০৩. ইয়েমেন রওয়ানা

তিন

১৩৩০ খ্রীস্টাব্দের শেষের হজের পরে আমি মক্কা থেকে ইয়েমেন রওয়ানা হলাম। প্রথমে জুন্দা (জেদ্দা) এসে পৌঁছলাম। জেদ্দা সমুদ্রোপকুলে পারশ্যবাসীদের দ্বারা তৈরী একটি প্রাচীন শহর। এখানে এসে একটি আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আমার অপরিচিত একজন অন্ধলোক যে আমাকে কখনও দেখে নাই, আমার নাম ধরে ডেকে হাত ধরে বলল, “আংটীটি কোথায়?”

আমার মক্কা শরীফ ত্যাগের পর একজন ফকির এসে ভিক্ষা চাইল। তখন আমার কাছে দেবার মত কিছুই না-থাকায় আংটীটি খুলে দিয়েছিলাম। আমি অন্ধ লোকটিকে তাই খুলে বলাম। সে তখন বলল, “ফিরে গিয়ে সেটির খোঁজ করো, কারণ, তার মধ্যে যে নাম লেখা আছে তাতে বিশেষ গোপন ব্যাপার আছে।”

আমি তাজ্জব হয়ে গেলাম তার এ কথা শুনে এবং তার এ রকম অলৌকিক জ্ঞান দেখে। আল্লাহ্ জানেন এ লোকটি কে ছিল। শুক্রবার জুমার নামাজের সময় মুয়াজ্জিন এসে শহরের বাসিন্দা মজিদে কতজন হাজির হয়েছে গণনা করে দেখে। তারা সংখ্যায়। যদি চল্লিশ জন হয় তবে ইমাম জুমার নামাজ পড়ান। আর শহরের বাসিন্দাদের সংখ্যা যদি চল্লিশের কম হয় তবে সেদিন তিনি পড়ান চার রাকাত জহুরের নামাজ। বিদেশী মুসাফেরের সংখ্যা সেদিন যত বেশীই হউক, এ গণনার সময় তাদের ধরা হয় না।

আমরা এখানে এসে একটি নৌকায় উঠলাম। নৌকাকে এখানে বলা হয় জলবা। শরিফ মনসুর আরেকটি নৌকায় উঠে আমাকেও তাতে উঠতে বললেন কিন্তু আমি তাতে অস্বীকার করলাম। তাঁর জবায় উঠান হয়েছিল অনেকগুলি উট। আমি কখনও সমুদ্রে সফর করিনি বলে তার জবায় উঠতে ভয় হয়েছিল। আমরা অনুকুল বাতাসে দু’দিন চলবার পরে বাতাস পালটে গেল। তখন আমাদের নৌকা পথ ছেড়ে দূরে যেতে আরম্ভ করল। ঢেউ নৌকায় উঠে আমাদের গায়ে পড়তে লাগল, আরোহীরা ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। আয়ধাব ও সাওয়াকিনের মাঝামাঝি রাস দাওয়াইর’ নাম নৌকা ভিড়াবার উপযোগী একটি জায়গায় না-আসা অবধি আমাদের এ আতঙ্ক বজায় ছিল। আমরা এখানে তীরে উঠে নল খাগড়া দিয়ে মসজিদের আকারে তৈরী একটি ঘর দেখতে পেলাম। তার ভিতর উটপাখীর ডিমের খোলা ভরতি পানি। আমরা সে পানি এবং তা। দিয়ে রান্নাও করলাম।

একদল বেজা এল আমাদের কাছে। আমরা উট ভাড়া করলাম তাদের কাছ থেকে। যে জায়গা দিয়ে আমাদের পথ সেখানে ঘোট ঘোট এক রকম হরিণ আছে প্রচুর। বেজারা সে সব হরিণ খায় না বলে মানুষ দেখেও তারা ভয় পেয়ে পালায় না। দুদিন পথ চলার পর আমরা সাওয়াকিন (সুয়াকিন) নামক দ্বীপে এসে পৌঁছলাম। সদ্ৰকুল থেকে ছ’মাইল দূরে অবস্থিত এটি একটি বড় দ্বীপ কিন্তু এখানে না আছে পানি না আছে কোন ফসল গাছ-গাছড়া। নৌকা বোঝাই করে এখানে পানি আনা হয়। আর বৃষ্টির পানি সংগ্রহের জন্য রয়েছে বড়-বড় চৌবাচ্চা। উটপাখীর, হরিণের ও বন্য গাধার গোত এখানে পাওয়া যায়। আর পাওয়া যায় অনেক ছাগল, দুধ ও মাখন। সে সব মক্কায় চালান হয়ে যায়। খাদ্যশস্য বলতে এখানে আছে জ্বরজুর নামে মোটা দানাওয়ালা এক রকম ভূট্টা বা জোয়ার। তাও মক্কায় রপ্তানী হয়ে যায়। আমি সাওয়াকিনে থাকাকালে সেখানকার সুলতান ছিলেন মক্কার আমীরের পুত্র শরীফ জায়েদ।

সাওয়াকিন থেকে আমরা জাহাজে উঠলাম ইয়েমেন যাওয়ার উদ্দেশ্যে। এ পথে সমুদ্রে অনেক পাহাড় আছে বলে রাত্রে জাহাজ চালান হয় না। সন্ধ্যা হলেই কোন জায়গায় থেমে আবার যাত্রা শুরু হয় ভোরে। জাহাজের কাপ্তেন সর্বক্ষণ সামনে দাঁড়িয়ে থেকে হাল ধরে যে থাকে তাকে হুঁশিয়ার করে দেয় পাহাড় সম্বন্ধে। সাওয়াকিন থেকে যাত্রার ছ’দিন পর আমরা হালি ২ শহরে পৌঁছি। আরবের দু’টি গোত্রের লোকেরা প্রধানতঃ বাস করে এ জনবহুল বড় শহরে। সুলতান একজন সপ্রকৃতির লোক। তিনি শিক্ষিত এবং একজন কবি। মক্কা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত পথে আমি তার সঙ্গী ছিলাম। তার শহরে এসে পৌঁছলে তিনি আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন এবং কয়েকদিন অবধি আমার মেহমানদারী করেন। আমি তারই একটি জাহাজে চড়ে সারজা এসে পৌঁছলাম। সারজায় ইয়েমেনের সওদাগরেরা বাস করে। তারা দয়ালু ও মুক্তহস্ত। মুসাফেরদের খেতে দেয় এবং হজযাত্রীদের সাহায্য করে নিজেদের জাহাজ দিয়ে। গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দিয়ে এবং অর্থ সাহায্যে করে। আমরা মাত্র একটি রাত্রি কাটালাম। সারজা শহরে তাদের মেহমান হিসাবে। তারপরে গেলাম আল-আহওয়াব এবং সেখান থেকে জাবিদ ৪।

জাবিদ সানা থেকে এক শ বিশ মাইল। সানার পরে জাবিদই ইয়েমেনের সবচেয়ে বড় ও সমৃদ্ধিশালী শহর। বহু খাল পরিবেষ্টিত অনেক ফলের বাগান আছে এ শহরের আশেপাশে। এখানে কলা ও ঐ জাতীয় আরও ফলাদি জন্মে। শহরটি দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত সমুদ্রের উকুলে নয় এবং এটি দেশের একটি প্রধান শহর। শহরটি যেমন বড় তেমনি জনবহুল। এর চারদিকে তাল বৃক্ষের কুঞ্জ, মধ্যে মধ্যে চলমান খাল। এক কথায় জাবিদ ইয়েমেনের সবচেয়ে সুদৃশ্য ও মনোরম শহর। এখানকার বাসিন্দারাও ব্যবহারে দ্র ন্ত্র এবং সৎ ও সুদর্শন। বিষেশতঃ এখানকার নারীরা পরমা সুন্দরী। এ শহরের লোকদের মধ্যে সুবুত-আন্ নখল নামে প্রসিদ্ধ আনন্দ ভোজের রীতি প্রচলিত আছে। যখন খেজুর রঙ ধরে ও পেকে উঠে তখন প্রতি শনিবার এরা খেজুর বাগানে গিয়ে জমায়েত হয়। শহরের স্থায়ী বাসিন্দাই হউক বা বিদেশী হউক শহরে তখন একজন লোকও থাকে না। গীতবাদ্যের দল সঙ্গে যায় তাদের আনন্দদানের জন্য, ব্যবসায়ীরা যায় তাদের ফল-ফলাদি ও মিষ্টির পশরা নিয়া। নারীরা সেখানে যায় উটের পিঠে আরোহণ করে। পরমা সুন্দরী হয়েও এখানকার নারীরা নীতিপরায়ণ ও বহু সদৃণ সম্পন্না। বিদেশীদের প্রতিও তারা অনুরাগিণী এবং আমাদের দেশের নারীদের মত বিদেশীদের সঙ্গে বিবাহে তারা অসম্মতি প্রকাশ করে না। যখন কোন স্বামী বিদেশে সফরে যায় স্ত্রী তখন তাকে বিদায় সম্ভাষণ দিয়ে এগিয়ে দিয়ে আসে। শিশু থাকলে স্বামীর অনুপস্থিতিকালে মা-ই তার পালন ও রক্ষণাবেক্ষণের ভার নেয়। স্বামী বিদেশে গেলে স্ত্রী তার নিজের খোরপোশ বাবদ কিছুই দাবী করে না। যখন সে স্বামীর সঙ্গে বাস করে তখনও অতি অল্পেই সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু এখানকার নারীরা কখনও নিজের শহর ছেড়ে কোনক্রমেই অন্যত্র যেতে রাজী হয় না।

সেখান থেকে আমরা ইয়েমেনের সুলতানের রাজধানী তাইজ পৌঁছি। তাইজ দেশের একটি চমৎকার বড় শহর ৬। কিন্তু এ শহরের বাসিন্দারা স্বেচ্ছাচারী উদ্ধত ও রূঢ় প্রকৃতির লোক। সুলতান যেখানে বাস করে সে শহরের অবস্থা সাধারণতঃ এ রকমই হয়ে থাকে। তাইজ শহরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে সুলতানের প্রাসাদ এবং তার সভাসদগণের বাসস্থান; দ্বিতীয় ভাগের নাম উদায়না, সেখানে সৈনিকদের ঘাঁটি; তৃতীয় ভাগে সাধারণ লোকদের বাসস্থানসহ হাটবাজার। ইয়েমেনের সুলতান নাসির উদ্দিন আলী ছিলেন রসুলের বংশধর। দরবারের সময় এবং অভিযানের সময় তিনি বিশেষ জাঁকজমক পছন্দ করেন। আমাদের এখানে আগমনের পরে চতুর্থ দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। সেদিন সুলতানের দরবার বসবার দিন। কাজী আমাকে তার কাছে নিয়ে গেলে আমি তাকে সালাম করলাম। সালামের রীতি অনুসারে প্রথমে তর্জনী দ্বারা মাটি স্পর্শ করে সে তর্জনী মাথায় ঠেকিয়ে বলতে হয় “খোদা শাহানশার হায়াত দারাজ করুক।” কাজীকে সে রকম করতে দেখে আমি তাঁরই অনুসরণ করলে সুলতান আমাকে তার সামনে বসতে বললেন। বসতে বলে আমার। দেশ, আমার দেখা অন্যান্য দেশ ও দেশের সুলতানের সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা। করলেন। উজির সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সুলতান তাকে আমার সঙ্গে সম্মানসূচক ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। তার মেহমানদারীতে কিছুদিন কাটিয়ে, আমি যাত্রা করলাম প্রাক্তন রাজধানী সানার পথে। ইট ও পলেস্তরা দিয়ে তৈরী সানা জনবহুল শহর। শহরের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং পানি উত্তম। বৃষ্টি সম্বন্ধে ভারত, ইয়েমেন ও আবিসিনিয়ার আশ্চর্য ব্যাপার এই, এসব জায়গায় বৃষ্টিপাত হয় গ্রীষ্মের সময়, বিশেষ করে সে সময়ের বিকেলবেলা, কাজেই বিদেশী ভ্রমণকারীরা বৃষ্টির ভয়ে দুপুরের দিকেই তাড়াহুড়া করে কাজকর্ম সারতে চেষ্টা করেন। বৃষ্টিপাত সে সব জায়গায় প্রচুর হয় বলে শহরের লোকেরাও তার আগে গৃহে ফিরে আসে। সমস্ত সানা শহরটি পোস্তা বাধানো বলে বৃষ্টি হলেও রাস্তাঘাট ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

সেখান থেকে আমি ইয়েমেনের সমুদ্রোপকুলের এডেনে এসে হাজির হলাম। এ বন্দরটি পবর্তবেষ্টিত এবং মাত্র একটি দিকে রয়েছে প্রবেশ পথ। এখানে না আছে কোন ফসল বা গাছ-গাছড়া, না আছে পানি। বৃষ্টির পানি ধরবার জন্য অনেক বড়-বড় চৌবাচ্চা রয়েছে এখানে। অনেক সময় আরবরা এখানকার পানি সরবরাহের ব্যবস্থা ছিন্ন করে দেয়। তখন টাকা-পয়সা ও কাপড়ের টুকরার বিনিময়ে পানি সরবরাহের পুনঃ প্রবর্তনের ব্যবস্থা করতে হয়। এখানে অত্যাধিক গরম অনুভূত হয়। এডেন ভারতীয়দের বন্দর এবং কিয়াত (ক্যাম্বে), ফালাম (কুইলন) কালিকট এবং মালাবারের বহু বন্দর থেকে বড়-বড় জাহাজ যাতায়াত করে এ বন্দরে। এখানে ভারতীয় সওদাগরেরা বাস করে, মিসরের অনেক সওদাগরও এখানে রয়েছে। এখানকার সমস্ত বাসিন্দাই হয় সওদাগর, মোটবাহী, নয় তো মৎস্যজীবী। কোন কোন ব্যবসায়ী বিশেষ বিত্তশালী। তাঁদের কেউ-কেউ এত ধনশালী যে একাই সমুদয় সাজসরঞ্জামসহ একটি জাহাজের মালিক। এ নিয়ে সওদাগরদের মধ্যে প্রতিযোগিতা পর্যন্ত চলে। তা সত্ত্বেও তারা ধর্মপরায়ণ, বিনয়ী, সৎ ও সদয় প্রকৃতির লোক। বিদেশীদের প্রতি তাদের ব্যবহার। ভাল, ধার্মিকদের মুক্তহস্তে দান-খয়রাত করেন এবং যাকাতাদি খোদার প্রাপ্য যথারীতি আদায় দেন।

এডেন বন্দরে জাহাজ ধরে চার দিন সমুদ্রপথে চলার পর আমি জায়লা (Zayla) পৌঁছি। বারবেরা নামক কাফ্রী সম্প্রদায়ের লোকদের শহর এটি। জায়গা থেকে দু’মাসের পথ মাগডাশা অবধি বিস্তৃত তাদের এ দেশটি মরুভূমিসঙ্কুল। বড় বাজার সহ জায়লা বেশ বড় শহর কিন্তু পৃথিবীর মধ্যে এ শহরটি সবচেয়ে নোংরা ও জঘন্য দুর্গন্ধময় শহর। তার কারণ এখানে যথেষ্ট মাছ আমদানী হয় এবং এখানকার বাসিন্দারা রাস্তায় উট জবাই করে রক্ত সেখানেই ফেলে রাখে। সমুদ্র তরঙ্গ সঙ্কুল থাকা সত্ত্বেও আমরা শহরের অপরিচ্ছন্নতা এড়াবার জন্য জাহাজে রাত কাটালাম।

জায়লা থেকে সমুদ্রপথে পরদিন জাহাজ চালিয়ে আমরা এলাম মাগডাশা (মাগদি)। মাগডাশা বিস্তৃত একটি শহর। এখানকার বাসিন্দারা ব্যবসায়ী এবং প্রত্যেকে বহু উটের মালিক। শত শত উট এখানে জবাই হয় খাদ্যের জন্য। কোন জাহাজ এসে এখানে ভিড়লে সামবাক নামক ছোট-ছোট নৌকা গিয়ে তার গায়ে লাগে। প্রত্যেক নৌকায় থাকে একদল যুবক, তাদের হাতে ঢাকা দেওয়া খাবারের থালা। জাহাজে যে সব সওদাগরেরা আসে তাদের একজনের হাতে খাবারের থালা দিয়ে বলে “ইনি আমার মেহমান।” এমনি করে সবাই এক এক জনকে মেহমান মেনে নেয়। সওদাগররাও তখন শুধু সেই মেজবানের বাড়ি যায়। যারা পূর্বে এ শহরে এসেছে এবং পূর্ব থেকেই লোকজনের সঙ্গে পরিচিত তারা যেখানে খুশী যেতে পারে। অতঃপর মেজবান সওদাগরের হয়ে তার জিনিসপত্র বেচাকেনা করে দেয়। যদি কেউ কোন জিনিস সওদাগরের কাছ থেকে অত্যন্ত কম দামে কিনে অথবা মেজবানের অনুপস্থিতিতে সওদাগরের কাছে কেউ কিছু বিক্রয় করে তবে সে কেনাবেচা সিদ্ধ হয় না। এ রীতি সওদাগরদের পক্ষে বিশেষ সুবিধাজনক। এ সব যুবকের দল আমাদের জাহাজে উঠলে তাদের একজন এগিয়ে এল আমার দিকে। আমার সঙ্গীরা বললেন, “ইনি সওদাগর নন; একজন ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ লোক ইনি।” তা শুনে যুবক তার বন্ধুদের ডেকে বলল, “ইনি কাজীর মেহমান। তাদের দলে কাজীর লোকও ছিল। সে ছুটে গেল কাজীকে খবর দিতে। কাজী তখন সমুদ্রতীরে এলেন তার একদল ছাত্র সঙ্গে নিয়ে। ছাত্রদের একজনকে পাঠিয়ে দিলেন আমার কাছে। আমার দলবল নিয়ে জাহাজ থেকে নেমে গিয়ে তাঁকে। সালাম করলে তিনি বললেন, “বিসমিল্লাহ্ বলে চলুন আমরা শেখকে ছালাম করতে যাই।”

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “শেখ এখন কে?”

তিনি বললেন, “সুলতান।” সুলতানকে তারা এখানে শেখ বলেন।

আমি তখন বললাম, “থাকবার জায়গায় ঠিকঠাক হয়ে গিয়ে দেখা করব তাঁর সঙ্গে।”

তিনি জবাব দিলেন, “কোন শাস্ত্রবিদ, শরিফ বা ধার্মিক কেউ এখানে এলে এখানকার রীতি অনুসারে বাসস্থানে যাবার আগেই দেখা করতে হয় শেখের সঙ্গে।

কাজেই, তার কথা মত শেখের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বারবেরা সম্প্রদায়ের এ সুলতানের নাম আবু বকর। আরবী জানা সত্ত্বেও তিনি কথা বলেন মাগডিসি ভাষায়। আমরা প্রাসাদে পৌঁছে অন্দরে খবর পাঠালে একজন খোঁজা এল থালায় পান সুপারী নিয়ে। সে আমাকে ও কাজীকে দশটি করে পান ও কিছু সুপারী দিয়ে বাকী সব দিল আমার সঙ্গীদের এবং কাজীর ছাত্রদের। পরে বলল, “আমাদের হুজুর বলেছেন, ইনি থাকবেন ছাত্রদের সঙ্গে।

পরে সে খোঁজা ভূত্যই প্রাসাদ থেকে আমাদের খাবার নিয়ে এল। তার সঙ্গে এল উজির। মেহমানদের দেখাশুনা করবার ভার তার উপর। তিনি বললেন, “আমাদের হুজুর আপনাকে তার শুভেচ্ছা ও অভ্যর্থনা জানিয়েছেন।”

আমরা সেখানে তিন দিন ছিলাম। প্রত্যহ তিন বার করে খাবার দেওয়া হত আমাদের। চতুর্থ দিন ছিল শুক্রবার। সেদিন কাজী ও একজন উজির আমাকে এক প্রস্থ পোশাক এনে দিলেন। অতঃপর আমরা মসজিদে গেলাম এবং সুলতানের পর্দার ৮ আড়ালে থেকে নামাজ আদায় করলাম। শেখ বাইরে এলে আমি তাকে অভিবাদন। জানালাম। তিনিও আমাকে অভ্যর্থনা করলেন। অতঃপর নিজে পাদুকা পরে আমাদেরও আদেশ করলেন আমাদের নিজ নিজ পাদুকা পরে নিতে। পাদুকা পরা হলে আমাদের নিয়ে পায়ে হেঁটে প্রাসাদের দিকে চললেন। বাকি সবাই চলে গেল খালি পায়ে। শেখের মাথার উপরে ধরা হয়েছে রঙ্গীন রেশমের চারটি চাঁদোয়া। প্রতিটি চাঁদোয়ার উপরে একটি করে সোনার পাখী। প্রাসাদের রীতিনীতি পালন করার পর সবাই সালাম করে নিজ নিজ পথে চলে গেল।

সাওয়াহিল দেশে কুওয়া (কিলওয়া, কুইলোয়া) শহরে যাবার উদ্দেশ্যে আমি মাগডাশা থেকে আবার জাহাজে চড়লাম। এ শহরটি জাজ নামক কাফ্রীদের। আমরা মোম্বাসা নামক বড় একটি দ্বীপে এলাম। সাওয়াহিল দেশ ১০ থেকে সমুদ্রপথে এখানে পৌঁছতে দুদিন লাগে। দ্বীপের বাইরে মূল ভূমিতে এ দ্বীপের কোন অংশ নেই। দ্বীপে ফলের গাছ আছে কিন্তু কোন খাদ্যশস্য নেই। খাদ্যশস্য আমদানী করতে হয়। সাওয়াহিল থেকে। এ দ্বীপের বাসিন্দাদের প্রধান খাদ্য কলা ও মাছ। বাসিন্দারা। ধর্মপরায়ণ, সম্মানী এবং সম্প্রকৃতির। শহরে কাঠের সুগঠিত মসজিদ আছে। এ দ্বীপে। আমরা এক রাত্রি কাটালাম। তারপরে যাত্রা করলাম উপকুল শহর কুলওয়ার উদ্দেশ্য। এ শহরের লোকেদের অধিকাংশ জাজ। তাদের গাত্র বর্ণ গাঢ় কৃষ্ণ, মুখে উঁকির চিহ্ন। একজন সওদাগর আমাকে বলেছিলেন, কুওয়া থেকে পনর দিনের পথ দক্ষিণে সুফালা। লিমিদের দেশ জুফি থেকে সুফালায় স্বর্ণরেণু আনা হয়। সুফালা থেকে জুফি এক মাসের পথ ১১। কুওয়া একটি সুন্দর শহর। শহরের সমস্ত ঘরবাড়ী কাঠের তৈরী। কুওয়ার সঙ্গেই নাস্তিক জাদের দেশ বলে কুওয়ার বাসিন্দাদের সর্বক্ষণ যুদ্ধ। বিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হয়। আমার সময়ে এখানে বাসিন্দাদের সর্বক্ষণ যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকতে হয়। আমার সময়ে এখানে সুলতান ছিলেন আবুল মুজাফফর হাসান। দান ধ্যানের জন্য তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন। যুদ্ধে জয়লাভের পর যা কিছু পাওয়া যেত, কোরাণের নির্ধারিত নীতি ১২ অনুযায়ী তার একপঞ্চমাংশ তিনি দাঁতব্য কাজের জন্য পৃথক করে রাখতেন। আমি দেখেছি একজন ফকির এসে চাইলে তিনি তার গায়ের। কাপড় দান করে দিলেন সেই ফকিরকে। এ দানশীল ও নীতিপরায়ন সুলতানের। এন্তেকালের পর সুলতান হলেন তার ভাই দাউদ। এসব ব্যাপারে তিনি ছিলেন ভাইয়ের। বিপরিত প্রকৃতির লোক। যখনই কেউ এসে তাঁর কাছে কিছুর আবেদন করত, তিনি বলতেন, “যিনি দিতেন তিনি মরে গেছেন এবং দেবার মত কিছুই রেখে যাননি।”মুসাফেররা তার ওখানে মাসেক থাকবার পর তিনি তাদের যৎকিঞ্চিৎ দিয়ে বিদায় করতেন। তার ফলে তার দরজায় আর কেউ কখনও আসত না।

কুলওয়া থেকে আমরা যাত্রা করি দাফারি (দোফার)। দাফারি ইয়েমেনের একেবারে শেষ প্রান্তে অবস্থিত। এখান থেকে ভাল জাতের ঘোড়া ভারতে রপ্তানী হয়। অনুকূল বাতাসে এখান থেকে ভারতে জাহাজ যেতে একমাস সময় লাগে। এডেন থেকে মরুভূমির মধ্য দিয়া দাফারি আসতে একমাস লাগে। শহরটি লোকালয়হীন স্থানে। অবস্থিত। এখানকার বাজারটি অত্যন্ত নোংরা, কারণ প্রচুর মাছ ও ফল আমদানী হয় এ বাজারে। এখানকার মাছ সামুদ্রিক পোনা জাতীয় এবং অত্যন্ত তৈলাক্ত। একটি আশ্চর্য। ব্যাপার এই, পোনা জাতীয় এ মাছ এখানে পশুর প্রধান খাদ্য। পৃথিবীর আর কোথাও এমন ব্যাপার আমার চোখে পড়ে নাই। বাজারের বেশীর ভাগ বিক্রেতা কাল রঙের বস্ত্র পরিহিতা ক্রীতদাস নারী। এখানকার বাসিন্দারা ভুট্টার চাষ করে এবং গভীর কুপ থেকে তুলে জমিতে পানি সেচন করে। ক্রীতদাসদের কোমরে দড়ি বেঁধে মস্ত বড় বালতির সাহায্য কুপ থেকে সেই পানি তোলা হয়। এদের প্রধান খাদ্য ভাত। সেজন্য চাউল আমদানী করা হয় ভারত থেকে। এখানকার বাসিন্দাদের একমাত্র জীবিকা ব্যবসায়। এখানে কোন জাহাজ এসে ভিড়লে তারা কাপ্তেন, খালাসী থেকে শুরু করে সবাইকে সুলতানের গৃহে নিয়ে যায় এবং তাদের ভোজন করায় তিন দিন অবধি। এমনি করে তারা জাহাজীদের কাছে সুনাম অর্জন করে। আরও একটি আশ্চর্য ব্যাপার এই, এখানকার লোকদের রীতিনীতির সঙ্গে পুরোপুরি মিল আছে উত্তর পশ্চিম আফ্রিকার লোকদের সঙ্গে। শহরের আশেপাশে অনেক ফলের বাগানেই কলা গাছ রয়েছে। এখানকার কলার আকারও বেশ বড়। আমার সাক্ষাতেই একটা কলা ওজন করে দেখা। গেল সেটি বার আউন্স। এখানকার কলা মিষ্টি ও সুস্বাদু। এখানকার লোকেরা পান ও নারিকেলের চাষ করে, যা শুধু ভারতে ও এখানেই দেখা যায়।১৩ আমি এ দুটি জিনিষের উল্লেখ করেছি বলে বিস্তারিত ভাবেই এ সম্বন্ধে বলছি।

পান গাছ আঙ্গুরের লতার মত জন্মে। পান গাছের কোন ফল হয় না। শুধু পাতার জন্য এ গাছ জন্মানো হয়। পান সম্বন্ধে ভারতবাসীর ধারণা খুব উচ্চ। কোন লোক বন্ধুর বাড়ী দেখা করতে গেলে বন্ধু যদি তাকে পাঁচটি পান এনে দেয় তবে মনে করতে হবে তাকে সারা দুনিয়া দেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে দাতা যদি নবাব বাদশা বা ঐরকম। কেউ হন। সোনা রূপার দানের চেয়ে পানের দান বেশী সম্মানজনক। পান ব্যবহার করা হয় নিম্নে বর্ণিত পদ্ধতিতে। প্রথমে নিতে হয় সুপারী। সুপারী জায়ফলের মত জিনিষ। সুপারীগুলি ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র খত্তাকারে কেটে চিবানো হয়। তারপরে লওয়া হয় পান। পানে। একটু chalk লাগিয়ে সুপারীসহ একত্রে চিবাতে হয়। পান শ্বাসপ্রশ্বাস মিষ্ট করে, হজমের সহায়তা করে, খালি পেটে পানি খাওয়ার দোষ নিবারন করে এবং কর্মশক্তি উদ্দীপিত করে।

আরেকটি আশ্চর্যজনক জিনিষ নারিকেল গাছ। নারিকেল গাছ দেখতে ঠিক খেজুর গাছের মত। নারিকেল মানুষের মাথার সদৃশ। কারণ, নারিকেলের দুটি চোখের এবং একটি মুখের চিহ্ন আছে। তাছাড়া কচি নারিকেলের শাঁস মগজের মত। মাথার চুলের মত নারিকেলের ছিবড়া আছে। ছিবড়া দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। তার-কাঁটার পরিবর্তে সেখানে দড়ি ব্যবহৃত হয় জাহাজ তৈরির কাজে। তাছাড়া ছিবড়া দিয়ে কাছিও তৈরি হয়। নারিকেলের গুণের মধ্যে প্রধান হল,-নারিকেল শরীরে শক্তি বাড়ায়, শরীর মোটা করে, এবং মুখমণ্ডলে লালিমা এনে দেয়। কচি নারিকেল কাটলে চমৎকার টাট্রা মিষ্টি পানীয় পাওয়া যায়। পানি পান করার পরে চামচের মত এক টুকরা খোসা নিয়ে শাস চেছে তুলতে হয়। এর স্বাদ ডিমের মত, যে ডিম সিদ্ধ অথচ পুরোপুরি রান্না করা নয়। নারিকেলের শাস পুষ্টিকর। আমি মালদ্বীপে দেড় বছর কাল নারিকেল খেয়ে বাস করেছি। এ ফলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য,তৈল, দুধ ও মধু এর ফল থেকে পাওয়া যায়। মধু বের করা হয় নিম্ন বর্ণিত উপায়ে। নারিকেল গাছের যে বৃন্তে ফল ধরে তা কেটে ফেলা হয় দু’আঙ্গুল পরিমাণ বাকি রেখে। তার সঙ্গে একটি ছোট হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। কাটা বৃন্ত থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় রস ঝরে হাঁড়িতে জমা হয়। ভোরে এ রকম করা হলে বিকেলে একজন লোক দুটি হাঁড়ি নিয়ে গাছে ওঠে। একটি হাঁড়িতে থাকে পানি, অপরটিতে ঢেলে আনা হয় সারাদিনের জমা রস। তারপরে বৃন্তটি ধুয়ে সামান্য একটু কেটে দেওয়া হয়। কেটে দেবার পর আরেকটি হাঁড়ি বেঁধে রাখা হয়। যথেষ্ট পরিমাণে রস জমা না হওয়া অবধি প্রতিদিন ভোরে একই রকম করা হয়। যথেষ্ট রস জমা হলে তা জ্বাল দিয়ে গাঢ় করা হয়। এমনি করে অতি চমৎকার মধু তৈরী হয় এবং ভারত, ইয়েমেন ও চীনের সওদাগরেরা তা কিনে দেশে নিয়ে মিষ্টি তৈরী করে। নারিকেলের (কোরানো) শাস পানিতে ডুবিয়ে রাখলে সেই পানির রঙ ও স্বাদ দুধের মত হয় এবং অন্য খাদ্যের সঙ্গে তা খাওয়া হয়। তৈল তৈরী করতে হলে পাকা নারকেলের শাঁস রৌদ্রে শুকাতে হয়, তারপর কড়াইতে জ্বাল দিয়ে তৈল নিষ্কাষণ করা হয়। এ তৈল দ্বারা বাতি জ্বালানো হয়, রুটীর সঙ্গে খাওয়া হয় এবং মেয়েরা মাথায় ব্যবহার করে।

মাসিরার একজন লোকের হোট একখানা জাহাজে আমরা দাফারি থেকে ওমান যাত্রা করলাম। যাত্রার দ্বিতীয় দিনে আমরা হাসিক১৪ নামক জাহাজ ভিড়বার একটি জায়গায় গিয়ে জাহাজ থেকে নামলাম। হাসিকে প্রধানতঃ আরবীয় মৎস্যজীবিরা বাস করে। এখানে বহু ধূপ গাছ আছে। ধূপ গাছের পাতা সরু সরু। পাতা কেটে দিলে। দুধের মত রস পড়তে থাকে। রস থেকে প্রথমে হয় গঁদ পরে ধূপ। এ বন্দরের বাসিন্দাদের জীবিকা প্রধানতঃ নির্ভর করে মাছের উপর। লুখাম নামক যে মাছ এখানে। ধরা হয় তা অনেকটা ক্ষুদ্রকায় হাঙরের মত। এ সব মাছ ধরার পরে তারা লম্বা করে কেটে রৌদ্রে শুকায় এবং খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। এখানে এসব মাছের কাঁটা দিয়ে ঘর তৈরী করা হয়। ঘরের চাল তৈরী হয় উটের চামড়া দিয়া।

ছয় দিন পর আমরা এক জনমানবহীন পাখীর দ্বীপে এসে পৌঁছলাম। নোঙ্গর ফেলে আমরা গিয়ে ডাঙ্গায় উঠলাম এবং দেখতে পেলাম অসংখ্য পাখীতে দ্বীপ ছেয়ে আছে। ব্ল্যাকবার্ড’ জাতীয় পাখী কিন্তু আকারে অপেক্ষাকৃত বড়। নাবিকরা কতকগুলি পাখীর ডিম সংগ্রহ করে রান্না করে খেল। তারপর ধরে আনল কতকগুলি পাখী। সেগুলি জবাই।

করেই কেটে রান্না করে ফেলল ১৫। আমার খাদ্য ছিল তখন শুকনো খেজুর আর মাছ। প্রতিদিন সকালে বিকেলে এরা মাছ ধরত। ধরা মাছ রান্না করে এরা সবাইকে সমানভাবে ভাগ করে দিত। মাছ ভাগের বেলা জাহাজের কাপ্তেনকেও বেশী দিত না। আমরা সে বছর হজ পর্ব সমুদ্রের বুকেই পালন করলাম। সে দিনের সারাদিন এবং পরের দিনেরও সূর্যোদয় অবধি সমুদ্র ছিল তরঙ্গসঙ্কুল। আমাদের সামনেই একটি জাহাজডুবি হয় এবং তার একটি লোকমাত্র অনেক কষ্টে সাঁতরে নিজের জীবনরক্ষা করে।

অতঃপর আমরা গেলাম মাসিরা নামক একটি বড় দ্বীপে। এ দ্বীপের অধিবাসীরা সম্পূর্ণভাবে মাছের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে।১৬ জাহাজ ভিড়াবার জায়গা দূরে বলে আমরা এ দ্বীপে উঠিনি। তা ছাড়া এ দ্বীপের লোকেরা জবাই না করেই পাখী খায় বলে তাদের প্রতি আমার একটা বীতরাগের ভাবও এসেছিল।

মাসিরা থেকে একরাত ও একদিন জাহাজ চালিয়ে আমরা সার নামক একটি বড় গ্রামে এসে জাহাজ ভিড়ালাম। সেখান থেকে একটি ঢালু পাহাড়ের গায়ে নির্মিত কালহাট শহর দেখা যায় এবং খুব নিকটে বলে মনে হয়।১৭ দুপুরের পরেই আমরা। এখানে এসে নোঙর করেছিলাম বলে আমার ইচ্ছে হল পায়ে হেঁটে কালহাট গিয়ে সেখানেই রাত কাটাব। কারণ, জাহাজের লোকদের ব্যবহার আমি পছন্দ করছিলাম না। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারলাম, বিকেলে মাঝামাঝি সময়ে সেখানে যেয়ে পৌঁছতে পারি। কাজেই একজন খালাসীকে চালক হিসেবে ভাড়া করে নিলাম। খিদর নামক একজন আমাদের সঙ্গে জাহাজের যাত্রী। সে আমার সঙ্গী ছিল। আমার সঙ্গের অন্যান্য লোকদের জাহাজে রেখে গেলাম জিনিষপত্র পাহারা দিয়ে রাখবার জন্য। কথা হল, পরের দিন তারা গিয়ে আমার সঙ্গে মিলিত হবে। আমার কিছু কাপড় জামা সঙ্গে নিলাম। ক্লান্তির হাত থেকে রেহাই পাবার জন্য সেগুলি বইবার ভার দিয়েছিলাম চালকের উপর। আমি নিজে নিয়েছিলাম একটা বর্শা। এদিকে চালক মতলব করেছে, সেগুলি চুরি করবে। কাজেই সে আমাদের নিয়ে গেল সমুদ্রের একটা বাড়ির দিকে। সেখানে নিয়ে কাপড়সহ খড়ি পার হতে শুরু করল। আমি তখন বললাম, “কাপড়গুলি রেখে তুমি একলা পার হয়ে যাও। আমরা পারি তো যাব, না হলে খুঁজে দেখব পানি কোথায় অগভীর!” তখন সে ফিরে এল। একটু পরে দেখতে পেলাম, কয়েকজন লোক সেখান দিয়ে সাতরে পার হয়ে যাচ্ছে। তখন ঠিক ধারণা হল, চালক আমাদের ডুবিয়ে মেরে কাপড় চোপড় নিয়ে সরে পড়বার মতলব করেছিল। বাইরে আমি নিশ্চিন্তভাব বজায় রেখে ভেতরে ভেতরে হুশিয়ার ছিলাম আর চালককে ভয় দেখাবার জন্য সারাক্ষণ হাতের বর্শাটা উঁচিয়ে রেখে চলছিলাম। তারপর পানিহীন একটা সমতল ভূমিতে পৌঁছে পিপাসায় ভয়ানক কষ্ট পেলাম। অতঃপর খোদার অনুগ্রহে একজন অশ্বারোহী সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন আরও লোকজন সঙ্গে নিয়ে। তারা আমাদের পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করালেন। তখন শহরের খুব কাছাকাছি এসে গেছি মনে করে আমরা আবার পথ চলতে লাগলাম। কিন্তু আসলে তখনও আমাদের সামনে কতকগুলি নালা ছিল। আরও মাইল কয়েক হাটার পর সন্ধ্যাবেলা চালক আমাদের নিয়ে যেতে চাইল সমুদ্রের উপকূলের দিকে। সে দিকটা পাহাড় সমান্ন বলে সেখানে কোন রাস্তাঘাট ছিল না। আমাদের। পাহাড়ের দিকে নিয়ে যেতে পারলে সে কাপড় জামাগুলি নিয়ে পালাবে এই ছিল তার ইচ্ছা। কিন্তু আমি তখন এ রাস্তা ছেড়ে আর কোন রাস্তায় যেতেই রাজী হলাম না। আমার ভয় ছিল, পথে আমাদের মারধর করবে বলে। কতটা পথ শহরে পৌঁছতে তখনও বাকি আছে তাও আমাদের জানা ছিল না। কাজেই, ঠিক করলাম, রাস্তা ছেড়ে একদিক সরে নিয়ে আমরা ঘুমাব। যদিও আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম তবু ক্লান্তির ভাব গোপন করে জামা-কাপড়গুলি নিজের কাছে রেখে বর্শী হাতে বসে রইলাম। আমার সঙ্গীটিও খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। সে ও আমাদের চালক ঘুমিয়ে পড়ল, আমি জেগে রইলাম। আমাদের চালক যখনই একটু নড়ে চড়ে উঠছিল তখনই তার সঙ্গে কথা বলে জানিয়ে দিচ্ছিলাম যে আমি জেগেই আছি। ভোরে আমি চালককে পাঠালাম পানি খুঁজে আনতে। তখন আমার সঙ্গী নিল কাপড়গুলি। তখন আমাদের কয়েকটি ছোট নদী ও নাল পার হতে বাকি ছিল। চালক পানি নিয়ে এল। অবশেষে অত্যন্ত ক্লান্ত অবস্থায়। আমরা এসে কালহাট শহরে পৌঁছলাম। জুতোর ভিতরে আমার পা দুটি এমনভাবে ফুলে উঠেছিল যে, প্রায় রক্ত বেরিয়ে আসছিল। তখন আবার আমাদের চরম দুরবস্থা স্বরূপ দ্বাররক্ষক পীড়াপীড়ি করতে লাগল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমাদের শাসনকর্তার কাছে হাজির করবে বলে। ভাগ্যক্রমে শাসনকর্তা ছিলেন খুব দয়ালু লোক। তিনি আমাকে সেখানে রেখে দিলেন। তার সঙ্গে আমি ছয় দিন কাটালাম। পায়ের ক্ষতের জন্য এ কয়দিন আমি চলাফেরা করতে পারিনি।

কালহাট শহরটি সমুদ্রের তীরে। এখানে ভাল বাজার এবং অতি সুদৃশ্য একটি মসজিদ আছে। মসজিদের দেওয়ালগুলি কাশানী টালি দিয়ে সাজানো। মসজিদটি বেশ উচ্চস্থানে অবস্থিত বলে এখান থেকে সারা শহর ও পোতাশ্রয় নজরে পড়ে। এখানে। এসে এমন এক রকম মাছ খেলাম যা আর কোথাও খাইনি। যে কোন রকম মাংসের চাইতে সে মাছ আমার কাছে ভাল লেগেছিল বলে আমি এ মাছ ছাড়া আর কিছুই খেলাম না। মাছগুলি গাছের পাতার সাহায্যে ভেজে ভাতের সঙ্গে খেতে দেয়। ভাতের জন্য সমুদ্র পথে তারা ভারত থেকে চাউল আমদানী করে। এখানকার বাসিন্দারা ব্যবসায়ী। ভারত মহাসাগর দিয়ে যা কিছু আসে তারই উপর এদের জীবিকা। কোন জাহাজ এসে। এ বন্দরে পৌঁছলে তাদের আনন্দের পরিসীমা থাকে না।

অতঃপর সেখান থেকে যাত্রা করে ছয়দিন পর আমরা ওমান দেশে পৌঁছি।১৮ নদী নালা, গাছপালা, বাগান, তালবন এবং অনেক রকম ফল দেখে বুঝা যায় দেশটি উর্বর। এখানকার রাজধানী নাজওয়া পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত। এখানে সুন্দর বাজার ও পরিচ্ছন্ন মসজিদ আছে। এ শহরের বাসিন্দাদের মসজিদের চত্বরে বসে আহার করা অভ্যাস। যার যা খাবার আছে সবাই এখানে এনে একত্র বসে খায় এবং মুসাফেররাও। তাদের সঙ্গে যোগদান করে। এরা খুব সাহসী ও যুদ্ধে পারদশী বলে সর্বক্ষণ নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ লেগেই আছে। এখানকার সুলতান আজ গোত্রের একজন আরবী। তাঁকে বলা হয় আবু মোহাম্মদ। ওমানের শাসনকর্তা মাত্রেরই পদবী আবু মোহাম্মদ।১৯ সুমদ্রোপকূলের বেশীর ভাগ শহর হরমুজ সরকারের শাসনাধীন।

আমি অতঃপর হরমুজ দেশে এলাম। হরমুজ নামে সমুদ্রের তীরে একটি শহর আছে। এ শহর মুর্গিস্তান নামেও পরিচিত। শহরের উল্টা দিকে সমুদ্রের নয় মাইল ভিতরে একটি দ্বীপ আছে। দ্বীপটির নাম নতুন হরমুজ।২০ এ দ্বীপে যে শহরটি আছে তার নাম জারাওন। শহরটি যেমন বড়, তেমনি সুন্দর। বাজারগুলিও কর্মব্যস্ত। কারণ এ বন্দর থেকেই ভারত ও সিন্ধু থেকে আমদানীকৃত পণ্যদ্রব্য উভয় ইরাক, ফারস ও খোরাসানে চালান দেওয়া হয়। দ্বীপটি লোনা এবং দ্বীপের বাসিন্দারা বসরা থেকে আমদানী করা মাছ ও খেজুর খেয়ে জীবনধারণ করে। এখানকার লোকেরা নিজেদের ভাষায় বলে, “খোরমা ওয়ামাহি সুতি পাদশাহী” অর্থাৎ খেজুর ও মাছ শাহী খাদ্য। এ দ্বীপে পানি একটি বিশেষ মূল্যবান বস্তু। শহর থেকে দূরে কুপ ও বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখবার জন্য চৌবাচ্চা আছে। লোকেরা সেখানে গিয়ে মশক ভর্তি করে সমুদ্রের তীরে আনে এবং তারপর নৌকার সাহায্যে দ্বীপে আনে। আমি একটি আশ্চর্যজনক জিনিষ এখানে দেখলাম। বড় মসজিদের দরজায় বিশাল একটি মাছের মাথা ফেলে রেখে যার আকার ছোটোখাটো একটি পাহাড়ের টিলার সমান। তার এক একটি চোখের কোটর ঘরের দরজার মত। লোকেদের দেখা যায় তার এক চক্ষু দিয়ে ভেতরে ঢুকে আরেক চক্ষু দিয়ে বেরিয়ে আসে।

হরমুজের সুলতান কুতুবউদ্দিন তাহামতান একজন অতিশয় দয়ালু ও প্রকৃতির শাসনকর্তা। যে সব ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ বা ধর্মপরায়ণ লোক কিংবা শরিফ এখানে আসেন। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে দেখা করে হক আদায় করা তার অভ্যাস। আমরা তাকে গিয়ে পেলাম বিদ্রোহী ভ্রাতুস্পুত্রদের সঙ্গে যুদ্ধরত অবস্থায়। সেখানে ষোলদিন কাটিয়ে ফিরে আসবার সময় আমার এক সঙ্গীকে বললাম, “সুলতানের সঙ্গে একটি বার দেখা না করে কি করে চলে যাই। কাজেই আমরা উজিরের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমার হাত ধরে প্রাসাদে নিয়ে হাজির করলেন। সেখানে ময়লা জামা কাপড় গায়ে, মাথায় পাগড়ী ও কটিবন্ধে রুমাল সহ এক বৃদ্ধ বসে আছেন দেখলাম। উজির তাকে সালাম করলেন। উজিরের দেখাদেখি আমিও তাকে সুলতান বলে না চিনেই সালাম করলাম। তারপর পরিচিত একজন লোক পাশে দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। পরে উজির আমার ভুল ভেঙ্গে দিলে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ও ত্রুটি স্বীকার করে ক্ষমা চাইলাম। সুলতান তখন উঠে প্রাসাদের ভেতরে চলে গেলেন। উজির ও অপরাপর সভাসদেরাও তাঁর সঙ্গে গেলেন। তৎপর আমিও ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, তিনি সেই জীর্ণমলিন পোষাক নিয়েই মসনদে বসে আছেন। তিনি আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। যে-সব দেশ সফর করেছি, রাজারাজড়াদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি তাদের সম্বন্ধে আলাপ আলোচনা করলেন। তারপর খাওয়ার পরে তিনি উঠে গেলে আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

আমরা হরমুজ থেকে যাত্রা করলাম খুজুবাল শহরে একজন তাপসের সঙ্গে দেখা করতে। প্রণালীটি পার হয়ে গিয়ে আমাদের বাহন ভাড়া করতে হল তুর্কমেনদের কাছ থেকে। এসব তুর্কমেন এখানকারই বাসিন্দা। এ অঞ্চলে এদের সঙ্গে ছাড়া সফর করা সম্ভব নয়। কারণ এরা খুব সাহসী এবং সমস্ত পথঘাট এদের জানা আছে। এখানে চারদিনের পথ অবধি বিস্তৃত একটি মরুভূমি আছে। সে মরুভূমিতে আরবরা বিচরণ করে এবং জুন ও জুলাই মাসে মারাত্মক সাইমুম’ এ অঞ্চল দিয়ে বয়ে যায়। সাইমুমের কবলে একবার পড়লে ধ্বংস ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। শুনেছি এ বিষাক্ত বাতাসের কবলে পড়ে যে প্রাণ হারায় তার আত্মীয় বন্ধুরা তার দাফন করার জন্য গোসল করাতে গেলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আলগা হয়ে যায়।২১ সারা রাস্তায়ই এভাবে মৃত্যুমুখে পতিত লোকদের কবর দেখতে পাওয়া যায়। আমরা রাত্রে সফর করতাম এবং সূর্যোদয় থেকে বিকেল অবধি বিশ্রাম করতাম গাছের ছায়ায়। এ মরুভূমিটির বুকেই কুখ্যাত দস্যু

জামাল আল-লুক লুটপাট করে বেড়াত। তার অধীনে একদল আরবী ও পারশী অশ্বারোহী দস্যু ছিল। লুষ্ঠিত টাকার সাহায্যে সে মুসাফেরখানা স্থাপন করত ও মুসাফেরদের অর্থ সাহায্য করত। শুনা যায়, যারা যাকাত আদায় করে না তাদের ছাড়া অপর কারও ধনরত্ন সে অপহরণ করত না। কোন সুলতানই তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারেন নাই। অবশেষে সে নিজেই অনুতপ্ত হয়ে ধর্মের পথে এসে ধর্মজীবনযাপন করতে থাকে। তার কবর এখন একটি তীর্থস্থান বিশেষ।

এ মরুভূমি পার হয়ে আমরা কাওরাস্তানে পৌঁছলাম। ছোট এ শহরে চলমান নহর ও ফলের বাগান আছে কিন্তু ভয়ানক গরম এখানে।২২ এখান থেকে অনুরূপ আরও একটি মরুভূমির উপর দিয়ে আমরা তিন দিন পথ চলে লার ২৩ নামক বড় একটি শহরে এলাম। এখানে সারা বছর পানি পাওয়া যায় এমন নদী ও অনেক ফলের বাগান আছে। আমরা দরবেশদের এক আস্তানায় বাস করতে লাগলাম। তাদের ভেতর একটি চমঙ্কার। রীতি প্রচলিত আছে। তারা প্রতিদিন বিকেলে এসে হাজির হন তাদের এ আস্তানায়; তারপরে বেরিয়ে শহরের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান। প্রত্যেক বাড়ী থেকে তাদের একখানা বা দু’খানা করে রুটী দেওয়া হয়। সে রুটী থেকেই এরা মুসাফেরদের খেতে দেয়। গৃহস্থরাও প্রয়োজনের অতিরিক্ত রুটী তৈরি করে এবং দরবেশদের এ রীতি প্রচলিত রাখতে সাহায্যে করে। আর শহরে একজন তুর্কমেন সুলতান বাস করেন। তিনি আমাদের উপহার ২৪ পাঠিয়েছিলেন কিন্তু আমরা তার সঙ্গে দেখা করি নাই।

অতঃপর আমরা শেখ আবু দুলাকের বাসস্থান খুজুবাল২৫ শহরে এসে পৌঁছলাম। এ শেখের সঙ্গে দেখা করতেই আমরা এসেছি। আমরা তার ফুসাফেরখানায় রইলাম। তিনি আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেছেন এবং তাঁর একটি পুত্রের দ্বারা আমার খাবার পাঠিয়ে দিতেন। সেখান থেকে আমরা এলাম কায়েস শহরে যার অপর নাম সিরাফ ২৬। সিরাফের বাসিন্দারা সত্বংশজাত পারশী। এদের ভেতর একদল আরবীও আছে। তারা পানির নীচে থেকে মুক্তা সংগ্রহ করে। সিরাফ থেকে বাহরায়েন পর্যন্ত নদীর মত বিস্তীর্ণ এ শান্ত উপসাগরে মুক্তা সংগ্রহের কাজ চলে। এপ্রিল ও মে মাসে এ অঞ্চলে ডুবুরী ফারস, বাহরায়েন ও কাদিফ থেকে সওদাগরদের নিয়ে অনেক নৌকা আসে। ডুব দেবার আগে ডুবুরীরা কচ্ছপের খোলসে তৈরী মুখোশ পরে এবং নাকেও কচ্ছপের খোলসের তৈরী ক্লিপ লাগায়। তারপরে একগাছি দড়ি কোমরে বেঁধে ডুব দেয়। পানির নীচে ডুবে থাকার শক্তি তাদের সবার সমান নয়। তাদের মধ্যে কেউ, কেউ এক ঘন্টা বা দুঘন্টা অবধি পানির নীচে থাকতে পারে।২৭ সমুদ্রের তলায় পৌঁছে ডবুরী দেখতে পায় ছোট-ছোট টুকরা পাথরের ফাঁকে বালির উপর ঝিনুক পড়ে আছে। তারপর সে ঝিনুকগুলি কুড়িয়ে অথবা সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে ছাড়িয়ে গলায় ঝুলানো চামড়ার থলেতে রাখে। যখন তার নিঃশ্বাস শেষ হয়ে আসে তখন সে দড়িতে টান দেয়। দড়িতে টান পড়লেই উপরে যারা আছে তারা দড়ি টেনে ডুবুরীকে নৌকায় তুলে আনে। তার থেকে তখন থলেটি নিয়ে ঝিনুকগুলি একে-একে খোলা হয়। ঝিনুকের খোলের ভেতর মাংস আছে। ছুরি দিয়ে মাংস কাটলে তা বাতাসের সংস্পর্শে এসে মুজায় পরিণত হয়। তখন ছোট বড় নানা আকারের মুক্তা একত্র সংগ্রহ করে সুলতানকে। দেওয়া হয় তার প্রাপ্য এক পঞ্চমাংশ এবং বাকিটা কিনে নেয় নৌকায় সওদাগরেরা। সওদাগরদের অধিকাংশই ডুবুরীদের পাওনাদার। তারা প্রাপ্যের পরিবর্তে মুক্তা নিয়ে যায়।

সিরাফ থেকে আমরা বাহ্রায়েন শহরে এলাম। সুন্দর ও বড় শহর বাহ্রায়েনে বাগান, গাছগাছড়া ও খাল আছে। এখানে পানি সহজলভ্য। হাত দিয়ে মাটি খুঁড়লেই এখানে পানি পাওয়া যায়।২৮ স্থানটি বালুকাময় এবং অত্যন্ত গরম। অনেক সময় বালি বাসস্থান অবধি বিস্তার লাভ করে। বাহরায়েন ছেড়ে আমরা পৌঁছি আল-কুদায়েফ শহরে(কাদিফ) এ সুন্দর বড় শহরে গোঁড়া শিয়া সম্প্রদায়ের আরবরা বাস করে। নিজেদের শিয়া বলে জাহির করতে তারা কাউকে ভয় করে না।

অতঃপর আমরা হাজার শহরে এলাম। এখন হাজারকে বলা হয় আলহা২৯। একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে, “হাজারে খেজুর বয়ে আনা। কারণ, অন্য কোন জেলার চেয়ে এখানে অনেক বেশী খেজুর আছে। এমন কি এখানকার লোকেরা পত্তকেও খেজুর খেতে দেয়। হাজার থেকে আমরা জামামা শহরে পৌঁছি। তারপর জামামার শাসন কর্তার সহযাত্রী হয়ে মাশরিফ গিয়ে হজব্রত পালন করি। সেটা ছিল ১৩৩২ খ্রষ্টাব্দে। সে বছরই মিসরের সুলতান আল-মালীক আন্-নাসির তার শেষ হজ পালন করেন। মক্কা ও মদিনার উভয় দরগায় তিনি সে বছর যথেষ্ট দান খয়রাত করেন এবং দরগার অধিবাসীদেরও উপহার দেন। এ যাত্রাতেই তিনি বিষপ্রয়োগে হত্যা করেন নিজের পুত্র আমীর আহমদকে এবং নিজের প্রধান আমীর বেকতিমারকে। সুলতান শুনেছিলেন, এরা তাকে হত্যা করে মসনদ দখলের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছে।

টিকা

পরিচ্ছেদ ৩

১। রাস দাওয়াইর, এর অর্থ বলা হয় “ঘূর্ণীবাত্যার তন্তরীপ” (কিম্বা ঘূর্ণীস্রোত)–কিন্তু আমি কোনো গ্রন্থে এর উল্লেখ দেখিনি। এটা সেই অগ্রভৃমি ছাড়া আর কিছু নয় যাকে এখন বলা হয় রাস্ রইয়া (২০ উত্তরে)-এবং খুব সম্ভব এ নাম ভুল করে লেখা হয়েছে।

২। হালি সঠিক ভাবে ‘হ্যালি (ব্যঞ্জন বর্ণের ওয়াই যুক্ত) ইয়াকুবের পুত্র। এটা ছিল সানা থেকে মক্কা যাওয়ার পথে একটি বড় শহর প্রায় তিরিশ মাইল ভিতরে। কুনফুদার চল্লিশ মাইল দক্ষিণ পূর্বে একটি জেলার মধ্যে যেখানে বছরে তিন ফসল তোলার যোগ্য যথেষ্ট উর্বর ভূমি রয়েছে।

হালির বন্দর জেলার মধ্যে একটি আশ্রিত নোঙ্গর স্থান। এখন একে বলা হয় আসির-১৮.৩৬ উত্তরে ৪১.১৯ পূর্বে অবস্থিত। সে সময়ে হালি ছিল ইয়েমেনের সুলতানের অধীনে। (হামদানী ১৮৮, রেড়হাউজ রাজত্বের প্রথম খন্ড, ৩০৭; ভূমির খণ্ড, ১৬৯; আরাবিয়ার হ্যান্ড বুক ১৩৬, ১৪৪)।

৩। সারজা নামের একটি স্থান সান-মক্কা পথের একটি বিশ্রাম স্থান-হালির দশ স্টেশন পূর্বের (হামদানী ১৮৮), কিন্তু ইব্‌নে বতুতার গন্তব্য বন্দর ছিল সারজা, লুহাইয়ের নিকটবর্তী একটি নোঙ্গর স্থান (ট্রাসিয়াল ওমানের সারজা থেকে পৃথক)। (কালকাশান্দি পঞ্চম খণ্ড, রেডহাউজ তৃতীয় খণ্ড)।

৪। জাবিদ ছিল সুলতানের শীতকালীন আবাস এবং তাইজ গ্রীষ্মকালের রাজধানী। সমুদ্র। উপকূল থেকে জাবিদের দূরত্ব পনেরো আরবী মাইল, আরবী গ্রন্থকারগণ একে বলেছেন ঘালাফিক-এর বন্দর ছিল আল-অহোয়াব (মুদ্রিত গ্রন্থের আল আবোয়াব নয়)। (কালকাশান্দি পঞ্চম খণ্ড, ৯-১০; রেড় হাউস ৩য়, ১৪৯)।

৫। সাবুত আন্-নখল, আক্ষরিকভাবে “পাম ষ্টার-ডে জাবিদের সামাজিক জীবনের একটি সুপরিচিত অনুষ্ঠান। রেড়হাউজের মতে “এটা ছিল স্থানীয় সাধারণের শনি-দেবতার উৎসব, সম্ভবতঃ এর উদ্ভব ইসলাম-পূর্বের জড়-উপাসকদের কাল থেকে।

৬। ইয়েমেন, আরাবিয়া ফেলিক্সের আরবী নাম-উঁচু মালভূমির উপরে অবস্থিত-দক্ষিণে এবং পশ্চিমে হঠাৎ উপকূল প্রান্তরে এসে নেমেছে। গ্রীষ্মকালের মৌশুমী বৃষ্টি বাধাপ্রাপ্ত হয় পর্বত মালায়, ফলে প্রধানতঃ কৃষি-নির্ভর। সর্বদা বিপুলভাবে সংস্কৃতি উপভোগ করেছে সমস্ত উপদ্বীপের অন্যদের চেয়ে বেশী। পুরাতন এবং বর্তমান রাজধানী সানা অভ্যন্তরভাগের পর্বতমালায় অবস্থিত। তাইজ অবস্থিত পাহাড়ের ধারের নিকট ৪,০০০ ফিট উপরে। রসুলিয়া রাজত্ব, যার পঞ্চম নরপতি ছিলেন আলী (১৩২১-৬৩ রাজত্ব কাল), নিজেদের মুক্ত করেছিলেন ১২৩৯ খ্রীষ্টাব্দে মিশর থেকে-এবং পনেরো শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ইয়েমেন শাসন করেছেন।

৭। মুসলিম শাসকগণের মধ্যে একটি প্রথা প্রচলিত ছিল যে তারা বিদেশী দূত এবং গুণবান পর্যটকদের আহারের ব্যবস্থা করতেন কিম্বা তাঁদের খরচের পরিমাণ অর্থ দৈনিক দিতেন। সতেরো শতাব্দীতে চার্ডিন তার পারশ্য ভ্রমণ বৃত্তান্তে উল্লেখ করেছেন যে, “ইস্পাহানে শার। নিজ বাড়ীর সংখ্যা ছিল তিন শ’র উপরে। সেগুলি খুব বড় এবং সুন্দর এবং প্রায়ই খালি-যথেষ্ট সংস্কারের অভাবে ধ্বংসে নিপতিত। এগুলি বিদেশী দূত এবং সে সব বিশিষ্ট লোককে দেওয়া হয় যারা ইস্পাহানে আসে।” এর বদলে কতকগুলি ধর্মীয় সংস্থানের মধ্যেও স্থান সঙ্কুলান করা হয়েছে।

৮। ইসলাম জগতে এরূপ প্রথা প্রচলিত ছিল যে নরপতি একটি খোদাই কাঠের পর্দা ঘেরা স্থানে উপাসনা করতেন–একে বলা হত মাকসুরা কিম্বা ঘেরা স্থান। এ প্রথাটি গ্রহণ করা হয়েছিল নরপতির জীবনকে ঘাতকের আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য।

৯। আস্ সাওয়াহিল (উপকুল ভূমি’), এটা আরবদের প্রদত্ত উপকুলের একটি অংশের নাম, এ অংশটি এখন কেনিয়া এবং টাঙ্গানিয়া অঞ্চলে নামে পরিচিত- সোয়াহিলি ভাষা থেকে। এর উৎপত্তি। জাজ শব্দটির উৎপত্তি অজ্ঞাত–মধ্যযুগে এটা ব্যবহৃত হতো পূর্ব আফ্রিকার নিগ্রোদের বুঝার জন্য–এখনো জাঞ্জিবার নামে এটা রক্ষিত রয়েছে।

১০। এটার অর্থ মনে হয় প্রধান ভূখণ্ড থেকে দ্বীপটিতে যেতে দু’দিনের পথ নয় (এর থেকে এটা বিচ্ছিন্ন হয়েছে কেবল একটি সংকীর্ণ প্রণালী দ্বারা) বরং সোয়াহিল ভূমি দক্ষিণ দিকে শুরু করেছে দুদিনের পথ।

১১। পরিচ্ছেদ এগারোর ১৫ টীকা দ্রষ্টব্য।

১২। সাধারণ আয়ের এবং সাধারণ ব্যয়ের অন্তর্গত করার পরিবর্তে-যা প্রায়ই বার করা হতো।

১৩। ধোপারের পেছনে রয়েছে একটি উঁচু পাহাড় এতে এসে পড়ে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমী বৃষ্টি এবং তার ফলে স্থানটি ট্রপিক্যাল উদ্ভিদে আবৃত হয়। এর চারপাশের জনতা আরব নয়, সুদানি শ্রেণীর।

১৪। কুরিয়া-মুরিয়া শ্রেণীর একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ।

১৫। মুসলিম আইন অনুসারে মৃত্যুর পূর্বে জবেহ্ করা না হলে কোনো পশু খাদ্যের জন্য হালাল নয়।

১৬। মাসিরা দ্বীপ, পেরিপ্লাসের অজ্ঞাত লেখকের সারাপিস্ তখনকার দিনে এর কচ্ছপের জন্য প্রসিদ্ধ এবং তখনকার মতো এখনো “মাছ খেকো এক প্রকার দূর্ধর্ষ জাতির দ্বারা। অধ্যুসিত। এদের ভাষা আরবী এবং এরা খেজুর পাতার কোমর-বন্দ ব্যবহার করে। (স্যর, এ, টি, ওইস, জিজ, এফ, ৯,২৩৬-৩৭’ স্কফের পেরিপ্লাস্ থেকে উধৃত)।

১৭। সুর এবং কালহাট স্থান দুটি ওমানের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত থাকার জন্য গুরুত্ব পেয়েছে। রাস-আল্-হাডের ঠিক উত্তরে আরবের প্রথম স্থান। ভারত থেকে আগত জাহাজ এখানে প্রথম ভিড়ে। কালহাট হচ্ছে মার্কোপলোর “কালাটু–এক সম্ভ্রান্ত নগর। বন্দরটি খুব বড় এবং ভাল, ভারতের মালবাহী বহু সংখ্যক জাহাজ এখানে আসে।” পতুর্গীজ যুগেও এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।

১৮। খাস্ ওমান অভ্যন্তর ভাগে জেবেল আদারের ঢালুতে অবস্থিত।

১৯। স্থানীয় ঐতিহাসিকদের বিবরণ অনুসারে নাওয়ায় শাসনকারী ওমানের আজদাইত ইমামগণের অনুক্রমে ১১৫৪ এবং ১৪০৬ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ছেদ পড়ে। এ সময়ে ধাহিরার অন্তর্গত মানিয়াতের একটি প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠি বানু নাভানগণ দেশের প্রভূ হয়ে বসেন। ইবনে বতুতার বিবরণ থেকে একথা সুস্পষ্ট যে নাওয়ায় আজদাই ইমাম বর্তমান ছিল কিম্বা ১৩৩২ খ্রীষ্টাব্দের পূর্বে পুনরুদ্ধার করা হয়েছিল। (জি,পি, বেজার, ওমানের ইমাম এবং সিআইদ, ৩৭,৪১; ওয়েলষ্টে আরব ভ্রমণ ১ম খণ্ড, ২১৫)।

২০। ওরমুজের দ্বীপ, বন্দর আব্বাসের দক্ষিণ-পূর্বে। ১৫১২ খ্রীষ্টাব্দে, পর্তুগীজগণ এ বন্দরটি দখল করেন এবং ১৬২২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত তাদের অধিকারে থাকে–তারপর ইংরেজদের সাহায্যে পার্শিয়ানগণ এটা পুনর্দখল করেন।

২১। “এই ভীষণ সংক্রামক ঝঞ্ঝাকে তারা বাদ সামাউন্ বলে। এর অর্থ হচ্ছে বিষাক্ত বাতাস। এই বাতাস প্রবাহিত হয় ১৫ই জুন এবং ১৫ই আগস্টের মাঝামাঝি। এই সময়টা গালফের নিকটে অত্যন্ত উত্তপ্ত। এ রকম তুফান আকাশে হু হু করে চলে। আকাশ তখন লাল এবং অগ্নিজ্বালা হয়। এ ঝড় লোকজন মেরে ফেলে এবং তাদের উড়িয়ে নেয়। একটি বিশেষ রকমে মানুষকে আঘাত করে, যেন তাদের শ্বাস রুদ্ধ করে এবং এটা বিশেষভাবে দিনের বেলা। ঘটে। এর অদ্ভুত ক্রিয়া ঠিক সাধারণ মৃত্যু নয়। যেটা অত্যন্ত বিস্ময়কর সেটা হচ্ছে এই যে, এর আক্রমণে দেহটা আলগা হয়ে যায়–কিন্তু তাতে বাহ্যিক আকারের কিছু হানি হয় না। মনে হয় যেন লোকটি ঘুমিয়ে রয়েছে। কিন্তু যখনি এই ঝড়ে নিহত লোকটির শরীরের কোনো অংশ হাতে ধরবেন তখন সে অংশটা আপনার হাতেই থেকে যাবে।” (চার্ডিন, পারস্য ভ্রমণ (১৯২৭)-১৩৬)।

২২। এটা শোয়ার্জ কতৃর্ক গৃহীত হয়েছে (ইরান ঈম মিটেল-আলটার ৩,১৩৩) খাওয়ারিস্তান বলে। (অন্যভাবে সার্ভিস্তান বলা হয়)। স্থানটি সিরাজের পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে। যদি তাই-ই হয় তাহলে এখানে শহরটির স্থান নির্দেশ করা ইনে বতুতার ভ্রান্তিবশতঃ হয়েছে। এ ভূল ঘটেছে ভারত থেকে ১৩৪৭ সালে (১২পরিচ্ছেদের ৩ টীকা দ্রষ্টব্য) ফিরবার সময়ে যে পথ তিনি ধরেছিলেন সেটার ভ্রান্ত স্মৃতি থেকে। সে সময়ে তিনি নিশ্চয়ই। খাওয়ারিস্তানের ভিতর দিয়ে সিরাজ গমন করেছিলেন। এটা খুব অসম্ভব ব্যাপার যে একজন। আরব খাওয়ারিস্তানকে কাওরি স্তান নামে প্রদর্শন করবেন। অবশ্য স্থানীয় লোকেরা যদি এরূপ উচ্চারণ করে তবে আর কোনো কথা উঠে না।

২৩। বন্দর আব্বাশের ১২০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে লার অবস্থিত।

২৪। “মেহমানদারী-উপহার”এর মধ্যে রয়েছে খাদ্য এবং অন্যান্য জিনিস-পত্র। বিশেষ অতিথিদের এ সব উপহার দেওয়া হয়। (উপরের ৭ টীকা দ্রষ্টব্য)।

২৫। খুনজুবাল সম্ভবতঃ দুই নাম। দ্বিতীয়টিকে ইয়াকুত উল্লেখ করেছেন ফাল্ বলে এবং বর্ণনা করেছেন একটি শহরের প্রান্তে অবস্থিত একটি বৃহৎ গ্রাম রূপে। সমুদ্র-উপকুলের নিকট ফারস্ প্রদেশের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত। তিনি আরো বলেন যে এর অবস্থিতি হরমুজ এবং হুজুর মাঝখানের পথে (কি দ্বীপের বিপরীত দিকে প্রধান ভূভাগের একটি দূর্গ, এখন কালাহ্ আল্ ওবাইদ)। এ নামের প্রথম অংশ আমাদের ম্যাপে হনুজ বা হুজু নামে পরিচিত, ২৭.০৪ উত্তরে, ৫৪.০২ পূর্বে। (শাওয়ার জ্ব, ইরান, ৩য় খণ্ড, ১৩২; ২য় খণ্ড, ৮০; Z.D.M.G.৬৮, ৫৩৩)।

২৬। ইব্‌নে বতুতা এখানে বেশ কিছুটা ভূল করেছেন। সিরাফের পুরাকালীন বন্দর, একদা পার্শিয়ান উপসাগরের একটি বাণিজ্যস্থান, বর্তমান তাহিরির নিকটে অবস্থিত ছিল। কে কিংবা কি হচ্ছে একটি দ্বীপ। এটা প্রায় সত্তর মাইল দূরে। বারো শতাব্দীতে এর স্থান দখল করেছিল। সিরাফ এবং তেরো শতাব্দীতে এর স্থান নিয়েছিল হরমুজ। আবার সতেরো শতাব্দীতে এর স্থানে বসেছিল বন্দর আব্বাস।

২৭। অধিকতর সঠিক চার্ডিন বলছেঃ “মুক্তা আহরণকারী ডুবুরিগণ অনেক সময় এক চতুর্থ ঘণ্টার অর্ধেক সময় কাল পানির তলায় থাকে।”

২৮। পূর্ব আরাবিয়ার ভূগর্ভস্থ পানির ধারা বাহারিণের সমুদ্রে পতিত হয়। তুর্কী অধিকারের সময় জাহাজীগণ সমুদ্রের তলায় ডুব দিয়ে চামড়ার ব্যাগে করে স্বচ্ছ পানি আনতে কাপ্তানের। ব্যবহারের জন্য-পর্তুগীজগণ এভাবেই পাম যোগে ব্যবহার্য পানি নিজেদের জন্য সরবরাহ করতো। একটি গল্প প্রচলিত আছে যে, একবার একটি উট আল-হাসাতে একটি উৎসের মধ্যে পরে যায় এবং সেটাকে পরে পাওয়া গিয়েছিল বাহারিণের নিকট সমুদ্রে।

২৯। আল্-হাসা বা হাজার মরুদ্যানের পূর্ণ বিবরণ (প্রথমটির মানে নুড়ি এবং দ্বিতীয়টির মানে পাথর) পাওয়া যাবে জিওগ্রাফিকেল জার্ণাল ৬৩(১৯২৪),১৮৯-২০৭ পৃষ্ঠায়। এর প্রধান। শ এখন হোফুফ নামে অভিহিত। এ প্রবন্ধ থেকে দেখা যায় সেখানে এখনো ছড়িয়ে রয়েছে। বেশ কিছু শিয়া সম্প্রদায়। এদের অধিকাংশ বাহরিণার বংশদ্ভূত (বাহারাই শিয়া)। এরা অনেক কাল আগে এই মরুদ্যানে বসবাস শুরু করেন।” ৩০। নাজুদের পূর্ববর্তী প্রধান শহর, বালুকাত্তরে চাপা এ শহরের ধ্বংসাবশেষ বর্তমান রাজধানী রিয়াদের ৫৮ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে পড়ে রয়েছে। এবং এটা ২৪.০৭ উত্তরে, ৪৭.২৫ পূর্বে (ফিবির হার অব আরাবিয়া ২য় খণ্ড, ৩১-৪০পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *