১১. সম্পদশালী চীন

এগারো

প্রচুর ফল, শস্য ও স্বর্ণ রৌপ্য প্রভৃতি সম্পদে সম্পদশালী চীন একটি বিশাল দেশ। সম্পদের দিক থেকে প্রতিযোগিতা করতে পারে দুনিয়ায় এমন দেশ আর নেই। খান বালিকা (পিকিং) শহরের কাছে বানরের পর্বত (Mountain of Apes) নামক পর্বতমালা থেকে আবে-হায়াত (water of Life) নামক একটি নদী এ দেশের মধ্যে। দিয়ে দীর্ঘ ছ মাসের পথ অবধি বয়ে গিয়ে সিন-আস-সিন (ক্যান্টন) অবধি পৌচেছে। মিশরের নীল নদের মতো এ নদীর দু’তীরে রয়েছে গ্রাম, মাঠ, ফলের বাগান ও বাজার। শুধু নীল নদের তুলনায় এ নদীর তীরবর্তী দেশগুলো অধিকতর শস্য-শ্যামল এবং জনবহুল। নদীর স্রোতে চালিত কলও এখানে বেশি। মিশরের মতো এমন কি মিশরের চেয়ে উৎকৃষ্টতর প্রচুর ইক্ষু চীনে জন্মে আর জন্মে কুল ও আঙ্গুর। চীন দেশের কুল দেখবার আগে আমি ভাবতাম দামেস্কের ওসমানী কুলের সমতুল্য কুল আর কোথাও নেই। খারিজম ও ইসপাহানের মতো এখানে চমৎকার তরমুজও পাওয়া যায়। আমাদের দেশে যেসব ফল আছে তার সবই এখানে পাওয়া যায়। তার কতকগুলো সমকক্ষ কতকগুলো উদ্ধৃষ্ট। এখানে যবও প্রচুর জন্মে। এমন উৎকৃষ্ট যব আমি কোথাও দেখিনি। এখানকার মসুর ও মটর সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে।

চীনা বাসন-কোসন কেবল মাত্র জয়তুন ও সিন-কালান শহরে তৈরী হয়। এ অঞ্চলের কোনো কোনো পাহাড়ের মাটী কাঠকয়লার মতোই জ্বলে। সে মাটী দিয়েই এ সব তৈরি করা হয়। পরে আমরা সে বিষয় আলোচনা করবো। এ মাটী তারা তাদের এক রকম পাথরের সঙ্গে মিশ্রিত করে। তারপর তিন দিন অবধি তা আগুনে পুড়িয়ে তার। উপর পানি ঢালে। এর ফলে এক রকম কাদা তৈরি হয়। সে কাদা পরে গাঁজানো হয়। একমাসকাল গাঁজানো কাদা দিয়ে উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বাসন-কোসন (Porcelain) তৈরি হয়। তার বেশি দিন দরকার হয় না। দশদিন গাঁজানো কাদার তৈরি জিনিষ নিকৃষ্ট। এখানে এসব চীনেমাটীর জিনিষের দাম আমাদের দেশের অতি সাধারণ বাসন কোসনের সমান অথবা তার চেয়েও কম। এসব ভারতে এবং অন্যান্য দেশে চালান হয়। এমন কি এসব জিনিষ পশ্চিমে আমাদের দেশ অবধি গিয়ে পৌঁছে। এখানকার বাসন-কোসন অন্য যে কোনো বাসনের তুলনায় উৎকৃষ্ট।

চীন দেশের মোরগ মুরগী আকারে খুব বড়–এমন কি আমাদের দেশের রাজহাঁসের চেয়েও বড়। এখানকার মুরগীর ডিম আমাদের দেশের রাজহাঁসের ডিমের চেয়েও বড়। কিন্তু এখানকার রাজহাঁস মোটেই বড় নয়। আমরা একবার একটা মুরগী কিনে রান্নার আয়োজন করছিলাম। দেখলাম একটা মুরগীর গোশত একপাত্রে ধরে না। কাজেই দু’পাত্রে তা রাখতে হলো। এখানকার মোরগ আকারে প্রায় উটপাখীর সমান। অনেক সময় মোরগের গায়ের সমস্ত পালক ঝরে পড়ে যায়, তখন তার বিশাল লাল। দেহটা মাত্র অবশিষ্ট থাকে। সর্ব প্রথম আমি একটা চীনা মোরগ দেখতে পাই কালাম শহরে। আমি সেটাকে উটপাখী ভেবে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার মালিক আমাকে বলেছিলো, চীনে কোনো কোনো মোরগ এর চেয়েও বড় হয়। সে সত্যি কথাই যে বলেছিলো তা এখন নিজেই দেখে বুঝতে পারলাম।

চীনের অধিবাসীরা বিধর্মী। তারা হিন্দুদের মতো পুতুল পূজা করে এবং মৃতদেহ দাহ করে ৩। চীনের রাজা চেংঙ্গিস খার বংশধর একজন তাতার। প্রতি শহরেই মুসলমানদের বসবাসের জন্য একটি পৃথক মহল্লা আছে। সেখানে শুক্রবার নামাজের জন্য এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানের জন্য মসজিদও আছে। এখানে মুসলমানদের সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। বিধর্মী চীনারা শূকর ও কুকুরের মাংস ভক্ষণ করে এবং বাজারেও তা বিক্রি হয়। তারা ধনী ও সঙ্গতিপন্ন কিন্তু তাদের খাদ্যে ও পোষাকে তা বুঝা যায় না। একজন বিরাট ধনী সওদাগর ধন দৌলতের যার সীমা নেই, তাকেও দেখা যায় সাধারণ একটি শার্ট পরে থাকতে। কিন্তু একটি ব্যাপারে চীনারা গর্ব করতে পারে। তা হলো তাদের সোনা-রূপার বাসন। তাদের প্রত্যেকের হাতে দেখা যায় একটি লাঠি। লাঠিতে ভর করে তারা হাঁটে এবং লাঠিকে তারা তৃতীয় পা’ বলে। রেশমের প্রচলন এখানে খুব বেশী। কারণ, রেশমের গুটিপোকা এখানে ফলের উপরে লাগে এবং ফল খেয়েই বাঁচে। তাদের জন্য বিশেষ কোনো যত্ন নিতে হয় না। সেজন্য রেশমের। প্রচলন এতো বেশী যে নিতান্ত গরীবদের পর্যন্ত তা ব্যবহার করতে দেখা যায়। সওদাগরদের অভাবে রেশমের কোনো মূল্যই সেখানে থাকতো না। এক টুকরো সূতী। কাপড়ের পরিবর্তে চীনে বেশ কয়েক টুকরো রেশমী কাপড় পাওয়া যায়। এদের ব্যবসায়ীদের একটি রীতি এই, যার যা সোনা বা রূপা আছে তার সব গালিয়ে একটি তাল তৈরি করে। অনেক সময় তার ওজন হয় কম বেশী এক হর। পরে সে তাল ঘরের দরজার উপর রেখে দেয়।

চীনের লোকেরা কেনা-বেচায় সোনার দীনার বা রূপার দেরহাম ব্যবহার করে না। সোনা বা রূপা যাই তারা পায় সব গালিয়ে পূর্ববর্ণিত মতে তাল তৈরি করে রাখে। দেশের সমস্ত বেচা-কেনা চলে রাজার মোহরাঙ্কিত হাতের তালুর সমান কাগজের সাহায্যে। এরকম পঁচিশ টুকরো কাগজে হয় এক বালিশট। অর্থের পরিমাণ হিসাবে এক বালিশট আমাদের এক দিনারের সমান ৪। ক্রমাগত হাত বদল হতে-হতে এসব নোট যখন ছিঁড়ে যায় তখন আমাদের টাকশালের মতোই এক অফিসে নিয়ে ছেঁড়ার পরিবর্তে নতুন নোট পাওয়া যায়। এ পরিবর্তনের জন্য কোনো রকম মূল্য দিতে হয় ৫ না। কারণ যারা এসব নোট তৈরি করে তারা সুলতানের নিকট হতে নিয়মিত বেতন পেয়ে থাকে। এ অফিসের পরিচালনভার দেওয়া হয় প্রধান একজন আমীরের উপর। যদি কেউ একটি রৌপ্য দেরহাম বা দীনার নিয়ে কোনো কিছু কিনতে বাজারে যায় তবে জিনিষের বিনিময়ে কেউ তা নিতে রাজী হয় না বা তার প্রতি মনোযোগ দেয় না। তার। দেরহাম বালিশটে পরিবর্তন করার পরে তাই দিয়ে যা-খুশী সে কিনতে পারে।

চীন এবং ক্যাথের ৬ সকল বাসিন্দাই কাঠকয়লার পরিবর্তে তাদের দেশের এক রকমের মাটীর তাল ব্যবহার করে। এ মাটী আমাদের দেশের সাজিমাটীর মতো এবং রঙও সাজিমাটির মতো। সাজিমাটীর বোঝা বহনের জন্য হাতি ব্যবহৃত হয়। এ মাটী তারা কাঠকয়লার আকারে ভাঙ্গে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়। তখন এ মাটী কাঠকয়লার মতোই জ্বলতে থাকে, কিন্তু এ মাটীর আগুনের উত্তাপ কাঠকয়লার আগুনের উত্তাপের চেয়ে অনেক বেশী। এ মাটী পুড়ে ছাই হলে সে ছাই পানি দিয়ে ছানানো হয়। পরে তাই শুকিয়ে আবার রান্নার কাজে ব্যবহৃত হয়। এমনি করে পুড়ে একেবারে নিঃশেষ হওয়া অবধি এ জিনিষ বার-বার ব্যবহার করা হয়। এ জিনিষের কাদার সঙ্গেই পাথর মিশিয়ে এরা যে বাসন কোসন তৈরি করে তা আগেই বলা হয়েছে।

চীনের সমস্ত অধিবাসীই শিল্পী হিসাবে অত্যন্ত নিপুণ, শিল্পে তাদের পূর্ণ দক্ষতা। তাদের এ বৈশিষ্ট্য সর্বত্র বিদিত এবং অনেক লেখকই তাদের গ্রন্থে এ বিষয়ে বার বার উল্লেখ করে গেছেন। সূক্ষ্ম প্রতিকৃতি অঙ্কণে গ্রীক বা অন্য কোনো দেশের শিল্পীর সঙ্গেই তাদের তুলনা হয় না। কারণ, অঙ্কনশিল্পে তারা অপূর্ব দক্ষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তাদের এ অসামান্য গুণের একটি দৃষ্টান্ত আমি নিজেই পেয়েছি। আমি দ্বিতীয়বার এমন। কোনো শহরে ফিরে আসিনি যেখানে প্রথম বারে আমাদের দেখে তাদের অঙ্কিত আমার। ও আমার সঙ্গীদের ছবি দেওয়ালের গায়ে বা কাগজের টুকরায় ঝুলানো অবস্থায় বাজারে দেখেছি। যে শহরে সুলতান বাস করেন সে শহরে এসে চিত্রশিল্পীদের বাজারের ভেতর দিয়ে আমি ও আমার সঙ্গীরা সুলতানের প্রাসাদে গিয়েছিলাম। আমাদের পরণে ছিল ইরাকী ধরণের পোষাক। বিকেলে প্রাসাদ থেকে ফিরবার সময় সেই পথেই এসে দেখতে পেলাম আমার ও সঙ্গীদের ছবি কাগজে একে তারা দেওয়ালে লাগিয়ে রেখেছে। আমরা তখন একে অপরের ছবি পরীক্ষা করে দেখলাম, প্রতিটি ছবি একেবারে নিখুঁতভাবেই আঁকা হয়েছে। শুনেছি, সুলতানের হুকুমে তারা এ-ছবি এঁকেছে। আমরা যখন প্রাসাদে উপস্থিত ছিলাম তখন তারাও সেখানে গিয়েছে এবং আমাদের অলক্ষ্যে সেখানে বসে এ ছবি এঁকে এনেছে। তাদের দেশে যারা যায় তাদের সবারই ছবি এঁকে রাখা এ দেশের একটি প্রচলিত রীতি। বস্তুতঃ এমন নিখুঁতভাবে তারা একাজ করে যে, কেউ যদি কোনো অপরাধ করে দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয় তবে তার ছবি দূর দুরান্তে পাঠানো হয়। তারপরে তার খোঁজ করা হয় এবং ছবির অনুরূপ কাউকে পেলে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

যখন কোনো মুসলমান সওদাগর চীনের কোনো শহরে উপস্থিত হয় তখন তাকে তার পছন্দ মতো সেখানকার কোনো মুসলমান ব্যবসায়ীর গৃহে অথবা হোটেলে থাকার স্বাধীনতা দেওয়া হয়। যদি সে ব্যবসায়ীর সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করে তবে তার টাকা কড়ি গৃহস্বামী ব্যবসায়ীর কাছে গচ্ছিত রাখা হয়। পরে বিশেষ সততা ও বদান্যতার সঙ্গে গৃহস্বামী সে টাকা কড়ির থেকে অতিথির ব্যয় বাবদ খরচ করে। অতিথির বিদায়ের সময় হলে সে টাকাকড়ি গণনা করা হয়। গণনায় কোনো কারণে কম হলে টাকার ভারপ্রাপ্ত গৃহস্বামী তা পূরণ করে দেন। অতিথি যদি কোনো হোটেলে থাকতে চায় তবে তার টাকাকড়ি রাখা হয় হোটেলের মালিকের হেফাজতে। অতিথির যা কিছু প্রয়োজন। মালিক তার সবই কিনে দেয় এবং পরে একটি হিসাব দাখিল করে। অতিথিদের মধ্যে যদি কেউ উপপত্নী রাখতে ইচ্ছে করে তবে হোটেল-মালিক একটি বালিকা-বাদী সংগ্রহ করে তাদের জন্য পৃথক বাসস্থান ঠিক করে দেয় এবং উভয়ের খাদ্য সরবরাহ করে। বাদীর মূল্য সেখানে কম, তবু চীনের সবাই তাদের পুত্রকন্যাদের বিক্রি করে। এ কাজকে তারা অবমাননাকর মনে করে না। ক্রেতার সঙ্গে ক্রীতদাস বা দাসীদের যেতে বাধ্য করা হয় না। পক্ষান্তরে তারা যেতে চাইলেও কোনো প্রকারে তাদের বাধা দেওয়া হয় না, ঠিক সে রকম, কোনো লোক যদি সেখানে এসে বিয়ে করতে চায় তবে তাও সে করতে পারে কিন্তু লাম্পট্যে অর্থ ব্যয় করতে পারে না। তারা বলে, মুসলমানদের ভেতর আমরা একথা আলোচনা হতে দিতে পারি না যে তাদের লোকেরা কেউ এদেশে এসে বিত্ত নষ্ট করেছে। কারণ, আমাদের এদেশ উচ্ছল জীবন যাপন ও অসামান্য সৌন্দর্যের (স্ত্রীলোক) দেশ।

বিদেশী সফরকারীদের জন্য চীন একটি নিরাপদ ও সুশৃঙখল দেশ। একজন লোক সঙ্গে বহু টাকাকড়ি নিয়েও অকুতভয়ে নয় মাসের পথ একাকী চলে যেতে পারে। নিম্ন উপায়ে তারা তার নিরাপত্তা বিধান করে। এ দেশে পথের প্রত্যেক বিরতিস্থানেই একজন কর্মচারীর নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি করে সরাইখানা আছে। তার অধীনে কিছু অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্য সেখানে রাখা হয়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বা তার পরে সেই কর্মচারী তার কেরানীসহ সেখানে আসে এবং যারা সেখানে রাত্রিবাস করবে তাদের নাম-ধাম লিখে নেয়। তারপর নামের সেই তালিকা সিল মোহর করে রেখে সরাইখানায় তালাবদ্ধ করে রাখে। পরের দিন সূর্যোদয়ের পরে কেরানীসহ সেই কর্মচারী পুনরায় এসে অতিথিদের প্রত্যেকের নাম ধরে ডাকে এবং তাদের পূর্ণ বিবরণী তালিকায় লিখে রাখে। তারপর পরবর্তী সরাইখানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য তাদের সবাইকে একটি লোকের হাওলা করে দেয়। সে লোক অতিথিদের যথাস্থানে পৌঁছে দিয়ে সেই সরাইখানা থেকে এ মর্মে লিখিয়ে আনে যে অতিথিরা সবাই সেখানে নিরাপদে পৌচেছে। পরিচালক লোকটি যদি লিখিত-চিঠি না দাখিল করতে পারে তবে তাদের নিরাপত্তার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। সিন-আস-সিন থেকে খান-বালিক অবধি তাদের দেশের সর্বত্রই এ নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। এসব সরাইখানায় সফরকারীর প্রয়োজনীয় সবকিছু এমনি কি হাঁস মুরগী অবধি থাকে। পক্ষান্তরে ভেড়া এখানে খুবই কম।

এবার আমাদের সফরের বিবরণী শুরু করা যাক। সমুদ্রযাত্রার শেষে প্রথম যে শহরে আমরা এসে পদার্পন করি তার নাম জয়তুন। যদিও জয়তুন শব্দের অর্থ জলপাই, তথাপি এ দেশের কোথাও জলপাই নেই। এমন কি সমগ্র চীনে বা ভারতে কোথাও জলপাই নেই। কাজেই এটি একটি জায়গার নামমাত্র। জয়তুন একটি বিস্তীর্ণ শহর। দামেস্ক রেশম নামে পরিচিত। রেশম ও সার্টিনের বয়ন-কার্য এ শহরেই হয়। খাসা ও খান্ বালিকের কাপড়ের চেয়েও এখানকার কাপড় উন্নত ধরণের। জয়তুনের বন্দর পৃথিবীর বড় বন্দরগুলোর অন্যতম, অথবা সবচেয়ে বড় বন্দর। আমি এ বন্দরে প্রায় শতেক বড় জাঙ্ক একত্র দেখেছি এবং ছোট জাঙ্ক এতো হাজার হাজার দেখেছি যে গুণে শেষ করা যায় না। সমুদ্রের একটি বৃহৎ খড়ি ভেতর দিকে এসে বড় নদীর সঙ্গে মিশে এ বন্দরের সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের নিজেদের দেশের শহর সিজিলমাসর১০ মতো চীনের এ শহরের এবং অন্য সমস্ত শহরের মধ্যস্থলে একটি লোকের ফলের বাগান, মাঠ ও বাসস্থান রয়েছে। এ জন্য এখানকার শহরগুলো বিস্তৃত। মুসলমানরা অন্য শহর থেকে। পৃথক শহরে বাস করে।

যে আমীর সুলতানের জন্য উপহার সামগ্রী নিয়ে দূত হিসেবে ভারতে গিয়েছিলেন, জয়তুন শহরে পৌঁছে সেদিন তাঁর দেখা পেলাম। ইনি আমাদের সঙ্গে আসতে পথে জাহাজডুবি হয়েছিলেন। আমাকে দেখেই ইনি সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বন্দর-রক্ষকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমি যাতে ভাল বাসস্থান পাই তার ব্যবস্থা করে। দিলেন১১। মুসলমানদের কাজী, শেখ-উল-ইসলাম এবং প্রধান প্রধান ব্যবসায়ীরা এসে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। ব্যবসায়ীদের ভেতর ছিলেন তাব্রিজের শরাফউদ্দিন। ভারতে পৌঁছে এর কাছ থেকেই আমি টাকা ধার করেছিলাম এবং ইনি আমার সঙ্গে বিশেষ সদয় ব্যবহার করেছিলেন। তিনি কোরআনে হাফিজ ছিলেন এবং সর্বদা কোর আন আবৃত্তি করতেন। এসব ব্যবসায়ীরা বিধর্মীদের দেশে যে অবস্থায়ই বাস করুক না। কেননা, মুসলমানদের দেখলে অত্যন্ত খুশী হতেন। তারা বলতেন, “ইনি ইসলামের দেশ। থেকে এসেছেন। তারপর তারা নিজেদের সম্পত্তির দশম অংশও (Tithe) তাকে দিতেন যাতে সেও তাদেরই মতো ধনী হতে পারে১২। জয়তুনে তখন যে সব প্রসিদ্ধ শেখ বাস করতেন তাঁদের মধ্যে কাজারুনের বোরহানউদ্দিনও ছিলেন। শহরের বাইরে তার একটি আস্তানা আছে। ব্যবসায়ীরা কাজারুনের শেখ আবু ইসহাকের উদ্দেশ্যে যা-কিছু মানত করে তা এখানেই আদায় দেয়।

বন্দর রক্ষক আমার সম্বন্ধে সবিশেষ জ্ঞাত হবার পরে আমার ভারত থেকে আগমন সম্বন্ধে তাদের সম্রাট কানকে১৩ পত্র লিখে জানালেন। কানকে লিখিত চিঠির জবাব আসবার আগে যাতে আমি সিন্ (সিন-আস-সিন)-তাদের কথায় সিন-কালান১৪ জেলা দেখে আসতে পারি সেজন্য বন্দর রক্ষককে অনুরোধ করলাম আমার সঙ্গে একজন লোক পরিচালক হিসেবে দিতে। এ জেলাটি তারই এলাকাধীনে। তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করে একজন কর্মচারী আমার সঙ্গে দিলেন। আমাদের দেশের যুদ্ধ জাহাজের মতো একটি নৌকায় নদীর উজান পথে আমরা রওয়ানা হলাম। এ নৌকার বৈশিষ্ট্য এই যে, দাড়িরা মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁড় টানে এবং যাত্রীরা বসে আগে ও পিছনের দিকে। তাদের দেশে জন্মে এমনি এক ধরনের গাছের তৈরি চাদোয়া খাটানো হয় নৌকায়। এ জিনিষ দেখতে শনের মতো কিন্তু আসলে শন নয়, শনের চেয়েও সুক্ষ্ম (সবতঃ ঘাসের তৈরি কাপড় বা মাদুর) আমরা এ নদীর উজান পথে পাল খাঁটিয়ে যেতে সাতাশ দিন। কাটালাম। প্রত্যেকদিন দুপুরের দিকে আমরা কোনো গ্রামের কাছে এসে নৌকা বাঁধতাম এবং সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনে নিতাম এবং জহুরের নামাজ পড়ে নিতাম। তারপর বিকেলে গিয়ে আরেকটি গ্রামে হাজির হতাম। এমনি করেই আমাদের দিন কাটছিলো সিন-কালান বা সিন-আস-সিন পৌঁছা অবধি। জয়তুনে এবং এখানে চীনে মাটীর জিনিষ তৈরি হয়। এর ধারে কাছেই আবেহায়াত নদী সমুদ্রে এসে মিশেছে। এজন্য জায়গাকে তারা পানির সভা’ (The Metting of the waters) বলে। এর আকারের জন্য এবং বাজারের উত্তৰ্ষতার জন্য সিন-কালান একটি প্রথম শ্রেণীর শহর। বড় বাজারগুলোর ভেতর একটি হলো চীনে মাটীর বাজার। এখান থেকে চীনে মাটীর জিনিষপত্র চীনের সর্বত্র, ভারত এবং ইয়েমেনে রপ্তানী হয়। এ শহরের মধ্যস্থলে প্রকাণ্ড। একটি মন্দির আছে। মন্দিরে নয়টি তোরণ। প্রত্যেক তোরণেই মন্দিরের বাসিন্দাদের যাবার জন্য আসন পাতা রয়েছে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তোরণের মধ্যস্থলে একটি জায়গায় অন্ধ ও খঞ্জেরা বাস করে। মন্দিরের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে তাদের খোরপোষ। সরবরাহ করা হয়। সব কয়টি তোরণের মধ্যেই অনুরূপ ব্যবস্থা আছে। মন্দিরের অভ্যন্তরে রুগ্নব্যক্তিদের জন্য একটি হাসপাতাল আছে, রান্নার জন্য একটি ঘরও আছে। আর আছে ডাক্তার ও খাদ্য পরিবেশনকারী কর্মীদল। শুনেছি, জীবিকার্জনে অক্ষম বৃদ্ধেরা এ মন্দির থেকে তাদের খোরপোষ পায়, আর পায় অনাথ ও নিঃসম্বল বিধবারা।

তাদের একজন রাজা এ মন্দির তৈরি করে গেছেন এবং এ শহর, শহরের গ্রাম ও ফল-বাগিচার আর মন্দিরের জন্য দান করে গেছেন। এ রাজার একটি প্রতিকৃতি মন্দিরে রক্ষিত আছে। তারা তার পূজা করে।

এ শহরের এক অংশে মুসলমানদের বাসস্থান। সেখানে তাদের মসজিদ, মুসাফিরখানা, বাজার প্রভৃতি আছে। তাদের একজন কাজী ও একজন শেখও আছেন। চীনের প্রতি শহরেই একজন করে শেখ-উল-ইসলাম থাকবার নিয়ম। তার কাছে মুসলমানদের সব কিছু ব্যাপার জানানো হয় এবং তিনি সেখানকার মুসলমান সমাজ ও সরকারের মধ্যস্থতা করেন। কাজী তাদের মধ্যকার আইন-সংক্রান্ত বিষয়ের মীমাংসা করেন। আমার বাসস্থান ছিলো আওহাদউদ্দিন নামে সিজারের একজন খ্যাতনামা ব্যক্তির গৃহে। তিনি ছিলেন অমায়িক প্রকৃতির একজন বিত্তশালী ব্যক্তি। আমি তার সঙ্গে চৌদ্দ দিন ছিলাম। এ সময়ে কাজী ও অন্যান্য মুসলমানদের কাছ থেকে একটার পর একটা উপহার অনবরত আমার কাছে এসেছে। প্রতিদিন তারা নতুন একটা আনন্দোৎসবের ব্যবস্থা করে গীতবাদ্যসহ সুসজ্জিত নৌকায় এসে তাতে যোগদান করতো। সিন-কালান শহরের পরে বিধর্মী বা মুসলমানদের কোনো শহরই নেই। শুনেছিলাম, সেখান থেকে ইয়াজুজ-মাজুজ দূর্গ প্রাচীর ষাট দিনের পথ। এর মধ্যবর্তী স্থানে যাযাবর বিধর্মীদের বাস। সুযোগ পেলেই তারা নরমাংস ভক্ষন করে১৮। সেজন্য সে দেশে কেউ যায় না। আমিও সিন-কালানে এমন কারও দেখা পাইনি যে দূর্গ প্রাচীরে গিয়েছে অথবা গিয়েছে এমন লোকের সঙ্গে আলাপ করেছে।

আমার জয়তুনে ফিরে আসবার কয়েকদিন পরেই কানের হুকুমনামা এসে পৌঁছলো। তিনি আমাকে বিশেষ সম্মানের সঙ্গে, আমার ইচ্ছানুসারে জলপথে, নতুবা স্থলপথে রাজধানীতে নিয়ে যেতে লিখলেন। নদীপথে ভ্রমণ করাই আমার পছন্দসই বলে শাসনকর্তাদের ব্যবহারের উপযোগী করে তৈরি একখানা জাহাজ ঠিক করা হলো আমার। যাত্রার জন্য। শাসনকর্তা তার কর্মচারীদের আমার সঙ্গে দিলেন। তিনি নিজে এবং কাজী মুসলমান ব্যবসায়ীরা আমার জন্য অনেক খাদ্যদ্রব্যও পাঠালেন। আমরা রাজকীয় অতিথি হিসাবে যাত্রা করলাম। কোনো এক গ্রামে গিয়ে আমরা মধ্যাহ্নভোজন করতাম। এবং অপর এক গ্রামে গিয়ে করতাম সান্ধ্যভোজন। দশ দিন পর আমরা কানজান পৌঁছি। ফলের বাগানে আবৃত একটি প্রশস্ত সমতলভূমিতে কানজান বেশ বড় একটি শহর। ফলের বাগানের জন্য শহরটিকে দামাস্কের ঘুটা২০ বলে মনে হয়। আমরা সেখানে পৌঁছলে কাজী, শেখ-উল-ইসলাম এবং ব্যবসায়ীরা পতাকা, ঢাক-ঢোল, বাঁশী প্রভৃতি বাদ্যবাজনাসহ দেখা করতে এলেন। তাঁরা আমাদের জন্য ঘোড়া এনেছিলেন। কাজেই আমরা সেখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে রওয়ানা হলাম এবং তাঁরা পায়ে হেঁটে আমাদের আগে-আগে চলতে লাগলেন। কাজী ও শেখ-উল-ইসলাম ছাড়া আর কেউ আমাদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়লেন না। স্বয়ং শাসনকর্তাও তার কর্মচারীদের নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। কারণ, সুলতানের অতিথিদের তারা খুব সম্মানের চোখে দেখে। এভাবে আমরা শহরে এসে পৌঁছলাম। এ শহরের চারটি দেওয়াল। প্রথম ও দ্বিতীয় দেওয়ালের মধ্যে বাস করে সুলতানের গোলামগণ। তাদের কেউ-কেউ রাত্রে

এবং কেউ-কেউ দিনে শহর পাহারা দেয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেওয়ালের মধ্যবর্তীস্থানে। বাস করে অশ্বারোহী সৈন্যেরা এবং একজন জেনারেল যিনি শহরের শাসনকার্য

পরিচালনা করেন। তৃতীয় দেওয়ালের মধ্যে বাস করে মুসলমানরা। এখানেই আমরা। শেখের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহন করলাম। চতুর্থ দেওয়ালের মধ্যে চীনাদের বাস। শহরের চারটি এলাকার মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। এ শহরের একটি প্রবেশদ্বার থেকে অপরটির দূরত্ব তিন থেকে চার মাইল। আগেই বলেছি এখানে প্রত্যেকেরই নিজের বাড়ী, বাগান ও জমি আছে।

আমি কানজানফুতে থাকতে একদিন বিশেষ গণ্যমান্য একজন ডাক্তারের প্রকাণ্ড একখানা জাহাজ সেখানে এসে ভিড়লো। তিনি সিউটার মওলানা কিয়ামউদ্দিন নামে পরিচিত। তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন কিনা জিজ্ঞাসা করা হলো। নাম শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ হলো। প্রচলিত অভিবাদনাদির পরে কথাবার্তা শুরু করে আমার মনে হলো তিনি আমার পূর্ব পরিচিত লোক। তার দিকে একাগ্রভাবে চাইতে দেখে তিনি অবশেষে বলে উঠলেন, আপনি আমার দিকে এমনভাবে চেয়ে আছেন যে দেখে মনে হয় আপনি আমাকে চেনেন।

কাজেই আমিও তখন বললাম, আপনি কোথা থেকে এখানে এসেছেন?

‘সিউটা থেকে তিনি জবাব দিলেন।

আমি বললাম, আমি এসেছি তাজিয়ার থেকে।

একথা বলায় তিনি পুনরায় আমার সঙ্গে অভিবাদনের আদান-প্রদান করলেন। তিনি চোখের পানি ছেড়ে দিলেন, সমবেদনায় আমারও চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠলো। অতঃপর আমি বললাম, আপনি কি ভারতে গিয়েছেন?

তিনি বললেন, হ্যাঁ, রাজধানী দিল্লী আমি গিয়েছি।

একথা বলায় আমারও তাকে মনে পড়লো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আল-বুশরী?

জবাবে তিনি বললেন, হ্যাঁ!

আমার মনে পড়লো, দাড়ী-গোঁফ না-উঠতে কিশোর ছাত্র অবস্থায় তাঁর মাতুল মারসিয়ার আবুল কাসেমের সঙ্গে দিল্লী এসেছিলেন। আমি তার বিষয়ে সুলতানকে বলায় তিনি তাকে তিন হাজার দীনার দিয়েছিলেন এবং দিল্লীর দরবারে থাকবার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি চীনদেশে যাবার জন্য তৈরি হয়েছেন বলে সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। চীনে এসে তিনি যথেষ্ট উন্নতি করেছেন এবং প্রভূত ধনসম্পত্তির। মালিক হয়েছেন। তার কাছে শুনলাম, তার পঞ্চাশ জন শ্বেতকায় গোলাম এবং সমসংখ্যক বাদী আছে। অন্যান্য অনেক উপহার সামগ্রীর সঙ্গে তিনি আমাকে দু’জন গোলাম ও দুজন বাদী উপহার দেন। পরবর্তী এক সময়ে আমি তার এক ভাইয়ের দেখা। পাই কাফ্রীদের দেশে (নিগ্রোল্যান্ড)। দু’ভায়ের বাসস্থান কততা দূরে অবস্থিত।

কানজানতে পনেরো দিন কাটিয়ে আবার যাত্রা শুরু করলাম। চীনদেশে যতো ভালকিছুই থাক, আমার কাছে এদেশ আকর্ষনীয় মনে হলো না। এদেশের বদ্ধমূল নীচতা ও ধর্মহীনতা আমার মনকে বিশেষভাবে পীড়িত করেছে। ঘরের বাইরে গেলেই নজরে পড়তো নানা রকম ন্যাক্কারজনক ব্যাপার। তা দেখে আমার এতো দুঃখ হতো যে নিতান্ত প্রয়োজন না-হলে আমি ঘরের বার হতাম না। চীনে যখনই আমার কোনো মুসলমানের সঙ্গে দেখা হতো তখনই মনে হতো স্বধর্মী একজন আত্মীয়ের দেখা পেলাম। ডাক্তার আল-বুশরী আমার প্রতি এতটা সদয় ছিলেন যে, চারদিনের পথ বায়াম কুলু ২১ পৌঁছা অবধি তিনি আমাদের সঙ্গে এলেন। এ ছোট শহরটিতে শুধু চীনাদের বাস। তাদের কিছু সংখ্যক সৈনিক, বাকি সবাই সাধারণ শ্রেণীর লোক। সেখানে মাত্র চার ঘর মুসলমানের বাস। তারা সবাই আমার এ জ্ঞানী বন্ধুর মুরিদ। আমরা তিন দিন তাদের একজনের গৃহে কাটিয়ে আবার রওয়ানা হলাম।

আমরা পূর্বের নিয়ম মতই এক গ্রামে মধ্যাহ্ন ভোজনের জন্য এবং রাত্রের আহারের জন্য অন্য গ্রামে গিয়ে থেমে নদী পথে চলতে লাগলাম। এমনি করে সতেরো দিন পরে আমরা পৌঁছলাম কাসা (হংচৌ) শহরে। ২২ পৃথিবীতে আমি যত শহর দেখেছি তার। ভেতর এ শহরটিই সর্ববৃহৎ। স্বাভাবিকভাবে হেঁটে এবং প্রয়োজনমত থেমে এ শহরটির এপাশ থেকে ওপাশ অবধি যেতে তিন দিন সময় লাগে। এ শহরটিও চীনের পূর্ব-বর্ণিত নিয়মে তৈরি। এখানেও প্রত্যেকেরই নিজের বাড়ী ও বাগান আছে। এ শহরটি ছয় ভাগে বিভক্ত। সে সব বিবরণ পরে দেওয়া হবে। আমরা সেখানে পৌঁছলে অধিবাসীদের একটি দল এলো আমাদের সঙ্গে দেখা করতে শ্বেতপতাকা, জয়ঢ়াক, বাঁশী প্রভৃতি নিয়ে। এ দলে ছিলেন কাজী শেখ-উল-ইসলাম এবং এ শহরের একজন প্রধান বাসিন্দা মিশরের ওসমান ইব্‌নে আফফানের পরিজনবর্গ নগরের শাসনকর্তা ও তাঁর কর্মচারীদের নিয়ে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আমরা নগরে প্রবেশ করলাম।

খানসা শহরের ছয়টি অংশ। প্রত্যেক অংশই পৃথক প্রাচীরে ঘেরা এবং সব কয়টি অংশ ঘিরে বাইরেও একটি প্রাচীর আছে। শহরের প্রথমাংশে প্রহরী ও তাদের পরিচালকের বাসস্থান। কাজীর কাছে শুনেছি, তাদের সংখ্যা বারো হাজার। তাদের সেই পরিচালকদের বাসায় আমরা প্রথম রাত্রি কাটালাম। দ্বিতীয় দিন আমরা শহরের দ্বিতীয়াংশে যে দরজা দিয়ে ঢুকলাম তার নাম য়িহুদী দরজা। এখানে বাস করে বহু সংখ্যক য়িহুদী, খৃষ্টান ও সূর্য ও পূজার। তুর্কী। এ অংশের শাসনকর্তা একজন চীনবাসী। আমাদের দ্বিতীয় রাত্রি তার গৃহেই কাঠে। তৃতীয় দিনে আমরা শহরের তৃতীয় অংশে প্রবেশ করি। এখানে মুসলমানদের বাস। এটি শহরের একটি চমৎকার অংশ। বাজারগুলো অন্যান্য মুসলিম দেশের বাজারের মতোই সাজানো গোছানো। এখানে। মসজিদ মোয়াজ্জিন সবই আছে। আমরা শহরে ঢুকেই শুনতে পেলাম জহুরের নামাজের আজান দেওয়া হচ্ছে। এখানে আমরা ওসমান ইব্‌নে আফফানের গৃহে স্থান পেলাম। তিনি একজন বিত্তশালী ব্যবসায়ী এবং এ শহরকে খুব পছন্দ করেন বলে নিজের গৃহ। এখানে তৈরি করেছেন। তাঁর নামানুসারে শহরের এ অংশ ওসমানিয়া নামে পরিচিত। তিনি এখানে যথেষ্ট সম্মান ও প্রভাব প্রতিপত্তির অধিকারী। তিনিই কানসা শহরের প্রধান মসজিদটা তৈরি করিয়েছেন এবং মসজিদের নানা রকম উন্নতি সাধন করেছেন। এখানকার মুসলমানদের সংখ্যা বিপুল। আমরা পনেরো দিন তাদের সঙ্গে কাটাই। প্রত্যেক দিন ও রাত্রেই আমাদের জন্য নতুনভাবে অতিথি সঙ্কারের ব্যবস্থা হয়। তারা প্রত্যেকদিনই আমাদের জন্য উপাদেয় খাদ্যের ব্যবস্থা করেছে এবং শহরের নিত্য নূতন জায়গায় আমাদের নিয়ে বেড়াতে বের হয়েছে।

একদিন তাদের সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে বের হয়ে আমি চতুর্থ শহরে বা শহরের চতুর্থাংশে গিয়ে প্রবেশ করলাম। এখানেই রাজধানী এবং প্রধান শাসনকর্তা কোয়ার্টে এখানে বাস করেন। আমরা প্রবেশদ্বারে পৌঁছতেই আমার সঙ্গীদের পৃথক করে নেওয়া। হলো। তখন উজির এসে আমাকে প্রধান শাসনকর্তার প্রাসাদে নিয়ে গেলেন। এ উপলক্ষ্যেই তিনি সিরাজের দরবেশ জালালউদ্দিনের দেওয়া আলখেল্লাটি নিয়ে নেন। সে কথা আগেই বলেছি। শহরের ছয়টি অংশের মধ্যে এ অংশটি সবচেয়ে বেশি সুন্দর। সুলতানের গোলাম ও ভৃত্য ছাড়া এখানে আর কেউ বাস করে না। এ অংশের ভেতর দিয়ে তিনটি নহর বয়ে গেছে। তার একটি খালের মতো। বড় নদী থেকে তা এসেছে। এ নদী দিয়ে শহরের ছোট-ছোট নৌকায় খাদ্যদ্রব্য ও কয়লা এসে পৌঁছে। অনেক প্রমোদতরীও এখানে আছে। শহরের মধ্যস্থলে একটি কেল্লা,২৩ আকারে বিশাল। কেল্লার মধ্যস্থলে শাসনকর্তার বাসস্থান। কেল্লায় অন্তর্গত অর্ধবৃত্তাকার খিলান-শ্রেণীতে। বহু সংখ্যক কারিগর বসে পোষাক পরিচ্ছদ ও অস্ত্রপাতি তৈরি করে। আমীর কোয়ার্টে বলেছেন এক সময়ে মোল শ’ দক্ষ কারিগর এবং তাদের প্রত্যেকের অধীনে তিন বা চারজন করে শিক্ষানবিশ ছিল। তারা সবাই ছিলো কানের গোলাম। তাদের সবারই গায়ে শিকল বেড়ি লাগানো। দূর্গের বাইরে তারা বাস করে। শহরের বাজার অবধি যাবার অনুমতি তাদের আছে কিন্তু প্রবেশদ্বারের বাইরে যাবার অনুমতি নেই। প্রতিদিন শাসনকর্তার সম্মুখ দিয়ে এক-এক বারে এক শ’ জন করে হটিয়ে নেওয়া হয়। তখন তাদের কাউকে খুঁজে না পেলে তার পরিচালক বা রক্ষককে দায়ী করা হয়। দশ বছর এভাবে কেউ কাজ করলে প্রচলিত রীতি অনুসারে তাকে শৃঙ্খলমুক্ত করা হয়। তখন সে ইচ্ছে মতো আগের কাজও করতে পারে অথবা কানের রাজত্বের মধ্যে থেকে অন্য কাজও করতে পারে কিন্তু তাকে এলাকার বাইরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় না। এমনি করে বয়স যখন তার পঞ্চাশ বছর হয় তখন আর তাকে কাজ করতে হয় না। সরকারী খরচে তার ভরণ-পোষণ চলে।২৪ অনুরূপভাবে অন্যেরাও যখন পঞ্চাশে পদার্পণ করে অথবা কমবেশী পঞ্চাশ বছর উত্তীর্ণ করে তবে তারাও সরকারী ভাতা পায়। তারপর ষাট বছর বয়স হলে তাকে শিশু বলে গণ্য করা হয়, এবং আইনগতভাবে সে তখন অপরাধের সাজা পাবার অযোগ্য। চীন দেশে বৃদ্ধদের বিশেষ সম্মানের চোখে দেখা হয়। তখন তাদের বলা হয় ‘আতা’ অর্থাৎ পিতা।

আমীর কোয়াটেই চীনের প্রধান আমীর ২৫। আমীর তার প্রাসাদে আমাদের মুসলমান হিসাবে গ্রহণ করেন এবং আমাদের উপলক্ষ্যে একটি ভোজের আয়োজন করেন। শহরের গণ্যমান্য লোকেরা সে ভোজ-সভায় যোগদান করেন। এ ধরণের ভোজকে তারা বলে তওয়া২৬। এজন্য আমীর মুসলমান বাবুরি ব্যবস্থা করেন। ভোজ্যবস্তু যাতে হালাল হয় সেজন্য হারাই জানোয়ার জবাই করে রান্না করে। একজন বিশিষ্ট আমীর হওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বহস্তে আমাদের খাদ্য পরিবেশন করেন। এবং গোশত স্বহস্তে কেটে দেন। আমরা তিনদিন তার প্রাসাদে মেহমান ছিলাম। আমাদের যাত্ৰা কালে তিনি তার ছেলেকে আমাদের সঙ্গে খাল অবধি এগিয়ে দিতে পাঠান। এখানে আমরা একটি জাহাজে গিয়ে উঠলাম। জাহাজটি দেখতে বারুদবাহী জাহাজের মতো। গায়ক ও বাদকদল সহ আমীরজাদা আরেকটি জাহাজে গিয়ে উঠলেন। গায়কগণ চীন আরবী ও ফারসী ভাষায় গান গেয়ে আমাদের শুনালো। আমীরজাদা ফাসীর সুরের একজন ভাল সমঝদার। গায়করা যখন আমাদের একটি ফাসী গান গেয়ে শুনালো তখন তিনি সে গানটি বার বার গাইতে বললেন। তাতে সে গানটি আমার মুখস্থ হয়ে গেলো। চমৎকার সে গানটি হলো–

Ta’ dil bimihnat da’dim
dar hahr-i fikr ustadim
Chun dar namaz istadim
qavi dimihrab andarim.২৭

উজ্জ্বল রঙের রঙীন পাল ও চন্দ্রাতপ খাটানো অনেক জাহাজ নিয়ে বহু লোক খালে এসে জড়ো হয়েছে। তাদের জাহাজগুলোও রং করা হয়েছে। তারা তখন কৃত্রিম যুদ্ধ আরম্ভ করলো ও লেবু ও কমলালেবু২৮ একে অপরকে নিক্ষেপ করতে লাগলো। আমরা সন্ধ্যায় আমীরের প্রাসাদে ফিরে সে রাত্রি সেখানেই কাটালাম। গায়ক ও বাদকরা সেখানে ছিল, তারা সুললিত সুরে গান গেয়ে শুনালো।

সে রাত্রে সেখানে একজন যাদুকর ছিলো। সে কানেরই একজন ক্রীতদাস। আমীর তাকে হুকুম করলেন তোমার কিছু খেলা দেখাও আমাদের।

লোকটি কাঠের একটি বল বের করলো। বলটির গায়ে কয়েকটি ছিদ্র এবং চামড়ার ফালি লাগানো। বলটি সে শূন্যে ছুঁড়ে মারতেই তা উর্ধ্বে উঠতে-উঠতে আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। গ্রীষের গরমে আমরা প্রাসাদের দরবার কক্ষের মধ্যস্থলে বসেছিলাম। লোকটির হাতে এক গাছি দড়ি ছাড়া আর কিছুই রইল না। তখন সে তার একজন শাগরেদকে ডেকে সেই দড়ি বেয়ে উপরে উঠতে বললো। অবশেষে সেও দড়ি বেয়ে উঠতে-উঠতে আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেলো। যাদুকর তিনবার শাগরেদের। নাম ধরে ডাকলো কিন্তু কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেলো না। তখন রাগের ভাণ করে একখানা ছোরা হাতে নিয়ে সেও দড়ি বেয়ে উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। তারপর সেই শাগরেদের একখানা কাটা হাত পড়লো উপর থেকে, পরে একখানা পা, তারপর বাকি হাত, পা এবং ধড়টা। সবশেষে পড়লো তার মাথা। তখন সে নিজে নেমে এলো হাঁপাতে হাঁফাতে। তার সমস্ত কাপড়-জামা রক্ত রঞ্জিত। নেমে এসে সে আমীরের সামনের মাথা চুম্বন করে চীন ভাষায় কি যেনো বললো। আমীরও তাকে কি যেনো হুকুম করলেন। তখন যাদুকর ছেলেটির হাত পা ঠিক জায়গা মতো লাগিয়ে একটি লাথি। মারলো। সঙ্গে সঙ্গে সে সুস্থ দেহে উঠে দাঁড়ালো। বিষয়ে আমার হৃদকম্প হতে লাগলো। ভারতের সুলতানের দরবারে একবার এ রকম একটি ব্যাপার দেখে আমার ঠিক এমনি অবস্থাই হয়েছিলো। তখন তারা আমাকে কিছু ঔষধ এনে দেওয়ায় আমি সুস্থবোধ করলাম। কাজী আখতারউদ্দিন আমার পাশেই বসেছিলেন। তিনি বললেন, খোদার কসম করে বলতে পারি, দড়ি বেয়ে ওঠা-নামা, হাত-পা কাটা কিছুই নয়,–সবই ভেলকি।

পরদিন আমরা শহরের পঞ্চমাংশ বা বৃহত্তম অংশে প্রবেশ করলাম। এখানে সাধারণ লোকদের বাস। এখানকার বাজারগুলো উত্তম। বাজারে অনেক দক্ষ কারিকর আছে। এ শহরের নামে যে উৎকৃষ্ঠ শ্রেণীর কাপড় পাওয়া যায় তা শহরের এ অংশেই তৈরি হয়। আমরা এখানকার শাসনকর্তার মেহমান হিসেবে একরাত কাটালাম। পরের দিন গেলাম শহরের ষষ্ঠ অংশে, যে দরজা দিয়ে সেখানে প্রবেশ করলাম তার নাম মাঝির দরজা। বড় নদীর তীরে অবস্থিত এ অংশে নাবিক, জেলে সূতার মিস্ত্রীর বাস। সে সঙ্গে আছে তীরন্দাজ ও পদাতিক সৈন্যেরা। তারা সবাই সুলতানের গোলাম। তাদের সঙ্গে অন্য কোনো শ্রেণীর লোক এখানে বাস করে না। এদের সংখ্যাও কম নয়। আমরা সেখানেও শাসনকর্তার মেহমান হয়ে এক রাত কাটালাম। আমীর কোয়ার্টে আমাদের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য-সহ একটি জাহাজ যাত্রার জন্য সজ্জিত করালেন। এবং আমাদের সুখ-সুবিধা বিদানের জন্য একজন পারিষদও পাঠালেন। আমরা চীনের। এ শেষ শহর ত্যাগ করে খিতা (ক্যাথে) নামক দেশে প্রবেশ করলাম।

ক্যাথে পৃথিবীতে একটি সর্বোত্তম আবাদী জমিপূর্ণ দেশ। এ দেশের কোথাও এতোটুকু জমি অনাবাদী নেই। তার কারণ, কোনো জমি অনাবদী পড়ে থাকলেও তার বাসিন্দা বা আশেপাশের লোকদের সে জমির কর দিতে হয়। খাসা শহর থেকে খান বালিক (পিকিং) শহর অবধি এ নদীর উভয় তীরে ফলের বাগান, গ্রাম ও মাঠ দেখতে পাওয়া যায়। খাসা থেকে খান্-বালিক চৌষট্টি দিনের পথ। এ অঞ্চলের কোথাও মুসলমানদের দেখা পাওয়া যায় না। ক্কচিৎ মুসলমান সফরকারীরা এখানে আসেন। কারণ, এ অঞ্চল মুসলমানদের স্থায়ীভাবে বসবাসের যোগ্য নয়। এখানে কোনো বড় শহর নেই। অধিকাংশই গ্রাম ও বিস্তৃত২৯ মাঠ। মাঠগুলো শস্য, ফলের গাছ ও ইক্ষু প্রভৃতিতে পূর্ণ। ইরাকের আনবার ও আনা মধ্যবর্তী চার দিনের পথ বিস্তৃত মাঠ ছাড়া এমন বিস্তৃত মাঠ আমি দুনিয়ার আর কোথাও দেখিনি। আমরা প্রতি রাত্রেই কোনো গ্রামে গিয়ে নামতাম এবং আমাদের জন্য সুলতানের মেহমান হিসাবে বরাদ্দকৃত রসদাদি গ্রহণ করতাম।

এভাবে আমরা খান-বালিক শহর-যা-খানিকু ৩০ নামেও পরিচিত, সফর শেষ করলাম। তাদের সম্রাট কানের রাজধানী খান-বালিক এ সম্রাটের রাজ্য চীন ও ক্যাথে অবধি বিস্তৃত। আমরা এখানে পৌঁছে রীতি অনুসারে শহরের দশ মাইল দূরে থাকতে আমাদের জাহাজ নোঙ্গর করলাম। আমাদের আগমন সংবাদ নৌ-সেনাপতিদের লিখিতভাবে জানানো হলে তারা আমাদের বন্দরে প্রবেশের অনুমতি দিলেন। বন্দরে। প্রবেশের পরে আমরা শহরে অবতরণ করলাম। পৃথিবীর বৃহত্তম শহরের ভেতর এটিও একটি। এ শহরটি চীন দেশের শহরের ধরনে নির্মিত নয়। চীন দেশের শহরের ভেতরেই বাগান থাকে। অন্যান্য দেশের মতো এখানকার বাগান নগর-প্রাচীরের বাইরে। শহরের মধ্যস্থলে সুলতানের প্রাসাদ একটি দূর্গের ন্যায়। তার বর্ণনা পরে। দেওয়া হবে। আমি এখানে সাগার্জের শেখ বোরহানউদ্দিনের সঙ্গে অবস্থান করি। ভারতের সুলতান একেই চল্লিশ হাজার দীনার পাঠিয়ে ভারতে যাবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন কিন্তু ইনি সে টাকা গ্রহণ করে নিজের দেনা পরিশোধ করেন এবং ভারতে যেতে অস্বীকার করে চীন যাত্রা করেন। এখানে কান তাকে সদর-আল-জিহান উপাধি দিয়ে তার রাজ্যের সমস্ত মুসলমানদের শীর্ষে তাকে স্থান দিয়েছেন। লুর দেশে যেমন শাসনকর্তাকে বলা হয় ‘আবেগ’ ৩১ এখানে তেমনি যিনি রাজ্য পরিচালনা করেন তাকে বলা হয় কান। এ কানের নাম পাশায় ৩২। দুনিয়ার বুকে পাশায়ের এ রাজ্যের চেয়ে বড় রাজ্য অপর কোনো বিধর্মীর নেই। তার প্রাসাদ শহরের মধ্যস্থলে। অবস্থিত। এটিই তিনি বাসস্থানরূপে ব্যবহার করেন। প্রাসাদের বহুলাংশ কাষ্ঠদ্বারা সূচারুভাবে নির্মিত।

আমরা যখন রাজধানী খান-বালিকে পৌঁছি তখন কান অনুপস্থিত ছিলেন। কানের ভ্রাতৃ সম্পৰ্কীয় ফিরোজ নামক এক ব্যক্তি কারাকোরাম জেলায় এবং ক্যাপের৩৩ বিশ বালিগে বিদ্রোহ করেছিলেন বলে কান তাকে দমন করতে গেছেন। উল্লিখিত জায়গা থেকে রাজধানী আবাদী অঞ্চলের ভেতর দিয়ে তিন মাসের পথ। কান রাজধানী ত্যাগ করলে আমীরদের অধিকাংশ তাঁর আনুগত্য অস্বীকার করে তাঁকে পদচ্যুত করাতে চায়, কারণ তিনি ইয়াসাক’ বা তাদের পূর্বপুরুষ চেংগিস খানের উপদেশাবলী মেনে চলেন না। এ চেংগিস খাই কয়েকটি মুসলিম দেশ ধ্বংস করেন। আমীররা কানের বিদ্রোহী ভাইপোর কাছে গিয়ে কানকে সিংহাসন ছেড়ে দিতে লিখিতভাবে জানান এবং খানসা শহর তার ভরণ-পোষণের জন্য রাখতে বলেন। তিনি তাতে অস্বীকৃত হন। ফলে তাদের ভেতর যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে তিনি পরাজিত ও নিহত হন।

আমাদের রাজধানীতে পৌঁছবার কয়েকদিন পরেই আমরা এ খবর শুনতে পাই। শহরটি সজ্জিত করা হয় এবং একমাস অবধি বাশী জয়-ঢাক প্রভৃতি বাদ্য-বাজনা ও নানাবিধ আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা হয়। অতঃপর নিহত কান এবং সে সঙ্গে তার জ্ঞাতিভ্রাতা ও অন্যান্য প্রায় শতেক নিহত ব্যক্তিকে সেখানে আনা হয়। তারপর মাটী খনন করে মাটীর নীচে প্রকাও একটি প্রকোষ্ঠ তৈরি করা হয়। প্রকোষ্ঠটি মূল্যবান আসবাবপত্রে সজ্জিত করে কানের দেহ রাখা হয় সেখানে। কানের সঙ্গে তার অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রাসাদের স্বর্ণ ও রৌপ্যের মূল্যবান পাত্ৰাদিও ভূগর্ভে রক্ষা করা হয়। সর্বশেষে সেই প্রকোষ্ঠে দেওয়া হয় কানের চারজন বাদী ও প্রধান পরিচারিকাদের দু’জন পানপাত্র বহন করা ছিল যাদের কাজ। তারপর প্রকোষ্ঠের দরজা চিরকালের জন্য বন্ধ করে সে জায়গায় মাটী চাপা দিয়ে বেশ বড়ো একটি টিলা তৈরি করা হয়। তখন তারা চারটি ঘোড়া নিয়ে আসে সেখানে। ঘোড়াগুলো পরিশ্রান্ত হয়ে থেমে না-যাওয়া অবধি কানের কবরের চারপাশে দৌড়াতে থাকে। ইত্যবসরে কবরের উপর কাঠের একটি ঘর নির্মাণ করা হয়। তারপর ঘোড় চারটি সেখানে ঝুলিয়ে রাখা হয় তাদের লেজ থেকে মাথা অবধি৩৪ একটি করে কাঠের দণ্ড ঢুকিয়ে। কানের উপরোক্ত আত্মীয়দেরও এমনি করে ভূগর্ভস্ত প্রকোষ্ঠে রাখা হয় তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গৃহের তৈজসপত্রসহ। আত্মীয়দের মধ্যে দশজন ছিলেন প্রধান। তাদের প্রত্যেকের কবরের উপর ঝুলানো হয় তিনটি করে শূলবিদ্ধ ঘোড়া। বাকি সবার কবরের উপরে ঝুলানো হয় একটি করে।

এ দিনটি পালন করা হয় পবিত্র পর্বদিন হিসেবে। জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে নারী পুরুষ কেউ এ দিনের উৎসবে অনুপস্থিত থাকে না। সেদিন সবাই তারা শোকের পোশাক পরিধান করে। অমুসলিমরা পরে হাতাবিহীন সাদা ফতুয়া আর মুসলিমরা পরে লম্বা সাদা কোর্তা। কানের স্ত্রীরা এবং সভাসদগণ চব্বিশ দিন কবরের আশেপাশে তার ফেলে বাস করেন। কেউ-কেউ তার চেয়ে বেশী, এমন কি এক বছর অবধি সেভাবে কাটান। তাদের খাদ্য ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহের জন্য সেখানে রীতিমত একটি বাজার বসে যায়। আমি যতদূর জানি, আজকাল এ-রকম রীতি আর কোনো জাতির মধ্যেই প্রচলিত নেই। ভারতীয় বিধর্মীরা এবং চীনের লোকেরা তাদের মৃতদেহ দাহন করে। অন্য সবাই মৃতদের দাফন করে কিন্তু আর কাউকে সে সঙ্গে দেয় না। বিশ্বস্ত লোকের মুখে শুনেছি, কাফ্রী দেশের অধিবাসীরা তাদের রাজা মারা গেলে একটি নাউস বা প্রকাণ্ড গর্ত খনন করে। তারপর সে গর্তে রাজার সঙ্গে তার কতিপয় সভাসদ ভৃত্য এবং প্রধান প্রধান বংশের ত্রিশটি ছেলে ও মেয়ের হাত পা ভেঙ্গে সমাহিত করে। তাদের সঙ্গে কয়েকটি পানপাত্রও দিয়ে দেওয়া হয়।

কানের হত্যার পরে তার ভাইপো ফিরোজ রাজ্য দখল করলে তিনি কারাকোরামে রাজধানী স্থাপন করা স্থির করেন। কারণ, এখান থেকে তার জ্ঞাতিভাই তুর্কীস্থানের রাজার ও ট্রান্সসোসানিয়ার৩৫ রাজ্য ছিল নিকটে। পরে কতিপয় আমীর, কানের হত্যাকালে যারা উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিঘ্ন ঘটায়, ফলে রাজ্যের সর্বত্র বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

***

টিকা

পরিচ্ছেদ ১১

১। যে নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে চীনাকে ভেদ করে ক্যান্টেনোর সমুদ্রে এসে পড়েছে সেই মহা নদীর বিবরণ পাঠ করলে মন হয় যে এ বিবরণ অনেক সময় প্রমাণ করছে যে ইব্‌নে। বতুতার চীন ভ্রমণ একটি নিছক গল্প। এ কথা মনে রাখতে হবে যে ইব্‌নে বতুতা চীনের বর্হিভাগে নিজে ভ্রমণ করেছেন সেটা ব্যতীত চীন সম্বন্ধে তার অধিক কিছু জানা ছিল না। এবং তিনি যে সব বিষয় সগ্রহ করেছেন সেগুলি বিন্নি সংবাদদাতাদের কাছ থেকে সংগৃহীত (তার সব সময় নির্ভরযোগ্যও ছিল না)-এবং স্থানে তিনি সে সময়ের সাধারণ মতকে পুণঃপ্রকাশ করেছেন। জীবনের নদী’ এর প্রথম অধ্যায়ে পিকিং এবং ইয়াংসির মধ্যস্থিত গ্রাও ক্যানাল। সমুদ্র উপকূলে অবস্থিত সওদারগণ আভ্যন্তরিক জল-পথের ব্যাপারে স্বল্পই জানতেন। এই জল পথ হ্যাংচাও এবং ইয়াংসিকে পশ্চিম নদী এবং ক্যান্টনের নদীর সঙ্গে সম্ভবতঃ সিয়াংকিয়াংয়ের ভিতর দিকে যুক্ত করেছিল এবং তার ফলে পিংকিয়াংয়ের মোহনাকে সমস্ত জল-পথ বলে মনে করেছিলেন। ইব্‌নে বতুতার এই বিবরণকে ব্যাখ্যা করা কঠিন যে জেতুন (তিসুয়ান-চাও-ফু) আভ্যন্তরিক জল-পথের দ্বারা ক্যান্টন এবং হ্যাংচাওয়ের সঙ্গে। এখানে বোধ হয় তিনি তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে কথা বলেছেন। কালিকট এবং কুইলনের মাঝখানে স্থলপথে ভ্রমণ সম্বন্ধে আমরা যেমন উপরে দেখেছি (পরিচ্ছেদ ৭, টীকা ১৭) ইব্‌নে বতুতা অপ্রয়োজনীয় বলে ভূভাগের বর্ণনা বাদ দিয়েছেন অথবা তার ভ্রমণকাল এবং তার দশ বছর পরে ভ্রমণ বৃত্তান্তের মৌখিক বিবৃতি দেওয়ার সময়ে সম্ভবতঃ সে ভুলে গিয়েছেন। এ কথা লিপিবদ্ধ করা কিছু অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে কতিপয় চীনে সহ অন্য সব লেখকও জেতুনকে সেই একই জল-পথের তীরে অবস্থিত বলে স্থির করেছেন। যেমন হ্যাংচাও উক্ত জল-পথের উপর রয়েছে, (খাসা বাক কুইবো)। (ইউল এবং ডান্ মজিক ছাড়াও আরও, হার্টম্যান, দার ইসলাম, ৪র্থ খণ্ড, ৪৩৪)।

২। পর্ডিনানের ফ্রাইয়ার ওড্ডারিকও মন্তব্য করেন ফাচোর সম্পর্কে, “পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মোরগ এখানে দেখতে পাওয়া যায়; কিন্তু তিনি আবার ক্যান্টনের রাজহাঁস সম্বন্ধে বলেন যে তারা “বৃহত্তর, সুন্দর এবং সস্তা পৃথিবীর যে কোনো স্থানের রাজহাঁস অপেক্ষা” (ক্যাথে ২য় খণ্ড, ১৮১, ১৮৫)।

৩। প্রথম যুগের একজন পর্যটক (Voyage de Marchand arabe Sulayman— en 851, অনুবাদক জি, ফেরাও, পৃঃ ৫৫) আমাদের বলছেন যে। চীনেগণ তাদের মৃত ব্যক্তিকে কবর দিতেন যেমন এখনো দিয়ে থাকেন। কিন্তু মার্কোপলো বার বার শবদাহের কথা উল্লেখ করেছেন-মনে হয় এটা চীন দেশে তখন একটি সাধারণ প্রথা ছিল।

৪। বালি কি বালিশ হচ্ছে মূলতঃ সাড়ে চার পাউন্ড ওজনের একটি ধাতব পিণ্ড। তেরো শতাব্দীর শুরুতে এটা ছিল স্তেপ অঞ্চলের প্রচলিত মুদ্রা। শব্দটা সম্ভব মোগলগণ চীনে ভাষাতে আমদানী করেছিলেন। চীনে কাগজের অর্থ সম্বন্ধে মার্কোপলো’ ১ম খণ্ড, ৪২৩ ff. দ্রষ্টব্য।

৫। মার্কোপলোর মতে ব্যবহার-করা নোটের অধিকারীকে নতুন নোট গ্রহণ করার সময় তার মূল্যের উপর তিন পারসেন্ট খরচ দিতে হতো (১ম খণ্ড, ৪২৫)।

৬। ক্যাথে (খিটে) প্রথমে মুসলিমগণ ব্যবহার করেন এং তাদের থেকে ইউরোপীদের পর্যটক এবং ধর্মপ্রচারকগণ ব্যবহার করেন তেরো থেকে ষোলো শতাব্দীর মাঝে। শব্দটি ব্যবহৃত হয় চীনের উত্তর অংশ সম্বন্ধে দক্ষিণ অংশের সিন্ বা খাশ চীনের বিপরীত নাম হিসেবে। নামটি এসেছে কিতে কি খিতে তুর্কীদের থেকে। এরা একটি রাজ্য স্থাপন করেন। (লিয়ায়ে রাজ্য) এবং দশ ও এগারো শতাব্দীতে পিকিংয়ে রাজত্ব করেন। সিকিম চীন (চীনা) নাম খুব সম্ভব সেই একই প্রকার গৃহীত হয়েছে তা-সিন্ রাজত্ব থেকে (২৫৫-২০৯ খ্রীঃ পূর্ব শতাব্দী)।

৭। এখানে ইব্‌নে বতুতা পাথর কয়লার সঙ্গে পর্সেলিন কাদার একত্র জড়িয়ে ফেলেছেন। সম্ভবতঃ এটা ঘটেছে চীনের সেই প্রথার জন্য যাতে কয়লা চূর্ণ করে নিয়ে কাদার সঙ্গে মেশানো হয় মৌলিক জ্বালানী’ তৈরী করার জন্য (মার্কোপলল ১ম খণ্ড, ৪৪২-৩ দ্রষ্টব্য)।

৮। এ কথা সাধারণভাবে স্বীকৃত যে মধ্যযুগে মুসলিম এরং ক্রিশ্চান উভয় পর্যটকের নিকট যে শহরটি জেতুন নামে পরিচিত সেটা তি’ওয়ান চো-ফু (চুয়ান-চৌ-ফু, ২৪-৫৩ উত্তরে, ১১৮-৩৩ পূর্বে। এই পরিচয়ের পক্ষে যুক্তি এবং চ্যাং-চু-ফুর (এময়) দাবির বিচার দেখা যাবে মার্কোপলোর বিবরণে, ২য় খণ্ড, ২৩৭।

৯। মধ্যযুগীয় ইতালির জেটানির মারফত জেতুনি শব্দ থেকে স্যার্টিন এসেছে বলে ইউল কতকগুলি জোরালো যুক্তি খাড়া করেছেন, (ক্যাথে ৪, ১১৮)।

১০। সিজিলমাসা ছিল দক্ষিণ মরক্কোর অন্তর্গত তাকিলেস্টের নিকটবর্তী। নিচে ১৪। পরিচ্ছেদ, টিকা দ্রষ্টব্য।

১১। গ্রন্থের এ স্থানে দেওয়ান’ শব্দটি ‘পরিষদ’ বলে গ্রহণ না করে সেটা যে কোনো প্রতিষ্ঠানই হোক না কেন) গ্রহণ করছি একটি প্রতিষ্ঠানরূপে যা উত্তর আফ্রিকায় এবং মিশরের সে সমস্ত বন্দর নামে পরিচিত যে সব বন্দর বিদেশী বাণিজ্যের জন্য মুক্ত-এর থেকে ইতালিয়ান দুগেন এবং ফ্রেঞ্চ দুয়ান শব্দের উৎপত্তি। এটা একই কালে গুরু-গৃহ, মালদাস, বাসাগৃহ এর বিদেশী বণিকগণের টাকার বাজার (এ কারণেই ইব্‌নে বতুতা এখানে বাসস্থান পেয়েছিলেন), এবং এর পরিচালক ছিলেন রাজ্যের অন্যতম কর্মচারী (মাসলট্রির Relations et Commerce de l Afique’ Septentrionale, ৩৩৫ ff. দ্রষ্টব্য)। কয়েক পংক্তি নিচে ইব্‌নে বতুতা ক্যান্টন সম্বন্ধে বলছেন যে দেওয়ান পরিচালকের আওয়াতার মধ্যে এটা অবস্থিত ছিল। সম্ভবতঃ এর মানে হচ্ছে এই যে সেখানকার বাণিজ্য ঘাঁটি তার সীমার মধ্যে ছিল।

১২। এ অংশটুকুর অর্থ সম্পূর্ণ পরিস্কার। কোরাণ অনুসারে আইনতঃ ভিক্ষা দিতে হবে “বাপ-মা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, দরিদ্র, এবং মুসাফিরদের। জেতুনের মুসলিম সম্প্রদায় এত সমৃদ্ধশালী ছিলেন যে এই ভিক্ষার যোগ্য পাঁচ শ্রেণীর মধ্যে সেখানে কেবল শেষটিই ছিল। ১৩। আরব এবং পার্শিয়ান লেখকগণ (মার্কোপলোর মতো) মোগলের মহান খান কে কান কিম্বা কা’আন্ বলে অভিহিত করতেন। ইউল যেমন বলেছেন, এটা সাধারণ তুর্কী খান পদবী খাকান থেকে একটা পৃথক পদবী নয়। (শিতরি, তুয়ো বাঙ্কোর অনুসন্ধান বিভাগের স্বারকলিপি, নম্বর ১, টকিও,১৯২৬,১৯-২৬ পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

১৪। সিকালান হচ্ছে পার্শিয়ান চিন্ কালানের আরবী রূপান্তর সংস্কৃত মহাচীনের পরিবর্তে-আরবী নাম সিন আস-সিনের অর্থও তাই।

১৫। এখানে বিষয়টি ত্রুটিপূর্ণ–এটা ঘটেছে একটি শব্দ ভুল লেখার জন্য কিম্বা অন্য শব্দ বাদ পড়ার জন্য।

১৬। টিসোয়ান-চু থেকে ক্যান্ টন্ অভিমুখে নদী পথে ইব্‌নে বতুতার পথ নানা কারণে অনিশ্চিত। ইউল একটি পথের কথা বলছেন ফুচো থেকে মিনের দিকে এবং কানের উঁচু সীমা থেকে মিলিং গিরিপথ হয়ে পিকিয়াং অবধি। মনে হয় এটা এক ঘোরালো পর্যটন-অথচ মি এবং টাং নদী পথে সোজা পথ রয়েছে, অবশ্য যদি নদী দুটি নৌ-চলাচলের যোগ্য থাকতো।

১৭। এ মন্দিরটি স্থির নিশ্চয়রূপে সনাক্ত করা হয়নি। ইউল বলেছেন এটা হচ্ছে “বিজয় এবং শ্রদ্ধার মন্দির।”আধুনিক নগরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।

১৮। গগ এবং ম্যাগগের প্রাচীর সম্বন্ধে কোরাণে বর্ণনা করা হয়েছে এবং আলেকজাণ্ডার দি গ্রেটকে বলা হয়েছে এর নির্মাতা। এ স্থানটি কোথায় তার নির্ধারণ আরবী ভৌগোলিকদের জন্য একটি সমস্যা। পৃথিবীর জনপদের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে এ স্থানটি রয়েছে বলে সাধারণের ধারণা এবং চীনের মহাপ্রাচীরের সঙ্গে এটাকে বিজড়িত করা হয়েছে। কিন্তু ইনে বতুতার হয়তো ধারণা ছিল না যে চীন সেই প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত এবং মনে হয় এলোমেলোভাবে তিনি প্রশ্নটি মীমাংসা করেছেন-সম্ভবতঃ মহাপ্রাচীর সম্বন্ধে কতকগুলি আকস্মিক কথা শুনবার পর।

মার্কোপলোও ফুকিন এবং কিয়ানসি কিম্বা চি-কিয়াং পর্বত অঞ্চলে একটি মানুষখেকো জাতির কথা বলেছেন (২য় খণ্ড ও ২২৬ এই শিমিটখেনার, জিটু ক্রিট দ্যর জে ফার আর্ডকুণ্ডেজ, বার্লিন, ১৯২৭, ৩৮৮ পৃঃ দ্রষ্টব্য)।

১৯। কান-জান-ফুর স্থান নির্ধারণ এখনও অনিশ্চিত। ইব্‌নে বতুতা কর্তৃক স্থানটি জেতুন এবং খাসার মাঝখানে নির্দিষ্ট করা যদি নির্ভুল হয়ে থাকে–তবে এর স্থান নির্ভর করবে সেই পথের উপরে তিনি যেটা অনুসরণ করেছিলেন। ইউল এটাকে কিয়াংসি প্রদেশ অন্তগর্ত ফু-হো তীরবর্তী কিয়েন-চ্যাং-ফুর সহিত এক বলে ধরেছেন এবং তার পরবর্তী স্টেশন বেওয়াম কুলুকে পো-ইয়াংসির সঙ্গে। এরূপ সনাক্তকরণের বিরুদ্ধে আপত্তি হচ্ছে এই যে (১) এতে করে অন্তর্গত করা হয় হ্যাংচাও পর্বত একটি ঘোরালো পর্যটন এবং তাতে করে হ্যাংচাওকেই সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়; (২) এবং এমন কোনো প্রমাণ নেই যে কিয়েনচ্যাং-ফুর ভিতর দিয়ে এত ঘন ঘন বাণিজ্য পথ রয়েছে (যেমন ইব্‌নে বতুতার পথ থেকে প্রদর্শিত হচ্ছে)।

যেহেতু হ্যাং-চাওতে পৌঁছতে ইব্‌নে বতুতার লেগেছিল ৩১দিন এবং উল্টো পথে মার্কোপলোর ২৭ দিন, সেজন্য এটা মনে করার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে যে তারা মূলতঃ একই পথ অবলম্বন করেছিলেন। এক্ষেত্রে কা-জান্-ফুর জন্য স্বাভাবিক সনাক্তকরণ হচ্ছে ফুচাও। এর স্বপক্ষের হচ্ছে : (১) একজন নিজস্ব গবর্ণর এবং বৃহৎ সৈন্য-নিবাস সহ নগরের পরিসর (যেটা মার্কোপলের বিবরণের সঙ্গে বেশ মিলে যায়); (২) বন্দরে একটি বৃহৎ জাহাজের আগমন”, মার্কোপলো পরিস্কার রূপে বছেন যে “জেতুন থেকে জাহাজগুলি সেই নদী দিয়ে সোজা ফিউজু নগরে এসে পৌঁছে যে নদীর কথা আমি বলেছি–এবং এভাবেই ভারতের মুল্যবান পণ্যদ্রব্য এখানে এসে থাকে। ভারতের মূল্যবান পণ্যদ্রব্য এখানে এসে থাকে।” ফিউচা জেলাকে মার্কোপলো যে নাম দিয়েছেন যেমন চা বা কঞ্চা (নগরের আসল নাম হচ্ছে চিকিয়ান) তাতে করে হয়তো সেটা কান্-জান্-ফুতে রূপান্তরিত হয়ে থাকবে। অন্যদিকে ফিউচা থেকে জেতুন যাওয়ার পথ মার্কোপলো কেবল পাঁচদিন বলেছেন-এতে মনে হচ্ছে মিন্ নদীর আরো উজানে কোনো স্থানকে তিনি নির্দেশ করছেন (মিন নদীর নৌ-চলাচল সম্বন্ধে মার্কোপলো ২য় খণ্ড, ২৩৪ দ্রষ্টব্য)।

ডিউলাওরিয়ার বলছেন কা-জান্-ফু হয়তো চিন্-কিয়াং-ফুর পরিবর্তে ইয়াংসি এবং গ্রাও ক্যানালের সন্ধিস্থলে অবস্থিত–এতে করে এ স্থানটি হবে খান্ পা এবং খান-বালিকের (পিকি) মাঝখানে। এ রকমের ভ্রান্ত স্থান নির্ধারণ ইব্‌নে বতুতার ক্ষেত্রে খুব বেশি দেখা যায় না-কিন্তু চিং-কিয়াং-ফু কদাচিং তার বিবরণের যোগ্য বলে মনে হয়। এ ফেরা মার্কোপলোর কে জানফুকে কা-জা-ফু বলে গ্রহণ করেছেন- এটা হচ্ছে চীনের পুরাতন রাজধানী–এখন। শে-সির উউ নদীর তীরে সি-আন্-ফু আরব ভৌগলিকগণ একে বলতেন খুসদান। এই সনাক্তকরণ এ কেরাস্ত্রে মতের মতোই একটি ব্যাপার যাতে তিনি বলেছেন যে ইব্‌নে বতুতা আদৌ চীন দেশ ভ্রমণ করেননি। এ কথা ধরে নেওয়া যথেষ্ট নিরাপদ যে মুসলিম সওদাগরগণ। ফিউচাওয়ের স্থানের কা-জা-ফু নাম ব্যবহার করেছেন (যেমন সাওয়ান-চাওর স্থানে জেতুনের মতন), অথবা ইব্‌নে বতুতা ওই একই ধ্বনির দুটি নাম এক জড়িয়ে ফেলেছেন।

২০। ঘুটা হচ্ছে দামাস্কাসের চারদিকে ঘোরান বৃক্ষ শোভিত প্রশস্ত প্রান্তরের নাম।

২১। চীনের আধুনিক নামচিত্রে এ নামের সম্পর্কিত কিছু অনুসন্ধান করা সময়ের অপব্যয় হবে-এর স্থান নির্ধারিত হতে পারে কেবল উল্লেখিত অন্য শহরগুলির উল্লেখ দ্বারা। এটা সম্পূর্ণ সব যে এ-কোনো স্থানের নাম নয় বরঞ্চ কোনো তুকী তাতার সেনাপতির নাম (বেআন কুৎলাঘ=“সৌভাগ্যবান বেআন”)-এটাই ইব্‌নে বতুতা ভুলক্রমে একটি শহরের নাম বলে গ্রহণ করেছিলেন।

২২। খ্রীষ্টান এবং মুসলিম উভয় পর্যটক দল কর্তৃক এ কথা স্বীকৃত যে, মার্কো পলো যাকে “কিনসের অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত নগর…সমস্ত তর্কের অতীত পৃথিবীর সুন্দরতম এবং মহান” বলে অভিহিত করেছেন সেটা বাস্তবিকই চৌদ্দ শতাব্দীতে পৃথিবীর বৃহত্তম নগর ছিল। এতে করে যে প্রশংসাবাদ জেগে উঠে সেটা পরিণত হয় আতিশয্যে, যেমন মার্কোপলো বলেছেন যে এর রয়েছে শত মাইল পরিসর, এতে রয়েছে বারো হাজার প্রস্তর নির্মিত সেতু এবং অধিকাংশ সেতু এতটা উঁচু যে তাদের তলা দিয়ে বৃহৎ নৌবহর চলে যেতে পারে। সুতরাং এতে আশ্চর্য হওয়ার। কিছু নেই যে ইব্‌নে বতুতার বৃত্তান্ত সম্বন্ধে ইউলের ভাষায় “এতে রয়েছে সন্দেহজনক উক্তি।” খাসা নামটি হচ্ছে আরবীর রূপান্তর (একজন আরবীয় মহিলা কবির নামের সঙ্গে সংযুক্ত আর কিসে ক্যানসে, ক্যাসে ইত্যাদি হচ্ছে চীনে কিং-সে রাজধানীর ইউরোপীয় রূপান্তর। হ্যাং চাও হচ্ছে ১১২৭ থেকে ১২৭৬ পর্যন্ত সাং রাজত্বের রাজধানী।

২৩। সিটাডেল বা দূর্গ শব্দের অনুদিত মানে হচ্ছে “শাসক বা গবর্ণর কর্তৃক অধিকৃত অভ্যন্তরিক নগর। শাসকের প্রাসাদ হ্যাং-চাওয়ের কেন্দ্রস্থলে ছিল না–বরঞ্চ এটা ছিল দক্ষিণ প্রান্তে।

২৪। “চেইন অব্ হিষ্টোরিতে” বলা হয়েছে “আশী বছর বয়সে উপনীত হলে একজন ব্যক্তিগত করদান থেকে মুক্ত হয় এবং রাজকীয় কোষ থেকে ভাতা পেয়ে থাকে। এ সম্বন্ধে চীনেগণ বলেন “যৌবন কালে এ ব্যক্তি ট্যাকস দিয়েছেন এখন সে যখন বুড়ো হয়ে গিয়েছেন তখন তাকে আমরা ভাতা দেবো।” (কেরাও সুলেমান সওদাগরের Voyage du marchand Sulayman, ৬৩ পৃঃ)।

২৫। কার্টে মনে হয় ক্যারাটের সংক্ষিপ্ত শব্দ। একটি সাধারণ তুর্কী পদবী-কিন্তু যতদূর জানা যাচ্ছে কোনো চীনে গ্রন্থে এ নামের কোনো শাসকের নাম উল্লেখিত হয়নি। এটা সব যে। তুর্কী সৈন্যগণ তাদের সেনাপতিকে এ পদবী দিয়েছে গ্রন্থের এ অংশে ইব্‌নে বতুতা আরো অনেক শব্দ ব্যবহার করেছেন যেগুলি চীনে শব্দ নয়। বরঞ্চ তুর্কী কিম্বা পার্শিয়ান। এ ভাবে তিনি তার তুক-ফার্সি পদবী “রাজা” ব্যবহার করেছেন ম্রাটের নাম রূপে। নিচের ৩২ টীকা দ্রষ্টব্য।

২৬। তোয়া কিম্বা তুই হচ্ছে একটি তুর্কী শব্দ–এর অর্থ ভোজ কিম্বা উৎসব।

২৭। ইউল মন্তব্য করেছেন যে আনন্দপ্রদ ছন্দ ধ্বনিত হচ্ছে ঠিক এই পংতিটিতে

প্রভাত না হলে মোরা ফিরিব না ঘরে,

কিছুটা মুক্ত অনুবাদ দেওয়া হয়েছে এ ভাবেঃ

আবেসের আলোড়নে বিসর্জিত আমার হৃদয়,
বিক্ষুব্ধ সমুদ্র সম তরঙ্গ আঘাতে;
কিন্তু যবে হয়েছি নিমগ্ন পুনঃ উপসনা মাঝে
বিদূরিত হলো মোর সব দুঃখ তাপ।

কবিতার শেষ পংতিটি সঠিক ভাবে পড়া বা সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা করা হয় না।

২৮। মার্কোপলোও হ্রদে আনন্দ-বিহারের কথা বলেছেন–কিন্তু নকল যুদ্ধের কথা উল্লেখ করেননি। (২য় খণ্ড, ২০৫)।

২৯। এ উক্তি সম্পর্কে ইউল যথার্থরূপে প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন, “এটা সত্যের এত বিপরীত যে লোকের মনে সন্দেহ উপস্থিত হতে পারে, ইব্‌নে বতুতা আদৌ হ্যাং-চাও ছাড়িয়ে আরো দূরে ভ্রমণ করেছেন কি না” (খ্যাথে ৪র্থ খণ্ড, ১৩৭)।

৩০। মোগলগণ পিকিংকে বলতেন “খান-বালিক” মানে খানের নগর, পশ্চিমী লেখকগণ বলেছেন ক্যাম্বা এবং ক্যাম্বলুক। খানিকু নাম ব্যাখ্যা করা হয়েছে একটি বিশেষণ রূপে, কানের নগর (এসিয়াটিক জার্নাল, মে, ১৯১৩, ৭০১ পৃঃ)

৩১। দুইয়ের পরিচ্ছেদ, টীকা ১২ দ্রষ্টব্য।

৩২। সম্ভবতঃ পারশিয়ান পান্দা বাজার বিকৃতি (টীকা ২৫ দ্রষ্টব্য)। রাজত্বকারী ম্রাট ছিলেন তগন তাইমুর (রাজত্বকাল ১৩৩৩-৭১)।

৩৩। কারাকুরাম হচ্ছে মোঙ্গলদের প্রথম রাজধানী, এর জায়গায় বর্তমানে অবস্থিত রয়েছে আরদেনি-সো, অ খন্ নদীর ডান তীরে উর্গা নদীর ২০০ মাইল পশ্চিম-দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং বাহির মোঙ্গালিয়ার অন্তর্গত কারাবল্গাসুনের ২০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে।

বিসবালিক অবস্থিত ছিল বর্তমান গুচেনের উপরে বা নিকটে। জন গেরিয়ার অন্তর্গত উরুমসির পূর্বে।

৩৪। এখানে ইব্‌নে বতুতা একজন তাতার প্রধানের সমাধি-ক্রিয়ার অনুষ্ঠানের যথার্থ বিবরণ দিয়েছেন। কিন্তু মনে হয় তিনি যেটা দেখেছেন সেটা ম্রাটের সমাধি-ক্রিয়া নয়–অবশ্য যদি বর্ণনাটি সরাসরি হয়ে থাকে।

৩৫। যেহেতু এই ফিরোজকে সম্পূর্ণ অপরিচিত বলে মনে হয়, এবং যেহেতু খানের আবাসস্থল ১৩৭১ খ্রীস্টাব্দে তোগন তাইমুরের মৃত্যুর পরবর্তীকাল পর্যন্ত কারাকুরামে স্থানান্তরিত হয়নি (অবশ্য যদি চীনে দলিল পত্র সত্য হয়ে থাকে), সেজন্য ১৩৫৬ খ্রীস্টাব্দের লেখা গ্রন্থে এই অংশের উপস্থিতি এখনো বর্তমান রয়েছে-সেটা এমন একটি সমস্যা যা ঐতিহাসিকের অপেক্ষা সাইকিক সোসাইটির অনুসন্ধানেই অধিক উপযোগী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *