প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড
চতুর্থ খণ্ড
পঞ্চম খণ্ড

১.৭ মন্ত্রিউল-সুর মের শহরে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

এরপর মন্ত্রিউল-সুর মের শহরে যা ঘটেছিল তা সব জানতে পারেনি শহরের লোক। তবে দু একটা যে সংক্ষিপ্ত খবর ছড়িয়ে পড়েছিল তাতে প্রচুর আলোড়ন সৃষ্টি হয় তা অবশ্যই যথাযথভাবে বর্ণনা করা উচিত। তার মধ্যে দু একটি ঘটনাকে পাঠকদের অসম্ভব বলেও মনে হতে পারে।

যেদিন সকালে জেভাতের সঙ্গে ম্যাদলেনের দেখা হয় সেদিন বিকালে যথারীতি হাসপাতালে ফাঁতিনেকে দেখতে যায় ম্যাদলেন। ফাঁতিনের কাছে যাওয়ার আগে যে দু জন নার্স তার হাসপাতালে কাজ করত, সিস্টার সিমপ্লিস নামে তাদের মধ্যে একজন নার্সকে ডেকে দেখা করল তার সঙ্গে। অপর একজন নার্সের নাম ছিল সিস্টার পার্পেচুয়া।

সিস্টার পার্পেচুয়া ছিল এক সরল সাদাসিধে গ্রাম্য মহিলা। সে অন্য কোনও কাজ না পেয়েই কুমারী অবস্থায় নার্সের কাজে যোগদান করে। এই ধরনের মেয়ে এমন কিছু বিরল নয়। ধর্মীয় প্রেরণাসিক্ত এক সেবার ব্রত তার চরিত্রের মূল ধাতুকে কোনওভাবে পরিবর্তিত করতে পারেনি। কোনও এক গ্রাম্য মেয়ের চার্চের কাজে যোগদান করা এবং সন্ন্যাসিনী হওয়াটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। গ্রাম্য চাষি মেয়ে আর গ্রাম্য চার্চের সন্ন্যাসিনীর একটা সাধারণ ভিত্তিভূমি থাকে এবং সেটা হল অজ্ঞতা। সিস্টার পার্পেচুয়া খুব কড়া প্রকৃতির মেয়ে এবং খিটখিটে মেজাজের। সে যখন হাসপাতালে নার্সের কাজ করত তখন রোগীরা তাকে মোটেই দেখতে পারত না। সে রুগণ আর মুমূর্ষদের কারণে অকারণে যখন-তখন তিরস্কার করত, ঈশ্বরকে যেন তাদের মুখের উপর ছুঁড়ে মারত। মৃত্যুর পদধ্বনির সঙ্গে তার প্রার্থনার সুরকে মিশিয়ে দিত। তার বাড়ি ছিল পানতয়।

ভিনসেন্ট দ্য পল কল্পিত সিস্টার অফ মার্সিকে কয়েকটি কথায় মূর্ত করে তোলেন। সিস্টার সিমপ্লিস-এর সঙ্গে পার্পেচুয়ার অনেক তফাৎ। সিস্টার অফ মার্সি অর্থাৎ যিনি দয়ার প্রতিমূর্তি তার মধ্যে স্বাধীনতা আর সেবাপরায়ণতা একই সঙ্গে দুটোরই প্রধান্য ছিল। যারা সিস্টার অফ মার্সির মতে হতে চায় অথবা তার আদর্শ অনুসরণ করতে চায় তাদের সেবাই হবে জীবনের ধর্ম, আনুগত্যই তাদের জীবনের শৃঙখলা, রোগীদের ঘরই তাদের ধর্মস্থান, ঈশ্বরের ভয়ই তাদের একমাত্র আশ্রয় এবং শালীনতাই তাদের অবগুণ্ঠন। সিস্টার সিমপ্লিসের কাছে আদর্শই ছিল এক জীবন্ত বাস্তব। কেউ তার বয়স কত তা জানত না, তাকে দেখে মনে হয় তার জীবনে কখনও যৌবন ছিল না এবং মনে হয় সে কখনও বুড়ো হবে না। সে খুব শান্ত এবং কঠোর প্রকৃতির মহিলা। আমরা তাকে নারী বলতেই পারি না, নারীসুলভ কমনীয়তা তার মধ্যে ছিল না। সে কাছে থাকলেও মনে হয় যেন কত দূরে আছে। সে জীবনে কখনও মিথ্যে কথা বলেনি। সে এত শান্ত ছিল যে তাকে দুর্বল প্রকৃতির মনে হত। কিন্তু গাঁয়ে তার প্রচুর শক্তি ছিল। সে যখন তার সুন্দর সরু সরু ও বিশুদ্ধ আঙুলগুলো রোগীদের উপর রাখত তখন তারা যন্ত্রণার মাঝেও আরাম ও আনন্দ অনুভব করত। তার কথার মধ্যে যেন এক আশ্চর্য নীরবতা ছিল। সে একটাও অনাবশ্যক কথা বলত না। তার কণ্ঠস্বর শুনে যে কেউ আনন্দ পেত। মোটা সার্জের গাউনের সঙ্গে তার চোখমুখের সূক্ষ্ম ও কমনীয় ভাবটা একরকম খাপ খেয়ে গিয়েছিল। তার ওই গাউনটা যেন তাকে সব সময় ঈশ্বরের কথা মনে করিয়ে দিত। সে জীবনে কখনও মিথ্যা কথা বলত না, বিনা কারণে কোনও কথা বলত না, এমন কোনও কথা বলত না যা সত্য নয় –সেইটাই তার চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল। তার অকম্পিত সত্যবাদিতা তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে তাকে বিখ্যাত করে তোলে এবং আব্বেসিকর্দ সে কথা একটি চিঠিতে মূকবধির ম্যাথিউকে জানান। আমরা যতই সৎ আর নীতিপরায়ণ হই না কেন, আমাদের সরলতা ও সত্যবাদিতার মধ্যেও কিছু না কিছু নির্দোষ মিথ্যা থেকে যায়। কিন্তু সিস্টার সিমপ্লিসের ক্ষেত্রে একথা খাটে না। তার কাছে মিথ্যা মিথ্যা, সাদা বা নির্দোষ মিথ্যা বলে কোনও কিছু নেই। যে মিথ্যা কথা বলে সে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথাই বলে। মিথ্যা মানেই শয়তানের মুখ। যে শয়তান সেই অসত্য। সিস্টার সিমপ্লিস এটা বিশ্বাস করত এবং এই বিশ্বাসমতো কাজ করত। যে পবিত্রতার জ্যোতি তার দেহ থেকে বিচ্ছুরিত হত, তার চোখে-মুখে ঝরে পড়ত, সেই বিশ্বাসই ছিল তার শক্তির উৎস। তার হাসি আর চোখের দৃষ্টি দুটোই ছিল পবিত্র। তার বিবেকের স্বচ্ছ দর্পণে কোনও ধূলিকণার বিন্দুমাত্র স্লানিমা বা কোনও ছলনার কুটিল জাল ছিল না। সে নাকি সিমপ্লিস নামটা নিয়েছিল সেন্ট ভিনসেন্ট দ্য পল থেকে।

সে যখন সেন্ট ভিনসেন্ট-এর দলে যোগদান করে তখন তার দুটো বাতিক ছিল। সে বেশি মিষ্টি খেতে ভালোবাসত আর চিঠি পেতে চাইত। পরে এই দুর্বলতাকে অপসারিত করে তার জীবন থেকে। বড় বড় অক্ষরে লাতিন ভাষায় লেখা একখানি প্রার্থনাপুস্তকই ছিল তার একমাত্র প্রিয় গ্রন্থ। সে লাতিন ভাষা না জানলেও সেই বইটা পড়ে বুঝতে পারত। ফাঁতিনের মধ্যে কিছু অন্তর্নিহিত গুণ থাকা সত্ত্বেও কোনও স্নেহমমতা ছিল না তার প্রতি। ফাঁতিনের দেখাশোনার সব ভার নিজের ওপরেই চাপিয়ে নেয়।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন সিস্টার সিমপ্লিসকে একটু আড়ালে ডেকে এমনভাবে তার ওপর ফাঁতিনের ভার দেয় যে সেকথা পরে সে কোনওদিন ভুলতে পারেনি। তার পর ম্যাদলেন ফাঁতিনেকে দেখতে যায়।

কোনও শীতার্ত ব্যক্তি যেমন উষ্ণতা আর আরাম চায় তেমনি ফাঁতিনে ম্যাদলেনের আসার জন্য পরম আগ্রহের সঙ্গে প্রতীক্ষায় থাকত। সে নার্সদের বলত, মেয়র যতক্ষণ আমার কাছে থাকেন ততক্ষণ যেন আমার দেহে প্রাণ থাকে।

সেদিন ফাঁতিনের জ্বর খুব বেড়েছিল। ম্যাদলেন তার কাছে যেতে সে সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, কসেত্তের কী হল?

ম্যাদলেন বলল, খুব শীঘ্রই সে এসে পড়বে।

সেদিন ম্যাদলেন আধ ঘণ্টার পরিবর্তে এক ঘণ্টা রইল। অন্য দিনকার মতোই সে কথাবার্তা বলতে লাগল। সে নার্সদের বলে দিল, ফাঁতিনের সেবা-শুশ্রষার যেন কোনও ত্রুটি না হয়। ওষুধপত্র বা পথ্যের যেন অভাব না হয়। একসময় ম্যালেনের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়। ডাক্তার তাকে একসময় বলল, ফাঁতিনের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। অনেকে ভাবল ডাক্তারের কথা শুনেই মুখটা ভার হয়ে পড়ে ম্যাদলেনের।

হাসপাতাল থেকে সোজা মেয়রের অফিসে চলে যায় সে। অফিসের কেরানি দেখল, ম্যাদলেন অফিসঘরে টাঙানো ফ্রান্সের বিভিন্ন রাস্তার একটা মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখছে। তা দেখতে দেখতে একটা কাগজের উপর কী লিখল সে।

.

মেয়রের অফিস থেকে বেরিয়ে ম্যাদলেন শহরের একটা রাস্তা দিয়ে তার চার্চের কুরে শফেয়ারের কাছে চলে গেল। শফেয়ার ঘোড়া আর গাড়ি ভাড়া দিত।

ম্যাদলেন দেখল শফেয়ার ঘোড়ার গাড়ির কী একটা জিনিস মেরামত করছিল।

সে তাকে বলল, মাস্টার শফেয়ার, একটা ভালো ঘোড়া দিতে পারেন?

শফেয়ার ফ্ল্যান্ডার্সের অধিবাসী ছিল বলে তাকে ফ্লেমিংও বলা হত। ফ্লেমিং বলল, আমার সব ঘোড়াই ভালোমঁসিয়ে মেয়র। আপনি কী চাইছেন?

ম্যাদলেন বলল, আমি এমন একটা ঘোড়া চাই যে দিনে কুড়ি লিগ অর্থাৎ চল্লিশ মাইল পথ যাওয়া-আসা করতে পারে।

ফ্লেমিং বলল, কুড়ি লিগ!

হ্যাঁ।

সারাদিন হাঁটার পর কতক্ষণ বিশ্রাম করতে পাবে?

পরদিন আবার আমাকে ফিরে আসতে হবে।

সেই একই দূরত্ব?

হ্যাঁ।

তা হলে পুরো চল্লিশ মাইল?

ম্যাদলেন একটা কাগজ বার করে দেখিয়ে বলল, জায়গাটার দূরত্ব ঠিক সাড়ে উনিশ মাইল।

ফ্লেমিং বলল, ঠিক আছে মঁসিয়ে মেয়র, আপনি যা চাইছেন সেই রকম ঘোড়াই আমার আছে। ঘোড়াটা বাস বুলোনাই থেকে আনা। একটা অদ্ভুত জানোয়ার। আগে ঘোড়াটাকে কেউ বশ করতে পারত না। তার পিঠে কেউ চাপলেই সে তাকে ফেলে দিত। তারপর আমি তাকে কিনে এনে বশ করি। এখন সে মেঘের মতো আর বাতাসের মতো গতিশীল। আপনি যা চাইছেন এই ঘোড়াই তা পারবে। তবে এর পিঠে চাপতে পাবেন না। এ গাড়ি টানতে পারে, কিন্তু পিঠে কাউকে বহন করে না।

এটাই হল এর রীতি।

ম্যাদলেন বলল, পুরো পথটা যেতে পারবে তো?

ফ্লেমিং বলল, চল্লিশ মাইল তো? স্বচ্ছন্দে আট ঘণ্টার মধ্যে চলে যাবে। তবে একটা কথা আছে।

কী কথা?

কথাটা হল এই যে, অর্ধেক পথ যাওয়ার পর এক ঘন্টা বিশ্রাম দিতে হবে। আর কোনও পান্থশালায় ওকে খাওয়াবার সময় দেখতে হবে হোটেলের চাকররা যেন ওর খাবারের থেকে কিছু যথারীতি চুরি করে না নেয়।

আমি তা অবশ্যই দেখব।

আর একটা কথা। আমি শুধু এই গাড়ি আর ঘোড়া দিচ্ছি আপনার খাতিরে মঁসিয়ে মেয়র। আপনি গাড়ি চালাতে জানেন তো?

অবশ্যই জানি।

এর ভাড়া হচ্ছে দিনে তিরিশ ফ্রাঁ। ঘোড়ার খাওয়ার খরচ আপনার।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন তিনটে স্বর্ণমুদ্রা বার করে টেবিলের উপর রেখে বলল, দু’দিনের অগ্রিম দেওয়া রইল।

ফ্লেমিং বলল, আর একটা কথা। বড় গাড়ি নিয়ে এত দূর পথ যাওয়া ঠিক হবে না। আপনি বরং আমার দু’চাকার হালকা গাড়িটা নিয়ে যান।

খুব ভালো কথা।

তবে দেখুন, গাড়িটা একেবারে ফাঁকা।

তাতে কিছু যায়-আসে না।

তবে একটা জিনিস দেখেছেন মঁসিয়ে মেয়র। এখন শীতকাল, দারুণ ঠাণ্ডা। তাছাড়া বৃষ্টি হতে পারে।

ম্যাদলেন বলল, আমি চাই ঘোড়া আর গাড়ি আমার বাড়ির সামনে রাত সাড়ে চারটের সময় হাজির করতে হবে।

ফ্লেমিং বলল, ঠিক আছে।

এরপর সে টেবিলের উপর তার নখ দিয়ে একটা আঁচড় কেটে বলল, এখনও কিন্তু আপনি কোথায় যাবেন তা জানতে পারলাম না।

এই কথাটা ফ্লেমিং প্রথম থেকেই ভাবছিল, কিন্তু মেয়রকে এতক্ষণ জিজ্ঞাসা করতে পারছিল না।

ম্যাদলেন সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ঘোড়াটার সামনের পা দুটো শক্ত তো?

হ্যাঁ, তবে ঢালুতে নামার সময় সাবধানে গাড়ি চালাবেন। আপনার পথে হয়তো অনেক ঢাল আছে।

ম্যাদলেন বলল, ঠিক রাত সাড়ে চারটের সময় যেন ঘোড়া আর গাড়িটা আমার বাড়ির সামনে নিয়ে আসা হয়।

এই কথা বলে বিস্ময়াভিভূত ফ্লেমিংকে ছেড়ে সেখান থেকে চলে গেল ম্যাদলেন।

কিন্তু কয়েক মিনিট পরেই ফিরে এল সে। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল মনটা তার তখনও এক দুর্বোধ্য চিন্তায় মগ্ন ছিল।

ম্যাদলেন বলল, মঁসিয়ে শফেয়ার, গাড়ি আর ঘোড়ার জন্য মোট কত দাম চান?

ফ্লেমিং বলল, আপনি কি সত্যিই এ দুটো কিনতে চাইছেন?

ম্যাদলেন বলল, না, তবে এগুলোর যদি কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয় তার জন্য কিছু টাকা জমা রাখছি। আমি গাড়ি ও ঘোড়া ফিরিয়ে দিলে আপনি টাকাটা ফেরত দেবেন। কত টাকা জমা দেব?

পাঁচশো ফ্রাঁ।

এই নিন।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন টেবিলের উপর একটা ব্যাংকনোট রেখে চলে গেল। এবার আর ফিরে এল না। ফ্লেমিং ভাবতে লাগল এক হাজার ফ্লা’র কথা বললে ভালো হত। কেন এক হাজারের কথা বলেনি তার জন্য অনুশোচনা করতে লাগল সে। আসলে কিন্তু ওই ঘোড়া আর গাড়ির দাম একশো ফ্রাঁ’র বেশি হবে না।

ফ্লেমিং তার স্ত্রীকে ডেকে সব কথা বলল। মেয়র কোন চুলোয় যাচ্ছে? এই নিয়ে আলোচনা করতে লাগল তারা। স্ত্রী বলল, উনি নিশ্চয় প্যারিস যাচ্ছেন।

স্বামী বলল, না।

ম্যাদলেন একটুকরো কাগজ ফেলে রেখে গিয়েছিল। ফ্লেমিং সেটা তুলে নিয়ে দেখল তাতে পরপর কয়েকটা জায়গার নাম আর তাদের দূরত্ব লেখা রয়েছে। অবশেষে রয়েছে অ্যারাসের নাম যার মোট দূরত্ব সাড়ে উনিশ মাইল। এটা দেখে বুঝল, মেয়র অ্যারাস যাচ্ছে।

পুরনো চার্চটার ভেতর না ঢুকে অন্য পথ দিয়ে ম্যাদলেন সোজা বাড়ি চলে গেল। সে তার শোবার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। প্রায় দিনই সে রাত্রিবেলায় তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। তাই এটা তেমন অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিল না। সেদিন তখন মাত্র সাড়ে আটটা বাজে। যে মেয়েটি একই সঙ্গে কারখানা আর ম্যাদলেনের বাড়িতে কাজ করত সেই মেয়েটি নিচের তলায় ক্যাশিয়ার আসতেই তাকে বলল, মেয়রের শরীর কি খারাপ? তার মুখখানা কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে।

ক্যাশিয়ার নিচের তলায় একটা ঘরে শুত। সে মেয়েটির কথায় কান না দিতে শুতে চলে গেল। কিন্তু দুপুররাতে ঘুম ভেঙে গেল তার। দোতলায় যে ঘরে ম্যাদলেন থাকে সে ঘরে পায়চারির পদশব্দ শুনে সে বুঝতে পারল ম্যাদলেনই পায়চারি করছে। ব্যাপারটাতে আশ্চর্য হয়ে গেল ক্যাশিয়ার। কারণ ম্যাদলেন সাধারণত সকাল হওয়ার আগে ওঠে না এবং তার আগে কোনও শব্দ শোনা যায় না তার ঘরে।

ক্যাশিয়ার শুনতে পেল উপরে ম্যালেনের আলমারি খোলার ও আসবাবপত্র সরানোর শব্দ আসছে। সে জানালার কাছে গিয়ে জানালা খুলে দেখল উপরতলায় এই শীতেও ম্যালেনের ঘরের জানালা খোলা আছে। কারণ আলোর ছটা আসছিল ভোলা জানালাটা দিয়ে। তখনও উপরে পায়চারির শব্দ হচ্ছিল।

মঁসিয়ে ম্যালেনের ঘরে তখন আসলে কী হচ্ছিল তার কথা এবার বর্ণনা করব আমরা।

.

পাঠকরা হয়তো বুঝতে পেরেছেন এই মঁসিয়ে ম্যাদলেনই হল জাঁ ভলজাঁ। আমরা এর আগেই তার বিবেকের গভীরে উঁকি মেরে দেখেছি একবার। আবার সেখানে উঁকি মেরে দেখতে গেলে ভয়ে কাঁপতে থাকব আমরা। এই ধরনের চিন্তার থেকে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না। মানুষের আত্মার চোখে মানুষের মতো দুর্বোধ্যতায় অন্ধকার, আবার স্পষ্টতার উজ্জ্বল আর কিছু হতে পারে না; সব জীবের মধ্যে মানুষই হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর, সবচেয়ে জটিল, সবচেয়ে রহস্যময় এবং গভীরতায় অন্তহীন।

মানুষের বিবেকের ওপর যদি একটা কবিতা লিখতে হয় তা হলে তা এমনই এক মহাকাব্য হবে যা অন্য সব মহাকাব্যকে ছাড়িয়ে যাবে। তার গভীরতায় পৃথিবীর সকল মহাকাব্য তলিয়ে যাবে। মানুষের বিবেক হচ্ছে এক মায়াময় গোলকধাঁধা, অভিলাষ আর অনুসন্ধানের লীলাক্ষেত্র, স্বপ্নের জ্বলন্ত চুল্লি। যেসব চিন্তার কথা আমরা ভাবতেও লজ্জা পাই সেইসব গোপন লজ্জাজনক চিন্তার এক অন্ধকারাবৃত ভাণ্ডার। সেখানে প্রতিনিয়ত চলে আত্মাভিমানের তাণ্ডব আর অরাজকতা, বিচিত্র আবেগানুভূতির দ্বন্দ্ব। কোনও মানুষ যখন চিন্তা করে তখন যদি আমরা সেই মুহূর্তে তার নীরব নিস্তব্ধ বহিরঙ্গের অন্তরালে অন্তরের অন্তস্তলে কী আলোড়ন চলছে তা একবার উঁকি মেরে দেখি তা হলে দেখতে পাব হোমার বর্ণিত এক তুমুল মহাযুদ্ধের মতো যুদ্ধ চলছে সেখানে। কত সব ড্রাগন আর হায়েড্রা, মিল্টন ও দান্তে বর্ণিত কত সব অলৌকিক ও অতিলৌকিক চরিত্রের বিরাট লড়াই চলছে যেন সে অন্তরের মধ্যে। প্রতিটি মানুষের মধ্যেই আছে অনন্ত এক মহাশূন্যতা যেখানে থেকে সে তার আত্মার গতিবিধির সঙ্গে তার জীবনের কার্যাবলির বিচার করে হতাশ হয় এবং সেই শূন্যতার গভীরে ডুবে যায়।

দান্তে এলিঘিরি একদিন একটি ভাগ্যনির্দিষ্ট দরজার সামনে এসে ঢুকতে ইতস্তত করতে থাকেন। আমরাও এই ধরনের দ্বারপথের সামনে এসে ইতস্তত করি, কিন্তু তা। সত্ত্বেও ঢুকে পড়ি তার মধ্যে। পেতিত গার্ভে নামে সেই ছেলেটার সঙ্গে জাঁ ভলজাঁ’র জীবনে যা যা ঘটে তা বলার আর কোনও প্রয়োজন নেই, কারণ তা পাঠকরা জানেন। তার পর থেকে তার জীবনে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। বিশপ যা চেয়েছিলেন, সে। তা-ই হয়েছিল। এটা শুধু এক পরিবর্তন নয়, এ এক আশ্চর্য রূপান্তর।

সে প্রথমে বিশপের রুপোর জিনিসপত্রগুলো বিক্রি করে শুধু রুপোর বাতিদান দুটো স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে রেখে পালিয়ে বেড়াবার চেষ্টা করে। ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে ঘুরে বেড়াতে থাকে সে। অবশেষে মন্ত্রিউল-সুর-মের শহরে এসে পড়ে। এখানে এসে কিভাবে সে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে তা আমরা আগেই দেখেছি। এখানে সে নানারকম জনকল্যাণমূলক কাজে মত্ত হয়ে থাকলেও ব্যক্তিজীবনে সে ছিল একেবারে নিঃসঙ্গ আর দুরধিগম্য। তার অবাঞ্ছিত অতীত জীবনের এক দুর্মর স্মৃতি ছায়াচ্ছন্ন করে রেখেছিল তার বিবেকবুদ্ধিকে। তবু সে তার বর্তমান জীবনের উদার ও মহৎ কার্যাবলির দ্বারা অতীতের জীবনের সব কলঙ্করেখাকে মুছে দিচ্ছে একে একে। এই ধরনের এক সান্ত্বনা থেকে শান্তি পেত সে। তার মনে তখন মাত্র দুটো উদ্দেশ্য ছিল–তার নাম ও আসল পরিচয়কে গোপন রাখা আর মানুষের কাছ থেকে ক্রমে দূরে চলে গিয়ে ঈশ্বরের কাছে ফিরে যাওয়া।

এই দুটো উদ্দেশ্য একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে গিয়ে এমন এক শক্তিশালী নীতিতে পরিণত হয়, যা তার জীবনের সব কর্ম ও চিন্তাকে নিয়ন্ত্রিত করতে থাকে। তার দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত আচরণ এই নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে থাকে। তার দুটি উদ্দেশ্য তাকে একটি পথে চালিত করে, তাকে মানুষের কাছ থেকে ক্রমশই দূরে নিয়ে যায় আর পরোপকারী ও সরল প্রকৃতির করে তোলে। তবে এই দুটি উদ্দেশ্যের মধ্যে যখন সংঘর্ষ বাধে তখন সে তার প্রথম উদ্দেশ্যকে দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের কাছে বলি দেয়। তার নৈতিক জীবনের শুচিতা এবং পবিত্রতা রক্ষার জন্যই কি দ্বিতীয় উদ্দেশ্যের কাছে বলি দেয়? তার নৈতিক জীবনের শুচিতা এবং পবিত্রতা রক্ষার জন্য বেশি সচেষ্ট হয়ে ওঠে সে। তার যথেষ্ট পরিণামদর্শিতা থাকলেও বিশপের রুপোর বাতিদান দুটি রেখে দেয় সে, বিশপের মৃত্যুসংবাদ শুনে সে শোকসূচক পোশাক পরে শোক পালন করে। শহরের কোনও ভবঘুরে ছেলে এলেই সে খোঁজখবর নিত, অর্থাৎ পেতিত গার্ভেকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করত। ফেবারোলেও লোক পাঠিয়ে সে খোঁজ নেয়, জেভার্তের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সত্ত্বেও সে ফকেলেভেন্তকে গাড়ির তলা থেকে উদ্ধার করে। মোট কথা সাধু-সন্ন্যাসীদের মতো সে কেবল মনে করত তার নিজের প্রতি কোনও কর্তব্য নেই।

কিন্তু এখনকার মতো এমন সমস্যামূলক পরিস্থিতি আর কখনও উদ্ভব হয়নি আগে। যে দুটি উদ্দেশ্য মিলে মিশে এই হতভাগ্য মানুষের জীবনটাকে নিয়ন্ত্রিত করে চলত, তারা এমন দ্বন্দে মেতে ওঠেনি কখনও। সেদিন তার অফিসে জেতার্ত ঢুকেই যে কথাগুলো বলে সে কথা শুনেই এই দ্বন্দ্বের কথা বুঝতে পারে সে। প্রথমে অস্পষ্টভাবে, তার পর গভীরভাবে। যে নামটাকে মনের মধ্যে গোপনীয়তার অনেকগুলো স্তরের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে জেভার্তের কণ্ঠে তা উচ্চারিত হতে দেখে। অভিভূত হয়ে পড়ে সে। নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাসে বিহ্বল ও বিমূঢ় হয়ে পড়ে সে। ঝড়ের আঘাতে অবনতমুখী ওকগাছের মতো নুয়ে পড়ে, শত্রুর আক্রমণে পরাভূত সৈনিকের মতো ভেঙে পড়ে সে। বুঝতে পারে, তার অন্তরের মধ্যে যে কম্পন, যে আলোড়ন শুরু হয়েছে তা এক প্রবল ঝড়েরই পূর্বাভাসমাত্র। সে বুঝতে পারে বজ্রগর্ভ মেঘমালার সঞ্চার হচ্ছে তার মাথার উপরে। জেভার্তের কথা শুনে যে চিন্তা মাথা তুলে ওঠে তার মনের মাঝে তা হল শ্যাম্পম্যাথিউ নামে লোকটাকে কারামুক্ত করে তার জায়গায় নিজেকে কারারুদ্ধ করা। এ চিন্তা ধারালো ছুরির ফলার মতোই মর্মভেদী ও বেদনাদায়ক। তবু সে নিজেকে বারবার বলতে লাগল, ধৈর্য ধরো, শক্ত হও। কিন্তু প্রথমে তার এই উদার আবেগকে অবদমিত করে রাখে।

জাঁ ভলজাঁ যদি বিশপের উপদেশ মেনে চলত শেষ পর্যন্ত, যেভাবে অনুশোচনা আর আত্মনিগ্রহের পথ ধরে তার আত্মার পুনর্বাসনের কাজে এগিয়ে চলেছিল সে, সেই ভাবটা যদি বজায় রেখে চলতে পারত শেষ পর্যন্ত, কোনও ভয়ঙ্কর উভয়সংকটের মধ্যে তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত না হয়ে অন্তরের যে বিরাট শূন্যতার মাঝে আত্মার পরম মুক্তি নিহিত আছে সেই শূন্যতার পথেই অদম্য গতিতে এগিয়ে চলত তা হলে তার পক্ষে খুবই ভালো হত। ভালো হত, কিন্তু তা হয়নি। তার আত্মার মধ্যে কী ঘটছিল তার একটা বিবরণ দেব আমরা। প্রথমে তার আত্মরক্ষার প্রবৃত্তি জয়ী হয় তার মধ্যে। সে তার এলোমেলো চিন্তাগুলোকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে, তার আবেগগুলোকে সংযত করে, জেভাৰ্তের বিপজ্জনক নৈকট্য সম্বন্ধে সতর্ক হয়ে ওঠে। এক আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটাকে স্থগিত রাখে। কী করতে হবে সে বিষয়ে তার চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করে, ঢাল ফিরে পাওয়া যোদ্ধার মতো সে তার প্রশান্তিটাকে আবার ফিরে পায়।

বাকি দিনটা ভলজাঁ’র এক অদ্ভুত অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটে। তার আপাত প্রশান্তির অন্তরালে এক তুমুল আলোড়ন চলতে থাকে তার অন্তরে। সে যেন এক নিরাপত্তামূলক সতর্কতা অবলম্বন করেছিল। তার মনের মধ্যে সব কিছু ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল, সে কোনও কিছুই স্পষ্ট করে দেখতে বা ভাবতে পারছিল না। তবে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছিল, সে এমন একটা জোর আঘাত পেয়েছে যা তাকে অভিভূত করে দেয় এবং যা তার অন্তরের এত সব আলোড়ন-আন্দোলনের মূল কারণ।

সে যথারীতি ফাঁতিনেকে দেখতে গেল এবং অনেক বেশি সময় সেখানে কাটাল। তার অনুপস্থিতিকালে যাতে ফাঁতিনের কোনও অসুবিধা না হয়, তার দেখাশোনা যাতে ঠিকমতো হয় তার জন্য নার্সকে বলে দিল। সে অস্পষ্টভাবে ভাবল তার একবার অ্যারাস যাওয়া উচিত। কিন্তু কী করবে না-করবে সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হল না। সেখানে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। ব্যাপারটা কী তা শুধু দেখে আসবে সে। সেইজন্যই ঘোড়া আর গাড়ির ব্যবস্থা করল।

সে ভালোভাবেই সে রাতে খেল। খাওয়ার পর শোবার ঘরে এসে আবার ভাবতে শুরু করল।

ব্যাপারটা সে নতুন করে ভেবে দেখল এবং ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হল তার। সে একসময় চেয়ার থেকে উঠে দরজার খিল দিয়ে এল। তার ভয় হতে লাগল বাইরে থেকে কেউ এসে পড়তে পারে।

বাড়ির আলোটায় বিরক্তবোধ করছিল সে। তাই সে নিবিয়ে দিল বাতিটা। কারণ কেউ দেখে ফেলতে পারে।

কিন্তু কে?

যাকে সে এড়িয়ে যেতে চাইছে, ঘরে ঢুকতে দিতে চাইছে না, যার কণ্ঠ চিরতরে রোধ করে দিতে চাইছে, সে কিন্তু ঘরেই আছে। সে তার বিবেক।

তার বিবেক, তার মানেই ঈশ্বর। কিছুক্ষণের জন্য একটা নিরাপত্তা বোধ করল সে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়ায় কেউ সে ঘরে ঢুকতে পারবে না, কেউ তার ইচ্ছার ওপর হাত দিতে পারবে না। ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়ায় কেউ তাকে দেখতে পাবে না। অন্ধকারে চেয়ারে বসে টেবিলের উপর কনুই রেখে তার উপর মাথা দিয়ে ভাবতে লাগল।

সে ভাবল, আমি কোথায় আছি? এটা কি একটা স্বপ্ন? আমি কি সত্যি সত্যিই জেভাৰ্তকে দেখেছি এবং সে আমাকে এইসব কথা বলেছে? শ্যাম্পম্যাথিউ নামে লোকটা কি সত্যিই আমার মতো দেখতে? এটা কি এক অকল্পনীয় ব্যাপার নয়? গতকাল সকালেও আমি কত নিরাপদ আর এক সংশয়াতীত সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত ছিলাম। আমি তখন কী করছিলাম? এইসব কিছুর মানে কী? এখন আমাকে কী করতে হবে?

এই সমস্ত প্রশ্নের দ্বারা আলোড়িত হচ্ছিল তার মনটা। যেসব চিন্তার দুর্বার তরঙ্গমালা একের পর এক করে তার মস্তিষ্কের ভেতরটাতে আঘাত হানছিল, সেসব চিন্তার গতিরোধ করতে না পেরে সে মাথাটাকে ধরল। সে এক তুমুল অন্তর্দ্বন্দ্ব, যা তার সমস্ত ইচ্ছাশক্তি আর যুক্তিবোধকে নিষ্পেষিত ও নিশ্চিহ্ন করে দেয়। সে দ্বন্দ্বের ভেতর থেকে উঠে আসে শুধু এক প্রবল অন্তর্বেদনা। কোনও কিছু ভালো করে বুঝতে না পারা বা কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারার এক নিষ্ফল বেদনা।

তার মাথার ভেতরটা যেন জ্বলছিল। সে উঠে পড়ে জানালাটা খুলে দিল। আকাশে কোনও তারা ছিল না। সে আবার ফিরে এসে চেয়ারটাতে বসল।

রাত্রির প্রথম প্রহর কেটে গেল এইভাবে।

ক্রমে ক্রমে ঘোলাটে অস্পষ্ট চিন্তাগুলো স্বচ্ছ হয়ে উঠতে লাগল তার মনের মধ্যে। আসল অবস্থাটা সে পুরোপুরি না হলেও কিছু কিছু করে বুঝতে পারল। সে দেখল অবস্থাটা খুবই অস্বাভাবিক এবং সংকটজনক হলেও সে অবস্থাকে সে আয়ত্তে আনতে পেরেছে।

কিন্তু এতে অবস্থার জটিলতাটা গম্ভীর হয়ে উঠল আরও।

তার সব কাজের অন্তরালে এক অন্তর্নিহিত ধর্মীয় অভিলাষ থাকলেও সেদিন পর্যন্ত সে যা কিছু করেছে সেসব কাজের মধ্য দিয়ে সে শুধু তার আসল পরিচয়টাকে কবর দেবার জন্য একটা গর্ত খুঁড়ে এসেছে। স্মৃতিচারণার কোনও নীরব নির্জন মুহূর্তে অথবা জাগ্রত রাত্রিযাপনের দীর্ঘ অবকাশে যে ভয় সবচেয়ে বেশি করে এসেছে তা হল ওই নাম কারও মুখে উচ্চারিত হওয়ার ভয়। নিজেকে সে বারবার বলে এসেছে ওই নামটার পুনর্জন্ম মানেই তার সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া, যে নতুন জীবন সে কত চেষ্টায় কত কষ্টে গড়ে তুলেছে, সে জীবনের নিঃশেষিত বিলোপ। যে আত্মার সে জন্ম দিয়েছে সে আত্মার মৃত্যু। শুধু এই নামের পুনরুজ্জীবনের চিন্তা আর সম্ভাবনাটাই তার সর্বাঙ্গ শিহরিত করে তুলেছে। কেউ কি তাকে বলেছে যে এমন একদিন আসবে যেদিন তার নাম অর্থাৎ জাঁ ভলজাঁ’র ভয়ঙ্কর নামটা অকস্মাৎ তার কানে ধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হবে বজ্রধ্বনির মতো। যে রহস্যের ছদ্মাবরণ দিয়ে সে নিজেকে ঢেকে রেখেছে এতদিন, সহসা অন্ধকারের গর্ত থেকে এক তীব্র আলোর ছটা এসে সে রহস্যের আবরণটাকে ছিন্নভিন্ন করে দেবে? একথা তাকে কেউ কি বলেছে যে সে আলোর ভয়ঙ্কর ছটা সে না চাইলে তার কোনও ক্ষতিই করতে পারবে না, বরং সে আলো তার ছদ্মাবরণটাকে আরও গভীর, আরও দুচ্ছেদ্য করে তুলবে এবং সেই জাঁ ভলজাঁ’র সঙ্গে মঁসিয়ে ম্যালেনের দ্বন্দ্ব বাধলে সে দ্বন্দ্ব থেকে মঁসিয়ে ম্যাদলেন বিজয়ী বীরের মতো বেরিয়ে এসে আরও বেশি সম্মানে ভূষিত হবে, তার মর্যাদার আসনে আরও বেশি করে প্রতিষ্ঠিত হবে সে। একথা কেউ কি তাকে বলেছে যে সে নাম কারও মুখে উচ্চারিত শুনে সে শুধু বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকবে তার মুখপানে, তার কথাটাকে উন্মাদের প্রলাপ বলে উড়িয়ে দেবে? তবুও এটাই ঘটেছে, একদিন যা ছিল অসম্ভব সেইসব অসম্ভবই পুঞ্জীভূত হয়েছে দিনে দিনে, ঈশ্বরের বিধানে যা ছিল কল্পনা তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে।

তার মনটা যতই পরিষ্কার হয়ে উঠল ততই সে তার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল। যেন সে ঘুম থেকে হঠাৎ জেগে উঠে দেখে একই সঙ্গে এক আশ্চর্য দৃঢ়তা আর কম্পিত বিহ্বলতার সঙ্গে অন্ধকারের অতল গহ্বরের মাঝে নেমে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। সেই গহ্বরের খাড়াই পাড়টাকে ধরে সেই পতনের প্রতিরোধ করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে সে। সেই প্রতিরোধকালে ভাগ্যপ্রেরিত এক অপরিচিত ব্যক্তির মূর্তিকে সে দেখেছে যে ব্যক্তি জোর করে সেই গহ্বরটাতে নামাবার জন্য তাকে নির্মমভাবে টেনেছে। কিন্তু সে অথবা সেই অপরিচিত ব্যক্তি–দু জনের একজনকে সে গহ্বরে নামতেই হবে। তা না হলে সে গহ্বরের আগ্রাসী মুখটা বন্ধ হবে না কখনও।

দুর্বার ঘটনাপ্রবাহকে তার নিজস্ব গতিপথে বয়ে যেতে দেওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই তার।

ঘটনাটা হল এই : পেতিত গার্ভে নামে একটা ছেলের পয়সা চুরি করার জন্য যে কারাগারে সে একদিন ছিল সেই কারাগারে তার শূন্য স্থানটা আবার তাকে ফিরে পেতে চাইছে। সে সেখানে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত সেই শূন্য স্থানটা তার প্রতীক্ষায় থাকবে, তাকে ফিরে পাওয়ার দাবিতে অটল অনমনীয় হয়ে থাকবে এবং এটাই হল ভাগ্যের অখণ্ডনীয় নির্মম বিধান। এখন তার মনে হল তার এক বিকল্পকে সে খুঁজে পেয়েছে, সে বিকল্প হল হতভাগ্য শ্যাম্পম্যাথিউ। সে যদি চায় তা হলে সে একই সঙ্গে নিজেকে দ্বিধাবিভক্ত করে দু জায়গায় অবস্থান করতে পারে কারাগারে শ্যাম্পম্যাথিউরূপে অবস্থান করতে পারে, আবার সেই সঙ্গে ম্যাদলেন নাম সভ্যসমাজের এক সম্মানিত সদস্যরূপে তার হাতে গড়া এই স্বরাজ্যে স্বরাট হয়ে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। তা হলে অবশ্য তার কলঙ্কের বোঝাটাকে শ্যাম্পম্যাথিউর মাথায় চাপিয়ে দিতে হবে, সমাধিস্তম্ভের মতো যে কলঙ্কের পুঞ্জীভূত বোঝাটা একবার কারও ওপর চাপিয়ে দিলে আর নামানো যাবে না।

এই ধরনের বিস্ময়কর বিক্ষোভ মানুষ সারাজীবনের মধ্যে মাত্র দু তিনবার অনুভব করে অন্তরে। এ বিক্ষোভ আত্মার বিরুদ্ধে আত্মার বিক্ষোভ। এই আত্মা যেন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একে অন্যের সঙ্গে মেতে ওঠে এক আমরণ দ্বন্দ্বে। অংশীভূত একটি আত্মার অপরের শোচনীয় পতন দেখে বিজয়গর্বে এক শ্লেষাত্মক বিদ্রুপে ফেটে পড়ে।

হঠাৎ বাতিটা আবার জ্বালল সে।

সে ভাবল, আমি কিসের ভয় করেছি? কেন আমি এখানে বসে এত সব ভাবছি? এখন তো আমি নিরাপদ। যে একটিমাত্র দরজার মধ্য দিয়ে তার অবাঞ্ছিত অতীত প্রবেশ করে তার বর্তমান জীবনে এক বিরাট বিপর্যয় ঘটাতে পারত, সে দরজা তো রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সে দরজার সামনে এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর গেঁথে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেসে যে আসল সত্যটাকে অনুমান করেছিল, প্রায় ধরতে পেরেছিল?–সে হল জেভাৰ্ত। রক্তপিপাসু যে শিকারি কুকুরটা একদিন তার গন্ধ শুঁকে শুঁকে তার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছিল, সে কুকুরটা এখন সেই গন্ধসূত্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে একেবারে। সে। তার জাঁ ভলজাঁকে খুঁজে পেয়েছে। সুতরাং আর তাকে বিরক্ত করবে না। খুব সম্ভবত সে শহর ছেড়ে অন্য কোথাও পালাবে। আমার আর কিছু করার নেই, আমার এতে কোনও ভূমিকা নেই। সুতরাং অন্যায়টা আমার? আমার দোষটা কোথায়? কিন্তু এখন কেউ যদি আমায় দেখে তা হলে ভাববে বড় রকমের এক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছি আমি। কিন্তু কেউ যদি বিপদে পড়ে তা হলে সেটা আমার দোষ না। ঈশ্বরের বিধানেই সে এই বিপদের মধ্যে পড়েছে। ঐশ্বরিক বিধানসৃষ্ট সে বিপদের মুখে আমি মাছির মতো উড়ে গিয়ে ধরা দিতে পারি না। আর আমি কী চাইতে পারি? এই ক’টি বছর ধরে ঈশ্বরের কাছে যে আশীর্বাদ আমি চেয়ে এসেছি, অসংখ্য রাতের স্বপ্নে বা জাগরণে ঈশ্বরের কাছে যে প্রার্থনা আমি করে এসেছি তা সার্থক হয়েছে এতদিনে অর্থাৎ আমি লাভ করেছি পরিপূর্ণ নিরাপত্তা। ঈশ্বরের যে ইচ্ছায় এটা ঘটেছে সে ইচ্ছার বিরোধিতা করা আমার কাজ নয়। কিন্তু ঈশ্বর এটা চেয়েছেন? চেয়েছেন যাতে এইভাবে সকলের কাছে এক আদর্শ সৃষ্টি করতে পারি, যাতে আমি দেখাতে পারি ধর্ম ও অনুতাপের পথ সুখশান্তি থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমি এখন বুঝতে পারছি না কেন আমি চার্চে গিয়ে কুবর কাছে স্বীকারোক্তি করে তার পরামর্শ চাইলাম না। চাইলে তো তিনি আমাকে এই কথাই বলতেন, যা কিছু হওয়ার তা হয়ে গেছে, যা ঘটে ঘটতে দাও, ঈশ্বরের ইচ্ছামতো যা কিছু ঘটার তা ঘটুক।

আপন বিবেকের গভীরে নেমে গিয়ে এইসব কথা ভাবতে লাগল সে। আপন ব্যক্তি-সত্তার শূন্যতার গভীরে আপনিই আটকে গেছে যে সে। সে চেয়ার থেকে উঠে আবার পায়চারি করতে লাগল। সে আপন মনে বলে উঠল, এ বিষয়ে আর কিছু চিন্তা করার নেই, আমি মনস্থির করে ফেলেছি।

তবু কিন্তু শান্তি পেল না মনে। কূলের দিকে নিয়ত ধাবমান তরঙ্গমালাকে আমরা যেমন প্রতিহত করতে পারি না কোনওক্রমে, তেমনি কোনও অবাধ্য চিন্তা যদি বারবার ফিরে আসে মনের মধ্যে তা হলে তারও প্রতিরোধ করতে পারি না! নাবিক এই তরঙ্গমালাকে জোয়ার বলে, বিপন্ন বিব্রত বিবেকের কাছে এ চিন্তা হল অনুতাপ বা অনুশোচনা। ঈশ্বর যেমন সমুদ্রে তরঙ্গমালাকে উত্তাল ও উদ্বেল করে তোলেন তেমনি চিন্তার তরঙ্গাঘাতে আত্মাকে করে তোলেন বিচলিত।

কিছুক্ষণ পরে নিজের মধ্যে আবার সেই সংলাপ শুরু করল। সে সংলাপের সে নিজেই একাধারে বক্তা এবং শ্রোতা। বক্তা হিসেবে সে এমন সব কথা বলতে লাগল যা সে বলতে চায়নি, আবার শ্রোতা হিসেবে এমন সব কথা শুনতে লাগল যা সে শুনতে চায়নি। সেই সংলাপের বক্তা এবং শ্রোতা এমন এক রহস্যময় শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করল যে তাদের শুধু বলল, চিন্তা করো, ভাব। যেমন দু হাজার বছর আগে সেই শক্তি আর এক দণ্ডিত মানুষকে বলেছিল, কুশটা তুলে নাও।

অথবা অনেক সময় নিজের সঙ্গে কথা বলি আমরা। সব চিন্তাশীল লোকেরাই তা করে থাকে। কোনও কথা যখন মানুষের মনে এক আশ্চর্য গতিশীলতায় চিন্তা থেকে বিবেক আর বিবেক থেকে চিন্তায় যাওয়া-আসা করে তখন তা এক চমৎকার রহস্যে পরিণত হয়। আমরা তখন নীরবতা ভঙ্গ না করে নিজের সঙ্গে কথা বলি, আর তখন আমাদের মুখ ছাড়া প্রতিটি অনুচ্চারিত চিন্তা-ভাবনাই মুখর হয়ে কথা বলতে থাকে। আত্মা অদৃশ্য এবং অদৃশ্য হলেও তার একটা বাস্তবতা আছে।

সে নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল, কোথায় সে দাঁড়িয়ে আছে, কোন সিদ্ধান্তে সে উপনীত হয়েছে। সে নিজের কাছে নিজেই স্বীকার করল, সে সংকল্প করেছে ঘটনার গতি যেদিকে চলে তাকে চলতে দেবে, ঘটনার গতির ওপরে ঈশ্বরের বিধানের ওপর সে হস্তক্ষেপ করবে না কোনওভাবে। কিন্তু এ সংকল্পটাকে অন্যায় বলে মনে হল তার। ভাগ্য আর মানুষ যে ভুল করেছে সেই ভুল সে এক নীরব অপ্রতিবাদে মেনে নেবে, তাতে প্রতিরোধের কোনও চেষ্টা করবে না–এটা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে কিছু না করাটাই সব কিছু করা, এক অপরাধমূলক ভণ্ডামি আর কাপুরুষতার গভীরে নেমে যাওয়া।

গত আট বছরের মধ্যে সে প্রথম এক অশুভ চিন্তা আর অশুভ কর্মের তিক্ত আস্বাদ বোধ করল।

বিতৃষ্ণায় নিজের মুখের উপর থুতু ফেলতে ইচ্ছা করল।

সে যখন মনে মনে বলল, আমার উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে তখন সে আবার নিজেকে প্রশ্ন করে যেতে লাগল। তার জীবনের নিশ্চয় একটা উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু সে উদ্দেশ্যের অর্থ কি নিজেকে গোপন রাখা, পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ঘুরে বেড়ানো? সে যা কিছু করে এসেছে এতদিন তার পেছনে অন্য কোনও বড় যুক্তি বা বড় উদ্দেশ্য নেই? নিজের জীবন নয়, আত্মাকে রক্ষা করার এক বৃহত্তর উদ্দেশ্য ছিল না? বিশপের কথামতো সৎ, সম্মানিত ও এক দৃঢ়চেতা লোক হওয়ার সংকল্প ছিল না কি তার? এইটাই কি তার হৃদয়ের গোপন গভীর অভিলাষ ছিল না? আজ যদি সে অতীতের দরজাটা চিরতরে বন্ধ করে দেয় তা হলে কি এক জঘন্যতম কাজের দরজা খোলা হবে না? সে কাজ চুরির থেকেও অনেক বেশি ঘৃণ্য কাজ। সে কাজ হল একটি লোককে তার জীবন, সুখশান্তি, পৃথিবীর আলো থেকে বঞ্চিত করা। জেলখানার কয়েদি হিসেবে একটি লোককে জীবন্ত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া মানে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা। কিন্তু সে যদি তার ভুল সংশোধন করে লোকটিকে উদ্ধার করে, যদি নিজেকে জাঁ ভলজাঁ হিসেবে ঘোষণা করে তা হলে তাতে হবে তার প্রকৃত পুনরভ্যুত্থান, আসল পুনরুজ্জীবন, তা হলে যে নরকের দরজা থেকে পালিয়ে যেতে চাইছে সে দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। সশরীরে সেই নরকে ফিরে যাওয়া মানেই বাস্তবে তার থেকে মুক্তি পাওয়া। আজ তাকে এটাই করতে হবে। এ কাজ না করলে এতদিন সে যা কিছু করেছে তা সব পণ্ড হয়ে যাবে। তার গোটা জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে। অর্থহীন হয়ে উঠবে তার সব অনুশোচনা। আমি কোনও কিছুর পরোয়া করি না। তখন এ কথা বলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকবে না। বিশপের উপস্থিতিকে সে আজ জীবনে অনুভব করল, তার মনে হল বিশপ তার পানে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আজ সে বুঝল মেয়র মঁসিয়ে ম্যাদলেন তার সকল সৎকর্ম সত্ত্বেও বিশপের চোখে ঘৃণ্য দেখাচ্ছে। অথচ ঘৃণ্য জাঁ ভলজাঁ পবিত্র ও প্রশংসনীয় হয়ে উঠবে। অন্যান্য লোক যেখানে শুধু মুখোশটা দেখবে, বিশপ সেখানে দেখবে আসল মুখটা। অন্যান্যরা যেখানে জীবনটাকে দেখবে, বিশপ সেখানে আত্মাকে দেখবে। সুতরাং এখন অ্যারাসে গিয়ে নকল জাঁ ভলজাঁকে মুক্ত করে আসর জাঁ ভলজাঁকে ঘোষণা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। সেটা হবে সবচেয়ে মর্মন্তুদ, সবচেয়ে মর্মস্পর্শী জয়, এক চূড়ান্ত ও অপ্রত্যাবর্তনীয় পদক্ষেপ। কিন্তু তবু তাকে করতেই হবে সে কাজ। এটা তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক পরিণতি যে, মানুষের চোখে অধঃপতনের শেষ প্রান্তে নেমে গিয়েই ঈশ্বরের চোখে সে শুচিতার সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারবে।

অবশেষে সে বলল, ঠিক আছে, এ বিষয়ে এক স্থির সিদ্ধান্তে আসা যাক তা হলে। আমাকে আমার কর্তব্য করতে দাও, লোকটিকে উদ্ধার করতে দাও।

এবার তার হিসেবের খাতাপত্রগুলো দেখল সে। অর্থকষ্টে পড়া সেসব ব্যবসায়ীর কিছু বন্ধকি কাগজ ছিল তার কাছে সে সব কাগজগুলো আগুনে পুড়িয়ে দিল। ব্যাংকমালিক মঁসিয়ে লাফিত্তেকে একটা চিঠি লিখল সে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা কাগজে জড়ানো ব্যাংক থেকে তোলা একতাড়া নোট আর ভোটের সময় ব্যবহৃত তার পরিচয়পত্রটা তুলে নিল।

এই অবস্থায় কেউ যদি তাকে দেখত তা হলে সে কিন্তু তার মনের মধ্যে চিন্তার সকল বোঝাভারগুলোর কথা কিছুই বুঝতে পারত না। শুধু দেখতে পেত তার ঠোঁট দুটো মাঝে মাঝে নড়ছে আর মাঝে মাঝে সে ঘরের মধ্যে কোনও একটা জিনিসের দিকে তার অনুচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে বোকার মতো।

মঁসিয়ে লাফিত্তেকে চিঠিটা লেখা হয়ে গেলে চিঠিটা আর কাগজ জড়ানো নোটের তাড়াটাকে কোটে ঢোকাল। তার পর আবার পায়চারি করতে লাগল ঘরের মধ্যে।

তার চিন্তার ধারাটা কিন্তু পাল্টাল না। যেদিকেই সে তাকাতে লাগল সেইদিকেই দেখল কর্তব্যের দাবি তার পানে তীক্ষ্ণভাবে তাকিয়ে জ্বলন্ত আগুনের অক্ষরে কয়েকটা কথা তার সামনে লিখে দিল, উঠে দাঁড়াও এবং তোমার আসল নাম বল।

ক্রমেই এই কথাগুলো এক স্পষ্ট রূপ লাভ করে দুটো পৃথক নীতিতে বিভক্ত হয়ে তার জীবনকে অনুশাসিত করার চেষ্টা করতে লাগল। একটা নীতি তাকে তার নামটা গোপন রাখতে বলল, আর একটা নীতি আত্মাকে বিশুদ্ধ করে তুলতে বলল। জীবনে প্রথম এই দুটো নীতির মধ্যে একটা পার্থক্য দেখতে পেল। সে দেখল, এদের মধ্যে একটা নীতি ভালো এবং একটা নীতি খারাপ। একটা নীতি যখন আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করছে, অন্য নীতি তখন স্বার্থপর হতে শেখাচ্ছে। একটা নীতি বেরিয়ে এসেছে আলোর সুউচ্চ স্তম্ভ থেকে, আর একটা নীতি বেরিয়ে এসেছে অন্ধকারের অতল গহ্বর থেকে।

ক্রমে সে দেখল এই দুটো নীতি এক চরম দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়ে উঠল তার মনে আর সেই দ্বন্দ্বের ছবিটা যতই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল তার সামনে ততই সেই পরস্পরবিরুদ্ধ দুটো নীতি বিরাট আকার ধারণ করতে লাগল। তার মনে হল সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার মধ্যে অন্তহীন আলো আর ছায়ার মধ্যে এক দেবী ও দানবী মত্ত হয়ে উঠেছে এক প্রাণপণ সংগ্রামে। সে ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু তবু তার মনে হল, যা কিছু শুভ যা কিছু ভালো তারই জয় হয়েছে।

সে আরও বুঝল বিশপই প্রথমে তার ভাগ্য আর আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম মোড় ঘুরিয়ে দেয় আর তার পর আর একজন দ্বিতীয়বার মোড় ঘুরিয়ে দেয়, সে হল শ্যাম্পম্যাথিউ। এটাই হল তার জীবনের সবচেয়ে বড় সংকট, তার সহিষ্ণুতার শেষ বিচার।

তার উত্তপ্ত মানসিক অবস্থাটা কিছুক্ষণের জন্য শান্ত শীতল হলেও আবার সেটা বেড়ে যেতে লাগল। অজস্র চিন্তার ঘাত-প্রতিঘাতে আন্দোলিত হতে লাগল তার মনটা। কিন্তু তার সেই মূল সংকল্পটা এক রয়ে গেল।

একসময় সে তার মনকে বোঝাল হয়তো সে ব্যাপারটাকে অহেতুক বড় বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। শ্যাম্পম্যাথিউ নামে লোকটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়, আসলে লোকটা একটা চোর। তখন তার মতোই উত্তর করল, লোকটা যদি শুধু কতকগুলি আপেল চুরি করে থাকে তা হলে তার বড়জোর এক মাসের জেল হত, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হত না কখনও। তাছাড়া সে যে সত্যি সত্যিই আপেল চুরি করেছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ জাঁ ভলজাঁ’র নামটাই যথেষ্ট, অন্য কোনও প্রমাণের প্রয়োজন ছিল না।

সরকার পক্ষের উকিল হয়তো একসময় বলেছিল, লোকটা যখন বলে সকলেই তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ বিশ্বাস করে নিচ্ছে। এবং আবার সে ভাবল, হয়তো সে আত্মসমর্পণ করলে অর্থাৎ তার আসল পরিচয় ঘোষণা করলে এই সাত বছরের মধ্যে যেসব মহৎ কাজ করেছে, যে সম্মানজনক জীবনযাপন করেছে তার কথা বিবেচনা করে তাকে মুক্তি দেওয়া হবে। কিন্তু তাড়াতাড়ি তার মন থেকে এ ভাবনাটা দূর করে দিল। সে ভাবল, পেতিত গার্ভের পয়সা চুরির কথাটা পর্যালোচনা করে তাকে দাগি অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হবে এবং তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দান করা হবে।

সমস্ত মোহ আর মিথ্যা আশা মন থেকে সরিয়ে দিয়ে জাগতিক সকল বিষয় থেকে মনটা বিচ্ছিন্ন করে অপার্থিব এক উৎস হতে এক মানসিক শক্তি আর সান্ত্বনা খুঁজে পাবার চেষ্টা করতে লাগল সে। সে নিজেকে বোঝাল সে যদি যথাকর্তব্য পালন করে তা হলে যে শান্তির আস্বাদ সে লাভ করবে, সে কর্তব্য এড়িয়ে গিয়ে সে যদি মঁসিয়ে ম্যাদলেন হিসেবে বর্তমান জীবনের মর্যাদা, সম্মান, সম্পদ এবং জনপ্রিয়তা ভোগ করে যায় তা হলে এক গোপন অপরাধচেতনাজনিত লজ্জার গ্লানি তাকে সে শান্তির আস্বাদ লাভ করতে কিছুতেই দেবে না। অন্যদিকে সে যদি এইসব কিছু ত্যাগ করে তা হলে সে সত্যিকারের মুক্তি লাভ করবে–কারাদণ্ডের কঠোরতা, কষ্টভোগ, অন্তহীন আমরণ শ্রম আর অপমান সত্ত্বেও মনে মনে এক নিবিড় স্বর্গসুখের আস্বাদ অনুভব করবে।

অবশেষে সে মনে মনে বলল, এই কর্তব্য অপরিহার্য এবং এটাই তার নিয়তি, নিয়তির এ বিধান, বিধিনির্দিষ্ট এ কর্তব্য সে পরিবর্তন করতে পারে না, সে তা এড়িয়ে যেতে পারে না। একদিকে বাইরের আপাত শূন্যময় জীবন আর অন্তরের দিক থেকে এক গোপন অপমানের গ্লানি; একদিকে বাইরের আপাতত অধঃপতনের লজ্জা আর অন্তরের শুচিতা–এই দুটোর একটাকে তাকে বেছে নিতেই হবে।

এইসব চিন্তার বিষাদময় প্রভাব তার মনের শক্তিকে হ্রাস করতে পারল না কিছুমাত্র, শুধু তার মস্তিষ্ককে অবসন্ন করে তুলল। সে এলোমেলোভাবে অনেক অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ের কথা ভাবতে লাগল। অশান্তভাবে সে পায়চারি করতে লাগল ঘরের ভেতরে। তার শিরায় শিরায় রক্তস্রোত দ্রুত আর উত্তাল হয়ে উঠল। চার্চ আর টাউন হলের ঘণ্টাধ্বনি রাত্রির দ্বিপ্রহর ঘোষণা করল। ঘণ্টার ধ্বনিগুলো সে মনে মনে গুনে চলল। দিনকতক আগে একটা পুরনো ঘড়ির দোকানে দেখা একটা বড় ঘড়ির কথা তার মনে পড়ল। তার শীত করছিল। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বালল সে, অথচ জানালাটা বন্ধ করল না।

ক্রমেই এক ঔদাসীন্যের ভাব আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। রাত্রি দুপুর হবার আগে সে যেসব কথা ভেবেছিল সেসব কথা একবার স্মরণ করল। অবশেষে সে নিজেকে বলল, হ্যাঁ, আমি স্থির করে ফেলেছি আমি আত্মসমর্পণ করবই।

হঠাৎ ফাঁতিনের কথাটা মনে পড়ে গেল। আপন মনে বলে উঠল, হায় হতভাগ্য নারী!

এই আকস্মিক স্মৃতি বিদ্যুৎচমকের মতো এক ঝলক নতুন আলো ফেলল তার অবস্থার ওপর। সে নিজের মনকে বলল, কিন্তু আমি শুধু নিজের কথা ভাবছি। হয় আমাকে চুপচাপ থেকে যেতে হবে অথবা নিজেকে আইনের হাতে সঁপে দিতে হবে, হয় আমাকে আগের মতো আত্মগোপন করে থাকতে হবে অথবা আত্মাকে বাঁচাতে হবে, হয় আমাকে সম্মানিত অথচ ঘৃণ্য মেয়র হিসেবে থেকে যেতে হবে অথবা জেলখানায় ক্রীতদাস হয়ে বেঁচে থাকতে হবে। এইসব কিছুই আত্মাভিমানের ব্যাপার। কিন্তু আর পাঁচজনের কথা তো ভাবছি না, কোথায় আমার খ্রিস্টীয় কর্তব্যবোধ?

এবার সে শহর থেকে চলে গেলে কী অবস্থার উদ্ভব হবে সেই কথা ভাবতে লাগল। তাতে শুধু এই শহর নয়, এই সমগ্র অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যে শিল্প সে গড়ে তুলেছে, সে শিল্প তার অবর্তমানে নষ্ট হয়ে যাবে এবং তার ফলে সে শিল্পের সঙ্গে জড়িত ও কর্মরত অসংখ্য নরনারী, বৃদ্ধ অসহায় যারা তার থেকে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে তারা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বে। সে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানকার সমস্ত কর্মচঞ্চলতার স্রোতে ভাটা পড়বে। তার অভাবে সমগ্র অঞ্চলের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে। তাছাড়া যে ফাঁতিনের দুঃখভোগের জন্য সে কতকাংশে দায়ী তার প্রতি কি তার কোনও কর্তব্য নেই? সে তাকে কথা দিয়েছে যে তার সন্তানকে এনে দেবে। যদি সে তা না পারে তা হলে সে অবশ্যই মারা যাবে, তা হলে তার সন্তানের কী যে অবস্থা হবে, তা একমাত্র ঈশ্বরই জানেন; সে নিজেকে ধরা দিলে এইসব অশুভ ঘটনা ঘটবে। আর যদি সে ধরা না দেয় তা হলে কী হবে?

একটি লোক চুরি করার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করবে। তাকে বাঁচাতে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তার চেয়ে আমি এখানেই থাকব যেমন আছি। ফাঁতিনে তার সন্তানকে মানুষ করবে। দশ বছরের মধ্যে আমি এক কোটি টাকা সঞ্চয় করব এবং তাতে সমগ্র অঞ্চলটা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে। এ টাকার আমার কাছে কোনও দাম নেই। তাতে এ অঞ্চলের অধিবাসীরাই উপকৃত হবে তাতে সমৃদ্ধি আরও বাড়বে, নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠবে, আরও অনেক লোক কাজ পাবে। এখন শহরের আশপাশে যেসব জায়গায় অনুন্নত খামার আর পতিত জমি পড়ে আছে সেসব জায়গায় কত গ্রাম ও জনবসতি গড়ে উঠবে। তাতে মানুষের অভাব চলে যাবে এবং সেইসঙ্গে অনেক অপরাধ ও পাপকাজের উচ্ছেদ হবে। গড়ে উঠবে এক সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ। কিন্তু শুধু তার ব্যক্তিগত আত্মতৃপ্তির জন্য, শুধু তার আত্মিক সুখের জন্য, অতি নাটকীয় এক বীরত্বপূর্ণ কাজ ও মহানুভবতার জন্য এইসব কিছুকে বিসর্জন দিতে হবে। আর তার ফলে একটি নারী হাসপাতালে অসহায়ভাবে মারা যাবে আর তার সন্তান পথে পথে ঘুরে বেড়াবে। এক বিরাট অঞ্চলের অধিবাসীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, শুধু একটি লোককে শাস্তির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য যে শাস্তির পরিমাণ বেশি না-ও হতে পারে। আর আমার বিব্রত বিবেককে শান্ত করার জন্য। কিন্তু এটা এক উন্মাদের কাজ ছাড়া আর কিছুই না। কোনও বোঝাভারে আমার বিবেক যদি বিপন্ন হয় সেটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তার জন্য অপরের প্রতি, সমাজের প্রতি তার যে কর্তব্য আছে তাতে জলাঞ্জলি দিতে পারে না।

উঠে সে আবার ঘরের ভেতর পায়চারি করে বেড়াতে লাগল। তার মনে হল এতক্ষণে তার বিবেক শান্ত হয়েছে। মাটির অন্ধকার গর্তেই হীরক পাওয়া যায়, তেমনি মনের অন্ধকারেই পাওয়া যায় শুভ্রোজ্জ্বল সত্য। মনের সেই অন্ধকার গহ্বরে নেমে গিয়ে সেখানে অনেকক্ষণ ধরে হাতড়ে বেড়িয়ে সত্যের যে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড খুঁজে পেয়েছে, সে হীরক এখানে জ্বলজ্বল করছে তার উপর।

সে ভাবল, এইটাই ঠিক পথ। ঠিক পথ দেখাবার জন্য সব মানুষেরই একটা নীতি থাকা দরকার। আমার এখন মনস্থির হয়ে গেছে। অবস্থা যেমন আছে থাক, ঘটনার স্রোত যেভাবে যে পথে বয়ে যায় যাক, আমি আর কোনও কিছু ভাবব না, আমার মধ্যে আর কোনও দ্বিধা বা দৌর্বল্যচিত্ততা থাকবে না। আমি যেমন মঁসিয়ে ম্যাদলেন আছি তেমনিই তা থেকে যাব। যে লোকটা ভলজাঁ নামে চলে যাচ্ছে, তাতে তার যা হয় হবে। আমি আর ভলজাঁ নই। আমি তাকে চিনি না, তার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তার ওপর যদি অন্য লোকের নাম চাপিয়ে দেওয়া হয় তা হলে সেটা বুঝতে হবে দৈবক্রমে সেটা ঘটে গেছে এবং দৈবই তার জন্য দায়ী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে একবার নিজের চেহারাটার পানে তাকাল। বলল, ওহ, স্থির সিদ্ধান্তে আসতে পারার কী একটা আরাম! আমার মনে হচ্ছে আমি যেন এক নতুন মানুষ।

আবার সে পায়চারি করতে লাগল ঘরের ভেতরে। একবার থেমে ভাবল, সে যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে তখন তার সম্ভাব্য পরিণামের কথাকে ভয় করলে চলবে না। এই ঘরের মধ্যে এমন অনেক জিনিস এখনও আছে যা ভলজাঁ নামের সঙ্গে জড়িত এবং সেগুলো নষ্ট না করলে বা সরিয়ে না দিলে তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসেবে তা গণ্য হতে পারে। সে একটা চাবি বার করে দেয়ালের গায়ের একটা আলমারির তালা খুলে একটা পুরনো নীল রঙের জামা, একটা কম্বল, একজোড়া পায়জামা, একটা পিঠের উপর ঝোলানো ব্যাগ আর একটা লাঠি বার করল। ১৮১৫ সালের অক্টোবর মাসে দিগনের পথে-ঘাটে কেউ যদি জাঁ ভলজাঁকে ঘুরে বেড়াতে দেখে থাকে তা হলে সে এইসব জিনিস দেখে অবশ্যই চিনতে পারবে।

বিশপের দেওয়া দুটো রুপোর বাতিদানসহ এই জিনিসগুলো সে যত্ন করে রেখে দিয়েছে, কারণ যেদিন থেকে সে নতুন জীবন শুরু করে সেদিনকার অর্থাৎ জীবনের সেই সন্ধিক্ষণের এক স্মারকচিহ্ন হিসেবে কাজ করবে জিনিসগুলো। কিন্তু জেলখানার ব্যবহৃত পোশাক ও জিনিসগুলো সে লুকিয়ে রাখলেও বিশপের বাতিদান দুটো সে প্রকাশ্যে রেখে দিয়েছে।

সে একবার চকিতে দরজার দিকে তাকাল। খিল দেওয়া থাকলেও হঠাৎ দরজাটা খুলে যাবে বলে ভয় হচ্ছিল তার। তার পর সে তার অতীত জীবনের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ রেখে দেওয়া সব জিনিস আগুনের মধ্যে ফেলে দিল। তার সেই ব্যাগ লাঠি যত কিছু। আলমারিটা একেবারে খালি হলেও সেটায় আবার তালাবন্ধ করে দিল। একটা কাঠের জিনিস টেনে এনে আলমারির সামনে রেখে সেটাকে আড়াল করে রেখে দিল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেসব পুরনো জিনিসের বান্ডিলটাতে আগুন ধরিয়ে দিল। আগুনের শিখাটা বেড়ে যাওয়ায় সমস্ত ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠল। লাঠিটা পোড়ার সময় তার থেকে ফটফট করে আওয়াজ হচ্ছিল।

তার পিঠের ব্যাগটা যখন পুড়ছিল তখন তার ভেতরকার সব কিছু পুড়ে গেলেও একটা জিনিস পুড়ল না। সেটা চকচক করছিল। একটু কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যেত সেটা হল সেই পেতিত গার্ভের চল্লিশ স’র মুদ্রাটা। তার কিন্তু সেদিকে দৃষ্টি ছিল না। সে তখন সমানে পায়চারি করে যাচ্ছিল।

সেই আগুনের আভায় রুপোর যে বাতিদান দুটো চকচক করতে থাকে সেদিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল তার। সে ভাবল, জাঁ ভলজাঁর আর একটা স্মৃতিচিহ্ন আর এটা একটা অভ্রান্ত প্রমাণ। ওগুলোকেও সরিয়ে ফেলতে হবে।

এই ভেবে সেগুলোকে নামিয়ে আনল সে।

আগুনটা তখনও বেশ জোর ছিল। তাতে ও দুটো ফেলে দিলে সেগুলো গলে গিয়ে একতাল ধাতুতে পরিণত হবে। আগুনের ধারে বসে রইল সে কিছুক্ষণ। বেশ একটা আরাম বোধ হচ্ছিল। ভাবল তাপটা বেশ আরামদায়ক। একটা বাতিদান দিয়ে আগুনের কাঠগুলোকে ঘাটতে লাগল। আর এক মিনিট পরেই এ দুটোকে ফেলে দেবে আগুনে।

কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার ভেতরকার এক কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল তার কানে, জাঁ ভলজাঁ, জাঁ ভলজাঁ!

তা শুনে ভয় পেয়ে গেল ভলজাঁ। তার মাথার চুল খাড়া হয়ে উঠল।

সেই কণ্ঠস্বর আবার বলে চলল, তাই হোক। যা আরম্ভ করেছ, তোমার সেই আরব্ধ কাজ শেষ করে ফেল। বাতিদান দুটো ধ্বংস করে ফেল। সব স্মৃতি মুছে ফেল, বিশপকে ভুলে যাও। সবকিছু ভুলে গিয়ে শুধু নিজের ভালোটার কথা ভাব। তোমার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেছে। একটা বুড়ো লোক, যে কী ঘটেছে না ঘটেছে তার কিছুই জানে না, যার ওপর তোমার নামটা চাপিয়ে দেওয়াই তার একমাত্র অপরাধ, তোমার জায়গায় সে জেলে যাবে, বাকি জীবনটা তার জেলেই দাসত্বের মধ্য দিয়ে কেটে যাবে। আর তুমি হবে এক বিশিষ্ট নাগরিক, সর্বজনশ্রদ্ধেয় সম্মানিত মঁসিয়ে লে মেয়র। তুমি এই নগরকে সমৃদ্ধশালী করে তুলবে, গরিব-দুঃখীদের মুখে অন্ন জোগাবে, অনাথ শিশুদের রক্ষা করবে, অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে এক সুখী জীবনযাপন করবে আর তখন অন্য একজন হতভাগ্য লোক তোমার নাম ধারণ করে হাতে হাতকড়া আর গায়ে নীল জামা পরে পতনের শেষ প্রান্তে চলে যাবে। ঘটনাগুলো কিভাবে তোমার ভাগ্যের অনুকূল হয়ে উঠেছে দেখ।

তার কপালে ভু যুগলের উপরে ঘাম দিতে শুরু করেছিল। সে আগুনের দিকে একবার তাকাল। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত সেই অদৃশ্য বক্তার কণ্ঠস্বর তখনও একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়নি। তার কথা তখনও শেষ হয়নি।

সে কণ্ঠস্বর আবার বলতে লাগল, অনেকে তোমার প্রশংসা করবে, অনেকে তোমায় আশীর্বাদ করবে। কিন্তু একজন সেসব প্রশংসা বা আশীর্বাদের কথা কিছুই শুনবে না। সে শুধু তার চারপাশে ঘিরে থাকা অন্তহীন অন্ধকারের ভেতর থেকে সারাজীবন ধরে অভিশাপ দিয়ে যাবে তোমায়। এটা কিন্তু মনে রেখ, মানুষ যা কিছু আশীর্বাদ পায় জীবনে তা স্বর্গে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছতে পারে না, শুধু অভিশাপগুলোই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছায়।

কণ্ঠস্বরটা আত্মার গভীর থেকে আসছিল বলে প্রথমে ক্ষীণ ছিল, কিন্তু ক্রমশ সেটা জোরালো হয়ে তার কানে এমনভাবে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে লাগল যে তার মনে হল ঘরের ভেতর থেকে কথা বলছে। শেষের কথাটা এত জোর শোনাল যে সে ভয়ে চিৎকার করে উঠল, কেউ আছে এখানে?

তার পর নিজের প্রশ্নে নিজেই হাসতে হাসতে জবাব দিয়ে বলল, আমি একটা বোকা, এখানে কেউ নেই।

একজন অবশ্য ছিল, কিন্তু তাকে চোখে দেখা যায় না।

বাতিদান দুটো আগুনের কাছ থেকে তুলে নিয়ে যেখানে ছিল সেখানেই রেখে দিল। তার ক্রমাগত বিষণ্ণ পায়চারির শব্দে নিচের তলায় একটি ঘুমন্ত লোকের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছিল।

এই ক্রমাগত পায়চারি আর ঘোরাফেরার কাজটা একই সঙ্গে তাকে কিছুটা সান্ত্বনা দিচ্ছিল আর উত্তেজিত করে তুলছিল। অনেক সংকটজনক মুহূর্তে আমরা ইতস্তত ঘোরাফেরা করে কিছুটা স্বস্তি পাই। আমাদের চোখে দেখা বিভিন্ন বস্তু থেকে আমরা পরামর্শ বা সান্ত্বনা পেতে চাই। কিন্তু ভলজাঁ এখন যতই ইতস্তত ঘোরাফেরা করতে লাগল ঘরের ভেতর ততই তার বর্তমানের জটিল অবস্থার প্রতি সচেতনতাটা বেড়ে যেতে লাগল। শ্যাম্পম্যাথিউ নামে লোকটাকে জাঁ ভলজাঁ মনে করে হয়তো ভুল করা হয়েছে এবং যে ঘটনাটা ঈশ্বরের বিধানে তার আত্মিক মুক্তির জন্য দৈবাৎ ঘটে গেছে, সে ঘটনা তার পায়ের তলা থেকে সব মাটি কেড়ে নিচ্ছে। সে পর পর দুটো সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে, কিন্তু এখন সে সিদ্ধান্তকেই অসম্ভব ভেবে বাতিল করে দিল।

এই চরম হতাশার মুহূর্তে নিজেকে ধরা দেওয়ার সব সম্ভাব্য পরিণামগুলোকে খুঁটিয়ে ভেবে দেখতে লাগল। ভেবে দেখতে লাগল তাতে সে কী হারাবে আর কী পাবে। যদি সে ধরা দেয় তা হলে তার এই বর্তমানের সুখী নির্দোষ জীবন, স্বাধীনতা, মানসম্মান, জনপ্রিয়তা সব কিছুকে বিদায় জানাতে হবে চিরদিনের জন্য। সে তাহলে আর মাঠে-ঘাটে স্বাধীনভাবে বেড়াতে পারবে না, পাখির গান শুনতে পারবে না, দুস্থ ছেলেমেয়েদের পয়সা দিতে পারবে না, সাদর অভ্যর্থনা বা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে কেউ তার পানে তাকাবে না। যে বাড়ি সে গড়ে তুলেছে, যে ছোট্ট ঘরটায় সে সুখে-স্বচ্ছন্দে বাস করে সে বাড়িঘর তাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। তার যে একমাত্র বৃদ্ধা ভৃত্য সকাল হতেই প্রতিদিন তাকে কফি করে এনে দেয়, আর সে তাকে কফি এনে দেবে না। এইসব আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা সব কিছু ছেড়ে দিতে হবে। তার পরিবর্তে জেলখানার ভেতর শৃঙ্খলিত অবস্থায় লাল জামা পরে খেটে যেতে হবে, জেলখানার ছোট ঘরের মধ্যে কাঠের তক্তায় শুতে হবে এবং আর যেসব ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে তাকে কাটাতে হবে তা তার সব জানা আছে। এই বয়সে এবং এত কিছু সুখশান্তির পর! যদি সে যুবক থাকত বয়সে তা হলেও-বা হত। কিন্তু এখন তার বয়স হয়েছে; এই বয়সে পায়ে লোহার বেড়ি পরে কত অপমান, কত গালাগালি সহ্য করতে হবে। প্রতিদিন জেলখানার প্রহরীকে সকাল-সন্ধ্যায় দু বার করে লোহার বেড়িপরা পাগুলো দেখাতে হবে। যেসব বাইরের লোক জেল পরিদর্শন করতে আসবে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। জেল কর্তৃপক্ষ তার সম্বন্ধে পরিদর্শককে বলবে, এই সেই বিখ্যাত জাঁ ভলজাঁ যে একদিন মন্ত্রিউল-সুর-মের শহরের মেয়র ছিল।… ভাগ্য, ভাগ্য মানুষের বুদ্ধির মতোই কুটিল, মানুষের মতোই নির্মম নিষ্ঠুর।

যতই সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ভাবতে লাগল ততই সে দেখল দুটো পথ খোলা আছে তার সামনে–হয় তাকে এই সুখের স্বর্গকে আঁকড়ে ধরে থেকে তাকে শয়তান হতে হবে অথবা নরকে ফিরে গিয়ে তাকে সাধু হতে হবে। কী সে করবে? কোনদিকে যাবে?

যেসব অন্তর্বেদনাকে কিছু আগে অতিকষ্টে মন থেকে বিতাড়িত করে দিয়েছিল সেগুলো আবার ফিরে এল তার মধ্যে, আবার তারা আচ্ছন্ন করে ফেলল তার মনটাকে, আবার তার চিন্তাগুলো জট পাকিয়ে জটিল হয়ে উঠল। হতাশাজনিত একটা উদাসীন ভাব পেয়ে বসল তাকে। হঠাৎ তার স্মৃতিতে ‘রোমানভিলে’ এই নামটা ভেসে উঠল আর সেই সঙ্গে বহু দিন আগে শোনা একটা গানের দুটো ছত্র মনে পড়ল। রোমানভিলে প্যারিসের নিকটবর্তী এক বনের নাম, যেখানে বসন্তকালে তরুণ প্রেমিক-প্রেমিকারা লিলাক ফুল তুলতে যায়। সে যেন দেহে-মনে ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছিল, চলৎশক্তি রহিত হয়ে পড়ছিল। শিশুর প্রথম হাঁটতে শেখার মতো টলছিল।

এই অবসাদ আর অনীহার সঙ্গে লড়াই করতে করতে সে তার চিন্তার মধ্যে শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা করতে লাগল। যে উভয়সংকট তার মনের সব শক্তিকে ক্ষয় করে দিয়েছে তার সম্মুখীন হয়ে এক স্থির সংকল্পে উপনীত হওয়ার জন্য চেষ্টা করতে লাগল সে। সে ধরা দেবে, না চুপ করে থাকবে? কিন্তু স্পষ্ট করে কিছুই বুঝতে পারল না সে। যেসব অস্পষ্ট ধারণা ভেসে বেড়াচ্ছিল তার মনের মধ্যে, সেগুলো কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে উঠল সহসা, ধোয়ার মতো মিলিয়ে গেল মুহূর্তে। একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারল সে, যেদিকেই সে যাবে, যে পথই ধরবে, তাকে একটা জিনিস হারাতেই হবে। সে বাঁ দিকে বা ডান দিকে যেদিকেই যাবে, তার জীবনের সুখ অথবা ধর্মকে হারাতে হবে। একে একে আবার সব অনিশ্চয়তাগুলো ফিরে এল তার মনে। এত চিন্তার পরেও যেখান থেকে সে শুরু করেছিল সেখান থেকে এক পা-ও এগোতে পারল না।

এইভাবে এক দুঃসহ বেদনার মধ্য দিয়ে মনে মনে সংগ্রাম করে যেতে লাগল সে, যেমন আর একজন মানুষ তার আগে আঠারোশো বছর ধরে সংগ্রাম করে গেছেন। সে এক রহস্যময় মানুষ যার মধ্যে মানবজগতের সমস্ত দুঃখ, সমস্ত সততা ও মহানুভবতা মূর্ত হয়ে উঠেছিল। নক্ষত্রখচিত আকাশের তলে তার চারদিকে যখন অলিভ গাছের পাতাগুলো কাঁপছিল এবং যখন বারবার ভয়ঙ্কর এক পেয়ালা করে অন্ধকার পান করতে দেওয়া হয় তাঁকে তখন তিনি অন্ধকারের সে পেয়ালা প্রত্যাখ্যান করেন।

.

ঘড়িতে রাত্রি তিনটে বাজল। পাঁচ ঘণ্টা ধরে ক্রমাগত পায়চারি করছে সে ঘরে। একটুও থামেনি। অবশেষে সে চেয়ারটায় বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতে লাগল।

অন্য সব স্বপ্নের মতো এ স্বপ্নও তার বর্তমান মর্মান্তিক অবস্থাকে নিয়েই গড়ে ওঠে। তবু স্বপ্নটা তার মনের ওপর এমনভাবে রেখাপাত করে যে পরে সে কথা লিখে রাখে সে। তার মৃত্যুর পর যেসব দরকারি কাগজপত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে এই স্বপ্নের বিবরণটা পাওয়া যায়। এ স্বপ্ন হল একটি রুগণ আত্মা হতে উদ্ভুত এক কল্পনা।

একটা খামের ভেতর স্বপ্নের বিবরণটা ভরা ছিল। তার উপর লেখা ছিল, সে রাতে আমি যা স্বপ্নে দেখি।

আমি তখন এমন এক বিশাল বন্ধ্যা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে ছিলাম যেখানে রাত-দিন বলে কিছু ছিল না। আমি তখন আমার ভাইয়ের সঙ্গে পথ হাঁটছিলাম যে ভাইয়ের কথা আমি আর ভাবি না এবং যার কথা আমি ভুলে গিয়েছি।

আমরা দু জনে কথা বলতে বলতে পথ হাঁটছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে কত লোক চলে যাচ্ছিল। আমরা এমন একটি মহিলার কথা বলছিলাম যে মহিলাটি আমাদের প্রতিবেশিনী ছিল। যখন সে আমাদের পাড়ায় থাকত তখন সে সর্বক্ষণ তার ঘরের জানালা খোলা রেখে কাজ করত। কথা বলতে বলতেই আমরা যেন সেই ভোলা জানালা দিয়ে আসা কনকনে ঠাণ্ডাটা অনুভব করছিলাম।

কোথাও কোনও গাছপালা ছিল না।

একটা লোক আমাদের খুব কাছ দিয়ে চলে গেল। সে ছিল সম্পূর্ণ নগ্ন, তার গায়ের রংটা ছিল ধূসর। সে একটা ঘোড়ার উপর চড়ে যাচ্ছিল আর তার ঘোড়ার রংটা ছিল মাটির মতো। তার মাথায় চুল ছিল না। তার ন্যাড়া মাথায় শিরাগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। তার হাতে একটা জাদুকাঠি ছিল। জাদুকাঠিটা আঙুরগাছের ডালের মতো নরম হলেও লোহার মতো ভারী। সে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল, কিন্তু কোনও কথা বলল না।

আমার ভাই বলল, ওই নিচু রাস্তাটা দিয়ে চল। কিন্তু সে পথে কোনও কাঁটাগাছ বা কোনও শ্যাওলা ছিল না। চারদিকে কোনও গাছপালা, ঘরবাড়ি কিছুই নেই, শুধু মাটি আর মাটি। আকাশটাও ছিল মাটি রঙের। আমি যেতে যেতে কী একটা কথা বললাম। কিন্তু কোনও উত্তর পেলাম না, দেখলাম, আমার ভাই চলে গেছে। এরপর আমি একটা গাঁয়ে চলে গেলাম। গাঁ-টা দেখে বুঝলাম গাঁটার নাম রোমানভিলে।

যে রাস্তা দিয়ে আমি গা-টাতে ঢুকলাম সেটা একেবারে জনশূন্য ছিল। আমি অন্য একটা পথ ধরে এগোতে লাগলাম। সে রাস্তাটার এক কোণে একজন লোক গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ জায়গাটার নাম কি, আমি এখন কোথায়? কিন্তু সে কোনও উত্তর দিল না। আমি তখন একটা বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে তার মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

সেই বাড়ির ভেতরে প্রথম যে ঘরটা পেলাম তার মধ্যে কোনও লোক ছিল না। আমি অন্য একটি ঘরে গেলাম। সে ঘরের পেছন দিকের দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কার বাড়ি? জায়গাটার নাম কী? কিন্তু কোনও উত্তর দিল না সে। সেই বাড়ির পেছনে একটা বাগান ছিল।

আমি সেই বাগানে চলে গেলাম। বাগানে কোনও লোক ছিল না। কিন্তু ভেতরে এগিয়ে যেতেই দেখলাম একটা গাছের পেছনে একটা লোক দাঁড়িয়েছিল। তাকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ বাগানটা কিসের বাগান? আমি কোথায়? সে কোনও উত্তর দিল না।

আমি গাঁয়ের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম। দেখলাম, সেটা একটা শহর। কিন্তু পথে কোনও লোক নেই। সমস্ত বাড়ির দরজা খোলা, কোনও লোক নেই। কোনও বাড়ি বা রাস্তায় একটা জ্যান্ত লোককেও দেখতে পেলাম না। কিন্তু প্রতিটি রাস্তার শেষ প্রান্তে, প্রতিটি ঘরের পেছনের দেয়ালে, বাগানের প্রতিটি গাছের পেছনে একটা করে লোক দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তাদের মুখে কোনও কথা নেই। কিন্তু একসঙ্গে একটার বেশি লোক কোথাও দেখিনি আমি। আমি চলে যাচ্ছিলাম। তারা আমার পানে তাকিয়ে ছিল।

আমি শহর ছেড়ে মাঠে চলে গেলাম।

কিছুক্ষণ পরে আমি পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম এক বিরাট জনতা আমার পিছু পিছু আসছে। শহরে যেসব লোককে আমি দেখেছিলাম সেই জনতার ভিড়ের মধ্যে তাদের দেখতে পেলাম। কোনও ব্যস্ততা না দেখিয়েও তারা আমার থেকে জোরে হাঁটছিল। তারা পথ হাঁটার সময় মুখে কোনও শব্দ করছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আমাকে ঘিরে ফেলল। তাদের মুখগুলো মাটি রঙের।

শহরে ঢুকেই আমি প্রথমে যাকে প্রশ্ন করেছিলাম সেই লোকটা আমাকে বলল, কোথায় যাচ্ছ তুমি? তুমি কি জান না তুমি অনেক আগেই মরে গেছ?

আমি উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলতেই দেখি সেখানে কেউ নেই।

স্বপ্নটা ভেঙে যেতেই উঠে পড়ল সে। তার মুখ ঠাণ্ডা লাগছিল। তখনও ভোর হয়নি, তবু ভোরের মতোই উতল ঠাণ্ডা বাতাসের আঘাতে জানালার কপাটগুলো থেকে শব্দ হচ্ছিল। আগুনটা নিবে গেছে। বাতিটা জ্বলতে জ্বলতে প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। রাত্রি তখনও শেষ হয়নি।

ঘুম থেকে উঠেই জানালার ধারে গেল সে। দেখল আকাশে তখন কোনও তারা ছিল না। খোলা জানালা দিয়ে সে বাড়ির উঠোন আর রাস্তা দেখতে পাচ্ছিল। পথ থেকে একটা শব্দ কানে আসছিল তার। শব্দটা শুনে নিচে তাকাল সে। দেখল দুটো লাল তারা যেন বড় রাস্তাটার ওধার থেকে এগিয়ে আসছে তার বাড়ির দিকে। যতই এগিয়ে আসছে ততই সেগুলো বড় হয়ে উঠছে আকারে। পরে সে বুঝতে পারল ওটা এক ছোট্ট ঘোড়ার গাড়ি। ছোট ধরনের একটা সাদা ঘোড়া টেনে আনছে গাড়িটাকে। পথের উপর ওই ঘোড়র ক্ষুরের শব্দ শুনেই চমকে উঠেছিল সে।

সে ভাবল, এ সব গাড়ি কেন? এ সময় কে গাড়ি ডেকেছিল?

এমন সময় তার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হল। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত। কাঁপতে লাগল এবং প্রচণ্ড রাগের সঙ্গে চিৎকার করে উঠল, কে ডাকে?

আমি, মঁসিয়ে মেয়র।

সে বুঝতে পারল যে বুড়ি মেয়েটি তার বাড়িতে কাজ করে এ তার কণ্ঠস্বর। তখন সে বলল, ঠিক আছে, কী ব্যাপার?

একটু পরেই পাঁচটা বাজবে মঁসিয়ে।

ঠিক আছে।

গাড়ি এসে গেছে।

কী গাড়ি?

ঘোড়ার গাড়ি।

কেন?

মঁসিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করেননি?

সে বলল, না।

ড্রাইভার বলছে সে আপনার জন্যই গাড়িটা এনেছে।

কোন ড্রাইভার?

মাস্টার শফেয়ারের ড্রাইভার।

হঠাৎ সে ব্যাপারটা বুঝতে পারল। সবকিছু মনে পড়ে গেল তার। হ্যাঁ হ্যাঁ, মাস্টার শফেয়ার।

ঠিক এই সময় তার মুখের উপর এমন একটা ভাব ফুটে ওঠে যে বুড়ি মেয়েটি তা দেখলে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ত।

এরপর ভলজাঁ চুপ করে রইল। বাতিটার দিকে তাকিয়ে কিছুটা মোম নিয়ে সে গোল করে পাকিয়ে আঙুলের মধ্যে ধরে রইল।

এবার বুড়ি মেয়েটি অসহিষ্ণু হয়ে বলল, মঁসিয়ে, ওকে কী বলব?

ওকে বল, আমি যাচ্ছি।

.

সে কালে অ্যারাস আর মন্ত্রিউল-সুর-মের শহরের মধ্যে যেসব ডাকগাড়ি যাতায়াত করত সেসব গাড়ি দু চাকার এবং ছোট। তাতে মাত্র দুটো সিট থাকত–তার একটাতে ড্রাইভার আর একটাতে একজন যাত্রী বসত। একটা বড় কালো ডাকবাক্স গাড়ির পেছনে চাপানো থাকত।

সেদিন সাতটার সময় অ্যারাস থেকে একটা ডাকগাড়ি ছেড়ে প্যারিস মেলের ডাক নিয়ে মন্ত্রিউল শহরে যখন পৌঁছল তখন ভোর পাঁচটা বাজতে কিছু বাকি। গাড়িটা শহরে ঢোকার আগে সেদিন পাহাড় থেকে নামার সময় একটা ঢালের উপর একটা সাদা ঘোড়ায় টানা একটা দ্রুতগতি ঘোড়ার গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে ডাকগাড়িটার। ডাকপিয়ন উল্টোদিকে থেকে আসা গাড়িটার চালককে গাড়ি থামাতে বলে, কিন্তু একটা বড় কোট পরে যে লোকটা গাড়ি চালাচ্ছিল সে গাড়ি না থামিয়ে জোরে চালিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।

ডাকপিয়ন বলল, লোকটা শয়তানের মতো গাড়ি চালাচ্ছে।

কিন্তু ডাকপিয়ন যদি জানত যে ওইভাবে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সে কে এবং কেনই বা এত কষ্ট করে এই সময়ে গাড়ি চালিয়ে কোথায় যাচ্ছে তা হলে অনুকম্পা জাগত তার মনে। তা হলে সে কখনই এ কথা বলতই না। আসলে কোথায় যাচ্ছে লোকটা নিজেই তা জানে না। সে অ্যারাসের দিকেই যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে একথা বুঝতে পারায় সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠছিল তার।

অন্ধকারের মধ্য দিয়ে গাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে। তার মনে হচ্ছিল নরকের অন্ধকার গর্ভে নেমে যাচ্ছে সে। এক অদৃশ্য শক্তি তাকে সামনের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল আর একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে টানছিল পেছন থেকে। তার মনের অবস্থাটা তখন এমনই ছিল যে সেকথা সকলেই বুঝতে পারলেও কেউ তা ভাষায় ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারবে না। এমন কেউ কি আছে যে এই ধরনের এক কৃষ্ণকুটিল অনিশ্চয়তাকে জীবনে অন্তত একবার অনুভব করেছে? সে কোনও কিছুই সংকল্প করেনি, কোনও কিছুই সিদ্ধান্ত করেনি, সে কিছুই ঠিক করেনি। বেদনার যে জটিল আবর্তে তার বিবেক আবর্তিত হচ্ছিল সে আবর্ত থেকে কোনও সংকল্প বা সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসতে পারল না। এত চিন্তাভাবনার পরেও যেখান থেকে সে রওনা হয়েছিল সেখানেই ফিরে এসেছে সে।

কিন্তু অ্যারাসে কেন সে যাচ্ছে?

যে যুক্তি সে গাড়ি ও ঘোড়া ভাড়া করার সময় দেখিয়েছিল সেই যুক্তিরই পুনরাবৃত্তি করল সে।

পরিণামে যাই হোক, নিজের চোখে সব কিছু দেখে সিদ্ধান্ত নিলে তাতে কোনও ক্ষতি হবে না। কী ঘটেছে তা নিজে গিয়ে জানা হবে বিজ্ঞজনোচিত কাজ। নিজে ভালো করে না দেখে বা ভালো করে খুঁটিয়ে সব বিচার না করে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা ঠিক হবে না। দূর থেকে উইঢিবিকেও পর্বত বলে মনে হয়। শ্যাম্পম্যাথিউকে ভালো করে দেখে যদি বোঝে সে নিঃসন্দেহে এক অপদার্থ ব্যক্তি তা হলে তার বিবেকই তাকে বলে দেবে সে তার জায়গায় জেলখানায় যাক। অবশ্য জেভাৰ্ত থাকবে, গ্রিভেত, শিনেলদো, কোশেপেন নামে যেসব পুরনো কয়েদি তাকে চিনত তারাও থাকবে সেখানে, কিন্তু তারা কেউ বর্তমানে ম্যাদলেন নামধারী ভলর্জকে চিনতে পারবে না কিছুতেই। কোনওক্রমে তাদের পক্ষে তাকে চেনা সম্ভব নয়। এমনকি জেভার্তও ভুল করেছে। সমস্ত সন্দেহ এবং অনুমান কেন্দ্রীভূত হয়েছে শ্যাম্পম্যাথিউর ওপর।

সুতরাং তার কোনও বিপদ নেই। তবু এটা তার জীবনে সবচেয়ে অন্ধকারময় মুহূর্ত। কিন্তু এ জীবন তাকে যাপন করতেই হবে। তার ভাগ্য যত খারাপই হোক তার হাতের মুঠোর মধ্যে আছে। এখন সে নিজেই তার ভাগ্য গড়ে তুলবে। সে এই চিন্তাটাকেই আঁকড়ে ধরে রইল।

অ্যারাসে যাওয়ার কোনও আন্তরিক ইচ্ছা তার ছিল না।

যাই হোক, সে যেখানে যাচ্ছে ঘণ্টায় সাত-আট ঘণ্টা বেগে ঘোড়াটাকে চাবুক মেরে চালাচ্ছে তার দিকে।

সকাল হতেই গাড়িটা একটা ফাঁকা প্রান্তরে গিয়ে পড়ল। সে দেখল মন্ত্রিউল শহর অনেক পেছনে পড়ে গেছে। সে দেখল সামনে দূর দিগন্তে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। শীতের সকালে ঠাণ্ডা কনকনে হাওয়া বইছিল। সন্ধ্যাবেলার মতো সকালবেলাতেও অনেক বস্তুকে প্রেতের মতো দেখায়। গাছপালা ও পাহাড়ের মাথাগুলো ছায়া-ছায়া অন্ধকারে। ভূতের মতো দেখাচ্ছিল। তবে সে সব কালো মূর্তি দেখে চিনতে পারছিল বস্তুগুলোকে।

পথের ধারে একটা বিচ্ছিন্ন বাড়ি দেখতে পেল ভলজাঁ। বাড়িটার লোকজন তখনও ঘুমিয়ে আছে। সে ভাবল, এখনও ঘুমোচ্ছে লোকগুলো? আমরা যখন আনন্দে উফুল্ল হয়ে থাকি তখন ঘোড়ার ক্ষুর, গাড়ির চাকা প্রভৃতির শব্দ আমাদের ভালো লাগে, কিন্তু বিষণ্ণ অবস্থায় থাকলে এইসব শব্দকে ভালো লাগে না।

এইসব বস্তুকে সে ভালোভাবে না দেখলেও তাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে সে পূর্ণমাত্রায় সচেতন ছিল এবং তাদের ছায়া-ছায়া অন্ধকারে আচ্ছন্ন উপস্থিতি তার মনের উত্তেজিত অবস্থাটাকে বিষাদে ভরিয়ে দিচ্ছিল।

ভলজাঁ যখন হেসিনে পৌঁছল তখন রোদ উঠে গেছে। তার নিজের বিশ্রাম আর ঘোড়টাকে খাওয়াবার জন্য একটা হোটেলে গিয়ে উঠল।

শফেয়ার ঠিকই বলেছিল, ঘোড়াটা ছিল বুলোনাই জাতীয়। তার মাথাটা আর পেটটা মোটা। ঘাড়টা ছোট। তবে বুকটা চওড়া, পাগুলো দড়ির মতো সরু সরু। কিন্তু পায়ের ক্ষুরগুলো খুব শক্ত। পাগুলো তীব্র গতিসম্পন্ন। ঘোড়াটা দেখতে কদাকার, কিন্তু বেশ বলিষ্ঠ। ঘোড়াটা দুঘণ্টায় দশ মাইল পথ অতিক্রম করেছে, অথচ একটু ঘাম ঝরেনি তার দেহে।

গাড়ি থেকে নামেনি ভলজাঁ। হোটেলের একটা ছেলে এসে ঘোড়াটাকে খাবার দিল। সে গাড়ির বাদিকের চাকাটা দেখে বলল, আপনি কি এই গাড়ি নিয়ে অনেক দূরে যাচ্ছেন?

কেন?

আপনি কি অনেক দূর থেকে আসছেন?

প্রায় দশ মাইল।

তাই নাকি?

তার মানে?

ছেলেটা আর একবার গাড়ির চাকাটার দিকে তাকাল এবং দাঁড়িয়ে রইল। বলল, দশ মাইল পথ এসেছে বটে, কিন্তু আর এক মাইলও যেতে পারবে না।

ভলজাঁ গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নেমে পড়ল। কী বলছ তুমি?

ছেলেটি বলল, এটা আশ্চর্যের ব্যাপার যে আপনি দশ মাইল পথ এসেছেন, অথচ গাড়িটা কোনও গর্তে পড়েনি। আপনি চাকাটা নিজে দেখতে পারেন।

চাকাটা সত্যিই ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পথে ডাকগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগায় তার দুটো নাভিদণ্ড ভেঙে যায় এবং তার মুহুড়িটা আলগা হয়ে যায়।

ম্যাদলেন ছেলেটাকে বলল, চাকা মেরামতের একজন লোক পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ যাবে।

তুমি তাকে নিয়ে আসবে?

সে পাশেই থাকে, বুরগেলার্দ।

বুরগেলার্দ কাছেই ছিল। সে এসে চাকাটা দেখে ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইল।

ম্যাদলেন বলল, তুমি কি চাকাটা এখন মেরামত করে দিতে পারবে?

হ্যাঁ মঁসিয়ে।

তা হলে কখন আমি গাড়ি নিয়ে রওনা হতে পারব?

আগামীকাল।

আগামীকাল!

একদিনে কাজ। মঁসিয়ের কি খুব তাড়াতাড়ি আছে?

হ্যাঁ, খুব তাড়াতাড়ি। আমাকে খুব জোর এক ঘণ্টা পরেই বার হতে হবে।

মঁসিয়ে, তা অসম্ভব।

তুমি যা টাকা চাও তাই দেব।

তা হলেও পারব না।

দু’ঘণ্টা সময় যদি দেওয়া হয়?

তবুও হবে না। আমাকে দুটো নাভিদণ্ড আর একটা মুহুড়ি তৈরি করতে হবে। আপনি আগামীকালের আগে যেতে পারবেন না।

আমার কাজ আজকেই সারতে হবে। কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করলে চলবে না। মেরামত তাড়াতাড়ি না হলে অন্য একটা চাকা লাগিয়ে দিতে পার?

তার মানে?

তুমি চাকা মেরামত করো। তুমি একটা চাকা আমাকে বিক্রি করতে পারো। তা হলে আমি এখনি যেতে পারি।

একটা চাকা? অন্য চাকা তো এতে লাগবে না। চাকা সব সময় জোড়া জোড়া বিক্রি হয়।

তা হলে একটা জোড়াই বিক্রি কর।

কিন্তু সে চাকা তো এ গাড়িতে লাগবে না।

তা হলে একটা গাড়ি ভাড়া করে দিতে পার?

বিক্রি করার মতো গাড়ি আমার নেই।

হালকা ধরনের কোনও গাড়ি নেই?

আমাদের গাঁ-টা ছোট। তবে আমার দোকানে একটা গাড়ি পড়ে আছে। এক ভদ্রলোক গাড়িটা মাঝে একবার করে ব্যবহার করেন। আমি গাড়িটা দিতে পারি, তবে মালিককে জানালে চলবে না। কিন্তু গাড়িটাকে দুটো ঘোড়ায় টানতে হবে।

আবার ডাকগাড়ির ঘোড়া ভাড়া করতে হবে।

আপনি কোথায় যাবেন?

আমি অ্যারাসে যাব।

আপনি আজকেই যেতে চান?

হ্যাঁ, আজকেই যেতে হবে।

আপনার পরিচয়পত্র আছে?

হ্যাঁ।

কিন্তু তা হলেও আপনি আগে পৌঁছতে পারবেন না। পথে অনেক পাহারা। তাছাড়া এখন চাষিদের মাঠে চাষ দেওয়ার সময়। একটা জায়গায় দেরি হবে।

ম্যাদলেন বলল, তা হলে আমাকে গাড়ি ছেড়ে ঘোড়ায় চড়ে যেতে হবে। আমাকে একটা জিন কিনে দিতে পার?

হ্যাঁ। কিন্তু এটা চড়ার ঘোড়া?

ও, তা-ও তো বটে। তুমি মনে করিয়ে দিয়ে ভালো করেছ। এ তো পিঠে জিন লাগাতে দেবে না।

তা হলে?

তা হলে এ গাঁ থেকে একটা ঘোড়া ভাড়া করে দাও।

কিন্তু আপনি তো এখানে কোনও ভাড়া পাবেন না আর কিনতেও পাবেন না।

তা হলে আমি কী করব?

আমার পরামর্শ যদি নিতে চান তা হলে বলব আমাকে চাকাটা মেরামত করতে দিন এবং আগামীকাল আপনি যাবেন।

ম্যাদলেন বলল, অ্যারাস যাওয়ার ডাকগাড়ি কখন আসবে?

চাকা মেরামঁতকারী মিস্ত্রি বলল, আজ রাত্রিতে আসবে, তার আগে নয়।

কিন্তু চাকাটা মেরামত করতে সারাদিন লাগবে?

হ্যাঁ, দুটো লোক লাগালেও সারাদিন লাগবে। দশজন লাগালেও তার আগে হবে না।

এ গাঁয়ে কোনও গাড়ি পাওয়া যাবে না?

না।

আর কোনও চাকা মেরামতের লোক নেই?

হোটেলের সেই ছেলেটা আর বুরগেলার্দ একসঙ্গে দু জনে ঘাড় নাড়ল।

এটা নিশ্চয় ঈশ্বরের বিধান। ম্যাদলেন একটা পরম স্বস্তি অনুভব করল। দৈবক্রমে তার গাড়ির চাকাটা ভেঙে গেছে। যে দৈব বিধানকে সে অবহেলা করেছিল এটা হল সেই দৈব বিধানের নির্দেশ। অ্যারাসে যাওয়ার জন্য সে যথাশক্তি চেষ্টা করেছে। সমস্ত সম্ভাবনা সে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছে। দারুণ শীত, পথক্লান্তি বা খরচ কোনও দিক দিয়েই সে দমে যায়নি। কোনও দিক দিয়ে নিজেকে নিজের গাফিলতির জন্য তিরস্কার করার কিছু নেই। যদি সে আর যেতে না পারে তা হলে তাতে তার কোনও দোষ, তার কিছু করার নেই। তার জন্য ঐশ্বরিক বিধানই দায়ী।

জেভার্তের সঙ্গে তার দেখা হওয়ার পর থেকে এই প্রথম একটা গভীর স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল ম্যাদলেন। যে লোহার একটা হাত কুড়ি ঘণ্টা ধরে তার বুকের ভেতরটা শক্ত করে রেখেছিল সে হাতটা সহসা আলগা হয়ে গেল। তার সহায় এবং তিনি সব সমস্যার সমাধান করে দিলেন। নিজেকে সে বলল, সে যা কিছু করার করেছে এবং এখন সে তার বিবেককে সহজেই শান্ত করতে পারবে।

এতক্ষণ ধরে তাদের মধ্যে যেসব কথাবার্তা হচ্ছিল সেসব কথাবার্তা যদি হোটেলের ভেতরে হত এবং তা বাইরের কেউ না শুনত তা হলে ব্যাপারটার এখানেই অবসান ঘটত, তা হলে এরপর আর কোনও ঘটনা ঘটত না। কিন্তু গাঁয়ে কোনও নবাগত এলে এবং সেই সঙ্গে কোনও বিষয়ে কোনও কথাবার্তা হলে সাধারণত তা আর পাঁচজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ম্যাদলেন যখন হোটেলের ছেলেটা আর বুরগেলার্দের সঙ্গে তার গাড়ির চাকা নিয়ে কথা বলছিল তখন তাদের কাছে ছোটখাটো একটা ভিড় জমে যায়।

এমন সময় ভিড়ের মধ্য থেকে একটা ছেলে বেরিয়ে ছুটে গিয়ে গাঁয়ের এক বুড়িকে ডেকে আনে।

ম্যাদলেন যখন এ বিষয়ে একেবারে মনস্থির করে ফেলেছিল তখন সেই বুড়ি তার। সামনে এসে বলল, মঁসিয়ে, আপনি কি একটা ছোট গাড়ি ভাড়া করতে চান?

সরলভাবে উচ্চারিত এই সামান্য নির্দোষ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঠাণ্ডার মধ্যেও ঘাম দেখা দিল ম্যাদলেনের শরীরে। যে লোহার হাতটা আগে তার গলাটা ধরে রেখেছিল সে হাতটা আবার অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তার গলাটা ধরার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল।

ম্যাদলেন বলল, হ্যাঁ ম্যাদাম, একটা গাড়ি ভাড়া করতে চাই, কিন্তু কোনও গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না।

বুড়ি বলল, কিন্তু গাড়ি আছে।

কোথায়?

আমার বাড়ির উঠোনে।

ম্যাদলেন আবার ভয়ে কাঁপতে লাগল। সেই লোহার অদৃশ্য হাতটা আবার তার গলাটা টিপে ধরল।

বুড়িটার বাড়ির উঠোনে সত্যিই একটা গাড়ি পড়ে ছিল। হোটেলের ছেলেটা আর বুরগেলার্দ একজন খরিদ্দারকে হারাতে হবে ভেবে হতাশ হয়ে গাড়িটার নিন্দা করতে লাগল। বলল, গাড়িটা খারাপ, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার ফলে চাকাগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। এই চাকাভাঙা গাড়িটা ভাড়া করা মোটেই ভালো হবে না। সে গাড়ি নিয়ে এত পথ যাওয়া উচিত হবে না এবং সেটার ওপর নির্ভর করা বাতুলতার কাজ হবে।

কথাটা সত্যি এবং গাড়িটা পুরনো হলেও গাড়িটার দুটো চাকা ছিল। ম্যাদলেন তার গাড়িটা মেরামত করতে দিয়ে বুড়িকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ভাড়াটে গাড়িটাতে ঘোড়াটাকে জুড়ে অ্যারাসের পথে তখনি রওনা হয়ে পড়ল।

সে নিজের মনে মনে স্বীকার করল, কিছুক্ষণ আগে তাকে আর যেতে হবে না ভেবে আনন্দ অনুভব করছিল। এখন সেই আনন্দের কথা ভেবে রেগে গেল সে। সে আনন্দকে অবান্তর মনে হল তার। মোটের ওপর সে নিজের স্বাধীন ইচ্ছাতেই অ্যারাস যাচ্ছে। কেউ যেতে বাধ্য করেনি তাকে। সে নিজে অন্য মত না করলে সে যাওয়া বন্ধ হবে না।

হেদসিন গা-টা ছেড়ে আসতেই একটা ছেলের গলা শুনতে পেল ম্যাদলেন। যে ছেলেটা বুড়িকে ডেকে দেয় সেই ছেলেটা তাকে গাড়ি থামাতে বলছিল চিৎকার করে। সে ছুটতে ছুটতে আসছিল গাড়ির পিছু পিছু।

ম্যাদলেন বলল, কী চাই?

ছেলেটা বলল, আমিই আপনার গাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিই, আমাকে কিছু দিলেন না।

ম্যাদলেন সাধারণত দানশীল হলেও সে দেখল ভাড়া হিসেবে বুড়িকে সে যথেষ্ট দিয়েছে। সুতরাং এ দাবি অতিরিক্ত। তাই সে বলল, তুমি আর কিছু পাবে না।

এই বলে ঘোড়াটাকে চাবুক মেরে গাড়িটা চালিয়ে দিল।

পনেরো মাইল পথ যাওয়ার পর সেন্ট পল নামে একটা জায়গায় এসে একটা হোটেলে উঠল ম্যাদলেন।

হোটেল মালিকের স্ত্রী এসে বলল, মঁসিয়ে, কিছু খাবেন?

ম্যাদলেন বলল, হ্যাঁ, আমার ক্ষিদে পেয়েছে।

মহিলাটির মুখখানা বেশ হাসিখুশিতে ভরা। ম্যাদলেন তার পিছু পিছু হোটেলের ভেতর নিচু ছাদওয়ালা একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। টেবিলের উপর অয়েলক্লথ পাতা ছিল।

ম্যাদলেন বলল, তাড়াতাড়ি কর, আমার সময় নেই।

এতক্ষণে তার মনে পড়ল তার প্রাতরাশ খাওয়া হয়নি।

তাকে খাবার দেওয়া হলে ম্যাদলেন একটা রুটি কামড়ে খেয়ে আর খেতে পারল না। পাশের একজন লোককে জিজ্ঞাসা করল, এখানকার রুটি তেতো কেন?

যাই হোক, এক ঘণ্টা বিশ্রামের পর আবার রওনা হয়ে পড়ল ম্যাদলেন। এরপর সে গিয়ে থামবে তিনকেতে। অ্যারাস থেকে তিনকে বারো মাইলের পথ।

অ্যারাস যাওয়ার পথে কী ভাবছিল সে? সকালের মতোই পথের ধারে ধারে গাছপালা। খড়ের ঘর, চষা মাঠ প্রভৃতি দৃশ্যগুলো দেখতে দেখতে যেতে লাগল সে। এইসব দৃশ্যমান বস্তুগুলো এক একটা চিন্তার আকার ধারণ করতে লাগল। প্রথম এবং শেষবারের মতো অসংখ্য বস্তু দেখার মতো দুঃখজনক এবং মর্মান্তিক আর কিছুই হতে পারে না। কোনও দূর পথে ভ্রমণ করতে যাওয়া মানেই জীবন-মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অজস্র রূপান্তর লাভ করা। আমাদের মনের মধ্যে অনেক সময় আমাদের জীবন আর বহির্জগতের চলমান দৃশ্যাবলি সমান্তরালভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলে। আলো অন্ধকারে মিলে মিশে জীবনের সব উপাদান আমাদের কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যেতে চায়। আমরা তখন দু হাত বাড়িয়ে ধরতে যাই তাদের। এইভাবে পথে যেতে যেতেই আমরা হঠাৎ বৃদ্ধ হয়ে পড়ি। অজস্র অভিজ্ঞতা আর চিন্তার মধ্য দিয়ে আমাদের বয়স বেড়ে যায়। ঘনায়মান অন্ধকারে আমরা অভিভূত হয়ে পড়ি। আমাদের সামনে দেখি। একটা কালো দরজা, আমাদের জীবনকে মনে হয় এক পলাতক অশ্বের পৃষ্ঠে উপবিষ্ট এক অসহায় সওয়ার। সেই কালো দরজাটার ওপারের ছায়ান্ধকারে অবগুণ্ঠিত এক অচেনা মানুষ সেই সওয়ারকে নামাবার জন্য প্রতীক্ষায় থাকে।

ম্যাদলেন যখন তিনকেতে পৌঁছল তখন গোধূলি হয়ে আসছিল। ছেলেমেয়েরা স্কুল থেকে পালিয়ে যাচ্ছিল। তারা দেখল একটা ঘোড়ার গাড়ি করে একজন পথিক ঢুকল। শহরে। ম্যাদলেন তিনকেতে থামল না। শীতের দিনে তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে যায়। শহর থেকে ম্যাদলেন যখন গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন একটা লোক রাস্তা মেরামত করতে করতে তার দিকে তাকিয়ে বলল, ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। আপনি কি অ্যারাসে যাচ্ছেন?

ম্যাদলেন বলল, হ্যাঁ।

কিন্তু সেখানে যেতে আপনার অনেক সময় লাগবে।

ম্যাদলেন তার ঘোড়ার লাগাম ধরে বলল, অ্যারাস এখান থেকে কতদূর?

পুরো চৌদ্দ মাইল।

সে কী! ভাবের লোক বলছে দশ মাইলের কিছু বেশি।

কিন্তু রাস্তা মেরামত হচ্ছে। আপনাকে ঘুরে যেতে হবে।

অন্ধকার হয়ে আসছে, পথ হারিয়ে ফেলব।

আপনি এ অঞ্চলের লোক নন?

না।

আপনি তিনকের একটা ভালো হোটেলে রাতটা কাটান। আপনার ঘোড়াটা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। হোটেলের ছেলেটাকে বলে একটা ঘোড়া ভাড়া করার ব্যবস্থা করুন।

লোকটার পরামর্শমতো ম্যাদলেন তিনকের সেই হোটেলে গেল। আধঘণ্টার মধ্যে একটা বাড়তি ঘোড়া ভাড়া করে গাড়িটাতে জুড়ল। হোটেলের ছেলেটাকে পথ দেখাবার জন্য সঙ্গে নিল। ম্যাদলেন তাকে বলল, ঠিক পথে গাড়ি চালাও। আমি তোমাকে ডবল মজুরি দেব।

পথের সামনে একটা গাছের ডাল পড়ে ছিল। ছেলেটা বলল, এই পথটা অন্ধকারে দুর্গম হয়ে ওঠে। আমরা ভোর হওয়ার আগে অ্যারাসে পৌঁছতে পারব না।

ম্যাদলেন বলল, একটা দড়ি আর ছুরি আছে তোমার কাছে?

ছেলেটা বলল, আছে।

ম্যাদলেন ছুরি দিয়ে ডালটা কেটে পরিষ্কার করল। তাকে কুড়ি মিনিট কেটে গেল। তার পর গাড়িটা চলতে লাগল ঠিকমতো।

এরপর ওরা একটা ফাঁকা মাঠ পেল। ধোয়ার মতো কুয়াশায় মাঠটা আর পাহাড়ের মাথাগুলো ঢেকে ছিল। আকাশে মেঘ ছিল। সমুদ্র থেকে ছুটে আসা বাতাসের গর্জন শোনা যাচ্ছিল। শীতের রাতের কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছিল ম্যাদলেন।

শীতের হাওয়া ম্যালেনের হাড় ভেদ করে কাঁপুনি ধরাচ্ছিল। গতকাল রাত থেকে সে কিছু খায়নি। অতীতের আর এক রাতের কথা মনে পড়ল তার। সে রাতে দিগনের প্রান্তে ফাঁকা মাঠটায় একা একা পথ হাটছিল সে। সেটা আট বছর আগের কথা, কিন্তু মনে হচ্ছে যেন কালকের কথা।

চার্চের ঘড়িতে টং টং করে সাতটা বাজল।

ছেলেটা বলল, অ্যারাস এখান থেকে মাত্র ছ মাইল। আমরা আটটার সময় পৌঁছে যাব।

এবার ম্যালেনের প্রথম মনে হল যে কাজের জন্য সে এত চেষ্টা করে এর অ্যারাসে সেই কাজটা পণ্ড হয়ে গেল। তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। সে জানে না মামলাটা কখন হবে। আগে সময়টা জেনে নেওয়া উচিত ছিল। সে সময়ে যেতে পারবে কি না

তা না জেনে এত তাড়াহুড়ো করে এখানে আসা উচিত হয়নি। সে এখন হিসাব করে দেখতে লাগল। সাধারণত কোর্টের অধিবেশন বসে সকাল ন’টায়। এ মামলা বেশিক্ষণ চলবে না। আপেল চুরির মামলা একটা তুচ্ছ ব্যাপার। তার পর আছে শনাক্তকরণের ব্যাপারটা। কয়েকজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। উকিলদের বলার কিছু নেই। সে অ্যারাসে পৌঁছবার আগেই হয়তো সব শেষ হয়ে যাবে।

ছেলেটা ঘোড়াটাকে চাবুক মারল। ওরা নদী পার হয়ে ম সেন্ট এলয় পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগল।

তখন রাত্রির অন্ধকার আরও ঘন হয়ে উঠল।

.

এদিকে ঠিক সেই রাতে ফাঁতিনের একেবারে ঘুম হয়নি। সারারাত কেশেছে, প্রবল জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকেছে। কুস্বপ্ন দেখছে। পরদিন সকালে ডাক্তার এসে দেখল সে তখনও প্রলাপ বকছে। ডাক্তার বিচলিত হয়ে পড়ল এবং বলল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাকে যেন খবর দেওয়া হয়।

সারা সকাল ফাঁতিনে কেমন উদাসীন হয়ে রইল। সে বিছানার চাদরটা হাতের মুঠোয় ধরে রইল। নিজের মনে দূরত্ব গণনা করতে লাগল। তার চোখদুটো কোটরে ঢুকে গিয়েছিল। চোখের দৃষ্টিটা শূন্য এবং নিষ্প্রাণ দেখাচ্ছিল, কিন্তু এক একসময় আকাশের তারার মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছিল পৃথিবীর আলো ছেড়ে অনেক অন্ধকার পার হয়ে স্বর্গের আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

সিস্টার সিমপ্লিস যতবার ফাঁতিনেকে সে কেমন আছে তা জিজ্ঞাসা করেছে ততবারই সে বলেছে, খুব ভালো, আমি শুধু মঁসিয়ে ম্যাদলেনকে দেখতে চাই।

কয়েক মাস আগে ফাঁতিনে যখন সব লজ্জা ও শালীনতা ঝেড়ে ফেলে এক ঘৃণ্য ও অবাঞ্ছিত জীবন যাপন করতে শুরু করে তখন তাকে দেখে মনে হয় আগেকার সেই সুন্দরী ফাঁতিনের সে যেন ছায়ামাত্র। এখন আবার রোগে ভুগে ভুগে তার চেহারা আরও খারাপ হয়ে যাওয়ায় তাকে তারই প্রেতাত্মার মতো মনে হচ্ছিল। তার দৈহিক রুগ্ণতা। আত্মিক রুগণতাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। মাত্র পঁচিশ বছরের এক যুবতী বলে তাকে চেনাই যাবে না। তার কপালে কুঞ্চন দেখা দিয়েছে, ঘাড়ের হাড় বেরিয়ে গেছে। মুখে সব দাঁত নেই, গালে মাংস নেই। রুগ্‌ণ চুলগুলোতে জট পাকিয়ে গেছে। রোগ মানুষের বয়সকে অনেক বাড়িয়ে দেয় অল্প দিনের মধ্যে।

ডাক্তার আবার দুপুরের দিকে এল। নার্সদের কিছু নির্দেশ দিল। ম্যাদলেন এসেছে। কি না জিজ্ঞাসা করল।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন রোজ বেলা তিনটের সময় দেখতে আসত ফাঁতিনেকে। এ বিষয়ে তার নিয়মানুবর্তিতার অভাব হত না। সেদিন বেলা আড়াইটে বাজতেই অধৈর্য হয়ে উঠল ফাঁতিনে। সে প্রায়ই কটা বাজে তা ঘন ঘন জিজ্ঞাসা করতে লাগল।

ঘড়িতে তিনটে বাজতেই বিছানায় উঠে বসল ফাঁতিনে। অথচ তার নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। তার হলুদ হয়ে যাওয়া শীর্ণ হাতদুটো জড়ো করা ছিল। দরজার দিকে তাকিয়ে ফাঁতিনে এমনভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যাতে মনে হল তার বুকের উপর থেকে যেন একটা ভারি বোঝা নেমে গেছে।

কিন্তু কেউ দরজা খুলে ঘরে ঢুকল না।

এইভাবে দরজার দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে পনেরো মিনিটকাল বসে রইল ফাঁতিনে। মনে হচ্ছিল তার শাস রুদ্ধ হয়ে গেছে। ভয়ে কথা বলতে পারছিল না নার্স। ঘড়িতে ফ্রাঁসোয়া চারটের একটা ঘণ্টা বাজতেই হতাশ হয়ে সে বালিশের উপর ঢলে পড়ল। সে কোনও কথা বলল না। শুধু বিছানার চাদরের আঁচলটা হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে রইল।

এইভাবে আরও একটা ঘণ্টা কেটে গল। ঘড়িতে ঘণ্টা বাজার শব্দ হতেই আগ্রহভরে উঠে বসল সে। দরজার দিকে তাকাল। কিন্তু দরজা খুলে কেউ না আসায় আবার হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ল।

তার মনের মধ্যে কী ছিল তা সবাই জানত। সে নিজে কিন্তু কোনও কথা বলত না, কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ করত না। সে শুধু কাশত। মর্মবিদারক তার সে কাশি দেখে মনে হত তার হৃৎপিণ্ডটা যেন ছিঁড়ে যাবে। একটা বিরাট ছায়া ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে তার গোটা দেহটাকে। তার গাল দুটো বিবর্ণ ও ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছে। আর ঠোঁট দুটো নীল দেখাচ্ছে।

অবশেষে পাঁচটা বাজলে ফাঁতিনেকে ক্ষীণ কণ্ঠে এক অনুযোগ করতে শোনা গেল, কাল আমি চলে যাচ্ছি, অথচ আজ তিনি এখনও এলেন না।

মঁসিয়ে ম্যাদলেন এখনও এল না দেখে সিস্টার সিমপ্লিস নিজেই আশ্চর্য হয়ে গেল। বিছানায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল ফাঁতিনে। সে যেন কী স্মরণ করার চেষ্টা করছিল। খুব নিচু গলায় একটা ঘুমপাড়ানি গান গাইতে শুরু করল সে। যখন তার মেয়ে। খুব ছোট ছিল তখন এই গানটা গেয়ে ঘুম পাড়াত তাকে। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এ গানের কথা একবারও মনে পড়েনি তার। গানটা ছিল বড় করুণ ও মধুর। তার সুরের। মধ্যে ছিল সুখ-দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, লাভ-ক্ষতির একটা মিশ্রিত অনুভূতি। ফাঁতিনে গানটা এখন হৃদয়গ্রাহী করে গাইল যে তা শুনে হাসপাতালের নার্সরা পর্যন্ত কেঁদে ফেলল। সিস্টার সিমপ্লিসের মতো নিষ্ঠুর প্রকৃতির মেয়ের চোখেও জল এল।

ঘড়িতে ছ’টা বাজল। কিন্তু সেদিকে আর কোনও খেয়াল করল না ফাঁতিনে। সে তার চারপাশের কোনও কিছুর দিকে একবার তাকালও না।

সিস্টার সিমপ্লিস একসময় হাসপাতালের একজন ঝিকে ম্যাদলেনের কারখানায় পাঠাল। মেয়র ফিরেছে কি না সে দেখে এসে খবর দেবে। মেয়েটি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এল। ফাঁতিনে তখন স্তব্ধ হয়ে শুয়ে কী ভাবছিল।

মেয়েটি ফিরে এসে সিস্টারকে চুপি চুপি জানাল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন আজ সকাল হতেই একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে বেরিয়ে গেছেন। তিনি বলে গেছেন আজ রাতে না-ও ফিরতে পারেন। কেউ কেউ বলছে তাকে নাকি অ্যারাসের কোনও এক রাস্তায় দেখা গেছে।

সিস্টার সিমপ্লিস যখন মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছিল চুপি চুপি তখন তা দেখে হঠাৎ বিছানার উপর উঠে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ফাঁতিনে। তার হাতের মধ্যে বিছানার চাদরের আঁচলটা ধরা ছিল।

ফাঁতিনে হঠাৎ বলে উঠল, তোমরা মঁসিয়ে ম্যালেনের কথা বলছ। কিন্তু চুপি চুপি বলছ কেন? তিনি কী করছেন এখন? কেন তিনি আসেননি?

তার গলার স্বর পুরুষের কণ্ঠস্বরের মতো মোটা শোনাচ্ছিল। সে আবার তাদের বলল, উত্তর দাও আমার কথার।

সিস্টার সিমপ্লিস বলল, তার ভৃত্য বলেছে তিনি আজ আসতে পারবেন না। শুয়ে পড় বাছা। শান্ত হও। তা না হলে রোগ আরও বেড়ে যাবে।

সে কথায় কান না দিয়ে ফাঁতিনে জোরে চিৎকার করে বলল, আসতে পারবেন না? কিন্তু কেন পারবেন না? তোমরা তার কারণ জান। তোমরা সে কথা বলাবলি করছিলে। আমি তা জানতে চাই।

হাসপাতালের সেই ঝি সিস্টারকে বলল, বল তিনি মিটিংয়ে গেছেন।

সিস্টার সিমপ্লিসের মুখখানা অপ্রতিভ হয়ে উঠল। তাকে মিথ্যা কথা বলতে হবে। আবার ভাবল সে যদি সত্যি কথা বলে তা হলে তার এই বর্তমান অবস্থায় সে কথার পরিণাম হবে মারাত্মক। যাই হোক, সব কুণ্ঠা সব দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সে ফাঁতিনের দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, শহরের বাইরে গেছেন।

ফাঁতিনের চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে তার পায়ের উপর ভর দিয়ে বসল। এক অনির্বচনীয় সুখের ভাব ফুটে উঠেছিল তার মুখের উপর। সে বলল, তিনি কসেত্তেকে আনতে গেছেন।

তার মুখখানা উজ্জ্বল দেখাচ্ছিল। এক নীরব নিরুচ্চার প্রার্থনায় ঠোঁট দুটো কাঁপছিল। একটু থেমে সে আবার বলতে লাগল, আমি এবার শুয়ে পড়ব। আমাকে যা করতে বলবে আমি তাই করব। কিছুক্ষণ আগে আমি খুব খারাপ ব্যবহার করেছি। তোমাদের সঙ্গে চিৎকার করে কথা বলেছি। আমি জানি সেটা অন্যায়। আশা করি তোমরা আমায় ক্ষমা করবে। আমি এখন সুখী। ঈশ্বর বড় দয়ালু। মঁসিয়ে ম্যাদলেনও আমার প্রতি বড় দয়ালু। তিনি আমার কসেত্তেকে আনছেন মঁতফারমেল হতে।

সে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল শান্তভাবে। সিস্টার বালিশটা ঠিক করে দিল। নার্স তাকে একটা রুপোর ক্রস দিয়েছিল। তার গলায় সেটা ঝুলছিল। সে সেটাকে চুম্বন করল।

সিস্টার সিমপ্লিস বলল, চুপ করে শুয়ে থাক। তোমার আর কথা বলা উচিত নয়।

ফাঁতিনে তার একটা উত্তপ্ত হাত বাড়িয়ে দিল। তার গায়ে তখনও প্রবল জ্বর ছিল দেখে সিস্টার ব্যথা পেল।

ফাঁতিনে তবু বলে যেতে লাগল, তিনি প্যারিসের দিকে গেছেন। কিন্তু তাঁকে অতদূর যেতে হবে না। মঁতফারমেল হল প্যারিসের বাঁ দিকে অল্প কিছু দূরে। গতকাল আমি যখন তাকে কসেত্তের কথা বলেছিলাম তখন তিনি বলেছিলেন, ‘শিগগির এসে যাবে।’ সে কথা মনে আছে তোমাদের? তিনি আমাকে চমক লাগিয়ে দিতে চান। তিনি থেনার্দিয়েরদের একটা চিঠি লিখে আমাকে দিয়ে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। সব টাকা মিটিয়ে দিলে তারা আমার মেয়েকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে। সব টাকা মিটিয়ে দিয়ে কেউ কখনও কারও ছেলেকে ধরে রেখে দিতে পারে? দয়া করে আমাকে কথা বলতে নিষেধ করবে না সিস্টার। আমার এখন খুব আনন্দ হচ্ছে। আমি এখন সুস্থ। আমি কসেত্তেকে দেখতে পাব। আমার এখন খিদে পেয়ে গেছে। পাঁচ বছর তাকে আমি দেখিনি। মা’র ওপর সন্তানের প্রভাব কতখানি তা জান না তোমরা। তোমরা দেখবে মেয়েটা দেবদূতের মতো। শৈশবে তার হাতের আঙুলগুলো সরু সরু আর গোলাপি ছিল। তার হাত দুটো খুব সুন্দর হবে। এখন তার বয়স সাত। এখন অনেকটা বড় হয়ে উঠেছে। আমি তাকে কসেত্তে বলে ডাকি। তার আসল নাম হল ইউফ্রেসি। আজ সকালেই আমার মনে হয়েছিল আমি তাকে শীঘ্রই দেখতে পাব। নিজের সন্তানকে বছরের পর বছর না দেখে থাকা যায় না। সেটা উচিতও নয়। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী; চিরকাল কেউ বাঁচে না। মঁসিয়ে ম্যাদলেন তাকে আনতে গিয়ে খুব ভালো কাজ করেছেন। আজ খুব ঠাণ্ডা ছিল, তাই নয় কি? আমার মনে হয় তার একটা খুব গরম ওভারকোট আছে এবং তারা আগামীকালই এসে যাবেন। কাল শুভ দিন। কাল ফিতেওয়ালা জামাটা পরার কথা আমাকে মনে করিয়ে দেবে তো? মঁতফারমেল এখান থেকে অনেক দূর। আমি একদিন সেখান থেকে সমস্ত পথ হেঁটে এসেছি। কত কষ্টকিন্তু ঘোড়ার গাড়ি খুব তাড়াতাড়ি যায়। তারা কালই এসে পড়বে। মঁতফারমেল এখান থেকে কত দূর?

দূরত্ব সম্বন্ধে সিস্টারের কোনও ধারণা ছিল না। সে বলল, তিনি আগামীকালই নিশ্চয় এসে পড়বেন।

ফাঁতিনে বলল, কাল আমি কসেত্তেকে দেখব। কাল। কাল। হে আমার প্রিয় সিস্টার, আমার কোনও রোগ নেই। আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেছি। তোমরা আমাকে বললে আমি এখন নাচতেও পারব।

যারা তাকে মাত্র পনেরো মিনিট আগে দেখেছে তারা এখন তাকে দেখলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাবে। মুখখানা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে আপন মনে কী বলছিল। সন্তানগর্বে গরবিনী মাতার আনন্দে আনন্দিত শিশুর মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সিস্টার বলল, ঠিক আছে, এখন তুমি যখন খুশি, তা হলে আমাদের কথা শোনা উচিত তোমার। তুমি আর কথা বলবে না।

ফাঁতিনে শান্ত কণ্ঠে বলল, হ্যাঁ, আমি যখন আমার সন্তানকে ফিরে পাচ্ছি তখন আমি ভালো হয়ে উঠব।

এই কথা বলে সে নীরবে শুয়ে পড়ল। শুধু বিস্ফারিত চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে রইল।

সে এবার ঘুমিয়ে পড়বে ভেবে সিস্টার মশারিটা মেলে দিল।

সন্ধে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে ডাক্তার এল। কোনও শব্দ না করে ডাক্তার মশারিটা তুলে দেখল ফাঁতিনে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।

ফাঁতিনে বলল, আমার মেয়েটার জন্য আমার পাশে একটা ছোট বিছানা পাততে হবে। ঘরেতে জায়গা আছে।

ডাক্তার ভাবল, ফাঁতিনে ভুল বকছে। সে সিস্টার সিমপ্লিসকে জনান্তিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে কথা বলল। সিস্টার সিমপ্লিস বলল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন দু একদিনের জন্য বাইরে গেছেন। কিন্তু রোগিণী ফাঁতিনে ভেবেছে তিনি তার মেয়েকে আনার জন্য তফারমেলে গেছে। কিন্তু সে তার ভুল ভাঙেনি এবং তাকে এই বলে আশ্বাস দিয়েছে যে তিনি মঁতফারমেলে গেছেন। ডাক্তার তা সমর্থন করে আবার ফাঁতিনের বিছানার পাশে গেল।

ফাঁতিনে বলল, সারারাত আমি তার শ্বাস-প্রশ্বাস শুনতে পাব। আমার ভালো ঘুম হয় না রাতে। সকালে সে জেগে উঠলেই আমি তাকে সুপ্রভাত জানাতে পারব।

ডাক্তার বলল, তোমার হাত দাও।

ফাঁতিনে তার হাতটা বাড়িয়ে হেসে উঠল। বলল, দেখুন আমি অনেকটা ভালো আছি। আগামী কাল কসেত্তে এখানে এসে যাবে।

রোগীর অবস্থা এখন ভালো দেখে ডাক্তার আশ্চর্য হয়ে গেল। রোগীর হাতের নাড়ির স্পন্দন আগের থেকে অনেক বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। তার মনের সেই চঞ্চল অবস্থাটা আর নেই। এক নতুন জীবনের ঢেউ যেন তার অবসন্ন দেহটাকে সঞ্জীবিত করে তুলেছে।

ফাঁতিনে বলল, সিস্টার আপনাকে বলেনি? মেয়র নিজে আমার মেয়েকে আনতে গেছেন।

ডাক্তার তাকে চুপ করতে বলল। গোলমাল করতে নার্সদের নিষেধ করল। সে কুইনাইন আর একটা হালকা ধরনের ওষুধের পিলের ব্যবস্থা করল। যদি রাতে জ্বর বাড়ে তা হলে তাকে খাওয়াতে হবে। সে যাওয়ার সময় সিস্টারকে বলল, রোগীর অবস্থার সত্যিই উন্নতি হয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে মেয়র যদি সত্যিই তার মেয়েকে নিয়ে আসেন তা হলে ভালো হয়। এ ধরনের কত আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। বড় রকমের সুখ বা আনন্দ অনেক সময় আশ্চর্যভাবে রোগ সারিয়ে তোলে। রোগটা ভেতরে ভেতরে বেড়ে গেছে ঠিক। কিন্তু ব্যাপারটা সত্যিই রহস্যময়। হয়তো তাকে আমরা সারিয়ে তুলতে পারব। হয়তো সে এ যাত্রা বেঁচে যাবে।

.

রাত্রি আটটার সময় ম্যাদলেনের গাড়িটা অ্যারাসের হোটেল দ্য লা পোস্তের গেটের মধ্যে ঢুকল। গাড়িটা দেখেই হোটেলের ভৃত্যরা অভ্যর্থনা জানাতে এল নবাগতকে। ম্যাদলেন গাড়ি থেকে নেমে অন্যমনস্কভাবে স্বল্প কথায় তাদের অভ্যর্থনার উত্তর দিল। তার পর বাড়তি ভাড়াটে ঘোড়াটা সেই ছেলেটার মারফত পাঠিয়ে দিয়ে তার ঘোড়াটা আস্তাবলে নিয়ে গেল। এরপর সে নিচের তলায় বিলিয়ার্ড খেলার ঘরটা খুলে একটা টেবিলের ধারে চেয়ারে বসল। এ একটানা চৌদ্দ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে এসেছে। তার আসার কথা ছিল ছটার মধ্যে। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ার জন্য সে দায়ী নয়। সুতরাং এ বিষয়ে কোনও ক্ষোভ বা আক্ষেপ ছিল না তার অন্তরে।

হোটেলমালিকের স্ত্রী ঘরে ঢুকে বলল, মঁসিয়ে রাত্রিতে থাকবেন তো? আপনার খাবার লাগবে?

ম্যাদলেন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।

হোটেলওয়ালী বলল, শুনছি আপনার ঘোড়াটা খুব ক্লান্ত। তার দু দিন বিশ্রাম দরকার।

ম্যাদলেন বলল, এখানে ডাকঘর আছে?

হোটেলওয়ালী বলল, হ্যাঁ, মঁসিয়ে।

সে ম্যাদলেনকে ডাকঘরে নিয়ে গেল। সেখানে সে জানতে পারল মন্ত্রিউল-সুর-মের যাওয়ার জন্য যে ডাকগাড়ি ছাড়বে তাতে ডাকপিয়নের পাশে একটা সিট আছে। টাকা দিয়ে সেই সিটটা সংরক্ষণ করে রাখল মাদলেন। কেরানি তাকে সতর্ক করে দিল গাড়ি ছাড়বে রাত ঠিক একটার সময়।

ম্যাদলেন হোটেল থেকে রেরিয়ে শহরে গেল। শহরের রাস্তাগুলো অন্ধকার। অ্যারাসে সে কখনও আসেনি এর আগে। এখনকার পথঘাট তার অচেনা। কিন্তু কাউকে পথনির্দেশের জন্য কোনও কথা বলল না। ক্রিনশান নদী পার হয়ে সে একটা সরু গলিপথ ধরল। একটা লোক লণ্ঠনের আলো হাতে আসছিল।

ম্যাদলেন তাকে জিজ্ঞাসা করল, মঁসিয়ে, আমাকে আদালতে যাওয়ার পথটা বলে দিতে পারেন?

লোকটি ছিল বয়োপ্রবীণ। সে বলল, আপনি বোধ হয় এ শহরে নতুন? আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। কারণ আমি সেখানেই যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি পুলিশ অফিসে। কোর্টঘর এখন মেরামত করার জন্য পুলিশ অফিসেই কোর্ট বসে।

দাগি আসামিদের জটিল মামলার বিচার সেখানেই হয়?

হ্যাঁ। বিপ্লবের আগে বর্তমানের এই পুলিশ অফিস ছিল বিশপের বাড়িতে। বিশপের নাম ছিল মঁসিয়ে কলদো। তিনি বিরাশি বছর বয়সেও বিশপের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি একটা বড় হলঘর নির্মাণ করেন। এখানেই এখন মামলার শুনানি হয়।

ওরা দু জনে একসঙ্গে পথ চলতে লাগল। বয়স্ক লোকটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি কি কোনও বিচার দেখার জন্য এসেছেন? কিন্তু আপনার দেরি হয়ে গেছে। ছ’টাতে কোর্ট বন্ধ হয়ে যায়।

কিন্তু ওরা কোর্টঘরের কাছাকাছি গিয়ে দেখল একটা বড় বাড়ির বড় বড় চারটে খোলা জানালা দিয়ে আলোর ছটা আসছে।

লোকটি বলল, আপনার ভাগ্য ভালো। হয়তো কোনও বিচারে বেশি সময় লাগার জন্য এখনও শেষ হয়নি কোর্টের কাজ। নিশ্চয় কোনও ফৌজদারি মামলা। আপনি কি সাক্ষ্য দিতে এসেছেন?

ম্যাদলেন বলল, না। আমি কোনও বিশেষ মামলার জন্য আসিনি। আমি একজন অ্যাটর্নির সঙ্গে কথা বলতে চাই।

ভদ্রলোক বলল, তা হলে আপনি সোজা ওই সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যান। দারোয়ান আছে ওখানে।

ম্যাদলেন মিনিটকতকের মধ্যেই একটা বড় ঘরে গিয়ে ঢুকল। ঘরটাতে তখন অনেক মানুষের ভিড় ছিল। এক একজন উকিল জটলা পাকিয়ে নিচু গলায় কথা বলছিল। আদালতের মাঝখানে কালো পোশাকপরা এইসব উকিলদের ঘোরাফেরা করতে দেখে ভয় লাগে। তাদের কথাবার্তা থেকে কোনও দয়া বা করুণার আভাস পাওয়া যায় না। করে কার বিরুদ্ধে হাকিম কী রায় দেবে, তা বোঝা যায় না। অন্ধকারে ঘুরে বেড়ানো এক ঝাঁক পোকার মতো দেখায় তাদের।

হলঘরের পাশে আর একটা বড় ঘর ছিল। একটামাত্র বাতির আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল ঘরটা। ঘরের দুটো দরজাই বন্ধ ছিল।

প্রথমে সামনে যে উকিলটাকে দেখতে পেল তাকে ম্যাদলেন বলল, মামলাটা কতক্ষণ চলছে স্যার?

মামলা হয়ে গেছে।

হয়ে গেছে?

ম্যালেনের গলার স্বর শুনে উকিল তার পানে তাকাল। বলল, আপনি আসামিপক্ষের কোনও আত্মীয়?

না। এখানে আমি কাউকে চিনি না। একটা রায় বেরোবার কথা ছিল।

হ্যাঁ। কোনও কিছু করার ছিল না।

কী রায় বার হল?

যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।

ম্যাদলেন এরপর খুব নিচু গলায় অস্পষ্টভাবে বলল, শনাক্তকরণের ব্যাপারটা?

শনাক্তকরণ? শনাক্তকরণের তো কোনও প্রশ্নই ছিল না। এ তো সোজা সরল ঘটনা। মহিলাটি তার সন্তানকে খুন করে। শিশুহত্যা প্রমাণিত হয়। জুরিরা শুধু পূর্বপরিকল্পিত এই কথাটা বাতিল করে দিয়েছেন। মহিলাটির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

ম্যাদলেন আশ্চর্য হয়ে বলল, মহিলা!

হ্যাঁ। লিমোসিন তার নাম। আপনি কী ভেবেছিলেন?

সে যাই হোক, কোর্টের কাজ সব হয়ে গেলেও এখনও আলো জ্বলছে কেন?

আর একটি মামলার বিচার চলছে। কয়েক ঘণ্টা আগে মামলার কাজ শুরু হয়।

মামলাটি কী?

এটাও সোজা ব্যাপার। একজন ভূতপূর্ব কয়েদি, চুরির অপরাধে অপরাধী। নামটা ভুলে গেছি। দেখে বোঝা যায় লোকটা একটা পাকা বদমায়েস। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গেই জেলে পাঠাতে ইচ্ছা করে।

আচ্ছা মঁসিয়ে, অফিসঘরে আমি একবার ঢুকতে পারি?

এটা কিন্তু খুবই মুশকিল। কোনও আসন খালি নেই। এখন বিরতি চলছে। তবে আবার কাজ শুরু হলে দু একজন উঠে যেতে পারে।

উকিল চলে গেলে ম্যাদলেন ভাবতে লাগল। উকিলের কথাগুলো বরফের সূচের মতো তার গায়ে যেন বিঁধছিল। উকিল যখন বলল, মামলাটা এখনও শেষ হয়নি তখন তা শুনে সে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কিন্তু সে শ্বাস স্বস্তি না বেদনার তা সে নিজেই বলতে পারবে না।

ম্যাদলেন ভাবতে ভাবতে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। কোর্টের হাতে অনেক মামলা থাকায় বিচারপতি একই দিনে দুটো মামলার নিষ্পত্তি করে ফেলার হুকুম দিয়েছেন। প্রথমে শিশুহত্যা এবং পরে জেলফেরত কয়েদির মামলাটা ওঠে। তার বিরুদ্ধে আপেল চুরির অভিযোগটা প্রমাণিত হয়নি। সে তুল’র জেলখানায় অনেকদিন ছিল, এটাই তার বিরুদ্ধে এখন সবচেয়ে বড় আপত্তি। তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণের কাজ সব হয়ে গেছে।

কিন্তু সরকারপক্ষের উকিল আর আসামিপক্ষের অ্যাটর্নির মধ্যে বিতর্ক হওয়ার জন্য মামলাটা রাত পর্যন্ত চলবে। সরকারপক্ষের উকিলের বেশ নামডাক ছিল। তিনি কোনও মামলায় হারতেন না। তিনি বেশ মার্জিত রুচির লোক ছিলেন। তিনি কবিতা লিখতেন।

বিচারপতি যে ঘরে দরজা বন্ধ করে ছিলেন সেই ঘরের দরজায় একজন ঘোষক দাঁড়িয়ে ছিল। ম্যাদলেন তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ঘরের দরজা এখন খোলা হবে না?

ঘোষক বলল, না, ভোলা হবে না।

কোর্টের কাজ আবার শুরু হলেও ভোলা হবে না?

কোর্টের কাজ আবার শুরু হয়েছে। হলঘর ভরে গেছে। এখন ভোলা হবে না।

তার মানে একেবারেই কোনও বসার জায়গা নেই?

ঘোষক বলল, বিচারপতির পেছনে দু-একটা সিট আছে। কিন্তু সে সিট পদস্থ সরকারি কর্মচারীদের জন্য।

এই বলে সে পেছন ফিরল।

গতকাল সন্ধ্যা থেকে ম্যাদলেনের মনে যে প্রবল অন্তর্দ্বন্দ্ব চলছিল সে দ্বন্দ্বের অবসান হয়নি। তার ওপর আরও অনেক চিন্তা এসে ভিড় করল তার মনে। সে সিঁড়ির দিকে সরে গিয়ে তার বড় কোটের পকেট থেকে একটা নোটবই আর পেন্সিল বার করে লিখল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন, মন্ত্রিউল-সুর-মের-এর মেয়র। তার পর সেই কাগজটা ঘোষকের হাতে দিয়ে বলল, এইটা বিচারপতির হাতে দাও।

.

ম্যাদলেন জানত না মন্ত্রিউল-সুর-মের-এর মেয়র হিসেবে সে এক বিশেষ খ্যাতিলাভ করেছে। তার নাম-যশ মন্ত্রিউল অঞ্চলের সীমানা ছাড়িয়ে উত্তরোত্তর বাড়তে বাড়তে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। সমগ্র অঞ্চলের ব্যবসা ও কাজকারবারের উন্নতিতে তার অবদান সারা মন্ত্রিউল জেলার অন্তর্গত ১৪১টা কমিউনের মধ্যে এমন কোনও কমিউন ছিল না যার অধিবাসীরা কোনওভাবে উপকৃত হয়নি তার দ্বারা। বুলোনের কাঁচের কারখানা ছাড়াও ফ্রিভেন্ত ও বুবার-সুর-কাশের সুতোর কারখানাগুলো তারই আর্থিক সাহায্যে উন্নতি করেছিল। ম্যালেনের নামটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রদ্ধা জাগত সবার মনে। অ্যারাস, দুয়াই প্রভৃতি শহরগুলো মন্ত্রিউল শহরের সৌভাগ্য ও সমৃদ্ধি দেখে ঈর্ষা অনুভব করত।

দুয়াই-এর রাজ-আদালতের কাউন্সিলার যিনি অ্যারাসের বিচারপতি হিসেবে কাজ করছিলেন তিনি ম্যাদলেনের নামটার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ঘোষক যখন বিচারপতির হাতে কাগজটা দিয়ে তার কানের কাছে ঝুঁকে বলল, মেয়র মঁসিয়ে ম্যাদলেন এই মামলার শুনানি শুনতে চান, তখন বিচারপতি সঙ্গে সঙ্গে ম্যাদলেনকে নিয়ে আসতে বললেন। তিনি ম্যাদলেনের কাগজটার তলায় একটা লাইন লিখে দিলেন।

এদিকে ম্যাদলেন ঘোষকের হাতে কাগজটা দিয়ে অস্বস্তির সঙ্গে সেইখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। ঘোষক ফিরে এসে তার সামনে নত হয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলল, দয়া করে হুজুর আমার সঙ্গে আসতে পারেন।

এই বলে সেই কাগজটা সে ম্যালেনের হাতে দিল। ম্যাদলেন দেখল তাতে লেখা আছে, বিচারপতি মঁসিয়ে ম্যাদলেনকে যথাযোগ্য সম্মান জানাচ্ছে। কাগজটা মুড়ে গুটিয়ে ঘোষকের সঙ্গে ঘরটার দিকে এগিয়ে গেল। বিচারপতির লেখা কথাগুলো তার মুখে তিক্ত একটা জিনিস ফেলে দিয়েছে।

যে ঘরটায় ম্যাদলেনকে রেখে ঘোষক চলে গেল সে ঘরটার মাঝখানে সবুজ কাপড়পাতা একটা টেবিলের উপর দুটো বাতি জ্বলছিল। ম্যাদলেন তখন এমন একটা মানসিক অবস্থার মধ্যে পড়েছিল যে অবস্থায় বাইরের বেদনার্ত পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের চিন্তাভাবনা সব সংগতি সব সামঞ্জস্য হারিয়ে ফেলল। ম্যাদলেন ভাবল এই সেই ঘর, যে ঘরে বিচারকরা একসঙ্গে মিলিত হয়ে আলোচনা করেন নিজেদের মধ্যে, এই ঘরে বসে তারা এমন সব বিচারের রায় লেখেন যাতে কত জীবন নষ্ট হয়ে যায়, যে ঘরে তারও নাম উচ্চারিত হবে এবং তার ভাগ্য নির্ধারিত হবে। ভাবতে ভাবতে সামনের দেয়ালের দিকে তাকাল সে। এই ঘরে সে এসে দাঁড়িয়ে আছে ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেল সে।

চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে সে কিছু খায়নি। গাড়ির ঝাঁকুনিতে তার সর্বাঙ্গ ব্যথাহত হয়েছে তবু এই মুহূর্তে ক্ষুধা বা ব্যথার কোনও অনুভূতিই ছিল না তার।

ম্যাদলেন দেখল সামনের দেয়ালে আঁ নিকোলাস পাশের লেখা একটা চিঠি কাঁচের ফ্রেমে বাঁধানো অবস্থায় ছবির মতো ঝুলছিল। পাশে ছিলেন ফরাসি বিপ্লবের আমলে প্যারিসের মেয়র। তিনিই ছিলেন ‘সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা অথবা মৃত্যু’ এই বৈপ্লবিক ধ্বনির রচয়িতা। এই পাশেই রাজতন্ত্রের যুগের মন্ত্রী ও ডেপুটিদের একটি তালিকা প্রকাশ করেন। এইসব মন্ত্রী ও ডেপুটিদের আপন আপন বাড়িতে অন্তরীণ করে রাখা হয়েছিল। যে মনোযোগের সঙ্গে ম্যাদলেন সেই চিঠিটা পড়ছিল তাতে মনে হচ্ছিল এ বিষয়ে যেন তার একটা বিশেষ আগ্রহ আছে। আসলে কিন্তু চিঠিটার প্রতি তার কোনও সচেতনতাই ছিল না। সে শুধু সেই চিঠিটার দিকে তাকিয়ে ফাঁতিনে আর তার মেয়ের কথা ভাবছিল।

সহসা কোর্টের হলঘরে যাবার দরজার দিকে নজর পড়ল তার। পিতলের হাতলওয়ালা সেই দরজাটার কথা মনেই ছিল না তার। এতক্ষণে সেদিকে তার নজর পড়তেই ভয় পেয়ে গেল সে। তার কপালে ও গালে কিছু কিছু ঘাম ফুটে উঠল।

হঠাৎ তার মনে যেন একটা বিদ্রোহের ভাব দেখা দিল। কে যেন তার ভেতর থেকে বলল, কে বলছে তোমাকে এইসব করতে? ঘর থেকে বেরিয়ে যে পথে এসেছিল সেই পথে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল। মনে হল সে যেন কার তাড়া খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। কেউ তাকে সামনে বা পেছন থেকে ডাকছে কি না, তা কান খাড়া করে শুনতে লাগল। কিন্তু কোনও শব্দই শুনতে পেল না। সে দেয়াল ধরে একবার দাঁড়াল। দারুণ ঠাণ্ডাতেও তার কপালে ঘাম ফুটে উঠেছিল। শীতে কাঁপতে কাঁপতে ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল সে। সে যেন কী ভাবছিল। গতকাল সারারাত এবং সারাদিন সে ভেবে এসেছে। অশ্রুত কণ্ঠে কে যেন তার ভেতর থেকে বলে উঠল, হায়!

এইভাবে পনেরো মিনিট কেটে গেল। অবশেষে গভীর বেদনায় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা নত করে ফিরে গেল সে। সে ধীর পায়ে আবার কোর্টঘরের দিকে হেঁটে চলল। সে পালিয়ে যাচ্ছিল। কে যেন তাকে আবার ধরে নিয়ে চলল।

কোর্টঘরে যেতেই প্রথমেই তার দরজায় পিতলের চকচকে হাতলটার ওপর নজর পড়ল। সেটা যেন তারার মতো জ্বলজ্বল করছিল। সেদিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে চলল দরজার দিকে। পাশের ঘর থেকে কিছু লোকের চাপা গুঞ্জনধ্বনি আসছিল। কিন্তু সেসব কিছুই শুনল না সে।

হঠাৎ কী যেন ঘটে গেল। সে কিছু বুঝতে পারল না। সে দরজার হাতল ধরে দরজাটা খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল।

.

তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করে সামনে তাকাল। সমবেত জনতার সামনে যে ঘরে অপরাধীর বিচার চলছিল সে ঘরটা বেশ প্রশস্ত আর আলোকিত। ঘরটার একপ্রান্তে একদল পোশাকপরা ম্যাজিস্ট্রেট বসে ছিল। ঘরটার মধ্যে এক একসময় অনেকগুলো মানুষের কলগুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল আর এক একসময় সবাই চুপ করে যাওয়ায় ঘরটা স্তব্ধ। হয়ে উঠছিল। দেয়ালে কতকগুলি বাতি ঝুলছিল আর টেবিলের উপর পিতলের বাতিদানে বাতি জ্বলছিল। আলো-ছায়ায় ভরা সমস্ত ঘরখানায় এক বিষাদময় কঠোরতা বিরাজ করছিল। মানুষের জগতে যাকে বলে আইন আর ঈশ্বরের জগতে যাকে বলে ন্যায়বিচার তার নির্মম রথচক্র যেন অত ধ্বনিতে সমস্ত ঘরখানার সব কিছুকে পিষ্ট করে চলে বেড়াচ্ছিল।

ম্যালেনের দিকে কেউ তাকাল না। সকলের দৃষ্টি তখন একদিকে নিবদ্ধ ছিল। দেয়ালের গাঁয়ে একটা বেঞ্চ পাতা ছিল। তার উপর একটা বাতি জ্বলছিল। সেই বেঞ্চের উপর একটা লোক বসে ছিল। তার দু দিকে দু জন পুলিশ তাকে পাহারা দিচ্ছিল।

এই সেই লোক।

তাকে খুঁজে নিতে হল না ম্যাদলেনকে। তার চোখ আপনা থেকে সেদিকে চলে গেল। তার বুঝতে দেরি হল না এই হল সেই আসামি। ম্যাদলেন নিজের দিকে তাকিয়ে দেখল দু জনের চেহারা একেবারে এক নয়। তবে সে যখন উনিশ বছর কারাবাসের পর এলোমেলো রুক্ষ চুল, অশান্ত দৃষ্টি আর নীল রঙের আলখাল্লা পরে দিগনের পথে ঘুরে। বেড়াত তখন তাকেও ওই লোকটার মতো দেখাত।

সে মনে মনে একটা কথা ভেবে কেঁপে উঠল। মনে মনে বলল, হে ভগবান, আসামির বয়স অন্তত ষাট হবে। তার মুখ-চোখ দেখে তাকে বোকা বোকা দেখাচ্ছিল। তার চেহারার মধ্যে একটা রুক্ষ ভাব ছিল।

ম্যাদলেন ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অনেকে সরে গিয়ে তার জন্য পথ করে দিল। বিচারপতি তাকে দেখেই বুঝতে পারলেন এই লোকই মন্ত্রিউল শহরের মেয়র। তাকে দেখে মাতা নত করে অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। অ্যাডভোকেট জেনারেল অফিসের কাজে কয়েকবার মন্ত্রিউল শহরে গিয়েছিলেন এর আগে। তাই তিনিও ম্যাদলেনকে দেখেই চিনতে পারলেন। তিনিও অভ্যর্থনা জানালেন।

এইসব সৌজন্য বা অভ্যর্থনায় ম্যালেনের কোনও খেয়াল ছিল না। সে হতবুদ্ধি হয়ে চারদিকে তাকাচ্ছিল।

সে আগে এইসব কিছুই দেখেছে। কোর্টঘরের এই বিচারের দৃশ্য সম্বন্ধে তার অভিজ্ঞতা আছে–এই বিচারপতি, উকিল, মুহুরি, পুলিশ, কৌতূহলী জনতা আজ হতে সাতাশ বছর আগে দেখেছে সে। আজ আবার দেখছে। এগুলো আজ আর কোনও দুঃস্বপ্নে দেখা অলীক বস্তু নয়, এগুলো সব জীবন্ত সত্য। অতীতে যে ভয়ঙ্কর সত্যের অন্ধকার অতল গহ্বরটা তাকে গ্রাস করেছিল, আজ আবার সেই গহ্বরটা তার সামনে গ্রাস করতে আসছে তাকে। ভয়ে চোখ বন্ধ করল সে। তবে আত্মার গভীরে কে যেন চিৎকার করে উঠল কাতরভাবে, না না, কখনও না।

যে মর্মান্তিক ঘটনা এই অবস্থার মধ্যে ফেলেছে তাকে, সে ঘটনা তাকে যেন হতবুদ্ধি করে দিয়েছে একেবারে। তার মনে হল সে যেন পাগল হয়ে যাবে। তার মনে হল আজ হতে সাতাশ বছর আগে যে এক বিচারসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল আজকের এই বিচারসভার সঙ্গে কোনও দিক দিয়েই কোনও অমিল নেই। সেই বিচারক, উকিল, পুলিশ–সেদিনও ছিল এমনি এক সন্ধ্যা। কোনও কিছুরই পরিবর্তন হয়নি। শুধু সেদিনকার বিচারসভায় বিচারপতির মাথার উপরে কোনও ক্রস ছিল না। আজ কিন্তু বিচারপতির মাথার উপর একটা ক্রস আছে দেয়ালে। আর আজ তার জায়গায় অন্য একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, যাকে লোকে জাঁ ভলজাঁ বলেই জানে। সেদিন ঈশ্বরের অনুপস্থিতিতেই বিচার হয় তার।

বিচারপতির পেছনে একটা খালি চেয়ার ছিল। ম্যাদলেন বসল তার উপর। তার কেবলই ভয় হচ্ছিল একজন হয়তো তাকে লক্ষ করছে। টেবিলের উপর একরাশ ফাইল থাকায় ওপাশের লোকরা তাকে দেখতে পাচ্ছিল না। অথচ সে সব কিছু দেখতে পাচ্ছিল। ক্রমে তার বুদ্ধি ফিরে আসতে লাগল। বাস্তব অবস্থার প্রতি সচেতন হয়ে উঠল সে। সব কথাবার্তা কান পেতে শোনার চেষ্টা করতে লাগল সে।

জুরিদের মধ্যে মঁসিয়ে বামাতাবয় ছিল। ম্যাদলেন চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে জেতার্তের খোঁজ করতে লাগল। কিন্তু তাকে দেখতে পেল না। সাক্ষীদের বেঞ্চির পাশে কেরানিদের টেবিল থাকায় সে ঠিক চিনতে পাচ্ছিল না। তাছাড়া ঘরের আলোর তেমন জোর ছিল না।

উপস্থিত সকলেই তার কথা মন দিয়ে শুনছিল। তিন ঘণ্টা ধরে শুনানি চলছিল। তিন ঘণ্টা ধরে সকলে একটা লোককে দেখে এসেছে। লোকটি এ অঞ্চলে সম্পূর্ণ অপরিচিত। লোকটি হয়তো একেবারে বোকা, অথবা খুব বেশি চালাক–ভয়ঙ্কর এক বিপদের শঙ্কা আর সম্ভাবনার বোঝাভারে সে মূক অসহায় এক প্রাণীর মতো নিষ্পেষিত হচ্ছে অহরহ। তার সম্বন্ধে কে কতটুকুইবা জানে?

সাক্ষীরা সাক্ষ্য দেবার সময় সকলেই একমত হয় তার পরিচয় সম্বন্ধে। বিচারের সময় আগের কিছু ঘটনার কথা জানা যায়। সরকারপক্ষের উকিল আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে বলে, আসামি শুধু এক পাকা চোরই নয়, সে শুধু ফল চুরিই করেনি, সে এক ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক জেলফেরত কয়েদি। সে অনেকবার জেল ভেঙে পালিয়ে যায়। তার নাম জাঁ ভলজাঁ, এক দাগি অপরাধী, পুলিশ যাকে অনেকদিন ধরে খুঁজছে। তুল’র জেল থেকে ছাড়া পাবার পরই সে বড় রাস্তায় পেতিত গার্ভে নামে একটি ছেলের কাছ থেকে বলপ্রয়োগ করে পয়সা চুরি করে। এই অপরাধের জন্য অপরাধবিধির ৩৮৩ ধারামতে তার বৈধ পরিচয় প্রমাণিত হলে তাকে আমরা শাস্তি দিতে পারব। সে আরও একটা চুরি করেছে। এই শেষের চুরির জন্য আগে তাকে শাস্তি দিন। আগের চুরির বিচার পরে হবে। অভিযোগের বহর আর সাক্ষীদের কথা শুনে আসামি শুধু যারপরনাই বিস্মিত হয়। অঙ্গভঙ্গির দ্বারা সব অভিযোগ অস্বীকার করে। তাকে যেসব প্রশ্ন করা হয় সেগুলোর সে বোকার মতো উত্তর দেয়। তার মূল মনোভাব হল সব কিছুকে অস্বীকার করা। এতগুলো বুদ্ধিমান শিক্ষিত লোকের আক্রমণের সামনে সে ছিল অসহায় এবং নির্বোধ। যে সমাজের কবলে সে ঘটনাক্রমে পড়ে গেছে তার কাছে সে বিদেশি। তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগই প্রমাণিত হতে চলেছে। তার বিরুদ্ধে মামলাটা জোরালো হয়ে উঠছে ক্রমশ এবং বিচারে তার কারাদণ্ডের সম্ভাবনাও বেড়ে চলেছে ক্রমশ। তার থেকে দর্শকরা যেন বেশি শঙ্কিত হয়ে উঠছে। এমনকি তার পরিচয় সাব্যস্ত হলে পেতিত গার্ভের পয়সা চুরির জন্য তার মৃত্যুদণ্ড হওয়াও অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কী ধরনের লোক সে? তার এই আপাত ঔদাসীন্যের কারণ কী? সে কি খুব বেশি বোঝে, না কিছুই বোঝে না? দর্শকদের মনে এই প্রশ্নই জাগে বারবার এবং জুরিরাও এই কথাই ভাবতে থাকে। ব্যাপারটা কেমন যেন কুৎসিত, যেন দুর্বোধ্য রহস্যে ভরা এক নাটক।

প্রচলিত রীতি অনুসারে আসামিপক্ষের উকিল জোরালো ভাষায় বক্তৃতা করলেও তা তত ফলপ্রসূ হয়নি। তিনি প্রথমে আপেল চুরির অভিযোগটার কথা তুলে তার বক্তৃতা শুরু করেন। তিনি বলেন, এই চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। সে পাঁচিল ডিঙিয়ে গাছের ডাল ভেঙে আপেল চুরি করেছে কেউ তা চাক্ষুষ দেখেনি। তার হাতে শুধু গাছের ডাল পাওয়া যায়। কিন্তু সে সেটা পথে যেতে যেতে কুড়িয়ে পায়। কিন্তু চুরির প্রমাণ কোথায়? কেউ একজন নিশ্চয় পাঁচিল ডিঙিয়ে ডাল ভেঙে আপেল চুরি করেছে। কিন্তু আমার মক্কেল শ্যাম্পম্যাথিউই যে সেই চোর তার প্রমাণ কোথায়? তার সম্বন্ধে শুধু একটা কথাই বলা যেতে পারে যে সে জেলফেরত কয়েদি, কারণ সেটা প্রমাণিত সত্য। সে আগে ফেবারোলে বাস করত। সে গাছকাটার কাজ করত এবং তার আসল নাম ছিল জাঁ ম্যাথিউ। চারজন সাক্ষী শ্যাম্পম্যাথিউকে জাঁ ভলজাঁ হিসেবে শনাক্ত করেছে। আসামির অস্বীকার ছাড়া এই শনাক্তকরণের ব্যাপারে তার পক্ষের উকিলের কিছু বলার নেই। কিন্তু সে জেলফেরত কয়েদি হলেও এর থেকে কি এই কথাই প্রমাণ হয় যে সে-ই আপেল চুরি করেছে। এটা শুধু অনুমান মাত্র।

আসলে আসামি ভুল নীতি অবলম্বন করে। সে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগই অস্বীকার করে। সে শুধু আপেল চুরির ব্যাপারটাই অস্বীকার করেনি, সে যে জেলে এতদিন ছিল সে কথাও অস্বীকার করে সে। সে যদি অন্তত জেলে যাওয়ার কথাটা স্বীকার করত তা হলে বিচারপতির মন অনেকটা নরম হত এবং তার শাস্তি লঘু হত। তাকে কি এ কথাটা বলার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, নাকি সে সে-পরামর্শ মানেনি? সে ভেবেছিল সব কথা, সব অভিযোগ অস্বীকার করলে সে বেঁচে যাবে। এটা ছিল এক মস্ত ভুল এবং এর জন্য তার বুদ্ধিহীনতা আর বোকামিই দায়ী। দীর্ঘ কারাবাস এবং জেল থেকে বেরিয়ে সে ভবঘুরে জীবন যাপন করেছিল, তাতে তার সব বুদ্ধি লোপ পায়। কিন্তু এর জন্যই সে দণ্ডিত হবে? পেতিত গার্ভের ব্যাপারটা এ মামলার মধ্যে না আসায় তার উকিল ও অভিযোগের বিরুদ্ধে কিছু বলেনি। সরকারপক্ষের উকিল বিচারপতি ও জুরিদের এই কথাই বোঝাল যে আসামি যদি জাঁ ভলজাঁ হয় তা হলে জেল থেকে বেরিয়ে চুরি করার জন্য তাকে শাস্তি পেতেই হবে। সরকারপক্ষের উকিল জোরালো ভাষায় স্বভাবসিদ্ধ বাগ্মিতার সঙ্গে তার যুক্তি প্রতিষ্ঠিত করে।

আসামিপক্ষের উকিলও এ কথা মেনে নেয় যে এই আসামিই জাঁ ভলজাঁ।

সরকারপক্ষের উকিল ওজস্বিনী ভাষায় আবেগের সঙ্গে বলতে থাকে, দীর্ঘ কারাদণ্ড এই আসামির জীবনে কোনও পরিবর্তন আনতে পারেনি। জেল থেকে বেরিয়েও সে ভবঘুরের মতো বেড়াতে বেড়াতে একের পর এক অপরাধ করে যেতে থাকে। সে প্রকাশ্য রাজপথের উপর পেতিত গার্ভে নামে একটি ছেলেকে আক্রমণ করে। অথচ চুরি, অনধিকার প্রবেশ, নাম গোপন প্রভৃতি সব অপরাধ সে অস্বীকার করে। এইসব অপরাধের সপক্ষে প্রাপ্ত প্রমাণাদি ছাড়াও চারজন সাক্ষী তাকে শনাক্ত করে। এইসব সাক্ষী হল সৎ ও নীতিপরায়ণ। পুলিশ ইন্সপেক্টর জেভার্ত আর ব্রিভেত, শিনেলদো ও কোশেপেন নামে তিনজন ভূতপূর্ব কয়েদি। কিন্তু আসামি তবু সব কিছু অস্বীকার করে। সুতরাং জুরি মহোদয়গণ ন্যায়বিচারের নামে আসামিকে যথাযোগ্য শাস্তি প্রদান করুন।

আসামি ভয়ে স্তম্ভিত হয়ে হাঁ করে সব কিছু দেখল। সরকারি পক্ষের উকিলের বক্তৃতা শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় সে। কোনও মানুষ এত তাড়াতাড়ি এমনভাবে বক্তৃতা দিয়ে যেতে পারে সে বিষয়ে তার কোনও ধারণাই ছিল না। সরকারপক্ষের উকিল যখন আবেগের সঙ্গে বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছিল আসামি তখন শুধু তার ঘাড়টা নেড়ে সব সময় এক বিষাদঘন প্রতিবাদ জানায়। দর্শকদের মধ্যে অনেকে শুনতে পায় আসামি মাঝে মাঝে শুধু একটা কথাই বলে, বঁসিয়ে বালুপকে জিজ্ঞাসা না করার জন্যই এইরকম হয়েছে।

সরকারপক্ষের উকিল আসামির ক্রুদ্ধ হাবভাবের প্রতি বিচারক ও জুরিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে বলে, এর থেকে বোঝা যায় আসামি মোটেই বোকা নয়। এ কাজ তার সুপরিকল্পিত এবং সে খুব ধূর্ত। সে চালাকি করে আইনের বিচারকে এড়িয়ে যেতে চায়। তার এই ভাব এবং অঙ্গভঙ্গি তার বিকৃত প্রবৃত্তি এবং স্বভাবের ওপর যথেষ্ট আলোকপাত করে। পেতিত গার্ভের মামলাটা বাদ দিলেও আইন অনুযায়ী এই আসামির যোগ্য শাস্তি হল যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড।

আসামিপক্ষের উকিল তার শেষ কথাটা জানাবার জন্য একবার উঠে দাঁড়াল। কিন্তু প্রথমেই সরকারপক্ষের উকিলের বাগ্মিতার প্রশংসা করল। তার যুক্তি তেমন জোরালো হল না। আসল কথা কিছু বলতে পারল না। কারণ সে বুঝল তার পায়ের তলার মাটি আগেই সরে গেছে।

.

১০

এবার মামলাটার নিষ্পত্তি করতে হবে। আসামিকে উঠে দাঁড়াতে বলে বিচারপতি তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলার আছে?

আসামি উঠে দাঁড়িয়ে টুপিটা মাথা থেকে খুলে হাতে নিয়ে এমন একটা ভাব দেখাল যাতে মনে হবে সে শুনতে পায়নি। বিচারপতি আবার সেই একই প্রশ্ন করলেন।

এবার লোকটা শুনতে পেয়েছে মনে হল। এমনভাবে সে তাকাতে লাগল যাতে মনে হচ্ছিল সে যেন এখনি ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। সে দর্শক, জুরি, পুলিশ, অ্যাটর্নি, উকিল সকলের পানে তাকিয়ে ছিল। অবশেষে সে সরকারপক্ষের উকিলের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে কথা বলতে শুরু করল। উত্তপ্ত অসংলগ্ন অজস্র কথার বন্যা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো বেরিয়ে আসতে লাগল তার মুখ থেকে।

সে বলল, আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই। আমি প্যারিসে মঁসিয়ে বালুপের অধীনে চাকা মেরামতের কাজ করতাম। খুবই কষ্টের কাজ। কারণ জানেন তো, চাকা মেরামঁতকারীকে এখানে-সেখানে ঘুরে ঘুরে বা একটা ফাঁকা জায়গায় চালার তলায় কাজ করতে হয়। তার কাজের কোনও নির্দিষ্ট ঘর নেই। শীতে তাদের গরম জামাকাপড়ও নেই। তাকে এমন সব ধাতু নিয়ে কাজ করতে হয় যেগুলোর উপর বরফ পড়ে এবং তা করতে গিয়ে দেহে রোগ ধরে। শরীরটা ক্ষয় হয়ে যায় ধীরে ধীরে। অকালে তাকে বুড়ো হয়ে যেতে হয়। চল্লিশেই তার জীবনীশক্তি স্তিমিত হয়ে আসে। আমার বয়স ছিল তিপ্পান্ন এবং আমাকে সবাই বুড়ো বলে উপহাস করত। সারাদিন খেটে আমি পেতাম মাত্র তিরিশ স্যু, আমি বুড়ো বলে আসল বেতন থেকে ধোপার কাজ করেও অল্প কিছু রোজগার করত। এইভাবে আমাদের দু জনের চলে যেত কোনওরকমে। তার কাজটাও বেশ কঠিন ছিল। জলের টবের উপর ঝুঁকে দাঁড়িয়ে কোমর পর্যন্ত ভিজিয়ে হাড়কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাস আর বৃষ্টি সহ্য করে সারাদিন ধরে কাপড় কেচে যেতে হত তাকে। শীতে জমে গেলেও তাকে কাপড় কেচে যেতে হবে, তা না হলে খরিদ্দার থাকবে না, অনেকেরই বেশি জামাকাপড় নেই। সে আবার এলফাত-রোগ নামে একটা লড্রিতেও কাজ করে। সে কাজ ঘরের মধ্যে হলেও গরম জলের ভাপ চোখে লাগে অনবরত। সে রোজ সন্ধে সাতটায় বাড়ি ফিরে ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ত। তার স্বামী তাকে মারত। এখন আর সে নেই। মরে গিয়ে সে যেন বেঁচেছে। কারণ আমরা মোটেই সুখে ছিলাম না। অথচ মেয়েটা খুব ভালো ছিল। এই ছিল আমার জীবন। আমি সব সত্য কথা বলছি। প্যারিস শহরে কে কার খবর রাখে? শ্যাম্পম্যাথিউ কথা কেই-বা শুনেছে? তবে মঁসিয়ে বালুপকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন। আর আমি কী-ই বা বলব।

এবার সে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। সে মোটা কর্কশ গলায় এক ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ সরলতার সঙ্গে সব কথা বলে শেষ করেছে; বলতে বলতে একবার সে দর্শকদের মধ্যে একজনের দিকে তাকিয়ে ঘাড় নেড়েছিল। কথা বলতে বলতে সে প্রায়ই তার হাতটা নাড়ছিল ঠিক যেমন কোনও মানুষ কাঠ কাটার সময় তার হাত দুটো সঞ্চালিত করে। তার কথা শেষ হয়ে গেলে সমবেত জনতা হেসে ওঠে। তাদের হাসির অর্থ বুঝতে না পেরে সে-ও হেসে ওঠে।

এবার বিচারপতি সব কিছু শুনে কথা বলতে শুরু করলেন। তিনি প্রথমে জুরিদের স্মরণ করিয়ে দিলেন, একসময় প্যারিসে মঁসিয়ে বালুপের চাকা মেরামতের একটা দোকান ছিল। তাকে সাক্ষী হিসেবে আনার জন্য তার খোঁজ করা হয়। কিন্তু তার দোকান উঠে যাওয়ায় তার কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

এরপর বিচারপতি আসামির দিকে তাকিয়ে বললেন, মন দিয়ে শোেন। তুমি তোমার অবস্থাটা ভালো করে ভেবে বুঝে দেখ। তুমি এখন এক গভীর সন্দেহের বস্তু। তোমার স্বার্থেই আমি তোমাকে অনুরোধ করছি তুমি কতকগুলি প্রশ্নের সঠিক জবাব দেবে। তুমি কি পিয়েরনের বাগানের পাঁচিলে উঠে গাছের ডাল ভেঙে আপেল চুরি করেছিলে না করনি? অর্থাৎ অবৈধ অনধিকার প্রবেশের মাধ্যমে চুরির অপরাধে তুমি কি অপরাধী নও? দ্বিতীয়ত তুমি কি জেলফেরত কয়েদি জাঁ ভলজাঁ, নাকি তা নও?

প্রথমত কথাটা বলে থেমে গেল শ্যাম্পম্যাথিউ। সে তার টুপি আর ছাদের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল।

সরকারপক্ষের উকিল তখন কড়াভাবে বলল, শোন, তুমি প্রশ্নের উত্তর দিতে চাইছ না এবং এই না চাওয়ার জন্যই শাস্তি হবে তোমার। এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে তুমি শ্যাম্পম্যাথিউ নও, তুমিই জেলফেরত কয়েদি জাঁ ভলজাঁ, একদিন যার নাম ছিল জাঁ ম্যাথিউ। তোমার জন্ম হয় ফেবারোলে, কাঠ কাটার কাজ করতে। তুমিই পিয়েরনের বাগান থেকে আপেল চুরি করো। জুরিরা এই সিদ্ধান্তে এখন উপনীত।

আসামি এতক্ষণ বসে ছিল। সে এবার হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলতে লাগল, তোমরা হচ্ছ দুষ্ট প্রকৃতির। আমি তখন এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ভাষাটা খুঁজে পাইনি। আমার তখন রোজ খাওয়া জুটত না। আমি পায়ে হেঁটে এইলি থেকে চলে যাচ্ছিলাম। তখন ওই অঞ্চলটা খালের জলে ডুবে যায়। চারদিকে শুধু জল আর কাদা। পথ হাঁটতে হাঁটতে পথের উপর আপেল ফল সমেত একটা গাছের ডাল পড়ে থাকতে দেখে আমি তা কুড়িয়ে নিই। আমি কারও কোনও ক্ষতি করতে চাইনি। অথচ এই জন্য আমাকে তিন মাস জেল খাটতে হয়। আর এই জন্যই তোমরা সকলে আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করে আমাকে তোমাদের প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য করছ আর আমার পাশের এইসব পুলিশরা আমাকে তো দিয়ে বলছে, উত্তর দাও। কিন্তু আমি জানি না, কিভাবে তোমাদের কথার জবাব দেব। আমি লেখাপড়া শিখিনি। আমি গরিব ঘরের ছেলে। তাই তোমরা আমার কথা বুঝতে পারছ না। আমি কখনও কিছু চুরি করিনি, শুধু পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিলাম। তোমরা জাঁ ভলজাঁর কথা বলছ, জাঁ ম্যাথিউ’র কথা বলছ। কিন্তু আমি তাদের কাউকেই চিনি না। ওরা হচ্ছে গাঁয়ের লোক আর আমি প্যারিসে বাজারের কাছে মঁসিয়ে বালুপের দোকানে কাজ করতাম। তোমরা চালাকি করে আমার জন্মস্থানের কথা বলেছ। কিন্তু আমি জানি না আমার কোথায় জন্ম হয়েছে। আমার বাবা-মা মনে হয় ভবঘুরে ছিল। আমি যখন ছোট ছিলাম তারা আমাকে শ্যাম্পম্যাথিউ বলে ডাকত। এখন আমি বুড়ো হয়ে গেছি। তোমরা যা খুশি বলতে পার। আমি অভানে গেছি, ফেবারোলেও গেছি। কিন্তু কয়েদি ছাড়া আর কোনও লোককে কি কোথাও যেতে নেই? আমি কখনও কিছু চুরি করিনি। তোমরা প্রশ্ন করে করে আমাকে বিরক্ত করে তুলছ।

সরকারপক্ষের উকিল এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। এবার সে বিচারপতির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করল। মঁসিয়ে প্রেসিডেন্ট, আসামি সুচতুরভাবে সব অভিযোগ। অস্বীকার করে নিজেকে যতই বোকা বলে চালাতে চাক না কেন সে তাতে সফল হবে। আমি ব্রিভেত, কোশেপেন, শিনেলদো আর ইন্সপেক্টর জের্তের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য মহামান্য আদালতের অনুমতি প্রার্থনা করছি। তারা যাতে এই আসামিই যে ভূতপূর্ব কয়েদি জাঁ ভলজাঁ তা তাদের সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত করতে পারে।

বিচারপতি বললেন, আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই ইন্সপেক্টার জেভাৰ্ত এখন আদালতে নেই। তিনি আদালত, সরকারপক্ষ ও আসামিপক্ষের উকিলদের অনুমতি নিয়ে তাঁর কাজের জায়গায় মন্ত্রিউল চলে গেছেন।

সরকারপক্ষের উকিল তখন বলল, ইন্সপেক্টারের অনুপস্থিতিতে তিনি একটু আগে যে বিবৃতি দিয়ে গেছেন আমি জুরিদের তা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। জেভার্ত একজন কর্তব্যপরায়ণ ও সম্মানিত ব্যক্তি। জেভার্ত যে বিবৃতি দিয়েছেন তা হল এইরূপ : ‘আসামি তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ খণ্ডন করতে গিয়ে যেসব বাস্তব তথ্যাদির কথা বলেছে তার ওপর নির্ভর করার কোনও প্রয়োজন অনুভব করি না আমি। আমি ভালোভাবে তাকে চিনি। সে শ্যাম্পম্যাথিউ নয়, সে হচ্ছে বিপজ্জনক জেলফেরত কয়েদি জাঁ ভলজাঁ। কারাদণ্ড শেষ হলে সে জেল থেকে মুক্তি পায় যে মুক্তি সে আসলে পেতে। চায়নি। চুরি-ডাকাতি ও বলপ্রয়োগের অপরাধে উনিশ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ। করতে হয় তাকে। সে পাঁচ-ছ বার জেল থেকে পালাবার চেষ্টা করে। পেতিত গার্ভের পয়সা ও পিয়েরনের ফলচুরি ছাড়াও দিগনের বিশপের ঘরে চুরি করে বলে আমার ধারণা। আমি তুলঁ’র জেলখানায় চাকরি করার সময় তাকে প্রায়ই দেখেছি এবং আমি আবার বলছি আমি তাকে চিনি।

এই জোরালো স্বীকারোক্তি দর্শক ও জুরিদের মনের ওপর বেশই রেখাপাত করে। জের্তের অনুপস্থিতির জন্য সরকারপক্ষের উকিল সাক্ষীদের ডেকে ডেকে আবার জেরা

করার দাবি জানাল। বিচারপতি আদেশ দিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন পুলিশের সাক্ষী বিভেত সাক্ষীর কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াল।

ব্রিভেত কালো পোশাক পরেছিল। তার গায়ে ছিল জেলখানার কয়েদিদের নীল আলখাল্লা। তার বয়স প্রায় ষাট। তাকে দেখে মনে হয় সে বেশ বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন অথচ দুষ্ট প্রকৃতির। জেলকর্তৃপক্ষ তাকে বিশ্বাস করত এবং বলত, লোকটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। তার যে ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মে মতিগতি আছে, সে কথা জেলপ্রহরী কর্তৃপক্ষকে বলে।

বিচারপতি বললেন, ব্রিভেত, তুমি এক লজ্জাজনক কারাদণ্ডে দণ্ডিত, যার জন্য তুমি শপথ করে কিছু বলতে পারবে না।

ব্রিভেত মাথা নত করল। বিচারপতি বললেন, যাই হোক, কোনও মানুষ আইনের বিচারে যতই অধঃপতিত হোক না কেন, ঈশ্বরের কৃপায় তার মধ্যে কিছুটা সততা এবং ন্যায়পরায়ণতা থাকে। আমার আবেদন তোমার সেই সততা আর ন্যায়পরায়ণতার কাছে। যদি তা অবশিষ্ট থাকে তোমার মধ্যে, এবং আমার বিশ্বাস তা আছে, তা হলে উত্তর দেবার আগে তা ভালো করে ভেবে দেখ। তোমাকে ভেবে দেখতে হবে, একদিকে। তোমার প্রদত্ত উত্তর একটি লোকের জীবন ধ্বংস করে দিতে পারে, আবার অন্যদিকে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করতে পারে। তুমি হয়তো ভুলও করতে পার। আসামি এখনি উঠে দাঁড়াবে… ব্ৰিভেত, কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটিকে ভালো করে দেখ, এবং তোমার বিবেক-বুদ্ধি সহকারে মহামান্য আদালতকে বল এই ব্যক্তি তোমার জেলখানার পুরনো সাথি কি না।

ব্রিভেত বলল, হ্যাঁ মঁসিয়ে প্রেসিডেন্ট। আমিই তাকে প্রথমে চিনি এবং এখনও এ বিষয়ে নিশ্চিত। এ-ই হল জাঁ ভলজাঁ যে ১৭৯৬ সালে তুল’র জেলখানায় প্রবেশ করে এবং ১৮১৫ সালে মুক্তি পায়। আমি তার এক বছর পরে ছাড়া পাই। এখন তাকে বোকা বোকা দেখাচ্ছে, কিন্তু সেটা বয়সের জন্য। আগে কিন্তু তাকে বেশ চালাক দেখাত জেলখানায়। আমি তাকে ভালোভাবেই চিনি।

বিচারক বললেন, ঠিক আছে তুমি বস। আসামি দাঁড়িয়ে থাকবে।

এরপর শিনেলদোকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় আনা হল। সে ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। তুল’র জেলখানা থেকেই সাক্ষ্য দেবার জন্য তাকে আনা হয়েছে। তার পরনে ছিল লাল জামা আর মাথায় সবুজ টুপি। তার চেহারাটা ছিল বেঁটেখাটো এবং বয়স প্রায় পঞ্চাশ। তার চেহারা দেখে বোঝা যায় তার মধ্যে একটা স্নায়বিক দুর্বলতা আছে। অথচ তার দৃষ্টির মধ্যে প্রচুর ইচ্ছাশক্তির আভাস পাওয়া যায়। জেলখানার অন্যান্য কয়েদিরা তাকে ‘ঈশ্বরহীন নাস্তিক’ বলে উপহাস করত।

বিচারপতি ব্রিভেতকে যে কথা বলে সতর্ক করে দিয়েছিলেন, শিনেলদোকেও সেই কথা বললেন। কারাদণ্ডের জন্য সে-ও শপথগ্রহণের অধিকার হতে বঞ্চিত। এ কথা তাকে বলা হতে সে দর্শকদের দিকে লজ্জায় তাকাল। তাকে যখন সে আসামিকে চেনে কি না জিজ্ঞাসা করা হল তখন সে জোরে হেসে উঠল। বলল, সে কি, তাকে না চিনে পারি কখনও? আমরা পাঁচ বছর ছিলাম একসঙ্গে। কী সাথি, কেমন আছ? তুমি যে একেবারে ভেঙে পড়েছ?

বিচারপতি তাকে বললেন, বস।

তার পর আনা হল কোশেপেনকে। সে-ও ছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত। প্রথম জীবনে লর্দে অঞ্চলের এক চাষি, পরে সে পিরেনিজে গিয়ে ডাকাতি করতে থাকে। পিরেনিজের পার্বত্য অঞ্চলে সে প্রথমে ভেড়া চরাত, তার পর ডাকাত হয়ে যায়। তার চেহারা দেখে তাকে দুর্বৃত্ত বলে মনে হয়, তবে আসামির থেকে তাকে বেশি মাথামোটা বলে মনে হচ্ছিল। প্রকৃতি যেন তার চেহারাটাকে হিংস্র পশুর মতো করে তুলেছে। হিংস্র জন্তুর পরিবর্তে সে হয়ে উঠেছে জেল-কয়েদি।

বিচারক প্রথমে তাকেও সেই একই কথা বললেন ভূমিকাস্বরূপ।

কোশেপেন তখন বলল, হ্যাঁ, এই সেই জাঁ ভলজাঁ। তার গায়ে খুব জোর ছিল বলে আমরা তাকে ‘ক্রোবার’ বলতাম।

এই তিনজন সাক্ষী এমন স্পষ্ট আর পরিষ্কারভাবে তাদের বক্তব্য জানাল যে তা শুনে দর্শকরা সকলেই আসামির ওপর রেগে গেল এবং তাদের মধ্য থেকে একটা চাপা কলগুঞ্জন ধ্বনিত হয়ে উঠল। আসামি নিজেও তাদের কথা শুনতে শুনতে বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। বাদীপক্ষের মতে এই বিস্ময়ই হল তার প্রতিরক্ষার একমাত্র অস্ত্র। আসামির পাশে যেসব পুলিশ দাঁড়িয়েছিল তারা তিনজন সাক্ষীর সাক্ষ্যদান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আসামির মুখে তিনটে কথা উচ্চারিত হতে শোনে। প্রথম সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হলে ঠিক আছে, একটা হল। দ্বিতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যশেষে সে আরও জোরে বলে ওঠে ‘চমৎকার। আর তৃতীয় সাক্ষীর সাক্ষ্যশেষে বলে, ‘বিখ্যাত।

বিচারক এবার তাকালেন আসামির দিকে। তিনি বললেন, কাঠগড়ায় দণ্ডায়মান হে আসামি, এইসব সাক্ষ্যের কথা তুমি শুনেছ। তোমার কিছু বলার আছে?

আসামি বলল, আমি শুধু বলছি এটা বিখ্যাত।

এ কথা শুনে দর্শকরা একযোগে হাসিতে ফেটে পড়ল। জুরিরাও সে হাসিতে যোগ দিলেন। আসামির আর কোনও আশা নেই।

বিচারপতি ঘোষককে সবাইকে চুপ করতে বলার জন্য আদেশ দিলেন। বললেন, আমি এবার রায় দেব।

এমন সময় পেছন থেকে এক কণ্ঠস্বর শোনা গেল।

সেই কণ্ঠস্বর বলল, ব্রিভেত, শিনেলদো ও কোশেপেন, আমার দিকে একবার তাকাও তো।

এই কণ্ঠস্বরের দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। সেই কণ্ঠস্বর একই সঙ্গে এমনই বিষাদময় ও সকরুণ এবং ভয়ঙ্কর যে সে কণ্ঠস্বর শোনার সঙ্গে সঙ্গে সকলের অন্তর হিমশীতল হয়ে গেল। বিচারপতির পেছনে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সিটে বসে থাকা এক ভদ্রলোক এবার উঠে দাঁড়াল। সে ধীরে ধীরে কোর্টঘরের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি, সরকারপক্ষের উকিল, জুরিদের অন্যতম মঁসিয়ে বামাতাবয় ও আরও কুড়িজন চিনতে পেরে একবাক্যে বলে উঠল, মঁসিয়ে ম্যাদলেন!

.

১১

হ্যাঁ, সে ছিল সত্যিই মঁসিয়ে ম্যাদলেন। কেরানিদের টেবিলের উপর জ্বলতে থাকা বাতির আলোটা তার মুখের উপর পড়ল। তার হাতে টুপিটা ধরা ছিল। তার পোশাকটা ছিল বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। তার বড় কোটটার সব বোতামগুলো দেওয়া ছিল। তার মুখখানি ছিল স্নান এবং সে কিছুটা কাঁপছিল। তার যে চুলগুলো সে অ্যারাসে আসার সঙ্গে সঙ্গে ধূসর হয়ে যায়, সেগুলো এখন যেন একেবারে সাদা হয়ে গেছে।

তার আকস্মিক আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলে হতবুদ্ধি আর স্তব্ধ হয়ে যায়। তার বেদনার্ত কণ্ঠস্বর আর তার বহিরঙ্গের প্রশান্ত ভাবের মধ্যে এমন একটা বৈপরীত্য। ছিল যে সে-ই একথা বলেছে তা বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না। বিচারপতি বা সরকারপক্ষের। উকিল কোনও কথা বলার আগে অথবা পুলিশরা নড়াচড়ার আগেই ম্যাদলেন সাক্ষী তিনজনের সামনে এগিয়ে গিয়ে বলল, তোমরা আমাকে চিনতে পারছ না?

সাক্ষীরা তার দিকে চরম বিস্ময়ের সঙ্গে তাকিয়ে নীরবে মাথা নাড়ল। কোশেপেন সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানাল তাকে। ম্যাদলেন এবার জুরিদের দিকে মুখ তুলে বলল, জুরি মহোদয়গণ, আপনারা আসামিকে ছেড়ে দিন। আমি মহামান্য আদালতের। কাছে প্রার্থনা করছি, আমাকে গ্রেপ্তার করার হুকুম দিন। আপনারা যাকে খুঁজছেন আমিই হচ্ছি সেই লোক। আমিই হচ্ছি জাঁ ভলজাঁ।

সকলেই এমনভাবে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল যে কেউ একটা নিশ্বাস পর্যন্ত ছাড়ল না। সমস্ত হলঘরের মধ্যে মৃত্যুশীতল এক স্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল। কোনও অস্বাভাবিক বা অতিপ্রাকৃত ঘটনা ঘটলে যেমন উপস্থিত জনতাকে এক ধর্মীয় ভীতি আচ্ছন্ন করে ফেলে, কোর্টঘরের জনতারও সেই দশা হল। শুধু বিচারপতির মুখের ওপর একটা বিষাদ আর সহানুভূতির ভাব ফুটে উঠল। তিনি সরকারপক্ষের উকিল ও তার পাশের জুরিদের সঙ্গে নিচু গলায় কী বললেন। তার পর সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখানে কোনও ডাক্তার আছে?

সরকারপক্ষের উকিল এবার কথা বলতে শুরু করল, জুরি মহোদয়গণ, এই আশ্চর্যজনক ঘটনা আমাদের এমন এক অনুভূতির সৃষ্টি করেছে, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আমরা সকলেই মন্ত্রিউল-সুর-মের-এর মেয়র পরম শ্রদ্ধেয় মঁসিয়ে ম্যাদলেনকে চিনি। তার নাম ও যশের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। এখানে যদি কোনও ডাক্তার উপস্থিত থাকেন তা হলে আমি তাকে অনুরোধ করছি তিনি যেন এই ভদ্রলোককে একবার দেখে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেন।

তিনি আরও কী বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু ম্যাদলেন তাঁকে থামিয়ে দিয়ে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলতে শুরু করে। সে যা বলেছিল তা সঙ্গে সঙ্গে লিখে নথিবদ্ধ করে রাখা হয় এবং যারা নিজের কানে সে কথা শুনেছিল তারা চল্লিশ বছর পরেও সে কথা মনে রাখে।

ম্যাদলেন বলতে থাকে, আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ মাননীয় অ্যাডভোকেট জেনারেল। কিন্তু আমি পাগল নই। আপনারা মস্ত বড় একটা ভুল করতে চলেছেন আর আমি আমার এক সাধারণ কর্তব্য পালন করছি। এই লোকটিকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে। আমিই সেই হতভাগ্য কয়েদি! এখন আমি যা আপনাদের বলব সেটাই হল প্রকৃত সত্য। ঈশ্বর হচ্ছেন একমাত্র আমার সাক্ষী। এই আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনারা আমাকে গ্রেপ্তার করতে পারেন। আমি আমার নাম পাল্টে অনেক কিছু করেছিলাম, আমি ধনী হয়ে উঠেছিলাম, মেয়র হয়েছিলাম। আমি একজন সৎ লোক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সেটা হবার নয়, আমার ভাগ্যে তা হয়তো নেই। অবশ্য আমার সমগ্র জীবনকাহিনী আপনাদের বলার কোনও প্রয়োজন নেই। যথাসময়ে তা জানতে পারবেন। তবে একথা সত্য যে আমি দিগনের বিশপের জিনিস আর পেতিত গার্ভের পয়সা চুরি করেছিলাম। আপনারা ঠিকই অনুমান করেছিলেন, জাঁ ভলজাঁ একজন দুর্বৃত্ত, যদিও সব দোষ তার ঠিক নয়। আমার মতো একজন সামান্য নিচুস্তরের লোক ঈশ্বরের বিধানের বিরুদ্ধ প্রতিবাদ করতে পারে না অথবা সমাজকে উপদেশ দিতে পারে না। কিন্তু যে অধঃপতনের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমি পালাতে চেয়েছিলাম তা সত্যিই সমাজের পক্ষে কলঙ্কজনক ব্যাপার। জেলখানার অবস্থাই জেলপলাতকদের সৃষ্টি করে–এ-কথা আপনাদের অবশ্যই মনে রাখা উচিত। জেলে যাবার আগে আমি ছিলাম একটা বোকা গ্রাম্য চাষি। কিন্তু জেলখানায় গিয়েই আমার পরিবর্তন হল স্বভাবের। আমার মধ্যে কুপ্রবৃত্তি জেগে উঠল। যেন একটা ধূমায়িত কাঠ সহসা জ্বলে উঠল। পশুপ্রবৃত্তি যখন আমার আত্মাকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছিল তখন একটি মানুষের সততা এবং অনুকম্পা আমার আত্মাকে রক্ষা করল। কিন্তু এসব কথা আপনাদের বুঝে কোনও লাভ নেই। আমি পেতিত গার্ভের কাছ থেকে যে চল্লিশ ব্যু চুরি করেছিলাম সেই মুদ্রাটা আমি যেখানে থাকি সেই ঘরের মধ্যে এখনও দেখতে পাবেন। আমার আর কিছু বলার নেই। আপনারা শুধু আমাকে গ্রেপ্তার করুন। কিন্তু অ্যাডভোকেট জেনারেল মাথা নাড়ছেন। আপনারা হয়তো আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, পাগল ভাবছেন। এতে আমার আরও কষ্ট হচ্ছে। একটি নির্দোষ মানুষের যেন কারাদণ্ড না হয়। এটা দুঃখের বিষয় যে জেতার্ত এখানে নেই, সে আমাকে চেনে। সাক্ষীরা বলছে, তারা আমাকে চিনতে পারছে না।

তার কণ্ঠস্বরে যে বিষাদ আর একটা প্রশান্ত ভাব ফুটে উঠেছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এবার সে সাক্ষী তিনজনের দিকে ঘুরে বলল, আমি তোমাকে চিনি ব্রিভেত। তোমার মনে আছে, তুমি একটা চেকওয়ালা জামা পরতে?

ব্রিভেত আশ্চর্য হয়ে তার মুখের দিকে চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।

ম্যাদলেন তখন শিনেলদোকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, আর তুমি শিনেলদো, ওরা তোমাকে নিরীশ্বর বলত। তুমি নিজেকেও তাই বলতে। তোমার বাঁ কাঁধে একটা ক্ষতের দাগ আছে। তাতে টি. ই. পি. এই তিনটে অক্ষর খোদাই করা আছে।

শিনেলদো বলল, হ্যাঁ, কথাটা সত্যি।

এবার সে কোশেপেনকে বলল, কোশেপেন, তোমার বাঁ হাতে সম্রাট যেদিন চেলস্-এ অবতরণ করেন সেই তারিখটি অর্থাৎ ১৮১৫ সালের ১ মার্চ উল্কিতে লেখা আছে, তোমার জামার আস্তিনটা গোটাও।

কোশেপেন আস্তিনটা গোটাতেই একজন পুলিশ লণ্ঠনের আলো নিয়ে দেখল সত্যিই তারিখটা তার হাতে উল্কির মধ্যে খোদাই করা আছে।

এবার মুখে ক্ষীণ একটু হাসি নিয়ে ম্যাদলেন বিচারপতির দিকে তাকাল। এক জয়ের গর্ব আর হতাশার বেদনায় ভরা সে হাসি যে দেখেছে তার অন্তর ব্যথায় মোচড় দিয়ে উঠল। ম্যাদলেন বলল, এবার বিশ্বাস হচ্ছে তো আমিই জাঁ ভলজাঁ?

কোর্টঘরের মধ্যে তখন যেন বিচারক, উকিল, পুলিশ বলে কেউ ছিল না, শুধু কতকগুলি কৌতূহলী চোখ আর ব্যথিত অন্তর ছাড়া সে ঘরে যেন আর কেউ ছিল না। কার কী কাজ তা যেন কেউ জানত না। সবাই তাদের আপন আপন কর্তব্য যেন ভুলে গিয়েছিল। সরকারপক্ষের উকিল ভুলে গিয়েছিল তাকে আসামির অভিযোগ প্রমাণিত করতে হবে। বিচারপতি রায় দেবার কথা ভুলে গিয়েছিলেন। আসামিপক্ষের উকিল আত্মপক্ষ সমর্থনের কথাও ভুলে গিয়েছিল। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা কেউ কোনও প্রশ্ন করেনি, কেউ আইনের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করেনি। যেন কোনও ভীতিপ্রদ ঘটনা উপস্থিত সকলের অন্তরাত্মাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল নিবিড়ভাবে। সেখানে উপস্থিত কেউ সে কী অনুভব করছে তা বুঝতে পারেনি, তার অনুভূতির কথা সে নিজেই ধরতে পারেনি। অকস্মাৎ এক বিরাট আলোর ছটায় সকলের চোখ যেন ধাঁধিয়ে গিয়েছিল। সে আলোর মূর্তিটাকে কেউ স্থিরভাবে দেখতে পারেনি। বুঝতে পারেনি।

মঁসিয়ে ম্যাদলেনই যে জাঁ ভলজাঁ তাতে কারও কোনও আর সন্দেহ ছিল না। সে সত্য এখন স্বরূপে প্রকটিত। যে কথা কয়েক মিনিট আগেও দুর্বোধ্য ছিল সকলের কাছে, ম্যালেনের সকরুণ চেহারাটাই এখন সে কথা সব প্রকাশ করে দিচ্ছে। যে মানুষটি অন্য একটি লোক তার জায়গায় বৃথা দুঃখ ভোগ করবে বলে নিজে থেকে আত্মসমর্পণ করতে এসেছে, তার মহত্ত্বের কথাটা উপস্থিত সকলে কারও কোনও সাহায্য ছাড়াই সরলভাবে বুঝতে পারল। এই সরল সত্য ঘটনাটার সামনে অন্য সব প্রশ্ন তাদের সব গুরুত্ব হারিয়ে ফেলল। এই মহান পুরুষটির প্রতি এক দুর্বার শ্রদ্ধা আর করুণার আবেগে বিগলিত হয়ে উঠেছিল যেন সকলের অন্তর।

জাঁ ভলক্স বলল, আমি আর মাননীয় আদালতকে বিরক্ত করব না। এখন যদি আমাকে গ্রেপ্তার করা না হয়, তা হলে চলে যাব আমি। আমার কাজ আছে। আদালত জানেন, আমি কে এবং কোথায় আমি যাচ্ছি। আদালত ইচ্ছা করলেই আমাকে ডেকে পাঠাতে পারেন।

ভলজাঁ এই কথা বলেই দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কেউ তাকে বাধা দিল না, হাত বাড়িয়ে কেউ তাকে ধরল না। সবাই তার যাবার জন্য পথ করে দিল। সেই মুহূর্তে সে এমন এক স্বর্গীয় জ্যোতিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল যা দেখে উপস্থিত জনতা তাকে শ্রদ্ধা না করে পারছিল না।

ভলজাঁ ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দরজার দিকে। দরজাটা খোলাই ছিল। কাউকে খুলতে হল না। যাবার আগে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে ভলজাঁ সরকারপক্ষের উকিলকে বলল, মঁসিয়ে, আমি আপনারই হাতে।

এরপর ঘরের সবাইকে লক্ষ্য করে সে বলল, আপনারা যারা এখানে উপস্থিত আছেন তাঁদের কাছে আমি এখন করুণার পাত্র, তাই নয় কি? যখন আমি ভাবি এ সব কাজ কেন করেছি তখন আমার মনে হয় এসব না করলেই ভালো হত।

ঘর থেকে বেরিয়ে তার পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে গেল ভলজাঁ।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে জুরিরা একমত হয়ে শ্যাম্পম্যাথিউকে মুক্তি দান করল। সব অভিযোগ থেকে মুক্ত হয়ে সে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে চলে গেল এক মুহূর্তে। কী করে কী ঘটে গেল তার কিছুই বুঝতে পারল না সে। তার মনে হল সব লোকই পাগল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *