মোক্ষম লাড্ডু
কাঠের লরির সে কী দৌড়। একে তো হইহই করে ছুটছে, তায় ভেতরের কাঠগুলো যেন হাত-পা তুলে নাচতে শুরু করেছে। যদিও মোটা দড়ি দিয়ে কাঠগুলো বেশ শক্ত করে বাঁধা, তবু মনে হচ্ছিল কখন যেন আমাদের নিয়ে ওরা চারদিকে ছিটকে পড়ে যাবে।
জামঝাঁকানো দেখেছ কখনও? সেই যে দুটো বাটির মধ্যে পুরে ঝকরঝকর করে ঝাঁকায়—আর জামের আঁটিটাটিগুলো সব আলাদা হয়ে যায়? ঠিক তেমনি করে আমার জ্বরের পিলে-টিলে ঝাঁকিয়ে দিচ্ছিল। আমার সন্দেহ হতে লাগল, আর কিছুক্ষণ পরে আমি আর পটলডাঙার প্যালারাম থাকব না—একেবারে শ্রীবৃন্দাবনের শ্রীকচ্ছপ হয়ে যাব। মানে, সব মিলিয়ে একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে যাব।
এর মধ্যে ঝড়াৎ-ঋড়াৎ। নাকের ওপর দিয়ে কে যেন চাবুক হাঁকড়ে দিলে। একটা গাছের ডাল।
টেনিদা বললে, ইঃ-হতভাগা ক্যাবলার বুদ্ধিতে পড়েই আজ মাঠে মারা যাব!
ক্যাবলা ইস্টুপিডটা এর মধ্যেও রসিকতার চেষ্টা করলে : মাঠে নয় রাস্তায়। রামগড়ের রাস্তায়।
রাস্তায়। টেনিদা দাঁত খিচিয়ে বললে, দাঁড়া না একবার, রামগড় পৌঁছে যাই। তারপর–
তারপর বললে-কোঁৎ!
মানে, ক্যাবলাকে কোঁৎ করে গিলে খাবে তা বললে না। একটা মোক্ষম ঝাঁকুনি খেয়ে ওটা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে।
হাবুল সেন ঘ্যানঘ্যান করতে লাগল : ইস, কর্ম তো সারছে। প্যাটের মধ্যে গজাদার রসগোল্লা যে ছানা হইয়া গেল।
আমি বললুম, শুধু ছানা? এর পরে দুধ হয়ে যাবে।
টেনিদা শুরু করলে : দুধ? দুধেও কুলোবে না। একটু পরে পেট ফুড়ে শিং-টিং সুষ্ঠু একটা গোরুও বেরিয়ে আসছে—দেখে নিস।
হাবুল আবার ঘ্যানঘ্যান করে বললে, হঃসত্য কইছ। প্যাট ফুইড়া গোরই বাহির হইব অখনে।
ক্যাবলা চেঁচিয়ে গান ধরলে, প্রলয় নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে হেনটাজ।
টেনিদা রেগেমেগে কী একটা বলে চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল, এমন সময় আবার সেই পেল্লায় ঝাঁকুনি। টেনিদা সংক্ষেপে বললে, ঘোঁ-ঘোঁ ঘোৎ।
কিন্তু সব দুঃখেরই শেষ আছে। শেষ পর্যন্ত লরি-রামগড়ের বাজারে এসে পৌঁছুল।
গাড়িটা এখন একটু আস্তে আস্তে যাচ্ছে আমরা চারজন কোনওমতে কাঠের ওপর উঠে বসেছি। হঠাৎ
—আরে ভগলু, দেখ ভাইয়া! লরিকা উপর চার লেড়কা বারকা মাফিক বৈঠল বা।
তিনটে কালোকালো ছোকরা। আমাদের দেখে দাঁত বের করে হাসছে।
আমি ভীষণ রেগে বললুম, তুমলোগ্ বান্দর হো! তুমলোগ বুন্ধু হো।
শুনে একজন অমনি বোঁ করে একটা ঢিল চালিয়ে দিলে একটুর জন্যে আমার কানে লাগল না। আমাদের লরির ড্রাইভার চেঁচিয়ে বলল, মারকে টিকি উখাড় দেব।
ছোকরাগুলোর অবশ্য টিকি ছিল না, তবু দাঁত বের করে ভেংচি কাটতে কাটতে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গেল।
লরিটা আর-একটু এগোতেই ক্যাবলা বললে,—টেনিদা কুইক। ওই যে নীল মোটর।
তাকিয়ে দেখি, সত্যিই তো। আমাদের থেকে বেশ খানিকটা আগে একটা মিঠাইয়ের দোকানের সামনে শেঠ ঢুণ্ডুরামের নীল রঙের মোটরটা দাঁড়িয়ে আছে।
আমার বুকের ভেতর ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। আবার সেই গজেশ্বর। সেই ষণ্ডা জোয়ান ভয়ঙ্কর লোকটা! এর চাইতে লরির ওপরে কচ্ছপরাম হয়ে থাকলেই ভালো হত—অনেক বেশি আরাম পাওয়া যেত।
কিন্তু ক্যাবলা ছাড়বার পাত্র নয়। টেনে নামাল শেষ পর্যন্ত।
—শোন্ প্যালা। তুই আর হাবলা এই পিপুল গাছটার তলায় বসে থাক। বসেবসে ওই নীল মোটরটাকে ওয়াচ কর। আমরা ততক্ষণে একটা কাজ সেরে আসি।
লরিটা ভাড়া বুঝে নিয়ে চলে গিয়েছিল। কাছে থাকলে আমি আবার তড়াক করে ওটার ওপরে উঠে বসতুম—তারপর যেদিকে হোক সরে পড়তুম। কিন্তু এ কী গেরো রে বাপু! এই পিপুল গাছতলায় বসে ওয়াচ করতে থাকি, আর এর মধ্যে গজেশ্বর এসে ক্যাঁক করে আমার ঘাড় চেপে ধরুক।
আমি নাক-টাক চুলকে বললুম, আমি তোমাদের সঙ্গেই যাই না। হাবুল এখানে একাই সব ম্যানেজ করতে পারবে।
ক্যাবলা বললে, বেশি ওস্তাদি করিসনি। যা বললুম তাই কর বসে থাক ওখানে। গাড়িটার ওপরে বেশ করে লক্ষ রাখিস। আমরা দশ মিনিটের মধ্যেই ফিরব। এসো টেনিদা—
এই বলে, পাশের একটা রাস্তা দিয়ে ওরা টুক করে যেন কোন্ দিকে চলে গেল।
আমি বললুম, হাবলা!
উঁ?
—দেখলি কাণ্ডটা?
হাবলা তখন পিপুল গাছের গোড়ায় বসে পড়েছে। মস্ত একটা হাই তুলে বললে : হঃ সইত্য কইছ।
—এ-ভাবে বোকার মতো এখানে বসে থাকবার কোনও মানে হয়?
হাবুল আর-একটা হাই তুলে বললে, নাঃ! তার চাইতে ঘুমানো ভালো। আমার কাঁচা ঘুমটা তোরা মাটি কইর্যা দিছস—তার উপর লরির ঝাঁকানি!—ইস–শরীরটা ম্যাজম্যাজ করতে আছে।
এই বলেই হাবুল পিপুল গাছটায় ঠেসান দিলে। আর তখুনি চোখ বুজল। বললে বিশ্বাস করবে না—আরও একটু পরে ফর ফোঁ-ফোঁ করে হাবুলের নাক ডাকতে লাগল।
কাণ্ডটা দ্যাখো একবার!
আমি ডাকলুম, হাবলা-হাবলা—
নাকের ডাক নামিয়ে হাবুল বললে, উঁ?
—এই দিন-দুপুরে গাছতলায় বসে ঘুমুচ্ছিস কী বলে?
হাবুল ব্যাজার হয়ে বললে, বেশি চিল্লাচিল্লি করবি না প্যালাকইয়া দিলাম। শান্তিতে একটু ঘুমাইতে দে। সঙ্গে সঙ্গেই পরম শান্তিতে সে ঘুমিয়ে পড়ল। আর নাকের ভেতর ঘেথকে ফুড়ৎ ফুড়ুৎ করে শব্দ হতে লাগল—যেন ঝাঁক বেঁধে চড়ই উড়ে যাচ্ছে।
কী ছোটলোক কী ভীষণ ছোটলোক! এখন আমি একা বসে ঠায় পাহারা দিই। কী যে রাগ হল বলবার নয়। ইচ্ছে করতে লাগল ওর কানে কটাং করে একটা চিমটি দিই। কিন্তু তক্ষুনি দেখলুম, তার চাইতেও ভালো জিনিস আছে। বেশ মোটা-মোটা একদল লাল পিঁপড়ে যাচ্ছে মার্চ করে। ওদের গোটাকয়েক ধরে ক্যাবলার নাকের ওপর ছেড়ে দিলে কেমন হয়?
একটা শুকনো পাতা কুড়িয়ে লাল পিঁপড়ে ধরতে যাচ্ছি, হঠাৎ–
—আরে খোঁকা—তুমি এহিখানে?
তাকিয়ে দেখি, শেঠ ঢুণ্ডুরাম।
ভয়ে আমার পেটের মধ্যে এক ডজন পটোল আর দুডজন শিঙিমাছ একসঙ্গে লাফিয়ে উঠল। আমি একটা মস্ত হাঁ করলুম, শুধু বললুম-আ-আ-আ-
শেঠ ঢুণ্ডুরাম হাসলেন : রামগড়ে বেড়াইতে এসেছ? তা বেশ, বেশ। কিন্তু এহিখানে গাছের তলায় বসিয়ে কেনো? লেকিন মুখ দেখে মনে হচ্ছে, তোমার বহুৎ খিদে পেয়েছে।
খিদে? বলে কী? সেই শালপাতার ঠোঙাটা শোঁকার পর থেকে আমার সমস্ত মেজাজ বিগড়ে রয়েছে। মনে হচ্ছে—আকাশ খাই, পাতাল খাই। এমন অবস্থা হয়েছে যে শেঠ ঢুণ্ডুরামের ভুড়িটাতেই হয়ত কড়াৎ করে কামড় বসিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সে কথা কি আর বলা যায়?
শেঠ ঢুণ্ডুরাম বললেন, আরে খিদে পেয়েছে তাতে লজ্জা কী? আইসো হামার সঙ্গে। ওই দোকানে বহুৎ আচ্ছা লাড়ু মিলে—গরমাগরম সিঙাড়া ভি আছে। খাবে? হামি খিলাবো–তোমাকে পয়সা দিতে হবে না।
এই পটলডাঙার প্যালারামকে বাঘ বালুক কায়দা করতে পারে না—টেনিদার গাঁট্টা দেখেও সে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকে, অঙ্কে গোল্লা খেলেও তার মন-মেজাজ বিগড়ে যায় না। কিন্তু খাবারের নাম করেছ কি, এমন দুর্ধর্ষ প্যালারাম একেবারে বিধ্বস্ত।
আমি আমতা আমতা করে বললুম-লেকিন শেঠজী, গজেশ্বর—
ঢুণ্ডুরাম চোখ কপালে তুলে বললেন, গজেশ্বর? কোন্ গজেশ্বর?
আমি বললুম, সেই যে একটা প্রকাণ্ড জোয়ান–হাতির মতো চেহারা আপনার গাড়িতে এসেছে–
ঢুণ্ডুরাম বললেন, রাম রাম-সীতারাম! আমি কোনও গজেশ্বরকে জানে না। আমার গাড়িতে হামি ছাড়া আর কেউ আসেনি।
—তবে যে স্বামী ঘুটঘুটানন্দের দাড়ি—
ঘুটঘুটানন্দ? ঢুণ্ডুরাম ভেবে-চিন্তে বললেন, হাঁ হাঁ একঠো বুড়া রাস্তায় হামার গাড়িতে উঠেছিল বটে। হামাকে বললে, শেঠজী, রামগড় বাজারে আমি নামবে। আমি তাকে নামাইয়ে দিলম। সে ইস্টেশনের দিকে চলিয়ে গেল।
এর পরে আর অবিশ্বাসের কী থাকতে পারে?
ঢুণ্ডুরাম বললে, আইসসা খোকা—আইসো। ভালো লাজু আছে—গরম সিঙাড়া ভি আছে—
আর থাকা গেল না। পটলডাঙার প্যালারাম কাত হয়ে গেল। হাবলা তখনও নাক। ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে আর ওর নাকের ভেতর থেকে সমানে চড়ুই পাখি উড়ছে। একবার মনে হল ওকে জাগাই—তারপরেই ভাবলুম : না—থাক পড়ে। আমি একাই গুটিগুটি ঢুণ্ডুরামের সঙ্গে গেলাম।
মস্ত খাবারের দোকান। থরেথরে লাড়ু আর মোতিচুর সাজানো। প্রকাণ্ড কড়াইয়ে গরম সিঙাড়া ভাজা হচ্ছে। গন্ধেই প্রাণ বেরিয়ে যেতে চায়!
শেঠজী বললেন, আইসসা খোকা—ভিতরে আইসো।
এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি, গজেশ্বর কিংবা ঘুটঘুটানন্দের টিকির ডগাটিও কোথাও নেই।
ঢুকে তো পড়ি।
দোকানের ভেতরে একটা ছোট্ট খাবারের ঘর। বসেই শেঠজী ফরমাস করলেন, স্পেশাল এক ডজন লাড়ু আর ছ-ঠো সিঙাড়া—
আমি বিনয় করে বললুম, আবার অত কেন শেঠজী?
ঢুণ্ডুরাম বললেন, আরে বাচ্চা খাও না! বহুৎ বড়িয়া চিজ আছে।
শালপাতায় করে বড়িয়া চিজ এল। একটা লাড়ু খেয়ে দেখি—যেন অমৃত! সিঙাড়া তো নয়—যেন কচি পটোল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল। আর বলতে হল না, আমি কাজে লেগে গেলুম।
গোটা চারেক লাড়ু আর গোটা দুই সিঙাড়া খেয়েছি–এমন সময় হঠাৎ মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। তারপর চোখে অন্ধকার দেখলুম। তারপর–
স্পষ্ট শুনলুম—গজেশ্বরের অট্টহাসি!
—পেয়েছি এটাকে। এক নম্বরের বিচ্ছু। আজই এটাকে আমি আলুকাবলি বানিয়ে খাব।
ব্যস—দুনিয়া একেবারে অথই অন্ধকার। আমি চেয়ার-টেয়ারসুদ্ধ হুড়মুড় করে মাটিতে উলটে পড়ে গেলুম।
Ore bap ree, Narayon babu eto hasate janen, Jana chilo nah, Pete beta dore gelo….