১০. সময় বড় দ্রুতগামী ঘোড়া

১০

ঘড়িতে চোখ পড়তেই বিদিশা চমকে উঠল। এই আটটা বেজেছিল, এরই মধ্যে বারোটা? সময় সত্যি বড় দ্রুতগামী ঘোড়া। রবিবারেও তার গতি মন্থর হয় না একটুকু।

সকাল থেকে কাজ অবশ্য বিদিশা কম করেনি। প্রুফের তাড়া নিয়ে বসেছিল। বইয়ের শেষ কয়েকটা ফর্মা যদি এক্ষুনি দেখে নেওয়া যায়। হয়ে উঠল না। যা ঘনঘন ফোন বাজছে। পার্টির রাজ্য কমিটির অলকেশ মজুমদার তো পাক্কা আধঘণ্টা খেয়ে নিল। সামনেই পার্লামেন্ট ইলেকশন, দলের হাল মোটেই সুবিধের নয়, ঘাসফুল পার্টি আন্দোলনে আন্দোলনে জেরবার করে দিচ্ছে, অবস্থা সামাল দিতে দলে এখন সাজো সাজো রব। গোটা রাজ্যের শিক্ষকদের নিয়ে বিশাল এক কনভেনশনের আয়োজন করছে পার্টি। প্রাইমারি টিচার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, সব্বাইকে নিয়ে। সেখানে কী লাইনে বক্তব্য রাখা হবে তাই নিয়ে একটানা বকবক করে গেল অলকেশ। একে সিচুয়েশন গোলমেলে, তায় নেতার বাক্য, সুতরাং শুনতেই হয় মন দিয়ে। এ ছাড়াও কত যে হাবিজাবি কল এল। অধ্যক্ষ সমিতির সভাপতি হওয়ার জন্য অভিনন্দন, খুচরো-খাচরা অনুরোধ…। তুচ্ছ ব্যাপারে পরামর্শও চায় কেউ কেউ। কোনও কলেজে ডি-পি-আই অফিসের সঙ্গে কাজিয়া বেধেছে, কারও বা ইউ-জি-সি নিয়ে বখেড়া। আবার কেউ বা বিদিশার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও আর্জি জানাতে চায়। নিজেদের দলের ছাত্র সংসদকে বশে রাখতে পারছে না, তারও সমাধান কিনা খুঁজে দিতে হয় বিদিশাকে!

আবেদনগুলো শুনতে বিদিশার মন্দ লাগে না। নিজের ওজন নিজের কাছেই যেন বাড়তে থাকে ক্রমশ। তবে এক এক সময়ে অতিষ্ঠও বোধ করে বই কী। দরকারি কাজের সময় এমন দৌড়ে দৌড়ে পালায়। বইয়ের কাজটাই তো ডিসেম্বরের মধ্যে সেরে ফেলবে ভেবেছিল, হয়ে উঠল কই! ছাপা শেষ হতে হতে ফেব্রুয়ারি না পেরিয়ে যায়।

ভাবনাটা আপাতত সরিয়ে রাখল বিদিশা। উঠে পড়ল চেয়ার-টেবিল ছেড়ে। স্টাডি থেকে বেরোতেই ভুরুতে ভাঁজ। মণিলাল। একতলার আমদরবারের ঢাউস সোফায় আসীন, বাতচিত করছে অনিমার সঙ্গে।

বিদিশাকে দেখামাত্র অনিমা ছিটকে চলে গেল রান্নাঘরে। মণিলালও যেন শশব্যস্ত। মুখে একখানা হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে বলল, “তোমার এবেলার কাজ সাঙ্গ হল তা হলে?”

“তুমি এখন এসেছ যে বড়? বলেছিলাম না, আজ প্রুফ শেষ হবে না!”

“ইলেকট্রিক বিলটা জমা করেছি। ওটাই দিয়ে গেলাম।” বলেই গলা সামান্য নামাল মণিলাল, “তোমার অনিমা তো ভারী বিপদে পড়েছে গো।”

“কেন? কী হল?”

“জামাই তো আবার ভাগিয়ে দিয়েছে মেয়েকে। এত খরচাপাতি করে বিয়ে দিল মেয়েটার, সবই বোধহয় জলে গেল।”

“আজকাল অনিমাকে নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু করেছ দেখছি!”

“না… মানে… অনিমা এসে দুঃখ করছিল তো…”

মণিলালের এই মিইয়ে যাওয়া আমতা আমতা ভাবটায় ভারী মজা পায় বিদিশা। এককালে কথায় কী চাকচিক্য ছিল মানুষটার। কত সপ্রতিভ ছিল চালচলন। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, জিনসের ওপর পাঞ্জাবি, অবিরল মুখে মার্কস লেনিন ছোটাচ্ছে…। আর বিদিশা তখন? নেহাতই দীনহীন, উদ্বাস্তু, পরগাছা, রামকৃষ্ণ কলোনির এক কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। স্মার্ট মণিলাল তরফদারের বুকনির টানেই না সেই মেয়েটার রাজনীতিতে আসা। অথচ বিদিশা আজ কোথায়, মণিলালই বা কোথায়! যোগ্যতা যে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কত ভাবে মানুষের অবস্থান বদলে দেয়!

যোগ্যতা? না অপারগতা? যোগ্যতা? না বরাতের ফের? যোগ্যতা? না লক্ষ্যে অবিচল থাকার অক্ষমতা? ঠিক কোনটা যে মণিলালের জন্য খাটে?

বিদিশা সামান্য তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “অনিমার মেয়ের যে এই হাল হবে, এ তো জানা কথা। অটো চালায় বর, তার কত খাঁই! বিয়ের পর সে যে দফায় দফায় দাবি চড়াবে, এ তো অবশ্যম্ভবী। ভাল মতোই বুঝে গেছে, বাচ্চাসুদ্ধু বউকে খেদিয়ে দিলে শাশুড়ি সুড়সুড় করে নোট বার করবে।”

“তুমি কেসটা তা হলে জানো?”

“আমি সব খবরই রাখি। অনিমা আমার কাছেই তো হাত পাতে।” বিদিশা মৃদু হাসল, “এ বাড়িতে কখন কে কী ভাবছে, তাও আমি টের পাই মণিদা। যেমন স্বচ্ছন্দে বলে দিতে পারি, অনিমা তোমায় এখন কী বলছিল।”

“কী?”

“যেন আমি জামাইটাকে ডেকে ধাতাই। পুলিশ-টুলিশের ভয় দেখাই।”

“তুমি তো অন্তর্যামীকেও হার মানালে।” মণিলালের চোখ বড় বড়, “তা হলে কিছু করবে নিশ্চয়ই?”

“সেটা আমাকেই ভাবতে দাও। এখন এসো। আমি খেয়েদেয়ে বেরোব।”

“ও হ্যাঁ, আজ তো তোমার বান্টির জন্য মেয়ে দেখতে যাওয়া। তা বান্টি যাবে তো?”

“যাওয়ার তো কথা।”

“যাক, বান্টির বিয়েতে মত হয়েছে তা হলে?”

“বড্ড বাজে বকো।”

“তা নয়, তবে বাগুইআটির মেয়েটা…”

“আহ মণিদা, থামবে?” বিদিশার গলা চড়ে গেল। কেটে কেটে বলল, “কথাটা মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলো। চিরতরে।”

মণিলাল ঈষৎ থতমত। পরক্ষণে মাথা নাড়ল ঢকঢক। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে ফের বলে ফেলল, “কিন্তু বিদিশা, বিয়ের ব্যাপারে জোর করা কি ঠিক? যদি হিতে বিপরীত হয়?”

“জ্ঞান মেরো না মণিদা। জগৎসংসারকে তোমার চেয়ে আমি ঢের ভাল চিনি।”

আবার কী যেন বলতে যাচ্ছিল মণিলাল, বিদিশার থমথমে মুখ দেখে বুঝি আর ভরসা পেল না। সোফা ছেড়ে আস্তে আস্তে হাঁটা দিয়েছে। ক্ষণিক দাঁড়িয়ে তার চলে যাওয়াটা দেখল বিদিশা। তারপর ধীর পায়ে উঠছে দোতলায়। একটা একটা করে ভাঙছে সিঁড়ি। কপালে চিন্তার রেখা। কাজটা সে ভুল করছে না নিশ্চয়ই? বান্টিটার একেবারেই বোধগম্যি নেই, নইলে বিদিশা চৌধুরীর ছেলে হয়ে এমন একটা ওঁচা মেয়ের খপ্পরে পড়ে! কত নিচুতলা থেকে জীবন শুরু করেছিল বিদিশা, অথচ দৃষ্টি ছিল উঁচুতে। আলোর অভিমুখে। আর তারই ছেলে কিনা শুধুই অন্ধকারের পানে ধেয়ে যায়!

কেন যে এমন ধারার হল বান্টি? ছোট থেকেই ছেলেটা বড্ড নিস্তেজ। ছোটাছুটি করত না বিশেষ, একা একাই খেলত ঘরে বসে। সমবয়সি তুতো ভাইবোনদের দঙ্গলেও ভিড়ত না বড় একটা। সঙ্গী বলতে ছিল ঠাম্মা আর বাবা। ঠাম্মার সঙ্গে বকবক করত, তবে বাবারই ন্যাওটা ছিল বেশি। সজলের ওই বিশ্রী মৃত্যুই কি আরও ঘেঁটে দিয়েছিল ছেলেটাকে? তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতে শাশুড়ি গত হলেন, সেটাও হয়তো বান্টিকে…। বাবা ঠাম্মার মতো বিদিশা বান্টিকে নিয়ে আহ্লাদিপনা করেনি ঠিকই, কিন্তু মনের মতো গড়ে তুলতে কোনও কসুর রেখেছিল কি সে? ভাল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল, বাছাই করা টিউটর, সবই তো ভস্মে। সারাজীবনে একটা ভদ্রসভ্য বন্ধু জোটাতে পারল না, উলটে যত অগাবগাদের সঙ্গে মেলামেশা। বিদিশারও কী কপাল, যে খুনে মস্তানটার সঙ্গ ছাড়াতে চেয়েছিল, তারই বোনের জালে ফাঁসল বান্টি! এমন একটা গর্দভকে কীভাবে বিদিশা সুপথে আনতে পারে? একমাত্র ঘাড় ধরে বিয়ে দিয়ে দেওয়া ছাড়া? বিছানায় নিয়মিত একটা নারীশরীর পেলে ওই ব্যক্তিত্বহীন ছেলে দুনিয়া ভুলে যাবে। যাবেই।

একতলার তুলনায় এ বাড়ির দোতলাটা অনেক বাহারি। নিচটা আটপৌরে ধাঁচের। গ্যারেজ, স্টাডি, একটা বসার জায়গা, বড়সড় রান্নাঘর, কমন বাথরুম, সবই আছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কিন্তু ওপরটা একদম টিপটপ। অতি সুসজ্জিত ড্রয়িংহলকে ঘিরে লাগোয়া বাথরুম সহ বিশাল বিশাল শোওয়ার ঘর, সামনের দিকে চওড়া বারান্দা…। সবই কেতাদুরস্ত। স্বাচ্ছন্দ্যে ভরপুর। বিদিশার মনোমতো।

তা এ বাড়ি অবশ্য সহজে ওঠেনি, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল বিদিশাকে। বিয়ের পর সে ছিল বালিগঞ্জ ফাঁড়ির শ্বশুরবাড়িতে। সজলের বাবা জ্যাঠাদের যৌথ মালিকানার অট্টালিকায়। সেখানে একটি দিনের জন্যও বিদিশা স্বস্তি পায়নি। সজলের তাকে বিয়ে করাটাই তো মানতে পারেনি কেউ। বনেদি পরিবারের ছেলে বাঙাল মেয়ে ঘরে তুলবে, ভাবা যায়? তার ওপর সেই মেয়ে আবার একাত্তরে ওপার থেকে পালিয়ে আসা রিফিউজি! নেহাত সজল সটান রেজিস্ট্রি করে বাড়িতে নিয়ে তুলেছিল বলে কোনও ক্রমে হজম করতে হয়েছিল সকলকে। কিন্তু প্রতি পদে বিদিশা টের পেত, ও বাড়িতে সে বেমানান। তার প্রতিটি ঘরোয়া কাজকর্মে খুঁত ধরে সজলের কাকি জেঠিরা। হাসাহাসি করে। আর শাশুড়ি তো প্রথম দিন থেকেই বিদিশাকে এড়িয়ে এড়িয়ে চলতেন, শ্বশুর মুক্তিনাথও কথা বলতেন না ভাল করে। বান্টি হওয়ার পরও ছবিটা বিশেষ বদলায়নি। বিদিশা নিজে নিজে কলেজে চাকরি জোগাড় করার পরেও না। সেই থেকেই ওই পরিবেশ ছাড়ার জন্য ছটফট করছিল বিদিশা। সল্টলেকের এই সাড়ে চার কাঠার প্লটটা মিলে গেল আচমকা। তখনই সে অধ্যাপক সমিতির উঠতি নেতা, পার্টির ওপর মহলেও চেনাজানা হয়েছে বিস্তর। ওই সুবাদেই অতি সস্তায়, ব্যাংক লোন নিয়ে, জমিটা কেনা হয়ে গেল। ছেলের বউ নিজের নামে জমি কিনেছে, জানতে পেরে শ্বশুরমশাই তো মহা চটিতং। কত চেঁচামিচি, ব্যঙ্গবিদ্রুপ যে আছড়ে পড়ল বিদিশার ওপর! কিন্তু বিদিশা অবিচল, বাড়ি ওখানে সে বানাবেই। তবে সে তো অনেক টাকার ধাক্কা, বিদিশা পাবে কোত্থেকে? স্থপতিকে দিয়ে প্ল্যান একটা তৈরি করিয়ে নিল, কিন্তু জমি পড়ে রইল জমির মতো। তারপর হঠাৎই একদিন অ্যাডভোকেট শ্বশুরের স্ট্রোক। হাইকোর্টেই। হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই জীবন শেষ। মাত্র পঁয়ষট্টি বছর বয়সে। ব্যস, বিদিশাও ওমনি কোমর বেঁধে নেমে পড়ল কাজে। বর, শাশুড়ি কারও আপত্তি টিকল না, বিদিশার জেদের কাছে হার মানতে হল মা-ছেলেকে। জেদ? নাকি ব্যক্তিত্ব? হয়তো দুটোই। বিদিশার চাপে টাকার জোগানও দিল তারাই। শ্বশুরমশাইয়ের সঞ্চয় উজাড় করে। পরে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির সম্পত্তির অংশ বেচে যা পাওয়া গিয়েছিল, সেটা এখনও সুদে বাড়ছে। বিদিশারই নামে।

ক্ষমতা অর্থ যশ, সব কিছু মিলিয়ে বিদিশার ঘট এখন পরিপূর্ণ। তবু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে আজকাল। ঘরে একটা লক্ষ্মীমন্ত বউ এলে, দামাল বাচ্চা ছুটে বেড়ালে, বুঝি খানিক ভরভরন্ত লাগে বাড়িখানা।

এহ, কী বোকা বোকা ভাবনা! চিত্তে হঠাৎ এই সব ল্যাদলেদে ভাব জেগে ওঠা কি বিদিশাকে মানায়? নিজেকে কষে ধমকাল বিদিশা। ছেলের বিয়ে সে দিচ্ছে ছেলেকে অধঃপতন থেকে বাঁচাতে। কোনও আদ্যিকেলে ভাবালুতাকে প্রশ্রয় দিতে নয়।

দোতলায় এসে বিদিশার চোখ আটকাল ছেলের দরজায়। পাল্লা বন্ধ। পরদা সরানো এক পাশে। টিভির আওয়াজ নেই, গান-টানও চলছে না, অকম্মাটা পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে নাকি?

যা খুশি করুক। সময় মতো তৈরি হলেই যথেষ্ট।

বিদিশা নিজের ঘরে ঢুকল। বাথরুমে গিয়ে অন করল গিজ়ার। ফাইনাল পরীক্ষার ফর্ম ফিল আপ চলছে, রোজই তাড়াহুড়ো করে বেরোতে হচ্ছে কলেজে। ক’দিন শ্যাম্পু করা হয়নি, কেমন যেন নেতিয়ে আছে চুলগুলো। আজ ভাল করে মাথা ঘষতে হবে। ভাবী কুটুমবাড়ি যাওয়া বলে কথা, নিজেকে সেখানে সুচারুভাবে উপস্থাপনা তো করা দরকার।

আশ্চর্য, কুটুমবাড়িই ধরে নিচ্ছে কেন? বিয়েটা যে হবেই, তার নিশ্চয়তা কী? ছবি দেখেই মেয়েটাকে চোখে লেগে গেছে বিদিশার, বান্টির মতামতের সে অপেক্ষাও করেনি, কিন্তু মেয়েটার দিক থেকেও তো ভাবতে হবে। তারও তো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। দেখতে বান্টিকে যেমনই হোক, পাত্র হিসেবে মোটেই সে আহামরি নয়। মেয়েটা তাকে স্বচ্ছন্দে বাতিল করতে পারে। সত্যি বলতে কী, মেয়ে দেখতে নয়, ছেলে দেখাতেই তো যাওয়া আজ। আলাপ-সালাপ করে পাত্রী ঘাড় নাড়লে তবেই না বিদিশা নিশ্চিন্ত হয়!

তিরতিরে ভাবনাটা নিয়ে বিদিশার স্নানবিলাস শেষ। এবার রুটিন মাফিক অঙ্গচর্চার পালা। ড্রায়ারে চুল শুকিয়ে গা হাত পায়ে লোশন ঘষল, ক্রিম মাখল মুখে। চুয়ান্ন বছর বয়সেও চেহারায় দিব্যি একটা চেকনাই ধরে রেখেছে বিদিশা। শুধু প্রসাধনের গুণে নয়, তার সদাব্যস্ত জীবনটাই যেন আটকে রেখেছে যৌবনকে। যাই যাই করেও থমকে আছে অপরাহ্ণে। এককালের সেই টানটান ফিগার অবশ্য নেই, বরং কোমর ভারীর দিকে। দেহে মেদও জমেছে অল্প স্বল্প। তবু এখনও পুরুষের চোখে সে যথেষ্ট আকর্ষক। মেনোপজ় হয়ে যাওয়ার চার বছর পরও।

আয়নায় সেই শরীরটাকেই বিদিশা দেখছিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। চোখের কোল, কপাল, গলা… উঁহু, বলিরেখা নেই। হরমোন ট্রিটমেন্টের গুণ আছে, একটুও শিথিল হয়নি ত্বক…

ফোন বাজছে। ড্রেসিংটেবিল থেকে বিদিশা তুলল মোবাইলটা। মনিটরে নামটা দেখামাত্র বিরক্তিতে ছেয়ে গেছে মুখমণ্ডল। স্বর ভারী করে বলল, “হ্যাঁ পল্টুদা, বলো।”

ও প্রান্তে ঘড়ঘড়ে গলা, “আছিস কেমন?”

“ভাল। তোমরা?”

“চলতাসে একরকম। ক’দিন তো জোর টেনশন গেল।”

“কেন?”

“যা একখান খেল দেখাইল মা। বুকে কফ-টফ বসাইয়া এহন তহন দশা। ভাগ্যিস অ্যান্টিবায়োটিকখান ধইরা গেল, নাইলে অহন তো সে পরপারে। তবে অহনও ভারী দুর্বল। হাতে পায়ে জোর নাই। হাগা মোতা, সবই চলতাসে বেডপ্যানে।”

“ও।… মামির বয়স কত হল যেন?”

“বড়দির সাতষট্টি। আরও ধর আঠেরো। পঁচাশি তো হইবই।” একটুক্ষণ থেমে থেকে পল্টু বলল, “বুড়ি আজকাল তর নাম করে খুব। তরে দ্যাখতে চায়। একদিন আয় না। মাইনষটা কবে আছে, কবে নাই…”

“দেখি। ফুরসত পেলে যাব।”

“এবার তরে একখান কামের কথা কই? নীলুটা তো কদ্দিন ধইরা বেকার। আমাগো দোকানটায় বসতে কইলাম, বাবুর মানে লাগে। কইলাম ব্যবসা কর, যা দু’-পাঁচ হাজার লাগে, দিমুখন। গা করল না। ওই কয়খান টিউশ্যান করে, আর উইড়া বেড়ায়। তরেও তো কত বার কইলাম, অহন তোর এত প্রতাপ, কোথাও একখান ঢুকাইয়া দে। তা তুইও তো…”

“আজাইরা কথা থামাও তো।” প্রায় ভুলে যাওয়া ভাষা ঠিকরে এল বিদিশার গলা থেকে। পরক্ষণে ফিরেছে বর্তমানে। কেঠো সুরে বলল, “তোমার দরকারটা বলো?”

“হ্যাঁ, কই। …এইবার সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসছিল নীলু। কোয়ালিফাই করসে। অহন শুধু পুলিশ ভেরিফিকেশনখান আটকে। চার মাস কাইটা গেল, এহনও তো কেউ আসেও না, কিসু হয়ও না। এখন তুই যদি একটু উপরমহলে বইল্যা কইয়্যা…। সুবিধা তো চাইতাসি না, শুধু যদি ব্যাপারখান তাড়াতাড়ি…”

“তোমাদের এখন কোন পি-এস? নাগেরবাজার?”

“না। মতিঝিল। নীলুর ভাল নাম মনে আছে নিশ্চয়ই? প্রত্যুষ।”

“হুঁ। দেখছি।”

“একটু দ্যাখ খুকু। নীলুর একখান গতি হইলে মনে বল পাই। ওই তো দোকান, ক’পয়সাই বা বেচাকেনা, তাতে কী আর সংসার চলে? বড়পুত্তুর তো বউ নিয়া পৃথক হইয়া গেল। ওই নীলুই তো অহন আমাগো সম্বল…”

“আমার কাজ আছে পল্টুদা। পরে কথা বলব।”

বিদিশা ঝট করে কেটে দিল লাইনটা। কাঁহাতক আর গাওনা শুনবে লোকটার! উদ্যমহীন মানুষদের এই পরিণতিই তো হয়। বাবার দোকান আঁকড়ে ধরে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার তাল করেছিল, এখন বুঝুক কত ধানে কত চাল! ব্যবসা বাড়ানোর কণামাত্র চেষ্টা করেছে? এখন তো বিনয়ে গদগদ, কী চিজ় ছিল একসময়ে, বাপস। ওপার থেকে সর্বস্ব হারিয়ে আশ্রয় নিতে এসেছে মা মেয়ে, ওই পল্টুদা তখন কম জ্বালাতন করেছে! ষোলো সতেরো বছরের বিদিশার ওপর যখন তখন হামলাচ্ছে। একলা পেলেই খপ করে বুক টিপে দিল, কিংবা গোপন অঙ্গে হাত। কী আতঙ্কে যে দিন কাটত তখন। আর ওই শয্যাশায়ী মামিটি? তিনি তো ছিলেন ছেলেরও বাড়া। দু’বেলা দু’মুঠো ভাত দিচ্ছে বলে কম অত্যাচার করেছে মায়ের ওপর! ঝিয়ের মতো খাটাত। জ্বর হলেও ছাড়ান নেই, পাঁজাভরতি বাসন নিয়ে মাজতে যাও পানাপুকুরে। ম্যালেরিয়ায় ভুগে মরে গেল মা, ভালমতো চিকিৎসা পর্যন্ত হল না!

সব স্মরণ আছে বিদিশার। কিচ্ছু ভেলেনি। তবু তো সে সাধ্যমতো করেছে মামা মামির জন্য। মামার পেটে ক্যানসার ধরা পড়ল, তখন তার চিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছে কে? বিদিশাই তো। মামির গলব্লাডার অপারেশনের খরচা কে জুগিয়েছিল? এই বিদিশা। পল্টুদার মেয়েকে বিয়েতে নেকলেস দিল, আলাদা করে নগদ বিশ হাজার। কেন করেছে এসব? কৃতজ্ঞতা। অন্নের ঋণ নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। ওই সংসারে, ওরকম একটা পরিবারে গিয়ে না পড়লে বিদিশা জীবনের লড়াইটা চালাতে পারত? জেদ চাপত কি উঁচুতে ওঠার? রামকৃষ্ণ কলোনির প্রত্যেকটা দিন তার রোখ বাড়িয়ে দিয়েছে, তাকে আরও শক্তপোক্ত করেছে, নয় কী?

সুতরাং নীলুর কেসটাও দেখবে বিদিশা। অসুবিধে কী, সামান্য তো ক’টা ফোনাফুনি। গায়ে শালটা ভাল করে জড়িয়ে বিদিশা ফের নেমেছে একতলায়। ডাইনিং টেবিলে বসে অনিমাকে ডাকল, “কী গো, খেতে দেবে না?”

“হ্যাঁ, এই তো… এক মিনিট। শীতের বেলা, একটু গরম করে দিই।”

“বেশি নয়, সামান্য উষ্ণ উষ্ণ হলেই চলবে।” বিদিশা রান্নাঘরের পানে তাকাল। সামান্য গলা উঁচিয়ে হালকাভাবে বলল, “এখনও কি মন খারাপ? মেয়ের চিন্তায়?”

“না না, ও আমি আর ভাবছি না।” ভাতের ডেকচি টেবিলে এনে রাখল অনিমা। ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলে বলল, “কপালে যা লেখা আছে, তাই তো হবে।”

“কপাল-টপাল বোলো না তো। কপাল মানুষ নিজে বানায়।” ঈষৎ ঝাঁঝ ফুটল বিদিশার গলায়, “কত বার করে তখন বলেছিলাম টিংকু স্কুলটা অন্তত শেষ করুক। তারপর আমি কোনও ট্রেনিং-ফেনিংয়ের বন্দোবস্ত করব। আজকাল মেয়েদের কত সুযোগ। প্রাইভেটে নার্সিংয়ের কোর্সই করতে পারত।”

“কী করে বুঝব, জামাইটা এত শয়তান?”

“অপরের দিকে শুধু আঙুল তুলো না। নিজের দোষটাও দেখো। পেটে বিদ্যে না থাকলে মেয়েদের দাম বাড়ির আসবাবের চেয়ে বেশি নয়, এটা বোঝো। বরের ইচ্ছে হলে ঘরে রাখবে, নয়তো ছুড়ে ফেলে দেবে।”

“তা কেন, জামাইয়ের তো মেয়ের ওপর টান আছে। শুধু টাকাটা পেলেই…”

“কত বার টাকা দেবে? যখন আর পারবে না, তখন কী হবে টিংকুর? মুখ বুজে মারধোর খাবে, তাই তো? অথবা মেয়ে নিয়ে তোমার ঘাড়ে চাপবে? কিংবা তোমারই মতো লোকের বাড়ি খেটে মরবে?”

“আমি তো কিছু খারাপ নেই দিদি। দ্যাখো না দ্যাখো, তোমার কাছে চোদ্দো পনেরো বছর হয়ে গেল, এখনও তো ভালই টিকে আছি।”

কথাটা ভুল নয়। শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর পরই অনিমাকে পেয়ে গিয়েছিল বিদিশা। কাছেই মহিষবাথানে বাপের বাড়ি, গেঁজেল বরটা কোন সাধুর চেলা হয়ে উধাও, ছেলেমেয়েদুটোকে বাবা-মায়ের জিম্মায় রেখে এসেছিল অনিমা। খুবই বিশ্বাসী, বিদিশার গোটা সংসারটা চার হাতে সামলায়। বিনিময়ে বিদিশাও তাকে রানির হালে রেখেছে। টাকাপয়সা যখন যা দরকার, সবই পায়। এমনটা তো টিংকুর নাও জুটতে পারে।

যাক গে, মরুক গে, বলে লাভ নেই, অনিমা বুঝবে না। স্বস্তির চেয়ে উদ্বেগে থাকাটাই বুঝি অনিমাদের বেশি প্রিয়। টিংকুর বরটাকে ডেকে একদিন ধাতানোই যায়। কিন্তু তাতে কী সে বদলে যাবে? মনে হয় না? মার্কস সাহেব যাই বলুন, টাকার লোভ কি ঘোচে কখনও? প্রোলেতারিয়েত, বুর্জোয়া, পেটি বুর্জোয়া ও ব্যাপারে সব্বাই সমান।

থালায় ভাত বেড়েছে অনিমা। খাওয়া শুরু করতে গিয়ে হঠাৎ থমকাল বিদিশা। জিজ্ঞেস করল, “বান্টি খেয়ে নিয়েছে?”

“না তো। সে তো বাড়িতেই নেই।”

“তাই নাকি? কখন বেরোল?”

“সেই সক্কালবেলা। জলখাবার খেয়েই।”

বিদিশা জোর চমকেছে। কোথায় গেল বান্টি? দেড়টা বাজে, এখনও ফিরছে না? কাল রাতেও তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, আজ সাড়ে তিনটে নাগাদ বেরোবে…!

বাঁ-হাতে মোবাইলটা নিয়ে বিদিশা বাটন টিপল। কী কাণ্ড, সুইচ অফ! ব্যাপারটা তো ঘোরালো লাগছে। রাত্তিরেও কাল গাঁইগুঁই করছিল, আজ কোথাও পিঠটান দিল নাকি? মেয়েটার কাছে যায়নি তো?

বিদিশার চোয়াল শক্ত হচ্ছিল ক্রমশ। বান্টি ভাবেটা কী? সে না গেলে আটকে যাবে বিয়ে? তেমন বুঝলে আস্ত মেয়ের বাড়িটাকে সে তুলে আনবে সল্টলেকে, তখন বান্টি পালাবে কোথায়?

নাহ, অকারণ দুশ্চিন্তা। মাকে অগ্রাহ্য করবে, এত সাহস নেই বান্টির।

খাওয়া শেষ করে আধ ঘণ্টাটাক গড়িয়ে নিল বিদিশা। উঠে কী যেন ভেবে গেল ছেলের ঘরে। আশ্চর্য, বন্ধ মোবাইল তো বিছানাতেই পড়ে।

আবার হানা দিয়েছে উদ্বেগটা। বান্টি কি তবে সত্যিই…? ছেলের মতলবটা কী? একটা অপরিচিত পরিবারের সামনে তাকে হাস্যাস্পদ করতে চায়?

উদ্বেগ ক্রমশ বদলে যাচ্ছিল ক্রোধে। ফুঁসছে বিদিশা। জ্বলছে। ধপাস করে বসল ড্রয়িংহলের সোফায়। কী করে সে এখন? কোথায় খুঁজবে বান্টিকে?

নীচে কলিংবেলের ঝংকার। বিদিশার কান খাড়া। বান্টি কি ফিরল তবে?

উঁহু, বনানী। বিদিশাকে নিয়ে যেতে হাজির। তাকে অপেক্ষা করতে বলে কাফতান পালটে একটা সুতি গাদোয়াল পরে নিল বিদিশা। সাদা খোল, মেরুন সবুজ পাড়। সাজল পরিপাটি, প্রসাধিত হল মাপমতো। চড়া নয়, আবার একেবারে হালকা হালকাও নয়। মিনিট কুড়ি পর সে যখন রাজেন্দ্রানীর ভঙ্গিতে নামল, কে বলবে তার বুকে একটা রাগ আছাড়িপিছাড়ি খাচ্ছে।

আলগা কুশল বিনিময়ের পালা শেষ। বনানী তাকাচ্ছে এদিক ওদিক, “আপনার ছেলে…?”

“নির্বাণ একটা জরুরি কাজে বেরিয়েছে।” বনানীর মুখের প্রশ্নটা প্রায় কেড়ে নিয়ে বিদিশা অতি স্বাভাবিক স্বরে বলল, “আমায় বোধহয় একলাই যেতে হবে।”

“তো কী আছে? আপনার চয়েসই তো ফাইনাল বিদিশাদি।”

“তবু… ছেলেকেও তোমাদের দেখা হয়ে যেত…”

“সে হবেখন। তাতে কিছু আটকাবে না।” বনানী হাসছে। চোখ পিটপিট করে বলল, “ছোড়দা… মানে আঁচলের বাবা আপনার নম্বরটা নিয়েছিল। ফোন করেছে আপনাকে?”

“কই, না তো।” বিদিশার ঠোঁটে চিলতে হাসি, “উনি অবশ্য ব্যস্ত মানুষ, ঘনঘন টিভিতে দেখা যাছে, গরম গরম ভাষণ দিচ্ছেন…”

“না, না, ছোড়দা একেবারেই রাজনীতির লোক নয় বিদিশাদি। কবেই দিল্লি ফিরে যেত। বড়দার অসুখের জন্য আটকে গেছে। এখানে বন্ধুবান্ধবদের চাপে পড়ে…”

কৈফিয়তটা তেমন বিশ্বাস্য মনে হল না বিদিশার। এই সব কবি শিল্পী সাহিত্যিকদের সে খুব চেনে। পার্টির ঘনিষ্ঠ কতজনকেই তো দেখছে কিনা। কত কী করা হয় এদের জন্য, তবু যেন খাঁই মেটে না। কারণে অকারণে বিবেকের দোহাই দিয়ে চেল্লানি শুরু করে দেয়। এখন শেয়ালের মতো একসুরে দল বেঁধে গাল পাড়ছে পার্টিকে। যত সব সস্তায় নাম কেনার বাসনা!

দেবরাজের প্রসঙ্গ এড়িয়ে বিদিশা বলল, “তোমার বড়দা এখন আছেন কেমন?”

“সবে তো রেডিয়েশান থেরাপি শুরু হল। বড্ড উইক হয়ে পড়েছে। প্রায় শয্যাশায়ী। এরপর কেমোথেরাপি হবে… কতটা কী নিতে পারবে…”

“হুম। চিন্তার কথা।” বিদিশা আলগোছে ঘড়ি দেখল, “চলো। কাজটা সেরেই আসি।”

মানিক গাড়ি বার করেছে। দু’জনে সবে সিটে বসতে যাচ্ছে, বিদিশার হৃৎপিণ্ডে হঠাৎ ঝাঁকুনি।

বান্টি আসছে। ঘাড় নিচু, চুল উশকোখুশকো, ফরসা মুখখানায় যেন কালি লেপে দিয়েছে কেউ।

হলটা কী? কোনও অঘটন? বিদিশার কিছু যায় আসে না।

গলায় কণামাত্র বিরক্তি ফুটতে দিল না বিদিশা। উচ্ছ্বাসও নয়। কৌতূহল তো নয়ই।

বান্টি কাছাকাছি আসতেই হিমেল স্বরে বলল, “যাও, চটপট তৈরি হয়ে এসো। আমরা ওয়েট করছি।”

নির্বাণের চোখে কি করুণ আর্তি? নাকি রণক্লান্ত পরাজিত সৈনিকের হতাশা? বিদিশা গ্রাহ্যই করল না।

১১

হরিনগরে ঢুকতে প্রায় দেড়টা বাজল। শান্তনু ভেবেছিল আর একটু আগেই পৌঁছবে, কিন্তু একবার কারখানা ছুঁয়ে আসতে হল যে। একখানা এনামেলিং মেশিন ক’দিন ধরে গড়বড় করছে, গতকাল থেকে চলছে মেরামতির কাজ। কদ্দূর এগোল, সরেজমিন তো করতেই হয়। তাড়াতাড়ি সারাই না হলে লেবারদের তো পোয়াবারো, তারা তো মাইনে ঠিকই পাবে। মাঝখান থেকে গাঁটগচ্চার পরিমাণ খানিক বাড়বে শান্তনুর। মন্দার বাজারে বড্ড গায়ে লাগে। উপায় থাকলে আজ সারাদিনই শান্তনু কারখানায় পড়ে থাকত। কিন্তু আজ হরিনগরে আসাটাও যে বড্ড জরুরি। কাজ শুরুর আগেই অশান্তির উপক্রম দেখা দিয়েছে, ঝামেলার সম্ভাবনা জিইয়ে রাখা মোটেই ঠিক নয়।

বেঁটে পাঁচিল ঘেরা অন্দরে গাড়ি রেখেছে ড্রাইভার। একতলা বাড়িটার সামনে। আগে ছিল শুধু একখানা খাপরার ঘর, এখন খানতিনেক রুমওয়ালা মোটামুটি ভদ্রস্থ চেহারা। অফিসকে অফিস, কেউ এসে রাতে থাকলে তারও বন্দোবস্ত মজুত।

কেয়ারটেকার কাম সিকিউরিটি স্টাফ শ্যামাপদ গেটেই ছিল। গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে এসেছে ভিতরে। শান্তনু আর অম্বর নামতেই বিনয়ী সুরে বলল, “পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো স্যার?”

শান্তনু হাসতে হাসতে বলল, “রাস্তাটা যা করে রেখেছ তোমরা! ফেরার পথে না টায়ার পালটাতে হয়।”

“এবার সব ঠিক হয়ে যাবে স্যার। সবে তো পঞ্চায়েতটা বদলাল… লোকসভা হয়ে গেলেই শুনছি নতুন করে রাস্তা তৈরির কাজ শুরু হবে।”

“বলছ?”

“হ্যাঁ স্যার। আর ক’টা মাস যেতে দিন।”

মনে সংশয় সত্ত্বেও শান্তনু আর কিছু বলল না। শ্যামাপদর সামনে কোনও বেফাঁস কথা বলা উচিত হবে না। সবে মাস তিনেক হল বহাল হয়েছে শ্যামাপদ, পঞ্চায়েত ভোটের পর। আগে ছিল উপেন নামে এক ছোকরা। লাল পার্টি এখানে ভোটে হেরে যেতেই তাকে জবাব দিতে হয়েছে। ঘাসফুল পার্টির ইচ্ছেমাফিক শ্যামাপদই এখন জায়গাটার দেখভাল করছে। অম্বরই একে এনেছে, স্থানীয় পঞ্চায়েতের সঙ্গে কথা বলে। শ্যামাপদ লোকটি অবশ্য এমনিতে মন্দ নয়। কাছেই চণ্ডীপুর এক নম্বর ব্লকে নিবাস, বউ-বাচ্চা আছে, চুরি-টুরি করে না…। শুধু বোধহয় আশায় আছে, মাছের কারবারটা আরম্ভ হলে পরিবারের আরও দু’-একজনকে ঢোকাবে এখানে। স্থানীয় পার্টির সঙ্গে শ্যামাপদর যোগাযোগ ভাল বলে তার সামনে একটু বুঝে-সমঝে কথা বলতে হয়।

শ্যামাপদ হাসি হাসি মুখে বলল, “এখন ভাত খাবেন তো আপনারা?”

অম্বর তাড়াতাড়ি বলল, “না না। কোলাঘাটে খেয়ে নিয়েছি। আপনি বরং নরেশবাবুকে খবর দিন।”

“উনি জেনে গেছেন। ফোন করেছিলেন আমাকে। দু’টোর সময়ে আসবেন। …আপনারা ততক্ষণ বসুন। একটু চা-টা খান।

“হুঁ, সেই ভাল।”

শান্তনু সায় দিল বটে, তবে তক্ষুনি ঘরে গেল না। হেঁটে-চলে দেখছিল জায়গাটা। যখন কিনেছিল, ঝোপঝাড়ে ভরতি ছিল, এখন প্রায় পুরোপুরি সাফসুতরো। কোণের দিকের ছোট ডোবাটাও অনেক পরিষ্কার এখন। রুই কাতলার চারা ছেড়েছিল, মোটামুটি নির্বিবাদেই বাড়ছে তারা।

শুকনো শুকনো ঘাসে ছাওয়া এবড়ো- খেবড়ো জমিটার প্রায় মধ্যিখানে গিয়ে দাঁড়াল শান্তনু। কল্পচোখে দেখল পরিকল্পনাটা। ঠিক যেখানে সে দাঁড়িয়ে, এখানেই কাটবে বড় পুকুর। চারশো ফিট লম্বা, নব্বই ফিট চওড়া। আর একটা হবে একটু ছোট মাপের। এমনভাবে কাটতে হবে, যেন প্রয়োজনে দুটোকে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়। আর বড়-ছোট চৌবাচ্চা বানাতে হবে অন্তত খান চারেক। অফিস আর পাঁচিলের মাঝামাঝি বসবে তার মিনি প্ল্যান্ট। থাকবে হিমায়নের বন্দোবস্ত, প্রসেসিংয়ের যন্ত্রপাতি, এমনকী প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থাও। হিমায়নের মেশিন সমৃদ্ধ দু’খানা কন্টেনার গাড়িও থাকবে কম্পাউন্ডে। বাসুদেববাবু, মানে যে মত্স্যচাষ বিশেষজ্ঞ এই পরিকল্পনাটি ছকে দিয়েছে, তার মতে আপাতত জনা কুড়ি লোক নিলেই যথেষ্ট। কিন্তু তারা থাকবে কোথায়, সেটাও তো চিন্তা। আরও কী কিনতে হবে জমি? কিন্তু গোটা চণ্ডীপুরে এখন জমি কেনা নিয়ে যা চলছে…

শ্যামাপদর গলা শোনা গেল, “স্যার, চা রেডি। চলে আসুন।”

শান্তনু ঘুরল। অম্বরকে বলল, “চল।”

হাঁটতে হাঁটতে অম্বর বলল, “একটা কথা বলব বড়কাকা?”

“কী রে?”

“নরেশ বেরা কিন্তু গভীর জলের মাছ। দেখো, এমন কিছু বোলো না যাতে সে চটে যায়।”

“তুই আমাকে উপদেশ দিচ্ছিস?” শান্তনু হাসল সামান্য, “ব্যবসা-ট্যবসা তুই তা হলে আজকাল ভালই বুঝছিস?”

“না, না, তা নয়। আমি ভেবেচিন্তে অ্যাপয়েন্টমেন্টটা করলাম তো… তাই ভাবছি হিতে না বিপরীত হয়।”

“ঘাবড়াচ্ছিস কেন? দেখি না কী বলে।”

মাঘের দুপুর। বাইরে রোদের তাপ বেশ কড়া, অথচ ঘরে ফ্যানের হাওয়ায় শীত করছে অল্প অল্প। তবু পাখা বন্ধ করতে বলল না শান্তনু। এই ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজটাই তার প্রিয়। চা শেষ হতেই টুকুস বেরিয়ে গেছে অম্বর। নির্ঘাত সিগারেট ফুঁকতে। টাকা পুড়িয়ে মানুষ কী যে আনন্দ পায়!

শান্তনু চট করে মোবাইলে একটা কল সেরে নিল। কলকাতার কারখানায়। মাঝে মাঝে ফোন করলে কর্মচারীরা সতর্ক থাকে। আছেও বোধহয়। মেরামতি আজই শেষ হয়ে যাবে সম্ভবত। ফেরার পথে একবার নামবে কি?

ভাবনার মধ্যেই বাইরে মোটরবাইকের আওয়াজ।

ক্ষণ পরে শ্যামাপদ হাজির। সঙ্গে এক ভদ্রলোক। পিছন পিছন অম্বর।

আলাপ পরিচয় সারতে সারতে নরেশ বেরাকে খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিল শান্তনু। বছর চল্লিশ বয়স, পরনে ধুতিশার্ট, গলায় সরু সোনার চেন। ঠোঁটের ওপর সযত্নলালিত মিহি গোঁফ। পায়ের চটিজোড়া যথেষ্ট দামি। হাতের মোবাইলখানিও নেহাত কম মূল্যের নয়।

মুখে পেশাদারি হাসি বজায় রেখে শান্তনু বলল, “কী খাবেন বলুন? চা, না কফি?”

“কিচ্ছু না। এই তো খেয়ে উঠলাম।” বলেই মোবাইল টিপে সময় দেখল নরেশ। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল, “আমার হাতে কিন্তু বেশি টাইম নাই। সাড়ে তিনটেয় ভূমিরক্ষা সমিতির একটা মিটিং আছে আজ। নেহাত অম্বরবাবুকে কথা দিয়েছিলাম…”

“ও।” শান্তনু একটু থেমে থেমে বলল, “বেশ, কাজের কথাই হোক। শুনলাম, আমার কাজকর্ম আপনি আপাতত স্থগিত রাখতে বলেছেন…”

হাতের ইশারায় শ্যামাপদকে ঘর থেকে চলে যেতে বলল নরেশ। তারপর বেতের চেয়ারখানায় হেলান দিয়ে বসেছে, “তা না হলে কি আপনি কলকাতা থেকে ছুটে আসতেন?”

“সে তো আপনি একবার ডাকলেই আমি আসতাম। আপনি এখানকার জেলা পরিষদের মেম্বার, এত বড় নেতা… আপনার আহ্বান আমি উপেক্ষা করতে পারি? আমার মতো এক নগণ্য চুনোপুঁটিকে হুমকির কী প্রয়োজন?”

“উঁহু, হুমকি তো দিই নাই। শুধু বলেছি, আমাকে না জানিয়ে কাজ স্টার্ট করবেন না।”

“বেশ। তা এখন তো জানলেন। আর নিশ্চয়ই কোনও সমস্যা নেই?”

নরেশ মুচকি হাসল, “শুনুন শান্তনুবাবু। কাজ শুরুরও একটা প্রসেস আছে। লাল পার্টি যা-ই বদনাম করুক, আমরাই কিন্তু উন্নয়ন চাই। আপনি যে গণ্ডগোলের অপপ্রচারে ভয় না পেয়ে এখানে শিল্প গড়তে এসেছেন, আমরা খুশি হয়েছি। আমরা চাই, কাজটা আপনি ঘটা করে আরম্ভ করুন।”

“ভাল কথা। সেরকম ব্যবস্থা নয় হয়ে যাবে। বলুন, কীভাবে করতে হবে?”

“যদি বলি, লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত হাত পা গুটিয়ে বসে থাকুন?”

“মানে?”

“অতি প্রাঞ্জল। আমাদের যা হিসাব, পূর্ব মেদিনীপুরের এই লোকসভা আসনটি আমরা জিতছি। আমাদের মাননীয় সাংসদ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রকল্পটির শিলান্যাস করবেন, এটাই আমাদের বাসনা।”

“তার মানে চার পাঁচ মাস প্রোজেক্টটা পিছিয়ে যাবে?”

“তা কেন। কাজকর্ম আপনি স্টার্ট করতেই পারেন। পুকুর কাটান… বিল্ডিং বানাতে থাকুন… আর যা যা করণীয়, তাও শুরু করুন। তবে অফিশিয়ালি প্রকল্পের সূচনা হবে আমাদের সাংসদের হাত দিয়ে। শুধু তাই নয়, গোটা রাজ্য জুড়ে এখন এক মহা পরিবর্তন আসন্ন। আগামী বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের ক্ষমতাও আমাদের দখলে আসবে। আসবেই। সুতরাং আমাদের ইচ্ছা, তখন কোনও মন্ত্রী এসে আড়ম্বর সহকারে প্রকল্পটির উদ্‌বোধন করুন। তাতে আপনারও পাবলিসিটি হবে, আমাদেরও।”

শান্তনু দু’-চার সেকেন্ড ভাবল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “নো প্রবলেম। তাই হবে। তবে আমি যে আপনাদের কথাগুলো মান্য করব, বিনিময়ে আমারও তো কিছু প্রত্যাশা আছে।”

“কীরকম?”

“প্রথমত, আমার আরও খানিকটা জমি লাগবে। দ্বিতীয়ত, স্টাফ রিক্রুটমেন্টে স্থানীয় লোকদের নিতে হবেই, এমন গ্যারান্টি দিতে পারব না। তৃতীয়ত, ট্যাক্সের ব্যাপারে যদি বিশেষ ছাড় সম্ভব হয়…”

“সব পাবেন। তবে স্থানীয় মানুষ একেবারেই চাকরি পাবে না, এটাও তো সম্ভব নয়।” নরেশের চোখে ধূর্ত হাসি, “পূর্ব মেদিনীপুরের লাল মহারাজ আপনাকে কোনও শর্ত-টর্ত দেয়নি? কোনও ফোন পাননি সেখান থেকে?”

চমকে উঠতে গিয়েও সামলে নিল শান্তনু। রাজনীতির লোকদের কি কিছুই অগোচর থাকে না? স্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “হ্যাঁ, একটা কার্টসি কল করেছিলেন বটে, সেরকম তো কোনও কথা হয়নি।”

“ছাড়ুন, ছাড়ুন। আমরা সব জানি। লালদের হুকুম মতোই তো উপেনকে আপনি পুষছিলেন, নয় কী? ওরা আপনাকে একটা লোকও ইচ্ছেমতো নিয়োগ করতে দিত না। আমরা মোটেই ওই প্রকার অত্যাচার করব না। তবে হ্যাঁ, অঞ্চলের মানুষদের ইচ্ছে অনিচ্ছের ব্যাপারগুলোও তো আমাদের মানতে হবে। আপনি আমাদের দেখবেন, আমরাও আপনাকে দেখব, এটাই তো স্বাভাবিক সম্পর্ক, ঠিক কী না?”

“হুম। অবশ্যই।”

“ব্যস, তা হলে তো কথা হয়েই গেল। এবার নেমে পড়ুন কাজে। তা যেভাবে বললাম, সেভাবেই ধাপে ধাপে এগোবেন। কেউ কোনও ভাবে বাধা সৃষ্টি করলে সরাসরি আমায় ফোন করবেন।” বলতে বলতে নরেশ উঠে দাঁড়িয়েছে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “আজ তা হলে চলি?”

“আসুন।” শান্তনুও উঠে দাঁড়িয়ে হাত ধরেছে নরেশের। মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “আবার দেখা হবে।”

“নিশ্চয়ই।” নরেশ বেরিয়ে যেতে গিয়েও কী ভেবে আবার ঘুরেছে। স্মিত মুখে বলল, “আমাদের নির্বাচনী তহবিলের কথাটা কি আপনাকে বলেছি?”

নরেশের চোখে চোখ রাখল শান্তনু। হাসি হাসি মুখে ঠোঁট নাড়ল, “অবশ্যই বলেছেন। আমার খেয়াল আছে।”

মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল নরেশ। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মোটরবাইকের সগর্জন মিলিয়ে যাওয়াটা দেখল শান্তনু। ফের ঘরে এসে বসতেই এতক্ষণ নিশ্চুপ অম্বরের গলা বেজে উঠেছে, “নরেশবাবু কখন তোমায় ইলেকশন ফান্ডের কথা বলেছেন?”

শান্তনু হেসে ফেলল, “তুই গাধাই রয়ে গেলি। ওটা একটা স্টাইল অফ অ্যাপ্রোচ। উনি নেতা মানুষ… সরাসরি আমার কাছে টাকা চাইবেন?”

“বুঝেছি।” অম্বর ঘাড় দোলাচ্ছে, “তা দেবে কত?”

“এক লাখ তুলে রাখব। একবারে নয়, তিন খেপে দিবি।”

“মাত্র এক লাখে কি পটবে এই পার্টি?”

“দেখা যাক। লালরাও তো আমাকে ছাড়বে না। দু’দিক সামলেসুমলেই তো…।” শান্তনু হাসছে, “আমাদের, ব্যবসাদারদের, কাজ কী জানিস? স্রোতের সঙ্গে চলো, হাওয়া বুঝে পাল তোলো। কিন্তু হালটিকে ঠিকভাবে ধরে রাখো, যাতে নৌকো নির্ভুল নিশানায় পৌঁছয়। কী বুঝলি?”

অম্বর দু’দিকে মাথা নাড়ল।

“তোর বুঝে কাজ নেই। চল, মিটিং তো ওভার, এবার ফিরি।”

“এক্ষুনি?”

“হোয়াই নট? সময় নষ্ট করব কেন? যদি পাঁচটা, সাড়ে পাঁচটার মধ্যে কলকাতা ঢুকে যেতে পারি… তা হলে একবার ফ্যাক্টরিতে…”

ফিরছে শান্তনু। সিটে হেলান দিয়ে হিসেব কষছে, হরিনগর এসে কতটুকু লাভ হল আজ। কাজ যে এখন একটু ধীর লয়ে এগোতে হবে, এ তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু সেটাই কি শান্তনুর কাম্য নয়? আঁচলের বিয়েটা এমন হুড়মুড়িয়ে ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল!

সত্যি, আঁচলের বিয়েটা যে এক সিটিংয়ে ফাইনাল হয়ে যাবে, শান্তনু কল্পনাও করতে পারেনি। ভেবেছিল আঁচলকে পছন্দ হলেও কথাবার্তা চলবে, বিয়ে হলেও ঘটতে ঘটতে সেই শ্রাবণ। কিন্তু বনানী দুম করে এমন একটা স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ তুলে দিল…! আঁচলের জ্যাঠা ক্যানসারে ভুগছে, কবে আছে কবে নেই… যদি ফাল্গুনে বিয়েটা হয়, তা হলে হয়তো উনি দেখে যেতে পারবেন…! ছেলের মা তো এক কথায় রাজি, মানসীও দুম করে বলটা শান্তনুর কোর্টে ঠেলে দিল…। শান্তনু কি এরপর অসম্মতি জানাতে পারে? আঁচল হয়তো ভাবত তার বাপি এত নিষ্ঠুর, যে তার জেঠুর মারণরোগকেও আমল দিতে চায় না! অথচ কী কৌতুক, সেই রাত্রেই কিনা মানসীর চোটপাট শুনতে হল শান্তনুকে! কেন তুমি এই ফাল্গুনেই মত দিলে! জেঠুর সঙ্গে কী এমন সম্পর্ক আছে আঁচলের, যে তার অসুখবিসুখের কথা ভেবে বিয়ের দিন স্থির করতে হবে! এত অল্প নোটিশে একটা ভাল বিয়েবাড়ি ভাড়া পাওয়া কি সম্ভব! তার ওপর অজস্র কেনাকাটা, নেমন্তন্নর চিঠি ছাপানো, সেগুলো বিলি করা… সবই তো আমায় একা হাতে তুলতে হবে!

কথাটা একশো ভাগ ঠিক। শান্তনু তো অত সময় দিতে পারবে না। তার চেয়েও বড় কথা, টাকা। আঁচলের বিয়ে তো শান্তনু নমো নমো করে সারতে পারবে না। আঁচল বলেই পারবে না। সেই কত বছর আগে সে সাগ্রহে আঁচলের ভার নিয়েছিল। কায়মনোবাক্যে সে তার দায়িত্ব পালন করেছে। বিয়েটাও তো এমনভাবে হওয়া দরকার, যাতে আঁচলের মনে কোনও খেদ না থাকে। শান্তনু একটা খসড়া করে দেখেছে, অন্তত লাখ বিশেক তো খরচ হবেই। এতগুলো টাকা এই অল্প সময়ে নগদে হাতে রাখা কি সহজ কাজ?

তবু… পারতেই হবে। শান্তনুর কাছে এটা একটা চ্যালেঞ্জ। চিংড়িমাছ চাষের প্রকল্পের চেয়ে যার মূল্য অনেক অনেক বেশি। সুতরাং হরিনগর নয় একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই হাঁটুক এখন। নতুন ব্যবসার জন্য সরিয়ে রাখা সঞ্চয়ে হাত পড়বে। তো কী আছে? আগামী চার-ছ’মাসে শান্তনু কি অবস্থা সামলে নিতে পারবে না?

নন্দকুমারের মোড়ে দীর্ঘ যানজট। একটা ভারী ট্রাক উলটে গেছে রাস্তায়। কোনওক্রমে ঢিকুর ঢিকুর করে এগোচ্ছে গাড়িঘোড়া। হর্ন আর লোকজনের কোলাহলে কানের পরদা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। স্টিয়ারিংয়ে বসা বিমল বিরক্ত মুখে বলল, “এ তো বিচ্ছিরি ভাবে ফেঁসে গেলাম! সন্ধের আগে কোলাঘাট পেরোতে পারলে হয়।”

অম্বর ঠাট্টার সুরে বলল, “ওই নরেশ বেরাই বোধহয় অলুক্ষুনে।”

“তা কেন। ও তো আজ তোর উপকারই করে গেল রে।”

“কীভাবে?”

“তোকে এখন এক-দু’মাস ফি হপ্তা হরিনগর আসতে হবে না।”

“তুমি কী সত্যি সত্যি এখন কাজ স্টপ করে বসে থাকবে? ওই শিলান্যাস কবে হবে, সেই আশায়?”

“ক’দিন নয় অপেক্ষা করলামই। অন্তত আঁচলের বিয়েটা আগে চুকুক। তারপর নয় কনস্ট্রাকশন, মাটি কাটার ব্যাপারগুলো নিয়ে এগোব।”

“হুঁ, ওদিকে তো এখন অনেক কাজ। তোমার বড়মেয়ের বিয়ে বলে কথা।”

“তোকে যে দায়িত্বগুলো দিয়েছি, সেগুলো পালন করছিস?”

“কোনটা বলো তো?”

“গড়িয়াহাট বালিগঞ্জ ফাঁড়ির বিয়েবাড়িগুলো তো পাওয়া গেল না..”

“তেইশে ফাল্গুন দিনটায় এত রাশ…। তবে কসবায় একটার সন্ধান মিলেছে। রিসর্ট টাইপ, খুব গরজাস, অনেকটা স্পেস…”

“তো বুক করিসনি কেন?”

“একটু ইন্টিরিয়রে যে। মেন রোড থেকে খানিকটা ভিতরে। তুলনায় চার্জটাও হাই। পৌনে দু’লাখ চাইছে।

“তুই দেখেছিস জায়গাটা?”

“না মানে… রেটটা শুনে…”

“তুই একটি হাঁদা। কাল সকালেই যাবি। আমার সাইন করা চেক নিয়ে। যে অ্যামাউন্ট বলবে, বসিয়ে দিবি। …আর গেস্টহাউস বুকিংয়ের কী হল?”

“দেখছি। গড়িয়াতেই যদি কাছেপিঠে পাই…”

“ওফ, হরিবল! মোটামুটি তো জানিস, বিয়েবাড়ি কোথায় চাইছি। তার কাছেপিঠে না ভেবে গড়িয়ায়…? রানিগড়ের লোকদের তুই চিনিস না? বিয়েবাড়ি দূরে হলে তারা যাতায়াতই করতে পারবে না।”

“হুঁ। আমার বাবা মা তো পারবেই না।”

“যাক গে, শোন। তোমার এই গয়ংগচ্ছ ভাব আমার ভাল লাগছে না। ফরটি এইট আওয়ারস সময় দিলাম, তার মধ্যে বুকিংয়ের কাজগুলো সেরে ফেলা চাই। কেটারিং, ডেকরেশান সমেত। প্রয়োজন বুঝলে কাকিমাকে নিয়ে যাও সঙ্গে। এই কারণে হয়নি, ওই জন্য আটকাল, এসব অজুহাত আমি কিন্তু শুনতে চাই না।”

“খাবারের মেনু কিন্তু এখনও ফাইনাল হয়নি!”

“আশ্চর্য, পরশু রাতেও খেতে বসে অত আলোচনা হল…!”

“তাতে বেরোলটা কী? অলি বলছে ফ্রায়েড রাইস, কাকিমা চাইছে পোলাও। স্টার্টার নিয়ে তো তোমার সঙ্গে অলির লেগে গেল। কাকিমা বলছে আইটেম কমাতে, তুমি চাও আরও বাড়াতে।”

“দ্যাখ অম্বর, এটা আমার জীবনের প্রথম বড় কাজ। আই ওয়ান্ট টু মেক ইট আ গ্র্যান্ড সাকসেস। বিরিয়ানি চাঁপ কাবাব পাতুরি মালাইকারি সব থাকবে। সব।” শান্তনু একটু দম নিয়ে উত্তেজিতভাবে বলল, “এক কাজ কর তুই। বাছাই করা তিনটে বড় কেটারারের লোককে তুই নিয়ে আয় অফিসে। কালই। আমি অন দা স্পট ফাইনাল করব। এমন একটা আয়োজন হবে, যাতে এই বিয়ের কথা সকলে মনে রাখে।”

বাক্যগুলো উচ্চারণ করে বেশ একটা তৃপ্তি অনুভব করল শান্তনু। পরক্ষণে এক চোরা আশঙ্কা তিরতির। বিয়ে স্থির হওয়ার দিন থেকে অনুভূতিটা ফিরে আসছে বারবার। কেন যেন মনে হচ্ছে, জাঁকজমক সবই নয় হল। কিন্তু তার উদ্দেশ্যটা সফল হবে তো? সুখী হবে তো আঁচল? মেয়েকে নিয়ে একটা দুশ্চিন্তার ভারী বোঝা বয়ে বেড়ায় মানসী। সেটা পুরোপুরি লাঘব হবে তো? চিরতরে?

কোথা থেকে যে উদয় হল ভাবনাটা? ছেলের মাকে দেখে? মহিলা একটু দাম্ভিক গোছের আছেন বটে, নিজের মতামতই চূড়ান্ত বলে মনে করেন। তবে ছেলে, ছেলের বউয়ের জীবনে বিশেষ নাক গলাবেন বলে মনে হয় না। যা ব্যস্ততার ফিরিস্তি শোনালেন, সময় কোথায় ওঁর! তা হলে কি নির্বাণ ছেলেটাকে ঘিরেই উত্কণ্ঠা? দেখতে অবশ্য মন্দ নয়, লালটু লালটু গোছের। অলি তো নাম দিয়েছে আলুভাতে। ছেলেটা বড্ড বেশি চুপচাপ। নিজে থেকে সেদিন একটি কথাও বলেনি। প্রশ্ন করলে ‘হুঁ’, ‘হ্যাঁ’ দিয়ে জবাব সারছিল। অলির মতো বাচাল মেয়েও ছেলেটাকে মুখর করতে পারল না একটুও। অন্তর্মুখী নাকি? আঁচলের সঙ্গে টাইপটা তা হলে মিলবে। কিন্তু সমমেরু বলেই বিকর্ষণ ঘটবে না তো? শান্তনুর কেন যে মনে হল, ছেলেটির ব্যক্তিত্বের অভাব আছে! প্রতিটি তুচ্ছ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়েও যেমন চোরাচোখে তাকাচ্ছিল মায়ের দিকে…!

কথাটা সে রাতেই মানসীকে বলেছিল শান্তনু। তেমন যেন গ্রাহ্যই করল না মানসী। বেমালুম বলে দিল, “ভালই তো। আঁচলের ওপর কোনও ব্যাপারে জোর ফলাবে না।”

শান্তনু তাও বলেছিল, “তোমার ধারণাটা বোধহয় ঠিক নয় মানসী। দুর্বল ব্যক্তিত্বের পুরুষরাই কিন্তু হীনমন্যতায় ভোগে। এবং বউয়ের ওপর জোরজবরদস্তি ফলায়।”

“আমাকে তুমি পুরুষ চিনিয়ো না। সবল ব্যক্তিত্বের পুরুষরা কী করে তা আমি জানি। হাড়ে হাড়ে জানি।”

উত্তরটা ঠং করে বেজেছিল শান্তনুর কাছে। একটু চুপ থেকে বলেছিল, “তুমি দেবরাজ সিংহরায়ের সঙ্গে নির্বাণের তুলনা এনো না। উনি শিল্পী মানুষ। দুশ্চরিত্র, কিন্তু খেয়ালি। ঘরসংসার ঠিকভাবে করার জন্য একটু অন্য ধরনের লোক লাগে।”

“সেই জন্যই তো নির্বাণকে আমার পছন্দ হয়েছে। ওরকম নরম-সরম ছেলেই আঁচলের জন্য মানানসই।” মানসী মুচকি হেসেছিল, “আঁচলের আড়ালে ও ঢাকা থাকবে।”

শান্তনু আর কথা বাড়ায়নি। মানসী যদি নির্বাণে সন্তুষ্ট হয়, সে আর আপত্তি তুলবে কেন। শুধু অস্বস্তি একটা রয়েই গেছে। মানসীকে সে চেনে বলেই বুঝি ভয় পাচ্ছে। শান্তনুর ওপর মানসীর অগাধ আস্থা। ভবিষ্যতে যদি কখনও কোনও অঘটন ঘটে, তাকে দায়ী করবে না তো মানসী? বলবে না তো, মনে যখন শঙ্কা ছিলই, জোর করে সম্বন্ধটা ভেঙে দিলে না কেন! শান্তনু কি তখন বোঝাতে পারবে, স্রেফ উড়ো সংশয়ের ভিত্তিতে এমনটা করা সে অসংগত ভেবেছিল!

নাহ, মানসীকে চেনাটা বোধহয় আজও সম্পূর্ণ হয়নি শান্তনুর। দেবরাজের ঠোক্কর খেয়ে বেরিয়ে আসা সেই দুঃখী মেয়েটাই যে এখনও তার চেতনাকে আবিষ্ট করে রেখেছে! কেন যে এখনও মনে হয়, এমন কিছু সে করবে না যাতে কণামাত্র আহত বোধ করে মানসী! যুক্তি দিয়ে সে বোঝায় প্রাণপণ, কিন্তু মতে না মিললে মানসীর কথাই সে মেনে নেয় শেষমেশ।

দেবরাজের উদ্দেশ্যে ঠিকরে আসা মানসীর ঘৃণা যে অকৃত্রিম ঘৃণা নয়, সেটাও কি শান্তনু টের পায় না? হয়তো পায়। হয়তো তার প্রখর আত্মসম্মানবোধই তাকে শান্ত, অনুত্তেজিত করে রাখে। একই সঙ্গে এও হয়তো বুঝতে পারে, তার অচঞ্চল পৌরুষ মানসীর স্বামী হিসেবে তাকে অনেকটা উঁচু আসন দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু প্রেমিকের ভূমিকায় সেই লম্পটটার চেয়ে সে পিছিয়ে।

মেয়েরা যে পুরুষের মধ্যে ঠিক কী চায়? নির্ভরতা? নিরাপত্তা? দামালপনা? খেপামি? নাকি সব কিছুই? একই সঙ্গে? একই অঙ্গে?

“বড়কাকা?” অম্বর ডাকছে, “তুমি কি সত্যিই এখন ফ্যাক্টরি যাবে?”

শান্তনু অস্পষ্টভাবে বলল, “উম।”

“আমি আর গিয়ে কী করব? আমাকে যদি রবীন্দ্র সদনের মুখটায় নামিয়ে দাও…”

শান্তনু একইভাবে বলল, “উম।”

“দেরি করব না। ন’টার মধ্যে বাড়ি ঢুকে যাব।”

এবার আর ধ্বনিটুকুও ফুটল না। কখন বম্বে রোড ছেড়ে কোনা এক্সপ্রেস ওয়েতে পড়ল গাড়ি, কখন পেরোল বিদ্যাসাগর সেতু, আঁধার ঘনিয়েছে শহরে, কখন নেমে গেল অম্বর, কিছুই যেন টের পাচ্ছিল না শান্তনু। হিসেবি মানুষটার যেন ভাবসমাধি ঘটেছে সহসা।

নাকি হিসেবের তল খুঁজে পাচ্ছিল না শান্তনু। তাই বুঝি ডুব দিয়েছে আরও অতলে?

১২

বিয়ের আর তিন সপ্তাহও বাকি নেই। পূর্ণোদ্যমে বাজারহাটে নেমে পড়েছে মানসী। দেওয়া-থোওয়ার ব্যাপার আছে, শাড়ি কিনতে হচ্ছে রাশি-রাশি। অন্য পোশাকও নিতে হচ্ছে নানানরকম। আঁচলের জন্য তো এলাহি আয়োজন। তার শাড়ি, তার সালোয়ার কামিজ পছন্দ করা কী সোজা কাজ! একটু চিকমিক কোথাও থাকলে মেয়ে পরবে না। এথনিক টাচ আর ধ্রুপদি ঐতিহ্য পছন্দ করে আঁচল। রং নিয়েও তার ফ্যাচাং কম নয়। নিজে কেনাকাটায় বেরোতে তার ঘোর অনিচ্ছে, তবু সে যাচ্ছে কোনও কোনও দিন। কখনও বা সঙ্গে অলি। বেনারসি কেনার দিন বনানী যেচে সঙ্গ নিল। তার ইচ্ছে লাল টুকটুকে, ওদিকে চড়া রং আঁচলের দু’ চোখের বিষ, অগত্যা রফা হল দুধেআলতায়। প্রসাধন সামগ্রী, নাইটি-ফাইটি, আর অন্তর্বাসের দায়িত্ব মেয়েদের ওপর ছেড়ে দিয়েছিল মানসী, দু’ বোন মিলে কিনে আনল একদিন। অলি যাওয়া মানে আর এক ঝকমারি। তার নজর সর্বদা উঁচুর দিকে। নামী ব্র্যান্ডের দামি জিনিসটি ছাড়া তার মন ওঠে না। আঁচলের আপত্তিকে সে বুড়ো আঙুল দেখায়। তবে শান্তনুর নির্দেশ অলিরই পক্ষে। ঢালাও হুকুম আছে, খরচের কথা ভেবে যেন সমঝোতা না করা হয়।

এখনও আর একটা আসল কাজ অবশ্য বাকি। নেমন্তন্ন। এক-দু’দিনের মধ্যে এসে যাবে কার্ড, তারপর শান্তনুকে নিয়ে টো-টো করতে হবে সারাদিন। একেবারে নিকটজন না হলেও এ শহরে শান্তনু-মানসীর আত্মীয় তো কম নেই। মানসীর বাবার বাড়ির তরফ, মামার বাড়ি, শান্তনুর তুতো ভাইবোন, ব্যবসার লোকজন, কারখানার কর্মচারী…। এর পর আঁচলের বন্ধু, অলির দলবল…। অলির তালিকা যেভাবে বাড়ছে রোজ, নিমন্ত্রিতের সংখ্যা না ছ’শো ছাড়িয়ে যায়।

আজও মানসী দুই মেয়েকে নিয়ে বেরিয়েছিল। ব্লাউজ়, কামিজ এসবের মাপ-টাপ দিতে। ফিরে দেখল দাদা বউদি বসে আছে, আর অম্বর তাদের খাতিরদারি করছে।

অলি উল্লসিত স্বরে বলল, “মামা মামি! তোমরা কখন এলে? একটা কল করোনি কেন? আমাদের তো কখন শেষ, বারিস্তায় বার্গার সাঁটাচ্ছিলাম। জানলে তোমাদের জন্যও আনতাম।”

তাপস হাসিমুখে বলল, “আমরা গরম গরম সিঙাড়া খেয়েছি রে। প্লাস, চা।”

“চা কে বানাল? অম্বরদা?”

“না না, কুসুমদি বানিয়েছে।” অম্বর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “খারাপ করেনি। লিকার চিনি ঠিকঠাকই ছিল।”

“তাই বলো! তুমি চা করেছ শুনলে আমি হার্টফেল করতাম। হি হি।”

অম্বর যেন সামান্য অপ্রস্তুত। মানসীর মজা লাগল দেখে। নিজের গলতাটি ছেড়ে অতিথি আপ্যায়নের কর্তব্যটি পালন করছে বলে একটু বুঝি খুশিও হল। মানতেই হবে, ছেলেটার গা এলানো ভাব কমেছে ইদানীং। ব্যস্ত কাকার হয়ে বিয়ের ঝক্কিও সামলাচ্ছে অনেকটা। যাক, শান্তনুর দৌলতে ছেলেটা বোধহয় মানুষ হয়ে গেল!

কিন্তু দাদা বউদি কেন আজ? তাও না জানিয়ে? আঁচলের বিয়ে স্থির হওয়া মাত্র কী উৎসাহ নিয়ে বাপের বাড়িতে খবরটা জানিয়েছিল মানসী, তখনই এমন একটা বোমশেল ফাটাল দাদা! ওই সময়েই নাকি দাদা বউদিকে বোস্টন যেতে হবে, ছেলের কাছে! শোনা ইস্তক মানসী আর যোগাযোগ করেনি দ্যাবা-দেবীর সঙ্গে। এত কেনাকাটা গেল, বউদিকে ডাকেনি একবারও। বোনের গোঁসা টের পেয়ে কী দাদা সিদ্ধান্তটা বদলাল?

বোঝার অবশ্য উপায় নেই। না দাদাকে দেখে, না বউদিকে। রিনা তো দিব্যি রসিকতা জুড়েছে আঁচলের সঙ্গে, “কী রে, দিন তো ঘনিয়ে এল। ব্রাইডাল পলিশ-টলিশ শুরু করেছিস?”

আঁচল অবাক মুখে বলল, “সেটা আবার কী?”

অলি খিলখিল হেসে উঠল, “দিদিভাইকে ওসব বলে লাভ নেই গো মামি। ও কেবলি দি গ্রেট। কিস্যু জানে না।”

“ওমা, সে কী? পার্লারে গিয়ে একটু মাজাঘষা কর। সর্বাঙ্গে বিয়ের কনে বিয়ের কনে ভাব আন।”

“ধুস। দিদিভাই পার্লারে যাবেই না। কত বার বলছি ওয়াক্সিং কর, চুলের শাইন বাড়া… দিদিভাইটা যা গেঁতো আর গাঁইয়া! কোথায় জমিয়ে বিয়েটা করবে তা নয়, কেমন যেন ঝিমোচ্ছে!”

আঁচল মৃদু প্রতিবাদের সুরে বলল, “না গো মামি, আমি নর্ম্যালই আছি। তবে বিয়ে হচ্ছে বলেই বাড়তি কিছু করা আমার পোষায় না।”

“তোর কিছু লাগবেও না।” তাপস ফুট কাটল, “আমাদের আঁচলকে মোটেও তেলকাজলে সুন্দরী হতে হবে না।”

“তবু একটু লাগে, বুঝলে। বিয়ে বলে কথা। জীবনের সব চেয়ে বড় ইভেন্ট।”

বাচনভঙ্গিটা মোটেই পছন্দ হল না মানসীর। বউদিটা সেই একই রকম সেকেলে রয়ে গেছে। অন্তত মনের দিক থেকে! মানসী যখন দেবরাজদের বাড়ি থেকে চলে এল, তখন বউদি এমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকত! যেন ননদটি তার আই-সি-ইউ বেডে, ডিভোর্সটা হলেই পুটুস করে মরে যাবে। তাপসের বন্ধু শান্তনুর সঙ্গে যখন মানসীর আবার বিয়ে হল, বউদির চোখে যত না আনন্দ, তার চেয়ে বেশি বিস্ময়। যেন বিয়ের মতো ঘটনা মেয়েদের জীবনে দু’বার ঘটতেই পারে না। অথচ বউদি মোটেই অশিক্ষিত নয়, পেটে ডিগ্রি আছে, চাকরিবাকরি করে, বাইরের জগতে মেশে…। আসলে জীবনে কখনও ঠোক্কর খায়নি তো, মনটাও তাই অচলায়তনের গণ্ডি ছেড়ে বেরোতে পারেনি।

রিনা ওদিকে উপদেশ দিয়েই চলেছে। কীভাবে অঙ্গচর্চা করলে রূপ আরও খুলবে, বোঝাচ্ছে আঁচলকে। অম্বর বোধহয় অস্বস্তি বোধ করছিল, টুকুস করে উঠে পালাল দোতলায়। অলিও উশখুশ করছে। সে ছাড়া অন্য কেউ বকবক করুক, এ বুঝি তার হজম হয় না। ফস করে বলে উঠল, মামি, “তুমি বিয়ের বাজার দেখবে না?”

“সব কমপ্লিট?”

“অলমোস্ট। শুধু বরের জিনিসগুলো কেনা বাকি।”

“কেন?”

“সে নাকি হেব্‌বি ব্যস্ত। টাইম দিতে পারছে না।”

“গয়না-টয়নাগুলোও এসে গেছে?”

“মোটামুটি। ওগুলো অবশ্য বাড়িতে নেই…”

“ভল্টে রেখেছি।” মানসী বলল, “বুঝতেই তো পারছ, দিনকাল ভাল নয়। চোর ডাকাতদের কাছে সব খবর চলে যায়। বিয়ের জুয়েলারি বাড়িতে আছে টের পেলে হানা দিতে কতক্ষণ!”

“সে তো বটেই। তা কী কী দিচ্ছ?”

“একটা সীতাহারের সেট, একটা কুন্দনের সেট, আর একটা হিরের। এ ছাড়া বালা চুড়ি চূড়, যেমন কমন দেয়…”

“ভেঙে গড়ালে? না নতুন?”

“আমার তো পুরনো নতুন মিশিয়ে করার ইচ্ছে ছিল। আঁচলের বাপি কিছুতেই রাজি হল না।” মানসী ঠোঁট উলটোল, “তার বড়মেয়ের বিয়েতে সব বিলকুল নয়া হওয়া চাই।”

“ব্যাপারটা বুঝলে তো মামি?” অলি ফোড়ন কাটল, “পুরনোগুলো আমার জন্য রইল।… আমি কিন্তু সাফ বলে রাখছি, পুরনো মাল পালটে-পুলটে আমায় চালানো চলবে না। আমি সোনা নেবই না।”

“তো কী নিবি? কস্টিউম জুয়েলারি?”

“আজ্ঞে না। আমি চাই প্ল্যাটিনাম। ওটাই এখন ইন থিং। ঢ্যাবলা-ঢ্যাবলা সোনা পরাটা আমার বিয়ের সময়ে অবসোলিট হয়ে যাবে। হি হি।”

“সে হবেখন। পার্ট ওয়ান পেরোল না, এখনই বিয়ের চিন্তা।” মানসী পলকা ধমক দিল। বলল, “যা তো, মামিকে জিনিসগুলো দেখা। বেশি ঘাঁটবি না, পাট করতে সমস্যা হবে।”

উঠে অলি-আঁচলের পিছু পিছু চলে যাচ্ছিল রিনা, আবার ফিরেছে পায়ে পায়ে। সোফায় ফের বসল। একটু থেমে থেমে তাপসকে বলল, “ওটা দেখিয়ে নিই?”

“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই।” হেলান দিয়ে সোফায় উপবিষ্ট তাপস চকিতে টানটান। হাসি হাসি মুখে বলল, “আগে আঁচলকে দেখাও। বলুক পছন্দ হল কি না।”

তিন জোড়া বিস্মিত চোখের সামনে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একখানা ভেলভেটের বাক্স বার করেছে রিনা। খুলে বাড়িয়ে দিল আঁচলের দিকে।

জড়োয়ার সেট। হার, দুল, আংটি। রঙিন পাথরগুলো ঝকমক করছে।

আঁচল চোখ বড় করে বলল, “এ তো ভীষণ দামি গয়না গো!”

“আয়, পর। দেখি তোকে কেমন মানায়।”

সত্যি, অপূর্ব দেখাচ্ছে। গয়নাটা বেশি সুন্দর না আঁচল, বুঝে ওঠা দায়।

আঁচল স্মিত স্বরে বলল, “খুব, খুউব ভাল হয়েছে। থ্যাংক ইউ মামি।”

“ধন্যবাদ তোর মামাকে দে। ও পছন্দ করে কিনেছে।”

“বিয়েতে না হোক, বউভাতে অন্তত পরিস।” তাপস স্নেহমাখা স্বরে বলল, “আর সেই ছবিটা তুলে পাঠাস বোস্টনে।”

“ও, তোমরা তা হলে থাকছই না?” আঁচলের গলা কেমন ম্রিয়মাণ শোনাল, “দিনটা কিছুতেই বদলানো গেল না?”

“উপায় নেই রে মা। তাতন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফেলেছে। যেখানে যেখানে বেড়াতে যাবে, সেগুলোরও বুকিং-টুকিং হয়ে গেছে। এখন সব ক্যানসেল করা যায়?”

সবাই চুপ। ঘরের পরিবেশ থমথমে হয়ে গেছে আচমকা। একটু পরে রিনা উঠে দাঁড়িয়েছে। আঁচলের পিঠে হাত রেখে বলল, “মন খারাপ করিস না। চল, কী কী কেনা হল দেখি।”

তিন জনের ছোট্ট দলটা বেরিয়ে গেছে ঘর ছেড়ে। আরও বুঝি স্তব্ধ হয়ে গেল পরিবেশ। মানসীর মুখে কুলুপ। তাপসও তথৈবচ।

মানসীই বরফ ভাঙল। গুমগুমে গলায় বলল, “তোর কাছে এটা আশা করিনি রে দাদা।”

তাপস নিচু গলায় বলল, “আমি হেল্‌পলেস। বিশ্বাস কর।”

“আর সাত দিন কি যাওয়াটা পেছোনো যেত না?”

“কেন বারবার বলছিস বুলু? আই অ্যাম ফিলিং হার্ট। সিরিয়াসলি হার্ট। তুই তো জানিস তোর দাদা তোকে কতটা ভালবাসে।”

“জানি বই কী। তাই তো আশা করেছিলাম… বাবা নেই, মা নেই… তুই অন্তত এই বিশেষ দিনটাতে আমার পাশে থাকবি।”

“ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল বুলু। বোস্টনে থাকি, কী কলকাতায়, আই অ্যাম অলওয়েজ উইথ ইউ। আজ তো তোর সুখের দিন। ভেবে দ্যাখ, বিপদের দিনেও কে তোর পাশে ছিল? এই দাদাই তো! তুই যে একটা ওয়েল সেটলড ফ্যামিলি লাইফ পেয়েছিস, এর মূলেও কার সব থেকে বেশি অবদান?”

তাপস মাঝে-মাঝেই শোনায় কথাটা। তেমন একটা আমল দেয় না মানসী। আজ শেলের মতো বিঁধল যেন। সে যখন পাইকপাড়া থেকে উত্খাত হয়ে ফিরল, কোন চোখে তাকে দেখেছিল দাদা? বাবা চিন্তায় আকুল, মা দিশেহারা, কিন্তু দাদা দিব্যি নির্বিকার। অসহায় বোন, মেয়ে কোলে এসে পড়েছে, চাইলে থাকুক, তার বউ ছেলে নিয়ে রচিত গণ্ডিতে কোনও অশান্তি না ঢুকলেই হল। বোনের প্রেমের বিয়ে যদি টেকে, যদি সে ফিরে যায়, তো খুব ভাল। যদি কাটানছেড়ান হয়ে যায়, বাবা মা ম্যাও সামলাবে। দেবরাজ যে অত অন্যায় করল, তাকে গিয়ে দুটো কথা শুনিয়ে আসতে পর্যন্ত রাজি হয়নি দাদা। সোজা বাবাকে বলে দিল, বোন ভগ্নিপতির পারসোনাল ব্যাপারে নাক গলাতে তার রুচিতে বাঁধে। ডিভোর্সের মামলা যখন ঠুকল, তখনই কী দাদা তাকে ভরসা জুগিয়েছে? মোটেই না। এক ছাদের নীচে বাস করা সত্ত্বেও খবরই রাখত না বোনের। বাবা নয়, মা নয়, মানসীকে তখন সাহস জুগিয়েছিল শান্তনু। না, সেটা পর্যন্ত জানত না দাদা।

সব মনে আছে মানসীর। সব। দাদার ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বন্ধু শান্তনু। শান্তশিষ্ট শান্তনুকে দাদারা খেপাত বোকা গাঁওয়ার বলে। কবে যে শান্তনু একটু একটু করে মানসীর হৃদয়ের কাছাকাছি এসেছে, দাদা খেয়ালও করেনি। উলটে ওই ছেলে বুলুকে বিয়ে করতে চায় শুনে কী বলেছিল বোনকে? গাঁইয়া পেয়ে ওকেই গাঁথলি রে বুলু! তুই শহুরে মেয়ে, ওর সঙ্গে তোর পটলে হয়! মেয়েসুদ্ধু ওর ঘরে গিয়ে উঠবি, পরে মেনে নিতে পারবে তো! ভেবেচিন্তে এগোস কিন্তু, ঝোঁকের মাথায় ডিসিশন নিস না!

সেই দাদা আজ অবদানের কথা বলে। কেন? তারই সুবাদে শান্তনুর সঙ্গে পরিচয় ঘটেছিল বলে? হয়তো বা। সেই দাদা দুর্দিনে পাশে থাকার কথা বলে। কেন? বাপের বাড়িতে বোনের জীবনটা বিষময় করে তোলেনি বলে? হবেও বা। সেই দাদা আজ আঁচলকে দামি গয়না দিতে এসেছে। কেন? চক্ষুলজ্জা? তা-ই হবে হয়তো।

মানসীর বুকের ভেতর দিয়ে ভিজে বাতাস বয়ে গেল। অবদানের কথাই শুধু শোনায় দাদা। প্রতিদানের কথা তো মনে পড়ে না? বছর আষ্টেক আগে, তখনও মা বেঁচে, হঠাৎ একদিন এসে বলল, বাড়িটা দোতলা তুলতে চায়। মা ছেলে মেয়ে, তিনজনেই যেহেতু মালিক, একার নামে সে ব্যাংক লোন পাবে না। মা তার স্বত্ব ছেলেকে দিয়ে দিচ্ছে, বুলুও যদি…। ঈষৎ দ্বিধা ছিল মানসীর, ফুত্কারে উড়িয়ে দিল শান্তনু। বলল, তোমার তো অনেক আছে মানসী, নয় অধিকারটা ছেড়ে দিলেই। তাপসরা একটু হাত পা ছড়িয়ে থাকুক। সই নিয়ে চলে যাওয়ার মাস তিনেক পরে আবার দাদার আবির্ভাব। পুরনো বাড়ি নাকি কমজোরি হয়ে গেছে, দোতলা তোলা সম্ভব নয়। প্রোমোটারকে জমিসুদ্ধু বাড়িটা দিলে দাদারা একটা বড় ফ্ল্যাটও পায়, সঙ্গে…। না, অস্বীকার করবে না মানসী, তখন তাকে করকরে পাঁচ লাখ দিয়েছিল দাদা। কিন্তু তার প্রাপ্যের তুলনায় সেটা কী নেহাত সামান্য নয়? দামি গয়না দিয়ে দাদা কি সেই বঞ্চনারও খানিকটা ক্ষতিপূরণ করল?

ছি, মানসী ওভাবে দেখছ কেন? দাদা হয়তো ভালবেসেই…। ভাই বোনের সম্পর্কটা কী শুধু দেওয়া-নেওয়া আর টাকাপয়সার নিক্তিতে মাপা উচিত? তুলাদণ্ডের দু’ প্রান্তে ভার কখনও সমান হয় না, কোনও না কোনও দিকে সে হেলবেই। তাই নিয়ে কপাল চাপড়ালে মনোকষ্টই বাড়ে শুধু। জীবনের অজস্র জটিলতা তো তাকে ঢের দুঃখ দিয়েছে, নতুন করে বেদনা বাড়িয়ে কী লাভ!

বড় একটা শ্বাস টেনে মানসী নিজেকে খানিকটা সহজ করল। মুখে হাসি টেনে বলল, “তোরা ফিরছিস কবে?”

“এপ্রিলের সেকেন্ড উইকে।”

“কেন? তোর তো তিন মাসের ভিসা?”

“বসে থেকে থেকে বোর হয়ে যাচ্ছি। মোটামুটি একটা ভাল অফার পেয়েছি, এসেই সেখানে জয়েন করব।”

“ফের যখন চাকরিই করবি, ভলান্টারি রিটায়ারমেন্ট নিলি কেন?”

“ভেবেছিলাম নিজের মতো করে স্বাধীন কিছু একটা স্টার্ট করব। মার্কেট স্টাডি করে বুঝলাম, হাল বহুৎ বুরা। শান্তনুটার মতো আমার গোঁ নেই, লেগে থাকতে পারব না। সুতরাং… ব্যাক টু স্কোয়্যার। নোকরি।”

“শান্তনুর নতুন বিজ়নেসটায় জয়েন করে যা না।”

“মাছচাষ? নমস্কার।” তাপস হাসছে, “শান্তনুর মাথায় কে যে ক্যাড়া নড়াল! তার ওপর জায়গাও বেছেছে মোক্ষম। কবে যে ওখানে আবার লাঠালাঠি লেগে যাবে!”

“হুঁ। শান্তনুও বোধহয় ওসব নিয়ে টেনশনে আছে।”

“বুঝেশুনে চলতে বলিস।” তাপস হঠাৎ গলা নামাল, “বাই দা বাই… দেবরাজ সিংহরায়ের তো আজকাল খুব নাম দেখছি কাগজে। টিভিতেও একদিন দেখলাম, ইয়া ইয়া লেকচার ঝাড়ছে…! ও কী কলকাতায় আবার পাকাপাকি চলে এল নাকি?”

“বোধহয় না। দাদার তো ক্যানসার, তার ট্রিটমেন্টের ব্যাপারেই আছে আর কী। ইনফ্যাক্ট, ওই দাদার অসুখের জন্যই তো বিয়েটা তাড়াতাড়ি দিতে হচ্ছে।”

“অ।… আঁচল কী যাচ্ছে বাপের কাছে?”

“জানি না। আমি মেয়েকে তার বাবার সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন করি না। মেয়েও আমায় কিছু বলে না।”

“তা ভাল।… তা হ্যাঁ রে, তোর বউদি বলছিল আঁচলের সম্বন্ধটা নাকি দেবরাজের বোন এনেছে?”

“আনাআনির কী আছে! ও বলছিল, তারপর যোগাযোগ হল, সম্বন্ধটা লেগে গেল…”

বনানীর প্রসঙ্গটাকে প্রাণপণে এড়াতে চাইছিল মানসী। কী যে জ্বালা হল, আত্মীয় মহলেও এখন বনানীর মহিমা রটবে। দেবরাজই বোনের মাধ্যমে মেয়ের বিয়েটা ঘটাচ্ছে, এমন একটা ধারণাও ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব নয়। দেবরাজের উপস্থিতি মুখরোচক খবরটাকে আরও পরিপুষ্ট করবে। রাঙাপিসি, মীনাদিরা সব চেটেপুটে খাবে। এই বয়সে আর ভাল্লাগে!

কথা ঘোরানোর জন্যই মানসী বলল, “জানিস তো দাদা, আঁচলের উড বি শাশুড়ি এখনই আঁচলে একেবারে গদগদ। প্রায়ই আজকাল আঁচলকে ফোন করছে।”

“বাহ, এ তো ভাল খবর।”

“কালই নাকি আঁচলকে বলেছেন, পিএইচ ডি-র রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারটা উনি তাড়াতাড়ি করিয়ে দেবেন। অন্য একজন রিসার্চ গাইডের নামও নাকি আঁচলকে সাজেস্ট করেছেন। ভদ্রলোক খুব ফেমাস। কী সাম মুখোপাধ্যায়।”

“এ তো আরও উত্তম সংবাদ।” তাপস চোখ টিপল, “মহিলার যা রিসোর্স, তিন বছরের মধ্যে আঁচল ডক্টরেট পেয়ে যাবে।”

“কিন্তু আঁচল তো ওঁর কথা শুনছে না। ও নিজের স্যারের আন্ডারেই…”

আলাপচারিতার মাঝেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেছে অলি। উত্তেজিত মুখে বলল, মা জানো, “হেব্‌বি কেস।”

হোঁচট খেয়ে মানসীর ভুরুতে ভাঁজ, “কী হল?”

“দিদিভাই আর আলুভাতে… সরি নির্বাণদা… এখনই ফরেন ট্যুরের ইনভিটেশন পেয়ে গেছে।”

“কে করল?”

“তাতনদা।” গাল ছড়িয়ে হাসল অলি, “ইয়া বড় একটা মেল পাঠিয়েছে দিদিভাইকে। আমায় বলেনি, চেপে গিয়েছিল, মামির সঙ্গে কথায় কথায় বেরোল।”

“তাই নাকি রে?” তাপসের মুখে পলকা বিস্ময়, “কই, আমায় তো কিছু জানায়নি! আঁচলের বিয়ের নিউজটা পেয়ে শুধু বলল, আঁচলটা নাকি মহা বজ্জাত… তাতনকে নাকি আঁচল বলেছিল, এখনই সে বিয়ে করবে না…!”

“হ্যাঁ, তাতনের খুব ইচ্ছে ছিল আঁচলের বিয়েতে পিঁড়ি ঘোরাবে।” রিনাও এসে গেছে। হাসতে হাসতে বলল, “আমরা গিয়ে হয়তো দেখব ছেলে নিজের পিঁড়ি ঘোরানোর বন্দোবস্ত সেরে ফেলেছে।”

“না গো, তাতনদা মোটেই কেস খাওয়ার ছেলে নয়। এখনও হয়তো ডেটিংই করে উঠতে পারেনি।”

“ওরে, ও আর সেই ধ্যানী বুদ্ধ টাইপ নেই। তাতনের রিসেন্ট ছবিগুলো দেখিস। হেয়ার কাটিং পালটে ফেলেছে। ফ্রেঞ্চকাট দাড়িও রাখছে।”

“সে তুমি যা-ই বলো বউদি, তাতন আমাদের জুয়েল। কানপুর আই আই টি থেকে বি এসসি-তে ফার্স্ট, এম এসসি-তে ফার্স্ট…। বিদেশ যাওয়ার চান্সও পেয়ে গেল স্কলারশিপ নিয়ে।”

“আমাদেরও কিছু মাল্লু খসেছে রে বুলু। ইন্ডিয়ান কারেন্সিতে পরিমাণটা নেহাত কম নয়।”

“অত টাকা টাকা করিস না তো। তোর তো টাকায় ছাতা পড়বে। মেয়ে নেই, মেয়ে পার করার দায়ও নেই। আমার ঘাড়ে দু’-দু’খানা…”

“ভেরি ভেরি অবজেকশনেবল ল্যাঙ্গুয়েজ মা। বাপি আসুক, বলছি।”

“হুঁহ, তোর বাপি আমার মাথা কাটবে।”

“দিদিভাইয়ের জন্য কী খরচ হচ্ছে তোমার? ফার্নিচার তো পুরো ঝাপ্পুস হয়ে গেল। ফ্রিজ, টিভি, ওয়াশিং মেশিন কিছু দিতে হচ্ছে না।”

“ওমা, তাই নাকি?”

“হ্যাঁ গো বউদি। ছেলের মা অনেকটা খরচা আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছেন। শান্তনুর খুব ইচ্ছে ছিল, একটা দারুণ খাট দেয়। ভদ্রমহিলা খাট আলমারি ড্রেসিংটেবিল কোনওটাতেই রাজি হলেন না। উনি নাকি দেওয়াল জুড়ে ওয়ার্ড্রোব-ফোয়ার্ড্রোব সবই বানিয়ে দিচ্ছেন। সাজগোজের জায়গাও।”

“ওটাই তো মর্ডান সিস্টেম এখন।”

“সে যা-ই হোক গিয়ে, আমায় কিন্তু ফাঁকি দিয়ো না মা। অ্যাট লিস্ট, টাকাটা আমার হাতে ধরে দিয়ো। হি হি।”

“শুনছিস? শুনছিস দাদা, আমার ছোটকন্যের বাক্যি! দিদিভাইয়ের কেনাকাটা করতে গিয়ে ও যে নিজের কত কী বাগাল…”

এলোমেলো আড্ডা চলছে টুকটাক। হালকা মেজাজে। একপ্রস্থ চা হল ফের। মানসীর বাপের বাড়ির দিকে কাকে কাকে নেমন্তন্ন করা হচ্ছে, কেউ বাদ পড়ল কি না, তাই নিয়েও গবেষণা চলল ভাইবোনে। কেনা শাড়িগুলোর তারিফ করল রিনা, আহ্লাদিত মুখে শুনল মানসী।

তাপস রিনা উঠল আটটা নাগাদ। হইহল্লা হাসিঠাট্টায় বেশ কেটেছে সন্ধেটা। ফুরফুরে মনে শাড়ি বদলে নাইটি পরল মানসী। এবার সংসারে ফিরতে হয়। ফ্রিজ থেকে রাতের খাবার বার করে রাখল রান্নাঘরে। চোখে পড়ল, গোটা তিনেক সিঙাড়া রয়ে গেছে ঠোঙায়। বাক্সে খানকয়েক সন্দেশও। একগাদা এনেছিল? নাকি খায়নি অম্বর? ডেকে জিজ্ঞেস করবে? ওপরে দিয়ে এলে হয়। ছেলেটা ভাজাভুজি খেতে বড় ভালবাসে, খুশি হবে নির্ঘাত। সিঙাড়াটা একটু গরম করে দেওয়া উচিত। মাইক্রোওয়েভে ঘোরালে কেমন নেতিয়ে যায়, চাটুতেই বরং…

শোওয়ার ঘরে মোবাইল বাজছে। কে রে বাবা? মোবাইলে তো তেমন একটা ফোন আসে না মানসীর। কোনও বন্ধু-টন্ধু? শিপ্রা, উজ্জ্বলারা আসন্ন অনুষ্ঠানটার খবর পেয়েছে, সেই সুবাদে চেতলার কোনও পুরনো সখী…?

মনিটারে অচেনা নম্বর। মানসী গলা ঝেড়ে বলল, “হ্যালো?”

ওপারে দু’-এক সেকেন্ডের নীরবতা। তারপর মেঘমন্দ্র স্বর, “আমি বলছি মানসী। কেমন আছ?”

হৃৎপিণ্ড বুঝি থেমে গেল সহসা। পরক্ষণে এক প্রবল জলোচ্ছ্বাস যেন আছড়ে পড়েছে বুকে। শ্বাস নিতে পারছিল না মানসী। কথা ফুটছে না মুখে।

কোনওক্রমে বলল, “তুমি হঠাৎ?”

“জরুরি দরকার ছিল। একটা ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই।”

আবেগ ছাপিয়ে ঝাঁঝটাই ঠেলে বেরোল, “আমার নম্বর পেলে কোত্থেকে? বনানী দিয়েছে?”

“সেটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট নয়। আঁচলের বিয়েটা তো তোমরা ফাইনাল করে ফেললে…”

“তো? তোমার আপত্তি আছে নাকি?”

“না, না, প্রশ্নই আসে না। তোমার ডিসিশনই ফাইনাল। আসলে একটা খবর কানে এল, ভাবলাম জানাই…।” দেবরাজের মধ্যে যেন ইতস্তত ভাব, “পরিবারটার সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছ?”

“আঁচলের বিয়ে নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করার আমার কোনও আগ্রহ নেই।”

“তবু বলি… পাত্রটির বাবা সজল চৌধুরী ওয়াজ় আ পোয়েট। উনি সুইসাইড করেছিলেন। মানসিক অবসাদ থেকে। এই ধরনের ব্যাধিগুলো তো অনেক সময়ে জিনে থেকে যায়… তাই বলছিলাম, একটু যদি ভেবেচিন্তে দেখতে…”

“চমৎকার। মেয়ের বিয়েতে ভাংচি দিচ্ছ? আরও উন্নতি হয়েছে তো তোমার!” মানসীর গলায় ব্যঙ্গ ঝরে পড়ল, “আঁচলের জিনও কি বিশুদ্ধ? পূতপবিত্র?”

ও প্রান্তে আর সাড়াশব্দ নেই।

মানসী বলল, “এবার আমি তোমাকে একটা রিকোয়েস্ট করি? বনানীকেই বলতাম…। অনুগ্রহ করে মেয়ের বিয়েতে এসে হাজির হোয়ো না। আমাদের অসুবিধে হবে।”

“বেশ। যা তোমার ইচ্ছে।”

ফোন অফ করে দিয়েছে দেবরাজ। তবু মানসী মোবাইলটা চেপে রেখেছে কানে। যদি আরও কিছু ভেসে আসে! যদি আর কিছুক্ষণ স্বরটা শোনা যায়! কত যুগ পর দেবরাজ…!

শান্তনু ফিরেছে। দম দেওয়া পুতুলের মতো উঠল মানসী। কথাবার্তা বলল, নিত্যনৈমিত্তিক কাজ সারল, সময়মতো এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিন্তু ঘুম আসে কই!

অন্ধকার কাঁপছে। রূপনারায়ণের ঢেউয়ে একটা নৌকো দুলছে তিরতির। নদীর জলে পা ডুবিয়ে গলা ছেড়ে গান ধরেছে এক তরুণ। জুড়াইতে চাই… কোথায় জুড়াই…

ওফ, ওই গানটাই যে কেন ফিরে এল আবার!

১৩

অম্বরের মনটা বেশ খুশি খুশি ছিল আজ। একটা নির্ভেজাল কর্মহীন দিন, এমন তো আজকাল মিলছে না সহজে। কাকা-কাকিমা যা খাটিয়ে মারছে, বাপস। বিয়ে তো নয়, যেন রাজসূয় যজ্ঞ হবে বাড়িতে। আর সব কাজে যেন অম্বরকেই চাই। নেমন্তন্নকার্ডটা পর্যন্ত কেউ গিয়ে পছন্দ করল না। কাঁধে করে বয়ে আনো স্যাম্পলের ক্যাটালগ, সবাই মিলে বাড়িতে বসে দেখে তারপর অর্ডার দেওয়া হবে! খাবারের মেনু শেষ পর্যন্ত ফাইনাল হয়েছে, এ একটা মহা স্বস্তি। আপাতত আর কোনও বড় ঝামেলায় ফাঁসানো যাবে না অম্বরকে। দিনটাকেও আজ মোটামুটি ছকে রেখেছে অম্বর। ব্রেকফাস্ট সারা, এবার ল্যাপটপ নিয়ে নাড়াচাড়া করবে খানিকক্ষণ, তারপর ছোট্ট একটা ঘুম, অতঃপর মধ্যাহ্ন ভোজন সমাপন করে বসবে লেখার টেবিলে। নববর্ষ সংখ্যার জন্য কবিতা চেয়েছে বিবস্বান আর অপভ্রংশ। হরিনগর থেকে বেরোয় অপভ্রংশ, মান নেহাত আহামরি নয়, তবু যত্ন করেই লেখা দরকার। শহরে কবিতার আর পাঠক কই! এখন মফস্‌সলই ভরসা। রানিগড়ের কমণ্ডলুর জন্যও পাঠাবে একখানা। এমনিতেই তো শিবেন তন্ময়দের ধারণা, কলকাতায় এসে ভাও বেড়েছে অম্বরের, গ্রামের পত্রিকায় লিখতে নাকি তার এখন ঘোর অনীহা। ব্যাটারা জানে না, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার উপদেশটা এমনি এমনি আসেনি, অম্বরের মতো কবিরা সেটা প্রমাণ করে ছাড়বে।

তা আজ কবিতা এল তো ভাল, নইলে আবার একটু ঘুম। তারপর বিকেলে তো একবার কলেজ স্ট্রিট যেতেই হবে। বইয়ের কাজটা বড্ড শনৈঃ শনৈঃ এগোচ্ছে। হাতে মাত্র আর বারো দিন, এর মধ্যে না পেলে বইটা ছাপানোই তো বৃথা। ওই সময়ে কফিহাউসও ছুঁয়ে আসবে না হয়। হ্যাঁ, তা হলেই মধুরেণ সমাপয়েৎ।

ক্রমানুসারেই শুরু হোক তা হলে। একখানা সিগারেট উড়িয়ে ল্যাপটপ খুলল অম্বর। দরকারি কোনও কাজ নয়, কম্পিউটারের ব্যবহার সে জানেও না ভালমতো, কাকার বাতিল ল্যাপটপখানা জুটে যেতে পিটিয়ে পিটিয়ে শিখেছে অল্পস্বল্প। অলি কয়েকটা গেমস ভরে দিয়েছিল, তারমধ্যে ‘মারিও’ খেলাটা অম্বরকে টানে খুব। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে বাধা পড়ছে অজস্র, খালবিল, প্রহরী, পাঁচিল পদে পদে গতি রুখছে… নানান কায়দায় সেগুলো টপকানো ভারী রোমাঞ্চকর। প্রথম লেভেল পার হলে আর একটু কঠিন হয় খেলা, তারপর আরও, তারপর আরও…।

খেলতে খেলতে কী করে যে ঘণ্টাখানেক কেটে গেল, অম্বর টেরই পেল না। চোখে এবার চাপ পড়ছে, মাথাও চিনচিন। সযত্নে বন্ধ করল ল্যাপটপ, বিছানায় গড়ানোর আগে ফের একটা সিগারেট ধরিয়েছে। দাঁড়াল এসে জানলায়। বাইরেটা পশ্চিম, অনেকটা দূর অবধি খোলা। তারপর একটা খুদে জলাশয়। তারও ওপারে একটি অট্টালিকা উঠছে। উঁহু, একটা নয়, একসঙ্গে অনেকগুলো। খান আষ্টেক। মোড়ের দোকানদার বলছিল সব ক’টাই নাকি বারোতলা চোদ্দোতলা। অর্থাৎ এক একটা বাড়িতে অন্তত গোটা ষাটেক ফ্ল্যাট। আটখানায় প্রায় পাঁচশো। তাদের রানিগড়ে সাকুল্যে দেড়শো পরিবার বাস করে কি না সন্দেহ। তার মানে আটখানা বাড়িতেই চারটে রানিগড়! উফ, কী পিলপিল করে বাড়ছে মানুষ! এত লোক জড়ো হলে এই জায়গাটারই বা চেহারা কেমন দাঁড়াবে? বাতাসে অক্সিজেন যে বেশ খানিকটা কমবে এতে কোনও সংশয় নেই। এদের ঘিরে বাড়বে দোকানপাট, আরও ঘিঞ্জি হবে এলাকাটা। ওই জলাশয়ে এবার শীতেও পাখি এসেছিল বিদেশ থেকে, আর বোধহয় তারা…

চিন্তাটা এগোতে পারল না। কাকিমার গলা শোনা যাচ্ছে। মেয়ের বিয়ে যত কাছে আসছে, কাকিমার মেজাজের পারাও যেন চড়ছে দিন দিন। এখন অলি আঁচল কেউ তো বাড়ি নেই, কার সঙ্গে লাগল?

আরে, অম্বরকেই ডাকছে না? সর্বনাশ। ঝটিতি সিগারেট নিভিয়ে অম্বর হুড়মুড়িয়ে সিঁড়িতে এল।

মানসী সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে। বিরক্তিমাখা স্বরে বলল, “কতক্ষণ ধরে ডাকছি… সাড়া দাও না কেন? ঘুমোচ্ছিলে নাকি?”

“না না।” অম্বর জোরে মাথা ঝাঁকাল। গলায় একটা খুকখুকে কাশি আসছিল, কোনও রকমে গিলে নিয়ে বলল, “কম্পিউটার প্র্যাকটিস করছিলাম।”

মানসী যেন পাত্তাই দিল না। গম্ভীর সুরে বলল, “শোনো, তোমার এখন একটা কাজ আছে।”

সে কী অম্বর বোঝেনি? অকাজে তাকে আহ্বান করবে, এমন কেউ আছে নাকি এ সংসারে?

অম্বর নীচে নেমে এল। গলায় মাপমতো বিনয় মিশিয়ে বলল, “বলুন কী করব?”

“খেয়ে উঠে তোমায় একবার বেরোতে হবে।”

“কোথায়?”

“রাজারহাটে যাবে। নির্বাণের অফিসে।”

বিস্ময়বোধ এখনও পুরোপুরি মরেনি বলেই বুঝি একটু অবাক হল অম্বর। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“কিছুই তো কারওর খেয়াল থাকে না। নির্বাণের সুটের অর্ডার দেওয়া হল, অত জামাকাপড় কেনা হল, সুট পাঞ্জাবির মাপ দিয়ে গেল নির্বাণ… ছেলেটার জুতো চটি কেনা হয়েছে?”

“হয়নি, না?”

“আশ্চর্য, তুমি আর অলি তো নাচতে নাচতে গিয়েছিলে সেদিন… মনে করে দ্যাখো তো…

সত্যি তো, জুতো সেদিন বাদ পড়েছিল বটে। কিন্তু দোষটা কি অম্বরের? নির্বাণকুমারের আসার কথা ছিল পাঁচটায়, হেলেদুলে তিনি হাজির হলেন ছ’টা বাজিয়ে। নেহাত অলির সঙ্গে গোটা শপিংমলে টো-টো করছিল বলে সময় তাও কেটেছে। নইলে টানা এক ঘণ্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা যে কী অসহ্য ব্যাপার! তাও কিনা ওই রামগরুড়ের ছানাটির জন্যে! আসার পরও তার কত নখড়া! না না, অত দামি জিনিস কিনবেন কেন, যা হোক একটা কিছু নিয়ে নিন…! অলি ধমকে-ধামকে ওই পর্বটি চুকিয়েছিল সেদিন। তারপরই অবশ্য অলিদেবীর ফুডকোর্টে বসার বাসনা চাগল। পিৎজা-পাস্তার মতো অখাদ্য গিলে যখন তারা মল ত্যাগ করল, ঘড়ির কাঁটা ন’টা পেরিয়ে গেছে। তারপরেও যে এতদিনে জুতো-চটি কেনা হয়নি অম্বর জানবে কী করে?

তা এসব কথা তো কাকিমার সামনে উচ্চারণ করা যাবে না। আর আজ যখন যেতে বলছে, “যেতে হবেই। তবু ঝামেলা খানিকটা এড়াতে চাইল অম্বর। গলায় একটা সপ্রতিভভাব এনে বলল, এর জন্যে নির্বাণের অফিসে যাওয়ার কী দরকার? ফোনে পায়ের মাপ জেনে নিলেই তো যথেষ্ট।”

“ওসব তোমাদের রানিগড়ে চলে। শহরের কিছু কেতাকানুন আছে। তোমার কাকার একটা মানসম্মান আছে।”

নির্বাণের পদযুগলের মাপ চাইলে কেন কাকার মর্যাদাহানি হবে, অম্বরের মগজে ঢুকল না। শহরে কি মাপ জানার প্রথা নেই? অম্বর তবু মিনমিন করে বলল, “ওর অফিসে গিয়ে মাপ নেব?”

“উফ, কবে যে তোমার ঘটে বুদ্ধি হবে!” মানসী ধমক দিতে গিয়েও হেসে ফেলল। পরমুহূর্তেই ফিরেছে গাম্ভীর্যে। কেজো গলায় বলল, “নির্বাণকে অফিস থেকে নিয়ে শপিংমলে যাবে, ব্র্যান্ডেড দোকানে ঢুকবে… তোমার নিশ্চয়ই আন্দাজ হয়েছে জামাইয়ের জন্য কীরকম দামের জিনিস আমরা কিনছি… ও সস্তার দিকে যেতে চাইলেও তুমি সেদিকে ঘেঁষতে দেবে না।”

অম্বর ঢক করে ঘাড় নাড়ল। নির্বাণ তো সোজা শপিংমলেই আসতে পারে। কেন তাকে অফিস থেকে পাঁজাকোলা করে তুলে আনতে হবে, সেটা আর জিজ্ঞেস করার সাহস হল না। বাধ্য স্বরে বলল, “কখন বেরোব?”

“নির্বাণের মা বললেন, ওকে চারটেয় পিক-আপ করতে।”

অ, বোঝা গেল। সেই মহিলারই ইচ্ছা তা হলে। আগের দিন ছেলেকে সমাদর করে নিয়ে যাওয়া হয়নি বলে আঁতে সুড়সুড়ি লেগেছে মায়ের। আঁচলকে যেদিন দেখতে এলেন, বিনয়ী সুরে কথা বলছিলেন বটে, তবে অহংকারের মটমটানিটাও দিব্যি টের পাওয়া যাচ্ছিল। যেন আঁচলকে বউ করে কাকাকে তিনি কৃতার্থ করবেন! আঁচলকে পেলে ওঁর বাড়িই যে ধন্য হবে, সেই বোধ থাকলে তো!

বিরস মেজাজে নিজের গলতায় ফিরল অম্বর। দিনটাই চৌপাট। কবিতারও বারোটা। প্যান্টশার্ট অবধি তাও ঠিক ছিল, শেষে কিনা আঁচলের বরের পদসেবার দায়িত্বও জুটল বরাতে! ওরে অম্বর, এবার না তোকে নির্বাণের জাঙিয়া কিনতে ছুটতে হয়!

অম্বর ধপাস করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। পরপর চারখানা সিগারেট শেষ করল। অ্যাশট্রে নিল না, ছাই ঝাড়ছে মেঝেয়। যেটুকু প্রতিশোধ নেওয়া যায় আর কী। পঞ্চম সিগারেটটা ধরিয়ে একটু ঠান্ডা হয়েছে মাথা। নিজেকে ধমকাল কষে। ওরে গাড়ল, কাজটা কি তুই নির্বাণের জন্য করছিস? আঁচল যার সঙ্গে সংসার পাততে চলেছে, সে যে-ই হোক, তার সেবা করছিস তুই। অর্থাৎ আঁচলই মুখ্য, সে গৌণ, এটা স্মরণে রাখলেই তো মন ঝরঝরে।

কিন্তু তাই কি হয়? কুটকুট করে কী একটা কামড়াচ্ছে যে! ফাল্গুন মাসে ট্যাঙ্কের জল এখনও তেমন গরম নয়, তবু স্নানের সময়ে শাওয়ার খুলতেই যেন ছ্যাঁকা লাগল গায়ে। দুপুরে আজ অম্বরের মনের মতো পদ। আলুপোস্ত, লাউচিংড়ি, পাবদামাছের ঝাল। একটি রান্নাতেও স্বাদ পেল না অম্বর। মাছ খাচ্ছে, না শাক, সেই অনুভূতিও যেন লোপ পেয়েছে।

দু’টোর মধ্যে তৈরি হয়ে অম্বর রওনা দিচ্ছিল, মানসীর পিছুডাক, “টাকাপয়সা না নিয়ে বেরোচ্ছ যে?”

অম্বরের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। রাগের মাথায় আর একটা কেলো করছিল।

মানসী উষ্মা প্রকাশ করল না। ঠান্ডা গলাতেই বলল, “একটু দাঁড়াও। আজ গাড়িটা রেখে দিয়েছি। নেমন্তন্ন করতে বেরোব। চলো, তোমায় খানিকটা এগিয়ে দিই।”

গাড়িতেই টাকাপয়সা বুঝিয়ে দিল মানসী। ইস্টার্ন বাইপাসের একটা মোড়ে অম্বরকে নামিয়ে দিয়ে বলল, “বাসের অপেক্ষায় বেশি সময় নষ্ট কোরো না। এখন তো খরচাই খরচা, ট্যাক্সি ধরে নিয়ো।”

গাড়ি হুস করে উড়ে যেতেই অম্বর হাসল মনে মনে। নিজের জন্যে ট্যাক্সি পাকড়াও করে রাজারহাট যাবে সে? একা ট্যাক্সি চড়লেই চোখ চলে যায় ঘুরন্ত মিটারে। সাঁই সাঁই চড়ে মিটার, বাড়ে অম্বরের রক্তচাপ। রাজারহাট অবধি গেলে শিরা ধমনি সব ফেটে চৌচির হয়ে যাবে না!

বাসেই নির্বাণের অফিসে পৌঁছে গেল অম্বর। নীচ থেকেই মোবাইলে ডাক পাঠাবে কি না ভাবল একবার। সাহসে কুলোল না। কীসে কার মানহানি হবে কে জানে!

ছ’তলা অফিসবিল্ডিং। বাড়িটা নতুন, তাই মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। তবে চায়ের দোকান গজিয়ে গেছে একতলায়। পৌনে চারটে বাজে, কিন্তু ওখানে ভিড় দেখে মনে হয় এখনও টিফিনটাইম ফুরোয়নি।

চারতলায় গিয়ে যে কোনও লোককে নির্বাণের নাম বললেই নাকি তার ঘরটা দেখিয়ে দেবে, এমন একটা ধারণা দেওয়া হয়েছিল অম্বরকে। কিন্তু লিফট থেকে বেরিয়ে অম্বর বেশ ফাঁপরে পড়ে গেল। কারওকে যে জিজ্ঞেস করবে, সেই কারওকেটিকে সে পায় কোথায়! বিশাল হলঘর, অগুন্তি চেয়ার-টেবিল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফাইলের স্তূপও কম নেই, কিন্তু এ তো প্রায় জনমানবশূন্য! করিডরে অবশ্য ভালই লোকজন, তবে তাদের চলাফেরা দেখে মনে হয় তারাও বুঝি কারওকে খুঁজে বেড়াচ্ছে!

একটুক্ষণ ভ্যাবাচ্যাকা মুখে দাঁড়িয়ে থেকে অম্বর একটা হলে ঢুকেই পড়ল। নাহ, বাইরে থেকে যতটা ফাঁকা দেখাচ্ছিল, তত শুনসান নয়। আট-দশ জনের মতো আছে এদিক সেদিক। বেশির ভাগই মাঝবয়সি মহিলা, ভারী রাগী রাগী মুখ। তাদের কাছে না গিয়ে এক আধবুড়োর টেবিলের সামনে দাঁড়াল অম্বর। কাজে বড় মনোযোগী মানুষটা, ডাকতে ভয় লাগে।

অম্বর সামান্য গলাখাঁকারি দিল। প্রতিক্রিয়া নেই।

ফের গলা ঝাড়ল। আর একটু উচ্চগ্রামে। এবারও হেলদোল নেই।

আওয়াজটা আরও বাড়াতে গিয়ে অম্বর কেশেই ফেলল। এবার চোখ না তুলে লোকটা বলল, “খুব গলা ঘড়ঘড় করছে বুঝি? কফটা বাইরে ফেলে আসুন।”

অম্বর অপ্রতিভ মুখে বলল, “মানে… একটা কাজে এসেছিলাম…”

“তো বলে ফেললেই হয়। কায়দা মারছেন কেন?”

“নির্বাণ চৌধুরী এই অফিসেই চাকরি করেন তো?”

“যদি করেন না বলেই মনে হয়, তা হলে এখানে নির্বাণ চৌধুরীর খোঁজে এসেছেন কেন?”

কী প্যাঁচোয়া জবাব! হ্যাঁ বলল, নাকি না, উদ্ধার করা মুশকিল। সাধে কি সরকারি কাজ পেয়েছে!

অম্বর নিরীহ ভাবেই বলল, “আমি ওঁর সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই।”

“করুন গিয়ে। কে আটকাচ্ছে?”

“কিন্তু ঘরটা তো চিনি না…”

লোকটা টেরিয়ে তাকাল, “সঙ্গে মোবাইল আছে নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ।”

“নির্বাণ চৌধুরীর নম্বর জানেন?”

“হ্যাঁ।”

“তো ফোন করে জেনে নিলেই হয়। আমাকে ডিসটার্ব করছেন কেন?”

যাচ্চলে, এ তো মহা টিকরম লোক! দাঁত কিড়মিড় করে অম্বর সরে আসছিল, পিছন থেকে লোকটা ডাকল, “শুনুন…”

অম্বর ঘুরতেই লোকটা বলল, “নেক্সট হল ছেড়ে তার পরেরটায় ঢুকবেন। এক্সট্রিম লেফটে দেখবেন পরপর চারটে কেবিন। তিন নম্বরে নির্বাণ চৌধুরীর থাকার কথা।”

“কথা মানে? উনি নেই?”

“কে জানে। বেশির ভাগ দিন তো কেটে পড়ে।”

পথনির্দেশ গুলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় অম্বর আর কথা বাড়াল না। এবং স্মরণে রেখে পৌঁছেও গেল নির্দিষ্ট ঘরে।

হ্যাঁ নির্বাণ আছে। সামনে একটা কাচ বসানো সেক্রেটারিয়েট টেবিল। সেখানে কম্পিউটার বিরাজমান। একটি টেলিফোনও। কিন্তু তার ওপারে গদি আঁটা চেয়ারটায় বসে কী করছে নির্বাণ? ঢুলছে না? জনসংযোগ আধিকারিকের এ কী হাল?

এবার আর অম্বর গলা ঝাড়াঝাড়িতে গেল না। সরাসরি বলল, “আমি এসেছি নির্বাণবাবু।”

হকচকিয়ে তাকাল নির্বাণ। চোখ-নাক-মুখে বিচিত্র কিছু মুদ্রা ফোটাল কয়েক সেকেন্ড। বোধহয় ঘুম ছাড়ানোর নিজস্ব পদ্ধতি। তারপর মুখে একটা হাসি হাসি ভাব ফুটেছে। সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে বলল, “বসুন। চা খাবেন তো?”

জিভ শুকিয়ে উঠছিল, অম্বর দমন করল ইচ্ছেটা। ঘড়ি দেখে বলল, “দরকার নেই। চলুন, আপনার অসুবিধে না থাকলে বেরিয়ে পড়ি।”

“চলুন তা হলে।”

নির্বাণের সঙ্গে সঙ্গে নেমে এল অম্বর। গেটের সামনেই ট্যাক্সি মজুত, উঠে ড্রাইভারকে নির্দেশ ছুড়ে হেলান দিল সিটে। আড়ে আড়ে দেখছে নির্বাণকে। হাত দু’খানা কোলের ওপর জড়ো করে বসে নির্বাণ। একটু যেন কাঠ কাঠ হয়ে।

আচমকা নির্বাণ বলে উঠল, “কোনও মানে হয় না।”

অম্বর অবাক, “কীসের…..?”

“এই… যা সব আপনারা করছেন। জুতো-চটি কেনাটা কি এতই জরুরি ছিল?”

শোনো কথা! গড়িয়া থেকে ছুটিয়ে এনে এখন উলটো গাইছে! সাধে কী ছোকরাকে দেখলে অম্বরের গা চিড়বিড় করে! তবে আঁচলের মুখ চেয়েই তুইয়ে-বুইয়ে চলতে হবে এখন। অম্বর হেসে বলল, “সামাজিক বিয়ে তো, এসব অত্যাচার মানতেই হয়।”

“আমার ভাল লাগে না। আপনাদেরও ব্যতিব্যস্ত করছি, নয় কী?”

মনে মনে আর একবার নির্বাণকে গাল পেড়ে নিল অম্বর। প্রসঙ্গ ঘোরানোর জন্য হালকাভাবে বলল, “আজ আপনার অফিসে কাজের চাপ কম, তাই না?”

নির্বাণ ঘুরে তাকাল। বুঝি বা পরখ করতে চাইল অম্বর তার সঙ্গে ঠাট্টা করছে কি না। তারপর কেমন যেন উদাস গলায় বলল, “আমার চাপ-টাপ থাকে না।”

“আপনাকে নিশ্চয়ই প্রচুর লোকজন মিট করতে হয়?”

“কই আর। তেমন কেউ তো একটা আসে না। আমার অ্যাসিস্ট্যান্টদের কাছেই ভিড় বেশি।”

“তা হলে তো আপনার অখণ্ড অবসর। কী করেন সারাদিন?” অম্বর চোখ সরু করল, “আপনিও কবিতা লেখেন নাকি?”

কবিতা? নির্বাণের স্বরে বিস্ময়, “এমন একটা ধারণা হল কেন?”

“বা রে, আপনার বাবা অত নামী কবি ছিলেন…। আমি তো ওঁর অনেক কবিতা পড়েছি। কী চমৎকার সব উপমা ব্যবহার করতেন। এক একটা চিত্রকল্প তো বুকে গেঁথে থাকে। বিষাদের ভূমিকম্প… আগুনরঙা সুখ…”

নির্বাণ এবার চোখ পিটপিট করছে। ধন্দমাখা গলায় বলল, “আপনি পড়েছেন এসব?”

“হ্যাঁ। ওঁর কবিতায় একটা চাপা নৈরাশ্যের আভাস থাকে সব সময়ে। যেন একটা অবসাদ ঘিরে আছে ওঁকে।” আঁচলের ভাবী বরকে নয়, যেন কবি সজল চৌধুরীর ছেলেক জিজ্ঞেস করল অম্বর, “ওঁর কি কোনও ডিপ্রেশন ছিল?”

প্রশ্নটায় নির্বাণ মোটেই খুশি হয়নি। সামান্য অসন্তুষ্ট স্বরে বলল, “আমি কী করে জানব? আমি তখন অনেক ছোট ছিলাম।”

বিরাগটা টের পেয়ে অম্বর কুলুপ এঁটেছে মুখে। নিজেকে মৃদু শাসনও করল। কেন যে মাত্রা রাখতে পারে না, বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়? বাবা যদি মানসিক অবসাদের শিকার হয়, নির্বাণ তা থোড়াই বলবে কন্যাপক্ষের লোককে।

সল্টলেক ভেদ করে বাইপাসে পড়েছে ট্যাক্সি। চিংড়িঘাটার মোড়ে লম্বা সিগন্যালে দাঁড়াল। বাইরে ফাল্গুনের নরম বিকেল। গাড়ির ধোঁয়ায়, উত্কট হর্নের আওয়াজে কেমন যেন মলিন হয়ে যাচ্ছিল বিকেলটা। যুবতী ভিখারিনির মতো।

হঠাৎ নির্বাণের গলা, “একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”

নির্বাণ সিগারেট খায় না। অম্বর জানে। ধোঁয়াতে নির্বাণের অস্বস্তি হবে ভেবে অনেকক্ষণ চেপে রেখেছিল নেশা। এবার ধরিয়ে ফেলেছে। ধোঁয়া জানলার বাইরে ভাসিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”

“ধরুন, কনেকে নিয়েই…”

আঁচলকে নিয়ে কৌতূহল? অম্বরের স্নায়ু টানটান, “কীরকম?”

“আপনার বোন… উনি তো আপনার বোনই, তাই না?”

সামান্য দ্বিধা নিয়ে অম্বর বলল, “হ্যাঁ… কেন?”

“না মানে… আপনার বোন তো লেখাপড়ায় শুনলাম খুবই ভাল। স্বীকার করতে বাধা নেই… যথেষ্ট সুন্দরীও। তুলনায় আমি বোধহয় অনেকটাই সাদামাঠা…”

প্রশ্নটা কী? অম্বরের ভুরুতে ভাঁজ।

নির্বাণ ঈষৎ সংকুচিত স্বরে বলল, “জানতে চাইছিলাম… আপনার বোনের আমাকে পছন্দ হয়েছে তো? নাকি বাড়ির চাপে… বাধ্য হয়ে…”

এই সংশয় তো অম্বরের মন থেকেও যায়নি এখনও। নির্বাণের চেহারাটি গাবলু-গুবলু হলেও হয়তো একেবারে অখাদ্য নয়। কিন্তু এই ছেলেটিকে আঁচল তার মনপ্রাণ সঁপে দিয়েছে এমনটা ভাবা বেশ কঠিন। এই বিয়েতে কাকিমার বাড়তি উৎসাহ আছে ঠিকই, তা বলে আঁচলের ওপর জোরাজুরি করেছে এমন তো অম্বর শোনেনি। তেমনটা হলে, অলি যা ভ্যাকভ্যাক করে, কানে চলে আসতই। এক্ষুনি বিয়ে না হলে আঁচল যে দয়ে পড়ে যাবে, এমনও নয়। সুতরাং স্বচ্ছন্দে নির্বাণকে বাতিল করতে পারত আঁচল। কিন্তু তা সে করেনি। তার অর্থ কী এই দাঁড়ায় না, স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে নির্বাণকে পতিত্বে বরণ করতে চলেছে আঁচল? তবে এও সত্যি, আসন্ন বিয়ে নিয়ে আঁচল তেমন একটা উল্লসিতও নয়। অবশ্য কোন ব্যাপারেই বা সে বেশি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে?

শেষ টান দিয়ে সিগারেটের টুকরো বাইরে ছুড়ে দিল অম্বর। মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “ওই নিয়ে টেনশন করবেন না। আঁচলের অমতে কিছুই হচ্ছে না।”

উত্তর শুনে নির্বাণের যতটা আশ্বস্ত হওয়া উচিত ছিল, ততটা হল না যেন। বরং একটু যেন ম্রিয়মাণ। আঁচলকে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে নাকি ছেলেটা?

শপিংমলে পৌঁছনো অবধি আর দু’জনের কারও মুখে বাক্যি নেই।

কেনাকাটাও চুকে গেল নির্বিবাদে। নির্বাণকে বাড়ি পৌঁছে দিতে চাইছিল অম্বর, কিছুতেই সে রাজি হল না। অন্য কোথাও নাকি যাবে এখন।

নির্বাণকে বিদায় জানিয়ে অম্বর এবার ঝাড়া হাত-পা। এক্ষুনি ফিরবে বাড়ি? নাকি নির্বাণের জুতো কাঁধে ছুটবে কলেজ স্ট্রিট? নিয়ম মাফিক দোনামোনায় অম্বর ভুগল খানিকক্ষণ, তারপর উঠে পড়ল শেয়ালদাগামী বাসে।

সাতটা বাজে। মহাত্মা গান্ধী রোডে থিকথিকে ভিড়। বাস ট্রাম ট্যাক্সি অটো রিকশা ঠেলা মানুষ সব যেন জট পাকিয়ে গেছে। মহারণ্য ভেদ করে কফিহাউসে যেতে ইচ্ছে করল না আর, মাঝপথেই বাঁক নিয়েছে অম্বর। আমহার্স্ট স্ট্রিট ধরে হাঁটল কিছুটা। তারপর বাঁয়ে গলি। আবার বাঁয়ে। আঁচলের বরের জুতো বওয়ার ধকল তো কম নয়, শ্রীহরি প্রিন্টিংয়ের দরজায় এসে হাঁপাল কিছুক্ষণ, তারপর উঁকি দিয়েছে প্রেসের অন্দরে।

অম্বর গলা ওঠাল, “হীরালালবাবু আছেন নাকি?”

বছর পঞ্চান্নর এক ধুতিগেঞ্জি পরা ভদ্রলোক বেরিয়ে এসেছেন। অম্বরকে দেখে বলল, “অ। আপনি? ফাইনাল প্রুফটা নিয়ে যাবেন নাকি?”

“কেন, আপনার তো দেখিয়ে রাখার কথা ছিল?”

“সে তো দেখেছেই। তাও প্রিন্ট অর্ডার দেওয়ার আগে আপনি যদি একবার চোখ বুলিয়ে নিতেন…।” হীরালাল দাঁত বার করে হাসল, “কবিতার বই তো, একটা দাঁড়ি কমা সেমিকোলনের ভুল থাকলেও আপনাদের কত মনোবেদনা হবে…”

পলক ভাবল অম্বর। না, আর সময় নষ্ট নয়, এখানেই দেখে দিয়ে যাবে আজ। ছাপার অর্ডারও দেবে সঙ্গে সঙ্গে। ভেতরে অফসেট প্রিন্টিংয়ের কাজ চলছে। বাইরে এখনও আদ্যিকালের ছাপাখানা। সেই প্রকাণ্ড ঘটাংঘটের পাশেই টুল নিয়ে বসে গেল অম্বর। আওয়াজ উপেক্ষা করে মনোযোগী হল ছোট্ট প্রুফের তাড়ায়। তেমন বড় তো নয়, ছাব্বিশটা কবিতা নিয়ে বত্রিশ পাতার বই। নাহ, এখনও ভুল বেরোচ্ছে একটা দুটো। আগের বার ঠিক করে দিয়েছিল, তবু নৈঃশব্দ্যের বিসর্গ মিসিং। একটা কমা এবারেও পড়েনি।

দেখতে দেখতে অম্বর বলল, “আমার কভারের কী খবর?”

“পরশু ছেপে আসবে।”

“আর এটা কবে ছাপবেন?”

“এই ধরুন পরশু… বড় জোর তার পরের দিন।”

“না না। আর পিছোবেন না। এরপর বাইন্ডিং আছে। ওরা মিনিমাম সাত দিন লাগাবে।”

“ঘাবড়াচ্ছেন কেন, হয়ে যাবে। কবে যেন ওপেনিং?”

তারিখটা উচ্চারণ করতে গিয়ে গলা সামান্য কেঁপে গেল অম্বরের-তেইশে ফাল্গুন।

“কাকে দিয়ে উদ্‌বোধন করাচ্ছেন? কবি? না শিল্পী?”

অম্বর চুপ। উদ্‌বোধন তো হবে না। হবে অর্পণ। যার হাতে জীবনের প্রথম বইটা তুলে দেওয়ার জন্যে অম্বরের এত তাড়াহুড়ো, সে নয় অম্বরের হৃদয়েই থাক।

কিন্তু অম্বরের স্বপ্ন পূরণ হবে কী? যদি কোনও নিরালা বিষণ্ণ মুহূর্তে একবারও সে ‘নদী, তোমাকে’র পাতা উলটোয়! যদি উলটোয়…!

১৪

অলির মন ভাল নেই। একদম ভাল নেই।

কাল বাদে পরশু আঁচলের বিয়ে। তাই মন খারাপ? জন্ম থেকেই দিদিভাইয়ের সঙ্গে যে অচ্ছেদ্য বন্ধনে সে বাঁধা ছিল উনিশ বছর, এবার সেটা বুঝি ছিঁড়তে চলেছে, ভেবেই কি দুঃখ-দুঃখ ভাবটা চাগাড় দিচ্ছে? দিব্যি দিনরাত খুনসুটি করত দিদিভাইয়ের সঙ্গে, দুম করে বাড়িটা ফাঁকা হয়ে যাবে, এই চিন্তাতেই কি অলি আকুল? সেই কবে থেকে তারা দুই বোন একসঙ্গে শুত পাশাপাশি, আর মাত্র দুটো রাত্রির পর থেকে বিছানায় সে একা, ছবিটা কল্পনা করেই কি হু-হু করছে বুক?

নাকি সেই চিরকালীন মনখারাপের অসুখটা জাঁকিয়ে বসছে আবার?

অলি জানে না। অলি বুঝতে পারছে না। তবে মন অলির সত্যিই খারাপ। ওফ, কী করলে যে এই বিষাদ রোগ থেকে ছুটকারা মেলে?

“কী রে, তুই আজ কলেজে এলি যে বড়?”

পিছন থেকে এসে ধরেছে ঈশিতা। অলির বিমনা ভাব পলকে কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে চনমনে অলির মুখোশটা চাপিয়ে দিয়েছে মুখমণ্ডলে। অভ্যেসটা সেই কোন কিশোরীবেলা থেকেই রপ্ত, এখন আর জোর করে আনার চেষ্টা করতে হয় না, আপনা আপনি এসে যায়।

অলি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “কাম অন ইয়ার। সারাদিন বাড়িতে বসে বসে করবটা কী?”

“ওমা সে কী? তোর দিদির বিয়ে, তোর কাজ নেই?” জিনস-টপ ঈশিতা নাকের ওপর ঠেলল চশমা। প্যাসেজ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তত্ত্ব সাজানো হচ্ছে না? ছেলের বাড়ি তত্ত্ব যাবে না?”

“আমি ওসবে নেই। দিদিভাইয়ের বন্ধুরা আসবে, তারা যা করার করবে।”

“আইবুড়োভাত ওভার?”

“উঁহু। কাল।”

“হেব্‌বি খ্যাটন?”

“ধুস। শুধুই ফিশফিশ। পাবদা ভেটকি কই।”

“তোর দিদি খুব মাছ ভালবাসে বুঝি?”

দিদিভাই যে কী খেতে ভালবাসে সেটাই তো আজ পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারল না অলি। দুনিয়ার কোনও খাবারই কি খুব আগ্রহভরে খায়? মনে তো হয় না। ফুচকা পর্যন্ত এমন ভেঙে ভেঙে গালে পোরে, দেখে গা কিশকিশ করে। ওই তিন ধরনের মাছ হচ্ছে শুধু মায়ের ইচ্ছেয়। আইবুড়োভাতে মাছ খাওয়ালে মেয়ের বিবাহিত জীবনে নাকি সুখ উথলে পড়বে। যত্ত সব বস্তাপচা বিশ্বাস।

অলি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, “হ্যাঁ, ও একটু মেছো টাইপ আছে।”

কলেজ আজ বেশ ফাঁকা ফাঁকা। থার্ড ইয়ার তো কবেই বিদেয় নিয়েছে, সেকেন্ড ইয়ারের ছেলেমেয়ে খুবই কম, পড়ে আছে শুধুই ফার্স্ট ইয়ার। তিনতলা পুরনো আমলের বাড়িটায় তারাই ঘুরে বেড়াচ্ছে ইতস্তত, জটলা করছে, তাদের কলকলানিতেই খানিকটা যা প্রাণের সাড়া পাওয়া যায়।

অনার্সের পিরিয়ড। শুরু হয়ে গেছে ক্লাস। টুকুস সেঁধিয়ে গেল দুই বান্ধবী। গিয়ে বসেছে দীপাঞ্জন কৌশিক রনিতাদের বেঞ্চটায়। তরুণ অতিথি অধ্যাপক সপ্তর্ষি সোম তাদের দেখেও দেখল না যেন। গলাখানা আরও ভারিক্কি করে মনোযোগী প্রভাষণে।

ব্যাগ থেকে খাতা-কলম বের করল অলি। নোট নেবে কি নেবে না ভাবল একটু। যাক গে, লিখে আঙুলকে মিছিমিছি কষ্ট দেবে কেন, মোটামুটি শোনা থাক, কোচিংয়ে তো নোট মিলবেই।

সপ্তর্ষি পড়াচ্ছে ভারী মন দিয়ে। সদ্য মাস্টার্স করে এই খেপ খাটার চাকরিটা মিলেছে, এখনও বেচারা বেশ নার্ভাসই থাকে। ক্লাসে ছাত্রীরাই সংখ্যায় বেশি, তাই সতর্ক থাকে খুব, যাতে সহজে মেয়েদের চোখে চোখ না পড়ে। নবীন অধ্যাপকের এই দুর্বলতাটি টের পেয়ে গেছে ছাত্রীরা, তারা রীতিমতো উত্যক্ত করে সপ্তর্ষিকে। কেউ ঢুলুঢুলু চোখে তাকাচ্ছে, কেউ ঘাড় বেঁকিয়ে তেরচা দৃষ্টি হানছে…। আগের দিনই তো অলি এমন একটা সেক্সি লুক ঝেড়েছিল, নয়নে নয়ন মিলতেই পড়ানোর প্রায় খেই হারিয়ে ফেলে আর কী। দৃষ্টিটা পিছলে নিয়ে কোনও ভাবে রক্ষা পেয়েছিল শেষমেশ।

আজ অবশ্য ওই ধরনের বজ্জাতিতে অলির আগ্রহ নেই। সপ্তর্ষির লেকচার শুনছে। বিষয়টা মজাদার। ভারতের বিভিন্ন জায়গার নানান উপজাতির বিচিত্র সামাজিক রীতিনীতি। মধ্যপ্রদেশের কোন এক আদিবাসীদের সমাজে তরুণ-তরুণীরা নাকি ‘ঘোটুল’ বলে এক কমিউনিটি হলে গিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে বাস করতে পারে। ইচ্ছেমতো সঙ্গী বেছে নিয়ে থাকো, পছন্দ না হলে বদলে ফেল পার্টনার…। এই করতে করতে পাকাপাকি একটা জুটি তৈরি হয়ে গেলে তবেই বেরোতে পারবে ঘোটুল থেকে। তারপর হবে তাদের সামাজিক বিয়ে। আর যদি জুটি বাঁধতে ব্যর্থ হয় কেউ, তাকে নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করতে হবে আবার ঘোটুলে ঢোকার সুযোগ পাওয়ার জন্য।

ব্যস, শুনতে শুনতেই চালু হয়ে গেল ফিসফাস।

কৌশিক চাপা গলায় বলল, “আমরাও তো ঘোটুল চালু করতে পারি।”

রনিতা বলল, “খুব আনন্দ, অ্যাঁ? সব মেয়েকে চেখে চেখে দেখবি?”

দীপাঞ্জন বলল, “তোরাও আমাদের চাখতে পারিস।”

ঈশিতা বলল, “যা, যা…। ছেলেদের আলাদা করে টেস্ট করার কী আছে। ছেলেরা সব্বাই এক।”

“ওটা মনে হয়। …ম্যাগনেটিক চার্ম বলে একটা কথা আছে জানিস তো? এমন এমন ছেলে থাকে যারা চুম্বকের মতো টানে, আর মেয়েরা তাদের দিকে পতঙ্গের মতো ছোটে।”

“তোরা নিশ্চয়ই কেউ তেমন পুরুষ নোস?” ঈশিতা ঠোঁট বেঁকায়, “একটা বউ একটা বাচ্চা… এতেই তোদের লাইফফোর্স শেষ। মাল্টিপল কেস কারা হ্যান্ডেল করতে পারে জানিস?”

“যাদের স্পেশাল ক্যালি আছে।” রনিতা চোখ টিপল, “যেমন ধর শ্রীকৃষ্ণ, রবিঠাকুর, পাবলো পিকাসো…”

বিনা মন্তব্যে বন্ধুদের কথা শুনছিল অলি। এমন আর এক পুরুষকে সে জানে বই কী। দিদিভাইয়ের আসল বাবা। লোকটার বহুৎ বদনাম। সে নাকি ভীষণ লুজ ক্যারেকটার, মেয়েদের পিছনে ছোঁক-ছোঁক করে বেড়ায়…! বহুকাল ধরে লোকটাকে স্বচক্ষে দেখার বাসনা ছিল অলির, মিটেছে সাধ। একবার চুপিচুপি তার এগ্‌জ়িবিশনে গিয়েছিল একদিন। কারওকে বলেনি, দিদিভাইকেও না। লোকটাকে দেখে বুঝেছে, বদনামের অনেকটাই ফাঁপা। মেয়েলি হিংসের রটনা। পটানোর দরকার নেই, ওই রকম এক টগবগে মানুষের কাছাকাছি এলে যে কোনও মেয়ে এমনিই গলে তুলতুলে হয়ে যাবে। এখনও কী মাচো! কী ফিগার! ভাবতে অবাক লাগে, একসময়ে মাকে ওই লোক বিয়ে করেছিল! মা তো একেবারেই সাধারণ, নয় কী? না রূপ, না গুণ, কোনও দিক দিয়েই লোকটার পাশে মাকে মানায় না। মায়ের জন্য বাপিই একদম ঠিকঠাক ম্যাচ। নিরীহ শান্ত ঘরোয়া হিসেবি…।

হঠাৎই অলির বুকটা কুনকুন করে উঠল। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই তো দিদিভাইয়ের কাছে হেরে আছে সে। লেখাপড়ায় তার মগজ নাকি দিদিভাইয়ের মতো নয়, চলনেবলনে স্বভাবে সহবতে সে নাকি দিদিভাইয়ের ধারেকাছে আসে না…। আর দেখতে তো সে দিদিভাইয়ের তুলনায় নেহাতই খেঁদিপেঁচি। শেষেরটা অবশ্য মা-বাপি উচ্চারণ করেনি কখনও, কিন্তু অলি তো আয়নার সামনে দাঁড়ায়। নিজেকে দেখতে পায়। ওই দেবরাজ সিংহরায়ের মুখোমুখি হওয়ার পরমুহূর্ত থেকে অলি এও মর্মে মর্মে টের পাচ্ছে, বাবা পাওয়ার ব্যাপারেও তাকে বিশ্রীভাবে হারিয়ে দিয়েছে দিদিভাই।

একেই বুঝি বলে কপাল। দেবরাজকে বাবা হিসেবে পছন্দ করায় দিদিভাইয়ের কোনও হাত ছিল না। তেমনই শান্তনুও অলির অনুমতি নিয়ে তার বাবা হয়নি। কিন্তু পাশার দান তো দিদিভাইয়ের ফেভারেই পড়ল!

ঈশিতা জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছে, “অ্যাই, এখনও ডায়াসে কী দেখছিস? সপ্তর্ষি স্যার অনেকক্ষণ বেরিয়ে গেছে।”

সংবিৎ ফিরল অলির। খসে যাওয়া খোলসটা ঝটিতি এঁটে নিল মুখে। চোখ গোল গোল করে বলল, “ওমা, সত্যি গেছে? আমি কি তবে হ্যালুসিনেশন দেখছিলাম?”

দীপাঞ্জন বিজ্ঞের মতো বলল, “মহাভারত পড়েছিস?”

“উঁহু। দেখেছি।”

“দেখায় হবে না। পড়তে হবে।… মহাভারতে পার ঋষি এক পিস অপ্সরা ফিট করা থাকত। আর এই ঘোটুলপার্টি একাই সাতখানা ঋষি। এর মায়াজাল এড়ানো তোদের পক্ষে খুবই কঠিন।”

অলি চোখ টিপল, “সপ্তর্ষিকে আমাদের ঘোটুলে ঢোকালে কেমন হয়?”

“আমাদের প্রবলেম। বালিকা কম পড়ে যাবে। ও একাই সাত পিস নিয়ে বেরিয়ে যাবে।”

অলি খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল। কাচভাঙা হাসিতে ক্লাসের অনেকে তাকাচ্ছে ঘুরে ঘুরে। চোখ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করছে, কী রে? কী রে? অলি বলবে কী, কল্পচোখে সে যে এখন দেখতে পাচ্ছে সপ্তর্ষিকে। আদিবাসীর বেশে। এদেশি নয়, আফ্রিকান। একেবারে ডিসকভারি চ্যানেলের ছাঁচ। আদুড় গা, কোমরের ঝালর ঝালর ট্যানা ঊরু অবধিও পৌঁছয়নি, মুখময় নানান রঙের উলকি, মাথায় চিত্রবিচিত্র পাখির পালক। ছবিটা ভেবেই মুচড়ে উঠছে পেট, ছিপিখোলা বোতলের সোডার মতো উপচে পড়ছে হাসি।

ওফ, সামনের দিন সপ্তর্ষির ক্লাস সে করবে কী করে? সিনটা মনে পড়ে যাবে না?

হাসি বড় ছোঁয়াচে রোগ। অলির দেখাদেখি হাসছে বাকিরাও। না বুঝেই। হঠাৎই দৌড়তে দৌড়তে দেবলীনা আর সায়ন্তীর প্রবেশ। দু’জনে প্রায় কোরাসে বেজে উঠল, “এই এই, টি-আর-সি আজ আসেনি।”

“কেন রে?” দীপাঞ্জন স্বগতোক্তির ঢঙে বলল, “উনিও কি ঘোটুলে?”

এবার গোটা ক্লাস জুড়ে হাসির ফোয়ারা। তারই মধ্যে ফটাফট ব্যাগ উঠে যাচ্ছে কাঁধে। সুড়ুত-সাড়ুত ছেলেমেয়েরা বেরিয়ে পড়ছে রুম ছেড়ে।

অলি বলল, “চল, আমরাও কাটি।”

রনিতা গা মোচড়াচ্ছে, “পাসের ক্লাস করবি না? এরপর তো পল সায়েন্সের পিরিয়ড।’

“তুই কর। রাজনীতিতে তোর ফান্ডা বাড়ুক।”

কথা বলতে বলতেই বেরিয়ে এল অলিরা। দঙ্গলের সঙ্গে নামছে সিঁড়ি বেয়ে, টের পেল কাঁপছে মোবাইল। সেলফোন বের করে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। হের মম!

ফোন কানে চেপে অলি এক উত্কট ব্যস্ততা ফোটাল গলায়, “বলো, বলো, তাড়াতাড়ি বলো। ক্লাসে ঢুকছি।” ওপ্রান্তে মানসীর ভার ভার গলা, “আজই তোমার ক্লাস করার ধুম পড়ল? কলেজে না গেলে চলছিল না?”

“আহ, দরকারটা কী বলবে তো? হাতে সময় নেই। স্যর ঢুকছেন।”

“তোমার ছোটকাকা এসেছে। তোমায় খুঁজছিল।”

“আমার হয়ে সরি বলে দাও। প্লিইইইইজ।” স্বরে একটু আদুরে খুকিপনা মিশিয়ে দিল অলি। আচমকা গলা নামিয়ে বলল, “তা হলে ছাড়ছি, কেমন।”

“বাড়িভরতি লোক, দয়া করে তাড়াতাড়ি ফিরো।”

“যথা আজ্ঞা। ক্লাস শেষ হলেই ব্যাক।”

ফোন অফ করে আপন মনে মুচকি হাসল অলি। অ্যাক্টিংটা জব্বর হয়েছে। এই একটা ব্যাপারে দিদিভাই বোধহয় তার সঙ্গে পেরে উঠবে না। তবে আঁচলরানিও খুব কাঁচা খেলোয়াড় নয়। সে যে মনে মনে কী ভাবে, বোমা মারলেও পেট থেকে বেরোয় কী? বিয়েতে সে খুশি, না ব্যথিত… আনন্দর ফোয়ারা ছুটছে, নাকি ঝোড়ো বাতাস বইছে…ঠাহর করা মুশকিল। সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও এমন ভাসা ভাসা উত্তর দেয়!

বিয়েটা ঠিক হওয়ার দিনই তো অলি ধরেছিল আঁচলকে, “অ্যাই দিদিভাই, কেমন লাগল রে ছেলেটাকে?”

কী নির্লিপ্ত জবাব, “মন্দ কী।”

“একটু হুমদোমুখো মনে হল না?”

“তাই বুঝি?”

“তোর সঙ্গে ম্যাচ করবে? আই ডাউট।”

“কেন? আমিই বা কী এমন আহামরি?”

“তার মানে তোর পছন্দ হয়েছে?”

“যারা আমায় ভালবাসে, তারা সবাই মিলে পছন্দ করেছে। আমি অপছন্দ করব কেন?”

লাও ঠ্যালা! কী বুঝবে বোঝো! বিয়ের বাজার করতে বেরিয়েও তো একই অভিব্যক্তি। গয়নার ডিজ়াইনটা এরকম করবি? চলতে পারে। ওরকম করবি? তাও চলতে পারে। শুধু দেখো, যেন বেশি ঝকমক না করে! শাড়িও তো সব কেনা হল মরা মরা কালারের। সারাক্ষণ কেমন সন্ত্রস্ত ভাব, যেন বেশি বেশি খরচা না হয়ে যায়। কেন রে বাবা, তুই তো ভাল মতোই জানিস, তোর জন্য সর্বস্ব উজাড় করতে বাপি ছটফট করছে।

বাপিও পারে। কেন যে এমন কাঁচাখোলা হয়ে টাকা ওড়াচ্ছে? মা বারবার রাশ টানতে চাইছে, তবুও। মায়ের অবশ্য একটু ঢংও আছে। মুখে যতই না না করুক, প্রাক্তন শ্বশুরবাড়িকে দেখানোর জন্য মাও যথেষ্ট উদ্‌গ্রীব। বিশেষত বনোপিসিকে। নইলে কী গায়ে পড়ে পড়ে প্রতিটি জিনিসের দাম শোনায়! কেটারার কত টাকা প্লেট নিচ্ছে, বিয়েবাড়ি ভাড়ায় কী পড়ল, এমনকী গেস্টহাউসে রানিগড় পার্টিদের রাখতে কীরকম খসছে, কিচ্ছুটি জানাতে ভুলছে না। দিদিভাইকে যে ফ্যালনা করে মানুষ করা হয়নি, ও বাড়িকে কি না দেখালে চলে! কী বলে এটাকে? চালবাজি? না অহং?

ভাবনার মাঝে হঠাৎ অলির খেয়াল হল, বন্ধুরা কেউ ধারেকাছে নেই। কোথায় বেপাত্তা হল সব? ক্যান্টিন গরম করতে গেল? নাকি কাট? অলির দিদির জন্যে গিফট কিনতেও যেতে পারে। সেখানে তো ওরা নিশ্চয়ই অলিকে সঙ্গে নেবে না। কিন্তু অলি যে ভেবেছিল, পরশু নেমন্তন্ন, কথাটা আর একবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেবে…। যাক গে যাক, সাড়ে ছ’শো টাকা প্লেট জেনে যখন ফেলেছে, মনে ওদের থাকবেই। দীপাঞ্জনটা যা হ্যাংলা, দুপুরে না গিয়ে হাজির হয়! কাল সেরকমই একটা হিন্ট দিচ্ছিল না? দুপুরে কী কী আইটেম জিজ্ঞেস করছিল…। ভবানীপুরে মেস করে থাকে তো, একটা মিল একস্ট্রা বাঁচাতে পারলে শালার লাভই লাভ।

কিন্তু অলি এখন যায় কোথায়? বাড়িতে এক্ষুনি ফেরা নেই, মা চাইছে বলেই দেরিতে ঢুকবে আজ। চারটে অবধি তো তার ক্লাসই থাকে, হিহি। এখন গড়িয়া যাওয়া মানেই তো রানিগড় পার্টিদের সঙ্গে হেঁ হেঁ করা। উফ, অসহ্য। বিশেষ করে ছোটকাকা তো…! এমন এক আজব ভাষায় কথা বলে ছোটকাকা! প্রতিটি বাক্যে বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল সাম্রাজ্যবাদ গোছের কোনও না কোনও অবসোলিট শব্দ থাকবেই। শুনলেই অলির কান কনকন করে। বিয়ে না করলে মানুষ যে কত ধরনের খ্যাপা হয়ে যায়!

এতাল বেতাল ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে নামছিল অলি। ল্যান্ডিংয়ের সামনে থার্ড ইয়ার অনার্সের প্রিয়াংশু।

আপনাআপনি অলির ভুরু কুঁচকে গেছে, “তুমি এখন কলেজে?”

ফুলস্লিভ শার্ট প্রিয়াংশু হাসি হাসি মুখে বলল, “অ্যাডমিট কার্ড তুলতে এসেছিলাম।”

“অ। তা অফিস তো নীচে, ওপরে উঠছ যে বড়?”

“তোদের কৌশিক রনিতাদের সঙ্গে দেখা হল। ওরা বলল তুই নাকি আছিস। ভাবলাম একবার মিট করে যাই। পরীক্ষার তো মাত্র আর টু উইকস… আর তো এদিকে আসতে পারব না… নেক্সট কবে দেখা হয় ঠিক নেই…”

“কেন? আমি কি কলেজ ছেড়ে পালাব?”

“তা নয়, তবু…।”

হোঁচট খেল প্রিয়াংশু। একটু যেন অপ্রতিভ সহসা। অলি ভারী মজা পেল। তাদের ডিপার্টমেন্টের পুনর্মিলন উত্সবে থার্ড ইয়ারের পান্ডা এই প্রিয়াংশু ছিল গোটা অনুষ্ঠানটার সঞ্চালক। কথাবার্তায় বেজায় তুখোড়, স্যাটাস্যাট আধুনিক কবিতা পর্যন্ত আউড়ে দেয়। আগে মুখোমুখি পড়ে গেলে হেসে বাতচিত করত অল্প-স্বল্প, যেমনটা করে ডিপার্টমেন্টের দাদা দিদিরা। কিন্তু ওই ফাংশনের পর থেকেই প্রিয়াংশুর হাবভাব কেমন বদলে গেছে। পেছন পেছন ঘুরছে খুব, অথচ অলির সামনাসামনি হলেই পুরো ভ্যাবলাকান্ত। কেস খেয়ে গেছে নির্ঘাত! কিন্তু অলির যে এসব আসেই না! কোনও বিশেষ একজনের সঙ্গে বসে চাঁদ তারা ফুল দেখাদেখি করছে, এ তো অলি ভাবতেই পারে না।

কিন্তু এই এঁটুলিকে অলি কীভাবে সরাবে এখন? কড়া গলায় বলে দেবে, ওই ইন্টু মিন্টুর মতলব ছাড়ো, বাড়ি গিয়ে বসো বই নিয়ে! নাকি হেসে-কেশে পার করে দেবে খানিকটা সময়?

পলক দোনামোনা করে অলি বলল, “আর নিশ্চয় তেতলা উঠবে না?”

“না।” প্রিয়াংশুর হাসি যেন চওড়া হল, “তোর জন্যই তো আজ…”

“জানি।” অলি মিচকে হাসল, “চলো, একতলায় নামি।”

নীচে এসে অলি বলল, “কেমন হচ্ছে প্রিপারেশন?”

“ওই চলছে আর কী।” প্রিয়াংশু এদিক ওদিক তাকাল, “তোদের তো আর অনার্সের ক্লাস নেই আজ?”

“কেন?”

“একটু কফি খেতে পারি আমরা।… যাবি ও ফুটের কফিশপটায়?”

এমন প্রস্তাব প্রিয়াংশুর কাছ থেকে এই প্রথম। ভারী আশান্বিত মুখে তাকিয়ে আছে বেচারা, না করতেও মায়া লাগে। সঙ্গে সঙ্গে অলির এও মনে হল কিছু একটা যেন বলতে চায় প্রিয়াংশু। ভালই তো, নয় একটা এস্পার ওস্পার হয়ে যাক আজ। সে যে আমল দেবে না, এ তো স্থির করাই আছে, কফিটা বেফালতু ছাড়বে কেন অলি?

অলির কাঁধে আলগা ঢেউ, “চলো।”

ছিমছাম ঝকঝকে সাজানো-গোছানো দোকান। ছোট টেবিল ঘিরে বাহারি চেয়ার সুবিন্যস্তভাবে ছড়ানো। অল্পবয়সিদেরই ভিড় বেশি, আড্ডা গল্পই চলছে টেবিলে-টেবিলে, তবে কেজো মানুষও আছে দু’চারজন। বকোমধ্যে হংস যথা হয়ে।

অলি এখানে অনভ্যস্ত নয়, মাঝে-সাঝেই আসে বন্ধুদের সঙ্গে। বসেছে চেয়ার টেনে। প্রিয়াংশু জিজ্ঞেস করল, “লাতে, না ক্যাপুচিনো?”

“লাতে মানে তো দুধে থকথক। ক্যাপুচিনোই বলো।”

“সঙ্গে স্ন্যাকস কিছু? স্যান্ডউইচ? বার্গার?”

“না না। শুধু কফি।”

প্রিয়াংশুই কাউন্টার থেকে নিয়ে এল কফি। ট্রে থেকে নামিয়ে কাপ বাড়িয়ে দিল অলিকে। স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিটা অলির মন্দ লাগল না, কেবলকান্ত ম্যানার্স জানে তা হলে।

কাপে চুমুক দিতে দিতে চারপাশটায় একটু চোখ চালিয়ে নিচ্ছিল অলি। আচমকাই প্রিয়াংশুর গলা কানে এল, “এ বছরটা বোধহয় আটকেই গেলাম।”

অলি ঘুরে তাকাল, “কেন?”

“ধুস, মনই বসাতে পারছি না।” প্রিয়াংশু অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করল মুখে, “শুধু বই খাতা খুলে রাখাই সার, একটু কিচ্ছু থাকছে না মেমরিতে।”

“ভেরি ব্যাড।” অলি টুকুস করে উপদেশ ঝেড়ে দিল, “ডাক্তার কনসাল্ট করো, স্মৃতি বাড়ানোর টনিক খাও।”

“ডাক্তারের সন্ধানেই তো আজ আসা।”

“তাই বুঝি?” অলি এবার একটু অবাক, “ডাক্তারের চেম্বার কি এদিকেই? কলেজের কাছাকাছি কোথাও?”

“উঁহু কাছাকাছি নয়, একেবারে কলেজের মধ্যেই।”

বলেই প্রিয়াংশু একটা ঝোলা ঝোলা লুক দিল। অলির চোখ থেকে আর চোখই সরাচ্ছে না। কী দৃষ্টি রে বাবা, অলিকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে নাকি? ক্লাস টুয়েলভে কোচিংক্লাসের ব্যাচমেট শৌনক তাকে চুমু খেয়েছিল একদিন, অলি একটু বিরক্ত হয়েছিল বটে, কিন্তু প্রিয়াংশুর ওই হা-পিত্যেস দৃষ্টি যেন আরও বেশি অস্বস্তিকর।

অলি গম্ভীর হয়ে বলল, “অসুখটা ভাল নয়। তোমার ডাক্তার এ রোগের ট্রিটমেন্ট জানে না।”

ব্যস, প্রিয়াংশুর চোখদুটো যেন নিভে গেল মুহূর্তে। একটুক্ষণ মাথা নামিয়ে বসে থেকে মৃদুস্বরে বলল, “ডাক্তারকে যদি মাঝে মাঝে ফোন করি?”

“বোর কোরো না ডাক্তারকে। সর্বদা সে ফোন ধরবে না।”

“যদি মেসেজ পাঠাই? জবাব মিলবে কী?”

“ডিপেন্ডস। মেসেজটা কি… ডাক্তারের মেজাজ কেমন আছে…। এক্ষুনি কিছু গ্যারান্টি করা যাবে না।”

প্রিয়াংশু চুপ মেরে গেল। বাড়ি ফেরার পথে প্রিয়াংশুর নেতিয়ে থাকা মুখখানা মনে পড়ছিল অলির। হেসে কুটিপাটি হওয়াটাই তো স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু সেভাবে হাসি পাচ্ছে না যেন। কেন যে মনে হচ্ছে আজ আর একটু নরমসরম ভঙ্গিতে শান্ত করতে পারত ছেলেটাকে। বেচারা পরীক্ষাটাই না গুবলেট করে বসে।

বাড়িতে পা রাখার আগেই অলি হাসিখুশি মুখোশটা পরে নিয়েছে। ঢুকে সামনেই অম্বরদা। বাধ্য ছাত্রের মতো বাপির কাছ থেকে একগাদা নির্দেশ নিচ্ছে। পরশু কখন কোথায় ফুল দিয়ে সাজাতে যাবে বরের গাড়ি। বর আনতে ক’টায় বেরোবে অম্বর। তার আগে কালই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অম্বরকে দেখে নিতে হবে পুরুতমশাইয়ের ফর্দমাফিক বিয়ের প্রতিটি উপকরণ এল কি না। শুধু তাই নয়, ম্যারেজ রেজিস্ট্রার মহিলাটিকেও একবার যেন টোকা দিয়ে আসে কাল। উঁহু, ফোনে নয়। সশরীরে।

অম্বরকে ছেড়ে হঠাৎ অলিকে ধরল শান্তনু, “এই মেয়ে, হাওয়ায় ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছিস কেন? তুইও কিছু দায়িত্ব নে।”

“কী করব বলো?” অলি নিরীহ মুখে বলল, “অম্বরদার অ্যাসিস্ট্যান্ট হব?”

অম্বর যেন আঁতকে উঠেছে, “না না, অলি দিদির বিয়ে এনজয় করুক। তুমি তো আছই, আমরা দু’জনে সব সামলে নেব।”

অলি হিহি হাসছে। শান্তনুকে চোখ টিপে বলল, “কেন আমাকে কাজে ভেড়াতে চাইছ বাপি? আমি তো দিদিভাইয়ের ম্যাসকট? ওটাই আমার ফিট জব।”

অলির গলা পেয়েই মানসীর আবির্ভাব, “এই যে মহারানির এতক্ষণে সময় হল। এ ঘরে এবার দয়া করে পদধুলি দাও।”

মায়ের মুখ দেখে রসিকতার বাসনা সংবরণ করল অলি। লোকজনের গলা পাচ্ছিল, ঘরে উঁকি দিয়েই মাথা ঝিমঝিম। কচিকাঁচারা বাদে আস্ত রানিগড়ই মজুত। কাকা-কাকি-জ্যাঠা-জেঠি, কে আছে আর কে নেই! সব ক’টা অপছন্দের মুখ জড়ো হয়েছে এক জায়গায়।

কেন যে অম্বরদা ছাড়া রানিগড়ের বাকি মানুষগুলোকে পছন্দ হয় না অলির? তাকে তো সবাই ওরা ভালই বাসে, গেলে আদরযত্নেরও ত্রুটি হয় না, তবুও। মায়ের প্রতি রানিগড়ের একটা সূক্ষ্ম বিরাগ আছে, সেটাই কি অলির ষষ্ঠেন্দ্রিয় টের পেয়েছে কখনও? হতে পারে। তবে অলি এখন অনন্ত আনন্দের ঝরনা হয়ে মজা-খুশি দেবে ওই মানুষগুলোকেই, দিয়েই চলবে। পেশাদার এক ভাঁড়ের মতো।

রাতে আরেকপ্রস্থ কাজ। কালই শেষ রজনী, আজ রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। দিদিভাইয়ের সঙ্গে গল্পে আড্ডায় স্মৃতিচারণে। অবিরল হাহা হিহি জুড়বে, প্রিয়াংশুর উপাখ্যানও শোনাবে রসিয়ে রসিয়ে।

শুতে এসে অলি ভ্যাবাচ্যাকা। মুঠোয় মোবাইলখানা ধরে অদ্ভুত এক বিষণ্ণ চোখে খাটে বসে আছে আঁচল। অলিকে দেখে আচমকা ডুকরে কেঁদে উঠল।

দিদিভাইকে কখনও কাঁদতে দেখেনি অলি। কোনওদিন না। তাই বুঝি আজ হঠাৎই বুকে তীব্র মোচড়। আঁচল কেন কাঁদছে, প্রশ্নটাই অলির মুখে এল না। দিদিভাইকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদছে।

মুখোশটা খুলে রেখে। হৃদয় নিংড়ে। অঝোরধারায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *