প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

৩.৩ কয়েকজন বিশিষ্ট লোকের বাড়িতে

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ যখন র‍্যু সার্ভাদোনিতে থাকতেন তখন তিনি প্রায়ই কয়েকজন বিশিষ্ট লোকের বাড়িতে যেতেন। তাঁকে অনেকে খাতির করত।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ যেতেন রাজতন্ত্রী অভিজাতদের বাড়িতে যেখানে তাঁর আত্মসম্মানে কোনও আঘাত লাগত না। তিনি বিশেষ করে যেতেন মঁসিয়ে দ্য রোনাল্ড আর মঁসিয়ে বেদি-পু-ভ্যালির কাছে। সেখানে গিয়ে রাজনৈতিক অবস্থা সম্বন্ধে অনেক ভবিষ্যদ্বাণী করতেন।

১৮১৭ সালে বা তার কাছাকাছি একসময় সপ্তায় দু’দিন বিকালে তিনি তার এক নিকট প্রতিবেশী ব্যারনের বাড়িতে যেতেন। এই ব্যারনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীই তাঁর একমাত্র উত্তরাধিকারী হয়। এই ব্যারন ষোড়শ লুই-এর অধীনে বার্লিনে রাষ্ট্রদূত ছিলেন। পরে তিনি নির্বাসিত অবস্থায় সর্বস্বান্ত হয়ে মারা যান। মৃত্যুকালে কোনও বিষয়সম্পত্তি দিয়ে যেতে পারেননি তিনি। শুধু তাঁর জীবনের স্মৃতিকথা সম্বলিত এক বিরাট পাণ্ডুলিপি রেখে যান, যা ছিল দশ খণ্ডে সমাপ্ত। জীবদ্দশায় সম্মোহনবিদ্যায় তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল এবং এ নিয়ে অনেক গবেষণা করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীর পক্ষে তাঁর পাণ্ডুলিপিগুলো প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, কারণ সে আর্থিক সামর্থ্য তার ছিল না। কোনও সন্তান না থাকায় অল্প যা কিছু আয় ছিল তাতে কোনও রকমে একা জীবনধারণ করতেন তিনি। অভিজাত সমাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে একা একা থাকতেন তিনি। শুধু সপ্তাহ দুদিন বিকালে তাঁর কিছু বন্ধু তাঁর নির্জন বাড়িতে আসত। যারা আসত তারা সবাই ছিল রাজতন্ত্রবাদী। তারা সবাই চা খেয়ে সমকালীন রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করত। সনদ, বোনাপাটপন্থীদের অবস্থা, অষ্টাদশ লুই-এর জ্যাকবিনবাদ, অযোগ্য লোকদের হাতে ‘কর্ডন মোর’ ভার দেওয়া প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা হত।

তারা অনেক সময় কবিতা আবৃত্তি করত। তারা ফরাসি বিপ্লবকে হীনভাবে দেখত এবং বিপ্লবের ওপর যে গান রচিত হয় তার একটা বিকৃত প্রতিরূপ খাড়া করে সেটা গাইত।

১৮১৬ সালে ফুয়ালদেকে নিয়ে যে ঘটনা ঘটে তাতে তারা বাস্তিদে এবং জনগণের পক্ষে যোগদান করে, কারণ ফুয়াদে ছিল বোনাপার্টপন্থী। উদার নীতিবাদীদের তারা ‘ভাই ও বোন’ বলত এবং এর থেকে আমাদের আর কিছু হতে পারে না।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ছাড়া আর একজন ব্যারনপত্নীর বাড়িতে মাঝে মাঝে যেতেন। তার সম্বন্ধে লোকে বলাবলি করত, জান উঁকি কে? উনি হচ্ছেন ‘নেকলেস’ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ল্যামোথি। তখনকার দিনের বুর্জোয়ারা মানুষ হিসেবে অবাঞ্ছিত হলেও আত্মীয়তা সম্পর্কের খাতিরে বড় বড় লোকের বাড়িতে যাতায়াত করত। মাদাম পারের ভাই মেরিগান প্রিন্স দ্য সুবিদের বাড়িতে যেতেন এবং গিলন দু ব্যারি মার্শাল দ্য রিচর বাড়িতে পেতেন সাদর অভ্যর্থনা।

১৮১৫ সালে কোত দ্য ল্যামোথি ভ্যালয়ের বয়স ছিল পঁচাত্তর। তার চেহারাটা হিমশীতল হলেও তার আচরণ ছিল নিখুঁত। তাঁর কোটের বোতামগুলো ঠিকমতো আঁটা থাকত। তাছাড়া তাঁর ভ্যালয় নামটার জন্যও তিনি খাতির পেতেন বেশি।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিত্বের জোরে খাতির পেতেন। তাঁর আচরণে কোনও আনন্দ ও চঞ্চলতার ভাব না থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা শ্রদ্ধাজনক ভাব ফুটে ওঠে তাঁর চেহারার মধ্যে। তাছাড়া তাঁর মন্তব্যগুলোর একটা গুরুত্ব ছিল। অষ্টাদশ লুইকে রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত করার পর প্রুশিয়ার রাজা তার সঙ্গে দেখা করতে এলে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়নি। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ এ ব্যাপারে সমর্থন করে মন্তব্য করেন, ফ্রান্সের রাজা অন্য দেশের রাজার প্রতি এই ধরনের ব্যবহার করে ঠিকই করেছেন। যে দেশেরই রাজা হোক ফ্রান্সের রাজার কাছে তিনি এক সাধারণ ব্যক্তি।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ব্যারনপত্নীর বাড়িতে যখনি যেতেন তখনি তিনি তাঁর বড় মেয়েকে সঙ্গে করে যেতেন। বড় মেয়ের বয়স তখন ছিল চল্লিশ। কিন্তু দেখে মনে হত পঞ্চাশ। তাঁদের সঙ্গে সাত বছরের একটি ছেলেও থাকত। ছেলেটির চোখ-মুখ বেশ উজ্জ্বল এবং সুন্দর ছিল। ছেলেটি ব্যারনপত্নীর বাড়ির বৈঠকখানায় পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলে বলাবলি করত, ‘আহা বেচারি, মা নেই, বাবা দেখে না।’ এই ছেলেটি হল মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ছোট মেয়ের ছেলে। তার বাবা একজন সামরিক অফিসার ছিল। ১৮১৫ সালে প্যারিসের পতনের সঙ্গে সঙ্গে লয়ের নদীর ওপারে কোথায় চলে যায়। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকেই ছেলের কোনও খোঁজখবর রাখত না। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তাঁর এই জামাই সম্বন্ধে মন্তব্য করতেন, আমাদের বংশের কলঙ্ক।

.

২.

সেকালে ভার্নল শহর দিয়ে হেঁটে গিয়ে সেন নদীর উপর পাথরের পুলটা পার হয়েই পুলের উপর থেকে মাথা টুপি, হাতে বোনা পায়জামা আর জ্যাকেট পরা প্রায় পঞ্চাশ বছরের একটি লোককে দেখতে পেত। লোকটির গায়ের রংটা রোদে কালো হয়ে গিয়েছিল। তার মাথার চুল ছিল একেবারে সাদা। আর কপালে উপর একটা ক্ষতের দাগ ছিল, যে দাগটা তার গাল পর্যন্ত নেমে এসেছিল। নদীর ধারে পাঁচিল-ঘেরা একটা বাগানে কয়েক খণ্ড জমিতে সে একটা কোদাল হাতে নিয়ে সারাদিন কাজ করত। বাগানটার সামনের দিকে ছিল নদী আর পেছনের দিকে ছিল একটা বাড়ি। বাগানটা ছিল নানারকম ফুলে ভর্তি।

পায়জামা আর জ্যাকেটপরা ওই লোকটিই ছিল ওই বাগান আর বাগান সংলগ্ন বাড়িটার বাসিন্দা। এই বাগানই ছিল তার একমাত্র সম্পত্তি। সে একা একাই থাকত। সেখানে। তার আত্মীয়-বন্ধু বলতে কেউ ছিল না। শুধু ঘর-সংসারের কাজ করার জন্য এক মধ্যবয়সী মহিলা থাকত বাড়িতে।

মহিলাটিকে দেখে যুবতী না বৃদ্ধা, সুন্দরী না কুৎসিত তা কেউ বুঝতে পারত না। তবে বাগানটার ফুলের ঐশ্বর্যের জন্য শহরের সবাই প্রশংসা করত।

ফুলগাছগুলোতে জল দিয়ে গোড়া খুঁড়ে সারাদিন পরিশ্রম করে গাঁদা, ডালিয়া প্রভৃতি অনেক ফুলের চাষ করত সে বাগানে। চীন, আমেরিকা থেকে আনা অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছের চারা বসাত বাগানে। সে ছিল কল্পনাপ্রবণ। গ্রীষ্মকালে সকাল হতেই সে বাগানে গিয়ে আগাছা পরিষ্কার করা, মাটি খোঁড়া, গাছে জল দেওয়া, পাতা বা ডাল ছাঁটা প্রভৃতি নানারকমের কাজ করত। রং-বেরঙের ফুলের মাঝখানে বসে এক প্রশান্ত বিষাদ মুখ নিয়ে নীরবে কাজ করে যেত সে। কখনও কখনও পুরো একটা ঘণ্টা বসে বসে কী ভাবত। স্তব্ধ হয়ে পাখির গান শুনত অথবা সকালের রোদের ছটা পেয়ে যে শিশির মুক্তোবিন্দুর মতো হয়ে উঠেছে সেই শিশিরবিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকত। সে মদের থেকে দুধ বেশি পান করত। বাড়িতে যে মেয়েটি থাকত সে প্রায়ই বকত লোকটিকে। মেয়েটি তাকে শিশুর মতো জ্ঞান করত।

লোকটি এমনই লাজুক প্রকৃতির ছিল যে লোকে তাকে অসামাজিক মনে করত। সে বাড়ি আর বাগানের বাইরে কোথাও যেত না। একমাত্র যেসব গরিব তার বাড়িতে সাহায্যের জন্য আসত বা উঁকিঝুঁকি মারত তারা ছাড়া আর কোনও মানুষের মুখ দেখতে পেত না সে। আর একজনকে সে মাঝে মাঝে দেখতে পেত তিনি হলেন স্থানীয় কুরে বা যাজক আব্বে মেথুব। তবে শহরের কোনও লোক বা বিদেশি কোনও পথিক যদি তার বাগানের ফুল দেখতে চাইত তা হলে সে হাসিমুখে তার বাগানটা ঘুরিয়ে দেখাত তাকে। এই লোককেই বলা হত ‘ব্রিগ্রান্ড অফ দি লয়ের অর্থাৎ লয়ের নদীর দস্যু।

সে যুগের সামরিক ইতিহাসের কোনও ছাত্র যদি এঁদ আর্মি বা বিশাল সৈন্যদলের বুলেটিন বা ফ্রান্সের যুদ্ধের কোনও স্মৃতিকথা পড়ে তা হলে সে দেখতে পাবে জর্জ “তমার্সির নামটা প্রায়ই উল্লেখ করা হয়েছে তাতে। পঁতমার্সি যুবক বয়সে সেঁতোনে সেনাদলের অধীনে এক পদাতিক হিসেবে যোগদান করে। রাজতন্ত্রের যুগে এক একটি প্রদেশের নাম অনুসারেই এক একটি সেনাদলের নামকরণ হয়। স্পায়ার, ওয়ার্মম, তাখেম প্রভৃতি বহু জায়গায় যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে পঁতমার্সি এবং যে বারোজন বীর সৈনিককে হেসির রাজার এক বিরাট সৈন্যদলের আক্রমণের প্রতিরোধ করতে হয়েছিল, পঁতমার্সি ছিল তাদের অন্যতম। যুদ্ধটা হয়েছিল আন্দারনাম দুর্গপ্রাকারের বাইরে। শত্রুপক্ষের জোর গোলাবর্ষণের সামনে দাঁড়াতে না পেরে পিছিয়ে আসে তারা। মত প্যালিসেলে ক্লেবারের অধীনে যুদ্ধ করার সময় তার হাতের এক জায়গা ভেঙে যায়। তার পর সে সহকারী লেফটেন্যান্ট হয়। অস্টারলিৎস-এর যুদ্ধে যুদ্ধ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে পঁতমার্সি। রাশিয়ার রাজকীয় বাহিনী যখন ফরাসি চতুর্থ বাহিনীকে আক্রমণ করে, পঁতমার্সি তখন একদল সৈন্য নিয়ে সেই আক্রমণ প্রতিহত করে রুশবাহিনীকে তাড়িয়ে দেয়। সম্রাট তাকে একটা ক্রস উপহার দেন। পঁতমার্সি ওয়ামদারকে খাবুওয়ার মেনামকে আলেকজেন্দ্রিয়া এবং ম্যাককে উলথে বন্দি হতে দেখে সে এঁদ আর্মির অধীনে অষ্টম বাহিনীতে থাকার সময় মর্তিমারের অধীনে যুদ্ধ করে হামবুর্গ দখল করে। তার পর সে ৫৫তম ফ্ল্যান্ডার্স বাহিনীতে স্থানান্তরিত হয়। এলয়-এর যুদ্ধে বীর ক্যাপ্টেন লুই হুগো যখন তিন ঘণ্টা ধরে শত্রুপক্ষকে প্রতিহত করে রাখে তখন যে তিনজন জীবিত অবস্থায় সেই আক্রমণের কবল থেকে বেরিয়ে আসে পঁতমার্সি ছিল তাদের অন্যতম। সে ফ্রেডন্যান্ডে যুদ্ধ করে। যুদ্ধের জন্য যেসব জায়গায় তাকে যেতে হয় সেগুলো হল মস্কো, লুৎজেন, বিরোসিনা, ড্রেসডেন, লিপজিগ, গেলেনহসেনের গিরিবর্ত্ত। এ ছাড়াও তাকে যেতে হয় মার্নের নদীর তীরে এক লাওর পরিখায়। আর্নে লে দাকের যুদ্ধে সে যখন একজন ক্যাপ্টেন ছিল তখন দশজন কশাককে তরবারির আঘাতে হত্যা করে তার ঊর্ধ্বতন অফিসারকে উদ্ধার করে। সেই যুদ্ধে সে আহত হয় এবং বোমার সাতাশটা টুকরো তার বাঁ হাতের উপর অংশ থেকে বার করা হয়। প্যারিসের পতনের আট দিন আগে সে অশ্বারোহী বাহিনীতে যোগদান করে। সে একই সঙ্গে তরবারি ও বন্দুক চালনায় পারদর্শী ছিল। আবার সেনাদল পরিচালনাতেও সে ছিল সিদ্ধহস্ত। নেপোলিয়নের সঙ্গে স্পে এলবা যায় এবং ওয়াটারলু যুদ্ধে সে এক সেনাদল পরিচালনা করে। শত্রুপক্ষের নুলেবার্গ বাহিনীর পতাকা দখল করে সেটাতে রক্ত মাখিয়ে নেপোলিয়নের পায়ের তলায় ফেলে দেয়। তার মুখে তখন তরবারির আঘাত লাগে এবং ক্ষত হয় তাতে। নেপোলিয়ন তখন তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, এখন থেকে তুমি হলে কর্নেল, ব্যারন, লিজিয়ন দ্য অনারের একজন অফিসার।

পঁতমার্সি তখন সম্রাটকে উত্তর করে, আমি আমার বিধবা পত্নীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মহারাজ। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে ওহেনের পথে পড়ে যায়। এই হচ্ছে পঁতমার্সির জীবনকাহিনী। পঁতমার্সিই হল লয়েরের দস্যু।

এর পরের কাহিনীরও কিছুটা শুনেছি আমরা। থেনার্দিয়ের তাকে ওহেনের সেই পথ থেকে তোলে। পরে সে সেরে ওঠে। আবার সে ফরাসি বাহিনীতে যোগ দেয়। রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর তাকে অর্ধেক বেতন দিয়ে ভাল শহরে প্রহরাধীন অবস্থায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। রাজা অষ্টাদশ লুই সবকিছু বিবেচনা করে তার কর্নেল এবং লিজিয়ন দ্য অনারের পদ অস্বীকার করেন। তার পদোন্নতি মেনে নিলেন না তিনি। তবু পঁতমার্সি কর্নেল ব্যারন পঁতমার্সি’ এই নামে স্বাক্ষর করত এবং তার নীল রঙের জ্যাকেটের উপর লিজিয়ন দ্য অনারের ব্যাজটা না লাগিয়ে কোথাও বেরোত না। এজন্য তাকে নোটিশ দেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। তবু সে আট দিন এই ব্যাজ পরে ঘুরে বেড়ায়, অথচ কেউ তার ওপর হস্তক্ষেপ করতে সাহস করেনি। এই সময় মেজর পঁতমার্সি’ নামে তার কাছে সরকারি চিঠি এলে সে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। স্যার হাডসন লো একসময় জেনারেল নেপোলিয়ন’ এই নামে চিঠি দিলে নেপোলিয়নও এইভাবে ফেরত পাঠান পত্রপ্রেরকের কাছে।

মেজরের অর্ধেক বেতন নিয়ে ভার্নল শহরের একটা বাড়ি ভাড়া করে থাকতে হয় তাকে। নেপোলিয়নের অধীনে সেনাদলে থাকার সময়েই মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ছোট মেয়েকে বিয়ে করে সে। এই বিয়েতে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ-এর মত না থাকলেও বাধ্য হয়ে মত দেন শেষে। মত দিয়ে প্রতিবাদের সুরে বলেন, অনেক বড় বড় অভিজাত পরিবারকেও এইসব ব্যাপার সহ্য করতে হয়। স্ত্রী হিসেবে ভালোই ছিল মাদাম মার্সি। সে তার স্বামীর যোগ্য সহধর্মিণী ছিল। সে একটি পুত্রসন্তান রেখে অকালে মারা যায়। ছেলেটা কাছে থাকলে স্ত্রী বিয়োগজনিত নিঃসঙ্গতার মাঝেও সান্ত্বনা পেত পঁতমার্সি। কিন্তু মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার মেয়ের ছেলের ওপর দাবি জানিয়ে তাকে কাছে রাখতে চান। বলেন, ছেলেকে এখন তাঁর কাছে না রাখলে তার কোনও সম্পত্তির উত্তরাধিকার লাভ করতে পারবে না সে। পঁতমার্সি তখন বাধ্য হয়ে ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ফুলের চাষ নিয়ে মেতে থাকে।

এরপর পঁতমার্সি রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের সব কিছু পরিত্যাগ করে। রাজ্যের কোনও ষড়যন্ত্র বা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি সে। সে শুধু তার অতীতের কৃতিত্বের কথা স্মরণ করে এক নির্দোষ নিরীহ জীবনযাপন করত।

জামাই-এর সঙ্গে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কোনও সম্পর্ক ছিল না। তাঁর কাছে জামাই হল এক দস্যু। আর জামাই-এর কাছে তার শ্বশুর ছিল এক নির্বোধ বৃদ্ধ। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার জামাই পঁতমার্সিকে কর্নেল বা ব্যারন বলে স্বীকার করতেন না। বরং তা নিয়ে উপহাস করতেন লোকের কাছে। তিনি জামাইকে আগেই বলে দিয়েছিলেন সে তার ছেলেকে দেখার জন্য কোনও দিন তার বাড়িতে আসতে পারবে না। যদি আসে তা হলে তার ছেলেকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন সঙ্গে সঙ্গে এবং উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন। ছেলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই রাখতে পারবে না সে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তার নাতিকে নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলঁতে চেয়েছিলেন।

এই ধরনের শর্ত মেনে নেওয়া হয়তো উচিত হয়নি পঁতমার্সির। কিন্তু ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু মেনে নেয় সে। সব দুঃখ সব অপমান নিজের মাথার উপর চাপিয়ে নেয় সে। অবশ্য মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের সম্পত্তির পরিমাণ খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু তাঁর বড় মেয়ে তার মা’র তরফ থেকে মোটা রকমের এক সম্পত্তি পায়। সে অবিবাহিতা, সুতরাং তার মৃত্যুর পর তার সব সম্পত্তি তার বোনের ছেলেই পাবে।

ছেলেটির নাম মেরিয়াস। মেরিয়াস জানত তার মা নেই, কিন্তু বাবা জীবিত আছে। তবে শুধু কানে এই কথাটাই শুনেছে। এর বেশি কিছু জানতে পারেনি। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ যে সব জায়গায় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান সেখানকার লোকেরা তার বাবার সম্বন্ধে যে সব উক্তি করে তাতে তার লজ্জা হয় বাবার কথা ভাবতে। তাকে দেখতে বা তার কথা জানতে আর ইচ্ছা হয় না।

এইভাবে বেড়ে ওঠে মেরিয়াস। দু-তিন মাস অন্তর একবার করে লুকিয়ে প্যারিসে যেত কর্নেল পঁতমার্সি। চোরের মতো লুকিয়ে নিজের ছেলেকে দেখতে যেত সে। সেন্ট আপ্রিসের চার্চে তার মাসির সঙ্গে যখন প্রার্থনাসভায় যেত মেরিয়াস তখন পঁতমার্সি চার্চের একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে থাকত ছেলেটাকে একবার শুধু চোখের দেখা দেখার জন্য। ম্যাদয়জেল গিলেনৰ্মাদ তাকে দেখে ফেলবে এই ভয়ে কাঁপত সে। যে জীবনে কত যুদ্ধ জয় করেছে, কত আঘাত কত আক্রমণের সামনে বুক পেতে দিয়েছে, সে আজ সামান্য এক নারীর ভয়ে ভীত।

এই অবস্থাতে ভার্নল শহরের ছোট গির্জার কুরে বা প্রধান যাজক আব্বে মেবুফে’র সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় পঁতমার্সির।

বন্ধুত্ব হওয়ার আগে মেবুফই প্রথম দেখেন পঁতমার্সিকে। সেন্ট সাপ্লিস চার্চের একজন কর্মচারী ছিল মেবুফে’র ভাই। সেই সূত্রে মাঝে মাঝে সেই চার্চে যেতেন মেবুফ। সেখানে তিনি একাধিকবার লক্ষ করেন চার্চের একটি থামের আড়াল থেকে একটি লোক কপালে এক ক্ষতচিহ্ন ও চোখে অশ্রুধারা নিয়ে একটি ছেলেকে লুকিয়ে দেখছে। মেবুফে’র ভাইও ব্যাপারটা লক্ষ করে আশ্চর্য হয়ে যায়। বলিষ্ঠ চেহারার একজন পুরুষ কেন মেয়েদের মতো চোখের জল ফেলছে, তা সে বুঝতে পারে না।

একদিন সেন্ট সাপ্লিস চার্চের সেই কর্মচারী ভার্নলে তার ভাই-এর কাছে বেড়াতে গিয়ে সেন নদীর পুল থেকে কর্নেল পঁতমার্সিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পেরে যায়। সে তার ভাইকে সঙ্গে নিয়ে কর্নেল পঁতমার্সির বাড়িতে চলে যায়। পঁতমার্সি প্রথমে কিছু বলতে চায়নি। পরে সে তার জীবনের সব কথা খুলে বলে তাদের কাছে। তখন মেবুফরা জানতে পারেন কিভাবে পঁতমার্সি শুধু তার ছেলের ভবিষ্যতের জন্য জীবনের সব সুখ ত্যাগ করেছে। এই কারণেই কুরে মেকুফ কর্নেলকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে থাকে সেদিন থেকে এবং মার্সিও সে শ্রদ্ধার প্রতিদান দিত। এইভাবে দুটি সৎ লোক অর্থাৎ একজন বয়োপ্রবীণ যাজক এবং একজন বয়োপ্রবীণ সৈনিক এক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। দু জনে দু জনকে গভীরভাবে বুঝতে পারে। একজন এই মর্ত্যভূমিতে দেশের সেবা করেছে, আর একজন স্বর্গে দেশের সেবা করে, অর্থাৎ দেশের জন্য স্বর্গলোকে প্রার্থনা জানায়। সুতরাং কোনও পার্থক্য নেই দু জনের মধ্যে।

শুধু সারা বছরের মধ্যে ছয় দিন মেরিয়াসকে তার বাবার কাছে দুটো চিঠি লেখার অনুমতি দেওয়া হত। একটা হল নববর্ষের দিন আর একটা হল সেন্ট জর্জের জন্মোৎসবের দিন। তার মাসি যা বলে দিত চিঠিতে তাই লিখত মেরিয়াস। সে চিঠির উত্তরে তার স্নেহ-ভালোবাসা জানিয়ে অনেক বড় চিঠি লিখত পঁতমার্সি। কিন্তু সে চিঠি তার ছেলের হাতে পৌঁছত না। সে চিঠি দুমড়ে-মুচড়ে তাঁর পকেটের মধ্যে ভরে রেখে দিতেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ।

.

২.

একমাত্র ব্যারনপত্নীর বাড়ি ছাড়া জগতের আর কোনও কিছুই জানে না বা চেনে না মেরিয়াস। বাইরের জগৎ ও জীবনের যা কিছু এই বাড়িটার মধ্যে দিয়েই সে দেখে। কিন্তু কেমন এক হিমশীতল বিষাদে সব সময় যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে বাড়িটা। এখানে আনন্দের থেকে নিরানন্দ ভাবটাই বেশি, উষ্ণতার থেকে শীতলতা বেশি, আলোর থেকে অন্ধকার বেশি।

মেরিয়াস এ বাড়িতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার মুখের সব হাসি, মনের সব খুশি মিলিয়ে যায়।

পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে সে-ও বদলে যায়। সে বাড়িতে যত সব বর্ষীয়ান অভিজাত পুরুষ আর বর্ষীয়সী মহিলাদের দেখত আর তাদের যত সব বাতিকগ্রস্ত আচরণের পরিচয় পেয়ে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেত মেরিয়াস। যে সব বর্ষীয়সী মহিলা ব্যারনপত্নীর বাড়িতে আসত তারা হল মাদাম নো, নেভি অব ক্যাম্বিস। তারা যে ঘরে আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসত সে ঘরটা এক সবুজ বাতির আলোর দ্বারা আলোকিত থাকত। উপস্থিত পুরুষ ও মহিলাদের মাথাভরা সাদা চুল, ঘরের মিটমিটে আলো, বিগত যুগের পোশাক, তাদের গম্ভীর কণ্ঠস্বর এবং দুর্বোধ্য কথাবার্তা এক অদ্ভুত ভাব জাগাত মেরিয়াসের মনে। তার মনে হত এরা যেন মহিলা নয়, প্রাচীন যুগের পিতামহী এবং ডাইনি। মনে হত তারা জীবন্ত মানুষ নয়, মানুষের প্রেমূর্তি।

কিন্তু এইসব প্রেমূর্তির মাঝে কিছুসংখ্যক যাজক ও সামন্তকে দেখা যেত। তাঁদের মধ্যে ছিলেন মার্কুই দ্য সাসেনে, বেরির ডিউকপত্নীর সেক্রেটারি, ভিকোঁতে দ্য ভ্যালেরয় যিনি চার্লস আঁতোনের ছদ্মনামে কিছু ছন্দোবদ্ধ প্রশস্তিমূলক কবিতা প্রকাশিত করেন, প্রিন্স দ্য বোফ্রেমত যার চুলগুলো সাদা হয়ে উঠলেও শক্তিতে যুবক এবং যার সুন্দরী স্ত্রী লাল মখমলের পোশাক পরে আসত, মার্কুই দ্য কোরিওলিস, কোঁত দ্য আমেন্দ্রে আর ছিলেন পোর্ত দ্য গি।

মঁসিয়ে পোর্ত দ্য গিকে সবচেয়ে বেশি বয়সের বলে মনে হত। তিনি শুধু ১৭৯৩ সালের স্মৃতিকথা বলতে ভালোবাসতেন। ওই বছর তিনি বিপ্লবীদের বিপক্ষে যুদ্ধ করার অভিযোগে ধরা পড়েন এবং তিনি কারারুদ্ধ হন। সেখানে গিয়ে দেখেন মিরেপয়ের অশীতিপর বৃদ্ধ বিশপকেও ধরে এনে আটক রাখা হয়েছে। সেটা হল তুলঁ’র কারাগার। তাঁদের সেখানে কাজ ছিল ফাঁসির মঞ্চে সারাদিন গিলোটিনে যাদের মাথা কাটা যেত তাদের কাটা দেহ ও মুণ্ডগুলো সন্ধ্যার পর সরিয়ে এক জায়গায় ফেলে দেওয়া। তারা পিঠে করে মৃতদেহগুলো বয়ে নিয়ে যেত। তাদের লাল জামাগুলোতে চাপ চাপ রক্ত লেগে যেত। রাত্রিতে যে জামাগুলো ভিজে যেত, সকাল হতেই সেগুলো শুকিয়ে যেত। এই ধরনের কাহিনী কথিত হত ব্যারনপত্নীর বাড়িতে।

যাজকদের মধ্যে প্রথমে নাম করতে হয় আব্বে হানসার। এছাড়া ছিলেন পোপের লোক মাননীয় মাচি এবং দু জন কার্ডিনাল মঁসিয়ে দ্য লা লুজার্নে আর ক্লারমত ডনারে। কার্ডিনাল লুজার্নে পরে লেখক হিসেবে নাম করেছিলেন এবং লে কনজারভেতিউর-এ নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। মঁসিয়ে ক্লারমত তুলুদের আর্কবিশপ ছিলেন, কিন্তু প্যারিসে নিয়মিত বেড়াতে আসতেন। তিনি লাল মোজা পরতেন এবং বিলিয়ার্ড খেলায় খুব ঝোঁক ছিল তার। তাকে ব্যারনপত্নীর বাড়িতে প্রথম নিয়ে এসে পরিচয় করিয়ে দেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু সেনলিসের বিশপ মঁসিয়ে দ্য রোকেনর যাঁর চেহারাটা খুব লম্বা ছিল এবং যিনি একাডেমি ফ্রাসোয়ার সদস্য হিসেবে প্রচুর খাটতেন। এইসব যাজক চার্চের লোক হলেও আসলে ছিলেন কেতাদুরস্ত সভাসদ এবং তাদের উপস্থিতি ব্যারনপত্নীর বাড়ির আবহাওয়াটাকে একটা আভিজাত্য দান করত। এছাড়া ফ্রান্সের পাঁচজন পিয়ার বা লর্ড ছিলেন। তথাপি সে যুগে বিপ্লবের প্রভাব সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় সামন্তদের এই সভায় একজন মধ্যবিত্ত সমাজের লোক উপস্থিত থাকতেন। তিনি মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ।

ব্যারনপত্নীর বাড়িতে যারা আসত তারা ছিলেন প্যারিস সমাজের শ্বেত প্রতিক্রিয়াশীলদের সার অংশ। তবে সেকালের রাজতন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত নামকরা লোকদের যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা হত। যেমন শ্যাতোব্রিয়াদ ব্যারনপত্নীর বাড়িতে ঢুকলে সবাই তাকে সন্দেহের চোখে দেখত। তা সত্ত্বেও যে সব রাজতন্ত্রী প্রজাতন্ত্রকে মেনে নেন তাঁদের বাছাই করে এই সভায় প্রবেশাধিকার দেওয়া হত। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কেঁতে বোগলৎ, যিনি সম্রাটের আমলে উচ্চ পদে আসীন ছিলেন।

বর্তমানে অভিজাত বাড়িগুলোর সে চেহারা আর নেই। আজকের দিনে রাজতন্ত্রীরা গণতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে।

ব্যারনপত্নীর কাছে বেশি বয়স বা কম বয়সের যে সব লোক আসত তারা সবাই মৃতবৎ। বাড়িটার মতোই নির্জীব। সেকেলে যেসব বৃদ্ধ এ বাড়িতে সভায় আসত তাদের ভুত্যগুলোও ছিল তাদের মতোই নির্জীব। তাদের দেখে মনে হত তারা যেন অনেক কাল আগে বেঁচে ছিল, এখন আর বেঁচে নেই এবং জোর করে মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাদের সম্বন্ধে শুধু একটা কথাই খাটে, তারা রক্ষণশীল। প্রভুরা যেমন প্রাণহীন পাথর দিয়ে তৈরি মনে হত, তেমনি তাদের ভত্যরা যেন ছিল খড়ের মানুষ। একজন বয়স্ক মহিলা বিদেশে বেড়াতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে এসে একটার বেশি ভৃত্য রাখতে পারত না। কিন্তু বাইরে কথায় কথায় সে বলত আমার লোকরা।

১৮১৪ থেকে ১৮২০ সাল পর্যন্ত এই ছয় বছরের মধ্যে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনা সব ঘটে যায়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়টা অদ্ভুত ধরনের। এ সময়টা একদিকে প্রাণচঞ্চলতায় ভরা, আবার অন্যদিকে মৃত্যুর মতো হিমশীতল। একদিকে অন্ধকার, ছায়াচ্ছন্ন, আবার অন্যদিকে এক নতুন প্রভাতের আলোকরশ্মির দ্বারা উদ্ভাসিত। আলো-ছায়ায় মেশানো সে এক অদ্ভুত জগৎ, যা ছিল একই সঙ্গে নবীন এবং প্রাচীন, বিপ্ন এবং হর্ষোফুলু, যৌবনসমৃদ্ধ এবং বার্ধক্যজর্জরিত। তারা রাগের সঙ্গে ফ্রান্সকে দেখত, অতীতের ফ্রান্সকে বিদ্রুপাত্মক ভঙ্গিতে দেখত। সে ফ্রান্সে মার্কুই এবং অভিজাত শ্রেণির লোকেরা রাস্তায় ভূতের মতো ঘুরে বেড়ায়। যারা বিদেশ থেকে এসে রাজতন্ত্রের অবসান দেখে তারা হতাশ হয়ে চোখের জল ফেলতে তাকে। তারা দেখে পুরনো জগতের সবকিছুই যেন এক বিরাট বন্যায় সর্বগ্রাসী প্লাবনে ভেসে গেছে। এ বন্যা ভাবাদর্শের বন্যা। এই বন্যা কত তাড়াতাড়ি পুরনো সবকিছুকে ডুবিয়ে দেয়, ভাসিয়ে নিয়ে যায়, আবার কত তাড়াতাড়ি নতুন অনেক কিছুকে সৃষ্টি করে।

ব্যারনপত্নীর বাড়িতে যারা আসত তারা এইসব কথা ভাবত। মঁসিয়ে মার্তেনভিলে ছিলেন ভলতেয়ারের থেকে রসিক এবং তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন। তারা রাজনীতি আর সাহিত্য দুটোই আলোচনা করত, যে সব লেখকের নাম আজ লোকে ভুলে গেছে তারা তখন তাদের কথা আলোচনা করত। দেশের রাজনৈতিক অবস্থার ওপরেও মন্তব্য করত। তারা বলত নেপোলিয়ন ছিলেন কর্সিকার এক নরখাদক, রাজার সেনাদলে লেফটেন্যান্ট জেনারেলের কাজ করতে করতে রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে অবতরণ করে বিরাট শক্তির অধিকারী হয়ে ওঠেন।

কিন্তু ১৮১৮ সালের মধ্যে রাজতন্ত্রবাদীরা তাদের চিন্তা ও বিশ্বাসের শুচিতা কাটিয়ে ফেলে। অনেক তাত্ত্বিক এসে ঢুকে পড়ে তাদের দলে। তারা নীতিগতভাবে রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী হলেও মুখে তা স্বীকার করতে লজ্জা পেত। আবার গোঁড়া নীতিবাদীরা প্রকাশ্যে তাদের মতবাদের কথা ঘোষণা করত।

তারা বলত, রাজতন্ত্রের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। এই রাজতন্ত্র আমাদের অনেক সেবা করেছে। এই রাজতন্ত্র আমাদের পুরনো প্রথা ও রাজনীতি, ধর্ম, শ্রদ্ধাভক্তি, আত্মসম্মান সবকিছুকে প্রতিষ্ঠা দান করেছে নতুন করে। রাজতন্ত্র মানুষকে আনুগত্য, বীরত্ব, ভালোবাসা, ভক্তি প্রভৃতি দান করে। রাজতন্ত্র রাজার মহত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জাতির মহত্ত্বকে তুলে ধরে। তবে রাজতন্ত্রের একটা ভুল, তা বিপ্লবের তাৎপর্যকে বুঝতে ভুল করে। বিপ্লব নতুন যুগের যে নতুন ভাবধারা নিয়ে এক নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি করে, রাজতন্ত্র তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু রাজতন্ত্র যেমন বিপ্লবের উত্তরাধিকারী এবং যারা এই মতবাদে বিশ্বাসী, সেই আমাদেরও আরও সহানুভূতিশীল হওয়া উচিত ছিল রাজতন্ত্রের প্রতি। বোঝা উচিত ছিল, যে বিপ্লব রাজতন্ত্রের ওপর আঘাত হানে সে বিপ্লব তার উদারনীতিবাদের পরিচয় দিতে পারেনি। একে যদি বিপ্লবীরা উদারনীতি বলে তা হলে সেটা হবে ধ্বংসাত্মক উদারনীতিবাদ। বিপ্লবী ফ্রান্স ঐতিহাসিক ফ্রান্সকে অশ্রদ্ধা করে অর্থাৎ সে যেন তার মাকেই অশ্রদ্ধা করে। আমরা যেমন আজ তাদের পতাকার মর্ম বুঝতে পারি না, বিপ্লবীরাও ঈগলচিহ্নিত পতাকার মর্ম বুঝতে পারেনি।

এইভাবে রাজতন্ত্রবাদী তাত্ত্বিকের দল রাজতন্ত্রের সমালোচনা করত এবং একই সঙ্গে তার গুণগান করত।

ব্যারনপত্নীর বাড়িতে অভিজাত সম্প্রদায়ের পুরুষ ও মহিলাদের যে সভা বসত তার বর্ণনা প্রসঙ্গে অধুনালুপ্ত এক সমাজের ছবি তুলে ধরা হল। এই বর্ণনায় কারও প্রতি তিক্ততা বা বিদ্রূপ প্রদর্শন করা হয়নি। ফ্রান্সের এক অতীত যুগ ও সমাজের প্রতিভূ ছিল যেন অভিজাতদের সেই সভাটা। তাদের আমরা ঠিক শ্রদ্ধা করতে না পারলেও ঘৃণা করা কোনও মতেই উচিত নয়।

পঁতমার্সির ছেলে মেরিয়াস প্রথমে স্কুল থেকে তার বাল্যশিক্ষা লাভ করে। প্রথম প্রথম তার মাসি তাকে বাড়িতে পড়াত। পরে সে বড় হয়ে উঠলে তার দাদামশাই মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ একজন গৃহশিক্ষক নিযুক্ত করেন। এই গৃহশিক্ষকও ছিলেন চিরায়ত ভাবধারার মানুষ এবং নিজের জ্ঞানবিদ্যা সম্পর্কে আত্মাভিমান ছিল তাঁর প্রচুর। এইভাবে মেরিয়াস পঁতমার্সি। স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া পড়তে থাকে সে। পরে সে আইন পাস করে। সে-ও হয়ে ওঠে এক গোঁড়া রাজতন্ত্রী। কিন্তু তার মা-বাবার প্রতি কোনও শ্রদ্ধা বা সহানুভুতি ছিল না। চপলতা ও উন্নাসিক ভাব মোটেই ভালো লাগত না তার। সে ছিল একই সঙ্গে উদার, উচ্চমনা, অহঙ্কারী, ধর্মপ্রবণ, আবেগপ্রবণ, আপোসহীন ও একদিক দিয়ে মনুষ্যবিদ্বেষী ও অসামাজিক।

.

৪.

মেরিয়াসের পড়াশুনো শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ ফবুর্গ সেন্ট জার্মেনকে বিদায় জানিয়ে তাঁর র‍্যু দ্য ফিলের বাড়িতে চলে আসেন। তখন তার কাছে দু জন ভূত ছিল –একজন নারী আর একজন পুরুষ ভৃত্য। নারীভৃত্যের নাম নিকোলেত্তে আর পুরুষ ভৃত্যের নাম বাস্ক।

১৮২৭ সালে মেরিয়াসের বয়স যখন ছিল সতেরো তখন একদিন সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফিরে দেখে দাদামশাই একটা চিঠি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মেরিয়াস কাছে এলে তিনি তাকে বললেন, মেরিয়াস, তোমাকে কাল ভার্নলে যেতে হবে।

মেরিয়াসের দেহটা কিছুটা কেঁপে উঠল। মেরিয়াস বুঝতে পারল তার বাবার কাছে তাকে যেতেই হবে। এ কাজ তার কাছে শুধু অপ্রত্যাশিত ও বিস্ময়কর নয়, অস্বস্তিকরও বটে। এইভাবে তার বাবার সঙ্গে পুরনো বিচ্ছেদের অবসান ঘটবে এটা সে ভাবতেই পারেনি। মেরিয়াসের মনে বরাবর এই ধারণা দানা বেঁধেছিল যে তার প্রতি তার বাবার কোনও স্নেহ-মমতা নেই। তাই তার বাবার প্রতিও কোনও ভক্তি-ভালোবাসা জাগেনি তার মনে। তার বাবা যদি প্রথম থেকে তাকে দেখত তা হলে কেন তাকে অপরের কাছে। থাকতে হবে?

কথাটা শুনে বিস্ময়ে এত অভিভূত হয়ে পড়ল মেরিয়াস যে সে আর কোনও প্রশ্ন করল না মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদকে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, মনে হয় সে অসুস্থ। সে তোমাকে দেখতে চায়। আবার দু জনেই চুপচাপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তোমাকে খুব সকালে উঠতে হবে। আমি জানি কুর দে ফঁতেন যাবার একটা গাড়ি ছাড়ে সকাল ছটায় এবং সেখানে সন্ধ্যার সময় পৌঁছায়। তোমাকে সেই গাড়িটা ধরতে হবে। সে চিঠিতে লিখেছে, তোমাকে যেতেই হবে।

চিঠিটা মুচড়ে পকেটের মধ্যে রেখে দিলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। মেরিয়াস ইচ্ছা করলে সেই রাতেই রওনা হয়ে পরদিন সকালে তার বাবার কাছে পৌঁছতে পারত। কারণ সেই রাতেই একটা গাড়ি ছাড়ে এবং সেটা ভার্নল শহরের পাশ দিয়ে যায়। কিন্তু সে গাড়ি সম্বন্ধে সে বা মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ কোনও কথা বলল না। কোনও খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করল না।

পরদিন সন্ধ্যার সময় ভাল শহরে পৌঁছল মেরিয়াস। গাড়ি থেকে নেমেই যাকে সামনে পেল মঁসিয়ে পঁতমার্সির বাড়িটা কোথায় তা জিজ্ঞাসা করল। তার বাবার নামের আগে কর্নেল বা ব্যারন কিছু বলল না।

বাড়িতে পৌঁছে দরজার ঘণ্টা বাজাতেই বাতি হাতে একজন মহিলা দরজা খুলে দিল।

মেরিয়াস তাকে বলল, এটা কি পঁতমার্সির বাড়ি?

কোনও কথা না বলে মহিলা মেরিয়াসের দিকে তাকাল।

মেরিয়াস আবার বলল, এখানে তিনি থাকেন?

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল মহিলা।

মেরিয়াস বলল, আমি তাঁর পুত্র। আমার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি।

মহিলা বলল, আর অপেক্ষা করছেন না।

মেরিয়াস দেখল মহিলার চোখে জল।

মহিলা নীরবে একটা ঘরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেখাল। মেরিয়াস সে ঘরে ঢুকে গেল। গিয়ে দেখল ঘরের মধ্যে তিনজন লোক রয়েছে। ঘরের মধ্যে একটা বাতি জ্বলছে। তিনজন লোকের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে আছে, একজন নতজানু হয়ে বসে আছে আর একজন মেঝের উপর শায়িত আছে। প্রথম দু জন হল ডাক্তার আর যাজক; তৃতীয় ব্যক্তি হল কর্নেল পঁতমার্সি।

তিন দিন আগে মস্তিষ্কের জ্বরে আক্রান্ত হয় পঁতমার্সি। রোগের গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরে সে তার ছেলেকে পাঠাবার জন্য মঁসিয়ে গিলেনর্মাদকে চিঠি লেখে। অবস্থা তার ক্রমশই খারাপের দিকে যেতে থাকে এবং আজ সন্ধ্যায় প্রলাপ বকতে বকতে হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে পড়ে। বাড়িতে যে মহিলাটি থাকত সে তাকে থামাতে বা আটকে রাখতে পারেনি। পঁতমার্সি শুধু বলছিল, আমার ছেলের আসতে দেরি হচ্ছে। আমাকে তার কাছে যেতে হবে।

যেতে গিয়ে পাশের ঘরে পড়ে যায় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। ডাক্তার আর যাজককে ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু তাদের দু জনেরই আসতে দেরি হয়। বাতির স্বল্প আলোয় পঁতমার্সির গালে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জলের একটা রেখা দেখতে পাওয়া যায়। যে চোখ থেকে সে জল গড়িয়ে পড়ে সে চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। তার ছেলের আসতে দেরি হওয়ার জন্যই এ জল বেরিয়ে আসে তার চোখ থেকে। চোখ বন্ধ হলেও সে জল শুকোয়নি।

মেঝের উপর মৃত লোকটিকে জীবনে প্রথম এবং শেষবারের মতো দেখছে মেরিয়াস। গম্ভীর বীর পুরুষের মতো মুখ, মাথায় সাদা চুল, যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত দেহ। যে মুখের ওপর ঈশ্বরদত্ত দয়ার ছাপ ফুটে আছে, সেই মুখেই বীরত্বের চিহ্নস্বরূপ এক ক্ষতের দাগ। মেরিয়াস ভাবতে লাগল, এই ব্যক্তিই তার পিতা, এবং এখন সে মৃত। তবু সে বিচলিত হল না কিছুমাত্র। অন্য যে কোনও মৃত ব্যক্তির জন্য যে দুঃখ সে অনুভব করে তার বেশি কোনও দুঃখ সে অনুভব করল না।

তথাপি শোকবিলাপের এক বেদনায় ভরে উঠল সমস্ত ঘরখানা। বাড়ির মহিলাটি ঘরের এক কোণে বসে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। যাজক নতজানু হয়ে প্রার্থনা করছিলেন মৃতের জন্য। ডাক্তারের চোখেও জল এসেছিল। তিনি চোখ মুছছিলেন। মৃতের চোখের জল তখনও শুকোয়নি।

ঘরের উপস্থিত সকলে মেরিয়াসের দিকে তাকাল। তারা কেউ তাকে চেনে না। নিজের মধ্যে কোনও শোকানুভূতি না জাগায় লজ্জাবোধ করছিল মেরিয়াস। তার টুপি হাতে ধরা ছিল। সেটা সে মেঝের উপর ফেলে দিল। যেন মনে হল সেটা ধরে রাখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে শোকের চাপে। পরে সে তার জন্য নিজেকেই দোষ দিতে লাগল মনে মনে। ভাবল সে যদি তার বাবাকে ভালো না বাসতে পারে তা হলে সেটা কি তার দোষ?

কর্নেল পঁতমার্সি কিছুই রেখে যেতে পারেনি। বাড়িতে যা জিনিসপত্র আছে তা বিক্রি করে শুধু অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার খরচ চলবে। পঁতমার্সি একটা কাগজে কী লিখে রেখে যায় মৃত্যুর আগে। কাগজটা মেরিয়াসের হাতে দেওয়া হল। লেখাটা কর্নেল পঁতমার্সির নিজের হাতে। এটা সে তার ছেলের উদ্দেশ্যে লিখে যায়। তাতে লেখা ছিল :

আমার ছেলের জন্য। ওয়াটারলুর যুদ্ধক্ষেত্রে সম্রাট আমাকে ব্যারন উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু যে উপাধি আমি দেহের রক্তের বিনিময়ে লাভ করি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত রাজতন্ত্র তা আমাকে দান করতে অস্বীকার করে। সে উপাধি আমার পুত্র ধারণ ও বহন করবে। আশা করি সে তার যোগ্য হয়ে উঠবে।

ওয়াটারলুর যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শেষ হবার পর একজন সার্জেন্ট আমার জীবন রক্ষা করে। তার নাম ছিল থেনার্দিয়ের। আমার মনে হয় বর্তমানে সে প্যারিসের অদূরে শেলেস বা মঁতফারমেল গাঁয়ে একটা হোটেল চালায়। আমার ছেলে যদি তাকে কখনও খুঁজে পায় তা হলে যথাশক্তি সে সেবা করবে তার।

পিতার প্রতি কর্তব্যবোধের খাতিরে নয়, মৃতের শেষ ইচ্ছার প্রতি সাধারণ মানুষের এক অন্ধ শ্রদ্ধার বশবর্তী হয়ে কাগজটা রেখে দিল মেরিয়াস।

পঁতমার্সির মৃত্যুর পর তার কোনও কিছুই আর অবশিষ্ট রইল না। তার তরবারি আর সামরিক পোশাক পুরনো জিনিস কেনাবেচার এক দোকানে কম দরে বিক্রি করে দিলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ।

মেরিয়াস ভার্নলে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টা ছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হবার সঙ্গেই সঙ্গেই সে প্যারিসে ফিরে আসে। তখন সে আইন পড়ছিল। সে আবার পড়াশোনায় মন দিল। তার বাবার জীবদ্দশাতে যেমন সে তার কথা ভাবেনি তেমনি তার মৃত্যুর পরেও তার কথা কিছুই ভাবল না।

মেরিয়াস শুধু কিছুদিনের জন্য মাথার টুপির উপর একটা কালো ব্যান্ড এটে রাখল। এই হল তার পিতার প্রতি শেষ কর্তব্য।

.

৫.

মেরিয়াসের ধর্মীয় আচার-আচরণগুলো তার বাল্যকাল থেকেই গড়ে ওঠে। সে নিয়মিত সেন্ট সাপ্লিসের ছোট চাৰ্চটায় সমবেত প্রার্থনাসভায় যোগদান করতে যেত। সাধারণত সে তার মাসির পাশে বসত। কিন্তু একদিন অন্যমনস্কতার জন্য একটা থামের পাশে বসে পড়ে। থামটার গাঁয়ে একটা জায়গায় লেখা ছিল, মঁসিয়ে মেবুফ।

প্রার্থনাসভা শুরু হতে না হতেই একজন বৃদ্ধ এসে মেরিয়াসের কাছে এসে বলল, মঁসিয়ে, এটা আমার জায়গা।

মেরিয়াস সরে গেল তাড়াতাড়ি। বৃদ্ধ মেবুফ সেখানে বসল।

মেবুফ বলল, আপনার সময় নষ্ট ও বিরক্ত করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন মঁসিয়ে। আপনি হয়তো আমাকে অভদ্র ভাববেন। অবশ্য এর কারণ আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলব।

মেরিয়াস বলল, তার দরকার হবে না।

মেবুফ বলল, হ্যাঁ, কারণ আছে। আমার সম্বন্ধে কারও মনে কোনও ভুল ধারণা থাকুক, এটা আমি চাই না। আমি আপনাকে বলব কেন আমি এই বিশেষ জায়গাটাতে বসি। বেশ কয়েক বছর আগে দু তিন মাস অন্তর এই জায়গাটাতে একজন বিষাদগ্রস্ত পিতাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। সে ছেলেকে এখান থেকে লুকিয়ে দেখত, কারণ পারিবারিক বিরোধের কারণে এ ছাড়া তার ছেলেকে দেখার জন্য কোনও সুযোগ ছিল না। যখন তার ছেলে চার্চের প্রার্থনাসভায় যোগদান করতে আসত ঠিক সেই সময়ে আসত সে। ছেলেটি জানত না যে তার বাবা এত কাছে আছে তার। আসলে সে তার বাবাকে চিনতই না, বাবা এই থামের আড়ালে লুকিয়ে চোখে জল নিয়ে তার ছেলের পানে তাকিয়ে থাকত। সে তার ছেলেকে গভীরভাবে ভালোবাসত। আমি সে দৃশ্য না দেখে পারতাম না। সেই থেকে এ জায়গাটা পবিত্র হয়ে আছে আমার কাছে। আমার বসার জন্য আলাদা বেঞ্চ থাকা সত্ত্বেও এই জায়গায় বসেই আমি প্রার্থনা শুনি।

আমি সেই বিষাদগ্রস্ত দুঃখী মানুষটির সঙ্গে পরে পরিচিত হই। তার শ্বশুর এবং ছেলেটির এক ধনী মাসি তাকে এই বলে সতর্ক করে দেয় যে, সে তার ছেলের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখলে বা ছেলেকে দেখতে গেলে তাদের সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে ছেলেটিকে বঞ্চিত করবে তারা। এই কারণে অর্থাৎ ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই নিজে সব ব্যথা সব দুঃখ বরণ করে নিয়ে ছেলের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করে। রাজনীতিই হল পারিবারিক বিচ্ছেদের কারণ। অবশ্য সব লোকেরই একটা করে রাজনৈতিক মতামত থাকবে। কিন্তু তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা উচিত নয়। একটা লোক ওয়াটারলুর যুদ্ধে যোগদান করেছে বলেই সে রাক্ষস হয়ে গেল! একজন পিতাকে তার পুত্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করার এটা কখনও একটা সংগত কারণ হতে পারে না। ভদ্রলোক ছিলেন বোনাপার্টের অধীনস্থ এক কর্নেল। সম্প্রতি মারা গেছেন। তিনি ভার্নলে বাস করতেন। সেখানে আমার ভাই গির্জার প্রধানের পদে আছেন। তার কপালে তরবারির আঘাতজনিত এক ক্ষতচিহ্ন ছিল। তার নামটা আমি ভুলে গেছি। পতমেরি অথবা মতপারসি।

মেরিয়াসের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। সে বলল, তাঁর নাম হল পঁতমার্সি।

হ্যাঁ, এটাই তার নাম। তুমি কি তাকে চিনতে?

মেরিয়াস বলল, তিনিই আমার পিতা।

মেবুফ বলল, ওহ, তুমিই তা হলে তাঁর ছেলে! এখন বড় হয়ে উঠেছ। তোমার বাবা সত্যিই তোমাকে বড় ভালোবাসতেন।

সভাশেষে যাবার সময় মেবুফের হাত ধরে তার বাসা পর্যন্ত গেল মেরিয়াস। পরের দিন সে তার মাতামহের কাছে গিয়ে বলল, কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমি শিকারে যাব ভাবছি। আপনি কি তিন দিনের জন্য সেখানে যাবার অনুমতি দেবেন?

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তিন কেন, চার দিনের জন্য যেতে পার। ভালো করে আনন্দ কর।

এরপর তাঁর বড় মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি জোর করে বলতে পারি, ও নিশ্চয় কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছে।

.

৬.

মেরিয়াস কোথায় গিয়েছিল পরে আমরা জানতে পারব। তিন দিন পরে সে প্যারিসে ফিরে এসেই সোজা চলে যায় আইন কলেজের লাইব্রেরিতে। সেখানে সে মন্ত্রিউল পত্রিকার সংখ্যাগুলো একের পর এক পড়ে যেতে থাকে।

সেখানে মন্ত্রিউল-এর একটি সংখ্যায় প্রকাশিত প্রজাতন্ত্র ও সম্রাট নেপোলিয়নের আমলের ফরাসি দেশের ইতিহাস পড়তে থাকে। তাতে ছিল সেন্ট হেলেনার স্মৃতিকথা, কিছু জীবনী, সংলাপ, সরকারি বিজ্ঞপ্তি ঘোষণা প্রভৃতি অনেক তথ্য। এঁদ আর্মি বুলেটিনের এক জায়গায় তার বাবার নাম দেখতে পেয়ে আবেগে উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। এই উত্তেজনাটা এক সপ্তা ধরে তার মনের মধ্যে ছিল। সে সেইসব সেনাপতির সঙ্গে একে একে দেখা করল, যাদের অধীনে তার বাবা সৈনিক হিসেবে কাজ করেছে। সে মেবুফের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলল এবং তার কাছ থেকে তার বাবার জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পারল। তার ফুলবাগানের কথা, নির্জন জীবনযাপনের কথা সব জেনে নিল। অবশেষে সে তার বাবার জীবন ও চরিত্রের একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি এঁকে ফেলল। বুঝল তার বাবা ছিল এমনই একটা আশ্চর্য মানুষ যার মধ্যে ছিল সিংহ আর মেষশাবকের এক অদ্ভুত সমন্বয়।

অবসর সময়ে মেরিয়াস যখন এইসব নিয়ে ব্যস্ত থাকত বেশ কিছুদিন ধরে তখন তার মাতামহ ও মাসির সঙ্গে প্রয়ে দেখাই হত না। সে শুধু খাবার সময় একবার করে বাড়িতে আসত। কিন্তু অন্য সময় তাকে দেখাই যেত না।

তার মাসি এতে দুঃখ পেত। কিন্তু মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বলতেন, মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার এই হল সময়। আমি বেশ বলতে পারি এই জন্যই ও আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছে। বড় রকমের এক প্রেমে পড়েছে নিশ্চয়।

এ সত্যিই এক প্রেম।

মেরিয়াস তখন তার বাবাকে জীবনে প্রথম ভালোবাসতে শুরু করেছে। সেই সঙ্গে তার আজন্মলালিত ভাবধারারও পরিবর্তন শুরু হল।

বর্তমান কালের ইতিহাস পড়ে যে ভাব তার মনে জাগল তা হল এক চরম বিস্ময়ের ভাব।

এতদিন পর্যন্ত প্রজাতন্ত্র আর সাম্রাজ্যতন্ত্রের নাম শুনলে আঁতকে উঠত ভয়ে। ও দুটো নাম যেন আস্ত দুটো কুলক্ষণ। প্রজাতন্ত্র মানেই সন্ধ্যার গিলোটিন আর সম্রাট বা সাম্রাজ্য মানেই রাত্রির তরবারি। কিন্তু যখন এ দুটোর ইতিহাস ভালোভাবে পড়ে দেখল তখন সে এক বিরাট বিস্ময়ের সঙ্গে বুঝতে পারল একদিন যাকে সে এক অশুভ রাত্রির নিপাট নিচ্ছিদ্র অন্ধকার বলে জেনে এসেছে, সে রাত্রির অন্ধকারেও অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র আছে।

যেমন মিরাবো ভার্গনিয়াদ, সেন্ট জাস্ট, রোবোসপিয়ার, ক্যামিলে, দাঁতন এবং নেপোলিয়নের মতো সূর্যের উদয়। এইসব নক্ষত্রের উজ্জ্বলতায় নিজেকে ম্লান মনে করে পিছিয়ে আসে সে। কিন্তু বিস্ময়ের ঘোরটা কাটলে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে সংহত করে এবং মন থেকে ঘৃণার ভাবটাকে অপসারিত করে ঘটনাগুলো সে যদি গভীরভাবে তলিয়ে দেখে, এইসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিশিষ্ট ব্যক্তিদের আগের থেকে একটু কম ভয় করে তা হলে দেখতে পারে সব ঘটনাগুলো দুটি প্রধান ভুলে পরিণত হয়। প্রজাতন্ত্র হল জনগণকে প্রদত্ত নাগরিক অধিকারের প্রতীক এবং সাম্রাজ্য হল সমগ্র ইউরোপের ওপর আরোপিত ফরাসি ভাবধারা, আদর্শ ও জাতীয় প্রভুত্বের প্রতীক। বিপ্লব থেকে বেরিয়ে আসে জনগণের এক উজ্জ্বল মূর্তি আর সাম্রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসে ফরাসি জাতীয় গৌরব।

এই উদ্‌ঘাটিত মন কিভাবে ধীরে ধীরে উন্নত হয় তা আমরা দেখাবার চেষ্টা করছি। উন্নতি কখনও রাতারাতি হয় না। মেরিয়াস দেখল, এতদিন সে যেমন তার বাবাকে বুঝতে পারেনি, তেমনি সে তার দেশকেও বুঝতে পারেনি। সে কাউকে চিনতে পারেনি, সে যেন ইচ্ছা করে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। এখন তার চোখ খুলে গেছে এবং এখন সে তার দেশের গুণগান করছে এবং ভক্তিভরে তার বাবাকে বরণ করে নিচ্ছে।

আজ সে এই ভেবে দুঃখে অভিভূত হয়ে উঠল যে আজ তার মৃত বাবা ছাড়া তার মনের গভীর গোপন কথাগুলো বলার দ্বিতীয় কোনও লোক নেই। ঈশ্বর যদি দয়া করে কোনওক্রমে তার বাবাকে বাঁচিয়ে দেন তা হলে সে দারুণ আগ্রহের সঙ্গে তার কাছে ছুটে গিয়ে চিৎকার করে বলত, বাবা, আমি এসেছি, আমি তোমার সন্তান। তোমার চিন্তা আমার চিন্তা এক। তার বাবাও তা হলে কত স্নেহভরে তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করত। ছেলের ভালোবাসা না পেয়েই এত কম বয়সে কেন মারা গেল তার বাবা? মেরিয়াস যখন প্রথম জীবনের গুরুত্ব বুঝতে পারল, যখন সে তার জীবনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য খাড়া করে তুলঁল, যখন তার চিন্তাশক্তি দানা বেঁধে উঠল এবং তার ধর্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়ে উঠল তখনি এক নিদারুণ দুঃখে তার অন্তরটা চমকে উঠতে লাগল। এক নতুন আলোয় প্লাবিত হয়ে উঠল তার সমগ্র মনোভূমি। এক নতুন সত্তা জেগে উঠতে লাগল যেন তার মধ্যে। তার পিতা এবং স্বদেশকে নতুন করে চিনতে পারার সঙ্গে সে যেন নবজন্ম লাভ করল।

যে সব বস্তু বা ব্যক্তিকে একদিন সে ঘৃণা করেছিল আজ তা যেন এক নতুন অর্থে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল তার কাছে। আজ সে ঐশ্বরিক ও মানবিক বিধানের অর্থ বুঝতে পারল এবং সে সব মহাপুরুষকে একদিন সে ঘৃণার চোখে দেখত এবং উপহাস করে উড়িয়ে দিত, তাঁদের গুরুত্ব সম্বন্ধে এক পরিষ্কার ধারণা লাভ করল।

তার বাবার সঙ্গে সঙ্গে নেপোলিয়নকেও নতুনভাবে দেখতে শুরু করল। কিন্তু তার মনের মধ্যে নেপালিয়নের এই পুনর্বাসনের কাজটা কিন্তু সহজে হয়নি।

তার শৈশব ও বাল্যের চিন্তা ১৮১৪ সালে যারা তার চারপাশে ছিল তাদের দ্বারাই গড়ে ওঠে। রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে ফ্রান্সের প্রায় সকলেই কথায় কথায় নেপোলিয়নের প্রতি এক তীব্র ঘৃণা এবং অশ্রদ্ধা প্রকাশ করত। সে যুগে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যেন ছিলেন রূপকথার এক ভয়ঙ্কর রাক্ষস। অনেকে তাকে ভয় করত এবং অনেকে আবার উপহাস করত। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন ভয় আর উপহাসের বস্তু। বোনাপার্টের নাম উল্লেখ করে কেউ রাগে দাঁত কড়মড় করতে পারত আবার এক অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেও পারত। কিন্তু সে যা-ই করুক তার ভিত্তিমূলে ছিল ঘৃণা। নেপোলিয়ন সম্বন্ধে তার মনে সঠিক ধারণা না থাকায় আর পাঁচজনের দেখাদেখি মেরিয়াসও ঘৃণা করতে থাকে তাকে।

কিন্তু সম্প্রতি দেশের সমকালীন ইতিহাস পড়ে এবং সামরিক নথিপত্র ঘেঁটে সে সঠিক জ্ঞান লাভ করল। দুর্বোধ্যতার যে কুয়াশা নেপোলিয়নকে ঢেকে রেখেছিল তার সামনে আজ সে কুয়াশা সরে যেতেই সে বেশ বুঝতে পারল নেপোলিয়নকে ভুল বুঝেছিল সে। তার চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা ক্রমশই স্পষ্টতা ও পূর্ণতা লাভ করতে লাগল। ক্রমশ অন্ধকার থেকে উজ্জ্বল আলোর রাজ্যে উঠে গেল সে।

একদিন সন্ধ্যাবেলায় তার উপরতলার ঘরে জানালার ধারে বসে বাতির আলোয় পড়ছিল। তার সামনে জানালাটা ভোলা ছিল। পড়ছিল আর ভাবছিল সে। অনন্ত প্রসারিত অন্ধকার হতে অসংখ্য চিন্তা আকাশের অজস্র তারার মতোই ভিড় করে আসছিল তার মনে। সে তখন পড়ছিল এঁদ আর্মির বিবরণ।

যুদ্ধক্ষেত্রে লেখা সেই মহাকাব্যিক বিবরণে প্রায়ই ম্রাটের নামের সঙ্গে তার পিতার নামোল্লেখ দেখতে পায় সে। সহসা সাম্রাজ্যের সমস্ত গৌরব উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যেন তার সামনে। এক ভাবের জোয়ার খেলে যায় যেন তার মধ্যে। মাঝে মাঝে তার মনে হচ্ছিল তার পিতার আত্মা যেন তার খুব কাছে এসে পড়েছে। সে তার পিতার কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছে কানে। সেই সঙ্গে সে যুদ্ধের বাদ্যধ্বনি, কামানের গর্জন, সৈনিকদের পদধ্বনি এবং অশ্বের ক্ষুরের শব্দ সব শুনতে পেল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে সে দেখল বিরাট নক্ষত্রমণ্ডল অন্ধকার অনন্ত আকাশের গভীরে কিরণ দান করছে। আর তার সামনে খোলা বই-এর মধ্যে শব্দগুলো জীবন্ত ঘটনার রূপ ধারণ করেছে। তার অন্তরটা এক অব্যক্ত অনির্দেশ্য বেদনায় মোচড় হয়ে উঠল। এক নতুন সত্যের উপলব্ধিতে আত্মহারা এবং রুদ্ধশ্বাস হয়ে উঠল সে। সহসা কেন বা কোন প্রবৃত্তির তাড়নায় সে জানে না, উঠে দাঁড়িয়ে জানালায় ঝুঁকে হাত দুটো বাইরে প্রসারিত করে অনন্ত আকাশের পানে তাকিয়ে আবেগের সঙ্গে বলে উঠল, সম্রাট দীর্ঘজীবী হোন!

সেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত থেকে কর্সিকার সেই নরখাদক রাক্ষস, সেই তথাকথিত অত্যাচারী নেপোলিয়ন অদৃশ্য হয়ে গিয়ে তার জায়গায় মহান সিজারের এক দূরধিগম্য উচ্চতায় অত্যুজ্জ্বল ভাস্বরতায় দীপ্যমান হয়ে উঠল। তার পিতার কাছে নেপোলিয়ন ছিলেন এক সাধারণ সেনানায়ক, যার অধীনে সে সৈনিকের কাজ করত। কিন্তু মেরিয়াসের কাছে নেপোলিয়ন অনেক বড়। মেরিয়াসের নেপোলিয়ন হলেন সেই দুর্জয় ফরাসি শক্তির প্রতিষ্ঠাতা যে শক্তি ছিল অপ্রতিরোধ্য রোমক শক্তির সমতুল্য এবং সে শক্তি ছিল সমগ্র পৃথিবীর ওপর এক অবিসংবাদিত প্রভুত্ব বিস্তারে তৎপর। নেপোলিয়ন ছিলেন এক জাতীয় পতনের বিরাট রূপকার, তিনি ছিলেন একাদশ লুই, রিচলু, চতুর্দশ লুই, বিপ্লবী কমিটির উত্তরাধিকারী। যেহেতু তিনি ছিলেন রক্তমাংসের মানুষ সেইহেতু তার কিছু দোষ, কিছু দুর্বলতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিল, কিছু অপরাধও হয়তো করেছিলেন; তথাপি তিনি তাঁর পতনের মাঝেও ছিলেন রাজকীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত, ত্রুটি-বিচ্যুতির কালিমার মাঝেও মহত্ত্বে ভাস্বর এবং অপরাধের মাঝেও দুর্দমনীয়ভাবে শক্তিমান। তিনি ছিলেন এমনই এক ভাগ্যবিধাতা যিনি সব জাতিকে একটি জাতির প্রভুত্বকে মেনে নিতে বাধ্য করেন। তিনি ছিলেন গৌরবোজ্জ্বল ফ্রান্সের মূর্ত প্রতীক, যিনি তরবারির দ্বারা সমগ্র ইউরোপ এবং তার প্রতিভার বিচ্ছুরিত আলো দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে জয় করেন। মেরিয়াসের চোখে বোনাপার্ট হলেন প্রজাতন্ত্র হতে উদ্ভূত এক স্বৈরাচারী, বিপ্লবের মূর্তিমান সারাংশ। তার মনে নেপোলিয়ন একাধারে মানুষের মতো মানুষ এবং জনগণ, যিশু ছিলেন একই সঙ্গে মানব এবং দেবতা।

ধর্মান্তরিত মানুষ যেমন নতুন ধর্মগ্রহণের মত্ততায় অনেক দূর এগিয়ে যায় তেমনি মেরিয়াসও অনেক দূর এগিয়ে গেল। সে বুঝতে পারল নেপোলিয়নের প্রতিভার পুজো করতে গিয়ে প্রকারান্তরে সে শক্তিরই উপাসনা করে ফেলেছে। বুঝতে পারেনি সে তার উপাস্য ব্যক্তির দুটি দিক দেবভাব ও পশুভাবের সঙ্গে জড়িত করে ফেলেছে নিজেকে। সে যেন সত্যের অনুসরণ করতে গিয়ে মিথ্যার গহ্বরে পড়ে গেছে। একদিন যে রাজতন্ত্রের পতনের অশ্রুপাত করেছিল আর পাঁচজনের সঙ্গে আজ সেই প্রজাতন্ত্রের পতনের মাঝে দেখল ফরাসি জাতির এক নতুন অভ্যুদয়। একদিন যাকে সূর্যাস্ত ভেবেছিল আজ বুঝল সেটা সূর্যোদয়।

তার মধ্যে যখন এত সব তীব্র আলোড়ন চলছিল, তখন তার বাড়ির লোক কিন্তু কিছুই বুঝতে পারেনি এ বিষয়ে। সে যখন বুর্বন ও জ্যাকোবাইনদের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে, রাজতন্ত্রীদের সঙ্গে সব সংস্রব ত্যাগ করে গণতন্ত্ৰীবাদী ও পুরোপুরিভাবে বিপ্লবী হয়ে ওঠে তখন একদিন কোয়ে দে অরফেভারে গিয়ে একশো কার্ড ছাপিয়ে আনে। সেই কার্ডের উপর ‘লে ব্যারন মেরিয়াস পঁতমার্সি’, এই নামটা মুদ্রিত ছিল। তার যে বিরাট পরিবর্তন এসেছিল, তার মৃত পিতার প্রতি আসক্তির ফলে যে মানসিক রূপান্তর এসেছিল তার মধ্যে এই কার্ড তারই ফলশ্রুতি। কিন্তু সে কার্ডগুলো সে নিজের পকেটের মধ্যেই রেখেছিল।

সে পিতার দিকে যতই ঝুঁকে পড়ছিল ততই সে তার মাতামহের কাছ থেকে দূরে সরে পড়ছিল। আমরা আগেই বলেছি তার প্রতি মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মনোভাব ক্রমশই কঠোর হয়ে উঠেছিল। চিন্তাশীল এক যুবক ও চপলমতি এক বৃদ্ধের মধ্যে ফারাকটা ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল। মেরিয়াস আর মাতামহ যেন একটি সেতুর উপর দাঁড়িয়েছিল দু জনে। সেতুটা হঠাৎ ভেঙে যেতেই দু জনে নদীর দু পারে চলে যায়। অনতিক্রম্য হয় ওঠে দু জনের ব্যবধান। তার মাতামহের প্রতি মেরিয়াসের রাগের কারণ হল এই যে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ পিতাকে পুত্রের কাছ থেকে এবং পুত্রকে পিতার কাছ থেকে নির্মমভাবে ছিনিয়ে নিয়ে পৃথক করে রেখেছিলেন। পিতার প্রতি নবজাগ্রত শ্রদ্ধাবশত সে বৃদ্ধ মাতামহকে ঘৃণা করতে শুরু করে।

কারও কাছে তার এই ঘৃণা প্রকাশ করেনি সে। সে শুধু কথা কম বলত, বাড়িতে কম থাকত। খাবার সময়ও বিশেষ কোনও কথা বলত না। তার মাসি একদিন যখন এ বিষয়ে প্রশ্ন করে তখন সে পড়া আর পরীক্ষার কথা বলে এড়িয়ে যায়।

তার মাতামহ সেই একই কথা বলে, ছেলেটা প্রেমে পড়েছে। তার উপসর্গ আমি বুঝতে পারছি।

তার মাসি বলত, কিন্তু কোথায় যায় ও?

এই সময় একদিন তার বাবার শেষ ইচ্ছা পূরণ করার জন্য মঁতফারমেলে গিয়ে থেনার্দিয়েরের খোঁজ করে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে হোটেলটি উঠে গেছে। হোটেল তুলে দিয়ে থেনার্দিয়ের কোথায় গেছে তা কেউ বলতে পারল না। যাই হোক, সেখানে খোঁজখবর নিতে চার দিন কেটে গেল মেরিয়াসের।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ সেই এক কথা বলতে লাগলেন, ছেলেটা এখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

তাঁদের ধারণা মেরিয়াস তার বুকের মাঝে এমন একটা কথা লুকিয়ে রেখেছে, যে কথা সে কারও কাছে প্রকাশ করতে পারছে না।

.

৭.

একজন অশ্বারোহী বিভাগের অফিসারের কথা আগেই বলা হয়েছে। সে ছিল মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের ভাইপো’র ছেলে। তার নাম ছিল লেফটেন্যান্ট থিওদুল গিলেনৰ্মাদ। সে প্যারিসে খুব কমই আসত; এত কম আসত যে মেরিয়াস তাকে কখনও দেখেনি। ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদও থিওদুলকে দেখেনি ভালো করে। কিন্তু ভালো করে না দেখলে বা তার কোনও কথা না শুনলেও তাকে সে ভালোবাসত। তাকে আদর্শ পুরুষ বলে মনে করত।

একদিন সকালে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ উত্তেজিত অবস্থায় তার নিজের ঘরে চলে গেল। মেরিয়াস আবার বাইরে যাবার জন্য অনুমতি চেয়েছে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের কাছ থেকে। তার কথা শুনে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, সে আগের থেকে আরও খারাপ হয়ে গেছে।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ সিঁড়িতে যেতে যেতে বলল, এটা কিন্তু সত্যিই বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোথায় যায় ও?

সে ভেবেছিল মেরিয়াস নিশ্চয় কোনও অবৈধ প্রেমের নায়ক। সে ঠিক তার প্রেমিকার সঙ্গে কোনও গোপন সংকেতস্থানে দেখা করতে চলেছে।

যাই হোক, তার মন থেকে এই উত্তেজনাটা কমাবার জন্য সে তার সূচিশিল্পের কাজ নিয়ে বসল। সে বেশ কিছুক্ষণ ধরে কাজ করেছে এমন সময় হঠাৎ দরজার সামনে এসে দাঁড়াল থিওদুল।

থিওদুলের মতো একজন বীরপুরুষকে তার ঘরের সামনে দেখে আনন্দে চিৎকার করে উঠল সে। বলল, থিওদুল তুমি!

হ্যাঁ, আমি এসেছি পিসি। এইদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।

ঠিক আছে, এখানে এসে আমাকে চুম্বন কর।

থিওদুল তাই করল।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ তার লেখার টেবিলের কাছে চলে গেল। বলল, অন্তত সপ্তাখানেক থাকবে তো?

হায়, আমাকে আজ সন্ধ্যাতেই চলে যেতে হবে।

না না, তা কখনই হতে পারে না।

কোনও উপায় নেই।

আর একটু বেশি সময় থাক থিওদুল।

আমার অন্তর থাকতে চাইছে, কিন্তু কর্তব্য থাকতে দিচ্ছে না।

আমার আসলে মেবুন থেকে ফাঁলোতে যচ্ছিলাম। যাবার পথে প্যারিসে থামতে হল। তাই ভাবলাম একবার পিসির সঙ্গে দেখা করে যাই।

এতে শুধু তোমার কষ্ট হল।

এই বলে দশ লুই-এর একটা মুদ্রা তার হাতে গুঁজে দিল।

কষ্ট নয়, আনন্দও পেলাম।

থিওদুল আবার চুম্বন করল তার পিসিকে।

তার সামরিক পোশাকের চাপে তার পিসির বুকটাতে যেন আঁচড় কেটে গেল। এতে তার পিসি আনন্দ অনুভব করছিল।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ বলল, তুমি কি অশ্বারোহী সেনাদলের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলে?

থিওদুল বলল, আমি আমার চাকরের কাছে ঘোড়াটাকে দিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ঘোড়ার গাড়িতে এসেছি এবং তাতেই ফিরে যাব। একটা কথা তোমায় জিজ্ঞাসা করছি।

বল।

আমার মনে হয় মেরিয়াস পঁতমার্সিও ওই একই গাড়িতে যাবে।

কৌতূহলী হয়ে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ বলল, কী করে জানলে?

আমি আমার আসন সংরক্ষণ করতে গিয়ে দেখি তালিকায় তার নাম রয়েছে।

তার পিসি বলল, ছেলেটা বড় বদমায়েস। সে তোমার মতো ভদ্র নয়। তা হলে সে। গাড়িতেই রাত কাটাবে?

আমাকেও তাই করতে হবে।

কিন্তু তোমাকে কর্তব্যের খাতিরে এটা করতে হবে আর সে উচ্ছল জীবনযাপনের জন্য এটা করবে।

থিওদুল বলল, হা ভগবান!

এমন সময় ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের মাথায় একটা পরিকল্পনা খেলে গেল। সে বলল, আচ্ছা ও তো তোমায় চেনে না। তাই নয় কি?

আমি ওকে চিনি, কিন্তু ও বোধ হয় আমাকে চেনে না। আমার সঙ্গে কোনওদিন কথা বলেনি।

তোমরা দু জনে একই গাড়িতে যাবে?

হ্যাঁ, সে গাড়ির উপরে বসবে আর আমি ভেতরে।

ও কোথায় যাবে?

আঁদেলিসে।

মেরিয়াস কি ওখানেই যাচ্ছে?

অবশ্য পথে মাঝখানে কোথাও নেমে পড়বে কি না জানি না। আমাকে ভালে নেমে গাড়ি পাল্টাতে হবে। ওর গন্তব্যস্থল কোথায় তা আমি ঠিক জানি না।

মেরিয়াস নামটাই বাজে। তোমার নামটা কত ভালো, থিওদুল।

থিওদুল বলল, আমার নামটা আলফ্রেড হলে ভালো হত।

যাই হোক, আমার একটা কথা শোন থিওদুল। বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

বল পিসি।

কথাটা হল এই যে, মেরিয়াস বাড়ি থেকে প্রায়ই চলে যায়।

তাই নাকি?

সে কোথাও প্রায়ই যায়। এক একবার কয়েক রাত বাড়ি ফেরে না।

তাই নাকি?

আমরা জানতে চাই কী করেছে ও, কোথায় যাচ্ছে।

অভিজ্ঞ সৈনিকের মতো শান্তভাবে বলল, উড়তে শিখেছে।

তার পর হাসতে হাসতে বলল, নিশ্চয় কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়েছে।

‘মেয়ে’ এই কথাটা শুনে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদের মনে হলো তার বাবাই যেন কথাগুলো বলছে। এ কথায় তার মনের বিশ্বাসটাও দৃঢ় হয়ে উঠল। সে বলল, একটা কাজ তোমায় করতে হবে। মেরিয়াস কোথায় যায় তা দেখতে হবে তোমায়। সে তোমাকে চেনে না; সুতরাং কোনও অসুবিধা হবে না। যদি কোনও মেয়েকে দেখ তা হলে তাকে ভালো করে দেখবে এবং আমাদের চিঠি দিয়ে জানাবে। আমরা এ ব্যাপারে খুব আগ্রহী।

এ ধরনের কাজে থিওদুলের কোনও মত ছিল না। কিন্তু তার পিসি তাকে দশ লুই-এর একটা মুদ্রা দেওয়ায় সে তৎপরতা দেখায় এ কাজে। এ ছাড়া আরও দিতে পারে পরে। সে বলল, ঠিক আছে। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।

তার পিসি তাকে আলিঙ্গন করল। তার পর বলল, তুমি কখনও এই বাড়ি থেকে পালাতে পার না যখন-তখন। তোমার শৃঙ্খলাবোধ ও কর্তব্যবোধ আছে। কোনও নির্লজ্জ কাজের জন্য তুমি যখন-তখন বাড়ি ছেড়ে যাবে না।

থিওদুল সততার হাসি হাসল।

সেদিন সন্ধ্যায় মেরিয়াস যখন ঘোড়ার গাড়িতে চেপে রওনা হল তখন সে বুঝতে পারল না তাকে একজন লক্ষ করছে। এদিকে থিওদুল কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে লাগল। পরদিন সকালে ভার্নলে গাড়ি থামতেই গার্ড থিওদুলকে গাড়ি পাল্টাবার কথা মনে করিয়ে দিল। ভার্নলে নামার পর থিওদুলের মনে পড়ে গেল মেরিয়াসের কথাটা। কিন্তু কথাটা মনে করতে হাসি পেল তার।

তার মনে হল মেরিয়াস অনেক আগেই নেমে গেছে। কী ছাইপাস চিঠি দিয়ে জানাব?

এমন সময় সে দেখল গাড়ির উপর থেকে কালো পায়জামা পরে মেরিয়াস নামছে।

এক চাষি মেয়ে একঝুড়ি ফুল বিক্রি করছিল। মেরিয়াস বড় একগোছা ফুল কিনল।

থিওদুল ভাবল, মেরিয়াস যে মেয়েটার প্রেমে পড়েছে সে নিশ্চয় খুব সুন্দরী। মেয়েটাকে একবার দেখতে হবে আমায়।

তার পিসিকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির জন্য নয়, কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই এ কথা ভাবল সে।

মেরিয়াস একবার থিওদুলের দিকে তাকালও না। দু তিনজন সুন্দরী সুসজ্জিতা মেয়ে নামল গাড়ি থেকে। সেদিকেও তাকাল না মেরিয়াস। কোনও দিকে খেয়াল নেই তার।

থিওদুল ভাবল, ও নিশ্চয় প্রেমে পড়েছে।

মেরিয়াস ভার্নল শহরের চার্চের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।

থিওদুল ভাবল, ভালো কথা। চার্চই হল আজকাল প্রেম করার জায়গা।

সে দেখল, মেরিয়াস চার্চের ভেতরে না গিয়ে উঠোনের ঘাসে ঢাকা একটা দিকে এগিয়ে চলল। তার পর ঘাসের উপর কালো কাঠের একটা ক্রসের সামনে নতজানু হয়ে বসে হাতের ফুলের গোছাটা নামিয়ে রাখল। হাতের মধ্যে মুখ ঢেকে প্রার্থনা করতে লাগল সে।

থিওদুল দেখল সেই কালো ক্রসের উপর সাদা অক্ষরে লেখা আছে কর্নেল ব্যারন পঁতমার্সি।

তা হলে ওর প্রেমিকা হল একটা কবর।

.

৮.

এক কবরের কাছেই প্যারিস থেকে বারবার আসে মেরিয়াস। আর তার মাতামহ বলে সে যাচ্ছে তার প্রেমিকার কাছে।

ব্যাপারটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেল লেফটন্যান্ট থিওদুল। একজন মৃত ব্যক্তি আর একজন মৃত কর্নেলের প্রতি তার দ্বিগুণীকৃত শ্রদ্ধার এক অনুভূতি সে বিশ্লেষণ করে বোঝাতে পারবে না।

থিওদুল সেখান থেকে শ্রদ্ধাবনত মস্তকে চলে গেল। সে ঠিক করল কোনও কথা সে তার পিসিকে জানাবে না চিঠিতে।

এদিকে তিন দিন পর একদিন সকালে বাড়ি ফিরল মেরিয়াস। দুটো রাত গাড়িতে যাওয়া-আসা করায় ঘুম হয়নি তার। সে সোজা তার নিজের ঘরে গিয়ে তার উপরকার কোট আর জামার উপর যে ফিতেটা ব্যবহার করত সেটা খুলে স্নান করতে চলে গেল।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদও সেদিন খুব সকালেই উঠেছিলেন। তিনি মেরিয়াসের আসার শব্দ পেয়ে সোজা তার ঘরে চলে যান। ভাবলেন, তিনি তাকে আলিঙ্গন করে কিছু কথা বার করে নেবেন। কিন্তু মেরিয়াসের ঘরে গিয়ে তিনি দেখলেন মেরিয়াস আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। দেখলেন বিছানার উপর তার কোট আর ফিতেটা নামানো রয়েছে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, তবু ভালো।

সেই কোট আর ফিতেটা নিয়ে সোজা বসার ঘরে চলে গেলেন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ। যেখানে তাঁর মেয়ে সূচিশিল্পের কাজ করছিল। তিনি মেয়েকে বললেন, জয় আমাদের হবেই। এবার আমরা রহস্য ভেদ করবই। ওর সব চতুরালি ধরে ফেলব। মেয়েটার ছবি আছে এই ফিতেটার সঙ্গে।

ফিতেটার সঙ্গে মেডেলের মতো দেখতে ছবি রাখার একটা খাপ ছিল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, এর মধ্যে নিশ্চয় কোনও মেয়ের ছবি আছে। ছেলের রুচিটা খুব খারাপ হয়ে গেছে।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ বললেন, খোল বাবা। খুলে দেখ কী আছে।

খাপটা খুলে দেখা গেল তার মধ্যে একটা ভাজকরা কাগজ রয়েছে। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বললেন, সেই পুরনো কাহিনী, নিশ্চয় এটা একটা প্রেমপত্র।

কিন্তু কাগজটা খুলে দেখা গেল কর্নেল পঁতমার্সির লেখা একটি চিঠি, যাতে সে তার ছেলেকে তার শেষ কথা জানায়।

চিঠিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে কোনও মৃত লোকের পাশে থাকাকালে কোনও মানুষ যেমন এক হিমশীতল অনুভূতির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ওদের অবস্থাও তেমনি হল। মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বলে উঠলেন, এটা হচ্ছে সেই ডাকাতটার হাতের লেখা।

ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ সেই কাগজটা আবার ভাঁজ করে প্যাকেটটার মধ্যে রেখে দিল। এমন সময় মেরিয়াসের কোটের পকেট থেকে কতকগুলি ছাপা কার্ড পড়ে গেল। ওরা পড়ে দেখল, তাতে লেখা আছে, লে ব্যারন মেরিয়াস পঁতমার্সি।

বৃদ্ধ গিলেনৰ্মাদ ঘণ্টা বাজিয়ে নিকোলেত্তেকে ডাকলেন। সে এলে বললেন, এইগুলো রেখে দিয়ে এস।

অবশেষে ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ বলল, চমঙ্কার।

মেরিয়াস স্নান সেরে ঘরে এসে ঢুকতেই মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ বিদ্রুপাত্মক কণ্ঠে বললেন, বেশ বেশ। তা হলে তুমি হচ্ছ একজন ব্যারন। আমি কি জানতে পারি এর মানে কী?

মেরিয়াস কিছুটা লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠল। সে বলল, এর মানে এই যে আমি আমার পিতার পুত্র।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের মুখ থেকে সব হাসি মিলিয়ে গেল। তিনি কড়া কর্কশ গলায় বললেন, আমি তোমার পিতা।

মেরিয়াস মুখটা নামিয়ে বলল, আমার পিতা একজন সামান্য সৈনিক হলেও তিনি বীরত্বের সঙ্গে প্রজাতন্ত্র ও ফ্রান্সের সেবা করেন এবং দেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে গৌরবের সঙ্গে উল্লিখিত আছে। তিনি দীর্ঘ পঁচিশ বছর ধরে বৃষ্টিতে, বরফে, কাদায়, জলে, কামানের সামনে বুক পেতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি শত্রুপক্ষের দুটো পতাকা দখল করেন, কুড়িবার আহত হন, অথচ সম্পূর্ণ বিস্মৃত ও অবহেলিত অবস্থায় মারা যান। তার শুধু একটামাত্র দোষ ছিল। দেশ আর আমি এই দুই অকৃতজ্ঞকে সমস্ত অন্তর দিয়ে ভালোবাসতেন। অন্তর উজাড় করে সব কিছু বিলিয়ে দেন তাদের জন্য।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ আর সহ্য করতে পারছিলেন না। প্রজাতন্ত্র’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বসে থাকতে থাকতে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তিনি লাফিয়ে উঠলেন। মেরিয়াসের প্রতিটি কথার আঘাতে ব্যথাহত হয়ে উঠছিলেন। তাঁর মুখের রংটা ধূসর থেকে গোলাপি এবং ক্রমে গোলাপি থেকে আগুনের মতো লাল হয়ে উঠল। তিনি গর্জন করে উঠলেন, ঘৃণ্য অর্বাচীন কোথাকার। আমি তোমার পিতার কথা কিছু জানি না, আর জানতে চাইও না। তবে এইটুকু জানি যে ওই ধরনের লোকরা সব শয়তান, দস্যু, ডাকাত, খুনি। তাদের সবাই তাই। কোনও ব্যতিক্রম নেই। তুমি যদি ব্যারন হও তা হলে আমার চটি জোড়াটার থেকে তার দাম বেশি নয়। যেসব লোক রোবোসপিয়ারের সেবা করে তারা ছিল শয়তান আর যেসব লোক বোনাপার্টের সেবা করে তারা ছিল জুয়োচোর। যারা তাদের বৈধ রাজার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, যারা ওয়াটারলু যুদ্ধ থেকে ইংরেজ ও প্রুশীয়দের ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল তারা কাপুরুষ, তারা দুবৃত্ত। আমি শুধু এইটুকু জানি। তোমার পিতা যদি তাদেরই একজন হয় তা হলে খুবই দুঃখের ব্যাপার। তা হলে আমার করার কিছু নেই।

মেরিয়াস রাগে কাঁপতে থাকে। তার সমস্ত ইন্দ্রিয়চেতনা ওলটপালট হয়ে যাচ্ছিল। কোনও যাজক যদি দেখে তার উপাস্যবস্তুকে কেউ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে অথবা কোনও সন্ন্যাসী যদি দেখে তার বিগ্রহ মূর্তির উপর কেউ থুতু ফেলেছে তা হলে তার যেমন অবস্থা হয় তেমনি মেরিয়াসেরও হল। এটা সহ্য করতে পারা যায় না। কিন্তু সে কী করবে? তার পিতা অপমানিত হয়েছে তার সামনে, কিন্তু এক্ষেত্রে অপমানকারী হচ্ছে তার মাতামহ। সে তার মাতামহকে অপমান করে যেমন প্রতিশোধ নিতে পারে না তেমনি পিতার ওপর চাপিয়ে দেওয়া এই অপমানের বোঝও সে সহ্য করতে পারে না। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকার পর সে চিৎকার করে বলে উঠল, বুর্বনদের সঙ্গে মোটা শুয়োর অষ্টাদশ লুই নিপাত যাক!

অষ্টাদশ লুই চার বছর আগেই মারা গেছে।

মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ উঠে ঘরের এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত দর্পিত পদভরে পায়চারি করতে লাগলেন। যেন মনে হল পাথরের এক ভারী মূর্তি হেঁটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর তিনি তাঁর মেয়ের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে বললেন, এই ভদ্রলোকের মতো একজন ব্যারন এবং আমার মতো একজন বুর্জোয়া কখনই এক বাড়িতে থাকতে পারে না।

তার পর প্রচণ্ড রাগের চাপে কপালটাকে ফুলিয়ে মেরিয়াসের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, বেরিয়ে যাও।

মেরিয়াস সেইদিনই বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।

পরদিন মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদ তাঁর মেয়েকে বললেন, ছয় মাস অন্তর কিছু করে ওই রক্তচোষাটাকে পাঠিয়ে দেবে। কিন্তু আমার কাছে তার নাম কখনও করবে না।

মেডেলের মতো যে খাপটাতে কর্নেলের নিজের হাতে লেখা চিঠিটা ছিল সেই খাপটা নিকোলেত্তের হাত থেকে কোথায় পড়ে যায়। সে মঁসিয়ে গিলেনৰ্মাদের হুকুমে মেরিয়াসের মালপত্র সব গুছিয়ে দিচ্ছিল। মেরিয়াস সেটা না পেয়ে ভাবল তার মাতামহ ইচ্ছা করে তার বাবার হাতের লেখা চিঠিটা নষ্ট করে দিয়েছে।

মেরিয়াস বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় সে কোথায় যাচ্ছে তা বলে গেল না। সে কোথায় যাচ্ছে তা সে নিজেই জানে না। তার কাছে তখন শুধু তিরিশ ফ্র, একটা হাতঘড়ি আর কিছু পোশাক ছিল। একটা ব্যাগে ভরে এইসব কিছু নিয়ে সে চলে গেল। সে একটা গাড়ি ভাড়া করে ড্রাইভারকে লাতিন কোয়ার্টারের দিকে যেতে বলল।

এরপর মেরিয়াসের কী হবে?

D0ne page 450 চতুর্থ পরিচ্ছেদ

১.

আপাতশান্ত আপাত উদাসীন যুগটার অন্তরালে একটা ক্ষীণ বিপ্লবের হাওয়া বইছিল। যেন অতীত ‘৮৯ ও ‘৯২ সালের ভেতর থেকে একটা করে দমকা হাওয়া উঠে এসে নিস্তরঙ্গ বাতাসটাতে ঢেউ খেলে যাচ্ছিল। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভাবধারার পরিবর্তন হচ্ছিল। সবাই এগিয়ে যেতে চাইছিল, অগ্রগতির মোহে মেতে উঠছিল সবাই। রাজতন্ত্রীরা উদারনীতিবাদী হয়ে উঠছিল। আবার উদারনীতিবাদীরা গণতন্ত্রবাদী হয়ে উঠছিল।

নেপোলিয়নের নামের সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার জয়গান গাইছিল সবাই। ইতিহাসের এমনই একটা যুগের কথা বলছি আমরা, যে যুগ যেন একটা মরীচিৎকার পেছনে ছুটে চলেছিল। ভলতেয়ারপন্থী রাজতন্ত্র আর বোনাপার্টপন্থী উদারনীতিবাদ মিলে মিশে যেন এক হয়ে গিয়েছিল।

এছাড়া আরও কিছু মতবাদ ছিল। একদল লোক মৌল নীতির খোঁজ করত আর একদল চাইত আইনের অনুশাসন। তবে বেশির ভাগ লোক এমন এক সর্বাত্মক তত্ত্বে বিশ্বাস করত যে তত্ত্ব তাদের মনকে উর্ধ্বে আকর্ষণ করবে। সে তত্ত্ব অলীক অবাস্তব হলেও তাতে কোনও ক্ষতি ছিল না, কারণ আজ যা অলীক এবং অবাস্তব, আগামীকাল তা-ই হয়ে উঠবে রক্তমাংসের মানুষের মতো জীবন্ত।

পরিবর্তনের যে প্রবল হাওয়া বইছিল তাতে পুরনো প্রতিষ্ঠিত সমাজব্যবস্থার ভিত্তি কেঁপে উঠছিল। সে ব্যবস্থায় কেউ আস্থা স্থাপন করতে পারছিল না। পরিবর্তনের হাওয়ায় ছিল বিপ্লবের পূর্বাভাস। জনগণের উচ্চাভিলাষের সঙ্গে রাষ্ট্রনেতাদের ক্ষমতাদ্বন্দ্বের এক অঘোষিত লড়াই চলছিল। জার্মানির তুগেনবাদ বা ইতালির কার্বোনারির মতো কোনও বড় প্রতিষ্ঠান তখন ফ্রান্সে ছিল না। এইতে তখন কুর্দ এবং প্যারিসে এলিসি নামে এক সংস্থা গড়ে উঠছিল সবেমাত্র।

আপাতদৃষ্টিতে এলিসি সংস্থার উদ্দেশ্য ছিল শিশুশিক্ষার বিস্তার। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিল জনগণের আত্মোন্নতি।

এলিসি অক্ষর তিনটি হল ‘অ্যাবাইসি’ এই ফরাসি শব্দের অপভ্রংশ, যার অর্থ হল সাধারণ জনগণ। সমাজে রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে জনগণের প্রতিষ্ঠা চাই।

এলিসি প্রতিষ্ঠান হিসেবে খুব একটা বড় ছিল না, তার সদস্যসংখ্যা বেশি ছিল না। আসলে সেটা ছিল এক রাজনৈতিক চক্রান্তের গোপন সংস্থা। প্যারিসের মধ্যে দুটো জায়গায় তার সদস্যরা মিলিত হত। একটা ছিল লে হ্যাঁনের কাছে কোরিনথের পানশালায় আর একটা জায়গা ছিল প্লে সেন্ট মাইকেল অঞ্চলে মুর্সে নামে একটা ছোট কাফেতে। প্রথম জায়গাটাতে সংস্থার শ্রমিক সদস্যরা মিলিত হত আর দ্বিতীয়টাতে মিলিত হত ছাত্রেরা।

এলিসি সোসাইটির আলোচনাসভা বসত কাফে মুসের পেছন দিকের একটা ঘরে। আসল কাফে থেকে সেই ঘরটার মাঝখানে একটা রাস্তা ছিল। ঘরটার মধ্যে দুটো জানালা আর একটা দরজা ছিল। সেখানে সদস্যরা প্রায়ই এসে মদ খেত আর ধূমপান করত। তারা জোর হাসাহাসি করত এবং সাধারণ বিষয়ে জোর গলায় কথা বলত। কিন্তু তাদের প্রয়োজনীয় কোনও বিষয়ে নিচু গলায় কথা বলত। একদিকের দেয়ালে প্রজাতন্ত্রের আমলের ফ্রান্সের একটা মানচিত্র টাঙানো ছিল।

এলিসি সংস্থার বেশির ভাগ সদস্য ছিল ছাত্র। এইসব ছাত্রের সঙ্গে যেসব শ্রমিকের যোগাযোগ ছিল সেইসব শ্রমিক এই সংস্থার সদস্য হত। পরে এইসব সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন ইতিহাসে স্থান পায়। এরা হল এঁজোলরাস, বেফারে, জাঁ প্রুভেয়ার, কুলি, কুরফেরাক, বাহেরেল, ল্যাগলে, জলি আর গ্রান্তেয়ার। এরা সবাই ছিল বয়সে যুবক। এরা সবাই মিলে যেন একটি পরিবার গঠন করে। তারা বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়। ল্যাগলে ছাড়া তারা সবাই মিদি থেকে আসে।

আমরা প্রথমেই তো এঁজোলরাসের নাম করেছি। তার একটা কারণও আছে। সে ছিল ধনী পিতামাতার একমাত্র সন্তান। দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি অন্যদিকে ত্রাসের বস্তু। একাধারে ভীষণ সুন্দর এই ছেলেটি ছিল যেন দুর্ধর্ষ অ্যান্টিনোয়াস। তার মুখখানাকে সব সময় চিন্তায় গম্ভীর দেখাত। তাকে দেখে মনে হত সে যেন বিপ্লবে অনেক পরিশ্রম করেছে। মনে হত সে যেন বিপ্লবের প্রতিটি ঘটনার কথা জানে। সেই বিরাট বিপ্লবের সব ঢেউ যেন তার রক্তের মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। সে ছিল সত্যিই এক অদ্ভুত যুবক যাকে দেখে একই সঙ্গে চিন্তাশীল পণ্ডিত ও বীর যোদ্ধা বলে মনে হত। একাধারে সে ছিল যেন গণতন্ত্রের সৈনিক আর ধর্মের যাজক, যিনি সমকালীন সব আন্দোলন প্রতি-আন্দোলনের ঊর্ধ্বে। তার ছিল দুটো বড় বড় চোখ, নিজের ঠোঁটটা থাকত সব সময় ঘৃণায় কুঞ্চিত, আর ছিল প্রশস্ত ললাট, যা ছিল দিগন্তের উপর শোভিত উদার আকাশের মতোই প্রশান্ত। সে ছিল এমনই একজন যুবক যার গায়ের চামড়া আর মুখখানা মেয়েদের মতো ম্লান হলেও মনে-প্রাণে সে ছিল অত্যুৎসাহী আর অতিপ্রাণচঞ্চল। তার বয়স বাইশ হলেও তাকে সতেরো বছরের এক কিশোর বলে মনে হত। নারী সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল খুবই কঠোর এবং পৃথিবীতে কোনও নারীর অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনও চেতনাই ছিল না। তার একমাত্র আসক্তি ছিল শুধু ন্যায়পরায়ণতার প্রতি, যতসব বাধা-বিপত্তিকে জয় করাই ছিল তার একমাত্র চিন্তা। সে কোনও গোলাপ দেখত না, কোনও পাখির গান শুনত না, বসন্তের কোনও মদির মোহময় আবেদনে সাড়া দিত না। পরমাসুন্দরী পরী ইভাদনের উন্নত অনাবৃত বক্ষস্থলও কোনওভাবে বিচলিত করতে পারত না তাকে। হর্মোদিয়াসের মতো ফুলের বনে শুধু তরবারি লুকিয়ে রাখা ছাড়া ফুলের অন্য কোনও প্রয়োজন ছিল না তার কাছে। এমনকি আমোদ-প্রমোদের ক্ষেত্রেও সে ছিল কঠোর এবং নীতিবাগীশ। প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন কোনও বস্তু বা ঘটনার প্রতি কোনও নজর বা আগ্রহ ছিল না তার। সে ছিল যেন কোনও স্বাধীনতা প্রেমিকের প্রাণহীন মর্মরমূর্তি। তার কথাগুলো কড়া হলেও কণ্ঠে ছিল গীতিময়তার সুর, যা ক্রমশ বাগিতার উচ্চস্তরে উঠে যেত ধীরে ধীরে। কোনও মেয়ের পক্ষে তাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলা বড় শক্ত ছিল। প্লেস কামাই বা র‍্যু সেন্ট জাঁ দ্য বোভাইয়ের কোনও সুন্দরী যুবতী যদি তার তরুণ বালকের মতো সুন্দর মুখ, নীল চোখের সুন্দর পাতা, হাওয়ায় উড়তে থাকা রেশমি চুলের রাশ, ঝকঝকে দাঁতের উপর লাল ঠোঁট প্রভৃতির দ্বারা সমৃদ্ধ তার দেহসৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে এগিয়ে যেত তা হলে তীক্ষ্ণ নীরস দৃষ্টির শরে বিদ্ধ হয়ে পিছিয়ে আসতে হত, যেন এক অনতিক্রম্য দুর্লঙ্ খাদের অন্তহীন বিশালতার সম্মুখীন হতে হত, যে খাদ তাকে এই শিক্ষাই দিত যে সে যেন এজেকাইলের শেরুবিসের সঙ্গে বোমারশাই-এর শেরুবিলিকে গুলিয়ে না ফেলে।

যে এঁজোলরাস ফরাসি যুক্তিতর্কের দিকটির প্রতিনিধিত্ব করত সেই এঁজোলরাসের পাশে ছিল কমবেফারে যে দর্শনের দিকটির প্রতিনিধিত্ব করত। যুক্তি বা তর্কবিদ্যা আর দর্শনের সঙ্গে তফাৎ এই যে যুক্তিতর্ক যখন সব সমস্যার যুদ্ধের দ্বারা সমাধান করতে চায়, দর্শন সে সমস্যার সমাধান করতে চায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে। কমবেফারে ছিল যেন এঁজোলরাসের সম্পূরক। এঁজোলরাস কোনও বিষয়ে বাড়াবাড়ি করলে তাকে সংহত করত কমবেফারে। কমবেফারে এঁজোলরাসের মতো অতটা উন্নত না হলেও তার মনের প্রসারতা ছিল। বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে সে সভ্যতার কথাটাও বলত। রুক্ষকঠিন পাহাড়ের মতো যে কোনও নীতি ও তত্ত্বকথার চারদিকে সে এনে দিত উদার উন্মুক্ত দিগন্তের প্রসারতা। এঁজোলরাস চেয়েছিল ঈশ্বরপ্রদত্ত অধিকার আর কমবেফারে চেয়েছিল বৈধ অধিকার। প্রথম জন রোবোসপিয়ারের সঙ্গে মিলে মিশে চলত আর দ্বিতীয় জন ছিল কনডরমেতের ভক্ত। এঁজোলরাসের থেকে অনেক বেশি বাস্তবজীবন সম্বন্ধে সচেতন ছিল কমবেফারে। একজন ছিল নীতি আর একজন জ্ঞানের উপাসক। এঁজোলরাস ছিল পুরুষোচিত শক্তি ও বীর্যবত্তার উপাসক, কমবেফারে ছিল বিশুদ্ধ জ্ঞান আর মানবতাবাদের উপাসক। সে নাগরিক’ কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ’ এ কথাটাও বলত। সে সবকিছু পড়ত, আর পাঁচজনের কথা শুনত, বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে পরিচিত ছিল। সে কুসংস্কারে বিশ্বাস না করলেও কোনও কিছু উড়িয়ে দিত না। এমনকি ভূতপ্রেতের অস্তিত্বকে স্বীকার না করলেও অস্বীকার করত না। সে বলত, দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে স্কুলমাস্টারদের ওপর। আবার দেশের শিক্ষাসমস্যা নিয়েও চিন্তা করত। আলোচনা করত। সে বিশ্বাস করত সমাজের কাজ হল বিজ্ঞান ও সাহিত্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন করে সকল মানুষের নৈতিক ও বুদ্ধিগত মানকে উন্নত করার জন্য ক্রমাগত চেষ্টা করে যাওয়া। বিজ্ঞানের সব রকম সাহায্য নিয়ে দেশের ভবিষ্যৎকে গড়ে তোলায় সে ছিল বিশেষ আগ্রহী। মানবজাতির অগ্রগতির পথে কুসংস্কার, স্বৈরাচার প্রভৃতি কোনও বাধা-বিপত্তিকে স্বীকার বা ভয় করত না সে। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, পরিশেষে জ্ঞানের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হবে সব কিছুর উপর। এঁজোলরাস ছিল যেন সেনাপতি আর কমবেফারে ছিল পদপ্রদর্শক। এঁজোলরাস সব পেতে চাইত লড়াই করে, সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে। কমবেফারে লড়াই যে চাইত না, তা নয়। অগ্রগতির পথে কোনও প্রত্যক্ষ বাধা অপসারিত করার জন্য বলপ্রয়োগ ও সগ্রামের পক্ষপাতী ছিল। তবে পারতপক্ষে যতদূর সম্ভব মানুষকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে মানুষের মনকে উন্নত করে কর্তব্য সম্বন্ধে তাদের সচেতন করে তোলার যথাসাধ্য চেষ্টা করে যেত সে। আগুন আর আলোর মধ্যে আলোটাকেই বেছে নিয়েছিল কমবেফারে। আগুনের কৃত্রিম আভায় অন্ধকার কাটে ঠিক, কিন্তু সব অন্ধকারের পরিপূর্ণ অপসারণের জন্য সূর্যোদয়ের জন্য কেন অপেক্ষা করব না আমরা যা কিছু মহান তার ভয়ঙ্কর ঐশ্বর্যের চোখধাঁধানো উজ্জ্বলতার থেকে যা কিছু শুভ তার শান্ত শুভ্র জ্যোতিকে বেশি পছন্দ করব। যে ১৭৯৩ সালে সত্যের সন্ধানে সমগ্র জতি বিপ্লবের গভীরে ঝাঁপ দেয়, যে ঘটনার আবর্তে জড়িয়ে পড়ে, কমবেফারে তাকে ভয় করত। সে স্থবিরতা বা স্থিতিশীলতা চাইত না, আবার অস্বাভাবিক দ্রুত গতির মত্ততাকেও চাইত না। তার বন্ধুরা যখন বিপ্লবের মাধ্যমে মানুষের ভাগ্যোন্নতির কথা বলত, সে বলত মানুষের প্রগতি হবে বুদ্ধিবিবেচনা প্রসূত, যার মধ্যে কোনও মত্ততা বা অপরিণামদর্শিতা থাকবে না, সে বলত প্রগতি তার নিজের পথ আপনিই বেছে নেবে। সে প্রগতি এক শান্ত শুভ পদ্ধতির পথ ধরে এগিয়ে যাবে। কমবেফারে মানবজাতির এমন এক ভবিষ্যতের জন্য প্রার্থনা করত যে ভবিষ্যৎ হবে শুভ শক্তি আর সরলতার মূর্ত প্রতীক, যা মানবজাতির বিরাট বিবর্তনধারাটিকে ক্ষুণ্ণ করবে না কিছুমাত্র। সে প্রায়ই বলত যা কিছু তা হবে নির্দোষ, সমস্ত কলুষ থেকে মুক্ত। সে বলত এক ধ্বংসাত্মক শক্তির ভয়ঙ্কর ঐশ্বর্যে দীপ্তিমান এবং ঈগলের মতো যে বিপ্লব চোখে আগুন আর ঠোঁটে রক্ত নিয়ে এক অন্ধ আদর্শের লক্ষ্যাভিমুখে এগিয়ে যায় সে বিপ্লবের মধ্যে প্রগতি বা অগ্রগতির কোনও সৌন্দর্য থাকতে পারে না। হাঁসের ডানাওয়ালা দেবদূত আর ঈগলের ডানাওয়ালা দেবদূতের মধ্যে যা পার্থক্য–ওয়াশিংটন আর দাঁতনের মধ্যেও সেই পার্থক্য।

জাঁ প্রভেয়ার ছিল কমবেফারের থেকে আরও নরম চিত্তের মানুষ। যে কল্পনা এবং আবেগ সেকালের যুবমানসের বৈশিষ্ট্য সেটা পূর্ণমাত্রায় ছিল তার মধ্যে। আসলে আঁ প্রভেয়ার ছিল প্রেমিক। সে ফুল ভালোবাসত, বাঁশি বাজাত, কবিতা লিখত, মানুষকে ভালোবাসত, নারী ও শিশুদের দুঃখে সমবেদনা জানাত ও কাঁদত। একই সঙ্গে ভবিষ্যৎ ও ঈশ্বরে বিশ্বাস করত। আঁদ্রে শেনিয়েরের গলা কাটার জন্য সে বিপ্লবকে ভর্ৎসনা করত। সে ছিল খুবই দয়ালু। তার কণ্ঠস্বর নরম হলেও মাঝে মাঝে তা গুরুগম্ভীর ও প্রভুত্বমূলক হয়ে উঠত। সে খুব পড়াশুনো করত। সে ইতালি, লাতিন, গ্রিক ও হিব্রু–এই চারটি ভাষা জানত এবং এই চারটি ভাষার সাহায্যে দান্তে, জুভেলাস, এসকাইলাস আর ইগাইয়ার রচিত কাব্য পড়ত। ফরাসি সাহিত্যে সে রেসিনের থেকে কর্নেল আর কর্নেলের থেকে অ্যাগ্রিপ্পা দ্যবিগ্নের লেখা পছন্দ করত। ফুলগাছে ঘেরা পথে বা প্রান্তরের উপর দিয়ে পথ চলতে ভালোবাসত সে। আকাশে মেঘেদের গতিভঙ্গির প্রতি তার যেমন কোনও খেয়াল ছিল না তেমনি সামাজিক ঘটনাবলির গতিপ্রকৃতির দিকেও কোনও খেয়াল ছিল না তার। তার মনের ছিল দুটো দিক–একদিকে ছিল মানুষ আর একদিকে দেবতা। মানুষের জন্য সে পড়াশুনো করত আর ঈশ্বরের জন্য সে ধ্যান করত, উপাসনা করত। সারাদিন ধরে বেতন, মূলধন, ধর্ম, বিবাহ, চিন্তা ও প্রেমের স্বাধীনতা, শিক্ষা, শাস্তিক্যবস্থা, দারিদ্র্য, সম্পত্তি, উৎপাদন, বণ্টন, সমাজের নিচের তলার মানুষদের আবিষ্কার ও জীবনযাত্রা প্রভৃতির নানা সামাজিক সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাত সে। কিন্তু রাত্রিতে সে শুধু ভাবত অনন্ত আকাশের কথা। এঁজোলরাসের মতো প্রুভেয়ারও ছিল ধনীঘরের একমাত্র ছেলে। সে ছিল লাজুক প্রকৃতির, খুব শান্ত ও নরম সুরে কথা বলত, যখন-তখন লজ্জায় রাঙা হত। আবার মাঝে মাঝে সে হয়ে উঠত নির্ভীক।

পিতৃমাতৃহীন কুলি ছিল একজন পাখা প্রস্তুতকারক মিস্ত্রি। তার দৈনিক রোজগার ছিল মাত্র তিন ফ্রাঁ। তার একমাত্র চিন্তা ছিল জগতের মানুষকে মুক্ত করা। তার আর একটা চিন্তা ছিল লেখাপড়া শেখার। সে বলত একমাত্র শিক্ষাই মানুষের আত্মাকে মুক্ত করতে পারে। সে নির্জনে নিজের চেষ্টায় পড়তে-লিখতে শেখে। তার অন্তর ছিল স্নেহমমতায় উত্তপ্ত। সে পিতামাতাকে হারিয়ে তার দেশকে মা আর সমগ্র মানবজাতিকে তার পিতা ভাবত। জাতীয়তার ভাবধারা গভীরভাবে অন্তরে পোষণ করত সে। তার প্রতিবাদ যাতে সুসংবদ্ধ ও সুদৃঢ় হয় তার জন্য ইতিহাস থেকে তথ্য সংগ্রহ করত। সেকালে যে যুবশক্তি শুধু ফ্রান্সের কথা, দেশের কথা ভাবত, সে ছিল তাদের থেকে স্বতন্ত্র, কারণ সে তখন ভাবত বিরাট বিশ্বের কথা যে বিশ্বে ফ্রান্সের সঙ্গে সঙ্গে ছিল গ্রিস, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া আর ইতালি। স্বাধিকারবোধ ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্বন্ধে তার চেতনা ছিল প্রবল। তুর্কির দ্বারা ক্রিট ও থেসালি দখল, রাশিয়ার দ্বারা পোল্যান্ড দখল, অস্ট্রিয়ার দ্বারা ভেনিস দখল প্রভৃতি ঘটনাগুলো প্রচণ্ড ক্রোধ জাগায় তার মনে। ঘৃণা আর আত্মপ্রত্যয় ও সত্যের প্রতি অবিচল আস্থা যে বাগিতা সঞ্জাত সেই বাগিতাই ছিল একমাত্র শক্তি। সে শুধু অক্লান্তভাবে বলত সেইসব বীর মহান জাতিদের কথা যারা বিশ্বাসঘাতক, অন্য কোনও অত্যাচারী আগ্রাসী জাতির দ্বারা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়, যারা এক বিরাট ফাঁদের শিকার, জন্মমুহূর্তে যে সব জাতির গলা টিপে তাদের হত্যা করা হয়। কপর্দকহীন নিঃস্ব এক শ্রমিক নিজেকে ন্যায়পরায়ণতার অভিভাবক ভাবতে থাকে এইভাবে। শুধু মানবজাতির সহজাত অবিনশ্বর অধিকারের দাবি জানিয়ে মহত্ত্ব অর্জন করে সে। আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদী রাজারা অহেতুক রাজ্য জয় করে তাদের উদ্যম, শক্তি আর সম্মানের অপচয় করে থাকে। কোনও বিজিত জাতিকে বেশিদিন বশীভূত রাখা যায় না। আজ হোক কাল হোক পদানত জাতি একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবেই। গ্রিস আজও গ্রিসই আছে, ইতালি ইতালিই আছে। পরাজয় দখল পরপহরণের মতোই ঘৃণ্য ও নিন্দনীয়। কোনও একটা জাতিকে কখনও রুমালের মতো পকেটে ঢুকিয়ে রাখা যায় না।

কুরফেরাক ছিল এক সম্মানিত ব্যক্তির ছেলে লোকে যাকে মঁসিয়ে দ্য কুরফেরাক বলে ডাকত। রাজতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠার যুগে ফ্রান্সে বুর্জোয়ারা আপন আপন উপাধির প্রতি অতিমাত্রায় সচেতন ছিল। কিন্তু কুরফেরাক নিজের নামের সঙ্গে কোনও সম্মানসূচক উপাধি জুড়ে না দিয়ে নিজেকে শুধু কুরফেরাক বলত।

যে থোলোমায়েস একদিন ফাতিনর প্রেমিক ছিল সেই থোলোমায়েসের লেখা পড়ত কুরফেরাক। সে ছিল এমনই এক যৌবনসুলভ উদ্যমের অধিকারী যে উদ্যমের মাঝে ছিল আত্মার এক নারকীয় সৌন্দর্য। কিন্তু সে সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতা বেশি দিন থাকে না, তা সহজেই ম্লান হয়ে যায়। ১৮১৭ সালে থোলোমায়েসের মুখে যে কথা শোনা গেছে, ১৮২৮ সালে যে কেউ কুরফেরাকের মুখেও সেই কথা শুনতে পেত। কিন্তু দু জনের মধ্যে পার্থক্যও ছিল প্রচুর। থোলোমায়েস অন্তরের দিক থেকে ছিল এক অবৈধ প্রেমের নায়ক আর কুরফেরাক অন্তরের দিক থেকে ছিল এক বীরপুরুষ।

এঁজোলরাস ছিল নেতা, কমবেফারে ছিল পথপ্রদর্শক আর কুরফেরাক ছিল কেন্দ্র। কেন্দ্রোচিত গুণ তার ছিল। কেন্দ্রে অবস্থান করে যে তাপ সে বিকীরণ করত সেই তাপ থেকেই আলো জ্বালাত এবং আলোক বিকিরণ করত অন্যরা।

উদারনীতিবাদীদের এক বিক্ষোভ মিছিলে লালিমাদ নামে যে ছাত্র মারা যায় এবং যার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়াকে কেন্দ্র করে ১৮২২ সালে এক রক্তক্ষয়ী হাঙ্গামা হয়, বাহোরেল তাতে এক সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে। বাহোরেলের উদ্দেশ্য ভালোই ছিল। কিন্তু সে ছিল এক উদ্ধত এবং আপোসহীন বিপ্লবী সাহসী, অমিতব্যয়ী, উদার এবং বাগ্মী। সে ছিল যেন জন্মবিক্ষুব্ধ এবং উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। ঝগড়ার থেকে বিদ্রোহে এবং বিদ্রোহের থেকে বিপ্লবে মজা পেত সে বেশি। একাদশ বর্ষের এক সামান্য ছাত্র হয়েও জানালার কাঁচের সার্সি ভাঙার মতো সহজে এক সরকারের উচ্ছেদ ঘটাতে পারত সে। সে স্কুলে পড়ার সময়েও যখন-তখন গান গাইত এবং শিক্ষকদের বিদ্রূপ করত। হাতখরচ হিসেবে বাড়ি থেকে তিন হাজার ফ্রা’র মতো যে মোটা টাকা পেত তা সে বাজে খরচ করে উড়িয়ে দিত। সে ছিল এক বড় চাষির ছেলে। কিভাবে ছেলেকে সম্মান দিয়ে চলতে হয় তা সে তার বাপ-মাকে শেখাত। সে তার বাবা-মা সম্বন্ধে বলত, ওরা চাষি, বুর্জোয়া নয়, তাই তাদের কিছুটা বোধশক্তি আছে।

বাহোরেল ছিল খেয়ালি। সে প্রায়ই বিভিন্ন কাফেতে ঘুরে বেড়াত। পথে পথে পায়চারি করে বেড়াত। ভুল করাই যেমন মানুষের কাজ তেমনি পথে পথে ঘুরে বেড়ানোই হল প্যারিসবাসীর কাজ। তবু তার মধ্যে ছিল এক চিন্তাশীল মন এবং এলিসি সংস্থা ও অন্যান্য সংস্থার মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে চলত।

যুবকদের এই সঙ্ঘের মধ্যে মাথায় টাকওয়ালা এক যুবক ছিল। তার নাম ছিল বোসেত। বোসেতের বাবার নাম ছিল মার্কুই দ্য আভারে। অষ্টাদশ লুই যেদিন বিদেশ থেকে ফ্রান্সে ফিরে এসে ক্যালে বন্দরে নামেন সেদিন তার জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করে। দেন বোসেতের বাবা ল্যাগলে। এজন্য খুশি হয়ে রাজা তাকে ডিউক উপাধি দান করেন। ল্যাগলে রাতারাতি হয়ে ওঠে মার্কুই দ্য আভারে।

বোসেত স্বভাবের দিক থেকে আনন্দোহূল্প হয়ে থাকলেও তার ভাগ্যটা ছিল খারাপ। সে জীবনে কোনও কিছুই লাভ করতে পারেনি। কোনও কিছুতে সফল হতে পারেনি। সে সব কিছুই হেসে উড়িয়ে দিত। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে তার মাথায় টাক পড়ে। তার বাবার মৃত্যুকালে একটা বাড়ি আর কিছু জমি দিয়ে যায়। কিন্তু ভুল পরিকল্পনায় ব্যবসা করতে গিয়ে সে সব খুইয়ে ফেলে। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পত্তির কিছুই অবশিষ্ট রইল না তার। তার বিদ্যা শিক্ষা ও জ্ঞানবুদ্ধি ছিল; কিন্তু তা সব ভুল পথে চালিত হয়। তাই সব দিকেই ব্যর্থ হয় সে। কাঠ কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলত সে। সব বিষয়ে সে ছিল ব্যর্থতার শিকার, তবু সব ব্যর্থতাকে, ভাগ্যের সব পরিহাসকে হেসে উড়িয়ে দিত সে। নিজের দুর্ভাগ্যকে নিজেই উপহাস করত। সব দুর্ভাগ্যকে, জীবনের যত সব অবাঞ্ছিত ঘটনাকে সহজ বলে মেনে নিত। সে ছিল নিঃস্ব, দরিদ্র, কিন্তু তার মধ্যে ছিল হাসির অফুরন্ত ভাণ্ডার। তার পকেটে পয়সা ফুরিয়ে গেলেও মুখ থেকে হাসি ফুরাত না কখনও। যে কোনও দুঃখ-বিপদে ঘটনাকে এক পুরনো বন্ধুর মতো বরণ করে নিত, তার পিঠের উপর হাত বুলিয়ে দিত। হাতে কোনওভাবে কোনও টাকা পেলেই উদারভাবে খরচ করে ফেলত সে। কোনও এক রাতে রাস্তার একটা অচেনা লোকের সঙ্গে কোনও এক হোটেলে নৈশভোজন করতে গিয়ে একশো ফ্রাঁ খরচ করে ফেলে।

বাহোরেলের মতো আইন পড়ে ওকালতি করার পথে এগিয়ে যায় বোসেত। তার কোনও নির্দিষ্ট থাকার জায়গা ছিল না। একজন বন্ধুর কাছে থাকত। তবে জলি নামে এক ডাক্তারি ছাত্রের কাছেই সে বেশি থাকত। জলি ছিল তার থেকে দু বছরের ছোট।

জলির বয়স ছিল তেইশ। চিকিৎসাশাস্ত্রের যেটুকু সে শিখেছিল তাতে নিজেকে সে ডাক্তারের থেকে রোগী করে তোলে বেশি। এই যুবক বয়সেই নিজেকে এক দুরারোগ্য ব্যাধির শিকার হিসেবে ভাবত। নিজেকে রুগ্‌ণ ভাবত সব সময় এবং আয়নার সামনে ঘন্টার পর ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে নিজে জিবটাকে পরীক্ষা করত। কোনও দুর্যোগের দিন সে নিজের হাতের নাড়ি টিপে দেখত। তার মধ্যে যৌবনসুলভ কিছু অসংগতি এবং অপ্রকৃতিস্থতা থাকলেও সে-ও আনন্দে প্রায়ই উফুল্ল হয়ে থাকত। তাই তার বন্ধু তাকে ‘জলি’ বলে ডাকত যার অর্থ হচ্ছে উফুল্ল। তার ছড়ির গোল বাঁট দিয়ে নিজের নাকটাকে ঘষার একটা বাতিক ছিল। এটা নাকি বিচক্ষণ মনের লক্ষণ।

বিভিন্ন প্রকৃতির এই যুবকদের মধ্যে একটা কিন্তু সাধারণ ধর্ম ছিল এবং সে ধর্মের নাম ছিল প্রগতি। এরা সবাই ছিল ফরাসি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ বংশধর। ১৭৮৯ সালের নাম উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গেই সবচেয়ে চপলমতি যুবকও গম্ভীর হয়ে উঠত। অথচ তাদের পিতারা সবাই ছিল রাজতন্ত্রী। কিন্তু তাতে তাদের কিছু যেত-আসত না। এক শুচিশুদ্ধ নীতি ও আদর্শের স্রোত বয়ে যেত যেন তাদের দেহের প্রতিটি শিরায়। অতীত যুগের কোনও বৈপরীত্য বা বৈষম্য কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারত না তাদের সামনে।

কিন্তু এইসব গোঁড়া বিশ্বাসী আদর্শে আস্থাবান বন্ধুদের মধ্যে একজন সংশয়বাদী এসে জোটে। এই সংশয়বাদীর ওপর তাদের আকস্মিক আকর্ষণ, বৈপরীত্যের প্রতি আমাদের সহজাত আকর্ষণেরই শামিল। এই সংশয়বাদী যুবকের নাম ছিল গ্রান্তেয়ার। গ্রান্তেয়ারও ছিল প্যারিসের এক ছাত্র। তার ধারণা ছিল প্যারিস শহরে না থাকলে পড়াশুনো হয় না। পড়াশুনো শেখার সঙ্গে সঙ্গে প্যারিসের বিখ্যাত জায়গাগুলোর নামও শিখে ফেলে সে। সে জানত সবচেয়ে ভালো কফি পাওয়া যায় নেম্বলিন কাফেতে, সবচেয়ে ভালো বিলিয়ার্ড খেলার ঘর আছে কাফে ভলতেয়ারে। সবচেয়ে ভালো নাচিয়ে এবং সুন্দর মেয়ে পাওয়া যায় বুলভার্দ দু মেইনে, সবচেয়ে ভালো চিকেন পাওয়া যায় মেরে সাগেতে, আর সবচেয়ে ভালো সাদা মদ পাওয়া যায় ব্যারিয়ের দু কমবাতে। একাধারে সে ছিল বক্সিং খেলায় পারদর্শী, ভালো ব্যায়ামবিদ এবং নাচিয়ে। সে খুব মদ খেতে পারত এবং অনেক বাজি রেখে মদ খেত। সে দেখতে দারুণ কুৎসিত ছিল। তার চোখ-মুখ দেখে বুটপালিশকরা একটা লোক একবার মন্তব্য করেছিল, মানষ এমন কুৎসিত হতে পারে তা আমার ধারণাই ছিল না। তবু তাতে কিছুমাত্র দমে যেত না গ্রান্তেয়ার। সে মেয়েদের দিকে স্থির ও লুব্ধ দৃষ্টিতে তাকাত এবং মনে মনে ভাবত, আমি ইচ্ছা করলেই ওদের পেতে পারি। সে বন্ধুদের কাছে বলে বেড়াত অনেক সুন্দরী মেয়ে তার পিছু নিয়েছে। তাকে ভীষণভাবে চাইছে।

জনগণের অধিকার, মানুষের অধিকার, সামাজিক চুক্তি, ফরাসি বিপ্লব, প্রজাতন্ত্র, গণতন্ত্র, মানবতা, সভ্যতা, ধর্ম, প্রগতি প্রভৃতি শব্দ বা শব্দের কোনও অর্থ ছিল না সংশয়বাদী গ্রান্তেয়ারের কাছে। সংশয়বাদ তার মাথার মধ্যে কোনও বিশ্বাসকেই দাঁড়াতে দিত না। তার বুদ্ধিকে করে তুলেছিল একেবারে শুষ্ক নীরস। সে সবকিছুকে উপহাস করে উড়িয়ে দিত। একগ্লাস মদই ছিল তার একমাত্র বিশ্বাসের বস্তু। কোনও আদর্শে বিশ্বাস তার কাছে ছিল চরম উপহাস ও বিদ্রুপের বস্তু। সে খ্রিস্টীয় ক্রসকে এক ধরনের ফাঁসিকাঠ বলে অভিহিত করত। সে ছিল নারীলোলুপ, মাতাল এবং অমিতব্যয়ী এবং সে তার আশাবাদী বন্ধুদের কাছে শুধু রাজা চতুর্থ হেনরির গুণগান করে বিরক্ত করে তুলঁত তাদের যে হেনরি ছিল তারই মতো নারীলোলুপ এবং পাপাসক্ত।

সংশয়বাদী হলেও একজনের প্রতি অদ্ভুত একটা আসক্তি ছিল গ্রান্তেয়ারের। কোনও আদর্শ, ধর্ম, কলা বা বিজ্ঞানের প্রতি তার কোনও আসক্তি ছিল না। একমাত্র আসক্তি তার এঁজোলরাসের প্রতি। গ্রান্তেয়ার এঁজোলরাসকে সত্যিই খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করত। যে সব বিশ্বাসকেই সংশয়াত্মক প্রশ্নের ছুরি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিত সে সবচেয়ে একজন গোড়া বিশ্বাসীরই ভক্ত হয়ে ওঠে। এঁজোলরাস কিন্তু কোনও যুক্তিতর্কের দ্বারা তার মন জয় করেনি, তার চরিত্রই তার প্রতি আকৃষ্ট ও আসক্ত করে তোলে গ্রান্তেয়ারকে। এটা অবশ্য এমন কিছু দুর্লভ ঘটনা নয়। আমাদের মধ্যে যা নেই আমরা তার দিকেই ছুটে চলি, সেটার প্রতি আসক্ত হই। কোলাব্যাঙ যেমন উড্ডীয়মান পাখির দিকে তাকিয়ে থাকে মুগ্ধ চোখে, তেমনি ধর্মবিশ্বাসের আকাশে উড্ডীয়মান এঁজোলরাসের পানে তাকিয়ে থাকতে ভালোবাসত সংশয়ের মাটিতে আবদ্ধ গ্রান্তেয়ার। এঁজোলরাসকে দরকার ছিল তার। সে তার অজানিতে এবং তার কোনও কারণ না জেনেই সৎ, সরল প্রকৃতির, ন্যায়পরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ ও এঁজোলরাসের দ্বারা মুগ্ধ হয়; আসক্ত হয়ে ওঠে তার প্রতি। আসলে সে বিপরীত প্রকৃতির প্রতিই যেন আকৃষ্ট হয়। তার অসংলগ্ন আকারহীন চিন্তা এঁজোলরাসকে যেন মেরুদণ্ড হিসেবে অবলম্বন করতে চায়। আসলে কতকগুলি অসংবদ্ধ, অসংগত ও পরস্পরবিরুদ্ধ উপাদানে গড়া ছিল যেন তার প্রকৃতি। সে ছিল একই সঙ্গে বন্ধুদের প্রতি বিদ্রুপাত্মক এবং অন্তরঙ্গ, উদাসীন এবং স্নেহমমতাশীল। সে জানত না মেহমমতা মাত্রই একটা বিশ্বাস। আসলে সে জানত না, মানুষের মন বিশ্বাস ছাড়া চলতে পারে না, কিন্তু হৃদয় বিশ্বাস বা বন্ধুত্ব ছাড়া চলতে পারে না। এই দ্বিধাবিভক্ত মনোভাব নিয়েই যেন অনেকে জন্মগ্রহণ করে। তারা জোড়া ছাড়া বাঁচতে পারে না। বন্ধুদের সঙ্গ ছাড়া থাকতে পারত না গ্রান্তেয়ার। আর এই যুবকরাও তার পরিহাসরসিকতার জন্য সহ্য করে যেত তাকে।

এঁজোলরাস কিন্তু গ্রান্তেয়ারকে মোটেই ভালোবাসতে পারত না। সে তার সংশয়মন্যতা আর পাপাসক্তি দুটোকেই অপছন্দ করত। ঘৃণা করত। এক করুণামিশ্রিত ঘৃণার সঙ্গে গ্রান্তেয়ারকে দেখত এঁজোলরাস। কিন্তু এঁজোলরাসের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েও এবং তার কাছ থেকে দুর্ব্যবহার পেয়েও বারবার সে ফিরে আসত তার কাছে। এসে বলত, কী চমৎকার এক প্রতিমূর্তি।

.

২.

কোনও এক বিকেলে কাফে সঁসের দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল বোসেত। তার দৃষ্টি ছিল প্লেস সেন্ট মাইকেলের ওপর নিবদ্ধ। তার আর এক নাম ছিল ল্যাগলে দ্য মিউ। সে তখন দু দিন আগে স্কুল অফ ল বা আইন বিদ্যালয়ের ক্লাসে ঘটে যাওয়া একটা তুচ্ছ ঘটনার কথা ভাবছিল। কিন্তু ঘটনাটা তুচ্ছ হলেও তার ভবিষ্যতের পরিকল্পনাটা ওলটপালট হয়ে যায়।

তার সেই দিবাস্বপ্নের মধ্যেও বোসেত দেখতে পেল দু চাকাওয়ালা একটা ঘোড়ার গাড়ি প্লেস সেন্ট মাইকেলের চারপাশে কী একটা জায়গা খোঁজ করে বেড়াচ্ছে। গাড়ির ভেতর যুবক একটা মোটা ব্যাগ হাতে বসে আছে। তার ব্যাগের উপর ঝোলানো একটা ছাপা কার্ডে লেখা আছে মেরিয়াস পঁতমার্সি।

এই নামটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠল বোসেত, মঁসিয়ে মেরিয়াস তমার্সিং

গাড়িটা থেমে গেল। গাড়ির ভেতর বসা যুবকটিও তখন ছিল চিন্তায় মগ্ন। সে হঠাৎ মুখ তুলে তাকাল। বলল, হ্যাঁ আমি।

তুমিই তো মেরিয়াস পঁতমার্সি?

অবশ্যই।

আমি তোমারই খোঁজ করছি।

মেরিয়াস বলল, তার মানে কী বলতে চাইছ তুমি?

মেরিয়াস কিছু আগে তার মাতামহের বাড়ি ছেড়ে আসে। কিন্তু এখানে যে তার নাম ধরে ডাকছে এবং যে তার খোঁজ করছে তাকে সে চেনে না। সে তাই আশ্চর্য হয়ে বলল, আমি তো তোমাকে চিনি না।

আমিও তোমাকে চিনি না।

মেরিয়াসের মনে হল যুবকটি ঠাট্টা করছে, কৌতুক করছে। কিন্তু ঠাট্টা-কৌতুক করার মতো মন তখন তার ছিল না।

কিন্তু এতে বোসেতের মন দমে গেল না। সে বলল, গত পরশু তুমি আইন স্কুলে ছিলে না?

সম্ভবত।

হ্যাঁ, তুমি অবশ্যই ছিলে।

মেরিয়াস জিজ্ঞাসা করল, তুমি একজন ছাত্র?

হ্যাঁ মঁসিয়ে, আমিও তোমার মতোই এক ছাত্র। গত পরশু আমি স্কুলে হঠাৎ গিয়ে পড়ি। এটা আমার খেয়াল। অধ্যাপক তখন নাম ডাকছিলেন। তুমি জান এই সময় তারা বড় বিরক্তিকর হয়ে ওঠেন। তিনবার নাম ডাকার পরও তুমি যদি উত্তর না দাও তা হলে ওঁরা তোমার নামের পাশে অনুপস্থিত লিখবেন। আর তার মানে ষাট ফ্রাঁ জলে যাবে।

মেরিয়াস আগ্রহসহকারে শুনতে লাগল। বোসেত ওরফে ল্যাগলে বলে যেতে লাগল।

অধ্যাপকের নাম ব্লদো। টিকোলো নাক আর স্বভাবটা বড় বাজে। সে ছাত্রদের অনুপস্থিত করে আনন্দ পায়। সে শুরু করে নামের আদি অক্ষর পি দিয়ে। ওটা আমার নামের আদি অক্ষর নয় বলে আমি তখন অন্যমনস্ক ছিলাম। যাদের নাম ডাকছিল তারা সবাই উপস্থিত ছিল। বেশই চলছিল। এমন সময় সে মেরিয়াস পঁতমার্সির নাম ডাকল। কিন্তু কেউ উত্তর দিল না। এবার আরও জোরে নামটা ডাকল। কিন্তু তবু কোনও উত্তর না পেয়ে কলমটা হাতে তুলে নিল। তখন আমার করুণা হল। আমি ভাবলাম, সময়মতো পৌঁছতে না পারার জন্য একটা ভালো ছেলে অনুপস্থিত হিসেবে চিহ্নিত হবে। ভাবলাম, তুমি একজন ভালো ছেলে, জ্ঞানবিদ্যা ও নানারকম শাস্ত্র পাঠে তোমার ঝোঁক আছে। তোমার নাম বাদ যাবে এটা হতে পারে না। অন্যদিকে আমি হচ্ছি একটা বখাটে ছেলে, একটা মস্ত কুঁড়ে। মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াই, তাদের পেছনে ঘুরে বেড়াই। এমনকি এই মুহূর্তে আমি আমার প্রেমিকার সঙ্গে এক বিছানায় শুতে পারি। সুতরাং তোমাকে যেমন করে হোক বাঁচাতে হবে। ব্লদো চুলোয় যাক। ব্লদো তাই তিনবারের বার তোমার নামটা ডাকতেই আমি বলে উঠলাম, মেরিয়াস পঁতমার্সি উপস্থিত। তার ফলে তুমি উপস্থিত চিহ্নিত হলে।

মেরিয়াস আমতা আমতা করে বলল, মঁসিয়ে আমি—

ল্যাগলে বলল, কিন্তু আমি—

মেরিয়াস বলল, কিন্তু কেন?

ল্যাগলে বলল, তার পরের ব্যাপারটা হল এই। আমি তোমার নামটা বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম। এমন সময় আমার নাম ডাকল এবং তখন এক শয়তানি চাতুর্যের সঙ্গে আমার দিকে তাকাল ব্লদো। আমার নাম হল ল্যাগলে।

মেরিয়াস বলল, তার মানে লা ঈগল। কী চমৎকার নাম! যাই হোক, ব্লদো আমার এই চমৎকার নামটা ডাকল এবং আমি উপস্থিত এই বলে উত্তর দিলাম। সে তখন ব্যাগ্রসুলভ তৃপ্তির সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু তুমি যদি মেরিয়াস পঁতমার্সি হও তা হলে তুমি ল্যাগলে হতে পার না। এই মন্তব্য তোমার কাছে অপমানকর ঠেকতে পারে, কিন্তু আমার কাছে ভয়ঙ্করভাবে বিপজ্জনক। সে সঙ্গে সঙ্গে আমার নামটা কেটে দিল।

মেরিয়াস বলল, আমি মর্মাহত।

ল্যাগলে বলে যেতে লাগল, ভাবলাম বেরিয়ে যাবার আগে ব্লদোর ওপর কতকগুলি শক্ত কথার ঢিল ছুঁড়ে যাই। আমি মনে করব ব্লদো মারা গেছে। অবশ্য তার বাঁচা-মরার মধ্যে বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। তার চর্মসার দেহ, ম্লান মুখ, তার গায়ের গন্ধ –সব মিলিয়ে তাকে মৃতই মনে হয়। ব্লদো হচ্ছে নিয়মশৃঙ্খলার দাস, নাকসর্বস্ব বলদ, নামডাকার ধ্বংসাত্মক দেবদূত। একই সঙ্গে সৎ, অনমনীয় এবং ভয়ঙ্কর। সে যেমন আমার নাম কেটে দিয়েছে, ঈশ্বর তেমনি তার নাম সরিয়ে দেবে পৃথিবী থেকে।

মেরিয়াস বলল, আমি খুব বিব্রত বোধ করছি।

ল্যাগলে বলল, হে যুবক, সাবধান হও, ভবিষ্যতে সময়মতো আসবে।

তোমার কাছে হাজারবার ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

নিজের নাম কেটে পরের উপকার করতে যেও না।

আমি সত্যিই খুব দুঃখিত।

আমি কিন্তু খুশি। আমার উকিল হবার ভয় ছিল। এই ঘটনা আমাকে সে ভয় থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। আমাকে আর কোনও বিধবাকে বাঁচাতে হবে না বা কোনও অনাথ শিশুকে বিপদে ফেলতে হবে না। কোনও গাউন পরতে হবে না। এইসব কিছুর জন্য মঁসিয়ে পঁতমার্সি, আমি তোমার কাছে ঋণী। তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমি তোমার বাড়ি যাব। কোথায় থাক তুমি?

এই বাড়িতে।

তা হলে বলতে হবে তুমি ধনী। আমি তোমায় অভিনন্দন জানাচ্ছি। তুমি এমন একটা বাসায় থাক যার দাম বছরে নয় হাজার ফ্রাঁ।

এমন সময় কুরফেরাক কাফে থেকে বেরিয়ে এল। মেরিয়াসের মুখে করুণ একফালি হাসি ফুটে উঠল।

মেরিয়াস বলল, গাড়িটা আমি দু’ঘণ্টার জন্য ভাড়া করছি। এখন বেরিয়ে এসেছি। আসল কথা আমার থাকার কোনও জায়গা নেই।

কুরফেরাক বলল, মঁসিয়ে, আমাদের বাসায় চলে এস।

ল্যাগলে ওরফে বোসেত বলল, আমারও থাকার জায়গা নেই, তা না হলে আমার কাছেই থাকতে।

কুরফেরাক বলল, চলে এস বোসেত।

মেরিয়াস বলল, তোমার নাম তো ল্যাগলে।

ল্যাগলে বলল, আমাকে বোসেত বলেই সবাই ডাকে।

কুরফেরাক ঘোড়ার গাড়িটাতে উঠে ড্রাইভারকে হোটেল দ্য লা সেন্ট জাকে নিয়ে যেতে বলল। সেইদিনই সন্ধ্যার সময় মেরিয়াস সেই হোটেলে কুরফেরাকের পাশের একটা ঘরে উঠল।

.

৩.

কয়েক দিনের মধ্যেই মেরিয়াস আর কুরফেরাক দু জনে বন্ধু হয়ে উঠল। যৌবনে মানুষের মনের আঘাত বা ক্ষত শীঘ্রই সেরে যায়। কুরফেরাকের সাহচর্যে স্বস্তি অনুভব করল মেরিয়াস। কুরফেরাক কোনও প্রশ্ন করত না মেরিয়াসকে। কোনও কিছু জানতে চাইত না। এই বয়সে মানুষের মুখ দেখেই অনেক কিছু জানা যায়। কথার কোনও দরকার হয় না।

একদিন সকালবেলায় কুরফেরাক মেরিয়াসকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার রাজনৈতিক মতামত আছে?

অবশ্যই আছে।

তা হলে তুমি কোন দলের?

আমি হচ্ছি বোনাপার্টপন্থীর গণতন্ত্রবাদী।

কুরফেরাক বলল, ঠিক আছে।

পরদিন সে মেরিয়াসকে কাফে খুঁসেতে নিয়ে গেল। হাসিমুখে বলল, আমি তোমাকে বিপ্লবীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেব।

এই বলে সে কাফের পেছন দিকে এলিসি সংস্থার কার্যালয়ে নিয়ে গিয়ে তার বন্ধুদের সামনে উপস্থিত করল। বলল, একজন নতুন লোক।

মেরিয়াস যেন এক ভীমরুলের চাকে গিয়ে পড়ল। সে চাক ছিল কতকগুলি জীবন্ত মনের গুঞ্জনে মুখরিত। সে ধীর স্থির মেজাজের এবং গম্ভীর প্রকৃতির হলেও তার হুলও কম ছিল না। অবস্থার বিপাকে সে একা পড়ে যাওয়ায় এক সঙ্গে অনেকগুলো যুবকের হৈ-চৈ ও আক্রমণে ভীত হয়ে উঠল। তারা ভয়ঙ্কর স্পষ্টতার সঙ্গে অসংযত উচ্ছ্বাসে যে সব চিন্তা-ভাবনার কথা প্রকাশ করছিল সে সব চিন্তা-ভাবনা তার নিজের চিন্তা-ভাবনার থেকে এত পৃথক ছিল যে সে তার কিছুই বুঝতে পারছিল না। তারা যে সব দর্শন, সাহিত্য, শিল্প, ইতিহাস ও ধর্মের কথা আলোচনা করছিল, তা তার কাছে নতুন। তার সামনে যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে গেল। কিন্তু কথাগুলো সে সব বুঝতে না পারায় সেগুলো অসংলগ্ন আর গোলমেলে মনে হচ্ছিল। সে যখন তার মাতামহের মতবাদ ত্যাগ করে তার পিতার নীতি গ্রহণ করে, তখন সে ভেবেছিল আর কোনও সমস্যা নেই তার মনে। সে তার আকাঙ্ক্ষিত আদর্শকে পেয়ে গেছে। কিন্তু এখন দেখল এক তুমুল আলোড়ন চলছে তার মনে; তার। দৃষ্টিভঙ্গির আবার পরিবর্তন ঘটছে। তার পুরনো ধারণা ও ভাবধারা সম্পর্কে প্রশ্ন জাগছে তার মনে। তবে তার মনে হল তার নতুন বন্ধুদের আলোচনার বিষয়বস্তু যা-ই হোক, তাদের কথাবার্তার মধ্যে গ্রহণযোগ্য কোনও যুক্তি নেই।

এরপর থিয়েটারের এক পোস্টার নিয়ে আলোচনা হতে লাগল। এক নতুন নাটকের প্রচার সম্বন্ধে বাহোরেল বলল, এইসব বুর্জোয়া ট্র্যাজেডি জাহান্নামে যাক।

এ কথা শুনে কমবেফারে উত্তর করল, তুমি ভুল করছ বাহোরেল। বুর্জোয়ারা ট্র্যাজেডি ভালোবাসে এবং তাদের তা ভালোবাসতে দেওয়া উচিত। আমি এসকাইলাসের লেখা পছন্দ করি। সহাবস্থানের অধিকার বিশ্বাস করি। পোলট্রিতে বানানো কৃত্রিম মুরগির পাশাপাশি যদি সত্যিকারের পাখি থাকতে পারে তা হলে অন্য সব নাটকের পাশাপাশি ক্লাসিক ট্র্যাজেডি থাকবে না কেন?

একদিন মেরিয়াস এঁজোলরাস আর কমবেফারের সঙ্গে র‍্যু জাঁ জ্যাক রুশোর অঞ্চলের এক রাস্তা দিয়ে বেড়াচ্ছিল। কমবেফারে একসময় মেরিয়াসের একটা হাত ধরে বলল, তুমি জান কোথায় আমরা এসেছি? আগে এ অঞ্চলের নাম ছিল র‍্যু প্ল্যাত্রিয়ের। এখন এটার নাম র‍্যু জাঁ জ্যাক রুশো। ষাট বছর আগে এখানকার পরিবারের নামে এ অঞ্চলের এই নাম হয়। সে পরিবারে জ্যাক আর থেরেসে বাস করত। তাদের কতকগুলি সন্তান হয়। থেরেসে যে সব সন্তান প্রসব করে আঁ জ্যাক তাদের তাড়িয়ে দেয়।

এঁজোলরাস কড়াভাবে তার প্রতিবাদ করে বলল, জাঁ জ্যাকের বিরুদ্ধে কোনও কথা আমি সহ্য করব না। আমি তাঁকে শ্রদ্ধা করি। যদিও তিনি তাঁর সন্তানদের পিতৃত্ব অস্বীকার করেন, তিনি জনগণের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন।

এইসব যুবক কেউ ম্রাট এই শব্দটা ব্যবহার করত না। জাঁ প্রুভেয়ার মাঝে মাঝে সম্রাটের পরিবর্তে নেপোলিয়ন বলত। অন্যরা বলত বোনাপার্ট। এঁজোলরাস কথাটা ‘বুনাপার্ত’ বলে উচ্চারণ করত।

.

৪.

তার নতুন বন্ধুদের যে সব আলোচনা মন দিয়ে শুনত মেরিয়াস এবং তাতে মাঝে মাঝে যোগদান করত তা তার মনে এক গভীর প্রভাব বিস্তার করে।

এইসব আলোচনা হত কাফে মুসের পেছন দিকে ঘরটায় যখন কোনও সন্ধ্যায়। এলিসি সংস্থার প্রায় সব সদস্য উপস্থিত হত। ঘরের মধ্যে বড় বাতিটা জ্বালানো হত। তারা কোনও উত্তেজনা বা চেঁচামেচি না করে এটা-সেটা আলোচনা করত। তাতে এঁজোলরাস আর মেরিয়াস খুবই কম যোগদান করত। কখনও কখনও একই সঙ্গে সদস্যরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে নানা বিষয়ে আলোচনা করত।

সে ঘরে নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। কেবল কাফের রান্নাঘরে লুসো নামে যে মেয়েটি কাজ করত সে মাঝে মাঝে ঘুরে ঢুকতে পেত। রান্নাঘরটাকে ওরা বলত ল্যাবরেটরি।

গ্রান্তেয়ার খুব বেশি মদ খেত। মদ খেয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে করতে সে তর্কবিতর্ক করত। একদিন সে চিৎকার করে বলে উঠল, আমার পিপাসা এখনও যায়নি। আমি আরও মদপান করতে চাই। আমি জীবনটাকে ভুলে যেতে চাই। জানি না কে এই জীবনটাকে সৃষ্টি করেছে। জীবনে কোনও কিছুই সত্য নেই, তবু আমরা বেঁচে থাকার জন্য ঝগড়া মারামারি করি। সুখ হল জীবনের উপর আঁকা একটা পুরনো প্রাণহীন পট। যাজকদের মতো আমিও বলি, সব কিছুই অভিমান আর অহঙ্কার। একটা নগ্ন শূন্যতাকে অহঙ্কারের পোশাক পরিয়ে তাকে বড় বড় কথা বলে চালানো হয়। ফলে রান্নাঘরকে ল্যাবরেটরি বলে চালানো হয়। একটা নাচিয়েকে বলা হয় নৃত্যশিল্পের অধ্যাপক, ওষুধের দোকানদারকে বলা হয় কেমিস্ট, পরচুলা তৈরিকারীকে বলা হয় শিল্পী। অহঙ্কারের দুটি দিক আছে, বাইরের দিকটা কালো নিগ্রো আর ভেতরের দিকটা ছদ্মবেশী দার্শনিক। একটার জন্য আমার চোখে জল পড়ে আর অন্যটার জন্য হাসি পায়। আমাদের তথাকথিত সম্মান আর মর্যাদা হচ্ছে অহঙ্কারেরই ছদ্মরূপ। মানুষের প্রকৃত যোগ্যতার মধ্যে প্রশংসনীয় কিছুই নেই। কোনও লোক কিভাবে তার প্রতিবেশীর প্রশংসা করে তা লক্ষ করবে। সাদা হচ্ছে সাদারই শত্রু। শ্বেত কপোত যদি কথা বলতে পারত এবং প্রাণীর মতো কাজ করতে পারত তা হলে শ্বেত কপোতের ডানাগুলো ছিঁড়ে দিত। কোনও গোড়া ধার্মিক যখন অন্য এক গোড়া ধার্মিকের সঙ্গে কথা বলে তখন সে বিষাক্ত সাপের মতোই ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। দুঃখের বিষয় আমি অনেক বিষয়েই অজ্ঞ। আমি জানলে আরও অসংখ্য বিষয়ের কথা বলতে পারতাম, অনেক দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারতাম। আমার বুদ্ধি ছিল, মাথা ছিল, কিন্তু যখন আমি স্কুলে পড়তাম তখন পড়ায় মন না দিয়ে আমি ফুলবাগানে গিয়ে ফুল চুরি করতাম। আমি তোমাদের মূল্য দিতে রাজি, কিন্তু তোমাদের পূর্ণতা বা সদগুণ সম্বন্ধে। আমার কোনও আগ্রহ নেই। প্রতিটি গুণের অন্তরালে আছে একটা করে দোষ। মিতব্যয়িতা হচ্ছে কৃপণতার প্রতিবেশী, আবার উদারতা হল অমিতব্যয়িতার প্রতিবেশী; বীরত্ব হচ্ছে অত্যধিক সাহসিকতা বা বাহবা পাবার প্রবণতার প্রতিবেশী; অতিরিক্ত ধর্মাচরণ হল ধর্ম সম্বন্ধে বাতিকের প্রতিবেশী। ডাওজেনিসের পোশাকের অসংখ্য ছিদ্রের মতো প্রতিটি গুণের মধ্যে আছে অসংখ্য দোষের ছিদ্র। নিহত বা ঘাতক কার প্রশংসা আমরা বেশি করি, সিজার অথবা ব্রুটাসের। আমরা ঘাতকের প্রশংসাই করে থাকি। তার মানে ব্রুটাসের। বলি, ব্রুটাস দীর্ঘজীবী হোন। এটাই তোমাদের গুণ। গুণ হয়তো বটে, কিন্তু সেই সঙ্গে মত্ততাও। সব মহাপুরুষের মধ্যেই ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে। যে ব্রুটাস সিজারের বুকে ছুরি মেরেছিলেন তিনিই গ্রিক ভাস্কর ঐঙ্গিলিয়নের গড়া এক প্রতিমূর্তির প্রেমিক ছিলেন। এই ঐঙ্গিলিয়ন আবার আমাজন নারী ইউকমেননের এক মূর্তি গড়েন যে মূর্তিটির প্রেমিক ছিলেন নিরো। এইভাবে ব্রুটাস ছিলেন নিরোরই সমগোত্রীয়। ইতিহাস হচ্ছে পুনরাবৃত্তির এক বিরাট পটভূমি। প্রতিটি যুগ তার আগের যুগের অনেক কিছুই অপহরণ করে। ম্যারেঙ্গোর যুদ্ধ পিদনার যুদ্ধেরই নকল। তলরিয়াক যুদ্ধে ক্লোডিয়ার জয় অস্টারলিৎসে নেপোলিয়নের কথাই মনে পড়িয়ে দেয়। দু ফোঁটা রক্তের মতোই এ দুটি যুদ্ধ জয়ের মধ্যে আছে এক অবিকল সাদৃশ্য। জয়ের মধ্যে আমার কোনও আগ্রহ নেই। জয়ের কোনও অর্থ নেই। আমরা সাফল্যলাভে সন্তুষ্ট হই। কিন্তু জয় মানেই দুঃখ। জয় মানেই অহঙ্কার আর বিশ্বাসঘাতকতা। সমগ্র মানবজাতিকেই আমি ঘৃণা করি। কোন জাতির প্রশংসা করব। আমি জিজ্ঞাসা করতে পারি কি? গ্রিকদের? যে এথেন্সবাসীরা প্রাচীন জগতের মধ্যমণি ছিল তারাই ফোসিয়ানকে হত্যা করে এবং তার অত্যাচারীদের সঙ্গে আঁতা করে। গ্রিসের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হলেন বৈয়াকরণিক ফিলেতাস। কিন্তু তিনি এত রোগা ছিলেন যে তিনি যাতে বাতাসে উড়ে না যান তার জন্য জুতোর তলায় সিসে ভরে রাখতেন। কোরিনথের মেন স্কোয়ারে সাইলানিয়নের দ্বারা নির্মিত এপিসথেটসের এক প্রতিমূর্তি আছে। কিন্তু এই এপিসথেটস কে ছিলেন? তিনি ছিলেন কুস্তিগির যিনি ক্রস বাটক নামে একটা অস্ত্র আবিষ্কার করেন। এই হল গ্রিস। আরও এগিয়ে যাও। এরপর ফ্রান্স বা ইংল্যান্ড কার প্রশংসা করব? ফ্রান্সের কেন প্রশংসা করব? প্যারিসের জন্য? এথেন্সের কথা আমি আগেই চলেছি। ইংল্যান্ডের প্রশংসা করব কেন? লন্ডনের জন্য? আমি কার্থেজকে ঘৃণা করি। তেমনি লন্ডনকেও ঘৃণা করি। লন্ডন হল। বিলাসিতার রাজধানী। চেয়ারিং ক্রস অঞ্চলে প্রতিবছর একশো করে তোক ক্ষুধায় মারা যায়। আমি এক ইংরেজ মহিলাকে একরাশ গোলাপ নিয়ে নীল চশমা পরে নাচতে দেখেছিলাম। ইংল্যান্ড জাহান্নামে যাক। জন্য বুলকে আমি যদি শ্রদ্ধা করতে না পারি তা হলে কি ব্রাদার জোনাথানকে শ্রদ্ধা করব? ক্রীতদাসের সেই মালিকের প্রতি আমার কোনও ভালোবাসা নেই। সময়ানুবর্তিতা ছাড়া ইংল্যান্ডের আর কোনও সম্পদ নেই যেমন তুলো ছাড়া আমেরিকার সম্পদ নেই। জার্মানি হচ্ছে অলস, অকর্মণ্য, ইতালি হচ্ছে বিকৃতমনা। তা হলে কি আমরা রাশিয়ার প্রশংসা করব? ভলতেয়ার অবশ্য রাশিয়ার প্রশংসা করতেন এবং তিনি চীনেরও প্রশংসা করতেন। রাশিয়াতে অনেক সুন্দরী আছে ঠিক, কিন্তু স্বেচ্ছাচারীও আছে। তবে সেইসব অত্যাচারীর জন্য দুঃখ হয় আমার। একজন অ্যালেক্সির মাথা কাটা যায়, একজন পিটার ছুরি খায়, একজন পলের ফাঁসি হয়, আর পায়ের তলায় নিষ্পেষিত হয়ে ভয়ে মারা যায়। অনেক ইভানস-এর মাথা কাটা যায় এবং অনেক নিকোলাসকে বিষ খাইয়ে মারা হয়। এর থেকে বোঝা যায় রাশিয়ার জারের প্রাসাদ বড় অস্বাস্থ্যকর জায়গা। তোমরা হয়তো বলতে পার এশিয়ার থেকে ইউরোপ ভালো। আমি স্বীকার করি এশিয়ার সব কিছু হাস্যাস্পদ। তবে একথাও ঠিক যে তিব্বতের রাজা প্রধান লামাকে নিয়ে হাসাহাসি করার যুক্তি নেই। আমরা পশ্চিমের লোকরা রাজতন্ত্রের সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো গ্রহণ করেছি। রানি ইসাবেলার ময়লা শেমিজ আর রাজা ডফিনের ফুটো চেয়ার হল আমাদের রাজতন্ত্রের প্রতীক। আমাদের ভদ্রলোকরা ব্রাসেলস্, স্টকহলম আর আমস্টারডমের ভালো মদ খায়, কনস্তান্তিনোপলের ভালো কফি খায় তারা। প্যারিস সেদিক থেকে সবচেয়ে ভালো। সভ্য জগৎ একটা জিনিসই ভালো শিখেছে সেটা হল যুদ্ধ, আর যুদ্ধ মানেই ডাকাতি, দস্যুগিরি। আমি প্যারিসের ভালো ভালো মদের দোকানগুলোকে সেলাম করি। আমি শেষ রিচার্ডে খাই। তবে আমার একটা পারস্যের কার্পেটের দরকার যার উপর নগ্ন ক্লিওপেট্রা পাবে। এই ক্লিওপেট্রা এসে গেছে। লুসো তুমি কেমন আছ প্রিয়তমা?

এমন সময় গ্রান্তেয়ার প্রচুর মদ খেয়ে মদের ঝোঁকে লুসের হাত ধরে ঘরটার যে কোণে সে ছিল সেখানে জোর করে নিয়ে গেল। বোসেত যখন হাত বাড়িয়ে তাকে বাধা দিতে গেল তখন সে রেগে গিয়ে বলে উঠল, হাত সরিয়ে নাও ল্যাগলে। তুমি আমাকে শান্ত করতে পারবে না। আমি শান্ত হব না। আমার মন-মেজাজ ভালো নেই। মানুষের থেকে প্রজাপতি অনেক ভালো। মানবজাতি সব দিক থেকে ব্যর্থ। অতীতাশ্রয়ী এক বিষাদে আমি ভুগছি। আমার তাই রাগ হচ্ছে। ঈশ্বর জাহান্নামে যাক শয়তানের কাছে। বোসেত তখন আইনের একটা বিষয় আলোচনা করছিল। সে বলল, ঠিক আছে, এখন চুপ কর। আমি এখনও উকিল হয়ে উঠতে পারিনি। তবু আমি জানি, নর্ম্যানদের মধ্যে একটা প্রথা আছে। সেটা হল এই যে মাইকেলমাসের লর্ডের কাছে বছরে সম্পত্তির অধিকার বা উত্তরাধিকারের জন্য একটা টাকা দিতে হয়।

গ্রান্তেয়ারের কাছে টেবিলে দুটো মদের গ্লাসের মাঝখানে কিছু কাগজ, কালি আর কলম ছিল। দু জন ঘন হয়ে সেখানে কী আলোচনা করছিল। একজন বলল, প্রথম কতকগুলি নাম জোগাড় কর। নামগুলো ঠিক করলেই জমি পাওয়া যাবে।

অন্যজন বলল, হ্যাঁ ঠিক বলেছ। তুমি বল, আমি লিখে নিচ্ছি।

মঁসিয়ে ডবিমনের নামটা কেমন হয়?

একটা ভাড়াটে?

অবশ্যই। তার সঙ্গে একটা মেয়ে আছে। মেয়েটার নাম সেলেস্তিনে।

হ্যাঁ সেলেস্তিনে। তার পর?

কর্নেল সেঁতন।

‘সেঁতন’ নামটা চলবে না। তার থেকে বল ভ্যালসিন।

তাদের আরও দু জন নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তিরিশ বছরের এক যুবক আঠারো বছরের একটি ছেলেকে এক ডুয়েলের কথা বলছিল। তার প্রতিদ্বন্দ্বীর বিষয়। বর্ণনা করছিল। সে বলল, ডুয়েলের সময় সব সময় তার দিকে লক্ষ রাখতে হবে। সে খুব ভালো তরোয়াল চালাতে পারে। তার কব্জির জোর আছে। সে আবার বাঁ হাতে সব কাজ করে।

গ্রান্তেয়ারের উল্টো দিকে এক কোণে জলি আর বাহোরেল তাদের প্রেমের ব্যাপার নিয়ে কথা বলছিল।

জলি বলল, তুমি ভাগ্যবান, তোমার প্রেমিকা সব সময় হাসে। বাহোরেল বলল, এটা তার ভুল। কোনও প্রেমিকার সব সময় হাসা উচিত নয়। হাসি থেকে অবিশ্বস্ততা আছে। অবশ্য সে খুশির মেজাজে থাকতে পারে। সেটা দেখতে ভালো লাগে। বরং বিষণ্ণ হয়ে থাকলেই খারাপ দেখায়।

মেয়েরা আনন্দে থাকলেই তাদের আরও সুন্দর দেখায়। বল, তুমি ঝগড়া করবে না।

না, কারণ আমরা দু জনে একটা সন্ধি করে আমাদের সীমানা ঠিক করে নিয়েছি। কেউ কারও অধিকারের সীমানায় পা দেবে না।

জলি বলল, শান্তি। ভালো হজম থেকে শান্তি আসে।

বাহোরেল বলল, তোমার খবর কী জলি? সেই মেয়েটার সঙ্গে তোমার কেমন ঝগড়াঝাটি হচ্ছে? বুঝতে পারছ আমি কার কথা বলছি?

মেয়েটা একটা জেদের সঙ্গে আমাকে ঠেলে সরিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা বড় নিষ্ঠুর।

তবু তোমার চেহারাটা বেশ রোগা রোগা আছে। কোনও মেয়ের হৃদয় গলাবার পক্ষে যথেষ্ট।

হায়! আমি যদি তুমি হতাম তা হলে তাতে ঠিক বশীভূত করে ফেলতাম।

কথাটা বলা সহজ।

করাও সহজ। তার নাম মুশিয়েত্তা। তাই নয় কি?

হ্যাঁ বাহোরেল, মেয়েটা সত্যিই বেশ সুন্দরী। ছোট ছোট শিল্পীসুলভ হাত-পা, ভালো সাজপোশাক পরা, ফর্সা রঙ, মুখে ব্রণ, চোখ দুটো জ্যোতিষীদের মতো তীক্ষ্ণ। আমি তার জন্য পাগল।

তা হলে তাকে তো প্রেম নিবেদন করা তোমার উচিত। বেশ ভালো পোশাক পরে এগিয়ে যাও। তুমি দর্জির কাছে গিয়ে হরিণের চামড়া দিয়ে একটা ভালো পায়জামা তৈরি করাও। ইলিউসন পাই রইনের নায়ক মঁসিয়ে দ্য রুবেমপ্রের মতো। তাতে তোমার কাজ হবে।

গ্রান্তেয়ার বলে উঠল, কিন্তু তার দাম কত জান?

এদিকে ঘরের আর এক কোণে কবিতা আলোচনা হচ্ছিল। আলোচনা চলছিল পেগান পুরান আর খ্রিস্টীয় পুরাণ নিয়ে। গ্রুভেয়ার পেগান পুরাণের পীঠস্থান অলিম্পাসের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। সে আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলে তার কথা থামতে চায় না। এক দুর্বার আবেগের স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। হাস্যরস আর কাব্যরস মিলেমিশে এক হয়ে যায়। সে বলল, প্রাচীন পৌরাণিক দেবতাদের অপমান করা উচিত নয়। এইসব দেবতার মাহাত্ম্য এখনও চলে যায়নি। জুপিটার নেই একথা আজও আমি ভাবতে পারি না। তোমরা হয়তো বলবে এসব স্বপ্নকথা; কিন্তু স্বপ্ন শেষ হয়ে গেলেও সেইসব পেগান পুরাণের প্রভাব শেষ হয়ে যায় না। ভগলেমেনের মতো পাহাড় আজও এক বিরাট দুর্গের মতো সাইবেলের মুকুটের মতো তাকিয়ে থাকে আমাদের পানে। প্যান যে আজও রাত্রিতে বনের মাঝে এসে উইলোগাছের ফাঁপা গুঁড়ির মধ্যে ঢুকে বাতাসের সঙ্গে গাছগুলোকে নাড়া দেয় না একথা আমি ভাবতেই পারি না।

ঘরের আর এক কোণে রাজনীতির আলোচনা হচ্ছিল। কমবেফারে আর কুরফেরাকের সামনে অষ্টাদশ লুই-এর চার্টারের একটা কপি ছিল। কমবেফারে আর সলজটার সমর্থনে অনেক কথা বলছিল, কিন্তু কুরফেরাক যুক্তি দিয়ে সেটা নস্যাৎ করে দেবার চেষ্টা করছিল। সে বলছিল, প্রথমত আমার মতে রাজাদের কোনও প্রয়োজনও নেই। শুধু অর্থনৈতিক কারণেই আমি তাদের উচ্ছেদ চাই। চতুর্দশ লুই-এর পরগাছা, তার কাজের মতো কাজ কিছুই নেই। কিন্তু তার পেছনে খরচ কত জান? চতুর্দশ লুই-এর মৃত্যুর পর আমাদের জাতীয় ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ছমিলিয়ার্ড, দু হাজার মিলিয়ন। প্রথম সোফ’র মৃত্যুতে জাতীয় ঋণের পরিমাণ ছিল তিরিশ হাজার লিভার। কমবেফারের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও বলতে হয়, সনদের মাধ্যমে রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রে রূপান্তরের পথটা বিপজ্জনক। সাংবিধানিক জটিলতায় সব নীতি হারিয়ে যায়। রাজারা কখনও জনগণকে কোনও সুযোগ-সুবিধা দেয় না, তাদের সঙ্গে কোনও আপোস করে না। সনদের চৌদ্দ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে জাতীয় স্বার্থের খাতিরে প্রজাদের কিছু সুযোগ-সুবিধা দান করার ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে রাজারা একদিকে দেয় আর অন্য দিকে নেয়। আমি সম্পূর্ণরূপে এই চার্টার বা সনদটাকে প্রত্যাখ্যান করছি। মিথ্যাকে ঢাকার এক ধোয়ার আবরণ ছাড়া এটা আর কিছুই নয়। কোনও জাতি এটা গ্রহণ করলে তাকে সব অধিকার ছাড়তে হবে। অধিকার যদি আংশিক হয়, অধিকার যদি সমগ্র বা সার্বিক না হয় তা হলে তার কোনও অর্থ হয় না।

তখন শীতকাল বলে আগুনে দুটো কাঠ পুড়ছিল। সে লোভ সামলাতে না পেরে চার্টারের দলিলটা মুচড়ে আগুনের উপর ফেলে দিল। বলল, অষ্টাদশ লুই-এর মহান সনদটাকে আগুন গ্রাস করে ফেলল।

এই হল যুবকদের সভা। আর তার মানেই যত সব বক্রোক্তি, বিদ্রূপ আর ভাঁড়ামি। একেই ফরাসিরা বলে শ্লেষাত্মক বিপ, আর ইংরেজরা বলে হাস্যরস। এর মধ্যে সুরুচি, কুরুচি, ভালো যুক্তি সব আছে। ঘরের এক কোণ থেকে সোচ্চার আলোচনার একটি ধ্বনি অন্য কোণে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে।

.

৫.

যুবকদের মনের বিশেষত্ব এই যে তারা কোনও বিস্ফোরণের সঙ্গে যে সব স্ফুলিঙ্গ থাকে সেগুলো আগে হতে দেখতে পায় না বা তার কথা ভাবে না। বিস্ফোরণ কী ধরনের হবে তা-ও বুঝতে পারে না আগে থেকে। তাদের অন্তরে হালকা ভাবটা কিছুক্ষণের মধ্যেই এক প্রবল হাসিতে ফেটে পড়ে, তার পর চরম আনন্দের উত্তেজনার মাঝে হঠাৎ তাদের ভাবটা গুরুগম্ভীর হয়ে ওঠে। এই সময় হঠাৎ বলা একটা কথা বা কোনও অলস দায়িত্বহীন উক্তি আলোচনার মোড়টা সম্পূর্ণ নতুন পথে ঘুরিয়ে দিতে পারে। অনেক অজানা বিষয় এসে পড়ে কথায় কথায়।

সহসা কার একটা কথা ঘরের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। গ্রান্তেয়ার, বাহারোল, প্রুভেয়ার, বোসেত, কমবেফারে আর কুরফেরাক একযোগে কথাটা নিয়ে আলোচনা করতে লাগল।

কথাটা কে তুলেছে তা কেউ জানে না। গোলমালের ভেতর বোসেত কমবেয়ারেকে একটা তারিখের কথা বলল। বলল, ১৮১৫ সালের ১৮ জুন–ওয়াটারলু।

মেরিয়াস এতক্ষণ টেবিলে কনুই-এর উপর মাথা রেখে বসেছিল। ওয়াটারলু’র নাম শুনে সে তাদের মুখপানে তাকাল হঠাৎ।

কুরফেরাক বলল, আশ্চর্য! আমি দেখেছি ১৮ সংখ্যাটা বোনাপার্টের পক্ষে সব সময় মারাত্মক হয়ে উঠেছে। অষ্টাদশ লুই আর ১৮ ক্ৰমেয়ার–এর দ্বারা বোনাপার্টের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছে।

এঁজোলরাস এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সে বলল, তোমাদের বলা উচিত যে অপরাধ তিনি করেছিলেন তার উপযুক্ত শাস্তি তিনি পেয়েছেন।

ওয়াটারলু’র নাম শুনে মেরিয়াস আগেই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল। তার ওপর অপরাধ কথাটা সহ্য করতে পারল না। সে উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালে টাঙানো ফ্রান্সের মানচিত্রটার দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। আর একটা দিকে কর্সিকার একটা মানচিত্র ছিল। কর্সিকার মানচিত্রটার দিকে সে হাত বাড়িয়ে বলল, একটা ছোট দ্বীপ কর্সিকা ফ্রান্সকে বড় করেছে।

একঝলক ঠাণ্ডা বাতাস যেন বয়ে গেল ঘরখানার মধ্যে। এঁজোলরাস তার নীল চোখের দৃষ্টি বাইরে প্রসারিত করে মেরিয়াসের দিকে না তাকিয়েই বলল, ফ্রান্সের বড় হওয়ার জন্য কর্সিকার দরকার ছিল না। ফ্রান্স বলেই সে বড়।

কিন্তু মেরিয়াস এ কথা অত সহজে মেনে নিতে পারল না। সে এঁজোলরাসের মুখোমুখি হয়ে আবেগকম্পিত কণ্ঠে বলতে লাগল, ঈশ্বর করুন আমি ফ্রান্সকে যেন ছোট না করি। কিন্তু ফ্রান্সকে নেপোলিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে দেখাটা তাকে ছোট করা নয়, তার গৌরবকে খর্ব করা নয়। বিষয়টা স্পষ্ট ও পরিষ্কার করে ভোলা ভালো। আমি তোমাদের কাছে নবাগত। তোমাদের কথাবার্তায় আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আমি। কোথায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি? তোমরা কে এবং আমিই-বা কে? সম্রাটের সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী? আমি শুনেছি বোনাপার্টের বদলে তোমরা বুনাপার্ট উচ্চারণ করেছ। আমার মাতামহ আবার বোনাপার্তে উচ্চারণ করতেন। তোমরা বয়সে যুবক। কিন্তু কী চাও তোমরা? তোমরা যদি সম্রাটকে শ্রদ্ধা করতে না পার তা হলে কাকে শ্রদ্ধা করবে তার বদলে? তিনি যদি মহান না হন তা হলে কোন ব্যক্তিকে তোমরা মহান মনে কর তা বল। তার সব কিছুই গুণই ছিল। তিনি ছিলেন সমগ্র। মানুষের সব গুণ, সব বুদ্ধিবৃত্তিই তার মস্তিষ্কে ছিল। তিনি জাস্টিনিয়ানের মতো আইন প্রণয়ন করতেন, তিনি ছিলেন সিজারের মতোই স্বৈরতন্ত্রী, তাঁর কথার মধ্যে ছিল পাসকেলের বিদ্যুৎ আর ট্যাসিফাসের বন্ধু। তিনি এক নতুন ইতিহাস রচনা করেন, তার প্রচারিত ইশতেহার এক একটি মহাকাব্য। তিনি নিউটনের গণিতের সঙ্গে মুহম্মদের উপমা অলঙ্কারের মিশ্রণ ঘটান। তিনি যেসব কথা বলে গেছেন সেসব কথার স্তূপ পিরামিডের মতোই উঁচু হবে। তিলসিতে তিনি সম্রাটদের দয়া কাকে বলে তা শেখান, অ্যাকাঁদেমি দে সায়েন্সে তিনি ল্যাপলেসের প্রশ্নের উত্তর দেন, স্টেট কাউন্সিলে তিনি মার্টিনের সমান মর্যাদা লাভ করেন। তিনি সব কিছুই দেখতেন এবং সব কিছুই জানতেন। তিনি তাঁর নবজাত পুত্রের দোলনার উপর একজন সরল সাধারণ লোকের মতো আনন্দ করতেন। সহসা সমগ্র ইউরোপ সন্ত্রস্ত হয়ে শুনেছে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের ধ্বনি, অস্ত্রবাহিনীর বজ্রগর্জন, অশ্বারোহী বাহিনীর দ্বারা উৎক্ষিপ্ত ধূলির ঝড়ের শব্দ, আর যুদ্ধের তূর্যনিনাদ। আর তাতে বিভিন্ন দেশের সিংহাসনগুলো কেঁপে উঠেছে, বিভিন্ন দেশের সীমারেখাগুলো অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারা এক অতিমানবিক আশ্চর্য তরবারির খাপ থেকে বার করার শব্দ শুনেছে, তারা দেখেছে এক অতিমানব দিগন্তে মশাল হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর চোখে চোখ ধাঁধানো বিদ্যুতের আলো, তিনি এঁদ আর্মি আর ভিলে গার্দে নামে দুটো বিরাট ডানা মেলে বজ্র ও বিদ্যুতের মাঝে উড়ে যাচ্ছেন। সকলে জানত তিনি হচ্ছেন যুদ্ধের ঊর্ধ্বতন দেবদূত।

ঘরের উপস্থিত সকলে চুপ করে শুনতে লাগল। এঁজোলরাস মাথা নত করল। সব নীরবতার মধ্যেই সমর্থনের এক অনুচ্চারিত সুর থাকে। মেরিয়াস হাঁফ না ছেড়ে প্রবলতর আবেগের সঙ্গে আবার বলে যেতে লাগল, বন্ধুগণ, আমাদের সৌজন্যমূলক আচরণ করা উচিত। এই ধরনের এক সম্রাটের সাম্রাজ্যে পরিণত হওয়ার থেকে কোনও জাতির পক্ষে বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে? সে জাতি হল ফ্রান্স এবং তার প্রতিভা এক বিরাট পুরুষের প্রতিভার সঙ্গে যুক্ত হবে। এক রাজধানী থেকে অন্য রাজধানীতে বিজয়গর্বে এগিয়ে যাওয়া, কত রাজবংশের পতন ঘটানো, ইউরোপের মুখটাকে বদলে দেওয়া, তোমাদের হাতের তরবারিগুলোকে ঈশ্বরের তরবারির মতো করে তোল। একটি লোকের মধ্যে হ্যাঁনিবল, সিজার এবং শার্লেমেনকে পাওয়া যায়। যে জাতির জীবনে প্রতিটি প্রভাত নব নব জয়ের সংবাদ এনে দেয় সে জাতির পক্ষে সেটা কি এক বিরল সৌভাগ্যের কথা নয়? ম্যারেঙ্গো, আর্কোল, অস্টারলিস, আয়েনা, ওয়াগরাম প্রভৃতি নামগুলো চির উজ্জ্বল হয়ে আছে ইতিহাসে। ফরাসি সাম্রাজ্যকে রোম সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী করে তোলা, পাহাড় থেকে যেমন ঈগলরা বিভিন্ন দিকে উড়ে যায় তেমনি এঁদ আর্মি গঠন করে পৃথিবীর চার প্রান্তে এক একটি বিরাট সেনাদল নিয়ে এগিয়ে যাওয়া; অস্ত্রশস্ত্র ও বুদ্ধির দ্বারা দু দু বার পৃথিবী জয় করার মতো এক উজ্জ্বলতম জাতীয় গৌরব অর্জন করা, যে কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়–এগুলো কি মহত্ত্বের পরিচায়ক নয়? এর থেকে মহত্তর আর কী হতে পারে?

কমবেফারে বলল, স্বাধীন হতে পারা।

এবার মেরিয়াস মাথা নত করল। শান্তভাবে বলা শীতল কথাটা তার বাগ্মিতাতপ্ত বুকটাকে তরবারির মতো বিদ্ধ করল। তার মনে হল সহসা সব উদ্যম উবে গেছে তার। মেরিয়াস মুখ তুলে দেখল কমবেফারে আর সেখানে নেই। কথাটা বলে ফল হয়েছে। দেখে তৃপ্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কমবেফারে আর তার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সব বন্ধুরাও তার সঙ্গে চলে যায়। শুধু এঁজোলরাস আর মেরিয়াস ঘরের মধ্যে রয়ে যায়। মেরিয়াসকে গভীরভাবে খুঁটিয়ে দেখছিল এঁজোলরাস। এদিকে মেরিয়াসও ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে। মনে মনে সে পরাজয় স্বীকার করল না কিছুমাত্র। আবেগের উত্তাপের তখনও বেশ কিছু অবশিষ্ট ছিল তার মধ্যে। সেই আবেগের সঙ্গে আরও অনেক কিছু সে শোনাত এঁজোলরাসকে। কিন্তু হঠাৎ একটা গান শুনে দমে গেল সে। সে শুনতে পেল কমবেফারে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে পথটার উপর দাঁড়িয়ে একটা গান গাইছে। গানটার বাণীগুলো এই : সিজার যদি আমায় অনেক যুদ্ধজয়ের গৌরব আমার হাতে তুলে দিয়ে বলতেন, মা’র ভালোবাসা ত্যাগ কর, তা হলে আমি তাকে বলতাম, তোমার রথ আর রাজদণ্ড ফিরিয়ে নাও সিজার। সবকিছুর থেকে আমি আমার মাকে ভালোবাসি।

মিষ্টি করুণ সুরে গানটা এমনভাবে গাইছিল কমবেফারে যে গানটার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। গানটা শুনতে শুনতে ঘরের ছাদের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল মেরিয়াস। আপন মনে অনুচ্চস্বরে অর্ধচেতনভাবে বলে উঠল, আমার মা?

এঁজোলরাস তখন তার কাঁধে একটা হাত রেখে বলল, হে নাগরিক, দেশের প্রজাতন্ত্রই হচ্ছে আমার মা।

.

৬.

সেদিনের সন্ধ্যাটা গভীরভাবে কাঁপিয়ে দেয় মেরিয়াসের মনটাকে। এক অব্যক্ত বিষাদের ভারে ভারী হয়ে ওঠে মনটা। মাঠে মাঠে যখন জমি কর্ষণ করে বীজ বপন করা হয় তখন ধরিত্রীর বুকেও এমনি একটা ব্যথা বাজে। বীজের অঙ্কুরোদগম, প্রাণচঞ্চলতা ও ফসলের আনন্দ অনেক পরে আসে।

বিষণ্ণ হয়ে ভাবতে লাগল মেরিয়াস। সম্প্রতি যে বিশ্বাসের সম্পদ সে খুঁজে পেয়েছে সে সম্পদ কি ত্যাগ করবে সে? সে নিজেকে এই বলে বোঝাল যে তার সংশয়ের কোনও প্রয়োজন নেই। দুটি বিশ্বাসের ঘাত-প্রতিঘাতে এই ভাবে দুলতে থাকাটা সত্যিই অস্বস্তিকর। একটি বিশ্বাস বা মতবাদ যখন তাকে বর্জন করে যায়নি, আবার আর একটি বিশ্বাস যখন তাকে এখনো আলিঙ্গন করে বরণ করে নেয়নি, তখন আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মতো এক দুঃসহ অবস্থা হয় তার মনের মধ্যে। স্বচ্ছ দৃষ্টিসম্পন্ন মেরিয়াস চাইছিল সত্যিকারের এক আলো। অথচ এক সংশয়ের গোধূলির দ্বারা পীড়িত হচ্ছিল তার মনটা। তার পুরনো বিশ্বাসের ভিত্তিভূমিটাতে দাঁড়িয়ে থাকার যতই ইচ্ছা হোক না কেন, অগ্রগতির পথে কে যেন নির্মমভাবে টানছিল তাকে। এগিয়ে যেতে সে বাধ্য। তাকে ভাবতে হবে এ নিয়ে, চিন্তা করতে হবে, প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু এ চিন্তা কোথায় নিয়ে যাবে তাকে? তার একমাত্র ভয়, তার বাবার অনেক কাছে এসে পড়েও আবার সে দূরে সরে যেতে বাধ্য হবে। কারা তাকে যেন জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তার বাবার কাছ থেকে। যতই ভাবতে লাগল সে এ বিষয়ে ততই আরও বেশি বিচলিত হয়ে পড়ল। একটা বিরাট বাধা ঘিরে ধরল তাকে। সে তার মাতামহের ও তার বন্ধুদের থেকে পৃথক হয়ে পড়ল। দু দিক থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল সে। প্রাচীন ও নবীন–কোনও দলেই যোগ দিতে পারল না সে। সে কাফে মুসেতে যাওয়া ছেড়ে দিল।

অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলে মনের অবস্থা খুব খারাপ থাকায় টাকা-পয়সার কথাটা ভেবে দেখেনি মেরিয়াস। হোটেলমালিক হোটেলের বিলটা তার কাছে এনে দিল। বলল, মঁসিয়ে কুলফেরাক আপনাকে নিয়ে এসেছে এখানে। তা-ই নয় কি?

হ্যাঁ।

কিন্তু বিলের টাকা চাই আমার।

দয়া করে কুরফেরাককে আমার কাছে কিছুক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দেবেন?

কুরফেরাক এসে দেখা করল তার সঙ্গে। মেরিয়াস তাকে এতদিন যে কথা বলেনি সে কথা বলল। বলল, সে এখন জগতে সম্পূর্ণ একা। তারা বাবা-মা কেউ নেই।

কুরফেরাক বলল, তা হলে তোমার কী হবে?

মেরিয়াস বলল, জানি না।

তোমার কাছে কত টাকা আছে?

পনেরো ফ্রাঁ।

তুমি কি আমার কাছ থেকে কিছু টাকা ধার চাও?

না, কখনই না।

তোমার কিছু পোশাক আছে?

যা আছে তা এই।

কিছু সোনারুপো আছে কাছে?

কেবল একটা হাতঘড়ি।

রুপোর?

সোনার, এই তো।

আমি একটা দোকানদারকে জানি যে তোমার পুরনো টেলকোট আর বাড়তি একজোড়া পায়জামা নেবে।

ভালো।

তা হলে তোমার পোশাকের মধ্যে শুধু থাকবে একজোড়া পায়জামা, একটা ওয়েস্ট কোট, টুপি আর জুতো।

এইসবই যথেষ্ট।

আমি ঘড়ি প্রস্তুতকারককে চিনি যে তোমার হাতঘড়িটা কিনে নেবে।

ভালো।

না, ভালো নয়। সব টাকা ফুরিয়ে গেলে কী করে চলবে তোমার?

যাই হোক, সৎভাবে চলতে হবে।

তুমি ইংরেজি জান?

না।

জার্মান?

না।

দুঃখের বিষয়।

কেন?

আমার এক পুস্তকবিক্রেতা বন্ধু একটা বিশ্বকোষ প্রকাশ করছে। ইংরেজি ও জার্মান ভাষা থেকে কিছু লেখা তুমি অনুবাদ করতে পারতে। পারিশ্রমিক খুবই কম, তবে কোনওরকমে চলে যেত।

তা হলে আমি ইংরেজি আর জার্মান ভাষা শিখে নেব।

ইতোমধ্যে চলবে কী করে?

পোশাক আর ঘড়ি বিক্রির টাকায় চলবে।

পোশাক বিক্রি করে কুড়ি ফ্রাঁ আর হাতঘড়ি বিক্রি করে পঁয়তাল্লিশ ফ্র পাওয়া গেল।

হোটেলে ফিরে এসে মেরিয়াস বলল, আমার কাছে পনেরো ফ্ৰাঁ আগে হতেই ছিল। এখন সব মিলিয়ে আশি ফ্রাঁ হল।

কুরফেরাক বলল, কিন্তু হোটেলের বিল?

হা ভগবান, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।

হোটেল বিল দেখা গেল সত্তর ফ্রাঁ হয়েছে।

কুরফেরাক বলল, কী মুশকিলের কথা! মাত্র দশ ফ্রাঁতে তুমি কি করে ইংরেজি ও জার্মান শিখবে?

এমন সময় মেরিয়াসের মাসি ম্যাদময়জেল গিলেনৰ্মাদ কোনওরকমে তার ঠিকানা জোগাড় করে একটা চিঠি আর একটা প্যাকেটে করে কিছু টাকা পাঠায়। টাকার পরিমাণ ষাট পিস্তোল, যা ভাঙালে দুশো ফ্রাঁ হবে। কিন্তু টাকাটা ফেরত পাঠিয়ে দিল মেরিয়াস। সে একটা চিঠিতে তার মাসিকে জানাল সে তার জীবিকার ব্যবস্থা করেছে। তাতেই তার চলে যাবে। অথচ তার হাতে তখন ছিল মাত্র তিন ফ্রাঁ।

তার মাসি তার এই টাকা প্রত্যাখ্যানের কথা মঁসিয়ে গিলেনর্মাদকে জানাল না। কারণ তাতে তাঁর রাগ আরও বেড়ে যাবে। তাছাড়া তাঁর কাছে মেরিয়াসের নাম উল্লেখ করতেই তিনি নিষেধ করে দিয়েছিলেন তাকে।

মেরিয়াস পোর্তে সেন্ট জ্যাক হোটেল ছেড়ে দিয়ে চলে গেল। আর ঋণ বাড়িয়ে লাভ নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *