিনি থাকেন চারতলায়।

চারতলার সামনের দিকে।

গোটা বাড়িটাই তো রাস্তার দিকে। সামনেই বড় রাস্তা।

 তিনি কী ধরনের মানুষ?

ব্যক্তিগত আয়ের ওপর তার চলে। ভদ্রলোক সরল অন্তঃকরণের লোক। তিনি গরিবদের যথাসাধ্য সাহায্য করেন, যদিও তিনি নিজে ধনী নন।

মেরিয়াস বলল, ভদ্রলোকের নাম কী?

দারোয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেরিয়াসের দিকে তাকাল। বলল, মঁসিয়ে কি পুলিশের লোক?

এ কথায় চুপ করে গেল মেরিয়াস। তবু সে খুশি হয়ে ভদ্রলোক সম্বন্ধে খোঁজখবর দিতে লাগল।

পরদিন অল্প কিছুক্ষণের জন্য লুক্সেমবুর্গ বাগানে এল মঁসিয়ে লেবলাঁ। তার মেয়েও সঙ্গে ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার আগেই চলে গেল। মেরিয়াস তাদের পিছু পিছু হোটেল পর্যন্ত গেল। কিন্তু মেয়েটিকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে মঁসিয়ে লেবলাঁ দরজা থেকে ফিরে অন্যত্র চলে গেল। যাবার সময় মেরিয়াসের দিকে একবার কড়াভাবে তাকাল।

পরদিন মঁসিয়ে লেবলাঁ তার মেয়েকে নিয়ে লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল না। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলে চলে গেল মেরিয়াস। মেরিয়াস গিয়ে দেখল তাদের ঘরে আলো জ্বলছে। হোটেলের বাইরে পায়চারি করতে লাগল সে। মঁসিয়ে লেবলাঁ’র ঘরে আলোটা নিবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মেরিয়াস চলে গেল।

পরের দিনও বাগানে এল না মঁসিয়ে লেবলাঁ। মেরিয়াসও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর হোটেলে গিয়ে তেমনিভাবে পায়চারি করতে লাগল আর তাদের জানালাটার পানে তাকাতে লাগল। রাত্রি দশটার সময় আলোটা নিবে যেতেই মেরিয়াস চলে গেল। জ্বর যেমন রুগ্ণ ব্যক্তিকে ছাড়তে চায় না তেমনি প্রেম একবার ধরলে প্রেমিককে ছাড়তে চায় না।

একটা সপ্তা কেটে গেল এইভাবে। লেবলাঁ আর তার মেয়ে আর লুক্সেমবুর্গ বাগানে আসত না। তারা কেন আর আসছে না, তা নিয়ে বিষণ্ণভাবে ভাবতে লাগল মেরিয়াস। নানারকম অনুমান করতে লাগল। কিন্তু দিনের বেলায় হোটেলের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে ভয় হল তার। তাই সন্ধ্যার পর হোটেলের সামনে গিয়ে তাদের জানালার আলোটার দিকে তাকিয়ে রইল। তার মনে হচ্ছিল ঘরের মধ্যে জ্বলন্ত বাতিটার সামনে দিয়ে একটা ছায়া যাওয়া-আসা করছে।

এইভাবে সাত দিন কেটে যাবার পর আট দিনের দিন সন্ধের পর সে জানালায় আর কোনও আলো দেখতে পেল না মেরিয়াস। তাদের ঘর অন্ধকার। সে ভাবল ওরা হয়তো সন্ধের সময় বাইরে কোথাও আছে। শুধু রাত দশটা নয়, রাতদুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করল মেরিয়াস। তবু আলো জ্বলল না সে ঘরে। অপরিসীম বিষাদ বুকে নিয়ে সেখান থেকে চলে গেল মেরিয়াস।

একদিন পর আবার লুক্সেমবুর্গ বাগানে গেল মেরিয়াস। কিন্তু সেদিন মঁসিয়ে লেবলাঁদের দেখতে পেল না সে। সন্ধের পর সে হোটেলে গেল। কিন্তু সেদিনও তাদের জানালায় আলো দেখতে পেল না। জানালাটার সার্সি বন্ধ।

মেরিয়াস হোটেলের দারোয়ানকে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, চারতলার ভদ্রলোক কোথায়?

দারোয়ান বলল, তিনি চলে গেছেন।

মেরিয়াসের মাথাটা ঘুরতে লাগল। সে ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, কবে চলে গেছেন?

গতকাল।

কোথায় গেছেন?

আমি তা জানি না।

কোনও ঠিকানা রেখে গেছেন?

না।

দারোয়ান এবার মেরিয়াসকে চিনতে পারল। ও আরও একদিন দারোয়ানকে ভদ্রলোকের কথা জিজ্ঞাসা করে। সে বলল, আপনি আবার এসেছেন, আপনি নিশ্চয় পুলিশের কোনও চর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *