১০. ভিটা নুভার ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি

অধ্যায় ১০

ভিটা নুভার ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি থেকে আলম শফিক নামের এক উঠতি নাট্য নির্মাতাকে গ্রেফতার করার পরই লেখক জায়েদ রেহমানের সদ্য বিধবা স্ত্রী বর্ষাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। আলম শফিকের আসল নাম ছিল শফিকুল আলম, কিন্তু অন্য অনেকের মতো মিডিয়াতে নিজের নাম উল্টেপাল্টে আলম শফিক করে নিয়েছে সে। যদি এ কাজটা না করতো তাহলে হয়তো এতো দ্রুত ধরা পড়তো না। কারণটা খুব সহজ, ইংরেজি বর্ণের প্রথম অক্ষর ‘এ’ দিয়ে তার নাম শুরু হওয়াতে ডাটা-ব্যাঙ্ক থেকে খুব দ্রুত খুঁজে বের করা গেছে।

আলম শফিকের গ্রেফতারের কথাটা অবশ্য মিসেস রেহমান জানে না। তাকে আসলে জানানো হয়নি। জেফরি বেগ ইচ্ছে করেই সেটা করেছে।

মহিলা মাথা নিচু করে দু’হাতে মুখ ঢেকে রেখে বসে আছে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ইন্টেরোগেশন সেলে। ভিটা নুভা থেকে তাকে সরাসরি এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।

ইন্টেরোগেশন সেলটি পঁচিশ বাই পঁচিশ ফিটের জানালাবিহীন বিশাল একটি ঘর। একটা মাত্র দরজা। সলিড লোহার। ঘরের দেয়াল আতঙ্কজনক রকমেরই ধবধবে সাদা টাইলসের। পশ্চিম দিকের দেয়ালে বিশাল একটি দ্বিমুখী আয়না রয়েছে। ঘরের ভেতরে থাকা লোকজনের কাছে এটা নিছক আয়না, তবে আয়নার ওপাশে থাকা ছোট্ট একটি কক্ষে যারা বসে থাকে তাদের কাছে এটি স্বচ্ছ কাঁচ ছাড়া আর কিছু নয়। ইন্টেরোগেশন সেলের ভেতরে কি ঘটছে না ঘটছে সবই দেখতে পায় তারা। এখান থেকে প্রত্যক্ষদর্শীরা সন্দেহভাজনদেরকে চিহ্নিতও করে থাকে। তবে সাধারণত জেরা করার কাজে বিশেষ পারদর্শী লোকজন এখান থেকে সন্দেহভাজনকে অবজার্ভ করে।

বিশাল ঘরের মাঝখানে একটা আয়তক্ষেত্রের কাঠের টেবিল আর চার পাঁচটা চেয়ার রয়েছে। টেবিলের উপর উজ্জ্বল পাওয়ারের একটা বাতি আর বিশেষ একটা চেয়ারের সামনে মাইক্রোফোন ছাড়া ঘরে তেমন কিছু নেই। সন্দেহভাজনকে যে চেয়ারে বসানো হয় সেটা আসলে পলিগ্রাফ টেস্টের চেয়ার। এই বিশেষ চেয়ারের সাথে লাগোয়া কতোগুলো ক্যাবল আর সেন্সর সন্দেহভাজনের শরীরের বিভিন্ন নার্ভ-পয়েন্টে লাগিয়ে দিলেই সত্য-মিথ্যার কারসাজি ধরা পড়তে শুরু করে।

মহিলা বলে ঘরে একজন মহিলা পুলিশ রাখা হয়েছে। হ্যাপি নামের এই তরুণী পুলিশ কনস্টেবল ঘরের এক কোণে একটা চেয়ারে বসে আছে চুপচাপ। জেফরি বেগ ছাড়া ঘরের চতুর্থ মানুষটি হলো জামান।

তারা দু’জন বসে আছে মহিলার ঠিক বিপরীতে। টেবিলের উপর কিছু নেই। মাথার উপর কেবল মৃদু আলোর একটি ঝুলন্ত ইলেক্ট্রক বাল্ব জ্বলছে।

মিসেস রেহমান বুঝতে পারছে তাকে হত্যার সন্দেহে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে নিজের নিদোষিতা প্রমাণ করার জন্য কোনো প্রচেষ্টা করেনি সে। শুধু গ্রেফতার করে গাড়িতে নিয়ে আসার পাথে দৃঢ়ভাবে বলেছে, খুনটা সে করেননি।

লেখক জায়েদ রেহমানের খুনের ঘটনাটি জেফরির কাছে এখন পানির মতোই পরিস্কার বলে মনে হচ্ছে। এ নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামানোর দরকার নেই। পুরো ঘটনাটিই ঐ একটা গ্রেফতারের মধ্য দিয়েই উন্মোচিত হয়ে গেছে। আসামীদের স্বীকারোক্তি খুবই দরকারি একটি জিনিস। আর সেটাই এখন আদায় করতে হবে।

“মিসেস রেহমান,” বেগ বলতে শুরু করল, “আপনি কাল রাতে কখন বাড়ি ফিরেছিলেন?”

মহিলা মুখ তুলে তাকাল। “সাতটা-আটটা হবে।”

“কোথায় গিয়েছিলেন?”

“একটু কেনাকাটা করতে।” ডান হাতের একটা আঙুলের নখ বাম হাতে খুটতে খুটতে জবাব দিল মহিলা।

“কি কিনতে গিয়েছিলেন?”

মহিলা একটু সময় নিলো। “মেয়েলী জিনিস…”

জেফরি স্থির চোখে তাকিয়ে রইল কয়েক মুহূর্ত। “আপনার তো গাড়ি আছে। নিজেই চালান?”

“মাঝেমধ্যে নিজেই চালাই। আমার ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে।”

“কাল কি আপনি নিজেই গাড়ি চালিয়েছিলেন?”

“হ্যাঁ।” ছোট্ট করে বলল সে। এবার বেগের চোখের দিকে তাকাল।

বুকের উপর দু’হাত ভাঁজ করে বেগ একদৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে বলল, “বাড়িতে কি একাই ফিরেছিলেন?”

মহিলা চমকালো না বলে বেগ একটু অবাকই হলো।

“হ্যাঁ।”

“তারপর কি করলেন?”

সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল মিসেস রেহমান। “বুঝলাম না?”

“বলতে চাচ্ছি, এরপর কি করলেন? কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরলেন… বেশ। তারপর যা করলেন সব বলুন।”

“ও!” প্রশ্নটা বুঝতে পেরে মহিলা বলল, “বাচ্চাকে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে নিজে ডিনার করলাম। তারপর বোধহয় একটু টিভি দেখেছিলাম…ওর ঘরে গিয়ে ওকে দেখে এসে নিজের ঘরে চলে আসি। এরপর ঘুমাতে চলে যাই।”

দারুণ! বেগ ভাবলো। “আপনার অ্যাপার্টমেন্টে বেশ কয়েক বার পুলিশ গিয়েছিল। আপনি কি সেটা টের পেয়েছিলেন?”

“ভোর রাতে ইন্টারকমে পুলিশ কল করলে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর তো…”

“হ্যাঁ। কিন্তু তার আগেও আরেক বার পুলিশ গিয়েছিল।”

“আমি তখন ঘুমিয়ে ছিলাম।”

“অবশ্যই। অতো রাতে তো ঘুমিয়ে থাকারই কথা,” কথাটা বলেই বেগ তার সহকর্মী জামানের দিকে তাকাল। জামান এতোক্ষণ ধরে কিছু না বললেও নিজের অভিব্যক্তি লুকাতে পারছে না। তোমাকে আরো অনেক শিখতে হবে, বেগ ভাবলো। তারপর মহিলার দিকে ফিরে বলল, “আপনি নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে আসার পর কেউ কি আপনার ফ্ল্যাটে এসেছিল?”

মহিলা নির্বিকারভাবে বলল, “না।”

“আপনি নিশ্চিত?”

“হ্যাঁ।”

আবারো মহিলার দৃঢ়তায় মুগ্ধ হলো বেগ। “তার মানে দাঁড়াল মি. জায়েদকে যে-ই খুন করে থাকুক সে তার ফ্ল্যাটেই ছিল সারা রাত।”

এই প্রথম মহিলা একটু ভড়কে গেল বলে মনে হলো বেগের কাছে। তবে কথাটার কোনো প্রতিবাদ করল না ভদ্রমহিলা।

“আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন, মিসেস রেহমান?”

বেগের এই প্রশ্নে মহিলা বিস্মিত হলো। সেটা লুকাতেও পারল না। “আমি নিজেই যেখানে সন্দেহের মধ্যে আছি সেখানে অন্য কাউকে সন্দেহ করি কিভাবে!” একটা কাষ্ঠ হাসি দেখা গেল মহিলার ঠোঁটে। যেন তার সাথে নির্মম রসিকতা করা হচ্ছে।

“কেন, আপনার বাড়িতে যারা থাকে তাদের মধ্যে কি কেউ এ কাজ করতে পারে না? আমরা তো সবাইকেই সন্দেহ করছি।”

“সেটা আপনারা করতেই পারেন। তবে আমি কাউকে সন্দেহ করতে পারছি না। কোনোভাবেই হিসেব মেলাতে পারছি না, ওকে কেন খুন করা হবে!”

“মিসেস রেহমান,” বেগ গম্ভীর কণ্ঠে বলল। “আপনার স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা সন্দেহ করছি। কেন করছি সেটা আপনিও ভালো করেই জানেন। সব কিছু বিবেচনা করে আমার কাছে মনে হচ্ছে আপনাকে আরেকটু সহযোগীতা করতে হবে আমাদেরকে।”

“কি ধরণের সহযোগীতা করবো আমি? খুনটা আমি করেছি বললেই বোধহয় সেটা করা হবে। কিন্তু সেটা তো আমি করিনি! ওকে খুন করে আমার লাভ কি…একটা কথাই শুধু বলতে পারি, ও যদি খুন হয়ে থাকে সেটা আমার কাছেও দুর্বোধ্য। আমি এসবের কিছুই জানি না।”

“মিসেস রেহমান,” বেগের ঠোঁটে মুচকি হাসি। “আমি বুঝতে পারছি, খুনটা যদি আপনি না-ই করে থাকেন তাহলে এতোক্ষণ ধরে আমাদের কাছে মিথ্যে বলে যাচ্ছেন কেন?”

মহিলা নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে বসল। তার চোখেমুখে প্রচণ্ড ক্রোধ। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বেগের দিকে। বেগও মহিলার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইল।

কয়েক সেকেন্ড ধরে পালাক্রমে তাদের দুজনের দিকে তাকাল জামান। বিশাল একটি নাটকীয় মুহূর্তের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে সে।

বেগ পরিস্থিতি শান্ত করার উদ্যোগ নিলো। দুহাত তুলে মহিলাকে প্রশমিত করার ইশারা করে বলল, “আপনি উত্তেজিত হবেন না। আপনাকে এখনও আমরা খুনি হিসেবে সন্দেহ করছি না।”

“তাহলে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কেন?” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে মিসেস রেহমান বলল।

“আমার কথা শেষ করতে দিন।” একটু সময় নিয়ে আবারো বলতে শুরু করল জেফরি বেগ। “আপনি হয়তো জানেন না এরইমধ্যে আমরা একজন সম্ভাব্য খুনিকে ধরে ফেলেছি…”

মহিলা শুধু বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে অনেকটা অনিচ্ছায় প্রশ্ন করল : “কে সে?”

“আপনি তাকে চেনেন।”

মহিলার মধ্যে অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট।

“আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস খুনটা সে-ই করেছে। তবে এখনও তদন্তের প্রাথমিক অবস্থায় আছি আমরা। আরেকটু খতিয়ে দেখতে হবে।”

“আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন কি জন্যে? আমার স্বামী খুন হয়েছে। তার লাশ পড়ে আছে পোস্টমর্টেম টেবিলে। আমার মানসিক অবস্থাটা বুঝতে পারছেন?”

“সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু এটা বুঝতে পারছি না আপনি কেন আমাদের কাছে মিথ্যে বলছেন?”

মহিলা আর নিজের রাগ সামলাতে পারল না। চিৎকার করে বলল, “আমি কোনো মিথ্যে কথা বলিনি। আপনি আমার কাজের লোকদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”

“মিসেস রেহমান, আমি আপনাকে সত্যি বলার জন্য চাপচাপি করবো না। কিন্তু মনে রাখবেন, মিথ্যে বললে আপনি ফেঁসে যাবেন।”

“আমি আবারো বলছি, আমি আপনাকে যা বলেছি তার মধ্যে কোনো মিথ্যে নেই।”

“আপনি যদি মিথ্যে না বলে থাকেন তাহলে আমরা যাকে অ্যারেস্ট করেছি সে মিথ্যে বলেছে।”

“কার কথা বলছেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না?” মহিলাকে এখন অসহায়ের মতো লাগছে। তার মধ্যে আগের সেই দৃঢ় ভাবটা আর নেই।

“যার সাথে কাল রাতটা কাটিয়েছেন আপনি!” কথাটা বলেই জেফরি বেগ উঠে দাঁড়াল।

.

“স্যার, বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি। আমি কিছুই জানি না।”

ধরা পড়ার পর সব অপরাধী যেমনটি বলে লেখক জায়েদ রেহমানের অ্যাপার্টমেন্টের ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি থেকে গ্রেফতার হওয়া আলম শফিকও বার বার সে কথা বলে গেছে।

সবার আগে তাকেই নিয়ে আসা হয়েছিল হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত অত্যাধুনিক ইন্টেরোগেশন সেলে। লেখকের তরুণী স্ত্রী বর্ষাকে গ্রেফতার করা হলেও তাকে অন্য একটি রুমে রাখা হয়। জেফরি বেগ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাকে পরে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। মহিলা অবশ্য জানতো না আলম শফিক গ্রেফতার হয়েছে।

ভিটা মুভার ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি থেকে আলম শফিককে গ্রেফতার করা হয়েছে একেবারেই নিঝটভাবে। কোনো রকম হৈহল্লা হয়নি। অ্যাপার্টমেন্টের কেউ বুঝতেই পারেনি তাদের বিল্ডিং থেকে একজন সম্ভাব্য খুনিকে ধরা হয়েছে। জেফরি বেগ সম্পূর্ণ খালি হাতে আলম শফিককে গ্রেফতার করতে পেরেছে তার কারণ এই যুবক নিজে থেকেই অনেকটা আত্মসমর্পনের ভঙ্গিতে ধরা দিয়েছে। দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেনি সে। বেগ জানে এটা অস্বাভাবিক নয়। অনেক সময়ই খুনি খুন করার পর নাভাস ব্রেকডাউনে ভুগে থাকে। কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই আত্মসমর্পন করে।

সনাতন-পদ্ধতিতে সন্দেহভাজন অপরাধীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, জেফরি বেগ অবশ্য সেসব করে না। এফবিআই’র আদলে গড়ে ওঠা এই ডিপার্টমেন্টে অত্যাধুনিক পলিগ্রাফ মেশিন রয়েছে, যা দিয়ে সন্দেহভাজনের কথা সত্য না কি মিথ্যে সেটা জানা যায়। অবশ্য এই পলিগ্রাফের ফলাফল আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তবে তদন্তকাজে এটা বেশ সাহায্য করে। জেফরি বেগ এই যন্ত্রটি খুব ভালোবাসে। অমানুষিক নির্যাতন করার বদলে এটা অনেক সভ্য আর মানবিক। তার মানে এই নয় যে, হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে কোনো রকম নির্যাতন করা হয় না। এখনও আগের মতো, অনেকক্ষেত্রে তারচেয়েও বেশি নির্মম পদ্ধতি প্রয়োগ করে জিজ্ঞাসাবাদ করার ব্যবস্থা আছে এখানে। অনেক সময় জেনেভা কনভেনশনে নিষিদ্ধ ঘোষিত ড্রাগ প্রয়োগেও সন্দেহভাজনের কাছ থেকে তথ্য আদায় করা হয়। ব্যাপারটা নির্ভর করে ঘটনার গুরুত্ব আর সন্দেহভাজনের সামাজিক অবস্থানের উপর। লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সে রকম কিছু ব্যবহার করার দরকার পড়বে না বলেই মনে করে জেফরি বেগ। আলম শফিক নামের যুবকটিকে কিছুক্ষণ জেরা করলেই পুরো ঘটনা বেরিয়ে আসবে।

আলম শফিককে ঠিক সেই চেয়ারে বসানো হয়েছিল। তার শরীরে যথারীতি লাগানো হয়েছিল ক্যাবলগুলো। তার সামনে জেফরি বেগ আর তার পাশের চেয়ারে বসেছিল জামান। ঘরে আর কেউ ছিল না।

জেফরি বেগ ধীরস্থিরভাবে জেরা করতে শুরু করে।

“আপনাকে আমরা কেবল হত্যাকারী হিসেবে সন্দেহ করছি। এর বেশি কিছু না,” জেফরি বেগের কণ্ঠ বেশ বন্ধুভাবাপন্ন।

আলম শফিক নামের যুবকটি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল। কথাটা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয় সে।

“এখন আপনার দায়িত্ব এই সন্দেহ থেকে নিজেকে বের করে আনা,” বেগ বলেছিল তাকে।

“স্যার, আপনি বিশ্বাস করুন, আমি খুন করিনি,” বার বার এই একটি কথাই বলে গেছে সে।

“খুনের কথা বাদ দিন। আমাকে বলুন, আপনার সাথে মিসেস জায়েদ রেহমানের সম্পর্কটা কি?”

“স্যার, আমি সব বলবো, কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি খুন করিনি।” আবারো নাছোরবান্দার মতো একই কথা বলল সে।

“মি. আলম শফিক,” কথাটা বলে বেগ জামানের দিকে তাকাতেই জামান ডান হাতের তিন আঙুল উঁচিয়ে হাই ফাইভ করে। “পরিস্থিতি জটিল করলে আপনার কোনো লাভ হবে না। সব বলুন। আস্তে আস্তে বলুন।”

নিচু করে রাখে আলম শফিক। বেগ তাকে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য কিছুটা সময় দেয়। তার মধ্যে তাড়াহুড়ার কোনো লক্ষণ নেই। “সব খুলে না বললে সবাই আপনাকেই হত্যার জন্য অভিযুক্ত করবে। আর এজন্যে কাউকে দোষ দিতে পারবেন না আপনি।”

ঘরের একমাত্র দরজাটা খুলে গেলে হাতে চায়ের ট্রে নিয়ে এক লোক ঢোকে। কোনো কথা না বলে সে তিন কাপ চা আর এক প্যাকেট সিগারেট রেখে যায় টেবিলের উপর। আলম শফিক চা আর সিগারেটের প্যাকেটের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বেগের দিকে তাকায়।

“চা নিন। একটা সিগারেটও ধরান। এ ঘরে ধূমপান করা যায়।”

বেগের কথা শুনে আলম শফিক আরো বিস্মিত হয়।

বেগ একটা কাপ তুলে নিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। আজ সকালে এটাই তার প্রথম কোনো খাবার মুখে দেয়া, অবশ্য চা’কে যদি খাবার হিসেবে গন্য করা হয় তো। জামান চায়ের তেষ্টায় ছটফট করছিল। হাতে কাপটা নিয়েই অস্থিরভাবে কয়েক চুমুক চা খেয়ে নেয় সে।

জেফরি বেগ ভুরু উঁচিয়ে আলম শফিককে চায়ের কাপ নিতে ইশারা করে আবার।

চায়ের কাপে আস্তে আস্তে চুমুক দেয় শফিক।

“সিগারেট ধরাতে পারেন,” বেগ বললে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে আলম শফিক। “আপনি যে ব্র্যান্ডের খান সেটাই আনা হয়েছে।”

চা আর সিগারেট খাওয়া শেষ করে সুবোধ বালকের মতো আলম শফিক গীত গাইতে শুরু করে। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে সন্দেহভাজনের মুখ দিয়ে কথা বের হলে তারা সেটাকে ‘গীত’ বলেই সম্বোধন করে।

প্রথমেই সে স্বীকার করে তার সাথে মিসেস রেহমানের প্রণয়ের কথা। কতো দিন ধরে চলছে, কিভাবে শুরু, সব। তারপর জানাল ইদানিং তারা মাঝেমধ্যেই ভিটা নুভা অ্যাপার্টমেন্টে অভিসারে লিপ্ত হয়। গতকাল রাতেও সেরকম এক অভিসারে গিয়েছিল।

রাত আটটার দিকে মিসেস রেহমান নিজে গাড়ি চালিয়ে বাইরে গিয়ে আলম শফিককে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে ভিটা নুভায় ফিরে আসে। অবশ্য তার এই আগমন প্রধান গেটের কাছে থাকা দারোয়ানের কাছে অজ্ঞাত ছিল। কেননা মহিলা গাড়ির পেছনের সিটে লুকিয়ে রেখে শফিককে নিয়ে ভিটা নুভায় ফিরে এলেও তাকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেনি। মিসেস রেহমান চলে যাবার অনেকক্ষণ পর শফিক গাড়ি থেকে বের হয়ে সবার অগোচরে পাকিং এরিয়া থেকে লিফটে করে উপরে চলে আসে। অ্যাপার্টমেন্টের একটা অব্যবহৃত দরজা ভেতর থেকে খুলে রেখেছিল মিসেস রেহমান। ঐ দরজাটা শফিকের প্রেমিকা বর্ষার শোবার ঘর। ফলে অ্যাপার্টমেন্টের ভেতর থাকা হাউজনার্স আর গৃহপরিচারিকাদের কেউই ব্যাপারটা টের পায়নি।

নিজেদের উদ্দাম রাতের কথা সংক্ষেপে বললেও জেফরি বেগ এ নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন করেনি। কনডমের ছেঁড়া প্যাকেটই সব বলে দেয় ওখানে কি ঘটেছিল।

শফিক বার বার জোর দিয়ে বলেছে লেখক জায়েদ রেহমানের ঘরে সে ঢোকেনি। ওখানে কি হয়েছে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। তবে শেষ রাতের দিকে ভিটা নুভার সামনে পুলিশের আনাগোনা আর তাদের বেলকনিতে টর্চের আলো ফেলা ঘটনায় তারা দু’জন বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল। এরপর ভোর রাতের দিকে ইন্টারকমে পুলিশের আগমনের কথা শুনে তারা রীতিমতো ভড়কে যায়। লেখকের তরুণী স্ত্রী বর্ষা ইন্টারকমের জবাব দেবার সময়ই হাউজনার্স প্রতিদিনকার মতো ভোরে ঘুম থেকে উঠে লেখকের মলমূত্রের প্যানটা পরিস্কার করার জন্যে ঘরে ঢুকেই দেখতে পায় লেখকের মুখে বালিশ চাপা দেয়া। দৃশ্যটা দেখে মহিলা ভড়কে গিয়ে চিৎকার করে উঠলে মিসেস রেহমানের ইন্টারকমের অপর প্রান্তে থাকা পুলিশ ইন্সপেক্টর সেটা শুনে ছুটে আসে তাদের ফ্ল্যাটে।

চিৎকার শুনে বর্ষা ছুটে যায় লেখকের ঘরে। পুরো ঘটনা দেখে একদম ভড়কে যায় সে। তবে পরক্ষণেই বুঝতে পারে তাদের ফ্ল্যাটে পুলিশ আসছে। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত বুদ্ধি খাঁটিয়ে নিজের প্রেমিককে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়িতে লুকিয়ে থাকতে বলে মহিলা। শফিক দরজা খুলে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়িতে ঢুকতেই হুরমুর করে লিফট থেকে বের হয়ে আসে ইন্সপেক্টর এলাহী নেওয়াজ। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের জন্য শফিক পুলিশের হাত থেকে বেঁচে যায় কিন্তু মেইন গেটে পুলিশ থাকার কারণে ফায়ারএস্কেপ সিঁড়ি থেকে আর বের হতে পারেনি। অনেকটা ফাঁদে আটকা পড়ে যায়, অবশেষে ওখানে দীর্ঘক্ষণ লুকিয়ে থাকার পর জেফরি বেগের হাতে ধরা পড়ে শফিক।

“বিশ্বাস করুন, আমি খুন করিনি,” কাতর কণ্ঠে আবারো নিজের নির্দোষিতা ঘোষনা করে আলম শফিক।

জেফরি বেগ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে শফিকের দিকে। অনেকক্ষণ পর সে মুখ খোলে। “দেখুন আমরা অনেকটা নিশ্চিত, লেখক জায়েদ রেহমানকে খুন করা হয়েছে। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পেলে সেটা অবশ্য কনফার্ম জানা যাবে। আপনার কথা যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে তাকে হত্যা করল কে?” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারো বলে সে, “শয্যাশায়ী এক লোক এমন এক দিনে খুন হলেন যেদিন তার স্ত্রী নিজের প্রেমিককে নিয়ে পাশের ঘরে গোপন অভিসারে লিপ্ত। এক শ’জন লোককে এ ঘটনার কথা বললে তারা বলবে আপনি এবং আপনার প্রেমিকা মিলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।”

“কিন্তু—”

হাত তুলে বাধা দেয় জেফরি বেগ। বার বার ঐ এক কথা বলার কোনো দরকার নেই, মি. শফিক। আপনি যদি আমাদের কাছে সব স্বীকার না করেন তাহলে বেশ সমস্যায় পড়ে যাবেন। আপনাকে একটু সময় দেবো, এই সময়টাতে সিদ্ধান্ত নিন সব কিছু স্বীকার করবেন কি না। মিসেস রেহমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর আবার আপনার সাথে কথা বলবো।”

শফিক ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে কেবল। বর্ষাকে যে গ্রেফতার করা হবে তাতে অবাক হয়নি সে। তারপরও কথাটা শুনে সে বিমূঢ় হয়ে যায়। নিজের নিদোষিতার কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ায় তার মুখে আর কোনো রা নেই। বুঝে যায় মারাত্মক এক বিপদে পড়ে গেছে। ভয়ঙ্কর বিপদ।

.

অধ্যায় ১১

খুব সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস নেই আবেদ আলীর তারপরও আজ অনেক সকালেই উঠে পড়েছে। প্রথম কারণ ঘুম ভেঙে গেছে; তবে ইচ্ছে করলে আবার ঘুম দিতে পারতো, সেটা আর করেনি। ইচ্ছে করেই করেনি।

পঞ্চান্ন বছর বয়সে নতুন এক নেশায় আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতো তীব্র নেশা এই জীবনে কখনই আসক্ত হয়নি।

পঁচিশ বছর ধরে প্রকাশনা ব্যবসা নিয়ে আছে, বেশ নামও করেছে। দেশের অন্যতম বড় প্রকাশনী সংস্থা অবয়ব-এর সত্ত্বাধিকারী। তিন বছর ধরে বিপত্নীক। এক ছেলে, আজ তিন বছর ধরেই অস্ট্রেলিয়ায় সেটেল্ড। মায়ের মৃত্যুর পর পরই সে চলে যায় সেখানে। প্রথম বার দেশে এসে ঈদ করে গেছে, তারপর থেকে আর আসেনি। ওখানেই এক বাঙালী মহিলাকে বিয়ে করেছে।

লেখক-সাহিত্যিকদের সঙ্গে ওঠাবসা করেই আবেদ আলীর সময় কেটে যায় এখন। ব্যবসায় আর আগের মতো সময় দেয় না। পুরনো ব্যবসা, কর্মচারীরাই সব করে থাকে। তাছাড়া ইদানীং তার ব্যবসা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। দিনে দুয়েক ঘণ্টার জন্য গেলেও চলে, না গেলেও ক্ষতি নেই। ফোনে কাজ সেরে নেয়। অখণ্ড অবসর। সেই অবসর ঘোচাতেই এক জুনিয়র লেখক-বন্ধুর প্ররোচনায় ফেসবুক নামের আজব জিনিসের গাট্টায় পড়েছে সে। সেই সুবাদে ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি। এখন সেটা রীতিমতো আসক্তির পর্যায়ে চলে গেছে। সারাটা দিন এখন কেটে যায় কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে।

আজ থেকে আট মাসে আগে ফেসবুকে মিলি নামের আমেরিকা প্রবাসী এক মাঝবয়সি মহিলার সাথে তার পরিচয়। সেই পরিচয় এখন অনেক গভীরে চলে গেছে। অবশ্য ব্যাপারটা কেউ জানে না, জানার মতো খুব বেশি লোক তার কাছে থাকেও না। কাজের লোক ছাড়া এখন একেবারেই একা বসবাস করে সে।

ইদানিং সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুকে যাওয়াটা তার অভ্যেস হয়ে গেছে। মিলি থাকে আমেরিকার সিয়াটল শহরে। স্বামী আছে কিন্তু সম্পর্ক তেমন একটা ভালো না। এক মেয়ে ছিল, বিয়ে হয়ে গেছে। থাকে কানাডায়। ভালো একটা চাকরি করে মিলি। খুবই স্বাধীনচেতা। নিয়মিত বই পড়ে। সেই সুবাদে লেখকদের সাথে তার অনেক জানাশোনা। আবেদ আলীর সেই লেখক-বন্ধুর সুবাদেই মিলি প্রথম তাকে ফেসবুক থেকে ইনভাইটেশন পাঠায়। সেই থেকে তাদের পরিচয়।

মিলির কাছ থেকে গরম কিছু পাবার আশায় বিছানা ছেড়ে সোজা পিসির সামনে গিয়ে বসল আবেদ আলী। কম্পিউটারটা চালু অবস্থায়ই ছিল, গতকাল রাত দুটো পর্যন্ত চ্যাট করেছে তারা। মিলি বলেছিল আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই গরম একটা চিঠি পাবে সে। সেই চিঠি পাবার উত্তেজনায় বাকি রাতটা ঠিকমতো ঘুমও হয়নি আবেদ আলীর।

ফেসবুকে চ্যাট করা ছাড়াও মিলি তার জন্য প্রতিদিন ইয়াহু মেইলে বাঙলা চিঠি লেখে। ইন্টারনেটে কিভাবে বাঙলা চিঠি লিখতে হয় সেটা মিলির কাছ থেকে সে নিজেও শিখে নিয়েছে। প্রতিদিন একটা করে গরম চিঠি লেখে মিলি তার জন্য। সেই চিঠির ভাষা এমনই যে কাউকে সেটা বলা যায় না। তার যে বয়স তাতে করে এসব শুনলে লোকজন ভাববে সবই বিকৃত মানসিকতার লক্ষণ।

এ রকম একটি গরম চিঠির আশায় ইয়াহু মেইলটা ওপেন করে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারে সোজা হয়ে বসল সে। যথারীতি মিলি তাকে গরম একটি মেইল পাঠিয়েছে কিন্তু সেটা দেখে নয়, তার বিস্ময় অন্য একটা মেইল দেখে।

মিলির মেইলটার ঠিক নিচে আরেকটা মেইল দেখে রীতিমতো ভিমড়ি খেলো সে। চোখ দুটো কচলে নিয়ে ভালো করে দেখল আবার। না, ঠিকই আছে। শুধু মেইলই নেই, সাথে বিশাল সাইজের একটি অ্যাটাচমেন্ট ফাইলও রয়েছে। দারুণ অবাক হলো আবেদ আলী। এমন এক লোকের কাছ থেকে মেইলটা এসেছে যা সে কখনও চিন্তাও করেনি। মেইলটা পাঠানো হয়েছে গতকাল রাতে। নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে রাত আড়াইটার পর পরই। এটাও একটা অস্বাভাবিক ঘটনা। ভুতের কাছ থেকে মেইল পেলেও এতোটা অবাক হোতো না সে।

মিলির মেইলের কথা ভুলে গতরাতে পাঠানো সেই মেইলটা খুলল প্রকাশক সাহেব। এক ধরণের উত্তেজনা টের পাচ্ছে ভেতরে। মেইলটা যে লোক পাঠিয়েছে তার নাম দেখে যতোটা অবাক আর বিস্মিত হয়েছিল তারচেয়ে অনেক বেশি বিস্মিত হলো মেইলটা পড়ে।

প্রতিটি শব্দ তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। না। স্বপ্ন নয়, বানোয়াট। কেউ কি তার সাথে রসিকতা করছে? এ রকম একটা আশঙ্কাও তার মনে উঁকি দিল কয়েক মুহূর্তের জন্য তবে সেটা বাতিল করে দিল সেন্ডারের মেইল অ্যাকাউন্টটা দেখে।

বেঈমানটা কোন মতলবে এটা করেছে কে জানে!

এক ধরণের কাঁপুনি টের পেল নিজের ভেতরে। মেইলের কথাগুলো তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।

আর হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না!

মানে কি? কিন্তু অ্যাটাচমেন্ট ফাইলটা যখন ডাউনলোড করে ওপেন করল চেয়ার থেকে উঠে দু’হাত ঘষতে লাগল আনমনে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না।

এসব কি হচ্ছে!

আপনি যদি সকালে উঠে দেখেন কেউ আপনার ঘরে কোটি টাকা রেখে গেছে তাহলে বিস্মিত না হলে তো আপনাকে ডাক্তারই দেখাতে হবে। বুঝতে হবে আপনি স্বাভাবিক নন।

কিন্তু আবেদ আলী বেশ স্বাভাবিক একজন লোক। আর সেজন্যেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল সে, সেই সাথে লটারি পাওয়া কোনো ব্যক্তির

মতো আনন্দে অস্থির আর চঞ্চল।

.

অধ্যায় ১২

হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ইন্টেরোগেশন সেলে জমজমাট নাটক চলছে। ডিপার্টমেন্টের প্রায় সবাই নিজের কাজ ফেলে সেই নাটক দেখার জন্য উসখুশ করলেও পাঁচ জন ব্যক্তি ছাড়া কারো পক্ষে সেই নাটক স্বচক্ষে দেখা সম্ভব হচ্ছে না।

মেইন ইন্টেরোগেশন রুমে আছে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগ আর ইন্সপেক্টর জামান, তবে একমুখী আয়নার ওপাশে ছোট্ট কক্ষে আরো তিনজন ব্যক্তি রয়েছে : পলিগ্রাফ টেস্ট অপারেটর মুরাদ, অবজাভার হিসেবে সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর রমিজ লস্কর আর ডিপার্টমেন্ট প্রধান ফারুক আহমেদ।

ফারুক সাহেব অবশ্য কৌতূহলবশত এসেছে। লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ড নিয়ে সে খুব আগ্রহী। ট্যাবলয়েড পত্রিকায় ছাপা হতে যাওয়া রসালো খবরটা আগেভাগে দেখে নেয়ার দুর্লভ সুযোগ হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। তার এই উপস্থিতির কারণেই ডিপার্টমেন্টের বাকিরা নিজেদেরকে সংযত রাখতে বাধ্য হয়েছে, নইলে এই ছোট্ট কক্ষে সবাই হুমরি খেয়ে পড়তো।

এইমাত্র দিয়ে যাওয়া গরম গরম চায়ে চুমুক দিল ফারুক সাহেব। তবে তার চোখ সামনের বিশাল আকারের আয়নাটার দিকেই নিবদ্ধ। যেন সিনেমা হলে বসে কোনো ছবির টান টান উত্তেজনার দৃশ্য দেখছে।

.

জেফরি বেগ ঘড়ির দিকে তাকাল। দশটা বাজে। সকালের নাস্তা যে খাওয়া হয়নি সেটা ভুলেই গেছিল। এখন পর্যন্ত দু’গ্লাস পানি আর এক কাপ চা তার পেটে পড়েছে।

তার সামনে বসে আছে মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক আলম শফিক। দু’জনেই মাথা নিচু করে রেখেছে। তবে দু’হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে ভদ্রমহিলা।

জেফরির পাশে বসে আছে জামান। নিজের বসের উপস্থিতিতে খুব একটা কথা বলে না সে।

মাত্র বিশ মিনিট আগে মিসেস রেহমানের সামনে আলম শফিককে হাজির করা হয়েছে। তারা দুজনেই নিজেদের আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভেবে একেবারে মুষড়ে পড়েছে এখন। কেউ কাউকে না চেনার ভান করেনি, সব কিছু মেনে নিয়েছে, শুধু একটা বিষয় বাদে : জায়েদ রেহমানকে তারা কেউ খুন করেনি।

জেফরির কাছে অবশ্য এটা নতুন কিছু নয়। খুনিরা এতো সহজে খুনের কথা স্বীকার করে না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় তবে এটাই হলো সাধারণ চিত্র।

মিসেস রেহমানকে প্রশ্ন করার আগে ঘরের বিশাল আয়নাটার দিকে আড়চোখে তাকাল বেগ। সে জানে ওপাশে বসে আছে তার বস ফারুক সাহেব।

“তাহলে আপনাদের এই সম্পর্কটা অনেক দিন থেকেই চলছে?” ভিটা নুভায় লুকিয়ে লুকিয়ে অভিসারের কথা ইঙ্গিত করল জেফরি।

তারা দুজনে কিছু বলল না।

“আপনাদের পরিচয় কতো দিনের?”

শফিকই জবাব দিল। “দু’বছর।”

“জায়েদ সাহেব কতো দিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন?”

আলম শফিক তার পাশে বসা বর্ষার দিকে তাকালেও মহিলা মাথা নিচু করেই জবাব দিলেন, “আট মাস ধরে।”

“আপনাদের এই সম্পর্কের কথা আর কে জানে? মানে, আপনাদের দু’জনের ঘনিষ্ঠ লোকজনের কথা বলছি।”

মহিলা মাথা নাড়ল।

“কেউ না!” জেফরি অবাক হয়ে বলল। শফিকের দিকে তাকাল সে।

সেও মাথা নেড়ে একই জবাব দিল।

“ভালো। মিসেস রেহমান, আপনার কি মনে হয়, যখন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তখন শফিক সাহেব জায়দে রেহমানের ঘরে গিয়ে থাকতে পারে? তার ঘরটা তো আপনার ঘরের ঠিক পাশেই। এমনও তো হতে পারে আপনি যখন ঘুমিয়ে পড়লেন তখন…?”

আলম শফিকের চোখেমুখে ঘাবড়ে যাবার স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মিসেস রেহমান এমনভাবে মুখ তুলে তাকালেন যেন কথাটা তার মাথায় না এলেও এখন এটাকে একটা সম্ভাবনা হিসেবে দেখছে।

“গুড!” আয়নার ওপাশে বসে থাকা ফারুক সাহেব তার পাশে বসে থাকা দু’জন অধস্তন কর্মচারীর দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে বলল। “ডিভাইড অ্যান্ড…” কোটেশনটা ভুলে গেল, আর বলতে পারল না। বুঝতে পারল অন্য একটা বিখ্যাত কোটেশনের সাথে গুলিয়ে ফেলেছে।

“মিসেস রেহমান?” তাড়া দিল জেফরি বেগ।

মহিলা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাল আলম শফিকের দিকে। এরই মধ্যে ছেলেটার কপালে ঘাম জমতে শুরু করেছে। আমি বলতে পারবো না।”

“ভালো করে মনে করে দেখুন। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন..শফিক সাহেব। সেই সুযোগে ঘর থেকে বের হয়ে কাজটা করে এল। এটা কি হতে পারে না?”

মিসেস রেহমান যে সন্দেহের ঘূর্ণিতে পড়ে গেছে, এটা বুঝতে পারছে বেগ।

আলম শফিক অস্থির হয়ে উঠল। “স্যার, বিশ্বাস-”

এবার জামান হাত তুলে মাঝপথে তাকে থামিয়ে দিল।

“অস্থির হবেন না। আমাদের হাতে চারটা সম্ভাবনা রয়েছে : এক, আপনি খুনটা করেছেন। দুই, মিসেস রেহমান সেটা করেছেন। তিন, আপনারা দুজনে মিলে কাজটা করেছেন পরিকল্পনা করে। আর চার নাম্বারটা খুব দুর্বল বলে মনে হচ্ছে এখন : গৃহপরিচারিকা কিংবা হাউজ-নার্সও কাজটা করে থাকতে পারে।”

সম্ভাবনার কথাগুলো শুনে মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিকের গলা শুকিয়ে এল।

“অপশন দেয়া হচ্ছে,” ফারুক সাহেব ফিসফিস করে পাশের জনকে কথাটা বলল যদিও তার কোনো দরকার নেই। কারণ এই ঘরের কোনো কথা ইন্টেরোগেশন রুমে শোনা যাবে না। দেখা যাক টোপটা প্রথমে কে গেলে!”

মিসেস রেহমানই টোপটা আগে গিলল। নিজের প্রেমিকের দিকে তাকিয়ে বলল : “তুমি তো মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে…সিগারেট খাওয়ার জন্য বেলকনিতে গিয়েছিলে…তাই না!”

“হ্যাঁ, হা,” অসহায়ের মতো বলল আলম শফিক। “শুধু বেলকনিতে গেছি, ঘরের বাইরে যাইনি। বিশ্বাস করো!”

ঠিক এ সময় জেফরি বেগ ঢুকে পড়ল তাদের মধ্যে। “এই ঘটনাটা কখন ঘটেছিল, মিসেস রেহমান?”

একটু ভেবে মহিলা বলল, “সেটা তো বলতে পারবো না। তবে দ্বিতীয়বার যখন পুলিশ এল তখন।”

“আপনি কিন্তু বলেছিলেন শেষবার পুলিশের আগমন ছাড়া বাকি দু’বারের ঘটনা আপনি টের পাননি। ঘুমিয়ে ছিলেন, জেফরি স্থির চোখে বলল কথাটা।

ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল মহিলা।

“আপনি অনেক মিথ্যে কথা বলছেন, মিসেস রেহমান। এই ইন্টেরোগেশন রুমে মিথ্যে বললে আপনার কোনো লাভ তো হবেই না বরং

অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। এটা আপনি ঠিক করছেন না।”

আয়নার ওপাশে বসে থাকা পলিগ্রাফ টেস্ট অপারেটর মুরাদ জানে জেফরি বেগ কথাটা ঠিক বলেনি। তার সামনে থাকা ফলাফল একেবারেই অন্য রকম। মি. জেফবিআই, এই কেসটা আপনাকে ভোগাবে, মনে মনে বলল মুরাদ।

“আপনি ঘুম থেকে উঠে বেলকনিতে গিয়েছিলেন কেন?” জেফরি প্রশ্ন করল আলম শফিককে।

“সিগারেট খেতে।”

“অতো রাতে ঘুম থেকে উঠে সিগারেট খাওয়ার জন্য বেলকনিতে গেলেন!”

“না, মানে ঘরের মধ্যে সিগারেট খাওয়াটা বর্ষা পছন্দ করে না,” শফিক কথাটা বলেই বর্ষার দিকে তাকাল। “তাই না, বর্ষা?”

মহিলা মাথা নিচু করে রাখল, কোনো জবাব দিল না।

পালাক্রমে তাদের দু’জনের দিকে তাকিয়ে জেফরি বেগ বলল, “আপনার সাথে আর কে কে ছিল?”

হকচকিয়ে গেল শফিক। “আমার সাথে…মানে…কি বলছেন, স্যার!”

“আপনি যখন সিগারেট খাওয়ার জন্য বেলকনিতে গেলেন ঠিক তখন নিচের রাস্তার ফুটপাতে আরেকজন যুবক ছিল। ছেলেটা গভীর মনোযোগ দিয়ে এই অ্যাপার্টমেন্টের দিকেই তাকিয়ে ছিল বলে আমাদের কাছে খবর আছে।”

মিসেস রেহমান অবিশ্বাসে তাকাল তার প্রেমিকের দিকে।

“বিশ্বাস করেন, স্যার, আমার সাথে কেউ ছিল না। বিশ্বাস করেন…” কাঁদো কাঁদো গলায় বলল আলম শফিক।

“সেই ছেলেটা কে?” মিসেস রেহমান জানতে চাইল বেগের কাছে। তার চোখেমুখে তীব্র অবিশ্বাস।

“সেটা আলম শফিক সাহেবই ভালো বলতে পারবেন। তবে মনে হচ্ছে। উনি খুব সহজে বলবেন না। কী আর করা…আমদের কাছে সব স্বীকার না করলে আপনাদেরকে পুলিশ রিমান্ডে দেয়া হবে। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি, তারা আপনাদের সাথে এ রকম ভদ্র ব্যবহার করবে না।”

.

অধ্যায় ১৩

আবেদ আলী টয়লেট থেকে বের হয়ে এল ফুরফুরে মেজাজে। আজ আর ঘরে তৈরি নাস্তা খাবে না। তার পছন্দের রেস্তোরাঁয় গিয়ে কলিজার ভুনা আর পরোটা খাবে। ভাবতেই মুখে পানি এসে গেল। খাদ্যরসিক হিসেবে তার খ্যাতি আছে।

নাস্তা করার আগে এক কাপ চা খেয়ে নেবে। এটা তার প্রতি দিনকার অভ্যাস। খালি পেটে চা না খেলে ভালো লাগে না। নাস্তার পরও অবশ্য আরেক দফা চা হবে। সকালের পত্রিকাটা ড্রইং রুমের টেবিলে রাখা আছে। এক হাতে সেটা তুলে নিয়ে অন্য হাতে রিমোটটা দিয়ে টিভি ছেড়ে আরাম করে বসে পড়ল সোফায়। শিষ বাজিয়ে বিটোফেনের ঔড টু জয় তোলার চেষ্টা করল ভুলভালভাবে।

কাজের ছেলেটা চা দিয়ে গেলে আবেদ আলী শিষ বাজাতে বাজাতে কাপটা তুলে নিয়ে টিভির চ্যানেলটা বদলে একটা দেশি চ্যানেলে সুইচ করল। পত্রিকায় কোনো খবর নেই। গুলি খেয়ে কেউ মরেনি। লঞ্চ ডুবির ঘটনাও ঘটেনি। আর রাজনীতিবিদেরাও কোনো বাকবিতণ্ডায় জড়ায়নি। গতকাল সাংবাদিকদের জন্য একটা বাজে দিন গেছে।

তারপরও তার চোখ ঘুরে বেড়াচ্ছে পত্রিকায়। চায়ের কাপে মাত্র চুমুক দেবে ঠিক তখনই টিভির একটা খবর শুনে পত্রিকা থেকে চোখ তুলে সেদিকে তাকাল আবেদ আলী।

ব্রেকিং নিউজ!

পত্রিকাটা একপাশে রেখে হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে রইল সে। খবরটা শোনার পর ঔড টু জয় বাজানোটা নির্মম পরিহাস বলেই মনে হচ্ছে তার কাছে।

অল্পবয়সি সংবাদ পাঠিকা যে সংবাদটি পড়ে শোনাচ্ছে সেটা তার কাছে এতোটাই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে যে, হাতের চায়ের কাপটা আরেকটু হলে হাত থেকে পড়েই যেতো।

হায়! হায়!

আবেদ আলীর বুকটা ধরফর করে উঠল। সকালের যে অবিশ্বাস্য একটা মেইল পেয়ে এতোক্ষণ ধরে ফুরফুরে মেজাজে ছিল সেটা নিমেষে তিরোহিত হয়ে গেছে।

আধ ঘন্টার মধ্যে একটা লটারি পেয়ে সেটা নস্যাৎ হতে দেখলে যে কারোরই হৃদপিণ্ড বন্ধ হবার কথা। আবেদ আলীরও মনে হলো তার বুকের বাম পাশটায় চিন চিন করে ব্যথা করছে।

বেঈমানটা…!

.

অধ্যায় ১৪

সারা দেশে একটা সংবাদ সুনামির মতো ছড়িয়ে পড়েছে : জনপ্রিয় লেখক জায়েদ রেহমান খুন হয়েছেন!

এই সংবাদটি প্রথম দিতে পেরেছে চ্যানেল সিক্সটিন নামের নতুন একটি টিভি স্টেশন। তবে কিভাবে তারা এ রকম একটি এক্সক্লসিভ নিউজ সবার আগে জানতে পারল সেটা একটা রহস্যই বটে।

তারা সরাসরি লেখক জায়েদ রেহমানের বাড়ির সামনে থেকে লাইভ রিপোটিং দেখিয়ে যাচ্ছে এখন। অবশ্য দেশের বাকি টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র এমনকি বেশ কয়েকটি এফএম রেডিও প্রচার করে যাচ্ছে খবরটা। একযোগে মাঠে নেমে পড়েছে সবাই।

একটা ইঁদুর দৌড় শুরু হয়ে গেছে বলা যায়।

নিহত লেখকের বাড়ির ভেতরে সাংবাদিকদের কেউ প্রবেশ করতে না পারলেও তারা বাইরে থেকে যে যার মতো করে সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছে। প্রত্যেকের কাছেই একটা করে নতুন খবর আছে। আছে অন্য রকম তথ্য।

ভিটা নুভার সামনে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে যারা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার তারা অবজ্ঞার চোখে না দেখলেও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিকেরা টেকনিক্যাল কারণেই একটু আপসেট হয়ে আছে।

ওরা লাইভ দেখাচ্ছে।

কিন্তু আমাদেরটা আগামীকালের আগে মুখ দেখবে না।

ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার নাক উঁচু সাংবাদিকেরা বেশ ভালো মতোই উপভোগ করছে এই ব্যাপারটা। এক ধরণের করুণার প্রকাশ দেখা যাচ্ছে তাদের আচরণে।

শতশত সাংবাদিক আর হাজার হাজার মানুষ। সেই সাথে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের ভিড়ের কারণে ভিটা নুভার সামনে দিয়ে সব ধরণের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ভিড় সামাল দিতে আরো পুলিশের দরকার বলে হেডকোয়াটারে খবর দেয়া হয়েছে একটু আগে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে। লেখক জায়েদ রেহমানের অল্পবয়সি পাঠকেরা এখনও ভিড় করতে শুরু করেনি। তারা এলে কী হবে কে জানে।

একটা স্কুপ আর এক্সকুসিভ পাবার জন্য সাংবাদিকের দল এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। যাকে তাকে ধরে ইন্টারভিউ নিচ্ছে তারা। এই সুযোগে কিছু জানে না এমন লোকও দিব্যি টিভি ক্যামেরার সামনে অনেক কথা বলে চলেছে। তাদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে লেখক জায়েদ রেহমানকে তাদের। সামনেই হত্যা করা হয়েছে কিংবা এ রকম একটা ঘটনা যে ঘটবে সেটা তারা আগেই টের পেয়েছিল।

“এই ভবনের ছয় তলার…ঐ কর্নার ফ্ল্যাটে লেখক জায়েদ রেহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে,” চ্যানেল সিক্সটিন-এর অন্যতম প্রতিপক্ষ একটি টিভি চ্যানেলের উঠতি বয়সি সাংবাদিক ভিটা নুভার দিকে লুক দিয়ে ক্যামেরার সামনে বলল। তার চারপাশে হাজার হাজার মানুষের ভিড়টাকে কোনো রকম আমলেই নিচ্ছে না সে। “আমরা জানতে পেরেছি নিহত লেখকের স্ত্রী আর তার প্রেমিককে সিটি হোমিসাইড গ্রেফতার করেছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ এখনও এ ব্যাপারে মুখ খুলছে না। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে…” এক উজবুক টাইপের কৌতূহলী দর্শক রিপোর্টারকে আলতো করে ধাক্কা মেরে উদাস ভঙ্গিতে চলে গেলে রিপোটার নিজেকে সামলে নিয়ে আবার বলতে লাগল…”লেখকের স্ত্রীর সেই প্রেমিক প্রবরটি হলেন তরুণ নাট্য নির্মাতা আলম শফিক।”

আশেপাশের লোকজন বুঝে গেছে এই রিপোটার লাইভ রিপোর্ট করছে, ব্যস! সাংবাদিকের চারপাশে শত শত লোক নিজেদের চেহারা দেখানোর জন্য হুমরি খেয়ে পড়লে বেচারা সাংবাদিকের অবস্থা নাকাল হয়ে গেল। কিন্তু সেই অবস্থায়ই রিপোর্ট করে গেল ছেলেটা।

পাভেল আহমেদ নামের দৈনিক দেশবিদেশ পত্রিকার সাংবাদিক ভিটা নুভার সামনে এসে দাঁড়াল। তার মধ্যে রিপোর্ট করবার কোনো তাড়া নেই। অনেকটা অলসভঙ্গিতে তাকাল ভিটা নুভার দিকে।

তার পিঠে আলতো করে কে যেন চাপড় মারলে পেছন ফিরে দেখতে পেল তার পরিচিত এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার দাঁত বের করে হাসছে। “এতো দেরি করলে?”

পাভেল আহমেদ মুচকি হাসল। “আমি তো আর এখন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করি না। দেরি করে এলে সমস্যা কি?”

“তা ঠিক। তুমিই ভালো আছে। আর আমাকে দ্যাখো, নাস্তাও করতে পারিনি। ছুটে এসেছি এখানে।”

“আমি তো আসতে চাইনি। এডিটর বললেন ঘটনাস্থলে যেতেই হবে।”

“তা আসতে চাইবে কেন! আমাদের রিপোর্টগুলো এদিক ওদিক করে ছাপিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। আছো তো সুখে,” ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক পকেট থেকে দুটো সিগারেট বের করে একটা বাড়িয়ে দিল পাভেল আহমেদের দিকে।

সিগারেটটা হাতে নিয়ে পাভেল আহমেদ ভিটা নুভার দিকে তাকিয়ে বলল, “এক্সকুসিভ কিছু পেলে?”

“মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক আলম শফিক গ্রেফতার হয়েছে। আপাতত এটাই আমাদের এক্সক্লসিভ।”

পাভেল আহমেদ ভুরু কুঁচকে তাকাল সাংবাদিকটির দিকে। “এটা তো আমি বাসায় বসে টিভিতেই শুনে এলাম। এরচেয়ে বেশি কিছু জানতে পারোনি?”

ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিক মাথা নেড়ে জবাব দিল। “নিউজ প্রডিউসার বার বার ফোন করে তাড়া দিচ্ছে নতুন কিছু দেবার জন্য। চ্যানেল সিক্সটিন তো আজকে ছক্কা মেরে দিয়েছে। এখন আমাদেরকে একটা কিছু করতেই হবে। কিন্তু চাইলেই কি এক্সকুসিভ কিছু পাওয়া যায়?”

পাভেল আহমেদের মাথায় চট করে একটা আইডিয়া চলে এল। একটু চুপ করে থেকে বলল, “চেষ্টা করে দ্যাখো কিছু পাও কি না।”

“আরে আমি চাইলেই কি পাবো! এক্সকুসিভ ঘটনা তো ঘটতে হবে, না কি?”

মাথা নেড়ে সায় দিল পাভেল। “আমি যাই। সিগারেটের জন্য ধন্যবাদ।”

“চলে যাবে?” বিস্মিত হলো সাংবাদিক।

“এখানে আমার কোনো কাজ নেই। খামোখাই এসেছি। এডিটরের কথা। রাখলাম আর কি।”

“রিপোর্ট করবে না?”

পাভেল আহমেদ মুচকি হেসে বলল, “রিপোর্টের কিছু বাকি রেখেছো তোমরা! সবই তো দেখিয়ে দিয়েছে।”

“নতুন কোনো ডেভেলপমেন্টও তো হতে পারে।”

“মনে হয় না। মাত্র তো গ্রেফতার করা হয়েছে। তাছাড়া আসামীরা কোনো জবানবন্দি দিলেও আমরা সেটা দু’এক দিনের আগে জানতে পারবো না।”

“তা ঠিক…”

অনেকটা হুট করেই পাভেল আহমেদ তাকে বলল, “তোমার জন্য একটা এক্সকুসিভ আইটেম আছে, অবশ্য তুমি যদি সেটা চাও তো…”

“মানে? কিসের এক্সক্লসিভ?”

মুচকি হাসল পাভেল। একটু কাছে এসে কাঁধে হাত রেখে ফিস ফিস করে সংক্ষেপে জানাল সেটা কি। কথাটা শুনেই সাংবাদিকের চোখ দুটো চক চক করে উঠল।

“নিয়ে আসো। এক্ষুণি নিয়ে আসো।”

“তার আগে তুমি আমাকে কনফার্ম করো তোমরা নেবে কি না,” বলল পাভেল আহমেদ।

“আমি ফোন করে নিউজ প্রডিউসারকে জানাচ্ছি, তুমি ওটা নিয়ে আসো।”

“ঠিক আছে আমি বাসায় যাচ্ছি। তুমি এখনই ফোন করে জেনে নাও।”

কথাটা বলেই পাভেল আহমেদ ভিড় ঠেলে চলে গেল।

.

অধ্যায় ১৫

জেফরি বেগের টোপটা ঠিকঠাকমতোই গিলেছে মিসেস রেহমান। মহিলা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে তার প্রেমিককে। জেফরিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে সে : প্রথমবার মিলনের পর তারা দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লে মাঝরাতে মিসেস রেহমানের ঘুম ভেঙে যায়, সে দেখতে পায় বিছানায় আলম শফিক নেই। পরে বেলকনি থেকে বেরিয়ে আসে শফিক। মহিলা নিশ্চিত করে বলতে পারেনি ঠিক কখন শফিক বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়েছিল।

ওদিকে আলম শফিক বিরক্তিকরভাবেই নিজের নির্দোষিতার কথা বলে গেছে। ব্যাপারটা বেগের কাছে অসহ্য লেগেছে এক পর্যায়ে।

সিগারেটের তেষ্টা পেলে সে না কি বেলকনিতে গিয়ে সিগারেট ধরিয়েছিল আর তখনই অ্যাপার্টমেন্টের সামনে পুলিশের গাড়ি থামতে দেখে ভয়ে ঘরের ভেতরে চলে যায়।

দেড় ঘণ্টার জেরায় অনেক তথ্য দিলেও হত্যার কথা তাদের কেউই স্বীকার করেনি। কিন্তু পরিস্থিতি এমনই যে, এ দুজন ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডটি যে অন্য কেউ ঘটায়নি সেটা মোটামোটি নিশ্চিত।

প্রচণ্ড ক্ষুধার কারণে জেফরি দেড় ঘণ্টা জেরা করে কোনো রকম স্বীকারোক্তি ছাড়াই ইন্টেরোগেশন পর্ব শেষ করেছে। এর অবশ্য কারণও রয়েছে। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্ট তদন্তের স্বার্থে যে কাউকে রিমান্ডে নিতেও পারে নাও নিতে পারে, এটা তাদের ইচ্ছের উপর নির্ভর করে কিন্তু পুলিশ রিমান্ড থেকে কারোর রেহাই নেই। তাছাড়া বেগের কাছে মনে হয়েছে আপাতত এরচেয়ে বেশি মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক বলবেও না।

জেফরির ইচ্ছে ছিল ইন্টেরোগেশন রুম থেকে বের হয়ে বাইরে গিয়ে একটু খেয়েদেয়ে আসবে কিন্তু সেটা আর হয়নি। রুম থেকে বের হতেই তার ডাক পড়ে মহাপরিচালকের রুমে।

এখন সে বসে আছে মহাপরিচালক ফারুক আহমেদের ডেস্কের বিপরীতে।

“ওরা স্বীকার করুক আর নাই করুক তাতে কিছু যায় আসে না,” ফারুক সাহেব বলল। তাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। কেন দেখাচ্ছে জেফরি সেটা আন্দাজ করতে পারল। “এটা নিশ্চিত, ওই মহিলা আর তার প্রেমিক পরিকল্পনা করেই খুনটা করেছে। পুরো ঘটনাটা একেবারে পানির মতোই পরিস্কার।”

জেফরি কিছু বলল না। তার খিদেটা এখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। ডেস্কে রাখা এক গ্লাস পানি আছে, সেটা তুলে নিলো।

“অসাধারণ কাজ করেছে। আমি খুবই খুশি। একেবারে ঘটনাস্থল থেকে একজন সাসপেক্টকে অ্যারেস্ট করা…মাইগড! তোমার উপর আমার বরাবরই আস্থা আছে। তুমিও সেটা জানো।”

পানিটুকু এক ঢোকে খেয়ে গ্লাসটা রেখে বলল জেফরি, “ধন্যবাদ স্যার।”

“প্রেস তো জ্বালিয়ে খাচ্ছে,” ফারুক সাহেব জেফরির উপর থেকে চোখ সরালো না। “একটা ইন্টারভিউ দিয়ে দাও।”

“ইন্টারভিউ?” বেগ আৎকে উঠল।

“হ্যাঁ।আরে সবাই তো এ রকম সুযোগের জন্য মুখিয়ে থাকে। তাছাড়া এতোবড় একটা ঘটনা, সবাই জানে তোমার কারণেই এতো দ্রুত খুনিকে ধরা গেছে। তোমাকেই চাইছে সবাই।”

“স্যার, আপনি তো জানেন আমি প্রেসকে ফেস করতে পারি না। ইচ্ছেও করে না। আপনি দেন। ডিপার্টমেন্টের হেড হিসেবে আপনারই দেয়া উচিত।”

ফারুক সাহেব একটু সামনে ঝুঁকে এল। “আমি তো দেবোই। বলছিলাম কি, তুমিও একটা দাও।”

“না, স্যার। এ ব্যাপারে আমাকে মাফ করবেন।” একটু থেমে বেগ প্রসঙ্গ পাল্টাল। “স্যার, পলিগ্রাফ টেস্টের খবরটা জানা দরকার।”

“ওহ, হাঁ।ভুলেই গেছিলাম।” ফারুক সাহেব ইন্টারকমটা তুলে তার পিএ’কে বলল রমিজ লস্করকে এক্ষুণি তার অফিসে চলে আসার জন্য।

“হোমমিনিস্টার তো খুব খুশি,” ইন্টারকমটা রেখে নিজের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল ফারুক সাহেব।

“তাই না কি,” ছোট্ট করে বলল বেগ।

“নিজে আমাকে ফোন করে বলেছেন। বুঝলে না, ঐ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির চাপে ছিলেন। আমাদের চেয়ে উনার খুশিটাও কম নয়।”

“স্যার, আসবো?”

দরজার কাছ থেকে একটা কণ্ঠ বলে উঠলে ফারুক সাহেব আর জেফরি বেগ দু’জনেই সেদিকে তাকাল। রমিজ লস্কর।

“আসো, একটা চেয়ারের দিকে ইশারা করে তাকে বসতে বলল ফারুক সাহেব।

“পলিগ্রাফ টেস্টের রিপোর্টটা কি?” রমিজকে বলল বেগ।

গাল চুলকে তাদের দুজনের দিকে একবার চেয়ে নিলো রমিজ। “রিপোর্ট ভালো না, স্যার।”

“মানে?” ফারুক আহমেদ বিস্মিত হলো।

“সাসপেক্টরা খুব কমই মিথ্যে বলেছে। মহিলা প্রথম দিকে মিথ্যে বললেও শফিক সাহেবের মুখোমুখি করার পর তেমন কোনো মিথ্যে কথা বলেনি। সবচাইতে আশ্চর্যের বিষয় হলো শফিক সাহেব কোনো মিথ্যেই বলেনি।”

“কি!” ফারুক সাহেব আবারো অবাক হলো। তবে বেগ কিছু বলল না।

“আমিও খুব অবাক হয়েছি,” রমিজ লস্কর বলল।

“মেশিনটা ঠিকমতো কাজ করেছো তো?” সন্দেহ করল মহাপরিচালক।

“জি স্যার। একদম ঠিক আছে।”

“মিথ্যে বলেনি!?” এই প্রথম বেগ জানতে চাইল। তাকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছে।

মাথা নেড়ে সায় দিয়ে বলল রমিজ লস্কর, “ভাইটাল প্রশ্নগুলোতে মিথ্যে বলেনি।”

“পলিগ্রাফ টেস্ট অবশ্য আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এটা কেবলই আমাদের ইন্টেরোগেশন টুলগুলোর একটি। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। পুলিশ রিমান্ডে ওরা সব স্বীকার করবে,” ফারুক সাহেব আশ্বস্ত করে বলল।

“তা ঠিক,” সমর্থন করল রমিজ লস্কর।

“স্যার, আদালতে গ্রহণযোগ্য না হলেও পলিগ্রাফ টেস্ট কিন্তু খুব নির্ভরযোগ্য। অন্তত আমরা তাই দেখে আসছি। এখন পর্যন্ত এটা ভুল প্রমাণিত হয়নি,” বেগ বলল।

“ব্যতিক্রম তো হতেই পারে। পারে না? ভুলে যাবে না, পলিগ্রাফ টেস্ট হান্ড্রেড পার্সেন্ট ফুলফ নয়। আর এজন্যেই এখনও পৃথিবীর কোথাও আদালতের কাছে এটা স্বীকৃত হয়নি।”

বেগের চেহারা দেখে মনে হলো না সে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারছে। তবে এটাও ঠিক, কথাটা মিথ্যে নয়। খুব বিরল প্রকৃতির মানুষ পলিগ্রাফ টেস্টকে ধোঁকা দিতে পারে। যারা এটা নির্মাণ করেছে তারাই এ রকম কথা স্বীকার করে। কিন্তু জেফরি বেগ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না ঐ মিসেস রেহমান আর তার প্রেমিক সেই রকম বিরল কোনো ব্যক্তি।

একই দিনে দুদুজন বিরল ব্যক্তি?

অসম্ভব!

.

অধ্যায় ১৬

হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের কেন্টিনটা ছয় তলা ভবনের একেবারে উপরে অবস্থিত। বিশাল ভবনের ছাদের এক তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে এই কেন্টিনটি জেফরি বেগের একটি প্রিয় জায়গা।

সব সময় এক কোণের একটি টেবিলে বসে চা-নাস্তা খেলেও আজকে আর সম্ভব হলো না। কেন্টিনে ঢোকার পর পরই ডিপার্টমেন্টের সবাই তাকে জেঁকে ধরল। আজকের সাফল্যে কগ্রাচুলেন্স জানাল তাকে। এমন কি যেসব সহকর্মী তাকে ঈর্ষা করে, আড়ালের আবডালে উল্টাপাল্টা কথা বলে তারাও মুখে কৃত্রিম হাসি এটে জেফরিকে সাধুবাদ জানাতে বাধ্য হলো।

সবার কৌতূহল যতোটা সম্ভব মিটিয়ে অবশেষে কেন্টিনের এক কোণে তার পছন্দের টেবিলে বসতে পারল জেফরি। পেটে ক্ষিধে থাকলেও মাথায় তার অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, তাই বেয়ারাকে খাবারের অর্ডার দিতে ভুলে গেল।

ইন্টেরোগেশন রুম থেকে বের হয়ে ফারুক সাহেবের রুমে যাবার আগে সহকর্মী জামানকে ভিটা নুভায় পাঠিয়েছে সে। লেখক জায়েদ রেহমানের ঘরের অনেক কিছু জব্দ করতে হবে : লেখকের ব্যক্তিগত ডায়রি-যদি থেকে থাকে, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, ব্যক্তিগত জিনিসপত্র।

সবাই খুশি হলেও জেফরি বেগের মনে একটা খটকা লেগে আছে। সে এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। পুরো ব্যাপারটা ভালো করে খতিয়ে দেখতে হবে। সত্যি বলতে কি এই কেসটা নিয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামালেও দ্রুত সাফল্য পেয়ে গেছে। তবে এখন তার কাছে মনে হচ্ছে কেসটা নিয়ে আরো বেশি সিরিয়াস হওয়া দরকার ছিল। জগিং থেকে ক্রাইম সিনে চলে আসাতে মানসিকভাবে প্রস্তত ছিল না। যতোটা সহজ বলে মনে করেছিল কেসটা বোধহয় ততোটা সহজ নয়। আবার এটাও ঠিক, পলিগ্রাফ টেস্টের ফলাফল থেকে এখনই কোনো সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবার জন্য তার হাতে যথেষ্ট সময় আছে। হঠাৎ তার ভাবনায় ছেদ পড়ল এডলিন ডি কস্তার আগমনে।

আলম শফিককে গ্রেফতার করার একটু আগে থেকেই এডলিনের সাথে আর কথা হয়নি তার।

এই মেয়ে যখনই কেন্টিনে আসে তখনই ডিপার্টমেন্টের পুরুষ সহকর্মীদের ঘাড় বেঁকে যায়। এজন্যে অবশ্য কাউকে দোষ দেয় না বেগ। মেয়েটা দেখতে খুবই আকর্ষণীয়।

জেফরি একটু নড়েচড়ে বসল, কারণ এডলিন তার কাছেই আসছে।

“কংগ্রাচুলেন্স, স্যার, মিষ্টি করে হেসে বলল সে।

“থ্যাংকস।” জেফরি এরপর কি বলবে বুঝতে পারল না। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ করেই তার মনে হলো তাকে বসতে বলা উচিত। “বসুন।”

“থ্যাংকস।” একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল এডলিন।

অস্বস্তিতে পড়ে গেল বেগ। দু’জন অবিবাহিত নারী-পুরুষ একসাথে বসবে আর ডিপার্টমেন্টে এ নিয়ে কোনো মুখরোচক গল্প হবে না তাতো হতে পারে না। ইতিমধ্যেই আশেপাশের টেবিলে ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে।

“ভিটা নুভা থেকে কখন ফিরলেন?” বেগ জানতে চাইল।

“ঘণ্টাখানেক আগেই। এলিমেনেশন প্রসেস এখনও করিনি। সেটার কি দরকার আছে?” বলল এডলিন।

একটু ভেবে নিলো বেগ। “না। আমরা যাকে গ্রেফতার করেছি সে স্বীকার করেছে রাতে অ্যাপার্টমেন্টেই ছিল।”

“আমি সেজন্যে প্রসেস করিনি।” এডলিন একটু থামল। “স্যার কি কিছু খাবেন? চা?”

“চা? না। আমি তো এখনও নাস্তাই করিনি। প্রচণ্ড ক্ষিধে পেয়েছে।”

“এখনও নাস্তা করেননি?” এডলিন কৃত্রিম বিস্ময়ে বললে ব্যাপারটা বেগও টের পেল। “আরেকটু পরে তো লাঞ্চের সময় হয়ে যাবে।”

“হ্যাঁ,” অন্যমনস্কভাবে বলল জেফরি।

“স্যার!” একটা জোড়াল কণ্ঠের কারণে জেফরির অন্যমষ্কভাবটা কেটে গেল। সাবের কামাল তার টেবিলের দিকে আসছে হাসিমুখে। কাছে এসে জেফরির হাতটা ধরে সে বলল, “আপনি তো দারুণ কাজ করেছেন। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। নিচে দেখে এলাম চার-পাঁচজন টিভি রিপোর্টার ঘুরঘুর করছে। আমার কাছে আপনার কথা জানতে চাইল। ওদের কাছে আপনি এখন হটকেক।” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে এডলিনের দিকে তাকাল সাবের কামাল।

বেগ তাকে বসার জন্য ইশারা করার আগেই সে চেয়ারে টেনে বসে পড়ল। “আরে এডলিন, আপনি বাসায় গেছিলেন না কি?”

“বাসায়! না। কেন?” এডলিন অনেকটা বিরক্ত হয়েই বলল।

“না মানে, এই জামাটা পরেই কি আজ অফিসে এসেছিলেন?”

“হ্যাঁ,” এডলিনর কাটাকাটাভাবে বলল কথাটা।

“আমি ভেবেছি বাড়িতে গিয়ে বোধহয় জামা পাল্টে এসেছেন।”

এডলিন বেগের দিকে ফিরল। “স্যার, আমি উঠি।” সাবের কামালকে কিছু না বলেই কেন্টিন থেকে চলে গেল মেয়েটা।

সাবের কামাল নারী সহকর্মীদের কাছে একটি বিরক্তিকর চিজ। সবাই তাকে এড়িয়ে চলে। জেফরি নিজেও তার আচরণে সন্তুষ্ট নয়। তবে খুব বেশি দূর যায় না সে। একটু খোঁচা মারবে তো একটু সুযোগ বুঝে বেমক্কা কথা বলে বিব্রত করে দেবে-এর বেশি নয়।

“কী খবর?” বলল জেফরি।

“খবর ভালো, স্যার,” চেয়ারটা সামনে টেনে আনলো কামাল যেন জরুরি একটা কথা বলবে। “সিগারেটের ফিল্টার থেকে সালিভা পাওয়া গেছে। এখন মি. শফিকের নমুনা কালেক্ট করে ম্যাচিং করে দেখতে হবে। তবে আমি নিশ্চিত পজিটিভ হবে।”

মাথা নেড়ে সায় দিল বেগ। সে-ও জানে এটা পজিটিভ হবে। আলম শফিক স্বীকার করেছে মিসেস রেহমানের ঘরে সিগারেট খাওয়ার কথা। তারপরেও সন্দেহভাজনরা যখন হত্যার কথা স্বীকার করছে না সেক্ষেত্রে আদালতে শক্ত প্রমাণ হিসেবে তাদেরকে কিছু কাজ করতে হবে। ডিএনএ টেস্ট এই কেসে বেশ বড় ভূমিকা রাখবে বলেই আশা করছে জেফরি।

“জায়েদ রেহমানের ঘরে কিছু পেয়েছো?” জানতে চাইল বেগ।

“না, স্যার। একদম ক্লিন। ফিঙ্গারপ্রিন্ট টিমও ওখানে কিছু পায়নি।”

বেগ কিছু বলতে যাবে তার আগেই জামান এসে হাজির। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে। হন্তদন্ত হয়ে জেফরির টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল সে।

“স্যার!”

“কী হয়েছে?” বলল জেফরি।

“জায়েদ রেহমানের ল্যাপটপটা চেক করে একটা জিনিস পেয়েছি। আমার মনে হয় এক্ষুণি আপনার সেটা দেখা দরকার।”

জেফরি বেগ খবরটা শুনে উফুল হতে পারল না। খিদের চোটে তার হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে। টেবিলে রাখা এক গ্লাস পানি দ্রুত খেয়ে উঠে দাঁড়াল সে। “ল্যাপটপটা কোথায়?”

“আপনার অফিসে।”

“চলো।”

সাবের কামালকে রেখে জেফরি আর জামান তাড়াহুড়ো করে কেন্টিন। থেকে বের হয়ে গেল।

.

অধ্যায় ১৭

আবেদ আলী আর বাইরে গিয়ে নাস্তা করেনি। ইয়াহু মেইলে গিয়ে মিলির গরম মেইলটাও খুলে দেখেনি এখন পর্যন্ত। অনলাইনে মিলি তাকে না পেয়ে তার মোবাইলে পাঁচ-ছয়টা এসএমএস করেছে, সেগুলোর জবাব দেয়া তো দূরের কথা একটাও পড়ে দেখেনি। জায়েদ রেহমানের হত্যার খবর শুনে কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে ড্রইংরুমে বসে আছে। বাড়ির কাজের লোক নাস্তা দিয়ে গেলেও পুরোটা খেতে পারেনি। অর্ধেক নাস্তা এখনও টেবিলে পড়ে রয়েছে। তিন বছর ধরে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল কিন্তু টেনশন দূর করার জন্য কাজের ছেলেটাকে দিয়ে কিছুক্ষণ আগে এক প্যাকেট সিগারেট আনিয়েছে সে। এটাও তো ঠিক, বিগত তিন বছরে তার জীবনে এ রকম একটা দিন আসেনি।

এরইমধ্যে তিনটা সিগারেট শেষ করে ফেলেছে, চার নাম্বারটায় আগুন ধরাল। সিগারেট যে কেন খাচ্ছে সেটাও জানে না। এক ধরণের ঘোরের মধ্যে পড়ে গেছে। তার মাথায় অসংখ্য চিন্তা ঘুরপাক খেলেও কোনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কারো সাথে পরামর্শ করা দরকার, কথাটা ভেবেই আধ ঘন্টা আগে তার এক লেখক বন্ধুর সাথে ফোনে এ নিয়ে কথা বলেছে। তারপর থেকে তার দুশ্চিন্তা বেড়ে গেছে কয়েক গুন। সেই লেখক বন্ধু সব শুনে যা বলেছে তা রীতিমতো গা শিউড়ে ওঠার মতো। অবশ্য তার কথায় যুক্তি আছে। আবেদ আলী নিজেও সেটা বুঝতে পারছে এখন।

*

নিজের অফিসে বসে আছে জেফরি বেগ। তার সামনে বসে আছে জামান। লেখক জায়েদ রেহমানের ল্যাপটপ চেক করে অসাধারণ একটি তথ্য পাওয়া গেছে।

মৃত্যুর আগে জায়েদ রেহমান একজনের কাছে মেইল করে গেছেন। শুধু মেইল না, সাথে একটা বিশাল আকারের ডকুমেন্ট ফাইলও অ্যাটাচ করেছেন তিনি।

অদ্ভুত।

মেইল আর অ্যাটাচমেন্ট ফাইলটা ওপেন করে দেখেছে জেফরি। এটা আরেকটা বোমার মতো। সে ভাবতেও পারেনি এভাবে এতো দ্রুত সব আলামত আর ক্ল পেয়ে যাবে।

যার কাছে লেখক মেইলটা পাঠিয়েছিলেন সেই ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। আর সেটা করতে হবে খুব দ্রুত। ভদ্রলোকের ফোন নাম্বার যোগার করাটা তেমন কঠিন কাজ ছিল না। ইয়েলো পেজ থেকে ভদ্রলোকের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ফোন করে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারটা নিয়ে নিয়েছে জামান।

ভদ্রলোক থাকে বেইলি রোডে, হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের খুব কাছে। জেফরি ঠিক করল এক্ষুণি ভদ্রলোকের সাথে কথা বলবে। তবে তার আগে ফোন করে জেনে নিতে হবে এখন সে কোথায় আছে। আবারো জামানকেই ফোনটা করার জন্য বলল সে।

.

আজকের সকালটা কতো দ্রুতই না বদলে যাচ্ছে! পেন্ডুলামের মতো দুলছে আবেদ আলীর ভাগ্য। তার মনে আশঙ্কা বেঈমানটা মরে যাবার আগে তাকে একটা গ্যাড়াকলে ফেলে দিয়ে গেছে। কিন্তু কেন? আবেদ আলী এর কোনো সদুত্তর খুঁজে পাচ্ছে না।

আরে, আমি তোর কী ক্ষতি করেছিলাম!

তাকে চমকে দিয়ে মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল।

নাম্বারটা অপরিচিত। প্রথমে ভেবেছিল ধরবে না, তারপর সাত-পাঁচ ভেবে কলটা রিসিভ করল সে।

“হ্যালো, আবেদ আলী সাহেব বলছেন?”

“জি…” ভয়ার্তভাবে বলল সে।

“সিটি হোমিসাইড থেকে বলছি। ইন্সপেক্টর জামান।”

“সিটি হোমি…” আবেদ আলী আর কিছু বলতে পারল না। যে আশঙ্কা করেছিল সেটাই বুঝি সত্যি হতে চলেছে। টের পেল তার নিশ্বাস দ্রুত হয়ে গেছে।

.

অধ্যায় ১৮

পাভেল আহমেদ ভিটা নুভা থেকে একটু দূরে এসে পকেটে হাত দিল। সেখানে ছোট্ট একটা জিনিস আছে।

নিজের দূরদর্শিতার কথা ভেবে খুব ভালো লাগছে তার। পাঁচ মাস আগেও যে জিনিসটার কোনো মূল্য ছিল না আজ সেটাই হয়ে উঠেছে লোভনীয় একটি বস্তু। তার সাবেক বস চ্যানেল সিক্সটিনের নিউজ এডিটর মামুনুর রশীদ যখন এই জিনিসটা দেখতে পাবে তখন তার অবস্থা কী রকম হবে ভাবতেই পাভেলের হাসি পেল।

কতো কষ্ট করেই না জিনিসটা জোগাড় করেছিল সে অথচ এডিটর সেটার মূল্যই বুঝতে পারল না! প্রিন্ট মিডিয়া থেকে অনেক শখ করে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় গেছিল সে, মাত্র দেড় মাসের মাথায় সে পাট চুকিয়ে ফিরে এসেছে পুরনো কর্মক্ষেত্রে।

পকেট থেকে সাদা কাগজে মোড়ানো জিনিসটা বের করল, তাতে ছোট্ট করে ইংরেজিতে লেখা আছে : Z.R-I

একটু সময় পার করে তাকে আবার ফিরে যেতে হবে ভিটা মুভার সামনে জটলার দিকে। সময় কাটানোর জন্য আশেপাশে একটা চায়ের দোকান খুঁজে সেখানে চলে গেল সে। আধ ঘণ্টার মতো সময় কাটাতে হবে তাকে।

*

ভিটা নুভার সামনে লোকজনের জটলা এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একদল অল্পবয়সি পাঠক রীতিমতো মিছিল করতে শুরু করে দিয়েছে। লেখকের স্ত্রী আর প্রেমিকের ফাঁসির দাবি তোলা হচ্ছে সেই মিছিল থেকে। প্রথমে মনে করা হয়েছিল নিতান্তই ছেলেমানুষি ব্যাপার। পাগলামি। কিন্তু এখন আর সেটা মনে হচ্ছে না। এই হুজুগে যোগ দিয়েছে ভাসমান আর কৌতূহলী আরো কয়েকশ’ মানুষ।

সবগুলো টিভি চ্যানেল এই দৃশ্য লাইভ দেখাচ্ছে। সাংবাদিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মিছিলের নেতাগোছের কারো সাক্ষাৎকার নেবার জন্য।

স্বদেশ টিভির রিপোর্টার হামিদ আলম তার ক্যামেরাম্যান ছেলেটাকে মিছিল কভার করার জন্য পাঠিয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ধরাল। প্যাকেটে আর কোনো সিগারেট নেই। একটু আগে পাভেল আহমেদকে সিগারেট দেয়াটা ঠিক হয়নি। তার স্টক শেষ হয়ে গেছে।

চারপাশে প্রচণ্ড হৈহট্টগোল থাকার কারণে প্রথমে সে বুঝতে পারেনি, পরে খেয়াল করল পকেটে থাকা মোবাইল ফোনে রিং হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে গেল সে। শালার নিউজ প্রডিউসার এসি রুমে বসে বসে খালি অর্ডার দিয়ে যাচ্ছে : একটা স্কুপ চাই! একটা স্কুপ চাই! পাঁচ মিনিট পর পরই তাকে ফোন করছে। তার ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝি এখানে বসে বসে বাল ফেলছে।

কিন্তু ডিসপ্লের নাম্বারটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে কলটা রিসিভ করল হামিদ আলম।

“হ্যাঁ, বলো?” খুব জোরে বলতে হলো চারপাশের নয়েজের কারণে।

“তুমি কি এখনও ভিটা নুভার সামনে আছো?” পাভেল আহমেদ জানতে চাইল।

“আর কোথায় যাবো! সারাটা দিন মনে হয় এখানেই থাকতে হবে।”

“নিউজ প্রডিউসারের সাথে কথা বলেছো?”

“হ্যাঁ, বলেছি। তুমি ওটা নিয়ে চলে আসো। ভালো দাম পাবে।”

“নগদ দিতে হবে কিন্তু।”

“নগদ মানে…আমি তো স্পটে আছি। এখানে টাকা দেবো কিভাবে?”

“এখন দিতে হবে সেটা বলছি না। আজকেই দিতে হবে।”

হামিদ আলম তাড়া দিয়ে বলল, “তুমি জলদি নিয়ে আসো। আজকেই পাবে। এ নিয়ে চিন্তা কোরো না।”

“ঠিক আছে, আমি আসছি।”

কলটা শেষ হতেই হামিদ আলম ভাবলো পাভেল তাকে যা বলেছে সেটা যদি ঠিক হয় তাহলে আজকের সন্ধ্যের মধ্যে তারা একটি ফাটাফাটি নিউজ করতে পারবে।

চ্যানেল সিক্সটিনের রিপোর্টার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। বিজয়ীর ঔদ্ধত্য দেখা যাচ্ছে তার চোখেমুখে। হামিদ আলম তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

.

অধ্যায় ১৯

দিনে এই প্রথম পুলিশস্টেশনে এসেছে আবেদ আলী। অবশ্য হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টকে পুলিশস্টেশন বলা যায় কি না সেটা ভাববার বিষয়। তবে এটাও ঠিক, এরা পুলিশেরই লোক।

এর আগে স্বচক্ষে কোনো গোয়েন্দাকেও দেখেনি সে, ফলে ইনভেস্টিগেটর জেফরি বেগকে দেখে বুঝে উঠতে পারছে না এ দেশের সব গোয়েন্দা এই লোকের মতো হয় কি না।

মানানসই উচ্চতা আর হালকা পাতলা শরীরের একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। চোখ দুটো বুদ্ধিদীপ্ত এবং গভীর। পোশাক-আশাক বেশ পরিপাটি। হাঁটাচলার মধ্যে প্রবল ব্যক্তিত্বের বহিপ্রকাশ স্পষ্ট চোখে পড়ে। দেখে মনে হয় নরম মনের একজন মানুষ। খুবই বন্ধুবৎসল। এখানে আসার পর আবেদ আলীর সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করছে সে। তার ব্যবহারের কল্যাণে আবেদ আলীর সমস্ত ভয় আর উদ্বিগ্নতা কিছুটা কমে এসেছে।

এই তরুণ ইনভেস্টিগেটর সন্দেহভাজনদেরকে আসামী হিসেবে দেখে না, এ ব্যাপারে আবেদ আলী নিশ্চিত। যেমনটা সব পুলিশ করে থাকে। পুলিশ যেমন সবাইকে চোর-ডাকাত ভাবে এই লোক সে রকম নয়।

তবে লোকটার নাম একটু অদ্ভুত। প্রথমে শুনে আবেদ আলী বুঝে উঠতে পারেনি। জেফরি বেগ! এটা আবার কেমন নাম? খৃস্টান হবে হয়তো।

তারা বসে আছে জেফরি বেগের অফিসে। আবেদ আলী এখানে এসেছে দশ মিনিট হলো। কিছুক্ষণ আগে জেফরি তাকে রেখে একটু বাইরে গেছে। এখন তার সামনে বসে আছে ইন্সপেক্টর জামান-যে লোক তাকে ফোন করেছিল এখানে আসার জন্য।

জামান কিছু বলছে না। চুপচাপ মোবাইলে কাকে যেন এসএমএস করে যাচ্ছে আর ফাঁকে ফাঁকে আবেদ আলীর দিকে তাকাচ্ছে। আবেদ আলীর কাছে মনে হচ্ছে সময় কাটানোর জন্যই সে এটা করছে।

জামানকে এসএমএস করতে দেখে মিলির কথা মনে পড়ে গেল তার। মোবাইলটা বের করে দেখল। যা ভেবেছিল তাই। মিলির বারো-তেরোটা এসএমএস জমে আছে। এখানে আসার আগে মোবাইলটা সাইলেন্স মুডে রেখে দিয়েছে সে তাই বিপগুলো শুনতে পায়নি। একটা এসএমএস ওপেন করল আবেদ আলী। ইংরেজি অক্ষরে বাংলায় লেখা এসএমএস।

কী হয়েছে বেবি? প্লিজ আমাকে বলো। আমি টেনশনে আছি। এনি প্রবলেম? এসএমএস করছো না কেন? অনলাইনেও নেই। প্লিজ আমাকে জানাও।

মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল আবেদ আলীর। মিলির এই বেশি বেশি কেয়ারিং তার কাছে ন্যাকামি বলে মনে হয় মাঝেমধ্যে। সে আছে মহা ঝামেলায় আর এই মেয়েটা…ছেচল্লিশ বছরের একজনকে মেয়ে বলা যায় কি না ভেবে হেসে ফেলল আবেদ আলী। আর কোনো মেসেজ ওপেন না করে মোবাইলটা পকেটে রেখে জামানকে বলল, “আমাকে এখানে কতোক্ষণ থাকতে হবে?”

মোবাইল থেকে মুখ সরিয়ে জামান তার দিকে তাকাল। “বেশিক্ষণ লাগবে না। স্যার আপনার সাথে বলবে, তারপরই আপনি চলে যেতে পারবেন। ভয় পাবার কিছু নেই।”

“না, না। ভয় পাবো কেন,” বলল আবেদ আলী।

জামান তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবারো মোবাইলে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

প্রকাশক সাহেব হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টে আসার পরপরই মহাপরিচালক ফারুক আহমেদ জেফরিকে ডেকে পাঠিয়েছে। কারণটা জামান জানে : লেখক জায়েদ রেহমানের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে এক টিভি চ্যানেলে ইন্টারভিউ দেবে মহাপরিচালক, সেজন্যে জেফরির কাছ থেকে পুরো ঘটনাটা সংক্ষেপে জেনে নিচ্ছে।

খুব তাড়াহুড়ো করে জেফরি নিজের অফিসে ঢুকলে জামান তার মোবাইলটা সঙ্গে সঙ্গে পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।

“সরি,” ছোট্ট করে বলে ডেস্কের অপর পাশে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল সে।

“না, না ঠিক আছে, আবেদ আলী কথাটা বললে জেফরি তার দিকে তাকিয়ে নীরব একটা হাসি দিল।

“আপনার সময় নষ্ট করবো না। কয়েকটা জরুরি প্রশ্ন করেই ছেড়ে দেবো।”

“বলুন। আমার যতোটুকু সাহায্য করার করবো,” বলল আবেদ আলী।

“উমমম…” কি বলবে সেটা একটু গুছিয়ে নিলো জেফরি। “আপনি কখন জানতে পারলেন লেখক জায়েদ রেহমান খুন হয়েছেন?”

“সকাল দশটার দিকে হবে। টিভি নিউজে দেখেছি।”

“আমরা জানতে পেরেছি উনি মারা যাবার আগে, রাত ২টার কিছু পরে আপনাকে একটা মেইল করেছেন। সাথে আস্ত একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপিসহ?”

“হ্যাঁ। আজ সকালে সেটা পেয়েছি। খুবই অবাক হয়েছি আমি।”

“অবাক হয়েছেন! কেন?”

“কারণ দীর্ঘ দিন ধরে তার সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। বলতে পারেন আমাদের সম্পর্কটা ভালো ছিল না।”

“তাই না কি,” জেফরি একটু অবাক হলো। “আমি যতোদূর জেনেছি উনার অনেকগুলো বই আপনর প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে।”

“হ্যাঁ। আগে আমার এখান থেকেই তার বই বের হোতো…দু’বছর ধরে আর বের হয় না।”

“কেন?”

“মৃতলোক সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। হাজার হোক এক সময় সে আমার খুব কাছের লোক ছিল।” একটু থেমে আবার বলতে লাগল সে, “জায়েদকে আমিই প্রথম সুযোগ করে দিয়েছিলাম। আমার এখান থেকেই তার প্রথম পঞ্চাশটি বই বের হয়েছে। এজন্যে আমার প্রতি কৃতজ্ঞও ছিল। দু’বছর আগে হঠাৎ করেই অন্য এক নতুন প্রকাশককে বই দিতে শুরু করে। ব্যাপারটা আমার জন্য খুব কষ্টের ছিল। শুধু মাত্র বেশি টাকা পাবার জন্যে সে এ কাজ করেছে। আমি অবশ্য তার কাছে কিছু জানতে চাইনি, সে-ও আমাকে কিছু বলেনি। এ ঘটনার পর থেকে তার সাথে আমার যোগাযোগ আস্তে আস্তে কমে আসে। এক পর্যায়ে আমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়।” আবেদ আলী থেমে আশেপাশে তাকালে জেফরি ভুরু তুলে জানতে চাইলে সে বলল, “একটু পানি হবে?”

“শিওর, জেফরিকে কিছু বলতে হলো না, জামান উঠে গিয়ে ঘরের এককোণে রাখা পট থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে আবেদ আলীকে দিল।

“আপনি বলতে চাচ্ছেন বিগত দু’বছরে আপনাদের মধ্যে একদম যোগাযোগ ছিল না, আবেদ আলীর পানি খাওয়া শেষ হলে জেফরি জানতে চাইল।

“হ্যাঁ।”

“তাহলে কাল রাতে উনি কি মনে করে আপনার কাছে একটা জরুরি মেইল করলেন? সেই সাথে একটা নতুন বইয়ের পাণ্ডুলিপিসহ?”

“আমিও এটার কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না। বিশ্বাস করুন, আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”

“জায়েদ রেহমান কাল রাতে নিজের ঘরে খুন হয়েছেন। খুন হবার আগে একজন পক্ষাঘাতগ্রস্ত লোক আপনার কাছে একটা মেইল করলেন, সাথে আনকোড়া একটা বইয়ের সফটকপি অ্যাটাচ করে। বিগত দু’বছর ধরে যে প্রকাশনা থেকে উনার বই বের হচ্ছে সেখানে না পাঠিয়ে আপনার কাছে পাঠালো…পুরো ব্যাপারটাই ঘোলাটে মনে হচ্ছে না আপনার কাছে?” জেফরি স্থির চোখে চেয়ে রইল আবেদ আলীর দিকে।

মাথা নেড়ে সায় দিল আবেদ আলী। “তা তো মনে হচ্ছেই।”

“ঝগড়া হবার আগে আপনাদের মধ্যে কেমন সম্পর্ক ছিল?”

“ঝগড়া? আমাদের মধ্যে তো সে রকম কিছু হয়নি,” আবেদ আলী অনেকটা প্রতিবাদ করে বলল।

“আই মিন, কথাবার্তা বন্ধ হবার কথা বলছি,” শুধরে দিয়ে বলল জেফরি।

“ভালো। খুব ভালো সম্পর্ক ছিল আমাদের মধ্যে। বয়সে আমরা প্রায় সমবয়সি ছিলাম। তার প্রথম বইটা আমার কারণেই বের হয়েছিল। তখন আমি আমাদের পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দিয়েছি মাত্র। আমার বাবা তার বই বের করতে রাজি ছিলেন না। এইসব ছেলেছোকরাদের বই বের করে কোনো লাভ হবে না বলে তিনি জায়েদকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু আমার খুব খারাপ লেগেছিল। সে চলে যেতে লাগলে আমি তাকে ডেকে নিই। বাবাকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে রাজি করাই। শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রকাশনী থেকেই তার প্রথম উপন্যাস বের হয়…সেই থেকে তার সাথে আমার বন্ধুত্ব।”

“তার মানে আপনাদের সম্পর্কটা অনেক দিনের?”

“হ্যাঁ প্রায় ছাব্বিশ বছরের মতো হবে।”

“এই ছাব্বিশ বছরের সম্পর্কটা শুধুমাত্র একটা বই না দেবার কারণে নষ্ট হয়ে গেল!”

আবেদ আলী কিছু বলল না, চুপ করে থাকল।

“আপনার সাথে মিসেস রেহমানের সম্পর্ক কেমন ছিল?”

“কোনুজনের কথা বলছেন?” জানতে চাইল আবেদ আলী।

“কোনজন মানে?” বুঝতে না পেরে বলল জেফরি।

“স্যার, জায়েদ রেহমান আগে আরেকবার বিয়ে করেছিলেন,” আবেদ আলী কিছু বলার আগেই জামান ধরিয়ে দিল ব্যাপারটা।

ব্যাপারটা জেফরির মাথায়ই ছিল না। মনে মনে জিভ কাটল সে। তেমন কোনো প্রচেষ্টা ছাড়া অভাবিত সাফল্য পেয়ে গেলেও এই কেসটা নিয়ে যে খুব বেশি মনোযোগ দিচ্ছে না এটা তারই প্রমাণ। এটা ঠিক হচ্ছে না, মনে মনে ভাবলো জেফরি বেগ। বর্তমান স্ত্রীর কথা বলছি,” বলল সে।

“তার সাথে আমার তেমন একটা সম্পর্ক ছিল না।”

আবেদ আলী দায়সারা গোছের জবাব দিলেও জেফরি সেটা ধরতে পারল। “তার মানে খারাপ ছিল?”

“ঠিক খারাপ বলবো না, বলতে পারেন তার সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না।”

“উনার দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি ছিল?”

“নিজের মেয়ের বান্ধবীকে বিয়ে করবে কথাটা শুনে স্বাভাবিকভাবেই প্রথমে আমি আপত্তি জয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাদের কারো আপত্তি কানে দেয়নি। আমরাও এ নিয়ে তাকে আর কিছু বলিনি।”

“আর প্রথম স্ত্রীর সাথে?” বেগ বলল।

“সম্পর্কের কথা বলছেন?”

“হ্যাঁ।”

“ভালো। জায়েদের সাথে আমার সম্পর্কটা যতো দিনের গ্যাটের সাথেও প্রায় ততোদিনের সম্পর্ক।”

“..গ্যাট?” জেফরি ভুরু কুঁচকে জানতে চাইল।

“সরি। গোলনূর আফরোজ তরফদার। সংক্ষেপে আমরা তাকে GAT বলে ডাকি।”

“আচ্ছা…মি. আলী, লেখক জায়েদ রেহমান আপনাকে মেইলে এমন কিছু কথা লিখেছেন যেগুলো আপনার কাছে লেখার কথা নয়। বিশেষ করে দু’বছর ধরে সম্পর্ক নেই এমন লোকের কাছে তিনি কেন এ রকম কথা লিখতে যাবেন?”

“এটা আমি নিজেও সারাটা সকাল ভেবেছি কিন্তু কোনো সদুত্তর পাইনি,” আবেদ আলী গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল।

সে আসলে অনেক প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে পাচ্ছে না। হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের ফোন পাবার পর থেকেই এইসব প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে : কি করে এরা জায়েদ রেহমানের পাঠানো মেইলটার কথা জানতে পারল? সেই মেইলটাই বা কি করে পড়তে পারল কে জানে। এমন কি অ্যাটাচমেন্ট ফাইলটা সম্পর্কেও এরা জানে! কিন্তু কিভাবে?

খুব বেশি দিন হয়নি ইন্টারনেট আর ই-মেইলের জগতে প্রবেশ করেছে আবেদ আলী। এখনও অনেক কিছু সে জানে না। কেবল দরকারি কিছু বিষয় ছাড়া বলতে গেলে সে এ ব্যাপারে অনভিজ্ঞ একজন মানুষ।

প্রথম প্রথম বেশিরভাগ মেইল ব্যবহারকারীই জানে না সাইন-আউট না করে মেইল অ্যাকাউন্ট থেকে বের হলে যে কেউ সেটাতে ঢুকতে পারে। এরজন্য কোনো পাসওয়ার্ড লাগবে না, সরাসরি অ্যাকাউন্টটা ওপেন হয়ে যাবে। আর অ্যাকাউন্টের সেন্টবক্সে গেলেই দেখা যাবে পাঠানো মেইল আর অ্যাটাচমেন্টগুলো। ওখান থেকে মেইল ওপেন করা যাবে, অ্যাটাচমেন্ট ফাইলও নামিয়ে নেয়া যাবে অনায়াসে। পানির মতো সহজ কাজ। আর এই সহজ কাজটা করতে জেফরি বেগের লেগেছিল মাত্র পাঁচ মিনিট। সেন্টবক্সে লিস্ট থেকে কোনো কিছু ডিলিট না করলে সব কিছুরই রেকর্ড থেকে যায়। বেশিরভাগ ব্যবহারকারীর মতো লেখক জায়েদ রেহমানও সেন্টবক্সের আইটেম ডিলিট করতেন না।

“কি ভাবছেন?”

জেফরির প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেল আবেদ আলী। “না, তেমন কিছু না। ভাবছি জায়েদ তো একদমই নড়তে চড়তে পারতো না, তার উপর সে ছিল হার্টের রোগি। রাত দুটোর দিকে আমাকে মেইল করল? অতো রাতেও জেগেছিল সে, কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছিল!”

যে প্রশ্ন একজন গোয়েন্দার মনে উদয় হওয়ার কথা সেটা কি না উদয় হলো একজন প্রকাশকের মনে! আবেদ আলীর কথাটা জেফরিকে মুহূর্তেই আলোড়িত করল।

তাই তো। লেখক জায়েদ রেহমান অতো রাতেও ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছিলেন…!

জেফরি স্থির চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল আবেদ আলীর দিকে। তারপরই নিজের সহকারী জামানের দিকে ফিরল সে। “জামান!”

“জি, স্যার?”

“জায়েদ রেহমানের ঘরে তার ল্যাপটপটা ছিল কফি টেবিলের উপরে!”

বোকার মতো তাদের দু’জনের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাল আবেদ আলী। সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

“জি, স্যার,” বলল জামান।

“হ্যাঁ, কফি টেবিলেই ছিল। আমি ঘরে অনেকগুলো ছবি তুলেছিলাম।” যেন আপন মনে বলল কথাগুলো।

“জি, স্যার।”

জট পাকিয়ে থাকা মাথাটা যেন চট করেই খুলে গেল। আবারো নিজেকে ভর্ৎসনা করল কেসটা নিয়ে যথেষ্ট মনোযোগ দিতে পারেনি বলে। এরজন্য নিজের বক্তিগত জীবনের একটি ঘটনাও যে দায়ি সেটা বুঝতে পারছে জেফরি। মানসিকভাবে সে পুরোপুরি স্থির নেই। ব্যাপারটা কেউ জানে না, কিন্তু জেফরির মানসিক অবস্থা আসলেই ভালো নেই। কোনোভাবেই তার ধীরস্থির আর বুদ্ধিদীপ্ত মাথাটা কাজ করছে না।

পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ইমেজ ফোল্ডার থেকে আজ সকালে তোলা জায়েদ রেহমানের ঘরের ছবিগুলো দেখতে শুরু করল জেফরি বেগ।

ছবিগুলো ঘরের বিভিন্ন অংশের। মোট আটটা ছবি। পাঁচ নাম্বার ছবিটাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে লেখকের বেডের পাশে কফি টেবিলের উপর ল্যাপটপটা খোলা অবস্থায় রয়েছে। এটা কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। তবে মারাত্মক একটি অসঙ্গতি আছে ছবিটাতে।

অসঙ্গতিটা অবশ্য সহজে চোখে পড়ার মতোও নয়, কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট বলে দিচ্ছে ঘটনা অনেক বেশি জটিল।

মাই গড!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *