॥ দশ ॥
ট্যাক্সি থেকে নেমে বীণা একবারও পিছু ফিরে না চেয়ে বাসার সদরে ঢুকল এবং সিঁড়ি বেয়ে উঠবার চেষ্টা করতে লাগল। একটু থেমে থেমে, রেলিঙে ভর রেখে, খুব ধীরে ধীরে উঠছিল সে। পিছনে রণেন, তার এক হাতে ফোলিও ব্যাগ, অন্য হাতে প্লাস্টিকের ঝোলায় বীণার জিনিসপত্র। দুটো ব্যাগ একহাতে নিয়ে অন্য হাতটা বাড়িয়ে বীণার হাত ধরল সে, সাহায্য করতে চেষ্টা করল। বীণা হাতটা ঝাঁকিয়ে তিব্র স্বরে বলে—আঃ, ছাড়ো! লাগছে!
লাগার মতো জোরে ধরেনি রণেন, তবু অপ্রস্তুত হয়ে ছেড়ে দিয়ে বলে—একা উঠতে পারবে? কষ্ট হচ্ছে তো!
—হোক। অনেক উপকার করেছ, আর করতে হবে না। বীণা বলে।
ট্যাক্সিতে শেষ দিকে তাদের কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বীণা চুপচাপ বাইরের দিকে চেয়ে বসেছিল। রণেনকে দরকার মতো উপেক্ষা করার একটা নিজস্ব ভঙ্গি আছে বীণার। মুখটায় একটু দুঃখী ভাব করে ছলছলে চোখে অন্যদিকে চেয়ে থাকে। মনে হয় বুঝি অভিমান। তা নয়! তখন সেই অভিমান ভাঙতে গেলেই অনর্থ ঘটে। ভঙ্গিটা দেখেই রণেন মনে মনে বিপদের গন্ধ পেয়েছিল তখনই।
থেমে থেমে অনেকক্ষণ ধরে সিঁড়ি ভাঙে বীণা। মাঝে মাঝে কাতর ব্যথা-বেদনার শব্দ করে—উঃ বাবা! রণেন ধৈর্য ধরে পিছনে অপেক্ষা করে। বীণাকে ধরে তুলবে তার উপায় নেই। ছুঁতে গেলেই ও নির্দয় অপমান করবে।
দরজা খুলে ননীবালা অবাক হয়ে বলেন—চলে এলে?
বীণা উত্তর দিল না। দরজার চৌকাঠে হাতের ভর রেখে দাঁড়াল একটু। ননীবালা সরে গিয়ে বলেন—ঘরে এস।
বাচ্চারা ঠাকুমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে। টুবাই মাকে দেখে ভারী খুশি হয়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে দু’কদম এগিয়ে গিয়েছিল, ননীবালা তাকে টেনে রেখে বলেন—ছুঁস না, অশৌচ। তারপর রণেনের দিকে চেয়ে বলেন—বউমাকে ঘরে নিয়ে আয়। আমি গরম জল করে দিচ্ছি, তুই স্নান করে ফেলিস।
বীণা কোনও কথা না বলে তার ঘরে চলে গেল, আর ঠাস করে ভিতর থেকে বন্ধ করে দিল দরজা। অপ্রস্তুত অবস্থা। ননীবালা অপমানটা হজম করতে পারছিলেন না। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন—কি জানি বাবা, আমরা তো এ অবস্থায় আঁতুড়-অশৌচ দুই-ই মানি। এতে রাগের কথা কী হল?
রণেন ব্যাগট্যাগ বাইরের ঘরের টেবিলেই রাখে। জামাকাপড় ছাড়তে পারে না, কারণ ঘরের দরজা বন্ধ। অগত্যা একটা গামছা জড়িয়ে সোফা-কাম-বেডটার ওপর বসে থাকে। ননীবালা চা করতে করতে রান্নাঘর থেকে ডেকে বলেন—বউমাকে জিজ্ঞেস কর তো চা খাবে নাকি!
রণেন অবশ্য সে চেষ্টা করে না। তখন বুবাই উদ্যোগী হয়ে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দেয়—মা, ও মা, চা খাবে? ঠানু জিজ্ঞেস করছে! মা, ও মা, খাবে? খাবে না?
বাচ্চাদের যা স্বভাব, মা দরজা খুলছে না, মা দরজা খুলছে না, কাজেই বুবাই ক্রমান্বয়ে দরজা ধাক্কায়, আর ডাকে। তার সঙ্গে জুটে যায় টুবাই আর শানুও। তিনজনে তুলকালাম করাঘাত করে দরজায়। তারস্বরে ডাকে। টুবাই দৌড়ে এসে বাপকে বড় বড় চোখ করে বলে যায়—দরজা খুলছে না, মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। গত লক্ষ্মীপুজোয় সারাদিন উপোসের পর ভোগ-টোগ বেঁধে, পিত্ত আর অম্বলে কাহিল হয়ে ননীবালা অজ্ঞান হয়ে যান। সেই অভিজ্ঞতা থেকে টুবাইয়ের ধারণা, কেউ বন্ধ ঘর থেকে সাড়া না দিলে, বা ঘুমন্ত অবস্থা থেকে সহজে চোখ না মেললে সে নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গেছে।
তিনজনের ওই ধাক্কাধাক্কি আর ডাকাডাকির বাড়াবাড়ি দেখে ননীবালা উঠে এসে ধমকান—ও-রকম করিস না, মেজাজ ভাল নেই, উঠে আবার মারধর করবে।
ঠিক তখনই বীণা দরজা খোলে। ক্লান্ত চেহারা, দরজাটা ধরে দাঁড়িয়ে, ডান হাতে পাখার ডাঁটটা তুলে এলোপাথাড়ি কয়েক ঘা কসায় বাচ্চাগুলোর মাথায়, গায়ে, শ্বাসের সঙ্গে চাপা চিৎকারে বলে—যাঃ যাঃ, আপদ কোথাকার। জন্মে কখনও শুনিনি পাঁচ মাসের আগে বাচ্চা নষ্ট হলে কেউ আঁতুড় বা অশৌচ মানে। আমার বেলা যত নিয়ম! যাঃ যাঃ, ছুঁবি না আমাকে, ধারেকাছেও আসবি না।
বীণার মূর্তি দেখে ননীবালার কথা জোগায় না। রণেন চায়ের কাপে চোখ রেখে বসে থাকে। বীণা দরজাটা বন্ধ করতে যাচ্ছিল, তখন ননীবালা বললেন—তা আমি কি জানি ক’মাস! আমাকে কি তোমরা কিছু বলো?
বীণা তীব্র চোখে বলে—পাঁচ মাসে পঞ্চামৃত হলে আপনি তা জানতে পারতেন না? কচি খুকি তো নন। ঢের বয়স হয়েছে।
রণেন বুঝতে পারে, মা একটা ভুল করেছে কোথাও। এ সব মেয়েলি ব্যাপার তার মাথায় ঢোকে না, কিন্তু এটুকু বুঝতে পারে হয় ননীবালা ভুল করে কিংবা ইচ্ছে করেই আঁতুড় আর অশৌচের কথাটা তুলেছেন। সম্ভবত ননীবালার ধারণা ছিল যে, বীণা একালের মেয়ে, এত সব খুঁটিনাটি সে জানে না। কিন্তু ইচ্ছে না ভুল তার বিচার হবে কী করে? সংসারের কত সত্য কথা কোনওদিনই জানা যায় না!
ননীবালা এক পরদা গলা নামিয়ে বলেন—অশৌচ না মানলেও হাসপাতালের ছোঁয়াটোয়া তো মানবে! না কি তাতেও দোষ?
তীব্র কণ্ঠে বীণা উত্তর দেয়—দোষ কিনা তা আপনিই জানেন! আমার বেলায় হাজার দোষ, হাজার নিয়মনিষ্ঠা। কিন্তু কারো দরদ তো দেখি না! নার্সিং হোমে বুবাইয়ের বাপ ছাড়া কেউ একদিন উকি দিয়েও দেখে আসেনি, এক বেলা কেউ ঘরের ভাত পৌঁছে দিয়ে আসেনি! আর দুর্বল শরীরে ঘরে পা দিতে না দিতেই আচার-বিচার শুরু হয়ে গেল!
রণেন এইটুকু শুনেছিল। চায়ের কাপ রেখে সে দ্রুত বাথরুমে গিয়ে ঢুকে পড়ে। ননীবালা গরম জল করে দেওয়ার সময় পাননি, কাজেই শীতে হিম হয়ে থাকা জল তুলে রণেন তার উত্তপ্ত মাথায় ঢালতে থাকে। স্নানের দরকার ছিল না। জলের শব্দে ঝগড়ার শব্দটা ডুবিয়ে দিল কেবল।
ননীবালা অবশ্য পিছিয়ে গিয়েছিলেন। ঝগড়াটা তাই বেশি দূর গড়ায়নি। স্নানটান করে এসে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে রণেন দেখে, বীণা মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে, বুকের কাছে টুবাই। টুবাই ছোট, তার অপমান জ্ঞান নেই, কিন্তু বড় দুজন মার খেয়ে ঠাকুমার ঘরে ঢুকে গেছে, সেখান থেকেই তাদের গলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল।
চুল পাট করতে করতে রণেন তার ব্যক্তিত্বের ঘাটতিঅলা মুখখানা দেখছিল। কিছু ব্যক্তিত্ব যদি এই মুখশ্রীতে থাকত তবে এই সংসারটাকে আঙুলের ডগার সঞ্চালনে শাসন করতে পারত সে। বাপের বড় ছেলে বোকা হয়—এটা একটা প্রচলিত কথা। তার নিজের ক্ষেত্রে কথাটার ব্যত্যয় হয়নি। সে বোকাই। এবং বোকা বলেই ব্যক্তিত্বহীন। এ সবই বুঝতে পারে রণেন। ব্রজগোপালের উপেক্ষিত সংসারটি সে টানছে আজ বহুদিন। বিনা প্রশ্নে এবং বিনা দ্বিধায়। মা-বাপ-ভাই মিলে এ সংসার তো তারই নিজস্ব সংসার ছিল এতকাল। শুধু সংসার নয়, এ ছিল তার অস্তিত্ব, তার বেঁচে থাকা। মায়ের জন্য মঠ-মন্দির গাড়ি-বাড়ি সবই সে করে দিতে চেয়েছিল মনে মনে, এতকাল। কোনও দ্বিধা ছিল না, সংশয় ছিল না। সকলে বলত—রণেনের মতো এমন মাতৃভক্তি দেখা যায় না। সেই ভক্তিটা এখন আর তেমন টের পায় না রণেন। সংসার টানতে আজকাল তার কষ্ট হয়। কত ব্যয়কে মনে হয় অপব্যয়। বাবার টাকায় মায়ের নামে কেনা জমিতে নিজের টাকায় বাড়ি করা যে কত বড় মূর্খতা তা অনায়াসে বুঝতে পারছে। তাই বীণার পরামর্শে চোরের মতো সে গিয়েছিল অজিতের কাছে, জমিটা বীণার নামে কেনার জন্য। সেই গ্লানিটাও তাকে চেপে ধরে। ব্যক্তিত্বহীনদের এই রকমই সব হয়। ভাল বা মন্দের বোধ নষ্ট হয়ে যায়। কী যে করবে, কী যে করা উচিত তা সে ভেবে পায় না।
অনেকক্ষণ বে-খেয়ালে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার পুরনো স্বভাব। আয়না পেলে প্রায়ই তার বাহ্যজ্ঞান থাকে না।
বিরক্ত হয়ে বীণা বলল—আলোটা নিবিয়ে দাও, চোখে লাগছে।
অপ্রস্তুত হয়ে সে আলো নেবায়, আর অন্ধকারে বীণার বাঁকা গলার স্বরটা আসে—দিনরাত মুখ দেখা, তাও যদি দেখার মতো মুখ হত।
এ সবই উপেক্ষা করতে পারে রণেন। তার স্বভাব শান্ত, রেগে গেলেও সহজে প্রকাশ পায় না তার রাগ। কথা কম বলে। সে বীণাকে অন্ধকারে শুয়ে থাকতে দিয়ে বাইরের ঘরের সোফা-কাম-বেডটায় একটু কেতরে বসে থাকে। রেডিয়োটা চালিয়ে দেয়। খবর হচ্ছে। একটা যুদ্ধ-টুদ্ধ লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা। চারদিকে টেনশন, কিন্তু দেশের খবর তাকে বিন্দুমাত্র চিন্তান্বিত করে না। সে নিজেকে নিয়ে ভাবে। ভাবতে ভাবতে ঘুম-ভাব এসে যায়, রেডিয়োটা চলতেই থাকে।
হঠাৎ চমকে উঠে শোনে পুরুষ-হাতে রেডিয়োটা বন্ধ করে দিল বীণা। ঝাঁঝ-গলায় বলে—এই কপাল-কুষ্ঠিটা খুলে রেখে ঘুমচ্ছো কেন? ব্যাটারি নষ্ট হয় না!
রণেন চোখ চায়। বীণার ক্লান্তির ভাবটা কি কেটে গেল। ঘরের আসবাবপত্র টেনে টেনে সরাচ্ছে আর আপনমনে বলছে—কদিন ছিলাম না, নোংরার হদ্দ হয়ে আছে ঘরদোর। ঝুল-কালি-ধুলো, বিছানাপত্র গু হয়ে আছে…বলতে বলতে আবার ও ঘরে যায়, আলনা হাঁটকে জামা-কাপড় ছুঁড়ে ফেলে মেঝেয়—আন্ডারওয়্যার, গেঞ্জি কী কালেকুষ্টি হয়ে আছে! আমাকে আবার আচার-বিচার শেখাতে আসে সব। নোংরার হদ্দ, বস্তিবাড়িতে গিয়ে থাকা উচিত।
রণেন বুঝতে পারে, এসব কথা শোনানোর জন্যই তাকে জাগিয়ে নিয়েছে বীণা। এখন সে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। সহজে ছাড়বে না। বিষণ্ণ মনে রণেন বসে শোনে, বীণা ও-ঘরে ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে বলছে—কী সব চেহারা হয়েছে এ ক’দিনে। খাস না নাকি তোরা? হাড় জিরজির করছে! কনুইতে ময়লা, ঘাড়ে ময়লা, চোখে পিচুটি, দাঁতে ছ্যাতলা—কেউ এসব দেখে না নাকি! এই শীতে গায়ে গরম জামাও কেউ পরায়নি!
ননীবালা গ্যাসের উনুনের সামনে বসে আছেন নিশ্চুপে। কিন্তু সেটা তাঁর পরাজয়-মেনে-নেওয়া মনে করলে ভুল হবে। মনে মনে তিনিও তৈরি হচ্ছেন, লেগে যাবে। রণেন উঠে বসল এবং বীণার উদ্দেশে একটা দুর্বল ধমক দিয়ে বলল—আঃ কী হচ্ছে! চুপ করে শুয়েটুয়ে থাকো না।
বীণা প্রায় ঝাঁপিয়ে আসে—কেন চুপ করে থাকব? এই ঘর-সংসারে আমি কি ফ্যালনা? আমার বলার কথা কিছু থাকতে পারে না?
—এই দুর্বল শরীরে অত চেঁচিও না। ডাক্তার তোমার ওঠা-হাঁটা বেশি বারণ করেছেন।
—থাক, অত দরদে কাজ নেই। মুখের দরদ অনেক দেখা আছে।
এইভাবে শুরু হয়েছিল। ননীবালা কেন যেন উত্তর দিচ্ছেন না। চুপচাপ আছেন। বীণা গনগন করে যেতে লাগল একা একা। দু-চার ঘা বাচ্চাদের মারধরও করল শোওয়ার ঘরে। বোঝা যায়, সে ননীবালাকে উত্তেজিত করে ঝগড়ায় নামাতে চাইছে। একটা হেস্ত-নেস্ত করাই তার উদ্দেশ্য। ক্রমে ক্রমে তার কথাবার্তায় মরিয়া ভাব ফুটে উঠতে লাগল, রণেন শুনতে পায় শোওয়ার ঘরের ভেজানো দরজার ওপাশে বীণা চাপা গলায় বলছে—পাগলের গুষ্ঠি। দ-পড়া কপাল না হলে কারও এরকম শ্বশুরবাড়ি হয়।
বহুকাল আগে রণেনের একবার কড়া ধাতের টাইফয়েড হয়েছিল। তখন টাইফয়েডের চিকিৎসা ছিল না। গ্রামে-গঞ্জে ডাক্তার-কবিরাজও ছিল না সুবিধের। প্রায় বাহান্ন দিনে তার জ্বর কমেছিল বটে, কিন্তু কিছুকাল তার বিকারের অবস্থা হয়েছিল। জ্বরের পরও প্রায় মাস তিনেক সে মস্তিষ্কবিকারে ভুগেছে। লোকে বলে টাইফয়েডের পর ওই পাগলামির সময়ে সে মা-বাপকে চিনতে পারত না, নিজের বাড়ি কোথায় বলতে পারত না। সেই পাগলামি সেরে যাওয়ার পর রণেন খুব ঠান্ডা আর ভালমানুষ হয়ে যায়। কিন্তু সে যে একদা পাগল হয়ে গিয়েছিল এই ঘটনাটা সে কোনওদিনই ভুলতে পারে না। মাঝে মাঝে তার মনে হয় পাগলামিটা ছাই চাপা হয়ে আছে তার অভ্যন্তরে। সেই কারণেই বোধ হয় আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে আজও এই বয়সেও সে নানা অঙ্গভঙ্গি করে, ব্যক্তিত্ব খোঁজে, ফাঁকা মাঠ পেলে ছেলেমানুষের মতো দু-চক্কর দৌড়ে নেয়, কিংবা একাবোকা অবস্থায় সে এরকম অনেক কিছুই করে। ‘পাগল’ কথাটা শুনলেই বরাবর একটু চমকে ওঠে। তার বুকের ভিতরে একটা ভয় যেন হনুমানের মতো এ-ডালে ও-ডালে লাফিয়ে বেড়ায়।
সে উঠে শোওয়ার ঘরের দরজার কাছে গিয়ে বলল—শোনো, এত অশান্তি কোরো না। যদি বাড়াবাড়ি করো, তা হলে আমি বেরিয়ে যাব।
বীণা টুবাইকে হাত-মুখ ধুইয়ে এনে গরম পোশাক পরাচ্ছিল হাঁটু গেড়ে বসে। মুখ না ফিরিয়েই বলে—তুমি বেরিয়ে যাবে বলে ভয় দেখাচ্ছ কাকে? তুমি কবে ঘরে থাকো, কতক্ষণই বা থাকো? ঘরের কোনও খবর কি তোমার কানে যায়? যেতে হয় যাও, আমাকে চোখ রাঙাতে এস না। আমি আর ও-সব গ্রাহ্য করি না।
অগত্যা বেরিয়েই গেল রণেন। শীতের রাস্তায় রাস্তায় খানিক হাঁটল। মাথাটা গরম। মোড়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেল। দু-চারজন চেনা পাড়ায় লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলল। সোমেন তার আড্ডা সেরে ফিরছিল। রাত হয়েছে। রণেনকে রাস্তায় দেখে সিগারেট লুকিয়ে নতমুখে পেরিয়ে যাচ্ছিল, রণেন তাকে ডাকল। এত রাত করে ফেরে, একটু শাসন করা দরকার। দিনকাল ভাল নয়।
—এত রাত করে ফিরিস কেন? লোকের চিন্তা হয় না?
সোমেন তার কমনীয় সুন্দর মুখটি তুলে হাসল। হাসিটি ভুবন-ভোলানো। রণেন শাসন করতে গিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। সোমেন বলে—একটা পিকনিকে যাব কাল, তার সব জোগাড়যন্ত্র করছিলাম, তাই দেরি হয়ে গেল।
রণেন গলাখাঁকারি দেয়। ভাইটাকে সে কোনওদিনই কড়া কথা বলতে পারে না। বড্ড মায়াবী। আজকালকার এই বয়সের ছেলেদের যেমন ডোন্টপরোয়া ভাব তেমন নয়। তাই রণেন বলে—ও। গায়ে গরম জামা নেই কেন? ওই পাতলা সোয়েটারে কি শীত মানে? একটা পুল-ওভার কিনে নিস।
—তেমন শীত কই? আমার তো ঠান্ডা লাগেই না।
—পিকনিকে বাইরে যাচ্ছিস তো! সেখানে শীত লাগবে। বরং আমার কোটটা নিয়ে যাস।
—তোমারও তো কাল বাইরে যাওয়ার কথা। কোট তোমারও তো লাগবে!
বাইরে যাওয়ার কথা! তাই তো! গোলমালে খেয়াল ছিল না। বাবার কাছে কাল তার একবার যাওয়া উচিত। ওই অভিশপ্ত জমিটার হাত থেকে তো রেহাই নেই।
রণেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল। বলল—হুঁ, আচ্ছা যা।
গোলমালটা বাঁধল রাত্রে।
খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা দিয়েছে তারা। রণেন দেখল বীণা কাগজ জ্বেলে ঘরের মেঝেয় একবাটি দুধ গরম করছে।
—ও কী করছ? রণেন জিজ্ঞেস করে।
বীণা উত্তর দিল—দেখতেই পাচ্ছ।
—ঘরে কাগজ জ্বালছ কেন, রান্নাঘর থাকতে?
—রান্নাঘরে আমি যাব না, কারও শুচিবাইয়ে লাগতে পারে।
—মাকে বললে মা নিজেই গরম করে দিত। কী করবে দুধ দিয়ে এত রাতে?
বীণা উত্তর দিল না। দুধ গরম করে ঘুমন্ত টুবাইকে টেনেহিঁচড়ে আনল বিছানা থেকে। টুবাই ঘুমের মধ্যে কাঁদে, হাত পা ছোড়ে। তাকে গোটাকয় চড়-চাপড় দিয়ে, গলায় আঁচল চেপে ঝিনুকে দুধ খাওয়াতে থাকে বীমা।
একটু অবাক হয় রণেন। একটু আগে টুবাই দুধ-ভাত খেয়ে ঘুমিয়েছে। এখনই আবার খাওয়ার কথা নয়। বলল—একটু আগেই তো খেলো, এখন আবার খাওয়ানোর কী দরকার? কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে কষ্ট দেওয়া শুধু শুধু।
বীণা হঠাৎ দু’খানা ঝকঝকে চোখের ছোরা মারে রণেনকে। একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে—কেন, টুবাই বেশি খাচ্ছে বলে চোখে লাগছে নাকি? লাগলে অমন চোখ কানা করে রাখো?
রণেন চুপ করে থাকে। বীণা নিজেই বলে—বাচ্চাদের খাওয়াই, এটাকে সকলেরই চোখ কেন যে কটকট করে!
রণেন একটু উত্তপ্ত হয়ে বলে—একে খাওয়ানো বলে না। এ হচ্ছে তোমার বাতিক। অত খাওয়া কি সহ্য হবে?
বীণা খুব অবাক চোখ তুলে বলে—দু’ঝিনুক দুধ বাচ্চারা খাবে না? এ কদিন ভাল করে দুধ গেছে নাকি পেটে? তোমরা পাগল না কি! ‘অত খাওয়া’ বলতে তুমি কী বোঝাতে চাও?
—বলছি, পেটে অত সইবে না।
—সে আমি বুঝব। পেটে কী সয় না সয় তা আমি মা হয়ে জানি না! তুমি জানবে?
—তোমার মাথায় ছিট-পড়া।
—তা হবে। পাগলদের সঙ্গে থাকলে লোকে পাগলই হয়।
রণেন শ্বাস ফেলে চুপ করে থাকে। কিন্তু বীণার আক্রোশ তাতে কমে না। সে বলে—পাগলের গুষ্ঠি। যেমন পাগল ছিল বাপ, বাউন্ডুলে হয়ে বেরিয়ে গেছে, তেমনি ছেলে পাগল।
হঠাৎ সেই পুরনো ক্ষতে হাত পড়ে। ঠান্ডা, ভালমানুষ রণেন একটা ঝাকুনি খেয়ে জেগে ওঠে যেন। হঠাৎ চেঁচিয়ে বলে—চুপ করো বলছি!
বীণা চমকে ওঠে। টুবাই বিষম খায়। দুধ গড়িয়ে নামে গাল বেয়ে। বীণা তার শান্তস্বভাব, উত্তাপহীন স্বামিটিকে হঠাৎ উত্তেজিত হতে দেখে একটু অবাক হয়। তাকায়। এবং তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে যায় সে তার স্বামীর একটি অতিশয় দুর্বলতার স্থান খুঁজে পেয়েছে। এতকাল এই দুর্বলতার কথা তার জানা ছিল না। মানুষ আর একটা মানুষের কত কিছু জানতে পারে না, কাছাকাছি থেকেও।
মেয়েদের নিষ্ঠুরতার বুঝি শেষ নেই। যে মুহূর্তে বীণা বুঝতে পারে যে ‘পাগল’ কথাটাই রণেনকে উত্তেজিত করেছে সেই মুহূর্তেই সে দুর্বল জায়গাটায় প্রবল নাড়া দিতে থাকে। এবং খেলাটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। বীণা বলে—কেন, চুপ করব কেন? তোমাদের মধ্যে পাগলামির বীজ নেই? তোমার বাবাকে লোকে পাগল বলে না? তোমারও ছেলেবেলায় অসুখের পর একবার পাগলামি দেখা দেয়নি? আমি কি ভুল বলছি? যা সত্যি তা বলব না কেন?
ঠান্ডা এবং শান্তস্বভাবের রণেনের ভিতরে সেই হনুমানের হাঁচোড় পাঁচোড় তার ভিতরটাকে নয়-ছয় করে দেয়, রাগে চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়। সে বুঝতে পারে বীণা তাকে পাগল করে দিতে চাইছে। তার মনে নিভৃতে লুকিয়ে রাখা বড় গোপন ও লজ্জার স্থানটিতে এই প্রথম হানা দেয় মানুষ। সে মাথা চেপে ধরে। সে আর একবার চেঁচায়, কিন্তু কোনও কথা ফোটে না, একটা জান্তব আওয়াজ বেরিয়ে আসে। এবং সেই মুহূর্তে তার মনের যাবতীয় মানবিক চিন্তাশক্তি লুপ্ত হয়ে যায়।
বীণা তার দিকে আঙুল তুলে বলে—তুমি পাগল নও? আগে এসব জানলে তোমার সঙ্গে বাবা আমার বিয়ে দিত? পাগলের বংশে কেউ জেনেশুনে মেয়ে দেয়?
রণেন মশারি সরিয়ে বিছানার ধারে বসে সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটটা পড়ে গেল। শূন্য এবং ভয়ার্ত চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে রণেন। এখন থেকে এই মেয়েমানুষটার চেয়ে বড় শত্রু তার আর কেউ নেই। ওই ভঙ্গি থেকেই সে হঠাৎ পা বাড়িয়ে লাথিটা কষাল বীণার বুকে। টুবাই ছিটকে গিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে উঠে বসে। বীণা পড়ে গিয়ে ফের উঠতে যাচ্ছিল। রণেন ঝুঁকে তার চুলের মুঠি চেপে ধরে তাকে হেঁচড়ে তোলে, অস্ফুট গলায় বলে—হারামজাদি, আমাকে জামাই পেয়ে তোর চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার হয়ে গেছে…বলতে বলতে সে তার ডান হাতে গোটাকয় প্রচণ্ড চড় মারে বীণার গালে। দেয়ালের কাছে নিয়ে মাথা ঠুকে দেয়, মুখ ঘষে দেয় দেয়ালে, আর বলে—পাগল! পাগল! বল, বল, পাগল? পাগল…
বদ্ধ দরজায় তখন প্রবল ধাক্কা দিয়ে বাইরে থেকে সোমেন চিৎকার করছে—দাদা, দাদা, কী করছ কী! দাদা, দরজা খোলো! মায়ের চিৎকারও কানে আসে রণেনের।
মা বলে—সর্বনাশ করিস না, ওরে সর্বনাশ করিস না!
ছেলেমেয়েরা ঘুম ভেঙে প্রথমটায় চিৎকার করে উঠেছিল। রণেন তার ক্ষ্যাপা চোখে তাদের দিকে চাইতেই তারা নিথর হয়ে গেল।
অনেকক্ষণ বাদে দরজা খুলেছিল রণেন। তখন বীণা মেঝেয় পড়ে আছে বটে, কিন্তু জ্ঞান হারায়নি। কেবল বড় বড় শ্বাস টানছিল। সোমেন গিয়ে বউদিকে ওঠায়, মা ধরে রণেনকে। রণেন ননীবালার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসে। সিগারেট ধরায়। জীবনে সম্পূর্ণ এক নতুন অভিজ্ঞতায় তার মনটা তখন অস্পষ্ট। আচ্ছন্ন। এই প্রথম সে মেয়েছেলের গায়ে হাত তুলল।
ঘরে সে আর যায়নি। সোমেন আর মা যা করার করেছিল রাতে। সম্পূর্ণ ভূতগ্রস্তের মতো সোফায় বসে রইল রণেন। ননীবালা এসে এক সময়ে বললেন—ঘরে যা রণো।
রণেন মাথা নাড়ল। সোমেন মাকে টেনে নিয়ে গেল ঘরে।
সারা রাত পরিত্যক্ত এবং আচ্ছন্ন রণেন বসে রইল সোফায়। মশার কামড় খেল, টের পেল না তেমন। সিগারেট খেল অনেক। মাথার ভিতর দিয়ে কত চিন্তার ঘূর্ণি বয়ে গেল।
মা বাবার কত ঝগড়া হয়েছে, কত আকথা কুকথা মা বলেছে বাবাকে। বাবা কোনওদিন হাত তোলেননি। স্ত্রীলোকের জন্য একটা আলাদা সম্মানবোধ ব্রজগোপালের বরাবর। এখনকার দিনে যখন আর ট্রামেবাসে পুরুষরা মেয়েদের বসার জায়গা ছেড়ে দেয় না, লেডিস সিটে জায়গা না থাকলে মেয়েরা যখন দাঁড়িয়েই যায় তখনও ব্রজগোপাল নিজের সিটটি ছেড়ে দেন। স্ত্রীলোকরা দাঁড়িয়ে থাকবেন আর আমি পুরুষ হয়ে বসে থাকব—বাবার পৌরুষে সেটা আজও লাগে। এখনও অনাত্মীয়া, অপরিচিতা মেয়েছেলের মুখের দিকে ব্রজগোপাল তাকান না, স্পর্শ বাঁচিয়ে চলেন, অধিকাংশ মেয়েকেই সম্বোধন করেন ‘মা’ বলে।
রণেনের মন তিক্ততা আর আত্মগ্লানিতে ভরে যায়। সারা রাত ধরে সে কত কী ভাবে। ভোরবেলা কেউ জেগে ওঠার আগেই সে পোশাক পরে বেরিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ এলোমেলো ঘুরে বেড়ায়। গড়ের মাঠের কাছে ট্রাম থেকে নেমে কুয়াশায় আচ্ছন্ন মাঠঘাটের সবুজ সৌন্দর্য দেখে। দেখতে দেখতে এক সময়ে বহেরুর খামারবাড়িটার কথা মনে পড়ে যায়। নির্বাসিত, বৃদ্ধ ব্রজগোপালকে মনশ্চক্ষে সে দেখতে পায়। নাতিদীর্ঘ সচ্চরিত্র একজন বাতিল মানুষ। হঠাৎ বাবার জন্য একটা আকুলতা বোধ করে সে।
খিদে পেয়েছিল। রেস্টুরেন্টে খেয়ে, সেলুনে দাড়ি কামিয়ে নিয়ে একটু বেলায় সে হাওড়ায় গিয়ে ট্রেন ধরে।
॥ এগারো ॥
বর্ধমানের বাজারে বহেরু একজন ভবঘুরে চেহারার লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। ডাল শস্যবীজের পাইকার পরান সাহার চেনা লোক। রোগা, কালো, লিকলিকে চেহারা, গালে আর থুতনিতে খামচা-খামচা কয়েক গাছা লোমের মতো দাড়ি—মাকুন্দই বলা যায়। দুটো গর্ত চোখে ভিতুভাব। এক চালান মাল গস্ত করে পরান সাহা তার দোকানঘরের বাইরে বলে কোঁচা নেড়ে হাওয়া খাচ্ছে—মোটা মানুষ, শীতেও ঘাম হয়। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলে—নিয়ে গিয়েই দেখ না। চোর ছ্যাঁচোড় নয়, দোষের মধ্যে কোনও একঠাঁই থাকতে পারে না! চোখে চোখে রেখো। তুমি তাঁতির কথা বলেছিলে, তাই আটকে রেখেছি।
বহেরু মাথা নাড়ল। পরান সাহা তার পুরনো খদ্দের। কাজেই খারাপ লোক দেবে না। কিন্তু ব্রজকর্তার সঙ্গে পরামর্শ না করে কথা দেয় কী করে? বলল—রও বাপু, আমি টপ করে ঘুরে আসছি। পালিও না যেন।
লোকটা সঙ্গে ধরে বলল—যদি নেন আপনার কাছে থাকব। বর্ধমানের বাজার ভাল, শানা-মাকু সব এখান থেকেই কিনে নিলে হয়।
—রাখো বাপু, আগে কর্তার মতামত দেখি। শানা-মাকু কিনতে হবে না, আমার তঁতঘর আছে।
—ও! লোকটা বিস্ময়ভরে বলে—তা কর্তা কে?
—ব্রাহ্মণ। আমার ব্রাহ্মণ। কথাটা অহংকারের সঙ্গে বলে বহেরু।
—আমি দাঁড়িয়ে রইলাম তবে!
—থাকো, বিড়িটিড়ি খাও, আমি এসে যাচ্ছি। লোকটা তখন হঠাৎ আপনমনে বলে—বড় খিদে পেয়েছিল। চাড্ডি মুড়িটুড়ি—সে কথায় কান না দিয়ে বহেরু বাজারের ভিড় ভেঙে এগোয়। মশলাপট্টি পার হয়ে বড় রাস্তা ধরে খানিক এগোলে ঘড়ির দোকান। ব্রজকর্তা বসে আছে ঠায় একটা পিঠ-উঁচু চেয়ারে।
—কর্তা, হল?
ব্রজগোপাল বহেরুর দিকে চেয়ে মাথা নাড়েন। হয়নি। বহেরু একটু হাসল। বলল—ও ঘড়ি তো চোদ্দোবার সারাই হয়েছে, যন্ত্রপাতি আর কি কিছু আছে? ফেলে দ্যান।
ব্রজগোপাল বিমর্ষভাবে বলেন—পুরনো জিনিস, মায়া পড়ে গেছে। বড় ছেলে প্রথম চাকরি পেয়ে দিয়েছিল, তা চোদ্দো পনেরো বছরের বেশি ছাড়া কম না।
—একটু কথা ছিল, আবডালে আসেন।
ব্রজগোপাল নেমে আসেন—কী বলবি?
—একটা তাঁতি পেয়েছি। দুশো সুতোর কাপড় বুনতে পারে।
ব্রজগোপাল অবাক হয়ে বলেন—দুশো সুতো? সে তো শৌখিন ব্যাপার। তোর সে কাপড় কী দরকার?
বহেরুর বড়সড় শরীরটা একটু ঝুঁকে পড়ে আহ্লাদে, একটু মৌজের হাসি হেসে বলে—দুশো সুতোর কাপড় বোন যার-তার কর্ম নয়। ও কাপড় পরলে টেরই পাওয়া যাবে না যে কিছু পরে আছি। মনে হবে ন্যাংটা আছি।
ব্রজগোপাল বড় চোখে চেয়ে বলেন—ও কাপড় পরে রাজা-জমিদার, তুই চাষিবাসি মানুষ, ও পরে কি আরাম পাবি?
—দেখি কীরকম করে। পাঁচজনকে দেখানোও যাবে। আশেপাশে ঘরে কেউ তো বোনে না। একটা গুণী লোক, আটকে রাখি। কি বলেন?
—নিবি তো নে। তবে দেখেশুনে নিস, একপেট ভাতের জন্য বহু হাঘরে নিষ্কর্মা গুণী সেজে ঘুরে বেড়ায়। ব্রজগোপালের মুখে অবশ্য কোনও উৎসাহ দেখা যায় না।
বহেরু উৎসাহে বলে—তো নিই? পরান সাহার চেনা লোক।
—কত লোক তো আনলি। সেই যে সুন্দরবনের এক রাইচাষা এল আনারসের ক্ষেত করতে, তারপর চৌপরদিন পড়ে ঘুমতো—সেরকম না হয়।
—হলে বের করে দেব। একটু দোষ আছে অবিশ্যি, মাঝেমধ্যে পালিয়ে যায়। তবে হাতটান নেই। পরান সাহা তো জামিন রইল। আপনি আসুন না, দেখবেন। যদি মত দেন তো কথা পাকা করে ফেলি।
ব্রজগোপাল বিরক্ত হয়ে বলেন—দাঁড়া, ঘড়ির মেরামতিটা হোক। চোখের আড়াল হলেই ওরা যন্ত্রপাতি সরিয়ে ফেলে। ঘড়ি বলে জিনিস।
বহেরু গুরগুরিয়ে হাসে—পুরনো যন্ত্র, ও নিয়ে কী করবে?
—তুই বড় বুঝিস। সব সারাইকর ঘড়ির পার্টস চুরি করে। বহেরু বোঝে বড় কর্তাকে এখন নড়ান যাবে না। আগাগোড়া মেরামতির সময়টা উনি ঠায় বসে থাকবেন অপলক চেয়ে। বড় সাবধানী লোক।
দোকানদার পুরনো চেনা লোক, ব্রজগোপালের টেবিল-ঘড়িটা না হোক বার ছয়-সাত সারিয়ে দিয়েছে। বুড়োসুড়ো লোক, হাত কাঁপে, মাথা নড়ে, তাই দোকানে বড় একটা খদ্দের হয় না। লোকটা, ব্রজগোপালকে উদ্দেশ করে চেঁচিয়ে বলল—ব্রজদা, এ হবে না।
ব্রজগোপাল চমকে দোকানে উঠে যান। ঝুঁকে ঘড়িটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলেন—হবে না?
বুড়ো লোকটা ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে মাথা নাড়ে—না, এর জান শেষ হয়ে গেছে। জং-ফং লেগে একাক্কার। এ-কদিন চলল কী করে সেইটাই ভারী বিস্ময়ের কথা।
—আর একটু নেড়েচেড়ে দেখুন না, বহু বছর ধরে সঙ্গে রয়েছে, বাতিল করতে মায়া লাগে।
—সারানো যায়। তবে তাতে নতুন কেনার খরচ। তেমন ভাল চলবেও না।
হতাশ হয়ে ব্রজগোপাল ঘড়িটা হাতে নিয়ে বলেন—বড় ছেলে দিয়েছিল।
—নতুন একটা কিনে নিন।
—দূর! ব্রজগোপাল ‘নতুন’ শব্দটা সহ্য করতে পারেন না বোধ হয়। বলেন—পুরনো আমলের জিনিসের মতো জিনিস হয়!
ব্রজগোপাল চাদরের তলায় ঘড়িটা নিয়ে নেমে আসেন। হাঁটতে হাঁটতে বলেন—লোকটা বুড়ো মেরে গেছে রে বহেরু, ও-পাশে একটা দোকান দেখেছি, চল তো দেখিয়ে যাই। বলে কি না চলবে না!
—আবার ঘড়ির দোকানে বসবেন! তবে আর কোকাকে দেখতে যাওয়া হবে না।
আমারও মালপত্র কেনার আছে। টাইম কটা হল?
হাতে ঘড়ি, তবু টাইম কটা হল তা দেখার উপায় নেই। ভারী রেগে গিয়ে ব্রজগোপাল বলেন—কী করে বলি?
টাইম জানতে বহেরু একজন চলতি ভদ্রলোককে দেখে এগিয়ে যায়। পিছিয়ে আবার ব্রজগোপালের পাশটি ধরে বলে—আজ আর হবে না। জেলখানার ফটক বন্ধ হয়ে যাবে যেতে যেতে।
শীতের বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাজারের ভিড়ে পায়ে পায়ে ধুলো উড়ছে। রাঙা ধুলো। একটা জলহীন শুকনো বাতাস বয়ে যাচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে শীতটা টের পাওয়া যাচ্ছে না, ফাঁকায় পড়লে আজ ঠান্ডা কামড়াবে খুব। বুড়ো হাড়ে শীতটা আজকাল লাগে। ব্রজগোপাল ঘড়িটা একবার ঝাঁকিয়ে কানে লাগান। কোনও শব্দ না পেয়ে বলেন—নষ্ট হবে না! তোর রাজ্যের সব লোকের ঘণ্টায় ঘণ্টায় সময় জানা চাই, যেন অফিস টাইম সবার। উত্তরের বেড়ার দিকটা ফাঁক করে বাচ্চাকাচ্চারা ঘরে ঢোকে। আমি না থাকলে ঘড়ির অ্যালার্ম বাজিয়ে মজা মারে।
বহেরু গম্ভীরভাবে বলে—হুঁ। ছাওয়াল পাওয়ালগুলান বড় খচ্চর হয়েছে। সবকটাকে কানে ধরে ওঠাবসা করাব।
গুণী লোকটা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে পরান সাহার দোকানের সামনে, আকাশমুখো চেয়ে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জির ওপর পড়ে পাওয়া একটা ছেড়া সোয়েটার। পেটটা খাল হয়ে পড়ে আছে, কতকাল বুঝি পেটপুরে খায়নি। পেটের খোঁদলটাকে আরও ভিতর ঢুকিয়ে শীতে কুঁজো হয়ে লোকটা আকাশের দিকে চেয়েছিল। বহেরু সামনে দাঁড়াতেও খানিকক্ষণ যেন চিনতে পারল না, তারপর সম্বিৎ পেয়ে শুকনো ঠোঁটে বড় বড় দাঁতগুলো ঢাকার চেষ্টা করল।
—কী? লোকটা বলে।
—দুশো সুতোর কাপড়? পরলে মনে হবে কিছু পরি নাই, ন্যাংটা আছি!
লোকটা ঘাড় নাড়ল। বলল—আমাদের বহু পুরুষে বুনে আসছি। ইদানীং সব গোলমাল হয়ে গেল। দাদন না পেয়ে আমার বাবা তাঁত বেচে দেয়। সে অনেক ইতিহাস। আমি তো শেষ অবদি বিষ্ণুপুর গিয়েলাম রেশমের কাজ শিখতে। ওরা শেখাতে গা করে না। সেই থেকে ঘুরে ঘুরে বেড়াই। তাঁত আর দাদন পেলে এখনও—
বহেরু বাধা দিয়ে বলে—মালপত্র সব পাবে। এখন কিছুদিন পেটভাতে কাজ করো তো বাপু! তোমার কাজ তো দেখি।
লোকটা রাজি। বহেরু ব্রজগোপালকে দেখিয়ে বলে—ইনি ব্রাহ্মণ। একটা নমো ঠুকে দাও, শুভকাজে ব্রাহ্মণের পায়ের ধুলো—
লোকটা কথাটা ধরতে পারে না, যেন বা পায়ের ধুলো নেওয়ার অভ্যাস নেই। সে তেমনি খুব আপনমনে বলে—বড্ড খিদে পেয়েছিল। চাড্ডি মুড়িটুড়ি হলে—
ব্রজগোপাল বলেন—থাক থাক। লোকটাকে দেখে তাঁর মনে হয় লোকটার আত্মবিশ্বাস নেই। তবে তাঁতের কথায় তার চোখ দুখানা যেমন ঝলসে উঠল, তাতে বোঝা যায় ওই একটা ব্যাপার ভালই জানে। বহেরুকে বলেন—যা, ওকে কিছু মিষ্টিটিষ্টি খাইয়ে আন, পেটটা খাল হয়ে আছে।
বহেরু মিষ্টি বা শৌখিন খাবারে বিশ্বাসী নয়। সে ভাতে বিশ্বাসী। চারবেলা সে নিজে ভাত মারে। ভাত ছাড়া সে কিছু ভাবতে পারে না। বহেরু হাসল—মিষ্টির কর্ম নয়। রামহরিদার হোটেল থেকে পেট চুক্তিতে ভাত খাইয়ে আনি। অতটা রাস্তা যাবে।
—তুই যা। আমি পরানের গদিতে আছি। বলে ব্রজগোপাল ঘড়িটা আবার কানে তোলেন।
রামহরি লোকটাকে দেখেই বেগড়বাঁই করতে থাকে। বলে—না বাপু, পেট চুক্তিতে হবে না।
বহেরু ঝেঁকে বলে—হবে না মানে? তোমার এখানে তো সবাই তাই খায়!
—সবাই না। লোক বুঝে আমাদের আলাদা আলাদা চুক্তি।
—কেন?
রামহরি লোকটার দিকে আর এক ঝলক চেয়ে বলে—এ বাপু গাঁ-ঘরের লোক, তার ওপর উপোসী, দেকেই মনে হয়। আমরা লোক চিনি। পাইস সিস্টেমে খেতে পারে, যত ভাত তত পয়সা।
বহেরু রেগে উঠতে গিয়ে হাসে। বলে—বর্ধমানের লোকের মুখে কী কথা! এ জেলা হচ্ছে লক্ষ্মীর বাথান, তুমি এখানের লোক হয়ে দুমুঠো ভাতের মায়া করলে! তো খাওয়াও তোমার পাইস সিস্টেমে। কুছ পরোয়া নেহি। লোকটা গুণী বুঝলে রামহরিদা, দুশো সুতোর কাপড় বুনতে পারে।
রামহরি তাতে কৌতূহল দেখায় না। বেল টিপে বেয়ারা ডাকে।
লোকটি কিন্তু খেতে পারল না। মরা পেট, তার ওপর তার খাওয়া নিয়ে এত গবেষণা শুনে লজ্জাও হয়ে থাকবে। লোকটা আঁচাতে উঠে গেল। সে সময়ে পাণ্ডুয়ার ঘিয়ের কারবারি গন্ধবণিক হরিপদ চা খেতে ঢুকে বলে—বহেরু যে।
দু-চারটে কথা হয়। হরিপদ বলে—আমাদের হাটে সেদিন এক বামন বীর এসেছিল, একুনে আড়াই ফুট উঁচু হবে। এত ছোট বামন বীর দেখিনি।
সঙ্গে সঙ্গে বহেরু কৌতূহল দেখায়—কতটুকু বললে? আড়াই ফুট! তাতে কতটা উঁচু হয়?
হরিপদ মেঝে থেকে বোধ হয় ছ-ইঞ্চি উঁচু একটা মাপ দেখায় হাত দিয়ে। বহেরু বলে—আরে বাপ্স! লোকটাকে পাওয়া যায়?
—দুই হাটবারে এসেছিল। আবারও আসবে। যা ভিড় লেগে গেল দেখতে! দাড়িগোঁফ আছে বিশ্বাস হয় না না-দেখলে। তোমার ঠেঁয়ে নেবে নাকি?
বহেরু মাথা নাড়ল—নিলে হয়। সামনের হাটবারে যাবখন। কিম্ভুত মানুষের বড় শখ আমার। ঠিক মাপ বলছ? বামন বীর আবার একটু লম্বাটে হয়ে গেলে তেমন কিম্ভূত থাকে না।
হরিপদ চোখ বড় করে বলে—ঠিক মাপ মানে! শ্রীমন্তর দরজিঘরে গজফিতে দিয়ে মাপা হয়নি নাকি। তা বামন বীর নিয়ে কি পালবে পুষবে?
—ওই একরকম। বলে বহেরু, একটু হাসে।
—তুমি বাপ নিজেই কিম্ভূত আছে।
তাঁতি লোকটা লুঙ্গিতে হাতমুখ মুছে দাঁড়িয়ে আছে তখন থেকে। বহেরু উঠে পড়ল। খাবারের পয়সা দিতে দিতে মুখ ঘুরিয়ে হরিপদকে আবার মনে করিয়ে দিল—সামনের হাটবারে যাচ্ছি।
রাস্তায় এসে পিছু-পিছু আসা লোকটার দিকে একবার ফিরে চেয়ে কী ভেবে বহেরু বলে—রাতেরবেলা আবার খেওখন। এ শালারা ব্যাবসাদার, লোকের পেট বোঝে না।
লোকটা এতটুকুন হয়ে বলে—আমি বেশি খাই না। ঘুরে ঘুরে বেড়াই, খাওয়ার বেশি বায়নাক্কা থাকলে চলে?
বহেরু একটু শ্বাস ফেলে বলে—কিন্তু দুশো সুতোর কাপড় বুনতে হবে—মনে থাকে যেন। আমার ইজ্জত রেখো।
পরানের গদিতে ব্রজগোপাল ক্যাশবাক্সের পিছনে বসে নিবিষ্টমনে তখনও ঘড়িটা ঝাঁকাচ্ছেন। মাঝে মাঝে কানে তুলে শব্দটা শুনবার চেষ্টা করছেন। বহেরুকে দেখতে পেয়ে বললেন—ঘরে থাকতে যাও বা একটু-আধটু চলছিল, এ ব্যাটা খুলেটুলে একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। একটুও টকটক শব্দ শুনছি না। পার্টস-ফার্টস খুলে নিয়েছে নির্ঘাত।
বহেরু হাসে। তার বলতে ইচ্ছে করে—নতুন ঘড়ি আপনাকে একটা কিনে দেব, ওটা ফেলে দ্যান। তা দিতেও পারে বহেরু। এবার ফসলে ভাল টাকা এসেছে। ঘেরপুলিশকে মাঠে কিছু ফসল দিতে হয়েছে। তা হলেও সে আর কতটুকু? ব্রাহ্মণকে একটা ঘড়ি দান করতে আটকায় না। কিন্তু ব্রজগোপালকে সেকথা বলতে সাহস পায় না বহেরু ডাকাত। ব্রজকর্তা কখনও কারও থেকে কিছু নেন না। ওই নষ্ট ঘড়িটা ধরে বসে থাকবেন, ঝাঁকাবেন, দুঃখ করবেন, কিন্তু অনাত্মীয় কারও কাছ থেকে নতুন একটা ঘড়ি নেবেন না হাত পেতে। এজন্যেই লোকটাকে বড় ভালবাসে বহেরু।
ব্রজগোপাল মুখ তুলে বলেন—সায়ংকালটা পার হয়ে গেল রে! আর কত দেরি করবি? আমার আহ্নিক হল না।
—এই আসি। বলে বহেরু বেরিয়ে যায়।
দোকানপাট সেরে গাড়ি ধরবার জন্য স্টেশনে যখন তিনজন পোঁছাল তখন চারধার অন্ধকার হয়ে গেছে। গাড়ি ছাড়তেই দৌড়ঝাঁপ-করা শরীরে যে ঘাম জমেছিল তা শিরশিরিয়ে ওঠে শীতের বাতাসে। বুড়ো হাড়ে শীত বড় লাগে। ব্রজগোপাল কানমুখ ঢেকে বসেন। বহেরু একটু আবডালে গিয়ে পকেট থেকে ছোট কলকে আর গাঁজা বের করে। তাঁতি লোকটা ব্রজগোপালের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ে ভাতঘুমে।
বহেরু গাঁজাটা উপভোগ করে। গাড়িতে লোকজন আছে, দেখছে তাকে গাঁজা খেতে। কিন্তু তার দিকে চেয়ে কেউ কিছু বলতে সাহস পায় না। বহেরু সেটা জানে। নিজেকে তাই মাঝেমধ্যে রাজা-জমিদারের মতো লাগে তার। সুখ এরেই কয়। কোকা গত তিন বছর জেলে পচছে, আরও বছর-দুই ঘানি টানবে। ছেলেটাকে একবার চোখের দেখা দেখে আসবে ইচ্ছে ছিল। হল না। মাঝলা সন্তান ভাল হয় না বড় একটা, আর বড় ছেলে হয় বোকা। কোকা তার মেজো ছেলে। ছেলেবেলা থেকেই খারাপ, গোবিন্দপুর ইস্কুলের মাস্টাররা মেরে মেরে হয়রান। তারপর ধরল ডন-বৈঠক, আখড়ায় যেত। পাহাড় সমান শরীর নিয়ে বজ্জাতি করত। সেবার বেদরকারে খামোক একটা ছোকরাকে কেটে ফেলল খালধারে। ছোকরাটা পার্টি করতে এসেছিল, একটু-আধটু বিষ ছড়িয়েছিল বটে, কিন্তু সে তেমন কিছু না। গাঁ ঘরে শহুরে কথা বুঝবার মতো বুঝদার কজন? তবু তার সঙ্গে কোকার কী একটা শত্রুতা তৈরি হল। ছোকরাকে পুলিশও ভাল চোখে দেখত না, নইলে কোকাকে আরও ঝোলাত কঠিন মামলায়। অল্পের ওপর দিয়ে বেঁচে গেছে কোকা। খুনটা ঠিক প্রমাণ হয়নি। শুধু জানা গেছে যে, খুনের দলে ছিল। কিন্তু নিজের ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারে না বহেরু। ও শালা অনেকটা তার নিজের মতোই। দাপ আছে। কিন্তু হিসেবি-বুদ্ধি নেই। ছেলেটাকে ভালও বাসে বহেরু, আবার একটু ভয়ও পায়। গত মাসে গিয়ে দেখা করেছে। শরীর মজবুত হয়েছে আরও, পাথরটাথর ভাঙে, যাঁতা ঘোরায়, ঘানি টানে। কিছু খারাপ নেই। বহেরুর তাই দুঃখ হয় না। তার আরও ছেলে আছে, এক-আধজন কম থাকলেও কিছু অভাব বোধ হয় না।
বৈঁচীতে যখন নামল তারা তখন চারধারে বেশ রাত ঘনিয়ে এসেছে। দুজন মুনিশ হাজির ছিল স্টেশনে, সঙ্গে বহেরুর দুই ছেলে। তাদের সঙ্গে আর একজন লোকও দাঁড়িয়ে আছে, মোটাসোটা চেহারা, কোটপ্যান্ট পরা। ব্রজগোপাল নামতেই লোকটা এগিয়ে এসে প্রণাম করে।
আলো-আঁধারে ঠিক চিনতে পারেননি ব্রজগোপাল। ঠাহর করে দেখেই চমকে ওঠেন। বুকের ভিতরটা ধক ধক করে। বহেরু ঝুঁকে দেখে বলে—রণেনবাবু না?
ব্রজগোপাল সর্বদাই দুঃসংবাদের অপেক্ষা করেন। বয়সটা ভাল না। ননীবালার বা তাঁর নিজের। গলাটা সাফ করে নিয়ে বলেন—তুমি?
রণেনের গলার স্বরটা ভারী মৃদু, বলে—দুপুরে এসেছি, তখন থেকে বসে আছি।
—ও। তা খবর কী? খারাপ খবর নাকি?
—না না। আপনার শরীর খারাপ খবর পেয়ে এলাম।
—চিঠি দিয়ে আসতে পারতে, তা হলে আর যেতাম না বর্ধমান। আমিও দুপুরের দিকেই গেছি। কিছু বলবে?
—কেমন আছেন এখন?
—ভাল। একটু বুকে ব্যথা হয়। বোধ হয় হার্টটার জন্যই। তা এই বয়সে আদিব্যাধি তো হবেই। চিন্তা কী?
—কলকাতা শীগগীর যাবেন-টাবেন না?
—যাব-যাব তো রোজই করি। হচ্ছিল না। শরীরটার জন্যই। দু-চারদিনের মধ্যেই যাব।
—সেই জমিটার ব্যাপারে—
ব্রজগোপাল থমকে যান। পুরনো অভিমানটা বুকের ব্যথার মতোই ঘনিয়ে ওঠে। এরা কেবল দশটি হাজার টাকা চায়, তার জন্যই এত যাওয়া-আসা, এত খোঁজখবর!
ব্রজগোপাল গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন—জমিটা তোমরা কিনা। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই গিয়ে টাকা দিয়ে আসব।
বড় ছেলের চেহারায় ঘরগৃহস্থালির ছাপ পড়ে গেছে। কচি-ভাবটি আর নেই। বরাবরই ছেলেটা মা-বাপ ন্যাওটা, শান্ত প্রকৃতির, আর একটু বোকাসোকা ছিল। এখনও প্রায় তাই আছে, তবে বোধ হয় এখন মা-বাপের জায়গায় বউয়ের ন্যাওটা হয়ে পড়েছে।
বহেরু ওদিকে মালপত্র ভাগাভাগি করে মুনিশদের মাথায় তুলে দিয়েছে। টর্চ আর লম্বা লাঠি হাতে ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। ব্রজগোপাল আদেশ করলে রওনা হতে পারে সবাই। বহেরু দুকদম এগিয়ে এসে বলে—ওদের রওনা করে দিই কর্তা। আপনি ছেলের সঙ্গে কথা বলুন, আমি মাস্টারবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলে আসি, তিনি পুরনো তেঁতুল চেয়ে রেখেছিলেন। একসঙ্গে যাবখন।
ব্রজগোপাল ঘাড় নাড়েন। প্ল্যাটফর্মের ফাঁকা কংক্রিটের বেঞ্চে বসেন দুজন। শিশির ভিজে সেঁতে আছে সিমেন্ট। হাওয়া দিচ্ছে, খুব শীত। রণেন বলে—আপনি বেশি দেরি করবেন না, ঠান্ডা পড়েছে, রওনা হয়ে পড়ুন।
—তুমি একা বসে থাকবে? আর বোধ হয় আধ ঘণ্টার মধ্যে গাড়ি নেই।
—তাতে কী? ঘোরাফেরা করব, তা করতেই সময় কেটে যাবে।
—আচ্ছা যাচ্ছি। ছুটির দিনে-টিনে এদিকে চলেও আসতে পারো তো, বহেরুর খামারের দক্ষিণে একটা চমৎকার জায়গা আছে, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে এসে চড়ুইভাতি করে যেতে পারো।
রণেন একটু অবাক হয়। বাবা এসব কথা এতকাল বলেননি। বরং রণেন এলে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন। সে চুপ করে থাকে।
ব্রজগোপাল বলেন—কলকাতা শহর আর ইংরেজি স্কুলে কোনও শিক্ষা হয় না। বাচ্চা-কাচ্চাদের নানা জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, লোকের সঙ্গে মিশতে দিতে হয়, নইলে মাথায় গাদ জমে যায়।
রণেন বলে—সারা সপ্তাহ খেটেখুটে ওই একটা ছুটির দিনে আর বেরোতে ইচ্ছে করে না।
ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ছাড়েন। একটু চুপ থেকে বলেন—আমার ঘরের বিশ্রামের চেয়ে বাইরের শ্রমটাই ভাল লাগত বরাবর। তোমার মা অবশ্য পছন্দ করতেন না। কিন্তু বাইরেটাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।
রণেন মাথা নাড়ে। কথা খুঁজে পায় না।
ব্রজগোপাল বলেন—আমার কথা বাদ দাও। আমার জীবনের দশা দেখে লোকে হাসে হয়তো। তবু বলি, মাঝেমধ্যে সংসার থেকে পালানো ভাল, নইলে সংসারের মাঝখানে সারাক্ষণ থাকলে কেবলই খিটিমিটি বাঁধে, সম্পর্কগুলো বিষ হয়ে যায়, একঘেয়েমি থেকে পরস্পরের প্রতি বিতৃষ্ণা আসে।
কথাগুলো খুব গভীর থেকে উঠে আসছে মনে হয় রণেনের। এবং বাবার এই অতি সাধারণ কথাগুলো তার ভিতরে যেন ছ্যাঁকার মতো লাগে। আত্মসংবরণ রণেনের আসে না। সে হঠাৎ বলে ওঠে—সংসারে বড় অশান্তি।
ব্রজগোপাল মুখ ফিরিয়ে বলেন—কীরকম?
রণেন নিজেকে সংযত করে নেয়, বলে—ওসব শুনে আপনার দরকার নেই।
ব্রজগোপাল মাথা নাড়লেন। বোঝেন। বলেন—কলকাতা শহরটাকে লক্ষ কোরো। চারদিকে মানুষকে লোভানী দেখাচ্ছে, স্বার্থপর করে তুলছে। ও হয়েছে মানুষ পচানোর জায়গা, সাধুকেও অসৎ করে ফেলে। সেই জন্যই আমি ভেবেছিলাম এদিকটায় বসত গড়ে তুলব—
রণেন গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার খুব ইচ্ছে করে সংসারের বাতিল এই মানুষটির কাছে থেকে যেতে। কাল রাত থেকে এক প্রবল অস্থিরতা, ভয়ংকর এক পাপবোধ তাকে তাড়া করে ফিরছে। তার বলতে ইচ্ছে করে—তাই হোক বাবা, এইখানেই বসত গড়ে তুলি।
কিন্তু বলে না। বহেরুর বিশাল শরীর চরাচর ঢেকে সামনে এসে দাঁড়ায়। হেসে সে বলে—আধ ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতার গাড়ি আছে।
রণেন মুখ তুলে বলে—বাবা, আপনি রওনা হয়ে পড়ুন। খুব ঠান্ডা।
ব্রজগোপাল গা করেন না, বলেন—তুমি একা বসে থাকবে। আমিও থাকি, দেখতে দেখতে আধ ঘণ্টা কেটে যাবে।
—না, আপনি উঠুন। রণেন জোর করে।
অগত্যা ব্রজগোপাল ওঠেন।
ওরা প্ল্যাটফর্মের গেট পর্যন্ত এগিয়ে যায়। ব্রজগোপাল সেখান থেকে পিছু ফিরে চান। কুয়াশা আর ঝুঁঝকো আঁধারে কিছু দেখতে পান না বোধ হয় ভাল করে। তবু অন্ধকারে চেয়ে থাকেন।
বহেরু ডাক দিয়ে বলে—কর্তা, রিশকা নিয়ে নেব নাকি!
ব্রজগোপাল বলেন—না রে, ও-সব বাবুগিরির কী দরকার? চল্। হেঁটে মেরে দিই।
দীর্ঘ রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে বহেরু বলে—কর্তা, এক বামন বীরের খবর পেয়েছি। আর একটা লোক আছে গুসকরায়, তার দুহাতে চোদ্দোটি আঙুল। ছ-আঙুলে অনেকে আছে, ও সাত আঙুলে। ছনম্বর আঙুল থেকে নাকি আবার একটা আঙুল বেরিয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার। এনে ফেলব দুজনকে বহেরু গাঁয়ে।
অন্য সময় হলে ব্রজগোপাল তাকে তার বাতিকের জন্য ধমকাতেন, এখন শুধু অন্যমনে একটা ‘হুঁ’ দিলেন। তিনি বহেরুর কথা শুনতেই পাননি। ছেলেটা হঠাৎ ওই কথা বলল কেন—সংসারে বড় অশান্তি।
এক ফাঁকা প্ল্যাটফর্মের ঠান্ডা বেঞ্চটায় বসে আছে রণেন। সিগারেট খায়। মনটা বড় অস্থির। কারণ রাতে সে বীণাকে মেরেছে খুব। এই প্রথম সে এই কাজ করল। হাত দুখানা আবছায়ায় চোখের সামনে তুলে ধরে সে। দেখে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা। মেয়েমানুষের গায়ে হাত তুলেছে! হায়! আত্মগ্লানিতে ভিতরটা ভরে ওঠে। তার বাবা ব্রজগোপাল এত ঝগড়া সত্ত্বেও কোনওদিন মার গায়ে হাত দেননি। এখনও ভিড়ের ট্রামে বাসে মেয়েছেলেকে সিট ছেড়ে দেন বাবা। মেয়েমানুষকে এখনও সম্মান করতে বাবা জানেন। সে তবে এ কী করল?
হলদে আলোয় উদ্ভাসিত কুয়াশার ভিতর দিয়ে ট্রেনটা আসছে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। রণেন হঠাৎ সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়ায়, তাই তো! এই গ্লানি থেকে এখনই মুক্তি পাওয়া যেতে পারে! সে উঠে ধীর পায়ে প্ল্যাটফর্মের ধারটায় চলে আসে। ঝুঁকে দাঁড়ায়। গাড়িটা আসছে। সব স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে লাইনের ওপর চোখ বুজে লাফিয়ে পড়া।
রণেন ঘোর-লাগা চোখে গাড়িটা দেখে। লাফানোর জন্য পা তোলে।
॥ বারো ॥
প্ল্যাটফর্মের লোকজন দেখতে পায়, রেলগাড়ির আলোয় একটা মোটামতো বোকা লোক লাইনের ওপর ঝুঁকে বোধ হয় পানের পিক ফেলতে, কী নাক ঝাড়তে, কী থুথু ফেলতে দাঁড়িয়েছে। তারা চেঁচিয়ে ওঠে—গাড়ি আসছে, গাড়ি আসছে, ও মশাই…
সময় মতোই রণেন পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভারী বিরক্ত হয়। পৃথিবীতে এত লোক বেড়ে গেছে যে কারও চোখের আড়ালে কিছু করার উপায় নেই। তার ধারণা হল, লোকগুলো না ডাকলে সে ঠিকই অন্তিম লাফটা দিতে পারত।
গাড়ি এলে রণেন উঠে পড়ে। বেশ ভিড়। সপ্তাহান্তে যারা মফঃস্বলের বাড়িতে গিয়েছিল কিংবা বেড়াতে, তারা সোমবার থেকে ফের কলকাতার জোয়াল ঠেলতে ফিরছে। গাড়ির মেঝেয় থিক থিক করছে আধবুড়ি আর কচিকাঁচা ননএন্টিটি সব ভারতীয়। বোঁচকায়, পোঁটলায়, কোমরে, গেঁজেয় বর্ধমানের সস্তা চাল রয়েছে, কলকাতার দামি বাজারে ছাড়বে। তাদের কাঁউ-মাউ চিৎকারে কামরা গরম। তিনজন বসতে পারে এমন সিটে একটা ঠেলাঠেলি করে রণেন বসে পড়ে। মোটা শরীর, ঠিক যুৎ পায় না বসে। কিন্তু তিনজনের জায়গায় চারজনের বসার নিয়ম আছে বলে কেউ আপত্তিও করে না। ঢেউ খেলানো কাঠের সিট। দুটো সিটের জোড়ের অংশটা উঁচু হয়ে আছে, পাছায় ফুটছে। তবু সেই অবস্থাতেও হা-ক্লান্ত রণেন বসে বসে ঢুলতে থাকে। নয়নতারা আজ বড় যত্ন করেছে। কতকাল পরে দেখা। বামুনের পাতে ওরা বেঁধে ভাত দেয় না বটে, কিন্তু কাছে বসে যত্ন করে খাওয়ানো, দেখাশুনো করা—সে বড় কম নাকি!
নয়নতারা তার মুখ-চোখ দেখে, আর হাবভাব লক্ষ করে প্রথমেই বলে দিয়েছিল—বউদির সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছেন তো!
নয়নতারার সঙ্গে যখন সে-সব হয়েছিল তখন কোথায় ছিল বীণা! বহুকালের কথা সব। বহেরুর খামারবাড়িতে প্রেমট্রেম বলতে গায়ে-হাত। সে সব না হলে সরু চালের ভাত যেমন পানসে মতো লাগে চাষার মুখে তেমনি হয়। হয়েওছিল তাই, তা বলে কি নয়নতারা সে সব স্মৃতি বুকে করে বসে আছে? মোটেই না। ভুলে গেছে কবে। রণেনকে দেখে অবাক, খুশি সবই হয়েছিল, কিন্তু কোনও গুপ্ত স্মৃতির পাপবোধ ছিল না। পুকুরে আজ বেড়াজাল ফেলেছে বহেরুর লোকজন, মাছগুলো নাড়াচাড়া পড়বে। জাল তুলে হাজার মাছ তুলে আবার জাল ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছিল, নয়নতারা হাঁটুভর জলে নেমে গিয়ে বাছাই একটা রুই তুলে আনল প্রায় দু-সেরি। উঠে এসে বলল—এর পুরোটা আজ না খাইয়ে ছাড়ব না।
খুব খাইয়েছে। ও-বেলা মুড়ো-সুদ্ধু বারোখানা টুকরো গেছে পেটে। এ-বেলাও সাঁঝ লাগার পরই আবার গরম ভাত, মাছের ঝাল আর দুধ খেতে হয়েছে। ঘুম তো আসবেই। ঘুমোতে ঘুমোতে স্বপ্নও আসে। নয়নতারার। বীণার কাছে যেমন বাঁধা-পড়া জীবন, বহেরুর খামারে নয়নতারার কাছে তেমন নয়। কীরকম হাওয়া-বাতাস, খোলা-মেলার মতো সম্পর্ক গড়ে তুলতে জেনেছিল নয়নতারা! সেই জন্যই কি ওর স্বামীটা ওকে নিতে পারল না শেষ পর্যন্ত? তা বলে নয়নতারাকে কেউ আবার যেন দুঃখী বলে না ভাবে। ও সব দুঃখ-টুঃখ তার আসে না। আজ দুপুরে মাথার কাছে বসে সুপুরি কাটছিল। জাঁতিটা ভারী শৌখিন। রুপোর মতো। রণেন হাত বাড়িয়ে জাঁতিটা টেনে নিয়ে বলল—কী জিনিস দিয়ে তৈরি বলো তো! এমন দেখিনি।
নয়নতারার একটা হাসি-রোগ আছে। মুখে আঁচল চেপে বলল—এখনও মানুষটার দোষ যায়নি দেখছি?
শোওয়া অবস্থা থেকে ঘাড় তুলে রণেন বলে—কী দোষ দেখলে?
—বয়সের।
—যাঃ! রণেন বলল।
—তবে জাঁতির নাম করে হাত ছুঁলেন যে বড়!
রণেন বলে—ওকে ছোঁয়া বলে না।
—খাবলকেও ছোঁয়া বলে না তো বাপু, ছোঁয়ার আবার আলাদা রকম আছে নাকি!
—মনে পাপ না থাকলেই হল। রণেন বলে।
নয়নতারা ছেনাল সন্দেহ নেই। কিন্তু বড় একটা শ্বাস ফেলে বলে—মনের পাপের কথা বলছেন! সে বড় জটিল কথা!
—জটিল কেন হবে?
নয়নতারা মাথা নেড়ে বলে—একটা পুরুষ আর একটা মেয়েমানুষ একঠাঁই হলেই মনে পাপ জাগে। এ প্রকৃতির নিয়ম।
ঘরটা ছিল নয়নতারার। পাকা ঘর, ওপরে টিন। দক্ষিণের জানালা দিয়ে দক্ষিণায়নের সূর্যরশ্মি ঠ্যাং বাড়িয়েছে। কেউ নয়নতারাকে কিছু বলতে সাহস পায় না, তাই তার বিছানাতেই এলিয়ে পড়েছিল রণেন। অবশ্য বাচ্চা একটা ঝিউড়ি মেয়েকে কাছে রেখেছিল সে, নলচে আড়াল দিয়ে তামাক খাওয়ার জন্য। সে মেয়েটা খানিক কড়ি খেলে মেঝেয় পড়ে ঘুমাচ্ছে। বালিশের অড়ে রোদের গন্ধ, নরম। লেপখানা যেন বা পালকের তৈরি। তার ওপর হাতের কাছে নয়ন নিজে। এমনতরো বিলাস জীবনে কমই ভোগ করেছে রণেন। সেই চিন্তাহীন আরামের মধ্যে হঠাৎ একটা দার্শনিকতা ঢুকিয়ে দিল নয়নতারা। রণেন নাড়া খেয়ে বলে—পাপ জাগে? সে কীরকম?
এতক্ষণ আপনি-আজ্ঞে করছিল, হঠাৎ গলা নামিয়ে নয়নতারা বলে—বলো তো, একটা বয়সের ছেলে আর একটা বয়সের মেয়ের দিকে যখন তাকায় তখনই সব সময়ে একটা কিছু পাপ ইচ্ছে জাগে কিনা? যেখানেই হোক, যখনই হোক, চেনা বা অচেনা যা-ই হোক, হয় কিনা-ওরকম? আমার তো মনে হয়, না হয়ে যায় না।
ভারী বিস্ময় বোধ করে রণেন শুয়ে থাকে। ভাবে। এবং আশ্চর্য হয়ে বোধ করে, ঠিক তাই। চোখে চোখে যৌনতার বীজ ছড়ায় বটে। নিজেকে দিয়েই সে বুঝতে পারে। যখন ভিড়ের মধ্যে, যখনই নিঃসঙ্গতায়, যখনই কখনও বয়সের মেয়ের দিকে চেয়েছে তখনই মনে হয়নি কি—ওই ওটা হচ্ছে মেয়েছেলে! হাঁ হাঁ বাবা, মেয়েছেলে। আর মেয়েছেলের মানে কী? মানে তো একটাই—পুরুষের কাছে মেয়েছেলের যা মানে হতে পারে। এই রকমই যৌনতার বীজাণুযুক্ত চোখ বটে আমাদের। এইজন্যই কী রামকৃষ্ণদেব বলেছেন—মাতৃভাব হৃদয়ে না এলে মেয়েদের ছুঁতে নেই। এমনকী মুখ দর্শন না করাই ভাল!
রণেন লজ্জা-টজ্জা পেল না, সে বয়স পেরিয়ে এসেছে। তা ছাড়া নয়নতারার কাছে লজ্জাই বা কী? বলল—মাইরি, কেবল জাঁতিটার দিকেই চোখ ছিল আমার!
নয়নতারা বিছানায় পড়ে-থাকা জাঁতিটা তুলে তার হাতে ফের ধরিয়ে দিয়ে বলল—তা হলে জাঁতিটাই দেখ। ভাল জিনিস। মুরগিহাটা থেকে বাবা কিনে এনেছিল, স্টেনলেস ইস্টিলের। অনেক দাম।
তখন জাঁতিটা ফেলে নয়নতারার হাত ধরতে কোনও বাধা হল না আর। তখন মনে মনে রণেন বলল—মেয়েছেলে, হাঁ হাঁ বাবা মেয়েছেলে! মেয়েছেলের মানে তো একটাই হয় পুরুষের কাছে।
চোখে চোখ রেখে নয়নতারা বলে—ঠিক বলিনি?
—ঠিকই বলেছ। ভেবেটেবে দেখলাম, জীবনের কোনও মানেই হয় না। এক-আধটা যা মানে করা যায় তার একটা হচ্ছে টাকা, অন্যটা মেয়েছেলে।
নয়নতারা ফের আপনি-আজ্ঞেয় ফিরে গেল। বলল—আমি মোটেই সে-কথা বলিনি আপনাকে।
—বলোনি?
—না, কেন বলব? টাকা আর মেয়েছেলে ছাড়া জীবনে আর কিছু থাকে না নাকি? সে আবার কীরকম? কত কিছু আছে!
—আমি তো খুঁজে পাই না।
নয়নতারা হাসল, বলল—আপনি আচ্ছা একটা লোক। অনেক ভেবেচিন্তে একটা কঠিন কথা বের করেছিলাম মাথা থেকে, সেটা জল করে দিলেন। জটিল কথা অত সহজে বোঝা যায় না।
নয়নতারারও বয়স হল, রণেনের চেয়ে বড়জোর এক-দুবছরের ছোট হতে পারে। বহেরুর প্রথম পক্ষের মেয়ে। গাঁ ঘরের তুলনায় ফরসা, মুখটায় সর্বদা একটা হাসি-মাখানো সহৃদয় ভাব, সকলের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করে, রাগ নেই। সেই ব্যবহারটাই আবার প্রেম-ট্রেম বলে ভুল করে লোকে। চোখ দু’খানা বড়, নাক-টাক, ঠোঁটের কায়দা সব মিলিয়ে একরকম চটক আছে। বুদ্ধি বোধ হয় বেশি রাখে না, হাসিখুশি মেয়েদের বুদ্ধি কম হবেই, কিন্তু এক-আধটা কথা বলে বড় মারাত্মক। যেমন এই পাপ-ইচ্ছের কথাটা।
বিকেল পর্যন্ত নয়নতারার হাতখানা মাঝে মাঝে ধরে রইল রণেন। হাতটা থেমে গেল, গলে গেল, কিন্তু সহৃদয়া নয়নতারা তা ফেরত নিল না। ভাগ্যিস শীতের বিকেল কিছু তাড়াতাড়ি আসে! অবশ্য রণেন হাতের বেশি এগোবার উৎসাহও পাচ্ছিল না। মেয়েমানুষ কথাটা তার মধ্যে মাঝে মাঝে বজ্রাঘাত করছিল তখন। মেয়েমানুষের গায়ে কাল রাতে জীবনে প্রথম হাত তুলেছিল রণেন। এ পাপ কি স্খালন হওয়ার?
নয়নতারা মুখের ওপর একটু ঝুঁকে বলে—বাবা একটা মানুষের চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে, শুনেছেন?
—সে কীরকম? বিষণ্ণ রণেন জিজ্ঞেস করে।
—সে চিড়িয়াখানায় থাকবে অদ্ভুত সব মানুষ। খুব বেঁটে, খুব লম্বা, খুব সুন্দর, খুব কচ্ছিৎ, হিজড়েও থাকবে। আরও থাকবে নানারকম। সাহেব থেকে সাঁওতাল। যত আজব মানুষ হতে পারে সব এনে জড়ো করবে। যদি বলেন তো বাবাকে আপনার কথা বলে দিই।
—কেন?
—বাবা ঠিক চিড়িয়াখানায় ভরতি করে নেবে আপনাকে।
হাতটা তখন ছেড়ে দিল রণেন।
নয়নতারা তখন দুঃখের গলায় বলে—আপনি পালটে গেছেন।
—একটু মোটা হয়ে গেছি বলে বলছ?
—তাই হবে বোধ হয়। একটা সময়ে আপনি খুব ভিতু ছিলেন, মেয়েমানুষকে বড় ভয় ছিল আপনার।
রণেন সনিঃশ্বাসে বলে—এখনও আছে।
নয়নতারা হাসে, বলে—সে মেয়েমানুষের ভয় নয়, এ বয়সের পুরুষ ডরায় কেবল বউকে, মেয়েমানুষকে নয়।
আবার চমকায় রণেন। ঠিক কথা, হক কথা। বলে—তুমি বেড়ে কথা বলছ আজ।
নয়নতারা জাঁতিটা ফের তুলে নিয়ে বলল—তখন আমাকে বড় ভয় ছিল আপনার, আজ আর নেই।
—সেটা ভাল, না খারাপ?
—খারাপ।
—কেন?
—ভয়ডর থাকাই ভাল।
—বউ কি মেয়েমানুষ নয়? তাকে তো ডরাই ঠিকই।
—দূর! বউ বিয়ের পর আর মেয়েমানুষ থাকে নাকি? পাশবালিশ হয়ে যায়।
কথাটা কতদূর অশ্লীল ও সত্য তা চোখ কপালে তুলে ভাবে রণেন। তারপর বলে—শুধু পাশবালিশ?
সে কথার উত্তরে নয়নতারা বলে—তা নয় অবশ্য, রাতের পাশবালিশ আর দিনের দারোগা-পুলিশ।
তারপর সে কী হাসি হেসেছিল সে। সারাটা দিনে কাল রাতের পাপবোধ অনেকটাই ধুয়ে মুছে দিয়েছিল। আংটিটা চাইবে বলে ভেবে রেখেছিল রণেন, তা আর চাইতে ভুলে গেল।
নয়নতারা বলে—আমাদেরও একটু একটু ভয় খাওয়া ভাল।
—কেন?
—স্বামী নেয় না বলে আমাকে সবাই কুমড়োলতা ভাবে, মাচান দিতে চায়। সে সব লোক আমার ভাল লাগে না। আমি লতানে গাছ নই, লতার মতো দেখতে যে জীব তাই। বিষ-দাঁত আছে।
—তোমার মনে পাপ। রণেন চোখ বুজে বলেছিল।
—হবে। যাই, ঠাকুরদা ডাকছে।
—কে ডাকছে বললে? রণেন চোখ খুলে জিজ্ঞেস করে।
—ঠাকুরদা, দিগম্বর। খোল-কপালে লোক।
রণেন অবাক হয়ে বলে—খোল-কপালে লোক কথাটার মানে কী?
নয়নতারা তার বিশুদ্ধ দাঁতে হেসে বলে—কোন যৌবন বয়সে ঠাকুরদার কপালে কেবল জুটেছিল ওই খোলটা, আর কিছু নাই। লোকে বলে গণেশের কলা-বউ যেমন, ঠাকুরদার খোলও তেমনি।
—বুঝলাম, তা ডাকল কোথায়, শুনতে পেলাম না তো!
—খোলের আওয়াজ হচ্ছে, শুনছেন?
রণেন কান পেতে শোনে। আগেও শুনেছে, দিগম্বরের খোল কথা কয়। এখনও কইছে।
নয়নতারা বলে—খিদের বোল তুলছে ঠাকুরদা। চিঁড়ে আন, চিঁড়ে আন, দে দই, দে দই। আমরা সব বুঝতে পারি। এই বাজনার জন্যই বাবা তার খুড়োকে আটকে রেখেছে এতকাল।
—বহেরু আবার এসবেরও সমঝদার না কি?
—তা নয়। মানুষের চিড়িয়াখানার কথা বলছিলাম যে আপনাকে? তাতে সব রকম মানুষ লাগে যে!
নয়নতারা উঠে গেলে ভারী একা লেগেছিল রণেনের। উঠে ঘুরে ঘুরে বহেরুর খামারবাড়ি দেখছিল। দেখে দিগম্বর পুকুরের ঘাটলায় বসে আছে, হাতে বড় কাঁসার গ্লাসে চা, চায়ের ওপর মুড়ির স্তূপ ঢেলে দিয়েছে, আর সেই মুড়ির তলা দিয়ে সুড়ুক সুড়ুক টেনে দিচ্ছে চা। চায়ে সিটনো মুড়ি চিবচ্ছে আরামে। চারদিকের দুনিয়া সম্পর্কে কোনও বোধই নেই।
একা একা ঘুরেছিল রণেন। বহেরুর খামার থেকে কয়েক কদম তফাতে তাদের জন্য বাস্তুজমি কিনে রেখেছিলেন বাবা। সেই জমি খুব সাবধানে ও যত্নে তারকাঁটা দিয়ে ঘিরেছে, জায়গা মতো আম-কাঁঠাল-নিম-নারকোল গাছ লাগিয়ে রেখেছে—এ-সব গাছ বাড়তে সময় নেয়। তাই আগেভাগে লাগিয়ে রেখেছেন বাবা। যখন ছেলেরা বসত করতে আসবে, তখন যেন ফসল দেয়। তারকাঁটার গায়ে গায়ে অমরি গাছ—এ গাছ জীবাণু মারে। সামনের দিকে শীতের গাঁদা ফুটে আছে। একটা কুয়ো কাটা ছিল। এখনও সেটা মজে যায়নি। রণেন কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কুয়োর ধারে দাঁড়াল। বড় কুয়ো। গভীরে কিছু জল আছে। বোধ হয় জলটা ব্যবহার হয়, এখনও আবর্জনা পড়েনি। ঝুঁকে দেখতে দেখতে মনে হল, ভিতরের জলে মাছ ফুট কাটছে। শীতের গভীর কুয়োয় রণেনের ছায়া, তার পিছনের ধূসর শীতের আকাশের ছায়া। রণেনের তখন একবার বজ্রাঘাতের মতো ‘মেয়েমানুয’ কথাটা মনে হয়েছিল। আর লাফিয়ে পড়তে ইচ্ছে হয়েছিল কুয়োর জলে। বড় শীত, তাই পারেনি।
কিন্তু একথা ঠিক, আজ বার-বারই তার মরতে ইচ্ছে হয়েছে। মেয়েমানুষের সম্মান যে রাখতে জানে না, তার মরাই উচিত। কথাটা ভাবতে ভাবতেই সে পিছু ফিরে ভূত দেখতে পায়। খুব লম্বা অপ্রাকৃত রকমের একটা লোক বেড়া ডিঙিয়ে জমির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বাঁশের একটা লাঠি, তাতে ভর দিয়ে কুঁজো হয়ে না দাঁড়ালে আরও লম্বা ঠেকত। তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়েছিল, মুখে কথা নেই। তবে চোখের ভাষায় কথা কিছু ছিলই। চমকে উঠেও সামলে গেল রণেন। কারণ, বহেরু যে মানুষের চিড়িয়াখানা বানাচ্ছে একথাটা ভোলেনি সে। এই অস্বাভাবিক লম্বা লোকটা বহেরুর সেই চিড়িয়াখানারই একজন কেউ হবে। পিটুইটারি গ্লান্ডের দোষেই এরকমটা হয়ে থাকবে, লম্বায় অন্তত সাত ফুটের কাছাকাছি। চেহারা দেখে মনে হয় সাঁওতাল। তবে ভারী অসুস্থ, জীর্ণ চেহারা, শরীরের দৈর্ঘ্যকে দাঁড় করিয়ে রাখার ক্ষমতা নেই। লোকটা দ্রুত এসেছিল বোধ হয়, হাঁফাচ্ছে। রণেন লক্ষ করে, কাঁটাতারের ওপাশে বহেরুর জ্ঞাতিগুষ্টির রাজ্যের ছেলেমেয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের হাতে ঢিল, চোখেমুখে শয়তানি মাখানো। লোকটাকে তাড়া করেছিল বোধ হয়, রণেনকে দেখে একটু থমকে গেছে।
লোকটা হাত তুলে ডাকে, বাবু।
রণেন একটু এগোতেই লোকটা হাত তুলে ছেলেগুলোকে দেখিয়ে বলে, মারে।
রণেন ছেলেগুলোকে একটু তাড়া করে—যা, যা।
ছেলেগুলো অল্প একটু দূরে সরে যায়। লম্বা লোকটা ঘাসে বসে হাঁফায়। সভয়ে চেয়ে থাকে ছেলেদের দিকে। কাঁটাতারের বেড়া ফাঁক করে আবার সাবধানে বেরিয়ে আসে। একটু দূরে এসেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পায়, ছেলেগুলো কাঁটাতারের বেড়ার কাছে ঘেঁষে গিয়ে লোকটার দিকে ঢিল ছুঁড়ছে। লোকটা কুয়োর আড়ালে সরে গেল। তারপর সেও ঢিল কুড়িয়ে উলটে ছুঁড়তে থাকে। লোকটাকে ছেলেগুলোর হাত থেকে বাঁচানোর কোনও ইচ্ছেই বোধ করে না সে। পৃথিবীতে যে যার মতো বেঁচে থাকার লড়াই করুক। তার কী?
এখন রেলগাড়ির সিটের জোড়ের ওপর অস্বস্তির সঙ্গে বসে ঢুলতে ঢুলতে পুরো ব্যাপারটাকেই অবাস্তব মনে হতে থাকে তার। দেখে লম্বা লোকটা কুয়োর মধ্যে ঝুঁকে দীর্ঘ হাতে বিষ মেশাচ্ছে তাদের পানীয় জলে। চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সে জেগে যায়। মেশায় যদি বিষ, মেশাগগে। তারা কোনওকালে ওই জল খেতে আসবে না তো। তারা কলকাতাতেই পার্মানেন্ট হয়ে গেল। টালিগঞ্জের বাড়িটা যদি হয়! ভারী ফাঁদে পড়ে গেছে রণেন। সিমেন্ট আর লোহালক্কড়ের জন্য আগাম দিয়েছে। বাড়িটা তাকেই করতে হবে। জমি হবে হয় মার নামে, নয়তো দু-ভাইয়ের নামে। বীণার কঠিন মুখখানা মনে পড়ে যায় তৎক্ষণাৎ। বজ্রাঘাত হয় বুকে। কাল রাতে সে বীণাকে মেরেছে। একে মেয়েমানুষ, তার ওপর রোগা শরীর। কী করে বাসায় ফিরে সে বীণার মুখোমুখি হবে। এক বিছানায় শোবেই বা কী করে, ফের কথাটথাই বা বলা যাবে কি কোনওদিন? হয়তো ফিরে গিয়ে দেখবে বীণা তার বনগাঁয়ের বাপের বাড়িতেই চলে গেছে। আর হয়তো আসবে না। …না যদি আসে তবে কি খুব মন্দ হয়? যদি চিরকালের মতো বীণা ছেড়ে চলে যায় তবে কি খুব খারাপ হবে রণেনের? হবে একটু অসুবিধে, বিয়ের পরের অভ্যেসগুলো যাবে কোথায়? তবু বোধ হয় মা-ভাই নিয়ে এরকম ব্যক্তিত্বহীন আনন্দের জীবনও আবার ফিরে পাবে রণেন। তখন মাঝে মাঝে নয়নতারার কাছে আসবে। আনাড়ি পুরুষের মতো।…লম্বা লোকটার কথা আবার ভাবে রণেন…নয়নতারার কথা…বীণার কথা…বাবার কথা…সব মিলেমিশে একটা তালগোল স্বপ্ন হয়ে যেতে থাকে।
কেষ্টনগরের দিককার দুটো লোক বসেছে সামনের সিটে। ও-দিকের লোক কথার ওস্তাদ। সারাক্ষণ রঙ্গরস করছিল। গাড়িটা হঠাৎ বেমক্কা থেমে যেতে তাদের একজন। অন্যজনকে ঠিক বীরভূম বা বাঁকুড়া জেলার কথা নকল করে বলে—গাড়িটা কোথায় থামা করাল রে?
অন্যজন বলে—এ হচ্ছে হালুয়া ইস্টিশান।
—সে কীরকম?
—হাওড়াও নয়, লিলুয়াও নয়, মাঝামাঝি। হাওড়ার হা আর লিলুয়ার লুয়া নিলে যা হয়। এ হচ্ছে বাবা কার শেড। রাজধানী এক্সপ্রেসও হাওড়ায় ঢোকার আগে এখানে থামে। হালুয়া ইস্টিশানে।
রণেন চমকে ওঠে। কার শেড! তার মানে হাওড়া এসে গেল প্রায়। একটু পরে সে বাসায় পৌঁছবে।
খুব ভয়ে রণেন বাসায় ঢুকল। ভারি লজ্জা করছিল তার। মা দরজা খুলে সরে যায়।
ছেলেমেয়েরা তাদের ঠাকুমার ঘরে হল্লাচিল্লা করছে। তার ঘর অন্ধকার। বীণা ঘরেই বিছানায় শুয়ে আছে, আন্দাজ করে সে। বাতি না জ্বেলে জামাকাপড় ছাড়ে নিঃশব্দে। লুঙ্গিটা আলনার অভ্যস্ত জায়গা থেকে টেনে পরে নেয়। খবরের কাগজটা নিয়ে বসে বাইরের ঘরের সোফায়। কাগজ ভরা যুদ্ধ লাগতে পারে, এই আশঙ্কা, দুর্দিনের সংকেত। সে সব পড়ে না রণেন। চোখ চেয়ে বসে থাকে।
সোমেন ফেরেনি। বলে গেছে, ফিরতে রাত হবে। রাতে খাবে না। বীণার আর বাচ্চাদের খাওয়া হয়ে গেছে। রণেন খেয়ে এসেছে। ননীবালা খাননি। ঘটনাটা কতদূর গুরুতর হয়েছে তা এখনও বুঝতে পারে না রণেন, ছেলেমেয়েরা কাছে ঘেঁষছে না, মা কথাটথা বলছে না। ভারি বিষন্ন বোধ করে সে।
বড় ছেলেমেয়ে দুটো ঠাকুমার কাছে শোয় এখনও, তাদের মা হাসপাতালে যাবার পর থেকেই। শুধু টুবাই শোয় বীণার কাছে। বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ার পরও রণেন অনেকক্ষণ বসে থাকে বাইরের ঘরে। তারপর এক সময়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সংশয় নিয়ে উঠে আসে। বিছানার মশারি তুলে ভিতরে ঢুকে শুয়ে থাকে চুপচাপ। বীণার গায়ে লেপ, লেপের অর্ধাংশ রণেনের প্রাপ্য। কিন্তু লেপটা টেনে নিতে তার সাহস হয় না। বিনা লেপে শুয়ে থাকে সে। বীণার গা থেকে একটা সুন্দর পাউডার বা সেন্টের গন্ধ আসে।
হঠাৎ তাকে চমকে দিয়ে বীণা নড়েচড়ে ওঠে। পাশও ফেরে বুঝি। এবং হঠাৎ লেপটা তুলে তার গা ঢেকে দেয় বীণা। রণেনের বুকখানা মুচড়ে ওঠে হঠাৎ। কান্না আসে চোখ ভরে। বুক ভরে। সে পাশ ফেরে।
—বীণা।
উত্তর নেই।
—ক্ষমা করো। রণেন বলে।
তারপর আঁকড়ে ধরে বীণাকে। প্রথমটায় শরীর একটু কঠিন করে রাখে বীণা। তারপর কেঁপে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। শরীরটা হঠাৎ নরম হয়ে যায়।
॥ তেরো ॥
সোমেন ভোরের গাড়িটা ধরতে পারেনি। অনেক রাত পর্যন্ত কাল বউদিকে নিয়ে ঝামেলা গেছে। তারপর শুয়ে শুয়ে গভীর রাত অবধি জেগে থেকেছে সে। টের পেয়েছে মাও ঘুমোয়নি। বাইরের ঘরে বসে মশা তাড়াচ্ছে। সে এক অসহনীয় অবস্থা। দাদা যে কেন বউদিকে মারল, কী করেই বা মারতে পারল, তা অনেক রাত অবধি ভেবে ভেবে তার মাথা গরম হয়েছে।
এপাশ ওপাশ করতে করতে মা এক সময়ে বলল—তোর দাদার কাছে একবার যা না।
—কেন? ক্লান্ত সোমেন জিজ্ঞেস করেছে।
—কী করছে দেখে আয়। ঝোঁকের মাথায় কী একটা করে ফেলল, এখন যদি আবার লজ্জায় ঘেন্নায় বেরিয়ে যায়—
—যাকগে। সোমেন রেগে উত্তর দিয়েছে—যাওয়াই উচিত। ভদ্রলোকের মতো দেখাবে লোকের কাছে, আর ছোটলোকের মতো সব কাণ্ড করবে।
মা নিঃশ্বাস ফেলে বলল—মানুষ রেগে গেলে কত অনর্থ করে। তখন কি আর মানুষ মানুষের মতো থাকে। বউমার বড্ড মুখ হয়েছে আজকাল, বিকেলে বাড়িতে পা দেওয়া থেকে ইস্তক কী না বলছে!
সোমেন সিগারেট ধরিয়ে বলল—তোমাদের জ্বালায় আমাকে একদিন বাড়ি ছাড়তে হবে।
মা চুপ করেছিল। সোমেন বাথরুম যাওয়ার নাম করে উঠে গিয়ে দাদাকে অবশ্য দেখেও এসেছে দুবার। সোফার ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে, মাতালের মতো। ডাকেনি সোমেন। থাক পড়ে। মশা কামড়ে খাক। বউদির অবশ্য তেমন কিছু লাগেনি। দুর্বল শরীর বলে আর ঘটনার বিস্ময়করতায় বোধ হয় কেমন হয়ে গিয়েছিল। গালে অবশ্য আঙুলের দাগ দগদগে হয়ে ফুটেছিল, কয়েক গুচ্ছি চুল ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু দাদার ওপর এই প্রথম একটা তীব্র ঘৃণা মেশানো রাগ অনুভবও করে সোমেন। হতে পারে, দাদাকে দিনের পর দিন গোপনে উত্তেজিত ও বিরক্ত করেছে বউদি, তবু দাদা কেন অমানুষ হয়ে যাবে!
এই সব কারণেই সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। বেরোবার সময়ে দেখে সদর দরজা ভেজানো রয়েছে, দাদা নেই। বুকটা একটু কেঁপে উঠেছিল তার। দাদা বড় ভাবপ্রবণ ছেলে, রাগীও। অনুতাপে লজ্জায় যদি দুম করে নিজের ওপর প্রতিবোশ নিতে গিয়ে ভালমন্দ কিছু একটা করে ফেলে?
কিন্তু ভাববার সময় ছিল না। শিয়ালদা থেকে ব্যারাকপুরের গাড়ি ছাড়তে তখন আর কুড়ি মিনিট বাকি। ঢাকুরিয়া স্টেশনে এসে তাকে অপেক্ষা করতে হল কিছুক্ষণ শিয়ালদার গাড়ির জন্য। দেরি হয়ে গেল। কথা ছিল ভোরের গাড়িতে হাঁড়ি-কড়াই নিয়ে সে আর শ্যামল গিয়ে গঙ্গার ধারে একটা পিকনিকের জায়গা খুঁজে বের করবে, তারপর স্টেশনে এসে নটার গাড়ি দেখবে। পূর্বা, অপালা, আর সব দূরের বন্ধুরা ওই গাড়িতে আসবে, তাদের নিয়ে যাবে জায়গা মতো। সেটা হল না। শ্যামল নিশ্চয়ই গাল দিচ্ছে সোমেনকে।
কুয়াশা আর শীতের ভিতর দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন তাকে কখন যে ব্যারাকপুরে এনে ফেলল তা অন্যমনস্ক সসামেন টেরও পেল না। নেমে ঘড়ি দেখল, নটা বাজতে আর অল্পই দেরি। মন ভাল ছিল না বলে তার খেয়াল হয়নি যে এই গাড়িটাতেই ওরাও আসতে পারে। সে আপন মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে স্টেশনের গেট পেরিয়ে বাইরে পা দিতে যাচ্ছে তখন পেছন থেকে শুনতে পেল—ও মা! সোমেন, আমাদের নিতে এসে ফিরে যাচ্ছিস যে বড়?
সোমেনের তখন খেয়াল হয়। ফিরে পূর্বাকে দেখে একটু হাসে।
পূর্বা চোখ বড় বড় করে তাকে দেখে, বলে কোথায় চলে যাচ্ছিলি আমাদের না নিয়ে?
সোমেন বলে—ওরা কোথায়?
—ওই তো! দেখিয়ে দেয় পূর্বা। একটু পিছনে অণিমা, অপালা, ম্যাক্স, অনিল রায়—সবাইকেই দেখা যায়। ওরা গেটের কাছে এগিয়ে আসে। অপালা তাকে দেখতে পেয়ে চেঁচিয়ে বলে—যা খিদে পেয়েছে না রে! ব্রেকফাস্ট রেডি আছে তো!
সোমেন সিগারেট ধরাল। মানুষের স্রোত বেরিয়ে আসছে। সে সেই স্রোতের মুখে থেকে একটু সরে দাঁড়ায়! অপেক্ষা করে। অপালা বোধ হয় হাতব্যাগে টিকিট খুঁজছে। পাচ্ছে না। ভ্রূ কুঁচকে অধৈর্য হাতে হাঁটকাচ্ছে, তোলপাড় করছে ব্যাগ। পাচ্ছে না। বেড়ার ওপাশে দলটা একটু সরে দাঁড়িয়েছে তোকজনকে পথ দেওয়ার জন্য। পূর্বার মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে, সে বলল—ভাল লাগে না। কী যে সব কাণ্ড করিস না!
অপালা বলে—আহা, কাণ্ড আবার কী? ব্যাগ খুলে টিকিটগুলো ভিতরে ফেলে দিয়েছিলাম, বেশ মনে আছে।
অনিল রায় পাইপ খাওয়ার অভ্যাস করছেন। সেটা ধরাতে ধরাতে বেশ নিরুদ্বেগ রসিক গলায় বলেন—ভিতরেই ফেলেছিলে তো! না কি ব্যাগটা খুলতে ভুলে গিয়ে টিকিটগুলো বাইরে ফেলে দিয়েছ!
—না স্যার, স্পষ্ট মনে আছে। বলে অকারণে হাসে অপালা। অণিমাও। কারো কোনও উদ্বেগ দেখা যায় না।
কেবল পূর্বার চোখ ছলছল করে—ইস্ কী ইনসাল্ট স্যার! কী বিচ্ছিরি কাণ্ড! এই সোমেন চলে যাস না।
সোমেন দুপা এগিয়ে যায়, বলে—কী হল, টিকিট পাচ্ছিস না?
—নারে! অপালার ভ্রূ কুঁচকে আসে, চোখ ছোট আর তীক্ষ্ণ হয়। ব্যাগটা তুলে কাত করে ভিতরে খোঁজে।
সোমেন নিরুদ্বেগ গলায় বলে—কী আর করবি, মামাকে বলেকয়ে চলে আয়।
অপালা চোখ তুলে অবাক হয়ে বলে—মামা! মামা আবার কে?
সোমেন চোখের ইশারায় টিকিট চেকারকে দেখিয়ে দেয়। অপালা আর অণিমা অমনি ইয়ারকির গন্ধ পেয়ে টিকিটচেকারের মুখের দিকে চেয়ে হাসতে থাকে। অনিল রায় ধমকে দেন—কী হচ্ছে কী?
—স্যার, সোমেন বলছে ইনি নাকি আমাদের মামা, ছি—ছি—
এ লাইনে সবাই চেকারকে মামা বলে। কেন বলে খোদায় মালুম। অল্পবয়সি চেকারটি গা ছেড়ে দাঁড়িয়েছিল। এখন হঠাৎ সোজা হল। একবার বিরক্তির একটু দৃষ্টিক্ষেপ করে সোমেনের দিকে। ততক্ষণে পূর্বা রুমালে চোখ মুছছে। অনিল রায় বললেন—কোথাও বোধ হয় পড়েটড়ে গেছে তাহলে। দেন উই হ্যাভ টু পে দি ফেয়ার। বলতে বলতে হিপ পকেটের ওয়ালেটে হাত দেন।
তৎক্ষণাৎ টিকিট খুঁজে পায় অপালা। চেঁচিয়ে বলে—পেয়েছি স্যার, ব্যাগের লাইনিঙের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।
ওরা বেরিয়ে আসে। অনিল রায় বলেন—স্পটটা কি খুব দূরে সোমেন?
—জানি না স্যার।
—জানো না? অবাক হল অনিল রায়।
—না স্যার, আমিও এই গাড়িতে এলাম।
অণিমা কাছেই ছিল, বলল—সে কী? তোমার তো শ্যামলের সঙ্গে আসার কথা।
—আসিনি।
পূর্বা বলে—এ মা! কী হবে তা হলে?
অপালা রেগে গিয়ে বলে—ঠিক জানি, একটা ভণ্ডুল হবেই! এখন গঙ্গার ঘাটময় ঢ্যাঙস ঢ্যাঙস করে শ্যামলকে খোঁজো, ততক্ষণে নাড়িভুঁড়ি হজম হয়ে যাবে।
অনিল রায় নিরুদ্বেগ গলায় বললেন—তাতে কী! ব্যারাকপুর তো আর নিউইয়র্ক নয়। ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে। ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটে আমি অনেক এসেছি এক সময়ে। চেনা জায়গা।
অপালা বাতাস শুঁকে বলে—স্যার, জিলিপির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
সবাই জিলিপির গন্ধ পায়। গন্ধে গন্ধে তারা দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। মুহূর্তেই সকালের শান্ত দোকানঘরটা সচকিত হয়ে ওঠে কলকাতার হাউড়ে ছেলেমেয়ের কলকলানো কথার শব্দে। জিলিপির পাহাড় ধ্বসে পড়তে থাকে।
সকাল নটাতেও রোদ ফোটেনি। কুয়াশায় আবছা গঙ্গার ধার বড় নিস্তব্ধ। এ অঞ্চলটায় বাগানঘেরা বাড়ি একের পর এক। লোকজন নেই। পাহাড়ি জায়গার মতো কুয়াশায় হিম হয়ে আছে এক প্রাচীন নিস্তব্ধতা। বাগানের মধ্যে কেবল মাথা উঁচু করে আছে কিছু মানুষের চেহারা। সত্যিকারের মানুষ নয়, পাথরের মূর্তি। কলকাতার রাস্তাঘাটে এক সময়ে যেসব সাহেবদের স্ট্যাচু ছিল তা তুলে এনে রাখা হয়েছে।
অনিল রায় পাইপের ডাঁটি তুলে ম্যাক্সকে দেখান, ইংরেজিতে বলেন—ওই হচ্ছে সত্যিকারের ব্রিটিশ স্কাল্পচার। আউট্রামের মূর্তিটা এখন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে রেখে দিয়েছে। সে মূর্তি ভোলা যায় না। টুপি পড়ে গেছে, আউট্রাম ঘোড়ার পিঠ থেকে ঘুরে দেখছে—এমন ডাইনামিক স্ট্যাচু খুব কম দেখা যায়। জীবন্ত পাথর। পার্ক স্ট্রিটে ওর পেডেস্টলে এখন গান্ধীর মূর্তি বসানো আছে—সেটাও মন্দ নয়। কিন্তু তার গ্র্যাঞ্জারই আলাদা।
কুয়াশার ভিতরে দেখা যায় আরও কয়েকজন পাথরের মানুষকে। ব্রিটিশ আমলের কলকাতার সব স্মৃতি। অনিল রায়ের বোধ হয় সেই সব মূর্তি দেখে যৌবন বয়সের কলকাতার কথা মনে পড়ে যায়। তিনি ম্যাক্সের কাঁধে হাত রেখে একটু পিছিয়ে চলতে থাকেন। এবং একটি ব্যর্থ প্রেমের গল্পই বলতে থাকেন বোধ হয়।
অন্যমনস্ক সোমেন এগিয়ে হাঁটছিল। পিছনে মেয়েরা। পূর্বা একটু এগিয়ে এসে বলে—কী কাণ্ড করলি বল তো!
—কী?
—এখন যদি শ্যামলকে খুঁজে না পাই আমরা?
সোমেন কথাটায় কান না দিয়ে বলে—পূর্বা, তোদের বাড়ির ওপরতলায় একটা এক-ঘরের ফ্ল্যাট খালি আছে বলছিলি না?
—হ্যাঁ। বাথরুম, কিচেন নিয়ে কমপ্লিট ফ্ল্যাট, বড় ঘর, চারধার খোলা। কেন?
—আমাকে থাকতে দিবি?
অণিমা এগিয়ে আসে—কী বলছে রে পাজিটা?
পূর্বা ঘাড় না ঘুরিয়ে বলে—আমাদের বাড়িতে থাকতে চাইছে।
—থাকবে মানে? ঘরজামাই হয়ে নাকি? বলে হাসে অণিমা।
পূর্বা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলে—যাঃ। আমাদের তিনতলার ফ্ল্যাটটার কথা বলছে, তোরা যা মুখ পলকা না!
অপালা অণিমার বেণী ধরে টেনে বলে—ঘরজামাই হবে কিরে, ও তোর বর না? সেই যে বিয়ে করে এলি সেদিন, ভুলে গেছিস?
সোমেন ‘আঃ’ বলে ধমক দেয়। তারপর পূর্বাকে বলে—সত্যিই আমার বড় দরকার। একমাস আমাকে থাকতে দিবি?
অপালা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে—বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? না কি কোনও পরীক্ষা—ফরীক্ষা দিবি?
সসামেন বলে—তা দিয়ে তোর কী দরকার? আমি তো পূর্বার কাছে ঘরটা ভাড়া চাইছি। মাগনা নয়।
অপালা উত্তর দেয়—তোকে দেবে কেন? পূর্বা ওটা একজন প্রসপেকটিভ ব্যাচেলরকে ভাড়া দেবে, সব ঠিক হয়ে আছে। আই-এ-এস বা ইঞ্জিনিয়ার। ডাক্তার যদিও আমি দুচোখে দেখতে পারি না, তবু তাও চলবে। তোকে দেবে কেন? বেকার, এম-এ’র মতো সোজা পরীক্ষাটাও পাশ করিসনি। তোকে দিয়ে পূর্বার ভবিষ্যৎ কী? বরং ধারকর্জ দিতে দিতে ফতুর হতে হবে।
কথাটা পূর্বার লাগে, গম্ভীর মুখখানা ফিরিয়ে বলে—কেন, ব্যাচেলারকে ভাড়া দেব কেন, আমার বুঝি বর জুটছে না?
অপালা ধমক দিয়ে বলে—কোথায় জুটছে? ধুমসি হয়ে যাচ্ছিস!
—তোরই বা কোন বর জুটছে শুনি!
সোমেন বিরক্ত হয়ে বলে—তোদের কারো জুটবে না। এত ইয়ারবাজ হলে কারো বর জোটে! ছেলেপক্ষ যদি দেখতে আসে তো তাদের সঙ্গেও তোরা ইয়ারকি দিবি, পার্টি কেটে যাবে।
—মাইরি, মাইরি! অপালা লাফিয়ে উঠে বলে—আমাকে একটা পার্টি দেখতে এসেছিল কিছুদিন আগে, পাত্রের জ্যাঠামশাই আর একজন ভগ্নীপতি। আমি খুব সিরিয়াস হয়ে গিয়ে বসলাম। কিন্তু মাইরি জ্যাঠামশাইটা যা বাটকুল না, দেখেই হাসি এসে যাচ্ছিল, অনেক কষ্টে হাসি চেপেচুপে বসে রয়েছি। হঠাৎ শুনি ফঁক-ফঁ ফঁক-ফঁ একটা শব্দ। প্রথমে বুঝতে পারিনি শব্দটা কোথা থেকে আসছে। এদিক ওদিক চাইছি। পাত্রপক্ষকে খাবার-টাবার দেওয়া হয়েছে, তারা খাচ্ছিল আর আমার দিকে মাঝে মাঝে দেখছিল। হঠাৎ টের পেলাম, শব্দটা জ্যাঠামশাইয়ের নাক থেকে আসছে। যখনই খাবার মুখে দেয় লোকটা তখনই মুখবন্ধ অবস্থায় নাক দিয়ে শব্দটা হয়। নাকে পলিপাস থাকলে ও-রকম হয় অনেকের, মুখ দিয়ে শ্বাস টানে, কিন্তু মুখ বন্ধ করলেই বিপদ। আমি মাইরি, আর চাপতে পারলাম না, ফুড়ুক ফুড়ুক করে হেসে ফেললাম।
অণিমা জোরে হেসে ওঠে, বলে—সত্যি?
—মাইরি। কয়েকদিন পর ওরা রিগ্রেট লেটার দিল। বাবার সে কী বকা আমাকে—কিন্তু কী করব বল তো!
গঙ্গার উন্মুক্ত বিস্তারের সামনে এসে পড়তেই কনকন করে ওঠে ঠান্ডা বাতাস। সোমেন বলে—তোদের কারও জুটবে না, আমি বলে দিচ্ছি।
—ঠিক বলেছিস। অপালা দুঃখের গলায় বলে—কেবল আমাদের মধ্যে অণিমাটাই যা লাকি। ওর জুটে গেল বোধ হয়।
—কে? সোমেন অবাক হয়ে বলে।
—দুজন তো দেখতে পাচ্ছি। তুই আর ম্যাক্স। ম্যাক্স তো রোজ প্রোপোজ করছে, একটু আগে গাড়িতেও করছিল। অপালা বলে।
—যাঃ! অণিমা লজ্জার ভাণ করে—আজ করেনি।
—এই মিথ্যুক, তোরা যে ও-পাশের সিটে গিয়ে আলাদা হয়ে বসলি, তখন স্পষ্ট দেখলাম ম্যাক্স, তোকে কী বলল, আর তুই খুব মিষ্টি হেসে মাথা নিচু করলি!
—না, না, সে অন্য কথা।
—কী কথা শুনি? অপালা চোখ পাকায়।
—বলছিল কলকাতায় কলার দাম নাকি বড্ড বেশি। ও কলা ছাড়া থাকতে পারে না।
—যাঃ।
—মাইরি। আমি বলেছি, সস্তায় ওকে কলা কিনে দেব।
‘মিথুক, মিথুক’ বলে অপালা হাসতে থাকে। শীতের নদীর ধারটা বড় নিস্তব্ধ, জলের শব্দ নেই। ওরা ঢালু বেয়ে নামতে নামতেই দেখতে পেল, ডান ধারে একটু গাছপালার জড়াজড়ি, তার ওধারে দু-চারজন লোক। উনুনের ধোঁয়া উঠছে।
ভারী খুশি হয়ে পূর্বা চেঁচায়—ওই যে!
দূর থেকে তাদের দেখেই শ্যামল রাগারাগি করতে থাকে। কিন্তু কেউ চটে না। কারণ, শ্যামল চমৎকার ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে রেখেছে, রুটি-মাখন, ডিমসেদ্ধ, কলা, চায়ের জল ফুটছে ইটের উনুনে। রান্নার দুজন লোক এনেছে শ্যামল, আর একজন নিরীহ চেহারার বন্ধু। বলেছিল বটে, একজন বন্ধুকে আনবে, তাহলে এ-ই। সোমেন লক্ষ করে, লোকটার চেহারা নাদুসনুদুস, মুখে ভালমানুষি আর বোকামি, পরনে খুব দামি স্যুট, হাতে এক ঠোঙা আঙুর।
শ্যামল যথেষ্ট মিহি ও মিষ্টি গলায় পরিচয় করিয়ে দেয়। লোকটার নাম মিহির বোস। শ্যামলের স্কুলফ্রেন্ড, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। বড় ফার্মে চাকরি করে। পরিচয়ের পর হাতজোড় করে রেখেই অপালার দিকে চেয়ে বলে—সবাই বুঝি আপনারা এম-এ দিয়েছেন!
তার চেহারার ভালমানুষি আর বোকা ভাব সবাই লক্ষ করেছে। অপালার মুখে হাসি খেলে গেল বিদ্যুতের মতো। একটু চাপা গলায় বলে—দূর শালা, তা দিয়ে তোর কী হবে! বলেই নিপাট ভালমানুষের মতো গলা তুলে বলে—হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন তো!
মিহির বোস পরিষ্কার আগের কথাটা শুনতে পেয়েছে, বুঝতে পেরে সোমেন বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরায়। কিন্তু মিহির বোস শুনলেও রাগ করে না, বলে—ভারী সুন্দর স্পষ্ট কিন্তু এটা। সারাদিন এই জায়গাটায় আপনাদের সঙ্গে কাটাতে পারব ভাবতেই ভাল লাগছে।
—হরি-হরি! চাপা গলায় অণিমা শ্বাস ফেলে বলে।
—কী বললেন? মিহির একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
অণিমা অমায়িক হেসে বলে—কিছু না, হরির নাম…
অপালা হু-হু করে হাসছে। শ্যামল গাছতলায় শতরঞ্চি পাতছে, কী একটু আন্দাজ করে ধমক দিল—এই, কী হচ্ছে? আয় না তোরা, বোস এসে।
অপালা হাসি চাপতে চাপতেই চাপা গলায় বলে—এই মিহির, বোস, বোস। তারপর গলা তুলে বলে—আয় রে সবাই বসি।
থতমত খাওয়া মিহির বোস হাসতে চেষ্টা করে। অপালার দিক থেকে চোখ সরিয়ে অণিমার দিকে চায়। অণিমা সঙ্গে সঙ্গে হৃ দুটো নাচাতে থাকে। অপ্রস্তুত মিহির বোস চোখ সরিয়ে নেয়। অপালা, অণিমা আর পূর্বা গা টেপাটেপি করে হাসতেই থাকে।
শতরঞ্চিতে বসে অপালা খুব দুঃখের গলায় মিহির বোসকে বলে—বাড়ি ফিরে গিয়ে আজ আপনি নিশ্চয়ই আমাদের খুব নিন্দে করবেন?
ভালমানুষ মিহির বোস তটস্থ হয়ে বলে—না, না, সে কী!
অপালা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে—করবে না রে অণি?
—হ্যাঁ করবে রে অপা। জানেন মিহিরবাবু, আমরা না খুব খারাপ। অণিমা মুখখানা চুন করে বলে।
—না, না। মিহির বোস ঠিক থই পায় না।
অপালা হাতজোড় করে বলে—আমরা সত্যিই ভীষণ খারাপ। সেইজন্য কেউ আমাদের ভালবাসে না, না রে পূর্বা?
পূর্বা মাথা নাড়ে। আঁচলে হাসি চাপতে গিয়ে কাশতে থাকে।
—আমাদের তাই বিয়েও হবে না। অণিমা করুণ স্বরে বলে।
অপালা তাকে একটা ঝাপটা মেরে বলে—না, না জানেন, আমাদের মধ্যে একমাত্র এই অণিমারই হবে। হত না কিন্তু। ভাগ্যিস লোকটা বাংলা তেমন জানে না। এই যে গঙ্গার ধারে উলোঝুলো সাহেবটা দাঁড়িয়ে আছে আমাদের স্যারের সঙ্গে—ওর সঙ্গে অণিমার ভাব। সাহেব বলেই করছে, বাঙালি হলে কিছুতেই—
অণিমা উৎকণ্ঠিতভাবে বলে—ও বাংলা শিখে গেছে অনেকটা। তাই আর একদম প্রোপোজ করছে না আজকাল। আপনার হাতে ওটা কীসের ঠোঙা মিহিরবাবু?
মিহির বোস এতক্ষণে কথা খুঁজে পেয়ে বলল—আঙুর। তারপর শ্বাস ফেলে বলে—খাবেন?
অপালা হাত বাড়িয়ে ঠোঙাটা নিঃসংকোচে নিয়ে নেয়। বলে—পেটুক ভাববেন না তো?
—না, না। বলে হঠাৎ মিহির বোস খুব হাসতে থাকে। সবাই তার দিকে ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিহির বোস বলে—আমার খুব ভাল লাগছে।
বলে চকচকে চোখে সে অপালার দিকে চেয়ে থাকে।
অণিমা শ্বাস ফেলে বলে—তোরও ব্যবস্থা হয়ে গেল অপা।
পাইপ মুখে অনিল রায়, আর চোখে নীলচে ফসফরাস নিয়ে রোগা সাহেব এগিয়ে আসে। অনিল রায় বলেন—কী হচ্ছে?
পূর্বা এতক্ষণে একটা রসিকতা করে—ম্যাট্রিমণি স্যার।
—ম্যাটিনি? অনিল রায় অবাক হন।
—না স্যার, ম্যাট্রিমণি।
সবাই এত জোরে হাসে, কেউ কিছু বুঝতে পারে না।
ম্যাক্স কথা বলে খুব কম। কদিন দাড়ি কামায়নি, সাদা দাড়িগোঁফে মুখটা আচ্ছন্ন। সবুজ পাঞ্জাবির ওপর জহরকোট, নীচে পায়জামা, উলোঝুলো চুল, ন্যালাক্ষ্যাপার মতো দেখাচ্ছে। সোমেনের পাশে এসে বসে পড়ল।
সোমেন দুঃখ করে বলল—তুমি পুরো ভেতো বনে গেছ সাহেব।
ম্যাক্স হাসল। দীন এবং মলিন একরকম হাসি। বাংলা বোঝে আজকাল। বলল—হুঁ, হুঁ, ঠিক কথা।
—এবার গরমকালে তোমাকে বাঁদিপোতার গামছা পরিয়ে আম আর কাঁঠাল খাওয়াব। আমার গ্র্যান্ডফাদার আর ফাদার ওইভাবে খেত। কনুই পর্যন্ত রস গড়াবে, আর চেটে চেটে খাবে।
অপালা হাসতে হাসতে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে—যাঃ! গরমকাল পর্যন্ত ও থাকবে নাকি? সেদিন ফেয়ারওয়েল দেওয়া হল, দেখলি না? ও চলে যাচ্ছে।
—যাচ্ছে কোথায়! কবে থেকে তো শুনছি যাবে-যাবে!
—যাবে। অণিমা আজও পাকা কথা দেয়নি যে।
অণিমা ফের লজ্জার ভাণ করে বলে—ও প্রোপোজ করে না আজকাল, মাইরি। বাংলা শিখে যাওয়ার পর থেকে—
॥ চোদ্দো ॥
এদের দঙ্গলে সোমেন বড় একটা আসে না। ভাল লাগে না। একসঙ্গে পড়ত, কিন্তু এখন ওরা এগিয়ে রইল, সোমেন পড়া ছেড়ে দিয়েছে। পিকনিকেও আসত না, কিন্তু কাল গাব্বুর পড়ার ঘরে এসে অণিমা খুব ধরল—আমরা চার-চারটে মেয়ে যাচ্ছি, পুরুষ মোটে তিনজন—ম্যাক্স, অনিল রায় আর শ্যামলের কে এক বন্ধু। তাই ব্যালান্স অফ পাওয়ার থাকছে না। তুমি চলো সোমেন। সোমেন অবাক হয়ে বলেছে—কেন, শ্যামল যাবে না? অণিমা অবাক হয়ে বলে—শ্যামলকে ধরেই তো চারজন মেয়ে! সোমেন হেসে ফেলে বলেছে—তাই বলল।
কথাটা মিথ্যে নয়। মেয়েদের সঙ্গ ছাড়া শ্যামল কখনও থাকতে পারে না। পুরুষ-বন্ধু শ্যামলের আছে কি নেই। থাকলেও তাদের সঙ্গ ও খুব পছন্দ করে না বোধ হয়। আশ্চর্যের বিষয়, মেয়েদের সঙ্গে মিশে ওর গলার স্বর আজকাল মিহি হয়ে গেছে। মিষ্টি করে হাসে, চোখের চাউনিতে কটাক্ষ দেখা যায়। অণিমা একটা শ্বাস ফেলে বলেছিল—জানো না তো, শ্যামল আজকাল পুরুষ মানুষ দেখলে বুক ঢাকার চেষ্টা করে।
সোমেনের মন ভাল নেই। কাল রাতে দাদার কাণ্ডটা সারাক্ষণ মনে পড়ছে। মাঝে মাঝে শীতে কেঁপে উঠছে সে। এতকাল সংসারের ভিতরের গণ্ডগোলটা এমনভাবে তাকে স্পর্শ করেনি। দাদা এত নীচে নেমে যায়নি কখনও। বড়দি মাকে ইনল্যান্ডে একটা চিঠি দিয়েছে, দাদা নাকি টালিগঞ্জের জমিটা বউদির নামে কিনবার চেষ্টা করছে। কেনে কিনুক, সোমেনের কিছু যায় আসে না। কিন্তু সেটা দাদা, বা সোমেনকে জানাতে পারত। জানায়নি। এটা নিয়েও হয়তো কথা তুলবে মা। সংসারে আর একটা অশান্তি লেগে যাবে। পিকনিকে এসে সোমেনের তাই মন ভাল নেই।
একা একা একটু ঘুরবে বলে দঙ্গল ছেড়ে বেরোচ্ছিল, এ সময়ে অণিমা সঙ্গ ধরে বলে—কোথায় যাচ্ছ?
—বসে থেকে কী হবে! আমার আজ ইয়ারকি ভাল লাগছে না। তোমরা মিহির বোসকে যা বাঁদরনাচ নাচাচ্ছ!
—বা রে, আমাদের দোষটা কী? লোকটা অত বোকা কেন?
সোমেন ক্ষীণ হাসে, বলে—অবশ্য লোকটারও খুব খারাপ লাগছে না। বোধ হয় অপালার প্রেমে পড়ে গেছে।
—পড়েছেই তো! তোমার মতো হার্টলেস নাকি!
সোমেন একটা ঢিল কুড়িয়ে দূরের একটা ল্যাম্পপোস্টের দিকে ছুঁড়ল। লাগল না। বলল—অণিমা, তুমি এবার একটা প্রেমে পড়ে যাও, নয়তো বাড়ি থেকে পছন্দ-করা ছেলেকে বিয়ে করে ফেল।
—কেন?
—এমন সুন্দর বয়সটা পেরিয়ে যাচ্ছে।
খিলখিল করে ইয়ারকির হাসি হাসে অণিমা, বলে—ভীষণ ফ্রাস্টেটেডরা ওই সব কথা বলে। নিজের হচ্ছে না, তাই অন্যকে উপদেশ দেওয়া।
—পুরুষের বয়স আর মেয়েদের বয়স কি এক? বলে আর একবার ল্যাম্পপোস্টটা লক্ষ্য করে ঢিল ছোঁড়ে সে। লাগে না।
অণিমা হাত ধরে হঠাৎ তাকে থামিয়ে বলে—ব্যস, আর এগিয়ো না, এখান থেকেই ল্যাম্পপোস্টটায় লাগাও দেখি, ক’বারে পারো দেখব!
সোমেন দাঁড়ায়। একটু হেসে ঢিল কুড়িয়ে নেয়। ছোঁড়ে। অনেক দূর দিয়ে সেটা চলে যায়। অণিমা তখন মুখ ফিরিয়ে বলে—সসামেন, তোমার ঢিল ছোঁড়া দেখেই বোঝা যায় আজ তোমার মন খারাপ।
—না না, কে বলল?
—ঢিলটা ল্যাম্পপোস্টে লাগাতে বললাম কেন জানো? ওটা একটা সাইকোলজিক্যাল টেস্ট। খুব গম্ভীরমুখে অণিমা বলে।
সোমেন জানে, এটা ইয়ারকি। তবু বলে—ঠিক আছে, দাঁড়াও লাগাচ্ছি।
একটার পর একটা ঢিল ছুঁড়ল সোমেন। একটাও লাগল না। অনেক দূর দূর দিয়ে চলে গেল। অণিমা হাসে, বলে—আর ছুঁড়ে কাজ নেই, আমার যা বোঝার তা বোঝা হয়ে গেছে। এখন চলো তো, কফি হচ্ছে।
সোমেন একটা সিগারেট ধরায়, চারপাশে চেয়ে দেখে। কুয়াশা এখনও কাটেনি, তবু এই বেলা সাড়ে দশটায় ভোরের সূর্যের মতো এক রক্তিম কুয়াশায় ঢাকা সূর্য গঙ্গার জলে কী অপরূপ আলো ঝরিয়ে দিয়েছে। শ্রীরামপুর এখনও আবছা, তবু এক বিমূর্ত ছবির মতো ফুটে উঠছে নদীর ওপারে। জলে নৌকা, শীতের শান্ত নদীতে চিত্রার্পিত হয়ে আছে। এ পারে ব্রিটিশ আমলের গন্ধমাখা নির্জনতা, বাংলোবাড়ি, ভাঙা পাড়। শ্রীরামপুরের পশ্চাৎপট নিয়ে অণিমা দাঁড়িয়ে। অণিমার মুখশ্রীর কোথাও কোনও বড় রকমের খুঁত নেই। ভোরের আলোয় তাকে ভালই দেখাচ্ছে। একটু হাসিমুখ, চোখে করুণা। সোমেন মাথা নেড়ে বলে—তুমি ঠিকই ধরেছ, মন ভাল নেই।
—কেন সোমেন?
—কিছু না। বলে সোমেন ঢিল কুড়িয়ে নেয়। আবার ছোঁড়ে।
অণিমা বলে—আজ লাগবে না। যতই চেষ্টা করো।
—লাগবে।
—অত সোজা নয় মশাই।
—আচ্ছা দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।
তারপর আরও অনেকগুলো ঢিল ছোঁড়ে সোমেন। এক-আধটা খুব কাছ দিয়ে যায়। কিন্তু লাগে না। অণিমা বলে—ইস, আর একটু হলে লেগে গিয়েছিল।
—লাগবে, দাঁড়াও না।
আবার ছোঁড়ে সোমেন। যত মনঃসংযোগ করে ততই ল্যাম্পপোস্টটা আরও দূরের বস্তু, অলীক কল্পনা, ছায়াশরীর হয়ে যায়। ঢিল লাগবার বাস্তব টং শব্দটা শোনা যায় না।
—অমন ডেসপারেটভাবে ছুঁড়ো না। অণিমা সাবধান করে দেয়—কার গায়ে লাগবে।
হতাশ হয়ে সোমেন বলে—এক-একদিন এ-রকম হয়। সেদিন যে কাজেই হাত দাও সব পণ্ড হবে। এক-একটা দুষ্ট দিন আসে।
অণিমা হাসে, বলে—তুমি যতক্ষণ ল্যাম্পপোস্টটাকে ভুলে না যাবে ততক্ষণ ঢিল লাগবে। না।
—লাগবে না? দেখি!
শ্যামল দূর থেকে তাদের নাম ধরে ডাকছে। অণিমা সাড়া দিয়ে সোমেনকে বলে—চলো, চলো, কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।
সোমেন মাথা নেড়ে বলে—না, যতক্ষণ না লাগাতে পারি ততক্ষণ যাচ্ছি না।
—আচ্ছা পাগল। ছেলেমানুষ একটা।
সোমেন হেসে আরও কয়েকটা ঢিল কুড়িয়ে বাঁ হাতে জড়ো করে।
—লক্ষভেদ করে কোন দ্রৌপদীকে পাবে বাবা! ঠান্ডা কফি আমি দু-চোখে দেখতে পারি না—বলে অণিমা চলে যায় রাগ করে।
সোমেন একা নিরর্থক ল্যাম্পপোস্টে ঢিল লাগানোর খেলাটা খেলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত লক্ষ্য স্থির থাকে না। কত কথা ভাবে, আর আন্দাজে ক্লান্ত হাতে ঢিল ছোঁড়ে। অনভ্যাসে হাত ব্যথিয়ে ওঠে, শীতের বাতাসে নিষ্পলক চোখে জল আসে। তবু আক্রোশে, হতাশায় ঢিল ছুঁড়তে থাকে সসামেন। ফ্রাস্টেশন? তাই হবে।
টং করে অবশেষে একটা ঢিল লাগল। সোমেন একা একা হাসল। সফলতার একটা ক্ষীণ আনন্দ টের পায় সে, এত তুচ্ছ ব্যাপার থেকেও। পরমুহূর্তেই ভাবে, কত নিরর্থক। হাত ব্যথা করছে, ক্লান্তি লাগছে। তারপর একা সোমেন বহুদূর পর্যন্ত হেঁটে চলে গেল।
একটু দূরে একটা গাছের তলায় অনিল রায় হুইস্কির বোতল খুলে বসেছেন, তাঁর সামনে গেলাস হাতে ম্যাক্স আর মিহির বোস। শ্যামল রান্নার তদারকিতে ব্যস্ত, তার কোমরে গামছা, পূর্বা তার পেঁয়াজ কুচিয়ে দিচ্ছে। গাছের ডালে একটা খাটো দোলনা বেঁধে দুলছে অপালা। অণিমার হাতে বই, হাঁটু মুড়ে গাছতলায় বসে আছে।
—কী করছিলি এতক্ষণ? একটা ধমক দেয় অপালা।
সোমেন বলে—ধুমসি কোথাকার, দোলনা ছিঁড়লে বুঝবি মজা। এখনও বয়স বসে আছে ভেবেছিস?
—তোর ঢিল ছুঁড়বার বয়স থাকলে আমারও দোলনার বয়স আছে।
অণিমা মুখ তুলে গম্ভীর গলায় বলে—শোনো।
—কী?
—শেষ পর্যন্ত তুমি ল্যাম্পপোস্টটায় ঢিল লাগিয়েছিলে?
—হুঁ।
—কবারে?
—খেয়াল করিনি। কেন?
—ভাবছিলাম। জানিস অপা, সোমেনের খুব ডিটারমিনেশন, ও দেখিস, উন্নতি করবে।
—কীসে বুঝলি? অপালা দোলনা থেকে নেমে কাছে আসতে আসতে বলে।
—ঢিল ছোঁড়া দেখে।
অপালা শ্বাস ছেড়ে বলে—ঠিকই, ও খুব বীর।
অণিমা বিচ্ছুর মতো মুখ করে বলে—না, না, ওকে এতকাল যা ভেবেছিল ও কিন্তু তা নয়। ঢিলটা লাগানো খুব শক্ত ছিল, ও কিন্তু পেয়েছে।
সোমেন রেগে গিয়ে বলে—তুমিই তো ঢিলটা লাগাতে বললে।
অণিমা হঠাৎ চোখ বড় করে তাকায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে সোমেনের দিকে, তারপর যেন সম্মোহন থেকে জেগে উঠতে উঠতে বলে—তুমি সেজন্যই অত সিরিয়াস হয়ে গেলে? না হয় আমার মুখ থেকে একটা কথা বেরিয়েই গেছে! বলে আবার বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে অণিমা। আস্তে করে বলে—ভেবেও সুখ যে একজনের কাছে আমার কথার এত দাম। সোমেন! তুমি কী তবে বলে থেমে চেয়ে থাকে অণিমা।
সোমেন মাথা নাড়ে। বড় বড় চোখে অণিমার দিকে তাকায়। আস্তে করে গাঢ় স্বরে বলে—তবে আজ বলি?
অণিমা মাথা নেড়ে কানে হাত চাপা দেয়, ভয়ার্ত গলায় বলে—না, না, এখন নয়। যেদিন ফুল-টুল ফুটবে, চাঁদ-টাঁদ উঠবে, লোডশেডিং থাকবে, সেদিন দূরে কোথাও গিয়ে—
অপালা ব্যাপারটা দেখে খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। এতক্ষণে হঠাৎ শ্বাস ছেড়ে বলল—মাইরি, পারিস তোরা! কিন্তু ও কথাটা কী। সোমেন কী বলতে চাইছিল, আর তুই-ই বা চাঁদ-ফুল-লোডশেডিং কী বললি ও-সব?
—ও একটা গোপন কথা। অণিমা বলে।
—আমার সঙ্গে কেউ গোপন কথা বলে না, মাইরি! অপালা দুঃখের গলায় বলল—বলবি। না, এই সোমেন? কিরে?
—ওটা কেবল আমার আর অণিমার একটা ডায়লগ। তুই বুঝবি না। সিক্রেট।
—ইস, সিক্রেট! মারব থাপ্পড়। বল শিগগির!
—না।
—এই সোমেন!
অপালা রেগে সোমেনের হাত খামচে ধরে। অন্য হাতে একটা থাপ্পড় কষায় পিঠে।
সোমেন বলে—ইস, হাতে কী জোর! একদম ব্যাটাছেলে।
—বলবি না?
—তোর বিয়ে হবে না, বুঝলি! সোমেন বলে—হলেও বর ফেরত দিয়ে যাবে। এমন ব্যাটাছেলে মার্কা মেয়ে জন্মে দেখিনি।
—ছেলেগুলো মেনিমুখো হলে আমাদের ব্যাটাছেলে হতেই হয়।
সোমেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলে—সেজন্যই ছেলে আর মেয়েতে ফ্রি মিক্সিং ভাল নয়। দুপক্ষেই ভেজাল মিশে যায়।
অণিমা গম্ভীর হয়ে বলে—সেই জন্যই বুঝি তুমি আমাদের সঙ্গে সহজে মিশতে চাও না সোমেন! ছোঁয়াচ বাঁচাচ্ছ?
—বটেই তো। আমার বউ হবে একটা আস্ত মেয়েমানুষ, তার মধ্যে ব্যাটাছেলের যেমন ভেজাল চলবে না, তেমনি আমার মধ্যে মেয়েছেলের ভেজাল থাকলে সে-ই বা খুশি হবে কেন?
—ইস! অপালা ঠোঁট ওলটায়—বউ! কোন বউ তোর জন্য ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে? ততাদের জেনারেশন বিয়ে হবে ভেবেছিস? বউ! মারব থাপ্পড়।
—তুই ঠিক পূর্বার মতো হয়ে যাচ্ছিস। আমার বউয়ের কথা শুনে তোর চটবার কী? সোমেন দু-পা পিছিয়ে গিয়ে বলে—আমার একটা বউ হতে নেই? ভিখিরিরও আর কিছু না হোক একটা বউ হয়।
—কিন্তু তোর হবে না। বলে অপালা আঙুল তুলে তেড়ে আসে—তোর কিছুতেই হবে না।
সোমেন তেমনি তটস্থ ভাব দেখিয়ে পিছিয়ে গিয়ে বলে—কিন্তু প্রায় হয়ে গেছে যে!
অপালা থমকে গিয়ে ভ্রূ কুঁচকে তাকায়, বলে—কে?
সোমেন তখন গালগলা চুলকোয়, চোখমুখ বিকৃত করে নানারকম, তারপর হঠাৎ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলে—দেখছিও তো কবো না, লম্বা ঘুঁষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা—
—ও কিরে? অপালা চেঁচিয়ে হেসে ওঠে।
—মনোপাগলা নামে একটা পাগল আসত আমাদের বাড়িতে। সে বলত।
অণিমা আর একটা কপট শ্বাস ফেলে বলে—তুই বুঝিসনি অপা।
—কী বুঝিনি?
—সোমেন প্রেমে পড়েছে। কিন্তু তার কথা আমাদের কাছে বলবে না। ওই ছড়াটার মধ্যে সেটাই বলে দিল। দেখেছে, বলবে না। না, সোমেন?
—মাইরি! অপালা চোখ বড় করে বলে—পড়েছিস?
—হুঁ
—কেমন দেখতে রে?
—দেখছিও তো কবো না!
—আবার?
সোমেন সিগারেট ধরায়, বলে—কী করে বলি কেমন দেখতে! তাকে এখনও ঠিক চোখে দেখিনি, তবে বাঁশি শুনেছি।
—বল না! বল না!
সোমেন অণিমার দিকে তাকায়, হঠাৎ গাঢ় স্বরে বলে—এই অনি, বলে দাও না সোনা! আর লুকিয়ে রেখে লাভ কী?
অণিমা ইয়ারকিটা লুফে নেয়। লাজুক নতমুখে বলে—যাঃ, আমার ভারী লজ্জা করে। তুমিই বলো।
বলে অণিমা আঙুল কামড়ায়।
ধুস! অপলা ভারী হতাশ হয়ে বলে—সেই পুরনো ইয়ারকি। যা ফাজিল হয়েছিস না তোরা। সোমেন, বলবি না তো?
—দেখছিও তো কবো না—সোমেন সুর দিয়ে বলে—লম্বা ঘুঁষি মারেগা, হা রে মনোপাগলা
ভেদ হয় না, কিছুতেই ভেদ হয় না বলে অপালা হঠাৎ দু-পা এগিয়ে এসে সোমেনের সোয়েটারটা বুকের কাছে খিমচে ধরে বলে—বলবি না? বল শিগগির!
সোমেন বলে—ছাড় ছাড়, মোটে একটাই সোয়েটার আমার, বেকার মানুষ।
—বল তা হলে!
—বলছি, বলছি, পূর্বা।
সোয়েটারটা মুঠো করে মোচড়ায় অপালা—বল শিগগির ঠিক করে।
—বলতেই হবে?
—ছিঁড়লাম কিন্তু।
—তুই।
অপালা একটা ধাক্কা দিয়ে ঘন শ্বাস ফেলে বলে—ইস, সাহস কত!
পিকনিক থেকে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেল। বলে গিয়েছিল, রাতে খাবে না। তার কারণ, এ বাড়িতে অনুগ্রহণ করতে তার অরুচি।
জামাকাপড় ছেড়ে অনেকটা ঠান্ডা জল খেয়ে শুয়ে পড়তে যাচ্ছিল সে। ননীবালা এসে বলেন—দুটো ভাত খাবি না?
—না।
—রাতে না খেলে হাতি শুকিয়ে যায়, যা হোক দুটো খা।
সোমেন একটু রেগে গিয়ে বলে—না, খিদে নেই। খাওয়া নিয়ে ঘ্যান ঘ্যান করো না তো, ভাল লাগে না।
ননীবালা হাল ছাড়েন না। মুখে কিছু না বলে পান আর জরদার কৌটো খুলে বসেন। বলেন—কখন থেকে ভাত তরকারি গরম করে বসে আছি। গরম কি থাকে। শীতকাল, টপ করে জুড়িয়ে যায়।
—তুমি খাওনি?
ননীবালা ছেলের চোখের দিকে চেয়ে একটু তাচ্ছিল্যের মতো করে বলেন—খাব। তাড়া কী? তুইও দুটো মুখে দিতিস!
সোমেন একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—সহজে ছাড়বে না, না বুড়ি?
—ছেলেরা না খেলে মা যে বড় জব্দ হয়ে যায়।
—দাদা ফিরেছে?
—হুঁ। কখন শুয়ে পড়েছে। একটু আগে শুনছিলাম ও-ঘরে কথাবার্তা চলছে। ভাব হয়ে গেছে বুঝি।
—আবার ওদের দরজায় কান পেতেছিলে? সোমেন মার দিকে কটমট করে তাকায়।
ননীবালা বিরসমুখে বলেন—তুই কেবল আমার কান-পাতা দেখিস। কান পাতব কেন? জোরেই বলছিল, শুনেছি।
সোমেন হতাশ হয়ে বলে—তোমাকে নিয়ে পারি না। যত গণ্ডগোলের মূলে তুমি ঠিক থাকবে। ছেলে আর ছেলের বউ ঘরে কী বলে না বলে তা শুনতে তোমার লজ্জা করে না?
ননীবালা অন্য সময় হলে এ কথায় রেগে যেতেন। কিন্তু এখন তাঁকে খুবই ভীতু আর হতাশ দেখাচ্ছিল। বললেন—সংসারের সব কি তুই বুঝিস? ছেলেদের ভালমন্দের জন্য মাকে অনেক অন্যায় করতে হয়। লজ্জা-ঘেন্না থাকলে চলে না।
সোমেন স্থির দৃষ্টিতে ননীবালার চোখের দিকে চেয়ে বলে—তার মানে তুমি আড়ি পেতে ওদের কথা শুনেছ।
—তুই দুটি খেয়ে আমাকে ছেড়ে দে তো! শীতের রাত, তাও অনেক বেজে গেছে। বলে সোজা পানটা মুখে না দিয়ে রেখে দেন ননীবালা। ছেলের দিকে চেয়ে বলেন—চল।
সোমেন কথা বলে না। কিন্তু খেতে যায়।
কয়েক দিন হল, রান্নাঘরের এক ধারে টেবিল পাতা হয়েছে। টেবিলটা ভালই। শ’চারেক খরচ করে দাদা বানাল। ওপরে কালচে রঙের সানমাইকা লাগানো, পায়ায় পেতলের শু। চেয়ারগুলোও চমৎকার। রান্নাঘরটা বেশ বড়, তবু টেবিল চেয়ার পাতার পর আর বেশি জায়গা নেই। ননীবালা টেবিলে খান না, তাঁর এঁটো বাতিক। টেবিলে খেলে সর্বস্ব এঁটো হয়। সোমেন টেবিলে খেতে বসলে মা তার পায়ের কাছটিতে একটা ছোট্ট কাঁসার বাটিতে নিজের জন্য একটু ভাত আর মাছের ঝোল নিয়ে বসেন। ভাল করে খেতে পারেন না। অনিচ্ছায় মুখে গ্রাস তুলে অনেকক্ষণ ধরে চিবোন।
সোমেন জিজ্ঞেস করে—আর কোনও হাঙ্গামা হয়নি তো?
—না, কী হবে! আমে দুধে মিশে গেছে বাবা। আঁটিটা পড়ে আছে।
সোমেন চাপা ধমক দিয়ে বলে—কেন, তাতে তোমার গা জ্বালা করছে? ওদের মিলমিশ হলে তোমার ক্ষতিটা কী হল?
—ক্ষতির কথা বলেছি? মিলমিশ হয়েছে ভালই তো।
—তবে বলছ কেন?
ননীবালা চুপচাপ ভাতের গ্রাস চিবোতে থাকেন। হঠাৎ বলেন—তোর চাকরিটা হল না কেন?
—হল না, এমনিই। সোমেন বিরক্ত হয়ে গেল—কেন, আমার চাকরি দিয়ে কী হবে?
—মাঝে মাঝে ভাবি, তোর একটা কিছু হলে বরং একটু আলাদা বাসা-টাসা করলে হয়।
সোমেন উঠে পড়ে।
ননীবালা খুব সম্প্রতি পান আর জরদার নেশা ধরেছেন। শোওয়ার আগে পান না হলে আজকাল চলে না। পানের বাটা নিয়ে বসতে যাবেন, জাঁতিটা মেঝেয় পড়ে শব্দ হল।
সোমেন শুয়েছিল, বলল—আঃ।
—জেগে আছিস?
—না ঘুমোচ্ছি। বিরক্ত হয়ে সোমেন বলে।
ননীবালা শ্বাস ফেলেন।
সোমেন পাশ ফিরে বলে—ইচ্ছে করে জাঁতিটার শব্দ করলে না?
—না, পড়ে গেল।
ও-সব চালাকি আমি জানি। আমাকে জাগিয়ে এখন ওদের নিন্দেমন্দ করতে বসবে তো!
—সংসারে থাকতে হলে অমন উদোর মতো থাকবি কেন? সব জেনেবুঝে থাকতে হয়।
—জেনেবুঝে আমার দরকার নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড, শুয়ে পড়ো, বিরক্ত কোরো না।
ননীবালা কথা বলেন না। পান খেয়ে ডাবরে পিক ফেলেন। বাতি নিবিয়ে মশারির মধ্যে ঢুকে যান। কিন্তু নানারকম শ্বাসের শব্দ আসে। একবার অস্ফুট কণ্ঠে বলেন—যা মশা! তারপর আবার খানিকক্ষণ চুপ থেকে সোমেন জেগে আছে কি না বুঝবার চেষ্টা করেন। আপন মনেই বলেন—আজ বাচ্চা দুটোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে গেল। ওরা যেতে চায়নি। আমার কাছে তো বড় একটা শুতে পায় না।
—বেশ করেছে নিয়ে গেছে। সোমেন বালিশে কান চেপে রেখে বলে—ওদের বাচ্চা ওরা নিয়ে যাবে না কেন? তা ছাড়া তুমিই তো বলো যে ওরা তোমার ঘর নোংরা করে, ওদের পায়ের ধুলোবালিতে তোমার বিছানা কিচকিচ করে!
—সে তো সত্যি। তোরা চারটে ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর থেকে বাচ্চাকাচ্চা বড় একটা টানি না তো!
—তা হলে আর দুঃখ কীসের?
ননীবালা হঠাৎ একটু চড়া গলায় বলেন—সব না শুনে অত রাগ-রাগ করছিস কেন?
—শুনতে চাই না। ঘুমোও।
ননীবালা মিইয়ে গিয়ে বলেন—হুঁ! ঘুম কি আর হুট বলতেই আসে! আজ বায়ুটা চড়ে গেছে। ঘুম আর হবে না।
—তা হলে আমাকে ঘুমোতে দাও।
—ওখানে কী কী খাওয়াল আজ? ননীবালা প্রসঙ্গ পালটান খুব কৌশলে।
—রণোটা সারাদিন কোথায় কী খেল কে জানে! বহেরুর ওখানে যাওয়ার কথা ছিল, সেখানেই গিয়েছিল বুঝতে পারলাম না। কথা বলতে সাহস পেলাম না। রাতে কিছু খেল না। মুখখানা শুকনো দেখাচ্ছিল। খায়নি বুঝি সারাদিন।
—না খাওয়াই উচিত। যে বউয়ের গায়ে হাত তোলে তার আবার খাওয়া!
—সেটা অন্যায় করে ফেলেছে ঠিকই, কিন্তু রণো তো অত রাগ করার ছেলে না। বউমা কিছু একটা অন্যায় বলেছে নিশ্চয়ই। কাল বাড়িতে পা দেওয়ার পর থেকেই তো টিক-টিক করছিল।
সোমেন কেঁকে উঠে বলে—যা খুশি করুক, তা বলে গায়ে হাত তুলবে!
—বলছি তো সেটা অন্যায় করে ফেলেছে। মানুষ কি সব সময়ে নিজের বশে থাকে?
—দাদার পক্ষ হয়ে একটাও কথা আর বলবে না তুমি।
—কেন বলব না? রণাকে আমি এইটুকুবেলা থেকে বড় করেছি, ওর ধাত আমার চেয়ে ভাল কে জানে! ও ঠান্ডা মানুষ, ওকে রাগালে কেমনতর হয়ে যায়। সেই জন্যই ওকে কেউ কখনও শাসন করেনি। তবে দরকারও হত না, ও তেমন কিছু দুষ্টুমি করতই না। কদিন হল দেখছি ও যেন কেমনধারা হয়ে যাচ্ছে!
—যাচ্ছে যাক। তুমি ওদের মধ্যে বেশি নাক গলিয়ো না।
ননীবালা আবার একটু চুপ থেকে সোমেনের মন বুঝবার চেষ্টা করেন।
তারপর বলেন—শীলার চিঠিটা পড়লি তো! আমি কিছু মাথামুণ্ডু বুঝলাম না। কী বলতে চেয়েছে বল তো! একটু বুঝিয়ে দে।
—আঃ! বলে ভীষণ বিরক্তিতে সোমেন উঠে বসে। বলে—কিছুতেই ঘুমোতে দেবে না?
—ঘুমোস। সকালেবেলা পর্যন্ত ঘুমোস, না হয় ডাকব না। এখন একটু বুঝিয়ে বল তো। বলে ননীবালা মশারি তুলে বাইরে বেরিয়ে বসেন।
ঘর অন্ধকার হলেও বাইরের আলো আবছাভাবে ঘরে আসে। ননীবালার ছায়ামূর্তিটার দিকে আক্রোশভরে একটু চেয়ে থাকে সোমেন। তারপর বলে—তুমি বড়দির চিঠিটা ঠিকই বুঝেছ।
—যা বুঝেছি তা কি হতে পারে?
—হবে না কেন? বাবা তো টাকা দিতে এলেন না। জমিটা হাতছাড়া হয়ে যাক—তাই চাও?
—তাই কি বলেছি? কিন্তু লোকটা এল না কেন, কেমন তার বুকের ব্যথা, এটা তো তোরা। দু-ভাইয়ের একজন গিয়ে খোঁজ নিতে পারতিস!
সোমেন বলে—বাবা তোমার কেউ হয় না? বহেরুর চিঠি পেয়ে তুমিও তো চলে যেতে পারতে!
ননীবালা কথা খুঁজে পান না। তারপর অনেকক্ষণ বাদে ক্ষীণকণ্ঠে বলেন—আমি তো চোখের বিষ। আমাকে দেখলে ব্যথা বেড়েই যাবে হয়তো।
সোমেন বালিশে উত্তপ্ত মাথাটা আবার রাখে। কথা বলে না। ননীবালাও কিছু বলেন না অনেকক্ষণ। তারপর ক্ষীণকণ্ঠে বলেন—তাই বলছিলাম, তোর যদি একটা চাকরি-বাকরি হত তা হলে আলাদা একটু বাসা-টাসা করে মায়ে-পোয়ে থাকতাম।
বড় রাগ হয় সোমেনের। সে বলে—দাদার মতো লোকের সঙ্গে থাকতে পারছ না, দাদা কত ভালবাসে তোমাকে!
—কী করব। দেখছিস তো! সব দোষ কি আমার?
—তোমারই। তোমাকে নিয়ে আমি থাকতে পারব না।
ননীবালা স্তব্ধ হয়ে থাকেন। হাতের ব্রোঞ্জের কয়েকগাছা চুড়ির একটু শব্দ হয়। শ্বাস ফেলেন। খুব বিষণ্ণ ক্ষীণ গলায় বলেন—জবাব দিলি?
॥ পনেরো ॥
বাসে ট্রামে আজকাল অজিত উঠতে পারে না। বড় কষ্ট হয়। অফিসের পরই তাই তার বাসায় ফেরা বড় একটা হয় না। এক সময়ে যখন ইউনিয়ন করত তখন প্রায়দিনই অফিসের পর ইউনিয়নের কিছু না কিছু কাজ থাকত, নয়তো কো-পারেটিবের। এখন সে সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে। ওভারটাইম থাকলে অফিসের পর সময়টা একরকম কাটে। নইলে বিকেলটা ফাঁকা এবং শূন্য।
অজিত যখন বেরোয় তার বহু আগেই অফিসের লোকজন চলে যেতে শুরু কর। সরকারি অফিস, তাই কেউ সময়টময় মানে না। অজিত যায় না, গিয়ে কী হবে! সাড়ে পাঁচটা ছটা পর্যন্ত কাজ করে সে সময় কাটায়। তারপরও বাসায় ফেরার নামে গায়ে জ্বর আসে। শীলা বেলা থাকতেই স্কুল থেকে ফেরে, কিন্তু অজিত ফেরে না। কার কাছে ফিরবে? একটা বাচ্চাও যদি থাকত!
মুশকিল হয়েছে এই যে, অফিসে তার বন্ধু-টন্ধু বড় একটা নেই। যখন ইউনিয়ন করত তখন বন্ধু ছিল সঙ্গীও ছিল। ইউনিয়ন ছেড়ে দিয়েছে বহুকাল, সেকশন ইনচার্জ হওয়ার পর আর কোনও সম্পর্কও রইল না। যাদের সঙ্গে এক সাথে কাজ করে তাদের সঙ্গে আজও ঠাট্টা মস্করা বা আড্ডার সম্পর্ক আছে বটে, কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে তারাও কেমন ভোঁতা হয়ে গেছে, সংসার-চিন্তায় কিছুটা বা আত্মকেন্দ্রিক। হাসি-ঠাট্টা আজও হয় কিন্তু সেও জলের ওপর ভেসে থাকা বিচ্ছিন্ন কুটোকাটার মতো, তাতে স্রোত নেই, টান নেই, গভীরতা নেই।
কলকাতার ভিড় দিনে দিনে কোন অসম্ভাব্যতার দিকে যাচ্ছে তা ভেবে পায় না অজিত। শহরটার আগাপাশতলা দেখলে মনে হয় না এত মানুষ আঁটার জায়গা এখানে আছে। তবু কী করে যেন ঠিক এঁটেও যায়। ট্রামে বাসে ঝুলন্ত মানুষ দেখে অজিত, রাস্তাঘাটে মানুষের শরীর আগেপিছু কেবলই ঠেলে, ধাক্কায়। বিরক্তি, রাগ, ভয় নিয়ে মানুষ চলেছে, ঘুরে মরছে, কোথাও পৌঁছোয় না শেষ পর্যন্ত।
ভিড় একটু কম থাকলেও, এবং অফিসের পর বাসে ট্রামে ওঠা গেলেও অবশ্য অজিত বাসায় ফিরত না। ফিরে গিয়ে কী হবে? শীলা সন্ধে থেকে রেডিয়ো খুলে রাখে, উল বোনে, সিনেমার কাগজ দেখে। অজিত তাড়াতাড়ি ফিরলে অবশ্য খুশি হয়। কিন্তু সেটা কেবল বাড়িতে একজন লোক আসার জন্য যেটুকু খুশি তাই। কথা প্রায়ই বলার থাকে না। শীলা ঝির নিন্দে করতে থাকে, আশেপাশের বাড়ির নানা খবরাখবরের কথা বলে, বড়জোর স্কুলের গল্প করে। ওদের স্কুলে নতুন এক ছোকরা মাস্টার এসেছে, সে নাকি বোকা তাই তাকে নিয়ে অনেক কাণ্ড হয় স্কুলে। সেই সব গল্প বলে শীলা। অজিতের হাই ওঠে।
অফিসের পর একা-একাই কিছুটা হাঁটে অজিত। কিন্তু হাঁটার মতো তেমন জায়গা নেই। ময়দানের অন্ধকারেও দুর্বৃত্তের মতো কিছু মানুষ মুখ লুকিয়ে চুপিসাড়ে ঘোরে পুলিশ নজর রাখে, ভাড়াটে মেয়েছেলেরা গা ঘেঁষে যায়। রেস্টুরেন্টে খুব বেশিক্ষণ একা বসে থাকা যায় না। আসলে এই চল্লিশের কাছাকাছি বয়সেও তার সেই বয়ঃসন্ধির সময়কার পিপাসা জেগে আছে লক্ষ্মণের জন্য। লক্ষ্মণ আর কোনওদিনই ফিরবে না। একটা কভার ফাইল কিনে তার মধ্যে লক্ষ্মণের সব চিঠি জমিয়ে রাখে অজিত। অবসরমতো সেইসব চিঠি খুলে পড়ে। পিপাসা তাতে বেড়েই যায়।
অবশেষে খুব রাত হওয়ার আগেই অফুরণ সময় ফুরিয়ে না পেরে সে বাসার দিকেই ফেরে। মাঝে মাঝে ভবানীপুরে নেমে নিজেদের বাড়িতেও ঢুঁ মারে। কিছুই আগের মতো নেই। ভাইপো-ভাইঝিরা কত বড় সব হয়ে গেল। মা এখন কত বুড়োটে মেরে গেছে। খুব ডেকে, ভালবেসে কথা বলার কেউ নেই। দাদা বউদি আলগা আলগা কথা বলে, চাকর চা খাবার দিয়ে যায়। ইদানীং অজিত ম্যাজিক দেখায় বলে ভাইপো-ভাইঝিরা ঘিরে ধরে। অন্যমনস্কভাবে কয়েকটা ম্যাজিক দেখায় সে। জমে না।
অজিতকে তাই বাসায় ফিরতেই হয়। নিস্তব্ধ বাড়ি। শিশুর কণ্ঠস্বর নেই। কেবল রেডিয়োটা বাজে। বেজে যায়। কেউ শোনে না।
শীলা দরজা খোলে। কথা বলে না।
অজিত ঘরে ঢোকে। কথা বলে না।
আবার বলেও। খাওয়ার টেবিলে, বিছানায় শুয়ে এক-একদিন কথা হয় অনেক। ডাক্তার মিত্রকে কম টাকা আজ পর্যন্ত দেয়নি অজিত। কম করেও তিন-চার হাজার টাকা বেরিয়ে গেছে। একবার নার্সিং হোমে শীলার একটা অপারেশনও হয়েছে। শীলার কোনও তেমন মারাত্মক খুঁত না পেয়ে ডাক্তার মিত্র অজিতেরও কিছু চিকিৎসা করেছেন। তবু লাভ হয়নি। শীলার পেটে বাচ্চা আসেনি।
—কী আর হবে, ছেড়ে দাও। অজিত হতাশ হয়ে বলেছে।
শীলা কেঁদেছে, বলেছে—তোমাকে জীবনের সবচেয়ে বড় জিনিসটাই দিতে পারলাম না।
—দূর দূর! অজিত সান্ত্বনা দিয়েছে—বাচ্চাকাচ্চা হলে ঝামেলাও কম নাকি। হল হয়তো, বাঁচল না। তখন বাচ্চা না হওয়ার চেয়েও বেশি কষ্ট। ছেলেপুলে বড় করা কি সোজা কথা!
এ কোনও সান্ত্বনার কথাই নয়। তবু আশ্চর্য যে শীলা সান্ত্বনা পায়।
মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ হেসে বলে—যা বলেছ! ছেলেপুলে হওয়া মানেই তো সারাদিন দুশ্চিন্তা। বাড়িঘর নোংরা করবে, কাঁদবে, চেঁচাবে। অশান্তি বড় কম নাকি! এই পড়ে গেল, এই ছড়ে গেল, এই এটা ভাঙল, সেটা ছিঁড়ল!
অজিত মাথা নেড়ে বলে—তবে?
শীলা শ্বাস ছেড়ে আবার তার বেদনার কাঁটা তুলে নিয়ে বলে—বাচ্চাকাচ্চা তো নয়, যেন অভিশাপ। না গো?
—হুঁ।
—এই বেশ আছি। শান্তিতে, নিরিবিলিতে। হুট করে যেখানে খুশি যেতে পারি। দুশ্চিন্তা নেই, ঝঞ্ঝাট নেই!
অজিত সায় দিয়ে যায়।
এবং এইরকমভাবেই দুটি শিশুর মতো তারা পরস্পরকে স্তোক দিয়ে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। পারেও।
কিন্তু দুজনের মাঝখানে একটা পরদা নেমে আসে ধীরে। যবনিকার মতো। তাদের দাম্পত্য জীবন যেন এই মধ্যযৌবনেই শেষ হয়ে আসে।
অজিত প্রথম ম্যাজিক শেখে রাস্তার এক ম্যাজিকঅলার কাছে। তিনটে টাকা নিয়ে সে অজিতকে বল অ্যান্ড কাপ, দড়িকাটা আর একটা তাসের খেলা শিখিয়েছিল। সেই তিনটে খেলা দেখিয়ে অজিত চমকে দেয় শীলাকে।
শীলা ভারী আবাক হয়ে বলেছিল—ভারী ভাল খেলা তো! তুমি তো বেশ খেলা দেখাও!
তারপর নানা সূত্রে সে সত্যিকারের ম্যাজিসিয়ানদের কাছে যাওয়া-আসা শুরু করে। বেশ কয়েকটা স্টেজ ম্যাজিক শিখে যায়, টেবিল ম্যাজিক অনেকগুলো টপাটপ শিখে নেয়। ফলে অফিসে, পাড়ায় ম্যাজিসিয়ান হিসেবে লোক তাকে চিনে গেছে। সে পয়সার খেলা দেখায়, জ্বলন্ত সিগারেট লুকিয়ে ফেলে কোথায়, হাতের আঙুলের ফাঁকে শূন্য থেকে নিয়ে আসে পিংপং বল। একটা দুটো তিনটে। এখন তার ভাণ্ডারে ম্যাজিকের মজুদ বড় কম নয়। ম্যাজিকের দোকান ঘুরে, ম্যাজিসিয়ানদের কাছ থেকেও সে সাজসরঞ্জাম কিনেছিল অনেক। ঘণ্টাখানেক স্টেজে দেখানোর মতো স্টক তার আছে।
মাঝেমধ্যে রাত জেগে সে আয়নার সামনে বসে পামিং আর পাসিং অভ্যাস করে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অন্যমনে পকেটে হাত দিয়ে কয়েন কনজিওরিং অভ্যাস করে। ভাবে, ম্যাজিকওয়ালা হয়ে গেলে কেমন হয়!
শীলা আজকাল মাঝে মাঝে বলে—তুমি আমাকে ভালবাস না।
—বাসি। নিস্পৃহ উত্তর দেয় অজিত।
—ছাই বাসো!
—কীসে বুঝলে?
শীলা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে—সবচেয়ে চাওয়ার জিনিসটা তোমার, তাই দিতে পারলাম না। নিস্ফলা গাছকে কে ভালবাসে বলো!
—হবে। সময় যায়নি।
—কবে আর হবে?
—মিত্র বলেছে, হবে মিত্র এশিয়ার সবচেয়ে বড় গায়নোকলজিস্টদের একজন।
—মিত্রর কথা ছাড়ো, ঘোরাচ্ছে আর টাকা বের করে নিচ্ছে। ওর দ্বারা হবে না। আমারই কোথাও দোষ আছে।
—না। কিছু দোষ নেই।
—ঠিক বলছ?
—বলছি।
অবশেষে একদিন ঋতু বন্ধ হয়ে যায় শীলার। বুক ধুকপুক করতে থাকে। একদিন দুদিন করে দিন যায়। শীলার চোখেমুখে একটা অপার্থিব আলো কোথা থেকে এসে পড়ে।
শীলা বলে—বড় ভয় করে গো!
—কেন?
—কী জানি কী হয়। আমার এমনিতেই একটু লেট ছিল।
—না, না, এ সে লেট নয়। তুমি শরীরের কোনও পরিবর্তন বুঝছ না?
—একটু একটু কিন্তু সেটা মানসিক ব্যাপারও হতে পারে।
—না, না। কাল একবার ডাক্তারের কাছে যাব।
মিত্র দেখেটেখে পরদিন বলেন—মনে হচ্ছে প্রেগন্যান্সি। তবে ইউটেরস একটু বাঁকা হয়ে আছে। নড়াচড়া একদম করবেন না। নরম, খুব নরম বিছানায় দিনরাত শুয়ে থাকবেন।
আজকাল তাই থাকে শীলা। অজিত একটা চমৎকার রবারের গদি কিনে এনেছে। অনেক টাকা দাম। স্কুল থেকে ছুটি নিয়েছে শীলা। অজিতও অফিস কামাই করে খুব। বিছানার পাশে চেয়ার টেনে বসে থাকে। চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, উদ্বেগ।
শীলা উপুড় হয়ে শুয়ে থাকে। নরম গদিতে সুখের শরীর ডুবিয়ে, মুখখানা অজিতের দিকে ফিরিয়ে ড্যাবা-ড্যাবা চোখে চেয়ে থাকে। মাঝেমধ্যে অর্থপূর্ণ হাসি হাসে, বলে—কী গো!
অজিত বলে—কী?
—অফিস যাওনা যে বড়!
—ছুটি জমে গেছে অনেক, নিয়ে নিচ্ছি।
—কেন শুনি। কোনওদিন ছুটি নিতে দেখি না। অফিস তো তোমার প্রাণ।
—প্রাণ-ট্রাণ নয়। কাজ থাকে।
—কাজ কী তা তো জানি।
—কী?
—ফিস খেলা, আড্ডা আর ম্যাজিক।
—না, না, প্রোমোশনের পর থেকে আর ওসব হয় না।
শীলা স্বামীর প্রতি গভীর ভালবাসায় একরকম সম্মোহিত হাসি হাসে, বলে বউয়ের গন্ধ শুঁকে এত বাড়িতে বসে থাকার কী?
—গন্ধটা বেশ লাগছে আজকাল।
—বউয়ের গন্ধ? না কি অন্য কিছু?
—বউয়ের গন্ধই।
—বুঝি গো, বুঝি!
—কী বোঝো?
—বউয়ের গন্ধ নয়। অন্য একজনের গন্ধ।
অজিত নিঃশব্দে হাসে। একটু লম্বাটে মুখ অজিতের। গায়ের রং ফরসার দিকে, সাননের। দাঁত সামন্য বড়। তবু হাসলে তাকে ভারী ভাল দেখায়। মূর্ণ হয়ে চেয়ে থাকে শীলা। স্বামীকে এত ভাল বহুকাল লাগেনি।
শীলা একটা শ্বাস ফেলে বলে—বউ তো পরের মেয়ে, তার জন্য কোনও মানুষটারই বা দরদ উথলে ওঠে! আসল দরদ তো তোমার নিজের জন্য, নিজের রক্তের জন আসছে। তাই অত ছুটি নিয়ে বসে থাকা। বুঝি না বুঝি?
—তোমার জন্য দরদ নেই, এটা বুঝে গেছ? কী বুদ্ধি তোমার!
—ওসব বুঝতে বুদ্ধির দরকার হয় না। হাবাগোবাও ভালবাসাটা বোঝে।
—হবে।
শীলা মৃদু হাসতেই থাকে। বালিশে মুখ ঘষে, গদিটায় একটু দোলায় শরীর, ঠ্যাং নড়ে।
অজিত সতর্ক হয়ে ধমক দেয়—আঃ! অত নড়ো কেন? আচ্ছা চঞ্চল মেয়ে যা হোক।
শীলা গুরগুর করে হাসে, বলে—কী দরদ!
অজিত ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে থাকে।
শীলা ফের বলে—কার জন্য গো, এত দরদ? এতদিন তো দেখিনি।
—বারবার এক কথা! অজিত বিরক্তির ভান করে। কিন্তু তার ভিতরে একটা টলটলে আনন্দ। নিঃশব্দে যেমন কলের তলায় চৌবাচ্চা ভরে ওঠে জলে, উপচে পড়ে—ঠিক তেমনি এক অনুভূতি, গলার কাছে একটা আবেগের দলা ঠেলা মেরে ওঠে।
শীলা একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ করে বলে—সে এখন পেটের মধ্যে একটুখানি রক্তের দলা মাত্র, তবু তার কথা মনে করেই দামি গদি এল, কাজের মানুষ ছুটি নিয়ে বসে থাকল, চোয়াড়ে মুখটায় মাঝে মাঝে হাসিও ফুটছে আজকাল গোঁফের ফাঁক দিয়ে। কী ভাগ্যি আমাদের!
—একটু চুপ করে থাকবে?
শীলা নিঃশব্দে হাসে, চোখেমুখে ঝিকরিমিকরি দুষ্টুমি। একটু চুপ করে থাকে। তারপর বলে—পরের মেয়ের কপাল খুলল এতদিনে।
শীলাকে প্রায়দিনই স্নান করতে দেয় না অজিত। ওঠা-হাঁটা প্রায় বন্ধ। এক-আধদিন শীলা বায়না করে—আর পারি না, শুয়ে থেকে থেকে কোমর ধরে গেল। স্নান না করে শরীর জ্বর-জ্বর। একটু স্নান করতে দাও না।
অজিত আপত্তি করে। শেষ অবধি আবার নিজেই সাবধানে ধরে তোলে শীলাকে। বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বলে—আমি স্নান করব।
—এ মা! লোকে কী বলবে?
—কে দেখতে আসছে?
—রেণু রয়েছে না! ঝি হলে কী হয় সব বোঝে।
—ও বাচ্চা মেয়ে, কিছু বুঝবে না।
—না গো, বোঝে।
—বুঝুকগে, অত মাথা ঘামানোর সময় নেই। একা বাথরুমে তুমি একটা কাণ্ড বাঁধাবে, আমি জানি।
বলে বাথরুমের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয় অজিত। শীলা আতঙ্কে বলে—না, না, ভারী বিশ্রী দেখায়। বড্ড লজ্জা করে।
অজিতও শোনে না। শীলা তখন অগত্যা চোখ বুজে দাঁড়িয়ে লজ্জায় হাসে। অজিত তার কাপড় ছাড়িয়ে দেয়। একটু আদর করে। খুব সন্দিগ্ধের মতো শীলার পেটটা স্পর্শ করে বলে—এখনও তো কিছু বোঝা যাচ্ছে না! একদম ফ্ল্যাট বেলি।
শীলা চোখ বড় বড় করে বলে—ও বাবাঃ, কী তাড়া! এখনই কী? পাঁচ-ছমাসের আগে। কিছু বুঝি বোঝা যায়।
অজিত বলে—কদিন হল যেন?
—প্রায় দেড়মাস।
অজিত শ্বাস ফেলে বলে—মাত্র!
শীলা হাসতে থাকে, বলে—তোমার বাচ্চা কি মেল ট্রেনে আসবে! সবার যেমন করে আসে তেমনই আসবে। বুঝলে?
অজিত বোঝে। যত্নে স্নান করিয়ে দেয় শীলাকে। ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে শীলার গায়ের জলে নিজেও স্নান করে। ঘরে এনে চুল আঁচড়ে দেয়। বিছানায় বসিয়ে চামচ দিয়ে নিজের হাতে ভাত খাইয়ে দেয়। একই পাতে খায় দুজনে। শীলা ভাজা বা মাছের টুকরো তুলে দেয় অজিতের মুখে। দুজনে পরস্পরের দিকে চেয়ে অর্থপূর্ণ হাসে। বড় সুখ।
রাতে শীলা ঘুমোয়। অজিতের ঘুম বড় অনিশ্চিত। তার স্নায়ুর একটা গণ্ডগোল আছে, মাঝে মাঝে সহজে ঘুম আসে না। মাথা গরম লাগে।
অন্ধকারেই উঠে টেবিল থেকে হাতড়ে রনসন গ্যাসলাইটারটা তুলে নেয়। সিগারেট ধরায়। দপ করে লাফিয়ে ওঠে চমৎকার নীলচে আগুনের শিখা। অমনি লক্ষ্মণের কথা মনে পড়ে। সেই সহৃদয় আর বুদ্ধির শ্রী মাখানো সরল মুখ। একটা ছবি পাঠিয়েছে লক্ষ্মণ। একটা প্রকাণ্ড স্ট্রিমলাইনড গাড়ি—খুব হালফ্যাশানের জিনিস, তার সামনে ওরা স্বামী-স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। বউটি ভালই দেখতে, তবে বয়সটা একটু বেশি—লক্ষ্মণেরই কাছাকাছি হবে। আর খুব লম্বা-লক্ষ্মণের সমান। লক্ষ্মণকে চেনাই যায় না ছবিতে। মোটা গোঁফ রেখেছে, বড় জুলপি, চুলও ঘাড়ের কাছে নেমে এসেছে। পরনে চেক প্যান্ট, গায়ে কোট, চোখে। রোদ-চশমা। মানাচ্ছে না লক্ষ্মণকে। মুখে খুশির হাসি। লক্ষ্মণকে কি আর চেনা যাবে না? পুরনো লক্ষ্মণ কি হারিয়েই গেল চিরকালের মতো? এরপর লক্ষ্মণের ছেলেমেয়েরা হবে, চাকরি আরও বড় হবে, কানাডায় শিকড় গেড়ে যাবে ওর। দেশে ফেরা হবে না। এবং লক্ষ্মণের পর ওর বংশধররাও হয়ে যাবে কানাডার মানুষ। তারা বাংলায় কথা বলবে না, আচরণ করবে না বাঙালির মতো, তারাও হবে ভিনদেশি। কেবল বহুকাল আগে প্রবাসে ছিটকে আসা লক্ষ্মণের পদবিটুকু স্মৃতিচিহ্নের মতো লেগে থাকবে তাদের নামের সঙ্গে। এরকম মুছে যাওয়া, নিঃশেষ হয়ে যাওয়া একটা মানুষের পক্ষে কতখানি দুঃখের তা কি লক্ষ্মণ বোঝে না? কলকাতার লক্ষ্মণ কেন অমন বিশ্বজনীন আর আন্তর্জাতিক হয়ে গেল? কোনও চিহ্ন রেখে গেল না স্বদেশে!
বাজে চিন্তা। মাথা থেকে চিন্তাটা বের করে দেয় অজিত। দরজির আঙুলের মাথায় যে ধাতুর টুপি পরানো থাকে হাত-সেলাই করার সময়ে, তাই দিয়ে নতুন একটা খেলা শিখেছে অজিত। পাশের ঘরে আলো জ্বেলে আয়নার সামনে বসে খেলাটা অভ্যাস করতে থাকে সে। ডান হাতের আঙুল থেকে চোখের পলকে বাঁ হাতের আঙুলে নিয়ে যায় বিদ্যুৎগতিতে লুকিয়ে ফেলে হাতের তেলোয়। আবার আঙুলে তুলে আনে। আঙুলের ডগায় ডগায় মুহুর্মুহু দেখা দেয় টুপিটা। হারিয়ে যায়, আবার দেখা দেয়। দ্রুত হাতে আঙুলে বিভ্রম সৃষ্টি করে চলে অজিত। বাচ্চাটা বড় হলে হাঁ করে দেখবে বাবার কাণ্ডকারখানা। ভাবতেই চকিত একটা অদ্ভুত হাসি খেলে যায় মুখে। ‘বাবা’ শব্দটা কী ভয়ংকর! কী সাঙ্ঘাতিক! দু-হাতের আঙুলে নৃত্যপর ধাতুর টুপির দ্রুত ও মায়াবী বিভ্রমটি তৈরি করতে করতে সে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে থাকে একটু।
শীলা ডাকে—ওগো কোথায় গেলে?
অজিত উঠে ও-ঘরে যায়—কী হল?
—কী করছ রাত জেগে? ম্যাজিক?
—হুঁ।
—পাগলা। ঘুমোবে না?
—ঘুম আসছে না। অজিত বলে।
—কাছে এস। তোমাকে ছাড়া ভাল লাগে না। এসো শিগগির, ও ঘরের বাতিটা নিবিয়ে দিয়ে এস।
অজিত তাই করে।
বিছানায় এসে শীলা ঘন হয়ে লেগে থাকে গায়ের সঙ্গে। লেপের ভিতরে ওম, দুজনের শরীরের তাপ জমে ওঠে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থাকে শীলা। আবার আলগা হয়ে উন্মুখ মুখখানা তুলে বলে—অনেক আদর করো।
অজিত আবছায়ায় স্ত্রীর মুখখানা দেখে। তার শ্বাস ঘন হয়ে আসে। দু-হাতে শীলার জলের মতো নরম শরীর চেপে ধরে। বলে—আদরখাকি!
—উসস। শীলা শব্দ করে।
—আদর খেয়ে শখ আর মেটে না তোর বউ?
শীলা করতলে চেপে ধরে তার মুখ, বলে—কথা নয়। আদর।
মুখটা সরিয়ে নিয়ে অজিত হাসে, বললে—আমি যে হাঁফিয়ে যাই! তুই যে বড় বেশি আদরখাকি!
তুমি বুড়ো।
—তুমি কচি খুকি!
শীলা আদর খেতে খেতে বলে—না না, আমাদের সবকিছু মাপমতো। বয়স-টয়স সব।
—মেড ফর ইচ আদার?
উম্ম্।
রতিক্রিয়ার পর যখন তারা তৃপ্ত ও ক্লান্ত তখন একটা সিগারেটের জন্য বুকটা বড় ফাঁকা লাগে অজিতের। বেরোতে যাচ্ছিল, শীলা জামা টেনে ধরে—কোথায় যাচ্ছ? সিগারেট?
—আগে বাথরুম। তারপর একটা সিগারেট।
উঁহু।
অজিতের সিগারেটের পিপাসা নিয়ে বসে থাকে। মেয়েদের এই বড় দোষ। স্বামীর কীসে ভাল হবে তা সময়মতো সঠিক বুঝতে পারে না, নিজের ধারণামতো চালায়। বিরক্তির সৃষ্টি করে। রতিক্রিয়ার পর এখন শীলার আকর্ষণ কিছুক্ষণের জন্য আর নেই। কেবল সিগারেটের জন্য বুকটা শূন্য। পিপাসা।
তবু অজিত মশারির বাইরে গেল না। হাত বাড়িয়ে বিছানার পাশের ছোট টেবিল থেকে জগ এনে জল খায়, শীলাকে খাওয়ায়। এক সময়ে আস্তে করে বলে—মাকে বলে আসব। কাঁথাটাঁথা সেলাই করতে।
শীলা আঁতকে উঠে বলে—এখনই কেন?
—বুড়ো মানুষ, এখন থেকে শুরু না করলে সময়মতো হবে না।
—না, না! শীলা বলে বাচ্চা হওয়ার আগে ওসব করতে নেই।
—কেন?
—ওসব তুকতাক তুমি বুঝবে না। বেশি সাধ করলে যদি খারাপ কিছু হয়! দূর, যত সব মেয়েলি সংস্কার।
—বাচ্চা হওয়ার আগে বাচ্চার জন্য কিছু করা বারণ। ও সব করবে না। বেশি আদেখলাপানা ভাল নয়।
অজিত একটা শ্বাস ছেড়ে বলে—আচ্ছা।
॥ ষোলো ॥
অফিসে ফিস্ খেলা হয় রানিং জোকারে। তাস বাঁটার পর যে তাসটা চিত হয় তার পরের নম্বরটা হয় জোকার, টেক্কা পড়লে দুরি, দুরি পড়লে তিন। অজিতের কপাল ভাল। প্রতিবার সে ঠিক দুটো তিনটে জোকার পেয়ে যায়। প্রচণ্ড জেতে। প্রতি কার্ডে দশ পয়সা হিসেবে এক-একদিন আট দশ টাকা পর্যন্ত জিতে নেয়।
মাঝখানে খেলত না, আবার ইদানীং খেলে অজিত। মনটা একরকম ফুর্তিতে থাকে আজকাল। মেশিন ডিপার্টমেন্টের কুমুদ বোস বয়স্ক লোক। চেহারাখানা বিশাল, এক সময়ে গোবরবাবুর আখড়ায় বিস্তর মাটি মেখেছে। চুলে কলপ-টলপ দিয়ে ফিনফিনে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে রইসবাবুর মতো থাকে সব সময়ে। বুদ্ধি কিছুটা ভোঁতা কথায় ভরপুর আদিরস। হেরে গিয়ে প্রায় দিনই বলে—ভাদুড়ি, তুমি তো শালা ম্যাজিসিয়ান।
অজিত বলে—তাতে কী?
—ম্যাজিসিয়ান মানেই হচ্ছে শাফলার।
অজিত হেসে বলে—একা আমিই তো প্রতিবার শাফল করছি না! সবাই করছে।
—তবু তুমি শালা তুকতাক জানো ঠিকই। নইলে রোজ জেতো কী করে?
—কপাল। অজিত বলে।
—কপাল না কচু। বলে গজগজ করে বোস—মুফত বসে বসে অতগুলো টাকা মাইনে পিটছ, দোহাত্তা জিতছ তাসে, তোমারটা খাবে কে হে? অ্যাঁ! এতদিনে একটা ছেলেপুলে করতে পারলে না!
—সেটাও কপাল।
—কপাল-টপাল নয়। ও সব করতে পুরুষকার চাই। তোমার সেটা নেই। কতবার তো বলেছি, যদি নিজে না পারো তো বউকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও।
উলটোদিক থেকে অরুণ দত্ত ধমক দেয়—বোসদা, চুপ!
বোস বলে—ও শালা জিতবে কেন রোজ?
গোপাল মুখার্জি সিগারেটসুদ্ধ ঠোঁটে বলে—ও রোজ সেফটি রেজার দিয়ে কপাল কামায়।
বোস থমথমে মুখ করে বলে কামায়? তাই হবে। ও শালা সবই কামিয়ে ফেলেছে বোধ হয়। পুরুষকার টুরুষকার সব।
একটা হাসি ওঠে।
অজিত সিগারেটের ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে চেয়ে বলে—বোসদা, এবার আপনাদের দেখাব।
—দেখাবে মানে?
—দেখবেন। সময় হোক।
—কিছু বাঁধিয়েছ নাকি এতদিনে?
অজিত উত্তর না দিয়ে হাসে।
বোস শ্বাস ছেড়ে বলে—বুঝেছি। কিন্তু এতদিন লাগল? আমার পাঁচ-ছ’টা নেমে গেছে, গোপালের ক’টা যেন! তিনটে না? ছবছরের বিয়েতে ভাল প্রগ্রেস! অরুণ, তোর? তুই তো নিরুদ্ধবাবু, সেই কবে একটা বানিয়ে বসে আছিস, পাঁচ বছরের মধ্যে আর মুখেভাতের নেমন্তন্ন পেলুম না! করিস কী তোরা, অ্যাঁ?
—সরকারের বারণ আছে। অরুণ দত্ত জবাব দেয়।
কী একটা অশ্লীল কথা বলতে যাচ্ছিল বোস, অজিত সিগারেট ধরিয়ে লাইটারটা বোসের মুখের কাছে ধরে বলল—ফের কোনও খারাপ কথা বেরোলে ছ্যাঁকা দিয়ে দেব। চুপ!
লাইটারটা পট করে কেড়ে নেয় বোস। নেড়েচেড়ে দেখে। বলে—মাইরি কী জিনিস যে বানায় সাহেবরা! আমি সিগারেট খেলে ঠিক এটা মেরে দিতুম।
তাস বাঁটা হয়েছে। সবাই হাতের তাস সাজাচ্ছে। চিতিয়ে পড়েছে টেক্কা, অর্থাৎ রানিং জোকার হচ্ছে দুরি। এবার অজিতের প্রথম টান। সে প্যাকের তাসের দিকে হাত বাড়িয়েছে, ঠোঁটে সিগারেট, চোখ কোঁচকানো, মাথার ভিতরকার যন্ত্র অটোমেশনের মতো হিসেব করে যাচ্ছে।
একটা অচেনা স্বরে কে ডাকল—অজিত!
অজিত উত্তর দিল—উঁ, কিন্তু ফিরে তাকাল না। ডাকটা তার ভিতরে পৌঁছয়নি।
অরুণ দত্ত ঠেলা দিয়ে বলে—কে ডাকছে দ্যাখ।
অজিত বিরক্ত হয়ে ফিরে তাকায়। টিফিনের সময় শেষ হয়ে এল। তাড়াতাড়ি করলে এখনও আর দুই রাউন্ড খেলা হতে পারে। এর মধ্যে কে আপদ জ্বালাতে এল!
অজিতের ঠোঁটে সিগারেট, তার ধোঁয়ায় চোখে জ্বালা, জল। স্পষ্ট কিছু দেখতে পায় না অজিত। ঘাড়টা ঘুরিয়ে একপলক আগন্তুকের দিকে চায়। নস্যি রঙের ব্যাপার গায়ে বুড়ো একটা লোক। গ্রাম্য চেহারা। লোকটা তার চোখে একটি বিস্ময়ভরে চেয়ে আছে।
—কী চাই? অজিত জিজ্ঞেস করে।
লোকটা তার চোখে চোখ রেখে একটু স্তম্ভিতভাবে চেয়েই থাকে। তারপর গলাখাঁকারি দিয়ে বলে—আমার পলিসিটার ব্যাপারে এসেছিলাম। তুমি ব্যস্ত থাকলে…
অজিত হঠাৎ লোকটাকে চিনতে পারে। ব্রজগোপাল লাহিড়ি, তার শ্বশুর। সিগারেটটা টপ করে নামায় সে।
—ওঃ! বলে শশ্যব্যস্তে উঠে পড়ে। আশেপাশে চেয়ার টেনে বসে যারা খেলা দেখছিল তাদের একজনের হাতে নিজের তাসটা ধরিয়ে দিয়ে আসর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
শ্বশুরমশাই এই অবস্থায় তাকে দেখে ফেলেছেন বলে অজিতের একটু লজ্জা করে। অফিসে বসে তাসটাস খেলা এ নোক যে ভাল চোখে দেখে না, এ তো জানা কথাই। তার ওপর পয়সার খেলা। ভাগ্যিস নগদ পয়সার খেলা হয় না! খাতায় হিসেব লেখা থাকে, মাসের শেষে পেমেন্ট হয়। তবু অস্বস্তি বোধ করে অজিত। এ লোকটার সামনে সে বরাবর এক অনির্দিষ্ট কারণে অস্বস্তি বোধ করেছে।
বহু দিন পর দেখা, একটা প্রণাম করা উচিত হবে কিনা ঠিক বুঝতে পারছিল না অজিত। অফিসের মধ্যে অবশ্য লজ্জাও করে।
দুধারে সার বেঁধে আই-বি-এম মেশিনগুলি চলছে। অনুচ্চ মৃদু শব্দ, কিন্তু অনেকগুলো মেশিনের শব্দ একসঙ্গে হচ্ছে বলে ঘর ভরে আছে শব্দে। তাসের মতো কার্ডুগুলি রোলালের ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে অনায়াসে, পড়ছে বিভিন্ন খোপে৷ ঠিক তাদের মতোই মেশিনগুলি তাস শাফল করছে, বাঁটছে। টিফিনের সময়ে মেশিন চলে না। কিন্তু এখন কমিশনের সময় বলে চলছে। কিছু লোক কাজ এগিয়ে রাখে। বিস্ময়ভরে ব্রজগোপাল যন্ত্রগুলির দিকে চেয়ে থাকেন একটু। ব্রজগোপালের পিছনে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রণেন। পরনে চমৎকার কাঠকয়লা রঙের স্যুট, চওড়া মেরুন টাই, গালে পানের ঢিবি। হাবাগঙ্গারাম! শ্বশুরমশাইকে দূরে দাঁড় করিয়ে রেখে রণেনই এসে ডেকে নিতে পারত অজিতকে, তা হলে আর অজিতকে ওই অবস্থায় দেখতেন না উনি।
রণেন এগিয়ে এসে বলে—অজিত, চেকটা?
বিরক্তি চেপে অজিত বলে—ডিসচার্জ ফর্মটা জমা দিয়েছ কবে?
—একমাস তো হবেই।
অজিত চিন্তিতভাবে বলে—এতদিনে চেক তো রেজিস্টার্ড পোস্টে চলে যাওয়ার কথা তোমাদের বাড়িতে।
—যায়নি।
অজিত একটু হেসে বলে—সরকারের ঘর থেকে টাকা বের করার কিছু পেরাসনী তো আছেই। সাধারণত ফর্ম জমা দেওয়ার মাস দুই তিন পর চেক যায়। আমি বলে রেখেছিলাম, তাই তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথা ছিল।
ব্রজগোপাল আই-বি-এম মেশিনের কার্ড বিলির চমৎকার নিপুণতা লক্ষ করে মেশিন থেকে চোখ তুলে তাঁর বড় জামাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন—একটু খোঁজ নিও। কোনও জায়গায় আজকাল আর কাজকর্ম তাড়াতাড়ি হয় না।
—আজই খোঁজ নিচ্ছি। হয়তো আজকালের মধ্যেই চেক চলে যাবে। আপনি এখন কয়েকদিন কলকাতায় থেকে যান।
ব্রজগোপাল তার দিকে চেয়ে থাকেন একটু। তাঁর চোখের বিস্ময় ভাবটা এখনও যায়নি। বললেন—আমি তো কলকাতায় থাকতে পারব না। তবে যদি বলো তো আবার কাল-পরশু আসতে পারি।
—অত ছোটাছুটির দরকার নেই। অজিত সহানুভূতির সঙ্গে বলে—রেজিষ্ট্রি চিঠির খবর পেলে আপনি পরে এসে রিসিভ করে চেক ব্যাঙ্কে জমা দিলেই চলবে। রেজিষ্ট্রি চিঠি পোস্ট অফিসে দিন-সাতেক ধরে রাখবে।
ব্যাপারটা অত সহজ তা যেন বিশ্বাস হতে চায় না ব্রজগোপালের। বলেন—আর কোনও সইসাবুদ বা সাক্ষির দরকার নেই তো?
—না, না।
ব্রজগোপাল রণেনের দিকে চেয়ে বললেন—তা হলে তো হয়েই গেল। চিঠি এলে তোমরা আমাকে খবর দিয়ে।
বলে ব্রজগোপাল দরজার দিকে এগোতে এগোতে বললেন—তোমরা সব ভাল আছ তো?
প্রশ্নটা অজিতকে করা। সে পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বলে—ভালই। আপনার শরীর খারাপ শুনেছিলাম।
—শরীরমুখী চিন্তা কখনও করি না। কাজকর্ম নিয়ে থাকি, ভালই আছি।
—কী একটা বুকের ব্যথার কথা শুনেছিলাম।
—হয় বটে মাঝেমধ্যে একটা। সেরেও যায়। আবার গা ঝাড়া দিয়ে উঠি ক্ষেতখামার করি।
—এই বয়সে একটু বিশ্রাম দরকার।
—বিশ্রাম মানে তো শুয়ে বসে থাকা নয়। বিশ্রাম হচ্ছে এক বিশেষ রকমের শ্রম। কোনও কোনও কাজই আছে যা ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়।
অজিত এ বাবদে আর কথা বলতে ভরসা পান না।
সিঁড়ি বেয়ে ব্রজগোপাল লবিতে আসেন। রণেন বাধ্য ছেলের মতো ব্রজগোপালের পায়ে পায়ে হাঁটছে। তার মুখে অন্যমনস্কতা, আর বিষাদ, জমিটার ব্যাপারে আর কোনও কথা বলতে আসেনি রণেন। কথা ছিল, ও বউয়ের নামে জমিটা কিনবে। এখনকার নামে যে লক্ষ্মণের জমিটা কেনা হবে তা সঠিক বুঝতে পারছে না অজিত।
ব্রজগোপাল লবি পার হয়ে পেভমেন্টে নেমে দাঁড়ালেন। বললেন—অজিত, তুমি ফিরে যাও বরং। কাজের ক্ষতি হচ্ছে।
কাজ বলতে ব্রজগোপাল কী বোঝাচ্ছেন তা বুঝতে পারে না অজিত। উনি তাকে তাস খেলতে দেখেছেন। বলা যায় না, কুমুদ বোসের দু-একটা রসিকতাও হয়তো কানে গিয়ে থাকবে। তাস খেলাটাকেই ‘কাজ’ বলে ঠাট্টা করছেন নাকি? অবশ্য ঠাট্টা করার লোক নন।
অজিত বলে—না, ক্ষতি হবে না। এইটুকুতে কী আর ক্ষতি?
—তবু তুমি তো ইনচার্জ। তুমি ফাঁকি দিলে কর্মচারীরাও ফাঁকিই শিখবে।
অজিত হেসে বলে—টিফিন শেষ হতে এখনও কিছু বাকি আছে।
—ও।
অজিত কবজির ঘড়িটা আড়চোখে দেখে নেয়। টিফিনের টাইমটা হড়কে গেল। শেষ কয়েকটা ডিল খেলা গেল না। খুব জমেছিল আজ। শ্বশুরের দিকে চেয়ে বলল—আমাদের বাসায় তো আসেন না।
—দূরে থাকি। সময় পাই না। দুর্বল অজুহাত দেন ব্রজগোপাল।
—আপনার মেয়ে আপনার কথা খুব বলে।
—হুঁ! বলে ব্রজগোপাল একটু অন্যমনস্ক হয়ে যান। ছেলেমেয়েরা তাঁর কথা বলে এটা যেন ঠিক তার বিশ্বাস হতে চায় না।
—একদিন যাব গোবিন্দপুরে। অজিত বলল।
ব্রজগোপাল একটা শ্বাস ফেলে জামাইয়ের মুখের দিকে তাকাল। বিশ্বাস করেন না, তিনি কলকাতার লোকের মুখের কথা বিশ্বাস করেন না। তবু মাথা নেড়ে বললেন—যেয়ো। জায়গাটা ভালই লাগবে।
একটু অন্যমনস্ক রইলেন ব্রজগোপাল। পেভমেন্টে গা ঘেঁষে অচেনা লোকেরা চলে যাচ্ছে। হাজার লোকের ভিড়ে এক অদ্ভুত অন্যমনস্কতাবশত তিনি বললেন—শীলার মুখটা ভুলেই গেছি। কতকাল দেখি না।
—আজই তো যেতে পারেন বাসায়, শীলা ভীষণ খুশি হবে।
ব্রজগোপাল জামাইয়ের মুখে মেয়ের নাম শুনে বোধ হয় একটু বিরক্ত হন। অজিত লক্ষ করে। ব্রজগোপাল বললেন—আগে প্রথা ছিল ছেলেপুলে না হলে মেয়ের বাড়িতে তার বাপ-মা যায় না।
অজিত সামান্য হাসে। ছেলেপুলে না হলে—কথা লক্ষ্য করেই হাস্য। বলল—ওসব তো প্রাচীন সংস্কার। না মানলেই হল।
ব্রজগোপাল মাথা নেড়ে বলেন—সংস্কারটা ভাল না মন্দ তা না জেনে ভাঙতে আমার ইচ্ছে করে না। তার দরকারই বা কী! আমরা বুড়ো হয়েছি, সব জায়গায় যাওয়া সম্ভব না হতে পারে। তোমরা যেয়ো।
—যাব।
রণেন একটু এগিয়ে রাস্তার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল। একটা খালি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে ডাকল—বাবা, আসুন।
ব্রজগোপাল বিরক্তির স্বরে বললেন—ট্যাক্সি নিলে নাকি?
—হ্যাঁ। রণেন কুণ্ঠিত ভাব দেখায়।
—কেন?
—এ সময়টায় বড্ড ভিড়। ট্রামে বাসে ওঠা যায় না।
—ভিড় হলেও তো লোকে যাচ্ছে আসছে! আমাদের বাবুগিরির কী দরকার?
ট্যাক্সিটা ছেড়ে যেতে অজিত সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ধরাল। আজ টিফিন খায়নি। খিদে পেয়েছে।
কিছু খাবে বলে ফুটপাথের হরেক টিফিনওয়ালাদের দিকে কয়েক কদম এগিয়েও গিয়েছিল সে। হঠাৎ মনে পড়ে যায়, শীলা বলেছিল ভাল চকোলেট নিয়ে যেতে। আর ঝাল আচার। আর চানাচুর। এই প্রথম শীলা এসব খেতে চাইছে। তার অর্থ, প্রেগন্যান্সির কোনও গোলমাল নেই।
ছোরার মারের মতো একটা তীক্ষ্ণ ও তীব্র আনন্দ বুক ছুঁড়ে দেয় হঠাৎ। এত তীব্র সেই আনন্দের অনুভূতি যে অজিতের শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, হাত পায়ে রিমঝিম করে একটা ঝিঁঝি ছাড়ার মতো হতে থাকে।
অজিত অফিসের সিঁড়ি ভেঙে উঠে যায়।
আই-বি-এম মেশিনগুলি সঙ্গমকালীন সুখের শব্দ তুলে চলছে। মেশিনগুলির পাশ দিয়ে হালকা পায়ে চলে যায় অজিত। অফিসার সেনগুপ্তর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
—সেনদা!
উঁ। বলে সেনগুপ্ত মুখটা তোলেন। হাসেন।
—আজ চলে যাচ্ছি।
—কী একটা খবর শুনছি!
—কী?
কুমুদ বোস বলে গেল। বউমার নাকি—
অজিত দাঁতে ঠোঁট কামড়ে বলে—একদিন বোসটাকে ঠ্যাঙাব সেনদা।
—মুখটা খারাপ, নইলে লোকটা খারাপ না। বলছিল—
—কী বলছিল?
—বলছিল, ম্যাজিসিয়ানের সব বিফলে যাচ্ছিল, আসল ম্যাজিকটা এতদিন দেখাতে পারছিল না। বউয়ের পেটে দুনিয়ার সবচেয়ে আশ্চর্য ম্যাজিকটা দেখাতে না পারলে নাকি সব বৃথা। বলে সেনগুপ্ত মোটা শরীরে দুলে দুলে হাসেন—সেটা এতদিনে দেখিয়েছে ম্যাজিসিয়ান।
—এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। সেনদা, আজ যাচ্ছি।
—যাও। কিন্তু আমার পড়ার স্কুলে একটা চ্যারিটি শো দিতে হবে, মনে থাকে যেন। বিনা পয়সায়।
—আমার তো টেবিল-ম্যাজিক। শো দিতে অ্যাপারেটাস লাগে।
—ওসব শুনছি না। আমি কথা দিয়ে রেখেছি। ফান্ডের অভাবে স্কুলটা উঠে যাবে হে৷ আমি সেক্রেটারি হয়ে বসে বসে দেখব?
—আচ্ছা।
অজিত অফিস থেকে বেরোবার আগে আর একবার আই-বি-এম মেশিনগুলির সামনে দাঁড়ায়। কতকাল ধরে এই সব মেশিন সে ঘাঁটছে। একঘেয়ে সব শব্দ। কিন্তু আজ শব্দটা অন্য রকম শোনায়। রতিক্রিয়াকালে শ্বাসবায়ুর মুখের শব্দ, দাঁত ঘষার শব্দ, চুম্বনের শব্দ—সব মিলেমিশে একটা তীব্র কম্পন উঠছে। অজিতের বুক এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে একটা আনন্দ ছোরা মারে আবার। বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো শরীর চমকায়।
প্রায় ছুটে বেরিয়ে আসে অজিত। ক্যাডবেরি কেনে, আচার কেনে, চানাচুর কেনে। গ্র্যান্ট স্ট্রিট থেকে কিছু না ভেবে একটা শাড়িও কিনে ফেলে হঠাৎ। টাকা উড়িয়ে দেয়।
এই দুপুরের নির্জনে সে বাড়ি ফিরে কী লিপ্সায়, কী কাতরতায় শীলাকে মিশিয়ে ফেলবে নিজের সঙ্গে। তীব্রতায় সে প্রবেশ করবে শীলার অভ্যন্তরে! শীলা ভীষণ—ভীষণ—ভীষণ—সুখে, লজ্জায়, হাসিতে একাকার হয়ে যাবে তার সঙ্গে!
শীলা হারিয়ে গিয়েছিল। কতকাল অজিতের জীবনে শীলা প্রায় ছিলই না। আবার হঠাৎ কবে শীলা পরিপূর্ণ বউ হয়ে গেল!
ধৈর্যহারা অজিত অস্থির হয়ে ধর্মতলা থেকে ট্যাক্সি ধরল। বলল—জোরে চালান ভাই! জোরে—
॥ সতেরো ॥
ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা। সারাটা দিন যখন শীলা একা, তখনই ভূতে ধরে তাকে। ভূতের ঢিল এসে পড়ে মাথার ভিতরের নিথরতায়। সারাদিন শুয়ে আর বসে সময় কাটে না। দিনটা কেবলই লম্বা হতে থাকে। মাঝে মাঝে অজিত অফিস কামাই করলে তবু এরকম কেটে যায় সময়। কিন্তু আদর ভালবাসা যখন শেষ হয় রতিক্রিয়ায়, তারপর ক্লান্তি আসে, কথা ফুরোয়, টান করে বাঁধা তার হঠাৎ ঢিলে হয়ে বেসুর বাজতে থাকে। বহুদিন শীলা এমন ভালবাসা পায়নি অজিতের কাছ থেকে। আবার বহুকাল ধরে সে নিজেও ভালবাসেনি এত অজিতকে। তবু দিনটা কাটতে চায় না। একা বা দুজন।
একা থাকাটা আরও ভয়ংকর। এখন ইস্কুলে পরীক্ষার সময়। এ সময়ে দু-একটা বেশি ক্লাস নিতে হয়, কোচিং থাকে। মেয়েদের ইস্কুলের নিয়মে বড় কড়াকড়ি। সাড়ে চারটে পর্যন্ত দম ফেলার সময় থাকে না। কিন্তু সেই ব্যস্ততা শীলার বড় ভাল লাগে। নিজেকে ভারী গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে মনে হয়। ফাঁকে ফাঁকে টিচার্স রুমের আড্ডাটি! খুব ব্যস্ততার মধ্যে দু-পাঁচ মিনিটের চুরি করা আড্ডা যা ঝলমলে করে দেয় মনটাকে।
ইস্কুলের জন্য মনটা বড় উন্মুখ হয়ে থাকে শীলার। কলকাতার শীতের দুপুরের মতো এমন সুন্দর সময় আর কি হয়! এমন দুপুরে ঘরে পড়ে থাকার মতো শাস্তি আর কী হতে পারে? নির্জনতা জিনিসটা কোনওদিনই সইতে পারে না সে। তার ভাল লাগে রাস্তাঘাট, মানুষজন, আলো ঝলমলে চারধার। ভাল লাগে ক্লাসভরতি ছাত্রী, টিচার্স রুমের জমজমাট কথার শব্দ। আর ভাল লাগে কাজ। সংসারের কাজ তার দুচোখের বিষ। কোনও কোনও মেয়ে থাকে যারা সংসারে ঢুকে, মধুর মধ্যে যেমন মাছি আটকে যায়, তেমনি আটকে থাকে। যেমন মা। ঘরসংসারে অমন আকণ্ঠ ডুবে-থাকা মানুষ কমই দেখেছে শীলা। সারা দুপুর মা জেগে থেকে টুকটাক কাজ করছে তো করছেই। কোনও কাজ না পেলে ঝিয়ের মেজে যাওয়া বাসনে কোন কোণে একটু ছাইয়ের দাগ লেগে আছে ব্লেড দিয়ে ঘষে ঘষে তাই তুলবে, আর আপনমনে বকতে থাকবে—ইস, কী নোংরা কাজ! বাপের জন্মে এমন নোংরা কাজ করতে কাউকে দেখিনি। সারা দুপুর রেশনের গম ঝাড়বে কুলোয়, চাল বাছবে, নইলে ফেরিঅলা ডেকে সংসারের জিনিস কিনবে দরদস্তুর করে। ওরকম জীবনের কথা শীলা ভাবতেও পারে না। তার নিজের সংসারটা পড়ে থাকে বাচ্চা ঝিয়ের হাতে। ছাড়া শাড়িটাও শীলাকে ধুতে হয় না, রান্নাবান্না থেকে যাবতীয় কাজ করে দেয় ঝিটা। রান্নায় কখনও কখনও গোলমাল করে। ঘরদোর খুব পরিষ্কার রাখে না, কাজ ফাঁকি দিয়ে পড়ে ঘুমোয়, কিন্তু তবু সংসারটা চলে ঠিকই। কিছু তেমন অসুবিধে বোধ হয় না।
অবশ্য এই ইস্কুল করা বা বাপের বাড়ি মাঝে মাঝে যাওয়া বা একটু দোকান পশার করা—এ ছাড়া শীলাও কি ঘরবন্দি নয়? অজিতের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার ধাতই নেই। বড় ঘরকুনো লোক। প্রচণ্ড আলসে। সারাদিন ঘর আর বারান্দা করে, সিগারেট খেয়ে কাটিয়ে দেবে, ছুটির দিনে রাস্তাঘাটে হাঁটতেও চায় না, বলে—যা ভিড়, আর রাস্তাঘাটের যা বিচ্ছিরি অবস্থা! এই লোকটার সঙ্গে থেকে শীলার বেড়ানোর শখ-আহ্লাদ চুলোয় গেছে।
যে যেমন চায় সে তেমন পায় না কখনও। যেমন তার ছোট বোন ইলা। ঠিক মায়ের স্বভাব পেয়েছে। ছেলেবেলা থেকেই ঘরের কোণে বসে একমনে বিভোর হয়ে পুতুল খেলত, ছাদে যেত না, সঙ্গী-সাথীর সঙ্গে খেলতে তেমন ভালবাসত না। বড় হয়ে মার সঙ্গে ঘুরঘুর করে ঘরের কাজ করত। বিছানা তোলা বা পাড়া, টুকটাক একটু রান্না নামানো চড়ানো, শুকনো কাপড় গুছিয়ে রাখা, ধোপার হিসেব, সংসারের হিসেব রাখা। বিয়ে হল একটা উজ্জ্বল স্মার্ট ছেলের সঙ্গে। মুম্বইতে চাকরি করে। হুল্লোড়বাজ ছেলে। এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে ভাল লাগে না বলে কলকাতার সরকারি চাকরি ছেড়ে মুম্বইতে একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি নিয়ে চলে গেল। সেখানে খুব আউটডোরে যায়। দিল্লি মাদ্রাজ করে প্রায়ই। সব সময়ে ঝুঁকি নিতে ভালবাসে। ঘরের জীবনের চেয়ে বাইরের জীবনটা ওর বড় প্রিয়। ইলাকে প্রায়ই ধমকায়, বলে—রোজ রান্নাবান্নার কী দরকার? সপ্তাহে দু-তিন দিন হোটেলে খেলেই হয়!
অমল আর ইলা বছর তিনেক আগে একবার এসেছিল। তখনই অমল দুঃখ করে বলেছিল শীলাকে—শীলাদি, আপনার বোনটি একদম ইনডোর গেম।
—কেন?
—বেরোতেই চায় না মোটে। সারাদিন কেবল ঘর সাজাবে আর গুচ্ছের খাবার-দাবার তৈরি করবে। আমাদের মতো ছেলে-ছোকরার কি ঘরে এসে বসে খুনসুটি ভাল লাগে! বলুন! আমি ওকে প্রায়ই বলি, চলো দুজনে মিলে হিপি হয়ে যাই। শুনেই ও ভয় খায়।
শীলা দীর্ঘশ্বাস চেপে হেসে বলেছে—আর আমার শিবঠাকুরটি হচ্ছে উলটো। ব্যোম বাবা ভোলানাথ হয়ে ঘরে অধিষ্ঠান করবেন। কলকাতা শহরের বারো আনা জায়গাই এখনও চেনেন না। কেবল অফিসের পরে আড্ডাটি আছে, আর কোনও শখ আহ্লাদ নেই। আমার যে বাইরে বেরোতে কী ভাল লাগে!
অমল বড় মুখ-পলকা ছেলে, দায়িত্বজ্ঞান নিয়ে কথা বলে না। ফস করে বলে বসেছিল—ইস শীলাদি, ইলার বদলে আপনার সঙ্গে যদি আমার বিয়ে হত!
শীলা মুখ লুকোতে পথ পায় না। বুকের মধ্যে গুরুগুরুনি উঠে গেল তখনই। সবশেষে খুব হেসেছিল।
ইলা ধমক দিয়ে বলল—দিদি গুরুজন না! ও কী রকম কথা!
অমল অবাক হয়ে বলে—তাতে কী হল! সম্পর্ক তো ঠাট্টারই।
কথাটা ঘোরানোর জন্য শীলা বলে—তা তুই-ই বা ওর সঙ্গে বেরোস না কেন?
—আমি অত ঘুরতে পারি না। গাড়ি-ঘোড়ায় বেশিক্ষণ কাটাতে বিশ্রি লাগে। হোটেলে আমি বড্ড আনইজি ফিল করি। তা ছাড়া নতুন নতুন জায়গায় নিয়ে যাবে, সেখানে পা দিয়ে বিশ্রামটুকুও করতে দেবে না। চলো, সমুদ্রে স্নান করে আসি। চলো পাহাড়ে উঠি। জায়গাটা দেখে আসি চলো। আমার দমে কুলোয় না।
—তোমার লাইফ সোর্স কম। শীলাদিকে দেখো, চোখেমুখে আর শরীরে টগবগ করছে জীবনীশক্তি। শুনে শীলা হাসবে না কাঁদবে ভেবে পায় না। বলেই অমল শীলার দিকে ফিরে বলে—জানেন শীলাদি, ঘুরব বেড়াব ফুর্তি করব বলে বাচ্চাকাচ্চা হতে দিইনি এতকাল। কোম্পানি থেকে ইয়োরোপের মার্কেট যাচাই করতে পাঠাবে বলছে, ভাবছিলাম ইলার ভিসাটাও করিয়ে নেব। কিন্তু এই আলুসেদ্ধ মার্কা মহিলাকে নিয়ে গিয়ে ঝামেলা ছাড়া কিছু হবে না, সাহেবসুবোর জায়গা—আমি চোখের আড়াল হলেই হয়তো ভয়ে কাঁদতে বসবে।
ইলা মুখ ঝামড়ে বলে—যেতে আমার বয়ে গেছে!
অমল শীলার দিকেই চেয়ে ছিল, দুঃখ করে বলল—ভেবে দেখলাম, বাচ্চাকাচ্চা মানুষ করতেই ওর জন্ম হয়েছে। তাই ভাবছি এবার মুম্বই গিয়েই বাচ্চার ব্যবস্থা করে ফেলব।
সে কী লজ্জা পেয়েছিল শীলা! অমলের সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলার ওই হচ্ছে মুশকিল। গনগনে অ্যাগ্রেসিভ চঞ্চল, প্রাণপ্রাচুর্য ভরা ছেলে। কোনও কথাই বলতে মুখে আটকায় না। কিন্তু ওকে বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। বুক গুর গুর করে। দমকা বাতাসের মতো মনের দরজা জানালার খিল নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
সংসারে ঠিক এরকমই হয়। যা চাওয়া যায় তার উলটোটি বরাতে জোটে।
মনের ভিতরে কত পাপের বাসা। বলতে নেই, শীলার এক-এক সময়ে মনে হয়েছে, অমলের সঙ্গে তার বিয়ে হলে মন্দ হত না। দমকা বাতাসের সঙ্গে খড়কুটোর মতো উড়ে বেড়াতে পারত। কলকাতা ছাড়া আর কোথায়ই বা তেমন গেছে শীলা। অনেক বলেকয়ে একবার পুরী গিয়েছিল একবার দার্জিলিং আর কাছেপিঠে দু-একটা জায়গায়। ইস্কুলের স্টাফ সবাই মিলে বছরে দুবছরে এক-আধবার ডায়মন্ডহারবার বা কল্যাণীতে গেছে পিকনিক করতে, একবার স্টিমার পার্টিতেও গিয়েছিল অজিতের অফিস স্টাফের সঙ্গে। কিন্তু বিশাল ব্যাপ্ত পৃথিবীতে এ তো চৌকাঠ পেরনোও নয়। আর ইয়োরোপ ওদিকে হাত বাড়িয়ে আছে ইলার দরজায়, ইলা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। গতবার ওর ছেলে হল, কলকাতা থেকে ওর শ্বশুর গিয়ে ইলাকে আগলাচ্ছে। অমল গত সেপ্টেম্বরে চলে গেছে ইয়োরোপে। বড় কষ্ট হয় শীলার। ইলুটা বড্ড বোকা।
ঘরবন্দি থাকা মানে একরকম মরে যাওয়া। সে তাই বিয়ের পরই চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ওঠে। তার শ্বশুরবাড়ি বড্ড সেকেলে, মেয়ে-বউদের চাকরি কেউ পছন্দ করে না। কিন্তু ওই বড় সংসারে জবরজং আটকে থাকার হাত থেকে মুক্তি পেতেই শীলা চাকরিটা জোগাড় করেছিল অতি কষ্টে। ওই চাকরিই তার শ্বশুরবাড়ির বদ্ধ সংসারে হাওয়া বাতাসের কাজ করেছে। নইলে সে মনে মনে মরে থাকত এতদিনে। সেই চাকরি থেকেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে গণ্ডগোলের সূত্রপাত। কিন্তু চাকরি ছাড়েনি শীলা। তার জেদ বড় মারাত্মক।
তার চাকরির টাকা জমে জমেই জমির দামটা হয়ে গেল, তার সঙ্গে অজিতের সঞ্চয়, আর কিছু ধারকর্জ করে বাড়িটা উঠে গেল অনায়াসে। অজিতের একার রোজগার হলে হত নাকি এত সহজে? তাই শীলার একটা চাপা অহংকার আছে বাড়িটা নিয়ে। একটা মস্ত অভাব ছিল, সন্তান। তাও বোধ হয়… না, বলতে নেই। আগে হোক। কত দুষ্ট লোক নজর দেয়, বাণ মারে, ওষুধ করে।
শরীরের ভিতরে একটা প্রাণ, একটা শরীর। এখনও হয়তো একটা রক্তের দলা মাত্র। সেই দলাটা শীলার শরীর শুষে নেয় ধীরে ধীরে, টেনে নেয়, অস্থি-মজ্জা-মাংস। কে এক রহস্যময় কারিগর তৈরি করে চলেছে এক আশ্চর্য পুতুল তার শরীরের ভিতরে। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়, কুলপ্লাবী এক অসহ্য আনন্দের ঢেউঁ গলা পর্যন্ত উঠে এসে দম বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার বার বার সাবধান করে দিয়েছে—নড়াচাড়া একদম বারণ, একটু দোষ আছে শরীরে। হঠাৎ দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। পাঁচ মাস ধৈর্য ধরে থাকতেই হবে। তারপর তার তেমন ভয় নেই।
কিন্তু পাঁচটা মাস কি শীলার কাছে কম। এই সুন্দর শীতের দুপুর বয়ে যায় নিরর্থক। সে ঘরের বাইরে পা দিতে পারে না। উল বুনতে বুনতে চোখ ব্যথা করে, দুহাতের আঙুল অসাড় হয়ে আসে। সকালের খবরের কাগজটা কতবার যে উলটোলটে পড়ে সে! মোটা মোটা গল্পের বই শেষ করে। সিনেমার মাসিক কাগজ উলটেপালটে দেখে। তবু সময় ফুরোয় না। বই পড়তে একনাগাড়ে ভালও লাগে না। কিন্তু শরীরের ভিতরে আর একটা শরীরের কথা ভেবে সয়ে যায়। কী নাম হবে রে তোর, ও দুষ্ট ছেলে? খুব জ্বালাবি মাকে? নাম কামড়ে ধরবি, চুল টেনে ধরবি, মাঝরাতে কেঁদে উঠে খুজবি মাকে?…না, না, ভাবতে নেই। আগে হোক। ভালয় ভালয় আগে আসুক কোলজুড়ে।…হতে গিয়ে খুব কষ্ট দিবি না তো মাকে? লক্ষ্মী সোনা ছেলে, কষ্ট হয় হোক আমার, তোর যেন ব্যথাটি না লাগে। কেমন ঝামরে আদর করব! মুখে মুখ দিয়ে পড়ে থাকব সারাদিন। নিজের পেটে আলতো হাত দুখানা রেখে শীলা শুয়ে থাকে। বুক ভরে যায়।
কিন্তু তবু, ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।
এই শীতকালে দুপুরেই রোদে একটা ধানি রং ধরে যায়। কোমল ঠান্ডা বাতাস দেয় টেনে। গায়ে একটা স্টোল বা স্কার্ফ জড়িয়ে ধীরে রাস্তা ধরে হেঁটে যেতে এখন বড় ভাল লাগে। শীত তার সবচেয়ে প্রিয় ঋতু। তার দিনে রাতে, তার কুয়াশায় ঢাকা মায়াবী আবহে, তার ফুলে ও ফসলে একটা দারিদ্র ঘুচে যাওয়া প্রাচুর্যের চেহারা আছে। আর থাকে রহস্য, ওম্। পরীক্ষা শেষ হলে শীতকালে ইস্কুলের বারান্দায় কখনও কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মিষ্টি গন্ধে বুক ভরে ওঠে। খাতা দেখার ফাঁকে ফাঁকে আড্ডা। মেয়েরা যখন কথা বলে তখন সবাই একসঙ্গে বলে, কেউ কারও কথা শোনে না। একজন তার ঝিয়ের গল্প শুরু করতেই অন্যজনও তার ঝিয়ের গল্প শুরু করে দেয়, একজন নিজের ভাইয়ের বিয়ের গল্প ফেঁদে বসতেই অন্যজন তার কথার মাঝখানেই নিজের ননদের প্রসঙ্গ এনে ফেলে। আর ঠিক কথার মাঝখানে তুচ্ছ কারণে সবাই কেবল হাসতে থাকে। এক-এক সময়ে মেয়েরা নিজেরাও ভাবে—ইস্, আমরা কী সব ছোট্টখাট্ট বিষয় নিয়ে কথা বলি—ঝি, গয়না, শাড়ি, বিয়ে! ভাবে আবার বলেও আর কেবলই হাসতে থাকে। তুচ্ছ তুচ্ছ সব কারণে, বহুবার শোনা কথা আবার শুনে, কিংবা পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হাসি পায় বলে কেবলই হেসে যায় তারা।
শীতের দুপুরটার জন্য মন বড় ছটফট করে শীলার, ঘরে বসে থেকে থেকে সে কেবলই দেখে, দিন পুড়ে কালো হয়ে অন্ধকার নেমে আসছে। ইস্কুল ছুটি হয়ে গেল কোথায়, ছেলেদের হল্লা কানে আসে। মনটা একটা ছবিহীন শূন্য চৌকো ফ্রেমের মধ্যে আটকে থাকে। সামান্য এই কারণে চোখে জল এসে যায়।
তাই ঠিক দুক্কুরবেলা, ভূতে মারে ঢেলা।
আজকাল অবশ্য অজিত মাঝে মাঝে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। কোনওদিন বা অফিস কামাইও করে। কিন্তু বড্ড নির্জীব পুরুষ। হঠাৎ উত্তেজনা বশত প্রচণ্ড আদর করতে থাকে, হাঁটকে-মাটকে একশা করে শীলাকে। এবং তারপর তারা পরস্পরের মধ্যে প্রবিষ্ট হয়। তারপরই অজিত অন্যরকম হয়ে যেতে থাকে। একটু বুঝি দূরের মানুষ হয়ে যায়। কথা বলে, আদরও করে, কিন্তু জোয়ারটা থাকে না। হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে, সিগারেট ধরিয়ে ছাদে বারান্দায় যায়। কিংবা আপনমনে ম্যাজিকের স্যুটকেস খুলে সরঞ্জাম বের করে আনে। আপনমনে পাসিং আর পাসিং অভ্যেস করে। করে কয়েন কনজিওরিং, কাপস অ্যান্ড বলসের খেলা অভ্যেস করতে থাকে। দু-চারটে স্কুল শোতেও আজকাল ম্যাজিক দেখায় অজিত। কিন্তু যাই করুক শীলা যে একা সেই একা। যেদিন অজিত থাকে না সেদিন শীলার বুকের ওপর সময়ের ভার হাতির পায়ের মতো চেপে থাকে। পাঁচ মাস! ওমা গো! ভাবাই যায় না।
কখনও কখনও আবার পেটের ওপর হাত দুখানা রাখে শীলা। কিছুই টের পাওয়া যায় ওপর থেকে। তবু শীলার হাত যেন ঠিক সেই রক্তের দলার ভিতরে অশ্রুত হৃৎস্পন্দন শুনতে পায়। সেই রক্তের পিণ্ডের ভিতরে বান ডাকে, অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসে স্পন্দন। শীলা টের পায়। ও ছেলে, কেমন হবে রে তোর মুখখানা? কার মতো?…না, না, থাক, ভাবতে নেই। শীলা ফের হাত সরিয়ে নেয়।
কিন্তু ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।
ইস্কুলটা খুব বেশি দূরে নয়। বড় রাস্তা পর্যন্ত হেঁটে যেতে লাগে, অজিতের সাত মিনিট, শীলার দশ মিনিট। সেখান থেকে উলটোবাগের ট্রাম ধরলে ঠিক দুটো স্টপ। স্টপ থেকে মোটে তিন-চার মিনিটের রাস্তা। তবে গলিঘুজি দিয়ে একটা শর্টকাট আছে। সে রাস্তাটা ভাল নয়, কিন্তু রিকশা যায়। এক-এক দিন শীলার খুব ইচ্ছে করে, অজিত বেরিয়ে গেলে, চুপি চুপি উঠে সামান্য একটু প্রসাধন করে বেরিয়ে পড়ে। রিকশাঅলাকে বলবে—ভাই খুব ধীরে ধীরে যাবে। বারো আনা ভাড়ার জায়গায় আমি তোমাকে না হয় একটা টাকা দেব। গর্তটর্ত বাঁচিয়ে যেয়ো, যেন ঝাঁকুনি না লাগে।
আবার তখন একটা ভয়ও করে।
ডাক্তাররা যা বলে তার অবশ্য সব সত্যি হয় না। রুগিকে বেশি ভয় দেখিয়ে অনেক সময়েই ওরা একটা বাড়াবাড়ি চিকিৎসা চালায়। ডাক্তারদের সব কথা শুনতে নেই। অন্য কিছু হলে অবশ্য শুনতও না শীলা। কিন্তু সন্তান বলে কথা। বিয়ের পর এতকাল তারা দুজনে যার পদধ্বনির জন্য কান পেতে ছিল সেই রাজাধিরাজ আসছে। সোজা লোক তো নয় সে। দুষ্টু ছেলে, মাকে যে কী কষ্টে ফেলেছিস! তোর জন্য দ্যাখতো কেমন ঘরবন্দি আমি! হোক, তবু তোর যেন কিছু না হয়।
কিন্তু ঠিক দুকুরবেলা ভূতে মারে ঢেলা।
দুপুরবেলায় শীলা তার সেলাই রেখে একটা শ্বাস ফেলে উঠল। আজ একবার যাবে ইস্কুলে। কিছু হবে না। ডাক্তারদের সবতাতেই বাড়াবাড়ি।
॥ আঠারো ॥
কিন্তু ঠিক দুক্কুরবেলা ভূতে মারল ঢেলা।
ভূতের ঢেলাগুলোই ঘরে টিকতে দিল না শীলাকে। অতিষ্ঠ। মাথার ভিতরে একটা পুকুরে যেন ঢিলের ঝড় বয়ে যায়। বিছানায় সর্বক্ষণ পেতে রাখা শরীরের খাঁজে খাঁজে কেবলই ধৈর্যহীনতার ভূতের ঢেলা এসে পড়ে টুপটাপ। শরীর এপাশ ফিরিয়ে শোয়, ওপাশ ফিরিয়ে শোয়। ভাল লাগে না, বই তুলে নেয় হাতে। সেখানেও টুপটাপ ভূতের ঢিল এসে যেন পড়তে থাকে, মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। রেকর্ড-প্লেয়ার একটা সম্প্রতি কেনা হয়েছে সময় কাটানোর জন্য। কিছুক্ষণ রেকর্ড শুনল সে, ইস্কুলে যাবে বলে উঠেও এইভাবে কিছুক্ষণ সময় কাটায় শীলা। যাবে না যাবে না করে। কিন্তু জানালার বাইরে ওই যে রোদে ধানিরং ধরে গেল, বাতাস মৃদু শ্বাস ফেলে বয়ে যায় হাহাকারের মতো। বাইরের পৃথিবীটা আলোর ইশারা হয়ে দক্ষিণের খোলা দরজার কাছে চৌকো পাপোশের মতো পড়ে আছে। ওই রোদে চপ্পল পায়ে গলিয়ে একবার একটুক্ষণের জন্য ঘুরে আসতে বড় ইচ্ছা করে। কী করবে শীলা! এতকাল এতদিন ধরে ঘরবন্দি থাকার অভ্যাস তো নেই।
কী রে ছেলে, যেতে দিবি একবার মাকে? একটুক্ষণের জন্য? সোনা আমার, লক্ষ্মী আমার, আর যে পারি না রে! একটু যাব? লক্ষ্মী সোনা, ভয় দেখাস না। তোর জন্য সারাজীবন কত কষ্ট সহ্য করব দেখিস। একটুও বিরক্ত হব না, রাগ করব না। যেতে দিবি? বাবা আমার, ছেলে আমার…
এ-ঘর গেল, ও-ঘর গেল শীলা, ঘড়িতে মোটে দেড়টা, এখনও লম্বা দুপুর পড়ে আছে। রেকর্ডে গান হচ্ছিল, কী গান তা শোনেওনি সে। রেকর্ড শেষ হয়ে ঘস-স্ আওয়াজ হচ্ছে, সেটা বন্ধ করে দিল। তারপর যেন বা সম্মোহিতের মতোই বেখেয়ালে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল সে। সামান্য একটু পাউডার, একটু লিপস্টিক ছুঁইয়ে নেয়। আলমারি থেকে শাড়ি বের করে দ্রুত হাতে পরতে থাকে, মনে মনে সময়ের হিসেবটা কষতে থাকে ঝড়ের মতো। যদি চারটেতেও ফেরে অজিত তা হলেও আড়াই ঘণ্টা সময় হাতে থাকে। রিকশায় বড় জোর শর্টকাট করে গেলে পনেরো কুড়ি মিনিট লাগবে। যাতায়াতে চল্লিশ মিনিট বাদ দিলেও প্রায় দেড় পৌনে দুই ঘণ্টা সে ইস্কুলে থাকতে পারে। কাজকর্ম করবে না কিছু। কেবল একটু অভ্যাস বজায় রেখে আসবে। একটু কথা, একটু হাসি, একটু চেনা মুখ দেখা, চেনা ইস্কুলবাড়িটার একটা ধুলোটে মৃদু গন্ধ আছে, সেই গন্ধটা একটু বুক ভরে নেওয়া। অজিত টের পেলে ভয়ংকর রাগ করবে, বকবে ভীষণ, সেই ভয়ে বুকটা একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে। পুরুষ মানুষের সন্তানক্ষুধা বড় প্রবল। সন্তান মানে পুরুষের নিজেরই পুনর্জন্ম। অজিতের নির্বিরোধী জীবনে ওই একটি প্রবল তীব্র ব্যাপার আছে। শীলা তা টের পায় ভীষণ, তার শরীরের এই বিপজ্জনক অবস্থায় সে যদিও বা দু-একটা বেচাল বেভুল কাজ করে ফেলে, হয়তো একটু জোরে ওঠে বা পাশ ফেরে, কিংবা হয়তো রান্নাঘরে যায় তরকারি পাড়তে কিন্তু অজিতের চোখে পড়লে আর রক্ষা থাকে না জোর করে আবার শুইয়ে দেবে, পাহারা দিয়ে বসে থাকবে। অজিতকে তাই বড় ভয়।
দ্রুত একটা একবেণী বেঁধে নেয় শীলা, ঝি মেয়েটাকে ঘুম থেকে ডেকে বলে—ঘোরদোর দেখে রাখিস।
—তুমি বেরোবে বউদি? তোমার না বারণ!
—এক্ষুনি আসব।
—দাদাবাবু যদি চলে আসে!
—বলিস, পাশের বাড়িতে একটু গেছি। একটা রিকশা ডেকে নিয়ে আয় তো।
রিকশায় ওঠার সময়ে যেন অনেকদিন বাদে আকাশ আর পৃথিবীর খোলামেলা কোলটিতে এসে যায় শীলা। কী ভীষণ ভাল লাগে তার।
—ভাই রিকশাঅলা, আস্তে যেয়ো, খুব আস্তে।
—হ্যাঁ।
রিকশা আস্তেই যায়। কখনও একটু জোর হলে শীলা সাবধান করে দেয়। রাস্তাটা খারাপ, এখানে-সেখানে গর্ত। একটু একটু টাল খায়। ওরে ছেলে, ভুল করলাম না তো! সর্বনাশ করিস না, তোর পায়ে পড়ি। না না, ছি ছি, তোর পাপ হবে, পায়ের কথা কেন বলতে গেলাম! চুপ করে থাকিস ছেলে, মাকে ধরে চুপ থাকিস।
দুহাতে দুপাশের হাতল ধরে শক্ত হয়ে বসে থাকে সে। শরীরকে যতদূর সম্ভব আলগা করে রাখে সিট থেকে। শরীরের মধ্যে যে রাজার শরীর সে যেন থাকে ভগবান। শরীরের মধ্যে যে দেবতা সে যেন ছেড়ে না যায়।
শরীরের কোন আবল্যি টের পায় না শীলা। রিকশাটা একটু দুলে দুলে, ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয়ে যায়। দূর থেকে ইস্কুলের বাড়িটা দেখতে পায়, শীলা, ইস্কুলের ছাদে শীতের সূর্য আটকে আছে।
স্টাফ-রুমটা ভাগ্যিস একতলায়। শীলা দুধাপ সিঁড়ি, বারান্দা পার হয়ে স্টাফরুমে আসতেই একটা চাপা আনন্দ আর অভ্যর্থনা ছুটে আসে।
—কী খবর!
—আরে, শীলা!
—শুনেছি, শুনেছি, মিষ্টি-টিস্টি খাওয়াও বাবা।
—বেশ সুন্দর হয়েছেন শীলাদি।
—কংগ্র্যাচুলেশনস।
এইরকম সব কথা। বহুকাল পরে স্টাফ-রুমে পা দিয়ে একটা গভীর তৃপ্তি তাকে ধরে থাকে। নাকের পাটা ফুলে ফুলে ওঠে, চোখ ঝলমল করে। দাঁতে ঠোঁট চেপে একরকম হাসতে থাকে সে। লজ্জার হাসি। সে আর চিরকালের সেই একা শীলাটি নেই। তার শরীরের মধ্যে এখন অন্য এক শরীর। হয়তো এক রাজার হয়তো এক দেবতার। অহংকার পাখির মতো তার দুকান ভরে ডাকে।
সে ঘুরে ঘুরে হেড-মিস্ট্রেসের সঙ্গে দেখা করে, ক্লার্কদের সঙ্গে কথা বলে, ছাত্রীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটায়, স্টাফ-রুমে বসে আড্ডা দেয়। কী ভাল যে লাগে তার! বারবার ঘড়ি দেখে। চারটের এখনও ঢের দেরি আছে।
মীনাক্ষী বলে—শীলা, সুভদ্রর মন খারাপ। দেখছিস না, কথা বলছে না।
সুভদ্র মেয়েদের থেকে দূরে আলাদা চেয়ারে বসেছিল, এ স্কুলে ছেলে স্টাফ খুব অল্প। পণ্ডিতমশাই ছাড়া একজন পুরনো আমলের বিএসসি আছে কেবল। সুভদ্র ঢুকেছিল কমিটির প্রেসিডেন্টের সুপারিশে, একজনের লিভ ভেকান্সিতে। খুবই সুন্দর দেখতে সুভদ্র। ফরসা টকটকে রং, লম্বা, একটু রোগা হলেও মুখশ্রী মায়াবী কিশোরের মতো। অল্প দাড়ি রাখে সে, মোটা গোঁফ, গায়ে খুব কমদামি কিন্তু সুন্দর রঙিন খদ্দরের শার্ট পরে সে, টেরিকটের গাঢ় রঙের প্যান্ট পরে। সুভদ্র একটু বোকা। কিন্তু আবার এও হতে পারে যে, বোকামির ভান করে। কারণ তার ধারাল মুখে, বা চোখের তীক্ষ চাউনিতে বোকামির লেশমাত্র নেই। তবু স্কুলের চটুল স্বভাবের শিক্ষিকাদের মধ্যে সুভদ্রর বোকামির গল্প চাউর আছে। সেটা সুভদ্র জানে, কিন্তু রাগ করে না। বরং হাসে।
শীলার সঙ্গে সুভদ্রর পরিচয় কিছু গাঢ়। বলতে নেই, স্কুলে শীলার মতো সুন্দরী কমই আছে। একটু সুখের মেদ জমেছে সম্প্রতি, নইলে শীলার আর কোনও খুঁত নজরে পড়ে না, দিঘল চোখ দুখানায় এখনও অনেক কথার, ইঙ্গিতের রহস্যের খেলা দেখায় শীলা, সিঁথেয় সিঁদুর যাদের আছে তারা ছেলেদের সঙ্গে সহজেই প্রথম আলাপের সংকোচটা কাটিয়ে উঠতে পারে। এই সুন্দর কিশোরপ্রতিম চেহারার যুবকটির সঙ্গে আড্ডা দিতে বরাবরই ভাল লেগেছে শীলার। সে মায়া বোধ করে।
শীলা সুভদ্রকে ডেকে জিজ্ঞেস করে—সুভদ্র, কী হয়েছে? মন খারাপ কেন?
—কে বলে মন খারাপ! সুভদ্র নিরুত্তাপ গলায় বলে।
মীনাক্ষী চাপা গলায় বলে—শোভনাদি ফিরে আসছে, তাই সুভদ্রর চাকরি থাকছে না।
শীলা অবাক হয়ে বলে—শোভনাদি ফিরে আসছে! সে কী! উনি তো বরের সঙ্গে মাদ্রাজ গেলেন এই সেদিন। চাকরি বলে করবেন না?
—সেইটেই তো গোলমাল হল। ওঁর বর আরও প্রমোশন পেয়ে কোম্পানির ডাইরেক্টর হয়ে কলকাতায় ফিরছেন। শোভনাদি জানুয়ারি বা ফেব্রুয়ারিতে জয়েন করবেন বলে চিঠি দিয়েছেন।
শীলার মন খারাপ হয়ে যায়।
মীনাক্ষী বলে—অবশ্য শুধু সে কারণেই যে সুভদ্রর মন খারাপ, তা নয়।
—আর কী কারণ? শীলা জিজ্ঞেস করে।
—সে তো তুই জানিসই বাবা।
—কী জানব?
—আহা, তুই যে ছুটি নিয়ে ঘরে বসে রইলি, সুভদ্র বেচারা এখন কোন আকর্ষণে স্কুলে আসবে?
শীলার কানটান একটু লাল হয়ে ওঠে। আবার মুখে সে হাসেও। সুভদ্র দূর থেকে একবার এদিকে তাকিয়েই উঠে বারান্দায় চলে যায়।
বয়স্কা মাধুরীদি ধমক দিয়ে বলেন—তোর ইতর রসিকতাগুলো একটু বন্ধ করবি মিনু?
—আহা! কে না দেখতে পাচ্ছে বাবা, শীলা ছুটি নেওয়ার পর থেকেই সুভদ্র কেমন মন খারাপ করে ঘুরছে!
মাধুরী হাসেন। অবিবাহিতা এবং বয়স্কা অচলা মুখখানা গাঢ় গাম্ভীর্যে মেখে রাখেন। মেয়েদের প্রেগন্যান্সি তাঁর সহ্য হয় না। গর্ভবতী মেয়েদের দেখলে রাগ করেন। তবু শীলার পক্ষ হয়ে বললেন—মীনাক্ষী, সব ধোঁয়াই কিন্তু আগুনের ইঙ্গিত করে না।
ঠাট্টা। কিন্তু শীলা একটু অস্বস্তি বোধ করে। সুভদ্র আর ঘরে আসে না।
স্কুল চারটের অনেক আগেই ছুটি হয়ে গেল আজ। পরীক্ষার প্রিপ্যারেশনের জন্য মেয়েরা ছুটি চেয়ে অ্যাপ্লিকেশন করেছিল। শুধু উঁচু ক্লাসগুলোর কয়েকটায় ক্লাস চলছে।
তিনটে নাগাদ শীলা বেরিয়ে আসে ফেরার জন্য। বেয়ারাকে রিকশা ডাকতে পাঠিয়েছিল। দীর্ঘ বারান্দার থামের আড়াল থেকে সুভদ্র বেরিয়ে এসে ডাকে—শীলাদি!
—কী খবর? পালিয়ে এলেন যে! কথাটা বলতে বলতেই শীলা হঠাৎ টের পায় তার বুকের মধ্যে কী একটা নড়ে গেল। একটা শ্বাস অর্ধেক কেটে গেল। সঙ্গে একটা শ্বাস কষ্ট। শরীরটা ভার লাগে। ভাল লাগছে না।
—মীনাক্ষীটা বড্ড স্ট্রেট।
—আপনার মন খারাপ কেন?
সুভদ্র একটা শ্বাস ফেলে বলে—শীলাদি, একটা কথার জবাব দেবেন?
—কী?
—আপনি চাকরি করেন কেন?
—কেন করব না?
—দরকার থাকলে নিশ্চয়ই করবেন। কিন্তু আপনার কি চাকরি করা খুব দরকার?
শীলা ক্ষীণ হেসে বলে—না হলে করব কেন?
সুভদ্র মাথা নেড়ে বলে—আমি জানি আপনার হাজব্যান্ড হাজার টাকার ওপর মাইনে পান, কলকাতায় আপনাদের নিজেদের বাড়ি, ফ্যামিলি মেম্বার মোটে দুজন। তবু কেন চাকরি করা দরকার বলুন তো!
শীলা একটু শ্বাস ফেলে কপট গাম্ভীর্য এনে বলে—দরকার যার যার নিজের কাছে। কারও খাওয়া-পরার প্রবলেম, কারও সময়ের প্রবলেম, ধরুন যদি বলি, আমার সময় কাটে বলে চাকরি করি!
সুভদ্র তার বোকামির মুখোশটা পরে নিয়ে একটু বোকা হাসি হাসে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে বলে—শীলাদি, আপনি সত্যিই সত্যবাদী।
—কেন?
—ঢাকবার চেষ্টা করেননি। কিন্তু আপনার মতো একজন ভাল চাকুরের বউ বা শোভনাদির মতো একজন ডাইরেক্টরের স্ত্রীর কেবলমাত্র সময়ের প্রবলেমের জন্য কি চাকরি করা উচিত? অঢেল সময় যদি থাকে তো আপনারা মহিলা সমিতি করুন, গান শিখুন বা সিনেমা থিয়েটার দেখুন। চাকরি কেন?
—কষ্ট করে লেখাপড়া শিখব, কিন্তু সেটা কাজে লাগাতে গেলেই কেন দোষ হবে?
—তাতে যে আমার মতো বেকাররা মারা পড়ি! শোভনাদি কলকাতায় ফিরে আসছেন বলেই চাকরিটা আবার নেবেন, নইলে তার দরকার ছিল না। অথচ তিনি জয়েন না করলে একজন অভাবী লোকের উপকার হয়। এ কথাটা আপনারা বোঝেন না কেন!
—কথাটা সত্যি হতে পারে, কিন্তু ওর যুক্তি নেই সুভদ্র।
সুভদ্র মাথা নেড়ে বলে, আছে শীলাদি। যার স্বামী ভাল রোজগার করে সে চাকরি করলে সমাজে ইকনমির ব্যালান্স থাকে না। নকশালাইটরা যে কয়েকটি ভাল কাজ করতে চেয়েছিল তার মধ্যে একটি হল স্বামী-স্ত্রীর দ্বৈত রোজগার বন্ধ করা।
শীলা হাসল। বলল—সুভদ্র, আমার একটু দুঃখ হচ্ছে শোভনাদি ফিরে আসছে বলে।
সুভদ্র ম্লান হেসে বলে—আমি চলে যাচ্ছি বলে নয়?
শীলার অকারণেই আবার কান মুখ লাল হয়ে ওঠে। বলে—সেজন্যও।
ইস্কুল বাড়ি প্রায় ফাঁকা। দুজন হাঁটতে হাঁটতে মাঠটুকু পার হয়ে গেট পেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। সুভদ্র একটা সস্তা সিগারেট ধরিয়ে বলে—আমার চাকরিটা খুব দরকার ছিল।
শীলা একটা শ্বাস ফেলে বলে—পেয়ে যাবেন। একটু খুঁজুন।
সুভদ্রর সাহস আছে। হঠাৎ মুখখানা উদাস করে বলে—চাকরি হয়তো পেতেও পারি, কিন্তু সেখানে আপনার মতো বুদ্ধিমতী সহকর্মী কি পাওয়া যাবে?
শীলা চারধারে চেয়ে দেখে একটু। কেউ নেই, কেউ তাদের লক্ষ করছে না। করলেও দোষের কিছু নেই। সুভদ্র ইস্কুলে ঢোকার পর থেকে দিনের পর দিন শীলা আর সুভদ্র ইস্কুল থেকে একসঙ্গে বেরিয়ে গল্প করতে করতে গিয়ে ট্রাম ধরেছে। ছাড়াছাড়ি হয়েছে শীলার নির্দিষ্ট স্টপে। আবার কখনও সুভদ্র নেমে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়েও দিয়ে গেছে। আবার শীলা কখনও বা স্টপে না নেমে কেনাকেটা করার জন্য চলে গেছে সুভদ্রর সঙ্গেই এসপ্লানেডে বা গড়িয়াহাটা। কিন্তু শরীরের অন্য এক রাজাধিরাজের আগমনবার্তা পাওয়ার পর থেকেই শীলা একটু অন্যরকম হয়ে গেছে। কারও কথাই বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না, কেবল শরীরের ভিতরকার সেই শরীর মনে পড়ে। সুভদ্রকে তাই তেমন করে ভেবেছে কি সে এ কয়দিন?
শীলা মুচকি হেসে বলে—শুধু বুদ্ধিমতী?
—সুন্দরীও। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেয় সুভদ্র।
শীলা মৃদু হাসে। এই স্তাবকতাটুকুর লোভ সে ছাড়ে কী করে?
আজ আর হাঁটে না শীলা। রিকশা আসবে তাই দাঁড়িয়ে থাকে। সুভদ্র পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে বলে—সত্যি আপনাদের ছেড়ে চলে যেতে খুব কষ্ট হবে। চাকরি পাওয়া সোজা নয়।
শীলা চুপ করে থাকে।
সুভদ্র নিজেই বলে আবার—আমি কোনওকালে পলিটিক্স করতাম না। কিন্তু এখন দেখছি পলিটিক্স করলেই আখেরে লাভ হয়।
—কীরকম?
চাকরি জোটে, বা ব্যবসার লাইসেন্স পাওয়া যায়। ভাবছি, পলিটিক্সে নেমে যাব কিনা।
শীলা পাশ থেকে সুভদ্রর মুখখানা দেখে। কী সুন্দর চেহারা! চাকরি দেওয়ার হাত থাকলে শীলা শুদ্ধমাত্র ওর চেহারা দেখেই একটা চাকরি দিয়ে দিত।
এই মুগ্ধতাটুকু পিনের আগার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে লাগে শীলার বুকে। সুভদ্র চলে গেলে স্কুলটা অনেক বিবর্ণ হয়ে যাবে তার কাছে। সে তবু একটু ঠাট্টা করে বলে—বরং সিনেমায় নেমে পড়ুন।
—অ্যাঁ।
—আপনাকে লুফে নেবে।
সুভদ্র হাসল, বলে—অত সোজা নয়। তবে যা পাই তাই করব। কিছুতেই আর আপত্তি নেই। আপনারা যখন আমাদের রাস্তা আটকে রাখবেনই, তখন আমাদের রাস্তা তৈরি করে নিতে হবে।
—শুনুন, শোভনাদির সঙ্গে আমার তুলনা চলে না। আমার চাকরির টাকা সংসারে অনেক হেলপ করে। শোভনাদির তা নয়, ওঁরটা নিতান্তই শখ।
সুভদ্র হেসে বলে—আমার কিন্তু কারও ওপরেই রাগ নেই। যা আছে তা কেবলমাত্র অনুরাগ।
—খুব মুখ হয়েছে দেখছি। বলে শীলা গাঢ় শ্বাস ফেলে মায়াবী যুবকটির মুখখানা দেখে।
—আপনার ঠিকানা জানি। কোনওদিন হুট করে চলে যাব। আপনার হাজব্যান্ডের সঙ্গে আলাপও করে আসব।
—নিশ্চয়ই।
—এলআইসির একটা এজেন্সি নিয়ে রাখি৷
—আমি বলে রাখব। কবে আসবেন?
—আসব যে কোনওদিন।
রিকশা এল। শীলা খুব সুন্দর একটু হেসে উঠে বসল। সুভদ্র নিঃসংকোচে তার মুখের দিকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইল। চোখ সরাল না শীলা। রিকশা কয়েক পা এগোলে শীলা মুখ ঘুরিয়ে হাসিমুখে চেয়ে রইল। গোপনে এই রকম তারা মাঝে মাঝেই চেয়ে থেকেছে পরস্পরের দিকে। যখনই তারা দুজন একা হয়েছে তখনই।
পাপ? কে জানে? কিন্তু ওই একরকম শিহরন, গোপনতা, রহস্য—যা না থাকলে বেঁচে আছে বলে মনে হয় না। শীলা যে কত ঝুঁকি নিয়ে আজ ইস্কুলে এসেছে তা কি আকারটাই সুভদ্রার জন্য নয়? মনের ভিতরে কত কী থাকে, ভাগ্যিস তা অন্যে জানতে পারে না!
সুভদ্রর কথা ভাবতে ভাবতে রিকশাওয়ালাকে আস্তে চালানোর কথা বলতে ভুল হয়ে গিয়েছিল। রিকশাটা পর পর দুটি ঝাঁকুনি খেল। আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে শীলা—আস্তে।
তেমন কিছু টের পেল না শীলা। কেবল বাড়ির সামনে রিকশা থেকে নামার সময়ে হেঁট হতে তলপেটে একটা চিনচিনে ব্যথা টের পেল।
॥ উনিশ ॥
বাসের দোতলায় তিন-চারটে মার্কামারা ছেলে উঠেছে। হাতে বইখাতা, পরনে কারও কলারঅলা গেঞ্জি, কারও রংচঙা সস্তা শার্ট। এই শীতেও গায়ে গরম জামা নেই। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স। দুজনের সিট তিনজন ঠেসে বসেছে। চেহারা দেখলেই বোঝা যায় গরিব ঘরের ছেলে, বাজে ইস্কুলে পড়ে, যে ইস্কুলে ইউনিফর্ম পরার বালাই নেই। কলকাতার বিস্তৃত বস্তি অঞ্চল থেকে এরকম চেহারার বহু ছেলে সস্তা বাজে ইস্কুলে লেখাপড়া শিখতে যায়।
একটা ছেলে চেঁচিয়ে বলে—কিস, কিস, এই টুবু, একটা কিস দিবি?
বলতে বলতে ছেলেটা তার পাশের ছেলেটার গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করে।
ছেলেটা মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে—যাঃ। পাবলিক রয়েছে।
—তোর পাবলিকের ‘ইয়ে’ করি।
ছনম্বর বাসের দোতলায় প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পিছনে দাঁড়িয়ে সোমেন দৃশ্যটা দেখে। সাদা আর ঘন নীল ইউনিফর্ম পরা তিন চারজন মেয়ে বসে আছে ডান দিকের দু-তিনটে সিটে, ফরসা ফরসা, গোলগাল অবাঙালি মেয়ে কজন, হাতে ছোট সুটকেস, কাঁধে প্লাস্টিকের জলের বোতল ঝুলছে। সম্ভবত ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পড়ে, ছেলেগুলো ওদের দিকে তাকায়ে ওই সব করে যাচ্ছে। ইংরেজি শব্দগুলো ওই কারণেই বলা।
রাগে হাত-পা রি-রি করে সোমেনের। বাসসুদ্ধ লোকের একজনও রুখে উঠলে পুরো দৃশ্যটা পালটে যায়। কিন্তু কেউ কোনও রা’ কাড়ে না। বরং না শুনবার ভান করে অন্যদিকে চেয়ে থাকে।
মেয়েগুলোর ফরসা মুখচোখ লাল হয়ে উঠেছে। বাচ্চা একটা মেয়ে হঠাৎ মুখ ফেরাতে সোমেন দেখল, মেয়েটার চোখে স্পষ্ট কান্নার চিহ্ন।
—হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? অন্যদিকে চেয়ে একটা ছেলে জিজ্ঞেস করে।
বন্ধুদের একজন বলে—মাই নেম ইজ—বলে মুম্বইয়ের একজন ফিলমস্টারের নাম করে। তাকে ধমকে দেয় প্রথম ছেলেটা, খিস্তি করে। তারপর আবার জিজ্ঞেস করতে থাকে—হোয়াট ইজ ইয়োর নেম? হোয়াট ইজ ইয়োর নেম?
মেয়েগুলো ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে।
সোমেনের পিছন থেকে একজন ফিসফিস করে বলে—কী সব ছেলে!
ব্যস। আর কোনও প্রতিবাদ হয় না। সোমেনের সামনে দু-চারজন দাঁড়িয়ে আছে। বাসের ঝাঁকুনিতে দোতলায় দাঁড়িয়ে ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছে। বাস ব্রেক কষে, আবার চলে। এ-ওর গায়ে ধাক্কা খায় আগে পিছে। টলে ঢলে পড়ে যেতে যেতে আবার দাঁড়ায়।
বাসটা কোথায় এসেছে বোঝা যাচ্ছিল না ভিড়ের জন্য। ছেলেদের একজন চেঁচিয়ে ওঠে—ওই যে, নিরোধের বিজ্ঞাপন। নিরোধ ব্যবহার করুন, পনেরো পয়সায় তিনটে…
কোথায় এসেছে তা না বুঝেও সোমেন ভিড় ঠেলে নামতে থাকে। বেশিক্ষণ তার এসব সহ্য হয় না। হয়তো মাথা গরম হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করা যাবে না। কেবল নিজের ভিতরে এক অন্ধ রাগ বেড়ে বেড়ে ফুসে উঠে নিজেকেই ছুবলে মারবে। সেই বিষও আবার হজম করতে হবে নিজেকেই। ক্লান্তি আসবে। আসবে ব্যর্থতার বোধ। কলকাতার নির্বিকার জনগণ সকলেই এই ক্লান্তিতে ও ব্যর্থতায় ভুগে জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে না কি?
নেমে সসামেন দেখে, সে খুব বেশি দূরে নামেনি। এখান থেকে বড়দির বাড়ি আর মোটে দুটো স্টপ। খোলা আলো-হাওয়ায় এটুকু হেঁটে যেতে ভালই লাগবে। সে সিগারেট কিনে ধরায়। পৃথিবীর কোথাও কোনও শান্তি নেই। না ঘরে, না বাইরে। সোমেনের মাঝে মাঝে বড্ড মরে যেতে ইচ্ছে করে। কিংবা পালাতে ইচ্ছে করে বিদেশে। কিন্তু জানে, শেষ পর্যন্ত কোথাও যাওয়া হবে না। এই নোংরা শহরে কিংবা এই নিস্তেজ, ভাবলেশহীন দেশে তার জীবন শেষ হয়ে যাবে একদিন।
অন্যমনস্কভাবে সোমেন হাঁটছিল। একটা ট্যাক্সি পাশ দিয়ে যেতে যেতে এগিয়েই থামল। মুখ বাড়িয়ে কে যেন ডাকল—শালাবাবু!
জামাইবাবু! সোমেন তাড়াতাড়ি সিগারেট ফেলে দেয়।
এগিয়ে গিয়ে বলে—আপনাদের বাড়িতেই যাচ্ছিলাম।
—উঠে পড়ো। বলে দরজা খুলে ধরে অজিত।
সোমেন উঠলে অজিত সরে বসে বলে—এতকাল পরে আমাদের মনে পড়ল।
সোমেন একটু লাজুক হাসি হেসে বলে—কেন, আসি না নাকি?
—আসো? সে বোধ হয় সূক্ষ্ম শরীরে, আমাদের সাদামাটা চোখে দেখতে পাই না।
—সময় পাই না।
—সময়? তোমার আবার সময়ের টানাটানি কবে থেকে? একটা তো মোটে টিউশনি করো শুনেছি। আর কী করো? প্রেম নয়তো? তা হলে অবশ্য সময়ের অভাব হওয়ারই কথা।
—না, না। প্রেম-ট্রেম কোথায়?
—লাস্ট বোধ হয় ভাইফোঁটায় এসেছিলে। তারপর টিকিটি দেখিনি।
—এবার খুব বেশি দেখবেন।
—সে দেখব যখন নিজেদের বাড়ি করে উঠে আসবে। তার এখনও ঢের দেরি, শ্বশুরমশাই একটু আগে অফিসে এসেছিলেন চেকটার খোঁজ করতে।
—বাবা এসেছেন?
—এসেছেন মানে? এতক্ষণে হয়তো চলেও গেছেন হাওড়ায়। বাসায় যাননি বোধ হয়?
—কী জানি! আমি তো বাসায় ছিলাম না।
অজিত একটা শ্বাস ফেলে বলে-তুমি ওঁর কাছে যাওটাও না?
—খুব কম।
—যেয়ো। সন্তানের টান বড় টান। আমার তো এখনও কিছু হয়নি, কিন্তু হওয়ার সম্ভাবনা দেখেই মনটা উসখুস করে।
কোটের বাঁ দিকের পকেট থেকে ডানহিলের সুন্দর প্যাকেটটা বের করে অজিত, আর রনসন লাইটারটা।
—কী সিগারেট জামাইবাবু? সোমেন জিজ্ঞেস করে—বেশ প্যাকেটটা তো!
—বিলিতি। একটা চলবে না কি?
—না, না। লজ্জার হাসি হাসে সোমেন।
—লজ্জার কী! ধরিয়ে ফেলো একটা। খাও তো!
—আপনার সামনে নয়।
—এই যে ভাই, সামনের বাঁ দিকের রাস্তা। বলে ট্যাক্সিওলাকে নির্দেশ দেয় অজিত। ডানহিলের প্যাকেটটা সোমেনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে—শালাবাবুরা সামনে সিগারেট না খেলে ভগ্নীপতিদের বড় অসুবিধে। দরকার হলে শালাদের ঘাড় ভেঙে সিগারেট খেতে পারে না।
—আমি আপনাকে আর কী খাওয়াব বলুন। বেকার শালার সাধ্য কী? একটা চাকরি-বাকরি দিতেন যদি!
—তোমার এক্ষুনি চাকরির কী হল? এম এ-টা দাও না।
—ও হবে না।
—একটা প্রফেসরি হয়তো জুটে যেত। নাও, ধরিয়ে ফেল।
সোমেন লম্বা সিগারেট একটা টেনে নেয়। ধরায়। খুব লজ্জা করে তারা।
অজিত বলে—আরে জামাইবাবু আবার গুরুজন নাকি! ঠাট্টার সম্পর্ক, লজ্জার কিছু নেই।
বাসার সামনে ট্যাক্সি থেকে নামে দুজনে।
কড়া নাড়তে বাচ্চা ঝিটা এসে ঘুমচোখে দরজা খোলে।
—শীলা, দেখ কে এসেছে! বলে হাঁক ছাড়ে অজিত।
বাচ্চা ঝিটা ভয়ার্ত মুখে বলে—বউদি নেই।
অজিত যেন বুঝতে পারে না কথাটা। একটু অবাক হয়ে বলে কী বলছিস?
—বউদি বেরিয়ে গেল একটু আগে। রিকশায়।
—কোথায় গেছে?
—পাশের বাড়িতে।
—পাশের বাড়িতে রিকশা করে। ভারী অবাক হয়ে বলে অজিত—কোন বাসায়?
—ঝি-মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখে বলে—ওই দিকের রাস্তা দিয়ে গেল। কোথায় তা জানি না। বলে গেছে পাশের বাড়িতে।
অজিত একটুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে। মুখচোখ লাল হয়ে ওঠে রাগে, উত্তেজনায়। তারপর জুতোমোজা ছাড়ে, কোট হ্যাঙারে টাঙায়।
রহস্যটা ধরতে না পেরে সোমেন জিজ্ঞেস করে—কী হল জামাইবাবু?
অজিত গম্ভীর স্বরে বলে—কিছু না।
ঝিকে ডেকে চা করতে বলে অজিত। কিছুক্ষণ মুখখানা দুহাতের পাতায় ঢেকে বসে থাকে। সামলে নেয় নিজেকে। মুখ তুলে বলে—তোমার দিদি আজকাল আমাকে লুকিয়ে পালাতে শিখেছে।
সোমেন হাসে—পালায়?
—ওর একটি প্রেমিক আছে যে!
—কে?
—ওর ইস্কুল। ইস্কুলটাই ওর সর্বস্ব। আমরা কিছু না। বুঝলে শালাবাবু, তোমার দিদি এবার একটা সর্বনাশ ঘটাবে। রিকশা করে গেছে, ঝাঁকুনিতে না পেটের বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যায়!
এ সব কথায় সোমেনের একটু লজ্জা করে। ডানহিলটা ঠোঁটে চেপে সে চমৎকার ধোঁয়াটা টানে। রিকশার ঝাঁকুনিতে পেটের বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাবে—ব্যাপারটা তার বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়।
সোমেন একটুক্ষণ বসে থেকে তারপর হঠাৎ বলে—জামাইবাবু।
—উঁ। অন্যমনস্ক অজিত উত্তর দেয়।
—আমার একটা উপকার করবেন?
—উপকার! নিশ্চয়ই।
—আমাকে কিছুদিন আপনার বাড়িতে থাকতে দিন।
অজিত একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। বলে—থাকবে? সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কেন?
—এমনিই।
—বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করোনি তো?
—না, সেসব কিছু নয়।
অজিত একটু অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। বলে—থাকবে? সে তো আমার সৌভাগ্য। কিন্তু কেন?
—এমনিই।
—বাড়ির সঙ্গে ঝগড়া করোনি তো?
—না, সেসব কিছু নয়।
অজিত একটু উদাস হয়ে বলে—কদিন আগে শাশুড়িঠাকরুন এসেছিলেন। তিনি তোমার বড়দিকে বলে গেছেন, তোমাদের বাসায় কী সব অশান্তি চলছে।
সোমেন মাথা নাড়ে।
অজিত একটু হেসে—তুমি বড় সেন্টিমেন্টাল হে শালাবাবু, সংসারে একটু-আধটু খটাখটি তো থাকবেই। আমি নিজে মা বাপ-অন্ত-প্রাণ ছেলে ছিলাম, সেই আমাকেই আলাদা হয়ে চলে আসতে হল! এখন তো তবু সংসারের কিছুই টের পাওনি, যখন বিয়ে করবে তখন বউ এসে রাত জেগে তোমাকে দুদিনে সংসারের সার সত্য সব শেখাতে থাকবে। তখন দেখবে মা-বাপ সম্পর্কে তোমার আজন্মের ধারণা পালটে যাচ্ছে, ভাই-দাদা, ভাইপো-ভাইঝি সকলেরই গুপ্ত খবর পেয়ে যাবে। বিয়ে করো, বুঝবে।
—বিয়ে! বলে একটু ঠাট্টার হাসি হাসে সোমেন।
—কেন, বিয়ে নয় কেন?
—আমাদের জেনারেশন বিয়ে-টিয়ে বোধ হয় উঠে যাবে।
—ধৈর্য ধরো, ধৈর্য ধরো, বাঁধো, বাঁধো বুক। বিয়েটাকে টারগেট করে যা করার করে যাও। তুমি যদি সংসার ছাড়ো তবে তোমার মা দাদার কী অবস্থা হবে জানো?
—কী হবে! আমার জন্য কিছু ঠেকে থাকবে না।
—থাকবে। তবে কিছুদিনের জন্য যদি আমার বাড়িতে এসে থাকো তো ভালই হয়। তোমার দিদিটিকে একটু পাহারা দিতে পারবে। চোখে চোখে না রাখলে ও ঠিক চুপি চুপি প্রায়ই পালিয়ে যাবে ওর প্রেমিকটির কাছে। ডাক্তারের কড়া নিষেধ। তবু ও শোনে না। আমি অবশ্য অন্য কোনওদিন ধরতে পারিনি। আজই হঠাৎ তাড়াতাড়ি এসে পড়েছি বলে বুঝতে পারছি।
চা শেষ করে আর একটা ডানহিল অজিতের প্যাকেট থেকে নিয়ে ধরায় সোমেন। বাইরে একটা রিকশা থামে। শব্দ হয়।
অজিত মুখখানা গম্ভীর করে বসে থাকে।
সদর দরজা খোলাই ছিল। শীলা ঘরে এসে একটু থতমত খেয়ে দাঁড়ায়। বলে—ওমা! কখন এলে? সোমেন, হঠাৎ যে দিদিকে মনে পড়ল?
সোমেন সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। হাসে। উত্তর দেয় না কেউ।
শীলা ভ্রূ কুঁচকে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—খুব যে উন্নতি দেখছি! গুরুজনদের সামনে সিগারেট খাওয়া!
শীলা ভ্রূ কুঁচকে সোমেনের দিকে চেয়ে বলে—খুব যে উন্নতি দেখছি! গুরুজনদের সামনে সিগারেট খাওয়া!
—জামাইবাবু জোর খাওয়ালেন, কী করব!
—কত জামাইবাবুর বাধ্য শালা! আবার ধোঁয়া ছাড়ার কায়দা হচ্ছে!
অজিত ভ্রূ কুঁচকে নিজের হাতের দিকে চেয়েছিল।
শীলা তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলে—একটা জরুরি কাজ ছিল, বুঝলে! রাগ করেছ নাকি!
অজিত শ্বাস ফেলে মাত্র। উত্তর দেয় না।
দাঁড়িয়ে থাকতে শীলার বোধ হয় কষ্ট হয়। মুখখানা সামান্য বিকৃত করে বলে—যা রাস্তাঘাট! এত হাঁফিয়ে পড়েছি!
বলে সোফায় বসে শীলা। হাতের ব্যাগ মেঝেয় ফেলে রেখে ঝি-মেয়েটাকে ডেকে চা করতে বলে দেয়। কপাল থেকে চুলের কুচি সরাতে সরাতে বলে—সোমেন, রাতে খেয়ে তবে যাবি। আজ ফ্রায়েড রাইস করব, আর মুরগি।
সোমেন হেসে বলে—আগে বাড়ির আবহাওয়াটা স্বাভাবিক হোক, তবে বলতে পারি খাব কিনা। এখন তো বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখছি।
—আহা! এরকম আমাদের রোজ হয়! জামাইবাবুটিকে তো চেনো না। রাগের হোলসেলার।
অজিত তীক্ষ্ণ চোখে শীলাকে একটু দেখে নেয়।
—কী দেখছ? শীলা জিজ্ঞেস করে।
অজিত নিস্পৃহ গলায় বলে—তোমার মুখ সাদা দেখাচ্ছে।
—ও কিছু না। রোদে এলাম তো।
—রোদে মুখ লাল হওয়ার কথা, সাদা হবে কেন?
—তোমার বড্ড বাড়াবাড়ি।
—শীলা, আমাকে লুকিয়ে লাভ নেই। তোমার কোনও কষ্ট হচ্ছে শরীরে।
শীলা হাসতে চেষ্টা করল। বিবর্ণ হাসি। চোখ দুটো একটু ঘোলাটে, মুখ সাদা, ঠোঁট দুটোর মধ্যে ফড়িংয়ের পাখনার মতো কী একটু কেঁপে গেল। বলল—না, কিছু নয়।
অজিত একটু শ্বাস ফেলে বলে—না হলেই ভাল। তবু বলি, সামান্য ধৈর্য রাখতে পারলে ভাল করতে। একটা পেরেকের জন্য না একটা সাম্রাজ্য চলে যায়।
শীলা একটুক্ষণ বসে থাকে। তারপর ক্ষীণ গলায় বলে—তোমরা বোসো, আমি ও-ঘরে গিয়ে একটু শুয়ে থাকি।
শীলা ধীরে ধীরে উঠে ও-ঘরে চলে গেল। অজিত আর একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকল সোমেনের মুখোমুখী। তারপর বলল—বোসো শালাবাবু, আমাদের দুজনের ভাগ্যটা কেমন তা দেখে আসি। এ যাত্রাটা যদি রক্ষা হয়।
অজিত ও-ঘরে গেল। সোমেন বসে থাকে একা। শুনতে পায় ভেজানো দরজার ওপাশ থেকে বড়দির ফোঁপানোর আওয়াজ আসছে। চাপা, আবেগপূর্ণ কথার শব্দ ভেসে আসে। একটা অস্ফুট চুম্বনের শব্দ আসে।
গায়ে কাঁটা দেয় সোমেনের। অনেকদিন বাদে হঠাৎ আবার তার মনের মধ্যে ঝিকিয়ে ওঠে একটা আসাহি পেনট্যাক্স ক্যামেরার ঢাকনা-খোলা ঝকঝকে চোখ, গর্-র শব্দে ডেকে ওঠে একটা অন্ধ কুকুর।
Leave a Reply