• Skip to main content
  • Skip to header right navigation
  • Skip to site footer

Bangla Library

Read Bengali Books Online (বাংলা বই পড়ুন)

  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • সব বই
  • লেখক
  • সিরিজ
  • বইয়ের ধরণ
  • Login/Register
  • My Account →
  • বাংলা ডিকশনারি
  • বাংলা কৌতুক
  • বাংলা লিরিক্স
  • বাংলা রেসিপি
  • হেলথ টিপস এন্ড নিউজ

বাংলা নতুন/পুরাতন বইয়ের পিডিএফ ডাউনলোড/সন্ধান করতে আমাদের বাংলা পিফিএফ সাইটে ক্লিক করুন।

Bangla PDF

মহারানি ভিক্টোরিয়ার মুনশি

লাইব্রেরি » বিবিধ লেখার সংকলন » প্রবন্ধ » মহারানি ভিক্টোরিয়ার মুনশি

ভারতসম্রাজ্ঞী ভিক্টোরিয়ার রাজপ্রাসাদের কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষের মৃদু গুঞ্জন। মহারানির বিশ্বস্ত ও স্নেহধন্য মুনশি এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মূল কারণ। প্রাসাদের ‘মেইড অব অনার’কে ভার দেওয়া হয়েছে এই অসন্তুষ্টির কথা মহারানির কানে তুলতে। ভয়ে ভয়ে রানির খাস কামরায় প্রবেশ করে তিনি অস্ফুট কণ্ঠে নিবেদন করলেন, রানির আসন্ন ফ্রান্স সফরে মুনশিকে সঙ্গে নিলে প্রাসাদের সব কর্মচারি একযোগে পদত্যাগ করবে বলে জানিয়েছে। শোনামাত্রই রানির মুখ গনগনে লাল। এক ঝটকায় টেবিল থেকে দোয়াত, কাগজ-কলম, ফাইলপত্র ছুড়ে ফেলে দিলেন তিনি। বিবর্ণ হয়ে গেছে মেইড অব অনারের মুখ। রানির ক্রোধের সামনে থেকে পালাতে পারলে বাঁচেন তিনি।
কে এই মুনশি? তাঁর নাম হাফিজ আবদুল করিম। আগ্রার অধিবাসী। ১৮৮৭ সালে ভিক্টোরিয়ার স্বর্ণজুবিলি উপলক্ষে লন্ডনে পৌঁছেছিলেন তিনি রানির খিদমতগার হয়ে। ব্রিটিশ ভারত থেকে এ উত্সব উপলক্ষে তাঁকে এবং আরও একজন খিদমতগারকে পাঠানো হয়েছিল উপহার হিসেবে। খিদমতগার হিসেবে শুরু করলে কি হবে, শেষ পর্যন্ত তিনি রানির ব্যক্তিগত ভারতসচিবের পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছিলেন। উর্দু ও হিন্দি শেখানোর শিক্ষক বা মুনশি হিসেবেই তিনি রানির এত কাছের মানুষ হতে পেরেছিলেন। ‘রানির মুনশি’ পরিচয় তাঁকে করে তোলে বিখ্যাত ও বিতর্কিত। এই পদের কারণেই লন্ডনের ক্ষমতার অলিন্দে তিনি হয়ে উঠেছিলেন ঘোর অপ্রিয় ও সন্দেহভাজন। ১৮৮৭ সালে ভিক্টোরিয়ার বয়স ৬৮ বছর। এ বছরই জুন মাসে ২৪ বছরের করিম ও তাঁর সঙ্গী রানিকে প্রথম যেদিন খানা পরিবেশন করেন, সেদিনের কথা রানি তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘এদের একজন হলো মোহাম্মদ বক্স, দেখতে বেশ কালো, তবে মুখে সব সময় হাসি। অপরজন অপেক্ষাকৃত তরুণ, নাম আবদুল করিম, গায়ের রং অনেক হালকা, দীর্ঘদেহী এবং চমত্কার মর্যাদাপূর্ণ মুখাবয়ব। তার বাবা আগ্রা শহরের একজন ডাক্তার।’ কিছুদিন পরই করিম অভিযোগ করেন, তিনি মজুরশ্রেণীর মানুষ নন। ভালো বংশের শিক্ষিত যুবক এবং আগ্রার এক চিকিত্সকের সন্তান। সুতরাং খিদমতগারের চাকরি তাঁর সম্মানের পক্ষে হানিকর। অতএব ভারতেশ্বরীকে সে দেশের ভাষা শেখানো এবং ধর্ম, রীতি-নীতি ইত্যাদি সম্পর্কে জানানোর জন্য রানির মুনশি অথবা শিক্ষক নামের একটি নতুন পদ সৃষ্টি করা হয়। সেই পদ দেওয়া হলো আবদুল করিমকে। এরপর করিমকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
দুই বছরের মধ্যেই ভৃত্যদের ঘর থেকে প্রাসাদের কর্মচারীদের সঙ্গে বসবাসের সুযোগ হলো তাঁর। ব্লটিং পেপার দিয়ে মহারানির চিঠির কালি শুকানোর দায়িত্ব নিয়ে কাজ শুরু করেন তিনি। মহারানি ভিক্টোরিয়ার বিশ্বস্ত, প্রিয়পাত্র এবং সর্বক্ষণের সহচর হয়ে উঠতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। উর্দু ও হিন্দি ভাষা এবং উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি শিখতে ভিক্টোরিয়া বেজায় আগ্রহী। তাঁকে ভাষা শেখানো ছাড়াও রাজকীয় চিঠিপত্রের হেফাজত করাসহ ভারত থেকে পাওয়া চিঠির হিন্দি ও উর্দুতে জবাবের খসড়া তৈরি করা—সবই ছিল মুনশির দায়িত্ব। মহারানি লিখেছেন, ‘মুনশি বেজায় কড়া ওস্তাদ, কিন্তু একেবারে সাচ্চা ভদ্রলোক।’ করিমের প্রশংসায় মহারানি সদাই পঞ্চমুখ—বলেছেন রানির ব্যক্তিগত সচিব স্যার হেনরি পন্স্নবি। রানির চিঠির উদ্ধৃতি দিয়ে সচিব লিখেছেন, রানির চোখে ‘মুনশি ঐকান্তিক আগ্রহে পরিপূর্ণ, মনোযোগী, শান্ত ও বিনয়ী। তিনি বুদ্ধিমত্তা ও সুবিবেচনার অধিকারী এবং প্রখর কর্তব্যপরায়ণ…ব্যবহার এবং অনুভূতিতে একজন নিখুঁত ভদ্রলোক।’
ভিক্টোরিয়ার এই মূল্যায়ন রাজপ্রাসাদের আর কেউ মেনে নিতে পারেননি। করিমের প্রতি রানির বিশ্বাস ও অযাচিত স্নেহ তাদের ঈর্ষাকাতর করে তুলেছিল।
ভিক্টোরিয়ার সময়ে ইংল্যান্ডে খুব কম সম্ভ্রান্ত ইংরেজই উপমহাদেশের কারও সঙ্গে খানাপিনা বা ওঠাবসা করতেন। ভারতীয় রাজা-মহারাজা বা সেরকম বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব হলে আলাদা কথা। এখন মহারানির ইচ্ছা প্রাসাদের কর্মকর্তারা করিমের সঙ্গে আন্তরিকভাবে মেলামেশা করুক। শুনে তারা অবাক। রাজকীয় অনুষ্ঠানে এখন থেকে রানির মুনশি প্রাসাদে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসবেন, কর্মচারীদের কাতারে নয়। রানি আরও আশা করেন, রোজ প্রাতঃরাশের টেবিলে করিমকে মুনশি নামে সম্বোধন করা হোক। এরপর নেহাত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সভাসদরা চিবিয়ে চিবিয়ে ‘সুপ্রভাত মুনশি’ বলে করিমকে অভ্যর্থনা জানাতে শুরু করলেন।
ভিক্টোরিয়া নানাভাবে চেষ্টা করেছেন, প্রাসাদের ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের তুলনায় ভারতীয় এই সেবকের প্রতি যেন কোনো বৈষম্যমূলক আচরণ না করা হয়। প্রাসাদে অতিথিদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে করিমকে বিদেশি অভ্যাগতদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ দিয়েছিলেন তিনি। এমনই এক অনুষ্ঠানে রাশিয়ার জারের দেখা পেয়েছিলেন মুনশি। তাঁকে সোনালি অ্যানামেল করা চায়ের সেট উপহার দিয়েছিলেন জার। এতে করিমের ওপর রাজপরিবারের কোনো কোনো সদস্যের বিতৃষ্ণা আরও বেড়ে যায়। আর এক অনুষ্ঠানে রাজপরিবারের সদস্যদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে মুনশির বসার ব্যবস্থা করা হয়। ক্ষুব্ধ রাজপুত্র মহারানির সচিব স্যার হেনরি পন্সিবর কাছে প্রতিবাদ জানালে পন্সিব বলেন, হার ম্যাজিস্টির নির্দেশানুযায়ী এটি করা হয়েছে। মহামান্য যুবরাজ কি দয়া করে তাঁর আপত্তির কথা নিজেই রানিকে জানাবেন? এমন জবাবে যুবরাজ ব্যাপারটি নিয়ে আর ঘাঁটাঘাঁটি করেননি।
মুনশিকে বিপদে ফেলার জন্য তাঁর প্রতিপক্ষের চেষ্টার খামতি হয়নি। সুযোগ পেলেই তাঁরা একহাত নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রতিবারই রানি দুহাতে আগলেছেন তাঁর মুনশিকে।
বালমোরাল প্রাসাদের চত্বরে মুনশির সরকারি বাসভবন ‘করিম কটেজে’ মহারানি চা খেতে গিয়েছেন। ফিরে এসে তিনি দেখেন, তাঁর মহামূল্যবান ব্রোচটি খোয়া গেছে। করিমের শত্রুরা যেন হাতে চাঁদ পেল; মুনশির বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ নিয়ে তেড়ে এল তারা। শুরু হলো তদন্ত, খানাতল্লাশি। অবশেষে হারানো ব্রোচের হদিস মিলল উইন্ডসরের এক গয়নার দোকানে।
এক ভারতীয় ছয় শিলিংয়ে এটি বিক্রি করে গেছে। মুনশির শ্যালক হুরমত আলীর দিকে গোয়েন্দারা সন্দেহের আঙুল তুললেন। ঘটনাটি করিমের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারত। তবে রানির হস্তক্ষেপে ব্যাপাটা বেশি দূর গড়াতে পারেনি। থানা পুলিশ না করে ব্রোচটি নীরবে রানিকে ফেরত দেওয়া হয়।
করিমের বংশ পরিচয়কে ঘিরে প্রাসাদের আনাচ-কানাচে বেজায় কানাঘুষা। নিজেকে সদ্বংশজাত বলে মহারানিকে যে পরিচয় তিনি দিয়েচিলেন তা যে সঠিক নয়, এটা প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লেগে গেল প্রাসাদের অনেকে। এদের মধ্যে একজন সভাসদ রানির কাছে প্রমাণ এনে দিলেন যে করিমের বাবা যথার্থ অর্থে কোনো ডাক্তার নন। রানির নির্বিকার জবাব, কমপক্ষে লন্ডনের দুজন আর্চবিশপকে তিনি চেনেন, যাঁদের একজন মুদি দোকানির, অন্যজন কসাইয়ের ছেলে। তাঁদের বংশ পরিচয় নিয়ে যদি কারও মাথাব্যথা না হয়, তবে করিমের বেলায় এত শোরগোল কেন? এ যে ব্রিটেন-স্নবারি ছাড়া আর কিছুই নয়। এরপর রানির সোজাসাপটা কথা, মানুষের জন্ম পরিচয়ই সব নয়—আগে দেখতে হবে চারিত্রিক গুণাবলি। মুনশির প্রতিপক্ষদের মুখ বন্ধ হলো।
তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনেক অভিযোগ হাজির করা হয়েছিল। করিমের কারণে প্রাসাদের ব্যক্তিগত কর্মচারীরা পদত্যাগের হুমকি দিয়েছিল একাধিকবার। কিন্তু রানি এসব কিছুই কানে তোলেননি। মুনশির বিশ্বস্ততা ও আনুগত্য নিয়ে তাঁর ধারণায় আঁচড়ও লাগেনি কখনো। সুশীলা আনন্দ তাঁর এমপ্রেস অ্যান্ড আই বইয়ে বিলেতের রাজকর্মচারীদের করিমের প্রতি সন্দেহ আর বিরাগের দুটি সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন। প্রথমটি হলো, রফিউদ্দীন আহমেদ নামের লন্ডন-প্রবাসী ভারতীয় রাজনীতিবিদের সঙ্গে মুনশির মেলামেশা ও বন্ধুত্ব। ভারতের জন্য সেলফরুলে বিশ্বাসী রফিউদ্দীন ব্রিটেনে বেশ কিছুদিন ধরে পার্লামেন্টের সদস্য হওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান গোয়েন্দাদের তৈরি সম্ভাব্য রাজদ্রোহীদের তালিকায় তাঁর নাম উঠে গেছে। বুদ্ধিমান ও শিক্ষিত রফিউদ্দীনের পক্ষে মুনশির কাছ থেকে সহজেই গোপন সরকারি তথ্য বের করে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গোয়েন্দাদের আশঙ্কা জন্মেছিল। এই ধারণার পক্ষে তাদের যুক্তি ছিল, মুনশির হাত দিয়েই সব কাগজপত্র রানির টেবিলে পৌঁছায়। এসব দলিলপত্রে চোখ বোলানোর প্রচুর সুযোগ রয়েছে তাঁর। তা ছাড়া রানি মাঝেমধ্যে ভাইসরয়ের চিঠিপত্রও তাঁকে পড়ে শোনান, এমন গুজব প্রাসাদে অনেক দিন ধরেই চালু রয়েছে। পরে অবশ্য প্রমাণিত হয়েছিল, এ ধারণা একেবারেই ভিত্তিহীন। তবু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে মুনশির উপস্থিতিকে সন্দেহ এবং বিদ্বেষের চোখে দেখতেন ব্রিটিশ রাজপুরুষ আর প্রাসাদের কর্মকর্তারা।
১৮৯০ সালের উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এই সন্দেহের জন্য অনেক কারণে দায়ী। ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে মৃদু অষন্তোষের আভাষ দেখা দিয়েছে। তত দিনে ভারতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়েছে এবং জাতীয়তাবাদী বুদ্ধিজীবীশ্রেণীর উদ্ভব ক্রমে ব্রিটিশ প্রশাসনের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে রানির প্রাসাদে মুনশির প্রভাব এবং তাঁর প্রতি রানির স্নেহের কারণে লন্ডনের ক্ষমতার অলিন্দে উত্কণ্ঠা জন্মানো স্বাভাবিক। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ও ভারতসচিব প্রায়ই রানিকে সরকারি কাগজ ও চিঠিপত্র সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বন করতে পরামর্শ দিয়েছেন। মুনশির হাত দিয়ে যেন ভারতবিষয়ক কাগজপত্র আনা-নেওয়া না হয়, সে বিষয়েও তাঁদের মতামত জানিয়েছেন রানিকে। ভিক্টোরিয়া অবশ্য এসব পরামর্শকে খুব গুরুত্ব দিয়েছেন বলে মনে হয় না। কারণ তাঁর দপ্তর থেকে মুনশিকে সরিয়ে দেননি তিনি। তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত করিম রানির প্রাসাদেই কর্মরত ছিলেন।
সুশীলা আনন্দর মতে দ্বিতীয় কারণটি হলো, মুনশিকে সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে রানির অতি আগ্রহ। করিমের জন্য প্রথমে ‘কমপেনিয়ন অব দি ইন্ডিয়ান অ্যাম্পায়ার’ ও ‘কমান্ডার অব রয়েল ভিক্টোরিয়ান অর্ডার’ (সিভিও) এবং পরে রানির ব্যক্তিগত ভারতীয় সচিবের মতো মর্যাদাসম্পন্ন পদ তৈরি করা হয়। অতীতে এসব খেতাব ও পদ করিমের চেয়ে যোগ্যতর ব্যক্তিদের দেওয়া হয়েছিল। যেমন ‘কমপেনিয়ন অব দি ইন্ডিয়ান অ্যাম্পায়ার’ উপাধি পেয়েছিলেন বিখ্যাত বাঙালি বিজ্ঞানি জগদীশচন্দ্র বসু। এ ধরনের উপাধি প্রাপ্তির ফলে প্রাসাদে করিমের প্রতি বিদ্বেষের আরেকটি নতুন দরজা উন্মুক্ত হয়েছিল।
বালমোরাল রাজবাড়ির চত্বরে করিম এবং তাঁর পরিবারের জন্য একটি বাংলো তৈরি করে দেন রানি। নাম দিলেন ‘করিম কটেজ’। এ ছাড়া অসবোর্ন হাউস এবং উইন্ডসর ক্যাসলে বাংলো তৈরি হলো করিমের জন্য। এসব কটেজে রানি মাঝেমধ্যে করিমের সঙ্গে বৈকালিক চা খেতে যেতেন। চায়ের আসরে যোগ দিতেন করিমের স্ত্রী, তাঁর শ্বশুর ও শাশুড়ি। রানির বদান্যতায় এঁদের আগ্রা থেকে বিলেতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মুনশিকে মহারানি একটি চমত্কার ঘোড়ার গাড়ি ও দামি ঘোড়া উপহার দিয়েছিলেন। ভিক্টোরিয়া যখন রয়েল ইয়াটে সমুদ্রভ্রমণে বের হতেন, তখন মুনশি ও তাঁর পরিবারের জন্য পৃথক ছোট একটি ইয়াটেরও ব্যবস্থা করা হতো। রানির ভ্রমণের সময় ট্রেনের একটি পুরো কামরা করিমের জন্য বরাদ্দ থাকত। ভিক্টোরিয়ার ইচ্ছানুযায়ী করিমের একটি প্রতিকৃতি আঁকানো হয়েছিল বিখ্যাত শিল্পী ভন এঞ্জেলিকে দিয়ে, যিনি রানিরও প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন।
মুনশিকে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মেনে চলতে কোনো বাধা দেননি রানি। প্রাসাদে ইংল্যান্ডের অভিজাতশ্রেণীর বর্ণবিদ্বেষ ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের গরিমার কমতি ছিল না। কিন্তু রানি নিজে এসব থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেছেন। ১৮৭৬ সালে কুইন এমপ্রেস অব ইন্ডিয়া বা ভারতসাম্রাজ্ঞী হওয়ার পর তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তনের সূচনা হয়। এ সময়ই নাকি তাঁর হিন্দুস্থানের প্রতি আকর্ষণের শুরু। নিজেই ভারতভ্রমণে আগ্রহী ছিলেন, কিন্তু দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত আর এগোননি। করিম এবং অন্য ভারতীয় সেবকেরা প্রাসাদে যোগ দেওয়ার পর তিনি যেন সেই না দেখা দেশটিকে নিজের কাছে টেনে আনলেন। করিমের উত্সাহে রাজবাড়িতে ভারতীয় কারির প্রচলন হয়েছিল। রানির অসবোর্ন হাউসে ভারতীয় শৈলীতে একটি চমত্কার ব্যাঙ্কোয়েট রুম তৈরি হলো।
করিমের প্রসঙ্গে রানির বিশ্বস্ত সহচর ব্রাউনের কথা মনে পড়া স্বাভাবিক। জন ব্রাউন রানির অতি প্রিয়পাত্র ছিলেন। ব্রাউনও প্রাসাদে যথেষ্ট অপবাদ ও বিদ্বেষ কুড়িয়েছিলেন। নিষ্ঠা ও আনুগত্যের কারণে ব্রাউন ও করিম দুজনকেই তাঁদের যোগ্য মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করেননি রানি। মুনশির বিলাত আগমনের সাত বছর আগে ব্রাউন মারা যান।
আগ্রার পরিশীলিত সৌজন্যবোধ ও মোগল দরবারের আভিজাত্যে পূর্ণ রীতি-নীতি দিয়ে মহারানিকে মুড়ে দিয়েছিলেন করিম। ব্রাউনের শূন্যস্থান পূরণ করতে তাই দেরি হয়নি তাঁর। রানিও তাঁকে স্নেহ ও দাক্ষিণ্য দিতে কার্পণ্য করেননি।
ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত চিকিত্সক রিড রানির স্নেহের কথা তাঁর ডায়েরিতে লিখে গেছেন। করিমের ঘাড়ে ফোঁড়া হওয়ায় তাঁর কষ্ট দেখে বিচলিত রানি ড. রিডকে নিজে করিমের সুচিকিত্সার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তাঁর আরোগ্যের জন্য রানির উত্কণ্ঠার কথা ড. রিড লিখেছেন এভাবে, ‘অসুস্থ করিমকে দিনে দুবেলা দেখতে যান রানি। তাঁর ঘরে বসে হিন্দুস্তানি ভাষায় পাঠ নেন। তাঁর ঘাড়ের ব্যথার যত্ন করেন আর বিছানার বালিশ এগিয়ে দেন।’ সন্দেহ নেই, ভিক্টোরিয়ার মাতৃহূদয়ের কোমল তন্ত্রী স্পর্শ করতে পেরেছিলেন করিম। আর রানিও তাঁকে মাতৃস্নেহে সিক্ত করেছিলেন জাতি-ধর্ম-বর্ণভেদ এবং তথাকথিত রাজকীয় সীমারেখা উপেক্ষা করে। প্রায়ই মহারানি আবদুল করিমকে স্নেহপূর্ণ চিঠি লিখতেন। চিঠির শেষে লিখতেন, ‘তোমার স্নেহময়ী মা ভিক্টোরিয়া’।
সাম্রাজ্ঞী খুব ভালো করেই জানতেন, মুনশির হিতৈষীর সংখ্যা রাজপ্রাসাদে নেই বললেই চলে। তাঁর চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গেই করিমকে যে বিলাত থেকে পাততাড়ি গোটাতে হবে, সে সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি। অনেক ভেবেচিন্তে ভারতসচিবের মারফত ভারতের তদানীন্তন ভাইসরয়কে তিনি নির্দেশ পাঠালেন, অবসরজীবনে ভরণপোষণের জন্য করিমকে যেন আগ্রায় বেশ কিছুটা জমি অনুদান হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়। সঙ্গে আরও একটি হুকুম জুড়ে দিলেন। এরপর ভাইসরয় যখন আগ্রা সফরে যাবেন, তখন যেন মুনশির বাবা ডা. ওয়াজিরুদ্দিনের খোঁজ করেন। তাঁর ছেলের কাজকর্মে মহারানি যে বেজায় সন্তুষ্ট, সেটাও তিনি ডাক্তার সাহেবকে জানাবেন। ঔপনিবেশিক দম্ভ আর শ্রেষ্ঠত্বের ধারণায় আবদ্ধ ব্রিটিশ রাজপুরুষটি কিছুতেই বুঝতে পারেননি, কেন বিশ্বজোড়া সাম্রাজ্যের অধিকারী সামান্য একজন নেটিভ কর্মচারীর ভবিষ্যত্ চিন্তায় এত ব্যস্ত, এত উত্কণ্ঠিত। তাই বিরক্ত ভাইসরয় জমি বরাদ্দের ফাইলটি করছি করব করে বেশ কিছুদিন ফেলে রাখলেন। ভেবেছিলেন, এত ব্যস্ততার মধ্যে ইংল্যান্ডেশ্বরী হয়তো এই তুচ্ছ ব্যাপারটি ভুলে যাবেন। কিন্তু মহারানির নির্দেশে তাগিদ দেওয়া টেলিগ্রাম আর চিঠির পর চিঠি এসে ভাইসরয়কে ব্যতিবস্ত করে তুলল। শেষে উপায়ান্তর না দেখে গজর গজর করে ফাইলে অনুমোদন দিয়ে লন্ডনের পত্রাঘাত থেকে রেহাই পেলেন ভাইসরয়।
মুনশির ভবিষ্যত্ নিয়ে ভিক্টোরিয়ার শঙ্কা পরবর্তী সময়ে সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ১৯০১ সালে তাঁর মৃত্যুর পর ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী সম্রাট সপ্তম এডওয়ার্ড মুনশি এবং তাঁর আত্মীয়স্বজনকে রাজদরবার থেকে বিতাড়িত করেন। তাঁদের সবাইকে আগ্রায় ফেরত পাঠানো হয়। মুনশির কাছে লেখা ভিক্টোরিয়ার চিঠি, তাঁর কাগজপত্র ও নানা স্মৃতিচিহ্ন বাজেয়াপ্ত করেন সম্রাট। তাঁর কাছে বিষয়টা এতই স্পর্শকাতর ছিল যে খোদ রানি আলেকজান্দ্রিয়াকে এগুলো পোড়ানোর দায়িত্ব দেন। মুনশিকে অন্য একটি অনুগ্রহ করেছিলেন সম্রাট। তাঁকে ভিক্টোরিয়ার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন।
দেশে ফিরে মুনশি আগ্রার বাড়ি ‘করিম লজ’-এ জীবনের বাকি দিনগুলো কাটান। যত দিন বেঁচে ছিলেন, মহারানিকে নিয়ে এমন কোনো বেফাঁস কথাবার্তা বা গালগল্প বলেননি তিনি যা রানির স্মৃতির প্রতি অবমাননাকর হতে পারে। আমৃত্যু ‘রানির মুনশি’ মহারানির প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন। ১৯০৯ সালে ৪৬ বছর বয়সে তিনি আগ্রায় মারা যান।
মুনশির বিতাড়ন প্রসঙ্গে ভাইসরয়ের পত্নী লেডি কার্জনের একটি মন্তব্য নিষ্ঠুর এবং অমানবিক। তিনি লিখেছেন, ‘চাবুক খাওয়া হাউন্ডের মতো মুনশি দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।’ ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর ছয় মাস পর আরেক চিঠিতে লেডি কার্জনের তীর্যক মন্তব্য, ‘সব ভারতীয় সেবক দেশে চলে গেছে। রাজদরবারে এখন আর কোনো প্রাচ্যদেশীয় ছবি বা পাগলামি নেই।’
জন ব্রাউন ও আবদুল করিমের সব স্মৃতি প্রাসাদ থেকে মুছে ফেলতে সপ্তম এডওয়ার্ডের চেষ্টার অন্ত ছিল না। তাই ভারতীয় দৃশ্যাবলির চিত্রসহ করিমের প্রতিকৃতি ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছিল রাজবাড়ি থেকে। এরপর বিস্মৃতির ধুলোয় চাপা পড়ে গেলেন একদা প্রভাবশালী রানির মুনশি। হারিয়ে গেল সেই বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা তাঁর মুখাবয়ব।
মুনশির গল্প কিন্তু শেষ হয়নি। ২০০২ সালের ডিসেম্বরে লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে একটি নতুন চিত্র প্রদর্শনী শুরু হলো। বহুদিন আগে তাঁর ‘স্নেহময়ী মা ভিক্টোরিয়া’র হুকুমে আঁকা করিমের একটি বিখ্যাত প্রতিকৃতি স্থান পেল এই প্রদর্শনীতে।
মহারানির মৃত্যুর ১০০ বছর পর তাঁর অনুগত ও স্নেহধন্য হাফিজ আবদুল করিম, সিআইই, সিভিও ওরফে রানির মুনশি আবার ফিরে এলেন লন্ডনে অতীতের সব গ্লানি ও অবিচার তুচ্ছ করে।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: জেরেমি হোজেস, দি ডেইলি মেল, লন্ডন মে ১৫, ২০০৩। পিটার ক্রক্স্টন, দি ডেইলি মেল, লন্ডন নভেম্বর ১২, ২০০২]

মাহবুব আলম
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, নভেম্বর ১৩, ২০০৯

Category: প্রবন্ধ
Previous Post:গভীরতর চেনা ও জানা
Next Post:কালো পাখির ডানা

Reader Interactions

Comments

  1. পাঠক

    January 29, 2012 at 8:18 pm

    অসাধারণ লাগল । নিষ্ঠা এবং সততা এভাবেই ইতিহাসের বুকে জায়গা করে নেয় আসলে ।

    Reply

Leave a Reply to পাঠক Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

ডিকশনারি

কৌতু্ক / জোকস

লিরিক

রেসিপি

বিবিধ রচনা

হেলথ

Download PDF


My Account

Facebook

top↑