২৫. মুখ ভেটকে আছ কেন

২৫

“কেসটা কী তোমার? অমন মুখ ভেটকে আছ কেন?”

“ধুস, কিচ্ছু ভাল লাগছে না।”

“সে তো ফেসকাটিংই মালুম দিচ্ছে। কিন্তু হয়েছেটা কী বলবে তো।”

“তুই বুঝবি না।”

“বোঝালেই বুঝব।” অলি ভুরু ওঠাল, “পরশু পার্ট থ্রির রেজাল্ট বেরোচ্ছে না? তাই নিয়ে খুব ঘেবড়ে আছ তো?”

“তা একটু আছি। এ ছাড়াও কত যে টেনশন। কী যে করি…”

প্রিয়াংশুর স্বর ডুবে গেল। চোখ কুঁচকে তাকে একবার দেখে দৃষ্টি সরিয়ে নিল অলি। ঘাড় ঘোরাচ্ছে এদিক সেদিক। দক্ষিণাপণের প্রশস্ত চাতালের সিঁড়িতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এলোমেলো মানুষ। একটু আগে মধুসূদন মঞ্চে শো শুরু হল, তার একটা ভিড় ছিল এতক্ষণ, এবার চারদিকে কেমন অলস মেজাজ। চা খাচ্ছে কেউ কেউ, কেউ বা দল বেঁধে গুলতানিতে মগ্ন, কেউ বা একা উদাস। লাগোয়া শপিং কমপ্লেক্সে কেনাকাটা সেরে খুশি খুশি মুখে জিরোচ্ছে কেউ বা। ছোটাছুটি করছে কচিকাঁচার দল। নবীন আষাঢ়ের আকাশে আজও মেঘ নেই। হাওয়াও নেই তেমন। সূর্য ডোবার পরেও এখনও কাটেনি দিনমানের গুমোট।

প্রিয়াংশু আরও যেন গুমোটটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল। যোধপুর পার্কের কোচিং ক্লাসে এসেছিল অলি, মাথাটা বেজায় ধরে আছে, ভেবেছিল প্রিয়াংশুর সঙ্গে বকবক করে একটু বোধহয় হালকা হওয়া যাবে। কিন্তু কোথায় কী, সে আসা ইস্তক এমন একটা গোঁজ মেরে বসে আছে প্রিয়াংশু! বাড়িতে টেনশন, এখানেও টেনশন… ধুৎ, পোষায় না!

নখ খুঁটছে প্রিয়াংশু। মাথা নামিয়েই বলল, “কীসের টেনশন জানতে চাইলি না?”

অলি অল্প ঝেঁঝে উঠল, “ভ্যানতাড়া করছ কেন? ঝেড়ে কাশলেই তো হয়।”

“আমার বোধহয় আর এম এ পড়াটা হল না।”

“কেন?” অলি নড়ে বসল, “পরীক্ষা তো ভালই দিয়েছিলে?”

“রেজাল্ট হয়তো খুব খারাপ হবে না। কিন্তু বাবা যে অলরেডি নোটিস ঝেড়ে দিয়েছে।”

“কীসের?”

“পড়াশোনায় দাঁড়ি টানার।”

“মানে?”

“সোশিয়োলজি নিয়ে আরও দু’বছর ধরে ঘষটানো নাকি টোটালি মিনিংলেস। তার বদলে আমি যেন কোনও প্রফেশনাল কোর্স-টোর্স পড়ি, ওই বি বি এ কী এম বি এ ধরনের। কিংবা কম্পিউটারের কোনও ট্রেনিং-ফেনিং নিয়ে…”

“ও। তা সেটাই বা খারাপ কী?”

“বুঝতে পারছিস না? আমার দ্বারা ওসব হবে না। একটা কিছু পড়তে পড়তে সম্পূর্ণ অন্যদিকে সরে যাওয়া… আমার পক্ষে সম্ভবই নয়।”

“তা হলে সেটা তোমার বাবাকে বুঝিয়ে বলো।”

“শুনছেই না আমার কথা। এক একটা বাপ এমন টেঁটিয়া হয়… মনে করে সে যা ভাবছে, দুনিয়ায় সেটাই একমাত্র ঠিক।” প্রিয়াংশু ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, “জীবনটা আমার নষ্টই হয়ে গেল রে।”

“যাহ বাবা, এত হতাশ হওয়ার কী আছে? পড়তে পড়তে লোকে লাইন চেঞ্জ করে না? আমার দিদিভাইই তো সায়েন্সের স্টুডেন্ট ছিল, হায়ার সেকেন্ডারিতে ভাল রেজাল্ট থাকা সত্ত্বেও দুম করে হিউম্যানিটিজে ঢুকে গেল। দিব্যি এম এ-টেম এ করে এখন কলেজে পড়াচ্ছে।”

সামান্য থমকে থেকে প্রিয়াংশু বলল, “সেটা তো ছিল তার নিজের পছন্দের ব্যাপার। আর এটা তো হচ্ছে বাই ফোর্স। আমি যেটা ডিসলাইক করি, সেদিকে আমায় ঠেলা হচ্ছে।” প্রিয়াংশু জোরে জোরে মাথা ঝাঁকাল, “আমি মানতে পারছি না। কিছুতেই না।”

“এতই যদি আপত্তি তো প্রোটেস্ট করো, লড়ে যাও।”

“লাভ হবে না রে।” আবার এক ফালি দীর্ঘশ্বাস, “আমার বাবাকে তো চিনিস না… একটা মিনি হিটলার। সোশিয়োলজি নিয়ে কলেজে ভরতি হওয়ার পর থেকেই চিল্লাচ্ছে। বেশি জোর দেখাতে গেলে আমাকেও হয়তো ঘেঁটি ধরে শাড়ির দোকানে বসিয়ে দেবে।”

পেট গুলিয়ে হাসি উঠে এল অলির। কল্পচোখে দেখতে পেল, তাক থেকে একের পর এক শাড়ি নামাচ্ছে প্রিয়াংশু। ফটাফট মেলে ধরছে কাউন্টারে আর বিনীত সুরে বলছে, এই কাপড়ের জমিটা দেখুন দিদি! আঁচল আর বডির কাজটা কী দারুণ ম্যাচ করেছে, তাই না! কিংবা কাউন্টারে বসে মাথা নামিয়ে বিল লিখছে এক মনে!

মুচকি হেসে অলি বলল, “তা সেই কাজই বা কী এমন খারাপ? সারাদিন মেয়েরা তোমায় ঘিরে থাকবে।”

“তুই মজা পাচ্ছিস?” আবার নাক দিয়ে খানিকটা ভারী বাতাস ছাড়ল প্রিয়াংশু। ভার গলায় বলল, “কত কী প্ল্যান ছকেছিলাম। এম এ পাশ করে কলেজে চাকরির জন্য জান লড়িয়ে দেব কিংবা কোনও কম্পিটিটিভ এগ্‌জ়্যামে বসব… তদ্দিনে তোরও গ্র্যাজুয়েশন হয়ে যাবে…”

“আমি?” অলি যেন আকাশ থেকে পড়ল, “এর মধ্যে আমি আসছি কীভাবে?”

“না মানে… তুই তো… তোকে নিয়েই তো…।” প্রিয়াংশু খাবি খাচ্ছে। যেন জোর করেই একটু হাসি ফোটাল ঠোঁটে। ঢোক গিলে বলল, “আমরা তো পরস্পরকে… তাই বলছিলাম…”

“অ্যাই, দাঁড়াও দাঁড়াও। কী বলতে চাও, অ্যাঁ? তুমি কি শাদি বিয়ে অবধি ভেবে ফেলেছ নাকি?”

থতমত মুখে প্রিয়াংশু বলল, “ভাবব না?”

“প্রশ্নই আসে না। তোমার সঙ্গে মিশছি বলে ওমনি তুমি আমার আশিক হয়ে গেলে বুঝি? ওসব চাঁদ ফুল তারা মন থেকে মুছে ফ্যালো, বুঝলে। যদি শুধু বন্ধু হয়ে থাকতে পারো তো ওকে। নইলে টা টা করে দিচ্ছি, সুড়সুড়িয়ে কেটে পড়ো।”

প্রিয়াংশুর মুখ চুন। গলায় আর স্বর ফুটছে না।

মিনিটখানেক পরে অলিই কথা বলল, “সন্ধেটা পুরো ছানা কেটে গেল। চলো, উঠবে তো?”

মিনমিনে স্বরে প্রিয়াংশু বলল, “হুঁ। চল।”

অলির পিছন পিছন সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল প্রিয়াংশু। তারপর দক্ষিণাপণের গেট পেরিয়ে বড়রাস্তায়। এবার দু’জনে দু’দিকে যাবে। প্রিয়াংশু চেতলা, অলি গড়িয়ায়।

রাস্তা পেরনোর আগে অলি বলল, “ওকে। বাই।”

প্রিয়াংশু মৃদু স্বরে বলল, “আমাদের আর দেখা হচ্ছে না, তাই না?”

“তা কেন। হতেই পারে।” অলি আলগা হাসল, “আমরা তো বন্ধুই আছি, নয় কী?”

প্রিয়াংশু অস্ফুটে কী যেন বলল। শুনতে পেল না অলি। পিঠের ঝোলা সামলে রাস্তা টপকে বাসস্ট্যান্ডে আসতেই সামনে গড়িয়ার অটো। এক বয়স্ক মহিলা নামল অটো থেকে, ওমনি গিয়ে অলি স্থান দখল করেছে। তেচাকা ফের সচল হওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল এখনও প্রিয়াংশু স্থির দাঁড়িয়ে ওপারে।

অলির কি খারাপ লাগল? ঠিকঠাক বুঝতে পারল না অলি। প্রিয়াংশুকে যে তার মন্দ লাগে তা নয়। কিন্তু বড্ড বেশি নেতানো ধরনের। সর্বদাই কিছু না কিছু নিয়ে গজগজ চলছে। সাহসটাও বেশ কম। নইলে এত দামড়া একটা ছেলে বাপের ভয়ে কেঁচো হয়ে থাকে? এই ছেলের সঙ্গে অলি জীবন জড়াবে, ভাবনাটাই তো হাস্যকর।

তবু মন যে কেন খচখচ করে? ছেলেটা যা খুশি বকে যাক, আমল না দিলেই কি ভাল হত না? আচমকা প্রতিক্রিয়াই বা দেখাতে গেল কেন? সে কি জানত না প্রিয়াংশু তার প্রতি গদগদ? তার পরেও তো না হোক আট দশবার মোলাকাত হয়েছে দু’জনের। মাঝেসাঝে প্রিয়াংশু দু’-চারটে ন্যাকা ন্যাকা কথাবার্তাও বলেছে এবং অলি তা নির্বিবাদে হজমও করেছে। একেবারে পুলকিত হয়নি, তাও তো নয়। তা হলে আজ হঠাৎ ফোঁস করার কী অর্থ? তার চেয়েও বড় কথা, যা মনে এসেছে অলি নয় বলেই দিয়েছে, তা নিয়ে মিছিমিছি ভাবছে কেন এখন?

ওরে অলি, কী হল রে তোর? ফস করে কথাগুলো আউড়ে দিয়ে তুই যেন কাতর হয়ে পড়েছিস? দেখিস বাবা, নিজেই চাঁদ ফুলের চক্করে পড়ে যাস না যেন!

পাশে দুই বাপির বয়সি ভদ্রলোক। তারস্বরে তারা তর্ক জুড়েছে রাজ্যরাজনীতি নিয়ে। লোকসভা ভোটে লাল পার্টির গো-হারা দশায় একজন দারুণ উল্লসিত, অন্যজন চটে আছে বেজায়। দু’জনের বাকযুদ্ধে অলির প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার জোগাড়। রাজনীতি নিয়ে কচকচ করে লোকগুলো যে কী সুখ পায়? ক্লাসেও অনেকে বলাবলি করছে, সামনের বিধানসভা ভোটে নাকি সরকারই উলটে যাবে। তাতেই বা কী লাভ হবে কে জানে। অবশ্য সেই সম্ভাবনায় কলেজের হাওয়া এখনই বেশ গরম। ঘাসফুল পার্টির ছেলেমেয়েরা খুব তেড়েফুঁড়ে উঠছে, জোর স্লোগান মাচাচ্ছে প্রায়ই। দীপাঞ্জন সেদিন কী কাজে যেন কলেজে গিয়েছিল, ফোনে বলল কলেজে নাকি মারপিট বাঁধতে পারে। এখন ভালয় ভালয় পার্ট ওয়ান পরীক্ষাটা চুকলে হয়।

গড়িয়ার মুখে এসে অটো থেকে নামল অলি। কেমন খিদে খিদে পাচ্ছে। কুসুমদি কি আছে এখন? মনে হয় না। মাকে বললে কিছু হয়তো বানিয়ে দেবে, কিন্তু বলতে ইচ্ছে করে না আজকাল। কেমন একটা হয়ে গেছে মা! দিদিভাইয়ের বিয়ে পর্যন্ত কী দারুণ চনমনে ছিল, অনুষ্ঠানটা চোকার পর থেকে ঝিমিয়ে গেছে যেন। মেয়েকে বিদায় করার ঝটকাটা এখনও সামলাতে পারেনি? হবেও বা।

বড়কন্যের ওপর মানসীর যে একটা আলাদা টান আছে, অলি তা টের পায় বই কী। সেই ছোটবেলা থেকেই তো অলি দেখছে তার দিদির মনমেজাজের সামান্যতম পরিবর্তন কীভাবে বিচলিত করে দেয় মাকে। দিদি হাসছে, তো মা ডগমগ। দিদির মুখ ভার, তো মা ছটফট…..। আঁচলের প্রতি মানসীর যে কোনও পক্ষপাতিত্ব নেই, সেটা প্রতিপন্ন করতে কত সময় যে তুচ্ছ কারণে বকাঝকা করেছে আঁচলকে। অথচ সেটাই যেন প্রকট করে দিয়েছে মানসীর মনোভাব। মানসী আর আঁচল মিলে যেন একটা আলাদা ইউনিট। যেন আঁচল কোনও অনাত্মীয় পরিবারে বাস করছে, আর ধমকধামকের বর্মের আড়ালে তাকে রক্ষা করছে মানসী। অলি অনেক বেশি বকুনি খায়, তবু কেন যেন ওরকমটাই মনে হয় অলির। শান্তনু যে কস্মিনকালে আঁচলকে কোনও কড়া কথা বলতে পারল না, সর্বদাই তার প্রশংসায় আপ্লুত, সেও তো মানসীর কারণে। পাছে মানসী আহত হয়, দুঃখ পায়…। হয়তো আঁচলের স্বভাব গুণেই মোহিত হয়ে থাকে শান্তনু, তবু অলি যে কেন এই ধারণার বাইরে বেরোতে পারল না এখনও?

দিদির প্রতি অসূয়া? না মার ওপর অভিমান? দুটো অনুভূতিকে ঠিক পৃথক করতে পারে না অলি। তবে কষ্ট একটা তার আছেই। মনের গহিনে।

আপাতত অবশ্য খিদের কষ্টটা বেশি জোরালো। পাড়ার মোড়ের স্ন্যাকস কাউন্টারে অলি দাঁড়িয়ে পড়ল। সবে চিকেন রোলের অর্ডার দিয়েছে, মোবাইলে ‘কাল হো না হো’ ধ্বনি। জিনসের পকেট থেকে ফোন বার করল অলি। মনিটরে আলগা চোখ বুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ রনিতা, বল।”

“কী করছিস? বাড়িতে?”

“না রে। কোচিং থেকে ফিরছি।”

“আমি এখন কোথায় বল তো?”

“কোথায়?” অলি মোবাইলটা কানে চাপল, “জোর হল্লাগুল্লা হচ্ছে, কোনও ফাংশানে-টাংশানে আছিস বুঝি?”

“উহু। আমি এখন রাজারহাট শপিং মলের ফুডকোর্টে।”

“অত দূরে কী করছিস?”

“তেঘরিয়ায় পিসির বাড়ি এসেছিলাম, সেখান থেকে…।” রনিতার স্বর ভারী উত্তেজিত, “আমাদের ঠিক দু’খানা টেবিল পরে কে বসে আছে, আন্দাজ করতে পারিস?”

“কে? অলি একটু মগজ হাতড়াল, কলেজের কোনও স্যার ম্যাডাম?”

“তুই গেস করতেই পারবি না।” রনিতা একটুখানি সময় নিল। বুঝি বা অলির কৌতূহলটাকে আর একটু উসকে দিতে চাইল। তারপর সামান্য চাপা গলায় বলল, “তোর জামাইবাবু রে।”

“ওমা তাই? কী করছে? দলবল জুটিয়ে আড্ডা?”

“না রে। সঙ্গে একটা মেয়ে। সালোয়ার-কামিজ পরা। শ্যামলা শ্যামলা গায়ের রং। দু’জনে প্রায় মাথায় মাথা ঠেকিয়ে কফি-স্যান্ডউইচ সাঁটাচ্ছে।”

ধক করে একটা ধাক্কা লাগল অলির। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গলা দিয়ে ঠিকরে এল, “যাহ, তুই বোধহয় ভুল দেখছিস।”

“ইমপসিবল। মেয়েদের মুখ আমি গুলিয়ে ফেলতে পারি, কিন্তু একবার দেখলেই ছেলেদের ফেস আমার মেমরি কার্ডে সেভ হয়ে যায়। তোর জামাইবাবুকে আমি ভুল করতেই পারি না।”

“ও। কিন্তু নির্বাণদা ওখানে যাবে কেন?”

“আমার তো সেটাই মিস্টিরিয়াস লাগছে। মাত্র ক’মাস আগে বিয়ে হয়েছে, এখন তো তোর দিদির সঙ্গে সন্ধেবেলা সেঁটে থাকার কথা। তার বদলে অন্য মেয়ের সঙ্গে…”

“হয়তো কোনও পুরনো বন্ধু-টন্ধু হবে। কিংবা কোনও অফিস কলিগ…”

“কী জানি বাবা, দু’জনে এমন গপ্পে বিভোর… কোনও দিকে তাকাচ্ছেই না…। দেখে কেমন লাগছে রে। তাই ভাবলাম তোকে একবার জানাই।”

“হুম।” প্রসঙ্গটা পছন্দ হচ্ছিল না অলির। কথার মোড় ঘোরাতে বলল, “তোর প্রিপারেশান কমপ্লিট?”

“কই আর। পিসতুতো দাদা ইউ-কে থেকে ফিরেছে, তাই একটু হইচই করতে এসেছি। আজ সবাই মিলে থ্রি ইডিয়টস দেখলাম। কাল সকালেই ব্যাক। …অ্যাই, অ্যাডমিট কার্ড কবে দিচ্ছে রে?”

“কৌশিক তো বলছিল পরীক্ষার তিন দিন আগে। কলেজে গিয়ে দেখতে হবে।”

“আমায় একটু জানাস প্লিজ।”

“শিওর। ছাড়ছি তা হলে?”

স্ন্যাকস কাউন্টারের ছেলেটা ডাকছে। মোবাইল পকেটে ঢুকিয়ে রোলটা নিল অলি। কামড় বসিয়ে হাঁটছে বাড়ির দিকে। মাথায় চিন্তার আঁকিবুকি। দিদিভাইয়ের গুল্লুগুল্লু গোমড়াথেরিয়াম বরটার কি গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে? বিশ্বাস হয় না। রনিতা নির্ঘাত ভুল দেখেছে। বিয়ের দিন ঝলক দেখেই মনে করে রাখবে? এত সোজা? অবশ্য ইচ্ছে করেও ঢপ মারতে পারে। রনিতার একটু গোল পাকানোর স্বভাব আছে। দীপাঞ্জন আর মধুশ্রীকে নিয়ে একটা গল্প ছেড়ে দিয়েছিল কলেজে। তাই নিয়ে ক্যান্টিনে তো একদিন ফাটাফাটির হওয়ার উপক্রম। ধরা পড়ে রনিতার সেদিন কী সাফাই! ও নাকি জোক করছিল! এটাও সেই রকম না তো? শালির দিকেই চোখ তুলে তাকাতে পারে না, সেই নির্বাণকুমার এক্সট্রা ম্যারিটাল চালাচ্ছে? ধুস হতেই পারে না।

কিন্তু ধন্দ যে কাটে না কিছুতেই। যদি রনিতার কথা সত্যি হয়…? দেখে যাকে যা মনে হয়, তা কি সঠিক হয় সবসময়ে? এই তো প্রিয়াংশু কী স্মার্ট ছেলে, কিন্তু অলির সামনে এলেই কেবলুস নাম্বার ওয়ান। আবার কোচিং ক্লাসের শৌণককে ভিজে বেড়ালটি লাগত, অথচ সেই বেপরোয়ার মতো আচমকা অলিকে জড়িয়ে ধরে…! রূপম নামের ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে ছেলেটার সঙ্গে নেটে বন্ধুত্ব হয়েছিল… কত চোখা-চোখা জোক বলত ছেলেটা। ওদিকে ফেস্টে গিয়ে মুখোমুখি আলাপের পর দেখা গেল সে একটি আদ্যন্ত রসকষহীন লাজুকলতা। সুতরাং নির্বাণকুমারও যে জলজ্যান্ত ক্যাসানোভা নয়, এ কী হলপ করে বলা যায়? যদি তেমনটা হয় তা হলে তো দিদিভাইকে সতর্ক করা ভীষণ ভীষণ জরুরি। মায়ের বড়কন্যেটি যা ঢ্যাঁড়স, দিবারাত্র বইয়ে মুখ গুঁজে থাকে, হয়তো সেভাবে খেয়ালই করে না বরের বেচালপনা! ভালমানুষ দিদিটিকে কোনও বিপদে পড়তে না দেওয়া তো অলির কর্তব্য, নয় কী?

হঠাৎই অলির মনে হল, আনসান না ভেবে সরাসরি পরখ করে নিলে কেমন হয়?

চটপট রোল শেষ করল অলি। আবার হাত পকেটে। মোবাইল বার করে বোতাম টিপল। বেশ খানিকক্ষণ বাজার পর ওপারে নির্বাণের সাড়া মিলেছে, “হ্যালো?”

“আমি অলি।”

“কে?”

“অলি। অলি। আমার নাম্বার বুঝি সেভ করা নেই?”

“হ্যাঁ আছে তো। সরি, খেয়াল করিনি।” নির্বাণ যেন ঢোক গিলল, “বলো কী খবর?”

“তোমার খবর বলো? কী করছ এখন?”

“এই তো, অফিস থেকে বেরোচ্ছি। এবার বাড়ি যাব।”

“কেন বাতেলা দিচ্ছ নির্বাণদা?’ অলি একটু খেলাল, “আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি , তুমি এখন একটা ফুডকোর্টে বসে। এইমাত্র চিকেন স্যান্ডউইচ শেষ করলে। এবার কফিতে চুমুক দিচ্ছ।”

ওপ্রান্তে আর কোনও আওয়াজ নেই। প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পর আবার ফিরেছে নির্বাণের কণ্ঠ, “যাহ কী যে বলো। আমি এখন অফিসের গেটে।”

“তা হলে এত গুনগুনানি কীসের?”

“ওই… লোকজন… নিজেদের মধ্যে কথা বলছে…।” আমতা আমতা স্বরটা হঠাৎই বদলে গেল, “তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে, অলি?”

“মোটামুটি। তুমি কি সত্যি এখন…?”

“আমার বাস আসছে, অলি। পরে কথা হবে, কেমন?”

কুট করে কেটে গেল লাইন।

অলি হাঁ। কী হল কেসটা? পরিষ্কার ফুডকোর্টের গুঞ্জন শুনেছে অলি। নির্বাণদা অস্বীকার করল কেন? তবে কি রনিতাই ঠিক? এক্ষুনি ফোন করবে রনিতাকে? দেখতে বলবে, নির্বাণদা কী করছে এখন? মোবাইলের বোতাম টিপতে গিয়েও অলি নিজেকে নিরস্ত করল। উঁহু, রনিতাকে আর না জড়ানোই ভাল। খবরটা কলেজময় চাউর হলে অলির কি মর্যাদা বাড়বে? বরং কৌশল করে ব্যাপারটা রনিতার কাছে এখন চেপে যাওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ।

কিন্তু হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে তো চলবে না, কিছু একটা তো করতেই হয়। এতাল-বেতাল ভাবতে ভাবতে অলি ঢুকল বাড়িতে। মানসীই খুলেছে গ্রিলবারান্দার তালা। বসার ঘরে চটি ছাড়তে ছাড়তে অলির নজরে পড়ল টিভির পরদায় তর্ক চলছে জোর। রাজনীতি নিয়ে। আলোচনায় দেবরাজ সিংহরায় রয়েছে যেন?

অলি কৌতূহলী সুরে বলল, “তুমি আজকাল এসবও দ্যাখো নাকি?”

“না না। এই মাত্র খুলেছিলাম।” মানসী রিমোট টিপে ঝুপ করে টিভি অফ করে দিল। কেমন একটা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে উঠল, “ফাঁকা বাড়ি, কেউ কোত্থাও নেই, তেমন কোনও সিরিয়ালও চলছে না, তাই একটু সময় কাটাতে…”

“তা বন্ধ করলে কেন? দ্যাখো।”

“দূর, কচকচি ভাল লাগে না। বরং ঘরে গিয়ে শুই একটু।” বলেই মানসীর কণ্ঠে খানিক বাড়তি উৎসাহ, “খাবি কিছু? বানিয়ে দেব? বলিস তো অল্প চাউমিন করে দিতে পারি।”

“না, লাগবে না।”

“বাইরে কিছু খেয়ে এসেছিস বুঝি? …রাস্তাঘাটের খাবার এখন অ্যাভয়েড করা উচিত, বুঝলি। সামনে পরীক্ষা, কী থেকে কী হবে…। এখন একটু রয়েসয়ে চল।”

মা যেন একটু বেশি নরমভাবে কথা বলছে। প্রাক্তন বরের প্রোগ্রাম শুনছিল মন দিয়ে, অলির কাছে ধরা পড়ে গিয়ে কি এই অচেনা কোমল সুর? আশ্চর্য, এতে লুকোছাপার কী আছে? সম্পর্ক চুকে গেছে বলে কি দেবরাজ সিংহরায়ের মতো এক চার্মিং পুরুষের মুখ দেখাও অপরাধ? ভাবছে হয়তো অলি কিছু মনে করতে পারে। হাহ, কী বোকা বোকা ধারণা।

কথা না বাড়িয়ে অলি ঘরে এল। পিঠের ব্যাগ নামিয়ে রেখে গড়িয়ে পড়ল বিছানায়। ওই আলুভাতে নির্বাণের চিন্তা ফিরে আসছে আবার। টিপটিপ করছে মাথা। দিদিভাইকে কি জানিয়ে দেবে? বেচারা বড্ড নরম সরম, আচমকা কোনও ঝড় এলে হয়তো সামলাতে পারবে না। কিন্তু বলবেটা কী? নির্বাণদা তোকে ঠকাচ্ছে? কিন্তু একেবারে নিশ্চিত না হয়ে কাউকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানোটা…? হয়তো নেহাতই কোনও দড়িকে সে সাপ ভাবছে, এমনিই কোনও বান্ধবীর সঙ্গে হয়তো ফুডকোর্টে… লজ্জা পেয়ে অলির কাছে হয়তো চেপে গেল…। সে যদি ভুল করে দিদিভাইয়ের মনে সংশয়ের বীজ ঢুকিয়ে দেয়, তা হলে হয়তো সম্পর্কটাই পুরোপুরি চিড় খেয়ে যেতে পারে। তা হলে? তা হলে?

অলি নিজের মনে কয়েকবার চোখ পিটপিট করল। তারপর আচমকাই গলা উঠিয়েছে, “মা, অম্বরদা ফিরেছে?”

“অনেকক্ষণ। ডাকব নীচে?”

“নাহ। আমিই যাচ্ছি।”

তড়াক করে বিছানা ছেড়ে নামল অলি। তরতর পায়ে সিঁড়িতে। দোতলায় উঠে অম্বরের দরজায় আওয়াজ করল টকটক।

পাল্লা খুলে অম্বর যেন একটু অবাক, “তুমি?”

জবাব না দিয়ে সুড়ুত ঢুকে এল অলি। একবার চোখ বুলিয়ে নিল ঘরখানায়। বিছানাময় বই খাতা ডায়েরি কত কিছু ছড়ানো। অ্যাশট্রেতে সিগারেট উপচে পড়ছে। দেওয়াল-হ্যাঙারে জামাকাপড় ঝুলছে যেমন তেমন।

চেয়ারে বসতে বসতে অলি বলল, “কী যে করে রাখো ঘরটাকে।”

অম্বর মুচকি হাসল, “তুমি কি ঘর গুছোতে এলে?”

“আমার দায় পড়েছে। একটা বিয়ে করো, বউ এসে গুছিয়ে রাখবে।”

“একেবারে এই বাড়িতে এনে তুলব? এমন বেকার দশায়? কাকা নিশ্চয়ই খুশিতে দু’হাত তুলে নাচবে?”

“ফাজলামি রাখো।” চোখের ইশারা করল অলি, “বোসো। দরকারি কথা আছে। রিকোয়েস্টও বলতে পারো।”

অম্বরের ভুরুতে ভাঁজ, “কী ব্যাপার?”

“বলছি। তার আগে প্রমিস করো, ঘুণাক্ষরেও কারওকে জানাবে না?”

“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। এবার বলো তো।”

“তোমাকে একটা কাজ করতে হবে। খুব সাবধানে। গোপনে।”

“কীরকম?”

“নির্বাণদার আগামী এক মাসের গতিবিধি আমি জানতে চাই। ফ্রম বাড়ি থেকে বেরোনো টু বাড়ি ফেরা। কীভাবে কাজটা করবে আমি জানি না। তবে করতেই হবে।”

অম্বর যেন ভীষণ চমকেছে। দৃষ্টি স্থির একটুক্ষণ। বুঝি শুধু অলিকে নয়, তাকে ফুঁড়ে আরও কিছু দেখছে অম্বর। অস্ফুটে বলল, “কিন্তু কেন?”

“সেটা এক্ষুনি বলা যাবে না। …আশা করি কাজটা পারবে?”

“দেখছি।” ঈষৎ থমকে থেকে অম্বর বলল, “তবে আমাকে বললে বোধহয় কোনও ক্ষতি হবে না।”

অলি দোটানায় পড়ে গেল। বললে তাও খানিক হালকা হতে পারে। কিন্তু বাধো বাধো ঠেকছে। মিনিট খানেক নিশ্চুপ বসে থেকে উঠে পড়েছে অলি। দরজা অবধি গিয়েও ঘুরে তাকাল।

অম্বর নরম গলায় বলল, “আমার ওপর কি কোনও আস্থাই নেই?”

ফের সেই দোলাচল। এবার এক পা এক পা করে ফিরছে অলি। বসল আবার।

২৬

সকালের জলখাবার আজ নিজেই বানিয়েছিল দেবরাজ। সাদামাঠা নাস্তা। বাটারটোস্ট ডিমসিদ্ধ কলা। ঝটপট খেয়ে চায়ে চুমুক বসাচ্ছিল। স্নান সেরে বেরোতে হবে এক্ষুনি। প্রথমে সোজা পাইকপাড়া, সেখান থেকে দাদা-বউদিকে তুলে রাজারহাটের ক্যানসার হসপিটাল। দেবপ্রিয়র আজ তৃতীয় দফা কেমোথেরাপি নেওয়ার দিন।

ডিশ কাপ প্লেট সিঙ্কে নামিয়ে দেবরাজ বাথরুমে ঢুকতে যাচ্ছে, দিলীপের আগমন। “কাঁচুমাচু মুখে বলল, একটা সমস্যা হয়েছে স্যার। আমাকে কয়েক দিনের জন্য দেশে যেতে হবে।”

“কেন রে?”

“ভাই কাল রাতে ফোন করেছিল। ক’দিন ধরে তার জ্বর, রক্ত পরীক্ষায় জন্ডিস ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে পুরো বিশ্রাম নিতে হবে। তাই চাষবাসের শুরুটা সামলাতে… খেতে লাঙল দেওয়া, ধান রোওয়া… বাবা তো আজকাল ওসব পারে না…”

“হুঁ। তা কবে যাবি?”

“কাল কিংবা পরশু। …আপনার কোনও অসুবিধে হবে না স্যার। সুনীতা থাকছে, আপনার দোকান-বাজার রান্নাবান্না ঘরদোর ধোওয়া-পোঁছা ওই সব সামলে দেবে।”

কলকাতায় তার এই একলা ফ্ল্যাটে একটা মেয়ে এসে ঘুরঘুর করবে, এ যেন মনোমতো নয় দেবরাজের। নারীদের প্রতি তার দুর্বলতা আছে এ যেমন সত্যি, উটকো মহিলার উপস্থিতিতে তার প্রিভেসি বিঘ্নিত হয় এও তো সত্যি। তা ছাড়া দিলীপকে যখন তখন ডাকা সম্ভব, রাত দশটাতেও কিছু আনাতে পারে অনায়াসে। কিন্তু সুনীতাকে কি ওভাবে পাঠানো যায়? তবু দিলীপের যাওয়ায় আপত্তিই বা জানায় কোন মুখে? প্রথম কথা, দিলীপ তার ক্রীতদাস নয়। দ্বিতীয়ত সে নিজে দাদার অসুখ বলে কর্মস্থল ছেড়ে এবার কলকাতায় এসে রয়েছে, অথচ দিলীপ তার ভাইয়ের রোগব্যাধির সময়ে সংসারকে সাহায্য করতে বাড়ি যেতে পারবে না, এমন একটা দ্বিচারিতামূলক দাবি কি দেবরাজকে সাজে? তার দাদার রোগটা হয়তো খুবই মারাত্মক, কিন্তু চাষবাসের ক্ষতি হওয়াটাও তো দিলীপের কাছে কম কিছু নয়।

তবু ভিতরের মধ্যবিত্তটা খোঁচা দিয়েই ফেলল, “কবে ফিরছিস?”

“আপনি তো আরও মাসখানেক নিশ্চয়ই আছেন? তার আগেই চলে আসব।” দিলীপ হাত কচলাচ্ছে, “আর একটা কথা ছিল স্যার।”

“আবার কী?”

“কিছু টাকা যদি দ্যান… বেশি নয়, হাজার পাঁচেক। গত বছর বন্যায় বড় চাষটা পুরো নষ্ট হয়ে গেল, নতুন করে বীজধান কিনতে হবে… সার-টারেরও খরচা আছে…”

“ঠিক আছে, নিস খন।”

“থ্যাংক ইউ স্যার। আমি মাস মাস কাটিয়ে দেব। যেভাবে আপনি বলবেন।”

“আচ্ছা আচ্ছা, সে দেখা যাবে। আর শোন, আজ কোনও রান্নাবান্নার দরকার নেই, আমি একেবারে রাতে খেয়ে ফিরব।”

স্নানে ঢুকে গেল দেবরাজ। মনে মনে স্থির করে নিল, টাকাটা সে দিলীপকে এমনিই দেবে। গতবার তো বটেই, এবারও তার জন্যে যা জান লড়িয়ে দিচ্ছে দিলীপ, বাড়তি সামান্য পাঁচ হাজার টাকা তো ওর হকেরই পাওনা। বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছে ছেলেটা, ওর সঙ্গে পাওনাদারি করলে কী চলে!

শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে দেবরাজের এও মনে হল, গতবার আর এবারের কলকাতাবাস তাকে যেন খানিকটা বদলেও দিয়েছে। আবছা স্মৃতির মতো মানুষগুলো যেন অনেক সজীব বাস্তব এখন। চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা বনোকে আর অত অসহ্য লাগে না, তন্ময়ের মতো কেজো মানুষকেও তত বিরক্তিকর ঠেকে না, ব্যক্তিত্বহীন বউদি, ধুঁকতে থাকা দাদা, আঁচল তো বটেই, এমনকি তুচ্ছ দিলীপ-সুনীতারাও অনবরত ঘুরপাক খায় মাথায়। তুলনায় দিল্লি যেন এখন অনেক ফিকে। এই তো কাল রাতে অত ফোনাফুনি হল, তার মধ্যে সিরিয়াস বাতচিতও কম হয়নি, অথচ মাত্র কয়েক ঘণ্টা যেতেই তারা কেমন ধূসর।

প্রথমে দিল্লি থেকেই ফোন এসেছিল। সবে তখন বিছানায় হাত-পা মেলেছে দেবরাজ, হঠাৎ লতা ভার্গব।

গলা শুনেই দেবরাজ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল, “এখন হঠাৎ? আমি তো দিল্লিতে নেই।”

“জানি। দিল্লি তোমায় বহুত মিস করছে দেব।”

জড়ানো ঘড়ঘড়ে আহ্লাদী স্বরে দেবরাজ বিরক্ত রীতিমতো। তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “আই ডোন্ট কেয়ার।”

“সে তো বলবেই। এই দিল্লিওয়ালির জরুরত এখন ফুরিয়েছে কিনা। তবে তুমি যে এমন স্বার্থপর হয়ে যাবে, আমি কিন্তু কখনও ভাবিনি দেব।”

“আভি অ্যায়সা হি সোচো। ওকে? অ্যান্ড প্লিজ ডোন্ট ইরিটেট মি।”

“ইতনা গুসসা কিঁউ? তোমার প্রয়োজনেই আমি ফোন করেছি দেব। আই নো, ইউ অ্যাভয়েড মি, লেকিন আমি তোমার ভালই চাই। আভি ভি। বিলিভ মি।”

“সো কাইন্ড অব ইউ। বাট আয়্যাম নট ইন্টারেস্টেড লতা। ছাড়ছি।”

“আরে, মেরি বাত তো শুনো। দিস ইজ প্রফেশনাল ম্যাটার। এবং আমি এর মাঝে নেই। পার্লামেন্টের কুছ ফেমাস মেম্বার, যো লোগ অলরেডি বিত গয়ে, উনকো পোর্ট্রেট আঁকানো হচ্ছে। অ্যাকসিডেন্টালি আমার কাছে পেন্টারদের নাম নিয়ে সাজেশন চাওয়া হয়েছিল। অশোক, মনজিৎ আর তোমার নামটা আমি প্লেস করেছি। অ্যান্ড হোয়াট এ লাক, তিনটে নামই অ্যাপ্রুভড হয়েছে।”

“ইজ ইট? কিন্তু আমি তো পোট্রেট আঁকি না।”

“এবার আঁকবে। কিতনে কা প্রোজেক্ট, মালুম হ্যায়? ফাইভ ক্রোড়স। ফর টোয়েন্টি পেন্টিংস। টোয়েন্টিফাইভ ল্যাকস ইচ। অ্যান্ড নো কমিশন। মেরে লিয়ে ভি নেহি।”

প্রত্যয় হয়নি দেবরাজের। লতাকে যদ্দূর চেনে, কোনও না কোনও ভাবে কিছু হাতাবেই। তবু প্রস্তাবটা এতই লোভনীয়, পলকের জন্য দেবরাজ দুলে গিয়েছিল। পরক্ষণেই কী যে বৈরাগ্য এল! অবহেলার সুরে বলে দিল, “মুঝে ছোড় দো লতা। আই ওন্ট ড্র পোট্রের্ট। নট ফর এনি অ্যামাউন্ট।”

দু’-চার সেকেন্ড চুপ থেকেই লতা হাঁউমাউ করে উঠল, “অ্যায়সা মত করনা দেব। আমি তোমার নাম দিয়েছি, আমার ইজ্জত চলে যাবে।”

“কান্ট হেল্‌প। তুমি কি তার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?”

“স্টিল… ইস্ বারকে লিয়ে মুঝকো বাঁচা লো.. প্লিজ। ফর দা সেক অব আওয়ার গুড ওল্ড ডেজ। ম্যায় তুমকো কেয়া নেহি দিয়া বোলো।”

শেষ বাক্যটিতেই যেন দেবরাজের বুক থইথই করে উঠল বিরাগে। নিলে বিনিময়ে কিছু দিতেই হবে, এই কি সম্পর্কের দস্তুর?

দেবরাজ কেটে কেটে বলল, “তার দাম ঠিক কোরো, দিয়ে দেব। তবে আমি স্থিরই করে ফেলেছি শুধু টাকার জন্য আর আঁকব না। যো দিলমে আয়েগা, সির্ফ ওহি ড্র করুংগা ম্যায়। ইট ইজ মাই প্রিন্সিপল নাও। সমঝে?”

সঙ্গে সঙ্গে লতা যেন হিসহিস করে উঠল, “খুব যে বড় বড় কথা বলছ? কৌন শিখায়া? তোমার ওই পুনম?”

“কথা হচ্ছে আমাদের, এর মধ্যে পুনমকে টানছ কেন?”

“গায়ে লাগল বুঝি? তুমি বিলকুল ঘরেলু আদমি বনে গেছ দেব। চোখ-কানও গেছে। না হলে দেখতে পেতে ও শালি রেন্ডি তুমহারা লায়েক নেহি।”

“তুমি খুব হাই হয়ে আছ লতা। বাদমে বাত করেংগে।”

“নেহি। আজই শুনতে হবে। তুমি জানো পুনম কী করছে? কার সঙ্গে সিঙ্গাপুর যাচ্ছে? অবধেশ। অবধেশ কুলকার্নি। পুনমের নয়া আশিক। নাটক-ফাটক উনকি ভাড়মে গয়া। কোম্পানির সি-ই-ও অবধেশের সঙ্গে ওর বহুৎ মৌজমস্তি চলছে এখন। তুমি শুধু ওর স্ট্যাটাস হয়ে ঝুলে আছ, সমঝা।”

“কথা শেষ? মাঝরাতে তোমার মাতলামি ভাল লাগছে না লতা। রাখলাম।”

ওপারের ফোঁসফোঁসানিকে গ্রাহ্য না করেই ফোন কেটে দিয়েছিল দেবরাজ। পাশ ফিরে শুয়ে হেসেছিল মনে মনে। মরিয়া লতা তার কান ভাঙানোর চেষ্টা করছে। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হয়েছিল, লতার কথাগুলো চুপচাপ মগজে পুষে রাখার কোনও মানেই হয় না। এতে তৈরি হবে সংশয়, ছিঁড়ে যাবে তার আর পুনমের বোঝাপড়ার বাঁধন।

ব্যস, ভাবামাত্র কাজ। ততক্ষণাৎ পুনমকে ফোন। বেশ খানিকক্ষণ বাজার পর ধরেছে পুনম, “কী হল? আভি তক শোয়া নেহি?”

“আর বোলো না। লতা এমন জ্বালাচ্ছিল। তোমার নামে এক রাশ উলটোসিধে বলল। যদিও আমি বিশ্বাস করিনি, তবু আমার মনে হল, তোমায় কথাগুলো জানিয়ে দেওয়া উচিত। এক্ষুনি।”

“কী বলে লতা?”

“তোমার নাকি অবধেশের সঙ্গে অ্যাফেয়ার চলছে। তার টানেই নাকি তুমি সিঙ্গাপুর ছুটছ।”

“লতার বহুৎ অবনতি হয়েছে তো। লেটেস্ট খবরটা বুঝি ও জানে না। আমি বোধহয় সিঙ্গাপুর যাচ্ছি না।”

“ইজ ইট? এ তো আমিও জানি না পুনম। কেন?”

“পিন্টারের একটা নতুন ড্রামার কাজ স্টার্ট হয়েছে। অফিসকে তাই জানিয়ে দিয়েছি, আমাকে স্পেয়ার করা হোক। এখন আমার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। মানল তো ভাল, নইলে নোকরিকো গোলি। আই ডোন্ট থিংক দে ওয়ান্ট টু লুজ মি। প্রিন্ট মিডিয়ার অ্যাডের লেআউট আমি ছাড়া আর সামলাবে কে, অ্যাঁ? এত কম মাইনেয়?”

“ও। স্টেজই তা হলে জিতে গেল?”

“জরুর রাজ। ভেবে দেখলাম নাটকই আমার জিন্দেগি। ঔর শায়েদ মওত ভি। নোকরি না থাকলেও কোনও না কোনওভাবে পেট চালাতে পারব এই এলেম যখন আছে, খামোখা বাঁদিগিরি করব কেন? লতাকে বলে দিয়ো, অবধেশ আমার খুবই বন্ধু। আর বন্ধু থাকবেও। …আশা করি, অবধেশকে নিয়ে তোমার কোনও কমপ্লেক্স নেই?”

“কী জানি। বুঝতে পারি না। আজকাল এই সব সম্পর্ক-টম্পর্কের ব্যাপারে আমি বোধহয় খুব ব্লান্ট হয়ে যাচ্ছি পুনম।”

“মানে বুড়ো হয়ে যাচ্ছ?”

সরাসরি জবাব দেয়নি দেবরাজ। মনে হয়েছিল, পুনমের ধারণাটা বোধহয় ঠিক নয়। সত্যি সত্যি বার্ধক্যের দিকে এগোলে নাকি সম্পর্কের টান আরও তীক্ষ্ণ হয়, অধিকারবোধ বাড়ে বই কমে না। হয়তো তার আর পুনমের সম্পর্কের বনেদটাই তেমন পাকাপোক্ত ছিল না কোনও দিন। রয়েছি তাই থাকা, এইরকম আর কী। অসূয়া কিংবা অভিমানের মতো জটিলতার সেখানে ঠাঁই কোথায়!

আলগাভাবে দেবরাজ তাই বলেছিল, “কে জানে। হবে হয়তো। …আমি কি তোমার ঘুম ভাঙালাম?”

“না। জাস্ট অনুবাদের কাজটা শেষ হয়েছে। ফাইনাল ভার্সানের একটা হার্ডকপি তৈরি করছিলাম।”

“গুড। ক্যারি অন। রাখছি।”

আশ্চর্য, ফোন অফ করার কয়েক মিনিটের মধ্যে লতা কিংবা পুনম আর মাথাতেই নেই। দাদাকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটতে হবে, এই ভাবনাই দখল নিল মগজের। এখন ঘুম থেকে উঠেও সেই চিন্তারই রেশ বইছে একটানা। কেন যেন মনে হচ্ছে, দেবরাজের এ এক নতুন লড়াই। এবং এই যুদ্ধে জেতাটা তার ভীষণ প্রয়োজন। শুধু দাদা-বউদির কারণে নয়, নিজের জন্যও।

বিবেকের গ্লানি? ঋণশোধের তাড়না? দেবরাজ জানে না।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে নিল দেবরাজ। সারাদিনের জন্য ভাড়ার গাড়ি নেওয়াই আছে, এসেও গেছে সময়মতো। ড্রাইভারের ফোন পেয়েই নেমে এল তাড়াতাড়ি। আকাশ আজ ছাইরঙা ইজেল। স্লেটবরণ ছোপ লেগে আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ভোরের দিকে কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল, রাস্তাঘাট এখনও ভিজে। এই বেলা দশটাতেও এক দুঃখী মলিন আলো ব্যেপে আছে চরাচর। তার মধ্যেও অফিস টাইমের কিতকিতে অবয়বহীন ভিড়। অত কোলাহল মেখেও কলকাতা এখন এক বিষণ্ণ শহর।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে এগোচ্ছিল গাড়ি। ধুঁকতে ধুঁকতে। রীতিমতো অসহিষ্ণু মুখে বাইরেটা দেখছিল দেবরাজ। হঠাৎ টের পেল পকেট কাঁপছে থরথর। মোবাইলটা বার করে দেবরাজ সামান্য অবাক। এই সময় অসীম?

ফোন কানে ধরে দেবরাজ বলল, “কী ব্যাপার? ক’দিন ফোন করিসনি কেন?”

“ছিলাম না তো। কাল রাতে তোর দিল্লি থেকে ফিরলাম।”

“তাই নাকি? গিয়েছিলি কবে?”

“নতুন মিনিস্ট্রির ওথ টেকিং সেরিমনি হল, তার আগের দিন।”

“কেন? শপথ গ্রহণের সঙ্গে তোর কী?”

“ওই অনুষ্ঠানেই গিয়েছিলাম যে। কার্ড পেয়েছিলাম। ঘাসফুল পার্টির নেতা নিজে আমায় কার্ড দিয়েছিলেন।”

“অ। তা গিয়ে কোনও এক্সট্রা হাত-পা গজাল?”

“ওহে নওলকিশোর, পুলকিত তো হয়েছি। বাড়তি হাত-পার চেয়ে তারই বা দাম কম কী। এই রাজ্যের লাল পার্টির কয়েকজন কাঁচুমাচু মুখে বসে ছিল সেদিন। উফ, দেখে যা মজা লাগছিল। ক’দিন আগেও কী হম্বিতম্বিই না করত সব। এখন একেবারে কেন্নোর মতো দশা।

“বুঝেছি। অন্যের বেদনা থেকে তুমি জুশ নিয়েছ। এবার তোমার চিল সিরিজ ছেড়ে অন্য কিছু শুরু করো।”

“ভাবছি। ঘুঘু ধরলে কেমন হয়? বাস্তুঘুঘু? উদাস ঘুঘু? দুঃখী ঘুঘু?”

টিপটিপ চিন্তার মাঝে হেসে ফেলল দেবরাজ। বলল, “যাক গে। তা এই কেজো সময়ে হাঁকাহাঁকি কেন?”

“কাজের জন্যেই ভাই। গুছিয়ে একটা সেলিব্রেট করতে হবে না? এত বড় একটা জয় পেলাম আমরা?”

“জয়? আমরা? জিতেছে তো ঘাসফুল। একটা পলিটিকাল পার্টি। এতে আমাদের, আর্টিস্টদের, কী এল গেল?”

“যাহ, কী যে বলিস না। আমরা শিল্পীরাও তো ঘাসফুলের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছি। লালেরা যে লোকসভা ভোটে এমন বেহাল হয়ে পড়ল, তাতে আমাদের অবদান কি কম? আমরা কি কম চাপের মুখে পড়েছি? তা হলে এই ভিক্টরিটা কেন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করব না?”

“দ্যাখ অসীম, রাজ্য জুড়ে এক ধরনের অন্যায় চলছিল, বিবেক অনুযায়ী কালচারাল ফিল্ডের অনেকে মিলে তার প্রতিবাদ করেছি। ভোটে যা হওয়ার হয়েছে। আমার তো মনে হয় এবার আমাদের সরে আসাই ভাল। লেখক শিল্পীরা শুড বি অলওয়েজ ইন দা সাইড অফ প্রোটেস্ট এগেনস্ট এনি ফর্ম অব ইনজাস্টিস। কিন্তু কোনও ধরনের পাওয়ারের ফেভারেই তাদের যাওয়া উচিত নয়।”

“ধ্যাৎ, কী যে বলিস! ক্ষমতা যদি মানুষের কল্যাণে কাজ করে, আমরা তার বিরোধিতা করব কেন? বরং ক্ষমতাকে প্রপারলি ইউজ করে সমাজের জন্যে পজ়েটিভ কিছু করতে পারি।”

“রাজনীতি বড় খারাপ জিনিস রে অসীম। ক্ষমতা আরও খারাপ। ওর কাছাকাছি থাকলেও মানুষকে ভিতর থেকে পচিয়ে দেয়। আমরা, যারা নিজেদের একটু বেশি সেন্সিটিভ বলে মনে করি, তারা অন্তত…”

“লেকচার স্টপ। কাজের কথা শোন। আগামী শনিবার সন্ধেয় তাজবেঙ্গলে একটা গ্র্যান্ড পার্টি দেওয়া হচ্ছে।”

“কে দিচ্ছে? তুই?”

“না না। আমি শুধু সবাইকে নেমন্তন্ন-টেমন্তন্ন করছি, কালচারাল মহলের সবাই যেন আসে সেটাও দেখছি।”

“কিন্তু মোটা খরচ আছে তো। সেটা করছে কে?”

“তা দিয়ে তোর আমার কী দরকার বল? অঢেল মাল থাকবে, দেদার খানা, আলোঝলমল অ্যাম্বিয়েন্স… চুটিয়ে এনজয় করব বস।”

এক মুহূর্ত থমকে থেকে দেবরাজ বলল, “সরি। আমায় বাদ দে।”

“কেন রে? অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে নাকি?”

“না। কার ঘাড়ে চেপে ফুর্তি করছি জানতে না পারলে দামি মদও আমার গলা দিয়ে নামে না রে।”

“তোর আবার এইসব আছে নাকি? আরে, আয় না। ওখানে গিয়েই শুনবি না হয়। গান নাটক কবিতার জগতের অনেকে থাকবে ওই দিন। দারুণ হুল্লোড় হবে।”

“ইজ ইট?”

“হ্যাঁ রে। বাইরে থেকে এসে তুই এত গলা ফাটালি, সব্বাই তোকে খুব এক্সপেক্ট করবে। তুই না এলে আমার প্রেস্টিজে ধাব্বা পড়ে যাবে ভাইটু।”

অনেকটা লতা ভার্গবের মতো শোনাল না অনুরোধটা? ফোন ছেড়ে মনে মনে একটু হাসল দেবরাজ। অসীমের মতো একজন শিল্পীর গলায় কেমন যেন টাউট-টাউট সুর। বোঝাই যায়, জেতা এম পি-রা কিংবা ঘাসফুল পার্টি আয়োজন করছে মোচ্ছবের। কিন্তু তাই নিয়ে এমন ঢাকঢাক গুড়গুড় কেন? তবে কি পিছন থেকে টাকা ঢালছে বিজনেসম্যানরা? এর দু’বছরের মধ্যে লাল পার্টি পুরো ধসে যাবে, সেটা আন্দাজ করেই কি দেবরাজদের এই তোয়াজ? যাতে ঘাসফুল প্রসন্ন হয়? সে যা খুশি হোক গে, রাজনীতি অর্থনীতির এই জটিল সমীকরণে দেবরাজের আগ্রহও নেই। তবে প্রতিবাদী স্বর তুলে ধরার পুরস্কার হিসেবে মদ গিলতে সে মোটেই রাজি নয়। এটুকু আত্মমর্যাদাবোধ না থাকলে তার হাত থেকে তুলি খসে যাবে না? ওখানে সুড়সুড় করে হাজির হলে রাজনীতির লোকরা তো তাকে পোষা কুকুর ভাববে।

শহরটাকে আরও যেন পাঁশুটে লাগছিল দেবরাজের। চিরকাল সে খোলা চোখে পৃথিবীকে দেখতে চেয়েছে, এই অসীমরা যেন সেই দৃষ্টিকেই ঘুলিয়ে দিচ্ছে আজকাল। প্রমিত সেদিন টিভিতেই যা উল্লাস জানাচ্ছিল তা তো রীতিমতো দৃষ্টিকটু। যেন একটা রাজনৈতিক দলের ভোটে সাফল্যের নামই বিপ্লব। কী জন্যে তারা লড়াই করছিল, সেটা নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই, শুধুই নেতানেত্রীদের স্তুতি। এ কোন দিকে এগোচ্ছে এরা?

পাইকপাড়ার বাড়িতে পৌঁছে দেবরাজের বিরক্তিটা আরও বেড়ে গেল। দাদা বেমালুম শুয়ে। ধমকের সুরে শুভ্রাকে বলল, “কী ব্যাপার, এখনও দাদাকে রেডি করোনি? সাড়ে এগারোটায় রিপোর্ট করতে হবে।”

শুভ্রা কাঁচুমাচু মুখে বলল, “চেষ্টা তো করছি। তোমার দাদা উঠছেই না। বলছে, আর হাসপাতালে যাবে না।”

“যত্ত সব ছেলেমানুষি। দেবরাজ খাটের পাশে এল। চুল-টুল ঝরে গিয়ে দাদার শীর্ণ চেহারা এখন কেমন কঙ্কালসদৃশ। হাড়ের খাঁচায় আলগা হাত বুলিয়ে দেবরাজ নরম গলায় বলল, “কী রে, হঠাৎ কী হল?”

খপ করে ভাইয়ের হাত চেপে ধরেছে দেবপ্রিয়। ভারী করুণ স্বরে বলল, “বড় কষ্ট রে। এত জ্বালাপোড়া শরীরে… যেন বিষ ঢুকেছে। আবার সেই বিষ…”

“আরে, বিষেই তো বিষক্ষয়। সাদামাঠা ওষুধ কি এই রোগ নির্মূল করতে পারে?”

“কিন্তু চিন্তা করলেই যে আমার… ওরে রাজু…”

“অত ভাবছিস কেন? আমি তো পাশে আছি।” সযত্নে দেবপ্রিয়কে উঠিয়ে বসাল দেবরাজ। বাচ্চা ভোলানোর সুরে বলল, “ডাক্তারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এবার নিবি চল, দেখবি জ্বালাপোড়া অনেক কম থাকবে।”

ঘোলাটে চোখজোড়া কয়েক পল স্থির। কী ভাবল কে জানে, ভাইয়ের হাত চেপে ধরেই দেবপ্রিয় নামল বিছানা ছেড়ে। তারপর ধীরে ধীরে একটা হাফ পাঞ্জাবি চড়াল গায়ে। লুঙ্গি বদলে একটা ফরসা পাজামা পরল। শুভ্রাও শাড়ি-টাড়ি পরে নিয়েছে। বেরোনোর আগে টলমল পায়ে বাথরুম গেল দেবপ্রিয়। ফিরছে শুভ্রার বাহু আঁকড়ে।

দৃশ্যটা ভারী আপ্লুত করছিল দেবরাজকে। কে যে কার ওপর নির্ভর এখন! বিয়ের পরদিন থেকে সংসারে মিশে গিয়েছিল বউদি, দাদার মতো নিরীহ মানুষকে নিশ্চিন্ত আশ্রয় ভেবে লতার মতো তাকে জড়িয়ে ছিল এতকাল, এখন অবস্থানটা কেমন পালটে গেছে। মানুষ যে চিরকাল সংসার গড়েছে, সে কি কোনও মধুর আশায়? নাকি এমনই এক ভয়ংকর দিন আসতে পারে এই আশংকায়? হেতু যাই হোক, দাদা-বউদির এই ছবিটা যেন মন ছুঁয়ে যায়।

ক্ষণপূর্বের বিক্ষিপ্ত মেজাজ সমে ফিরেছে দেবরাজের। দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো দাদা-বউদিকে তুলল গাড়িতে। সামনের সিট থেকে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিল, শুভ্রার কাঁধে হেলে পড়েছে দেবপ্রিয়র মাথা। যেন ওই কাঁধেই তার নিশ্চিন্ততা। এমন এক সাদামাঠা জীবনে কোনওদিন আস্থা ছিল না দেবরাজের, তবু এই মুহূর্তটা যে কেন তাকে ব্যাকুল করছে বারবার? তবে কি হৃদয়ের গহনে এমন একটা মায়াময় অথচ নিরুত্তাপ জীবনের বাসনা লুকিয়ে আছে কোথাও? দেবরাজের অজান্তেই?

বিল্ডিংটার গেটেই দাঁড়িয়েছিল বনানী। দেবরাজদের দেখে দৌড়ে এল। হাসপাতালের এক ইউনিফর্মধারী কর্মীকে ডাকছে হাত নেড়ে। সঙ্গে সঙ্গে হুইল চেয়ার হাজির। দেবপ্রিয়র পিছন পিছন শুভ্রা আর বনানীও চলেছে অন্দরে। ভরতির পাট চুকিয়ে ডক্টর নন্দীর সঙ্গে দেখা করে এল দেবরাজ। একটা নাগাদ কেমো শুরু হবে, এখন ঘণ্টা কয়েক অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

ড্রিপ চালু হওয়ার পর শুভ্রা আর বনানীকে নিয়ে লাউঞ্জে এল দেবরাজ। শুভ্রার মুখ থমথমে। বনানী টুকটাক কথা বলছে। জবাব না পেলেও তার কিছু যায় আসে না, সে একাই দিব্যি বকে যেতে পারে।

দেবরাজের মাথাটা ভার ভার ঠেকছিল। বাইরে বেরিয়ে একটা সিগারেট খেয়ে এল। ফিরে ফের চেয়ারে বসেছে। বনানীকে জিজ্ঞেস করল, “হ্যাঁ রে, তন্ময় আজ এল না যে?”

“ও একটু আটকে গেছে রে। আজ ওর ড্রাইভিং টেস্ট। দু’টোয়।

“তন্ময় গাড়ি চালানো শিখছে? এই বয়সে লাইসেন্স দেয়?”

“আপ টু ফিফটি। ও একদম কান ঘেঁষে আছে। অক্টোবরে ওর পঞ্চাশ হচ্ছে।”

“এই বয়সে কিন্তু রিফ্লেক্স ভাল হয় না। নতুন গাড়ি কিনছিস, ড্রাইভার রাখলে তো পারতিস।”

“সেই রকমই প্ল্যান আছে। তবে ফুল টাইম নয়, পার্ট টাইম। ফুল টাইমরা যা দর হাঁকছে, বাপস। তাই দরকারে-অদরকারে চালানোর জন্য ও শিখে রাখছে আর কী। তা ছাড়া রিটায়ার করার পর ড্রাইভার রাখা মানে তো হাতি পোষা।”

“তন্ময়ের রিটায়ারমেন্টের তো ঢের দেরি। এখনই তোরা সেই সময়ের কথা ভাবছিস?”

“আমরা তো তোর মতো বাউন্ডুলে নই। মধ্যবিত্ত পরিবার, দু’জনে চাকরি করি বলে একটা গাড়ি কিনছি, ভবিষ্যতের কথা মাথায় রাখব না?”

হালকাভাবেই একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিল দেবরাজ, হঠাৎ লাউঞ্জে আঁচল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। দেবরাজদের দেখতে পেয়েই এগিয়ে এল, “কেমো স্টার্ট হয়ে গেছে?”

“এই তো খানিকক্ষণ…। তুই আজ এলি যে বড়? কলেজ গেলি না?”

“ইচ্ছে করল না।” মৃদু স্বরে আঁচল বলল, “মনে হল তোমরা সবাই থাকবে… এখানেই চলে আসি।”

“বেশ করেছিস। আয় বোস।”

দেবরাজের পাশে বসল আঁচল। একটু যেন জড়োসড়ো হয়ে। ভাইঝিকে পেয়ে নতুন উদ্যমে এতাল-বেতাল বকবক চলছে বনানীর। শুনছে আঁচল, হুঁ হাঁ দিয়ে জবাব সারছে প্রশ্নের।

মেয়েকে দেখছিল দেবরাজ। কেমন যেন শুকনো লাগে না? তার কাছে এলেই আঁচলের চোখেমুখে চনমনে ভাব ফুটে ওঠে, আজ যেন মেয়ে ভারী নিষ্প্রভ। আনমনাও। দাদার আগের কেমোর দিন এসেছিল মেয়ে, সেদিনও এতটা গুমসুম লাগেনি। কথা আঁচল কমই বলে, তবে এত কম…? আজ কী হয়েছে আঁচলের?

হঠাৎ দেবরাজের মনে হল, বিয়ের পর আঁচল যেন কেমন ম্লান হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।

কেন? নতুন পরিবেশে কি মানিয়ে নিতে পারছে না? নির্বাণকে নিয়ে সুখী নয়? শাশুড়ির সঙ্গে খটাখটি?

দেবরাজ সরাসরি জিজ্ঞেস করবে মেয়েকে? সে অধিকার কি আছে তার? দেবরাজ বুঝতে পারছিল না।

২৭

বৃষ্টি নেমেছে । কাচের দরজার এপার থেকে জলধারা দেখা যায় শুধু, শব্দ শোনা যায় না। হাওয়াও দিচ্ছে খুব। হাসপাতাল প্রাঙ্গণের গাছপালা নড়ছে এলোমেলো। আকাশের যা চেহারা, কখন যে বর্ষণ থামবে অনুমান করা মুশকিল।

আঁচলের কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। বাড়ি ফেরার কোনও তাড়া নেই, সময়ের ধীর গতিতে তার কিছু যায় আসে না, বৃষ্টি নিয়েও সে তেমন চিন্তিত নয়, তবে লাউঞ্জের চেয়ারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় বসে থাকাও যে কী ক্লান্তিকর! উঠে হেঁটে হাসপাতালের ভিতরে একটু-আধটু ঘুরে আসতে পারে। কাউন্টার থেকে ব্রশিওরের তাড়া এনে উলটোলেও নিজেকে খানিক ব্যস্ত রাখা যায়। কিন্তু কিছুই যে ইচ্ছে করছে না। যা বিশ্রী এক গা গুলোনো ভাব চলছে সারাক্ষণ। সঙ্গে তলপেটে একটা হালকা চিনচিনে ব্যথা। ঝোঁকের মাথায় এখানে চলে এসেছে আজ, না এলেই কি ভাল হত?

লাউঞ্জের বড় টিভিতে অ্যানিমাল প্ল্যানেট। একটা বাঘ হরিণ শিকার করছে। দৃশ্যটা বড় বড় চোখে দেখছে বনানী। পাশে শুভ্রা, ঢুলছে। দেবরাজ উঠে কোথায় যেন গিয়েছিল, ফিরে বসল চেয়ারে। নিজের মনেই বলে উঠল, “আরও বোধহয় ঘণ্টা দেড়েক লাগবে।”

বনানীর চোখ সরল টিভি থেকে। ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “এবার একটু বেশি দেরি হচ্ছে না?”

“দেখলি না, দাদার ভেইন পেতে কত ঝামেলা হচ্ছিল? শেষমেশ তো বেবি চ্যানেল করতে হল। ফ্লুয়িড খুব স্লো যাচ্ছে।”

“কোনও মানে হয়? ভেবেছিলাম ছ’টার মধ্যে ফিরতে পারলে হয়তো কাজের মেয়েটাকে ধরা যাবে, নইলে সেই আবার রাতের রুটি কিনতে ছোটো… টাবলু তো আবার দোকানের এমনি রুটি মুখে তুলতে চায় না, তার জন্য নিতে হবে রুমালি… এদিকে বৃষ্টির যা বহর দেখছি, রুটির দোকানটা আজ খুললে হয়। আমাকেই বোধহয় গিয়ে চাকি-বেলুন নিয়ে বসতে হবে।”

“উফফ, চিন্তার তো তোর শেষ নেই রে!” দেবরাজ পলকা ঠাট্টা ছুড়ল, “এত ভাবনা মাথায় রাখিস কী করে?”

“তোর মতো উড়ে উড়ে তো বেড়াই না, তাই সাদামাঠা ঘরোয়া চিন্তাই আমাদের মগজে ঘোরে।”

“উঁহু, ঘরোয়া নয়, বল ঘরের। আরও স্পেসিফিকালি বললে, টাবলু। …অত ছেলে ছেলে করিস না বনো, কয়েক বছর পরেই জোর দাগা খাবি। ও একটা চাকরিবাকরি পেলেই দেখবি তোর জন্য একটা খান্ডারনি দাসী কাম মালকিন এনে হাজির করেছে। সে তোকে অ্যাইসান রগড়ানি দেবে…”

ভাই বোনে আলাপচারিতা চলছে লঘু তালে। কানে আসছে বটে আঁচলের, তবে সেভাবে শুনছিল না যেন। এমন এক উদ্বেগে টানটান হয়ে আছে স্নায়ু, মাথাও অসম্ভব ভার, রঙ্গরসিকতা তাকে স্পর্শই করছে না এখন। আজ কি তার বাড়িতে শুয়ে থাকাই উচিত ছিল?

হঠাৎ দেবরাজের আলগা ঠেলা, “অ্যাই আঁচল, তুইও কি ঝিমোচ্ছিস? তোর জেঠির মতো?”

আঁচল নড়ল সামান্য, “কই না তো। জেগেই আছি।”

“তা হলে একটু কথা-টথা বল।”

“তোর হয়েছেটা কী?” বনানী ঈষৎ ঝামরে উঠল, “আসা ইস্তক কেমন জবুথবু মেরে আছিস, ঠোঁটে সারাক্ষণ কুলুপ, দুপুরে ক্যান্টিনে কিছুই মুখে তুললি না…”

“হ্যাঁ রে আঁচল, তোর শরীর-টরির ঠিক আছে তো?”

বাবার নরম জিজ্ঞাসায় একটু বুঝি দুলে গেল আঁচল। অল্প হাসি ফুটিয়ে বলল, “নাথিং টু ওরি। আমাকে নিয়ে তোমরা ভেবো না, প্লিজ।”

“আচ্ছা বাবা আচ্ছা। এবার তোরা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠ তো, সবাই মিলে একটু কফি পেঁদিয়ে আসি।”

“আমি পরে খাব। তোমরা জেঠিকে নিয়ে যাও।”

কয়েক পা গিয়েও কী ভেবে যেন ঘুরেছে দেবরাজ। একদৃষ্টে দেখছে আঁচলকে। ভারী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, যেন আঁচলের ভিতরটা পর্যন্ত পড়ে নিতে চায়।

আঁচল অস্বচ্ছন্দ স্বরে জিজ্ঞেস করল, “কিছু বলবে?”

“একা বসে থাকবি? সঙ্গে এলে পারতিস।”

“আমি ঠিক আছি বাবা। তোমরা যাও।”

আরও এক লহমা দাঁড়িয়ে থেকে পা চালাল দেবরাজ। তিনজন চোখের আড়াল হতে আঁচল যেন একটু স্বস্তি বোধ করল। সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তার পাহাড়টাও যেন ঝাঁপিয়ে এসেছে মাথায়। কী চলছে এখন শরীরের ভিতর? সে আছে, না গেছে?

গত কয়েকটা দিন কী যে দ্বিধাদ্বন্দ্বে কেটেছে আঁচলের। ইন্টারনেট ঘেঁটে গর্ভনাশের ওষুধের নাম তো বেরোল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে অজস্র সতর্কবার্তাও দেওয়া আছে যে। যেন কোনও ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্রথম ট্যাবলেটটা খাওয়া হয়। দু’দিন বাদে দ্বিতীয়টি নেওয়ার পর নিয়ম মাফিক ব্লিডিং হয়ে চুকে গেল তো ভাল, কিন্তু যদি কোনওরকম বিপজ্জনক শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়? তখন তো ডাক্তার ছাড়া গতি নেই। হয়তো ভরতিও হতে হবে হাসপাতালে। অর্থাৎ সব গোপনীয়তার দফারফা। বিচ্ছিরি একটা কেলেঙ্কারি ঘটানোর দায়ে সবাই তো তর্জনী ওঠাবে আঁচলের দিকে। আর যাকে ঘৃণা করে আঁচল কাজটা করল, সে হয়তো খুব মজা পাবে তখন।

তা হলে কী কর্তব্য? কোনও একটা অজুহাত খাড়া করে, সবাইকে জানিয়ে, ধাপে ধাপে এগোবে আঁচল? কী বলবে সে? এক্ষুনি বাচ্চা চায় না? কারণ কী দেখাবে? পড়াশোনা? গবেষণা? শাশুড়ি কি মানবেন? অত তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিলেন, জলদি জলদি নাতিনাতনির দেখার বাসনা আছে বলেই না…? আর মা তো মানবেই না। উলটে এমন হাউমাউ জুড়বে, বাধ্য হয়ে তখন হয়তো অভিপ্রায়টি বর্জন করতে হবে আঁচলকে।

সারাক্ষণ এই টানাপোড়েন। ভেবে ভেবে আঁচলের ঘুম উধাও। অবশেষে মরিয়া হয়ে পরশু কলেজফেরতা ঢুকে পড়ল উল্টোডাঙার এক ওষুধের দোকানে। কোনও মতে সাহস সঞ্চয় করে চেয়ে ফেলল ওষুধ দুটো। আশ্চর্য, কলকাতা বলেই, পেয়েও গেল। প্রেসক্রিপশন ছাড়াই। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করে কাল রাতে গিলেও ফেলেছে, প্রথম দফার বড়িখানা।

তারপর থেকে নতুন দোলাচল। কী নিয়ে আঁচল তা বুঝতে পারছে না। লোক জানাজানির আশঙ্কা ঘিরে নয়, এ যেন অন্য কিছু। মাঝে মাঝে কে যেন কানের কাছে বিনবিন করছে, কাজটা বোধহয় ঠিক হল না রে আঁচল। অহর্নিশি যদি এই চলে, কাল সে পরের ওষুধটা খাবে কী করে? ওদিকে এখনও তো ব্লিডিংয়ের চিহ্নমাত্র নেই, সেও তো এক সমস্যা। ওষুধটা কি ধরলই না?

এই সব দুশ্চিন্তা মাথায় আঁচল বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল আজ। প্রথমে ভেবেছিল মায়ের কাছে গেলে হয়। সেখানে নয় শুয়ে থাকবে সারাটা দিন। কিন্তু এমন বুক ঢিপঢিপ শুরু হল আচমকা। মায়ের চোখ রঞ্জনরশ্মিকেও হার মানায়। সপ্তাহের মধ্যিখানে এমনি এমনি মেয়ে গড়িয়ায় বেড়াতে এল, মা বিশ্বাসই করবে না। এবং যতই আঁচল স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করুক, মা ঠিক আন্দাজ করবে কিছু একটা ঘটেছে। জেরায় জেরায় অস্থির করে তুলবে আঁচলকে। ভাগ্যিস তখন মনে পড়ল, জেঠুর আজ কেমোথেরাপি। বাবা তো সেখানে আসবেই, বাবার সান্নিধ্যে সময়টা কাটালে হৃদয়ের উচাটন ভাব হয়তো বা খানিক বশ মানতেও পারে।

কিন্তু এখানে এসেও কি লাভ হল কিছু? এলোমেলো কথা বলে একটু হালকা হবে… পারছে কী? সেই এক চিন্তা মাকড়সার জাল বুনে চলেছে মাথায়। গোদের ওপর বিষফোড়া, শরীরে একগাদা বিশ্রী অস্বস্তি। কী যে সংকটে পড়ল আঁচল!

ভ্যানিটিব্যাগে মোবাইলের ডাকাডাকি। আঁচল চমকে ব্যাগের চেন খুলল। কে ফোন করে এখন? কলেজের কেউ? পিয়ালী কিংবা সুচরিতা? সদ্য শুরু হওয়া সেশনে না জানিয়ে ডুব মেরেছে বলে খোঁজ? নাকি অম্বরদা? উদ্ভট উদ্ভট টাইমে অম্বরদাই ফোন করে কিনা। হয়তো বৃষ্টি দেখে তার চিত্তে কোনও ভাব জেগেছে…

উঁহু। অলি! গলা স্বাভাবিক রেখে আঁচল বলল, “কী রে, তুই এখন?”

“তোর কলেজের ওদিকে বৃষ্টি হচ্ছে?”

“বলতে পারব না। আমি আজ কলেজ যাইনি।”

“বাংক? আকাশ মেঘলা দেখেই? খিচুড়ি-টিচুড়ি খেয়ে খুব ঘুম দিলি বুঝি দুপুরে?”

“আমি বাড়িতে নেই। হসপিটালে। জেঠুর কেমো চলছে।”

“ও। অলি একটুক্ষণ নীরব। তারপর বলল, আর কে কে আছে?”

“পিসি, জেঠি…। বাবাও।”

“নির্বাণদা নেই?”

“নাহ। সে কেন আসবে?”

“যাবে নাই বা কেন? বউয়ের জেঠুর অসুখ, নতুন জামাইয়ের কোনও কর্তব্য নেই?”

“আহ, ফালতু কথা ছাড় তো। ফোন করছিস কেন তাই বল।”

“এমনিই। পড়তে পড়তে বোর হয়ে যাচ্ছি, তাই ভাবলাম তোকে একটু জ্বালাই…।” আবার একটু চুপ থেকে অলি বলল, “একটা কথা তোকে না বলে পারছি না দিদিভাই। তুই কিন্তু নির্বাণদাকে বড় বেশি আশকারা দিচ্ছিস।”

“মানে?”

“ওকে তুই বড্ড ছাড়া গরু করে রেখেছিস। তোদের বিয়ে হয়েছে তো মাত্র ক’মাস… তোর তো উচিত সর্বত্র ওকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া।”

ভিতরের তীব্র বিক্ষোভটা প্রায় আছড়ে পড়ছিল, কোনও মতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আঁচল বলল, “বেশি পাকামি করিস না তো। সে কী কচি খোকা, যে আমার হাত ধরে ঘুরবে?”

“বিয়ের পর প্রথম প্রথম বর-বউ কিন্তু সেভাবেই ঘোরে দিদিভাই। ভেবে দ্যাখ, বিয়ের পর তুই কত বার এ বাড়ি এলি, অথচ নির্বাণদা অষ্টমঙ্গলার পর আর এদিকের ছায়াই মাড়াল না।”

“আশ্চর্য, তার নিজের কাজ থাকতে পারে না?”

“কী জানি, সুন্দরী নতুন বউয়ের গা ঘেঁষে থাকা ছাড়া এই সময়ে বরদের আর কোনও কাজ থাকে কী?”

“আবার ইয়ার্কি? অফিস ছেড়ে সে এখানে বসে থাকবে?”

“অসুবিধের কী আছে? অফিসে সে এমন কিছু রাজকার্য করে না। ফাঁকা রুমে বসে বসে তো ঢোলে। বিয়ের আগে অম্বরদা স্বচক্ষে দেখে এসেছে।”

“আর অফিস থেকে এমনি এমনি মাইনে দেয়? বাজে বকিস না তো। …সোমবার থেকে তোর পরীক্ষা না?”

“হ্যাঁ।”

“পড় পড়। অন্যের পিছনে না লেগে বইখাতায় মন বসা।”

“ও, আমার কথা পছন্দ হচ্ছে না তো? দেখিস পরে না পস্তাতে হয়।”

“ফের ডেঁপোমি? আমি ছাড়ছি।”

লাইনটা কেটে দিয়ে আঁচলের মনে হল, অলি যেন আচমকাই তার দাম্পত্য জীবনে বেশি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। গত সাতদিনে অন্তত বার পাঁচেক ফোন করল, প্রতিবারই নানান আলতু-ফালতু প্রশ্ন! নির্বাণদা অফিস গেছে কিনা, কখন ফিরল, তোরা দু’জনে কী নিয়ে গল্প করিস, একসঙ্গে সিনেমা শপিংমল রেস্তোরাঁয় যাস না কেন, উইক-এন্ডে কেন তোকে নিয়ে বেরোয় না নির্বাণদা… আঁচল সেভাবে ধমকাতে পারে না বলে বড্ড বেড়ে যাচ্ছে অলি। এত বড় স্পর্ধা, সেদিন ফস করে জিজ্ঞেস করে বসল, হ্যাঁরে দিদিভাই নির্বাণদা তোকে আদর-টাদর করে তো? নেহাত চুকলি খেতে আঁচলের মানে বাঁধে, তা ছাড়া অলির বিরুদ্ধে নালিশ করার কথা সে চিন্তাই করতে পারে না, নইলে মাকে বলে কবেই না ওই মেয়েকে সজুত করে দিত আঁচল!

হঠাৎ নির্বাণ সম্পর্কে অলির এত আগ্রহ জন্মাল কেন, তাও তো বোঝা দায়। গলাটাও মাঝে মাঝে বেশ সিরিয়াস শোনায় অলির, সেটাও যেন আঁচলের কেমন অদ্ভুত ঠেকে। এমন নয়তো মা-বাপিই অলিকে লাগিয়েছে। বলেছে কায়দা করে জানতে, আঁচল আর নির্বাণের মধ্যে ঠিকঠাক রসায়ন গড়ে উঠছে কিনা…?

এনকোয়ারি কাউন্টার থেকে একটা ঘোষণা চলছে। কোন এক রোগীর বাড়ির লোকজনকে ডাকছে। নিরাবেগ মহিলাকণ্ঠের হাঁকাহাঁকিতে লাউঞ্জে উপবিষ্ট সকলে পলকে টানটান। আরে, জেঠুর নাম করছে না! হ্যাঁ, তাই…! ভাবনা ফেলে আঁচল দৌড়ে গেল কাউন্টারে। নার্ভাস গলায় মেয়েটিকে বলল, “আমি দেবপ্রিয়বাবুর রিলেটিভ। কী হয়েছে ওঁর?”

“আপনি একা?”

“না, অনেকে আছেন। কেন?”

“কেমোথেরাপি চলাকালীন পেশেন্টের কিছু কমপ্লিকেশন দেখা দিয়েছে। আপনারা কেউ একজন গিয়ে ডক্টর নন্দীর সঙ্গে মিট করুন। ইমিডিয়েটলি।”

আঁচল মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ়, তারপরই পা চালিয়েছে কাফেটেরিয়া অভিমুখে। সমাচারটা পেয়েই শুভ্রা কাঁপছে থরথর, বনানীর মুখমন্ডল পলকে ছাইবর্ণ, কফির কাপ অর্ধসমাপ্ত রেখেই দৌড়োল দেবরাজ।

পিসি-জেঠিকে নিয়ে লাউঞ্জে ফিরল আঁচল। প্রতিটি সেকেন্ড যেন এখন দিনের চেয়েও দীর্ঘ। শুভ্রা তো বটেই, বনানীও টুঁ শব্দটি করছে না। যেন জলের নীচে শ্বাস বন্ধ করে ডুবে আছে দু’জনে, ভাল খবর এলে তবেই বুঝি ভেসে উঠবে আবার।

মিনিট পনেরো পর ফিরেছে দেবরাজ। সে কিছু বলার আগেই শুভ্রা প্রায় ডুকরে উঠেছে, “আমায় কিছু লুকিয়ো না রাজু। আমি সব সইতে পারব। ও আছে, না নেই?”

“অত ঘাবড়াচ্ছ কেন? দাদা বহাল তবিয়তে আছে, কেমো চলছে, এবার শেষ হবে। তখন গিয়ে দেখো।”

“তা হলে ডাকল কেন? এমনি এমনি?”

“ঠিক তা নয়। একটু সমস্যা হচ্ছে। প্রেশারটা খুব ফ্লাকচুয়েট করছিল, সেটাই ডাক্তারবাবু জানালেন।”

“রক্তচাপ ওঠানামা করা তো খুব খারাপ, তাই না?”

“ভাল তো নয়ই। স্ট্রোকের একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। ইন ফ্যাক্ট ডক্টর নন্দী চাইছেন দাদাকে আই সি ইউ-তে দিতে, যাতে সর্বক্ষণ ফিজিকাল প্যারামিটারগুলো মনিটর করা যায়।”

“তাতে কি স্ট্রোক আটকাবে?”

“সে গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারে বউদি? তবে হ্যাঁ, ওখানে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে ধরা পড়বে। এবং তক্ষুনি ট্রিটমেন্টও চালু হয়ে যাবে।” শুভ্রাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে দেবরাজ বলল, “এটা তো মানতে হবে, দাদার শরীর এখন এক্সট্রিমলি উইক। এক একটা কেমোর ধকলও তো কম নয়। তাই যে কোনও ধরনের অ্যাডভার্স সিচুয়েশন আসতেই পারে। তার মোকাবিলার জন্য তৈরি থাকাও ভীষণ জরুরি।”

শুভ্রা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “কী জানি। আমার তো মনে হয় সবটাই পণ্ডশ্রম হচ্ছে।”

“কী বলছ?”

“ও বাঁচবে না রাজু। এই টানাহেঁচড়ার আর কোনও মানে হয়? কেন যে জলের মতো পয়সা খরচ করছ?”

শুভ্রার কথাটাতে হয়তো বেদনা ছিল, কিন্তু দেবরাজ বেশ বিরক্ত হয়েছে, “আহ বউদি, থামবে? খরচ আবার কী? অসুস্থ মানুষের চিকিত্সা হবে না?”

‘তবু এ তো অপচয় রাজু। স্রেফ ভস্মে ঘি ঢালা। এত জ্বালাপোড়ার কষ্টের চাইতে নিজের বিছানায় শান্তিতে চলে যাওয়া ঢের ঢের ভাল।”

“খবরদার। দেবরাজের গলা চড়েছে, একদম ওসব কথা বলবে না। দাদা যতক্ষণ বেঁচে আছে, ততক্ষণ বেঁচেই আছে। সেই অবস্থায় তাকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়া মানে সজ্ঞানে মেরে ফেলা। সে তো এক ধরনের খুন।”

“এ তোমার জেদের কথা। নিজেও জানো তোমার দাদার শরীরে আর লড়বার ক্ষমতা নেই। এক্ষুনি এক্ষুনি মরলে সে বেঁচে যাবে।”

“আবার? আবার ওই কথা? স্থানকাল ভুলে দেবরাজ চেঁচিয়ে উঠল, তুমি যা খুশি চাইতে পারো, কিন্তু দেবরাজ সিংহরায় অত সহজে দাদাকে মরতে দেবে না। আই উইল ফাইট টিল হিজ লাস্ট ব্রেথ। যমরাজকে আমার সঙ্গে লড়তে হবে, বুঝলে।”

দেবরাজের উত্তেজিত স্বরে অনেকেই ঘুরে তাকাচ্ছে। কোনও গোলমাল হচ্ছে ভেবে এক-দু’জন এগিয়েও এল। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আঁচল মৃদু ধমক দিল দেবরাজকে, “আহ বাবা, সিনক্রিয়েট কোরো না প্লিজ।”

“ওই সব বাজেবাজে কথা চুপচাপ মেনে নেব? কভি নেহি।”

“উফ। চলো তো আমার সঙ্গে। এসো বলছি।”

প্রায় টানতে টানতে দেবরাজকে সরিয়ে আনল আঁচল। ঠেলতে ঠেলতে ফের ক্যাফেটারিয়ায় ঢোকাল। চেয়ারে বসিয়ে বলল, “কুল কুল।”

“আর কুল! দেবরাজ গরগর করছে, মাথায় আমার আগুন জ্বলছে।”

জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে দেবরাজের। অস্থিরভাবে নড়াচড়া করছে দু’ চোখের মণি। বাবার এহেন অগ্নিশর্মা মূর্তি কখনও দেখেনি আঁচল। তার চোখে বাবা এক প্রবল পুরুষ। এবং সেই পুরুষ স্নেহময়, রগুড়ে, আর দরাজদিল। এই ক্রুদ্ধ রূপটা যেন তার সঙ্গে মেলে না কোনও মতে।

বেশ ঘাবড়েছে আঁচল। আবার এই অচেনা দেবরাজকে দেখে একটু যেন মজাও লাগছে। নরম গলায় বলল, “আর একবার কফি খাবে নাকি?”

“বল।”

উঠে কাউন্টারে গিয়ে কফি নিল আঁচল। গা গুলোন ভাব যেন একটু কম এখন, নিজের জন্যও নিল একটা। ফিরে বসেছে বাবার মুখোমুখি। আলগা অনুযোগের সুরে বলল, “হঠাৎ এত খেপে গেলে কেন? জেঠি তো অনেক দুঃখে বলছিল। ওগুলো তো জেঠির মনের কথা নয়।”

“হয়তো। কিন্তু আমি যে ওই ধরনের কথা স্ট্যান্ড করতে পারি না রে।”

“তবু… জেঠি যা বলেছে, সেটা তো খুব প্র্যাকটিকাল থট বাবা। ভেবে দ্যাখো, যদি ফাইট করে জেঠুকে আর কিছুদিন বাঁচিয়ে রাখতেও পারো, সেটা কি একটা বাঁচা? জাস্ট একটা আধা ভেজিটেবল হয়ে শুধু শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়াই কি জীবন? মৃত্যু কি সেখানে বেটার অপশন নয়?”

চমকে তাকাল দেবরাজ, “তুই? তুই এ কথা বলছিস?”

“কেন, ভুল বললাম কিছু?”

দেবরাজ একটুক্ষণ চুপ। তারপর শান্ত স্বরেই বলল, “জানিস তো, সারাটা জীবন একটা জিনিসকেই আমি সব থেকে অপছন্দ করে এসেছি। দিস নেগেটিভ অ্যাটিচিউড টুওয়ার্ডস লাইফ। আগামী কাল কী হবে আমি তার পরোয়া করি না। গতকাল কেমন গেছে, তা নিয়েও আমি মনকে ট্যাক্স করি না। আমি এই মুহূর্তের জন্যেই বাঁচি। তাই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, এই মুহূর্তে যে আছে, সে আছে। দুনিয়ার কোনও লজিক আমায় কনভিন্স করতে পারবে না, সেই থাকার চেয়ে না থাকাটা মোর মিনিংফুল। অপশন কথাটা এখানে খাটেই না। অ্যাম আই ক্লিয়ার?”

“হ্যাঁ… কিন্তু… জেঠুর ক্ষেত্রে…”

“শুধু জেঠু কেন, আমার কাছে দিস ইজ ট্রু ফর এভরি ওয়ান, এভরি হোয়্যার। একটা অঙ্কুরিত প্রাণ থেকে জীবনের শেষ নিশ্বাস পড়া পর্যন্ত পুরো চক্রটাই মানুষের বেঁচে থাকা। তার মধ্যে কেউ যদি কোনও সময়ে প্রচণ্ড কষ্ট পায়, সেটাও তার বাঁচারই অংশ। তাকে সেটা নিতে হবে। সইতে হবে।”

আঁচল ভিতরে ভিতরে কেঁপে গেল। অস্ফুটে বলতে চাইল কী যেন, শব্দ বেরোল না।

দেবরাজ চুমুক দিল কফিতে। হাসছে অল্প অল্প। তার জ্বলজ্বলে মুখখানায় আর রাগের চিহ্নমাত্র নেই। হালকা গলায় বলল, “এই প্রিন্সিপলে অটল না থাকলে আমার এই মিষ্টি মেয়েটাকেও পেতাম নাকি?”

“মানে?”

“তুই এখন অ্যাডাল্ট হয়েছিস, শাদিসুদা লেড়কি… তোকে এখন বলাই যায়। তোর মা যখন তোকে কনসিভ করল, তখনই আমাদের সম্পর্কটা খারাপের দিকে এগোচ্ছে। দোষ অবশ্য সম্পূর্ণই আমার। কারণ তখন আমি যে বেসামাল লাইফটা লিড করতাম, কোনও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মহিলার পক্ষে সেটা মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। সম্পর্কটা যে কোনওদিন ভেঙে যেতে পারে এই ভেবে তোর মা বলেছিল বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে যাওয়াই ভাল। তখন তাকে কীভাবে যে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠান্ডা করেছিলাম, সে আমিই জানি। দেবরাজ হাত ছড়িয়ে বলল, “তোর মা আমার রিকোয়েস্টটা মানল। কিন্তু আমি কত বড় শয়তান ভাব, সেই তোকে ফেলে রেখে দিব্যি পগার পার। তবু…”

আঁচল জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। দেবরাজ নিজের মনেই বলে চলেছে, “তবু তোকে যখন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, মনে হয় আমার বিশ্বাসটা ভুল নয়। একটা প্রাণকে যে কোনও মূল্যেই হোক টিকিয়ে রাখা.. সে আমার মরণাপন্ন দাদাই হোক, কি মানসীর পেটের তুই…”

আঁচলের কান বুজে আসছিল। আরও কত কী বলছে দেবরাজ, শুনতে পাচ্ছে না। মাথার ভিতরে কে যেন হাতুড়ি পেটাচ্ছে। নিজে প্রায় অনস্তিত্ব হতে হতেও একটা অস্তিত্বে পরিণত হয়েছে, জগতের রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ ছুঁয়ে ছেনে উপভোগ করছে…। কষ্ট পাচ্ছে অনেক, আনন্দও তো মিলেছে। মা-বাবা-বাপি-অলি, আরও কতজনের ভালবাসা পেয়েছে আঁচল। সে তো আঁচল পৃথিবীতে আসার সুযোগ পেয়েছে বলেই না। একটা মানুষের ওপর বিতৃষ্ণার কারণে আর একটা সদ্য আগত প্রাণকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবে আঁচল? চরম অন্যায় হবে না কী?

কিন্তু যে ভুলটা আঁচল করে ফেলেছে…! কী হবে এখন? কী হবে?

জেঠুকে দেখে হাসপাতাল থেকে বেরোতে বেরোতে সন্ধে। তখনও বৃষ্টি পড়ছে টিপটিপ। দেবরাজ তাকে নামিয়ে দিতে চাইছিল, রাজি হল না আঁচল। সে এখন একা হতে চায়। নিজের মুখোমুখি।

বাড়ি ফিরে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে ছিল আঁচল। মাথায় যেন এক উথাল-পাথাল তরী। ঘাটে ভেড়াতে পারছে না কিছুতেই।

নির্বাণ ফিরল আটটা নাগাদ। আলো জ্বেলেছে ঘরের। শায়িত আঁচলকে দেখতে দেখতে বলল, “শরীর খারাপ নাকি?”

আঁচল জবাব দিল না।

নির্বাণ আবার বলল, “ট্যাবলেট-ফ্যাবলেট কিছু খেয়েছ?”

এবারও আঁচল নীরব।

একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নির্বাণ চলে গেল ঘর থেকে। বোধহয় টিভি খুলবে।

কী অদ্ভুত মানুষ। নাকি পশু? বাবা কি এর চেয়েও খারাপ লোক ছিল? আরও বেশি হৃদয়হীন ব্যবহার করত মায়ের সঙ্গে।

আঁচল ভিতর থেকে চমকে উঠল। সে কি এখনও নিজের কাজের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছে? নতুন ঝুঁকিটা নিতে এখনও দ্বিধা?

নাহ, আর না। বিছানা ছেড়ে নামল আঁচল। দৃঢ় পায়ে এসেছে বিদিশার দরজায়। বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিল বিদিশা। নিচু গলায়। আঁচলকে দেখে বিদিশা বুঝি একটু থমকাল। ফোনে হাত চাপা দিয়ে বলল, “কিছু বলবে?”

“আপনার সঙ্গে একটা দরকার ছিল।”

“এক সেকেন্ড।” বাক্যালাপ দ্রুত শেষ করে মোবাইল কোলে রাখল বিদিশা, “হ্যাঁ বলো। কোনও বই-টই আনাতে হবে কলেজ স্ট্রিট থেকে? মণিদাকে খবর দেব?”

“না। অন্য কথা।” আঁচল স্পষ্ট স্বরে বলল, “আমি বোধহয় মা হতে চলেছি।”

এক-দু’ সেকেন্ড বুঝি সময় লাগল কথাটা হৃদয়ঙ্গম করতে। তারপরই বিদিশার মুখ ভরে গেছে হাসিতে, “ওমা, তাই? তোমার মাকে বলেছ?”

“না। আপনিই প্রথম। একটু সময় নিয়ে আঁচল বলল, আরেকটা কথা ছিল।”

“কী?”

“আমার কিছু সমস্যা হচ্ছে। কালই আমি ডাক্তার দেখাতে চাই। একা।”

আঁচলের শেষ শব্দটা ক্ষণিক ভাসল বাতাসে। বিদিশার ভুরু কি জড়ো হল সহসা? প্রশ্নচিহ্ন আঁকছে? গ্রাহ্য করল না আঁচল।

২৮

শ্রাবণ প্রায় ফুরিয়ে এল। এ বছর আষাঢ় মাসটারই মতিগতির কোনও স্থিরতা ছিল না। কোনওদিন হয়তো ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ দু’-এক পশলা ঝরিয়ে থেমে গেল, কখনও বা এমন ঝমঝমিয়ে নামল, এক-দু’ ঘণ্টার বর্ষণেই শহর জল থই থই। আবার হয়তো পাঁচ-সাতদিন দিব্যি ঝলমল করছেন সূর্যদেব, কড়া তাপ আর ভ্যাপসা গুমোটে শহরবাসীর ত্রাহি-ত্রাহি দশা। শ্রাবণের শুরু থেকে অবশ্য আবির্ভূত হল আসল বর্ষা ঋতু। সকাল বিকেল রাত্রি পৃথক করা যায় না, গোটা দিনটাই কেমন ধূসর হয়ে থাকে। আর সারাদিন কখনও রিমঝিম, কখনও ঝমাঝম, চলছে তো চলছেই। অবশেষে গত হপ্তাখানেক মোটামুটি ধরেছে বৃষ্টিটা। কাল পরশু একটি ফোঁটাও পড়েনি, আজও সকাল থেকে আকাশ প্রায় মেঘহীন। নীলাভ গগনে যেন শরতের পলকা ইশারা।

এমন এক সোনালি রোদে ভরা দিনে মন যেন আপনাআপনি প্রসন্ন হয়ে যায়। পথেঘাটে ভিখিরি দেখলে পকেটে হাত ঢোকাতে ইচ্ছে করে, বাসেট্রামে কেউ পা মাড়ালে দুম করে মুখে খিস্তি উঠে আসে না, কষ্টেসৃষ্টে বেঁচে থাকাও ভারী সার্থক বলে বিভ্রম জাগে।

অথচ এমন দিনেও কিনা নির্বাণের মনে এতটুকু শান্তি নেই! অফিসে নিজস্ব নিরালা কোণটিতেও সুস্থির বসতে পারছে না দু’ দণ্ড। এই ছুটল টয়লেটে, তো এই গিয়ে দাঁড়াচ্ছে করিডরের প্রান্তে। ঝকঝকে আকাশে দৃষ্টি পড়লেই দীর্ঘশ্বাস গড়িয়ে আসছে বুক থেকে। যেন সে এই সুন্দর পৃথিবী থেকে নির্বাসিত এখন।

আর চেয়ারে গিয়ে বসলেই ওমনি বিদিশার মুখ। সে তো আরও ভয়ংকর। উফ, কী ফ্যাসাদে যে পড়ল নির্বাণ!

কাল রাতে দোতলার ড্রয়িংহলে আধশোয়া হয়ে নির্বাণ রোজকার মতোই টিভি দেখছিল। সলমন খানের ছবি। উদ্দাম প্রেম, দারুণ ঝাড়পিট… বেশ ভোঁ মেরে যাচ্ছিল মেজাজ। আচমকা মাতৃদেবীর প্রবেশ। মুখে যথারীতি ছিছিক্কার, “কী কুত্সিত রুচি! এমন একটা কালচারড শিক্ষিত বউ এল, তবু তোর টেস্ট বদলাল না?”

নির্বাণ ধড়মড়িয়ে টানটান। পলকে রিমোট টিপে টিভিও বন্ধ। নিরীহ মুখে বলেছিল, “তুমি এখনও শোওনি?”

“আমারও তো সেটাই প্রশ্ন। এখনও শুতে যাসনি?”

“এই যাব। উঠব উঠব করছিলাম।”

“তোর আক্কেলটা কবে হবে, অ্যাঁ?” বিদিশার গলায় হঠাৎই কেমন অচেনা সুর। ভর্ত্সনাও যেন স্নেহমাখা, অনুযোগ মেশানো। নির্বাণকে অবাক করে সোফায় বসে পড়েছিল বিদিশা। ঠিক ছেলের পাশটিতে। গলার পরদা নামিয়ে বলেছিল, “এই সময়ে বউরা তো কিছু এক্সপেক্ট করে। বরকে একটু কাছাকাছি থাকতে হয়।”

কথাটা নির্বাণের মাথাতেই ঢোকেনি। অস্ফুটে বলল, “এই সময়ে? মানে?”

“শরীরের এই অবস্থায়।”

“কেন? কী হয়েছে ওর?”

“আশ্চর্য, তুমি জিজ্ঞেস করছ?” বিদিশার চোখে লঘু ধমক, “বলতে চাও আঁচল তোমায় কিছুই জানায়নি?”

মায়ের কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছিল না নির্বাণ। আঁচলের সঙ্গে তার যে বাক্যালাপ প্রায় নেই বললেই চলে, এ কি মাতৃদেবীকে বলা যায়? কোনও সিরিয়াস অসুখটসুখ বাঁধিয়েছে নাকি আঁচল? নির্বাণ অবশ্য সেভাবে খেয়ালও করেনি। মহুয়ার সঙ্গে সম্পর্কটা ফের জুড়ে যাওয়ার পর আর তো সে আঁচলের দিকে ঘেঁষেই না। আর আঁচল যে নিজে থেকে তার সমস্যার কথা নির্বাণকে জানাবে, এও তো প্রায় অসম্ভব। যা ঢ্যাঁটা মেয়ে।

নির্বাণ আমতা আমতা করে বলল, “না সেভাবে তো তেমন কিছু…”

বিস্ময় ঠিকরোচ্ছিল বিদিশার চোখে। একটু যেন থমকেও রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর স্বভাবসিদ্ধ তীব্র স্বরে বলল, “স্টেঞ্জ! সে না হয় লজ্জায় সংকোচে ব্যাপারটা ঘোষণা করেনি। কিন্তু তোমার কি চোখ নেই? কিছুই কি দেখতে পাও না? গত দেড় মাসে সে না হোক বার পাঁচ-ছয় ডাক্তারের কাছে ছুটল… নেট পরীক্ষায় বসল না… কিচ্ছু খাচ্ছে না.. সারাক্ষণ তার গা গুলোয়… দিনে কতবার বমি করে তার ঠিক নেই… কিচ্ছু তোমার নজরে পড়েনি? কোন জগতে তুমি থাকো, অ্যাঁ?”

নির্বাণ ঢোক গিলল। তখন এও মনে পড়ল, পরশু না তার আগের দিন, কবে যেন রাতে খেয়ে এসে আঁচল আচমকা ঢুকে গেল বাথরুমে, তখন ওয়াক ওয়াকও করছিল বটে। তারপর তো নির্বাণ জিজ্ঞেসও করল, আঁচলের কোনও ওষুধ-টষুধ লাগবে কী না…। জবাব না দিয়েই তো আঁচল চলে গেল শয্যায়। কেউ যদি ইচ্ছে করে গুমোর দেখিয়ে অসুস্থ থাকতে চায়, নির্বাণের কী করার আছে। এ তো তাকে জব্দ করার চেষ্টা। মাতৃদেবীর চোখে নির্বাণকে আরও হেয় করার চাল।

আঁচলের এত কিছু উপসর্গ শুনেও কেন যে দুর্ঘটনাটি ঠাহর করতে পারেনি নির্বাণ? মানসিক কোনও প্রস্তুতি ছিল না বলেই কি বুরবকের মতো নানান উলটোসিধে ভাবছিল তখন?

ক্ষণিক নির্বাক নির্বাণকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বিদিশা ফের বলেছিল, “ভাবতে লজ্জা করে তুমি বিদিশা চৌধুরীর ছেলে। আর সেই তুমি কিনা বাবা হতে চলেছ!”

তখনও ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারেনি নির্বাণ। ভ্যাবলার মতো তাকিয়েছিল, “মানে?”

“ন্যাকামোর একটা লিমিট আছে। বাবা হওয়ার মানে বোঝো না? আঁচল ইজ ক্যারিইং।”

এবার পুরো জট পাকিয়ে গেল মগজ। নির্বাণ বাকরুদ্ধ। মহুয়ার সঙ্গে চমৎকার কাটিয়েছিল সন্ধেটা, তার রেশ তখনও বুঝি লেগে ছিল মনে। এক ঝটকায় ঘেঁটে গেল সব কিছু।

আবার বিদিশার স্বর ধাক্কা মেরেছিল নির্বাণের শ্রবণযন্ত্রে, অনিমা বলছিল তুমি নাকি এখনও অফিস থেকে দেরি করে ফেরো? করো কী সন্ধেবেলায়, অ্যাঁ?

অচল মস্তিষ্ক ফুঁড়ে আলটপকা মিথ্যে বেরিয়ে এসেছিল, “একটা কম্পিউটার কোর্সে জয়েন করেছি।”

“হঠাৎ?”

“এমনিই। শেখার ইচ্ছে হল।”

“তা ভাল। একটু যেন হালকাভাবে বলল বিদিশা, আঁচলের হাওয়া তোমার গায়ে লেগেছে তা হলে।”

নির্বাণ নিরুত্তর। তাকে আরও চমকে দিয়ে কাঁধে বিদিশার হাত। মৃদু চাপ দিয়ে বলল, “বি সেন্সেবল বান্টি। বুঝতেই পারছ, তুমি আর কচি খোকা থাকছ না, এবার তোমায় দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারটা শিখতে হবে।”

নির্বাণ কি ঘাড় নেড়েছিল? মনে নেই নির্বাণের।

“আর হ্যাঁ, কম্পিউটার কোর্সটা আপাতত পোস্টপন্ড রাখো। আঁচলকে আর একটু কম্প্যানি দাও। ডোন্ট অ্যাক্ট লাইক ইওর ওয়ার্থলেস ড্যাড। এই সময়ে হাজ়ব্যান্ডের সঙ্গ না পেলে মেয়েদের মনে নানা ধরনের ক্ষত তৈরি হয়। আমি চাই না আঁচলের তেমন কিছু ঘটুক। দেখতেই পাচ্ছ, ভিসির চার্জ নিয়ে আমি এখন হাজারো প্রবলেমে জড়িয়ে আছি। সংসারের দিকে তাকাতেই পারছি না। আশা করব তুমি এই সময়টায় আঁচলের টোটাল দেখভালটা করবে। বুঝেছ?”

উঁহু, কিচ্ছু বোঝেনি নির্বাণ। বিদিশা চলে যাওয়ার পরও যে নির্বাণের মগজে গিঁটের পর গিঁট। মাথা পুরো থানইট। মাঝে মাঝেই ধড়াস ধড়াস করে উঠছিল হৃত্পিণ্ড। চিনচিনে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছিল শিরদাঁড়া বেয়ে। এ কী ঝঞ্ছাটে ফেঁসে গেল সে? কত সাধ্যসাধনার পর মহুয়াকে সে আবার গলিয়েছে, এখন কী ভবিষ্যৎ হবে সেই সম্পর্কটার? যা সে এঁচে রেখেছিল তার তো দফারফা। এই আঁচলকে নিয়েই কি তাকে…?

নেশাগ্রস্তের মতো টলতে টলতে উঠেছিল নির্বাণ। শোওয়ার ঘরে এসে দেখল, আঁচল ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। পাশ ফিরে। রাতবাতির আলোয় ঈষৎ রহস্যময় ওই মনোলোভা নারীদেহ তাকে বিন্দুমাত্র টানছিল না। উলটে এক চরম বিতৃষ্ণায় রি রি করছিল সর্বাঙ্গ। কী বজ্জাত মেয়ে! নির্বাণ তো দূরে দূরেই থাকছিল, তাকে খেপিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে নিল? আর নির্বাণও কিনা উদোমাদার মতো… কী গোক্ষুরি, কী গোক্ষুরি। সুতো এখন লোহার শিকল, আর কি ছিঁড়তে পারবে সে?

পলকের জন্য নির্বাণের মনে হয়েছিল, হ্যাঁচকা মেরে ওই মেয়েকে টেনে তোলে ঘুম থেকে। চুলের মুঠি ধরে আছড়ায় ঘরের মেঝেতে। তাতে যদি ফাঁসিকাঠে ঝুলতে হয়, সেও ভি আচ্ছা। অন্তত মহুয়া তো বুঝবে তার নির্বাণ একটা ঝুটা আদমি নয়।

কিন্তু ওই ভাবাই সার। তেমন কিছু ঘটানোর সাধ্য কই নির্বাণের? থাকলে কি আজ এই অপরাহ্ন ছুঁইছুঁই বেলায়, নিজের অফিসঘরের কোণটিতে ঘাড়ঝোলা আধমরা শালিখ পাখির মতো বসে আপন মনে গুমরিয়ে চলে এখনও?

দরজা ঠেলে ঢুকল কে যেন। নির্বাণ অতি কষ্টে তুলল চোখ। প্রসাদ, হাতে চায়ের কেটলি।

“খাবেন তো স্যার?”

“ইচ্ছে করছে না। …আচ্ছা, দাও।”

“আপনার টিফিন তো এখনও পড়ে।”

ঠান্ডা ঘুগনি আর নেতানো টোস্টের দিকে তাকাল নির্বাণ। ভাঙাচোরা গলায় বলল, “নিয়ে যাও।”

“ও কী হবে এখন?”

“নর্দমায় ফেলে দাও।”

এ দফতরের নানাবিধ চিড়িয়া দেখে বহুকাল আগেই বিস্ময়বোধ মরে গেছে প্রসাদের। তবু প্লেটখানা তুলে নিতে নিতে আড়চোখে নির্বাণকে দেখল একবার।

নির্বাণ চুমুক দিল কাপে। ওফ, কী বিস্বাদ কী বিস্বাদ। জীবনটাই যার পানসে মেরে গেছে, এই চিনিগোলা পানীয়টি সে গেলে কী করে!

চা সরিয়ে রাখল নির্বাণ। ওহ, কী যে সে করে এখন? মহুয়ার কাছে যাওয়ার জন্যে মন ছটফট করছে, উচিত হবে কী? কিন্তু টানাপোড়েন যে কিছুতেই যায় না। মহুয়াকে সে কত কষ্টে বুঝিয়েছে, আঁচলের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক হয়নি… এখন কোন মুখে সে দাঁড়াবে মহুয়ার সামনে? অবশ্য আঁচলের প্রেগনেন্সির ব্যাপারটা পুরো চেপে যাওয়া যায়… কিন্তু কদ্দিন? বাচ্চা তো পেট থেকে বেরোবেই, তখন কী হবে? যদি এখুনি নিজের অপরাধ কবুল করে পায়ে পড়ে যায় মহুয়ার? মহাভারতের কত মুনিঋষি তো অপ্সরাদের দেখে ইয়ে করে ফেলত। সেখানে নির্বাণ তো এক সামান্য মানুষ, তার মতিভ্রম হতে পারে না? কিংবা আঁচলকেই যদি আসামীর কাঠগড়ায় তুলে দেয়? বলবে তাকে আঁচল এমন সিডিউস করেছিল, সে মাথার ঠিক রাখতে পারেনি? আর কথাটা তো পুরোপুরি মিথ্যে নয়। নির্বাণকে অপমান করে তাতিয়ে দেওয়া সিডাকশন ছাড়া আর কী? সে কি এমনি এমনি বারবার হামলেছে আঁচলের ওপর? উপেক্ষা অবহেলা তাচ্ছিল্য, সব কিছুরই তো একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, ঠিক কী না?

যতই যুক্তিজাল বিছোক, নির্বাণ তবু যেন জোর পাচ্ছে না। নিজের ভাবনার অসারত্ব টের পাচ্ছে বলেই কি? মহুয়ার তোড়ের মুখে পড়লে তার একটি কারণও যে টিকবে না, বুঝতে পেরেই কি ত্রস্ত হয়ে পড়েছে নির্বাণ?

নাহ, এভাবে গুটিয়ে থাকলে চলবে না। এড়াতে তো পারবে না, মুখোমুখি হতেই হবে মহুয়ার। আজ, নয় তো কাল। তা হলে আজই নয় কেন? সন্ধে সন্ধে বাড়ি ফেরা নয় পিছিয়ে যাক এক দিন। অবশ্য মায়ের নির্দেশ সে অগ্রাহ্য করতেই পারে। কিন্তু… কিন্তু…

আরও দু’-চার মিনিট বসে থেকে উঠেই পড়ল নির্বাণ। দরজা ঠেলে বেরিয়েছে, সামনে বড়বাবু। বছর পঞ্চান্নর শুঁটকোমতো লোকটা মোলায়েম গলায় জিজ্ঞেস করল, “চললেন নাকি স্যার?”

“হ্যাঁ… মানে একটা জরুরি কাজ ছিল…”

“আপনি তো স্যার ব্যস্ত মানুষ, দরকারি কাজ তো আপনার থাকবেই।”

এরকম টিপ্পনি নির্বাণের গা সওয়া। এই অফিসে তার নিজের অবস্থান আর ওজন, দুটোই যে বায়বীয় তা জানে নির্বাণ। তাই বিশেষ গায়ে মাখে না কথাগুলো। ফ্যাকাশে হেসে নির্বাণ বলল, “কিছু প্রয়োজন আছে?”

“হাউজ়িং ডিপার্টমেন্ট কয়েকটা কোয়্যারি করেছিল, রিপ্লাইটা যদি একবার দেখে নিতেন…।” লোকটার হলদেটে দাঁত বেরিয়ে গেল, “থাক, তাড়া নেই কোনও। আজও যা, কালও তা। আর যদি অনুমতি করেন তো এ-পি-আর-ও সাহেবকে দিয়েই সই করিয়ে পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

“আমি তো কখনও অবজেকশন দিই না। যা ভাল বোঝেন তাই করুন।”

বলেই লোকটাকে পেরিয়ে এল নির্বাণ। লিফট অবধি যাওয়া পর্যন্ত ভুলেও আর তাকাল না পিছন পানে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে লোকটা… দেখে লাভ আছে কোনও?

আহা রে, নির্বাণ যদি এই অপমানের পরিবেশটা ছাড়তে পারত! যেখানে তাকে পুরোপুরি অপদার্থ ভাববে না, এমন কোথাও একটা চাকরি যদি সে জোগাড় করতে পারত নিজ গুণে! যদি বা একেবারে ছোটমোটো কিছু জোটাতেও পারে, সেই তনখায় মহুয়া বাবদ খরচ সামাল দিতে পারবে কি? সুতরাং চোখ কান চামড়া, এই তিনটে ইন্দ্রিয়কে তো অবশ করে রাখতেই হয়।

নীচে নেমে নির্বাণ খানিকটা স্বচ্ছন্দ বোধ করল। খোলা হাওয়ায় একটু যেন বাড়তি অক্সিজেন। গেটের মুখে এসে ভাবল ক্ষণেক। বাস ধরবে, না অটো? বাস থেকে নেমে বেশ খানিক হাঁটতে হয়, এদিকে অটোতে এখন জায়গা পাওয়া মুশকিল। দুম করে একটা ট্যাক্সিই নিয়ে ফেলল। আনসান মানুষের সঙ্গ ভাল লাগছে না। তা ছাড়া মনকে তৈরি করার জন্য এখন একটু একা থাকা দরকার।

নির্বাণ হেলান দিল সিটে। চোখ বুজতেই মহুয়া। আঁচলের মতো রূপসি না হোক, মুখখানা কী মিষ্টি। মনকাড়া। চোখের কালো মণিদুটো যেন তির হানছে সদাই। যখন ভেজা ভেজা ঠোঁট দু’খানা ছড়িয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলে, নির্বাণের তো মনে হয় তার জন্যই মহুয়া সৃষ্টি হয়েছিল। ওই মেয়ে নির্বাণের থেকে প্রায় ছিটকে যাচ্ছিল, ভাবা যায়!

হনিমুন থেকে ফিরে বেশ কয়েকদিন দম বন্ধ করে ছিল নির্বাণ। হৃদয়ের গতিপ্রকৃতি ঠাহর করতে চাইছিল। ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, আঁচলের সঙ্গে একটা সম্পর্ক যখন হয়েই গেছে, সেটাকেই মোটামুটি গড়ে তুলবে নাকি? দিন কয়েক অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরল, ঘুরঘুর করল আঁচলের আশেপাশে, হাসিমশকরার চেষ্টা করল একটু-আধটু। কিন্তু আঁচল যেন পাষাণপ্রতিমা। নির্বাণকে মানুষ বলে গণ্যই করে না। উপহাস আর ঘেন্না ছাড়া কিছুই যেন প্রাপ্য নেই নির্বাণের। জোর ফলিয়ে নির্বাণ আদর করল একদিন, সংগমের পর দৃষ্টি দিয়েই আঁচল যেন থুতু ছিটোল মুখে।

ওই ঘেন্নাই কি আবার নির্বাণকে ঠেলে দিল মহুয়ার দরজায়? নাকি সে নিজেই ভিতর থেকে আনচান করছিল মহুয়ার জন্য? কোনটা যে আসল সত্যি, কোনটা যে মনকে চোখ ঠারা, হৃদয় কি তার খবর রাখে পুরোপুরি? কেই বা জানে, বুকের গোপন কুয়োয় কত রঙের মাছ কিলবিল করে দিনরাত!

ফোন ধরছিল না মহুয়া, সরাসরি বাড়ি যাওয়ারও সাহস নেই। নির্বাণ অগত্যা হানা দিয়েছিল তার অফিসে। কলসেন্টারের গেটে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়েছিল নির্বাণ, তাকে দেখামাত্র মহুয়া হাঁটা দিল উলটোদিকে। নির্বাণ দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরল। গলা কাঁপিয়ে, আবেগ মিশিয়ে, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগে এমন তীব্র স্বরে ঝনঝনিয়ে উঠল মহুয়া। সেদিন রাতে আঁচলের শরীরে ক্ষোভের জ্বালা ঝাড়ল নির্বাণ, কিন্তু শান্তি পেল কই!

পরের প্রচেষ্টাতে অবশ্য খানিক নরম হল মহুয়া। ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “কেন আমার পিছনে লেগে আছ বলো তো? কী চাও?”

নির্বাণ মরিয়া হয়ে বলল, “কিছু না। শুধু চাই তুমি আমাকে ভুল বুঝো না।”

“আমি তোমায় ভুল বুঝি, ঠিক বুঝি, তাতে তোমার কী আসে যায়? যাকে বিয়ে করেছ, তাকে নিয়ে এখন সুখে ঘরসংসার করো।”

“সম্ভব নয় মহুয়া। বিশ্বাস করো।” দুম করে একটা ডায়ালগ এসে গিয়েছিল নির্বাণের মুখে, “এ জীবনে নির্বাণ একজনকেই ভালবেসেছে। আর কেউ সেখানে এনট্রিই পাবে না।”

“বটে? বউকে তোমার মনে ধরেনি বুঝি? ভাবভালবাসা করোনি?”

“প্রশ্নই আসে না। মায়ের সম্মান রাখতে অনুষ্ঠানটাই যা করেছি, তার বেশি কিচ্ছু নয়। বিশ্বাস করো। তুমি আমার মনের যেখানে ছিলে, সেখানেই আছ। বিশ্বাস করো।”

কেন যে বারবার বিশ্বাসের কথা বলছিল নির্বাণ? কাকে বিশ্বাস করাতে চাইছিল? মহুয়াকে? না নিজেকে? শব্দবন্ধটি কি কোনওভাবে উজ্জীবিত করছিল নির্বাণকে? মা যে তার বুদ্ধি চিন্তা কর্মের একমাত্র নিয়ন্ত্রক নয়, এই ভাবনায় কি আস্থা জোগাচ্ছিল?

মহুয়ার তবু সংশয় ঘোচেনি। জুলজুল চোখে দেখছিল নির্বাণকে।

আবার নির্বাণই বলেছিল, “কী ভাবছ বলো তো?”

“কিছু না।”

“গুড, কিচ্ছু ভেবো না। …চলো, আমাদের কাফেটায় গিয়ে বসি।”

সেই এক দিনেই নয়, তবে তাড়াতাড়িই সহজ হল সম্পর্ক। অবশ্য তার জন্য নির্বাণের গাঁটগচ্চাও গেল বিস্তর। কন্যের মান ভাঙাতে কত কী যে উপহার দিল নির্বাণ। দামি সানগ্লাস, শৌখিন ব্যাগ, বাহারি মোবাইল, বিদেশি পারফিউম…। মহুয়া পেয়ে খুশি, নির্বাণ দিয়ে ধন্য। পুরনো দিনগুলোও ফিরে এল আবার। এদিকসেদিক বেড়াতে যাচ্ছে দু’জনে। কখনও ডায়মন্ডহারবার তো কখনও গাদিয়াড়া। মহুয়ার শরীরের ওমে নতুন করে তাজা হয়েছে নির্বাণ, কামরসের ঢেউয়ে আবার উপচে উঠছে প্রেমের নদী, সুখের বাতাসে পাল খাটিয়ে দিব্যি ভাসছে।

হঠাৎ এ কী ছন্দপতন! রাতদুপুরে আঁচলকে দুরমুশ করতে গিয়ে কেন যে প্রোটেকশনের ব্যাপারটা মাথায় আসেনি? কই মহুয়ার বেলায় তো কদাচ ভুল হয় না! অসাবধানতার এত বড় শাস্তি!

নিজেকে তুড়ে গালাগাল করল নির্বাণ। এই অসতর্কতার জন্যই না তার পিলে চমকিয়ে দিয়েছিল আঁচলের খিল্লি খাওয়া বোনটা? কি বেপরোয়ার মতোই না মহুয়াকে নিয়ে তখন ক’দিন মলে মলে চক্কর কাটছিল নির্বাণ, হঠাৎ অমন একটা ফোন! ভাগ্যিস হুঁশ খোয়ায়নি তাই কোনও মতে সামাল দিতে পেরেছিল পরিস্থিতি! পরদিন সকালেই অবশ্য আবার কল করেছিল পাকা মেয়েটা। বলে কিনা, জামাইবাবুর সঙ্গে মজা করছিল! এমন ফক্কড়, জানতে চায় নির্বাণ কতখানি ঘাবড়েছে! ঠাটিয়ে চড় কষাতে হয় অমন আহ্লাদী মেয়েকে। যাই হোক, তারপর থেকে আর শপিংমল-ফুডকোর্টের ছায়া মাড়ায়নি যুগলে, একসঙ্গে সিনেমা পর্যন্ত দেখেনি।

কিন্তু এই কেসটার কী হবে? ওরে গাড়ল, তোকে যে পুরো জালে জড়িয়ে ফেলল আঁচল?

বাগুইহাটি এসে গেছে। যানবাহন আর দুপেয়ের বৈকালিক ঠাসাঠাসিতে মোড়টা জিভ বার করে হাঁপাচ্ছে। সিগন্যাল পেরোতেই ঝাড়া পনেরো মিনিট লেগে গেল। ডানদিকের ভাঙাচোরা রাস্তায় ট্যাক্সি ঢুকিয়ে আরও খানিকটা এগোল নির্বাণ, একটা সরু গলির মুখে এসে থেমেছে।

ভিড় কোলাহলে নির্বাণের স্নায়ু অবশ হয়েছিল খানিকক্ষণ, ট্যাক্সি ছেড়ে নামতেই ফের তন্ত্রী টানটান। লালপার্টির লোকাল কমিটির অফিসের সামনে কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে, বেশ মারমুখী ভঙ্গিতে। ইলেকশনের ফল বেরনোর পর থেকেই ঘাসফুল পার্টির দাপট ভীষণ বেড়েছে, যত্রতত্র হুটহাট লেগে যাচ্ছে লালেদের সঙ্গে। এখানেও আজ একটা লাঠালাঠি বাধবে বোধহয়। খাক, একটু ঝাড় খাক লালেরা, যদি তাতে মায়ের মতো হেক্কড়গুলো খানিকটা শায়েস্তা হয়।

অপাঙ্গে লোকগুলোকে দেখে নিয়ে স্যাঁত্সেঁতে গলির ভিতরটায় সেঁধিয়ে গেল নির্বাণ। লাল ইটের দাঁত দেখানো ভাঙাচোরা শিবমন্দিরের পাশে বটগাছের ছায়ায় আজও তাসের জুয়া চলছে, বিমল পাল যথারীতি আসরে মজুত। তাকে দেখতে পেলেই চিত্তির, পাঁচশো হাজার খসে যাবে নির্ঘাত। এই দু’-তিনমাসে না-হোক হাজার দশেক তো গিলেছেই। সে গিলুক, নিজের গলতির প্রায়শ্চিত্ত তো নির্বাণকে করতেই হবে। বিমল আর ছায়া তাকে আবার ক্ষমাঘেন্না করে মেনে নিয়েছে, খাতির-টাতির করছে, এটাও তো কম কথা নয়। কিন্তু এই সংকটের মুহূর্তে যক খেলে বড্ড গায়ে লাগবে না!

কপাল ভাল, বিমলের চোখ এড়িয়েই নির্বাণ পৌঁছেছে মহুয়াদের বাড়ি। নামে পাকা হলেও বারোঘর এক উঠোনি বন্দোবস্তে প্রায় বস্তিরই চেহারা।

পাশাপাশি দু’খানা ঘর নিয়ে মহুয়াদের ডেরা। সামনে ফালি বারান্দা ঘিরে রান্নার জায়গা। ছায়া সেখান থেকে দেখেছে, নির্বাণকে। গলা উঠিয়ে বলল, “এসো বাবা এসো। মহুয়া ঘরেই আছে।”

নির্বাণ সোজা ঢুকতেই পারে, তবু ভদ্রতা করে দাঁড়াল একটু। হৃত্যন্ত্রের উচ্চণ্ড লাফঝাঁপে লাগাম টেনে বলল, “আজ তো ওর ডে অফ। কী করছে সারাদিন?”

“এই দিনটায় যা করে। শুধুই বিছানায় গড়াগড়ি। এই তো খানিক আগে উঠে ভাতটাত খেল। আবার বুঝি শুয়েছে।” ছোটখাটো গোলগাল ছায়া ঠোঁট টিপল, “যাও না, গিয়ে তোলো।”

না, মহুয়া শয্যায় নেই। গায়ে ঢলঢলে একখানা ম্যাক্সি চাপিয়ে পাশের টুলে বসে মোবাইলে মগ্ন। চোখ না উঠিয়েই বলল, “সারাদিন আজ ফোন করোনি যে বড়?”

“চলেই তো এলাম। কাঁপাকাঁপা পায়ে খাটে বসল নির্বাণ। কীভাবে কথা শুরু করবে ভেবে না পেয়ে বলে বসল, মনটা আজ খুব আপসেট হয়ে আছে।”

বিনুনি সরিয়ে ঘাড় হেলিয়ে মহুয়া, “কেন?”

চোখাচোখি হতেই বিচিত্র এক ত্রাস ছেয়ে ফেলল নির্বাণকে। মুখে কোনও মিথ্যে এল না, রেখে ঢেকে কিংবা সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশনের জন্য কথাও খুঁজে পেল না, আচমকা শুকিয়ে আসা ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে বলল, “এমন একটা খবর শুনলাম কাল…”

“কী খবর?”

“কীভাবে কী হল বুঝতে পারছি না… আমার বউয়ের নাকি বাচ্চা হবে…”

মহুয়া দু’-এক পল নীরব। হাঁ করে দেখছে নির্বাণকে। তারপর হঠাৎই নির্বাণকে স্তম্ভিত করে হাসিতে ফেটে পড়ল। সে হাসি আর থামেই না, কত বিভঙ্গে যে লুটিয়ে পড়ছে মহুয়া! হাসতে হাসতেই চেঁচাল, “মা, নির্বাণদার কথা শুনেছ? বউ কেন প্রেগনেন্ট হয়েছে নির্বাণদা নাকি জানে না!”

ছায়া এসেছে ঘরে, কিন্তু হাসছে না। মেয়েকে ছোট্ট ভ্রুকুটি হেনে অনুত্তেজিত গলায় নির্বাণকে বলল, “বাহ, এ তো ভাল খবর।”

“শুধু ভাল? বলো হেব্বি নিউজ। হাতে মিষ্টি নেই কেন?” টুল থেকে উঠে এল মহুয়া। মুখখানা নির্বাণের প্রায় কান ছুঁইয়ে ফিসফিস করল, “তোমার ক্যালি আছে বটে। বউকে না ছুঁয়েই পেটে বাচ্চা এনে দিলে?”

একটু বুঝি স্বচ্ছন্দ হচ্ছিল নির্বাণ, ফের গলা শুকিয়ে কাঠ। কিছু একটা বলতে গেল, স্বর ফুটল না।

মহুয়া কিন্তু আবার হাসছে। কোনও অভিযোগ নেই, অনুযোগ নেই, সহজ সুরে বলছে একথা-সেকথা। প্রসঙ্গটা আর পাড়ার সুযোগই পেল না নির্বাণ। সে যে নিজেও কখন গল্পে মেতে উঠেছে, নিজেই জানে না। চা-সিঙাড়া খেয়ে, বিমল পালের কাছে সাতশো টাকা ধসিয়ে সে যখন মহুয়ার ঘর ছাড়ল, মনটা তার আশ্চর্য রকমের নির্ভার।

বেরিয়েই আবার চিন্তার ওঠাপড়া। এত বড় ঘটনাটা এত সহজে মেনে নিল মহুয়া, এতটুকু অসূয়া দেখাল না, এ যে প্রায় অবিশ্বাস্য। মহুয়ার মনটা এত বড়? নাকি এর সবটাই অভিনয়? ভিতরের রক্তক্ষরণ ঢেকে রাখল হাসির মোড়কে?

আবার গুলিয়ে যাচ্ছিল সব। নির্বাণের মাথা ফের থান ইট।

২৯

মানুষ যা চায় তাই কি ঘটে সর্বদা? যদি বা ঘটে, তাতেই কি ভাঁড়ার ভরে পুরোপুরি? কত সময়ে তো কত আপাত তুচ্ছ ছোটখাটো ঝাপটাও প্রাপ্তিসুখে কাঁটা বিঁধিয়ে দেয়। তখন মনে হয় সব আকাঙ্ক্ষাই বেকার, হয়তো বা চাওয়াটাই শূন্যগর্ভ। না হলে এই যে কাল বিকেলে আঁচল গড়িয়ার বাড়িতে এল, এখন দু’-চারদিন থাকবে, এতে তো মানসীর প্রাণে উচ্ছ্বাসের বান ডাকা উচিত। কিন্তু তেমনটা হচ্ছে কই? এই সময়ে মেয়ের আগমনে সে খুশি হয়েছে ঠিকই, তবু কেন যে সেই পুরনো খচখচ ভাব যায় না কিছুতেই?

কারণটা ঠাহর করতে পারছিল না মানসী। আতিপাতি খুঁজছিল নিজের মনের কুঠুরিগুলো। সে তো অন্তর থেকে চেয়েছিল আঁচল একটা নিজস্ব ঘর পাক। হয়তো একটু হুটোপাটি করেছিল, কিন্তু মেয়েকে তো জলে ফেলে দেয়নি। আশা আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখেই একটা রুচিশীল পরিবারে দিয়েছে বিয়েটা। একালের হিসেবে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি যথেষ্ট মান্যগণ্য। জামাই অবশ্য তেমন আহামরি নয়, নেহাতই চলনসই গোছের। কিন্তু মানসী কি সেরকমটাই চায়নি? বর অসাধারণ হওয়ার জ্বালা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে বলেই না নজর খানিক খাটো করেছিল মানসী। তবু কেন যেন মনে হয় আর একটু দেখলে হত, আর একটু সময় নিলে হত।

আঁচলের বাচ্চা হবে, এমন একটা সুসমাচারেও কি মানসী নিখাদ খুশি হতে পেরেছে? কেন পারেনি? খবরটা মেয়ের শাশুড়ির মুখ থেকে প্রথম শুনতে হয়েছিল বলে? কেন যে আঁচল তাকে জানাল না? লজ্জা? সংকোচ? কুণ্ঠা? মায়ের কাছে? মেয়েকে পক্ষিনীর মতো ডানার ছায়ায় বড় করেও মানসী কি আঁচলের যথেষ্ট আপন হতে পারেনি?

ধেই ধেই নৃত্য করার মতো পুলকিত না হওয়ার আরও একটা কারণ আছে বই কী। মনে তো হচ্ছেই, বড্ড তাড়াহুড়ো করে ফেলল আঁচল, আর একটু সময় নিলে পারত! তবে এও ঠিক, বাচ্চা হলে পুরোপুরি একটা নিজের জগৎ পাবে মেয়ে।

এসব হাজারো গন্ডা চিন্তা নিয়েই খবরের কাগজের পাতা উলটোচ্ছিল মানসী। পড়া নয়, শুধুই হেডলাইনে চোখ বোলানো। সেই ভোটের পর থেকে এখনও একই চর্বিতচর্বণ নিউজ, এখানে গণ্ডগোল, ওখানে মারপিট, পড়তেও আর ইচ্ছে করে না। এবার তো উঠতেও হবে। কাকা-ভাইপো ডিমটোস্ট খেয়ে অফিস বেরোল, এখন রান্না বসানোর পালা। কুসুম আছে ঠিকই, তবু আঁচলের জন্য নিজে কিছু একটা রাঁধবে আজ। মেয়েটা ক’দিনের জন্য এসেছে, শান্তনুও বলে গেল…

বসার ঘরে ফোন বাজছে। বেজেই চলেছে। ল্যান্ডলাইন মানেই কোনও আত্মীয়-টাত্মীয়। বোধহয় শান্তনুর দেশের কেউ। কিংবা মানসীর দাদা-বউদি। আমেরিকা থেকে ফেরার পর দু’জনে একটু ঘনঘনই ফোন করে আজকাল। হয়তো কোনও প্রয়োজন আছে, এখনও ঝেড়ে কাশেনি যদিও। অলিটা মহা বজ্জাত, ঘরে বসে ক্রিংক্রিং শুনবে, তবু কিছুতেই গিয়ে তুলবে না। অগত্যা কাগজ ফেলে হাঁপর-ঝাপর করে মানসীকেই এসে ওঠাতে হয় রিসিভার।

আজ ওপারে বনানী। গলায় যথারীতি তরল সুর, “কী গো, খুব ব্যস্ত নাকি?”

ইদানীং বনানীর ফোন আসা কমে গেছে অনেক। তাই বুঝি ঈষৎ অবাক হয়েছে মানসী। পালটা প্রশ্ন জুড়ল, “কেন?”

“বারে, মেয়ে ওখানে গেছে… এখন নিশ্চয়ই তার বাড়তি খাতিরযত্ন চলছে…”

“আমি আর কী করছি। আহ্লাদ তো দেখছি তার বাপির।” মানসী ইচ্ছে করে স্বর তুলল, “এমন ভাব করছে, যেন দুনিয়ায় তিনিই প্রথম দাদু হচ্ছেন। মেয়ে যা যা খেতে ভালবাসে, সব হাজির। আজকাল তো বাজারের পথ মাড়ায় না, অম্বরকে দিয়ে ঝক্কিটা সারে… আজ সক্কাল না হতে থলি হাতে দৌড়। ইয়া পেল্লাই ইলিশমাছ এল, হাঁড়ি করে লালদই, গাদাখানেক ফল…”

“আঁচল খেতে পারবে এত কিছু?” মানসীকে একটু যেন মিইয়ে দিতে চাইল বনানী, “ওর বমি কমেছে?”

“হ্যাঁ, হ্যাঁ।” মানসী দমল না, “এখন তো অনেকটাই ভাল। বাপের বাড়ি পা দিতেই ওসব ভ্যানিশ।”

“খুব ভাল। এবার তো মুখে রুচি ফিরবেই… চার মাসে পড়তে চলল…। তা সে মেয়ে কোথায়? মোবাইল অফ রেখেছে কেন?”

“তা তো বলতে পারব না। …ডেকে দেব?”

“থাক। হয়তো শুয়ে-টুয়ে আছে…। ওকে একটা খবর দিয়ে দিয়ো।”

“কী গো?”

“ওর জেঠুর নেক্সট কেমোটা সামনের সপ্তাহে হচ্ছে না।”

মানসী আলগাভাবে জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“দাদা বেজায় উইক হয়ে পড়েছে। শুনেছ নিশ্চয়ই গত কেমোটা নেওয়ার পর দাদার খুব ক্রিটিকাল অবস্থা হয়েছিল। প্রেশার কিছুতেই স্টেবল হচ্ছিল না, তিনদিন আই সি ইউ-তে রাখতে হল…”

কীভাবে জানবে মানসী? তাকে কোন কথাটা বলে আঁচল? অবশ্য মানসীও আঁচলের জেঠুর শারীরিক পরিস্থিতি নিয়ে খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি কখনও। মানুষটার ওপর তার রাগ বিদ্বেষ নেই বটে, তবে ওই সব লোকদেখানো আহা উহু করাও তার ধাতে নেই।

তবু এই মুহূর্তে মানসীকে বলতেই হল, “হ্যাঁ, আঁচলও খুব টেনশন করছিল।”

“এখনও সিচুয়েশন মোটেই ভাল নয়। কিছু খেতে পারছে না, মাথা তুলতে পারছে না… প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই শয্যাশায়ী। হিমোগ্লোবিন খুব ফল করেছে। ডব্লু বি সি কাউন্টও বেশ নীচের দিকে। ছোড়দা আর আমি কাল ডাক্তারকে মিট করলাম। উনি বলছেন পেশেন্ট আগে রক্ত-টক্ত নিয়ে চাঙা হোক… কাউন্ট-টাউন্টগুলো বাড়ুক… একটা সাইকল নয় পিছিয়ে গেল… সেই পুজোর পর আবার…”

মানসী কেঠো সৌজন্য দেখাল, “ইস, বড় ভুগছেন বেচারা।”

“হ্যাঁ গো। ভীষণ। এত কষ্ট পাচ্ছে, চোখে দেখা যায় না। এদিকে ছোড়দাও ঝামেলায় পড়ে গেছে। জেদ করে দাদার চিকিত্সা চালাতে গিয়ে কিছুতেই আর দিল্লি যেতে পারছে না। এখন ক’দিন ফুরসত পেল তো, এবার হয়তো ঘুরে আসবে।”

“ও।”

“জানো তো, ছোড়দাও কিন্তু আঁচলের খবরে দারুণ এক্সসাইটেড। বলছিল, দেখিস ওর ঠিক টুকটুকে একটা মেয়ে হবে।”

“তাই? মানসীর গলায় ব্যঙ্গ এসে গেল, তোমার ছোড়দা আজকাল গণনাও করছে নাকি?”

“না গো বউদি, ঠাট্টা কোরো না। ছোড়দা কিন্তু আর আগের মতো নেই।”

“একেবারে সাধুসন্ত হয়ে গেছে বুঝি?”

“তা নয়, তবে…।” বনানী যেন একটু থমকে থেকে বলল, “ছাড়ো ওসব। আঁচলকে মনে করে জানিয়ে দিয়ো। ও হ্যাঁ, আরও একটা কথা, দাদার নেক্সট কেমোতে ও যেন অবশ্যই না যায়। কেন সে এখন বারবার হাসপাতালে ছুটেছুটে আসবে বলো তো? তাও কিনা এই রকম একজন মরোমরো রোগীকে দেখতে? এই সময়ে প্রেগনেন্ট মেয়েদের মৃত্যু থেকে দূরে দূরে রাখাই ভাল, তাই না? কী দেখে কী রিঅ্যাকশন হবে, তার ঠিক আছে?”

শ্লেষ ছুড়ল মানসী, “তা উপদেশটা কার? তোমার ছোড়দার?”

“আরে দুর, ছোড়দা এসব ভাবে নাকি? কারওর ইচ্ছেয় থোড়াই সে বেড়ি পরানোর মানুষ? এটা আমার ওপিনিয়ন।”

“তাই বলো। তোমার ছোড়দার এতটা আক্কেল আছে মনে করাটাই তো ডাহা…”

“দেরি হয়ে গেছে গো, এবার অফিস দৌড়োব।” বনানীই থামাল মানসীকে, “ছাড়ছি… তুমি মেয়েকে প্রাণভরে খাওয়াও।”

ফোন রেখে মানসী মুখ বেঁকাল। ছোড়দাকে বিদ্রুপটা বনানীর গায়ে লেগেছে? বয়েই গেল মানসীর। যেচে যেচে এত দেবরাজের কথা শোনায় কেন? উফ, লোকটা কেন যে তার জীবন থেকে পুরোপুরি সরে না?

আঁচলের কাছে যেতে গিয়েও দাঁড়াল মানসী। এমন কী ভয়ংকর জরুরি কথা যে এক্ষুনি বলতে হবে?

ঘুরল মানসী, এসেছে রান্নাঘরে। মন দিল সরষেভাপা ইলিশে। পাশে কুসুম, জোগাড়যন্ত্র করছে কাঁটাচচ্চড়ির। কোটা সবজি ধুতে ধুতে সে বলল, “একটু টক করলে হত না?”

“কাঁচা আম আছে?”

“নেই আবার… বাবু তো আজ ঝেঁটিয়ে বাজার করেছে।”

তা ঠিক। বনানীকে সে বাড়িয়ে বলেনি, শান্তনু তো সত্যিই খুব উল্লসিত। এরই মধ্যে সে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করে দিয়েছে, বিদিশাদেবীর কোনও ওজর চলবে না, আঁচলের বাচ্চা এ বাড়ি থেকেই হবে। এখন তার খাতিরদারির ঠেলায় মেয়ে না পালাই পালাই করে!

মানসী অল্প হেসে বলল, “হুম। যজ্ঞের আয়োজন। …টকটা তুমিই করো তা হলে। আর মাছ দু’-তিন পিস ভাজাও রেখো, বাবু ওবেলায় খাবে।”

“মাছের তেলও রাখব তো?”

জবাব দেওয়ার আগেই অলির গলা উড়ে এল, “কী গো, আমার ভাত-টাত জুটবে?”

মানসী বেরিয়ে এসে অবাক মুখে বলল, “তুই আজ কলেজ যাচ্ছিস নাকি?”

“মানে? …আজ তো ছুটি-ফুটি নেই।”

“বা রে, কদ্দিন পর মেয়েটা এল… সারাদিন সে একা একা থাকবে?”

“কেন, তুমি তো আছ।”

“আহা, তুই ওকে সঙ্গ দিতে পারিস।”

“দিদিভাই একা থাকতেই ভালবাসে মা। বই পড়বে, নেট ঘাঁটবে… নইলে ঘুমোক না দিনভর।”

“তবু… ওর শরীরটা তো ভাল নেই…”

“সে তো সাধ করে মা।”

“ছি। ও কী কথা?”

“খারাপটা কী বলেছি? বিয়ে হতে না হতেই এসবে জড়িয়ে পড়ার কোনও মানে হয়?”

“আবার বাজে কথা?”

“ঠিকই বলছি। আগে ভাবতাম দিদিভাই যথেষ্ট সেন্সিবল, এখন দেখছি ও একটা আস্ত ভোঁদাই। কেউ কাউকে সেভাবে চিনল না, জানল না…”

“থামবি? খুব পাকা পাকা বুলি শিখেছিস, তাই না? মারব এক থাপ্পড়..”

“বেশ, মুখে কুলুপ আঁটলাম। পরে বুঝবে অলি মোটেই কচি খুকিটি নেই। ভেবেচিন্তেই কথা বলে।”

মানসীও যে অলির সঙ্গে খুব একটা দ্বিমত পোষণ করে, এমন তো নয়। তবু ছোটকন্যের মুখে শুনতে কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বিরক্তিও বোধ করছিল যেন। তবে ধমকাধমকিতে গেল না।

প্রসঙ্গ বদলে মানসী বলল, “তা কী দেব এখন? মাছ তো হয়নি।”

“ইলিশ আমার এখন পোষাবেও না। উফ, যা কাঁটা! কাল রাতের চিকেনটা হলেই তো কাফি।”

“সে কী রে? গরম গরম একটা ভাজা অন্তত খা। তোর বাপি এত শখ করে আনল…”

“বাপি আমার টেস্ট জানে মা। মাছ মানেই দিদিভাই। তার সময়ও অঢেল, ঝোল ভাজা এটসেটরা এটসেটরা ও চেটেপুটে খাবে।”

খুব তৃপ্তি করে না হলেও দুপুরে মাছটা বেশ যত্ন করেই খাচ্ছিল আঁচল। তার মুখখানা দেখে ভারী ভাল লাগছিল মানসীর। কাল কেমন একটা শুকনো শুকনো ভাব ছিল, আজ স্নান-টানের পর আবার যেন পুরনো স্নিগ্ধতা ফিরে এসেছে।

খেতে খেতে টুকটাক কথা হচ্ছিল দু’জনে। বনানীর বার্তা বিনা মন্তব্য শুনে গেল আঁচল। হরিনগরে শান্তনুর ব্যবসা শুরুর সমস্যা মিটল কিনা জানল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, শিগগিরি চালু হচ্ছে জেনে একটু যেন নিশ্চিন্তির ভাব ফুটল তার মুখমণ্ডলে।

কথায় কথায় মানসী বলল, “তুই এসেছিস ভালই হয়েছে। চল পুজোর কেনাকাটাগুলো সেরে ফেলি। পারবি তো যেতে?”

“না পারার কী আছে, কলেজ তো করছি। কবে যাবে?”

“কাল চল। তোর বাপিকে বলব অফিস গিয়ে গাড়িটা পাঠিয়ে দিতে। দুপুর দুপুর ঘুরে আসব। এবার তো তোর শ্বশুরবাড়িতেও দেওয়া-থোওয়া আছে।”

“বেশি বাড়াবাড়ি করো না কিন্তু। আমার বিয়েতে বাপির বিস্তর খরচ হয়েছে, এটা মাথায় রেখো।”

“তোকে ওই নিয়ে ভাবতে হবে না। …তোর শাশুড়ির জন্য কী শাড়ি কিনি বল তো? কাঞ্জিভরম সিল্ক?”

“অত দামি? কেন?”

“সস্তা কিছু কিনলে তোর বাপি যে আমাকে পেটাবে।” মানসী হাসছে। ভুরু উঠিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর নির্বাণকে কী দিই? মাপ তো আছেই, আর এক সেট সুট করাই?”

“পাগল হলে নাকি?” আঁচলের গলা হঠাৎ খর, “জাস্ট একটা শার্ট-প্যান্ট, ব্যস।”

“তা বললে হয়? নতুন জামাই… বিয়ের পর এই প্রথম পুজো…”

“তা হলে যা ইচ্ছে করো। আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন?”

আঁচলের আকস্মিক উষ্মায় মানসী থতমত। কী এমন সৃষ্টিছাড়া কথা বলছে সে? নমো নমো করে সারলে যে শান্তনুর সম্মান ক্ষুণ্ণ হতে পারে, এটুকুও কি আঁচল বোঝে না?

আহার সেরে উঠেছে আঁচল। হাত ধুয়ে ঘরে যাচ্ছিল, কী ভেবে ফিরে এল। শান্ত ভাবে বলল, “অন্য কারওর ব্যাপার জানি না। তবে মণিকাকার জন্যে একটা কিছু কিনো। উনি খুব খুশি হবেন।”

পলকা একটা কৌতূহল তো ছিলই। মানসী জিজ্ঞেস করে ফেলল, “ভদ্রলোক সারাদিন ও বাড়িতে কী করেন রে এগজ্যাক্টলি? উনি কি তোর শাশুড়ির সেক্রেটারি?”

“ঠিক তা নয়। সংসারেরও প্রচুর দেখভাল করেন।”

“বিয়ে থা তো করেননি, তাই না? ওঁর কী একটা ব্যবসা আছে যেন?”

“কাগজের দোকান। কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়। ভাইপোরা বসে দোকানে।”

“ও। আর উনি এখানে… শাশুড়ি বুঝি ওঁকে মাইনে-টাইনে দেন?”

“আরে না না, মণিকাকা এমনিই করেন… জাস্ট ফ্যামিলি ফ্রেন্ডের মতো।”

“তোর শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু ছিলেন বুঝি? নাকি পার্টির সূত্রে…”

“আহ মা, এত জেরা করছ কেন? আমি এগুলো পছন্দ করি না।”

আঁচল যেন প্রায় খেঁকিয়ে উঠল। মেয়ের এহেন প্রতিক্রিয়া কদাচ দেখেনি মানসী। মেয়ে চোখের আড়াল হওয়ার পরও মানসীর স্তম্ভিত ভাব কাটছিল না। আঁচলের উচ্ছ্বাস আনন্দ রাগ বিরাগ চিরকালই তো নিচু পরদায় বাঁধা। আজ সে বারবার এভাবে মেজাজ হারাচ্ছে কেন? মনের ভিতর কি কোনও ওঠাপড়া চলছে? নাকি শারীরিক গড়বড়? যাইই হোক, কোনওটাই তো ভাল নয়। এই প্রেগনেন্সির সময়ে কত রকম যে সমস্যা চলে মেয়েদের। হে ভগবান, তার শান্ত মেয়েটার তেমন কিছু যেন না ঘটে।

রান্নাঘর গুছিয়ে মানসী একটু দাঁড়িয়ে রইল। কে জানে কেন স্বস্তি পাচ্ছে না। আনচান ভাব কাটাতে পায়ে পায়ে হাজির হয়েছে আঁচলের দরজায়।

খাটের বাজুতে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিল আঁচল। মাকে দেখে ঘাড় বেঁকাল, “আবার কী হল?”

“না না, এমনিই এলাম। মানসী এল বিছানায়। নরম গলায় বলল, কী নিয়ে বসলি? গল্পের বই?”

“প্রায় ওরকমই। পুরনো একটা জার্নাল। নূরজাহানের ভাইকে নিয়ে এখানে একটা লেখা ছিল, ওটাই দেখছি।”

“ও। তোর সেই রিসার্চের ব্যাপার। মানসী অল্প হাসল, রাখ না ওসব? ঘুম না এলে দুপুরবেলা টিভি দ্যাখ।”

ইন্টারেস্ট পাই না। আমার বইই ভাল।

“বেশ। মন যা চায় তাই কর। মানসী গলা ঝাড়ল, আমার একটা রিকোয়েস্ট শুনবি?”

“কী?”

“কলেজ যাতায়াতটা এবার বন্ধ কর। অকারণে বেশি ধকল নেওয়ার কী দরকার? কয়েকটা মাস এখন সারাদিন বাড়িতেই থাক না। যদি শ্বশুরবাড়িতে একা লাগে, এখানে চলে আয়।”

“যখন ছুটি নেওয়ার ঠিক নেব। এখন আমি পারফেক্টলি ফাইন মা।”

“উঁহু। তা হলে তুমি বারবার এমন টেম্পার লুজ করতে না। তবে এটা কিছু অস্বাভাবিকও নয়। মানসী সহজ স্বরেই বলল, এটা তো মানবি, তোর রিসার্চে জয়েন করা এখন শিকেয়?”

“হ্যাঁ। একটু তো বাধা পড়ল।”

“উঁহু, অনেকটাই। তোর এই যে এতদিনের খাটাখুটি, বই ঘাঁটা, লাইব্রেরি ছোটা, সব আপাতত থমকে রইল। তারপর ধর, এবারে নেটে বসতে পারলি না। ডিসেম্বরেও পারবি না। নেক্সট জুনেও না। পরের ডিসেম্বরেও আনসার্টেন…”

“হুউউম।”

“তার মানে তোর পড়াশোনা কেরিয়ার সব এখন অন্তত দু’-তিন বছর পিছিয়ে গেল?”

“তা তো বটে। সামনে এখন অনেকটাই অনিশ্চয়তা।”

“এমন নয় তো, এই সব কারণেই তুই ভিতর থেকে অ্যাজিটেটেড হয়ে আছিস?”

আঁচল সামান্য থেমে থেকে বলল, কী জানি। হতেও পারে।

“শোন। ওসব চিন্তা এখন মন থেকে ঝেড়ে ফ্যাল। মা হচ্ছিস, এটাই এখন সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট ইভেন্ট। শুধু এই ব্যাপারটাই ভাব। এর চেয়ে বড় আনন্দ মেয়েদের জীবনে আর কিচ্ছু নেই রে।” মানসী মেয়েকে প্রফুল্ল করতে চাইল। ঠাট্টার ছলেই বলল, “তবে হ্যাঁ, তোরা যে সাত তাড়াতাড়ি এমনটা করে ফেলবি, ভাবিনি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো শুনি বাচ্চাকাচ্চার ব্যাপারে যথেষ্ট প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে এগোয়।”

আঁচল মৃদু স্বরে বলল, “অ্যাক্সিডেন্টও তো ঘটে মা।”

“এটা কিন্তু গা বাঁচানো কথা। দুর্ঘটনার তো রেমেডিও থাকে আঁচল। তোদের বয়স এমন কিছু বেশি নয়। কেরিয়ারের ব্যাপারটা ভেবে… পরে ধীরেসুস্থে, নিজেকে সেটল করে আবার ট্রাই নিতিস…”

আঁচলের চোখ সরু, “কী বলতে চাইছ?”

“বাদ দে। ওসব ভেবে আর লাভ আছে? প্রিলিমিনারি স্টেজ হলে তাও একরকম কথা ছিল।”

“কী ভাবতাম তখন? তুমি যেমন আমাকে নষ্ট করে ফেলতে চেয়েছিলে, সেরকম কিছু?”

আঁচলের কণ্ঠ নয়, যেন এক বিষমাখা তিরের ফলা এসে বিঁধল মানসীর পাঁজরে। মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে। নিজের অজান্তে ঠোঁট নড়ল সামান্য, “তোকে কে বলল?”

জবাব নেই। অপ্রতিভ চোখে তাকিয়ে আছে আঁচল। মানসী আর কিচ্ছুটি বলল না। মাথা নামিয়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বুকের ভিতর উথাল-পাথাল ঢেউ জেগেছে সহসা। পা যেন বশে নেই, লুটিয়ে পড়ল বিছানায়।

এই কথাও তাকে গিলতে হল আজ? এতদিন পর? আঁচলের মুখ থেকে? দেবরাজই যে মেয়েকে বলেছে, এতে কণামাত্র সন্দেহ নেই। দুনিয়ায় আর কারও তো জানার কথা নয়। কবে বলল দেবরাজ? সম্প্রতি? নাকি বহুকাল আগেই? এই জন্যেই কি মেয়ে তাকে পর পর ভাবে? আর বাবা তার এত আপন?

আঁচলকে মানসী পৃথিবীতে আনতে চায়নি, এ তো নিখাদ সত্যি। তবে এর চেয়ে বড় মিথ্যেও তো আর কিছু নেই। সেও তো শুধু মানসীই জানে। হয়তো তলিয়ে দেখলে দেবরাজও বুঝত। কিন্তু সেই হৃদয় কি ছিল দেবরাজের?

বিয়ের পর, তখনও বছরখানেক কাটেনি, রোজই বদ্ধ মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরছে দেবরাজ, বাতাসে জোর গুজব কোন এক বিবাহিত মহিলার সঙ্গে তার লটঘট চলছে জোর… হঠাৎ তিন দিনের জন্য দেবরাজ বেপাত্তা। ফিরতে চেপে ধরল মানসী, ওমনি বাবুর কী মেজাজ! দেবরাজকে পেতে গেলে নাকি ভাগজোক করে নিতে হবে। কোনও মেয়েমানুষের নিঃশর্ত দখলদারি সে মানবে না। কী কান্নাই না তখন কেঁদেছিল মানসী। তখনই স্থির করেছিল এই মানুষকে বাঁধতে হবে তার সন্তান দিয়ে। সেই হিসেব মতোই না একদিন পেটে এল আঁচল। খবর শুনে দেবরাজের মতো দানবও আহ্লাদে আটখানা। দেবরাজের দুর্বলতা টের পেয়ে মানসী শেল হেনেছিল জোর। বলেছিল, বেসামাল বাবার সন্তান সে কিছুতেই আনবে না দুনিয়ায়। দেবরাজ তখন মানসীর হাত ধরে শপথ করেছিল, সে বদলে ফেলবে নিজেকে। ফেলবেই।

হ্যাঁ, মানতে দ্বিধা নেই, নিজেকে খানিকটা সংযত করেছিল দেবরাজ। কিন্তু সেটা যে স্রেফ ভবি ভোলানো, তা কীভাবে আন্দাজ করবে মানসী? আঁচলের তখন এক বছরও পোরেনি, আবার শুরু হল দেবরাজের আশনাই। এক ছুটকো অভিনেত্রীর সঙ্গে। তাকে নিয়ে পাক্কা সাতদিন দার্জিলিং বেড়িয়ে এসে দাঁত বার করে হাসছে, আমাকে একটু মানিয়ে-গুনিয়ে নাও না মানসী, আমি তো এরকমই! এরপর আর ওই মানুষের সঙ্গে ঘর করা যায়?

কী কপাল! দেবরাজকে বাঁধতে চেয়ে হুমকি দেওয়াটাই চিরস্থায়ী হয়ে গেল! তার যে আঁচলকে চাওয়াটা দেবরাজের চেয়ে কম ছিল না, এই গভীরতর সত্যিটা মানসী আর প্রতিষ্ঠা করতে পারবেই না। ন’মাস পেটে ধরা নয় বাদই দিল, তারপর মূলত আঁচলের কথা ভেবেই তো শান্তনুকে বিয়ে, মেয়েকে এত বছরের সযত্ন প্রতিপালন, কোনও কিছুই কি আর হিসেবে আসবে? আঁচলকে নতুন করে বোঝাতে চাওয়ার চেষ্টাও তো পণ্ডশ্রম। যে ধারণা আঁচলের মনে গেঁথে আছে, তা কি আর উপড়ে ফেলা যায়?

উহ, কী বিষ যে মেয়ের অন্তরে ঢুকিয়ে দিয়েছে দেবরাজ। এত বড় শত্রুতাও মানুষে করে?

কাছেই কোথায় যেন একটা ঘুঘু ডাকছে। মানসীর বুকটা ভারী হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। সময়েরও আর হুঁশ নেই। ভাদ্রের দুপুর কখন যে গড়িয়ে গেছে অপরাহ্নে, টেরও পায়নি।

হঠাৎ আঁচলের ডাক, “মা?”

চমকে উঠে বসল মানসী। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ বল।”

“কুসুমদি তো এখনও এল না। চা খাবে তো? আমি করি আজ?”

আঁচলের স্বর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। যেন কিছুই ঘটেনি। মানসীই বা ঝড় বুঝতে দেবে কেন? সহজ গলায় বলল, “আমাকে লিকার দিস। চিনি ছাড়া।”

“তুমি? কালো চা?”

“খুব অম্বল হচ্ছিল রে। দুধ-চিনিটা বন্ধ করেছি।”

“কবে থেকে?”

“এই তো, সবে। হ্যাবিট পালটানোর চেষ্টা করছি।” মানসী হাসল, “ফল খাবি এখন? কেটে দেব?”

“চায়ের সঙ্গে ফল?” আঁচলও হাসছে, “আজ থাক। ইলিশমাছ এখনও হজম হয়নি। ঢেকুর উঠছে।”

দিব্যি টুকটাক কথা বলছে মা-মেয়ে। পরিবেশ যেন আবার আগের মতোই। গুমোট নেই। অন্ধকার নেই। সুন্দর আলোহাওয়া খেলছে।

তা জীবন তো এরকমই। ঝড় তুফান আসে, যায়, তবু নৌকো চলতেই থাকে দরিয়ায়। কখনও দুলতে দুলতে। কখনও বা তরতরিয়ে।

তা বলে ঝড়-তুফানটা কি মিথ্যে? তাও তো নয়। তরণি যে বায়, ঝড়ের স্মৃতি বুকে নিয়েই তো এগোয় সে। এই বুঝি জীবনের নিয়ম। এবং নিয়তি।

পোড় খাওয়া মানসী তা জানে বই কী। এখন কিছুটা বা আঁচলও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *